১. সমস্ত ঘটনাটা

সমস্ত ঘটনাটা ঘটে গেল চোখের নিমেষে। অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো।

 শংকর বসেছিল হাইওয়ের চণ্ডীতলার মোড়ে, বটতলা ঘেঁষে, দুলালের চায়ের দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে। রোজই বিকালে, সূর্যাস্তের আগে সে এখানে এসে বসে, চা খায়, এবং গ্রামের অন্যান্যরা যখন দোকানের ভিতরে বাইরে নানা কথা নিয়ে আসর সরগরম করে তোলে, সে বেঞ্চির এক পাশটিতে বসে, পশ্চিমের দিগন্তবিসারী মাঠের শেষে, দিকচক্রবালের দিকে তাকিয়ে সূর্যাস্ত দেখে। এই সময়টা সে সব ভুলে যায়। কলকাতার কথা, এই দূর গ্রাম-বাসের কথা, প্রতি দিনের নানা ঘটনা, নিজের কাজকর্ম, যা নিয়ে দিনে রাত্রে নানা আলোড়ন সৃষ্টি করে, কোনও কথাই এ সময়ে মনে থাকে না। এমন দিগন্তব্যাপী মাঠ, যা আকাশের গায়ে গিয়ে মিশেছে, এবং যেখানে সূর্য ক্রমে ক্রমে একটি বিশাল লাল টকটকে গোলকের মতে, যেন দিগন্তের ভূমিশয্যার পিছনে আস্তে আস্তে ডুবে যেতে থাকে। আকাশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে রক্তের ছটা, আর পাখিরা সেই ছটার রং ডানায় মেখে, জোড়ায়, কঁক বেঁধে অথবা একা নানা দিকে উড়ে যেতে থাকে, শংকর যেন স্পষ্ট বুঝতে পারে, পৃথিবী ক্রমাগত ঘুরে চলেছে। মনে হয়, পৃথিবীর আর কোথাও বসে এমন একটি মহিমময় দৃশ্য দেখা যাবে না। এই সময়টিতে ওর এই আটত্রিশ বছর বয়সের জীবনের যত সুখ-দুঃখ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, জট-জটিলতার অতীত, এক অনির্বচনীয়তায় ভরে ওঠে।

শংকর আজও সেই রকম চায়ের দোকানের বাইরের বেঞ্চিতে বসে, পশ্চিমের আকাশে তাকিয়ে সূর্যাস্ত দেখছিল। সময়টা মাঘের প্রথম দিক। সকাল থেকেই আকাশের নানা প্রান্তে টুকরো টুকরো মেঘ ছড়িয়ে ছিল। এখন সেই মেঘই যেন বিশাল এক ঝাঁক পাখির মতো, আকাশের মাঝখান থেকে, সারিবদ্ধ ভাবে একটি বিন্দুর আকারে পশ্চিমের রক্তাকাশে উধাও হয়ে চলেছে। আসলে একেই হয়তো কোদালে কুড়ুলে মেঘ বলে, এবং সেই মেঘের গায়ে রক্তের ছটা। শংকরের মনে হয়, অদৃশ্যে থেকে কোনও এক মহান শিল্পী যেন ক্রমান্বয়ে রঙের তুলি বুলিয়ে চলেছে। পাখির দল অন্যান্য দিনের মতোই, নিজেদের নিশানায় উড়ে চলেছে। আজকাল আমন ফসল কাটা হয়ে গেলেও মাঠ খা খা করে না! দিগন্ত জুড়ে রবিশস্যই কেবল না, ভিন্ন জাতের ধানের চারাও অনেক জায়গায় মাথা তুলেছে।

শংকর দেখছিল, ঝুলন্ত লাল গোলকের মতো সূর্যের নীচের অংশের রং যেন কিঞ্চিৎ ছায়াবৃত, ওপরের অংশটি অধিকতর উজ্জ্বল। সীমাহীন আকাশের মাঝখানে, পাখির ঝাকের মতো কোদালে কুড়ুলে মেঘ, প্রতি মুহূর্তে রং বদলাচ্ছে। এই সময়ে দূরে কোথাও থেকে একটা যান্ত্রিক গোঁ গোঁ শব্দ ভেসে আসছিল। সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। হাইওয়ের ওপর দিয়ে লরি, ট্রাক, কলকাতার এবং আঞ্চলিক বাস, প্রাইভেট গাড়ির যাতায়াত লেগেই আছে। ও যখন তন্ময় হয়ে সূর্যাস্ত দেখতে থাকে, তখন নানা শব্দে ওর চোখের ওপর দিয়ে গাড়ি চলে গেলেও, ও ফিরে তাকায় না। তাকাবার কথা মনেও পড়ে না, কোনও কৌতূহলও নেই।

কিন্তু আজ শংকরের কী মনে হল, ও বাঁ দিকে মুখ ফিরিয়ে, হাইওয়ের পূর্ব-দক্ষিণের দূরের বাঁকের দিকে তাকাল। একেই কি ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে? কোনও কারণেই ও এ সময়ে অন্য দিকে ফিরে তাকায় না, অনেকটা ধ্যানময়ের মতোই সূর্যাস্ত দেখে। মুখ ফিরিয়ে ও দেখতে পেল, একপাল ছাগল তাড়িয়ে নিয়ে, একটি সাত-আট বছরের ছেলে, রাস্তার উত্তর থেকে দক্ষিণে পার করে নিয়ে চলেছে। দূরে প্রাইভেট গাড়িটা আসছে কম করে সত্তর থেকে আশি কিলোমিটার বেগে, এবং পুব-দক্ষিণে বাঁক নিয়ে পশ্চিম-মুখো হয়েই, আচমকা ছাগলের পাল দেখে গতি কমাবার চেষ্টা করল। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গিয়েছে, কেন না, গতির সঙ্গে ব্রেক কষারও একটা সীমা আছে। অন্তত নিজেকে বাঁচাবার জন্য। চালক সমানে হর্ন দিয়ে যাচ্ছিল, যদিও ডাবল হর্নের একটি মাত্র বাজছিল, যার জোর তেমন নেই, এবং সামনের হেডলাইট দুটো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেটাও অর্থহীন, কারণ হেডলাইট জ্বালিয়ে যাকে সংকেত করা হচ্ছে, সাত-আট বছরের রাখাল ছেলেটি তার কিছুই বোঝে না। সে হতচকিত হয়ে দেখছিল, তার ছাগলগুলি এলোমেলো ছুটোছুটি জুড়ে দিয়েছে, আর হাতের ছোট ছপটিটা নিয়ে অসহায় ভাবে, রাস্তার প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে, ছাগলের পালকে রাস্তার দুপাশে সরিয়ে দেবার জন্য হইহই করছে।

শংকর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারল না। গাড়িটার গতি যদিও অর্ধেক হয়ে এসেছে, কিন্তু ভয়ংকর দুর্ঘটনা কিছুতেই এড়াতে পারল না। সামান্য ডাইনে বাঁয়ে করবার চেষ্টা করেও, ছেলেটাকে সোজা এসে ধাক্কা দিল। এটা প্রায় অনিবার্য ছিল, কারণ যে কোনও চালকই বাঁকের মুখে গাড়ির গতির তীব্রতা কমাতে বাধ্য। তা সে কমায়নি। চালকের পা বোধ হয় অ্যাকসেলারেটরের ওপর চেপে বসেছিল। গাড়িটা এক বার লাফিয়ে উঠল যেন, এবং একেবারে থেমে গেল।

শংকর দৌড়ে এগিয়ে গেল। আশ্চর্য, ছাগলের পাল ঠিক নিজেদের বাঁচিয়ে, রাস্তার দুপাশের ঢালুতে নেমে ম্যা ম্যা করে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল। ছেলেটাই চাপা পড়েছে। শংকর দৌড়ে যেতে যেতে, অবাক হয়ে দেখল, গাড়িটা হঠাৎ কিছুটা ব্যাক করল, এবং এঞ্জিনের শব্দেই টের পেল চালক পালাবার জন্য, ডান দিকে বাঁক নিয়ে একেবারে ফাস্ট গিয়ারে স্পিড তুলে এগিয়ে আসছে। শংকরের মুখ শক্ত হয়ে উঠল। ও দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে একেবারে চলন্ত গাড়ির চালকের দরজার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে উঠল, থামুন, থামুন বলছি।

চালক এমনই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল, সে ভাবতেই পারেনি, কেউ এসে তার দরজার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আসলে সে শংকরকে লক্ষই করেনি। হতচকিত হয়ে প্রথমে সে ব্রেক কষে গাড়ি দাঁড় করাল, কিন্তু কোনও চালকের মনে যদি এক বার ভয় আর অপরাধ বোধ যুগপৎ জেগে ওঠে, সে তখন মরিয়া হয়ে পালাবারই চেষ্টা করে। সে ব্রেক কষলেও, গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করেনি, বরং সহসা বাধা পেয়ে, সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। চকিতে দরজাটা খুলেই, সপাটে এমন ভাবে শংকরের দিকে ঠেলে দিল, দরজার ওপরের দিকটা সজোরে লাগল ওর কপাল আর ভুরুতে। আর একটা পাশ আঘাত করল বা গালে আর চোয়ালে। দরজার নীচের দিকটা আঘাত করল ওর পেটে কোমরে হাঁটুতে। চালক ভেবেছিল, আচমকা দরজার আঘাতেই শংকর ছিটকে পড়বে।

কিন্তু ফল হল উলটো। আঘাত খেয়ে, শংকর আরও নির্মম হয়ে উঠল, দরজাটা না ছেড়ে, রুদ্ধ কঠিন স্বরে বলল, এত বড় সাহস, খুনের ভয় দেখাচ্ছ আমাকে?’ ও হাত বাড়িয়ে চালকের হাত ধরে টানবার চেষ্টা করল। চালক তার মধ্যেই আরও কয়েক বার, ঝটিতি দরজার ধাক্কায় শংকরকে আঘাত করল, এবং যখন বুঝল, শংকরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া সম্ভব না, তখন গাড়ি স্টার্ট করে দিল। ইতিমধ্যে গাড়ির ভিতরে কারা ছিল, শংকর লক্ষই করেনি, কেবল ভয়ার্ত অস্ফুট কয়েকটি আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিল। গাড়ি স্টার্ট দিতেই, ও মুহূর্তে, প্রায় ঝুলন্ত অবস্থায় স্টিয়ারিঙে হাত দিয়ে আপ্রাণ শক্তিতে বাঁয়ে। মোচড় দিতে লাগল। তখন ওর মুখে কয়েকটা ঘুষি পড়েছে, কিন্তু গাড়ির ভিতর থেকে তীক্ষ্ণ একটা আর্তনাদ শোনা গেল, গাড়ি রাস্তার নীচে পড়ে যাবে।

সেই মুহূর্তেই গাড়িটা একেবারে থেমে গেল। শংকর চালকের বুকের জামা আঁকড়ে ধরে, এক এ্যাচকায় রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে এল, এবং ওর চওড়া হাতের মুঠি পাকিয়ে ঘুষি তুলতেই, গাড়ির ভিতর থেকে এক জন মহিলার আর্তনাদ ভেসে এল, মারবেন না, দোহাই, আপনার পায়ে পড়ি।

চালকও তখন দুহাত তুলে মার বাঁচাবার চেষ্টা করছিল। শংকরের আঘাতে উদ্যত হাত নেমে গেল। ইতিমধ্যে চায়ের দোকানে এবং আশেপাশে যারা ছিল, তারা হইহই করে ছুটে এল। শুধু হইহই করে এল না, এল মারমুখী হয়ে। শংকরের হাত থেকে কয়েকজন চালককে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করল। গাড়ির ভিতর থেকে ততক্ষণে দুজন তরুণী দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। শংকর মুহূর্তেই বুঝল, ঘটনার গতি অন্য দিকে মোড় নিচ্ছে। ও চালক যুবকটিকে দুহাতে আড়াল করে বলে উঠল, মারধোর এখন নয়, তার সময় অনেক পাওয়া যাবে। তোমরা আগে দেখো, যে ছেলেটি চাপা পড়েছে, তার কী অবস্থা। শিগগির ওকে তুলে নিয়ে এসো।

ভিড়ের মধ্যে থেকে এক জন বলে উঠলো, অই গ মাস্টের তুমার গোটা মুখখানা অক্তে ভেসে যাইচে যে?

সেটা পরে দেখলে হবে, আগে ছেলেটাকে নিয়ে এসো৷’ শংকর বলল।

আধুনিক বেশভূষায় সজ্জিত দুটি তরুণী এবং একটি বছর বারো-তেরো বয়েসের ছেলে তখন গাড়ি থেকে নেমে, শংকরের আড়াল করে রাখা গাড়ির চালকের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের চোখে মুখে ভয়ার্ত অসহায়তার ছাপ। চালক যুবকটি যে বেতনভোগী ড্রাইভার না, তার ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক-আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ডান হাতের কবজিতে দামি ঘড়ি, মণিরত্নের দুটি আংটি মধ্যমা ও অনামিকায়। অলংকার তরুণী দুটির অঙ্গে সামান্য হলেও যথেষ্ট মূল্যবান। যুবকটি এই মাঘের আসন্ন। সন্ধ্যায় ঘামছে। এখন তার আর মরিয়া ভাব নেই, চোখে মুখে ত্রস্ত ভয়।

ভিড় করে আসা গ্রামবাসীরা চিৎকার করে শাসাচ্ছে, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করছে। কেউ কেউ গাড়ির গায়েই কিল চড় মারছে। ইতিমধ্যে দু-তিনজন গ্রামের বউ-ঝিও হুতোশে ছুটে এসেছে। কার ছেলে, চাপা পড়েছে, সেটাই তাদের আতঙ্কিত অনুসন্ধিৎসা। একটু দূরেই পড়ে থাকা বালকটির দিকে কয়েকজন ছুটে গেল, এবং একজন তাকে দুহাতে তুলে শংকরের সামনে নিয়ে এল। বলল, মাস্টের, এ আমাদের বদি বাউরির বিটা, দেখ্যে মনে লিচ্ছে, ড বেঁচে লাই।

সমস্ত ভিড় অচৈতন্য ছেলেটার দিকে ফিরে তাকাল। কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠল, মেরে ফেলাইচে গ্য, ছেলেটার মাথা মুখ অক্তে ভেস্যে যাইচে!

শংকর লক্ষ করে দেখল, কেবল মুখ মাথা না, ধূলি ঝাড়া ছেঁড়া সামান্য বুক খোলা জামাটার ফাঁকে দেখতে পাচ্ছে, কণ্ঠার হাড় ও বুকের এক দিকে ফুলে উঠেছে। বাঁ পা নিশ্চয়ই চাকার তলায় পড়েছিল, থেঁতলে গিয়েছে। চোখ বোজা হাত পা এলানো শরীরটা দেখেই, শংকরের সন্দেহ হল, সত্যি হয় তো বেঁচে নেই! থাকাটাই আশ্চর্য কারণ যে বেগে এসে গাড়িটা ধাক্কা মেরেছে, তাতে যে-কোনও জোয়ানের পক্ষেও বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না। তবু যার কোলে ছেলেটি ছিল, গায়ে শুকনো একটা গামছা জড়ানো, কোমরে জড়ানো নেংটির মতো খাটো ধুতি, গায়ে এখনও মাঠের ধুলা লাগানো, তাকে লক্ষ্য করে বলল, পঞ্চু, তুমি ছেলেটাকে নিয়ে গাড়ির সামনে বসো। আগে আমাদের ব্লক হাসপাতালে নিয়ে চলো, বেঁচে আছে না মরে গেছে, সেটা ডাক্তারবাবু দেখে বলবেন।

কে একটি গ্রামের স্ত্রীলোক হুতোশে চিৎকার করে উঠল, আর তুমারে কে দেখবে গ্য মাস্টের? খুনেটা যে তুমাকেও মেরে ফেলাইচে গ্য!

মেরে না ফেললেও, শংকর মাথায় মুখে যন্ত্রণা বোধ করছিল। ইতিমধ্যেই ওর পাঞ্জাবির বুকে, কপাল থেকে রক্তের ফোঁটা পড়তে আরম্ভ করেছে। কিন্তু শংকর সে কথার কোনও জবাব না দিয়ে, গাড়ির চালক যুবকটিকে গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দিল, যান, আপনি স্টিয়ারিঙে গিয়ে বসুন। চালিয়ে নিয়ে যাবেন।

আর আমরা? আমরা কী করব?’ একজন তরুণী আর্তস্বরে বলে উঠল।

 শংকর মুখ ফিরিয়ে এই প্রথম তরুণীদের এবং কিশোর ছেলেটির দিকে তাকাল এই মুহূর্তে কারোকেই ভাল করে দেখবার অবকাশ নেই। শংকর কেবল দেখল, আর্তস্বরে কথা বলে ওঠা তরুণীর সিথেয় সিঁদুর। অন্যটির বয়স বোধ হয় সামান্য কম, এবং সিথেয় সিঁদুর নেই। ও বলল, আপনারাও গাড়ির পিছনে বসুন, কিন্তু আপনাদের সঙ্গে

না, এদের সব্বাইকে আমরা ছাড়ব নাই। শংকরের কথায় বাধা দিয়ে এক জন বলে উঠল।

শংকর মুখ ফিরিয়ে দেখল, অঞ্চল-প্রধান গুইরাম পাল কখন এসে দাঁড়িয়েছে। সে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে না চাইলেও, পুরোপুরি পারে না। তার কথা শুনে অনেকেই চিৎকার করে প্রতিধ্বনি করে উঠল, না, ইয়াদের সবাইকে আমরা ছাড়ব নাই।

শংকর গুইরামের ধোপদুরস্ত ধুতি পাঞ্জাবি পরা, বছর চল্লিশ বয়সের শক্ত-সমর্থ চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল, গুইরামবাবু এসে গেছেন, ভালই হয়েছে। আমি এদের কারোকেই ছাড়ব না, বলতে যাচ্ছিলাম, পেছনে আমাদের লোকও ওদের সঙ্গে দু-একজন যাবেন। আপনি যখন এসে গেছেন, আপনিই চলুন। আগে আমরা হাসপাতালে যাব। তারপরে থানায়। দুটোই কাছাকাছি।

গুইরামের অপ্রস্তুত মুখ দেখে বোঝা গেল, শংকরের এ রকম একটা প্রস্তাব সে আশা করেনি। যারা তার সমর্থনে চিৎকার করে উঠেছিল, সবাই তার মুখের দিকে তাকাল। শংকর সে দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ডাকল, পঞ্চু এসো, তুমি আর আমি বাউরির ছেলেকে নিয়ে সামনে বসি। চলে আসুন গুইরামবাবু, সঙ্গে কারোকে নিতে চান তো নিয়ে নিন, আর দেরি করা উচিত নয়।’ও তরুণীদের দিকে তাকিয়ে তাড়া দিল, নিন নিন উঠে পড়ুন, দেরি করবেন না।

পঞ্চু বদি বাউরির ছেলের রক্তাক্ত অচৈতন্য শরীর নিয়ে শংকরের কাছে এগিয়ে গেল। শংকর গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজাটা খুলে ধরল, এবং পঞ্চকে সামনের আসনে উঠতে সাহায্য করল। চালক যুবকটি সামনের ভিড় ঠেলে ড্রাইভারের আসনে গিয়ে বসতে যেন ভরসা পাচ্ছিল না, কারণ ক্রুদ্ধ গালাগাল চিৎকার চলছিলই। শংকর ধমকে উঠল, কী হল মশাই, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? পালিয়ে যাবার মতলবে তো খুব সাহস দেখিয়েছিলেন, এখন যে ভয়ে একেবারে জুজু হয়ে গেলেন? যান যান, নিজের জায়গায় বসুন।

গুইরাম পাল তখন কয়েকজনের সঙ্গে কী বলাবলি করছিল। যুবকটি ড্রাইভারের আসনে বসতে গিয়ে, দু-একজনের কনুই আর হাতের ধাক্কা খেল। এক জন চেঁচিয়ে বলল, আমাদের বিটা যদি মরে, ত শালা তুমাকেও আমরা জ্যান্ত যেতে দিব নাই।

ইতিমধ্যে তরুণীরা কিশোরকে নিয়ে পিছনের আসনে জড়সড় হয়ে বসেছে। গুইরাম সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, পাঁচ মিনিটের রাস্তা, তোমরা সবাই চলে এসো। কার্তিক, তুমি আমার সঙ্গে ওঠা।

কার্তিক পঞ্চায়েতের একজন সভ্য। শংকর জানে, হাসপাতালে আর থানার গ্রামবাসীদের ভিড় করার কোনও দরকারই নেই, একমাত্র হইচই হল্লা করা ছাড়া। এখন সবথেকে বড় প্রয়োজন, ছেলেটি বেঁচে থাকলে তার চিকিৎসা শুরু করা, এবং অপরাধীকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া। গুইরাম একাই সেক্ষেত্রে যথেষ্ট। তবু অঞ্চল-প্রধান হিসাবে গ্রামবাসীদের ডাকাটা বোধ হয় তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। শংকর সামনের আসনে বসে, বদি বাউরির ছেলেটির মাথা নিজের কোলে তুলে নিল। গুইরাম কার্তিককে নিয়ে পিছনের আসনে চাপাচাপি করে বসল। যুবক গাড়ি স্টার্ট করে আগে ব্যাক করল, তারপরে রাস্তায় উঠে, শংকরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোন দিকে যাব?

সোজা। শংকর জবাব দিল।

গাড়িটাকে ঘিরে তখনও লোকের ভিড় আর হই হুল্লা। যুবক হর্ন দিল। ইতিমধ্যে গাড়ির গায়ে দুমদাম ঘুষি পড়ছিল। গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। শংকর দেখল, পশ্চিমের আকাশে রক্তিম ইশারা। সন্ধ্যা আসন্ন। গাড়ির পিছনে লোজন হইহই করে ছুটে আসছে।

.

 গাড়ি যথেষ্ট আস্তে চললেও, মিনিট তিনেকের মধ্যেই এক কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে এল। ডান দিকে বি. ডি. ওর অফিস এবং কোয়ার্টার। আরও খানিকটা এগিয়ে থানাও ডান দিকে। মাঝামাঝি বাঁ দিকে ব্লক ডেভলপমেন্ট স্কিমের হাসপাতাল। গেট খোলাই ছিল। তার দিয়ে ঘেরা প্রায় দেড়-দু বিঘা জমির কম্পাউন্ডের মধ্যেই ডাক্তার নার্স এবং অন্যান্য স্টাফদের কোয়ার্টার। জন্মনিয়ন্ত্রণের বড় সাইনবোর্ড ছাড়াও, হাসপাতালের আলাদা বোর্ড রয়েছে। শংকর চিন্তিত ছিল, ডাক্তারকে পাওয়া যাবে কি না। সৌভাগ্যবশত দেখা গেল, ওর থেকেও কয়েক বছরের ছোট ডাক্তার সুজিত রায় সাইকেল নিয়ে হাসপাতালের গেটের দিকে হেঁটে বেরিয়ে আসছে। শংকর গাড়ির ভিতর থেকেই ডাক্তারের দিকে হাত বের করে তুলে দেখাল, এবং চালক যুবককে বলল, গাড়ি ভেতরে ঢুকিয়ে বিল্ডিঙের বারান্দার কাছে নিয়ে চলুন।

যুবক বাঁ দিক স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে, গাড়ি ঢোকাল হাসপাতাল কম্পাউন্ডের মধ্যে। মোরাম বিছানো রাস্তা দিয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল একতলা বিল্ডিঙের দীর্ঘ বারান্দার সামনের সিঁড়ির কাছে। ডাক্তারও সাইকেল নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এল গাড়ির কাছে। শংকর দরজা খুলে আগেই পঞ্চুর সঙ্গে ধরাধরি করে বদি বাউরির ছেলেকে নিয়ে গাড়ি থেকে বাইরে বেরোল। সুজিত ফরসা রোগা লম্বা, গোঁফ দাড়ি কামানো পরিষ্কার বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। সাদা ট্রাউজার আর ফুল স্লিভ সাদা শার্টের ওপর বাসন্তী রঙের হাত কাটা সোয়েটার গায়ে। বয়সের তুলনায় তার মুখ যেন বেশি গম্ভীর, বড় চোখ দুটিতে যেন কেমন বিষণ্ণতা, যা আপাত দৃষ্টিতে চোখে পড়ে না। শংকর আর পঞ্চুর হাতে বদি বাউরির ছেলেকে ও গাড়ির ভিতরে চকিতে এক বার চোখ বুলিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার শংকরবাবু?

অ্যাকসিডেন্ট। শংকর জবাব দিল, এবং পঞ্চসহ বদি বাউরির ছেলেকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলল, অবস্থা বোধ হয় ভাল নয়, তাড়াতাড়ি একটু দেখতে হবে। কিন্তু আলো তো জ্বলছে না দেখছি।

সুজিত বলল, ইলেকট্রিকের কথা বলছেন? সারা দিনে-রাত্রে ঘণ্টা চারেকের বেশি কারেন্ট কোনও দিনই থাকে না।

শংকরও তা জানে, যদিও গ্রামের ভিতরে ওর বাসস্থানে বিদ্যুতের কোনও ব্যবস্থা নেই। সারা গ্রামে মুষ্টিমেয় কয়েকটি বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে, এমনকী একটি বাড়িতে টেলিভিশনও আছে। কিন্তু গ্রাম যে অন্ধকারে ছিল, সেই অন্ধকারেই আছে। অধিকাংশ গ্রামবাসীর কাছে বিদ্যুৎ একান্ত বিলাসের বস্তু। যাদের আছে, তাদেরও বিজলি আলো পাখা মৃত গৃহশোভা মাত্র। কিন্তু একটা হাসপাতালের পক্ষে বিদ্যুৎ শোভা বা বিলাস না, আবশ্যিক প্রয়োজন। সারা দেশের দুর্দশার ভাগ তাকেও বহন করতে হয়, তবে তুলনা করলে, এখানে দুর্দশাটা বড় বেশি। রাত্রে কদাচিৎ আলো চোখে পড়ে।

ইতিমধ্যে গুইরাম কার্তিককে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমেছে। সুজিত সাইকেলটা বারান্দার গায়ে হেলান দিয়ে রাখতে রাখতে বলল, কিন্তু আপনার অবস্থাও তো ভাল দেখছি না। চলুন, এমারজেন্সি রুমের টেবিলে নিয়ে চলুন।বায়ে কোয়ার্টারের দিকে মুখ ফিরিয়ে গলা তুলে ডাকল, গোলক, গোলক কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি এসো।

এই সময়ে সাড়া পেয়ে, ভিতর থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এল। নীল পাড় সাদা শাড়ি, কালো দোহারা চেহারার বছর চব্বিশ-পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে। ডাক্তার তাকে দেখেই বলল, সিস্টার, এমারজেন্সি রুমে তাড়াতাড়ি ছোট হ্যাজাকটা নিয়ে আসুন।

নার্স ভিতরে চলে গেল। শংকর বারান্দার বাঁদিকে যেতে যেতে, গাড়ির দিকে ফিরে, চালক যুবকটিকে বলল, আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন।

যুবকটি গাড়ির স্টার্ট তখনও বন্ধ করেনি। এক বার পিছনের আসনের দিকে ফিরে তাকাল। সেখানে তখন উৎকণ্ঠা আর চোখের জল মোছামুছি চলছে। যুবক দেখল গুইরাম পাল এবং কার্তিক নামে তোক দুটি গাড়ির কাছেই পঁড়িয়ে আছে। সে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দরজা খুলে নামল। দূর থেকে গ্রামবাসীদের চিৎকার চেঁচামেচি ক্রমে এগিয়ে আসছে।

শংকর বারান্দার বাঁ দিকের শেষপ্রান্তে খোলা দরজা দিয়ে, পঞ্চর সঙ্গে বদি বাউরির ছেলেকে নিয়ে ঢুকল। দরজার মাথার ওপরে ইংরেজিতে লেখা, এমারজেন্সি’। ঘরটি প্রায় অন্ধকার, একটিমাত্র জানালা খোলা। এমারজেন্সি রুম বলতে যা বোঝায়, ঘরটিতে সে রকম কিছুই নেই। রুগি শোয়াবার জন্য একটি উঁচু টেবিলের ওপর প্লাস্টিকের কভার। একটি বালিশ। এক পাশে একটি আলমারি। মাথার ওপরে নিশ্চল পাখা, দেওয়ালে দুটি আলোর কাচের ঝিলিক শুধু। শংকর আর পঞ্চ বদি বাউরির ছেলেকে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিল। হাসপাতালের ভিতরে যাবার একটি দরজা রয়েছে। সেই দরজা। দিয়ে সুজিত ঢুকল। পিছনে নার্সের সঙ্গে, হাফপ্যান্ট পরা, গায়ে চাদর জড়ানো খালি পা, মাঝবয়সি একজন ছোট একটি হ্যাজাক নিয়ে ঘরে ঢুকল। যুবকটি এসে দাঁড়াল বারান্দার দিকের দরজায়। তার পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকল গুইরাম।

সুজিত এগিয়ে এল টেবিলের সামনে, ঝুঁকে দেখল বদি বাউরির ছেলের নিথর শরীর ও রক্তাক্ত মুখের দিকে। আস্তে আস্তে তার দৃষ্টি ছেলেটির মাথা থেকে, সারা গা বুলিয়ে নেমে এল পায়ের দিকে। তার গম্ভীর মুখ থমথমিয়ে উঠল। ছেলেটির একটি হাত তুলে এক বার কব্জিতে স্পর্শ করল। একটি চোখের পাতা খুলে এক বার দেখল, তারপর তাকাল শংকরের দিকে। স্তব্ধ ঘরে কেবল সকলের মৃদু নিশ্বাসের শব্দ। সকলের দৃষ্টি সুজিতের মুখের দিকে। সুজিত চকিতে এক বার বাইরের দরজায় যুবকের দিকে দেখে, আবার শংকরের দিকে তাকিয়ে বলল, ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ছেলেটি মারা গেছে। গাড়ি নিশ্চয়ই বেশ স্পিডে আসছিল।

ই কথা আমার পেথমেই মনে হইচিল গ্য! পঞ্চু আর্তস্বরে বলে উঠল, মনে লিইচিল কী, উয়ার শরীলে পেরাণ নাই।

শংকর বলল, আমারও তাই মনে হয়েছিল। ধাক্কা মারার সময় গাড়ির স্পিড মিনিমাম তিরিশ থেকে চল্লিশ কিলোমিটার ছিল। ছেলেটি অনেকটা দূরে ছিটকে পড়েছিল। তারপরেও এই ভদ্রলোক–। কথা শেষ না করে সে দরজার ওপরে যুবকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।

যুবক মুখ নিচু করল। শংকর বলল, সুজিতবাবু, আপনি মৃত্যুর কারণ লিখে একটা সার্টিফিকেট দিন। আমরা গাড়ি নিয়ে থানায় যাচ্ছি।’

আমার যা করবার তা আমি করছি।’সুজিত বলল, থানার অফিসার ঠিক করবেন, ডেডবডি ময়না। তদন্তে পাঠাবেন কি না। কেসের প্রয়োজনে তা করতেই হবে বোধ হয়। কিন্তু আপনার কপাল ভুরু কাটল কেমন করে? বাঁ গালে কালসিটে পড়ে গেছে। কী করে এমন হল?

শংকর এই প্রথম বাঁ গালে আলতো করে নিজের হাতে স্পর্শ করল। অনুভব করল চোখের নীচে হাড়ের ওপর গাল ফুলে উঠেছে। ও আর এক বার দরজার ওপর যুবকের দিকে দেখে নিয়ে, একটু হেসে বলল, অ্যাকসিডেন্ট কেউ ইচ্ছে করে করে না, এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ভয় পেলে মানুষ। কতখানি অপরাধী হয়ে উঠতে পারে, সে অভিজ্ঞতা আমার আগেও ছিল, আজ আর এক বার হল। কিন্তু ও সব কথা থাক। আমার চিকিৎসা পরে করবেন, তার আগে আমার দায়িত্বটা পালন করি। আইনের কাজটা সেরে ফেলি, গাড়ি আর তার চালককে থানায় জমা করে দিয়ে আসি। ও আর এক বার যুবকের দিকে তাকাল।

থানায় আপনি পরে গেলেও হবে।’ সুজিত শংকরের সামনে এগিয়ে এসে তার মুখের আঘাত দেখে বলল, অন্তত ভুরুর ওপরে একটা জায়গায় স্টিচ তো করতেই হবে। অ্যান্টি-টিটেনাস ইনজেকশন একটা, আর দু-একটা ওষুধও এখনই দেওয়া দরকার। সে গুইরামের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ওই ভদ্রলোককে আর গাড়ি নিয়ে আপনিই থানায় চলে যান। শংকরবাবুকে আমি দশ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে দিচ্ছি।

গুইরাম ব্যস্ত উৎসাহে বলল, া হ্যাঁ, ক্যানে নয়। আমিই নিয়ে যাচ্ছি থানায়। সে দরজার দিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল।

এই সময়ে হাসপাতালের কম্পাউন্ডে বহু লোকের চিৎকার শোনা গেল। শংকর ডাকল, শুনুন গুইরামবাবু।

গুইরাম ফিরে তাকাল। শংকর বলল, কাছে আসুন।

গুইরামের মুখ দেখে বোঝা গেল, শংকরের ডাকাডাকি, কথা শোনা তার তেমন পছন্দ না। তবু এগিয়ে এল। শংকর গলার স্বর নামিয়ে বলল, বাইরে লোকজন ক্ষেপে আছে। গাড়িটা ড্যামেজ করতে পারে, বা ছেলেটিকে মারধোর করতে পারে। আমি জানি, আপনার কথা সবাই শুনবে। মেয়েরাও রয়েছে গাড়ির মধ্যে, ওদের অক্ষত অবস্থায় থানায় জমা করে দিন।

আরে মশাই সে কথা আপনাকে বলতে লাগবে ক্যানে?’ গুইরাম গেরামভারি চালে কথাটা বলে, আবার দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলে গেল, মাস্টেরবাবুরা সবেতেই মাস্টেরি না করে থাকতে পারে না। আইন কি আমরা কম বুঝি?’ সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

শংকর আর সুজিত এক বার চোখাচোখি করল। শংকরের ঠোঁটে বিমর্ষ হাসি ফুটল। কিন্তু সুজিতের। মুখ গম্ভীর হল। ও নার্সের দিকে ফিরে বলল, সিস্টার, আপনি স্টিচ ইনজেকশন সব নিয়ে আমার ঘরে যান। হ্যারিকেনের আলোতেই আমি শংকরবাবুকে দেখব। গোলক, তুমি এ ঘরে থাকো আর তোমার। কী নাম যেন?

পঞ্চু। শংকর বলল।

সুজিত বলল, তুমিও একটু থাকো। আসুন শংকরবাবু।

পঞ্চু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, থাইকব গ্য বাবু, থাইকব। কিন্তুক বদি বাউরির বউটার, বদি নাই, বেধবা মেয়্যামানুষটার ইটি বড় বিটা ছিল। ধান পান দুটা পয়সা ই বিটাই ওজগার কইরত, এখন কী হবেক গ্য?

গোলক বলল, হুঁ হুঁ পঞ্চু, ই ত কপালের লিখন হে, ই কেউ খণ্ডাতে পারে নাই।

শংকর আর এক বার বদি বাউরির মৃত ছেলেটির রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ আগেও টগবগে জীবন্ত ছেলেটা জাতীয় সড়কের ওপরে, অসহায় হুতোশে বিভ্রান্ত পশুগুলোকে লাঠি তাড়া করে, গাড়ি চাপা পড়া থেকে বাঁচাতে ছুটোছুটি করছিল। কিন্তু বলি হয়েছে ও নিজেই। মানুষ যুক্তিতে বিশ্বাসী, শংকরও। তবু অমোঘ দৈব যেন সব যুক্তিকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ও সুজিতকে অনুসরণ করতে করতে শুনতে পায়, বাইরের লোকজনের হইচইয়ের মধ্যে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ। গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে।

শংকর ভিতরে যাবার দরজা দিয়ে ঢুকল। হাসপাতাল ওর অচেনা না। এমারজেন্সি রুমের বাইরেই এক ফালি সরু করিডর। বাঁ দিকের ঘরটি হাসপাতালের ও-টি। এবং তা নামে মাত্রই। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তো দূরের কথা, অক্সিজেন দেবারও ব্যবস্থা নেই। একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার পুরনো হয়ে অনেক দিন পড়ে আছে। অপারেশনের যন্ত্রপাতির অভাব, প্রয়োজনীয় ওষুধও সবসময়ে থাকে না। চার বিছানার একটি ওয়ার্ড, তুলনায় রুগির সংখ্যা অনেক বেশি। মেঝের ওপরেও রুগিদের থাকবার ব্যবস্থা করতেই হয়। কোন রুগি হাসপাতালে জায়গা পাবে না পাবে, সেটাও তাদের ভাগ্যের লিখন। কারণ, দলাদলি।

শংকর ও-টির পরে পাশাপাশি আর একটি দরজা বন্ধ ঘর পেরিয়ে, মুখোমুখি আর একটি ঘরের সম্মুখীন হল, ভিতরে আলো জ্বলছে। সুজিতের ঘর। ডাক্তারের খাস চেম্বার যাকে বলে। সুজিত দাঁড়িয়ে ছিল দরজার পাশেই। ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, আসুন।

শংকর ভিতরে ঢুকল। ডাক্তারের খাস চেম্বার বলতে, একটি সানমাইকার টেবিল, টেবিলের ওপর এক পাশে কিছু কাগজপত্র, কলমদান, টেবিল-ল্যাম্পের শোভা। ডাক্তারের নিজের চেয়ার ছাড়া আরও তিনটে চেয়ার মুখোমুখি। দেওয়ালে একটি ইংরেজি ক্যালেন্ডার। দেওয়ালের গায়ে একটি কাচের পাল্লা দেওয়া দেয়াল আলমারি, তার তাকের ওপর রয়েছে কয়েকটি শিশি বোতল কৌটো। আপাতত টেবিলের ওপর জ্বলছে একটি হ্যারিকেন।

সুজিত না বসে আবার দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, বসুন শংকরবাবু। আমি দেখছি, সিস্টার সব নিয়ে আসছে কি না।

সুজিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই, করিডরে নার্সের গলা শোনা গেল, আমি এসে গেছি।

শংকর এতক্ষণে অবকাশ পেল, পকেট থেকে, সস্তা ভাজা তামাকের সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই বের করার। কিন্তু বাধা দিল সুজিত। সে টেবিলের কাছে সরে এসে বলল, সিগারেট পরে ধরাবেন শংকরবাবু, আগে আমার কাজটা করে নিই।

নার্স ঘরে ঢুকল একটা বড় ব্যাগ নিয়ে। টেবিলের ওপরে ব্যাগ রেখে তার মুখ খুলল। সুজিত হ্যারিকেনটা উঁচু করে তুলে ধরল। নার্স একটা বড় ইথারের শিশি আর তুলো বের করে, আগে তুলো ইথারে ভিজিয়ে সুজিতের হাতে দিল। সুজিত হ্যারিকেনটা টেবিলে রেখে, ইথারে ভেজানো তুলো দিয়ে শংকরের কপাল, ভুরুর ওপরের ক্ষতে, আলতো করে রক্ত মুছতে মুছতে বলল, ধাক্কা লাগল ছেলেটির, কিন্তু আপনার এ রকম লাগল কী করে, সে কথাটা কিন্তু পরিষ্কার হল না। বাঁ দিকের ভুরুর ওপরটা তো চামড়া ফেটে গেছে। ডান দিকেরটা ততখানি নয়। কপালের ওপরেও দেড় ইঞ্চির মতো কেটে গেছে।

শংকর কিছু না বলে হাসল। ওর টেবিলের ওপর রাখা হাতে দেশলাই আর সিগারেটের প্যাকেট। ইথারের কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ল ওর উন্নত নাকে আর চিবুকে। চোখ বুজে বলল, বলব পরে।

সুজিত নার্সের দিকে ফিরল। নার্স হাতে স্টিচের নিডলে সুতো পরিয়ে প্রস্তুত। সুজিত নিজের হাতে সেটা নিয়ে বলল, আপনি একটু হ্যারিকেনটা তুলে ধরুন সিস্টার। সে শংকরের মাথাটা চেয়ারের পিছনে ঠেকিয়ে দিয়ে বলল, মাথাটা এ ভাবে রাখুন, একটু লাগবে, সহ্য করতে হবে। পারবেন না?

পারব।’ শংকর বলল।

সুজিত দ্রুত হাতে আগে কপালে এবং পরে বাঁ ভুরুর ওপরে স্টিচ করল! শংকর ঠোঁটে ঠোঁট টিপে রইল। তেমন কিছু যন্ত্রণাবোধ করল না। ছুঁচ ফেঁড় দেবার সময় যা একটু লাগছিল। কিন্তু সুজিতের দুরন্ত হাতে সেলাই হয়ে গেল যেন নিমেষে। সেলাইয়ের পরেই, ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে, তুলো চাপা দিয়ে, ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল কপাল থেকে মাথার পিছন থেকে জড়িয়ে। নার্স মেয়েটি এক হাতে হ্যারিকেন ধরে, অন্য হাতে সব জোগাড় দিল। শংকরের চেহারাটা গেল বদলে। ও ব্যান্ডেজের ওপর এক বার হাত দিয়ে দেখে বলল, মাথার পেছনে চুল সুদ্ধ ঢাকা পড়ে গেল। কতদিন এ ব্যান্ডেজ রাখতে হবে?

আপাতত তিন দিন এ ব্যান্ডেজ খোলা চলবে না। সুজিত ইথারে তুলো ভিজিয়ে শংকরের বাঁ দিকের গাল মুছতে মুছতে বলল, আর এ তিন দিন জল লাগানো চলবে না। ইথারের তুলো রেখে সে নার্সের হাত থেকে মারকিউরাক্রমের শিশি নিয়ে, তুলোতে ভিজিয়ে, গালে লাগিয়ে দিল।

শংকর বলল, সর্বনাশ! বলেন কী? তিন দিন চান করতে পারব না?

গা ধুতে পারবেন, মাথায় জল ঢালতে পারবেন না।সুজিত এই প্রথম হাসল, বলল, তবে যদি বোধ করেন, মাথা খুব গরম হয়ে গেছে, তবে ভেজা তোয়ালে বা গামছা দিয়ে, মাথাটা মুছে ফেলবেন।

মাথা আমার খুব গরম নয় ডাক্তারবাবু। শংকর হেসে বলল, রোজ স্নানের অভ্যাস, অস্বস্তি হবে।

তা হবে। সুজিত বলল, কিন্তু উপায় নেই। জল লাগলে সেপটিকের ভয় আছে। তিন দিনের পরও কয়েক দিন যাতে জল না লাগে, তাও দেখতে হবে। তিন দিন পরে ব্যান্ডেজ খুলে নতুন করে ড্রেস করতে হবে। প্রথমে এক দিন অন্তর, তারপরে রোজ কয়েক দিন। ধরে নিন দু সপ্তাহের ধাক্কা। সে নার্সের দিকে ফিরল।

নার্সের হাতে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ ধরাই ছিল। সুজিত সিরিঞ্জ নিয়ে বলল, আপনার পাঞ্জাবির হাতটা গোটাতে হবে।

শংকর সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই টেবিলে রেখে, বাঁ হাতের মোটা কাপড়ের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে অনেকখানি তুলে, ডানা এগিয়ে দিল। সুজিত বাঁ হাতে ইথারের তুলো দিয়ে ডানা মুছে, ইনজেকশান দিল। নার্সের দিকে সিরিঞ্জ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আপনি এ বার তুলোটুলোগুলো তুলে সব গুছিয়ে নিয়ে চলে যান। ওষুধ আমি দিচ্ছি, আপনি এক গেলাস জল দিয়ে যাবেন।

নার্স মাথা ঝাঁকিয়ে, নির্দেশ অনুযায়ী সব গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল। সুজিত বলল, আপনার শরীরের আর কোথাও লাগেনি তো? ঠিক জানেন?

শংকরের তলপেট এবং ঊরুতে সামান্য ব্যথা করছিল। কিন্তু ও বলল, না সে রকম কিছু লাগেনি।

তা হলে এ বার সিগারেট ধরিয়ে বলুন তো, আপনার মুখে এ রকম চোট লাগল কেমন করে? সুজিত ঘরের দেওয়াল আলমারির কাচের পাল্লা খুলল, কিন্তু মুখ ফেরানো শংকরের দিকে।

শংকর সিগারেট ধরিয়ে, একটি দীর্ঘ টান দিয়ে, ধোঁয়া ছাড়ল।

সুজিত বলল, এক মিনিট, আমি ওষুধগুলো বের করি আগে।

শংকর বলল, আপনাকে তো তখনই বলেছিলাম, দুর্ঘটনার জন্য কে কতটা দায়ী, তা বিবেচ্য কিন্তু দুর্ঘটনার পরে কেউ যদি অপরাধ প্রবণ হয়ে ওঠে, সে যে কী করতে পারে না পারে, সে নিজেও বোধ হয় জানে না।

সুজিত রাংতায় মোড়া কিছু ওষুধ নিয়ে টেবিলের সামনে ওর নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল, জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল শংকরের দিকে। শংকর সিগারেটে টান দিয়ে, অ্যাকসিডেন্ট এবং তার পরবর্তী ঘটনা সুজিতকে বলল। কথাগুলো শুনতে শুনতে, সুজিতের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, কিন্তু চোখে উৎকণ্ঠিত বিস্ময়। বলল, তার মানে, আপনি স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে দিতে না পারলে, ও হয় তো আপনাকেও চাকার তলায় পিষে দিয়ে যেতে পারত।

তা চলন্ত অবস্থায় আমি যদি ছিটকে পড়তাম, পেছনের চাকার তলায় হয় তো চলে যেতাম।শংকর হাসল।

সুজিত প্রায় ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে বলল, আপনি হাসছেন? ভদ্রবেশী লোকটা তো একটা জঘন্য ক্রিমিনাল বলে মনে হচ্ছে। তার হাতে কোনও অস্ত্র থাকলে, তা দিয়েই হয়তো আপনাকে সাবাড় করে দিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যেত।

তা হয়তো পারত। শংকর ওর স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হেসে বলল, অবস্থা বিপাকে, কে যে কী ক্রাইম করতে পারে, ক্রিমিনাল নিজেও তা জানে না।

সুজিত জোরে মাথা নেড়ে বলল, না না শংকরবাবু, এ ক্ষেত্রে আপনার এ রকম সিনিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি আমি মেনে নিতে পারছি না। এ অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। আপনি না বললেও, আমিই থানায় এ ঘটনা বলব।’

কী দরকার ডাক্তারবাবু? শাস্তি তো ওর এমনিতেই হবে। শংকর শান্ত স্বরে বলল।

সুজিত কিছু বলতে যাচ্ছিল। নার্স কাচের গেলাসে জল নিয়ে ঢুকল। গেলাস টেবিলে রেখে, জিজ্ঞেস করল, আর কিছু দিতে হবে?

না, আপনি ওয়ার্ডে যান।সুজিত রাংতার মোড়ক ছিঁড়ে ওষুধ বের করতে করতে বলল।

নার্স চলে যাবার আগে এক বার শংকরের দিকে দেখল। সুজিত দু রকমের তিনটি বড়ি দিয়ে বলল, এগুলো খেয়ে ফেলুন, আর বাকিগুলো নিয়ে যান। আজ রাত্রে শোবার আগে তিনটি বড়ি খাবেন। কাল থেকে দিনে তিন বার এই ওষুধই চলবে। ফুরিয়ে গেলে আর দিতে পারব কি না বলতে পারি না, আপনাকে বিষ্ণুপুর থেকে আনিয়ে নিতে হবে। আমি প্রেসকৃপশন লিখে দেব। আর তিন দিন পরে ইস্কুলে যাবার আগে সকালবেলা আমার এখানে আসবেন, আমিই ড্রেস করে দেব।

শংকর গেলাস তুলে গলায় জল ঢেলে, বড়ি তিনটি মুখে ফেলে একসঙ্গে গিলে ফেলল। বাকি জলটুকুও চুমুক দিয়ে শেষ করল। সুজিত আবার কিছু বলবার উদ্যোগ করতেই, বাইরে থেকে স্ত্রী-স্বরের আর্তকান্না ভেসে এল, অ আমার বুধাই, তোকে কোন যমে খেয়া লিল র‍্যা…অ আমার বুধাই কুথায় গ্য।

বদির বউ এসেছে। শংকর উঠে দাঁড়াল, আমি যাই।

সুজিত চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, চলুন, আমিও যাই। আপনি ওষুধগুলো পকেটে নিন।

শংকর ওষুধ পকেটে পুরে ঘরের বাইরে গেল। এমারজেন্সি রুমের ছোট হ্যাজাকের আলোরই সামান্য রেশ করিডরের অন্ধকার অনেকটা লঘু করে দিয়েছে। শংকর সেই আলোয় এমারজেন্সি রুমে ঢুকে দেখল, বদির বউ টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে, দুহাতে বুধাইকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদছে। গোলক সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে, অই, শুন গ্য বদির বউ, কাদিস নাই।

বুধাইয়ের রক্ত শুকিয়ে যাওয়া মুখে, সারা গায়ে নিজের মুখ ঘষতে ঘষতে বদির বউ কেঁদে বলল, আমি পোড়াকপালি রাড়ি মাগি, বুধাই, আমার বড় বিটা গ্য, উ যে আমার সব ভরসা ছিল গ্য। উয়াকে ক্যানে যম কেড়ে লিল…।’ সে বুধাইয়ের মুখটা বুকের কাছে তুলে চিৎকার করে ডাকল, অ বাপ বুধাই, এক বার চখ মেল্যে দেখবি নাই, নাই কি র‍্যা? মা বুল্যে আর ডাকবি নাই, নাই কি র‍্যা?

শংকর কী বলবে, ভেবে পাচ্ছে না। বদির বউকে সে চেনে। একই গাঁয়ের, দক্ষিণে বাউরিপাড়ার বউ। সারা গায়ে হাতে মাঠের ধুলা, গায়ে শুকনো কাদার দাগ। খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। অভাব। অনটনের মধ্যেও, বদির বউয়ের খেটে খাওয়া শরীরে এখনও স্বাস্থ্যের দীপ্তি আছে। ভাসা চোখ বোঁচা নাক মুখে একটা শ্ৰী আছে। বয়সও বেশি না, পঁচিশ-ছাব্বিশ হতে পারে। শংকরের সঙ্গে পথে-ঘাটে দেখা হলে, ছেঁড়া খাটো ময়লা শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা টানবার অনর্থক চেষ্টা করে, হেসে বলে, গড় করি গ্য মাস্টেরবাবুর। জবাবে শংকরের সামান্য কুশল জিজ্ঞাসা, ভাল আছো?’ বদির বউয়ের জবাব, আমাদিগের আর ভাল মন্দ, চলে যাইচে।’ এ পর্যন্তই। কিন্তু দুর্ঘটনায় সদ্যমৃত পুত্রের মাকে কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়, শংকরের তা জানা নেই। তার বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে যাচ্ছে, একটা অসহায় কষ্ট ছাড়া আর কোনও অনুভূতি নেই। ও সুজিতের মুখের দিকে তাকাল।

পঞ্চু ডেকে বলল, আই গ বদির বউ, মাস্টেরবাবু আইচেন।

কই কুথায়?’ বদির বউ ছেলের মাথা টেবিলে রেখে মুখ তুলল, আর শংকরকে দেখে, টেবিলের পাশ দিয়ে ছুটে এসে হাঁটু পেতে পায়ের কাছে বসে, দুহাত তুলে হাহা স্বরে কেঁদে উঠল, বলল, অই মাস্টেরবাবু, আমি শুনিচি, তুমি গাড়িঅলাকে ধরেছ। কিন্তু আমার কী হবেক গ মাস্টেরবাবু। গাড়িঅলা কি আমার বুধাইয়ের পেরানটা ফিরাই দিবেক?

পঞ্চু এগিয়ে এসে বলল, অ বদির বউ, শুন ক্যানে।

কী শুনব গ, আঁ, কী শুনব?’ বদির বউ বুক চাপড়ে বলল, বুধাই আমার বড় বিটা, ছোট বিটা বিটি দুটা খালায়েক কুরাগুড়া। বুধাইয়ের মুখ চেয়ে আমি কারুকে সাঙা করি নাই, বাবুদিগের সঙ্গে নাঙিন করি নাই। কত ফোঁসলানি, ফিসফাস গুজগুজ, কুন কথায় কান দিই নাই। ক্যানে? না আমার বুধাই মরদ হচ্ছে, উ সমসার দেখবেক। হা আমার পেত্যয় গ…।’ কান্নায় তার কথা ভেসে গেল। মাথা নিচু করে মেঝেতে ঠুকল।

শংকর অসহায় ব্যাকুল চোখে পঞ্চু আর গোলকের দিকে তাকাল। ও জানে, বদির যুবতী বিধবা একটি কথাও মিথ্যা বলেনি। সাঙা তাকে কেউ কেউ করতে চেয়েছিল। তার ফলে সন্তানদের অযত্ন হবে, সেই ভয়ে বিয়ে করেনি। বাবুদের লোভের হাতছানিতে সে ভোলেনি, নষ্ট হয়নি, একমাত্র বুধাইয়ের বড় হবার ভরসায়। পঞ্চ এগিয়ে এসে বদির বউয়ের মাথাটা চেপে ধরে তাকে তুলে বসাল। এত সহবত জ্ঞান, এখন বুকের কাপড় খসে পড়ে, মায়ের বুক জোড়া উদাস। পঞ্চু বলল, অই গ বদির বউ শুন, এমন করে কপাল ঠুইকলে কি তুমার বুধাইকে ফিরে পাবে? নিজের শরীলটাকে ক্যানে ভাঙচুর কর।

বদির বউয়ের চুল খোলা। মাথাটা ওপর দিকে তুলে, চোখ বুজে ঘাড় নাড়তে লাগল। চোখে জলের ধারা।

সুজিত বলল, ভাবছ কেন, যে চাপা দিয়েছে, সে তো ধরা পড়েছে। বিচার একটা হবেই।

আর কী বিচার হবেক গ বাবু। বদির বউ উঠে দাঁড়িয়ে বুক ঢাকল, টেবিলের উপর শোওয়ানো বুধাইয়ের গায়ে হাত রেখে, মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ভগবানের বিচার হেথা শুয়ে রইচে। আ…! কী তুমার বিচার গ, বুইতে লারলাম। বুধাই র‍্যা!’ সে বুধাইয়ের বুকে মুখ রাখল।

শংকর সুজিতের মুখের দিকে এক বার দেখে, মাথা নিচু করে ঘরের বাইরে এল। হাসপাতালের বারান্দা থেকে নেমে, খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়াল। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা। এ সময়ে শংকরের বাইরে থাকবার কথা না। সূর্যাস্তের পরেই ও প্রতিদিনের মতো ফিরে যেত নিজের ঘরে। গায়ের চাদরটা জড়িয়ে আবার বেরিয়ে পড়ত পশ্চিমপাড়ায়, ছাত্র পড়াতে। ছাত্র পড়ানোটা তার রুজির কারণে না, একা হাতে ঘরকন্না করতে সে অসমর্থ। ইস্কুলের শিক্ষক হিসাবে, সময় ওর হাতে থাকে, কিন্তু জীবনে একটা কাজ ওর দ্বারা কখনও সম্ভব হয়নি। নিজের হাতে রান্না করে খাওয়া। সবাই সব পারে না। খুঁজলে, রান্নার লোক হয়তো গ্রামে খুঁজে পাওয়া যেত। তার ঝামেলাও কম না। ওর মতো একলা মানুষের পক্ষে ঝাড়া হাত পা হওয়া যায় না। সেটাও এক রকমের সংসার পেতে বসার মতো। এক জনের ওপর সব দায়িত্ব দিয়েও নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। গ্রামে শহরের মতো হোটেল কেউ আশা করতে পারে না। সেই কারণেই, সকালে রাত্রে, দুটি বাড়িতে ও ছাত্র পড়ায়, প্রতিদানে, নগদ মূল্যের বদলে, দুপুরে রাত্রে আহারের ব্যবস্থা। গ্রামে এ রকম সুযোগ পাওয়াও এক রকম ভাগ্যের কথা। যদিও ভাগ্যের দরজাটা সহজে খোলেনি, কারণ গ্রামীণ জীবনের ক্ষেত্রে এ রকম ব্যবস্থার প্রচলন, বলতে গেলে কোথাও বিশেষ দেখা যায় না। এবং যে কোনও দিনই এ ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ে পড়তেও পারে। বাইরে থেকে গ্রামের জীবনযাত্রাকে যতটা সহজ দেখায়, আদৌ তেমন সহজ না।

যাই হোক, শংকর বাইরে বেরিয়ে এই মুহূর্তে একটি মাত্র জামা গায়ে থাকলেও শীত বোধ করছে না। সেটা ওর আটত্রিশ বছর বয়সের উত্তাপ বা ঋজু দীর্ঘ শরীরের জন্য না। দুর্ঘটনার আকস্মিকতা ও বুধাইয়ের মৃত্যুর আঘাত ও সহজ ভাবে নেবার চেষ্টা করলেও, বদির বউয়ের কান্না ওকে জীবনের নতুন। জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। বিশেষ করে, বুধাইয়ের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে তার শেষ কথাটা ওর মস্তিষ্কের কোষে কোষে বাজছে, ভগমানের বিচার হেথা শুয়ে রইচে! আ…কী তুমার বিচার গ, বুইতে পারলাম।’…তা ছাড়াও দুর্ভাগা বাউরি বিধবাটি যে কয়টি কথা বলেছে, তার মধ্যে ফুটে উঠেছে, একটি অসহায় রমণীর নির্মম জীবনের সারাৎসার। তার জীবনের এই পরিপ্রেক্ষিতে, কে কোন অভয়বাণী শোনাতে পারে?

শংকর ওর কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখটা আকাশের দিকে তুলল। কুয়াশা নেই, ইতিমধ্যেই অজস্র তারার বিন্দু ঝিকমিক করছে। সেই ঝিকিমিকি তারায় তারায় কেবল একটা রহস্যের হাসি, এই পৃথিবী নামক গ্রহের, কোনও এক বিধবা বাউরি বউয়ের জিজ্ঞাসার কোনও জবাব নেই। যেন চিরকাল ধরেই সীমাহীন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঘুরপাক খেতে খেতে, একই নির্বাক রহস্যের হাসি হেসে চলেছে। তথাপি মানুষ নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে কোনও জবাবের প্রত্যাশা করে না, তার নিজের জীবন থেকেই সে জবাব খুঁজে নিতে চায়। হয়তো বদির বিধবাও নিজের জিজ্ঞাসার জবাব নিজেই খুঁজে নেবে। সংসারের এটাই নিয়ম।

.

শংকরের গায়ের ওপর টর্চের আলো পড়ল। সুজিতের গলা শোনা গেল, শংকরবাবু? আমি ভাবলাম, আমার দেরি দেখে, আপনি বোধ হয় থানায় চলে গেছেন।

না যাইনি, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। শংকর মুখ ফিরিয়ে জবাব দিল। সুজিতের হাতের টর্চের আলো সাইকেলের সামনে বেতের ঝুড়িতে পড়ল, কিছু দেখল। তারপর টর্চের আলো নীচে নামিয়ে, সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, টর্চ আর হসপিটালের লেটার প্যাডটা আনতে গিয়ে একটু দেরি হয়ে গেল। চলুন।

শংকর টর্চের আলোয় সুজিতের পাশাপাশি চলতে চলতে হেসে বলল, ডাক্তারবাবু, আমার কথা শুনে তখন বলছিলেন, আমার সিনিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি আপনি মেনে নিতে পারছেন না। বদুর বউ আপনার বিচারের জবাবে মরা ছেলেকে দেখিয়ে বলল, ভগবানের বিচার তার সামনে পড়ে রয়েছে। তার কী জবাব দেবেন?

সুজিত বলল, শংকরবাবু, আপনি সমস্ত ব্যাপারকে এক রকমের দার্শনিক দৃষ্টিতে দেখছেন। হয়তো বদির বউয়ের কথা খুবই সত্যি। ছেলেই যখন মরে গেল, তখন আর কীসের বিচার? কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কি আমরা চলতে পারি? আমরা চাই অপরাধের বিচার হবে, অপরাধী শাস্তি পাবে। আপনিও কি তাই চান না?

নিশ্চয়ই চাই৷ শংকর বলল, অপরাধ, বিচার, শাস্তি, এ সব তো আমাদের জীবন ধারণের আবশ্যিক ব্যাপার। তার ওপরেও বোধ হয় কিছু আছে, যেখানে আমরা অসহায়। অবিশ্যি তা বলে আমি হাত পা গুটিয়ে থাকতে বলছি না।

সুজিত বলল, আমিও সে কথাই বলছি। আমি মশাই ডাক্তারি করি। যদি ধরে নিই, ধন্বন্তরি ওঝা বলে কেউ সত্যি ছিল, তাকেও কিন্তু বস্তুর সাহায্য নিতেই হয়েছিল। মন্ত্রে তন্ত্রে ব্যাধি সারে না। তেমনি সভ্য সমাজে বাস করতে গেলে, আমরা যে কোনও ব্যাপারেই একটা ব্যবস্থা না নিয়ে পারি না। সে ব্যবস্থার ফলাফল যা-ই হোক। অবিশ্যি কথাগুলো আপনাকে বলার কোনও মানে হয় না, নিজেরই কানে। কেমন বক্তৃতার মতো লাগছে।

আপনার সঙ্গে আমার মতবিরোধ কিছু নেই।শংকর হাসল, বলল,’কোনও কারণেই আমরা নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতে পারি না। ওটা তো আমাদের স্বভাবের মধ্যেই রয়েছে। তবু আপনার কথাটাই আপনাকে শোনাচ্ছি, কোনও ব্যবস্থার ফলাফল সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই।

হাসপাতালের গেটের বাইরে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই পশ্চিমের দূর থেকে হেডলাইটের আলো পড়ল ওদের গায়ে। শংকর আর সুজিত দুজনেই দাঁড়াল। আলো দুটো দেখলেই বোঝা যায়, ট্রাক অথবা। বাস আসছে। বাস হলে থানার কাছাকাছি দাঁড়াবে। সুজিত বলল, আপনার কথা আমি বুঝেছি। তবু। বলি, একজন রুগিকে যখন চিকিৎসা করি, তখন কিন্তু বাঁচিয়ে বা সারিয়ে তোলার ফলাফলেই বিশ্বাস করি।

তা নইলে তো আপনার চিকিৎসা করাই চলে না। শংকর বলল, হয় তো আমার কথাও বক্তৃতার মতো শোনাবে, তবু বলছি, আশা না থাকলে, কীসের জোরেই বা কোনও কাজ করা যায়? মানুষ তো নিয়তির হাতের খেলার পুতুল নয়।

সুজিত ওর বাঁ পাশে শংকরের মুখের দিকে তাকাল। শংকরের মুখে, ক্রমাগত এগিয়ে আসা গাড়ির হেডলাইটের আলো। ওর ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা। সুজিতের চোখে কেমন সংশয় ও সন্দেহ জাগল। শংকর মুখ ফিরিয়ে সুজিতের মুখের দিকে দেখল। সুজিতের চোখে সন্দেহের ছায়া দেখতে পেল। কিছু বলল না, কেবল ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসিটুকু গোপন করার চেষ্টা করল। অন্ধকার ভেদ করে হেডলাইট দুটো দ্রুত এগিয়ে এল, এবং থানার সামনে না পঁড়িয়ে, ঝড়ের বেগে শংকর সুজিতের গায়ে বাতাসের ঝাপটা দিয়ে চলে গেল। অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে উঠল। সুজিত হাতের টর্চলাইট জ্বালল। মাঘের ঝরা শুকনো পাতার খড়খড় আওয়াজ। টর্চের আলো পিচের রাস্তার ওপর পড়ল। দুজনেই বড় রাস্তায় উঠে, পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলল। একটু দুরেই ডান দিকে থানার ঘরে হ্যাজাকের আলোর রেশ বাইরে দেখা যাচ্ছে। সুজিত যেন আপন মনে উচ্চারণ করল, আপনার শেষের কথাটা মনের মধ্যে কেমন একটা খটকা ধরিয়ে দিল।

কীসের খটকা?

 তা বলতে পারিনে। আপনি কি নিজে সত্যি বিশ্বাস করেন, মানুষ নিয়তির হাতের খেলার পুতুল নয়?

এখন শংকরের মুখে আলো নেই। ওর ঠোঁটে আবার হাসি ফুটল। ওর মনে হয়েছিল, সুজিত এ রকম কিছু জিজ্ঞেস করবে। সুজিতের চোখে সন্দেহের ছায়া দেখেই কথাটা মনে হয়েছিল। ও বলল, বিশ্বাস করতে চেষ্টা করি। তা নইলে কোন তাগিদে কলকাতা ছেড়ে এই গ্রামে এসে পড়ে আছি, বলুন!

সুজিত বলল, তাই কি শংকরবাবু? আমার তো ধারণা, আপনি এখানে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে পড়ে আছেন।

আর আপনি কি এখানে অনিচ্ছায় নির্বাসিত হয়ে পড়ে আছেন?’ শংকর হেসে জিজ্ঞেস করল।

সুজিত দাঁড়িয়ে পড়ে, শংকরের গলার কাছে টর্চের আলো ফেলল। ওর মুখ স্পষ্ট দেখা গেল। ওর ঠোঁটে হাসি। এখন টর্চের আলোয় চোখ দুটো লাল দেখাচ্ছে। শংকরও সুজিতের মুখ অস্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বেশ কয়েক মুহূর্ত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারপরে দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠল। সুজিত টর্চের আলো নিচু করল, বলল, শংকরবাবু, আপনাকে এক বছরের ওপর দেখছি, কিন্তু সত্যি বলছি, আপনাকে আমি বুঝে উঠতে পারি না।

সে কী! আপনি কি আমাকে পাচোয়াড় লোক ভাবছেন নাকি?

মোটেই না! পাচোয়াড় তোক চিনতে আমার অসুবিধে হয় না। এখানে এসে দুবছরে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। কলকাতা থেকে এখানে যখন বদলি হয়ে এসেছিলাম, তখন একটা আশা নিয়ে এসেছিলাম গ্রামের মানুষের সেবা করার সুযোগ পেয়ে, বেশ একটা আনন্দ পেয়েছিলাম, ভারী উৎসাহ ছিল মনে। কিন্তু ছ’মাসের মধ্যেই আমার সমস্ত মোহ ঘুচে গেছে। পাচোয়াড় কাকে বলে, আমি জানি। আপনাকে আমি কখনও সেই চোখে দেখিনি। সে দিক থেকে দেখলে, আপনাকে আমি শ্রদ্ধাই করি।

শ্রদ্ধা?’ শংকর হেসে বলে উঠল, না না ডাক্তারবাবু, শ্রদ্ধাট্রদ্ধা বলবেন না। আপনি আমাকে প্রীতির চোখে দেখেন, সেটা জানি, আর সেটাই আমার ভাগ্য। পাচোয়াড় কথাটা আমি ঠাট্টা করে বলেছি। আমি জানি, আপনি আমাকে সেই চোখে দেখেন না। তবে আপনি একটা কথা ঠিকই বলেছেন, স্বেচ্ছা নির্বাসন না হলেও, আমি গ্রামে থাকাটাই বেছে নিয়েছি, আর তার জন্য মনকে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু আপনি মুখে না বললেও, এখান থেকে চলে যেতে চান, সেটা আমি বুঝি। তাই ও কথা বললাম।

সুজিতের আরও কিছু বলার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু দুজনেই তখন থানার গেটের সামনে এসে পড়েছে। থানার বারান্দায় দুদিকে দুটো হ্যারিকেন জ্বলছে। সামনের ঘরে হ্যাজাকের জোরালো আলোটা বাইরে থেকে দেখা যায় না, কিন্তু তার রেশ বাইরে এসে পড়েছে। দুপাশের ঘরেও আলো জ্বলছে। দেখা গেল, থানার প্রাঙ্গণে, এক পাশে একটি জিপ, অন্য পাশে বুধাইকে চাপা দেওয়া সেই গাড়িটি। গ্রামের লোকেরা ভিড় করে আছে থানার প্রাঙ্গণে, বারান্দার ওপরে। এক জন মাত্র সেপাই সামনের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে। লোকজনের মধ্যে কে বলে উঠল, অই, শংকর মাস্টের আর ডাক্তারবাবু আইচেস গ।