৩য় ভাগ – সক্রেটিসের উপদেশ
প্রথম অধ্যায় – জ্ঞানচর্চা
প্রথম প্রকরণ
১. শিক্ষাব্রতের আদর্শ – সফিষ্ট আন্টিফোনেব সহিত কথোপকথন
(Memorabilia, Book I. Chapter 6)
সফিষ্ট আন্টিফোনের সহিত সক্রেটিসের যে-সকল কথোপকথন হইয়াছিল, তাঁহার প্রতি সুবিচার করিতে হইলে সেগুলি বর্জ্জন করা উচিত হবে না। একদা আন্টিফোন সক্রেটিসের সহচরগণকে তাঁহার নিকট হইতে হরণ করিবার উদ্দেশ্যে তাঁহার নিকটে আসিয়া উহাদিগের সমক্ষেই বলিলেন,–“সক্রেটিস, আমি ভাবিয়াছিলাম, যে যাহারা তত্ত্বজ্ঞানের চর্চা করে, তাহারা অপরের অপেক্ষা সুখী হইবে; তুমি কিন্তু, আমার বোধ হয়, তাহার বিপরীত ফলই লাভ করিয়াছ। কেন না, তুমি এমন জীবনই যাপন করিতেছ, যে কোন দাসও তাহার প্রভুর আশ্রয়ে সে প্রকার জীবন যাপন করিতে সম্মত হইবে না। তুমি অতি নিকৃষ্ট খাদ্য আহার ও অতি নিকৃষ্ট পানীয় পান করিয়া থাক; তুমি যে-বস্ত্র পরিধান কর, তাহা যে শুধু অপকৃষ্ট, তাহাই নয়, কিন্তু তাহা শীতে ও গ্রীষ্মে এক; তুমি বিনা পাদুকায় ও বিনা অঙ্গরক্ষায় সারা বৎসর কাটাইতেছ। তুমি অর্থ গ্রহণ কর না—যে অর্থ পাইলে লোকে আহ্লাদিত হয়, এবং যাহা অর্থস্বামীকে সুখে ও স্বচ্ছন্দে বাস করিতে সমর্থ করে। অন্যান্য ব্যবসায়ের শিক্ষকগণ যেমন শিষ্যদিগকে আপনাদিগের অনুকরণ করিতে শিক্ষা দেন, তেমনি তুমি যদি স্বীয় সহচরদিগকে তোমার অনুকরণ করিতে শিক্ষা দেও, তবে তুমি আপনাকে দুঃখের শিক্ষক বলিয়াই জ্ঞান করিও।”
সক্রেটিস এই কথাগুলির উত্তরে বলিলেন,–“আন্টিফোন, আমার বোধ হয়, তুমি ধরিয়া লইয়াছ, যে আমি এতই দুঃখময় জীবন যাপন করিতেছি, যে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, তুমি বরং মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিবে, তথাপি আমার মত জীবন ধারণ করিবে না। এস, আমরা পরীক্ষা করিয়া দেখি, তুমি আমার জীবনে কি কষ্টকর বলিয়া অনুভব করিতেছ। যাহারা অর্থ গ্রহণ করে, তাহারা যে-কার্য্যের জন্যে বেতন পাইয়াছে, তাহা সম্পাদন করিতে বাধ্য; কিন্তু আমি অর্থ গ্রহণ করি না, সুতরাং যাহার সহিত আলাপ করিতে চাহি না, তাহার সহিত আলাপ করিতেও বাধ্য নই;–এই জন্য কি? না তুমি এই ভাবিয়া আমার জীবনযাপনের ধারাকে অবজ্ঞা করিতেছ, যে আমি তোমার অপেক্ষা কম স্বাস্থ্যপ্রদ ও বলকর খাদ্য আহার করি? অথবা আমার আহার্য দুর্লভ ও মহার্ঘ, অতএব তোমার আহার্য অপেক্ষা সংগ্রহ করা কঠিন? না তুমি তোমার জন্য যে খাদ্য আহরণ কর, তাহা তোমার পক্ষে যেমন স্বাদু, আমি আমার জন্য যে-খাদ্য আহরণ করি, তাহা আমার পক্ষে তেমন স্বাদু নহে? তুমি কি জান না, যে, যে-ব্যক্তি পরম প্রীতির সহিত ভোজন করে, তাহার ব্যঞ্জন অতি অল্পই আবশ্যক; এবং যে পরম প্রীতির সহিত পান করে, সে, তাহার যে-পানীয় আছে, তদ্ব্যতীত অন্য কোনও পানীয়ই চাহে না? তুমি জান, যে যাহারা বস্ত্র পরিবর্তন করে, তাহার শীত ও তাপের জন্যে বস্ত্র পরিবর্তন করে; এবং যাহারা পাদুকা পরে, তাহারা পদদ্বয়ের ক্লেশ-নিবন্ধন যাহাতে চলিতে অশক্ত না হয়, এই জন্যই পাদুকা পরে; কিন্তু তুমি কি কখনও দেখিয়াছ, যে আমি উত্তাপের জন্য ছায়া লইয়া অপরের সহিত লড়াই করিয়াছি? অথবা পদদ্বয়ের যন্ত্রণাবশতঃ, যেখানে যাইতে চাহিয়াছি, তথায় হাঁটিয়া যাইতে পারি নাই? তুমি কি জান না, যে, যাহারা স্বভাবতঃ দুর্বল, তাহারা শারীরিক ব্যায়াম দ্বারা যে যে অঙ্গের পরিচালনা করে, যাহারা উহা পরিচালনা করে না, সেই সেই অঙ্গে তাহাদিগের অপেক্ষা সবলতর হইয়া উঠে, এবং তাহারা সহজে ব্যায়ামের শ্রম সহিতে পারে? তুমি কি মনে কর না, যে আমি, দেহের পক্ষে যাহাই ঘটুক না কেন, সর্ব্বদা তাহা সহ্য করিবে জন্য ব্যায়াম দ্বারা দেহকে সুপটু করিয়া তুলিয়াছি, এবং এজন্য, তুমি যে মোটেই ব্যায়াম কর না, তোমার অপেক্ষা সকলই অনায়াসে সহ্য করিতে পারিতেছি? আমি যাহাতে উদর বা নিদ্রা কিংবা অপর ইন্দ্রিয়-সুখের দাস না হই, তদুদ্দেশে তুমি আর কোন্ সফলতর উপায় কল্পনা করিতে পার?—আমার ঐ সমুদায় অপেক্ষা মধুরতর এমন কতকগুলি বস্তু আছে, যাহা কেবল সম্ভোগের মুহূর্তেই আনন্দ দান করে না, কিন্তু নিয়তই ইষ্ট সাধন করিবে বলিয়া আশায় প্রাণকে পূর্ণ রাখে, (তুমি ইহা অপেক্ষা কোনও সফলতর উপায় দেখাইয়া দিতে পার কি?) তুমি ইহাও জান, যাহারা ভাবে, যে তাহারা কোন বিষয়েই কৃতকার্য হইল না, তাহারা নিরানন্দ থাকে; কিন্তু যাহারা মনে করে, যে তাহারা তাহাদিগের কৃষিকার্যে বা নাবিকের কর্মে, কিংবা তাহারা অন্য যে-কোনও ব্যবসায় অবলম্বন করিয়াছে, তাহাতেই সুফল প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহারা স্বীয় কৃতকার্যতার আনন্দে পরিপূর্ণ হয়। কিন্তু তুমি কি মনে কর, তুমি নিজে দিন দিন উন্নতি লাভ করিতেছ, এবং উত্তমতর বন্ধু প্রাপ্ত হইতেছ,–এই চিন্তায় যে-সুখ আছে, ঐ সকল কর্ম হইতে তেমন সুখ পাওয়া যায়? আমি তো এই প্রকার চিন্তাতেই কাল যাপন করিতেছি।
“কিন্তু যদি বন্ধুদিগের বা স্বদেশের হিত সাধন করিবার প্রয়োজন উপস্থিত হয়, তবে কাহার হিতসাধনে তৎপর হইবার অধিকতর অবসর ঘটিবে?—যে আমার ন্যায় জীবন যাপন করে, তাহার? না তুমি যাহাকে সুখ বলিয়া বিবেচনা কর, যে সেই সুখ সম্ভোগ রত থাকে, তাহার? উভয়ের মধ্যে কে অবলীলাক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রসর হইবে?—যে-ব্যক্তি মহার্ঘ আহার্য ভিন্ন প্রাণ ধারণ করিতে পারে না, সে? না যে-ব্যক্তি যাহা পায়, তাহাতেই তৃপ্তি বোধ করে, সে? পুরী অবরুদ্ধ হইলে উভয়ের মধ্যে কে সহজে পরাজয় স্বীকার করিবে?—যে ব্যক্তির এমন খাদ্য না হইলে চলে না, যাহা সংগ্রহ করা একান্ত কঠিন, সে? না যাহা অক্লেশে সংগৃহীত হইতে পারে, যে তাহা পাইয়াছি সন্তুষ্ট থাকে, সেই? ওহে আন্টিফোন, তুমি যেন এইরূপ ভাব বলিয়া বোধ হয়, যে বিলাসে ও ব্যয়বাহুল্যেই সুখ নিহিত রহিয়াছে; কিন্তু আমি মনে করি, যে মানুষের যখন কোন বস্তুরই প্রয়োজন থাকে না, তখনই সে দেবতুল্য হয়; যাহার অভাব অত্যল্প, সে দেবতার নিকটতম। দেবপ্রকৃতি পূর্ণ, যে দেবপ্রকৃতির নিকটতম, সে পূর্ণতার নিকটতম।”
আর একদিন আন্টিফোন সক্রেটিসের সহিত আলাপ করিতে করিতে কহিলেন, “সক্রেটিস, আমি তোমাকে ন্যায়পরায়ণ বলিয়া বিশ্বাস করি, কিন্তু জ্ঞানী বলিয়া মোটেই বিশ্বাস করি না। আমার তো বোধ হয়, যে তুমি নিজেও তাহা জান; কেন না, তোমার সাহচর্যের জন্য তুমি কাহারও নিকট হইতে অর্থ গ্রহণ কর না। অথচ তুমি যদি তোমার বস্ত্র বা বাসবাটী কিংবা অপর কোনও সম্পত্তি মূল্যবান জ্ঞান করিতে, তবে তাহা অপরকে বিনা মূল্যে তো দিতেই না, বরং তাহার উচিত মূল্য হইতে এক কপর্দ্দকও কম গ্রহণ করিতে না। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, যে তুমি যদি মনে করিতে, যে তোমার সাহচর্যের কোনও মূল্য আছে, তবে তুমি ইহার উচিত মূল্য অপেক্ষা কম অর্থ চাহিতে না। অতএব, তুমি ন্যায়পরায়ণ হইতে পার, যেহেতু, তুমি অর্থ-লোভে কাহাকেও প্রবঞ্চনা কর না; কিন্তু তুমি জ্ঞানী হইতেই পার না, কেন না, (তুমি নিজেই স্বীকার করিতেছ, যে) তুমি যাহা জান, তাহার কোনই মূল্য নাই।” সক্রেটিস ইহার উত্তরে বলিলেন, “আমাদিগের মধ্যে এই একটা মত প্রচলিত আছে, যে দৈহিক সৌন্দর্য ও জ্ঞান, উভয়ই, যেমন মহদ্ভাবে, তেমনি হীনভাবে ব্যবহৃত হইতে পারে; কারণ, যদি কেহ অর্থ পাইয়া, যে চাহে, তাহাকেই দৈহিক সৌন্দর্য বিক্রয় করে, তবে লোকে তাহাকে পুংশ্চল কহে; কিন্তু যদি কেহ এক ব্যক্তিকে সুন্দর ও সচ্চরিত্র ও প্রেমিক বলিয়া জানিয়া তাহার সহিত সখ্য স্থাপন করে, তবে সে বুদ্ধিমান বলিয়া পরিগণিত হয়। সেইরূপ, যাহারা অর্থ-বিনিময়ে, যে-কেহ চাহে, তাহাকেই জ্ঞান বিক্রয় করে, লোকে তাহাদিগকে সফিষ্ট অর্থাৎ একজাতীয় পুংশ্চল কহে; কিন্তু যদি কেহ, যাহাকে সে উপযুক্ত জ্ঞান করে, তাহাকে, সে যাহা কিছু কল্যাণকর বলিয়া অবগত আছে, তাহা শিক্ষা দিয়া আপনার বন্ধু করিয়া লয়, তবে আমাদিগের বিবেচনায় সুন্দর ও মহৎ পুরবাসীর পক্ষে যাহা শোভন, সেই ব্যক্তি তাহাই সম্পাদন করে। আন্টিফোন, এই জন্যই অন্য লোকে যেমন উৎকৃষ্ট ঘোটক, বা কুকুর কিংবা পক্ষীতে আনন্দ পায়, আমি নিজে তেমনি উত্তম বন্ধু হইতে তদপেক্ষাও অধিক আনন্দ পাই। অপিচ, আমার যদি হিতকর কিছু জানা থাকে, তবে তাহাদিগকে তাহা শিক্ষা দিই; এবং অন্য যে-সকল উপায়ে আমি মনে করি, তাহারা ধর্মে কিঞ্চিত উন্নতি লাভ করিবে, তৎসম্বন্ধেও তাহাদিগকে সুপরামর্শ প্রদান করি। তৎপরে, প্রাচীন কালের জ্ঞানী পুরুষদিগের সঞ্চিত ধন—যাহা তাঁহারা পুস্তকে লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন—আমি বন্ধুদিগের সহিত একত্র অনুশীলন ও অধ্যয়ন করিয়া থাকি, যদি আমরা তাহাতে উৎকৃষ্ট কিছু দেখিতে পাই, তবে তাহা বাছিয়া রাখি, এবং (এইরূপে) আমরা পরস্পরের প্রিয় হইতে পারিলে, তাহা পরম লাভ বলিয়ে গণনা করি।” (জেনফোন লিখিয়াছেন,) আমি এই কথাগুলি শুনিয়াছিলাম, আমার বোধ হইল, যে সক্রেটিস নিজেও সুখী, এবং যাহারা তাঁহার উপদেশ শ্রবণ করে, তাহাদিগকেও সুন্দর ও মহতের পথে লইয়া যাইতেছেন।
পুনশ্চ, একদিন আন্টিফোন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি রাষ্ট্রকর্মের বোধ হয় কিছুই জান না, যদিই বা জান, তুমি যখন নিজে রাষ্ট্রের সেবা কর না, তখন কি করিয়া তুমি মনে কর, যে অপরকে রাষ্ট্রীয় কার্যের উপযোগী শিক্ষাদান করিবে?” সক্রেটিস তদুত্তরে কহিলেন, “আন্টিফোন, আমি কোন উপায়ে রাষ্ট্রের অধিকতর সেবা করিতে পারিব?—আমি যদি একাকী রাষ্ট্রীয় কর্মে রত থাকি, তাহা হইলে? না যাহাতে সর্বাপেক্ষা অধিকসংখ্যক লোক রাষ্ট্র-পরিচর্যার উপযুক্ত হইতে পারে, তৎপক্ষে যদি যত্নবান হই, তাহাতে?”