অধ্যায় ২০
হোমিসাইডের কমিনিউকেশন্স রুমে জেফরি বেগ আর জামান অলস সময়। পার করছে। জামানের কাছে মনে হচ্ছে এই কেসে টেলিফোন কল ট্র্যাকডাউন করে খুব বেশি ফলাফল পাওয়া যাবে না। তারচেয়ে বরং মি: চৌধুরির বাড়ির সামনে যেসব কিডন্যাপার নজরদারি করছে তাদের ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই জানা যাবে মেয়েটাকে ওরা কোথায় আটকে রেখেছে। কিন্তু অতিরিক্তি সতর্কতার কারণে তার বস্ এটা করতে রাজি হচ্ছে না। জামানও স্বীকার করে কাজটাতে একটু ঝুঁকি আছে, এটা করতে গেলে হয়তো বাচ্চামেয়েটার জীবন বিপন্ন হতে পারে, তারপরও কথা থাকে। ঝুঁকি নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় কি আছে? সব কাজেই একটু ঝুঁকি থাকে। ঝুঁকির ভয়ে পদক্ষেপ না নিলে তো সব স্থবির হয়ে পড়ে থাকবে। ঠিক এখন যেমন তাদের অবস্থা।
জেফরি বেগকে দেখলে মনে হবে সুস্থির হয়ে চুপচাপ বসে আছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক ধরণের অস্থিরতার মধ্যে আছে সে। একটা আশংকা ক্রমশ দানা বাধছে তার ভেতরে। মিসেস চৌধুরি বার বার অনুরোধ করা সত্ত্বেও অপহরণকারীরা তার মেয়ের সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছে না। দিচ্ছি দেবো করে টালবাহানা করছে। ওরা মেয়েটাকে মেরে ফেললো না তো?
মনে মনে আশা করলো মেয়েটা যেনো বেঁচে থাকে। ঐ নিষ্পাপ মেয়েটাকে জীবিত উদ্ধার করতে পারলে তার যে কী ভালো লাগবে সেটা অন্য কেউ বুঝবে না। একটা জীবন রক্ষা করার মতো সফলতা আর হয় না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েটাকে যদি জীবিত উদ্ধার করা না যায় তাহলে অপহরণকারীদের কাউকে সে ছাড়বে না। একটা কঠিন আর অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো : অপহরণকারীদের নাগাল পেলে একটাকেও গ্রেফতার করবে না!
সে যে নিয়মে চলে, যে নীতিতে অটল থাকে এবার তার ব্যত্যয় ঘটবে, এটা নিশ্চিত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। সাড়ে সাতটার বেশি বেজে গেছে।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালে জামান তার দিকে ফিরে তাকালো।
“বাইরে যাবেন, স্যার?”
“না, ওয়াশরুমে যাচ্ছি।”
কমিউনিকেশন্স রুমের অ্যাটাচড ওয়াশরুমটার দরজার হাতলে হাত রাখতেই পেছন থেকে জামান বলে উঠলো, “স্যার!”
ফিরে তাকালো সহকারীর দিকে।
“কিডন্যাপাররা আবার ফোন করেছে।”
.
আনিকার মনে হচ্ছে তার ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে। যদিও এর আগে কখনও তার এই সমস্যা ছিলো না, তারপরও মনে হচ্ছে আকস্মিক এক দুর্যোগে তার শরীরের অনেক কিছুই বিগড়ে যাচ্ছে, এতোটা চাপ সহ্য করার মতো মেয়ে নয় সে। নিজেকে জোর করে দৃঢ় আর অটুট রেখেছে, আসলে সময় যতোই গড়াচ্ছে ভেতরে ভেতরে তার সমস্ত জগতটা ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। একটু আগে বাবলুর সাথে ফোনে কথা বলার পর থেকে তার মধ্যে নতুন একটি ভীতি জেঁকে বসেছে : হয়তো বাবলুও কিছু করতে পারছে না। অন্তত তার ম্রিয়মান কণ্ঠ শুনে আনিকা বুঝতে পেরেছে এটা। টেলিফোনে খুব বেশি কথাও বলে নি সে। যেনো তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলো না পাছে যদি মিথ্যে বলতে হয়।
বাবলু জানে আনিকা তার মিথ্যে কথা ধরে ফেলবে, হয়তো সে কারণেই বেশি কথা বলে নি। তবে আনিকার ভয় অন্য জায়গায়। বাবলুর কণ্ঠে কেমন জানি অসহায়ত্ব ছিলো। হঠাৎ করেই সে এখন চাচ্ছে। কিডন্যাপারদের মুখোমুখি হতে। ওদের মুক্তিপণের এক কোটি টাকা নিয়ে যাবে সে। এতোগুলো টাকা সে কোথায় পাবে আনিকা জানে না। কিডন্যাপারদের ধোকা দিতে গেলে ঘটনা আরো খারাপ হতে পারে। বাবলু নিশ্চয় এটা বোঝে। আর যদি সত্যি সত্যি টাকাগুলো ওদের দিয়ে আসে তাহলেই বা কী লাভ? বাবলু কি জানে না কিডন্যাপাররা টাকা পাবার আগেই জিম্মিকে…
আনিকা আর ভাবতে পারলো না। ওদের দাবি অনুযায়ী টাকাগুলো যদি দিতেই হয় তাহলে সে-কাজটা তারা যেকোনো সময় করতে পারে। নিশ্চয় বাবলুর মাথায় অন্য কোনো পরিকল্পনা আছে। এ মুহূর্তে তার উপর বিশ্বাস রাখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
বাবলুর সাথে কথা বলার পরই কিডন্যাপারদের ফোনে বেশ কয়েক বার কল করার চেষ্টা করেছে সে, পায় নি। ওদের ফোনটা বন্ধ। তাকে এখন জানতে হবে টাকাগুলো কোথায় আর কখন দিয়ে আসতে হবে। কাজটা যে বাবলু করবে সেটাও নিশ্চিত করতে হবে, কিন্তু বদমাশগুলোর ফোন বন্ধ। অস্থির হয়ে উঠেছে আনিকা। সে এখন বসে আছে ড্রইংরুমের সোফায়। তার স্বামী একটু আগে শোবার ঘরে চলে গেছে। পুরো বাড়িটা জুড়ে আছে অদ্ভুত এক ভুতুরে পরিবেশ। কারোর কোনো সাড়া শব্দ নেই। অথচ এই বাড়িতে কম করে হলেও পাঁচজন মানুষ আছে। তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জন ছাড়াও রয়েছে দুজন কাজের বুয়া আর একজন কাজের ছেলে। কাজের লোকগুলোও শোকগ্রস্ত। যে যার ঘরে চুপ মেরে বসে আছে। তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে কাউকে যেনো কিছু না বলে। বাড়ির একমাত্র মেয়ে দিহান যে অপহৃত হয়েছে সেটা যেনো ঘুণাক্ষরেও কেউ না জানে।
আনিকা অবশ্য ওদের নিয়ে চিন্তিত নয়। ওরা তিনজনই খুব বিশ্বস্ত। যা বলবে তা-ই শুনবে, অবাধ্য হবে না।
হঠাৎ নীরবতার মধ্যে একটা গোঙানি শুনতে পেলো সে। কান পেতে বোঝার চেষ্টা করলো। সোফা থেকে উঠতে গিয়েও উঠলো না। “সবুজ?” কাজের ছেলেটাকে ডাকলো।
সবুজ হয়তো ধারেকাছেই ছিলো তার ডাকের অপেক্ষায়, সে ড্রইংরুমে ঢুকলো। “জি, আপা?”
“এটা কিসের আওয়াজ?”
সবুজ নামের কাজের ছেলেটা কাঁচমাচু খেলো। “ভাইজানে…” আর কিছু বললো না।
আনিকা বুঝতে পেরে তাকে চলে যেতে ইশারা করলো। চুপচাপ কথা না বলে ঘর থেকে চলে গেলো ছেলেটা।
দিহানের বাবা শোবার ঘরে ঢুকে কাঁদছে। নিজের কান্না জোর করে আটকে রাখার চেষ্টা করাতে সেটা কেমন জানি শোনাচ্ছে। আনিকার একবার ইচ্ছে হলো স্বামীকে সান্ত্বনা দিয়ে আসবে কিন্তু পরক্ষণেই সেটা বাতিল করে দিলো। হয়তো দেখা যাবে স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই ভেঙে পড়েছে।
কপালের বাম পাশটা ধরে আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে।
ছবির মতো সুন্দর তার সংসারটা এক নিমেষে এলোমেলো হয়ে গেছে!
এমন সময় ফোনের রিং বাজতে শুরু করলে নড়েচড়ে বসলো আনিকা।
“হ্যালো?” রিসিভারটা তুলে নিয়ে বললো সে।
“ফোন দিছিলেন ক্যান?” ওপাশ থেকে কিডন্যাপারদের একজন বললো তাকে। “মিসকল অ্যালার্টে দেখি আপনার নাম্বার…ঘটনা কি?”
“একটা দরকারে ফোন দিয়েছিলাম,” বললো সে।
“বলেন?”
“টাকাগুলো কোথায় দেবো, কখন দেব?”
একটু ভাবলো কিডন্যাপার তারপর বললো, “টাকা জোগার হয়া গেছে?”
“সকালে ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিতে পারবে ওর বাবা।”
“ও,” বললো ওপাশ থেকে। “আমি বসের সাথে কথা বইলা আপনারে জানাইতাছি।”
“আপনি বলেছিলেন আমার মেয়ের সাথে কথা বলিয়ে দেবেন…কখন দেবেন?”
“একটু পর।”
“যখনই বলি, বলেন একটু পর, কখন দেবেন ঠিক করে বলুন,” একটু ঝাঁঝের সাথেই বললো দিহানের মা।
“আমি তো অন্য জায়গা থিকা কথা বলতেছি–”
“এ-কথা বার বার বলছেন,” কিডন্যাপারের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো আনিকা। সে কোনো জবাব দেবার আগেই বললো আবার, “আমার মেয়ের কাছে যারা আছে তাদের সাথে তো আপনার ফোনে যোগাযোগ হচ্ছেই। তাদেরকে বলুন আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই।”
“ঠিক আছে, বলতেছি।”
“কখন দেবেন?”
“আমি একটু পর ফোন দিয়া জানাইতাছি।”
“একটু পর কখন-” তার কথা শেষ হতে না হতেই ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দেয়া হলো।
রিসিভারটা অনেকক্ষণ কানের কাছে ধরে রাখলো আনিকা। সে বুঝতে পারছে না তার মেয়ের সাথে একটু কথা বলিয়ে দিতে এতো অনীহা কেন ওদের। প্রথমবার কিডন্যাপাররা যখন ফোন করে জানায় দিহানকে তারা অপহরণ করেছে, এককোটি টাকা না দিলে তার মেয়েকে জীবিত পাবে না, তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য মেয়ের সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলো-এরপর আর কথা হয় নি।
তার মনে খারাপ একটি আশংকা দানা বাঁধতে শুরু করলো। কখন যে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো টেরই পেলো না।
আমার আম্মুটা!
অধ্যায় ২১
বাচ্চুর গ্যারাজের সামনে বাইকটা থামাতেই ভেতর থেকে ছেলেটা বের হয়ে এলো। তার হাতে-পায়ে কালি লেগে রয়েছে। ডান হাতে সাদা রঙের জুট, কালি লেগে একাকার। বাবলুকে দেখে খুশি হলেও কিছুটা চিন্তিতও মনে হলো তাকে।
“কিছু হইছে নি, বস্?” বললো সে।
“আমার আবারো গাড়ি লাগবে,” বাইক থেকে নেমে বললো বাবলু।
বাচ্চু অবাক। মাত্র গত সপ্তাহে তার কাছ থেকে একটা গাড়ি নিয়ে গেছিলো, এক রাত পরই সেটা ফেরত দিয়েছিলো একেবারে অক্ষত অবস্থায়। এখন আবারও গাড়ি চাচ্ছে। এতে ঘনঘন তো কখনও গাড়ির জন্যে আসে না।
“একটু পুরনো হলেও সমস্যা নেই কিন্তু ইঞ্জিন হতে হবে ফিট। গাড়িটা হয়তো তুই আর ফিরে নাও পেতে পারিস,” বললো বাবলু।
বাচ্চু অবাক হলো না। অনেক আগে একবার এরকম হয়েছিলো। বাবলু তার কাছ থেকে গাড়িটা নেবার পর আর ফেরত দেয় নি। হয়তো কাজ শেষে সেটা কোথাও ফেলে চলে এসেছিলো। গাড়ি নিয়ে ফিরে আসার মতো পরিস্থিতি ছিলো না। তাতে কোনো সমস্যা হয় নি বাচ্চুর। ওটা ছিলো মান্ধাতা আমলের টয়োটা কোরোলা। গাড়িটা বেচে দিলে যে দাম পেতে তারচেয়ে বেশিই পেয়েছিলো। বাবলুর সাথে টাকা-পয়সা নিয়ে তার কোনো ঝামেলা হয় নি কোনোদিন। কয়েক মাস আগে ঝকঝকে নতুন আর বেশ দামি একটি গাড়ি তাকে দিয়ে দিয়েছিলো। গাড়িটার সামনের ডান দিক ভচকানো থাকলেও বাচ্চু সেটা ঠিকঠাক করে, ইঞ্জিনে নতুন নাম্বার পাঞ্চ করে বেশ ভালো দামে বিক্রি করে দিয়েছে উঠতি এক ছাত্রনেতার কাছে।
“এখন তো ব্যাঙ্ক বন্ধ, আর বুথ থেকে অতো টাকা তোলাও যাবে না,” বাবলু বললো, “কাল সকালে তুই টাকা পাবি।”
“আমি কি আপনেরে ট্যাকার কথা কইছি?” বাচ্চু রাগ দেখিয়ে বললো। “আপনের যহন খুশি দিয়েন।”
বাবলু তার কথা শুনে শুধু হাসলো।
“কবে লাগবো?” জুট দিয়ে হাতের কালি মুছতে মুছতে বললো সে।
“এখনই।”
“এহনই?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “কেন, সমস্যা আছে?”
বাচ্চু দাঁত বের করে হেসে উঠলো। “বিরাট সমস্যার মইদ্যে আছি, বস।”
“কেন?”
আবারো সাদা ঝকঝকে দাঁতগুলো প্রদর্শন করলো মোটর মেকানিক্স। “আর কইয়েন না, আমার পোলাটায় আইজকা ফাঁকি মারছে। ফোন কইরা কয়, ওর নাকি জ্বর। আইবার পারবো না। কন দেহি, একলা একলা এতো বড় গ্যারাজ চালানো যায়?”
বাবলু কিছু বললো না। মাথা নেড়ে সায় দিলো শুধু। আরো কিছুক্ষণ বকবক করে চললো ছেলেটা।
“দুনিয়ার কাম হাতে, আমি তো সারাদিন খাইট্টা মরতাছি। তিনটা গাড়ি ডেলিভারি দেওন লাগবো কাইলকা…” একটু থেমে আবার বললো সে, “স্টিশনওয়াগনটা দিবার পারুম। ওইটা ফিট আছে। চলবো?”
এই স্টেশনওয়াগনটাই গত সপ্তাহে নিয়েছিলো সে। ওটার কাঁচগুলো কালো। বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখা যায় না। তার কাজের জন্যে উপযুক্ত জিনিস। “ঠিক আছে, ওটাই দে।”
অধ্যায় ২২
ফোনসেটের সামনে অধীর অপেক্ষায় বসে আছে আনিকা। বাবলু যা যা বলেছে, যেভাবে সব করতে বলেছে সবই করবে। অনেক কষ্টে নিজের ভেতরে জমে থাকা উদ্বেগ আর অস্থিরতা দমন করে ঝিম মেরে বসে আছে সে।
দিহানের বাবার কান্না থেমে গেছে অনেক আগে। এখন হয়তো আবার পান করছে। তার জন্যে খুব মায়া হলো। একেবারে ঝামেলামুক্ত একজন মানুষ। সামান্য ঝঞ্ঝাট পোহাতেও রাজি নয়। অনেক বড় ব্যবসা করলে কি হবে, মানসিক দৃঢ়তা শিশুদের মতো, আনিকা ছাড়া এটা আর কে বেশি জানে। দেখতে দেখতে প্রায় আট-নয় বছর হয়ে গেলো তাদের বিয়ের। লোকটাকে সে ভালো করেই চেনে।
বাবলু এখন কি করছে কে জানে, ভাবলো সে। ঐসব কিডন্যাপারদের হাত থেকে তার মেয়েকে উদ্ধার করতে পারবে তো? এ প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই, তারপরও এক ধরণের নির্ভরতা তৈরি হয়েছে, মনের গহীনে বিশ্বাস জন্মেছে, বাবলু তার দিহানকে তার কাছে ঠিকই ফিরিয়ে দেবে।
তার ভালোবাসার মানুষটি তো বহুকাল আগেই অপরাধজগতে ঢুকে পড়েছে। সেই জগতে দীর্ঘদিন ধরে বিচরণ করে আসছে সে। ওখানকার অলিগলি ভালো করেই চেনে। হয়তো তার পক্ষে এটা করা সম্ভব।
ফোনের রিং বাজার শব্দে চমকে উঠলো আনিকা। রিসিভারটা তুলে নেবার আগে গভীর করে দম নিয়ে নিলো।
“হ্যালো?”
“হুম বলেন,” ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে অন্য একটা কণ্ঠ বললো। কিডন্যাপারদের বস? হতে পারে। “টাকা নাকি রেডি করছেন?”
“এখনও রেডি হয় নি…কাল সকালে জোগার করতে পারবো।”
“আচ্ছা, তাইলে আপনের জামাইরে বলবেন-”
কিডন্যাপারের কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো আনিকা, “আমার স্বামী না…টাকা নিয়ে যাবে আমার এক কাজিন।”
“কাজিন?”
“হুম। আমার এক খালাতো ভাই।”
“না, না। কোনো খালাতো ভাই-টাই চলবো না। আপনের জামাইরে বলবেন টাকা নিয়া আসতে, উনার ফোন নাম্বারটা দিয়া দিবেন, আমি বইলা দিমু কোথায় আসতে হইবো,” ঝাঝালো কণ্ঠে বললো কিডন্যাপার।
গভীর করে আবারো দম নিলো আনিকা। “আমার স্বামী প্রচণ্ড ভীতু মানুষ, ও এসব করতে পারবে না। তারচেয়ে ভালো হয়
এবার তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো বাজখাই কণ্ঠটা, “আরে না। যা কইলাম তা-ই করেন। বাইরের কুনো মানুষরে ইনভলভ করন যাইবো না। আপনার হাজব্যান্ডরে কইবেন, কুনো ঝামেলাই হইবো না। যেইখানে বলবো সেইখানে টাকা নিয়া আসবো…ব্যস, হয়া গেলো। ভয়ের কিছু নাই।”
একটু গুছিয়ে নিলো আনিকা। “আপনি বুঝতে পারছেন না, আমার হাজব্যান্ড অনেক ভীতু…ও এটা করতে পারবে না।”
“মন দিয়া শুনেন…অন্য কুনো লোক অ্যালাউ করন যাইবো না। ওর বাপেরেই কইবেন টাকা নিয়া আসতে।”
আনিকা আর কিছু বলতে পারলো না কারণ লাইনটা কেটে দেয়া হলো ওপাশ থেকে।
.
কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে রাখলো জেফরি বেগ।
“তাহলে আগামীকাল সকালে…” কিডন্যাপারদের একজনের সাথে মিসেস চৌধুরির ফোনালাপ শোনার পর আপন মনে বলে উঠলো সে।
“কিন্তু টাকাটা কে নিয়ে যাবে সেটা তো নিশ্চিত হওয়া গেলো না।”
“এহসান সাহেবই নিয়ে যাবেন,” জামান বললো। “মনে হয় না কিডন্যাপাররা অন্য কাউকে অ্যালাউ করবে। ওরা তো তাই বললো।”
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “তাই তো মনে হচ্ছে।”
“স্যার, আমার ভয় হচ্ছে অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে,” বললো জামান।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো তার বস্।
“মিসেস চৌধুরি বার বার তার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইছে অথচ কিডন্যপাররা দিচ্ছি দেবো করে ঘোরাচ্ছে।”
এই ব্যাপারটা নিয়ে জেফরিও চিন্তিত। তার মনে খারাপ আশংকাটি ক্রমশ দানা বাঁধছে। কিডন্যাপারদের প্রবণতা খুবই মারাত্মক রকম হয়ে উঠেছে আজকাল। অপহৃত মেয়েটির বাবা-মা যে এ কথা জানে না তা নয়। কিন্তু জানলেও এক্ষেত্রে তারা নিরুপায়। তাদের কিছু করারও নেই।
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ওরা মেয়েটাকে এরইমধ্যে মেরে ফেলেছে।”
জামানের এ কথায় চুপ মেরে গেলো জেফরি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “সেটা এখনও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।”
“কিন্তু ওরা মেয়েটার সাথে যা-ই করুক, আমাদের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না,” জামান বেশ দৃঢ়ভাবে বললে কথাটা। “আমরা সব ব্যাটাকে ধরবো।”
“আমি কাউকেই ধরবো না, আস্তে করে বললো জেফরি বেগ।
অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো জামান। “ধরবেন না!”
মাথা দোলালো সে। “না!”
“কী বলেন, স্যার!” জামানের বিস্ময় আরো বেড়ে গেলো। “তাহলে কি করবেন?”
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো জেফরি। “আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি।”
হতভম্ব জামান একটু পরই বুঝতে পারলে তার নিয়মনিষ্ঠ বস কি করবে ওদের সাথে। ঠিকই আছে, মনে মনে বললো সে। মাসুম-বাচ্চাদের সাথে যারা এমন কাজ করে তাদের সাথে আবার কীসের নিয়ম-কানুন?
অধ্যায় ২৩
বাবলুর ফোনটা আবারো বিপ্ করে উঠলো। মেঘলা ফোন করেছে। এখনও বাচ্চুর গ্যারাজে আছে সে। তার ফোনালাপ যাতে কেউ শুনতে না পায় সেজন্যে একটু সরে গেলো।
“হ্যালো?”
“ওদের সাথে কথা হয়েছে,” বললো মেঘলা।
“কি বললো?”
“ওরা কোনোভাবেই রাজি হচ্ছে না…বলছে দিহানের বাবাকেই টাকা নিয়ে যেতে।”
“আচ্ছা।” দ্রুত মাথা খাটাতে লাগলো সে। কিডন্যাপারদের সাথে মেঘলার মতো এক মেয়ে কথা বলে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। অন্য কিছু করা দরকার, আর সেটাই দ্রুত তার মাথায় চলে এলো। “ড্রাইভারের খুনের ব্যাপারে তোমাদের বাড়িতে পুলিশ এসেছিলো না?”
“হ্যাঁ। তোমাকে তো বলেছি সেটা।”
“তুমি ওদেরকে বলবে, ড্রাইভারের খুন হওয়ার ব্যাপারে পুলিশ কিছু একটা সন্দেহ করছে। সম্ভবত সাদা পোশাকের পুলিশ তোমাদের বাড়ির আশেপাশে নজরদারি করছে। এ অবস্থায় দিহানের বাবা টাকা নিয়ে গেলে পুলিশ হয়তো টের পেয়ে যেতে পারে। বুঝতে পেরেছে, কি বললাম?”
মেঘলা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ওরা যদি তাতেও রাজি না হয়?”
এইমাত্র পাওয়া আইডিয়াটা গুছিয়ে নিলো সে। “ওদের সাথে যখন কথা বলবে তখন এক কানে ইয়ারফোন দিয়ে তুমি আমার সাথে লাইনে থাকবে। ওদের কথাগুলো যেনো আমি শুনতে পাই…মানে স্পিকার অন করে কথা বলবে। বুঝতে পেরেছো?”
“হ্যাঁ।”
“খুবই শান্তভাবে, আস্তে আস্তে ওদের সাথে কথা বলবে। আমি তোমাকে বলে দেবো কখন কি বলতে হবে?”
“ঠিক আছে।”
বাবলু লাইন কেটে দিলো না কিন্তু কথাও বলছে না।
“হ্যালো?” মেঘলা বললো।
“হুম, বলো।”
কিন্তু মেঘলা কোনো কথা খুঁজে পেলো না। আজ এতোদিন পর বাবলুর সাথে কী নিয়ে কথা বলবে, তাও আবার এরকম পরিস্থিতিতে।
“ঠিক আছে, যা বললাম তা করো।”
মেঘলা যে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না সেটা বাবলুও বুঝতে পেরেছে। লাইন কেটে দিলো সে। ফোনটা রেখে তাকালো বাচ্চুর দিকে। একটু দূরে বসে থেকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে।
“কিছু খাবারের ব্যবস্থা কর। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। সকাল থেকে চা ছাড়া আর কিছু খায় নি।
বাচ্চু উঠে ভেতরে যেতে নিলে বাবলু তাকে টাকা নিয়ে যেতে বললো।
“কী যে কন ভাই। একটু মেহমানদারিও করবার দিবেন না!” কপট রাগ দেখিয়ে বললো সে।
হেসে ফেললো বাবলু। “ঠিক আছে। মেহমানদারি কর।”
বাচ্চু এবার হেসে ভেতরে চলে গেলো। একটু পরই তার দোকানের এক পিচ্চি চলে গেলো খাবার আনতে।
বাবলু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো কাল সকালে কি করবে। এই প্ল্যানটা তার একদম পছন্দ হচ্ছে না। এটা অনেকটা সিনেমাটিক। চলচ্চিত্রেই এরকম ঘটনা মানায় : অপহরণকারীদের কাছে মুক্তিপণ নিয়ে যাবে হিরো, তারপর সব ব্যাটাকে শেষ করে জিম্মি উদ্ধার করে ফিরে আসবে বীরদর্পে।
অবশ্য, তার পরিকল্পনাটি অতোটা সিনেমাটিক নয়। সে আসলে কিডন্যাপারদের থোকা দেবে নকল টাকা দিয়ে। ওই মুহূর্তে টাকাগুলো আসল না নকল সেটা চেক করে দেখার কোনো সুযোগ থাকবে না ওদের। তনাইয়ের কাজের উপর তার যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। খালি চোখে তার নকল টাকা ধরার উপায় নেই।
মুক্তিপণের টাকা লেনদেনের চেয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েই সে বেশি চিন্তিত। টাকাগুলো হস্তান্তর করার পর ওরা যদি দিহানকে ফেরত না দেয় তাহলে কী করবে? সরাসরি অ্যাকশনে চলে যাবে? কিভাবে সেটা করলে দিহানের কোনো ক্ষতি হবে না? এ প্রশ্নগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু এগোলে টাকা হস্তান্তর করার কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাবে দিহান বেঁচে আছে। কিন্তু কোথায় আছে, কার কাছে আছে সেটা নিশ্চিত করে জানা সম্ভব হবে না।
একটা কাজ করা যেতে পারে। কিডন্যাপারদের সংখ্যা যদি দু’তিনজন হয় তাহলে একজনকে বাঁচিয়ে রেখে বাকিদের মেরে ফেললে জীবিতজনের কাছ থেকে দিনের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এটা ভাবা যতোটা সহজ বলে মনে হচ্ছে আদতে কাজটা তত সহজ হবে না।
সব সময় তুমি আশা করতে পারো না, তোমার মতো করেই ঘটনা ঘটবে।
একটু এদিক ওদিক হলেই আসল উদ্দেশ্য-দিহানের জীবনটা-ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
মাথা দোলালো বাবলু। এই দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি তার পছন্দ না হলেও এখন আর কিছু করার নেই। ডাকাইত শফিকের ব্যাপারটা ছিলো ধোঁকা। অপহরণকারীরা বেশ ভালোমতোই সেটা করতে পেরেছে। তার ভাগ্য কিছুটা ভালো, ডাকাইত তার নিজের লোকের হাতে গতকাল রাতে খুন হয়ে গেছে, নইলে এখন হয়তো ওর নাগাল পাবার জন্যেই হন্যে হয়ে ছুটে বেড়াতে সে।
ফোনটা আবার বিপ্ করতেই অন্যমনস্ক ভাব কেটে গেলো বাবলুর।
“বলো?”
“ওরা ফোন করেছে,” ওপাশ থেকে বললো মেঘলা।
“ঠিক আছে, তুমি কথা বলো।”
কয়েক মুহূর্ত পরই স্পিকার ফোনে একটা কণ্ঠ শুনতে পেলো বাবলু।
অপহরণকারীদের একজন বললো : “বলেন।”
“ড্রাইভারের খুনের ব্যাপারে বাড়িতে পুলিশ এসেছিলো, সেটা তো জানেন?” বললো মেঘলা।
“হ, জানি।”
“আমরা ওদের কিছু বলি নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওরা কিছু একটা সন্দেহ করছে…”
“কি সন্দেহ করতাছে?”
“ঠিক জানি না। তবে আমার ধারণা ওরা সাদা পোশাকে বাড়ির বাইরে নজরদারি করছে। সেজন্যেই বলছিলাম, দিহানের বাবাকে দিয়ে টাকা পাঠানোটা ঠিক হবে না। ওরা ওকে ফলো করতে পারে।”
কিডন্যাপার চুপ মেরে গেলো।
“গুড, ঠিক আছে,” বললো বাবল। মেঘলার বাম কানের ইয়ারফোনে প্রতিধ্বণি করলো সেটা। কিডন্যাপারের ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো ধরণের শব্দ কিংবা নয়েজ হচ্ছে কিনা শোনার চেষ্টা করলো।
“আমি কোনো ঝামেলা চাই না বলেই অন্য কাউকে দিয়ে টাকাটা পাঠাতে চাচ্ছি।”
“হুম।” মনে হলো অপহরণকারী ভাবছে। “ঠিক আছে, তাইলে উনারে পাঠানোর দরকার নাই।”
মেঘলার মতো বাবলুও আশান্বিত হয়ে উঠলো।
“তাহলে আমার কাজিনকে সকালে টাকা দিয়ে
“না, না…” মেঘলার কথা শেষ করতে দিলো না বাজখাই গলাটা। “ওইসব কাজিন-টাজিন পাঠানোর কাম নাই। আপনে এক কাজ করেন, বাড়ির কাজের লোকরে দিয়া পাঠায়া দেন।”
“কাজের লোক!” মেঘলার মুখ দিয়ে অস্ফুট কথাটা বের হয়ে গেলো।
শিট! মনে মনে বলে উঠলো বাবলু।
“ক্যান, আপনেগো বাড়িতে কাজের লোক নাই?”
“তুমি বলো কাজের লোক ভয় পাবে। রাজি হবে না।” মেঘলাকে তাড়া দিয়ে বললো বাবলু।
সে-মতোই বললো মেঘলা।
“ভয় পাইবো ক্যান…ভয়ের কিছু নাই। ওরে একটা ফোন দিয়া দিবেন…তারপর আমি বইলা দিমু কুনখানে আসতে হইবো।”
“বলো, কাজের ছেলেটা যদি এ কাজ করতে রাজি না হয়?” বাবলু বলে দিলো মেঘলাকে।
মেয়েটা বাবলুর কথা হুবহু বললো।
“রাজি না হওনের কী আছে, আজব!” কিডন্যাপার নাছোরবান্দা। “মনিবের জন্য এইটা করবার পারবো না?”
“না, মানে…” মেঘলা বুঝতে পারলো না কী বলবে।
“বলো কাজের ছেলে রাজি হবে না, ও খুব ভীতু।”
“মনে হয় না ও রাজি হবে…খুব ভীতু টাইপের ছেলে…”
“আপনেগো বাড়ির সবাই কি ভীতু নাকি?” টিপ্পনি কাটলো কিডন্যাপার।
মেঘলা কিছু বললো না।
“ওরে চাপ দেন, ও রাজি হইবো। ভয় পাইবো না। গেরাম দ্যাশের পোলা…আপনাগো মতো ডরফুক না।”
মেঘলাকে আবারো চুপ থাকতে দেখে বাবলু বলে উঠলো : “বলো, ঠিক আছে। ওকে রাজি করাবে। এখন জানতে চাও কখন, কোথায় টাকা নিয়ে যাবে।” কিডন্যাপার এ ব্যাপারে অনমনীয় বলে ও আর চাপাচাপি করতে চাইলো না।
“আচ্ছা, আমি ওকে বলে দেখি।”
“হ, তাই করেন।”
“টাকাগুলো কোথায় দেয়া হবে? কখন দিতে হবে?”
“কাইল সকালে সবুজুরে বইলা দিমু কুথায় কখন আসতে হইবো।”
“ঠিক আছে।”
“কুনো রকম দুই নাম্বারি করবেন না। করলে কি হইবো জানেনই তো?”
“এরকম কিছু হবে না। নিশ্চিত থাকতে পারেন,” জোর দিয়ে বললো মেঘলা। “এখন আমার মেয়ের সাথে আমাকে কথা বলতে দিন।”
“এখন তো সম্ভব না,” কাচুমাচু খেয়ে বললো কিডন্যাপার।
“আশ্চর্য, আপনি একটু আগে কিন্তু বলেছেন কথা বলিয়ে দেবেন?”
“হ, কইছিলাম, কিন্তু…”
“কিন্তু কি?” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো আনিকা।
“না, মানে…কিছু না।” কিডন্যাপারের কণ্ঠে দ্বিধাগ্রস্ততা সুস্পষ্ট।
কয়েক মুহূর্ত ধরে বাবলু অন্য একটা চিন্তায় ডুবে গেছিলো, হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে শুনতে পেলো মেঘলা তার মেয়ের সাথে কথা বলতে চাইছে।
“বার বার বলছেন একটু পর দেবেন, দিচ্ছেন না। ঘটনা কি?” অস্থির হয়ে উঠলো মেঘলা। “সত্যি করে বলেন, আমার মেয়ের কি করেছেন?” তার কণ্ঠটা কেঁপে উঠলো।
“আপনের মাইয়া ভালা আছে। চিন্তার কুনো কারণ নাই।”
“তাহলে ওর সাথে আমাকে কথা বলতে দিচ্ছেন না কেন?”
“কাইল সকালে কথা বইলেন,” বললো অপহরণকারীদের নেতা।
“দিহানের সাথে কথা বলার জন্য জোরাজুরি করো, তাগাদা দিলো বাবলু।
“আমি ওর সাথে এখনই কথা বলবো। আর কোনো ধানাইপানাই শুনবো না।”
“কইলাম তো এখন সম্ভব না।”
“এখন দিতে সমস্যা কি?…আশ্চর্য, আপনারা এমন করছেন কেন?”
“আছে একটা সমস্যা। বুঝবেন না।”
“আমার অতো কিছু বোঝার দরকার নেই। আমার মেয়েকে দিন। ওর সাথে আমি কথা বলবো,” রেগেমেগে বললো সে।
“না দিলে কী করবেন?” কিডন্যাপারও রেগে গেলো এবার।
চুপ করে থাকলো মেঘলা। সঙ্গে সঙ্গে বাবলু বলে দিলো তাকে কি বলতে হবে। তার কথাটা শুনে থ বনে গেলো সে। “প্লিজ বলো!” তাড়া দিলো। সেও জানে কোনো মায়ের পক্ষে এটা বলা কতোটা কঠিন।
গভীর করে দম নিয়ে নিলো মেঘলা। “তাহলে আমার কথাটা মন দিয়ে শুনুন, আমি আমার মেয়ের সাথে কথা না বললে কোনো টাকা দেবো না।”
“টাকা দিবেন না?”
“না।” দৃঢ়ভাবে বললো সে। “মনে করবো…” কথাটা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে গেলো। “…আমার মেয়েকে আপনারা মেরে ফেলেছেন!”
“কি?” মনে হলো কিডন্যাপার ভড়কে গেছে। “এমন মা তো জীবনে দেখি নাই। কি কয়?” যেনো পাশের কাউকে বললো।
মেঘলা অপেক্ষা করলো কিডন্যাপারদের নেতা কী বলে।
“শুনেন, আপনার মাইয়া বাঁইচা আছে…ভালা আছে। এর বেশি কইতে পারুম না এখন।”
লাইনটা কেটে গেলো।
“হ্যালো? হ্যালো?” হতাশায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো দিহানের মায়ের।
“মেঘলা, শান্ত হও,” ওপাশ থেকে বললো বাবলু।
“এখন কি করবে?” উতলা হয়ে জানতে চাইলো সে।
বাবলু এখন জানে তাকে কি করতে হবে। “তুমি কোনো চিন্তা কোরো না। আমি একটু পর তোমাকে ফোন করছি।”
ফোনটা পকেটে রেখে বাচ্চুকে ডাকলো সে।
“কি হইছে?”
“গাড়িটা জলদি বের কর।”
একটু অবাক হলো মেকানিক্স। “খাইবেন না?”
“না।”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ছেলেটা, তারপর কথা না বাড়িয়ে গ্যারাজের ভেতরে চলে গেলো সে।
দশ মিনিট পর স্টেশনওয়াগনটা নিয়ে বাচ্চুর গ্যারাজ থেকে বের হয়ে এলো বাবলু। অনেকক্ষণ পর যেনো দম বন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছে। নতুন উদ্যমে ছুটে চললো এবার। এখন সে কোথায় যাবে শুধু তা-ই জানে না, কি করবে, কিভাবে করবে তাও জানে।
এতোক্ষণ কোণঠাসা রাজার মতো অসহায় ছিলো সে। এবার দান উল্টে গেছে।
তার এবারের গন্তব্যটি খুবই অদ্ভুত।
অধ্যায় ২৪
জেফরি বেগ কমিউনিকেশন্স রুমে বসে আছে। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে চুপচাপ শুনে যাচ্ছে একটু আগে ট্যাপ করা মিসেস চৌধুরির সাথে কিডন্যাপারদের একজনের কথোপকথন।
মনে মনে মিসেস চৌধুরিকে বাহবা না দিয়ে পারলো না সে। ভদ্রমহিলা সুচতুরভাবেই মোক্ষম একটি চাল চেলেছে। অপহৃত হওয়া সন্তানের মা হিসেবে তার এমন বুদ্ধি প্রয়োগ সত্যিই প্রশংসনীয়।
মহিলা কিডন্যাপারদের নতুন একটি শর্ত দিয়েছে : একটু পরই তার মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিতে হবে। তাছাড়া আগামীকাল সকালে মুক্তিপণ দেবার আগেও মেয়ের সাথে কথা বলবে।
মহিলার দৃঢ়তায় জেফরি মুগ্ধ। সে জানে, মুক্তিপণ পেতে হলে ঐ বাচ্চামেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া কিডন্যাপারদের এখন আর কোনো উপায় নেই।
জামান উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার বসের দিকে। তারা এখন জেনে গেছে আগামীকাল সকালে কে টাকাগুলো নিয়ে যাবে। তারচেয়ে বড় কথা, একটু পর বাচ্চামেয়েটার সাথে মিসেস চৌধুরির কথা হয়ে গেলেই তারা নিশ্চিত হয়ে যাবে কিডন্যাপার আর জিম্মির অবস্থান।
ইয়ারফোনটা খুলে রাখলো জেফরি। “ভদ্রমহিলা খুব চেষ্টা করেছেন স্মার্টলি হ্যাঁন্ডেল করতে,” বললো সে।
“জি, স্যার,” বললো জামান। “মনে হচ্ছে একটু পরই আমরা মেয়েটার লোকেশন জানতে পারবো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি।
“কিন্তু কাজের ছেলেটা কি টাকা নিয়ে যেতে রাজি হবে?”
“মিসেস চৌধুরির কথায় তো মনে হলো রাজি করাতে পারবে।”
“উনি অবশ্য চাচ্ছিলেন, উনার এক কাজিনকে দিয়ে পাঠাতে।”
“হুম।”
“ভদ্রমহিলা মনে করছেন পুলিশ সাদা পোশাকে তাদের বাড়ির আশেপাশে নজরদারি করছে,” বললো সহকারি।
জেফরিও অবাক হয়েছে কথাটা শুনে। তারা এমন কিছু করে নি, কিংবা তাদের আচরণে এমন কিছু প্রকাশ পায় নি যে, মিস্টার এবং মিসেস চৌধুরি এরকম ভাববে। মেয়েটার মায়ের সাথে তো তাদের দেখাই হয় নি। তাহলে কেন মিসেস চৌধুরি এটা বলতে গেলো? তারপরই মনে হলো, হয়তো এটা একটা কৌশল।
“মনে হয় কাজিনকে পাঠানোর জন্যেই এটা বলেছে। মিসেস চৌধুরি চাচ্ছে না মুক্তিপণের টাকাগুলো মেয়েটার বাবা দিয়ে আসুক।” একটু থেমে কাজের কথায় চলে এলো জেফরি। “জামান, কিডন্যাপারের ফোনটা ট্র্যাকড্রাউন করার পর পরই আমরা দ্রুত ফিল্ডে নেমে যাবে।”
“আশা করি কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটা জানতে পারবো, স্যার। অনলি অ্যা ম্যাটার অফ টাইম।”
“বাট টাইম ডাস ম্যাটার,” গম্ভীর হয়ে বললো জেফরি।
“স্যার?” জামান বলে উঠলো। “ঐ কিডন্যাপারের নাম্বারে একটা কল এসেছে!”
জেফরি বেগ সঙ্গে সঙ্গে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে নিলো আবার।
.
বারিধারার লেকের পানিতে সোডিয়াম লাইটের হলদেটে আলোগুলো অদ্ভুতভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। রাত নেমে এসেছে, ক্রমশ হালকা হয়ে উঠছে যানবাহনের আনাগোনা। লেকের পারে কিছু লোক সান্ধ্যকালীন হাটাহাটি শেষ করে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের ঘরে। অল্পবয়সী কিছু ছেলেমেয়ে প্রাইভেটকার পার্ক করে গল্প করছে এখানে সেখানে। ছেলেগুলোর পরনে গৃ-কোয়ার্টার আর টি-শার্ট। বোঝা যাচ্ছে আশেপাশেই থাকে তারা। মেয়েগুলো সবকিছু থোরাই কেয়ার করে সিগারেট টানছে বুক ফুলিয়ে। যেনো নারী স্বাধীনতা আর প্রগতির চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছানোর সহজতম একটি পথ পেয়ে গেছে! তাদেরকে সিগারেট খেতে দেখে ছেলেগুলো বেশ মজা পাচ্ছে।
স্টেশনওয়াগনটা প্রায় নিঃশব্দে লেকের কোল ঘেষে চলে যাওয়া প্রশ্বস্ত রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে এখন। একদম ধীরগতিতে চলছে সেটা। হেডলাইটের আলো জ্বলছে না। তার কোনো দরকারও নেই। লেকের দিকে। মুখ করে থাকা অভিজাত বাড়িগুলো একে একে অতিক্রম করে গেলো গাড়িটা। অবশেষে রাস্তার উপর পার্ক করা একটি পাজেরো গাড়ির পেছনে থামলো। জায়গাটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন।
বাবলু গাড়ি থেকে নেমে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলো।
লেকের পাড়ে কয়েক মিনিট ঘুরে বেড়ালো সে। চারপাশে কড়া নজর রাখলো। তার চোখে সন্দেহজনক কিছু পড়লো না। এটাই প্রত্যাশা করেছিলো। পুরো এলাকাটি চষে বেড়াতে গিয়ে পর পর তিনটি সিগারেট শেষ করলো সে। মুখটা বিস্বাদে তেতো হয়ে গেছে। সিগারেট খায় না বলে জঘন্য লাগছে এখন। ব্রাশ করার আগপর্যন্ত এই বিশ্রি অনুভূতিটা থাকবে।
পুরো এলাকা একবার টহল দিয়ে আসার সময় একদম ধীরস্থির রইলো। এখন তার মাথাটাও কাজ করছে দারুণ। নিজের মধ্যে হারানো আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে পেতে শুরু করেছে। অবাক হয়ে ভাবলো, কতো দ্রুতই না পরিস্থিতি পাল্টে যায়। একটু আগেও যারপরনাই হতাশার মধ্যে ছিলো। যেনো কানাগলিতে ঢুকে পড়া উদভ্রান্ত একজন।
তারপর, দীর্ঘ দু’ঘণ্টার হতাশাজনক মুহূর্ত এক নিমেষে উধাও হয়ে যায়। মেঘলা যখন কিডন্যাপারদের সাথে ফোনে কথা বলছিলো আর সে তাকে বলে দিচ্ছিলো কখন কি বলতে হবে তখনই এটা তার কাছে ধরা পড়ে। মেঘলা অবশ্য ধরতে পারে নি।
এখন কানাগলি থেকে বের হবার সহজ একটি পথ পেয়ে গেছে সে।
যখন মাথা ঘামিয়ে যাচ্ছিলো তখন কোনো কূল-কিণারা খুঁজে পায় নি অথচ অপ্রত্যাশিতভাবেই তার কাছে এই জিনিসটা ধরা পড়ে যায়।
এখানে আসার আগেই মেঘলাকে ফোন করেছে। তার কথা শুনে মেঘলা খুবই অবাক হয়েছিলো। হয়তো কিছুটা ভড়কেও গিয়ে থাকবে। কেন সে এটা করতে চাচ্ছে জিজ্ঞস করলে বাবলু শুধু বলেছিলো তার কথামতো কাজ করতে। এখন কোনো প্রশ্ন নয়। মেঘলা আর কিছু বলে নি। বোঝাই যাচ্ছে নিজের মেয়ের জীবন বাঁচাতে সে এখন সবকিছু করতে প্রস্তুত।
আবারো গাড়ির কাছে ফিরে গেলো সে। কিছুক্ষণ পর একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে এসে থামালো তার স্টেশনওয়াগনটা। মেইনগেটের সামনে হালকা-পাতলা গড়নের এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলফোনে কথা বলছে সে।
ড্রাইভিং সিটের জানালার কাঁচ নামিয়ে দিলো বাবলু। দূর থেকে যুবকটির সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেলে হাত নেড়ে তাকে কাছে আসতে বললো।
দ্রুত ফোনালাপ শেষ করে যুবক এগিয়ে আসতে লাগলো তার দিকে।
সাইলেন্সার পিস্তলটা সিটের পাশে রেখে গভীর করে দম নিলো বাবলু।
অধ্যায় ২৫
“শূয়োরের বাচ্চা,” সেলফোনটা রেখে বললো রাজন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিন যুবক। তাদের একজনকে উদ্দেশ্য করেই গালিটা দিলো সে। “তোরে আমি বলছিলাম ইনজেকশন মারতে?”
অপরাধী ভঙ্গিতে গাল চুলকালো কালোমতো যুবকটি।
“এই চুতমারানির পোলায় সব সময় একটু বেশি বোঝে,” কথাটা বলেই একটা কাঠের চেয়ারে বসলো। অপহরণকারীদের দলনেতা সে। আন্ডারকন্ট্রাকশন ভবনের উপর তলার একটি ফ্লোরে আছে তারা। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাল-সামান, সিমেন্টের বস্তা আর স্তূপ করে রাখা বালু। মাথার উপর জ্বলছে লালচে টিমটিমে আলোর একটি ইলেক্ট্রক বাল্ব। “ঐ মহিলা তো বার বার তার মাইয়ার সাথে কথা কইতে চাইতাছে। বলে মাইয়ার সাথে কথা না বললে টাকা দিবো না। আমি এখন কী করি?”
তিনজন যুবকের কেউ কোনো কথা বললো না। রাজন পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে দেয়াশলাই হাতরালো অন্য পকেটে। তিন যুবকের একজন, খাটোমতোন, টি-শার্ট পরা, নিজের জিপো লাইটারটা বের করে তার সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিলো।
“ট্যাকা কি কাইল দিবো, ভাই?” জিপো লাইটারটা পকেটে রেখে বললো যুবক।
সিগারেটে লম্বা টান দিলো বললো রাজন। “ট্যাকা তো সকালেই দিবার চাইতাছে কিন্তু মাইয়ার লগে কথা কইতে চায় এখন।”
জিপো চিন্তায় পড়ে গেলো। “তাইলে কি করবেন?”
রেগেমেগে তাকালো জিপেপার দিকে। আস্তে করে চলে গেলো সে। একটু দূরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো পাণ্ডার সাথে।
.
একটু আগে ট্যাপ করা ফোনালাপ আবারো মনোযোগ দিয়ে শুনছে জেফরি বেগ। কৌতূহল নিয়ে জামান চেয়ে আছে তার দিকে।
.
“ওইখানকার খবর কি?”
“সব কিছু ঠিকঠাক আছে, সকালেই টাকা পায়া যাইবা,” কিডন্যাপারকে একজন বললো।
“হুম, কিন্তু মহিলা তো বার বার তার মাইয়ার সাথে কথা কইতে চাইতাছে…”
“সমস্যা কি…কথা বলাইয়া দাও…”
“আর বইলো না, টুন্ডায় একটা আকাম কইরা ফালাইছে।”
“ক্-কি আকাম কু-করছে?” একটু তোতলালো লোকটা।
“ইনজেকশন মাইরা দিয়া দিছে। এখন কেমনে কথা বলাইয়া দেই?…হারামজাদারে বার বার কইছিলাম আমি না কইলে কিছু করতে না…”
কলার কিছু বললো না।
“তুমি চিন্তা কইরো না। ঐ মহিলারে আমি সামলাইতাছি। বেটি কয়, ওর মাইয়ার লগে কথা না কইলে নাকি ধইরা নিবো মাইয়াটা বাঁইচা নাই।”
“তা-তাই নাকি…” শুধু এটুকুই বলতে পারলো অপরিচিত কলার।
“কেমন মা, বোঝে এইবার। কলিজা খুব শক্ত।” একটু থেমে আবার বললো, “তুমারে কইছে, ট্যাকা নিয়া যাইবার কথা?”
“হ…একটু আগে কইলো তো…”
“তাইলে তো কুনো সমস্যা হইবো না মনে হইতাছে।”
“কুনো সমস্যা নাই। মনে হয় আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেইকা ট্যাকা জোগার করনের চেষ্টা করতাছে। আমারে এহন বাইরে পাঠাইছে একজনের কাছ থেইকা কিছু জিনিস আননের লাইগা। আমি শিউর, কেউ ট্যাকা নিয়া আইছে। ম্যাডাম মনে হয় স্যারূরে এইটা জানাইতে চাইতাছে না,” নোকটা জানালো।
“কিন্তু ট্যাকা তো ব্যাঙ্ক থেইকা তুইলা দিবো কইছিলো।”
“ব্যাঙ্কে মনে হয় অতো ট্যাকা নাই।”
“কয় কি? এতো বড়লোক, আর এক কোটি টাকা থাকবো না?”
“ট্যাকা যেখান থেইকা জোগার করার করুক। আমাগো এইটা নিয়া মাথা ঘামানোর দরকার কি?”
“তারপরও তুমি চোখ-কান খোলা রাইখো।”
“অসুবিধা নাই। আমি দেখতাছি।”
“ঠিক আছে। পরে কথা হইবো।”
.
জেফরি বেগ ইয়ারফোনটা খুলে জামানের দিকে তাকালো। ঘটনা কি বুঝতে পারছে সে। মিসেস চৌধুরি রাজি হয়েছিলো তার বাসার কাজের ছেলেটা মুক্তিপণের টাকা নিয়ে যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে ওই ছেলেটাই কিডন্যাপারদের সহযোগী!
“স্যার, ওদের বাসার কাজের ছেলে সবুজ জড়িত।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “হুম।”
দুপাশে মাথা দোলালো জামান।
“ওদের লোকেশন কোথায়?” সহকারীকে তাড়া দিলো সে।
সামনে রাখা বিশাল আকারের এলইডি মনিটরের দিকে তাকালো জামান। ঢাকা শহরের ভার্চুয়াল মানচিত্রটা ভেসে উঠলো পর্দায়।
“স্যার, পাশে না তাকিয়েই বললো সে। তার দৃষ্টি মনিটরের দিকে। “কিডন্যাপারদের লোকেশনটা এখানে…” থমকে গেলো সে। একই জায়গায় দুটো লাল বিপ! পাশ ফিরে তাকালো জেফরির দিকে। “বারিধারায়, স্যার!” তারপরই মাউস দিয়ে একটা বাটনে ক্লিক করতেই মানচিত্রটা আরো বড় হয়ে গেলো। “ইনকামিং কলটার লোকেশনও একই জায়গায়!
“ওহ্!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো জেফরি বেগ।
“এহসান চৌধুরির বাড়ির খুব কাছেই!” বিস্মিত জামান বললো।
অধ্যায় ২৬
এহসান চৌধুরি বুঝতে পারছে না এসব কী হচ্ছে। তার বাড়ির কাজের লোক সবুজকে বাড়িতে দেখা যাচ্ছে না। দাড়োয়ান বলেছে আধঘণ্টা আগে সে বাড়ির বাইরে যাবার পর আর ফিরে আসে নি।
দিহান কিডন্যাপ হবার পর বাড়ির সবাইকে বিনা কারণে, না জানিয়ে বাইরে যেতে নিষেধ করে দিয়েছিলো। তার কড়া নিষেধ শুনে কেউ সারাদিন বাইরে যায় নি। এহসান চৌধুরির মন বলছে, কিছু একটা হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে সবুজের হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়াতে আরো ঘাবড়ে গেলো সে। অথচ তার স্ত্রী আনিকা অদ্ভুত রকমভাবেই শান্ত আছে। হয়তো ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে কিন্তু বাইরে থেকে তাকে দেখলে বোঝা যাবে না, তার প্রাণপ্রিয় সন্তান আজ সকাল থেকে অপহৃত।
এহসান ড্রইংরুমে এসে দেখতে পেলো টেলিফোনের সামনে চুপচাপ বসে আছে তার স্ত্রী। তবে একটু আগে যেমন দেখে গেছিলো এখন আর ততোটা শান্ত মনে হলো না। যেনো চাপা ক্রোধ কোনো রকমে সামলে রেখেছে। রাগে লাল হয়ে আছে তার ফর্সা মুখটা। বিগত কয়েক ঘণ্টা ধরে স্ত্রীকে চিনতে পারছে না। এই আনিকা তার কাছে বড্ড অচেনা।
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, সবুজ গেলো কোথায়?” স্ত্রীর কাছে এসে বললো সে।
মুখ তুলে তাকালো আনিকা, তবে কিছু বললো না।
“তুমি চুপ করে আছো কেন, কিছু একটা বলো?” স্ত্রীর অসহ্য নীরবতায় অধৈর্য হয়ে উঠলো সে।
“সবুজকে নিয়ে এতো টেনশনের কী আছে,” শান্তকণ্ঠে বললো আনিকা। “সে যদি বাইরে গিয়ে থাকে তো গেছে।”
“আশ্চর্য, ওর মোবাইলফোনটাও বন্ধ আছে। কী হচ্ছে এসব?”
আনিকা কিছু বলছে না দেখে আবারো অস্থির হয়ে উঠলো তার স্বামী।
“আমার তো মনে হচ্ছে ও আর ফিরে আসবে না,” কথাটা বলেই স্ত্রীর পাশে বসে পড়লো সে। “আমার কড়া নিষেধ সত্ত্বেও বাড়ির বাইরে গেছে…মোবাইলটাও অফ করে রেখেছে এখন!”
“ও ফিরে না আসলে আসবে না, এ নিয়ে এতো অস্থির হবার কী আছে?” অনেকটা বিরক্ত হয়ে বললো আনিকা। “আমি আমার মেয়ের টেনশনে মরে যাচ্ছি আর তুমি…” কথাটা শেষ না করে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো সে।
এহসান চুপ মেরে বসে রইলো স্ত্রীর পাশে। “দাড়োয়ান বললো ওকে নাকি তুমি বাইরে পাঠিয়েছো?” কিছুক্ষণ পর আস্তে করে বললো সে।
“আমি বুঝতে পারছি না,” আবারো রেগে গেলো আনিকা। “তুমি সবুজের ব্যাপারে এতো অস্থির হয়ে উঠছো কেন?”
স্ত্রীর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো, “কী হচ্ছে না হচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমিও আমাকে কিছু বলছে না। এদিকে সবুজ লাপাত্তা হয়ে গেছে…তুমি নাকি তাকে বাইরে পাঠিয়েছো…বলে দিলেই হয় ওকে কোথাও পাঠিয়েছো…”
আনিকা মুখ সরিয়ে রাখলো অন্যদিকে, কিছু বললো না।
“প্লিজ আনি…” স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে বললো এহসান। “কি করছো না করছো অন্তত আমাকে বলো…সামান্য ভুল হলে আমাদের মেয়েটার কী হবে ভেবে দেখেছো?”
“আমার কোনো ভুল হচ্ছে না, দাঁতে দাঁত চেপে বললো আনিকা। “দয়া করে আমাকে আর কোনো প্রশ্ন কোরো না তো।”
এহসান কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো। তার স্ত্রীর ডান হাতে একটি মোবাইলফোন। আনিকা ব্যবহার করে আইফোন। কিন্তু এই ফোনটা অন্য ব্র্যান্ডের। আগে কখনও এটা তাকে ব্যবহার করতে দেখে নি।
“এটা কার ফোন?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো সে।
হাতের ফোনটার দিকে তাকালো আনিকা। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমার।”
“তোমার?” বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো এহসানের। “তুমি তো আইফোন ইউজ করো!”
“আমি কি ফোন ইউজ করি না করি সেটা কি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ?” রেগেমেগে বললো দিহানের মা। “ছেলেমানুষির মতো সব প্রশ্ন করে যাচ্ছো…একটু শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারো না?”
অনেকটা ধমক খেয়ে স্ত্রীর কথায় চুপ মেরে গেলো সে। তারপর আমতা আমতা করে বললো, “এতো রাগ করছো কেন? বলে দিলেই হয় সবুজকে কোনো কাজে পাঠিয়েছে।”
চট করে স্বামীর দিকে তাকালো। “ওকে আমি জাহান্নামে পাঠিয়েছি।”
এহসান চৌধুরি স্ত্রীর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো। এই মেয়েটা কি তার স্ত্রী?
হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠলো এ সময়। এহসান জানে কিডন্যাপারদের কেউ ফোন করেছে। স্ত্রীকে ইশারা করলো স্পিকার মুডে দিয়ে কথা বলার জন্য।
স্পিকার মুড়ে দিয়ে রিসিভারটা তুলে নিলো আনিকা। “হ্যালো?”
“কাল সকাল আটটা বাজে টাকাগুলা চাই…” ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। এই কণ্ঠটা অন্য একজনের। সম্ভবত দলের নেতার। যাকে অপহরণকারীরা বস্ বলে সম্বোধন করে।
“এতো সকালে পিরবো না, ব্যাঙ্ক খোলার পর টাকা তুলে দিতে হবে, বললো দিহানের মা।
এহসান উন্মুখ হয়ে শুনছে।
“তাইলে, সকাল দশটায়?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে,” আনিকা চকিতে স্বামীর দিকে তাকালো। “সবুজ টাকাগুলো পৌঁছে দেবে…”
এহসান চৌধুরি দারুণ অবাক হলো। তাদের বাড়ির কাজের ছেলেটা এতোগুলো টাকা পৌঁছে দেবে কিডন্যাপারদের কাছে! তাহলে কি এই কাজেই সবুজকে কোথাও পাঠিয়েছে? না। তা কেন হবে। টাকা তো সে-ই দিতে পারবে কাল সকালে। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। আনিকা তাকে এখনও বলে নি টাকাগুলো কাল সকালে কখন তুলতে হবে।
“আচ্ছা,” বললো কিডন্যাপারদের বস্। “কাজের ছেলের ফোন নাম্বারটা আমারে দেন…আমি তারে বইলা দিমু কোথায় যাইতে হবে। বুঝলেন?”
একটু ভেবে বললো আনিকা, “হ্যাঁ। বুঝেছি। নাম্বারটা লিখে রাখুন…” তারপর একটা সেলফোন নাম্বার বলে গেলো সে। বলার সময় এক ফাঁকে স্বামীর দিকে তাকালো। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে বেচারা।
“ঠিক আছে। কাইল সকালে ওরে ফোন দিয়া বইলা দিমু কখন কোথায় আসতে হইবো,” নাম্বারটা টুকে নেবার পর বললো কিডন্যাপার।
গভীর করে দম নিলো আনিকা। “আপনি নিশ্চয় শুনেছেন, আমি আমার মেয়ের সাথে কথা না বলে কোনো টাকা দেবো না…”
গোল গোল চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালো এহসান চৌধুরি।
“হ, শুনছি,” কাটাকাটাভাবে কিডন্যাপার। “চিন্তার কোনো কারণ নেই। আপনার মাইয়ার সাথে আপনে কথা কইতে পারবেন।”
“কখন?”
“কাইল সকালে।”
“কাল সকালে তো কথা বলবোই…আমি এখন ওর সাথে কথা বলে নিশ্চিত হতে চাইছি, ও ভালো আছে।”
একটু চুপ মেরে থাকলো ওপাশের কণ্ঠটা।
“হ্যালো?” তাড়া দিলো দিহানের মা।
“উম…ঠিক আছে, রাইত দশটা-এগারোটার মইদ্যে ফোন দিমু নে। তখন মাইয়ার লগে কথা কইয়েন।”
আনিকা রিসিভারটা কানে চেপে ধরে রাখলো, যদিও লাইনটা কেটে দেয়া হয়েছে।
“সবুজ টাকা নিয়ে যাবে!” এহসান চৌধুরি যেনো বিশ্বাসই করতে পারছে না।
স্বামীর দিকে তাকালো আনিকা, কিছু বললো না। শুধু নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলো।
অধ্যায় ২৭
টান টান উত্তেজনা নিয়ে বসে আছে জেফরি আর জামান। তাদের মনোযোগ মনিটরের দিকে।
“আমাদের ম্যাপ বলছে, এটা একটা আন্ডারকন্সট্রাকশন ভবন…” জামান পদার ছবিটা আরো বড় করে পেছন ফিরে বসের দিকে তাকালো। “…এটা তিন মাস আগে আপডেট করা হয়েছে, স্যার।”
হোমিসাইডে ঢাকা শহরের যে ভার্চুয়াল মানচিত্রটি আছে সেটা বছরে দু’বার আপগ্রেড করা হয়। ডিপার্টমেন্টের অনেকেই মনে করে এর কোনো দরকার নেই। খামোখা এতোগুলো টাকা নষ্ট করা হয়। কিন্তু জেফরি জানে স কিছু আপগ্রেড করে রাখাটা ভীষণ জরুরি। তার চাপাচাপিতেই এটা নিয়মিত করা হয়।
পর্দায় লোকেশনটা ভেসে উঠলে জেফরি বেগ দেখতে পেলো জায়গাটা বারিধারার কাছে কালাচাঁদপুর নামের একটি এলাকা। কয়েকদিন আগেও এটা ছিলো ডোবা-নালায় পরিপূর্ণ। এখন রিয়েল এস্টেটের খপ্পরে পড়ে গেছে। গড়ে উঠছে শত শত ভবন।
কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে উঠে দাঁড়ালো জেফরি বেগ।
জামানও উঠে দাঁড়ালো। বুঝতে পারলো মাঠে নামার সময় হয়ে গেছে। তাদের।
“আমরা কোনো পুলিশফোর্স সঙ্গে রাখবো না,” বললো জেফরি। “কেসটা খুবই ডেলিকেট। একটু এদিক ওদিক হলেই মেয়েটাকে ওরা মেরে ফেলবে।”
“আমরা আমাদের নিজস্ব ফোর্স ব্যবহার করবো?”
“আমরা চার-পাঁচ জনের একটি দল অপারেশন চালাবো। তুমি আমিসহ আরো তিনজনকে সঙ্গে নেবো।”
“লোকাল থানাকে জানাবেন না?”
“ওদেরকে ব্যাকআপে রাখবো কিন্তু কিডন্যাপিংয়ের কথা বলবো না।”
জামান বুঝতে পারলো তার বস কি চাইছে। পুলিশকে এরকম কেসে জড়িত করতে গেলে ঝুঁকি আছে। তারা হঠাৎ করে এ রকম অভিযানের জন্য দ্রুত প্রস্তত হতে পারবে না। কাজটা যদি নিছক কোনো সন্ত্রাসীদলকে গ্রেফতার করার হতো তাহলে সমস্যা ছিলো না, কিন্তু এখানে ছোট্ট একটি মেয়ের জীবন নির্ভর করছে। অন্য সব অপারেশনের চেয়ে আরেকটু বেশি বিচক্ষণতার দরকার। সুতরাং, পুরো অপারেশনটি হোমিসাইডই করবে, পুলিশ থাকবে ব্যাকআপে। হয়তো তাদেরকে বলা হবে, একটা খুনিচক্রকে ধরতে যাচ্ছে তারা।
“বাকি তিনজন কে, স্যার?”
জেফরি একটু ভেবে বললো, “আজ রাতে স্ট্যান্ডবাই র্যাটদের মধ্যে যারা শুটিংয়ে ভালো স্কোর করেছে তাদের মধ্য থেকে তিনজনকে রেডি হয়ে যেতে বলো।”
হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে ছোট্ট একটি র্যাপিড অ্যাকশন টিম রয়েছে-সংক্ষেপে তাদেরকে র্যাট বলা হয়। অবশ্য ডিপার্টমেন্টের অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে আড়ালে আবডালে তাদেরকে ইন্দুর’ বলেও ডেকে থাকে। রাতের বেলায় তাদের মধ্য থেকে ছয়জন সদস্য স্ট্যান্ডবাই থাকে। পুলিশ, হাসপাতাল আর ফায়ার-সার্ভিসের মতো হোমিসাইডকেও জরুরি সার্ভিস হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে।
“ঠিক আছে, স্যার,” বললো জামান। “পাঁচজনে কি হবে, নাকি আরো বেশি দরকার?”
“পাঁচজনেই হবে,” জানালো জেফরি বেগ। “লোকাল থানার ব্যাকআপ তো থাকছেই। কোনো সমস্যা হবে না।”
জামান উঠে চলে গেলো। সে এখন সবকিছু রেডি করার জন্য ইন্সট্রাকশন দেবে। আর জেফরি চলে গেলো নিজের অফিসে, অপারেশেনের জন্যে প্রস্তত হতে।
.
হাত-পা আর মুখ বাধা অবস্থায় গাড়ির পেছনের সিটে হালকা-পাতলা গড়নের যে যুবকটি পড়ে আছে সে আর কেউ নয়, এহসান চৌধুরির বিশ্বস্ত কাজের লোক সবুজ। তার দু’চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। যেনো এখনই মারা যাবে। নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছে। তার সামনে যে আজরাইলটা আছে তাকে সে কখনও দেখে নি। চেনেও না। একটু পর পর আজরাইলটা তার নাক চেপে ধরছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মরে যাবার আগেই আবার ছেড়ে দিচ্ছে সে। তাকে নিয়ে নির্মম ছেলেখেলা খেলছে।
বাড়ির কর্তা চৌধুরি সাহেবের স্ত্রী একটু আগে তাকে ডেকে বলেছিলো আগামীকাল সকালে টাকা নিয়ে কিডন্যাপারদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। কথাটা শুনে প্রথমে সে ভয় পাবার অভিনয় করে তারপর এমন ভান করে যেনো বাধ্য হয়ে কাজটা করতে রাজি হয়েছে। এরপরই মিসেস চৌধুরি আরেকটা কাজ দেয়-বাইরে গিয়ে তার এক পরিচিত লোকের কাছ থেকে একটা জিনিস নিয়ে আসতে হবে। লোকটা নাকি বাড়ির বাইরে একটা কালো রঙের গাড়িতে করে আসবে। আসামাত্রই সবুজ তার নিজের নাম বললেই জিনিসটা দিয়ে দেবে।
কথামতো সে বাড়ির বাইরে এসে দেখে তখনও কালো রঙের গাড়িটা আসে নি। অপেক্ষার সেই সময়টাতে রাজনকে ফোন করে একটু কথা বলে। তার ফোনালাপ শেষ হবার আগেই দেখতে পায় রাস্তার ওপারে কালো রঙের একটা গাড়ি এসে থেমেছে। তার ধারণা ছিলো মিসেস চৌধুরি হয়তো স্বামীর অগোচরে নিকট কোনো আত্মীয়ের কাছ থেকে টাকা ধার করছেন।
গাড়ির কাছে যেতেই এই লোকটাকে দেখতে পায়। তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি তার জন্য কি অপেক্ষা করছে।
লোকটা ড্রাইভিং সিটের অন্যদিকের দরজাটা খুলে তাকে গাড়ির ভেতরে আসতে বলে। সবুজ ভেতরে ঢুকেই দেখে লোকটার হাতে পিস্তল। পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এরকম কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো
সে। তারপর থেকে এই লোকটার কজায় আছে সে। এক পর্যায়ে তার মাথার পেছনে পিস্তলের বাট দিয়ে জোরে আঘাত করতেই জ্ঞান হারায় সবুজ। যখন চোখ খোলে দেখতে পায় হাত-পা আর মুখ বাধা অবস্থায় পড়ে আছে গাড়ির পেছনের সিটে। তবে জানালার কাঁচ দিয়ে বাইরে শুধু অন্ধকার দেখতে পায়। এখন কোথায় আছে সে জানে না।
“মেয়েটা কাদের হাতে আছে?” বেশ শান্তকণ্ঠে বললো বাবলু।
কথাটা শুনে সবুজের হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার জোগার হলো যেনো। এই লোক তাকে এ কথা জিজ্ঞেস করছে কেন! মাথা দুলিয়ে সে জানালো কিছু বুঝতে পারছে না।
মুচকি হাসলো বাবলু। একটা হাত তুলে তার মোবাইলফোনটা দেখালো। বুঝতে পারC, সে যখন জ্ঞান হারিয়েছিলো তখন তার পকেট থেকে ওটা নিয়ে নিয়েছে। তিন-চার হাজার টাকা দামের সস্তা চায়নিজ মোবাইলফোনের দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো সবুজ।
“আমি ঠিক করেছিলাম তুই মিথ্যে বললেই তোর এক পায়ে গুলি করবো,” কথাটা বলেই সাইলেন্সর পিস্তলটা বের করে সবুজের বাম হাটুর উপর ঠেকালো। “যা, তোকে একটা সুযোগ দিলাম…এবার বল, মেয়েটা এখন কাদের হাতে আছে?”
এহসান চৌধুরির কাজের লোক সবুজের নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে উঠলো। সে বুঝতে পারছে না কী বলবে। এই লোক কে? পুলিশ! হতে পারে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, বাড়ির কর্তা, মিসেস চৌধুরি তাকে এই আজরাইলের হাতে তুলে দিয়েছে! এটা কিভাবে সম্ভব হলো? কতো সতর্কই না ছিলো সে। এমন কিছু করে নি যে দিহানের মা-বাবা ভুলেও তাকে সন্দেহ করবে। একটু আগে পর্যন্ত সে বুঝতে পারে নি তার ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে। মিসেস চৌধুরি কীভাবে এটা ধরতে পারলো!
দিহানের কিডন্যাপের ব্যাপারেও তারা সবাই বেশ সতর্ক ছিলো। বারিধারা এলাকায় কয়েক মাস ধরে আনাগোনার ফলে রাজনদের চেহারা মোটামুটি পরিচিত হয়ে উঠেছিলো, তাই মেয়েটার স্কুলের সামনে থেকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সবদিক থেকে ওটাই ছিলো ভালো জায়গা।
তারপরও কিভাবে সব জানাজানি হয়ে গেলো তার মাথায় ঢুকছে না।
বাবলু আবারো নাক চেপে ধরলো সবুজের। তার ধারণা এই বদমাশটা বড়জোর পাঁচ মিনিট সহ্য করতে পারবে, তারপরই গীত গাইতে শুরু করবে।
শক্ত করে নাকটা চেপে ধরতেই সমস্ত শরীর বেঁকিয়ে হাসফাস করে উঠলো সবুজ। তার পা দুটো বাধা, সেই পায়ের উপর বসে আছে বাবলু।
উদভ্রান্তের মতো মাথা ঝাঁকাতে লাগলো সে। তার নিঃশ্বাস ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে। বাতাসের অভাবে ফুসফুস পুড়ে যাচ্ছে যেনো। মৃত্যু যন্ত্রণা কাকে বলে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে এখন।
নাকটা ছেড়ে দিলো বাবলু। “তুই কিছু না বললেও আমি ঠিকই বের করতে পারবো,” ফিসফিসিয়ে বললো সে। “এই ফোনে তুই ওদের সাথে যোগাযোগ করেছিস। ওরাও তোর সাথে যোগাযোগ রাখছে। আমার মনে হয় আর কোনো চালাকি না করে বলে দিলেই তুই বেঁচে যাবি।”
সবুজের চোখ দুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসছে যেনো। নাক দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো সে।
“আমি তোর মুখটা খুলে দিচ্ছি…যা জানতে চাইবো সব বলবি। কোনো রকম চিৎকার দেবার চেষ্টা করবি না। তোকে খুন করতে পারলে আমার ভালোই লাগবে। বুঝলি?”
মুখের বাধন খুলে দিতেই হা করে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো সবুজ। বাবলু একটু অপেক্ষা করলো।
মেঘলার সাথে কিডন্যাপারদের নেতা কথা বলার সময় অসতর্ক হয়ে ছোট্ট একটা ভুল করে বসে। বাড়ির কাজের ছেলেকে দিয়ে টাকা পাঠানোর প্রস্তাব দেবার পর এক পর্যায়ে সবুজের নামটা বলে ফেলে সে। মেঘলা এটা ধরতে পারে নি। ধরার কথাও নয়, কিন্তু বাবলু ঠিকই বুঝে যায়। কারণ তখনও মেঘলা জানায় নি তাদের বাড়ির কাজের ছেলেটার নাম সবুজ।
কিডন্যাপার কিভাবে ছেলেটার নাম জানলে? প্রশ্নটা মাথায় ঢুকতেই মুহূর্তে সব পরিস্কার হয়ে ওঠে তার কাছে। দিহানের কিডন্যাপের সাথে সবুজ জড়িত। এরফলে আচমকা কানাগলি থেকে বের হবার সহজ রাস্তাটা পেয়ে যায় বাবলু।
“রাজন…” অবশেষে হাফাতে হাফাতে বললো এহসান চৌধুরির কাজের লোকটি। “…রাজনদের কাছে আছে…”
“গুড,” মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “ওরা এখন কোথায়?”
চোখ পিটপিট করে চেয়ে রইলো সবুজ। “আমি জানি না-আ-!”
আর বলতে পারলো না সে। বাবলু তার মুখের ভেতর সাইলেন্সারের নলটা ঢুকিয়ে দিয়ে শীতল কণ্ঠে বললো “হয় বলবি, নয় মরবি!”
আবারো বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো ছেলেটা।
“আমি তিন গুণববা…এক,” বললো সে। “দুই…”
উভ্রান্তের মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো বন্দী।
পিস্তলের নলটা বের করে নিলো বাবলু। “বল্।” তার ঠোঁটে দেখা দিলো ক্রুড় হাসি। বানচোত!
অধ্যায় ২৮
গাড়িটা পূর্ণ গতিতে ছুটে চললেও জেফরি বেগের মনে হচ্ছে আরো দ্রুত ছুটছে না কেন। অন্য সবার মতো সে কখনও ড্রাইভারকে গতি বাড়ানোর তাগাদা দেয় না, আজও দিলো না কিন্তু তার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়ে গেছে।
গাড়ি চালাচ্ছে জামান। তার পাশে বসেছে জেফরি। পেছনের সিটে বসেছে র্যাট-এর একজন সদস্য। তাকে এরইমধ্যে বৃফ করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে গিয়ে কি করতে হবে না হবে। তবে ঐ ভবনের লে-আউট যেহেতু তাদের জানা নেই সে কারণে অ্যাসল্ট প্ল্যানটা চুড়ান্ত করা যায় নি। ভবনটা বাইরে থেকে দেখে যতদূর সম্ভব একটা ধারণা করে নিতে হবে।
বারিধারার কালাচাঁদপুরের একটি নির্মাণাধীন ভবনের কোনো ফ্লোরে আছে অপহরণকারীরা, সম্ভবত বাচ্চামেয়েটাসহ। সে অবশ্য নিশ্চিত, মেয়েটা ওখানেই আছে। তারপরও শতভাগ নিশ্চিত হবার কোনো উপায় নেই। যেমনটি নিশ্চিত হতে পারছে না অপহরণকারীর সংখ্যা নিয়ে। দুটো প্রাইভেটকারে করে অপারেশনে যাচ্ছে তারা। এই অপারেশনে অংশ নিচ্ছে। মোট পাঁচজন। পেছনের আরেকটা গাড়িতে আছে বাকি দুই র্যাট সদস্য। লোকাল থানাকে একটা ব্যাকআপ টিম রেডি করতে বলা হয়েছে। তাদের ডাক পেলেই ওরা চলে আসবে ঘটনাস্থলে।
জেফরি বেগের এক হাতে জিপিএস ডিভাইস, সেটার দিকে বার বার তাকাচ্ছে। আর বড়জোর পনেরো মিনিট। তবে রাস্তার জ্যাম আর ট্রাফিক সিগন্যালের উপর নির্ভর করছে সময়টা।
“আমার ধারণা ওদের সংখ্যা পাঁচ-ছয়জনের বেশি হবে না,” পেছনের সিট থেকে সৈকত নামের র্যাট সদস্য বললো। তার পরনে কালো প্যান্ট আর শার্ট, মাথায় একই রঙের সানক্যাপ। শার্টের উপর ধূসর রঙের চেস্টর্যাক। পায়ে বুট জুতো। তাকে দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সোয়াট টিমের একজন বলে মনে হচ্ছে। সাব-মেশিনগানটা কোলের উপর রেখে আদর করছে যেনো।
পেছনে না তাকিয়েই মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। সেও জানে সংখ্যাটা এরকমই হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে যতোগুলো অপহরণের ঘটনা পুলিশ রেকর্ডে রয়েছে সেখানে দেখা যায়, গড়ে পাঁচ-ছয়জনের মতো লোক জড়িত থাকে এরকম কাজে।
“যদি বেশি হয় তাতেও সমস্যা নেই,” গাড়ি চালাতে চালাতে বললো জামান। “ওদের সবার কাছে নিশ্চয় অস্ত্র থাকবে না।”
“হুম, তা ঠিক,” জিপিএস থেকে মুখ তুলে তাকালো জেফরি। কিন্তু আমাদের একটা সমস্যা আছে…ঐ বাচ্চামেয়েটা। ওকে জীবিত উদ্ধার করতে হবে। সুতরাং সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে।”
জামান আর সৈকত সায় দিলো তার কথায়।
“যাদের হাতে অস্ত্র থাকবে তাদেরকে কোনো সুযোগ দেবে না,” জেফরি বললো। “একদমই না।”
“বডিতে গুলি করবো, স্যার?” পেছন থেকে সৈকত বললো। “আই মিন, শুট অ্যাট সাইট?”
“হ্যাঁ,” দৃঢ়ভাবে বললো জেফরি।
জামান চকিতে রিয়ার-ভিউ মিরর দিয়ে সৈকতের দিকে তাকালো। ছেলেটা জেফরির কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছে।
“আমরাও কি র্যাবের মতো ক্ৰশফায়ারের নাটক সাজাবো?”
জেফরি বেগ এবার পেছন ফিরলো। তার ঠোঁটে মুচকি হাসি। “না। আমাদের ক্রিয়েটিভিটি এতোটা নীচে নেমে যায় নি, সৈকত।”
“তাহলে আমরা কী বলবো?”
“খুব সহজ,” রাস্তার দিকে চোখ রেখেই জামান বললো। “গানফাইট, সেল্ফ ডিফেন্স, এনকাউন্টার…”
মুচকি হাসলো জেফরি বেগ।
“এসব নিয়ে আমার ভাবার দরকার নেই। এগুলো আপনারা সামলাবেন,” সৈকত বললো। চেস্টর্যাকের পকেটগুলো চেক করতে শুরু করলো সে।
জিপিএস-এর দিকে আবারো তাকালো জেফরি বেগ। সিদ্ধান্ত নিলো তাদের গাড়ি দুটো থামাবে ঐ ভবন থেকে একটু দূরে। কিডন্যাপাররা যেনো কোনোভাবেই টের না পায়।
অধ্যায় ২৯
রাত। আকাশে এক টুকরো চাঁদ ভাসছে। সেই চাঁদের আলো শহরের এ অংশে কতোটুকু এসে পড়েছে তা জানার কোনো উপায় নেই। প্রশ্বস্ত রাস্তার দু’পাশে সোডিয়াম লাইটের হলুদ আলোয় চারপাশ উদ্ভাসিত। আশেপাশে সারি সারি ফ্ল্যাট আর সুউচ্চ ভবন থেকে ইলেক্ট্রক বাল্বের আলো এসে মিশে গেছে সেই আলোর সাথে।
পুরনো মডেলের কালো রঙের স্টেশনওয়াগনটা বেশ ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে কারণ পরবর্তী গন্তব্য খুব কাছেই। তাড়াহুড়া করার কোনো দরকার নেই।
গাড়ির দু’জন যাত্রির মধ্যে একজন বসে আছে ডাইভিং সিটে। তার চোখ রাস্তার উপর নিবদ্ধ। চেষ্টা করছে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে। মাথা ঠাণ্ডা থাকলে অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলতে পারে সে। একটু পর যে কাজ করবে সেটার জন্য মাথা ঠাণ্ডা রাখা ভীষণ জরুরি। রাগ-ক্ষোভের দরকার এখানে নেই।
একজন মানুষকে তুমি রাগের বশে মেরে ফেলতে পারবে কিন্তু তিন চারজনকে মারতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সঠিক পরিকল্পনা করে এগোতে হয়। সে জানে, মাথা ঠাণ্ডা রাখলে কাজটা তার জন্যে মোটেও কঠিন কিছু হবে না।
চারজন যুবক। তাদের মধ্যে দু’জন সশস্ত্র। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবগুলোকে শেষ করে দিতে পারবে। ঝড়ের গতিতে হানা দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারবে সবগুলোর মাথা। কিন্তু সেটা করা যাবে না। ওদের হাতে বন্দী হয়ে আছে ছোট্ট দিহান। তাকে খুব সতর্কভাবে কাজটা করতে হবে। নিজের জীবন বিপন্ন হবার ঝুঁকি নিতে পারলেও ঐ ছোট্ট মেয়েটার বেলায় কোনো ঝুঁকি নেয়া যাবে না।
গাড়ির অন্য যাত্রি পেছনের সিটে বরফের মতো জমে আছে। হাত-পা মুখ বাধা আছে বলে তার কিছু করার নেই। মরা লাশের মতো পড়ে আছে সে। কোনো শব্দ করছে না। রিয়ার মিররে তাকালো বাবলু যদিও জানে। বন্দীকে দেখতে পাবে না। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো কুড় হাসি।
বেঈমানের বাচ্চা!
বিগত আধঘণ্টায় এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে সবুজের। আতঙ্কে হাত-পা অসাড় হয়ে আছে। তীব্র আতঙ্কের মধ্যেও এক ধরণের অনুশোচনায় আক্রান্ত সে। যে ঘৃণ্য কাজ করেছে তার প্রাপ্য শাস্তিই এখন পাচ্ছে। চিরটাকাল অভাবে বড় হলেও এহসান চৌধুরির বাড়িতে কাজ করার সুবাদে বেশ ভালোই কাটছিলো দিনগুলো। থাকা-খাওয়া ছাড়াও ভালো বেতন পেতো মাস শেষে। চৌধুরি আর তার স্ত্রী বেশ ভালো মানুষ। তার প্রতি বেশ সহমর্মিও ছিলো। বিপদে-আপদে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করতো। তারপরও কেন যে এরকম জঘন্য একটা কাজ করতে রাজি হলো! অনুশোচনায় কান্না চলে এলো তার, কিন্তু ভালো করেই জানে এখন আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না। তার মৃত্যু অবধারিত। বেঘোরে প্রাণ হারিয়েই এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
মাসখানেক আগে যদি রাজনের সাথে তার দেখা না হতো, রাজনের দুঃসাহসিক আর জঘন্য প্রস্তাবে রাজি না হতো তাহলে আজ তার এই পরিণতি হতো না।
তাদের গ্রামের ছেলে রাজন হাওলাদারের সাথে এই বারিধারায় দেখা হয়ে গিয়েছিলো অনেক দিন পর। খুব কাছেই নাকি একটা ভবনে দলবল নিয়ে উঠেছে। রাজন যে ঢাকায় আছে সে খবর তার জানা ছিলো না। পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হবার পর তাদের মধ্যে আবার যোগাযোগ শুরু হয়। শুধুমাত্র ফোনে নয়, সময় পেলেই তার সাথে দেখা করতো, গল্পগুজব করতো। রাজন এখন অপরাধ জগতের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। বারিধারার একটি নির্মাণাধীন ভবন দখল করে রেখেছে তার ছোটোখাটো দলটি। টাকার বিনিময়ে এরকম কাজ করে থাকে সে। এছাড়া কাওরানবাজারে এক বড় ভায়ের অধীনে থেকে চাঁদাবাজিও করে।
বারিধারায় দেখা হবার সপ্তাহখানেক পরই রাজন তাকে এই প্রস্তাবটি দেয়। কথাটা শুনে সবুজ প্রথমে ভড়কে গেছিলো। রাজন এসব কী বলে? তারপর যখন বুঝতে পারলো বিরাট অঙ্কের টাকা পাবে-এতো টাকা সে এই জীবনে কল্পনাও করে নি-তখন রাজি হয়ে যায়। রাজন তাকে বলেছিলো, বড় হতে হলে, দুনিয়াতে টাকা কামাতে হলে একটু অন্যায় কাজ করতেই হয়। সব বড়লোকেই এভাবে টাকা কামায়। তার বাড়ির মালিক চৌধুরি সাহেব যে বিরাট বড় বাড়ি আর দু’তিনটা গাড়ির মালিক, সুন্দরি বউ আর ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে সুখে আছে সেটা কি এমনিতেই হয়েছে? না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেও বড় কোনো অন্যায় করে অঢেল টাকার মালিক বনে গেছে।
রাজন তাকে আরো বলেছিলো, সবুজকে তো আর কিছু করতে হবে না। যা করার তার লোকজনই করবে। সে শুধু ভেতর থেকে কিছু খবরাখবর সময় মতো পৌঁছে দেবে, বিনিময়ে পাবে লাখ-লাখ টাকা।
রাজনের পরিকল্পনামতোই ঘটনা এগিয়ে গেছে। মেয়ের বাবা-মা এক কোটি টাকা দিতে রাজি হয়ে যায়। আগামীকাল সকালে পুরো টাকা দিয়ে দেবার কথা ছিলো কিন্তু আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সবুজের উপর এই ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসে।
এই লোকটার চেহারার সাথে কাজকর্মের কোনো মিল নেই। তাকে সহজ আর যন্ত্রণাময় একটা শাস্তি দিয়েই সবকিছু আদায় করে নিয়েছে। এখন তাকে নিয়ে যাচ্ছে রাজনদের আস্তানায়। ওখানে গিয়ে এই লোক কী করবে সবুজ জানে না। তার শুধু মনে হচ্ছে বিরাট কিছু হতে যাচ্ছে। তার মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইচ্ছে করলে এই লোক তাকে রওনা দেবার আগেই মেরে ফেলতো, কিন্তু সে তা করে নি। কেন করে নি সে বুঝতে পারছে। তার দেয়া তথ্য সঠিক কিনা খতিয়ে দেখবে আগে। তারপরই শেষ করে দেবে তাকে।
গাড়িটা থেমে গেলো।
“এই বিল্ডিংটায়?”
সবুজ চেয়ে দেখলো সামনের সিট থেকে পেছন ফিরে তার দিকে চেয়ে আছে মৃত্যুদূত।
সিটে শুয়ে থেকেই জানালা দিয়ে দেখতে পেলো রাস্তার ওপারে থাকা আন্ডারকন্ট্রাকশন ভবনটি।
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
প্রায় নয়-দশ তলা উঁচু কাঠামোটা দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর আর বাইরে এখনও অনেক কাজ বাকি। মালিকানা নিয়ে কী একটা আইনী ঝামেলায় কাজ বন্ধ আছে। মালিকানা দাবি করা একজনের পক্ষ হয়ে রাজনরা এই ভবনটি দখল করে রেখেছে আজ প্রায় দু মাস হলো। পুলিশ প্রশাসন ওই মালিকানা দাবিদারের পক্ষেই আছে। মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে এ কাজে। রাজন তার দলবল নিয়ে এখানে আস্তানা গেড়েছে। দিন-রাত এখানেই থাকে তার লোকজন। কোনো দাড়োয়ান কিংবা কেয়ারটেকার নেই। অনেকটা পরিত্যাক্ত নির্মাণাধীন এই ভবনটিই বেছে নেয়া হয়েছে তাদের কাজের জন্য।
সবুজ টের পেলো গাড়িটা আবার চলতে শুরু করেছে। কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি জায়গায় থামলো সেটা। ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হলো এবার। চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। ভালো করেই জানে মৃত্যু তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এখন।
খুট করে শব্দ হতেই দেখতে পেলো প্যাসেঞ্জার ডোরটা খুলে মৃত্যুদূত তার দিকে ঝুঁকে আছে।
সবুজের হৃদস্পন্দন থেমে গেলো। লোকটার হাতে পিস্তল। আর সেটা তা করা আছে ঠিক তার কপাল বরাবর।
ভয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললো সবুজ।
হায় আল্লাহ!