ভাবীকালের একটি গল্প ( A Story of the Days to Come) – উপন্যাস – এইচ জি ওয়েলস। অনুবাদ – অদ্রীশ বর্ধন
[‘A Story of the Days to Come’ ধারাবাহিক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯৯ সালের জুন থেকে অক্টোবর মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। ১৮৯৯ সালে লন্ডনের ‘Doubleday & McClure Co’ থেকে প্রকাশিত ‘Tales of Space and Time’ সংকলনে উপন্যাসটি স্থান পায়। এপ্রিল ১৯২৮ সালে এটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়।]
১। প্রেমরোগ সারানোর দাওয়াই
মহারানি ভিক্টোরিয়ার আমলের খাঁটি ইংরেজ মি. মরিস অতিশয় সজ্জন পুরুষ। সচ্ছল অবস্থা। টাইমস দৈনিক পড়েন রোজ। ফি-হপ্তায় গির্জায় যান। দুপায়ে যারা দাঁড়াতে পারেনি, তাদেরকে তাচ্ছিল্যের চোখে দেখেন। নিয়মমতো চুল কাটেন। দানধ্যান করেন। জামাকাপড়ও পরিচ্ছন্ন। স্মার্ট। তৃপ্ত। সুখী। আদর্শ পুরুষ।
একটি বউ-ছেলেমেয়েও আছে। বেশি নয়, কমও নয়। সুশিক্ষা দিয়েছেন ছেলেমেয়েদের –যার যা দরকার, সবই দিয়েছেন। যা সংগত, যা ন্যায্য, মি. মরিসের জীবনে তার কোনওটিরই ঘাটতি নেই। মাঝবয়সে একদিন মারাও গেলেন ভদ্রলোক। কবরস্থ হলেন। মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত হল তাঁর জমকালো স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিফলকে উত্তীর্ণ বাড়াবাড়ি কিছু রইল না, অর্থহীনও কিছু রইল না।
এই গল্প শুরু হওয়ার অনেক আগেই ধুলো হয়ে গেল তাঁর দেহাস্থি–উড়িয়ে দেওয়া হল হাওয়ায়। শুধু তাঁর নয়, তাঁর নাতিপুতিদের হাড়ের ধুলোরও অবস্থাটা দাঁড়াল একই রকম। মি. মরিস কিন্তু কল্পনাও করতে পারেননি, এমন কাণ্ড ঘটতে পারে। জীবদ্দশায় কেউ তাঁকে এই ধরনের সম্ভাবনার কথা বললে দুঃখ পেতেন। মানুষ জাতটার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যাঁরা নির্বিকার, তিনি তাঁদেরই একজন। মি. মরিস অবশ্য আর-এক কাঠি সরেস এ ব্যাপারে। ওঁর মৃত্যুর পর মানবজাতির আদৌ কোনও ভবিষ্যৎ থাকবে কি না, এ বিষয়ে ঘোর সন্দেহ ছিল তাঁর।
কিন্তু ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অসহিষ্ণু মনোভাব নিয়ে মানুষ জাতটা টিকে রইল তাঁর এবং নাতিপুতিদের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার পরেও। ভদ্রলোকের নয়নসুন্দর স্মৃতিসৌধের মার্বেল পুড়িয়ে বাড়ি তৈরির উপাদানও তৈরি হয়ে গেল। দুনিয়া এগিয়ে চলল আগের মতোই।
আর-একটা ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী শুনলে রেগে যেতেন মি. মরিস। পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়া অগুনতি মানুষের রক্তে মিশে গিয়েছিল তাঁরও ধমনির রক্ত। হাজার হাজার পরদেশির রক্তে ঠাঁই নিয়েছিল তাঁর খাঁটি ইংরেজ রক্ত।
এই একই পরিণতি ঘটবে এ কাহিনি যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের ক্ষেত্রেও। যে জীবনে তাঁরা অভ্যস্ত, দিকে দিকে ছড়িয়ে যাবে সেই জীবন–হাজারখানেক পরদেশি ছাপ পড়বে সেই জীবনে–উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে না–কল্পনাও করা যাবে না।
মি. মরিসের বংশধরদের মধ্যে ছিলেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি তাঁর পূর্বপুরুষের মতোই প্রায় সুস্থমস্তিষ্ক এবং কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। সেইরকমই খর্বকায় বলিষ্ঠ আকৃতি। নামটিও তা-ই –তবে উচ্চারণটা অন্যরকম–মরিস হয়ে গিয়েছে স্বরেস। মুখের ভাবেও সেই একই রকম ফিকে অবজ্ঞা। অবস্থা সচ্ছল। সমকালীন তরুণ তুর্কিদের দুচক্ষে দেখতে পারেন না। মরিসের মতো ভবিষ্যৎ এবং নিম্নশ্রেণির ব্যক্তি সম্বন্ধে একই মনোভাব পোষণ করেন। টাইমস বলে যে একটা দৈনিক পত্রিকা ছিল, সে খবরও রাখেন না। মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেছে টাইমস। ওঁকে খবর শুনিয়ে যায় ফোনোগ্রাফ মেশিন। প্রাতঃকর্ম সারবার সময়ে বকবক করে বিশ্বের খবর বলে যায় আশ্চর্য এই যন্ত্র। আকার-আয়তনে ডাচ ঘড়ির মতো। সামনের দিকে আছে বিদ্যুৎচালিত আবহাওয়া নির্দেশক ব্যারোমিটার, বিদ্যুৎচালিত ঘড়ি আর একটা ক্যালেন্ডার। সারাদিনে কার কার সঙ্গে দেখা করতে হবে, তা মনে করিয়ে দেওয়ার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রও আছে ফোনোগ্রাফের সামনে। ঘড়ির মুখটা তুরীর মতো ফাঁদালো। খবর শুরু হলেই গাঁকগাঁক আওয়াজ বেরিয়ে আসে তূরীর চোঙা দিয়ে। উড়ুক্কু বাস সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলেছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটে আকছার–রাতে কোথায় কটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটেছে, সে খবর পরিবেশন করে ফোনোগ্রাফ; তিব্বতে নতুন কী ফ্যাশনের আমদানি ঘটল, তা-ও জানা হয়ে যায়। জামাকাপড় পরার সময়ে শুনতে পান একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কোথায় কী মিটিং হয়ে গেল গতকাল। খবর ভালো না লাগলে, শুধু একটা বোতাম ছুঁয়ে দেন স্বরেস। যেন দম আটকে আসে ফোনোগ্রাফের–খাবি খেতে খেতে শুরু করে অন্য খবর।
