1 of 2

১.১৫ বাংলাদেশ দেখে এলাম

বাংলাদেশ দেখে এলাম

২৫শে বৈশাখ, ৯ই মে তারিখে, বাংলাদেশে পৌঁছই। রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সেদিন বিকেলে বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে সভার ব্যবস্থা ছিল। পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেই সভায় বক্তা ছিলেন শ্রীপান্নালাল দাশগুপ্ত। আমিও বলবার জন্য অনুরুদ্ধ হই। বিশাল জনসমাবেশ; অতি সুশৃঙ্খল সভা। পরে একাডেমীর মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তাফা কামাল সাহেবের আমন্ত্রণে আরো একদিন বক্তৃতা দিই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ বিষয়ে। মহাপরিচালক মহাশয়কে এই সুযোগে ধন্যবাদ জানাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি সভার আয়োজন হয়, একটি ডঃ আনিসুজ্জামানের উদ্যোগে, অন্যটির উদ্যোক্তা বন্ধুর মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। চট্টগ্রামে সভার ব্যবস্থা করে ওখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সমিতি।

বাংলাদেশে এর আগেও একাধিকবার গিয়েছি। কিন্তু এবার শহরে ও গ্রামে ঘুরে দেখবার যতটা সময় ও সুযোগ ছিল অন্যবার ততটা ছিল না। ঢাকা শহরে অনেকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে বিশেষ সহায়তা করেছিলেন কাজী নূর-উজ্জামান। এবং তাঁর বিদূষী স্ত্রী সুলতানা জামান। এঁদের বাড়ীতেই উঠেছিলাম। চট্টগ্রামে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের গৃহে স্থান পেয়েছিলাম, ইনি গণিতশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। সুদূর পটুয়াখালীর দশমিনা গ্রামে আতিথ্যদান করেছিলেন কৃষকনেতা আবদুস সাত্তার খান। কুমিল্লার পথে ও অন্যত্র অযাচিতভাবে অজস্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিয়েছেন বিশ্বভারতীর ছাত্রী জাহানারা নিশি। আরো বহু বন্ধু, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, সেবাব্রতী, ব্যবসায়ী, জাহাজের সারেঙ, মাঠের চাষী, গ্রামের স্কুলের শিক্ষক, পরিচিত ও অপরিচিত কতো মানুষ, সকলের কাছ থেকে যে সহায়তা ও হৃদয়ের উষ্ণতা লাভ করেছি। তা ভুলবার নয়।

নতুন ঢাকা জাকজমকে কলকাতা নয় বরং দিল্লীর সঙ্গে অনেকটা তুলনীয়। এমন প্রশস্ত রাস্তা, এত রকমারি বিদেশী গাড়ী, সুদৃশ্য পার্ক ও স্মৃতিস্তম্ভ, কলকাতায় চোখে পড়ে না। নতুন ও পুরনো ঢাকার ভিতরে প্রচণ্ড পার্থক্য, নতুন ও পুরনো দিল্লীর মতোই। নাগরিক উন্নয়নের দুটি মডেল ভারতে চোখে পড়ে; পশ্চিমবঙ্গ, যেখানে কলকাতা মহানগরীর একাধিপত্য, আর পাঞ্জাব অথবা হরিয়ানা, যেখানে একাধিক মাঝারি ধরনের পৌরকেন্দ্র পারস্পরিক সামঞ্জস্য রক্ষা করে বেড়ে উঠেছে। কলকাতার বিষম কর্তৃত্ব ওপার বাংলায় যখন শিথিল হল তখন সেখানে নাগরিক উন্নয়নের দুটি বিকল্প সম্ভাবনার কথা। চিন্তা করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সেখানেও এককেন্দ্রিকতাই বিজয়ী হয়েছে।

কলকাতা মহানগরী পশ্চিমবঙ্গকে শুষে নিচ্ছে এই রকম আমাদের অভিযোগ। আরো প্রকটভাবেই বাংলাদেশকে শুষে নিচ্ছে নতুন ঢাকা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা শুনছিলাম; ভালো অধ্যাপকদের সেখানে ধরে রাখা যায় না, তাঁরা প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন ঢাকার দিকে। কিন্তু এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েরই সমস্যা নয়। সমগ্র বাংলাদেশের আর্থিক ও সামাজিক জীবনের ভারসাম্য খণ্ডন করে দাঁড়িয়ে আছে রাজধানী ঢাকা।

সেখানকার নতুন উচ্চমধ্যবিত্তের বিলাসী নাগরিক জীবনযাত্রার সঙ্গে গ্রামের চাষীর দারিদ্র্যের ব্যবধান বেদনাদায়ক। এই অসামঞ্জস্য বর্তমান দুই বাংলাতেই। বাংলাদেশে। সেটা যেন আরো বেশি করে চোখে পড়ে। ভারত স্বয়ম্ভরতার দিকে যতটা এগিয়েছে বাংলাদেশ এখনো তা পারে নি। ওদেশের অর্থনীতি প্রচণ্ড নির্ভরশীল মার্কিনী সাহায্যের ওপর। এদেশের সমাজে যেসব দোষ দুর্বলতা উপস্থিত ওদেশে পাই তারই পুনরাবৃত্তি। ভালো ভালো ছাত্রছাত্রীরা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। দুর্নীতিতে ছেয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। রাজনীতি ও ব্যবসায়।

আমরা যখন ঢাকায় পৌঁছাই তখন নির্বাচন প্রায় শেষ, ভোট গণনা চলছে, ফলাফল ঘোষণা করা হচ্ছে। কাজেই আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় তখন নির্বাচন। কদিনের ভিতরই জানা গেল, এরশাদের জাতীয় পার্টি পেয়েছে তিনশর ভিতর দেড়শর কিছু বেশি আসন, আওয়ামি লীগ পঁচাত্তর। ধর্মীয় দল জাময়েত-এ-ইসলামী পেয়েছে দশটি আসন। কম্যুনিস্ট দল পাঁচটি। নির্দল প্রার্থীদের জুটেছে বেশ কিছু আসন। তাদের ভিতর কজন মনে মনে কোনদিকে, অন্তত আমার কাছে সেটা অজ্ঞাত। সুযোগ বুঝে অনেকেই এদিকে ওদিকে যাবেন এইরকম শোনা যাচ্ছিল। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন নি বেগম জিয়ার দল। হাসিনা নিজেই জিতেছেন একাধিক কেন্দ্র থেকে। বামপন্থী প্রগতিশীল অনেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণেরই বিরোধী। আগে সামরিক শাসন তুলে নিতে হবে তারপর নির্বাচন, এই দাবি থেকে এঁরা নড়তে রাজী নন।

নির্বাচন সঠিকভাবে হয়নি, ভোটগ্রহণে বহু অন্যায় কারচুপি ও বলপ্রয়োগের ঘটনা ছিল, সকলের মুখেই একথা শুনেছি। এ অবস্থায় এরশাদের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। এটা কিছু আশ্চর্য নয়, আওয়ামি লীগ তবু পঁচাত্তরটি আসন পেল কী করে সেটাই প্রশ্ন। কেউ কেউ বলছেন যে, এরশাদের দল যেমন বহু ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ করে জয়ী হয়েছে, আওয়ামি লীগও তেমনি কোথাও কোথাও একই পদ্ধতিতে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। আবার অনেকে বলছেন, আওয়ামি লীগের প্রতি সারাদেশে জনসমর্থনের ঢেউ এত জোরালো ছিল যে নানা রকমের অন্যায় বাধা সত্ত্বেও কিছু আসন এই দল। অনিবার্যভাবে পেয়েছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা ঠাট বজায় রাখবার জন্য এরশাদ নিজেই হাসিনার দলকে কিছু পাইয়ে দিয়েছেন, এই রকম মন্তব্যও শোনা যাচ্ছে। যাই হোক, এবিষয়ে সন্দেহ নেই যে ভালোভাবে নির্বাচন হলে ফলাফল অন্যরকম দাঁড়াতো। আওয়ামি লীগই সম্ভবত একমাত্র দল সারা বাংলাদেশে যার সংগঠন আছে, ব্যাপক জনসমর্থন আছে। বামপন্থী শক্তি আজ বহু ছোটো ছোটো গোষ্ঠীতে বিভক্ত ও দুর্বল। দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় দল সুসংবদ্ধ, কিন্তু তাদের প্রতি জনসমর্থন সীমাবদ্ধ।

ঢাকায় মধ্যবিত্তের ভিতর বামপন্থী মার্কসবাদী কিংবা আধা-মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী সংখ্যায় কম নন। এঁদের অনেকেই বলছেন, এই নির্বাচন থেকে জনগণ একটা শিক্ষাই পেতে পারে, সে হল নিবার্চনের ব্যর্থতা। নির্বাচনের পথে আজ দেশের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, এটাই নিবার্চনের শিক্ষা। এর পর স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, তবে পথ কোনটা? বামপন্থীদের কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই। একটা উত্তেজক কল্পনা তাঁদের মনকে আচ্ছন্ন করে আছে। সেটাই পরিচ্ছন্ন চিন্তার পথে বাধা। মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। তারপর দেশে শৃঙ্খলাস্থাপন সহজ কাজ ছিল না। বিশৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে সামরিকশাসনের দুষ্টচক্র দেশের উপর চেপে বসেছে। বিপ্লববাদীরা অপেক্ষা করছেন জনগণের আরেক মুক্তিযুদ্ধের জন্য। তারই ভিতর দিয়ে ঘটবে সামরিক শাসনের অবসান, প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের প্রকৃত মুক্তি। এই দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ কোন পথে আসবে, তার নেতৃত্ব ও সংগঠন কেমন হবে, ঢাকার বুদ্ধিজীবীরা তা জানেন না। তবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নসন্তান এই দ্বিতীয় বৈপ্লবিক অভুত্থানের কল্পনা বাংলাদেশের বামপন্থী চেতনাকে যেন একটা মুগ্ধতায় গ্রাস করে আছে।

আর্থিক ও সামাজিক সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠলে বাংলাদেশে জনগণের একটা সশস্ত্র অভুত্থান ঘটা সম্ভব। এজন্য যে অস্ত্রশস্ত্র দরকার সেটা হয়তো এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে অথবা কোনো কোনো ভাবে এসে যাবে। এই সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ পথে বাংলাদেশে মুক্তসমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা এবিষয়ে গুরুতর সন্দেহের অবকাশ আছে। বিপ্লবের প্রত্যুত্তরে দেখা দেয় প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা। একটা কথা পরিষ্কারভাবে মনে রাখা দরকার। বাংলাদেশে এমন কোনো দেশব্যাপী সংগঠিত বামপন্থী। দল নেই যেদল ক্ষমতা হাতে নিয়ে বিপ্লবের অরাজকতা অতিক্রম করে দেশে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করবার প্রতিশ্রুতি বহন করতে পারে। তুলনায় বেশি সংগঠিত দক্ষিণপন্থী শক্তি। কিন্তু তাদের দ্বারাও দেশের সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। বিপ্লব হয়তো সাময়িকভাবে ডেকে আনবে প্রতিবিপ্লবের বিভীষিকা। তাতে দেশের দুর্দশা দূর হবে না।

সামরিক শাসন থেকে দেশকে কীভাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির সেটাই প্রধান প্রশ্ন। এমন কি সামরিক শাসনকর্তাদের পক্ষেও আজকের অবস্থা সন্তোষজনক নয়, বরং ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় কণ্টকিত পরিস্থিতি। আজ যিনি দেশের মাথায় বসে আছেন কাল তাঁরই মুণ্ডপাত হতে পারে। দেশকে একটা স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দিকে নিয়ে যেতে পারলে সকলের পক্ষেই সেটা মঙ্গল। দেশের বুকের উপর যে ভয়ের শাসন চেপে বসে আছে সেটাকে কিছুতেই চিরকালের মতো মেনে নেওয়া যায় না। তাকে সরাবার পথ তৈরি করতে হবে। হয়তো পরিবর্তন ঘটবে বিভিন্ন পর্যায়ে। কামাল হোসেন প্রমুখ আওয়ামি লীগের চিন্তাবিদেরা এই পরিস্থিতিটা মনে রেখে পথ খুঁজছেন। সামরিক শাসকেরা পরিবর্তন চাইলেও তাঁরা সতর্ক, এমন কি মনে মনে ভীত। মুখে তাঁরা যাই বলুন না কেন, এ চিন্তা তাঁদের মনে নিশ্চয়ই ঢুকেছে যে জনসমর্থন আসলে জাতীয় পাটির পক্ষে নেই। সতর্কভাবে গণতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়াটা জরুরী, কারণ অনির্দিষ্ট কালের জন্য সামরিক শাসন বজায় রাখা যায় না এটাই দেয়ালের লিখন। এ কথাটা এরশাদ সম্ভবত বোঝেন না। সামনের পথটা দুর্গম সন্দেহ নেই। তবু আশা রক্ষা করে ধীর স্থির ভাবে এগোতে হবে এই রকম একটা চিন্তা থেকেই আওয়ামি লীগ নির্বাচনে যোগ দিয়েছিল।

পরিষদীয় গণতন্ত্র অবশ্য যথেষ্ট নয়। ওপরের দিকে কাজ করলেই চলবে না। তলার দিকে গঠনমূলক কাজও প্রয়োজন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় গান্ধী দেশব্যাপী অসহযোগের সঙ্গে যোগ করেছিলেন গঠনমূলক কাজ, বিশেষত গ্রামে গ্রামে। অনুকরণে কাজ হবে না, পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সঙ্গে যোগ করা প্রয়োজন গঠনমূলক কাজ। এ পথে কি নেতৃত্ব দিতে পারবে আওয়ামি লীগ? না কি রাজধানীই শুষে নেবে দলীয় রাজনীতির সমস্ত শক্তি?

এরশাদের আমলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিশ্রুতিতে গঠিত হয়েছে উপজিলা পরিষদ। উপজিলা পরিষদের জন্য আছে নির্বাচিত সভাপতি। কয়েকটি ইউনিয়ন নিয়ে এক একটি উপজিলা। ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতিরাও সদস্য হিসেবে থাকবেন উপজিলা পরিষদে। এই সব নিবাচনে আওয়ামি লীগ অংশ নেয়নি। ফলে বর্তমান উপজিলা পরিষদগুলি জনপ্রতিনিধিত্ব দাবি করতে পারে না। সামরিক শাসকদের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের একটা বাহ্যিক ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। একে কাজে লাগানো দরকার। দশমিনায় দেখে এলাম উপজিলা পরিষদের ভিতর দিয়ে কিছু কাজ শুরু হয়েছে। কাজের সঙ্গে সঙ্গে টাকার অপব্যয়ও চলছে। এখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি জনগণের প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষদের কর্তৃত্ব। গ্রামের মানুষদের সংগঠিত করা প্রয়োজন। কঠিন সে কাজ তবু বাংলাদেশে সেটা সম্ভব নয় এমন নৈরাশ্যবাদের কারণ দেখি না।

বাংলাদেশ স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, ঝড়-ঝাঁপটার ভিতর দিয়েই সে এগিয়ে চলেছে। বেগম সুফিয়া কামালের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি বললেন, চারদিকে নৈরাশ্যজনক কত কিছু ঘটছে, কিন্তু এর ভিতরও আশার আলো চোখে পড়ে নারী জাগরণে। কথাটা সত্যি। বাংলাদেশের মুসলমান নারী জেগে উঠছে।

পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় একবার গিয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তানে। উঠেছিলাম আমারই এক পুরনো বন্ধুর বাড়ীতে, প্রেসিডেন্সি কলেজে এককালে তিনি আমার সহপাঠী ছিলেন। কয়েকদিন তাঁর বাড়ীতে উদার আতিথ্য লাভ করেছিলাম। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর দর্শনলাভ করিনি, যদিও তিনি বাড়ীতেই ছিলেন। বন্ধুবর বললেন যে, মুসলমান সমাজের এটাই। রীতি।

সত্তরের দশকে সেই বন্ধুর বাড়ীতেই যখন আবার যাই তখন তাঁর স্ত্রী দর্শন দেন, ততদিনে তিনি অবগুণ্ঠন থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সেবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে বুঝতে পারি যে, অনেক কিছুই বদলে গেছে, অন্তত নাগরিক সমাজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সঙ্গে ঢাকার পার্থক্য চোখে পড়ে না।

এবার নারী জাগরণ গ্রামেও প্রত্যক্ষ করা গেল। পান্নালাল বাবু আর আমি দশমিনা বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এক সভায় মিলিত হই। শহর থেকে বহু দূরে দশমিনা। গ্রামের স্কুল তবু ছাত্রীরা সভায় উপস্থিত ছিল ভালো সংখ্যায়। তাদের ভঙ্গিতে আড়ষ্টতা ছিল না, মাথায় ছিল না অবগুণ্ঠন। আমাদের কথা তারা মন দিয়ে শুনেছে। গরীব চাষীর ঘরে যখন গেছি মহিলারা অনায়াসে বেরিয়ে এসেছেন, নিজেদের কথা পরিষ্কারভাবে বলেছেন। এই এক নতুন শক্তি দেখে এলাম বাংলাদেশে নারীর অধিকার ক্রমে স্বীকৃতি লাভ করছে, আইনকানুনেও তার প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্বামী আইনত দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন না। ইসলামী ঐতিহ্যের পরিবর্তন ঘটছে? বাংলাদেশের সমাজে সাম্য ও সামঞ্জস্য বিধানের কাজে নারীশক্তির ভূমিকা হবে অগ্রণী, বেগম সুফিয়া কামালের এই আশা। শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনবার যোগ্য কথা এটা।

.

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রাদুর্ভাব আমি দেখিনি। সাম্প্রদায়িক বুদ্ধি থেকে উল্লেখযোগ্য ভাবে মুক্ত সাধারণ মানুষের মন। হিন্দুদের ভিতর ভয়সংশয় যথেষ্টই আছে। কিন্তু মুসলমান সাম্প্রদায়িকতা সেজন্য দায়ী এমন আমার মনে হয়নি। অপরিচিতা এক হিন্দু মহিলা আমাকে নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি বললেন, কিছুদিন আগে তাঁর বাড়ীতে ডাকাতি হয়েছে, তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করবার কথা ভাবছেন। পশ্চিমবঙ্গেও কিন্তু ডাকাতি হয়, আমরা সেজন্য দেশত্যাগ করবার কথা ভাবি না। বাংলাদেশের অস্থির অবস্থায় এসব ঘটনা বিরল নয়, হিন্দুরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল বলেই তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয় দুবৃত্তেরা। এটা দুঃখজনক, কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানকে বিচার করা যাবে না অল্প কিছু অপরাধীর আচরণ দিয়ে।

সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তার অভাব স্বাভাবিকভাবেই আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের এ বিষয়ে একটা বিশেষ দায়িত্ব স্বীকার্য। বাংলাদেশের একটি অপরিচিত মুসলমান ছেলে আমাকে অভিমানের সুরে বলল, আপনারা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন কেন? তার কথায় কোনো কপটতা আমি লক্ষ করিনি। বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কি পথ দেখাতে পারবে? সংখ্যালঘুদেরও কিছু কর্তব্য আছে। বাংলাদেশে হিন্দুরা যে যে-বৃত্তিতে আছে। তাকে সেই বৃত্তিতে যথার্থ যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, যাতে প্রতিবেশীর চোখে তার কাজ মূল্যবান হয়ে ওঠে, দশমিনায় একথা বললেন সমাদ্দার। আত্মরক্ষার এটাই শ্রেষ্ঠ উপায়; এটাই সেবা ও সমম্বয়ের পথ।

সাম্প্রদায়িকতা নয়, তবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের প্রতি বাংলাদেশে একটা সন্দেহের মনোভাব আছে। নেপালেও সম্ভবত ভারতের প্রতি ঐ ধরনের মনোভাব অনুপস্থিত নয়। ফরাক্কার জল আর ভারতের বস্ত্রব্যবসায়ীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য বাংলাদেশে হামেশাই শোনা যায়। এতেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। জল নিয়ে কোন্দল। আছে পাঞ্জাব আর হরিয়ানার ভিতরও। বিদেশী বস্ত্র বাংলাদেশে প্রবেশ করছে প্রচুর পরিমাণে। ভারতকে আলাদাভাবে দোষ দিয়ে আজ লাভ নেই। একটা সুখবর, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। শিখতে হবে নিজের চেষ্টায়। তবে সেই সঙ্গে ভারতেরও একটা বিশেষ দায়িত্ব আছে কারণ সে অপেক্ষাকৃত শক্তিমান প্রতিবেশী। দুই দেশের ভিতর সহযোগিতার অনেক সুযোগ আছে। সন্দেহের আতিশয্যে সহযোগিতার এই সুযোগগুলি দৃষ্টির বাইরে চলে না গেলেই ভালো। সতর্কভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।

বৈদেশিক অর্থের প্রশ্নটা সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। দুবাই থেকে অনেক টাকা বাংলাদেশে এসে পৌঁছচ্ছে। চট্টগ্রামের কাছাকাছি অঞ্চলে তার প্রভাব বিশেষভাবে চোখে পড়ল। ছাত্রদের একাংশের উপর ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আশ্রিত রাজনীতির প্রভাব লক্ষণীয়। এরা বেশ সংগঠিত। আমার বাংলাদেশের বন্ধুদের কেউ কেউ বলেন, এসব হচ্ছে বিদেশী টাকার প্রভাবে। বিদেশী টাকা আছে ঠিকই, কিন্তু তাই দিয়ে সবটা ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না। ধর্মীয় গোঁড়ামির কবলে যে ছেলেরা পড়েছে তাদের অনেকেই অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। উচ্চবিত্তদের ভিতর যে বিলাসব্যসন বাড়ছে তারই প্রতিক্রিয়ায় কিছু স্বল্পবিত্ত পরিবারের ছেলে ইসলামী গোঁড়ামির দিকে ঝুঁকছে। এটাও একটা কারণ। তাছাড়া শাসক দল ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে অল্পবেশি প্রশ্রয় দিতে অভ্যস্ত। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে এই কৌশল লাভজনক মনে করা হয়। দেশের পক্ষে এটা ক্ষতিকর বিপজ্জনক চিন্তা। হিন্দু মুসলমানের ভিতর সদ্ভাব দুই বাংলাতেই হিন্দু মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের দীর্ঘকালীন স্বার্থেই প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িকতায় গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রসমাজের ভিতর শুভবুদ্ধির অভাব নেই। এ আশা হয় তো দুরাশা নয় যে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁদের সাহসী সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন থাকে বারুদের গন্ধ বাংলাদেশে রাজনীতিতে তেমনি আছে সর্বব্যাপী সন্দেহের ধোঁয়া আর চক্রান্তের গন্ধ। কেউ কোনো ভাল কাজ করলে লোকে সন্দেহ করে, এর পিছনে কুমতলব আছে। এই পরিবেশে ভালো কাজ করা সহজ নয়। তবু কিন্তু কাজ হচ্ছে। গত কয়েক বছরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে। নতুন শিল্প দেখা যাচ্ছে যদিও সীমাবদ্ধ আকারে। জাতীয় সঞ্চয়ের হার বড়ই নিম্নস্তরে। ভূমিসংস্কার আটকে আছে। সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের পরিচালনায় দক্ষতার অভাব। তবু বাংলাদেশ ঝিমিয়ে পড়েনি। ওপার বাংলার মানুষের সর্বোপরি আছে একটা উচ্ছুসময় প্রাণশক্তি। ধারাবাহিকতার বাইরে নতুন চিন্তার স্পন্দনও শুনেছি কিছু মানুষের মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে ঐ প্রাণশক্তিকেই বিশেষভাবে স্বাগত জানাতে ইচ্ছা যায়। রবীন্দ্রনাথ তো সমানভাবে দুই বাংলারই। তাঁকে প্রয়োজন দুই বাংলাতেই। যেমন সঙ্গীতে সাহিত্যে তেমনি শিক্ষায়, পল্লীসংগঠনে আর সর্বোপরি সকল প্রকার সংকীর্ণতা ও খর্বতাকে অতিক্রম করবার ব্রতে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের পথ দেখাতে পারেন সেই ভাষায় যে ভাষা আমরা ভালোবাসি।

ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলবে। তারই পাশাপাশি চাই গঠনমূলক কাজ আর কিছু মুক্তবুদ্ধি মানুষ। আশা করা যায় গঠনমূলক কাজে বাংলাদেশের নবজাগ্রত নারীশক্তি সামিল হবে বর্ধিত সংখ্যায় শহরে ও গ্রামে, সমাজের সর্বস্তরে। আর বুদ্ধিমুক্তির যে আন্দোলন পূর্ববঙ্গে বিশের দশকে জন্মলাভ করেও বারবার পথভ্রষ্ট হয়েছে, আজ রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ চিন্তার প্রেরণা সঙ্গে নিয়ে সেই আন্দোলন যদি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে তবেই মঙ্গল।

সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (১৯৮৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *