১. শুভার দীর্ঘশ্বাস পড়ে

শুভার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ভাবে, কে তার এমন নাম রেখেছিল। শুভা। ছি ছি! যে মেয়ে এমন একটা প্রকাণ্ড অশুভা, অশুভ যার চারপাশে মৌরসিপাট্টা করে গেড়ে বসে আছে, তার শুভা নামটাই একটা ঠাট্টা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে, গরাদহীন জানালাটার ধারে, ঠাণ্ডা দেওয়ালে গাল পেতে, ও বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে অন্ধকার। জানালা দরজা প্রায় সবই বন্ধ। শুধু এই জানালাটাই শুভা খুলে দিয়েছে। এটা পুবের জানালা, ঠাণ্ডা বাতাস আসে না। সব বন্ধ করে কেমন যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। খাট, বিছানা, ওয়ারড্রব আলমারি, ড্রেসিংটেবল, পাশের আর একটা ঘরের সোফাসেট, বইয়ের আলমারি, সেক্রেটারিয়েট টেবল, সবই যেন ওকে গিলতে আসে। আলো জ্বালাতে আরও খারাপ লাগে। তখন। যেন নিজের অসহায় অবস্থাটা আরও বেশি করে চোখে পড়তে থাকে। রাত্রি হলেই, যে উদ্বেগ থার্মোমিটারের পারার মতো ডিগ্রিতে ডিগ্রিতে বাড়তে থাকে, আলো জ্বাললে যেন সেই অসহায় উদ্বিগ্নতা আরও তীব্র হয়ে উঠতে থাকে।

অথচ ঘর অন্ধকার করে দিয়েও থাকতে পারে না। মনে হয়, একটা ভয়ংকর অন্ধকার হাঁ যেন গিলতে আসছে। তখন জানালা খুলে দিয়ে, বাইরের দিকে চেয়ে থাকলে, তবু যেন একটু স্বস্তি বোধ হয়। তবু যেন মনের অন্ধকার থেকে একটু বেরিয়ে আসা যায়। তবু যেন এ ঘরের পরিবেশ থেকে, নিজেকে একটু অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়।

কিন্তু এও যেন এক যক্ষপুরীর দেশ। এই দোতলা ঘরের চারপাশে, আটতলা দশতলা ছতলা চারতলা বিশাল ইমারতগুলো যেন বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই দোতলা বাড়িটার, পুবের এই জানালার নীচে, অনেকখানি জমি নিয়ে কেমন করে এত বড় একটা গ্যারেজ বজায় রাখা গিয়েছে, শুভা বুঝতে পারে না। নীচের দিকে তাকালেই মস্ত বড় ঢেউ-খেলানো অ্যাসবেসটরের চালটা যেন ওর চোখের সামনে, রৌদ্র-ছায়ার নানা রঙে, পুকুরের মতো টলটল করে। এ বাড়ি আর গ্যারেজের মাঝখানে, ডান দিক ঘেঁষে একটা জামগাছও রয়েছে। সেখানে পাখিদের জটলা হয়। গ্যারেজের চালে, ভোরবেলাতেই কাকেরা ভিড় করে। এ বছরের মরশুমে, জামগাছে, জাম হতেও দেখেছে শুভ। কেউ-ই প্রায় খায় না। অ্যাসবেসটরের সাদা চালে, পাকা জাম পড়ে পড়ে জাম রঙের ছোপ লেগে যায়। কোনও কোনও দিন হয়তো দেখা গিয়েছে, গ্যারেজের কোনও ছোকরা ক্লিনার বা মেরামতি মিস্তিরি বা ড্রাইভার চালে উঠে জাম পাড়ছে। তাও, গ্যারেজের দরোয়ানকে লুকিয়ে চুরিয়ে। তার চোখে পড়লেই চিৎকার করে গাল দেয়।

এখানে আর কারাই বা জাম খাবে। চারপাশে যারা আছে, তারা বোধ হয় কেউ জাম খায় না। তারা হয়তো স্ট্রবেরি বা পিচ বা আঙুর খেতেই ভালবাসে। জামের স্বাদ জানে না। অধিকাংশই তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, পার্শি, বড়লোক মুসলমান, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের ধনী অবাঙালি এবং বাঙালিরা এই সব আকাশ-ছোঁয়া বাড়িগুলোতে থাকে। দু-তিন ফুটের একটা পরিত্যক্ত জমির ফালিতে, কোথায় একটা জামগাছ আছে, এখানকার অধিবাসীদের চোখেও পড়ে না বোধ হয়। পাশেই নিউ মার্কেট। সেখানে মরশুমের সময় ধুয়ে মুছে রঙিন ডালিতে জাম রাখা হয়, তাই হয়তো চোখে পড়ে। ইচ্ছে হলে কেনে।

জানালা দিয়ে, আশেপাশে, কত রকমের পরিবার, দম্পতি, মেয়ে পুরুষ শিশুদের যে দেখতে পায় শুভা। মনে হয়, শুধু ভারতবর্ষ না, গোটা পৃথিবীর সব রকমের মানুষ এখানে আছে। রুশ, আমেরিকান, ইংরেজ, ফরাসি, সব রকম। এ পাড়াটাই তো সেই রকম। তবে, একটা কথা খালি মনে হয়, জামা কাপড় শাড়ি ফ্রক যা কিছুরই তফাত থাক, যাদের যেমনই খাবার হোক, তবু যেন সব মিলিয়ে, এরা সব এক রকম। এদের দেখলেই মনে হয়, এরা এক আলাদা জগতের মানুষ। এরা পাশাপাশি থাকে, কথাবার্তা তেমন বলে না, পাশাপাশি মেলামেশা নেই, তবু এরা যেন একই গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন পরিবার।

কেবল একটা বাড়িকেই, আগে আগে খুব রহস্যময় মনে হত। পশ্চিমের জানালা খুললে, চারতলা প্রকাণ্ড বাড়িটার পিছন দিক দেখা যায়। শুভা শুনেছিল, ওটা একটা হোটেল। এখন জানতে পেরেছে, ওটা হোটেলের নামে চলে বটে, আসলে লুকিয়ে মেয়েদের দেহের ব্যবসা বাড়ি। বে-আইনি ব্যবসা, শহরের এমন জায়গায়, এত বড় বাড়িতে, দিনে রাত্রে চলে, অথচ পুলিশ নাকি কিছুই জানে না। ভাবলে, শুভার মতো মেয়েরও, ঠোঁট বেঁকে যায়। সত্যিই তো, অপরাধীরা লুকিয়ে পাপ করে। পুলিশ কেমন করেই বা জানবে। এই সব অপরাধীরা তো দিনের বেলা মিছিল করে অপরাধ করে না। পুলিশ এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কেমন করে!

প্রথম প্রথম শুভা দেখত, বাড়িটার যে কোনও জানালাই যখন খোলে, সব জানালাতেই আলাদা আলাদা মেয়ের মুখ। আবার, কয়েক দিন যাকে দেখা গেল এক জানালায়, কয়েক দিন পরে, আবার অন্য মেয়ের মুখ সেখানে। হয়তো, শ্যামাঙ্গিনীর জায়গায়, এক গৌরাঙ্গী ফুক-ফুক করে সিগারেট খাচ্ছে। আর শ্যামাঙ্গিনীকে দেখা গেল, অন্য জানালায়, গেলাসে করে কী যেন চুমুক দিচ্ছে। প্রথমে অবাক কৌতূহল, তারপরে চমক। দুপুরে সন্ধ্যায় রাত্রে, আলাদা আলাদা পুরুষের চেহারা হঠাৎ দেখা যেত। জানালাগুলো অধিকাংশ সময় তো বন্ধই থাকে। হঠাৎ হঠাৎ খুলে যায়, আর হঠাৎ হঠাৎই ওরকম দেখা যায়। তারপর আরও কিছু চোখে পড়তে আরম্ভ করেছিল। মেয়ে পুরুষের নানান আচরণ। শরীরের নগ্নতা, আচরণের নগ্নতা চোখে পড়েছিল।

প্রথম দিনটা ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠেছিল, যখন দেখেছিল, উলঙ্গ মেয়ে পুরুষ, রাস্তার কুকুরের মতো খেলা করছে। মুহূর্তের জন্যেই। মুহূর্তের জন্যেই হয়তো তাদের খেলার আবেশে, জানালা খোলা ছিল। তারপরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তারপরেও যেটুকু বুঝতে অসুবিধে ছিল, সেটুকুও বুঝিয়ে দিয়েছিল একদিন এক মত্ত শক্ত হাত। শুভার ঘাড় চেপে ধরে, পশ্চিমের জানালাটার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। জানালাটা খুলে, চারতলা বাড়িটার দিকে দেখিয়ে বলেছিল, বেশি তেড়িবেড়ি করলে, ওই বাড়িটায় ঢুকিয়ে দিয়ে আসব। সতীর যত সতীত্বপনা, বিলকুল ওখানে মিলে যাবে। সতীর বিচার যারা করে, কাজিরা সব ওই বাড়িতে আছে। ছেনালি!

তারপরে আর কিছু বোঝবার ছিল না। কিন্তু তারপরে, পশ্চিমের জানালা খুলে প্রকাণ্ড চারতলা বাড়িটা যত বার চোখে পড়েছে, শুভার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠেছে। সেই কেমন করাটা কেবল ভয় না। কল্পনায় যেন ও বাড়ির খোপে খোপে মেয়েদের সে দেখতে পায়। কল্পনায় নিজেকেও যেন সেখানে দেখতে পায়। আর তৎক্ষণাৎ মুখে হাত চাপা দিয়ে, শক্ত হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।

শুভা পশ্চিমের জানালাটা খুলতে এখন ভুলেই গিয়েছে। তা ছাড়া, এই শীতের সময় তো খোলবার কোনও দরকারও নেই।

শীতের রাত্রি। চারিপাশেই নিঝুম। মাঝে মাঝে গ্যারেজে এসে গাড়ি ঢুকছে। তাও শব্দ শোনা যাচ্ছে। চারপাশের আকাশ-ছোঁয়া বাড়িগুলোর শত শত জানালা। যেন শত শত আলো ঝলসানো চোখ। বাতি জ্বালানো ব্যালকনিগুলো যেন ভিন্ন ভিন্ন ছাঁদের শূন্যে দোলানো দোলনা। কোনও কোনও বিল্ডিংয়ের এলিভেটর-এর ওঠানামা কাঁচের শার্সি দিয়ে দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু নিঝুমতা যতই ঘনিয়ে আসে, জানালাগুলো ততই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে, ব্যালকনির দোলনাগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। ঘরে ঘরে বাতি নিভতে থাকে, তাই সবই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। যেন যক্ষপুরীর ঘরে ঘরে ঘুম নেমে এসে, বাতি নিভিয়ে দিতে থাকে। বন্ধ কাঁচের ঝিকিমিকিও চোখে পড়ে না। কেবল সিঁড়ি বা বারান্দার দু-একটা আলো জ্বলতে থাকে। বিশাল ইমারতগুলোকে এখন মনে হয়, ঋজু বাঁকা বা বৃত্তের নানা আকারে, অতিকায় জীবগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

চারপাশের আলো যত নিভে যায়, আকাশের তারাগুলো যেন ততই জেগে ওঠে। নক্ষত্রেরা যেন অনেক নীচে নেমে আসে, উঁচু বাড়িগুলোর ছাদের কাছাকাছি। শহরের আলো যতক্ষণ জ্বলে, ততক্ষণ নক্ষত্র কাছে আসে না। চারপাশে যতই নিঝুমতা নেমে আসে, গ্যারেজে গাড়ি আসার শব্দও ততই কমে আসে। আর শুভার বুকের মধ্যেও উদ্বেগ থরথরানি বাড়তে থাকে।

বাইরের অন্ধকার যত বাড়ে, শব্দ যত কমে, ততই যেন এক ভয়ংকর পায়ের শব্দ দূর থেকে ওর কানে এসে বাজতে থাকে। বুকের মধ্যে বিধতে থাকে, একটা উৎকণ্ঠা ভয় আর যন্ত্রণা পাক দিয়ে দিয়ে উঠতে থাকে। জানালার ধারে দেওয়ালের গায়ে, আরও চেপে ধরে নিজেকে। যেন আড়াল করতে চায়। শরীরটা রক্তশূন্য মনে হতে থাকে। নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে, যেন হাঁফ লাগে।…

হঠাৎ আটতলা বাড়িটার, কয়েকটা জানালায় আলো ফুটে উঠতে থাকে। দু-একটা গলার উঁচু স্বর শোনা যায়। হয়তো কিছু একটা ঘটেছে। কেন না, গলার স্বর ক্রমেই বাড়তে থাকে। শুভা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। প্রথমেই ওর মনে অশুভ চিন্তা জাগে। কেউ কি মারা গেল। না কি, বিশেষ কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। আলোগুলো জ্বলে ওঠা আর গলার স্বরের ডাকাডাকিগুলো শুনলে, একটা অশুভ ঘটনার মতোই মনে হয়।

ভাবতে ভাবতেই, শুভা চমকে আটতলা বাড়িটার ছাদের দিকে তাকাল। ও কি সত্যিই দেখতে পাচ্ছে, আলসেহীন ছাদের ওপর দিয়ে, একটা মানুষের মূর্তি এক দিক থেকে, আর এক দিকে ছুটে যাচ্ছে। তা হলে কি চোর নাকি! লোকটা ওখানে উঠল কী করে। কে লোকটা। বাড়িরই লোক, নাকি বাইরের লোক। বাইরের অচেনা লোক দরোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকবে কেমন করে। ঢুকলেও, সিঁড়ি বেয়ে, দরজা খুলে, ছাদে উঠবে কোন সাহসে!

ইতিমধ্যে চারপাশের গোলমাল আরও বেড়ে উঠতে থাকে। জানালায় জানালায় নানা মুখের উঁকিঝুঁকি। এ জানালা থেকে, ও জানালায় নানান জিজ্ঞাসাবাদ, কোন দিকে গেল? পালিয়েছে? নীচে নেমে যায়নি তো! ছাদে গেছে বোধ হয়…

নানান জনের নানান কথা। নানা দিকে ছুটোছুটি। দশতলা ছ তলাগুলোতেও আলো জ্বলে উঠতে আরম্ভ করেছে। চারদিক থেকে শত শত চোখের মতো জানালাগুলোতে আলো জ্বলে উঠছে। আলো ছড়িয়ে পড়ছে।

অন্ধকার ঘর থেকে, শুভাই একমাত্র পলাতককে দেখতে পাচ্ছে। মুর্তির ভাব-ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, সে-ই পলাতক। তার পিছনেই লোক ছুটছে। কিন্তু কোন সাহসে লোকটা ছাদে উঠেছে। এইবারই তো সবাই ওকে ধরে ফেলবে।

কিন্তু শুভার বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে গেল। দুই চোখে ওর আতঙ্ক। আটতলা বাড়িটার দুটো অংশ, দুটো ব্লক। মাঝখানে দশ বারো ফুটের মতো ফাঁক। দুই অংশেরই ছাদে, বড় বড় জলের ট্যাঙ্ক। একটা দুই ইঞ্চি ডায়ামেটারের পাইপ, এক ছাদের ট্যাঙ্ক থেকে আর এক ছাদের ট্যাঙ্কে জোড়া লাগানো। শুভা দেখল, লোকটা সেই পাইপ ধরে ঝুলে পড়েছে। প্রাণে বাঁচবার চেয়ে, ধরা পড়ার ভয় কি এত বেশি? লোকটা তো পড়ল বলে! শুভা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, মসৃণ পাইপটা, লোকটার ভারে ভোঙা হয়ে পড়ছে, বেশ জোরে জোরে দুলছে। কিন্তু লোকটা থামছে না।

ইতিমধ্যে কয়েকটা টর্চের আলো লোকটার গায়ে পড়ল। ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর নীচে, ওপরে, জানালায় জানালায় চিৎকার শোনা গেল, ওই যে, পাইপ বেয়ে যাচ্ছে। অন্য ব্লকে চলে যাচ্ছে।

কয়েকটা টর্চের আলো, লোকটাকে যেন সঙ্গিনের মতো বিধে আছে। সেই আলোতেই শুভা দেখতে পেল, কয়েকটা ঢিল এবং জুতো নীচের থেকে কারা ছুড়ছে। তার মধ্যে একটা মাত্র ঢিলই লোকটার প্যান্ট-পরা হাঁটুর কাছে স্পর্শ করল।

কিন্তু লোকটা না থেমে, একটু একটু করে এগিয়েই চলেছে। পাইপের মাঝামাঝি যখন এসেছে, তখন পাইপটাকে প্রায় ধনুকের মতো বাঁকা দেখাল। আর লোকটা হঠাৎ যেন থেমে গেল। শুভা নিশ্বাস বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত টিপে রইল। নিশ্চয়ই লোকটা আর ঝুলে থাকতে পারছে না। হাত নিশ্চয়ই ঘেমে ভিজে উঠেছে। শরীরের ভার আর ধরে রাখতে পারছে না। পড়বার পর, ওকে আর কারুর মারবার দরকার হবে না। আটতলা উঁচু থেকে পড়ে, এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।

পড়ে যাবার দৃশ্যটা সহ্য হবে না বলে, শুভা জানালার পাশ থেকে সরে আসতে গেল। আর লোকটা তখনই, বন্ধ মেশিন চালু হয়ে যাওয়ার মতো, আবার চলতে আরম্ভ করল। শুভা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি লোকটার এত জোর! না কি মরার ভয়েতেই, এরকম শক্তি পাচ্ছে। কোথায় চুরি করতে এসেছিল লোকটা! এমনকী চুরি করতে এসেছিল, যে জন্যে এমন ভয়াবহ বিপদে পড়তেও ভয় পায়নি।

ইতিমধ্যে, যে ব্লকের দিকে লোকটা চলেছে, সেই ব্লকের ফ্ল্যাটগুলোর জানালায় জানালায় আলো জ্বলে উঠতে আরম্ভ করেছে। পালাবার কোনও উপায়ই নেই। লোকটা কি তা বুঝতে পারছে না। যদি বুঝতে পেরে থাকে, তবে এমন ভয়ংকর ভাবে জীবন-সংশয় করে, পাইপ বেয়ে পালাতে গেল কেন।

লোকটার জন্যে, শুভার উদ্বেগের কোনও কারণই থাকতে পারে না। একটা চোরের জন্য, কারুর কোনও উদ্বেগ হয় না। কিন্তু, নিজে সে একলা একলা ব্যাপারটা দেখছে। লোকটাও একলা একলা এভাবে পালাবার চেষ্টা করছে। সেই জন্যেই বোধ হয়, এরকম একটা উদ্বেগে ওর বুকের মধ্যে ধক ধক করছে। সকলের সঙ্গে থেকে, হইচই করলে এরকম হয়তো মনে হত না। তা ছাড়া, লোকটা এমন একটা দূরত্বে, ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তাতে চোরের ভয়টাও ঠিক হচ্ছে না। বরং লোকটা হয় মরবে, না হয় ধরা পড়বেই, এ কথা ভেবে কেমন যেন বেচারি বেচারিই মনে হচ্ছে। সব চোরের যা হয়, এরও তাই হবে।

এ ধরনের চোরেরা যে কেমন হয়, শুভা জানে না। চোরেদের সম্পর্কে তার একটা সাধারণ ভীতি আছে। যেটা, অধিকাংশ মেয়েদেরই বা মানুষদেরই থাকে। এখন যে ভয়টা ঠিক লাগছে না।

কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা যে সত্যি অন্য ব্লকের ছাদে গিয়ে পৌঁছল! ইতিমধ্যে, যে ব্লকের ছাদ থেকে লোকটা পাইপে ঝুলে পড়েছিল, সেই ছাদে কয়েকজন লোক এসে পড়েছে। তাদের এক জনের হাতে টর্চ। টর্চের আলো পড়ল লোকটার গায়ে। লোকটা অন্য ব্লকের ছাদে পৌঁছেই, জলের ট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে কোথায় যে মিলিয়ে গেল, শুভা দেখতে পেল

যেখানেই যাক, এবার লোকটা ধরা পড়বেই। নিশ্চয় অমন উঁচু ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না। আর সিঁড়ি দিয়ে, এতক্ষণে, অবধারিত ভাবে, লোকজন ছাদে উঠে আসছে। অথচ পাশের ছাদ থেকে যারা টর্চের আলো ফেলছে, তারা যেন কেমন দিশেহারা। টর্চের আলো যেন বিভ্রান্তের মতো, চারদিকে হাতড়ে ফিরছে। কে একজন চিৎকার করে উঠল, শিগগির পাশের ছাদে উঠে পড়ো। কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। চোর ব্যাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না।

সেই চিৎকার শেষ হবার আগেই, পাশের ব্লকের ছাদেও কয়েক জনের মূর্তি ভেসে উঠল। তাদের কাছেও দুটো টর্চ লাইট। তারা ছুটোছুটি করে, চারপাশে আলো ফেলে দেখছে। জলের ট্যাঙ্কের আশেপাশে, তলায়, সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না।

অন্য ছাদ থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, পাওয়া যাচ্ছে না?

পাশের ছাদ থেকে জবাব গেল, না, কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

ভাল করে দেখো, নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে। ভূত তো না, এভাবে হাওয়া হয়ে যেতে পারে না।

অন্ধকার একলা ঘরে, গরাদহীন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শুভাও অবাক হয়ে গেল। আশ্চর্য, কোথায় পালাতে পারে লোকটা! বোধ হয়, এক বা দেড় মিনিট সময় পেয়েছে লোকটা। এইটুকু সময়ের মধ্যে, পাইপ বেয়ে ছাদে নেমেই, কোথায় অদৃশ্য হতে পারে!

একজনের গলা শোনা গেল, পাইপ বেয়ে ঠিক এ ছাদেই এসেছিল তো?

অন্য ছাদ থেকে জবাব এল, নিশ্চয়ই। সবাই দেখেছে ওকে পাইপ বেয়ে যেতে। ওই হুদা ম্যানসনটার দিকে দেখেছ?

দেখেছি।

নরম্যান কোর্টের দিকে?

 তাও দেখেছি।

 তবে ওই বাজপেয়ী বিল্ডিংয়ের দিকে দেখো।

ওদিকে তো আগেই দেখেছি।

হঠাৎ সবাই যেন কী রকম চুপচাপ হয়ে যায়। অন্যান্য মেয়ে-পুরুষদের গলা শোনা যায় জানালায় জানালায়, ব্যালকনি, বারান্দায়। কয়েক বার পুলিশের হুইশলও বেজে উঠেছে। নীচের রাস্তায় হয়তো  পুলিশের গাড়িও এতক্ষণে এসে গিয়েছে।

শুভা অবাক হয়ে ভাবে, কোথায় যেতে পারে লোকটা! সে তো নিজের চোখে দেখেছে লোকটাকে পাইপ বেয়ে নামতে।

আরও খানিকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি চলল। কিন্তু দুরের এই অন্ধকার ঘরের কোণ থেকেই, শুভা বুঝতে পারল, তার সন্ধানীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। তাদের উৎসাহে ভাঁটা এসে পড়েছে। চোরকে তারা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে, দরজা জানালা বন্ধ হবার শব্দ পাওয়া যেতে লাগল। একটা করে ফ্ল্যাটের আলো নিভে যেতে লাগল। বোঝা গেল, চোরের আশা সবাই আস্তে আস্তে ত্যাগ করছে। যে যার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকছে। একমাত্র, ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর দরোয়ান আর পুলিশের সেপাইরাই বোধ হয়, নীচে, রাস্তায়, বাগানে, উঠোনে, সিঁড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আরও প্রায় পনেরো মিনিট কেটে যাবার পর, আবার আগের মতোই নিঃশব্দ হয়ে আসতে লাগল সব। ফ্ল্যাটগুলো অধিকাংশই অন্ধকার হয়ে এল। এমনকী, শুভার কানে ঝিঁঝির ডাক পৌঁছল।

শুভার এখন আর সেই উদ্বেগটা নেই। মনে মনে খানিকটা ভয়ই পেল। কী সাংঘাতিক লোক! এমন চোরকে কে ভয় না পায়! কোথায় পালিয়ে গেল লোকটা! ও কি জাদু জানে?

হঠাৎ কোথায় একটা, কীসের শব্দ হল। শুভার বুকটা ধক করে উঠল। সে আবার তার নিজের চিন্তায় ফিরে এল। যে শব্দের জন্যে সে প্রতি রাত্রের নিশীথে, রুদ্ধশ্বাস ভয়ে ও যন্ত্রণায় অপেক্ষা করে থাকে, হয়তো সেই শমন এল। এখনই, প্রচণ্ড জোরে, দরজায় আঘাত পড়বে। সেই সঙ্গেই ক্রুদ্ধ নিষ্ঠুর মত্ত গলা তার মন ও শ্রবণকে রক্তাক্ত করে, সেই ভাষায় চিৎকার করে উঠবে। শুভা, অন্ধকারেই, পাশের ঘরের অন্ধকারে তাকাল। দুই ঘরের মাঝখানের দরজার পরদাটা সে সরিয়েই রেখেছে। দরজায় শব্দ হলেই যাতে খুলে দেবার জন্যে আলো জ্বালিয়ে ছুটে যেতে পারে।

কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেও দরজায় কোনও আঘাত বাজল না। অথচ, আবার সামান্য একটা শব্দ পেতেই শুভা চমকে জানালার দিকে তাকাল। তাকিয়েই, তার বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে এল। গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে দেখল, জানালার কাছে, নীচের দিক থেকে আস্তে আস্তে একটা মানুষের মাথা যেন উঠে আসছে।

শুভা জানালার ধারে ছিল। চকিতে দেয়ালের আড়ালে সরে গেল। কিন্তু ততক্ষণে ওর বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছে। কে লোকটা! কে হতে পারে? চোর! সেই চোরটা নাকি! কী সাংঘাতিক ব্যাপার। জানালায় তো গরাদ নেই, গ্রিল নেই। এ পাড়ার এই এক আপদ, জানালায় গরাদ গ্রিল কিছুই থাকে না, কেবল কাঁচের পাল্লা ছাড়া। মোটা পরদা সবসময়ের জন্যেই ঢাকা থাকে। রাত্রের এই অন্ধকার নিরালায়, শুভা পরদাটা সরিয়ে দেয় রোজ। দিয়ে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, চারপাশের দৃশ্য দেখে। আজও যেমন দেখছিল।

কিন্তু এমন ভয়ংকর অভাবিত ঘটনা সে কল্পনাও করতে পারেনি। দেওয়ালের আড়ালে সরে গেলেও, আবছায়াতে ও পরিষ্কার বুঝতে পারে, একটা মানুষ জানালায় উঠে এসেছে। চারদিক নিঝুম স্তব্ধ। বাইরে চোরের পিছনে ছোটা মানুষদের গোলমালও আর নেই। শুভা চিৎকার করে ডাকলে যে কেউ শুনতে পাবে, তাও মনে হয় না। ওর কেবলই মনে হতে লাগল, এ কি সেই চোরটাই নাকি! একটু আগেই যাকে আটতলা বাড়ির ছাদে দেখা গিয়েছিল, ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সে-ই কি এখন এ ঘরে চুরি করতে ঢুকছে।

জানালার কাছে হঠাৎ জোনাকির মতো একটা ক্ষীণ আলো চকিতে জ্বলল, চকিতে নিভল। পর পর কয়েক বারই জ্বলল, নিভল। একটা বিন্দুর মতো আলোর ইশারা, ঘরের মধ্যে যতটা সম্ভব, আশেপাশে ঘুরে গেল। শুভা সরতে সরতে, দেয়ালের শেষে, একটা আলমারির পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। ও নিশ্বাস বন্ধ করে রাখতে চাইছে, পারছে না। এতক্ষণ ভয়েই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। এখন ভয়েই যেন, ঘন ঘন নিশ্বাস, স-শব্দে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চোরের কাছে, চুরি করে, নিজেকে লুকিয়ে রাখাটাই এখন ওর কাছে সব থেকে নিরাপদ উপায় বলে মনে হচ্ছে।

জানালাটা একটু উঁচুতে, প্রায় শুভার বুকের কাছাকাছি। একটুও শব্দ না করে, জানালা থেকে একটি মূর্তি নেমে এল ঘরে। শুভার মনে হল, লোকটার পরনে একটা প্যান্ট, গায়ে কালো রঙের একটা জামা। সেটা শার্ট বা পুরো হাতা সোয়েটার, বোঝা যায় না। মূর্তি ঘরে নামতেই তার হাতে বিন্দুর মতো একটা আলো জ্বলে উঠল। অনেকটা যেন সিগারেটের আগুনের মতোই, একটু হয়তো বড়। সেই আলোটা ঘরের চারপাশে এক বার ঘুরে গেল। আলমারির পাশে, প্রায় শুভার গা ছুঁয়ে গেল। তারপরে, আলোটা পাশের ঘরে যাবার দরজায়, এক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল। পরমুহূর্তেই মূর্তি সেই দরজার দিকে গেল।

শুভা একটু সরে এসে দেখতে চাইল, নোকটা কী করে। এখন শুভা মনে মনে নিশ্চিত হয়েছে, এ সেই পলাতক চোরই। কীভাবে লোকটা আটতলার ছাদ থেকে নেমে আসতে পেরেছে, ও কল্পনা করতেও পারে না, তবে ওদিক দিয়ে নিশ্চয় পালাবার উপায় ছিল না। লোকজন এবং পুলিশ রাস্তার ওপরে ঘোরাঘুরি করছে। সেই জন্যেই, এদিকে চলে এসেছে। কোনওরকমে গ্যারেজের চালে এসে, এ বাড়ির পিছনের সরু গলিতে নেমে, স্যানিটারি পাইপ বেয়ে ওপরে চলে এসেছে। সম্ভবত, এই খোলা জানালাটা লোকটার নজরে পড়েছিল। সরু গলি দিয়ে বেরুতে গেলেও ধরা পড়ে যাবার ভয়। তাই ঘরের ভিতরে কোথাও আশ্রয় নিয়ে, বোধ হয় সময় কাটাবার মতলব।

কিন্তু তা-ই কী? চোরের মতলব চুরি করা ছাড়া আর কী থাকতে পারে। কোনও এক ফ্ল্যাটের অন্ধকার ঘরে আশ্রয় নিয়ে, সময় কাটাবার সাহস কোনও চোরের থাকতে পারে না। আর পাশের ঘরেই, এদিককার দেওয়াল ঘেঁষে, এ ঘরের যে মালিক তার আয়রন লকার রয়েছে। সেই আয়রন লকারের ওপর শুভার বিন্দুমাত্র মায়া-মমতা নেই। বরং ঘৃণাই আছে। কিন্তু লকারে যে প্রচুর টাকা থাকে, তা ও জানে। যদি শুভার সামনেই লোকটা লকার খুলে টাকা নিয়ে যায়, তবে সর্বনাশ। তা হলে শুভার নিস্তার নেই। ভয়ংকর শাস্তি এবং অপমান ওর ওপর নেমে আসবে।

শুভা আরও একটু সরে এসে দেখতে চাইল নোকটা কোন দিকে যায়, কী করে। দেখল লোকটার অস্পষ্ট মূর্তি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্ষীণ আলোর বিন্দু চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক জোনাকির মতো বারে বারে নেভে, বারে বারে জ্বলে। লোকটা এবং আলোটা লকারের দিকে গেলেই, শুভা আলো জ্বালিয়ে চিৎকার করে উঠবে। তাতে যা হয়, তাই হবে। লোকটা যদি তাকে গলা টিপে ধরে মেরেও ফেলে, তাও ভাল। সেটাও একটা মুক্তি। তবু সামনা-সামনি চুপচাপ এ চুরি সে দেখতে পারবে না। কারণ সে পরিণতি বেঁচে থাকার চেয়েও নিদারুণ।

কিন্তু শুভা দেখল, আলোর বিন্দুটা, বাইরের বন্ধ দরজার ওপর স্থির হয়ে রয়েছে। মূর্তি ক্রমেই সেই দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে আলোর বিন্দুটা পড়ল দরজার মাথার ছিটকিনির ওপর। সেই আলোর বিন্দুতেই, শুভা দেখতে পেল, লোকটা ছিটকিনিতে হাত দিয়েছে। দরজা খোলার উদ্যোগ করছে। তা হলে, এদিক দিয়ে পালাবারই মতলব।

ঠিক এই মুহূর্তেই, বাইরে থেকে, দরজায় আঘাত পড়ল। আলোর বিন্দু নিভে গেল। চকিতের মধ্যেই, মূর্তি ঘরের মধ্যেই কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওদিকে বাইরে থেকে, দরজায় আঘাত, ক্রমাগত প্রচণ্ড হয়ে উঠল। এক মুহূর্তও থামবার নাম নেই। সেই সঙ্গেই, মত্ত ক্রুদ্ধ গলা শোনা গেল, কী হল কী। এ যে বাবা মালের খোয়ারির থেকেও বেশি দেখছি। নাকি বিষ টি গিলে মরে পড়ে আছে। দরজা খোলা হবে, না কি?

শুভা তবু যেন স্থির করতে পারছে না, ও কী করবে। ও কি আলো জ্বালবে। না কি, অন্ধকারের মধ্যেই গিয়ে দরজাটা খুলে দেবে। কারণ, আলো জ্বলে উঠলে, চোরকে যদি এই মত্ত মাতঙ্গ দেখতে পায়, তা হলেও চোরের পরিচয় বিশ্বাস করবে না। জঘন্য নোংরা কোনও অপবাদ দিয়ে, অন্য কিছু বলবে।

দরজায় সমানে করাঘাতের পর, পদাঘাত। নেহাত ওপরে আর কোনও ফ্ল্যাট বা বাসিন্দা নেই। তা হলে, এতক্ষণ বাইরের বারান্দায় লোকের ভিড় জমে যেত। তারই সঙ্গে, চিৎকার শোনা গেল, এই হারামজাদি, দরজা খুলবি, না ভেঙে ফেলব? তা হলে জানবি, তোকেও আমি ভাঙব, আস্ত রাখব না।

শুভা আর স্থির থাকতে পারে না। সে ঘরের আলো জ্বেলে দেয়। পাশের ঘরে গিয়ে, দরজার পাশ থেকেই, সুইচ টিপে আলো জ্বালায়। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায়না। তবুও বাইরের দরজার বাঁ পাশে, পুরনো সেকালের একটা খাটো কিন্তু বিরাট, টানা দেরাজের আলমারিটার দিকে চকিতে এক বার ওর চোখ যায়। সহসা যেন, দুটো তীক্ষ্ণ চোখের সঙ্গে ওর দৃষ্টি মিলে যায়। তার সঙ্গে আরও একটা কিছু। একটা সরু সূচিবিদ্ধ তীক্ষ্ণ চকচকে কিছু।

কিন্তু দ্বিতীয়বার আর সেদিকে ফিরে তাকাল না শুভা। ও গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিল। দিতেই ঝড়ের বেগে, একটি মূর্তি ঢুকল। লোকটার বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ, যে-কোনও একটা অঙ্কের হতে পারে। তার বেশি কম নয়। পাতলা চুল উশকো খুশকো। গলা বন্ধ কোটের বোতামই শুধু খোলা নয়, ভিতরের সিল্ক পাঞ্জাবির, পাথর বসানো সোনার বোতামগুলোও খোলা। ফুল কোঁচানো ধুতি, চটকানো। কোঁচা মাটিতে লুটোচ্ছে। লোকটির কলেবর দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রস্থেই বেশি। রং ফরসা। ঠোঁটের কষ বেয়ে, রক্তের মতো পানের পিক লেগে আছে। চোখ দুটো যেন আগুনে তাতানো লাল ছুরির মতো।

শুভা দরজাটা খুলে দিয়েই সরে আসছিল। তার আগেই ফরসা আংটি পরা মোটা থাবা ওর ঘাড়ের কাছে আঁচলটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। শুভা পড়তে পড়তে কোনওরকমে সামলে নিল। লোকটি আর এক হাতে দরজাটা বন্ধ করতে করতেই, কুৎসিত ভঙ্গিতে বলে উঠল, এত তাড়া কীসের, অ্যাঁ? দরজা খুলতে কোনও তাড়া নেই, অথচ পালাবার তাড়া। কেন, ভেতরে কোন নাগরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে?

শুভা আঁচলে টান দিয়ে বলল, ছাড়ো, বাজে কথা বকো না।

বাজে কথা? আমার খালি বাজে কথা, উম?

বলেই, আঁচল টেনে, একটা ঝটকা দিল। তাতে, শুভার গোটা গা থেকেই প্রায় আঁচল সরে গেল। লাল জামার ওপরে, বুকের কাছে, ও হাত চাপা দিল। লোকটি আবার বলে উঠল, তা এতক্ষণ হচ্ছিল কী? দরজা খুলতে এত দেরি কীসের? কেউ জুটেছে টুটেছে বুঝি? পিরিতের নাগরকে পার করতে সময় লাগছিল?

একদিকে এই আক্রমণ আর অপমান। আর একই সঙ্গে, শুভার মস্তিষ্কের সীমা জুড়ে বেঁটে ঢাউস আলমারিটার পাশে, লুকিয়ে থাকা লোকটা বিধে আছে। কিন্তু লোকটার কথা এখন ও বলতে পারছে না। অথচ লোকটা এই ঘটনা দেখছে, ওর এই লাঞ্ছনা আর অপমান, সেটাও ভুলতে পারছে না। তবু বলল, তুমি তো দিন রাত্তির ও সবই দেখছ। আমার ঘুম পেয়েছিল, তাই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুমি কাপড় ছাড়ো।

এ্যাততো ঘুম।

হ্যাঁ, তোমার জন্যে সারা রাত জেগে বসে থাকতে পারি না আমি। কাপড় ছাড়ো।

 শুভার গলায় ঝাঁজ। কাপড় ধরে টান দিল। কিন্তু ছাড়িয়ে নিতে পারল না।

আহা ছাড়ছি ছাড়ছি। জানি, তুই হচ্ছিস খাঁটি সতী। কাপড় ধরলেও তোর সতীত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তা, এ সব করে আর কত দিন চলবে? আমার কাছে এক ঘরে থেকে, এখনও কি লোককে বোঝাতে পারবি, তোর গোটা অঙ্গটি একেবারে পবিত্তির আছে?

বলতে বলতে সে আবার শুভাকে নিজের দিকে জোরে টানল। শুভাও নিজের কাপড় টেনে ধরে রাখল। যদিও তাতে আরও যেন এলোমেলো হয়ে উঠল। ওর শিথিল করে বাঁধা খোঁপা ঘাড়ের পাশে ভেঙে পড়ল। জোর করে কাপড় টানতে গিয়ে, ওর শ্যাম উদ্ধত স্বাস্থ্য যেন বুকের জামার কাছে অলজ্জ বে-আবরু হয়ে উঠতে চাইল। গোলের মধ্যেই ঈষৎ লম্বা ভাবের সমস্ত মুখখানি এই শীতেও যেন ঘেমে উঠল। কোনও প্রসাধনের ছাপ নেই মুখে। কপালে একটা টিপও নেই। সিঁদুর-হীন সিঁথি জ্বলজ্বল করছে। কানে গলায় হাতে, কোথাও সামান্য একটি অলংকার পর্যন্ত নেই।

থাকার মধ্যে আছে একটি সাধারণ স্বাস্থ্যের দীপ্তি। চোখ-মুখেও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য নেই। তবু ওর চোখের দৃষ্টিতে যেন, চোখ দুটিতে একটি বিশেষ ভঙ্গি ফুটে উঠেছে। করুণ অথচ কঠিন। বাংলাদেশের আর দশটা সাধারণ মেয়ের মুখের মতোই মুখ। তবু, চরিত্র ও মানসিকতার একটা বিশেষ ছাপ পড়ে, কোথায় যেন একটা অসামান্যতা আয়ত্ত করেছে। ওকে হঠাৎ দেখলে, একটি স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী এবং গভীর প্রকৃতির মেয়ে বলে মনে হয়। যদিও, তার মধ্যে কোথাও শহর নগরের ঝলক নেই। একটু বরং দূরান্তের গ্রামীণ ভাবই লক্ষিত হয়। তবে ওর চোখ দুটি বেশ আয়ত এবং কালো। বয়স অনুমান করতে অসুবিধা হলেও সম্ভবত চব্বিশ-পঁচিশের কম নয়।

এবার হঠাৎ শুভার চোখ দুটি জ্বলে উঠল। বলল, লোককে বোঝাবার আমার কিছু নেই। আমি সতী কি অসতী, সে পরীক্ষা আমি কারুর কাছে দিতে চাই না। কিন্তু তুমি আমার কাপড় ধরলেও আমার ঘেন্না হয়। ছাড়ো বলছি।

বটটে! আমি কাপড় ধরলেও ঘেন্না হয়?

বলেই, আচমকা কাপড়টা ছেড়ে দিয়ে, বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে শুভার গালে একটা থাপ্পড় মারে। শুভা ছিটকে খানিকটা সরে যায়। অপরিসীম ঘৃণায় আর রাগে, ওর দুই চোখ ধক ধক করে। কাপড় ঠিক করে, বুকের ওপর দিয়ে টেনে দিতে দিতে বলে, এই না হলে পুরুষ। একটা মেয়ে দুরবস্থায় পড়ে তোমার কাছে রয়েছে, তাও নিজের ইচ্ছেয় নয়। তোমার নিজের বউ নয়, মেয়েও নয়। তার গায়ে হাত না তুললে আর পুরুষ কীসের?