স্বরেস সাহেবের প্রাতঃকর্ম অবশ্য তাঁর পূর্বপুরুষের মতো নয় মোটেই। পুরাকালের মরিস দেখলে আহত হতেন। বুক চৌচির হয়ে যেত আদ্যিকালের মরিসের জামাকাপড়ের ছিরি দেখলে। ছি ছি ছি! স্বরেস সাহেব ন্যাংটা হয়ে দুনিয়া চরকি দিয়ে আসবেন তবুও ভালো, কিন্তু প্রাচীনকালের মরিস সাহেবের মতো সিল্কের টুপি, ফ্ৰককোট, ধূসর ট্রাউজারস আর ঘড়ির চেন গায়ে চাপিয়ে সং সাজতে রাজি নন কোনওমতেই। দাড়ি কামানোর হাঙ্গামার মধ্যেও মরতে মলেও যান না স্বরেস সাহেব। ও আদি অভ্যাস এ যুগে কি মানায়? নিপুণ কারিগর অনেকদিন আগেই গাল থেকে প্রতিটা চুলের গোড়া পর্যন্ত তুলে দিয়েছে। দাড়ি এক্কেবারে নির্মূল মৃত্যু পর্যন্ত। কামানোর ঝাটও নেই। পদযুগলকে ঢেকে রাখবার জন্যে ট্রাউজারস নামক বিদঘুটে পোশাকই বা পরতে যাবেন কেন? পরেন গোলাপি আর অম্বর রঙের এয়ার-টাইট বস্তুনির্মিত পোশাক–দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। পা দুখানা যে লিকলিকে সরু নয় রীতিমতো পেশিবহুল তা বোঝানোর কায়দাটা দারুণ অভিনব। পাম্প লাগানো আছে পোশাকের মধ্যে। বাতাস ঢুকিয়ে ট্রাউজারস ফুলিয়ে দেন। দেখলেই মনে হয় যেন থাকে থাকে মাস্ল সাজানো রয়েছে পুষ্ট পদযুগলে। কোথায় লাগে হারকিউলিসের পেশি! এর ওপর চাপানো বাতাস ভরতি ধরাচুড়া–সবার ওপর অবশ্য থাকে অম্বর সিল্কের টিউনিক–যা রোম দেশের মানুষরা পরত। ফলে, হঠাৎ প্রচণ্ড গরম বা নিদারুণ ঠান্ডায় কষ্ট পেতে হয় না। সবকিছুর ওপর পরেন টকটকে লাল রঙের একটা আলখাল্লা–কিনারাগুলো অত্যাশ্চর্যভাবে বাঁকানো। মাথার টুপিটা বাস্তবিকই অদ্ভুতদর্শন–মোরগের ঝুঁটির মতো। অদ্ভুত হলেও দেখতে ভারী সুন্দর। টকটকে লাল রং। মাথায় সেঁটে থাকে বাতাসের শোষণ-টানে। টুপি ফুলে থাকে হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরতি থাকায়। ও হ্যাঁ, স্বরেস সাহেবের মাথায় কিন্তু চুলের বালাই নেই। নাপিত নামক চুলের কারিগর প্রতিটা কেশ সমূলে উৎপাটন করেছে বহু বছর আগে। ফলে, টুপি ঠিকরে যাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। রোজ সকালে এহেন পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে প্রশান্ত চোখে স্বরেস সাহেব বেরিয়ে পড়েন সমকালের মানুষদের সামনে।
স্বরেসকে মি. স্বরেস বলার কাষ্ঠ সৌজন্য লোপ পেয়েছে বহু বছর আগেই। স্বরেস এখন। শুধুই স্বরেসমিস্টার-ফিস্টারের বালাই নেই। ভদ্রলোক উইন্ডভেন অ্যান্ড ওয়াটারফল ট্রাস্ট কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। কোম্পানিটা বিরাট। এই পৃথিবীতে যাঁর যত বিদ্যুৎশক্তি দরকার, সবই জোগান দিচ্ছে এই কোম্পানি। দুনিয়ার সমস্ত জলচক্র আর জলপ্রপাতের মালিক এই একটা কোম্পানি। ফলে, পৃথিবী গ্রহটার জল পাম্প করে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করার অধিকার রয়েছে কেবল এই কোম্পানিরই। ভদ্রলোক থাকেন লন্ডনের সেভেন্থ ওয়ে অঞ্চলের একটা পেল্লায় হোটেলে-সতেরোতলার একটা অতীব আরামপ্রদ এবং সুবিশাল ফ্লাটে। ভিক্টোরীয় আমলের বাবুগিরির ইতি হয়ে গেছে। অনেককাল আগেই–ঝি-চাকর-খানসামা রেখে নবাবি চালে থাকার সাধ থাকলেও সাধ্য হয় না কারওই। বাড়ি ভাড়া আর জমির দাম যে হারে বেড়েছে এবং ঝি-চাকরের অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে রান্নাবান্নার যান্ত্রিক ব্যবস্থার এমন উন্নতি ঘটেছে যে, আলাদা বাড়িতে পৃথক ঘরকন্না করার রেওয়াজও লোপ পেয়েছে। দলছাড়া হয়ে থাকা এ যুগে বর্বর বিলাসিতার শামিল। এহেন অ্যাপার্টমেন্টে সাজগোজ শেষ করে স্বরেস গিয়ে দাঁড়ালেন। একটা দরজার সামনে। দুটো দরজা আছে অ্যাপার্টমেন্টে–এক-এক প্রান্তে একটা। প্রত্যেক দরজার ওপর বিশাল তির চিহ্ন-নিশানা করছে বিপরীত দরজার দিকে। বোতাম ছুতেই খুলে গেল দরজা। চওড়া গলিপথে এসে দাঁড়ালেন স্বরেস সাহেব। গলিপথের ঠিক মাঝখানে সারি সারি চেয়ার পাতা রয়েছে–ধীরস্থির গতিবেগে চেয়ার সরে যাচ্ছে বাঁদিকে। ঝলমলে পোশাক-পরা নরনারী বসে কয়েকটি চেয়ারে। পরিচিত একজনকে অভিবাদন জানালেন বাতাসে মাথা ঠুকে। কথা বললেন না। এ যুগে প্রাতরাশ খাওয়ার আগে কথা বলাটা শিষ্টাচার নয় মোটেই। টুপ করে বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। চলন্ত চেয়ার গিয়ে দাঁড়াল লিফটের সামনে। লিফটে করে নেমে গেলেন বিশাল হলঘরে। বসে রইলেন। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় প্রাতরাশ পরিবেশনের প্রতীক্ষায়।
ভিক্টোরীয় যুগে যে ধরনের প্রাতরাশ খাওয়ার রেওয়াজ ছিল–এ প্রাতরাশ কিন্তু সে প্রাতরাশ নয়। এক ধ্যাবড়া ময়দার তাল থেঁতলে চটকে বেঁকিয়ে সেঁকে পশুচর্বি মাখিয়ে সুস্বাদু করা হত তখন। সেই সঙ্গে থাকত সদ্যনিহত পশুমাংস–যা দেখলেই চেনা যেত কোন পশুর মাংস। কদাকারভাবে ঝলসিয়ে নির্মমভাবে কেটেও টুকরো টুকরো চেহারা পালটানো যেত না। নিষ্ঠুরভাবে ডিম কেড়ে আনা হত মুরগির বাসা থেকে, মুরগি বেচারির কোঁকর-কোঁ আপত্তিতে কর্ণপাতও করা হত না। ভিক্টোরীয় যুগে এসবই ছিল মামুলি ব্যাপার–কিন্তু পরবর্তী এই যুগের মানুষদের মার্জিত রুচি বরদাস্ত করতে পারে না এহেন জঘন্য আহার। বিভীষিকা এবং বিবমিষায় শিউরে ওঠে। কুৎসিত এইসব খাবারদাবারের বদলে আছে বিভিন্ন রঙের এবং আকারের নয়নসুন্দর কেক আর পেস্ট। রং দেখে বোঝাও যাবে না, রাঁধা হয়েছে কোন পশুর উপাদান আর রস থেকে। একধারে আছে ছোট্ট একটা বাক্স। বাক্সর ভেতর থেকে