১. শালার মিছিল

শূন্যের উদ্যান – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

০১.

গেরো! শালার মিছিল!

গৌরহরি ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, এ রাস্তায় গাড়ি যাবে না দাদা।

পিছনের সিটে মুখে উদ্বেগ নিয়ে বসে আছে চশমা-পরা মোটাসোটা গোলগাল যুবকটি। মুখে ঘেমো ভাব। চশমাখানা পিছলে নাকের ডগার দিকে নেমে এসেছে। খুবই বোকাটে আর অসহায়। দেখাচ্ছে তাকে। ফরসা মুখখানায় লালচে আভা। মানুষের যে কত রকমের বিপদ আছে! এ ছেলেটার কীরকম বিপদ কে জানে! গৌরহরি অতশত জানে না। জানার দরকারই বা কী! সব মানুষই চলেছে নিজের গলির গলিপথে। সে সব প্রাইভেট গলিপথ। সব মানুষের জীবনই প্রাইভেট গলিপথ, সেখানে গৌরহরির ট্যাক্সি ঢোকে না।

ছেলেটা বলল, তাহলে কী হবে! আমার যে খুব তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার।

দেখছেন তো মিছিল! এর ল্যাজা মুড়ো কোথায় কে জানে! সামনেটা হয়তো কলেজ স্ট্রিট পেরোচ্ছে, পিছনটা বোধহয় শ্যামবাজারের পাঁচমাথা পেরোয়নি।

কিন্তু আমার ভীষণ তাড়াতাড়ি দরকার।

গৌরহরি বিড়বিড় করে আপনমনে হিন্দিতে বলে, তব ক্যা করু! উড়কে যাই!

ছেলেটা অসহায়ভাবে বলে, দেখুন যদি গাড়িটা ঘোরাতে পারেন। সারকুলার রোড দিয়ে আরও নর্থে গেলে বোধহয় মিছিলটা এড়ানো যাবে।

গ্ৰে স্ট্রিটে এখন গায়ে গায়ে গাড়ি জমে আছে। ভিড়ের মধ্যে বদ ছোকরারা যেমন মেয়েদের গায়ে গা ঘষে সেরকমই গা ঘষটাচ্ছে গাড়ি। একটা লম্বা প্লিমাউথ গৌরহরির ট্যাক্সির ডানদিকে এসে দাঁড়াল, দরজা খোলারও জায়গা রইল না।

এই প্রাইভেট!—গৌরহরি চেঁচাল, এটা কী হচ্ছে অ্যাঁ! এটা কী ধরনের ইন্টারফিয়ারেন্স!

ইংরিজি শব্দটা গৌরহরি উচ্চারণ করল ঠিক যেমন ঢাকার ইংলিশ স্কুল সেন্ট অ্যান্টনিজ-এর ফাদার ইভান্স উচ্চারণ করত। আজও যখন গৌরহরি মাঝেমধ্যে এক আধটা ইংরিজি বলে তখন সমঝদার মানুষ তাকে একটু চেয়ে দেখে। এ সব উচ্চারণ সেই ইংলিশ স্কুলে শেখা, পাক্কা সাহেবদের কাছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত সেন্ট অ্যান্টনিজ-এর শেষ ক্লাস পর্যন্ত পৌঁছয়নি গৌরহরি। পর পর দু’বছর টাইফয়েড আর পোলিও তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিল। টাইফয়েড় নিয়েছিল গৌরহরির মগজটাকে, পোলিও নিল বাঁ-হাত আর বাঁ-পা। এখনও উত্তেজিত হলে গৌরহরির মাথার মধ্যে কেমন ঝমঝম একটা শব্দ হয়। পাগল-পাগল লাগে। টাইফয়েডের পর সে যখনই বইপত্র নিয়ে পড়তে বসেছে, তখনই কিছুক্ষণ একটানা পড়ার পর মাথায় কোথাকার কোন সাজঘর থেকে দু’খানা নূপুর-পরা পা তার মাথার মঞ্চে চলে আসত নাচতে নাচতে। কীরকম রিমঝিম শব্দ হতে থাকত। তখন গৌরহরি প্রায়ই সেই শব্দে সম্মোহিত হয়ে বসে থাকত, চোখের সামনের সব দৃশ্য মুছে গিয়ে ফুটে উঠত এক শূন্যতার দৃশ্য। আর কেবল সেই শব্দ আর শব্দ। রিমঝিম রিমঝিম, দু’খানা নাচের পা ঘুরছে, উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিম দিচ্ছে গুলিয়ে। সেই শব্দে তার সব বোধ ড়ুবে যেত। তার বাবা বগলাপতি ডাকসাইটে ব্যবসাদার, টিকাটুলিতে সাহেবের বাড়ির মতো বাড়ি করেছিলেন। সব ছেলেকে বিলেত ঘুরিয়ে আনবেন, এরকম সংকল্প ছিল তার। বড় দুই ছেলে সেন্ট অ্যান্টনিজ পার হল, কিন্তু গৌর পারল না। গিরি ডাক্তার, সাহেব ডাক্তার, কলকাতার স্পেশালিস্ট, কেউই সেই শব্দটাকে বন্ধ করতে পারল না। বগলাপতি আপনমনে অনেক গাল দিলেন ছেলেকে, ডাক্তারদের এবং নিজের ভাগ্যকে। অবশেষে স্কুল ছাড়িয়ে গৌরহরিকে অসাধ্যসাধন থেকে মুক্তি দিলেন। বাড়িতে মাস্টারের কাছে গৌর পড়ত একটু-আধটু। পড়ার কোনও চাপ দেওয়া হত না। পরের বছরই পোলিও। আবার দীর্ঘকাল বিছানা নিতে হল তাকে। অনেক চিকিৎসার পর মেহের কালীবাড়ি থেকে এক তান্ত্রিক এসে বলল, সারিয়ে দিতে পারি, তবে খুঁত থেকে যাবে। থাক খুঁত, সারাও। কীসে সেরেছিল কে জানে। তবে সেরেছিল ঠিকই। কেবল বাঁ-হাত আর বাঁ-পা শুকিয়ে কাঠি হয়ে রইল। অবশ্য যে দুটো একেবারে অকেজো নয়। একটু কমজোরি, এই যা। নইলে গৌরহরি তাদের দিয়ে সব কাজই করিয়ে নেয়। মেয়েমানুষকে আদর করা পর্যন্ত।

গৌরহরির ইংরিজি কথাটা শুনে প্লিমাউথের জানালা দিয়ে কালো চশমাপরা একজোড়া চোখ তাকে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। প্লিমাউথের জন্যই জ্যাম হয়ে গেল রাস্তাটা। ঘোরানোর জায়গা নেই। একটু পিছু হটবার চেষ্টা করল সে, পি পি করে অমনি পিছন থেকে আর্তনাদ করল একটা ফিয়াট। গৌরহরি ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটাকে বলল, দেখছেন তো গাড্ডা! ডানদিকের প্রাইভেটটাই ঝামেলা করেছে। এ জট ছাড়াতে এখন কত সময় লাগে কে জানে!

ছেলেটা চশমা-জোড়া ঠেলে তুলে চারদিকে চেয়ে দেখল টালমাটাল। বলল, নেমে যদি মিছিলটা ক্রস করে ওপাশ থেকে ট্যাক্সি ধরতে পারি তবে বোধহয়—

তাই করুন।

মিছিলটা কি খুব বড় মনে হচ্ছে?

গৌরহরি হাসে, ভুখা মানুষ, বেকার মানুষ সমস্ত দেশে ভর্তি। তা মিছিল তো একটু বড় হবেই। এগিয়ে গিয়ে দেখে আসুন না, ল্যাজ দেখা যাচ্ছে কি না।

ছেলেটা দরজা খুলে নেমে একটু এগিয়েই ফিরে এল, ও বাব্বাঃ, ওদিকটা লালে লাল। আরও মাইল খানেক আছে বোধহয়।

এই বলে ছেলেটা মিটার দেখে পয়সা দিয়ে দেয়। গৌর বলে, মিছিলটা ক্রস করতে পারবেন তো?

বলে কয়ে চলে যাব। আমার বড় জরুরি দরকার। ওরা দেবে না ক্রস করতে?

 তাই দেয়? পেরোতে গেলে ঝাড় লাগাবে।

ছেলেটা অসহায়ভাবে বলে, তাহলে?

গৌর হাসে, লাইনে ঢুকে মিছিলে শামিল হয়ে যান। কয়েক পা হেঁটে দু’একটা স্লোগান ঝেড়ে লাইন পালটে ওপাশের লাইনে চলে যাবেন। আবার স্লোগান ঝাড়বেন কয়েকটা, তারপর টুক করে কেটে পড়বেন। মিছিল ক্রস করার ওই হচ্ছে কায়দা।

ছেলেটা চলে গেল। ওই রকম গোল চশমা-পরা মোটাসোটা বোকাটে ছেলে এ যুগে অচল। ভাবে গৌর, আর হাসে। বলতে কী, একসময়ে সবাই মনে করেছিল যে গৌরহরিও অচল। এ সংসারে দুটো শুখো হাত-পা আর মগজে নাচের শব্দ নিয়ে কিছুতেই বেশিদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় না। বগলাপতি তাই ভাবতেন আর বিড়বিড় করে গাল দিতেন। মুখটা বড় খারাপ বগলাপতির। ছেলেদের শালা-শোরের বাচ্চা বলতে আটকায় না। তা গৌরহরি ছিল তার ছেলেদের মধ্যে। একেবারে অচল মুদ্রা। বড় দুই ছেলে ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে পাস করল, তারপর গেল কলকাতা, তারপর গেল বিলেত। তৃতীয় গৌরহরি হয়ে রইল অর্ধেক তৈরি করা পুতুলের মতো। যেন বা কোনও কারিগর গড়তে গড়তে হঠাৎ হাত থামিয়ে উঠে গেছে, তাই গৌরহরির মূর্তিখানা আর শেষ হয়নি।

বগলাপতি দেশভাগের সময়ে বিস্তর বুক চাপড়ে ভিতরে ভিতরে মাল পাচার করলেন কলকাতায়। তখনও দুই ছেলে বিলেত থেকে ফেরেনি। কেবল অপদার্থ গৌরহরি তার সহায়-সম্বল। বগলাপতি একা-একাই অতবড় ব্যাবসা গোটালেন বিড়বিড় করতে করতে। বউ আর আধা-ফিনিশ ছেলেকে নিয়ে এলেন কলকাতায়। একটা বাড়ি কিনলেন বালিগঞ্জে গোপনে। আর প্রকাশ্যে খানিকটা জায়গা দখল করলেন যাদবপুরে রিফিউজি কলোনিতে। সে সময়ে খবর এল, তার বড় ছেলে মেম বিয়ে করেছে। সে আর ফিরবে না। বগলাপতি ভয়ংকর ভেঙে পড়লেন। গৌরহরি তখন যুবাপুরুষ, কিন্তু অপদার্থ। তবু হাতের মুঠোর মধ্যে থাকা ছেলে। বগলাপতি বরাবরই গৌরকে একটু বিশ্রী প্রশ্রয় দিতেন, সে অসুস্থ এবং নিরীহ বলে। বড় ছেলের খবর পেয়ে। তিনি আরও আঁকড়ে ধরলেন গৌরকে। কিন্তু গৌর তো অপদার্থ, হাফ-ফিনিশ। চলে-ফেরে, খায়-দায়, কথা বলে, কিন্তু তাকে দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না যে, তার দ্বারা কিছু হবে। বগলাপতিরও হল না। তিনি বড় ছেলেকে চিঠি লিখলেন, বিধিমতো মেমকে ত্যাগ করিয়া চলিয়া আইস। তোমার আবার বিবাহ দিব। উত্তরে ছেলে লিখল, তা সম্ভব নয়। আমার আশা ত্যাগ করুন। তখন থেকেই গৌর জানে, সে বাপের সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। বগলাপতি তাকে গড়িয়াহাটায় একটা দোকান করে বসিয়ে দিলেন। গৌরহরি দোকান করতে লাগল। বিক্রিবাটা মন্দ ছিল না। কিন্তু ঝামেলা হত দিনের শেষে, যখন দোকান বন্ধ করে গৌর হিসেব করতে বসত। হিসেবের অঙ্ক তার কাছে বরাবরই ভয়াবহ। কাজেই টাকা-আনার হিসেব শুরু করলেই সে স্পষ্ট টের পেত তার মাথার মধ্যে সেই অনভিপ্রেত নর্তকী তার সাজঘর থেকে বেরিয়ে আসছে ঝমঝম করে, এক্ষুনি নাচ শুরু হবে। বগলাপতি আবার চিন্তায় পড়লেন। গৌরকে ডেকে মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন, কী করবি গেীরা? কী করতে তোর ইচ্ছে করে? বসে বসে তো আর খেতে পারবি না, পাঁচভূতে লুটে খাবে। একটা কিছু কর।

গৌর খুব ভাবত। কিন্তু ভেবে কিছু পেত না। বস্তুত তার মাত্র দু’-একটা বিষয়ই প্রিয় ছিল। ময়দানে ফুটবল খেলা দেখা, সিনেমা আর ঘুম। এইসব, আর চিন্তাভাবনাহীন, উদ্বেগহীন হালকা দিন কাটানো। কোনও কাজের কথা ভাবলেই তার বুকের ভিতরটা দুরদুর করত, আমি ব্যাটা হাফ-ফিনিশ, ফিফটি পারসেন্ট মানুষ, আমি শালা কী করব?

কিন্তু তারপরও একটা কয়লার ডিপো তাকে দিয়ে চালানোর চেষ্টা করেছিলেন বগলাপতি। সেটা ফেল মারল তো নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘুরলেন এদিক ওদিক। বগলাপতির ব্যাবসা ছিল নানারকম জটিল কুটিল পথে, সেগুলো বোঝবার মতো চিন্তাশক্তি গৌরের ছিল না। বগলাপতি ক্রমেই হতাশ হতে হতে একদিন ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, যাঃ শুয়োরের বাচ্চা, কিছুই যখন পারবি না, তখন যা, গিয়ে ড্রাইভারি শেখ। শিখে আমার গাড়ি চালাবি। প্রতি মাসে কেন পরের ছেলেকে দেড়শো টাকা করে ধরে দিই! অর্থাৎ সোজা কথা, বগলাপতি ছেলের বসে খাওয়া সইতে পারতেন না। কিছু না পারো তো বাপের সোফারি করা।

পুরনো একখানা ডজ গাড়ি ছিল তাদের। সেটা চালাত হরিপদ। রোগাটোগা ভালমানুষ ছেলেটা। হাফ-ফিনিশ গৌরহরি গাড়ি চালানো শিখবে জেনে সেও খানিকটা হাঁ করে রইল। বলল, গাড়ির যে

অনেক ব্যাপার রে! ক্লাচ, ব্রেক, অ্যাকসেলেটার, গিয়ার, স্টিয়ারিং, তুই সব সামলাতে পারবি?

গৌরহরি উদাস গলায় বলল, তা আমি কী করব? আমি কি চেয়েছি শিখতে? বগলু ছাড়ছে না যে!

আড়ালে-আবডালে গৌরহরি বাপকে আদর করে বগলু বলে উল্লেখ করত। ফলে কতবার বকুনি খেয়েছে।

তারপর বগলাপতির ব্যাটা গৌরহরি, অর্থাৎ বগলুর পোলা গৌরা পুরনো আমলের ডজ গাড়িতে ভালমানুষ হরিপদর পাশে বসে অবরে সবরে গাড়ি চালানো শিখত কলকাতার নির্জন রাস্তা-ঘাটে।

আরে বাঃ! প্রথম দিনেই ভাল লেগে গেল গৌরহরির। গাড়ির যন্ত্রপাতিগুলো খুব একটা জটিল না তো! কিংবা হয়তো জটিলই, কিন্তু তার কাছে এই প্রথম একটা কাজ এল যে কাজ তার পারব না’ বলে মনে হ’ল না। ব্যাপারটা এরকমই হয়, দুনিয়ার সবচেয়ে অপদার্থ লোকটারও একটা না একটা বৈশিষ্ট্য মাফিক কাজ আছে, সেটা খুঁজে পেলে বিস্তর বখেরা চুকে যায়। গৌরহরি তার দুটো রুখে-শুখো হাত-পা আর মগজের ঝমঝম নিয়েও মোটরগাড়ির যন্ত্রপাতির মধ্যে সম্পূর্ণ সেঁধিয়ে গেল। কেমন যেন নেশা পেয়ে বসল তাকে। একমাসে সে গড়গড় করে গাড়ি চালাতে লাগল। পিছনের সিটে বসে তার কান্ড দেখে বগলাপতি হেসে খুন, আরে বাঞ্চোত, খুব শিখেছে তো! অ্যাঁ! আরে বাঃ! এ যে মোলায়েম ব্রেক মারে। ডাইনে বাঁয়ে হাত দেখিয়ে বাঁক নেয়! অ্যাঁ! এ যে দিব্যি স্পিডও মারছে।

বাবা আর মাকে কয়েকদিন সে দক্ষিণেশ্বর, বেলুড়, পানিহাটি ঘুরিয়ে আনল। মাস চারেক পর হরিপদকে বিদায় দেওয়া হল। যাওয়ার সময়ে হরিপদ আড়ালে ডেকে বলল, ছোটবাবু, তুমি মাইরি এক নম্বরের টিকরমবাজ। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি তোমার মত হাফ-ফিনিশ লোক ব্যাপারটা কোনওকালে শিখতে পারবে। ভাবলে কি শেখাতুম! ঠিক গোলেমেলে হরিবোল করে দিতুম।

ডানদিকে প্লিমাউথ, পিছনে ফিয়াট, বাঁদিকে পার্ক করা কয়েকটা অ্যামবাসাডার, সামনে মিছিল, বিচিত্র গাড্ডা। ভিতরে বসে বাতাসহীনতায় ঘামতে লাগল গৌরহরি। ছেলেটা নেমে যাওয়ার পর সে লাল শালুর টুকরোটা দিয়ে মিটার ঢেকেছে। এখন নো সোয়ারি বিজনেস। বগলাপতির ছেলে গৌরহরি, অর্থাৎ কিনা বগলুর পোলা গৌরা কি কারও সার্ভেন্ট? ইজ হি? এই বলে গৌর গাড়ির ছোট চৌকো আয়নায় নিজের মুখখানা দেখল। সদ্বংশের ছেলেদের মুখে কিছু কিছু চিহ্ন থাকে। তার মুখেও আছে। এই যেমন তার কপালখানা, কেমন গড়ানে, মাঝখানে মাথার চুল ছুঁচোলো হয়ে নেমে এসেছে। কিংবা, যেমন তার দু’খানা কান, দুটিতে বুদ্ধদেবের মূর্তির কানের মতো ভারী ভারী বড় লতিতে কানদুটো বাহারে দেখায়। নাকখানাও চোখা। আর কিছু লক্ষ করার মতো নেই অবশ্য। গাল ভাঙা চোয়াড়ে চেহারা, গালে কয়েকদিনের দাড়ি। রুখু চুল। একটু গোঁফ আছে গৌরের। সেখানে আজকাল চিকমিকে দু’-একটা পাকা রোঁয়া মাঝে মাঝে দেখা যায়।

শালা প্রাইভেটটা যদি ডানদিকে না থাকত তবে এতক্ষণে দাশ কেবিনে গিয়ে টিফিন করত গৌরহরি। সে ঘড়ি দেখল। হ্যাঁ, এখন গৌরবাবুর টিফিন টাইম পেরিয়ে যাচ্ছে। গৌরবাবুর খিদে পেয়েছে আর এ শালারা রাস্তা আটকে এ সব কী টিকরমবাজি শুরু করেছে! অ্যাঁ! গৌরবাবুর খিদে পায় না নাকি? ডানদিকের ওই শালা প্রাইভেটটা! কালো চশমা-পরা লোকটা থুতনিতে হাত দিয়ে ঝিমোচ্ছ। খিদে পেলে গৌরের ঘুম আসে। বাবুদের বাড়ির ছেলে, খিদে তেষ্টা সে একদম সইতে পারে না। সে হল গে টিকাটুলির ডাকসাইটে বগলাপতির ছেলে গৌরহরি, অর্থাৎ কিনা বগলুর পোলা গৌরা, খিদে তেষ্টা সইতে নারে–ছারারা-রা-রা, গুনগুন করে গান গাইল গৌর। আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে গাল দিল দুনিয়ার সব প্রাইভেটদের, আর মিছিল করা যাবতীয় ভুখখা পাটির লোকদের। গৌরবাবুর গাড়ি আটকে শালাদের যত আশনাই!

একটা টেরিলিন পরা লোক জানালায় বুকে বলল, গাড়ি যাবে নাকি?

কোথা দিয়ে যাবে দাদা? উড়ে?

 মিছিল তো শেষ হয়ে এল। রাধা সিনেমার কাছে পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে, ওই তো শেষ।

গাড়ি যাবে না দাদা, আমার টিফিন হয়নি।

 লোকটা একটু শ্বাস ফেলে বলে, আপনি মালিক, আপনার দয়া।

বলে সরে গেল।

 মালিক! আলবত মালিক। গৌরবাবুর টিফিন হয়নি আর গাড়ি যাবে বললেই যাবে। কে না জানে বিশ্বসংসারে যে, বিকেল সাড়ে চারটেয় চা না পেলে গৌরবাবুর ঘুম পায়! স্টিয়ারিং-এর ওপর মাথা ঝুঁকে আসে! তখন নিজেকে কত কাকুতি মিনতি করে গৌর, ওঠো গৌরবাবু, ওঠো, অমন হেঁদিয়ে পড়লে কি চলে? ওঠো বাবা, গৌর, ওঠো। চোখ মেলে তাকাও তত বাপধন। নইলে যে কখন লাল আলো পেরিয়ে যাবে। কোন গাড়ির পিছনে ভিড়িয়ে দেবে, আর ধরবে এসে পুলুসবাবা। ওঠো হে বগলাপতির ব্যাটা গৌরহরি। জেগে থাকো হে বগলুর ছাওয়াল,

তবু শালার ঘুম পায়! আড়মোড়া আসে। দাশ কেবিনের চা কড়া, গৌরের চা আরও কড়া করে দেওয়া হয়। সঙ্গে থাকে বিস্তর কাঁচা লঙ্কার কুঁচি মেশানো রগরগে গরম অমলেট আর টোস্ট। শালার টোস্টে মাখনের বদলে লাড় লাগানো। এইসব খায় গৌর, আর বলে, খেয়ে নে বাবা গৌর, এই শেষ খাওয়া রে। এই অমলেট ভেজেছে মবিল অয়েলে, পাউরুটিতে চর্বি, আর শুকনো চোতরাপাতার কাথ দিয়ে হয়েছে এই চায়ের লিকার, আফিমের জল মিশিয়ে খেয়ে নে বাবা গৌর, তোর শেষ খাওয়া।

তারপর রুমালে মুখ মুছে মৌরি চিবিয়ে আবার নিজেকে বলে, না বে, মরবি না। তোর ঠাকুন্দা খেত মুক্তাভস্ম, তোর বাবা খেত স্বর্ণসিন্দুর, তোরা রুপোর গেলাসে জল খেয়ে বড় হয়েছিস। বিস্তর সোনারুপো মুক্তো হজম করা পেট তোর, সেই পেটের কী করবে রে শালার চোতরাপাতার কাথ, কিংবা চর্বি, কিংবা মবিল অয়েল? সব হজমে দে শালা, সব হজমে দে, যা খাবি সব হজমে দিয়ে বসে থাকবি, কেউ যদি এসে বাতাপী’ বলে ডাক দেয়। ঘাবড়াবার কিছু নেই, বাতাপী আর বেরোবে না।

মিছিলের লেজ ভেসে যাচ্ছে। পিছনে পুলিশের কালো গাড়ি। তারপর রাস্তা ক্লিয়ার। স্টার্ট, গৌরবাবু। মাথাটা সত্যিই ঘুমে ভরে আসছে। ঘুম যেন ঠিক জলের মতো, টল টল করে আর তার মধ্যে নানা টুকরো-টাকরা স্বপ্ন মাছের মতো ঘাই মারে। যখন এরকম হয় তখনই গৌরহরির সামনে উইন্ডস্ক্রিন জুড়ে নানা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যেতে থাকে। গৌর দেখে, সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের মোড়ে ট্রাফিক পুলিশটা বুড়িগঙ্গার ধারের সেই কামানটার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কখনও বা হঠাৎ গৌর আচমকা ব্রেক চেপে ধরে বলে, আরে সাবাস, এখানকার রাস্তাটা কেটে কবে খাল বানিয়েছে। শালারা! তারপর চোখ কচলে দেখে, কোথায় খাল, রাস্তাই তো! কিংবা কখনও বা দেখে সামনের রাস্তায় অনেক রঙিন বল ভাসছে, লোকজন উড়ে উড়ে যাচ্ছে। রাস্তাটা হঠাৎ যেতে যেতে আকাশমুখো খাড়া উঠে গেছে। ঘুম পেলে গৌরহরির এরকম সব হয়। তখনই দাশ কেবিনের সেই চোতরাপাতার কাথ না হলে, ওরা কি বাস্তবিক আফিঙের জল মেশায় নাকি! নইলে গৌরের এরকম হবে কেন? কলকাতার যেখানেই থাকুক গৌর, একটা না একটা সময়ে, প্রায়ই বিকেলের দিকে ওই অদ্ভুত ঝিমুনি আসতে থাকে তার। আর এলেই পাগলের মতো সে লাল কাপড়ে মিটার ঢাকে, তারপর ভোঁ ভোঁ করে চালিয়ে দেয় দাশ কেবিনের দিকে। পৃথিবীর এক এবং অদ্বিতীয় দাশ কেবিন।

ও বাবা পুলুস, ও পুলুসবাবা!—গৌর নরম গলায় বিড়বিড় করে ডাকে, হাতটা একনাগাড়ে তুলে রাখলে যে ভেরে যাবে বাবা। হাতটা একটু নামাও। আমরাও তো যাব বলেই রাস্তায় বেরিয়েছি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমার পিছনখানা দেখলে তো চলবে না বাবা, গৌরবাবু যে এখনও চা খায়নি, তার যে টিফিন টাইম, রাস্তাটা একটু ছাড়ো বাবা পুলিশ।

অবশেষে ট্রাফিক পুলিশ হাত নামায়। ঘুরে দাঁড়িয়ে রাস্তা খুলে দেয়।

আই বাবা পুলুস, তোমার পায়ে পায়ে দণ্ডবৎ। দরগায় শিন্নি, বাবার গির্জেয় মোমবাতি, এই মৌতাতটার সময়ে আর আটকে রেখে মেরো না।

এই ট্যাক্সি।

গেরোর পর গেরো। শালা সার্জেন্ট।

গৌর গাড়ি থামায়। কোমরে পিস্তল-ওলা সার্জেন্টটা এগিয়ে আসে। খামোকা হাত বাড়িয়ে বলে, লাইসেন্স দেখি।

এসব ফালতু বদমাইশি।

কী করতে হবে স্যার, বলুন না।

সার্জেন্টটা ধমক দেয়, বদমাইশির আর জায়গা পান না। শিগগির ওই লাল কাপড় খুলুন। এই ভদ্রলোক পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছেন ট্যাক্সির জন্য। শিগগির খুলুন।

খুলছি পুলুসবাবা, খুলছি। কিন্তু আমার যে টিফিন হয়নি। মিছিলের হুজ্জতে হড়কে গেছে টিফিন টাইম। গৌরবাবু যে হেঁদিয়ে পড়ছে বাবা পুলুস!

গৌর বিড়বিড় করে লাল কাপড় খুলে নেয়। বুড়োমতো লোকটা সবিনয়ে দরজা খুলে গাড়িতে ঢোকে। জানালা দিয়ে মুখ বার করে সার্জেন্টকে বলে, ধন্যবাদ, আপনি না থাকলে কিছুতেই ট্যাক্সি পেতাম না। সবেতে লাল কাপড়। নয়তো মিটার ডাউন। আচ্ছা চলি।

সার্জেন্টটা হাসে তৃপ্তির হাসি। জানালায় কুঁকে গৌরকে বলে, ঠিকমততা নিয়ে যাবেন। রাস্তায় যেন আবার ব্রেকডাউন না হয়। আমি কিন্তু নম্বর টুকে রেখেছি।

দরগায় শিন্নি, গিঞ্জেয় মোমবাতি, শালার পুলুস যেন না ছোয় গৌরবাবুকে। নিয়ে যাবে, পুলসবাবা, ঠিক নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন যেন কেমন রাস্তাগুলো খালের মতো লাগে, ঢাকার কামানটা এসে বসে থাকে চৌরাস্তায়, রঙিন বল ভাসে বাতাসে, মানুষগুলো উড়তে থাকে, রাস্তা উঠে যায় আকাশমুখে খাড়া হয়ে, গৌরবাবুর চায়ের টাইম যে হড়কে গেছে বাবা!

কোথায় যাবেন?

 পি জি।বুড়োটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।

দরগায় শিন্নি, গির্জেয় মোমবাতি, তবু ভাল, দক্ষিণে। যদি উত্তরে হত। আর যদি দাশ কেবিন থেকে আরও দূরে কোনও গাড্ডায় বেঘোরে নিয়ে ফেলত বগলাপতির ব্যাটা গৌরহরিকে, বগলুর গোলা গৌরাকে!

রাস্তাগুলো এমন সব জলে ডোবা, আবছা আবছা, রঙিন রঙিন গোলার মতো বল ছুঁড়ে দিচ্ছে ঢাকার সেই কামান। চৌরঙ্গির ট্রাফিক পুলিশ আড়বাঁশিতে পূরবী ধরেছে, দুটো পা কদমতলায় শ্রীকৃষ্ণের কায়দায় ক্রস করা, চারপাশে মুগ্ধ গাভীর মতো ভিড় করে এগিয়ে আসছে গাড়ির পর গাড়ি, গোর চোখ মুছে নেয়। কোথায় যেন যাচ্ছে সে? ওঃ হ্যাঁ, পি জি। পিছনের সিটে বুড়োটা আছে তো ঠিকমতোবুড়ো মানুষদের বিশ্বাস কী! কখন আছে, কখন নেই। সার্জেন্টটা নম্বর টুকে রেখেছে।

গৌর ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, আপনি ঠিক আছেন তো স্যার? কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

অসুবিধে!–বুড়োটা খাক কবে ওঠে, কীসের অসুবিধে!

গৌর ভারী মুশকিলে পড়ে। সত্যিই তো, অসুবিধে কীসের! ল্যান্ডমাস্টারের গভীর গদি। চারদিকে শরতের রোদ মজা বিউটিফুল বিকেল, চৌরঙ্গির মতো জায়গা দিয়ে যাচ্ছে গাড়ি, তবে আর অসুবিধে কীসের? অসুবিধে যা, তা তো গৌরের। এই শালা রিয়্যালিটির সঙ্গে কে যেন স্বপ্নের ভেজাল দিয়ে দিচ্ছে, চামচে নেড়ে মিশিয়ে দিচ্ছে এমন যে আর আলাদা করা যাচ্ছে না, কোনটা শালার রিয়্যালিটি, আর কোনটা ড্রিম।

সে একটু আমতা আমতা করে বলে, অসুবিধে আর কী! আপনার বয়সটাই যা একটু গোলমেলে। এই বয়সে বুঝলেন, যখন তখন যা তা হয়ে যেতে পারে।

কী রকম!

গৌর একটু ইতস্তত করে বলে, এই কয়দিন আগেও আপনার মতো এক বুড়ো মানুষকে তুলেছিলুম। মাঝরাস্তায় ডাইরেকশন জিজ্ঞেস করতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, ঘাড় লটকে নেতিয়ে আছে। থ্রম্বসিস। তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হল, তাই বলছিলুম কোনও অসুবিধে ফিল করলে বলবেন।

পি, পি, পা, পা গাভীর ডাক। চলো বাবা গৌর, পুলুসবাবা হাত দেখাচ্ছে। চোখে সবুজ মারছে ট্রাফিকের আলো। চলল হে বগলাপতির ব্যাটা পি জি। মনে থাকে যেন সার্জেন্ট শালা নম্বর টুকে রেখেছে, দেবে’খন ঠুকে!

কোথায় যেন যাবেন স্যার।

বললাম যে পি জি!

আই। ঠিক। পি জি। চলো বাবা গৌর। বুডোর গল্পটা সে সম্পূর্ণ বানিয়ে বলল। এমনিই। আসলে বুড়োটাকে সাবধান করে দিল, যেন তার গাড়িতে বসে হঠাৎ বুড়োর মরার শখ না হয়।

যখন কখনও গৌরহবি একা একা তার ট্যাক্সি নিয়ে বসে থাকে, প্রায়ই দুপুরের দিকে হঠাৎ হঠাৎ তার কেমন অদ্ভুত ব্যাপার সব মনে হয়। মনে হয় পিছনের সিটে একটা মৃতদেহ বসে আছে। মাঝেমধ্যে অনেক রাতে নাইট শোর ট্রিপ মেরে গ্যারাজ করার সময়ে তার সুস্পষ্ট মনে হয় রাস্তার টালে গাড়ি লাফিয়ে উঠতেই লাগেজ বুটে কী যেন নড়ল। সে যেন এক মৃত মানুষের শরীর। কে যেন কখন অলক্ষিতে মালটি তার ঘাড়ে পাচার করে গেছে। কত দিন এমন হয়েছে। গৌর গাড়ি থামিয়ে সত্যিই লাগেজ বুট খুলে দেশলাই জ্বেলে খুঁজে দেখেছে। খুঁজেছে পিছনের সিটে, মেঝেয়। কোথাও কিছু নেই। তবু মাঝে মাঝে দুপুরে কি নিশুত রাত্রে গাড়ি চালাতে চালাতে তার এই রকম আজও মনে হয়। একটা মৃত লোক বসে আছে পিছনের সিটে ঘাড় লটকে, লটপট করছে দুলুনিতে। কিংবা কারা লোড করে দিয়ে গেছে লাগেজ বুটে হাত পা বাঁধা ডেডবডি। তখন যে মৌতাতের সময় তা নয়। এমনিতেই সহজ স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়েছে। গৌর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছে পিছনের সিট। গাড়ি থামিয়ে খুঁজে এসেছে লাগেজ বুট।

তাই গাড়ি চালাতে চালাতে মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে গৌর। বুড়োটা বসে আছে বাইরের দিকে চেয়ে! খুব বুড়ো নয় লোকটা, তবু মরার কি কোনও বয়স আছে? মৰলেই হল।

গৌর মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস কবে, পি জি-তে কী ব্যাপার স্যার! কারও অসুখ?

আমার মেয়ে। ডেলিভারি কেস।

 বাঃ বাঃ। কী হল! নাতি না নাতনি?

হয়নি। আজকালের মধ্যেই হওয়ার কথা। পেইন উঠেছে কাল বিকেল থেকে।

আজকালকার বাচ্চা তো! জন্মের আগে থেকেই জ্বালাতে শুরু করে, শেষ জীবন তক জ্বালায়।

আসলে এসব কথার কোনও মানে নেই। খামোখা বলে যাচ্ছে গৌরহরি। তার সন্দেহ, বুড়ো মানুষটা যদি হঠাৎ কেঁসে যায় স্ট্রোক-ফোক হয়ে, আর সে হয়তো টেরও পেল না, ওদিকে সার্জেন্টের কাছে তার নম্বর টোকা, তাই কথায় কথায় সে বুড়ো মানুষটার বেঁচে থাকার প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকে।

গাড়িটা সে কিনেছিল এক পাঁইয়ার কাছ থেকে। সেই পাঁইয়ার কাছেই গাড়িটার দোষ ধরেছিল। কোনও অপঘাত ঘটেছিল গাড়ির মধ্যেই। তারপর থেকেই এ গাড়িতে একটা ভৌতিক ব্যাপার চলেছে। কেবলই ওই মৃতদেহ টের পায় গৌর। শালার পাঁইয়া পোড়ো গাড়ি ঠকিয়ে বেচে গেল ন’ হাজারে, কিনল বগলুর পোলা গৌরা।

ডজটা পেলে এসব ঝামেলা হত না। সেটাতেই সে শিখেছিল গাড়ি চালানো।

হরিপদ চলে যাওয়ার পর বাবা বগলাপতি ছেলে গৌরহরিকে দেড়শো টাকায় সোফার রাখলেন। গৌর আপত্তি করল, হরিপদ তো রাত্রে থাকত না। আর আমি চবিবশ ঘণ্টার ড্রাইভার।

শালার টনটনে বুদ্ধি দেখ! আচ্ছা যা, একশো পঁচাত্তর পাবি, তার বেশি কিছুতেই না। বলেছিলেন বগলাপতি, বগলু, গৌরের বাবা।

গৌর একশো পঁচাত্তর পেত, প্লাস খাওয়া-দাওয়া, জামাকাপড়, ঘরদোর। মা কেবল দুঃখ করে বলত, এ রকম কান্ড জন্মে শুনিনি, ছেলে নাকি বাবার চাকরি করে।

বাবা বগলাপতি বলত, তবুও তো বাবার চাকরি করে। তাতে মানসম্মানের হানি হয় না। যা ছেলের সুরত তোমার, অন্য জায়গায় হলে কী কান্ড যে হত!

তা গৌর গাড়ি চালাত। বাবাকে নিয়ে যেত এখানে সেখানে। ব্যাবসাপত্রের নানা ধান্ধায় ঘুরতেন বাবা। আস্তে আস্তে জমিয়ে নিচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে তাকে ডেকে বলতেন, তোর হাতে গাড়ি থাকলে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু বেশ তো চালাস রে! অ্যাঁ! বেশ তো হাত তোর! দিব্যি চালিয়ে নিচ্ছিস কলকাতার রাস্তাঘাটে। অ্যাঁ! পাকা হয়ে গেছিস বেশ।

এ সবই গ্যাস। গৌরহরি বুঝত। কেননা পিছনের সিটে বসে বাবা বিস্তর টাকাপয়সার লেনদেন করতেন নানা পার্টির সঙ্গে। গোছ গোছ নোট বেহাত হত। আসত তার বাবার পোর্টমান্টোতে। খুশি হত গৌর। বড়দা কেটেছে। এখন যা আসবে একদিন তার অর্ধেক বখরা পাবে সে, যদি না ইতিমধ্যে মেজদাও কাটে। গৌর সেইসব টাকাপয়সার হিসেব বুঝত না। কিন্তু ছোট্ট আয়নাটা দিয়ে টাকার ছবি সে দেখেছে বিস্তর। বাবা বগলাপতি সেটা বুঝতে পেরে গৌরকে অন্য কথায় ভুলিয়ে রাখবার চেষ্টা করতেন। কিন্তু গৌর তখন টাকা চিনেছে। অঙ্কের হিসেব না বুঝলেও এটুকু জানা ছিল যে টাকা নিয়ে বিস্তর কাজ হয়। টাকার শক্তি অসম্ভব।

তাই সে মাঝে মাঝে বাপ বগলাপতির দিকে চেয়ে অকুতভাবে হাসত। একটু টের হাসিটি, চোখদুটি মিটমিট করত, গরগরে একটা শব্দ হত গলায়। এইসব দেখে বগলাপতি সাবধান হয়ে যেতেন। বলতেন, এ সবই তো তোদের জন্য। বড়দা উচ্ছন্নে গেল, এখন তোদের দুটোকে যদি একটু রেখেটেখে যেতে পারি।

গভর্নমেন্টের কন্ট্রাক্টর বগলাপতি। তখন বিস্তর বালি মেশাচ্ছেন সিমেন্টে। না মিশিয়ে উপায়ও নেই। গভর্নমেন্টের লোকেদের খাওয়াতে খাওয়াতে কিছুই থাকে না প্রায়। বগলাপতি ব্যাবসা জানতেন হাতের উলটোপিঠের মতো। কলকাতার বাজার ছিল নখদর্পণে। কোন মালের কত স্টক আছে বাজারে, কতদিনের মধ্যে সেই মালের চালান আর আসবে না,এসবই প্রাচীন কবিরাজের নাড়িজ্ঞানের মতো টনটনে ছিল তার। একবার ইচ্ছে করেই একটা মালের টেন্ডারে উঁচু রেট দিলেন। তারপর বাজারের সব মাল কিনে মজুত করলেন গুদামে। তারপর মিটিমিটি হাসতে লাগলেন আপনমনে। আয়নায় গৌরহরি সেই হাসি দেখত। মাঝে মাঝে আপনমনে বলতেন, বুঝলি গৌর, মালটা বছর খানেকের মধ্যে আর আসছে না বাজারে। গৌরকে সম্বােধন করে বলা, কিন্তু আসলে বলা নিজেকেই। টেন্ডার বগলাপতি পেলেন না বলাই বাহুল্য। কিন্তু যে পেল সে বাজার ঘুরে মাথায় হাত দিয়ে বসল। গভর্নমেন্টের কন্ট্রাক্ট, সিকিউরিটির টাকা জমা দেওয়া আছে, পিছোবার উপায় নেই, ওদিকে মাল নেই এক কণাও। মাল কোথায়! মাল কোথায়! লোকটা যখন পাগল পাগল, ঠিক সেই সময় বগলাপতি তার কাঁধে হাত রাখলেন, আছে, মাল আছে। তবে লোকসানে তো দিতে পারি না। এই আমার রেট। বলে রেট দেখালেন। লোকটা ডজ গাড়ির পিছনের সিটে বসে বগলাপতির পা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে বলল, দাদা, আর একটু কমান। আমি যে গভর্নমেন্টকে ওর চেয়ে চার আনা কম রেট দিয়েছি। লাখ লাখ টাকার কন্ট্রাক্ট, এত লস হলে চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাব। বগলাপতি হাসেন, তবু তো জেল থেকে বাঁচবে! অবশেষে বগলাপতি রেট কমিয়েছিলেন। লোকটা প্রতি ইউনিটে দু’পয়সা ক্ষতি করে মাল নিল। বগলাপতি কয়েক লাখ কামালেন। একা একা পিছনের সিটে বসে গৌরকে ডেকে বললেন (আসলে নিজেকেই বলা), বুঝলি গৌরা, বাঘকে যদি ধরতে না পারিস, ঘোগকে ধরিস। বাজারটাকে হাতের মুঠোয় না রাখলে কি ব্যাবসা চলে?

গৌরের মাইনে বেড়ে দুশোয় দাঁড়াল। সে সারাদিন গাড়ি নিয়ে থাকত। ইঞ্জিনটা সে খুব ভাল চিনত, যেমন বাজার চিনতেন বগলাপতি। ইঞ্জিনের একটু সর্দিকাশি, একটু ফাস শব্দ থেকেও গৌর তার গোলমাল বুঝে নিত। সারাদিন সে গাড়িখানার পিছনে খাটত। মাটিতে শুয়ে ইঞ্জিনের তদবির করত সারাদিন। গাড়ি ধোয়াত, মুছত। ঝকঝকে রাখত সবকিছু বগলাপতি দুরে দাঁড়িয়ে ঘাড় এধারে ওধারে কাত করে পুরনো গাড়িখানার শোভা দেখতেন। আর বলতেন, বাহাঃ রে গৌর, বাহাঃ। প্রশংসাটুকু খুব উপভোগ করত গৌরহরি। এতদিন বাদে সে এমন একটা কাজ পেয়েছে যে কাজ তার উপযুক্ত। যে কাজ তাকে মানায়। সে তাই জান লড়িয়ে দিয়েছিল। ওই গাড়িখানার যত চমক-ঠমক ততটাই তার হাতযশ ততটাই তার গুণ। গৌরহরি পুরনো ডজখানাকে জড়িয়ে ধরে লতিয়ে উঠেছিল। সে যখন গাড়ি চালাত তখন মন-প্রাণ দিয়ে কোনওদিন তার হাতে গাড়ি ঘষাটাও খায়নি। স্টিয়ারিং-এ বসলেই তার হাত পা মগজ চোখ সব ধীরে ধীরে অধিকার করে নিত গাড়ির যন্ত্রপাতি। সে হয়ে যেত গাড়িটা স্বয়ং। তখন গৌরহবি না গাড়ি, তা বোঝাও যেত না।

তা গৌরহরি মাঝে মাঝে গাড়ি হয়ে যায়। তখন আর সে মানুষ থাকে না। ভুলেই যায় যে সে গৌরহরি, বগলাপতির ব্যাটা, অর্থাৎ কিনা বগলুর পোলা।

বগলাপতি তখন স্টোরিং এজেন্ট। বিস্তর ঝামেলার কাজ। অনেক বখেরা। ঠিকমতো চালাতে পারলে লাভও বিস্তর। বগলাপতির তখন হাই-ব্লাডপ্রেশার। সহায়-সম্বল বলতে হাফ-ফিনিশ গৌরহরি আর কর্মচারীরা। মেজো ছেলে রাখোহরি বিলেতে যা পড়তে গিয়েছিল তা শেষ না করে আর একটা কী পড়তে লেগেছে। আসলে পড়ার নাম করে বাপের পয়সায় ফালতু কিছুদিন বিলেতে থেকে যাওয়া। ইতিমধ্যেই সে টাকার বরাদ্দ কয়েকবার বাড়িয়ে নিয়েছে। ফুর্তি লুটছে খুব। বড় ছেলে থাকোহরি সে সব কথা মাঝে মাঝে জানাত। সে নিজেও ফুর্তি লুটেছিল। তাই রেখে-ঢেকে লিখত। যেটুকু লিখত না বুদ্ধিমান বগলাপতি আন্দাজ করে নিতে পারতেন। গভর্নমেন্টের স্টোরিং এজেন্সি পেয়ে বগলাপতি যখন ফ্যাসাদে পড়লেন তখন বিস্তর পয়সা খরচ করে তার করলেন মেজো ছেলেকে গৌরহরির নামে, ফাদার সিক, কাম শার্প।

রাখোহরি চলে এল। পুরোদস্তুর সাহেব। বিলেতে সে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট শিখেছে কয়েক বছর। পাস করেনি, কিন্তু যা পড়েছে তার দাপটেই ম্লান হয়ে গেলেন বগলাপতি। রাখোহরি বিশাল জাল ছড়াল চারদিকে। আসলে জালটা টাকার। রাখোহরির বুদ্ধিটা যে খুব খারাপ ছিল তা নয়। অমনিতে সে ছিল মিষ্টভাষী, বিনয়ি এবং ছোটখাটোর মধ্যে সুপুরুষ, নেভি ব্লু স্যুট আর বো পরলে তাকে বড় সুন্দর দেখাত। কতবার ফার্পো কি গ্র্যান্ড কি মোকাম্বাের পার্টিতে ডজে চড়িয়ে তাকে নিয়ে গেছে গৌর। অল্প ক’দিনেই গৌর রাখোহরির ভক্ত হয়ে পড়েছিল। রাখোহরির যোগাযোগটা ছিল মিনিস্টার আর সেক্রেটারিদের লেভেল-এ। অল্প কয়েকদিনেই সে এজেন্সির ব্যাপারে বিস্তর সুবিধে আদায় করে নিল। তার পক্ষে এবং পিছনে বড় বড় মহারথী দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু যাদের সঙ্গে দৈনিক কাজ-কারবার সেইসব ইনস্পেক্টর, ঠিকাদার, দারোগা ইত্যাদিকে একদম গ্রাহ্য করত না সে। তাদের ওপর দিয়ে চলত। রাখোহরির বিশাল বিশাল লোকের সঙ্গে ভাব দেখে তারাও সহ্য করত মুখ বুজে। বগলাপতির আমলে তারা কিছু পয়সাকড়ি রোজগার করেছিল, রাখোহরির আমল্পে দেখা দিল উলটো, তাদের চাকরির ভয়। কিংবা বদলির। বগলাপতি রাখোহরিকে বোঝানোর চেষ্টা করত, বাবা, এরা সব খুদে দেবতা, এদেরই সঙ্গে কাজকারবার, এদের একেবারে পায়ে ঠেলো না। মিনিস্টার, সেক্রেটারির বদল হয় কিন্তু এদের হয় না। কারবারে ঘুরেফিরে এদের সঙ্গেই দেখা হবে। ছোট মানুষ সব, তোমাকে ভয়ও পায়, কিন্তু জোট বাঁধলে তোমাকে আমাকে দেশছাড়া করবে। রাখোহরি তখন গরম। বাপের টাকায় তখন ব্ল্যাঙ্ক চেক কেটে দেওয়া আছে তার নামে। স্টোরিং-এ বিস্তর ডিমারেজ দেখিয়ে সে মাল পাচার করছে। ইন্সপেক্টর, ঠিকাদার, দারোগা সবাই হাঁ করে দেখছে। সবাই ওরকম করে, কিন্তু তারা ভাগ পায়, রাখোহরির আমলে তাদের ভাগ নেই। রাখোহরি ফুড স্টোরিং-এর প্রায় একরারনামা পেয়ে গিয়েছিল। অ্যান্টিকরাপশান তার পিছনে ঘোরে, তার নামে রিপোর্টও যায়। কিন্তু তা সব চাপা পড়ে থাকে। বগলাপতি নীরবে একা ঘরে বুক চাপড়ান। রাতারাতি উন্নতি দেখে তিনি ভেঙে পড়েন, আর বলেন, বুঝলি গৌরা, ভিত না গেঁথে বাড়ি উঁচু করার অনেক বিপদ। ভিতটাই যে কাঁচা। এ ছেলেটা যে বোঝেই না দারোগাকে খাতির করা দরকার। ইন্সপেক্টরকেও পান-তামাক দিতে হয়। আমরা ছেলেবেলা থেকে এসব শিখেছিলাম। বিপদে-আপদে এরা যে কত কাজে আসে।

রাখোহরি তখন একটার পর একটা কন্ট্রাক্ট নিচ্ছে। প্রায় সবই সরকারি। তখন আলাদা মেজাজে চলে। কিন্তু তখনও ডজ গাড়িটার বশংবদ ড্রাইভার হয়ে পরমানন্দে গাড়িখানা চালায় গৌরহরি। সে উন্নতি ভাল বোঝে না, কেবল আনন্দ বোঝে। রাখোহরি যখন মোকাম্বাের ভিতরে স্বপ্ন-আলোয়। নাচে গায়, গ্র্যান্ডে পার্টি দেয়, তখন গৌরহরি সযত্নে পালকের ঝাড়নে ডজ গাড়িখানা বার বার মুছছে আর মুছছে। ওই তার আনন্দ, সুখ, সম্পদ। অল্প একটু মাতাল হয়ে বেরিয়ে আসে রাখোহরি, ইংরিজিতে কথা বলে বড় বড় অফিসারদের সঙ্গে, বিদায় নেয়। গৌরহরি গাড়ির দরজা খুলে ধরে। থাকে। সযত্নে গাড়ি চালিয়ে রাখোহরিকে নিয়ে আসে। বগলাপতি জেগে অপেক্ষা করে থাকেন। গৌরহরিকে ডেকে রাখোহরির গতিবিধির খবর নেন, ব্যাবসাপত্রের অবস্থা বুঝবার চেষ্টা করেন। গৌরহরি বুঝতে পারে, একটা গোলমাল পাকাচ্ছে। কিন্তু সেটা কেমন গোলমাল তা তার মাথায় আসে না, সে যা দেখে তাই বলে দেয় বগলাপতিকে। বগলাপতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকেন। মাঝে মাঝে বলেন, বড়গাছে নৌকো বাঁধবার চেষ্টা। গৌরা, এবার তোর জন্য আলাদা বন্দোবস্ত করতেই হচ্ছে। সবংশে রাখোহরি যদি ডায়, তুই কেন মরবি? তুই আলাদা ব্যবস্থা করে নে। তোর জন্যই রাতে আমার ঘুম নেই।

.

পি জি-তে গাড়ি ঢোকাল না গৌর। বাইরেই ছেড়ে দিল বুড়ো লোকটাকে। লোকটা খুব সাবধানি। ভিতরের পকেটে হাত চালিয়ে নোট বের করল, ঝুলপকেট থেকে খুচরো। যা ভাড়া টায়ে-টায়ে তা-ই দিল, খুচরো ফেরতের কোনও ঝামেলা রাখল না। একজ্যাক্ট ফেয়ার। বাহাঃ রে বাহাঃ!

স্যার, ওই সার্জেন্ট কি আপনার কেউ হয়? হলে নম্বরটা কেটে দিতে বলবেন। আমি তো ঠিকমতোই পৌঁছে দিয়েছি আপনাকে! দিইনি?

