১. মানুষ অনেক বেড়ে গিয়েছে

বিশ্বাস – উপন্যাস – সমরেশ বসু

কথাটা বোধ হয় ঠিকই, মানুষ অনেক বেড়ে গিয়েছে। যে কোনও ব্যাপারেই। আমি আপাতত সংখ্যার কথাই ভাবছি। তা না হলে, এই ভর দুপুরে এত লোক চলাফেরা করছে কেন। এ সময়ে বাড়িতে যাদের থাকবার কথা তারা নিশ্চয়ই বাড়িতেই আছে। তথাপি এত লোক বাইরে চলাফেরা করছে, এই ভর দুপুরে, কাজেই হোক বা অকাজে, লোকসংখ্যা বেড়ে না গেলে এরকম হওয়া সম্ভব ছিল না। এ কথা যখন কেউ ভাবে বা বলে, লোকসংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে, এবং সে বাড়াবাড়িটা নিশ্চয়ই অবাঞ্ছিত, তখন নিজের সম্পর্কে সে কী মনে করে। বর্ধিত এবং অবাঞ্ছিত লোকসংখ্যার সেও যে একজন, এ কথা কি তার মনে হয়? আমার তো হচ্ছে না। আমি নিজেকে বর্ধিত ও অবাঞ্ছিতদের একজন মনে করতে পারছি না। বরং এই যে এত লোককে দেখতে পাচ্ছি, মেয়ে পুরুষ, পায়ে হেঁটে, বাসে ট্রামে ঠাসাঠাসি করে চলেছে, এদের সবাইকে বর্ধিত বলে মনে হচ্ছে। নিজেকে বোধ হয় কেউ বর্ধিত বলে মনে করে না। জন্মানোটা মানুষের নিজের হাতে না থাক, কিন্তু জন্মের পরে, রক্তে মাংসে মনে প্রাণে, সব মিলিয়ে, সে বোধ হয় তখন তার নিজের হাতেই বাঁধা পড়ে যায়। সে যে নিজের সম্পর্কে কতখানি সচেতন, সমস্ত বিষয়ে, নিজেও বোধ হয় জানে না।

হঠাৎ জল পড়ার ছরছর শব্দ হল, আর আমার পায়ে এসে ছিটে লাগল। পাশ ফিরে দেখি, একটা প্রকাণ্ড বাদামি রঙের গোরু প্রস্রাব করছে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে গেলাম, দুটো মেয়ে আমাকে দেখে, নিজেদের সঙ্গে চোখাচোখি করে, ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে চলে গেল। খুব মজা পেয়েছে মনে হচ্ছে। একটা লোক অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর একটা গোরু তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মূত্র ত্যাগ করছে এবং সে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়াচ্ছে, এটা দেখে মজা পাবার কী আছে! যত সব বর্ধিত সংখ্যার–, মেয়েদের কেন যেন বর্ধিতের দলে ফেলতে ইচ্ছে করে না। নিজেকেও না, মেয়েদেরও না। এই তো কয়েকদিন আগেই অফিসের অত্যন্ত ভিড় আর ব্যস্ত সময়ে, যখন আমার সামনে অনেক লোক লাইন দিয়ে অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কখন একটা রবার স্ট্যাম্প মেরে সই করে ফর্মগুলো তাদের হাতে তুলে দেব, তখনই আমি মনে মনে ভাবছিলাম, পৃথিবীতে আমি ছাড়া একটাও পুরুষ নেই, বাদ বাকি সব মেয়ে, এরকম হলে কেমন হয়। ভেবে বেশ মেজাজ এসেছিল, হাসিও পেয়েছিল, নিজেকেই মনে মনে বলেছিলাম, টপ গুরু। কিন্তু বাঁদর আর মোরগরা সেরকমই চায় বটে, তোমাকে আর বেঁচে থাকতে হত না, মেয়েরা তোমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলত। এ সব যখন ভাবছিলাম, তখন আমি হাত আড়াল করে, কলমের হিজিবিজি কেটে যাচ্ছিলাম, লাইনের লোকেরা যেন ভাবে, আমি কোনও কাজে ব্যস্ত রয়েছি। কিছু কিছু অধৈর্য মন্তব্য টীকা-টিপ্পনী শুনতে পাচ্ছিলাম। দাদার বোধ হয় হুঁশ নেই, এত লোক দাঁড়িয়ে আছে কিংবা দাদা এখন কবিতা লিখছেবা না, চিঠি। মনে মনে নিশ্চয়ই খুবই খারাপ খারাপ গালাগাল দিচ্ছিল। আমিও মনে মনে কাঁচকলা দেখিয়ে, পালটা দিচ্ছিলাম। অথচ আমার এ সব ভাবা উচিত ছিল না, কারণ এ সব মনোভাবকে আমি নিজেই ঘৃণা করি, কিন্তু দেখছি এই স্ব-বিরোধটা ক্রমেই আমার মধ্যে বাড়ছে।

না, এ ভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব। যার জন্য, যাদের জন্য অপেক্ষা করছি, তাদের দেখতে পাচ্ছিনা বলেই হয়তো, লোকসংখ্যা বেশি লাগছে। যাদের আসার কথা, তাদের আসতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। অথচ দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল, দাঁড়িয়ে আছি, পায়চারি করছি। কখনও ডাইনের পা বাঁয়ে, বাঁয়ের পা ডাইনে রেখে দাঁড়াচ্ছি, কেষ্ট ঠাকুরের মতো, পা টনটন করছে বলে। কেষ্টঠাকুর এর কম কাঁইচি মেরে দাঁড়ায়, না কি নাচে, বাঁশি হাতে নিয়ে, জানি না, ছবিতে দেখেছি।

ওদের কথাটা মনে হতেই আবার বুকের মধ্যে কেমন ধকধক করে উঠছে। গলার কাছটা শুকিয়ে উঠছে। যে দিক দিয়ে ওদের আসবার কথা, সে দিকে একবার তাকিয়ে দেখে তাড়াতাড়ি পায়চারি শুরু করলাম। যাদের জন্য অপেক্ষা করছি, যে কারণে অপেক্ষা করছি, কথাটা মনে হতেই, আমার হাত পায়ের জোর যেন কমে গেল। তবুও, খানিকটা জায়গা নিয়ে, ফুটপাথের ওপর পায়চারি করতে লাগলাম। রাস্তার তোক আর মানুষে ঠাসাঠাসি বাস ট্রাম কোনও কিছুর দিকেই আর মন যাচ্ছে না। খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে বোধ হয় এরকম হয়। ভয় মেশানো উত্তেজনা। এখন আমার দুশ্চিন্তাও হচ্ছে, উদ্বেগ বোধ করছি। কিছু একটা ঘটে গেল না কি? ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়নি তো? হয়তো বেরোবার মুহূর্তেই ওদের কেউ দেখে ফেলেছে, তারপরেই একটা চেঁচামেচি এবং পরিমলকে ধরে সবাই মারতে আরম্ভ করে দিল, আর লিপি ব্যাপার দেখে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতরে গিয়ে কোনও ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

অসম্ভব, ভাবতে পারছি না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। দর দর করে ঘাম ঝরছে। কাছেই একটা চায়ের দোকান রয়েছে, কী একটা কেবিন বলে ছোট সাইনবোর্ড টাঙানো। দু-তিনজন ঠেলাওয়ালা বা রিকশাওয়ালা বসে চা খাচ্ছে। দোকানের মধ্যে পাখা আছে, চলছে না। একজন মাঝবয়সি খালি গা কালো লোক, গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছছে, আবার গামছাটাই নেড়ে নেড়ে হাওয়া খাচ্ছে। আমি তাকেই বললাম, এক কাপ চা দিতে। সে ঘরের পিছনে পার্টিশনের আড়ালে চলে গেল। আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। যেদিক থেকে পরিমল আর লিপির আসার কথা, সেদিকে আবার দেখলাম। তারপরে হঠাৎ আমার মনে হল, আমি মাঝে মাঝে বড় বাজে কথা ভাবি। পরিমলকে কেউ মারতে পারে না বা পরিমলের সঙ্গে লিপিকে বেরোতে দেখলে কেউ চেঁচামেচিও করবে না। সেই কারণেই পরিমলকে পাঠানো, পরিমলকে লিপিদের বাড়ির সবাই চেনে। পরিমলের বিষয়ে লিপিদের বাড়িতে খারাপ কিছু ভাবে না।

পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছলাম। হঠাৎ উদ্বেগের ধড়ফড়ানি একটু যেন কমল। আবার রাস্তার দিকে ফিরে তাকালাম। ওপারের সবথেকে উঁচু হলুদ বাড়িটার চিলে কোঠার ছাদে এক ঝাঁক পায়রা বসে রয়েছে। ওদের গায়ে রোদের ঝলক। এই রোদে ওখানে কেমন করে ওদের ভাল লাগছে। পায়রারা তো ছায়াই ভালবাসে, ছায়াতে থাকে, মাদি মদ্দা ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমো খায়–চুমোই তো, আমার ঠিক তাই মনে হয়, মানুষের মতোই যেন ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে আদর করে। তারপরে একজনের ওপরে আর একজন ওঠে, জোড় খায়। দেখে এমন স্বাভাবিক আর সুন্দর লাগে, মনে হয় যেন ওরা কোনও একটা সাত্ত্বিক আচরণ করছে। আবার ছাড়াছাড়ি করে, পাখা ঝাপটা দেয়, যেন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিল, এদিক-ওদিক দেখতে লাগল, সুন্দর সুডৌল রঙিন গলায় ঢেউ দিয়ে দিয়ে হঠাৎ উড়ল দুজনে দুদিকে, ফিরল, একজনের ঠোঁটে খাবার, আর একজনের কুটো। ঘরের মধ্যে ঢুকে দুজনেরই বকম বকম কথা। কারোর সাতে নেই পাঁচে নেই, পিকাসোর আঁকা শান্তির প্রতীক। তারপরে আবার চুমো, আবার জোড়, সত্যি এমন সুন্দর–কিন্তু মানুষের বেলায় সেটা ভাবাই যায় না। আমাকে আর লিপিকে যদি কেউ ওরকম ভাবে দেখত, ধরে পাগলা গারদে দিয়ে দিত–আশ্চর্য, তিনটেও বেজে গেল, এখনও ওরা এল না। সেই বেলা একটা থেকে

চা নিন।

চাওয়ালার গলা শুনে পিছন ফিরে চায়ের কাপ নিলাম। ফুটপাথে দাঁড়িয়েই চুমুক দিলাম। সেই বেলা একটা থেকে অপেক্ষা করছি। ওদের আসতে পনেরো কুড়ি মিনিটের বেশি লাগবার কথা নয়, এখনও পর্যন্ত পাত্তা নেই। কী ঘটতে পারে। এমন কী ঘটতে পারে, যাতে দু ঘণ্টার মধ্যে ওরা এসে পৌঁছুতে পারল না। লিপি কি কোনওরকম ভয় পেয়ে গেল। কিংবা মন বদলে ফেলেছে। তা হলেও পরিমলের এসে আমাকে খবর দেওয়া উচিত। ও তো জানে আমি কী অবস্থায় কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। এমন নয় যে, আমি দুটো তিনটে জায়গার কথা বলেছি, একটা জায়গারই কথা বলেছি, এখানকার কথা। নিশ্চয় পরিমলের শুনতে ভুল হয়নি। আর তা যদি হয়ে থাকে তবে যাকে বলে, একেবারে কেলোর কীর্তি হয়ে বসে আছে। আবার একটা দুশ্চিন্তা, লিপিকে নিয়ে পরিমল অন্য কোথাও গিয়ে আমাকে খুঁজছে না তো? তা হলে উপায়, কোথায় গিয়ে ওদের খুঁজব!

চা খাওয়া হয়ে গেলে কাপ আর পয়সা দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম, তখনই দোকানের ডান দিকের দেওয়ালের আয়নায় আমার মুখ দেখা গেল। একে কালো, রোদে পুড়ে আর ঘামে ভিজে এখন আরও কালো দেখাচ্ছে। এক বার ভুরু কোঁচকালাম, দু বার নাচালাম, আমার চেহারাটা কালোর ওপরে খুব খারাপ না, সবাই বলে একটু মেয়েলি মেয়েলি নরম, আর নাকের মাঝখানটা একটুখানি ভাঙা, এই যা খারাপ। ছেলেবেলায় বকসিং শিখতে গিয়ে নাকের মাঝখানে হাড়টা ভেঙে গিয়েছিল। খালি হাতেই শেখা হচ্ছিল, নরেশ নাকের ওপর এত জোরে কষিয়েছিল, প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। অবিশ্যি, তারপরে বাবাও কয়েক ঘা কষিয়েছিলেন, সেটা পিঠে, কারণ বকসিং শিখতে গিয়ে নাকের হাড় ভেঙেছি বলে। লিপি মাঝে মাঝে নাকের এই ভাঙা জায়গাটায় হাত দিয়ে হেসে ওঠে, বলে, তোমার এই ভাঙাটা তোমার মুখটাকে কেমন করে দিয়েছে।

আমি জিজ্ঞেস করি, কেমন করে দিয়েছে, বম্বেটের মতো?

লিপি খিলখিল করে হেসে বলে, বম্বেটে? তোমার এই বড় বড় চোখ, আর চোখা নাক, মেয়েলি মুখ, ঢেউ খেলানো চুলে কোনওদিন বম্বেটে দেখাবে না।

তবে কী রকম?

তুমি যেন গোবেচারা, হেলপলেস। অবিশ্যি সেটা তোমার মুখের ভঙ্গি, আমি জানি। ভিতরে ভিতরে তুমি অন্যরকম।

কী রকম?

 ন্যাকা, জান না? মিটমিটে শয়তান।

এরকম বললে, আমি লিপির মুখের দিকে চুপ করে চেয়ে থাকি। লিপি তৎক্ষণাৎ আমার মুখের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ওঠে, এই তো, এই তো, তুমি এখন এমন মুখ করে আছ, যেন গোবেচারা, আমি জানি, তুমি মনে মনে শয়তানি করছ।

শুনে আমারও হাসি পায়, ওর গালটা টিপে দিই, এবং আমার নিজেরও মনে হয়, বোধ হয় আমি সত্যি মিটমিটে শয়তান, বন্ধুরা যাকে অন্য কিছু বলে, আর আমার হাসিটা তখন অনেকটা ধরা পড়ে যাওয়া হাসির মতো। একটু মিটমিটে ভাব আমার আছে। আমি যতটা ভাল মানুষ নই, তার চেয়ে আমার মুখ অনেক বেশি শান্ত আর গোবেচারা দেখায়। কেন কে জানে, অথচ আমি ইচ্ছা করে কিছু করি না।

কিন্তু, এ সব বুঝলাম, আমার চেহারাটা কার্তিকের মতে, এদিকে জামা আর কোমরে ঊরুতে কাপটি খাওয়া প্যান্ট ঘামে ভিজে উঠেছে। লিপি পরিমল এখনও আসছে না কেন! বেলা একটার সময় এখানে এসে যখন দাঁড়িয়েছিলাম, তখন যে উত্তেজনা আর ভয়-ভয় ভাবটা ছিল, সেটা অনেক কমে। এসেছে। চা খাবার পরে মুখের ভিতরটাও তেমন শুকনো লাগছে না। তবে, মাঝে মাঝেই মনের মধ্যে যেন বিদ্যুতের মতো চমকে চমকে উঠছে। এখন ভেবেই পাচ্ছি না, ওদের কী হল, আসছে না কেন! নিশ্চয় সারা দিন সারা রাত এভাবে এখানে অপেক্ষা করতে পারি না। একটা কিছু নিশ্চয় ঘটেছে, কিন্তু কী ঘটতে পারে, কিছুই বুঝতে পারছি না। আগে থেকেই সব জানাজানি হয়ে যায়নি তো। তা হলে অবিশ্যি পরিমলের কিছু করবার থাকবে না। তবে সেটাও তো পরিমল এসে আমাকে জানাবে।

.

লিপির ওপরেই আমার রাগ হচ্ছে বেশি। এ সব আমার ডিগনিটিতে লাগে। আমি এত বড় একটা ছেলে, লোকে জানে ভদ্রলোকেরই ছেলে, লিপিও ভদ্রলোকের মেয়ে। আমরা প্রেম করেছি, তা বেশ করেছি, বাড়ি থেকে পালাব কেন? আমরা তো জোর করেই বিয়ে করতে পারি, আমাদের তো সেই ইয়ে আছে, অধিকার, আমরা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করব, অন্য জায়গায় বাসা ভাড়া করে থাকব, তারপরে যে যা খুশি করুক গিয়ে। লোকে তো জানে, আমি একটা এম এ পাশ ছেলে, আমি নিজেও তা-ই জানি, আমি একটা এম এ পাশ করা ছেলে। কিন্তু বাংলায়, যে কথা ভাবলেই গায়ের মধ্যে কেমন ঘুলিয়ে ওঠে, একটা বমি বমি ভাব লাগে। একে বাংলা তায় আবার থার্ড ক্লাস, নিজেকেই চিবিয়ে খেতে ইচ্ছা করে। শরীরে একটু মাংস আছে, রূপ নেই, এরকম অশিক্ষিত মেয়েরও আমার থেকে বাজার-দর বেশি। চোখের সামনেই তো সে সব কত দেখছি। কী জন্য আমি এরকম একটা জঘন্য কাণ্ড করেছিলাম, জানি না। কলেজে লেকচার দেওয়া বা ইস্কুল মাস্টারি করার কথা আমি কখনও ভাবিনি। একমাত্র এই একটা কারণেই কেউ বাংলায় এম এ পড়তে পারে। একে তো বিষয়টি কূটকচালে, ব্যাকরণ আর বানানেই পিতৃপুরুষের নাম ভুলিয়ে দিতে পারে। লিখতে হয় গাদা গাদা, হাজার বছরের সাহিত্য মুখস্থ রাখতে হয়। তারপরে যখন সার্টিফিকেটটি নিয়ে বাজার বেরিয়ে এলে, যেন গায়ে বিষ্ঠা মেখে এলে, এমনই করে সকলে তাকাবে, মুখ বিকৃত করবে। যা কখনও চাইনি, ইস্কুলের মাস্টারি, তাও বি-টি না হলে অচল। কলেজে থার্ড ক্লাসের কোনও আশা নেই। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এক বিভাগে অস্থায়ী কেরানির চাকরি করছি। তার জন্যও অনেক কাঠখড় পোড়ানোর ব্যাপার আছে। অবিশ্যি তলে তলে অন্য মতলবে আছি, থার্ডক্লাস-ই কী করে ফাস্টক্লাসকে ডিঙিয়ে প্রফেসরের চাকরি পায়, সেটা হয়তো দেখিয়ে দিতে পারব শিগগিরই।

কিন্তু সেটা যাই হোক, একটা মেয়েকে মানে প্রেমিকাকে নিয়ে পালিয়ে যাব, কাউকে কিছু না বলে কয়ে, এটা আমার ভাল লাগে না। পালাব কেন? বড় জোর, পালিয়ে একদিন বিয়েটা রেজিষ্ট্রি করে আসতে পারি। যেন ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখতে যাওয়া হয়েছিল, এইভাবে। তারপরে গুছিয়ে গাছিয়ে সব ঠিকঠাক করে জানিয়ে দিলেই হত। পাড়ার লোকেরা বা বন্ধুরা বলবে, আমি পাড়ার একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছি, সেটা বিশ্রী। লিপিকে অনেক রকম ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম। এ রকম একটা ছেলেমানুষি আমাদের না করাই উচিত। যা-ই হোক, পাড়ায় বা লোকজনের কাছে এখনও ভাল ছেলে বলেই তো আছি। বাংলায় এম এ পাশ যতই নিৰ্ঘিন্নে ব্যাপার হোক, এম এ পাশ কথাটার একটা দাম আছে, সেজন্য পাড়ায় একটু প্রেস্টিজও আছে। লিপির জন্য এবার তা ঢিলে হয়ে যাবে। আমার বাবা মায়ের জন্য আমি ভাবি না। লিপিকে আমাদের বাড়িতে কেউ পছন্দ করে না, সবাই বলে, ও নাকি খুব বাজে মেয়ে। বাজে বললে অল্পই বলা হয়। আমার মা বোনের মুখে যখন শুনেছিল, আমি লিপিকে ভালবাসি, ওকে বিয়ে করবার কথা ভাবছি, মা নাকি বলেছিল, তার চেয়ে বাজার থেকে একটা মেয়ে ধরে নিয়ে এলেই হয়–আমার বোনের মুখে শুনেছি। মায়ের সঙ্গে বাবার চিন্তা-ভাবনার যে বিশেষ তফাত হবে, তা মনে হয় না। অতএব লিপিকে বিয়ে করলে আমাকে বাড়ি ছাড়তে হবেই, সেজন্য মায়ের এত আপত্তির কারণ কী। লিপির বাবার অবিশ্যি তেমন আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। কারণ রাস্তায় দেখা হলে হুমদোমুখে লোকটি আমার সঙ্গে কথা বলেন। হুমদোমুখোই, এমন ফাঁপানো ফোলানো মস্ত বড় মুখ, যেন চাপ চাপ মাংস থেবড়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফোলা ফোলা চোখের কোলের ওপরে ড্যাবডেবে দুটো চোখ ভেসে থাকে, তাতে হাসি রাগ কিছু খেলে বলে মনে হয় না। পুরো রামগরুড়ের ছানা, হাসির লেশমাত্র নেই। রাস্তায় দেখা হলেই কী খবর, ভাল তো, তোমাদের পার্টি কী বলছে–এ ধরনের কথা জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু জবাব শুনতে চান বলে হয় না, মালকোঁচা দিয়ে ধুতি আর সাবেকি হাফশার্ট পরা মোটা শরীরটা নিয়ে চলে যান।

আচ্ছা, উনি কি জানেন না ব্যাপারটা, কেন আমি আর ওঁদের বাড়ি যাই না। লিপির মা কি ওঁকে বলেনি। হয়তো বলেছে, উনি জানেন সবই, গায়ে মাখেন না, কেন না, উনি কথা বলেন, অথচ এক দিনও জিজ্ঞেস করেন না, কেন ওঁদের বাড়ি যাই না। আগে তো প্রায়ই প্রায় রোজই লিপিদের বাড়ি যেতাম। অনেক ছেলেই ওদের বাড়ি যেত, এখনও যায়, আমিই শুধু বাদ। আগে আমার মনে হত, সব ছেলেই লিপির সঙ্গে প্রেম করতে যায়, লিপির সঙ্গে সকলেরই খুব ভাব, হাসি ঠাট্টা ইয়ার্কি কথাবার্তা। তারপরে বুঝতে পেরেছিলাম, সকলের সঙ্গে ভাব, প্রেমটা আমার সঙ্গেই, তথাপি এক-একটা ছেলের সঙ্গে ও এমন হাবভাব করে দেখলে আমার হিংসা হয়, কষ্ট হয়, রাগও হয়। তখন দাঁতে দাঁত চেপে বলি, এক বার কপালে সিঁদুর ঠেকিয়ে ঘরে তুলতে পারলে হয়। ও সব ছেলে-ন্যাকরামি ছাড়িয়ে দেব। কিন্তু আমার মনের কথা ওকে কখনও বলি না। কিন্তু এও আবার সেই কনট্রাডিকশন, লিপি সম্পর্কে সত্যি আমি এরকম কিছু ভাবতে চাই না, কিছু করতেও পারব না।

এখন তো কিছুই দেখতে পাই না, জানতে পারি না, ছেলেদের সঙ্গে ও কীরকম ঠাট্টা ইয়ার্কি করে, গায়ে হাত দিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করলেই আমার সবথেকে বেশি খারাপ লাগে। এখন লিপির সঙ্গে আমি লুকিয়ে দেখা করি। বাড়িতে না, অন্য কোথাও, রেস্তোরাঁয় বা ময়দানে বা সিনেমায় বা গঙ্গার ধারে। প্রায় আট মাস হয়ে গেল, একদিন সন্ধ্যার ঝোঁকে দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে লিপিকে আদর করছিলাম– মানে চুমো খাচ্ছিলাম, ঠিক সে সময়েই ওর মা এসে পড়েছিল, লিপি আমার কাছ থেকে ছিটকে ওপরে চলে গিয়েছিল। আমার বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছিল, মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল, লজ্জায় আর ভয়ে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। চকিতে একবার দেখে নিয়েছিলাম, লিপির মায়ের চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। লিপির মাকে আমি বরাবরই একটু ভয় পাই, অমন রোগা-চোখা খাণ্ডার মেয়েমানুষ আমি কমই দেখেছি। শরীরের বাঁধুনি এখনও বেশ শক্ত, শুধু পুরুষ না, ছেলে ভোলানোও বলা যায়, সাজগোজও সেই রকম। সবসময়েই সেজেগুজে থাকে, বাড়িতে থাকলেও চোখে কাজল, ঠোঁটে একটু রং, ফলস দিয়ে বড় করে খোঁপা বাঁধা থাকে। লিপিও সেইরকমই থাকে তবে ওর মায়ের চেয়ে সাজগোজটা একটু কম। কেন, তা জানি-মানে ওর মা কেন এত সেজেগুজে থাকে বা লিপি কেন কম। আমি ভেবেছিলাম, লিপির মা বোধ হয় আমাকে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দেবে। কিন্তু আমি খালি উত্তেজিত আর ক্রুদ্ধ গলাই শুনতে পেয়েছিলাম, অনেক দিন থেকেই আমার এ সব সন্দেহ হচ্ছিল, ভাবছিলাম কোনওদিন হাতেনাতে ধরতে পারলে বলব। যাও, আর কোনওদিন এ বাড়ি এসো না।

আমার তো কাপ ছটকে যাবার অবস্থা, কোনওরকমে পালানো নিয়ে কথা। রীতিমতো পা কাঁপছিল। কোনওরকমে মাথা নিচু করে, লিপির মায়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম, পাউডার আর সেন্টের গন্ধ পেয়েছিলাম। লিপির মা যে কী, সবাই জানে। কেন এত ঠসক ঠমক, সাজগোজ করে বেরোনো আর পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে এদিক-ওদিক যাওয়া কারো কিছু জানতে বাকি নেই। সে কিনা আমাকে ওরকম করে বলেছিল, মেয়েকে একটা চুমো খেয়েছিলাম বলে। আমি যদি তখন লিপির মাকে তার বিষয়ে কিছু বলতাম। …না, সেটা ভাবা যায় না। তা হলে নির্ঘাত মারধোর করত। এত বড় একটা ছেলেকে কেউ যদি ওভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে, খারাপ কিছু বললে দু ঘা কষিয়ে দেবে, এমন কী বেশি কথা। সেই থেকে আর লিপিদের বাড়ি যাই না। তবে গোরু বাছুরে ভাব থাকলে যেমন বনে গিয়ে দুধ দেয়, আমরাও তেমনই বাইরে বাইরে দেখা করি, আর মনে মনে লিপির মাকে বলি, হ্যাঁদ্দ্যাখ মোর কলাটা! তা-ই ভাবি। লিপির বাবা তবু আমার সঙ্গে কথা বলেন, যেন কিছুই জানেন না, বা কোনও রাগ নেই।

.

কিন্তু সত্যি বখাটে ছেলেদের মতো এভাবে পালিয়ে যেতে আমার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না। প্রেস্টিজ বলে একটা কথা আছে। লিপির খালি এক কথা, ওরে বাবা, মা বাবাকে আমি কিছু বলতে পারব না। তা হলে বিয়ে তো দূরের কথা, মা আমাকে মেরেই ঠাণ্ডা করে দেবে, আমার ভীষণ ভয় করে।

আসলে, লিপি যেন কেমন, মোটেই সিরিয়াস না, অথচ ওকেই আমার ভাল লাগে। পালিয়ে যাওয়া ব্যাপারটা ওর কাছে যেন একটা থ্রিলিং, উত্তেজনা মেশানো মজার মত। ওর কথা শুনলে, চোখমুখের ভাবভঙ্গি দেখলে, সেইরকম মনে হয়। প্রেম বা বিয়েটা যেন আসল না, পালিয়ে যাওয়াটাই আসল। একটা ছোট চিঠি লিখে রেখে টুক করে কেটে পড়ব। এইরকম ওর কথা। হার বালা সব পরে নেব। আগে থেকেই ও সব ভেবে রেখেছে। আমার আবার এরকম ঠিক ভাল লাগে না, একটা যে সেরকম গভীর আর গুরুতর ব্যাপার, আমাদের বিয়েটা, তা মোটেই মনে হচ্ছে না। লিপিকে নিয়ে নীরেন শালা পালিয়েছে রে এইরকম বলবে পাড়ার ছেলেরা। লিপিকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না, অথচ ওর কথায় রাজি না হলে আমাদের বিয়েটাই কোনওদিন হবে না। সেটা আমি ভাবতে পারি না। রাজি না হয়ে আমার উপায় নে

রাজি হয়েছি, ঠিক আছে, কিন্তু এ কী ব্যাপার, চারটে বাজল যে! কী করব বুঝতে পারছি না।

নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে–আমার মন বলছে; আর আমার মন বলছে, লিপি শেষ পর্যন্ত ভয় পেয়ে গিয়েছে, তাই বেরোয়নি। এ ছাড়া আর কী হতে পারে। কিন্তু সে কথাও বলবার জন্য পরিমল আমার কাছে আসবে তো। ও তো নিজেই বলেছিল, মা যখন একটার সময় সেই তাকে টেলিফোন করতে যাবে পনেরো কুড়ি মিনিটের কমে তো কথা শেষ হবে না। তখন আমি বেরিয়ে যাব। পরিমলদাকে বলে দেবে, সে যেন আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে। একলা একলা আমি যেতে পারব না। সেই তাকে মানে ওর মায়ের সেই সে যাকে বলে কী বলা যায় বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই আমি লিপির যা, সেই সে ওর মায়ের তা না, কারণ আমরা অবিবাহিত যুবক-যুবতী। অবিশ্যি তাতেও কিছু যায় আসে না, বিবাহিতা মহিলাদেরও প্রেমিক থাকতে পারে, কিন্তু সেই তাকে আমি দেখেছি, কখনও মনে হয়নি, সে লিপির মায়ের প্রেমিক। সে বেশ দেখতে, বয়স কম, লিপির মায়ের থেকে ছোট। আমার কেমন যেন মনে হয়, লিপির মায়ের সোনার গহনা বা সুন্দর দামি কাপড় জামা বা তার বয়সকালের শরীরের বাঁধুনিতে এখনও যৌবন বলে যে পদার্থ আছে, যেটাকে আমার একধরনের ভালগার আর লজ্জাজনক বলে মনে হয়, যা দেখাতে সে ভালবাসে, সেই সে অনেকটা তা-ই, দেখো, কেমন জোয়ান সুন্দর ছোকরাকে এখনও আঁচলে বেঁধে নিয়ে বেড়াচ্ছি। এ রকম লোককে প্রেমিক বলা যায় কি না জানি না। ঠিক বেলা একটার সময় লিপির মা সেই তাকে টেলিফোন করে, তখন সে এত বিভোর হয়ে থাকে, কোনও দিকে খেয়াল থাকে না। লিপি সেই সময়েই পরিমলের সঙ্গে চলে আসবে বলেছিল। সেই রকমই ব্যবস্থা করা হয়েছে, পরিমলকে পাঠিয়ে দিয়ে তবে আমি এসেছি। কিন্তু তিন ঘণ্টা লাগবার কারণ কী, বুঝতে পারছি না।

.

এ কী রে নীরেন, তুই এখানে দাঁড়িয়ে?

আমাদের পাড়ারই ছেলে, দিগন্ত। দিগন্ত, একটা নাম, কেবল কোন দিগন্ত এটাই আমি বুঝি না, পুব না পশ্চিম, উত্তর না দক্ষিণ। ও এমন থমকে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল আর বলল, যেন কী একটা অদ্ভুত লোককে দেখছে। আমি কথা বাড়াতে চাই না, বললাম, এমনি।

দিগন্ত আরও অবাক হল, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন ওর মুখে কথা আটকে গেল, তারপরেই যেন ছিটকে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, লিপি কোথায়?

অবাক হয়ে বললাম, তার মানে?

দিগন্ত এবার আমার কাছে দু পা এগিয়ে এল, অবাক মুখেই হাসল, বলল, মানে আবার কী, তুই তো ভালই জানিস বাবা।

ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারলাম না, অথচ আমার বুকের মধ্যে ধক ধক করতে লাগল, গলাটা শুকি কে সাদা দাঁতের হাসি, আমার দিকে চেয়ে থাকা চকচকে চোখ, উঁচু চোয়াল মোটা য়ে যেতে লাগল, দিগন্তকে আমার অচেনা মনে হল। শুধু অচেনা নয়, ওর ঝকঝ নাক মুখটা যেন ঠিক মানুষের মুখ না, অন্য কোনও একটা জীবের মুখ, পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনও একটা জগৎ থেকে এসেছে আর সেই অচেনা জগতের স্বরে কথা বলছে, যা শুনলেই বুকের মধ্যে কাঁপতে থাকে। লিপি কোথায়, এ কথা ও আমাকে জিজ্ঞেস করছে কেন। আমি লিপির জন্য অপেক্ষা করছি এ কথা ও কি জানে? জানে নিশ্চয়ই, না হলে জিজ্ঞেস করবে কেন, ভাবতেই শিউরে উঠছি, তার মানে কিছু কি জানাজানি হয়ে গিয়েছে।

দিগন্ত আবার বলল, আতা ক্যালানের মতো চেয়ে রইলি যে! তুই এখানে দাঁড়িয়ে কেন, তোকে যে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, পুলিশ!

 দিগন্ত কেমন একরকম করে হাসল, দেখলেই মনে হয়, এ হাসি দিয়ে চিবিয়ে খাওয়া যায়। আমার বুকের ধকধকানিটা বেড়ে উঠল। দিগন্ত কী বলছে আমি যেন ঠিক বুঝতে পারছি না, অথচ প্রত্যেকটা কথাই যেন আমার বুকে, ঢাকের কাঠিতে দগর দিচ্ছে। দিগন্ত বলল, এখনও আর কেন নকশা দিচ্ছিস বাবা। সশালা পরের মেয়ে নিয়ে কাট মারবে, তারা তোমাকে এমনি ছেড়ে দেবে? ন্যাকা।

মনে মনে যা-ই ভাবি, আমি দিগন্তর মতো কথা বলতে পারি না। কিন্তু ওর কথা শুনতে শুনতে আমার বোধবুদ্ধি সব যেন কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে, মাথার ভিতরটা ফাঁকা, তথাপি শিরদাঁড়ায় একটা ভয় সাপের মতোই পাক দিয়ে দিয়ে জড়াচ্ছে। আমি বললাম, কিন্তু আমি তো লিপিকে নিয়ে–মানে কোথাও যাইনি।

দিগন্ত না হেসে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তার পরে যেন ও রেগে উঠে হাসল, বলল, সেইনকশা, মামারবাড়ির গপপো ঝাড়ছিস। দেড়টা-দুটোর সময় লিপিকে নিয়ে তুই পালিয়ে যাসনি? লিপি বাবা-মাকে চিঠি লিখে রেখে গেছে। ওর মা ওর বাবাকে অফিস থেকে টেলিফোন করে বাড়িতে ডেকে এনেছে। ওর বাবা এসে থানায় গিয়ে খবর দিয়েছে। পাড়াময় ঢি ঢি। তুই লিপিকে নিয়ে পালিয়েছিস। পুলিশ তোদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, আর তুমি শালা এখানে দাঁড়িয়ে আমাকে নকশা দিচ্ছ? ৬৯৪

দিগন্তর প্রত্যেকটা কথাই সত্যি, এতে কোনও সন্দেহ নেই, আমার মন বলছে। কিন্তু তা সম্ভব কী করে, লিপি তো আমার কাছে আসেনি। সেই বেলা পৌনে একটা থেকে আমি এখানে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম না নিশ্চয়ই। পরিমলও আমাকে কোনও খবর দিতে আসেনি-আরে, ওটা কে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, লিপি না? আমি প্রায় পা বাড়াতেই যাচ্ছিলাম, এক সেকেন্ডেই বুঝে নিলাম, লিপি না, লিপির মতো শরীরটা, হাঁটবার ভঙ্গিটাও, আর চুল বাঁধার ধরনে একটু মিল আছে। আমি দিগন্তর দিকে তাকালাম, কোনও কথা বলতে পারছি না। দিগন্ত আবার বলল তা, আমাকে যা খুশি বুজরুকি দিতে পারিস, আর লিপিকে কোথাও লুকিয়ে রেখে এসে এখানে যতই ভাল মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাক, দাঁড়কাক ভুলবে না, খাবলে খাবে।

দাঁড়কাকে খাবলে খাবে, মানে কী। আমি কি একটা মড়া নাকি যে, দাঁড়কাক কী বিশ্রী কালো লম্বা ধারালো ঠোঁট দিয়ে আমাকে খাবলাবে। দিগন্ত চলে গেল, যাবার আগে ঘৃণা আর রাগ মেশানো ধারালো হাসি দিয়ে আমাকে যেন হেনে গেল। শুধু রাগ আর ঘৃণাই বা বলছি কেন, কেমন একটা দয়ার ভাবও যেন ওর হাসির মধ্যে ছিল। ওটাকে দয়া বলে না বিদ্রূপ বলে, আমি তা ঠিক বুঝতে পারছি না, কিন্তু সব মিলিয়ে ওর ভঙ্গিটা এমন, যেন অনেক দিন তকে তকে থেকে হঠাৎ ও আমাকে বেকায়দায় পড়তে দেখে খুশিনা, খুশি বলব না, একটা মেজাজে এসে গিয়েছে। আমি দিগন্ত বা দিগন্তের গ্রুপের সঙ্গে অনেক কাল মেলামেশা করি না, তেমন দরকার না হলে কথাও বলি না। দিগন্ত আমার ছেলেবেলার বন্ধু, কিন্তু একটা সময়ে, যখন আমি কলেজে পড়ছি, কবিতা বা গল্পটল্প লেখবার চেষ্টা করছি–রোজ একটা করে কবিতা বরাদ্দ ছিল, বিষয় দুটো, প্রেম আর সংগ্রাম, কখনও কখনও দুটো মিলিয়ে একটা, এবং নানারকম পড়াশুনোয় মনোযোগ দিয়েছি, তখন ওদের কাছ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। দিগন্ত, বা নিখিল, আরও কয়েকজন, ওরা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিল, রকে আর পাড়ার মোড়ে বসতে আরম্ভ করেছিল, পূজা কমিটি আর ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, শিস্ দিতে ভালবাসছিল, আর–আর কী বলব, ভাল কথা তো খুঁজেই পাচ্ছি না, র‍্যালা করা যাকে বলে, কেন না সেই যে কী গান: একে দিলি, তাকে দিলি…ধরনের গানগুলো, মেয়েদের দেখলেই গেয়ে উঠছিল।

কী দেওয়ার কথা বলছিল ওরাই জানে, সিকি আধুলি নাকি, না খই-মুড়কি, আর নয়তো তুলসী পাতা, তা ছাড়া একে-তাকে আর কী দেওয়া যায়, আর মনে হচ্ছিল ওরা একটা যুদ্ধক্ষেত্রে তৈরি করছিল, যুদ্ধক্ষেত্র রকে রকে, মোড়ে মোড়ে, কারণ এখন তো রোজই যুদ্ধ, সকালে-বিকালে সন্ধ্যায়, যে কোনও সময়েই হঠাৎ যুদ্ধ লেগে যায়, দুম দুম বোমা ফাটতে আরম্ভ করে, তার সঙ্গে ইট-পাথর ছোঁড়াছুড়ি, হঠাৎ দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, ট্রাম বাস চলে না, পাড়ার ভিতর থেকে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা মজা দেখবার জন্য ছুটতে থাকে, ব্যালকনিতে ছাদের আলসেয় মেয়েরা দল বেঁধে ঝুঁকে পড়ে, বুকের আঁচল এলিয়ে পড়ে, ব্লাউজের বোতাম থাকে কিনা দেখে না, কেমন একটা অবাক উল্লাসে তাদের চোখ-মুখ ঝকঝক করে, আর পুরুষেরা, যাদের নাকি আমাদের দেশে ব্যাটাছেলে বলে তারা ফুটপাথের নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে, সিগারেট টানতে টানতে, পান চিবোতে চিবোতে, দাঁতে খড়কে খুঁটতে খুঁটতে দর্শকের ভূমিকা নেয়, বেশি বাড়াবাড়ি বা পুলিশ আসতে দেখলে, দু ঠ্যাঙের মাঝখানের লুঙ্গি বা ধুতি বা প্যান্ট বা পায়জামা চেপে, ইঁদুরের মতো গলিতে ঢুকে পড়ে, আর বলাবলি করে, ওই যে পেটো ছুড়ছে, ওটা দিগা না? মানে দিগন্ত, ও এখন এই নামেই বিখ্যাত। আমার সেই কলেজে পড়ার সময় দিগন্ত যখন দিগা হচ্ছিল, তখন থেকেই আমার সঙ্গে মেলামেশা নেই, ওর একটা জগৎ, আমার একটা, কিন্তু দেখা হলে একটু-আধটু কথাবার্তা যা হত, তার সবটাই যেন রাগে আর বিদ্রুপে ঠাসা ছিল, কী ভাল ছেলে, কোথায় তাল দিচ্ছ আজকাল, কিংবা গুরু, লিপিকে ছাঁকনিতে তুলেছিস, কী মানে এ সব কথার কে জানে, লিপিকে আবার ছাঁকনিতে তুলব কী, লিপি কি ছাঁকবার জিনিস, অবিশ্যি তখন আমি লিপির সঙ্গে প্রেম করছিলাম ঠিক-ই, অথবা দেখব রে মাস্টের, ক্যালকাটা য়ুনিভার্সিটি থেকে এই রকে আসতে হয় কি না, এইরকম কথা বলত। রকে আমি যাইনি, কিন্তু থার্ড ক্লাস বাংলার এম এ, অস্থায়ী সরকারি কেরানি, তার চেয়ে অনেক জঘন্য, সে কথা আমি ওদের বলতে পারি না, মনে মনেই জানি আমি কী। এই সব কথার থেকে মনে হয়, কেমন একটা রাগ ঘৃণা আর বিদ্রুপের মনোভাব আমার ওপর ছিল। আর আজ দিগন্ত জানল, আমি আমার মতো ছেলে, পাড়ার একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে, পুলিশ আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, তার মানে তলে তলে আমি অনেক কিছুই করি, আজ এক মুহূর্তে, একটা ঘটনায় আমাকে সবাই চিনে ফেলেছে। লিপিকে তখন কত করে বলেছিলাম কিন্তু পুলিশ আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, বলাবলি সব শেষ, লিপি গেল কোথায়, আমার সঙ্গে তো ও পালায়নি! দিগন্তর কথা থেকে বোঝা গেল, ও মিথ্যা বলেনি।

আবার আমার বুকের মধ্যে ধকধকানি শুরু হয়ে গেল। আমি দেখলাম আমার জামা-প্যান্ট ঘামে ভিজে গিয়েছে, মুখের ভিতরে এক ফোঁটা রস নেই, ঢোক গিলতে কষ্ট হচ্ছে, আমি যেন স্পষ্টই দেখতে, এবং শুনতে পাচ্ছি, সবাই এক কথা নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছে, নীরেন লিপিকে নিয়ে পালিয়েছে, ওদের পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে। পুলিশ আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে, অথচ কী আশ্চর্য, লিপি তা হলে গেল কোথায়, বাড়িতে বাবা-মাকে নাকি চিঠিও লিখে গিয়েছে, কী লিখেছে কে জানে। আমার নাম করে লিখেছে বোধ হয়, নীরেনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিলাম, তার সঙ্গে নিজের ইচ্ছায় চলে যাচ্ছি, বৃথা আমাকে খোঁজ কোরো না, তোমাদের আশীর্বাদ চাই, ইতি–লিপি।..এরকমই কিছু লিখেছে নিশ্চয়ই, কথাও ছিল তা-ই, একটা চিরকুট রেখে আসবে, এবং আপাতত আমরা মধ্যমগ্রামে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে কয়েক দিন কাটাব, তার মধ্যেই আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করব। লিপির সঙ্গে একসঙ্গে কাটাব ভাবতেই আমার রক্তের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ করে উঠছিল, তার সঙ্গে একটা ভয় আর উত্তেজনাও ছিল, আর ঠিক এখনকার মতোই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। খুব সুখের ভাবনা আর উত্তেজনাতেও গলা শুকিয়ে যায় ভয় পাওয়ার মতোই।

কিন্তু এখন আমি কী করব। পাঁচটা বাজছে, রাস্তায় ভিড় বাড়ছে, দুপুরের তুলনায় বেশি। ওপারের ফুটপাথে যে একটা গাছ রয়েছে, সেটা এতক্ষণে প্রায় চার ঘণ্টা পরে আমার চোখে পড়ল, কারণ সেই গাছে কতকগুলো কাক–দাঁড়কাক না, বাঁচিয়েছে, তা হলে বোধ হয় আমাকে খাবলে খেতে আসত। পাতি কাকগুলো কা কা করছে, এ ডালে ও ডালে লাফালাফি করছে। পাতি কাক, পাতি হাঁস, পাতি বুর্জোয়া, তার মানে যারা বড় না, জালিও না, জালি বোট, জালি কুমড়া, জালি বিছে, যার মানে ছোট, তা না, সব মাঝামাঝি কিন্তু না, এর পরে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে, বুকটা ফেটে যেতে পারে। আমি পিছন ফিরে সেই চায়ের দোকানওয়ালাকে বলতে গেলাম, এক গেলাস জল দেবেন দাদা, কথা ফুটল না, চেষ্টা করে ঢোক গিলে গিলে গলাটা ভেজাবার চেষ্টা করলাম, গলাখাঁকারি দিয়ে স্বরটা জাগাবার চেষ্টা করলাম, একটু জল দেবেন বললাম।

খালি গা কালো লোকটা এক বার আমার মুখের দিকে তাকাল, যেন চেনবার চেষ্টা করল, আমিই সেই লোক কি না যে চা খেয়েছিল, তা না হলে বিদায় করে দেবে। তারপরে সবুজের আভা দেখা যায় সেরকম একটু ত্যাবড়ানো কাঁচের গেলাসে জল এনে দিল। আমি সেটা শেষ করে একটু যেন প্রাণ ফিরে পেলাম আর জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, আর এক গেলাস পাওয়া যাবে কি না, তার আগেই তোকটার মোটা স্বর শোনা গেল, আর এক গেলাস দেব?

আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম, সত্যি, মানুষকে দেখে চেনা যায় না, বললাম, দিন।

আর এক গেলাস জল খেয়ে এই প্রথম আমার তলপেটে একটা ভার বোধ হল। চারদিকে চেয়ে দেখলাম, কোথাও ইউরিনাল চোখে পড়ছে না। আমি যে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে একটু দূরে একটা দেওয়াল দেখে তাড়াতাড়ি সেখানেই এগিয়ে গেলাম, অথচ কীরকম লজ্জা করছে, বেআবরু হয়ে পড়ার ভয়, কিন্তু চাপটা যেন হঠাৎ-ই বড় বেশি বোধ হচ্ছে, এখন ইউরিনাল খুঁজতে বেরোলে প্যান্টটা-ই যাবে। নিরুপায় হয়ে দেওয়ালের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, মনে হল কাঁচা হলুদ গোলা জল পড়ছে, আর ঠিক এ সময়েই কে যেন চেঁচিয়ে বলে উঠল, ওই যে, ওই যে..পুলিশ নাকি! আমি চমকে উঠে তাড়াতাড়ি পিছন ফিরলাম, কিন্তু আমার দিকে কাউকে তাকাতে বা আসতে দেখলাম না, কেবল একটা কুকুর আমার কাছে এগিয়ে এল, আমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে দেওয়াল শুঁকে অন্য দিকে চলে গেল। ওখানে যদি কুকুর প্রস্রাব করে যেত, তা হলে এ কুকুরটা ছেড়ে কথা কইত না, ও তার ওপরে প্রস্রাব করে যেত, আমি তা-ই দেখেছি। কেন ওরকম করে কে জানে, একটা যেন রাগ রাগ ভাব, অনেক সময় কুস্তিগীরেরা যেমন রণং দেহি হয়ে কুঁচকির কাছে চাপড় মারে, সেইরকম ভাবে কুকুরেরা সামনের থাবা দিয়ে মাটিতে আঁচড়ায়, তারপরে প্রস্রাব করে চলে যায়। তুই করেছিস?আমিও করলাম, কী করিস দেখি, এমনি একটা ভাব। অবিশ্যি রাগ হয়েছে অথচ কিছু করা যাচ্ছে না, এরকম অবস্থায় অনেক মানুষ কুকুরের থেকে খারাপ ব্যবহার করে বলে আমার ধারণা।….

লিপি কোথায় গেল? পরিমল এল না কেন? দিগন্ত যা বলে গেল, তারপরে এখন আমার কী করা উচিত? আমি কি সরাসরি লিপিদের বাড়ি গিয়ে বলব, আমি লিপিকে নিয়ে পালাইনি। সে কথাও দিগন্ত বলে গিয়েছে, আমার এই ভালমানুষি কেউ বিশ্বাস করবে না, ভাববে, খুন করবার পরে যেমন খুনি অ্যালিবাই তৈরি করে, আমি সেইরকম করতে গিয়েছি। কিন্তু আমাকে তো কোথাও যেতে হবে, কিছু করতে হবে। এভাবে চুপচাপ, যেন মড়া আগলে বসে আছি, থাকা যায় না। আমি তো থানায়ও যেতে পারি, গিয়ে বলতে পারি, আমি লিপিকে নিয়ে পালাইনি। কিন্তু তখন যদি পুলিশ দাঁড়কাক হয়ে ওঠে।

হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল পরিমলের বাড়ি যাবার কথা। ঠিক, পরিমলদের বাড়ি গিয়ে দেখি, ও আছে কি না। ও আর কোথায় যাবে, ওর তো আমার মতো অবস্থা না, ওদের বাড়িতেই খুকু আসে, খুকু মানে পরিমলের প্রেমিকা। পরিমলদের বাড়িতে ও নিয়ে কেউ মাথায় ঘামায় না। এখন হয়তো খুকু এসেছে, তার সঙ্গে পরিমল গল্প করছে। পরিমলের ভাগ্য যদি আমার হত। লিপিকে যেমন আমাদের বাড়িতে পছন্দ করে না, বাজারের মেয়েদের থেকেও নাকি খারাপ, তেমনি খুকুকেও পরিমলদের বাড়িতে তেমন পছন্দ করে না, তথাপি খুকু ওদের বাড়ি যায়, লজ্জা ভয় কিছুই পায় না। খুকুকে অবিশ্যি আমারও ভাল লাগে না, ওকে আমার কখনও ভাল মেয়ে বলে মনে হয় না। খুকুর অনেক পার্টি, মানে বয় ফ্রেন্ডস। আমার তো ধারণা, ও করে বেড়ায় না এমন কোনও কাজ নেই। একবার আমি ওর ব্যাগ থেকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের একটা জিনিস পড়ে যেতে দেখেছিলাম। ও তাড়াতাড়ি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে ব্যাগে রেখেছিল, আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। ও আমার গাল টিপে দিয়ে হেসে বলেছিল, হাঁদার মতো কী দেখছেন?