রেললাইনের ওপর দিয়ে হড়কে বেরিয়ে আসবে একটার পর একটা ডিশ ভরতি এইসব পেস্ট আর কেক। ঊনবিংশ শতাব্দীর মানুষ টেবিলের ওপরে হাত বুলিয়ে অথবা এক ঝলক দেখেই মনে করতে পারে, খুব মিহি সাদা বুটিদার কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে টেবিল। কিন্তু মোটেই তা নয়। অক্সিডাইজড ধাতু দিয়ে ঢাকা এই টেবিল খাওয়ার পরেই সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে নেওয়া যায়। এই ধরনের কয়েকশো ছোট টেবিল রয়েছে হলঘরে। বেশির ভাগ টেবিল দখল করে বসে রয়েছে পরবর্তী এই যুগের মানুষরা–কোথাও একা, কোথাও দল বেঁধে। স্বরেস বসলেন এইরকমই একটা টেবিলে। অদৃশ্য অর্কেস্ট্রা নীরব ছিল বিরতির সময়ে। উনি বসতেই আরম্ভ হয়ে গেল শ্রুতিমধুর বাজনা।
প্রাতরাশ বা সংগীত নিয়ে বিভোর হয়ে রইলেন না কিন্তু স্বরেস। চোখ ঘুরতে লাগল হলঘরে। যেন কারও আসার প্রতীক্ষায় রয়েছেন। একটু পরেই দেখা গেল তাকে। দীর্ঘদেহী কৃষ্ণকায় এক পুরুষ। পরনে হলুদ এবং জলপাই-সবুজ পরিচ্ছদ। ঘরের শেষ প্রান্তে তাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে সাগ্রহে হাত নেড়ে ডাকলেন স্বরেস। আগন্তুক এগিয়ে এল টেবিলের আশপাশ দিয়ে। অস্বাভাবিক তীব্রতা প্রকট হল দুই চোখে-মূর্ত হল আত্যন্তিক ব্যগ্রতা মুখের পরতে পরতে। বসে পড়লেন স্বরেস-হাতের নির্দেশে বসতে বললেন পাশের চেয়ারে।
বললেন, দেরি দেখে ভাবলাম বুঝি আর আসবেন না।
সময়ের দুস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষাটা কিন্তু পালটায়নি–ভিক্টোরীয় আমলে যা ছিল, এখনও রয়েছে ঠিক তা-ই। ফোনোগ্রাফ মেশিনের এবং ওই জাতীয় বিবিধ রেকর্ডিং মেশিনের আবির্ভাবের ফলে এবং আস্তে আস্তে কেতাবজাতীয় পদ্ধতিগুলো অপসৃত হওয়ার দরুন মানুষের চোখই যে কেবল অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়েছে তা-ই নয়, মোটামুটি নিশ্চিন্ত একটা মান বজায় রাখতে পেরেছে ইংরেজি ভাষা–উচ্চারণ আর পালটায়নি–আগে যা ঘটতই, আটকানো যেত না।
সবুজ আর হলুদ পোশাক-পরা পুরুষ বললে, কৌতূহলোদ্দীপক একটা কেস নিয়ে আটকে পড়েছিলাম। নামকরা এক রাজনীতিবিদ অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমাইনি এঁর জন্যে।
তাই নাকি? হিপনোটিস্টদেরও কাজ থাকে?
প্রাতরাশ এসে গিয়েছিল টেবিলে। অম্বর রঙিন একটা জেলি প্লেটে তুলতে তুলতে হিপনোটিস্ট বললে, পসার তো বাড়ছে।
সর্বনাশ! আপনারা না থাকলে দেশ তাহলে অচল!
জেলির আঘ্রাণ নিতে নিতে বললে হিপনোটিস্ট, অতটা অপরিহার্য অবশ্য নই। আমাদের ছাড়াও হাজার হাজার বছর দিব্যি চলেছে। দুশো বছর আগে পর্যন্ত তো বটেই ব্যাবহারিক প্রয়োগ শুরু হয়েছে তো মোটে একশো বছর আগে থেকে। হাজার হাজার ডাক্তার অন্ধের মতো হাতড়েছে তার আগে-ভেড়ার পালের মতো ছুটেছে একই পুরানো চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে। নরক গুলজার করে রেখেছিল বলা যায়–মনের ডাক্তাররা কিন্তু ভুল করেনি–দু-চারজন হাতুড়ে ছাড়া।
জেলির দিকে মন দিল হিপনোটিস্ট।
স্বরিস বললেন, মানুষ জাতটার মস্তিষ্ক সে যুগে এতটা বিগড়ায়নি বলেই
মনের ওপর এরকম চাপ তো পড়েনি। হেসে-খেলে জীবন কেটে যেত। রেষারেষির বালাই ছিল না। খুব একটা বাড়াবাড়ি না হলে মানুষের মন নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। বেগতিক দেখলে পাঠিয়ে দিত পাগলাগারদ নামে একটা জায়গায়।
নামটা শুনেছি। ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনিগুলোয় হামেশাই তো মেয়েদের উদ্ধার করে আনা হয় পাগলাগারদ বা ওই জাতীয় জায়গা থেকে। জঘন্য কাহিনি। লোকে শোনে কী করে বুঝি না।
আমি তো শুনি। ভালো লাগে। আধা-সভ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার মনকে ভরিয়ে তোলে। সে যুগের পুরুষরা ছিল বলিষ্ঠ, মেয়েরা সরল। এইসব নিয়েই লেখা চাঞ্চল্যকর গল্পে ভেসে যাওয়ার মতো আনন্দ আর নেই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে অদ্ভুত সেই যুগের কত আশ্চর্য ছবি… লোহার রেললাইন, ধোঁয়া-ওঠা সেকেলে লোহার ট্রেন, ঘিঞ্জি ছোট্ট বাড়ি, ঘোড়ায় টানা গাড়ি। বই পড়ার নেশা আপনার নেই মনে হচ্ছে?
একেবারেই না। পড়েছি আধুনিক স্কুলে, ওসব সেকেলে বাজে ব্যাপারের মধ্যে মানুষ হইনি। ফোনোগ্রাফই যথেষ্ট আমার পক্ষে।
তা ঠিক, তা ঠিক, বলতে বলতে পরবর্তী খাদ্য অন্বেষণে ব্যস্ত হল হিপনোটিস্ট। টেনে নিল একটা ঘন নীল রঙের মিষ্টান্ন-হিপনোটিজম নিয়ে সে যুগে অবশ্য কল্পনা-টল্পনারও বালাই ছিল না। দুশো বছর পরে একশ্রেণির মানুষের পেশাই হবে স্মৃতিপটে ছাপ এঁকে দেওয়া, অন্যায্য ভাবাবেগকে দমন করা, অথবা অনেক কিছুই সম্মোহনের সাহায্যে ঘটিয়ে দেওয়া। অথচ এই ধরনের কথাবার্তা শুনলে আগে সবাই হেসেই উড়িয়ে দিত। খুব কম লোকই জানত, মেসমেরিজুমের ঘোরে যে হুকুম দেওয়া যায়, তা ঘোর কেটে গেলেও মেনে চলতে বাধ্য হয়। হুকুম দিয়ে মেসমেরিজুমের ঘোরে অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেওয়া যায়, ইচ্ছামতো কাজ করানো যায় ঘোর কেটে যাওয়ার পরেও–এত ব্যাপার কজন। জানত বলুন? অথচ অনেক অসম্ভব ব্যাপারও যে ঘটতে পারে–এমন কথা বলার মতো লোকও তো ছিল। যেমন ধরুন শুক্র গ্রহে যাওয়া।
হিপনোটিজমের খবরও তাহলে রাখত?
নিশ্চয়! কাজেও লাগিয়েছে-যন্ত্রণা না দিয়ে দাঁত তোলার ব্যাপারে এবং ওই জাতীয় কাজে! এই নীল জিনিসটা তো খাসা। কী দিয়ে তৈরি জানেন?
মোটেই না! খেতে কিন্তু চমৎকার। আরও একটু নিন।
আর-এক দফা প্রশস্তি নিয়ে নীরবে নীল বস্তুর রসাস্বাদন করে গেল হিপনোটিস্ট।
স্বরেস বললেন, ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনির আলোচনায় আবার আসা যাক। আপনার সঙ্গে দেখা করত চেয়েছিলাম কিন্তু এই ব্যাপারে। বলে শ্বাস নিলেন গভীরভাবে।
চোখে চোখ রাখল হিপনোটিস্ট। বিরাম রইল না কিন্তু খাওয়ার।
স্বরেস বললেন, আমার একটি মেয়ে আছে। সুশিক্ষা যত রকমের হতে পারে–সবই দিয়েছি তাকে। মামুলি লেকচারার দিয়ে নয়–টেলিফোন লেকচারার মারফত! সহবত, নাচ, কথাবার্তা, দর্শন, শিল্পসমালোচনা–কিছু বাদ দিইনি। ইচ্ছে ছিল আমারই এক বন্ধুকে বিয়ে করুক। চেনেন নিশ্চয়–লাইটিং কমিশনের বিনডন, সাদাসিধে ছোট্ট মানুষ, কিন্তু খাসা মানুষ, তাই না?
তা ঠিক। বয়স কত আপনার মেয়ের?
আঠারো।
বিপজ্জনক বয়স। তারপর?
তারপর আর কী! ঐতিহাসিক রোমান্স নিয়ে বড় বেশি মাতামাতি করছে। বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। জীবনদর্শন শিকেয় উঠেছে। যতসব লড়াকু সৈনিকদের রাবিশ ব্যাপার মাথায় ঢুকিয়ে বসে আছে। কী যেন নাম তাদের… ইট্রাসকান, তা-ই না?
ইজিপশিয়ান।
তা-ই হবে। তলোয়ার আর রিভলভার নিয়ে যাচ্ছেতাই সব ভয়ংকর মারদাঙ্গা ব্যাপার… রক্তারক্তি কাণ্ড… বীভৎস! বীভৎস! ফাঁদ পেতে টর্পেডো ধরা, বারুদ ফুটিয়ে স্প্যানিয়ার্ডদের উড়িয়ে দেওয়া, ননসেন্স অ্যাডভেঞ্চার! কোনও মানে হয়? এইসবের সঙ্গে আরও একটা বদ ব্যাপার মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে বসে আছে… বিয়ে করবে ভালোবেসে। এদিকে বিনডন বেচারি…
বাধা দিয়ে বললে হিপনোটিস্ট, নতুন কিছু নয়। আগেও পেয়েছি এ জাতীয় কেস। অন্য ছোকরাটা কে বলুন তো?
হাল ছেড়ে দেওয়ার মুখভঙ্গিমা করলেন স্বরেস। জবাব দিতে গিয়ে যেন মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম হল বিষম লজ্জায়–প্যারিস থেকে উড়ুক্কু মেশিন এসে নামে যে মঞ্চে, সেইখানকার অতি সামান্য এক কর্মচারী। মেশিন থেকে নামতে সাহায্য করে, ফাইফরমাশ খাটে। রোমান্স গল্প-উপন্যাসে যেমনটি বলে, সেইরকমই দেখতে–মানে, মন্দ নয়– ভালোই। কাঁচা বয়স। মাথায় ছিট আছে। পুরাকালের বাতিল বিষয় মাথায় ঢুকিয়ে বসে আছে। যেমন ধরুন, লিখতে জানে, পড়তে পারে! ভাবতে পারেন? আমার মেয়েটিও সেই একই দলের। লিখতে জানে, পড়তেও পারে! দুজনে কথাবার্তা বলে টেলিফোনে নয়– আর পাঁচটা সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ হলে তা-ই করত–কিন্তু এরা মনের কথা লিখে ফেলে… কী যেন নাম জিনিসটার?
চিঠি?
না, না, চিঠি নয়… ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে… কবিতা।
ভুরু তুলল হিপনোটিস্ট–ছোকরার সঙ্গে আপনার মেয়ের দেখা হল কীভাবে?
প্যারিস থেকে ফ্লায়িং মেশিনে এসে নামতে গিয়ে মেয়ে আমার হোঁচট খেয়ে পড়বি তো পড় এক্কেবারে ছোকরার দুহাতের মধ্যে। বাস! শুরু হয়ে গেল সেই থেকে।
আচ্ছা?
এবার বুঝেছেন, কেন ধড়ফড় করে মরছি? এ জিনিস বন্ধ করতেই হবে। হিপনোটিস্ট আমি নই–জানি না কী করতে হবে। কিন্তু আপনি
হিপনোটিজম তো আর ম্যাজিক নয়।
তা তো বটেই। কিন্তু তবুও
রাজি না থাকলে কাউকে হিপনোটাইজ করা যায় না। বিনডনকে বিয়ে করার যার ইচ্ছে নেই, সম্মোহিত হওয়ার ইচ্ছেও তার থাকবে না। কিন্তু একবার যদি সম্মোহিত হয়ে যায়– যেই করুক-না কেন–কাম ফতে হয়ে যাবে।
আপনিই তো পারেন
পারিই তো! মনের জোর একবার ভেঙে দিতে পারলেই হল। তারপর হুকুম দেওয়া যাবে, যাও ভুলে ছোকরাকে। অথবা দেখলেই যেন মাথা ঘোরে… নয়তো, অজ্ঞান হয়ে যেয়ো। ঘটবেও ঠিক তা-ই। সম্মোহনটা জবরদস্ত হওয়া চাই
তা তো বটেই! ভুলে মেরে দেওয়াটাই সবচাইতে ভালো—
কিন্তু সমস্যা তো হিপনোটাইজ করানোটা। আপনি বললে তো রাজিই হবে না।
বলে, হাতে মাথা রেখে কিছুক্ষণ ভেবে নিল হিপনোটিস্ট।
খাপছাড়া স্বরে বললেন স্বরেস, নিজের মেয়েকে সিধে করতে পারার মতো দুঃখ আর হয় না।
হিপনোটিস্ট বললে, আপনার মেয়ের নাম-ঠিকানা দিন। বিষয়টা সম্বন্ধে আরও কিছু খবর জানিয়ে রাখুন। ভালো কথা, এর মধ্যে টাকাকড়ির ব্যাপার আছে নাকি?
দ্বিধায় পড়লেন স্বরেস।
তা… ইয়ে… একটু আছে বইকী। ওর মায়ের টাকা। মোটা টাকা। পেটেন্ট রোড কোম্পানিতে খাটছে। এই টাকাটার জন্যেই তো ভাবনায় পড়েছি।
বুঝেছি, বলে স্বরেসকে জেরা শুরু করল হিপনোটিস্ট।
চলল অনেকক্ষণ।
ইতিমধ্যে এলিজাবেথিটা স্বরেস নামের মেয়েটি বসে আছে প্যারিস থেকে ফ্লায়িং মেশিন এসে নামে যে মঞ্চে, তার পাশের ওয়েটিং রুমে। এলিজাবেথিটা নামটা অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর উচ্চারণে দাঁড়ায় এলিজাবেথ। থ হয়ে গেছে থিটা। সে যাক গে। এলিজাবেথিটার পাশে বসে কবিতা পড়ে শোনাচ্ছে তার ছিপছিপে চেহারার সুদর্শন প্রেমিক-কবিতাটা লিখেছে সেইদিনই সকালে মঞ্চে ডিউটি দেওয়ায় সময়ে। শেষ হল কবিতা। দুজনে মুখোমুখি যেন গভীর দুঃখী হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপরেই হু হু। করে আকাশ থেকে নেমে এল আমেরিকা থেকে আসা বিশাল উড়ুক্কু যন্ত্রটা।
প্রথমে ছোট্ট, লম্বাটে, নীলচে একখণ্ড বস্তুর মতো দেখা গেল ফ্লায়িং মেশিনটাকে সুদূর গগনে পেঁজা তুলোর মতো মেঘের ওপরে। বড় হয়ে উঠল দেখতে দেখতে। সুস্পষ্ট হল রং, ঝকঝকে সাদা। আরও কাছে আসতে আরও সাদা হল উড়ুক্কু যান। স্তরে স্তরে সাজানো পৃথক পালগুলো দেখা গেল স্পষ্ট। চওড়ায় প্রতিটা কয়েকশো ফুট। হিলহিলে বপুটা হল স্পষ্টতর। ফুটকি ফুটকি সারবন্দি প্যাসেঞ্জার চেয়ারগুলোও দেখা গেল সুস্পষ্ট। ভীমবেগে আকাশ থেকে খসে পড়া সত্ত্বেও নিচ থেকে মনে হল যেন ঠিকরে যাচ্ছে ঊর্ধ্বগগনের দিকে। শহরের ছাদের ওপর দিয়ে বিশাল ছায়া লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে মঞ্চের দিকে। যন্ত্রযানের আশপাশ দিয়ে শিস-দেওয়া শব্দে বাতাস ধেয়ে যাওয়ার আওয়াজ আছড়ে পড়ল কানের পরদায়। আর্তনাদ শোনা গেল সাইরেনের। মঞ্চে যারা রয়েছে, তীব্র তীক্ষ্ণ শব্দে হুঁশিয়ার করছে তাদের। আচম্বিতে ঝপ করে পড়ে গেল সাইরেনের বিকট আওয়াজ। পরিষ্কার হয়ে গেল আকাশ। স্নিগ্ধ চোখে এলিজাবেথিটা তাকালে পাশে বসা ডেনটনের পানে।
নৈঃশব্দ্য ভঙ্গ হল ডেনটনের ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে। এ ভাষায় কথা বলা হত আদিম যুগে–বিশ্বসংসার যখন শৈশবাবস্থায়, তখন। নিরালায় ভাববিনিময়ের জন্যে এই ভাষাকেই বেছে নিয়েছে এলিজাবেথিটা আর ডেনটন। এ ভাষায় কথা বলে শুধু দুজনে মুখোমুখি বসে, দুজনের গণ্ডির বাইরে আর কেউ জানে না ভাষাটার শ্রুতিমাধুর্য। হোঁচট-খাওয়া আধো আধো ভাষায় ডেনটন ব্যক্ত করল তার মনোগত অভিপ্রায়। একদিন এলিজাবেথিটাকে নিয়ে সে-ও যাবে আকাশপথে সূর্যালোকিত আনন্দের দেশ জাপানে। চারদিকের বাধাবিপত্তি কাটিয়ে উঠে ছিটকে ধেয়ে যাবে শূন্যপথে–আধখানা দুনিয়া পেরিয়ে দুজনে পৌঁছাবে রোদ্দুর ঝলমলে নিপ্পনে।
এ স্বপ্ন ভালো লাগে এলিজাবেথিটারও। কিন্তু ভয় পায় শূন্যপথে লাফ দিতে হবেখন– পরে হবে বলে প্রবোধ দিয়ে গেল ডেনটনকে–সমানে উৎসাহ জুগিয়ে গেল ডেনটন সেদিনের নাকি আর দেরি নেই। বলতে বলতে শোনা গেল তীব্র বাঁশির আওয়াজ-মঞ্চে ডিউটি দেওয়ার সংকেত। বিচ্ছিন্ন হল দুজনে–যেভাবে প্রেমিকযুগল বিচ্ছিন্ন হয়েছে যুগে যুগে হাজার হাজার বছর ধরে। করিডর বেয়ে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল এলিজাবেথিটা। লিফ্ট থেকে নেমে এল পরবর্তীকালের লন্ডন শহরের একটি রাস্তায়। কাঁচ দিয়ে বাঁধানো ঝলমলে চকমকে রাস্তা–রোদে-জলে যাতে রাস্তার দফারফা না হয়–তাই এই স্ফটিক আবরণ। কোথায় লাগে ইন্দ্রপুরীর রাজপথ। কেননা, স্ফটিকাবৃত অপরূপ এহেন পথের ওপর দিয়ে বিরামবিহীনভাবে সঞ্চরমাণ রয়েছে চলমান মঞ্চ। গোটা শহর জুড়ে রয়েছে এই মঞ্চ–যেখানে খুশি যাওয়া যাবে শুধু টুপ করে মঞ্চে উঠে বসলেই। এইরকমই একটা মঞ্চে উঠে বসে নারী হোটেলের নিজস্ব অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছাল এলিজাবেথিটা। বিশ্বের যাবতীয় সেরা লেকচারারদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রয়েছে এখানকার প্রতিটা অ্যাপার্টমেন্টের। সেই মুহূর্তে কিন্তু এলিজাবেথিটার হৃদয় সূর্যালোকে মর্থিত থাকায় বিশ্বের সেরা লেকচারারদের প্রজ্ঞাও অতি-তুচ্ছ মনে হল সেই আলোর পশ্চাৎপটে।
দিনের মধ্যভাগ কাটল জিমন্যাশিয়ামে। দুপুরের খাওয়া খেল অন্য দুটি মেয়ে আর সেই বয়স্কা রমণীর সঙ্গে, যেসব মেয়েকে একাই দেখাশোনা করে–যুবতী মেয়েদের সহচরী রাখার রেওয়াজ ভিক্টোরীয় যুগের মতো এ যুগেও রয়ে গেছে। যে মেয়েদের মা নেই অথবা যে মেয়েরা বিত্তশালী শ্রেণিভুক্ত, তাদের সহচরী থাকে এখনও। এককথায় এদের বলা হয় শ্যাপেরোন।
শ্যাপেরোন সেদিন একলা নয়। সঙ্গে রয়েছে একজন দর্শনার্থী। সাদা মুখ। চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। পরনে সবুজ আর হলদে রঙের পোশাক। কথার ধোকড়। বলার ভঙ্গিমাটাও চমৎকার। সাত-পাঁচ কথা বলতে বলতে শুরু করল ঐতিহাসিক রোমান্স। নতুন ধরনের প্রেমকাহিনি৷ এ যুগের একজন নামী গল্প-বলিয়ে সদ্য উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। কাহিনিটা অবশ্য ভিক্টোরীয় আমলের। কিন্তু একটা অভিনব আঙ্গিক সংযোজন করেছেন এ যুগের যশস্বী এই কথাশিল্পী। ভিক্টোরীয় যুগে প্রতিটি পরিচ্ছেদের মাথায় একটা শিরোনামা থাকত। উনি শিরোনামার অনুকরণে ছোট্ট ছোট্ট রংচঙে ভূমিকা জুড়ে দিয়ে প্রতিটি কাহিনিখণ্ডের আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছেন। সেকেলে কেতাব কাহিনির চাইতেও আঙ্গিকটি তাই চমকপ্রদ। হলুদ এবং সবুজ বর্ণের পোপাশাক-পরা পুরুষটিও মুখর হয়েছে আঙ্গিকের প্রশংসায়। ছোট্ট ছোট্ট এই বাক্যের নাকি তুলনা হয় না। এক ঝলকে মনের চোখে ভাসিয়ে তোলে বেপরোয়া দামাল যুগটাকে। মানুষ আর পশু তখন নোংরা রাস্তায় গায়ে গা দিয়ে চলত–তিলধারণের জায়গা থাকত না পথে। কোণে কোণে ওত পেতে থাকত মৃত্যু। জীবন তো একেই বলে! জীবনের মতো জীবন! অথচ পৃথিবীর বহু জায়গা তখনও ছিল অনাবিষ্কৃত। এ যুগে বিস্ময় জিনিসটা বলতে গেলে একেবারেই লোপ পেয়েছে। এ যুগের মানুষ বড় ছিমছাম কাটছাঁট ধরাবাঁধা জীবনযাপন করে। তাল কাটে না, সুর কাটে না। মানুষ জাতটার সাহস, সহিষ্ণুতা, আস্থা মিলিয়ে যেতে বসেছে একটু একটু করে–মহৎ কোনও গুণই আর থাকবে না দুদিন পরে–এত ঘড়ি ধরে নিয়ম মেনে ওজন করে চলার ফলে।
কথার ফুলঝুরি শুনে মেয়েরা তো মন্ত্রমুগ্ধ। অবাক হয়ে শুনছে গৌরবময় অতীতের কাহিনি। এই লন্ডন শহরেই কী বিপুল উচ্ছ্বাস-আনন্দ-প্রাণস্ফুর্তির বন্যায় ভেসে গেছে সে যুগের মানুষ। লন্ডন এখন আরও বড় শহর, আরও জটিল–দ্বাবিংশ শতাব্দীর এই লন্ডনের সঙ্গে তুলনা চলে না ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই ঘিঞ্জি নোংরা আধা-বর্বর লন্ডনের। এ যুগের লন্ডন থেকে পৃথিবীর যে কোনও অঞ্চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা এখন কোনও সমস্যাই নয়। তা সত্ত্বেও বক্তার বাচনভঙ্গিমার ফলে মনে হচ্ছে, বড় একঘেয়ে কষ্টের জীবন এই লন্ডনের মানুষদের–এর চাইতে অনেক উচ্ছল, অনেক প্রাণবন্ত জীবন ছিল আদি লন্ডনের আদিম মানুষদের।
কথোপকথনে প্রথমে অংশ নেয়নি এলিজাবেথিটা। কিছুক্ষণ পরেই এমনই জমে উঠল বিষয়বস্তু যে, দু-চারটে মন্তব্য না করে পারল না। যদিও বেশ লাজুকভাবে। কিন্তু বক্তার যেন নজরই নেই তার দিকে। কথা বলে যাচ্ছে অনর্গল… আপন মনে। বলে যাচ্ছে আরও একটা চিত্তবিনোদনের পন্থা। সদ্য আবিষ্কৃত পন্থা। সম্মোহন করে নাকি শ্রোতাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গৌরবোজ্জ্বল অতীতে। সম্মোহিত অবস্থায় শ্রোতার কানে কানে বলে দেওয়া হয়, এখন তুমি এসেছ প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর হারিয়ে যাওয়া সেই যুগে। সম্মোহিত ব্যক্তি মনে করে, সে সত্যি সত্যিই রয়েছে পুরাকালের আনন্দ-অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে। বাস্তব জীবনের মতোই অতীতের রোমান্সে গা ভাসিয়ে দেয় কিছুক্ষণের জন্যে, প্রেমক্রীড়ায় মত্ত থাকে মনের আনন্দে, ঘোর কেটে যাওয়ার পরেও কিন্তু মনে থাকে সবকিছুই… যেন সত্যি, সত্যি, সব সত্যি!
বহু বছর ধরে এই আনন্দ দেওয়ার পথ খুঁজেছি, বললে হিপনোটিস্ট, ব্যাপারটা আসলে স্বপ্ন, নকল স্বপ্ন। এতদিনে জেনেছি কীভাবে এই নকল স্বপ্ন মানুষের মনে অজস্র রং দিয়ে এঁকে দেওয়া যায়। ফলে, অভিজ্ঞতার বর্ণসুষমা, অ্যাডভেঞ্চারের পুনর্জাগরণ, ন্যক্কারজনক রেষারেষির মধ্যে থেকে পলায়ন… সবই এখন সম্ভব! অত্যাশ্চর্য এই আবিষ্কারের তুলনা হয় না!
সাগ্রহে শুধায় শ্যাপেরোন, আপনি জানেন নাকি কায়দাটা?
নিশ্চয়। কী স্বপ্ন চান, হুকুম দিয়েই দেখুন-না!
প্রথমে সম্মোহিত হল শ্যাপেরোন। আশ্চর্য স্বপ্ন নিয়ে আনন্দে আটখানা হল ঘোর কেটে যাবার পর।
উৎসাহ সঞ্চারিত হল অন্য মেয়েদের মধ্যেও। একে একে ধরা দিল হিপনোটিস্টের খপ্পরে। প্রেমমদির অতীতে ফিরে গিয়ে অবগাহন করে এল কৃত্রিম প্রেম-অভিজ্ঞতার ঝরনাধারায়। রোমান্স কে না চায়!
এলিজাবেথিটাকে কিন্তু কেউ সাধেনি। সে নিজেই এই আশ্চর্য মজার স্বাদ পেতে চেয়েছিল। তাই তাকে হিপনোটিস্ট নিয়ে গিয়েছিল স্বপ্নের জাদুপুরীতে–যেখানে গেলে আর নিজের কোনও স্বাধীনতা থাকে না, নিজের ইচ্ছেয় আর কিছু করা যায় না…
নষ্টামিটা সাঙ্গ হল এইভাবেই।
উড়ুক্কু যন্ত্রযানের মঞ্চের নিচে রাখা নিরিবিলি শান্তির চেয়ারটায় একদিন এসে বসল ডেনটন। কিন্তু এলিজাবেথিটাকে দেখতে পেল না। এল হতাশা, সেই সঙ্গে ক্রোধ। পরের দিনও এল না এলিজাবেথিটা, তার পরের দিনও নিপাত্তা। এবার ভয় পেল ডেনটন। ভয় ভুলে থাকার জন্যে লিখতে বসল চতুর্দশপদী সনেট কবিতা–এলিজাবেথিটা এলেই গছিয়ে দেওয়া যাবে হাতে…
মনকে বিষয়ান্তরে নিবিষ্ট করে তিন-তিনটে দিন এইভাবে নিজের সঙ্গেই ভয়াবহ লড়াই করে গেল ডেনটন–নিষ্ঠুর সত্যটা প্রকট হল তারপর। কিন্তু এলিজাবেথিটা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, এ ধারণা মাথায় আনতে পারল না কিছুতেই–নিশ্চয় অসুস্থ, অথবা হয়তো ধরাধামেই আর নেই। বড় কষ্টে গেল একটা সপ্তাহ। সাত-সাতটা দিন অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর সমগ্র সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করল এলিজাবেথিটা তার কাছে কতখানি ডেনটনের সমস্ত ভুবন জুড়ে রয়েছে যে মেয়েটি, তাকে খুঁজে বার করতে হবে যে করেই হোক–হয়তো নিষ্ফলে যাবে তল্লাশি–তবুও খুঁজতে হবে, খুঁজতে হবে–তাকে ছাড়া যে জীবন বৃথা।
পুঁজি কিছু ছিল। সেই ভরসাতেই চাকরি ছেড়ে দিল ডেনটন। এলিজাবেথিটা কোথায় থাকে, সে কোন স্তরের কী পরিবেশের মানুষ–কিছুই জানা নেই ডেনটনের। এলিজাবেথিটাই বলেনি মেয়েলি রোমান্সের পুলকে, সমাজের দুজনের দুই স্তরে স্থান, ডেনটন না-ই বা জানল সে বৃত্তান্ত। তাই যেদিকে দুচোখ যায়, বেরিয়ে পড়ল ডেনটন। লন্ডন শহরটা চিরকালই গোলকধাঁধার মতো। ছিল ভিক্টোরীয় আমলেও, রয়েছে এখনও। কিন্তু তখন লন্ডনে থাকত মোটে চল্লিশ লক্ষ মানুষ, দ্বাবিংশ শতাব্দীর লন্ডনে থাকে তিন কোটি মানুষ। বিষম উৎসাহে এই জনারণ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ডেনটন, খাওয়া ভুলে গিয়েছিল, ঘুমানোর কথা মনে থাকেনি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস খুঁজেছে প্রেয়সীকে, ক্লান্তি আর হতাশায় উবে গেছে প্রথমদিকের বিপুল উৎসাহ, দেহে-মনে নেমেছে অবসাদ, অধিক উত্তেজনা অপসৃত হওয়ার পর চিত্ত জুড়ে বসেছে অপরিসীম ক্রোধ। বহু মাস পর আশার ক্ষীণ প্রদীপটিও নিবে গেছে একসময়ে, তা সত্ত্বেও যন্ত্রবৎ খুঁজে গেছে এলিজাবেথিটাকে পথে পথে, গলিখুঁজিতে। যাকে দেখেছে, তারই মুখের দিকে অনিমেষে চেয়ে থেকেছে। লিফ্ট, প্যাসেজ, অন্তহীন পথে-বিপথে হন্যে হয়ে খুঁজেছে… খুঁজেছে… মানুষ-চাকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটিমাত্র মানুষকে…
দৈব সহায় হল একদিন। দেখা পেল এলিজাবেথিটার।
সেদিন ছিল উৎসবের দিন। ক্ষুধায় কাতর ছিল ডেনটন। ভেতরে ঢোকার দক্ষিণা গুনে দিয়ে ঢুকেছিল শহরের অন্যতম দানবাকার ভোজনকক্ষে। টেবিলের পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিছক অভ্যাসের বশে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে যাচ্ছিল চেয়ারে আসীন প্রতিটি মুখ…।
দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আচম্বিতে স্থাণুর মতো, নড়ার শক্তি তিরোহিত হয়েছিল পদযুগল থেকে, দুই চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল কোটর থেকে, দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল অধরোষ্ঠ। মাত্র বিশ গজ দূরে বসে রয়েছে এলিজাবেথিটা, সটান চেয়ে রয়েছে তার দিকেই। কিন্তু এ কী চাহনি! পাথরের মূর্তির চোখেই যে এমন কঠোর, নির্ভাষ, নিরাবেগ চাহনি দেখা যায়। ডেনটনকে চিনতে পারার কোনও চিহ্নই নেই কুলিশ-কঠিন অক্ষিতারকায়।
মুহূর্তেক ডেনটনের পানে এহেন দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল এলিজাবেথিটা, পরক্ষণেই চেয়েছিল অন্যদিকে।
শুধু চাহনি দিয়ে যদি বিচার করতে হয়, তাহলে এই এলিজাবেথিটা ডেনটনের সেই এলিজাবেথিটা নয়। কিন্তু ডেনটনের এলিজাবেথিটাকে যে ডেনটন চেনে হাত দিয়ে, কানের পাশে দোলানো চূর্ণ-কুন্তল দিয়ে। মাথা ঘোরানোর সঙ্গে সঙ্গে কী সুন্দরভাবেই না দুলে ওঠে অলকগুচ্ছ। পাশে বসা মানুষটার কথা শুনে সংযত হেসে তার দিকে মুখ ফেরাল এই এলিজাবেথিটা। মানুষটাকে কটমট করে দেখল ডেনটন। খর্বকায় নির্বোধ আকৃতি। পরিচ্ছদ বুড়োটে সরীসৃপের মতন৷ মাথায় বাতাস-ফোলানো জোড়া শিং। এরই নাম বিনডন, এলিজাবেথিটার পিতৃদেবের মনোনীত পাত্র।
ক্ষণকাল দাঁড়িয়ে ছিল ডেনটন বিস্ফারিত চোখে–সমস্ত রক্ত নেমে গিয়েছিল মুখ থেকে। তারপরেই মনে হল, বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে। বসে পড়েছিল পাশের ছোট্ট টেবিলের সামনে। বসে ছিল কিন্তু এলিজাবেথিটার দিকে পিঠ ফিরিয়ে, চোখাচোখি তাকানোর সাহসও ছিল না। সামলে নেওয়ার পর আবার তাকিয়ে দেখেছিল, চেয়ার ছেড়ে উঠে। দাঁড়িয়েছে এলিজাবেথিটা আর বিনডন। উঠে দাঁড়িয়েছে তার বাবা আর শ্যাপেরোনও। যাওয়ার সময় হয়েছে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে ছিল ডেনটন-নিশ্চল, নিথর, নীরব। আস্তে আস্তে দূরে সরে গিয়েছিল চার মূর্তি। সংবিৎ ফিরে পেয়েছিল ডেনটন। উঠে দাঁড়িয়ে ধাওয়া করেছিল পেছনে। চলমান মঞ্চের মোড়ে এসে দেখেছিল এলিজাবেথিটা আর শ্যাপেরোনকে। উধাও হয়েছে বিনডন আর স্বরেস।
ধৈর্য আর বাধ মানল না। এলিজাবেথিটার সঙ্গে এখুনি দুটো কথা না বললে যেন মৃত্যু হবে মনে হল। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল দুজনের দিকে। ওরা বসে ছিল দুটো চেয়ারে। ডেনটন বসল পাশের চেয়ারে। বিষম উত্তেজনায় ক্ষিপ্তের মতো তখন থরথর করে কাঁপছে ডেনটনের সাদা মুখ।
হাত রেখেছিল এলিজাবেথিটার মণিবন্ধে–এলিজাবেথ, তুমি?
অকৃত্রিম বিস্ময়ে চোখ ফিরিয়েছিল এলিজাবেথিটা। অজানা-অচেনা মানুষ গায়ে পড়ে আলাপ করতে এলে যুগে যুগে তরুণীরা যেভাবে ভয় পেয়েছে–সেই ভয় ছাড়া আর কিছুই প্রকটিত হল না দুই নয়নতারকায়।
এলিজাবেথ! উত্তেজনা-বিকৃত নিজের কণ্ঠস্বর নিজেই চিনতে পারেনি ডেনটন –এলিজাবেথ! কী সর্বনাশ! চিনতে পারছ না?
সভয়ে সরে বসেছিল এলিজাবেথিটা। উজ্জ্বল-চক্ষু ধূসর-কেশী শ্যাপেরোন ঝুঁকে বসে নিরীক্ষণ করেছিল ডেনটনকে–কী বললেন?
ইনি আমাকে চেনেন।
চেনো এঁকে?
না, কপালে হাত রেখে ক্লিষ্ট কণ্ঠে যেন শেখানো বুলি আওড়ে গিয়েছিল এলিজাবেথিটা, চিনি না… চিনি না… চিনি না।
কি-কিন্তু আমি যে ডেনটন। যার সঙ্গে কত কথা বলতে তুমি ফ্লায়িং স্টেজের নিচে বসে? মনে পড়ছে না? মনে পড়ছে না কবিতাগুলো–
না, না, না, চিনি না… চিনি না… আরও যেন কী আছে, কিন্তু মনে পড়ছে না… শুধু জানি… এঁকে আমি চিনি না– নিদারুণ অন্তর্দ্বন্দ্বে কালো হয়ে ওঠে এলিজাবেথিটার মুখচ্ছবি।
এইভাবেই চলেছিল কিছুক্ষণ। এলিজাবেথিটা চেষ্টা করেও কিছু মনে করতে পারেনি তোতা পাখির মতো শুধু আওড়ে গেছে একটাই কথা–চিনি না… চিনি না… চিনি না ওঁকে। ক্ষিপ্তের মতো মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে ডেনটন–কবিতার কথা, গানের কথা, প্রেমকাহিনির কথা।
কিন্তু বৃথাই। ক্লান্ত অবসন্ন এলিজাবেথিটাকে অবশেষে বাঁচিয়ে দিয়েছিল শ্যাপেরোন। ভাগিয়ে দিয়েছিল ডেনটনকে। পাগলের মতো চলমান মঞ্চ থেকে মঞ্চে লাফিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল ডেনটন। সেইদিকে নির্নিমেষে চেয়ে থেকে এলিজাবেথিটা শুধু জানতে চেয়েছিল, লোকটা কে? অনিমেষে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে শ্যাপেরোন বলেছিল, বাজে লোক -মাথায় ছিট আছে। জীবনে দেখিনি। খামকা ও নিয়ে আর মাথা ঘামিয়ো না।
এই ঘটনার পরেই সবুজ-হলদে পোশাক-পরা হিপনোটিস্টের কনসাল্টিং চেম্বারে আবির্ভূত হল একজন নয়া মক্কেল। তরুণ বয়স। উশকোখুশকো চুল। বিধ্বস্ত আকৃতি। উন্মাদের মতো শুধু বললে, ভুলতে চাই… ভুলিয়ে দিন… সব ভুলিয়ে দিন।
প্রশান্ত চোখে যুবকের পোশাক, আচরণ এবং মুখাবয়ব অবলোকন করে বললে হিপনোটিস্ট–ভুলে যাওয়ায় যন্ত্রণা অনেক কম। কিন্তু আমার দক্ষিণা যে বেশ চড়া।
ভুলতে যদি পারি…
হয়ে যাবে। আপনার নিজের ইচ্ছে যখন আছে… অসুবিধে হবে না। এর চাইতেও কঠিন কেস করেছি আমি। এই তো সেদিন একটি মেয়েকে সব ভুলিয়ে দিলাম– ভালোবাসার ব্যাপার ছিল।
হিপনোটিস্টের পাশে বসল তরুণ যুবা। জোর করে সংযত রাখল ছটফটানি। বললে অবরুদ্ধ কণ্ঠে, নাম তার এলিজাবেথটা স্বরেস।
কথাটা বলেছিল হিপনোটিস্টের চোখে চোখে চেয়ে। তাই দেখেছিল, নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ময় উথলে উঠল তার চোখে। বুঝেওছিল তৎক্ষণাৎ। ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠে কাঁধ খামচে ধরেছিল হিপনোটিস্টের। মুখে কথা সরেনি কিছুক্ষণ।
তারপরেই ফেটে পড়েছিল বিষম ক্রোধে। ফিরে পেতে চেয়েছিল এলিজাবেথিটাকে। আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ধস্তাধস্তি। দুজনের কেউই অ্যাথলিট নয়। কুস্তি করতে কেউই শেখেনি। এ যুগে ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শিত হয় কেবল বিশেষ উপলক্ষে। ব্যায়ামচর্চার রেওয়াজ আর নেই। কিন্তু দুজনের মধ্যে গায়ে জোর বেশি তরুণ যুবার। তাই অচিরেই আছড়ে ফেলল হিপনোটিস্টকে। কপালে চোট লাগায় জ্ঞান হারাল সম্মোহনের জাদুকর কিছুক্ষণের জন্যে। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখল, তার-ছিড়ে-আনা একটা ল্যাম্প বাগিয়ে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ডেনটন! খুনে চাহনি। খুনে কণ্ঠেই সে বললে, কথা না শুনলে প্রস্তর যুগের অস্ত্রচালনা করবে এখুনি। পাথরের হাতিয়ারের বদলে এই ল্যাম্প ছাতু করবে খুলি। অজ্ঞান থাকার সময়ে কাগজপত্র হাঁটকে পেয়েছে এলিজাবেথিটার ঠিকানা। ফোন করে দিয়েছে। শ্যাপেরোনকে নিয়ে সে আসছে এখুনি। এলেই যেন তাকে সম্মোহন করা হয়। ভাঁওতা দিতে হবে শ্যাপেরোনকে–সম্মোহন করা হচ্ছে মর্কটের মতো কদাকার ছোকরাটাকে এখুনি বিয়ে করার জন্যে–বললেই সে চুপ করে থাকবে। সম্মোহনের ঘোর এসে গেলেই ফিরিয়ে দিতে হবে এলিজাবেথিটার পূর্বস্মৃতি।
ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি জানিয়েছিল সম্মোহক ভদ্রলোক। আধুনিক মানবজাতির আচরণবিধি গ্রন্থে এ জাতীয় প্রস্তর-যুগীয় হামলাবাজির কথা কোথাও লেখা নেই। অটল থেকেছে ডেনটন। বেচাল দেখলেই ছাতু করবে খুলি। নিজে মরতে তার দ্বিধা নেই।
কিন্তু খুলির মায়া যে বড় মায়া–নির্দ্বিধায় জানিয়েছিল সম্মোহক। চিকিৎসকের সততা এখন শিকেয় তোলা থাকুক–কাকপক্ষীও জানবে না, এলিজাবেথিটা পূর্বস্মৃতি ফিরে পেল কী করে। ডেনটনের প্রতিও আক্রোশ মিলিয়ে যাবে দুদিনে। অনেকক্ষণ মেঝেতে বসে রয়েছে সম্মোহক, এখন উঠে বসলে হয় না? এলিজাবেথিটা যে এসে যাবে এখুনি।