বুড়োটা খ্যাঁক করে ওঠে, সার্জেন্ট আমার বাবাকেলে আত্মীয় হয় আর কি! নম্বর টুকেছে তো আমি কী করব? তোমাদের বদমাইশি কে না জানে? দেয় যদি ঠকে তো ঠিকই করবে। উচিত শিক্ষা হওয়া দরকার। লোকে বিপদের সময়ে ট্যাক্সি পায় না, আর তোমরা নানা কাজে ট্যাক্সি ভাড়া খাটাও। গভর্নমেন্টের পুষ্যিপুত্তুর সব!

বুড়োটা বকবক করতে করতে কাটল।

শালা! গৌরবাবুর টিফিন টাইম হড়কে দিয়ে আবার গরম খাওয়া হচ্ছে!

শালার ওই সার্জেন্ট না ধরলে গৌরবাবু কবে পিছলে বেরিয়ে যেত, তখন কী করতে বাবা বুড়ো মাল!

বিড়বিড় করতে করতে গৌরহরি আবার লাল কাপড়ে তার মিটার বাঁধে। একটা মেয়েছেলে দূর থেকে আঙুল দেখাচ্ছে, এই যে, এই ট্যাক্সি!

আর না বাবা। আর না। এবার দাশ কেবিন। সোজা নাক বরাবর। একচুল এধার ওধার হয়েছে তো গৌরহরির নামই গৌরহরি নয়। কারও সার্ভেন্ট নাকি বগলাপতির ছেলে? অ্যাঁ! তোমাদের পকেট গরম বাবা, সে তো বুঝতেই পারছি। মাসের প্রথম দিকটা তো, জানি। কিন্তু বাবা, আমি কারও পয়সায় কেনা চাকর নই। এই ল্যান্ডমাস্টার এখন প্রাইভেট প্রপার্টি। বগলাপতির ডজ গাড়িটার মতো। হ্যাঁ, আলবত, লাল কাপড়ে মিটার ঢাকার পর এখন এটা আমার প্রাইভেট। ফোটো সবাই, ফুটে যাও সব সোয়ারি। গৌরবাবুর টি-পার্টি আছে দাশ কেবিনে। ছাড়ো রাস্তা।

বদর-বদর। দরগায় শিন্নি, গির্জেয় মোমবাতি, বাবা পুলুসে যেন আর না ধরে। পুলুসে ধরলে আঠারো ঘা।… অই দ্যাখো, শালাদের কারবার। রসা রোডটা বেমালুম গায়েব করে দিয়ে নদী বানিয়েছে! কেমন ঢেউ দিচ্ছে দেখো। কেমন কুলকুল শব্দ ঢাকার বুড়িগঙ্গার মতো। দোতলা একতলা স্টিমলঞ্চ যাতায়াত করছে দিব্যি। বয়ার ওপরে দাঁড়িয়ে জল-পুলুস। লাল-নীল সবুজ বলগুলো উড়ে আসছে, উঠছে নামছে। দু-একটা এসে ধীরে ধীরে বসল গৌরবাবুর গাড়ির বনেটে। সেই বুড়ো লোকটা উড়ে আসছে পি জি হাসপাতালের দিক থেকে, চেঁচিয়ে বলছে, এই ট্যাক্সিওলা, আট আনা পয়সা বেশি চলে গেছে ভাড়ার সঙ্গে, পালিয়ো না, নম্বর টোকা আছে, সাবধান!

গৌর চোখ কচলে নেয়, কেমন ঘুমের আঁশ জড়িয়ে আছে চোখে। মাথার মধ্যে রিমঝিম শব্দ। ঠাহর করে সে রাস্তাঘাট বুঝবার চেষ্টা করে। নাঃ, রসা বোড় রসা রোডের মতোই দেখাচ্ছে আবার। কেবল ওই রঙিন বলগুলো ঝামেলা করছে। উড়ে উড়ে আড়াল করছে উইন্ডস্ক্রিনটা, ওই তো পুলিশটার কাধে একটা নীল বল চেপে বসল।

নাঃ, ওটা গ্রিন লাইট। চলো হে গৌরবাবু।

গৌর তার খুদে ল্যান্ডমাস্টার একটা ডবলডেকারের গা ঘেঁষে উড়িয়ে নিল। দাশ কেবিন। আফিং মেশানো চোতরাপাতার কাথ না হলে আর এখন গৌববাবুর নার্ভ কাজই করবে না, পুরোটা ব্রেক ডাউন হয়ে বড়ি পড়ে যাবে।

গৌর ওড়ে। সত্যিই ওড়ে। তার স্পষ্টই মনে হয়, মাটির ছ’ ইঞ্চি ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে তার গাড়ি, রাস্তার টালগুলো আর চাকায় লাগছে না। ভারী ভাল লাগে গৌরহরির। নিরন্তর রাস্তা আঁকড়ে চলতে কাহাতক ভাল লাগে রোজ? মাঝে মাঝে এই উড়ে যাওয়া কীরকম ভাল! গৌর খুশিতে শিস দেয়। তার গাড়ি উড়ছে, উড়ে যাচ্ছে।

সামনের আয়নাটা ঠিক করে নেয় গৌর। পিছনের ফাঁকা সিটটা নজরে রাখে। শালার ডেডবডিটা আছে ওখানে ঠিকই। কেবল সবসময়ে ওটাকে ঠাহর করা যায় না এই যা। মগন সিং-এর কাছে যখন ছিল তখনই শালা কোনও হুজ্জতে গাড়িটার গ্রহদোষ ঘটে গেছে। সেই অপঘাতের মড়া এখন সবসময়ে বসে আছে পিছনের সিটে। নয়তো নড়ছে লাগেজ বুটে। নড়বি তো নড় শালা, আমার কী! আমি তোরটা খাই, না পরি! আমি হচ্ছি গে বগলাপতির অর্থাৎ কিনা বগলুর ছেলে গৌরহরি, অর্থাৎ কিনা গৌরা। আমি শালা কার সার্ভেন্ট! লাল কাপড়ে মিটার ঢাকলেই এ আমার প্রাইভেট প্রপার্টি। এই দেখ, আমি গৌরা, নিজের প্রাইভেট গাড়িতে চলেছি দাশ কেবিনে। চা খাব। তুই মরা মানুষ, মরা মানুষের মতো থাকবি, নো ইন্টারফিয়ারেন্স। মড়াদের সঙ্গে জ্যান্তদের নো বিজনেস। মাগনা ট্যাক্সি চড়ছিস, এই ঢের। খবরদার যদি গৌরবাবুকে কখনও ভয় দেখিয়েছিস!

ভবানীপুর, কালীঘাট পেরিয়ে গেলে দাশ কেবিন আর খুব দূরে নয়। তবু, দেয়ার আর মেনি এ স্লিপস,। ফুটপাথে রং-বেরঙের মানুষের ভিড়। খালি ট্যাক্সি দেখলেই শালারা হাত ওঠায়। মোড়ে লালবাতিতে দাঁড়িয়েছ কি, যেতে চাও বা না চাও, দরজা লক করা না থাকলে নিজেরাই খুলে ঢুকে পড়বে। একশো কারণ দেখালেও কাকুতি-মিনতি করতে থাকবে, বড় দরকার দাদা, একটু কাইন্ড হয়ে নিয়ে যান। বাড়তি পয়সা দেব। দেখছেন তো সঙ্গে মেয়েছেলে রয়েছে। গৌর খেয়াল করে চলতি গাড়িতেই পিছনের দরজা দুটো হাত বাড়িয়ে লক করে দিল। এখন দাশ কেবিন ছাড়া কোথাও যাবে না গাড়ি। কেবল যদি ধরে বাবা পুলুসে তবে অন্য কথা। পুলিশকে বরাবর ডরায় গৌরহরি, যেমন রাত তার বাবা বগলাপতি। কত দারোগা যে তাদের বাড়িতে পাঁঠা খেয়ে ঢেকুর তুলে আশীর্বাদ করে গেছে। গৃহদেবতার মতো তাদের খাতির ছিল। যেদিন দারোগা খেত, সেদিন বগলাপতির ছিল সকাল থেকে বাঁধা উপোেস। সেই সব ভয়-ভীতি থেকেই তাদের উন্নতি। সেটা কোনওকালে বুঝল না রাখোহরি। সে এসে দারোগাদের দাবড়াতে লাগল, ইন্সপেক্টরদের সঙ্গে চাকর-বাকরের মতো ছিল তার ব্যবহার। এই যেমন এখন গৌরহরির গাড়িখানা উড়ছে, ঠিক তেমনই উড়ত রাখোহরি। পুরনো দারোগা সমাদ্দার মাঝে মাঝে বগলাপতির কাছে দুঃখ করে যেত, তোমার ছেলের কাছে আর আমাদের পদমর্যাদা বলে কিছু রইল না হে বগলা। বগলাপতি তাকে হাত কচলে বলতেন, ও আমার ছেলে না। আমার রক্তের ধাতই নয়। ও ব্যাটা পেয়েছে ওর মামাবাড়ির ধাত। আমার শ্বশুরবাড়িটার ওই দোষেই কিছু হল না। ও শালা ওর মায়ের ছেলে, আমার না।

চুলকে ঘা করা। রাখোহরি তাই করেছিল। তার দুরের খুটির জোরে সে আশেপাশের সবাইকে মাটির ঢেলার শামিল করে দিয়েছিল। চুরি-চামারি যেমন চলছিল তেমনই চলতে লাগল। বাড়িতে এল রেডিয়োগ্রাম, রেফ্রিজারেটার, বগলাপতির ঘরে লাগানো হল এয়ারকুলার। তারপর ডজ গাড়িটা বেচতে চেষ্টা করতে লাগল রাখোহরি।

সেবার উত্তরবাংলায় বন্যার পর স্টোরিং এজেন্টদের খুব রবরবা দেখা দিল। হাজার হাজার টন খাদ্যশস্য মজুত হতে লাগল এজেন্টদের মারফত। রাখোহরির ছোটাছুটি গেল বেড়ে। সে কেবল গুদাম ভাড়া করে, আর মজুত করে মাল। লোডিং আনলোডিং-এর দরুন শস্যের যে ক্ষয়ক্ষতি হয় তার একটা হিসাব ধরে শস্যের পরিমাণ বাদ দেয় সরকার। ধরে করে সেই পরিমাণটা বাড়িয়ে নিয়েছিল রাখোহরি। সেটা ছিল হাতের মুঠোর আইনসঙ্গত ইনকাম। তার ওপর কমিশন আর হ্যান্ডলিং। এইসব নিয়ে রাখোহরি যখন ভীষণ ব্যস্ত তখন একদিন বগলাপতি গৌরহরিকে ডেকে পুরনো ডজ গাড়িটা বের করতে বললেন। তারপর সাজ-পোশাক পরে বেরোলেন। গৌরহরি গাড়ি চালিয়ে দিল। না, পুরনো ব্যাবসাপত্রের জায়গায় আর গেলেন না তিনি। তার নির্দেশে গাড়ি এসে থামল মগন সিং-এর গ্যারেজে। সেইখানেই ল্যান্ডমাস্টারখানা ছিল। প্রথমদিককার মডেল, খুব চাল গাড়ি। বগলাপতি ন’ হাজারে কিনলেন গাড়িখানা। গৌরকে ডেকে বললেন, বুঝলি গৌরা, তোকে যা দেব ভেবেছিলাম তা আর বুঝি হল না। তা এই গাড়িখানা দেবই, এটায় তোর সারা জীবন চলে যাবে হয়তো বা, যদি ভাগ্যে থাকে। রাখোহরি সর্বনাশ আনল বলে। তা তুই অবোধ প্রাণী, সে গর্দিশে তোর কষ্ট পাওয়ার দরকার কী? যার যেমন গুণ তার তেমনি প্রাপ্য হওয়া উচিত। তোকে লাখ টাকা দিলেও তো গুনে-গেঁথে হিসেব করে চলতে পারবি না। ওই রাখোহরিই তোর মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে নেবে। তার চেয়ে এই ট্যাক্সিখানা চালা। চালাবিও ভাল, থাকবি আনন্দে, খেয়ে-পরে। খুব বেশি লোভ-টোভ করিস না বাবা।

তারপর সেই গাড়ি সাদা-হলুদ রং করে, সিট-টিট পালটে, মেরামত করে, কালীঘাটে নিয়ে মায়ের পুজোর ফুল-সিন্দুর ঠেকিয়ে লাইসেন্স পারমিটের ঝামেলা মিটিয়ে একদিন ট্যাক্সি হয়ে রাস্তায় বেরোল। মা দৃশ্য দেখে বুক চাপড়ালেন, ছেলেটাকে চাকরের অধম করেছ। এতদিন ছিল ড্রাইভার, তাও না হয় বুঝতাম। এখন কিনা ট্যাক্সিওয়ালা!

দূরদর্শী বগলাপতি কপালে ভাঁজ ফেলে চেয়ে থেকে আস্তে আস্তে বললেন, লজ্জার কী! এখন ওর স্বাধীন ব্যাবসা। ওর যা ক্ষমতা সেই অনুযায়ি ওকে স্বাধীন করে দিলাম। এখন ও নিজেকে চালিয়ে নিতে পারবে। ভাইদের হাততোলা হয়ে থাকলে আমাদের চোখ বুজবার পর ও সত্যিই চাকর-বাকর হয়ে যেত। বাপ-মা মরলে ভাইতে আর তালুইতে তফাত কী?

মা তবু ঘ্যানঘ্যান করতে লাগলেন, তা দিলেই যদি তবে নতুন আব ভাল গাড়ি দিলে না একখানা? বিশ-ত্রিশ হাজার টাকার দামি গাড়ি হলেও না হয় বুঝতাম।

দূরদর্শী বগলাপতি আবার কপালে ভাঁজ ফেলে কী একটু ভাবেন, তারপর বলেন, সামনে বড় দুর্দিন, বুঝলে বড় বউ! সেই দুর্দিনে একখানা দামি গাড়ি যদি গৌরের কাছে থাকে তবে রাখোহরি কি ছেড়ে দেবে? সেটা একটা অ্যাসেট বলে কেড়ে নেবে হয়তো বা। তা নতুন ল্যান্ডমাস্টার একটা দিতে পারতাম বটে, কিন্তু তার জন্য বসে থাকতে হবে। এই বয়সে এখন আর আমার দেরি সইছে না। নতুন না হোক গোরাই জানে যে গাড়িখানা খুব চাল, পচা মাল দিয়ে ওকে ঠকাইনি। আমারই তো ছেলে, ওর ভবিষ্যৎ ভেবেচিন্তে ঠিক জিনিসখানাই দিয়েছি, এখন ইবলিশের বাচ্চা নিজের কপাল যদি নিজে না ভাঙে তো সংসারে চালু থাকবে।

দক্ষিণের রাস্তাগুলোই ভাল। না আছে মিছিল, না জ্যাম। পুলিশও নয় নর্থের মত টিকরমবাজ। গৌরহরি ট্যাক্সির মিটার ঢেকে এখন মালিকের মতো গাড়ি চালাচ্ছে। মিটার খুললেই টাক্সিওয়ালা। মিটার ঢাকলেই গৌরবাবু। তার ঘুমটা এখন মাথা থেকে বেরিয়ে একটা মাছির মতো চারধারে ভো ভোঁ করে ঘুরছে। সুযোগ পেলেই আবার ঢুকে পড়বে মাথায়। অমনি আবার আবছা হয়ে যাবে রাস্তাঘাট, রিয়্যালিটির সঙ্গে ড্রিম মিশে যেতে থাকবে। ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরের সেই কামানখানা এখনও লাল নীল হলুদ বল ছুঁড়ে দিচ্ছে বাতাসে। সেইসব বল ওড়াউডি করছে। ধীর গতিতে গড়াচ্ছে, ভাসছে, এসে বসছে বনেটের ওপর। মাঝে মাঝে সামনের রাস্তা উঠে যাচ্ছে উঁচুতে। এক-আধজন মানুষ চলতে চলতে হঠাৎ উড়ে যাচ্ছে কোথায়! ভুস করে। ঠিক থাকো গৌরবাবু, ঠিক থাকো। আর একটু দূরেই দাশ কেবিন। এই তো প্রায় এসে গেছি বাপধন। আর একটু, আর একটু মাথাখানা পরিষ্কার রাখো তো বগলুর ছাওয়াল।

পিছনের সিটে মচ করে একটা শব্দ হয়। পরিষ্কার শব্দ। কোনও ভুল নেই। গৌরহরি আয়নায় চোখ রাখে। ওই শালা ডেডবডিটা। বস্তুত ডেডবড়িটাকে দেখা যায় না কখনও। কিন্তু শালা আছে ঠিকই। যখনই গৌর গাড়িতে একা তখনই শালার নড়াচড়া শুরু হয়। বিনা পয়সার সোয়ারি শালা, ধরতে পারলে ঘাড় ধরে ঝাকার দিত গৌর। বগলুর ছাওয়ালের সঙ্গে চিটিংবাজি! শালা ডাকটিকিটের মতো অন্যের জিনিসে সেঁটে থাকা! কিন্তু ওই একটা অসুবিধে। জ্যান্তদের সঙ্গে তবু ট্যাকল করা যায়, যতই আঁাহাবাজ হোক। কিন্তু মড়াগুলোকে কিছুতেই কিছু করা যায় না। এই ডেডবডিটাকে আজ পর্যন্ত কিছু করতে পারল না গৌর। শালা বগলুর ব্যাটাকে ছোলাগাছি দেখিয়ে দিব্যি ল্যান্ডমাস্টারখানা বিনিপয়সায় ভোগ করে যাচ্ছে। দেখছে কলকাতা। ফোর টুয়েন্টি কোথাকার!

বিস্তর হাত উঠছে ভিড় থেকে তার ল্যান্ডমাস্টার লক্ষ্য করে। লোকে চেঁচাচ্ছে, ট্যাক্সি, ই, ই,

মাছিটা ভোঁ ভোঁ করে উড়ছে মাথার আশেপাশে। এক্ষুনি নাক কি কানের ফুটো দিয়ে ভিতরে সেঁধিয়ে যাবে। গৌর বিড়বিড় করে, আর একটু বাবা গৌর, আর একটু। শালারা ভেবেছে ভাড়ার গাড়ি। দেখছে না শালা যে লাল কাপড়ে মিটার ঢেকেছি! এখন শালা এ গাড়ি আমার প্রাইভেট। ওই ডেডবডিটা ছাড়া আর কোনও সোয়ারি নেই। এখন আমি ফ্রি। এখন আমার টিফিন টাইম।

ফাদার ফ্রান্সিস যখন খেলা শেখাত, তার সঙ্গে শেখাত উচ্চারণও। সেন্ট অ্যান্টনিজ-এর ঘেরা মাঠে ফাদার ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে ডাকত, হে গৌরঅরি, ফ্যাস দি বল।

গৌর চেঁচিয়ে বলত, পাস দি বল।

সে ফ্যাস ফ্যাস, নট পাস।

গৌর হেসে কুটিপাটি, ফ্যাস ফ্যাস, আই ওনট ফ্যাস দি বল ফাদার, আই উড লাইক টু পাস।

দুষ্টু ছেলে গৌরঅরি, অ্যাও, বালো ওবে না।

আই! অবিকল ফাদার ফ্রান্সিস লাল নীল বলগুলোকে ঠেলে দিচ্ছেন এধার ওধার। সারা চরাচর জুড়ে ভাসছে সেই সব রঙিন গোলা। ফাদার চেঁচিয়ে বলছেন, এই গৌরঅরি, ফ্যাস ইট, ফ্যাস ইট।

আই ফাদার,–গৌরহরি বিড়বিড় করে, আই উড লাইক টু ফ্যাস ইট ফাদার। আই উড ভেরি মাচ লাইক টু

ফাদার ফ্রান্সিস চরাচর জুড়ে খেলা করেন। তার সঙ্গে খেলে স্বপ্নের শিশুরা।

উড়ন্ত মানুষেরা বল ধরে এগিয়ে দিচ্ছে ফাদারের পায়ে। গৌরের গাড়ি আবার মাটি ছেড়ে উড়তে থাকে। গৌর জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা লাল বল ধরার চেষ্টা করে। পারে না। হেসে গড়িয়ে পড়েন ফাদার, গৌরঅরি, অ্যাও গৌরঅরি, গুড ফর নাথিং!

রাসবিহারীর মোড়ে তার গাড়ি আবার মাটিতে নামে ঝং শব্দ করে। গৌরহরি চমকে ওঠে। চমকায় পিছনের সিটের সেই ডেডবডি।

 গৌরের জানালায় দুটো মুখ ঝুঁকে পড়ে, হাঁফাতে হাফাতে বলে, যাবেন দাদা! আমরা বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি।

দেখছেন তো মিটার ঢাকা রয়েছে।

একটু দয়া করুন।

দয়া। কীসের দয়া! কোন পুলুসটা দয়া করে বগলুর ব্যাটাকে! কোন ম্যাজিস্ট্রেট! কোন সোয়ারি কথা না শুনিয়ে ছাড়ে! অ্যাঁ! পুলুস ডেকে যখন ট্যাক্সি ধরো, তখন! না, হবে না। কে বলেছে এটা ট্যাক্সি? এটা গৌরবাবুর প্রাইভেট।

দাশ কেবিনে কি পৌঁছনো যাবে শেষ পর্যন্ত? কে জানে! রাস্তাটা যে অফুরান লাগছে গৌরহরির। এখনও মনে হচ্ছে হাজার হাজার মাইল রয়ে গেছে। মোড়ে জ্বলছে লালবাতি। বাবা লালবাতি, গৌর যে আর পারে না, বগলুর পোলার প্রাণটা যে গেল। দাশ কেবিনের সেই চোতরাপাতার ঘন কাথটি, যার নাম কিনা চা, সেইটি সিস্টেমে না ঢাললে যে এখন ড্রিমে আর রিয়্যালিটিতে চামচে নাড়া হয়ে যাচ্ছে, আমে-দুধে মিশে যাচ্ছে বাবা!

মচ করে পিছন থেকে আবার শব্দ হয়।

চোপ!বলে ধমক মারে গৌরহরি। শালা ডেডবডিটা। বিনিপয়সার পার্মামেন্ট সোয়ারি। হাফ-ফিনিশ ফিফটি পারসেন্ট গৌর না হলে শালা তোমার দম বের করে দিত।

গ্রিন লাইট।

গৌর শ্বাস ছেড়ে গাড়ি ছাড়ে।

.

দাশ কেবিন থেকে যখন বেরোল গৌর, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল সে। শরীরের ভিতরটায় বাতাস বইছে, চাঁদ উঠেছে সেখানে, বাগান আলো করে ফুল ফুটেছে। শরীরের ভিতরে এইসব হচ্ছে এখন। গৌর মৌরি চিবোতে চিবোতে একটা খো আর একটা ভাল পায়ের ওপর একটু টেরছা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর শরীরের ভিতরকার সেই জ্যোৎস্না, সেই বাগান, সেই বাতাস অনুভব করল কিছুক্ষণ। গৌর কোনওদিনই কারও সার্ভেন্ট নয়। ওই সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার ল্যান্ডমাস্টার, মিটারে লাল কাপড় জড়ানো প্রাইভেট। গৌর যখন খুশি খুলবে কাপড়, যখন খুশি প্রাইভেটকে ভাড়াটে গাড়ি বানাবে। কোনও শালার কিছু বলার নেই। এখন দাশ কেবিনের গরম অমলেট, চা আর টোস্ট তার পেটে গিসগিস করছে। ঠিক যেন বাতাসে, চাঁদের আলোয় একখানা ফুল-ফোটা বাগান। ইচ্ছে করলে, যতক্ষণ খুশি শরীরের ভিতরকার সেই দৃশ্যটা উপভোগ করতে পারে বগলুর পোলা গৌরা, কোনও শালার কিছু বলার নেই। বাপ বগলাপতিই তাকে স্বাধীন করে দিয়ে গেছে। লোকটার ফোর-সাইট ছিল বটে।

স্টোরিং এজেন্সিটা যখন ফুলেফেঁপে একটা বিশাল আকার নিয়েছে তখনই বলতে কী রাখোহরি তার ভুল বুঝতে পারছিল। কারবারটা এত ছড়ানো তার ঠিক হয়নি। বিস্তর দৌড়ঝাপ এবং তদবির করতে হচ্ছিল। সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল বিবিধ ফুটোফাটা। ওদিকে বড়কর্তাদের রদবদল শুরু হয়ে গেছে। পালটে গেছে মিনিস্টার। নতুন করে আবার কোমরে কাপড় বেঁধে রুই-কাতলা ধরো। যাদের চিরকাল উপেক্ষা করে এসেছে রাখোহরি, তখন তাদের জো। তারা ওঁত পেতেই ছিল। কোনও গুদামেই মাপমতো মাল থাকে না। একথা কে না জানে! রাতারাতি মাল এদিক ওদিক হয়, ওজন ম্যানেজ হয়, বড়কর্তারা পান-তামাক খেয়ে ব্যাপারটা চেপে যান। কিন্তু সেবার বড়কর্তাদের পান-তামাকের বন্দোবস্ত তখনও করে উঠতে পারেনি রাখোহরি। উত্তরবাংলার গর্দিশে আটকে গিয়েছিল। এক রাতে ইন্সপেক্টর আর দারোগা তার দুটো গুদাম দিল সিল করে! রাখোহরি প্রথমে চোখ রাঙাল, তারপর লোভ দেখাল, তারপর বসল মাথায় হাত দিয়ে। ফুডের সেক্রেটারি রিটায়ার করেছে, মিনিস্টার পেয়েছে অন্য পোর্টফোলিও। রাখোহরি করে কী?

প্রথমে বগলাপতি ব্যাপারটা জানতেও পারেননি। একা-একাই ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছে। রাখোহবি। অবশেষে বেগতিক দেখে এসে পড়ল বগলাপতির কোলে, বাবা, বাঁচাও।

বগলাপতি চুপ করে সব শুনলেন। বুঝলেন, শুধু দারোগা বা ইন্সপেক্টর নয়, অন্য ব্যবসায়িরাও আছে এই চক্রান্তে। প্রফেশনাল জেলাসি। বিলেতে ম্যানেজমেন্ট শেখা রাখোহরি মূলেই গণ্ডগোল করে বসে আছে। তবুবলাপতি শেষ চো করতে বেরোলেন। কিন্তু বৃথা। ব্যাপারটা নালি ঘায়ের মতো চাউর হয়ে গেছে তখন। পাবলিক গেছে খেপে। কাগজেও ছোট্ট করে খবর বেরিয়ে গেল। পাবলিকের দুর্ভিক্ষের খাবার নিয়ে কালোবাজার। দেশদ্রোহ, মানবতার শত্রুতা। তার ওপর রাখোহরি বোকার মতো নিজের দোষ ঢাকতে সিল করা গুদামের টিন লোক লাগিয়ে রাতারাতি ফুটো করে চুরি দেখাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা টিকল না। রাখোহরি আর বগলাপতি, দু’জনকেই পুলিশে ধরল। বালিগঞ্জের বাড়িটাতে তখন মা আর হাফ-ফিনিশ গৌরা।

গৌরা অতশত বোঝে না। মা সারাদিন কান্নাকাটি করে। গৌরা সকালে ল্যান্ডমাস্টার নিয়ে। বেরোয়। সারাদিন কলকাতার সোয়ারি এধার ওধার করে, রাতে টাকা আর খুচরো একগাদা নিয়ে এসে মায়ের কোচড়ে ফেলে। মা কেঁদে আকুল হয়, ও আমার গৌরা! শেষে তুই খাওয়াবি আমাকে, একথা কে ভেবেছিল বাপ আমার? তোর যে বাঁচার আশা ছিল না। টিক টিক করে টিকে আছিস এই যে আমার ভাগ্যি।

ধীরেসুস্থে মিটারের লাল কাপড়টা খোলে গৌর। অমনি তৎক্ষণাৎ একজোড়া ছেলেমেয়ে এসে গাড়ির দরজার হাতল ছুঁয়ে বলে, আমরা একটু গঙ্গার ঘাটে যাব।

গঙ্গার ঘাট। মৃদু হাসে গৌর। মন্দ কী? দাশ কেবিনের পর এখন গঙ্গার ঘাট ভালই লাগবে গৌরের।

চলুন।–বলে সে লক খুলে দেয়।

 ছেলেমেয়ে দুটো কলকল করতে করতে পিছনে উঠে পড়ে।

তাদের কথার মাঝখানে মাঝখানে একটু-আধটু ফিসফিসানি শুনতে পায় গৌর। মেয়েটা বলে, লোকটার একটা হাত দেখেছ। কেমন শুকনো কাঠের মতো?

ছেলেটা বলে, একটা পা-ও তাই।

 ওমা! তাই নাকি? কী করে তবে গাড়ি চালায় গো? অ্যাকসিডেন্ট করবে না তো!

দূর। গাড়ি তো অভ্যাসে চলে।

 গৌর হাসে। আহা, বগলুর পোলা গৌরা, হাফ-ফিনিশ ফিফটি পারসেন্ট, ছা-রা-রা রা রা—

জামিনে খালাস পেয়ে বগলাপতি যখন বেরোলেন তখন তার চেহারা রোঁয়া-ওঠা কাকের বাচ্চা মতো। মুখের চামড়া কী এক রোগে কালো হয়ে গেছে অর্ধেক। চামড়া দুল দুল করে ঝোলে। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট লালবাতি দেখাচ্ছে। বাড়ি মর্টগেজে। ডজ গাড়িটা ছ’ হাজারে বিক্রি করেছে। রাখোহরি। কেস চলতে লাগল। সে কী চলা! তার ব্রেক নেই, ইঞ্জিন গরম হয় না, ড্রাইভার টিফিন খায় না। সে চলে তো চলেই। সেই কেই আস্তে আস্তে শুষে নিল তাদের সংসার। বগলাপতি ঘন ঘন দুটো স্ট্রোক সামলালেন। তৃতীয় স্ট্রোকে হড়কে গেলেন দুনিয়া থেকে। তার দুমাস পর মা। তখন বিলেত-ফেরত ম্যানেজমেন্ট শেখা রাখোহরি লুঙ্গি পরে রকে বসে বিড়ি খায়। বিলেত থেকে ফিরে অনেক কান্ড করার পর বিয়ে করেছিল। গুষ্টি বেড়েছে। মাঝেমধ্যে গৌরের ল্যান্ডমাস্টারটার দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। জিজ্ঞেস করে, এটার যেন কত দাম পড়েছিল রে?

গৌরহরি সতর্ক হয়ে বলত, হাজার চারেক বোধহয়। এখন দু’হাজারেও বিকোবে না।

বিক্রি করতে করতে অস্থাবর সবকিছুই ফিনিশ করেছিল রাখোহরি। এক কথা ছাড়া তার আর কিছুই ছিল না। মাঝে মাঝেই ধার বলে পয়সা নিত গৌরের কাছ থেকে। বিনিপয়সায় তার ট্যাক্সিতে এধার ওধার যেত। বাপের যা ছিল তার এক পয়সাও হেঁয়াল না গৌরকে। দূরদর্শী বগলাপতি তা জানতেন। ল্যান্ডমাস্টারখানা নিয়ে গৌর তাই সুখেই আছে।

তা গৌরা তেমন চিন্তা-ভাবনা করতে পারে না কোনওদিনই। করলেই মলপরা দুটি পা মাথার মধ্যে চক্কর মারতে থাকে। সে এমন চক্কর যে গৌর ছোটাছুটি করে, শব্দ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, গায়ে ঘাম দেয়, চোখ-মুখ ফেটে পড়তে থাকে। কিন্তু সেই নাচুনে মাগির নাচ আর শেষই হতে চায় না। শেষে সেই ঝমঝম মাথা থেকে তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তার রক্ত, হাড়, মজ্জা সব সেই ঝমঝমের সঙ্গে তাল দেয়। বড় নেতিয়ে পড়ে গৌরহরি। তার বাহ্যজ্ঞান প্রায় লোপ পেয়ে যায়। বগলাপতি দুনিয়া থেকে হড়কে গেলে তার স্থাবর-অস্থাবর সব যা ছিল, কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিল রাখোহরি। রিফিউজি কলোনির বাড়িতে উঠে গিয়ে বালিগঞ্জের বাড়িতে ভাড়াটে বসাল। কেবল ছুঁল না কম দামের ল্যান্ডমাস্টারটা তার আর একটা কারণ বোধহয় এই যে গৌরহরির আয় থেকে সে নিয়মিত ভাগ বসাতে পারত। এই সব যে করল রাখোহরি, তার এত যে কায়দা কৌশল, এই সব গৌরহরি বুঝতে পারত, কিন্তু বেশি বুঝতে গেলেই মাথার মধ্যে নানা জটিল চিন্তা দেখা দিত। আর তার সঙ্গে ওই নাচুনে মাগির বেহদ্দ নাচ। তাই চিন্তাভাবনা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে গৌর। কেবল মাঝে মাঝে ভাবে, আমি শালা গৌরহরি বগলাপতির ছাওয়াল, এই দুনিয়ায় আমি কি খুব ঠকে গেলুম! এই যে রুখে শুখো দুটো হাত-পা, মগজে এই যে এত ঝমঝম, এই সব নিয়ে আমি কতদুর কী করছি দুনিয়ায়? কী করার ছিল আমাব? আর কী-ই বা করেছি? তবে কি আমার সারাজীবনের একমাত্র কাজ একখানা পুরনো ল্যান্ডমাস্টারে সারা কলকাতা চষে এধারকার মানুষ ওধারে নেওয়া। এই করতে করতেই কি শালা কোনও মানুষ পারফেকশানে পৌঁছাতে পারে! অ্যাঁ? বগলুর পোলার কপালে শেষে কি এইটুকু মাত্র পারফেকশনি লেখা ছিল? বিলেত না, বিদেশ না, পয়সাকড়ি না, বউ না, না ছেলেপুলে, কেবল একটা ভুতুড়ে ল্যান্ডমাস্টার, আর দাশ কেবিনের চোতরাপাতার কাথ, আর শালা পুলুসবাবা, লাল নীল আলো, ঝুটঝামেলা, গঙ্গার ঘাট থেকে পগেয়াপট্টি, টেরিটিবাজার থেকে সাউথ সিথি, আর মাঝে মাঝে মৌতাতের সময় বয়ে গেলে ড্রিম আর রিয়্যালিটির অ্যাডমিকশ্চার!

একটা বাজে মেয়েমানুষ আছে চৌরঙ্গির। তাকে জুটিয়েছিল আর এক ট্যাক্সিওয়ালা মদনা। মদনাই ধরে দিয়েছিল তাকে মেয়েমানুষটা। সেই মেয়েমানুষটারও সোয়ারি আছে। সোয়ারি জুটলে গৌরের ট্যাক্সি ডাকায়। ডাকিয়ে চক্কর দেওয়ায় ময়দানে। একটু অন্ধকার মতো হয়ে এলে গঙ্গার ঘাটে নির্জনে কোথাও গাড়ি দাড় করাতে বলে। গৌরহরি তখন নেমে গিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়, আর দেখে দূব থেকে, তার গাড়ির পিছনের কাচে দুটো ছায়া পরস্পর লেপ্টে গেল। তারপর আর তাদের দেখা যায় না। গৌরহরি চোখ ফিরিয়ে নেয় লজ্জায়। ঘণ্টাখানেকের এইসব ব্যাপারের জন্য ত্রিশ-চল্লিশ টাকা আয় হয় তার। আর সেই সঙ্গে কখনও সেই মেয়েমানুষটার শরীর একটু-আধটু ঘেঁয়া যায়। সেটুকু ভাল লাগে না গৌরের। কেবল বরক্ত বেরিয়ে যাওয়ার পর একটা রিমঝিমে ক্লান্তি আর ঘুম আসে। জীবন থেকে সে মাত্র এইটুকু পাচ্ছে, এইটুকু পারফেকশান। তার বাপের কিনে দেওয়া ল্যান্ডমাস্টারে এইসব পাপের কাজ হয় বলে মাঝে মাঝে মরমে মরে থাকে। গৌবহরি। তার আর উন্নতি হয় না। সে যা ছিল তাই রয়ে গেছে।

রাখোহরির সংসার বিস্তর টেনেছিল গৌর। এক এক সময়ে মাসের পর মাস। কেস চলছিল। তিনটে কেস। কপাল ভালই রাখোহরির। একের পর এক কেস জিতে গেল। কী করে জিতল, কোন লিখুঁজির পথে, কে জানে! তবে জিতল ঠিকই। ফিরে গেল বালিগঞ্জের বাড়িতে। আবার গাড়ি কিনল। দাবড়ে শুরু করল বাবা বগলাপতির ব্যাবসা। রিফিউজি কলোনির বাড়িটাতেই রয়ে গেল গৌর। তার আর উন্নতি হল না। রাখোহরি বগলাপতির কথার মতোই এখন তার তালুই।

বিচিত্র গাড্ডা। এ নিয়ে যে সে ভাববে তারও উপায় নেই। কোনও সুন্দর সকালে সে রাখোহরির কাছ থেকে বাবা বগলাপতির কিছু বিষয়-সম্পত্তি ঝেকে আনবে এমনটা সে ভাবতেই পারে না। লড়াকু ছেলে রাখোহরি। বিপরীত ভাগ্যকে নিজের কোলে টেনে এনেছে আবার। মদনা গৌরকে পরামর্শ দিয়েছিল, মামলা কর।

আই বাপ! বাপের দেওয়া ল্যান্ডমাস্টারখানা আর রিফিউজি কলোনির দুখানা টিনের ঘর ছাড়া তার কিছুই নেই। মামলার খুরে খুরে তাও চলে যাবে। তার ওপর রাখোহরির মতো লড়াকু।

গাড়িটা চমকাচ্ছে। ইঞ্জিন টানছে না তেমন। গৌর বিড়বিড় করে গাল দেয়, শালা, তুই কি হিউম্যান বিয়িং যে চমকাচ্ছিস! আর একটু চল বাবা, গঙ্গার হাওয়া খাওয়াব।

গাড়ির ভিতরের অন্ধকারে পিছনের সিটে ছেলেটা আর মেয়েটা বসে আছে। পিছনের আবছা কাচে তাদের ছায়া দুটোকে দেখা যায়, লেপ্টে আছে। একটু আগেও কলকলাচ্ছিল। এখন চুপ, চুমকুড়ি কাটছে বোধহয়। আঠা দেখ শালার। কাটে কাটুক। তাতে গৌরের কী! গৌর হাত বাড়িয়ে আয়নাটা ঘুরিয়ে দেয় একটু।

রেসকোর্সের গা ঘেঁষে চমৎকার একখানা বাঁকে গাড়িখানা উড়ে যাচ্ছে। গঙ্গার বাতাস ঝাপটা মারে। নিয়োনের আলোয় তারার গুঁড়ো ঝরে পড়ছে। ওই দেখা যায় জাহাজের হলুদ মাস্তুল, জিরাফের মতো উঁচু গলার ক্রেন। আলোয় আলো বন্দর। চওড়া রাস্তায় ধুলোর কণা মেলে না প্রায়। যতবার এই ঘাটে এসেছে গৌর ততবার মনে হয়েছে, এই তো বিদেশ! এই তো শালার লন্ডন, যেখানে একদা ল্যাস্ত করেছিল তার দুই দাদা, রাখোহরি আর থাকোহরি। গৌরও করত। স্বভাবের নিয়মে সব চললে আজ তারও হয়তো মেম বউ। বেগড়বাই বাধালো মগজের ওই ঝমঝম শব্দ, আর দুটো রুখখা-শুখো হাত-পা।

ভাবতে ভাবতে শাস টানে গৌর। গঙ্গার বাতাসে তার ফুসফুস পালের মতো ফুলে ওঠে। কলকাতা পার হয়ে লন্ডনের ধার ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করায় গৌর।

ওমা! এসে গেছি! মেয়েটা চমকে গিয়ে বলে।

আড়চোখে আয়নাটা দেখে গৌর। ছায়া দুটো আবার আলগা দিয়েছে। শালা ভুখখা পার্টি। ঘরদোরে জায়গা পায় না, তাই ট্যাক্সিতে চড়ে যত আশনাই। গৌরবাবুর ল্যান্ডমাস্টারখানাকে কী পেয়েছিস তোরা? ফুলশয্যার বিহানা, না হানিমুন কটেজ?

ছেলেটা নেমে মিটার দেখল না, জিজ্ঞেস করল, কত?

গৌরও মিটার দেখল না, কেবল একটু আলস্যের সঙ্গে বলল, চার টাকা দশ পয়সা।

ছেলেটা ভ্রুক্ষেপও করল না। দিয়ে দিল। তারপর ছেলেটা আর মেয়েটা গঙ্গার ঝোড়ো বাতাসে এলোমেলো চুল হাতে সামলাতে সামলাতে আলো থেকে অন্ধকারে কোথায় চলে গেল।

গৌর নেমে মিটার ঘুরিয়ে দেয়। সত্যিকারের কত উঠেছিল তা দেখার চেষ্টাও করে না। সঙ্গে মেয়েছেলে থাকলে উঁটিয়াল ছেলেরা মিটার-ফিটার দেখার ঝামেলা করে না। গৌরেরই বা কী দায় পড়েছে! সেও আন্দাজি মারে। বগলুর পোলা গৌরা, প্রেস্টিজে সে কম যায় কীসে?

বনেটটা খুলে দেয় গৌর। খা বাবা ল্যান্ডমাস্টার, গঙ্গার হাওয়া খেয়ে নে। মিটারটা আবার লাল শালুতে ঢাকে গৌর।

তারপর বগলুর ব্যাটা গৌর গাড়ির গায়ে বসে পেচ্ছাব করে, থুতু ফেলে। তারপর নির্জন ঘাটের কংক্রিটের রেলিং ধরে এসে দাঁড়ায়। সামনেই হলুদ একখানা জাহাজ। তার সর্বত্র উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। উঁচু মাস্তুল পর্যন্ত উজ্জ্বল আলোয় ধুধু করছে। জাহাজের বিশাল খোল দেখে গৌর, দেখে তার সাদা কেবিন, আর শুনশান ডেক। কোনওখানে কোনও মানুষ নেই। এমন নির্জন আলোকিত জাহাজ কখনও দেখেনি গৌর। সে হা করে দেখে আর দেখে। জাহাজটা খুব ধীর লয়ে দোলে। কোন কোন মুলুকে চলে যাও হে জাহাজবাবা! বগলুর ছাওয়াল পড়ে আছে কোন গাড়ায়! ফিফটি পারসেন্ট বলে গৌরার সব ফুর্তিই বিলা হয়ে গেল। নইলে বাবা জাহাজ, তোমার ওই ডেকের রেলিং ধরে ঝুকে আমি সমুদ্র দেখতুম। অ্যালবাট্রসের ছায়া দেখতুম, আমার টাই ফুরফুর করে উড়ত হাওয়ায়। জাহাজবাবা, হাফ-ফিনিশ গৌরার লাইফটায় কী আছে বলো তো! ওই ভূতুড়ে ল্যান্ডমাস্টার, দুটো রুখে-শুখো হাত-পা, মগজে এক বেহদ্দ নাচুনে মাগির ঝমাঝম। কলকাতার সওয়ারি এধার ওধার করে কেটে যাচ্ছে জীবন। বাবা জাহাজ, সাত ঘাটের জল খাও তুমি। সমুদ্রের জলে তোমার ছায়া পড়ে, সেই ছায়ায় খেলা করে স্বপ্নের পৃথিবী। নোনা হাওয়ায় কোন কোন মুলুকের গন্ধ ভেসে আসে। আর গৌরা!

মার শালা ভুতুড়ে ল্যান্ডমাস্টারের মুখে তিন লাথি, নি লাথি কলকাতার সোয়ারিদের, আর তিন লাথি লাগা গৌরার কপালটায়। ফিফটি পারসেন্ট হাফ-ফিনিশ গৌরা এইসব ভাবে, আর বিভোর হয়ে দেখে হলুদ জাহাজখানা।

ল্যান্ডমাস্টারটা হাঁ করে হাওয়া খাচ্ছে, গাঁই গাঁই করে ডেক-এ বাতাস বইছে ঝড়ের মতে। গৌরার লম্বা চুল ওড়ে। বিদেশি বাতাসে ভরে ওঠে বুক। গৌরার ফিরতে ইচ্ছে করে না, জাহাজখানা দেখতে দেখতে গৌর এক অদ্ভুত ওয়্যারলেস শুনতে পায়। বাতাসের ডাকের মধ্যে অন্তর্নিহিত একটা ভাষা ভেসে আসে। জাহাজটা গৌরকে কী যেন বলে। আই। জাহাজখানা হাফ-ফিনিশ গৌরাকে ওয়্যারলেসে ডাকে, বলে, বুয়েনস এয়ারিসের মতো সুন্দর শহর বড় একটা নেই। আমি সেখান থেকে এলুম। যাচ্ছি টোকিও, ফিরব লন্ডনে, যতদিন চালু আছি ততদিনই জীবনটা সুন্দর। জল আর স্থলের জীবন দুরকম বাবা গৌর। যেমনই হোক, চালু থাকাটাই আসল কথা। জলে, স্থলে বা অন্তরীক্ষে চালু থেকে। হে বগলাপতির ব্যাটা, বগলুর ছাওয়াল। সংসারে চালু থাকাটাই সাকসেস।

অবিকল এইরকম কথা বলতেন বগলাপতিও। ইবলিশেব বাচ্চা যদি নিজের কপাল না ভাঙে তবে এই ল্যান্ডমাস্টারটার জোরেই সংসারে চালু থাকবে। বগলুব ফোর-সাইট ছিল বটে। আজও যে সংসারে চালু আছে গৌর তা ওই ল্যান্ডমাস্টারটার জোরেই। ওই যে শালা হা করে গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছে ওই ভুতুড়ে ল্যান্ডমাস্টারটার জোরেই। ওই যে শালা হাঁ করে গঙ্গার হাওয়া খাচ্ছে ওই ভুতুড়ে ল্যান্ডমাস্টার, মগন সিং-এর গ্যারাজ থেকে যেটাকে ন’ হাজারে কিনেছিলেন বগলাপতি। সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি বলে রাখোহরি ছোয়নি ওটাকে। গৌর চালু আছে ল্যান্ডমাস্টারটার জোরে, তবু কখনও-সখনও গঙ্গার ঘাটে এলে নীল সাদা হলুদ জাহাজগুলো অনেকক্ষণ দেখে গৌর। তখন তার ইচ্ছে করে ভুতুড়ে ল্যান্ডমাস্টারটাকে তিন লাথি, তিন লাথি কলকাতা আর কলকাতার সোয়ারিদের আর তিন লাথি নিজের কপালটায় মারতে।

জাহাজবাবা, আমার বাবা বগলও বলত এরকম কথা তোমার মতো। সংসারে চালু থাকাটাই আসল কথা। তবু মাঝে মাঝে জাহাজ কি উড়োজাহাজ দেখলে, কিংবা হাওড়া কি শেয়ালদা থেকে দুরের রেলগাড়ি ছাড়ার সময়ে হঠাৎ বুকে বড়শি বিধে যায়। কোন অচেনা দূর যেন আমায় কলকাতার ঘোলা জল থেকে টেনে তুলে নিয়ে যেতে চায় জাহাজবাবা। আমি তো জানি, আমি হচ্ছি গে ঢাকার টিকাটুলির বগলাপতির ব্যাটা, হাফ-ফিনিশ ফিফটি পারসেন্ট গৌরা, খুব বেশিদূর যাওয়া আমার নেই। কলকাতাই আমার লিমিট। ঘুরে ঘুরে সেই কলকাতা, ঘুরে ঘুরে ফের কলকাতা। বাবা হলদে জাহাজ, আমি যখন মুরগিহাটার সোয়ারি বাগবাজারে খালাস করি, তখন তুমি বুয়েনস এয়ারিস ছেড়ে চলেছ টোকিও, কিংবা ফিরতি পথে লন্ডনে। নীল পাহাড়ের ওপর বাতিঘরের আলো দেখো তুমি, দেখো সমুদ্রের ঝড়। ইটালির জলপাইয়ের বনের ঝড় এসে লাগে তোমার মালে। বাবা জাহাজ, বুকের বড়শিটা মাঝে মাঝে জোর টান মারে। কলকাতার ঘোলা জলে গৌর চমকায়, ঠিক যেমন ইঞ্জিন গরম হলে মাঝে মাঝে চমকায় তার ল্যান্ডমাস্টার। হাফ-ফিনিশ বলে গৌরা যে কোনও কিছুই পায়নি জাহাজবাবা!

খুব জোর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে গৌর, সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দে সে নিজেই চমকে ওঠে। আই! বগলুর দুই ব্যাটা বিস্তর জাহাজ দেখেছিল, দেখেছিল সমুদ্র, বিদেশ, দেখেছিল বিস্তর মেয়েছেলে। কিন্তু বগলুর তিন নম্বর ব্যাটা আটকে গেছে এক ভুতুড়ে ল্যান্ডমাস্টারের বগলতলায়। ছাড় নেই। তাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গৌর আবার ল্যান্ডমাস্টারের কাছে ফিরে আসতে থাকে।

মিটারের লাল শালুটা অন্যমনস্কভাবে খোলে গৌর, বনেট বন্ধ করে। ড্রাইভিং সিটে বসে চাবিটা বের করে, তারপর হঠাৎ আগাপাশতলা চমকে উঠে বুঝতে পারে, তার পিছনের সিটে কে যেন বসে আছে। আয়নায় দেখা যায় পিছনের কাচের গায়ে একটা মাথা একটু হেলে আছে। এলানো একটা শরীরের ছায়া দেখা যায়। দরজাটা ঠেলে এক লাফে বেরিয়ে আসে গৌর। শালা ডেডবডিটা!

কয়েক পা নেংচে নেংচে দৌড়ে যায় গৌরহরি। তারপর থামে। একটু দুরে দাঁড়িয়ে নিজের ল্যান্ডমাস্টারটার দিকে হা করে চেয়ে থাকে। বাস্তবিক ল্যান্ডমাস্টারটা কোনওদিনই সেন্ট পারসেন্ট গৌরহরির না। ওর ফিফটি পারসেন্ট ওই শালা ডেডবডিটার, এটা গৌর মাঝে মাঝে টের পেত। এখন ডেডবডিটার আবছা অবয়ব দেখে গৌরহরি বুঝতে পারে, শালা ভূতেরাও দাবি-দাওয়া ছাড়ে না। কবে মরে-হেজে গেছিস, তবু একটা পুরনো ল্যান্ডমাস্টারের মায়া কাটাতে পারলি না, বাবা ডেডবডি! মানুষের কত কিছু চলে যায়। আমার বাপ বগল সাতটা জাহাজড়ুবির শোক পেয়েছিল। আর আমি সেই বগলুর তিন লম্বর ব্যাটা, দ্যাখ এই হাফ-ফিনিশ আমার জীবনটা, টিকাটুলির ডাকসাইটে বগলাপতির ছাওয়াল আমি, তবু আমার কপালে কেবল অবশিষ্ট আছে ওই ল্যান্ডমাস্টারটা, যার ফিফটি পারসেন্ট ভূতের কবজায়। বাবা ডেডবডি, গৌর কি কখনও ইন্টারফিয়ার করেছে তোমাদের ব্যাপারে? তবে তুমি কেন বাবা, হাফ-ফিনিশ গৌরার ল্যান্ডমাস্টারে? ল্যান্ডমাস্টারটা ছাড়া গৌরের যে আর কিছুই নেই বাবা!

গৌর দুরে দাঁড়িয়ে তার ল্যান্ডমাস্টারটার দিকে অবাক চোখে চেয়ে থাকে, আর বিড়বিড় করে। তারপর চমকায়।

গাড়ির পিছনের জানালা দিয়ে আস্তে আস্তে একটা মাথা বেরিয়ে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে থাকে। তারপর হঠাৎ গৌরকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলে, হেই! কাম হিয়া

অমনি গৌরের মাথার ধোঁয়া কেটে যায়। গাড়ির দরজা লক করা ছিল না। মাতালের পো উঠে বসে আছে। ভারী রেগে যায় গৌরহরি। নেংচে নেংচে এগিয়ে গিয়ে দরজাটা হ্যাচকা টানে খুলে ফেলে সেন্ট অ্যান্টনিজের পাকা ইংরিজিতে বলে, এখানে কী হচ্ছে! অ্যাঁ? বেরোও, বেরিয়ে যাও!

লোকটা তবু দিব্যি গা ছেড়ে বসে থাকে, মাথাটা পিছনে হেলাননা। ডান হাতখানা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে নেড়ে গৌরের ধমক-ধামক উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে, টেক মি টু স্যু।

স ফু আমি জানি না। তুমি বেরিয়ে এসো।

মাতাল লোকটা তবু হাত নেড়ে বলে—দেন টেক মি টু এ গুড উম্যান মেট।

বগলাপতির ছাওয়াল কি মেয়েছেলের দালাল? ইজ হি?–চোস্ত ইংরিজিতে গৌর বলে, মাতাল আর মেয়েছেলেদের আমি ঘেন্না করি। তুমি কেটে পড়ো।

গৌরের ইংরিজি শুনেই বোধহয় লোকটা একটু থমকে যায়। ইতস্তত করতে থাকে। গৌর লক্ষ করে, লোকটা বেঁটে-খাটো, বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মতো বয়স। জুলপিতে পাক ধরে একগোছা চুল সাদা হয়ে আছে। গায়ের রং রোদে জলে খেয়ে গেছে বলে বোঝা যায় না কোন দিশি। তবে জাহাজি বলেই মনে হয়। বাতাস যদিও ওড়াচ্ছে সবকিছু, তবু গৌর একঝলক মদের গন্ধ পায়। মাতালদের গাড়িতে তোলে না গৌর। শালাদের কখনও কোনও স্থির ডেস্টিনেশন থাকে না। তার ওপর মাঝে মাঝেই শরীরের কাথ হড়হড় করে ঢেলে দেয় গাড়িতে। বোয়ামোছা করতে গৌরের দম বেরোয়।

নামবে কি না বাপু, না কি পুলিশ ডাকব? গৌর ইংরিজিতে বলে।

গৌরের সেন্ট অ্যান্টনিজের নির্ভুল ইংরিজি শুনে লোকটা সত্যি ভড়কে যায়। নামবে কি না ইতস্তত করে, ঠোঁট চাটে, চুলে হাত বোলায়, উদভ্রান্ত চোখে চারদিকে চায়।

উত্তেজনার মধ্যেও লোকটার হাবভাব দেখে গৌর তৃপ্তি পায়। আই জাহাজির পো, শুনে লে ইংরিজি কাকে বলে! বগলাপতির এক ব্যাটা বিলেতে রয়ে গেছে, আর এক ব্যাটা বিলেত ফেরত, তিন নম্বর যদিও হাফ-ফিনিশ তবু ইংরিজি শিখেছিল ফাদার ফ্রান্সিসের কাছে। শুনে লে বাবা জাহাজি।

লোকটা অসহায়ের মতো বিড়বিড় করে বলে, আমাকে সুর কাছে যেতেই হবে। আমাকে পোঁছে দাও। দয়া করো।

বলতে বলতে লোকটা একটু কাত হয়ে হিপ পকেট থেকে একগোছা দশ টাকার নোট বের করে গৌরকে দেখায়, বলে, আমার টাকা আছে, চিন্তা নেই। একটু আগে আমি একটা ঘড়ি বিক্রি করেছি, আর একটা স্পাই ক্যামেরা। এই দেখো কত টাকা।

টাকা দেখাচ্ছে। টিকাটুলির বগলাপতির ব্যাটা গৌরহরি, যে কিনা ডজ গাড়িটার আয়না দিয়ে বিস্তর রাজার মাথা আর তিন সিংহের মূর্তির ছবি দেখেছে, তাকে কি দেখাচ্ছে ফুটো পকেটের জাহাজি! ভারী রেগে যায় সে। ভাল হাতখানা বাড়িয়ে সে জাহাজিটার হাত ধরে টান মারে, চেঁচিয়ে বলে, নামমা, নামো, টাকা আমি বিস্তর দেখেছি।

গৌর টানে। লোকটা কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে ভিতরে সেঁধোতে থাকে। পা দু’খানা সিটের ওপর তুলে গোঁজ হয়ে পুঁটলি পাকিয়ে বসে, বলে, দয়া কবো!

অসুবিধে এই যে গৌরের একটা হাত আর একটা পা কমজোরি। আর লোকটা সেন্ট পারসেন্ট হাত-পাওলা, গৌর সুবিধে করতে পারে না। যত টানে, তত লোকটা সিট আঁকড়ে শুয়ে পড়তে থাকে। গৌর রেগে বাংলায় বলে, ফোট শালা বেজন্মা। আজ তোরই একদিন কি আমারই!

শুনে, শুয়ে থেকেই জাহাজিটা বড় বড় চোখ করে চায়। বলে, আরে বাঃ, তুমি বাঙালি দেখছি!

লোকটাকে গৌর সাহেব ভেবেছিল অনেকক্ষণ ধরে। এখন তার মুখে পরিষ্কার বাংলা শুনে চমকাল খুব। হা করে একটু চেয়ে থেকে বলল, তুমি সাহেব নও?

লোকটা সিট আঁকড়ে আধাশোয়া অবস্থাতেই বলে, আরে দূর! আমি তোমাকেই সাহেব ভেবেছিলাম। যা ইংরিজি বলছিলে! মাইরি, শিখলে কোথেকে অমন ইংরিজি?

গৌর একটু দম নিয়ে বলে, সেন্ট অ্যান্টনিজ, ঢাকা। তুমি কোথেকে শিখেছ?

লোকটা যেন সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে, এমনভাবে সহজ ভঙ্গিতে উঠে বসে, হাত-টাত ঝেড়ে বলে, আমি শিখেছি জাহাজে, সাত ঘাটের জল খেয়ে।

গঙ্গার বাতাসে গৌরের রাগ উড়ে গেল। বাঙালির মুখে ভাল ইংরিজি শুনলে গৌরের এরকম হয়। তবু সে বলে, আমার গাড়িটা মাতালদের জায়গা না।

লোকটা ভয়ে ভয়ে মিটমিট করে তাকায়, বলে, আমি শুধু একটু বিয়ার খেয়েছি। মুখ শুকে দেখো। হাই!

লোকটা হাঁ করে এগিয়ে আসে। গৌর পিছোয়। পিছিয়ে নিরাপদ দুরত্বে সঁড়িয়ে বলে, তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। গাড়ি খুলে আমি দেখি একটা ভূত বসে আছে।

লোকটা হাসে। একটা সোনালি দাত চিকমিক করে। পরমুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে বলে, আজ বিকেল থেকেই আমার মনটা খুব খারাপ, বুঝলে! খুব খারাপ।

মাতালদের দুঃখের কথা সহজে শেষ হয় না। গৌর জানে। তাই সে একটা শ্বাস ছেড়ে বলে, বুঝেছি। এখন গাড়িটা ছাড়ো, আমার কাজ আছে।

লোকটা আতঙ্কিতভাবে দরজার হাতলটা আঁকড়ে ধরে ভয়ের চোখে গৌরের দিকে চায়।

তাকে ভয় পায় এমন লোক বড় একটা দেখেনি গৌর। বরং সারাটা দিন গৌরই বিস্তর লোককে ভয় পায়। কখন কোন পুলুসবাবা ধরে, কোন সোয়ারি কোন গাড়ায় নিয়ে ফেলে, কখন ল্যান্ডমাস্টারের ভূতটা শব্দ করে ওঠে। সারা দিনটা ভয়ে ভয়েই কাটে গৌরের, তাই এখন একজন তাকে ভয় পাচ্ছে দেখে গৌরের একটু মায়া হয়। সে নরম গলায় বলে, তোমার মতলবখানা কী?

লোকটা মিনতি করে, আমাকে নামিয়ে দিয়ো না। সুর কাছে পৌঁছে দাও। আমি বড় দুঃখী লোক, বুঝলে, সারা সন্ধে একটাও ট্যাক্সি আমাকে নেয়নি।

বলতে বলতে লোকটা হেঁচকি তোলে। কাত হয়ে হিপ পকেট থেকে এক প্যাকেট রথম্যান সিগারেট বের করে গৌরের দিকে বাড়িয়ে দেয়, এই নাও সিগারেট।

গৌর মাথা নাড়ে, না।

লোকটা মিনতি করে, নাও মেট। খুব ভাল সিগারেট। পুরো প্যাকেটটাই তুমি নিয়ে নাও।

গৌরা মাথা নাড়ে, না।

লোকটা করুণ চোখে চেয়ে বলে, আমার জাহাজের জাহাজিরা সব যে যার মেয়েমানুষের কাছে চলে গেছে, ফুর্তি লুটছে সবাই। আর আমি শেষ জাহাজিটা সারা সন্ধেবেলা চেষ্টা করছি, কোথাও যেতে পারছি না। মাইরি!

জাহাজিটা ওয়ার্নিং না দিয়ে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। টপটপ করে চোখের জল পড়তে থাকে।

গঙ্গার এই হুড় বাতাসটাই খারাপ। গৌরের মনটাকে দুবলা বানিয়ে দিয়েছে। সে যথেষ্ট বদমেজাজি হওয়ার চেষ্টা করেও পারছে না। তার ওপর লোকটা কাঁদতে শুরু করতেই সে কেমন কেবলে যায়। মায়েদের মতো ষাট ষাট’ করতে ইচ্ছে করে।

তা না করে গৌর লোকটার সিগারেট নেয়।

বলে, স্যু কে?

লোকটা নীরবে খানিকটা চোখের জল মোক্ষণ করে রুমালে চোখ মোছে। একটু চুপ করে থেকে আবার দাত দেখায়। সোনালি সঁাতটা চিকমিক করে। সযত্নে সে একটা দামি গ্যাসলাইটার বের করে গঙ্গার বাতাস থেকে নিপুণ হাতের তেলোয় আড়াল করে আগুন জ্বালে। গৌরের সিগারেট ধরিয়ে দেয়, নিজে ধরায়। অন্ধকারে ভিতরে সরে গিয়ে গৌরের জন্য জায়গা করে দিয়ে বলে, বোসো।

বনেটটা আবার খুলে দেয় গৌর। গঙ্গার হাওয়া খেয়ে লে বাবা ল্যান্ডু। লাল শালুতে আবার মিটারখানা ঢাকা দেয় সে। এসে পিছনের সিটে বসে দরজাটা খোলা রেখে, গঙ্গার হুড় বাতাস বিদেশের গন্ধ উড়িয়ে আনে। তছনছ করে দিয়ে যায় মানুষের মন।

লোকটা নরম গলায় বলে, দেশের মাটিতে যখন জাহাজ ভেড়ে তখন জাহাজিরা নামে লাফ দিয়ে, তারপর দৌড় লাগায়। আত্মীয়স্বজনকে আঁকড়ে ধরে, হাগিং কিসিং, কত আদর ভালবাসার কথা হয় না? বুঝলে, ওরকম হত, কলকাতায় জাহাজ ভিড়লে। বাচ্চাবেলায় পালিয়ে গিয়ে জাহাজে চাকরি নিই। মা কান্নাকাটি করত, বাপ দুশ্চিন্তা করত, আমারও জাহাজে সময় কাটত না। কলকাতা-মুখো জাহাজ মুখ ফেরালে দুনিয়ার রং পালটে যেত। মা বাপ ছোট্ট ভাইটার জন্য। আনতাম রাজ্যের জিনিস, কত আদব হত আমার, কলকাতায় কয়েকটা দিন উড়ে যেত ফুয়ে। তারপর বুড়ো হয়ে বাপ মরল, মা মরল। দু’বার দুনিয়া চক্কর দিয়ে এসে দুটো সংবাদ পেয়ে মন ভেঙে গেল খুব। কলকাতার ওপর টান কমতে থাকল। ছোট ভাইটা ছিল, তার কাছে আসতাম। কিন্তু সে ব্যাটা বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে হল প্রফেসর, আর আমি লেখাপড়া শিখিনি, জাহাজের খালাসি। আমাকে ব্যাটা ভাল চোখে দেখত না। তাছাড়া বাপের কয়েক কাঠা জমি-বাড়ি সে ভোগদখল করছে। আমি এলে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখত। তার বউ বাচ্চা পর্যন্ত আমাকে পছন্দ করে না। এটা বুঝবার পরই হঠাৎ একদিন কলকাতার ওপর আমার টানটা ঝড়াৎ করে ছিড়ে গেল, জাহাজের টানে যেমন জেটির মোটা কাছি ছিড়ে যায়। তখন কলকাতা-মুখো জাহাজ চললেও মনে হত বিদেশেই যাচ্ছি, যেমন লন্ডন বা টোকিওয় যাই। তা এই রকম যখন অবস্থা তখন একদিন চলন্ত জাহাজের ডেক-এ দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগলাম, আরে, আমার যে কোনও পিছুটান নেই! আমি যে কেবল যাই, কোথাও ফিরি না! অন্য জাহাজিরা দুনিয়ার সর্বত্র যায়, আবার দেশে ফেরে। আমার দেশ নেই বলে যে ফেরাও নেই! ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেল, বুঝলে! ছেলেবেলা থেকেই আমার ভাবনা-চিন্তার অভ্যাস নেই। বেশি চিন্তা করলে আমার মাথায় ঋইঝাই শব্দ হত, ওই শব্দের জন্যই আমার পড়াশুনো হয়নি।

গৌর চমকে জিজ্ঞেস করে, কেমন শব্দ বললে?

ঝাঁইঝাঁই। অনেকটা বড় কত্তালের মতো।

 গৌর শ্বাস ছাড়ে। বলে, আমার হত ঝমঝম। অনেকটা নূপুরের মতো।

আই।– লোকটা বলে, তা চিন্তা-ভাবনা করতে করতে যখন মাথা ঝাইফাই করতে শুরু করল তখন আর এক জাহাজি পরামর্শ দিল, বিয়ে করো। ঘরসংসার হলে তোমার ফেরার জায়গা হবে। তা আমি বিয়ে করলাম, সানফ্রান্সিসকোতে। আমার বউ বেশ সুন্দরীই ছিল, খুব আদুরে। তার আর আমার টাকা-পয়সা যোগ করে আমরা তিন-চার মাসের লম্বা হানিমুন কাটালাম আমেরিকার নানা। জায়গায়। সে কী ফুর্তি! কিন্তু সুখের দিন যায়। সেবার হানিমুনের শেষে অস্ট্রেলিয়া হয়ে জাপান যেতে হল, লম্বা টুর। ফিরতে ফিরতে বছর গেল ঘুরে। শেষে ক’মাস বউয়ের চিঠি পাইনি। জাহাজ আমেরিকা-মুখখা হতেই আমার মন আনন্দে হাততালি দিল, এতদিন বাদে আমি ফিরছি। আমার ফেরা আছে। জাহাজ ডাঙার দিকে এগোয় আর আমি উৎকণ্ঠায় সাত-আট ফুট লম্বা হয়ে তীর দেখার চেষ্টা করি। অবশেষে পৌঁছে দেখলাম, বউ জাহাজঘাটায় আসেনি। খানিক দূরে এক ছোট্ট টিলার নীচে আমাদের বাসা ছিল, সেখানে গিয়ে দেখি, বাসায় অন্য লোক। বাড়িওলা বুড়ো অনেক কষ্টে চিনতে পেরে বলল, খুবই দুঃখের কথা, সে মেয়েটি তো আবার বিয়ে করে নিউইয়র্ক চলে গেছে। বুঝলাম, বউ ভেগেছে। সেই দুঃখে জমি নিলাম। কিন্তু ভেবে দেখলে তার দোষ দেওয়া যায়না । মেমসাহেবরা বেশিদিন একা একা থাকতে পারে না। আমি আবার ভেসে পড়লাম, একা একা ফাঁকা ডেক-এ দাঁড়িয়ে থাকি, বিয়ার খাই, দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমার কেবল যাওয়া আছে, ফেরা নেই। বয়স বাড়ল। বুড়ো হয়ে যাওয়ার ভয় ঢুকল মনে। সেবার অস্ট্রেলিয়ায় জাহাজ ভিড়লে আবার গাড়ায় পড়লাম। আর একটি মেয়ে। আমাকে দুঃখী দেখে ভালবেসে ফেলল। বুঝলে, মেমসাহেবরা চট করে ভালবেসে ফেলে। আমার বয়স বাড়ছে, মনে হাঁকুপাঁকু। তাই প্রথম বিয়ের কথা গোপন করে বিয়ে করে ফেললাম আবার। আমার এ বউ গরিব অরফ্যান। ভাবলাম, গরিবের মেয়ে হয়তো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে। যথাসাধ্য টাকা-পয়সা খরচ করলাম তার জন্য, একটা বাসা করে দিলাম বন্দরের কাছাকাছি। মাস দুই হানিমুনে কাটালাম। তা আমার এ বউ টিকল। কয়েকবার টুর সেরে তার কাছে ফিরেছি। ফিরে যত্ন আদর পেয়েছি, দেশে ফেরার আনন্দ পেয়েছি। আস্তে আস্তে মন বসে যাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ায়। ভাবলাম, জাহাজের চাকরি ছেড়ে ওখানেই জমিজিরেত কিনে বসবাস করব। পোলট্রি, ফার্মিং করব। তা সেবার লম্বা টুরে বেরোনোর সময়ে মনে মনে ঠিক করলাম, এটাই শেষ টুর, আর জাহাজে না। হলদে জাহাজটায় বসবাস করতে করতে আমার মনে ন্যাবা ধরে যাচ্ছে। তা সেবার টুরে বছর দেড়েক লেগে গেল। বউ মাঝে মধ্যে অভাব দুঃখের কথা জানিয়ে টাকা-পয়সার জন্য লিখত। আমি গা করতাম না। মেয়েছেলেদের অভাব কে কবে মেটাতে পেরেছে বলো! দেড়-দু’বছর বাদে ফিরে বাসায় ঢুকতেই মনে হল, এ বাসাটা যেন কেমন কেমন। ঠিক আগেকার মতো ঘর-গেরস্থালির গন্ধ যেন পাচ্ছি না! বউ কেমন চোর-চোখে চাইছে, হঠাৎ হঠাৎ কথার মধ্যে ঝাঝ দিচ্ছে! বিছানায় শুয়ে কেমন যেন অন্য পুরুষের গায়ের গন্ধ পেলাম। তারপর পাড়ায় ঘুরে এ-মুখ সে-মুখ থেকে যা খবর পেলাম তাতে আমি তাজ্জব। আমার বউটা ভাড়াটে মেয়েমানুষ হয়ে গেছে। জাহাজিদের এন্টারটেন করে। ভীষণ রেগে যখন বউয়ের ওপর চোটপাট করে কৈফিয়ত চাইলাম সে উল্টে ঝাড়ল আমাকে, তা কত টাকা-পয়সা আর সোদানা দিয়ে গেছ আমাকে? আমার পেট চলে কী করে? খুব ঝগড়া হল দু’জনে, একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা। তারপর আমি বুঝতে পারলাম, ঝগড়া করে লাভ নেই! মেয়েমানুষটা সত্যিই বেশ্যা হয়ে গেছে। কোনও কোনও মেয়েমানুষের মধ্যে নষ্টামির বীজ থাকে। বুঝলে! তারপরও তার কাছে তিন-চারদিন ছিলাম আমি। সেও রাগ-টাগ ঝেড়ে ফেলে আমাকে খুব খাতির যত্ন করল, অন্য কোনও পুরুষ সে ক’দিন ঘেঁষতে দিল না। কিন্তু আমি আর তাকে ঘরে তোলার চেষ্টা করলাম না। বাঁধা মেয়েমানুষের সঙ্গে যে রকম ব্যবহার করে লোকে, সে রকমই ট্রিট করলাম তাকে। সে আপত্তি করল না। তারপর তাকে চিরদিনের মতো ছেড়ে দিয়ে ভেসে পড়লাম আবার। কিন্তু মুশকিল হল, দুই বউয়ের জন্য দু’রকম দুঃখ মাঝে মাঝে বুকের দু’ধারে খামচে ধরে, মাথায় ঝইঝাই শব্দ হতে থাকে। আর কেবলই মনে হয়, আমিই একমাত্র জাহাজি, যার ফেরা নেই, কেবলমাত্র যাওয়া আছে। জাহাজ ভো দিলে আমার বুড়ো হয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে, মরে যাওয়ার কথা মনে হয়। অবসর সময়ে মদ খেয়ে ঝুম হয়ে থাকি, আর তখন জাহাজের আনাচে-কানাচে ভূত দেখি। এরকম যখন মনের অবস্থা তখন একদিন কলকাতায় জাহাজ ভিড়ল। আমি পাগলের মতো মা বলে ডাক দিয়ে জাহাজ থেকে লাফ দিয়ে নামলাম, দৌড় দিলাম গ্যাংওয়ে ধরে। ডাঙায় পা দিয়েই খেয়াল হল, মা ততা নেই। অমনি আড়ষ্ট হয়ে গেল শরীর। কার কাছে যাব? আবার ধীরে ধীরে গ্যাংওয়ে ধরে ফিরলাম জাহাজে। শুন্য জাহাজ, সব জাহাজি গেছে ফুর্তি লুটতে। আমি একা একা ভুতুড়ে জাহাজটার আনাচে কানাচে গিয়ে দাঁড়াই আর কাদি। কাঁদ মরা মা বাপের জন্য, দুই বউ আর না-হওয়া বাচ্চাকাচ্চার জন্য, কাদি দেশের জন্য, কলকাতার জন্য। এইরকম অবস্থায় কয়েকদিন পর আর এক অভিজ্ঞ জাহাজি আমাকে ধরে নিয়ে গেল ওয়েসিস বার-এ। সুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। মেয়েটা বাংলা বলত, ইংরিজিও বলত। শাড়ি পরত, চেহারাটা ছিল সাদামাটা বাঙালি মেয়ের মতো। ভারী ভাল লেগে গেল তাকে, চোখ জুড়িয়ে গেল। বার থেকে সে আমাকে নিয়ে গেল তার ঘরে। ঘরে যিশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ মূর্তি ছিল, কালীর পটও ছিল। বিছানা পরিষ্কার, মাটির কুঁজোয় জল, হাতপাখা, সবই ছিল তার। ভারী আমুদে মেয়ে, বলল, তুমি এখানেই থাকো। থাকলাম। এক রাত্রে খুব জ্যোৎস্না ফুটল আকাশে। রাত তখন অনেক। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় আমাকে স্যু বের করে আনল। ট্যাক্সি করে এসে নামলাম ভিক্টোরিয়ার ধার ঘেঁষে। চারিদিক শুনশান, নির্জন। চুপি চুপি দেয়াল পার হয়ে বাগানে ঢুকলাম দুজনে। ঢুকেই দেখি পৃথিবী ছেড়ে আমরা এক গভীর মায়ার রাজ্যে চলে এসেছি। চারিদিকে মায়াবী ফুল, শিশিরের জল, জ্যোৎস্নার মোম, নরম জলের শব্দ, মাটির সুগন্ধও রকম সুন্দর দৃশ্য জীবনে দেখিনি। সামান্য মদ ছিল দু’জনেরই পেটে, ঝুমঝুম মাতাল ছিলাম দুজনেই। আমরা আনন্দে ঘাসে গড়াগড়ি দিতে লাগলাম। হঠাৎ স্যু লাফিয়ে উঠে বলল, দেখো দেখো, কীরকম বৃষ্টির মতো জ্যোৎস্না পড়ছে! আঁজলা ভরে তুলে নাও। বলে দু’হাত ভরে জ্যোৎস্না খেতে লাগল। মাঝে মাঝে আমার দিকে মুখ তুলে বলে, ইস দেখো, কীরকম হাত উপচে গড়িয়ে পড়ছে, আঁঠার মতো ঘন…কী মিষ্টি..কী স্বাদ…! দেখতে দেখতে আমি ঠিক তার মতো আঁজলা পেতে দিলাম শূন্য আকাশের তলায়। কী আশ্চর্য, অমনি টলটলে ঘন জ্যোৎস্নায় ভরে গেল আঁজলা, উপচে গড়িয়ে পড়তে লাগল। চুমুক দিয়ে দেখি, কী স্বাদ! কী গন্ধ! যত খাই, পিপাসা বেড়ে যায়, ক্ষুধা বাড়ে, শরীর তেজি ঘোড়ার মতো ফুঁসে ফুসে ওঠে। সেই জ্যোৎস্না দেখি, গড়িয়ে যাচ্ছে ঘাসের ওপর, মিশছে জলে, গাছ বেয়ে পড়ছে টুপটাপ। আমরা আঁজলা ভরে খেলাম, ঘাস থেকে চেটে নিলাম, জলে মুখ ড়ুবিয়ে খেলাম। জ্যোৎস্নায় স্নান করলাম দুজনে। যতক্ষণ জ্যোৎস্না ছিল ততক্ষণ এক মুহূর্ত আমরা জ্যোৎস্না খাওয়া ছাড়িনি। সে এক অতি আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। তিন-চারদিন ছিলাম সুর কাছে। সারা দিনটা রাত্রির অপেক্ষায় কাটত। সন্ধেবেলা দু’জনে হালকা মদ খেয়ে নেশা করে নিতাম। চোখে চোখে আমাদের গোপন বোঝাপড়া হত। রাত গভীর হলেই বেরোতাম জ্যোৎস্নায়। পার হতাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের নিচু দেওয়াল। শুরু হত জ্যোৎস্না খাওয়া। আহা!

জাহাজিটা চুপ করে অতীতের কথা ভাবে একটু। লম্বা রথম্যান সিগারেট গৌরের আঙুলে ছাকা দিচ্ছে ছোট হয়ে। জাহাজিটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উদভ্রান্তের মতো গৌরের দিকে চায়, বলে, এসব আড়াই-তিন বছর আগেকার কথা, সেই শেষবার কলকাতায় এসেছিলাম। তারপর কত জায়গায় গেছি, কতবার জ্যোৎস্না রাতে মাতাল হয়ে জ্যোৎস্না খাওয়ার চেষ্টা করেছি কত মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু খেতে গিয়ে দেখেছি আঁজলায় কিছু নেই। ফাঁকা। বুঝেছি, স্যু ছাড়া আর কেউ পারে না জ্যোৎস্না খাওয়াতে। সারা পৃথিবীতে একমাত্র স্যু পারে। খুব ভাগ্যবান কেউ কেউ স্যুর দেখা পায় তারা জ্যোৎস্নার স্বাদ জেনে যায়। আর কেউ জানে না।

জাহাজিটা রথম্যানের প্যাকেটটা গৌরের ডান হাতে গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করে। বলে, বার ওয়েসিস, স্যু, তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও।

গৌর একটু সময় নেয়। ব্যাপারটা তার এখনও হজম হয়নি।

জাহাজিটা মিনতি করে, দশটার পর স্যু থাকবে না, বার বন্ধ হয়ে যাবে, মেট। মেয়েমানুষের সঙ্গে পুরুষের যে ব্যাপার স্য-র সঙ্গে আমার তা নয়। আমি আর-একবার সেই জ্যোৎস্না খাব। তেষ্টায় বুক জ্বলে যাচ্ছে। গত তিন বছর ধরে আমি কলকাতায় আসার অপেক্ষায় ছিলাম। আজই জাহাজ ভিড়েছে। দুপুর গড়িয়ে নামার পারমিশান পেয়েছি। অন্য জাহাজিরা পাছে সু-র কথা জেনে যায় সেই ভয়ে আমি নেমেছি সবার পরে। এমনই কপাল, সব জাহাজি গাড়ি পেল, বাদে আমি। দু’ঘণ্টা ধরে একটা ট্যাক্সি থামানোর চেষ্টা করেছি, একটাও থামেনি। সবশেষে তোমার ফাঁকা ট্যাক্সিটা দেখে উঠে বসে আছি, আমাকে ফেলে যেয়ো না, সেই জ্যোৎস্না স্যু ছাড়া আর কেউ খাওয়াতে পারে না মেট। সে পৃথিবীর জিনিস না। সেই মায়াবী বাগান, জ্যোৎস্না, সেইসব ফুল, স্বপ্নের মতো মনে পড়ে। কী নেশা তার। বয়স কমে যায়। চোখের জ্যোতি বাড়ে। শরীর ফুসে ওঠে। আর-একবার সেই জ্যোৎস্না খেতে পারলে আমি আর কোথাও যাব না। মেট, তাড়াতাড়ি করো, স্যকে যদি অন্য কেউ নিয়ে নেয়!

ঠিক হয় তবে। গৌর বিড়বিড় করে তার মিটারের ঢাকা খোলে, বন্ধ করে গেট। বিড়বিড় করে বলে, দুনিয়ার যত মাতাল আর পাগল গৌরার গাড়ির জন্য রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। চল বাবা ল্যান্ডু, জাহাজিটাকে খালাস দিই।

গৌড় গাড়ি ছাড়ে। পিছনের সিটে ঝিম মেরে থাকে জাহাজিটা। আয় বাবা ধরমতলা, বার ওয়েসিস, জাহাজিটাকে ডেলিভারি দিই। গৌর বিড়বিড় করে। জ্যোৎস্না খাবে, মাইরি, জ্যোৎস্না খাবে! আই! গৌরের ব্যাপারটা হজম হয় না। সে আয়নায় দেখে, জাহাজীটা গম্ভীর স্থিরভাবে ঝুম মেরে আছে। আলোকিত এসপ্ল্যানেড গৌরের দিকে ছুটে আসতে থাকে।

বার ওয়েসিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করায় গৌর। জ্যোৎস্না খাবে! মাইরি! গৌরের ধন্দ লেগে আছে এখনও। জাহাজিটা দরজা খোলার জন্য খুটখাট করে, পারে না। গৌর হাত বাড়িয়ে খুলে দেয়। জাহাজিটা নামে। একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, কিপ ইট মেট। বলে হাত তুলে বিদায় জানায়। একটু টলমলে পায়ে উজ্জ্বল শুঁড়িখানার দিকে চলে যেতে থাকে।

গৌর চেঁচিয়ে ডাকে, এই, চেঞ্জটা নিয়ে যাও।

 জাহাজিটা শুনতেই পায় না।

 ভারী অপমান লাগে গৌরের বখশিশ-টখশিশ সে কখনও নেয় না, দরকার মতো মিটারের বেশি পয়সা নেয় নিজের ইচ্ছেমতো। টিকাটুলির বগলাপতির ব্যাটাকে কে দয়া করবে? কোন মালদার? বাপ বগলু তাকে স্বাধীন করে দিয়ে যাওয়ার পর থেকে সে কার দয়া ভিক্ষা করেছে?

গৌর মিটার দেখল। দেড় টাকা। ফেরত-পয়সা গুনে গেঁথে হাতে নিল সে। ফুটো পয়সার জাহাজিটার দয়া গৌর রিটার্ন দেবে।

সাবধানে গাড়িটা লক করে গৌর নামে। লাল কাপড়ে মিটার ঢাকে, তাবপর ধীরেসুস্থে ফুটপাথ পার হয়ে কাচের দরজা ঠেলে শুঁড়িখানাটায় ঢুকে পড়ে।

ভিতরে, শুঁড়িখানায় যেমন হয়, তেমনি নরম আলো-টালে, চেয়ার-টেবিল, কয়েকজন গম্ভীর মাতাল। লম্বা কাউন্টারের ওপাশে কাচের ঝিলিক, নানা রঙের বোতল চিকমিক করে। সেই কাউন্টারে কনুইয়ের ভর রেখে তিন-চারজন মেয়েছেলে।

গৌর দরজার কাছে তার শুখো পায়ের ওপর তেরছা হয়ে দাঁড়ায়। চারদিক দেখে। জাহাজিটাকে নিম-আলোয় ঠিক ঠাহর করতে পারে না। আরও দু’-এক পা এগোয় গৌর। দু’-একজন মুখ তুলে তার নেংচে-হাটা দেখে, একটা মেয়ে নিঃশব্দে হাসে, একজন বেয়ারা মাঝপথে থেমে তাকায়।

গৌর দেখতে পায় ছায়ার মতো জাহাজিটা সারা শুঁড়িখানা চক্কর দিয়ে দরজার দিকে আসছে।

গৌর হাত তুলে ডাকে, এই।

জাহাজিটা তার দিকে তাকায়, বিড়বিড় করে। এগিয়ে এসে গৌরের দুধ দু’হাতে ধরে ঝাকানি দিয়ে বলে, নেই। এখানে নেই। আচ্ছা দাঁড়াও।

বলে গৌরের হাত ধরে টানতে টানতে কাউন্টারের দিকে এগোতে থাকে।

কী হচ্ছে! ছেড়ে দাও।

জাহাজিটা কেবল চাপা গলায় বলে, কম অন। কে এইখানে না পেলে অন্য জায়গায় খুঁজতে হবে। কম অন।

কাউন্টারের স্যুট-পরা লোকটা মুখ তোলে। জাহাজিটা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে চোস্ত জাহাজি ইংরিজিতে বলে, স্য, শ্যামলা পাতলা চেহারা, মিষ্টি মুখ, চোখের পাতা ভারী ভারী, খুব ফুর্তিবাজ, তিন বছর আগে এইখানে তাকে দেখেছিলাম, খোজ দিতে পারো?

লোকটা চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ে, না। ও নামে কাউকে চিনি না। তিন বছর লম্বা সময়, কত কী হয়ে যায়!

বলে লোকটা হাসে।

কাউন্টারে দাঁড়ানো মেয়েদের সবচেয়ে কাছের জন জাহাজিটার পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। সে মুখ ঘুরিয়ে চাপা গলায় বাংলায় বলল, আমরা সবাই স্যু, কেউ কু নই গো!

বলে হেসে অন্য একটি মেয়ের কাধে শরীর ছেড়ে দিল।

জাহাজিটা গম্ভীর মুখ ফিরিয়ে তাকে দ্যাখে, তারপর হতাশ গলায় বলে, না, তোমরা নও। স্যু অনেক জাদু জানত। সে আমাকে জ্যোৎস্না খাইয়েছিল।

শোন লতিকা!– বলে সেই মেয়েটি আবার আগের মেয়েটির কাধে হেসে গড়াল। দু’জনেই হাসতে থাকে। গৌরের কান মাথা ঝা ঝাঁ করে। বগলুর পোলা গৌরা এ কোন গাড়ায় এসে পড়েছে! জাহাজিটা ধরে আছে তার শুখো বাঁ-হাতখানা। কমজোরি হাতটা তার, ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নেওয়ার উপায় নেই, চেঁচামেচিও করা যাচ্ছে না।

জাহাজিটা ঠোঁট চেটে বলে, বড় তেষ্টা। চলো একটু বিয়ার খাই।

গৌর মাথা নাড়ে, আমি না। চেঞ্জটা ফেরত নিয়ে আমাকে ছেড়ে দাও।

সেসব কথায় কানই দেয় না জাহাজি। বলে, তেমন কিছু না। একটু বিয়ার, এসো।

তার শুখো হাতখানা ধরে টেনে নেয় জাহাজি, এক টেবিলে পাশাপাশি বসে হাতখানা ধরে রাখে। ফিসফিস করে বলে, তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না মেট। কলকাতায় এক স্যু ছাড়া তোমাকেই আমি চিনি। তুমি ভাল লোক।

দুটো বাহারি কাচের জগ-এ বিয়ার আসে। আসে সেঁকা পাপর, শসা আর পেঁয়াজের চাক। গৌর কিছু বুঝবার আগেই এসব ঘটে যায়। তখনও তার ডানহাতের মুঠোয় ফেরত পয়সা, বাঁ-হাতখানা

জাহাজির কবজায়। ধন্দ ভাবটা গৌরের এখনও কাটেনি। মাথাটা ঝিমঝিম করে। সে একটু ভাববার। চেষ্টা করে, এসব কী হচ্ছে! চোখ বন্ধ করে পুরো ব্যাপারটা ভাববার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল গৌর, অমনি তার মাথার মধ্যে একখানা মল-পরা পা ঝম করে তাকে সতর্ক করে দিল। অমনি চোখ খোলে গৌর। মাথা নেড়ে ভাবনা-চিন্তা তাড়াবার চেষ্টা করে।

মদ সে কখনও খায়নি, এমন নয়। খেয়েছে শখে শখে, নেশা করেনি। কিন্তু নেশা করলেই বা কী? এ দুনিয়ায় গৌরের আর ক্ষতির ভয় কী? যদি সে নিজে টিকে থাকে, আর থাকে তার ল্যান্ডমাস্টারখানা, তো এই জীবনটা পিছলে বেরিয়ে যাবে গৌর।

বুক জুড়ে তেষ্টা ছিল। হাতটা ছাড়ানো গেল না। মাথার মধ্যে মল-পরা পা আর-একবার ঝম করার জন্য ধীরে ধীরে উঠছে, টের পেল গৌর। এখনই নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া দরকার। সে ঠান্ডা জগটা ঠোঁটে তোলে। তারপর আকণ্ঠ ড়ুব দেয় একটা। জাহাজিটা এক চুমুকে সবটা টেনে নেয়। তারপর মুখ তুলে বলে, বড্ড তেষ্টা। বেয়ারা!

বেয়ারা বিনীতভাবে টেবিলে ছায়া ফেলে দাঁড়ায়।

আরও।

বেয়ারা জগ ভরে দিয়ে যায়।

মেয়েছেলেগুলো ঘুরঘুর করে চারপাশে। একটুক্ষণ। তারপরই ঝুপ করে মুখখামুখি চেয়ারে বসে পড়ে দু’জন। কাউন্টারে দাঁড়ানো সেই দুজনই।

একটু খাওয়াও না গো! বড্ড তেষ্টা পেয়েছে। যে মেয়েটা হেসেছিল সে বলে। তার চোখেমুখে সত্যিকারের তেষ্টা ফুটে আছে। কাছ থেকে এখন তার ভাঙা মুখ, মুখে ঘামে-ভাসা পাউডার, চোখের গাঢ় কাজল দেখা গেল। সিথির কাছে চুল পাতলা হয়ে প্রায় টাক দেখা যাচ্ছে।

তার সঙ্গিনী সেই লতিকা। একটু মোটাসোটা, কালো, পুরু ঠোঁট, বেশি বয়স। মুখখানা গোল, কপাল বেরিয়ে এসেছে ঝুলবারান্দার মতো। সে হাত বাড়িয়ে গৌরের জগটা ধরবার জন্য উদ্যত হয়েও ঠিক সাহস পায় না, হাতটা টেবিলের ওপর ওইভাবেই ফেলে রেখে বলে, নতুন পেগ না নাও, তোমাদের গেলাস থেকেই ঢেলে দাও একটু করে।

বলে সে টেবিলে উপুড় করে রাখা পাতলা গ্লাস উলটে বাড়িয়ে ধরে, দাও।

এইসব মেয়েছেলেদের বিস্তর দেখেছে গৌর। প্রায় একই রকম শ্রীহীন চেহারা, কেউ একটু রোগা, কেউ মোটা। মুখে প্রচুর পাউডার, লিপস্টিক, চোখে কাজল, পরনে ঝলমলে শাড়ি। তার ল্যান্ডমাস্টারে মাঝে মাঝে এরকম মেয়েরা খদ্দেরের পয়সায় ফুর্তি ললাটে। টের পেলে তোলে না গৌর, ভুল করে তুললে আয়নায় বিস্তর নিষিদ্ধ দৃশ্য দেখা যায়।

স্বাভাবিক অবস্থায় হলে গৌর তাড়া দিত, কিন্তু বিয়ারের আঁঝটা তার পেট থেকে মগজে রিনরিন করে ছড়িয়ে পড়ছে। যেমন ওজন নেওয়ার যন্ত্রে পয়সা ফেললে রিনরিন শব্দটা বহুদুর গভীরে গড়িয়ে যায়। গৌর তাই রাগ করে না। কেবল অবাক হয়ে বলে, এঁটো খাবে?

এঁটো আবার কী গো!—প্রথম মেয়েটা বড় চোখে চেয়ে হঠাৎ হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, মুখের এটোকে এঁটো ধরলে আমরা তো পচে গেছি।

আমাদের সবকিছু এঁটো!

বড় অশ্লীল কথা। অঙ্গভঙ্গিও ভাল না। গৌরের বড় ঘেন্না করে। সে অর্ধেক জগ মোটা মেয়েটার গ্লাসে ঢেলে দেয়, বাকি অর্ধেক টেনে নেয় নিজে। তারপর শ্বাস ছেড়ে মেয়ে দুটোকে বলে, এবার ফোটো। যথেষ্ট হয়েছে।

জাহাজিটা জগ-এ লম্বা ড়ুব মেরে মুখ তোলে। মেয়েদুটোর দিকে তাকিয়ে মাতাল হাসি হাসে, বলে, আরও খাবে? খাও। বেয়ারা।

মেয়েদুটো আনন্দে, সুখে ভেসে যায়। বেয়ারা বিনীতভাবে দুটো জগ ভরে দিয়ে যায়।

এবার বলো। জাহাজীটা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে।

কী?— মেয়েরা ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করে।

 স্যু-র কথা।

মেয়েদুটো রুমালে মুখ চেপে হাসে।

কেমন ছিল তোমার স্যু?–রোগা জন জিজ্ঞেস করে।

লম্বা। সোনালি চুল। নীল চোখ। খুব ফরসা।

যদিও মাথাটা একটু গুলিয়ে যাচ্ছে তবু গৌর বোঝে জাহাজিটা ঠিক কথা বলছে না। সে মুখ ফিরিয়ে বলে, এই, তুমি যে একটু আগে বললে, শ্যামলা রং, চোখের পাতা ভারী ভারী।

লম্বা রথম্যান ধরিয়ে জাহাজিটা ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ভাববার চেষ্টা করে। বলে, বলেছি?

নিশ্চয়ই।– গৌর ডানহাতে টেবিলে চাপড় মারে।

জাহাজিটা শ্বাস ছেড়ে বলে, তবে তাই।

মাতাল। গৌর হাসে।

জাহাজিটা প্রশ্ন করে, চেনো?

মোটা মেয়েটা মাথা নাড়ে, না।

সে আমাকে জ্যোৎস্না খাইয়েছিল।

রোগা মেয়েটা তার লম্বা দাতগুলো বের করে গরগরে হাসি হাসে, জ্যোৎস্না আমরাও খাওয়াতে পারি। চাদের আলো, ফুলের গন্ধ, কত কী খাওয়াই আমরা।

জাহাজিটা স্থিরভাবে মেয়েটিকে লক্ষ করে, তারপর গম্ভীর গলায় বলে, পৃথিবীর সাত ঘাটের মেয়েমানুষ আমাকে ওই কথা বলেছে। কেউ পারেনি। তিন বছর ধরে আমার বুক তেষ্টায় কাঠ হয়ে আছে।

গৌরকে একটা কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে উঠে দাঁড়াল জাহাজি।

 চলো মেট, সময় নেই।

তারপর মেয়েদুটোর দিকে চেয়ে বলল, তোমরা খাও। সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না, তার জন্যে দুঃখ কোরো না। সময় বড় মূল্যবান, নইলে আমি তোমাদের সঙ্গে আর একটু সময় কাটাতাম।

জাহাজিটা বিল মেটায়। গৌরের হাত ধরে বেরিয়ে আসে।

গৌর চারদিকে একটা রিমঝিম আনন্দকে টের পাচ্ছিল। ঠিক নেশা নয়। কিন্তু রাস্তা দোকান সিনেমাহল-এর আলোেগুলো আরও রঙিন, মানুষেরা ভারী আনন্দিত। চরাচর জুড়ে ফুর্তির বাতাস বয়ে যাচ্ছে। জাহাজিটাকে মনে হচ্ছে বহুকালের পুরনো বন্ধু, মাঝখানে কেবল একশো বছর দেখা হয়নি।

দু’জন সৈন্যের মতো পায়ে পা মিলিয়ে তারা পাশাপাশি হেঁটে ল্যান্ডমাস্টারের কাছে আসে।

 এবার কোথায়?

জাহাজিটা চিন্তিত মুখে মাথা নাড়ে, স্যু যেখানে। খুঁজে বের করতে হবে। কাছাকাছি কোনও বার-এ সে আছে।

গৌরের এখনও যাকে নেশা বলে তা হয়নি ঠিক। গাড়িটা সে দিব্যি চালায়। জাহাজি তার বা পাশে, মাঝখানে সিটের ওপর রথম্যানের প্যাকেটটা পড়ে আছে। সবই বুঝতে পারছে গৌর। না, নেশা হয়নি। গাড়িটা মাখনের মতো যাচ্ছে।

ব্যস মেট। একবার এ জায়গাটা

 জাহাজি হাত বাড়িয়ে গৌরের হাত চেপে ধরে।

গৌর গাড়ি থামায়। বাঁ পাশে আর-একটা বার। খুব বড় নয়, কিন্তু জায়গাটার বেশ ফুর্তিবাজ চেহারা। আলোয় আলোময়। দুঃখ-কষ্টের কথা ভুল পড়ে যায় মানুষের।

জাহাজি হাত ছাড়ে না।

 নামো।

গৌর হাই তুলে বলে, আমি বরং বসে থাকি, তুমি খুঁজে এসো।

না, আমি একা খুঁজে পাব না। শহরটা বড় অচেনা লাগছে, নামো মেট।

গৌর নামে।

জায়গাটা ফুর্তিবাজ ঠিকই। ঢুকতেই আচমকা একটা মোলায়েম শীতভাব জড়িয়ে ধরে। গিজগিজ করছে লোজন, কাউন্টারে বেয়ারাদের ভিড়। একধারে কাঠের পাটাতনে মাইক্রোফোনের মাউথপিস মুখের কাছে ধরে দরাজ গলায় গান গাইছে কালো চেহারার একটা লোক, বোঙ্গো বাজছে দমাদম। লোকটা দুলে দুলে ঘুরে ঘুরে গায় হিন্দি বিষাদসংগীত। তবু ফুর্তির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সুদিন এসে গেছে এইখানে। গান গাইছে টাবু। টাবু সিংগস! আঙুরের রস তার গলা ছুঁয়ে ফোটা ফোটা গড়িয়ে পড়ছে মনের গেলাসে।

সিনেমার মতোই কাচ লাগানো একটা কাউন্টারের ওপাশে সাহেবি চেহারার দু’জন তোক ভারী ব্যস্ত। টাকা-পয়সা গুনে নিচ্ছে। জাহাজিটা কাচের ওপর টোকা দিতে দু’জন মুখ তোলে।

স্যু নামে একটি মেয়ে, গায়ের রং শ্যামলা, বাদামি চুল, নীল চোখ—

–মাতাল। গৌর হাসে। বলে, অ্যাই, গায়ের রং শ্যামলা হলে চোখ নীল হয় কী করে? অ্যাঁ!

 হয় না?— ভারী অবাক হয় জাহাজি। বলে, তবে কী রকম চোখ ছিল তার?

গৌর একটু ভাববার চেষ্টা করে। মাথা রিমঝিম করে তার। তবু বুদ্ধি খাটিয়ে সে বলে, কালো।

তো তাই।

জাহাজিটা আবার লোকদুটোর দিকে ঝুঁকে বলে, তার চোখ আর চুল কালো, খবর দিতে পারো? লোকদুটো গম্ভীর বিনীত মুখে শোনে। একজন নরম গলায় বলে, দুঃখিত। আমাদের এখানে নেই।

আমরা একটু ঘুরে দেখি জায়গাটা?

অফ কোর্স। বেয়ারা নিয়ে যাবে তোমাদের।

আধবুড়ো ভদ্র এক বেয়ারা তাদের নিয়ে যায়। টাবুর গান থেকে দূরে ছায়াচ্ছন্ন কোণের টেবিলে বসিয়ে দিয়ে বলে, ড্রিংকস?

হুইস্কি। বলে ক্লান্তিতে টেবিলে মাথা রাখে জাহাজি।

এই!

ডাক দেয় গৌর।

অনেকক্ষণ বাদে মাথা তোলে জাহাজি। চোখ রক্তজবা। গলায় টাবুর বিষাদসংগীতের বিষাদ এসে বাসা নিয়েছে। বলে, এখানে স্যু নেই। এসব তার জায়গা নয়। আরও নিরিবিলি জায়গায় তার থাকার কথা।

বোঙ্গোর শব্দ মৃদু গুঁড়ো হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে। টাবু তার বিষাদসংগীতের করুণতম অংশে এসে গেছে। ঘুমপাড়ানির মতো মৃদু, অরুদ্ধ তার গলা। যেন বা এই রাত আর ভোর হবে না। মহাপ্লাবনে ভেসে যাবে পৃথিবী। টাবুর অনন্ত বিষাদ বুকে নিয়ে সরে যাবে মানুষ। লোকে তাই শেষ আনন্দটুকু গেলাস থেকে তুলে নিক।

গৌর নিল। জাহাজিও।

আমি জানি স্যু এখানে নেই। এখানে থাকলে তার গায়ের গন্ধ পেতাম। জাহাজিটা ফিসফিসিয়ে বলে।

গৌরেরও তাই মনে হয়। তার চোখে কোনও মেয়েছেলে পড়ে না। তবু সে একবার চারদিক চেয়ে দেখে, না, নেই।

হঠাৎ উদ্দাম হয়ে ওঠে বোঙ্গোর শব্দ। দুলে ওঠে টাবু। আশা-নিরাশায় দোলে মানুষের মন।

চলো মেট।

 গেলাস শেষ করে গৌর ওঠে। একটু দোলে তার শরীর। মাথা ফাকা লাগে। তবু বলে, চলো।

কোথাও না কোথাও আছেই।— জাহাজি আত্মবিশ্বাসে বলে।

গৌর তা বিশ্বাস করে। কলকাতার জ্ঞান তার নখে নখে। কোথায় যাবে জাহাজির মেয়েছেলে স্যু? গৌর ঠিক বের করবে।

.

যদিও একটু দুলছে কলকাতার রাস্তাঘাট, তবু গৌর, বগলুর ছাওয়াল, যার হাতে গাড়ি কোনওদিন ঘষাটাও খায়নি, ঠিক গাড়িটা বের করে আনল চৌরঙ্গির বড় রাস্তায়।

ওই যে দেখছ উঁচু মিনার, ওই যে

এই বলে জাহাজি গৌরকে কনুইয়ে ঠেলা দিয়ে অদুরের মনুমেন্টটা দেখায়। গৌর দেখে।

জাহাজি গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে বলে, ওই মিনারটা আমি আমার মায়ের চিতার ওপর তুলেছিলাম। ভাল হয়নি?

মনুমেন্টটাকে আবার ভাল করে দেখে গৌর। দেখে-টেখে মাথা নেড়ে বলে, ভাল। দিব্যি উঁচু।

আই।

জাহাজি শ্বাস ছেড়ে নিশ্চিন্ত হয়।

.

পার্ক স্ট্রিটকে কখনও কলকাতা বলে মনে হয় না গৌরের। বিয়ারের মাথায় হুইস্কি বসে আছে পেটে। এখন তাই আরও মনে হয় না। স্পষ্টই যেন লন্ডনের এক রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করায় গৌর।

জাহাজি বলে, লন্ডন হুবহু এরকম।

গৌর হাসে।

সামনেই একটা বিশাল রেস্তরাঁর চওড়া মুখ, সে মুখে হাসি।

গেট-এর কাছে দু’জন সাহেবি পোশাক পরে দাঁড়াননা। তারা সিড়িতে পা দিতেই দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল আপনা থেকেই। ভারী অবাক হয় গৌর। এরকম জাদুই দরজা সে আর দেখেনি। দরজাটা পরখ করার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সে, জাহাজিটা হ্যাচকা টান দিয়ে তাকে ভিতরে নিয়ে গেল।

কম অন। সময় নেই। এখনও আকাশে জ্যোৎস্না রয়েছে, দেখছ না?

গৌর আকাশ দেখার জন্য মুখ তুলল। তুলে দেখল, সুন্দর সিলিং, তাতে নরম রঙের ওপর মানুষের কত কারুকাজ, কাচে ঢাকা আলো। জ্যোৎস্নার মতোই। কিংবা ঠিক জ্যোৎস্নার মতো নয়। কিন্তু সুন্দর।

তারা কার্পেটের ওপর দিয়ে হাঁটে। কী নরম! এরকম কার্পেটের ওপর হাঁটলে গৌরের শুখো পায়ে কোনও ব্যথা লাগে না। কার্পেটটা একবার ছুঁয়ে দেখার জন্য হাঁটু গেড়ে বসতে যাচ্ছিল গৌর। জাহাজি তাকে টেনে তুলল।

সময় নেই মেট।

ওঃ হ্যাঁ, ঠিক। গৌর বুঝতে পারে।

এমন সুন্দর জায়গা, তবু কেউ কোথাও তাদের পথ আটকায় না। বলে না ভিতরে যাওয়া বারণ। কেন বলে না? অ্যাঁ! গৌর বুঝতে পারে না। তার দাদা রাখোহরি যখন এসব জায়গায় আসত, গৌরই পুরনো ডজ গাড়িটায় নিয়ে আসত তাকে। স্যট আর বোপরা বিলেতফেরত সুন্দর চেহারার রাখোহরি অনায়াসে ঢুকে যেত সব জায়গায়। পালকের ঝাড়নে ডজ গাড়িটার গা মুছতে মুছতে ভয়ের চোখে চেয়ে দেখত গৌর। তার ধারণা ছিল, হাফ-ফিনিশ গৌরার এসব জায়গায় অ্যাডমিশন নেই। সেই ধারণা নিয়েই সে এত বড়টা হল। অথচ আশ্চর্য! আশ্চর্য! সব দরজা খুলে যাচ্ছে আপনা থেকে, একটু নেংচে হাফ-ফিনিশ গৌরা, বগলুর ছাওয়াল, অর্থাৎ কিনা বগলাপতির তিন নম্বর, আজ যে সব জায়গায় চলে যেতে পারছে। কী হচ্ছে এসব! অ্যাঁ! এরকম আর দেখেনি গৌর। প্রজাপতি, রামধনু, সুন্দরীর চোখ, এইসব জিনিস দিয়ে যেন তৈরি হয়েছে এই দোকান। এখানে দেয়াল নেই, কড়িকাঠ নেই, দরজা জানালা নেই, কেবল আলো আর রং, গন্ধ আর সুন্দর শব্দ, একটু স্বপ্ন আর কল্পনার মিশেল। পৃথিবীরই, তবু ঠিক পৃথিবীতে নয়। একটু উঁচুতে যেন বা বাতাসে ভর করে আছে জায়গাটা! বাতাসে ভর করে আছে? সত্যি? পরীক্ষা করে দেখার জন্য কয়েকটা লাফ দিল গৌর। দেখল দোলে কি না। হ্যাঁ, দোলে। একটু একটু।

জাহাজি তাকে টেনে বসায়, গভীর পালকের মধ্যে ড়ুবে যেতে থাকে গৌর। টেবিলে কনুইয়ের ভর রেখে ড়ুবে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচায়।

কে যেন মুখের কাছে ভরা গেলাস রাখে। গৌর ঠোঁটে তোলে গেলাস। আনন্দে চোখের জল নেমে আসে।

একটা ভিতর প্রকোষ্ঠের দরজা নিঃশব্দে খোলে। উদ্দণ্ড ড্রামের শব্দ, সাপুড়ের বাঁশির শব্দ শোনা যায়। আবার দরজা বন্ধ হয়। শব্দটা ক্ষীণ হৃৎপিন্ডের শব্দের মতো ঢিপঢিপ করে বাজে।

জাহাজিটা হঠাৎ চমকে উঠে দাঁড়ায়।

চলো মেট, শিগগির।

কোথায়?

ওইখানে। ভিতরে কোথাও নাচ হচ্ছে, একটা মেয়ে, স্যু হতে পারে।

গৌর ওঠে।

সত্যিই একটা রঙিন দরজা রয়েছে। সামনে সতর্ক পাহারা। তারা দরজার সামনে দাঁড়াতেই একটা হাত এগিয়ে আসে।

টিকিট?

জাহাজি হিপ পকেট থেকে টাকার গোছাটা টেনে বের করে। অফুরন্ত টাকা। দরজা খুলে যায়।

লোলা নাচছে স্পটলাইটে। আলো থেকে অন্ধকারে চলে যায় লোলা। আলোটা ঘুরে ঘুরে তাকে খুঁজে বের করে। লোলার বাদামি শরীরের চামড়া যেন তেল মাখা। চামড়ার তলায় তার খেয়ালি নরম মাংসের ঢেউ। কোমরে জাফরান রঙের পুঁতির ছোট্ট ঘাগরা, বুকে জাফরানি পুতির কঁচুলি, মাথার চারদিকে ঘিরে আছে এক সবুজ সাপ, চুলের চূড়ার ওপর তার ফণা। আলো থেকে অন্ধকারে, আবার আলোয়, মায়াবী যাতায়াত করে লোলা। পৃথিবীর পুরুষকে ডাক দেয় তার পায়ের তলায়। নরমুণ্ড লুটিয়ে পড়ে পায়ে। লোলা অন্ধকারে, আবার আলোয়, আবার অন্ধকারে, তার জাদুকরী মুদ্রাগুলি ছিটিয়ে দেয়। আলো তাকে চঞ্চল হয়ে খোঁজে, খোঁজে অন্ধকার। চারদিকে অনেক মানুষ, কাউকে দেখা যায় না। কেবল অন্ধকারে সিগারেটের আগুন তীব্র হয়ে উঠে মিইয়ে যায়। খাস পড়ে, খাস ওঠে, কাউকে দেখা যায় না। চরম মুহূর্তের কাছে উঠে যায় ড্রামের অসহ্য আনন্দের শব্দ-লোলা-লোলা-লোলা।

হঠাৎ আলো নিভে যায়। গৌর টপ করে চোখ বুজে ফেলে। আজ পর্যন্ত সে কখনও ন্যাংটো মেয়েমানুষ দেখেনি।

অন্ধকারেই জাহাজি তার হাত চেপে ধরে, মেট, এ নয়।

নয়?

নাঃ।

অন্ধকারে হোঁচট খেতে খেতে তারা বেরিয়ে আসে। পিছন ফিরে তাকায় না। কিন্তু তখন লোলা তার ঘাগরা ছেড়েছে, কঁচুলি দিয়েছে ফেলে। অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে। পাগলের মতো আলো তাকে খুঁজছে। লোলা দু’হাত বাড়িয়ে আলোকে বলছে। এসো, এসো, এইখানে পৃথিবীর প্রিয়তমা লোলা।

তবু সে স্যু নয়। হতাশ জাহাজিকে সে খাওয়ায়নি অলৌকিক জ্যোৎস্না। দুটি দুঃখী লোক তাকে অবহেলা করে চলে গেল।

দুটি মানুষের কাছে ব্যর্থ লোলার নগ্ন শরীরে তখন লাল নীল সবুজ আলোগুলো পাগলের মতো এসে আঘাত করছে, মাঝে মাঝে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তখন গৌরের ল্যান্ডমাস্টার পার্ক স্ট্রিট ছেড়ে উড়ে যেতে থাকে স্য-র খোঁজে।

আই! গৌর টের পায়, গাড়িটা উড়ছে। উইন্ডস্ক্রিন জুড়ে পার্ক স্ট্রিটের আলোর ধাঁধা। গৌর চোখ কচলে নেয়। মোড়ের ট্রাফিক বাতি দেখতে পাচ্ছে না সে, দেখবার দরকারই বা কী! গাড়িটা উড়ছে যখন।

মেট!— জাহাজি মৃদুস্বরে বলে।

 উম।

 নেশাটা কেটে যাচ্ছে। কলকাতার শুঁড়িরা মদে জল মেশায়।

 হবেও বা। গৌর জানে না। সে বুকে রাস্তাটা দেখে। ফাকা হয়ে এসেছে রাস্তা। চোরাগলির অন্ধকার মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। চলেছে মাতাল, ভিখিরি, মতলববাজ লোক, এসবের ওপরে ওই আকাশ। জ্যোৎস্না ক্রমে ম্লান হয়ে আসছে। ওই আকাশে থাকেন ফাদার ফ্রান্সিস। তাকে ঘিরে থাকে স্বপ্নের শিশুরা। লাল নীল সবুজ বল গড়িয়ে সারা দিনমান শিশুদের সঙ্গে খেলা করেন ফাদার। পৃথিবীর ওপরে যে আকাশটা আছে সেটা মানুষের বাবার ভাগ্যি। গৌর মাঝে মাঝে তাই চোখ তুলে আকাশখানা দেখে। ভারী খুশি হয়। গাড়িটা আর-একটু উঁচুতে উঠে যায়। ভাল লাগে গৌরের। সে মুখ ফিরিয়ে বলে, দেখ, কত উঁচুতে উঠেছি।

জাহাজিটা গলা বাড়িয়ে নীচের দিকে চায়, তারপর বলে, আর একটু ওপরে ওঠো মেট। স্যু বোধহয় পৃথিবীতে নেই। এখানে বড় ধুলো ময়লা, নোংরা মানুষ। এ সব দেখে সে বোধহয় উঁচুতে উঠে গেছে।

মাতাল। গৌর আপনমনে হাসে। একটা লাল সিগন্যাল পেরিয়ে যায়। পুলিশ নেই। কেউ তাকে থামায় না।

জাহাজিটা এলিয়ে পড়েছে সিটে। বিড়বিড় করে বকছে, বাড়ি বাড়ি খুঁজব। ভিখিরিদের মুখ দেখে দেখে ফিরব। প্রতিটি খুঁড়িখানায়, বেশ্যার ঘরে, দোকানে, অফিসে। কোথায় যাবে?

গৌর রাস্তাটা ভাল দেখতে পায় না। কুয়াশা হয়েছে নাকি? কিংবা স্বপ্ন দেখছে? সামনের রাস্তাটা জুড়ে পরি নামছে। শিশু-পরি সব। ন্যাংটো, ফরসা, সুন্দর। দুটো করে ছোটো ডানা। গাছে গাছে ফলের মতো ঝুল খাচ্ছে। রাস্তায় খেলা করছে। ব্রেক কষে গৌর। চোখ মুছে নেয়। হর্ন দেয়। চাপা পড়বে যে বাবারা সব! ওড়ো, উড়ে যাও।

তারপরই হাসে গৌর। চাপা দেবে কী? উড়ন্ত গাড়ি কাউকে চাপা দেয় না। গৌর আবার গাড়ি ছাড়ে। আকাশে ফাদার ফ্রান্সিস রয়েছেন। শিশুদের তিনিই সরিয়ে নেবেন। ভয় নেই।

কলকাতার শুঁড়িরা মদে জল মেশায়, বুঝলে মেট? ভীষণ জল মেশায়। বলে হেঁচকি তোলে জাহাজি।

গাড়িটা জোরে চালাও মেট। নইলে জমছে না। আমার নেশা কেটে যাচ্ছে।

পাগলা! জোরে চালালে ওদের গায়ে ধাক্কা লেগে যাবে।

 কাদের?–জাহাজি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।

ওই যে, পরিরা নেমেছে সব। বাচ্চা পরি, ভাল উড়তে শেখেনি এখনও।

 জাহাজি ঝুঁকে রাস্তাঘাটে পরি দেখার চেষ্টা করে।

কোথায় পরি?

শালা মাতাল। দেখতে পাচ্ছে না। গৌর হাসে।

ওই তো। সব জায়গায় রয়েছে। গাছে ঝুল খাচ্ছে, রাস্তায় খেলছে, আকাশে উড়ছে, কোথায় নেই? ওই দেখো একজন আমার গাড়ির বনেটে বসল, ওই আবার উড়ে গেল। নীল চোখ, কী সুন্দর নীল চোখ।

জাহাজি শ্বাস ফেলে বলে, দেখতে পাচ্ছি না। কলকাতার শুড়িরা বড্ড জল মেশায় মদে।

 কিন্তু পরিরা আছে ঠিক। সেন্ট অ্যান্টনিজে এরকম পরিদের ছবি ঘরে ঘরে ঝোলানো থাকত। সোনালি ডানা, লাল ঠোঁট, নীল চোখ…।

জাহাজি বুক কাঁপিয়ে শ্বাস ফেলে, নীল চোখ নীল চোখ। সুরও ছিল ওই নীল চোখ। ঠিক নীল নয়, একটু বাদামি। কিন্তু ওর গায়ের রং ছিল বড় কালো। যখন ঘরের আলো নিভিয়ে দিত, বুঝলে, যখন ঘরের আলো নিভিয়ে দিত তখন ওকে কিছুতেই খুঁজে পেতাম না। ওর ওই কালো রঙের জন্যই। সু-র বুকভরা দিল, একশো মজা। বাতি নিভিয়ে সে লুকোত, আর আমি দুহাত বাজিয়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে কখনও দেয়ালে, কখনও ওয়ার্ডরোবে, কখনও খাটের বাজুতে ধাক্কা খেতাম। ও লুকোত খাটের তলায়, আলমারির ভিতরে কিংবা ছেড়ে রাখা পোশাকের নীচে। একশো মজা ছিল ওর। বড্ড কালো ছিল বলে

কালো!— গৌর ভারী অবাক হয়, কালো কোথায়! তুমি যে বললে, ফরসা আর নীল চোখ!

বলেছি?

আলবাত!

তবে তাই। জাহাজিটা গভীরভাবে মাথা নাড়ে, তবে তাই। কিন্তু তাহলে অন্ধকার ঘরে ওকে খুঁজে পেতাম না কেন?

গৌর হাসে, দূর। অন্ধকার ঘরে কালোই কী, ফরসাই কী? সব সমান। সোজাসুজি একটা নিয়োন সাইন ছিল। কী যেন সাইনটা! আঃ হাঃ, কী যেন? ঠিক মনে পড়ছে না, কী যেন?

লিপটন? লুফটাহানসা? গুড ইয়ার? ক্যাপস্টান?

নাঃ। ওসব নয়। কলকাতার শুড়িরা—

জাহাজি হেঁচকি খেল।

 যেতে দাও।– গৌর বলে।

জাহাজিটা মাথা নাড়ে, না না। যেতে দেব কেন? সেই নিয়োন সাইনটা ছিল খুব ইম্পর্ট্যান্ট। খুব। দাঁড়াও মনে করি।

জাহাজি মুখে আঙুল পুরে ভাবে। শিস দেয় মাঝে মাঝে। ওদিকে রাস্তায় পরিরা আরও নামছে। কলকাতা জুড়ে কেবলই পরি নেমে আসছে। দু-তিনজন গাড়ির জানালা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছে। কাচ ভোলা বলে পারছে না। আহা! গৌর হাত বাড়িয়ে পিছনের জানালার কাচ নামায়। বোসো বাবারা। বসে থাকো! আমি তোমাদের পুরো কলকাতা দেখিয়ে দেব।

ইয়াঃ! সেই নিয়োন সাইনে লেখা ছিল—ইউ ওয়ান্ট লায়লাজ ব্রেড। তুমি চাও লায়লার রুটি। প্রথমে জ্বলত ‘তুমি’, তারপর চাও,তারপর লায়লার’, সবশেষে ‘রুটি’, চারটে শব্দ। তুমি’ জ্বললে। ঘরটায় স্বচ্ছ আলো আসত-সবুজ আলো। দ্বিতীয়টা ছিল ‘চাও’, সেটা জ্বললে আরও একটু সবুজ আলো আসত। তারপর লায়লার’ থেকে রুটি পর্যন্ত চমৎকার আলো হত ঘরে। সবুজ আলোয় ভরে যেত ঘর। মনে হত, মাঠঘাট, সবুজ ঘাস এই সবের মধ্যে রয়েছি। আবার হঠাৎ দপ করে নিভে যেত আলো, কী অন্ধকার এখন। ঘুটঘুট্টি। হঠাৎ আবার জ্বলে উঠত—“তুমি’, তারপর ‘চাও’, তারপর

জাহাজিটা হেঁচকি তোলে।

পিছনের জানালা গলে তিনটে পরি ঢোকে। গৌর আড়চোখে আয়নায় দেখে নেয়। ন্যাংটাপুটো, সাদা। মোটা মোেটা থােরা, নধর হাত, নাদা পেট। সোনালি ডানাগুলো পাতলা ফিনফিনে, যেন বা মাকড়সার জালে তৈরি পাখাগুলো থিরথির করে কাঁপে।

ই-ফ!— জাহাজি আবার হেঁচকি গেলে।

চোপ!–ধমক মারে গৌর, হেঁচকি তুলো না। পরিরা ভয় পাবে।

জাহাজি অবাক হয়ে বলে, কারা বললে?

পরিরা।

কোথায়?

পিছনের সিটে বসে আছে। তিনজন। এখন হেঁচকি তুলো না।

জাহাজি মুখ ফিরিয়ে দেখে। তারপর বলে, কোথায় কী?

আছে। তাকিয়ো না।

জাহাজি গম্ভীর হয়ে বলে, আসলে কলকাতার শুড়িরা

বলে ঠোঁট চাটে জাহাজি। গৌর গাড়িখানা কঁকা রাস্তায় ঘোরাতে থাকে। ড্যাশবোর্ডে তেলের কাটা নেমে যাচ্ছে। গৌর তা লক্ষ্য করে না। সে কেবল চরাচর জুড়ে পরিদের কাণ্ড দেখে।

জাহাজিটা বলে, আমরা জানালায় বসে সেই নিয়োন সাইনটা দেখতাম।

 কোন নিয়োন সাইন?

 সেই যে, তুমি চাও লায়লার রুটি। সবুজ রঙের নিয়োন সাইন। ঘরটা সবুজ আলোয় চমকাত। আমি স্যুকে জিজ্ঞেস করতাম, স্যু, লায়লা কে? ও আমাকে জিজ্ঞেস করত, লায়লা কে? আমরা কেউ বলতে পারতাম না। অথচ নিয়োন সাইনটা সন্ধে রাত্রি থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সবুজ আলো দিয়ে একই কথা বলত, তুমি চাও…তুমি চাও..তুমি চাও…লায়লার রুটি। আমি সুকে জিজ্ঞেস করতাম, স্য, তুমি লায়লার টানে বাত, চাই। ফের সে আমাকেও ওই কথা জিজ্ঞেসকরত, আমিও চাই কি না, আমি বলতাম, চাই। কিন্তু মেট, খুঁজে দেখেছি, সেই রুটি পাওয়া যায় না।

পাওয়া যায় না?

না।

 সে কী! তাহলে নিয়োন সাইনটা ছিল কী করতে?

জাহাজিটা একটু ভেবে বলে, অবিশ্যি দিনের বেলা তো কখনও লায়লার রুটির খোঁজ করিনি। দিনের বেলা মনেই থাকত না। রাত্রি বেশি হলে যখন নিয়োন সাইনটা নজরে পড়ত, তখন আমরা খুঁজতে বেরোতাম। পাওয়া যেত না। মেট, সেই থেকে লায়লার রুটির জন্য আমি অস্থির হয়ে আছি। এখনও মাঝে মাঝে মাঝরাতে ঘুমে আমি স্বপ্ন দেখি, নিয়োন সাইন জ্বলে জ্বলে উঠছে, তুমি চাও…তুমি চাও…তুমি চাও…ভয় পেয়ে উঠে বসি, আর তখন বাদবাকিটা মনে পড়ে, লায়লার রুটি…লায়লার রুটি…লায়লার রুটি…

মাতাল। গৌর হাসে।

জাহাজিটা ঠোঁট চাটে। একটা রথম্যান ধরাবার চেষ্টা করে। দেশলাই জ্বালতেই গৌর ধমকায়, আলো জ্বেলো না।

কেন?

পরিরা পালাবে।

আঃ! জাহাজি হতাশভাবে সিগারেট ফেলে দেয়। তারপর বলে, লায়লার রুটি। সবুজ আলো, স্যু, জ্যোৎস্না—মেট, এসব কোথায় গেল? কলকাতা একদম শুকিয়ে গেছে যে। কিছু নেই।

গাড়িটা আপনা থেকেই ঘুরেফিরে চলে যাচ্ছিল। গৌর দিক ঠিক করতে পারে না। আসলে গাড়ি যখন মাটির ওপর দিয়ে যায় তখন রাস্তাঘাট ঠিকই চিনতে পারে গৌর, গৌরা, বগলাপতির ব্যাটা। তখন তার সব ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে। কিন্তু এখন, এই পরিদের রাজ্যে চলে এলে, মাঝরাতে দিক নির্ণয় করা ভারী মুশকিল। গাড়ি তখন নিজের থেকেই চলে। গৌর কেবল নিমিত্তমাত্র।

চাঁদ ঢলে পড়েছে। আকাশের একদিকটা কালিবর্ণ, বেশ্যার চোখের কাজলের মতো, সেই কালিবর্ণে ফ্যাকাসে শসার মতো চাঁদ ঢলে পড়ে যাচ্ছে। গৌর এই মর্মান্তিক দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

জাহাজি হঠাৎ আঁতকে উঠে বলে, এটা কোন জায়গা! অ্যাঁ! কোন জায়গা? থামো মেট।

গৌর থামে।

একটা পুরনো প্রকাণ্ড বাড়ি বটগাছের মতো দাঁড়িয়ে। অন্ধকার। রাস্তাটা নিঝঝুম। চারদিকে সুনসান নির্জনতা। রাস্তায় সারি সারি গাছ। গাছের আড়ালে আড়ালে রাস্তায় টিমটিমে আলো। হাওয়ায় গাছের পাতা নড়লে আলোগুলো দোল খেয়ে যেতে থাকে। গৌর রাস্তাটা ঠিকঠাক চিনতে পারে না। গভীর গলায় বলে, কী জানি!

জাহাজিটা মুখ তুলে বাড়িটা দেখে।

মেট!

 উম।

 এই বাড়িটা আমার চেনা।

গৌরও বাড়িটা দেখে। কলকাতার প্রথম বয়সে তৈরি বাড়ি। পলেস্তারা খসে পড়ছে। বোধহয় কর্পোরেশনের নোটিশ পেয়েছে। ভেঙে ফেলা হবে। তাই সবাই ছেড়ে গেছে বাড়ি। একা অন্ধকার বাড়িটা আয়ুর শেষে ক’টা দিন নির্জনে ঝিমিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে।

গৌর হাই তোলে।

জাহাজি হঠাৎ গৌরের হাত চেপে ধরে বলে, বাড়িটা আমি চিনি মেট। এখানে আমি এসেছি।

কার কাছে?

 জাহাজি ফিসফিস করে বলে, স্যুর কাছে।

গৌর চমকে বলে, এই বাড়িটাই?

তারা নামে। আগে জাহাজি, পিছনে গৌর।

বাড়ির দরজাটা হাঁ হাঁ করছে খোলা। একটা পাল্লা বাতাসে নড়ে চামচিকের মতো শব্দ করছে। আরশোলার নাদির গন্ধ পাওয়া যায়। আর বহু পুরনো এক বদ্ধ বাতাসের ঘ্রাণ।

জাহাজি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁ করে একটু তাকিয়ে থাকে। তারপর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, এইটাই। সেটারও দরজা এরকম চামচিকের মতো শব্দ করত।

জাহাজি শ্বাস ছাড়ে। বলে, মেট, চলল। দেখা যাক।

দু’জনে সিড়ি ভাঙতে থাকে। সিড়ি যতই ওপরে উঠেছে ততই আরও অন্ধকার, পিছল পিছল, ধাপ তত উঁচু উঁচু। ক্রমান্বয়ে চুনবালি খসে পড়ার একটা ঝিরঝির ঝুরঝুর শব্দ হতে কে। মুখে গায়ে ঝাপটা মেরে উড়ে যায় চামচিকে। টিকটিকি ডাকে।

ক’তলায়?–গৌর জিজ্ঞেস করে।

দশ তলায়। আমার মনে আছে।

গৌর অবাক হয়ে বলে, কিন্তু এ বাড়িটা তো মোটে চার-পাঁচ তলা।

ঠিক বলছ?

 ঠিক। এ কলকাতার পুরনো বাড়ি, চুন-সুরকির গাঁথুনি, এর ওপর দশ তলা হয় না।

তাহলে! বলে জাহাজিটা নাক চুলকোতে চুলকোতে ভাবে। বলে, তাহলে ক’তলায়! ঠিক মনে পড়ছে না তো!

চারদিকে নিস্তব্ধতা। ঝিঝি হঠাৎ ডেকে উঠে আরও নিস্তব্ধ করে দিতে থাকে। চুনবালি খসছে ততা খসছেই। ঝিরঝির ঝুরঝুর। বাইরে পরিরা নামছে এখন। কিন্তু এখানে, বাড়িটার ভিতরে কেবল হাজার বছরের অন্ধকার। হাজার বছরের জমে থাকা ধুলোব গন্ধ।

দু’জনে আবার সিঁড়ি ভাঙে। পলেস্তারা খসে, চুনবালি পড়ে সিড়িতে পুরু আস্তরণ। পায়ে লেগে ঢেলা গড়িয়ে পড়ে। ইদুরের নরম পা তাদের পায়ের পাতা ছুঁয়ে দৌড়ে যায়। মুখে গায়ে লেগে মাকড়সার জাল ছিড়ে যাচ্ছে। সারা বাড়ি জুড়ে সেই মিহিন পতনের শব্দ। ঝিরঝির ঝুরঝুর। আপনা থেকেই বাড়িটা অবিরল ক্ষয়ে যাচ্ছে। দরজা জানলা হা-হা করছে খোলা। বেশির ভাগেরই পাল্লা নেই। দু’এক জায়গায় বাঁশের ঠেকনা দাড় করানো আছে। জাহাজিটা ভালুকের মতো ঘরে দোরে ঢুকে দেখে। চারদিক খুঁজে বেড়ায়। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে কুকুরের মতো মুখ তুলে বাতাস শোকে।

কোনও ঘরেই নেই খাট পালং, টেবিল চেয়ার, আলমারি। কিছু নেই। দু’একটা কৌটোবাইটো পায়ে লেগে শব্দ করে গড়িয়ে যায়। একটা শিশি পড়ে ভেঙে গেল।

মেট!

উম।

এই বাড়িটাই। এইখানে সু থাকত। এইসব ঘর আমার চেনা।

আবার তারা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠে। ওপরে আবর্জনা বেশি। ইটের স্তুপ পড়ে আছে। ইদুর চামচিকে আরশোলা ঝিঝি অবিরল নানারকম শব্দ করতে থাকে। তারা এ ঘর থেকে ও ঘরে যায়। ঘরের পর ঘর দেখতে থাকে। এক-একবার এক-একটা জানালা দিয়ে বুকে দেখে জাহাজি। মাথা নেড়ে বলে, এ ঘর নয়। এখান থেকে লায়লার রুটির বিজ্ঞাপন দেখা যায় না তো! অন্য ঘরে চলো মেট। যে ঘর থেকে সবুজ নিয়োন সাইনে দেখা যাবে, তুমি চাও লায়লার রুটি, সেইটাই স্যুর ঘর। প্রথমে জ্বলবে তুমি’, তারপর ‘চাও’, তারপর লায়লার’, সবশেষে ‘রুটি।

অন্ধকার ঘরে, প্যাসেজে, বারান্দায়, প্যানট্রিতে তারা বার বার হোঁচট খায়। ডেব্রিসের ওপর হাঁটু ভেঙে যায়। আরও বাঁশের ঠেকনা, ডেব্রিস, ইটের ভূপ তারা চারদিকে টের পায়। বার বার দেশলাই জ্বালে জাহাজি। চারদিকে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির জরা স্নান ছবির মতো জেগে উঠে মিলিয়ে যায়। পোড়া কাঠি ছুঁড়ে ফেলে জাহাজি মাথা নাড়ে, না, এ ঘরটা নয়। কিন্তু এই বাড়িতেই ঘরটা আছে মেট। অনেকটা এইসব ঘরের মতোই। সু তো কালো ছিল, ভীষণ কালো। বাতি নিভিয়ে যখনই সে লুকোত তখন অন্ধকারে তাকে কোথাও খুঁজে পেতাম না। বাইরে তখন বার বার জ্বলে উঠত, তুমি চাও…তুমি চাও…তুমি চাও…লায়লার…লায়লার…রুটি। সবুজ আলোয় ঝলসে ঝলসে উঠত ঘর, কিন্তু সেই আলোতে ঠিক গায়ের রং মিলিয়ে লুকিয়ে থাকত সে। কিন্তু তার গায়ে একটা সুগন্ধ ছিল। সেই গন্ধটা ঘর ভরে থাকত। আমি সেই গন্ধ শুকে এঁকে চারধারে খুঁজতাম। ধরি ধরি করেও, কাছাকাছি গিয়েও ছুঁতে ধরতে পারতাম না। পালিয়ে যেত। তখন আবার পাগলের মতো খুঁজতাম। বাইরে তখন সবুজ আলো দপদপিয়ে উঠত, তুমি চাও…তুমি চাও…তুমি চাও…এইরকম—ঠিক এইরকম ঘরে সেইসব দারুণ ঘটনা ঘটত।

প্রকাণ্ড পাঁজর-কাঁপানো শ্বাস ছাড়ে জাহাজি। বলে, বুঝলে মেট, বড্ড কালো ছিল স্য, কিন্তু মধুরঙের চুল ছিল তার। খয়েরি চোখ—

খয়েরি? অবাক হয় গৌর।

খয়েরি নয়?

দুর! বাদামি তো।

তবে তাই। জাহাজি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়।

আর ফরসা রং।

ঠিক আছে।

আর কালো চুল।

আই। জাহাজি বলে। বলেই শ্বাস ছাড়ে। দেশলাইয়ের কাঠি ধরায়। সেটা নিভে যেতে হতাশভাবে আবার মাথা নাড়ে।

আবার পুরনো পিছল অন্ধকার সিড়ি ভাঙে তারা। টের পায়, সেই অন্ধকারে এক আলাদা জগৎ রয়েছে। সে জগৎ মানুষের নয়। চামচিকে, আরশোলা, ইদুর, ঝিঝির। রয়েছে তাদের ভয়, খেলা, আত্মীয়তা। তারা নড়ে চড়ে, দৌড়ায়, ওড়ে, ডাকে। একটি বহু পুরনো বাতাস বাড়িটার ভিতরে এখনও রয়ে গেছে। তাতে একশো-দুশো বছর আগেকার মানুষের শ্বাস মিশে আছে। অবিরল বাড়িটার বিন্দু বিন্দু গুঁড়ো গুঁড়ো পতনের মিহিন শব্দ হয়। ঝিরঝির ঝুরঝুর। ক্ষয়, অবিরল ক্ষয়।

অন্ধকারে জাহাজি হঠাৎ লাফ দিয়ে দুই ধাপ সিড়ি উঠে যায়।

কর্কশ চাপা গলায় বলে, মেট, এইখানে একটা বন্ধ দরজা।

 দরজা?

দরজা। দুটো পাল্লা বন্ধ।

অন্ধকারে গৌর কিছুই দেখে না। উঠে আসে। জাহাজি দেশলাই জ্বালতেই দেখা যায়, দুই মানুষ সমান উঁচু এক বিশাল, নিরেট, বিবর্ণ দরজা বন্ধ হয়ে আছে। জাহাজি হাতড়ে দরজাটা দেখে বলে, মেট, ভিতর থেকে বন্ধ।

এইটাই কি স্যু-র ঘর?

মনে হচ্ছে।

জাহাজি সাবধানে দরজায় টোকা দিয়ে বলে, কে আছ?

সাড়া নেই।

কে আছ?

সাড়া নেই।

 জাহাজি ক্রমে ক্রমে জোরে, আরও জোবে কড়া নাড়তে থাকে।

কে আছ? কে আছ? কে আছ?

প্রকাণ্ড পুরনো বাড়িটা তার স্বর শুষে নিয়ে আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেবল চামচিকের ডানা নড়ে। টিকটিকি হঠাৎ ডেকে ওঠে। অলক্ষে চুনবালি খসে পড়ার শব্দ হয়। ক্ষয়ের শব্দ। পতনের।

জাহাজি দরজায় কান পেতে ভিতরের শব্দ শোনার চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ, অনেকক্ষণ ধরে। শোনে। দেয়ালে হেলান দিয়ে গৌরহরি একটা রথম্যান ধরায়। ঘুমে চোখ তুলে আসে। চোখের সামনে রঙিন ডানাওয়ালা পরিরা ভেসে ওঠে। গৌর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুলতে থাকে।

মেট!

উম।

ঘরের ভিতরে শ্বাস ফেলার শব্দ হচ্ছে।

অ্যাঁ!

কেউ আছে। শোনো।

গৌর কান পাতে। বহুকালের পুরনো কাঠের দরজাব গন্ধ পায় গৌর। ভারী কাঠের, পুরু পাল্লার দরজা। গৌর কোনও শব্দ পায় না। সে কান পেতে কেবল অবিরল বাড়িটার ক্ষয়ের শব্দ পায়। চামচিকের ডানা বাতাস কাটে। টিকটিকি ডাকে। আরশোলা ফর ফর করে উড়ে যায়।

কোথায় শব্দ?

মন দিয়ে শোনো। খুব লম্বা টানা শ্বাস। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠে ভেঙে যাচ্ছে। বুকের একটা ঘড় ঘড় শব্দ হচ্ছে। বড় কষ্টের খাস। শুনতে পাচ্ছ না?

না।

জাহাজি আবার কান পেতে শোনে। তারপর অন্ধকারে তার অস্পষ্ট মুখখানা গৌরের মুখের কাছে এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বলে, মেট, এই ঘরে কেউ মারা যাচ্ছে।

অ্যাঁ?

এই শব্দ আমি চিনি।

গৌরের নেশা ধাক্কা খায়। টলমল করে মাথা। সে হাত বাড়িয়ে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কী বলছ?

এখানে কেউ মারা যাচ্ছে। নিরিবিলি, নির্জন এইখানে একা একা একজন মারা যাচ্ছে। খুব কষ্টের। খাস। বুকের শব্দ। মরবার আগে ঠিক এইরকম খাস ওঠে। উঠতে উঠতে ভেঙে ভেঙে যায়।

তাহলে?— গৌর তার রথম্যানে টান দেয়। তারপর কাশে।

চুপ!–জাহাজি ধমক দিয়ে চাপা গলায় বলে, ডিসটার্ব কোরো না।

কাকে?

যে মরছে, তাকে। সারাজীবন কত দুঃখকষ্ট মানুষের, কত খোঁজা, কত না-পাওয়া। বোধহয় অনেক শোকতাপ পেয়েছে। আহা! এতদিনে একটু সময় পেয়েছে মরার। একা একা, অন্ধকারে, নির্জনে আরামে মরছে এখন। ডিসটার্ব কোরো না। অতিথি এসেছে বুঝতে পারলেও তার পক্ষে উঠে এসে দরজা খোলা ভারী বিশ্রী ব্যাপার। মবার সময়টায় কাউকে বিরক্ত করা ঠিক না।

তারা চুপ করে শোনার চেষ্টা করে। গৌর কেবল বাইরে বাতাসে শুকনো পাতা গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ পায়। আর পোকা-মাকড়, পাখিদের শব্দ। আর ক্ষয়ের শব্দ।

জাহাজি দেশলাই জ্বালে। সেই ম্লান আলোয় তার মুখখানা বড় বিবর্ণ দেখে গৌর। জাহাজি ফিসফিস করে বলে, এই ঘরের জানালা থেকেই দেখা যাবে, তুমি চাও লায়লার রুটি’। এই ঘরেই স্যু রয়েছে মেট।

গৌরের শিরদাঁড়া বেয়ে সাপ নেমে যায়। গায়ের রোমকূপ শিউরে ওঠে। শীত করে তার।

সে স্খলিত গলায় বলে, স্যু?

স্যু।

জাহাজি আবার দেশলাই জ্বালে। আগুনটা জ্বলে উঠতেই জাহাজির দিশেহারা মুখ দেখতে পায় গৌর। কাঠিটা কাঁপতে কাঁপতে জ্বলে। আস্তে আস্তে কালো হয়ে কুঁকড়ে আসতে থাকে। আগুন সরে এসে জাহাজির আঙুল হেঁয়। দিশেহারা মুখখানা আবার অন্ধকার গ্রাস করে নেয়। কোনওখানে আলো নেই। তবু গৌর মনশ্চক্ষে দেখে একটা সবুজ আললা দপ করে জ্বলে উঠল। তাতে লেখা–তুমি চাও…।

প্রকাণ্ড ভারী দরজায় হেলান দিয়ে জাহাজি দাঁড়িয়ে। গৌর হাত বাড়িয়ে তার কাধটা ধরে।

কিন্তু সেই নিয়োন সাইনটা কোথায়? সেটা তো দেখা যাবে!

জাহাজি শ্বাস ছেড়ে বলে, কোথাও নেই। কেবল ওই ঘর থেকে দেখা যায়।

মাতাল। গৌর হাসে। বলে, চলো তো দেখি।

অন্ধকারে তারা দু’জন হাতড়ে হাতড়ে ঘুরে বেড়ায়। পাশের ঘরগুলো অন্য সব ঘরের মতোই ফাকা, চুন সুরকির তূপ পড়ে আছে। বাঁশের ঠেকনা রুজু রুজু দাঁড়িয়ে। তার ভিতর দিয়ে পথ করে করে তারা এ জানালায় ও জানালায় উঁকি মেরে দেখে। গাছের ডাল, ল্যাম্পপোস্ট, ঘুমন্ত বাড়ি, নিঝঝুম রাস্তা দেখা যায়। কোথাও নেই তুমি চাও লায়লার রুটি’র সেই সবুজ আলোর বিজ্ঞাপন। নেই, তবু গৌরের মনে হতে থাকে, আছে। কোথাও না কোথাও আছে। বাস্তবিক, বাজারে লায়লার রুটি নামে কোনও রুটি পাওয়া যায় কি না সে জানে না। ওরকম নিয়োন সাইনও তার চোখে পড়েনি। তবু মনে হয়, আছে। সে দেখেছে। বোধহয় স্বপ্নে। ঠিক ওই রকম একের পর এক সবুজ আলোর বান—তুমি…চাও…ােয়লার…রুটি। ওই কথা কটি যেন পৃথিবীর বাইরের কোনও জগৎ থেকে ভেসে আসে। লোভ দেখায়। স্বপ্নে জাগরণে কেবলই তার অলীক নিমন্ত্রণ। মানুষের ভিতরে কানায় কানায় উথাল-পাথাল ক্ষুধা জাগিয়ে তোলে লায়লার রুটি। মানুষ দু’হাত বাড়িয়ে চায়, তখন কোথায় মিলিয়ে যায় সবুজ অলৌকিক নিয়োন সাইন।

কষ্টেসৃষ্টে তারা আরও এক তলা ওঠে। সিঁড়ি কোথাও কোথাও ভাঙা, রেলিং ভেঙে পড়েছে, অন্ধকার। তবু তারা ওঠে। নিয়োন সাইনটা খোঁজার জন্য। আছে, কোথাও আছে ঠিক। কিন্তু উঠতে কষ্ট হয় খুব। আবর্জনার তূপ জমে আছে। কড়ি বরগা পড়ে আছে চারদিকে। আলটপকা বেরিয়ে থাকা লোহার শিক গায়ে খোঁচা মারে। বাঁশের ঠেকনোতে তারা ধাক্কা খায়।

ওপরে হাঁ হাঁ দরজার সব ঘর। আবর্জনা প্রচুর। পা দিতেই ধুলো ওড়ে। পা হড়কায়। ধুলোয় কোথাও বা পা ড়ুবে যায়। কিন্তু এখানে অন্ধকার তেমন জমাট নয়। ফিকে। একটা অপার্থিব হলদে আলোর আভা চারদিকে, ভারী অবাক হয় তারা। হলুদ আলোয় নানারকম ছায়া পড়েছে। তারা আবর্জনার স্তুপ পার হয়ে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। জানালায় জানালায় লায়লার রুটির বিজ্ঞাপন খোঁজে, পায় না। হলুদ আলোয় নিজেদের মুখ দেখে তারা।

গৌর হঠাৎ মুখ তুলে ভারী চমকে যায়। কী সুন্দর ছাদ! কী প্রকাণ্ড! তাতে চুমকি বসানো। একটা হলুদ আলোর ড়ুম জ্বলছে একধারে। কারা যেন ড়ুমটাকে ভারী অদ্ভুতভাবে ফিট করেছে দেয়ালে। বড় ভাল লাগে গৌরের। আরে বাঃ! দিব্যি ঘর। জাহাজিও হাঁ করে ছাদটাকে অনেকক্ষণ দেখে।

কয়েক পলক সময় লাগে ব্যাপারটা বুঝতে।

কী সুন্দর সিলিং! গৌর বলে।

উম।

ড়ুম জ্বলছে।

জাহাজি শ্বাস ফেলে বলে, ওটা সিলিং নয় মেট।

তবে?

 জাহাজি বিষন্ন গলায় বলে, ওটা আকাশ। ওর ওপর আর কোনও তলা নেই।

গৌর তখন বুঝতে পারে। ঠিক। মাথার ওপর ওটা আকাশই বটে। ছাদটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। চারদিকে কড়ি বরগা শোয়ানো। বাড়িটা এখানেই শেষ।

চাঁদের আলোয় তারা ছাদহীন ঘরগুলোর মধ্যে ঘুরে বেড়াতে থাকে। আকাশের একধারে বেশ্যার চোখের মতো কালি ঢালা গাঢ় কালোর মধ্যে বিবর্ণ মণির চোখ ওই চাঁদ। শেষে জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে। সোনার গুঁড়োর মতো চারদিকে জ্যোৎস্নার ধুলো ওড়ে। পরিদের আবার দেখতে পায় গৌর। ফিনফিনে শিফনের পাখায় উড়ে যাচ্ছে। তাদের ছায়া পড়ে না। জ্যোৎস্নাময় শরীর। ‘ওড়ো বাবারা, ওড়ো’–সে বিড়বিড় করে বলে।

জাহাজি তার হাত ধরে, মেট, একমাত্র সু-র ঘর থেকেই দেখা যায় লায়লার রুটির বিজ্ঞাপন। আর কোথাও ওই বিজ্ঞাপন নেই। কিন্তু সর ঘরে তো ঢোকা যাবে না। এখন, মরে যাওয়ার সুন্দর সময়ে সে কিছুতেই এসে দরজা খুলবে না। টুনাইট শি উইল এন্টারটেন ওনলি ওয়ান গেস্ট। ডেথ।

বাড়িটা খুবই উঁচু। গাই গাঁই গঙ্গার হাওয়ায় দমকা ধুলোবালি উড়ে আসে। চোখ কির কির করে, মাথার চুলে আটকে থাকে। হাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বগলুর পোলা গৌরা, অর্থাৎ কিনা বগলাপতির ব্যাটা গৌরহরির দম আটকে আসতে থাকে। ডেথ’ কথাটাই বাতাস হয়ে নাকের ফুটো দিয়ে ঢুকে ফুসফুস বেলুনের মতো ফুলিয়ে ফাটিয়ে দিতে চায়। কষ্ট হয় গৌরের। চাঁদের নীচে হঠাৎ মেঘ ডেকে ওঠে। বিদ্যুৎ চমকায়।

তারা বেভুল ঘুরতে ঘুরতে সিড়ির দরজায় আসে। তারপর অন্ধকার সিড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকে। বন্ধ দরজার সামনে তারা একটু দাঁড়ায়। স্বপনের ঘর। দরজা খুললেই একটা অন্য জগতে চলে যাওয়া যেত। যেখানে রয়েছে স্য, জাহাজিকে যে একদিন অলৌকিক জ্যোৎস্না খাইয়েছিল। আর রয়েছে সবুজ আলোর অপার্থিব বিজ্ঞাপন, তুমি চাও লায়লার রুটি। পৃথিবীর আর কোনও ঘরের জানলা থেকে যা দেখা যাবে না। ঘরের মধ্যে সুর গায়ের সুগন্ধ। সেই সুগন্ধের রেশ ধরে এসেছে এক হিম বাতাস। ভাঙা দীর্ঘ কয়েকটি খাস শেষবারের মতো টানছে স্য, অন্ধকারে একা।

জাহাজি দরজায় একটুক্ষণ কান পাতে। তারপর শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ে, বিরক্ত করা ঠিক হবে না। চলো মেট।

সিড়ি দিয়ে ঘুরে ঘুরে তারা নামতে থাকে। অন্ধকার ধুলোর গন্ধ। চামচিকে, ঝিঝি, ইদুর, আরশোলার শব্দ। আর সব শব্দের আড়ালে অবিরল এক মিহিন পতনের শব্দ শোনে গৌর। ক্ষয়ের শব্দ। ঝিরঝির ঝুরঝুর।

ফাঁকা কপাটহীন জানালা দরজা দিয়ে এক ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস হুড় দৌড় করে ঢোকে। ধুলো উড়তে থাকে। দুইজন দীর্ঘ অন্ধকার সিড়ি বেয়ে নামতে থাকে।

বাইরে এসে তারা দেখতে পায়, জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি পড়ছে। কী উল্লাস বৃষ্টির! চারদিকে। জলে মাটিতে প্রবল ভালবাসার চিৎকার ওঠে। জুড়িয়ে যাচ্ছে ভাপ। বৃষ্টি ভেদ করে ক্ষয়া চাদের আললা মেঘের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে। চরাচর জুড়ে দৌড়চ্ছে বৃষ্টির পা। অপার্থিব শিশু-পরিরা ধুয়ে মুছে গেছে। মেঘ ডাকে। পুরনো বাড়ির ভিত কেঁপে ওঠে। গুরগুর করে বাড়িটার বুক। অন্ধকারে তার অবিরল ক্ষয় চলেছে। মেঘের ডাকে তার আলগা পলেস্তারাগুলো খসে পড়ে। মৃত্যুভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে সে।

তারা দু’জন দরজায় দাঁড়িয়ে সেই জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি দেখে। তারপর জাহাজি হাত বাড়িয়ে গৌরের শুখো হাতখানা ধরে আত্মীয়ের মতো বলে, চলো মেট।

গৌর ঘাড় নাড়ে।

ল্যান্ডমাস্টারটা গাড়লের মতো দাঁড়িয়ে ভিজছে। লোকে যেমন গৃহপালিতের গায়ে হাত রাখে তেমনি আদরে গৌর ল্যান্ডমাস্টারের বনেটে একটা চাপড় দিয়ে বলে, চল বাবা ল্যাভু।

গভীর বৃষ্টির অভ্যন্তরে চলে যেতে থাকে তারা। রাস্তা কিছুই চেনা যায় না। পুরনো কলকাতা ধুয়ে গলে গেছে। তার বদলে মাঝরাতের বৃষ্টির ঝরোখা ভেদ করে এক অপরূপ কল্পনার শহর ফুটে ওঠে উইন্ডস্ক্রিনো চাদের হলুদ আলল, টিমটিমে ল্যাম্পপোস্ট, গাছের ছায়া, রাস্তার জল থেকে বিচ্ছুরিত আলো, বৃষ্টির ফোঁটায় আলোর বিন্দুর দ্রুত সরে যাওয়া। ঝিলমিলে অস্পষ্ট এক শহরের ভিতর দিয়ে জল ঠেলে চলে গৌরের ল্যান্ডমাস্টার, ওয়াইপারের কাটা দুটো পাগলের মতো নড়ে। তবু জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টির তীব্র ফোঁটাগুলো গভীর আবেগে এসে ফাটে কাচের ওপর। গৌর চোখে তেমন দেখে না। দু’জনের ভেজা শরীরে বাতাস লাগে। চুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। গাড়ির কাচ তোলা, বদ্ধ বাতাসে তাদের শ্বাসের ভাপ জমতে থাকে কাচের গায়ে।

গৌরের গাড়ি বড় আনন্দে অচেনা শহরটাকে ফঁকা রাস্তায় চক্কর মেরে ফিরতে থাকে। কিন্তু ক্ৰমে শহরের বাড়িঘর ফুরিয়ে যেতে থাকে। গাড়িটা একটা ফাঁকা জায়গায় চলে আসে। সামনে বিপুল বিস্তৃত অন্ধকার। সেই অন্ধকারে ছোট্ট ছোট্ট ফুটোর মতো কয়েকটা আলো। বৃষ্টির তীব্র শব্দ উইন্ডস্ক্রিন ফাটিয়ে দেয়। গৌর হাত দিয়ে কাচ মুছে ভাল করে সামনেটা দেখে। ঠিক বুঝতে পারে না, এটা কোন জায়গা। মনে হয়, একটা বিশাল মাঠ সামনে।

ল্যান্ডমাস্টার, ঘড় ঘড় করে। ভুড়ুক ভুড়ুক তামাক টানার মতো শব্দ হয়। তারপর কাশির শব্দ করে ল্যান্ডমাস্টার। গৌর একটু ঝুঁকে সামনে হঠাৎ দেখতে পায়, বিশাল সাদা একটা বাড়ি। চারদিকে ঘোর অন্ধকার। তবু বাড়িটা আবছায়ায় ঠিকই দেখতে পায় গৌর। বাড়ির চারদিকে বিরাট বাগান।

ল্যান্ডমাস্টারটার সব শব্দ হঠাৎ থেমে যায়। নিঃশব্দে গাড়িটা গড়ায় খানিক।

শালা!– গৌর বলে।

কী?— জাহাজি ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।

 শালার ল্যান্ডমাস্টারের তেল মরেছে।

জাহাজি উত্তর দেয় না। উইন্ডস্ক্রিনের ঝাপসা ভেদ করে প্রবল বৃষ্টির চিকের ভিতর দিয়ে সে সেই প্রকাণ্ড বাগান আর অস্পষ্ট বাড়িটা দেখছে।

মেট, ওই বাড়িটা আমার চেনা। আর ওই বাগান।

আমারও চেনা-চেনা লাগছে। কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না।

জাহাজি মুখ ফিরিয়ে বলে, ওই তো সেই বাগান যেখানে স আমাকে জ্যোৎস্না খাইয়েছিল।

অ্যাঁ!

জাহাজি মাথা নেড়ে বলে, ওই সেই ভিক্টোরিয়ার বাগান। চারদিকে অন্ধকার, তবু দেখো ওই বাগানে একটুখানি জ্যোৎস্না এখনও পড়ে আছে।

গৌর প্রাণপণে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই জ্যোৎস্না দেখতে পায় না। বলে, কোথায় জ্যোৎস্না?

জাহাজি গম্ভীর গলায় বলে, আছে মেট। আমার জন্য এখনও একটু জ্যোৎস্না রয়েছে। সবাই সবকিছু দেখতে পায় না।

জাহাজি হাতড়ে দরজার হাতল খোঁজে।

কোথায় যাবে?–গৌর অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

 জাহাজি বিড়বিড় করে বলে, ওই বাগানে আর একবার আমি যাব।

 পাগল! যা বৃষ্টি!

জাহাজি মাথা দুলিয়ে বলে, জাহাজ ছেড়ে গেলে আর হয়তো ফেরা হবে না। পৃথিবী বড় বিশাল। হারিয়ে যাব। আর এই বাগান, এই জ্যোৎস্নায় আসা হবে না মেট। আমাকে নামিয়ে দাও।

গৌর হাত বাড়িয়ে লক খুলে দেয়। বড় মায়া হয় তার। আহা, দুঃখী জাহাজি যদি ওই বৃষ্টির ফঁকা বাগানে কিছু পেয়ে যায় তো যাক।

দরজা খুলতে খুলতে জাহাজি বিড়বিড় করে বলে, স্য…জ্যোৎস্না…সবুজ আলো…লায়লার রুটি…

বলতে বলতে নেমে যায় জাহাজি। মুহূর্তে বৃষ্টির ঝরোখা ঢেকে নেয় তাকে। অন্ধকার ডাকে। বিদ্যুতের চমক, বাতাস, প্রকাণ্ড বাগানের বিস্তার ছোট্ট একা মানুষটাকে গ্রাস করে নেয়।

হুড় হাওয়া দেয়। উড়ে আসে তীব্র বৃষ্টির ফোটা। সব ওলট-পালট করে দিয়ে যাচ্ছে। পাল্টে দিচ্ছে শহর। বদলে দিচ্ছে মানুষের মন। চেনা চারদিকে অচেনা জগতের ছবি ফুটিয়ে তুলছে। গৌর অস্পষ্ট চোখে এইসব দেখে। বিদ্যুৎ চমকায়। গৌর আবছায়া ভেদ করে ঘুমের আঁষ-জড়ানো চোখে, জাহাজি বেড়ালের মতো লাফ দিয়ে উঠে দেয়াল ডিঙিয়ে বাগানের ভিতরে নেমে গেল।

চারটে দরজাই ভাল করে লক করে গৌর। হাই তোলে। পরিদের আর দেখা যাচ্ছে না। গৌর সামনের সিটে তার দুটো রুখে-শুখো হাত-পা গুটিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়ে।

তারপর বগলুর তিন নম্বর, হাফ-ফিনিশ ফিফটি পারসেন্ট গৌর বড় আরামে ঘুমোতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *