১.২ প্রথম পর্ব – ভাটা

ট্রাস্ট

লুসিবাড়ি দ্বীপটা এমনিতে ছোট হলেও বেশ কয়েক হাজার লোক বাস করে এখানে। অধিবাসীদের মধ্যে অনেকেই সেই ১৯২০ সালে আসা আদি বাসিন্দাদের পৌত্র-প্রপৌত্র। কিন্তু তা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ঢেউয়ের মতো এসেছে মানুষ। একদল এসেছে ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর, আবার অনেকে এসেছে ১৯৭১-এ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। এমনকী তার পরেও এ দ্বীপে লোক এসে বসত করেছে। তারা এসেছে আশেপাশের দ্বীপ থেকে বাস্তুহারা হয়ে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকার অনেক সময় জোর করে এ অঞ্চলের কিছু দ্বীপ খালি করে দিয়েছে; এই শেষ শ্রেণীর বাসিন্দারা সেই সরকারি ব্যবস্থার শিকার। এই সবকিছু মিলিয়ে লুসিবাড়ির জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফলে এক টুকরো জমিও এখন আর খালি পড়ে নেই এখানে। ঘন সবুজ ফসলখেতের কথা মুড়ি দিয়ে পড়ে রয়েছে গোটা দ্বীপটা, তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট কিছু মাটির ঘর, আর খেতের এদিক থেকে ওদিক কাটাকুটি খেলার দাগের মতো চলে গেছে কয়েকটা পায়ে হাঁটা পথ। কয়েকটা চওড়া রাস্তা আবার ইট-বাঁধানো, দু’ধারে সারি দিয়ে লাগানো ঝাউগাছের ছায়ায় ঢাকা। তবে এ হল ওপর ওপর দেখা। এ দেখায় বাংলাদেশের আর পাঁচটা গায়ের সাথে লুসিবাড়ির কোনও তফাত মিলবে না। এমনিতে বোঝাই যাবে না এই শান্ত চেহারার গ্রামটার জীবনপ্রণালী নির্ভর করছে একটি মাত্র ভৌগোলিক উপাদানের ওপর। সে হল এখানকার বাঁধ। পুরো গ্রামটাকে বেড় দিয়ে থাকা প্রাকারের মতো সে বাঁধ রোজ দু’বেলা লুসিবাড়িকে বাঁচায় বানভাসি থেকে।

বাদাবন ট্রাস্টের কম্পাউন্ডটা মূল লুসিবাড়ি গ্রাম থেকে কিলোমিটার খানেক দূরে, শাঁখের মতো দ্বীপটার গোল দিকে। এখানেই একটা ছোট বাড়িতে নীলিমা থাকে। অতিথি অভ্যাগত কেউ এলে তাদেরও সেই বাড়িতেই থাকতে দেওয়া হয়।

কানাই আর নীলিমা যখন এসে পৌঁছল তখন সন্ধে গড়িয়ে গেছে। ওরা বোট থেকে নেমেছিল দ্বীপের অন্য দিকটায়, চড়ার ওপরে। সেটা সুসিবাড়ি গ্রামের কাছে। সেখান থেকে যখন রওয়ানা হয়েছে তখনই সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। ঘাটের কাছ থেকে তারপর একটা রিকশাভ্যান ভাড়া করতে হয়েছে ট্রাস্টে আসার জন্য। এই রিকশাভ্যান জিনিসটা আগের বার এখানে দেখেনি কানাই। এখন এখানে এটার খুব চল হয়েছে। মালপত্র, গোরু-ছাগল, মানুষ সবকিছুই নিয়ে যাওয়া যায় ভ্যানে করে। পেছনের পাটাতনটায় ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে প্যাসেঞ্জাররা, আর মাঝে মাঝে খানাখন্দে পড়ে ভ্যান লাফিয়ে উঠলে এ ওকে ধরে টাল সামলায়।

“এটাতে আমাদের সবাইকে ধরবে তো?” ভ্যানটার দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই।

“কেন ধরবে না? উঠে পড়, আমরা ধরে থাকব তোকে, ভয়ের কিছু নেই,” নীলিমা অভয় দিল।

যাত্রা শুরু হল। কানাইয়ের সুটকেসটা চাপানো হয়েছে একটা সবজির ঝুড়ির ওপর, তার একপাশে আবার কয়েকটা হাঁস মুরগি, তারস্বরে চেঁচাচ্ছে সেগুলো। খানিক চলার পর একটা ইট-ফেলা রাস্তার ওপর এসে পড়ল ভ্যানটা। ভাল করে বসানো হয়নি ইটগুলো, মাঝে মাঝেই দু’-একটা উঠে গেছে, গর্ত গর্ত হয়ে আছে সে জায়গাগুলো। ভ্যানের চাকা একেকবার সে গর্তের মধ্যে পড়ছে, আর ছিটে-গুলির মতো শূন্যে ছিটকে যাচ্ছে লোকগুলো। কানাই তো একবার পড়েই যাচ্ছিল, কোনও রকমে ওর জামা-টামা ধরে সামলাল অন্য যাত্রীরা।

“আমাদের গেস্ট হাউসটায় তুই থাকতে পারবি তো রে কানাই?” নীলিমার গলায় চিন্তার সুর। “খুব সাধারণ ব্যবস্থা কিন্তু। কোনও স্পেশাল কিছু আশা করিস না। তোর জন্যে একটা ঘর সাফসুতরো করে রাখা হয়েছে। রাতের খাবারও রাখা থাকবে টিফিন ক্যারিয়ারে। আমাদের একজন ট্রেনি নার্সকে বলা আছে, ও-ই তোর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তোর কিছু দরকার হলে ওকেই বলতে পারিস। মেয়েটার নাম ময়না। ও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে ওখানে আমাদের জন্যে।”

নামটা কানে যেতেই ভ্যানের চালক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কি ময়না মণ্ডলের কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ।”

“ওকে তো আপনি এখন গেস্ট হাউসে পাবেন না মাসিমা। আপনি শোনেননি কী হয়েছে?”

“কী হয়েছে?”

“ওর বর ফকির তো আবার কোথায় চলে গেছে। এবার আবার ছেলেটাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছে। ময়না বেচারি এখন চারদিকে খুঁজে খুঁজে মরছে।”

“সত্যি? তুই ঠিক জানিস?”

“হ্যাঁ মাসিমা,” অন্য কয়েকজন যাত্রীও মাথা নেড়ে সমর্থন করল ভ্যানওয়ালাকে।

জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করল নীলিমা। “বেচারি ময়না। লোকটা একেবারে ওকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খেল।”

মন দিয়ে সব শুনছিল কানাই। নীলিমার মুখে চিন্তার ছায়া দেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার তো খুব মুশকিল হয়ে যাবে তা হলে, না?”

“না রে। আমরা কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক করে নেব। আমি ভাবছি ময়নার কথা। এই বরটার জ্বালায় তো পাগল হয়ে যাবে মেয়েটা।”

“লোকটা, মানে, ওর বরটা কে?”

“ওকে তুই চিনবি না–” বলতে বলতে মাঝপথে থমকে গেল নীলিমা। কানাইয়ের হাতটা খামচে ধরল। “দাঁড়া, দাঁড়া, আমারই খেয়াল ছিল না। তুই তো ওকে চিনবিই। মানে

ওকে ঠিক না, ওর মাকে তুই চিনিস।”

“ওর মাকে?”

“হ্যাঁ। কুসুম বলে একটা মেয়ের কথা তোর মনে আছে?”

“কেন মনে থাকবে না?” কানাই বলল। “খুব মনে আছে। আগের বার যখন এসেছিলাম। তখন ও-ই তো এখানে আমার একমাত্র বন্ধু ছিল।”

“হ্যাঁ।” ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল নীলিমা। “আমারও মনে পড়ছে, তোরা একসঙ্গে খেলাধুলা করতিস। তো এই ছেলেটা, ফকির, ও হল সেই কুসুমের ছেলে। ওর সঙ্গে আমাদের ময়নার বিয়ে হয়েছে।”

“এই ফকিরকেই কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”

“হ্যাঁ, ওকেই পাওয়া যাচ্ছে না।”

“আর কুসুমের কী খবর? ও কোথায় আছে এখন?”

লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল নীলিমা। “কুসুমও কোথায় একটা পালিয়ে গিয়েছিল; বোধহয় তুই ফিরে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই। তার পর বহু বছর কোনও খোঁজখবর নেই, শেষে একদিন ফিরে এল আবার। ওর কথা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।”

“কেন? কী হয়েছিল ওর?”

চোখ বন্ধ করল নীলিমা। যেন মনের থেকে আড়াল করে রাখতে চাইছে কুসুমের স্মৃতিটাকে। “ওকে মেরে ফেলেছিল।”

“মেরে ফেলেছিল? কারা? কেন?”

“সেসব তোকে পরে বলব,” নিচু গলায় বলল নীলিমা। “এখন নয়।”

“আর ওর ছেলে?” কানাই নাছোড়বান্দা। “কত বড় ও তখন? কুসুম মারা যাওয়ার সময়?”

“ও তো তখন একেবারে বাচ্চা। বছর পাঁচেক বয়স। ওদের এক আত্মীয়, হরেন, ওকে নিয়ে গিয়ে মানুষ করল।”

হঠাৎ চোখের সামনে একটা বিশাল বাড়ি কানাইয়ের মনোযোগ কেড়ে নিল। “ওখানে ওটা কী মাসি?”

“ওটা হাসপাতাল,” বলল নীলিমা। “আগের বার দেখিসনি তুই?”

“না। এটা তৈরি হওয়ার পর তো আর আসিনি আমি।”

হাসপাতালের গেটের কাছে অনেকগুলো লাইট লাগানো, প্রত্যেকটার চারদিকে মনে হচ্ছে একেকটা আলোর পুঞ্জ জমে আছে। জীবন্ত মনে হচ্ছে সেগুলোকে ঘুরছে, নড়াচড়া করছে। ভ্যানটা গেট পেরিয়ে ঢোকার সময় কানাই দেখল সেই জ্যোতিপুঞ্জগুলি আসলে খুদে খুদে কতগুলি পোকার ঝক। মেঘের মতো জমে আছে আলোর কাছে।

প্রত্যেকটা বালবের নীচে কিছু স্কুলের ছেলেমেয়েও বসে আছে। কোলের ওপর বইখাতা নিয়ে ওই আলোয় পড়াশোনা করছে তারা।

“এগুলো ইলেকট্রিক আলো?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই। ৫৪

“হ্যাঁ রে।”

“কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম লুসিবাড়িতে ইলেকট্রিসিটি আসেনি এখনও?”

“বিজলি বাতির ব্যবস্থা শুধু আমাদের এই কম্পাউন্ডটুকুর মধ্যে। মাত্র কয়েক ঘণ্টা থাকে আলো, সূর্য ডোবার পর থেকে রাত ন’টা পর্যন্ত,” নীলিমা বলল।

এই বিদ্যুৎ আসলে আসে একটা জেনারেটর থেকে। একজন পৃষ্ঠপোষক যন্ত্রটা ট্রাস্টকে দান করেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধেবেলা কয়েক ঘণ্টার জন্য চালানো হয় জেনারেটরটা। হাসপাতালের কর্মীদের সেটা সবচেয়ে ব্যস্ততার সময়। তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে তারা রাতের নিস্তব্ধতার জন্য প্রস্তুত হয়। আশেপাশের স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও ওই আলোর টানে সন্ধের সময় হাসপাতালের সামনে চলে আসে। বাড়িতে পড়ার চেয়ে এখানে এই ইলেকট্রিকের আলোয় পড়ার অনেক সুবিধা। তা ছাড়া কেরোসিন মোমবাতির খরচটাও বাঁচে।

“আমাদের এখন ওইখানে যেতে হবে,” সামনের একটা বাড়ির দিকে দেখিয়ে বলল নীলিমা। দোতলা গেস্ট হাউসটা হাসপাতালের কাছেই, মাঝে শুধু একটা পুকুর আর একসারি নারকেল গাছ। চুনকাম করা ছোট্ট স্কুলের মতো দেখতে ঝকঝকে বাড়িটায় বেশ একটা মন ভাল করে দেওয়া ভাব রয়েছে। অতিথিদের থাকার জায়গা দোতলায়। একতলায় নীলিমার সংসার। নির্মলের সঙ্গে এখানেই থেকেছে ও, সত্তরের দশকের শেষ দিক পর্যন্ত। এ বাড়িরই ছাদের ওপর ছিল নির্মলের পড়ার ঘর। ওর সমস্ত কাগজপত্র এখনও ওখানেই রাখা আছে।

ভ্যান থেকে নেমে কানাইয়ের হাতে একটা চাবি দিল নীলিমা। “এই নে, এটা তোর মেসোর ছাদের ঘরের চাবি। ঘরে ঢুকেই ডেস্কের ওপর দেখতে পাবি ওই খামটা রাখা রয়েছে। আমিই তোকে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু ভীষণ ক্লান্ত লাগছে রে।”

“কিছু ভেবো না মাসি, আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। সকালে দেখা হবে তা হলে তোমার সঙ্গে।”

সুটকেসটা নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল কানাই, এমন সময় নীলিমা আবার ডাকল পেছন থেকে। “জেনারেটর কিন্তু ন’টায় বন্ধ হয়ে যায়, খেয়াল রাখিস। অন্ধকারের মধ্যে মুশকিলে পড়বি না হলে।”

.

ফকির

লঞ্চের শব্দটা দূরে মিলিয়ে যেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পিয়া। বিপদ কেটে যাওয়ার পর এতক্ষণে ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল পেশিগুলো, মারাত্মক ধকলটা যেন শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাওয়া গেল। হঠাৎ হাত-পাগুলি কঁপতে শুরু করল, থুতনিটা বার বার ঠকঠক করে এসে ধাক্কা খেতে লাগল হাঁটুর ওপরে। মুহূর্তের মধ্যে এমন একটা কাঁপুনি এল সারা শরীরে যে গোটা ডিঙিটা দুলতে লাগল, ছোট ছোট ঢেউ ছড়িয়ে গেল নদীর জলে।

কার যেন একটা ছোঁয়া লাগল কাঁধের কাছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে পিয়া দেখল বাচ্চা ছেলেটা, ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে পিয়ার গলা জড়িয়ে ধরল বাচ্চাটা, নিজের গায়ের ওম দিয়ে ওর শরীরে তাপ দিতে লাগল। স্বস্তিতে, আরামে চোখ বন্ধ হয়ে এল পিয়ার। দাঁতের খটখট বাজনা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আর চোখ খুলল না ও।

চোখ মেলেই দেখল ওর সামনে উবু হয়ে বসে আছে জেলেটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ওর মুখ, চোখে চিন্তার ছাপ। পিয়ার শরীরের কাঁপুনি থেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার চেহারাতেও আস্তে আস্তে স্বস্তি ফিরে এল। একটা হাসির আভাসও দেখা গেল ঠোঁটের কোনায়। বুকের ওপর একটা আঙুল রেখে ও বলল, “ফকির”। ওর নাম। পিয়াও নিজের দিকে দেখিয়ে বলল, “পিয়া”। মাথা নাড়ল ফকির। বুঝতে পেরেছে। এবার বাচ্চাটার দিকে ইশারা করে বলল, “টুটুল”। তারপর আঙুল দিয়ে একবার বাচ্চাটার দিকে আর একবার নিজের দিকে দেখাতে লাগল। পিয়া বুঝতে পারল ওরা বাপ আর ছেলে।

“টুটুল।”

বাচ্চাটার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল পিয়া। যা মনে হচ্ছিল ওর বয়স আসলে তার থেকেও কম। খুব বেশি হলে বছর পাঁচেক হবে। এই নভেম্বরের ঠান্ডায় শুধু টিঙটিঙে পাতলা একটা সোয়েটার পরে রয়েছে ছেলেটা। আর একটা বেটপ রং-জ্বলা হাফপ্যান্ট। নিশ্চয়ই কারও পুরনো স্কুলের পোশাক হবে। বাচ্চাটার হাতে ওটা কী? তুলে দেখাল–পিয়ার ডিসপ্লে কার্ডটা। কোথা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে কে জানে। ওটা যে আবার ফিরে পাওয়া যাবে ভাবেইনি পিয়া। একটা ট্রের মতো করে ধরে ওটা পিয়ার সামনে নিয়ে এল ছেলেটা। তারপরে ওর আঙুলগুলো ধরে আলতো একটা চাপ দিল, যেন বলতে চাইছে “ভয় পেয়োনা, আমি তো আছি।”

কিন্তু বাচ্চাটার আশ্বাসে উলটো প্রতিক্রিয়া হল পিয়ার ওপর। আচমকা ওর নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। একেবারেই নতুন এই অনুভূতি পিয়ার। এর আগে বহুবার ও একা একা জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে, অনেক সময়ই একেবারে অচেনা লোকেদের সাথেও ঘুরেছে, কিন্তু আজকে ওই ফরেস্ট গার্ড আর মেজদার ব্যবহারে আত্মবিশ্বাস একটু চিড় খেয়ে গেছে পিয়ার। এখনও ওর মনে হচ্ছে ও যেন আস্তে আস্তে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে থেকে জেগে উঠছে, যেন এই মাত্র কয়েকটা হিংস্র পশুর হাত থেকে কোনও রকমে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে। সত্যিই, এই ডিঙিতে বাচ্চাটা আছে বলে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল পিয়া।

তা না হলে আগেকার মতো সম্পূর্ণ অচেনা একটা লোকের ওপর কিছুতেই হয়তো আর ভরসা রাখতে পারত না। এক হিসাবে দেখতে গেলে তো বাচ্চাটা সত্যিই ওর রক্ষাকর্তা এখন। হঠাৎ কী রকম একটা মমতা-মাখা কৃতজ্ঞতায় বুকটা ভরে গেল পিয়ার। ওর স্বভাবের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না ব্যাপারটা, কিন্তু এখন এই টলমলে নৌকোর ওপর পিয়ার আবেগ আর বাঁধ মানল না–দু’হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে ও বুকে টেনে নিল।

আদর শেষে হাত আলগা করতে গিয়ে পিয়া লক্ষ করল ছেলেটা একদৃষ্টে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নজর পড়তে দেখল মানিব্যাগটা এখনও দু আঙুলের ফাঁকে ধরা। হঠাৎ নিজেকে একটু অপরাধী মনে হল পিয়ার, মনে পড়ল জেলেটার সঙ্গে এখনও টাকাপয়সার ব্যাপারে কোনও কথাই বলা হয়নি। মানিব্যাগ থেকে একতাড়া টাকা নিয়ে পাতলা একটা গুছি আলাদা করে বের করল ও। টাকাটা গুনতে গুনতেই মনে হল ওরা বাপ-ব্যাটা দু’জনে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুখ তুলে দেখল ওদের নজর যেন আঠার মতো আটকে গেছে ওর হাতের সঙ্গে, স্তব্ধ বিস্ময়ে ওরা লক্ষ করছে ওর আঙুলের প্রতিটি নড়াচড়া যেন কোনও মায়াবিনীর হাতের জাদু। লোভ কিন্তু নয়, এমন একটা মুগ্ধতা ছিল ওদের দৃষ্টিতে যে পিয়া বুঝতে পারল জীবনে এই প্রথম ওরা এত টাকা একসঙ্গে দেখছে। এতগুলো কড়কড়ে নোট এত কাছ থেকে দেখার ভাগ্য ওদের আগে কখনও হয়নি। কিন্তু ওর জন্যেই যে ওগুলো গুনছে পিয়া সেটা মনে হল ফকিরের কল্পনায়ও আসেনি। গোনা শেষ করে টাকাটা এগিয়ে দিতেই অপরাধীর মতো কুঁকড়ে গেল ফকির, যেন পিয়া কোনও নিষিদ্ধ জিনিস ওর হাতে তুলে দিতে চাইছে।

মাত্র তো কয়েকটা টাকা, দু’কাপ কফি আর স্যান্ডউইচের জন্যেও পিয়া অনেক সময় এর থেকে বেশি খরচ করেছে। আর রিসার্চ গ্রান্ট হিসেবে যে পয়সা পাওয়া যায় তাতে বেহিসেবি হওয়ার সুযোগও বিশেষ মেলে না। এই সামান্য ক’টা টাকা ওদের প্রাপ্য বলেই ওর মনে হয়েছিল। লোকটার পরনে যদি কোনও জামা থাকত পিয়া ওর পকেটেই খুঁজে দিতে পারত টাকাগুলো, কিন্তু কোমরে জড়ানো ওই ভেজা টুকরো কাপড়টা ছাড়া আর কিছুই নেই ওর গায়ে। অবশ্য একটা মাদুলি বাঁধা আছে এক হাতে। উপায়ান্তর না দেখে ওই মাদুলির সুতোটার মধ্যেই পিয়া টাকা ক’টা মুড়িয়ে খুঁজে দিল। লোকটার সারা গায়ে ঘামাচির মতো কাটা দিয়ে উঠল। সে ওর হাতের ছোঁয়ায়, নাকি এই নভেম্বরের সন্ধ্যার হাওয়ায়, সেটা বুঝতে পারল না পিয়া।

মাদুলির বাঁধন থেকে টাকাটা বার করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ফকির। এতগুলো টাকা নিজের হাতে ধরে আছে সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওর। মুখের সামনে থেকে একটু দূরে রেখে নোটগুলো নিরীক্ষণ করতে লাগল ও। অবশেষে লঞ্চটা যেদিকে গেছে সেদিকে ইশারা করে একটা মাত্র নোট আলাদা করে নিল। পিয়া বুঝতে পারল ও আসলে বলতে চাইছে যে লঞ্চের লোকগুলো তো এই ক’টা টাকাই নিয়ে গেছে, তাই এর থেকে বেশি ও নেবে না। আলাদা করে রাখা নোটটা ছেলের হাতে দিতেই সে দৌড়ে চলে গেল ছইয়ের মধ্যে ওটাকে লুকিয়ে রাখতে।

বাকি টাকাগুলো পিয়াকে ফেরত দিয়ে দিল ফকির। প্রতিবাদের চেষ্টা করতেই দিগন্তের দিকে হাত তুলে হড়বড় করে একটানা অনেক কথা বলে গেল। তার মধ্যে শুধু লুসিবাড়ি’ শব্দটা পিয়ার কানে চেনা ঠেকল। মোটের ওপর বোঝা গেল লুসিবাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত এই দেনাপাওনার ব্যাপারটা স্থগিত রাখতে চায় ও। আপাতত সেই ব্যবস্থাতেই সম্মত হল পিয়া।

.

চিঠি

গেস্ট হাউসটা দোতলায়। পুরো দোতলাটা জুড়েই। সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সব মিলিয়ে চারটে ঘর, হুবহু এক ভাবে সাজানো–দুটো সিঙ্গল খাট, একটা ডেস্ক আর-একটা চেয়ার। ঘরগুলোর সামনে দিয়ে টানা একটা জায়গা। তার খানিকটা বারান্দা, খানিকটা ডাইনিং রুম, আর একদিকে রান্না-বান্নার ব্যবস্থা। বারান্দার শেষপ্রান্তে একটা বাথরুম, শাওয়ার লাগানো। গোটা বাড়িটায় এটুকুই যা বিলাসিতার ছোঁয়া। বাথরুমটা দেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কানাই। পুকুরে গিয়ে স্নান করতে হবে ভেবে ও একটু ভয়ে ভয়েই ছিল এতক্ষণ।

ডাইনিং টেবিলের ওপর ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের একটা টিফিন ক্যারিয়ার। ওর রাতের খাবার, কানাই আন্দাজ করল। নিজের সংসারের সব দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও ময়না খাবারটা রেখে যেতে ভোলেনি। ঘুরে ফিরে দেখে একটা ঘরে ওর সুটকেসটা রাখল কানাই। ওরই জন্যে মনে হয় গুছিয়ে গাছিয়ে রাখা হয়েছে ঘরটা। তারপর ধীরে সুস্থে সিঁড়ির দিকে এগোল।

ছাদের ওপর উঠে এসে চোখ জুড়িয়ে গেল কানাইয়ের। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সারা আকাশ লালে লাল। ভাটা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ, দ্বীপগুলো জলের অনেক ওপরে মাথা তুলে জেগে রয়েছে। নীচে নদীর জলেও যেন লাল আবির ছড়িয়ে রয়েছে। ছাদটায় এক চক্কর মেরে কানাই দেখল এদিকে ওদিকে সব মিলিয়ে অন্তত গোটা ছয়েক দ্বীপ দেখা যাচ্ছে কাছাকাছি। আর আটটা নদী’। লুসিবাড়ির দক্ষিণে আর কোনও দ্বীপেই জনবসতি নেই। খেত-জমি বাড়ি-ঘরেরও তাই কোনও চিহ্ন নেই। গভীর ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে ঢাকা দ্বীপগুলো।

ছাদের একধারে একটা লম্বাটে টিনের চালাঘর। দরজায় তালা আঁটা। এটাই তা হলে মেশোর পড়াশোনার ঘর ছিল। নীলিমার দেওয়া চাবিটা দিয়ে তালাটা খুলল কানাই। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। মুখোমুখি উলটোদিকের দেওয়াল ভর্তি তাক, কাগজ আর বইপত্রে ঠাসা। একটাই মাত্র জানালা ঘরটার পশ্চিম দিকে। সেটা খুলে দিল কানাই। এখান থেকে রায়মঙ্গলের মোহনাটা দেখা যায়। জানালার ঠিক নীচে ডেস্ক। তার ওপর একটা দোয়াত, কয়েকটা কালির কলম, একটা পুরনো ধাঁচের অর্ধগোলাকার ব্লটার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। মনে হচ্ছে যেন কাছেই কোথাও গেছে নির্মল, একটু পরেই ফিরে এসে কাজে বসবে। ব্লটারটার নীচে বেশ বড়সড় একটা বন্ধ খাম, কানাইয়ের নাম লেখা। খামটা কয়েকপ্রস্থ প্লাস্টিকে মোড়া। সেগুলোকে আবার গঁদের আঠা দিয়ে জোড়া হয়েছে। তার ওপর বোধহয় কোনও নোটবই থেকে ছেঁড়া টুকরো একটা কাগজে কুড়ি বছর আগের নির্মলের হাতে লেখা কানাইয়ের নাম ঠিকানা। দু’আঙুলে চাপ দিয়ে বুঝতে পারল না কানাই ভেতরে কী আছে। কী করে প্যাকেটটা খোলা যাবে সেটাও কিছু বোঝা গেল না। প্লাস্টিকের পরতগুলো একেবারে গায়ে গায়ে সেঁটে গেছে মনে হচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে জানালার তাকের ওপর আধখানা দাড়ি কামানোর ব্লেড দেখতে পেল কানাই। সেটা নিয়ে এসে সাবধানে খামটার একদিকে কাটতে শুরু করল। বেশ কয়েক পরত কেটে ফেলার পর প্যাকেটটার ভেতরের বস্তুটা নজরে এল। একটা বাঁধানো খাতা। পাখির বাসার মধ্যে ডিমের মতো সযত্নে রাখা। একটু আশ্চর্য হল কানাই। ও ভেবেছিল হয়তো এক গোছা খোলা পাতা থাকবে, কবিতা বা প্রবন্ধ লেখা। একটা গোটা বাঁধানো খাতা ঠিক আশা করেনি। কয়েকটা পাতা উলটে পালটে দেখল। ঘন করে বাংলায় লেখা। জায়গা বাঁচানোর জন্য এত ছোট ছোট করে লেখা হয়েছে যে প্রায় গায়ে গায়ে লেগে গেছে লাইনগুলো। হাতের লেখাও ট্যারাবাকা, দেখেই মনে হয় খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। কাটাকুটিতে ভর্তি সমস্ত খাতাটা, একেকটা লাইন মার্জিনের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। এতগুলি প্লাস্টিকের মোড়কের মধ্যে রাখা সত্ত্বেও ছোপ ছোপ ড্যাম্প ধরে গেছে মাঝে মাঝে। কয়েক জায়গায় তো লেখা এমন ঝাপসা হয়ে গেছে যে প্রায় পড়াই যায় না।

লেখাটার প্রথম কয়েকটা শব্দ খুবই অস্পষ্ট। খাতাটা প্রায় নাকের কাছে নিয়ে এসে সেগুলো পাঠোদ্ধার করতে হল। প্রথম পাতার একেবারে ওপরে বাঁদিকে তারিখ আর সময় ইংরাজিতে লেখা : May 15, 1979, 5.30 a.m. তার ঠিক নীচে কানাইয়ের নাম। বিশেষ কোনও সম্ভাষণ দিয়ে শুরু না হলেও, পড়তে শুরু করলেই বোঝা যায় এটা আসলে কানাইয়ের জন্যই লেখা লম্বা একটা চিঠি।

প্রথম কয়েকটা লাইন পড়তেই সে ব্যাপারে নিঃসন্দিগ্ধ হয়ে গেল কানাই : “এ লেখাটা আমি এমন একটা জায়গায় বসে লিখছি যে জায়গার নাম তুমি হয়তো শোনেইনি। ভাটির দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের এই দ্বীপের নাম মরিচঝাঁপি..”

