অধ্যায় ২০
করাচির তৃতীয় দিন সকালে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলো সে। গতরাতে ক্লিফটন বিচে বসে ছয়টা বিয়ার আর মাঝরাতে হোটেলে ফেরার আগে জাভেদের ভাষ্যমতে করাচির সেরা রেস্টুরেন্ট চেয়ারম্যান মাও-এ গিয়ে ভালোমন্দ খেয়েছে। পোর্ট গ্র্যান্ড নামের একটি এলাকায় জিন্নাহ ফ্লাইওভারের কাছেই অবস্থিত রেস্টুরেন্টটি শুধুমাত্র নামের কারণেও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। পাকিস্তানের মতো দেশে, করাচির মতো শহরে চেয়ারম্যান মাও! এরচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার আর কি হতে পারে। এ যেনো ভুতের রাজ্যে রামের মন্দির।
তবে মাও-এর খাবারের মান আর স্বাদ খুবই ভালো। হয় রেস্টুরেন্টটির মালিক একজন মাওভক্ত কমিউনিস্ট নয়তো চায়নার সাথে গভীর কানেকশান বোঝাতে এরকম নামকরণ করা হয়েছে।
রাত প্রায় একটার দিকে খেয়েদেয়ে হোটেল সামুনাবাদে ফিরে আসে সে। মজার ব্যাপার হলো, যে শহরটি জঘন্য আইন-শৃঙ্খলা আর আত্মঘাতি বোমাবাজদের ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত সারাবিশ্বে, সেখানে প্রায় সারারাত লোকজন চলাফেরা করে, প্রচুর রেস্টুরেন্ট আর খাবারের দোকান খোলা থাকে। যানবাহনের চলাচলও চোখে পড়ার মতো। জাভেদের কথামতোই করাচি তাকে তাজ্জব করতে শুরু করে দিয়েছে!
ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই জিপিএস ট্র্যাকারটা অন করে দেখলো। সকাল সাড়ে দশটার দিকে আশা করে নি ভিন্ন কিছু দেখতে পাবে। তা-ই হলো। বইটা এখনও মওলানার অফিসেই আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েক মিনিট বসে রইলো বিছানার উপরে। এটার আশা বাদ দিতে হবে। এভাবে বসে বসে প্রতীক্ষা করার কোনো মানেই হয় না। তাকে খুব দ্রুত কার্যকরি একটি প্ল্যান করতে হবে।
গতকাল রাত থেকে এটা ভেবে যাচ্ছে, এখনও কোনো সমাধান বের করতে পারে নি। বিছানা ছেড়ে উঠে হট-ওয়াটারে শাওয়ার নিয়ে নিলো। সাধারণ শার্ট-প্যান্ট আর মাথায় একটা সানক্যাপ পরে চলে গেলো নীচের রেস্টুরেন্টে। হালকা নাস্তা করার সময়ও তার মাথায় ঐ একটাই চিন্তা-এখন সে কি করবে?
নাস্তা করার পর বেরিয়ে পড়লো হোটেল থেকে। বিক্ষিপ্তভাবে হাটাহাটি না করে চলে গেলো কয়েক ব্লক দূরে মওলানার অফিসের দিকে। একটা উদ্দেশ্যে সে এখানে এসেছে-অন্য একটি বিকল্প-জিপিএস’টা যদি শেষপর্যন্ত কাজ না করে তাহলে মওলানাকে তার অফিসে ‘অ্যাসল্ট করা যায় কিনা সেই সম্ভাবনাটি আরেকবার খতিয়ে দেখা।
পরবর্তী আধ-ঘণ্টা ভালো করে ঘুরে দেখলো সে। বিশেষ করে রাস্তাঘাটের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখলো। যেকোনো মেট্রোপলিটান শহরের চেয়ে অনেক বেশি পুলিশ ঘোরাফেরা করে এখানে। তার মানে সাদা পোশাকের পুলিশ আর গোয়েন্দার দলও আছে প্রচুর। মওলানা ইউসুফকে তার অফিসে খুন করে নির্বিঘ্নে বের হয়ে আসাটা প্রায় অসম্ভব। কাজটা হয়তো করা যাবে অনায়াসে কিন্তু ধরা পড়ার সম্ভাবনা নব্বইভাগ। ঝুঁকিটা খুব বেশি। সুতরাং এটা আরো একবার বাতিল করে দিলো। দ্বিতীয়ত, রাস্তায় কোথাও পথরোধ করে খুন করার ব্যাপারটাও ঝুঁকিপূর্ণ। এরজন্য যে পরিমাণ লোকবলের দরকার তার সেটা নেই। জাভেদ নামের যে একজন আছে তাকে এ কাজে জড়িত করা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেটা নিজেও মনে হয় না এরকম কোনো কাজে জড়িত হতে চাইবে। সে একটা রাজনৈতিক দলের উঠতি ক্যাডার। কিছু অস্ত্র আছে তার কাছে, কিংবা ওগুলো জোগাড় করে দেবার সামর্থ্য রাখে-এর বেশি না। তাকে মোটামুটি অন্ধকারে রেখেই পুরো মিশনটা শেষ করার ইচ্ছে বাস্টার্ডের। তার কাছ থেকে অস্ত্র নেবে, একটা রেন্ট-এ-কার ব্যবহার করবে, এটাই অনেক বেশি। ফলে রাস্তায় পথরোধ করে খুন করার আইডিয়াটি কোনাভাবেই তার পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। সে একা কাজ করে। তার নিজস্ব একটা ধরণ রয়েছে। শিকারি পশুর মতো অলক্ষ্যে থেকে, শিকারের উপর তীক্ষ্ণ নজরদারি করে উপযুক্ত সময়ে আঘাত হানে। ধীরে ধীরে এই কাজটাকে সে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
মওলানার অফিসের উল্টোদিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে যখন এসব ভাবছে ঠিক তখনই আইডিয়াটা তার মাথায় চলে এলো। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলো এটাতে কাজ হবে। সে জানতো ঠাণ্ডা মাথায় কিছুক্ষণ চিন্তা করলে সমাধান আসবেই। মুচকি হেসে সানক্যাপটা একটু উপরে তুলে বারো তলার ভবনটি দেখে নিলো আরেকবার।
হ্যাঁ। এতে কাজ হবে। ব্যাপারটা আরো আগে তার মাথায় আসা উচিত ছিলো। মনে মনে বলে উঠলো সে : খিদমতে-এ-খালাক!
*
বিকেল পাঁচটার একটু আগে দিয়ে হোটেল থেকে আবার বের হলো বাস্টার্ড। লাঞ্চের পর জাভেদকে ফোন করে বলে দিয়েছিলো বিকেলের এই সময়টায় চলে আসতে।
জাভেদ বরাবরের মতোই চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। গতকালের মতো সামনের সিটে নয়, এবার বাস্টার্ড বসেছে পেছনের সিটে। সেখান থেকে রিয়ার-মিররে তাকালো। জাভেদের মনে কি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আন্দাজ করতে পারলো-একই জায়গায় পর পর দু-দিন যাওয়ার মানেটা কি?-মনে মনে মুচকি হাসলো। সব প্রশ্নের উত্তর সব সময় দিতে হয় না। আর এই ছেলে যতো কম জানবে ততোই ভালো। এই ভালোটা তাদের দুজনের জন্যই।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তারা চলে এলো মওলানার অফিসের কাছে। রিয়ার মিররে তাকালো জাভেদ। “অফিসের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংয়ে চলে যাবো?”
“হুম। তুমি গাড়িতে অপেক্ষা করবে।”
“ঠিক আছে।”
গাড়িটা নিয়ে সে ঢুকে পড়লো বারোতলা ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিংলটে। ঢোকার সময় জাভেদকে থামিয়ে প্রহরি জানতে চাইলো কোথায় যাচ্ছে তারা। জবাবটা আগেই জানা ছিলো তার। প্রহরিকে সেটা বললে আর কোনো কথা জানতে চাইলো না।
পার্কিংলটটা বেশ বড়। প্রায় ত্রিশ-চল্লিশটির মতো গাড়ি আছে। সুবিধাজনক জায়গায় পার্ক করে রাখতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সে। জাভেদকে বললো, বড়জোর দশ-পনেরো মিনিটের মতো লাগতে পারে।
কথামতোই জাভেদ গাড়িতে বসে রইলো। জানালার কাঁচ নামিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে। ঢাকা থেকে আসা তওফিক আহমেদের কাজকারবার এখনও তার মাথায় ঢুকছে না। তবে তার মন বলছে লোকটা সাধারণ কোনো কাজ করতে আসে নি। তার চলাফেরা, কথা বলার ভঙ্গি, কম কথা বলা আর চোখের চাহনি দেখে আন্দাজ করতে পারছে বড়সড় কিছুই করতে যাচ্ছে। তবে এ নিয়ে তার মনে কোনো ভয় নেই। তার কাজ হলো একটা অস্ত্র দেয়া আর গাড়িতে করে এখানে ওখানে নিয়ে যাওয়া। সামাদভাই তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, এই লোক যা করার একা একাই করবে। তাকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।
লিফটের সামনে এসে ফোনটা বের করলো বাস্টার্ড। বিজনেস কার্ড থেকে মওলানার অফিসের নাম্বারে ফোন করলো। কলটা ধরলো রিসেপশনিস্ট।
“হ্যালো, আমি ফয়সাল ব্যাঙ্ক থেকে বলছি,” ইংরেজিতে বললো সে, “মওলানা ইউসুফ হোসাইনীকে একটু চাচ্ছিলাম।” আজ হোটেলের দেয়া পাকিস্তানের নামকরা ইংরেজি দৈনিক ডন-এ ফয়সাল নামের একটি ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপন দেখেছিলো প্রথম পৃষ্ঠায়।
“আপনার নাম?” রিসেপশনিস্টও ইংরেজিতে জানতে চাইলো। লোকটার চেহারা বাস্টার্ডের স্পষ্ট মনে আছে।
“অ্যাসিসটেন্ট মার্কেটিং ম্যানেজার আলী নকভি বলছি। উনি কি অফিসে আছেন নাকি বের হয়ে গেছেন?”
“উনি একটা জরুরি কাজে ব্যস্ত আছেন। এখন ফোন দেয়া যাবে না।”
“ওকে। নো প্রবলেম। আমি পরে ফোন দিচ্ছি। উনি অফিসে কতোক্ষণ আছেন?”
“আধঘণ্টার মতো…তারপরই বের হয়ে যাবেন।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি একটু পর ফোন দিচ্ছি।”
ফোনটা রেখে পা বাড়ালো পার্কিংলটের দিকে। সে আর ফোন না করলেও রিশেপসনিস্টের মধ্যে কোনো সন্দেহ জাগবে না। প্রতিদিন অসংখ্য কল রিসিভ করে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এটা ভুলে যাবে লোকটি।
পার্কিং-এরিয়াটি দেখলো। এখানকার মৃদু আলোয় দূরের গাড়িগুলো ভালো করে দেখার উপায় নেই। দুই সারিতে রাখা ত্রিশ-চল্লিশটি গাড়ির দিকে চোখ বুলাতে খুব একটা বেগ পেলো না। লিফটের দরজার কাছ থেকে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে কাজটা করতে লাগলো সে। একটু পরই ছয়-সিটের বিলাসবহুল হামার এইচ-টু লাক্সারিটা দেখে থেমে গেলো। কালো রঙের গাড়িটির সাইডডোরে স্টিকার লাগানো। উর্দু আর ইংরেজিতে লেখা নামটিও স্পষ্ট চোখে পড়লো : খিদমত-এ-খালাক!
একটু দূর থেকেও দেখতে পাচ্ছে লম্বা দাড়ি আর মাথায় টুপি পরা ড্রাইভার গাড়ির ভেতরে বসে ঝিমুচ্ছে। তার মানে মওলানা কিছুক্ষণ পরই অফিস থেকে বের হবে।
বেশ স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে মওলানার গাড়িটার সমানে দিয়ে চলে গেলো সে। যাবার সময় নাম্বারপ্লেটটা দেখে নিলো ভালো করে, তারপর পা বাড়ালো সামনের দিকে। বিশগজ দূরেই জাভেদ তার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তাকে আসতে দেখে সিগারেটের শেষ অংশটুকু ফেলে দিলো গাড়ির বাইরে।
“কাজ হয়ে গেছে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। প্যাসেঞ্জার ডোরটা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে।
“এখন কোথায় যাবো?”
“কোথাও না।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জাভেদ।
“অপেক্ষা করো…একটু পরই রওনা দেবো।”
*
মওলানার অফিস থেকে বের হবার পর দশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে গেছে তারপরও গুলশান টাওয়ারের পার্কিংলট ছেড়ে যায় নি তাদের গাড়িটা।
বাস্টার্ড বসে আছে গাড়ির পেছনের সিটে, গভীর মনোযোগের সাথে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। স্টিয়ারিংয়ের উপর দু-হাত রেখে বিরক্তিকর সময় পার করছে জাভেদ।
একটু আগে তাকে বলেছে একটা গাড়ি ফলো করতে হবে, তবে বেশ দূর থেকে। ঘুণাক্ষরেও যেনো ওই গাড়ির লোকজন টের না পায়।
ছেলেটা শুধু বলেছে “ওকে, ভাই।” আর কোনো প্রশ্ন করে নি।
বাস্টার্ডের মনে হচ্ছে এরকম কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। “আগে কখনও এরকম কাজ করেছো?”
মুচকি হেসে জাভেদ জবাব দিলো, “খুব বেশি না। তবে পুলিশ আর আইএসআই’র এজেন্টদের হাত থেকে অনেকবারই আমার লিডারকে বাঁচিয়েছি গাড়ি চালিয়ে। ওরা আমাদের পিছু নিয়েছিলো।”
ভুরু তুলে প্রশংসার সুরে বললো বাস্টার্ড, “গ্রেট।”
“আমার লিডার বলে আমি নাকি খুব ভালো ড্রাইভিং করি।”
“আমারও তাই মনে হচ্ছে,” কথাটা বলেই আবারো তাকালো পার্কিং এরিয়ার দিকে।
তার মনে হচ্ছে আজ আর ব্যর্থ হবে না। যে গাড়িটা সে দেখেছে সেটা নিশ্চিতভাবেই মওলানা ব্যবহার করে। এরকম দামি গাড়ি খিদমত-এ খালাক’র কোনো কর্মচারির ব্যবহার করার কথা নয়। হামার এইচ-টু লাক্সারি খুব কম কর্মচারিই ব্যবহার করবে। এনজিওগুলো গরীবের জন্য কাজ করলেও এর হতা-কতারা রাজকীয়ভাবে চলাফেরা করে। সুতরাং এটা নিশ্চিতভাবেই মওলানার গাড়ি।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পরও মওলানার গাড়িটাকে বের হতে দেখলো না। ঘড়িতে সময় দেখলো, পৌনে ছ-টা। এরইমধ্যে গুলশান টাওয়ারের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং থেকে একে একে অনেক গাড়ি বের হয়ে যেতে শুরু করেছে। তার মনে আশংকার দানা বাঁধতে শুরু করলো আবার। প্রায় নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
এদিকে চুপচাপ অপেক্ষা করতে করতে জাভেদও বিরক্ত হয়ে উঠলো। একের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছে সে আর সেগুলো খুব দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন মোটা অঙ্কের টাকা পাচ্ছে বলে কিছু বলছে না। সামান্য কাজে এতো টাকা সে কখনও পায় নি। তার আসল যে কাজ সেই পিস্তলের ব্যবস্থা এখনও করে দেয় নি, শুধু গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-সেখানে, খুব বেশি তেলও খরচ হচ্ছে না, তারপরও দিনশেষে ছয় হাজার রুপি জুটে যাচ্ছে। এই পরিমাণ রুপির কথা সে নিজে থেকে বলে নি। তার ধারণা ছিলো চার-পাঁচ হাজার রুপি পাবে হয়তো। সেটাই যথেষ্ট ছিলো। লিডারের গাড়িটা বেশিরভাগ সময় পড়েই থাকে। মাঝেমধ্যে রেন্ট-এ-কার হিসেবে চালিয়ে কিছু ইনকাম করে। সে তো আর ট্যাক্সি ড্রাইভার নয় যে প্রতিদিন গাড়ি নিয়ে বের হবে। লিডার যতোদিন করাচিতে না আসছে ততোদিন একটু আধটু কামিয়ে নিচ্ছে, এই যা। এতে দোষের কিছু দেখছে না।
সামাদভাই বলেছে, এই তওফিক আহমেদ নামের লোকটাকে সাহায্য করলে শেষে মোটা অঙ্কের বখশিস পাবে সে। কিন্তু কথা হলো, লোকটা কি করতে চাইছে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। একটু আগে যখন বলেছে একটা গাড়ি বের হলে সেটাকে ফলো করতে হবে তখন কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে। তার ধারণা এই লোক ঐ ভবনের কাউকে খুন করবে। এখন যা করছে সেটাকে বলা যেতে পারে রেকি। এই রেকি জিনিসটার সাথে তার পরিচয় হয়েছিলো লিডারের একটি কাজ করতে গিয়ে। কয়েক বছর আগে তার লিডার নাজিমাবাদের এক লোকের পেছনে লেগে থাকার কাজ দিয়েছিলো-লোকটা কখন কোথায় যায়, কি করে, কার সাথে দেখা করে সব জেনে নিতে হবে। ঐ কাজটা অবশ্য সে একা করে নি। তাদের পার্টির এক বড়ভাই আসলাম খান আর সে মিলে এক সপ্তাহ ধরে লোকটার পেছনে লেগেছিলো। ওই সময়েও তার কাজ ছিলো গাড়ি চালানো, আর আসলাম যা যা দেখতো, জানতে পারতো তার সবকিছু টুকে রাখতো একটা কাগজে। তাদের কাজে লিডার খুব খুশি হয়েছিলো, বখশিসও দিয়েছিলো বেশ ভালো। তবে যে লোকটার পেছনে তারা লেগেছিলো তার খুন হবার খবরটি পত্রিকায় এসেছিলো কাজ শেষ হবার চারদিন পরই। করাচির ন্যাপিয়ের রোডের বেশ্যাপাড়ার এক ফ্ল্যাটের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় সে। টানা একসপ্তাহ লোকটার পেছনে লেগে থাকার কারণে নিহতের রক্তাক্ত মুখের ছবি দেখেও জাভেদের চিনতে একটুও ভুল হয় নি। খবরে আরো বলা হয়েছিলো, লং-রেঞ্জের রাইফেলের গুলিতেই খুন করা হয়েছে তাকে। সে জানে, ঐ সময় দক্ষ নিশানাবাজ সামাদ করাচিতেই ছিলো!
এ-ব্যাপারে আসলামকে জিজ্ঞেস করতে গেলে সে তাকে সতর্ক করে বলে এসব ব্যাপার নিয়ে কারো সাথে কথা বলার দরকার নেই। লিডার জানতে পারলে খুবই রাগ করবেন।
“জাভেদ!”
সম্বিত ফিরে পেয়ে পেছনে তাকিয়ে বললো সে, “জি, ভাই?”
“গাড়ি স্টার্ট দাও।” বাস্টার্ড দেখতে পেলো হামারটা গুলশান টাওয়ার থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। “ঐ যে কালো রঙের হামারটা…ওটাকে ফলো করতে হবে।”
“ওকে, ভাই।” জাভেদ গাড়িটা চালু করে পার্কিং এরিয়া থেকে বের হতে লাগলো।
দিনের আলো তিরোহিত হয়ে গেছে এতোক্ষণে, সন্ধ্যার অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে, তাই গাড়ির ভেতরে কে আছে সেটা দেখা গেলো না। হামারটি বেশ ধীরগতিতেই ভবন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো।
“খুব বেশি কাছ থেকে ফলো করার দরকার নেই…একটু দূর থেকে করলেও হবে।”
পেছনের সিট থেকে ইন্সট্রাকশন দিলে মাথা নেড়ে সায় দিলো জাভেদ। “বুঝেছি, ভাই।”
সামনের হামারটার দিকে চোখ রাখতে শুরু করলো বাস্টার্ড। গুলশান-এ ইকবাল টাউন থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা। অনেকটা পথ এগিয়ে বামদিকে মোড় নিতেই জাভেদকে বললো সে, “এটা কোন রাস্তা?”
“হাবিব মেট্রোপলিটান ব্যাঙ্ক রোড,” রাস্তার দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো। ছেলেটি।
জাভেদ খুব সুন্দরভাবে সন্দেহহী দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ি চালাচ্ছে। তার কাজটা সহজ করে দিচ্ছে পথের স্বল্পসংখ্যক যানবাহন। কিছুক্ষণ পর আবারো বামদিকে মোড় নিলো গাড়িটা।
“এটা?”
“ইউনিভার্সিটি রোড।”
আরেকটু এগোলে সাইন দেখে সামনের রাস্তাটার নাম জানতে পারলো সে। সুপারকো রোড। হামারটা সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে এখন।
“মনে হয় গুলজার-এ-হিজরি’তে যাচ্ছে,” জাভেদ বলে উঠলো। তার চোখ হামার থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরছে না।
রাস্তার দু-পাশে তাকালো বাস্টার্ড। চমৎকার সব বাড়ি। বেশিরভাগই ডুপ্লেক্স নয়তো তিনতলা। উঁচু ভবন খুব কম। দেখেই বোঝা যায় এটা ধনীদের এলাকা। মনে মনে খুশিই হলো সে। জায়গাটা বেশ নিরিবিলি আর ছিমছাম। লোকজন খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। নব্বইর দশকে ঢাকার গুলশান-বারিধারা আবাসিক এলাকার কথা মনে পড়ে গেলো তার। তবে গুলজার-এ-হিজরি আরো বেশি অভিজাত, আরো বেশি জমকালো বলে মনে হচ্ছে। চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা প্রায় ‘বেডরুম কমিউনিটি। লোজন রাতের বেলায় ফিরে আসে; ঘুমায়; তারপর সকাল হলেই যে যার কাজে চলে যায়।
দারুণ! মনে মনে বললো সে। কাজ করার জন্য ভালো জায়গা।
মওলানা ইউসুফের হামারটি একটি কর্নার প্লটের দ্বিতীয় বাড়ির সামনে এসে গতি কমিয়ে দিলো।
“এখন কি করবো?” জাভেদ রিয়ার-মিরর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে কোনো জবাব পেলো না। সে দেখতে পাচ্ছে তওফিক আহমেদ স্থিরচোখে চেয়ে আছে বাইরে। তার সেই চোখ দেখে বোঝার উপায় নেই সে কি ভাবছে।
“আরেকটু সামনে এগিয়ে রাস্তার পাশে রাখো,” অবশেষে মওলানার গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো।
বাস্টার্ড একটু অবাকই হচ্ছে বাড়িটা দেখে। এরকম কিছু আশা করে নি মোটেও। যে প্রশ্নগুলোর জবাব মনে মনে খুঁজছিলো তার কিছু জবাব পেয়ে গেলো।
কোথায় এবং কখন।
আর কিভাবে, সেটা নিয়ে তার মধ্যে কোনো দ্বিধা নেই।
অধ্যায় ২১
ইসমাইলসহ দলের পাঁচজনকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আবু মুজাহিদ ভীষণ কৌতূহলি হয়ে পড়েছে। ঘরে এখন যে পাঁচজন আছে তারা প্রায় সমবয়সি, আর যাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারা সবাই তাদের থেকে বয়সে বড়। বড়দের কেন আলাদা ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো?
মুজাহিদের মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু ঘরে এখন যারা আছে তাদের কারো কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যাবে না। সত্যি বলতে এদের সাথে তার তেমন কথাও হয় না। উসখুশ করতে থাকা মুজাহিদের দিকে তাকালো আবু আলী নামের এক ছেলে। ওকারা থেকে এসেছে সে। বয়সে মুজাহিদের চেয়ে এক-দু-বছরের বড়ই হবে, তবে সমবয়সি হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় নি।
“তুমি এমন ছটফট করছো কেন?”
আলীর প্রশ্নে কপাল কুচকে চেয়ে রইলো মুজাহিদ। “মানে? কি বলতে চাইছো?”
“ওরা ঘর থেকে চলে যাবার পরই তুমি পেরেসান হয়ে আছো…কেন?”
“বাহ্, ওদের আলাদা ডেকে নিয়ে গেলো কেন, এটা নিয়ে ভাববো না? তুমি ভাবছো না বুঝি?”।
“আমি এসব নিয়ে ভাবতে যাবো কেন?” আলী বেশ জোর দিয়ে বললো। “আমি আল্লাহর পথে নেমেছি। এসব বিষয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।”
মুজাহিদ চুপ মেরে গেলো।
“তোমাকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোনো।”
আলীর দিকে চেয়ে রইলো সে। ছেলেটার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়।
“এই পেরেসানি একটু কমাও। নইলে শাহাদাঁতের পথে ঠিকমতো এগিয়ে যেতে পারবে না।”
মুজাহিদের রাগ চড়ে গেলেও ছেলেটার কথার কোনো জবাব দিলো না। ইসমাইল ভাই ছাড়া নিজেকে তার বড় একা আর অসহায় লাগে। সেই ছেলেবেলা থেকেই তার জীবনটা অনাদরে, অস্থিরতায় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটেছে। ফলে এইসব জিনিস তার স্বভাবে ঢুকে পড়েছে। ইচ্ছে করলেও বাদ দিতে পারছে না। আশার কথা, খুব জলদিই তার জীবনটা পাল্টে যাবে। সে আর তুচ্ছ, অসহায়, চিরবঞ্চিত একজন থাকবে না। অনেক বড় মানুষ হয়ে যাবে। তার স্থান হবে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে! সব মুমিনের আজন্ম সাধনার বস্তু!
*
অবশেষে লোকটার ডেরা খুঁজে পাওয়া গেছে।
করাচির গুলজার-এ-হিজরি নামের আবাসিক এলাকার ৩ নাম্বার রোডের ২ নাম্বার বাড়িতে থাকে মওলানা ইউসুফ হোসাইনী। কিন্তু বাড়ির নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দেখে অবাকই হয়েছে মনে মনে।
জাভেদ বুঝতে পারছে তাওফিক আহমেদ তার উপরে বেশ সন্তুষ্ট। গাড়িটা সুন্দর করে ফলো করেছে সে, তারপর কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই বাড়ির খোঁজ পেয়ে গেছে।
তাদের গাড়িটা এখন গুলজার-এ-হিজরির ঐ বাড়ি থেকে একটু সামনে এগিয়ে রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা।
“চলো, হোটেলে ফিরে যাই,” আস্তে করে বললো বাস্টার্ড।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জাভেদ ইগনিশানে চাবি ঘোরালো। গাড়িটা ইউ টার্ন করে আবার ফিরে যেতে শুরু করলো হোটেল সামুনাবাদে।
গাড়িটা চলতে শুরু করলে বাস্টার্ডের মাথায় কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো। মওলানা ইউসুফ একজন সাধারণ নাগরিক, একটি ইসলামিক এনজিও চালায়। তার সমস্ত পাপ বারো শ’ মাইল দূরে জন্মভূমিতে ফেলে এসেছে ছত্রিশ-সাইত্রিশ বছর আগে, অথচ তার বাড়িটা দূর্গের মতোই সুরক্ষিত!
কেন?
প্রায় দশ-বারো ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। সেই দেয়ালের উপরে আবার তিনফুটের মতো কাঁটাতারের বেষ্টনি। সেই বেষ্টনির প্রায় পুরোটাই অর্কিডের সবুজ পাতায় ঢাকা। মেইনগেটটা যেমন বিশাল তেমনি ভারি। বড় গেটের বামদিকে মানুষজন চলাচলের জন্য তিন-চার ফুট চওড়া আরেকটি গেট আছে। তার চেয়েও বড় কথা মেইনগেটটা আট-নয় ফুটের মতো উঁচু। উপরের দিকটা আবার তিন-চার ফুটের মতো কাঁটাতারের বেষ্টনি, এবং একই রকম অর্কিডে ঢাকা। ফলে গেটের ওপাশে কি আছে সেটা বাইরে থেকে দেখার কোনো উপায় নেই। এর অর্থ বাড়ির চারপাশে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। সে আরো ধারণা করলো, বেশ কয়েকটি সিসিক্যাম আছে। বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে। তবে কুকুর না-থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কট্টরপন্থী ওয়াহাবি মতবাদে বিশ্বাসী লোকজন বাড়িতে কুকুর রাখবে না। তার বদলে হয়তো অন্য কিছুর ব্যবস্থা করবে।
কিন্তু কথা হলো, এতোটা সুরক্ষার দরকার পড়লো কেন?
মওলানা ইউসুফ হোসাইনী নিজের বাড়িটাকে কেন এরকম দূর্গ বানিয়ে রেখেছে সেটা কোনোভাবেই তার বোধগম্য হচ্ছে না। তবে ঘটনা যা-ই হোক একবার যখন মওলানার নাগাল পেয়ে গেছে মিশন শেষ না করে ফিরে যাবে না। বাড়িটার খোঁজ পাবার আগে খুন করার স্থান আর সময় নিয়ে নিশ্চিত ছিলো না মোটেও।
গুলজার-এ-হিজরি থেকে হোটেল সামুনাবাদ গাড়িতে করে গেলে মাত্র পনেরো মিনিটের পথ। জায়গাটা তার হোটেলের কাছাকাছি হওয়াতে একদিক থেকে সুবিধাই হলো।
হোটেলের কাছে আসতেই অনেকক্ষণ পর কথা বলে উঠলো জাভেদ। “আজকে আর কোথাও যাবেন, ভাই?”
“না।”
“তাহলে আগামিকালের কাজ কি?”
একটু ভেবে জবাব দিলো সে, “কাল সকালের দিকে কোনো কাজ নেই। বিকেলের পরে গাড়িটা লাগবে আমার। বিকেল থেকে রাত সাতটা-আটটা পর্যন্ত।”
“ঠিক আছে।”
“তুমি সাইলেন্সারটা কিনে ফেলতে পারো কাল বিকেলের মধ্যে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। “ওকে। আর জিনিসটা?”
বাস্টার্ড বুঝতে পারলো পিস্তলের কথা বলছে সে। “ওটা কি আগামীকাল সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবে?”
“পারবো।”
“কোনো সমস্যা হবে না? পথে পুলিশ চেকিং হয় যদি?”
“আমি ওটা গাড়ির এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখবো যে ওরা খুঁজেও পাবে। এ নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না,” আশ্বস্ত করে বললো জাভেদ।
“গুড।”
“সাইলেন্সারের জন্য কতো দিতে হবে?”
“এখন কিছু দিতে হবে না। আমি জিনিসটা কিনে আনি তারপর দাম দিয়েন,” একটু হাসলো সে। “আসলে এই জিনিস কখনও ইউজ করি নি…কেনা তো দূরের কথা, তাই দাম জানা নাই আমার। তবে মার্কেটে এরকম জিনিস দেখেছি।”
কথাটা শুনে খুশিই হলো বাস্টার্ড। আজকের পর থেকে যেকোনো দিন সুযোগ চলে আসতে পারে, সেজন্য তাকে পুরোপুরি প্রস্তত থাকতে হবে। এখন হোটেলে ফিরে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে কোথায় এবং কিভাবে কাজটা করলে সবচেয়ে ভালো হয়।
জাভেদকে বিদায় দিয়ে সোজা হোটেলের রুমের দিকে পা বাড়ালো সে।
অধ্যায় ২২
করাচির চতুর্থ দিনটি শুরু হলো সুন্দরভাবেই। সকাল থেকেই রোদ আর শীতের প্রকোপ একটু কম। জিন্স প্যান্ট, সাদা শার্ট, কালো লেদারের জ্যাকেট আর চোখে সানগ্লাস পরে বাইরে বের হলো সে। জাভেদকে ছাড়াই একা একা পায়ে হেঁটে শহরের কিছু অংশ ঘুরে দেখলো। দুপুরের খাবার খেলে করাচি ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি একটি রেস্টুরেন্টে। ওখান থেকে কিছুটা পথ হেঁটে গুলজার-এ-হিজরি’তে চলে গেলো। শহরের পথঘাট আর জায়গাগুলো তার চিনে রাখা দরকার। গাড়িতে বসে থেকে কোনো শহরের রাস্তাঘাট আর এলাকা সহজে মনের মধ্যে গেঁথে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভালো পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখলে।
গতকাল কিভাবে মওলানার বাড়ির সামনে চলে এসেছিলো সেটা তার মনে আছে। তিন নাম্বার রোডের দুই নাম্বার বাড়ি। গুলজার-এ-হিজরি’তে ঢুকে খুব সহজেই পৌঁছে গেলো সেখানে।
মওলানার বাড়িটা বাইরে থেকে সামান্য অংশও দেখার উপায় নেই। রাস্তার ওপাড়ে গিয়ে একটু দূর থেকে দেখার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। মেইনগেটের ভেতরে বেশ বড় বড় গাছ সীমানা প্রাচীর ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। গাছগুলোর ডালপালা এমনভাবে ছেয়ে আছে যে ফাঁক-ফোকর দিয়ে শুধু একটা দালানের কিছু অংশ চোখে পড়ে। বাড়িটার দু-পাশ থেকে কিছু দেখারও উপায় নেই। দু-দিকে দুটো বাড়ি। সীমানা প্রাচীরের উচ্চতা আর গাছের আধিক্য থাকার কারণে পাশ থেকেও কিছু বোঝা গেলো না। তবে ধারণা করলো বাড়িটা বেশ বড়।
বাস্টার্ড খুব সতর্ক থাকলো একটা ব্যাপারে। বেশিক্ষণ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নজরদারি করলে সন্দেহের সৃষ্টি হবে, তাই ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ালো সে। যদিও সানগ্লাসের আড়ালে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বাড়িটাকেই দেখে গেলো। হেঁটে হেঁটে বাড়িটার পেছনের রাস্তায় চলে গেলেও যথারীতি হতাশ হলো। মওলানার বাড়ির পেছন দিকে আরেকটা বাড়ি আছে। সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েও কিছু দেখতে পেলো না, কারণ এই বাড়িটি আশেপাশে হাতেগোনা কিছু অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের একটি। গুনে দেখলো ভবনটি আটতলা উঁচু।
ওখান থেকে আর মওলানার বাড়ির সামনে ফিরে না গিয়ে গুলজার-এ হিজরি থেকে বের হয়ে এলো বাস্টার্ড।
বিকেল চারটার পর পায়ে হেঁটেই হোটেল সামুনাবাদ ফিরে এলো। বেশখানিকটা হাটাহাটি করে একটু ক্লান্ত হয়ে গেছে। ঠিক করলো পাঁচটা পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে, তারপর আবার জাভেদকে নিয়ে চলে যাবে মওলানার বাড়ির সামনে। হোটেল রুমে ফিরে এসে ভাবতে লাগলো, আসন্ন রেকিটা কিভাবে করলে কারো চোখে সন্দেহ সৃষ্টি করবে না।
একটা রিকন্ডিশান প্রাইভেটকার। দু-জন যুবক। কারোর বাড়ির সামনে পথের পাশে দু-তিন ঘণ্টা পার্ক করে রাখলে কি কি সমস্যা হতে পারে?
নিজে নিজেই জবাব খুঁজতে লাগলো সে।
আবাসিক এলাকার কোনো উৎসুক লোকের চোখে পড়তে পারে এটা। টহল পুলিশ থাকলে তাদের চোখেও পড়বে হয়তো। সেক্ষেত্রে জবাবটা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা দরকার। কিন্তু কি জবাব দেবে? ঘোরাঘুরি করছে? আবাসিক এলাকায়? দু-তিনঘণ্টা ধরে?
না। এটা যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা হবে না। তারা যা-ই বলুক, ওখানে যদি তাদের কোনো পরিচিত লোক না থাকে, সত্যি সত্যি কারো সাথে দেখা করতে না গিয়ে থাকে তাহলে কোনো বানোয়াট কথাই ধোপে টিকবে না। এই ব্যাপারটা নিয়ে জাভেদের সাথে কথা বলতে হবে। সমস্যা দেখা দিলে দু জনকে একই কথা বলতে হবে। দু-জনের কথা দু-রকম হলেই বিপদ।
বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে ছাদের দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। সে জানে ব্যাখ্যাটা হতে হবে সহজ আর সাধারণ। জটিলতার ভাঁজে ভাঁজে থাকে সন্দেহ। একটু পর জাভেদ চলে এলে তারা বেরিয়ে পড়বে আবার। কিন্তু তার আগেই এই প্রশ্নের সহজ একটি জবাব জেনে নিতে হবে।
এভাবে ভাবতে ভাবতে কখন যে সময় গড়িয়ে গেলো টেরই পেলো না। জাভেদের ফোনকল তার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটালে বুঝতে পারলো বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠে শুধু জুতোটা পরে নিলো। রুমে ঢোকার পর পোশাক পাল্টায় নি। একই বেশে বেরিয়ে পড়লো আবার।
নীচে নেমে দেখলো সামুনাবাদ হোটেলের বাইরে জাভেদ অপেক্ষা করছে। ছেলেটা প্রচুর সিগারেট খায়। গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে উদাস হয়ে সিগারেট টানছে। তাকে আসতে দেখে নিঃশব্দে হাসি দিলো।
“খোশখবর আছে, ভাই,” সিগারেটে টান দিতে দিতে বললো সে। প্যাসেঞ্জার ডোরটায় হাত রেখে জানতে চাইলে বাস্টার্ড, “ওটা কিনেছো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। সিগারেটটা ফেলে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। বাস্টার্ডও ঢুকে পড়লো গাড়ির ভেতরে। “দেখবেন নাকি?”
“এখানে?”
“সমস্যা কি?” মাথা দোলালো সে। “গাড়ি চালাও…যেতে যেতে দেখে নেবো।”
মুচকি হেসে গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো জাভেদ। “কোথায় যাবেন? ওখানে?”
হুম।”
তাদের গাড়িটা চলতে শুরু করলো। তার হোটেল থেকে গুলজার-এ হিজরির দূরত্ব মাত্র পনেরো মিনিটের। করাচির এই অংশে তেমন একটা
ট্রাফিক জ্যামও নেই যে সময়টা বেশি লাগবে।
“করাচিতে তেমন ট্রাফিক জ্যাম দেখলাম না…ঘটনা কি?”
“এখানে জ্যাম খুব একটা নেই। এটা বড়লোকদের এলাকা। বাকি শহরে। জ্যাম আছে।”
বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। বিশাল এই শহরের সবচেয়ে ভালো অংশে আছে তারা। এখন পর্যন্ত নোংরা করাচি দেখার সুযোগ হয় নি। হবেও যে তার কোনো সম্ভাবনা দেখছে না।
“আচ্ছা, ওখানে যদি দু-তিন ঘণ্টার জন্য রাস্তার পাশে গাড়ি রাখি তাহলে লোকজন সন্দেহ করবে না?”
রিয়ার-মিররে তাকালো জাভেদ। দু-তিন ঘণ্টার কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছে। “সন্দেহ করবে কেন? আমরা তো কিছু করবো না। নাকি?”
“হুম, শুধু গাড়িতে বসে থাকবো। হয়তো একটু এদিক ওদিক হাটাহাটিও করবো।”
কাঁধ তুললো জাভেদ। “তাহলে প্রবলেম কি?” ..
“ওটা রেসিডেন্সিয়াল এলাকা…কারোর বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাখলে পুছতাছ করতেই পারে।”
“আমার মনে হয় না কেউ কিছু করবে। বড়লোকেরা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। ওরা নিজেদের গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়িতে ঢুকে পড়ে…বাইরে কি হলো না হলো সে-সব নিয়ে ওদের কোনো পরোয়া নেই।”
বাস্টার্ড জানে জাভেদ ঠিকই বলেছে কিন্তু খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকারও দরকার আছে। “ধরো, পুলিশ কিংবা অন্য কেউ যদি আমাদের কাছে এসে জানতে চায় আমরা ওখানে কি করছি…তখন?”
একটু ভেবে বললো জাভেদ, “নো প্রবলেম। বলবো, আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে।”
কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলো সে। কতো সহজ সমাধানই না বের করে ফেললো ছেলেটা। দারুণ!
“এটা বললে কাজ হবে না?”
“আলবৎ হবে।” জোর দিয়ে বললো বাস্টার্ড। যে কারোর গাড়ি যেকোনো জায়গায় বিগড়ে যেতে পারে। এরকম সহজ-সরল আর যৌক্তিক সমাধানে মুগ্ধ সে। এটা তার মাথায় আগেই আসা উচিত ছিলো।
“তবে আমার মনে হয় কেউ কিছু জানতে চাইবে না।”
জাভেদের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“ওটা কি এখন দেখবেন?”
করাচি ইউনিভার্সিটি রোডটা বেশ নিরিবিলি, তাদের গাড়ি এখন সেই পথ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে।
“ওকে।”
ডানহাতে স্টিয়ারিং ধরে বামহাতে গাড়ির সিটের নীচ থেকে পুরনো পত্রিকার কাগজে মোড়া একটি প্যাকেট বের করে আনলো। “এই যে…” সাইলেন্সার আকৃতির প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলো বাস্টার্ডের দিকে।
জিনিসটা হাতে নিয়ে কাগজটা খুলে দেখলো সে। রাশিয়ার তৈরি ‘স্ত্রিৎজ’ সাইলেন্সার। একটু পুরনো। তবে তাতে কিছু যায় আসে না, কাজ করলেই হলো।
“ঠিক আছে।” আবারো কাগজে মুড়িয়ে রাখলো জিনিসটা। “রেখে দাও।”
একটা হাত পেছনে বাড়িয়ে জিনিসটা নিয়ে নিলো সে। রেখে দিলো আগের জায়গায়। এখানেই রাখলাম। সমস্যা হবে না। করাচির এইসব এলাকায় পুলিশ চেক-আপ খুব একটা হয় না।”
গুড। মনে মনে বলে উঠলো বাস্টার্ড। তার কাজের জন্য বাড়তি একটি সুবিধা!
অধ্যায় ২৩
এশার নামাজ পড়ে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। বিশ্রাম বলতে নিজেদের ঢালা বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া। নীচুকণ্ঠে কথা বলছে কেউ কেউ, তবে দু-একজন কারো সাথে কোনো রকম আলাপে মশগুল নেই। তাদের এই কনডেম-সেলে করার মতো কিছু নেইও। তাই নামাজ পড়া আর বুজুর্গের মাসালা শোনার পর কিছুই করার থাকে না। অনেকে কোরান তেলাওয়াত করে সময় কাটায়। কেউ কেউ জিকরও করে। কিন্তু মুজাহিদ আর ইসমাইল এসব করে না। আজো তারা পাশাপাশি শুয়ে আছে। ইসমাইলের চোখ আবছা-অন্ধকার সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ কিন্তু তার বামপাশের বিছানায় শোয়া মুজাহিদ পাশ ফিরে চেয়ে আছে তার দিকে।
“ভাইজান, বললেন না তো?…” প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো মুজাহিদ।
ইসমাইল ছাদের দিকে চেয়েই বললো, “কি বলবো?”
“ঐ যে, আপনাদের কেন ডেকে নিয়ে গেলো?”
“কাজ ছিলো তাই ডেকে নিয়ে গেছে, কাটাকাটাভাবে জবাব দিলো সে।
“কি কাজ?”
ইসমাইল যেনো জানতো এরপর এই প্রশ্নটাই করা হবে। আমরা যেটা করতে যাচ্ছি।”
মুজাহিদ চুপ মেরে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু সে দমে যাবার পাত্র নয়। তাহলে সবাইকে ডাকলো না কেন?”
কী বলবে বুঝতে পারলো না ইসমাইল। পাঁচজন সিনিয়রকে যে আলাদা করে অপারেশনের ব্যাপারে বিস্তারিত বলা হচ্ছে এটা বাকি পাঁচজন জুনিয়রকে বলা যাবে না-এমনটাই বলেছে বুজুর্গ।
“আমাকে জিজ্ঞেস না করে বুজুর্গকে করবি, কেন সবাইকে একসঙ্গে ডাকা হলো না, ঠিক আছে?”
“এটা তো বুজুর্গকে বলা যাবে না।”
“কেন?”
“উনি রাগ করবেন।”
“তাহলে আমাকে বলছিস কেন?”
“আপনি তো রাগ করবেন না। নিরবে হাসলো মুজাহিদ।
“আমিও রাগ করেছি। তোর এইসব প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না। কয়েকটা দিন যাক, সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবি। একটু ধৈর্য ধরে ইনতেজার কর,” একটু থেমে আবার বললো সে, “ইন্নালাহ্ মা সোয়াবেরিন। বুঝলি?”
মুজাহিদকে দেখে মনে হলো না সে কিছু বুঝেছে।
“আল্লাপাক ধৈর্যশীলদের সঙ্গে থাকেন।”
পাঞ্জাবের ফরিদকোটের ছেলেটি চুপ মেরে গেলো। তার ধৈর্য বলতে গেলে নেই-ই। তাহলে কি আল্লাহ তার সঙ্গে থাকবেন না?
*
তিনঘণ্টা প্রায় হতে চললো কোনো ফলাফল নেই। মওলানা ইউসুফ হোসাইনীর বাড়ি থেকে একটু সামনে এগিয়ে ইউ-টার্ন করে রাস্তার বিপরীত দিকে গাড়িটা পার্ক করে রাখা হয়েছে। সামনের বাম দিকেই রয়েছে সুরক্ষিত বাড়িটি। ওটার মেইনগেটের ঠিক বিপরীতে পার্ক করা হয় নি ইচ্ছে করেই। তাতে হয়তো সন্দেহজনক বলে মনে হতো। তবে জাভেদের কথাই সত্যি। গুলজার-এ-হিজরি এলাকার কোনো প্রাণী এসে তাদের কাছে জানতে চায় নি। কেন তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে বসে আছে-কি তাদের উদ্দেশ্য। এই ব্যাপারটা নিশ্চয় স্বস্তির, কিন্তু বাস্টার্ডের কাছে নয়। রেকি করার প্রথম দিনটা পুরোপুরি হতাশাজনক। তারা এখানে আসার পর থেকে একটা গাড়িও ভেতরে ঢোকে নি, বাড়ি থেকেও কোনো গাড়ি বের হয়ে যায় নি।
জাভেদের দিকে তাকালো। ছেলেটা বহুকষ্টে চুপ মেরে আছে। একটু আগে দশ মিনিটের জন্য ছুটি দিয়েছিলো তাকে। ঐ সময়টা হাটাহাটি করে, সিগারেট খেয়ে কাটিয়েছে। বিরক্ত হলেও মুখ ফুটে কিছু বলছে না।
“আর মাত্র আধ-ঘণ্টা থাকবো, ওকে?”
পেছনের সিটের দিকে ফিরে তাকালো জাভেদ। “নো প্রবলেম, ভাই।”
বাস্টার্ড কিছু বললো না। আজকের দিনটা হতাশার হলেও সে জানে রেকি করাটা খুবই ধৈর্যের কাজ। কঠিন একাগ্রতা নিয়ে লেগে থাকার মতো গুণাবলী যাদের আছে তারাই এ কাজে সফল হয়। যেকোনো মানুষকে কয়েকটা দিন নজরদারিতে রাখলে, তার গতিবিধি, চাল-চলন আর লাইফ-স্টাইল পর্যবেক্ষণ করলে দুর্লভ তথ্য পাওয়া যায়। মওলানা ইউসুফ সম্পর্কে খুব কম তথ্য আছে তার কাছে। লোকটার সন্তান-সন্ততি কয়জন, স্ত্রী বেঁচে আছে কিনা, বাড়িতে কতোজন লোক বসবাস করে, এসব কিছুই জানে না, তবে এগুলো যে খুব জরুরি তাও নয়। আসলে এখানে রেকি করার উদ্দেশ্যটা খুবই সহজ-সরল : মওলানা প্রতিদিন সাধারণত কয়টার দিকে অফিস থেকে বাসায় ফেরে, সঙ্গে কে কে থাকে-এটা জানাই বেশি জরুরি।
এই বাড়ির সুকঠিন নিরাপত্তা দেখার পরই সে ঠিক করেছে মেইনগেটের সামনেই অ্যাম্বুশ করবে। যেহেতু জায়গাটা খুবই নিরিবিলি, লোকজনও খুব কম, তাই প্রকাশ্যে কোনো গানম্যান গুলি করে খুব সহজেই সটকে পড়তে পারবে। বিশেষ করে গাড়িটা যে মুহূর্তে গেটের সামনে চলে আসবে তখনই অতর্কিতে গুলি চালিয়ে হত্যা করাটা সহজ হবে, কিন্তু সেটা করতে হলে তাকে আগে নিশ্চিত হতে হবে গাড়ির ভেতরে মওলানা ইউসুফ রয়েছে। কালো কাঁচের কারণে গতকাল গাড়ির ভেতরে কে ছিলো দেখতে পায় নি, তাই নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই ঐ হামারে করে মওলানাই বাড়িতে ফিরেছিলো। আন্দাজে চান্স নিয়ে কাজ করাটা তার পদ্ধতি নয়। তাকে আগে নিশ্চিত হতে হবে। শতভাগ নিশ্চিত না-হয়ে পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া তো দূরের কথা, দ্বিতীয়বারের মতো মওলানার ধারে-কাছেও যাবার ইচ্ছে নেই। সে চায় না শিকার টের পেয়ে যাক তার পেছনে শিকারি লেগেছে।
হাতঘড়িতে সময় দেখলো। রাত সাড়ে আটটা। যথেষ্ট হয়েছে। এখানে বসে থেকে আর কোনো লাভ নেই।
“চলো…হোটেলে ফিরে যাই।”
কথাটা শুনে আবারো পেছনে ফিরে তাকালো জাভেদ। “চলে যাবো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“ওকে।” ওদের গাড়িটা গুলজার-এ-হিজরি থেকে বের হতে শুরু করলো।
“রাতে কোথায় খাবেন?” পেছনে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো জাভেদ।
“তুমিই বলো, কোথায় খাওয়া যায়?”
“করাচিতে স্ট্রিট-ফুড খুব ভালো হয়…খাবেন নাকি? দামও কম, স্বাদও বেশ ভালো।”
কাঁধ তুললো সে। “ঠিক আছে। চলো তাহলে।” তাদের গাড়িটা ইউনিভার্সিটি রোডের দিকে চলে যাচ্ছে।
“করাচিতে কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত মানুষ ঘুরে বেড়ায়।” গাড়ি চালাতে চালাতে বললো জাভেদ।
“হুম, তা তো দেখলামই।”
“আসলে দিনের চেয়ে রাতের করাচিই বেশি সুন্দর।”
মুচকি হাসলো সে। কথাটা মিথ্যে নয়।
রিয়ার-মিরর দিয়ে পেছনের সিটের যাত্রির দিকে তাকিয়ে বললো ছেলেটি, “ভাই কি ডিসকো’তে যাবেন?”
“ডিসকো? এখানে?!” দারুণ অবাক হলো সে, কারণ দেশটার নাম পাকিস্তান।
মুখ টিপে হাসলো জাভেদ ওয়ার্সি। “আগেই বলেছি, করাচি আপনাকে তাজ্জব করে দেবে।”
“সত্যি কি ডিসকো আছে এখানে?” বাস্টার্ডের যেনো বিশ্বাসই হচ্ছে না। ঢাকা শহরেই বৈধ ডিসকো বলে কিছু নেই। গোপনে কিছু ডিসকো-নাইটক্লাব চলে, তবে ওগুলোর খোঁজ খুব কম মানুষই জানে। আর করাচির মতো শহরে ডিসকো? তাও জাভেদের মতো স্বল্পশিক্ষিত একজন তার খোঁজ জানে!
ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন অবিশ্বাস্য লাগছে।
“আছে মানে,” জাভেদ বললো। মনে হচ্ছে খুব মজা পাচ্ছে সে, “কয়টাতে যেতে চান?”
বাস্টার্ডের ভুরু কপালে উঠে গেলো। “কয়টা মানে?”
মুখ টিপে হাসলো ছেলেটি। “আছে তো অনেকগুলোই, তবে আমি চিনি কেবল একটা।”
“এখানে যে ডিসকো আছে এটা কি মোল্লা আর তালিবানরা জানে?”
“আলবৎ জানে।”
“বলো কি?”।
মনে হলো বাস্টার্ডকে অবাক করে দিতে পেরে জাভেদ ছেলেটা দারুণ মজা পাচ্ছে।
“আমার কথা বিশ্বাস না-হলে চলেন, একটু ঘুরে আসি। দারুণ অভিজ্ঞতা হবে আপনার।”
“এখনই যেতে চাইছো?”
“হুম। ওগুলো তো রাতেই ওপেন হয়। এই তো…আর একটু পরই জমে উঠবে।”
একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেও প্রচণ্ড কৌতূহলের কারণে সে রাজি হয়ে গেলো। “ওকে, চলো তবে।”
জাভেদ ওয়ার্সি চওড়া হাসি দিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলো। “পোের্ট গ্র্যান্ডের স্ট্রিট-ফুডের খুব কাছেই…বিচের দিকে…এক কাজে দুই কাজ হয়ে যাবে।”
“ওরা কি আমাদের ঢুকতে দেবে?”
“আরে ভাই, আমি আছি না,” জাভেদের বুকটা যেনো ফুলে উঠলো। “এ নিয়ে কেননা টেনশনই করবেন না।”
বাস্টার্ড বুঝতে পারলো ছেলেটা সম্ভবত প্রায়শই ডিসকোতে যাওয়া-আসা করে। “ওখানে রেগুলার যাও নাকি?”
“আরে না,” লজ্জিত ভঙ্গিতে বললো সে। “আমার এক ভাই কাজ করে ওখানে…ওর সাথে দেখা করতে যাই মাঝেমধ্যে।”
“ও।” আর কিছু বললো না সে। করাচি তাকে তাজ্জব করবে!? মনে মনে বলে উঠলো, ঠিক আছে, দেখা যাক কতোটা তাজ্জব করতে পারে।
অধ্যায় ২৪
আরব-সাগরের তীরে করাচি বিচের খুব কাছে একটি অভিজাত এলাকায় ঢুকে পড়লো জাভেদ ওয়ার্সির গাড়ি। পেছনের সিটে বসে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে বাস্টার্ড। জায়গাটা বেশ জমকালো। সম্পদশালীদের একটি এলাকা, তাই খুব সহজেই চোখে পড়ে প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্য। পথেঘাটে যেসব লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের বেশভুষাও বলে দিচ্ছে এখানে যারা থাকে তারা বেশ ধনী, করাচির সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ। পোর্ট গ্র্যান্ড থেকে দেখেছে লোকজনের পোশাক আধুনিক হতে হতে ক্রমশ ‘ফিল্মি’ হয়ে যাচ্ছে। ছেলেদের প্যান্ট শর্টসে পরিণত হচ্ছে, আর মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ বদলে যাচ্ছে প্যান্ট শার্ট আর স্কার্টে। প্রচুর বিদেশী টুরিস্টও ঘুরে বেড়াচ্ছে। করাচির রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছে তারা।
নিরিবিলি রাস্তায় ঢুকে চমৎকার একটি বাড়ির সামনে এসে থামলো তাদের গাড়িটা।
“এসে গেছি, ভাই,” জাভেদ সহাস্যে বলে উঠলো।
গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটার দিকে তাকালো সে। তিনতলা একটি বাড়ি। সম্ভবত প্রথমবার নির্মাণের সময় ডুপ্লেক্স ছিলো, পরে বাড়তি একটি ফ্লোর যোগ করা হয়েছে। মেইনগেটের সামনে যে দু-জন যুবক দাঁড়িয়ে আছে তাদের দেখে দারোয়ান বলে ভুল করার কোনো কারণই নেই। পরনে লেদার জ্যাকেট আর জিন্সপ্যান্ট। একজনের কানে আবার রিং। দু-জনেই চুইংগাম চিবোচ্ছে।
“চলুন,” জাভেদ তার বাহুটা আলতো করে ধরে বললো।
মেইনগেটের সামনে এসে জাভেদ ঐ যুবকের সাথে উর্দুতে নীচু গলায় কিছু বললে তারা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চকিতে বাস্টার্ডের দিকে তাকালো, চাপাস্বরে কিছু কথাও বললো।
“আসুন, ভাই,” কয়েক মুহূর্ত পর তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো জাভেদ।
যুবকদের একজন মেইনগেট খুলে দিলে জাভেদের সাথে ঢুকে পড়লো সে। ছোট্ট একটা লন আর ড্রাইভওয়ে পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো তারা। কানে শুনতে পেলো ডান্সবিটের ভোতা শব্দ। শুধু ড্রামসের আওয়াজটাই ভেসে আসছে। বাড়িটার আরো ভেতরে যাবার আগে ছোট্ট একটা ডেস্কের সামনে দাঁড়ালো জাভেদ। বাস্টার্ডকে টাকা বের করার ইশারা করলো সে। গাড়িতেই বলেছিলো, এখানে ঢোকার এন্ট্রি মাথা প্রতি তিন-হাজার রুপি। তবে এখানে যেহেতু ওর ভাই কাজ করে তাই ওর জন্য কোনো টাকা দিতে হবে না।
তিনহাজার রুপি দেবার পর তারা দু-জনে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে। একটি আলো-আধারি হলওয়ে দিয়ে চলে গেলো বাড়িটার পেছন দিককার দোতলায়। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই টের পেলো মিউজিকের শব্দ প্রকট হয়ে উঠেছে। একটা দরজা খুলে দিতেই ডিসকোথেক লাইটের বিচ্ছুরণ আর চড়া ভলিউমের ডান্সবিট তাদের দু-কান চেপে ধরলো।
বিশাল এক ফ্লোরে শ-খানেক নারী-পুরুষ দ্রুতলয়ের সঙ্গিতের তালে তালে উন্মাতাল হয়ে নাচছে। কোনোদিকে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। বাদামি চামড়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছু সাদা চামড়াও চোখে পড়লো। সত্যিকার অর্থেই তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড। এটা তার জন্য এক ধরণের কালচারাল শকই বটে!
জাভেদ কোনো কথা না বলে হাসি-হাসি মুখে তাকালো তার দিকে। যেনো তাকে চমকে দিতে পেরে খুব মজা পাচ্ছে। “করাচির সবচেয়ে ফেমাস ডিসকো!” চড়া সঙ্গিতের সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করে বললো সে।
বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলতে পারলো না বাস্টার্ড। অনেক দেশের নাইটক্লাব-ডিসকো দেখেছে কিন্তু পাকিস্তানের কারাচিতে এমন জিনিস দেখে তাজ্জব না-হয়ে পারলো না। বিশাল ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লোকজন। একপাশে ডিজে’র দল কানে ইয়ারফোন চাপিয়ে মিউজিক নিয়ে ব্যস্ত। ঘরের দু-দিকে বসার জন্য কিছু সোফা আর চেয়ার রয়েছে। ওখানে বসে বসে লোকজন বিয়ার আর মদ খাচ্ছে। প্রায় কারোর হাতই খালি নেই। ফ্লোরে গিয়ে উন্মত্ত হয়ে নাচছে, ক্লান্ত হয়ে আবার ফিরে আসছে সোফায়, চেয়ারে। বিয়ার-মদ পান করে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে আবার চলে যাচ্ছে উন্মাতাল ফ্লোরে।
আরো অবাক করার ব্যাপার হলো, নারী-পুরুষের দেহজ ভঙ্গি খুবই খোলামেলা। একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে, আদর করছে, নেচে বেড়াচ্ছে। কারোর দিকে কেউ তাকিয়েও দেখছে না। বড়লোকের কিছু প্লেবয় ছেলে একসঙ্গে দু-দুজন যুবতী বগলদাবা করে মুদ্রাবিহীন নাচ নেচে যাচ্ছে। ঝলমলে আলোতে আরো দেখতে পেলো ছেলে-ছেলে আর মেয়ে-মেয়েতেও চলছে এসব। তবে এখানে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিটি খুব সহজেই তার নজর কাড়লো। তাকে ঘিরে আছে কমপক্ষে পাঁচ-ছয়জন তরুণী! যেনো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা করছে কে কার আগে জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে।
মুচকি হাসলো সে।
“এ হলো আমাদের ফেমাস আলী!” তার কানের কাছে মুখ নিয়ে জাভেদ বললো। এদিকে আসুন, ভাই।”
তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ঘরের অন্য মাথায়। ঘরের এদিকটায় মদ আর বিয়ার বিতরণ করা হচ্ছে। লোকজন ছোট্ট একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে হাতে বিয়ার-মদের বোতল আর গ্লাস নিয়ে। তাকে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে পড়লো জাভেদ।
“ইয়াসিন?” আমুদেকণ্ঠে ডেকে উঠলো সে।
জিন্সপ্যান্ট আর টি-শার্ট পরা মাঝারিগোছের এক যুবক কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মেঝেতে রাখা বিয়ারের ক্যানের দিকে গভীর মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে সে। চমকে মুখ তুলে তাকাতেই হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
“আরে, ওয়ার্সিসাব দেখি!” জাভেদের দিকে এগিয়ে এসে জাপটে ধরলো তাকে। “কি অবস্থা?”
“এই তো…চলছে,” আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে বললো জাভেদ।
“হঠাৎ এখানে? অনেকদিন পর এলে…”
“এক মেহমানকে নিয়ে এলাম তোমাদের হেরেমখানা দেখাতে,” পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বাস্টার্ডকে দেখিয়ে বললো সে। “এ হলো তওফিক ভাই…লন্ডন থেকে এসেছে…আমার লিডারের আত্মীয়।” তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দিলো সে।
ইয়াসিনের দিকে হাত বাড়ালো বাস্টার্ড।
“উর্দু জানেন?” করমর্দন করতে করতে বললো ইয়াসিন।
মাথা ঝাঁকালো সে। “একটু আধটু…বলার মতো না।”
জাভেদ হেসে বললো, “তওফিক ভায়ের উর্দু শুনলে তোমার মনে হবে উনি হিন্দিতে কথা বলার চেষ্টা করছেন।”
হাতটা ছেড়ে দিয়ে হেসে ফেললো ইয়াসিন। “হিন্দি সিনেমার কারণে এটা হয়েছে। আমার বড়বোনের ছেলেমেয়েরা থাকে কানাডায়…ওরা হিন্দি সিনেমা দেখে দেখে হিন্দিটা ভালোই পারে কিন্তু উর্দু তেমন একটা পারে না।”
কিছু বললো না বাস্টার্ড।
“শোনো, আমি তো এখন ব্যস্ত আছি, তোমরা ফ্লোরে গিয়ে এনজয় করো। তওফিক ভাইকে একটু পান করাও। পরে কথা হবে, ঠিক আছে?”
“ওকে,” ইয়াসিনের পিঠে চাপড় মেরে বললো জাভেদ।
তারা আবারো চলে এলো ফ্লোরে।
“নাচবেন নাকি?”
মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো বাস্টার্ড। প্রশ্নই ওঠে না।
“তাহলে চলেন, বসে বসে সরবত খাই আর তামাশা দেখি।”
মুচকি হাসলো সে। “চলো।”
ঘরের এককোণে একজোড়া খালি সোফায় বসে পড়লো তারা। একের পর এক মিউজিক বাজছে আর তার তালে তালে নেচে উঠছে সবাই। “ইয়াসিন কি হয় তোমার?…বন্ধু?”
“বন্ধু এবং আত্মীয় দুটোই। আমরা একই এলাকায় থাকি।” তারপরই সে উঠে দাঁড়ালো। “আপনি বসেন, আমি ড্রিঙ্কস নিয়ে আসছি। আপনি তো ঐ সরবতই খাবেন নাকি অন্য কিছু? আমি কিন্তু আজ ভদকা খাবো।”
“তাহলে দু-জনের জন্যেই ভদকা নিয়ে এসো।”
“ওকে।” জাভেদ ওয়ার্সি হাসিমুখে চলে গেলো।
ঠিক এমন সময় বাস্টার্ড দেখতে পেলো একটু আগে যে লোকটাকে পাঁচ ছয়জন তরুণী ঘিরে চুমু খাচ্ছিলো, জড়িয়ে ধরছিলো সে এক যুবককে জড়িয়ে ধরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মুখে হাসি এঁটে রকস্টারদের মতো বড় বড় চুল দুলিয়ে কথা বলছে। তারা দু-জন এসে বসলো ঠিক তার পাশের সোফাতে। বসতে না বসতেই আলীকে চুমু খেলো সঙ্গি যুবকটি।
খুব কাছ থেকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আলীর ভুরু প্লাক করা, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে মাসকারা! এমন কি তার পোশাকটিও অন্য রকম। লম্বা পাঞ্জাবির মতো ঘিয়েরঙা একটি জামা। সেই পাঞ্জাবির নীচে যেটা দেখতে পাচ্ছে সেটা তাকে ভীষণ অবাক করলো।
আলী ব্রা পরেছে!
অধ্যায় ২৫
সবাই যাকে আলী বলে ডাকে সে আসলে বেগম নওয়াজিশ আলী!
তথ্যটা জেনে ভিরমি খেলো বাস্টার্ড। জাভেদ তাকে আরো জানালো আলীই এই ডিসকো’র আয়োজক। বলা যেতে পারে প্রধান ব্যক্তি। তার কিছু পার্টনার আছে অবশ্য, তবে সবাই এটাকে আলীর ডিসকো হিসেবেই জানে।
একটা মেয়ে ডিসকো চালাচ্ছে এই করাচি শহরে! আরো একবার তাজ্জব হলো সে। ভদকার গ্লাসে আস্তে করে চুমুক দিলো। লোকজনের উন্মাতাল নৃত্য দেখছে। কাউকে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। এটা অবশ্য সব ডিসকো আর নাইটক্লাবের বেলায় প্রযোজ্য। যারা এখানে আসে তারা ইচ্ছে করেই স্বাভাবিক খোলস থেকে বের হয়ে যেতে চায়। যেনো কৃত্রিম এক আবরণে নিজেদের ঢেকে রাখে দৈনন্দিন জীবনটাকে, মাঝেমধ্যে সেটা ছেড়ে বেরিয়ে এসে একটু দম নিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচে।
তাদের পাশে এখনও বসে আছে বেগম নওয়াজিশ আলী। সুদর্শন এক যুবককে প্রগাঢ় চুম্বনে সিক্ত করার পর এখন মদ্যপানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নীচু গলায় কথা বলছে তারা। মাঝেমধ্যেই হেসে উঠছে দু-জনে। বাস্টার্ড বুঝতে পারছে এই বেগম বাই-সেক্সয়াল। ছেলে-মেয়ে দুটোতেই গমন করে।
“আলী কিন্তু খুবই ফেমাস,” পাশ থেকে বললো জাভেদ।
“হুম, তা তো দেখতেই পাচ্ছি,” মুচকি হেসে বললো সে। “সবাই তার সাথে খাতির জমাতে চায়।”
“আমি সেটার কথা বলছি না।”
জাভেদের দিকে তাকালো বাস্টার্ড।
“আলী টিভিতে প্রোগ্রাম করে।”
“কি?!”
ছেলেটা মুখ টিপে হাসলো। “তার প্রোগ্রাম কিন্তু খুবই জনপ্রিয়। প্রচুর লোকে দেখে।”
কী দেখে। মনে মনে বলে উঠলো সে। ডিসকো ড্যান্স?
“আমার লিডারও একবার তার প্রোগ্রামে গেছিলেন।”
বাস্টার্ড বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো। জাভেদের লিডার মানে এমকিউএম-র স্থানীয় এক নেতা। সে আলীর প্রোগ্রামে গিয়ে কি করেছে? বলডান্স? আলীর সাথে?
“তার প্রোগ্রামের ‘ওয়াত পাবার জন্য ইয়াসিনকে সুপারিশ করতে বলেছিলেন লিডার,” ভদকা গিলতে গিলতে বললো জাভেদ। “আমার রিকোয়েস্টে ইয়াসিনই ব্যবস্থা করে দেয়। আলীর সাথে তো ওর খুব খাতির।”
ডিসকো চালানো বাইসেক্সয়াল এক মেয়ের প্রোগ্রামে দাওয়াত পাবার জন্য কোনো পলিটিশিয়ান হন্যে হয়ে উঠবে, এটা বিশ্বাস করতেও তার কষ্ট হচ্ছে। জাভেদ তাকে তাজ্জব করার জন্য বাড়িয়ে বলছে না তো? “তোমার লিডার ওর প্রোগ্রামে গিয়ে কি করলো?” কৌতূহল দমাতে না পেরে জানতে চাইলো সে।
“কি আর করবে…কথা বললো…” গ্লাসটা খালি করে ফেললো জাভেদ। “আলী তো পলিটিক্যাল টকশো করে।”
পলিটিক্যাল টকশো করে?! এরকম এক মহিলা পাকিস্তানের মতো দেশে বসে ডিসকো চালাচ্ছে টকশো করছে, তাও আবার পলিটিক্যাল! ঠিক আছে, আমি যথেষ্ট তাজ্জব হয়েছি!
উঠে দাঁড়ালো ছেলেটি। “আমি আরো ভদকা নেবো, আপনি?”
তার গ্লাসে এখনও অর্ধেক ভদকা রয়ে গেছে, আর বেশি পান করার ইচ্ছে নেই। সত্যি বলতে ভদকা তার খুব একটা ভালো লাগে না। “আমি আর নেবো না। এটাই শেষ করতে পারি নি।”
“তাহলে একটা সরবত নিয়ে আসি?”
কাঁধ তুললো সে। ভদকা খেলেই তার মুখটা কেমনজানি হয়ে যায়। স্প্যানিশ স্মিরনফ আর সুইডিশ অ্যাবসলিউট ছাড়া ভদকা জিনিসটা তার খুব একটা ভালো লাগে না।
গানের তালে তালে দুলতে দুলতে চলে গেলো জাভেদ।
বেগম নয়াজিশ আলী হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। কাউকে ঘরে ঢুকতে দেখে আহ্লাদে ডেকে উঠলো সে। সঙ্গি যুবককে রেখেই চলে গেলো মাঝবয়সি একজনের দিকে। বাস্টার্ড দেখতে পেলো সেই যুবকও উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত বোকার মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে চলে গেলো ফ্লোরে। বেগম সাহেবা নতুন মেহমানকে জড়িয়ে ধরে স্বাগত জানালো। এরপর ঐ মাঝবয়সি লোকটার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে প্রগাঢ় চুম্বন করে বসলো সে। প্রকাশ্যেই তারা দু জন ফ্রেঞ্চ কিস্ করতে লাগলো। বেগম সাহেবার নিতম্বেও হাত রাখলো মাঝবয়সি মেহমান। আলী সেটা টের পেয়েও কিছু করলো না, বরং প্রচ্ছন্ন উৎসাহ দিলো তার গালে টোকা মেরে। দূর থেকেও সে বুঝতে পারলো মহিলা এ সময় কি বলেছে।
নটি বয়!
মুচকি হেসে মাথা দোলালো বাস্টার্ড। ভদকার গ্লাসের দিকে তাকালো। চুমুক দেবে কিনা বুঝতে পারছে না। এমন সময় আচমকা কেউ একজন তার উপরে হুমরি খেয়ে পড়লো।
“সরি সরি!”
টলতে টলতে এক মেয়ে বলে উঠলো। দু-পা স্থির রাখতেই হিমশিম খাচ্ছে। হালকা গোলাপি রঙের একটি আটোসাটো ককটেল ড্রেস পরে আছে। অনেকটা ইউরোপ-আমেরিকান মেয়েদের মতো। একজন বাদামি মেম! দেখেই বোঝা যাচ্ছে অতিরিক্ত মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে।
“ইটস অলরাইট,” হাত তুলে মেয়েটাকে অভয় দিয়ে বললো সে।
“ওহ্, শিট!” মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বললো মেয়েটি। তারপরই ধপাস করে বসে পড়লো একটু আগে যেখানে আলী বসেছিলো সেখানে। “আ’ম এক্সট্রিমলি সরি।”
“এতোটা দুঃখিত হবার দরকার নেই,” ইংরেজিতে বললো সে। “ভদকা আমার ফেবারিট ড্রিঙ্কস নয়। সত্যি বলতে, কোথায় ফেলবো জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”
মেয়েটা ভুরু তুলে হাসলো। “তাই নাকি?” সেও চমৎকার ইংরেজিতে বললো। বাচনভঙ্গি বলে দিচ্ছে দীর্ঘদিন ইউরোপ-আমেরিকায় ছিলো। “তাহলে, আপনার পছন্দের কথাটা একটু শুনি…দেখি আমি ক্ষতিপূরণ করতে পারি কিনা।”
“আমার মনে হয় সেটার কোনো দরকার নেই।”
“কেন?”
“আমার পছন্দের ড্রিঙ্কস এসে গেছে,” লিকার-রুমের দরজার দিকে দেখালো। একহাতে বিয়ার আর অন্যহাতে ভদকার গ্লাস নিয়ে জাভেদ আসছে তাদের দিকে।
মেয়েটা ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো। সে বুঝতে পারছে না কোনটা এই আগম্ভকের প্রিয় জিনিস।
“এই নিন, আপনার সরবত,” বাস্টার্ডের দিকে বিয়ারের ক্যানটা বাড়িয়ে দিয়ে তার বামপাশের চেয়ারে বসে পড়লো জাভেদ।
“বিয়ার?!” মেয়েটি খুব অবাক হয়ে বললো। জাভেদ মাথা ঝুঁকে দেখে নিলো মেয়েটিকে এইমাত্র সে খেয়াল করেছে।
বিয়ারটা একটু তুলে ধরে দেখালো সে। “হুম। এটাই আমার ফেবারিট।”
“আহ্!”
“হতাশ হলেন নাকি?”
জাভেদ ভদকার গ্লাসে চুমুক না দিয়ে মেয়েটার সাথে তওফিক আহমেদের কথোপকথন শুনে যেতে লাগলো।
“না। ঠিকই আছে। যার যেটা ভালো লাগে তার সেটাই নেয়া উচিত।”
“তা ঠিক।” বিয়ার-ক্যানের মুখটা খুলে ফেললো সে।
“আমি যদি আপনাকে আরেকটা বিয়ার কিনে দেই তাহলে কি আপনি কিছু মনে করবেন?”
“সরি বলাটাই যথেষ্ট। ক্ষতি পূরণের কোনো দরকার নেই।”
“শিওর?” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“থ্যাঙ্কস।” টেনে বললো কথাটা। তারপরই হাত দিয়ে মাথার ডানপাশটায় ঘষতে লাগলো।
“কে, তওফিক ভাই?” ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো জাভেদ। “পরিচিত নাকি?”
“চিনি না। এখানেই দেখা হয়েছে…আমার ড্রিঙ্কস ফেলে দিয়েছিলো,” চাপাস্বরে বলে পায়ের কাছে ভাঙা গ্লাসটা দেখিয়ে দিলো।
“ড্রাঙ্ক হয়ে গেছে মনে হয়,” নীচুস্বরে বললো ছেলেটা।
কিছু না বলে বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে মেয়েটার দিকে ভালো করে তাকালো। বয়স সম্ভবত সাতাশ-আঠাশ হবে। দেখতে বেশ স্মার্ট আর আকর্ষণীয়। বড়লোক বাবা-মার বখে যাওয়া সন্তান।
হঠাৎ করে মেয়েটার সাথে তার চোখাচোখি হয়ে গেলো। “কি দেখছেন?”
“মাথা ধরেছে?”
“উফ! ফাকিং হ্যাংওভার! জাস্ট কিলিং মি!” কপালে হাত বোলাতে বোলাতে অনেকটা বিড়বিড় করে বললো।
বাস্টার্ডও বুঝতে পারলো বেশি খেয়ে হ্যাংওভার হয়ে গেছে। “আপনার উচিত বাড়িতে চলে যাওয়া।”
“ফাকিং হোম!” বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো মেয়েটি। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো অচেনা কারোর সামনে এটা বলা ঠিক হয় নি। “সরি…হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড?”
“ইটস ওকে।”
“আপনি স্মোক করেন?” অনেকটা হুট করেই জানতে চাইলো।
“কেন?”
“আমার একটা সিগারেট ধরাতে হবে…নইলে এই মাথাব্যথা আরো বাড়তে থাকবে।”
“দাঁড়ান।” জাভেদের দিকে ফিরলো। ছেলেটা বিস্ময়ের সাথে ভদকায় চুমুক দিচ্ছে আর তাদের কথা শুনছে। “একটা সিগারেট হবে?”
তড়িঘড়ি পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে দিলো সে।
জাভেদের কাছ থেকে প্যাকেটটা নিয়ে মেয়েটার দিকে বাড়িয়ে দিলো।
কম্পিত হাতে প্যাকেট আর লাইটারটা নিয়ে একটা সিগারেট ধরালো মেয়েটি। “থ্যাঙ্কস,” প্যাকেট আর লাইটারটা ফেরত দিয়ে বললো।
ঠিক এমন সময় এক লোক এসে হাজির হলো মেয়েটার সামনে। “আরে, এখানে কি করছো? ফ্লোরে চলো!” ইংরেজিতেই চেঁচিয়ে বললো সে।
বিরক্ত হয়ে যুবকের দিকে তাকালো সে। “আমার ভালো লাগছে না। খুব মাথা ধরেছে।”
“আহা,” বলেই মেয়েটার হাত ধরে তাকে রীতিমতো টেনে দাঁড় করালো। “আসো তো। আরেকটু নাচলে তোমার মাথাব্যথা চলে যাবে।”
“প্লিজ!”।
মেয়েটার অনুরোধ পাত্তাই দিলো না যুবক। তাকে অনেকটা টেনে-হিঁচড়ে ডান্স-ফ্লোরে নিয়ে গেলো।
“দেখলেন তো, ভাই,” পাশ থেকে বলে উঠলো জাভেদ। “এই হলো করাচি!”
“অনেক হয়েছে…এবার চলো…খিদে পেয়েছে।”
“ওকে,” বলেই ভদকার গ্লাসটা খালি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো জাভেদ।
উঠে দাঁড়ালো বাস্টার্ড। ডান্সফ্লোরের দিকে চোখ যাচ্ছে বার বার। মাতাল মেয়েটিকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নাচতে বাধ্য করছে ঐ যুবক। সম্ভবত বয়ফ্রেন্ড কিংবা স্বামী। ছেলেটাও যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই সেটা বোঝা যাচ্ছে।
“চলেন, ভাই,” তাড়া দিলো জাভেদ। সম্বিত ফিরে পেলো সে। “হ্যাঁ, চলো।”
আলীর ডিসকো থেকে বেরিয়ে গেলেও কেউ সেটা খেয়ালই করলো না। সবাই উন্মাতাল গানের তালে নেচে যাচ্ছে।
অধ্যায় ২৬
মুজাহিদ বুঝতে পারছে না কি লিখবে। কাগজ আর কলম নিয়ে বসে আছে সে। উসখুশ করে তাকাচ্ছে আশেপাশে। বাকি নয়জন চুপচাপ লিখে যাচ্ছে নিজেদের কথা। এখন ঘরে উজ্জ্বল বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলোয় দেখতে পাচ্ছে কেউ কেউ নিজেদের চোখ মুছতে মুছতে কলম চালিয়ে যাচ্ছে। বাকিরা চোখের জলে একাকার না হলেও মুখ ভার করে লিখে যাচ্ছে সাদা কাগজের উপরে।
“কিরে, এখনও কিছুই লিখিস নি?” ইসমাইল বললো পাশ থেকে।
মুজাহিদ ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। “কি লিখবো, ভাই? আমি তো কখনও কাউকে চিঠি লিখি নি।”
মুচকি হাসলো ইসমাইল। “আমিও কোনোদিন চিঠি লিখি নি…এই প্রথম লিখছি।” তারপর একটু থেমে আবার বললো, “এই শেষ!”
ঢোক গিললো স্বল্প-শিক্ষিত ছেলেটি। শেষ চিঠির কথা শুনে তার বুকের ভেতরটা কেমনজানি করলো।
“কিছু একটা লিখ,” তাগাদা দিলো ইসমাইল।
“আমি তো লিখতে পারছি না, ভাই।”
“কেন, তুই না চার-ক্লাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিস?”
“হুম,” মাথা নেড়ে সায় দিলো আবু মুজাহিদ। “কিন্তু সেটা তো কতো আগের কথা।”
“সব ভুলে গেছিস নাকি?”
বলপেনের মাথা দিয়ে গাল চুলকালো ছেলেটি। আসলেই সে ভুলে গেছে।
“ঠিক আছে, আমি তোরটা লিখে দেবো।” আর কোনো কথা না বলে ইসমাইল নিজের চিঠি লিখতে লাগলো আবার।
“আমাদের একটা মোবাইলফোন দিলেই তো পারতো?…আম্মির সাথে কথা বলতাম?”
কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকালো বড়জন, কিছু বলতে গিয়েও বললো না। সেও আবেগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বুক ঠেলে কান্না পাচ্ছে কিন্তু অনেক কষ্টে দমিয়ে রেখেছে। এই চিঠিগুলো যখন তাদের নিকটজনদের কাছে পৌঁছে যাবে তখন তাদের কেউই এই পাপি দুনিয়াতে থাকবে না। “উনারা যা ভালো মনে করেছেন তা-ই করেছেন। এ নিয়ে কথা বলা ঠিক হচ্ছে না।”
চুপ মেরে রইলো মুজাহিদ। পুরো ঘরে যে দশজন মানুষ আছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে না। শুধু কাগজের উপরে খসখসে শব্দ হচ্ছে। শব্দগুলোর আকার দিতে গিয়ে যে খুব বেগ পাচ্ছে সেটাও জানান দিচ্ছে বিরতি আর টেনে টেনে খসখস করা আওয়াজগুলো।
“আপনি কি আপনার আম্মির কাছে লিখছেন?”
ছলছল চোখে তাকালো ইসমাইল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আম্মি আর বুল্লার কাছে।”
“বুল্লা?”
“আমার ছোটোভাই। তোর মতোনই বয়স হবে।” চোখ সরিয়ে নিয়ে আবারো লেখায় মনে দিলো।
“আপনি খুব আদর করতেন ওকে?”
মাথা নেড়ে সায় দেবার সময় ইসমাইলের দু-চোখ বন্ধ হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্যে। “যখন ছোটো ছিলো আমাকে ছাড়া ও ঘুমাতেই পারতো না। খুব জ্বালাতো। সব সময় আমার পেছন পেছন ঘুর ঘুর করতো।”
মুজাহিদ উন্মুখ হয়ে চেয়ে রইলো।
“সবাই বলতো ও আমার ‘লেঞ্জু’ হয়ে গেছে।”
মুজাহিদ দেখতে পেলো ইসমাইলের চোখ দিয়ে টপ-টপ করে পানি পড়ছে। কয়েক মাস ধরে তারা একসঙ্গে আছে, কখনও তাকে কাঁদতে দেখে নি। “ভাই, আপনি কাঁদছেন!” একটু অবাকই হলো সে।
চোখ মুছে নিলো ইসমাইল। “এটাই আমার জীবনের শেষকান্না। আর কখনও আমি কাঁদবো না।”
আবু মুজহিদেরও খুব কান্না পেলো কিন্তু চোখে পানি এলো না। তার গ্রামের কথা ভাবলো, চোখ ভিজলো না। বন্ধুবান্ধব, পরিচিত সবার কথা ভাবলো, চোখ সাড়া দিলো না। কিন্তু মায়ের মুখটা কল্পনা করতেই দু-চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগলো। তার কষ্টে থাকা মা। সন্তানদের জন্য সারাটাদিন খেটে যাওয়া আম্মি!
সাদা কাগজে মুজাহিদের কলম কোনো আঁচড় ফেলতে না পারলেও তার চোখের জলে দাগ তৈরি করতে পারলো। অনেক কষ্টেও অশ্রু সংবরণ করতে পারলো না। তার চোখ দুটো যেনো তাদের গ্রামের সেই সরকারি পানির কলটার মতো, যেটার চাবি নষ্ট হয়ে থাকতো বলে সব সময়ই পানি পড়তো, কখনও সেটা বন্ধ করা যেতো না।
অধ্যায় ২৭
করাচির পোর্ট গ্র্যান্ডের স্ট্রিট-ফুড সত্যিই অসাধারণ ছিলো।
জাভেদ যতোটুকু বলেছে খাবারের মান আর বৈচিত্র্য আসলে তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি। তবে পোর্ট গ্র্যান্ডের বৈচিত্রপূর্ণ সুস্বাদু খাবারের চেয়েও মনোমুগ্ধকর ছিলো আরব-সাগরের তীরে খোলা রেস্টুরেন্টগুলো। মনে হয় নি জায়গাটি পাকিস্তানের মতো কোনো দেশের। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। প্রচুর টুরিস্টও দেখেছে ওখানে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো হলে জায়গাটা নিশ্চয়ই পর্যটকে গিজগিজ করতো। মওলানার মিশনটা নিয়ে যদি না আসতো তবে সময় নিয়ে, বেছে বেছে অনেক খাবার চেখে দেখতো সে।
যাক, শেষ পর্যন্ত তিনঘণ্টারও বেশি বিরক্তিকর সময় কাটিয়ে রাতের শেষে দুটো ঘণ্টা দারুণই কেটেছে। তবে আলীর ডিসকো-ক্লাব ভড়কে দিয়েছে তাকে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এটা পাকিস্তানে সম্ভব। যেখানকার ক্রিকেটাররা পর্যন্ত মাঠে ইসলামি জোশ দেখাতে উন্মুখ হয়ে থাকে, খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করার জন্য সেজদা দেয় হর-হামেশা, যারা নিজেদেরকে ইসলামের পরাকাষ্ঠা ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে, তালিবানদের মতো বর্বরের জন্ম দেয়, আত্মঘাতি বোমাবাজদের বীরের চোখে দেখে, সেখানে আলীর মতো বাইসেক্সয়াল একজন টিভিতে টকশো করে বেড়ায়, রাতে ডিসকো চালায়!
বাস্টার্ড বুঝতে পারলো করাচি কেন তাকে বার বার চমকে দিচ্ছে, তাজ্জব করে দিচ্ছে। আসলে এই শহরটা সম্পর্কে সে যতোটুকু জানে তা দুনিয়ার বাকি লোকদের মতোই মিডিয়া থেকে আহরিত। আর মিডিয়া কখনও এসব দেখাবে না। ভয়াবহ খারাপ দিকগুলোই ওদের কাছে প্রাধান্য পায় সব সময়। ওরা অনেকটা কফিন ব্যবসায়ির মতো নিজের ব্যবসার সমৃদ্ধির জন্য যাদেরকে মানুষের মৃত্যু কামনা করতে হয়!
হোটেল রুমে ফিরে আসার আগে জাভেদকে বলে দিয়েছে, কাল থেকে পিস্তলটা যেনো গাড়িতেই রাখে–অবশ্যই গোপন আর নিরাপদ কোনো কম্পার্টমেন্টে। ছেলেটা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, গুলি-পিস্তল আর সাইলেন্সার এমন জায়গায় রাখবে যে, অটোমোবাইল মেকানিকের পক্ষেও সেটা খুঁজে বের করা কষ্টকর হবে। এমকিউএম-এর স্থানীয় এক নেতার সহচর হিসেবে এ কাজে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ছেলেটাকে দেখেও মনে হয় খুব বিশ্বস্ত। আন্ডারওয়ার্ল্ডে থাকতেই বাস্টার্ড শিখে গেছিলো কিভাবে মানুষের চোখ দেখে বোঝা যায় সে বিশ্বস্ত কিনা। তার ধারণা যদি ভুল না-হয়ে থাকে তাহলে জাভেদ ওয়ার্সি বিশ্বস্ত একজন মানুষ।
বাতি নিভিয়ে শোবার পোশাক পরে বিছানায় শুয়ে অনেক ভেবে দেখেছে, মওলানাকে রেকি করার জন্য চার থেকে পাঁচদিন দিন সময় ব্যয় করবে। তার ধারণা এতেই হয়ে যাবে। যদিও প্রথম দিনটা পুরোপুরি বিফলে গেছে, কিন্তু তিন-চারদিনের মধ্যেই মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে যাবে ঐ যুদ্ধাপরাধী কখন বাড়ি ফেরে, তার সঙ্গে কে থাকে। বাড়ি ফেরার সময় যদি মওলানার সঙ্গে দু একজন থেকেও থাকে তবুও সেটাকে বড় কোনো বাধা হিসেবে দেখছে না। ওরা নিশ্চয় সঙ্গে করে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়াবে না।
নিরস্ত্র লোকজনকে নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। অভিজ্ঞতা থেকে জানে, গোলাগুলি শুরু হলে এরা অসহায়ের মতো আচরণ করবে। আতঙ্কিত হয়ে নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করবে, খুনির পেছনে লাগতে যাবে না।
তাকে আসলে একটা বিষয়েই নিশ্চিত হতে হবে-ঐ হামারে করেই মওলানা ইউসুফ হোসাইনী যাতায়াত করে। ওটাতে করেই সে অফিস থেকে বাড়ি ফেরে। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কিছু করা যাবে না। দরকার পড়লে আরো কয়েকটা দিন বেশি ব্যয় করবে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠলো একদম নির্ভার হয়ে। সারাদিন কি করবে সেটা নাস্তা খেতে খেতে ঠিক করে নিলো। করাচিতে তার একটাই কাজ, একটাই মিশন।
আজ আবার মওলানার বাড়ির সামনে রেকি করবে বিকেল থেকে। কোনো কিছু ঘটুক আর না ঘটুক, এ কাজটা তাকে করে যেতে হবে চার পাঁচদিন। তারপর পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভেবে দেখবে।
নাস্তা শেষে আবারো হোটেল থেকে বের হয়ে গেলো। গতকালের মতোই হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো গুলশান টাওয়ারে। এবার অফিস ভবনটির চারপাশের এলাকা ভালো করে দেখে নিলো। গুলশান-এ-ইকবাল একটি বিশাল টাউন। এটা পুরোপুরি আবাসিক নয়। বিরাট একটি অংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হয়। এখান থেকে করাচি ইউনিভার্সিটি খুব কাছে। গুলশান নামে বেশ কিছু এলাকা রয়েছে করাচি শহরে। গুলশান-এ-কানিজ ফাতিমা, গুলশান-এ-জোহার, গুলশান-এ-হাদিদ এরকম কিছু জায়গা।
লাল-কমলার মিশেলে এক রঙের ইউনিফর্ম পরে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রাস্তার পাশে ডাস্টবিন থেকে ময়লা তোলার কাজ করছে। সাদা ইউনিফর্মের ট্রাফিক পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে নির্দেশ দিচ্ছে চলাচলকারী যানবাহনগুলোকে। পথচারী নারীদের মধ্যে শাড়ি পরা কাউকে খুব একটা চোখে পড়ছে না। প্রায় সবাই সালোয়ার-কামিজ পরেছে। কেউ কেউ পরেছে ঘাগড়া জাতীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাক। প্যান্ট-শার্ট আর টি-শার্ট পরা পুরুষদের ভীড়ে বহুল পরিচিত কাবুলি ড্রেসও চোখে পড়ছে প্রায়শই।
গতকালের মতোই সে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালো অনেকটা সময় কাটানোর জন্য, অনেকটা রেকির অংশ হিসেবে। যদি শেষ পর্যন্ত কোনো কারণে বাড়ির সামনে কাজটা করা না যায় সেক্ষেত্রে বিকল্প একটি জায়গা ঠিক করে রাখতে হবে। প্রথমে অফিসের ব্যাপারটা বাদ দিলেও তার এখন মনে হচ্ছে উপায় না দেখলে ওখানেও একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। এর কারণ তার কাছে এখন সাইলেন্সার আছে, আর মওলানার সাথে দ্বিতীয়বার দেখা করার একটা রাস্তাও খোলা রেখেছে। সে কি বলে নি, করাচিতে থাকাকালীন যদি সময় পায় তাহলে মওলানার অফিসে এসে এক কাপ কফি খেয়ে যাবে?
ঐ এককাপ কফি খাওয়ার উসিলায় ওখানে আরেকবার যাওয়া যেতেই পারে। তবে ভালো করেই জানে দ্বিতীয়বার দেখা করতে গেলে লোকটা গভীরভাবে সন্দেহ করতে শুরু করবে। সেটা অবশ্যই বাস্টার্ডের চিন্তার কারণ হবে না। ঐ দেখাটাই যে শেষ দেখা হবে। মওলানা আর কখনও এ নিয়ে ভাবার ফুরসতই পাবে না!
দ্বিতীয়বার যদি ঐ অফিসে যায় তাহলে সেখান থেকে বের হবার আগেই মওলানার দেহটা নিথর হয়ে পড়ে থাকবে। একটামাত্র বুলেট। কপালের ঠিক মাঝখানে। কোনো শব্দ নেই। কোনো সন্দেহ নেই। নিজের ডেস্কে গুলি খেয়ে বসে থাকবে লোকটা। বাঁচার জন্য কোনো প্রচেষ্টা নেবার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বেরিয়ে পড়বে সে।
আর যদি মওলানার সাথে ঘরে অন্য কেউ থেকে থাকে?
কোলাটেরল ড্যামেজ! মনে মনে বললো। সেক্ষেত্রে তার কিছু করার থাকবে না।
অধ্যায় ২৮
বিকেলের পর জাভেদ ওয়ার্সি গাড়ি নিয়ে চলে এলে বাস্টার্ড তাকে নিয়ে সোজা চলে গেলো গুলজার-এ-হিজরিতে। আবার সেই একই কাজ-বসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেকি করা।
এবার একটা কাজ করলো তারা। ওখানে যাবার পথে কিছু শুকনো খাবার আর সফট-ড্রিঙ্কস নিয়ে নিলো। জাভেদ বলেছিলো রাস্তার পাশে কিছু ভালো কাবাব নিয়ে নিলে ভালো হতো, সে রাজি হয় নি। পর পর কয়েকদিন মসলাদার খাবার খাওয়া ঠিক হবে না। সাধারণত এরকম কোনো কাজের সময় দরকার ছাড়া বাড়তি খাবার খায় না সে। হুট করেই হজমে সমস্যা হয়ে যেতে পারে। শরীর খারাপ করে জ্বর-টরও চলে আসতে পারে।
গুলজার-এ-হিজরির তিন নাম্বার রোডের দুই নাম্বার বাড়ির সামনে যে রাস্তাটা চলে গেছে সেটার উল্টোদিকে, ঠিক গতকালের জায়গাতেই গাড়িটা পার্ক করলো জাভেদ। প্রায় আধঘণ্টা গাড়ির ভেতরেই বসে রইলো তারা দু জন। বিরক্তিকর সময়টি সহজ করার জন্য নীচু ভলিউমে গান ছেড়ে দিলো এমকিউএম-এর কর্মী। পাঞ্জাবি ফোক গান, শুনতে খারাপ নয় বলে সে বাঁধা দিলো না।
“পিস্তলটা গাড়ির কোথায় রেখেছো?” অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর জানতে চাইলো বাস্টার্ড।
“এই তো…এখানে,” ড্যাশবোর্ডের নীচে হাত দিয়ে দেখালো।
“ওখানে?” অবাক হলো সে। “এই তোমার কঠিন জায়গা?”
দাঁত বের করে হাসলো ছেলেটা। “আলবৎ, বড়ভাই,” ড্যাশবোর্ডের নীচে টোকা মেরে বললো, “এটা কিন্তু মোডিফাই করা। কেউ বুঝতেই পারবে না এর পেছনে ছোট্ট একটা কম্পার্টমেন্ট আছে।”
“তুমি মোডিফাই করেছো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “হুম। স্কুল ছাড়ার পর আমি তিন-চার বছর মেকানিকের কাজ করেছি এক ওস্তাদের কাছে।”
বাস্টার্ড কিছু বললো না। একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে দেখে সে ওদিকে তাকালো কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে গাড়িটা চলে গেলো মওলানার বাড়ি অতিক্রম করে।
“প্রাইভেটকারের কোন জায়গায় কি থাকে সব আমার জানা। এসব মোডিফাই করা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না।”
“আচ্ছা।”
“ভেবে দেখলাম গাড়িতে জিনিস নিয়ে ঘুরে বেড়ানোটা একটু রিস্কি হয়ে যায়। তাই আজ সকালে ড্যাশবোর্ডটা মোডিফাই করে একটা ছোট্ট কম্পার্টমেন্ট বানিয়ে নিয়েছি।”
“কিন্তু পুলিশ চেকিংয়ে কি তোমার এই কম্পার্টমেন্ট ধরা পড়বে না?”
“ইনশাল্লাহ্ কেউ বুঝতেই পারবে না,” জোর দিয়ে বললো জাভেদ।
“তুমি ওটা বের করে দেখাও আমাকে।” সে দেখতে চাইছে কথাটা কতোটুকু সত্য।
হাসতে হাসতে জাভেদ ওয়ার্সি ড্যাশবোর্ডের নীচে এমন একটি জায়গায় হাত ঢোকালো যেখানে কোনো কিছু থাকার কথা নয়। একটু জোরে চাপ দিয়ে হাতটা ভেতরে ঢুকিয়ে পিস্তলটা বের করে আনলো সে। “এই যে…”
“সাইলেন্সার আর কিছু গুলিও বের করো।”
ছেলেটা তাই করলো।
বাস্টার্ড পিস্তলের ম্যাগাজিনটা ভরে নিয়ে সাইলেন্সারটা লাগিয়ে নিলো ব্যারেলে। “এবার এটা রেখে দাও ওখানে।”
“ওকে,” কাঁধ তুলে বললো জাভেদ। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলটা খুব সহজেই লুকিয়ে ফেললো সে।
“ভালো হয়েছে। মনে হয় না কেউ ওখানে চেক করতে যাবে।”
আবারো দাঁত বের করে হাসলো এমকিউএম-এর কর্মী। “আমি আর আপনি ছাড়া।”
নিঃশব্দে হাসলো সে। তারপর আবারো নীরবতা নেমে এলো গাড়ির ভেতরে। পুণরায় বিরক্তিকরভাবে বসে বসে সামনের একটা বাড়ির দিকে চোখ রাখা।
জাভেদ ভেবে পাচ্ছে না এই লোক এতো ধৈর্য পায় কোথায়। সে নিজেও এরকম কাজ করেছে তার লিডারের জন্য, কিন্তু এভাবে খামোখা কোনো কাজ ছাড়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে নি। ওই কাজেও তারা দুজন ছিলো। গাড়ি নিয়ে বের হলেও পায়ে হেঁটেই বেশিরভাগ কাজ করেছে। একটা লোককে ফলো করা, সে কোথায় যায়, কখন যায় সেটা দেখা-এসব কাজের মধ্যে মজা ছিলো। তাদের টার্গেট আবার নানান জায়গায় ঢু মারতো, এমনকি বেশ্যাপাড়ায়ও। জাভেদ আর তার পার্টনার লোকটার পেছনে লেগে থাকতো আঠার মতো। কখনও তারা পায়ে হেঁটে ফলো করতো, কখনও গাড়িতে করে, আবার অনেক সময় জাভেদ গাড়ি চালিয়ে ফলো করতো আর তার পার্টনার স্কুটার ভাড়া করে নোকটার পিছু নিতো। এক জায়গায় এভাবে ঝিম মেরে বসে থাকার কাজ ছিলো না ওটা। এভাবে বসে থাকতে থাকতে তার পায়ে ঝি-ঝি ধরে গেছে। টের পাচ্ছে প্রস্রাবের বেগও চাপ দিচ্ছে ভীষণ।
“ভাই, আমি একটু আসছি,” কড়ে আঙুল দেখিয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো জাভেদ।
বাস্টার্ডের মনে হলো তারও প্রস্রাব করা দরকার। গাড়ির ভেতর থেকে সে দেখতে পেলো মওলানার বাড়ির পরের দুটো বাড়ির মাঝখানে ঝোঁপের মতো একটি জায়গায় ঢুকে পড়লো ছেলেটি। মুচকি হাসলো সে। ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন টয়লেট সমস্যার চটজলদি সমাধান করতে বরাবরই পটু।
জাভেদ ফিরে এলে কড়ে আঙুল আর মুখে হাসি এঁটে গাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। মুচকি হেসে ছেলেটা বসে পড়লো ড্রাইভিং সিটে। রাস্তাটা পার হয়ে জাভেদ যেখানে কাজ সেরেছে সেখানে চলে গেলো। দুটো বাড়ির মাঝখানে যে ফাঁকা জায়গা আছে সেটা আসলে ড্রেন। উপরে স্ল্যাবগুলোর জায়গায় জায়গায় ভেঙে উন্মুক্ত হয়ে আছে। ফাঁকটার মুখের কাছে আবার ঝোঁপের মতো কিছু একটা থাকায় আড়াল হিসেবে কাজ করে।
ঝোঁপের ফাঁক গলে ঢুকে পড়লো সে। মিনিটখানেক বাদে ঝোঁপ থেকে বের হতেই থমকে গেলো। তার বাম দিকে একটা বাড়ির পরই মওলানার বাড়িটা। মেইনগেট দিয়ে একটা প্রাইভেটকার বের হচ্ছে ধীরে ধীরে। গাড়িটা রাস্তায় নেমেই বাম দিকে মোড় নিয়ে গতি বাড়িয়ে চলে গেলো।
বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ড্রাইভিং ডোরের কাঁচ নামানো ছিলো বলে গাড়িটা যে চালাচ্ছে তাকে দেখতে পেয়েছে অল্প কিছুক্ষণের জন্যে। যে মুখটা দেখেছে সেটা চিনতে একটুও কষ্ট হয় নি।
আরো একবার করাচি তাকে তাজ্জব করে দিলো।
অধ্যায় ২৯
গাড়ি চালাচ্ছে জাভেদ ওয়ার্সি। এই প্রথম তওফিক আহমেদ নামের লোকটি তাকে কাজের মতো কাজ দিয়েছে-একটা গাড়িকে ফলো করতে হবে। গাড়িতে বসে বসে বিরক্ত হওয়ার চেয়ে এটা অনেক বেশি রোমাঞ্চকর কাজ।
রিয়ার-মিররে তাকালো সে। তওফিক আহমেদ উদগ্রীব হয়ে সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কি কিছুই বুঝতে পারছে না জাভেদ। প্রস্রাব করে ফিরে আসার পর গাড়িতে বসে সফট ড্রিঙ্কসের বোতলটা খুলে চুমুক দিচ্ছিলো। সামনের ঐ বাড়ি থেকে কেউ বের হয়েছে কিনা দেখতেও পায় নি। ঝড়ের বেগে গাড়িতে উঠেই সামাদভায়ের লোকটি তাকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে। গতি বাড়িয়ে সামনের একটা গাড়িকে ধরেও ফেলে সে, অবশ্য পেছনের সিট থেকে তাকে বলা হয় নিরাপদ দূরত্ব রেখে ফলো করতে। তাই করে যাচ্ছে। কাজটা তেমন কঠিন কিছু নয়। যে গাড়ি চালাচ্ছে সে খুবই ভদ্র ড্রাইভার। রাস্তার নিয়ম আর স্পিড লিমিট মেনে সুন্দরভাবে ড্রাইভ করছে। করাচির এই অংশটা ধনীদের এলাকা আর বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত। বেশ নিরিবিলি। পথে যানবাহনের সংখ্যা খুবই কম, ফলে সহজেই ফলো করা যাচ্ছে।
জাভেদ আবারো তাকালো রিয়ার-মিরর দিয়ে। একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে করলো না।
“এই রাস্তাটার নাম কি?” জানতে চাইলো বাস্টার্ড।
“ইস্পাহানি রোড,” সামনের দিকে তাকিয়েই জবাব দিলো ছেলেটি।
তাদের সামনের গাড়িটার বামদিকের ব্যাক-লাইট জ্বলে উঠলো এবার।
“বামদিকে যাচ্ছে?”
“মনে হচ্ছে জান্নাত-এ-গুল টাউনের দিকেই যাচ্ছে।”
আর কিছু বললো না সে। তার চোখ সামনের গাড়িটার দিকে নিবদ্ধ।
“হুম, গুল টাউনেই যাচ্ছে,” বললো জাভেদ।
বাস্টার্ড দেখতে পাচ্ছে গাড়িটা গুল টাউন নামের আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়েছে। চারপাশে সব উঁচু উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট। সম্ভবত নতুন একটি এলাকা। “আস্তে চালাও।”
গতি কমিয়ে দিলো জাভেদ।
ডানে-বামে কয়েকটা মোড় নিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের সামনে থামলো গাড়িটা।
“রাখো,” বেশ দূরে থাকতেই নির্দেশ দিলো। এখানেই পার্ক করে রাখে। সব লাইট অফ করে দাও।”
ছেলেটা তাই করলো।
অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়িটা থামলেও কেউ বের হয়ে এলো না। প্রায় তিন-চার মিনিট পর বোরকা পরা এক নারী অ্যাপার্টমেন্ট ভবন থেকে বের হয়েই ঢুকে পড়লো সেই গাড়িতে।
“ফলো করো,” সামনের গাড়িটা চলতে শুরু করলে সে বললো। “কোনোভাবেই মিস কোরো না। ওকে?”।
“ওকে, ভাই।” দৃঢ়তার সাথেই জবাব দিলো ছেলেটি।
বাস্টার্ড দেখলো প্রায় পনেরো মিনিট ধরে একটানা ছুটে যাচ্ছে সামনের গাড়িটি।
জাভেদ রিয়ার-মিররে তাকিয়ে বললো, “ভাই, পোর্ট এ্যান্ডে যাচ্ছে মনে হয়।”
গাড়িটা পোর্ট গ্র্যান্ডের একটি আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করলো। বাস্টার্ড রিয়ার-মিররে তাকালে দেখতে পেলো জাভেদের দু-চোখ কুচকে আছে। “জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে?”
আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি। “জি, ভাই। গতকাল আমরা এখানে এসেছিলাম।”
বাস্টার্ড কিছু বললো না। তার দৃষ্টি একেবারেই সামনের গাড়িটার দিকে নিবদ্ধ। খুবই পরিচিত পথ ধরে ছুটে চলেছে ওটা।
“আহ্,” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো জাভেদ ওয়ার্সি। “আলীর ডিসকোতে যাচ্ছে দেখি।”
“তাই নাকি?” অবাক হলো পেছনের সিটের যাত্রি।
গাড়িটা ডিসকো’র সামনে আরো কিছু গাড়ির পাশে পার্ক করা হলো। “কি করবো, ভাই?”
“এখানেই রাখো।” সে চাচ্ছে না সামনের গাড়ির যাত্রিরা তাদের দেখে ফেলুক। একটু নিরাপদ দূরত্বে থাকাই ভালো। “আজকে ভেতরে ঢোকা যাবে তো?”
“ইয়াসিন যতোদিন আছে নো প্রবলেম,” হেসে বললো জাভেদ।
সামনের গাড়ির বাতি নিভে গেলো। ইঞ্জিন বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। একটু পরই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো এক তরুণী, তবে তার গায়ে কোনো বোরকা নেই। তারপর ড্রাইভিং ডোর খুলে যে বেরিয়ে এলো তাকে দেখেই চিনতে পারলো জাভেদ।
তাহলে এই মেয়েটার পেছনেই লেগেছে তওফিক ভাই? মনে মনে বলে উঠলো সে। গতরাতে আলীর ডিসকোতে এই মেয়েটার সাথেই তাকে কথা বলতে দেখেছে। কিন্তু তার বিশ্বাস হচ্ছে না এটা। নিশ্চয় অন্য কোনো কারণ আছে। যাক, সময় হলে সবই জানা যাবে।
এদিকে বাস্টার্ড খুব উত্তেজনার মধ্যে থাকলেও তাকে দেখে কিছুই মনে হচ্ছে না। মওলানা ইউসুফের বাড়ি থেকে যে গাড়িটা বের হতে দেখেছে সেটা চালাচ্ছিলো এমন একজন যার সাথে গতরাতে আলীর ডিসকোতে ঘটনাচক্রে দেখা হয়েছে, কথাবার্তাও হয়েছে সামান্য। এই কাকতালীয় ঘটনাটি তার জন্য সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে ভেবে পেলো না। দুনিয়াটা আসলেই খুব ছোটো, মনে মনে বলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সে।
একটু আগে ঐ মেয়েটি আরেক মেয়েকে সাথে নিয়ে আলীর হেরেমে ঢুকে পড়েছে। মেয়েটা কে-সেই প্রশ্নের কোনো সদুত্তর তার কাছে নেই। মওলানার মেয়ে হবার সম্ভাবনাই বেশি, কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। ছেলের বউ কিংবা নাতনিও হতে পারে। মওলানা ইউসুফের বয়স তো আর কম হয় নি।
“আলীর ডিসকো সপ্তাহে ক’দিন খোলা থাকে?” জানতে চাইলো সে।
“আগে তো খোলা থাকতো শুধু শনি আর রবিবার…এখন সেলিব্রেটি হয়ে গেছে সে…তার ডিসকোও পপুলার হয়ে গেছে, তাই রবি থেকে বুধবার পর্যন্ত খোলা রাখে।”
“ওকে,” কথাটা শুনে আশ্বস্ত হলো বাস্টার্ড। “তাহলে চলো। আরেকবার যাওয়া যাক।”
মুখ টিপে হাসলো জাভেদ। “সরবত খেতে?”
মাথা দুলিয়ে হেসে বললো সে, “না, তোমার প্রিয় ভদকা খেতে।”
“তিনহাজার রুপি খরচ করে ওখানে গিয়ে ভদকা খাবেন?”
মুচকি হেসে ছেলেটার পিঠে চাপড় মারলো। “কখনও কখনও এক রুপির জন্য তিন-চার রুপিও খরচ করতে হয়, ছোটোভাই।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটা। “যার রুপি সে বুঝবে, আমার অতো বুঝে কী লাভ।”
বাস্টার্ডকে নিয়ে সে ঢুকে পড়লো আলীর ডিসকোতে।
আবারো সেই কান ফাঁটানো মিউজিক, ডিসকো-লাইট, ড্যান্স-ফ্লোর আর মদ-বিয়ারের রাজ্যে হাজির হলো তারা। আলীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
অবশ্য বাস্টার্ডের চোখজোড়া খুঁজে বেড়াতে লাগলো ঐ মেয়েকে।
“ফ্লোরে যাবেন আজ?” জানতে চাইলে জাভেদ।
মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো সে। নাচানাচি তার কম্ম নয়।
“তাহলে চলুন, ইয়াসিনের সাথে দেখা করে আসি?”
“তুমি যাও, আমি এখানেই থাকি।”
কাঁধ তুললো ছেলেটা। “ঠিক আছে। আমি তো ভদকা…আপনার জন্য কি আনবো?”
মুচকি হেসে বললো সে, “সরবত।”
হাসতে হাসতে জাভেদ পা বাড়ালো লিকার-রুমের দিকে।
ছেলেটা চলে যাবার পর ডান্স ফ্লোরের দিকে ভালো করে তাকালো সে। প্রচুর লোকজন নাচানাচি করছে, তাদের বেশিরভাগই ঘনিষ্ঠভাবে। তাছাড়া ডিসকো-লাইটের দ্রুতলয়ের বিচ্ছুরণের কারণে ভালো করে দেখতেও পারছে না। কিছুক্ষণ পর হাল ছেড়ে দিয়ে ঘরের এককোণে খালি একটা সোফায় বসে পড়লো।
গতরাতের তুলনায় আজ লোকজন একটু কম, তার কারণ সম্ভবত একটু আগেভাগে চলে এসেছে তারা। রাত যত বাড়বে এখানকার চিত্র ততোই পাল্টে যাবে। অবশ্য পৃথিবীর সব ডিসকো আর নাইটক্লাবগুলো এরকমই হয়।
কিছুক্ষণ পর দেখতে পেলো ঘরে ঢুকছে আলী। আজ সে দারুণ সাজ সেজেছে। কড়া মেকআপ, অলঙ্কার, ককটেইল ড্রেস আর হাইহিল জুতো। গতরাতের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে পরিপূর্ণ এক নারী। যথারীতি একদল ছেলে-মেয়ে ওকে ঘিরে ধরলো। বোঝাই যাচ্ছে ওদের সাথে ওর বেশ খাতির। মজার ব্যাপার হলো ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে আলিঙ্গন করছে ওকে।
“হাই?”
চমকে তাকালো সে। গতকালের ঐ মেয়েটি বসে আছে তার পাশের সোফায়, হাতের গ্লাস একদম ভরা। আলীর দিকে তাকিয়ে থাকার সময় খেয়ালই করে নি কখন তার পাশে এসে বসেছে।
“হ্যালো,” মুখে হাসি এঁটে বললো।
“সরি…কালকের জন্য।”
“গতকাল কিন্তু কার কবার সরি বলেছেন…আজকে বলার কোনো দরকার দেখছি না,” ইংরেজিতেই বললো সে। “আগেও বলেছি, ঐ ড্রিঙ্কসটা ফেলে দেবার জন্য সুযোগ খুঁজছিলাম।”
“আমি সেটার কথা বলছি না,” মেয়েটা হেসে বললো।
“তাহলে?”
“আপনার নামটাই জানা হলো না…আসলে আমি জিজ্ঞেস করার আগেই আমার ফ্রেন্ড চলে এলো…দেখেছেনই তো, পুরোপুরি ড্রাঙ্ক ছিলো সে।”
“বুঝতে পেরেছি,” হাসিমুখে বলেই হাত বাড়িয়ে দিলো, “আমি তওফিক আহমেদ…লন্ডন থেকে এসেছি।”
“ওয়াও, তাই নাকি,” মেয়েটাও হাত বাড়িয়ে দিলো, “আমি আইনাত। আমি কিন্তু চার বছর লন্ডনে ছিলাম…পড়াশোনা করার জন্য।”
হাত মেলানোর সময় বাস্টার্ড মনে মনে প্রমাদ গুনলো। সর্বনাশ! তবে মুখে হাসি ধরে রেখে জানতে চাইলো, “লন্ডনের কোথায়?”
“ব্রাকনেইলে। আপনি?”
“ওহ,” হাতটা ছেড়ে দিয়ে একটু সময় নিলো। ব্রাকনেইল? এখন কি বলবে সে? “আমি অবশ্য একটু দূরে ছিলাম…” ভাগ্য ভালো নব্বই দশকে বিটিভিতে দেখানো রোড টুন ওয়েম্বলি’র কথা মনে পড়ে গেলো চট করে। “…ওয়েম্বলিতে।”
“ওয়াও,” আবক হয়ে বললো আইনাত। “আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে ওখানে অনেক যেতাম।”
“ফুটবল খেলা দেখতে?”
মাথা দোলালো মেয়েটি। “না, না…কনসার্ট দেখতে।”
“ও,” মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। রোড টু ওয়েম্বলি ছিলো ফুটবলের অনুষ্ঠান।
“এখানে কবে এসেছেন?”
“এই তো…এক সপ্তাহ হবে?”
“পাকিস্তানি অরিজিন?”।
“আমাকে দেখে কি পাকিস্তানি অরিজিন মনে হয়?” দারুণভাবেই বলতে পারলো সে।
“অনেকটা…তবে আমি নিশ্চিত নই…ইরান কিংবা মিডল-ইস্টও হতে পারে।”
“বাবা ইরানের…মা ইটালিয়ান।”
ভুরু কপালে উঠে গেলো আইনাতের। “ওয়াও!”
“কিসের জন্য ওয়াও?”
মুখে হাতচাপা দিয়ে বললো মেয়েটি, “হাফ-ইটালিয়ান হবার জন্য।”
“আমার তো মনে হয় আমি আমার বাবার মতো হয়েছি। মায়ের দিক থেকে ছিটেফোঁটাও কিছু পাই নি।”
“ওহ, বিনয় দেখানোর দরকার নেই। ইউ লুক গ্রেট।”
“থ্যাঙ্কস।”
“আজকে আমি আপনাকে একটা বিয়ার কিনে দেই?”
“বিয়ার?”
“হুম। আপনি তো ভদকা পছন্দ করেন না।”
হা-হা-হা করে হেসে উঠলো সে। “আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই প্রখর।”
“ভুলে যাবেন না, ঘটনাটা মাত্র গতরাতের…আর আমার স্মৃতিশক্তি অতো দুর্বল নয় যে একদিন আগের কথা ভুলে বসে থাকবো।”
এমন সময় বিয়ার আর ভদকার গ্লাস হাতে নিয়ে জাভেদ এসে পড়লো তাদের সামনে।
“ওহ্, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি,” জাভেদের হাত থেকে বিয়ারটা নিয়ে বললো বাস্টার্ড, “আমার গাইড জাভেদ ওয়ার্সি।”
“হাই,” মেয়েটা হাত তুলে বললো।
ছেলেটা শুধু হাত তুলে জবাব দিলো, মুখে কিছু বললো না।
“আর এ হলো আইনাত,” মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো।
ঠিক এমন সময় আলী দূর থেকে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, “তুমি এখানে?”
বাস্টার্ড আর আইনাত ঘুরে তাকালো সেদিকে।
কাছে এসে ডিসকোর মক্ষিরানী ন্যাকা-ন্যাকা সুরে বলতে লাগলো, “ছেলে পেয়ে গেলে আমার কথা আর মনেই থাকে না। দুনিয়াটা কেন যে এরকম, বুঝি না!”
আইনাত হেসে ফেললো। কিছুটা বিব্রতও সে। “আলী!” চোখ বড়বড় করে তার বেফাঁস কথা থামানোর ইশারা করলো। “আমি এখানে এসেই তোমার খোঁজ করেছি। সাহিদকে জিজ্ঞেস করে দেখো। ও বললো তুমি নাকি প্রাইভেটরুমে আছো, তাই আর বিরক্ত করি নি।”
“ওহ শিট!” হাত নেড়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো আলী। “সাহিদ না জেনেই কথা বলে। আমি টপফ্লোরে ছিলাম…ওখানে কিছু গেস্ট আসবে আজ… ওদের জন্য বার-বি-কিউ পার্টি করছি। তুমি কিন্তু থেকো।” তারপর বাস্টার্ডের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালো সে। “এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা কে?” চমৎকার ইংরেজি তার।
“পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, এ হলো তওফিক…লন্ডন থেকে এসেছে, আইনাত তাকে আলীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।
হাত বাড়িয়ে দিলো আলী। “আচ্ছা, তো এই হ্যান্ডসামের জন্যই আমাকে ভুলে গল্পে মজে ছিলে এতোক্ষণ?”
আইনাত লজ্জা পেয়ে আলীর পিঠে চাপড় মারলো।
“নাইস টু মিট ইউ, ম্যাম,” বললো বাস্টার্ড।
“ম্যাম!” হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো আলী। “ওয়াও! অনেকদিন পর কেউ আমার মধ্যে নারীত্ব খুঁজে পেয়েছে…তাও আবার একজন হ্যান্ডসাম-সেক্সি পুরুষ!”
আইনাত মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো। বাস্টার্ড কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো চেয়ে রইলো দু-জনের দিকে।
“ইউ নটি-গার্ল,” আইনাতকে মিষ্টি করে ভৎর্সনার সুরে বললো আলী, “দেখো, বেচারা কেমন ব্লাশ করেছে।” হা-হা-হা করে অট্টহাসি দিয়ে উঠলো উভগামী। বুঝুক আর না বুঝুক তার সাথে যোগ দিলো আশেপাশে অনেকেই।
গাল চুলকে কাচুমাচু খাওয়ার ভঙ্গি করলো তওফিক আহমেদ।
“অ্যাই হ্যান্ডসাম, তোমাকে দেখে আমি কি ভেবেছিলাম জানো?”
“কি?”
“তুমি বোধহয় দিয়েগোর ভাই-টাই হবে।”
ঠোঁট উল্টালো বাস্টার্ড। “কোন দিয়েগো? বুঝতে পারলাম না?”
হা-হা-হা করে আবারো হাসলো আলী।
আইনাত এমনভাবে হাসছে যেনো খামখেয়ালি আলীর খপ্পরে পড়ে গেছে লন্ডনের ছেলেটি।
“দিয়েগো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে কাজ করে,” বললো বেগম নওয়াজিশ আলী। “ও আমাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করতে এসেছিলো গতবছর। তোমার চেহারা অনেকটাই ওর মতো।” একটু থেমে আবার বললো, “ওয়াও, সে খুবই কেয়ারিং ছিলো…চমৎকার একটি ছেলে।”
“আলী, তুমি কি আমাদের মেহমানকে আরো বিব্রত করতে চাও?” আইনাত তার হাতটা ধরে বললো। “বেচারাকে একটু রেহাই দাও, প্লিজ।”
“অ্যাই, তুমি কি বিব্রত হচ্ছো, হ্যান্ডসাম?”
মুচকি হেসে মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “মোটেই না।”
“দেখলে ডার্লিং,” আইনাতকে বললো সে, “আমার সঙ্গ পেয়ে কেউ কখনও বিব্রত হয় না। ওরা এটা উপভোগ করে। অ্যাই, তুমিই বলো, আমি কি মিথ্যে বলেছি?”
“অবশ্যই না।”
হা-হা-হা করে হেসে উঠলো ডিসকোর কর্ণধার। “ওকে, অনেক মজা করলাম, কিছু মনে কোরো না। পরে কথা হবে। বাই।”
“বাই,” বাস্টার্ডও হাত নেড়ে জবাব দিলো।
“ওকে, হানি…চলো,” বলেই আইনাতের হাত ধরে চলে যেতে উদ্যত হলো ডিসকোর কর্ণধার।
“ওকে…পরে কথা হবে…বাই,” আইনাত ঝটপট বলেই আলীর সাথে চলে গেলো ঘরের আরেক কোণে।
“উফ্,” সশব্দে হাফ ছেড়ে বললো জাভেদ। এতোক্ষণ পাশে থেকে চুপচাপ তামাশা দেখছিলো সে। “চিজ একটা।”
মুচকি হাসলো বাস্টার্ড। এ-ব্যাপারে তার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। “আমার মনে হয় আলীর মধ্যে কেমনজানি একটা অস্বাভাবিক কিছু আছে…ঘটনাটা কি?”
জাভেদ দাঁত বের করে হাসলো। “ও কিন্তু মেয়ে নয়, পুরুষ।”
বিস্মিত হলো সে। “তাই নাকি!”
“হুম,” ভদকার গ্লাসে চুমুক দিলো ছেলেটি। “ইয়াসিনের কাছ থেকে শুনেছি ওর নাম ছিলো আলী সালিম। বিয়েও করেছিলো, পরে এরকম হয়ে গেছে। লারকা থেকে লারকি!”
ট্রান্সভেস্টাইস! বুঝতে পারলো সে। এবার সব অসঙ্গতির ব্যাখ্যা পেয়ে গেলো। আলীর কণ্ঠস্বর পুরোপুরি মেয়েলি নয়, কড়া মেক-আপের আড়ালে তার চোখেমুখে এমন কিছু দেখেছে যেটাকে ঠিক রমনীয়ও বলা যাবে না। গতরাতে তাকে মেকআপ আর মেয়েলি পোশাক ছাড়া ছেলে বলে কেন ভুল হয়েছিলো সেটা এখন বোধগম্য। আলীর চুলগুলো না-লম্বা না-ছোটো। রকস্টারদের মতো বাবরি চুল। একটু এদিক-ওদিক করলে ছেলেমেয়ে দুটো বলেই চালিয়ে দেয়া যায়।
“ও সবার সাথেই মেশে,” জাভেদ ভদকায় আরেক চুমুক দিয়ে বললো। “আজব কিসিমের মাল!”
‘সবার মানে কি বুঝতে পারলো সে। আলী একজন উভগামি। গতরাতে এটা নিজের চোখে দেখেছে। ছেলেমেয়ে উভয়কেই ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করে সে। এমনকি ঠোঁটে ঠোঁট রেখে চুমুও খায়।
“খুলুন, ভাই?”
বাস্টার্ড সম্বিত ফিরে পেলো। এতোক্ষণ বিয়ারের ক্যানটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যানটার মুখ খুলে বিয়ারে চুমুক দিলো। “করাচিতে ওর কোনো সমস্যা হয় না?”
জাভেদ প্রশ্নটা চট করেই ধরতে পারলো। “তালিবান আর জঙ্গিদের কথা বলছেন?”
“হুম।”
“এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয় নি। কেন হয় নি জানি না। তবে পাকিস্তানে, বিশেষ করে করাচিতে এরকম অনেক জায়গা আছে যেখানে গেলে আপনি তাজ্জব হয়ে যাবেন।”
আবারো তাজ্জব! মনে মনে হেসে ফেললো সে। তাজ্জব হতে তো আর। বাকি নেই!
“বাইরের দেশের লোকজন মনে করে পাকিস্তান একটি মৌলবাদি দেশ। এখানে সবাই তালিবান আর জঙ্গি, কিন্তু দেশটা ঘুরে দেখলে বুঝতে পারবেন কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। আপনার ধারণাই পাল্টে যাবে।”
বাস্টার্ড কিছু বললো না। জাভেদের সাথে এ নিয়ে তর্ক-বির্তক কিংবা আলাপ করার কোনো ইচ্ছে তার নেই।
“করাচি এক আজব শহর, বুঝলেন?”
পুরো পাকিস্তানটাই আজব দেশ, ছোটোভাই, মনে মনে বললো সে।