১.৪ সাত্তি আল-নিসার সহযোগী

১.৪

সাত্তি আল-নিসার সহযোগী তার গায়ে স্যাফায়ার সিল্ক জড়িয়ে মমতাজ সাবধানে নেমে গেলেন সাদা মার্বেলের তৈরি সিঁড়ির তিন ধাপ নিচে গোলাপ তেলের সুগন্ধিওয়ালা পানির পুকুরে। ভারী শরীর সত্ত্বেও কয়েক সপ্তাহের মাঝেই সন্তান জন্মদান করবেন মমতাজ। তাঁর প্রতিটি চলনে ফুটে উঠেছে এক ধরনের মাধুর্য, হাম্মামের দরজার কাছ থেকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলেন শাহজাহান।

মোমবাতির উজ্জ্বলতায় ফুটে রয়েছে মমতাজের শরীরের প্রতিটি ভজ। এক মুহূর্তের জন্য পত্নীর দিকে তাকিয়ে থাকার বিলাসিতায় পেয়ে বসলো সম্রাটকে। পাশের দেয়ালে মাথা রেখে বসে আছেন মমতাজ, সেবাদাসীরা পানি ঢালছে মাথার উপর। নিচে মাছের আশের আকৃতিতে তৈরি বাকানো মার্বেলে পানি পড়ে বৃষ্টির মত নৃত্য করছে। বোরহানপুরের এই চার দেয়ালের মাঝে মমতাজের জন্য স্বর্গ রচনা করেছেন শাহজাহান। আঙিনায় ফুটে আছে লাল পদ্ম আর মিষ্টি সুগন্ধওয়ালা চম্পা ফুল, অন্যদিকে প্রাচীন ঝরনা গেয়ে চলেছে জীবনের জয়গান।

দেয়ালের বাইরের কঠোর বাস্তবতায় রুক্ষ সূর্যতাপের নিচে যুদ্ধ করছে মানুষ আর পশু, জীবনীশক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে মাটি আর মানুষের। হিন্দু মন্দিরের ভক্তরা প্রার্থনা শুরু করেছে দেব-দেবীর উদ্দেশে, যেন তাদের দুঃখ লাঘব করেন দেবতারা। এমনকি কালীর উদ্দেশে রক্ত উৎসর্গও করা হচ্ছে। অন্য কয়েকজন আবার নিজেদের দুর্ভাগ্যের সময় সহায়তা না করার অভিযোগে দোষারোপ করছে মোগল সম্রাটকে। গত সপ্তাহে দুজন সাধু সারা গায়ে ছাই মাখানো হাড়সর্বস্ব ভূতের মত চেহারা নিয়ে হাজির হয় বোরহানপুরের প্রধান ফটকে। নিজেদের লাঠি নেড়ে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে ম্রাটকে। শাহজাহান নির্দেশ দেন যেন তাদেরকে কিছু করা হয় আর তাই কড়া রোদে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায় সাধুগণ। কিন্তু যাবার আগে মাটিতে রেখে যায় ছোট্ট বাচ্চার দেহের মত কিছু একটা। সৈন্যরা গিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে পায় যে ময়লা ন্যাকড়ায় জড়িয়ে ফেলে রেখে গেছে একদঙ্গল কাঠি আর মাথার কাছে শুকনো লাউ; কিন্তু যা বলতে চেয়েছে সেই বার্তা পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছেন সম্রাট। মারা যাচ্ছে ছোট বাচ্চারা আর এর সব দোষ সম্রাটের। মমতাজকে কিছুই জানাননি তিনি।

পুকুরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন শাহজাহান। পদশব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাসলেন মমতাজ। কেন যেন খুব ক্লান্ত লাগছে আজ রাতে–তাই ভাবলাম গোসল করলে ভালো লাগবে।

লম্বাদেহী সাত্তি আল-নিসা আর অন্য দাসীরা চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন শাহজাহান। এরপর বসলেন পুকুরের মার্বেল বাঁধানো ঘাটে। দুর্ভিক্ষের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। প্রতিদিনই আমি খবর পাচ্ছি যে গ্রামবাসী পুরো গ্রাম খালি করে গবাদিপশু নিয়ে চলে যাচ্ছে পশ্চিমে পানির খোঁজে। আক্রান্ত অঞ্চলগুলোর রাজকীয় শস্যাগার খুলে দেয়ার আদেশ দিয়েছি আমি; কিন্তু প্রয়োজনীয় শস্যেরও মজুদ কম। শুধুমাত্র সপ্তাহখানেক দেয়া যাবে মানুষকে, পশুকে নয়। কিন্তু গবাদি প্রাণী ছাড়া তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। কয়েকটা জায়গায় আবার বিজাপুরের বিদ্রোহীরা শস্যভাণ্ডারে হামলা চালিয়েছে।

আপনি তো যা পারছেন, করছেন।

কিন্তু নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছে। আমার সম্পদ আর শক্তি সত্ত্বেও যেটার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে পানি, সোনা নয়। যদি এরই মাঝে বর্ষা না হয়। তো আরো বহু প্রাণ মৃত্যুবরণ করবে।

আপনি তো আর প্রকৃতিকে পরাজিত করতে পারবেন না।

আমার জনগণের জন্য আরো ভালো কিছু করতে হবে আমাকে, কিন্তু এই যুদ্ধের কারণে তাও পারছি না…দ্রুত এর সমাপ্তি টানতে হবে।

আপনি আবারো অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। আমি এখানে এক বছর এমনকি দুই বছরও থাকতে রাজি আছি। তবুও একটা সংক্ষিপ্ত অভিযানের জন্য আপনাকে এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় দেখতে চাই না।

মোমবাতির আলোয় মমতাজের চোখে ফুটে ওঠা আকুতি দেখতে পেলেন শাহজাহান। সামনে ঝুঁকে টোকা দিলেন পত্নীর গালে। ঠিকই বলেছো তুমি। আমি অধৈর্য। আমি সবসময় তাই ছিলাম। শুধুমাত্র এই কারণে নয় যে তাড়াতাড়ি শত্রুর সাথে বোঝাঁপড়া করে অন্য কোথাও উচ্চাকাংখা মেটাতে চাই আমি তোমাকেও ফিরিয়ে নিতে চাই আগ্রার সুরক্ষিত আর আরামদায়ক দেয়ালের মাঝে। অনেক আগে যখন আমাদের প্রথম প্রথম বিয়ে হয়েছে, আমি শপথ নিয়েছিলাম যে সব ধরনের বিপদ থেকে তোমাকে রক্ষা করব আর দেব শান্তি ও সমৃদ্ধশালী জীবন, যেটা তোমার প্রাপ্য। কিন্তু পিতা আমার বিরুদ্ধে যাওয়ায় আমি সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারিনি। যখন থেকে বোরহানপুরে এসেছি আমার ভয় হচ্ছে যে, আবারো তোমাকে টেনে নিয়ে এসেছি অপ্রয়োজনীয় বিপদের মুখে। এই জায়গা তোমার জন্য নয়।

এই সিদ্ধান্ত ছিল আমার। আমি তো জেদ করে করেছিলাম যে আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারব না যেমনটা আমি সবসময় করে এসেছি… উঠে বসলেন মমতাজ। মার্বেলে হাত রেখে উঠে দাঁড়াতে চাইলেন। সাহায্য করুণ আমাকে। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাতে শাহজাহানের মুখমণ্ডল ধরে, চুম্বন করলেন কপালে। বর্তমান যা, ঠিক তাই ভালো। আবারো আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিচ্ছি। আবারো বলছি আপনার সাথেই থাকতে চাই। যেমনটা অতীতেও আমরা সব ঝঞ্ঝা দূর করেছি। আগেও আপনাকে কতবার বলেছি যে, সেই সময় পার করে এসেছি আমরা। কেন শুধু শুধু অনুতাপ করে নিজেকে কষ্ট দেন?

হুম, ঠিক বলেছো তুমি। আমাকে সামনের দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু কিছু বিষয় ভুলে যাওয়া খুব কঠিন। দ্রুত শত্রুকে মোকাবেলা করে আমি যাদেরকে ভালোবাসি তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ কাজটাই করতে হবে আমাকে। আর এছাড়া প্রজাদের শ্রদ্ধাও আদায় করে নিতে পারব নতুন সম্রাট হিসেবে।

আপনি ইতিমধ্যেই তা করেছেন। আপনার পিতা নিজে আপনাকে শাহজাহান পৃথিবীর প্রভু উপাধি দিয়েছেন আর সময়ের সাথে সাথে আপনি এর যথার্থতা প্রমাণ করবেন নিশ্চয়।

এটা অনেক আগের কথা। এরপর ঘটে আছে বহুকিছু। আমার লোকেরা আমাকে এখন পর্যন্ত জানেও না।

আপনি আপনার পুত্র আওরঙ্গজেবের মতই জেদী। যদি যেতে হয় তবে যান। কিন্তু অন্তত একটা প্রতিজ্ঞা করুন আমার কাছে যুদ্ধে যাবার আগে ভেবে দেখবেন যে শত্রুর মাথায় কোন্ ভাবনা চলছে…অন্যেরাও ততটাই বুদ্ধিমান যতটা আপনি। প্রতিবার আপনাকে বিদায় জানাবার সময় আমাকে বিশ্বাস করতে হয় যে আপনি ফিরে আসবেন আমার কাছে।

কথা দিচ্ছি নিজের খেয়াল রাখবো। শাহজাহান তাকিয়ে দেখলেন যে উষ্ণ বাতাসেও কাঁপছেন মমতাজ। তোমার ভেজা কাপড় পাল্টে শুকনো কাপড় পরা উচিত। আমি ডেকে দিচ্ছি তোমার সেবাদাসীদের।

সবুজ সিল্কের দড়ির সাথে ঝোলানো রুপার ঘণ্টি বাজাতে যাবেন শাহজাহান, এমন সময় ছুটতে ছুটতে এলো জাহানারা। হাঁপাতে হাঁপাতে জানালো, দারা…এক অশ্বারোহী এই মাত্র খবর নিয়ে এসেছে… আগামীকাল পৌঁছে যাবে এখানে।

তুমি নিশ্চিত? আরো দুই সপ্তাহ পর্যন্ত তো বোরহানপুরে আসার কথা ছিল না তাঁর। জানালেন সম্রাট।

বার্তাবাহক জানিয়েছে যে দারা সারাদিন আর রাতেরও বেশির ভাগ সময় ঘোড়া চালাতে জেদ করেছে।

মমতাজের দিকে তাকালেন মোগল সম্রাট। এত মাস পরে পুত্রের মুখ দেখার আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চেহারা, আমি এখনি সৈন্য পাঠাচ্ছি তাদেরকে এগিয়ে আনার জন্য।

আওরঙ্গজেবকেও তাদের সাথে যেতে দিন, যাতে সেও তার ভাইয়ের গৌরবে অংশগ্রহণ করতে পারে। বলে উঠলেন মমতাজ। বয়সে ছোট হওয়ায়, নয়তো আমি জানি পারস্যের দরবারে ভাইয়ের সাথে যাবার ব্যাপারে সে কতটা উৎসুক ছিল।

 এক মুহূর্ত ভাবলেন শাহজাহান। যদি এখন শান্তির সময় হত আমি অমত করতাম না। কিন্তু বিজাপুরের বিদ্রোহীরা যে কোন সময় যে কোন কিছু করতে পারে। আমি দেখানোর জন্য কোন স্বাগতম পার্টি পাঠাচ্ছি না। শুধুমাত্র দারা ও তার দল যাতে নিরাপদে বোরহানপুরে পৌঁছতে পারে সে ব্যবস্থা করছি। আমার মনে হয় আওরঙ্গজেব এখানে থাকলেই ভালো হবে।

*

বোরহানপুর দুর্গের দরবারে বালি পাথরের মঞ্চের উপর তৈরি মাঝখানে থাকা সিংহাসনে বসে নিজের অধৈর্যভাব চেপে ধরে অপেক্ষা করতে লাগলেন শাহজাহান। খুব কম সময়ই এসেছে যখন তিনি ভেবেছেন যে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে পরিবারের সাথে সময় কাটানো বা যখন যা খুশি করতে পারার ক্ষমতা থাকলেই ভালো হতো, এখন এই মুহূর্তেও ঠিক সে রকমই মনে হচ্ছে। খিলানওয়ালা ফটকদ্বারের পেছন থেকে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি আর খুরের আওয়াজে বুঝতে পারলেন যে তুহিন রায়, তার দূত ও বাহিনী এসে পৌঁছেছে। ছুটে গিয়ে নিজ পুত্রকে অভিবাদন জানানো থেকে নিজেকে বিরত রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, কিন্তু রীতির খাতিরে আনুষ্ঠানিকতা পালন করাও জরুরি। এই কারণে সারি বেঁধে সামনে দাঁড়িয়ে আছে সভাসদ ও সেনাপতিরা। অন্যদিকে ডান পাশে অপেক্ষাকৃত নিচু একটা মঞ্চে অপেক্ষা করছে ছোট তিন পুত্র, যাদের সবার পরনে ব্রোকেডের সবুজ মোগল কোর্ট ও গলায় মুক্তার মালা।

তের বছর বয়স্ক শাহ সুজা হাসি মুখে তাকিয়ে দেখছে চারপাশ কিন্তু রাশভারী। চৌকানা মুখের অধিকারী দুই বছরের ছোট আওরঙ্গজেব শ্রদ্ধাবনত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। শীঘ্রই এদের দুজনের জন্য তাঁকে যথাযথ দায়িত্বপূর্ণ কাজ খুঁজে বের করতে হবে। যেমনটা তিনি করেছেন দারার জন্য, ভাবলেন শাহজাহান। একজন রাজকীয় শাহজাদার শিক্ষা এত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় না। শাহ সুজাকে শিখতে হবে যে জীবন শুধুমাত্র শিকার আর আমোদ-প্রমোদের জন্য নয়। অন্যদিকে আওরঙ্গজেবকেও বুঝতে হবে যে ক্ষমতার ব্যবহার করা এত সহজ নয় যতটা সে পূর্ব-পুরুষের কাহিনী পড়ে, মনে মনে ভাবে। যাই হোক, ছয় বছর বয়সী মুরাদের কথা এখনই চিন্তা না করলেও চলবে। সে এখন ব্যস্ত শাহ-সুজার ওড়নার প্রান্ত টেনে তার মনোযোগ আকর্ষণের কাজে।

বাদ্য বেজে উঠল আর ঠিক নিয়মানুযায়ী প্রথমে আগমন ঘটল দূতাবাস প্রধান তুহিন রায়ের। বয়স হলেও এখনো ঋজু দেহী তুহিন রায় দাড়ি রাঙিয়ে রাখে কালো রঙে। ধীরে ধীর এগিয়ে এসে অবনত হল সিংহাসনের সামনে।

স্বাগতম তুহিন রায়। শাহের কাছে গিয়ে সফল হয়েছে তোমার দূতাবাস? এর উত্তর খুব ভালো করেই জানেন শাহজাহান–দূত মারফত নিয়মিত সংবাদ পেয়েছেন তিনি–তারপরেও সফলতা সম্পর্কে জনসমক্ষে প্রচার করাটা জরুরি।

শাহ আপনাকে ভাই নামে ডেকে শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন। আমি একটি চিঠিও বহন করে এনেছি তাঁর পক্ষ থেকে। আমি কি এটি উচ্চ স্বরে পাঠ করব জাহাপনা?

অনুমতি দেয়া হল, তুহিন রায়।

আইভরি কেস খুলে বের করা হল একটি কাগজ। পড়া শুরু করল তুহিন রায়। শুরু হয়েছে ফুলের মত বর্ণনা দিয়ে একটি অনুচ্ছেদের মাধ্যমে যাতে লেখা হয়েছে মোগল সাম্রাজ্যের মহত্ত্ব আর যেখানে হাসি ফুটিয়েছেন শাহজাহান পারস্যের শাহ ও মোগল সম্রাট বহুদিন যাবৎ মিত্র নয় বরঞ্চ শত্রু ছিলেন। এরপরই আসল কথায় এলো তুহিন রায়: আমি, শাহ আব্বাস, বিনয় সহকারে আপনার প্রস্তাবিত হেরাটে বাণিজ্যিক অধিকারসমূহ স্বীকার করে নিচ্ছি। এর পরিবর্তে আমি ঘোষণা করছি যে আমার শহর ইসফাহানে আগত মোগল সাম্রাজ্যের বণিকদের উপর কর ধার্য করা হবে না।

তুমি বেশ ভালো মধ্যস্থতা করেছ তুহিন রায় আর এ কারণে তোমাকে পুরস্কৃত করা হবে। কিন্তু তার আগে এই ক্লান্তিকর ভ্রমণের জন্য বিশ্রাম কর। এ কারণে আমি জানি দোষারোপ করতে হবে আমার পুত্রকে। কেননা সে পরিবারের সাথে মিলিত হতে উৎসুক ছিল। ক্ষমা কর, কিন্তু আমি নিজেও সমানভাবে আগ্রহী তাঁর সাথে মিলিত হবার জন্য।

এত তাড়াতাড়ি তাকে যেতে বলায় খানিকটা আশাহত হল তুহিন রায়। কুর্নিশ করে চলে গেল। শাহজাহান ইশারা করতেই বাদ্যের বাজানার সাথে প্রবেশ পথে দেখা গেল দারা শুকোকে। উপস্থিত সভাসদবৃন্দ বাতাসে গমের শীসের ন্যায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল, সবার মাঝ দিয়ে এগিয়ে আসল সম্রাটের জ্যেষ্ঠ পুত্র। হাসি মুখে দারা এগিয়ে এলো মঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ানো পিতার বাড়ানো হাতের দিকে। ডান হাতে দারাকে ধরে সভাসদদের দিকে তাকালেন সম্রাট।

আমার প্রিয় পুত্রের নিরাপদ আগমনের আনন্দ উদ্যাপনের জন্য আমি তাকে একটি ব্যানার উপহার প্রদান করছি–উপহার হিসেবে একজন সম্রাট এর মাধ্যমেই সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতে পারেন, যে নিয়ম চলে আসছে আমার পূর্বপুরুষ বাবরের সময় থেকে।

এই রাতে অন্ধকার নেমে এলে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল নতুন চাঁদের পাণ্ডুর আলো আর সেই সাথে বদলে গেল বোরহানপুর দুর্গ হারামের পরিবেশ। প্রধান আঙিনায় গাছের সাথে শিকল বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়া হল লাল, নীল, সবুজ আলোর কাঁচের বল। মোলায়েম আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চারপাশ। শাহের উপহার দেয়া দামি পারস্যের কার্পেট বিছানো মঞ্চের মাঝখানে পা ভাঁজ করে বসে আছেন শাহজাহান। জ্যেষ্ঠ তিন পুত্র এখনো আহারে রত। ব্রোকেডের কাজ করা হলুদ পাশবালিশে শুয়ে আছেন মমতাজ। পাশে জাহানারা আর রোশনারা একই সাথে মাথা রেখে হাস্যরসে ব্যস্ত। ছোট্ট মুরাদ গভীর ঘুমে মগ্ন ছোটদেরই মত।

দারার ফিরে আসার কথা শুনেই শাহজাহানের প্রথম চিন্তা হয়েছিল আনন্দ ভোজনের নির্দেশ দেবেন কিনা, কিন্তু একপাশে টেনে এনে তাঁকে বুঝালেন মমতাজ। দুর্ভিক্ষের সময় এমন করাটা কী উচিত হবে আমাদের? জিজ্ঞেস করলেন মমতাজ। এত জাঁকজমক ভোজন করলে ব্যাপারটা ঠিক অমানবিক হবে না? আমাদের রান্নার গন্ধ বোরহানপুরের দেয়ালের বাইরে তাদের কাছে পৌঁছে যাবে যারা জানে না পুনরায় আবার কবে খেতে পারবে।

তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারলেন সম্রাট। অন্যরা কী ভাববে–ঠিকই বলেছেন মমতাজ। সাধারণত এরকমটাই হয়। তাই মমতাজের পরামর্শানুযায়ী বড়সড় ভোজের পরির্বতে তিনি নির্দেশ দিলেন দারার সম্মানার্থে আশেপাশের গ্রামে শষ্য বিতরণ করতে আর নিজ বঁধুনীকে আদেশ দিলেন হেরেমে একাকী উপভোগ করার জন্য তাঁর পরিবারের নিমিত্তে সাধারণ খাবার তৈরি করতে।

পারস্যের দরবার নিয়ে দারা শুকোহকে প্রশ্ন করে চলল শাহ সুজা। একে অন্যের সাথে তাদেরকে এত সহজভাবে মিশতে দেখে ভালোই লাগছে, ভাবলেন শাহজাহান। কতটা পৃথক তাঁর নিজের বাল্যকালের চেয়ে–এমনকি কম বয়সেও তিনি ও তার সম্ভাইদের মাঝে সদ্ভাব ছিলনা। আর পরবর্তীতে সিংহাসনের উচ্চাকাঙ্খ কিছু হবার আশা থাকলেও আর হতে দেয়নি কোন হৃদ্যতা। যদি তাঁর নিজের কোন ভাই থাকত–যেমনটা তাঁর পুত্রেরা একে অন্যের–হয়ত পরিস্থিতি ভিন্ন হত…

দারা কিছু একটা বলছে–নিজের ভাবনায় ডুবে ছিলেন শাহজাহান অবিশ্বাসে মাথা নাড়ছে শাহ সুজা।

কী হয়েছে শাহ সুজা?

দারা আমাদেরকে বলছে যে শাহ তাকে কী জানিয়েছে অনেক বছর আগে পারস্যরা নাকি আমাদের পূর্বপুরুষ বাবরকে সাহায্য করেছে উজবেক নেতা শাহেবানী খানের সাথে যুদ্ধে…পারসীয়রা উজবেকদের হাত থেকে বাবরের বোনকে উদ্ধার করেছিল আর শাইবানী খানের খুলি দিয়ে চায়ের কাপ বানিয়ে উপহার পাঠিয়েছিল বাবরকে। এটা সত্যি হতে পারে না…পারসীয়দের সাথে মোগলদের কখন এত সখ্যতা ছিল, পিতা?

কিন্তু উত্তর দিল অন্য দুজনের চেয়ে একটু পিছনে বসে থাকা আওরঙ্গজেব। যদি তুমি কখনো ঘটনাপঞ্জিগুলো পড়ে দেখার কষ্ট করতে, তাহলে তুমিও জানতে পারতে যে এটি সত্যি ঘটনা। বিশেষ করে বাবর নিজের মুখে বলে গেছেন। তুমি আরো জানতে পারতে যে অবশেষে হুমায়ুন যে হিন্দুস্তানে ফিরে এসেছেন তার অন্যতম একটা কারণ হল যে পারস্যরা সেনাবাহিনী দিয়েছিল। 

আমি মুগ্ধ আওরঙ্গজেব। তোমার গৃহশিক্ষক জানিয়েছেন যে তুমি কতটা বিদ্যানুরাগী, কিন্তু আমি বুঝতে পারেনি যে কতটা। হয়ত কোন দিন তুমি অনেক বড় বিদ্বান হয়ে উঠবে। জানালেন শাহজাহান।

একজন বিদ্বান? না–আমি আপনার মতন যোদ্ধা হব।

হয়ত।

আমি সত্যিই তাই চাই, পিতা। জ্বলে উঠল আওরঙ্গজেবের তরুণ চেহারা। আমি যা পড়ি সেখানে লেখা আছে যে, মোগলরা হিন্দুস্তান জয় করেছে কলমের জোরে নয়, তলোয়ারের জোরে। এভাবেই আমরা এগিয়ে যাবো।

হাসি চাপলেন শাহজাহান। আওরঙ্গজেবের কৌতুকবোধ তেমন তীক্ষ্ণ নয়, তার অনুভূতিতে সহজেই আঘাত লাগে–এই ব্যাপারটা আর ভাইয়েরাও ভালোই জানে যারা তাকে প্রায়শই খ্যাপায়। আমি নিশ্চিত তুমি তাই হবে যা তুমি হতে চাও।

নিজের পরিবারের দিকে তাকালেন শাহজাহান, সবাই একসাথে বসে আছে। চোখ পড়ে গেল মমতাজের চোখে। ছোট্ট করে প্রায় না বোঝার মতই মাথা নাড়লেন মমতাজ ইশারা করে বুঝালেন যে মধ্যরাতে নিজেদের মাঝে হওয়া বিষয়ে অবতারণা করতে।

দারা শুকোহ্, তুহিন রায় পারস্যে তোমার কৌশলের প্রশংসা করেছে। নিজেকে একজন পুর্ণবয়স্ক মানুষ হিসেবে প্রমাণ করেছ তুমি, বালক হিসেবে নয়। এ ব্যাপারে তোমার মা একটি পরামর্শ দিয়েছেন যে কীভাবে এ সংবাদ পৃথিবীর কাছে প্রকাশ করা যায়।

আপনি কী বলতে চান, জাহাপনা? দারা শুকোহর পরিষ্কার পিঙ্গল বর্ণের চোখ ঘুরে তাকাল শাহজাহান থেকে মমতাজের দিকে।

এখন তোমার সময় হয়েছে বিবাহ করার। তোমার মা এক্ষেত্রে পরামর্শ দিয়েছে বধূ হিসেবে তোমার চাচাতো বোন নাদিরা হবে উপযুক্ত। তিনি খেয়াল করেছেন যে তুমি তাকে কতটা পছন্দ কর…

দারা শুকোহ্ লজ্জামাখা আনন্দের অভিব্যক্তি দেখে বোঝা গেল যে মমতাজ সঠিক বলেছেন। একই ভাবে সবজান্তার হাসি ফুটে উঠল শাহ সুজা আর আওরঙ্গজেবের মুখেও। এখন পর্যন্ত যদিও তিনি এই সখ্যতার কথা জানাতেন না, খুশিই হলেন শাহজাহান। যদি কোন এক সময় রাজবংশের প্রয়োজনে দারাকে একাধিক পত্নীর পাণি গ্রহণ করতে হয়, সে ক্ষেত্রেও এটাই ভালো হবে যে প্রথম স্ত্রী এমন কেউ থোক যাকে সে ভালোবাসে। তিনি নিজেও দারার চেয়ে খুব বেশি বয়সী ছিলেন না, যখন তিনি মমতাজের সাথে আবদ্ধ হয়েছিলেন। আর রাজবংশের জন্যও এ সম্বন্ধ উপযুক্ত। নাদিরা তাঁর সন্তাই মৃত পারভেজের কন্যা, কিন্তু অতিরিক্ত মদপান ও আফিম আসক্তির কারণে অল্প বয়সেই মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে পারভেজ। সে সময়টাতে দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এ রাজবংশ। নাদিরা আর দারা শুকোহ্র এই মিলনে অতীতের কিছু ক্ষতে প্রলেপ তো অন্তত লাগবে আর বিশাল রাজকীয় পরিবারও বাঁধা পড়বে একসূত্রে। মেয়েটা সুন্দরীও–খাটো কিন্তু সুদর্শনা আর ইতিমধ্যে বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানে দারার চঞ্চলতার বিপরীতে বিভিন্ন উপস্থিত বুদ্ধিরও পরিচয় দিয়েছে যেখানে মমতাজ ঠিকই লক্ষ্য করেছেন তাদের পারস্পরিক আগ্রহ।

তো দারা, তোমার কী মত?

নাদিরাকে বিবাহ করতে পারলে আমি খুশিই হবো। কণ্ঠস্বরে আনন্দ আর অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল দারা। শেষোক্ত অনুভূতি নির্ঘাত ভাইদের উসকানিমূলক কথাবার্তা শুনে।

আমিও খুশি হয়েছি যে তুমি মত দিয়েছ। আমি এখন থেকেই পরিকল্পনা শুরু করে দিচ্ছি তোমার বিয়ে নিয়ে। এই শেষ কয়েক সপ্তাহে আমরা অপেক্ষা করছি তোমার ভাই অথবা ভগ্নির আগমনের জন্য। নিজের স্ফীত মধ্যভাগের দিক তাকিয়ে উত্তর দিলেন মমতাজ।

 কুশনে হেলান দিয়ে বসলেন শাহজাহান। এরই মাঝে কল্পনা করে ফেলেছেন কেমন হবে বিবাহ শোভাযাত্রা। বিজয়ীর বেশে আগ্রায় ফিরে যাবার সাথে সাথে শুরু হবে অনুষ্ঠান। এটি শুধুমাত্র প্রিয় পুত্র বা একজন রাজকীয় শাহজাদার বিবাহের চিহ্ন নয় বরঞ্চ তার নিজের রাজত্বকালেরও সত্যিকারের সূচনা হবে। দক্ষিণের বিদ্রোহ প্রশমিত হলেই কেবলমাত্র তিনি নতুন অভিযানের মাধ্যমে মোগল সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে পারবেন।

*

জাহাপনা! রায় সিং ত্রিশ মাইল দূরে পশ্চিম দিকে বিজাপুর সৈন্যদলের এক বিশাল অবস্থান জানতে পেরেছে। বার্তাবাহকের ঘামে ভেজা শরীর দেখেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়ে উঠল যে সে কতটা দ্রুতগতিতে বোরহানপুরে ছুটে এসেছে।

উত্তেজনা অনুভব করলেন শাহজাহান। অবশেষে এটাই হতে পারে সেই সুযোগ যার মাধ্যমে তাঁর শত্রুর উপর আঘাত হানা সম্ভব হবে। ঝড়ের গতিতে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলেন সম্রাট।

তরতাজা একটি ঘোড়া নিয়ে ফিরে যাও রায় সিংহের কাছে। জানাও যে আমি অশ্বারোহী দল আর কামান ও যন্ত্রপাতিসহ হাতির দল নিয়ে আসছি তার সাথে যোগ দিতে। কী বলেছ বিজাপুরের সৈন্যরা ত্রিশমাইল দূরে? যদি আমি ঘোড়সওয়ারদের নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যাই তাহলে তিন ঘণ্টার মাঝে দেখা হবে রায় সিংয়ের সাথে।

প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে হেরেমের দিকে স্তেপায়ে ছুটতে ছুটতে আসলেন শাহজাহান। একজন শৃঙ্খল শত্রু যে কিনা কখনো এখানে আর কখনো সেখানে দেখা দিয়ে, আক্রমণ করে পালিয়ে যায়, তার সাথে খেলতে খেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।

একটি টুলের উপর বসে আছেন মমতাজ আর লম্বা কেশরাজি আঁচড়ে দিচ্ছে সাত্তি আল-নিসা। কাছেই বসে মমতাজের প্রিয় পারস্যের কবি ফেরদৌসের কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে জাহানারা। দারা আর আওরঙ্গজেবের মতই বিদ্বান জাহানারা, ভাবলেন শাহজাহান।

কী হয়েছে? আপনি এত উত্তেজিত? হাত বাড়িয়ে জানতে চাইলেন মমতাজ।

শুভ সংবাদ অবশেষে অন্তত আমার তাই মনে হয়। আমার সৈন্যরা বিজাপুরের বড় একদল সৈন্যের দেখা পেয়েছে। যদি আমি দ্রুত এগোতে পারি তাহলে আমি যা আশা করছি সেই যুদ্ধের দেখা পাবো।

হাসি মুছে গেল মমতাজের চেহারা থেকে। আপনি আবারো নিজের যাবার কথা বলছেন, তাই না?

আমাকে অবশ্যই যেতে হবে। এটা এমন একটা সুযোগ যে অভিযানের ফলাফল আমাদের পক্ষেই আসবে, একে অবহেলা করা যাবে না।

আমিও আশা করছি তাই হবে…আমি নিশ্চিত। ভালো থাকবেন।

আমি কথা দিচ্ছি। নিচু হয়ে পত্নীর উষ্ণ ঠোঁটে চুম্বন করলেন শাহজাহান আর মমতাজের অনুরোধে পেটের উপর হাত রেখে অনুভব করলেন নতুন প্রাণের স্পন্দন। আর এক মাসও বাকি নেই শিশুটির আগমনের। এর অনেক আগেই তিনি ফিরে আসবেন আর হয়ত অভিযানও শেষ হয়ে যাবে। মমতাজের কক্ষ থেকে প্রায় দৌড়ে যেতে যেতে ইতিমধ্যেই ভাবা শুরু করে দিলেন যুদ্ধের কথা।

তিন ঘণ্টা পরে শাহজাহান সৈন্য দলের প্রধান অংশের সাথে ছুটে এসে রায় সিংয়ের জায়গায় পৌঁছে তাকালেন নির্দেশিত দিকে। বিদ্রোহীরা ওই অংশে পাথুরে পাহাড়ের উপর পুরাতন দুর্গ দখল করে রেখেছে জাহাপনা।

প্রায় আধা মাইল দূরে ছোট পাহাড়ের মাথায় ভেঙেপড়া মাটি ইটের তৈরি দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখতে পেলেন সম্রাট। দেয়ালের কিছু কিছু অংশ একেবারেই ভেঙে গেছে। ছোট্ট দুৰ্গটা শক্রর অশ্বারোহী আর পদাতিক সৈন্যদলের জন্য খুব বেশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবে না, তিনি তাদের হটিয়ে ঢালুর দিকে নিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু পাহাড়ের মাথার জায়গাটা পরিষ্কারভাবে কিছু বাড়তি সুবিধা এনে দেবে। কয়েকজন বিদ্রোহী দেয়ালের অক্ষত অংশের পেছনে জায়গা নিয়েছে। অন্যরা প্রাণপণে চেষ্টা করছে পড়ে যাওয়া ইট আর সুড়কি তুলে ব্যারিকেডের ব্যবস্থা করতে।

কতক্ষণ যাবত তারা আছে এখানে? জানতে চাইলেন শাহজাহান।

প্রথম আলো ফোঁটার সময়ে তাদের কয়েকজন চরের সাথে সংঘর্ষ হয়েছিল আমাদের। এরপর আমাদের উপস্থিতি পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে পাহাড়ের মাথার দিকে সরে যায় শত্রুরা।

আমি এটা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি যে তারা শুধুমাত্র পিছিয়ে আসেনি, গ্রামে লুকিয়ে আছে যেমনটা আগেও করেছিল।

আগে আমি যতটা জেনেছি তার চেয়েও পদাতিক সৈন্যের সংখ্যা বেশি তাদের, এই মানুষেরা হেঁটে বেশিদূর যেতে পারেনি।

প্রায় কত হবে এখানে তাদের সংখ্যা?

দুই হাজার বা তা চেয়ে বেশি হবে না।

আমরা তাহলে তাদের চেয়ে সংখ্যায় কম। কিন্তু এটা খারাপ না…। ঢালুর উপরে আক্রমণ করলে তাদের চেয়ে আমাদেরকেই বেশি দেখা যাবে, তারা তো দেয়ালের পিছনে। অশোক সিংয়ের দিকে ফিরে তাকালেন শাহজাহান।

আমাদের অশ্বারোহী দিয়ে পাহাড় ঘিরে ফেলে। এরপর ছোট কামান নিয়ে যুদ্ধহাতি পৌঁছালেই আমরা অগ্রসর হব। দেরি করার কোন মানে হয় না।

যতটা শাহজাহান ভেবেছিলেন তার চেয়েও দেরিতে পৌঁছালো হাতির দল। এই সময়ের মাঝে বিদ্রোহীরা ক্লান্তিহীন হাত দিয়ে কাজ করার পাশাপাশি ঝুড়ি আর শাবল ব্যবহার করে দুর্গ নির্মাণ কাজ করে চলল। স্বস্তি পাচ্ছেন না সম্রাট। আদেশ দিলেন বন্দুকধারীদের ছোট দলটাকে পাহাড়ের পাশে জড়ো হতে। পিঠে বন্দুকের পাশাপাশি পানির বোতল আর বাড়তি গুলি বহন করে শত্রু রেঞ্জের ঠিক বাইরে পাথুরে কিনারের পিছনে গিয়ে অবস্থান নিল মোগল সৈন্যরা, যেন যুদ্ধ শুরু হলে তারাও তাড়াতাড়ি অংশ নিতে পারে।

হাতিরা এসে পৌঁছানোর পর বারুদ আর গোলার বল দিয়ে প্রস্তুত করা হল কামান, মধ্যাহ্নের গরমে ঘামতে ঘামতে ব্যারেল গুলি ছোঁড়ার উপযুক্ত হতেই শাহজাহান আগে বাড়ার আদেশ দিলেন। দৃঢ় পদক্ষেপে, ধীরে ধীরে তাই করল সকলে। হাতিদের ভারী শরীরের নিরাপদ বেষ্টনীর মাঝে পিছনে দৌড়ে এগোতে লাগল বন্দুকধারী, তীরন্দাজ আর পদাতিক সৈন্যর দল। গুপ্তচর মারফত শাহজাহান সংবাদ পেয়েছেন যে বিদ্রোহীদের কাছে এমন কী ছোট কোন কামানও নেই। তার পরেও ভয়ে ভয়ে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন যে কখন আবার পাহাড়ের দিক থেকে ধেয়ে আসে গর্জন সহ সাদা ধোঁয়া, দেখা যাবে আবারো তিনি বোকা হয়েছেন শত্রুর শক্তি আর ধূর্ততার কাছে। কিন্তু কিছুই হল না।

এখন, তাঁর অগ্রসরমান হাতির দল ঢালুর দিকে প্রায় অর্ধেক পথ এগিয়ে গেছে আর গোলন্দাজেরা তাদের ছোট্ট কামান প্রস্তুত করে ফেলেছে। কামানের গোলা গিয়ে আঘাত করায় দুর্গের দেয়ালের লম্বা একটি অংশ খসে পড়তে দেখলেন শাহজাহান। এর পেছনে আশ্রয় নেয়া শক্রদলের কয়েকজন অশ্বারোহী সৈন্য বেরিয়ে এলো ধুলার মধ্যে। কিন্তু ম্রাট নিশ্চিত যে বাকিরা নির্ঘাত চাপা পড়েছে ইট-সুড়কির নিচে। এখন পর্যন্ত বিজাপুরের দিক থেকে পাল্টা কামানের শব্দ পাওয়া যায়নি। তার মানে গুপ্তচর সঠিক সংবাদই দিয়েছে তাদের কাছে কামান নেই, স্বস্তির সাথে ভাবলেন শাহজাহান। ভালোই বিপর্যয় নেমে এসেছে শত্রু বাহিনীর উপর। এখন সময় হয়েছে প্রধান সৈন্য বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার।

তলোয়ার নিয়ে আক্রমণের জন্য ইশারা করেই ঘোড়া ছোটালেন সামনের দিকে। সম্রাট ও তাঁর দেহরক্ষীদের আগে বাড়তে দেখে পাহাড়ের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সৈন্যরাও দুর্গের দিকে এগিয়ে এলো। সবুজ ব্যানার উড়তে লাগল।

ছড়িয়ে থাকা পাথর এগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যুদ্ধহাতি নিয়ে পৌঁছে গেলেন শাহজাহান। হঠাৎ করেই এগুলোর মাঝে একটি পিঠের উপর তিনজন বন্দুকধারী ও ছোট্ট কামান সহ-লাল রঙে রাঙানো শুড় তুলে ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। শত্রু দলের ভাগ্যবান গুলি এসে লোহার পাতে মোড়া দেহবর্মের বাইরে ঠিক ডান চোখে আঘাত হেনেছে। গাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ল বাঁকানো দাঁতের উপর, ঘুরে গিয়ে আস্তে করে মাটিতে পড়ে গেল বিশালদেহী প্রাণীটা-সাথে পড়ে গেল ব্রোঞ্জের কামান আর বন্দুকধারী সবাই। আর এ সবকিছুই পড়ে গেল শাহজাহানের ডান পাশে ছুটতে থাকা দেহরক্ষীর পথের উপর। সাথে সাথে ঘোড়া হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। আরোহী সৈন্যটার পা আটকে গেল বড় একটা পাথরের মাঝে।

যুদ্ধের অন্য সব শব্দ ছাপিয়ে আহত সৈন্যের আর্তনাদ শুনতে পেলেন ম্রাট। একই সাথে নিজের বাম গোড়ালিতেও তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন, পাশের দিকে হেলে আরেকটু হলে পড়ে যাচ্ছিল তাঁর নিজের ঘোড়াও। পড়ে থাকা ঘোড়া লাথি দিয়েছে তাদের উপর। গোড়ালির ব্যথা তীব্র হলেও ঘোড়া ছুটিয়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য এতে করে পাহাড়ের দিকে এগোতে থাকা তাঁর অশ্বারোহী দলের পথ রুদ্ধ করে ফেলায় গতি কমে গেল তাদের। ঠিক যখন নিজের ঘোড়াকে সামলে নিলেন, শাহজাহান দেখতে পেলেন দুর্গের দিক থেকে ছুটে আসছে অন্তত ত্রিশ জনের শত্রু বাহিনী। দূরত্ব খুব বেশি হলে তিনশ গজ। এদিকে গজিয়ে ওঠা সমস্যার সুযোগ নিতেই ছুটে আসছে তারা।

যুদ্ধহাতির উপর থেকে বন্দুকধারীরা গুলি করে দুজন শত্রু অশ্বারোহীকে ফেলে দিল ঘোড়ার পিঠ থেকে, ঢালুর সুবিধা নিয়ে বাকিরা এসে চড়াও হল সম্রাটের বাহিনীর উপর। দাড়িওয়ালা এক অশ্বারোহী বন্যভাবে হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে এগিয়ে এসে বর্শা ছুঁড়ে মারলো হাতির গাল লক্ষ্য করে। তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়ে পাহাড়ে হারিয়ে গেল বর্শাটা। তবে তার আগে আঘাত করে গেল পথিমধ্যে পড়া কয়েকজন পদাতিক সৈন্যকে। আরেকজন বিদ্রোহী অশ্বারোহী শাহজাহানের এক দেহরক্ষীর ধূসর ঘোড়ার বুকে আঘাত করল লম্বা বর্শা দিয়ে, প্রায় তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করল অবোধ জীবটা। তৃতীয়জন নিজের ঘোড়ার পিঠে বসেই গেঁথে ফেললো শাহজাহানের এক তরুণ কর্চিকে। এটা ছিল বেচারার প্রথম যুদ্ধ–নিঃসন্দেহে এটিই শেষ।

নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে সম্রাট এগিয়ে গেলেন আক্রমণকারীর দিকে, যে কিনা ব্যস্ত আহত তরুণের বুক থেকে নিজের বর্শা টেনে বের করবার কাজে। মাটিতে শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে তরুণ কর্চি। সময় মত শাহজাহানের দিকে ফিরে তাকাতে পারল না শত্রুসৈন্য, সম্রাটের তলোয়ার কঠিনভাবে আঘাত করল তার হাঁটুর উপরে, পড়ে গেল লোকটা আর হাতের বর্শা পড়ে গেল মৃতপ্রায় কর্চির দেহের পাশে। বিদ্রোহীদের ভার অন্যদের উপর ছেড়ে দিয়ে তিনি আক্রমণ করলেন আরেকজন শত্রু সৈন্যের উপর; মনোযোগ দিয়ে রাজকীয় বন্দুকধারীর গলা কেটে ফেলতে উদ্যত লোকটা টেরও পেল না কখন এগিয়ে এলেন সম্রাট যতক্ষণ পর্যন্ত না অনুভব করল যে আঘাত লেগে ফেটে গেছে নিজের মাথার খুলি। ঘোড়ার পিঠে বসে মাথা ঘুরিয়ে সম্রাট দেখলেন বিদ্রোহীদের আক্রমণ প্রতিহত করে তাঁর সৈন্যরা এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের দিকে। গোড়ালিতে প্রচণ্ড ব্যথা সত্ত্বেও সামনের দিকে ছুটলেন নিজের ঘোড়া নিয়ে।

ঝোঁপঝাড় দিয়ে বানানো ব্যারিকেডের একটি পার হল তার ঘোড়া, এমন সময় আরো একবার তীব্র ব্যথা অনুভব করলেন শাহজাহান। এবার বাম কাঁধে। কাঁধে লাগার আগে একটা উড়ন্ত গুলি এসে ধাক্কা খেয়েছে তার বুকের বর্মের কিনারে। দ্বিতীয় গুলির বলটা পার হয়ে গেল মাথার কাছে দিয়ে হিসহিস শব্দ করে। এরপরই কয়েকটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে মরিয়া হয়ে পুনরায় গুলি ভরার কাজে ব্যস্ত থাকা শত্রুসৈন্যদের উপর চড়াও হলেন শাহজাহান। একজন বন্দুকের লম্বা ব্যারেল ঘুরিয়ে চেষ্টা করল ধাক্কা দিয়ে সম্রাটকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিতে। কিন্তু শাহজাহানের তলোয়ার কেটে ফেলল লোকটার গাল, উনুক্ত হয়ে পড়ল দাঁতের সারি, পড়ে গেল সৈন্যটা। মিনিটখানেকের ভেতরে দুর্গের দেয়ালের ভেতরে ঢুকে পড়লেন মোগল সম্রাট ও সৈন্যের দল। সমানে কচুকাটা করতে লাগল বিজাপুরের সৈন্যদের, এরা আবার মরিয়া হয়ে পালাতে লাগল এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। একটু পরেই কয়েকজন বিদ্রোহী নিজেদের তলোয়ার ফেলে দিয়ে ভূমিবনত হল দয়া ভিক্ষার জন্য। অন্যরা বেশির ভাগই অশ্বারোহী, চেষ্টা করল পালাতে কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হল স্রাটের অশ্বারোহী বা বন্দুকধারীদের বদৌলতে। একজন শত্রু অশ্বারোহী সাদা আলখাল্লা পরিহিত বিশালদেহী একজন নিজের ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেও পা জড়িয়ে ফেললো পাদানিতে, ফলে ঘোড়াটা নিজের আরোহীকে নিয়েই ছুটে গেল পাহাড়ের নিচের দিকে। পাথর থেকে পাথরে ধাক্কা খেয়ে মাংসের দলাতে পরিণত হল চূর্ণ-বিচূর্ণ মাথা। আরেকজন শত্রুসৈন্য, পোশাক দেখে বোঝা গেল একজন সেনাপতি, বেকায়দাভাবে হাত ঝুলতে থাকা অবস্থায় ভূপাতিত হল মাটিতে। শাহজাহানের পাশ থেকে এগুলি ছুড়ছে একজন বন্দুকধারী, না হলেও দুইশ গজ অতিক্রম করে গুলি আঘাত হেনেছে শত্রুসৈন্যকে। ফিরে তাকিয়ে নিজ সৈন্যকে অভিবাদন জানালেন শাহজাহান, প্রতিজ্ঞা করলেন এ দক্ষতার জন্য পুরস্কৃত করা হবে তাকে, ঠিক সে সময় পাহাড়ের উপর থেকে দেখতে পেলেন নিচে বোরহানপুরের দিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে একদল অশ্বারোহী।

একটুক্ষণ দ্বিধা করলেন শাহজাহান। যুদ্ধ জেতা হয়ে গেছে আর তিনি এটাও জানতে আগ্রহী যে কারা এরা।

নিজের দেহরক্ষীদের ডেকে অনুসরণ করতে বলে নিজের ঘোড়া ছোটালেন সম্রাট। পাহাড়ের নিচে নেমে গাছের সারির কাছে অপেক্ষারত অশ্বারোহীর দিকে এগিয়ে গেলেন। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলেন ছয়জন মানুষ–পাঁচজন সৈন্য ও সবুজ আলখাল্লা পরিহিত সাদা বেশধারী একজন। মাথা ঘুরাতেই সম্রাট চিনতে পারলেন আসলান বেগকে। কী এমন ঘটেছে যে তার বয়স্ক পরিচারক বোরহানপুর থেকে যুদ্ধের মাঠে ছুটে এলো?

নিজের ক্লান্ত ঘোড়াকে আরো জোরে ছুটিয়ে নিলেন শাহজাহান, কান নেড়ে অভিযোগ জানালো জন্তুটা। নিজের রক্ষীদের ফেলে মানুষের ছোট্ট দলটার কাছে এগিয়ে গেলেন সম্রাট। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে? কী ব্যাপার?

জাহাপনা! সময়ের আগেই ম্রাজ্ঞীর প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। শাহজাদি জাহানারা আমাকে পাঠিয়েছেন সংবাদ জানাতে…আমি অনুভব করেছি যে এটা আমার দায়িত্ব, তাই নিজেই এসেছি.. বৃদ্ধ মানুষটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এই কঠিন পরিশ্রমে ও ভ্রমণে নিশ্চয় তার সব শক্তি শেষ হয়ে গেছে।

হঠাৎ করেই পাকস্থলী থেকে মনে হল ঠাণ্ডা স্রোত বের হতে লাগল। জাহানারা কেন এত তাগাদা দিয়ে সংবাদ পাঠিয়েছে? যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে কী তারা তার ফেরার জন্য জন্ম সংবাদ রেখে দিতে পারেনি? ম্রাজ্ঞী কেমন আছেন? জানতে চাইলেন শাহজাহান।

আমি জানি না। যখন আমি এসেছি, হাকিমেরা ওনার সাথেই ছিল… আমি তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য অপেক্ষা করিনি। আপনার কন্যা জোর করছিলেন যেন কোন সময় নষ্ট না করা হয়।

দ্বিধায় পড়ে গেলেন শাহজাহান। পুরো ইচ্ছেশক্তি দিয়ে চাইছেন বোরহানপুরে ছুটে যেতে; কিন্তু এত কষ্টে অর্জিত জয়ের সম্ভাবনা কেউ হেলায় নষ্ট করতে পারেন না। দ্রুত চিন্তা করে নিয়ে দেহরক্ষীদের দলনেতার দিকে তাকালেন।

অশোক সিংকে জানাও যে, এখানকার দায়িত্ব তার উপর অর্পণ করা হল। তার প্রতি আমার আদেশ হল যে যতদূর সম্ভব বিজাপুরদের ধাওয়া করতে; কিন্তু কোন ঝুঁকি নিয়ে নয়। এই দুর্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে বাকি সৈন্যদেরকে নিয়ে যেন বোরহানপুরে ফিরে আসে। আর দ্রুত আমার জন্য নতুন একটি ঘোড়া নিয়ে এসো।

নিজের ঘোড়াকে আরো জোরে ছোটার তাগিদ দিয়ে অস্পষ্ট দিগন্তের দিকে চোখ আটকে রাখলেন সম্রাট। ইচ্ছে হচ্ছে বোরহানপুরে কী ঘটছে তা যদি এখান থেকেই দেখা যেত, যদিও তিনি জানেন যে অনেক মাইলের ব্যবধান উভয়ের মাঝে। আহত বাম গোড়ালিও বেশ ব্যথা করছে, নিজের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন পায়ের কাছের কাপড় ভিজে গেছে রক্তে। নিজের না শত্রুর নিশ্চিত হতে পারলেন না–কিন্তু যুদ্ধের স্মৃতি এরই মাঝে মুছে যেতে শুরু করেছে মন থেকে। সমগ্র ভাবনা জুড়ে শুধুই মমতাজ ও কখন তাঁর সাথে দেখা করবেন তাতে ব্যগ্র হয়ে আছেন শাহজাহান। অন্তত এ সংবাদটুকু মমতাজকে স্বস্তি দেবে যে তিনি যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে এসেছেন।

অবশেষে আবছা আলোয় সামনে দেখতে পেলেন তাপ্তি নদী। আর এর উত্তর দিকে দেখা গেল চৌকোনা টাওয়ার সেখানে রয়েছে মমতাজের আবাস।

ঘোড়া ছুটিয়ে নিচে তীরের দিকে নেমে গেলেন তিনি, এরপর অগভীর কাদা পানির মধ্য দিয়ে হাতিমহলের প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে গেলেন; এই পথে প্রতি সন্ধ্যায় হাতিদেরকে তাদের খোয়াড় থেকে বের করে নদীতে আনা হয় গোসল আর পানি পান করতে। সাধারণত এই পথে তিনি দুর্গে প্রবেশ করেন না, কিন্তু এটিই দ্রুততম পথ।

হাতিমহলের বাইরের আঙিনাতে সম্রাটকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেল প্রহরী। ঘোড়া থেকে নেমে গোড়ালির ব্যথা সত্ত্বেও অর্ধেক দৌড়ানো আর অর্ধেক খোঁড়ানোর ভঙ্গিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন দুর্গের প্রাণকেন্দ্রে থাকা হারেমে। যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন। এরপর কোনমতে বুকের বর্ম খুলেই হারেমের প্রবেশমুখে অপেক্ষমান সেবাদাসীর হাতে ছুঁড়ে দিলেন। সাধারণ সময় হলে রক্ত ধুয়ে যুদ্ধের ঘাম মুছে পরিষ্কার হয়ে তবেই যেতেন; কিন্তু এখন যেভাবে আছেন সেভাবেই ছুটলেন মমতাজের কাছে।

এত হঠাৎ করে তিনি এসেছেন যে সাধারণত সম্রাটের আগমনবার্তা যেভাবে ধ্বনিত হয়, তর জন্যে সময় পাওয়া যায়নি। জাহানারা মাতার কক্ষের অর্ধখোলা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের মেঝেতে পিতার পদশব্দ শুনতে পেয়ে মাথা তুললে পর শাহজাহান দেখতে পেলেন পানি পড়ছে তার চোখ বেয়ে।

জাহানার কী হয়েছে? কী ঘটেছে?

নতুন শিশু কিছুতেই আসছে না। গত তিন ঘণ্টা ধরে মা এই যন্ত্রণা ভোগ করছেন। কিছুই সাহায্য করতে পারছে না। আমি চেষ্টা করেছিলাম শান্ত করতে কিন্তু তিনি শুধু আপনাকে দেখতে চেয়েছেন… জাহানারা কথা শেষ করার আগেই দীর্ঘ চিৎকার শোনা গেল; মানুষ নয় মনে হল কোন পশু চিৎকার করে উঠল। এতটা ভয় পেয়ে গেলেন শাহজাহান যা তিনি কখনো যুদ্ধক্ষেত্রেও অনুভব করেননি। সামনে পা বাড়িয়ে পুরো দরজা খুলে ভেতরে তাকালেন।

নিচু একটি বিছানায় শুয়ে আছেন মমতাজ, হাঁটু ভোলা অবস্থায় পিঠ দিয়ে শুয়ে দুই হাতে শক্ত করে ধরে আছেন বিছানার পাশ। সাদা চাদর ভরে গেছে ঘামে। লম্বা চুলের রাশি লেপ্টে আছে ব্যথাতুর মুখের সাথে, চিবুক তুলে আবারো চিৎকার করে উঠলেন তিনি। সাত্তি আল-নিসা হাত ধরে রেখে চেষ্টা করছে শান্ত করতে, কিন্তু মমতাজ এত বন্যভাবে সরিয়ে দিচ্ছে যে সাত্তি আল-নিসা ধরে রাখতে পারছে না। দুজন হাকিম, একজন বয়স্ক, আরেকজন কম বয়সী, দাঁড়িয়ে আছে কক্ষের এক কোণায়।

কয়লার উনুনের উপর তামার পাত্রে বুদবুদ তুলে কড়া গন্ধওয়ালা কিছু একটা ফুটছে।

ওনাকে ছেড়ে দিন জনাবা। ওষুধ প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে, ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে। হাকিমদের একজন বলে উঠল।

চোখ তুলে দরজার কাছে শাহজাহানকে দেখতে পেল সাত্তি আল নিসা। তার মুখে একই অসহায় অভিব্যক্তি দেখতে পেলেন সম্রাট, যা তিনি দেখেছিলেন কন্যার মুখে।

উঠে দাঁড়িয়ে একপাশে সরে গেল সাত্তি আল-নিসা। ধীরে ধীরে শাহজাহান এগিয়ে গেলেন বিছানার কাছে। কোন একভাবে মমতাজ বুঝতে পারল যে তিনি এসেছেন, মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই আরো একবার প্রসব ব্যথা এসে নাড়িয়ে দিল। তবে এবার তিনি চিৎকার করলেন না, শাহজাহানকে পাশে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে হাসলেন। ফিসফিস করে বললেন, আপনি এসেছেন।

অবশ্যই। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

না। বাচ্চাটা আসবে না… আমি অনেক চেষ্টা করেছি…আমি চাই না ও আমার ভেতরে মৃত্যুবরণ করুক।

যখন প্রস্তুত তখন এসে যাবে… শান্ত হও।

হাকিমেরাও এটাই বলছে, কিন্তু আমি পারছি না। ব্যথা আর চাপে মনে হচ্ছে আমার শরীর ছিঁড়ে যাবে, কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।

জাহাপনা। বয়স্ক হাকিম এসে শাহজাহানের পাশে দাঁড়ালো। হাতে একটি কাপ। এই ওষুধ ব্যথা কমিয়ে দেবে।

আমাকে দাও। বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে শাহজাহান কাপটা ধরলেন মমতাজের মুখের কাছে।

খেয়ে নাও… প্রথম দিকে হলুদ রঙের তরল চিবুক বেয়ে গড়িয়ে পড়লেও শেষপর্যন্ত খানিকটা খেয়ে নিলেন মমতাজ।

এতে যন্ত্রণা প্রশমিত হবে জাহাপনা। ভেতরে দানা বাঁধা চিন্তা কমে যাবে। ষোল ঘণ্টা চলছে যে প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে। তিনি প্রায় নিঃশেষ হয়ে পড়েছেন। কয়েক মিনিটের মাঝে নিস্তেজ হয়ে পড়বেন।

জানালো হাকিম। কিন্তু মনে হল যেন তাকে ভুল প্রমাণিত করতেই আবারো চিৎকার করে উঠলেন মমতাজ। ব্যথার ভারে ঝটকা দিয়ে শাহজাহানের হাতের কাপ ফেলে দিলেন, সবটুকু তরল গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। ও আসছে। নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়। অসংখ্য ধন্যবাদ, আল্লাহ ও আসছে অবশেষে… এত জোরে শাহজাহানের ডান হাত চেপে ধরলেন যে নখ ঢুকে গেল মাংসের ভেতরে।

ওর ব্যথা আমাকে দাও। আমাকে বহন করতে দাও এ যাতনা। আপন মনে প্রার্থনা করতে লাগলেন শাহজাহান।

হঠাৎ করেই মমতাজ তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে বসার মত ভঙ্গি করলেন। চাদরের নিচে হাঁটু উঠে গেল দুই ভাঁজ হয়ে। এরপর ঝট করে মাথা নামিয়ে দিলেন পেছন দিকে। কিন্তু এবারের চিৎকারে হতাশা নয় বিজয়ের সুর ভেসে এলো। পরমুহূর্তেই শিশুর কান্না শুনতে পেলেন শাহজাহান।

জাহাপনা, দেখুন, অনিন্দ্যসুনদর কন্যাশিশু। সাত্তি আল-নিসা এক টুকরো সবুজ লিনেন কাপড়ে মোড়ানো পুঁটুলি ধরে রেখেছে হাতে মোগল রাজবংশের নতুন আগত অতিথির উপযুক্ত এই কাপড়।

অবসন্নভাবে পায়ের উপর দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্তভাবে তাকালেন শিশুর দিকে; কিন্তু তার সব চিন্তা মমতাজকে ঘিরে। আমি জানতাম যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে… শুরু করলেন শাহজাহান। কিন্তু আবারো পত্নীর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন মমতাজের চেহারায় আনন্দ নয় আতঙ্কের চিহ্ন। বুঝতে পারলেন যে চাদর, বস্তুত পুরো বিছানাই লাল বর্ণ ধারণ করেছে রক্তে। হাকিমদের বিস্মিত আর ত্রাস মেশানো চিৎকার ছাড়াও তিনি বুঝতে পারলেন যে এই রক্ত সন্তান জন্মদান জনিত নয়।

একপাশে সরে গিয়ে হাকিমদেরকে কাজ করার সুযোগ দিলেন সম্রাট। এদিকে সাত্তি আল-নিসা শিশুকে আরেকজনে দাসীর হাতে দিয়ে দৌড়ে গিয়ে নিয়ে আসল তুলার কাপড়, হাকিমেরা যা দিয়ে রক্ত শুষে নিচ্ছে। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে মমতাজ, শরীর একেবারে স্থির। পার হতে লাগল মিনিটের পর মিনিট। শাহজাহানের মনে হল হাকিমেরা কিছুই করছে না, শুধু মমতাজের ভেতর থেকে বের হওয়া রক্তের ধারা মুছে চলেছে। তামার বেসিন যেখানে তারা কাপড় ধুচ্ছে, সেখান থেকে উপচে পানি পড়ে পড়ে লাল হয়ে গেছে পুরো মেঝে।

নিশ্চয় কিছু করার আছে। বলে উঠলেন ম্রাট, কিন্তু কোন প্রত্যুত্তর পেলেন না। শুধুমাত্র মাথা নেড়ে নিজেদের মাঝে কথা বলতে লাগল দুই চিকিৎসক।

আমাদেরকে একা থাকতে দাও! হঠাৎ করেই পরিষ্কার কণ্ঠে তীক্ষ্ণভাবে বলে উঠলেন মমতাজ।

আমি কিছুক্ষণ আমার স্বামীর সাথে একাকী থাকতে চাই। যাও… এখনি যাও…! বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে এভাবে আদেশ দিতে আর কখনো মমতাজকে শোনেননি শাহজাহান।

হাকিম দুজন আর সাত্তি আল-নিসা তাকাল তাঁর দিকে। সম্রাজ্ঞীর আদেশ পালন কর, কিন্তু কাছাকাছি থাকো যেন তলব করলেই আসতে পারো। নির্দেশ দিলেন সম্রাট।

মমতাজ… একাকী হতেই কথা বলে উঠলেন তিনি।

না, আমাকে বলতে দিন। রক্তের সাথে সাথে আমার জীবনও আমার হাত ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি মারা যাচ্ছি…আমি জানি। কেউ কিছুই করতে পারবে না। শেষ এই মূল্যবান সময়গুলো আমি আপনার সাথে কাটাতে চাই। আমাকে শক্ত করে ধরে রাখুন…আপনার হৃদয়ের স্পন্দন আমাকে অনুভব করতে দিন।

আবারো হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে পাজাকোলা করে পত্নীকে ধরে রাখলেন শাহজাহান।

তুমি খুব সুন্দর একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে আর শীঘ্রই সুস্থ… হাকিমেরা রক্তপাত বন্ধ করে দেবে…

না, আমার হৃদয় বলছে যে তা হবে না। আমার কথা শোনেন… একসাথে আর বেশিক্ষণ থাকতে পারব না আমরা। চেতনা পরিষ্কার থাকতে থাকতে আপনাকে কয়েকটা কথা বলতে চাই আমি…

যা খুশি বলো।

দয়া করে আর বিবাহ করবেন না…যদি আপনি অন্য নারীর সাথে আরো ছেলেমেয়ের জনক হন তাহলে তা আমাদের পুত্রদের জন্য ঝুঁকির কারণ হবে। এটা ঘটতে দেয়া যাবে না…সভাইদের মাঝে বিবাদ দুঃখ ছাড়া আর কিছু ডেকে আনে না। আমরা উভয়েই এটা জানি।

আমি আর কাউকে বিবাহ করব না। তুমিই আমার সব…সবকিছু।

আমি অনেক স্বস্তি পেলাম–জানতে পারলাম যে আমি সব সহ্য করতে পারব, এমনকি আপনাকে ছেড়ে যাওয়াও। কিন্তু আরো কিছু আছে। যা আপনাকে অনুনয় করতে চাই। স্বপ্নে আমি সাদা মার্বেলের সমাধি দেখেছি…বিশাল বড় একটা মুক্তোর মতই উজ্জ্বল…এরকম একটি স্থান নির্মাণ করেন যেখানে আপনি আর আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাকে স্মরণ করতে আসতে পারবে।

সমাধির কথা বলো না। আরো অনেক বছর আমরা একসাথে থাকব। এত জোরে স্ত্রীকে আগলে ধরলেন সম্রাট যেন তার ভেতরে বয়ে যাওয়া জীবনীশক্তি মমতাজের মাঝেও শক্তি সঞ্চার করবে।

দয়া করে…আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেন…আপনাকে করতেই হবে। তাহলে আমি শান্তিতে যেতে পারবো-যা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

যখন সময় আসবে আমি পৃথিবীতে তোমার জন্য স্বর্গ নির্মাণ করে দেব। কোন কিছু চিন্তা করব না, অর্থ, প্রচেষ্টা কিছুই না। পৃথিবীর কাছে এটি এমন একটি মার্বেল হবে, যা এর ত্রুটিহীন সৌন্দর্যই নয় বরঞ্চ মানুষ এটিকে জানবে ত্রুটিহীন ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে।

 শুনতে পেলেন মমতাজ–গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেললেন। যেন কথাগুলো তাকে প্রশান্তি এনে দিয়েছে। কয়েক মিনিটের জন্য চুপচাপ একে অন্যকে ধরে রইলেন দুজনে, এরপর ফিসফিস করে মমতাজ বলে উঠলেন,

কখনো আক্ষেপ করবেন না, আপনি, দারা, জাহানারা অথবা আমাদের কোন সন্তানও না…আমার মত করেই ভালোবেসে তাদেরকেও…তাদের সামনে এখনো অনেক কিছু পড়ে আছে। যেমনটা আমি একদা করেছিলাম, প্রথম রাতে যখন আপনাকে দেখেছিলাম মিনা বাজারে। সেই রাতের কথা মনে আছে? গাছের গায়ে লণ্ঠন ঝুলছিল, আমার দোকানে এসেছিলেন আপনি। দরদাম জানতেন না ভাল…শাহজাহান, আসছে বছরগুলোতে স্মরণ করবেন আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসতাম– অন্যকে যতটুকু ভালোবাসা যায় তার চেয়েও বেশি।

আর আমিও তোমাকে ভালোবাসি…আর এই কারণেই আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না তুমি…।

আমার ভাগ্য লেখা হয়ে গেছে। এর বাইরে যাবার ক্ষমতা নেই আমার। উঠে দাঁড়ান, শেষবারের মত আপনাকে দেখতে দিন…

মনে হল যেন স্বপ্নের ঘোরে মমতাজকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শাহজাহান। মমতাজের ফ্যাকাশে মুখে এমন বেদনার্ত একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে যে অশ্রুমাখা চোখে শব্দ খুঁজে পেতে চেষ্টা করছেন শাহজাহান। সব শক্তি যেন শুষে নেয়া হয়েছে তাঁর শরীর থেকে, মমতাজ… শুধু এটুকুই বলতে পারলেন সম্রাট। হাঁটু গেড়ে আবারো জড়িয়ে ধরলেন পত্নীকে।

কমনীয় চোখ জোড়ার উপর ইতিমধ্যেই নেমে এসেছে একটা ছায়া। রণক্ষেত্রে বহুবার এ চাহনি তিনি দেখেছেন শত্রু কিংবা বন্ধুর চোখে যখন আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় হয়। আমাকে ভুলে যাবেন না… মাথা পিছনে ফেলে দেয়ার আগে ফিসফিস করে জানালেন মমতাজ। ছোট্ট রক্তমাখা আকৃতিটার দিকে তাকিয়ে শাহজাহানের মনে হল এখনো কথাগুলো বাতাসে ভাসছে, যদিও ভালোবাসার নারী তাকে ছেড়ে চলে গেছেন চিরতরে।

.

১.৫

বার্নিশ করা রুপার আয়নাতে যে চেহারা দেখা গেল তা কোন এক আগন্তুকের। কৃশকায় অবয়বের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শাহজাহান, চোখের নিচে ফোলা, টুপির নিচ থেকে এলোমেলো যে কেশরাজি দেখা যাচ্ছে সেগুলোও কালো হবার কথা ছিল–এমন রুপালি সাদা তো নয়! আয়নাতে নিশ্চয় কোন সমস্যা আছে। পাথরের থামের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিলেন আয়না। তাকিয়ে দেখলেন কার্পেটময় ছড়িয়ে পড়ল ফ্রেমে লাগানো মুক্তাদানা। যাই হোক, তাঁকে কেমন দেখাচ্ছে তাতে আর কী বা যায় আসে–তিনি খেলেন না বা পান করলেন কী করলেন না…আরেকটা সূর্যোদয় দেখলেন কী দেখলেন না? মমতাজ বিনা জীবনই বা কী আছে বাকি আর।

কক্ষের জোড়া দরজা ভেদ করেও শুনতে পেলেন বাইরের ফিসফিস আওয়াজ। ক্ষেপে গেলেন সম্রাট। আদেশ দিয়েছেন যেন তাকে বিরক্ত করা না হয়…এমনকি পুত্র-কন্যারাও আসতে পারবে না। গত পাঁচ দিন যাবৎ কেউ যদিও কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না তাঁর এই বেদনার্ত অবস্থায়; তারপরেও যখন তখন পদশব্দ সহ কানা-ঘুষা, তর্ক-বিতর্ক শুনতে পাচ্ছেন যে সম্রাট আর কতক্ষণ এভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবেন। তিনি নিজেই নিজেকে চিনতে পারছেন না। সম্ভবত চিরতরে…দরবারের কাজ আবারো শুরু করা তো অচিন্ত্যনীয়। কীভাবে তিনি মিষ্ট ভাষণের পেছনে স্বার্থপর উচ্চাকাঙ্খ মেটানোর জন্য সভাসদদের আর্তি শুনবেন অথবা তুচ্ছ বিষয়ের বিবাদ মেটানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন যখন তাঁর সমগ্র সত্তাই হয়ে পড়েছে শূন্য আর অনুভূতিহীন?

মমতাজের মৃত্যুর পর প্রথম কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত স্থবিরের মত হয়ে পড়েছিলেন শাহজাহান। চলে গিয়েছিলেন শোক আর আতঙ্কের উর্ধ্বে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছেন সাত্তি আল-নিসা মোলায়েমভাবে কর্পূর মেশানো পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে মমতাজের শরীর, আইভরি চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দিয়েছে লম্বা কেশ, এরপর পরিয়ে দিয়েছে সাদাসিধে কাপড়। আর পুরোটা সময় অশ্রু গড়িয়েছে সাত্তি আল-নিসার নিজের গাল বেয়ে। তার কাজ শেষ হবার পর, পবিত্র কোরান থেকে মৃতের উদ্দেশে প্রার্থনা আয়াত উচ্চারণ করলেন ইমামেরা; এরপর একে একে সবাই মৃতের কক্ষ ছেড়ে গেল শাহজাহান যেন অন্তিম বিদায় জানাতে পারেন প্রিয়তমা পত্নীকে। ইতিমধ্যেই শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে যখন চুমু খেলেন তিনি, এক মুহূর্তের জন্য হাত চেপে বসল কাপড়ের ভাঁজে থাকা ছুরির উপর, প্রচণ্ডভাবে মন চাইল নিজের জীবনও শেষ করে দিয়ে মমতাজের সাথে বেহেশতের পথে যাত্রা করার।

আর এখন মমতাজ প্রথানুযায়ী নারীদের শব আচ্ছাদনের জন্য পাঁচ টুকরা সাদা কাপড় জড়িয়ে শুয়ে আছে তাঁর অস্থায়ী সমাধিতে। তাপ্তি নদীর অপর পাড়ে পুরাতন মোগল বিনোদন ভূমির দেয়ালের মাঝে জায়নাবাদ বাগান উত্তর দিকে মাথা দিয়ে মক্কামুখী করে শোয়ানো হয়েছে মমতাজকে। একেবারে সাধারণ পোশাকে, কোন রত্ন ধারণ ছাড়াই শব শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন শাহজাহান। এমনকি পেছনে অনুসরণ করে আসা হাতির পিঠে সন্তানেরা কিংবা সভাসদদের সম্পর্কেও অসচেতন ছিলেন। একটা মাত্র বাদ্যের হালকা বাজনা তাল সঙ্গত করেছে এ শ্রদ্ধাবিনীত শেষযাত্রায়।

গরাদহীন জানালার কাছে গিয়ে তাপ্তি নদীর ওপাড়ে তাকালেন। কল্পনার চোখে দেখতে পেলেন প্রথম প্রভাতের মুক্তার ন্যায় আলোর মাঝে জ্বলছে হাজারো মোমবাতির উজ্জ্বল শিখা। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যেন মমতাজের সমাধি সবসময় আলোকিত থাকে হাজার মোমবাতির আলোয়। হঠাৎ করেই মাথা ঘুরে উঠল। পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে সামলে নিলেন মার্বেল টেলিলের কিনার ধরে। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে কলসের কাছে গিয়ে গলায় ঢেলে দিলেন সবটুকু পানি। পাকস্থলীতে তরল গিয়ে পৌঁছানোর সাথে সাথে মনে হল তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। থপ করে মেঝেতে বসে দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে বন্ধ করে ফেললেন চোখ।

আব্বাজান…আব্বাজান… ওঠেন!

ভাঙ ভাঙা ঘুমের মাঝে শুনতে পেলেন মোলায়েম গলার স্বর আর একটা হাত তার কাধ ধরে নাড়া দিচ্ছে। ভারী চোখ মেলে শাহজাহান দেখতে পেলেন তাঁর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে আছে জাহানারা।

তুমি এখানে কেন? আমি বলেছি আমি একা থাকতে চাই… বিড়বিড় করে উঠলেন শাহজাহান। জানালা দিয়ে তেরছা মতন সূর্যের আলো এসে পড়েছে ঘরের মাঝে; কিন্তু তিনি বুঝতে পারলেন না যে কতক্ষণ যাবত ঘুমিয়েছেন।

আমি আপনাকে নিয়ে অনেক উদ্বিগ্ন ছিলাম, আমরা সকলেই… বিরক্ত না করার আদেশ তাই মানতে পারি নি।

মাথা থেকে টুপি খুলে ফেললেন শাহজাহান। চুলে হাত বুলাতেই শুনতে পেলেন জাহানারার দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। আমার বেশভূষা দেখে অবাক হচ্ছ তুমি; কিন্তু সুন্দর পোশাক বা দামি রত্ন আর প্রয়োজন নেই আমার… এই সংক্ষিপ্ত পোশাকে তোমার মায়ের শব শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছি আমি আর ততক্ষণ পর্যন্ত খুলব না, যতক্ষণ না এগুলো খসে পড়ে আমার দেহ থেকে।

আপনার চুল, আব্বাজান…।

কী বলতে চাও? এক গোছা চুল সামনে এনে পরীক্ষা করে দেখলেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যখন ঘোড়া ছুটিয়ে মমতাজের কাছে এসেছিলেন তখন এগুলো ঠিক রাতের মতই কালো ছিল। এখন বেশির ভাগটাই সাদা। আয়না মিথ্যা বলেনি।

আল্লাহ আমাকে সত্যিই অভিশাপ দিয়েছেন। আমার পাপের জন্য শাস্তি দিয়েছেন। এটি তারই ইশারা।

আব্বাজান… আব্বাজান, …শোকে আর দুঃখেই এমনটা….।

না, এটা একটা বার্তা আমাদের সৃষ্টিকর্তা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে আমার সম্পদ আর ক্ষমতা সত্ত্বেও আমি শুধুমাত্র একজন মানুষ–খরার কারণে মৃত্যুবরণ করা কৃষকদের মতই কষ্ট ভোগ করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছি। বেদনা মাখা হাসি হেসেই আবার থেমে গেলেন, এর চেয়েও গভীর চিন্তা এসেছে মাথায়। মমতাজের মৃত্যু কী সম্ভাইদের হত্যার দেনা শোধ?

কার্পেটের দিকে তাকাতেই রক্ত লাল আর নীল রং নাচতে লাগল চোখের সামনে, মনে হল আবারো মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। সামনে ঝুঁকে মাথা চেপে ধরলেন হাত দিয়ে আস্তে আস্তে দুলতে লাগলেন।

আব্বাজান, নিজেকে অসুস্থ করে ফেলেছেন। এখনি কিছু খাওয়া দরকার। বলে চলল জাহানারা, তোমার পরিচারকদের বলছি খাবার তৈরি করে দেবে।

এ কথা শুনেই মোচড় দিচ্ছে পাকস্থলী।

আপনাকে চেষ্টা করতে হবে, আমাদের পরিবারের জন্য। আমাদের দরকার আপনাকে। আর ভুলে গেছেন আপনার নতুন আগত কন্যার কথা। সাত্তি আল-নিসা তার এতটাই খেয়াল রাখছে যতটা রাখত আমাদের নিজের মা। কিন্তু তার পরেও ওর যত্নের জন্য আপনার আদেশ আমাদের জানা দরকার…

হাত তুললেন শাহজাহান। যে সন্তানের জন্মের কারণে জীবন দিতে হয়েছে মমতাজকে, তাকে নিয়ে চিন্তা করতে চান না তিনি।

সাত্তি আল-নিসাকে জানাও আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ; কিন্তু এ বিষয় এখন মুলতবী থাকুক।

পৃথিবীকে এড়িয়ে আপনি তো শুধু এ জায়গায় থাকতে পারেন না।

আমার কোন ইচ্ছে নেই। আজ ঠিক এক সপ্তাহ হয়েছে যে তোমার মা মৃত্যুবণ করেছেন। আজ রাতে আমি আবারো তাঁর সমাধিতে যাবো।

আমাকে আপনার সাথে আসতে দিন, আব্বাজান…দারাও যাবে। আপনার জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে এতে কোন সমস্যা নেই আর আমরাও তাই চাই।

প্রথমে মনে হল যে বলবেন তিনি একা যাবেন। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল যে সন্তানদেরও অধিকার আছে মমতাজের জন্য শোক করার। ঠিক আছে।

সেই সন্ধ্যায় প্রায় কালোর কাছাকাছি এমন ধরনের গাঢ় বেগুনি রঙের কাপড়ে ঢেকে দেয়া পালকিতে চড়ে বসলেন শাহজাহান, জাহানারা আর দারা শুকোহ্। একই প্রবেশদ্বার দিয়ে বের হল পালকি তিনটি, কয়েকদিন আগে এ প্রবেশদ্বার থেকেই বের হয়েছে মাথা সামনে রেখে মমতাজের শব শোভাযাত্রা, বোরহানপুর থেকে। এখনো ইট তুলে দেয়া হয়নি। গ্রাম্য মানুষের বিশ্বাস যে মৃতদেহ যে পথ দিয়ে বের করা হয় সেখানে ইটের দেয়াল তুলে বাঁধা স্থাপন করে দিতে হয়, যাতে নাকি মৃত আত্মা আবার পথ খুঁজে শরীরে ফেরত আসতে না পারে আর এই আত্মা ভূত ছাড়া আর কিছু নয়।

শাহজাহান সবসময় ভাবতেন যে এটি একটি নির্বোধ কুসংস্কার; কিন্তু এখন মনেপ্রাণে কামনা করেন যে যদি এটি সত্যি হত–আত্মা বেশেও মমতাজ যদি ফিরে আসতেন, ক্ষতে খানিকটা প্রলেপ পড়ত। মমতাজের ভূত দেখে কখনোই ভয় পেতেন না তিনি।

পালকি বাহকেরা পায়ে হেঁটেই পার হয়ে গেল নদী, গভীরতা মাত্র ফুট খানেকের একটু বেশি। এরপর এগিয়ে গেল তীর ধরে জায়নাবাদ বাগানের কাছে। অন্ধকারের মাঝেও দেখা যাচ্ছে অর্ধ-ভঙ্গুর খিলানওয়ালা ফটক। এখানেই রাখো আমাকে। আদেশ দিলেন শাহজাহান। পালকি থেকে নেমে অপেক্ষা করলেন জাহানারা আর দারা শুকোহ্র জন্য। এরপর সন্তানদের সাথে এগিয়ে গেলেন প্রবেশদ্বারের দিকে, হালকাভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে রাজপুত প্রহরীর সালাম গ্রহণ করলেন।

খিলানের মাঝে দিয়ে সাদা মার্বেলের প্যাভিলিয়ন, ভেসে যাওয়া মেঘের ফাঁক গলে চাঁদের আলো এসে পড়ায় ছড়াতে লাগল ফ্যাকাশে উজ্জ্বলতা; তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন এখানেই হবে মমতাজের সমাধি। সাধারণ মার্বেল স্ল্যাবের উপরে মমতাজের নাম জ্বলজ্বল করছে হাজারো ছোট মোমবাতির আলোয়।

শাহজাহানের চোখ ভরে গেল অশ্রুতে, তাই সমাধি পর্যন্ত হেঁটে যেতে গিয়ে মনে হল চারপাশের সবকিছু বেড়ে চতুগুণ হয়ে গেছে। সমাধির কাছে পৌঁছে অসহায়ের মত কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন, মার্বেল ধুয়ে যাচ্ছে অশ্রুকণায়। নিচু হয়ে চুম্বন করলেন ঠাণ্ডা পাথর। জীবনের সমস্ত জটিলতায় মমতাজ ছিলেন তাঁর বন্ধু, প্রেমিকা, পথপ্রদর্শক। তাকে ছাড়া প্রতিটি নতুন দিন মনে হল দুঃসহ পীড়াদায়ক। কিন্তু এ বোঝা বহন করতেই হবে। জাহানারা, দারা শুকোহ্ যাদের হাত তিনি অনুভব করছেন কাঁধের উপর, আর অন্য সন্তানদের খাতিরে সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করে তোলা ও রাজবংশের ভবিষ্যত নিরাপদ করার কাজে নিজেকে উৎসর্গ করবেন তিনি। যদিও মমতাজ এখন অন্য জগতের বাসিন্দা, তিনি এ সাম্রাজ্যকে আরও সমৃদ্ধ করবেন পত্নীর স্মৃতি গৌরবময় করার উদ্দেশ্যে…কিন্তু তারপরেও মনে হল এই অনুনয় ফাঁপা আওয়াজ তুলল তাঁর শূন্য চেতনায়, তেমন কোন প্রবোধ পেলেন না তিনি। স্ত্রী পাশে না থাকলে এসবের কীই বা মানে আছে? একটাই শুধু সান্ত্বনা যে জীবনের শেষ সময়ে মমতাজের কাছে একটি প্রতিজ্ঞা করেছেন। মাথা তুলে বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, আমি পৃথিবীর বুকে স্বর্গের মতন একটি সমাধি নির্মাণ করে দেব তোমাকে–আগ্রাতে। এই দুর্ভিক্ষপীড়িত ভূমিতে তোমাকে বেশি দিন শুয়ে থাকতে হবে না। সমাধির কাছে হাঁটু গেড়ে সময়ের সব হিসাব বুঝে গেলেন শাহজাহান।

আব্বাজান…আপনি ঠিক আছেন? দ্বিধাভরা কণ্ঠে জানতে চাইল দারা শুকোহ্।

এইবারই প্রথম তাঁর পুত্র এ জাতীয় কোন কিছু জিজ্ঞেস করল পিতাকে। এর আগপর্যন্ত পিতা হিসেবে তাঁরই দায়িত্ব ছিল সন্তানের লালন-পালন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কত বার তিনি এই একই কথা বলেছেন তাঁর কোন না কোন পুত্রকে যখন সে ঘোড়া থেকে পড়ে গেছে অথবা মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতায় টলমল হয়েছে? কী অদ্ভুত এই জীবন। মাত্র এক সপ্তাহ আগেই কৃষ্ণ কালো চুল নিয়ে, যুদ্ধে ছুটে গেছেন তিনি শত্রুর বিরুদ্ধে, কখনোই বুঝতে পারেননি যে কতটা কাছে–অথবা এই পথে–বেদনা এসে আঘাত করবে। এখন তিনি সহানুভূতির প্রার্থী, সন্তানও অনুকম্পা দেখাচ্ছে যে কিনা এখনো কৈশোর অতিক্রম করেনি।

আমি একজন সম্রাট আর তাই যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা আর জীবনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র যেভাবে সহ্য করেছি, তেমনি এটাও সহ্য করতে হবে। কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে, না, আমি মোটেও ভালো নেই। এই ক্ষত কখনো আরোগ্য হবে না। ব্যথা হয়ত কমে যাবে কিন্তু কখনোই আমাকে ছেড়ে যাবে না। আর আমিও তা চাই না, কেননা এই যাতনা না থাকলে আমি তোমার মাকে ভুলে যাবো।

কোন কিছুই আর আগের মত হবে না, আমাদের কারোর জন্যই। জানালো দারা। ভাইয়ের কথা শুনে জাহানারা হাত বাড়িয়ে খানিকক্ষণ ধরে রাখলো ভাইকে। ঠিক ছোট্টবেলার মত যখন দারার সান্ত্বনার প্রয়োজন হত তখন মাত্র এক বছরের বড় হলেও জাহানারা এমনটাই করত।

আস্তে আস্তে বাগান থেকে বের হয়ে আসার সময় শাহজাহান ভাবলেন যে তার সন্তানেরা এখনো বেশ তরুণ আর সহজেই ভেঙে পড়ে। বেদনার ভার আঘাত করেছে পুরো পরিবারের উপর; পিতা হিসেবে তাকেই এগিয়ে আসতে হবে এর ভার লাঘবের জন্য।

মমতাজের মৃত্যুর পর এই প্রথম মনে পড়ল যুদ্ধের কথা। আর শত্রুর মাধ্যমেই এ ক্ষত উপশম করার চিন্তা করলেন সম্রাট। শত্রু বাহিনী নিশ্চয়ই এতক্ষণে ফন্দি আঁটা শুরু করে দিয়েছে যে কীভাবে এই অবস্থার সুবিধা নেয়া যায়। তারা নিশ্চয়ই আশা করছে যে তিনি দক্ষিণাত্য ছেড়ে শোক করার জন্য আগ্রাতে ফিরে যাবেন। ভ্রুকুটি করে উঠলেন শাহজাহান।

বিজাপুর সৈন্যদের ষড়যন্ত্রেই তিনি বাধ্য হয়ে দক্ষিণে এসেছেন। যদি তারা বিদ্রোহী না হয়ে উঠত তাহলে তিনি এখনো আগ্রাতে থাকতেন। মমতাজ হারেমের নিরাপত্তা আর আরামের মধ্যে থেকেই সন্তান জন্মদান করতে পারত, তা না করে তাঁকে সাম্রাজ্যের এই অনুর্বর অংশে কষ্টকর ভ্রমণ করে আসতে হয়েছে। মমতাজ হয়ত বেঁচে থাকত…এই নির্বুদ্ধিতার জন্য অনুতাপ করে মৃত্যুবরণ করতে হবে শত্রুদের।

*

বিতৃষ্ণা ভরে সামনে ছড়িয়ে থাকা ড্রয়িং থেকে চোখ তুলে তাকালেন শাহজাহান। প্রধান স্থপতি তাঁর নির্দেশ মতই সব করেছে; তারপরেও কী যেন একটা নেই। বিশাল চৌকোনা বাগানের মাঝখানে হওয়ায় সমাধিটাকে কেমন বেখাপ্পা দেখাচ্ছে। এখন পর্যন্ত তার ইচ্ছে বাগানের মাঝখানেই থাকবে সেই ত্রুটিহীন রত্ন, মমতাজের সমাধিসৌধ। আমি জানি যে আমি কী চাচ্ছি কিন্তু কীভাবে এটি সৃষ্টি হবে তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না… এটি বড় বেশি সাধারণ দেখাচ্ছে। তোমার কী মনে হয় জাহানারা?

আমি ঠিক নিশ্চিত নই…বলাটা ঠিক সহজ নয়।

 বাঁকা চোখে আরো একবার ড্রয়িংগুলোর দিকে তাকালেন শাহজাহান।

আমি বলেছিলাম যেন বিরক্ত না করা হয়। তুমি এখানে কেন জাহানারা?

কারণ, আমাকে আপনার সাথে কথা বলতে হবে। ছয় সপ্তাহ হয়ে গেছে, আম্মিজান মারা গেছেন। তারপরেও এখনো আমরা ভাই-বোনেরা আপনাকে তেমন দেখতে পাই না। একই অবস্থা আপনার উপদেষ্টা আর সভাসদদের। আমি কোন রকম কোন অশ্রদ্ধা করতে চাই না, কিন্তু আম্মিজান বেঁচে থাকলেও একই কথা বলতেন। তাঁর জন্য দুঃখ করতে গিয়ে আপনি আপনার দায়িত্ব অবহেলা করতে পারেন না।

কীভাবে আমি দায়িত্ব অবহেলা করেছি? সেনাপতিদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আমরা তাদেরকে পিছু হটিয়ে দিয়েছি। আর কিছু কী আশা কর আমার কাছ থেকে? জাহানারার মুখে ছায়া দেখে গলার স্বর নরম করে তিনি আরো যোগ করলেন, দয়া করে বুঝতে চেষ্টা কর। সমাধিসৌধের পরিকল্পনা সম্পন্ন না করা পর্যন্ত আমি কিছুতেই শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না।

আমি জানি এ ব্যাপারে আপনি কতটা উৎসুক, কিন্তু এখন পর্যন্ত আপনার ছোট কন্যাকে দেখেন নি। তাকে কোন নামও দেয়া হয়নি। আর এখন আমি শুনতে পাচ্ছি যে তাকে আগ্রায় রাজকীয় হারেমে পাঠিয়ে দিতে চাইছেন।

তুমি বুঝতে পারছ না। আমি চাই শিশুটির সঠিক দেখ ভাল করা হোক; কিন্তু তাকে নিয়ে চিন্তা করাটা আমার জন্য বেদনাদায়ক।

ও কোন শিশুটি নয়। আপনার কন্যা। অন্তত পাঠিয়ে দেয়ার আগে ওর দিকে একবার তাকান। উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই হাত তালি দিল জাহানারা। ইশারা পেয়ে কক্ষে প্রবেশ করল সাত্তি আল-নিসা। হাতের মাঝে উলের কম্বলে গুটিগুটি মেরে শুয়ে আছে ছোট্ট শিশুটি। জাহানারা। মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানিয়ে শাহজাহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সাত্তি আল-নিসা।

দ্বিধার পড়ে গেলেন শাহজাহান। আরেকটু হলেই সাত্তি আল-নিসাকে সরে যাবার আদেশ দিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছু একটা থামিয়ে দিল। আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে গেলেন আর হালকাভাবে সরিয়ে দিলেন কম্বল। ঘুমিয়ে আছে শিশুটি। মুখের কাছে হাত মুঠি করে রাখা। এত ছোট্ট অবুঝ একটা দেহের প্রতি কীভাবে তিনি শত্রুতা করবেন…তার পরেও পিতাসুলভ কোন অনুভূতি এলো না মনে। ব্যাপারটা এমন যেন কোন কিছু অনুভব করার শক্তিটাই হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।

জাহানারা, সম্রাজ্ঞী প্রায়ই যেসব নামের কথা বলতেন যেগুলো আপনারা দুজনে মিলে নির্বাচন করেছিলেন যদি কন্যাশিশু হয় তাহলে রাখার জন্য। তাদের মাঝে একটি নাম তিনি বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। জানালো সাত্তি আল-নিসা।

কী ছিল সেটা? আমার মনে আসছে না…

গওহরা আরা।

 তাহলে তাই রাখা হোক।

হঠাৎ করেই জেগে গেল গওহর আরা, সাত্তি আল-নিসার কোলে আড়মোড়া ভেঙে কাঁদতে শুরু করে দিল।

ওকে হারেমে নিয়ে যাও। সাত্তি আল-নিসা দ্রুত তাঁর কন্যাকে নিয়ে কক্ষ ছেড়ে চলে যেতেই ঘুরে দাঁড়ালেন শাহজাহান।

গওহর আরাকে আমাদের কাছ থেকে পাঠিয়ে দিবেন না আব্বাজান। সাত্তি আল-নিসা ওর দেখাশোনা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এক মুহূর্তের জন্য পিতার মোটা করে বোনা সুতির টিউনিকের উপর হেনা দিয়ে রাঙানো আঙুল রাখল। মমতাজের মৃত্যুর পর শাহজাহান আদেশ জারি করেছেন যে পুরো দরবার শুধুমাত্র সাদাসিধে পোশাক পরিধান করবে।

ঠিক আছে। জাহানারার তরুণ মুখখানায় স্বস্তি দেখতে পেয়ে সম্রাটের খারাপ লাগল যে তিনি তাকে উদ্বিগ্ন করেছিলেন, কিন্তু তারপরেও কিছু করার নেই তাঁর মমতাজের মৃত্যুর পর থেকে যেন তাঁর ও বাকি পৃথিবীর মাঝে কেমন একটা ব্যবধান তৈরি হয়েছে। এমনকি তার পরিবারের সাথেও। অথচ তিনি জানেন যে তিনি এদেরকে ভালোবাসেন। এমনকি এখনো মনে হচ্ছে জাহানারা যেন চলে যায়। তাহলে তিনি আবারো ডুবে যাবেন তাঁর চিন্তার জগতে। কিন্তু মনে হচ্ছে জাহানারার আরো কিছু বলার আছে।

আব্বাজান, আরো একটা ব্যাপার আছে যা আপনার জানা উচিত। কয়েকদিন আগে আওরঙ্গজেব আমার কাছে এসেছে চরম হতাশা নিয়ে। একজন মোল্লা তাকে জানিয়েছেন যে আল্লাহ আমাদের আম্মিজানকে নিয়ে গেছেন কারণ আপনি একজন ভণ্ড মুসলমান। যে কিনা ইসলামিক আইনের অবমাননা করে দরবারে হিন্দু ও অ-মুসলিমদেরকে ঠাই দিয়েছে। আমি আওরঙ্গজেবকে বলেছি যে মোল্লার কথার কোন সারবত্তা নেই। আপনি ঠিক আমাদের পিতৃপুরুষ সম্রাট আকরের নির্দেশিত পথানুযায়ী সহিষ্ণুতার উদাহরণ রেখেছেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব ঠিক আশ্বস্ত হয়নি।

হতে পারে সে আশ্বস্ত না হয়ে ভালোই করেছে। এমনো হতে পারে যে মোল্লা সঠিক কথাটাই বলেছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি নিজেকেই শুধু প্রশ্ন করছি যে আমাকে এভাবে শাস্তি প্রদানের পেছনে আল্লাহর যৌক্তিকতাটা কী? হতে পারে অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের প্রতি আমি একটু বেশিই উদার আচরণ করেছি, ঠিক সেই পর্তুগিজের উদ্ধত জেসুইটদের মত যারা আমার সাম্রাজ্যের সর্বত্র ঘুরে বেরিয়ে দাবি করে যে তারাই একমাত্র আল্লাহর কথা শুনতে পায়। তারাও তো দূষিত আর দুর্নীতিগ্রস্ত। মনে করে দেখো, যখন আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন তারা কীভাবে আমাদেরকে হুগলি নদীর তীরে তাদের ঘাঁটি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, অথচ তোমার আম্মিজান সে সময় বেশ দুর্বল ছিল। নিজেদের ধর্মের প্রধান বিষয় হিসেবে যে সহানুভূতি আর যত্নের কথা গর্ব করে বলে, তার কোন চিহ্নই পাওয়া যায়নি সেই আচরণে। কেননা তারা আমার পিতা আর মেহেরুন্নিসার কাছে ভালো হতে চেয়েছিল। বছরের পর বছর আমি তাদের কথা ভেবেছি; কিন্তু এখন পদক্ষেপ নিয়েছি। দুই সপ্তাহ আগে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছি যেন তাদের যাজকদেরকে উচ্ছেদ করে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তারা আর ফিরে আসতে পারবে না। এছাড়াও ভাবছি যে আমার শহরগুলোতে পুনরায় আর কোন হিন্দু মন্দির নির্মাণের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করব।

কি? বিস্ময়ে থ হয়ে গেল জাহানারা। বেশ কিছুক্ষণ লেগে গেল পুনরায় ভাষা খুঁজে পেতে। আব্বাজান, যদি বিদেশী যাজকদেরকে উৎখাত করতে হয় তো করেন, কেননা তারাও সেরকমই কাজ করেছে। কিন্তু আপনার বিশ্বস্ত প্রজাদেরকে শুধুমাত্র ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে শাস্তি দিবেন না। আপনার নিজের আম্মাজান, দাদীমা ছিলেন রাজপুত রাজকন্যা। আপনার এবং আমার শিরায় হিন্দু রক্ত বইছে। এর চেয়েও বড় কথা আপনার হিন্দু প্রজারা কোন অপরাধ করেনি আর আমাদের দুঃখের সময় সমব্যথী হয়েছে…সমবেদনা জানিয়ে কত বার্তা এসেছে। আমদের কাছে ভেবে দেখেন। আম্বার, মেওয়ার আর মারওয়ার দরবার আমাদের সাথে শোক করেছে, আমরা যেভাবে চল্লিশ দিন পালন করেছি, ওরাও তেমনি কঠোরভাবেই তা পালন করেছে। এর পরিবর্তে তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ করবেন না…এতে কিছুই হবে না।

শাহজাহান এমনভাবে কন্যার দিকে তাকিয়ে রইলেন যেন এই প্রথমবারের মত তাকে দেখছেন। মেয়েটার অবিশ্বাস্য অভিব্যক্তি কণ্ঠের আবেগ দেখে বুঝতে পারলেন যে সে হৃদয় থেকেই বলেছে কথাগুলো। আর অনেকটাই মমতাজ আছে যেন তার মাঝে–মেয়েটা তার আম্মাজানের সাহস আর নম্র অধ্যবসায়ের অভ্যাস পেয়েছে। এমনকি এক মুহূর্তের জন্য তার কণ্ঠস্বরটাও ঠিক মমতাজের মতই কানে বাজল, মনে হল চোখ বন্ধ করলে মনে হবে স্ত্রীর কাছেই আছেন তিনি। চিন্তাটা বেদনাদায়ক কিন্তু খানিকটা সান্ত্বনাও পেলেন।

সম্ভবত তুমি ঠিকই বলেছ। কিছু করার আগে আমি আরো ভেবে দেখব। কিন্তু এর পরিবর্তে আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। আমি আগ্রাতে অস্থায়ীভাবে সমাধিস্থ করার জন্য তোমার আম্মাজানের শরীর পাঠিয়ে দিতে চাই, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাকে গ্রহণ করার জন্য সমাধিটি নির্মাণ না করতে পারছি। দুই থেকে তিন দিনের মাঝে সোনালি শবাধার এসে পৌঁছাবে, আমি সেইরকমই নির্দেশ দিয়েছি আর তাই দেরি করার কোন মানে হয় না। সে তার ভালোবাসার স্থানেই বিশ্রাম নিতে গেছে জানতে পারলে আমার চিত্ত শান্ত হবে। শত্রুকে নিজ হাতে শিক্ষা না দেয়া পর্যন্ত আমি নিজে দাক্ষিণাত্য ছেড়ে যেতে পারব না। তাই আমি চাই তুমি এবং দারা শেষকৃত্যের সঙ্গী হও। যেমনটা তুমি আমাকে একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলে যে আমার জ্যেষ্ঠ পুত্রকন্যা হিসেবে এটি একেবারে যথাযোগ্য।

*

বিজাপুরের অশ্বারোহী সৈন্যের বিশাল এক স্কোয়াড্রনের বিপক্ষে শাহজাহান নিজে তার সৈন্যদলের নেতৃত্ব দিলেন। পল্লী অঞ্চলে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হলে মোগল সম্রাট পরাজিত করেন শত্রুদের। আগ্রার উদ্দেশে মমতাজের শবদেহ যাত্রা করার পর ইচ্ছে না থাকলেও নিজের সেনাপতিদের অনুরোধে পুনরায় সৈন্যবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এখন তিনি খুঁজে পেলেন যে শত্রুকে খুঁজে বেড়ানো আর পিছু নেওয়ার যে ঝুঁকি ও উত্তেজনা, এটাই একমাত্র জিনিস যা মমতাজের জন্য সৃষ্টি হওয়া দুঃখ কমিয়ে দিয়েছে। অতীতের চেয়ে বর্তমান বিপদের উপর মনোসংযোগ করতে বাধ্য হলেন তিনি। এ ধরনের তৃতীয় একটি অভিযানে বের হয়ে বেশ উৎফুল্ল হলেন শাহজাহান।

জাহাপনা, আপনি আমাদেরকে ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছেন। খানিকটা ধীরে ছুটবেন নতুবা আমরা আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারব না। ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ ছাপিয়েও দেহরক্ষীদের দলনেতার চিৎকার শুনতে পেলেন সম্রাট। কোনই মনোযোগ দিলেন না তিনি। যদি তার ভাগ্যে মৃত্যু থাকে তবে তাই হোক। স্বর্গের উদ্যানে মমতাজের সাথে একত্রিত হতে পারবেন তিনি। মুহূর্তখানেকের মধ্যেই প্রথম বিজাপুরের সৈন্যের সাথে সংঘর্ষ হল। সাদা ঘোড়র উপর উবু হয়ে বসে থাকা সৈন্যের বাঁকানো ভোজালির প্রথম আঘাত বাতাস কেটে গেল শাহজাহানের ময়ূরপুচ্ছ লাগান শিরস্ত্রাণের উপর দিয়ে, নিচু হয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু তার ঘোড়া এতটাই দ্রুত ছুটে গেল যে তিনি আঘাত হানার আগেই পিছনে পড়ে গেল লোকটা। আরেকটা বিজাপুরী সৈন্য নিজের লম্বা বল্লম ছুঁড়ে মারল সম্রাটের দিকে; কিন্তু নিজের তলোয়ার দিয়ে তিনি এটিকে একপাশে সরিয়ে দিলেন। এরপর নিজের অস্ত্র ব্যবহার করে বিদ্রোহীর বাদামি ঘোড়ার পিঠে আঘাত করতেই হেষা ধ্বনি তুলে আরোহীকে ফেলে দিল জন্তুটা।

তৃতীয় বিজাপুরীর উপর আঘাত হানলেন শাহজাহান; কিন্তু বুকের বর্মে লেগে পিছলে গেল তলোয়ার। মুহূর্তখানেক পরেই দেখতে পান যে বিজাপুরীদের মাঝে তিনি একেবারে একা। অসংখ্য শত্রু ঘোড়সওয়ার এগিয়ে আসছে তাকে আক্রমণের জন্য। উপলব্ধি করলেন যে বোকামি আর গোঁয়ার্তুমি তাঁকে এই বিপদের মাঝে ডেকে এনেছে। দ্রুত দুরুদুরু বক্ষে এগিয়ে গেলেন সবচেয়ে কাছের সৈন্যের দিকে। ঘোড়সওয়ার কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুকবর্মের নিচে পেটের ভেতর তলোয়ার ঢুকিয়ে দিলেন। শাহজাহান নিজের তলোয়ার মুক্ত করতেই ঘোড়ার পিঠে ঢলে পড়ে নিজের ছোট বর্শাটা মাটিতে ফেলে দিল সৈন্যটা।

দ্বিতীয় বিজাপুরী সৈন্যটা দ্রুত ঘুরে গিয়ে তৎক্ষণাৎ আঘাত হানল সম্রাটের উপর। তলোয়ার দিয়ে শাহজাহানের জিনের সম্মুখ ভাগে আঘাত করতেই হেলে পিছিয়ে গেলেন তিনি একই সাথে রক্তমাখা ফলা ব্যবহার করে শত্রুসৈন্যের শিরস্ত্রাণ ফেলে দিলেন মাথা থেকে। কিন্তু অক্ষত সৈন্য আবারো এগিয়ে এলো সম্রাটের দিকে তবে এবার নিজের দুই সঙ্গীকে সাথে নিয়ে। উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেন শাহজাহান, ফলে সামনের পা উপরে তুলে ডাক ছাড়ল ঘোড়া। খুরের আঘাতে সবার সামনে থাকা বিজাপুরী সৈন্য পড়ে গেল পিছন দিকে। সাথে সাথে তিনি বাম হাতে লাগাম ধরে ঘুরে গিয়ে আঘাত হানতে উদ্যত হলেন পরবর্তী শত্রুসৈন্যের দিকে। কিন্তু লোকটা তার ডান হাতের উপরের অংশ ধরে ফেলে, শাহজাহান বাধ্য করেন তাকে হাতের অস্ত্র ফেলে দিতে। এরপর বহুকষ্টে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে তৃতীয় আক্রমণকারী শিরস্ত্রাণবিহীন সৈন্যের দিকে এগিয়ে যান শাহজাহান; কিন্তু বুঝতে পারেন যে তিনি তেমন কিছু করতে পারবেন না। তার আগেই হয়তো আঘাত করবে লোকটা। তাই অবচেতনেই চেষ্টা করলেন নিজেকে বাঁচানোর। কিন্তু হঠাৎ করেই তাঁর চোখের সামনে মাথার খুলি ফেটে রক্ত-মাংসের দলা পাকিয়ে গেল বিজাপুরী সৈন্যটা। সারির মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে এগিয়ে এসেছে দেহরক্ষী প্রধান আর দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছে শিরস্ত্রাণবিহীন অরক্ষিত মাথা। এরই মাঝে অন্য দেহরক্ষী সৈন্যরাও এসে পড়ে চড়াও হয় শত্রুসৈন্যদের উপর। বিজাপুরী সৈন্যরা যারা এখনো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েনি–কোন দিকে না তাকিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করে, সঙ্গীদেরকে রেখে যায় মৃত্যুবরণ করতে কিংবা বন্দিত্ব বরণ করে নিতে।

আটচল্লিশ ঘণ্টা পরে এই সময়ের মাঝে ঘোড়ার পিঠ থেকে প্রায় নামেনইনি বলতে গেলে শাহজাহান, ঘুম তো দূরের কথা–অশোক সিংয়ের সঙ্গে সমান্তরাল একটি পাথর খণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে নিচে শুকিয়ে যাওয়া নদীর বাঁকের মুখে গরুর পিঠের কুঁজোর মত দেয়াল ঘেরা কৃষ্ণপুর নামের ছোট্ট শহরটার দিকে তাকিয়ে রইলেন সম্রাট। একটু আগের সংঘর্ষের পর আটক কয়েকজন বন্দি বিজাপুরী সৈন্যের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে এই শহরেই ঘাঁটি গেড়েছে তারা। নিজে অথবা মোগল বাকি সৈন্য কাউকেই বিশ্রাম নেবার সুযোগ না দিয়ে দুই ঘণ্টা আগে কৃষ্ণপুর পৌঁছে দেখতে পান বদ্ধ দুয়ার। মোগল সৈন্যরা এখন চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে শহরটাকে।

না, অশোক সিং! আমি তাদের সাথে কোন ধরনের সমঝোতা করব না। বিনা শর্তে তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। পত্নীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি অনুকম্পা দেখিয়ে যে ইস্তেহার প্রকাশ করেছিলাম তারা সেটাকে অবহেলা করেছে। এখন তাদেরকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। তাহলে তারা কীভাবে আশা করে যে আমি আমার দয়া নীতি পুনরায় বিবেচনা করব?

আমি তাদের প্রতিনিধিকে জানাব। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে অশোক সিং বলে চলল, ক্ষমা করুন জাহাপনা। কৃপা পাবার কোন আশাই যদি না থাকে তাহলে তারা কী কঠিন দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যাবে না?

হতে পরে অশোক সিং সত্যি কথাই বলছে, ভেবে দেখলেন শাহজাহান। ঠিক আছে। তাদের প্রতিনিধিকে জানিয়ে দাও যারাই শহর ছেড়ে গেছে এক ঘণ্টার মাঝে ফিরতে পারলে বেঁচে যাবে। মুক্ত অথবা বন্দি এ ব্যাপারে আমি কোন প্রতিজ্ঞা করব না, তবে তারা বেঁচে থাকবে।

তীর আর বন্দুকের গুলির রেঞ্জ বাঁচিয়ে ঠিক কৃষ্ণপুরের ফটকের সামনে শাহজাহান। পঞ্চাশ মিনিট কেটে গেছে এরই মাঝে। ফটকগৃহটি বালিপাথর দিয়ে তৈরি মজবুত একটি দালান, জোড়া ফটকের উপরে কোনমতে একটি সাপ বেরিয়ে যাবার মত ফাঁক রাখা হয়েছে। ঘোড়া থেকে নেমে পুরো জায়গাটা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে নামলেন শাহজাহান। বুঝতে চাইলেন তারা তার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে কিনা, যা না করে সেক্ষেত্রে করণীয় নিয়েও ভাবতে লাগলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে এক ঘণ্টা পার হবার সাথে সাথে নিজ সৈন্যদেরকে আদেশ দেবেন যেন কৃষ্ণপুরের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ করা হয়। আক্রমণের জন্য শ্রেষ্ঠ পথ হতে পারে শুকনো নদীবক্ষ, কেননা শহরের দেয়াল এদিকে নিচু আর দেখাচ্ছেও দুর্বল। বলা বাহুল্য যে সাধারণত সময়ে এই অংশই হয়ে ওঠে প্রধান প্রতিরক্ষাব্যুহ।

জাহাপনা… আবারো সম্রাটের পাশে এগিয়ে এলো অশোক সিং। যদি বিদ্রোহীরা যুদ্ধ করতে মনস্থির করে তাহলে আমার এবং আপনার দেহরক্ষী নেতার পক্ষ থেকে আমি একটি অনুরোধ করতে চাই। দয়া করে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে সামনে তুলে ধরবেন না, পরিণাম সম্পর্কে না ভেবে, যেমনটা গতকালকের আগের দিন করেছিলেন। খানিকক্ষণ থেমে আবারো বলে চলল তরুণ রাজপুত শাহজাদা, পুরো দরবার জানে যে সম্রাজ্ঞীর মৃত্যুতে আপনি কতটা দুঃখ ভারাক্রান্ত…আপনি বলেন যে আপনার জীবন কতটা শূন্য হয়ে পড়েছে। আমিও আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছি, সন্তান জন্মদানের সময়ে না, জ্বরের কারণে আমাকে জানানোর আগেই সে মৃত্যুবরণ করে। পল্লী অঞ্চলের দিকে পিতার অংশ পরিদর্শন করে ছুটে আসার সময়টুকুও আমি পাইনি। আমিও বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলাম। নিজের জীবনকে কোন মূল্যই দিতাম না, যুদ্ধক্ষেত্রে কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম, শিকারে মেতে উঠতাম। এরপর পিতা আমাকে ডেকে নিয়ে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন সবকিছু। তিনি আমাকে বলেন যে, ঈশ্বরই এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন যে মানুষ কখন মৃত্যুবরণ করবে। কোন মানুষের হাতে এই সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। একজন শাহজাদা হিসেবে ভাগ্যের প্রতি, পিতার প্রতি, ও রাজবংশের প্রতি আমার দায়িত্ব আরো বেশি। যদিও আপনি একজন হিন্দু নন, আমি বিশ্বাস করি যে আপনার ধর্মও নিশ্চয় শিক্ষা দেয় যে একজন মানুষের উচিত ঈশ্বরের ইচ্ছের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করা। এর চেয়েও বড় কথা আপনার দায়িত্ব আমার চেয়েও বেশি। আপনি কোন কনিষ্ঠ পুত্র নন বরঞ্চ একটি রাজবংশের প্রধান যিনি কিনা আম্বার প্রদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বড় একটি সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। অপ্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করলে পর এ সাম্রাজ্যের ও আপনার পরিবারের কী হবে?

উত্তর দেবার আগে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন শাহজাহান। আমি জানি, তুমি সঠিক বলেছো। আমার পুত্রদের এখনো এত বয়স বা অভিজ্ঞতা হয়নি যে তারা আমার উত্তরসূরি হতে পারে। আমি জানি মমতাজ থাকলেও একই কথা বলতেন এবং আমার কন্যা জাহানারা ইতিমধ্যে তা বলেছেও। কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তুমি নিশ্চয় জানো যে গ্রহণ করে নিজের জীবনে প্রয়োগ করার চেয়ে এ ধরনের সদুপদেশ দেয়া কতটা সহজ।

কিন্তু আমার কথায় কর্ণপাত করুন জাহাপনা। ভাবে জোর করলেন অশোক সিং।

হ্যাঁ। বিজাপুরী সৈন্যরা যদি কৃষ্ণপুর থেকে বেরিয়ে আসে তাহলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার বদলে আমি এমন একটা অবস্থানে চলে যাবো সেখান থেকে পুরো কাজের নির্দেশ দিতে পারব।

মুহূর্তখানেক পরে যেন তাঁর কথার উত্তর দিতেই কৃষ্ণপুরের প্রধান ফটক খুলে গেল হাট হয়ে। আক্রমণ না আত্মসমর্পণ? নিজেকে শুধোলে শাহজাহান।

ফটকের মাঝে থেকে নারীদের সারি বেরিয়ে আসতেই মনে হল দাসত্ব গ্রহণ নিশ্চয়ই। বেশির ভাগই ছোট ছেলেমেয়েদের হাত ধরে রেখেছে, অন্যরা হাতের তালু একত্র করে প্রার্থনার মত ভঙ্গি করে বের হয়ে আসছে। বুঝাই যাচ্ছে যে প্রায় সবাই দাসত্ব বরণের জন্য মোটামুটি তৈরি। অন্যান্য জায়গার মত কৃষ্ণপুরকেও ছাড়েনি খরা। শাহজাহান মাত্রই অশোক সিংয়ের দিকে ঘুরে তাকিয়ে নির্দেশ দিতে চাচ্ছিলেন যেন সৈন্য পাঠিয়ে বন্দিদের গ্রহণ করা হয়, এমন সময় হঠাৎ করে ফটক দ্বার থেকে বের হয়ে এলো স্বশস্ত্র অশ্বারোহী দল। নিজেদের ঘোড়া ছুটিয়ে কৃষ্ণপুরের দেয়ালের কাছে চললো পালানোর উদ্দেশে। এদেরকে অনুসরণ করে এলো বাকি বিজাপুরী সৈন্যরা। কেউই প্রথম দলের ঘোড়ার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে ভ্রূক্ষেপ করল না, বরঞ্চ সজোরে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল নারী-শিশুর উপর।

গুলি ছোড় ওসব অশ্বরোহীদের দিকে। একজনও যেন পালাতে না পারে। অশোক সিংয়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলেন শাহজাহান। শহরের নারীদের প্রতি বিজাপুরী সৈন্যদের আচরণে এতটাই শিপ্ত হয়ে উঠলেন যে ভুলে গেলেন নিজের প্রতিজ্ঞা, ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলেন সবার সামনে। বেশি দূর যাবার আগেই এহেন কোন ষড়যন্ত্রের জন্য পদক্ষেপ হিসেবে দেয়ালের কাছে তার নির্দেশে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সুশৃঙ্খল বন্দুক বাজদের বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলেন। ফলে খালি হয়ে গেল বেশ কিছু ঘোড়ার পিঠ। শত্রু স্কোয়াড্রন সংখ্যায় কমে গিয়ে যতজন বেঁচে আছে কাছাকাছি চলে এলো প্রত্যেকে। তারপর নারী-শিশুর দলের মতই আহত নিহত সঙ্গীদের রেখে মাড়িয়ে মাথা নিচু করে ছুটে চলল কোনমতে নিরাপদে পার হবার আশায়।

বন্দুকের গুলির প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য খুব দ্রুত ছুটে এলেন শাহজাহান। এরপর আবারো ঘোড়া ছুটাতে গেলে অশোক সিং আর দেহরক্ষীরাও চলে এলো তার পাশে। একত্রে জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে ধরে ফেললেন বিজাপুরী সৈন্যদের। এসময় ডজনখানেক শত্রুসৈন্য ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে পিছু ধাওয়াকারীদের উপর আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো– পরিষ্কারভাবে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে চাইছে সহ সৈন্যদেরকে বাঁচাতে। নিজেদেরকে তারা ঠিকই উৎসর্গ করবে, কিন্তু অন্য কাউকেও পালিয়ে যাবার সুযোগ দেয়া হবে না। নিজের তলোয়ার বের করতে করতে ভাবলেন শাহজাহান। এগিয়ে গেলেন মাত্র গজখানেক দূরত্বে থাকা বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করতে।

প্রথম জন একেবারে তরুণ শাহজাহানের দেহরক্ষীদের প্রথম সারির সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হল। নিজের তলোয়ার দিয়ে এক কোপে ফেলল দাড়িঅলা এক রাজপুত সৈন্যের পেশীবহুল হাত; কিন্তু পরমুহূর্তেই মোগল সৈন্যদের আঘাতে ঘোড়া থেকে পড়ে উন্মুক্ত ঘোড়ার খুরের নিচে পড়ে মৃত্যুবরণ করল। তার সঙ্গীরা অবশ্য একটু ভালো মূল্য পেল। মাত্র একজনেই সমর্থ হল রাজপুত দেহরক্ষীদের একজনকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিতে; কিন্তু নিজেও মৃত্যুবরণ করল রাজপুতের ছোঁড়া বর্শার আঘাতে পড়ে গিয়ে। শীঘ্রই শাহজাহানের অশ্বারোহী সৈন্যরা হাতাহাতি লড়াই শেষ করে দ্রুতগতিতে ছুটে চলল, পিছনে পড়ে রইল ছিন্ন-ভিন্ন। দেহ আর আরোহীবিহীন ঘোড়া। পাঁচ মিনিটের মাঝে বাকি বিজাপুরী সৈন্যদের দেখা গেল শুকনো নদীবক্ষের দিকে ছুটে চলতে। হঠাৎ যেন একজন কেউ চিৎকার করে আদেশ দিল আর এর উত্তরে পুরো বিজাপুরী সারি থেমে গিয়ে ফেলে দিল নিজেদের অস্ত্র। সব মিলিয়ে পঞ্চাশজন শক্ত সমর্থ অশ্বারোহী।

সাবধানে। তাদের খুব কাছে যেও না। যদি এটা অন্য কোন কৌশল হয়। চিৎকার করে বলে উঠলেন শাহজাহান।

সোনালি কাপড় পরিহিত লম্বা এক বিজাপুরী অশ্বারোহী সৈন্য সবার মাঝে দিয়ে এগিয়ে এসে ঘোড়া থেকে নেমে ভূমিশয়ান হল। আমরা আত্মসমর্পণ করছি, জাহাপনা। আমরা বেঁচে থাকার জন্য আপনার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি।

কী? চিৎকার করে উঠলেন ম্রাট। নারী আর শিশুদের পদদলিত করা, আমার নিজের লোকের মৃত্যুর কারণ হবার পরও তোমরা আশা কর যে আমি তোমাকে বাঁচার প্রস্তাব দিব? বেঁচে থাকার সুযোগ তোমরা পেয়েছিলে কিন্তু নিজেদের পাশবিক আচরণের জন্যে তা হেলায় হারিয়েছ। তুমি, তোমার সেনাপতিরা মৃত্যুবরণ করবে। তোমার লোকেদেরকে দাস হিসাবে বিক্রি করে দেয়া হবে।

জাহাপনা, আমি কাতর অনুনয় করছি…

অনুনয়ের আর কোন অর্থ হয় না। শ্রদ্ধার সাথে নিজের ভাগ্য স্বীকার করে নাও। মৃত্যু আমাদের সকলের কাছেই আসবে, আগে অথবা পরে। তোমার মৃত্যু বৃথা যাবে না বরঞ্চ বিদ্রোহ আর আক্রমণের জন্য যদি কেউ ষড়যন্ত্র করে তাদেরকে প্রতিরোধ করবে।

এক ঘণ্টা পরে শাহজাহান তাকিয়ে দেখতে লাগলেন যে মোঘল সৈন্যরা তার নির্দেশানুযায়ী কতল করা মস্তক সাজিয়ে রাখার জন্য টাওয়ারের প্রথম পাথর স্থাপন করল। এরই মাঝে পাশেই একটা জায়গায় রক্তাক্ত স্কুপের উপর নীল ডুমো মাছি উড়াউড়ি শুরু করেছে। তার যোদ্ধা পূর্বপুরুষেরা এশিয়ার অনুর্বর ভূমির মাতৃভূমিতে এ ধরনের টাওয়ার নির্মাণ করতেন। নিজের শাসনামলের প্রথম দিকে অবাধ্য শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য একই নিয়ম অনুসরণ করতেন ম্রাট আকবর। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন, ইতিমধ্যে চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুন, আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে কখন চোখ, গাল আর ঠোঁটের নরম মাংসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে। এই রক্তমাখা সুউচ্চ স্তম্ভ বিজাপুরী সৈন্যদেরকে মনে করিয়ে দেবে যে মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে তারা কোনভাবেই জয়ী হতে পারবে না আর যদি তারা তাদের এ আক্রমণ অব্যাহত রাখে তাহলে শাস্তিও এমনতর হবে।

কয়েকদিন পরে বোরহানপুরের প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকে আলোকিত দরবার অঙ্গনে আসলান বেগকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পান। শাহজাহান, হাতে একটি চিঠি। জাহাপনা, গতকাল একজন অশ্বারোহী এটি নিয়ে এসেছে। মাননীয় জাহানারা এ চিঠির প্রেরক। আমি ভাবলাম আপনি নিশ্চয়ই আসার সাথে সাথে দেখতে চাইবেন এটি।

তৎক্ষণাৎ সীলমোহর খুলে ফেললেন সম্রাট।

‘আব্বাজান, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি আপনাকে জানাতে চাই যে, আমরা দশ সপ্তাহের ভ্রমণ শেষে নিরাপদে আগ্রা পৌঁছেছি আর ঠিক যেভাবে আপনি চেয়েছেন, যমুনার তীরে অস্থায়ী একটি সমাধিতে মায়ের মৃতদেহ রাখা হয়েছে। যতই আমরা শহরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম রাস্তার দুই পাশে মাথায় ধুলা মেখে ক্রন্দন করছিল সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জনতা। পুরো ভ্রমণ জুড়েই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ছিল এরকম যেন দুঃখের নীল ছায়া গ্রাস করেছে আমাদের পুরো ভূমি। পরবর্তীতে সবিস্তারে সব জানিয়ে পত্র লিখব।‘

পত্রখানা পড়তে গিয়ে, আবারো নিদারুণ দুঃখের গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল শাহজাহানের মন। সামরিক সফলতারও ম্লান হয়ে গেল মুহূর্তের মাঝে। যখন তিনি এবং মমতাজ আগ্রা থেকে যাত্রা করেছিলেন তখন ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেননি যে একত্রে থাকার দিন ফুরিয়ে এসেছে। পত্নীকে পাশে নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে সাম্রাজ্যকে বিস্তৃত করার তার উচ্চাকাঙ্খও পূর্ণ হবে। আর এখন সম্রাট হিসেবে যত বড় বিজয় আসুক না কেন কী মূল্য আছে এসবের যখন একজন মানুষ হিসেবে তিনি হারিয়েছেন সব উষ্ণতা আর আনন্দ? একটা শীতল সমাধি নির্মাণের মাঝে দিয়ে কতটাই বা সান্ত্বনা খুঁজে পাবেন তিনি? তিনি মমতাজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কখনোই হতাশায় ডুবে যাবেন না; কিন্তু এ প্রতিজ্ঞা কি রাখতে পারবেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *