১.৪ বেদেদের আস্তানায়

পরের দিন শিবরাম নিজেই গেলেন বেদেদের আস্তানায়। শহর পার হয়ে সেই গঙ্গার নির্জন তীরভূমিতে বট-অশ্বথের ছায়ায় ঘেরা স্থানটিতে।

কে কোথায়? কেউ নাই। পড়ে আছে কয়েকটা ভাঙা উনোন, দু-একটা ভাঙা হাড়ি, কিছু কুচো হাড়—বোধহয় পাখির হাড় ছড়িয়ে পড়ে আছে। বেদেরা চলে গিয়েছে। গঙ্গার জলের ধারে পলিমাটিতে অনেকগুলি পায়ের ছাপ জেগে রয়েছে। কতকগুলো কাক মাটির উপর বিচরণ করে বেড়াচ্ছে, কুঁচো হাড়গুলো ঠোকরাচ্ছে। শহরের দুটো পথের কুকুর বসে আছে গাছতলায়। ওরা বোধহয় বেদেদের উচ্ছিষ্টের লোভে শহর থেকে এখানে এসে কয়েকদিনের জন্য বাসা গেড়েছিল। বেদেরা চলে গিয়েছে, সে কথা ওরা এখনও ঠিক বুঝতে পারে নাই। ভাবছে—গেছে। কোথাও, আবার এখুনি আসবে।

শিবরামও একটু বিস্মিত হলেন। এমনিভাবেই বেদেরা চলে যায় ওরা থাকতে আসে না, এই ওদের ধারা। এ কথা তিনি ভাল করেই জানেন, তবুও বিস্মিত হলেন। কই, কাল দুপুরবেলা শবলা তো কিছু বলে নাই! তার কথাগুলি এখনও তাঁর কানে বাজছে।

–ধরমভাই, ধন্বন্তরি ভাই, বেদের বেটি কাললাগিনী বইন। লরে লাগে বাস হয় না চিরকালের কথা। হয়েছিল বণিককন্যে আর পদ্মগের দুটি ছাওয়ালের ভালবাসার জোরে, ভাইফোঁটার কল্যাণে, বিষহরির কৃপায়। এবারে হল তুমাতে আমাতে। তুমি মোরে বইন কইলা, মুই কইলাম ভাই।

আরও কানে বাজছে—যদি দিবারে পারতে ধরমভাই, তবে বইনটা তুমার বাঁচত।

সেদিন শিবরাম সারাটা রাত্রি ঘুমাতে পারেন নাই। ওই কথাগুলিই তার মাথার মধ্যে বহু বিচিত্র প্রশ্ন তুলে অবিরাম ঘুরেছিল এবং সেই কথাই তিনি আজ জানতে এসেছিলেন শবলার কাছে। জিজ্ঞাসা করতে এসেছিলেন—এ কথা কেন বললি আমাকে খুলে বল্ শবলা বোন, আমাকে খুলে বল।

নিস্তব্ধ হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন জনহীন নদীকূলে।

***

এক বৎসর পর আবার এল বেদের দল।

এর মধ্যে শিবরাম কত বার কামনা করেছেন—আঃ, কোনোক্রমে যদি এবারও সূচিকাভরণের পাত্রটি মাটিতে পড়ে ভেঙে যায় তা হলে গুরু আবার যাবেন সাঁতালী গাঁয়ে। ঘাসবনের মধ্যে থেকে হাঙরমুখী খালের বাঁকে বেরিয়ে আসবে কালনাগিনী বেদের মেয়ে। নিকষকালো সুকুমার মুখখানির মধ্যে, তার চোখের দৃষ্টিতে, ঠোঁটের হাসিতে আলোর শিখা জ্বলে উঠবে।

কিন্তু সে কি হয়?

আচার্য ধূর্জটি কবিরাজ যে শিবরামের পাংশু মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারবেন। সূচিকাভরণের পাত্রটি দৈবাৎ মাটিতে পড়ে চূর্ণ হয় নি, হয়েছে। শিবরাম শিউরে উঠেছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুঠি দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে।

যাক সে কথা। বেদেরা এসেছে। এক বৎসরেরও বেশি সময় চলে গিয়েছে। প্রায় এক সপ্তাহ বেশি। অন্য হিসেবে আরও বেশি। এ বৎসর পর্ব-পার্বণগুলি অপেক্ষাকৃত এগিয়ে এসেছে। মলমাস এবার দুর্গাপূজারও পরে। নাগপঞ্চমী গিয়েছে ভদ্রের প্রথম পক্ষে। শারদীয়া পূজা গেছে আশ্বিনের প্রথমে, সে হিসাবে ওদের আরও অনেক আগে আসা উচিত ছিল।

বাইরে চিমটের কড়া বাজল—ঝনাৎ ঝন–ঝনাৎ ঝন–ঝনাৎ ঝন!

তুমড়ী-বাঁশি বাজছে—একঘেয়ে মিহিসুরে। সঙ্গে বাজছে বিষম্যাকিটা ধুম-ধুম! ধুম-ধুম!

ভারী কণ্ঠস্বরে বিচিত্র উচ্চারণে হাকছে-জয় মা-বিষহরি! জয় বাবা ধন্বন্তরি! জয়জয়কার হোক–তুমার জয়জয়কার হোক।

শিবরাম ঘরের মধ্যে বসে ওষুধ তৈরি করছিলেন। ধূর্জটি কবিরাজ আজ বাইরেই আছেন। একটি বিচিত্র রোগী এসেছে দূরান্তর থেকে, পরিপূর্ণ আলোর মধ্যে আচার্য রোগীটিকে দেখছেন। শিবরাম চঞ্চল হয়ে উঠলেন বেদেদের কণ্ঠস্বর শুনে। গুরুর বিনা আহ্বানে নিজের কাজ ছেড়ে বাইরে যেতে তার সাহস হল না।

ওদিকে বাইরে বেদের কণ্ঠস্বর শোনা যেতে লাগল—পেনাম বাবা ধন্বন্তরি। জয়জয়কার হোক। ধন্বন্তরির আটন আমাদের যজমানের ঘর, ধনে-পুত্ৰে উথলি উঠুক। তুমার দয়ায় আমাদের প্যাটের জ্বালা ঘুচুক।

ভারী গলায় আচার্যের কথা শুনতে পেলেন শিবরাম।—কি, মহাদেব কই? বুড়ো? সে!

–বুড়া শয়ন নিছে বাবা। বুড়া নাই।

—মহাদেব নাই? গত হয়েছে? শান্ত কণ্ঠস্বরেই বললেন আচার্য। মানুষের মৃত্যুসংবাদে আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের তো বিস্ময় নাই। ক্ষীণ বেদনার একটু আভাস শুধু ভারী কণ্ঠস্বরকে একটু সিক্ত করে দেয় মাত্র। আবার বললেন কি হয়েছিল? নাগদংশন?

–লাগিনী বাবা, লাগিনী! কাললাগিনী–শবলা—তাকে নিয়েছে।

এবার শিবরাম আর থাকতে পারলেন না, কাজ ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেন, সেই অর্ধ-উলঙ্গ রুক্ষ ধূলিধূসরমূর্তি পুরুষের দল, কালোপাথরকেটে-গড়া মূর্তির মত মানুষ উঠানে সারি দিয়ে বসেছে। পিছনে কালো ক্ষীণদেহ দীর্ঘাঙ্গী মেয়ের দল। কিন্তু কই–শবলা কই?

আচার্য আবার একবার মুখ তুলে তাকালেন ওদের দিকে। বললেন গতবারের ঝগড়া তা হলে মেটে নাই? আমি বুঝেছিলাম, বিষ গালতে গিয়ে মহাদেবের হাতটা বেঁকে গেল—সেই দেখেই বুঝেছিলাম। তা হলে দুজনেই গিয়েছে?

অর্থাৎ শবলার প্রাণ নিয়েছে মহাদেব, মহাদেবের প্রাণ নিয়েছে শবলা?

নূতন সর্দার সবে পৌঢ়ত্বের সীমায় পা দিয়েছে। মহাদেবের মতই জোয়ান। তার দেহখানায় বহুকালের পুরনো মন্দিরের গায়ে শ্যাওলার দাগের মত দাগ পড়ে নাই, এত ধূলিধূসর হয়ে ওঠে নাই। সে মাথা হেঁট করে বললে না বাবা, সে পাপিনী কাললাগিনীর জানটা নিতে পারি নাই আমরা। লোহার বাসরঘরে লখিন্দরকে খেয়ে লাগিনী পলায়েছিল, বেহুলা তার পুচ্ছটা কেটে লিয়েছিল; আমরা তাও লেরেছি। বুডোর বুকের পাঁজরে লাগদন্ত বসায়ে দিয়া পড়ল গাঙের বুকে ঝাঁপায়ে ড়ুবল, মিলায়ে গেল। শেষ রাতের গাঙ, চারিপাশ আকাশের বুক থেক্যা গাঙের বুক পর্যন্ত অ্যাঁধার দেখতে পেলম না কুন্ দিকে গেল। রাতের অ্যাঁধারে কালো মেয়েটা যেন মিশায়ে গেল।

* * *

নতুন সর্দারের নাম গঙ্গারাম।

গঙ্গারাম মহাদেবের ভাইপো। গঙ্গারাম বেদেকুলে বিচিত্র মানুষ। সে এরই মধ্যে বার তিনেক জেল খেটেছে। অদ্ভুত জাদুবিদ্যা জানে সে। ওই জেলখানাতেই জাদুবিদ্যায় দীক্ষা নিয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়েও সে বড় একটা গ্রামে থাকত না। এখান ওখান করে বেড়াত, ভোজবিদ্যা জাদুবিদ্যা দেখাত, দেশে দেশে ঘুরত। এবার ওকে বাধ্য হয়ে সর্দারি নিতে হয়েছে। মহাদেবের ছেলে নাই। সে মরেছে অনেক দিন। বিধবা পুত্রবধূ শবলা—নাগিনী কন্যা মহাদেবকে নাগদন্তে দংশন করিয়ে তাকে হত্যা করে পালিয়েছে। এই মাত্র এক পক্ষ আগে। সাঁতালী থেকে বেরিয়েছে ওরা যথাসময়ে; হাঙরমুখীর খাল বেয়ে নৌকার সারি এসে গাঙে পড়ল; মহাদেব বললে–বাঁধ নৌকা রাতের মতুন।

ভাদ্রের শেষ, ভরা গঙ্গা। গঙ্গার জল ভাঙনের গায়ে ছলাৎ-ছল ছলাৎ-ছল শব্দে ঢেউ মারছে। মধ্যের বালুচর যেটা প্রায় সাত-আট মাস জেগে থাকে সেটার চিহ্ন দেখা যায় না। ভাঙা গাঙের পাড় থেকে মধ্যে মধ্যে ঝুপঝাপ শব্দে মাটি খসে পড়ছে। মধ্যে মধ্যে পড়ছে। বড় বড় চাঙর। বিপুল শব্দ উঠছে। দুলে দুলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে এপার থেকে ওপার পর্যন্ত চলে যাচ্ছে।

মাথার উপরে কটা গগনভেরী পাখি কর-কর কর-কর শব্দ তুলে উড়ছিল। দূরে, বোধহয় আধ ক্রোশ তফাতে, ঝাউবনে ফেউ ডাকছিল। বাঘ বেরিয়েছে। হাঁসখালির মোহনার কাছাকাছিঘাসবনে বিশ্রী তীক্ষ্ণ ক্রুদ্ধ চিৎকার উঠছে, দুটো জানোয়ার চেঁচাচ্ছে। দুটো বুনো দাতাল শুয়োরে লড়াই লেগেছে। আশপাশে মধ্যে মধ্যে কোনো জলচর জল তোলপাড় করে ফিরছে। কোনো কুমির হবে। নৌকাগুলি এরই মধ্যে ঢেউয়ে দুলছিল। ছইয়ের মধ্যে প্রায় সবগুলি ডিবিয়ার আলোই নিবে গিয়েছে। ছইয়ের মাথায় জনচারেক জোয়ান বেদে বসে পাহারা দিচ্ছিল। কুমিরটা কাছে এলে হইহই করে উঠবে। তা ছাড়া, পাহারা দিচ্ছিল বেদের মেয়েরা, কেউ না এ-নৌকা থেকে ও-নৌকায় যায়।

এরই মধ্যে মহাদেবের নৌকা থেকে উঠল মর্মান্তিক চিৎকার। নৌকাখানা যেন প্ৰচণ্ড আলোড়নে উল্টে যায়-যায় হল। কি হল?

–কি হইছে? সর্দার? দাঁড়িয়ে উঠল বেদে পাহারাদারেরা ছইয়ের উপর। আবার হাঁকলে–সর্দার।

সর্দার সাড়া দিলে না। একটা কালো উলঙ্গ মূর্তি বেরিয়ে পড়ল সর্দারের ছই থেকে, মুহূর্তে ঝপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল গঙ্গার জলে। দূরে জলচর জীবটাও একবার উথল মেরে নিজের অস্তিত্ব। জানিয়ে দিলে। আরও বার দুই উথল মারলে, তারপর আর মারলে কি না দেখার কারও অবকাশ ছিল না।

সর্দারের চিৎকার তখনও উঠছে। গোঙাচ্ছে সে।

নৌকায় নৌকায় আলো জ্বলল। সর্দারের পাঁজরায় একটা লোহার কাটা বিঁধে ছিল। দেখে শিউরে উঠল সকলে।

নাগিনী কন্যের নাগন্ত। কন্যেদের নিজস্ব অস্ত্ৰ। বিষমাখা লোহার কাটা। এ যে কি বিষ, তা কেউ জানে না। নাগিনী কন্যেরাও জানে না। বিষের একটি চুঙিআদি বিষকন্যে থেকে হাতে হাতে চলে আসছে। ওই কাটাটা থাকে এই চুঙিতে বন্ধ। অহরহ বিষে সিক্ত হয়ে। এ সেই কাটা। সর্দারের চোখ দুটি আতঙ্কে যেন বিস্ফারিত হয়ে উঠছে।

গঙ্গারাম ডাকলে—কাকা! কাকা!

সর্দার কথা বললে না। হতাশায় ঘাড় নাড়লে শুধু। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তারপর বললে—জল।

জল খেয়ে হতাশভাবে ঘাড় নেড়ে বললে—শুধু আমার পরানটাই লিলে না লাগিনী, আমাকে লরকে ড়ুবায়ে গেল। অন্ধকারে মুই ভাবলম-এল বুঝি দধিমুখী, মুই–

হতাশায় মাথা নাড়লে, যেন মাথা ঠুকতে চাইলে মহাদেব।

শিউরে উঠল সকলে।

দধিমুখী মহাদেবের প্রণয়িনী, সমস্ত বেদে-পল্লীর মধ্যে এ প্রণয়ের কথা সকলেই জানে।

মেঝের উপর শবলার পরিত্যক্ত কাপড়খানা পড়ে রয়েছে। সর্বনাশী নাগিনী কন্যা এসেছিল। নিঃশব্দে। নৌকার দোলায় জেগে উঠল মহাদেব, সে ভাবলে—দধিমুখী এল বুঝি। সর্বনাশী বুড়ার আলিঙ্গনের মধ্যে ধরা দিয়ে তার বুকে বসিয়ে দিয়েছে নগদন্ত। শুধু তাকে হত্যা করবার অভিপ্রায় ছিল না তার, তাকে ধর্মে পতিত করে-পরকালে তার অনন্ত নরকের পথ প্রশস্ত করে। দিয়ে উলঙ্গিনী মূর্তিতে ঝাঁপ খেয়েছে গঙ্গায়।

গঙ্গারাম বললে—এ সব তো বাবার কাছে লতুন কথা লয়। ই সব তো আপুনি জানেন। কন্যেটার এ মতি অ্যানেক দিন থেক্যাই হয়েছিল বাবা-অ্যানেক দিন থেক্যা। ওই কন্যেগুলানেরই ওই ধারা।

****

কন্যাগুলির এই ধারাই বটে।

চকিতে শিবরামের মনে পড়ল শবলা তাকে বলেছিল-সে ওষুধ যদি না জান ধরমভাই, যদি দিতে না পার, তবে অঙ্গের জ্বালা জুড়াবার ওষুধ দাও। হিজল বিলের জলে ড়ুবি, মা-গঙ্গার জলে ভাসি, বাহির জুড়ায় ভিতর জুড়ায় না। তেমনি কোনো ওষুধ দাও, আমার সব জুড়ায়ে যাক।

গঙ্গারাম বললেওই নাগিনী কন্যেরা চিরটা কাল ওই করে আসছে। ওই উয়াদের ললাট, ওই উয়াদের স্বভাব। বিধেতার নির্দেশ। বেহুলা সতীর অভিশাপ।

সতীর পতিকে দংশন করলে কালনাগিনী।

সতীর দীর্ঘশ্বাসে কালনাগিনী কালনাগেরাও শেষ হয়ে গেল। বেহুলা সতী মরা পতি কোলে নিয়ে কলার মাঞ্জাসে অকূলে ভাসলে। দিন গেল, রাত্রি গেল, গেল কত বর্ষা, কত ঝড়, কত বজ্ৰাঘাত, এল কত পাপী, কত রাক্ষস, কত হাঙ্গর, কত কুম্ভীর, সে সবকে সহ্য করে উপেক্ষা করে সতী মরা পতির প্রাণ ফিরিয়ে আনলে; মা-বিষহরি মধামে নিজের পূজা পেলেন, চাদসাধুকে ফিরিয়ে দিলেন হারানো ছয় পুত, হারানো সপ্তডিঙা মধুকর; কিন্তু ভুলে গেলেন, হতভাগিনী কালনাগিনীর কথা। সতীর অভিশাপে যে কালনাগ সৃষ্টি থেকে বিলুপ্ত হল, তারা আর ফিরল না। কালনাগিনী নরকুলে জন্মায়, কিন্তু কালনাগিনীর ভাগ্য নিয়েই জন্মায়। তার স্বামী নাই; তাই যে বেদের ছেলের সঙ্গে তার শাদি হয়, শিশুকালে নাগদংশনে তার প্রাণটা যায়। তারপর নাগিনী কন্যার লক্ষণ ফোটে তার অঙ্গে। তখন সে পায় মা-মনসার বারি, পায় তাঁর পূজার ভারও; কিন্তু পতি পায় না, ঘর পায় না, পুত্র পায় না হতভাগিনী। তারপর নাগিনী স্বভাব বেরিয়ে পড়ে। হঠাৎ বাধে তার সর্দারের সঙ্গে কলহ।

গঙ্গারাম বললে-বাবা, ওইটি হল পেথম লক্ষণ। বুঝলে না! বাপের উপর পড়ে আক্রোশ। বাপের ঘরে ধরে অরুচি।

****

গতবার মহাদেব এই ধন্বন্তরি বাবার উঠানে বিষ গালতে বসে এই কথাই বলেছিল; বলতে গিয়ে এমন উত্তেজিত হয়েছিল যে, হঠাৎ তার সাপের মুখধরা হাতখানা চঞ্চল হয়ে বেঁকে গিয়েছিল। তীক্ষ্ণদৃষ্টি বেদের মেয়ে শবলা ঠিক মুহূর্তে তার হাত সরিয়ে নিয়েছিল, তাই রক্ষা পেয়েছিল, নইলে সেদিন শবলাই যেত। মহাদেব বলেছিল—মেয়েটার রীতিচরিত্র বিচিত্র হয়ে উঠেছে। মনে তার পাপ ঢুকেছে। সে আরও সেদিন বলেছিল, জাতের স্বভাব যাবে কোথা বাবা, ও-জাতের ওই স্বভাবওই ধারা। মুহূর্তের জন্য নাগিনী কন্যা শবলার চোখ জ্বলে উঠেছিল, সে জ্বলে-ওঠা এক-আধ জনের চোখে পড়েছিল, অধিকাংশ মানুষের চোখেই পড়ে নাই–তাদের দৃষ্টি ছিল মহাদেবের মুখের দিকে। শিবরাম দেখেছিলেন। বোধ করি তারুণ্যধর্মের অমোঘ নিয়মে তার দৃষ্টি ওই মোহময়ী কালো বেদের মেয়ের মুখের উপরই নিবদ্ধ ছিল, তাই চোখে পড়েছিল। না হলে তিনিও দেখতে পেতেন না; কারণ মুহূর্ত মধ্যেই সে দীপ্তি নিবে। গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, মেয়েটার নারীরূপের ছদ্মবেশ ভেদ করে মুহূর্তের জন্য তার নাগিনী। রূপ ফণা ধরে মুখ বের করেই আবার আত্মগোপন করলে।

আচার্য বলেছিলেন–শিরবেদে আর বিষহরির কন্যে—বাপ আর বেটি। বাপ-বেটির ঝগড়া মিটিয়ে নিয়ো।

বাপের উপর আক্রোশ পড়েছিল নাগিনী কন্যের।

পড়বে না? কত সহ্য করবে শবলা? কেন সহ্য করবে? সাধে বাপের উপর আক্রোশ পড়ে কন্যের কম দুঃখে পড়ে?

সাপের বিষকে পৃথিবীতে বলেহলাহল। মানুষের রক্তে এক ফোঁটা পড়লে মানুষের মৃত্যু হয়; দুর্গম পাহাড়ের মাথায় ঘন অরণ্যের ভিতর যাও দেখবে পাথর ফাটিয়ে গাছ জন্মেছে, সে গাছ আকাশ ছুঁতে চলেছে; জন্মেছে লোহার শিকলের মত মোটা লতা, একটি গাছ জড়িয়ে মাথার উপর উঠে সে গাছ ছাড়িয়ে গাছের মাথায় মাথায় লতার ভাল তৈরি করেছে; দেখবে পাহাড়ের বুক ছেয়ে বিচিত্র ঘাসের বন; তারই মধ্যে সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখলে দেখবে স্থানে স্থানে জেগে রয়েছে এক-একখানা পাথরঘাস না, শ্যাওলা না, কঠিন কালো তার রূপ। ভাল করে দেখলে দেখতে পাবে, তার চারিপাশে জমে রয়েছে মাটির গুড়োর মত কিছু; মাটির গুড়ো নয়, পিঁপড়ে জাতীয় কীট। তোমরা জান না, বেদেরা জানে, ও পাথর বিষশৈল—বিষপাথরে পরিণত হয়েছে। এই পাহাড়ের মাথায় ঘন বনে বাস করে শঙ্খচূড় নাগ। সাত-আট হাত লম্বা কালো রঙের ভীষণ বিষধর। তারা রাত্রে এসে দংশন করে বিষ ঢালে ওই পাথরের উপর। পাথরটা মরে গিয়েছে, গাছ তো গাছ, ওতে শ্যাওলা ধরবে না কখনও। সাপের বিষের এক ফোঁটায় মানুষ মরে, এক ফোঁটা পাথরের বুকে পড়লে পাথরের বুকও জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় চিরদিনের মত। পিঁপড়েগুলো ওই পাথরের বুকে চটচটে বিষকে রস মনে করে দল বেঁধে ছেয়ে ধরেছিল, বিষে জরে ধুলো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার চেয়ে ভীষণ হল এক টুকরো রুপো—এক বিন্দু সোনা। তারও চেয়ে ভীষণ হল আটন গো আটন।

নাগিনী কন্যার আটনে বসে মা-বিষহরির বারিতে ফুল জল দিয়ে কি করে সে সহ্য করবে বুড়ার অনাচার?

গতবার যখন এই ধন্বন্তরি বাবার এইখানেই তারা এল বিষ বিক্রি করবার জন্য, তখন কি সকলে শবলাকে বলে নি, বলে নিকন্যে, তু বুল সদ্দারকে—যার যা পাওনা সব এই ঠাঁইয়েই মিটিয়ে দিক? লইলে—

নোটন যে নোটন—মহাদেবের অতি অনুগত লোক—সেই নোটনও বলেছিল—গেল বারের হিসাবটা, সেও মিল না ই বছর তাকাত।

সেই কথাতে বিবাদ। নাগিনী কন্যা বিষহরির পূজারিণী, বেদেকুলের কল্যাণ করাই তার কাজ; সেই তার ধর্ম—এ কথা সে না বললে বলবে কে? এই বলতে গিয়েই তো বিপদ। ঝগড়ার শুরু। সে সবারই অধরম দেখে বেড়াবে, কিন্তু সে নিজে অধরম করবে তাতে কেউ কিছু বললে সে-ই হবে বজ্জাত!

বিষহরি পূজার প্রণামী-পূজার সামগ্ৰী ভাগও করবে নাগিনী কন্যা। কন্যের এক ভাগ, শিরবেদের এক ভাগ, বাকি দু ভাগ সকল বেদের। কন্যের ভাগ আবার হয় দু-ভাগ পুরনো নাগিনী কন্যে পায়, যে বেদের ঘরে বেদে নাই সে ঘরের মেয়েরা পায়। এই সব ভাগ নিয়ে বিবাদ। সমস্ত ভাল সামগ্রীর উপর দাবি ওই সর্দারের। হবে না-হবে না বিবাদ!

এ বিবাদ চিরকালের। চিরকাল এ বিবাদ হয়ে আসছে। কখনও জেতে শিরবেদে, কখনও জেতে কন্যে। কন্যে জেতে কম; জিতলেও সে জয় শেষ পর্যন্ত দাঁড়ায় পরাজয়ে। মা-বিষহরির পূজারিণী এই কন্যে, ও যে অন্তরে অন্তরে নাগিনী, ওকে দংশন করেই পালাতে হয়; না পারলে ঘটে মরণ। তা ছাড়া বেহুলার অভিশাপ ওদের ললাটে, হঠাৎ একদিন সেই অভিশাপের ফল। ফলে। দেহে মনে ধরে জ্বালা। রাত্রে ঘুম আসে না চোখে, মাটির উপর পড়ে অকারণে কঁদে। হঠাৎ মনে হয় যেন কে কোথায় শিস দিচ্ছে।

 

শিবরামের সঙ্গে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, সেই দিন রাত্রে শবলা তাদের আড্ডায় শুয়ে ছিল বিনিদ্র চোখে। ঘুম আসছিল না চোখে। মধ্যরাত্রের শেয়াল ডেকে গেল। গঙ্গার কূলের বড়। বড় গাছ থেকে বাদুড়েরা কালো ডানা মেলে উড়ে গেল এপার থেকে ওপার, এল ওপার থেকে এপার; গাছে গাছে পেঁচা ডেকে উঠল। বেদেনীর মাথার উপরে গাছের ডালে ঝুলানো ঝাঁপির মধ্যে বন্দি সাপগুলো যুঁসিয়ে উঠল। বেদেনীর অন্তরটাও যেন কেমন করে উঠল। গভীর রাত্রে ডাইনীর বুকের ভিতর খলবল করে ওঠে, শ্মশানে কালীসাধক মা-মা বলে ডেকে ওঠে, চোরডাকাতের ঘুম ভেঙে যায় শেয়ালের ডাকে, বিছানায় ঘুমন্ত রোগীও একবার ছটফট করে উঠবে। এই ক্ষণটিতে, ঠিক এই ক্ষণটিতে নাগিনী কন্যার অন্তরের মধ্যে কালনাগিনী স্বরূপ নিয়ে জেগে ওঠে; নিত্যই ওঠে। কিন্তু বিছানার খুঁট ধরে দাঁতে দাঁত টিপে নিশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকতে হয়। নাগিনী কন্যাকে। এই নিয়ম। কিছুক্ষণ পর বন্ধকরা নিশ্বাস যখন বুকের পাঁজরা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসবে মনে হয়—তখন ছাড়তে হয় নিশ্বাস। তারপর যখন হাপরের মত হাঁপায় বুকের। ভিতরটা তখন উঠে বসতে হয়। চুল এলিয়ে থাকলে চুল বেঁধে নিতে হয়, এঁটেসেঁটে নতুন করে কষে কাপড় পরতে হয়। বিষহরির নাম জপ করতে হয়। তারপর আবার শোয়। নাগিনী কন্যের অন্তরের নাগিনী তখন চোয়াল-টিপে-ধরা নাগিনীর মত হারমানে, তখন সে খোঁজে কাঁপি, অন্তরের ঝাপিতে ঢুকে নিস্তেজ হয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে। তা না করে যদি নাগিনী কন্যে বিছানা ছেড়ে ওঠে, বাইরে বেরিয়ে আসে তবে তার সর্বনাশ হয়।

রাতের অ্যাঁধার তার চোখে-মনে নিশির নেশা ধরিয়ে দেয়।

নিশির নেশা–নিশির ডাকের চেয়েও ভয়ঙ্কর। নিশির ডাক মানুষ জীবনে শোনে কালেকস্মিনে। নিশির নেশা রোজ নিত্য-নিয়মিত ডাকে মানুষকে। ওই হিজল বনের চারিপাশে জ্বলে আলেয়ার আলো। ঘন বনের মধ্যে বাজে বাঁশের বশি। হিজলের ঘাসবনে এখানে ডাকে বাঘ, ওখানে ডাকে বাঘিনী। বিলের এ-মাথায় ডাকে চকা, ও-মাথায় ডাকে চকী। বনকুকী পাখিরা পাখিনীদের ডাকে–পাখিনীরা সাড়া দেয়–

–কুক!

–কুক!

–কুক!

–কুক!

নাগিনীও পাগল হয়ে যায়। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড ভুলে যায়। ভুলে যায় মা-বিষহরির নির্দেশ, ভুলে যায় বেহুলার অভিশাপের কাহিনী, ভুলে যায় তার নিজের শপথের কথা। বেদের শিরবেদের শাসন ভুলে যায়, মানসম্মান পাপ-পুণ্য সব ভুলে যায়; ভুলে গিয়ে সে ঘর ছেড়ে নামে পথে। তারপর ওই ঘন ঘাসবনের ভিতর দিয়ে চলে—শনশন করে কালনাগিনীর মতই চলে। সমস্ত রাত্রি উদ্ভ্রান্তের মত ঘোরে; ঘাসবনের ভিতর দিয়ে, কুমিরখালার কিনারায় কিনারায়, হিজলের চারিপাশে ঘুরে বেড়ায়।

বাঁশি! কে বাঁশি বাজায় গ! কোথায় গ!

রাত্রির পর রাত্রি ঘোরে নাগিনী কন্যা। একদিন বেরিয়ে এলে আর নিস্তার নাই। রোজ রাত্রে নিশির নেশা ধরবে, যেন চুলের মুঠো ধরে টেনে নিয়ে যাবে।

এক নাগিনী কন্যেকে ধরেছিল এই নেশা তার প্রাণ গিয়েছিল বাঘের মুখে। এক নাগিনী কন্যের দেহ পাওয়া গিয়েছিল বিলের জলে। এক কন্যের উদ্দেশ মেলে নাই। হাঙরমুখী খালে পাওয়া গিয়েছিল তার লাল কাপড়ের ছেড়া খানিকটা অংশ। কুমিরের পেটে গিয়েছিল সে।

জন দুই-তিন পাগল হয়ে গিয়েছিল। হিজল বিলের ধারে সর্বাঙ্গে কাদা মেখে বসে ছিল, চোখ দুটি হয়েছিল কুঁচের মত লাল। কেউ কেবলই কেঁদেছে, কেউ কেবলই হেসেছে।

জন চারেকের হয়েছে চরম সর্বনাশ। সর্বনাশীরা ফিরেছে—ধৰ্ম বিসর্জন দিয়ে। কিছুদিন পরই অঙ্গে দেখা দিয়েছে মাতৃত্বের লক্ষণ। তখন ওই সন্তানকে নষ্ট করতে গিয়ে নিজে মরেছে। কেউ পালাতে চেয়েছে। কেউ পালিয়েছে। কিন্তু পালিয়েও তো রক্ষা পায় নি তারা। রক্ষা পায় না। হয় মরেছে বেদে-সমাজের মন্ত্ৰপূত বাণের আঘাতে নয়তো নাগিনী-ধর্মের অমোঘ নির্দেশে প্রসবের পরই নখ দিয়ে টুঁটি টিপে সন্তানকে হত্যা করেছে। ডিম ফুটে সন্তান বের হবামাত্র নাগিনী সন্তান খায়-নাগিনী কন্যাকেও সেই ধর্ম পালন করতেই হবে। নিষ্কৃতি কোথায়? ধর্ম ঘাড়ে ধরে করাবে যে!

নিশির নেশা—নাগিনী কন্যের মৃত্যুযোগ। রাত্রি দ্বিপ্রহর ঘোষণার লগ্নে চোখ বন্ধ করে, শ্বাস রুদ্ধ করে, দতে দত টিপে দু হাতে খুঁট অ্যাঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে নাগিনী কন্যে।

গঙ্গার কূলে বটগাছের তলায় খেজুর-চাটাইয়ের খুঁট চেপে ধরতে গিয়েও সেদিন শবলা তা ধরলে না। কি হবে ও? কি হবে? কি হবে? এত বড় জোয়ানটাই তার জন্যে প্রাণটা দিয়েছে। না হয় সেও প্রাণটা দেবে। তার প্রেতাত্মা যদি ওই গঙ্গার ধারে এসে থাকে? বুকের ভিতরটা তার হুহু করে উঠল। উঠে বসল সে খেজুর-চাটাইয়ের উপর।

আকাশ থেকে মাটির বুক পর্যন্ত থমথম করছে অন্ধকার। আকাশে সাতভাই তারা ঘুরপাক। খেয়ে হেলে পড়বার উদ্যোগ করছে। চারিদিকটায় দুপহর ঘোষণার ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। নিশির ডাক এরই মধ্যে লুকিয়ে আছে। বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠল। শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে, ধক-ধক-ধক-ধক। চোখে তার আর পলক পড়ছে না।

অন্ধকারের দিকে চেয়ে রয়েছে। গাছপালা মিশে গিয়েছে অন্ধকারের সঙ্গে, শহর ঢেকে। গিয়েছে অন্ধকারের মধ্যে, ঘাট মাঠ ক্ষেত খামার বন বসতি বাজার হাট মানুষ জন—সব-সবসব অন্ধকারের মধ্যে মিশে গিয়েছে। যেন কিছুই নাই কোথাও; আছে শুধু অন্ধকার–জগৎজোড়া এক কালো পাথা—র–

সে উঠল; এগিয়ে চলল। এগিয়ে চলল গঙ্গার দিকে। গঙ্গার উঁচু পাড় ভেঙে সে নেমে গিয়ে বসল—সেইখানটিতে, যেখানটিতে সেদিন সেই জোয়ান ছেলেটা তার জন্যে বসে ছিল। একটানা ছলছল ছলছল শব্দ উঠছে গঙ্গার স্রোতে, মধ্যে মধ্যে গঙ্গার স্রোত পাড়ের উপর। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছে। পাশেই একটু দূরে তাদের নৌকাগুলি দোল খাচ্ছে। ভিজে। মাটির উপর উপুড় হয়ে পড়ে সে কাঁদতে লাগল।

ইচ্ছে হল, সেও ঝাঁপ দেয় গঙ্গার জলে।

মা-গঙ্গা! মোর অঙ্গের জ্বালা তুমি জুড়িয়ে দিয়ে, মুছিয়ে দিয়ে। মা গঙ্গা! আমার জন্যে শুধু আমার জন্যে সে দিলে তার পরানটা! হায় রে! হায় রে!

তার বুকে জ্বালাও তো কম নয়। জ্বালা কি শুধু বুকে? জ্বালা যে সর্বাঙ্গে।

হঠাৎ মানুষের গলার আওয়াজে চমকে উঠল সে। চিনতে পারল সে, এ কার গলার আওয়াজ। বুড়ার! বুড়া ঠিক জেগেছে। ঠিক বুঝতে পেরেছে। দেখেছে, শবলার বিছানায় শবলা নাই।

মুহূর্তে শবলা নেমে পড়ল গঙ্গার জলে। একটু পাশেই তাদের নৌকাগুলি গাঙের ঢেউয়ে অল্প অল্প দুলছে। সে সেই নৌকাগুলির ধারে ধারে ঘুরে একটি নৌকায় উঠে পড়ল। এটি তারই নৌকা। লাগিনী কন্যের লা। মা-বিষহরির বারি আছে এই নৌকায়। উপুড় হয়ে সে পড়ে রইল বারির সামনে। রক্ষা কর মা, রক্ষা কর। বুড়ার হাত থেকে রক্ষা কর। নিশির নেশা থেকে শবলারে তুমি বাঁচাও। বেদেকুলের পুণ্যি যেন শবলা থেকে নষ্ট না হয়। জোয়ানটার প্রাণ গিয়েছে—তুমি যদি নিয়েছ মা, তবে শবলার বলবার কিছু নাই। কিন্তু মা গ, জননী গ, যদি মানুষে ষড়যন্ত্র করে নিয়ে থাকে তবে তুমি তার বিচার কোরো। সূক্ষ্ম বিচার তোমার মা–সেই বিচারে দণ্ড দিয়ে।

-–তুমি তার বিচার করো মা বিচার কোরো।

কখন যে সে চিৎকার করে উঠেছিল, সে নিজেই জানে না। কিন্তু সে চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল নৌকার পাহারাদারদের। তারা সভয়ে সন্তৰ্পণে এসে দেখলে শবলা পড়ে আছে বিষহরির বারির সম্মুখে। চিৎকার করছে—বিচার কোরো। বেদের ছেলেরা জানে, নাগিনী কন্যার আত্মা–সে মানুষের আত্মা নয়, নাগকুলের নাগ-আত্মা। বিষহরি তার হাতে পুজো নেবেন বলে তাকে পাঠান বেদেকুলে জন্ম নিতে। তার ভর হয়। চোখ রাঙা হয়ে ওঠে—চুল এলিয়ে পড়ে—সে তখন আর আপনার মধ্যে আত্মস্থ থাকে না। সাক্ষাৎ দেবতার সঙ্গে তার তখন যোগাযোগ হয়। বেদেকুলের পাপপুণ্যের পট খুলে যায় তার লাল চোখের সামনে। সে অনর্গল বলে যায়—এই পাপ, এই পাপ। হবে না–এমন হবে না?

বেদের ছেলেরা শিউরে উঠল ভয়ে। ভিজে কাপড়ে ভিজে চুলে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। নাগিনী কন্যে। হাত জোড় করে চিৎকার করছে—বিচার কোরো।

তারা নৌকাতে উঠছে নৌকা দুলছে—তবু হুঁশ নাই। এ নিশ্চয় ভর। এই নিশীথ রাত্রি এই চিৎকার, উঃ! চিৎকারে অন্ধকারটা যেন চিরে যাচ্ছে।

দেখতে দেখতে ঘুমন্ত বেদেরা জেগে উঠল। এসে ভিড় করে দাঁড়াল গঙ্গার কূলে। হাত জোড় করে সমবেত স্বরে চিৎকার করে উঠলরক্ষা কর মা, রক্ষা কর।

কিন্তু সর্দার কই? সর্দার? বুড়া? বুড়া কই?

ভাদু বেদে কলে–সর্দার! অ–গ! কই? কই?

কোথায় বুড়া? বুড়া নাই।

ভাদু শবলার কাকা। ভাদু বললে শবলার মাকে। প্রৌঢ়া সুরধুনী বেদেনীকে বললে—ভাজ বউ গ, তুমি দেখ একবার। কন্যেটারে ডাক।

বেদেনী ঘাড় নাড়লেনা দেওর, লারব। ওরে কি এখুন ছোঁয়া যায়?

–তবে?

–তবে সবাই মিল্যা একজোট হয়ে চিল্লায়ে ডাক দাও। দেখ কি হয়?

—সেই ভাল। লে গ,–সবাই মিল্যা একসাথে লে। হে—মা–

সকলে সুর মিশিয়ে দিলে একসঙ্গে।—হে মা-বিষহরি গ! স্তব্ধ নিশীথ রাত্রির সুষুপ্ত সৃষ্টি চকিত হয়ে উঠল। ধ্বনির প্রতিধ্বনি উঠল গঙ্গার কূলে ও-পাশের ঘন বৃক্ষসন্নিবেশে, ছুটে গেল এ পারের প্রান্তরে, ছড়িয়ে পড়ল দিগন্তরে। শবলার চেতনা ফিরে এল। সে মাথা তুললে।—কি?

পরমুহূর্তেই সে সব বুঝতে পারলে। তার ভর এসেছিল। দেবতা তার পরান পুতলির মাথার উপর হাত রেখেছিলেন। শরীরটা এখনও তার ঝিমঝিম করছে। তবু সে উঠে। বসল।

উঠিছে, উঠে বসিছে, কন্যে উঠে বসিছে গ!–বললে জটাধারী বেদে।

বেদেরা আবার ধ্বনি দিলে—জয় মা-বিষহরি!

টলতে টলতে বেরিয়ে এল শবলা।

—ধর গ। ভাজবউ, কন্যেরে ধর। টলিছে।

সুরধুনী বেদেনী এবার জলে নামল।

–কি হছিল কন্যে? বেটি?

শবলা বললে–মা দেখা দিলেন গ। পরশ দিলেন।

—কি কইলেন?

–কইলেন? চোখ দুটো ঝকমক করে উঠল তার। সে বললে—সূক্ষ্ম বিচার করবেন না। সুতার ধারে সূক্ষ্ম বিচার।

ঠিক এই সময় তটভূমির উপর কুকুরের চিৎকার শোনা গেল। সকলে চমকে উঠল।

কি সে গলার আওয়াজ কুকুরের! একসঙ্গে দু-তিনটে চিৎকার করে ছুটে আসছে। কাউকে যেন তাড়া করে আসছে।

ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়াল দৈত্যের মত একটা মানুষ।

সর্দার! শিরবেদে!

তার পিছনে ছুটে আসছে দুটো মুখ-থ্যাবড়া সাদা কুকুর।

লাঠি! ভাদু লোটন, লাঠি! খেয়ে ফেলবে, ছিঁড়ে ফেলাবে!

সঙ্গে সতে ই এল লাঠি লোহার ডাণ্ডা। চিৎকার ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

 

কামড়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে মহাদেবকে।

–হুই বড় বাড়িটার পোষা বিলাতি কুকুর! হুই!

মহাদেব গিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে ভিতরে লাফিয়ে পড়বামাত্র তাড়া করেছিল। পাঁচিল ডিঙিয়েই সে পালিয়ে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে তারাও এসেছে। সারাটা পথ মধ্যে মধ্যে দাঁড়িয়ে ঢেলা ছুঁড়ে রুখতে চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নাই। ঢেলা তারা মানে নাই। হাতে একটা লোহার ডাণ্ডা ছিল। লাফ দিয়ে পড়বার আগে সে পঁচিল থেকে ডাণ্ডাটা ভিতরে ছুঁড়ে ফেলেছিল সেটা আর কুঁড়িয়ে নেবার অবকাশ হয় নাই। তার আগেই কুকুর দুটো এসে পড়েছিল।

–কিন্তুক হোথাকে গেছিলি ক্যানে তু?

–ক্যানে? মহাদেবের ইচ্ছে হল শবলার টুঁটিটা হাতের নখে বিঁধে ঝাজরা করে দেয়। সে তাকাল শবলার দিকে।

শবলার চোখ দুটি ফুঁ-দেওয়া আঙরার মত ধকধক করে উঠল। সে বললে কুকুরের কামড়ে মরবি না তু। মরবি তু লাগিনীর পাঁতে। মা বুলেছে আমাকে। আজ তার সাথে আমার বাত হল্ছে। সূক্ষ্ম বিচার করবেন জননী।

মহাদেব চিৎকার করে উঠল—পাপিনী!

মুহূর্তে তার হাত চেপে ধরে ভাদু প্রতিবাদে চিৎকার করে উঠল—সর্দার!

মহাদেবও চিৎকার করে উঠল—অ্যাই! হাত ছাড়া পাপিনীরে আমি–

—আঃ! মুখ খ্যা যাবে তুর। সারা বেদেপাড়া দেখেছি—কন্যের পরে আজ জননীর ভর হছিল। উ সব বুলিস না তু। তু দেখলি না—তুর ভাগ্যি।

শবলা হেসে বললে—উ গেলছিল আমাকে খুঁজতে। সে দিনে আমি উ-বাড়ির রাজাবাবুকে লাচন দেখছি, গায়েন শোনাল্ছি; বাবু আমাকে টকটকে রাঙারবন শাড়ি দিছে, তাই উ রেতে আমাকে বিছানাতে না দেখে গেছিল আমার সন্ধানে হোথাকে। ভেবেছিল আমি পাপ করতে গেছি। ইয়ার বিচার হবে। মা আমাকে কইলেন বিচার হবে, সূক্ষ্ম বিচার হবে।

স্তব্ধ হয়ে রইল গোটা দলটা। শঙ্কা যেন চোখে মুখে থমথম করছে।

স্থিরদৃষ্টিতে মহাদেব তাকিয়ে রইল শবলার মুখের দিকে। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন উঠল, সত্যিই শবলা মা-বিষহরির বারির পায়ের তলায় ধ্যান করছিল? মা তাকে ডেকেছিলেন? হাতপায়ের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে, কিন্তু মহাদেবের তাতে গ্রাহ্য নাই। পায়ের ক্ষতটাই বেশি। খানিকটা মাংস যেন তুলে নিয়েছে। তার ক্ৰক্ষেপ নাই। সে ভাবছে। শবলা বললে রক্তগুলান ধুয়ে ফেল বুড়া, আমার মুখের দিকে তাকায় থেক্য কি করব? কি হবেক? লে, ধুয়ে ফেল, খানিক রেড়ির তেল লাগায়ে লে। বিলাতি কুকুরের বিষ নাই, কুকুরের মতুন ঘেউ ঘেউ করা চেঁচায়ে ত মরবি না। উ কামড়ে মরণ নাই তুর ললাটে, কিন্তুক উঁটুরে উঠে পাকলি পর কষ্ট পাবি। আর–

ভাদুর মুখের দিকে চেয়ে বললে—আর মরা কুকুর দুটারে লায়ে করে নিয়া মাঝগাঙে ভাসায়ে দে। সকালেই বাবুর বাড়িতে কুকুরের খোঁজ হবেক। চারিদিকে লোক ছুটবেক। দেখতে পেলে মরণ হবে গোটা দলের। বুঝলা না? ভাসায়ে দিয়া আয়। আর শুন। ভোর হতে হতে আস্তানা গুটায় লে। লায়ে লায়ে তল্যা দে চিজবিজ। ইখানে আর লয়।

মহাদেব স্তব্ধ হয়েই রইল। কোনো কথা সে বললে না। কিন্তু রাত দুপ্রহরেই সেই। ঘোরালো লগনটিতে-পেঁচার ডাকে শিবাদের হাঁকে, গাছের সাড়ায় বাদুড়ের পাখার ঝাপটানিতে, ঠিক নিশি যখন জাগল-ইশারা পাঠালে পরানে পরানে ঠিক তখনই সেই মুহূর্তটিতেই যে তারও ঘুম ভেঙেছিল। নিত্যই যে ভাঙে। শিরবেদের ঘুম ভাঙে মা-বিষহরির। আজ্ঞায়, শিরবেদে উঠে তার লোহার ডাণ্ডা হাতে–দণ্ডধরের মত বেদেকুলের ধমের পথ রক্ষা। করে। লগনটি পার হয়তখন মহাদেব ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ায় দধিমুখী বেদেনীর ঘরের ধারে। দধিমুখীও জাগে, সেও বেরিয়ে আসে। তখন শিরবেদে আর দণ্ডধর নয়। সে তখন সাধারণ মনিষ্যি।

এখানেও আজ কদিন এসেছে। মহাদেবের ঠিক লগনে ঘুম ভেঙেছে ঘুম ভেঙেছে নয়, মহাদেব এ লগনের আগে এখানে ঘুমায় নাই। সে সতর্ক হয়ে লক্ষ্য রেখেছিল—ওই জোয়ানটার। দিকে। পাপিনী কন্যের দিকে তো বটেই। জোয়ানটা গিয়েছে। মা-বিষহরির আজ্ঞায় সে ছেড়েছিল ওই রাজ গোখরাটাকে। বলেছিলপাপীর পরান তু লিবি ত লাককুলের রাজপুর বিচারের ভার তোরে দিলাম। জোয়ানটার পিছনে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। বাঁশের চোঙায় পুরে দড়ি টেনে খুলে দিয়েছিল চোঙার মুখের ন্যাকড়াটা।

পাপী জোয়ানটা গিয়েছে। কিন্তু–। সে ভেবেছিল, একসঙ্গে দুজনে যাবে। পাপী-পাপিনী দুজনে। কিন্তু জোয়ানটা একা গেল।

আজ সেই লগনে উঠে সে স্পষ্ট দেখেছে, নাগিনী উঠল—কালনাগিনী—বটগাছটাকে বেড় দিয়ে ওপাশে গেল। সেও সন্তৰ্পণে তার পিছনে পিছনে বটগাছটার এপাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। চোখে পড়েছিল অন্ধকারের মধ্যে বড় বাড়িটার মাথায় জ্বলজ্বলে আলোটা। মনে পড়েছিল, ওই বাড়িতে শবলা রাঙা শাড়ি, ষোল আনা বকশিশ পেয়েছে—সেই কথা, রাঙাবরন সোনার রাজপুত্রের কথা অন্য বেদেনীদের কাছে শবলাকে বলতেও সে নিজের কানে শুনেছে। পাপিনীর চোখে নিশির নেশার ঘোরের মত ঘোর জমতে দেখেছে।

পাপিনী নাগিনী কন্যের বুকে তা হলে কাঠালীচাপার বাসের ঘোর জেগেছে! সেই ঘোরে। দিশা হারিয়ে সে নিশ্চয় গিয়েছে ওই বড় বাড়ির পথে—সেই সোনার বরন রাজপুত্রের টানে টানে। স্থিরদৃষ্টিতে শিরবেদে তাকিয়ে রইল ওই পথের দিকে। কত দূরে চলেছে সে পাপিনী! হঠাৎ এক সময় মনে হল—এই যে, সাদা কাপড় পরা কালো পাতলা মেয়েটা লঘুপায়ে ছুটে চলে যাচ্ছে! শনশন করে চলে যাচ্ছে কালনাগিনীর মত। ওই যে! সেও ছুটল।

কোনোদিকে সে চোখ ফেরায় নি। সাদা কাপড় পরা কালো পাতলা মেয়েটাকেসে যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে চলতে দেখেছে। নাগিনীর পায়ে পাখা গজায়-এই লগে; সে হাঁটে না, উড়ে চলে। ঠিক তাই। পিছনে সাধ্যমত দ্রুত পায়ে মহাদেব তাকে অনুসরণ করেছে, সে ছুটেছে। ওই পাচিলের কোল পর্যন্ত আসতে ঠিক দেখেছে।

পঁচিলের এপারে তাকে দেখতে না পেয়ে সে পাচিলের উপর উঠে বসেছিল। কুকুরে করেছিল তাড়া। পালিয়ে আসতে সে বাধ্য হয়েছিল।

তবে? তবে এ কি হল? সেই কন্যে এখানে মা মনসার বারির সামনে কেমন করে এল?

যেমন করেই আসুক, বেদেদের কাছে তার মাথা হেঁট হয়ে গেল। নাগিনী তার সে হেঁট। মাথার উপর ফণা তুলে দুলছে। যে-কোনো মুহূর্তে ওকে দংশন করতে পারে।

উঠ বুড়া, উঠ। লা ছাড়বে।–বললে শবলা।

ভোর হতে না হতে বেদেদের নৌকা ভাসল মাঝ-গঙ্গায়।

দক্ষিণে–দক্ষিণে। স্রোতের টানে ভাসবে লা। দক্ষিণে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *