বিকেলের দিকে ইকবাল মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধা চারপাই-এর ওপর নিজেকে এলিয়ে দিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। গতরাতে তিনি ট্রেনের একটি তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় নিজের মোড়ানো বিছানার ওপর বসে কাটিয়েছেন। কামরাটি ছিল যাত্রীতে ভরা। যখনই তিনি একটু ঘুমাবার চেষ্টা করেছেন তখনই ট্রেনটা হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেছে। কামরার দরজা জোর করে খুলে যাত্রীভরা কামরায় আরও যাত্রী উঠেছে। সাথে রয়েছে পরিবারের অন্যান্য সদস্য আর বিছানাপত্র। অনেক মহিলা যাত্রীর কোলে শিশুরা ঘুমিয়েছিল। কিন্তু যাত্রীদের ওঠানামা, ঠেলাঠেলি ও চিৎকারে তাদের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তারা চিৎকার শুরু করে দেয়।
নিরুপায় মায়েরা সেই ভিড়ের মধ্যেই অবুঝ শিশুর মুখে স্তন দিলে তাদের কান্না থেমে যায়। কিন্তু ক্টেশন ছাড়ার পর বহুক্ষণ ধরে সেই চিৎকারের রেশ থাকে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বার বার। কারণ পঞ্চাশ জন যাত্রীর এই কামরায় উঠেছিল। প্রায় দুশ জন যাত্রী। কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। সাথে তো বিছানাপত্র ছিলই। দরজার পাদানিতে দাঁড়িয়ে ছিল প্রায় ডজন দুই যাত্রী। হ্যান্ডেল ধরে তারা দাঁড়িয়ে ছিল। ছাদের ওপর ছিল বহু লোক। গরম ও বিকট গন্ধ ছিল অসহনীয়। ঝগড়া করার জন্য তাদের মেজাজ যেন তৈরিই ছিল। কয়েক মিনিট পরপরই যাত্রীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। কারণ অতি সামান্য। কেউ হয়ত অন্যের জায়গা সামান্য একটু দখল করে নিয়েছে অথবা টয়লেটে যাওয়ার সময় কারও পায়ে পাড়া লেগেছে। দুজনের কথা কাটাকাটিতে অন্যেরা দুই পক্ষ নিয়ে যোগ দিয়েছে। আবার শেষে অনেকে বিরোধ মিটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। সব মিলিয়ে একটা অসহনীয় পরিবেশ। এর মধ্যে ইকবাল স্বল্প আলোয় কিছু পড়ার চেষ্টা করছিলেন। বাঘের চারপাশে পতঙ্গ উড়ছিল। তিনি একটা প্যারা পড়া শেষ না করতেই পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন:
আপনি পড়ছেন?
হা, আমি পড়ছি।
আপনি কি পড়ছেন?
একটা বই।
এ উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। ইকবালের হাত থেকে বইখানা নিয়ে তিনি বইয়ের পাতা উল্টে-পাল্টে দেখলেন।
ইংরেজী?
হ্যাঁ, ইংরেজী।
আপনি নিশ্চয়ই শিক্ষিত লোক।
ইকবাল এ কথার জবাব দিলেন না।
বইখানার হাত বদল হলো। কামরার অনেক যাত্রীই তা পরখ করে দেখলেন। তাদের ধারণা হলো, তিনি শিক্ষিত, ফলে অন্য শ্রেণীর লোক। তিনি বাবু শ্রেণীর লোক।
আপনার নাম কি?
আমার নাম ইকবাল।
স্ত্ৰষ্টা আপনার ইকবাল (সুনাম) বৃদ্ধি করুক।
লোকটা মুসলমান বলে সবাই ধরে নিল। ভাল হলেই ভাল। যাত্রীদের প্রায় সবাই ছিল মুসলমান। তারা যাচ্ছিল পাকিস্তানে।
আপনার বাড়ী কোথায় বাবু সাহেব?
আমার পর্ণকুঠির ঝিলাম জেলায়। ইকবাল বললেন অতি সহজভাবে। তাঁর উত্তরে সবাই নিশ্চিত হলেন যে, লোকটি মুসলমান। কারণ বিলাম জেলা পাকিস্তানে।
ফলে অন্য যাত্রীরাও ইকবালকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলল। ইকবালকে তাদের বলতে হলো: সে কি করে, তাঁর আয়ের উৎস কি, সমাজে তাঁর মর্যাদা কতটুকু, কোথায় সে লেখাপড়া শিখেছে, সে বিয়ে করেনি কেন, এ যাবত সে কি কি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তারা তাদের পারিবারিক সমস্যা ও অসুখের কথা তুলে ইকবালের পরামর্শ চাইল। যৌন শক্তিহ্রাস পেলে ইংরেজ লোকেরা যা করে এমন কোন ওষুধ বা আয়ুৰ্বেদীয় ওষুধ ইকবাল কি জানে? ইত্যাকার প্রশ্নে জর্জরিত ইকবালকে পড়া বা ঘুমানোর চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হলো। সারা রাত এবং পরদিন সকাল পর্যন্ত তারা এ ধরনের আলোচনা চালিয়ে গেল। ইকবাল এই সফরকে দুঃসহ বলে বর্ণনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি জানেন ভারতে মানুষের সহোর সীমা কত বিস্তৃত। তাই তিনি সফরের বর্ণনা দেয়াকে অর্থহীন বলে মনে করলেন। মানো মাজরা স্টেশনে তিনি ট্রেন থেকে নেমে পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। তিনি সেবন করলেন নির্মল বায়ু। অপেক্ষা করতে লাগলেন একটা দীর্ঘ নিদ্রার।
কিন্তু ঘুম ইকবালের চোখে এলো না। কামরায় বাতাস চলাচলের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ছাতা-পড়া মাটির দুৰ্গন্ধ। কামরার এক কোণায় এক স্তুপ ময়লা পুরাতন কাপড়। হয়ত ধোয়ার জন্য রাখা আছে। তার চারপাশে মাছি ভন্ ভিন্ন করছে। ইকবাল তাঁর মুখের ওপর একটা রুমাল ছড়িয়ে দিলেন। তাঁর শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন পরিবেশেও তিনি নিদ্রায় ঢলে পড়লেন। কিন্তু মিত সিং-এর দার্শনিক কথায় তার সে নিদ্ৰা ভেঙ্গে গেল।
নিজ গ্রামের লোকের বাড়িতে ডাকাতি করা আর মায়ের জিনিস চুরি করা একই ব্যাপার। ইকবাল সিংজি এটা হলো কলিযুগ, অন্ধকার যুগ। প্রতিবেশীর বাড়িতে ডাকাতি করার কথা। আপনি কখনও শুনেছেন? এখন দুনিয়ায় নৈতিকতা বলতে আর কিছু নেই।
ইকবাল তাঁর মুখ থেকে রুমালটা সরিয়ে নিলেন।
কি ঘটেছে?
কি ঘটেছে? একই কথার পুনরাবৃত্তি করে মিত সিং বিস্ময়ের ভান করে বললেন, কি হয়নি। তাই বলুন! জুগ্গার জন্য পুলিশ এসেছে। জুগ্গা হলো দশ নম্বর বদমায়েশা। (পুলিশের খাতায় লিপিবদ্ধ অসৎ লোকদের তালিকার নম্বর মোতাবেক)। কিন্তু জুগ্গা পালিয়েছে, ফেরার। কিন্তু জুগ্গার ঘরের আঙ্গিনায় লুঠ করা এক জোড়া চুড়ি পাওয়া গেছে। সুতরাং এ কাজ কে করেছে তা আমরা বুঝতে পেরেছি। এবারই প্রথম সে হত্যা করল না। হত্যার নেশা তার রক্তের সাথে মিশে আছে। তার পিতা ও পিতামহ ডাকাত ছিল এবং খুন করার জন্য তাদের ফাঁসি হয়। কিন্তু তারা নিজের গ্রামের কারও বাড়িতে কোনদিন ডাকাতি করেনি। সত্যি কথা বলতে কি, তারা বাড়িতে থাকলে মানো মাজরায় কোন ডাকাত আসতে সাহস করত না। জুগ্গাত্ সিং তার পরিবারকেই অসম্মান করল।
ইকবাল উঠে বসে দু’হাত দিয়ে চোখ রূপড়াতে লাগলেন। তুরি ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এমন অনেক কিছুই ধরা পড়ে যা তাঁর দেশীয় ভাইদের কাছে কিছুই নয়। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে মাঝে মাঝে হতবাক করে দেয়। পাঞ্জাবীদের নীতিবোধ আরও বেশি বিভ্রান্তিকর। তাদের কাছে সত্য, সম্মান, অর্থনৈতিক সাধুতা—এসবই ভাল। কিন্তু এর মূল্য বন্ধুর কাছে বন্ধুর উপকারী এবং নিজ গ্রামবাসীর চেয়ে কম। বন্ধুর জন্য তুমি আদালতে মিথ্যা বলতে পার বা কাউকে ঠকাতে পোর। এজন্য তোমাকে কেউ দোষ দেবে না। একইভাবে তুমি যদি পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটকে অগ্রাহ্য করতে পোর, ধর্মকে অস্বীকার করতে পোর, অথচ বন্ধুর প্রতি অবিচল থাক, তাহলে লোকে তোমাকে বীরের মর্যাদা দেবে। গ্রামীণ সমাজের চিত্ৰ এটাই। এখানে গ্রামের সবাই সবার আস্ত্রীয় কিনা এবং সবাই সবার প্রতি অনুগত কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। জুগ্গা হত্যা করেছে, এটা কিছু ধর্মগুরু মিত সিং-এর কাছে বড় কিছু নয়। তার কাছে বিবেচ্য বিষয় হলো, জুগ্গা নিজ গ্রামের এক লোকের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করেছে। জুল্পী যদি এমন অপরাধ পাশের গ্রামে করত তাহলে হয়ত মিত সিং তার পক্ষ সমর্থন করে এবং পবিত্র গ্রন্থের নামে শপথ করে বলতেন খুন হওয়ার সময় জুগ্গা গুরুদুয়ারায় প্রার্থনারত ছিল! মিত সিং-এর মতো লোকের সাথে কথা বলতে ইকবালের ক্লান্তিবোধ হয়। তারা কিছু বুঝতে পারে না। ইকবাল শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি ঐ ধরনের লোকের সমপর্যায়ের নন।
ইকবাল কোন আগ্রহ দেখাল না বলে মিত সিং হতাশ হলেন।
আপনি দুনিয়া দেখেছেন, অনেক বই পড়েছেন। কিন্তু শুনে রাখুন, সাপ তার খোলস ছাড়লেও বিষ ছাড়তে পারে না। একথা হাজার টাকার চেয়েও দামী।
এই মূল্যবান কথারও গুণগান করল না ইকবাল। মিত সিং ব্যাখ্যা করে বললেন, জুগ্গা কিছু দিন বেশ সৎভাবেই দিন কাটাচ্ছিল। সে জমি চাষ করত, গৃহপালিত পশু দেখাশোনা করত। গ্রাম থেকে বাইরে যেত না, সরদারের কাছে প্রতিদিন রিপোর্ট করত। কিন্তু কতদিন একটা সাপ না কামড়িয়ে থাকতে পারে? তার রক্তের সাথে পাপ মিশে আছে।
কারও রক্তে যদি পুণ্য মিশে থাকে তাহলে তার চেয়ে বেশি কারও রক্তে পাপ মিশে থাকে না, কিছুটা উত্তেজিত হয়েই বললেন ইকবাল। অনেক মতবাদের মধ্যে এটাও তাঁর একটা মন্ত্ৰ। কেউ কি কখনও জানার চেষ্টা করেছে মানুষ কেন চুরি, ডাকাতি, হত্যা করে? না। তারা তাদের জেলে ঢোকায় আর না হয় ফাঁসিতে ঝোলায়। এটা খুব সহজ কাজ। ফাঁসি কাষ্ঠ বা জেলের সেল যদি মানুষকে খুন বা চুরি থেকে বিরত রাখতে পারত। তাহলে কোন খুন, বা চুরি হত না। এটা হতে পারে না। এ প্রদেশে তারা প্রতিদিন একজন লোককে ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে। কিন্তু প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় দশ জন লোক খুন হচ্ছে। না, ভাইজি, কেউ পাপী হয়ে জন্মায় না। ক্ষুধা, চাহিদা ও অবিচার তাদেরকে পাপী করে তোলে।
এমন নিরস বক্তব্য দেয়ায় ইকবাল নিজেকে অবিবেচক বলেই মনে করল। আলোচনার সময় এ ধরনের বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস তাঁর পরিত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
জুগ্গা যেহেতু সবার অতি পরিচিত, সেহেতু আমার মনে হয়, তারা সহজেই তাকে ধরতে পারবে।
জুগ্গা বেশি দূর যেতে পারবে না। এলাকার সবাই তাকে চেনে। সাধারণ লোকের চেয়ে সে বেশ লম্বা। ডেপুটি সাহেব সবস্থিানায় নির্দেশ পাঠিয়েছেন জুগ্গার ওপর কড়া নজর রাখতে।
ডেপুটি সাহেব কে? ইকবাল জিজ্ঞাসা করলেন।
আপনি ডেপুটি সাহেবকে চেনেন না? মিত সিং বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তাঁর নাম হুকুম চাঁদ। তিনি এখন আছেন পুলের উত্তর পাশে ডাকবাংলোয়। এখন হুকুম চাঁদই সত্যিকারের বীর। তিনি ছিলেন একজন কনস্টেবল। আর এখন তিনি কোথায়! তিনি সব সময় সাহেবদের খুশি রাখেন এবং তারা তাঁকে একটার পর একটা পদোন্নতি দেন। শেষের জন্য তাঁকে ডেপুটি করে দেন। সত্যি ইকবাল সিংজি, হুকুম চাঁদ একজন বীর এবং তিনি চালোকও বটে। তিনি বন্ধুদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের সব কাজ তিনি করিয়ে দেন। তিনি তাঁর বহু আত্মীয়স্বজনকে ভাল চাকরি জুটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতো লোক এক শ জনে একজন পাওয়া ভার।
তিনি কি আপনার বন্ধু?
বন্ধু? না, না। প্রতিবাদের সুরে বললেন মিত সিং। আমি এই গুরুদুয়ারার একজন সাধারণ ভাই। আর তিনি একজন সম্রাট। তিনি সরকার আর আমরা তাঁর প্ৰজা। তিনি মানো মাজরায় আসলে আপনি তাঁকে দেখতে পাবেন।
আলোচনায় কিছুটা বিরতি ঘটল। ইকবাল তাঁর স্যান্ডেলে পাঢুকিয়ে দাঁড়ালেন। আমার কিছুটা হাঁটা দরকার। কোন দিকে যাওয়া ঠিক বলে আপনি মনে করেন?
আপনার যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যান। সব দিকই উন্মুক্ত। নদীর ধারে যান। দেখবেন ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। রেল রাস্তা পার হয়ে গেলে আপনি ডাকবাংলো দেখতে পাবেন। কিন্তু দেরি করবেন না। এখন সময় ভাল নয়। সন্ধ্যার আগে ঘরে ফেরাই ভাল। তাছাড়া আমি মসজিদের ইমাম বখশ ও সরদারকে বলেছি আপনার কথা। তারা আপনার সাথে দেখা করার জন্য আসতে পারে।
না, আমার দেরি হবে না।
গুরুদুয়ারা থেকে বেরিয়ে পড়লেন ইকবাল। এ সময় কারও কোন কর্মব্যস্ততা তার নজরে পড়ল না। বাহ্যত পুলিশ তদন্ত কাজ শেষ করেছে।
পিপুল গাছের নিচে ছয়জন কনস্টেবল খাটিয়ার ওপর অলসভাবে শুয়ে-বসে আছে। রামলালের ঘরের দরজা খোলা। ঐ ঘরের আঙ্গিনায় কিছু গ্রামবাসী তখনও বসে ছিল। একজন মহিলা কাঁদছিলেন। হৃদয়ফাটা চিৎকার। তাঁর সাথে কান্নায় যোগ দিলেন আরও কয়েকজন মহিলা। বাইরে বেশ গরম। বাতাস নেই। সূর্যের প্রখর রশ্মি ঘরের মাটির দেয়ালে এসে যেন আছড়ে পড়ছিল।
ইকবাল গুরুদুয়ারার মাটির দেয়ালের ওপর দেয়া চালের নিচ দিয়ে হাঁটছিলেন। পথটিতে মলমূত্রের ছাপ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান। পুরুষ লোকেরা এ পথটিকে তাদের প্রস্রাবের স্থান হিসাবে ব্যবহার করে। একটা মেয়ে কুকুর পাশ ফিরে শুয়েছিল। তার আটটি ছোট বাচ্চা উী:উ: শব্দে দুধ খাচ্ছিল।
গলি পথটি হঠাৎ শেষ হয়ে গেল গ্রামের প্রান্তসীমায় এসে। সামনেই একটা ছোট পুকুর, পানি কম, কাদা বেশি। ঐ পুকুরে দেখা গেল কাদা পানির মধ্যে মহিষ শুয়ে আছে। শুধু মুখটা পানির ওপরে।
ছোট পুকুরটার পাশ দিয়ে একটা পায়ে হাঁটা পথ। গম খেতের মধ্য দিয়ে ঐ পথটা মিশে গেছে নদীর কিনারায়। পায়ে হাঁটা পথের পাশ দিয়ে আছে একটা দীর্ঘ নালা, সেটাও শেষ হয়েছে নদীর কিনারায়। ঐ নালায় এখন পানি নেই, শুকনো। নালার পাশ দিয়ে ইকবাল সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। পা ফেললেন অতি সাবধানে। পথের শেষ প্রান্তে অর্থাৎ নদীর তীরে এসেই তিনি দেখলেন লাহোর থেকে আসা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ব্রিজ পার হচ্ছে। ইস্পাতের তৈরি ব্রিজ কিভাবে ট্রেনটি অতিক্রম করছে তা তিনি আপলক নেত্ৰে তাকিয়ে দেখলেন। অন্যান্য ট্রেনের মতো এ ট্রেনটিতেও ছিল যাত্রী ঠাসা। ট্রেনের ছাদে, পদানিতে, দরজা ও জানালায়সবখানে মানুষ। দরজা ও জানালায় দেখা গেল মানুষের মাথা ও হাত। দুই বগির মধ্যে যে জায়গা আছে, সেখানেও যাত্রী দেখা গেল। শেষ বগির পিছনেও দুজন লোককে বসে পা নাড়তে দেখা গেল। ব্রিজ পার হওয়ার পর ট্রেনের গতি বেড়ে গেল। গাড়ি চালক হুইসেল বাজাতে শুরু করল। মানো মাজরা স্ট্রেশন অতিক্রম না করা পর্যন্ত হুইসেল বাজানোর বিরতি ঘটল না। তারা পাকিস্তান থেকে ভারতের সীমানায় এসে পৌঁছেছে। এই স্বস্তির, এই নিশ্চিন্ততার প্রকাশ ঘটল যেন হুইসেল বাজানোর মধ্যে দিয়ে।
ইকবাল নদীতীর দিয়ে এগিয়ে গেলেন ব্রীজের দিকে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, তিনি ব্রিজের নীচে দিয়ে ডাকবাংলোর দিকে যাবেন। কিন্তু তিনি দেখলেন, ব্রিজের এক প্রান্ত থেকে একজন শিখ সৈন্য তাঁকে নিরীক্ষণ করছে। ইকবাল তাঁর মত পরিবর্তন করে সোজা রেল রাস্তার ওপরে গিয়ে উঠলেন এবং অতঃপর মানো মাজরা স্টেশনের দিকে তার গতিপথ পরিবর্তন করলেন। এতে প্রহরীর সন্দেহ প্রশমিত হলো। ইকবাল কিছুদূর এগিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে রেল রাস্তার ওপর বসে পড়লেন।
এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর মানো মাজরা যেন বিলম্বিত দিবা নিদ্রা থেকে জেগে উঠল। ছেলেরা পুকুরে বিশ্রামরত মহিষকে লক্ষ্য করে ঢ়িল নিক্ষেপ করে। তাদের বাড়ির পথে নিয়ে গেল। দল বেঁধে মেয়েরা মাঠে গিয়ে জঙ্গলের আড়ালে ছড়িয়ে পড়ল। যে গরুর গাড়িতে রামলালের মৃতদেহ তোলা হয়েছিল, তা গ্রাম ছেড়ে ক্টেশনের পথ ধরল। গরুর গাড়িকে পাহারা দিচ্ছিল পুলিশ। গ্রামের অনেকে ঐ গাড়ির সাথে সাথে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়ে আবার গ্রামে ফিরে এলো।
ইকবাল দাঁড়িয়ে চারদিকে দেখলেন। তিনি রেল স্টেশনের দিকে তাকিয়ে ডাকবাংলো দেখলেন। দেখলেন, বাংলোটি যেন দাঁড়িয়ে আছে পাতাহীন কুল গাছের অদূরে। একই স্থানে দাঁড়িয়ে তিনি ব্রিজ এবং গ্রাম দেখলেন। ফের দেখলেন স্টেশন। সব এলাকাতেই তার চোখে পড়ল। পুরুষ, মেয়ে, শিশু, গরু-ছাগল ও কুকুরের ভিড়। আকাশে দেখা গেল উড়ন্তীয়মান ঘুড়ি। কাকের দল উড়ে চলেছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। হাজার হাজার চড়ুই পাখি গাছে বসে এদিক-ওদিক দুটাছুটি করছে। ভারতে এমন কোন স্থান নেই যেখানে জীবনস্পন্দন নেই। ইকবাল প্রথম যেদিন বোম্বাই যান, সেদিনকার স্মৃতি তাঁর মনে পড়ল। রাস্তায়, রাস্তার ধারে, রেলওয়ে প্লাটফর্মে হাজার হাজার মানুষের ভিড়, এমন কি রাতেও ফুটপাতগুলো মানুষের ভিড়ে পূর্ণ। সমস্ত দেশটাই যেন মানুষে ভরা একটা কামরার মতো। প্রতি মিনিটে ছজন করে মানুষ বাড়ছে, প্রতি বছরে বাড়ছে ৫০লাখ। সুতরাং কি আশা করা যায়। শিল্প বা কৃষি খাতে সব পরিকল্পনা তাই নিস্ফল হচ্ছে। এই পরিমাণ অর্থ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করা হচ্ছে না কেন? কিন্তু কামসূত্রের এই দেশে, লিঙ্গ পূজা ও পুত্রের প্রতি ভক্তির এই দেশে তা কি সম্ভব?
ইকবাল যেন দিবাস্বপ্ন দেখছিলেন। রেল লাইনের সমান্তরালভাবে বিছানো ইস্পাতের তারের ঝন ঝন্য শব্দে তাঁর যেন স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। ব্রিজের কাছে প্রহরী কক্ষের ওপরে সিগন্যাল ডাউন হলো। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে কাপড়ের ধুলো বাড়লেন। ইতোমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। পাটল বর্ণ আকাশ ধূসর রং ধারণ করেছে। রং ধনুর রং প্রতিভাত হয়েছে আকাশে। সন্ধ্যাতারার পিছনে নতুন চাঁদ স্পষ্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে। একটা ট্রেন আসার শব্দ পাওয়া গেল। কিন্তু সেই শব্দকে ছাপিয়ে শোনা গোল মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি।
ইকবাল অতি সহজে ফিরে আসার পথ খুঁজে পেলেন। পিপুল গাছকে কেন্দ্র করে তিনটি গলিপথ গ্রামে ঢুকেছে। একটা পথ মসজিদ, অন্যটি গুরুদুয়ারা এবং অপরটি গেছে মহাজনের বাড়ির দিকে। রামলালের বাড়ি থেকে তখনও বুকফাটা কান্না শোনা যাচ্ছিল। মসজিদে বারো-তেরো জন লোক দুই লাইনে দাঁড়িয়ে নীরবে নামাজ পড়ছিল। গুরুদুয়ারায় মিত সিং বসেছিলেন একটা ছোট টেবিলের ওপর মসলিন কাপড়ে জড়ানো গ্রন্থের পাশে। তিনি সন্ধ্যার প্রার্থনা করছিলেন। পাঁচ-ছয় জন পুরুষ ও মহিলা অর্ধবৃত্তাকারে বসে তাঁর কথা শুনছিল। তাঁদের মাঝে ছিল একটি জুলানো হারিকেন।
ইকবাল সরাসরি তার কামরায় গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে খাটিয়ার ওপর শুয়ে পড়লেন। তিনি চোখ বন্ধ করার আগেই প্রার্থনাকারীরা সমবেতভাবে মন্ত্র পাঠ শুরু করল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর তারা থামল, যেন পুনরায় শুরু করার জন্য। অনুষ্ঠান শেষ হলো সৎ শ্ৰী আকাল বলে এবং ড্রাম পিটিয়ে। পুরুষ ও মহিলারা বেরিয়ে এলো। মিত সিং হারিকেন হাতে করে তাদের জুতো খুঁজতে সাহায্য করলেন। তারা বেশ জোরেই কথা বলছিল। ঐ গোলমালের মধ্যে ইকবাল একটা কথা বুঝতে পারলেন। ঐ কথাটি হলো বাবু। কেউ একজন ইকবালকে দেখে অন্যদের সে কথা বলেছিল। পরে কানে কানে ফিস ফিস কথা হলো, পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল এবং অতঃপর নীরবতা।
ইকবাল চোখ বুজে ঘুমাবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিনিটখানেক পরেই মিত সিং লণ্ঠন হাতে কামরার কাছে এলেন।
ইকবাল সিংজি। কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লেন? কিছু সবজি খাবেন? আমার কাছে দই, ঘোল আছে।
ধন্যবাদ ভাইজি। আমার কাছে খাবার আছে।
আমাদের কাছে যা আছে তা গরিব মানুষের খাবার…, মিত সিং বলতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁর কথায় বাধা দিয়ে ইকবাল বললেন, না না, আসল কথা তা নয়। তিনি উঠে বসলেন। বললেন, আসল কথা হলো, আমার কাছে খাবার আছে। এগুলো যদি না খাই তাহলে তা নষ্ট হয়ে যাবে। আমি কিছুটা ক্লান্ত। আমি ঘুমাতে চাই।
তাহলে কিছুটা দুধ খান। সরদার বানতা সিং আপনার জন্য দুধ আনতে গেছেন। আপনি আগেভাগে ঘুমাতে চাচ্ছেন, তাঁকে তাড়াতাড়ি দুধ আনার কথা বলি। ছাদে আমি আপনার জন্য আরও একটা খাটিয়া রেখে দিয়েছি। এত গরমে ঘরের মধ্যে ঘুমানো খুব কষ্ট। মিত সিং ঘরের মধ্যে হারিকোনটা রেখে অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়ে গেলেন।
সরদারের সাথে কথা বলার সম্ভাবনা খুব সুখপ্রদ ছিল না। ইকবাল তাঁর বালিশের তলা থেকে ফ্লাক্সটা নিয়ে তার মুখ খুলে এক পেগী হুইস্কি ঢেলে নিলেন। কাগজের প্যাকেট কয়েকটা শুকনো বিস্কুট ছিল। তিনি তাই খেলেন। এরপর তিনি গদি ও বালিশ নিয়ে ছাদে গেলেন। সেখানে তার জন্য একটা খাটিয়া ছিল। গুরুদুয়ারার আঙ্গিনায় মিত সিং শুয়েছিলেন। বাহাত তিনি ঘুমিয়ে আছেন বলেই মনে হলো। কিন্তু তিনি ঘুমান নি। তিনি গুরুদুয়ারা পাহারা দিচ্ছিলেন।
ইকবাল খাটিয়ার ওপর শুয়ে আকাশের তারা দেখছিলেন অস্বচ্ছ আলোয়। তিনি কিছু লোকের কথাবার্তা শুনতে পেলেন। তাঁরা সব গুরুদুয়ারায় প্রবেশ করে সিড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিলেন। তাদের স্বাগত জানাতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
শুভ রাত, বাবু সাহেব।
আপনাদের প্রতি সালাম, বাবু সাহেব।
তাঁরা করমর্দন করলেন। মিত সিং তাদের সাথে ইকবালের পরিচয় করার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। অতিথিদের বসার জায়গা করে দেয়ার জন্য ইকবাল খাটিয়ার গদি এক পাশে সরিয়ে দিলেন। তিনি নিজে মেঝের ওপর বসলেন।
আগে আপনার সাথে দেখা করিনি, এজন্য আমি লজ্জিত, একজন শিখ বললেন। আমাকে দয়া করে মাফ করে দিন। আমি আপনার জন্য কিছু দুধ এনেছি।
সত্যি সাহেব, আমরা খুবই লজ্জিত। আপনি আমাদের অতিথি আর আমরা আপনার কোন সেবাই করলাম না। ঠাণ্ডা হওয়ার আগে দুধ টুকু খেয়ে নিন, অন্য একজন আগভুক বললেন। লোকটা লম্বা, পাতলা এবং মুখে ছোট ছোট দাড়ি।
সত্যি আপনারা দয়ালু… আমি জানি আপনারা পুলিশ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন… আমি দুধ খাই না। সত্যি আমি দুধ খাই না। আমরা শহরবাসীরা …।
সরদার সাহেব ইকবালের ভদ্রজন্যোচিত আপত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি তার পিতলের মগের ওপর থেকে একটা ময়লা কাপড় সরিয়ে নিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দুধ নাড়াতে লাগলেন। একেবারে টাটকা দুধ। ঘন্টটা খানেক আগে আমি মহিষের দুধ দুয়েছি। স্ত্রীকে বলেছি দুধ গরম করে দিতে। কারণ আমি জানি, শিক্ষিত লোকেরা গরম দুধ খায়। এর মধ্যে বেশ চিনি আছে। সব নিচে পড়ে আছে, কথাগুলো বলে তিনি দুধে আর একবার নাড়া দিয়ে দিলেন। দুধের খাঁটিত্ব প্রমাণ করার লক্ষ্যে তিনি দুধের ওপর পড়া জমাট সর আঙ্গুলো করে তুলে আবার দুধের সাথে মিশিয়ে দিলেন।
এই যে ভাইজি, ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই খেয়ে নিন।
না না, ধন্যবাদ। ইকবাল আপত্তি জানালেন। তিনি বুঝতে পালেন না, আগডুকদের মনে আঘাত না দিয়ে তিনি কিভাবে না বলবেন। আমি কোনদিন দুধ খাইনি। কিন্তু আপনারা যদি অনুরোধ করেন তাহলে পরে খাব। আমি ঠাণ্ড দুধই পছন্দ করি।
আপনার পছন্দ অনুযায়ী খান ভাইজি, একজন মুসলমান আগন্তুক এ কথা বলে তাঁকে বাঁচালেন। বানতা সিং, এখানেই মগটা রেখে যাও। ভাই মিত সিং কাল সকালে নিয়ে যাবে।
সরদার সাহেব কাপড় দিয়ে মগটার মুখ ঢেকে দিয়ে তা ইকবালের খাটিয়ার নিচে রাখলেন। সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সরসহ মগের দুধ নৰ্দমায় ফেলে দেয়ার সুযোগ ইকবালের হলো। এ কথা ভাবতেও ইকবালের ভাল লাগল।
ঠিক আছে বাবুজি, মুসলমান লোকটি শুরু করলেন। আমাদের কিছু বলুন। বিশ্বে কি ঘটছে? পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান নিয়েই বা কি হচ্ছে?
আমরা ছোট এই গ্রামে বাস করি, সরদার সাহেব বললেন। বাবুজি, ইংরেজরা কেন চলে গেল আমাদের বলুন।
এ ধরনের ছোট প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দিতে হয় ইকবালের তা জানা ছিল না। এসব লোকের কাছে স্বাধীনতা হয়। অন্ধ কিছু আর না হয় কিছুই না। তারা একথা বুঝতেও পারে না যে, এটা তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা যা সত্যিকার অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম ধাপ।
তারা চলে গেছে, কারণ তাদের চলে যেতে হয়েছে। আমাদের হাজার হাজার ছেলেরা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। এখন তাদের কাছে অস্ত্ৰও আছে। আপনার কি ভারতীয় নাবিকদের বিদ্রোহের কথা শোনেন নি? এই সৈন্যরা একই কাজ করত। ইংরেজরা এতে ভয় পেয়ে গেল। জাপানীরা যে ভারতীয় জাতীয় সৈন্য বাহিনী গড়ে তোলে তাতে যেসব ভারতীয় যোগ দেয় তাদের একজনকেও ইংরেজরা গুলি করেনি। কারণ তারা চিন্তা করেছিল যে, এর ফলে সমগ্ৰ দেশ তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে।
ইকবালের এই গবেষণাসমৃদ্ধ বক্তব্য কারও বিশেষ ভাল লাগল না।
বাবুজি, আপনি যা বললেন তা হয়ত ঠিক, সরদার সাহেব বললেন। গত বিশ্বযুদ্ধে আমি ছিলাম। মেসোপটেমিয়া ও গ্যালিপোলিতে আমি যুদ্ধ করেছি। ইংরেজ অফিসারদের আমরা পছন্দ করতাম। তারা ভারতীয়দের চেয়ে ভাল।
হ্যাঁ, মিত সিং এ কথার সাথে যোগ করলেন, আমার হাবিলদার ভাই বলে যে, সব সেপাই ভারতীয়দের চেয়ে ইংরেজ অফিসারদের কাছে সুখী ছিল। আমার ভাইয়ের যিনি কর্নেল ছিলেন তাঁর স্ত্রী এখনও লন্ডন থেকে আমার ভাতিজির জন্য উপঢৌকন পাঠায়। আপনি তো জানেন সরদার সাহেব, তার বিয়েতে মেমসাহেব টাকাও পাঠিয়েছিল। ভারতীয় অফিসারদের স্ত্রীরা এমন কিছু করে?
ইকবাল কিছুটা আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেয়ার চেষ্টা করলেন।
কেন, আপনারা কি স্বাধীন হতে চান না? সারা জীবন ধরে আপনারা কি অন্যের দাস হিসাবে থাকতে চান?
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সরদার সাহেব বললেন, স্বাধীনতা নিশ্চয়ই একটা ভাল জিনিস। কিন্তু এর থেকে আমরা কি পাচ্ছি? আপনাদের মতো যারা শিক্ষিত লোক অর্থাৎ বাবু সাহেব তারা চাকরি পাবেন, যা আগে ইংরেজরা করত। কিন্তু আমরা, আমরা কি বেশি জমি বা বেশি মহিষ পাব?
না, মুসলমান লোকটি বললেন, যারা যুদ্ধ করেছে স্বাধীনতা সেই সব শিক্ষিত লোকের জন্য। আগে আমরা ইংরেজদের দাস ছিলাম, এখন আমরা শিক্ষিত পাকিস্তানী বা ভারতীয়দের দাস হবো।
ইকবাল এই ব্যাখ্যায় বিস্মিত হলেন।
আপনারা যা বললেন তা সম্পূর্ণ ঠিক, তিনি তাদের বক্তব্য সাদরে গ্রহণ করে নিলেন। আপনারা যদি স্বাধীনতাকে আপনাদের জন্য সত্যিকারের অর্থবহ করতে চান তাহলে কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে। বেনিয়া কংগ্রেস সরকারকে হটাতে হবে। রাজপুরুষ ও জমিদারদের হাত থেকে মুক্ত হতে হবে। তবেই আপনাদের কাছে স্বাধীনতা হবে আপনাদের পছন্দমতো। অনেক জমি, অনেক মহিষ এবং থাকবে না কোন ঋণ।
এ ধরনের কথাই একটা লোক আমাদের বলেছিল, মিত সিং কথার মাঝে বললেন, ঐ লোকটা …কি যেন তার নাম সরদার সাহেব?
কমরেড কি যেন! আপনি কি কমরেড বাবু সাহেব?
না।
খুশি হলাম। কারণ ঐ কমরেড আল্লাহয় বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল ক্ষমতায় এলে তুরুণ তারুণ মন্দিরের চারপাশের পবিত্র পানির নালা কেটে জমিত্রে সেচের ব্যবস্থা করবে এবং তাতে ধান ফলাবে। এতে অনেক উপকার হবে। বলে তিনি বলেন।
এ ধরনের কথা অসার, ইকবাল প্রতিবাদ জানালেন। তিনি মিত সিংকে ঐ কমরেডের নাম স্মরণ করতে বললেন। এ ধরনের লোক সম্পর্কে হেড কোয়ার্টার্সে জানানো দরকার এবং তার যথাযথ শাস্তি হওয়া উচিত বলে ইকবাল জানালেন।
আল্লাহয় যদি আমাদের বিশ্বাস না থাকে তাহলে আমরা তো পশুর মতো, বেশ গভীরভাবে বললেন মুসলমান লোকটি। বিশ্বের সব লোকই ধাৰ্মিক লোককে শ্ৰদ্ধা করে। গান্ধীকে দেখুন। আমি শুনেছি যে, তিনি বেদ ও শাস্ত্রের সাথে সাথে কোরআন শরীফ ও ইনজিল পাঠ করেন। তামাম দুনিয়ার লোকে তাঁর প্রশংসা করে। আমি পত্রিকায় গান্ধীর একটা ছবি দেখেছিলাম, তিনি প্রার্থনা করছেন। ঐ ছবিতে দেখেছিলাম, অনেক সাদা চামড়ার পুরুষ ও মহিলা পা মুড়ে বসেছিল। একজন বিদেশী মহিলার চোখ ছিল বন্ধ। অনেকে বলে, তিনি ছিলেন একজন সন্ত্ৰান্ত লর্ড-এর কন্যা। দেখ ভাই মিত সিং, ইংরেজরাও ধাৰ্মিক লোককে সম্মান দেয়।
নিশ্চয় চাচা। তুমি যা বলেছি তার ষোল আনাই ঠিক, মিত সিং তাঁর পেটে হাত বুলাতে বুলাতে ঐ কথায় সমর্থন জানালেন।
ইকবালের বেশ রাগ হলো। তারা প্রতারকের জাত, ইকবাল বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। তারা যা বলে তা বিশ্বাস করবেন না।
তিনি বুঝলেন, হিংসার মাত্রা তাঁর ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু সম্ভ্রান্ত লর্ড-এর কন্যা সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশের জন্য পা মুড়ে চোখ বন্ধ করে আছেন, আর সেই সন্ত্রান্ত লর্ড যিনি দেখতে সুন্দর ও রাজার হিন্দুস্তানী ভাই, তিনি ভারতকে ভালবাসেন মিশনারীদের মতো—এসব কথা ইকবালের মোটেই ভাল লাগে না।
আমি ওদের দেশে অনেক বছর ছিলাম। মানুষ হিসাবে ওরা ভাল। কিন্তু রাজনীতিতে ওরা বিশ্বের সেরা ঠগবাজ। ওরা সৎ হলে তামাম দুনিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারত না। এ কথা অবশ্য এখানে অপ্রাসঙ্গিক, ইকবাল বললেন, এখন কি ঘটতে যাচ্ছে তাই বলুন।
আমরা জানি কোথায় কি হচ্ছে, সরদার সাহেব বেশ রাগত স্বরেই বললেন। সারা দেশে ধ্বংসের বাতাস বইছে। আমরা যা শুনছি তা শুধু হত্যা আর হত্যা। স্বাধীনতা ভোগ করছে। কেবল চোর, ডাকাত ও হত্যাকারীরা। অতঃপর তিনি শান্তভাবে বললেন, আমরা ব্রিটিশদের অধীনে বেশ ভালই ছিলাম। অন্ততপক্ষে সে সময় নিরাপত্তা ছিল।
কিছুটা অস্বস্তিকর নীরবতা। ট্রেন লাইনের ওপর দাঁড়ানো মালগাড়ির বগি। পুনর্বিন্যাস করতে ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। মুসলমান লোকটি আলোচনার বিষয় পরিবর্তন করলেন।
মাল গাড়ি। আজ নিশ্চয়ই দেরিতে পৌঁছেছে। বাবু সাহেব, আপনি ক্লান্ত। আপনার আরাম করার সুযোগ দেয়া আমাদের উচিত। আমাদের দরকার হলে বলবেন, আমরা সব সময় আপনার সেবার জন্য রয়েছি।
তারা সবাই উঠে পড়লেন। ইকবাল তাদের সাথে করমর্দন করলেন। তাঁর ব্যবহারে রাগের কোন বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল না। সরদার সাহেব ও মুসলমান লোকটিকে মিত সিং আঙ্গিনা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তারপর তিনি সেখানেই রাখা চারপাই-এ শুয়ে পড়লেন।
ইকবাল আবার শুয়ে আকাশের তারা দেখতে লাগলেন। শান্ত রজনীতে ইঞ্জিনের আর্ত চিৎকারে তাঁর মনে হলো তিনি বড় একা এবং হতাশাগ্ৰস্ত। ভারতের মতো বিশাল দেশে এবং অগণিত মানুষের মাঝে তাঁর মতো ক্ষুদ্র এক ব্যক্তি কতটুকুই বা করতে পারেন? তিনি কি হত্যা বন্ধ করতে পারবেন? হিন্দু, মুসলমান, শিখ, কংগ্রেস কর্মী, লীগ কামী, আকালী বা কমিউনিস্ট দল-সবাই এ কাজে জড়িত। বুর্জেীয়া বিপ্লব প্রোলেতারিয়েত বিপ্লবে রূপান্তরিত হবে এমন কথা বলা আত্মতুষ্টিরই নামান্তর। ঐ অবস্থা এখন আসেনি। হিন্দুস্তান বা পাকিস্তানের সাধারণ লোক এখনও রাজনৈতিক স্বাধীনতার ব্যাপারে উদাসীন। ভিন্নধৰ্মী লোককে খুন করে তার জমি আত্মসাৎ করাকে তারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মনে করে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে খুন করে সম্পত্তি আহরণের প্রবণতাকে দূর করে ধনিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে ঐ সংগ্রাম পরিচালনা করা যেতে পারে। এটাই সাধারণ শ্রেণীর লোকের সংগ্রামের সহজ পথ। তাঁর দলীয় নেতারা এ কথাটা বুঝতে পারেন না।
দলীয় নেতারা মানো মাজরায় অন্য কাউকে পাঠাক, ইকবাল সেটাই চেয়েছিলেন। নীতি নির্ধারণ এবং মানুষের মন থেকে বাজে চিন্তা দূর করার কাজে তিনি কিছু কাজ করতে পারতেন। তাঁর যোগ্যতার অভাব আছে, তিনি সংকল্পবদ্ধও নন। তিনি কোনদিন জেলে যাননি। প্রয়োজনীয় ‘উৎসর্গের’ কোনটিই তিনি করেননি। ফলে কেউ তাঁর কথা শোনেনি। কোন কারণে বন্দিত্ব গ্রহণের পর তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করা উচিত ছিল। এখনও অবশ্য সময় আছে। দিল্লী ফিরে যাওয়ার পর প্রথম সুযোগেই তিনি সে কাজ করবেন। ততদিনে হত্যাযজ্ঞ শেষ হয়ে যাবে এবং তখন তার জন্য তা নিরাপদও হবে।
মাল ট্রেন স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় গুড় গুড় শব্দ শোনা গেল। জেলখানায় এক শান্তিময় জীবনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ইকবাল ঘুমিয়ে পড়লেন।