খাতা থেকে মুখ তুলে নামটা নিয়ে মনের মধ্যে কয়েকবার নাড়াচাড়া করল কানাই। অভ্যাসের বশেই প্রায় শব্দটার একটা মানেও চলে এল মনে : ‘লঙ্কার দ্বীপ।

আবার খাতার দিকে মন দিল ও :

“ঘড়ির কাটা যেন আর ঘুরতেই চাইছে না। অজানা এক ভয়ংকরের আশঙ্কায় কাটছে প্রতিটা মুহূর্ত। মনে হচ্ছে যেন খানিক বাদেই এসে আছড়ে পড়বে প্রচণ্ড সাইক্লোন, আমরা সবাই যেন তার অপেক্ষায় গুটিসুটি মেরে ঘরের ভেতরে বসে আছি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। একেকটা সেকেন্ড মনে হচ্ছে একেকটা যুগ। বাতাসও যেন গম্ভীর, স্থির হয়ে আছে। সময় যেন নিথর হয়ে গেছে ভয়ের ধাক্কায়।

অন্য কোনও পরিস্থিতিতে হলে হয়তো এরকম ক্ষেত্রে আমি কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন এই খাতা, ডটপেন আর রিলকের দুইনো এলিজির ইংরাজি আর বাংলা অনুবাদগুলো ছাড়া আর কিছুই নেই আমার সঙ্গে। এমনিতেও অবশ্য খানিকক্ষণ আগে পর্যন্ত কিছুই পড়া সম্ভব ছিল না। কারণ এইমাত্র ভোরের আলো ফুটছে, আর আমি বসে আছি একটা ঘঁচের বেড়ার ঘরে, যেখানে একটা মোমবাতি পর্যন্ত নেই। ছাঁচের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সামনে গারল নদী দেখা যাচ্ছে। সবে মাত্র সূর্য উঠতে শুরু করেছে, আর তার সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদীর জল। জোয়ার আসছে। আশেপাশের দ্বীপগুলো তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। খানিক পরেই মেরু সমুদ্রের আইসবার্গের মতো ওগুলোর বেশিরভাগটাই চলে যাবে জলের নীচে। শুধু সবচেয়ে উঁচু গাছের চুড়াগুলো জেগে থাকবে নদীর ওপর। এখনই দ্বীপের ধারের চর আর জালের মতো ঠেসমূলগুলোর ওপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে–শেকড়-বাকরগুলি জলের নীচে কেমন একটা ঝাপসা ভূতুড়ে চেহারা নিয়েছে মনে হচ্ছে যেন ওগুলো কোনও সামুদ্রিক আগাছা, থিরথির করে কাঁপছে স্রোতের টানে। একটু দূরে একঝাক বক উড়ে যাচ্ছে জলের ঠিক ওপর দিয়ে। জোয়ার আসছে, তাই ডুবন্ত দ্বীপগুলোর থেকে দূরে কোনও নিশ্চিন্ত আস্তানার খোঁজে যাচ্ছে ওরা। ভোর হচ্ছে, ভাটির দেশের মিষ্টি সুন্দর ভোর।

যে ঘরটায় আমি এখন বসে আছি সেটা আসলে আমার ঘর নয়। আমি এখানে অতিথি। এ ঘরের মালকিনকে তুমি চেন–কুসুম। প্রায় বছরখানেক হল ও ছেলেকে নিয়ে এখানে আছে। আচ্ছা, এই এক বছর রোজই তো ঘুম ভেঙে উঠে ওরা এই রকম ভোর দেখেছে–কুসুম আর ফকির। কেমন লেগেছে ওদের? ওদের প্রতিদিনের জীবন-যাপনের যন্ত্রণায় কতটুকু শান্তির প্রলেপ দিতে পেরেছে এই ভোর? কে বলতে পারে? এখন, এই অন্তহীন অপেক্ষার সময়, আমার শুধু কবির কথাগুলোই মনে পড়ছে:

‘সৌন্দর্য আর-কিছু নয়,
শুধু সেই আতঙ্কের আরম্ভ, যা অতি কষ্টে আমাদের পক্ষে নয়
এখনো অসহনীয়। আরাধ্য সে আমাদের, যেহেতু সে শান্ত উপেক্ষায়
তার সাধ্য সংহার হানে না।’

কাল সারারাত ধরে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, কাকে ভয় পাচ্ছি আমি? কীসের ভয়? আজ, এই সূর্যোদয়ের সময় আমি সে প্রশ্নের উত্তর পেলাম। আমি ভয় পাচ্ছি কারণ আমি জানি এই ঝড় কেটে গেলে তার আগের কথা কেউ আর মনে রাখবে না। এই ভাটির দেশের পলি কত তাড়াতাড়ি অতীতকে ঢেকে দেয় তা আমার চেয়ে ভাল তো আর কেউ জানে না।

যে অনাগত ভয়ংকরের অপেক্ষায় আমরা এখানে প্রহর গুনছি, তাকে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি আমার নেই। কিন্তু এক সময় তো আমি সাহিত্যচর্চা করেছি। যা এখানে ঘটছে, ঘটতে চলেছে, তার কিছুটা তো আমি লিখে রেখে যেতে পারি। একটু তো অন্তত দাগ রেখে যেতে পারি মহাকালের স্মৃতির পাতায়। এই ভাবনা আর এই ভয়ই আমাকে দিয়ে আজ এক অসাধ্য সাধন করিয়ে নিল–তিরিশ বছর পর কলম ধরিয়ে ছাড়ল আমাকে।

জানি না কতটা সময় আমার হাতে আছে। হয়তো শুধু আজকের দিনটাই। তার মধ্যেই আমি চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব লিখে রেখে যেতে যদি কোনওদিন তোমার হাতে গিয়ে পৌঁছয় এ লেখা। তুমি হয়তো ভাববে, এত লোক থাকতে তোমার জন্যই কেন লিখছি। কারণ হিসাবে এটুকুই আমি বলতে পারি যে এ গল্প আসলে আমার গল্প নয়। যাকে নিয়ে এই লেখা, লুসিবাড়িতে থাকার দিনগুলিতে সেই ছিল তোমার একমাত্র সঙ্গী। সে হল কুসুম। আমার জন্য না হলেও, কুসুমের কথা মনে করে অন্তত লেখাটা পড়ো।”

.

ডিঙিতে

ফকিরের নৌকোটা লম্বায় প্রায় মিটার পাঁচেক হলেও খুব একটা চওড়া নয়। এমনকী ঠিক মাঝখানটাতেও দু’জনের বেশি লোকের পাশাপাশি বসার জায়গা নেই। ডিঙিটাকে পিয়ার মনে হল ঠিক যেন একটা বস্তিবাড়ির ভাসমান সংস্করণ–ছেঁচা বাঁশ, টুকরো-টাকরা কাঠ আর ভেঁড়াখোঁড়া পলিথিন দিয়ে কোনও রকমে জোড়াতাড়া দেওয়া। নৌকোর বাইরের দিকের তক্তাগুলোতেও কোনওকালে পালিশ পড়েছে বলে মনে হয় না, ফঁক-ফোকরগুলো আলকাতরা দিয়ে বোজানো; যাতে জল চুঁইয়ে না ঢুকতে পারে। ডিঙির ওপরে কতগুলো পুরনো চায়ের পেটির প্লাইউড পাতা, কয়েকটাতে চা কোম্পানির নামটা এখনও পড়া যায়। পেরেক-টেরেকেরও কোনও বালাই নেই, তক্তাগুলি স্রেফ একটা তাকের মতো কাঠের ওপর পর পর রাখা। ইচ্ছে করলেই এদিক সেদিক নাড়াচাড়া করা যায়। নীচের গোল মতো অংশটায় জিনিসপত্র রাখার জায়গা। ডিঙির সামনের দিকে কোনাচে জায়গাটায় কিছু বুনো ঘাস আর জংলা গাছের ডালপালা জড়ো করা, কয়েকটা কাঁকড়া সেগুলোর মধ্যে নড়াচড়া করছে। এখানেই রাখা থাকে ফকিরের সারাদিনের শিকার। ডালপালা আর ঘাসগুলো দিয়ে জায়গাটাকে স্যাঁতস্যাঁতে রাখা হয়েছে। ওগুলো না থাকলে কাঁকড়াগুলো বোধহয় নিজেদের মধ্যে ছেঁড়াছিঁড়ি শুরু করে দিত।

নৌকোর ছইটাও তৈরি করা হয়েছে হেঁচা বাঁশ, কঞ্চি আর বাখারি দিয়ে। ছোট্ট ছইটা, কোনওরকমে দুটো লোক তার মধ্যে রোদ-বৃষ্টি থেকে মাথা আড়াল করতে পারে। জল আটকানোর জন্য ভেতরে আবার একটা ধূসর ছিট ছিট প্লাস্টিক দেওয়া। সেটার ওপরের লেখাগুলো চেনা লাগল পিয়ার–ওটা আসলে একটা ছেঁড়া মেলব্যাগ। ও নিজেই কতবার এরকম ব্যাগ ব্যবহার করেছে আমেরিকা থেকে চিঠিপত্র পাঠানোর জন্য। ডিঙির একেবারে পেছনের দিকে, বাঁকানো ল্যাজের মতো অংশটা আর ছইয়ের মাঝে ছোট একটা প্ল্যাটফর্ম মতো করা। পোড়া দাগ ধরা একটা তক্তা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে সেটা। ছইয়ের ভেতরে তক্তার নীচে আরও একটা খোপ। সেটাই এই নৌকোর ভাড়ার। জায়গাটা কাঠের দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা। নীল একটা পলিথিন যেমন তেমন ভাবে পাতা আছে জল আটকানোর জন্য। ভেতরটায় সুন্দর করে গোছানো আছে কিছু শুকনো জামাকাপড়, রান্নার বাসনপত্র, সামান্য কিছু খাবার-দাবার আর খাওয়ার জল। খুপরিটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা ভজ করা কাপড় বের করে আনল ফকির। ভাঁজ খুলতে দেখা গেল সেটা একটা শস্তার ছাপা শাড়ি।

এর পর যা ঘটতে লাগল তাতে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পিয়া। প্রথমে টুটুলকে নৌকোর সামনের দিকে পাঠিয়ে দিল ফকির। তারপর পিয়ার ব্যাগগুলো ঠেসেটুসে ঢোকাল ছইয়ের মধ্যে। এবার নিজে বেরিয়ে এসে পিয়াকে ভেতরে যেতে ইশারা করল। পিয়া কোনওরকমে গুঁড়িসুড়ি মেরে ঢুকে যাওয়ার পর ছইয়ের সামনের দিকে পর্দার মতো শাড়িটাকে টাঙিয়ে দিল ফকির।

ব্যাপারটা মাথায় ঢুকতে বেশ খানিকক্ষণ লাগল পিয়ার। আসলে ওর জন্য একটা ঘেরা জায়গা বানিয়ে দিয়েছে ফকির, একটা আড়াল করে দিয়েছে, যাতে ও নিশ্চিন্তে ভেজা জামাকাপড় পালটে নিতে পারে। এতক্ষণে একটু অস্বস্তি হল পিয়ার। ওর নিজের সংকোচ হওয়ার আগেই ফকিরই চিন্তা করেছে কী করে ও আড়াল রেখে জামাকাপড় পালটাবে। একটু হাসিও এল ঠোঁটের কোনায়, কারণ ছাত্র অবস্থায় তো ওকে অনেক বছরই ছেলেদের সঙ্গে এক ডর্মিটরিতে থাকতে হয়েছে, এমনকী এক বাথরুম শেয়ার করতে হয়েছে। কাজের প্রয়োজনেও পুরুষদের সঙ্গে এক বাড়িতে কাটাতে হয়েছে অনেক সময়। তা সত্ত্বেও ফকিরের এই আচরণ পিয়ার মনকে কোথাও একটা ছুঁয়ে গেল। ফকির যে ওকে শুধু জামাকাপড় পালটানোর জন্যে একটা জায়গা করে দিয়েছে তা তো নয়, সাথে সাথে একটা সহজ সামাজিকতায় ওকে গ্রহণ করেছে, কথা না বলতে পারলেও বুঝিয়ে দিয়েছে পিয়া কেবল নামহীন ভাষাহীন কোনও বিদেশি নয়, সুন্দরবনের এই জেলের কাছে ও আপন লোক। কিন্তু ফকিরের মতো একজন মানুষ, যে হয়তো এর আগে কোনও বিদেশির এত কাছাকাছি আসেইনি, তার পক্ষে এটা সম্ভব হল কী করে?

জামাকাপড় বদলানো হয়ে যাওয়ার পর শাড়িটাকে হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে দেখল পিয়া। বহুদিন ধোপ খেয়ে খেয়ে পাতলা আর নরম হয়ে এসেছে কাপড়টা। ঠিক এইরকম শাড়ি পরত পিয়ার মা, ওদের আমেরিকার বাড়িতে। এই রকম নরম, কোঁচকানো, ব্যবহারে ব্যবহারে পাতলা হয়ে আসা সেই শাড়ির ছোঁয়া এখনও ওর স্মৃতিতে লেগে আছে। মাঝে মাঝে খুব রাগও হত মায়ের ওপর। মনে হত সব সময় এই রকম রং-জ্বলা পুরনো একটা কাপড় পরে থাকলে ওর বন্ধুরা কী ভাববে? ওরা হয়তো মনে করবে পিয়ার মা জামাকাপড় পরে না, একটা বিছানার চাদর গায়ে জড়িয়ে থাকে।

কিন্তু এই শাড়িটা কার? ওর বউয়ের? বাচ্চাটার মা-র? দু’জনে কি একই লোক? প্রশ্নগুলো মনে আসছিল বটে, কিন্তু উত্তর জানার কোনও উপায় নেই বলে যে খুব একটা আফশোস হচ্ছিল পিয়ার, তাও ঠিক নয়। একদিক থেকে বাঁচোয়া; একটা মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি জানার সাথে সাথে কিছু দায়িত্বও তো চলে আসে। তার থেকে অন্তত অব্যাহতি পাওয়া গেল।

ছইয়ের ভেতর থেকে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল পিয়া। নৌকোর নোঙর তোলা হয়ে গেছে, দাঁড় হাতে তুলে নিয়েছে ফকির। ওরও স্নান সারা হয়ে গেছে। চুল-টুল আঁচড়ে একেবারে ফিট বাবুটি হয়ে গেছে এর মধ্যে। মাঝখানে সিঁথি কাটা, চুলগুলি পেতে আছে মাথার ওপর। মুখে গলায় নুনের গুঁড়োগুলো না থাকায় খুব ছেলেমানুষ মনে হচ্ছিল ফকিরকে, এক্কেবারে একটা কলেজ-পালানো দুষ্টু ছেলের মতো লাগছিল। স্নান করে জামাকাপড়ও পালটে নিয়েছে ও। একটা ঘিয়ে রঙের টি শার্ট গায়ে দিয়েছে, পরনে একটা কাঁচা লুঙ্গি। দূরবিন দিয়ে পিয়া ওকে যে লুঙ্গিটা পরে থাকতে দেখেছিল সেটা আপাতত মেলা আছে ছইয়ের ওপর।

সূর্য এর মধ্যে পাটে বসেছে। দিগন্ত থেকে যেন একটা রঙের ধূমকেতু ছিটকে উঠে ডুব দিয়েছে ঠিক মোহনার মাঝখানে। একটু পরেই রাত নামবে, রাত কাটানোর মতো একটা কোনও জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে হবে তার মধ্যে। দিনের আলোতেই এই নদী-খাঁড়ির ভুলভুলাইয়ায় পথ খুঁজে পাওয়া কঠিন, রাতের অন্ধকারে এইটুকু ডিঙি নিয়ে তো দিশাহারা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। তবে ফকির নিশ্চয়ই কোনও একটা নিরাপদ জায়গার কথা মনে মনে ভেবে রেখেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে পৌঁছনো যায় ততই মঙ্গল।

নৌকো চলতে শুরু করার পর উঠে দাঁড়াল পিয়া, দূরবিন চোখে তুলে নিয়ে কাজ শুরু করল ফের। জরুরি সব যন্ত্রপাতি সঙ্গেই আছে, কোমরের বেল্টের সাথে লাগানো। দূরবিনে চোখ রাখতেই মনে হল যেন স্নিগ্ধ বৃষ্টি এসে ধুয়ে দিল চারপাশের দৃশ্যপট, চেনা কাজের ছন্দে মনের অস্থিরতা কমে এল ধীরে ধীরে। দূরবিন চোখে ঘড়ির কাটার মতো নদীর দিকে নজর রাখছিল পিয়া, আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরাচ্ছিল–ডানদিক থেকে বাঁদিক, বাঁদিক থেকে ডানদিক, যেন কোনও বাতিঘরের সিগনাল, আলো দেখিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো। নৌকোর দুলুনিতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছিল না ওর। এত বছরের চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওর শরীর, অভ্যাসগত প্রতিবর্তে জলের দোলার সাথে সাথে এখন সংকুচিত প্রসারিত হয় হাঁটুর পেশি। ভারসাম্য রাখার জন্য আর আলাদা করে চেষ্টা করতে হয় না।

ওর কাজের এই ব্যাপারটাই পিয়ার সবচেয়ে পছন্দের : সারাক্ষণ ভেসে ভেসে বেড়ানো, মুখে জোলো বাতাসের ঝাঁপটা, সতর্ক চোখ নদীর দিকে, আর হাতের কাছে সব জরুরি জিনিসপত্র যা যা দরকার। পিয়ার কোমরে সবসময় বাঁধা থাকে পর্বতারোহীদের বেল্ট, ক্লিপবোর্ড থেকে শুরু করে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি সব হুকের সঙ্গে ঝোলানো। সবচেয়ে দরকারি যে যন্ত্রটা ও কখনও কাছছাড়া করে না সেটা হল ছোট্ট একটা হাতে-ধরা মনিটর। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে যে-কোনও জায়গায় নিজের নির্ভুল অবস্থান জানা যায় এটা দিয়ে। পিয়া যখন চোখে দূরবিন এঁটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুশুক খুঁজতে থাকে, তখন নিখুঁতভাবে এই যন্ত্র রেকর্ড করে যায় ওর পথ, প্রতিটি সেকেন্ডের, প্রতিটি মিটারের হিসেব রেখে চলে। এমনকী খোলা সমুদ্রেও এটার সাহায্যে অভ্রান্ত ভাবে দিক নির্ণয় করা যায়। হয়তো কোনও একদিন কোনও এক সময় এক জায়গায় একটা শুশুকের পাখনার একটু আভাস দেখা গিয়েছিল, প্রয়োজন হলে ঠিক সেই বিন্দুতে আবার ফিরে আসা যায় যদি এই যন্ত্র হাতে থাকে।

এই জিপিএস মনিটর ছাড়াও পিয়ার সঙ্গে আছে একটা রেঞ্জফাইন্ডার আর একটা ডেস্থ সাউন্ডার। প্রথম যন্ত্রটা দিয়ে কোনও বস্তুর দূরত্ব মাপা যায়, আর দ্বিতীয়টা কাজে লাগে জলের গভীরতা মাপতে। এই সব ক’টা যন্ত্রই পিয়ার কাজের জন্য খুব জরুরি, কিন্তু সবচেয়ে দরকারি হল ওর গলায় ঝোলানো ওই দূরবিন। ওটা কিনতে গিয়ে প্রায় ফতুর হয়ে গিয়েছিল পিয়া, কিন্তু তাতে ওর কোনও দুঃখ নেই। কারণ দূরবিন ছাড়া এ ধরনের রিসার্চ একেবারেই কানা। বহু বছরের ব্যবহারে যন্ত্রটার বাইরের ঔজ্জ্বল্য কমেছে, লেন্সের ঢাকনাগুলো রোদে আর নুনের গুঁড়োর আঁচড়ে আঁচড়ে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে এসেছে, কিন্তু জলনিরোধক আবরণ যেটা আছে সেটা খুবই কাজের। এই ছয় বছর ধরে একটানা ব্যবহার করার পরেও তাই একেবারে ঠিকঠাক কাজ করে যাচ্ছে পিয়ার এই বিশ্বস্ত দূরবিন। শক্তিশালী লেন্সগুলো এখনও বহুদূরের জিনিসকে যেন নাকের কাছে নিয়ে চলে আসে। ডানদিকের আইপিসটার সঙ্গে আবার একটা কম্পাস লাগানো আছে। ফলে দূরবিনটা চোখ থেকে না নামিয়েই দৃষ্টিপথ ঠিক রাখতে পারে পিয়া, জলের দিকে নজর রাখতে পারে অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নিখুঁত অর্ধবৃত্ত। ১৮০ ডিগ্রি। বেশিও নয়, কমও নয়। এটা যখন কিনেছিল তখন ও সদ্য ক্যালিফোর্নিয়ার স্ক্রিপস ইন্সটিটিউশন অব ওশ্যেনোগ্রাফিতে ভর্তি হয়েছে গ্র্যাজুয়েশন করতে। খুব জোর হলে বছর খানেক হয়েছে। সে ভাবে বলতে গেলে সে সময় এরকম একটা দূরবিনের দরকারই ছিল না ওর। তবে পিয়ার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। পড়াশোনা শেষ হলে কী করবে সেটা তখন থেকেই মনে মনে ও স্থির করে নিয়েছিল। দুরবিন কেনার কথা মনে হতে তাই বাজারের সেরাটাই কেনার ইচ্ছে হয়েছিল ওর। বেশ কিছুদিন ধরে বহু ক্যাটালগ ঘেঁটেঘুঁটে অবশেষে মানি অর্ডার করেছিল কোম্পানিতে।

প্যাকেটটা যখন এসে পৌঁছল সেটার ওজন দেখে বেশ একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল পিয়া। সে সময়ে ও যেই ঘরটায় থাকত সেটা ছিল ইউনিভার্সিটির রাস্তার একেবারে পাশে। বইখাতা হাতে ছাত্রছাত্রীরা সব সময় সেখান দিয়ে যাতায়াত করছে। দূরবিনটা নীচের দিকে তাক করে ও ছেলেমেয়েগুলোর মুখ, ওদের হাতের বইপত্র দেখার চেষ্টা করছিল। অত উঁচু থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল প্রতিটা লোককে। এমনকী বইয়ের মলাটের লেখা, খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো পর্যন্ত পরিষ্কার পড়া যাচ্ছিল। কিন্তু দূরবিনটা ঘুরিয়ে অন্যদিকে দেখতে গিয়ে বোঝা গেল যতটা সহজ মনে হয়েছিল আসলে ততটা সহজ নয় ব্যাপারটা। এ যন্ত্র হাতে একশো আশি ডিগ্রি পর্যন্ত ঘুরে দেখতে গেলে শুধু ঘাড় ঘোরালে চলবে না, একেবারে গোড়ালি থেকে শুরু করে কোমর কাধ মাথা সুদ্ধ পুরো শরীরটাই ঘোরাতে হবে। কয়েক মিনিটেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল পিয়া। হাতে ব্যথা ধরে গিয়েছিল। এই ভারী দূরবিন নিয়ে দিনে দশ বারো ঘণ্টা কী করে কাজ করে লোকে? তা হলে কি ওকে দিয়ে এ ধরনের কাজ হবে না? একটু হতাশ হয়ে পড়েছিল পিয়া।

এমনিতে বরাবরই বন্ধুবান্ধবদের তুলনায় ও দেখতে একটু ছোটখাটো। একেবারে ছেলেবেলায়, এমনকী কিশোর বয়সেও, ওর সমবয়সিদের সামনে ওকে লিলিপুটের মতো লাগত। তবে সেটা এক রকম অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল পিয়ার। কিন্তু যেদিন প্রথম ও লা জোলাতে ওর সিটোলজির ক্লাসে গেল সেদিন সহপাঠীদের সামনে ওর নিজেকে একেবারে একরত্তি একটা পুঁচকে মেয়ে মনে হচ্ছিল। “এ তো দেখা যাচ্ছে তিমির দলে পুঁটিমাছের প্রবেশ,” একজন অধ্যাপক ঠাট্টা করে বলেছিলেন। হবে না-ই বা কেন? অন্য যারা ওর ক্লাসে ছিল তারা প্রায় সকলেই পোড়-খাওয়া খেলোয়াড় গোছের ছেলেমেয়ে-ইয়া মোটা মোটা হাড়, পেশিগুলো যেন পাথর কুঁদে বের করা। বিশেষ করে মেয়েগুলো বোধহয় জন্ম থেকেই ক্যালিফোর্নিয়া কি হাওয়াই কি নিউজিল্যান্ডের সমুদ্রের ধারে ভলিবল খেলে, ডাইভিং করে, ডুবসাঁতার কেটে, নৌকো চালিয়ে বড় হয়েছে। তাদের শরীরের গড়নই তো অন্য রকম। রোদে পুড়ে পুড়ে গায়ের চামড়া প্রায় তামাটে সোনালি, তার ওপর হাতের কুচি কুচি লোমগুলো যেন চিকচিকে বালির দানা। পিয়া নিজে কোনওদিন খেলাধুলোর ধার দিয়েই যায়নি। তাতে করে অন্যদের থেকে আরও নিজেকে আলাদা মনে হত ওর। শুধু এই ছোটখাটো চেহারার জন্যই সারা কলেজে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল ও, সবাই চিনে গিয়েছিল এই “পুঁচকে ইস্ট ইন্ডিয়ান” মেয়েটাকে।

তবে কোস্টারিকা উপকূলের কাছে জীবনে প্রথমবার সার্ভের কাজ করতে গিয়েই নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে সন্দেহ মিটে গিয়েছিল পিয়ার। শুরুর ক’টা দিন কিছুই দেখা গেল না সেবার, শুধু এ দিগন্ত থেকে ও দিগন্ত নিষ্ফলা নজর রেখেই সময় কেটে গেল। দূরবিনের ভারে পিয়াকে হাসফাস করতে দেখে মনে হয় মায়া হচ্ছিল সহপাঠীদের, রুটিন ভেঙে ডেকে বসানো বড় বাইনোকুলারটা বেশিক্ষণ ধরে,ওরা ওকে দেখতে দিচ্ছিল। যাই হোক, এ ভাবে পর পর তিন দিন কেটে যাওয়ার পর চতুর্থ দিনে দেখা মিলল এক দঙ্গল ডলফিনের। শুরুতে মনে হয়েছিল ছোট একটা দল, খুব বেশি হলে সব মিলিয়ে গোটা কুড়ি হয়তো হবে। কিন্তু ক্রমেই বাড়তে থাকল সংখ্যাটা–কুড়ি থেকে একশো, দুশো করে বাড়তে বাড়তে প্রায় হাজার সাতেকে গিয়ে দাঁড়াল। শেষপর্যন্ত এত অজস্র ডলফিন দেখা যেতে লাগল চতুর্দিকে যে গুণতে গুণতে খেই হারিয়ে ফেলল ওরা। মনে হচ্ছিল গোটা সমুদ্রটা যেন ভরে গেছে ডলফিনে, যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই একেবারে দিগন্ত পর্যন্ত থিকথিক করছে অগুন্তি ডলফিন, ঢেউয়ের চেয়েও সংখ্যায় বেশি, জলের ওপর চার দিকে শুধু অজস্র ছুঁচোলো ঠোঁট আর চকচকে তেকোনা পাখনা। ঠিক সেই সময়ে পিয়া দেখল কীভাবে হঠাৎ হালকা হয়ে গেল ওর দূরবিনটা। মানে, রাতারাতি যে ও মহা শক্তিশালী গামা পালোয়ান হয়ে গেল তা নয় (যদিও ততদিনে দড়ির মতো পাকানো পাকানো পেশি গজিয়ে গেছে ওর হাতে), কিন্তু শুধু ওই একজোড়া কাঁচ সমুদ্রটাকে আর ডিগবাজি-খাওয়া ডলফিনগুলোকে এত কাছে এনে দিয়েছিল, যে ভারী ওজনের সমস্যাটা একেবারে বেরিয়েই গেল মাথা থেকে।

.

নির্মল আর নীলিমার কথা

নির্মল আর নীলিমা বোস প্রথমবার লুসিবাড়িতে আসে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সেটা ১৯৫০ সাল, তখন একবছরও হয়নি ওদের বিয়ে হয়েছে।

নির্মলের আদি বাড়ি ঢাকায়। কলকাতায় ও এসেছিল পড়াশোনা করতে। তারপর স্বাধীনতা, দাঙ্গা, দেশভাগ–পরিবারের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। নির্মল নিজেও কলকাতাতেই থেকে যেতে চেয়েছিল। তখন ও উঠতি লেখক, একটু নাম-টামও হয়েছে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে। সেই সময়েই একটা চাকরি জুটে গেল আশুতোষ কলেজে। ইংরেজি পড়ানোর চাকরি। নীলিমা ছিল সেই কলেজের ছাত্রী।

পরিবারগত ভাবে দেখতে গেলে নির্মল আর নীলিমার মধ্যে কোনও মিলই ছিল না। নীলিমা ছিল বনেদি পরিবারের মেয়ে, ওর বাপ-কাকাদের লোকে এক ডাকে চিনত। ওর ঠাকুর্দা ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম সদস্যদের একজন। আর বাবা, অর্থাৎ কানাইয়ের দাদু, ছিলেন হাইকোর্টের ডাকসাইটে ব্যারিস্টার। নীলিমার যখন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স, তখন একবার ওর প্রচণ্ড হাঁপানি হয়। তার প্রকোপ চলেছিল বেশ কিছুদিন। ফলে কয়েক বছর পর স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই ওকে ভর্তি করে দেওয়া হল ওদের বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ির কাছে আশুতোষ কলেজে। বাড়ির একটা প্যাকার্ড গাড়ি রোজ সকালে ওকে কলেজ পৌঁছে দিত, আবার বিকেলে ফেরত নিয়ে আসত।

একদিন ছুটির পর একটা ছুতো করে বাড়ির ড্রাইভারকে ফেরত পাঠিয়ে দিল নীলিমা, আর বইখাতা বগলে নিয়ে কলেজের ইংরেজির অধ্যাপকের পেছন পেছন একটা বাসে গিয়ে উঠে পড়ল। অধ্যাপকের চোখের আদর্শবাদের দীপ্তি তখন আগুনের দিকে পতঙ্গের মতো টেনেছিল নীলিমাকে। ওর ক্লাসের অনেক মেয়েই তখন নির্মলের আগুনঝরা বক্তৃতা আর আবেগময় আবৃত্তিতে মুগ্ধ, এমনকী তাদের কেউ কেউ নির্মলের প্রেমে পাগলও ছিল, কিন্তু নীলিমার মানসিক শক্তি বা উদ্ভাবনী ক্ষমতা তাদের ছিল না। বাসে উঠে সেদিন ও ঠিক নির্মলের পাশের সিটটায় গিয়ে বসল; আর এক মাসের মধ্যেই বাড়িতে জানিয়ে দিল যে বিয়ের পাত্র ওর ঠিক করা হয়ে গেছে। বাড়ির লোকেদের স্বাভাবিক ভাবেই প্রচণ্ড আপত্তি ছিল এই বিয়েতে, কিন্তু তাতে নীলিমার জেদ বাড়ল বই কমল না। ১৯৪৯ সালে একদিন সাদামাটা এক অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয়ে গেল ওদের। হোম-যজ্ঞ-মন্ত্রপাঠের বদলে পড়া হয়েছিল ব্লেক, মায়কোভস্কি আর জীবনানন্দের কবিতা। সে বিয়েতে পৌরোহিত্য করেছিল নির্মলের এক পাটি কমরেড।

বিয়ের পর মাস খানেকও হয়নি, হঠাৎ একদিন সকালে ওদের মুদিয়ালির ছোট্ট ফ্ল্যাটে পুলিশ হানা দিল। আগের বছর কলকাতায় সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের এক কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিল নির্মল–সেই সূত্রে। (গল্পের ঠিক এই জায়গায় এসে নির্মল একটু থেমে যেত, তারপর একটু ঝোঁক দিয়ে শুরু করত পরের বাক্যটা। ওর মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কলকাতার এই কনফারেন্স ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমনকী দশ-বিশ বছর পরেও এশিয়ার সমস্ত গণ অভ্যুত্থানের সঙ্গে পশ্চিমি গোয়েন্দা দফতরগুলি এই কনফারেন্সের যোগসূত্র খুঁজে বের করত–সে ভিয়েতনামই হোক, কি মালয়েশিয়ার আন্দোলন, অথবা বার্মার রেড ফ্ল্যাগ অভ্যুত্থান। ওদের মতে এই সবকিছুর মূলেই ছিল ১৯৪৮-এর কলকাতা কনফারেন্সের ‘সশস্ত্র সংগ্রাম নীতি’। নির্মল বলত এমনিতে যে এসব কথা সবাইকে জানতেই হবে তার কোনও মানে নেই, কিন্তু এই ভাটির দেশে এ ধরনের খবরের বিশেষ মূল্য আছে। বাইরের পৃথিবীর বড় বড় ঘটনার খোঁজ এখানে সহজে এসে পৌঁছয় না, সেই জন্যেই আরও বেশি করে সেগুলি এখানকার মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ইতিহাসের প্লাবনের ঢেউ এক সময় না এক সময় পৃথিবীর দুর্গমতম অঞ্চলেও গিয়ে ধাক্কা দেয়।)

আটচল্লিশের কনফারেন্সে অবশ্য নির্মলের ভূমিকা ছিল খুবই সামান্য, সে ক’দিন ওকে বার্মিজ ডেলিগেশনের গাইড হিসেবে কাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু বার্মায় কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সেই সূত্র ধরেই পুলিশ এল ওর বাড়িতে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওরা নিয়ে গেল ওকে। এখনও ওই ডেলিগেশনের কারও সাথে ওর যোগাযোগ আছে কিনা, অথবা ওদের সম্পর্কে নতুন কিছু খবর যদি ও দিতে পারে, এই সব তথ্য ওর কাছে জানতে চেয়েছিল পুলিশ।

সবসুদ্ধ মাত্র দু-এক দিনই লক-আপে থাকতে হয়েছিল নির্মলকে। কিন্তু ওর পক্ষে সে অভিজ্ঞতার ফল হল মারাত্মক। সে সময় নীলিমার পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, নিজের বাড়ির থেকেও একেবারে বিচ্ছিন্ন, ফলে নিজের মধ্যে কেমন গুটিয়ে গেল নির্মল। কলেজে যেত না, দিনের পর দিন বিছানা থেকে উঠতে চাইত না। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির দিকে যাচ্ছে দেখে লজ্জার মাথা খেয়ে অবশেষে বাপের বাড়ির শরণাপন্ন হল নীলিমা। নির্মলের সঙ্গে বিয়েটা পরিবারের লোকেরা কখনওই ক্ষমার চোখে দেখেনি, কিন্তু এই বিপদের দিনে ওরাই ওর পাশে এসে দাঁড়াল। নীলিমার বাবার কথায় কয়েক জন ডাক্তার এসে নির্মলকে দেখে হাওয়া বদলের পরামর্শ দিলেন। নির্মলের পার্টির লোকেদেরও মনে ধরল কথাটা। আসলে ওরাও বুঝে গিয়েছিল এই রকম দুর্বল মানসিকতার লোক পার্টির বিশেষ কাজে আসবে না। নীলিমাও খুশি হল–শহর থেকে দূরে গেলে নির্মলও সেরে উঠবে, ওর নিজের হাঁপানিরও হয়তো কিছুটা উপশম হবে। কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে সেটা ঠিক করাই হল সমস্যা। এবারেও মুশকিল আসান করলেন নীলিমার বাবা। সে সময় হ্যামিলটন এস্টেটের কিছু কাজকর্ম উনি দেখাশোনা করতেন। সেই সূত্রেই জানতে পারলেন এস্টেটের ম্যানেজার একজন শিক্ষকের খোঁজ করছেন লুসিবাড়ির স্কুলটা চালানোর জন্য।

১৯৩৯-এ স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন মারা যাওয়ার পর এস্টেটের মালিকানা বর্তায় তার ভাইপো জেমস হ্যামিলটনের ওপর। কিন্তু জেমস থাকতেন স্কটল্যান্ডের অ্যারান দ্বীপে। কাকার সম্পত্তি পাওয়ার আগে কখনও ভারতে আসার কথা তার চিন্তাতেও আসেনি। স্যার ড্যানিয়েলের মৃত্যুর পর কয়েকদিনের জন্য উনি গোসাবায় এসেছিলেন বটে, কিন্তু এস্টেটের কাজেকর্মে কখনও মাথা গলাননি। সেসব দেখাশোনা করত ম্যানেজার আর কর্মচারীরা। ফলে নীলিমার বাবা একবার বলে দিলেই যে নির্মলের চাকরিটা হয়ে যাবে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ ছিল না।

কিন্তু বেঁকে বসল নির্মল নিজে। এতদিন বামপন্থী রাজনীতি করার পর শেষে একজন পুঁজিপতির এস্টেটে গিয়ে কাজ করতে হবে? সে কী করে সম্ভব? অনেক সাধ্যসাধনার পর নীলিমা একবার গিয়ে জায়গাটা দেখে আসতে রাজি করাল ওকে। অবশেষে একদিন ওরা দু’জন গোসাবায় গিয়ে পৌঁছল। ঘটনাচক্রে সেদিন ছিল হ্যামিলটনের জন্মদিন। অবাক হয়ে ওরা দেখল ঠিক একটা পুজোর মতো করে জয়ন্তী উদ্যাপন করা হচ্ছে। এস্টেটের বিভিন্ন জায়গায় স্যার ড্যানিয়েলের মূর্তিগুলোকে মালা চন্দন দিয়ে সাজানো হয়েছে, ধূপ-ধুনো জ্বলছে সামনে, মূর্তির সামনে গিয়ে লোকে গড় হয়ে প্রণাম করছে। বোঝাই যাচ্ছিল স্থানীয় মানুষের কাছে এই স্কট সাহেব একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি, প্রায় ভগবানের মতো ভক্তি করে হ্যামিলটনকে এখানকার লোকেরা। বাসিন্দাদের কাছে এস্টেটের আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠাতার গল্প শুনে অবশেষে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হল নির্মল আর নীলিমা। মনে মনে একটু লজ্জাও হল ওদের।

কোথাকার কোন বিদেশি পুঁজিপতি এই জল-জঙ্গলের দেশে এসে গরিব মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য কত কিছু করেছেন, আর সেখানে কলকাতা শহরের বাইরে মানুষ কীভাবে থাকে সে ব্যাপারে ওদের কোনও ধারণাই নেই। এতদিন ধরে যা বড় বড় প্রগতিশীল কথা বলে এসেছে সেগুলি হঠাৎ কেমন শূন্যগর্ভ মনে হল নির্মলের।

দু-একদিনের মধ্যেই মন স্থির করে ফেলল ওরা। আর লুসিবাড়িতে পা দেওয়ার পর ঠিক করে ফেলল এই দ্বীপেই এসে কাটাবে কয়েক বছর। সেবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে নিজেদের সামান্য জিনিসপত্র যা ছিল গুছিয়ে নিল নির্মল আর নীলিমা, তারপর বর্ষা কেটে যাওয়ার পর একদিন চাটিবাটি গুটিয়ে এসে উঠল লুসিবাড়িতে।

প্রথম কয়েক মাস ওরা যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। সব কিছুই এখানে একেবারে নতুন, সব জায়গার থেকে আলাদা। এমনিতে গ্রামগঞ্জের ব্যাপারে যেটুকু ধারণা ওদের ছিল সেসব সাধারণ সমতলের গ্রাম। সেসব জায়গার সঙ্গে এতটুকুও মিল নেই এই ভাটির দেশের। অদ্ভুত এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনপ্রণালী ওদের মতো শহুরে লোকেদের বোধবুদ্ধির বাইরে। কতটুকুই বা দূর এখান থেকে কলকাতা শহর? মেরেকেটে সাতানব্বই কিলোমিটার। কিন্তু এদের সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না কলকাতার মানুষ। কত কথাই তো বলা হয় গ্রামভারতের স্মরণাতীত কালের ঐতিহ্য নিয়ে, কিন্তু চেনা জগতের থেকে একেবারে অন্যরকম এই পৃথিবীর কথা ক’টা লোক জানে? ক’জন চোখে দেখেছে এরকম একটা জায়গা যেখানে জাতপাত নেই, উঁচুনিচুর ভেদ নেই? আবার অন্যদিকে, কোথায় গেল সেই সমবায় ঋণ ভিত্তিক গণতান্ত্রিক দেশ? এখানকার সেই আলাদা মুদ্রা আর ব্যাঙ্কেরই বা কী হল? ভাটির দেশের কাদায় সোনা ফলানোর যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল সে সোনা কোথায়?

দারিদ্র্য এত চরম এই ভাটির দেশে যে পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল নির্মল আর নীলিমার। তফাত শুধু একটা খিদে, মৃত্যু আর বিপর্যয় লুসিবাড়ির মানুষের রোজকার জীবনযাপনের অঙ্গ। দশকের পর দশক ধরে মানুষ বাস করছে এই দ্বীপে, কিন্তু বহু চেষ্টায়ও এখানকার জমির লোনাভাব পুরোপুরি দূর করা যায়নি। চাষবাস তাই বিশেষ হয় না, যেটুকু ফসল ওঠে তাও খুবই নিকৃষ্ট মানের। দ্বীপের বেশিরভাগ মানুষই একবেলা খেয়ে থাকে। এত বছর ধরে এত পরিশ্রমে যে বাঁধ বাঁধা হয়েছে, তার ওপরেই বা কতটুকু ভরসা করা যায়? ঝড়ে বন্যায় প্রায়ই ফাটল ধরে এখানে সেখানে। আর বাঁধ ভেঙে একবার যদি লোনা জল ঢুকে পড়ে গ্রামের মধ্যে, বেশ কয়েক বছরের মতো চাষবাসের দফারফা। শুরুতে যারা এসে বসত শুরু করেছিল লুসিবাড়িতে তাদের বেশিরভাগই ছিল চাষিবাসি মানুষ। বিনেপয়সার চাষের জমি দিয়ে এখানে এনে বসানো হয়েছিল তাদের। এদিকে অনাবাদি জমিতে ফসল ভাল হয় না। অথচ পেটের জ্বালাও বড় বালাই। তাদের কেউ তাই শুরু করল মাছ ধরতে, আবার কেউ বা গেল জঙ্গলের দিকে, যদি কিছু শিকার পাওয়া যায় সেই আশায়। ফল হল মারাত্মক। বহু লোক জলে ডুবে মরল, অনেককে কুমিরে কামটে টেনে নিয়ে গেল। এই বাদাবন থেকে যা পাওয়া যায় তাতে রোজকার পেটের খিদে মেটে না। তবুও হাজার হাজার মানুষ জঙ্গলে যেতে শুরু করল, সামান্য একটু মধু, মোম, জ্বালানি কাঠ বা কেওড়া গাছের টোকো ফলের আশায়। ফলে প্রতিদিনই একটা না একটা লোক মরত হয়–বাঘের বা কুমিরের মুখে, কিংবা সাপের ছোবলে।

আর স্কুলটারও যা ছিরি দেখল ওরা সে আর বলবার নয়। থাকার মধ্যে আছে চারটে দেওয়াল আর মাথার ওপরে একটা ছাদ। এস্টেটের তো ভাঁড়ে মা ভবানী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উন্নয়ন, সবকিছুর জন্য পয়সার বরাদ্দ আছে ঠিকই, কিন্তু সে পয়সা যে কোথায় যায় তা কেউ জানে না। লোকে বলে ফান্ডের সব টাকাই যায় আসলে ম্যানেজারবাবুর পকেটে, আর সে নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করলেই পোষা গুণ্ডা লেলিয়ে তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা আছে। পুরো জায়গাটাই যেন দ্বীপান্তর পাওয়া লোকেদের কলোনি। পরিবেশটাও দমবন্ধ, প্রায় জেলখানার মতো।

নির্মল আর নীলিমা হ্যামিলটনের স্বপ্নরাজ্যের খোঁজে লুসিবাড়িতে আসেনি বটে, কিন্তু এখানে এসে দারিদ্র্যের এরকম নির্মম চেহারা দেখতে হবে সেটাও ওদের কল্পনাতে ছিল না। সব দেখেশুনে একটাই প্রশ্ন মনে এল ওদের : “কী করা যায় এই মানুষগুলোর জন্য?”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নির্মল লেনিনের “কী করতে হবে” বইটা বারবার পড়তে লাগল, কিন্তু সন্তোষজনক কোনও পথ খুঁজে পেল না। তুলনায় নীলিমার বাস্তবুদ্ধি অনেক বেশি। পুকুরে বা কুয়োতে স্নান করতে কি কাপড় কাঁচতে গিয়ে গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করল ও। তাদের সুখদুঃখের খবরও জেনে নিতে লাগল।

লুসিবাড়িতে আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করল নীলিমা। দ্বীপের মহিলাদের বেশিরভাগেরই বেশভূষা বিধবাদের মতো–সাদা শাড়ি, সাদা সিঁথি, হাতে একগাছা রুলিও নেই। মাঝে মাঝে তো এমন হয় যে একজনও সধবা মহিলা খুঁজে পাওয়া যায় না পুকুরঘাটে কি কুয়োতলায়। খোঁজখবর করে নীলিমা জানতে পারল ভাটির দেশের এ এক অদ্ভুত নিয়ম। এখানকার মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই জেনে আসে শাখা সিঁদুরের জোর ওদের নেই। বিয়ে যদি হয়ও, কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামীহারা হতেই হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। পঁচিশ, কি খুব বেশি হলে তিরিশ বছর, তার বেশি বয়স পর্যন্ত স্বামী-সোহাগ লেখা নেই ওদের কপালে। এ ধারণা ওদের একেবারে মর্মে মর্মে গেঁথে গেছে। সেই জন্যই ঘরের লোক মাছ ধরতে কি জঙ্গল করতে গেলে এখানকার মেয়েরা রঙিন শাড়ি ছেড়ে সাদা কাপড় পরে, সিঁদুর ধুয়ে ফেলে মাথা থেকে। যেন আগে থেকে দুঃখভোগ করে নিতে চায় স্বেচ্ছায়–যদি তাতে একটু দেরিতে আসে সে দুঃখের দিন। নাকি অনিবার্য ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নিতেই এই নিয়ম বানিয়ে নিয়েছে এরা?

পুরো ব্যবস্থাটার প্রচণ্ড তীব্রতা নীলিমাকে যেন একটা ঝাঁকি দিয়ে গেল। ওর চেনা। জগতের মহিলারা–ওর মা কি দিদি তো মরে গেলেও এভাবে তাদের সধবার বেশ ত্যাগ করতে পারবে না। নিজেই কি পারবে নীলিমা? এত প্রগতিশীলতার শিক্ষা সত্ত্বেও তো ওর কাছে এখনও সজ্ঞানে শাঁখা সিঁদুর ফেলে দেওয়া আর স্বামীর বুকে শেল বিধিয়ে দেওয়া একই ব্যাপার। কিন্তু এই মেয়েদের জন্য বৈধব্যের পরীক্ষা বৃথা যায় কমই। ভাটির দেশের নদী-খাড়ির বাঁকে বাঁকে মরণ ওত পেতে থাকে। পেটের ভাতের জন্য জলে-জঙ্গলে যাওয়া ছাড়া যাদের গতি নেই বেশি দিন শাঁখা-সিঁদুরের বিলাসিতা ভোগ করা তাদের ঘরের বউ মেয়েদের কপালে নেই।

হিন্দু সমাজের প্রান্তবাসী ভাটির দেশের এই গ্রামে অবশ্য সামাজিক অনুশাসনের চোখরাঙানি নেই। বিধবারা যদি চায় আরেকবার বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু সমর্থ পুরুষ মানুষেরই যেখানে আকাল সেখানে সে বাধা থাকাই বা কী, না থাকাই বা কী। বরঞ্চ নীলিমা দেখল সমতলের গ্রাম-শহরের তুলনায় এখানেই বিধবাদের আরও বেশি পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়, বছরের পর বছর সহ্য করে যেতে হয় পীড়ন আর লাঞ্ছনা।

কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এই মেয়েদের যন্ত্রণার জীবনকে? কোন শব্দ দিয়ে বর্ণনা করবে এদের নীলিমা? এরা তো একটা অন্য শ্রেণী। কিন্তু নির্মলকে কে বোঝাবে। তার মতে শুধুমাত্র এই মেয়েদের কী করে একটা শ্রেণীতে ফেলা যায়? শ্রমিকরা হল একটা শ্ৰেণী, কিন্তু শ্রমিকের বিধবাদের একটা শ্ৰেণী বলে উল্লেখ করার কোনও মানেই হয় না, এরকম কোনও শ্রেণী কখনও হতে পারে না।

কিন্তু এরা যদি একটা আলাদা শ্রেণী না হয়, তা হলে এরা কী?

শব্দ আর তত্ত্বের ভাড়ার যখন খালি হয়ে এল তখন অবশেষে বোধোদয় হল নীলিমার। কী আসে যায় নামে? শ্রেণী হোক বা না হোক, এই মেয়েদের কষ্টের জীবন পালটাতেই হবে। সে যে করেই হোক। স্কুলের কাছেই থাকত বছর পঁচিশ বয়সের এক বিধবা মহিলা, তাকে গিয়ে নীলিমা একদিন জিজ্ঞেস করল সে গোসাবা থেকে কিছু সাবান, দেশলাই ও আরও দু-একটা টুকিটাকি জিনিস কিনে আনতে পারবে কি না। লুসিবাড়িতে ওই সব জিনিসের যা দাম, তাতে সেগুলো বিক্রির পর ওর যাতায়াত ভাড়া বাদ দিয়েও হাতে বেশ কিছুটা পয়সা থেকে যাবে। তার অর্ধেক ও নিজের জন্য রাখতে পারে। নীলিমার এই ভাবনার বীজ থেকেই ধীরে ধীরে পাতা মেলল লুসিবাড়ির মহিলা সংগঠন। আর সেদিনের সেই চারাগাছ অবশেষে মহীরুহের আকার নিল বাদাবন ট্রাস্টের জন্মের পর।

নির্মল আর নীলিমার লুসিবাড়িতে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই জমিদারি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিল সরকার। আইন হল কোনও একজন ব্যক্তি বা সংগঠনের মালিকানায় খুব বেশি জমি থাকতে পারবে না। টুকরো টুকরো হয়ে গেল হ্যামিলটন এস্টেটের সম্পত্তি। যেটুকু যা বাকি ছিল মামলা-মোকদ্দমায় তারও শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াল। অন্যদিকে নীলিমার মহিলা সংগঠন তখন দিনে দিনে বাড়ছে। রোজ নতুন নতুন মেয়েরা আসছে নাম লেখাতে, কাজও বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসা, চাষ-আবাদ, ছোটখাটো আইনি সমস্যা–সব ব্যাপারে মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সংগঠন। আস্তে আস্তে এত বিশাল আকার নিল নীলিমাদের এই আন্দোলন যে সেটা রেজিষ্ট্রি করানোর প্রশ্ন এল তখন। সাথে সাথে খাতায়-কলমে যাত্রা শুরু হল বাদাবন ট্রাস্টের।

নীলিমার এই কাজ কিন্তু কখনওই নির্মলের পুরোপুরি সহযোগিতা পায়নি। সমাজসেবার গন্ধলাগা এই সব কাজে কোনওদিনই ও বিশেষ উৎসাহ পায়নি। ট্রাস্টের নামটা অবশ্য ওরই দেওয়া। কিন্তু ওই পর্যন্তই।

আসলে ‘বাদাবন’ শব্দটা ছিল নির্মলের খুব পছন্দের। ও বলত ইংরেজি ‘বেদুইন’-এর মতো বাদাবনও এসেছে আরবি ‘বাদিয়া’ শব্দ থেকে, যার অর্থ মরুভূমি। “কিন্তু ইংরেজরা তো আরবি শব্দটাকেই শুধু একটু পালটে নিয়েছে। আর বাঙালিরা আরবি বাদা’র সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে সংস্কৃত ‘বন’,” নীলিমাকে প্রায়ই বলত নির্মল। “বাদাবন শব্দটা নিজেই যেন দুটো বিরাট ভাষার মোহনায় গড়ে ওঠা একটা দ্বীপের মতো যেন গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্রের মাঝে জেগে ওঠা আরেকটা ভাটির দেশ। তোমার ট্রাস্টের জন্য এর থেকে ভাল নাম আর কিছু হতে পারে না।”

ট্রাস্ট তৈরি হওয়ার পর প্রথমেই দ্বীপের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বেশ খানিকটা জমি কিনল নীলিমারা। পরে, সত্তরের দশকের শেষদিকে, সেই জমির ওপরেই আস্তে আস্তে গড়ে উঠল ওদের নিজস্ব হাসপাতাল, ওয়ার্কশপ, অফিসঘর আর গেস্ট হাউস। কিন্তু সেসব তো বছর দশেক পরের কথা। কানাই প্রথম যখন লুসিবাড়িতে আসে–সেই ১৯৭০ সালে–এসবের কোনও চিহ্নই ছিল না তখন। মহিলা সমিতির মিটিং-ও তখন নির্মলদের ‘বাংলো’র উঠোনেই হত। আর সেখানেই কুসুমের সঙ্গে প্রথম দেখা হল কানাইয়ের।

.

নোঙর

সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোয় বড় একটা খাঁড়ির মুখে এসে পৌঁছল ফকিরের ডিঙি। আবছা আঁধারে কয়েক কিলোমিটার দূরের ডাঙা প্রায় দেখাই যায় না। খাঁড়ির মাঝ বরাবর তাকিয়ে পিয়ার নজরে এল কিছু একটা নোঙর করা রয়েছে। মনে হল যেন বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা কিছু জলের ওপর ভাসছে। দূরবিন চোখে লাগিয়ে পিয়া দেখল জিনিসটা আর কিছুই না, গোটা ছয়েক মাছ-ধরা নৌকো জড়ো হয়ে রয়েছে এক জায়গায়। নৌকোগুলো আকারে আয়তনে অবিকল ওদের ডিঙিটার মতো একটার সঙ্গে আরেকটা পাশাপাশি দড়ি দিয়ে বাঁধা। এদিকে ওদিকে আরও কতগুলো দড়িদড়া নেমে গেছে জলের ভেতর, বোধ হয় স্রোতের মুখে নৌকোগুলোকে এক জায়গায় ভাসিয়ে রাখার জন্য। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকেও দুরবিন দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল পিয়া নৌকোর ওপর চলে ফিরে বেড়াচ্ছে লোকজন। কয়েকজন একা একা বসে বিড়ি ফুকছে, অন্যরা কেউ চা খাচ্ছে, অনেকে আবার গোল হয়ে বসে তাস পেটাচ্ছে। দু-এক জনকে দেখা গেল কাপড় কাঁচছে, বাসন মাজছে, বা স্টিলের বালতি করে জল তুলছে নদী থেকে। ঠিক মাঝখানের একটা নৌকো থেকে ধোঁয়া উঠছে পাকিয়ে পাকিয়ে। ওটাতেই নিশ্চয়ই রান্না-বান্নার ব্যবস্থা। দৃশ্যটা খুব পরিচিত পিয়ার, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত। মেকং কি ইরাবড়িতেও ও দেখেছে ঠিক এইভাবেই সন্ধে নামে নদীর ধারের গ্রামগুলোতে। অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে সেখানেও এইরকম মন্থর ধোঁয়ার কুন্ডলী পাক খেতে খেতে হারিয়ে যায় আবছা আলোয়, গাঁয়ের লোকজন পা চালিয়ে এগোতে থাকে নদীর দিকে, সারাদিনের ধুলোময়লা ধুয়ে রাতের বিশ্রামের জন্য তৈরি হয়। সময় একদিকে যেমন দ্রুত কাটতে থাকে, অন্যদিকে আবার মনে হয় কালের গতি যেন থমকে থেমে গেছে হঠাৎ। কিন্তু ঠিক সেইরকম গ্রামই এখানে ডাঙা ছেড়ে নেমে এসেছে মাঝনদীতে। কেন?

ডিঙিগুলো চোখে পড়তেই ফুর্তিতে চেঁচিয়ে উঠল টুটুল। তারপর কী সব বকবক করতে লাগল বাপের সঙ্গে। নিশ্চয়ই ওরা চিনতে পেরেছে নৌকোগুলোকে। হয়তো ওদেরই বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনরা আছে ওখানে। এত বছর ধরে নদীতে নদীতে জেলেদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে একটা জিনিস বুঝেছে পিয়া–নিজেদের এলাকার মধ্যে এই সব জেলে বা মাঝিরা প্রত্যেকে প্রত্যেককে চেনে, জানে। মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় ফকিররা ওই নৌকোর দঙ্গলের লোকজনদের ভালই চেনে, আর একবার ওখানে গিয়ে পৌঁছতে পারলে আদরযত্নেরও অভাব হবে না। আজকে রাতের বিশ্রামটা ওখানেই হবে বোঝা যাচ্ছে। স্নান টান সেরে বন্ধুবান্ধবদের কাছে সারাদিনের অভিজ্ঞতা গল্প করবে ফকির, হয়তো বলবে “দেখো কাকে নিয়ে এসেছি আমাদের সঙ্গে।” হয়তো শুরু থেকেই এখানে এসে রাত কাটানোর পরিকল্পনা ছিল ফকিরের। সেইজন্যই হয়তো নৌকোটা ও এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। কে জানে!

বাঁকের মুখে ডিঙিটা ঘুরতেই আরও নিশ্চিত হয়ে গেল পিয়া। এর পরের কয়েকটা ঘণ্টা কীভাবে কাটবে ভাবতে লাগল। এইরকম অভিজ্ঞতা তো আর ওর কাছে নতুন কিছু নয়। সার্ভের কাজে বছরের পর বছর নদীতে নদীতে কাটিয়েছে ও, এই রকম জেলেদের সঙ্গে। কতবার এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় গিয়ে রাতের জন্য নোঙর ফেলেছে ওদের নৌকো। এখন পর পর কী ঘটবে চোখ বুজে বলে দিতে পারে পিয়া। ওকে দেখে প্রথমে কীরকম বিস্মিত হয়ে যাবে মানুষগুলো, তারপর শুরু হবে প্রশ্নের বন্যা–সবকটার জবাব দিতে হবে ফকিরকে, তারপর অভ্যর্থনার পালা। সে অভ্যর্থনার ভাষা না বুঝলেও জোর করে মুখে হাসি টেনে এনে প্রত্যুত্তর দিতে হবে পিয়াকে। পুরো ব্যাপারটা ভেবেই গায়ে জ্বর এল পিয়ার। এমন নয় যে ওদের কাছ থেকে ওর কোনও বিপদের আশঙ্কা আছে–বরং এই জেলেদের মধ্যেই ও সবচেয়ে নিরাপদ, সেটা ও জানে কিন্তু ওই ভিড়ের মধ্যে এখন কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না ওর। তার চেয়ে ফকিরের এই ডিঙিতেই ওর নিজস্ব নিস্তব্ধতার দ্বীপটুকুর মধ্যে গা এলিয়ে চুপচাপ ভাসতে ভাসতে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া অনেক আরামের হবে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল ফকিরকে বলে এখানে না থেমে এগিয়ে যেতে, পাড়ের কাছে কোনও নিরাপদ জায়গা দেখে রাতের জন্য নৌকো বাঁধতে।

কিন্তু সে কথা তো আর ফকিরকে বলা যায় না, ভাষার ব্যবধান না থাকলেও পিয়া ওরকম বলতে পারত না। তাই ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেল পিয়া যখন ও দেখল যে ফকিরের নৌকো ওর যেদিকে ইচ্ছে সেদিকেই যাচ্ছে। একটু পরেই আরও পরিষ্কার বোঝা গেল ডিঙি ঘুরিয়ে নিয়েছে ফকির ওই নৌকোর ঝুঁকের দিক থেকে, পাড়ির ছায়ায় ছায়ায় বেয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। বাইরে নিজের মনের ভাব একটুও বুঝতে দিল না পিয়া, দূরবিন হাতে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নজর রেখে চলল জলের দিকে, কিন্তু ওর বুকের ভেতরটা যেন লাফিয়ে উঠল বাচ্চা ছেলে অযাচিত ল্যাবেঞ্চস হাতে পেলে যেরকম খুশি হয়ে ওঠে, ঠিক সেইরকম আনন্দ হল পিয়ার।

দিনের আলো মিলিয়ে যেতে একটা খালে নৌকো ঢুকিয়ে নোঙর ফেলল ফকির। স্রোতের টানে টানে মাটি সরে গিয়ে খালটা এখানে সুরক্ষিত একটা খাঁড়ির চেহারা নিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছিল আজ রাতে এর থেকে বেশি দূরে আর যাওয়া সম্ভব ছিল না ওদের পক্ষে, কিন্তু ফকিরের হাবভাব দেখে মনে হল ঠিক এই জায়গায় নৌকো বাঁধতে ও চায়নি। ও যেন মনে মনে অন্য কোনও জায়গার কথা ভেবে রেখেছিল। আর সেখানে পৌঁছতে পারেনি বলে যেন নিজের ওপরেই খানিকটা রেগে গেছে।

এবার বিশ্রামের সময়। সারাদিনে বিচিত্র অভিজ্ঞতার পর যেন একটা শ্লথ শ্রান্তির ছায়া নেমে এসেছে ডিঙির ওপর। কোমরের কষি থেকে দেশলাই বের করে কালচিটে একটা লক্ষ জ্বালাল ফকির। সেই আগুনে বিড়ি ধরিয়ে পাটায় বসে টানতে লাগল ফুকফুক করে। টানতে টানতে যখন ছোট্ট হয়ে এল বিড়িটা তখন সেটা নিভিয়ে উঠে পড়ল ও। ইশারায় পিয়াকে দেখিয়ে দিল নৌকোর পেছনের দিকে ছোট্ট চৌকোনো ঘেরা জায়গাটা–কী করে সামনে একটা পর্দা টেনে সেটাকে বাথরুমের মতো ব্যবহার করা যায়। পুরো ব্যাপারটা পিয়াকে পরিষ্কার করে বোঝানোর জন্যই যেন নদী থেকে এক বালতি লোনা জল তুলে সেই জলে টুটুলকে স্নান করাতে লাগল সাবান ঘষে ঘষে। একটা ক্যানেস্তারায় খানিকটা মিষ্টি জলও রাখা আছে দেখা গেল, মাঝে মাঝে তার থেকে একটু একটু করে নিয়ে সাবানের ফেনা ধুয়ে দিতে লাগল টুটুলের গা থেকে।

সূর্য ডোবার পর নদীর জোলো হাওয়ায় বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল শীতের কামড়। স্নানের পর ভিজে চুপ্পড় বাচ্চাটা ঠকঠক করে কাঁপছিল ঠান্ডায়। কোথা থেকে একটা চেক কাটা কাপড় বের করে ভাল করে ওর গা মুছিয়ে জামাকাপড় পরিয়ে দিল ফকির। লাল রঙের এই গা মোছার কাপড় আরও কয়েকটা রাখা ছিল নৌকোয়। পিয়ার আবছা মনে হল এরকম কাপড়ের টুকরো আগেও যেন ও দেখেছে, কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা কিছুতেই মনে পড়ল না।

এবার টুটুলের পালা তার বাবাকে স্নান করাবার। গায়ের সমস্ত জামাকাপড় খুলে শুধু একটা ল্যাঙোট পরে পাটাতনের ওপর বসল ফকির, আর নদী থেকে ঠান্ডা জল তুলে টুটুল ঢালতে লাগল ওর মাথায়। বাপকে স্নান করানোর ফুর্তিতে ওর খিলখিল হাসি আর চিৎকারে বেশ মজা লাগছিল পিয়ার। এত রোগা ফকির যে ওর খালি গায়ে পাঁজরের সবক’টা হাড় গোনা যায়। টিনের কৌটোর ওপর থেকে লেবেলটা ছিঁড়ে নিলে তার ঢেউখেলানো গা-টা যেমন দেখায় ফকিরের হাড় বের-করা শরীরটা দেখে ঠিক সেইরকম মনে হচ্ছিল। ওর সারা গা বেয়ে সরু আঁকাবাঁকা রেখার মতো গড়িয়ে পড়ছে জল, পাঁজরের হাড়ে ধাক্কা খেতে খেতে নেমে আসছে ছোটো ছোটো ঝরনার মতো।

বাপ-বেটার স্নান শেষ হল। এবার পিয়ার পালা। নদী থেকে এক বালতি জল তুলে রাখল ফকির, একটা শাড়ি টেনে দিল সামনে পর্দার মতো। কিন্তু এইটুকু ডিঙির ওপর নড়াচড়া করাই এক সমস্যা। দু’জনকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাওয়া তো অসম্ভব। ছইয়ের নীচে প্রায় বুকে হেঁটে কনুইয়ে ভর দিয়ে ওদের একদিক থেকে আরেক দিকে যেতে হচ্ছিল। ফকিরকে এক হাত দিয়ে লুঙ্গিটা চেপে ধরে থাকতে হচ্ছিল, যাতে খুলে না পড়ে। পাশ দিয়ে যাবার সময় পিয়া আর ও মুখোমুখি হয়ে গেল। চোখে চোখ পড়তে দু’জনেই হেসে ফেলল।

ডিঙির পেছন দিকে এসে পিয়া দেখল আবছা অন্ধকারে পারার মতো চিকচিক করছে জল। আকাশ ভরা ফুটফুটে জোছনায় সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাগুলো শুধু চোখে পড়ছে। নৌকোর লম্ফটা ছাড়া জলে ডাঙায় কোথাও কোনও বাতি দেখা যাচ্ছে না। কোথাও কোনও শব্দও নেই নদীর ছলাৎ ছলাৎ ছাড়া। পাড় এখান থেকে এত দূরে যে এমনকী জঙ্গলের ঝিঁঝির ডাকও কানে আসছে না। চারদিকে জনমানবের চিহ্ন নেই। এর আগে একমাত্র মাঝসমুদ্রে ছাড়া আর কোথাও এরকম পরিস্থিতিতে থেকেছে বলে মনে পড়ল না পিয়ার। তবুও লম্ফর হলদে আলোয় ওর ছোট্ট বাথরুমের ভেতর তাকিয়ে ও দেখল পরিষ্কার স্নান টানের জন্য সব ব্যবস্থাই মজুত রেখেছে ফকির। সত্যি বলতে কী, এই মাঝনদীতে এইরকম ব্যবস্থা আশাই করেনি পিয়া। সদ্যতোলা নদীর লোনা জলের বালতির পাশেই একটা ক্যানেস্তারায় খানিকটা টলটলে মিঠে জল রাখা আছে, একটা তাকের ওপর এক টুকরো সাবান, আর তার পাশে একেবারে অপ্রত্যাশিত একটা জিনিস ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে খানিকটা শ্যাম্পু। ক্যানিং-এ কয়েকটা চায়ের দোকানে এরকম শ্যাম্পুর প্যাকেটের লম্বা ফিতে ঝুলতে দেখেছে পিয়া। তবুও, জিনিসটা হাতে নিয়ে ওর মনে হল এইরকম একটা জায়গায় এটা একেবারে বেখাপ্পা। ও হয়তো টান মেরে ছুঁড়ে ফেলেই দিত ওটা, কিন্তু মনে হল ফকিরদের কাছে প্যাকেটটা নিশ্চয়ই বহু মূল্যবান (কে জানে ক’টা কঁকড়ার বিনিময়ে কিনতে হয়েছে ওটা), আর শুধু ওর সম্মানেই মনে হয় এটা আজকে বের করা হয়েছে। এটা ফেলে দিলে ওদের ভালবাসার আন্তরিকতাকে অসম্মান করা হবে। এই শ্যাম্পু মাথায় দেওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা না থাকা সত্ত্বেও পিয়া তাই একটুখানি হাতে নিয়ে চুলে মাখল। জল ঢেলে ফেনা ধুয়ে নিল তারপর যদি জলে ভেসে যাওয়া বুদ্বুদগুলো চোখে পড়ে ফকিরের।

দু’এক মগ জল গায়ে ঢালতেই কাঁপুনি ধরল পিয়ার। এতক্ষণে মনে হল গা মোছার জন্য কোনও তোয়ালে-টোয়ালে তো সঙ্গে নেই! শীত কাটানোর জন্য পাটাতনের ওপর উবু হয়ে বসে নিজের হাঁটুদুটোকে জড়িয়ে ধরল ও। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল গা মোছার ব্যবস্থাও করে রেখেছে ফকির। ওই লাল চেক-কাটা কাপড়ের একটা টুকরো বাখারিতে ঝোলানো রয়েছে ওর জন্য। টুকরোটা খটখটে শুকনো। তার মানে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই নিশ্চয়ই ওটা রাখা আছে ওখানে। জিনিসটা হাতে নিয়েই ওর কীরকম যেন মনে হল এটা পরেই জলে ঝাঁপ দিয়েছিল ফকির ওকে তোলার জন্য। এই কাপড়গুলো অনেক কাজে লাগে, পিয়া জানে। নাকের কাছে এনে ওর মনে হল রোদে-শুকোনো খরখরে কাপড়টায় নদীর কাদামাটির ধাতব ঘ্রাণ ভেদ করে আবছা একটু ঘামের গন্ধও যেন পাওয়া যাচ্ছে।

হঠাৎ পিয়ার মনে পড়ে গেল এরকম কাপড় ও আগে কোথায় দেখেছে। যখন ও ছোটো ছিল, আমেরিকায় ওদের এগারোতলার ফ্ল্যাটে এই জিনিস দেখেছে ও। ওর বাবার ওয়ার্ডরোবের হাতলে জড়ানো। পরে আস্তে আস্তে ও বড় হয়েছে, কাপড়টা কিন্তু রয়েই গেছে ওখানে–ধূলিমলিন, শতছিন্ন। মাঝে মাঝেই ওটা খুলে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে হত পিয়ার, কিন্তু বাবা কিছুতেই ফেলতে দিত না। এমনিতে সেন্টিমেন্ট-ফেন্টিমেন্টের বিশেষ বালাই ছিল না বাবার, দেশের ব্যাপারে তো নয়ই। অন্যদের মতো দেশের স্মৃতি আঁকড়ে থাকা পছন্দ করত না বাবা। বলত, “আমি বর্তমানের মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে ভালবাসি”, সাদা বাংলায় ওই বর্তমানের মাটির অর্থ চাকরির উন্নতির সিঁড়ি। সেটা পিয়া পরে বুঝেছে। কিন্তু ওই কাপড়ের টুকরোটা ফেলে দেওয়ার কথা তুললেই বাবা প্রায় আর্তনাদ করে উঠত। বলত এত বছর ধরে ওটা আছে ওখানে যে নখ বা চুলের মতো ওটা প্রায় শরীরের অংশ হয়ে গেছে বাবার। “ওটার সঙ্গে আমার ভাগ্য জড়ানো রয়েছে”, ওটা ফেলে দেওয়ার কথা ভাবাই যায় না। কী যেন নাম কাপড়ের টুকরোটার? কী যেন বলত বাবা? শব্দটা জানত একসময় পিয়া। কিন্তু বহুদিনের অব্যবহারে সেটা স্মৃতি থেকে মুছে গেছে।

.

কুসুম

গেস্ট হাউসটার ছাদে দাঁড়ালে একটানা অনেকটা অবধি চোখে পড়ে। বেশ খানিকটা দূরে হ্যামিলটন হাই স্কুল, তারও পরে নির্মলদের আগেকার বাড়ির জায়গাটা পর্যন্ত এখান থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল কানাই। সে বাড়িটার জায়গায় এখন একটা হস্টেল উঠেছে স্কুলের ছাত্রদের জন্য, কিন্তু কানাইয়ের মনে নির্মলের সেই বাংলোর ছবি এখনও স্পষ্ট। নামে ‘বাংলো’ হলেও আকারে প্রকারে বাড়িটা আসলে ছিল স্রেফ একটা গুমটি। পুরোটা কাঠের তৈরি, ইট কি সিমেন্টের বালাই নেই। মাটি থেকে একটু ওপরে হাত-খানেক উঁচু কয়েকটা খুঁটির ওপর যেন কোনওরকমে দাঁড় করানো ছিল সেই বাড়ি। মেঝেটাও ছিল এবড়ো খেবড়ো মতো। শীতে বর্ষায় আবার তার ঢাল বদল হত। কানাইয়ের মনে আছে বর্ষাকালে কেমন স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যেত মেঝেটা, একটু দেবে যেত নীচের দিকে। শীতকালে হাওয়া শুকনো হয়ে এলে আবার টানটান যেমনকে তেমন।

সাকুল্যে দুখানা মাত্র ঘর ছিল সেই ‘বাংলোয়। একটা শোয়ার ঘর, আরেকটাকে বলা যেতে পারে স্টাডি মতন, নির্মল আর নীলিমা দুজনেই সেখানে তাদের লেখাপড়ার কাজকর্ম করত। ওই ঘরেই একটা খাট পাতা হয়েছিল কানাইয়ের জন্য। সব সময় মোটা সুতির মশারি ফেলা থাকত তার ওপর। নির্মলদের বড় খাটটাতেও থাকত। যত না মশার জন্য, তার চেয়েও অন্যান্য প্রাণীর জন্য মশারিটা বেশি জরুরি ছিল সে সময়। রাতে তো বটেই, এমনকী দিনের বেলাতেও মশারি খাটানো না থাকলে সাপ-খোপ কি কাঁকড়াবিছে বালিশের তলায় বা বিছানার চাদরের নীচে ঢুকে বসে থাকত। পুকুরের পাড়ে একটা কুঁড়েতে নাকি একদিন তক্তপোশের ওপর একটা মরা মাছ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছিল। সে বাড়ির বউ এসে গল্পটা বলেছিল। একটা আস্ত কইমাছ কে জানে কখন কানে হেঁটে এসে উঠেছে, তারপর বিছানার ওপরেই মরে পড়ে রয়েছে।

রাত্তিরে মশারি গোঁজার আগে সব কোনা-খামচাগুলো একবার ভাল করে দেখে নিতে হত। এইসব রোজকার সাধারণ কাজের মধ্যেও মাঝেমধ্যেই ছোটবড় নানা উত্তেজনার খোরাক থাকত ভাটির দেশে। লুসিবাড়িতে আসার কিছুদিন পর একবার তো মশারি খাটাতে গিয়ে আরেকটু হলেই বিপদে পড়েছিল নীলিমা। রাত্রিবেলা, ঘরে একটা মাত্র মোমবাতি। সেটা আবার রাখা আছে ঘরের অন্য প্রান্তে, জানালার তাকের ওপর। নীলিমা একেই বেঁটেখাটো, তার ওপর চোখেও বেশ পাওয়ার, কম আলোতে ভাল দেখে না। খাটের চারকোনায় চারটে বাঁশের খুঁটি আটকানো, সেগুলির থেকেই মশারিটা ঝোলানো হত। খুঁটি অবধি ভাল করে হাত যায় না, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কোনওরকমে, আন্দাজে আন্দাজে মশারির দড়িগুলি বাঁধছিল নীলিমা। আচমকা একটা দড়ি যেন জ্যান্ত হয়ে ছিটকে এল। সঙ্গে ফোঁস করে একটা আওয়াজ। নীলিমা তো পড়ি কি মরি করে কোনওরকমে মারল এক লাফ। হাতটা টেনে নেওয়ার আগেই চটাস করে লেজের একটা ঝাঁপটা লাগল তালুর মধ্যে। তারপর একেবেঁকে দরজার তলা দিয়ে সাপটা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে ও দেখল সেটা একটা বেশ বড়সড় চিতিবোড়া। যথেষ্ট বিষাক্ত সাপ। সাধারণত মাঝারি গাছের ডালপালার মধ্যে এদের বাস। মশারি খাটানোর বাঁশটাকেও তাই নিজের জায়গা মনে করে বেশ গুছিয়ে বসেছিলেন বাবাজি।

রাত্তিরে খাটে শুলেই কানাইয়ের মনে হত গোটা ছাদটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। চালার মধ্যে থেকে থেকেই অদ্ভুত সব আওয়াজ পাওয়া যেত–কখনও হয়তো কিছু একটা খচমচ করে দৌড়ে গেল, অথবা ফোঁস করে উঠল কোথাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়তো একটা প্রবল কিচমিচ। মাঝে মধ্যেই ঠপ করে চালা থেকে নীচে পড়ত প্রাণীগুলো। পড়েই অবশ্য লাফিয়ে উঠে বেরিয়ে যেত দরজার তলা দিয়ে, কিন্তু মাঝে মধ্যে সকালে ঘুম থেকে উঠে কানাই দেখত একটা মরা সাপ কি কয়েকটা পাখির ডিম পড়ে আছে মেঝের ওপর, আর পিঁপড়েরা ভোজ লাগিয়ে দিয়েছে। কখনও কখনও একেকটা আবার সোজা মশারির ওপর এসে পড়ত। পড়েই এমন নড়াচড়া শুরু করত যে মশারি টাঙানোর খুঁটিগুলো পর্যন্ত দুলতে থাকত। এইরকম ক্ষেত্রে একটাই উপায় ছিল। বালিশটা নিয়ে চোখ বুজে এক ঝাঁপটা মারতে হত মশারির চালে। সাপ, ইঁদুর, বিছে যাই হোক না কেন, ওই এক ঝাঁপটাতেই পগার পার হয়ে যেত তারা। কয়েকটা অবশ্য শূন্যে ছিটকে উঠে আবার মশারির ওপর এসে পড়ত। সেরকম হলে ফের বালিশ হাতে রণাঙ্গনে নামতে হত কানাইকে।

বাংলোর পেছন দিকে একটা খোলা উঠোন মতো জায়গা ছিল, সেখানেই লুসিবাড়ি মহিলা সমিতির মিটিং-টিটিং হত। ১৯৭০ সালে কানাইকে যখন নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল এখানে, তখনও মহিলা সমিতি এত বিরাট হয়নি, টিমটিম করে চলছিল কোনওরকমে। সপ্তাহে কয়েকবার করে সমিতির সদস্যারা জড়ো হত নীলিমার বাড়ির উঠোনে। সেলাই-ফোঁড়াই, কাপড় বোনা, সুতো রং করা–এইসব নানান রোজগারমূলক কাজকর্ম নিয়ে আলাপ আলোচনা হত। সাধারণ গল্পগুজবও হত নানা রকম। আর ঘরের কথা উঠলেই অনেক সব জমানো ক্ষোভ-দুঃখের কথাও চলে আসত অনিবার্য ভাবেই।

শুরুর দিকে গাঁয়ের মেয়েদের এইসব ঘরোয়া পাঁচালি শুনতে অসহ্য লাগত কানাইয়ের। সমিতির মিটিং শুরু হলেই ও তাই বেরিয়ে পড়ত বাড়ি থেকে। ঘুরে বেড়াত এদিক ওদিক। কিন্তু তার একটা সমস্যাও ছিল। লুসিবাড়িতে কানাইয়ের সমবয়সি কোনও বন্ধু ছিল না। আর সেরকম কোনও যাওয়ার জায়গাও ছিল না। ওর বয়সের ছেলেপুলে যারা ছিল তারা হয় একেবারে সরল-সোজা, চুপচাপ অথবা অকারণে মারকুটে ধরনের। আর কানাইও মনে মনে জানত যে কয়েক সপ্তাহ পরেই ও এই নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে, ওদের সঙ্গে মেশার জন্য তাই বিশেষ কোনও ইচ্ছেও হয়নি। বারদুয়েক আড়াল-আবডাল থেকে ছোঁড়া ঢিল খাওয়ার পর অবশেষে ওর মনে হল বাড়ির বাইরে থেকে ভেতরেই বেশি নিরাপদ। ফলে দুপুরগুলো ওর কাটতে লাগল মাসির বাংলোর স্টাডিতে শুয়ে-বসে। উঠোনে মিটিং-এর কথাবার্তা হট্টগোলও গা সওয়া হয়ে এল আস্তে আস্তে।

এইরকম একটা মিটিঙেই প্রথম কুসুমকে দেখল কানাই। সামনের একটা দাঁত একটু ভাঙা, ছোটো করে কাটা চুল–একটু যেন আলাদা দ্বীপের অন্যসব মেয়েদের থেকে। আগের বছর টাইফয়েড হওয়ার পর ওকে নেড়া করে দেওয়া হয়েছিল। কোনওরকমে বেঁচে উঠেছিল মেয়েটা। তখনও বেশ দুবলা, সবাই আগলে আগলে রাখত ওকে। সমিতির মিটিংগুলোর সময় ও সেখানে থাকলে কেউ তাই কিছু বলত না। একই কারণে বোধ হয় সেই পনেরো-ষোলো বছর বয়সেও ফ্রক পরে ঘোরাঘুরিতেও ওর বারণ ছিল না। ওর বয়সি গাঁয়ের অন্যান্য মেয়েদের তো শাড়িই পরতে হত। ওই বয়সেও ফ্রক পরার পেছনে অবশ্য অন্য একটা কারণও থাকতে পারে। জামাগুলি তো তখনও যথেষ্ট ব্যবহারযোগ্য। শাড়ি ধরার আগে আরও যতটুকু পরে নেওয়া যায় নিঙড়ে নেওয়া যায় সবটুকু উপযোগিতা। গোটা গোটা ফ্রকগুলি কি প্রাণে ধরে ফেলে দেওয়া যায়?

একদিন সমিতির মিটিং-এ গাঁয়ের এক বউ সবিস্তারে তার দুঃখের কথা শোনাচ্ছিল। কিছুদিন আগের এক রাতের ঘটনা, বলছিল বউটি। তার সোয়ামি গিয়েছিল মাছ ধরতে, ঘরে শুধু সে আর বাচ্চারা। সবাই গভীর ঘুমে। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, একখানা লম্ফ শুধু টিমটিম করে জ্বলছে। এমন সময় গলা পর্যন্ত মাল টেনে টলতে টলতে ঘরে এসে ঢুকল তার শ্বশুর। হাতে এক বিশাল রামদা। বাচ্চাগুলির সামনেই দাটা গলার কাছে চেপে ধরে ছেলের বউয়ের কাপড়ে টান দিল সে। বউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেই লোকটা দায়ের এক কোপ মারল তার হাতে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা প্রায় দু’-আধখান হয়ে গেল। শেষমেশ জ্বলন্ত লক্ষটা বুড়োর গায়ে ছুঁড়ে মেরে সে যাত্রা রক্ষা পেল মেয়েটি। এদিকে বুড়োর লুঙ্গিতে তো গেল আগুন ধরে। বেশ খানিকটা পুড়েও গেল। তাতেই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা খেপে গেল। ঘাড় ধরে বউকে বাড়ির বাইরে বের করে দিল। বেচারির স্বামীর ঘর করা শেষ হল স্রেফ নিজের আর ছেলেমেয়েদের ইজ্জত বাঁচাতে চেয়েছিল বলে।

গল্পের এই জায়গায় এসে গলা চড়তে লাগল বউটির। যেন ঘটনাটা প্রমাণ করার জন্যই প্রায় চিৎকার করে সে বলতে লাগল, “এই যে, এইখানে কোপ মেরেছিল আমাকে, এইখানে, এইখানে।”

কানাই আর থাকতে না পেরে দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখতে গেল। যে বউটি গল্প বলছিল তাকে দেখা যাচ্ছিল না। বাকি সকলে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল বলে কানাইকে কেউ নজর করল না। শুধু একজন ছাড়া কুসুম। বাকিদের থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল সে। চোখে চোখ পড়ল দু’জনের। মুহূর্তের জন্য মনে হল ওরা যেন সৃষ্টির আদিমতম সময়ে কোনও প্রান্তরের দুদিক থেকে পরস্পরের দিকে চেয়ে রয়েছে, একে অন্যকে মেপে নিতে চাইছে, বুঝে নিতে চাইছে কতটা ভয়ংকরের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে অন্য প্রান্তে। মনে হচ্ছিল দু’জনের মধ্যেকার এই দূরত্বটুকুর মধ্যেই হয়তো গোপন রয়েছে আজকের এই আবেগের সূত্র–এই বীভৎস হিংসার বীজ। এই পারস্পরিক সমীক্ষার ফলাফল কিন্তু সাধারণ ভয় বা বিতৃষ্ণা ছিল না, দু’জনের দৃষ্টিতেই ছিল একে অপরের সম্পর্কে এক সজাগ কৌতূহল।

কানাইয়ের যদূর মনে পড়ে, কুসুমই ওর সঙ্গে প্রথম এসে কথা বলেছিল। সেই দিন নয়, অন্য আরেক দিন। সকাল বেলায়। বাংলোর মেঝেতে বসে দেয়ালে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল কানাই। পরনে স্রেফ একটা খাকি হাফপ্যান্ট। বইটা রাখা ছিল ওর কোলের ওপর। হঠাৎ মনে হল দরজার বাইরে থেকে কে যেন ওকে উঁকি মেরে দেখছে। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে ও দেখল হাঁটা চুল আর ছেঁড়া ফ্রক-পরা ধীর গম্ভীর একটা চেহারা দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজার সামনে। খানিকটা ঝগড়াটে গলায় চোখমুখ কুঁচকে ওকে জিগ্যেস করল, “কী করছিস তুই এখানে বসে?”

“বই পড়ছি।”

“আমি দেখেছি–সেদিন তুই সব শুনছিলি।”

“কী হয়েছে তাতে?” কাঁধ ঝাঁকাল কানাই।

“আমি বলে দেব।”

“বলগে যা।” কিন্তু বাইরে সাহস দেখালেও ভেতরে ভেতরে ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল কানাইয়ের। যদি সত্যি সত্যি বলে দেয়। প্রসঙ্গটা অন্য দিকে ঘোরাতে তাড়াতাড়ি একপাশে সরে কুসুমের বসার জন্য জায়গা করে দিল ও। কানাইয়ের পাশেই এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল মেয়েটা। একেবারে গা ঘেঁষে। হাঁটুর ওপর চিবুক। খুব কাছ থেকে ওর দিকে তাকিয়ে দেখার সাহস হল না কানাইয়ের, কিন্তু টের পাচ্ছিল মেয়েটার শরীরে ঠেকে আছে ওর শরীর ওর কনুইয়ের সঙ্গে, পায়ের সঙ্গে, হাঁটুর সঙ্গে ঘষা খাচ্ছে কুসুমের কনুই, পা, হাঁটু। ওর বাঁদিকের বুকের ওপর একটা ছোট্ট তিল নজরে এল কানাইয়ের। খুবই ছোট্ট একটা তিল, কিন্তু কিছুতেই ও আর সেটার থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।

“দেখি, তোর.বইটা দেখা তো আমাকে”, বলল কুসুম।

বইটা ছিল একটা ইংরিজি রহস্য গল্প। কানাই তাই পাত্তাই দিল না ওর অনুরোধকে। “এটা দেখে তুই কী করবি? কিছুই বুঝবি না।”

“কেন বুঝব না?”

“তুই ইংরেজি পড়তে পারিস?” জিগ্যেস করল কানাই। “না।”

“তালে দেখতে চাইছিস কেন?”

জবাব না দিয়ে কয়েকমুহূর্ত প্যাটপ্যাট করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা। তারপর ডানহাতটা ওর নাকের সামনে এনে আস্তে আস্তে মুঠোটা খুলে জিগ্যেস করল, “এটা কী জানিস?”

একটা ঘাসফড়িং। তাচ্ছিল্যের ভাব করে কানাই বলল, “না জানার কী আছে। এ তো সব জায়গায় পাওয়া যায়।”

“তা’লে দেখ”, বলেই খপ করে ফড়িংটা নিজের মুখের ভেতরে পুরে দিল কুসুম।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাতের বইটা নামিয়ে হাঁ করে মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল কানাই। “তুই খেয়ে ফেললি ওটাকে?”

হঠাৎ হাঁ করল কুসুম। সঙ্গে সঙ্গে ঘাসফড়িংটা একলাফে বেরিয়ে সোজা কানাইয়ের মুখের ওপর এসে পড়ল। চমকে চেঁচিয়ে উঠে পেছন দিকে উলটে পড়ে গেল কানাই, আর খিলখিল করে হাসতে লাগল মেয়েটা।

“কী বোকা রে! ওটা তো এমনি একটা পোকা। ভিতু কোথাকার।”

.

কথা

স্নানের পর জামাকাপড় পালটে ছইয়ের তলা দিয়ে গুঁড়ি মেরে নৌকোর সামনের দিকটায় গেল পিয়া। সেই চেক-চেক কাপড়ের টুকরোটা তখনও ঝুলছে হাতে। কিছুতেই মনে আসছে না কাপড়টার নাম। ফকিরকে একবার জিগ্যেস করল, কিন্তু ওর ইশারার প্রশ্ন ফকির বুঝতেই পারল না। একটু অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে। অবশ্য বুঝবে যে, সে আশাও পিয়া বিশেষ করেনি; কারণ এতক্ষণের মধ্যে একবারও ফকির ওকে বাংলা শেখাবার কোনও চেষ্টাই করেনি। একটু আশ্চর্যই হয়েছে তাতে পিয়া। এইরকম ক্ষেত্রে সাধারণত ও দেখেছে লোকে আশেপাশের এটা-সেটার দিকে দেখিয়ে তাদের ভাষায় সেগুলির নাম বলে বলে দিতে থাকে, চেষ্টা করে যাতে ভিনদেশি মানুষটা কিছুটা অন্তত বুঝতে পারে তারা কী বলতে চাইছে। কিন্তু ফকির দেখা গেল ব্যতিক্রম। পিয়া যে ওই চেক কাটা কাপড়টার বাংলা নামটা জানতে চাইতে পারে সেটা তাই ওর মাথাতেই এল না।

কিন্তু পিয়াও হাল ছাড়ার পাত্রী নয়। নানারকম ইশারা অঙ্গভঙ্গি করেই যেতে লাগল যতক্ষণ না ফকির বুঝতে পারে ও কী বলতে চাইছে। বেশ খানিকক্ষণের চেষ্টার পর অবশেষে সফল হল পিয়া। “গামছা”, ফকির সংক্ষেপে বলল। আরে, তাই তো! গামছা, গামছা–শব্দটা তো পিয়া জানে! কিছুতেই মনে পড়ছিল না এতক্ষণ।

আচ্ছা, কেমন করে একেকটা শব্দ এভাবে হারিয়ে যায়? স্মৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকে–ভাঙা আলমারির এক কোনায় পড়ে থাকা পুরনো খেলনার মতো? তারপর কোনওদিন কেউ জঞ্জাল সাফ করতে গিয়ে হঠাৎ সেটা ফিরে পায়, বের করে আনে মাকড়শার জাল আর ধুলোর মধ্যে থেকে।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে পিয়ার। বাংলা ভাষা সে সময় যেন ক্রোধের বন্যার মতো আছড়ে আছড়ে পড়ত ওর দরজায়। ঝড়ের মতো, ঢেউয়ের মতো প্রবল সেই তোড়ের থেকে বাঁচার জন্য গুঁড়ি মেরে ও গিয়ে ঢুকত কাপড়ের আলমারির পেছনে, দু’কান চেপে ধরে দূরে ঠেলে রাখতে চাইত শব্দগুলোকে। কিন্তু আলমারির পলকা দরজা বাবা-মার গলার আওয়াজ আটকাতে পারত না। বাংলা ছিল পিয়ার মা আর বাবার ঝগড়া করার ভাষা। সে ঝগড়ার শব্দ দরজার তলা দিয়ে ফাঁকফোকর গলে পৌঁছে যেত পিয়ার কাছে, মুহূর্তে মুহূর্তে বাড়তে থাকত বন্যার জলের মতো, একেক সময় মনে হত শব্দের সেই জলোচ্ছ্বাস যেন ডুবিয়ে মারতে চাইছে ওকে। যেখানেই লুকোক, কী করে যেন সেই ঝগড়ার আওয়াজ ঠিক খুঁজে খুঁজে বের করত পিয়াকে। সে সময় বাবা আর মা তাদের সমস্ত জমা রাগ উগরে দিত বাংলা ভাষায়। সেই থেকেই ভাষাটার সঙ্গে কোথায় যেন একটা বিষণ্ণতার সুর লেগে রয়েছে। আলমারির কোনায় গুঁড়ি মেরে শুয়ে থাকতে থাকতে সে সময় পিয়া ওই শব্দগুলোকে মাথা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলতে চাইত; এমন সব শব্দের কথা ভাবত যেগুলি হবে ইস্পাতের মতো ভারী, ডাক্তারের দস্তানার মতো পরিষ্কার, ঝকঝকে, জীবাণুমুক্ত। সেই সব শব্দের স্বপ্ন দেখত অভিধানে যাদের ঠিকানা মেলে, যাদের সঙ্গে কোনও অসুখের অনুষঙ্গ জড়িয়ে নেই।

পিয়ার সেই ছোটবেলার শোয়ার ঘরের একটা জানালা দিয়ে এক চিলতে সমুদ্র নজরে আসত। ওদের অ্যাপার্টমেন্টটা ছিল ছোট্ট দুটো বেডরুম, একটা লিভিংরুম আর একটা রান্নাঘর। সেই অ্যাপার্টমেন্টের একটা বেডরুমের জানালা দিয়ে এরকম সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া রীতিমতো ভাগ্যের ব্যাপার ছিল।

সেই সবচেয়ে ভাল ঘরটাই ছিল পিয়ার নিজের ঘর। দু’বছরের পিয়াকে ঘিরেই তখন ওর মা-বাবার সাজানো সংসার। ওর কাছে তখন সেই বাড়িটা ছিল একটা মন্দিরের মতো, আর ওর নিজের ঘরটা তার গর্ভগৃহ। মা আর বাবা থাকত অন্য ঘরটাতে। সেটা এত ছোট যে খাটের পায়ের দিকটা বেয়ে ওদের বিছানায় উঠতে হত। সেই ছোট্ট বদ্ধ ঘরটাই ছিল ওদের দু’জনের সমস্ত রাগ-অভিমান প্রকাশের একমাত্র জায়গা। তার মধ্যেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাত ওরা, এটা-সেটা নিয়ে খিটিমিটি করত, আর মাঝে মধ্যে চিৎকার করে ঝগড়া করত।

বড় ঘরটাকে প্রায় বছর পাঁচেক নিজের দখলে রেখেছিল পিয়া। তারপর হঠাৎ একদিন মা এসে ওকে সেখান থেকে উৎখাত করল। বাবার সঙ্গে এক ঘরে আর থাকতে পারছিল না মা। দরজা বন্ধ করে তাই বাকি পরিবারের থেকে নিজেকে আলাদা রেখে শান্তিতে থাকতে চাইছিল। কিছুদিন পরেই ধরা পড়ল মায়ের ক্যান্সার হয়েছে। সার্ভাইকাল ক্যান্সার। কিন্তু মাঝের বেশ খানিকটা সময় মা ওকে বিছানায় বসতে দিত মনে আছে। একমাত্র পিয়াই তখন যেতে পারত মা-র কাছে, দেখা করতে পারত, ছুঁতে পারত মাকে। আর কাউকেই সে সময় সহ্য করতে পারত না মা। বাবাকে তো নয়ই। পিয়ার মনে আছে ও স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলেই মা ওকে আদর করে ডেকে নিত : “আয় পিয়া, আয়, এখানে এসে বোস।” অদ্ভুত ব্যাপার, সেই শব্দগুলো কেমন শুনতে ছিল সেটা পিয়ার আর কিছুতেই মনে পড়ে না (ইংরেজিতে বলত কি মা, নাকি বাংলাতে?) কিন্তু শব্দগুলির মানে, মায়ের গলার আওয়াজ, কথা বলার সুরটা স্পষ্ট মনে আছে এখনও। ও আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখত মা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে বিছানার ওপর, পুরনো একটা শাড়ি পরে। সারা সকালটা তখন বাথরুমে কাটাত মা, ধুয়ে ধুয়ে কাল্পনিক ময়লা সব সাফ করতে চেষ্টা করত। অতক্ষণ ভিজে থাকার জন্য তাই কেমন যেন ভাজ ভাজ হয়ে থাকত হাতের চামড়া।

সেই সময়েই একদিন জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পিয়া জানতে পারল মায়ের ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে এইভাবে জলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। মায়ের বাবা ছিলেন আসামের এক চা বাগানের ম্যানেজার। সেই বাগানের ধার ঘেঁষে বয়ে যেত এক বিশাল নদ। তার নাম ব্ৰহ্মপুত্র। আমেরিকার খুপরি ফ্ল্যাটবাড়ির ঘরে শুয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে মা পিয়াকে তার ছোটবেলার সুখের সময়ের গল্প বলত। রোদটলা সেই চা বাগানে ওরা কেমন দৌড়োদৌড়ি করে খেলে বেড়াত, মাঝে মাঝে লম্বা নৌকোসফরে যেত ব্রহ্মপুত্রে, সেই সব কথা বলত।

পরে, পিয়া যখন গ্রাজুয়েট স্কুলে ভর্তি হল, সে সময়ে ওকে অনেকেই জিজ্ঞেস করত মিষ্টি জলের শুশুকের বিষয়ে ওর আগ্রহের পেছনে কোনও পারিবারিক কারণ আছে কি না। প্রসঙ্গটা উঠলেই গা জ্বলে যেত পিয়ার। ও কী পড়াশোনা করবে, কী গবেষণা করবে সেটা মা বাবা ঠিক করে দিয়েছে–সে ইঙ্গিতটার জন্যে রাগ হত ওর। তা ছাড়া ব্যাপারটা আদৌ সে রকম কিছু ছিল না। ছোটবেলা থেকে ইতিহাসের কথা, পরিবারের কথা, ভাষার কথা, নানা রকম দায়িত্বের কথা পিয়া অনেক শুনেছে, কিন্তু ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা মা-বাবা কখনও ভাবেইনি।

যেমন, কলকাতার কথা বহু শুনেছে পিয়া মা-বাবার কাছে, কিন্তু কেউ ওকে কখনও বলেনি যে আমেরিকার এই পিউগেট সাউন্ড সমুদ্রের খুনে তিমির সমগোত্রীয় ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস সেখানেই প্রথম দেখা গিয়েছিল।

.

খানিক বাদেই রাতের খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোড় শুরু করল ফকির। তক্তার নীচ থেকে দুটো বেশ বড়সড় জ্যান্ত কাঁকড়া বের করে নিয়ে এল। সেগুলোকে কালচিটে একটা পাত্র দিয়ে ঢেকে রেখে রান্নার অন্যসব সরঞ্জাম আনতে গেল। ছইয়ের ভেতর থেকে নিয়ে এল বড় একটা ছুরি, সঙ্গে আরও কিছু বাসনপত্র, আর একটা চোঙামতন মাটির জিনিস। সেটাকেও প্রথমে একটা বাসনই ভেবেছিল পিয়া। তার পরে দেখল জিনিসটার গায়ে একদিকে গোলমতো একটা গর্ত করা আছে। শেষে যখন তার মধ্যে টুকরো টুকরো জ্বালুনি কাঠ গুঁজে দিল ফকির, তখন পিয়া বুঝল ওটা আসলে একটা স্টোভ, মাটির তৈরি। স্টোভটাকে নৌকোর পেছনের দিকে তুলে নিয়ে গেল ফকির। ছইয়ের থেকে বেশ খানিকটা দূরে রেখে তাতে আগুন দিল, তারপর হাওয়া দিয়ে দিয়ে গনগনে আঁচ তুলল। এবার খানিকটা চাল ভাল করে ধুয়ে জলটা একটা তোবড়ানো টিনের পাত্রের মধ্যে ঢালল। তারপর চালটাতে আবার খানিকটা জল দিয়ে আগুনে বসাল সেটাকে। খানিক পরে হাঁড়িতে যখন টগবগ শব্দ উঠল, তখন কঁকড়াগুলোকে নিয়ে বসল ফকির। টুকরো টুকরো করে কেটে, দাঁড়াগুলো ছুরি দিয়ে ভেঙে ভেঙে নিল। ভাত হয়ে যাওয়ার পর হাঁড়ি নামিয়ে আরেকটা কালচে রঙের অ্যালুমিনিয়ামের পাত্র বসাল সেখানে। তারপর একটা তোবড়ানো টিনের কৌটো থেকে পাঁচ-সাতটা ছোট ছোট কাগজের পুঁটলি বের করল। পুঁটলিগুলো খুলে খুলে পর পর গোল করে সাজিয়ে রাখল স্টোভটার সামনে। দাউ দাউ আগুনের আভায় পিয়া দেখল বিভিন্ন রঙের সব মশলা রাখা আছে মোড়কগুলির মধ্যে কোনওটা লাল, কোনওটা হলুদ, কোনওটা তামাটে। আগুনে বসানো পাত্রটার মধ্যে খানিকটা তেল ঢালল ফকির, তারপর মশলার মোড়কগুলির ওপরে ওর হাত যেন উড়ে বেড়াতে লাগল পাখির মতো। একের পর এক মশলা ছিটিয়ে দিতে থাকল ফুটন্ত তেলে হলুদ, লঙ্কা, ধনে, জিরে।

রান্নার গন্ধটা ঝাঁঝালো লাগছিল পিয়ার নাকে। অনেকদিন এরকম খাবার খায়নি ও। ফিল্ডে থাকলে তো এমনিতে প্যাকেট, ক্যান বা বোতলের জিনিস ছাড়া কিছু মুখেই দেয় না। বছর তিনেক আগে ফিলিপাইন্সের মালাম্পায়া সাউন্ডে কাজ করার সময় একবার অসাবধান হয়েছিল ও। ফল হয়েছিল মারাত্মক। প্রায় বেহুশ অবস্থায় হেলিকপ্টারে করে ওকে তুলে নিয়ে যেতে হয়েছিল ম্যানিলায়, চিকিৎসার জন্য। তারপর থেকে সার্ভেতে গেলেই সব সময় নিজের সঙ্গে খাদ্য-পানীয়ের একটা জোগান রাখে পিয়া। যথেষ্ট পরিমাণে মিনারেল ওয়াটার, আর হালকা কিছু খাবার। প্রধানত হাই-প্রোটিন নিউট্রিশন বার। কখনও কখনও গুঁড়ো দুধ বা ওভালটিন জাতীয় পাউডারও রাখে। দুধ খাওয়ার একান্ত দরকার পড়লে সেটা গুলে নেয়। তা না হলে দিনে গোটা দুয়েক প্রোটিন বারেই ওর চলে যায়। তার একটা বাড়তি সুবিধাও আছে। এতে করে অজানা-অচেনা জায়গায় জঘন্য সব বাথরুম ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় কম।

আগুনের সামনে বসে ফকিরের রান্না করা দেখতে দেখতে বেশ বুঝতে পারছিল পিয়া যে রান্না শেষ হলেই ওকে খেতে বলবে ফকির। কিন্তু এই খাবার তো পিয়া খাবে না। তবু, রান্নার ঝাঝালো গন্ধে গা গুলিয়ে উঠলেও, মশলার মোড়কের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ানো ফকিরের আঙুলগুলির দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিল না পিয়া। মনে হচ্ছিল ও যেন আবার সেই ছোট্ট পিয়া হয়ে গেছে, পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ডিঙি মেরে দেখছে স্টোভের পাশে রান্নার তাকের ওপর পর পর সাজানো সব স্টেনলৈস স্টিলের বাসন, যেন ও দেখছে ওর মায়ের আঙুল, মশলার রং আর আগুনের আভার মধ্যে ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে ওদিক। ছেলেবেলার এই ছবিটা হারিয়েই গিয়েছিল পিয়ার মন থেকে। আর সে ছবি যে সুন্দরবনের নদীতে এই নৌকোর ওপর এভাবে ফিরে আসবে সে কথা ও কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি।

এই ঝাঝালো গন্ধগুলোই এক সময় কত চেনা ছিল পিয়ার। এগুলিই ছিল ওর বাড়ির গন্ধ। সব সময় এই গন্ধই ও পেত মায়ের গায়ে; স্কুল থেকে ফেরার পথে, ফ্ল্যাটের লিফটে উঠতে উঠতে–সারাক্ষণ এ গন্ধগুলো নাকে লেগে থাকত পিয়ার। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই দৌড়ে আসত গন্ধগুলো পোষা প্রাণীর মতো। ফ্ল্যাটের বদ্ধ গরম হাওয়ায় যেন পুষ্টি পেত ওরা। পিয়া কল্পনা করত রান্নাঘরটা যেন ওদের খাঁচা, ওখানেই ওরা খায়-দায়, ঘুমোয়। তাই খেলার মাঠে লোকের আলগোছ মন্তব্য বা বন্ধুদের খোঁচা-মারা রসিকতায় পিয়া যখন বুঝতে পারত যে অদৃশ্য পোষা প্রাণীর মতো গন্ধগুলি সব সময় ওর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন রীতিমতো চমকে যেত ও। এক সময় পিয়ার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। লড়াই শুরু করল ও–এই গন্ধগুলির বিরুদ্ধে, ওর মায়ের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ, শান্ত, নাছোড়বান্দা লড়াই। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে সেখানেই ও ওদের আটকে রাখতে চেষ্টা করত।

কিন্তু এখানে এই নৌকোর ওপরে চারপাশের পরিবেশ যেন শান্ত করে রেখেছে ওই পোষা গন্ধের ভূতগুলোকে। ফকিরের আঙুলগুলোর চলনে প্রায় সম্মোহিত হয়ে গেছে। পিয়া। কেবল একেকটা হাওয়ার দমকে যখন লঙ্কার তীব্র ঝাঁঝ সরাসরি ওর নাকে এসে ঝাঁপটা মারছে, তখনই শুধু মুহূর্তের জন্য কেটে যাচ্ছে সে সম্মোহনের ঘোর। হঠাৎ করে তখন যেন জেগে উঠছে ভূতগুলো, তীক্ষ্ণ নখে চিরে দিচ্ছে ওর গলা আর চোখ–যেন ও কোনও শত্রুপক্ষের লোক, হঠাৎ সীমান্ত পেরিয়ে চলে এসেছে এখানে। আস্তে আস্তে নৌকোর সামনের দিকটায় সরে গেল পিয়া। একটু পরে ফকির যখন এগিয়ে এসে ভাতের থালা বাড়িয়ে দিল, তখন জলের বোতল আর প্রোটিন বারগুলোর দিকে দেখিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে মাথা নাড়ল ও। হাবেভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল, ফকির কিছু যেন মনে না করে।

কিন্তু ফকির যেন জানতই যে ওই খাবার ও খাবে না। একটু অবাক হল পিয়া। ও ভেবেছিল প্রতিবাদ করবে ফকির, আশ্চর্য হবে, কতটা আহত হয়েছে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবে, কিন্তু সেসব কিছুই করল না ও। একবার মাথা নাড়ল শুধু, আর খানিকক্ষণ চেয়ে রইল পিয়ার দিকে, যেন যাচাই করার দৃষ্টিতে। মনে হল নিজের মনে একটা লিস্টিতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে ও, বোঝার চেষ্টা করছে কী কী কারণে ওর আনা খাবার ফিরিয়ে দিতে পারে পিয়া। পিয়ার আশঙ্কা হল ফকির হয়তো ভাবছে জাত-পাত বা ওই রকম কোনও রহস্যময় কারণে ও খাচ্ছে না ওই খাবার। তাই নিজের পেটে হাত রেখে খানিকটা শরীর খারাপের অভিনয় করে দেখাল ও কাজ হল তাতে। হেসে ফেলল ফকির। তারপর থালাটা দিয়ে দিল ছেলের হাতে। সেটা হাতে নিয়ে লোভীর মতো সাপটে সুপটে ভাত ক’টা খেয়ে নিল টুটুল।

খাওয়া-দাওয়া হলে বাসনপত্র আর স্টোভটা নিয়ে ফের তক্তার নীচে রেখে দিল ফকির। কয়েকটা মাদুর আর চাদর বের করে আনল সেখান থেকে। এর মধ্যেই ঝিমোতে শুরু করেছিল টুটুল। ছইয়ের নীচে একটা মাদুর পেতে নিয়ে মাথা অবধি চাদর মুড়ি দিয়ে খানিকক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ও। তার পাশেই আরেকটা মাদুর পেতে দিয়ে সেটার দিকে ইশারা করল ফকির। রাতের জন্য ওখানেই ও পিয়ার শোয়ার ব্যবস্থা করছে। কিন্তু পিয়ার নিজেরই একটা মাদুর রয়েছে সঙ্গে। নীল রঙের পাতলা ফোম একটা, পিঠব্যাগের ফ্রেমের সঙ্গে বাঁধা। ইলাস্টিকের দড়িটা খুলে নৌকোর ওপর সেটা পেতে নিল পিয়া। মাথার দিকটা রাখল নৌকোর মুখের সরু জায়গাটার কাছাকাছি।

পিয়াকে ওইখানে রাতের জন্য শোয়ার বন্দোবস্ত করতে দেখে অস্থির হয়ে উঠল ফকির। বারবার মাথা নেড়ে দূরের জঙ্গলের দিকে ইশারা করতে লাগল হাত দিয়ে। ফকিরের ইঙ্গিতটা মনে হল ইচ্ছাকৃতভাবে খানিকটা অস্পষ্ট। পিয়া অনুমান করল কোনও জংলি জানোয়ারের ভয় পাচ্ছে ও। কোনও হিংস্র জন্তুর ভয়। এতক্ষণে একটু একটু বুঝতে পারছিল ও কেন এরকম একটা অদ্ভুত জায়গায় এনে নৌকোটাকে রেখেছে ফকির। মাঝরাতে যাতে বাঘ এসে হানা দিতে না পারে সেই জন্য মনে হয়। স্থলচর মাংসাশী প্রাণীদের নিয়ে পিয়া কখনও বিশেষ চর্চা করেনি বটে, কিন্তু যত খিদেই পাক শিকারের জন্য পাড় থেকে এতটা দূরে কোনও জন্তু সাঁতরে আসতে পারে বলে মনে হল না ওর। আর চলেই যদি আসে, তা হলে ছইয়ের নীচেই শোও কি বাইরেই শোও, খুব একটা তফাত কি হবে? এ নৌকোর যা ছিরি, একটা বাঘ উঠে এলে তার ভারে সবসুদ্ধই উলটে যাবে মনে হয়।

সব কিছু মিলিয়ে ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত অবাস্তব ঠেকল, যে হেসে ফেলল পিয়া। ফকিরকেও মজার ভাগ দেওয়ার জন্য ও হাতের আঙুলগুলো বাঁকিয়ে বাঘের মতো হিংস্র মুখভঙ্গি করে এগিয়ে গেল ওর দিকে। কিন্তু ফকির দু হাত দিয়ে ওর কবজি চেপে ধরল; আর প্রচণ্ড মাথা নাড়াতে লাগল। মনে হল কোনওভাবে ওই প্রসঙ্গটা তুলতেই ও বারণ করছে। তখনকার মতো ব্যাপারটাকে আর না ঘাঁটানোই স্থির করল পিয়া। হাত দিয়ে নিজের মাদুরটাকে টানটান করে নিয়ে শুয়ে পড়ল তার ওপর। মনে হল এটাই ফকিরকে বোঝানোর সবচেয়ে সহজ উপায় যে, কোনও জলচর শ্বাপদের ভয়ে ওই ছইয়ের নীচে গাদাগাদি করে রাত কাটানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। ও আর প্রতিবাদ করল না দেখে স্বস্তি পেল পিয়া। ছইয়ের ভেতর থেকে একটা শাড়ি নিয়ে সেটাকে ভাজ করে বালিশ বানিয়ে এনে দিল ফকির। সঙ্গে একটা তেলচিটে ময়লা চাদর।

তারপর নৌকোর মাঝের দিকে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে একটা বিড়ি ধরাল ফকির। একটু পরেই আধো তন্দ্রায় পিয়ার কানে একটা গানের সুর ভেসে এল। ফকির গুনগুন করছে। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে পড়ল পিয়া। বলল, “সিং”। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওর দিকে খানিক চেয়ে রইল ফকির। এবার পিয়া দু হাত ওপরের দিকে তুলে ইশারা করে বলল, “লাউডার। সিং লাউডার”।

বুঝল ফকির। মাথাটা পেছনে হেলিয়ে গাইল দু’ কলি। সুরটা শুনে অবাক হয়ে গেল পিয়া। এক্কেবারে অন্যরকম। এর আগে যেসব ভারতীয় গান ও শুনেছে–ওর বাবার প্রিয় হিন্দি ফিল্মের গান, আর মায়ের গলায় দুয়েকটা বাংলা গান–সেগুলোর সঙ্গে এই সুরটার কোনও মিলই নেই। ফকিরের গলা যে খুব ভাল তা বলা চলে না, একটু কর্কশই; খাদে বা চড়ায় সুর ধরে রাখতে পারছিল না ঠিক, কিন্তু সুরটার মধ্যে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতার ছোঁয়া লেগে রয়েছে। পিয়াকে ভেতরে ভেতরে নাড়া দিয়ে গেল সেটা।

এতক্ষণ পিয়ার মনে হচ্ছিল ফকিরের ওই পেশল চেহারার মধ্যে একটা সরল নিষ্পাপ ভাব রয়েছে, যেটা মনকে টানে। কিন্তু এখন এই গান শোনার পর পিয়ার মনে হল ও নিজেই কি একটু বেশি সরল তা হলে? ওর জানতে ইচ্ছে করছিল গানটা কী নিয়ে, গানের কথাগুলোর কী মানে; কিন্তু এই সুরের বেদনা আজ এখানে মনের কোন তার কীভাবে ছুঁয়ে গেল, এক নদী শব্দ খরচ করেও যে তা ঠিকমতো বোঝানো যাবে না সেটাও বেশ বুঝতে পারছিল পিয়া।

.

বনবিবির মহিমা

কুসুমের বাড়ি ছিল কাছেই একটা দ্বীপে। সাতজেলিয়ায়। ওর বাবা মারা গিয়েছিল জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে। ঘটনাটা ঘটেছিল বনবিভাগের নিষিদ্ধ এলাকায়, আর ওর বাবার কোনও পারমিটও ছিল না। তাই কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি কুসুমের মা। সংসার প্রায় চলে না, রোজগারেরও কোনও সংস্থান নেই, এইরকম সময় একদিন গ্রামের জোতদার দিলীপ চৌধুরি এসে বলল তার সঙ্গে শহরে গেলে একটা কাজ জোগাড় হতে পারে। হাতে যেন চাঁদ পেল কুসুমের মা।

গাঁয়ের আরও অনেক মেয়েকেই কাজ জুটিয়ে দিয়েছে দিলীপ, তাই এ প্রস্তাবে আপত্তির আর কী থাকতে পারে? কুসুমকে আত্মীয়দের কাছে রেখে একদিন সকালে দিলীপের সঙ্গে চলে গেল সে, কলকাতার ট্রেন ধরতে। দিলীপ ফিরে এল একা। কুসুমকে বলল তার মা খুব ভাল একটা বাড়িতে কাজ পেয়েছে, কদিন পরে ওকেও নিয়ে যাবে। খুব বেশিদিন লাগল না; মাসখানেক পরেই দিলীপ এসে বলল মা বলে পাঠিয়েছে ওকে কলকাতায় তার কাছে নিয়ে যেতে।

এই সময় হরেন নস্কর জানতে পারল ব্যাপারটা। হরেন কুসুমের বাবার সঙ্গে কাজ করত। ওর মা-র সঙ্গেও শ্বশুরবাড়ির সূত্রে তার দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তা ছিল। সে এসে বলল ভুলেও যেন কুসুম দিলীপের ফাঁদে পা না দেয়। ও লোক ভাল নয়। মেয়ে পাচার করাই হল ওর ব্যবসা। কুসুমের মাকে কী কাজ জুটিয়ে দিয়েছে সে খবর কি ও রাখে? নিশ্চয়ই সোনাগাছির কোনও বেশ্যাবাড়িতে পচছে বেচারি। আর কুসুমের দিকে তো আরও বেশি করে নজর যাবেই দিলীপের। কমবয়সি মেয়েদের বেচতে পারলে অনেক বেশি পয়সা আসে। দিলীপের হাতে পড়লে ও হয় কলকাতার কোনও বেশ্যাপট্টিতে, নয়তো বোম্বের কোনও খারাপ জায়গায় গিয়ে ঠেকবে। হরেনই তারপর কুসুমকে লুসিবাড়িতে নিয়ে এসে মহিলা সমিতির হাতে তুলে দিল। ঠিক হল স্থায়ী একটা কিছু ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সমিতির সদস্যারাই ওর দেখাশোনা করবে।

মাসকয়েক যেতে না যেতেই লুসিবাড়ি দ্বীপটাকে নিজের হাতের তেলের মতো চিনে গেল কুসুম। আর কানাই আসার পর ও-ই হল তার মুরুব্বি। কুসুমই কানাইকে গাঁয়ের সব খবরাখবর দিত–কে কীরকম লোক, কে কার ছেলে বা মেয়ে, গায়ে কোথায় মোরগ লড়াই হচ্ছে, কোথায় কী পুজো হচ্ছে, কার বাচ্চা হল, কে মারা গেল–সব। আর কানাই ওকে বলত শহরের গল্প, ওর স্কুলের কথা, বন্ধুদের কথা। কুসুমের গল্পগুলোর তুলনায় নিজের গল্পগুলো সাদামাটা, ম্যাড়ম্যাড়ে মনে হত কানাইয়ের। কুসুম কিন্তু খুব মন দিয়ে শুনত। মাঝে মাঝে এটা ওটা প্রশ্ন করত।

“আচ্ছা, আমি যদি তোর সঙ্গে শহরে চলে যাই কেমন হয়?” একদিন জিজ্ঞেস করল : কুসুম। “তুই কোথায় থাকিস দেখব বেশ।”

কানাই চুপ করে গেল। এরকম একটা প্রশ্ন যে কুসুম করতে পারে সেটা ভাবতেই পারেনি ও। মেয়েটা কিচ্ছু বোঝে না নাকি? ওকে কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুললে কী হবে কল্পনা করতেই সিঁটিয়ে গেল কানাই। মনে মনে পরিষ্কার শুনতে পেল মায়ের গলার ঝাঝালো সুর। আর পাড়ার লোকেরাই বা কী বলবে? “নতুন ঝি নিয়ে এলেন নাকি দিদি? বাসন মাজা কাপড় কাঁচার লোক তো ছিলই একটা আপনাদের। আরও একটা?”

“কলকাতায় তোর ভাল লাগবে না,” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল কানাই। “ওখানে গিয়ে মানাতে পারবি না তুই।”

কুসুমের কাছ থেকেই শুনেছিল কানাই একটা যাত্রার দল আসছে লুসিবাড়িতে, বনবিবির পালা করবে। বনবিবির গল্পের কথা দুয়েকবার শুনেছে কানাই এখানে এসে, কিন্তু পুরো গল্পটা ঠিকমতো ওর জানা ছিল না। কুসুমকে জিজ্ঞেস করতে ও প্রায় আঁতকে উঠল, “সে কী রে? তুই বনবিবির গল্প জানিস না?”

“না।”

“ভয় পেলে তালে কাকে ডাকিস তুই?”

প্রশ্নের মানেটা ঠিক ধরতে না পেরে অন্য কথা পেড়েছিল কানাই। কিন্তু কথাটা ঘুরতেই থাকল ও মাথার মধ্যে। একটু বাদে নির্মলকে গিয়ে ও ধরল বনবিবির গল্প বলার জন্য।

নির্মল পাত্তাই দিল না। “ছাড়ো তো। এসব এখানকার লোকেদের বানানো উদ্ভট গল্প। এগুলি নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। যত্তসব গাঁজাখুরি কল্পনা।”

“গল্পটা বলোই না আমাকে।”

“হরেনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো,” বলেছিল নির্মল। “দেখবে ও বলবে, বনবিবি এই পুরো জঙ্গলটার দেবী। বাঘ, কুমির, আরও সব জন্তু জানোয়ার সবাই এখানে বনবিবির কথা শুনে চলে, এই সব। এখানকার অনেক বাড়ির সামনে ছোট ছোট মন্দিরের মতো দেখনি? ওগুলির মধ্যে বনবিবির মূর্তি আছে। তোমার মনে হতে পারে যে এরকম একটা জায়গায় বাস্তব সমস্যাগুলো নিয়ে মাথা ঘামানোটাই গ্রামের লোকের পক্ষে বেশি স্বাভাবিক, কিন্তু এরা সব এই দেবী, পির আর যত সব আজগুবি অলৌকিক জিনিসেই বিশ্বাস করে।”

“কিন্তু গল্পটা আমাকে বলো না,” কানাই নাছোড়বান্দা। “কী নিয়ে গল্পটা? কী ঘটনার কথা আছে ওটাতে?”

“যেমন থাকে সব এরকম গল্পে,” অধৈর্য হয়ে হাত ওলটাল নির্মল। “দেবদেবী, পির ফকির, জন্তু জানোয়ার, দত্যি দানো–এই সব। অনেক লম্বা গল্প। তার চেয়ে এক কাজ করো। যাত্রাটা দেখে নাও, তাহলেই জেনে যাবে গল্পটা।”

যাত্রার মঞ্চ বানানো হয়েছিল লুসিবাড়ির বড়ো ময়দানে, হ্যামিলটনের কুঠি আর স্কুলের মাঝামাঝি জায়গায়। সাদামাটা একটা মঞ্চ, একদিনও লাগেনি তৈরি করতে। চারিদিকে বাঁশের ভারা মতে বেঁধে খানিকটা ওপরে কয়েকটা তক্তা পেতে দেওয়া হল। ওইটাই মঞ্চের মেঝে। পালা চলার সময় পেছনদিকের একটা বাঁশ থেকে একটা রংচং করা কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়া হল। দর্শকদের জন্য সেইটাই হল দৃশ্যপট, আর অভিনেতাদের জন্য পর্দা। তার আড়ালে তারা বিড়ি টানে, খাওয়া-দাওয়া করে, পোশাক বদল করে। আলোকসম্পাতের জন্য ঝুলিয়ে দেওয়া হল কয়েকটা হ্যাঁজাক বাতি, আর সংগীতের জন্য একটা ব্যাটারিতে চালানো ক্যাসেট রেকর্ডার আর লাউডস্পিকার।

লুসিবাড়িতে রাত নামে তাড়াতাড়ি। মোমবাতি কি লম্ফর দাম তো কম নয়; খরচ বাঁচানোর জন্য তাই হিসেব করে আলো জ্বালানো হয়। সূর্যের আলো থাকতে থাকতেই রাতের খাওয়া সেরে নেয় সবাই, আর রাতের অন্ধকার নেমে এলে নিঝুম হয়ে যায় সারা গাঁ। সে নিস্তব্ধতা ভাঙে কদাচিৎ দূর থেকে জলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা জানোয়ারের ডাকে। ফলে, রাতে কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন হলে লুসিবাড়িতে সেটা একটা বিশেষ ঘটনা। কয়েকদিন আগে থেকেই ছেলেবুড়ো সকলে মেতে ওঠে। আসল অনুষ্ঠানের চেয়ে প্রস্তুতিপর্বের উৎসাহটাও কম নয়। যাত্রা যখন শুরু হল, রাতের পর রাত জেগে বনবিবির পালা দেখল গাঁয়ের সমস্ত লোক। কুসুম আর কানাইও।

যাত্রার শুরুতেই একটা চমক অপেক্ষা করে ছিল কানাইয়ের জন্য। এরকম দেবদেবীর কাহিনি আগে যা শুনেছে ও, সেগুলো শুরু হয় স্বর্গে কিংবা গঙ্গার তীরে। কিন্তু এই বাঘের দেবীর গল্পের আরম্ভটা এক্কেবারে অন্যরকম। প্রথম দৃশ্য শুরু হল আরবদেশের এক শহরে। পেছনের সিনে মসজিদ আর মিনারের ছবি আঁকা।

দৃশ্যটা মদিনার। মুসলমানদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। সেই শহরে বাস করত এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান, ইব্রাহিম। সন্তানহীন ইব্রাহিম সুফি ফকিরদের মতো পবিত্র জীবন যাপন করত। শেষে দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের কৃপায় দুটি যমজ সন্তান হল তার, বনবিবি আর শা জঙ্গলি। এই দুই ছেলেমেয়ে যখন বড় হল, তখন একদিন দেবদূত এসে বলল তাদের ভাইবোনকে আল্লা একটা কাজের ভার দিয়েছেন। এই আরবদেশ থেকে তাদের যেতে হবে আঠারো ভাটির দেশে। গিয়ে সেই জায়গাটাকে মনুষ্যবাসের উপযুক্ত করে তুলতে হবে। এই দায়িত্ব পেয়ে তো বনবিবি আর শা জঙ্গলি রওনা হল বাংলাদেশের বাদাবন অঞ্চলের উদ্দেশ্যে। পরনে তাদের সাধারণ সুফি ভিক্ষুকের পোশাক।

আঠারো ভাটির দেশে তখন দানবরাজ দক্ষিণরায়ের রাজত্ব। ভয়ংকর তার ক্ষমতা। সেখানকার সমস্ত প্রাণী, ভূত, পিশাচ–সকলে তার কথায় ওঠে বসে। আর মানুষ হল দক্ষিণরায়ের দু’ চক্ষের বিষ। কিন্তু মানুষের মাংসের প্রতি তার অসীম লোভ।

একদিন দক্ষিণরায় শুনল জঙ্গলের মধ্যে কে যেন আজান দিচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারল বনবিবি আর শা জঙ্গলি এসেছে তার রাজত্বে। ভয়ানক রেগে গিয়ে তো দক্ষিণরায় তার সমস্ত সৈন্য সামন্ত জড়ো করল। এই দু’জনকে তাড়াতেই হবে এলাকা থেকে। ভীষণ এক যুদ্ধ হল তারপর। যুদ্ধে গোহারা হেরে গেল দক্ষিণরায়। কিন্তু বনবিবির দয়ার শরীর। যুদ্ধে জিতেও দানবরাজকে মারলেন না তিনি। বরং বললেন, এই ভাটির দেশের অর্ধেকটার ওপর রাজত্ব করতে পারে দক্ষিণরায়। সেখানে জঙ্গলের মধ্যে সে তার ভূত পিশাচদের নিয়ে থাকতে পারে। বাকি অর্ধেকটা নিয়ে নিলেন বনবিবি। সেখানে বন কেটে বসত হল। শান্তি এল আঠারো ভাটির দেশে। দেশটাকে জঙ্গল আর বসত, এই দু’ভাগে ভাগ করে বনবিবি সেখানে শৃঙ্খলা নিয়ে এলেন। সুখেই কাটছিল সময়, কিন্তু মানুষের লোভই একদিন শান্তি ভাঙল আবার।

ধনা নামে একটা লোক ভাটির দেশের একপ্রান্তে বাস করত। সে একদিন ঠিক করল জঙ্গলে যাবে, ভাগ্যান্বেষণে। কিন্তু সপ্তডিঙা সাজিয়ে ধনা যখন রওনা হতে যাবে তখন দেখা গেল একজন মাল্লা কম পড়ছে। হাতের কাছেই ছিল দুখে বলে একটা ছেলে। নামেও যেমন দুখে, সারাটা জীবন সেরকম দুঃখেই কেটেছে তার। ছোট্টবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছিল দুখে। এখন সে থাকে তার অসুস্থ বুড়ি মা-র সঙ্গে। কোনওরকমে কায়ক্লেশে তাদের সংসার চলে। দুখেকে যেতে দেওয়ার একটুও ইচ্ছে ছিল না তার মায়ের। কিন্তু অবশেষে বিদায় নেওয়ার সময় এল। মা তখন তাকে একটা পরামর্শ দিল। বলল যখনই বিপদে পড়বে, দুখে যেন বনবিবিকে স্মরণ করে। বনবিবি আর্তের সহায়, গরিবের মুশকিল আসান। তিনি নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করবেন।

ধনার নৌবহর তো যাত্রা শুরু করল। ভাটির দেশের এ নদী সে নদী এ খাল সে খাল দিয়ে অবশেষে গিয়ে পৌঁছল কেঁদোখালির চরে। এখন, কেঁদোখালির চর ছিল দক্ষিণরায়ের রাজত্বের মধ্যে। কিন্তু মাল্লারা সেটা জানত না। তারা তো গিয়ে নৌকো ভেড়াল সেখানে। দক্ষিণরায় কিন্তু আগে থেকেই খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল। ধনা আর তার দলবলের জন্য কিছু চমকেরও ব্যবস্থা করে রেখেছিল সে। চরে নেমেই তারা দেখল গাছে গাছে বড় বড় সব লোভনীয় মধু-টসটসে মৌচাক। কিন্তু যেই সেগুলির দিকে এগিয়ে যায়, মৌচাক আর দেখা যায় না। সেটা তখন একটু দূরের কোনও গাছে ঝুলছে। সারাদিনে একটা মৌচাকও জোগাড় করতে পারল না ধনা। নাকানিচোবানি খেয়ে গেল একেবারে। তারপর সেই রাতে স্বপ্নের মধ্যে ধনাকে দেখা দিয়ে দক্ষিণরায় দু’পক্ষের স্বার্থরক্ষার জন্য একটা প্রস্তাব দিল। ধনা তার নৌকোয় যে ছেলেটাকে এনেছে সেই ছেলেটাকে চাইল দক্ষিণরায়। বহুদিন হল মানুষের মাংস জোটেনি। দুখেকে খাওয়ার জন্য তাই নোলা সক সক করছে তার। তার বদলে সে ধনাকে নৌকো বোঝাই করে ধনসম্পদ দেবে।

লোভে পড়ে এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল ধনা। যেই না রাজি হওয়া, সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের সব ভূত দানো পিশাচ, এমনকী মৌমাছিরা পর্যন্ত মধু আর মোম’ নিয়ে এসে ধনার নৌকো ভরে দিল। সবগুলো নৌকো টইটম্বুর হয়ে গেল মোমে আর মধুতে। এবার ধনার কথা রাখার পালা। দুখেকে ডেকে সে বলল জঙ্গল থেকে কিছু কাঠ নিয়ে আসতে। কী আর করে দুখে, নৌকো থেকে নেমে জঙ্গলে ঢুকল। খানিক পরে কাঠ নিয়ে যখন ফিরে এল তখন দেখল যা ভয় পেয়েছিল তাই হয়েছে। একটা নৌকোরও কোনও চিহ্ন নেই। সে একা দাঁড়িয়ে আছে চরে–সামনে তার বিশাল নদী আর পেছনে জঙ্গল। এই সময়ে হঠাৎ দূরে একটা হলুদ কালো ঝলক চোখে পড়ল দুখের। দেখে এক বিরাট বাঘ। নদীর অন্য পারে ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে আসছে ওর দিকে। বাঘটা আর কেউ নয়, দক্ষিণরায় স্বয়ং। পৃথিবী ঝাঁপিয়ে প্রচণ্ড এক গর্জন ছেড়ে সেটা লাফ দিল দুখের দিকে। বাঘের ওই বিশাল ভয়ানক

চেহারা দেখে তো তার প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার দশা। ভয়ে জ্ঞান হারাতে হারাতে মায়ের উপদেশের কথা মনে পড়ল দুখের। মনপ্রাণ দিয়ে সে ডাকতে লাগল, “ও বনবিবি, ও দয়াবতী, আমাকে রক্ষা করো, আমার সহায় হও।”

তখন বহুদূরে ছিলেন বনবিবি। কিন্তু ভক্তের ডাক শুনে এক লহমায় নদী পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন তার কাছে। দুখেকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে তার শুশ্রূষা করতে লাগলেন তিনি। আর তার ভাই শা জঙ্গলি প্রচণ্ড প্রহার করে তাড়িয়ে দিলেন দক্ষিণরায়কে। দুখেকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে সেবা শুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তুললেন বনবিবি। তারপর দুখের যখন ঘরে ফেরার সময় হল, প্রচুর মধু আর মোম তার সাথে দিয়ে তাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিলেন তিনি। দুনিয়াকে বনবিবি বুঝিয়ে দিলেন, এই হল জঙ্গলের আইন। লোভী বড়লোকেরা শাস্তি পাবে, আর সৎ গরিব মানুষেরা পাবে তার আশীর্বাদ।

কানাই ভেবেছিল বুঝি ওর একঘেয়ে লাগবে এই গেঁয়ো যাত্রা। কলকাতায় তো ওরা নাটক দেখতে যায় অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসে আর সিনেমা দেখতে যায় গ্লোবে। কিন্তু যাত্রা দেখতে দেখতে কাহিনিটার মধ্যে ও ডুবে গেল। দানোটা যখন দুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে, সত্যিই প্রচণ্ড ভয়ে তখন কাটা হয়ে গিয়েছিল কানাই। যদিও বাঘের চেহারাটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হয়নি, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল সেটা ডোরাকাটা কাপড় জড়ানো আর মুখোশ পরা একটা লোক। আবার বনবিবি যখন দুখের পাশে এসে দাঁড়ালেন, তখনও কানাই কেঁদে ফেলেছিল আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায়। সত্যিকারের কান্না। আসরের সক্কলেরই তখন চোখে জল। অবশ্য মঞ্চে বনবিবির আবির্ভাবটা যে খুব অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে হয়েছিল তা নয়। এমনকী দুখে যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আর বাঘ তাকে খেয়ে নিতে যাচ্ছে, তখনও বনবিবি মঞ্চের একপাশে ঝুঁকে পড়ে মুখ থেকে পানের ছিবড়ে ফেলতে ব্যস্ত। শেষে দর্শকরাই তাড়া দিয়ে দিয়ে পাঠাল তাকে দুখের কাছে। কিন্তু এসব কিছুই কাহিনির সাবলীল গতিকে রোধ করতে পারেনি। অভিনয় শেষ হওয়ার আগেই কানাই বুঝতে পেরেছিল এ পালা তাকে আবার দেখতে হবে।

যাত্রা যেদিন শেষ হল লুসিবাড়িতে, সেদিন সে এক দেখার মতো দৃশ্য। আশেপাশের সব দ্বীপ থেকে লোক একেবারে ভেঙে পড়েছিল। প্রচণ্ড ঠেলাঠেলি। ময়দানে তিল ধারণের জায়গা নেই। গুঁতোগুঁতির মধ্যে কানাই আর ভেতরের দিকটায় ঢুকতে পারেনি। একধারে কোনার দিকে বসে দেখছিল। এতবার দেখার পর প্রথম দিকটায় একটু একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল কানাইয়ের; বসে বসেই ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙে দেখল ও কুসুমের পাশে বসে আছে। “কী হচ্ছে রে?” ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল কানাই। “কোন জায়গাটা হচ্ছে এখন?” কোনও সাড়া নেই। যাত্রায় একেবারে ডুবে গেছে কুসুম, কানাই যে পাশে বসে আছে সে তার খেয়ালই নেই। কী এত মুগ্ধ হয়ে দেখছে কুসুম বোঝার জন্য মঞ্চের দিকে তাকিয়ে কানাই দেখে যা ভেবেছিল তার চেয়ে একটু বেশিই ঘুমিয়েছে ও। কাহিনি অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। ধনা আর তার দলবল কেঁদোখালির চরে পৌঁছে গেছে। এর পরেই দক্ষিণরায়ের সঙ্গে সেই চুক্তিটা হবে।

“কুসুম?” ফিসফিস করে আবার ডাকল কানাই। মুহূর্তের জন্য মুখ ফেরাল কুসুম।

হ্যাজাকের অস্পষ্ট আলোয় কানাই দেখল নীচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে আছে ও, আর দু’গাল বেয়ে গড়াচ্ছে চোখের জল। এই যাত্রা দেখতে দেখতে কান্না আসতেই পারে, তাই খুব একটা আশ্চর্য হল না কানাই। কিন্তু তারপর কুসুম যখন হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না শুরু করল, তখন ওর মনে হল শুধু যাত্রা দেখে তো এরকম ভাবে কাঁদবে না। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে। মুহূর্তের আবেগে, কুসুমকে সান্ত্বনা দিতে একটা হাত বাড়িয়ে দিল কানাই, ওর হাত ধরার জন্য। কিন্তু যেখানে থাকবে ভেবেছিল কুসুমের হাত সেখানে ছিল না। বদলে ওর ফ্রকের ভঁজে জড়িয়ে গেল কানাইয়ের আঙুল। ফ্রকের জট থেকে হাত ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল কানাই, কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আসার বদলে কুসুমের শরীরের একটা নরম আর অপ্রত্যাশিত রকম গরম জায়গায় ঠেকে গেল ওর আঙুল। সে স্পর্শের অভিঘাতে চমকে উঠল ওরা দুজনেই, ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো।

চাপা একটা চিৎকার করে উঠে দাঁড়াল কুসুম। তারপর কোনওরকমে হোঁচট খেতে খেতে বেরিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। কানাইয়ের ইচ্ছে করছিল ছুটে যায় ওর পেছন পেছন, কিন্তু স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বশেই মনে হল ঠিক হবে না সেটা করা। লোকে দেখলে খারাপ ভাবতে পারে। মিনিট দুয়েক তাই অপেক্ষা করল কানাই। তারপর ধীরে ধীরে উঠে অন্য আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে এল ভিড় ছেড়ে। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে অনেকটা ঘুরে এসে কানাই ধরল কুসুমকে। ও তখন হ্যামিলটনের কুঠির দিকে যাচ্ছে। “কুসুম–একটু দাঁড়া। দাঁড়া একটু।”

দূরের হ্যাঁজাক থেকে যেটুকু আলো চুঁইয়ে আসছিল তাতে দেখা যাচ্ছিল কোনও রকমে হাতড়াতে হাতড়াতে হাঁটছে কুসুম, মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিচ্ছে জামার কাঁধে। “কুসুম,” চাপা গলায় আবার ডাকল কানাই। “দাঁড়া একটু বলছি।” কাছে এসে ওর কনুই ধরে ফেলল কানাই। “ভুল করে হয়ে গেছে, আমি ইচ্ছে করে করিনি।”

থেমে গেল কুসুম। কানাইও দাঁড়িয়ে গেল শক্ত হয়ে। ভাবল এক্ষুনি কুসুম খিঁচিয়ে উঠবে, গালাগাল আর বকুনির তোড়ে ধুইয়ে দেবে ওকে। কিন্তু কিছুই বলল না কুসুম। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কানাইয়ের মনে হল কুসুমের মন খারাপের পেছনে ওর ভূমিকা নিতান্তই সামান্য। মনে হল শুধু একটা ছেলের ভুল করে ছুঁয়ে দেওয়া নয়, ওই কান্নার উৎস রয়েছে আরও গভীরে কোথাও।

কুঠির গেটের প্রায় সামনে চলে এসেছে ওরা এখন। এক লাফে গেটটা ডিঙিয়ে গেল কানাই। কুসুমকে ডাকল তারপর, “আয় না, চলে আয়।” এক মুহূর্ত দোনামনা করে কুসুমও ঢুকল ভেতরে। ওর হাত ধরে পুকুরপাড়ের শ্যাওলা ধরা ইটের ওপর দিয়ে দৌড়ে কুঠিতে ওঠার সিঁড়ির সামনে এসে পৌঁছল কানাই। কুসুমকে নিয়ে তুলল ঢাকা বারান্দাটায়। তারপর পুরনো কাঠের দেওয়ালটায় পিঠ দিয়ে মেঝের ওপর বসে পড়ল ওরা। ময়দানটা পরিষ্কার চোখে পড়ছে এখান থেকে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্টেজের ওপর দুখে শুয়ে আছে, আকুল হয়ে ডাকছে বনবিবিকে।

কুসুমই কথা বলল প্রথম। “আমিও ডেকেছিলাম। কিন্তু আসেনি।”

“কে?”

“বনবিবি। যেদিন বাবা মরে গেল। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার চোখের সামনে একেবারে। আমি কত বার ডাকলাম বনবিবিকে…”

আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল সেই দিনটা। আর ঘটনাটা ঘটেছিল ভর দুপুরে–সূর্য তখন মাঝ আকাশে। বাড়িতে টাকা ছিল, খাবারও ছিল। কারণ ঠিক তার আগের দিন মাছ ধরা সেরে ফিরেছে কুসুমের বাবা। বেশ ক’দিনের জন্যে বেরিয়েছিল মাছ ধরতে। অনেক মাছ পেয়েওছিল। ক্ষতি বলতে একটাই হয়েছিল সেবার, গামছাটা বাবা হারিয়ে এসেছিল। ভাল করে খেতে চেয়েছিল বাবা। মা বসে রাঁধছিল, ভাত ডাল তরকারি। কিন্তু মাছ রাঁধতে গিয়ে দেখে জ্বালানি কাঠ শেষ হয়ে গেছে। শুনেই তো বাবা খেপে আগুন। কতদিন খাওয়া জোটেনি ঠিক মতো, সেদিন তো ভাল করে খাবেই। কিছুতেই ছাড়বে না। দুমদাম করে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। বলল এক্ষুনি ফিরবে কাঠ নিয়ে।

ওদের কুঁড়েটা ছিল বাঁধের গায়ে, সরু একটা খাঁড়ির পাড়ে। নৌকো বেয়ে অন্য পারের জঙ্গলটায় যেতে খুব বেশি হলে দশ থেকে পনেরো মিনিট লাগত। রিজার্ভ ফরেস্ট ছিল ওটা, কিন্তু জ্বালানি কাঠের দরকার হলে ওখান থেকেই নিয়ে আসত ওদের গাঁয়ের লোক। কুসুমও বেরোল বাবার পেছন পেছন; বাবা নৌকো নিয়ে ওপারে গেল, আর ও বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। উলটোদিক থেকে প্রচণ্ড হাওয়া দিচ্ছিল সেদিন, তাই এমনিতে যা লাগে তার চেয়ে বেশি সময় লাগছিল বাবার ওপারে পৌঁছতে। তারপর বাবা যখন নৌকোটাকে ঠেলে পাড়ে তুলছে, তখনই কুসুম দেখতে পেল জানোয়ারটাকে–গোটাটা দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু ঝোঁপের ফাঁকে হলুদ কালো ডোরা যেটুকু নজরে আসছিল সেটুকুই বোঝার পক্ষে যথেষ্ট।

“মানে, তুই দেখতে পেলি–” কিন্তু কানাই বাঘশব্দটা উচ্চারণ করার আগেই কুসুম ওর মুখটা চেপে ধরল হাত দিয়ে। “বলিস না, বলিস না একদম। নাম বললেই এসে হাজির হবে।”

পাড়ের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছিল জন্তুটা। ওর এগোনো দেখেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল কুসুম যে নদী পেরোনোর সময় ও নৌকোটাকে দেখতে পেয়েছে। কুসুমের প্রথম চিৎকারটাতেই ওর মা আর আশেপাশের পড়শিরা ছুটে বেরিয়ে এসেছিল বাঁধের ওপর। কিন্তু যাকে ডাকছিল চেঁচিয়ে সে-ই শুনতে পেল না। তখন উলটোদিকে বইছিল হাওয়া, তাই কুসুমের গলার আওয়াজ পৌঁছল না বাবার কানে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জনা বিশেক লোক জড়ো হয়ে গেল বাঁধের ওপরে। কুসুমের সঙ্গে ওরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল জানোয়ারটা এগোচ্ছে বাবার দিকে। গাঁয়ে পুরুষ যারা ছিল সবাই দৌড়ল নৌকো আনতে। মেয়েরা হাতের কাছে থালা ঘটি বাটি যা পেল সব নিয়ে বাজাতে লাগল আর চিৎকার করতে লাগল যত জোরে পারে। কিন্তু কোনও লাভ হল না। হাওয়া তখন ওদের দিকে বইছিল, ওপারে তাই কিছুই শুনতে পেল না বাবা। জানোয়ারটাও ছিল তার শিকারের তুলনায় হাওয়ার উলটোদিকে এপার থেকে দেখা যাচ্ছিল চকচক করছে ওর গাটা। ও জানে হাওয়ায় ওর গায়ের দুর্গন্ধ পাওয়া যায়, তাই সেরকম ভাবেই চলাফেরা করে ও। এই উলটো হাওয়ার মুখে ওপারের অতগুলো লোক কিছুই করতে পারবে না সেটা যেন ও জানত। এত ওর সাহস, শেষটায় তো বেরিয়েই পড়ল ঝোঁপের আড়াল ছেড়ে। শিকার ধরার জন্য দৌড়তে শুরু করল পাড় ধরে; আড়াল-টাড়ালের আর পরোয়াই করল না। সবাই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল এপার থেকে। আশ্চর্য সেই ভয়ংকর দৃশ্য। এরকম আগে বোধহয় কেউ দেখেওনি কখনও। কারণ ভাটির দেশের এই বড় বেড়ালের চলাফেরা এক্কেবারে ভুতের মতো। তার পায়ের ছাপ দেখা যায়, গর্জন শোনা যায়, গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়, কিন্তু তাকে দেখা যায় না সহজে। এতই কম চোখে পড়ে জন্তুটা, যে বলা হয় যারা তাকে দেখে তারা কেউ আর ঘরে ফেরে না। সেদিনের ওই দৃশ্য দেখতে দেখতে তো কয়েক জন মেয়ে অজ্ঞানই হয়ে গেল বাঁধের ওপর।

কিন্তু কুসুম অজ্ঞান হয়নি। ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল। ফিসফিস করে বলছিল, “ও বনবিবি, দয়াবতী গো, আমার বাবাকে বাঁচিয়ে দাও।” চোখ বুজে ছিল কুসুম, তাই দেখতে পায়নি শেষটা। কিন্তু কান তো খোলা ছিল। হাওয়া ওদের দিকে ছিল বলে প্রতিটা আওয়াজ স্পষ্ট ভেসে আসছিল জলের ওপর দিয়ে। প্রথম কানে এল গর্জনটা, যাতে ভয়ে কাঠ হয়ে গেল বাবা। “বাঁচাও” বলে একবার চেঁচিয়ে উঠল। তারপর জানোয়ারটার থাবার ঝাঁপটে ঘাড়টা মটকে গেল বাবার। হাড় ভাঙার শব্দটা স্পষ্ট শোনা গেল। শেষে ঝোঁপঝাড়ের সড়সড় আওয়াজ এল কানে। শিকার নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল শয়তানটা।

এই সারাটা সময় বনবিবির নাম জপ করে গিয়েছিল কুসুম। একবারও থামেনি।

হরেন এসে তুলেছিল ওকে ধুলো থেকে। “বনবিবি শুনতে পেয়েছেন তোর কথা। অনেক সময় তার কাছের মানুষদের এভাবেই ডেকে নেন উনি। তোর বাবার মতো বাউলেরাই তাই সবসময় আগে যায়,” বলেছিল হরেন।

ঘটনাটা বলতে বলতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল কুসুমের। কোনও রকমে কানাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে বসেছিল ও। কানাই টের পাচ্ছিল ওর গায়ে এসে লাগছে কুসুমের চুল। গল্পটা শুনতে শুনতে কী যেন একটা দলা পাকিয়ে উঠছিল ওর গলার কাছে। ইচ্ছে করছিল দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কুসুমকে, ইচ্ছে করছিল ওর শোক ভুলিয়ে দেয়, মুছিয়ে দেয় ওর চোখের জল। নিজের শরীর দিয়ে দেওয়ালের মতো আড়াল করে রাখে ওকে গোটা পৃথিবীর কাছ থেকে। এরকম তীব্র শারীরিক অনুভূতি এর আগে কখনও হয়নি কানাইয়ের। কাউকে আগলে রাখা, আড়াল করার এই প্রচণ্ড ইচ্ছা, সহানুভূতির এরকম সুতীব্র শারীরিক প্রকাশ কানাই এর আগে কোনওদিন এভাবে অনুভব করেনি। নিজের ঠোঁট দিয়ে কুসুমের চোখ মুছিয়ে দিল ও। এত কোমল উষ্ণ সেই অনুভূতি, যে থামতে পারল না কানাই। এক হাতে জড়িয়ে ধরে কুসুমকে বুকে টেনে নিল ও, নিজের মাথা চেপে ধরল ওর মাথায়।

হঠাৎ একটা আওয়াজ শোনা গেল। কেউ যেন দৌড়ে আসছে। মচমচ করে উঠল হ্যামিলটন বাংলোর সেগুনকাঠের সিঁড়ি। “কুসুম, কুসুম”–হরেনের গলা। চাপা হিসহিস স্বরে ও ডাকছে কুসুমকে।

“আমি এখানে,” বলে দাঁড়িয়ে উঠল কুসুম।

ওদের সামনে এসে হাঁপাতে লাগল হরেন। “কুসুম, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের। আমি দিলীপকে দেখলাম, কয়েকটা লোককে নিয়ে এসেছে। তোকে খুঁজছে। এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়। লুসিবাড়ি থেকে পালাতে হবে তোকে।”

কানাইয়ের পাশে এসে হাঁটু গেড়ে বসল হরেন। ওর ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে বলল, “একটা কথা শুনে রাখো ছোটবাবু। যদি কেউ জানতে পারে কুসুম কোথায় গেছে আর কার সঙ্গে গেছে, তা হলে তুমিও কিন্তু খুব বিপদে পড়বে বলে রাখলাম। বুঝেছ?”

জবাবের অপেক্ষা না করে কুসুমের হাত ধরে বেরিয়ে গেল হরেন। দৌড়ে।

সেই শেষ দেখা কুসুমের সঙ্গে। পরদিন নির্মল বলল কানাইয়ের বনবাস শেষ, ওকে ফেরত দিয়ে আসা হবে কলকাতায়।

.

স্পন্দন

পূর্ণিমা আসতে এখনও ক’দিন বাকি। চাঁদের তিন ভাগ মাত্র দেখা যাচ্ছে। তাও এত উজ্জ্বল জ্যোৎস্না এসে পড়েছে জলের ওপর, মনে হচ্ছে নদীর ভেতর থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা পড়েছে রাতের দিকটায়, কিন্তু হাওয়া চলছে না। পাড় থেকেও কোনও শব্দ ভেসে আসছে না। নিঝুম নিস্তরঙ্গ চারদিক। অস্বচ্ছন্দ তন্দ্রায় একবার পাশ ফিরল পিয়া। ঠিক করে নিল ভাজ-করা শাড়ির বালিশটা। দেখে নৌকোর গলুই-এর কাঠটার ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে ও। হঠাৎ একটা নড়াচড়ার আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল পিয়ার। কীসে যেন খচমচ করছে, নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে নৌকোর গা, ডিঙি বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। যেন নৌকোর পেটের ভেতর থেকে কাঠ ভেদ করে কানে আসছে আওয়াজটা। কয়েকমিনিট লাগল পিয়ার বুঝতে, ব্যাপারটা কী। কিছুই না, ফকিরের ডিঙির জীবন্ত পণ্যভাণ্ডার। তক্তার নীচে কঁকড়াগুলি নড়াচড়া করছে, তারই শব্দে ঘুম ভেঙেছে পিয়ার। কঁকড়ার খোলার খটর খটর, দাঁড়াগুলোর কট কট আওয়াজ, ডালপালার খসখস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল পিয়া। মনে হচ্ছিল ও যেন একটা দৈত্য, মাটিতে কান পেতে শুনছে কোনও পাতালপুরীর প্রাণস্পন্দন।

নৌকোটা দুলে উঠল হঠাৎ, মনে হল কারও নড়াচড়ায়। পায়ের দিকে তাকিয়ে পিয়া দেখল ডিঙির মাঝের জায়গাটায় ফকির বসে আছে। একটা চাদর দিয়ে তাঁবুর মতো করে ঘাড় পর্যন্ত মোড়া। পিয়া ভেবেছিল ও বোধহয় ঘুমোচ্ছে ছইয়ের নীচে। কিন্তু ফকিরের বসার ভঙ্গিটায় এমন একটা পাথুরে নিশ্চলতা রয়েছে, বোঝাই যাচ্ছিল বেশ খানিকক্ষণ ওই ভাবে বসে আছে ও। পিয়া যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সেটা যেন টের পেল ফকির। ঘুরে তাকাল ওর দিকে। পিয়া জেগে গেছে দেখে হাসল। হাসিটার মধ্যে একই সঙ্গে একটা কৈফিয়ত আর আত্মবিদ্রুপের ভাব। ওখানে বসে বসে ওকে আর টুটুলকে পাহারা দিচ্ছে ফকির, ভেবে ভাল লাগল পিয়ার। মনে পড়ল জলের তলায় প্রথম যখন ফকিরের হাতের ছোঁয়া পেয়েছিল, কী প্রচণ্ড চেষ্টা করেছিল পিয়া সেটাকে সরিয়ে দিতে–যতক্ষণ না ও বুঝেছিল যেটা ওকে ধরার চেষ্টা করছে সেটা কোনও হিংস্র প্রাণী নয়, একটা মানুষ, যার ওপর ও ভরসা করতে পারে, যে ওর কোনও ক্ষতি করবে না। বিশ্বাসই হচ্ছিল না পিয়ার যে কয়েক ঘণ্টা হয়েছে মাত্র ও উলটে পড়েছিল জলে ওই লঞ্চটা থেকে। ঘটনাটা মনে পড়তেই সারা শরীর কেঁপে উঠল পিয়ার। চোখ বুজতেই মনে হল আবার যেন জল চেপে ধরেছে ওকে চারদিক থেকে, ও যেন সেই অদ্ভুত উজ্জ্বল অতলে তলিয়ে যাচ্ছে ফের, যেখানে সূর্যের আলোর কোনও দিকদিশা নেই, যেখানে বোঝা যায় না কোনদিকে গেলে ওপরে ওঠা যাবে আর কোনদিকে গেলে ডুবে যাবে নিতল গভীরে।

.

পিয়ার মনে হল নৌকোটা যেন নড়ছে ওর শরীরের নীচে। বুঝতে পারছিল কাঁপুনি হচ্ছে ওর। একের পর এক লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, এমন সময় কাঁধের কাছে একটা ঠান্ডা, দৃঢ় হাতের স্পর্শ পেল পিয়া। অদ্ভুত ভাবে, এই ছোঁয়াটাও ওকে সেই পড়ে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। ফকির এসেছে–বুঝতে পারল ও। চোখ মেলে দেখল উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে ফকির চেয়ে আছে ওর মুখের দিকে। একটু হাসার চেষ্টা করল পিয়া, কিন্তু খিচুনির মতো কাঁপছে সারা শরীর, তাই মুখবিকৃতির মতো দেখাল হাসিটা। ও বুঝতে পারল ফকিরের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যাচ্ছে, তাই ওর হাতের ওপর একটা হাত রাখল। হাতটা ধরে নিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়ল ফকির, লম্বা হয়ে। ওর শরীরের লোনা, রোদে-পোড়া গন্ধ এখন পিয়ার নাকে; দু’জনের মধ্যে ব্যবধান বলতে একটা চাদর, সেটা ভেদ করে ফকিরের পাঁজরগুলি অনুভব করতে পারছিল পিয়া। ফকিরের গায়ের ওমে ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠল চাদরটা, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থিরথিরে কাঁপুনির ভাবটা থিতিয়ে এল আস্তে আস্তে। কাঁপুনি থামতে একটু অপ্রতিভ হয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল পিয়া। ফকিরও ছিটকে উঠে পড়ল। পিয়া বুঝতে পারছিল একই রকম অপ্রস্তুত বোধ করছে ও-ও। কী করে বোঝানো যায় ফকিরকে যে সব ঠিক আছে, কিছু মনে করেনি পিয়া, ভুল বোঝেনি ওকে? ভেবে পেল না পিয়া। সশব্দে গলা পরিষ্কার করল একবার, তারপর শুধু বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ”। ঠিক সেই সময়েই, যেন এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করার জন্য ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল টুটুল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে ছইয়ের ভেতর ঢুকে গেল ফকির, ছেলেকে শান্ত করতে।

পুঁটুলি পাকানো শাড়িটার ওপর আবার মাথা নামাল পিয়া। মনে হল কাপড়টার ভাজে ভজে ওটার মালিকের গন্ধ পাচ্ছে ও। যেন হঠাৎ সে সশরীরে উপস্থিত হয়েছে এই নৌকোর ওপর। ভেবে ভাল লাগল পিয়ার, ফকিরকে যা বলতে চেয়েছিল একই কথা বলতে পারবে তাকেও –অনৈতিক কিছু করেনি ওরা, কিছু ঘটেইনি আদতে।

কীই বা ঘটতে পারত? ফকিরের বিষয়ে খুব একটা কিছু জানে না পিয়া, কিন্তু এটুকু তো বোঝা গেছে যে ও বিবাহিত এবং ওর একটা বাচ্চা আছে। আর নিজের সম্পর্কেও এটা অন্তত বলতে পারে পিয়া যে এরকম ব্যক্তিগত কোনও জটিলতায় জড়ানোর কথা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। ও একটা কাজের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে, এ জায়গাটা প্রকৃতপক্ষে ওর কর্মক্ষেত্র। আর ব্যক্তিগত সম্পর্কের থেকে দূরে থাকলেই একটা জায়গা কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। দুয়ের মধ্যে যে ভেদরেখা সেটার পবিত্রতায় বিশ্বাস করে পিয়া; নিজের কাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে সে রেখা ও কিছুতেই পেরোতে পারবে না।

.

সকালে যখন ঘুম ভাঙল পিয়ার নৌকো ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। চোখ খুলে দেখে রাতের ঠান্ডা বাতাস আর নদীর গরম জলের ধাক্কায় ধাক্কায় জমে ওঠা কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আছে চারদিক। নিজের পাটুকু পর্যন্ত কোনওরকমে দেখতে পাচ্ছিল পিয়া; গায়ের চাদরটা চুপচুপে ভিজে গেছে হিমে। পুব আকাশে একটা আবছা আভা দেখে শুধু বোঝা যাচ্ছিল যে সূর্য উঠেছে। এই আলোতেও কী করে নৌকো চালাচ্ছে ফকির ভেবে একটু আশ্চর্য হল পিয়া। বোঝাই যাচ্ছে এই জলের রাস্তা ওর মুখস্থ প্রায়, তাই এই ঝুম কুয়াশাতেও নদী-খাঁড়ির কিনারা বুঝে বুঝে ডিঙি চালিয়ে নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না।

উঠে পড়ার কোনও তাড়া ছিল না, তাই আবার আরামে চোখ বুজল পিয়া। একটু পরে হঠাৎ থেমে গেল নৌকোটা। পিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখল কুয়াশা এখনও বেশ ঘন, চারপাশের জল জঙ্গল কিছুই নজরে আসছে না। ডিঙির পেছনের দিক থেকে নোঙর নামানোর শব্দ কানে এল এবার। পিয়া একটু অবাক হল। এরকম একটা জায়গায় এনে কেন নোঙর ফেলছে ফকির? কুয়াশার জন্যই হবে নিশ্চয়ই। হয়তো বড় নদীতে কি মোহনায় এসে পড়েছে, ভাল করে না দেখে আর দিক ঠিক করা যাচ্ছে না।

আবার ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছিল পিয়া, হঠাৎ একটা আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে বসল সোজা হয়ে। ভাল করে শোনার জন্য হাত রাখল কানের পেছনে। আবার সেই আওয়াজ! ছলাৎ করে জলের শব্দ একটু, তারপর একটা চাপা নাক ঝাড়া দেওয়া শব্দ। যেন খুব মোটা রুমালের মধ্যে কেউ নাক পরিষ্কার করছে।

“আশ্চর্য!” ছিটকে উঠে হাঁটু গেড়ে বসল পিয়া, কুয়াশায় কান পেতে শুনতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। মিনিট কয়েক ভাল করে শুনে বোঝা গেল বেশ কয়েকটা ডলফিন ঘোরাঘুরি করছে নৌকোর চারপাশে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা দিক থেকে আসছিল শব্দগুলো, জায়গা বদলাচ্ছিল মুহূর্তে মুহূর্তে। কয়েকটা আওয়াজ খুব ক্ষীণ, মনে হয় যেন কিছুটা দূর থেকে আসছে; কয়েকটা আবার বেশ স্পষ্ট, ধারে কাছেই। দিনের পর দিন কাটিয়েছে পিয়া এই চাপা ঘোঁতঘোঁত আওয়াজ শুনে, ও জানে একমাত্র ইরাবড়ি ডলফিন, মানে ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস ই পারে এরকম আওয়াজ করতে। অর্থাৎ একটা ওর্কায়েলার ঝক এই পথ দিয়ে যেতে যেতে নৌকোটাকে দেখে একটু থেমেছে এখানে। আর এমনই পিয়ার কপাল যে ঘটনাটা এমন একটা সময় ঘটছে যখন ও নিজের হাতের তেলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। আগের আগের অভিজ্ঞতা থেকে পিয়া জানে যে মিনিট কয়েক পরেই অস্থির হয়ে উঠবে ডলফিনগুলো। হয়তো ওর যন্ত্রপাতি বের করতে করতেই ওরা চলে যাবে দূরে।

“ফকির!” ও-ও শুনেছে কিনা আওয়াজগুলো সেটা বোঝার জন্য চাপা গলায় ডাকল পিয়া। একটু দুলে উঠল নৌকোটা। বুঝল ফকির এগিয়ে আসছে। তাও চমকে গেল পিয়া ওকে দেখে : কাঁধের কাছে ঘেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশায় মনে হল ওর মাথাটা যেন ভাসছে শূন্যে, একটা মেঘের ওপর।

“লিসন,” শব্দগুলোর দিকে ইশারা করে কানের পেছনে একটা হাত রেখে বলল পিয়া। মাথা নাড়ল ফকির, কিন্তু অবাক হল না; যেন এই ডলফিনের ঝকের সঙ্গে দেখা হওয়াটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, ও যেন আগে থেকেই জানত যে ওগুলি থাকবে এখানে। তা হলে ও কি রাত থেকে এদিকেই আসছিল, পিয়াকে ডলফিন দেখাবে বলে?

আরও গুলিয়ে গেল পিয়ার মাথাটা। ফকির করে জানবে যে ঠিক এই সময়ে এই এক ঝাক ওর্কায়েলা আসবে এখানে? হতে পারে নদীর এ জায়গাটায় ডলফিনের ঝাক মাঝে মাঝে আসে, কিন্তু তাও, আজকে এই সময়টাতেই যে ওরা এখানে থাকবে সেটা ও জানবে কী করে? আর যাই হোক, এরকম ভ্রাম্যমাণ শুশুকের ঝুঁকের চলাফেরার ঠিক ঠিকানা আগে থেকে অনুমান করা তো অসম্ভব ব্যাপার, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না। যাক গে, এখন এসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আপাতত এই কুয়াশার মধ্যেই যতটা পারা যায় তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে।

হাতে সময় বেশি নেই যদিও, কিন্তু ব্যাগ থেকে কাজের যন্ত্রপাতি বের করার সময় পিয়া খুব ধীর এবং গোছানো। একগোছা ডেটাশিট বের করে ক্লিপবোর্ডে আটকাতে যাবে, ঠিক সেই সময় মাত্র মিটার খানেক দূরে ভেসে উঠল একটা ডলফিন। এত কাছে যে ওটার নিশ্বাসের সঙ্গে ফোয়ারার মতো বিন্দু বিন্দু জল এসে লাগল পিয়ার গায়ে। পিঠের পাখনা আর ভোঁতা নাকটা একবারের জন্য দেখা গেল। সন্দেহের আর কোনও জায়গা নেই, এগুলো ওর্কায়েলা-ই।

কোনওই ভুল নেই। যদিও শুরু থেকেই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল পিয়া সে ব্যাপারে, তাও এবার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে গেল। নৌকোর এত কাছে ভেসে উঠেছিল শুশুকটা, যে জিপিএস মনিটরটা হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেই রিডিং নিয়ে নিল পিয়া। ডেটাশিটে সংখ্যাগুলো লেখার সময় যেন একটা যুদ্ধজয়ের আনন্দ হচ্ছিল ওর–এক্ষুনি, এই মুহূর্তেও যদি চলে যায় ডলফিনগুলো, এই ছোট্ট কাগজের টুকরোটায় তো ধরা থেকে গেল এই তথ্যপ্রমাণ।

এর মধ্যে পাতলা হয়ে এসেছে কুয়াশা। ভাটাও শেষ হতে চলল প্রায়; কয়েকশো মিটার দূরেই ডাঙা দেখা যাচ্ছে। পিয়া লক্ষ করল ফকির নৌকোটা যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে, সেটা একটা বাঁকের মুখ। পাড়টা এখানে এসে একটা ভাঁজ করা হাতের মতো বেঁকে গেছে। ফলে কনুইয়ের বাঁকটায় একটা নিস্তরঙ্গ এলাকা তৈরি হয়েছে নদীর মধ্যে। আর ঠিক এই স্থির গভীর জায়গাটার মধ্যেই এসে নোঙর ফেলেছে ফকির। খানিকটা বুমেরাং-এর মতো দেখতে এই দহটা লম্বায় প্রায় এক কিলোমিটার। এই জায়গাটুকুতেই, যেন অদৃশ্য একটা পুকুরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ওই ডলফিনগুলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের কুয়াশা আর রাতের ঠান্ডা সুদূর স্মৃতির মতো কোথায় মিলিয়ে গেল। উঁচু বাঁধ আর ঘন জঙ্গলের বাধা পেরিয়ে কোনও হাওয়াও আসতে পারছে না নদী পর্যন্ত। স্থির জলের বুকে নদীর মধ্যে যেন আর একখানা সূর্য জ্বলছে। ওপরের মেঘহীন আকাশ থেকে আগুনের হলকা নামছে, জলের বুক থেকেও ঠিকরে উঠে আসছে তাপ। পারা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁসফাস করতে করতে মাটির নীচের জীবনপ্রবাহ উঠে আসছে পাড়ের কাদায়। পালে পালে কঁকড়া চলে বেড়াচ্ছে সেখানে, ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর রেখে যাওয়া পাতা আর অন্যান্য রসালো আবর্জনার ওপর।

দুপুর পর্যন্ত ডেটা যা জোগাড় হল তাতে ঝকটায় কটা ডলফিন আছে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই আন্দাজ করা চলে। পিয়া হিসাব করে দেখল সব মিলিয়ে সাতটা। তার মধ্যে একটা জোড়া মনে হচ্ছে একসাথে সাঁতরাচ্ছে আর মোটামুটি একই সঙ্গে ভেসে উঠছে। জোড়াটার একটা ডলফিন দলের অন্যগুলোর চেয়ে মাপে একটু ছোট। ওটা নিশ্চয়ই একটা ছানা; একেবারে কচি বাচ্চাও হতে পারে। হয়তো এখনও মাকে ছেড়ে নিজে নিজে আলাদা সাঁতরানোর বয়স হয়নি। পিয়া দেখল ছানাটা বার বার পাক খেতে খেতে উঠে আসছে জলের তলা থেকে, ছোট্ট মাথাটা ভেসে উঠছে জলের ওপর–মানে এখনও ঠিকমতো শ্বাস নিতেও শেখেনি ওটা। যতবার ওই কচি মাথাটা ভেসে উঠছিল, আনন্দে নেচে উঠছিল পিয়ার মনটা : তার মানে ওর্কায়েলারা এখনও বংশবৃদ্ধি করছে এখানে।

সাঁতার কেটেই যাচ্ছে শুশুকগুলো, বাঁকের মুখটা ছেড়ে অন্যদিকে যাচ্ছেই না প্রায়। নদীর ওই ছোট্ট গভীর অংশটার মধ্যে পাক খেয়ে যেতেই যেন ভাল লাগছে ওদের। নৌকোটার জন্য যে ওরা এখানে ঘুরঘুর করছে তাও নয়; যেটুকু আগ্রহ নৌকোটার প্রতি ওদের ছিল সে কখন ফুরিয়ে গেছে।

তা হলে কীসের জন্য ঘুরছে ডলফিনগুলো এখানে? এ জায়গাটায় ওরা এসেছেই বা কেন, আর কীসের জন্যই বা অপেক্ষা করছে? খুবই গোলমেলে সমস্যা। পিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে খুব কৌতুলহজনক কিছু একটা ঘটছে এখানে; এমন কিছু, যা থেকে ইরাবড়ি ডলফিন এবং তাদের স্বভাব সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য জানা যেতে পারে। ওকে শুধু মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হবে রহস্যটা কী।

.

মরিচঝাঁপি

সবে ভোর হয়েছে। জানালায় পর্দা নেই, তাই নরম রোদে ধুয়ে যাচ্ছে ঘরটা। সাতসকালেই ঘুম ভেঙে গেল কানাইয়ের। মুখহাত ধুয়ে জামাকাপড় পালটে একটু বাদে নীচে নেমে এল ও। টোকা দিল নীলিমার দরজায়।

“কে?” কেমন যেন কাঁপা কাঁপা শোনাল মাসির গলাটা।

“আমি–কানাই।”

“আয়। ভোলাই আছে দরজা।” ঘরে ঢুকে কানাই দেখল পিঠের কাছে কয়েকটা বালিশ জড়ো করে তাতে ঠেস দিয়ে বসে আছে নীলিমা। পায়ের ওপর বড় একটা লেপ ফেলা রয়েছে অগোছালো ভাবে। চোখদুটো কুঁচকে রয়েছে, যেন দেখতে পাচ্ছে না ভাল করে। বিছানার পাশের টেবিলে এক কাপ চা আর একটা প্লেটে মারি বিস্কুট চার-পাঁচটা। ঘরে জামাকাপড় বা নীলিমার নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্র বলতে কিছুই নেই; শুধু বই আর ফাইলপত্র ঠাসা বিছানায়, মেঝেতে, এমনকী মশারির পুঁটলির ওপরে পর্যন্ত। খুবই সাদামাটা কেজো চেহারার ঘর, আসবাব বলতে প্রধানত কয়েকটা বইয়ের আলমারি আর ফাইল ক্যাবিনেট। নীলিমার বড় খাটটা না থাকলে এটাকে ট্রাস্টের আর-একটা অফিসঘর বলে ভুল হতে পারত।

“তোমাকে কিন্তু অসুস্থ দেখাচ্ছে মাসি, কানাই বলল। “ডাক্তারকে খবর দিয়েছ?” হাতের রুমালটায় একবার নাক ঝাড়ল নীলিমা। “ওই সর্দি লেগেছে একটু। সেটা বলে দিতে আবার ডাক্তার কেন লাগবে?”

“যাই বল মাসি, তোমার কাল ক্যানিং-এ যাওয়াটা ঠিক হয়নি,” বলল কানাই। “ধকলটা একটু বেশি হয়ে গেছে। শরীরের দিকে আরেকটু নজর দিতে হবে তোমাকে।”

হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে কথাটা উড়িয়ে দিল নীলিমা। “ছাড় তো আমার কথা। তোর কথা বল। আয়, এখানে এসে বোস। ভাল ঘুম হয়েছিল তো রাত্তিরে?”

“তোফা।”

“আর প্যাকেটটা?” নীলিমার গলায় আগ্রহ ঝরে পড়ছে। “ওটা পেয়েছিস তো?”

“হ্যাঁ। যেখানে বলেছিলে সেখানেই রাখা ছিল।”

“বল না রে কী আছে ওটায়? গল্প না কবিতা?”

মাসির গলায় প্রত্যাশার সুরটুকু কানাইয়ের কান এড়াল না। ও বুঝতে পারছিল নীলিমার বিশ্বাস এমন কিছু আছে ওই প্যাকেটটায় যাতে মৃত্যুর পরেও তার স্বামীর সাহিত্যিক খ্যাতি নতুন করে ছড়িয়ে পড়বে। মাসিকে নিরাশ করতে খারাপ লাগছিল কানাইয়ের। যতটা সম্ভব নরমভাবে ও বলল, “আসলে আমি যা ভেবেছিলাম সেরকম কিছু নেই ওটায়। আমার মনে হয়েছিল হয়তো গল্প কি কবিতা বা প্রবন্ধ-টবন্ধ থাকবে, কিন্তু যেটা আছে সেটা একটা ডায়ারি বা জার্নাল মতো। সাধারণ একটা খাতায় লেখা, স্কুলের বাচ্চারা যেমন খাতা ব্যবহার করে সেরকম।”

“ও, তাই?” ম্লান হয়ে এল নীলিমার চোখ। একটা আশাভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে। “কোন সময়কার লেখা রে? তারিখ-টারিখ কিছু আছে?”

“হ্যাঁ। ১৯৭৯-তে লেখা,” কানাই বলল।

“১৯৭৯?” এক মুহূর্ত চুপ করে কী ভাবল নীলিমা। “কিন্তু সে বছরই তো ও মারা গেল। জুলাই মাসে। তুই ঠিক দেখেছিস? ওই বছরেই লেখা ওটা?”

“হ্যাঁ,” বলল কানাই। “কেন আশ্চর্য হচ্ছ তুমি?”

“বলছি,” নীলিমা বলল। “কারণ সে বছরটায় একেবারে লেখালিখির ধার দিয়েই যায়নি নির্মল। তার আগের বছরই ও রিটায়ার করল লুসিবাড়ি স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে। তার পর থেকেই ওর সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। আমরা লুসিবাড়ি চলে আসার পর থেকেই, মানে প্রায় তিরিশ বছর ধরে ওই স্কুলটাই ছিল ওর প্রাণ। রিটায়ার করার পর থেকেই কেমন একটা যেন হয়ে গেল ও। আগেও ওর একটা মানসিক সমস্যা ছিল, সে তো জানিসই, তাই সব সময় খুব চিন্তায় থাকতাম আমি। দিনের পর দিন কোথায় উধাও হয়ে যেত, ফেরার পর আর মনেও করতে পারত না কোথায় গিয়েছিল। খুবই অস্থিরতার মধ্যে কেটেছিল সে বছরটা ওর। লেখার মতো অবস্থাতেই ছিল না।”

“হয়তো খানিকটা সময়ের জন্য সুস্থিতি ফিরে এসেছিল কখনও একটা,” বলল কানাই। “আমার এক ঝলক দেখে যা মনে হল, গোটা খাতাটা একদিনে, বা খুব বেশি হলে দু’দিনে লেখা।”

“তারিখটা লিখেছে কি?” খুঁটিয়ে কানাইকে নজর করতে করতে জিজ্ঞেস করল নীলিমা।

“লিখেছে,” কানাই বলল। “মেসো ওটা লিখতে শুরু করেছিল ১৯৭৯ সালের ১৫ মে সকালবেলা। মরিচঝাঁপি বলে একটা জায়গায়।”

“মরিচঝাঁপি!” শব্দটা বলতে গিয়ে হঠাৎ একটা শ্বাস টানল নীলিমা।

“হ্যাঁ, কানাই বলল। “সেখানে কী হয়েছিল বলো তো আমায়।”

নীলিমা বলতে শুরু করল। মরিচঝাঁপি এই ভাটির দেশেরই একটা দ্বীপ। লুসিবাড়ি থেকে নৌকোয় কয়েক ঘণ্টার পথ। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের আওতায় ছিল দ্বীপটা, কিন্তু এ ধরনের অন্য দ্বীপগুলোর মতো দুর্গম ছিল না। ১৯৭৮ সালে একটা সময় হঠাৎ বহু মানুষ এসে হাজির হল মরিচঝাঁপিতে। যে দ্বীপে মানুষের কোনও বসতি ছিল না, প্রায় রাতারাতি হাজার হাজার লোক এসে থাকতে শুরু করল সেখানে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা বাদাবন সাফ করে, বাঁধ তৈরি করে, শত শত কুঁড়ে বানিয়ে ফেলল। এত তাড়াতাড়ি পুরো ব্যাপারটা ঘটল, শুরুতে তো কেউ জানতেই পারেনি এ লোকগুলো কারা, কোথা থেকে এসে উদয় হল এখানে। আস্তে আস্তে জানা গেল ওরা হল বাংলাদেশি রিফিউজি। অনেকে সেই পার্টিশনের সময় এসেছিল, অনেকে আবার পরে বিভিন্ন সময় বর্ডার পেরিয়ে এসে ঢুকেছে। একেবারে হতদরিদ্র সব মানুষ, বাংলাদেশে মুসলমানদের আর উঁচু জাতের হিন্দুদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে চলে এসেছে এপারে।

“বেশিরভাগই ছিল আমরা এখন যাদের দলিত বলি সেরকম,” নীলিমা বলল। “তখন বলা হত হরিজন।”

মরিচঝাঁপিতে আসার সময় কিন্তু এরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসেনি; তখন ওরা পালাচ্ছিল মধ্য ভারতের একটা সরকারি পুনর্বাসন শিবির থেকে। এই শিবির ছিল মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে। পশ্চিমবাংলা থেকে বেশ কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। পার্টিশনের পর পরই তখনকার ওই পূর্ব পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের অনেককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে।

“সরকার তো ওগুলোকে বলত ‘পুনর্বাসন’ শিবির, কিন্তু লোকে বলত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, জেলখানা,” বলল নীলিমা। “ওই উদ্বাস্তুদের সব সময় পাহারা দিয়ে রাখত নিরাপত্তারক্ষীরা, ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জো ছিল না। কেউ পালালে ঠিক খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনা হত তাকে।”

ক্যাম্পগুলো যেখানে বানানো হয়েছিল সেখানকার মাটি ছিল পাথুরে, বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে তার কোনও মিল ছিল না। উদ্বাস্তুরা ওখানকার ভাষা বলতে পারত না, আর স্থানীয় লোকেরাও মনে করত ওদের ওখানে থাকার কোনও অধিকার নেই, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। মাঝে মাঝেই তারা তির ধনুক আর মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উদ্বাস্তুদের ওপর হামলা চালাত। অনেক বছর ধৈর্য ধরে ওই ক্যাম্পে ছিল মানুষগুলো। অবশেষে ১৯৭৮-এ কিছু লোক জোট বেঁধে পালাল ওখান থেকে। ট্রেনে করে, পায়ে হেঁটে ওরা পুবদিকে চলতে শুরু করল। ভাবল সুন্দরবনে গিয়ে বসত করবে। মরিচঝাঁপিতে আসবে বলেই ঠিক করে রেখেছিল ওরা।

তার কিছুদিন আগেই বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে পশ্চিমবঙ্গে; রিফিউজিরা ভেবেছিল এই সরকার তাদের বিশেষ কিছু বলবে না। কিন্তু এইখানেই হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল ওদের। সরকার বলল মরিচঝাঁপিকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেখান থেকে উঠে যেতেই হবে উদ্বাস্তুদের। প্রায় বছর খানেক ধরে বার বার রিফিউজিদের সংঘর্ষ হল সরকারি লোকেদের সঙ্গে।

“আর শেষ ঝামেলাটা হয়েছিল,” বলল নীলিমা, “আমার যদূর মনে পড়ছে, ওই ১৯৭৯-র মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে।”

“মানে তুমি বলছ ওই গণ্ডগোলটা যখন হয়েছিল মেসো তখন ওখানে ছিল?” এক মুহূর্ত থেমে গেল কানাই। আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে হল ওর। “নাকি পুরোটাই কল্পনা?”

“জানি না রে কানাই,” অন্যমনস্ক ভাবে নিজের হাতের দিকে চেয়ে বলল নীলিমা। “সত্যি জানি না। সে বছরটায় যেন একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল নির্মল। আমার সঙ্গে কথা বলত না, কথা লুকিয়ে রাখত। এমন ব্যবহার করত যেন আমি ওর শত্রুপক্ষের লোক।” কানাই দেখতে পাচ্ছিল আরেকটু হলেই কেঁদে ফেলবে নীলিমা। মাসির জন্য খুব খারাপ লাগছিল ওর। “খুব কষ্টে কেটেছে সে সময়টা তোমার,?”

“খুব কষ্টে রে,” নীলিমা বলল। “মরিচঝাঁপি নিয়ে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল মানুষটা। আমার ভাল লাগত না। বুঝতে পারছিলাম একটা ঝামেলা হতে যাচ্ছে ওখানে; নির্মলকে তার থেকে দূরে রাখতে চাইছিলাম আমি।”

কানাই মাথা চুলকাল একবার। “একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না। এই ব্যাপারটা নিয়ে এত কেন ভাবছিল মেসো?”

একটু সময় নিয়ে জবাবটা দিল নীলিমা। “একটা জিনিস ভুলে যাস না কানাই, কম বয়সে বিপ্লবের কথা ভাবতে ভালবাসত নির্মল। পার্টি বা পুরনো কমরেডদের থেকে সরে এলেও এরকম লোকেরা জীবনে সেসব কথা ভুলতে পারে না। বুকের মধ্যে থেকে গোপন ঈশ্বরের মতো সে চিন্তা ওদের চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়, ওদের প্রাণশক্তির কাজ করে। যন্ত্রণার মধ্যে, বিপদের মধ্যে ওরা আনন্দ পায়। মেয়েদের কাছে সন্তানের জন্ম দেওয়ার অনুভূতি যে রকম, ভাড়াটে যোদ্ধাদের কাছে যুদ্ধ যে রকম, বিপ্লবের চিন্তায়, আপদ বিপদের মধ্যে সেই রকম অনুভূতি হয় ওদের।”

“কিন্তু মরিচঝাঁপিতে যারা এসেছিল তারা তো আর বিপ্লব করছিল না।”

“না,” বলল নীলিমা। “একেবারেই না। ওদের উদ্দেশ্য ছিল একেবারে সোজাসাপটা। ওরা শুধু মাথা গোঁজার জন্য একটু জমি চেয়েছিল। কিন্তু তার জন্য সরকারের সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত ছিল ওরা। একদম শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের জন্য ওরা তৈরি ছিল। তাই যথেষ্ট। তার মধ্যেই বিপ্লবের কাছাকাছি পৌঁছনোর একটা রাস্তার ছায়া দেখতে পেয়েছিল নির্মল। ওদের লড়াইয়ে তাই অংশ নিতে চেয়েছিল ও। খানিকটা হয়তো নিজের বয়সটাকে ভুলে থাকার ইচ্ছেও কাজ করছিল এর পেছনে।”

মেসোর চেহারাটা কানাইয়ের চোখে ভাসছিল। ওই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শান্ত নম্র মানুষটাকে ঠিক বিপ্লবী বলে কিছুতেই ভাবতে পারছিল না ও। “তুমি কখনও বোঝাতে চেষ্টা করেছিলে মেসোকে?”

“করিনি আবার?” নীলিমা বলল। “কিন্তু শুনলে তো! আমাকে বলত, “তুমিও ওই সরকারি লোকেদের মতো হয়ে গেছ, ওদের মতো করে ভাবছ। এই যে সমাজসেবা করে যাচ্ছ এত বছর ধরে, সেজন্যেই তোমার দৃষ্টিভঙ্গি এরকম পালটে গেছে। সেইজন্যেই এরকম সব চিন্তা আসছে তোমার মাথায়। আসল ব্যাপারগুলোই আর চোখে পড়ছে না তোমার।” সারা জীবন ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা ওর কাজকে কেমন এককথায় উড়িয়ে দিয়েছিল নির্মল সে কথা মনে করে একবার চোখ বন্ধ করল নীলিমা। গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে নিতে মাথাটা ঘুরিয়ে নিল ও। “আমরা দু’জন যেন দুটো ভূতের মতো বাস করছিলাম একটা বাড়িতে। শেষের দিকটায় আমাকে যেন শুধু কষ্ট দিতেই ভাল লাগত ওর। আচ্ছা ভাব, অন্য কী কারণ থাকতে পারে তা ছাড়া এই খাতাটা আমাকে না দিয়ে তোকে দিয়ে যেতে চাওয়ার?”

“কী বলব বুঝতে পারছি না।” কানাই ভেবেছিল খাতাটা ওকে দিয়ে যাওয়ার কারণ হল ওর সঙ্গেই শুধু বাইরের বধির জগৎটার একটা যোগসূত্র আছে বলে মনে করেছিল মেসো। এক মুহূর্তের জন্যেও ওর মনে হয়নি যে নীলিমার মনে ব্যথা দিতে চেয়েছিল নির্মল। ব্যাপারটা ভেবেই একটু শিউরে উঠল কানাই। বরাবরই মেসোকে একটু খ্যাপাটে মানুষ বলে জানে ও, কিন্তু তার মধ্যে কোনও নিষ্ঠুরতা আছে বলে কখনওই মনে হয়নি। আর নীলিমার প্রতি নিষ্ঠুর হবে নির্মল সে তো ও স্বপ্নেও ভাবেনি কখনও। আর সকলের মতো কানাইও এতদিন জানত যে বেশ ভালই ছিল ওদের দুজনের জীবন; ঠিক রাজযোটক যাকে বলে তা না হলেও, সুখী দম্পতিই ছিল ওরা। এখন ও বুঝতে পারল নির্মল লুসিবাড়ি ছেড়ে বেরোত না বলেই এই ধারণাটা ওদের কোনওদিন বদলায়নি।

কী কষ্টের মধ্যে মাসিকে এতগুলো বছর কাটাতে হয়েছে ভেবে কী যেন একটা দলা

পাকিয়ে উঠছিল কানাইয়ের গলার ভেতরে। “শোনো,” দাঁড়িয়ে উঠল কানাই, “আমি এক্ষুনি তোমাকে খাতাটা এনে দিচ্ছি। তুমি রেখে দাও, ফেলে দাও–যা ইচ্ছে করো। ওটা আমার কোনও দরকার নেই।”

“না, কানাই!” নীলিমা যেন চেঁচিয়ে উঠল। “বোস, বোস।” হাতটা ধরে টেনে ওকে। চেয়ারে বসাল নীলিমা। “কানাই, আমার কথাটা একবার শোন। আমি সব সময় নির্মলের প্রতি আমার কর্তব্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ওর শেষ ইচ্ছের যাতে অসম্মান না হয় সেটা দেখাটাও খুব বড় ব্যাপার আমার কাছে। আমি জানি না কেন নির্মল ওটা তোকে দিয়ে যেতে চেয়েছিল, ওটায় কী আছে তাও জানি না আমি, কিন্তু ওর ইচ্ছাটা আমাকে রাখতেই হবে।”

চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় মাসির পাশে গিয়ে বসল কানাই। ওর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল কুসুমের প্রসঙ্গটা তুলতে, কিন্তু আর কোনও উপায় দেখল না ও। “আচ্ছা,” খুব আস্তে বলল কানাই, “তোমার কি মনে হয় কুসুমের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আছে ব্যাপারটার?”

নামটা শুনেই যেন একটু কুঁকড়ে গেল নীলিমা। “হ্যাঁ কানাই, এরকম একটা গুজব সে সময় শোনা গিয়েছিল। সেটা অস্বীকার করব না।”

“কিন্তু মরিচঝাঁপিতে কী করতে গিয়েছিল কুসুম?”

“কী করে কী ঘটেছিল সে আমি জানি না, কিন্তু সে সময় কুসুম ছিল মরিচঝাঁপিতে।”

“যে সময়টায় ও ওখানে ছিল তার মধ্যে কুসুমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমার?” কানাই জিজ্ঞেস করল।

ঘাড় নাড়ল নীলিমা। “হ্যাঁ, একবার মাত্র। দেখা করতে এসেছিল ও আমার সঙ্গে। এই ঘরেই।”

একদিন সকালবেলা–১৯৭৮ সালে–এসেছিল ও। নীলিমা তখন নিজের টেবিলে বসে কাজ করছে। একজন নার্স এসে বলল কে যেন দেখা করতে এসেছে, বলছে নাকি নীলিমাকে চেনে। কী নাম জিজ্ঞেস করতে বলতে পারল না নার্সটি। “ঠিক আছে,” বলল নীলিমা, “নিয়ে এসো এখানে।” খানিক পরে দরজা খুলে ভেতরে এল একটি কমবয়সি মহিলা, সঙ্গে একটা বছর চার-পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে। মহিলার বয়স মনে হল খুব বেশি হলে বছর কুড়ি-বাইশ হবে। কিন্তু সাদা শাড়ি পরা, শাঁখা-সিঁদুর কিছু নেই। অন্য কোথাও হলে দেখেই বোঝা যেত বিধবা, কিন্তু লুসিবাড়িতে সেটা বলা কঠিন।

চেনা চেনা লাগছিল নীলিমার। মুখটা ততটা নয়, কিন্তু চোখদুটো আর তাকানোর ভঙ্গিটা খুব পরিচিত মনে হল। কিন্তু নামটা ও কিছুতেই মনে করতে পারল না। মেয়েটি এসে প্রণাম করল পা ছুঁয়ে। নীলিমা বলল, “তুমি কে বলো তো মা?”

মেয়েটি বলল, “আমাকে চিনতে পারছেন না মাসিমা? আমি কুসুম।”

“কুসুম!” প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওকে বকতে শুরু করল নীলিমা। “কোথায় ছিলি বল তো এতদিন? কোনও খোঁজ নেই, খবর নেই। কত খুঁজেছি জানিস তোকে আমরা?”

হেসে ফেলল কুসুম। “কত কী হয়ে গেছে মাসিমা এর মধ্যে। একটা-দুটো চিঠিতে অত কিছু ধরতই না।”

ও উঠে দাঁড়াতে নীলিমা দেখল পুরোদস্তুর শক্ত সমর্থ ঝকঝকে চোখের মহিলা হয়ে উঠেছে কুসুম। “এই ছেলেটা কে রে, কুসুম?”

“আমার ছেলে,” জবাব দিল কুসুম। “ওর নাম ফকির–ফকিরচাঁদ মণ্ডল।”

“আর ওর বাবা?”

“ওর বাবা মারা গেছে মাসিমা। আমিই এখন ওর সব।”

নীলিমা দেখে খুশি হল এই অকালবৈধব্য কুসুমের মুখের হাসিটা কেড়ে নিতে পারেনি। “বল এবার, এখানে কেন এসেছিস?”

তখন কুসুম বলল যে ও মরিচঝাঁপিতে থাকে। ও এসেছে নীলিমাকে বলতে যদি ওখানকার জন্য লুসিবাড়ি থেকে ডাক্তার, ওষুধ কিছু পাঠানো যায়।

সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে গেল নীলিমা। বলল মেডিকেল টিম পাঠাতে পারলে খুবই খুশি হত ও, কিন্তু সেটা অসম্ভব। সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে মরিচঝাঁপির জবরদখলিদের উচ্ছেদ করা হবেই। কাজেই ওদের কোনওরকম সাহায্য করতে গেলেই এখন সরকারের কোপে পড়তে হবে। এই হাসপাতাল আর মহিলা সমিতির কথা তো ভাবতে হবে নীলিমাকে। সরকারকে বাদ দিয়ে ও চালাতে পারবে না। বেশি লোকের যাতে মঙ্গল হয় সেভাবেই চলতে হবে নীলিমাকে।

আধঘণ্টা খানেক পর চলে গেল কুসুম। আর কখনও ওকে দেখেনি নীলিমা।

“তার পর তা হলে কী ঘটল?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “কুসুম কোথায় গেল?”

“কোথাও যায়নি রে কানাই, ও তো খুন হয়ে গেল তারপর।”

“খুন?” কানাই জিজ্ঞেস করল। “সে কী? কী করে?”

“ওই ম্যাসাকারের সময়ই মারা গিয়েছিল ও। মরিচঝাঁপি গণহত্যা।”

দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল নীলিমা। “ভীষণ ক্লান্ত লাগছে রে। খানিকটা বিশ্রাম নিলে মনে হয় ভাল লাগবে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *