১-২. খাবার টেবিলে

গাব্বু – কিশোর উপন্যাস – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

খাবার টেবিলে বসে আব্বু এদিক-সেদিক তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু খেতে আসে নাই?”

আব্বুর কথাটা একটা প্রশ্নের মতো শোনালেও এটা আসলে প্রশ্ন না, কারণ দেখাই যাচ্ছে গাব্বু নাই। সে কখনো কোথাও থাকে না। তাকে আনতে হলে প্রথমে ডাকাডাকি করতে হয়, তারপর চেঁচামেচি করতে হয়, সবার শেষে কাউকে গিয়ে তাকে ধরে আনতে হয়। আব্বু ডাকাডাকি শুরু করলেন, “গাব্বু? খেতে আয়।”

গাব্বু কোনো সাড়াশব্দ করল না। তখন আম্মু চিৎকার করলেন, “এই গাব্বু! ডাকছি কথা কানে যায় না?”

এবারেও গাব্বু উত্তর দিল না, উত্তর দেবে সেটা অবশ্যি কেউ আশাও করেনি। টুনি তখন গাব্বুকে ধরে আনার জন্যে উঠে দাঁড়াল তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে গাব্বু নিজেই হাজির হল। সে অবশ্যি এমনি এমনি হাজির হল না, সে হাজির হল ঘুরতে ঘুরতে। দুই হাত দুইদিকে ছড়িয়ে দিয়ে সে সাইক্লোনের মতো ঘুরতে ঘুরতে খাবার টেবিলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

গাব্বুকে এভাবে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে আসতে দেখে কেউই একটুও অবাক হল না, তার কারণ সে সবসময়ই এরকম কিছু না কিছু করছে। তারপরেও আব্বু আর আম্মু অবাক হওয়ার ভান করলেন, আব্বু বললেন, “এটা কী হচ্ছে গাব্বু?”

গাব্বু বলল, “কিছু না।”

আম্মু বললেন, “কিছু না মানে? এভাবে ঘুরছিস কেন?”

গাব্বু কোনো উত্তর দিল না, তখন আম্মু ধমক দিয়ে বললেন, “এভাবে ঘুরলে মাথা ঘুরবে না? থামবি?”

গাব্বু বলল, “এই তো থামছি আম্মু। আর এক সেকেন্ড!”

গাব্বু তখন তখনই থামল না, আরও কিছুক্ষণ পাক খেল। তারপর ঘুরতে ঘুরতে বসার জন্যে এগিয়ে এল। টুনির চেয়ারে ধাক্কা খেল, মিঠুর চেয়ারটা ধরে তাল সামলিয়ে কোনোমতে নিজের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। গাব্বুর মনে হতে থাকে তার সামনে সবকিছু ঘুরছে, তার সাথে সাথে সে নিজেও ঘুরছে। মনে

হতে থাকে সে এক্ষুনি বুঝি উল্টে পড়ে যাবে, তাই সে শক্ত করে টেবিলটা ধরে রাখল যেন তারা পড়ে না যায়। গাব্বু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল, সবাইকে ঝাঁপসা ঝাঁপসা দেখাচ্ছে, আস্তে আস্তে সবাই স্পষ্ট হতে শুরু করল।

সবাই গাব্বুর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, মাথায় উষ্কখুষ্ক চুল, চোখে বড় ফ্রেমের চশমা, চরকির মতো ঘোরার কারণে মুখে লালচে আভা, নাকের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। আব্বু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “গাব্বু, এখানে কী হচ্ছে বলবি?”

গাব্বু হাসি হাসি মুখে বলল, “একটা এক্সপেরিমেন্ট করলাম।”

“সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু কীসের এক্সপেরিমেন্ট?”

গাব্বু সবার দিকে তাকাল, তারপর নিশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা মনে হয় বুঝবে না।”

গাব্বুর বয়স মাত্র বারো, কিন্তু এর মাঝেই তার চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক। সেটি কোনো বড় সমস্যা হওয়ার কথা না, কিন্তু সে যেহেতু প্রতি মুহূর্তেই কোনো না কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করছে এবং তার বেশির ভাগ পরীক্ষার ধকলগুলো বাসার সবাইকে সহ্য করতে হচ্ছে, তাই বাসার সবারই”এক্সপেরিমেন্ট” শব্দটার সাথে একধরনের অ্যালার্জির মতো হয়ে গেছে। তাই যখন গাব্বু তার বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্টের কথা সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে অন্যেরা অনেক সময়ই তার গুরুত্বটা গাবুর মতো করে বুঝতে পারে না।

আব্বু মুখে গাম্ভীর্য ধরে রেখে বললেন, “চেষ্টা করে দেখ, বুঝতেও তো পারি।”

একটা বৈজ্ঞানিক বিষয় বোঝানোর সুযোগ পেয়ে এবারে গাব্বুর চোখ-মুখ ঝলমল করে ওঠে, সে চোখ বড় বড় করে বলল, “তোমরা সবাই নিশ্চয়ই ভাবো যে, কান দিয়ে আমরা শুধু শুনি। এটা সত্যি না।”

মিঠুর বয়স আট, এই বাসায় শুধু মিঠুই এখনো গাব্বুর বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে মাঝে মাঝে একটু উৎসাহ ধরে রাখতে পেরেছে। সে চোখ বড় বড় করে বলল, “আমরা কান দিয়ে দেখি?”

“ধুর গাধা! কান দিয়ে আবার দেখব কেমন করে?”

“তা হলে?”

“কানের ভেতরে ছোট ছোট টিউবের মাঝে একরকম তরল পদার্থ আছে। সেটা ব্রেনের মাঝে সিগন্যাল পাঠায়, সেই সিগন্যাল দিয়ে ব্রেন বুঝতে পারে আমি কোথায় আছি, তাই আমরা পড়ে যাই না। সেই জন্যে কেউ যদি ঘোরে তা হলে কানের ভেতরে ছোট ছোট টিউবের মাঝে যে তরল পদার্থ আছে সেটা ওলট পালট হয়ে যায়। তখন আর ব্যালেন্স থাকে না–মাথা ঘোরায়।”

সবাই একধরনের অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে গাব্বুর দিকে তাকিয়ে রইল, গাব্বু বলল, “তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করলে না? ঘুরে দেখো। ঘুরে দেখো আমার মতো।”

আম্মু বললেন, “অনেক হয়েছে। বাসায় একজন পাগল আছে সেইটাই বেশি। এখন সবাই মিলে পাগল হতে হবে না।”

গাব্বু বলল, “পাগল? পাগল কেন হব? তুমি আসো তোমাকে দেখাই আম্মু! খুব সোজা এক্সপেরিমেন্ট।” গাম্বু আম্মুকে ঘোরানোর জন্যে উঠে দাঁড়াল।

আম্মু মাথা নেড়ে বললেন, “ব্যস! অনেক হয়েছে। তোর এক্সপেরিমেন্টের জ্বালায় আমাদের জীবন শেষ।”

টুনি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “কী বলছ আম্মু তোমাদের জীবন শেষ? তোমাদের জীবন কেন শেষ হবে? জীবন যদি শেষ হয় তা হলে সেটা হচ্ছে আমার!”

টুনি গাব্বু থেকে দুই বছরের বড়। এই বাসায় গাবুর সাথে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয় টুনির। সে ছিমছাম শান্তশিষ্ট মেয়ে, তার সবকিছু নিয়মমাফিক, সাজানো-গোছানো। গাব্বু হচ্ছে ঠিক তার উল্টো। টুনির সব নিয়মকানুন সাজানো-গোছানো ছিমছাম জীবন গাব্বুর কারণে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। টুনি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “গাব্বু কী করে তোমরা তার কিছুই টের পাও না। টের পাই আমি।” বুকে থাবা দিয়ে বলল, “আমি।”

মিঠু পাশে বসে থেকে সমান উৎসাহে বলল, “আর আমি।”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কেন? আমি কী করেছি?”

টুনি বলল, “তুই কী করিসনি? সেইদিন তুই একটা এত্ত বড় গোবদা কোলা ব্যাঙ ঘরের ভেতর নিয়ে আসিসনি? বিছানার নিচে তুই গামলা গামলা পচা জিনিস রেখে দিসনি?”

মিঠু সমান উৎসাহে যোগ দিল, “আমার রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা তুমি নষ্ট করে দাওনি? এখন সামনে পিছে যায় না–শুধু এক জায়গায় ঘোরে।”

টুনি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, “আমার মোবাইল ফোনটা তুই নষ্ট করিসনি? ক্যালকুলেটরের বারোটা বাজিয়ে দিসনি?”

গাব্বু হালকা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। টুনি আর মিঠু যে কথাগুলো বলছে সেগুলো সত্যি, কিন্তু সেগুলো কেন অভিযোগ করার মতো বিষয় সেটা সে বুঝতে পারছে না। কয়েকদিন আগে সন্ধেবেলা বাসায় আসার সময় সে দেখে বিশাল একটা কোলা ব্যাঙ লাইটপোস্টের নিচে বসে মহানন্দে লাইটপোস্টের নিচে পড়ে থাকা পোকা খাচ্ছে। গাব্বুকে দেখে সেই কোলা ব্যাঙ লাফ দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু গাব্বু তাকে ধরে ফেলল। বিশাল সেই কোলা ব্যাঙ তার হাত থেকে পিছলে বের হওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু গাব্বু ছাড়ল না, বাসায় নিয়ে এল। ব্যাঙটাকে দেখে টুনি লাফিয়ে নিজের বিছানায় উঠে আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে। গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

“তুই হাত দিয়ে এত বড় ব্যাঙ ধরে রেখেছিস কেন?”

“পালব।”

“পালবি? কোথায় পালবি?”

“কেন, আমার ঘরে।” বলে সে ব্যাঙটাকে ছেড়ে দিল আর ব্যাঙটা ছাড়া পেয়ে কয়েক লাফ দিয়ে বিছানার নিচে ঢুকে গেল।

টুনি চিৎকার করে বলতে লাগল, “এক্ষুনি ব্যাঙটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আয়, বাইরে ছেড়ে দিয়ে আয় বলছি। না হলে তোকে খুন করে ফেলব।”

গাব্বু কিছুতেই বুঝতে পারল না, কেন একটা ব্যাঙের জন্যে তাকে খুন করে ফেলা হবে। সে দুর্বলভাবে চেষ্টা করল, “আপু, ব্যাঙ খুবই শান্তশিষ্ট। এটা বিছানার নিচে থাকবে, পোকামাকড় খাবে। তুমি তো তেলাপোকাকে খুব ঘেন্না কর, এখন এই ঘরে কোনো তেলাপোকা আসতেই পারবে না। আমার ব্যাঙটা খপ করে খেয়ে ফেলবে।”

টুনি বলল, “তেলাপোকা খাওয়ার জন্যে আমার কোনো সাপ-ব্যাঙের দরকার নাই।”

গাব্বু বলল, “আপু, কুনো ব্যাঙের চোখের নিচে বিষাক্ত গ্ল্যান্ড থাকে। এটা কুনো ব্যাঙ না, এটা কোলা ব্যাঙ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন

টুনি চিৎকার করে বলল, “চাই না আমার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যাঙ–”

চেঁচামেচি শুনে আব্বু আম্মু মিঠু সবাই চলে এল, গাব্বু অবাক হয়ে দেখল, বাসায় সবাই টুনির পক্ষে, কেউই তার পক্ষে নেই একটা কোলা ব্যাঙ পোর পক্ষের যুক্তিটা কেউ দেখতে পেল না। গা তখন খুবই মন খারাপ করে বিছানার নিচে গিয়ে ব্যাঙটাকে ধরে আবার লাইটপোস্টের নিচে ছেড়ে দিয়ে এল। সে এখনো বুঝতে পারে না, কেন তার বাসায় আসার পর সাবান দিয়ে গোসল করতে হল।

বিছানার নিচে গামলা গামলা পচা জিনিস রেখে দেওয়ার কথাটা অবশ্যই অতিরঞ্জন। সে মোটেও গামলা গামলা পচা জিনিস রাখেনি, মাত্র দুটো প্লেটে ময়দা দিয়ে তৈরি লেই রেখে দিয়েছিল। একটার মাঝখানে সে একটু থুথু ফেলেছে, অন্যটা পরিষ্কার। তারপর দুটাই প্লাস্টিক দিয়ে ভালো করে ঢেকে বিছানার নিচে রেখে দিয়েছে। মানুষের মুখের মাঝে লক্ষ লক্ষ ব্যাক্টেরিয়া থাকে, তাই থুথুর সাথে সেই ব্যাক্টেরিয়া ময়দার তৈরি লেইয়ের মাঝখানে জায়গা নিয়েছে। আস্তে আস্তে সেই ব্যাক্টেরিয়াগুলো বাচ্চাকাচ্চা দিয়েছে, নাতিপুতি দিয়েছে। সেই নাতিপুতিদের আবার নাতিপুতি হয়েছে। প্লেটের মাঝে ব্যাক্টেরিয়াদের কী বিচিত্র কলোনি! গাব্বু প্রতিদিন মুগ্ধ হয়ে সেগুলো দেখে–সেখান থেকে ধীরে ধীরে একটা পচা গন্ধ বের হতে শুরু করেছে, কিন্তু সেটা তো হওয়ারই কথা। কে শুনেছে ব্যাক্টেরিয়ার কলোনি থেকে মিষ্টি গন্ধ বের হয়?

সপ্তাহখানেক যাওয়ার পর টুনি শুধু নাক কুঁচকে গন্ধ নেয় আর বলে, “ঘরের মাঝে পচা গন্ধ কীসের?” গাব্বু না শোনার ভান করে। শেষে একদিন টুনি খোজা শুরু করল আর সত্যি সত্যি বিছানার নিচে দুটো থালা পেয়ে গেল। একটার মাঝে বিশাল ব্যাক্টেরিয়ার কলোনি, সেখানে কী চমৎকার রঙ, কী বিচিত্রভাবে সেটা বেড়ে উঠছে, অন্যটাতে কী সুন্দর ফাংগাস! গাব্বু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, টুনি এই অসাধারণ সৌন্দর্যের কিছুই লক্ষ করল না, নাক চেপে ধরে প্রায় বমি করে দেয় সে রকম ভঙ্গি করতে থাকে। চিৎকার করে সে সারা বাসা মাথায় তুলে ফেলল। আব্বু আম্মু এসেও টুনির পক্ষ নিলেন, আর গাবুর এত চমৎকার ব্যাক্টেরিয়া কলোনি টয়লেটে ফ্লাশ করে দেওয়া হল। কী দুঃখের ব্যাপার!

মিঠুর রিমোট কন্ট্রোল গাড়িটা যে এক জায়গায় ঘোরে সেটা সত্যি, কিন্তু এখন সেটাই তো করার কথা। গা প্রথমে গাড়িটা খুলে ভেতরে কী আছে দেখেছে, যে মোটরটা চাকাগুলোকে ঘোরায় সেই মোটরের কানেকশনগুলো উল্টে দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিল গাড়িটার যখন সামনে যাওয়ার কথা তখন পেছনে আর যখন পেছনে যাওয়ার কথা তখন সামনে যায় কি না। যখন গাড়িটার সবগুলো লাগানোর চেষ্টা করল তখন অবাক হয়ে লক্ষ করল তার কাছে দুটা ক্রু বেশি। কী আশ্চর্য–এই দুটা বাড়তি ক্রু কোথা থেকে এসেছে সে বুঝতেই পারল না। গাড়িটা নাড়ালে অবশ্যি ভেতরে কিছু একটা খটর-মটর করে নড়ে, মনে হচ্ছে সেটা ঠিক করে লাগেনি। কাজেই গাব্বু আবার গাড়িটা খুলে ফেলল। পুরোটা ঠিক করে লাগানোর পর এবারে গাব্বু অবাক হয়ে লক্ষ করল এবার তিনটা ক্র বেঁচে গেছে। গাড়িটার ভেতর খটর-মটর শব্দটা নেই, কিন্তু নতুন ইন ইন একধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সে আবার খুলে ঠিক করে ফেলতে চাইছিল, কিন্তু মিঠু চিৎকার করে বাসা মাথায় তুলে ফেলল। তাই গাব্বু আর ঠিক করতে পারল না, এখন গাড়িটা বাঁকা হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। গাব্বুকে যে গাড়িটা ঠিক করতে দেয়নি সেটা তো আর তার দোষ হতে পারে না।

মোবাইল ফোন আর ক্যালকুলেটরের বিষয়টা একটু জটিল। সে বইয়ে পড়েছে লিকুইড ক্রিস্টাল ডিসপ্লের মাঝে পোলারাইজার থাকে, একটা পোলারাইজার ব্যবহার করার তার অনেকদিনের শখ। ক্যালকুলেটর খুলে সে এক টুকরো প্লাস্টিকের মতো জিনিস বের করেছে, সেটা পোলারাইজার কি না তা বোঝার জন্যে তার আরেকটা পোলারাইজার দরকার। গাব্বু ভাবছিল হয়তো টুনির মোবাইলের ওপরে একটা পোলারাইজার থাকতে পারে। সেটা যখন খোলার চেষ্টা করছে ঠিক তখন টুনি এসে হাজির, সাথে সাথে চিৎকার চেঁচামেচি হইচই! গাব্বুকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করারই সুযোগ দিল না।

আজকে খাবার টেবিলে সবার সামনে আলোচনাটা শুরু হয়ে একদিক দিয়ে ভালোই হল, যে কথাগুলো গাব্বু আগে বলতে পারেনি এখন সেটা বলা যাবে। কাজেই সে গলা পরিষ্কার করে বলা শুরু করল, “আপু, তুমি যেগুলো বলেছ সেগুলো সত্যি না। আসলে হয়েছে কী–”

আম্মু তখন ভাতের চামচ দিয়ে টেবিলে ঠাস করে মেরে বললেন, “ব্যস! অনেক হয়েছে। দিনরাত শুধু ঝগড়া আর ঝগড়া। তোরা কি কখনো মিলে মিশে থাকতে পারবি না?”

গাব্বু বলল, “আম্মু, আমি মোটেই ঝগড়া করছি না।”

আম্মু গলা উঁচিয়ে বললেন, “আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। মুখ বন্ধ করে খা–”

এরকম একটা অবৈজ্ঞানিক কথা, গাব্বু প্রতিবাদ না করে পারল না, মুখ বন্ধ করে মানুষ কেমন করে খাবে? সে বলল, “আম্মু, মুখ বন্ধ করে খাওয়া অসম্ভব। ইন্টার ভেনাস–”

আম্মু টেবিলে থাবা দিয়ে বললেন, “আর একটাও কথা না!”

কাজেই সবাই চুপ করে খেতে শুরু করল। গাব্বু আজকেই জেনেছে কেমন করে লবণের মাঝে আয়োডিন আছে কি নেই সেটা পরীক্ষা করা যায়। এর জন্যে দরকার কয়েকটা ভাত, এক টুকরো লেবু আর একটুখানি লবণ। টেবিলের ওপর সবকিছু আছে, গাব্বু চাইলেই সেই এক্সপেরিমেন্টটা করতে পারে, কিন্তু এখন সাহস করল না। তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা নিয়ে টুনি এত কিছু বলেছে, মিঠুও নালিশ করেছে, তার মাঝে এক্ষুনি যদি সে আবার এক্সপেরিমেন্টটা করা শুরু করে তা হলে তার উপর দিয়ে শুধু ঝড় না, সাইক্লোন শুরু হয়ে যেতে পারে।

কিছুক্ষণের মাঝেই আব্বু আর আম্মু পলিটিক্স নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। ভাগ্যিস দেশে মন্ত্রী-মিনিস্টাররা প্রত্যেকদিনই কিছু না কিছু অঘটন করছে, পলিটিশিয়ানরা ঝগড়াঝাটি করছে। তাই আব্বু-আম্মুদের মতো বড় মানুষদের আলাপ করার একটা বিষয় আছে, তা না হলে তারা কী নিয়ে আলাপ করতেন কে জানে! যখন গাব্বু দেখল তার দিকে আর কেউ নজর দিচ্ছে না তখন সে তার প্লেটের কোনায় কয়েকটা ভাত নিয়ে তার মাঝে লেবুর টুকরো থেকে চিপে লেবুর রস ফোঁটা ফোঁটা করে মিশিয়ে দিল, তারপর সেখানে খানিকটা লবণ দিয়ে পুরোটা আচ্ছা করে কচলে নিতে শুরু করে। গাব্বু ভাবছিল, সে কী করছে কেউ খেয়াল করবে না, কিন্তু মিঠু ঠিকই দেখে ফেলল, আর চিৎকার করে বলল, “ভাইয়া এক্সপেরিমেন্ট করছে, ভাইয়া আবার এক্সপেরিমেন্ট করছে!”

সবাই তখন ঘুরে গাব্বুর দিকে তাকাল। গাব্বু ইতস্তত করে বলল, “আমি মোটেও এক্সপেরিমেন্ট করছি না। আমি একটা দরকারি জিনিস পরীক্ষা করে দেখছি।”

আব্বু জানতে চাইলেন, “কী জিনিস?”

“লবণে আয়োডিন আছে কি না। আয়োডিন ছাড়া লবণ খেলে গলগণ্ড রোগ হয়।”

মিঠু জানতে চাইল, “গলগণ্ড রোগ কী?”

আব্বু বললেন, “গলা ফুলে যাওয়ার একরকম রোগ।”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী দেখলি? লবণে আয়োডিন আছে?”

গাব্বু বলল, “যদি এই লবণটা বেগুনি হয়ে যায় তা হলে বুঝবে লবণে আয়োডিন আছে।”

সবাই তখন গাব্বুর প্লেটের কোনায় তাকাল, প্রথমে কিছু হল না, তারপর হঠাৎ করে লবণটুকু ঠিক বেগুনি না হয়ে নীল হয়ে গেল। আব্বু মাথা নাড়লেন, বললেন, “গাব্বু তো ঠিকই বলেছে। লবণটা তো দেখি আসলেই বেগুনির মতো হয়ে গেল।”

মিঠু চোখ বড় বড় করে বলল, “ভাইয়া, তুমি হচ্ছ সায়েন্টিস্ট।”

গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। আমি এখনো সায়েন্টিস্ট হই নাই। আমি বড় হলে সায়েন্টিস্ট হতে চাই।”

টুনি বলল, “তুই এখনো সায়েন্টিস্ট হোস নাই তাতেই আমাদের বাসার সবার জীবন শেষ। যখন তুই সায়েন্টিস্ট হবি তখন কী অবস্থা হবে চিন্তা করতে পারিস? তখন শুধু বাসার না, সারা দেশের সব মানুষের জীবন নষ্ট করে দিবি।”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কক্ষনো না। সায়েন্টিস্টরা কক্ষনো মানুষের জীবন নষ্ট করে না।”

“তুই করিস।”

“করি না।”

টুনি জোর গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আব্বু থামিয়ে দিলেন, বললেন, “ব্যস, ব্যস। অনেক হয়েছে। এখন থাম। তোদের জ্বালায় শান্তিমতো খেতেও পারি না।”

কাজেই টুনি আর গার সবাইকে শান্তিতে খেতে দেওয়ার জন্যে চুপ করে যেতে হল। আব্বু আর আম্মু আবার খানিকক্ষণ পলিটিক্স নিয়ে কথা বললেন, তারপর গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে কথা বললেন, তারপর ইউরোপ-আমেরিকা নিয়ে কথা বললেন, তখন টুনি বলল, “জানো আম্মু, মিথিলা আমেরিকা থেকে একটা ভিউকার্ড পাঠিয়েছে। কী সুন্দর ভিউকার্ড!”

মিথিলা ওদের ফুপাতো বোন, ফুপার বিশাল গার্মেন্টসের ব্যবসা। ভীষণ বড় লোক, ছুটিছাটাতে তারা ইউরোপ-আমেরিকা বেড়াতে চলে যায়। আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী লিখেছে মিথিলা?”

“এই তো, কত মজা করছে এইসব।”

মিঠু জানতে চাইল, “কার্ডে কীসের ছবি আপু?”

“নায়েগ্রা ফলসের।”

“নায়েগ্রা ফলস কী?”

“অনেক বড় একটা জলপ্রপাত।”

“ছবিটা দেখাবে আপু?”

“আমার টেবিলের ওপর ভিউকার্ডটা আছে। দেখে নিস।”

মিঠুর অবশ্যি দেরি সহ্য হল না, তখন তখনই উঠে গিয়ে কার্ডটা নিয়ে এল। সবাই ছবিটা দেখল, টুনি কার্ডের উল্টোপিঠের চিঠিটা একনজর দেখে বলল, “মিথিলা চিঠিতে আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লিখেছে।”

আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, “কী?”

টুনি পড়ে শোনাল, “তুই কী জানিস আমেরিকাতে বাংলাদেশের একজন বৈজ্ঞানিককে নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে?”

“রিফাত হাসান!” আব্বু মাথা নাড়লেন, “আমি পত্রিকায় পড়েছি, কী একটা জিনিস জানি আবিষ্কার করেছেন।”

টুনি গাব্বুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “গাব্বু, তুই জানিস?”

গাব্বু কার্ডটার দিকে তাকিয়ে ছিল, বাতাসের চাপের একটা এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে তার ঠিক এই সাইজের একটা কার্ড দরকার। কী নিয়ে কথা হচ্ছিল সে খেয়াল করেনি। অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বলল, “আপু, তোমার এই কার্ডটা আমাকে দেবে?”

টুনি ধরেই নিল নায়েগ্রা ফলসের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গাব্বু কার্ডটা চাইছে, তাই সে গাবুকে কার্ডটা দিয়ে দিল। কোনোকিছুর সৌন্দর্য নিয়ে গাবুর কোনো উৎসাহ আছে বলে বাসার কেউ জানে না।

গাব্বু দ্রুত খাওয়া শেষ করে পানি খেল, তারপর জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাসটাকে কানায় কানায় ভরে নিল। আম্মু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হচ্ছে গা? গ্লাসে এত পানি ভরছিস কেন? পানি খাবি কেমন করে?”

গাব্বু বলল, “পানি খাব না।”

“তা হলে?”

মিঠু বুঝে গেল, হাততালি দিয়ে বলল, “এক্সপেরিমেন্ট! ভাইয়ার আরেকটা এক্সপেরিমেন্ট! তাই না ভাইয়া?”

গাব্বু মাথা নাড়ল, বলল, “এটা খুবই সোজা এক্সপেরিমেন্ট। এই দেখ।”

গাব্বু কানায় কানায় ভরা গ্লাসটার ওপর ভিউকার্ডটা রাখতেই টুনি চিৎকার করে বলল, “তুই ভিউকার্ডটা নষ্ট করছিস কেন?”

গাব্বু বলল, “তুমি এই কার্ডটা আমাকে দিয়ে দিয়েছ। এখন এটা আমার–আমি এটা দিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি।”

“তাই বলে নষ্ট করবি?”

গাব্বু কোনো উত্তর না দিয়ে গ্লাসটাকে উপুড় করে ফেলল, ভিউকার্ডটা থেকে হাত সরিয়ে ফেলার পরও পানিটা গ্লাসে আটকে রইল, পড়ে গেল না। মিঠু

আনন্দে চিৎকার করে বলল, “এক্সপেরিমেন্ট! সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট।”

গাব্বু রাজ্য জয় করে ফেলার মতো একটা ভঙ্গি করে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছ, পানির চাপ কীভাবে পানিটাকে আটকে রেখেছে!”

মিঠু হাততালি দিয়ে বলল, “সায়েন্টিস্ট! ভাইয়া হচ্ছে সায়েন্টিস্ট!”

আম্মু ভয়ে ভয়ে বললেন, “ঠিক আছে। এক্সপেরিমেন্ট তো হয়েছে, এখন গ্লাসটা সোজা করে ফেল। হঠাৎ করে যদি পানি পড়ে যায় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

গাব্বু কঠিন মুখ করে বলল, “কখনো পড়বে না আম্মু। কখনো পড়বে না। তুমি সায়েন্সকে বিশ্বাস কর না? বাতাসের একটা চাপ আছে? এই চাপ পানিটাকে আটকে রেখেছে। এইটা তো ছোট একটা গ্লাস–এই গ্লাসটা যদি তিরিশ ফুট লম্বা হত তা হলেও আটকে রাখতে পারত।”

আবু বললেন, “ঠিক আছে গাব্বু। আমরা বিশ্বাস করে ফেললাম। এখন এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে ফেল। দেখে ভয় লাগছে।”

গাব্বু বলল, “কোনো ভয় নাই। যতক্ষণ পৃথিবীতে বাতাস আছে ততক্ষণ বাতাসের চাপ আছে, আর যতক্ষণ বাতাসের চাপ আছে ততক্ষণ কোনো ভয় নাই। এই দেখো–”

বলে গাব্বু উল্টো করে ধরে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটাকে রীতিমতো একটা ঝাঁকুনি দিল এবং সত্যি সত্যি কিছুই হল না। গাব্বু বিজয়ীর মতো সবার দিকে তাকাল এবং ঠিক তখন কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ ঝপাৎ করে পুরো গ্লাসের পানি টেবিলের ওপর পড়ে গেল। টেবিল থেকে পানি মাছের ঝোলের সাথে মিশে ছিটকে এসে সবার চোখে-মুখে গায়ে এসে লাগে। বাড়তি কিছু পানি টেবিল থেকে গড়িয়ে টুনির কোলে এসে পড়ল, বাকিটুকু গড়িয়ে আব্বুর দিকে যাচ্ছিল, আব্বু লাফিয়ে সরে গেলেন।

মিঠু শুধু আনন্দে চিৎকার করতে থাকে, “এক্সপেরিমেন্ট! সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট!”

টুনি চিৎকার করে লাফিয়ে কুঁদিয়ে একটা বিশাল হইচই শুরু করে দিল, “আবু আম্মু তোমরা দেখেছ? দেখেছ? দেখেছ গাব্বু কী করল? আমার এত সুন্দর টি-শার্টটা-দিল বারোটা বাজিয়ে। তোমরা কিছু বল না দেখে গাবুটা এত সাহস পেয়েছে। দিন নাই রাত নাই খালি এক্সপেরিমেন্ট আর এক্সপেরিমেন্ট।”

আব্বু হতাশভাবে মাথা নাড়লেন, আম্মু টেবিলের থই থই পানি, মাছের ঝোল আর ডাল পরিষ্কার করতে লাগলেন, শুধু মিঠু আনন্দে চিৎকার করতে লাগল, “এক্সপেরিমেন্ট। সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট!”

.

সোফায় বসে চা খেতে খেতে আব্বু টেলিভিশন দেখছিলেন–অবশ্যি দেখছিলেন বললে কথাটা ভুল বলা হবে, ঠিক করে বলা উচিত, একটার পর একটা চ্যানেল পাল্টে যাচ্ছিলেন। বিদঘুঁটে গান, বাংলা সিনেমা, হিন্দি সিরিয়াল আর কয়েকটা মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন দেখে বিরক্ত হয়ে টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ করে একটা চ্যানেলে খবর পেয়ে গেলেন। আব্বু খুব খবর শুনতে পছন্দ করেন, তাই খুব মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর শুনতে লাগলেন।

প্রথমে রাস্তায় শ্রমিকদের সাথে পুলিশদের একটা দুর্ধর্ষ মারপিটের দৃশ্য দেখাল, না বলে দিলে এটাকে সিনেমার একটা দৃশ্য বলে মনে হত। তারপর একটা কাগজের গোডাউন পুড়ে যাওয়ার খবর দেখাল, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে সেই দৃশ্যটি দেখানোর সময় সাংবাদিকের চোখ-মুখ আনন্দে ঝলমল করছিল যেন আগুনে কিছু পুড়ে যাওয়া খুব মজার ব্যাপার। তারপর একটা বাস দুর্ঘটনার খবর শোনাল, খবরের পর সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আঁতেলটাইপের কিছু মানুষের প্যানপ্যানানি অনেকক্ষণ ধরে শুনতে হল। তারপর টেলিভিশনে সেজেগুঁজে থাকা মেয়েটা একটু ন্যাকা ন্যাকা গলায় বলতে শুরু করল, “যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর রিফাত হাসান তিন দিনের সফরে আজকে বাংলাদেশে পৌঁছেছেন। এয়ারপোের্ট থেকে আমাদের সংবাদদাতার বিশেষ রিপোর্ট…–”

আব্বু তখন টেলিভিশনের ভলিউম বাড়িয়ে গলা উঁচিয়ে বললেন, “এই তোরা দেখে যা। বাংলাদেশী সায়েন্টিস্টকে দেখাচ্ছে।”

টুনি আর মিঠু দেখার জন্যে ছুটে এল, গাব্বু বেশি গা করল না। বিজ্ঞান নিয়ে তার অনেক আগ্রহ, বিজ্ঞানী নিয়ে বেশি মাথা ব্যথা নেই। তা ছাড়া কোনো এক জায়গায় সে পড়েছে টেলিভিশন দেখলে মানুষের সৃজনশীলতা কমে যায়, তাই সে কখনো টেলিভিশন দেখে না।

দেখা গেল পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের একজন মানুষ এয়ারপোর্টের করিডর ধরে হেঁটে আসছেন এবং অনেক সাংবাদিক তাকে হেঁকে ধরেছে। মানুষটাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে, সাংবাদিকদের কথা শুনে যেন বুঝতে পারছেন না কী বলতে হবে। আব্বু ভলিউমটা আরও একটু বাড়িয়ে দিলেন, সবাই কান পেতে শোনার চেষ্টা করল সাংবাদিকেরা কী প্রশ্ন করে আর বৈজ্ঞানিক রিফাত হাসান কী বলেন।

.

০২.

রিফাত হাসান এয়ারপোর্টে নেমে সত্যি সত্যিই একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তিনি মোটেও আশা করেননি এয়ারপোর্টে এতজন সাংবাদিক হাজির হবে। তাদের ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে তাঁর চোখ রীতিমতো ধাঁধিয়ে গেল। তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে মন্ত্রণালয়ের যে জুনিয়র অফিসারটা এসেছে সে অনেক কষ্টে সাংবাদিকদের ঠেলে রিফাত হাসানের কাছে গিয়ে বলল, “স্যার আমি আপনাকে নিতে এসেছি। আপনার সাথে আমার ই-মেইলে যোগাযোগ হয়েছিল।”

রিফাত হাসান মনে হয় একটু ভরসা পেলেন, বললেন, “তুমি ইউসুফ?”

“জি স্যার।”

“থ্যাংক গড।” তারপর গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এত সাংবাদিক কেন এসেছে?”

“আপনি স্যার একজন ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। সাংবাদিকেরা তো আসবেই।”

“আমি আবার সেলিব্রেটি হলাম কবে থেকে?”

“কী বলেন স্যার! সারা পৃথিবী আপনাকে এখন এক নামে চেনে।”

“কে বলেছে? মোটেও সারা পৃথিবী চেনে না। আমি ইউনিভার্সিটির মাস্টার, অন্য মাস্টারদের সাথে যোগাযোগ আছে, সাধারণ পাবলিক আমাকে চিনবে কেন? সাধারণ পাবলিক চেনে ফিল্মস্টারদের। ফুটবল প্লেয়ারদের। তারা হচ্ছে। সেলিব্রেটি।”

ইউসুফ মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের দেশে আপনি হচ্ছেন আসল সেলিব্রেটি। ফেসবুকে আপনাকে নিয়ে কী হইচই হয় আপনি জানেন না?”

“উঁহু, জানি না।” রিফাত হাসান আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই সাংবাদিকেরা তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তেজী চেহারার একটা মেয়ে একেবারে তার মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরে বলল, “আপনি কতদিন পর দেশে এসেছেন?”

রিফাত হাসান কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “আপনি যে পার্টিকেল আবিষ্কার করেছেন তার নাম কী?” একই সাথে আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “এই পার্টিকেলটাকে কী রিফাত পার্টিকেল ডাকবে?” তার প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখন কী নিয়ে গবেষণা করছেন?” সিরিয়াস ধরনের একজন কঠিন মুখে জিজ্ঞেস করল, “বাংলাদেশে কি বিজ্ঞানচর্চার সত্যিকারের সুযোগ আছে?” কমবয়সী একটা মেয়ে সবার গলাকে ছাপিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “বৈশ্বিক উষ্ণায়নে বাংলাদেশ কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আপনি মনে করেন।”

রিফাত হাসান একেবারে হকচকিয়ে গেলেন, এতজন সাংবাদিকের এতগুলো প্রশ্ন, তিনি কোনটি ছেড়ে কোনটির উত্তর দেবেন? হাত তুলে বললেন, “আস্তে! আস্তে! সবাই একসাথে প্রশ্ন করলে তো আমি কারও প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারব না!”

কম বয়সী মেয়েটি গলা উঁচিয়ে বলল, “আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন–”

তার গলা ছাপিয়ে আরেকজন জিজ্ঞেস করল, “আপনি কতদিন পর দেশে এসেছেন?”

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রশ্ন থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সোজা, তাই রিফাত হাসান এই প্রশ্নটার উত্তর দিলেন, বললেন, “আঠার বছর।”

“এতদিন পর দেশে এসে আপনার কেমন লাগছে? আপনি কী কী পরিবর্তন দেখছেন?”

“আমি এখনো এয়ারপোর্ট থেকেই বের হতে পারিনি, তাই এখনো কিছুই দেখতে পারিনি। অনুমান করছি দেশের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ফর এক্সাম্পল, এই এয়ারপোর্টটাই অনেক বড় আর আধুনিক হয়েছে। নিশ্চয়ই দেশেও এরকম আরো অনেক পরিবর্তন হয়েছে।”

সবাইকে ঠেলে মুশকো জোয়ান টাইপের একজন সাংবাদিক সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কতদিন দেশে থাকবেন?”

রিফাত হাসান বললেন, “তিন দিন। আমি তিন দিনের জন্যে দেশে এসেছি।”

“মাত্র তিন দিন? আঠার বছর পরে এসে আপনি মাত্র তিন দিন থাকবেন?”

রিফাত হাসান একটু থতমত খেয়ে বললেন, “আমি আবার আসব। তখন আমি সময় নিয়ে আসব। আমি কথা দিচ্ছি এর পরের বার আসতে আমার আর আঠার বছর লাগবে না।”

তেজী চেহারার মেয়েটা বলল, “এই তিন দিন আপনার প্রোগ্রাম কী?”

“আমি বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে এসেছি, তাই বেশির ভাগ সময় দেব এই মন্ত্রণালয়ের সাথে। এ ছাড়াও আমি দেশের অধ্যাপক-গবেষকদের সাথে কথা বলব। দুটি ইউনিভার্সিটিতে দুটি টক দিতে হবে–”

মুশকো জোয়ান সাংবাদিকটা কনুই দিয়ে অন্যদের ঠেলে পেছনে ফেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞান শিক্ষা এবং গবেষণা নিয়ে আপনার একটা কমেন্ট প্লীজ–”

রিফাত হাসান মাত্র এসেছেন, এ ধরনের বিষয় কিছুই জানেন না, কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না, তখন বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র অফিসার ইউসুফ তাঁকে রক্ষা করল। সে রিফাত হাসানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এখন আপনারা স্যারকে যেতে দিন প্লীজ। স্যার অনেক লম্বা ফ্লাইটে এসেছেন, খুবই টায়ার্ড। হোটেলে গিয়ে স্যার রেস্ট নেবেন। কাল সকালে স্যারের জরুরি মিটিং।”

কম বয়সী মেয়েটি গলা উঁচিয়ে বলল, “একটা প্রশ্ন। খালি একটা প্রশ্ন-”

ইউসুফ মুখ কঠিন করে বলল, “না। কোনো প্রশ্ন না। এখন আর কোনো প্রশ্ন না। স্যার যখন সাংবাদিকদের ব্রিফিং করবেন তখন আপনারা আসবেন, যত খুশি প্রশ্ন করবেন। এখন স্যারকে যেতে দিন, প্লীজ।”

সাংবাদিকেরা রিফাত হাসানকে যেতে দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখাল না, তখন ইউসুফ সবাইকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে একটু জায়গা করে রিফাত হাসানকে নিয়ে এগুতে থাকে। সাংবাদিকেরা পেছনে থেকে ছুটতে থাকে, ছবি তুলতে থাকে। তার মাঝে কোনোভাবে রিফাত হাসান এয়ারপোর্টের সামনে রাখা গাড়িটাতে উঠে পড়লেন।

গাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার পর রিফাত হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “বাবারে বাবা! শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেলাম।”

ইউসুফ বলল, “না স্যার। পুরোপুরি ছাড়া পাননি। ওই দেখেন মোটর সাইকেলে করে পিছু পিছু আসছে।”

রিফাত হাসান তাকিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি একটা মোটরসাইকেলে করে দুজন সাংবাদিক গাড়ির পাশাপাশি যেতে যেতে চলন্ত গাড়ির ছবি তোলার চেষ্টা করছে। রিফাত হাসান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ির সিটে মাথা রাখলেন। সেভাবে খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে রিফাত হাসান বললেন, “আঠার বছরে দেশের কত পরিবর্তন হয়েছে। আমি কিছুই চিনতে পারছি না!”

ইউসুফ বলল, “আঠার বছর অনেক লম্বা সময় স্যার, এই সময়ে আসলেই অনেক পরিবর্তন হতে পারে।”

“তাই তো দেখছি। কত চওড়া রাস্তা, হাজার হাজার গাড়ি, বড় বড় বিল্ডিং, পুরো শহরটাকেই অচেনা লাগছে।”

“আমাদেরই অচেনা লাগে! আপনার তো লাগতেই পারে–কতদিন পরে এসেছেন।”

রিফাত হাসান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আমার আরও আগে আসা উচিত ছিল। এতদিন পরে দেশে এলে দেশ মনে হয় অভিমান করে দূরে দূরে থাকে। অপরিচিতের মতো ভান করে।”

রিফাত হাসানের গলার স্বরে একটু দুঃখ দুঃখ ভাব ছিল, ইউসুফ তাঁর দিকে একবার তাকাল, কিছু বলল না। রিফাত হাসান অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বললেন, “আসলে খুব ছেলেবেলায় আমার বাবা-মা মারা গেছেন–আমি বিদেশে চলে গেছি। আমার দুই ভাইবোন, তারাও বিদেশে, এখানে সে রকম ক্লোজ আত্মীয়স্বজনও নেই। তাই দেশের সাথে সে রকম সম্পর্ক ছিল না। কাজকর্মের এত চাপ, দেশে আসার সময়ও পাইনি।”

ইউসুফ বলল, “এতদিন পর দেশে এসেছেন–আপনার নিজের জন্যে কোনো সময়ই তো দেখছি না, মিটিংয়ের পর মিটিং।”

“হ্যাঁ। একটার পর একটা মিটিং, না হয় সেমিনার।”

“আলাদা কোনো কিছু করার প্ল্যান কি আছে স্যার?”

রিফাত হাসান মাথা নাড়লেন, বললেন, “নাহ্ সেরকম কোনো প্ল্যান নেই! শুধু ছেলেবেলায় যেখানে ছিলাম সময় পেলে সেই জায়গাটা একটু হয়তো দেখে আসতাম।”

“আপনাকে নিয়ে যাব স্যার।”

“তোমাকে নিতে হবে না। আমি নিজেই খুঁজে বের করে নেব।”

ইউসুফ হাসল, বলল, “পারবেন না স্যার। আপনি নিজে নিজে যেতে পারবেন না।”

“কেন পারব না?”

“সাংবাদিকদের উৎপাতে। আগামী তিন দিন সাংবাদিকেরা আপনাকে এক সেকেন্ডও একা থাকতে দেবে না। সারাক্ষণ আপনার পিছু পিছু লেগে থাকবে। এই দেখেন পেছনে একটা টিভি চ্যানেলের গাড়ি, সামনে আরেকটা। একটা মোটরসাইকেল তো আগেই দেখেছেন-এখন দেখেন দুই নম্বর মোটরসাইকেলও চলে এসেছে। আমি লিখে দিতে পারি এর মাঝে হোটেলে অনেকে পৌঁছে গেছে।”

রিফাত হাসানকে কেমন জানি আতঙ্কিত দেখায়। শুকনো গলায় বললেন, “কেন? আমার পেছনে কেন?”

ইউসুফ বলল, “কারণ আপনি শুধু সেলিব্রেটি না, আপনি হচ্ছেন ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রেটি। এই দেশে তো রোল মডেলের খুব অভাব, তাই যদি কোনোভাবে একজনকে পেয়ে যায়, তার আর ছাড়াছাড়ি নেই। এই দেশের সব মানুষ আপনার কাজকর্ম ফলো করছে। ফেসবুকে আপনার বিশাল বিশাল ফ্যান ক্লাব, পত্রিকায় প্রত্যেকদিন আপনার ওপর আর্টিকেল বের হচ্ছে!”

“কী বলছ তুমি?”

“আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না স্যার। আগামী তিন দিন আপনি এক সেকেন্ডও একা থাকতে পারবেন না। আমার মনে হচ্ছে পুলিশ প্রটেকশন ছাড়া আপনার বের হওয়া যাবে না।”

রিফাত হাসান শুকনো মুখে বললেন, “কী সর্বনাশ!”

ইউসুফ বলল, “আই অ্যাম সরি স্যার।”

.

হোটেলে পৌঁছানোর পর দেখা গেল ইউসুফের কথা সত্যি-বেশ কয়েকজন সাংবাদিক হোটেলের সামনে ভিড় করে আছে। গাড়ি থামতেই তারা ছুটে এল, কয়েকজন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে প্রশ্ন করার চেষ্টা করে, কিন্তু ইউসুফ কাউকে কোনো সুযোগ দিল না। রিফাত হাসানকে রীতিমতো টেনে হোটেলের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলল। হোটেলের গেটে দারোয়ান কোনো সাংবাদিককে ভেতরে ঢুকতে দিল না, রিফাত হাসান নিশ্বাস ফেলে বাঁচলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *