রামিয়া কাণ্ড
তাৎমানীদের ‘ধানকাটনী’র রাজ্যে যাত্রা
কার্তিক অঘ্রাণ মাসে তাৎমা পুরুষদের রোজগার কিছু অনিশ্চিত হয়ে আসে। ঘরামির কাজ কমে যায় অথচ কুয়ো পরিষ্কার করার কাজ তখনও আরম্ভ হয় না। বোধ হয় সেই জন্যেই তাৎমা মেয়েরা অঘ্রাণে যায় ধান কাটতে। তারা ফিরে আসে পৌষের শেষাশেষি। পূর্বেই যায় বেশি, মায়সী, জামৌর, রুত্বা থানাতে। ওদিকে রোজগার বেশি, বাঙ্গাল মুল্লুকের কাছে কিনা, সেই জন্য; কিন্তু রোজগার বেশি হলে কী হয়, পানি বড় লরম আওর বড্ড বুখার [২০১]। তার উপর ওদিকে মিয়া বেশি [২০২]। সবসময় জাতপাত বাঁচিয়ে চলাও শক্ত, ঐ পাট আর পানির দেশে। তাই অধিকাংশ বছরেই তাৎমা মেয়েরা যায় পচ্ছিমের কমলদাহা, বড়হড়ী, ধোকড়ধাড়া এই সব থানায়। এসব জায়গার জল ভাল আধাসের সাত্ত্ব হজম করতে আধা ঘণ্টা। বড় খিদে পায় এই যা মুশকিল। কিন্তু গেরস্তরা ভাল লোক। যে মজুরনী কম খায় তাকে কাজে নিতে চায় না;–বলে যত পুরণের বিমারী সিমারী লোগ [২০৩], এরা হজম করতেই পারে না, তার কাজ করবে কী? তবে মজুরের চাহিদা পশ্চিমে কম; তাই গঙ্গাজী, গোশীজী পার হয়ে, মুঙ্গের আর ভাগলপুর জেলার হাজারে হাজারে মজুর মজুরনী এদিকে আসে ধানকাটনীর সময়। তাদের মতো পরিশ্রম করতে তাৎমানীরা পারে না।
এই ধান কাটার সময় মহতের পরিবারের মেয়েরা আর দুখিয়ার মা ছাড়া তাৎমাটুলিতে আর কোনো তাৎমা মেয়েই থাকে না। সেই জন্য অঘ্রাণ পোষ মাসে বাড়ির সব কাজই তাৎমা পুরুষরা নিজ হাতে করে। এই সময় পাড়ায় নেশাভাঙের মাত্রা বেড়ে যায়। ধানকাটনীরর দল দেড় মাস পরে ফিরে এলে প্রতি বারই পুরুষদের এই সময়ের কৃতকর্মের ফিরিস্তি, মহতোগিন্নী, পাড়ার মেয়েদের শুনিয়ে দেন; ঝোটাহারা তখন নতুন আনা ধানের মালিক; ধরাকে সরা জ্ঞান করে। প্রতি সংসারে ঝগড়া-বিবাদ বেশ জমে ওঠে। বাড়ির কর্তাই নিচু হয়ে, এই দুমাস ঝোটাহাদের খোসামোদ করে। তাই তাৎমাটুলির মেয়েরা বলে- কখনও নৌকার, উপর গাড়ি, কখনও গাড়ির উপর নৌকা। দশ মাস পুরুষ রাজা, তো দুমাস মেয়েরাও রাজা।
তাৎমাদের বছরখানেক থেকে দিন বড় খারাপ যাচ্ছে। কাজ পাওয়া শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। চার আনা তো মজুরি; তাই দিতেই আবার বাবুভাইয়াদের তন্বি কত! চাল, শুনতেই চার পয়সা সের; কিন্তু সস্তা জিনিসের দাম তো দিতে হবে। ঐ চারটে পয়সাই আসে কোথা থেকে, সে খবর কি বাবুভাইয়ারা রাখে। খেতে গেলে পরনের কাপড় নেই, পরনের কপড় কিনতে গেলে উপোস করে থাকতে হয়। পাক্কীতে কাজ করার সময় ঢোঁড়াইরা প্রত্যহ দেখে যে, পাট বোঝাই করা গরুর গাড়ির সার ফিরে চলেছে; জিরানিয়া বাজারের গোলাদাররা আর কিনতে চায় না। তাৎমাটুলির সাঝের পর বাবুভাইয়া আর বাজারের লোকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। ধাঙড়রা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে যে, এবার দেখছি গোসাই থানে বেলফুলের মালা বিক্রি হবে। ঝোটাহাদের ঝুটিতে তেল পড়ছে দেখিস না?
পচ্ছিমের ভর্সড় লোয়ার প্রাইমারি স্কুলের গুরুজী থাকে গ্রামের বাবুদের বাড়ি। সেখানেই বাবুদের ছেলে পড়ায়, খায়দায়, মোসাহেবি করে, ফাঁইফরমাস খাটে, মোকদ্দমার তদবির করে, চিঠি লিখে দিয়ে। সে এসেছিল জিরানিয়ার চেরমেন সাহেবের কাছে, ভর্সড়ের বাবুকে সঙ্গে নিয়ে; তার বদলির হুকুম রদ করাতে। বাবু চেরমেন সাহেবের পুরনো মক্কেল। চেরমেন সাহেব জিরানিয়ায় ছিলেন না। বাবুলাল চাপরাসী তাদের নিয়ে যায় কেরানীবাবুর বাড়ি। ঘিয়ের ভাঁড় আর কলার কাঁদি উঠোনে রেখে সে কেরানী সাহেবকে ডাকে। এক মিনিটের মধ্যে গুরুজির কাজ হয়ে যায়। এর জন্য আবার রায়বাহাদুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল এই দেহাতী দুটো; বাবুলাল মনে মনে হেসেই বাঁচে না। ভর্সড়ের বাবুসাহেব বাবুলালের হাতেও একটা টাকা দেন। বাবুলাল বলে মোটে এক টাকা?
ধান ঘরে আসুক। বিক্রি করে তারপর টাকা দেব। এখন টাকা কোথায় গেরস্তর কাছে?
বাবুলাল এসব শুনতে অভ্যস্ত; কাজ হবার পর আবার কেউ টাকা দেয়?
আচ্ছা ধানকাটনীর লোক তোমরা নাও কোথা থেকে?
এবার আবার লোকের অভাব? কবে থেকে লোকেরা ঘোরাঘুরি করছে।
আমার টোলার লোক নাও না।
গুরুজি চেরমেন সাহেবের চাপরাসীকে চটাতে রাজী নন- ভবিষ্যতে আবার এ শয়তানটার দরকার হতে পারে।
তা, দিও, জন চল্লিশেক।
তাৎমাটুলির বর্ধিষ্ণু লোক বাবুলাল। উর্দি পাগড়ি পরবার অধিকার সে পেয়েছে ভগবানের কৃপায়! সে নিজের জাতের জন্য এটুকুও করবে না? আজকে এ অভাব অনটনের দিনে, এ একরকম রামজির ছাপ্পর ভেঙে দান বলতে হবে! কার্তিক মাস শেষ হতে চলল এখন পর্যন্ত তাৎমাটুলিতে ধানকাটনীর জন্য কোনো জায়গা থেকে ডাক আসেনি। এবার গেরস্তরা ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই রাখবে নাকি? এই হতাশার মধ্যে ভর্সড়ের খবরে, পাড়ায় সাড়া পড়ে যায়! ধন্যি ধন্যি করে সকলে বাবুলালের, ঠেকারে দুখিয়ার মার মাটিতে পা পড়ে না। তার দেমাক আরও বেড়ে যায়, যখন সে দেখে যে, গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে এবার মহতের স্ত্রী আর খোঁড়া মেয়েও ধানকাটনীতে যাচ্ছে।
যাওয়ার সময় মহতোগিনীর মাথার উপরের উদুখলটিতে, দুখিয়ার মা কচুপাতায় মুড়ে খানিকটা তামাক দিয়ে বলে, ভালয় ভালয় সব কটাকে ফিরিয়ে এনো গুদরের মা। মরমে মরে যায় মহতোগিন্নী। তবুও জবাব দেয়, হাঁ, সেই জন্যেই তো যাচ্ছি এদের সঙ্গে।
দূর থেকে রতিরা ছড়িদার চেঁচায়-এসো না সকলে, এখনও মেয়েদের এত কি গল্প তা বুঝি না।
যাওয়ার পথে সকলে গোঁসাই থানে প্রণাম করে যায়।
ধানকাটনীর সময় একেবারে মেলা বসে গিয়েছে ভসঁড়ের চাপ এর [২০৪] ধারে। সিরিপুর, ভর্সড়, সোনাদীপ, কেমৈ এই চার গাঁ জুড়েক এক চকে নিচু জমিতে ধানের ক্ষেত। ধান হয়েছেও তেমনি;-শীষের ভারে শুয়ে পড়েছে গাছগুলো কোথাও আল দেখা যায় না। উঁচু জায়গাগুলিতে কাটা ধানের সোনালী পাহাড়। তারই আশেপাশে মানুষ ঢুকতে পারে এইরকম ছোট ছোট খড়ের টোপর খাড়া করা হয়েছে, সারির পর সারি। রাতে যা হিম পড়ে! পোয়ালের পাহাড়ের ধুর জ্বালালেও কিছুতেই আর কান গরম হতে চায় না [২০৫]।
ভর্সড়ের বাবুদের ধান কাটতে এবার এসেছে দুদল লোক; একদল মুঙ্গের জেলার তারাপুর থেকে, আর একদল তাৎমাটুলি থেকে। সব মিলিয়ে প্রায় সত্তর জন লোক, পুরুষ মাত্র জন দশেক। ভড়ে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই গান গাইতে গাইতে দোকান গলায় ঝুলিয়ে পানওয়ালা পৌঁছয়-টিকিয়া, তামাকু, গান। ধানকাটনীর অস্থায়ী গাঁগুলোয় এরা ঘুরে বেড়ায়, বিড়ি, খয়নি, তামাক, পান, সুপুরি, সাবান আরও কত জিনিস বেচতে। এ ছাড়া অন্য পেশাও আছে এদের এই ধানকাটনীর মেয়েদের মধ্যে।
পানওয়ালারা গান গেয়ে লোক জমিয়ে তারপর সওদা বেচে। কিন্তু তারা এই তো। সবে এসেছে; ধান কাটা আরম্ভ করবে, তবে না তাই দিয়ে জিনিস কিনবে।
অবকী সমৈয়া ধিরজা ধরেনি গে বেটী
নহী উপ জল ছেই পাটুয়া ধান,
কি রঙ্গ কে করবৌ বীহা দাম
অবকী সমৈয়া ধিরজা ধরেনি গে বেটী।
(এবার ধৈর্য ধরে থাক মেয়ে। পাট ধান জন্মায়নি কেমন করে বিয়ের খরচ করব) তাৎমা মেয়েরা সকলে পানওয়ালাকে ঘিরে বসে। এমন গান যে গাইতে পারে তার সঙ্গে কি আলাপ জমাতে দেরি লাগে। কিছুক্ষণের মধ্যেই, এই ধানের রাজ্যের সব খবর পানওয়ালা তাদের জানিয়ে দেয়।
-ভর্সড়ের বাসিলে ধানকাটনীর লোকেরা নাকি সব চলে গিয়েছে এবার সিরিপুরে কাজ করতে। দুএকটা ডালার বেগুন [২০৬] কেবল ভর্সড়ে আছে- কখনও এদিক থেকে গড়িয়ে ওদিকে যায় সেগুলো, কখনও ওদিকে থেকে গড়িয়ে এদিকে আসে। এবার ধান রোপার সময়, সিরিপুরের বাবুরা প্রত্যেক মজুর মজুরানীকে জলপান-এর সঙ্গে হয় লঙ্কা, না হয় পেঁয়াজ দিত! তাই নিয়ে ভড়, কেমৈ, আর সোনাদীপের বড় গেরস্তরা মিটিং করে। কত বোঝায় সিরিপুরের বাবুকে, পেঁয়াজ লঙ্কা বন্ধ করবার জন্য-পরের পুরুষের লোকেরা তোমায় দোষ দেবে। গেরস্তরা মরে যাবে এতে, যা চলে আসছে তার বিরুদ্ধে যেও না, ওদের তো চেনো না- পেঁয়াজ লঙ্কা দেবার রেওয়াজ হয়ে যাবে। একবার যে গাছে বক বসে সে গাছকে খরচের খাতায় লিখে রেখে দাও। [২০৭] কিন্তু সিরিপুরের বাবুও হিম্মৎওয়ালা লোক- মরদের কথা আর হাতির দাঁত; টস থেকে মস হবার জো নেই সেখানে। [২০৮] সেই সিরিপুরে বাবুর লঙ্কা-পিয়াজের উদারতার কথা মনে রেখে, কাছাকাছির যত মেয়েছেলে গিয়েছে সেখানে কাজ করতে। আরও কত খবর বিরজু পানওয়ালা শোনায়।
গুদরের মা বলে, তাই বলি! এই জন্যই ভর্সড়ের বাবু বাবুলাল চাপরাসীর কথা রেখেছে। শুনলে তো? আর তাই নিয়ে দুখিয়ার মার ঠেকারে মাটিতে পা পড়ে না। সব তাৎমানীরই নীরব সমর্থন আছে এই কথায়। বিরজু পানওয়ালা লোক চেনে। মহতোগিন্নীকে দিয়েই তার কাজ হবে।
[২০১. চাকর। ২০২. জল বড় খারাপ আর ম্যালেরিয়া। ২০৩. মুসলমান বেশি। ২০৪. পূর্বের রুগ্ন লোক। ২০৫. দহ।]
.
ধানক্ষেত্রে রামিয়ার দর্শন লাভ
অদ্ভুত এই ধানকাটুনীর রাজ্য। নতুন পোয়াল আর পচা পাঁকের গন্ধে ভরা দহের ধার রোজ রাতে কুয়াশায় ঢেকে যায়। আগুনের ঘুর-এর ক্ষীণ আলোয়, কারো মুখ চেনার উপায় নেই, অথচ কাটা ধানের পাহাড়ের উপর তাদের ছায়া নড়ে। সোনার পাহাড়গুলো প্রকাণ্ড কালো হাতির মতো দেখতে লাগে। ধানখেগো হাঁসগুলোর ডাক হঠাৎ ছোট ছেলের কান্না বলে ভুল হয়। খড়ের গাদার মধ্যে সর্বাঙ্গ ঢুকিয়ে রাতে ঘুমুতে হয়। জলের মধ্যে দিয়ে পানডুব্বী ভূত [২০৯] রাতদুপুরে ছপছপ করে চলে বেড়ায়- সেই শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দহের উপর র ভূত [২১০] আলো জ্বালিয়ে হাতছানি দেয়- এই এখানে, তো পরের মুহূর্তে হুই-ই-ই সাওতালটুলির ধারে চলে গিয়েছে। ঘুর-এর ধারে গল্প জমে ওঠে। সব তাৎমার অভিজ্ঞতা একই রকম,-রাতে যখন সে মাঠে গিয়েছিল, তখন তাকে একটা মেয়ে ইশারা করে সঙ্গে যেতে বলে। দেখেই বোঝা গিয়েছে যে মেয়েটা শখড়েল [২১১]। তার ডাকে সাড়া না দেওয়ায় সে ঐ পুবের শিমুল গাছটায় উঠে গেল। কসলের গা ছমছম করে।
একে এই বিবিত্র পরিবেশের আবেদন, তার উপর মহতো নায়েবদের নাগালের বাইরের জায়গা এটা। ধানকাটানীর দল তাই এখানে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
অন্য অন্যবার দলের গিন্নীপনা করত রতিয়া ছড়িদারের স্ত্রী। এবার মহতোগিন্নী এসে পড়ায় পদমর্যাদার দাবীতে তিনিই ধানকাটানীর গাঁয়ে বর্বেসর্বা হয়ে যান। বাইরের লোকের সঙ্গে দলের তরফ থেকে কথাবার্তা চালায় রতিয়া ছড়িদার।
এই একমাসের শিবিরের রীতিনীতি, আচার-ব্যবহার সবই তাৎমাটুলী থেকে ভিন্ন। সামাজিক বাধানিষেধ এখানে শিথিল; জাত-পাত এর বিচার কম; যে বেশি ধান কাটতে পারে, সবাই তাকে হিংসা করে; যে মেয়ের যৌবন আছে তার রোজগারের অভাব নেই; যে পুরুষের বয়স আছে, মেয়েদের কাছে তার কদর আছে; এখানে তার সাতখুন মাপ।
কোনো সংস্কারের বালাই থাকলে কি এত লোক থাকতে গুদরের মার আলাপ হয় মুঙ্গের তারাপুর দেরলর রামিয়ার মার সঙ্গে। বেশ সুশ্রী চেহারা রামিয়ার; ভাল নাম রামপিয়ারী। তাদের লোকের কাছ থেকে তাৎমাটুলির দল প্রথম কানাঘুষো খবর শোনে রামিয়ার মার সম্বন্ধে। সে ছিল ঝাজির বাড়ির দাই [২১২]-দাই কথাটার উপর অস্বাভাবিক জোর দিয়ে মুখে হাসির ইঙ্গিত এনে তারা বলে। না হলে তাৎমানীরা আবার ঝিগিরি করে নাকি? তার স্বামী ছিল পক্ষাঘাতে পঙ্গু। কয়েক বছর আগে মরেছে। গত বছর ঝাজীও মারা গিয়েছে।
ধনকাটনীর পরিবেশে এমন রসালো খবরও মোড়লগিন্নীর মনে উল্লাস জাগায় না। তার উপর রামিয়ামাইটাও [২১৩] এত ভালমানুষ। সবসময় কুণ্ঠিত থাকে একটু দোষী- দোষী ভাব, অথচ কোনো কথা লুকানোর চেষ্টা নেই। মহতোগিন্নীর মায়া হয় তার উপর। অন্য জায়গার সমাজের লোক সে; তার চালচলনের নাড়ী নক্ষত্র দিয়ে তাৎমাটুলির লোকের দরকার কি? তারাপুরের দল থাকে এখান থেকে রশি-খানেক দূরে। রামিযামাইয়ের উখালিটা থাকে এখানে- তাৎমার দলের মধ্যে। রোজ রাতে উখলিতে ধান ভানতে রামিয়ামাই আর মহতোগিন্নীতে কত সুখদুঃখের কথা হয়। দুজনেরই আইবুড়ো মেয়ে নিয়ে হয়েছে যত সমস্যা।
আমার রামিয়ার পা খোঁড়া না হলে কী হয়; তার বিয়ে নিয়েও মুশকিলে পড়েছি। তুমি তো বহিন তোমার কপালকে দোষ দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছ, আমার তো সে উপায়ও নেই। আমার কপাল তো আমি নিজেই পুড়িয়েছি।
বলেই রামিয়ামাই বুঝতে পারে যে ফুলঝরিয়ার খোঁড়া পায়ের কথাটা তোলা উচিত হয়নি, দুজনেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। আবার গল্প জমে উঠতে কিছুক্ষণ সময় লাগে।
ঐ পোড়ারমুখো পানওয়ালাটা এসে রামিয়ার কথা পেড়েছিল। ভর্সড়ের বাবু বোধ হয় পাঠিয়েছিল তাকে। দিয়েছি তার খোতা মুখ ভোঁতা করে। তারই জবাবে দাঁত বের করে বলে কিনা- সব কেচ্ছাই জানি তোমার, মেয়ের বেলায় এত সতীপনা কেন? হারামজাদা! ধোদলের বিচির মতো তার দাঁতগুলো ইচ্ছে করে এক থাবড়ায় ভেঙে দি।
মহতোগিন্নীর কাছে বিরজু পানওয়ালার স্বভাব অজ্ঞাত নয়। ঐ দালালটার কাছ থেকে সে প্রায় দুটাকার জিনিস মাঙনা পেয়েছে। অন্য অন্য বছর এই রোজগারটা করত ছড়িদারের বৌ। ঐ তো রবিয়ার বৌ আর হরিয়ার বৌ চলেছে দহের দিকে, এত রাতে। রামিয়ার মা টা আবার বুঝতে পারল নাকি? বোঝে নিশ্চয়ই সব।
খড়ের গাদা থেকে রামিয়া আর ফুলঝরিয়ার হাসির স্বর ভেসে আসে দুই মায়ের কানে; একেবারে হেসে ফেটে পড়ছেন দুই সখীতে। যাক ফুলঝরিয়াও তাহলে হাসতে জানে।
শুনে ফেলেনি তো ওরা আমাদের কথা?
না, এতক্ষণ উখলি-সামাট-এর শব্দে নিজেরাই নিজেদের কথা প্রায় শুনতে পাচ্ছিলাম না, আর ওরা শুনবে।
ফুলঝরিয়ারও বেশ লাগে রামিয়াকে। কী পরিষ্কার-ঝরিষ্কার থাকে রামিয়াটা; কাপড় চোপড় দুখিয়ার মার চাইতেও সাফসুত্রা [২১৪]। প্রত্যেক সপ্তাহে ওরা বিরজু পানওয়ালার কাছ থেকে আধ কাঠা ধানের কাপড়কাঁচা সাবান কেনে। ফুলঝরিয়া এর দেখাদেখি সাবান কেনার কথা তুললে, তার মা তাড়া দিয়ে ওঠে। রামিয়ার কাছে থেকে এই সব কিরিস্তানি শেখা হচ্ছে। তুই কি নাচওয়ালী নাকি যে হপ্তায় হপ্তায় পরিষ্কার করতে হবে। কত ধান রোজ ক্ষেত থেকে খুঁটে তুলিস, সেইটা আগে হিসাব করিস, তারপর সাবান কেনার কথা ভাবিস। একটানা বসে ধান কাটবার তো মুরোদ নেই। কাটবার সময় সিপাহী১৫ নজর এড়িয়ে, দু-চারটে করে ধানের গোছা তোর জন্যে আমরা ছেড়ে দি, তাই কুড়িয়ে তো চলে তোর পেট, আবার কাপড়ে সাবান দেবার শখ! কেউ ফিরেও তাকাবেনা তোর দিকে, যতই কাপড়ে সাবান দিস না কেন…
ফুলঝরিয়া সকলের কথাতেই তার অঙ্গহীনতার প্রতি ইঙ্গিতের আভাস পায়। তার মা সুদ্ধ তাকে ছেড়ে কথা বলে না। তার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। কিন্তু এই জলকাদা হিম কুয়াশার দেশে, কারও চোখের পাতা ভিজল কিনা, তা দেখবার সময় নেই তাৎমাদের।
তবু বেশ লাগে তার রামিয়াকে। চোখেমুখে কথা রামিয়াটার। কথা বলবার সময় হেসে ফেটে পড়ে। গান ছড়া সরস গল্প তার জিবের ডগায়! দুনিয়ার কারও তোয়াক্কা রাখে না। একটুও ভয়ডর নেই তার মনে। সব ভাল, তবু ফুলঝরিয়ার মনে হয়, রামিয়ার একটু যেন গায়ে পড়া ভাব; ধানকাটনীর গাঁয়ে এ জিনিস চলে, কিন্তু নিজের গাঁয়ে এ জিনিস চলবার নয়। হয়তো বা পশ্চিম-এর গাঁয়ের শিক্ষাদীক্ষাই এই রকম। কত দূরে তারাপুরে তার বাড়ি, মুঙ্গের জেলায়। এত দূরের কোনো লোকের সঙ্গে, এর আগে ফুলঝরিয়ার কথা বলার সুযোগ হয়নি। ওদের দেশের ভাষার টান আবার এমন যে শুনলেই হাসি আসে! কী রসিয়ে যে সে অন্যের নকল করতে পারে। মালিকের সিপাহী রামনেওরা সিং লম্বা জুলফি চুলকোতে চুলকোতে কেমন করে চোখ-ইশারা করে, তারই নকল করছিল রামিয়া এখন; একেবারে হাসতে হাসতে নাখোদম [২১৬] হয়ে যেতে হয়।
সেই হাসির স্বরই গিয়ে পৌঁছেচে মায়েদের কানে।
ওরে ও রামিয়া, আজ কি আর বাড়ি যেতে হবে না?
বাড়িই বটে, রামিযা বিদ্রূপ করে।
আজ চাচী, ও এখানে থাকুক না।
না না না ফুলঝরিয়া, তা কি হয়? রামিয়ার মা কারও উপর ভরসা পায় না।
কাল রাতে আবার এসো- যাবার সময় মোড়লগিন্নী বলে দেন।
খড়ের গাদার মধ্যে গা ঢুকিয়ে শুয়ে ফুলঝুরিয়া আকাশ পাতাল ভাবে। বড় একা একা লাগে তার, এত লোকের মধ্যেও। ঢোঁড়াইটা কী যে মাটিকাটার কাজ পেয়েছে। ধানকাটনীতে এলে বাবুসাহেবের ইজ্জতে চোট লাগত। নিজের গোঁতেই গেলেন। যাক ভালই হয়েছে না এসে। যা একগুঁয়ে। হয়তো শখড়েল ডাকলেও তার সঙ্গে সঙ্গে শিমুল গাছের দিকে চলে যেত।…এ কিসের শব্দ! কুকুর-টুকুর আঁচড়াচ্ছে নাকি খড়ের গাদা! চমকে উঠছে ফুলঝরিয়া। না হরিয়ার বৌ, পা টিপে টিপে এসে খড়ের গাদার মধ্যে ঢুকেছে। তাই বলো!
[২০৬. আগুন পোয়াবার স্থান। ২০৭. কানেই এদেশের লোকের ঠাণ্ডা লাগে সবচেয়ে বেশি। শীতকালে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ ঢাকা থাকুক না থাকুক, কানটি ঢাকা চাই-ই। ২০৮. হিন্দী প্রতিশব্দ- ভাগরেকা বৈগন। ২০৯. জিস গাছপর বগুলা বৈঠে, জিস দরবারমে- মৈথিল পৈঠে অর্থাৎ যে গাছে বক বসেছে, আর যে দরবারে মৈথিল ঢুকেছে, তা গেল বলে। ২১০. বিন্দুমাত্র নড়চড় হওয়ার জো নেই। ২১১. জলে ডুবে এদেশে পানডুব্বী ভূত হয়। এই ভূতেরা সারারাত জলের মধ্যে ছপছপ শব্দ করে। ২১২. আলেয়া। ২১৩. এক শ্রেণীর পেত্নির নাম! এরা পুরু দেখলে ডাকে। ২১৪. ঝি। ২১৫. রামিয়ার মা।]
.
রামিয়ার মাতার দেহান্ত
সেদিন রাতে মহতোগিন্নীকে ঘিরে বসে তাৎমাটুলির দল জটলা করছে। আজ কদিন হল রামিয়ার মা এখান থেকে চলে গিয়েছে দেড় ক্রোশ দূরের কেমৈ গ্রামে, তা না হলে রাত্তিরে মহতোগিন্নীকে কি আর পাওয়া যেত দলের মধ্যে। যাবার সময় রামিয়ার মা মহতোগিন্নীর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে গিয়েছিল–এ কটা দিন আর তোমাকে ছেড়ে যেতাম না বহিন; কিন্তু রামনেওরা সিং আর বিরজু পানওয়ালা জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এখানে থাকলে মেয়েটাকে আর বাঁচাতে পারব না। কেমৈ-এর রাজপুতরা আর যাই হোক এদিক দিয়ে লোক ভাল শুনেছি।…
এ কথার পর মহতোগিন্নী রামিয়ার মাকে বারণ করতে ভরসা পায়নি। ধানকাটনী শেষ হলে, দুদিন পরে তো ছাড়াছাড়ি হতই।
…হাটের দিন দেখা কোরো বহিন।
তারপর রামিয়ার চিবুকে হাত দিয়ে বলেন, মন খারাপ হবে আমার ফুলঝরিয়ার।.. তার পরদিন থেকে মহতোগিন্নী রোজ রাতে তাৎমাটুলির সকলকে নিয়ে আসর জমিয়ে বসেন।
গল্প জমে উঠেছে। কেমৈ-এর ওদিকে নাকি হৈজার বিমারী [২১৮] আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। যা দেশ, লোকেরা ভয়-টয় পেয়েছিল বোধ হয় রাতে [২১৯]। ভয় না পেলে কখনও হৈজা হয়?
সকলে মিলে ঠিক হয় রাতে কেউ ভয় পেতে পারবে না। ভয় পাব পাব হলেই সকলকে জাগিয়ে আগুনের ঘুরের ধারে বসতে হবে।
মহতোগিন্নী রামিয়ামাইটার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন- বেচারির কোথাও গিয়ে স্বস্তি নেই- কেমৈ গেল, সেখানেও আবার অসুখ আরম্ভ হলো।
নতুন একটা ঝগড়া ওঠায় এ প্রসঙ্গ তখনকার মতো চাপা পড়ে যায়।…একটা মাত্র কুপি জ্বালায় তাৎমাটুলির দলের লোকেরা। সবাই কুপিটাকে নিয়ে টানা টানি করে, কিন্তু মহতোগিন্নীই ওটাকে দখল করে থাকেন বেশি। এক একদিন এক একজনের তেল কিনবার কথা ধানের বদলে; আজ বিরজু পানওয়ালা তেলের দাম পায়নি। আজ ছিল রবিয়ার বৌয়ের পালা। সে সোজা বলে দিয়েছে যে, কুপিটা থাকবে মহাতোগিন্নীর কাছে, আর তেলের দাম দেবে সে? ওসব ফুটানি মহতোগিন্নী যেন তাৎমাটুলিতে ফিরে গিয়ে ছাঁটে- বড় বাড় বেড়েছিস রবিয়ার বৌ। কার সঙ্গে কি রকম কথা বলতে হয় জানিস না।
মহতোগিন্নী বোঝে যে সকলের সহানুভূতি রবিয়ার বৌয়ের দিকেই। কাজেই সে আর কথা বাড়াতে দেয় না..আচ্ছা, যেতে দাও না ফিরে তাৎমাটুলিতে, তারপর মজা টের পাওয়াব। কিছু বলি না সেখানে তাই।…
আচ্ছা, তেলের দাম আমি দিয়ে দেব বিরজু।
বিরজু পানওয়ালা হাসতে হাসতে চলে যায়।
পরদিন দুপুরে রামিয়া হঠাৎ একা এসে হাজির। তার চোখ দুটো ফোলাফোলা। আজ আর এসে ফেটে পড়ল না।
কী রে রামিয়া একা যে? তোর মার খবর কী?
রামিয়া হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে। তার মার হৈজা হয়েছিল, রাতে মরে গিয়েছে। কেমৈ-এর ধান ক্ষেতে পড়ে আছে। ওখানকার দলের সকলে পালিয়েছে হৈজার ভয়ে। কাটা ধান পর্যন্ত নেয়নি কেউ। মারা যাবার আগে কী তেষ্টা! কী তেষ্টা! সারারাত ঠায় একা। এতক্ষণে কাক শকুনে নিশ্চয়ই ঠুকরোচ্ছে। মা বলে গিয়েছিল ফুলঝুরিয়ার মার কাছে আসতে…তার কান্নার মধ্যে সব কথা বোঝাও যায় না।
তাৎমারা এ খবরে বিশেষ হৈ-চৈ করে না। মরাকে তারা মানুষের একটা অতি সাধারণ বৃত্তি বলে মনে করে। কিন্তু জানোয়ার মরা, আর মানুষ মরায় তফাৎ কী? কেবল কুকুর মরলে ডোমে ফেলবে, গরু মরলে পাড়ার মধ্যে তার ছাল ছাড়াতে পারবে না, আর মানুষ মরলে ভোজ দিতে হবে; এই তফাৎ।
তাৎমার দল বিরক্ত হয়ে ওঠে মেয়েটার উপর। মরার ছোঁয়া কাপড়-চোপড় পরে, ছিষ্টি ছুঁয়ে একাকার করবে মেয়েটা। যাক না ও মুঙ্গেরের দলের লোকদের কাছে। তা না গুদরের মা-ই হল বেশি আপনার লোক।
ভর্সড়ের বাবুর ছেলে, বিরজু পানওয়ালা, রামনেওরা সিং সকলেই খড়গহস্ত হয়ে ওঠে মেয়েটার উপর হঠাৎ। এই মেয়েটার দেওয়া রোগের খবরে আবার ধানকাটনীর দল ভয়ে না পালায়। তাহলে অর্ধেক ক্ষেতের ধান ক্ষেতেই পড়ে থাকবে। এমনি তো কেমৈ-এর রাজপুতেরা হয়তো ডিস্টিবোডে খবর দিয়েছে এতক্ষণ। ডিস্টিবোডের হৈজার ডাক্তার যদি এসে সুই [২২৫] দিতে চায়, তাহলেই তো ধানকাটনীর দল সব পালাবে।…
ভর্সডের গুরুজীকে পাঠানো হয় ডিস্টিবোড় অফিসে, ঘোড়ার পিঠে। তিনি সেখানে লিখিয়ে দিয়ে আসবেন যে, কেমৈ-এ যারা মরেছে, তাদের হয়েছিল ম্যালেরিয়া জ্বর। ভর্সড়ের বাবু কেমৈ–এর চৌকিদারটাকে বখশিশ করেন, সে যেন থানায় রিপোর্ট করে যে লোকেরা জ্বরে মরেছে। এখন ভালয় ভালয় ধানকটা ঘরে উঠলে বাঁচা যায়।
তারাপুরের দলের লোকেরা রামিয়াকে সঙ্গে রাখতে রাজী নয়। এমনিই রামিয়ার মার উপর কারও সহানুভূতি ছিল না। যতদিন ঝাজী বেঁচে ছিল, ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে, রুগ্ন স্বামীটার মুখে এক ফোঁটা জলও দেয়নি কোনোদিন।…তেমনি জল জল করে মরেছে নিজে…এলি দলের সঙ্গে এখানে। তা মন বসল না গেলেন পটের বিবি মেয়েকে সঙ্গে করে কেমৈ।…
শেষ পর্যন্ত রামিয়া তাৎমাটুলির দলের সঙ্গেই থেকে যায়।
মা-বাপ মরা মেয়ে, সোমত্ত বয়স। আপনার জনে দূরে ঠেলেছে।
মহতোগিন্নীর সমর্থনে রতিয়া ছড়িদারও মনে বল পায়। সে এই মেয়েটার সম্বন্ধে অনেক কিছু ভেবে রেখেছে। তারা রবিয়ার বৌকে বলে, তুই-ই রাখ মেয়েটাকে তোর সঙ্গে। রবিয়ার বৌটা আবার একটু বোকা বোকা গোছের। সে তার সাদা মনের কথাটা বলে ফেলে।
রাখতে আমার আপত্তি নেই, মেয়েটার মায়ের কিরিয়া করমে [২২১[ তো গুড় বাগনর [২২২] কিনতে হবে। বামুনকে পয়সা দিতে হবে। সে আমি একা দেব কোথা থেকে। মেয়ে বলে না হয় মাথা মুড়ানোর পয়সাটা লাগবে না।
সকলেই এক এক মুঠো ধান দিলেই কাজ হয়ে যায়, কিন্তু কেউ রাজী না।
হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে রামিয়া। কার সাধ্যি সে মুখের সামনে দাঁড়ায়।
মা-বাপ মরা বলে আজ হেনস্থা করছ। যদি কিরিয়া করম-এর অভাবে আমার মা শাখড়েল পেত্নী হয়, তাহলে যেন এই সতী লক্ষ্মীদের দলের সকলের সঙ্গে রাতে দেখা করে। একটা দানা ধান আমি কারও কাছ থেকে চাই না। পূবের ভূত তোরা, ভুচ্চর-এ দল [২১৩] কোথাকার। এদের খপ্পরে তার মা তাকে ফেলে দিয়েছে।
নরম পানির [২১৪] লোক এরা, এদের কলিজা [২২৫] আসবে কোথা থেকে? এতটুকু সরু দিল এদের, সুপুরি হলে কেটে দেখিয়ে দিতাম-পচা পোকাড়ে, ভর্সড়ের বাবুদের আর সব বাবুভাইয়ার দিলের মতো। তাদের তবু পয়সা আছে, জামার বোতাম এঁটে দিল ঢেকে রাখে; আর এই লরম পানির জানোয়ারগুলোর বোম কেনবার পয়সা নেই, মেহনৎ করবার তাকৎ নেই, তাকৎ কাজে লাগানোর মগজ নেই। আমি এখানে থাকার সময়, রামদানার [২২৬] শীষ দহের ধার থেকে কেটে পুঁতে রেখেছিলাম। তাই দিয়ে আমি মায়ের কিরিয়া করমে খরচ করব।
অকথ্য গালি দিতে দিতে সে ছিটকে বেরিয়ে যায় দহের দিকে।
তাৎমাদের ভাষায় অশ্লীল শীলের মধ্যে বাছবিচার নেই। রসিকতা আর রাগের সময় বীভৎস অশ্লীল কথা না বললে তাদের ফিকে ফিকে মনে হয় ভাষাটা। যে ওষুধের ধকল নেই, সে কী আবার একটা ওষুধ! তারাপুরের পাড়াকুঁদুলি মেয়েটা আজ এহেন তাৎমাদেরও চুপ করিয়ে দিয়েছে।
কেবল কে একজন যেন বলে ওঠে ফটফটিয়ে চলে গেলেন।
মহতোগিন্নী বলেন, চল চল সকলে। মেয়েটাকে স্নানটাও তো করাতে হবে। ফুলঝরিয়া, সেই আচারের হাঁড়িজড়ানো নেকড়াটা আনিস তো। আবার শীতের দিনে মেয়েটা ভিজে কাপড়ে থাকবে।
[২১৬. জমির মালিকের চাকর। ২১৭. খামার। ২১৮. কলেরা। ২১৯. এদের বিশ্বাস রাত্রে ভয় পেয়েই কলেরা হয়। ২২০. কলেরায় টিকা। ২২১. ক্রিয়াকর্ম। ২২২. কাঁচাকলাপাকা-এদের পূজার নৈবেদ্যে দরকার হয়। জিরনিয়া জেলার অতি প্রিয় ফল। ২২৩. একটি সাধারণ গালি-কথাটি ভুচর অর্থাৎ জানোয়ার। ২২৪. যেখানে জল খারাপ। ২২৫. হৃদয়। ২২৬ এর থেকে একরকম খই হয়। জলো জমিতে এর গাছ হয়। ফল মাটির ভিতর পচিয়ে তারপর ওর ভিতর থেকে দানা বার করতে হয়।]
.
পশ্চিম দিগ্বিজয়ের পর ধানকাটনীর দলের প্রত্যাবর্তন
ধাঙড়দের গ্যাং রাস্তা মেরামত করছে মরগামার পল-এর কাছে ২৭। পাটনা থেকে একজন বড় হাকিম এসেছেন সার্কাস বাংলায় [২৯৮]। প্রায় লাট সাহেবের মতো বড় হাকিম; ইয়ার টুপির নিচে লাল টকটকে মুখ; সে মুখ থেকে আগুনের ঘুর-এর মতো ধোঁয়া ছাড়ে ফন ফন ফন ফন। কথা বলে বাঘের মতো। কলস্টর সাহেব তো তাকে দেখে থর থর থর থর। সেই সাহেব যাবেন শিকারে- রাজদ্বারভাঙ্গার কুশীর ধারে ভৌয়া জঙ্গলে, বনভঁয়সা [২৯৯] মারতে। চেরমেন সাহেবের তো শুনেই সটক দম [৩০০]। তাই তাদর গ্যাংয়ের সকলকে আসতে হয়েছে। এমনি তো কোনো পুছ [৩৩১] নেই তাদের; কাজ আটকালে এনজিনিয়র সাহেবের মনে পড়ে তাদের কথা। এমনি যে রোজ সকালে ওরসিয়রবাবু সারা গ্যাংটাকে তার বাগানে কাজ করান, সেটা এনজিনিয়র সাহেবের নজরে পড়বে না। তবে চোখে সোনার চশমা পরার দরকার কী? সময় নেই অসময় নেই, জোয়ালে জুতলেই হল?
ঢোঁড়াই সায় দিয়ে বলে–হাঁ, বেয়াই মশায়ের বলদ পেয়েছিস হাতে; যত পারিস জুতে নে। তার মনটা খারাপ হয়েছে, যখন ওকে ওরসিয়রবাবু আজ মহরমের দিনেও তাদের পাক্কীতে কাজ করতে বলেছেন। তারা ফুদী সিং-এর মহরমের দলের লোক। দল ভারি করতে না পারলে ওজীর মুন্সীর দলের কাছে মাথা নিচু হয়ে যাবে। এখনও মহরমের ঢাকের শব্দ কানে আসছে আর ওরসিয়রবাবুর উপর রাগে তার গা জ্বালা করছে। আজ ফুদী সিংয়ের সঙ্গে দেখা হলেই সে বলবে, তাৎমারা চিরকাল একইরকম থেকে গেল। লাঠি গদকা তোরা কোনো কালেই খেলিস না, আর সেজন্য তোদের ডাকিও না। খালি একটু সঙ্গে সঙ্গে সারা শহর ঘুরবি, বাবুভাইয়াদের কাছ থেকে বখশিশ আদায় করবার জন্য। দিনের বেলাতেই যতটা শেষ করতে পারা যায় ততই ভাল, না হলে ঐ বখশিশের পাওয়া পয়সা থেকেই রাতের মশালের তেলের খরচ দিতে হবে। এক ঘণ্টা কলালীতেও [২৩২] তো যাবি সবাই। কলালী আবার রাত নটায় বন্ধ হয়ে যায়…
কিন্তু সন্ধ্যার আগে কি আর এই রাস্তার কাজ থেকে ছুটি হবে।
শালা ধান বোঝাই গরুর গাড়ির আর কামাই নেই। এ রাস্তা মেরামত কিসের জন্য। একটা জিরানিয়ার হাটের দিন গেলেই তো আবার যে কে সেই। এই যে কোদাল মেরে মেরে এনে মাটি ফেলেছি, এই শীতের দিনেও গা দিয়ে ঘাম ঝরছে, নবাবপুর গাড়োয়ানরা বলদের লেজ মুভতে মুড়তে হলালালালা করে একদিনে সাফ করে দিয়ে যাবে। চেরমেন সাহেবের এত তাকৎ; আর এই গরুর গাড়িগুলো রাস্তা দিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে পারে না!
এই বোকাগুলোর কথায় ঢোঁড়াই মনে মনে হাসে; আরে এটুকু বুঝিস না রাস্তা খারাপ না হলে তোদের রোজগার চলবে কী করে। আর এই গাড়িতেই তো ধান আসে জিরানিয়া বাজারে। ধান না এলে খেতিস কী? সত্যিই ধাঙড়গুলো বোকা। তবে এ কথা ঠিক যে চেরমেন সাহেব আর কলস্টর সাহেব ইচ্ছে করলে তাৎমা ধাঙড়দের অনেক কিছু ভাল করতে পারে। এই তো ধান চাল এত সস্তা করে দিয়েছে। এই সঙ্গে যদি বাবু ভাইয়াদের উপর হুকুম করে দিত, তাৎমাদের রোজ ঘরামির কাজ দিতে, তাহলেই হতো বেশ। কিন্তু রামজীর মর্জি ছাড়া তো কিছু হওয়ার উপায় নেই। কখন না কখন গরীবদের কথা তার মনে পড়বেই।
গই বহের গরীব নেবাজু।
সরল সবল সাহিব রঘুরাজু। [২৩৩]
তিনি ছাড়া আর গরীবদের দেখার কে আছে?…
এই বহলমান [২৩৪]। পাক্কীর উপর দিয়ে চালাচ্ছিস যে বড়। দিনের বেলা ঘুমুচ্ছে; ছুছন্দর কোথাকার।
গ্যাং-এর লোকের চেঁচামেচিতে ঢোঁড়াইয়ের নজর গিয়ে পড়ে ঐ গাড়ির দিকে। গাড়ি বোঝাই ধানের বস্তার উপর যে মেয়েটি বসে আছে, সে বস্তাগুলোর উপর হামাগুড়ি দিয়ে এসে গাড়োয়ানকে ধাক্কা দেয়- এই! ওঠো না। সেই সিসিয়া থেকে শুয়েছে। শুয়েছি তো কার পাঁজরার উপর মুখে ডলেছি [২৩৫]। তোমার নামবার জায়গা এসে পড়ে থাকে তো নেমে পড়ো না।
না, আর এক রাশি আগে নামবে। এখানে না।
কে মেয়েটা? সবাই তাকিয়ে দেখে। মহতোর মেয়ে ফুলঝরিয়া একটু অপ্রস্তুতের হাসি হাসে-সবাই তার খোঁড়া পায়ের কথা ভাবছে না তো।
ঢোঁড়াই বলে, কি ধানকাটনী থেকে নাকি? কত ধান হলো? আর সকলে কোথায়?
এই তারা একক্ষণ চিথরীয়া পীরে হবে। গোঁসাই ডুববার আগেই এসে পড়বে।
ফুলঝরিয়া ধানের বস্তার আড়ালে তার পায়ের দিকটা সরিয়ে নেয়, গায়ের কাপড় সামলায়, অন্যদিকে তাকাতে চেষ্টা করে। ঢোঁড়াইয়ের সম্মুখে এলেই তার কেমন যেন সব ঘুলিয়ে যায়।
ঢোঁড়াইয়েরও মায়া হয় মেয়েটাকে দেখে। হেসে বলে, যাক খুব পৌঁছেচো, মহরমের মেলার আগে। কালই দুলদুল ঘোড়া বেরুবে।
কৃতার্থ হয়ে যায় ফুলকরিয়া।
ঢোঁড়াইদের ফেলা মাটির উপর নিয়ে গভীর রেখা এঁকে গাড়ির চাকা এগিয়ে যায় তাৎমাটুলির দিকে। গাড়োয়ানটা আপন মনে বকতে বকতে যায়- আর কদিন পরে গেরস্তরা সত্যিই আনবে না ধান হাটে। গাড়িতে আনার মজুরি পোষায় না। কিনবার লোক নেই; গত হাটের দিনও এই ধান ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। এমন হলে তো নিলামেই বিকিয়ে যাবে জমি।…
না রামজী আছেন- ফুলঝরিয়া গাড়োয়ানকে সান্ত্বনা দেয়।…
আবার মাটি ফেলার কাজ আরম্ভ হয়। গোঁসাই ডোবার আগে ঢোঁড়াই দের আর ছুটি নেই। না হলে আবার কাল দুলদুল ঘোড়ার মেলার দিনও কাজ করতে হবে। আজ দক্ষিণ দিক থেকে তারা এগুবে বাড়ির দিকে।…
ফুর্তিসে ভাইয়া। [২৩৬] গোঁসাই ডুববার আর বেশি দেরি নেই।
দূরে দেখা যায়, একদল লোক এদিকেই আসছে। তাদের কোলাহলের স্বর শোনা যাচ্ছে। মহরমের দল নাকি? না ঝাণ্ডা কই? মাথায় কাঁধে জিনিসপত্রের বোঝা, তাই বলো। ঢোঁড়াই তোর টোলার ধানকাটনীর দল ফিরছেন পচ্ছিম ফতে করে। রতিয়া বলো। ঢোঁড়াই তো টোলার ধানকাটনীর দল ফিরছেন পচ্ছিম ফতে করে। রতিয়া ছড়িদার আবার মাথায় পাগড়ি বেঁধেছেন।
ধাঙড়ের দল নিবিষ্ট মনে রাস্তায় কাজ করবার ভাব দেখায়, যেন ধানকাটনীর দলকে দেখতেই পায়নি। ঢোঁড়াই এসে তাদের সম্বর্ধনা জানায়। মহতোগিন্নী মুখে এক গাল হাসি নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসেন।
ফুলঝরিয়ার সঙ্গে দেখা হয়নি খানিক আগে? পাড়ার খবর ভালো তো? আর আমাদের বুড়োর খবর? বাড়িতে এসো, নতুন ধানের চিড়ে খাওয়াব।
যাবার সময় মহতোগিন্নী তাকে বলে যান সে যেন ঠিক আসে। অনেক দিনের জমানো কথা আছে বাচ্চার সঙ্গে। সব তাৎমা মেয়েই ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে একটা-না একটা রসিকতার কথা বলার চেষ্টা করে। এতদিন পরে পাড়ার ছেলের সঙ্গে প্রথম দেখা; ধানকাটনীর হাওয়ার রেশ এখনও লেগে রয়েছে তাদের মনে। ঢোঁড়াই হেসে বলে, এখন বাড়ি গিয়ে কারও দেখা পাবে না, সব গিয়েছে ফুদী সিং-এর মহরমের দলে। রবিয়ার বৌয়ের পাশে ফরসা শাড়ি পরা মেয়েটাও খিলখিল করে হেসে ওঠে তাৎমানীদের রসিকতায়। এই তাহলে ঢোঁড়াই , যার গল্প রামিয়া ফুলঝরিয়ার কাছে শুনেছে।
মেয়েটিকে অচেনা অচেনা লাগে ঢোঁড়াইয়ের। পাড়ার তো নয়ই, অন্য কোথাও দেখেছে বলেও মনে পড়ে না। ছিপছিপে গড়ন, বেশ ছিমছাম, দুখিয়ার মার চাইতেও। মরগামার মেয়েটেয়ে নাকি! হয়তো জিরানিয়ার বাজারে যাচ্ছে। না ঐ তো এদের সঙ্গেই তাৎমাটুলির দিকে চলল? ইনারসন এর পরীর [২৩৭] মতো দেখতে। কাঁচা কঞ্চির মতো লচক [২৩৮] মেয়েটার দেহে। হঠাৎ ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়ে যায়, সামুয়রের সাহেবের হাওয়া-গাড়ির সম্মুখের একটা চাঁদির মূরতের কথা-৩৯। ঠিক সেই মেয়েটার মতো দেখতে এই নতুন মেয়েটাকে। একেবারে উড়ে যেতে চাইছে যেন, সেই রকম। দুটো ধনেশ পাখি সম্মুখের বটগাছের কোটরে এসে ঢোকে, ডানা ফটফট করতে করতে। দুটো বাদুড় লুইস সাহেবের পেয়ারা আর নারকুলী কুলের বাগানের দিকে উড়ে চলে যায়। তাৎমাটুলি, ধাঙড়টুলির আকাশ, দূরে জিরানিয়া শহরের গাছপালা সব রঙিন হয়ে উঠেছে- গোঁসাই ডুবছেন।
ভোঁ, ভোঁ, জিরানিয়া কুর্সেল লাইনের সাঝের লৌরী [২৪০] ছাড়ল। রাস্তা খারাপ করার যম এই লৌরীগুলো। ওরসিয়রবাবুর নানী মরে [২৪১], আর যদি ও আমাদের কাজ তদারক করতে আসে এর পরে। এক, দো, তিন। কাম খতম, পয়সা হজম! চলো চলো ঘর।
[২২৭. পারর, মাইলস্টোন। ২২৮. সার্কিট হাউস। ২২৯. বুনোমোষ। ২৩০. আক্কেলগুড়ুম। ২৩১. কদর! ২৩২. একটি প্রচলিত প্রবাদ-সমর্ধির্কা বয়েল। ২৩৩. মদের দোকান। ২৩৪. তুলসীদাস থেকে: সবল প্রভু রঘুরাজ হারানো ধন ফিরিয়ে দেন আর গরীবকে পালন করেন। ২৩৫. গরুর গাড়ির গাড়োয়ান। ২৩৬. তাড়াতাড়ি ভাই। ২৩৭. ইন্দাসনের পরী। কোন মেয়ে সুন্দরী হলেই তাৎমারা বলে ইন্দ্রাসনের পরীর মতো দেখতে।]
.
দুলদুল ঘোড়ার উৎসবে রামিয়ার যোগদান
নতুন মেয়েটা তাৎমাটুলিতে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই পাড়ায় সাড়া পড়ে যায়, ছেলেদের মধ্যে! আজব আজ পশ্চিমের খবর শোনায়। পুরুবের নরম পানির লোকেদের সম্বন্ধে নাক সিঁটকে কথা বলে। ছেলেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে, থাক না আর কিছুদিন, তারপর লরম কি কড়া বুঝবি।
তাৎমাটুলির ছেলেরা মহরমের দলে লাঠি খেলে শুনে, রামিয়া চোখ কপালে তুলে বলে, এখনও পুরুবের হিন্দুরা ঐ গরুখোরদের পরবে লাঠি খেলে নাকি? আমাদের পচ্ছিমে তোর চার সাল থেকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কী বন্ধ হয়েছে? লাঠি খেলা?
হাঁ হিঁদুর লাঠি খেলা, মহরমে।
সত্যিই তাৎমারা এ খবর কখনও শোনেনি এর আগে। ফুদী সিংয়ের দল লাঠি খেলা বন্ধ করবে, এ কথা তারা ভাবতেও পারে না। অদ্ভুত ঐ পচ্ছিমের লোকগুলো কী করে, কী ভাবে, কিছুই বোঝা যায় না। তবে কপিলরাজার জামাইয়ের মতো বদলোককে ঠাণ্ডা করতে হলে, ঐ সব একটা কিছু করতে হয়। রবিয়ার বৌ একটু ভয়ে ভয়েই তাকে জিজ্ঞাসা করে, তোমাদের দেশে কি দুলদুল ঘোড়ার মেলাতেও যাওয়া বারণ নাকি?
যাক, তবু নিশ্চিন্দি যে তোমাদের দেশে দুলদুল ঘোড়ার মেলা হয় না, মহরমের পরদিন। দুলদুল ঘোড়া কী জানো না, আর এই পচ্ছিমের এত বড়াই! অন্তত এই একটা বিষয়ে তাৎমানীরা রামিয়াকে হারিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আজ আর নষ্ট করার মতো সময় নেই তাদের। আজ মেলায় যাওয়ার দিন, আজ তাৎমানীদের স্নান করতে হবে, কাপড় শুখোতে হবে, একরত্তি মেয়েটার সঙ্গে ভ্যাজর ভ্যাজর করে বকলেই তাদের দিন চলবে না…
নরকটিয়াবাগে নবাব সাহেবদের পরিবারের কবরগা২৪২। ইমামবারা থেকে বেরিয়ে দুলদুল ঘোড়ার মিছিলে আসে ঐ কবরগা পর্যন্ত। এই গোরস্থানের বাইরে পথের উপর বসে মেলা, আর কবরগার ভিতর বসবার জায়গা করা হয় সাহেব আর হাকিম-হুকুমদের।
ভোঁ, ভোঁ! ধুলো উড়িয়ে লালরঙের হাওয়া-গাড়ি গোরস্থানের পাশে এসে থামে। ঢোঁড়াইরা সকলে সেইদিকে তাকিয়ে দেখে। সামুয়রের সাহেব সিগারেট খেতে খেতে কবরর ভিতর গিয়ে ঢোকেন। সাহেবের আরদালীর পোশাক পরে সামুয়রও এসেছে সঙ্গে হাওয়া-গাড়িতে। ধুলো আর ধোঁয়ার মধ্যে দিয়েও হাওয়াগাড়ির সম্মুখের ডানাওয়ালা চাদির মেয়েটাকে দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে ঢোঁড়াইয়ের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে তাৎমাটুলির মেয়েদের উপর। নূতন পচ্ছিমা মেয়েটাকে খোঁড়া ফুলঝরিয়া কী যেন বোঝাচ্ছে, এই হাওয়াগাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে বোধহয় সামুয়রের কথা। এক নজরেই বোঝা যায় যে মেয়েটা অন্য সব তাৎমা মেয়েদের থেকে আলাদা ধরনের। একমাত্র তারই কাপড় হরশিঙ্গার-এর ফুল [২৪৩] দিয়ে তাজা রাঙানো! মেলার এত লোকজনের মধ্যেও নজর গিয়ে পড়ে তারই উপর। হাওয়া-গাড়ির মধ্যে বসে আছে সাহেবের ডেরাইভার, সাহেবের কুকুর আর সামুয়র। আরদালী না ছাই!
এতক্ষণে সামুয়র নিশ্চিন্দি হয়ে বসে সিগারেট ধরাবার আর লোকজন ভাল করে দেখবার অবকাশ পায়। পথের পুবে রেললাইনের দিকে দাঁড়িয়েছে তাৎমাটুলির দল, আর পশ্চিমে তেঁতুলগাছের তলাটায় দাঁড়িয়েছে ধাঙড়টুলির দল। মেলাতেও তারা দুদল এক জায়গায় দাঁড়াবে না; কিন্তু নিজের পাড়ার সকলে একসঙ্গে দল বেঁধে থাকে; কত রকমের লোক আসে মেলায়। এই ভিড়ের মধ্যে মেয়েছেলে নিয়ে কাণ্ড, বলা তো যায় না। এরকম গোলমাল বহুবার হয়েছে, এত সাবধানতা সত্ত্বেও। তার উপর ফিরবার সময় রাত হয়ে যায়। প্রতিবারেই এক আধটি মেয়ে দল থেকে ছিটকে পড়ে; একটু রাত করে বাড়ি ফেরে; বলে দুলদুল ঘোড়া যাওয়ার সময় ভিড়ের চাপে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। মাতব্বরেরা বোঝে; বাড়ির লোকেরা দরকার বুঝলে প্রহারও দেয়।
ঢোঁড়াই শালা ধাঙড়টুলির দলের মধ্যেই বসেছে দেখছি। শনিচরার বৌটা আবার দেখছি পায়ে তিনগাছা করে সিলবরের পৈড়ী [২৪৪] পরেছে। আবার এদিকে তাকানো হচ্ছে।বুদ্ধি তো ঘটে খুব! ঝমড় ঝমড় শব্দ হবে হাঁটবার সময়! যাক তাতে দুঃখ নেই সামুয়রের; আজ তাকে ফিরতে হবে সাহেবের গাড়িতেই; কোনো উপায় নেই। ঢোঁড়াইটা আবার ওদিকে হাঁ করে কী দেখছে। দাঁত উঁচু মহতোগিন্নী এখানেও দেখছি জমিয়ে বসেছে। তেল পড়েছে আজ মাথায়। তার খোঁড়া মেয়েটাও দেখছি ভালুকের মতো বসেছে। ওর পাশেই হলদে কাপড় পরে কে ওটা, একেবারে হেসে গড়িয়ে পড়ছে? খাসা মেয়েটা! বাই গড বলছি, বেশ নিমকিন [২৪৫] দেখতে। সিনুর আছে নাকি কপালে? এতদূর থেকে দেখাও যায়! সামুয়রের মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। একটানে সিগারেটটার গোড়া পর্যন্ত জ্বালিয়ে সেটাকে ফেলে দেয়। তারপর আর কৌতূহল চাপতে না পেরে এগিয়ে যায় ঢোঁড়াইয়ের কাছে।
হাঁরে ঢোঁড়াই তুই ইদিকে বসেছিস যে বড়?
কেন ইদিকে কি কারও বাপের কেনা নাকি?
অন্য সময় হলে এ কথা নিয়েই বেঁধে যেত কুরুক্ষেত্র…তাৎমার বাচ্চা বাপ তুলে কথা বলবে? কিন্তু এখন সামুয়রের মনের ভাব সেরকম নয়। সে চায় ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে গল্প জমাতে। ঢোঁড়াইকে সিগারেট বের করে দিতে দিতে সে বলে এবার মেলা জমেনি সেরকম; লোকের হাতে পয়সাই নেই, তাই মেলা জমবে কী করে? ঢোঁড়াইও অন্যমনস্কভাবে সায় দেয় সামুয়রের কথায়। পথের ওধারে দুটো ছোঁকড়া বৌকাবাওয়াকে দহিবড়ার ঠোঙা দেখিয়ে ঠাট্টা করছে। আর একটু বেশি বাড়াবাড়ি করলেই ঢোঁড়াইকে উঠতে হবে, ফাজিল ছোঁড়া দুটোকে ঠাণ্ডা করতে।
ওটা কে রে ঢোঁড়াই? ঐ হলুদ রঙের শাড়ি পরে ঢলে পড়ছে খোঁড়া মেয়েটার গায়ে?
ওকে রবিয়ার বৌ এনেছে ধানকাটনীর থেকে।
বড় ফুরৎ ফুরৎ করছে রে মেয়েটা। রবিয়ার বৌয়ের আবার কে হয়? এখানে থাকবে নাকি এখন ঐ পাতলী কোমরওয়ালী ছুঁড়িটা?
ঢোঁড়াই এই সব প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় না। এই খ্রিস্টানদের সঙ্গে ঐ নূতন মেয়েটার সম্বন্ধে আলোচনা করতে মন চায় না। এই প্রসঙ্গ চাপা দেওয়ার জন্য সে বলে- এইবার এসে পড়ল দুলদুল ঘোড়া। ঢাকের শব্দ শুনতে পাচ্ছিস না? হলদে শাড়িপরা মেয়েটার পাশ দিয়ে সামুয়র শিস দিয়ে দিতে গট গট করে, তাৎমাদের দলের ভিড়ের মধ্যে ঢোকে। রামিয়ার হাসি থেমে যায়। ফুলঝরিয়া ফিস ফিস করে, সাহেবের মতো রঙের সামুয়রের পরিচয় দিতে দেয়- সাহেবদের বাড়ি কাজ করে, ঢেরী আমদানীর নৌকরী [২৪৬]; সাহেব অনেক টাকা দিয়ে যাচ্ছে ওকে, এখান থেকে যাওয়ার সময়…
দুলদুল ঘোড়ার মিছিল এসে পড়েছে। মেলার ছত্রভঙ্গ ভিড় জমে চাপ বেঁধে যায় মুহূর্তের মধ্যে। বুড়ো নবাব সাহেব নিজে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে দুলদুল ঘোড়ার লাগাম ধরে নিয়ে আসছেন। সাদা রঙের ঘোড়াটা। চোখ দুটো তুলি দিয়ে ঢাকা। সোনার ঝালর দেওয়া জিন ঘোড়ার পিঠে।- মেহেদিপাতা দিয়ে রাঙানো নবাব সাহেবের দাড়ি। মখমলে ঢাকা আস্তাবলে বন্ধ করে রাখা হয় দুলদুল ঘোড়াটাকে সারা বছর। হাসসান হোসসান! হাসসান হোসসান! লাঠি আর বুক চাপড়ানোর শব্দে দম বন্ধ হয়ে আসে। ধুলোয় চারিদিক অন্ধকার হয়ে ওঠে। হায়রে হায়! জুলুস [২৪৭] ঢুকছে কবরগার মাঠে, কারবালা করতে। মেলাসুদ্ধ লোক ভেঙ্গে পড়ে কবরগার মাঠের দেওয়ালের চারিদিকে। ফুলঝরিয়া নিজের জায়গা থেকে নড়তে পারেনি। রামিয়ার একটা কথা বারবার মনে হয়- ফুলঝরিয়া বলছিল যে দুলুদুল ঘোড়াটা সারা বছর মখমলের উপর থাকে। মখমলটা নোংরা হয় না?…ভিড়ের চাপে আর কৌতূহলের আতিশয্যে, সে কখন ফুলঝরিয়াকে ফেলে এগিয়ে এসেছে বুঝতেও পারে না। টের পায় যখন দহিবড়াওয়ালা গালাগালি দিয়ে ওঠে,-তার ঝুড়ির ওপর দিয়ে মাড়িয়ে চলে গিয়েছে রামিয়া, আরও অনেকে। কী কাণ্ড! দহিবড়াওয়ালাটা আর তাদের আস্ত রাখবে না। পুবের লোককেও রামিয়া ভয় পায় তাহলে।…হায় রে হায়!…হঠাৎ দেখে যে সাহেবের মতো রং আরদালীটা কখন যেন গা ঘেঁষে এসে দাঁড়িয়েছে। সে রামিয়ার তরফ নিয়ে ঝগড়া করে দুহিবড়াওয়ালাটার সঙ্গে। তার চেহারা আর পোশাক দেখেই দুহিবড়াওয়ালা আর পালানোর পথ পায় না।…হায় রে-হায়।…
[২৩৮. নমনীয়তা। ২৩৯. রৌপ্যমূর্তি। ২৪০. মোটর বাস। ২৪১. নানী মরে শব্দার্থে দিদিমা মারা যায়। কিছুতেই নয় এই অর্থে ব্যবহত হয়। ২৪২. কবর দেবার জায়গা। ২৪৩. শিউলি ফুল। ২৪৪. জার্মান সিলভারের মল। ২৪৫. নিমকিন সুন্দর আর লাবণ্যযুক্ত। কথাটি সম্মানজনক পাত্রপাত্রীর সম্বন্ধে প্রয়োগ করা হয় না। ২৪৬, অনেক আয়ের চাকরি।]
.
ঢোঁড়াইয়ের নাগপাশে বন্ধন
ঢোঁড়াইয়ের খুব ভাল লাগে রামিয়াকে। মেয়েমানুষের উপর সে আগে ছিল একটু নিস্পৃহ গোছের; নিস্পৃহ কেন, বোধ হয় একটু বিরক্তই- কোনো কথার ঠিক নেই নোংরা ঝোটহহাদের, বেটাছেলে দেখলে হেসে ঢলে পড়ে, কিন্তু এ মেয়েটা ঠিক নেই নোংরা ঝোটহোদের, বেটাছেলে দেখলে হেসে ঢলে পড়ে, কিন্তু এ মেয়েটা কেমন যেন অন্য রকম। কথা বলে যেন কত কালের চেনা! মেয়েটার গায়ের তাকৎও [২৪৮] খুব; বেটাছেলেদেরও হার মানায়। তাৎমাটুলির ঝোটাহারদের মতো কমজোর [২৪৯] না। সেদিন কুয়ো থেকে জল নিয়ে যাচ্ছিল রামিয়া। তিনটে ইয়া বড় বড় কলসী একসঙ্গে মাথায় দুটো, কাঁখে একটা। এক ফোঁটা জল পড়েনি গায়ে। ঢোঁড়াই দেখেছিল পিছন দিক থেকে; আলবৎ পচ্ছিমের পানির গুণ। বাঙালী মেয়েদের মতো চুল, জলের কুঁজোর মতো গলা কোমরের নীচেটা তার মতো দেখতে [২৫০]। ভারি ইচ্ছে করে মেয়েটার সঙ্গে বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করতে। আবার একটু ভয় ভয়ও করে ওর সঙ্গে কথা বলার সময়। হাজার হলেও পচ্ছিমের মেয়ে, ওদের রসম রেওয়াজ আলাদা, সংস্কার ভাল; পুরুব-এর লোক মুখে স্বীকার না করলেও প্রত্যেকেই মনে মনে একথা না মেনে নিয়ে পারে না। রহন সহন কিরিয়া রকম এর [২৫১] যা কিছু ভাল সবই তা পচ্ছিম মুল্লুকের জিনিস; পুরবে তো কেবল মিয়াদের কিচির-মিচির বুলি [২৫২] আর বাঙালীদের আচার ব্যবহারের কথা ছেড়েই দাও, তাদের তো ও সবের বালাই-ই নেই।
রামিয়া নামটাও বেশ। হবে না! পশ্চিমের লোক; কোথায় সেই মুঙ্গের জেলা, গঙ্গা কিনার [২৫৩]; কাঢ়াগোলার চাইতেও পচ্ছিমে! আমাদের মেয়েদের নামেরই বা কী ছিরি! বুধনী, জিবছী; আর ওদের দেখো তো। রামিয়া-রামপিয়ারী। পচ্ছিমের মুলুকে মেয়েদের নাম যত ভাল, আমাদের জিরানিয়ার বেটাছেলের নাম পর্যন্ত অত ভালো হয় না। ওদের মরদদের নামের তো কথাই নেই। ঐ তো পচ্ছিমের; অচ্ছেবট সিং ডিস্টীবোডের কল মেরামতিতে কাজ করে। ঢোঁড়াই তার নামের সঙ্গে নিজের নাম মিলিয়ে মনে মনে লজ্জিত হয়-রামিয়া তার ঢোঁড়াই নাম শুনে নিশ্চয়ই হেসেছে। মেয়ের গড়ন দেখতে চাও- পচ্ছিমের; মরদ দেখতে চাও, পচ্ছিমের; পানি [২৫৪] দেখতে চাও, পচ্ছিমের আদব কায়দা দেখতে চাও, পচ্ছিমের; সব ভালো পচ্ছিমের। যাক, যাদের মুল্লুক যেমন, তাদের মুল্লুক [২৫৫] তেমন; হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান হয়?
মেয়েটা অত হাসিখুশি হলে কি হয়, দেখলেই ঢোঁড়াইয়ের মায়া লাগে, বোধ হয় ওর মা-বাপ নেই বলে। তার নিজেরও তো বলতে গেলে ঐ একই দশা।
মহতোগিন্নীর সঙ্গে গল্পে গল্পে বলেই ফেলল ঢোঁড়াই , এই কথাটা ফুলঝরিয়ার মা কীভাবে নিল বোঝা গেল না।
হ্যাঁ, তোরও মা অবিশ্যি না থাকার মধ্যেই; তবে তোর বাওয়া রয়েছে, আমরা রয়েছি। মনে করলে সবই আছে, না মনে করলে কিছুই নেই। কত কী যে ভাবে আমার বাচ্চা। এই হল সেই মিল, সেই যে কথায় বলে না, তোর বেয়ানের উঠোনেও বাবলা গাছ, আর আমার বেয়ানের উঠোনেও বাবলা গাছ, আমরা দুজনে আপনার লোক। তোর এ কথা হল তাই।…ও ফুলঝরিয়া, নতুন ধানের চিড়ে যে রাত কুটলি, তাই চারটি ঢোঁড়াইকে খাওয়া না। ঘটির জলটা হেঁকে দিস তোের কাপড়ের আচঁল দিয়ে-বড় ময়লা হয়েছে জলে।
রামিয়া থান-এ এসেছিল গোঁসাইকে প্রণাম করতে। গোঁসাইয়ের মাথায় জল ঢালবার পর সে ঢোঁড়াইকে জিজ্ঞাসা করে সে পুরবের মুলুকে কি গোঁসাইয়ের বেদী রোজ লেপতে নেই নাকি?
ঢোঁড়াই অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বলে এসবের দেখাশুনো বাওয়াই করে।…
না, না, বেদী নিকোনোর কাজ বাওয়ার নয়। আমাদের পচ্ছিমে পাড়ার মেয়েরাই গোঁসাইয়ের বেদী লেপে।
সে দেশের কথা হল আলাদা। ঢোঁড়াই এই এক কথাতেই পচ্ছিম মুল্লুকের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নেওয়ায় রামিয়ার মনটা খুশী হয়ে ওঠে।
ঢোঁড়াই জানে যে, পচ্ছিমের লোকের ভাল লাগবে না তাদের তাৎমাটুলি; তবু জিজ্ঞাসা করে, কেমন লাগছে আমাদের টোলা? আর অন্য কোনো কথা সে চেষ্টা করেও মনে করতে পারে না।
মেয়েটি বোধ হয় ঢোঁড়াইয়ের মন রাখবার জন্যই বলে, বেশ লাগছে, তোমাদের টোলা। বেশ, কোন মুসলমান নেই, ডোম নেই, মুসহর [২৫৬] নেই। কিন্তু জমি বড় বালুবুর্জ [২৫৭]। আর কেউ রামায়ণ পড়তে পারে না।
অদ্ভুত পচ্ছিমের লোকদের ভাববার ধরন। এইসব দিক দিয়ে যে তাদের টোলার বিচার কেউ করতে পারে, এ তার মাথায়ই আসেনি কখনও। তারা চাষবাস করে না, তাই জমি বালুবুর্জ না এঁটেল মাটির এ নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি। কেবল এইটুকু জানে যে, এই বালুবুর্জ জমিতে অল্প খুঁড়লেই কুয়োর জল ওঠে; বালিতে কুয়ো বেশি দিন টেকে না; পাক্কীতে তারা যে মাটি ফেলে, তা বালি ভরা বলে একপশলা বৃষ্টিতেই ধুয়ে যায়। মেয়েটা মুসলমান, ডোম, মুসহর, কী সব কথা বলে।
জিজ্ঞাসা করে, কেন, মুসলমান থাকলে কী হত?
এ গোঁসাই থানে মুরগী চরত, আর কী হত।
তাই তো মেয়ে হয়েও রামিয়া বুদ্ধিতে বেশ দড় দেখছি। কথাটা ঠিকই বলেছে। সত্যি, যদি সে রামায়ণ পড়তে পারত তাহলে, রামিয়ার চোখে সে কত বড় হয়ে উঠতে পারত আজ। পড়তে না পারুক, রামায়ণ সে জানে, এই কথাটা রামিয়াকে জানিয়ে দেবার জন্য বলে, আমাদের কাছে তাৎমাটুলিই ভাল রাগে। জলু পয় সরিস বিকাই, দেখহু প্রীতি কি রীতি ভলি২৫৮, জলও দুধের মতো বিক্রী হয়, যেখানে ভালবাসা আছে। এখানে আগে কুশীনদী ছিল কিনা, তাই এত বালি। কৌশিকীমাই চলে যাচ্ছে পচ্ছিমে; ঘোমটার আড়ালে পিদিপ জ্বালিয়ে মায়ের কাছে যাচ্ছে। ফেলে রেখে যাচ্ছে এই সব বালুবুর্জ জমি। কৌশিকীমায়ের গল্প তুমি জান না? খুব বড় গল্প। রবিবারে শুননা মিসিরজীর কাছ থেকে, তিনি যখন এই থানে রামায়ণ শোনাতে আসবেন। এই কথার মধ্যে দিয়ে ঢোঁড়াই চালাকি করে রামিয়াকে শুনিয়ে দিতে চায় যে তাদের টোলাতেও নিয়মিত রামায়ণ পড়া হয়। যতটা বাজে জায়গা তাৎমাটুলিকে মনে করেছে, ততটা খারাপ জায়গা এটা নয়।
মেয়েটা কিন্তু এসব কথায় বিশেষ কান দিল বলে মনে হল না। তবে ঢোঁড়াইকে দেখে যা মনে হয়েছিল তার চাইতে অনেক চালাক-চতুর। তার কাঁধ আর হাতের ঢেউখেলানো মাংসর দলাগুলো দেখলেই বোঝা যায়- পাথরের মতো শক্ত। ওর রোজগার ভাল হবে না তো কার হবে? এই কথাগুলোই থান থেকে ফিরবার পথে রামিয়ার মনে আনাগোনা করে।
[২৪৭. মিছিল। ২৪৮. জোর। ২৪৯. দুর্বল। ২৫০. এইগুলিই সৌন্দর্যের লক্ষণ বলে গণ্য হয়। ২৫১. আচার ব্যবহার ক্রিয়াকর্ম (রহন সহন কিরিয়া করম)। ২৫২. দুর্বোধ্য ভাষা। ২৫৩. গঙ্গাতীর। ২৫৪. জলবায়ু। ২৫৫. দেশ। ২৫৬. একটি অনুন্নত শ্রেণীর নাম; এই অঞ্চলে সবচেয়ে নোংরা বলে অখ্যাতি আছে। ২৫৭. একেবারে বালিভরা মাটি। ২৫৮. প্রীতির কি যথার্থ রীতি দেখ, জলও দুধের মতো বিক্রয় হয়!-(তুলসীদাস)।]
.
রেবণগুণীর ঢোঁড়াইকে বরাভয় দান
ঘুরে ফিরে রামিয়ার কথা মনে পড়ে ঢোঁড়াইয়ের। অন্য কথা ভাবতেও ভাল লাগে না। রামিয়াকে একেবারে আপনার করে পাওয়া চাই, শাদি [২৫৯] ছাড়া তো হতে পারে না। শাদির কথা ওমনি বললেই হল নাকি; মাথার উপর বাওয়া রয়েছে; মেয়ের দিকের কোনো বেটাছেলের কাছে কথা পাড়তে হবে; সমাজ রয়েছে; মহতো আর নায়েবদের মজুরি দিতে হবে, টাকা দিতে হবে, ভোজ দিতে হবে, তার উপর এ তো আর এখানকার জোটাহার বিয়ে নয়, পচ্ছিমের মেয়ের নিজেরও পছন্দ অপছন্দ আছে। রামায়ণ পড়তে শেখেনি সে, তাকে কি আর রামিয়ার পছন্দ হবে।
পরের দিন যখন রামিয়া সন্ধ্যাবেলায় থানে পিদিপ দিতে আসে, তখনই ঢোঁড়াই তাকে এক কোঁচড় গলাকাটা সাহেবের বাড়ির কুল খেতে দিয়েছিল। এ রকম কুল পচ্ছিমে আছে, বড় যে পচ্ছিমের বড়াই করো? রামিয়া একটা খেয়েই বলেছিল বেটা মরে [২৬০] এমন কুল জীবনে খাইনি, গুড়ের মতো মুখে দিলে মিলিয়ে যায়।
আরে বেটা কোথায় তোমার ছেলের দিব্যি দিচ্ছ?
বেটা কোনো দিন হবে তো।
বোকার মতো দুজনেই হেসে ওঠে; কে কী ভাবে কে জানে। চেরা কচি আমের মতো রামিয়ার চোখদুটোর২৬১ দিকে চেয়েই ঢোঁড়াই বুঝতে পারে যে,রামিয়া তার উপর বিরক্ত নয়।
সেই রাতেই ঢোঁড়াই যায় রেবণগুণীর কাছে। গুণীকে রাতে ধরা শক্ত, সে নেশা করে রাতে নাকি শ্মশানে চলে যায়, সেখানে সারারাত ভূত নাচায়, মানুষের মাথা নিয়ে ভূতদের সঙ্গে খেলা করে। কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের বরাত ভাল। বাড়িতেই রেবণগুণীর দেখা পেয়ে যায়, নেশা সে করেছিল ঠিক, কিন্তু তখনও শ্মশানে যায়নি। থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে ঢোঁড়াই তার পায়ের কাছে আট আনা পয়সা রাখে, তার গাঁজার ভেট-এর জন্য। সবাই জানে যে এ না দিলে গুণীর মুখ খোলে না। কুপিটা পর্যন্ত নেই, গুণীর মুখ দেখা যাবে কী করে?
কে?
মদের গন্ধ গলার স্বরে মুখটা কোথায় ঠাহর করা যাচ্ছে। তারপর আরম্ভ হয় কাজের কথা। গুণীকে যতটা রগচটা সবাই ভাবে, ততটা নয়, কাজের সংস্রবে তার কাছে এসে ঢোঁড়াই বুঝতে পারে। নতুন পরদেশী শুগা [২৬২] রামিয়ার সম্বন্ধে রেবণগুণী বেশ ঔৎসুক্যই দেখায়, ঢোঁড়াইয়ের মনে হয় দরকারের চাইতেও বেশি। সেও শুনেছে মেয়েটার কথা, কিন্তু এখনও দেখেনি। ডবকা নাকি? তাকে শনিবার রাতে শ্মশানে পাঠাতে পারিস? না আমারই ভুল হচ্ছে, যদি শ্মশানেই পাঠাতে পারবি তবে আর আমার কাছে আসবি কেন? তার মায়ের কিরিয়া করম-এর [২৬৩] কথা বলতে পারিস না? তুই মরদ, না কী?
ঢোঁড়াই বলে, ভুল বুঝো না গুণী। আমি তাকে শাদি করতে চাই।
সঙ্গে সঙ্গে গুণীর গলার সুর বদলে যায়। তাই বল! আচ্ছা তাহলে তার শ্মশানে না গেলেও চলবে। তুই চল এখনই আমার সঙ্গে চিথরিয়া পীর।
চিথরিয়া পীরের পাকুড় গাছটার নীচের বেদীটার কাছে এসে যখন ঢোঁড়াই দাঁড়ায় তখন হাড়কাঁপানি শীতের মধ্যেও সে ঘামতে আরম্ভ করেছে। হাত পা যেন স্থির রাখতে পারছে না। ইচ্ছা হয় বেদীটা ধরে বসে পড়তে। অন্ধকার নিঝুম রাত। শুকনো পাতার উপর দিয়ে চলার সময় যে শব্দটুকু হচ্ছে, মনে হচ্ছে যে তাইতেই সারা গাঁয়ের লোক জেগে উঠবে। শীতের হাওয়ায় বিরাট গাছটায় ডালে ডালে ঝোলানো অজস্র নেকড়ার ফালি দুলছে। কিচিন পেত্নীগুলোর২৬৪ শাড়ি দুলছে না তো? সেগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে নাকি? না সেগুলো বোধহয় কাপড় নেড়ে নেড়ে জোনাকপোকা তাড়াচ্ছে?
খোকা-ভূতের চোখ নাকি ঐ জোনাকপোকাগুলো?…রেবণগুণী তাকে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে বসিয়ে দেয়। তারপর খানিকটা মাটি বেদীটার থেকে ভেঙে নিয়ে বলে, যেই আমি মন্তর পড়ে গোঁসাই জাগাব, অমনি দেখবি যে তুই হামাগুড়ি দিয়ে চলতে আরম্ভ করেছিস। একেবারে গাছের গুঁড়িতে গিয়ে ঠেকে যাবি, তবে থামবি। কারও বাপের সাধ্যি নেই তার আগে তোকে থামায়।
গুণী মন্ত্র পড়তে আরম্ভ করে। হাঁটুর নিচের মাটি কেঁপে ওঠেকিসে যেন ঢোঁড়াইকে ঠেলে নিয়ে চলেছে তার সম্বিত নেই, ভাববার ক্ষমতা নেই, কেবল তাকে এগিয়ে যেতে হবে। তার মাথাটা গিয়ে খুঁড়িটায় লাগে, ঠিক যেখানটায় সিঁদুর লাগানো আছে। জ্ঞান হলে ঢোঁড়াই দেখে যে সে উবু হয়ে, হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বেদীটার উপর।
ওঠ!
ঢোঁড়াই উঠে দাঁড়ায়। কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগে, জ্বর ছাড়বার পরের মতো। মনে হচ্ছে হাঁটু দুটো দুমড়ে আছে।
এই মাটি রাখ খানিকটা। কোনো রকমে তার মাথার চুলে ছোঁয়াতে হবে।
তাৎমাটুলির মোড়ে এসে, রবিয়ার বাড়ির দিকে মুখ করে গুণী পথের বালির উপর কী সব কতগুলো আঁকেজোখে। বলে চক্কর মেরে দিলাম২৬৫, কাজ হবে। আমার বাকি পাওয়া দিয়ে দিস পরের সপ্তাহে।
গুণীর কথার খেলাপ করে কেউ যেতে পারে না একথা সে জানে।
ঢোঁড়াই মাটিটুকু নিয়ে থানে ফিরে আসে প্রায় ভোর রাত্রে। বাকি রাতটুকুও অজস্র চিন্তায় জেগেই কেটে যায়। কী করে তার মাথায় দেওয়া যায় এক খাবলা মাটি? দেওয়ার সময় যদি জানতে পারে। তারিবহ্বলী২৬৬ পচ্ছিমের মেয়ে আবার কী জানি কী ভাবে নেবে জিনিসটাকে। মেয়েটাই আমাকে গুণ করেছে কিনা কে জানে। না হলে এমন তো কখনও হয়নি। বিড়ি না খেলেও এত মন আনচান করে না। মেয়েটা শাঁখরেল নয়ত? দূর কী যে অঠর পটর ভাবি২৬৭ তার ঠিক নেই।…
ঢোঁড়াই ঠিক করতে পারে না, বাওয়াকে তার এই শাদি করতে ইচ্ছার কথা বলবে কিনা। বাওয়া চেয়েছিল তাকে এই গোঁসাই থানের ভার দিতে। সেই জন্য তাকে ভকত বানিয়েছিল। তার মাটিকাটার কাজ নেওয়ার পর থেকে বাওয়া বোধ হয় সে আশা ছেড়ে দিয়েছে; অন্তত তারপর থেকে আর কোনোদিন সে কথা বলেনি। তবুও লজ্জা লজ্জা করে বাওয়াকে এই শাদির কথা বলতে। বাওয়া যদি জিজ্ঞাসা করে টাকা পাবি কোথায়? তবে আজকাল বিয়ের খরচ একটু কমেছে মনে হচ্ছে, অথচ সরাধ এর কানুনের [২৬৮] জন্য তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতেই হবে। লোকে খরচ করবে কোথা থেকে। অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছ থেকে টাকায় রোজ এক পয়সা করে সুদে গো কয়েক টাকা পাওয়া যেতে পারে। শুক্রা আর এতোয়ারী ধাঙড়ও কিছু দিতে পারে। দুখিয়ার মা? তার এক পয়সা মরে গেলেও না; এর জন্য শাদি যদি নাও হয় ভাল! বেঁচে থাকুন অনিরুদ্ধ মোক্তার। বিয়ে শ্রাদ্ধয় ধার করবে না তো করবে কখন? কিন্তু শাদির পর বৌ থাকবে কোথায়?
গোঁসই থানে তো মেয়েমানুষের থাকবার জায়গা হবে না। মাটি কাটার কাজ থাকলে পয়সার অভাব হবে না; আর রামিয়া নিজেও কামাবে খুব; যা তাকৎ ওর গায়ে, ও কোদারীর কাজ পর্যন্ত করতে পারে [২৬৯] দরকার হলে; এখানকার ঝোটাহাদের মতো খালি খুরপি দিয়ে মাটিতে সুড়সুড়ি দেওয়া নয়। মরদের মজুরি কামাবে।
সন্ধ্যাবেলা আবার ঢোঁড়াই গলাকাটা সাহেবের হাতা থেকে কুল পেড়ে আনে। একেবারে গাছ ঝেড়ে পেড়ে নিয়ে যায় পাড়ার ছোঁড়াগুলো। আজকালকার ছেলেদের সাহস কি বেড়েছে। ঢোঁড়াইরা তো ছোটবেলায় গলাকাটা সাহেবের হাতার মধ্যে ঢুকতে ভয় পেত। সে কিছুতেই ভেবে কূলকিনারা পায় না- কী করে একটু মাটি সে রামিয়ার মাথায় চুলে দেবে। খানিকটা মাথায় মাখবার সরষের তেল রামিয়াকে দিলে হয়- তার সঙ্গে এই মাটি একটু মিশিয়ে। মাথায় মাখবার তেল দিলে নেবে না, এমন ঝোটাহা ঢোঁড়াই জীবনে দেখেনি। তবে এ হচ্ছে পাচ্ছিমের পাখি, কী জানি যদি না নেয়। থানের পিদিপের জন্য বলে খানিকটা তেল মেয়েটাকে নিশ্চয় দেওয়া যায়; তাতে সংকোচের কোনো কথা নেই। অমন ঢের পচ্ছিমবালি ঢোঁড়াই দেখেছে।
বাওয়ার তেলের শিশি থেকে একটু তেল নারকেলের মালায় ঢেলে নেয়। ঢোঁড়াই এতদিন বাওয়াকে ঠাট্টা করেছে, কেন সে নারকেলের মালা দেখলেই কুড়িয়ে রেখে দেয়! এখন সে বোঝে যে বাওয়া সত্যিই বুদ্ধিমান। পুজোর পিদিপের তেল বলে দিলেও একটু আধটু মাথায় মেখেই নেবে, কমসে কম তেলের হাতটা মুছবে মাথায়। ঢোঁড়াই ভেবে রাখে, এই তেলটুকু থানেই রেখে দিতে বলবে রামিয়াকে। রোজ রোজ এখানে এসে যেন পিদিপে ঢেলে নেয়। না হলে বাড়ি নিয়ে গেলে রবিয়ার ঐ হ্যাংলা সাতগুষ্টির ভাল্লুকের মতো চুলেই-বাস এক মিনিটেই সাফ।…
পিদিপটা আঁচলের আড়াল করে রামিয়া আসে গোঁসাইথানে সন্ধ্যাবেলায়। এসেই বলে- আজ বড় জলদি জলদি ফিরেছ কাজ থেকে। অথচ রামিয়া এইটাই আশা করেছিল। ঢোঁড়াই এখন না এলে একটু হতাশ হত। ঢোঁড়াইয়ের বুকের ভিতর তখন হাতুড়ি পিটছে, আবার ধরা পড়ে গেল না তো? একটু ঢোক গিলে সে রামিয়ার কথার জবাব দেয়- হাঁ।
থানে পিদিপ দেওয়ার আগে, আঁচলটা মাথায় দিতে দেখেই ঢোঁড়াইয়ের মাথায় হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে। কুল কটার সঙ্গে এক চিমটে মন্তরের মাটি মিলিয়ে রাখলে হয় না পচ্ছিমের মেয়ের কখন কী মতিগতি কিছু বলা যায় না, কুল কটা নিশ্চয়ই আঁচলে বেঁধে নেবে; পরে আবার যখন আঁচলটা মাথায় তুলে দেবে, তখন কি মাটির একটা কণাও তাতে লেগে থাকবে না? হঠাৎ সে হড়বড় করে বলে ফেলে একটু তেল নেবে- থান-এ দেওয়া পিদিপে জ্বালানোর জন্যে!
কচি আমের ফালির মতো চোখ দুটোতে আগুনের ঝলক খেলে যায়।
তোমার দেওয়া তেল আমি থান-এ জ্বালব কোন দুঃখে? আমি কি রোজগার করে খেতে জানি না? রামজী কি আমায় হাত পা দেননি? তোমাদের ঝোটাহাদের জানি না; আমাদের তারাপুরে এমন কথা মরদ বললে তার মোচ উপড়ে নিতাম!
ঢোঁড়াই একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কী তেজ কী দেমাক মেয়েটার! ফনফনিয়ে চলেছে বাড়ির দিকে। এই রামিয়া শোন শোন।
মেয়েটা ফিরে দাঁড়ায়।
পশ্চিমের রীত রেওয়াজ তো জানা নেই।
রামিয়ার চাউনি আগেকার মতো নরম হয়ে গিয়েছে আবার।
গলাকাটা সাহেবের বাড়ির কুল নিতে তো মানা নেই তারাপুরের মেয়েদের?
হেসে ফেটে পড়ে রামিয়া। এই চটে আবার এই হাসে, আজব পচ্ছিমের মেয়েদের চালচলন।
হাতে না। অনেক আছে। আঁচলটা ভাল করে পাত। ছোঁড়ারা কি কুল থাকতে দেবে গাছে? দিনরাত গাছ ঠেঙাচ্ছে?
রামিয়া চলে গেলে ঢোঁড়াই মনে মনে নিজের বুদ্ধির তারিফ করে। আর একটু হলেই হয়েছিল আর কী। খুব সময় মতো মনে পড়েছিল কুলের সঙ্গে মাটি মিলিয়ে রাখবার কথা। রামিয়াটা আবার রোজ স্নান করে; এখানকার ঝোটাগহদের মতো না। কাল সকালে স্নানের আগে, এই আঁচলের ধুলোর কণা রামিয়ার চুলে লাগলে হয়। রামজী আর গোঁসাইয়ের উদ্দেশে সে প্রণাম করে, রামিয়ার মাথায় ঐ আঁচলের ধুলো একটুখানি লাগিয়ে দেওয়ার জন্য প্রার্থনা জানায়।
[২৫৯. মিথ্যা বললে আমার যেন ছেলে মরে যায়। ২৬০. এদের গল্পে গানে, প্রিয়ার চোখ কাটা আমের ফালির মত দেখতে হয়। ২৬১. বিদেশী টিয়াপাখি। ২৬২ শ্রাদ্ধ তপণ ক্রিয়াকর্ম। ২৬৩- কিচিন একশ্রেণীর পেত্নী। এরা যখন তখন গাছে পা ঝুলিয়ে বসে দোল খায়। অনেক সময় আমরা দেখি যে গাছের ডাল অকারণে দুলে উঠল, তা কিচিনদের কাজ। ২৬৪. গুণীরা উদ্দেশ্য সিদ্ধকল্পে মন্ত্র পড়ে একটি বৃত্তাকার দাগ কাটে। ২৬৫. আদবকায়দা জানা স্ত্রীলোক। ২৬৬- ছাইভস্ম; যে চিন্তার কোন মাথামুণ্ডু নেই। ২৬৭, সরদা আইন। ২৬৮. কোদাল। জিরানিয়ার কাছাকাছি স্ত্রীলোকেরা কোদাল নিয়ে কাজ করতে পারে না, সামাজিক বাধা অপেক্ষা শারীরিক অক্ষমতাই এর কারণ বলে বোধ হয়। ২৬৯-ত।]
.
কুক্কুরমেধ যজ্ঞের অপ্রত্যাশিত ফললাভ
জিরানিয়াতে আজ দুদিন থেকে একটা পাগলা কুকুরের উপদ্রব চলেছে। ছয়জন লোককে কুকুরটা এরই মধ্যে কামড়েছে। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তেঁড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, প্রত্যেকে যেন নিজের নিজের পোষা কুকুর বাড়িতে বেঁধে রাখেন। রাস্তার যে কোনো কুকুরই থাক না কেন, তার গলায় চেন কিংবা বকলেস না থাকলে তাকে মেরে ফেলা হবে। বেশ একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে এই নিয়ে শহরে। মিউনিসিপ্যালিটির মেথররা মোটা মোটা বাঁশ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। কুকুরের পিছু এক টাকা করে পাবে; না কথাটায় একটু ভুল থাকল- এক জোড়া কুকুরের কান পিছু এক টাকা করে পাবে মেথররা! সদ্যোমৃত কুকুরের কান দুটো কেটে নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে দেখাতে হবে। এইটাই নিয়ম; তবে জ্যান্ত কুকুরের কান কেটে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারলেও কে আর ধরছে। সঙ্গে সঙ্গে টাকা মঞ্জুর, আর তাড়ির দোকানের সফেন আনন্দস্রোতের আবর্ত।
বিজনবাবুর বাড়ির সম্মুখে আমলকী গাছটার তলায় তাঁর আধ ডজন মেয়ের সিরিজ প্রাত্যহিক অভ্যসমতো এক্কাদোক্কা খেলছে। তারা সকলেই একই ছিটের আঁটো ফ্রক পরে, একজন হাসলে সকলে হেসে গড়িয়ে পড়ে, একজন লজেনস চিবিয়ে খেলে আর কেউ চুষে খায় না নিজের লজেনসটা; নতুন লোক দেখলে সকলে এক থামের আড়ালে গিয়ে খিক খিক করে হাসে, একজনের ফ্রকে ধুলো লাগলে সকলে নিজের নিজের জামা একবার ঝেড়ে নেয়। এদের মধ্যে সব চাইতে যে ছোট তাকে পাড়ার বখাটে ছেলেরা অলমতি বলে ডাকে।
অলমতি হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে- সে কুকুর দেখেছে, পাগলা কুকুর। অলমতির চিৎকারে শ্রীমতী চেঁচায়, সুমতি হাউমাউ করে ওঠে, বাকি তিনমতির ব্যাকুল কণ্ঠ সকলের স্বর ছাপিয়ে ওঠে।
বিজনবাবু তীব্রগতিতে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় ওঠেন, গা-আলমারি থেকে বার করেন তাঁর বাবার আমলের পুরনো বন্দুকটা। লাইসেন্সরিনিউয়াল এর দিন ছাড়া তিনি বছরে কেবল আর একদিন করে বলুকে হাত দেন। প্রতি বছরের কেনা এক ডজন কার্তুজ তিনি বছরের শেষে, এক সন্ধ্যায় দোতলার ছাত থেকে উড়ন্ত বাদুড়ের ঝাঁকের মধ্যে নিশানা করে ছেড়েন। ঐ একদিন তাঁর মেয়ের দল সন্ধ্যাবেলায় বাদুড় বাদুড় পিত্তির কোরাস গান বন্ধ করে। ঐ একদিন শুক্রা ধাঙড় মরা বাদুড়ের লোভে [২৭০] বসে থেকে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরে। আজ পর্যন্ত কোনো বছর একটা বাদুড়ও বিজনবাবুর বন্দুকের গুলিতে মারা পড়েনি।
এই উড়ন্ত বাদুড় মারতে অভ্যস্ত হাত, তাই পাগলা কুকুর মারবার সময় একটুও কাঁপেনি। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার অন্যপাড়ের বাকসের জঙ্গলটা যেখানে নড়ছিল, সেখান থেকে গোঙার কাতরানির শব্দ আসে। বিজন উকিল আর পাড়ার অন্য কয়েকজন মিলে খানিক পরে সেখান থেকে তুলে নিয়ে আসেন বৌকাবাওয়াকে। তার ডান পায়ের উরুতে বন্দুকের গুলিটি লেগেছ। সেখান থেকে রক্তের স্রোত বইছে। ময়লা কৌপীনটাতেও কিছু কিছু রক্ত জমে কালো হতে আরম্ভ হয়েছে। বিজনবাবুর বাড়ির দোতলায় বৌকাবাওয়ার জায়গা হয়। চুপি চুপি বিমল ডাক্তারকে তখনই খবর দিয়ে আনা হয়, বন্দুকের ছিটগুলি বের করে দেবার জন্য। এ বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্য বিজনবাবুর স্ত্রী চিথরিয়া পীর-এ- [২৭১] সিন্নি মানত করেন। বৌকাবাওয়া সে রাতটা বিজনবাবুর দোতলাতেই থাকে। পরের দিন ব্যাণ্ডেজ বাঁধা পা নিয়ে আসবার সময় বিজনবাবুর স্ত্রী বলে দেন যে রোজ তাদের বাড়িতে এসে যেন সে এক ঘটি করে দুধ খেয়ে যায়। ব্যাপারটা এত সহজে মিটে যাবে তা বিজনবাবুও ভাবেননি। তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।
মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। গোঁসাই থানে ফিরে গিয়ে বাওয়া সলাপরামর্শ করে, ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে কী কথা হয় কে জানে। দুজনে মিলে আসে অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছে। কী মনে করে কী বিজনবাবু উকিল? চিড়িয়ার সামিল মনে করে তাৎমাদের। একটা বাদুড় মারার ক্ষমতা নেই আর বাওয়ার উপর বন্দুক দেগে দিল!
ফৌজদারী কাছারীতে বৌকাবাওয়াকে অনিরুদ্ধ মোক্তারের সঙ্গে ঘুরতে দেখে বিজনবাবুর মুখ শুকিয়ে যায়। মোকদ্দমায় কিছু হোক না হোক, বন্দুকের লাইসেন্সটাকে নিয়ে টানাটানি করবে কলেক্টর সাহেব নিশ্চয়ই। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। দরকার কী হাঙ্গামা বাড়িয়ে। অনিরুদ্ধ মোক্তারকে ডেকে বিজনবাবু একান্তে কথাবার্তা বলেন। ব্যাপারটা যাতে বেশি দূর না গড়ায় তার জন্য বিজনবাবুর আর এখন টাকা খরচ করতে দ্বিধা নেই। বৌকাবাওয়াকে সাড়ে তিনশ টাকা দিতে তিনি তৈরি হয়ে যান।
বাওয়া ভয়ে কেঁপে মরে অত টাকার কথা শুনে। সতর কুড়ি টাকা। সে অনেক টাকা। এক কুড়ির চাইতেও বেশি। একটা চাদির পাহাড়। তা দিয়ে যা মন চায় করা যেতে পারে- রূপোর মন্দির করা যেতে পারে গোঁসাই থানে; পেট ভরে ঢোঁড়াই জিলাপী খেতে পারে; ঢোঁড়াইয়ের শাদি আর থাকবার ঘর তুলবার খরচা ঐ টাকা দিয়ে হতে পারে; অযোধ্যাজী যাওয়ার রেলকিরায়ার [২৭২] চাইতেও অনেক বেশি টাকা।
টাকাটা দেওয়ার সময় বিজনবাবু বলেন একটু দুধটুধ কিনে খাবেন এই দিয়ে, বাওয়া। বৌকাবাওয়া ভাবে আজ সকালেও বিজনবাবুর স্ত্রী উঠোন নিকিয়ে কম্বলের আসন পেতে তাকে ফল দুধ খাইয়েছিলেন; কিন্তু আজ থেকে এ বাড়ির ভিক্ষা বন্ধ হয়ে গেল। রামজী তার ভাল করলেন কি মন্দ করলেন তা সে ঠিক বুঝতে পারে না। এই উত্তেজনার মধ্যে টাকাটা দেখে বাওয়ার মনটা দমে যায়- চাঁদি নয়, লোট! অনিরুদ্ধ মোক্তার টাকাটা গুনে নিয়ে তার হাতে দেন- এই এত্তো লোট! এই একখানা লম্বরী [২৭৩]। ওগুলো শুনে নাও- পাঁচটাকিয়া দাশটাকিয়া লোট। বাওয়া দু-তিনখানা গুনে হাল ছেড়ে দেয়। এত লোট; একখানা থেকে আর একখানা আলাদাই হতে চায় না; হরফ, ছবি, রঙবেরঙের লেখা, তার বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করতে আরম্ভ করে। সে কোনো রকমে টাকাটা অনিরুদ্ধ মোক্তারের কাছে রেখে দিয়ে বাঁচে; পরে দরকার মতো নেবে।
অনিরুদ্ধ মোক্তার বলে, আমি খালি একখানা দশটাকিয়া নেব [২৭৪] তুমি ভকত আদমী! আমরাও হিন্দু, তোমার কাছে থেকে বেশি নিলে আমারই পাপ হবে, আহা-হা তাক তাক বাওয়া; আমার পায়ে হাত দিচ্ছ বাওয়া হয়েও? রামজীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করো। এ তো তিনিই করিয়েছেন আমাকে দিয়ে, আমার ধরমের কাজ।…
বাওয়ার চোখ ফেটে জল আসে মোক্তার সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতায়। ইনিই তার রামরাজ্যের চাঁদির দুয়োর খুলে দিয়েছেন। ইচ্ছা হয় আরও খানকয়েক দশটাকিয়া তাকে দিতে।…আচ্ছা সে পরে হবে। এখন সব টাকাই তো তাঁর কাছে থাকল।…
[২৭০. ধাঙড়রা, বাদুড়ের মাংস খুব পছন্দ করে, খেতে নাকি খাস্তা মচমচে। ২৭১. হিলিয়া মানে যেখানে ঘেঁড়া নেকড়া টাঙানো হয় পীরের আস্তানে। ২৭২. রেল ভাড়া! ২৭৩. একশ টাকার নোট। ২৭৪. দশ টাকার নোট।]
.
মহতোগিন্নীর সমাজশাসন
রামিয়া পাড়ার মহতো নায়েবদের সুনজরে পড়তে পারেনি। মহতোগিন্নীর সহানুভূতি না থাকলে প্রথমটাই এই পরদেশী মেয়েটার তাৎমাটুলিতে জায়গা শক্ত হত। প্রথম থেকেই মহতো ভাবে, মুঙ্গের জেলার মধ্যে তারাপুর ডাকসাইটে গাঁ-পচ্ছিমের পানি, বাড়বাড়ন্ত গড়ন; এ মেয়েকে সামলানো শক্ত হবে। মেয়েটা আবার একটু ছিনার [২৭৫] গোছের! অন্য পাড়ার এমন মেয়ে হলে দেখতে বেশ, বলতে বেশ; যেমন ধাঙড়টোলার শনিবার বৌ। কিন্তু নিজেদের বাড়িতে এ মেয়ে হলে নাকের জলে চোখের জলে হতে হয়! তাৎমাটুলিতে বিয়ের পর কোনো মেয়ে একটু-আধটু বাবুভাইয়াদের নেকনজরে পড়লে, স্বামীরা জিনিসটা বিশেষ অপছন্দ করে না। এতে স্ত্রীরা একটু ফরসা শাড়ি পরে, মাথায় তেল মাখতে পায়, পরুখ [২৭৬] দিনে রোজগারে না বেরুলেও তার ঝোটাহা রাগারাগি করে না। কিন্তু কুমারী মেয়ের বেলায় এ নিয়ম খাটে না।
তা ছাড়া সরাধের কানুনের [২৭৭] যুগে মেয়ের বিয়ে দিতে গেলে মিছামিছি পাড়ায় একটা পাত্র খরচ। কটা ছেলেই বা মোট আছে তাৎমাটুলিতে। কুমারী মেয়ে পাড়ায়, সমাজের চোখের সম্মুখে অনছিষ্টি কাণ্ড করবে, তা আর ধনুয়া মহতো বেঁচে থাকতে হওয়ার উপায় নেই। মহতো ছড়িদারকে হাড়ে হাড়ে চেনে। তার আর রবিয়ার বৌয়ের এই মেয়েটার উপর হঠাৎ সহানুভূতি উছলে উঠল কেন তা সে আন্দাজ করতে পারে। একি নট্টিনদের [২৭৮] গ্রাম পেয়েছে নাকি! এখানে ওসব চলবে না লাভের বখরা দিলেও না। কিন্তু প্রথম কদিন হুঁকোতে জোরে জোরে টান মারা ছাড়া কিছু উপায় ছিল না; কেননা গুদরের মা মেয়েটার দিকে টেনে কথা বলত। ধানকাটনী থেকে ফিরবা পর ঝোটা তাদের একটু সমীহ করে চলতে হয়। সে জন্য মহতো তার স্ত্রীর কথার প্রতিবাদ করেন। রামিয়ার পারিবারিক ইতিহাস ধানকাটনীর দলের কাছে থেকে মুখে মুখে পাড়ার বাইরে পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
ঠিক একদিন মহতো দেখে যে হাওয়া গেছে বদলে। ভোরবেলা মহতো বসে কচর কচর করে কাঁচা পেঁপে খাচ্ছে; মহতোগিন্নী এসে বলে দাঁড়াও একটু নুন এনে দি। মহতো অবাক হয়ে যায়। ব্যাপার কী? ধানকাটনীর পর কিছুদিন তো ঝোটাহাদের কাছ থেকে এমন ব্যবহার পাওয়া যায় না।
গুদরের মা বলে, মেয়েটা বড় ঢঙ্গিলা। [২৭৯]
কোন মেয়েটা?
আবার কে, ঐ তারাপুরবালী।
সব সময় ঐ একই মুখ দিয়ে কথা বল না কি। এই তো তারাপুরবালীর তারিফে জিভ দিয়ে জল পড়ত।
মহতোগিন্নী এ অভিযোগ মাথা পেতে নেয়।
খোসা দেখে কি সব সময় ধরা যায়, বেগুনের ভেতর পোকা আছে কিনা।
মেয়েদের বুদ্ধি।
সে তো একশবার।
তারপর আসল কথাটা প্রকাশ পায়। মেয়েটা নাকি ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে ঢলানি আরম্ভ করেছে গোঁসাই থানে।
খবর শুনে মহতো চোখে অন্ধকার দেখে। তাদের পঙ্গু মেয়েটার একটা সুরাহা হয়ে যাবে, এ কথা নিয়ে তারা স্বামী স্ত্রী কতদিন কত জল্পনা-কল্পনা করেছে, আর তাতে বাদ সাধল কিনা ঐ বেজাত মেয়েটা। রাগে তার সর্বশরীর জ্বলে ওঠে।
লোকে শাক খাওয়ার জন্য তেল পায় না ছটপরবের দিনও স্নানের আগে মাথায় এক খাবলা তেল দিতে পারে না, আর ইনি গোঁসাই থানে পিদিপ জ্বালান রোজ। আড়াই পয়সায় এক ছটাক তেল। রবিয়ার এত পয়সা আসে কোথা থেকে? এদিকে তার বাড়িঘর তো নিলাম চড়াচ্ছে জমিদার, বাকি খাজনার ডিক্রিতে।
মাঝে থেকে মুশকিল হল রাতিয়া ছড়িদারের। রামিয়াকে তাৎমাটুলিতে আনবার সময়, সে যেমন নির্ঝঞ্ঝাটে কিছু টাকা রোজগার করে নেবে মনে ভেবেছিল, এখন দেখে যে তা হবার নয়; একটা জায়গায় তার হিসাবে ভুল হয়েছে। সে ভেবেছিল লাভের হিসসা [২৮০] দিয়ে মহতোকে হাত করবে। মহতোর সঙ্গে মিলে এ ধরনের কারবার সে অনেক করেছে। পঞ্চায়েতের নায়েবগুলোর মহামত সে ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। সেগুলো সব সুরদাস [২৮১]; দিন আর রাতের তফাত বোঝে না। মহতোর চোখ দিয়েই তারা সব জিনিস দেখে; তার হর সঙ্গে হাঁ মিলোয় [২৮২]। টাকার লোভে মহতো গলে না, তা এই ছড়িদার জীবনে প্রথম দেখল। মহতোগিন্নী সমর্থনের উপরও কিছুটা নির্ভর করেছিল। দিন কয়েকের মধ্যে তাকেও রামিয়ার উপর বিরূপ দেখে, সে মাথায় হাত দিয়ে বসে। সে চালাক লোক, সব জিনিস দিনের মতো পরিষ্কার হয়ে ওঠে তার কাছে; এতদিনে সে বোঝে যে মহতোগিন্নীর নজর ছিল ঢোঁড়াইয়ের উপর। এ কি মুশকিলে পড়ল সে।
এসব ঝঞ্ঝটা একবার আরম্ভ হলে আর তার শেষ নেই। হলও তাই। পরদিন সকালেই ব্যাপারটা গড়াল অনেক দূর।
পরদিন ভোরে মহতোগিন্নী যাচ্ছিল জঙ্গলের দিকে। হঠাৎ দেখে যে কুলের জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে, হলাদ রঙের শাড়ি পরা একটি মেয়ে। কে মেয়েটা? ছাই চোখে ভাল দেখিও না; তারাপুরের রাজকুমারী ছাড়া আর হলদে কাপড় কাপড় এখানে কে পরবে? হাতে আবার দেখছি লোটা! ব্যাপার কী? হয়তো মানটানত করে থাকবে গোঁসাইথানে, তাই মরগামায় মোষের দুধ আনতে যাচ্ছে। কিন্তু জঙ্গলের দিকে যাবে কেন?
ওরে ও রামিয়া, কোথায় চল্লি? একমুখ হাসি নিয়ে রামিয়া জবাব দেয় এই ময়দানে! [২৮৩]
বলে কী ছুড়িটা? ময়দানে যাচ্ছিস, ঘটি নিয়ে?
কেন, তাতে কী হয়েছে?
আবার জিজ্ঞাসা করছে, কেন? তুই কি মরদ লোটা নিয়ে ময়দানে যাবি?
কোনো মরদের বাপের লোটা তো নিইনি।
দেখ কী কথার কী জবাব! পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে মহতোগিন্নীর।
বলি লজ্জা শরমের মাথা কি খেয়েছ? লোটা নিয়ে ময়দানেযাচ্ছ, বেটাছেলেরা দেখলে বলবে কী? লোটা হাতে ঝোটাহা দেখলেই তো বেটাছেলেরা বুঝতে পারবে তুই কোথায় যাচ্ছিস, এই সোজা কথাটাও কি ঘটির মধ্যে গুলে গিলিয়ে দিতে হবে নাকি? তারাপুরের রাজকন্যাকে? এসব কিরিস্তানি আচার-ব্যাভার আমার পাড়ায় চালাতে এসেছিস; একি নটিনদের গ্রাম পেয়েছিস নাকি?
মাথায় খুন চড়ে যায় রামিয়ার।
জল না নিয়ে ময়দানে যাওয়া আমাদের পচ্ছিমের মুলুকে নেই; তা কোনোদিন শিখিওনি, পারবও না। জংলী মুল্লুকের নরম পানির লোক, তরিবৎ শেখাতে এসেছেন তারাপুরের লোককে!
হাতের লোটটা দড়াম মাটিতে রাখে। তারপর হাতের মুঠোর একটা মুদ্রা দেখিয়ে বলে, এমনি করে ঠুসে তোমার মধ্যে তরবিৎ গুঁজে দিতে পারি দশ বচ্ছর ধরে। এই যদি তোমাদের জংলী ভুচ্ছরদের টোলার নিয়ম হয়, তাহলে আমি এই এক লাথি দু লাথি তিন লাথি মারি সে নিয়মে। ঘটিটি কাৎ হয়ে পড়ে। গালির স্রোত একটানা চলতে থাকে। রামিয়া না মহতোগিন্নী কার পারদর্শিতা এ শাস্ত্রে বেশি বলা যায় না। লোক জড় হয়ে যায় সেখানে। পাড়ার মেয়েরা মহতোগিন্নীকে ঠেলেঠুলে বাড়ির দিকে নিয়ে আসে। মহতো তখন সবে একটু রোদ পোয়াতে বসেছে।
তুমি না এ গাঁয়ের মহতো। তুমি থাকতে স্ত্রীকে, তোমার জাতকে, তোমার টোলাকে বেইজ্জৎ করে ঐ একরত্তি পরদেশী হুঁড়িটা। কার সঙ্গে কেমন কথা বলতে হয় জানে না। অন্ধনগরী, চৌপটরাজা, টাকে সের ভাজি, টাকে সের খাজা। [২৮৪] বয়সের গরবে আজ আমায় যা অপমান করেছে ঐ মেয়ে, ওকে যদি আমি জল না খাইয়ে ছেড়েছি [২৮৫] তবে আমি ডগরাহার মেয়ে না। আমাদেরও একদিন ছিল ঐ বয়স। কিন্তু কখনও কোনোদিন সমাজকে হেনস্তা করে লোটা নিয়ে ময়দানে যাওয়ার বেহায়াপনা করিনি। কি কুক্ষনেই এ মেয়েকে এনেছিলাম। এ যে ফুসকুড়ি খুঁটে ঘা করে তুললাম। [২৮৬] ও চুড়ি লাথি তো আমাকে মারেনি, মেরেছে জাতের মহতো নায়েবদের। থাকো তোমার ঐ মহতোগিরি, মোচ, আর তোমাদের তন্ত্রিমাত্রি না কি জাত বলে তারই গরবে…।
কী! এতবড় আস্পদ্ধা ঐ একচিমটি মেয়েটার। লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে মহতো বাড়ির বাইরে। কোথায় রতিয়া ছড়িদার। বোলাও নায়েবদের। দুজন নায়েব গাঁ থেকে অনুপস্থিত ছিল সেদিন, গিয়েছিল ভিনগাঁয়ে কুটমৈতি [২৮৭] করতে। আচ্ছা আসছে রবিবারে মেয়েটার বেহায়াপনার বিচার হবে, সাঁঝের বেলা; পঞ্চায়েতে। লোটা নিয়ে ময়দানে যাবে মেয়ে-মানুষে তাৎমাটুলিতে? আমরা বেঁচে থাকতে কভভী নহী [২৮৮]। অকথ্য ভাষায় রামিয়ার উদ্দেশে গালি দিতে দিতে বাড়ি ফেরে।
রামিয়া তখন রবিয়ার উঠোনে আপন মনে বকে, বুক চাপড়ায়, মাটিতে মাথা কোটে, মরা মায়ের নাম করে কী বলে কাঁদে। পাড়ার ছেলেপিলেরা রবিয়ার আঙনে উঁকিঝুঁকি মারে। ফৌজী ইঁদারাটার চারিদিকে ঝোটাহারা জটলা করে।
[২৭৫. চটুলা। ২৭৬, স্বামী। ২৭৭ সরদা আইন (বাল্যবিবাহ বন্ধ করবার)। ২৭৮. নাচ-গান করে যে জাতের মেয়েরা রোজগার করে। ২৭৯, ঢলানী। ২৮০. অংশ। ২৮১. অন্ধ। ২৮২. হা মে হাঁ মিলানা-সায় দেওয়া। ২৮৩. হিন্দীতে ময়দান মে যানার অর্থ পায়খানায় যাওয়া। জল নিয়ে পায়খানায় যাওয়া তাৎমা মেয়েদের বারণ। মেয়েদের পক্ষে এর চেয়ে চরম নির্লজ্জতা আর কিছু হতে পারে না। ২৮৪. যেমন রাজ্য, তার তেমনি রাজা; এখানে শাকের দামও দুই পয়সা সের, খাজাও দুই পয়সা সের। ২৮৫. স্থানীয় ভাষায় পানি পিলা কর ছোড়নার মানে নাকানি চুবানি খাওয়ানো। ২৮৬- হিন্দী প্রবাদ। ২৮৭- কুটুম্বিতা। ২৮৮, কখনও নয়।]
.
বাওয়ার নিকট ঢোঁড়াইয়ের বর প্রার্থনা
তাৎমাটুলিতে শোরগোল পড়ে যায়। বাওয়া টাকা পেয়েছে। অনেক টাকা এই এত্তো! টাকার পাহাড়, পুঁতে রাখতে গেলে ঘড়াতেই আঁটবে না তার লোটাতে কী বলছিস? কত আর বুদ্ধি হবে মেয়ে-মানুষের। হাঁড়ি নামিয়ে মহতোগিন্নী ছোটে; খুরপি হাতে নিয়ে রাবিয়ার বৌ আসে; ফৌজী ইঁদারাটার চারিদিকে কলশীর সার যেমন- কে তেমন পড়ে থাকে। হরিয়াদের দলের সাতজন ঘর ছাইছিল শহরে; সেখানে থেকে হাঁফাতে হাঁফাতে আসে গোঁসাইথানের দিকে। ঝোটাহার দল পাড়ার অলিগলিতে মাচার পাশে গাছের নিচে জটলা করে। মরদরা থানে পৌঁছুনোর পর তারা যাবে থানে। সেখানে তারা পিছনে আলাদা থাকবে। মরদের সঙ্গে সভায় গাঁ ঘেঁষাঘেষি করে বসা-মাগো! সে করুকগে ঐ ঢলানী ধাঙড়ানীর দল, সেটি আর এখানে হওয়ার জো নেই।
গোঁসাইথানে লোক গিজ গিজ করছে। ধাঙড়টুলি থেকে পর্যন্ত সকলে এসেছে, ঝুড়ি কোদাল নিয়ে। বাওয়া বসেছে মাঝখানটায়। তাকে ঘিরে বসেছে মহতো ছড়িদার আর নায়েবদের দল। এক মুহূর্তের মধ্যে বাওয়ার স্থান টোলার মধ্যে অনেক উঁচুতে হয়ে গিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ঢোঁড়াইয়েরও। বাবুলাল চাপরাসীর চাইতেও উঁচু কিনা তা এখনও সে ছেলেটা আবার এখন গেল কোথায়।
শনিচরা ঢোঁড়াইকে কনুই খোঁচা দিয়ে দেয়। রতিয়া ছড়িদার বলে, এদিকে এসে কাছে বস না কেন?
এক জায়গায় বসলেই হল তাৎস্নারা সকলেই মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হয়; আজও কি ঐ ধাঙড়দের মধ্যে না বসলেই নয়। ঐ এক ধরনের ছেলে।
আদুরে ছেলের দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে দেবার উদারতা জেগেছে আছ সকলের মনে। মহতো কাজের কথা পাড়ে। তা বাওয়া প্রসাদী তো চড়াতে হয় [২৮৯] থানে- পেঁড়ার প্রসাদী। থানের দয়াতেই তো তোমার সব কিছু।
বাওয়া ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
আর একটা ভোজ।
একটা ভেড়া বলি।
থানের পাশে একটা ইঁদারা করে দিয়ে তার বিয়ে দাও [২৯০]। না হলে বড় অসুবিধা হয় আমাদের দশবিধ-এ [২৯১]।
থানের জন্য একখানা সীতা রামজীর রঙিন ছবিওয়ালা রামচরিতমানস কেনো।
টোলার ওজনের করতাল দুটো ভেঙে গিয়েছে; তাই একজোড়া কিনে দাও। কত রকমের ফরমাস আসে। বাওয়া কারও কথার জবাব দেন না। ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় যে সলাপরামর্শ করে যা করার তা করবে। এখন কেবল পেঁড়ার প্রসাদ সব পাবে।
মহতো নায়েবরা দুঃখিত হয়। সলাপরামর্শ করে বলার মানে সবাই জানে; ও তো কেবল কথা চাপা দেওয়ার ফন্দি। এই থানের মাটি এককুড়ি বছর গায়ে মেখে তবে তো যখের ধন পেয়েছে। এখানে একটা মন্দির করে দেবে, এর মধ্যে সলাপরামর্শ আবার কী! মন্দির করে দিলে নাম হবে তোমার না আমাদের! ভিক্ষে করে যার জীবন গিয়েছে সে ইজ্জতের কথা কী বুঝবে; নভ দুহি দুধ চহত এ প্রাণী [২৯২]। এর কাছে থেকে থানের আর পাড়ার কোনো জিনিস আশা করা, আকাশ দুয়ে দুধ চাইবার মতোই অবাস্তব। তবে টাকাওলা লোককে সমীহ করে চলতে হয়, তাদের সঙ্গে কথা বলবার আগে ভেবে বলতে হয়, আর সকলেরই মনে একটি ক্ষীণ আশা আছে যে আজকালকার মতো দুর্দিনে টাকা ধার করার জন্য হয়তো আর অনিরুদ্ধ মোক্তারের খোসামোদ করতে হবে না।
ঢোঁড়াই কে বাওয়া শহরের দিকে পাঠায় পেঁড়া কিনতে। বাবুলাল ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে কথা বলবার জন্যই বলে, ঢোঁড়াই লছমন হালুয়াই-এর দোকান থেকে নিয়ে আসিস।
ঢোঁড়াই চরিতমানস . ১৬৩
মহতোও সায় দেয়, হা লছমন হালুয়াই, পেঁড়াতে চিনি কম দিয়ে ঠকায় না। কথার সুরে মনে হয় যেন সে রোজই লছমনের আর অন্য মিঠাইওয়ালাদের দোকান থেকে খাবার কিনে খেয়ে থাকে।
এখন পয়সার আকাল এসেছে দেশে। টাকার দরকার তাৎমাদের সকলেরই। এরই মধ্যে টাকার আণ্ডিল পেল কিনা বাওয়া! ছেলে নেই, পিলে নেই, ঘর নেই, সংসার নেই, শাদি সরাধ-এর কোনো ফিকির নেই, [২৯৩] খাওদাও ডুগডুগি বাজাও, না আগে নাথ, না পিছে পগাহা [২৯৪]। সেই বাওয়ারই খুলল তকদীর [২৯৫]।
তবে ঐ যে ধাঙড়গুলো বসে রয়েছে, ওগুলো বেশ করে বুঝুক যে ঢোঁড়াই ওদের সঙ্গে মাটি কাটে বলে, ওরা ঢোঁড়াইয়ের সমান হয়ে ওঠেনি।
অনেকরাতে ভজন শেষ হবার পর সকলে চলে গেলে বাওয়া ঢোঁড়াই কে টেনে নিয়ে গিয়ে নিজের চাটাইয়ের উপর শোয়ায়- সেই ছোট বেলার মতো। আজ কবছর থেকে তারা আর এক চাটাইতে শোয় না। শীতকালে আগুনের ঘুর-এর এক দিকে শোয় ঢোঁড়াই, একদিকে বাওয়া-তা না হলে বড় শীত করে। বহুদিন পরে আজ আবার বাওয়া তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। বাওয়ার জটার গন্ধে ঢোঁড়াইয়ের কত ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।
অনেক টাকা, না বাওয়া?
বাওয়া মাথা নেড়ে বলে, হা।
অনেক কুড়ি- না?
হাঁ।
তারপর ঢোঁড়াই একেবারে চুপ করে যায়। বাওয়া ভাবে এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল নাকি ছেলেটা।
হঠাৎ ঢোঁড়াই বলে, বাওয়া, আমি রামিয়াকে শাদি করব। নিশ্বাস বন্ধ করে ঢোঁড়াই বাওরার উত্তরের প্রতীক্ষা করে। বাওয়া তার ভালবাসার অত্যাচার ছোটবেলা থেকে অনেক সয়েছে। কত সময় কত অন্যায় করেছে সে, কিন্তু বাওয়া সব সময় নিজের ব্যবহার দিয়ে তাকে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ঢোঁড়াইয়ের বাওয়ার উপর অবিচার করার, জুলুম করার দাবি আছে। এই দাবিই ঢোঁড়াইয়ের আসল পুঁজি। কিন্তু তবু আজ তার মনের মধ্যে খচখচ করে বেঁধে-শাদির কথায় কোথায় যেন খানিকটা অন্যায্যতা আছে। বাওয়া চেয়েছিল তাকে ভকত করতে; বিয়ের পর বাওয়ার কাছে থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবে; অথচ বাওয়া টাকা না দিলে রামিয়ার সঙ্গে শাদি হওয়া শক্ত। একটার পর একটা করে এই সব চিন্তা ঢোঁড়াইয়ের মনে আসে। তার মনে হয়
বাওয়ার করস্পর্শ মুহূর্তের জন্য একটু যেন আলগা হয়ে আসে। রামিয়া, রামিয়াকে তার চাই-ই। কোনো বাধা সে মানবে না।
ঢোঁড়াই বোঝে যে বাওয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আঙুল দিয়ে ঢোঁড়াই তার চোখের জল মুছিয়ে দেয়। বাওয়া তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এই দিনটার অপেক্ষা বাওয়া অনেক দিন থেকে করছে। আর এ বিচ্ছেদকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। টাকার প্রশ্ন এর মধ্যে কেবল গৌণ নয়, এক রকম অবান্তর। ঢোঁড়াই বিয়ে করবে এ বাওয়া ক বছর আগে থেকেই ধরে নিয়েছে, আর বিয়ের পর তাৎমা ছেলেমেয়েদের মা-বাপ শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে থাকার রেওয়াজ নেই।
ঢোঁড়াই জানে যে বাওয়া টাকা দিতে আপত্তি করবে না। আর বাওয়া মনে মনে ভাবে যে ঢোঁড়াইটা এখনও ছেলেমানুষ আছে, মোচ উঠলে কী হয়; না হলে আজ যে খানিক আগে সকলে টাকা খরচ করবার নানারকম রাস্তা দেখাচ্ছিল তখন সে কারও কথার জবাব দেয়নি কেন। ওরে মুখ, এই সোজা কথাটুকু বুঝতে পারছিল না। থানে মন্দির তৈরি করবার চাইতেও বেশি আনন্দ আমার তোকে সুখী দেখলে, একথাও কি মুখ ফুটে তোকে বলতে হবে নাকি? ছোটবেলায় যখনই তোকে কোলে নিয়েছি, তখনই মনে হয়েছে যে বুড়ো রাজা দশরথ অযোধ্যাজীতে এমনি করেই একদিন তার রামচন্দ্রজীকে কোলে নিয়েছিলেন।
ধূসর ধূরি ভরে তনু আয়ে
ভূপতি বিহঁসি গোদ বৈঠায়ে। [২৯৬]
আমার সেই ঢোঁড়াই কথাটা পাড়ল, যেন ভিক্ষে চাইছে টাকা আমার কাছ থেকে! আশ্চর্য! কী চিনেছে সে আমাকে? আরে তোরই তো সব।
ঢোঁড়াইয়ের ঘর তুলে দিতে হবে। ভাল রোজগারের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তারপর ছেলেপিলে; বাড়বাড়ন্ত সংসার ঝকঝকে নেপে উঠোন, বড় বড় কাঁচামাটির জালা দাওয়ার উপর; ঢোঁড়াইয়ের বৌ রঙিন কাপড় পরে কাঁচা হলুদ সিদ্ধ করছে শুখিয়ে বিক্রি করবার জন্য, তেঁতুল গাছ জমা নিয়েছে পাঁচ টাকায়, আদা দিয়ে বড়ি দিচ্ছে উঠোনে, আমলকী আর অশ্বথের ডগার আচার শুখোতে দেওয়া হয়েছে;–সমৃদ্ধির রামায়ণের ছবিভরা পাতা, একখানার পর একখানা খুলে যাচ্ছে বাওয়ার বন্ধ চোখের সম্মুখে। তার ঢোঁড়াই, সেই একরত্তি ঢোঁড়াই , ভিক্ষের সাথী ঢোঁড়াই। কথা বলতে পারে না বাওয়া। কী করে সে ঢোঁড়াইকে বোঝাবে তার মনের এত অব্যক্ত কথা, ভিক্ষের চালের মতো একটি একটি করে জমানো, তার মনের কত অশ্রু বেদনা ভরা কথা। ঢোঁড়াইকে একদিনও দুবেলা ভাত খাওয়াতে পারেনি। কত সাধ তার মনে। ঢোঁড়াইকে একদিন পেট ভরে আলুর তরকারি খাওয়াবে। তাকে একটা বিলিতি লণ্ঠন [২৯৭] কিনে দেবে। সেই লণ্ঠনের আলোতে মিসিরজী রামায়ণ পড়ে শোনাচ্ছেন। কত লোক! এই তো দেশি চিনি, পাকা শশা খোসা সুদ্ধ চাকা চাকা করে কাটা, এত হলদে হলদে বাগনর,২৯৮ রমরমা জমজমা সমৃদ্ধির পাহাড় ফুলে ফেঁপে উঠছে। অশ্রুর ধারা তার এতকালের সঞ্চিত দুঃখের মালিন্য ধুয়ে নিয়ে যায়। রামজী! অদ্ভুত তোমার লীলা। রামায়ণপড়া লোকই কত সময় বুঝতে গিয়ে হিমসিম খেয়ে যায়, তা বাওয়া তো কোন ছার। ঢোঁড়াইয়ের মায়ায় সে কি ভরতরাজার মতো হয়ে যাবে নাকি। সামান্য কুকুর কামড়ানোর ঘটনার মধ্যে দিয়ে রামজী তার সম্মুখে স্বর্গের দুয়ার খুলে দিয়েছেন, পৃথিবীর স্বর্গ অযোধ্যাজীর দুয়ার, বাওয়ার চিরজীবনের স্বপ্ন, মানুষের সেরা তীর্থের দুয়ার। সে যদি নালায়েক২৯৯ হয়, তবুও সে রামজীর এই অদৃশ্য ইঙ্গিত মানবে না…ঢোঁড়াইটা এখনও উসখুস করছে, চাটাইয়ের নিচে থেকে ঠাণ্ডা উঠছে বোধ হয়…ঢোঁড়াই কে জীবনে একখানা কম্বল কিনে দিতে পারেনি।…ঢোঁড়াই সুখী হবে তো রামিয়াকে বিয়ে করে? মেয়েটা আবার শুনছি লোটা নিয়ে ময়দানে যায়!…
বাওয়ার হাতের স্পর্শের ভিতর দিয়ে ঢোঁড়াই তার সমস্ত মনের কথা বুঝতে পারে। জীবনে এই প্রথম ঢোঁড়াইয়ের চোখে জল আসে।…
[২৮৯. পূজো দিতে হয়। ২৯০. তাৎমাদের মধ্যে কুয়োর বিয়ে দেবার একটি প্রথা প্রচলিত। বিয়ের গান ইত্যাদি শুনলে বোঝ যায় এ কোনো এক কামলার সঙ্গে কোয়ালার বিবাহ অনুষ্ঠান। তাৎমাদের বিয়ের সময় এইরূপ কুয়োর জলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফৌজি কুয়ো ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের। সরকারী কুয়োর ঐ সকল অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না, সেইজন্য নূতন করে কথা উঠেছিল। ২৯১. বিবাহ শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠান। ২৯২. তুলসীদাস-আকাশ দুয়ে দুধ চায় লোক। ২৯৩. বিয়ের শ্রাদ্ধর কোনো চিন্তা নেই। ২৯৪. হিন্দী প্রবাদ- যে লোকের আগেপিছে ভাববার দরকার নেই। শব্দার্থ : (বলদের) না আছে নাকের দড়ি সম্মুখে, না আছে রাশের দড়ি পিছনে। ২৯৫. ভাগ্য। ২৯৬. তুলসীদাস ধূলি ভরা ঘুসর তনু (রামচন্দ্রের): রাজা হেসে তাঁকে কোলে তুলে নেন। ২৯৭. ডিজ লণ্ঠন।]
.
ঢোঁড়াইয়ের বিবাহের অয়োজন
রোজগারের অবস্থা দিন দিনই খারাপ হচ্ছে তাৎমাদের। ধানকাটনীর ধান আর কদিন চলবে। খাপড়ার বাড়ি আর নূতন করে বাবুভাইয়ারা করাচ্ছে না। ঐ যে এক ফঙ্গবেনে ঢেউখেলানো টিন হয়েছে, লোকে গোয়াল পর্যন্ত করতে আরম্ভ করছে তাই দিয়ে; তা কাজ পাওয়া যাবে কোথা থেকে। এখনও অবশ্য পুরনো খাপড়ার বাড়িগুলো আছে; তাও কতক লোকে বদলে টিন দিয়ে নেওয়া আরাম্ভ করেছে, বছর বছর খাপড়া বদলানোর ঝক্কি আর খরচের হাত থেকে বাঁচবার জন্য। সুদখোর অনিরুদ্ধ মোক্তার আর সাওজীর তো টাকার অভাব নেই। তারা নতুন ভাড়া দেবার বাড়ি করাচ্ছিল সব ঐ ঢেউখেলানো টিনের। তাদের দুজন ভাড়াটের মাথায় গোঁসাই ভর করেছিলেন জৈঠ মাহিনার দুপুরে [৩০০]- আমাদের রুজি মারবার জন্য বটে। কাঁচা আমপোড়া খাইয়ে কোনো রকমে তো তারা সেরে উঠল, কিন্তু তারপর আর কেউ টিনের বড়িতে থাকতে রাজি নয়। তাইতে এখন আবার সব বাড়ির টিনের উপর খাপড়া। টিন তো আর বছর বছর বদলাতে হবে না। তবু মন্দের ভাল! এ হল কি দুনিয়ার। দিনে দিনে সব বদলে যাচ্ছে। আগে দেখেছি কদু কুমড়োর গাছে বাবুভাইয়াদের বাড়ির চাল ভরে থাকত; আর বাবু ভাইয়াদের ছেলেরা চব্বিশ ঘণ্টা খাপড়াগুলো মটমট করে গুড়ো করে কদু-কুমড়ো পাড়ত। আজ সে গাছ পোতাও নেই, সেই ছেলেগুলোও বদলাচ্ছে। ছেলে তো ছেলে! দুনিয়াটাই বদলে যাচ্ছে! সে রকম বৃষ্টি কোথায় হয় আর, যেমন আগে হত; যতক্ষণ তাৎমারা গিয়ে চাল মেরামত করে দিচ্ছে, ততক্ষণ বাবুভাইয়ারা সকলে খাটের তলায় বসে থাকত। সে রকম বড় বড় পাথলও [৩৩১] পড়ে না আজকাল- সে রকম খাপড়া গুঁড়ো করা পাখল। আগে বারোমাস মরণাধারে জল থাকত; এখন বছরে ছমাসও থাকে না।
কুয়ো খোঁড়ানো, আর কুয়ো পরিষ্কার করার রোজগারেরও ঐ হালৎ। বাড়ি বাড়ি বমমা [৩০২] বসেছে আজকাল। বাবুভাইয়াদের বলতে গেলে বলে মমমা বসাতে খরচ, কুয়ো তৈরি করার খরচের চাইতে কম। বাবুভাইয়ারা সব তাদের বাপঠাকুরদার চাইতেও বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে। পয়সা আছে তোদের, যা বোঝাবি বুঝে যাব। কিন্তু বুঝলেই কি পেট ভরে?
রতিয়া ছড়িদারের দরকার টাকার। ওদিকে তো রোজগারের ঐ অবস্থা। তার উপর পঞ্চায়েতেও কম মামলা আসছে। ভোজে খরচ করার পয়সা থাকলে তবে তো লোকে পঞ্চায়েতে মামলা আনবে।
তাই ছড়িদার আসে রবিয়ার সঙ্গে গোটাকয়েক কাজের কথা বলতে। ঢোঁড়াইটার রামিয়ার সঙ্গে বিয়ে দেওয়াতে পারলে কিছু রোজগার হতে পারে দুজনেরই।
চলে এস আট আনা-আট আনা। [৩০৩]
রবিয়া বলে, তা কী করে হবে। এ কি অন্ধকে লণ্ঠন দেখাচ্ছ? আমি মেয়েটাকে এতদিন থেকে খাওয়াচ্ছি। দশ আনা- ছে আনা হলেই কাফি।
ধানকাটনীতে তার বৌয়ের সঙ্গে মেয়েটাকে জুটিয়ে দিয়েছিল কে? পঞ্চদের মত করাতে পারবি, এই বিয়ের পক্ষে? সে সময় দরকার হবে ছড়িদারের। মহতো আবার যা বিগড়ে আছে মেয়েটার উপর! রবিবারে পঞ্চায়তি, মনে আছে তো?
রবিয়া জানে যে, কথায় ছড়িদারের সঙ্গে পারা শক্ত। সে ছড়িদারের দেওয়া শর্তে রাজী হয়ে যায়।
টাকাওয়ালা লোকের বিরুদ্ধে পঞ্চরা যেতে পারে না, একথা সবাই জানে। রবিবারে পঞ্চায়তির ভিতর মহতো পর্যন্ত বিয়ের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস পায় না; কেবল ভোজের সম্বন্ধে কথা হয়। মহতোর সম্মান রাখবার জন্য নায়েবরা ঠিক করে দেয় যে রবিয়া এখনই গিয়ে মহতোগিন্নীর গোড় রাগবে। [৩০৪] লোটা নিয়ে ময়দানে যাবার কথাটা কেউ তোলেই না। ভাবী পুতহুর [৩০৫] নির্লজ্জতার কথা উঠিয়ে আজ আর তারা বাওয়ার মতো একজন লোকের মাথা হেঁট করাতে পারে না।
বাওয়া ভেবেছিল যে, আর দুচার মাস যাক; কিন্তু রবিয়ার টাকার দরকার এখনই। সে বলে, ভাদ্রতে দেবে নাকি বিয়ে-পুরুব মুল্লুকের বেঙ্গার শাদি [৩০৬]। বাওয়া লজ্জিত হয়ে মাথা নাড়ে-না না তা বলছি না। তবে থাকবার ঘর তুলতে হবে তো।
সে আর কী? সাতদিনের মধ্যে সব হয়ে যাবে। সত্যিই সাতদিনের মধ্যে সব তৈরি করে দেয়, ঢোঁড়াইয়ের তাৎমাটুলি আর ধাঙড়টুলি দুজায়গার বন্ধুরা মিলে। বাওয়ার ইচ্ছা উঠোনের মধ্যে একটি পাতকুয়া থাকুক…প্রত্যহ স্নান করার অভ্যাস রামিয়ার। ছড়িদার চটে যায় তার চাইতে বল না কেন, বাড়িতে পায়খানা তৈরি করবে, চেরমন সাহেবের বাড়ির মতো।
বাওয়া কিন্তু নিজের জিদ ছাড়ে না, কুয়ো এখন না করলে বর্ষাতে করা যাবে না।
আচ্ছা, আচ্ছা, কুয়ো হয়ে যাবেন- বুড়ো এতোয়ারী ব্যাপারটির নিষ্পত্তি করে দেয়।
ধাঙড়রা ঢোঁড়াইয়ের ঘর তুলতে সাহায্য করে। রবিয়া ঢোঁড়াইকে বলে, আবার ও গুলোকে ডাকছিস কেন ঢোঁড়াই? দুদিনের মধ্যে রবিয়া তার শ্বশুরস্থানীয় হয়ে উঠেছে। ঐ মিচকে রবিয়াটা বাওয়ার বেয়াই হয়ে যাবে। হাসি পায় ঢোঁড়াইয়ের।
বুড়ো এতোয়ারী সোডা কোম্পানী থেকে ছুটি নিয়ে ঢোঁড়াইয়ের বাড়ির বেড়া বাঁধতে বসে, আর বাওয়াকে মধ্যে রেখে অন্য তাৎমাদের সঙ্গে গল্প জমায়। এ গল্প সে গল্প।- চৌকিদারী খাজনা আবার বাড়িয়েছে তহশীলদার। তাৎমাটুলির ও ধাঙড়টুলির। বেইমানি করেছে। রবিয়ারও ধরেছে বারো আনা, আবার বাবুলাল চাপরাসীরও বারো আনা। রবিয়ার বারো আনা হলে বাবুলালের তিন টাকা হওয়া উচিত; নিশ্চয়ই টাকা খেয়েছে তহশীলদার। শনিচরার কী করেছে জান? লিখে দিয়েছে যে, বছরের শেষে খরচ-খরচার পর ওর পঞ্চাশ টাকা বাঁচে। ঝুঠঠা [৩০৭] কোথাকার। এর কিছু প্রতিকার হওয়া দরকার।
রবিয়া বলে- ঠিক বলেছ এতোয়ারী। তহশীলদারটা আমার পিছনে কেন লেগেছে। জানি না। একটা বাকি খাজনার ডিগ্রিও করিয়েছে আমার খেলাপে। অত বড় টাট বাঁধিস না ঢোঁড়াই ; গল্পের মধ্যেও সবদিকে নজর আছে এতোয়ারীর। বীচেকলার গাছ পোঁতার জন্য পিছনে একটু একটু জায়গা থাকবে- সকলের মনে পড়ে বাড়ির সঙ্গে একটু আবরুর দরকার হবে রামিয়ার।৩০৮ ঢোঁড়াই নিজেই কুয়োর পাট বসায়, মাটি আনতে ছোটে। বড় আস্তে আস্তে কাজ হচ্ছে; আর তর সইছে না তার। সে ভাবে বাড়ি তৈরি করার সময় একবার রামিয়াকে এনে দেখাতে পারলে হত। পশ্চিমে মেয়ের পছন্দ অপছন্দ দরকার-অদরকারের খবর তাদের কারুরই জানা নেই। ঐ তো কলাগাছের আবরুর কথা কোনো তাৎমারই মনে ছিল না- ভাগ্যে এতোয়ারী ছিল। বাওয়া সব বিষয়ে পঞ্চদের মতামত জিজ্ঞাসা করে, আর ঢোঁড়াইকেও তাই করতে বলে। এখন তোর সংসার হল; আর এখন পঞ্চকে তাচ্ছিল্য করলে চলবে না। যে সমাজে থাকবি তার সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে।
ঢোঁড়াই গম্ভীর হয়ে শোনে মুখ দেখে মনে হয় যে, এ বিষয়ে তারও মত ঐ একই। বাওয়ার ইচ্ছে করে, ঢোঁড়াইকে জিজ্ঞাসা করতে- হ্যারে ঢোঁড়াই, তোর কি একটু কষ্ট হচ্ছে না, আমাকে ছেড়ে থাকতে হবে বলে।–দূর একথা কি জিজ্ঞাসা করা যায়? হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছে!
সূত মানহি মাতৃ-পিতা তব লৌ।
অবলা নাহি ভীঠ পরী জব লোঁ। [৩০৯]
আর কি এখন ঢোঁড়াই য়ের বাওয়ার কথা ভাববার ফুরসত আছে? ভুলুক সে বাওয়াকে; কিন্তু রামচন্দ্রজী! সে নিজে যেন সুখী হয়। রবিয়ার বৌ ছুটতে ছুটতে আসে- রামিয়ার ইচ্ছে একটা তুলসিগাছের বেদী করার উঠোনে। সকলে লজ্জিত হয়ে যায়, দেখ তো কত বড় ভুল হয়ে যাচ্ছিল, মরদদের কি অত মনে থাকে।
বাওয়ার মুখ প্রসন্নতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠে- পচ্ছিমের মেয়ে, সংস্কার ভাল। ঢোঁড়াই সুখী হবে; তার ঢোঁড়াই।
[২৯৮. কাঁচকলা পাকা। ২৯৯. অযোগ্য। ৩০০. জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে। ৩০১. শিলাবৃষ্টি। ৩০২. টিউবওয়েল। ৩০৩. আধাআধি বখরা। ৩০৪. প্রণাম করবে। ৩০৫. পুত্রবধূ। ৩০৬. জিরানিয়ার পূর্বদিকের মুসলমান প্রধান অঞ্চলগুলির হিন্দুরাও ভাদ্র মাসে বিবাহাদি দেয়। সেইজন্য জেলার পশ্চিমের লোকেরা এই বিবাহকে ব্যাঙের বিয়ে বলে ঠাট্টা করে। ৩০৭. মিথ্যাবাদী। ৩০৮. প্রতি বাড়ির পিছনে অন্তত এক বাড় কলাগাছ ধাঙড়েরা রাখে মেয়েদের আবরূর জন্য। ৩০৯. ছেলে ততদিনই বাপ-মাকে দেখে যতদিন তার চোখ স্ত্রীর উপর না পড়ে।]
.
ঢোঁড়াই রামিয়ার বিবাহ অনুষ্ঠান
তাৎমাটুলীর বিয়েতে যারা বরপক্ষ, তারাই কন্যাপক্ষ। মহতোগিন্নী, রতিয়া ছড়িদারের বৌ, দুখিয়ার মা, হারিয়ার বৌ, এরাই পানকাটিতে [৩১০] যায় ফৌজী ইদারা তলায়; এরাই গোসাই জাগাবার গান গায় বিয়ের আগের দিন; তাদেরই বাড়ির পুরুষরা বরযাত্রী হয়ে এলে সঙ্গে সঙ্গে দুয়ার লাগার [৩১১] অশ্লীল গান আরম্ভ করে। এ বিয়েতে আবার ধাঙড়রাও বরযাত্রী এসেছে। বাওয়াকে দেখে আজ হুঁকো নামিয়ে রাখে রবিয়ার বৌ। মাথার কাপড় টেনে দিয়ে বলে, হাতের ঐ চিমটে দিয়ে সমধী [৩১২] তোমার ছেলেটাকে কোথা থেকে টেনে বের করেছিলে? অঙ্গন-ভরা লোক হেসে ওঠে এই রসিকতায়।
দুখিয়ার মায়ের আজ খাতির কত! হঠাৎ দুখিয়ার মা ঢোঁড়াইয়ের মা হয়ে উঠেছে। কিছু কাজ করতে গেলেই সবাই হাঁ-হাঁ করে ওঠে। চেলাকাঠ পেতে দিয়ে বলে, বসো সমধীন [৩১৩]। মেয়ের বাড়িতে তুমি খাটবে, সে হয় না। এই নাও তামাক খাও। দেখো না তোমাকে আজ কী গালাগালিটা দিই।
পাঁচ এয়োত তেল, সিঁন্দুর গুলে মাটিতে পাঁচটা ফোঁটা দেয়। নাপিত ঢোঁড়াইয়ের আঙুল চিরে রক্ত বের করে দুটো পানের খিলিতে লাগিয়ে দেয়। এইবার নাপিত ধরেছে শক্ত করে রামিয়ার হাতখান, এই নরুন দিয়ে চিরে দিল। টপ টপ করে রক্ত পড়ছে পানের খিলির ভিতরে! খুব শক্ত মেয়ে যাহোক, এ পর্যন্ত যত মেয়ের বিয়ে দেখেছে ঢোঁড়াই ছোটবেলায়, সকলেই এই সময় ভয়ে চোখ বুজে ফেলে। রামিয়া একবার ভুরুটি পর্যন্ত কোঁচকাল না! আলবৎ হিম্মৎ বটে! রক্ত দেওয়া পানের খিলি টোই খাওয়ায় রামিয়াকে। রামিয়া দিব্যি কচমচ করে চিবোয়। রবিয়ার বৌ ইশারা করে, অত হ্যাংলাপানা করে চিবুস না, লোকে বেহায়া বলবে। ঢোঁড়াইয়ের মুখে পান দিয়ে দেয় রামিয়া। ঢোঁড়াই ভকতের রক্তের কথা ভেবেই গা ঘিনঘিন করে। নোন্তা নোন্তা লাগে খেতে-সামুয়রটা আবার রামিয়াকে বলেছিল নোন্তা মেয়ে। চমৎকার মানিয়েছে রামিয়াকে লাল শাড়িটিতে। কাপড়টা পছন্দ করেছে বাওয়া নিজে লালের উপর হলদে ফুল। সিরুমলের দোকানের কাপড় ভারি টেকসই; দামও নেয় পুরো-তিন টাকা বার আনা।
বর-কনে দুজনে মিলে উখলিতে ধান ভানে [৩১৪]। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দুজনেই দুহাত দিয়ে সমাটটাকে [৩১৫] ধরেছে। মহতোগিন্নী ঠাট্টা করেন-সব দেখে যাচ্ছি, বর কনেকে মেহনৎ করতে দিচ্ছে না। দুখিয়ার মা বলে, তুমি থাম দিদি এখন। হঠাৎ দুখিয়ার মা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে…আজ ঢোঁড়াইয়ের বাপ বেঁচে নাইরে।…এসে দ্যাখো ছেলে আজ তোমার কত বড় লোক। বাবুলাল চাপরাসী পর্যন্ত এতে বিষণ্ণ হয় না আজ!
মিসিরজী গুটিকয়েক চাল উখলি থেকে তুলে নিয়ে মনে মনে গুনতে আরম্ভ করেন। মেয়েপুরুষ সকলের নজর গিয়ে পড়েছে মিসিরজীর হাতের দিকে। চাল সংখ্যায় বেজোড় হলেই এ বিয়ে সুখের হবে না। তবে সকলেই জানে যে বেজোড় সংখ্যায় চাল কখনও মিসিরজীর হাতে ওঠে না। আর পঞ্চায়তিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা এলেই মহতো নায়েবরা বলে যে ফৌজী ইঁদারার জল দিয়ে পানকাট্টি করা হয়েছিল বলেই বিয়ের ফল এমন হয়েছে- ও ইঁদারটার বিয়ে দেওয়া হয়নি তো?
পুরুতমশাই চাল গুনবার সময় রামিয়া ঢোঁড়াই দুইজনেরই বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে। ঢোঁড়াই সঙ্গে সঙ্গে গুনে যায় মনে মনে এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয়। ঢোঁড়াইয়ের ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়, মাড়োয়ার৩১৬ চাটাইটা যেন পায়ের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে…মিসিরজীর মতো তাড়াতড়ি সে গুনতে পারবে কোথা থেকে। তাই একটা কম গুনেছিল সে।
এইবার মহতোর রামায়ণ থেকে ছড়া কাটবার কথা। কোথায় মহতো? তার বলা শেষ না হলে তো মিসিরজী নিজের ছড়াটা বলতে পারেন না। চিরকালের এই নিয়ম। মহতো ঢুলছিল বসে। সে নেশার আমেজ আছে এখন। হঠাৎ চমকে উঠে হড়বড় করে বলে ফেলে
সব লচ্ছন সম্পন্ন কুমারী।
হোইহি সন্তত পিয়হি পিয়ারী৷
সব সুলক্ষণ আছে এ মেয়ের। এ চিরকাল পুরুখের পিয়ারী থাকবে।
এইবার মিসিরজী বলেন
সদা অচল এহি কর অহিবাতা।
এহি তেঁ জসু পইহহি পিতুমাতা।।
এর এয়োতি অচল থাকবে; এর জন্য এর বাপ-মার নাম হবে।
বাওয়ার বুকের ভিতরটা টনটন করে ওঠে। বহুদিন পর আজ দুখিয়ার মাকে ঢোঁড়াইয়ের খুব ভালো লাগে; চোখের জল ফেলছে তার বাবার জন্য, যে বাপের কথা ঢোঁড়াই জীবনে একদিনও ভাবেনি। বাওয়ারও দুখিয়ার মায়ের ছেলের উপর এই নতুন টান দেখে মনে মনে খুশি হয়; হাজার হলেও মা- যাক ঢোঁড়াইয়ের বৌটাকে একটা দেখবার লোক তবু হল।
নাপিত চিৎকার করে কোথায় গেলে দুই সমধী।
উখলির ধান বাওয়া একমুঠো দেয় রবিয়াকে; আর রবিয়া একমুঠো ধান দেয় বাওয়ার হাতে।
সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের একটানা গান আরম্ভ হয়ে যায় দুখিয়ার মাকে লক্ষ্য করে।
বুজরুকি রাখ সমধীন,
বল ছেলের বাপটি কে
উর্দি-পরা চাপরাসী, না লেঙট-পরা সন্ন্যাসী?
না অন্য কোনো নাগর ছিল,
বলেই ফেল ছাই?
খুসুর ফুসুর খুসুর ফুসুর
কর কেন? [৩১৭]
অন্য কোনো নাগর বুঝি
ভাঁটবনেতে লুকিয়ে আছে?
এ-গানে দুখিয়ার মা, বাওয়া, বাবুলাল, সকলেই আর দশজনের মতো হাসে। ঢোঁড়াইয়ের লজ্জা লজ্জা করে। রামিয়ার জন্মের ইতিহাসও সে শুনেছে। তবু মনে হয়, সে যেন রামিয়ার কাছে মর্যাদায় একটু ছোট হয়ে গেল। রামিয়ার গলার উপরটা নড়ছে, নিশ্চয় মনের আনন্দে পানের রস গিলছে।
মেয়েদের গানের লক্ষ্য গিয়ে পড়ে ধাঙড় বরযাত্রীদের উপর…
কর্মাধর্মার চাঁদনী রাতে
পাটের ক্ষেত নড়ছে কেন?
এতোয়ারীর সাদা মাথায়
চাঁদের আলো পড়ছে কেন?..
বড্ড বেশি নড়ছে যেন…
মহতো বলে, এতোয়ারী শুনছ তো?
তাৎমা-ধাঙড় সকলেই একসঙ্গে হেসে ওঠে। এই বিয়ের হিড়িকে ধাঙড় তাৎমারা, দুই টোলার ইতিহাসে, এই প্রথমবার যেন একটু কাছে আসে। এই দুর্দিনের রোজগারের অসুবিধে, তহশিলদার সাহেবের বেইমানি, আরও অনেক জিনিস হয়তো এর মধ্যে আছে, কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের বিয়েকে উপলক্ষ করেই এটা সম্ভব হয়েছে।
[৩১০. জল সহার ন্যায় একটি স্ত্রী-আচার। ৩১১. বরযাত্রীরা মেয়ের বাড়ির দুয়ারে এলে আরম্ভ হয়ে দুয়ার লাগার গান। ৩১২. বেয়াই। ৩১৩. বেয়ান। ৩১৪. উদুখল। ৩১৫. উদুখলের মুষল। ৩১৬. মণ্ডপের। ৩১৭. উসখুস।]
.
ধাঙড়টুলির অভিসম্পাত
হাসিখুশি-ভরা ধাঙড়টুলিতে হঠাৎ অমঙ্গল আর আশঙ্কার ছায়া ঘনিয়ে আসে। শনিচরার বাঁশঝাড়টায় ফুল ধরেছে।
প্রথমটা কেউ লক্ষ্য করেনি। আকলুর মা বুড়ি কী করে ঝাপসা চোখে এর ঠাহর করল, কেউ ভেবে পায় না। সাধে কি আর লোকে যায় তার কাছে সলা-পরামর্শ করতে। সেবার বিরষার যখন বাই-এর অসুখ হয়, তখন রেবণগুণী বিছানার পাশে একুশটি পান সারি সারি সাজিয়ে যখন চোখ বুজে মন্ত্র পড়ছিল, তখন বুড়ি মিটমিট করে হাসছিল। তারপর কলার পাতায় তেল-সিঁদুর গুলে গুণীর সম্মুখে রেখে দেয়। গুণী চোখ খুলে সিঁদুরের ফোঁটা দেয় মাটিতে। যে রেবণগুণীকে সিঁদুরের কথা মনে করিয়ে দেয়, সে আর বাঁশের ফুলের খবর পাবে না।
এত বড় অমঙ্গলের খবর পাবে না।
এত বড় অমঙ্গলের সূচনা ধাঙড়টুলিতে আর কখনও আসেনি। বাঙ্গাবাঙ্গীর [৩১৮] নির্দেশ আছে পাড়ার বাঁশঝাড়ে ফুল ফুটলেই বুঝবে যে আকাল, না হয় দুঃসময় কাছে। ঐ ফুলের ফসল ছেড়ো না। তাই দিয়ে বুটি তৈরি করে খাবে। তারপর বারো বছরের বেশি, সেখানে থেকো না- বারোবার গাছে তেঁতুল পাকুক। তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে, নতুন জায়গায় গিয়ে বসবাস করবার কথা ভাবতে হবে।
ধাঙড়টুলির পঞ্চায়েত বসায়। এতোয়ারী মোড়ল। মেয়েদের মুখে পড়েছে শঙ্কার ছায়া, আর পুরুষদের মুখ বিষাদে ভরা। গাছ, বাঁশ, কুয়ো ফেলে, যেতে হবে নাকি? আজ আর পচই-এর উত্তেজনা নেই; পিড়িং পিড়িং মাদল বাজছে না; বাঁশি আর গানে কারও উৎসাহ নেই। কোনো বাড়িতে উনুতে আগুন পড়েনি। এতোয়ারী আর শুক্রা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে; আর সকলে নির্বাক।
অবশেষে এতোয়ারী এ সম্বন্ধে অন্তিম রায় দেয়। মোড়ালের কাজ বড় কঠিন। কত অপ্রিয় কাজ বাঙ্গাবাঙ্গী মোড়লকে দিয়ে করান; কিন্তু শেষকালে দেখবে এই কথা এখন খারাপ লাগলেও পরে ফল ভাল হয়। যার বাঁশঝাড়, তাকে ধাঙড়টুলি ছেড়ে চলে যেতে হবে।
শনিচরার বৌ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।
আর যাদের যাদের বাড়ি থেকে ঐ বাঁশঝাড় দেখা যায়, তাদের কারও দানাপানি জুটবে না এ-গাঁয়ে বারো বছরের পর। কাঁদিস না শনিচরার বৌ, এখন তোরা যা তো। আমরাও পরে যাব।
এই তাৎমাগুলোর থেকে যত দূরে যাওয়া যায়, ততই ভাল। বুঝি তো তা, কিন্তু নাড়ি যে বাঁধা এখানে। হয়ে ওঠে কই। তাৎমারা ঠিকই বলে- বাঁশঝাড় লাগাবে পাড়া থেকে দূরে যে বাড়ি থেকে ভোরবেলায় পুবে বাঁশঝাড় দেখা যায়, সে বাড়ির উপর যমের নজর।
ঠিক হয় পঞ্চায়েতে যে ধাঙড়রা নতুন কলমের গাছ পোঁতা বন্ধ করবে। কুটিরের খুঁটিতে ঘুণ ধরলেও বদলাবার চেষ্টা করো না। যার যা জমে নগদ রাখবার চেষ্টা করবে। গোরু-মোষ কিনতে খরচ করো; মুরগী ছাগল বাড়াতে আরম্ভ করো; শনিচরা পশ্চিমে কোনো জায়গায় চলে যাক বটেদারীর কাজে; [৩১৯] কুশীর দিকে। সেখানে জমি খুব ভাল। অড়র ক্ষেতে দাঁতওয়ালা হাতি ডুবে যায়, ধনে মৌরির গাছ মানুষের সমান ডগা ছাড়ে, ভুট্টা তামাকের তো কথাই নেই। ওদিকে পড়তি জমি আছে অনেক। নদীর জল খাস না খবরদার, গলগণ্ড হবে। শনিচরা চলে গেলে কর্মাধর্মার গান আর কি সেরকম জমবে?
যাহা খেলে বোঁচাবোঁচি চলু দেখে যাই, [৩২০]। মাদলের সঙ্গে কী সুরই দেয় শনিচরা। শনিচরা একটাও কথা বলে না। অনবরত নখ দিয়ে মাটিতে হিজিবিজি কাটে। তার ছলছলে চোখের দিকে কেউ আর তাকাতে পারে না।
সে রাত্রে এতোয়ারীর ঘুম হয় না। সারারাত শনের গাছ তৈরী মাদুরখানার ওপর এ পাশ আর ও পাশ করে। মোড়লের অপ্রিয় দায়িত্বের বোঝা আর সে বইতে পারছে না। ধাঙড়টুলির মধ্যে সবচাইতে ফুর্তিবাজ লোক শনিচরা; হাসি, নাচ, গান, গল্পে চব্বিশ ঘণ্টা ধাঙড়টুলি মশগুল করে রাখে; সে কেন পড়ল বাঙ্গাবাঙ্গীর কোপদৃষ্টিতে? তহশীলদারেরও আক্রোশ দেখছি তারই উপর বেশি। ওর বৌটার দোষ আছে ঠিকই- বড় ছমকী আওরৎ [৩২১]। বক যে রকম মাছের উপর নিশানা করে বসে থাকে, সামুয়ারটাও সেই রকমই লেগেছিল শনিচরার বোটার পেছনে। খালি সামুয়রকে দোষ দিলে চলবে কেন, শনিচরার বৌটাও গায়ে পড়া। কিছুদিন আগে সামুয়রটা ধরা পড়েছিল; সে ঐ বাঁশ-ঝাড়টার মধ্যে ঢুকে, বাঁশের উপর বাড়ি মেরে একটা শব্দ করত রাতে আর শনিচরার বৌটা উঠে যেত বাঁশঝাড়ে। খুব ঠোকন খেয়েছিল সামুয়রটা। তারপর থেকে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। বাঙ্গাবাঙ্গী কি শনিচরার বৌকেই পাড়া থেকে সরাতে চান নাকি? কে জানে? সেইজন্যেই কি ওঁর ঐ বাঁশঝাড়টার উপর রাগ?…এতোয়ারী ভেবে কূলকিনারা পায় না। দোষ করল শনিচরার বৌ; তাও সেসব গণ্ডগোল কবে মিটে গিয়েছে; আর সাজা পাবে কিনা শনিচরা!…
ঠক! ঠক! শব্দটা কানে আসছে কিছুক্ষণ থেকে। হাতুড়ি-ঠোকা পেঁচার ডাক নয়তো?না সেরকম তো মনে হচ্ছে না। শনিচরার বাড়ির দিক থেকেই আসছে…।
ধড়মড় করে ওঠে এতয়ারী। একখান লাঠি নেওয়া ভাল। ঠিকই শনিচরার বাঁশঝাড়টা থেকে আসছে শব্দ।
জোছনা উঠেছে শেষ রাত্রে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে মেঠো পথ! এতোয়ারী আস্তে আস্তে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। একটা আওরও গিয়ে ঢোকে সেই বাঁশ ঝাড়ে। দূর থেকে এতোয়ারী দেখে মেয়ে মানুষ বলেই তো মনে হলো। আজ আর সামুয়রের রক্ষা নেই। পা টিপে টিপে এতোয়ারী বাঁশঝাড়ের মধ্যে ঢোকে- হাতের লাঠিটা বাগিয়ে ধরেছে শক্ত করে। কিন্তু সে শব্দটা থামছে না- বাঁশ কাটার শব্দ বলে মনে হচ্ছে। হুড়মুর করে শব্দ করে এতোয়ারীর কাছেই একটা বাঁশ মাটিতে পড়তে পড়তে কিসে যেন আটকে যায়- বোধ হয় অন্য একটা বাঁশে।
সবগুলো কাটো। সবগুলোকে। একটাও রেখো না। পরিষ্কার শনিচরার বৌয়ের গলা। বাঁশের ঝাড়কে ঝড় একেবারে নির্মূল করে করে কেটে ফেলে দেবে শনিচরা। আর কার উপর সে তার আক্রোশ, অভিমান দেখাবে? আগাছার মত গাঁ থেকে উপড়ে ফেলে দিচ্ছে সকলে তাকে।…তাই রাতের আঁধারে স্বামী-স্ত্রী দুজনে এসেছে এখানে। চোখের কোণে জল আসে বুড়ো এতোয়ারীরা। সে আবার পা টিপে টিপে ফিরে আসে নিজের ঘরে, কোনো সাড়া না দিয়ে।
[৩১৮. ধাঙড়দের দেবতা। ৩১৯. আধিয়ার, বর্গাদার। ৩২০. যেখানে পুরুষ কুমির আর মেয়ে কুমির খেলা করছে, চল দেখতে যাই। ৩২১. উড়ু উড়ু ভাবের স্ত্রীলোক।]
.
ঢোঁড়াইয়ের নিকট মহতোর আবেদন
ঢোঁড়াইয়ের ইচ্ছা রামিয়াকে রোজগার করতে না দেওয়া। দুখিয়ার মায়ের মতো। অন্য তাৎমানীদের মতো রামিয়া বাবু ভাইয়াদের বাড়ি তাল, কুল, হেলেঞ্চার শাক বেচতে যাবে, সে ঢোঁড়াই পছন্দ করে না। সব সে বোঝে। সামুয়র-টামুয়রের মতো বদ লোকগুলোর চোখের দিকে এক নজর তাকিয়েই সে বোঝে। তার রামিয়াকে সে বাড়ির বাইরে যেতে দেবে না; কিন্তু মাটিকাটার রোজগার দিয়ে বৌকে বেড়ার ভিতরে রাখা চলে না। বাওয়াও সে কথা জানে।
কী করবি ঢোঁড়াই?
বাওয়ার ইচ্ছে ঢোঁড়াই একখান মুনীখানার দোকান খুলুক। কী, জবাব দিস না না যে? ঢোঁড়াইও একথা ভেবেছে। রামিয়ার সঙ্গে কত গল্প হয়েছে। এ নিয়ে। রামিয়া পয়সা আর আনা জুড়ে সেদিন সরষের তেল, রিঠে আর খয়নির হিসাব করে দিল। দোকান চালানোয় রামিয়া মদদ [৩২২] করতে পারবে ঠিকই; কিন্তু আরওরতের সাহায্য নিয়ে রোজগার।–তেমনি মরদ ঢোঁড়াই কে পাওনি। তার উপর এককুড়ি লোক চব্বিশ ঘণ্টা তার দোকানে ফষ্টিনষ্টি করবে, ঐ সামুয়রটা পর্যন্ত সেসব চলবে না।
পান-বিড়ির দোকান। তাহলে তো দোকান করতে হয় জিরানিয়াতে। বাওয়ারও হঠাৎ মনে পড়ে যে, সেদিন যখন সে অনিরুদ্ধ মোক্তারের সঙ্গে কাছারির মুন্সীখানায় গিয়েছিল, সেখানে কে যেন বলাবলি করছিল মহাৎমাজীর কথা- আবার নাকি একটা হল্লা [৩২৩] হতে পারে সেবারকার মতো। তাদের সব কথা বাওয়া বোঝেনি, তবে বুঝেছে যে, এবার তামাসা জমবে আরও বেশি।…দরকার কী এই সব সময় পান বিড়ির দোকান করে।
তাহলে ভাড়ার গরুর গাড়ি চালা ঢোঁড়াই। ভাড়ার মাল বোঝাই করে যখন ইচ্ছে যাও, যখন ইচ্ছে ফেরো। বাড়ির দুয়োরে বলদজোড়া বাঁধা থাকবে- ইয়া: তাজা তাগড়া শিঙে তল লাগানো বলদ- বটোহী [৩২৪] রাস্তা থেকে তাকিয়ে দেখবে। পাড়ার লোক হিংসেয় ফেটে পড়বে, লোকে সমীহ করবে। পথের মাঝে গরুর গাড়ি আড়াআড়ি করে রেখে দাও, মরদুরা পর্যন্ত গাড়ির নিচ দিয়ে যাবে; রাখুক তো দেখি কেউ গাড়িটা সরিয়ে একপাশে-কারও হিম্মৎ হবে না। বাড়ির সম্মুখে ফুঁটের পাহাড় দেখে লোকের চোখ টাটাবে।
শেষ পর্যন্ত ঢোঁড়াইয়ের গাড়ি বলদ কেনাই ঠিক হয়- ভিখনাহাপট্টির মেলা থেকে পাড়া আবার সরগরম হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে হয়ে উঠল কী তাৎমাটুলি। বড় যখন হয় তখন এমনি করেই হয়। এবেলা-ওবেলা বাড়ে। একেবারে বাবুলালের সমান হয়ে গেল ঢোঁড়াই। দুখিয়ার মা নিত্যি এসে কানিয়ার [৩২৫] সংসার তদারক করে যায়। দুখিয়াটা পর্যন্ত ভাবীর [৩২৬] ফাঁই-ফরমাস খাটে। রামিয়ার কাছে আসে কেবল ফুলঝরিয়া? ডাকতে গিয়েছিল রামিয়া; তাও আসেনি। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলেছিল।
বিনা কাজে মহতোর কারও বাড়ি যাওয়া নিয়ম নয়- তার পদমর্যাদায় বাধে। সে সুষ্ঠু একদিন ঢোঁড়াইয়ের বাড়িতে এল, নতুন বলদজোড়া দেখবার ছুতো করে। মহতো তার দুয়ারে; ঢোঁড়াই কী করবে ভেবে পায় না। রামিয়া তাকে উঠোনে নিয়ে গিয়ে বসায়। পাড়ার লোকেরা বাড়ির বাইরে জটলা করে- নিশ্চয়ই ফের ঢোঁড়াইটা কোথায় একটা কী কাণ্ড বাঁধিয়েছে; না হলে কি আর মহতো এসেছে অঙ্গনে। পচ্ছিমে মেয়েটা আবার কিছু করেনি তো?
রামিয়া মহতোকে পা ধোবার জল দেয়। মশলা বাঁটবার জন্য দুখিয়ার মা যে দু টুকরো পাথর দিয়েছে তাই দিয়ে সুপুরি ভেঙে দেয়। মহতো যতটা খুশী হয়, তার চেয়ে আশ্চর্য হয় বেশি। তাৎআটুলির লোকেরা এসব পচ্ছিমে তরিবৎ-এ অভ্যস্ত নয়। অথচ মহতো একথা প্রকাশ করতে চায় না। তাড়াহাড়ি পা ধোবার জলটা খেয়ে সুপুরি কয়টা মুখে ফেলে।
রামিয়া ফিক করে হেসে ফেলায় মহতো বলে, এই রকম হাসিই তো চাই; কিন্তু অঙ্গনের বাইরে গিয়ে নয়। একি মুঙ্গেরিয়া তাৎমাদের সিঁড়িতে চড়া মেয়ে পেয়েছে। আমাদের কনৌজী তাৎমার ঝোটাহারা মদ তাড়ি পর্যন্ত আঙিনায় বসে খাবে কলালীতে৩২৭ নয়। এই আমার গুদরের বৌকে দেখ না। তাড়ি খাওয়ার পর একদিন কেউ তার চোখে জল দেখতে পেয়েছে? বাড়ির লোকেও না। কিন্তু বেচারি এখন মুশকিলে পড়েছে ভারি। জানই তো আজকালকার রোজগারের বাজার। আমি আর গুদরের মা তোমাকে তো নিজের বেটা বলেই মনে করি। তোমার ঐ গ্যাং-এর কাজটা গুদরকে পাইয়ে দাও। তুমি তো ছেড়েই দিলে।
ঢোঁড়াই এতক্ষণে বুঝতে পারে, কেন মহতো এসেছে তার বাড়িতে। আচ্ছা আমি এতোয়ারীকে বলে দেখব। ওই তো সব- নামেই শনিচরার দল।
এতোয়ারীর কাছে কথাটা তুলতেই সে বলে যে, তা কী করে হবে! ধাঙড়টুলির কথা তো তারা আগে ভাববে। আর একটা জায়গা অবিশ্যি খালি হবে-শনিচরারটা; কিন্তু কজনকে ঢুকোতে হবে কাজে জান? ছোেটা বিরষার চাকরি গিয়েছে, তার সাহেব চলে গিয়েছে বাড়ি বিক্রি করে। সামুয়রের খুড়তুতো ভাই, মানুয়র, যেটা গীর্জায় ঘণ্টা বাজায়, সেটার চাকরিও টলমল। পাদবী সাহেবরা জিরানিয়া থেকে চলে যাচ্ছে দুমকা জেলা। বাচ্চাদের একপোয়া করে যে দুধ দেয় গীর্জা থেকে, সেটা যাবে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে। আরও গোটা কয়েক চাকরি যাওয়ার ফিরিস্তি দেয় এতোয়ারী। তাছাড়া সামুয়রের সাহেব তো এই গেল বলে- তার মালীটাকেও তো এক জায়গায় ঢুকোতে হবে। এর উপর আর কথা চলে না। ঢোঁড়াই বোঝে মহতো চটবে, কিন্তু উপায় কী?
[৩২২. সাহায্য। ৩২৩- গণ্ডগোল : আন্দোলন। ৩২৪. পথিক। ৩২৫. কনিয়া-কনে বৌ, পুত্রবধূ। ৩২৬. ভ্রাতৃবধূ। ৩২৭- মদের দোকান।]
.
বৌকা বাওয়ার অন্তর্ধান
বাওয়া ঢোঁড়াইয়ের বিয়ের পর থেকে একটু বিমনা হয়ে পড়েছে। এতদিন তবু হাতের কাজ ছিল; বিয়ের যোগাড়, ঘর তুলবার বাঁশ-খড়ের যোগাড়, গাড়ি বলদ কেনা এসব কাজে একরকম উৎসাহও এসে গিয়েছিল তার। তার ঢোঁড়াইয়ের সংসার সে নিজে হাতে পেতে দিয়েছে। রামজী তার মাথায় যে কর্তব্যের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন, তা বইতে ইতস্তত করেনি একদিনও। সে আর কী করেছে; যার কাজ তিনি করিয়েছেন। তবে এতদিন ঢোঁড়াই ছিল, একটা অবলম্বন ছিল। এখন বড় একলা লাগে; ভিক্ষা চাইতে ইচ্ছা করে না; রামজীর কথা পর্যন্ত মনে আসে না। তিনি সব দেখছেন উপর থেকে।
আত্মগ্লানিতে ঘন ঘন মিলিট্রি ঠাকুরবাড়িতে যাতায়াত আরম্ভ করে; বেশিক্ষণ করে বসে রামায়ণ শুনতে। বার বার সেখানকার রাম-সীতা লছমনজী মহাবীরজীর মুরুগুলিকে৩২৮ প্রণাম করে। মোহান্তজী প্রসাদ করে কল্কে তার হাতে দিলে অন্যমনস্ক হয়ে টান মারে; কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি পায় না। ঢোঁড়াই আর রামিয়া ধরেছিল তাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্য। সে রাজী হয়নি। তাই নিয়ে রামিয়া চোখের জল ফেলেছিল, কিন্তু বাওয়ার মতের নড়চড় হয়নি। বাওয়া স্বপাক খেত চিরকাল। তবে ঢোঁড়াইয়ের ছোঁয়া খেতে তার কোনোদিন দ্বিধা হয়নি। রামচন্দ্রজী যাকে ছেলে বলে কোলে তুলে দিয়েছেন তার বেলায় কি ছোঁয়াছুঁয়ির কথা ওঠে; কিন্তু তাই বলে সে আর তার স্ত্রী এক নয়। ঢোঁড়াই এজন্য মনে মনে বেশ দুঃখিত হয়েছিল। বলেই ফেলল- তোমাকে মেয়ে বাছতে দিইনি বলে রাগ করেছ বাওয়া? দেখ অবুঝ ছেলের কথা- বোঝালেও বুঝতে চায় না। আরে না না, তা কি হয়? তবে কেন খাবে না বাওয়া? ঢোঁড়াইয়ের সন্দেহের নিরসন হয় না। বাওয়া হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়! অনুতাপ নয়, তবু ঢোঁড়াই য়ের মনে হয় যে সেও যদি বাওয়ার মতো সন্নাসী হয়ে থাকত, তাহলে তার সঙ্গে গোঁসাই থানে থাকতে পারত। কিন্তু রামিয়া? তাহলে তার জীবনে রামিয়া তো আসত না। তাহলে তার আজ থাকত কী? এই কয়দিনের মধ্যেই সে রামিয়াকে বাদ দিয়ে নিজের জীবনের কথা ভাবতেই পারে না। একদিনও সে জীবনে রামিয়াকে ছেড়ে থাকবে না। যদি রামিয়া কোনদিন মরে যায়- সীত্তারাম! সীত্তারাম! কেবল বাজে কথা মনে পড়বে।
বাওয়ার মন অস্থির অস্থির করে; নিঃসঙ্গতায় সে পাগল হয়ে যাবে নাকি! সবই তো সেই আছে, সেই থান সেই রামায়ণ পাঠ। কেবল তার ঢোঁড়াই আর তার নেই। আর একজন তাকে একেবারে আপন করে নিচ্ছে। এতে দুঃখ কিসের; এ তো আনন্দের কথা। আর ঢোঁড়াই সুখে থাকুক এই তো বাওয়া চেয়েছিল।…
চৈতী গানের সুর ভেসে আসছে। হরখুরের মাতাল জামাইটা বোধ হয় মনের আনন্দে তান ধরেছে।
চায়েৎ সুভা দিনোয়া রামা, হো রামা…
চবি গেলে পিয়াকী গামানোয়া [৩২৯]।
-চৈত্রের শুভদিন এসে গিয়েছে রাম, পিয়ার দ্বিরাগমনের সময় এসে গিয়েছে।
–পাড়ার সবাই গিয়েছে মরনাধারে পুলের কাছে, ঐ যেখানে আলো আর আগুন দেখা যাচ্ছে। কাল রাতেও এই সময় ওখানে তাৎমাটুলি আর ধাঙড়টুলির সকলে গিয়েছিল। মহাৎমাজীর চেলারা ঐ জায়গাটাকে বেছেছেন নিমক তৈরীর মহলা দেবার জন্য।
রংরেজ-এর [৩৩০] নিমক খেলে, রংরেজের খেলাপ যেতে পারবে না। রংরেজ, দারোগা কলস্টরের মালিক। গরীবদের হালতের সুধার [৩৩১] করতে হলে নিমক তৈরী করতে হবে। নিমক তৈয়ার করবার সময় দারেগা এলে, কী করে সকলে মিলে নিমকের কড়াইখানাকে বাঁচাবে, তারই মহলা দিতে এসেছেন মাস্টার সাহেবের চেলারা। রামিয়া, মহতোগিন্নী, রবিয়ার বৌ আরও অনেক ঝোটাই সন্ধ্যাবেলায় মরনাধারের পুলের কাছে ঐ জায়গাটাতে পিদিপ দিয়ে এসেছে। কাল একদল এসেছিল মহলা দিতে, আজ আবার এসেছে নতুন একদল। এরাই সব আবার গাঁয়ে গাঁয়ে চলে যাবে এর পর। কিন্তু মরনাধারের কাছে থেকে যাবে একটু নতুন থান [৩৩২] মহাৎমাজীর থান, ঠিক যেখানটিতে আজ ঝোটাহারা সাঁঝে পিদিপ দিয়েছে। সেইখানটায়। বাওয়া ভাবে যে সত্যি যদি ওখানে আর একটা থান হয়ে যায়; তাহলে তাৎমাটুলিতে গোঁসাইথানের গুরুত্বতেও কিছুটা টান পড়তে পারে। কাল সে মরনাধারের কাছে মাস্টার সাহেবকে দেখেছে। বাওয়া চিমটে কমণ্ডলু নিয়েও ঢোঁড়াইয়ের কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারে না, আর মহাৎমাজীর চেলারা কি করে নিজের ছেলেপিলে ছেড়ে জেলে থাকে। তাদের কি মন কেমন করে না? না, বজরঙ্গবলীর [৩৩৩] শক্তি মহাত্মা আর তাঁর চেলাদের। রামচন্দ্রজীর আশীর্বাদ আছে তাঁদের উপর। কিন্তু একটা জিনিস বাওয়ার মাথায় কিছুতেই ঢোকে না। উকিল সাহেব আরও কত মুসলমান পিঁয়াজ ছেড়ে গানহীবাওয়ার চেলা হয়েছিল। ঐ মিয়াদের আবার বিশ্বাস! মিসিরজীর কাছ থেকে বাওয়া শুনেছে যে, অযোধ্যাজীতে রামচন্দ্রজীর মন্দিরটাকে মিযারা মসজিদ করে নিয়েছে। দেখ আস্পর্ধা। ঐ মিয়াদের সঙ্গে এত মাখামাখি মহাৎমাজীর চেলারা করেছিল তবু রামচন্দ্রজী কেন মহাৎমাজীর চেলাদের উপর এত সদয়? মহাৎমাজীকে রাখুক তো দেখি সরকার জেলে? রামচন্দ্রজীর আশীর্বাদ তার মাথায়, তাকে কি কলস্টর দারোগা জেলে পুরে রাখতে পারে। তুলসী দাসজীকে একবার এক নবাব জেলে রেখেছিল; লাখে লাখে বাঁদররা গিয়ে তাঁকে জেল থেকে বের করে এনেছিল। আর মহাৎমাজীর রাখবে তালা দিয়ে। মা মরার সময় বলে গিয়েছিল অযোধ্যাজীতে গিয়ে থাকিস, সেখানে অনেক ভিখ পাওয়া যায়। হঠাৎ একথা মনে পড়ল কেন। রামজী বোধ হয় মনে পড়িয়ে দিচ্ছেন আমার পথের কথা। তিনি আমার মাথার উপর থেকে সব ভার সরিয়ে নিয়েছেন; অযোধ্যাজী যাওয়ার রেলভাড়া জুটিয়ে দিয়েছেন; বলেছেন, ভরত রাজার মতো তোর হল নাকি?
শুভদিন এসে গিয়েছে।
— আবুহো বাভনমা, বৈঠোহো আঙনমা,
গনি দেহ পিয়াকে গামনমা
হো রামা-[৩৩৪]
এসো বামুনঠাকুর অঙ্গনে বসো, পিয়ার দ্বিরাগমনের দিনক্ষণ দেখে দাও।
না, না, আর পাঁজিপুথি দেখবার দরকার নেই। বাওয়া ঝেড়ে ফেলে দিতে চায় মনের পরতে পরতে জমানো ঢোঁড়াইয়ের স্মৃতিগুলি। চৈতী গানের ঈঙ্গিত, মরা মায়ের আদেশ, রামজীর অঙ্গুলি সংকেতকে তাচ্ছিল্য করতে পারে না। তাকে সব ছিঁড়ে বেরুতে হবে, না হলে তার দশা হবে ভরত রাজার মতো। এই জন্যই বোধ হয় তার মন এত অস্থির অস্থির লাগছিল। ঢোঁড়াইরা এখন সব গিয়েছে মরনাধারের কাছে মহাৎমাজীর চেলাদের তামাসা দেখতে। এখনই সময়টা ভাল আর এক মুহূর্ত দেরি করবে না। চিমটে কমণ্ডলু নিয়ে সে ওঠে। থানের বেদীটিকে প্রণাম করে। চিমটের আংটাটার সঙ্গে ঢোঁড়াই ছোটবেলায় একটা আধলা ফুটো করে ঢুকিয়েছিল। হঠাৎ সেটার উপর নজর পড়ায়, সেটাকে খুলে ফেলবার জন্যে টানাটানি করে। না এত তাড়াতড়ি খোলা সম্ভব ওটা।
সময় নেই। সীত্তারাম।
চায়েৎ সুভা দিনোয়া রামা,
আবি গেলে পিয়াকী গামানোয়া
হো রামা
শুভদিন এসে গিয়েছে। আর এক মুহূর্তও সময় নেই নষ্ট করবার
চিমটের আংটার সঙ্গে আধলাটা লেগে যে শব্দ হচ্ছিল সেটা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসে। তেল ফুরোনোয় থানের পিদিপটার বুক জ্বলছিল; সেটা দপ করে নিভে যায়।
[৩২৮. বিগ্রহ। ৩২৯. তাৎমাটুলির একটি প্রচলিত চৈত্রীগান। চৈত্রের শুভদিন এসে গিয়েছে রাম, পিয়ার দ্বিরাগমনের সময় এসে গিয়েছে। ৩৩০. ইংরাজ। ৩৩১. অবস্থায় উন্নিতি। ৩৩২- পূজার স্থান। ৩৩৩. মহাবীরজী। ৩৩৪. চৈতী গানের অপর এক লাইন–
এস হে বামুন ঠাকুর অঙ্গনে বস
পিয়ার দ্বিরাগমনের দিনক্ষণ দেখে দাও
হে রাম!… ]
.
গানহী বাওয়ার ভিন্ন মূর্তিতে পুনরাবির্ভাব
সার্ভে খাতাখতিয়ান অনুযায়ী, মরনাধার সমেত বকরহাট্টার মাঠ, তাৎমাটুলির জমিদারবাবুর নিজস্ব সম্পত্তি। আসলে তাৎমা ধাঙড়রা এখানে আসবার অনেককাল আগে থেকেই বকরহাট্টার মাঠ ছিল মরগামার লোকদের গরুচরানোর জায়গা। এ ছিল জনসাধারণের জমি [৩৩৫]। ঢোঁড়াই জন্মাবার ছয় বছর আগে, যখন এখানে সার্ভে [৩৩৬] হয় তখন জমিদার বাবু টাকাপয়সা খরচ করে, এটাকে তার নিজের পতিত [৩৩৭] জমি বলে সার্ভে কাগজপত্যে লিখিয়ে নেন। তারপর থেকে লার জন্য কুলগাছ বিলি করতেন তিনিই; কপিলরাজার কাছে শিমুলগাছ বিক্রি করতেন তিনিই। কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। এখন জমিদারবাবুর মাথায়, বকরহাট্টার মাঠ নিয়ে অনেক জিনিস খেলছে। এর মধ্যে যদি মহাৎমাজীর থান হয়ে যায়, বকরহাট্টার মাঠের মধ্যে কিংবা এই নিয়ে যদি থানা পুলিশ মামলা মোকদ্দমা হয়, তা হলে হয়তো আবার নতুন করে, এত দিনের চাপা পড়া জমির স্বত্বের কথা উঠবে। ওখানে পিদিপ দেওয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, এ খবরও তিনি সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গিয়েছেন। রতিয়া ছড়িদার, পরসাদী, নায়েব, রবিয়া সকলের নামেই বাকি খাজনার ডিক্রি করানো আছে তারা সবাই এখন তাঁর মুঠোর মধ্যে। তিনি সাঁঝেই তাদের ডেকে পাঠান।
পরের দিন ভোর হতে না হতে হৈ হৈ কাণ্ড তাৎমাটুলিতে। মোটরে করে লাইন থেকে পুলিশ এসে হাজির, সঙ্গে আবার রংরেজী টুপিপরা [৩৩৮] হাকিম। তারা মরনাধারের দিক থেকে ফিরছেন। মরনাধারের কাছে এখন কোনো লোক নেই, তবে রাত্রে সেখানে আগুন জ্বালানো হয়েছিল, শুকনো ঘাসের উপর তার চিহ্ন আছে। চৌকিদার আর দফাদারের খবর যে, রাতে তাৎমাটুলির আর ধাঙড়টুলির ছেলেবুড়ো সকলে ভেঙে পড়েছিল মরনাধারের কাছে। তাই হাকিম এসেছেন তাৎক্সাটুলিতে। দেখা গেল যে পুলিশ সব খবরই জানে। হাকিম বললেন যে সব খবর আমরা রাখি। আজ কিছু বললাম না। যা করেছ করেছ, আর যেন ভবিষ্যতে না হয়। বাইরের লোক কেউ তোমাদের পাড়ায় এসে সরকারের খেলাপ কাজ করলেও ধরব তোমাদের। তাৎমাটুলির একখানা ঘরও দাঁড়িয়ে থাকবে না তাহলে, বলে রাখলাম। রোজগার কর, খাও দাও থাক। না হলে ফল ভুগবে। তোমাদের কিছু বলার থাকে তো আমার কাছে যখন ইচ্ছা বলতে পার, কিন্তু কংগ্রেসের লোকদের পাল্লায় পড়েছ কি, তোমাদের সব কটাকে ধরে জেলে দেবে।
সকলের মন ভয়ে কেঁপে ওঠে। মহাৎমাজীর চেলারা, মাস্টারসাহেবের চেলারা তাহলে কাংগ্রিস-এর লোক। কিছুদিন থেকে মিসিরজীও রামায়ণ পাঠের সময় কাংগ্রিস কাংগ্রিস কী সব বলে। এখন এস.ডি.ও. সাহেবও সেই কথাই বলছেন। তাই বলো। বাবুভাইয়াদের কাংগ্রিস আর দারোগা হাকিম সরকার! এদের মধ্যে লেগেছে টক্কর৩৯ হাকিম বোধ হয় ভুল বোঝাচ্ছে- মহাৎমাজীর নাম তো নিচ্ছে না এক বারও।…
ঢোঁড়াই হাকিমকে সেলাম করে বলে হুজুর মা বাপ! আপনার কাছে আমাদের একটা আর্জি আছে। আমাদের চৌকিদারি ট্যাকস বসাতে তশীলদার সাহেব বেইমানী করেছে; রবিয়ারও বারো আনা, বাবুলাল চাপরাসীও বারো আনা। তা কী করে হয়? সকলে অবাক হয়ে যায় ঢোঁড়াইয়ের সাহসে। হাকিমের সঙ্গে কথা বলছে; দারোগার সম্মুখে; আবার তশীলদার সাহেবের বিরুদ্ধে নালিশ! এই বুঝি হাকিম তাকে তাড়া দিয়ে ওঠেন। হাকিম জিজ্ঞাসা করেন তশীলদার কে?
ফুদনলাল, মাহীটোলার হুজুর।
বাবুলাল চাপরাসীর গলা শোনা যায়-এ ছোকরা তো মাত্র কদিন হলো ঘর তুলেছে। এ কী জানে চৌকিদারির [৩৪০] সম্বন্ধে?
হাকিম বাবুলালকে তাড়া দেন- তোমাকে কে জিজ্ঞাসা করেছে? তারপর ঢোঁড়াইকে বলেন, লিখে দরখাস্ত দিও আমার কাছে। সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু খবরদার সরকারের খেলাপ কিছু দেখলে, তাৎমাটুলির একটা লোকও থাকবে না জেলের বাইরে।
এস.ডি.ও. সাহেব হাতের ঘড়ি দেখেন। একপাল উলঙ্গ ছেলে, এতক্ষণে সাহসে ভর করে পুলিশ ভ্যানের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। টপ টপ করে মোটরের এঞ্জিন থেকে জল পড়ছে মাটিতে, ছেলেরা বলছে পিট্রোল [৩৪১] পড়ছে, দরদের ওষুধ।
গাড়ি চলে যায়। লু বাতাসে তার চাকায় উড়ানো ধুলো মরনাধারের দিকে ছুটে যায়, বোধ হয় রাতের কলঙ্কের দাগ ঢাকবার জন্য।
লু বাতাসের মধ্যে দিনের বেলায় কারও বাড়ি রান্না হবে না- খড়ের ঘরে আগুন লেগে যেতে পারে! তাৎমাটুলির কেউ আর সেদিন কাজে বেরোয় না। সারাদিন সকলে মিলে সম্ভব অসম্ভব অনেক রকম আলোচনা করে। গানহী মহারাজ, পুরনো গানহী বাওয়া হঠাৎ কবে থেকে মহাৎমাজী হয়ে গিয়েছেন। মাস্টারসাহেবের বেটা কাল এসে মরনাধারের কাছে বলে গিয়েছে যে রংরেজ সরকারের জন্যই তাৎমাদের রোজগার নেই। অনেকদিন আগে নাকি সরকার তাৎমাদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নিয়েছিল। দেখ কাণ্ডখানা একবার! তবে একটা সুবিধে বুড়ো আঙুল না থাকলে কেউ আর জোর করে সাদা কাগজে আঙুলের ছাপ দিতে পারবে না; না অনিরুদ্ধ মোক্তার, না সাওজী, না জমিদারবাবু। …তারপর থেকেই তো তারা কাপড় বুনবার কাজ ভুলেছে।…কলিযুগে।
নৃপ পাপপরায়ণ ধর্ম নঁহী।
করি দণ্ড বিড়ম্ব প্রজা নিহঁহী৷ [৩৪২]
সাধে কি আর মহাৎমাজী রংরেজ-এর নিমক খেতে বারণ করেছেন। সব দেখতে পান তিনি। ঐ রংরেজ-এর নিমক ছিল বলেই না কপিলরাজার জামাইটা তাৎমাটুলির বুকের উপর বসে, গরুর চামড়ার কারবার করতে পেরেছিল।…
আচ্ছা, আচ্ছা ছাড় এখন এসব কথা। দেখছিস তো গাঁয়ের খবর দারোগার কাছে চলে যায়। আচ্ছা পরশু রাতের খবর কে পুলিশকে দিল বলতে পারিস? ধাঙড়টোলার কেউ নয়তো? রতিয়া ছড়িদার, আর বাসুয়া নায়েবকে হারিয়া দেখেছে দফাদারের সঙ্গে জিরানিয়াতে! দফাদারের সঙ্গে আবার তাদের কী কাজ থাকতে পারে? সে দুটো গেল কোথায়? সত্যিই তাদের তো সকালবেলা থেকে দেখা যাচ্ছে না।
হারিয়ে বলে যে আমি কাল জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাদের। তারা বলে যে চৌকিদারি খাজনার কথা বলছিলাম।
এসব আবার কী গাঁয়ের মধ্যে! পঞ্চায়তিকে না জানিয়ে চৌকিদার দফাদারের সঙ্গে মেলামেশা! ঢোঁড়াইয়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।
গাঁয়ের লোকের বিরুদ্ধে দফাদারকে খবর দেবে? হোক না সে নায়েব! এ মামলা নেবে কিনা বল, মহতো। সাফ সাফ বল এ মামলা পঞ্চায়তিতে রাখবে কি না-ঘসর ফসর [৩৪৩] কথা নয়। কেবল লোটা নিয়ে ময়দানে যাওয়া পঞ্চায়তি করেন সব।
সকলেই ঢোঁড়াইকে সমর্থন করে। গ্রামের সকলেই মুখচোখের ভাব, আর কথাবার্তার ধরন দেখে, ভয়ে মহতোর মুখ শুকিয়ে যায়; আর ঐ সেদিনের ভুইফোড় ছোকরা ঢোঁড়াই , সেই কি না গাঁয়ের লোকের মুখিয়া [৩৪৪] হয়ে আগিয়ে আসে। নতুন পয়সার গরমে ফুলে ভাঁথী [৩৪৫] হয়েছে ছোঁড়াটা। বললাম গুদরকে একটা কাজ দিতে মাটিকাটার; সে বেলা পারলেন না! গুদরকে আমার পাঠাতে হল মুঙ্গেরিয়া তাৎমাদের সঙ্গে মজুরি করতে। আমার পুতহু, [৩৪৬] ঐ মইয়েচড়া মুঙ্গেরিয়াতাৎমা [৩৪৭] মেয়েদের সঙ্গে এক হয়ে গেল। কনৌজী তন্ত্রিমাছত্রিদের ঘরের বৌ শহরে মইয়ে চড়তে আরম্ভ করেছে- এই রকম দুর্দিন পড়েছে। এর মধ্যে আবার থানা পুলিশের ঝঞ্ঝাট করবার দরকার কী।…সেবারের মতো আবার মহাৎমাজীর চেলারা তাড়ির দোকানে গোলমাল করবে নিশ্চয়। এই রুখার দিনে৩৪৮ এ আবার আর এক ফ্যাসাদ- যাগগে! লোকের হাতে পয়সা থাকলে তবে তো তাড়ির দোকান যাবে।…
ঢোঁড়াইয়ের সব থেকে বেশি আনন্দ যে সে আজ হাকিমের সঙ্গে কথা বলেছে। বলবার সময় সে একটু ঘাবড়ায়নি। যা যা ভেবেছিল সব গুছিয়ে বলতে পেরেছে। হাকিম দিয়েছেন।…এখন ঢোঁড়াই যে কোনো হাকিম আসুন না, তার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। আজ সে আবার লোকের চোখে বাবুলাল চাপরাসীর চাইতেও উঁচুতে হয়ে গিয়েছে। রামজীর কৃপায় তার জীবনের একটা আকাঙ্ক্ষা আজ পূর্ণ হয়েছে। রতিয়া ছড়িদার আর বাসুয়া নায়েবের ব্যবহারে মনটা খারাপই হয়ে গিয়েছিল ঢোঁড়াইয়ের। সেই সব কথাই ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির দিকে আসে; রামিয়ার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করা হয়নি।
রামিয়া বলদের নাদায় জল ঢালছে। বাইরে এসে এসব কাজ করতে মানা করলেও সে শুনবে না।
ওটা কে? সামুয়র না!
এই যে বলদের মালিক এসে পড়েছেন। যাচ্ছিলাম বাড়ি। রাস্তা থেকে হঠাৎ বলদজোড়ার উপর নজর পড়ল।
তারপর একথা সেকথা হয়।…তোমাদের পাড়ায় তো দেখি ভীষণ কাণ্ড। আগে জানলে আমি আজ সাহেবের কুঠিতেই থেকে যেতাম। আমার সাহেবত চলে যাচ্ছে আসছে সপ্তাহে। এই সব মহাৎমাজীর হল্লার জন্য না কি কে জানে।….
তাহলে অনেক টাকা পাচ্ছ, বলো?
সামুয়র বলে, শুনেছি তো সাতশো টাকা দেবে। ভারি খুপসুরৎ তোমার বলদজোড়া।…
তুমিও কেননা এই রকম গাড়ি-বলদ।…
পাতলী কমরোয়ার [৩৪৯] গান গাইতে গাইতে সামুয়র ধাঙড়টুলির পথ ধরে।
অকারণ বিরক্তিতে ঢোঁড়াইয়ের মন তেতো হয়ে ওঠে।
রামিয়াই প্রথম কথা বলে। আজ বাওয়াকে দেখলাম না থানে। রামিয়া জানে যে বাওয়ার কথায় ঢোঁড়াইয়ের মন সব সময়ই সাড়া দেয়। সত্যি তো সারাদিনের হট্টগোলের মধ্যে বাওয়ার কথা একবারও ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়েনি। গেল কোথায়? পুলিশের গাড়ি দেখে ভোরেই কোথাও পালিয়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু এতক্ষণ তো ফেরা উচিত ছিল।
এখনই ফিরে আসবে;
বাওয়ার খোঁজে ঢোঁড়াই কয়েকবার থানে যায়। রামিয়ার সঙ্গে গল্প আজ ভাল জমে না! সন্ধ্যার পর পশ্চিমা বাতাস থামলে, কাঠ জ্বেলে আগুন করে রাখে। মারুয়া [৩৫০] ঠেসে লিটির লেচি পাকিয়ে রাখে। এই বাওয়া এল বলে! পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রামিয়া এসে ডাকে, বাওয়া, এখনও তো এল না। তুমি খেয়ে নাও না বাড়ি এসে। ক্ষিদে পেয়েছে বুঝি খুব? রামিয়া লজ্জিত হয়ে যায়। গঙ্গাস্নানে যায় নাই তো? মিলিট্রি ঠাকুরবাড়িতে প্রসাদ পাওয়ার জন্য থেকে যায় নাই তো?
[৩৩৫. রেকর্ড অব রাউটস-এ লেখা থাকে, গৈর মজরুয়া আম-সর্বসাধারণের সম্পত্তি। ৩৩৬. সরকারী Cadastral Survey. ৩৩৭. অনাবাদী। ৩৩৮. হ্যাট। ৩৩৯, সংঘর্ষ। ৩৪০. স্থানীয় ভাষায় চৌকিদারির অর্থ চৌকিদারি ট্যাক্স। ৩৪১. পেট্রোল-ব্যথার ওষুধ। ৩৪২. রাজা পাপপরায়ণ, তার ধর্ম নেই; প্রজাদের দণ্ড দিয়ে বিড়ম্বনায় ফেলে- তুলসীদাস। ৩৪৩ বাজে কথা। ৩৪8. (মুখ্য শব্দ হইতে) প্রধান, প্রমুখ। ৩৪৫. হাপড়। ৩৪৬, পুত্রবধূ। ৩৪৭. তাৎমাটুলির তাৎমারা নিজেদের বলে কনৌজী, আর যে তাৎমারা রাজমিস্ত্রীর কাজ করে তাদের বলে মুঙ্গেরিয়া; মুঙ্গেরিয়া তাৎমাদের মেয়েরা রাজমিস্ত্রীর কাজ করার সময় মইয়ে চড়ে বলে, তাৎমাটুলির ঝোটাহারা তাদের অবতার চোখে দেখে। ৩৪৮. রুক্ষ শব্দ থেকে। শুকনো গরমের দিনে! এ অঞ্চলে লোকের বিশ্বাস যে, গরমের সময় তাড়ি খেলে শরীর ভাল থাকে। ৩৪৯. সরু কোমর’টির গান। ৩৫০. গরীবের খাদ্য এক প্রকার শস্য। লিটি-রুটির মতো খাদ্যদ্রব্য।]
.
ঢোঁড়াইয়ের আত্মদর্শন
রামিয়ারই প্রথম নজর পড়ে, বাওয়ার কম্বলটা তো নাই। কম্বল নিয়ে কোথায় যাবে এই গরমের মধ্যে। নিশ্চয়ই কোথাও বাইরে গিয়েছে, দিন কয়েকের জন্য। তা যাওয়ার সময় বলে গেল না কেন?….
বহুদিন প্রতীক্ষার পর বাওয়া ফেরে না। কী জানি কেন, ঢোঁড়াই নিজেকে এর জন্য দায়ী মনে করে। কিন্তু সত্যিই কি সে দোষী? বাওয়ার উপর ভালবাসা তার একটুও শিথিল হয়নি; এক বিন্দুও না। বাওয়ার উপর কর্তব্যের ক্রটি সে করেনি। তার বিয়ে করায় বাওয়ার আপত্তি ছিল না। তবু সে বোঝে যে বাওয়ার চলে যাওয়ার সঙ্গে তার বিয়ের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ আছে; কিন্তু এমন দোষ সে কী করেছে যে বাওয়া যাওয়ার আগে তার সঙ্গে কোনো কথা বলে গেল না।
রামিয়া বলে- আমার জন্যই বাওয়া হয়তো চলে গেল। ঢোঁড়াই কথাটা তাড়াতাড়ি চাপা দিয়ে দেয়। সত্যি রামিয়াকে বাওয়া পছন্দ করতে পারেনি। না হলে হাতের ছোঁয়া খেল না কেন? কেন বিয়ের পর থেকে বাওয়া অন্য রকম হয়ে গেল। এই ধুলো রোদ্দুরের মধ্যে এখন কোথায় সে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে। সেই ছেলেবেলা থেকে, ঢোঁড়াই বাওয়াকে দেখেনি, এমন বোধহয় এর আগে একদিনও হয়নি। তা ছাড়া এখানে বাওয়া থাকলে, সে ছিল এক কথা; দেখা না হলেও মনের মধ্যে স্বস্তি ছিল যে, তার মাথার উপর একজন আছে। তার সংসারের বিপদ আপদের সময় বাওয়া নিশ্চয়ই এসে দাঁড়াত তার পাশে।–এইসব কথা ভাবতেই ঢোঁড়াইয়ের মন খারাপ হয়ে যায়।-চলে যাওয়ার দিন এসেছে, ঢোঁড়াইয়ের দুনিয়ায়। শনিচরটা চলে গেল ধাঙড়টুলি ছেড়ে; সেও যাওয়ার আগে দেখা করে গেল না। এতোয়ারীরা যেদিন এসেছিল, খাজনার দরখাস্তে মিসিরজীর কাছে বুড়ো আঙ্গুলের ছাপ দিতে, সে দিন তার কাছেই শুনেছে ঢোঁড়াই -এর খবর যাওয়ার আগে শনিচরা আর তার বৌয়ের কী কান্না! বাড়ি ঘর দেখে আর ডুকরে ডুকরে কাঁদে।…শনিচরা চলে যাওয়ার খবরেও সেদিন ঢোঁড়াইয়ের প্রাণের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল।…শনিচরা বলেই পেরেছে। ঢোঁড়াই তাত্মতুলি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। বড় ভাল লোকটা ছিল; দিনের পর দিন তারা একসঙ্গে কাজ করেছে পাক্কীর উপর। কাজের মধ্যে দিয়ে তারা আপনার হয়ে উঠেছিল। সে সম্বন্ধ কোনোদিন যাওয়ার নয়। এতোয়ারীই সেদিন খবর দিয়েছিল যে, সামুয়র বলেছে যে সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া টাকাটা দিয়ে সে ভাড়ার টমটম কিনবে, গরুরগাড়ি কিছুতেই না। এখন কিনলে হয় ঘোড়া আর টমটম; তার আগেই আবার নেপালে জুয়ো খেলে টাকাটা উড়িয়ে দিয়ে না আসে; সব গুণই আছে সামুয়রটার। ঢোঁড়াই ভাবে যে সকলেই তাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে, পাড়ার মাতব্বরগুলো পর্যন্ত। সেদিন চৌকিদারি খাজনার কথাটা হাকিমকে বলার পর থেকে বাবুলাল আর দুখিয়ার মা তার বাড়িতে আসে না। মহতোর তো কথাই নাই। রতিয়া ছড়িদার, আর বাসুয়া নায়েব, সেই পুলিশ আসার দিন থেকে তার সঙ্গে কথা বলে না।…থাকার মধ্যে তার কাছে রামিয়া–রামপিয়ারী। রামিয়ার মধ্যে সে নিজেকে একেবারে ডুবিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর সব কিছু, আয়নার হঠাৎ আলো পড়ার মতো মধ্যে মধ্যে সেখানে ঝলক ফেলে, আবার তখনি কোথায় তলিয়ে যায়। রামিয়ার সব ভাল। কোটা ধরার মধ্যে; তামাকের ধোঁয়াটুকু ছাড়ার মধ্যেও তার অন্য তাৎমানীদের থেকে বিশেষত্ব আছে; ভারি সুন্দর লাগে ঢোঁড়াইয়ের। আর ঠাট্টা যা করতে পারে একেবারে হাসতে হাসতে নখোদম [৩৫১] করিয়ে দেয়। ঢোঁড়াইয়ের কাছে সামুয়রকে বলে মর্কট। এমন মজার মজার কথা বলবে! মর্কটের সঙ্গে একটু নাকি তফাত করে দিয়েছেন ভগবান; অন্যমনস্কভাবে গড়তে গড়তে লাল রঙটা মুখেই পড়ে গিয়েছে ভুলে।…দুজনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই এত হাসি, এটাই ঢোঁড়াই য়ের কেমন কেমন যেন লাগে। বলে রামিয়াকে বাড়িতে থাকতে; কিন্তু কে কার কথা শোনে! চব্বিশ ঘণ্টা ফুড়ত করে উড়ে বেড়াতে ইচ্ছা করে এখানে ওখানে; হাসিমস্করা ফৌজী কুয়োতলায়; বেটাছেলে দেখলেও শরম নেই। কীরকম যেন। আর ঢোঁড়াইর জন্য সব জায়গায় জোর দেখাতে পারে; রামিয়ার কাছে সে একটু নরম। পচ্ছিমবালী মেয়ে, বুদ্ধিতে তার চাইতে বড়; কত জোর করা যায় তার উপর। কিন্তু তার মন রামিয়ার মধ্যে ডুবে থাকলেও তার দৃষ্টির প্রসার বাড়ছে আস্তে আস্তে, তার জগত্তা বড় হয়ে উঠেছে, গাড়ি বলদ কিনবার পর থেকে। পাকীতে কাজ করার সময় দূরের বাটোহীর সঙ্গে দেখা হত তার পথের উপর। এখন সে নিজেই গাড়িতে মাল বোঝাই করে কত দূরে চলে যায়, পাঁচ কোশ, পুরুবে, পশ্চিমে, কারহাগোলার গঙ্গাস্নানে, মবৈলী, কুর্বাঘাটের মেলায়। জাত পাত৩৫২ আলদা হলে কী হয়, সব জায়গায় লোকের হালত একই রকম। তবে পচ্ছিমের গাগুলোতে মহাৎমাজীর হল্লা আর পুলিশের হল্লাটা অন্য জায়গার চাইতে বেশি। এই যা। মাতব্বররা ছাড়া, পাড়ার অন্য সকলে এইসব দূর দূরান্তরের গ্রামের খবর শুনবার জন্য আসে তার কাছে, যখনি সে গাড়ি নিয়ে ফেরে।…
[৩৫১. নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ৩৫২. জাত]
.
মহোতোর বিলাপ
কিছুদিন থেকে দুনিয়া দরকারের চাইতেও বেশি তাড়াতাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে। ঘটনার পর ঘটনার আঘাত লাগছে তাৎমাটুলির সমাজে, তাৎমাদের মনে। জিনিসটা আরম্ভ হয়েছে হঠাৎ, কবে থেকে তা ঠিক মহতোর মনে নেই, এই এক সাল দেড় সাল হবে আর কী। লোকের মনে কিসের যে আগুন লেগেছে যে স্রোত এসেছে। চারিদিকে, মহতো তা বুঝতেই পারে না, তো তার সঙ্গে তাল রাখবে কী করে?
রোজ শহর থেকে নতুন খবর শুনে আসছে তত্মারা কাজে গিয়ে।…অলৌচী [৩৫৩] ঘোড়সওয়ার শহরে রাস্তায় টহল দিচ্ছে। পাদরীসাহেবরা চলে যাচ্ছে, এখন খালি একজন দেশী পাদরী থাকবে জিরানিয়াতে। কিরিস্তান ধাঙড়গুলোর বিনা পয়সার দুধ বন্ধ হয়ে যাবে রে, পাদরী সাহেবগুলো ছিল তোদের গরু, দুধ দিত। ভেউ ভেউ করে কেঁদে নে, তোদের গরু চলে যাচ্ছে।…কালোঝাষাবালী পাদরী মেমদের [৩৫৪] হাসপাতাল একেবারে সন্নাটা [৩৫৫] দেখলাম আজ। ধাঙড়টোলার ছয়ঘর কিরিস্তান আবার হিন্দু হয়ে গিয়েছে; বলেছে আর গির্জায় যাবে না; পাদরীসাহেবরা চাকরি জুটিয়ে দেবে না, তবে খৃষ্টান থাকব কিসের জন্য।…সামুয়রটাও হিন্দু হয়েছে! মিসিরজী প্রায়শ্চিত্ত করিয়েছেন তার; ভাগলপুর থেকে একজন টুপিওয়ালা সাধুবাবা এসেছেন এই কাজ করতে। প্রায় সব সাহেব চলে গেল; এইবার ধাঙড় আর কিরিস্তানগুলো মজা বুঝবে; বাঁধ এখন বাড়িতে বসে বসে রঙবেরঙের খুশবদার ফুলের তোড়া। সামুয়রের শাম্পসীটার [৩৫৬] রঙ কিন্তু চোখে ঝিকমিক ঝিকমিক করে লাগে। তশীলদার সাহেব বলতে এসেছিল যে, এবার আবার বাড়িতে বাড়িতে লম্বর৩৫৭ লিখতে হবে, তোক গোনার জন্য; সেবার তো লোক গোনবার পর গাঁয়ের আধখানা উজাড় হয়ে গিয়েছিল অসুখে; তবু মন্দের ভাল যে, বেশির ভাগই মরেছিল মুসলমান; এবারে দ্যাখ কী হয়। লোক গোনবার সময় কেউ কিছু বলিস না তশীলদারকে; করুকগে শালা যা করতে পারে; এস.ডি.ও. সাহেবের কাছে তো ওর বিরুদ্ধে চৌকিদারীর [৩৫৮] দরখাস্ত দেওয়াই আছে। কী যে হল সে দরখাস্তের তা বুঝি না। কেন, এখন যাক না ঢোঁড়াই তার পেয়ারের হাকিমের কাছে; এ কথা বললেই অনিরুদ্ধ মোক্তার বলে যে, মহাৎমাজীর হল্লার মধ্যে হাকিমের সময় নেই এসব দেখবার; যেমন সরকার তেমনি হাকিম, ঠিকই বলে মহাৎমাজীর চেলারা।…সমাজে কেউ কথা মানবে না; কারও কথা কেউ শুনবে না, কী করে সমাজ চলবে? ঢোঁড়াইয়ের দল বলে- কার কথা শুনব? ঐ রতিয়া ছড়িদারের আর বাসুয়া নায়েবের? দুটোই তো দফাদারের খুফিয়া। [৩৫৯] ছড়িদার আর বাসুয়া শুনছি আবার মাস্টারসাহেবের বেটার খেলাপে হাকিমের কাছে সাক্ষী দেবে। মাস্টারসাহেবের বেটা নাকি কলালীতে কার মাথায় মদের বোতল দিয়ে মেরেছে; ওরা নাকি তাই স্বচক্ষে দেখেছে। ঢোঁড়াইয়ের দল তাই তাদের উপর ক্ষেপে আছে! আরে রতিয়া ছড়িদার তো কোন ছার! আমি মহতো, আমরাই হাতের তেলের শিশি আনবার সময় তারা শুঁকে দেখল; বলে যে গুদরের মায়ের জন্য তেলের শিশিতে তুমি রোজ সাঝে কী কিনে নিয়ে আস সবাই জানে। এই হল সমাজের ব্যবহার তাদের মহতোর সঙ্গে। আমার সঙ্গে আসিস ফুটানি ছাঁটানে; কর দেখি দফাদার সাহেবের সঙ্গে লড়াই, তবে না বুঝি হিম্মৎ! দেওয়া দেখি ডিস্টিবোডের ফৌজি ইঁদারাটার বিয়ে, তবে বুঝব বুকের পাটা।…এই সেদিন বাবুভাইয়াদের কাছে কী অপ্রস্তুত হতে হল পাড়ার লোকদের জন্য! এবার দশারায় [৩৬০] ভগবত্তির মুরতের ঘরে তাৎমা ধাঙড় চামার দুসাদ সকলকেই যেতে দিয়েছিল; বাবুভাইয়াদের ছেলেরা ডেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন সকলকে কেবল ছত্তিস বাবুর বুড়হিয়া মাই যখন পূজো চড়াচ্ছিলেন তখন ছত্তিস বাবুর বেওয়া বহন [৩৬১] একখানা ইয়া মোটা সজনের ডাল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যতক্ষণ বুড়ি মাইজির পূজো না হয় ততক্ষণ তাৎমা ধাঙড় দুসাদ কেউ এসেছে কি পিঠে ভাঙব এই ডাল। ঢোঁড়াইরা দল বেঁধে চলে এসেছিল সেখান থেকে। বাবুভাইয়াদের ছেলেরা পরে তাৎআটুলিতে খোশামোদ করতে এসেছিল। আবার তাদের নেওতা [৩৬২] দিয়ে যেতে এসেছিল। আমি কত বোঝালাম বাবুভাইয়াদের বলছে সকলে! কখনও তো উঠতে পেতিস না ভগবত্তি থানে [৩৬৩] এবার উঠতে পেয়েছিস। কোন মাইজী পান চিরে দু-টুকরো করেছে৩৬৪ আর অমনি অনথ বধিয়ে তুললি। আরে ঢোঁড়াই তুই রাজী হলেই তোর এই হাঁ তে হাঁ মিলানেবোলা [৩৬৫] সাগরেদগুলো এখনই রাজী হয়। এই কথায় ফোঁস করে উঠলো সবগুলো। আচ্ছা বাবা যা ভাল বুঝিস তাই কর। বাবুভাইয়াদের কাছে তোদের টোলার ইজ্জত খুব রাখলি বটে! আবার আমাকে শোনানো হল যে, রতিয়া ছড়িদার। মহাৎমাজীর চেলার খেলাপে সাক্ষী দেবে, তাতে টোলার ইজ্জত বাড়বে? সেটা বন্ধ করার মহতো তুমি না, আর বাবুভাইয়াদের পা চাটাবার মহতো তুমি।
–না, না, মহতোগিরিতে না আগেকার মতো পয়সা, না আছে সম্মান, না আছে এক মুহূর্তের শান্তি।- নায়েব ছড়িদারদের পর্যন্ত কিছু ঠিকঠিকানা নেই। তাদের মধ্যে কে যে কখন কোন দিকে বোঝা দায়। রামিয়ার সেই লোটা নিয়ে ময়দানে যাওয়ার ব্যাপারে সবাই চলে গিয়েছিল মহতোর বিরুদ্ধে; সেইজন্যই মহতো সে কথাটাই পাড়েনি পঞ্চায়েতে। চৌকিদারী ট্যাকসের ব্যাপারে সব নায়েবই বাবুলালের বিরুদ্ধে। মোকদ্দমায় সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারে সব নায়েবই ছড়িদার আর বাসুয়ার বিরুদ্ধে। এখন কাকে হাতে রাখব? কাকে সঙ্গে নিয়ে চলব? আর সমস্যা কি একটা। তাৎমাটুলি থেকে লোক চলে যাচ্ছে। বতুয়ার বোনটা মুসলমানের সঙ্গে চলে গেল। হারিয়া মেয়েটার বিয়ে দিয়ে এসেছে মালদা জেলায়, টাকার লোভে। আর বলেছে যে সেইখানেই চলে যাবে চাষবাসের কাজ করতে। আমার নিজের ছেলে গুদব, সে আজ আরম্ভ করেছে মুঙ্গেরিয়া তাৎমা রাজমিস্ত্রীদের যোগান দেওয়ার কাজে। সেই হয়তো চলে যাবে মুঙ্গেরিয়া তাৎমাদের গাঁ মারগামায়।–মুঠো থেকে সব পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে। কাকে সে আটকাবে? এই যে হরখুর বাপটা- যেটা ধোদলের ফুলে ভরা মাচাটার পাশে তেল মেখে ল্যাটা হয়ে পড়ে থাকত সারাদিন, তাঁকে গোঁসাই টেনে নিয়েছেন কদিন হল। বড় ভাল হয়েছে- তাৎমাটুলির বুড়োবুড়ি তো মরতে জানে না। ডাইনের জোর ছোট ছেলেপিলেদের উপরই খাটে কি না! পৈতা নেওয়ার পর থেকেই ঢোঁড়াইয়ের দল চেঁচামেচি করছে যে, তেরহমা করবে, তিরসা নয়৩৬৬। বড়ো তোক না মরলে গাঁ-সুদ্ধ লোক মাথা নেড়া করার সুযোগ পায় না। এতদিনের মধ্যে এক কেবল মরেছিল বুড়ো মহাবীরা, তা সে সাপের কামড়ে। তাই তার কিরিয়া করম কিছু দরকার হয়নি। এইবার এই ঢোঁড়াই শয়তানটার দল গোলমাল পাকাবে তেরো দিনের দিন। সেটা হতে দিচ্ছি না। কিসে থেকে কী হয় তার খবর রাখিস, এদিকে তো খুব ফরফর ফরফর করিস তোরা। পিতৃপুরুষের জল চড়ানোতে একটু-ওদিক হয়েছে কি উদ্বাস্তু হয়ে যাবি সকলে, ঘরবাড়িতে বিনা আগুনে আগুন লেগে যাবে, কালো টিকের মতো দাগ হবে প্রথম চালে, তারপর দেখবি সেখান থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে; তাদের ঘাটাস না। আগে লেজ তুলে দ্যাখ এঁড়ে কি বকনা, তবে না কিবি। মহতো থই পায় না; এক বছরের মধ্যে সে এত বুড়ো হয়ে পড়ল নাকি? যাকগে, মরুকগে, যা হবার তা হবেই। তুমহসন মিহি কি বিধি কে অঙ্কা ৩৬৭। তোমার জন্য কি বিধাতার লেখা বদলাবে?- পঞ্চায়তির জরিমানার টাকার হিসাব চায় গাঁয়ের লোক! আশ্চর্য! রাতারাতি বদলে যাচ্ছে। তাৎমাটুলি। মরনাধারে বালির মধ্যে যেমন তার পা ধসে যাচ্ছে।
হঠাৎ রতিয়া ছড়িদারের বৌ চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় করে। মহতো উঠে দাঁড়ায়। মহতোর দুদণ্ড নিশ্চিন্দি হয়ে বসবার জো নেই আজকাল। নিশ্চয় ছড়িদার বৌকে মারছে, আগুন-টাগুন লাগলে তো দেখাই যেত।
সকলে দৌড়ে যায় রতিয়া ছড়িদারের বাড়ি। তার বৌ কুপী ধরে সকলকে দেখায় যে ছড়িদারের ভুরুর উপর খানিকটা কেটে গিয়েছে। এখনও অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। একটা বাঁশে হেলান দিয়ে বসে আছে। সে শহর থেকে ফিরছিল; একটু বেশি রাত করেই সে আজকাল ফেরে। যেই শহরের বাইরে কপিলদেওবাবুর আমবাগানটায় পৌঁছেছে, অমনি অজস্র ঢিল তার উপর এসে পড়তে আরম্ভ করে।–ছড়িদার কোনো লোককে দেখতেই পায়নি, তা চিনবে কী? তবে পায়ের শব্দ সে শুনেছে।
-মহাৎমাজীর চেলারা মাছ মাংস পিয়াজ রসুন খায় না। তারা কি কখনও কারও গায়ে হাত তুলতে পারে?-এই আবার এক নতুন কাণ্ড হল পাড়ার মধ্যে! দেখিস ছড়িদার, তুই আবার দফাদারকে এসব বলিস না যেন।–থানা-পুলিশের কথা ভাবলেই মহতোর বুক শুকিয়ে যায় ভয়ে-নিশ্চয়ই ঢোঁড়াইয়ের দলের কাণ্ড এটা! কিন্তু ঢোঁড়াই-ঢোঁড়াই সকলকেই তো দেখছি এখানে।-ছড়িদারের বৌ তখনও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে-হারামীর দলের সব কটাকে হাতে হাতকড়া পরাব।-বাইরে ঠুনঠুন করে ঘোড়ার গলার ঘণ্টার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। সামুয়রটা গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরছে; এই তাৎমাটুলির পথ দিয়েই সে .জি ফেরে, মদের দোকান বন্ধ হওয়ার পর। ওঃ! তাহলে অনেক রাত হল। চল চল সকলে। ছড়িদারকে ঘুমুতে দে। শ্যাওড়া গাছের দুধ লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে কাটাটার উপর; কালই শুকিয়ে যাবে ঘা।
[৩৫৩. বেলুচি। ৩৫৪. কালো- ঘাঘরা-পরা পাদরী মেম। ৩৫৫. খালি, চুপচাপ। ৩৫৬, জিরানিয়ার ভাড়া গাড়ির নাম। ৩৫৭. নম্বর (আদমশুমারীর)। ৩৫৮. চৌকিদারী ট্যাক্সের। ৩৫৯, গুপ্তচর। ৩৬০ দশহরা বা দুর্গাপূজায়। ৩৬১- সতীশবাবুর বিধবা ভগ্নী। ৩৬২ নিমন্ত্রণ। ৩৬৩- বাঙালীদের দুর্গামণ্ডপ। ৩৬৪- স্থানীয় ভাষায় পান চিরে দু টুকরো করা- বাঙায় পান থেকে চুন খসা এই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ৩৬৫. যারা সব কথায় সারা দেয়। ৩৬৬, শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্মাদি মৃত্যুর তেরো দিনের দিন করবে না ত্রিশ দিনের দিন, তাই নিয়ে পৈতা নেওয়ার পর তাম্র সমাজে বেশ মতদ্বৈত হয়। এতদিন থেকে ত্রিশ দিনের দিন কাজ করাই চলে আসছিল। নতুন দ্বিজ হবার পর স্থানীয় সকল জাতের মধ্যেই এই বিষয় নিয়ে দলাদলি, মারামারি, থানা-পুলিশ পর্যন্ত হয়েছে! নতুনের দল তেরো দিয়েই কাজ করতে চায়, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের মত। ৩৬৭. তোমার জন্য কি বিধাতার লেখা বদলাবে।]
.
তাৎমাটুলিতে ডাকপিয়নের দৌত্য
হিন্দু হওয়ার পর থেকে সামুয়রের সম্মান বেড়েছে তাৎমাটুলিতে, নাহলে ঘোড়ার গাড়ির মালিক হলেও কিরিস্তানকে কে পোঁছে। মহতো আর নায়েবরাও জল্পনা-কল্পনা করে, এক সময় তো হিন্দু ছিলো ওরা। জাত কি কারও যাওয়ার জিনিস। সোন অ নহী জরইছে,৩৬৮ সোনা জ্বালালে পরিষ্কারই হয় আগের চেয়ে লোকটাকে যত খারাপ মনে করত সকলে আগে, আসলে সে তত খারাপ নয়। সে সকালে যখন গাড়ি নিয়ে শহরে যায়, তখন মহতো, নায়েব, ছড়িদার, যার সঙ্গে দেখা হয় পথে, তাকে গাড়িতে চড়িয়ে নেয়। আর আগে তাৎমাটুলির কেউ কোনদিন জীবনে ঘোড়ার গাড়িতে চড়েছিল? তাৎমা ছেলেমেয়েরাও গাড়ি চড়ার জন্য পাগল। কিরিস্তান সামুয়রটা আজকাল সকলের সামুয়রভাই [৩৬৯] হয়ে উঠেছে। মহতোগিন্নী পর্যন্ত এক দিন তাকে আমলকীর আচার খাইয়েছে। গাড়ি নিয়ে শহরে যাওয়ার আর ফিরবার সময় সে তাৎমাটুলি হয়েই যায়; আর সকলের সঙ্গে খুব আলাপ জমাতে চায় সে আজকাল। পাদরী সাহেবের সম্বন্ধে এমন সব রসের গল্প করে যে সকলে হেসে ফেটে পড়ে।
না, তুই বানিয়ে গল্প করছিস সামুয়র।
তবে শোন আর একটা। এই বলে সে কালো-ঘাঘরা-পরা মেম-পাদরীদের নিয়ে আর একটা অবিশ্বাস্য গল্প বলে।
সে যখনি গাড়ি নিয়ে এ-পথ দিয়ে যায়, একবার হেঁকে যায়- ঢোঁড়াই বাড়ি আছিস নাকি?
রামিয়া ভিতর থেকে জবাব দেয়, না, সে গরুর গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে সেই সক্কালে; এখনও ফিরবার নাম নেই।
ঢোঁড়াই কাজে বেরিয়েছে কিনা, তা বাড়ির বাইরে গাড়ি-বলদ আছে কি নেই, দেখলেই বোঝা যায়। তবু তার একবার জিজ্ঞাসা করা চাই-ই চাই, জিনিসটা মহতোগিন্নীর চোখেও কেমন যেন ঠেকেছে।
সামুয়রের এত মাখামাখি ঢোঁড়াইয়ের ভাল লাগে না। মজার মজার গল্প বলে সামুয়র যে রকম রামিয়াকে হাসাতে পারে, তেমনিটি ঢোঁড়াই পারে না। এ কথা ঢোঁড়াই বোঝে, আর মনে মনে সংকুচিত হয়ে যায় এর জন্য-তার গল্প শুনে রামিয়া হেসেছে বলে ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়ে না; অথচ সামুয়রটা এমন করে গল্প বলে যে রামিয়া শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ে। এতটা বাড়াবাড়ি ঢোঁড়াইয়ের ভাল লাগে না। সামুয়রটা ছেলেবেলা থেকে সাহেবদের ওখানে কত আণ্ডা চিড়িয়া উড়িয়েছে [৩৭০] বোধ হয়। সে কথা মনে করলেই ঢোঁড়াইয়ের গা ঘিনঘিন করে। রসুন হজম হওয়ার পরও ঢেকুরে রসুনের গন্ধ থাকে, আর ঐ সামুয়রটা কত অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়েছে আগে; তার কি আর কিছু ওর শরীরে এখনও নেই। আর সেটাকে নিয়ে এখন অত মাখামাখি।
রামিয়াটা আবার একা-একা রয়েছে।
ছড়িদারের বাড়ি থেকে ঢোঁড়াই কত কী ভাবতে ভাবতে আসে।
বাড়ির দুয়ারে সামুয়র গাড়ি থামিয়েছে। তাই হঠাৎ ঘোড়ার গলার ঘুঙুরের শব্দটা আর শোনা যাচ্ছিল না।
রামিয়াই প্রথম কথা বলে, এই শোনো এর কাছ থেকে; ডাকপিয়ন তোমাকে খুঁজছিল।
ডাকপিয়ন, কেন?
সামুয়র বলে, ডাকপিয়ন তাকে ঢোঁড়াই দাসের কথা জিজ্ঞাসা করছিল শহরে। তোমার নামে মানি আটার [৩৭১] আছে।
মানি আটার?
হাঁ, হাঁ, টাকা।
ডাকপিয়নে আবার টাকা দেয় নাকি? ঢোঁড়াই কী করবে ভেবে পায় না। টাকা কে পাঠাবে? কত টাকা, তাও সামুয়র বলতে পারে না। কেবল ডাকপিয়ন জিজ্ঞাসা করছিল তাই বলতে পারি।
সামুয়র চলে গেলে রামিয়া জিজ্ঞাসা করে, বাওয়া পাঠায়নি তো?
সকলেরই সে কথা মনে হয়েছে, ঢোঁড়াই আর সামুয়রেরও! টাকার কথা উঠলে ঢোঁড়াইয়ের অন্য নাম কি মনে পড়তে পারে? ঢোঁড়াই কেন, সব তাৎমাই জানে যে, রোজগার করে হয় আনা-টাকা নয়। আর টাকা আসে লোকের দৈবাৎ- রামজীর কৃপাদৃষ্টি হলে। বাওয়া পাঠিয়েছে নিশ্চয়ই, বাওয়া এখনও তাকে মনে রেখেছে তাহলে।
তাৎমাটুলিতে সাড়া পড়ে যায়-মানি-আটার মানি-আটার! মহতো নায়েবদের বুকের ভিতরে করকর করে- ঢোঁড়াই টা আরও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল বুঝি এবার। ডাকিয়া [৩৭২] আনল ঢোঁড়াই পাড়ার ভিতর।
উঠোন-ভরা ঝোটাহার দল সসম্ভ্রমে রামিয়ার গল্প শোনে। সে রাত্রে রামিয়া কি ঢোঁড়াই, কেউই ঘুমুতে পারে না। সারারাত তারা টাকার কথা, আর বাওয়ার কথা বলে কাটিয়ে দেয়।
দিনকয়েক পরে ডাকপিয়ন আসে সেই সন্ধ্যাবেলায়। মিসিরজী তখন পিয়নের জন্য অপেক্ষা করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ি ফিরবার যোগাড় করছেন। বাবুলালের বাড়ি থেকে কাজললতা আসে। পিয়ন তিনটি টাকা থলির ভিতর থেকে বের করে দেয়, আর মানি-আটার ছিঁড়ে একটুকরো কাগজ দেয়।
ওলায়তী লণ্ঠনের [৩৭৩] জন্য বাওয়া তিন টাকা পাঠিয়েছে অযোধ্যাজী থেকে। আর কিছু লেখা নেই কাগজে। বাওয়ার হাতের ছোঁয়া চিঠি- ঢোঁড়াই কত রকমে উলটে পালটে দেখে- বাওয়ার জটার গন্ধ পাওয়া যায় কিনা তাতে। তারপর সযত্নে সেখানা রামিয়ার তৈরি বেনাঘাসের কাঠাতে রেখে দেয়।
মহতো বলে, বড় খরচার রাস্তা-অর্থাৎ লণ্ঠন জ্বালতে বড় খরচ। বাওয়া তোর ভাল করল কি মন্দ করল বলা শক্ত।
ছড়িদার সায় দেয় যাকে জেরবার করতে হবে, তাকে নাচিয়ে দেয় জমিদারবাবুরা। তারপর সামলাও তার খরচা।
হারিয়ার ছেলে, হাঁ এসব পঞ্চায়েতের তরফ থেকে কিনে রাখবার জিনিস। তাহলে দশের কাজে-কর্মে একটু উপকার হয়। ফোঁস কবে ওঠে ছোঁকবার দল। আরে রাখ। পঞ্চায়েতের সতরঞ্চি কিনবার কথা আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, তা আজ পর্যন্ত কেনা হল না। আর ওলায়তী লাস্টেম জ্বালিয়া–যুগিরা আর বলবাহী৩৭৪ নাচ নাচবে পঞ্চরা। এত টাকা জরিমানা ওঠে, কী কী হয় সে সব?
মহতো এ প্রসঙ্গ চাপা দিতে চায়।
ঢোঁড়াই, তাহলে একটা ভাল করে দেখেশুনে লণ্ঠন কিনিস। কাঁচটা বাজিয়ে নিবি-ঠনন। ঠনন।
আমি কি অত শত চিনি? তা তোমরাই চল না কেন মহতো নায়েবরা, কাল সকালে বিলিতি লণ্ঠনের সওদা করে দিতে।
রতিয়া ছড়িদার তার ফ্যাটা-বাঁধা ভুরুর নিচের চোখটা দিয়ে মহতোকে কী যেন ইশারা করে।
না না, কাল সুবিধে হবে না আমাদের। একটা কাজ আছে।…
–আরে ফটফট করিস না, তোরা আমার হাঁটুর বয়সী। আমার মাথার চুলটা রোদ্দুরে পাকেনি। আমাদের সরাতে চাচ্ছিস কাল সকালে হরখুর বাপের তেরহাঁ[৩৭৫] করার মতলবে; সেটুকু আর বুঝি না?…
ঢোঁড়াই, তুই-ই বরঞ্চ যাস সামুয়রের গাড়িতে, কাল ভোরে ও যখন কাজে যাবে। ও সাহেবদের বাড়িতে কত ওলায়তী লাল্টেম জ্বালিয়েছে আর ছত্তিসবাবুর দোকানে গাড়িতে করে গেলে জিনিসটা দেবে মজবুত।
[৩৬৮: সোনা জলে না- সোনা জ্বালালে আরও পরিষ্কার হয় এই অর্থে ব্যবহৃত হয়। ৩৬৯. সামুয়র দাদা। ৩৭০. মুরগীর ডিম আর মাংস খেয়েছে। ৩৭১. মানি-অর্ডার। ৩৭২- ডাকপিয়ন। ৩৭৩, বিলাতী লণ্ঠন (ডিজ লণ্ঠন)। ৩৭৪. যুগীরা আর বলবাহ দুইরকম পল্লীনৃত্যের নাম। ৩৭৫- মৃত্যুর তেরো দিনের দিন শ্রাদ্ধাদি করার নাম তেরহাঁ।]
.
তেরহাঁ তিরসার দ্বন্দ্ব
মহতোর কথামতো ঢোঁড়াই সামুয়রের সঙ্গে লণ্ঠন কিনতে যায় বটে; কিন্তু সকালে নয়, বিকেলের দিকে। সকালবেলা কি ঢোঁড়ই যেতে পারে? বুড়োরা নিজেদের যতই চালাক ভাবুক, তারা আঙুল উঠোলেই [৩৭৬] ঢোঁড়াইয়ের দল তাদের মতলব বুঝতে পারে।
যাস না ঢোঁড়াই খবরদার সকালের দিকে। তাহলে পাঁচ-পাঁচটা বুনো মোষের তাল সামলানো-পাঁচটা কেন, ছড়িদারকেও ধর, ছটা- সে আমাদের দ্বারা হয়ে উঠবে না। পরের দিন সকালে ঝগড়া-ঝাঁটি, গালাগালির মধ্যে মাথা নেড়া করবার পর্ব শেষ হয়। তাৎমানের কিরিয়াক এর নাপিত পূরণকে মহতো নায়েবরা বারণ করে দিয়েছিল, হরখুর বাপের তেহতে কারও মাথা নেড়া করতে। ঢোঁড়াই ধরে নিয়ে আসে মরগামার নাপিতের ছেলেটাকে।
–সে ছোকরা নাপিতটা কি ঢোঁড়াই না থাকলে আর কারও কথা শুনত!- ঢোঁড়াই গাড়ি বোঝাই মাল নিয়ে গিয়েছিল কুশী স্নানের মেলায়। মেলায় দেখা এই নাপিতের ছেলেটার সঙ্গে। তার মেলাতে কেনা চাক্কী [৩৭৭] ঢোঁড়াই ঠিক করে রেখেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দরকার হয়নি। মিসিরজী রাজী হয়ে গিয়েছিল পূজো করাতে। রতিয়া ছড়িদার মিসিরজীকে ভয় দেখিয়েছিল যে থানে রামায়ণ পাঠ বন্ধ করিয়ে দেবে। ঢোঁড়াই জবাবে বলেছিলে, দফাদারকে বলে করাবে নাকি রামায়ণ পাঠ, ছড়িদার? সকলে হেসে ওঠায় ছড়িদার আর ভাল করে কথাটার উত্তর দিতে পারেনি।
ভাগ্যে সামুয়রের সঙ্গে গিয়েছিল লণ্ঠন কিনতে ঢোঁড়াই। না হলে তো ঠকেই মরেছিল- সামুয়র সঙ্গে ছিল বলেই না, সে বলে দেয় যে পলতেটাতে বড় ঠকায় দোকানদারেরা; নীল কোর [৩৭৮] ওয়ালা পলতে নিবি। সেই রাতে সামুয়র বিলাতী লণ্ঠনটি জ্বালিয়ে দেয় ঢোঁড়াই য়ের বাড়িতে। ভিড় বেশি হয়নি। মহতো নায়েবের দল চটে আছে; তারা ঢোঁড়াইয়ের বাড়িতে আসিতেই পারে না। আর ঢোঁড়াইয়ের দল ছিল হরখুর বাড়ি, তেরহাঁর ভোজের আয়োজনে ব্যস্ত।
রামিয়া বলে, একবারে দিনের মতো আলো হয়েছে, না?
সামুয়র ঢোঁড়াইকে বলে- এমন আলো কিনলি ঢোঁড়াই একেবারে দোকানের আলো। এবার খুলে দে একটা দোকান। তোর বৌ হবে মুদিয়ানী; সওদা ওজন করবে, রামে রাম, রাম; রামে-দো দো; দুয়ে তিন তিন
রামিয়া হেসে লুটিয়ে পড়ে।
সামুয়রের এসব রসিকতা ঢোঁড়াইয়ের একটুও ভাল লাগে না। কিছু বলতেও পারে না; এত কষ্ট স্বীকার করে লণ্ঠন পছন্দ করে দিয়েছে। বাওয়ার কথা ঢোঁড়াইয়ের মনে পড়ছে। তারই দেওয়া বিলাতি লণ্ঠন ঢোঁড়াইয়ের আঙিনা আলো হয়ে গিয়েছে। তারই দেওয়া তো সব-বাড়ি, ঘর, গাড়ি, বলদ, রামিয়া, ঢোঁড়াইয়ের আপন বলতে যা-কিছু আছে এ দুনিয়াতে। রামজীর রাজ্যে গিয়েও বাওয়া তাকে ভুলতে পারেনি। আর সে বাওয়ার কথা কদিন ভেবেছে? এই সামুয়রের কথায় খিলখিল করে হাসা মেয়েটার জন্য গেল এক মাসের মধ্যে তার একবার গোসাই থানে যাওয়ার কথাও মনে পড়েনি।
–আগে দেখেছি, এ মেয়ের থানে পিদিম দেওয়ার সে কী ধূম। এখন সে কথা মনেও পড়ে না। না, না, মিছিমিছি সে রামিয়ার উপর দোষ দিচ্ছে; উঠোনের তুলসীতলায় তো সে রোজই পিদিম দেয়। বাড়ির বাইরে যেতে তো সেই মানা করে রামিয়াকে।
সামুয়র কী যেন একটা মজার গল্প করছে। রামিয়াটা হাঁ করে গিলছে কথাগুলো। ঢোঁড়াই যদি অমন গল্প করতে পারত।
হঠাৎ সে আলো নিয়ে ওঠে।
যাই বাওয়ার থানে একবার আলোটা দেখিয়ে, তারপর ওটা নিয়ে যেতে হবে হরখুর বাড়ির ভোজে। বাওয়ার দেওয়া জিনিসটা দশজনের কাজে লাগুক।
–পাড়ার লোককে নিজের বিলাতী লণ্ঠন দেখানোর ইচ্ছার কথাটা সে মনে মনেই রাখে।
অনেক লোক এসেছে হরখুর বাড়ির ভোজে। আট বাঁশের বাতি৩৭৯ লোক খেতে বসেছে! আরও জনকয়েক পরের দলে খাবে। মহতো নায়েবদের এরকম পরাজয়ের কথা ঢোঁড়াই কল্পনাও করতে পারেনি। ঢোঁড়াইয়ের জয়জয়কার। তারই নাম সকলের মুখে। তারই আনা নাপিত, তারই বিলাতী লণ্ঠন, সে-ই তো সব, বাকি লোকেরা তো পাহাড়ের আড়ালে আছে।…সকলের মুখে তার প্রশংসা শুনতে শুনতে ঢোঁড়াইয়ের নিজেকে মহতোর সমান বড় মনে হচ্ছে। চোখের সম্মুখে স্বপ্নরাজ্যের ছবি ভিড় করে আসছে- মহতো মারা যাওয়ার পর তাকে পাড়ার লোকেরা মহতো করেছে? সে জরিমানার পয়সা দিয়ে তাত্মাাটুলীর জন্য সতলঞ্চি কিনেছে; দলের জন্য ঢোলক। কিনেছে; ভোজের জন্য প্রকাণ্ড কড়াই কিনেছে; রতিয়া ছড়িদারকে বরখাস্ত করে হরখুরকে ছড়িদার করেছে; বাওয়া এসে দেখবে যে তার ঢোঁড়াই গাঁয়ের মহতো হয়েছে; রামিয়াটাকে আবার সকলে ডাকবে মহতোগিন্নী বলে; সত্যিই গিন্নি হয়ে উঠেছে সে আজকাল।…
হঠাৎ মনে পড়ে যে, সে বেচারি রয়েছে ঘরে। তার মন উসখুস করে।
আঁচানোর পর ঢোঁড়াই বলে, আলোটা থাক এখন এখানে। পরের খাওয়ার সময় লাগবে।
ঢোঁড়াইয়ের আর তর সইছে না–সকলে হেসে ওঠে।
[৩৭৬, তারা কথা বলবার আগেই ঢোঁড়াইরা তাদের দুরভিসন্ধি বুঝতে পারে-এই রূপ অর্থে স্থানীয় ভাষায় ব্যবহৃত হয়। ৩৭৭. ভাতা। ৩৭৮. বর্ডার; নীল বর্ডারযুক্ত। ৩৭৯- সামাজিক ভোজের পঙক্তিতে ভোজের সময় একখানি করে সরু বাঁশের পাতা দেওয়া হয়। এর উপর পা রেখে সকলে উবু হয়ে বসে।]
.
তেরহাঁ যজ্ঞের কুলপতির স্ত্রী নিগ্রহ
ঢোঁড়াই হনহন করে বাড়ির দিকে আসছে। ভোজবাড়ি চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে অল্প অল্প। বেশ কুয়াসা হয়েছে চারিদিকে। কার্তিক মাস শেষ হয়ে গিয়েছে; পরসু বুঝি ছট পূজো [৩৮০]। রামিয়া হয়তো এতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে; একা একা কতক্ষণ আর জেগে বসে থাকে। পায়ের নিচে বালি বেশ ঠাণ্ডা; শিশির পড়ে পথের ঘাস ভিজে উঠেছে। গা শিরশির করছে ঠাণ্ডায়। হাতে তার ভোজবাজির মুখশুধ-[৩৮১]। ঘুমন্ত রামিয়ার মুখের মধ্যে সে এক টুকরো দিয়ে তারপর তাকে জাগাবে। ওটা কী সম্মুখে! হাতির মতো প্রকাণ্ড! তাই বল! গাড়ি, সামুয়রের! ঘোড়াটা খুলে রেখেছে; পথের ধারে চলছে। সামুয়র তাহলে যায়নি। এত রাতেও এখানে। তার রক্ত গরম হয়ে ওঠে। সেই সন্ধ্যায় এসেছে, এখনও গল্প করছে। একটু চক্ষুলজ্জাও তো থাকা উচিত। এত বুদ্ধি, আর এটুকু খেয়াল নেই রামিয়ার? পাড়ার লোকে কী বলবে; সামুয়রের মতো লাখেরার [৩৮২] সঙ্গে একা গল্প করা এত রাত পর্যন্ত? দোরগোড়া থেকে দেখে যে উঠোনে কেউ নেই। তাদের গল্প শোনা যাচ্ছে। কথার একবিন্দুও বোঝা যায় না। রামিয়ার হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে, সেই খিলখিল করে হাসি।
ঢোঁড়াইকে নিয়েই হয়তো হাসাহাসি করছে।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে ঢোঁড়াই দেখে যে তারা দাওয়ার উপর বসে গল্প করছে। তুলসীতলার পিদিপের ঝাপসা আলোতে তাদের পরিষ্কার দেখা যায় না। ঢোঁড়াই ঢুকতেই সামুয়র উঠে দাঁড়ায়। তোর বৌকে পাহারা দিচ্ছিলাম। এই আসছে তো এই আসছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছি কি এখন থেকে। বিলাতী লণ্ঠনটা যে রেখে এলি দেখছি?
ঢোঁড়াই তার কথার জবাব দেয় না। গম্ভীর ভাবে মাটির কলসী থেকে জল নিয়ে পা ধুতে বসে।
আচ্ছা, আমি যাই তাহলে এখন। অনেক রাত হয়েছে।
ঢোঁড়াই বা রামিয়া কেউ উত্তর দেয় না।
সামুয়রের সঙ্গে গল্প করলে ঢোঁড়াই চটে, এ কথা রামিয়া ভালোভাবেই জানে। কতদিন এ সম্বন্ধে ঢোঁড়াই তাকে বলেছে। রামিয়া সেসব কথা গায়ে মাখেনি। আজ কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের ভাব একটু যেন বেশি গম্ভীর লাগে রামিয়ার। রামিয়া মনে মনে হাসে। শোবার পর একটু ভাল করে গল্প করলেই রাগ পড়ে যাবে বাবুর।
সামুয়র চলে যাওয়া মাত্র ঢোঁড়াই গটগট করে ঘরে ঢোকে।
রামিয়া।
গলার স্বরেই রামিয়া বোঝে যে তার আন্দাজ থেকে আজ রাগটা একটু বেশি; তোরহাঁর লড়াই জিতে এসেছে কি না তাই।
ফের যদি সামুয়রের সঙ্গে কথা বলতে কোনোদিন দেখি, তাহলে খাল [৩৮৩] ছিঁড়ে নেব।
কেন?
আবার বলা- কেন! ঢোঁড়াইয়ের সর্বাঙ্গে আগুন লেগে যায়। রামিয়ার চুলের খুঁটি ধরে তার মুখে মাথায় কয়েকটি চড়চাপড় মারে। পচ্ছিমা মিসিরজির মতো কথা, আর তাৎমাটুলির ঝোটাহার মতো চালচলন। মুখে জবাব! গরুর চাবুক মেরে ঠাণ্ডা করে দেব। উঠোনে মানাল না, দাওয়ায় উঠে ঢলাঢলি করছিলে এতক্ষণ।
রামিয়া প্রথমটা হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। ঢোঁড়াই যে তার গায়ে হাত তুলতে সাহস করবে, সে কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সে উঠে দাঁড়ায়। আমাকে তোমাদের এখানকার ভুচ্চর [৩৮৪] তাৎমাদের খুরপিধরা, কমজোর ঝোটাহা ভেব না। বাওয়ার পয়সার ফুল তাথি [৩৮৫] ভিখমাঙ্গার [৩৮৬] পয়সা হয়েছে। আর বাবুভাইয়াদের মতো বৌকে বন্ধ রাখতে সাধ গিয়েছে। তা করতে গেলে বাবুভাইয়াদের মতো ব্যবহার শিখতে হয়…গালি দিতে দিতে রামিয়া বাড়ির বাহির হয়ে যায়। এমন মরদের ঘর করতে বাপ-মা শেখায়নি…
তোর মা-বাপের কথা ঢের জানা আছে! থাকগে যা না সামুয়রের সঙ্গে। খানিক পরেই তো আবার কুত্তীর [৩৮৭] মতো ফিরে আসবি জানি।…
গুটি গুটি পাড়ার লোক জমতে আরম্ভ করে। তাৎমাটুলিতে সব বাড়িতেই এমনি নয়। বিশেষ করে ধানকাটনীর আগে ঝোটাহাদের উপর মারধরটী একটু বেশি বাড়ে। পাড়ার লোকজন এসে দুজনকে থামিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে দুজনেই দিব্যি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে, যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু ঢোঁড়াইয়ের বাড়িতে মারধর এই প্রথম, তাই প্রতিবেশীদের মধ্যে কৌতূহল বেশি। কারও প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঢোঁড়াই শুয়ে পড়ে। পাড়ার লোকের কথাবার্তা থেকে জানতে পারে যে, রামিয়া রবিয়ার বাড়ি গিয়ে খুব চেঁচামেচি করছে। কিছুক্ষণ পরই ঢোঁড়াইয়ের আঙিনা খালি হয়ে যায়।
কুয়াশা আরও ঘন হয়ে তাৎমাটুলির বুকে চেপে বসে।
[৩৮০. ষষ্ঠি এবং সূর্যের পূজা। ৩৮১. মুখশুদ্ধি, সুপারি কিংবা পান। ৩৮২- লক্ষ্মীছাড়া। ৩৮৩, চামড়া। ৩৮৪, জানোয়ার। ৩৮৫. হাপড়। ৩৮৬- ভিখারী। ৩৮৭. কুক্কুরী।]
.
অগ্নিপরীক্ষা
পরদিন সকালেও রামিয়া এল না দেখে শেষ পর্যন্ত ঢোঁড়াই রবিয়ার বাড়িতে যায়। অনুশোচনায় তখন তার মন ভরে গিয়েছে। ঝোঁকের মাথায় কী কাণ্ডই সে করে ফেলেছে রাতে! কাল আবার ছটপরব। আজ রামিয়ার উপোস। রাত্রে রামিয়া খেয়েছিল তো? খেল আবার কখন, সন্ধ্যা থেকেই তো সামুয়র বাড়িতে বসে।
রবিয়ার বৌ বলে যে, রামিয়াকে নিয়ে রবিয়া গিয়েছে মহতোর কাছে সেই ভোরবেলায়; রামিয়া পঞ্চায়তি করবে। রবিয়ার বৌয়ের কথা বলবার সময় নেই; ছটপরবের যোগাড়-যাগাড়ের ছিষ্টিকাজ তার পড়ে রয়েছে; নিঃশ্বাস ফেলবার বলে সে সময় করে উঠতে পারছে না, তা আবার সে এখন ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে গল্প করতে বসবে।
ঢোঁড়াইয়ের আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে- কেবল আত্মমর্যাদায় নয়, আত্মবিশ্বাসেও। কী আক্কেল রামিয়ার! তাদের ঘরোয়া কথা নিয়ে গিয়েছে মহতো নায়েবদের কাছে! সামান্য জিনিসকে এত বাড়ানোর কী দরকার ছিল? কালকে ছটপরব তা কি রামিয়া ভুলে গিয়েছে? তাদের নতুন সংসারের প্রথম ছটপরব এইটা। কী কী জিনিস আনতে হবে তা কী ঠিক ঢোঁড়াই অতশত জানে। সোহাগিন [৩৮৮] থাকল ছটপরবের সময় বাড়ির বাইরে- ঢোঁড়াইয়েরই বিরুদ্ধে নালিশের তদবিরে। তার রঙিন জগৎ আবছা অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে।
ঢোঁড়াই সেদিন গাড়ি নিয়ে কাজে বেরোয় না, রামিয়া আবার যদি বাড়ি ফিরে তাকে দেখতে না পায়। বাড়িতে ফেরবার সঙ্গে সঙ্গে সে রামিয়ার কাছে মাপ চাইবে। ঠোঁটের কোণে হাসি এনে রামিয়া বসবে উনুনে আগুন দিতে, ঢোঁড়াইয়ের জন্য ভাত রাঁধতে। না না আজ আবার ভাত রান্না কী? স্নান করে রামিয়া বসবে গম ধুতে ছটপরবের ঠেকুয়ার [৩৮৯] জন্য। ঢোঁড়াই ধাঙড়টুলি থেকে নিয়ে আসবে বাতাপিলেবু, আখ, সাওজীর দোকান থেকে আনবে গুড় আর ঠেকুয়া ভাজাবার তেল।…
উঠোনে বসে ঢোঁড়াই আকাশপাতাল ভাবে। সময় কাটতে চায় না। বড় একা একা লাগে। রামিয়া। বেনাঘাসের কাঠা, গোবর মাটি দিয়ে ন্যাপা তুলসীতলা, ঝকঝকে করে নিকানো উনুন, বাড়ির প্রতিটি জিনিসে রামিয়া মেশানো।
বাইরে বলদের ডাক কানে আসে। ওঃ তাই তো আজ বলদ দুটোকে জল আর জাব দেওয়া হয়নি তো। একদম ভুলে গিয়েছি সে কথা।
ঢোঁড়াই ধড়ফড় করে ওঠে।
বলদ দুটোকে খেতে দেওয়ার সময় রতিয়া ছড়িদার খবর দিয়ে যায় যে, রাতে মহতোর বাড়িতে রামিয়ার নালিশের পঞ্চায়তি হবে; সে যেন যায়।
তেরহাঁর মতো দশজনের ব্যাপার হলে ঢোঁড়াই মহতো নায়েবদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে। কিন্তু এ নালিশ যে রামিয়ার আনা। ঢোঁড়াই দোষ করেছে; সে পঞ্চায়তের সম্মুখে সব দোষ স্বীকার করে নেবে। খালি বাড়িতে তার মন এরই মধ্যে হাঁফিয়ে উঠছে। কাল শেষরাত্রে যখন রামিয়া ময়নাধারে ছট-এর পিদিপ [৩৯০] ভাসাতে যাবে, তখন সঙ্গে যাওয়ার জন্য ঢুলী আনবে ঢোঁড়াই মরগামা থেকে, যেমন বাবুভাইয়াদের ছট-এর পিদিমের সঙ্গে যায়। তার জন্য আট আনা দশ আনা যত খরচই হোক না কেন! পশ্চিমের মেয়ের ছট-এর ঘটনা দেখুক তাৎমাটুলির ঝোটাহা-রা। রামিয়াটা পঞ্চাতের থেকে বাড়ি এসে কখন কোন কাজ করবে। সাজিমাটি পড়ে রয়েছে, তাই দিয়ে কাপড় কাঁচবে, গোবর দিয়ে ঘর আর উঠোন নেপবে, গম পিষবে, কত কাজ ছট পরবের। রামিয়ার কাজ আগিয়ে রাখবার জন্য সে নিজেই উঠোন নিকোতে বমে। গোবরমাটি দিয়ে। রামিয়া বাড়ি ফিরে অবাক হয়ে যাবে। দাওয়া নেপবার সময় মনে পড়ে যে রাতে এইখানটাতেই রামিয়া বসে ছিল। যেখানটায় সামুয়র বসেছিল সেখানে একটু বেশি করে গোবর দিয়ে দেয়; ঐ শালাই তো যত নষ্টের গোড়া। তার কথা ঢোঁড়াই ভুলতে চায়।
সাঁঝের আলোয় রঙিন হয়ে ওঠে ঢোঁড়াইয়ের নিজ হাতে নিকানো ঝকঝকে আঙিনা। তুলসীতলায় অনভ্যস্ত হাতে পিদিপ জ্বালিয়ে দেয়। ভরে তেল দেয় তাতে, রামিয়া ফিরবার সময় পর্যন্ত যাতে সেটা জ্বলে। একটু তেল শিশিতে রেখে দেয়, বিনা তেলে রামিয়াটা একদিনও স্নান করতে পারে না।…
তারপর রামজীর নাম নিয়ে ঢোঁড়াই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে। মহতোর বাড়ি পৌঁছে দেখে যে মহতো নায়েব সকলে এসে গিয়েছে। সে ভেবেছিল রামিয়াকেও সেখানে দেখবে, কিন্তু রামিয়া নেই সেখানে। বোধ হয় মহতোর বাড়ির ভিতর ফুলঝরিয়ার সঙ্গে গল্প করছে। ঢোঁড়াইয়ের সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে সামুয়রকে সেখানে দেখে। ঐ হাড়খৃষ্টান বদমাইশটা, মহতো নায়েবদের পাশে চুপটি করে বগুলা বগৎ [৩৯১]-এর মতো বসে আছে কেন? রামিয়া কি সামুয়রকে সাক্ষী মেনেছে না কি? তা হলে তো সামুয়রকে নিয়েই যে কালকে রাতের ঝগড়া, সে কথা নিশ্চয়ই সবাই জেনে গিয়েছে। লজ্জায় ঢোঁড়াইয়ের মাথা কাটা যায়।
বস ঘেঁড়াই। ছড়িদার জায়গা দেখিয়ে দেয়। তাড়াতাড়ি পঞ্চায়েতের কাজ শেষ করতে হবে, বুঝলি ঢোঁড়াই। কাল ছট। রামিয়া কোথায়?
বাইরে থেকে জবাব দেয় রবিয়ার বৌ। সারাদিন ছটের উপোস করে শরীরটা খারাপ হয়েছে তার। কাল সাঁঝেও খায়নি তার উপর পা-ভারি [৩৯২]। আমরা বললাম তোর আর ওখানে গিয়ে কাজ নেই, আমরা তো থাকবই। মহতো নায়েবদের তো সব কথা সকালেই বলে এসেছিস। বাড়িতে বসে পরবের আটাগুড় ফলমূল পাহারা দে। সুরুজ মহারাজের জিনিস, ওগুলো তো ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে রাখতে পারি না [৩৯৩]।
আচ্ছা, আচ্ছা। হয়েছে।
তারপর ঢোঁড়াইয়ের বিচার আরম্ভ হয়। পা-ভারি! ঢোঁড়াইয়ের আশ্চর্য লাগে। ঢোঁড়াই স্বীকার করে যে সে মেরেছে রামিয়াকে রাগের মাথায়।
চব্বিশ ঘণ্টা আমার মেয়েকে গঞ্জনা দেয়। বাড়ির বাইরে যেতে দেয় না। কোন বেটাছেলের সঙ্গে কথা বললে মারধর করে পা-ভারির! উপরও। তোমরা পঞ্চ, জাতের মালিক। ওর পড়ে পাওয়া পয়সার গরমাই ঠাণ্ডা করে দাও।-বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দেয় রবিয়ার বৌ।
মহতো নায়েবরা সকলেই তার বিরুদ্ধে, এ কথা ঢোঁড়াই য়ের চাইতে কেউ ভাল করে জানে না। প্রত্যেকের তার উপর রাগের আসল কারণ সে জানে। তবু পঞ্চরা তাকে যে সাজা দেবে তা সে মাথা পেতে নিতে তৈরী আছে। এবার থেকে সে চেষ্টা করবে রামিয়ার উপর সন্দেহ না করবার। তাকে সব জায়গায় যেতে দেবে। তার ভারি পা; এ কথা ঢোঁড়াইয়ের আগে খেয়ালই হয়নি।
বাবুলাল কথার মোড় ঘুরোবার জন্য বলে, পা-ভারি, তবু পচ্ছিমে মেয়ের ফুড়ৎ ফুড়ৎ সারে না।
হেঁপো তেতর কাশতে কাশতে বলে, ওই শুনতেই পচ্ছিমের মেয়ে। আমাদের ঝোটাহাদের অধম।
বাইরে ঝোটাহাদের-চেঁচামেচি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। মহতো বলবে এবার কথা। চুপ! চুপ কর সকলে।
আমরা তোমার ভালই চাই ঢোঁড়াই । সকলেই মহতোর এই কথায় সায় দেয় আরে ঢোঁড়াই তো আমাদেরই।
ঢোঁড়াই অবাক হয়ে সকলের মুখের দিকে তাকায়। মহতো নায়েবদের কথার এই সুর সে জীবনে শোনেনি। আর তার নিজের ক্ষেত্রে কোনো সহানুভূতিও তাদের কাছ থেকে আশা করেনি। সে কিছুই বুঝতে পারে না। বাবুলালের মুখের দিকে তাকাতেই সে চোখ নামিয়ে নেয়। সব হিসাবে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ঢোঁড়াইয়ের।
পচ্ছিমের মেয়ে পচানো [৩৯৪] আমাদের কম্মা না।
বাইরে থেকে মহতো গিন্নীর গলা শোনা যায়। সেবার লোটা নিয়ে ময়দানে যাওয়ার ব্যাপারটা তো একেবারে হজমই করে গিয়েছিল নায়েবরা। জোয়ান মেয়ে দেখে ঢোঁড়াই না হয় তখন উন্মত্ত; তোমরা কি করে জাতের বেইজ্জত গুলে গুলে খাচ্ছিলে তখন?
তোকে কে পঞ্চায়তিতে কথা বলতে বলেছে? ছড়িদার, সরিয়ে দাও সকলকে এখান থেকে। রবিয়ার বৌ চিৎকার করে-আমাদের মেয়ে নিয়ে মামলা; আর আমরা শুনব না?
আচ্ছা, থাক থাক।
হাঁ দেখলি তো ঢোঁড়াই, বিয়ের আগেই আমরা মানা করেছিলাম। হাতির মতো জোয়ান মেয়ে পচ্ছিমের পানির। কা ন করই অবলা প্রবল [৩৯৫]…মহতোর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বাবুলাল পাদপূরণ করে দেয়-কে হি জগ কালু ন খাঈ [৩৯৬]। বাবুলাল সকলকে জানাতে চায়, সেও রামায়ণের সবজানে।
হেঁপো তেতরও রামায়ণের জ্ঞানে কারও থেকে পেছিয়ে নেই। সেও ছড়া কাটে
নিজ প্রতিবিম্বু বরুকু গহি জাঈ।
জানি না জাই নারি গতি ভাই ॥ [৩৯৭]
আরশির উপর নিজের ছায়া যদিই বা ধরে রাখা সম্ভব হয়, তবু মেয়েদের মনের গতি জানা সম্ভব নয়।
ঢোঁড়াই কিছুই আন্দাজ করতে পারে না। মহতো নায়েবরা কী করতে চায়? কেউ ঢোঁড়াইয়ের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলছে না কেন? সকলেই দেখছি রামিয়ার খেলাপেই বলছে। পঞ্চায়তের লোকরা এত শান্ত কেন? কেউ তাকে গালাগালি দিচ্ছে
কেন?…রামিয়া নিজে এসে আমাদের বলে দিয়েছে, যে সে আর কিছুতেই তোমার ঘর করবে না। পঞ্চায়েতের লোকজনের চেহারা ঢোঁড়াইয়ের চোখের সম্মুখ থেকে মুছে যায়। ঢোঁড়াই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে বসে। ভারি মাথাটা নিয়ে আর সে সোজা হয়ে বসতে পারছে না। একটা গম পেষা জাঁতার চাকা ঘুরছে, তারই উপর যেন সে বসে আছে। তার শব্দের মধ্যে দিয়েও কানে পৌঁছুচ্ছে রবিয়ার বৌয়ের কান্না-মেশানো কথার স্রোত।
যা জুলুম করে ঢোঁড়াই আমার মেয়ের উপর। এক মিনিট দম নিতে দেয় না। বাইরে আসতে দেয় না, ফৌজীকুয়োতলাতে পর্যন্ত না; হাসতে দেয় না। আমার মেয়ে কী টিয়াপাখি নাকি যে খাঁচার মধ্যে বন্ধ করে রাখবে? রোজ মেয়ে আমার কাছে কান্নাকাটি করত। অনেক লাথিঝাটা সয়েছে ঐ ভিখিরির বেটা বড়-মানুষের। বাবুভাইয়াদের মাইজীরা মহাৎমাজীর নিমক বেচে, জিরানিয়ার রাস্তায়, আর ইনি আমার মেয়েকে বাড়িতে বন্ধ করে রাখবেন। সাতকাল গেল ভিক্ষে করে, আজ আমাদের বিলাতী লণ্ঠন দেখাতে আসে। চুপ করব কেন? আমার পা-ভারি মেয়ের হাড় গুঁড়ো করছে ও মেরে, আর আমি চুপ করব। তোমরা পঞ্চ, আমাদের দেবতা। ওই পাখীটার [৩৯৮] ঘরে আর আমার মেয়েকে ফিরে যেতে বোলো না। নিয়ে নিক ও ফিরিয়ে, বিয়েতে ও মেয়েকে যত টাকা দিয়েছিল। কান্নার শব্দে রবিয়ার বৌয়ের তারপরের কথাগুলি আর বোঝা যায় না।
টাকার কথায় ঢোঁড়াই চমকে ওঠে। কানের ভিতরের জাঁতার শব্দটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়; সঙ্গে সঙ্গে ঘুরুনিটাও। বলে কী! রবিয়ার বৌ দেবে টাকা! জমিদারের ডিক্রি ঝুলছে তার মাথার উপর। বিয়ের সময় মিসিজী যে চাল গনেছেলেন তা সংখ্যা বেজোড় ছিল; সে সময় ঢোঁড়াই ঠিকই দেখেছিল। আর কোন সন্দেহ নেই তাতে।
বাবুলাল এতক্ষণে কথা বলে বলছ যে সে মেয়ে ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে থাকবে না। কিন্তু জোয়ান মেয়ে থাকবে কার সঙ্গে। এখন না হয় ধানকাটনী আসছে; তারপর?
রবিয়ার বৌ ঘোমটার মধ্যে থেকে কাঁদতে কাঁদতে জবাব দেয়, সে মেয়ে কিছুতেই ঢোঁড়াইয়ের সঙ্গে থাকবে না, মরে গেলেও না। এখন তোমরা অন্য কারও সঙ্গে ওর সাগাই [৩৯৯] ঠিক করে দাও।
এইবার মহতো কেশে গলা সাফ করে নেয়।
–কথা যখন উঠেছে, তখন পরিষ্কার কথাই বলি। তাৎমাটুলির মধ্যে ঐ মেয়ের সাগাই টাগাই আর আমরা করাচ্ছি না। একবার কমজোরী [৪০০] দেখিয়ে ঠকেছি।
ঢোঁড়াইয়ের মাথাটির মধ্যে যেন একখানা পাথর ঢুকে আছে- কোনো কথা ঢুকবার আর জায়গা নেই সেখানে। নিজেকে দুর্বল লাগছে। বিয়ের সময় ফৌজীকুয়োর জল দিয়ে কাজ সারা হয়েছিল, ও কুয়োটার বিয়ে দেওয়া নেই। কেন সে সেই সময় আপত্তি করেনি?
আর এই পা ভারি মেয়ে। এর অন্য জায়গায় সাগাই হওয়াটি শক্ত। আমাদের। জাতের মধ্যে না-হয় এরকম সাগাই চলে। কিন্তু বাইরের লোকের মধ্যে তো তাৎমাটুলির পঞ্চদের কথা খাটবে না…
ঢোঁড়াই ঘেমে উঠেছে। মাথার মধ্যেটা ঠাণ্ডা-ঝিমঝিম করছে। সাগাই… রামিয়া… কথাগুলোর মানে সে ঠিক বুঝতে পারছে না।…
তার উপর ঢোঁড়াই বিয়েতে টাকাও খরচ করেছে, সেটাও ফিরে না পেলে চলবে কেন। ওরও তো তাহলে আবার শাদি করার দরকার হবে।
হ্যাঁ, এটা ইনসাফ এর [৪০১] কথা বলেছ মহতো।
এই সব কথাবার্তার মধ্যে সামুয়র এতক্ষণ একটিও কথা বলেনি। এক কোণে বসে সে একটা ঘাস দিয়ে দাঁত খুঁটছিল, আর মধ্যে মধ্যে থুতু ফেলছিল। সে ঢোক গিলে বলে, তোমাদের যদি মত হয় তো আমি ঢোঁড়াইয়ের টাকা দিয়ে দিতে রাজী আছি।
ঢোঁড়াইয়ের কান খাড়া হয়ে ওঠে। রামিয়াকে বিয়ে করতে রাজী আছি এ কথা পরিষ্কার না বললেও সামুয়রের কথার অর্থ সুস্পষ্ট।…
দপ করে জ্বলে ওঠে ঢোঁড়াই। কী বললি? জিব টেনে ছিঁড়ে নেব। শরীরের সবকটা শিরা ঢিলে করে দেব [৪০২] পিটিয়ে। ঢোঁড়াই উঠে দাঁড়িয়েছে। আগুন বেরুচ্ছে তার চোখ দিয়ে।
মহতো একটু ভয় পেয়েছে। বোসো ঢোঁড়াই ঠাণ্ডা হয়ে। সামুয়র, তুই রাজী হলেই তো হল না। আবার রামিয়া রাজী আছে কিনা তাও তো জানতে হবে।…
রবিয়া সামুয়রের হয়ে জাবাব দেয়–আজ সাঁঝেই তো ছড়িদারের সম্মুখে বলেছে রামিয়া যে সে রাজী আছে।
ঢোঁড়াইয়ের কাঁধ আর হাতের পেশীগুলি শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে। এই বুঝি বাঘের মতো ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পঞ্চদের উপর।…
টাকা খেয়ে সাজশ করছে, শালা চোট্টার দল! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠে ঢোঁড়াই। তার হিংস্র চোখের মধ্য দিয়ে ঠিকরে পড়ছে অজস্ৰ বজ্রের স্ফুলিঙ্গ। বজরঙ্গবলী [৪০৩] মহাবীরজীর অসীম শক্তি এসে গিয়েছে তার দেহে আর বাহুতে। অনেক বড় দেখাচ্ছে তাকে। সম্মুখের এই হফৎরঙ্গী [৪০৪] পিঁপড়েগুলোকে সে ফুঁ দিয়ে ছত্রাকার করে দিতে পারে মুহূর্তের মধ্যে; টেনে ফেলে দিতে পারে দূরে যেখানে ইচ্ছে; ঝড়ের মুখে বকরহাট্টার মাঠের সিমুল তুলোর মতো উড়িয়ে দিতে পারে এক নিশ্বাসে; পড়পড় করে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে ঐ কুত্তা সামুয়রটাকে; যেদিকেই সবুজ দেখে সে দিকেই চরতে যায় এই পঞ্চায়েতির ছাগলের দল; কিন্তু এইসব উকুন মারবার তার সময় কোথায় এখন।…রামিয়া আগে রামিয়া সেই পচ্ছিমা বাজারের আওরৎ রামিয়া [৪০৫];- সামুয়রকে বিয়ে করতে চায় রামিয়া… এতদিন থেকে তাকে ঠকিয়ে আসছে।…বলেছিল মর্কটের মতো দেখতে সামুয়রকে; পঞ্চায়ৎ ঘরের সকলে ভয়ে তার জন্য পথ ছেড়ে দেয়। কী করে, কখন সে মহতোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে, তা সে নিজেই জানতে পারে না। সারা পৃথিবী তার চোখের সম্মুখে থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। যে পচ্ছিমা সাপটাকে সে পুষেছিল সেটা এতদিনে ছোবল মেরেছে। তার কাছে রামিয়া সামুয়রকে নিয়ে ঠাট্টা করে কটাচোখো বিলাড় [৪০৬] বলে। কিছু জানতে পারিনি এতদিন!…যাক, কিন্তু কারও শক্তি নেই সেই সাপটার কাছে যাবার পথে তাকে বাধা দেয়, মহাবীরজীও না, গোসাইও না, খোদ রামচন্দ্রজী এলেও না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের হাওয়া শান্ত হয়ে গিয়েছে, তার প্রতিটি স্নায়ুর উদ্দণ্ড আলোড়ন দেখে। তার হাত মুঠো হয়ে আসছে; প্রচণ্ড শক্তিতে পৃথিবীকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ফেলতে পারে এখনই। এর প্রতিটি অণুপরমাণু তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে সারাজীবন।…মিষ্টিকে তেতো বিস্বাদ করে দিয়েছে।…
রবিয়ার বাড়ির কুকুরটা কেঁউ করে ডেকে ভয়ে পালায়।
পিদিপ জ্বলছে দাওয়ায়। রামিয়া বাঁশে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে। সারাদিন উপোসের পর ছট পূজোর জিনিসগুলো পাহারা দিতে তার দুলুনি এসে গিয়েছে।…
ঝুঠঠী [৪০৭]!…বাজারের আওরৎ। পচ্ছিমের কুত্তী! [৪০৮]…তার মনের প্রচণ্ড বিক্ষেভ প্রকাশ করার মতো ভাষা নেই ঢোঁড়াইয়ের। দরকার বা কী?… লাথি… কিলঘুষি… চড়…এই নে!…এই নে। এখানে। …এখানে…মাথায়, পিঠে…সর্বাঙ্গে…ছটপরবের আখটা মট করে ভেঙে যায়।
থেঁতলে, কুটে, পিষে, চটকে, ঘেঁচে ফেলতে ইচ্ছে করে, হারামজাদীর দেহটাকে পা দিয়ে নড়ালেও নড়ে না…
রবিয়ার বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েছে ঢোঁড়াই অন্ধকারের মধ্যে। যে দুনিয়া তার বিরুদ্ধে গিয়েছে, সম্পর্ক কী তার সে দুনিয়ার সঙ্গে। রবিয়ার বাড়ির কুকুরটা ডাকছে। পিছনে; থানের দিকে আলো নড়ছে। তারই বিলাতী লণ্ঠনটা নিয়ে বোধ হয় সকলে তাকে খুঁজতে বেরিয়েছে।…রামিয়ার কপালের খানিকটা কেটে গিয়েছিল…তার পাক্কীর উপর দিয়ে ঢোঁড়াই অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। টিমটিম করে আলো জ্বলছে দূরে রেবণগুণীর বাড়িতে। সেই- সেই রাতে রেবণগুণী বলেছিল তার পাওনাটা দিয়ে দিতে শীগগিরই; হঠাৎ মনে পড়ল সেকথা। আর কারও ধার ধারে না সে! কোমরে গোঁজা এক আনা পয়সা রেবণণীর নাম করে সে অন্ধকারে ফেলে দেয়। পাক্কীর পাথরের উপর কেবল একটু খুট করে শব্দ হয়। কাছের ঝিঁঝিপোকাটা পর্যন্ত সে শব্দ শুনে এক মুহূর্তের জন্য তার একঘেয়ে ডাক থামায় না। ঠক ঠক! ঠক ঠক! ঠক ঠক! তাৎমাটুলিতে একটানা হাতুড়ি পিটে চলেছে কামার পাখি [৪০৯]।
———–
[৩৮৮. এয়ো। ৩৮৯. আটা ও গুড় দিয়ে তৈরি একরকম শুকনা পিঠা : ছটপূজোয় লাগে। ৩৯০. ছটপরবের পরদিন ভোররাতে মেয়েরা নদীতে কিংবা পুকুরে ষষ্ঠিঠাকরুন আর সূর্যদেবের নামে পিদিপ জ্বেলে ভাসিয়ে দেয়। প্রত্যেক বাড়ির মেয়েরা এই উপলক্ষে নদীর ধারে যাবার সময় সংগতি অনুযায়ী জাঁকজমক করে। ৩৯১. বক-ধার্মিকের মতো। ৩৯২. সন্তানসম্ভবা। ৩৯৩. ছট কথাটি যষ্ঠি শব্দের অপভ্রংশ। কিন্তু পূজো কেবল যষ্ঠির করা হয় নাম সূর্যদেবেরও সঙ্গে সঙ্গে পূজো হয়। সাধারণ লোকেরা সূর্যদেবের পূজাকেই আসল ছটপূজো মনে করে। এ পূজোর জিনিসপত্র অতি শুদ্ধাচারে রাখা হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছতা এবং শুদ্ধাচারের অবহেলা হলে তারা জানে যে, সূর্যদেব তাদের কুষ্ঠরোগগ্রস্ত করে দেবেন। ৩৯৪. হজম করা। ৩৯৫. মেয়েমানুর প্রবল হলে কী না করে! – তুলসীদাস। ৩৯৬. কাল পৃথিবীর কোন জিনিসকে না নষ্ট করে। তুলসীদাসের সম্পূর্ণ লাইনটি এই রকম-কা ন করই অবলা প্রবল কে হি জগ কালু ন খাঈ। ৩৯৭. আরশির উপরের নিজের ছায়া যদিই বা ধরে রাখা সম্ভব হয় তবুও মেয়েদের মনের গতি জানা সম্ভব নয়। তুলসীদাস। ৩৯৮. পাষণ্ড। ৩৯৯. সাঙ্গা; নিকা। ৪০০. দুর্বলতা। ৪০১. ন্যায়বিচার। ৪০২. স্থানীয় ভাষায় মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব, এই ধরনের আছে ব্যবহৃত হয়। ৪০৩. বজ্রের মত অঙ্গ ও বলশালী মহাবীরজীকে বলা হয়। ৪০৪. যারা সপ্তাহে রং বদলায়; যাদের মতের স্থিরতা নেই। ৪০৫. অসচ্চরিত্রা স্ত্রীলোক। ৪০৬. বিড়াল। ৪০৭. মিথ্যাবাদী। ৪০৮. পশ্চিমের কুকুর। ৪০৯. এ শ্রেণীর পেঁচা; এনে ডাক দূর থেকে হাতুড়ি পেটার শব্দের মত মনে হয়।