চোপ!

কীসের চোপ। তোমার জ্বালা তো, কেন তোমার কথা শুনছি না, তোমার ঘর করছি না। কিন্তু তোমার ঘর করতে তো আমি আসিনি, আমাকে

তোকে তোর পিরিতের লোক ঠাকুর ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। তারপরে, বন্ধুর হেফাজতে রেখে, সে-ই যে শালা কেটেছে, আর তার টিকির দেখা নেই। এর মানে কী, আমি জানি না ভেবেছিস? ও সব ছেনালি সতীগিরি অন্য জায়গায় দেখাস।

হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, একবার টলে উঠে আবার বলল, তোর সেই তারকদাদাটি আর কোনওদিনই আসবে না, জেনে রাখিস।

শুভা বলে উঠল, আর সেই সুযোগটাই তুমি নিতে চাইছ।

ক্ষিপ্তের মতো লোকটা আরও দু পা এগিয়ে গেল, গর্জে উঠল, সুযোগ কীসের, আঁ? কীসের সুযোগ?

খবরদার, তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে এসো না আর!

একেবারে দেয়াল ঘেঁষে, এমনভাবে দাঁড়াল শুভা, যেন সমস্ত শক্তি সংহত করে, প্রত্যাঘাতের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। লোকটি থমকে দাঁড়াল। হিংস্র কিন্তু ভীরু দাঁতাল শুয়োরের মতো শুভার দিকে তাকাল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, আমার ঘরে আমাকেই চোখ রাঙানো হচ্ছে?

শুভাও যেন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, একে চোখ রাঙানো বলে না। কিন্তু পড়ে পড়ে তোমার মার খেতে পারব না আমি। দরকার হয় রাত পোহালেই আমি তোমার এখান থেকে চলে যাব।

লোকটা শব্দ না করে, ফুলে ফুলে হাসতে লাগল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, চকিতে এক বার শুভার চোখে পড়ল, আলমারিটার পাশে। সেই চোখ, আর সেই সরু সূচিবিদ্ধ তীক্ষ্ণ চকচকে জিনিসটা! মনে হল, কপালের কাছে রুক্ষু চুলের গোছা এসে পড়েছে। চকিতে একবার চোখাচোখি হল মাত্র। চোখ দুটো শুভার দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু, মুখটা যে কেমন, কী রং, কিছুই বুঝতে পারল না ও।

অন্য দিন অনেক লাঞ্ছনাতেও, এতটা কঠিন হয়ে ওঠে না শুভা। আজ, এই পলাতক চোরের সামনে যেন ওর আত্মসম্মানবোধ সহসা খাপ-খোলা অস্ত্রের মতো ঝলসে উঠল। অন্য দিন তৃতীয় কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকে না। তা-ই যতটা সম্ভব আত্মরক্ষাটাই ওর কাছে বড় হয়ে ওঠে। আজ, আর একজন, সে যে-ই হোক, চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, যা-ই হোক, কিন্তু একটা মানুষ। আর একটা মানুষের সামনে, এই অপমান আর লাঞ্ছনায় কেবল আত্মরক্ষা করতে যেন ওর লজ্জা করছে। এতটা হীনতা যেন মেনে নিতে পারছে না।

এই লোকটা নিঃশব্দে ফুলে ফুলে হেসে উঠে বলল, কোথায় যাবি? বর্ধমানে, তোদের বাড়িতে নাকি?

শুভা সেই ভঙ্গিতেই বলল, সে যেখানেই যাই, তোমার আশ্রয় থেকে আর খারাপ কিছুই হবে না। বাড়িতে গেলেও না হয়, বাপ মা মেরে ফেলবে, তবু

মেরে ফেলবে না, তাতে তাদের হাতেই হাতকড়া পড়বে। মুখে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে। দেয় দেবে। তাদের লাথি খেয়ে যদি আমাকে অন্য কোনও আঁস্তাকুড়েতেও যেতে হয়, তাও ভাল। তবু তোমার কাছে থাকতে চাই না।

কেন, তোর তারকার জন্যে অপেক্ষা করবি না? পিতিক্ষে যাকে বলে। অমন তোদের সস্বর্গীয় পিরিত, ভালবাসা। সে তোকে নিতে আসবে। তোকে নিয়ে সংসার পাতবে, সুখের সংসার।

তারকদার বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার কথা বলার কিছু নেই। তুমি তার ছেলেবেলার বন্ধু। তুমিই ভাল জান, সে কী করবে না করবে।

আমি? লোকটা হাসতে হাসতে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। পায়ে ভর করে, এমনিতেই দাঁড়িয়ে থাকতে

 পারছিল না। টলটলায়মান অবস্থা। হাসির বেগে পড়ে যেতে গিয়ে, কোনওরকমে টাল সামলে নিয়ে বলল, প্রেম করলি তোরা। ঘর ছেড়ে পালিয়ে এলি তারকের সঙ্গে, সে তোর ভাবী সোয়ামি, আর আমি ওকে ভাল চিনব?

শুভা ঠোঁটে ঠোঁট টিপে চুপ করে রইল। লোকটির কথার মধ্যে যে নিষ্ঠুর সত্যি ছিল, কুৎসিত আর বীভৎস সত্যি ছিল, তা যেন ওর মুখের কথার ওপরে আঘাত করল। তথাপি, একটি তৃতীয় ব্যক্তির সামনে, এই অপমানকর কথাগুলো, ওর বুকের মধ্যে যেন একটা তীক্ষ্ণ জ্বালাও ধরিয়ে দিল। ভিতরটা পুড়তে লাগল। কোনও কথা বলতে পারল না।

লোকটি হঠাৎ তর্জনী তুলে, এক চোখ বুজে, হেসে, একটা নোংরা ভঙ্গি করল। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, আর আমার কথাই যদি মানিস, সে তো আমি বহুদিন আগেই বলে দিয়েছি সুন্দরী, তারকা নামে চিড়িয়াটি ফুড়ুৎ কেটেছে। সে আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। এবার এই নরেশ নামক চিড়িয়াটিকে নিয়ে থাকো। দানাপানি খাওয়াও। তা নয়, তোর সতীত্ব

চুপ কর, নোংরা ইতর ছোটলোক!

শুভা আবার ফুঁসে উঠল। এবং চকিত মুহূর্তের জন্যে, ওর দৃষ্টি প্রকাণ্ড বেঁটে আলমারিটার কোণ ঘুরে এল। লোকটা তেমনি করেই শুভার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু, শুভার মনে হল, সূচিবিদ্ধ সেই চকচকে জিনিসটা আর মুখের সামনে তোলা নেই। তাতে যেন লোকটার রোগা রোগা • মুখটা পুরোপুরিই দেখা গেল। মনে হল, লোকটার বয়স বেশি নয়। পঁচিশ-তিরিশের মধ্যেই হবে। একজোড়া সরু গোঁফ আছে যেন। মুখে ভয়ের ভাব তেমন নেই। বরং যেন, কেমন শক্ত রাগ রাগ ভাব।

এদিকে নরেশের মুখ ভয়ংকর হয়ে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমার ঘরে দাঁড়িয়ে, আমার খেয়ে, এত বড় কথা! আজ লাশ ফেলে দেব।

বলেই, একটা দাঁতাল শুয়োরের মতো সে শুভার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। শুভা যেন এটা অনুমানই করেছিল। তাই, চকিতে সরে যেতেই দেওয়ালে নরেশের মাথা ঠুকে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে, কোঁচার কাপড় বেধে, মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ ওঠবার চেষ্টা করলেও, ভারী শরীর নিয়ে সম্ভব হল না। তবু সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। শুভা ততক্ষণে, ঘরের প্রায় মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নরেশ আর ও, দুজনেই দুজনের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে। দুজনেরই চোখে, ঘৃণার জ্বলন্ত আগুন ঝরছে।

নরেশের চোখে তবু একটু বিস্ময়। সে আর এগিয়ে এল না। ওখান থেকেই বলল, হুম। এত সাহসের পেছনে কী আছে, আমাকে দেখতে হবে। সারাদিন বাড়ি থাকি না। বোধ হয় নতুন কোনও নাগর জুটেছে, দিনের বেলা আসা-যাওয়া চলছে। তাই খুব মেজাজ দেখিয়ে চলে যাবার হিড়িক দেওয়া হচ্ছে, আর গালাগাল ফুটছে।

শুভার চোখে আগুন থাকলেও, নরেশের দেওয়ালে আঘাত বা পতনটা বোধ হয় চায়নি। তবু কোথায় যেন একটা তৃপ্তিও বোধ করছে ও। সম্ভবত তৃতীয় মানুষটা আছে বলেই। তৃতীয় মানুষটা আছে বলেই, ওর মেয়ে মনের বিদ্বেষ এবং ঘৃণাটা এখন এমনভাবে ঝলকে উঠেছে। তৃপ্তিটাও বুঝি সেই কারণেই। ও বলল, তুমি যা খুশি তা-ই ভাবতে পারো, আমার কিছুই যায়-আসে না। তবে তুমি জেনে রেখো আমি এখনও বিশ্বাস করি, তারকদা ফিরে আসবে। সে তো তোমার মতো জোচ্চুরি করে টাকা রোজগার করে না। সে নিশ্চয় টাকা-পয়সার ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ফিরে এলে, তখন তাকে এ সব বোলো।

কথাগুলো বলতে বলতে, শুভার বুকের মধ্যে যেন যন্ত্রণা করে উঠল। চোখের রাগ আর ঘৃণার মধ্যেও, একটু জলের আভাস ফুটে উঠল। ওর মনে হল, তৃতীয় লোকটিকে শোনাবার জন্যেই যেন, নিজের এই অসংশয় বিশ্বাস ঘোষণা করল। অথচ ওর ভিতরে এই বিশ্বাসের কোনও সাড়া পাচ্ছে না। বরং একটা কষ্ট বুকে বিধে গেল।

নরেশ বলে উঠল, বটে? সেই ফিরে আসাটা কবে, জানতে পারি কী?

আবার হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলাল সে। শুভা বলল, যত দিনেই আসুক, তোমাকে তা দেখতে হবে না।

নরেশ মাথা নাড়িয়ে, খানিকক্ষণ টলতে লাগল। তারপরে সোজা পাশের ঘরে চলে গেল। এ ঘরের আলো যতটুকু পড়েছিল, তাতে পাশের ঘরের খাটটা দেখা যায়। সেই খাটে গিয়ে নরেশ হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কী যেন সে বিড়বিড় করছে। কোনও কথাই বোঝা যাচ্ছে না। কেবল হাত দুটো এগিয়ে দিয়ে, একটা মরা ব্যাঙের মতো উপুড় হয়ে পড়ল। শুভা জানে, আজ রাত্রের মতো এখানেই শেষ। নরেশ আর উঠবে না। নেশা আর ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাবে।

সহসা শুভার গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। ঘরের প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে ওর মনে পড়ে গেল, আলমারির পাশে, সেই লোকটা রয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে গিয়েও, ও আড়ষ্ট হয়ে রইল। নরেশের সঙ্গে ঝগড়ার সময়, তবু দু-একবার তাকাতে পেরেছিল। এখন আর কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে দেখতে সাহস পেল না। এমনকী, ঘরের মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন, গা শিরশির করে উঠছে। এবার কী করবে লোকটা? এই মুহূর্তেই বা কী করবে? নিশ্চয়ই শুভার অসহায় অবস্থাটা সে বুঝতে পেরেছে। জানে, এসময়ে মেয়েটিকে সাহায্য করবার কেউ নেই। যে ব্যক্তি আছে, সে মেয়েটির রক্ষক নয়। আলমারির পাশ থেকে লোকটা উঠে আসছে না তো!

ভাবতে ভাবতেই, শুভা পাশের ঘরের দরজার কাছে চলে যায়। হঠাৎ বলে উঠল, তোমার খাবার কি দেব?

কথাটা নিতান্ত ছলনা নয়। নরেশ বাড়ি এসে কোনওদিনই খায় না। তবু শুভা রোজই জিজ্ঞেস করে। রোজই এক জবাব পায়, কোনওদিন বা, তোর হাতে আমি খেতে চাই না।

 আসলে, প্রতি রাত্রেই নরেশ ফিরে আসার পরে, যে পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তারপরে আর খাওয়ার কথা কোনও পক্ষ থেকেই ভাবা যায় না। তবু রোজই জিজ্ঞেস করতে হয়।

আজ নরেশের কাছ থেকে কোনও জবাবই পাওয়া গেল না, কেবল নাক ডাকার শব্দ ছাড়া। সেই শব্দ যেন শুভকে আরও অসহায় করে তুলল। নরেশকে ঘুমন্ত ভেবে লোকটা হয়তো আরও সাহসী হয়ে উঠবে। আশ্চর্য, যেনরেশের সঙ্গে ও এভাবে ঝগড়া করল, তৃতীয় লোকটার উপস্থিতিতেই, এখন সেই নরেশ ঘুমিয়ে পড়াতে ভয় পাচ্ছে।

ঠিক এই মুহূর্তেই পিছনে একটা সামান্য শব্দ হল। শুভা চমকে পিছনে ফিরে তাকাল। দেখল লোকটা দরজা খুলে, ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করছে। আর এক বার শুভার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। লোকটা যেন বেরিয়ে যাবার আগে, ইচ্ছে করেই শব্দ করল, এবং শুভার দিকে ফিরে তাকাল।

লোকটার মুখের ওপর তখন আলো পড়েছে। রোগা রোগা, কিন্তু চোখা মুখ একটা ছেলে যেন। চোর ডাকাত বলে ঠিক মনে হল না। যেন ভদ্র ঘরেরই ছেলে। মাথার চুলগুলো উশকো খুশকো। গায়ে একটা কালো রঙের, কলারওয়ালা, ফুলহাতা পাতলা পুলওভার। ভিতরে কোনও জামা আছে কি না বোঝা যায় না। পরনে সেই রঙেরই একটা প্যান্ট। নাক চোখ মুখ সব মিলিয়ে একটা তীক্ষ্ণতা। কিন্তু হাতে যেটা চকচক করে ঝিলিক দিচ্ছিল, সেটা দেখা গেল না।

চকিতের মধ্যেই এই দেখাদেখি। শুভার চোখে ভয় ও উদ্বেগই ফুটে উঠল। লোকটার ঠোঁট দুটো যেন একবার নড়ল। কোনও শব্দ হল না। পরমুহূর্তেই নিঃশব্দে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শুভা তখনও স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। নিশ্চিন্ত ও নিশ্চিত হতে পারল না, লোকটা চলে গিয়েছে, নাকি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে, চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। যদি কোনও শব্দ পাওয়া যায় বা দরজা নড়ে ওঠে, তা হলে বুঝতে পারবে, লোকটা ওইখানে দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর হঠাৎ শুভার মনে হল, এত ভয় পাবারই বা কী আছে। শুভার কীসের এত ভয়। লোকটা যদি তাকে আক্রমণ করে, তবে ও চিৎকার করবে। আর যদি ছুরিটা বিধিয়ে দেয়, তা হলে তো সব যন্ত্রণার শেষ। শুভার জীবনে, আর কোন ভয় অবশিষ্ট আছে? এবং এই মুহূর্তে, সহসাই ওর মনে হল, লোকটাকে ও এতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে দিল কেন। ওর তো উচিত ছিল, নরেশ ঘরে ঢোকা মাত্র, লোকটার কথা বলে দেওয়া।

কিন্তু মত্ত নরেশের কি চোর ধরবার মতো শরীর বা মনের অবস্থা ছিল? হয়তো মনের অবস্থার পরিবর্তন হত। হয়তো, সহসা চোরের উপস্থিতিতে, নরেশ চমকে উঠত। এমন কী, একটু আগেই এই ইতর বিবাদের ঘটনাটা চোর ধরার উত্তেজনাতে আর ঘটতে পেত না।

ভাবতে ভাবতেই শুভার ঠোঁটের দুই কোণ বেঁকে উঠল। বৃথাই এ সব ভাবনা। তবু যদি নরেশকে চিনতে বাকি থাকত শুভার। লোকটা চোর ডাকাত, যা-ই হোক, নিরস্ত্র মাতাল নরেশকে ধাক্কা দিয়েই পালিয়ে যেত। মাঝখান থেকে, নরেশ সমস্ত ব্যাপারটাও অপব্যাখ্যা করত। সে অপব্যাখ্যার বচনও শুভা জানে। গোটা পাড়াটাকে জাগিয়ে নরেশ ঘোষণা করত, শুভারই কোনও প্রেমিক ঘরে এসে লুকিয়েছিল।

তা ছাড়া, আরও একটা ভয় ছিল শুভার। লোকটার হাতে যে জিনিসটা ও দেখেছিল, সে যদি নরেশকে আঘাত করত, সেটা হত, আর এক দুর্দৈব। লোকটা যদি মানে মানে পালিয়ে বিদায় হয়, এটাই চেয়েছিল।

শুভা দেখল, দরজাটা একটুও নড়ছে না। কোনও শব্দও নেই। ও ঘরের এক পাশে সরে গিয়ে, দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে, দরজার কাছে গেল। দরজা খুলে দেখবার সাহস হল না। কোনওরকমে, দ্রুত হাত বাড়িয়ে আগে ছিটকিনিটা বন্ধ করে দিল। উত্তেজনায় ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে, দরজায় কান পাতল, যদি কিছু শোনা যায়। কিছুই শোনা গেল না।

আস্তে আস্তে শুভা শান্ত হল। ওর নিশ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হল। ক্লান্তভাবে, দরজায় হেলান দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইল। যেন, সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড করে, এই মাত্র ঝড় থামল। ওর ভিতরের অবস্থাটা সেই রকমই। ভিতরের সবকিছু এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো। তার মাঝখানে, ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে, বিস্রস্ত এলোমেলা শুভা একলা দাঁড়িয়ে আছে। মনের ভিতরের চারদিকে বিশৃঙ্খলা। কোনও একটা ভাবনাও যেন, সারি সারি, পাশাপাশি সাজানো নেই।

এই বিশৃঙ্খলার ভিতর থেকে, প্রথমেই জেগে উঠল, পলাতক লোকটি। কে লোকটা। আটতলার ছাদ থেকে পালানো, সেই লোকটাই নাকি। তাই যদি হয়, এ ঘরে এল কেন। এলই বা কেমন করে। কেবল কি পালাতেই এসেছিল, নাকি চুরির মতলবও ছিল। কিন্তু চোরদের চেহারা কি ওরকম হয়। ওদের দেশের ছোট মফস্বল শহরে বা গাঁয়ে কখনও যে চোর দেখেনি, তা নয়। তার সঙ্গে, এ লোকটার কোনও মিল নেই। তাদের চেহারা ভাবভঙ্গি, সবই আলাদা।

কিন্তু এ লোকটাই যদি ছাদ থেকে পালানো লোকটা হয়, তবে এ-চোরও আলাদা জাতের। শুভার গায়ে যেন আবার কাঁটা দিয়ে উঠল। এই লোকটাই তা হলে পাইপ বেয়ে, এ ছাদ থেকে ও ছাদে যাচ্ছিল। সেই লোকটাই এতক্ষণ ঘরে ছিল।

পাশের ঘরের দরজা দিয়ে, পিছনের সেই জানালাটার দিকে ওর চোখ পড়ল। এখনও জানালাটা তেমনই ভোলা। না, এভাবে আর কোনওদিন জানালাটা খুলে রাখবে না শুভা।

এ কথা মনে হতেই, নতুন চমক দেখা দিল ওর চোখে। সেই সঙ্গে উদ্বেগ। কী সর্বনাশ, এখনও দুটো ঘরের মাঝখানের দরজা ও খুলে রেখেছে। একটা ভয় গিয়েছে। সেটা অপরিচিতের ভয়। কিন্তু পরিচিত ভয়ংকর ভয়টা তো এখনও, একই ছাদের তলায়, পাশের ঘরের খাটে, মরা ব্যাঙের মতো পড়ে আছে। জেগে উঠলে একটা অতিকায় সরীসৃপের থেকেও সে ভীষণ। বিশেষ, রাত্রে কোনও সময়ে ঘুম ভেঙে গেলে নিস্তার নেই।

শুভা তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে, মাঝখানের দরজাটা টেনে, এদিক থেকে ছিটকিনি এঁটে দিল। দিয়ে, এই রাত্রির, আপাতত কয়েক ঘণ্টার মতো নিশ্চিন্ত হল। এ ঘরেও একটা খাট এবং বিছানা রয়েছে। সংলগ্ন বাথরুমও আছে। পাশের ঘরেও তাই। দরজা বন্ধ করে দিলে, কোনও অসুবিধা নেই। এই সব বাড়ির, এরকম ব্যবস্থায়, শুভা রোজ স্বস্তিতে এক বার করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। এ ব্যবস্থা না থাকলে, একটা রাত্রিও এবাড়িতে বাস করা যেত না।

নরেশ এ ঘরেই শোয়। এটা তারই ঘর। এই খাট বিছানাও তারই। এ ঘরেরই আর এক পাশে রয়েছে একটা ছোট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। সেটাকে ঘিরে, গোটা কয়েক চেয়ার। এখানেই নরেশের কাজকর্ম হয়। লোকজন এলে বসে, কথাবার্তা বলে। কিন্তু মত্ত নরেশের কোনও কিছুরই ঠিক নেই। সে যে কোন দিন, কোন ঘরের বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে, কিছুই বলা যায় না। তার তো নির্লজ্জ পরিষ্কার উক্তি শুভা শুনেছে, শোয়াশুয়ির কোনও ঠিক ঠিকানা নেই বাবা আমার। কখন কোনদিন কোথায় শুই, তার কিছু ঠিক আছে! এ ঘরেই বা আমার কটা রাত্রি আর কাটে। কীসের টানেই বা রাত্রে এ ঘরে ফিরে আসব। তার চেয়ে কোনও মেয়ের ঘরে গিয়ে কাটিয়ে আসব। তবে এখন তুমি একটা মেয়েছেলে রয়েছ, তাই আসি। তাও তো বাবা, নেউলের মতো ফ্যাঁস ফ্যাঁস করেই আছ। পাবার আশা লবডঙ্কা।…

যেদিন নরেশ পাশের ঘরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সেদিন রাত্রে শুভা এঘরেই শোয়। কিন্তু নরেশের বিছানায় কোনওদিনই নয়। সে আলাদা একটা মাত্র মাদুর মেঝেয় পেতে শোয়। সে জন্যে মাদুরটা শুভা বড় ঢাউস আলমারিটার পিছনে লুকিয়ে রাখে, নরেশ যাতে টের না পায়। টের পেলে হয়তো কোনওদিন ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

শুভা এগিয়ে গেল ঢাউস আলমারিটার কাছে। মাদুরটার জন্যে, কোণের দিকে হাত বাড়াবার আগেই আবার সেই লোকটির কথা ওর মনে পড়ে গেল। আলমারিটার গায়ে হাত রেখে ও ভাবল, কে হতে পারে লোকটা? সম্ভবত চোরই, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুভার মনে একটা অদ্ভুত কৌতূহল জাগে। লোকটা কী ভেবে গেল। এইরকম মাতাল নরেশ, তার মুখের সেই সব নোংরা কথা, আর শুভকে দেখে, লোকটা কী ভেবেছে। মনে মনে বিদ্রূপ করে নিশ্চয় ভেবেছে, শুভা একটা দুশ্চরিত্রা জঘন্য মেয়ে। কথা থেকে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, তারকদা নামে কোনও একজনের সঙ্গে প্রেম করে সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আর তারকদা ওকে এখানে রেখে সরে পড়েছে। এখন ও একটা দুশ্চরিত্র লম্পট মাতালের আশ্রয়ে রয়েছে। এ লোকটাও নিশ্চয় নরেশের চোখেই শুভকে দেখেছে এবং ভেবেছে। একে পুরুষ, তায় চোর। এ ছাড়া আর কী-ই বা লোকটা ভাবতে পারে।

তবু শুভার মনে হয়, অন্য কিছুও লোকটা ভাবতে পারে। শুভকে দেখে, শুভার কথাবার্তা শুনে কি, খুব খারাপ মেয়ে বলে মনে হতে পারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পাশ ফিরে, নিচু হয়ে শুভা মাদুরের জন্য হাত বাড়ায়। হঠাৎ ওর চোখে পড়ে, নীচে যেন কী একটা পড়ে আছে। চিকচিক করছে। লোকটা তো ওখানে ঢুকেই বসে ছিল। বোধ হয় সেই ছুরিটা।

শুভা আরও নিচু হয়ে, সেটা কুড়িয়ে নিল। অবাক হয়ে দেখল, সেটা ছুরি নয়। একটা অদ্ভুত জিনিস। ছ ইঞ্চি একটা লোহার পাতের ওপর, দু ইঞ্চি ডায়ামেটারের গোল রিং। যেন অনেকটা আইগ্লাসের মতো। একটা লোহার পাতেই গোটাটা তৈরি। রিঙের মাঝখানটা ফাঁকা। কিন্তু, রিঙের গায়ে, তিন দিকে তিনটে, অদ্ভুত আকারের লম্বা লম্বা চাবির মতো রয়েছে। কোনওটাই আলাদা নয়, একই লোহার পাত থেকে কেটে তৈরি করেছে। কোনও জোড় নেই। তিনটেই তিন রকমের। একটা চ্যাপটা, বাকি দুটো গোল চাবির মতো।

শুভা অবাক হয়ে ভাবে, কী জিনিস এটা। কী হতে পারে? নরেশের কোনও জিনিস, না লোকটাই ফেলে গিয়েছে? বস্তুটি চোখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ও। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। জিনিসটা শক্ত লোহার পাতের এবং একেবারে হালকা নয়। কে জানে কী হতে পারে। শুভার স্নায়ু সমূহ যেন শিথিল হয়ে আসতে থাকে। তার আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না।

হাতের জিনিসটা যা-ই হোক, আবার আলমারির পাশে ফেলে রেখে দিয়ে লাভ নেই। এই ঢাউস আলমারিটাতে কিছুই প্রায় থাকে না। টাকাগুলো সবই এমনি বন্ধ করা আছে। ওপরের টানা খুলে, লোহার জিনিসটা ও রেখে দিল। কোণ থেকে মাদুরটা বের করে নিয়ে এসে দেওয়ালের এক পাশে পাতল। তারপরে বাথরুমে গেল। শীত করছে না ওর। তার পরিবর্তে, চোখ মুখ কান ঘাড়ের পিঠ যেন জ্বালা করছে।

বেসিনের কল খুলে, চোখে মুখে জল দিল। আঁচলেই মুছল। ঘরের মধ্যে এসে, নরেশের খাটের কাছে, ছোট ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়াল। মুখ মুছতে মুছতে, নিজেরই চোখের দিকে তাকিয়ে, নিজের সঙ্গেই দৃষ্টিবিনিময় করল।–নিজের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, এক সময়ে ওর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল।

চোখের কোণ বেয়ে, জলের ফোঁটা গড়িয়ে এল। দাঁত দিয়ে, ঠোঁট কামড়ে ধরে, মনে মনে বলে উঠল, কী হবে আমার? কী আছে আমার কপালে? তারকদা কি সত্যি আর কোনওদিন আসবে না?…

এই অবস্থাতেই, তাড়াতাড়ি সরে এসে, আলো নিভিয়ে দিয়ে, অন্ধকারে মাদুরের ওপর মুখ চেপে, উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সমস্ত কিছুর পরে, ওর ভিতরে, ঝড়ে ছত্রখান জীবনটার শোকে, কান্না বাধা মানল না। এখন শুধু ওর একলার কাঁদবার পালা।

তারপরে কখন এক সময় কান্না শেষ হয়। কিন্তু ঘুম আসে না। চোখের সামনে, পিছনের দিনগুলো ভেসে ওঠে। যে দিনগুলোর প্রতিটি উদয়াস্ত ছিল সুন্দর উজ্জ্বল, সুখে দুঃখে মেলানো একটু আশা, আরও দশটি সাধারণ মেয়ের মতোই। কিন্তু কী অপরাধে কে জানে, আজ রাত্রে সে এখানে শুয়ে আছে। সেখানে ওর জন্যে স্কুল সুখের সকল দরজা খোলা পড়ে রয়েছে। ও হাত বাড়িয়ে নিতে পারছে না। এমন জায়গায় বাধছে, যেখান থেকে হাত বাড়াতে গেলে, হাতটাই হয়তো বা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

এর কি একমাত্র কারণ, একমাত্র অপরাধ, তারকদাকে শুভা ভালবেসেছিল।

.

কলকাতা থেকে, এমন বেশি কিছু দূরে নয়, কাছাকাছি জেলারই এক মফস্বল শহরের প্রান্তে, গ্রামের পাশ ঘেঁষে শুভাদের বাড়ি। মফস্বল শহরের যতটুকু সুবিধা, সেটুকুও পাওয়া যায়। গ্রামের সান্নিধ্যটুকুও আছে। ধানখেত, মাঠ, বন, সবই কাছাকাছি।

একদা নিশ্চয়ই শুদের বাড়ির অবস্থান গ্রামের মধ্যেই ছিল। যুদ্ধ আর দেশ-বিভাগের পর, সবখানেই যেমন শহর বিস্তৃত হয়েছে, এ শহরও তেমনি হয়েছে। বিস্তৃত হতে হতে, যা ছিল গ্রাম থেকে দূরে, তা এসে পড়েছে গ্রামের হাতায়।

আর দশটা সাধারণ হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই, শুভাদের বাড়ি। শুভার বাবা নিজে সেই বাড়ি তৈরি করেননি। ওর বাবার ঠাকুরদার আমলের বাড়ি। একতলা, পুরনো, বড় বড় কোঠাওয়ালা সেকালের বাড়ি। পুরনো বাড়ির ইটে শ্যাওলা ধরেছে। নোনা লাগতে শুরু করেছে, শুভার জন্মের আগে থেকেই। সেই পুরনো দেওয়ালেরই পাশ ঘেঁষে উঠেছে, মাটির দেওয়াল, খড়ের চালের ঘর। অথবা পাতলা ইটের দেওয়াল, মাথায় টালির চাল।

একলা শুভদেরই তো সব নয়। কাকা-জ্যাঠারা আছেন। সকলেরই বংশবৃদ্ধি ঘটেছে, অতএব ঘর দরজা বাড়াতে হয়েছে। একান্নবর্তী পরিবার নয়। সকলেই আলাদা, বিচ্ছিন্ন। একই বাড়িকে নানা ভাগে ভাগাভাগি করে, নতুন করে ঘর তুলে, যে যার নিজের সীমানা ঠিক করে বাড়িয়ে নিয়েছে।

কিন্তু ঠাকুরদার আমলটা আর কোনওদিনই ফিরে আসেনি। বাবা কাকা জ্যাঠাদের জন্য যতখানি ধান-জমি ঠাকুরদা রেখে গিয়েছিলেন, তাতে সমস্ত পরিবারগুলোর তিন মাসের বেশি খোরাকি জুটত না। অতএব সবাইকেই, জীবিকার জন্যে বাইরে পা বাড়াতে হয়েছিল। তবু পুরনো দিনের সেই লক্ষ্মীশ্রী আর ফেরেনি। কোনওরকমে জীবনযাপনের একটা ঠেকেজোড়া দেওয়া অবস্থায়, দিনগুলো চলেছে। আধা-গ্রামীণ, আধা-শহুরে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর দিন যেমন কাটে, চেহারা যেমন হয়, সেইরকমই।

কাকা-জ্যাঠারা তবু বাইরে চাকরির ধান্দায় গিয়েছিলেন। শুভার বাবা, সেকালের একজন ম্যাট্রিকুলেট, চিরদিন গ্রামের ইস্কুলে মাস্টারি করেই কাটিয়েছেন। এখনও কাটাচ্ছেন। শুভদের পরিবারে যেটা সব থেকে বড় অসুবিধে, তা হল, ওর ভাইয়েরা সকলেই ছোট। বোনেরা সকলেই বড়। ষষ্ঠীর দয়াটা নেহাত কম নয়। শুভারা চার বোন তিন ভাই।

সেকালের একজন ইস্কুল মাস্টার, যার কোনও ডিগ্রি নেই, বি-টি পাস তো অনেক দূরের কথা, তাঁর পক্ষে এত বড় পরিবার চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ওর বাবার আমলে, গ্রামে একটি ম্যাট্রিক পাস ছেলের তবু কিছু কদর ছিল। এখন কথায় কথায় বি-এ, এমএ পাস করা ছেলেদের ভিড়। এখন কলকাতার ছেলেরা পর্যন্ত গ্রামে যায় পড়াতে। শুভার বাবা এখন বাতিলের পর‍্যায়ে। নিতান্ত অনুগ্রহ করে ইস্কুলে রাখা হয়েছে। তবু মাস গেলে, যা হোক কিছু ঘরে আসে। সেই সঙ্গে আছে কিছু বাড়িতে ছাত্র পড়ানোর আয়। সকালে বিকালে চট আর মাদুর বিছিয়ে অনেক ছেলে পড়ে। ইস্কুলের থেকে সেই আয়টাই বেশি।

কিন্তু দিনকালের অবস্থায়, কিছুই না। সাত ভাই বোন, বাবা মা। এতগুলো মানুষের জীবনযাপন সহজ কথা নয়। অভাবটা প্রত্যহের। একটু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, শুভা এটা প্রতি দিন অনুভব করেছে। তবু তারই সঙ্গে, একটা আশা, অতি সঙ্গোপনে প্রতি দিন মনে মনে লালন করেছে। একটি বিয়ে। ওর একটি বিয়ে, ওর পরের বোনের একটি বিয়ে, তার পরের বোনের একটি বিয়ে…। না, খুব বেশিদিন আর সে আশা লালন করতে পারেনি।

ওর বড় হয়ে ওঠার পিছনে, যেন দৌড়তে দৌড়তে ধাওয়া করে পরের বোনটি বড় হয়ে উঠেছিল। তখনও আশা করত, একটি বিয়ে, একটি বিয়ে হবে। তারপরে যখন তৃতীয় বোনও পেছন থেকে ক্রমে ছুটে আসছিল, তখনও আশা ছিল, কিন্তু নিরাশাও সমান তালে বেড়েছিল। শুভার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মাও বিয়ের কথা বলত। বাবা-মা আলোচনা করত। নিতান্ত যদি টাকার জোগাড় না হয়ে ওঠে, তা হলে, অংশের ধান-জমিই বিক্রি করে বিয়ে দিতে হবে। মেয়ের বিয়ে তো কোনওরকমে আটকে রাখা যায় না! খুব সাধারণ কথা, সত্যি কথা, যদিও দুঃখের কথা, অবিশ্বাসের কোনও কারণ ছিল না।

কিন্তু কতকখানি জমি আছে। কয়টি মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায় সেই জমি বিক্রি করে। পিঠোপিঠি বোনেরা বড় হয়ে উঠতে, এ চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই শুভার মনে এসেছিল। অবিশ্বাস আর নিরাশা, তখন থেকেই শুরু। তখন থেকেই, স্বাভাবিকভাবে আরও মনে হয়েছে শুভার, ভাল করে লেখাপড়া শিখলেও, একটা স্বাধিকারের কথা ভাবা যেত। কিন্তু বাবা ইস্কুল মাস্টার হলে কী হবে, মেয়েদের লেখাপড়ার রেওয়াজ ছিল না। গ্রামের পাঠশালাতেই যতটুকু হয়েছে। তারপরে আর কেউ সে কথা চিন্তা করেনি। সেদিক থেকে, ওদের পরিবার যেমন গ্রামীণ, তেমনই অশিক্ষা আর কুসংস্কারেই ভরা।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে, সবকিছুরই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। সমাজে পরিবারে ভাবনায় চিন্তায়। তার ঢেউ এসে লেগেছে ওদের পরিবারে, মূলে কোথাও ভাঙতে পারেনি। কেবল আর্থিক ধাক্কাটাই প্রতি দিন বড় বেশি করে বেজেছে। চিন্তা ভাবনার জগতে, একটু আঁচড়ও কাটেনি। এই দূর জেলায়, নতুন শহরের গ্রামের সীমানায়, যদি বা কিছু আবর্জনা এসে পৌঁছেছে, আসল কিছুই নিয়ে আসেনি। আবর্জনাগুলো এসেছে নানান ঝলক নিয়ে। তার মধ্যে ভোগের ইন্ধন ছিল। আত্মপ্রকাশের শক্তি নয়। তাই দল বেঁধে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে সিনেমা দেখেছে। বাবার আয়ের সঙ্গে মিলিয়ে, শাড়ি জামা কিনতে পারেনি, বুকের মধ্যে হু হু করেছে, তবু যতটুকু পারা গিয়েছে, তাই সংগ্রহ করেছে। জীবনের আর যা কিছু সব তো একটি জায়গাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। একটি বিয়ে। যদিও আর বিশ্বাস করতেও পারছিল না। তবু, বাবার পরিচর‍্যা, মায়ের কনিষ্ঠ সন্তানের দেখাশোনা করার অবসরে, আর কী-ই বা করার ছিল। আর কী বা ভাববার ছিল।

ছিল, কিছু ছিল বইকী। প্রেম করার ছিল, প্রেম ভাববার ছিল। করেছেও, ভেবেছেও। সেই রকমই প্রেম করেছে, সেই রকমই ভেবেছে। কখনও কখনও, কোনও ছেলের হাতছানিতে মন ভুলেছে। চোখে দেখা, একটু হাসাহাসি। তার চেয়ে বেশি, দু-একখানি চিঠির আদান-প্রদান। নেহাত কাছাকাছি হলে, একটু স্পর্শ। এ সবের মধ্যে জীবনের কোনও যোগ নেই। একটা খেলা। হয়তো, অবচেতনের অবিশ্বাস নৈরাশ্য, আর আপাতত বয়সের একটা স্বধর্ম লীলা। একটু ভাল লাগা, একটু ঘনিষ্ঠ হবার ইচ্ছা। ভেবে চিন্তে কিছু নয়। আপনা থেকেই যতটুকু আসে আর যায়। ভোরের কুয়াশার মতো। যতক্ষণ শিশির, ততক্ষণই রোদের আলোয় একটু রং-বেরঙের ঝিকিমিকি। তারপর প্রখর কিরণে, সবই মিলিয়ে যাওয়া।

তার মধ্যে, মনে রাখবার মতো কিছু নেই, কেউ নেই। তার মধ্যে গভীরতাও কিছু ছিল না। সে রকম কোনও অঙ্গীকারই, কেউ নিয়ে আসেনি। শুভার নিজের মধ্যেও কোনও অঙ্গীকারের সৃষ্টি হয়নি। তেমন গম্ভীরভাবে, মূল্য দিয়ে, কিছু ভাবেনি। ও রকম হয়েই থাকে। একটি ডাগর মেয়ে। তাকে ঘিরে, পাড়ার দশটি ডাগর ছেলে, একটু হাসি একটু কটাক্ষ, এমনি সব নানান উপহার তাকে দিতে চায়।

তবু, যত দিন গিয়েছে, যত আশা গিয়েছে, ততই অবিশ্বাসের সঙ্গে একটা বিক্ষুব্ধ ধিক্কার শুভার মনের মধ্যে জেগে উঠেছে। ভেবেছে, বাবার প্রাণে কি একটু ভয় হত না। নিজের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে, এতগুলো ভাই-বোনকে সংসারে আনতে, একটু কি বুক কাঁপত না বাবার। সব কি এতই সহজ। ভবিষ্যতের ভাবনা কি একটুও হত না।

ভেবেও, বাবার ওপর বেশিক্ষণ রাগ বিদ্বেষ নিয়ে থাকতে পারত না শুভা। বাবাকে দেখলে, ভারী অসহায় মনে হত। বাবার জন্যে কষ্টই হত। আসলে, বাবার মনের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা নিরলস ভাই-বোনের সৃষ্টি করেছে, তা একটি ছেলের জন্য। শুভার বদলে যদি একটি ছেলে হত, কিংবা মেজোবোনের বদলে, তা হলেও সে এত দিনে বড় হয়ে উঠত। বাবার একজন সাহায্যকারী সহকারী জুটত।

এ কথা মনে হলেই, শুভা বার বার বলেছে, কেন ছেলে হলাম না। তা হলেও বাবার কষ্ট কিছু ঘোচানো যেত।

১. শুভার দীর্ঘশ্বাস পড়ে

১. শুভার দীর্ঘশ্বাস পড়ে

অলিন্দ – উপন্যাস – সমরেশ বসু

শুভার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। ভাবে, কে তার এমন নাম রেখেছিল। শুভা। ছি ছি! যে মেয়ে এমন একটা প্রকাণ্ড অশুভা, অশুভ যার চারপাশে মৌরসিপাট্টা করে গেড়ে বসে আছে, তার শুভা নামটাই একটা ঠাট্টা।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে, গরাদহীন জানালাটার ধারে, ঠাণ্ডা দেওয়ালে গাল পেতে, ও বাইরের দিকে চেয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে অন্ধকার। জানালা দরজা প্রায় সবই বন্ধ। শুধু এই জানালাটাই শুভা খুলে দিয়েছে। এটা পুবের জানালা, ঠাণ্ডা বাতাস আসে না। সব বন্ধ করে কেমন যেন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। খাট, বিছানা, ওয়ারড্রব আলমারি, ড্রেসিংটেবল, পাশের আর একটা ঘরের সোফাসেট, বইয়ের আলমারি, সেক্রেটারিয়েট টেবল, সবই যেন ওকে গিলতে আসে। আলো জ্বালাতে আরও খারাপ লাগে। তখন। যেন নিজের অসহায় অবস্থাটা আরও বেশি করে চোখে পড়তে থাকে। রাত্রি হলেই, যে উদ্বেগ থার্মোমিটারের পারার মতো ডিগ্রিতে ডিগ্রিতে বাড়তে থাকে, আলো জ্বাললে যেন সেই অসহায় উদ্বিগ্নতা আরও তীব্র হয়ে উঠতে থাকে।

অথচ ঘর অন্ধকার করে দিয়েও থাকতে পারে না। মনে হয়, একটা ভয়ংকর অন্ধকার হাঁ যেন গিলতে আসছে। তখন জানালা খুলে দিয়ে, বাইরের দিকে চেয়ে থাকলে, তবু যেন একটু স্বস্তি বোধ হয়। তবু যেন মনের অন্ধকার থেকে একটু বেরিয়ে আসা যায়। তবু যেন এ ঘরের পরিবেশ থেকে, নিজেকে একটু অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া যায়।

কিন্তু এও যেন এক যক্ষপুরীর দেশ। এই দোতলা ঘরের চারপাশে, আটতলা দশতলা ছতলা চারতলা বিশাল ইমারতগুলো যেন বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই দোতলা বাড়িটার, পুবের এই জানালার নীচে, অনেকখানি জমি নিয়ে কেমন করে এত বড় একটা গ্যারেজ বজায় রাখা গিয়েছে, শুভা বুঝতে পারে না। নীচের দিকে তাকালেই মস্ত বড় ঢেউ-খেলানো অ্যাসবেসটরের চালটা যেন ওর চোখের সামনে, রৌদ্র-ছায়ার নানা রঙে, পুকুরের মতো টলটল করে। এ বাড়ি আর গ্যারেজের মাঝখানে, ডান দিক ঘেঁষে একটা জামগাছও রয়েছে। সেখানে পাখিদের জটলা হয়। গ্যারেজের চালে, ভোরবেলাতেই কাকেরা ভিড় করে। এ বছরের মরশুমে, জামগাছে, জাম হতেও দেখেছে শুভ। কেউ-ই প্রায় খায় না। অ্যাসবেসটরের সাদা চালে, পাকা জাম পড়ে পড়ে জাম রঙের ছোপ লেগে যায়। কোনও কোনও দিন হয়তো দেখা গিয়েছে, গ্যারেজের কোনও ছোকরা ক্লিনার বা মেরামতি মিস্তিরি বা ড্রাইভার চালে উঠে জাম পাড়ছে। তাও, গ্যারেজের দরোয়ানকে লুকিয়ে চুরিয়ে। তার চোখে পড়লেই চিৎকার করে গাল দেয়।

এখানে আর কারাই বা জাম খাবে। চারপাশে যারা আছে, তারা বোধ হয় কেউ জাম খায় না। তারা হয়তো স্ট্রবেরি বা পিচ বা আঙুর খেতেই ভালবাসে। জামের স্বাদ জানে না। অধিকাংশই তো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, পার্শি, বড়লোক মুসলমান, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের ধনী অবাঙালি এবং বাঙালিরা এই সব আকাশ-ছোঁয়া বাড়িগুলোতে থাকে। দু-তিন ফুটের একটা পরিত্যক্ত জমির ফালিতে, কোথায় একটা জামগাছ আছে, এখানকার অধিবাসীদের চোখেও পড়ে না বোধ হয়। পাশেই নিউ মার্কেট। সেখানে মরশুমের সময় ধুয়ে মুছে রঙিন ডালিতে জাম রাখা হয়, তাই হয়তো চোখে পড়ে। ইচ্ছে হলে কেনে।

জানালা দিয়ে, আশেপাশে, কত রকমের পরিবার, দম্পতি, মেয়ে পুরুষ শিশুদের যে দেখতে পায় শুভা। মনে হয়, শুধু ভারতবর্ষ না, গোটা পৃথিবীর সব রকমের মানুষ এখানে আছে। রুশ, আমেরিকান, ইংরেজ, ফরাসি, সব রকম। এ পাড়াটাই তো সেই রকম। তবে, একটা কথা খালি মনে হয়, জামা কাপড় শাড়ি ফ্রক যা কিছুরই তফাত থাক, যাদের যেমনই খাবার হোক, তবু যেন সব মিলিয়ে, এরা সব এক রকম। এদের দেখলেই মনে হয়, এরা এক আলাদা জগতের মানুষ। এরা পাশাপাশি থাকে, কথাবার্তা তেমন বলে না, পাশাপাশি মেলামেশা নেই, তবু এরা যেন একই গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন পরিবার।

কেবল একটা বাড়িকেই, আগে আগে খুব রহস্যময় মনে হত। পশ্চিমের জানালা খুললে, চারতলা প্রকাণ্ড বাড়িটার পিছন দিক দেখা যায়। শুভা শুনেছিল, ওটা একটা হোটেল। এখন জানতে পেরেছে, ওটা হোটেলের নামে চলে বটে, আসলে লুকিয়ে মেয়েদের দেহের ব্যবসা বাড়ি। বে-আইনি ব্যবসা, শহরের এমন জায়গায়, এত বড় বাড়িতে, দিনে রাত্রে চলে, অথচ পুলিশ নাকি কিছুই জানে না। ভাবলে, শুভার মতো মেয়েরও, ঠোঁট বেঁকে যায়। সত্যিই তো, অপরাধীরা লুকিয়ে পাপ করে। পুলিশ কেমন করেই বা জানবে। এই সব অপরাধীরা তো দিনের বেলা মিছিল করে অপরাধ করে না। পুলিশ এদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কেমন করে!

প্রথম প্রথম শুভা দেখত, বাড়িটার যে কোনও জানালাই যখন খোলে, সব জানালাতেই আলাদা আলাদা মেয়ের মুখ। আবার, কয়েক দিন যাকে দেখা গেল এক জানালায়, কয়েক দিন পরে, আবার অন্য মেয়ের মুখ সেখানে। হয়তো, শ্যামাঙ্গিনীর জায়গায়, এক গৌরাঙ্গী ফুক-ফুক করে সিগারেট খাচ্ছে। আর শ্যামাঙ্গিনীকে দেখা গেল, অন্য জানালায়, গেলাসে করে কী যেন চুমুক দিচ্ছে। প্রথমে অবাক কৌতূহল, তারপরে চমক। দুপুরে সন্ধ্যায় রাত্রে, আলাদা আলাদা পুরুষের চেহারা হঠাৎ দেখা যেত। জানালাগুলো অধিকাংশ সময় তো বন্ধই থাকে। হঠাৎ হঠাৎ খুলে যায়, আর হঠাৎ হঠাৎই ওরকম দেখা যায়। তারপর আরও কিছু চোখে পড়তে আরম্ভ করেছিল। মেয়ে পুরুষের নানান আচরণ। শরীরের নগ্নতা, আচরণের নগ্নতা চোখে পড়েছিল।

প্রথম দিনটা ভয়ে বিস্ময়ে চমকে উঠেছিল, যখন দেখেছিল, উলঙ্গ মেয়ে পুরুষ, রাস্তার কুকুরের মতো খেলা করছে। মুহূর্তের জন্যেই। মুহূর্তের জন্যেই হয়তো তাদের খেলার আবেশে, জানালা খোলা ছিল। তারপরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

তারপরেও যেটুকু বুঝতে অসুবিধে ছিল, সেটুকুও বুঝিয়ে দিয়েছিল একদিন এক মত্ত শক্ত হাত। শুভার ঘাড় চেপে ধরে, পশ্চিমের জানালাটার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। জানালাটা খুলে, চারতলা বাড়িটার দিকে দেখিয়ে বলেছিল, বেশি তেড়িবেড়ি করলে, ওই বাড়িটায় ঢুকিয়ে দিয়ে আসব। সতীর যত সতীত্বপনা, বিলকুল ওখানে মিলে যাবে। সতীর বিচার যারা করে, কাজিরা সব ওই বাড়িতে আছে। ছেনালি!

তারপরে আর কিছু বোঝবার ছিল না। কিন্তু তারপরে, পশ্চিমের জানালা খুলে প্রকাণ্ড চারতলা বাড়িটা যত বার চোখে পড়েছে, শুভার বুকের মধ্যে কেমন করে উঠেছে। সেই কেমন করাটা কেবল ভয় না। কল্পনায় যেন ও বাড়ির খোপে খোপে মেয়েদের সে দেখতে পায়। কল্পনায় নিজেকেও যেন সেখানে দেখতে পায়। আর তৎক্ষণাৎ মুখে হাত চাপা দিয়ে, শক্ত হয়ে ওঠে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।

শুভা পশ্চিমের জানালাটা খুলতে এখন ভুলেই গিয়েছে। তা ছাড়া, এই শীতের সময় তো খোলবার কোনও দরকারও নেই।

শীতের রাত্রি। চারিপাশেই নিঝুম। মাঝে মাঝে গ্যারেজে এসে গাড়ি ঢুকছে। তাও শব্দ শোনা যাচ্ছে। চারপাশের আকাশ-ছোঁয়া বাড়িগুলোর শত শত জানালা। যেন শত শত আলো ঝলসানো চোখ। বাতি জ্বালানো ব্যালকনিগুলো যেন ভিন্ন ভিন্ন ছাঁদের শূন্যে দোলানো দোলনা। কোনও কোনও বিল্ডিংয়ের এলিভেটর-এর ওঠানামা কাঁচের শার্সি দিয়ে দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু নিঝুমতা যতই ঘনিয়ে আসে, জানালাগুলো ততই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে, ব্যালকনির দোলনাগুলো হারিয়ে যেতে থাকে। ঘরে ঘরে বাতি নিভতে থাকে, তাই সবই অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে। যেন যক্ষপুরীর ঘরে ঘরে ঘুম নেমে এসে, বাতি নিভিয়ে দিতে থাকে। বন্ধ কাঁচের ঝিকিমিকিও চোখে পড়ে না। কেবল সিঁড়ি বা বারান্দার দু-একটা আলো জ্বলতে থাকে। বিশাল ইমারতগুলোকে এখন মনে হয়, ঋজু বাঁকা বা বৃত্তের নানা আকারে, অতিকায় জীবগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

চারপাশের আলো যত নিভে যায়, আকাশের তারাগুলো যেন ততই জেগে ওঠে। নক্ষত্রেরা যেন অনেক নীচে নেমে আসে, উঁচু বাড়িগুলোর ছাদের কাছাকাছি। শহরের আলো যতক্ষণ জ্বলে, ততক্ষণ নক্ষত্র কাছে আসে না। চারপাশে যতই নিঝুমতা নেমে আসে, গ্যারেজে গাড়ি আসার শব্দও ততই কমে আসে। আর শুভার বুকের মধ্যেও উদ্বেগ থরথরানি বাড়তে থাকে।

বাইরের অন্ধকার যত বাড়ে, শব্দ যত কমে, ততই যেন এক ভয়ংকর পায়ের শব্দ দূর থেকে ওর কানে এসে বাজতে থাকে। বুকের মধ্যে বিধতে থাকে, একটা উৎকণ্ঠা ভয় আর যন্ত্রণা পাক দিয়ে দিয়ে উঠতে থাকে। জানালার ধারে দেওয়ালের গায়ে, আরও চেপে ধরে নিজেকে। যেন আড়াল করতে চায়। শরীরটা রক্তশূন্য মনে হতে থাকে। নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে, যেন হাঁফ লাগে।…

হঠাৎ আটতলা বাড়িটার, কয়েকটা জানালায় আলো ফুটে উঠতে থাকে। দু-একটা গলার উঁচু স্বর শোনা যায়। হয়তো কিছু একটা ঘটেছে। কেন না, গলার স্বর ক্রমেই বাড়তে থাকে। শুভা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। প্রথমেই ওর মনে অশুভ চিন্তা জাগে। কেউ কি মারা গেল। না কি, বিশেষ কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। আলোগুলো জ্বলে ওঠা আর গলার স্বরের ডাকাডাকিগুলো শুনলে, একটা অশুভ ঘটনার মতোই মনে হয়।

ভাবতে ভাবতেই, শুভা চমকে আটতলা বাড়িটার ছাদের দিকে তাকাল। ও কি সত্যিই দেখতে পাচ্ছে, আলসেহীন ছাদের ওপর দিয়ে, একটা মানুষের মূর্তি এক দিক থেকে, আর এক দিকে ছুটে যাচ্ছে। তা হলে কি চোর নাকি! লোকটা ওখানে উঠল কী করে। কে লোকটা। বাড়িরই লোক, নাকি বাইরের লোক। বাইরের অচেনা লোক দরোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকবে কেমন করে। ঢুকলেও, সিঁড়ি বেয়ে, দরজা খুলে, ছাদে উঠবে কোন সাহসে!

ইতিমধ্যে চারপাশের গোলমাল আরও বেড়ে উঠতে থাকে। জানালায় জানালায় নানা মুখের উঁকিঝুঁকি। এ জানালা থেকে, ও জানালায় নানান জিজ্ঞাসাবাদ, কোন দিকে গেল? পালিয়েছে? নীচে নেমে যায়নি তো! ছাদে গেছে বোধ হয়…

নানান জনের নানান কথা। নানা দিকে ছুটোছুটি। দশতলা ছ তলাগুলোতেও আলো জ্বলে উঠতে আরম্ভ করেছে। চারদিক থেকে শত শত চোখের মতো জানালাগুলোতে আলো জ্বলে উঠছে। আলো ছড়িয়ে পড়ছে।

অন্ধকার ঘর থেকে, শুভাই একমাত্র পলাতককে দেখতে পাচ্ছে। মুর্তির ভাব-ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, সে-ই পলাতক। তার পিছনেই লোক ছুটছে। কিন্তু কোন সাহসে লোকটা ছাদে উঠেছে। এইবারই তো সবাই ওকে ধরে ফেলবে।

কিন্তু শুভার বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে গেল। দুই চোখে ওর আতঙ্ক। আটতলা বাড়িটার দুটো অংশ, দুটো ব্লক। মাঝখানে দশ বারো ফুটের মতো ফাঁক। দুই অংশেরই ছাদে, বড় বড় জলের ট্যাঙ্ক। একটা দুই ইঞ্চি ডায়ামেটারের পাইপ, এক ছাদের ট্যাঙ্ক থেকে আর এক ছাদের ট্যাঙ্কে জোড়া লাগানো। শুভা দেখল, লোকটা সেই পাইপ ধরে ঝুলে পড়েছে। প্রাণে বাঁচবার চেয়ে, ধরা পড়ার ভয় কি এত বেশি? লোকটা তো পড়ল বলে! শুভা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, মসৃণ পাইপটা, লোকটার ভারে ভোঙা হয়ে পড়ছে, বেশ জোরে জোরে দুলছে। কিন্তু লোকটা থামছে না।

ইতিমধ্যে কয়েকটা টর্চের আলো লোকটার গায়ে পড়ল। ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর নীচে, ওপরে, জানালায় জানালায় চিৎকার শোনা গেল, ওই যে, পাইপ বেয়ে যাচ্ছে। অন্য ব্লকে চলে যাচ্ছে।

কয়েকটা টর্চের আলো, লোকটাকে যেন সঙ্গিনের মতো বিধে আছে। সেই আলোতেই শুভা দেখতে পেল, কয়েকটা ঢিল এবং জুতো নীচের থেকে কারা ছুড়ছে। তার মধ্যে একটা মাত্র ঢিলই লোকটার প্যান্ট-পরা হাঁটুর কাছে স্পর্শ করল।

কিন্তু লোকটা না থেমে, একটু একটু করে এগিয়েই চলেছে। পাইপের মাঝামাঝি যখন এসেছে, তখন পাইপটাকে প্রায় ধনুকের মতো বাঁকা দেখাল। আর লোকটা হঠাৎ যেন থেমে গেল। শুভা নিশ্বাস বন্ধ করে, দাঁতে দাঁত টিপে রইল। নিশ্চয়ই লোকটা আর ঝুলে থাকতে পারছে না। হাত নিশ্চয়ই ঘেমে ভিজে উঠেছে। শরীরের ভার আর ধরে রাখতে পারছে না। পড়বার পর, ওকে আর কারুর মারবার দরকার হবে না। আটতলা উঁচু থেকে পড়ে, এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।

পড়ে যাবার দৃশ্যটা সহ্য হবে না বলে, শুভা জানালার পাশ থেকে সরে আসতে গেল। আর লোকটা তখনই, বন্ধ মেশিন চালু হয়ে যাওয়ার মতো, আবার চলতে আরম্ভ করল। শুভা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি লোকটার এত জোর! না কি মরার ভয়েতেই, এরকম শক্তি পাচ্ছে। কোথায় চুরি করতে এসেছিল লোকটা! এমনকী চুরি করতে এসেছিল, যে জন্যে এমন ভয়াবহ বিপদে পড়তেও ভয় পায়নি।

ইতিমধ্যে, যে ব্লকের দিকে লোকটা চলেছে, সেই ব্লকের ফ্ল্যাটগুলোর জানালায় জানালায় আলো জ্বলে উঠতে আরম্ভ করেছে। পালাবার কোনও উপায়ই নেই। লোকটা কি তা বুঝতে পারছে না। যদি বুঝতে পেরে থাকে, তবে এমন ভয়ংকর ভাবে জীবন-সংশয় করে, পাইপ বেয়ে পালাতে গেল কেন।

লোকটার জন্যে, শুভার উদ্বেগের কোনও কারণই থাকতে পারে না। একটা চোরের জন্য, কারুর কোনও উদ্বেগ হয় না। কিন্তু, নিজে সে একলা একলা ব্যাপারটা দেখছে। লোকটাও একলা একলা এভাবে পালাবার চেষ্টা করছে। সেই জন্যেই বোধ হয়, এরকম একটা উদ্বেগে ওর বুকের মধ্যে ধক ধক করছে। সকলের সঙ্গে থেকে, হইচই করলে এরকম হয়তো মনে হত না। তা ছাড়া, লোকটা এমন একটা দূরত্বে, ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে রয়েছে, তাতে চোরের ভয়টাও ঠিক হচ্ছে না। বরং লোকটা হয় মরবে, না হয় ধরা পড়বেই, এ কথা ভেবে কেমন যেন বেচারি বেচারিই মনে হচ্ছে। সব চোরের যা হয়, এরও তাই হবে।

এ ধরনের চোরেরা যে কেমন হয়, শুভা জানে না। চোরেদের সম্পর্কে তার একটা সাধারণ ভীতি আছে। যেটা, অধিকাংশ মেয়েদেরই বা মানুষদেরই থাকে। এখন যে ভয়টা ঠিক লাগছে না।

কিন্তু আশ্চর্য, লোকটা যে সত্যি অন্য ব্লকের ছাদে গিয়ে পৌঁছল! ইতিমধ্যে, যে ব্লকের ছাদ থেকে লোকটা পাইপে ঝুলে পড়েছিল, সেই ছাদে কয়েকজন লোক এসে পড়েছে। তাদের এক জনের হাতে টর্চ। টর্চের আলো পড়ল লোকটার গায়ে। লোকটা অন্য ব্লকের ছাদে পৌঁছেই, জলের ট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে কোথায় যে মিলিয়ে গেল, শুভা দেখতে পেল

যেখানেই যাক, এবার লোকটা ধরা পড়বেই। নিশ্চয় অমন উঁচু ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে না। আর সিঁড়ি দিয়ে, এতক্ষণে, অবধারিত ভাবে, লোকজন ছাদে উঠে আসছে। অথচ পাশের ছাদ থেকে যারা টর্চের আলো ফেলছে, তারা যেন কেমন দিশেহারা। টর্চের আলো যেন বিভ্রান্তের মতো, চারদিকে হাতড়ে ফিরছে। কে একজন চিৎকার করে উঠল, শিগগির পাশের ছাদে উঠে পড়ো। কোথায় যেন লুকিয়ে পড়েছে। চোর ব্যাটাকে আর দেখা যাচ্ছে না।

সেই চিৎকার শেষ হবার আগেই, পাশের ব্লকের ছাদেও কয়েক জনের মূর্তি ভেসে উঠল। তাদের কাছেও দুটো টর্চ লাইট। তারা ছুটোছুটি করে, চারপাশে আলো ফেলে দেখছে। জলের ট্যাঙ্কের আশেপাশে, তলায়, সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজছে। কিন্তু পাচ্ছে না।

অন্য ছাদ থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, পাওয়া যাচ্ছে না?

পাশের ছাদ থেকে জবাব গেল, না, কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

ভাল করে দেখো, নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে। ভূত তো না, এভাবে হাওয়া হয়ে যেতে পারে না।

অন্ধকার একলা ঘরে, গরাদহীন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শুভাও অবাক হয়ে গেল। আশ্চর্য, কোথায় পালাতে পারে লোকটা! বোধ হয়, এক বা দেড় মিনিট সময় পেয়েছে লোকটা। এইটুকু সময়ের মধ্যে, পাইপ বেয়ে ছাদে নেমেই, কোথায় অদৃশ্য হতে পারে!

একজনের গলা শোনা গেল, পাইপ বেয়ে ঠিক এ ছাদেই এসেছিল তো?

অন্য ছাদ থেকে জবাব এল, নিশ্চয়ই। সবাই দেখেছে ওকে পাইপ বেয়ে যেতে। ওই হুদা ম্যানসনটার দিকে দেখেছ?

দেখেছি।

নরম্যান কোর্টের দিকে?

 তাও দেখেছি।

 তবে ওই বাজপেয়ী বিল্ডিংয়ের দিকে দেখো।

ওদিকে তো আগেই দেখেছি।

হঠাৎ সবাই যেন কী রকম চুপচাপ হয়ে যায়। অন্যান্য মেয়ে-পুরুষদের গলা শোনা যায় জানালায় জানালায়, ব্যালকনি, বারান্দায়। কয়েক বার পুলিশের হুইশলও বেজে উঠেছে। নীচের রাস্তায় হয়তো  পুলিশের গাড়িও এতক্ষণে এসে গিয়েছে।

শুভা অবাক হয়ে ভাবে, কোথায় যেতে পারে লোকটা! সে তো নিজের চোখে দেখেছে লোকটাকে পাইপ বেয়ে নামতে।

আরও খানিকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি চলল। কিন্তু দুরের এই অন্ধকার ঘরের কোণ থেকেই, শুভা বুঝতে পারল, তার সন্ধানীদের মধ্যে হতাশা নেমে এসেছে। তাদের উৎসাহে ভাঁটা এসে পড়েছে। চোরকে তারা কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে, দরজা জানালা বন্ধ হবার শব্দ পাওয়া যেতে লাগল। একটা করে ফ্ল্যাটের আলো নিভে যেতে লাগল। বোঝা গেল, চোরের আশা সবাই আস্তে আস্তে ত্যাগ করছে। যে যার নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকছে। একমাত্র, ফ্ল্যাটবাড়িগুলোর দরোয়ান আর পুলিশের সেপাইরাই বোধ হয়, নীচে, রাস্তায়, বাগানে, উঠোনে, সিঁড়িতে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আরও প্রায় পনেরো মিনিট কেটে যাবার পর, আবার আগের মতোই নিঃশব্দ হয়ে আসতে লাগল সব। ফ্ল্যাটগুলো অধিকাংশই অন্ধকার হয়ে এল। এমনকী, শুভার কানে ঝিঁঝির ডাক পৌঁছল।

শুভার এখন আর সেই উদ্বেগটা নেই। মনে মনে খানিকটা ভয়ই পেল। কী সাংঘাতিক লোক! এমন চোরকে কে ভয় না পায়! কোথায় পালিয়ে গেল লোকটা! ও কি জাদু জানে?

হঠাৎ কোথায় একটা, কীসের শব্দ হল। শুভার বুকটা ধক করে উঠল। সে আবার তার নিজের চিন্তায় ফিরে এল। যে শব্দের জন্যে সে প্রতি রাত্রের নিশীথে, রুদ্ধশ্বাস ভয়ে ও যন্ত্রণায় অপেক্ষা করে থাকে, হয়তো সেই শমন এল। এখনই, প্রচণ্ড জোরে, দরজায় আঘাত পড়বে। সেই সঙ্গেই ক্রুদ্ধ নিষ্ঠুর মত্ত গলা তার মন ও শ্রবণকে রক্তাক্ত করে, সেই ভাষায় চিৎকার করে উঠবে। শুভা, অন্ধকারেই, পাশের ঘরের অন্ধকারে তাকাল। দুই ঘরের মাঝখানের দরজার পরদাটা সে সরিয়েই রেখেছে। দরজায় শব্দ হলেই যাতে খুলে দেবার জন্যে আলো জ্বালিয়ে ছুটে যেতে পারে।

কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেও দরজায় কোনও আঘাত বাজল না। অথচ, আবার সামান্য একটা শব্দ পেতেই শুভা চমকে জানালার দিকে তাকাল। তাকিয়েই, তার বুকের কাছে নিশ্বাস আটকে এল। গায়ের মধ্যে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে দেখল, জানালার কাছে, নীচের দিক থেকে আস্তে আস্তে একটা মানুষের মাথা যেন উঠে আসছে।

শুভা জানালার ধারে ছিল। চকিতে দেয়ালের আড়ালে সরে গেল। কিন্তু ততক্ষণে ওর বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছে। কে লোকটা! কে হতে পারে? চোর! সেই চোরটা নাকি! কী সাংঘাতিক ব্যাপার। জানালায় তো গরাদ নেই, গ্রিল নেই। এ পাড়ার এই এক আপদ, জানালায় গরাদ গ্রিল কিছুই থাকে না, কেবল কাঁচের পাল্লা ছাড়া। মোটা পরদা সবসময়ের জন্যেই ঢাকা থাকে। রাত্রের এই অন্ধকার নিরালায়, শুভা পরদাটা সরিয়ে দেয় রোজ। দিয়ে, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, চারপাশের দৃশ্য দেখে। আজও যেমন দেখছিল।

কিন্তু এমন ভয়ংকর অভাবিত ঘটনা সে কল্পনাও করতে পারেনি। দেওয়ালের আড়ালে সরে গেলেও, আবছায়াতে ও পরিষ্কার বুঝতে পারে, একটা মানুষ জানালায় উঠে এসেছে। চারদিক নিঝুম স্তব্ধ। বাইরে চোরের পিছনে ছোটা মানুষদের গোলমালও আর নেই। শুভা চিৎকার করে ডাকলে যে কেউ শুনতে পাবে, তাও মনে হয় না। ওর কেবলই মনে হতে লাগল, এ কি সেই চোরটাই নাকি! একটু আগেই যাকে আটতলা বাড়ির ছাদে দেখা গিয়েছিল, ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সে-ই কি এখন এ ঘরে চুরি করতে ঢুকছে।

জানালার কাছে হঠাৎ জোনাকির মতো একটা ক্ষীণ আলো চকিতে জ্বলল, চকিতে নিভল। পর পর কয়েক বারই জ্বলল, নিভল। একটা বিন্দুর মতো আলোর ইশারা, ঘরের মধ্যে যতটা সম্ভব, আশেপাশে ঘুরে গেল। শুভা সরতে সরতে, দেয়ালের শেষে, একটা আলমারির পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল। ও নিশ্বাস বন্ধ করে রাখতে চাইছে, পারছে না। এতক্ষণ ভয়েই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। এখন ভয়েই যেন, ঘন ঘন নিশ্বাস, স-শব্দে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চোরের কাছে, চুরি করে, নিজেকে লুকিয়ে রাখাটাই এখন ওর কাছে সব থেকে নিরাপদ উপায় বলে মনে হচ্ছে।

জানালাটা একটু উঁচুতে, প্রায় শুভার বুকের কাছাকাছি। একটুও শব্দ না করে, জানালা থেকে একটি মূর্তি নেমে এল ঘরে। শুভার মনে হল, লোকটার পরনে একটা প্যান্ট, গায়ে কালো রঙের একটা জামা। সেটা শার্ট বা পুরো হাতা সোয়েটার, বোঝা যায় না। মূর্তি ঘরে নামতেই তার হাতে বিন্দুর মতো একটা আলো জ্বলে উঠল। অনেকটা যেন সিগারেটের আগুনের মতোই, একটু হয়তো বড়। সেই আলোটা ঘরের চারপাশে এক বার ঘুরে গেল। আলমারির পাশে, প্রায় শুভার গা ছুঁয়ে গেল। তারপরে, আলোটা পাশের ঘরে যাবার দরজায়, এক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল। পরমুহূর্তেই মূর্তি সেই দরজার দিকে গেল।

শুভা একটু সরে এসে দেখতে চাইল, নোকটা কী করে। এখন শুভা মনে মনে নিশ্চিত হয়েছে, এ সেই পলাতক চোরই। কীভাবে লোকটা আটতলার ছাদ থেকে নেমে আসতে পেরেছে, ও কল্পনা করতেও পারে না, তবে ওদিক দিয়ে নিশ্চয় পালাবার উপায় ছিল না। লোকজন এবং পুলিশ রাস্তার ওপরে ঘোরাঘুরি করছে। সেই জন্যেই, এদিকে চলে এসেছে। কোনওরকমে গ্যারেজের চালে এসে, এ বাড়ির পিছনের সরু গলিতে নেমে, স্যানিটারি পাইপ বেয়ে ওপরে চলে এসেছে। সম্ভবত, এই খোলা জানালাটা লোকটার নজরে পড়েছিল। সরু গলি দিয়ে বেরুতে গেলেও ধরা পড়ে যাবার ভয়। তাই ঘরের ভিতরে কোথাও আশ্রয় নিয়ে, বোধ হয় সময় কাটাবার মতলব।

কিন্তু তা-ই কী? চোরের মতলব চুরি করা ছাড়া আর কী থাকতে পারে। কোনও এক ফ্ল্যাটের অন্ধকার ঘরে আশ্রয় নিয়ে, সময় কাটাবার সাহস কোনও চোরের থাকতে পারে না। আর পাশের ঘরেই, এদিককার দেওয়াল ঘেঁষে, এ ঘরের যে মালিক তার আয়রন লকার রয়েছে। সেই আয়রন লকারের ওপর শুভার বিন্দুমাত্র মায়া-মমতা নেই। বরং ঘৃণাই আছে। কিন্তু লকারে যে প্রচুর টাকা থাকে, তা ও জানে। যদি শুভার সামনেই লোকটা লকার খুলে টাকা নিয়ে যায়, তবে সর্বনাশ। তা হলে শুভার নিস্তার নেই। ভয়ংকর শাস্তি এবং অপমান ওর ওপর নেমে আসবে।

শুভা আরও একটু সরে এসে দেখতে চাইল নোকটা কোন দিকে যায়, কী করে। দেখল লোকটার অস্পষ্ট মূর্তি ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্ষীণ আলোর বিন্দু চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক জোনাকির মতো বারে বারে নেভে, বারে বারে জ্বলে। লোকটা এবং আলোটা লকারের দিকে গেলেই, শুভা আলো জ্বালিয়ে চিৎকার করে উঠবে। তাতে যা হয়, তাই হবে। লোকটা যদি তাকে গলা টিপে ধরে মেরেও ফেলে, তাও ভাল। সেটাও একটা মুক্তি। তবু সামনা-সামনি চুপচাপ এ চুরি সে দেখতে পারবে না। কারণ সে পরিণতি বেঁচে থাকার চেয়েও নিদারুণ।

কিন্তু শুভা দেখল, আলোর বিন্দুটা, বাইরের বন্ধ দরজার ওপর স্থির হয়ে রয়েছে। মূর্তি ক্রমেই সেই দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে আলোর বিন্দুটা পড়ল দরজার মাথার ছিটকিনির ওপর। সেই আলোর বিন্দুতেই, শুভা দেখতে পেল, লোকটা ছিটকিনিতে হাত দিয়েছে। দরজা খোলার উদ্যোগ করছে। তা হলে, এদিক দিয়ে পালাবারই মতলব।

ঠিক এই মুহূর্তেই, বাইরে থেকে, দরজায় আঘাত পড়ল। আলোর বিন্দু নিভে গেল। চকিতের মধ্যেই, মূর্তি ঘরের মধ্যেই কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওদিকে বাইরে থেকে, দরজায় আঘাত, ক্রমাগত প্রচণ্ড হয়ে উঠল। এক মুহূর্তও থামবার নাম নেই। সেই সঙ্গেই, মত্ত ক্রুদ্ধ গলা শোনা গেল, কী হল কী। এ যে বাবা মালের খোয়ারির থেকেও বেশি দেখছি। নাকি বিষ টি গিলে মরে পড়ে আছে। দরজা খোলা হবে, না কি?

শুভা তবু যেন স্থির করতে পারছে না, ও কী করবে। ও কি আলো জ্বালবে। না কি, অন্ধকারের মধ্যেই গিয়ে দরজাটা খুলে দেবে। কারণ, আলো জ্বলে উঠলে, চোরকে যদি এই মত্ত মাতঙ্গ দেখতে পায়, তা হলেও চোরের পরিচয় বিশ্বাস করবে না। জঘন্য নোংরা কোনও অপবাদ দিয়ে, অন্য কিছু বলবে।

দরজায় সমানে করাঘাতের পর, পদাঘাত। নেহাত ওপরে আর কোনও ফ্ল্যাট বা বাসিন্দা নেই। তা হলে, এতক্ষণ বাইরের বারান্দায় লোকের ভিড় জমে যেত। তারই সঙ্গে, চিৎকার শোনা গেল, এই হারামজাদি, দরজা খুলবি, না ভেঙে ফেলব? তা হলে জানবি, তোকেও আমি ভাঙব, আস্ত রাখব না।

শুভা আর স্থির থাকতে পারে না। সে ঘরের আলো জ্বেলে দেয়। পাশের ঘরে গিয়ে, দরজার পাশ থেকেই, সুইচ টিপে আলো জ্বালায়। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায়না। তবুও বাইরের দরজার বাঁ পাশে, পুরনো সেকালের একটা খাটো কিন্তু বিরাট, টানা দেরাজের আলমারিটার দিকে চকিতে এক বার ওর চোখ যায়। সহসা যেন, দুটো তীক্ষ্ণ চোখের সঙ্গে ওর দৃষ্টি মিলে যায়। তার সঙ্গে আরও একটা কিছু। একটা সরু সূচিবিদ্ধ তীক্ষ্ণ চকচকে কিছু।

কিন্তু দ্বিতীয়বার আর সেদিকে ফিরে তাকাল না শুভা। ও গিয়ে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দিল। দিতেই ঝড়ের বেগে, একটি মূর্তি ঢুকল। লোকটার বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ, যে-কোনও একটা অঙ্কের হতে পারে। তার বেশি কম নয়। পাতলা চুল উশকো খুশকো। গলা বন্ধ কোটের বোতামই শুধু খোলা নয়, ভিতরের সিল্ক পাঞ্জাবির, পাথর বসানো সোনার বোতামগুলোও খোলা। ফুল কোঁচানো ধুতি, চটকানো। কোঁচা মাটিতে লুটোচ্ছে। লোকটির কলেবর দৈর্ঘ্যের চেয়ে প্রস্থেই বেশি। রং ফরসা। ঠোঁটের কষ বেয়ে, রক্তের মতো পানের পিক লেগে আছে। চোখ দুটো যেন আগুনে তাতানো লাল ছুরির মতো।

শুভা দরজাটা খুলে দিয়েই সরে আসছিল। তার আগেই ফরসা আংটি পরা মোটা থাবা ওর ঘাড়ের কাছে আঁচলটা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। শুভা পড়তে পড়তে কোনওরকমে সামলে নিল। লোকটি আর এক হাতে দরজাটা বন্ধ করতে করতেই, কুৎসিত ভঙ্গিতে বলে উঠল, এত তাড়া কীসের, অ্যাঁ? দরজা খুলতে কোনও তাড়া নেই, অথচ পালাবার তাড়া। কেন, ভেতরে কোন নাগরকে বসিয়ে রাখা হয়েছে?

শুভা আঁচলে টান দিয়ে বলল, ছাড়ো, বাজে কথা বকো না।

বাজে কথা? আমার খালি বাজে কথা, উম?

বলেই, আঁচল টেনে, একটা ঝটকা দিল। তাতে, শুভার গোটা গা থেকেই প্রায় আঁচল সরে গেল। লাল জামার ওপরে, বুকের কাছে, ও হাত চাপা দিল। লোকটি আবার বলে উঠল, তা এতক্ষণ হচ্ছিল কী? দরজা খুলতে এত দেরি কীসের? কেউ জুটেছে টুটেছে বুঝি? পিরিতের নাগরকে পার করতে সময় লাগছিল?

একদিকে এই আক্রমণ আর অপমান। আর একই সঙ্গে, শুভার মস্তিষ্কের সীমা জুড়ে বেঁটে ঢাউস আলমারিটার পাশে, লুকিয়ে থাকা লোকটা বিধে আছে। কিন্তু লোকটার কথা এখন ও বলতে পারছে না। অথচ লোকটা এই ঘটনা দেখছে, ওর এই লাঞ্ছনা আর অপমান, সেটাও ভুলতে পারছে না। তবু বলল, তুমি তো দিন রাত্তির ও সবই দেখছ। আমার ঘুম পেয়েছিল, তাই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুমি কাপড় ছাড়ো।

এ্যাততো ঘুম।

হ্যাঁ, তোমার জন্যে সারা রাত জেগে বসে থাকতে পারি না আমি। কাপড় ছাড়ো।

 শুভার গলায় ঝাঁজ। কাপড় ধরে টান দিল। কিন্তু ছাড়িয়ে নিতে পারল না।

আহা ছাড়ছি ছাড়ছি। জানি, তুই হচ্ছিস খাঁটি সতী। কাপড় ধরলেও তোর সতীত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তা, এ সব করে আর কত দিন চলবে? আমার কাছে এক ঘরে থেকে, এখনও কি লোককে বোঝাতে পারবি, তোর গোটা অঙ্গটি একেবারে পবিত্তির আছে?

বলতে বলতে সে আবার শুভাকে নিজের দিকে জোরে টানল। শুভাও নিজের কাপড় টেনে ধরে রাখল। যদিও তাতে আরও যেন এলোমেলো হয়ে উঠল। ওর শিথিল করে বাঁধা খোঁপা ঘাড়ের পাশে ভেঙে পড়ল। জোর করে কাপড় টানতে গিয়ে, ওর শ্যাম উদ্ধত স্বাস্থ্য যেন বুকের জামার কাছে অলজ্জ বে-আবরু হয়ে উঠতে চাইল। গোলের মধ্যেই ঈষৎ লম্বা ভাবের সমস্ত মুখখানি এই শীতেও যেন ঘেমে উঠল। কোনও প্রসাধনের ছাপ নেই মুখে। কপালে একটা টিপও নেই। সিঁদুর-হীন সিঁথি জ্বলজ্বল করছে। কানে গলায় হাতে, কোথাও সামান্য একটি অলংকার পর্যন্ত নেই।

থাকার মধ্যে আছে একটি সাধারণ স্বাস্থ্যের দীপ্তি। চোখ-মুখেও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য নেই। তবু ওর চোখের দৃষ্টিতে যেন, চোখ দুটিতে একটি বিশেষ ভঙ্গি ফুটে উঠেছে। করুণ অথচ কঠিন। বাংলাদেশের আর দশটা সাধারণ মেয়ের মুখের মতোই মুখ। তবু, চরিত্র ও মানসিকতার একটা বিশেষ ছাপ পড়ে, কোথায় যেন একটা অসামান্যতা আয়ত্ত করেছে। ওকে হঠাৎ দেখলে, একটি স্বাস্থ্যবতী, সুন্দরী এবং গভীর প্রকৃতির মেয়ে বলে মনে হয়। যদিও, তার মধ্যে কোথাও শহর নগরের ঝলক নেই। একটু বরং দূরান্তের গ্রামীণ ভাবই লক্ষিত হয়। তবে ওর চোখ দুটি বেশ আয়ত এবং কালো। বয়স অনুমান করতে অসুবিধা হলেও সম্ভবত চব্বিশ-পঁচিশের কম নয়।

এবার হঠাৎ শুভার চোখ দুটি জ্বলে উঠল। বলল, লোককে বোঝাবার আমার কিছু নেই। আমি সতী কি অসতী, সে পরীক্ষা আমি কারুর কাছে দিতে চাই না। কিন্তু তুমি আমার কাপড় ধরলেও আমার ঘেন্না হয়। ছাড়ো বলছি।

বটটে! আমি কাপড় ধরলেও ঘেন্না হয়?

বলেই, আচমকা কাপড়টা ছেড়ে দিয়ে, বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে শুভার গালে একটা থাপ্পড় মারে। শুভা ছিটকে খানিকটা সরে যায়। অপরিসীম ঘৃণায় আর রাগে, ওর দুই চোখ ধক ধক করে। কাপড় ঠিক করে, বুকের ওপর দিয়ে টেনে দিতে দিতে বলে, এই না হলে পুরুষ। একটা মেয়ে দুরবস্থায় পড়ে তোমার কাছে রয়েছে, তাও নিজের ইচ্ছেয় নয়। তোমার নিজের বউ নয়, মেয়েও নয়। তার গায়ে হাত না তুললে আর পুরুষ কীসের?

চোপ!

কীসের চোপ। তোমার জ্বালা তো, কেন তোমার কথা শুনছি না, তোমার ঘর করছি না। কিন্তু তোমার ঘর করতে তো আমি আসিনি, আমাকে

তোকে তোর পিরিতের লোক ঠাকুর ঘর থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। তারপরে, বন্ধুর হেফাজতে রেখে, সে-ই যে শালা কেটেছে, আর তার টিকির দেখা নেই। এর মানে কী, আমি জানি না ভেবেছিস? ও সব ছেনালি সতীগিরি অন্য জায়গায় দেখাস।

হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, একবার টলে উঠে আবার বলল, তোর সেই তারকদাদাটি আর কোনওদিনই আসবে না, জেনে রাখিস।

শুভা বলে উঠল, আর সেই সুযোগটাই তুমি নিতে চাইছ।

ক্ষিপ্তের মতো লোকটা আরও দু পা এগিয়ে গেল, গর্জে উঠল, সুযোগ কীসের, আঁ? কীসের সুযোগ?

খবরদার, তুমি আমার গায়ে হাত তুলতে এসো না আর!

একেবারে দেয়াল ঘেঁষে, এমনভাবে দাঁড়াল শুভা, যেন সমস্ত শক্তি সংহত করে, প্রত্যাঘাতের জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। লোকটি থমকে দাঁড়াল। হিংস্র কিন্তু ভীরু দাঁতাল শুয়োরের মতো শুভার দিকে তাকাল। গলার স্বর নামিয়ে বলল, আমার ঘরে আমাকেই চোখ রাঙানো হচ্ছে?

শুভাও যেন দাঁতে দাঁত চেপে বলল, একে চোখ রাঙানো বলে না। কিন্তু পড়ে পড়ে তোমার মার খেতে পারব না আমি। দরকার হয় রাত পোহালেই আমি তোমার এখান থেকে চলে যাব।

লোকটা শব্দ না করে, ফুলে ফুলে হাসতে লাগল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, চকিতে এক বার শুভার চোখে পড়ল, আলমারিটার পাশে। সেই চোখ, আর সেই সরু সূচিবিদ্ধ তীক্ষ্ণ চকচকে জিনিসটা! মনে হল, কপালের কাছে রুক্ষু চুলের গোছা এসে পড়েছে। চকিতে একবার চোখাচোখি হল মাত্র। চোখ দুটো শুভার দিকেই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু, মুখটা যে কেমন, কী রং, কিছুই বুঝতে পারল না ও।

অন্য দিন অনেক লাঞ্ছনাতেও, এতটা কঠিন হয়ে ওঠে না শুভা। আজ, এই পলাতক চোরের সামনে যেন ওর আত্মসম্মানবোধ সহসা খাপ-খোলা অস্ত্রের মতো ঝলসে উঠল। অন্য দিন তৃতীয় কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকে না। তা-ই যতটা সম্ভব আত্মরক্ষাটাই ওর কাছে বড় হয়ে ওঠে। আজ, আর একজন, সে যে-ই হোক, চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, যা-ই হোক, কিন্তু একটা মানুষ। আর একটা মানুষের সামনে, এই অপমান আর লাঞ্ছনায় কেবল আত্মরক্ষা করতে যেন ওর লজ্জা করছে। এতটা হীনতা যেন মেনে নিতে পারছে না।

এই লোকটা নিঃশব্দে ফুলে ফুলে হেসে উঠে বলল, কোথায় যাবি? বর্ধমানে, তোদের বাড়িতে নাকি?

শুভা সেই ভঙ্গিতেই বলল, সে যেখানেই যাই, তোমার আশ্রয় থেকে আর খারাপ কিছুই হবে না। বাড়িতে গেলেও না হয়, বাপ মা মেরে ফেলবে, তবু

মেরে ফেলবে না, তাতে তাদের হাতেই হাতকড়া পড়বে। মুখে লাথি মেরে তাড়িয়ে দেবে। দেয় দেবে। তাদের লাথি খেয়ে যদি আমাকে অন্য কোনও আঁস্তাকুড়েতেও যেতে হয়, তাও ভাল। তবু তোমার কাছে থাকতে চাই না।

কেন, তোর তারকার জন্যে অপেক্ষা করবি না? পিতিক্ষে যাকে বলে। অমন তোদের সস্বর্গীয় পিরিত, ভালবাসা। সে তোকে নিতে আসবে। তোকে নিয়ে সংসার পাতবে, সুখের সংসার।

তারকদার বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমার কথা বলার কিছু নেই। তুমি তার ছেলেবেলার বন্ধু। তুমিই ভাল জান, সে কী করবে না করবে।

আমি? লোকটা হাসতে হাসতে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। পায়ে ভর করে, এমনিতেই দাঁড়িয়ে থাকতে

 পারছিল না। টলটলায়মান অবস্থা। হাসির বেগে পড়ে যেতে গিয়ে, কোনওরকমে টাল সামলে নিয়ে বলল, প্রেম করলি তোরা। ঘর ছেড়ে পালিয়ে এলি তারকের সঙ্গে, সে তোর ভাবী সোয়ামি, আর আমি ওকে ভাল চিনব?

শুভা ঠোঁটে ঠোঁট টিপে চুপ করে রইল। লোকটির কথার মধ্যে যে নিষ্ঠুর সত্যি ছিল, কুৎসিত আর বীভৎস সত্যি ছিল, তা যেন ওর মুখের কথার ওপরে আঘাত করল। তথাপি, একটি তৃতীয় ব্যক্তির সামনে, এই অপমানকর কথাগুলো, ওর বুকের মধ্যে যেন একটা তীক্ষ্ণ জ্বালাও ধরিয়ে দিল। ভিতরটা পুড়তে লাগল। কোনও কথা বলতে পারল না।

লোকটি হঠাৎ তর্জনী তুলে, এক চোখ বুজে, হেসে, একটা নোংরা ভঙ্গি করল। জড়িয়ে জড়িয়ে বলল, আর আমার কথাই যদি মানিস, সে তো আমি বহুদিন আগেই বলে দিয়েছি সুন্দরী, তারকা নামে চিড়িয়াটি ফুড়ুৎ কেটেছে। সে আর কোনওদিন ফিরে আসবে না। এবার এই নরেশ নামক চিড়িয়াটিকে নিয়ে থাকো। দানাপানি খাওয়াও। তা নয়, তোর সতীত্ব

চুপ কর, নোংরা ইতর ছোটলোক!

শুভা আবার ফুঁসে উঠল। এবং চকিত মুহূর্তের জন্যে, ওর দৃষ্টি প্রকাণ্ড বেঁটে আলমারিটার কোণ ঘুরে এল। লোকটা তেমনি করেই শুভার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিন্তু, শুভার মনে হল, সূচিবিদ্ধ সেই চকচকে জিনিসটা আর মুখের সামনে তোলা নেই। তাতে যেন লোকটার রোগা রোগা • মুখটা পুরোপুরিই দেখা গেল। মনে হল, লোকটার বয়স বেশি নয়। পঁচিশ-তিরিশের মধ্যেই হবে। একজোড়া সরু গোঁফ আছে যেন। মুখে ভয়ের ভাব তেমন নেই। বরং যেন, কেমন শক্ত রাগ রাগ ভাব।

এদিকে নরেশের মুখ ভয়ংকর হয়ে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমার ঘরে দাঁড়িয়ে, আমার খেয়ে, এত বড় কথা! আজ লাশ ফেলে দেব।

বলেই, একটা দাঁতাল শুয়োরের মতো সে শুভার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল। শুভা যেন এটা অনুমানই করেছিল। তাই, চকিতে সরে যেতেই দেওয়ালে নরেশের মাথা ঠুকে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গে, কোঁচার কাপড় বেধে, মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। তৎক্ষণাৎ ওঠবার চেষ্টা করলেও, ভারী শরীর নিয়ে সম্ভব হল না। তবু সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। শুভা ততক্ষণে, ঘরের প্রায় মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নরেশ আর ও, দুজনেই দুজনের চোখের দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে। দুজনেরই চোখে, ঘৃণার জ্বলন্ত আগুন ঝরছে।

নরেশের চোখে তবু একটু বিস্ময়। সে আর এগিয়ে এল না। ওখান থেকেই বলল, হুম। এত সাহসের পেছনে কী আছে, আমাকে দেখতে হবে। সারাদিন বাড়ি থাকি না। বোধ হয় নতুন কোনও নাগর জুটেছে, দিনের বেলা আসা-যাওয়া চলছে। তাই খুব মেজাজ দেখিয়ে চলে যাবার হিড়িক দেওয়া হচ্ছে, আর গালাগাল ফুটছে।

শুভার চোখে আগুন থাকলেও, নরেশের দেওয়ালে আঘাত বা পতনটা বোধ হয় চায়নি। তবু কোথায় যেন একটা তৃপ্তিও বোধ করছে ও। সম্ভবত তৃতীয় মানুষটা আছে বলেই। তৃতীয় মানুষটা আছে বলেই, ওর মেয়ে মনের বিদ্বেষ এবং ঘৃণাটা এখন এমনভাবে ঝলকে উঠেছে। তৃপ্তিটাও বুঝি সেই কারণেই। ও বলল, তুমি যা খুশি তা-ই ভাবতে পারো, আমার কিছুই যায়-আসে না। তবে তুমি জেনে রেখো আমি এখনও বিশ্বাস করি, তারকদা ফিরে আসবে। সে তো তোমার মতো জোচ্চুরি করে টাকা রোজগার করে না। সে নিশ্চয় টাকা-পয়সার ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ফিরে এলে, তখন তাকে এ সব বোলো।

কথাগুলো বলতে বলতে, শুভার বুকের মধ্যে যেন যন্ত্রণা করে উঠল। চোখের রাগ আর ঘৃণার মধ্যেও, একটু জলের আভাস ফুটে উঠল। ওর মনে হল, তৃতীয় লোকটিকে শোনাবার জন্যেই যেন, নিজের এই অসংশয় বিশ্বাস ঘোষণা করল। অথচ ওর ভিতরে এই বিশ্বাসের কোনও সাড়া পাচ্ছে না। বরং একটা কষ্ট বুকে বিধে গেল।

নরেশ বলে উঠল, বটে? সেই ফিরে আসাটা কবে, জানতে পারি কী?

আবার হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে টাল সামলাল সে। শুভা বলল, যত দিনেই আসুক, তোমাকে তা দেখতে হবে না।

নরেশ মাথা নাড়িয়ে, খানিকক্ষণ টলতে লাগল। তারপরে সোজা পাশের ঘরে চলে গেল। এ ঘরের আলো যতটুকু পড়েছিল, তাতে পাশের ঘরের খাটটা দেখা যায়। সেই খাটে গিয়ে নরেশ হুমড়ি খেয়ে পড়ল। কী যেন সে বিড়বিড় করছে। কোনও কথাই বোঝা যাচ্ছে না। কেবল হাত দুটো এগিয়ে দিয়ে, একটা মরা ব্যাঙের মতো উপুড় হয়ে পড়ল। শুভা জানে, আজ রাত্রের মতো এখানেই শেষ। নরেশ আর উঠবে না। নেশা আর ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যাবে।

সহসা শুভার গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। ঘরের প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে আবার নতুন করে ওর মনে পড়ে গেল, আলমারির পাশে, সেই লোকটা রয়েছে। ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে গিয়েও, ও আড়ষ্ট হয়ে রইল। নরেশের সঙ্গে ঝগড়ার সময়, তবু দু-একবার তাকাতে পেরেছিল। এখন আর কিছুতেই চোখ ফিরিয়ে দেখতে সাহস পেল না। এমনকী, ঘরের মাঝখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতেও যেন, গা শিরশির করে উঠছে। এবার কী করবে লোকটা? এই মুহূর্তেই বা কী করবে? নিশ্চয়ই শুভার অসহায় অবস্থাটা সে বুঝতে পেরেছে। জানে, এসময়ে মেয়েটিকে সাহায্য করবার কেউ নেই। যে ব্যক্তি আছে, সে মেয়েটির রক্ষক নয়। আলমারির পাশ থেকে লোকটা উঠে আসছে না তো!

ভাবতে ভাবতেই, শুভা পাশের ঘরের দরজার কাছে চলে যায়। হঠাৎ বলে উঠল, তোমার খাবার কি দেব?

কথাটা নিতান্ত ছলনা নয়। নরেশ বাড়ি এসে কোনওদিনই খায় না। তবু শুভা রোজই জিজ্ঞেস করে। রোজই এক জবাব পায়, কোনওদিন বা, তোর হাতে আমি খেতে চাই না।

 আসলে, প্রতি রাত্রেই নরেশ ফিরে আসার পরে, যে পরিস্থিতি দাঁড়ায়, তারপরে আর খাওয়ার কথা কোনও পক্ষ থেকেই ভাবা যায় না। তবু রোজই জিজ্ঞেস করতে হয়।

আজ নরেশের কাছ থেকে কোনও জবাবই পাওয়া গেল না, কেবল নাক ডাকার শব্দ ছাড়া। সেই শব্দ যেন শুভকে আরও অসহায় করে তুলল। নরেশকে ঘুমন্ত ভেবে লোকটা হয়তো আরও সাহসী হয়ে উঠবে। আশ্চর্য, যেনরেশের সঙ্গে ও এভাবে ঝগড়া করল, তৃতীয় লোকটার উপস্থিতিতেই, এখন সেই নরেশ ঘুমিয়ে পড়াতে ভয় পাচ্ছে।

ঠিক এই মুহূর্তেই পিছনে একটা সামান্য শব্দ হল। শুভা চমকে পিছনে ফিরে তাকাল। দেখল লোকটা দরজা খুলে, ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করছে। আর এক বার শুভার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল। লোকটা যেন বেরিয়ে যাবার আগে, ইচ্ছে করেই শব্দ করল, এবং শুভার দিকে ফিরে তাকাল।

লোকটার মুখের ওপর তখন আলো পড়েছে। রোগা রোগা, কিন্তু চোখা মুখ একটা ছেলে যেন। চোর ডাকাত বলে ঠিক মনে হল না। যেন ভদ্র ঘরেরই ছেলে। মাথার চুলগুলো উশকো খুশকো। গায়ে একটা কালো রঙের, কলারওয়ালা, ফুলহাতা পাতলা পুলওভার। ভিতরে কোনও জামা আছে কি না বোঝা যায় না। পরনে সেই রঙেরই একটা প্যান্ট। নাক চোখ মুখ সব মিলিয়ে একটা তীক্ষ্ণতা। কিন্তু হাতে যেটা চকচক করে ঝিলিক দিচ্ছিল, সেটা দেখা গেল না।

চকিতের মধ্যেই এই দেখাদেখি। শুভার চোখে ভয় ও উদ্বেগই ফুটে উঠল। লোকটার ঠোঁট দুটো যেন একবার নড়ল। কোনও শব্দ হল না। পরমুহূর্তেই নিঃশব্দে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

শুভা তখনও স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। নিশ্চিন্ত ও নিশ্চিত হতে পারল না, লোকটা চলে গিয়েছে, নাকি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে, চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। যদি কোনও শব্দ পাওয়া যায় বা দরজা নড়ে ওঠে, তা হলে বুঝতে পারবে, লোকটা ওইখানে দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর হঠাৎ শুভার মনে হল, এত ভয় পাবারই বা কী আছে। শুভার কীসের এত ভয়। লোকটা যদি তাকে আক্রমণ করে, তবে ও চিৎকার করবে। আর যদি ছুরিটা বিধিয়ে দেয়, তা হলে তো সব যন্ত্রণার শেষ। শুভার জীবনে, আর কোন ভয় অবশিষ্ট আছে? এবং এই মুহূর্তে, সহসাই ওর মনে হল, লোকটাকে ও এতক্ষণ লুকিয়ে থাকতে দিল কেন। ওর তো উচিত ছিল, নরেশ ঘরে ঢোকা মাত্র, লোকটার কথা বলে দেওয়া।

কিন্তু মত্ত নরেশের কি চোর ধরবার মতো শরীর বা মনের অবস্থা ছিল? হয়তো মনের অবস্থার পরিবর্তন হত। হয়তো, সহসা চোরের উপস্থিতিতে, নরেশ চমকে উঠত। এমন কী, একটু আগেই এই ইতর বিবাদের ঘটনাটা চোর ধরার উত্তেজনাতে আর ঘটতে পেত না।

ভাবতে ভাবতেই শুভার ঠোঁটের দুই কোণ বেঁকে উঠল। বৃথাই এ সব ভাবনা। তবু যদি নরেশকে চিনতে বাকি থাকত শুভার। লোকটা চোর ডাকাত, যা-ই হোক, নিরস্ত্র মাতাল নরেশকে ধাক্কা দিয়েই পালিয়ে যেত। মাঝখান থেকে, নরেশ সমস্ত ব্যাপারটাও অপব্যাখ্যা করত। সে অপব্যাখ্যার বচনও শুভা জানে। গোটা পাড়াটাকে জাগিয়ে নরেশ ঘোষণা করত, শুভারই কোনও প্রেমিক ঘরে এসে লুকিয়েছিল।

তা ছাড়া, আরও একটা ভয় ছিল শুভার। লোকটার হাতে যে জিনিসটা ও দেখেছিল, সে যদি নরেশকে আঘাত করত, সেটা হত, আর এক দুর্দৈব। লোকটা যদি মানে মানে পালিয়ে বিদায় হয়, এটাই চেয়েছিল।

শুভা দেখল, দরজাটা একটুও নড়ছে না। কোনও শব্দও নেই। ও ঘরের এক পাশে সরে গিয়ে, দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে, দরজার কাছে গেল। দরজা খুলে দেখবার সাহস হল না। কোনওরকমে, দ্রুত হাত বাড়িয়ে আগে ছিটকিনিটা বন্ধ করে দিল। উত্তেজনায় ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে, দরজায় কান পাতল, যদি কিছু শোনা যায়। কিছুই শোনা গেল না।

আস্তে আস্তে শুভা শান্ত হল। ওর নিশ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হল। ক্লান্তভাবে, দরজায় হেলান দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইল। যেন, সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড করে, এই মাত্র ঝড় থামল। ওর ভিতরের অবস্থাটা সেই রকমই। ভিতরের সবকিছু এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো। তার মাঝখানে, ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে, বিস্রস্ত এলোমেলা শুভা একলা দাঁড়িয়ে আছে। মনের ভিতরের চারদিকে বিশৃঙ্খলা। কোনও একটা ভাবনাও যেন, সারি সারি, পাশাপাশি সাজানো নেই।

এই বিশৃঙ্খলার ভিতর থেকে, প্রথমেই জেগে উঠল, পলাতক লোকটি। কে লোকটা। আটতলার ছাদ থেকে পালানো, সেই লোকটাই নাকি। তাই যদি হয়, এ ঘরে এল কেন। এলই বা কেমন করে। কেবল কি পালাতেই এসেছিল, নাকি চুরির মতলবও ছিল। কিন্তু চোরদের চেহারা কি ওরকম হয়। ওদের দেশের ছোট মফস্বল শহরে বা গাঁয়ে কখনও যে চোর দেখেনি, তা নয়। তার সঙ্গে, এ লোকটার কোনও মিল নেই। তাদের চেহারা ভাবভঙ্গি, সবই আলাদা।

কিন্তু এ লোকটাই যদি ছাদ থেকে পালানো লোকটা হয়, তবে এ-চোরও আলাদা জাতের। শুভার গায়ে যেন আবার কাঁটা দিয়ে উঠল। এই লোকটাই তা হলে পাইপ বেয়ে, এ ছাদ থেকে ও ছাদে যাচ্ছিল। সেই লোকটাই এতক্ষণ ঘরে ছিল।

পাশের ঘরের দরজা দিয়ে, পিছনের সেই জানালাটার দিকে ওর চোখ পড়ল। এখনও জানালাটা তেমনই ভোলা। না, এভাবে আর কোনওদিন জানালাটা খুলে রাখবে না শুভা।

এ কথা মনে হতেই, নতুন চমক দেখা দিল ওর চোখে। সেই সঙ্গে উদ্বেগ। কী সর্বনাশ, এখনও দুটো ঘরের মাঝখানের দরজা ও খুলে রেখেছে। একটা ভয় গিয়েছে। সেটা অপরিচিতের ভয়। কিন্তু পরিচিত ভয়ংকর ভয়টা তো এখনও, একই ছাদের তলায়, পাশের ঘরের খাটে, মরা ব্যাঙের মতো পড়ে আছে। জেগে উঠলে একটা অতিকায় সরীসৃপের থেকেও সে ভীষণ। বিশেষ, রাত্রে কোনও সময়ে ঘুম ভেঙে গেলে নিস্তার নেই।

শুভা তৎক্ষণাৎ এগিয়ে এসে, মাঝখানের দরজাটা টেনে, এদিক থেকে ছিটকিনি এঁটে দিল। দিয়ে, এই রাত্রির, আপাতত কয়েক ঘণ্টার মতো নিশ্চিন্ত হল। এ ঘরেও একটা খাট এবং বিছানা রয়েছে। সংলগ্ন বাথরুমও আছে। পাশের ঘরেও তাই। দরজা বন্ধ করে দিলে, কোনও অসুবিধা নেই। এই সব বাড়ির, এরকম ব্যবস্থায়, শুভা রোজ স্বস্তিতে এক বার করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে। এ ব্যবস্থা না থাকলে, একটা রাত্রিও এবাড়িতে বাস করা যেত না।

নরেশ এ ঘরেই শোয়। এটা তারই ঘর। এই খাট বিছানাও তারই। এ ঘরেরই আর এক পাশে রয়েছে একটা ছোট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। সেটাকে ঘিরে, গোটা কয়েক চেয়ার। এখানেই নরেশের কাজকর্ম হয়। লোকজন এলে বসে, কথাবার্তা বলে। কিন্তু মত্ত নরেশের কোনও কিছুরই ঠিক নেই। সে যে কোন দিন, কোন ঘরের বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে, কিছুই বলা যায় না। তার তো নির্লজ্জ পরিষ্কার উক্তি শুভা শুনেছে, শোয়াশুয়ির কোনও ঠিক ঠিকানা নেই বাবা আমার। কখন কোনদিন কোথায় শুই, তার কিছু ঠিক আছে! এ ঘরেই বা আমার কটা রাত্রি আর কাটে। কীসের টানেই বা রাত্রে এ ঘরে ফিরে আসব। তার চেয়ে কোনও মেয়ের ঘরে গিয়ে কাটিয়ে আসব। তবে এখন তুমি একটা মেয়েছেলে রয়েছ, তাই আসি। তাও তো বাবা, নেউলের মতো ফ্যাঁস ফ্যাঁস করেই আছ। পাবার আশা লবডঙ্কা।…

যেদিন নরেশ পাশের ঘরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, সেদিন রাত্রে শুভা এঘরেই শোয়। কিন্তু নরেশের বিছানায় কোনওদিনই নয়। সে আলাদা একটা মাত্র মাদুর মেঝেয় পেতে শোয়। সে জন্যে মাদুরটা শুভা বড় ঢাউস আলমারিটার পিছনে লুকিয়ে রাখে, নরেশ যাতে টের না পায়। টের পেলে হয়তো কোনওদিন ছুঁড়ে ফেলে দেবে।

শুভা এগিয়ে গেল ঢাউস আলমারিটার কাছে। মাদুরটার জন্যে, কোণের দিকে হাত বাড়াবার আগেই আবার সেই লোকটির কথা ওর মনে পড়ে গেল। আলমারিটার গায়ে হাত রেখে ও ভাবল, কে হতে পারে লোকটা? সম্ভবত চোরই, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শুভার মনে একটা অদ্ভুত কৌতূহল জাগে। লোকটা কী ভেবে গেল। এইরকম মাতাল নরেশ, তার মুখের সেই সব নোংরা কথা, আর শুভকে দেখে, লোকটা কী ভেবেছে। মনে মনে বিদ্রূপ করে নিশ্চয় ভেবেছে, শুভা একটা দুশ্চরিত্রা জঘন্য মেয়ে। কথা থেকে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, তারকদা নামে কোনও একজনের সঙ্গে প্রেম করে সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আর তারকদা ওকে এখানে রেখে সরে পড়েছে। এখন ও একটা দুশ্চরিত্র লম্পট মাতালের আশ্রয়ে রয়েছে। এ লোকটাও নিশ্চয় নরেশের চোখেই শুভকে দেখেছে এবং ভেবেছে। একে পুরুষ, তায় চোর। এ ছাড়া আর কী-ই বা লোকটা ভাবতে পারে।

তবু শুভার মনে হয়, অন্য কিছুও লোকটা ভাবতে পারে। শুভকে দেখে, শুভার কথাবার্তা শুনে কি, খুব খারাপ মেয়ে বলে মনে হতে পারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পাশ ফিরে, নিচু হয়ে শুভা মাদুরের জন্য হাত বাড়ায়। হঠাৎ ওর চোখে পড়ে, নীচে যেন কী একটা পড়ে আছে। চিকচিক করছে। লোকটা তো ওখানে ঢুকেই বসে ছিল। বোধ হয় সেই ছুরিটা।

শুভা আরও নিচু হয়ে, সেটা কুড়িয়ে নিল। অবাক হয়ে দেখল, সেটা ছুরি নয়। একটা অদ্ভুত জিনিস। ছ ইঞ্চি একটা লোহার পাতের ওপর, দু ইঞ্চি ডায়ামেটারের গোল রিং। যেন অনেকটা আইগ্লাসের মতো। একটা লোহার পাতেই গোটাটা তৈরি। রিঙের মাঝখানটা ফাঁকা। কিন্তু, রিঙের গায়ে, তিন দিকে তিনটে, অদ্ভুত আকারের লম্বা লম্বা চাবির মতো রয়েছে। কোনওটাই আলাদা নয়, একই লোহার পাত থেকে কেটে তৈরি করেছে। কোনও জোড় নেই। তিনটেই তিন রকমের। একটা চ্যাপটা, বাকি দুটো গোল চাবির মতো।

শুভা অবাক হয়ে ভাবে, কী জিনিস এটা। কী হতে পারে? নরেশের কোনও জিনিস, না লোকটাই ফেলে গিয়েছে? বস্তুটি চোখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ও। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারল না। জিনিসটা শক্ত লোহার পাতের এবং একেবারে হালকা নয়। কে জানে কী হতে পারে। শুভার স্নায়ু সমূহ যেন শিথিল হয়ে আসতে থাকে। তার আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না।

হাতের জিনিসটা যা-ই হোক, আবার আলমারির পাশে ফেলে রেখে দিয়ে লাভ নেই। এই ঢাউস আলমারিটাতে কিছুই প্রায় থাকে না। টাকাগুলো সবই এমনি বন্ধ করা আছে। ওপরের টানা খুলে, লোহার জিনিসটা ও রেখে দিল। কোণ থেকে মাদুরটা বের করে নিয়ে এসে দেওয়ালের এক পাশে পাতল। তারপরে বাথরুমে গেল। শীত করছে না ওর। তার পরিবর্তে, চোখ মুখ কান ঘাড়ের পিঠ যেন জ্বালা করছে।

বেসিনের কল খুলে, চোখে মুখে জল দিল। আঁচলেই মুছল। ঘরের মধ্যে এসে, নরেশের খাটের কাছে, ছোট ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়াল। মুখ মুছতে মুছতে, নিজেরই চোখের দিকে তাকিয়ে, নিজের সঙ্গেই দৃষ্টিবিনিময় করল।–নিজের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে, এক সময়ে ওর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল।

চোখের কোণ বেয়ে, জলের ফোঁটা গড়িয়ে এল। দাঁত দিয়ে, ঠোঁট কামড়ে ধরে, মনে মনে বলে উঠল, কী হবে আমার? কী আছে আমার কপালে? তারকদা কি সত্যি আর কোনওদিন আসবে না?…

এই অবস্থাতেই, তাড়াতাড়ি সরে এসে, আলো নিভিয়ে দিয়ে, অন্ধকারে মাদুরের ওপর মুখ চেপে, উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সমস্ত কিছুর পরে, ওর ভিতরে, ঝড়ে ছত্রখান জীবনটার শোকে, কান্না বাধা মানল না। এখন শুধু ওর একলার কাঁদবার পালা।

তারপরে কখন এক সময় কান্না শেষ হয়। কিন্তু ঘুম আসে না। চোখের সামনে, পিছনের দিনগুলো ভেসে ওঠে। যে দিনগুলোর প্রতিটি উদয়াস্ত ছিল সুন্দর উজ্জ্বল, সুখে দুঃখে মেলানো একটু আশা, আরও দশটি সাধারণ মেয়ের মতোই। কিন্তু কী অপরাধে কে জানে, আজ রাত্রে সে এখানে শুয়ে আছে। সেখানে ওর জন্যে স্কুল সুখের সকল দরজা খোলা পড়ে রয়েছে। ও হাত বাড়িয়ে নিতে পারছে না। এমন জায়গায় বাধছে, যেখান থেকে হাত বাড়াতে গেলে, হাতটাই হয়তো বা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

এর কি একমাত্র কারণ, একমাত্র অপরাধ, তারকদাকে শুভা ভালবেসেছিল।

.

কলকাতা থেকে, এমন বেশি কিছু দূরে নয়, কাছাকাছি জেলারই এক মফস্বল শহরের প্রান্তে, গ্রামের পাশ ঘেঁষে শুভাদের বাড়ি। মফস্বল শহরের যতটুকু সুবিধা, সেটুকুও পাওয়া যায়। গ্রামের সান্নিধ্যটুকুও আছে। ধানখেত, মাঠ, বন, সবই কাছাকাছি।

একদা নিশ্চয়ই শুদের বাড়ির অবস্থান গ্রামের মধ্যেই ছিল। যুদ্ধ আর দেশ-বিভাগের পর, সবখানেই যেমন শহর বিস্তৃত হয়েছে, এ শহরও তেমনি হয়েছে। বিস্তৃত হতে হতে, যা ছিল গ্রাম থেকে দূরে, তা এসে পড়েছে গ্রামের হাতায়।

আর দশটা সাধারণ হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই, শুভাদের বাড়ি। শুভার বাবা নিজে সেই বাড়ি তৈরি করেননি। ওর বাবার ঠাকুরদার আমলের বাড়ি। একতলা, পুরনো, বড় বড় কোঠাওয়ালা সেকালের বাড়ি। পুরনো বাড়ির ইটে শ্যাওলা ধরেছে। নোনা লাগতে শুরু করেছে, শুভার জন্মের আগে থেকেই। সেই পুরনো দেওয়ালেরই পাশ ঘেঁষে উঠেছে, মাটির দেওয়াল, খড়ের চালের ঘর। অথবা পাতলা ইটের দেওয়াল, মাথায় টালির চাল।

একলা শুভদেরই তো সব নয়। কাকা-জ্যাঠারা আছেন। সকলেরই বংশবৃদ্ধি ঘটেছে, অতএব ঘর দরজা বাড়াতে হয়েছে। একান্নবর্তী পরিবার নয়। সকলেই আলাদা, বিচ্ছিন্ন। একই বাড়িকে নানা ভাগে ভাগাভাগি করে, নতুন করে ঘর তুলে, যে যার নিজের সীমানা ঠিক করে বাড়িয়ে নিয়েছে।

কিন্তু ঠাকুরদার আমলটা আর কোনওদিনই ফিরে আসেনি। বাবা কাকা জ্যাঠাদের জন্য যতখানি ধান-জমি ঠাকুরদা রেখে গিয়েছিলেন, তাতে সমস্ত পরিবারগুলোর তিন মাসের বেশি খোরাকি জুটত না। অতএব সবাইকেই, জীবিকার জন্যে বাইরে পা বাড়াতে হয়েছিল। তবু পুরনো দিনের সেই লক্ষ্মীশ্রী আর ফেরেনি। কোনওরকমে জীবনযাপনের একটা ঠেকেজোড়া দেওয়া অবস্থায়, দিনগুলো চলেছে। আধা-গ্রামীণ, আধা-শহুরে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর দিন যেমন কাটে, চেহারা যেমন হয়, সেইরকমই।

কাকা-জ্যাঠারা তবু বাইরে চাকরির ধান্দায় গিয়েছিলেন। শুভার বাবা, সেকালের একজন ম্যাট্রিকুলেট, চিরদিন গ্রামের ইস্কুলে মাস্টারি করেই কাটিয়েছেন। এখনও কাটাচ্ছেন। শুভদের পরিবারে যেটা সব থেকে বড় অসুবিধে, তা হল, ওর ভাইয়েরা সকলেই ছোট। বোনেরা সকলেই বড়। ষষ্ঠীর দয়াটা নেহাত কম নয়। শুভারা চার বোন তিন ভাই।

সেকালের একজন ইস্কুল মাস্টার, যার কোনও ডিগ্রি নেই, বি-টি পাস তো অনেক দূরের কথা, তাঁর পক্ষে এত বড় পরিবার চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। ওর বাবার আমলে, গ্রামে একটি ম্যাট্রিক পাস ছেলের তবু কিছু কদর ছিল। এখন কথায় কথায় বি-এ, এমএ পাস করা ছেলেদের ভিড়। এখন কলকাতার ছেলেরা পর্যন্ত গ্রামে যায় পড়াতে। শুভার বাবা এখন বাতিলের পর‍্যায়ে। নিতান্ত অনুগ্রহ করে ইস্কুলে রাখা হয়েছে। তবু মাস গেলে, যা হোক কিছু ঘরে আসে। সেই সঙ্গে আছে কিছু বাড়িতে ছাত্র পড়ানোর আয়। সকালে বিকালে চট আর মাদুর বিছিয়ে অনেক ছেলে পড়ে। ইস্কুলের থেকে সেই আয়টাই বেশি।

কিন্তু দিনকালের অবস্থায়, কিছুই না। সাত ভাই বোন, বাবা মা। এতগুলো মানুষের জীবনযাপন সহজ কথা নয়। অভাবটা প্রত্যহের। একটু বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, শুভা এটা প্রতি দিন অনুভব করেছে। তবু তারই সঙ্গে, একটা আশা, অতি সঙ্গোপনে প্রতি দিন মনে মনে লালন করেছে। একটি বিয়ে। ওর একটি বিয়ে, ওর পরের বোনের একটি বিয়ে, তার পরের বোনের একটি বিয়ে…। না, খুব বেশিদিন আর সে আশা লালন করতে পারেনি।

ওর বড় হয়ে ওঠার পিছনে, যেন দৌড়তে দৌড়তে ধাওয়া করে পরের বোনটি বড় হয়ে উঠেছিল। তখনও আশা করত, একটি বিয়ে, একটি বিয়ে হবে। তারপরে যখন তৃতীয় বোনও পেছন থেকে ক্রমে ছুটে আসছিল, তখনও আশা ছিল, কিন্তু নিরাশাও সমান তালে বেড়েছিল। শুভার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মাও বিয়ের কথা বলত। বাবা-মা আলোচনা করত। নিতান্ত যদি টাকার জোগাড় না হয়ে ওঠে, তা হলে, অংশের ধান-জমিই বিক্রি করে বিয়ে দিতে হবে। মেয়ের বিয়ে তো কোনওরকমে আটকে রাখা যায় না! খুব সাধারণ কথা, সত্যি কথা, যদিও দুঃখের কথা, অবিশ্বাসের কোনও কারণ ছিল না।

কিন্তু কতকখানি জমি আছে। কয়টি মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায় সেই জমি বিক্রি করে। পিঠোপিঠি বোনেরা বড় হয়ে উঠতে, এ চিন্তা স্বাভাবিকভাবেই শুভার মনে এসেছিল। অবিশ্বাস আর নিরাশা, তখন থেকেই শুরু। তখন থেকেই, স্বাভাবিকভাবে আরও মনে হয়েছে শুভার, ভাল করে লেখাপড়া শিখলেও, একটা স্বাধিকারের কথা ভাবা যেত। কিন্তু বাবা ইস্কুল মাস্টার হলে কী হবে, মেয়েদের লেখাপড়ার রেওয়াজ ছিল না। গ্রামের পাঠশালাতেই যতটুকু হয়েছে। তারপরে আর কেউ সে কথা চিন্তা করেনি। সেদিক থেকে, ওদের পরিবার যেমন গ্রামীণ, তেমনই অশিক্ষা আর কুসংস্কারেই ভরা।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে, সবকিছুরই পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। সমাজে পরিবারে ভাবনায় চিন্তায়। তার ঢেউ এসে লেগেছে ওদের পরিবারে, মূলে কোথাও ভাঙতে পারেনি। কেবল আর্থিক ধাক্কাটাই প্রতি দিন বড় বেশি করে বেজেছে। চিন্তা ভাবনার জগতে, একটু আঁচড়ও কাটেনি। এই দূর জেলায়, নতুন শহরের গ্রামের সীমানায়, যদি বা কিছু আবর্জনা এসে পৌঁছেছে, আসল কিছুই নিয়ে আসেনি। আবর্জনাগুলো এসেছে নানান ঝলক নিয়ে। তার মধ্যে ভোগের ইন্ধন ছিল। আত্মপ্রকাশের শক্তি নয়। তাই দল বেঁধে পাড়ার মেয়েদের সঙ্গে সিনেমা দেখেছে। বাবার আয়ের সঙ্গে মিলিয়ে, শাড়ি জামা কিনতে পারেনি, বুকের মধ্যে হু হু করেছে, তবু যতটুকু পারা গিয়েছে, তাই সংগ্রহ করেছে। জীবনের আর যা কিছু সব তো একটি জায়গাতেই কেন্দ্রীভূত ছিল। একটি বিয়ে। যদিও আর বিশ্বাস করতেও পারছিল না। তবু, বাবার পরিচর‍্যা, মায়ের কনিষ্ঠ সন্তানের দেখাশোনা করার অবসরে, আর কী-ই বা করার ছিল। আর কী বা ভাববার ছিল।

ছিল, কিছু ছিল বইকী। প্রেম করার ছিল, প্রেম ভাববার ছিল। করেছেও, ভেবেছেও। সেই রকমই প্রেম করেছে, সেই রকমই ভেবেছে। কখনও কখনও, কোনও ছেলের হাতছানিতে মন ভুলেছে। চোখে দেখা, একটু হাসাহাসি। তার চেয়ে বেশি, দু-একখানি চিঠির আদান-প্রদান। নেহাত কাছাকাছি হলে, একটু স্পর্শ। এ সবের মধ্যে জীবনের কোনও যোগ নেই। একটা খেলা। হয়তো, অবচেতনের অবিশ্বাস নৈরাশ্য, আর আপাতত বয়সের একটা স্বধর্ম লীলা। একটু ভাল লাগা, একটু ঘনিষ্ঠ হবার ইচ্ছা। ভেবে চিন্তে কিছু নয়। আপনা থেকেই যতটুকু আসে আর যায়। ভোরের কুয়াশার মতো। যতক্ষণ শিশির, ততক্ষণই রোদের আলোয় একটু রং-বেরঙের ঝিকিমিকি। তারপর প্রখর কিরণে, সবই মিলিয়ে যাওয়া।

তার মধ্যে, মনে রাখবার মতো কিছু নেই, কেউ নেই। তার মধ্যে গভীরতাও কিছু ছিল না। সে রকম কোনও অঙ্গীকারই, কেউ নিয়ে আসেনি। শুভার নিজের মধ্যেও কোনও অঙ্গীকারের সৃষ্টি হয়নি। তেমন গম্ভীরভাবে, মূল্য দিয়ে, কিছু ভাবেনি। ও রকম হয়েই থাকে। একটি ডাগর মেয়ে। তাকে ঘিরে, পাড়ার দশটি ডাগর ছেলে, একটু হাসি একটু কটাক্ষ, এমনি সব নানান উপহার তাকে দিতে চায়।

তবু, যত দিন গিয়েছে, যত আশা গিয়েছে, ততই অবিশ্বাসের সঙ্গে একটা বিক্ষুব্ধ ধিক্কার শুভার মনের মধ্যে জেগে উঠেছে। ভেবেছে, বাবার প্রাণে কি একটু ভয় হত না। নিজের আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে, এতগুলো ভাই-বোনকে সংসারে আনতে, একটু কি বুক কাঁপত না বাবার। সব কি এতই সহজ। ভবিষ্যতের ভাবনা কি একটুও হত না।

ভেবেও, বাবার ওপর বেশিক্ষণ রাগ বিদ্বেষ নিয়ে থাকতে পারত না শুভা। বাবাকে দেখলে, ভারী অসহায় মনে হত। বাবার জন্যে কষ্টই হত। আসলে, বাবার মনের মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা নিরলস ভাই-বোনের সৃষ্টি করেছে, তা একটি ছেলের জন্য। শুভার বদলে যদি একটি ছেলে হত, কিংবা মেজোবোনের বদলে, তা হলেও সে এত দিনে বড় হয়ে উঠত। বাবার একজন সাহায্যকারী সহকারী জুটত।

এ কথা মনে হলেই, শুভা বার বার বলেছে, কেন ছেলে হলাম না। তা হলেও বাবার কষ্ট কিছু ঘোচানো যেত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *