২০
দুর্গে মেজরের বাড়িতে হাজি মুরাদের এক সপ্তাহ কেটে গেল। তিনি সঙ্গে মাত্র দুজন মুরিদ রেখেছিলেন–খানেফি আর এলডার। মেরি দমিত্রিয়েভনা নোংরা খানেফিকে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেও হাজি মুরাদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি ছিল পরিষ্কার। সে আর তাকে খাবার পরিবেশন করত না, সে কাজটা এলডারকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যেকোনো সুযোগে হাজি মুরাদকে দেখতে বা সেবা করতে যেত। তার পরিবারের ব্যাপারে আলোচনায় তার খুব আগ্রহ ছিল। জানত তার স্ত্রী কজন। সন্তান কজন, তাদের বয়স কত। কোনো চর তার সঙ্গে দেখা করতে এলেই সে আলোচনার ফলাফল জানতে সব রকম চেষ্টা করত।
এই সপ্তাহে বাটলার আর হাজি মুরাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কোনো কোনো সময় হাজি মুরাদ তার ঘরে যেতেন বা বাটলার যেত তার ঘরে। কখনো তারা দোভাষীর মাধ্যমে কথা বলতেন, কখনো ইশারা-ইঙ্গিতে বা হাসিতে।
হাজি মুরাদ বাটলারকে পছন্দ করতেন বোঝাই যায়। তার সঙ্গে এলডারের সম্পর্ক দিয়ে সেটা বোঝা যায়। বাটলার হাজি মুরাদের ঘরে এলে এলডার মধুর হাসি দিয়ে তাকে স্বাগত জানায়, তার ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে। তাড়াতাড়ি একটা তাকিয়া নামিয়ে তাকে বসতে দেয়। তার তলোয়ার নিয়ে এলে তা খুলে রাখতে সাহায্য করে।
বাটলার হাজি মুরাদের ধর্মভাই নোংরা খানেফির সঙ্গেও ভাব জমিয়ে ফেলে। খানেফি অনেক পাহাড়ি গান জানত এবং গাইতও ভালো। বাটলারকে খুশি করার জন্য হাজি মুরাদ প্রায়ই খানেফিকে গান গাইতে বলতেন। নিজের পছন্দের গানগুলো গাইতে বলতেন। খানেফির গলা ছিল চড়া এবং অতি চমৎকার পরিষ্কার গলায় ভাবগুলো ফুটিয়ে গাইত। একটা গান হাজি মুরাদের বিশেষ পছন্দের। সেটার পবিত্র বেদনাবিধুর সুরে বাটলার অভিভূত। দোভাষীকে সে গানটির অর্থ করে দিতে বলেছিল।
গানটির বিষয়বস্তু হাজি মুরাদ ও খানেফিদের দুই বংশে শত্রুতা। তার কথাগুলো এমন :
আমার গোরের মাটি শুকিয়ে যাবে,
মা, মা গো আমার!
তুমি ভুলে যাবে যে আমায়,
আমার ওপর বয়ে যাবে ঘাসসিঁড়ি ঢেউ,
বাবা, আমার বাবা!
তোমাকেও বিধবে না আমার শোক!
যখন গভীর চোখে অশ্রু শুকোবে তোমার,
বোন, আমার বোন!
শোকে আর অস্থির হবে না তো কেউ!
তুমি তো আমার ভাই, বড় ভাই কখনো ভুলবে না,
আমার বদলা তুমি নিতে পারোনি!
তুমি তো আমার ভাই, ছোট ভাই করবে মাতম,
যত দিন না ঘুমাবে আমারই পাশে!
তপ্ত হয়ে এসেছিলে আমার অবজ্ঞার মৃত্যুবাহী গুলি,
তুমিই তো ছিলে আমার কৃতদাস!
এবং কষ্ণ মত্তিকা, ঘোড়ার পায়ের ঘায়ে হয়েছ মথিত!
তুমিই তো ঢেকে দেবে আমার শরীর!
হে মৃত্যু, শীতল চিত্রকলা একদা তো আমিই প্রভু, তোমার ঈশ্বর!
শরীর আমার ডুবে যাচ্ছে পৃথিবীর ভেতর;
স্বর্গে যাচ্ছে উড়ে আত্মা আমার।
হাজি মুরাদ সব সময় গানটি শুনতেন চোখ বুজে, দীর্ঘ টানে গানটি আস্তে আস্তে শেষ হয়ে গেলে তিনি রুশ ভাষায় মন্তব্য করতেন, ভালো গান! জ্ঞানীদের গান!
হাজি মুরাদ আসার পর তার এবং তার মুরিদদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে পাহাড়িদের তেজস্বী জীবনের কাব্য বাটলারকে ভীষণ মুগ্ধ করে। নিজের জন্য সে একটা বেশমেত, একটা চাপকান আর আঁটসাঁট পায়জামা কেনে। কল্পনায় মনে করে সে পাহাড়িদের মতো জীবন কাটাচ্ছে।
হাজি মুরাদের যাওয়ার দিন তাকে বিদায় জানানোর জন্য মেজর কয়েকজন অফিসারকে দাওয়াত দিয়েছিল।
তারা বসে ছিল। কেউ কেউ বসে ছিল যে টেবিলে মেরি দমিত্রিয়েভনা চা ঢালছিল সেটায়, কেউ কেউ ভোদকা, চিখির ও কিছু খাবার রাখা টেবিলটায়। ভ্রমণের জন্য পোশাক পরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাজি মুরাদ হালকা দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলেন।
তারা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে হাজি মুরাদের সঙ্গে হাত মেলাল। মেজর তাকে সোফায় বসতে বললে হাজি মুরাদ তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বসলেন গিয়ে জানালার পাশের একটা চেয়ারে।
ঘরে ঢোকার পর নীরবতা তাকে অপ্রস্তুত করেনি। তিনি মনোযোগ দিয়ে প্রত্যেকটি চেহারা দেখলেন এবং সামোভার ও খাবার রাখা টেবিলটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হাজি মুরাদের সঙ্গে উচ্ছল অফিসার পেত্রভস্কির সেই প্রথম দেখা। দোভাষীর মাধ্যমে সে জিজ্ঞেস করল তিবলিস তার ভালো লেগেছে কি না।
আলিয়া! তিনি জবাব দিলেন।
তিনি বলেছেন, হ্যা, দোভাষী বলল।
এখানকার কী তার ভালো লেগেছে?
হাজি মুরাদ জবাবে কিছু বললেন।
তার কাছে থিয়েটার সবচেয়ে ভালো লেগেছে।
সেনাপ্রধানের বাড়িতে বলনাচের আসর তার ভালো লাগেনি?
হাজি মুরাদ ভুরু কুঁচকালেন। প্রতিটি জাতির নিজেদের রীতি আছে! আমাদের মেয়েরা ওই রকম পোশাক পরে না, মেরি দমিত্রিয়েভনার দিকে চোখ ফেলে তিনি বললেন।
তার কি তা ভালো লাগেনি?
আমাদের একটা প্রবাদ আছে, হাজি মুরাদ দোভাষীকে বললেন, কুকুর গাধাকে মাংস দিল, গাধা কুকুরকে খড় দিল এবং দুজনেই না খেয়ে থাকল, তিনি হাসলেন। সব জাতিরই নিজেদের রীতি ভালো লাগে।
কথা আর এগোল না। অফিসাদের কেউ কেউ চা নিলেন। কেউ কেউ খাবার নিলেন। হাজি মুরাদ তাকে দেওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে তার সামনে নামিয়ে রাখলেন।
আপনি মাখন দিয়ে একটা বান খাবেন? মেরি দমিত্রিয়েভনা তাকে জিজ্ঞেস করল।
হাজি মুরাদ সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন।
তাহলে, বিদায় নিতে হবে! তার হাঁটু ছুঁয়ে বলল বাটলার। আবার কবে দেখা হবে?
বিদায়, বিদায়, মৃদু হেসে রুশ ভাষায় বললেন হাজি মুরাদ। বিদায় বন্ধু। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব দৃঢ় হোক! যাওয়ার সময় হয়েছে? বলে যে পথে যেতে হবে, হাজি মুরাদ সেদিকে ঘাড় কাত করলেন।
এলডার দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাঁধে সাদা একটা জিনিস আর হাতে তলোয়ার। হাজি মুরাদ ইশারা করে তাকে কাছে ডাকলেন। এলডার লম্বা পা ফেলে তার কাছে এসে সাদা চাদর আর তলোয়ারটা দিল। হাজি মুরাদ দাঁড়িয়ে চাদরটা হাতে নিয়ে দোভাষীকে কিছু বলে সেটা মেরি দমিত্রিয়েভনাকে দিলেন।
দোভাষী বলল, তিনি বলছেন তুমি চাদরটার প্রশংসা করেছ, তাই এটা নাও।
ওহ্, কেন? লজ্জা পেয়ে বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা।
এটা দরকার। আদত, আমাদের রীতি, বললেন হাজি মুরাদ।
বেশ, আপনাকে ধন্যবাদ, চাদরটা হাতে নিয়ে বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা। ঈশ্বর করুক যেন আপনার ছেলেকে মুক্ত করতে পারেন, সে বলল। তাকে বলো তার ছেলেকে মুক্ত করায় আমি তার সাফল্য কামনা করছি।
হাজি মুরাদ মেরি দমিত্রিয়েভনার দিকে তাকিয়ে সম্মতিতে মাথা নাড়লেন। তারপর এলডারের কাছ থেকে তলোয়ারটি নিয়ে সেটা মেজরকে দিলেন। সেটা নিয়ে মেজর দোভাষীকে বলল, তাকে আমার বাদামি ঘোড়াটা নিতে বলো। তাকে দেওয়ার মতো আমার আর কিছু নেই।
হাজি মুরাদ মুখের সামনে হাত নেড়ে বোঝালেন কিছুই চাই না এবং নেবেন না। তারপর পাহাড়ের দিকে, পরে নিজের বুকে হাত দেখিয়ে বের হয়ে গেলেন।
সবাই দরজা পর্যন্ত তার পিছু পিছু এল। ঘরের ভেতরে রয়ে যাওয়া অফিসাররা খাপ থেকে তলোয়ারটা বের করে পরখ করল, ওটা ছিল খাঁটি গুরদা (নামের) অত্যন্ত দামি তলোয়ার।
বাটলার হাজি মুরাদের সঙ্গে গাড়িবারান্দা পর্যন্ত গেল, তখনই খুব অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনা ঘটে গেল, যাতে চারদিকে তার নজর, দৃঢ়তা আর ক্ষিপ্রতা না থাকলে হাজি মুরাদ মারা যেতে পারতেন।
কুমুখ এলাকার গ্রাম তাশ-কিচুর বাসিন্দারা রুশদের বন্ধুভাবাপন্ন ছিল। তারা হাজি মুরাদকে শ্রদ্ধা করত। তাই শুধু বিখ্যাত নায়েবকে দেখার জন্য তারা দুর্গে আসত। তিন দিন আগে তারা বার্তাবাহক পাঠিয়ে তাকে শুক্রবার মসজিদে যাওয়ার দাওয়াত দেয়। কিন্তু তাশ-কিচুর কুমুখ প্রিন্সরা জ্ঞাতিবৈরিতার জন্য হাজি মুরাদকে দেখতে পারত না। তাকে দাওয়াত দেওয়ার কথা শুনে তারা ঘোষণা করে যে হাজি মুরাদকে তারা মসজিদে ঢুকতে দেবে না। বাসিন্দারা এত উত্তেজিত হয়ে যায় যে প্রিন্সদের লোকজনের সঙ্গে বাসিন্দাদের লড়াই লেগে যায়। রুশ কর্তৃপক্ষ পাহাড়িদের শান্ত করে এবং হাজি মুরাদকে মসজিদে যেতে নিষেধ করে খবর পাঠায়।
হাজি মুরাদ মসজিদে যাননি এবং সবাই ভেবেছিলে ব্যাপারটা মিটে গেছে।
কিন্তু বিদায়ের সময় হাজি মুরাদ গাড়িবারান্দায় আসেন। ঘোড়াগুলো সেখানে রাখা ছিল। কুমুখ প্রিন্সদের একজন, বাটলার ও মেজরের পরিচিত আরসালান খান, বাড়ির সামনে এসে অপেক্ষা করতে থাকে।
হাজি মুরাদকে দেখে সে বেল্ট থেকে পিস্তল বের করে তার দিকে তাক করে। খোঁড়া হওয়া সত্ত্বেও সে গুলি করার আগেই হাজি মুরাদ বিড়ালের মতো আরসালানের দিকে ছুটে যান। আরসালান গুলি করলে তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।
আরসালানের ঘোড়ার লাগাম এক হাতে কেড়ে নিয়ে হাজি মুরাদ তার ছোরা বের করে চিৎকার করে আরসালানকে তার ভাষায় কিছু বলেন।
বাটলার আর এলড়ার দুজনেই দৌড়ে দুই শত্রুর কাছে এসে তাদের হাত ধরে ফেলে। গুলির শব্দ শুনে মেজর বের হয়ে এসেছিলেন।
এসব কী আরসালান–আমার বাড়িতে এসে ভয়ংকর ঝামেলা শুরু করেছ, ঘটনা শুনে মেজর বলল। এটা ঠিক না, বন্ধু! যুদ্ধক্ষেত্রে তুমি শত্রুর কাছে হেরো না! কিন্তু আমার বাড়িতে এসে তুমি জবাই শুরু করতে পারো না!
আরসালান খান, বেঁটেখাটো কালো গোঁফধারী। ফ্যাকাশে হয়ে ঘোড়া থেকে নামল। হাজি মুরাদের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দিয়ে মেজরের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে গেল। হাজি মুরাদ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মৃদু হেসে ঘোড়াগুলোর দিকে চলে গেলেন।
সে কেন তাকে খুন করতে চেয়েছিল? বাটলার দোভাষীকে জিজ্ঞেস করল।
সে বলছে, এটা তাদের আইন, দোভাষী বাটলারকে দেওয়া হাজি মুরাদের উত্তর বুঝিয়ে দিল।
আরসালান কোনো আত্মীয়ের খুনের বদলা নিতে তাকে খুন করার চেষ্টা করে।
পথে যদি আবার দেখা হয়? বাটলারের প্রশ্ন।
হাজি মুরাদ হাসলেন।
বেশ, সে যদি আমাকে খুন করতে পারে, তাহলে সেটাই আল্লাহর ইচ্ছা। বিদায়, ঘোড়ার ঘাড়ে হাত রেখে তিনি আবার রুশ ভাষায় বললেন। তাকে বিদায় জানাতে আসা সবার দিকে তাকালেন এবং তারপর নরম চোখে তাকালেন মেরি দমিত্রিয়েভনার দিকে।
বিদায়, ম্যাডাম, তিনি তাকে বললেন। আপনাকে ধন্যবাদ!
ঈশ্বর আপনাকে সাহায্য করুন। ঈশ্বর আপনার পরিবারকে মুক্ত করতে সাহায্য করুন! বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা।
তিনি তার কথা বুঝতে পারেননি, কিন্তু তার প্রতি সহানুভূতি অনুভব করে মাথা নাড়লেন।
মনে রাখবেন, বন্ধুকে ভুলবেন না। বলল বাটলার।
তাকে বলো, আমি তার খাঁটি বন্ধু, কখনো তাকে ভুলব না। হাজি মুরাদ দোভাষীর মাধ্যমে উত্তর দিলেন। এক পা খাটো হওয়া সত্ত্বেও দ্রুত হালকাভাবে শরীরটাকে ঘোড়ার ওপর তুলে দিলেন পাদানি সামান্য ছুঁয়ে। গদিতে বসে অনেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছোরা আর তলোয়ার ঠিক করে নিলেন। তারপর একমাত্র ককেশীয় পাহাড়িদের মতো দেমাগি দৃষ্টি নিয়ে তিনি মেজরের বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। খানেফি আর এলডারও মেজবান ও অফিসারদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এসেছিল। দুলকি চালে তারা মুরশিদের অনুসরণ করছিল।
কেউ বিদায় নিয়ে গেলে যারা রয়ে যায়, স্বাভাবিকভাবেই তাদের নিয়ে আলাপ করে।
দারুণ সাহসী! আরসালান খানের দিকে একদম নেকড়ের মতো ছুটে গিয়েছিল। তার চেহারা বদলে গিয়েছিল!
কিন্তু তার মনে কোনো ফন্দি আছে–ভয়ানক শয়তান, আমি বলব, পেত্রভস্কির মন্তব্য।
ঈশ্বর যদি রুশদের মধ্যে আরও ওই রকম শয়তান দিতেন! বিরক্তিভরে হঠাৎ বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা। আমাদের সঙ্গে এক সপ্তাহ থেকেছে, আমরা ভালো ছাড়া তার মধ্যে আর কিছু দেখিনি। তিনি ভদ্র, জ্ঞানী ও ন্যায়পরায়ণ।
তুমি কী করে বুঝলে?
বেশ, আমি বুঝতে পেরেছি!
সে একদম মুগ্ধ, কেবলই ঘরে ঢুকে বলল মেজর। এটা ঠিক!
ঠিক আছে আমি না হয় মুগ্ধ! কিন্তু তাতে তোমার কী? একটা ভালো লোককে কেন খারাপ বলবে? সে তাতার হতে পারে, তারপরও সে ভালো লোক!
ঠিক বলেছ, মেরি দমিত্রিয়েভনা, বাটলার বলল। তার পক্ষে তুমি ঠিক কথা বলেছ!
২১
চেচেন সীমানার কাছাকাছি আমাদের অগ্রবর্তী দুর্গগুলোয় জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল। আগে যে ঘটনাটার বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তারপর মাত্র দুবার বিপৎসংকেত দেওয়া হয়। তখন কোম্পানিগুলোকে ডাকা হয়েছিল। ঘোড়া ছুটিয়ে সৈন্যরা সেখানে যায়। কিন্তু দুবারই উত্তেজনা সৃষ্টিকারী পাহাড়িরা পালিয়ে যায়। একবার ভজভিঝেনস্কে তারা একজন কসাককে মেরে ফেলে আর আটটি ঘোড়া নিয়ে যায়। সেগুলোকে গোসল করানো হচ্ছিল। আগের ঘটনায় গ্রামটি ধ্বংস করার পর আর কোনো হামলা চালানো হয়নি। কিন্তু লেফট ফ্ল্যাঙ্কে নতুন কমান্ডার, প্রিন্স বারিয়াতিনস্কিকে নিয়োগের পর বড় ধরনের একটি অভিযান আশা করা হচ্ছিল। তিনি ভাইসরয়ের একজন পুরোনো বন্ধু। কাবার্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন। পুরো লেফট ফ্ল্যাঙ্কের কমান্ডার হিসেবে গ্রজনিতে আসেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে চেরনিশভের মাধ্যমে ভরসভের কাছে পাঠানো জারের আদেশ পালনের জন্য একটা সেনাদল গড়ে ফেলেছেন। ভজভিঝেনস্কে জড়ো করা সেনাদলটি অবস্থান নেয় দুর্গের বাঁয়ে কুরিনের দিকে। সেখানে শিবির গেড়ে সৈন্যদের রেখে বন কাটা শুরু হয়। তরুণ ভরন্তসভ সুন্দর একটা কাপড়ের তাঁবুতে ছিল। তার স্ত্রী মেরি ভাসিলিয়েভনা প্রায়ই শিবিরে আসত আর রাতটা তাঁবুতে থেকে যেত। বারিয়াতিনস্কির সঙ্গে মেরি ভাসিলিয়েভনার সম্পর্কের বিষয়টা কারও কাছে গোপন ছিল না। নিম্নশ্রেণির অফিসার এবং সৈন্যরা তার সম্পর্কে বাজে বাজে কথা বলত। কারণ, সে শিবিরে থাকলে তাদের ওত পাতার জায়গায় রাত কাটাতে হতো। পাহাড়িদের স্বভাব ছিল কামানগুলো শিবিরের কাছে এনে গোলা ছোঁড়া। গোলাগুলো সাধারণত লক্ষ্যে পড়ত না। তাই অন্য সময় তাতে বাধা দেওয়ার জন্য বিশেষ কিছু করা হতো না। কিন্তু এখন মেরি ভাসিলিয়েভনা যাতে কামানের গোলায় আহত না হয় বা ভয় না পায়, সে জন্য পাহাড়িদের বাধা দিতে ওত পাততে পাঠানো হচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত সৈন্যদের সঙ্গে অফিসাররাও মেরি ভাসিলিয়েভনার সম্বন্ধে বাজে কথা বলে।
বাটলার দুর্গ থেকে ছুটি নিয়েছে। ক্যাডেট কোরের এবং কুরিন রেজিমেন্টের পুরোনো বন্ধুরা অর্ডারলি-অফিসার হয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য বাটলার এসেছে শিবিরে। প্রথম আসার পর তার সময়টা খুব ভালো কেটেছিল। তার জায়গা হয়েছিল পোলতোরাৎস্কির তাঁবুতে। সেখানে অনেক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সবাই তাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে। আগে একই রেজিমেন্টে থাকার সুবাদে সামান্য পরিচয় থাকায় সে ভরসভের সঙ্গেও দেখা করেছিল। ভরন্তসভ তাকে ভদ্রভাবে অভ্যর্থনা করে এবং প্রিন্স বারিয়াতিনস্কির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেয়। বাটলারকে জেনারেল কজলভস্কির বিদায়ি ভোজেও দাওয়াত করে। প্রিন্স বারিয়াতিনস্কি আসার আগে কজলভস্কি লেফট ফ্ল্যাঙ্কের কমান্ডার ছিলেন।
ভোজসভাটি ছিল জাঁকালো। এক সারিতে বিশেষ তাঁবু খাটানো হয়। তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছয়টা টেবিল ডিনার সেট, গ্লাস ও বোতল দিয়ে সাজানো হয়েছিল। সবকিছু পিটার্সবার্গে দেহরক্ষী বাহিনীর জীবন মনে করিয়ে দিচ্ছিল। দুটোয় খাবার পরিবেশন করা হয়। টেবিলের মাঝখানে একদিকে বসেছিলেন কজলভস্কি, অন্য পাশে বারিয়াতিনস্কি। কজলভস্কির বাঁ ও ডান দিকে ভরন্তসভ দম্পতি বসেছিল। পুরো টেবিলের দুই পাশে কাবার্ডা আর কুরি রেজিমেন্টের অফিসাররা বসেছিল। বাটলার বসেছিল পোলতোরাৎস্কির পাশে। তারা দুজন ফুর্তিতে গল্প করছিল আর চারপাশের অফিসারদের সঙ্গে মদ পান করছিল। রোস্ট দেওয়া হলে আরদালিরা ঘুরে ঘুরে শ্যাম্পেনের গ্লাস ভরে দিচ্ছিল। পোলতোরাৎস্কি উদ্বিগ্ন হয়ে বাটলারকে বলল, আমাদের কজলভস্কি নিজেকে অভিশাপ দেবে!
কেন?
তাকে এখন বক্তৃতা দিতে হবে। তিনি মোটেই ভালো বলেন না। এটা গুলির মধ্যে পরিখা দখল করা নয়। তার ওপর পাশে বসা এক মহিলা আর সামনে অফিসাররা!
সত্যি, তার জন্য দুঃখ হয়, অফিসাররা একে অন্যকে বলছিল। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসেছে। বারিয়াতিনস্কি তার গ্লাস তুলে কজলভস্কির উদ্দেশে ছোট্ট বক্তৃতা দিলেন। কজলভস্কি উঠলেন এবং তোতলাতে তোতলাতে শুরু করলেন (তার আবার কেমন করে কথাটি বারবার বলার অদ্ভুত অভ্যাস ছিল), মহামহিমের আদেশ পালন করতে আমি বিদায় নিচ্ছি। ভদ্রমহোদয়গণ, তিনি বললেন। কিন্তু মনে করবেন আমি সব সময় আপনাদের মধ্যেই আছি। সেই প্রবাদটির সত্যতা আপনারা জানেন কেমন করে যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ যোদ্ধা না হয়ে পারেন। অতএব, কেমন করে আমি যেসব পদক পেয়েছি…কেমন করে মহামান্য সম্রাটের বদান্যতায় আমি যেসব সুবিধা পেয়েছি…কেমন করে আমার সব পদ…কেমন করে আমার সুনাম…কেমন করে সবকিছু নির্ধারিতভাবে… কে ম ন ক রে… (এখানে তার গলাটা কেঁপে উঠল) … কেমন করে এর জন্য আমি আপনাদের প্রতি ঋণী, শুধু আপনাদের কাছে বন্ধুরা! তার মুখের ভাঁজ পড়া ত্বক আরও কুঁচকে গেল, তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন, চোখ দিয়ে জল বের হয়ে এল। কেমন করে আমার অন্তর থেকে আপনাদের প্রতি আন্তরিক ও গভীর কৃতজ্ঞতা জানাই!
জলভস্কি আর বলতে পারলেন না। ঘুরে অফিসারদের আলিঙ্গন করতে শুরু করলেন। প্রিন্সেস রুমালে তার মুখ ঢাকলেন। প্রিন্সের মুখ বিস্ময়ে বাঁকা, তিনি চোখ টিপলেন। অনেক অফিসারের চোখ ভিজে গিয়েছিল। বাটলার কজলভস্কিকে প্রায় না চিনলেও চোখের পানি বন্ধ করতে পারল না। এসব তার খুব ভালো লাগছিল।
তারপর শুরু হলো অন্যান্যের সুস্বাস্থ্য কামনা করে পান, বারিয়াতিনস্কির, ভরন্তসভের, অফিসারদের, সৈন্যদের। তারপর মাতাল অতিথিরা তাদের সামরিক অহংকার নিয়ে টেবিল ছেড়ে চলে যেতে শুরু করলেন। আবহাওয়া ছিল চমৎকার, রৌদ্রোজ্জ্বল, শান্ত। মন চাঙা করা তাজা। বাতাস। চারদিকে চলছিল গান ও বহ্নি উৎসব। মনে হতে পারে সবাই কোনো আনন্দ উদযাপন করছিল। বাটলার পোলতোরাৎস্কির তাঁবুতে গেল আবেগে আপ্লুত হয়ে খুব খুশিমনে। সেখানে আরও কিছু অফিসার এসেছিল, আর একটা তাসের টেবিল পাতা হয়েছিল। একজন অ্যাডজুট্যান্ট এক শ রুবল নিয়ে তহবিল খুলল। ট্রাউজারের পকেটে মানিব্যাগটা চেপে ধরে বাটলার দু-তিনবার তাঁবু থেকে বের হয়ে গেল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ভাই আর নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করা সত্ত্বেও সে আর খেলার প্রলোভন ঠেকাতে পারল না। বাজি ধরতে শুরু করল সে। একটি ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই সে টেবিলে দুই কনুই তুলে বসে তাসের নিচে লেখা বাজির টাকার হিসাবের দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে দেখে। ইতিমধ্যে এত হেরেছে যে সে হিসাব করতেই ভয় পাচ্ছে। কিন্তু সে হিসাব না করেই জানত সে যত ধার নিয়েছে, তাতে তার ঘোড়াটি দিয়ে দিলেও অপরিচিত অ্যাডজুট্যান্টকে টাকা শোধ করতে পারবে না। বাটলার তারপরও খেলা চালিয়ে যেত। কিন্তু অ্যাডজুট্যান্ট হঠাৎ উঠে গিয়ে বাটলারের হারের হিসাব করে ফেলল। বিভ্রান্ত বাটলার তখনই সব টাকা দিতে না পারার জন্য নানা রকম অজুহাত দেখাতে শুরু করল। বলল সে বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেবে। এ কথা বলার সময় সে দেখল সবাই তার দিকে দয়ার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কিন্তু সবাই, এমনকি পোলতোরাৎস্কি, তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়া এড়িয়ে যাচ্ছে। সেটাই ছিল সেখানে তার শেষ সন্ধ্যা। তার উচিত ছিল না খেলে ভরন্তসভদের তাঁবুতে যাওয়া। তারাই তাকে দাওয়াত দিয়েছিল, তাহলে সবকিছুই ঠিক থাকত। এখন সবকিছু ঠিক তো নয়ই, ভয়ংকর হয়ে গিয়েছে।
বন্ধু ও পরিচিতদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরে সোজা বিছানায়। ঘুমাল টানা আঠারো ঘণ্টা। খুব বড় হারের পর এমন ঘুমানোই স্বাভাবিক। তার সঙ্গে আসা কসাক সৈন্যটিকে বখশিশ দিতে পঞ্চাশ কোপেক ধার নেওয়ায় আর তার বিধ্বস্ত চেহারা ও সংক্ষিপ্ত জবাব থেকে মেরি দমিত্রিয়েভনা আন্দাজ করতে পারছিল সে জুয়ায় অনেক টাকা হেরেছে। মেরি খেপে গেল মেজরের ওপর, কেন সে ছুটি দিয়েছিল।
পরদিন দুপুরে ঘুম ভাঙল বাটলারের। মনে পড়ল তার অবস্থা। সে আবার বিস্মরণে ডুবে যেতে চাইল, যা থেকে কেবলই উঠেছে। কিন্তু সেটা ছিল অসম্ভব। অপরিচিত লোকটির কাছে ঋণের চার শ সত্তর রুবল শোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ ভাইয়ের কাছে চিঠি লেখা। দোষ স্বীকার করে অনুনয় করল শেষবারের মতো পাঁচ শ রুবল ধার দেওয়ার। তাদের যৌথ মালিকানার কারখানায় তার অংশ বন্ধক রেখে। তারপর চিঠি লিখল তাদের এক কিপটে আত্মীয়কে। যেকোনো সুদেই হোক পাঁচ শ রুবল ধার চাইল সেই মহিলার কাছে। তারপর সে গেল মেজরের কাছে। সে জানত মেজরের, অর্থাৎ মেরি দমিত্রিয়েভনার কিছু টাকা আছে। পাঁচ শ রুবল ধার চাইল সে।
আমি তোমাকে এক্ষুনি দেব, কিন্তু মারিয়া দেবে না! বলল মেজর। মেয়েদের মুঠো এমন শক্ত, কোন শয়তান তাদের বুঝতে পারে?…কিন্তু তোমার তো একটা উপায় করতে হবে!…ওই পাষাণ ক্যানটিনওয়ালার কাছে কিছু নেই?
ক্যানটিনওয়ালার কাছে ধার চাওয়ার কোনো মানে নেই। তাই বাটলারের মুক্তি আসতে পারে একমাত্র উপায় ভাইয়ের বা কিপটে আত্মীয়ের কাছ থেকে।
২২
চেচনিয়ায় উদ্দেশ্য সফল না হওয়ায় হাজি মুরাদ তিবলিসে ফিরে আসেন। সেখানে প্রতিদিন ভরসভের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতে থাকেন। কখনো দেখা পেলে ভাইসরয়ের কাছে অনুনয় করেন সব পাহাড়ি বন্দীকে এক জায়গায় এনে তার পরিবারের সঙ্গে বিনিময় করার জন্য। তিনি বলেন, সেটা না করা পর্যন্ত তার হাত বাঁধা। শামিলকে ধ্বংস করার জন্য তিনি রুশদের সাহায্য করতে চান, কিন্তু পারছেন না। ভরন্তসভ ভাসা-ভাসা কথা দেন, তিনি যা পারবেন করবেন। এই বলে তা থামিয়ে দেন। বলেন। জেনারেল আরগুতিনস্কি তিবলিসে পৌঁছালে বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলবেন।
তারপর হাজি মুরাদ ট্রান্সককেশীয়ার ছোট্ট নুখা শহরে কিছুদিন থাকার অনুমতি চান। তিনি ভাবছেন, শামিলের কাছ থেকে তার পরিবারকে মুক্ত করার আলোচনা চালাতে সেখান থেকে সুবিধা হবে। তার ওপর নুখা একটা মুসলমান শহর। সেখানে মসজিদ আছে। তার নামাজ এবং ধর্মীয় কাজেও সুবিধা হবে। ভরন্তসভ বিষয়টি পিটার্সবার্গে জানান। কিন্তু তার আগেই হাজি মুরাদকে নুখা যাওয়ার অনুমতি দেন।
ভরন্তসভ, পিটার্সবার্গের কর্তৃপক্ষ এবং হাজি মুরাদের ইতিহাস যারা জানেন, তাদের কাছে পুরো ঘটনাটা ককেশীয় যুদ্ধের সৌভাগ্যসূচক পরিবর্তন। না হলেও মজার একটা ঘটনা। আর হাজি মুরাদের কাছে এটা (বিশেষ করে শেষ দিকে) তার জীবনের এক ভয়ানক সংকট। তিনি পাহাড় থেকে পালিয়েছেন কিছুটা নিজেকে বাঁচানোর জন্য। কিছুটা শামিলের প্রতি ঘৃণায়। পালানোটা কষ্টকর হলেও তার উদ্দেশ্য সফল হয়। বর্তমানে তিনি তার সাফল্যে খুশি। শামিলকে আক্রমণের একটা পরিকল্পনাও তিনি করে ফেলেছেন। কিন্তু তার পরিবারকে উদ্ধারের বিষয়টাকে যতটা সহজ ভেবেছিলেন, দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি কঠিন।
শামিল তার পরিবারকে বন্দী করে রেখেছে। মহিলাদের ভিন্ন গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। তার ছেলেকে অন্ধ করে ফেলার বা হত্যা করার কথা বলেছে। তিনি মুখা গেছেন দাগেস্তানে তার অনুসারীদের নিয়ে জোর বা বুদ্ধি খাঁটিয়ে তাদের উদ্ধারের চেষ্টায়। নুখায় তার সঙ্গে দেখা করে শেষ চরটি জানিয়ে গেছে দাগেস্তানে তার অনুসারী আভাররা তার পরিবারকে উদ্ধার করে রুশদের পক্ষে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। তাই তারা ভিদেনোয় চেষ্টা করার ঝুঁকি নিচ্ছে না। তার পরিবার এখন ভিদেনোয় আটক। সেখান থেকে তাদের অন্য কোথাও নেওয়া হলে তারা চেষ্টা চালাবে। সে ক্ষেত্রে তাদের সরিয়ে নেওয়ার পথেই তারা আক্রমণ করার ওয়াদা করেছে।
হাজি মুরাদ তার বন্ধুদের জানিয়ে দিলেন যে তার পরিবারের মুক্তির জন্য তিনি তিন হাজার রুবল দেবেন।
নুখায় মসজিদ ও খানের প্রাসাদের কাছে পাঁচ কামরার একটা ছোট বাড়ি হাজি মুরাদকে দেওয়া হলো। তার দায়িত্ব পাওয়া অফিসার, দোভাষী ও ভৃত্যদেরও একই বাড়িতে থাকার জায়গা হলো। হাজি মুরাদের দিন চলল পাহাড়ি এলাকা থেকে বার্তাবাহকদের অপেক্ষায় আর অভ্যর্থনায়। মাঝেমধ্যে অনুমতি নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে কাছাকাছি বেরিয়ে।
২৪ এপ্রিল তেমন বেরোনো থেকে ফিরে হাজি মুরাদ খবর পেলেন, তিবলিস থেকে ভরসভের পাঠানো একজন বার্তাবাহক এসেছে। অফিসারটি কী খবর এনেছে, জানার আগ্রহ থাকলেও হাজি মুরাদ যে ঘরে ভারপ্রাপ্ত অফিসার এবং বার্তাবাহক অপেক্ষা করছিল, সেটায় গেলেন না। তার শোবার ঘরে গিয়ে জোহরের নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষ হলে এলেন অভ্যর্থনা ও বসার ঘরে। তিবলিস থেকে আসা কর্মকর্তা কাউন্সিলর কিরিলভ জানাল, ভরন্তসভ চাচ্ছেন হাজি মুরাদ ১২ তারিখে তিবলিস গিয়ে জেনারেল আরগুতিনস্কির সঙ্গে দেখা করুন।
ইয়াকশি! গজগজ করে বললেন হাজি মুরাদ। কাউন্সিলর তাকে খুশি করতে পারেনি। জিজ্ঞেস করলেন, টাকা এনেছ?
জি, এনেছি, কিরিলভের জবাব।
দুই সপ্তাহ দেরি হয়েছে, হাজি মুরাদ প্রথমে দশ আঙুল এবং পরে চার আঙুল দেখিয়ে বোঝালেন। দাও এখানে!
এক্ষুনি দিচ্ছি, বলে কিরিলভ তার ব্যাগের ভেতর থেকে টাকার ছোেট ব্যাগটি বের করল।
টাকা দিয়ে সে কী করবে? রুশ ভাষায় বলল কিরিলভ। ভেবেছিল হাজি মুরাদ বুঝতে পারবেন না। কিন্তু হাজি মুরাদ বুঝেছিলেন এবং রাগতদৃষ্টিতে তাকালেন কিরিলভের দিকে। টাকা বের করতে করতে সে হাজি মুরাদের সঙ্গে আলাপ করার চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য, ফিরে গিয়ে ভরন্তসভকে হাজি মুরাদ সম্পর্কে খবর দেওয়া। দোভাষীর মাধ্যমে সে জিজ্ঞেস করল হাজি মুরাদের সেখানে ভালো লাগছে কি না। হাজি মুরাদ রেগে বেঁটেখাটো মোটা নিরস্ত্র লোকটির দিকে আড়চোখে তাকালেন। কোনো জবাব দিলেন না। দোভাষী প্রশ্নটা আবার করল।
তাকে বলো আমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না! আমাকে টাকাটা দিতে বলো! বলে হাজি মুরাদ টাকা গোনার জন্য টেবিলে গিয়ে বসলেন। কিরিলভ টাকা বের করে দশটি করে সোনার টাকার সাতটি স্কুপ সাজাল। (হাজি মুরাদ দিনে পাঁচটি সোনার মুদ্রা পেতেন।) তারপর স্তূপগুলো হাজি মুরাদের দিকে ঠেলে দিল। তিনি টাকাগুলো তার চাপকানের পকেটে ঢুকিয়ে আচম্বিতে কিরিলভের টাক মাথায় চাটি মেরে চলে যাওয়ার ইশারা করলেন।
কাউন্সিলর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দোভাষীকে তাকে বলতে বলল তিনি যেন তার (কি) মতো কর্নেল পদমর্যাদার কারও সঙ্গে এমন ব্যবহারের দুঃসাহস না করেন। ভারপ্রাপ্ত অফিসারও তাতে সায় দিলেন। হাজি মুরাদ ঘাড় নেড়ে বোঝালেন তিনি জানেন এবং ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
তাকে নিয়ে কী করা যায়? বলল ভারপ্রাপ্ত অফিসার। তিনি তো ছোরা ঢুকিয়ে দেবেন, ব্যস! কেউ এই শয়তানগুলোর সঙ্গে কথা বলতে পারে না! আমি তো দেখছি সে রেগে গেছে।
সন্ধ্যা হতে শুরু করলে পাহাড় থেকে দুজন চর কাপড়ে চোখ পর্যন্ত ঢেকে তার সঙ্গে দেখা করতে এল। ভারপ্রাপ্ত অফিসার তাদের হাজি মুরাদের কাছে নিয়ে গেল। তাদের একজন মোটাসোটা শ্যামলা তাভিলি, অন্যজন হালকা-পাতলা বুড়ো। তারা হাজি মুরাদের জন্য খুশির খবর আনেনি। যে বন্ধুরা তার পরিবারকে উদ্ধারের ভার নিয়েছিল, তারা শামিলের ভয়ে তা করবে না বলে জানিয়েছে। হাজি মুরাদকে কেউ সাহায্য করলে শামিল তাকে ভয়ংকর নির্যাতন করার হুমকি দিয়েছেন। চরদের কথা শুনে হাজি মুরাদ ভাঁজ করা দুই হাঁটুর ওপর কনুই দুটো রেখে পাগড়ি পরা মাথা নুয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন।
তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। তিনি জানতেন, সেটাই তার শেষবারের চিন্তা। তাকে এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অবশেষে মাথা তুলে তিনি চরদের প্রত্যেককে একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বললেন, যাও!
আমরা গিয়ে কী বলব?
বলবে, আল্লাহর যা ইচ্ছা হবে…যাও!
চররা উঠে চলে গেল। হাজি মুরাদ গালিচার ওপর বসে হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন।
আমি কী করব? শামিলকে বিশ্বাস করে তার কাছে ফিরে যাব? তিনি ভাবছিলেন। সে একটা শিয়াল, আমার সঙ্গে বেইমানি করবে। সে বেইমানি না করলেও ওই লালমুখো মিথুকের কাছে নত হওয়া অসম্ভব। কারণ, আমি রুশদের কাছে আসার পর সে আর আমাকে বিশ্বাস করবে না। বাজ পাখি নিয়ে একটা তাভিলি গল্প তার মনে পড়ল। ধরা পরার পর বাজটি মানুষের সঙ্গে থাকত। কিছুদিন পর সে পাখিদের মধ্যে ফিরে যায়, পায়ে চামড়ার ঘুঙুর বেঁধে! কিন্তু অন্য পাখিগুলো সেটাকে গ্রহণ করল না। তোমার পায়ে যারা ঘুঙুর বেঁধেছে, তাদের কাছে ফিরে যাও! বলল পাখিগুলো। আমাদের পায়ে ঘুঙুরও নেই, চামড়ার আংটাও নেই। বাজটা নিজের বাসা ছেড়ে যেতে চাইল না, থেকে গেল। কিন্তু অন্য বাজগুলো সেটাকে সেখানে থাকতে দিতে চায়নি, তাই সেটাকে ঠুকরে ঠুকরে মারল।
তারাও আমাকে ওইভাবে ঠুকরে মারবে, হাজি মুরাদ ভাবলেন। আমি কি এখানেই থেকে রুশ জারের জন্য ককেশিয়া জয় করে সুনাম, খেতাব আর টাকাপয়সা পাব?
সেটা হতে পারে, ভরসভের সঙ্গে আলাপ আর প্রিন্স যেসব মিষ্টি কথা বলেছেন, তা মনে করে তিনি ভাবলেন। কিন্তু আমাকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা না হলে শামিল আমার পরিবারকে শেষ করে ফেলবে।
রাতটা হাজি মুরাদ না ঘুমিয়ে চিন্তা করে কাটালেন।
২৩
মাঝরাতের দিকে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। তিনি পাহাড়ে ছুটে যাবেন এবং এখনো যে আভাররা তার অনুগত, তাদের নিয়ে ভিদেনোয় আক্রমণ করবেন। উদ্ধার করে আনবেন পরিবারের সবাইকে, না হয় মৃত্যু। তাদের উদ্ধার করার পর রুশদের কাছে ফিরে যাবেন, না খুনজাখে পালিয়ে গিয়ে শামিলের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, সেটা তিনি ঠিক করেননি। তিনি শুধু জানতেন, রুশদের কাছে থেকে পালিয়ে পাহাড়ে যেতে হবে। তিনি তক্ষুনি পরিকল্পনা কাজে লাগাতে শুরু করলেন।
বালিশের নিচ থেকে দলামোচড়া করে রাখা বেশমেত বের করে ভৃত্যদের কামরায় গেলেন। তারা হলঘরের অন্যদিকে থাকত। সেটার বাইরের দরজাটা খোলা থাকত। ঘরটায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশাভেজা তাজা চাঁদের আলোয় তিনি আবৃত হলেন। তার কান ভরে গেল পাশের বাগানের কয়েকটি পাপিয়ার কাঁপা শিষে।
হলঘরটি পার হয়ে হাজি মুরাদ ভৃত্যদের ঘরের দরজা খুললেন। ঘরে কোনো আলো ছিল না। শুক্লপক্ষের চাঁদের আলো পড়ছিল জানালা দিয়ে। ঘরের একদিকে একটা টেবিল আর দুটো চেয়ার রাখা। হাজি মুরাদের চারজন ভৃত্য গালিচা বা চাদরের ওপর শুয়ে খানেফি ঘোড়াগুলো নিয়ে বাইরে ঘুমাত। গামজালো দরজার কাঁচ কাঁচ আওয়াজ শুনে উঠে গিয়েছিল। ঘাড় ঘুরিয়ে হাজি মুরাদকে দেখতে পেল। তাকে চিনতে পেরে সে আবার শুয়ে পড়ল। তার পাশেই শুয়ে ছিল এলডার। সে তড়াক করে উঠে বেশমেত পরতে শুরু করল। হাজি মুরাদ আদেশ করবেন এই ভেবে। খান মাহোমা আর বাটা ঘুমিয়েই থাকল। হাতের বেশমেতটা টেবিলের ওপর রাখলেন হাজি মুরাদ। ধপ করে একটা শব্দ হলো ওটার ভেতরে সোনাগুলো সেলাই করে রাখায়।
এগুলোও ভেতরে দিয়ে দাও, এলডারের হাতে সেদিন পাওয়া সোনাগুলো দিয়ে হাজি মুরাদ বললেন। সেগুলো নিয়ে এলভার তখনই চাঁদের আলোয় চলে গেল। তার খাপের নিচ থেকে একটা ছোট ছুরি নিয়ে বেশমেতের ভেতরের কাপড় খুলতে বসে গেল। গামজালো উঠে আসন করে বসে থাকল।
গামজালো, তুমি সবাইকে রাইফেল আর পিস্তলগুলো পরীক্ষা করে দেখতে আর গুলি ভরে তৈরি করে রাখতে বলল। কাল আমরা অনেক দূরে যাব, হাজি মুরাদ বললেন।
আমাদের গুলি আর বারুদ আছে; সবকিছু তৈরি থাকবে, জবাব দিল গামজালো, তারপর হেঁড়ে গলায় চাপা স্বরে কিছু বলল, যা বোঝা গেল না। সে বুঝতে পেরেছিল হাজি মুরাদ কেন রাইফেলগুলো গুলি ভরে প্রস্তুত করতে বলেছেন। শুরু থেকেই তার কেবল একটাই ইচ্ছা। যতগুলো সম্ভব রুশকে খুন করে বা ছোরা মেরে পাহাড়ে পালিয়ে যাওয়া { দিনকে দিন তার সেই ইচ্ছা বেড়েছে। এখন সে বুঝতে পেরেছে হাজি মুরাদও তা-ই চাচ্ছেন। তাতেই গামজালো খুশি।
হাজি মুরাদ চলে যাওয়ার পর গামজালো সঙ্গীদের উঠিয়ে দিল। তারা চারজনই রাতভর রাইফেল, পিস্তল, চকমকি পাথর আর অন্যান্য জিনিস পরীক্ষা করল। কিছু নষ্ট হয়ে থাকলে সেগুলো বদলাল। রাইফেলে বারুদ ভরল। তৈলাক্ত কাপড়ের টুকরায় জড়ানো একেকটি গুলির জন্য বারুদের ছোট ছোট পুঁটলি বানাল। তলোয়ার আর ছোরাগুলোয় শাণ দিয়ে তাল্ল মাখিয়ে রাখল।
ভোর হওয়ার আগেই হাজি মুরাদ অজুর পানি নিতে হলঘরে এলেন। বুলবুলিগুলোর গানে সেদিন যেন উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছিল। আর তার ভৃত্যদের কামরা থেকে ছোরা ও তলোয়ার শাণ পাথরে ঘষার ছন্দময় আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।
চৌবাচ্চা থেকে সামান্য পানি নিয়ে হাজি মুরাদ তার ঘরের দরজার কাছে আসতেই মুরিদদের ঘর থেকে শাণের শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল খানেফির গলায় পরিচিত গানের সুর। হাজি মুরাদ শোনার জন্য থামলেন। গানের বাণী কী করে হামজাদ নামের অশ্বারোহী তার সাহসী সৈন্যদের নিয়ে রুশদের কাছ থেকে একপাল সাদা ঘোড়া দখল করে নিয়েছিল। তারপর একজন রুশ প্রিন্স তাকে ধাওয়া করে তেরেক নদী পার করে নিয়ে। বনের মতো বিশাল সেনাদল দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। তার পরের কথাগুলোয় রয়েছে কী করে হামজাদ ঘোড়াগুলো মেরে ফেলে। সেগুলো দিয়ে রক্তাক্ত প্রাচীর বানায়। তার আড়াল থেকে রাইফেলে গুলি, বেল্টে ছোরা আর শিরায় রক্ত থাকা পর্যন্ত তারা লড়ে যায়। মারা যাওয়ার মুহূর্তে হামজাদ আকাশে একটি পাখির ঝাঁক দেখে চিৎকার করে বলে :
যাও পাখি উড়ে, আমাদের ঘরে ঘরে!
বলে গিয়ে মায়েদের বোনেদের,
বল গিয়ে প্রিয়তমা বধূদের,
আমরা শহীদ জিহাদে! আমাদের লাশ
কখনো রবে না শুয়ে কবরের ঘুমে!
শরীর খুবলে খাবে নেকড়ের দল,
চোখগুলো যাবে কাক-শকুনের পেটে।
শোকের সুরে গানটা শেষ হলে বাটা ভরাট গলায় চিৎকার করে উঠল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! তারপর সব চুপ। কেবল বাগানে বুলবুলির চুক চুক চুক চুক গান। দরজার পেছনে পাথরে লোহা ঘষার শব্দ।
হাজি মুরাদ এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে খেয়াল করেননি কখন হাতের জগ থেকে পানি পড়ে গেছে। হুঁশ হলে মাথাটা নেড়ে আবার নিজের ঘরে ঢুকলেন। ফজর নামাজ পড়ার পর নিজের অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে বিছানায় বসলেন। তার আর কিছুই করার ছিল না। বাইরে যেতে হলে তাকে ভারপ্রাপ্ত অফিসারের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু দিনের আলো ফোটেনি, অফিসার তখনো ঘুমিয়ে।
খানেফির গান তাকে আরেকটি গান মনে করিয়ে দিল। গানটা তার জন্মের ঠিক পরপর তার মায়ের রচনা। তার বাবার উদ্দেশে এই গানটার কথাই হাজি মুরাদ লরিস-মেলিকভকে বলেছিলেন।
দামেস্ক ইস্পাতে গড়া তোমার তলোয়ার আমার শুভ্র বুক চিরেছিল;
অবশ্য তার পাশেই রেখেছি ছোট্ট ছেলেটিকে;
আমার উষ্ণ লহুস্রোতে ধুয়েছি তাহারে; এবং সে ক্ষত
ওষধি ও যত্ন বিনা দ্রুতই শুকায়,
মৃত্যুর মুখেও আমি ভয়হীনা, সে-ও তা-ই,
আমার বাচ্চা, অশ্বারোহী, মুক্ত থাকবে সে ভয়ডর থেকে!
হাজি মুরাদের মনে পড়ল কেমন করে তার মা তাকে বাড়ির ছাদে চাদর মুড়ে পাশে শুইয়ে রাখতেন। তিনি কেমন করে মায়ের কাটা দাগটি দেখতে চাইতেন। হাজি মুরাদের মনে হলো তিনি মাকে সামনে দেখছেন–লোল চর্ম, পাকা চুল ফোকলা দাঁতে তিনি শেষবার যেমন দেখেন, তেমন নয়। সুন্দরী সুঠাম তরুণী পাঁচ বছরের ভারী ছেলেটিকে পিঠের ঝুড়িতে যেভাবে পাহাড়ে বাবার কাছে নিয়ে যেতেন, সেই রূপে। তার দাদার কথাও মনে হলো। চামড়ায় ভাজ পড়ে যাওয়া, সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো তার বলিষ্ঠ হাতে রুপার ওপর হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতেন। তাকে নামাজ পড়তে বাধ্য করতেন।
তার মনে পড়ল পাহাড়ের পায়ের কাছে ঝরনাটার কথা। তার লম্বা পায়জামা গুটিয়ে তিনি মায়ের সঙ্গে পানি আনতে যেতেন। মনে পড়ল কৃশকায় কুকুরটার কথা, যেটা তার গাল চেটে দিত। বিশেষ করে মনে পড়ল টক দুধ আর ধোয়ার অদ্ভুত গন্ধ। দুধ দোয়ানো বা দুধ জ্বাল দেওয়ার সময় মা তাকে চালাঘরে নিয়ে গেলে ধোয়ায় সেই গন্ধ পেতেন। মা প্রথমবার তার চুল কামিয়ে দেওয়ার ঘটনা তার মনে আছে। ঘরের দেয়ালে ঝোলানো চকচকে পিতলের গামলায় তার ঘন নীল মাথা দেখে কী অবাকই না তিনি হয়েছিলেন।
নিজের ছোটবেলার স্মৃতি তাকে ছেলের কথা মনে করিয়ে দিল। ইউসুফের চুল প্রথমবার তিনিই কামিয়ে দিয়েছিলেন। এখন ইউসুফ একজন সুদর্শন তরুণ অশ্বারোহী যোদ্ধা। শেষবার দেখা ইউসুফের চেহারা মনে হলো তার। হাজি মুরাদ তসেলমেস থেকে চলে আসার দিন শেষ দেখেছিলেন। তার ছেলে ঘোড়া এনে দিয়ে তার সঙ্গে আসার অনুমতি চেয়েছিল। অস্ত্রসজ্জিত ইউসুফ তার নিজের ঘোড়ায় লাগাম হাতে তৈরি ছিল। তার সুশ্রী চেহারায় গোলাপি আভা এবং ছিপছিপে লম্বা গড়ন (সে বাবার চেয়ে লম্বা) যেন শ্বাস নেয় দুঃসাহস, তারুণ্য আর জীবনের আনন্দের। কম বয়সী হলেও চওড়া কাঁধ, চিকন কোমর, বলিষ্ঠ লম্বা হাত, শক্তি, নমনীয়তা ও চলাফেরায় ক্ষিপ্রতা হাজি মুরাদকে মুগ্ধ করত।
তুমি বরং থেকেই যাও। বাড়িতে তুমি মা, দাদিমার খেয়াল রেখো, হাজি মুরাদ বলেছিলেন। তার মনে আছে কী তেজ, অহংকার আর আনন্দ নিয়ে ইউসুফ জবাব দিয়েছিল, জান থাকতে কেউ মা-দাদিমার ক্ষতি করতে পারবে না। ইউসুফ বাবাকে ঝরনা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে যায়। তারপর থেকে হাজি মুরাদ তার স্ত্রী, মা আর ছেলেকে দেখেননি। শামিল এই ছেলেরই চোখ তুলে নিতে চায়। তার স্ত্রীর কী হবে হাজি মুরাদ ভাবতে চাননি।
এসব চিন্তায় তিনি উত্তেজিত হয়ে আর বসতে পারলেন না। লাফিয়ে উঠে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দরজার কাছে গেলেন, খুলে এলডারকে ডাকলেন। সূর্য তখনো ওঠেনি কিন্তু বেশ আলো। বুলবুলিগুলো তখনো ডাকছিল।
যাও, অফিসারকে বলো আমি বাইরে যেতে চাই, আর ঘোড়ায় জিন লাগাও, তিনি বললেন।
২৪
এ সময় বাটলারের একমাত্র সান্ত্বনা ছিল যুদ্ধের কবিতা। সে শুধু কাজের সময় কবিতায় ডুবে যেত তা নয়, নিজস্ব সময়েও। চাপকান গায়ে ঘোড়ায় চড়ে সে ঘুরে বেড়াত। বোগদানোভিচের সঙ্গে দুবার গিয়েছিল ওত পাতার জায়গায়। কোনোবারই তারা কাউকে খুঁজে পায়নি বা মারেনি। সাহসী হিসেবে বোগদানোভিচের সুনাম ছিল। তার সঙ্গে বন্ধুত্বে বাটলার যুদ্ধে থাকার মতো মজা পেত। চড়া সুদে এক ইহুদির কাছ থেকে ধার নিয়ে সে তার ঋণ শোধ করে দিয়েছিল। বরং বলা যায়, সে তার সমস্যার সমাধান না করে শুধু থামিয়ে রেখেছিল। সে তার অবস্থা চিন্তা না করার চেষ্টা করত। তাই শুধু যুদ্ধের কবিতা নয়, মদেও তা ভুলে থাকা। প্রতিদিন সে বেশি করে মদ পান করত, আর দিন দিন নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছিল। আগে সে মেরি দমিত্রিয়েভনার প্রতি জোসেফের মতো পবিত্র ছিল। কিন্তু এখন তার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটা তাকে সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করায় সে অবাক ও লজ্জিত।
এপ্রিলের শেষে দুর্গে একটি সেনাদল এল। বারিয়াতিনস্কি তাদের দিয়ে চেচনিয়ার সরাসরি আক্রমণ করতে চায়। এত দিন সেটা অসম্ভব মনে করা হতো। সেনাদলে কাবার্ড রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি ছিল। ককেশীয় রীতিতে কুরিণ কোম্পানিগুলো তাদের মেহমান হিসেবে যত্ন করত। সৈন্যদের থাকতে দেওয়া হলো ব্যারাকে। রাতের খাবারে বাজরার পরিজের সঙ্গে দেওয়া হলো তোদকা। অফিসাররা কুরিন অফিসারদের বাড়িতে জায়গা পেল। স্বভাবতই সেই সঙ্গে রাতের খাবারও। ডিনারে রেজিমেন্টের গায়ক দল গাইল। তা শেষ হলো মদ্যপান দিয়ে। মেজর পেত্ৰভ আর রক্তিমাভ ছিল না, ফ্যাকাশে ছাইয়ের মতো হয়ে গিয়েছিল। দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে একটা চেয়ারে বসা। তলোয়ার বের করে কাল্পনিক শত্রুকে এফোঁড়-ওফোড় করছিল। মুখে কখনো খিস্তি আর কখনো হাসি। কখনো কাউকে জড়িয়ে ধরছে আবার কখনো নাচছে প্রিয় গানের সুরে।
শামিল হাঙ্গামা করেছে
পেছনের দিনগুলোয়;
টারা রা রা টা টা
পেছনের বছরগুলোয়!
বাটলারও সেখানে ছিল। এই গানেও সে যুদ্ধের কবিতা খুঁজতে চেষ্টা করল। কিন্তু মনের গভীরে মেজরের জন্য তার খারাপ লাগছিল। কিন্তু তাকে থামানো ছিল অসম্ভব। মাথাটা ধোয়াটে হয়ে উঠছে অনুভব করে বাটলার নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে বাসায় চলে গেল।
চাঁদের আলোয় সাদা বাড়িগুলো আর রাস্তার পাথরগুলো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। প্রতিটা নুড়ি, খড় আর ছোট ছোট ধুলার চিপি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। বাসার কাছাকাছি গেলে বাটলারের দেখা হলো মেরি দমিত্রিয়েভনার সঙ্গে। তার মাথা ও ঘাড়ে একটা শাল জড়ানো। মেরির কাছে ঘেঁকা খাওয়ার পর বাটলার লজ্জায় তাকে এড়িয়ে চলত। কিন্তু চাঁদের আলো আর পেটে মদের কারণে তাকে দেখে বাটলার খুশি। আবার ভাব জমাতে ইচ্ছা হলো তার।
কোথায় যাচ্ছ? সে জিজ্ঞেস করল।
কেন, আমার বুড়োর খোঁজে, মিষ্টি করে জবাব দিল মেরি। বাটলারকে সে সত্যি সত্যি প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু তাকে বাটলারের এড়িয়ে চলা সে পছন্দ করেনি।
তার জন্য ভাবছ কেন? সে শিগগিরই চলে আসবে।
আসলেই কি আসবে?
সে না এলে তারা নিয়ে আসবে।
এই অবস্থা…এটা তো ভালো না!…তুমি বলছ আমার না যাওয়াই ভালো?
না, যেয়ো না। তার চেয়ে বাড়ি চলো।
মেরি দমিত্রিয়েভনা ফিরে তার পাশাপাশি হেঁটে চলল। চাঁদের দারুণ উজ্জ্বল আলোয় মনে হচ্ছিল তাদের মাথার ছায়ার চারপাশে দুটো আলোর বলয় চলছে। বর্তিকা দুটোর দিকে তাকিয়ে বাটলার ভাবছিল, আবার বলবে সে মেরিকে কত পছন্দ করে। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে, বুঝতে পারছিল না। মেরি তার কথা শোনার জন্য চুপ করে ছিল। তাই তারা কোনো কথা না বলে বাড়ির কাছে চলে এসেছে। সে সময় কয়েকজন ঘোড়সওয়ার দেখতে পেল। একজন অফিসার কয়েকজন দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে এসেছে।
তোমারা কারা? পাশে সরে মেরি দমিত্রিয়েভনা জিজ্ঞেস করল। চাঁদটা ঘোড়সওয়ারদের পেছন দিকে থাকায় তারা বাটলার ও তার কাছাকাছি না আসা পর্যন্ত তাদের চিনতে পারেনি।
তুমি কি পিটার নিকোলায়েভিচ? আগন্তুককে মেরির প্রশ্ন।
হ্যাঁ, আমি, কামিনে বলল। আহ, বাটলার, কেমন আছ?…এখনো ঘুমাওনি? মেরি দমিত্রিয়েভনার সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছ! সাবধান, মেজর কিন্তু তোমাকে দেখিয়ে দেবে।…কোথায় সে?
কোথায় আবার, ওই ওখানে…শোনো! মেরি দমিত্রিয়েভনা জবাব দিল নাগড়া বাজার শব্দের দিকে আঙুল দেখিয়ে। তারা আমোদ-ফুর্তি করছে।
কী জন্য? তোমাদের লোকেরা কি নিজেরা নিজেরাই ফুর্তি করে?
না। হাসাভ-ইয়ার্ট থেকে কয়েকজন অফিসার এসেছে। তাদের আদর যত্ন করা হচ্ছে।
ভালোই হলো! আমি ঠিক সময়ে এসেছি…মেজরের সঙ্গে আমার একটু দেখা করা দরকার।
কোনো কাজে? বাটলার জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ, ছোট্ট একটা কাজ।
ভালো না খারাপ?
সেটা নির্ভর করে।…আমাদের জন্য ভালো, কিছু লোকের জন্য খারাপ, বলে হাসল কামিনেভ।
তারা ইতিমধ্যে মেজরের বাসার পৌঁছেছে।
শিখিরেভ, চিৎকার করে একজন কসাককে ডাকল কামিনেভ, এখানে এসো।
সঙ্গের কসাকরা ছিল ডন অববাহিকার। তাদের মধ্য থেকে একজন এগিয়ে এল। পরনে সাধারণ ডন কসাকদের উর্দি, লম্বা বুট, গলায় বাধা লম্বা পশমি জোব্বা, কাঁধে ব্যাগ।
কামিনেভ নেমে ঘোড়াটা নিয়ে যেতে বলল।
কসাক সৈন্যটিও ঘোড়া থেকে নেমে ব্যাগ থেকে একটা থলে বের করল। কামিনে থলেটা তার কাছে থেকে নিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল।
বেশ, আমি তোমাদের একটা নতুন জিনিস দেখাব! ভয় পেয়ো না মেরি দমিত্রিয়েভনা?
আমি কেন ভয় পাব?
এই দেখো! বলে কামিনেভ থলে থেকে একটা মানুষের মাথা বের করল। চাঁদের আলোয় ওটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করল, তোমরা চিনতে পেরেছ?
ওটা ছিল একটা ন্যাড়া মাথা, মোটা ভুরু, ছোট করে ছাঁটা কালো দাড়ি ও গোঁফ, এক চোখ খোলা, অন্যটা আধবোজা। ন্যাড়া মাথাটায় চিড় ধরা কিন্তু সোজা নয়, নাকে জমাট রক্ত। ঘাড়টা রক্তমাখা ভোয়ালে দিয়ে প্যাঁচানো। নীল ঠোঁট শিশুর মতো দয়ালু অভিব্যক্তি ধরে আছে।
মেরি দমিত্রিয়েভনা মাথাটার দিকে তাকিয়েই দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
বাটলার বীভৎস মাথাটা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। ওটা ছিল সেই হাজি মুরাদের মাথা, যার সঙ্গে কয়েক দিন আগেই বন্ধুর মতো মিশেছে।
এটা কেমন করে হলো? কে তাকে খুন করেছে? সে জিজ্ঞেস করল।
সে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু ধরা পড়ে যায়, বলে কামিনে মাথাটা কসাক সৈন্যটার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে বাটলারের সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।
সে বীরের মতো মরেছে, কামিনেভ বলল।
কিন্তু এত সব ঘটল কীভাবে?
একটু দাঁড়াও। মেজর আসুক। সবই বলব। আমাকে এই জন্যই পাঠানো হয়েছে। সব কটি দুর্গ আর গ্রামে এটা দেখাতে হবে।
মেজরকে খবর পাঠানো হলো। সে তার মতোই মাতাল আরও দুজন অফিসারের সঙ্গে এসে কামিনেভকে জড়িয়ে ধরল।
আমি হাজি মুরাদের মাথাটা নিয়ে এসেছি, বলল কামিনেভ।
না?…খুন হয়েছে?
হ্যাঁ, পালাতে চেয়েছিল।
আমি সব সময় বলেছি সে ধোঁকা দিতে এসেছে!…কোথায় সেটা? মানে মাথাটা আমি দেখতে চাই।
কসাক সৈন্যটাকে ডাকা হলো। সে মাথাসহ ব্যাগটা আনল। মাথাটা বের করার পর মেজর মাতাল চোখে ওটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল।
সব আগের মতো আছে, সে ভালো মানুষ ছিল, বলল মেজর। আমি তাকে চুমু দিতে চাই।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। এটা এক বীরের মাথা, বলল অফিসারদের একজন।
সবাই মাথাটা দেখার পর সৈন্যটার কাছে সেটা ফিরিয়ে দেওয়া হলো। মেঝেয় যত কম সম্ভব লাগিয়ে যত্ন করে সে মাথাটা ব্যাগে ঢোকাল।
কামিনেভ, আমার প্রশ্ন, মাথাটা দেখানোর সময় তুমি কী বলো, একজন অফিসার প্রশ্ন করল।
না!…আমাকে তাকে চুমু দিতে দাও। সে আমাকে একটা তলোয়ার দিয়েছে চিৎকার করে বলল মেজর।
বাটলার বের হয়ে এল গাড়িবারান্দায়।
সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপে মেরি দমিত্রিয়েভনা বসে ছিল। সে ঘুরে একবার বাটলারের দিকে তাকাল, তারপর রেগে ঘুরে বসল।
কী হয়েছে, মেরি দমিত্রিয়েভনা? বাটলার জিজ্ঞেস করল।
তোমরা সবাই খুনি!…আমি এসব ঘেন্না করি! সত্যিই তোমরা খুনি, বলে উঠে গেল সে।
যে কারও জীবনে এটা ঘটতে পারে, কী বলবে না বুঝে বাটলার মন্তব্য করল। এটাই যুদ্ধ।
যুদ্ধ! আসলেই, যুদ্ধ!…খুনির দল আর কিছু না। একটা লাশ মাটির কাছে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। আর তারা সেটা নিয়ে আমোদ করছে!…আসলেই গলাকাটা খুনি, বলতে বলতে সিঁড়ি থেকে নেমে সে পেছনের দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
বাটলার ফিরে গেল ঘরে, কামিনেভকে কীভাবে এটা ঘটল তা বিস্তারিত বলতে বলল।
এবং কামিনেভ সব বলল।
ঘটনাটা পরের অধ্যায়ে।
২৫
শহরেই আশপাশে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি ছিল হাজি মুরাদের। তবে সঙ্গে সব সময়ই একদল কসাক সৈন্য রাখতে হবে। নুখায় কসাক সৈন্যের সংখ্যা সাকল্যে পঁচিশ। তাদের প্রায় অর্ধেকই ছিল আবার অফিসারদের কাজে। বাকিদের মধ্য থেকে দশজনকে হাজি মুরাদের সঙ্গে দেওয়ার আদেশ পালন করতে হলে একই দলকে এক দিন পরপর একই কাজ করতে হতো। তাই প্রথম দিন দশজন দেওয়া হলেও ভবিষ্যতে তা পচে নামানোর সিদ্ধান্ত হয়। আর হাজি মুরাদকে তার লোকদের সবাইকে সঙ্গে না নিতে বলা হয়। কিন্তু ২৫ এপ্রিল তিনি তাদের সবাইকে নিয়ে বের হন। তিনি ঘোড়ায় চড়লে তার পাঁচ সহকারীও সঙ্গে চলল। তাই দেখে কমান্ডার বলে যে তিনি তাদের সবাইকে নিতে পারেন না। কিন্তু হাজি মুরাদ না শোনার ভান করে ঘোড়া চালিয়ে দেন। কমান্ডার আর জোর করেনি।
কসাক দলের সঙ্গে একজন নিম্নপদস্থ অফিসার (এনসিও) ছিল। সাহসিকতার জন্য নাজারভ সেন্ট জর্জেস ক্রস পদক পেয়েছিল। সে ছিল গোলাপের মতো টাটকা এক বাদামি চুলের তরুণ। এক দরিদ্র গোড়া খ্রিষ্টান পরিবারের বড় ছেলে। পিতৃহীন অবস্থায় সে বড় হয়। বুড়ি মা, তিনটি বোন আর দুই ভাই নিয়ে তার পরিবার।
নাজারভ, তার কাছাকাছি থেকো! কমান্ডার চিৎকার করে আদেশ দিল।
ঠিক আছে, স্যার! বলে নাজারভ ঘোড়ায় উঠে পিঠের রাইফেলটা ঠিক করে নিল। তার দুরঙা বড় খোঁজা ঘোড়াটা জোর কদমে চালিয়ে দিল। তার পিছে পিছে চলল চারজন কসাক : লম্বা ছিপছিপে থেরাপভ, পেশায় চোর আর লুটেরা। (সে-ই গামজালোর কাছে বারুদ বিক্রি করেছিল।) সুঠামদেহী চাষি ইগ্নাতভ! যে নিজের গায়ের জোর নিয়ে বড়াই করত! সেনাবাহিনীতে তার বাধ্যতামূলক চাকরি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। সে আর তরুণ ছিল না। মিশকিন ছিল কমজোর। সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আর ছিল মায়ের একমাত্র ছেলে সুন্দর চুলের পেত্রাকভ। সব সময় অমায়িক আর আমুদে।
সকালটা কুয়াশাঢাকা হলেও পরে পরিষ্কার হয়ে যায়। পাতার কলি, কুমারীর মতো নতুন গজিয়ে ওঠা দূর্বা, কচি ভুট্টার মোচা এবং রাস্তার বাঁ দিকে তরতর করে বয়ে চলা নদীর ছোট ছোট ঢেউ কেবল দেখা যাচ্ছিল। সবই কাঁচা রোদে চকচক করছিল।
হাজি মুরাদ ধীরে ধীরে চলছিলেন। তার পিছু পিছু কসাকরা আর তার সহকারীরা। রাস্তাটি ধরে হেঁটে হেঁটে তারা দুৰ্গটা ছাড়িয়ে গেলেন। রাস্তায় দেখতে পেলেন মেয়েরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছে, সৈন্যরা ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছে আর মহিষগুলো ক্যাচক্যাচে গাড়ি টেনে চলেছে। মাইল দেড়েক যাওয়ার পর হাজি মুরাদ তার সাদা কাবার্ডা জাতের ঘোড়াটা একটু জোরে চালালেন। তার সঙ্গে থাকতে কসাক ও সহকারীদের ঘোড়া দুলকি চালে চালাতে হলো।
বাহ, কী সুন্দর তার ঘোড়াটা। সে যদি এখনো শত্রু থাকত, তাহলে আমি তাকে গুলি করে ফেলে দিতাম! বলল থেরাপন্তভ।
ঠিকই বলেছ। তিবলিসে ঘোড়াটার জন্য তিন শ রুবল দিতে চেয়েছিল।
আমার ঘোড়াটা নিয়ে আমি তার আগে চলে যেতে পারি, নাজারভ বলল।
তাই মনে করো!
হাজি মুরাদ আরও জোরে চলছিলেন।
বন্ধু, ওইভাবে যাবেন না। দাঁড়ান! চিৎকার করে বলে নাজারভ হাজি মুরাদকে কাটিয়ে যেতে শুরু করল।
হাজি মুরাদ পিছে তাকালেন। কিছু না বলে একই রকম জোরে যেতে থাকলেন।
দেখো, শয়তানগুলো কিছু একটা করবে! বলল ইগ্নাতভ। তারা দূরে সরে যাচ্ছে।
তারা পাহাড়ের দিকে প্রায় এক মাইল চলে এসেছে।
আমি বলে দিচ্ছি এতে কোনো কাজ হবে না! চিৎকার করে বলল নাজারভ।
হাজি মুরাদ উত্তর দিলেন না, ফিরেও তাকালেন না। শুধু ঘোড়াটা আরও জোরে ছোটালেন।
ধোঁকাবাজ! তোমাকে যেতে দেব না! চিৎকার করে নাজারভ বুটের আল দিয়ে ঘোড়াটাকে খোঁচা দিল। দুরঙা খোঁজা ঘোড়াটায় চাবুক মেরে পাদানিতে ভর দিয়ে উবু হয়ে দাঁড়িয়ে হাজি মুরাদকে ধরতে ছুটল।
উজ্জ্বল আকাশ আর পরিষ্কার বাতাসে নাজারভের বুক ভরে গেল এক খেলার আনন্দে। কারণ, তার সবচেয়ে সুন্দর ঘোড়াগুলোর একটায় মসৃণ পথে সে হাজি মুরাদকে ধাওয়া করছিল। ওই আনন্দের কারণে তার মনে কোনো দুঃখজনক বা ভয়ানক ঘটনার চিন্তা আসেনি। প্রতি কদমেই সে হাজি মুরাদের কাছে চলে আসছিল বলে সে খোশমেজাজে ছিল।
তার পেছনে বড় ঘোড়াটার খুরের আওয়াজ থেকে হাজি মুরাদ হিসাব করলেন কতক্ষণে সেটা তাকে কাটিয়ে যাবে। তিনি ডান হাত দিয়ে পিস্তলটা ধরলেন আর বাঁ হাতে রাশ টেনে তার কাবার্ডা ঘোড়াটার গতি কমিয়ে আনলেন। পেছনে আরেকটা ঘোড়ার আওয়াজ পেয়ে ওটা উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিল।
আমি বলছি, আপনি এ রকম করবেন না! হাজি মুরাদের ঘোড়াটার লাগাম ধরার জন্য বাঁ হাতটা বাড়িয়ে দিতে দিতে নাজারভ চিৎকার করে বলল। কিন্তু সেটা ধরার আগেই একটা গুলি ছোঁড়া হলো। আপনি কী করছেন, বুকে হাত চেপে নাজারভের চিৎকার। ছেলেরা, এদের আটকাও। চিৎকার করে সে উপুড় হয়ে জিনে চড়ার হাতলটার ওপর পড়ে গেল।
কিন্তু পাহাড়িরা আগেই তাদের হাতিয়ার তুলে নিয়ে কসাকদের ওপর পিস্তলের গুলি চালায় আর তলোয়ার দিয়ে কোপায়।
নাজারভ তার ঘোড়াটার ঘাড়ে ঝুলে থাকল। ঘোড়াটা তার সঙ্গীদের চারপাশে ঘুরছিল। ইগ্নতভ আর দুজন পাহাড়ির পা দলে তার ঘোড়াটা পড়ে গেল। কিন্তু পাহাড়িরা না নেমেই তলোয়ার বের করে ইগ্নাতভের মাথা আর হাতে কোপ মারে। পেত্রাকভ সহযোদ্ধাদের উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই দুটো গুলি লাগল তার পিঠে ও পাশে। সে একটা বস্তার মতো ঘোড়া থেকে পড়ে গেল।
মিশকিন ঘোড়া ঘুরিয়ে জোর কদমে ছুটল দুর্গের দিকে! খানেফি আর বাটা তাকে ধাওয়া করে কিন্তু সে ততক্ষণে এত দূর চলে গিয়েছিল যে তাকে। ধরতে পারল না। তাই তারা অন্যদের কাছে ফিরে এল।
পেত্রাকভ পড়ে ছিল চিত হয়ে। তার পেট কেটে ভুড়ি বের হয়ে এসেছে। তার কচি মুখটা আকাশের দিকে, মারা যাওয়ার আগে সে মাছের মতো শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
ইগ্নাতভকে তলোয়ার দিয়ে শেষ করে গামজালো নাজারভের ওপরও একটা কোপ দিল। মৃতদের শরীর থেকে গুলির থলিগুলো খুলে নিল বাটা। খানেফি নাজারভের ঘোড়াটা নিতে চাইল কিন্তু হাজি মুরাদ তাকে বারণ করলেন এবং রাস্তা ধরে এগোতে থাকলেন। মুরিদরা তাকে অনুসরণ করল। নাজারভের ঘোড়াটা তাদের সঙ্গে আসছিল কিন্তু তারা ওটাকে খেদিয়ে দেয়। তারা ইতিমধ্যে নুখা থেকে ছয় মাইল চলে এসেছে। ধানখেতের মধ্য দিয়ে চলছে। তখন দুর্গের কামান থেকে সতর্কতার সংকেত হিসেবে একটা গোলা দাগা হলো।
.
হায় হায়! হায় খোদা! এটা তারা কী করল? হাজি মুরাদের পালানোর খবর শুনে দুই হাতের মধ্যে মাথা রেখে দুর্গের কমান্ডার চিৎকার করতে থাকল। তারা আমার সর্বনাশ করেছে। তারা তাকে পালাতে দিয়েছে, পাজি শয়তানগুলো? মিশকিনের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনে তার হা-হুতাশ।
সব জায়গায় বিপৎসংকেত দেওয়া হলো। শুধু সেখানকার কসাই না, রুশপন্থী গ্রামগুলো থেকে যত যোদ্ধা পাওয়া গেল, সবাইকে পলাতকদের খুঁজতে লাগানো হলো। হাজি মুরাদকে জীবিত বা মৃত ধরে আনার জন্য এক হাজার রুবল পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। কসাকদের কাছ থেকে হাজি মুরাদ আর তার সঙ্গীরা পালানোর দুই ঘণ্টার মধ্যে দুই শ অশ্বারোহী ভারপ্রাপ্ত অফিসারের অধীনে পলাতকদের ধরার জন্য বের হলো।
রাস্তা দিয়ে কয়েক মাইল যাওয়ার পর হাজি মুরাদ তার হয়রান ঘোড়াটার অবস্থা দেখলেন। সাদা ঘোড়াটা ঘেমে ছাইরং হয়ে গিয়েছে।
রাস্তার ডান দিকে বেলারঝিক গ্রামের বাড়িগুলো আর মিনার দেখা যাচ্ছে। বাঁ দিকে কিছু খেত, তারপরই নদী। পাহাড়গুলো ডান দিকে হলেও হাজি মুরাদ উল্টো বাঁ দিকে চলতে শুরু করলেন। ভাবলেন, তাকে ধরতে সৈন্যরা অবশ্যই ডান দিকে যাবে। আর তিনি বড় রাস্তা ছেড়ে আলাজান পার হয়ে অপর দিকের বড় রাস্তায় পড়বেন। যেখানে তার যাওয়ার কথা কেউ ভাববে না। ওই রাস্তা ধরে বনের পাশ দিয়ে গিয়ে নদীটা আবার পার হয়ে পাহাড়ের পথ ধরবেন।
এই ভেবে তিনি বা দিকে ঘুরলেন। কিন্তু নদীর কাছে যাওয়া অসম্ভব। ধানখেতগুলো বসন্তকালের বন্যায় ডুবে গেছে। ঘোড়ার খুর কাদায় দেবে যাচ্ছে। হাজি মুরাদ ও তার সঙ্গীরা কখনো ডানে, কখনো বায়ে ঘুরছেন একটু শুকনা মাটির আশায়। কিন্তু খেতগুলো সবখানেই ডুবেছে। কাদার গর্ত থেকে ঘোড়াগুলো খুর টেনে ওঠানোর সময় বোতলের ছিপি খোলার মতো পপ পপ শব্দ হচ্ছে। ওগুলো কয়েক কদম পরপর হাঁপিয়ে থেমে যাচ্ছে। এইভাবে সন্ধ্যা নেমে আসা পর্যন্ত তারা নদীর কাছে পৌঁছাতে পারলেন না। তাদের বা দিকে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে একটু উঁচু জায়গা দেখে হাজি মুরাদ ঠিক করলেন সেখানে রাত পর্যন্ত থাকবেন। ঘোড়াগুলো যাতে জিরিয়ে নিতে পারে। তারা সঙ্গে আনা রুটি আর পনির খেয়ে নিলেন। শেষ পর্যন্ত রাত নেমে এল। চাঁদটা প্রথমে উজ্জ্বল আলো দিলেও পাহাড়ের আড়ালে ডুবে গেল। আবার অন্ধকার। এলাকাটায় অসংখ্য বুলবুলি। তাদের ঝোঁপটাতেও দুটো ছিল। মানুষগুলো কথা বলার সময় ওগুলো কোনো শব্দ করেনি। কিন্তু তারা চুপ করলে বুলবুলিগুলো ডাকতে শুরু করল।
জেগে জেগে রাতের সব রকম শব্দ শুনছিলেন হাজি মুরাদ। পাখির গানের কাঁপা সুরে তার মনে এল হামজাদকে নিয়ে গানটি। আগের রাতে পানি আনতে গিয়ে তিনি যেটা শুনেছিলেন। মনে হলো তার নিজের অবস্থাও সে রকম। তিনি সেটাই চাইলেন। চট করে তার মন বদলে গেল। চাদর বিছিয়ে নামাজ পড়লেন তিনি। নামাজ শেষ না করতেই শুনতে পেলেন একটা শব্দ তাদের দিকে আসছে। সেটা ছিল বানে ডোবা খেতের মধ্য দিয়ে আসা অনেকের পায়ের শব্দ।
হুঁশিয়ার বাটা ঝোঁপটার কিনারে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে কিছু ছায়া দেখতে পেল। হেঁটে আর ঘোড়ায় চড়ে কিছু লোক আসছে। খানেফিও অন্যদিকে সে রকম লোকদের দেখতে পেল। ওই জেলার সেনা কমান্ডার কারগানভ তার আধা সামরিক বাহিনী নিয়ে আসছে।
হাজি মুরাদ ভাবলেন, তাহলে আমরা হামজাদের মতোই লড়ব।
বিপৎসংকেত পেয়ে কারগানভ তার আধা সামরিক আর কসাক সৈন্যদের দল নিয়ে হাজি মুরাদকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু সারা দিনে তার কোনো চিহ্নও পায়নি। আশা ছেড়ে দিয়ে সে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল। সন্ধ্যার দিকে সে একটা বুড়ো লোককে পেয়ে জিজ্ঞেস করল, ঘোড়ায় চড়া কোনো লোককে যেতে দেখেছে কি না। বুড়ো বলল দেখেছে। ছয়জন লোককে পথ ভুল করে ধানখেতের মধ্য দিয়ে যেতে দেখেছে। সে যেই জঙ্গলটা থেকে লাকড়ি কুড়াচ্ছিল, সেখানেই তাদের ঢুকতে দেখেছে। কারগানভ ঘুরে বুড়ো লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে চলল। বাধা ঘোড়াগুলো দেখে সে নিশ্চিত হলো, হাজি মুরাদ সেখানেই। রাতে সে ঝোঁপটাকে ঘিরে রাখল, যাতে সকালে হাজি মুরাদকে জীবিত বা মৃত ধরতে পারে।
ঘেরাও হয়ে গেছেন বুঝতে পেরে আর ছোট ছোট গাছের মধ্যে একটা খন্দক দেখতে পেয়ে হাজি মুরাদ সেটায় নেমে গেলেন। ঠিক করলেন, শক্তি আর গুলি থাকা পর্যন্ত লড়বেন। সঙ্গীদের তিনি তা বলে গর্তটার সামনে একটা বাঁধ দিতে বললেন। তারা সঙ্গে সঙ্গে কাজে লেগে গেল। ডালপালা কেটে ফেলল আর ছোরা দিয়ে মাটি তুলে একটা পরিখা খুঁড়ল। হাজি মুরাদ নিজেও তাদের সঙ্গে হাত লাগালেন।
আলো ফোঁটার সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যদের কমান্ডার ঝোঁপটার কাছে এসে চিৎকার করে বলল,
হাজি মুরাদ, হার মানো। আমরা অনেক, তোমরা মাত্র কয়েকজন!
জবাবে এল রাইফেলের একটা গুলি। আর গর্তটা থেকে ধোয়ার একটা রেখা উঠল। গুলিটা কমান্ডারের ঘোড়ায় লাগে। ঘোড়াটা তার নিচে টাল খেয়ে পড়ে যায়। সৈন্যদের তরফে শুরু হলো পাল্টা গুলির বৃষ্টি। শাঁই শাঁই করে তাদের গুলিগুলো পাতা আর ছোট ছোট ডাল ভেঙে ফেলল। কিছু গিয়ে লাগল গর্তটার বাধে। কিন্তু সেটার আড়ালে কারও গায়ে লাগেনি। অন্যগুলোর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় গামজালোর ঘোড়াটার মাথায় একটা গুলি লাগে। ওটা পড়ে না গিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়ে অন্যগুলোর কাছে যায়। ওটার রক্তে ঘাস ভিজে যায়। হাজি মুরাদ আর তার সঙ্গীরা কোনো সৈন্য কাছে এলেই কেবল গুলি করে আর তাদের নিশানা ব্যর্থ হয় খুব কম। তিনজন সৈন্য আহত হয়। আর অন্যরা পরিখার কাছে না গিয়ে ক্রমেই পিছু হটতে থাকে আর দূর থেকে দিগবিদিক গুলি করতে থাকে।
এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে এমন চলল। সূর্য গাছগুলোর মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠেছে। হাজি মুরাদ তার ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে নদীর দিকে চলে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। তখনই আরও অনেক লোক আসায় তাদের গোলমালের শব্দ শোনা গেল। মেখতুলির হাজি আগা তার লোকদের নিয়ে এসেছিল। প্রায় দুই শ জন। হাজি আগা একসময় হাজি মুরাদের মিত্র ছিল এবং পাহাড়ে তার সঙ্গেই থাকত। কিন্তু পরে সে রুশদের পক্ষে চলে যায়। তার সঙ্গে ছিল হাজি মুরাদের পুরোনো শত্রুর ছেলে আহমেদ খান।
কারগানভের মতো হাজি আগাও হাজি মুরাদকে হার মেনে নিতে বলে। হাজি মুরাদও আগের মতোই গুলি ছুঁড়ে জবাব দেয়।
তলোয়ার হাতে নাও! চিৎকার করে আদেশ দিয়ে হাজি আগা নিজেরটাও বের করে। প্রায় এক শ লোক তীব্র চিৎকার করে তলোয়ার নিয়ে ঝোঁপের মধ্যে হামলা করে।
হাজি আগার যোদ্ধারা ঝোঁপের মধ্যে দৌড়াতে থাকে আর পরিখা থেকে একটার পর একটা গুলিও আসতে থাকে। তিনজন পড়ে যাওয়ার পর হামলাকারীরা ঝোপে ঢোকা বন্ধ করে বাইরে থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করল। গুলি করতে করতে তারা ধীরে ধীরে পরিখার দিকে এগোতে শুরু করে এক ঝোঁপের আড়াল থেকে আরেক ঝোপে দৌড়ে গিয়ে। কেউ কেউ তা করতে পারল। অনেকে হাজি মুরাদ ও তার সঙ্গীদের গুলিতে মারা পড়ল। হাজি মুরাদের কোনো গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি, গামজালোর গুলিও খুব কমই নষ্ট হয়। যতবার তার গুলিতে কেউ পড়ে যায়, ততবারই সে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। খান মাহোমা পরিখার কিনারে বসে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ! পড়ছিল আর মাঝেমধ্যে গুলি করছিল। কিন্তু সেগুলো প্রায়ই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। এলডার ছোরা হাতে শত্রুর দিকে ছুটে যাওয়ার জন্য ছটফট করছিল। সে ঘন ঘন এদিক-সেদিক গুলি করছিল পরিখার বাইরে বের হয়ে আর বারবার হাজি মুরাদের দিকে তাকাচ্ছিল। নোংরা খানেফি এখানেও ভূতের কাজই করছিল। হাজি মুরাদ আর খান মাহোমা তার হাতে বন্দুক দিলে সে সাবধানে শিক দিয়ে বারুদ গেদে তাতে তেলে ভেজানো ন্যাকড়ায় মোড়া গুলি ভরে দিচ্ছিল। বাটা অন্যদের মতো পরিখায় থাকেনি। নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসতে দৌড়ে ঘোড়াগুলোর কাছে যায়। আর চিৎকার করে দৌড়াতে দৌড়াতে বন্দুক কোনো কিছুর সঙ্গে না ঠেকিয়েই সে গুলি করছিল। সে-ই আহত হলো সবার আগে। তার ঘাড়ে গুলি ঢুকেছিল। সে বসে পড়ল। রক্তমাখা থুতু ছিটিয়ে সে শাপশাপান্ত করতে থাকল। তারপর আহত হলো হাজি মুরাদ। একটা গুলি তার কাঁধে ঢুকেছিল। বেশমেতের ভেতরের দিক থেকে কিছু তুলো ছিঁড়ে ক্ষতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে তিনি আবার গুলি চালাতে থাকলেন।
চলুন, আমরা তলোয়ার দিয়ে ওদের চামড়া তুলে ফেলি! তৃতীয়বারের মতো বলল এলডার। মাটির বাঁধটার পেছন থেকে শত্রুর দিকে ছুটে যেতে সে প্রস্তুত। সেই মুহূর্তে একটা গুলি এসে লাগল তার গায়ে। সে ধনুকের মতো বেঁকে পেছনে হাজি মুরাদের পায়ের ওপর পড়ে গেল। হাজি মুরাদ দেখলেন, তার ভেড়ার মতো চোখ উৎসুক দৃষ্টিতে ভোলা। তার মুখে ওপরের ঠোঁটটা শিশুর ঠোঁটের মতো ভোলা। মুখ থেকে বুদবুদ বের হচ্ছে। হাজি মুরাদ তার নিচ থেকে নিজের পা বের করে নিয়ে আবার গুলি চালাতে শুরু করলেন।
খানেফি এলডারের শরীরের ওপর ঝুঁকে পড়ে তার চাপকানের ভেতর থেকে ব্যবহার না করা গুলিগুলো বের করে নিতে শুরু করল।
খান মাহোমা তার জিকির চালিয়ে যাচ্ছিল, ফাঁকে ফাঁকে গুলিও করছিল। শত্রুরা চিৎকার করতে করতে সাবধানে এক ঝোঁপের আড়াল থেকে অন্য ঝোঁপের আড়ালে দৌড়ে যাচ্ছিল এবং একটু একটু করে কাছে চলে আসছিল।
হাজি মুরাদের বাঁ দিকে আরেকটি গুলি লাগল। তিনি আবার শুয়ে পড়ে বেশমেত থেকে তুলো বের করে গুঁজে দিলেন। কিন্তু আঘাতটা ছিল মারাত্মক। তার মনে হলো তিনি মারা যাচ্ছেন। তার কল্পনায় একের পর এক ছবি ও স্মৃতি ভেসে উঠতে শুরু করল। দেখলেন আবু নুতসাল খান এক হাতে ছোরা আর অন্য হাতে কাটা গাল চেপে ধরে শত্রুর দিকে তেড়ে যাচ্ছে, তারপর দেখলেন দুর্বল রক্তশূন্য ভরসভের মুখ। কানে বাজল তার ধূর্ত মুখে নরম গলার কথা। তারপর তিনি দেখলেন তার ছেলে ইউসুফ ও স্ত্রী সোফিয়ার মুখ। তারপর তার চোখে ভেসে উঠল ফ্যাকাশে ও লাল দাড়িওয়ালা শত্রু শামিলের মুখ, আধবোজা চোখ। এই সব ছবি ভেসে ওঠার সময় তার মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না–না দয়া, না রাগ বা অন্য কোনো রকম ইচ্ছা জাগল না। তার মধ্যে যা শুরু হতে যাচ্ছিল বা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তার তুলনায় অন্য সবকিছু তুচ্ছ।
তা সত্ত্বেও সবল দেহে তিনি যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা-ই চালিয়ে গেলেন। সব শক্তি সঞ্চয় করে তিনি বাধের পেছন থেকে উঠে তার দিকে দৌড়ে আসা একটা লোককে লক্ষ্য করে গুলি করলেন। লোকটা পড়ে গেল। তারপর হাজি মুরাদ পরিখা থেকে বের হয়ে এলেন। ভীষণ খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছোরা হাতে এগিয়ে গেলেন সোজা শত্রুর দিকে।
কয়েকটি গুলি ফুটল। তিনি বাঁকা হয়ে পড়ে গেলেন। কয়েকজন সৈন্য বিজয় উল্লাসে তার পড়ে যাওয়া দেহটার দিকে দৌড়ে গেল। কিন্তু মৃত মনে হওয়া শরীরটা হঠাৎ নড়ে উঠল। প্রথমে খালি ন্যাড়া মাথাটা উঠল, পরে একটা গাছের গুঁড়ি হাত দিয়ে ধরে উঠল শরীরটা। তাকে এত ভয়ংকর দেখাচ্ছিল যে যারা তার দিকে দৌড়ে আসছিল, তারা থমকে দাঁড়াল। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তার শরীরটা গাছ থেকে ছিটকে উপুড় হয়ে পড়ল। কাঁটা গেন্ধালির মতো শরীরটা পড়ল পুরো লম্বা হয়ে। তিনি আর নড়লেন না।
তিনি নড়তে পারছিলেন না, কিন্তু অনুভব করতে পারছিলেন। তার কাছে সবচেয়ে আগে এসেছিল হাজি আগা। সে একটা বড় ছোরা দিয়ে তার মাথায় আঘাত করল। হাজি মুরাদের মনে হলো, কেউ হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন না, কে বা কেন তা করছে। এটাই ছিল শরীর নিয়ে তার শেষ চেতনা। তার আর কোনো হুঁশ ছিল না। শত্রুরা তার শরীরে লাথি মারতে আর কোপাতে শুরু করল, যেটার মধ্যে তাদের মতো প্রাণ ছিল না।
হাজি আগা লাশটার পিঠে পা দিয়ে দাঁড়াল এবং দুই কোপে তার মাথাটা কেটে ফেলল এবং পা দিয়ে ওটা সরিয়ে দিল সাবধানে, যাতে জুতায় রক্ত লেগে না যায়। ঘাড়ের ধমনিগুলো থেকে ফিনকি দিয়ে তাজা লাল রক্ত বের হয়ে এল, আর মাথা থেকে কালো রক্তে ঘাসগুলো ভিজতে থাকল।
কারগান, হাজি আগা, আহমেদ খান ও সৈন্যরা হাজি মুরাদের লাশ এবং তার সঙ্গীদের চারপাশে (খানেফি, খান মাহোমা আর গামজালোকে বেঁধে ফেলা হয়েছিল) শিকারির মতো ঘিরে দাঁড়াল। ঝোঁপগুলোর ওপরে বারুদের ধোয়ার মধ্যে তারা বিজয় উল্লাস করছিল।
গোলাগুলির সময় বুলবুলিগুলো গান থামিয়ে দিয়েছিল। আবার সেগুলো তীক্ষ্ণ সুরে গাইতে শুরু করল। প্রথমটা একদম কাছ থেকে, তারপরে দূরেরগুলো।
.
চষা খেতের মধ্যে দলে যাওয়া কাটা গেন্ধালির ডালটা দেখে যে মৃত্যুর ঘটনা আমার মনে পড়েছিল, এটাই সে ঘটনা।