.

তা আমাকে হাঁদা-ই বলতে হবে। পরিমলের বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে–পরিমলের বাড়িতে যেতে, আমাদের পাড়ার রাস্তায় না ঢুকেও যাওয়া যায়, ও থাকে কেষ্টকলি লেনে–খুকুর কথাই ভাবছি, আমি সত্যি হাঁদার মতোই ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। একটা অবিবাহিতা মেয়ে, তার ব্যাগের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের জিনিস নিয়ে ঘুরে বেড়াবে, দেখতে পেলে ভ্যাবাচাকা খাওয়া ছাড়া কী করবার আছে। আর ব্যাপারটা ঘটেছিল পরিমলদের বাড়িতেই, পরিমল তখন বাড়িতে ছিল না, আমি ওদের বাড়িতে বসেছিলাম, খুকু পরিমলের খোঁজে এসেছিল। আমি একটা কথাও বলতে পারিনি, কেবল সেই এক বুক ধকধকানি, আমার বড় বেশি বুক ধকধক করে, হার্টটা একবার পরীক্ষা করিয়ে দেখতে হবে, আমি কেন কথায় কথায় খারাপ আশঙ্কা করি, আর বুকের মধ্যে ধড়ফড় করতে থাকে। খুকু চলে গিয়েছিল, আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলাম, আর কেবলি মনে হচ্ছিল, লিপির ব্যাগেও কি ও সব জিনিস থাকে। ওর সঙ্গে আমার কোনও শারীরিকনা কথাটা ঠিক না, শারীরিক ব্যাপার আছে, কিন্তু ওপর ওপর, যাতে কোনও ভয় নেই। ও বলেছে যা হবার তা বিয়ের পরে হবে। সত্যি, লিপির মধ্যে একটা খাঁটি মেয়ে আছে। তথাপি কথাটা ভাবতেই বুকের ধড়ফড়ানিটা আরও বেড়ে গিয়েছিল, আর একটু পরেই আমার কেমন গা ঘুলিয়ে উঠেছিল, তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়েছিলাম, এবং সত্যি সত্যি টক জল খানিকটা বমি হয়েছিল। এত দুর্বল মনে হচ্ছিল, যেন শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল। আমার শরীরটা কোনও কাজের না, যখন-তখন পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব, গা ঘোলানো, বিশেষত হঠাৎ যদি কোনও দুশ্চিন্তা আসে, উদ্বেগ হয়। গর্ভবতী মেয়েদেরও হার মানাই আমি। তবে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, পরিমলকে ব্যাপারটা জানাতে হবে। ভাবতে আমার বেশ মজাই লাগছিল, পরিমল ঠিক খুকুকে ছেড়ে দেবে। কয়েকদিন পরে, অনেক ভণিতা-উনিতা করে পরিমলকে কথাটা বলেছিলাম। শুনে ও হো হো করে হেসে উঠেছিল, বলেছিল, মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প বলছিস, আমি কি জানি না নাকি।

তুই জানিস?

জানব না? আমি জানব না তো কে জানবে।

তা হলে বোধ হয় আমার মনটাই ছোট, এরকম ভেবেছিলাম, তথাপি, খুকুকে আমি যাদের সঙ্গে পার্ক স্ট্রিট বা চৌরঙ্গি এলাকায় ঘুরে বেড়াতে দেখেছি, তাদের কারোকেই আমার ভাল লোক বলে মনে হয়নি। তা ছাড়া লিপি আমাকে খুকুর সম্পর্কে যা বলেছে তা যদি বিশ্বাস করি, তা হলে খুকুকে তো প্রোফেশনাল বলতে হয়–মানে বেশ্যা যাকে বলে। এতটা কি না, আমি জানি না, যা-ই হোক ভদ্রলোকের ঘরের মেয়ে, এমনকী গরিবও না, অবস্থা ভালই। সেরকম হলে পরিমল কি বুঝতে পারত না। পরিমল বোকাসোকা ছেলে না। আসলে আমিই হয়তো বুঝি না। তবে খুকুকে আমার ভাল লাগে না। এমনি যা-ই হোক, ও সবকিছুতেই বড় ভিকনেশি কাটে, চারদিকেই ও খালি অসভ্যতা দেখে বেড়াচ্ছে। সব নোংরা, খারাপ, আর ও যেন গেঁয়ো বিধবাদের মতো, নাকে কাপড় দিয়ে, পেঁয়াজের খোসা বাঁচিয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে পা ফেলে চলেছে।

কেষ্টকলি লেনে ঢুকেই আমার গায়ের মধ্যে কেমন ছমছম করতে লাগল, এই বুঝি কতকগুলো দাঁড়কাক আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খাবলাতে শুরু করল। স্টেশনারি দোকানের ট্যারা লোকটা আমার দিকে অমন করে তাকাচ্ছে কেন, যেন গালের ভাঁজে হাসি, ঠোঁটের কোণটা বাঁকা। শিরদাঁড়াটা যেন একটু নড়ে উঠল, আর এক পাক ভয় জড়াল। হঠাৎ কী মনে হতে মুখ ফিরিয়ে উলটো দিকে তাকালাম, দেখলাম, জানলায় একটা ফ্রক পরা মেয়ে দোকানের লোকটির দিকে তাকিয়ে জিভ ভ্যাংচাচ্ছে। আসলে লোকটা সেই দিকেই চেয়ে আছে, আমি বুঝতে পারিনি। এইরকম চোখ যাদের, ডাইনে তাকিয়ে থাকলে বাঁয়ে মনে হবে, তাদের দিয়ে স্পাইয়ের কাজ করানো যায়। কোন দিকে তাকিয়ে আছে বোঝা যাবে না।

.

পরিমলদের বাড়ির বাইরের দরজাটা খোলাই ছিল, আমি ভিতরে চলে গেলাম। আর তখনই মেয়ে-গলায় খিলখিল করে ঢলে পড়া হাসি শুনলাম। খুকুর গলা। তা হলে পরিমল বাড়িতেই আছে। হঠাৎ বুকের ধড়ফড়ানিটা বেড়ে উঠল, কী শুনতে হবে কে জানে। কিন্তু যে-ঘর থেকে হাসি শোনা গেল, সেটা নীচের তলার ঘর, পরিমলের ঘর ওপরে। এ বাড়িতে আমার অবারিত দ্বার, তথাপি আমি একবার পরিমলের নাম ধরে ডাকলাম, আশ্চর্য, শুকনো গলা থেকে শব্দটা বেরোল, কাঁউমাউ। শুকনো গলার আর উদ্বেগেই কি এরকম বিকৃত শোনাল ডাকটা। পরিমলের বোন ঝরনা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, আর আমাকে দেখেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। প্রায় চিৎকার করে বলল, আপনি!

তারপরেই ডেকে উঠল, খুকু, কে এসেছে দেখবি আয়।

খুকুও বেরিয়ে এল, ওর চোখ মুখের চেহারাও ঝরনার মতো হয়ে উঠল। ঝরনা ভয় পেয়ে বলে উঠল, লিপিকে এখানে নিয়ে এসেছেন না কি?

আমি অবাক হয়ে বললাম, না তো।

ঝরনা এত অবাক যেন ওর চোখের তারা দুটোই ছিটকে পড়ে যাবে, চোখের ভাবটা এমনি। জিজ্ঞেস করল, তবে কোথায় রেখে এলেন!

হায় ভগবান–অথচ ভগবানে আমি বিশ্বাস করি না, তবু এক এক সময় বলে ফেলি, বোধ হয় এটা একটা অভ্যাস, কিন্তু কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, এরাও দিগন্তর মতোই কথা বলছে। যাতে ঝরনা খুকু বিশ্বাস করে, আমি সেরকম মিনতি ভরা স্বরে বললাম, কোথাও রেখে আসিনি, আমি তো ওকে নিয়ে যাইনি।

ঝরনা অবাক রাগে আমাকে প্রায় ধমক দিয়ে উঠল, নীরেনদা, এ কথা বলতে পারছেন আপনি!

এবার খুকু মুখ খুলল। ওর গোল মুখ, চোখগুলো ঢুলুঢুলু, গোটা শরীরটাই যেন একটু গোল গোল ভাবের, গোল গোল, চাপ চাপ, দলা দলা। ওর স্বরটা সরু আর–আর কবিতার ভাষায় যাকে ঝংকার বলে, সেইরকম একটা ঝংকার আছে। ও আমার সামনে এসে ঘাড় বাঁকিয়ে, চোখের তারা ঘুরিয়ে, ছড়া কেটে বলল, কচি কচি উচ্ছে, খেতে বড় ইচ্ছে।

খুকুর দিকে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঝরনা যেন ভরসা করে এবার আমার সামনে খুকুর গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। কিন্তু খুকুর কথার মানে কী, আমার শুধু শুধু কচি উচ্ছে খেতে ইচ্ছা করবে কেন। কথাটা আমি আগেও শুনেছি! কচি উচ্ছে তেতো, ছেলেবেলায় খেতে পারতাম না বলে বাবা বকতেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে?

খুকুর গলায় ঠাট্টা থাকলেও ওর ঢুলুঢুলু চোখদুটো যেন দিগন্তর মতো দেখাচ্ছে। বলল, এর মানেও বলে দিতে হবে? বলছি, কচি উচ্ছে খেতে গেলে পুলিশের হ্যাঁপা পোয়াতেই হবে। লিপির বাবা মা

পুলিশকে বলেছে, লিপি আন্ডার এজেড, আপনার ওপর নাবালিকা হরণের চার্জ এসেছে।

বুকের মধ্যে আমার প্রাণটা যেন ফাঁদে পড়া চড়ুই পাখির মতো ছটফট করে উঠল। একটা কথাও আমার মুখ থেকে বেরোল না। ঝরনা হঠাৎ নাকে আঁচল চেপে ঘৃণা করার মতো বলে উঠল, উঁ, আপনি কি প্যান্টে ইয়ে করে দিয়েছেন নাকি, এরকম ভেজা কেন!

আমি মাথা নিচু করে দুই ঠ্যাঙের মাঝখানে তাকালাম, ভেজা ভেজাই দেখাচ্ছে, সে তো ঘামে, ও যা ভাবছে তা তো আমি করেছি বলে মনে হচ্ছে না। খুকু হাসতে হাসতে যেন আরও গোল হয়ে গেল, বলল, কী যে বলিস ঝরনা, তোর কথা শুনলে মরা মানুষ জেগে যাবে।

আর খুকু জীবন্ত, সে হেসে ফেলবে এতে আর আশ্চর্য কী। কিন্তু আমার লজ্জা করছে, ওরা যে ভাবে আমার প্যান্টের দিকে তাকাচ্ছে। হাসিটা একটু থামলে খুকু বলল, শুনুন, আমার অ্যাডভাইস নিন, লিপিকে যেখানেই রেখে থাকুন, তাড়াতাড়ি একজন বড় ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। তাকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে, যদি অ্যাডাল্ট বলে, তবে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে রাখুন গিয়ে। তা না হলে আপনার শ্রীঘর যাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।

আশ্চর্য, খুকু তো একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট বলেছে। অবিশ্যি আমি আর লিপিকে নিয়ে যাব কেমন করে, ওকে নিয়ে যখন পালাইনি, কিন্তু যদি পালাতাম তা হলে উপদেশটা খুব কাজে লেগে যেত। খুকু এত সব জানল কী করে। খুকু এ সব জানে, জন্মনিয়ন্ত্রণের জিনিস ব্যাগে রাখে, অনেক পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, আবার পরিমলের সঙ্গে প্রেম করে, একেবারে অল রাউন্ড। ইতিমধ্যে পরিমলের বউদি এসে পড়ল, কোনও কথা না বলে অবাক হয়ে একবার আমার দিকে আর একবার। ঝরনা খুকুর দিকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, কিন্তু তোমরা আমাকে বিশ্বাস করছ না কেন? আমি সত্যি লিপিকে নিয়ে পালাইনি, মাইরি বলছি!

খুকু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, মাইরি ইললি দিললি, প্রাণের ইয়ার পঞ্চা তেলি। বাজে কথা ছাড়ুন তো, আমাদের কাছে লুকোতে হবে না। আপনাকে যা বললাম, তাই করুন গিয়ে।

এবার ঝরনা বলে উঠল, তুই কি ন্যাকামি করছিস খুকু, লিপিকে ডাক্তার দেখাবার দরকার আছে না কি। ওর বয়স মিনিমাম বাইশ-তেইশের কম না।

সে তো তুই বলছিস, ওর বাবা, মা তো বলছে না।

 ওর বাবা, মা তো গোলমাল পাকাবার জন্য মিথ্যে বলেছে।

ওরা নিজেদের তর্কেই ব্যস্ত, আমি যে কিছু বলছি সেটা যেন ধর্তব্যের মধ্যেই না। বেশ বুঝতে পারছি, এদের বিশ্বাস করানো যাবে না। ঝরনাকে আমি ভাল মেয়ে বলে জানি, আমাকে নীরেনদা নীরেনদা করে খুব খাতির করে, একটু যেন সমীহ-ই করে। দেখতে তেমন ভাল না, মুখটা বিশেষ করে, সেজন্য ওর দিকে ছেলেদের বিশেষ নজর নেই। এমনও আমার কখনও কখনও মনে হয়েছে, ঝরনা আমার সঙ্গে প্রেম করতে চায়। লিপির সঙ্গে যে প্রেম করে সে ঝরনার সঙ্গে কখনও প্রেম করতে চাইবে না। সেই ঝরনা যেন এক বেলাতেই বদলে গিয়েছে। আজ সকালবেলাও তো পরিমলের সঙ্গে দেখা করার জন্য এ বাড়িতে এসেছিলাম, তখনও ঝরনা কত ভাল ব্যবহার করেছে, আর এখন শুধু ধারালো চোখে যে তাকিয়ে দেখছে, তা না। যা ভাবতে পারি না, তা-ই ও আমাকে বলেছে। আমি প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছি কি না, তাও জিজ্ঞাসা করল মুখের ওপর, আবার তাকিয়ে দেখল, নাকে আঁচল চাপল। এরকম একটা অবস্থার মধ্যেও মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল, খুবই দুঃখ লাগছে। আমি ওকে একটা ধমক দিয়ে প্রতিবাদ করতে পারি, সেইভাবে যদি বলতে আরম্ভ করি, বেশ ধারালো মোটা গলায়, বাছা বাছা শব্দ জুড়ে, তা হলে হয়তো বিশ্বাস করাতে পারি, কিন্তু পারব কি, ঝরনা যেভাবে চেয়ে রয়েছে, আর চোয়াল গাল সবই এমন শক্ত, যেন আমি কী একটা এসে দাঁড়িয়েছি, একটা নেড়ি কুত্তার থেকেও খারাপ কিছু।

সত্যি সত্যি আমার একটা নিশ্বাস পড়ল, জিজ্ঞেস করলাম, পরিমল কি বাড়ি আছে?

ঝরনা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, তা হলে কি দেখতে পেতেন না। আপনাকে দেখবার জন্য ছুটে আসত। দাদা সেই দুপুর বেলা খেয়ে বেরিয়ে গেছে।

আমি সাবধান হলাম, যাতে ওরা বুঝতে না পারে পরিমলের সঙ্গে আমার প্ল্যান করা ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ও কখন বেরিয়েছে?

ঝরনা যেন কথা ছুঁড়ে দিল, কখন আবার, আমি তো ঘড়ি ধরে দেখিনি, বারোটা একটা হবে।

এর মধ্যে ও আর বাড়ি আসেনি?

ঝরনা এবার যাকে বলে ঝামটা দিয়ে উঠল,–জানি না যান। দাদাকে এখন আপনার কী দরকার, ওকেও আপনার সঙ্গে জড়াতে চান বুঝি?

ঠিক এ সময়েই কোনও বাড়িতে শাঁখ বেজে উঠল, আর ঝরনা খুকু বউদি তিনজনেই তাড়াতাড়ি কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার করল। খুকু আবার কয়েকবার জোড় হাতটা কপালে ঠুকল, তারপরে বলল, কী যে সব খারাপ খারাপ ব্যাপার ঘটছে, সন্ধের মুখে যত সব নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি।

আমি যেন একটা মূর্তিমান মহাপাপের মতো তিনজনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ঝরনার ধারণা, আমি পরিমলকে আমার সঙ্গে জড়াতে চাইছি, আর তা হল, যা আমি করিনি, তারই সঙ্গে। আর খুকু এই সন্ধের মুখে কোথায় শাঁখ বাজিয়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে ভগবানের নাম করবে, তা না, ওকে নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করতে হচ্ছে, মানে আমার বিষয়েই বলছে। আমার নোংরা কাজের কথা। অথচ, একটু আগেই খুকু আমাকে কী চমৎকার অ্যাডভাইস করল। এর জন্য ওর কাছে আমি সত্যি গ্রেটফুল–অর্থাৎ কৃতজ্ঞ, কেন না, আমি তো এরকম একটা কথা চিন্তাই করতে পারতাম না। পরিমল যে এত চালাক-চতুর, অনেক কিছু জানে বোঝে, কিন্তু এরকম একটা উপদেশ ওর মাথায় আসেনি।

এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আমার আর লাভ নেই। পরিমল সেই দুপুরে খেয়ে বেরিয়েছে, সে কথা আমিও জানি, কারণ কেষ্টকলি লেনের মোড়ে ওর সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম। তার আগে, আজ সকাল বেলা, এ বাড়িতে আমি এসেছিলাম, শেষবারের মতো সমস্ত ব্যাপারটা আগাগোড়া আলোচনা করে নেবার জন্য। আমি যতটা অস্থির হয়ে পড়ছিলাম, একটা ভয়ে আর উত্তেজনায় থরথর করছিলাম, পরিমলের সে সব কিছুই ছিল না। অবিশ্যি আসল ব্যাপারটা আমার, সেই জন্য আমার মধ্যেই যত ছটফটানি, কিন্তু পরিমলের কাছ থেকে সাহস না পেলে আমি এতটা এগোতে পারতাম কি না সন্দেহ। ও এমন ডেসপারেট, যেন এ একটা কিছু ব্যাপারই না, এভাবেই আমাকে বলেছিল, এমনকী আমাকে ধমকও দিয়েছিল, কী এত ভাবছিস, বাজে বাজে যত ভাবনা। কত ছেলে কত মেয়ে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল আর তোর একেবারে হাত-পা খসে পড়ছে।

এরকম ভাবে বলেছিল, কিন্তু আসলে আমার সেখানেই আপত্তি ছিল, ওই হাওয়া হয়ে যাওয়া ব্যাপারটায়। অনেক ছেলে অনেক মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে বটে, খবরের কাগজে প্রায়ই যে সব কেলেঙ্কারির কথা পড়ি, সেটা ভাবতেই যেন আমার গায়ের মধ্যে কী রকম করে ওঠে। এ সব আমার রুচিতে বাধে। লিপিকে তো সে কথা বোঝাতে পারলাম না। সকালবেলা পরিমলের সঙ্গে দেখা করে যাওয়া সত্ত্বেও ও ঠিক সময় মতো লিপিদের বাড়ি যায় কি না জানবার জন্যই আমি দুপুরে কেষ্টকলি লেনের মোড়ে এসেছিলাম। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ও বলেছিল, তুই ঠিক জায়গায় গিয়ে দাঁড়া, আমি লিপিকে নিয়ে আসছি। একটি উদ্বেগ আর উত্তেজনায় মাথার ঠিক ছিল না। লিপির কথাগুলো এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে, এমনি আমি একলা বাড়ি থেকে বেরোতে পারি। কিন্তু তোমার সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি ভাবতেই হাত-পা যেন কাঁপছে। আমি একলা যেতে পারব না। খুবই ঠিক কথা, আমারই যদি এরকম হতে পারে, ওর নিশ্চয়ই হবে, মেয়ে তো। এমনি বেরোনো আর আমার সঙ্গে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, একেবারে আলাদা। সেই জন্যই পরিমলকে বলতে হয়েছিল, পরিমল রাজি হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারছি না। এখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে যাবার জন্য পিছন ফিরলাম, এই সময়ে খুকুর গলা শুনতে পেলাম, শুনুন তো।

খুকুর দিকে ফিরে তাকালাম, ওর ঢুলু ঢুলু চোখে যেন একটা সন্দেহ, আঁকা ভুরু কোঁচকানো। জিজ্ঞেস করল, অন্য কিছু করে বসে আছেন নাকি?

অন্য কিছু মানে আবার কী, বুঝতে পারলাম না। বোধ হয় ঝরনা আর বউদিও খুকুর জিজ্ঞাসাটা বুঝতে পারেনি, তাই খুকুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছে। জিজ্ঞেস করলাম, অন্য কিছু মানে, কী?

খুকু ঝরনা আর বউদির দিকে একবারে দেখল, রং করা ঠোঁট টিপে একটু হাসল, তারপরে বলল, ন্যাকামো করবেন না, আপনি সবই বুঝতে পারছেন। সেই জন্যই আপনার চোখ-মুখ ওরকম কালি মারা দেখাচ্ছে, আর পরিমলের খোঁজে এসেছেন।

বলে, খুকু আবার ঝরনা আর বউদির দিকে দেখল এবং মনে হল ঝরনা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে, বউদি বোধ হয় না, আর আমি তো, যাকে বলে অগাধ জলে। সেই যে বলে রহস্যপ্রিয়া খুকু একটু তা-ই, ওর কথাবার্তার ভাবভঙ্গি একটু এইরকমই, তথাপি আজ যেমন হেলাফালা করে কথা বলছে, এরকম আমার সঙ্গে বলত না। কিন্তু খুকুর কথার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারলাম না, কথা বাড়াতেও আর ইচ্ছা করছে না, তাই কোনও জবাব দিলাম না। খুকু আবার বলে উঠল, ন্যাকামি করছেন, না সত্যি আপনি একটা বুন্ধু। বলছি, বাঁধিয়ে বসেননি তো?

বলতে বলতে খুকু ওর নিজের পেটের দিকে হাত দিয়ে উঁচু হওয়ার ভঙ্গি করল। বউদি খিলখিল করে হেসে উঠল, ঝরনাও হাসল, তবে শব্দ না করে এবং বউদি আর ঝরনা মজা পাওয়ার সঙ্গে যেন লজ্জাও পেল। সন্ধেবেলা ভগবানকে না ডেকে নোংরা ঘাঁটাঘাঁটি করার ইচ্ছা খুকুর নেই, তথাপি করতে হচ্ছে আমার জন্য। কিন্তু ওর কথা শুনে আমার গায়ের মধ্যে যেন শিরশির করে উঠল, তবে তার মানে, লিপি গর্ভবতী হয়েছে কি না, এ কথা খুকু জিজ্ঞেস করছে! মানে–তার মানে, আমি আমার দ্বারা অসম্ভব, আমি ভাবতেই পারছি না। কিন্তু এ কথা খুকু জিজ্ঞেস করছে কেন। বললাম, না তো।

খুকু ওর গোটা শরীরটাকে কেমন একরকম ভাবে যেন দুলিয়ে দিল, এটাকে ওর গোল শরীরে গোলালো দোলানো বলব কি না বুঝতে পারছি না, হাতের চেটো ঘুরিয়ে বলল, আপনার সবটাতেই না। আপনি লিপিকে নিয়ে পালাননি, লিপি কনসিভ করেনি, এর পরে আরও কত কী বলবেন। আমি বলছিলাম, এর ওপরে যদি আবার ওটাও করে থাকেন, তবে আপনার আর রক্ষে নেই। এখন যান, আপনাকে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে, হয়তো এখানেই এসে পড়বে।

আমি তো চলেই যাচ্ছিলাম, ও ডাকল বলেই ফিরলাম। ইচ্ছা করলে খুকুকে আমি মুখের মতো জবাব দিতে পারি। এখন আমার আরও অনেক কথা মনে পড়ছে, মনে আগেই পড়েছিল, আমি কথাটা ভাবতে চাইনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল, আমি নিজেই যেন একটা দোষ করে ফেলেছি।

.

সেই প্রায় বছরখানেক আগে, বিজয়ার দিন রাত্রে, আমরা কয়েকজন বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। আমি, পরিমল, খুকু, সিদ্ধেশ্বর আর তার বান্ধবী কি রীতা না ফিতা নাম মেয়েটার, গঙ্গার ধারে গিয়েছিলাম, ময়দানে বেড়িয়েছিলাম, ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের ধারে গিয়েছিলাম, আর সেখানে গিয়ে পরিমলের কী খেয়াল গিয়েছিল, ড্রিঙ্ক করবে। বিজয়ার দিন লোকে সিদ্ধি খায়, আমাদের মতো লোক আবার মদ খাবে কী। কিন্তু পরিমলের জেদে মদ খাওয়া হয়েছিল, আর সেই আমি প্রথম জেনেছিলাম, ওখানে লুকিয়ে মদ বিক্রি হয়। সোড়া গেলাস সবই পাওয়া যায়। আমি মদ খেতে পারি না, তথাপি মুখে ছোঁয়াতে হয়েছিল, তারপরে ময়দানের দিকে গিয়েছিলাম, আর সেখানে পরিমল মাঠের ওপরে শুয়ে পড়েছিল, খুব নেশা হয়েছিল ওর। সিদ্ধেশ্বর ওর বান্ধবীকে নিয়ে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল, আমার যেন মনে হচ্ছিল ওরা জড়াজড়ি করছে, আরও সব–মানে চুমো খাচ্ছে, আমার কীরকম অবাক ব্যাপার মনে হচ্ছিল, আর ভিতরে ভিতরে কীরকম যেন লাগছিল, বুকে ধকধকানি, গলা শুকিয়ে যাওয়া, অথচ রক্তের মধ্যে একটা ছলাৎ ছলাৎ ধাক্কা। কিন্তু কেমন একটা চিরচিরে জ্বালাও। ঠিক তখনই খুকু আমার পাশে বসে কাঁধে হাত রেখেছিল, বলেছিল, হাঁদার মতো ওদিকে কী দেখছেন?

আমি প্রায় চমকে উঠে শব্দ করেছিলাম, অ্যাঁ? আর তখন, এই খুকু, ভাবা যায় না, সে কথা আমি কোনওদিন পরিমলকে বলিনি, কেন না, আমার মনে হয়েছিল আমি নিজেই একটা দোষ করে ফেলেছি, খুকু আমাকে চুমো খেয়েছিল, ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে। এমন আশ্চর্যের ব্যাপার, আমার বুকের মধ্যে এমন ধক ধক করে উঠেছিল, আর খুকুর এই মোটা গরম ভেজা ঠোঁটের মধ্যে আমি যেন আটকা পড়ে গিয়েছিলাম, কিছু বলতেও পারছিলাম না এবং আমাদের কাছ থেকে খানিকটা দূরেই পরিমল মাতাল হয়ে পড়েছিল, অন্য দিকে আর একটু দূরে সেই সিদ্ধেশ্বর আর রীতা না ঋতা না ফিতা জড়াজড়ি করছিল, আমি তখন ওদের দিকেও দেখছিলাম, তার জন্য খুকু আমাকে গালে আস্তে করে চাপড় মেরেছিল, আর মুখের ভিতর থেকে নালিশের সুরে শব্দ করেছিল, উম! মানে, আমি কেন সিদ্ধেশ্বরদের দিকে দেখছিলাম। বেশ খানিকক্ষণ পরে আমাকে ছেড়ে দিয়ে খুকু বলেছিল, ওয়ার্থলেস, ওদিকে কী দেখছেন?

ওর চোখগুলো অন্ধকারেও যেন জ্বলজ্বল করছিল আর আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, খুকু এটা পারল কী করে, ও আমার বন্ধুর প্রেমিকা, আর আমি ঠিক এরকম ব্যাপার ভাবতে পারি না, যে কারণে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া আমার রুচিকর না, ডিগনিটিতে বাধে, সেটাও সেইরকম লেগেছিল কিংবা তার চেয়েও বেশি খারাপ। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে খুকু আবার সেই কাজ করেছিল। এবারে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে যে, আর একটু হলে আমি চিত হয়ে পড়েই যেতাম। আমি মনে মনে নিজেকেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, খুকু কী চায়, এভাবে আমার ওপর আক্রমণ কেন, কী, কী বলব, এমন বিশ্রী ব্যাপার, আমার-আমার-আমার যেন শরীরটা কী রকম করছিল, মানে লিপিকে জড়িয়ে ধরলে যেরকম একটু উ-উ-উন্মাদনা আসে সেইরকমই অনেকটা বোধ করছিলাম, অথচ খারাপ লাগছিল, আর ঠিক সে সময়েই পরিমল নড়ে উঠেছিল, খুকু তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দিয়ে সরে গিয়েছিল। পরিমল উঠে বসেছিল, আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, আর ঠিক তখনই মনে হয়েছিল, আমি নিজেও দোষ করে ফেলেছি। খুকু উঠে পরিমলের কাছে গিয়ে বসেছিল এবং সিদ্ধেশ্বর আর ওর বান্ধবী যা করছিল, ওরাও তা-ই করছিল, আর আমি, কোনদিকে তাকাব বুঝতে পারছিলাম না। অথচ মাথাটা ভরে তখনও খুকুর ব্যাপারটাই দাপাদাপি করছিল, বুকের ধকধকানিটা তখনও থামেনি।

খুকু যে এত ফরফর করছে, আমি যদি এখন সে কথা বলি, তা হলে কী হয়। এদিকে তো গলার হারের লকেটে কোনও এক গুরুদেবের ছবি আটকানো, ঠাকুরভক্তি গুরুভক্তি খুব, সবাইকেই ভিকনেশি কাটে। কিন্তু আমি ওকে কিছু বলব না, জানি ও তখন সুস্থ বা সাব্যস্ত ছিল না, কী হবে বলে, তবে মনটা সত্যি খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে, দুঃখও পাচ্ছি।

.

পরিমলদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবার সময় পিছন থেকে খুকুর গলা শোনা গেল, যান, এখন গিয়ে লিপির সঙ্গে ফুর্তি করুন, তবে আমাদের খাওয়াতে ভুলবেন না।

তারপরে ওরা তিনজনেই হেসে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *