১৫. কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে
শীতের বিকেল।
কম্পাউন্ডের মধ্যে লাঠি হাতে বার পাঁচেক পাক দিয়ে অমৃতবাবু বেঞ্চিতে এসে বসলেন।
ওপাশে আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বেঞ্চির ওপর পা তুলে বসেছিলেন বিভূতিবাবু। পাশে মহিমাবাবু। গায়ে পুরনো একটা অলেস্টার। মাথায় মাংকি-ক্যাপ।
অমৃতবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, পৌষ সংক্রান্তিটা কবে?
ওদিকের বেঞ্চিতে শচীনবাবু বিকেলের ম্লান আলোতেও কাগজ পড়বার চেষ্টা করছিলেন। বয়েস এঁদের চেয়ে কিছু কম। রসিকতা করে তিনি বললেন, পৌষ সংক্রান্তিটা পৌষ মাসের শেষ দিন।
–আহা তা তো জানি। ইংরিজির কত তারিখ?
এবার আর শচীনবাবু উত্তর দিতে পারলেন না।
তা সংক্রান্তির খোঁজ কেন? পিঠে খেতে ইচ্ছে করছে নাকি? অমৃতবাবুর দিকে মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে মহিমাবাবু হা-হা করে হাসলেন।
-হ্যাঁ, কত দিন যে পিঠে খাইনি!
—তা গিন্নিকে বলবেন। পিঠে ভেজে দেবেন।
–তা হলেই হয়েছে। ওসব পাট বহুকাল চুকে গিয়েছে। বৌমাও পিঠে করতে জানেন না।
–যা বলেছেন। বিভূতিবাবু নড়ে চড়ে বসলেন।
–এমন শীতে বেগুন পোড়া কঁচা লংকা দিয়ে খাব তার উপায় নেই। বৌমাকে বললাম, তো উনি বললেন, গ্যাসের উনুনে বেগুন পোড়াব কি করে?
শচীনবাবু বললেন, আমি তো এই জন্যেই গ্যাসের উনুন নিইনি।
বিভূতিবাবু বললেন, বেগুন পোড়ানো যাবে না বলেই গ্যাস-উনুন নেননি।
-না, ঠিক তা নয়। তবে অন্যতম কারণ বটে।
–তা বাকি কারণগুলি কি? অ্যাকসিডেন্ট?
–নিশ্চয়। প্রায়ই তো শুনি গ্যাস লিক করে আগুন ধরে গেছে।
–তা কয়লার উনুনে কি অ্যাকসিডেন্ট হয় না? এখন কি-সব শাড়ি উঠেছে–সিন্থেটিক না কি ছাইভস্মতা সেই সিন্থেটিক শাড়ির আঁচলটি একবার উনুনে পড়লেই
অমৃতবাবু হাসলেন। ঠিক বলেছেন। একবার আঁচল ধরলেই আর দেখতে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে বধূহত্যার দায়ে বাড়িসুদ্ধ সকলের কোমরে দড়ি। তা পুত্রবধূই হন আর নিজের বৃদ্ধা বধূই হন।
–তা বটে। কোনটে যে অ্যাকসিডেন্ট আর কোনটে যে আত্মহত্যার প্ররোচনা, কে বিচার করবে? বাড়ির বৌ মরল তো ধর ছেলেকে আর ছেলের বাপকে।
অ্যাকসিডেন্ট কি শুধু আগুনে পুড়েই হয়? এ বাড়িতেই সেদিন কী কাণ্ডটা হতে যাচ্ছিল ভাবুন তো। সে তো আমরা চোখের সামনেই দেখলাম।
–হ্যাঁ। ভাগ্যি ঠিক সময়ে ডাক্তারবাবু এসে পড়েছিলেন?
–কিন্তু ছেলেকে নিয়ে ঝাঁপ?
–অশান্তিটা বোধহয় খুবই গুরুতর। নিচুগলায় বললেন বিভূতিবাবু।
–একে ডাক্তার তার ওপর যোয়ান বয়েস। আবার হাসপাতালে নার্সদের নিয়ে কাজ-করবার…!
-কিন্তু উনি কি সত্যিই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন?
তাছাড়া কি?
তাছাড়াও ব্যাপার আছে মশাই, ব্যাপার আছে। আমার ওয়াইফ তো সঙ্গে সঙ্গে ওপরে গিয়েছিলেন। নিজে কানে শুনেছেন কিছু-একটা দেখে ভয় পেয়ে নাকি ঝাঁপ দিতে গিয়েছিল।
মহিমাবাবুর কথায় হঠাৎ যেন সবাই থমকে গেলেন। অমৃতবাবু আরও কাছে সরে এসে বললেন, তাঁ, ব্যাপার যে কিছু আছে সে বিষয়ে আমারও সন্দেহ নেই। মনে আছে মাস দেড়েক আগে অনেক রাত্তিরে ওপরের ঘরে চেঁচামেচি?
–হ্যাঁ, গেলাস ভাঙার শব্দ?
ডাক্তার তো বলে দিলেন বেড়ালে ভেঙেছে। কিন্তু আমার খটকা যায়নি।–তা তো বটেই। অবশ্য আর কী-বা হতে পারে? চোর-ডাকাত হলে ধরা পড়ে যেত।
যাই হোক ব্যাপারটা রহস্যজনক।
রহস্যজনক বলে রহস্যজনক। পুরনো বাড়ি। কী দোষ আছে কে জানে!
–তুমি থামো বিভূতিবাবু! সন্ধেবেলা আর ভয় ঢুকিয়ে দিয়ো না। মনে রেখো আমরাও এক বাড়িতে থাকি।
-কিন্তু একটা মীমাংসা হওয়ার তো দরকার।
–কিসের মীমাংসা?
—বাড়িতে যদি কোনো দোষ থাকে–
–দোষ থাকলেই কি আমরা বাড়ি ছাড়তে পারব?
সবাই একটু থমমত খেয়ে শচীনবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
শচীনবাবু কাগজটা ভাঁজ করতে করতে বললেন, আমি তো পারব না। এত কম ভাড়ায়, সেলামী ছাড়া আর কোথায় বাড়ি পাব?
যুক্তি অকাট্য। সত্যিই তো। যতই ভূতের উপদ্রব হোক এ বাড়ি ছাড়া যাবে না। ভূতের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু একটা বাড়ি ছেড়ে দিলে বাড়ি পাওয়া দায়।
শাস্তি-স্বস্ত্যয়ন তো করা যায়।
–তা যায়। তবে তার আগে আসল ব্যাপারটা জানা দরকার।
–তাহলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করতে হয়।
—ডাক্তার কিছু বলবে মনে করেছ? দেখছ না লোকটা কারো সঙ্গে মেশে না।
তা হোক, তবু একবার সবাই মিলে–ঐ তো ডাক্তার ফিরছেন। চলোচলো-খুব উৎসাহে বিভূতিবাবু সবাইকে বললেন বটে কিন্তু আর নাড়তে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত শচীনবাবু একাই এগিয়ে গেলেন।
-নমস্কার, ডাক্তারবাবু।
নমস্কার, ভালো আছেন?
–এই চলছে আর কি! আপনার কথাই এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম। আপনার স্ত্রী এখন কেমন আছেন?
–ভালোই আছেন। কেন বলুন তো?
–যাক। নিশ্চিন্ত হলাম। সেদিন যা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল–খুব সময়ে আপনি এসে পড়েছিলেন। তারপরই উনি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
হ্যাঁ, নার্ভাস ব্রেকডাউন। সঞ্জয় সংক্ষেপ করতে চাইল।
ইতিমধ্যে সকলেই এসে দাঁড়িয়েছেন সঞ্জয়কে ঘিরে। মহিমাবাবু বললেন, এমনি-এমনি কি নার্ভাস ব্রেকডাউন হয় ডাক্তারবাবু? নিশ্চয়ই কোনো কিছুতে ভয় পেয়েছিলেন।
ভয়! না না, ভয় কিসের? কলকাতার মতো জায়গায় আমরা সকলে মিলে মিশে রয়েছি–একবার চেঁচিয়ে উঠলে পাঁচজনে ছুটে আসবে। এখানে চোর-ডাকাতের সাধ্য কি ঢোকে। না-না, কোনো ভয় নেই। নিশ্চিন্তে থাকুন। বলতে বলতে সঞ্জয় সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।
মহিমাবাবুরা কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখলেন তো। আমাদের কিছু বলতেও দিলে না।
ও দিকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বিরক্ত সঞ্জয় মনে মনে বলল, এদের জন্যেই দেখছি বাড়িটা ছাড়তে হবে। প্রেস্টিজ বলে কিছু আর রইল না।
.
১৬.
মিস থাম্পির জীবনকথা
পুপুর জ্বর ছেড়ে গেছে–খবরটা ডাক্তার রুদ্র আগেই ফোনে পেয়েছেন। তবু এদিন সন্ধ্যায় এলেন। এসে রীণাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?
রীণা ম্লান হেসে বলল, ভালো। কি খাবেন বলুন, চা না কফি?
কফিই করো।
রীণা রান্নাঘরে ঢুকল।
ঘরে ছিলেন বন্দনার মা। রীণা অসুস্থ হবার পর থেকে উনি প্রায়ই আসেন। তিনিও উঠে রীণার সঙ্গে রান্নাঘরে গেলেন। রীণা এখন বেশ সুস্থ। তবু তার চোখের চাউনিতে একটা উদভ্রান্তভাব। ডাঃ রুদ্রের তা লক্ষ্য এড়ায়নি।
বন্দনার মা রীণাকে বললেন, আপনি গল্প করুন, আমি কফি করছি।
কলকাতায় মান্তু ছাড়া রীণা এই একজন মানুষকে কাছে পেয়েছে। বাড়ির অন্য ভাড়াটেদের স্ত্রীরা কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতির। কারো পরের সংসারের ওপর মাত্রাতিরিক্ত কৌতূহল, কেউ-বা ঈর্ষাকাতর। বন্দনার মা-ই ব্যতিক্রম। অল্প কথা বলেন, রীণার ওপর তাঁর যেন সত্যিকারের মেহ, রীণাও যেন একজন দিদি পেয়েছে।
কফির পেয়ালার চুমুক দিয়ে ডাক্তার রুদ্র বললেন, তোমরা তো মিস থাম্পিকে দেখলে। আমার দুর্ভাগ্য তাঁকে দেখতে পেলাম না। খবর পেলে নিম্ম আসতাম। বলে সঞ্জয়ের দিকে তাকালেন।
সঞ্জয় অপরাধীর মতো বলল, আপনি যে ওঁর সম্বন্ধে এত ইন্টারেস্টেড কি করে জানব বলুন। জানলে নিশ্চয় খবর দিতাম।
–আবার যদি কখনো আসেন তাহলে খবর দিতে ভুল না। ইংরিজি একটা ম্যাগাজিনে ওঁর লাইফহিস্ট্রি পড়ে অবাক হয়েছিলাম। ওঁর মতো spiritualist এখন সারা ভারতে নেই। অথচ মজার কথা প্রথম জীবনে উনি ছিলেন নামকরা সম্মোহনবিদ। ওঁর জীবনটাই ইনটারেস্টিং। সম্মোহনবিদ থাকার সময়ে তরুণী বয়েসে তিনি একবার তার সেই শক্তির অপব্যাবহার করেছিলেন। অবশ্যই তার একটা কারণ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওঁর অনুশোচনা হয়। অনুশোচনা থেকেই আসে পরিবর্তন। তিনি হিপনোটিজ ছেড়ে দেন। শুরু হয় জীবনের আর এক নতুন অধ্যায় স্পিরিচুয়ালিজমের সাধনা।
ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। তারপর বললেন, সঞ্জয় তুমি তো জান মেসমেরিজম্ নিয়ে আমিও কিছু পড়াশোনা করছি। কাজেই ও সম্বন্ধে আমি যদি কিছু বলি তাহলে নিশ্চয় অনধিকারচর্চা হবে না।
বলে তিনি একটু হাসলেন।
রীণা জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, হিপনোটিজম্ আর মেসূমেরিজম্ কি এক?
বন্দনার মা চলে যাচ্ছিলেন, রীণা তার হাত ধরে বলল, বসুন না।
বন্দনার মা বসলেন।
ডাঃ রুদ্র বললেন, হ্যাঁ, একই। বাংলায় এর নাম সম্মোহন।
সঞ্জয় বলল, তা হলে ম্যাজিসিয়ানরা যে হিপনোটিজমের খেলা দেখায় সেও কি এই সম্মোহন?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, কতকটা। তবে প্রকৃত সম্মোহনবিদরা কিন্তু একটু তাকিয়েই অপরকে সম্মোহিত করতে পারেন। এমন কি গল্প করতে করতেও এ বিদ্যা প্রয়োগ করতে পারেন। এমনও দেখা গেছে, এক জন পাকা সম্মোহনবিদ অনেক দূরের কোনো মানুষকে সম্মোহিত করেছেন। আমাদের দেশের কাঁপালিক বা ডাইনিরা কতকটা এই জাতীয় একটি বিদ্যায় পটু ছিলেন। তাকে বলে বশীকরণ। মানুষ বশ করতে ওস্তাদ ছিলেন তাঁরা। তবে তার জন্যে যে সাধনার প্রয়োজন তা অনেকের পক্ষেই করা সম্ভব হতো না। অল্পস্বল্প যেটুকু শক্তি তারা অর্জন করতেন তার বেশির ভাগটাই প্রয়োগ করতেন ব্যক্তিগত স্বার্থে। এখন তাদের কথা থাক। আমার বক্তব্য মেসমেরিজ।
ফ্রেডারিক অ্যান্টনী মেমার এই সম্মোহিনী শক্তির আবিষ্কার। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকের লোক। এক বার জাহাজডুবি হয়ে এই জার্মান ভদ্রলোক ভাঙা মান্তুল আঁকড়ে ভাসতে ভাসতে অজানা জঙ্গলভরা এক তীরে এসে ঠেকলেন। রাতে আশ্রয় নিলেন একটা গাছে। সকাল হলে দেখেন গাছের নিচে এক বিরাট অজগর মড়ার মতো পড়ে আছে। বুদ্ধিমান মেমার তখনি গাছ থেকে নামলেন না। তিনি লক্ষ্য করতে লাগলেন। একসময়ে দেখলেন সাপটা পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর আকাশ থেকে উড়ন্ত পাখি এসে পড়ছে তার মুখে। মেম্বার অবাক হলেন–এ কি করে সম্ভব? সাপের চোখের চাউনিতে এমন কোন শক্তি আছে যাতে আকাশের পাখি ছুটে এসে পড়ছে তার মুখে?
এই ভাবনা থেকে শুরু হল সাধনা। সেই সাধনার ফলশ্রুতি সম্মোহন-বিদ্যা। তাই এই সম্মোহন-বিদ্যার একটা নাম মেসমেরিজ। কিন্তু এ তো অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্যাপার। তার ঢের আগে তিব্বত, চীন, ভারতে এই মহাবিদ্যার চর্চা শুরু হয়েছিল। পশ্চিমী দেশগুলি এই বিদ্যাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসার কাজে লাগিয়েছিল। প্রাচ্যের দেশগুলি ত পারেনি।
এই পর্যন্ত বলে ডাঃ রুদ্র একটু থামলেন। একটা চুরুট ধরিয়ে আবার শুরু করলেন, মিস থাম্পি প্রথম জীবনে এই সম্মোহনবিদ্যার চর্চা করে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র দশ বছর, তখন তাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল এক জাদুকরী। জাদুকরীটি ঝাড়ফুঁক করত, সম্মোহনশক্তিও ছিল অসাধারণ। তার বোধহয় ইচ্ছা ছিল থাম্পিকে সে উত্তরাধিকারিণী করে যাবে। তাই সেই বালিকা বয়স থেকেই তাকে সম্মোহনবিদ্যায় তালিম দিতে থাকে। বেশ কিছুকাল পরে পুলিশ যখন জাদুকরীর হাত থেকে থাম্পিকে উদ্ধার করে তখন সে একজন পাকা সম্মোহনবিদ।
বাড়ি ফিরে আসার পর মিস থাম্পি পড়াশুনা শুরু করেন পুরোদমে। তিনি যথেষ্ট মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বেশি পরিচিত ছিল ধনীকন্যা বলে। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো মিস থাম্পির মনটাও ছিল সংসারী। তিনিও চাইতেন একজন দায়িত্বশীল মমতাময় স্বামী। মিস থাম্পি ভালো করেই জানতেন যে তিনি সুশ্রী নন। তবু তিনি মনে মনে অপেক্ষা করতেন এমন কারও জন্যে যিনি শুধু তার বাইরের চেহারাটাই দেখবেন না, যাঁর উদার হৃদয়ে তার জন্যে ভালোবাসার আসন পাতা থাকবে। কিন্তু বহুদিন অপেক্ষা করেও এমন কাউকেই পেলেন না যিনি স্বেচ্ছায় ভালোবেসে তাকে ঘরে নিয়ে যাবেন। ধনী পিতার কন্যা হিসেবে বিবাহের সম্বন্ধ তাঁর অনেক এসেছিল। কিন্তু সে সবই তিনি নাকচ করে দিয়েছিলেন। পাত্রপক্ষের লক্ষ্য যে তাঁর বাপের টাকা তা তিনি বুঝতেন।
এমনি সময়ে মিস থাম্পি এক অধ্যাপকের সান্নিধ্যে আসেন। দর্শনের অধ্যাপক। সুদর্শন, ধীর, স্থির, জ্ঞানদীপ্ত মানুষটি। এই প্রথম মিস থাম্পি দুর্বল হয়ে পড়লেন। কিন্তু অপর পক্ষে তেমন চাঞ্চল্য নেই, অথচ তিনি যে একটু বিশেষ চোখে তাঁকে দেখেন, তাঁকে একটু বিশেষ যত্ন নিয়ে পড়াতে চান থাম্পি তা বেশ বুঝতে পারেন।
থাম্পি যখন বুঝলেন–এই সুপুরুষটির সব গুণই আছে নেই শুধু এগিয়ে আসার সাহস, তখন তিনি নিজেই অধ্যাপকের কাছে বিয়ের ইচ্ছা জানালেন।
অধ্যাপক সস্নেহে তার মাথায় হাত রেখে বললেন, তুমি আমার ছাত্রী। আমাদের সম্পর্ক সেইরকম হওয়াই উচিত। তা ছাড়া আমার বিয়ে অন্যত্র স্থির হয়ে আছে।
এ কথায় থাম্পির দুচোখ জ্বলে উঠল। তিনি অধ্যাপকের কথা বিশ্বাস করলেন না। যদি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিকই হয়ে থাকত, তা হলে তার হাবভাব অন্যরকম হত। সেরকম তো কিছু লক্ষ্যে পড়েনি।
মিস থাম্পি ক্ষুব্ধ অভিমানে বললেন, মিথ্যে কথা বলে আমায় ভোলাচ্ছেন কেন? বললেই তো পারেন আমাকে আপনার পছন্দ নয়।
অধ্যাপক লজ্জিত হয়ে বললেন, বিশ্বাস কর অন্য একজনের সঙ্গে আমি engaged.
মিস থাম্পি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, একথা আগে আমাকে বলেননি কেন? একটা মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা?
অধ্যাপক বললেন, তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে, শান্ত হয়ে ভাবার চেষ্টা করো। আমার দিক থেকে তোমার সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি বা এমন কোনো কথা বলিনি যাতে তোমাকে ঠকানো হয়।
কিন্তু মিস থাম্পির ধৈর্য ধরে ভাবার অবস্থা ছিল না। তার শুধু একটা কথাই মনে হল অধ্যাপক তাকে পছন্দ করেননি। যদি পছন্দ করতেন তা হলে অন্য মেয়েকে ছেড়ে তার কাছেই আসতেন। এনগেজড় তো কি হয়েছে? তাকে তো আর তিনি বিয়ে করেননি। পুরুষের জীবনে অমন কত মেয়ে রঙীন স্বপ্নচোখ নিয়ে আসে তার পর একদিন সে স্বপ্ন ছুটে যায়।
এরপর মিস থাম্পি আর অধ্যাপকের সামনে আসেন নি। দূরে দূরে রইলেন। কিন্তু চুপ করে বসে রইলেন না। চেষ্টা করতে লাগলেন অধ্যাপককে জব্দ করবার।
একদিন অধ্যাপক ক্লাস নিতে ঢুকছেন। হঠাৎ তার মাথাটা কিরকম টলে উঠল। চোখে যেন ধোঁয়া ধোঁয়া দেখলেন। তবু ক্লাস করতে গেলেন। কিন্তু লেকচার দিতে গিয়ে সব ঘুলিয়ে ফেললেন। ছাত্ররা তো অবাক। তারা বলল, স্যার, আপনার বোধহয় শরীর খারাপ। চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
বাড়ি এসেই অধ্যাপক শুয়ে পড়লেন। ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে এল।
এরপর থেকে রোজই তার লেকচার এলোমেলো হতে লাগল। ছাত্ররা বিরক্ত হয়ে প্রিন্সিপ্যালকে জানাল। প্রিন্সিপ্যাল শেষ পর্যন্ত একদিন আড়ালে দাঁড়িয়ে তাঁর লেকচার শুনলেন। বুঝলেন অধ্যাপক ঠিক সুস্থ মস্তিষ্কে নেই। তিনি তখন তাঁকে ছুটি নিতে বাধ্য করালেন।
এরই মধ্যে একদিন রাত্তিরে হঠাৎ অধ্যাপক মিস থাম্পির বাড়ি গিয়ে হাজির।
মিস থাম্পি কিছুমাত্র অবাক না হয়ে শ্লেষের সুরে বললেন, হঠাৎ কি মনে করে আমার কাছে?
অধ্যাপক ঘুমের ঘোরে উত্তর দিলেন, তুমি যে আমায় ডাকলে।
–আমি ডাকলাম? মিস থাম্পি হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, যদি ডেকেই থাকি তাহলেও কি আমার মতো নগণ্য একটা মেয়ের বাড়িতে এই রাত্তিরে আপনার মতো এক জন বিশিষ্ট অধ্যাপকের আসা উচিত?
অধ্যাপক এর উত্তর দিতে পারেন নি। তাঁর দুচোখ তখন ঘুমে জড়িয়ে আসছিল।
এমনিভাবেই মিস থাম্পি এক নিরীহ অধ্যাপককে সম্মোহিত করে নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠলেন। প্রায় প্রতিদিন গভীর রাত্রে অধ্যাপককে ডেকে নিয়ে আসেন। এক বিকৃত ভোগের খেলায় মেতে থাকেন তিনি। তাকে খুশি করেই অধ্যাপক ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙলে তার আর কিছুই মনে থাকে না। তিনি শুধু অবাক হয়ে যান। মিস থাম্পির বিছানায় শুয়ে আছেন দেখে তিনি ভীষণ লজ্জা পান। ছিঃ ছিঃ এ কী করে সম্ভব বলতে বলতে ছুটে পালিয়ে যান।
মিস থাম্পি এতে এক ধরনের আনন্দ পান বটে কিন্তু ঠিক সুখ পান না। এ যেন জোর করে কৃত্রিম উপায়ে পুরুষসঙ্গ আদায় করা। তা তো তিনি চান নি। তিনি চেয়েছিলেন ভালোবাসা।
তবু তিনি অধ্যাপককে ছাড়তে পারেন নি। বেঘোর অবস্থাতেও যদি মানুষটা দুটো ভালোবাসার কথা বলেন, যদি কাছে টানেন তাহলে সেইটুকুই লাভ। রক্তমাংসের ঐ দেহটা যে কিছুক্ষণের জন্যেও তাঁরই–অন্য কারও নয়–এইটুকু মনে করেই তাঁর আনন্দ।
একদিন মিস থাম্পি একটা ফন্দি আঁটলেন। অন্য দিনের মতোই অলক্ষ্যে থেকে হিপনোটাইজ করে অধ্যাপককে ডেকে আনলেন। সম্মোহিত অধ্যাপক যখন মিস থাম্পির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে প্রেমের কথা বলে যাচ্ছিলেন তখন থাম্পি অধ্যাপকের হাতে একটা কাগজ আর কলম গুঁজে দিয়ে বললেন, আপনি যেসব কথা বলছেন, তা এই কাগজে লিখুন।
সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপক লিখলেন–I love you dearly and want to have you as my life-partner by marriage.
লেখাটুকু পড়ে মিস থাম্পির বৃথাই রোমাঞ্চ হল। তবু বললেন, নিচে সই করুন।
অধ্যাপক সই করলেন।
তারিখ দিন।
অধ্যাপক তারিখ বসালেন।
মিস থাম্পি কাগজটি যত্ন করে রেখে দিলেন।
মাস ছয় পর।
মিস থাম্পি লক্ষ্য করলেন দিন দিন অধ্যাপকের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে।
তা তো পড়বেই। অমন সম্মানের চাকরিটা গেল। বেকার জীবন। লোকে তাকে দেখলে হাসাহাসি করে। বলে–পাগলা প্রফেসার।
এ যন্ত্রণা কে আর কতদিন সহ্য করতে পারে?
এদিকে যে মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ের কথা–মিস থাম্পি খবর নিয়ে জানলেন সেই মেয়েটির বাড়ির লোকরাও পাগলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজী নন। মেয়েটি কান্নাকাটি করছে।
অধ্যাপকের শরীর আর মনের অবস্থা দেখে মিস থাম্পি চিন্তায় পড়লেন। সম্মোহনের সাহায্যে তাকে আবার চাঙ্গা করা যায়। কিন্তু সে তো সাময়িক। তাছাড়া একজনের ওপর বার বার সম্মোহন প্রয়োগ করলে বিশেষ ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা।
তখন একদিন তিনি প্রফেসারকে ডেকে বললেন, আপনি কি রকম লোক যে একটা কলেজ থেকে চাকরি গেছে বলে অন্য কোথাও চেষ্টা করছেন না?
অধ্যাপক ম্লান হেসে বললেন, সবাই যে বলে আমি অসুস্থ। অসুস্থ লোককে কেউ চাকরি দেয়?
মিস থাম্পি বললেন, না, আপনি অসুস্থ নন। আমি বলছি আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। লোকে শত্রুতা করে আপনার বিরুদ্ধে লেগেছিল।
অধ্যাপক বললেন, চাকরি করেই-বা কি হবে? আমার জীবনে আর কোনো আনন্দ নেই। আমার সব আশা শেষ হয়ে গেছে।
মিস থাম্পি বললেন, না, কিছুই শেষ হয় নি। আমি বলছি সব ঠিক আছে।
এই বলে শহরের বাইরে একটা কলেজের ঠিকানা দিলেন। এখানে একজন ফিলজফির প্রফেসার দরকার। আপনি অ্যাপ্লাই করুন।
মিস থাম্পির প্রেরণায় অধ্যাপক দরখাস্ত করলেন। তারপর দুমাসের মধ্যে সেই কলেজে চাকরি পেয়ে গেলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পাণ্ডিত্যে আর অধ্যাপনার গুণে ছাত্ররা মুগ্ধ হয়ে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই অধ্যাপক তার সুনাম আর সম্মান ফিরে পেলেন। অধ্যাপক সুস্থ হয়ে উঠলেন।
মিস থাম্পি সব খবরই রাখেন। যেদিন শুনলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় অধ্যাপককে সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে সেদিন তিনি গোপনে একটু হাসলেন। কিন্তু তিনি আর কোনো দিন প্রফেসারকে সম্মোহন করে ডাকেন নি।
না ডাকলেও একদিন অধ্যাপক নিজেই হাসিমুখে মিস থাম্পির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। এলেন প্রায় এক বছর পর। তবে একা এলেন না। সঙ্গে সুন্দরী একটি মেয়ে। অধ্যাপক আলাপ করিয়ে দিলেন–এরই নাম এলিশ। এর সঙ্গেই আমি engaged ছিলাম। সামনের মাসে আমাদের বিয়ে।
মিস থাম্পি এলিশকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। ওরা চলে যাবার সময়ে মিস থাম্পি প্রফেসারকে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার বোধহয় আর দেখা হবে না।
প্রফেসার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
–আমি সব ছেড়ে এখান থেকে চলে যাচ্ছি।
–কোথায়?
–তা এখনো ঠিক করি নি।
–তুমি যেখানেই থাক আমায় চিঠি দিও।
মিস থাম্পি তার কোনো উত্তর দেন নি। শুধু একটু হেসেছিলেন।
তারপর সুযোগমতো প্রফেসারকে আলাদা করে ডেকে তাঁর হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন, এটা পড়ে দয়া করে ছিঁড়ে ফেলে দেবেন। দেখবেন যেন অন্য কারো হাতে না পড়ে।
চিঠিতে মিস থাম্পি সব কথাই খুলে লিখেছিলেন। অকপটে স্বীকার করেছিলেন তাঁর অপরাধের কথা। শেষ দুটি ছত্র এইরকম–কোনো প্রত্যাখ্যাতা মেয়ের মর্মযন্ত্রণা উপলব্ধি করার ক্ষমতা যদি আপনার থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তাকে আপনি ক্ষমা করবেন।
এই চিঠির সঙ্গেই ছিল আলাদা আর একটুকরো কাগজ। তাতে লেখা ছিল–I love you dearly and want to have you as my life-partner by marriage….
ডাক্তার রুদ্র থামলেন। ঘড়িতে তখন নটা বেজে পনেরো মিনিট। ডাঃ রুদ্র উঠে পড়লেন।
তারপর থেকে মিস থাম্পি আর সম্মোহন করার চেষ্টা করেননি। ঐ লাইনটা ছেড়েই দিলেন। তিনি ঘুরতে লাগলেন দেশ-বিদেশ-পাহাড়-জঙ্গল-মঠ-মন্দির-গির্জা। যেখানেই প্রাচীন পুঁথি পান সেখানেই ছোটেন। বিশেষ কোনো মানুষকে চেয়েছিলেন বড় আপন করে। তা তিনি পাননি। তাই শেষ পর্যন্ত খুঁজে বেড়াতে লাগলেন অলৌকিক রহস্য- জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে কোনো কিছু অদৃশ্য অস্তিত্বের সন্ধান।
.
ডাক্তার রুদ্রকে এগিয়ে দিতে যাচ্ছিল সঞ্জয়। ওরা যখন সিঁড়ির কাছে গিয়েছে তখন হঠাৎই রীণা ব্যস্ত হয়ে সঞ্জয়কে ডাকল, শুনে যাও।
ডাঃ রুদ্র থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সঞ্জয় ঘরে এসে ঢুকল।
–পুপুর চোখ দুটো দ্যাখো কিরকম বসে গেছে না?
সঞ্জয় টর্চ জ্বেলে ভালো করে দেখল। হ্যাঁ, চোখের নিচে কালি। চোখ দুটো হঠাৎ যেন বসে গেছে।
–কি হল? বলে ডাঃ রুদ্রও এসে দাঁড়ালেন। তিনিও দেখলেন। অনেকক্ষণ ধরেই দেখলেন।
রীণা জিজ্ঞেস করল, ওরকম হলো কেন?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, ও কিছু নয়।
গাড়িতে ওঠার সময়ে ডাঃ রুদ্র জিজ্ঞেস করলেন, ওর কি পেটের অসুখ কিংবা বমি হয়েছিল?
সঞ্জয় বলল, বিকেলেও এরকম দেখিনি।
আচ্ছা, লক্ষ্য রেখো। আমায় জানিও। ডাক্তার রুদ্রের গাড়ি কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
সঞ্জয় ওপরে উঠতে লাগল। তাকে কেমন চিন্তাচ্ছন্ন মনে হচ্ছিল। হঠাৎ চোখ বসে যাওয়াটা কেমন যেন অস্বাভাবিক।
.
১৭.
সংকেত
বৃহস্পতিবার। বেলা তখন তিনটে।
সঞ্জয় একটু আগে রাউন্ড দিয়ে নিজের চেম্বারে এসে বসেছে। হঠাৎ টেলিফোন। সঞ্জয় রিসিভারটা তুলে নিল।
হ্যালো!
ওপার থেকে ব্যাকুল কণ্ঠস্বর শোনা গেল–ডাঃ গুপ্ত? আমি বন্দনার মা–
কী ব্যাপার?
–আপনি শিগগির চলে আসুন। আপনার স্ত্রী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন।
–এখনি যাচ্ছি। বলে ফোন রেখে সঞ্জয় বেরিয়ে পড়ল।
কম্পাউন্ডে ঢুকে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে সঞ্জয় প্রায় দৌড়ে তিনতলায় উঠল। দেখল বিছানায় শুয়ে আছে রীণা। মুখটা একেবারে সাদা। মাথার কাছে বসে আছেন বন্দনার মা। পুপুকে কোলে নিয়ে ঘুরছে বন্দনা।
রীণার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু তাকাচ্ছে না। তাকাতে গেলেই কষ্ট হচ্ছে। সঞ্জয় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। একবার ডাঃ রুদ্রকে ফোন করার চেষ্টা করল। লাইন পেল না।
বিকেলের দিকে রীণা একটু একটু কথা বলল। কিন্তু কেন যে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলে তা বলতে পারল না।
–আজও কিছু দেখেছিলে নাকি?
রীণা অতিকষ্টে বলল, মনে নেই। ভাবতে গেলেই সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
–আচ্ছা, তুমি ঘুমোও।
বলামাত্রই রীণা অতি ধীরে পাশ ফিরে শুলো।
সঞ্জয় আবার ডাক্তার রুদ্রকে ফোন করল। এবারে পেয়ে গেল। ডাঃ রুদ্র সব শুনলেন। একটি কথাও বললেন না। শুধু বললেন,যাচ্ছি।
সন্ধের সময়ে ডাঃ রুদ্র এলেন। রুগীকে দেখে মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। সঞ্জয়ের তা লক্ষ্য এড়ালো না। তবু জিগ্যেস করল, কিরকম বুঝছেন?
–বিশেষ ভালো না।
একটু থেমে বললেন, আমি তো তোমাকে বার বার বাসা বদলাতে বলেছি। এখনি বাসা না পাও, আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছিলাম। তা তো শুনলে না। জেদ ধরে রইলে। মনে রেখো, আর একদিন পরেই সেই শনিবার।
নিরুপায় সঞ্জয় বলল, এখন যদি নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় তো
ডাঃ রুদ্র মাথা নাড়লেন–না, এ অবস্থায় ওকে আর নিয়ে যাওয়া যাবে না।
ডাঃ রুদ্রের একটা মিটিং ছিল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন। বলে গেলেন মিটিঙের পর আবার আসবেন। যাবার সময়ে জিজ্ঞেস করলেন, পুপু কেমন আছে?
সঞ্জয় অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ভালো।
–চোখ বসাটা?
পুপুকে নিয়ে বন্দনা বাইরে ঘুরছিল। সঞ্জয় ডাকল। বন্দনা পুপুকে নিয়ে এল। ডাঃ রুদ্র পুপুকে ভালো করে দেখলেন।
–চোখটা কিন্তু তেমনি বসে আছে। চোখের কোণে কালো দাগটা যেন আরো prominent হয়েছে। দেখেছ?
সঞ্জয় নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল, তাঁ। তবু ও ভালোই আছে। হাসছে খেলছে।
–কিন্তু চোখের নিচে কালিটা কিসের, ওটা এখনো আমরা ধরতে পারিনি। বলতে বলতে তিনি নেমে গেলেন।
.
১৮.
শেষ ছোবল
শনিবার।
সেই শনিবার। বিশ্বাস করুক না করুক, তবু একটা অজানা ভয়ে সকাল থেকেই সঞ্জয় যেন বিশেষ চিন্তিত। তার ওপর রীণার শরীর মোটেই ভালো নয়। বিছানা থেকে ওঠার শক্তিটুকুও নেই। কেন যে এমন হল সঞ্জয় কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। তার ওপর কাল রাত্তির থেকে হঠাৎই পুপুর জ্বর হয়েছে। এবার শুধু চোখ নয়, বুড়োদের মতো গাল দুটোও বসে গেছে।
সঞ্জয় কদিন বেরোচ্ছে না। সকালেই একবার ডাঃ রুদ্রকে ফোন করেছিল। পায়নি। একটু আগে ফের ফোন করল। এবার পেল। ডাঃ রুদ্র বললেন, সন্ধের সময়ে যাচ্ছি। আর দ্যাখো, আজ যে শনিবার এটা রীণাকে জানিও না।
শেষ বিকেল।
পশ্চিমের জানলা দিয়ে একফালি রোদ দেওয়ালে এসে পড়েছে। কেমন যেন ফ্যাকাশে রোদ। এ যেন এক মন-খারাপ-করা বিকেল। এরকম সময়ে অন্যদিন সে বাড়ি থাকে না। তাই নির্জন ঘরে শীতের বিকেল যে এমন ভারাক্রান্ত হয় সঞ্জয় তা জানত না। এই-সব বিকেলে বেচারি রীণা কি করে যে একা থাকে তাই ভেবে সঞ্জয় আজ বিচলিত হল।
রীণার বিছানার কাছে একটা চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। ভাবনাটা এবার অন্যদিকে মোড় নিল। আজ রাত্তিরে যদি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে তা হলে সাবধানতার জন্যে যা যা ব্যবস্থা ইতিমধ্যে করেছে তা যথেষ্ট কি না আর একবার যাচাই করে দেখতে চাইল।
নিজের ছোটো টর্চ ছাড়াও নতুন একটা বড়ো টর্চ কিনে রেখেছে। ছোটো বড়ো দুটো টর্চেই নতুন ব্যাটারি। রুগীর হার্ট ঠিক রাখার মতো প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত রেখেছে। ঘরে কুঁজো-ভর্তি খাবার জল, চা, কফি, দুধ, এক টিন বিস্কুট–তাছাড়া এক বোতল ব্রান্ডি-রাত জাগার জন্যে এসবেরই দরকার। সব কিছুরই ব্যবস্থা হয়ে আছে।
সারা রাত তাকে একাই জেগে থাকতে হবে। একবার ভেবেছিল বন্দনার মা-বাবাকে ডাকবে। কিন্তু ভেবে দেখল, কি জন্যে ডাকবে? তাঁদের তো বলা যাবে না যে, আজ রাত্রে অশরীরীটি হানা দেবে তার ঘরে।
একমাত্র রীণার কিছুটা বাড়াবাড়ি হওয়া ছাড়া আর যে কিছুই ঘটবে না সঞ্জয় সে সম্বন্ধে নিশ্চিত। কেন না সে জানে ঘরে লোক জেগে থাকলে তেমন-কিছু হয় না।
সঞ্জয় ঘড়ি দেখল। ছটা বাজে। পুপুকে ওষুধ খাওয়ালো। কেন কে জানে, ও আজ বড় ঘুমোচ্ছ। এবার রীণাকে দুধ খাওয়াতে হবে। ও তো কিছুই খেতে চাইছে না। শুধু চোখ বুজিয়ে পড়ে আছে। তবু গরম দুধ একটু না খাওয়ালেই নয়।
সঞ্জয় উঠে দুধ গরম করতে গেল।
একটু পরেই রীণার ক্ষীণ ব্যাকুল স্বর শোনা গেল।
–তুমি কোথায়?
–এই যে দুধ গরম করছি।
–শুনে যাও।
যাচ্ছি।
হিটার থেকে দুধের সসপ্যানটা নামিয়ে রেখে সঞ্জয় রীণার কাছে গেল। দেখল রীণা চারিদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে।
-কি হল?
কিছু না। তুমি আমার কাছে বোসো।
–দুধটা আনি?
–পরে এনো। তুমি এখন বোসো।
–দুধ জুড়িয়ে যাবে। ফের গরম করতে হবে। বলে সঞ্জয় বসল।
দ্যাখো, আমি যেন কিছুই ভালো করে মনে করতে পারছি না। সব যেন কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে।
–কিরকম? রীণার হাতটা সঞ্জয় তুলে নিল নিজের হাতে। একটু চমকালো। হাত দুটো ঠাণ্ডা।
–মনে হচ্ছে আমি যেন কত যুগ ধরে ঘুমোচ্ছি। কখনো মনে হচ্ছে আমি যেন আর এই পৃথিবীতে নেই। কত দূরে চলে গেছি। তারপরেই বুঝতে পারছি না, কোথাও তো যাইনি। এই তো আমার ঘর–এই তত আমার বিছানা–এই তো পুপু সোনা–পুপু কোথায়?
বন্দনা নিয়ে গেছে।
রীণা একটু থামল। তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে ফিসফিস্ করে বলল, আচ্ছা, সেই লোকটা কি আর এসেছিল?
–কোন লোকটা?
–সেই যে ম্যাজিসিয়ানের মতো দেখতে। কালো প্যান্ট-কোট কালো টুপি
না তো, কোনো লোকই আসেনি। একটু হেসে আবার বলল, তাঁকে দেখার সৌভাগ্য তো আমাদের হয় না। উনি কেবল তোমাকেই দেখা দেন।
হ্যাঁ। আমাকেই যে তার দরকার। কি দরকার গো বলল না।
রীণা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল সঞ্জয়ের চোখের দিকে।
উঃ! কী সাংঘাতিক গেছে সেদিনের সেই বিকেলটা। আমি পুপুকে কোলে নিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি ঘরের মধ্যে কী যেন ঘুরছে তো ঘুরছেই। ধোঁওয়া–শুধু ধোঁওয়া….
বলতে বলতে রীণা হঠাৎ ছিটকে উঠে বসল। দ্রুত নিশ্বাসে তার বুক ওঠা-পড়া করতে লাগল। দুচোখে ভয়ের কালো ছায়া।
–কি হল? অমন করে উঠে বসলে কেন?
–আজ–আজ সেই শনিবার না?
শনিবার! না, না, শনিবার তো কাল গেছে। আজ রবিবার।
রীণা প্রবলভাবে মাথা নাড়ল। কক্ষণো না। আজই শনিবার।
সঞ্জয় হাসল–পাগল! শনিবার হলে আমি বাড়ি থাকি?
রীণার তবু যেন বিশ্বাস হল না। এদিক ওদিক তাকাল।
–এখানে যে ক্যালেন্ডারটা ছিল?
–পেরেকটা খসে গেছে। ওঘরে টাঙিয়ে রেখেছি।
রীণা আর বসে থাকতে পারল না। শুয়ে পড়ল।
কী জানি, আমার মনে হচ্ছে তুমি আমায় লুকোচ্ছ।
–শুধু শুধু লুকোব কেন?
–আর ভাবতে পারছি না। বলে পাশ ফিরে শুলো। একটু পরে পাশ ফিরেই বলল, সন্ধে হয়েছে?
না।
–তবু আলোটা জ্বেলে দাও। একটু অন্ধকার হলেই ভয় করে।
সঞ্জয় আলো জ্বেলে দিল। রীণার চোখদুটো হঠাৎ ঝকঝক করে উঠল।
–এবার তোমার দুধ গরম করে আনি?
–পুপু খেয়েছে?
–হুঁ। বন্দনাই দুধ খাইয়ে নিয়ে গেছে।
মনে হচ্ছে ছেলেটাকে যেন কত দিন দেখিনি। ওকে একবার নিয়ে এসো না।
-আগে তুমি দুধ খেয়ে নাও। তারপরে আনব।
সঞ্জয় উঠে দুধ আনতে যাচ্ছিল রীণা আবার ডাকল, তুমি বলছ আজ রবিবার?
–হ্যাঁ। কতবার বলব?
শনিবারের সেই ফাড়া তাহলে কেটে গেছে?
সঞ্জয় ধমক দিয়ে বলল–ফাড়া আবার কি? কিছুই হয়নি। সবই মনের ভুল।
রীণা হঠাৎ আবার উঠে বসার চেষ্টা করল।
–শোনো শোনো বলে দুহাত বাড়িয়ে সঞ্জয়ের হাত দুটো চেপে ধরল–আচ্ছা, মিস থাম্পি যেমন সেই প্রফেসারকে হিপনোটাইজ করেছিল তেমনি আমাকেও কেউ করছে না তো?
হিপনোটাইজ! শুধু শুধু তোমায় কেউ হিপনোটাইজ করবে কেন? তাছাড়া ওসব গালগল্প। বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুধ আনতে গেল।
.
সন্ধের একটু পরে ডাঃ রুদ্র এলেন। মমম্ করে ঢুকলেন রীণার ঘরে।
-কেমন আছ?
–ভালো নয়। মোটেই ভালো নয়। তবু আপনাকে দেখলে যেন ভরসা পাই।
ডাক্তার রুদ্র একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। তারপর রীণার হাতটা টেনে নিলেন।
লেপের বাইরে হাত রেখে শুয়েছিলে বুঝি?
রীণা বলল, কী জানি। খেয়াল নেই।
ডাক্তার রুদ্র প্রেসার মাপতে লাগলেন। এক বার বার তিন বার। সঞ্জয় ঝুঁকে পড়ল।
-কত? রীণা জিজ্ঞেস করল।
—-ঠিক আছে।
রীণা সঞ্জয়কে বলল, ওঁকে কফি দাও।
ডাঃ রুদ্র বললেন, আজ অনেকবার চা-কফি হয়েছে। আর নয়। বরঞ্চ রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। বলে রীণার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
রীণা উৎফুল্ল হয়ে বলল, আপনি রাত্তিরে এখানে খাবেন? কী সৌভাগ্য! কিন্তু আমি তো রান্না করে খাওয়াতে পারব না।
কথার শেষে হতাশ ভাব ফুটে উঠল রীণার মুখে।
–ঠিক আছে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠলে আবার একদিন না হয় খাব।
রীণা ম্লান হাসল। মনে রাখবেন কিন্তু।
হ্যাঁ, নিশ্চয়। বলে ডাঃ রুদ্র চুরুট ধরালেন।
.
নটা বাজল।
ডাঃ রুদ্র নিচু গলায় বললেন, খুব ভাগ্য এক চান্সেই আমার বাড়ির লাইন পেয়ে গেলে। নইলে বাড়ি ফিরব না এই খবরটুকু দেবার জন্যে আবার বাড়ি ছুটতে হত।
সঞ্জয় কিছু বলল না। অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছিল।
–কি হল? অমন করে রয়েছ যে?
–ওর অবস্থা কি খুবই খারাপ?
খারাপ বলব না। তুমি নিজে ডাক্তার। প্রেসার তো দেখলে। ফল্স করছে। তাই ভাবলাম রাত্তিরে যদি আরো কিছু হয় তুমি একা নার্ভাস হয়ে পড়বে। সেজন্যেই থেকে গেলাম। তাছাড়া বলা যায় না যদি আজ রাত্রে ও কিছু দেখেটেখে? দুর্বল শরীর
পাশের ঘর থেকে রীণা ডাকল–একবার আসবে?
সঞ্জয় তাড়াতাড়ি উঠে গেল।
মৃদু আলো জ্বলছে। ধবধবে বিছানায় গলা পর্যন্ত সাদা ওয়াড় পরানো লেপ ঢাকা দিয়ে রীণা শুয়ে আছে। সঞ্জয় কাছে আসতেই রীণা তাকালো–
-কি বলছ?
–উনি খেয়েছেন তো?
-হুঁ।
–কিই বা খেলেন! ভারি লজ্জা করছে আমার।
–লজ্জার কি! তুমি সেরে উঠলে ভালো করে খাওয়াব।
রীণা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না উনি রাত্তিরে এখানে থাকবেন কেন? সত্যি বলো আমার অবস্থা কি খারাপের দিকে যাচ্ছে?
সঞ্জয় হেসে উঠল। আরে না–না। আগের চেয়ে অনেক ভালো আছ।
–তা হলে উনি থাকছেন কেন?
–এমনিই। বললেন, বাড়িতে কেউ নেই। বাড়ি যেতে আর ইচ্ছে করছে না।
রীণা অবিশ্বাসের সুরে বলল, বাড়িতে কেউ না থাকলে লোকে কি বাইরে রাত কাটায়? ডাক্তারের বাড়ি বলে তো চোর-ডাকাতে খাতির করবে না।
সঞ্জয় হাই তুলে বলল, তা হয়তো ঠিক। তবে এও ওঁর একটা খেয়াল। হয়তো স্টকে নতুন কোনো গল্প জমেছে। রাত জেগে শোনাবেন।
কথাটা রীণার মনে ধরল না। বলল, আমার ধারণা নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে উনি এখানে থাকতে চাইছেন।
রীণা একটু চুপ করল। সঞ্জয় কিছু বলার আগেই বলল, আমার মনে হয় আজই শনিবার। সত্যি করে বললো না গো!
–দূর! তোমার কেবল সেই এক কথা–শনিবার–শনিবার–সাড়ে নটা বাজল। একটু ঘুমোও তো।
–এত তাড়াতাড়ি ঘুমোব? যদি মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়?
–ভাঙবে না। তুমি ঘুমোও।
রীণা ঘুমোবার জন্যে পাশ ফিরল। তারপরেই জিজ্ঞেস করল, পুপু কি করছে?
–ঘুমোচ্ছে।
–মশারি টাঙিয়ে দিয়েছ তো?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমার কোনো চিন্তা নেই। এবার তুমি একটু ঘুমোও।
বলে সঞ্জয় তাড়াতাড়ি বাইরের ঘরে চলে এল।
.
রাত সাড়ে দশটা।
বাইরের ঘরে সঞ্জয় আর ডাক্তার রুদ্র। ডিভানের ওপরে ডাক্তার রুদ্র র্যাগ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছেন। মাটিতে শুয়েছে সঞ্জয়।
ডাক্তার রুদ্র জিজ্ঞেস করলেন, কী ভাবছ? তুমি অবশ্য আমার সামনে স্বচ্ছন্দে স্মোক করতে পার।
সঞ্জয় সে কথায় সাড়া না দিয়ে বলল, ও তত বেশ সামলে উঠেছিল। হঠাৎ এমন হল কেন?
ডাঃ রুদ্র বললেন, আমি তো তোমায় বলেছি এবাড়ি না ছাড়লে ও কখনন একেবারে সুস্থ হবে না। পুপুও ভালো নেই। কেমন Pale হয়ে যাচ্ছে। কেন?
সঞ্জয়ের বুকটা কেঁপে উঠল। উত্তর দিতে পারল না।
–সত্যি হোক মিথ্যে হোক এবাড়ির সঙ্গে ওর মানসিকতার সম্পর্ক এমন একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে ওর subconscious মনে সবসময় একটা আতঙ্ক দানা বেঁধে রয়েছে। তার থেকে ওর নিষ্কৃতি নেই। ওষুধ দিয়ে ওকে আর সুস্থ করা যাবে না।
–আমি ভাবছি, এত দুর্বল হয়ে পড়ল কেন? সন্ধের সময়ে বলছিল–কিছুই মনে করতে পারছে না। সব যেন খেই হারিয়ে ফেলছে।
ডাঃ রুদ্র বললেন, শুধু শরীর নয়, মনও অসুস্থ হলে দুর্বল হয়ে পড়বেই।
একটু থেমে বললেন, আচ্ছা, আজ যে শনিবার ও জানে না তো?
সঞ্জয় বলল, না। তবে আজই শনিবার কিনা বার বার জিজ্ঞেস করছিল। ক্যালেন্ডার দেখতে চাইছিল। আমি আগেই সরিয়ে রেখেছিলাম।
ডাঃ রুদ্র বললেন, ভালো করেছ। ও যদি জানতে পারে আজ সেই শনিবার তাহলে একেবারে ভেঙে পড়বে।
–কিন্তু ক্যালেন্ডার সরিয়ে রেখেও নিস্তার নেই। আমায় অনেক জেরা করল।
–কিরকম?
–জানতে চাইল আপনি রাত্তিরে হঠাৎ এখানে থাকছেন কেন? বললাম কাকীমা এখানে নেই-বাড়ি খালি। তাই যেতে চাইলেন না। ও বিশ্বাস করল না। ওর ধারণা হয় ওর অবস্থা ভালো নয়, না হয় নিশ্চয় আজ সেই শনিবার বলে আপনি রাতে এখানে থাকছেন।
ডাক্তার রুদ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, এসব চিন্তা ওর মাথায় ঢুকলে তো মুশকিলের কথা।
সঞ্জয়ের মুখটা শুকিয়ে গেল।–মুশকিল কেন বলছেন?
–জান তো ওর হার্ট কিরকম দুর্বল। প্রেসারও অনেক কম। তার ওপর যদি হঠাৎ ও ভয় পায়–
সঞ্জয় ব্যাকুল হয়ে বলল, তাহলে
আমরা তো ওর পাশেই রয়েছি। সব রকম ব্যবস্থাই করে রেখেছ। দেখা যাক।
ঘড়িতে এগরোটা বাজল।
ডাক্তার রুদ্র টেবিল-লাইট জ্বেলে একটা বই পড়ছিলেন। বইটা মুড়ে রেখে বললেন, যদি আজ রাত্রে সত্যিই কেউ আসে তাহলে হাতে অন্তত ঘণ্টা তিনেক সময়।
সঞ্জয় মাটিতে মশারি টাঙিয়ে পুপুকে নিয়ে শুয়েছিল। বলল, ততক্ষণ একটু ঘুমিয়ে নেবেন ভাবছেন?
–না, এখনই ঘুমনো নয়। আগে রীণার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বলে ব্যাগটা নিয়ে ডাক্তার রুদ্র ভেতরে গেলেন।
মিনিট দশেক পরে বাইরে এসে বসলেন। সঞ্জয়কে বললেন, একটা ইনজেকশান দিলাম। গভীর ঘুমের মধ্যে থাকুক। তেমন কিছু ঘটলেও জানতে পারবে না।
.
বারোটা বাজল।
ডাক্তার রুদ্র বইটা মুড়ে চেয়ারের ওপর রাখলেন। টেবিল থেকে প্রেসার মাপার যন্ত্রটা নিয়ে রীণার ঘরে ঢুকলেন।
পুপু উসখুস করছিল। পিঠ চাপড়ে ওকে আবার ঘুম পাড়িয়ে সঞ্জয় যখন বিছানা থেকে বেরিয়ে এল ডাঃ রুদ্র তখন রীণাকে পরীক্ষা করে ফিরে এসেছেন।
-কেমন দেখলেন?
–একই রকম। তবে ঘুমোচ্ছ। আচ্ছা, এবার তুমি ওর ঘরের আলোটা নিভিয়ে দাও।
–একেবারেই নিভিয়ে দেব, না নীল বালবটা
–না, একেবারে অন্ধকার করে দাও।
সঞ্জয় একটু অবাক হল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। আলো নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল।
–এবার চলো আমরা বাইরে গিয়ে বসি।
–বাইরে? কেন?
–শোনো সঞ্জয়, আজ যখন রাত্তিরটা এখানে থেকেই গেলাম তখন একটু বিশেষ করে লক্ষ্য করতে চাই, সত্যিই কিছু ঘটে কি না!
এত মানসিক দুশ্চিন্তার মধ্যেও সঞ্জয় একটু হাসল। বলল, কিছু ঘটলেও তো আপনি আমি দেখতে পাব না।
–কি করে জানছ? এর আগে যখনই ঘটনা ঘটেছে তখন তোমরা ঘুমোও। জেগে থাকলে হয়তো কিছু দেখতে না পাও, বুঝতে পারতে।
সঞ্জয় আবার হাসল।তার জন্যে আমরা রীণাকে, পুপুকে একলা ফেলে বাইরে যাব? সেটা কি উচিত হবে?
হু, এ ঘরটাও খালি রাখতে হবে।
–এই শীতে আমরা বাইরে কোথায় বসব?
–ব্যালকনিতে, ঐখানেই আমরা বসব। বলে নিজেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বাইরে চলে এলেন। অগত্যা সঞ্জয়কেও আর একটা চেয়ার নিয়ে বসতে হল।
যাক, সিঁড়ি থেকে রীণার ঘর পর্যন্ত সব ফঁকা। ডাঃ রুদ্র যেন বেশ খুশি হলেন।
–আপনি কি ভেবে রেখেছেন তিনি এলে আমরা সিঁড়ির মুখেই জাপটে ধরব?
সঞ্জয়ের বলার ভঙ্গিটা বিদ্রপের মতো শোনাল।
–না, তা নয়। spirit যাতে বিনা বাধায় রীণার কাছে যেতে পারে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
সঞ্জয় গরম চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে বলল, spirit যদি সত্যি আসতে চায় সে কি কোনো বাধা মানবে? রীণা যখন তাকে দেখেছিল ঘরের দরজা কি ভেতর থেকে বন্ধ ছিল না?
রুদ্র বললেন, সে বাধা অন্য। আমি বলছি ঘরের মধ্যে একাধিক লোক জেগে বসে থাকলে স্পিরিট কিছুতেই আসে না। আমার মনে হয়, মানুষ যেমন প্রেতের ভয় পায়–প্রেতরাও তেমনি মানুষকে ভয় পায়। দুর্বল একাকী মানুষই তাই প্রেতের শিকার হয়। যাক, টচটা নিয়েছ তো?
–হ্যাঁ। বলে বড়ো টর্চটা রুদ্রের হাতে দিল।
কয়েক মিনিট দুজনেই চুপচাপ। ডাঃ রুদ্র একটা চুরুট ধরালেন। বললেন, এখনকার মতো একটা চুরুট খেয়ে নিই। এরপর আর খাওয়া যাবে না। চুরুটের আগুন এমনকি গন্ধও হয়তো স্পিরিটের আসার পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
–আচ্ছা, spirit-এর আসার জন্যে আমরা ব্যাকুলই বা হচ্ছি কেন? সে তো আমাদের আনন্দদান করতে আসবে না।
ডাঃ রুদ্র বললেন, spirit যদি সত্যিই তার কথা রাখে তা হলে যা ঘটবার তা আজই ঘটে যাক। নইলে তো আবার অনিশ্চিন্তে আর একটা দিনের অপেক্ষা করতে হবে।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। হঠাৎ ঘরের ভেতরে মনে হল রীণা জেগে উঠেছে।
ও কি ডাকছে? সঞ্জয় গায়ের র্যাগ ফেলে রেখে ছুটল। পিছনে ডাক্তার রুদ্র।
সঞ্জয় আলো জ্বালল। দেখল রীণা উসখুস করছে আর মুখে অস্বস্তির একরকম শব্দ। লেপটা মাটিতে পড়ে গেছে।
সঞ্জয় লেপটা তুলে ভালো করে গায়ে ঢাকা দিয়ে কিছুক্ষণ রীণার কাছে বসে রইল।
–এবার এসো।
সঞ্জয় উঠে এল।
–আলোটা নিভোও।
অগত্যা সঞ্জয়কে আলো নিভিয়ে দিতে হল। বাইরের ঘরে এসে মশারির মধ্যে টর্চ ফেলে একবার পুপুকে দেখে নিল সঞ্জয়। না, পুপু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
দুজনে আবার বসল।
নিশুতি শীতের রাত থমথম করছে। পরিষ্কার নীল আকাশের গায়ে তারাগুলোর রহস্যময় নিঃশব্দ হাসি।
সঞ্জয় বলল, আমি এখনো এসব বিশ্বাস করি না। সত্যি কথা বলতে কি থ্রিল অনুভব করলেও জানি না এমন কেন মনে হচ্ছে যে, আমরা বড়োই অসহায়। তার ওপর নিরস্ত্র।
ডাক্তার রুদ্র হেসে বললেন, অশরীরীদের মোকাবিলা করতে রিভলভার কোনো কাজে লাগে না–এই টই একমাত্র অস্ত্র।
.
আরও কতক্ষণ কেটে গেল। নিচে কারো ঘরে দেওয়াল-ঘড়িতে ঠং করে শব্দ হল। সঞ্জয় চমকে উঠল। কটা বাজল? একটা না দেড়টা?
–দেড়টা। বলে ডাক্তার রুদ্র হাতের আড়াল দিয়ে আলগা করে টর্চের বোতাম টিপে রিস্টওয়াচটা দেখে নিলেন।
–দেড়টা! তা হলে একটা বাজল কখন?
ডাক্তার রুদ্র বললেন, তুমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে।
সঞ্জয় লম্বা আলিস্যি ভাঙল।
–সত্যি আমি আর পারছি না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। শুধু শুধু
সঞ্জয় কথা আর শেষ করল না। ডা
ক্তার রুদ্র গম্ভীর স্বরে বললেন, হোক শুধু শুধু। এছাড়া উপায়ও ছিল না। আজ এই শনিবারের রাত্রিটা ছিল রীণার পক্ষে মারাত্মক। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে রীণার এতক্ষণ কী হত বলতে পারি না।
–তা হলে আপনি বলছেন, আমরা পাহারা দিচ্ছি বলে আজ আর কিছু হবে না?
–না হওয়াই স্বাভাবিক। যদি হয়ও মারাত্মক কিছু হবার আগেই আমরা গিয়ে পড়ব।
এমনি সময়ে দূরে বড়ো রাস্তায় একটা খ্যানখেনে বিকৃত গলার চিৎকার শোনা গেল।
ডাক্তার রুদ্র চমকে উঠলেন।
সঞ্জয় হেসে বলল, ও কিছু নয়। একটা মাতাল যাচ্ছে। রোজই এই সময়ে যায়।
বলে ব্যালকনির ধারে গিয়ে দাঁড়াল।
ডাক্তার রুদ্র হেসে বললেন, কি দেখছ? রাতের কলকাতার শোভা?
সঞ্জয় বলল, না। মাতালটার গলা শুনেছি, দেখিনি কখনো। তাই
–দেখতে পেলে?
–হ্যাঁ, ঐ যে যাচ্ছে–ঠিক যেন একটা ছায়ামূর্তি।
মাতালটা চলে গেল। সঞ্জয় তবু দাঁড়িয়ে রইল।
নিস্তব্ধ রাত। বাড়ির পিছনে কম্পাউন্ডের গায়ে বনঝাপের মধ্যে রাতকানা একটা পাখির পাখা ঝাঁপটানো। ও দিকে যশোর রোডের মসৃণ দেহের ওপর দিয়ে গর্জন করতে করতে মাঝেমধ্যে ছুটছে লরি। স্ট্রীট-লাইটের আলোয় ঝলমল করছে রাস্তাটা।
গোটা বাড়িটা গভীর রাতে একটা রহস্যপুরীর মতো দাঁড়িয়ে। কত নিশ্চিন্তে নিচের তলায় মহিমাবাবু, অমৃতবাবুরা ঘুমোচ্ছেন। দোতলার ঘরে উদ্ভিন্নযৌবনা কিশোরীটি কি কোনো সুখস্বপ্ন দেখছে?
–আচ্ছা সঞ্জয়, বাড়িটার ওপর ওরকম মধ্যযুগীয় গম্বুজটা কেন ভেবেছ কখনো?
না। ও আর ভাবব কি? বাড়িওয়ালার শখ।
সঞ্জয় চেয়ারে বসল।
–কিন্তু কোন যুগের মানুষের এইরকম শখ ছিল?
–তা বলতে পারব না।
-সঠিক বলতে না পারলেও অনুমান করা যায় এ তল্লাটে এত পুরনো বাড়ি আর নেই। যদিও পরে অনেক অল্টারেশান হয়েছে।
–হ্যাঁ, তা হয়েছে। তবে তিন তলাটা এখনো ইনকমপ্লিট। আর সিঁড়িটা
সঞ্জয় প্রচণ্ড জোরে নিজের গালে একটা চড় মেরে বলে উঠল–উঃ! মশায় অস্থির করে দিল। এ অঞ্চলের মশা! এদের কামড়ই আলাদা।
–আচ্ছা, মিস থাম্পি বাড়িটা সম্বন্ধে কিছু বলেননি?
সঞ্জয় ইতস্তত করে বলল, হ্যাঁ বলেছেন। তাঁর মতে এখানে কিছু আছে।
উনি এ কথা বলেছেন?
সঞ্জয় হাই তুলে হালকা মেজাজে বলল, হ্যাঁ, উনি যেখানেই যান সেখানেই কিছুর সন্ধান পান বোধ হয়। মার এক বান্ধবীর বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখানেও অশরীরী আত্মা দেখেছিলেন।
–তাই নাকি?
–হ্যাঁ। তবে এখানে কিছু দেখার ভাগ্য তার হয়নি। বুঝতে পেরেছিলেন।
ডাক্তার রুদ্র চোখ বুজিয়ে কিছু ভাবতে লাগলেন। হঠাৎ একসময়ে তিনি চমকে উঠলেন।
–কিছু শুনতে পাচ্ছ? ডাঃ রুদ্রর স্বরটা কেমন চাপা।
মশার ঐকতান ছাড়া আর তো কিছু শুনছি না।
ডাক্তার রুদ্র চুপ করে রইলেন। সঞ্জয়ও আর কিছু বলল না। জোর করে একটা হাই তুলল।
আরো কিছুক্ষণ কাটল। ডাক্তার রুদ্র হঠাৎ র্যাগটা খুলে ফেললেন।
–কি হল? এই ঠাণ্ডায় র্যাগ খুললেন কেন?
কেমন একটা গরম হাওয়া বইছে না?
সঞ্জয় চোখ বুজিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বলল, গরম বা ঠাণ্ডা কোনো হাওয়াই তো পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীটা হাওয়াশূন্য হয়ে গেছে।
–কিন্তু, আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
যা ঘটছে তা শুধু রাত্রিজাগরণ।
ডাক্তার রুদ্র এবার হাই তুললেন। বললেন, তা বটে। আমারও এখন ঘুম পাচ্ছে।
সঞ্জয় ব্যালকনির পাঁচিলে দু পা তুলে চেয়ারে শরীরের আধখানা বিছিয়ে দিয়ে বলল, ঘুমোন তবে। ঘুমেই আরাম ঘুমেই শান্তি। ঘুমের তুল্য জিনিস নেই।
–আশ্চর্য, এত মনের জোর করেও ঘুম আটকাতে পারছি না। এমন কখনো হয় না। কিন্তু ঘুমোলে চলবে না। কটা বাজল? নিজেকে যেন নিজেই প্রশ্ন করলেন রুদ্র। সাবধানে টর্চের আলোয় ঘড়িটা দেখলেন।
–just two, কিন্তু নিচের ঘড়িতে দুটো বাজল না তো?
সঞ্জয় চোখ বুজিয়েই বলল–বোধহয় শুনতে পাইনি।
–কিন্তু–এইটেই সময়। ঠিক দুটোতেই তো—
রুদ্র উঠে দাঁড়ালেন।
রীণাকে একবার দেখে আসি।
সঞ্জয়ও উঠে পড়ল।
ঠিক সেই সময়ে ঘরের মধ্যে পুপু ককিয়ে কেঁদে উঠল। সেই কান্না শুনে সঞ্জয়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। চিৎকার করে উঠল কাকাবাবু, শীগগির–
বলে দৌড়ে ঘরের দিকে গেল।
দুটো ঘরই অন্ধকার। সঞ্জয় যখন বসার ঘরের সুইচ হাতড়াচ্ছে ডাক্তার রুদ্র ততক্ষণে ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।
ঢুকেই তিনি সুইচে হাত দিলেন। আলো জ্বলল না। দেওয়ালে ধাক্কা লেগে টচটা হাত থেকে কোথায় ছিটকে পড়ল।
–লোডশেডিং! সঞ্জয়, টচটা–শীগগির
সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জয়ের হাতের টর্চের আলো ঝলকে উঠল। সেই আলো গিয়ে পড়ল রীণার বিছানায়। দেখল রীণার মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত ঝুলছে খাট থেকে। লেপটা পড়ে আছে মাটিতে।
কয়েক মুহূর্ত….।
সঞ্জয়ের পা দুখানা যেন মেঝের সঙ্গে আটকে গিয়েছে।
সঞ্জয়ের হাত থেকে টর্চটা ছিনিয়ে নিয়ে রুদ্র ছুটে গেলেন রীণার কাছে। এক হাতে টর্চ। অন্য হাতে কোনোরকমে তুলে ধরলেন মাথাটা।
তাড়াতাড়ি এসো।
সঞ্জয় এগিয়ে এল। ওর হাত দুটো তখন কাঁপছে।
–পা দুটো ধরো। ওদিক থেকে ধরো–dont get nervous.
সঞ্জয় বিছানার ওপর উঠে রীণার পা দুটো ধরল।
–এবার লম্বালম্বিভাবে শোওয়াতে হবে। দাঁড়াও-বালিশটা দিই-উঃ! আলোটাও এই সময়ে গেল! না, আলো তো দেখছি শুধু এ বাড়িতেই গেছে–ও কী! তুমি ওরকম করছ কেন? সরো। বলে ধমকে উঠলেন।
রীণাকে বিছানায় ঠিকমতো শুইয়ে দিয়ে রুদ্র নিজেই লেপটা তুলে রীণার গায়ে দিয়ে দিলেন।
লণ্ঠনটা জ্বালো। কী হল? দাঁড়িয়ে রইলে কেন?
–ও বোধহয় আর নেই।
কী যা-তা বকছু! ধমকে উঠলেন রুদ্র। আমার স্টেথস্কোপটা–লণ্ঠনটা জ্বালো না।
লণ্ঠনটা কোনোরকমে জ্বেলে দিয়ে সঞ্জয় বাইরের ঘরে গিয়ে পুপুর কাছে বসে রইল।
পুপু তখনো ফুলে ফুলে কাঁদছে।
ডাঃ রুদ্র স্টেথস্কোপ নিয়ে ঝুঁকে পড়লেন।
মিনিটের পর মিনিট কাটতে লাগল। রুদ্ধনিঃশ্বাসে সঞ্জয় বসে রইল অন্ধকারে।
রীণা কি বেঁচে আছে?
এটুকু বুঝতে কত সময় লাগে? এত দেরি হচ্ছে কেন?
তবু সঞ্জয় উঠে গিয়ে জানতে পারল না রীণা বেঁচে আছে কিনা।
–সঞ্জয়-please help me! ডাক্তার রুদ্র চেঁচিয়ে উঠলেন।
–আমার ব্যাগটা—
সঞ্জয় একঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে ডাক্তার রুদ্রের কাছে গেল।
কী দেখলেন ডাক্তারবাবু?
Thank God! হার্ট বীট পাওয়া যাচ্ছে। তোমার ছেলে কি করছে?
–ঘুমিয়েছে।
–যাক, অল্পর ওপর দিয়ে গেছে। সঞ্জয় বিছানায় বসে পড়ে রীণার হাত দুটো কোলের ওপর টেনে নিল।
–হাত যে একেবারে ঠাণ্ডা।
–ও ঠিক হয়ে যাবে। তুমি একটু সেঁক দাও।
–হসপিটালে নিয়ে যাব?
না, এখনই দরকার নেই। তেমন বুঝলে আমি বলব। গাড়ি তো রয়েছেই। উঃ! আর একটু দেরি হলেই শেষ হয়ে যেত।
.
সকালবেলা।
দুজনে দুকাপ গরম কফি নিয়ে বসেছে। দরজায় শব্দ।
সঞ্জয় চমকে উঠল। এত সকালে কে? তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিল। দেখল মান্তু আর ললিতবাবু শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে।
-কি ব্যাপার?
–সকালেই চলে এলাম। মিস থাম্পি টেলিগ্রাম করেছিলেন। টেলিগ্রামটা পেতে একদিন দেরি হয়েছে। বলে টেলিগ্রামটা সঞ্জয়ের হাতে দিল।
টেলিগ্রামের বক্তব্য–যে কোনো প্রকারে আজকেই মিসেস গুপ্তকে আপনাদের কাছে এনে রাখুন। জীবন বিপন্ন।
সঞ্জয় টেলিগ্রামটা ললিতবাবুর হাতে ফেরত দিয়ে বলল, ভেতরে আসুন।