১. প্রধান প্রধান স্থানীয় দুর্ব্বৃত্ত জাতি

প্রথম ভাগ
যে সকল প্রধান প্রধান স্থানীয় দুর্ব্বৃত্ত জাতি বাঙ্গালায় চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে।

.

সূচিপত্র

প্রথম ভাগ

  • যশোহরের বেদিয়া
  • ভূমিজ
  • নিমবঙ্গের ব্যাধ
  • বাঙ্গালার বাগদী, পোদ এবং কাওরা
  • ঢেকারু
  • গায়েন
  • লোধা
  • তুঁতিয়া মুসলমান
  • জাল মক্কা মোয়ালেম
  • ছোটভাগিয়া মুচি
  • সান্দার

.

যশোহরের বেদিয়া।

উৎপত্তি।

“ইম্পিরিয়াল অব্ ইণ্ডিয়া” নামক পুস্তকের ২য় খণ্ডের ৪৯৪ পৃষ্ঠায় উক্ত হইয়াছে যে যে সময়ে মধ্য ভারত, বোম্বাই ও মান্দ্রাজ প্রদেশে মহারাষ্ট্রীয়দিগের পরিবর্তে পিণ্ডারিগণ ভীষণ ডাকাইতি করিতে আরম্ভ করিল, সেই সময়ে বাঙ্গালাদেশে ছত্রভঙ্গ মুসলমান সৈনিকগণ ও যে সকল হিন্দু জাতি ডাকাইতি করাই পেশা তাহারা অনেক ডাকাইতের দল গঠন করে। যশোহরের বেদিয়াগণ এই সকল দলের অবশিষ্ট অংশ। আমরা শুনিয়াছি যে বঙ্গদেশে যে সকল দল গঠিত হয় তাহারা ওয়ারেণ হেষ্টিংসের কঠোর শাসনে শীঘ্রই ছত্রভঙ্গ হয়। কিন্তু নিশ্চয়ই তখনও কতকগুলি দল কোনরূপে নিজেদের অস্তিত্ব এবং অপেক্ষাকৃত মৃদুভাবে লুটপাটের অভ্যাস রক্ষা করিয়াছিল। বেদিয়ারা নিজেরাই বলে যে তাহারা প্রথমে গুজরাট হইতে আসে, কিন্তু গুজরাট যে কোথায় তৎসম্বন্ধে তাহারা কিছুই জানে না। তাহাদের ভাষাতে অনেক হিন্দুস্থানি কথা আছে। ইহার দ্বারাও প্রমাণ হয় যে তাহারা পশ্চিম অঞ্চল হইতে আসিয়াছিল।

বেদিয়া নামের প্রয়োগ।

বেদিয়া শব্দের অর্থ শিকারী। রিজলী ও অন্যান্য লেখকগণ , বাঙ্গালার সান্দার গায়েন প্রভৃতি হিন্দু ও মুসলমান অনেক শ্রেণীর লোককে বেদিয়া নাম দিয়াছেন। অতএব বলিয়া রাখা উচিত যে পুলিশ যে সকল লোককে যশোহরের বেদিয়া বলিয়া জানে তাহারা একটি ছোট জাতির অন্তর্গত। এই জাতিতে প্রায় ৪০০ প্রাপ্তবয়স্ক লোক আছে। ইহারা আর এখন ঘুরিয়া বেড়ায় না।

বাসস্থান।

যশোহর জেলার গাইঘাটা সার্সা, বনগাঁও ও ঝিকরগাছা থানার অধীন কতকগুলি গ্রামে এবং ২৪ পরগণার অন্তর্গত বসিরহাটে বাস করে। বেদিয়া শব্দটি ইহারা নিজেরা ব্যবহার করে না এবং আপনাদিগকে বেদিয়া বলিয়া স্বীকারও করে না। ইহারা আপনাদিগকে “শিকারী” বলে।

সমাজ এবং ধর্ম্ম।

ইহারা নামে হিন্দু, কিন্তু কয়েক বৎসর পূর্ব্ব পর্যন্তও ইহারা মুসলমানের হাতের জল এবং কখনও কখনও রন্ধন করা আহাৰ্য্যও ব্যবহার করিত। কোয়ারী সাহেব, যিনি ১৯১৪ সালে যশোহরের পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ছিলেন তিনি দেখাইয়াছেন যে ইহারা এখন কালী পূজা ও মৃত্যুর ১১ দিন পরে শ্রাদ্ধ করিলেও ইহাদের মধ্যে ২/১টা মুসলমান রীতি আছে, যেমন নিকা বিবাহ। ব্রাহ্মণেরা ইহাদের পৌরোহিত্য করে না। ইহাদের পূজা পার্বণাদি গ্রামের বৃদ্ধেরা করিয়া থাকে।

বৃত্তি।

ইহাদের কোন নিয়মিত জাতীয় বৃত্তি নাই। কোয়ারী সাহেব বলেন যে এক পরিবারভুক্ত দুই ভাইয়ের মধ্যে একজনের ছুতারের পেশা ও অপরের নাপিতের পেশা হইতে পারে। কিন্তু সাধারণতঃ ইহাদের পুরুষেরা মজুরী করে এবং স্ত্রীলোকেরা ও ছেলেপিলে খেজুর গাছের পাতা দিয়া মাদুর তৈয়ারি করে। প্রায় সমগ্র বেদিয়া সমাজই অত্যন্ত দরিদ্র হইলেও ইহারা ভিক্ষা করে না, কিন্তু প্রয়োজন মত আহাৰ্য্য সংগ্রহের জন্য চুরি করে। সম্প্রতি ধীরে ধীরে ইহাদের অবস্থার উন্নতির চিহ্ন দেখা গিয়াছে। ঝিকরগাছার অন্তর্গত দোশোটিনা গ্রামে এক ব্যক্তি একখানা নৌকা কিনিয়া ধানের ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছে। সার্সা থানার অধীন উলসী গ্রামে আর এক ব্যক্তি ডাক বিভাগে চাকরী পাইয়াছে।

কার্যপ্রণালী।

যশোহরের বেদিয়ারা ভীরুস্বভাব। ইহারা যে সকল অপরাধ করে তাহার মধ্যে জোরজবরদস্তি মারপিট থাকে না। ইহাদিগকে কখনও ডাকাইতি করিতে জানা যায় নাই। ইহারা চুরি এবং সিঁদচুরি করে। যদিও সিঁদ কাটিতে, বিশেষতঃ ঘরের বেড়ায় সিঁদ কাটিতে, ইহারা খুব নিপুণ তথাপি ইহাদিগকে খুব দুর্দান্ত সিঁদচোরও বলা যায় না। সম্ভবত অধিকাংশ স্থলে ইহারা শস্য চুরিই করিয়া থাকে। চোরাই মাল ইহারা খুব শীঘ্র শীঘ্ৰ বেচিয়া ফেলে, এবং কদাচিৎ ঐ মাল নিজের ঘরে রাখে। কোয়ারী সাহেব বলেন যে, যে স্থানেই বেদিয়ারা বাস করে তাহারই চতুর্দিকে এমন কতকগুলি লোক থাকে যাহারা চোরাই মাল কিনিয়া প্রভূত লাভ করে। কিন্তু কোন কোন স্থলে বেদিয়ারা চোরাই মাল কলিকাতায় আনিয়াও বেচিয়া যায়।

কাৰ্য্যক্ষেত্র।

বেদিয়ারা বেশীর ভাগ তাহাদের বাসস্থানের চারিদিকেই চুরি করে। কিন্তু কতকগুলি বেদিয়ার নদীয়া, খুলনা, হুগলি, ২৪-পরগণা ও কলিকাতায় সাজা হইয়াছে। ১৯০৭ সালে একদল বেদিয়াকে কলিকাতার উত্তর উপকণ্ঠে ধরা গিয়াছিল। এখানে উহারা পশ্চিমা ও কলিকাতার বদমাইসদিগের সহিত একযোগে চুরি করিত (১৯১০ সালের ২০শে মার্চ তারিখের “বেঙ্গল ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স গেজেটের” বিশেষ পরিশিষ্ট দেখ)। বেদিয়ারা নিজের নিজের জেলার পুলিশের নিকট হইতে লুকাইয়া থাকিতে ইচ্ছা করিলে প্রায় কলিকাতাতেই আসে।

বেদিয়ারা চুরি বিষয়ে কথাবার্তা কহিবার সময়ে যে সকল সাঙ্কেতিক শব্দ ব্যবহার করে কোয়ারী সাহেব তাহাদের নিম্নলিখিত কয়েকটি নমুনা দিয়াছেন:- সিদ=মাধী; চুরি=বেলি; পুলিশকাকারো; লুকাইয়া থাকাঁচাগ্লোকী।

.

ভূমিজ।

মানবতত্ত্ব।

কর্ণেল ডালটন তাঁহার “বঙ্গদেশের মানবতত্ত্ব” নামক পুস্তকে ভূমিজদিগকে হো এবং মুণ্ডা জাতির সহিত একশ্রেণীভুক্ত করিয়া বলেন যে এই তিন জাতি কোল জাতির তিন অংশ। সার হার্বার্ট রিজলির মতে ভূমিজগণ ছোটনাগপুরের মুণ্ডাদিগের বংশধর। উহারা পূৰ্ব্বদেশে আসিয়া বাস করে এবং বাঙ্গালার হিন্দুদিগের সংস্পর্শে আসিয়া ভাষা এবং সামাজিক ও ধৰ্ম্মসম্বন্ধীয় রীতিনীতিবিষয়ে তাহাদিগের মূল জাতি হইতে অনেক ভিন্ন হইয়া পড়ে।

ভূমিজ জাতির অধিকাংশ সামান্য চাষ ও মজুরী করে। কিন্তু ইহাদের মধ্যে উচ্চ এক শ্রেণী আছে তাহাদের অধিকাংশ জমিদার। তাহারা ক্রমশঃ রাজপুত বলিয়া আপনাদিগকে পরিচিত করিতেছে এবং ছোটনাগপুরের অনাৰ্য্য স্বজাতিদিগের অধিকাংশের সহিত সম্বন্ধ লোপ করিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেছে।

সামাজিক পদ্ধতি।

ভূমিজ জাতির মধ্যে বহুবিবাহ, বিবাহচ্ছেদ এবং বিধবাবিবাহ চলে। ইহারা মৃতদেহকে পোড়াইয়া এবং পুতিয়া অদ্ভুতভাবে সৎকার করে। ইহারা মৃতদেহটিকে পোড়ায় এবং পরে নিজেদের বাড়িতে ঐ ছাই পুতিয়া রাখে।

ইহাদের পেশা চাষ যাহারা অত্যন্ত গরীব তাহারা মজুরী করে। যাহারা মাথামাথা লোক তাহাদের চাষের জন্য নিজেদের যথেষ্ট জমি আছে।

মোটের উপর ভূমিজ জাতি চোর, দস্যু প্রভৃতির জাতি নহে। কেবল বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশের মানভূম জেলার এবং বাঙ্গালা প্রদেশের বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে এই জাতির যে অংশ বাস করে, তাহাদেরই চোর দস্যুপ্রভৃতি বলিয়া অখ্যাতি আছে।

বাঁকুড়ার ভূমিজগণের দুর্ব্বৃত্ততা।

মেদিনীপুর জেলায় এই জাতি প্রবল। ১৯১১ সালের আদমসুমারি অনুসারে এই জেলার পুরুষ ভূমিজগণের সংখ্যা ২২০৪১। কিন্তু ইহাদিগকে চোর, দস্যু প্রভৃতি বলিয়া জানা যায় নাই [সার হার্বার্ট রিজলি মেদিনীপুরের লোকগণকে ভূমিজদিগের একটি শাখা বলিয়াছেন। কিন্তু এই পুস্তকে উহাদিগকে ভূমিজ হইতে ভিন্ন বলিয়া ধরা হইয়াছে এবং একটি ভিন্ন অধ্যায়ে উহাদের বিষয় লেখা হইয়াছে।]। বাঁকুড়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে পুরুষ ভূমিজদিগের সংখ্যা ১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ৯৪৭৭। কয়েক বৎসর পূৰ্ব্ব পর্যন্ত বাঁকুড়া জেলার এই অংশ মানভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। নিম্নলিখিত থানাগুলির এলাকার মধ্যেই ভূমিজগণের নাম পুলিশের খাতাপত্রে বেশী দেখা যায় :- বাঁকুড়া জেলার মধ্যে খাটরা, রাইপুর, কাটনা ও ইন্দপুর থানা এবং মানভূম জেলার মধ্যে বান্দোয়ান, মানবাজার, হুরা, পুরুলিয়া, বড়বাজার ও গৌরাঙ্গদী থানা।

চেহারা।

কর্ণেল ডাল্টন তাঁহার “বাঙ্গালার মানবতত্ত্ব” নামক পুস্তকে বলিয়াছেন যে চেহারায় ভূমিজগণ সিংভূমের হো এবং ছোট নাগপুরের সর্বোকৃষ্ট মুণ্ডাদিগের অপেক্ষা নিকৃষ্ট। তাহাদের শরীর লম্বায় ছোট, কিন্তু বলিষ্ঠ গঠনের এবং সাধারণত মোটা রকমের হয়। মুণ্ডাদিগের ন্যায় তাহাদের শরীরের রং ঘোর পাটকিলে হইতে হালকা বাদামী পর্যন্ত নানা রকমের হয়।

জাতীয় ইতিহাস।

গত শতাব্দীতে জঙ্গল মহলের ভূমিজগণের নাম শুনিলে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও মানভূমের লোক ভয়ে কাপিত। লোকে উহাদিগকে চুয়াড় (দস্যু) বলিত। ১৭৯৮ ও ১৮৩২ সালে জঙ্গী ফৌজদ্বারা এই জাতির বিদ্রোহ দমন করিতে হইয়াছিল। ইহার পরেও তাহাদের জাতিগত দস্যুবৃত্তি চলিতে থাকে এবং ১৮৯৭ সালে পুলিশ একটি অতিশয় দুর্দান্ত দলের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। হলধর ভূমিজ নামক এক ব্যক্তি ইহাদের সর্দার ছিল। ১৮৬৭ হইতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত মেদিনীপুর ও বাঁকুড়া জেলায় যে সকল ভয়ানক চুরি ডাকাতি হয় তাহাদের মধ্যে অনেকগুলিই এই দলের লোকে করে। ১৮৯৮ সালে এই দলের ১৮ জনকে ফৌজদারী মোকদ্দমার কার্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১১০ ধারা অনুসারে মুচলেকাবদ্ধ করা হয়। ১৯০২ সালে আরও ১১ জনকে ঐ ধারা অনুসারে মুচলেকাবদ্ধ করা হয়। কিন্তু দলটি অতিশয় বৃহৎ হওয়ায় সহজে ভাঙ্গিয়া ফেলা যায় না। ১৯০৫ সাল পর্যন্ত এই দল বাড়িয়া যাইতে থাকে। ঐ সালে মানভূম ও বাঁকুড়া জেলায় ভয়ানক ডাকাইতি হইতে আরম্ভ হইলে নবগঠিত ক্রিমিন্যাল ইনভেষ্টিগেসন ডিপার্টমেন্টের দৃষ্টি ঐ দিকে আকৃষ্ট হয়। ডাকাইতি করিবার সময়ে এই ভূমিজ ডাকাইতেরা সড়কি, টাঙ্গি ও তরবারি এমনকি বন্দুক পর্যন্ত সঙ্গে রাখিত এবং প্রায় প্রত্যেক স্থলে যে বাড়ি তাহারা লুট করিত সেই বাড়ির লোকদিগের প্রতি অত্যন্ত নির্দয় ব্যবহার করিত।

ডাকাতি করিবার প্রণালী।

সাধারণতঃ উহারা কোন বাড়ি আক্রমণ করিবার প্রথমে খুব ইঁট ছুড়িত এবং পরে মশাল জ্বালাইয়া তাহাদের কার্য সমাধা করিত। কখনও কখনও উহারা উহাদের চেহারা লুকাইবার জন্য মুখোস পরিত। ডাকাইতি করিবার পূর্ব্বে উহারা সাবধানে মতলব ঠিক করিত এবং চরের দ্বারা সমস্ত খবর সংগ্রহ করিত। আক্রমণের প্রথমে কিম্বা বাধা দিবার জন্য সমবেত গ্রামবাসীদিগকে তাড়াইয়া দিবার জন্য ইট ছোঁড়া ভিন্ন। তাহাদের কার্যপ্রণালীর অন্য কোন বিশেষত্ব নাই। হঁটও যে ইহারা সৰ্ব্বস্থলে ছুড়িত বা অন্য কোন ডাকাইতরা ছুড়িত না তাহাও নহে।

১৯০৫ সালে যে তদন্ত আরম্ভ হয় তাহার ফলে ১৯০৬ সালে মানভূম ও বাঁকুড়া জেলায় ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০০ ধারা অনুসারে দুইটি দলের বিরুদ্ধে দুইটি মোকদ্দমা রুজু করা হয়। মানভূমের দল ১৮৯২ হইতে ১৯০৫ সালের মধ্যে ৩৬টি ডাকাইতি করে বলিয়া প্রমাণ হয়। সমগ্র দলে ১১৩ জন লোক এবং তাহাদের মধ্যে ৯২ জন ভূমিজ ছিল। ৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাহাদের মধ্যে ৬ জনকে ফৌজদারী মোকাদ্দমার কাৰ্যপ্রণালীবিষয়ক আইনের ১১০ ধারা অনুসারে মুচলেকাবদ্দ করা হয় ও ৩৭ জনকে ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০০ ধারা অনুসারে চালান দেওয়া হয়। ২৫ জনের অপরাধ সপ্রমাণ হয় এবং ৭ বৎসরের জন্য কঠোর কারাদণ্ড হইতে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি হয়।

মোকদ্দমার বিবরণ।

বাঁকুড়ার মোকদ্দমায় এপ্রুভার (রাজসাক্ষীদিগের) স্বীকারোক্তি হইতে জানা যায় যে ১৮৯৩ সাল হইতে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ৯৩ জন লোক মানভূম, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, হুগলি ও বর্ধমান জেলায় ১৮টি ডাকাইতি ও ৮টি সিঁদ চুরিতে লিপ্ত ছিল। এই ৯৩ জন লোকের মধ্যে ৪৪ জন দাগী অপরাধী ছিল। এই মোকদ্দমায় ১৪ জনকে ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০০ ধারা অনুসারে চালান দেওয়া হয়। তন্মধ্যে ১২ জনের অপরাধ সপ্রমাণ হয় ও ৩ বৎসর হইতে ৭ বৎসর পৰ্য্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন কালের জন্য কঠোর কারাদণ্ড হয়।

“দিগম্বর ভূমিজের দল” নামে খ্যাত ভূমিজের দলের ৪৫ জন লোককে বিহার ও উড়িষ্যার গবর্ণমেণ্ট ১৯১৫ সালের ৮ই জানুয়ারি তারিখের ৩৭৯ পি নং বিজ্ঞাপনদ্বারা ১৯১১ সালের ৩ আইন অনুসারে দুর্ব্বৃত্ত জাতি বলিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন।

.

নিম্নবঙ্গের ব্যাধ।

উৎপত্তি।

ব্যাধগণ ভ্রমণকারী নিম্নশ্রেণীর হিন্দু। যশোহর নদীয়া ও ২৪ পরগণা জেলায় ইহাদের বাস, ইহাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে কিছু জানা নাই। রিজলি সাহেবের বাঙ্গালাদেশের জাতিবিষয়ক গ্রন্থে ইহাদের উল্লেখ নাই এবং আদমসুমারিতেও ইহাদিগকে ভিন্ন করিয়া ধরা হয় নাই। ইহারা বলে যে পাখি ধরা ইহাদের পেশা এবং ইহাদের পূর্ব্বপুরুষগণ মুর্শিদাবাদের নবাবদিগকে পাখি সরবরাহ করিত। লোকে বলে যে কেবল সম্প্রতি কয়েক বৎসর যাবৎ ইহারা ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ান ধরিয়াছে। ইহাদের পুরুষ, স্ত্রী ও ছেলেপিলে সব এক স্থান হইতে অন্য স্থানে ঘুরিয়া, বেড়ায়। বাহ্যিকও ইহারা বাঁশের ঝুড়ি প্রভৃতি বুনিয়া বেচিয়া এবং সাতনলা দিয়া পাখি ধরিয়া জীবিকা নির্বাহ করে।

বাসের প্রণালী।

ইহারা সাধারণতঃ একস্থানে কয়েক মাসের জন্য তাঁবু ফেলিয়া থাকিয়া কতকগুলি গ্রামবাসীর সহিত বন্ধুত্ব করে ও তাহাদিগকে ধৰ্ম্মবাপ বা ধৰ্ম্মমা বলিয়া তাহাদের বিশ্বাসভাজন হয়, এবং তৎপরে নিম্নলিখিত কোন না কোন উপায়ে তাহাদিগকে প্রতারিত করে। পুরুষ ও স্ত্রী উভয়েই সমানভাবে প্রতারণায় দক্ষ।

কার্য্যপ্রণালী।

প্রতারণা করিবার উহাদের একটি উপায় এই যে যাহাদিগকে ইহারা প্রতারণা করিতে চায় তাহাদিগকে বিশ্বাস করাইয়া দেয় যে উহাদের নিকট কতকগুলি, সোণার মোহর আছে; এগুলি ইহারা একটি পুরাতন বাড়ি ভাঙ্গিবার সময়ে পায়। ইহারা হাঁড়ির আকারের একতাল মাটি বাহির করিয়া বলে যে উহার মধ্যে সোণার মোহরগুলি আছে এবং যে ব্যক্তিকে প্রতারিত করিতে চায় তাহার নিকট হইতে নগদ কিছু টাকা লইয়া উহা বন্ধক রাখিতে চায়। যদি টাকা পায় তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাহা লইয়া সেই স্থান ছাড়িয়া চলিয়া যায়। ১৯১৩ সালে বাঁকুড়া জেলার একটি মোকদ্দমায় প্রকাশ পায় যে ৪ জন পুরুষ ও ৩ জন স্ত্রী ও ৪ জন বালকবালিকা দ্বারা একটি দল গঠিত হয়।

প্রতারনার দৃষ্টান্ত।

এক গ্রামে তাঁবু ফেলিবার কয়েকদিন পরে উহাদের মধ্যে একজন কোন গ্রামবাসীকে বিশ্বাস করায় যে তাহার অনেকগুলি সোণার মোহর আছে। এই গুলিকে সে এই সর্তে ঐ গ্রামবাসীকে দিতে চায় যে ঐ গ্রামবাসী তাহাকে যাবজ্জীবন ভরণপোষণ করিতে অঙ্গীকার করিবে ও নগদ ১০০ টাকা দিবে। গ্রামবাসী এই সর্তে রাজি হইয়া ঐ ব্যাধের সঙ্গে এক নির্জন মাঠে গিয়ে তাহাকে ঐ স্বীকৃত টাকা দেয় ও তৎপরিবর্তে একটা মুখ বন্ধ করা ভারী ভাড় পায়। পরীক্ষায় দেখা যায় যে ভঁড়টি মাটিতে পোরা; তখন প্রতারিত ব্যক্তি ব্যাধকে ধরিয়া রাখিতে চেষ্টা করে কিন্তু তাহার সঙ্গিগণ লুক্কায়িত স্থান হইতে বাহির হইয়া তাহাকে উদ্ধার করে।

লক্ষ্মীর ভাঁড়।

পুলিশের কাগজপত্র হইতে জানা যায় যে অনেক স্থলে ব্যাধরমণীগণ “লক্ষ্মীর ভাড়” দিতে অঙ্গীকার করিয়া গ্রাম্য রমণীগণের নিকট হইতে গহনা ধার করিয়াছে। লক্ষ্মীর ভাঁড়ের টাকা কখনও ফুরায় না–লোকের এই ধারণা। প্রত্যেক স্থলে কোনও নির্জন স্থানে এই মূল্যবান ভঁড় দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়। বাস্তবিক পক্ষে এই ভাঁড় মাটিতে পোরা থাকে এবং কখনও কখনও উহার উপরে গুটিকতক মুদ্রা থাকে।

দুনা করিবার চাতুরী।

ব্যাধেরা দুনা করিবার চাতুরীও করে, এবং ইদানীং যাহারা শেষ মুহূর্তে টাকা দিতে অস্বীকার করে তাহাদের উপর বল প্রয়োগ করিতেও আরম্ভ করিয়াছে।

ব্যাধেরা কখনও কখনও আপনাদিগকে বাঁশফোড় ডোম বা কুরুরিয় বলিয়া পরিচিত করিবার চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে ইহাদের সহিত তাহাদের কোনো সম্বন্ধ নাই।

যে সকল লোক আপনাদিগকে পাইখমারা ও কোল বলে তাহাদিগকেও ব্যাধ বলা যাইতে পারে।

চেহারা এবং ভাষা।

ব্যাধেরা চেহারায় সাধারণ নিম্নশ্রেণীর বাঙ্গালীর ন্যায় এবং যশোহরের লোকের মত একটা টান দিয়া কথা বলে।

.

বাঙ্গালার বাগদী, পোদ এবং কাওরা।

বাগদী, পোদ এবং কাওরারা যে সৰ্ব্বত্রই দত্ত তাহা নহে। এই পুস্তকে ইহাদিগকে স্থান দিবার কারণ এই যে বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের ডাকাইতের দলে সাধারণতঃ ইহারাই বেশীর ভাগ থাকে। চুরি, ডাকাইতি প্রভৃতিতে এই তিন জাতি অন্যান্য হিন্দুজাতি ও মুসলমানের সহিত অবাধে মিশিয়া কাৰ্য্য করে। সিঁদচুরি ও ডাকাইতি করিতেই ইহারা সর্বাপেক্ষা বেশী অভ্যস্ত। এই জাতিগুলির কোনটিরই কাৰ্য্যপ্রণালীতে বিশেষ বিশেষত্ব নাই।

রিজলি সাহেবকর্ত্তৃক বাগদীদিগের বিবরণ।

সার হার্বার্ট রিজলি বলেন যে বাদীরা মধ্য ও পশ্চিম বাঙ্গালার চাষী, জেলে ও চাকর জাতি। ইহারা ১১টি অন্তর্জাতিতে বিভক্ত। এই অন্তর্জাতিগুলি আবার অনেকগুলি বিভাগে বিভক্ত। এই সকল বিভাগের লোক নিজ নিজ বিভাগের মধ্যে বিবাহ করে না।

বিবাহ ও স্ত্রী ত্যাগ।

বাগ্‌দীদিগকে নিজ নিজ অন্তর্জাতির মধ্যে কিন্তু নিজ নিজ বিভাগের বাহিরে বিবাহ করিতে হয়। তেঁতুলিয়া নামক অন্তর্জাতি ভিন্ন অন্যান্য অন্তর্জাতির মধ্যে বিধবা বিবাহ প্রচলিত। স্ত্রী বন্ধ্যা, অসতী বা অবাধ্য হইলে তাহাকে ত্যাগ করা যায়। এ সকল বিষয় জাতির বৃদ্ধেরা পঞ্চায়ত করিয়া নিষ্পত্তি করে।

ধর্ম্ম।

১৮৯১ সালে সার হার্বার্ট রিজলি বাগ্‌দীদিগের সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন–“বাগদীদিগের ধর্ম্ম গোঁড়া হিন্দুধর্ম্ম হইতে ধার করা উপকরণ এবং পশ্চিম বাঙ্গালার আদিম অধিবাসীদিগের মধ্যে প্রচলিত মিশ্রিত ভূতপ্রেত ও প্রকৃতি পূজার অবশিষ্টাংশদ্বারা গঠিত। ইহারা পতিত ব্রাহ্মণদিগের পৌরোহিত্যে শিব, বিষ্ণু, মনসা, ধৰ্ম্মরাজ ও দুর্গার পূজা করে। ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতে বাগদীরা শোভাযাত্রা করিয়া ভাদু নামী এক সাধ্বী রমণীর মূৰ্ত্তি লইয়া বেড়ায়। এই রমণী পাচেটের এক পূৰ্ব্ববর্তী রাজার কন্যা ছিলেন এবং এই জাতির কল্যাণের জন্য কুমারী অবস্থাতেই মারা যান। গীত ও উন্মত্ত নৃত্যদ্বারা এই পূজা সম্পন্ন হয় এবং স্ত্রী, পুরুষ, বালকবালিকা, সকলেই ইহাতে যোগ দেয়।”

বৃত্তি।

“আজকাল (অর্থাৎ ১৮৯১ সালে) তেঁতুলিয়া ও কসাইকুলিয়া বাগদীরা রাজমিস্ত্রী কাৰ্য্য করে এবং ইমারতের জন্য চূর্ণ প্রস্তুতও করে। দুলিয়া বাগদীরা পালকী বা ডুলি বহন করে। সাধারণতঃ বাগদীরা মাছ ধরিয়া, চটের থলে তৈয়ারী করিয়া, তুলার কাপড় বুনিয়া এবং কতক পরিমাণে চাষ করিয়াও জীবিকানির্বাহ করে। অনেক বাগদী জমিদারদিগের নিকটে মজুরি করে কিম্বা ঘুরিয়া ঘুরিয়া চাষ করিয়া বেড়ায়। বাগ্‌দীদিগকে প্রায়ই চৌকিদার হইতে দেখা যায়। জমিদারেরা ইহাদিগকে পাইক সর্দার ও লাঠিয়াল করিয়া রাখে।”

সামাজিক অবস্থা।

“বাগদীদিগকে সাধারণতঃ হিন্দুধর্মের প্রান্তদেশে অবস্থিত বলিয়া বাউরী ও ভূইয়াদিগের সহিত এক শ্রেণীভুক্ত করা হয়। গো মাংস খায় না বলিয়া বাদীরা আপনাদিগকে বাউরী, মুচি ও ওরাওঁদিগের অপেক্ষা উচ্চ বলিয়া মনে করে। ইহারা মাল জাতীয় লোকের সহিত পানাহার করে এবং বড় পচাই মদের ভক্ত।”

পুলিশের পুরাতন কাগজপত্র হইতে জানা যায় যে, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূম, হুগলী ও মুর্শিদাবাদের বাগদীরা বিখ্যাত ডাকাইত ও দস্যু, উত্তম লাঠিয়াল এবং দেওয়াল বাহিয়া উঠিতে নিপুণ। জমিদারেরা প্রায়ই ইহাদিগকে জোরজুলুমের জন্য নিযুক্ত করে। অনেক বাগদী বিশেষ বিশেষ ডাকাইতি ও দস্যুতার মোকদ্দমায় শাস্তি পাইয়াছে, কিম্বা এই সকল অপরাধ ঘটিত বদমাইসির মোকদ্দমায় মুচলেকাবদ্ধ। হইয়াছে।

বর্তমান সময়ে ২৪-পরগণার ডায়মণ্ড হারবার মহকুমায়, হুগলীর আরামবাগ মহকুমায় এবং বর্ধমানের সদর মহকুমায় সর্বাপেক্ষা বেশি দুর্ব্বৃত্ত বাগদী দেখিতে পাওয়া যায়।

পোদ।

স্যার হার্বার্ট রিজলি বলেন যে পোদেরা নিম্নবঙ্গের জেলে, চাষী, জমিদার ও ব্যবসাদার জাতি এবং ২৪-পরগণায় ইহাদিগকে অধিক সংখ্যায় দেখিতে পাওয়া যায়।

অন্তর্জাতি।

ইহাদের উৎপত্তি অনিশ্চিৎ। ইহারা ৪টি অন্তর্জাতিতে বিভক্ত যথা:-বাগণ্ডে, বাঙ্গলা, খোট্টা বা মানা, ও উরাইয়া। প্রথম দুই অন্তর্জাতি প্রধানতঃ ২৪-পরগণা ও যশোহরে, তৃতীয় অন্তর্জাতি মুর্শিদাবাদ ও মালদহে এবং চতুর্থ অন্তর্জাতি মেদিনীপুর ও বালেশ্বরে দেখিতে পাওয়া যায়।

ধৰ্ম্ম, সামাজিক অবস্থা ও বৃত্তি।

ধৰ্ম্মে পোদেরা হিন্দু। ইহাদের নিজেদের পুরোহিত আছে। এই সকল পুরোহিত এক শ্ৰেণীর পতিত রাঢ়ীশ্রেণীর ব্রাহ্মণ। বর্তমান কালে, অন্যান্য কতকগুলি নিম্নজাতীয় হিন্দুর ন্যায় পোদেরা তাহাদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি করিবার চেষ্টা করিতেছে। কতকগুলি পোদ এ বিষয়ে, এতদূর অগ্রসর হইয়াছে যে তাহারা আপনাদিগকে ব্রাত্য ক্ষত্রিয় বলে ও উপবীত গ্রহণ করে। অধিকাংশ পোদ অশিক্ষিত এবং পুরুষেরা অত্যন্ত মদ খায় ও দুশ্চরিত্র হয়। চাষকার্য্যে ইহারা খুব দক্ষ নহে এবং কদাচিৎ নিয়মমত কোন ব্যবসা বা বৃত্তি অবলম্বন করে। ইহারা চিড়া তৈয়ারী করিয়া বিক্রয় করে।

লোকসংখ্যা ও দুর্ব্বৃত্ততা।

১৯১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে মোট পুরুষ পোদের সংখ্যা ২৭৪১৮১ এবং এই সংখ্যার মধ্যে ১৬৯১০৪ জন এক ২৪-পরগণারই অধিবাসী। কেবল ২৪-পরগণার ডায়মণ্ড হারবার মহকুমাতেই পোদেরা অত্যন্ত দুর্ব্বৃত্ত বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছে।

পোদেরা সাধারণতঃ বাগদী ও কাওরা এবং কখনও কখনও মুসলমানের সহিত একযোগে চুরি ডাকাইতি করে। ডায়মণ্ড হারবার মহকুমার অন্তর্গত মগরাহাট থানার এলাকার মধ্যে উপস্থিত পোদ, বাগদী ও কাওরাদ্বারা গঠিত অন্যূন ১০টি ডাকাইতের দল আছে। মথুরাপুর থানার এলাকায় এইরূপ দুইটি এবং কুলপী থানার এলাকায় চারিটি দল আছে।

কাওরা।

কাওয়ারা হাড়িদিগের একটি অন্তর্জাতি। ইহারা শূকর পোষে এবং খেজুর রস হইতে গুড় তৈয়ারী করে। অনেকে ইউরোপীয় ও ইউরেশীয় পরিবারের বাবুরচির কাৰ্য্য করে। ১৯১১ সালের আদমসুমারী অনুসারে মোট পুরুষ কাওরার সংখ্যা ৫৬০৭২ এবং এই সংখ্যার মধ্যে ৩১৯০৪ জন ২৪ পরগণার অধিবাসী। পোদদিগের ন্যায় ইহাদের দুর্ব্বৃত্ততা ২৪ পরগণার ডায়মণ্ড হারবার মহকুমাতেই সৰ্ব্বাপেক্ষা বেশি দেখা যায় এবং ইহারা সাধারণতঃ পোদ ও বাগদী এবং কখনও কখনও মুসলমানের সহিত একযোগে কাৰ্য্য করে। ডায়মণ্ড হারবার মহকুমায় সমগ্র কাওরাজাতি, কি পুরুষ, কি স্ত্রী, অতিশয় দুর্ব্বৃত্ত ও দুর্দান্ত। কাওরাদের সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত নীচ এবং ইহারা সাধারণতঃ গ্রামের বহির্ভাগে অপরিষ্কার ও অস্বাস্থ্যকর কুটীরে বাস করে।

.

টেকারু।

উৎপত্তি ও বাসস্থান।

ঢেকারুরা নীচ জাতীয় হিন্দু কামার। ইহারা বাঙ্গালার বীরভূম জেলায় এবং বেহার ও উড়িষ্যার সাঁওতাল পরগণায় বাস করে।

বীরভূম জেলায় ইহাদিগকে কেবলমাত্র সাঁওতাল পরগণার প্রান্তবর্তী কতকগুলি গ্রামে দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপ, সাঁওতাল পরগণায় ইহাদিগকে কেবলমাত্র বীরভূম জেলার প্রান্তবর্তী কতকগুলি গ্রামে দেখিতে পাওয়া যায়।

বীরভূম জেলায় ইহারা নিম্নলিখিত গ্রামগুলিতে বাস করে, যথা :-রাজনগর থানার এলাকায় টোবাড়ু কানমোর, হরিপুর, ব্রেলা ও কুমদীরা গ্রাম, মহম্মদবাজার থানার এলাকায় রাসপুর ও বৈদ্যনাথপুর গ্রাম এবং সিউড়ি থানার এলাকায় পাঁচকুরথি ও লাঙ্গুলিয়া গ্রাম।

সাঁওতাল পরগণায় ইহারা জামতাড়া মহকুমার মধ্যে খাজুরি, মোহুলা, আমলাধি, জলাপাহাড়, কান্টা, ডঙ্গপাহাড় চাষপাড়া, মানধারা, ধুমধারি, মুরিদি ও ঘুসরুকাট্টা গ্রামে এবং দুমকা মহকুমার মধ্যে মুরিদি, ফোরাকুসুম, দোলহর, মধুয়াদি, পাটাজোর, নাদুয়া ও সুকজোরা গ্রামে বাস করে।

এই জাতির উৎপত্তি ভালরূপ ধরা যায় না। ইহারা নিজেরা বলে যে ইহারা আগে মানভূম জেলায় বাস করিত এবং সেখান হইতে সাঁওতাল বিদ্রোহের পরে সাঁওতাল পরগণার স্থানে স্থানে আসিয়া বাস করে। রিজলি সাহেব তাহার বাঙ্গালার জাতি সম্বন্ধীয় পুস্তকের ১ম খণ্ডের ৩৮৯ পৃষ্ঠায় মানভূম জেলার এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গল মহালের অধিবাসী ঢেক্রা নামক যে এক অস্পৃশ্য নীচজাতীয় কামারের উল্লেখ করিয়াছেন, সম্ভবতঃ তাহাদের সহিত এই জাতির কিছু সম্বন্ধ থাকিতে পারে।

আচার ব্যবহার।

ঢেকারুরা মুরগী খায় যাহা অন্য কামারেরা খায় না। ইহারা শূকর, গোমাংস, ছাগল ও হাঁসও খায়, কিন্তু ভেড়া খায় না। বেনেকুমড়া এবং চিচিঙ্গা নামক উদ্ভিদ খাওয়াও ইহাদের কুসংস্কার অনুসারে নিষিদ্ধ। কালু, ধোপা, মুসলমান সাঁওতাল, বাউরি হাড়ি এবং ডোমের হাতে ইহারা রাধা খাবার খায় না। ইহারা মদ খায় এবং বহু বিবাহ ও সাঙ্গা প্রণালীতে বিবাহ করে। ইহারা ব্রাহ্মণকে পুরোহিত করে না। ইহাদের নিজেদের জাতির লোকেই ধর্মোৎসবে পুরোহিতের কাৰ্য্য করে।

চেহারা।

চেহারায় পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নিম্নজাতীয় হিন্দুদিগের হইতে ঢেকারুদিগের পার্থক্য বড় কম। ইহাদের বর্ণ কালো, চক্ষু ছোট ও তীক্ষ্ণ, দাড়ি সাধারণতঃ কামান ও দুই নাকের ছিদ্র করা। ইহারা গলায় কাঠের ছোট মালা আঁট করিয়া দুই পেঁচ করিয়া পরে এবং কেহ কেহ সম্মুখের দাঁতগুলিকে সোণা ও রূপা দিয়া অলঙ্কৃত করে।

স্ত্রীলোকেরা সাধারণতঃ প্রত্যেকে হাতের পশ্চাৎ দিকে চারিটি করিয়া এবং সর্বত্রই উপরের ও নীচের বাহুতে একটা বা দুইটা করিয়া ফুলের মত উল্কী পরে। চিবুকে এবং দুই ভ্রুর মধ্যেও ইহারা উল্কী পরে। এই উকী কখনও কখনও নাক পর্যন্ত নামাইয়া দেওয়া হয়। ইহারা হাতে আঁট চুড়ি ও পাকান বালা এবং নাকে গহনা পরে।

ভাষা ও বৃত্তি।

ঢেকারুদিগের ভাষা বাঙ্গালা, কেবল সাঁওতাল পরগণার জঙ্গলী লোকদিগের যেমন থাকে তেমনি একটা টান আছে। জাতীয় বৃত্তিতে ইহারা কামার, কিন্তু যাহাতে নিপুণতার প্রয়োজন হয় না এরূপ প্রায় সৰ্ব্বপ্রকার কাৰ্য্যই ইহারা করে। কেহ কেহ সাপুড়ে হইয়া জীবিকানিৰ্ব্বাহ করে।

ঢেকারুদিগের মধ্যে খুব কম লোকেরই জমি বা বাঁধাবাঁধি কোন বৃত্তি আছে। ইহাদের অধিকাংশই গ্রামের প্রধান লোকদিগের নিকট ঋণে আবদ্ধ। এই সকল লোক প্রায়ই ইহাদের চোরাই মাল গ্রহণ করে। পুরুষদিগের পেশা সিঁদচুরি ও চুরি করা এবং স্ত্রীলোকেরা পকেট মারিতে, ছিঁচকে চুরি কার্যে নিপুণ। ইহারা প্রধানতঃ বীরভূম বর্ধমান এবং হুগলি জেলায় চুরি করে এবং সাধারণতঃ দল বাঁধিয়া কাৰ্য্য করে। এক দলে অনেক গ্রামের লোক থাকিতে পারে।

অপরাধ অনুষ্ঠানের প্রণালী।

চুরি করিতে যাইবার পূৰ্ব্বে ইহারা কালী পূজা করে এবং ৯ মদ খাইয়া নেশা করে। গঙ্গা স্নানের ন্যায় যত মেলার সময়ে ইহারা তীর্থযাত্রা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে পথে যাইতে যাইতে যেমন সুবিধা হয় তেমনি চুরি ও সিঁদচুরি করে। এ সকল স্থলে পূৰ্ব্ব হইতে ইহাদের কোন একটি নির্দিষ্ট চুরির মতলব ঠিক থাকে না।

যে বাড়িতে চুরি করিবে সেই বাড়িতে ইহারা সিঁদ বা বগলির সাহায্যে ঢোকে না। কামার হওয়ার দরুণ ইহারা অপেক্ষাকৃত সহজে তালা ও খিল ভাঙ্গিতে ও খিলের মুখ খুলিয়া ফেলিতে পারে। ইহারা সাধারণতঃ এক রাত্রে একই পাড়ায় দুই তিন খানা বাড়িতে ঢোকে। ইহারা কদাচিৎ ভারী জিনিস লইয়া যায় এবং কখনই বল প্রয়োগ করে না। ইহারা রান্নাঘরে ঢুকিয়া খাবার খাইতে ও তৎপরে বাসনগুলি চুরি করিয়া লইয়া যাইতে ভালবাসে। ইহারা অল্প দামের জিনিষ চুরি করে এবং কখনও কখনও যে বাড়ি আক্রমণ করে সেই বাড়ির মধ্যে বা নিকটে বাহ্যে করিয়া যায়। স্ত্রীলোকেরা দল বাঁধিয়া বড় বড় ঝুড়ি লইয়া হাটে ও মেলায় যায় এবং সেখানে ভিড়ের মধ্যে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ছেলেপিলের গা হইতে গহনা টানিয়া লয়, পকেট মারে এবং স্ত্রীলোকদিগের আঁচলে বাধা টাকা পয়সা চুরি করে। ইহারা কিনিবার জন্য পরীক্ষা করিবার ছল করিয়া, এবং দোকানদার অন্য দিকে নজর দিলেই ভিড়ের মধ্যে নিপুণতার সহিত হাতে হাতে পার করিয়া দিয়া, দোকান হইতেও জিনিষ চুরি করে।

চোরাই মাল বিক্রয়।

ঢেকারুরা প্রায়ই চোরাই মাল পুকুরের জলে লুকাইয়া কিম্বা নির্জন স্থানে মাটির নীচে পুতিয়া রাখে এবং পরে ঝুড়ি বা বাঙ্গি করিয়া নিজ বাড়িতে লইয়া গিয়া নগদ টাকা পয়সা ভিন্ন সমস্ত জিনিষ স্থানীয় চোরাই মাল ক্রয়কারীদিগের নিকট বিক্রয় করে। কোন কোন স্থলে এই চোরেরা যখন চুরি করিতে যায় সেই সময়ে তাহাদের সঙ্গে এই সকল চোরাই মাল ক্রয়কারী ব্যক্তি গরুর গাড়ি করিয়া যায় এবং চোরাই মাল কিনিয়া সেই গাড়িতে বোঝাই করিয়া লইয়া আসে।

.

গায়েন।

উৎপত্তি।

“গায়েন” শব্দের অর্থ যে গান গায়। সার হার্বার্ট রিজলি তাঁহার বঙ্গদেশের জাতিসম্বন্ধীয় পুস্তকে (১ম ভাগ ২৭৬ পৃষ্ঠা) লিখিয়াছেন : “গায়েন (যে গান গায়) এক শ্রেণীর মুসলমান। ইহারা প্রথমে সান্দার ছিল বলিয়া লোকের বিশ্বাস। ইহাদের গুরুর নিকট হইতে ইহারা এই কাহিনী শিখিয়াছে যে যখন শাহ জিহাদ শ্রীহট্ট জয় করিতে যান সেই সময়ে তাঁহার সহিত যে জিহাদ গায়েন ছিল ইহারা সেই জিহাদ গায়েনের সন্তান। এবং ইহারা বলে যে শ্রীহট্ট হইতে ইহারা ঢাকা ডোঙ্গা করিয়া চলিয়া আসে। এই সকল ডোঙ্গা বেদিয়ারা যে ডোঙ্গা ব্যবহার করে তাহা হইতে ভিন্ন রকমের।”

সামাজিক অবস্থা।

দুই শ্রেণীর গায়েন আছে। এক শ্রেণীর গায়েন পরিশ্রমী, সচ্চরিত্র এবং জমির উপর স্থায়ী গৃহে বাস করে। আর এক শ্রেণীর গায়েন জলের উপর ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। ইহাদের কোন নির্দিষ্ট জীবিকানির্বাহের উপায় নাই এবং ইহারা নিয়মিতভাবে চুরি প্রভৃতি করে। সান্দারদিগের ন্যায় এই দ্বিতীয় শ্রেণীর পুরুষেরা নিজেদের আহারের জন্য ছিপ দিয়া মাছ ধরে এবং স্ত্রীলোকেরা গ্রামে গ্রামে খেলানা প্রভৃতি চকচকে জিনিষ বেচিয়া বেড়ায় ও হাটে বাজারে দোকান করিয়া বসে। ইহাদের স্ত্রীলোকদের পর্দা নাই এবং গোঁড়া মুসলমানেরা ইহাদিগকে ভদ্র মুসলমান সমাজের বহির্ভূত মনে করে। পুরুষেরা মদ, গাঁজা খায় ও জুয়া খেলে, এবং স্ত্রীলোকেরা দুশ্চরিত্রা হয়।

বাসস্থান।

ভ্রমণকারী গায়েনরা, ত্রিপুরা জেলায় হোমনা ও মীরপুর থানার এলাকায় বাঘমারা, দুলালপুর ও তালতলী গায়ের নিকটে ও বাঞ্ছারামপুর থানার এলাকায় খোসকান্দি গ্রামের নিকটে এবং ঢাকা জেলার নরসিংদী থানার এলাকায় রামচন্দ্রাদি ও শ্রীনগর গ্রামের নিকটে, রায়পুরা থানা এলাকায় নোয়াদি ও মাজোল গ্রামের নিকটে ও বৈদ্যবাজার থানার এলাকায় চেঙ্গাকান্দি গ্রামের নিকটে মেঘনা নদীর উপর ও তাহার শাখা প্রশাখায় নৌকায় বাস করে। নদীর তীরে ইহাদের কোন স্থায়ী গৃহ নাই। কাহারও কাহারও অস্থায়ী কুটীর থাকে, কিন্তু এই কুটীরে তাহারা কদাচিৎ বাস করে।

জীবন প্রণালী ও বৃত্তি।

সান্দারদের ন্যায় গায়েনরা বৎসরের অধিকাংশ সময় তাহাদের নৌকায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। ৭২ নং পৃষ্ঠায়। গায়েনদের নৌকার আলোকচিত্র দেওয়া হল। এই নৌকার ছই ইহার বিশেষত্ব। পুর্ববঙ্গের নদীর ধারে অন্যান্য যে সকল মুসলমানেরা বাস করে তাহারা যে রূপ পোষাক পরে, গায়েনরাও সেই রূপ পোষাক পরে। কিন্তু গায়েন যুবকেরা কখনও কখনও ধুতি চাদর পরে, এবং দাড়ি কামায়।

কার্যপ্রণালী।

দুর্ব্বৃত্ত গায়েনরা নদীর উপরে ডাকাইতি করে। ইহাদের ডাকাইতি করিবার প্রণালী প্রায় সৰ্ব্ব বিষয়ে সান্দারদিগের মত। কোন কোন পুলিশ কর্মচারী গায়েন ও সান্দারের মধ্যে কোন প্রভেদ করেন না, কিন্তু তদন্তে জানা গিয়াছে যে গায়েন ও সান্দারদের চালচলন ও চরিত্র এক রকমের হইলেও ইহারা ভিন্ন ভিন্ন জাতি।

ডাকাইতি করিবার সময়ে ইহারা সারঙ্গ নামক লম্বা দ্রুতগামী নৌকা ব্যবহার করে। সাধারণতঃ ইহারা মাঝ নদীতে আগুন চাহিবার ছলে যে নৌকায় ডাকাইতি করিতে ইচ্ছা করে সেই নৌকার নিকটে যায়, কিম্বা নোঙ্গর করা নৌকার আরোহীরা যখন ঘুমাইতে থাকে তখন তাহার কাছি কাটিয়া দেয় এবং নৌকা বাহিরে ভাসিয়া গেলে আক্রমণ করে।

কাৰ্য্যক্ষেত্র।

ইহাদের কার্যক্ষেত্র মেঘনা ও পদ্মা নদীতে ও উহাদের কতকগুলি শাখা প্রশাখায় সীমাবদ্ধ এবং মৈমনসিংহ জেলার ভৈরব নামক স্থান হইতে ঢাকা জেলায় মধ্য দিয়া ত্রিপুরা জেলায় চাঁদপুর পর্যন্ত বিস্তৃত।

১৯১২ সালে জানুয়ারি মাসে ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট গায়েনদের সম্বন্ধে লিখিয়াছিলেন :-“মেঘনা নদীর উপর যত চুরি ডাকাইতি হয় এই গায়েনরা নিশ্চয়ই তাহাদের প্রায় সবগুলির জন্য দায়ী। এই চুরি ডাকাইতির সংখ্যা প্রথম দৃষ্টিতে যত মনে হয় বাস্তবিক তাহার অপেক্ষা বেশি, কারণ অনেক চুরি ডাকাইতির খবর থানায় দেওয়া হয় না।”

দুর্ভাগ্যবশতঃ সর্বত্রই নদীর উপর চুরি ডাকাইতি সম্বন্ধে এই কথা খাটে। পথে যাইতে যাইতে যে ব্যক্তির সম্পত্তি লুণ্ঠিত হয় সে ব্যক্তি থানায় খবর দেওয়া অপেক্ষা নীরবে ঐ অত্যাচার সহ্য করা ভাল মনে করে। কারণ, পুলিশের তদন্ত এবং তৎপরে অনেক সময়ে সংঘটিত ফৌজদারী বিচারে যে অবশ্যম্ভাবী দেরী হয় তাহা তাহার পক্ষে আরও ক্ষতি ও অসুবিধার কারণ হইয়া পড়ে।

১৯০০ সালের ঢাকা জেলায় আব্দুল গফুর নামে এক গায়েন ৫টা ডাকাইতির করিয়াছেন বলে, কিন্তু ইহাদের মধ্যে কেবল একটিরই খবর পুলিশে আসিয়াছিল। দুর্ব্বৃত্ত জাতি বিষয়ক আইনের অধীনে গায়েনদিগকে আনিবার কালে ইনস্পেক্টর চন্দ্র কান্ত দে তাহাদের অনুষ্ঠিত অথচ থানায় কোন খবর আসে নাই এরূপ তিনটি ডাকাইতির সন্ধান পাঠাইয়াছিলেন।

দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক আইন ঘোষিত হয়।

১৯১৪ সালে দুর্ব্বৃত্ত গায়েনগণ দুর্ব্বৃত্ত জাতিবিষয়ক ১৯১১ সালের আইন অনুসারে  (১৯১০ সালের অনুসারে ঘোষণা। ২২ শে জানুয়ারি তারিখের বাঙ্গালাদেশের গবর্ণমেন্টের ৯১০ পি নং বিজ্ঞাপন দেখ)।

.

লোধা।

উৎপত্তি ও ইতিহাস।

সার হার্বার্ট রিজলি লোধাদিগকে ভূমিজদিগের একটি শাখা বলেন। ইহারা মেদিনীপুরের পশ্চিমে জঙ্গল অঞ্চলের অধিবাসী আদিম জাতি। ইহারা ইহাদের পূর্ব্বপুরুষের ডাকাতি করা স্বভাব এখনও বজায় রাখিয়াছে। গত শতাব্দীর প্রারম্ভে ইহাদের পূৰ্বপুরুষগণ মেদিনীপুরের অনেক স্থান আক্রমণ করিয়া কর্তৃপক্ষকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল এবং জঙ্গল অঞ্চলের নিকটবর্তী গ্রামবাসীদিগের হৃদয়ে আতঙ্ক উৎপাদন করিয়াছিল। সেই সময়ে তাহাদিগকে চূয়াড় ও তাহাদিগের আক্রমণকে চুয়াড়ি বলিত। এই সকল আক্রমণের জন্য তাহারা তরবারি, কুঠার ও অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত হইয়া অনেকে মিলিয়া বাহির হইত ও যে কোন দ্রব্য পাইত তাহাই লইয়া যাইত এবং বাধা দিলে অত্যন্ত মারপিট করিত।

সম্প্রতি কয়েক বৎসর লোধারা যে সকল ডাকাইতি করিয়াছে সেই সকল ডাকাইতি হইতে পূৰ্বের চুয়াড়ির পার্থক্য খুব কম, কেবল বোধ হয় আজকাল ইহারা আর আগেকার মত খুন বা জখম করিতে তত প্রস্তুত নহে। ১৯০২-৩ সালে ৪৯জন লোধাকে বিশেষ বিশেষ ডাকাইতির অপরাধে বিচারার্থ চালান দেওয়া হয় এবং তাহাদের মধ্যে ৪জন ভিন্ন সকলেরই সাজা হয়। ১৯০৪ সালে ৫২জনকে ডাকাইতিতে চালান দেওয়া হয় এবং তাহাদের মধ্যে ৪৪জনের সাজা হয়। ১৯০৫ সালে মেদিনীপুরের লোধা ডাকাইতের দলের (ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০০ ধারা অনুসারে) মোকদ্দমায় অন্যান্য লোকের সহিত ইহাদের বিচার হইবে স্থির হওয়ায় ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা তুলিয়া লওয়া হয়। এই মোকদ্দমায় ড্রে ব্রম্যান সাহেব যে রায় দেন তাহা হইতে নিম্নলিখিত অংশ উদ্ধৃত করা গেল। এই উদ্ধৃত অংশে লোধাদের যে সকল কার্যের জন্য এই মোকদ্দমা রুজু হয় সেই সকল কার্যের সুন্দর বিবরণ দেওয়া আছে :–

প্রণালী।

“এই মোকদ্দমায় যে সকল রাজসাক্ষী (এপ্রুভার) আছে তাহাদের মধ্যে কয়েকজন ইতঃপূর্বেই ডাকাইতি অপরাধে সাজা পাইয়াছে। এই সকল রাজসাক্ষীর ও যাহাদের সম্পত্তি লুণ্ঠিত হইয়াছে তাহাদের সাক্ষ্য হইতে আমরা দেখিতে পাই যে সৰ্ব্বসমেত প্রায় ২০০জন ডাকাইত ছিল এবং ইহারা ৬০/৭০ জন করিয়া দলবদ্ধ হইয়া আক্রমণ করিত। ইহারা অস্ত্র ও এই জেলার পশ্চিমে যে লাল বেলে পাথর প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় সেই বেলে পাথরও সঙ্গে রাখিত। যে বাড়ি আক্রমণ করিত সেই বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি লইয়া যাইত ও বাড়ির লোকদিগকে সময়ে সময়ে আঘাত করিত। দুই স্থলে এই আঘাত হইতে মৃত্যু পর্যন্ত হয়। অনেক সময়ে একাধিক বাড়ি এবং কেবল বাড়ি নহে, বড় রাস্তার উপরের দোকান এবং খালের নৌকা পৰ্য্যন্ত ইহারা আক্রমণ করিত। গহনা, খাবার জিনিষ, পোষাক পরিচ্ছদ, নগদ টাকা, বাসন প্রভৃতি যাহা কিছু পাইত তাহাই ইহারা লইয়া যাইত। ইহারা নগদ টাকা খরচ করিয়া ফেলিত, খাবার অনেক সময়ে ঘটনা স্থানে বসিয়াই খাইয়া ফেলিত, বাসন ও পোষাক পরিচ্ছদ কিছু রাখিত ও পরে পুলিশ তাহা উদ্ধার করিত, এবং বক্ৰী কোন মূল্যবান্ জিনিস থাকিলে বেচিয়া ফেলিত। চতুর্দিকের গ্রামে যে সকল চোরাই মাল গ্রহীত থাকিত তাহাদের মধ্যে গহনা সহজেই বিক্রয় হইয়া যাইত। এই সকল চোরাই মাল গ্রহীতাদের মধ্যে অন্যূন ১৫জনের বিচার হইয়া সাজা হইয়া গিয়াছে। চোরাই মালের কতক অংশ উদ্ধার করা হইয়াছে, কিন্তু তাহা খুব কম। এই সকল ডাকাইত সৰ্ব্বস্থানেই এক প্রণালীতে কাৰ্য্য করিত। কযেক জন তরবারি, লাঠি ও টাঙ্গি লাইয়া বাড়ি লুট করিত ও স্ত্রীলোকদিগের গাত্র হইতে গহনা খুলিয়া লইত, আর কয়েক জন বাহিরে থাকিয়া পূৰ্ব্ব সংগৃহীত পাথর ছুড়িয়া যে সকল লোক নিকটে আসিবার চেষ্টা করিত তাহাদিগকে তাড়াইত। ইহারা জিনিষপত্র খুঁজিয়া বাহির করিবার সুবিধার জন্য চালের খড় টানিয়া লইয়া আগুন ধরাইয়া দিত। এক স্থলে ইহারা কতকগুলি পায়রা ধরিয়া গৃহ স্বামীর সম্মুখেই তাহাদিগকে ছাড়াইয়া আগুনে ঝলসাইয়াছিল। অনবরত ধরা না পড়ায় ইহাদের সাহস ও তেজ বড় বাড়িয়া গিয়াছিল। অনেক সময়ে ইহারা একই গ্রামে দুইবার এবং এমন কি পর পর রাত্রে আক্রমণ করিত। পুলিশের উপস্থিতিতে ইহাদের কাৰ্য্য বন্ধ হইত না, কারণ একস্থলে পুলিশ ও ডাকাইতে সংঘর্ষ ঘটিলে উভয় পক্ষই জখম হইয়াছিল কিন্তু কেহই গ্রেপ্তার হয় নাই।”

এই ডাকাইতের দলের মোকদ্দমা রুজু হইবার পূর্বে যে পুলিশের তদন্ত হয় সেই তদন্তের লোধারা নিজেদের কুটীর ছাড়িয়া জঙ্গলে চলিয়া গিয়াছিল, কেহ কেহ ময়ূরভঞ্জ রাজ্যে আশ্রয় লইয়াছিল এবং অপর অনেকে চা বাগানের মজুর হইয়া আসামে চলিয়া গিয়াছিল।

চালচলন ও বৃত্তি।

এই মোকদ্দমায় ১৯০০ হইতে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত যে সকল ডাকাইতি হয় তৎসম্বন্ধে বিচার হয়। লোধারা জঙ্গলের প্রান্তভাগে ছোট ছোট কুটীরে বাস করে। পুরুষেরা কেবলমাত্র একখানি ধূতি পরে ও তাহাদের চুল সাধারণতঃ অপরিষ্কার ঝড়া ঝড়া হইয়া থাকে। এই জাতির অধিকাংশ নারায়ণগড় থানার এলাকায় বাস করে, কিন্তু এলাকায়ও কতক কতক দেখিতে পাওয়া যায়। সাধারণতঃ ইহারা কোন না কোন দলের বাড়ির নিকটস্থ গ্রামসকলে ডাকাইতি করে।

১৯১১ সালে আদমসুমারি অনুসারে বঙ্গদেশে পুরুষ লোকের সংখ্যা ৩৭৯৩। ইহাদের মধ্যে ৩১১৬ জন মেদিনীপুরে ও হুগলিতে ৫৪৯ জন বাস করে। বক্রী কলিকাতা ও অন্যান্য জেলায় ছড়াইয়া থাকে। পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনেরল আর, বি, হিউজ-বুলার, সি, আই, ই, ১৯১৪ সালের মার্চ মাসে মেদিনীপুরের উপর তাহার পরিদর্শন মন্তব্যে লোধাদের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন :–”অনেক বৎসর ধরিয়া ইহারা আমাদের পার্শ্বে কণ্টকস্বরূপ হইয়া আছে। আমাদের সি শ্রেণীর নজর বন্দীর ফর্দে নিম্নলিখিত সংখ্যাক লোধার নাম আছে :–নারায়ণগড় থানার ১১৫ জনের মধ্যে ১০৫ জন, ঝাড়গ্রাম থানার ৪৭ জনের মধ্যে ২৩ জন, কাশীয়াড়ী থানার ৪৭ জনের মধ্যে ২২ জন। ইহাদিগকে লোকে যে প্রায়ই ডাকাইতি করিতে ভাড়া করিয়া লইয়া যায় সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, এবং শুনা যায় যে আজকাল ইহারা গরু বাছুর প্রভৃতি বধ করিতেও আরম্ভ করিয়াছে। ইহারা জঙ্গলে বাস করিতে ভাল বাসে এবং ভাল মজুর হয়।”

লোধারা অল্প অল্প সংখ্যায় আসামে চা বাগানে যায়। সেখানে তাহাদের ভাল মজুর বলিয়া খ্যাতি আছে। যে সকল আদিম জাতি উৎকৃষ্টতর সভ্যতার আগমনে বিতাড়িত হইয়া জঙ্গলে আশ্রয় লইয়া অত্যন্ত দারিদ্র্যের পীড়নে চুরি ডাকাইতি করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিতে বাধ্য হইয়াছে লোধাদিগকে তাহাদেরই মধ্যে এক জাতি বলিয়া ধরিতে হইবে।

.

তুঁতিয়া মুসলমান।

উৎপত্তি ও বৃত্তি।

তুঁতিয়া শব্দ উঁত গাছ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। যখন রেশমের ব্যবসার খুব উন্নতি ছিল তখন ইহারা প্রধানতঃ উঁত গাছের চাষ করিয়া জীবিকানির্ব্বাহ করিত। বর্তমানকালে তুঁতিয়ারা উত্তম চাষী। ইহারা নিজেদের জমিতে চাষ করে কিম্বা মজুরী করে। ইহাদিগকে দড়ি তৈয়ারী করিতে, গরুর গাড়ি হাঁকাইতে, দোকান করিতে, মাছ ধরিতে এবং এমন কি রাজমিস্ত্রীর কাজ করিতেও দেখা যায়। জন কয়েক প্রায় চুরি ডাকাইতি করিয়াই জীবিকানির্ব্বাহ করে। এই শ্রেণীর মধ্যে এমন কতকগুলি পাকা চোর ডাকাইত আছে যাহাদের বাপ মাও চোর ডাকাইত ছিল।

সামাজিক অবস্থা।

মেদিনীপুরের ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটীয়ার নামক পুস্তকে সিভিলিয়ান ওমালি সাহেব হুঁতিয়াদের সম্বন্ধে  লিখিয়াছেন :–”সম্প্রদায় হিসাবে ইহাদের বড় দুর্নাম আছে। ইহাদের মধ্যে অনেকে জন্মাবধি চোর ও ডাকাইত। ইহারা বড় অধঃপতিত বলিয়া বিবেচিত হয়। অন্য মুসলমানেরা তুঁতিয়াদের কন্যা স্ত্রী রূপে গ্রহণ করিতে আপত্তি না করিলেও তুঁতিয়াদের সহিত নিজেদের কন্যার বিবাহ দেয় না।”

উক্ত ডিষ্ট্রিক্ট গেজেটীয়ারের (১৯১১ সালে) অন্যত্র ওমালি সাহেব লিখিয়াছেন:- “মেদিনীপুর জেলার মধ্যে অনেক ডাকাইতি হয় বলিয়া বহুদিন যাবৎ মেদিনীপুরের অখ্যাতি আছে। এই সকল ডাকাইতি প্রধানতঃ আদিম জাতি লোধারা ও মুসলমান তুঁতিয়ারা করে।”

যে যে স্থানে বাস করে।

তুঁতিয়ারা নিম্নলিখিত স্থানে বাস করে :-”মেদিনীপুর জেলায় রামজীবনপুর, গড়বেতা ও খড়গপুর থানার এলাকায়, বাঁকুড়া জেলার শিরোমণিপুর, অণ্ডা, তালডাঙ্গরা, ইন্দপর, সিমলাপুর, বিষ্ণুপুর ও জয়পুর থানার এলাকায়; হুগলী জেলায় বদনগঞ্জ, গোঘাট ও আরামবাগ থানার এলাকায়। বর্ধমান জেলার রায়না থানা ও কলিকাতায় বেলিয়াঘাটা থানার এলাকাও অল্প সংখ্যক তুঁতিয়া দেখা যায়।

দুর্ব্বৃত্ততার ক্ষেত্র।

ইহাদের দুর্ব্বৃত্ততার ক্ষেত্র কিন্তু ইহা অপেক্ষা অনেক বড়। পাঁচু সেখের দলের মোকদ্দমা নামক মোকদ্দমায় যেসকল একরার হইয়াছে সেই সকল একরার দ্বারা ইহা প্রমাণিত হয় (১৯০৫ সালের স্পেশাল রিপোর্ট মোকদ্দমা নং ৪৪, জেলা হুগলী, ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০০ ধারা, সিআইডির ডাকাইতের দলের মোকদ্দমা নং-৪৮)। এই মোকদ্দমায় দলের সর্দার পাঁচু সেখ একরার করে যে ২৪ পরগণা, নদীয়া যশোহর, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও হুগলি জেলায় ইহারা ২২টি ডাকাইতি করে। এই দল মিশ্রিত দল–ইহাতে গুঁড়ি, বাগদী, মুচি, উড়িয়া ও অন্যান্য হিন্দু জাতি এবং তুঁতিয়া ভিন্ন অন্যান্য শ্রেণীর মুসলমানও ছিল। সর্দার পাঁচু সেখ ও দলের অন্যান্য প্রধান প্রধান লোক কিন্তু তুঁতিয়া ছিল।

১৯০৪ সালে দমদমায় এক ডাকাইতির ফলে ২৪ পরগণার ভারতবর্ষীয় দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনের ৪০০ ধারা অনুসারে এক মোকদ্দমা রুজু হয়। এই মোকদ্দমায় ১১ জন তুঁতিয়ার সাজা হয়। ইহারা একটা মিশ্রিত দলের লোক ছিল। এই দলে সবশুদ্ধ ৪৬ জন ডাকাইত ছিল।

১৯০৫ সালে বাঁকুড়ায় যে ডাকাইতের দলে মোকদ্দমা রুজু করা হয় তাহাতে ১২ জনের সাজা হয়। ইহারা সকলে তুতিয়া ছিল।

ঐ বৎসর হুগলী জিলায় যে আর একটা ডাকাইতের দলের মোকদ্দমা রুজু হয় তাহাতে একটা মিশ্রিত দল ভাঙ্গিয়া দেওয়া হয়। এই দলে ১৩৪ জন লোক ছিল। ইহাদের মধ্যে ১৫ জন তুঁতিয়ার সাজা হয়। এই মোকদ্দমায় যে সকল একরার হয় তাহা হইতে জানা যায় যে এই দল ১২ বৎসরের অধিক কাল ধরিয়া ২৪-পরগণা, নদীয়া, যশোহর, বর্ধমান, মেদিনীপুর ও হুগলী জেলায় ডাকাইতি করিয়াছিল।

কার্যপ্রণালী।

তুঁতিয়াদের ডাকাইতিতে সাধারণতঃ একজন ডাকাইত উঠানের প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া গিয়া বাহিরের দরজা খুলিয়া অন্যান্য ডাকাইতদিগকে ঢুকাইয়া লয়। তারপর ঘরের দরজা টেকি দিয়া ঘা দিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলা হয়। অনেক পুলিশের কর্মচারী মনে করেন যে চেঁকি দিয়া দরজা ভাঙ্গা হইয়া থাকিলেই বুঝিতে হইবে যে নিশ্চয় তুঁতিয়ারা ডাকাইতি করিয়াছে, কিন্তু অন্যান্য ডাকাইতেরা, বিশেষতঃ যাহারা এক সময় তুঁতিয়াদের সঙ্গে কাজ করিয়াছে তাহারা যে দরজা ভাঙ্গিবার জন্য ঢেঁকি ব্যবহার করিতে পারে না, কিংবা তুঁতিয়ারাই যে অন্য উপায়ে দরজা ভাঙ্গিতে পারে না এরূপ ধারণা করা আদৌ নিরাপদ নহে। অনেক সময়ে হাতের কাছে ঢেঁকিই একমাত্র দরজা ভাঙ্গিবার উপযোগী অস্ত্রস্বরূপ পাওয়া যায়। ঢেঁকির ব্যবহারসম্বন্ধে যে বিশেষ কোন কুসংস্কার কিংবা অলঙ্ঘনীয় প্রথা আছে তাহা নিশ্চয়ই নহে। তুঁতিয়ারা লাঠি ও মশালও লইয়া যায়, কিন্তু তাহারা সাধারণতঃ অনাবশ্যক মারপিট করে না। কখনও কখনও তাহারা যে বাড়ি আক্রমণ করে সেই বাড়ির লোকদিগকে বাঁধিয়া রাখে। সম্ভবতঃ তাহারা যাহাতে পলাইয়া গিয়া বাহিরে গোল না করিতে পারে তাহার জন্য তুঁতিয়ারা স্ত্রীলোক ও বালকবালিকাদের গাত্র হইতে গহনা খুলিয়া লয়। মূল্যবান্ যে কোন বস্তু দেখিতে পায় তাহা তাহারা চুরি করে, বিশেষতঃ নগদ টাকা ও গহনার প্রতি তাহাদের বড় লোভ। সাধারণতঃ তাহারা ডাকাইতি করিবার ঠিক পরেই কোন নির্জন স্থানে গিয়া চোরাই মাল ভাগ করিয়া লয় এবং প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ ইচ্ছানুসারে তাহার অংশ চোরাইমাল গ্রাহকের নিকট বিক্রয় করে।

ডাকাইতি করিতে উদ্যত হইয়াছে এমন তুঁতিয়ার দল সাধারণতঃ ডাকাইতির জন্য নির্দিষ্ট রাত্রের প্রথমভাগে একত্র হইয়া পান ও আহার করে। কিন্তু ইহাও যে তুঁতিয়াদের কোন বিশেষ প্রথা তাহা নহে।

ডাকাইতি করিবার সময়ে গ্রামের লোক জড় হইলে কিংবা অন্য কোন বিপদে সম্ভাবনা ঘটিলে, বাহিরে তাহারা পাহারায় থাকে তাহারা সাধারণতঃ “মাছি ঘন, জাল গুটাও” এই বলিয়া চিৎকার করিয়া পলায়নের সঙ্কেত দেয়। কিন্তু কেবল তুতিয়াদের নহে, বর্ধমান ও প্রেসিডেন্সি বিভাগের সকল ডাকাইতের দলেরই ইহা সাধারণ পলায়নের ডাক। পলায়নের সময়ে যদি দলের কোন ব্যক্তি দলছাড়া হইয়া যায় তাহা হইলে দলের লোক শৃগালের ডাকের অনুকরণ করিয়া তাহারা কোথায় আছে জানাইয়া দেয়। প্রতিবেশীরা যাহাতে বাহির হইয়া আসিয়া কোনরূপ সাহায্য করিতে না পারে তজ্জন্য তুঁতিয়ারা অনেক সময়ে তাহাদের বাড়ির দরজা বাহির হইতে বন্ধ করিয়া দেয়।

মোটামুটি হিসাবে, ১৯১৩ সালে প্রায় ৬০৯৬ জন পুরুষ ৫৮৯৯ জন স্ত্রী ও ৮১৭২ জন বালকবালিকা, মোট ২০১৬৭ জন তুঁতিয়া ছিল। ইহাদের মধ্যে ২৮১ জন পুরুষ ও ২ জন স্ত্রীলোক নিজেরাই চুরি ডাকাইতিতে লিপ্ত ছিল বলিয়া প্রমাণ হয়। ইহাদের মধ্যে আবার ৭৭ জন নিজে নিজে স্বাধীনভাবে চুরি প্রভৃতি করিত ও ২০৬ জন ডাকাইতের দলে থাকিত।

ক্রিমিনাল ইনভেষ্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের এক রিপোর্ট অনুসারে ১৯১৪ সালে তুঁতিয়াদের সাতটা দলকে (এই সাত দলে মোট ২০৬ জন পুরুষ ও ২ জন স্ত্রী লোক ছিল। গভর্ণমেন্ট ১৯১১ সালের দত্ত জাতিবিষয়ক আইনের ৩ ও ৪ ধারা অনুসারে ঘোষিত করিয়া আদেশ করেন যে তাহারা ঐ আইনের ১০ ধারা অনুসারে তাহাদের গতিবিধি জ্ঞাপন করিবে।

.

জাল মক্কা মোয়ালেম।

বাসস্থান ও প্রণালী।

জাল হাজী বা মক্কা মোয়ালেমগণ পূর্ব্ববঙ্গের এক শ্রেণীর অতি ভয়ানক দুর্ব্বৃত্ত লোক। ইহাদের অধিকাংশ ঢাকা জেলায় বাস করে। ইহারা পূর্ব্বদিকের জেলা সকলে ঘুরিয়া ঘুরিয়া সরলহৃদয় মুসলমান অধিবাসীদিগকে মক্কাতীর্থে যাইতে কিম্বা, যদি নিজেরা না যাইতে পারে তাহা হইলে কোনও ধার্মিক মুসলমানকে–এই ধার্মিক মুসলমান জাল মোয়ালেমদিগের মধ্যে একজন হইলেই ভাল হয়–মক্কায় যাইয়া বেহেস্তে যাইবার আশা করে এরূপ বিশ্বাসী মুসলমানের যে সকল ধর্ম্মকাৰ্য্য করা কর্তব্য তাহাদের হইয়া সেই সকল ধৰ্ম্মকাৰ্য্য করিবার খরচ দিতে বিশেষ অনুরোধ করে।

এই সকল দুর্ব্বৃত্তদের মধ্যে অনেকে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার অধীন বারইখালি, শ্রীধর খোলা, পৌষা এবং আরও কয়েকখানি পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতে আসে।

কাৰ্য্যক্ষেত্র।

ইহারা হজের ৫/৬ মাস পূৰ্ব্ব হইতে বাহির হইয়া দুই হইতে ছয়জন করিয়া এক এক দলে ভ্রমণ করে। ইহাদের মধ্যে কেহ কখনও মক্কা দেখিয়া থাকিলে তাহাদের সংখ্যা অতি কম। তথাপি ইহারা খাঁটি হাজীদের চেহারার উত্তম অনুকরণ করিয়া পোষাক পরিচ্ছদ পরে। ইহারা ইহাদের বাসস্থানের ভাষার টান। বেশ লুকাইয়া রাখে ও ধর্ম্মকথার মধ্যে কতকগুলি আরবী ও পার্শী শব্দ মিশাইয়া দেয়। এই রূপে ইহারা বাখরগঞ্জ, নোয়াখালী, ত্রিপুরা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর জেলার মুখ গ্রামবাসীদিগকে সহজে ঠকাইতে পারে। সাধারণতঃ এই সকল জেলাতেই ইহারা কাৰ্য্য করে।

কার্যপ্রণালী।

কোন ব্যক্তি ইহাদের সহিত তীর্থযাত্রা করিতে প্রস্তুত হইলে ইহারা তাহাকে অনেকগুলি টাকা ৩০০ টাকার কম প্রায়ই নহে, সঙ্গে আনিতে বলে এবং প্রথমেই তাহাকে পথের মোয়ালেমদের হাতে দিতে পরামর্শ দেয়। লোকটি যদি মোয়ালেমদের হাতেই টাকা দেয় তাহা হইলে ঐ প্রতারকেরা সুবিধা পাইলেই ইহা লইয়া সরিয়া পড়ে। যদি যে টাকা দিতে অস্বীকার করে তাহা হইলে উহারা বল প্রয়োগ করিতেও দ্বিধা করে না। একবার ঐরূপ এক ব্যক্তিকে নৌকা করিয়া লইয়া যাইবার সময়ে উহারা তাহার গলায় একটি কলসী বাধিয়া জলে ফেলিয়া দেয়। ইহারা মনে করিয়াছিল যে ঐ ব্যক্তি ডুবিয়া মরিয়া যাইবে। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ সে গলা হইতে কলসীটি খুলিয়া ফেলিতে পারিয়াছিল এবং ৫ বৎসর পরে যখন ঐ সকল লোক গ্রেপ্তার হয় তখন তাহাদিগকে সনাক্ত করিতে পারিয়াছিল। কাগজপত্রে এমন সকল বৃত্তান্তও পাওয়া যায় যে এই কৃত্রিম মোয়ালেমরা লোককে ওষুধ খাওয়াইয়া অজ্ঞান করিয়া জলে ফেলিয়া দিয়াছে।

১৯০৬ সালে ঢাকা জেলার শ্রীনগর পোষ্ট অফিসের অধীন বারইখালি গ্রামের হাতিমসেখ নামক এক ব্যক্তি একরার করে যে সে ও আর চারিজন লোক মক্কাতীর্থে যাইবার জন্য তাহাদের সঙ্গে যোগ দিয়াছিল এমন দুই জন লোককে নৌকায় যাত্রার পর প্রথম রাত্রিতেই খুন করিয়া জলে ফেলিয়া দেয়। ইহাদের বিশ্বাস ছিল যে লোক দুইটি ঠিক খুন হইয়াছে। কিন্তু বাস্তবিক একজন মরে নাই এবং পরে সে এই মোকদ্দমায় হাজির হইয়া সাক্ষী দিয়াছিল। হাতিম আর একটা ঘটনাসম্বন্ধেও একরার করে। এই ঘটনায় সে এবং তাহার ছয় জন সঙ্গী তীর্থযাত্রা করিতে ইচ্ছুক দুই ব্যক্তিকে চাঁদপুর পর্যন্ত ভুলাইয়া লইয়া যায় সেখানে তাহাদের সর্বস্ব লুটিয়া লইয়াছিল।

যখনই এই সকল জাল মোয়ালেমকে ইহাদের কাৰ্য্যের সময়ে গ্রেপ্তার করা গিয়াছে তখনই ইহাদের সঙ্গে ইহারা যে সকল লোকের নিকট হইতে টাকা সংগ্রহ করিয়াছে তাহাদের নামের বড় বড় ফর্দ পাওয়া গিয়াছে।

কাৰ্য্যকালে ইহারা যেসকল জিনিষ সঙ্গে রাখে।

ইহারা সাধারণতঃ নিজেরদের সঙ্গে মক্কার জমজম নামক পবিত্র কূপের জল বলিয়া কিছু জল, তাবিজ ও অন্যান্য জিনিষ লইয়া বেড়ায় এবং বলে যে এই সকল জিনিষ খুব ভক্তির সহিত ব্যবহার করিলে রোগ সারিয়া যায় ও ভাল সময় আসে।

কাগজপত্রে এই সকল দুৰ্ব্বত্তের সংখ্যা উপস্থিত ২৪১ জন।

.

ছোট ভাগিয়া মুচি।

বাসস্থান।

ছোট ভাগিয়া মুচিদিগকে প্রধানতঃ যশোহর, নদীয়া মুর্শিদাবাদ, খুলনা, পাবনা, রাজসাহী ও ২৪-পরগণা জেলায় ও অল্প সংখ্যায় হুগলী ও বর্ধমান জেলায় দেখিতে পাওয়া যায়।

সামাজিক অবস্থান ও ধর্ম্ম।

ইহারা মুচিজাতির নিম্নশ্রেণীর লোক। বড় ভাগিয়া নামক উচ্চ শ্রেণীর মুচিরা ইহাদিগকে সমাজে হীন বলিয়া মনে করে। কিন্তু এই শ্রেণীবিভাগ যে খুব পাকাপাকি তাহা নহে, কারণ অনেক জেলায় ছোট ভাগিয়াদের রীতিনীতি অনুসরণ করে এরূপ মুচিরা আপনাদিগকে বড় ভাগিয়া বলে। উভয় শ্ৰেণীই আপনাদিগকে হিন্দু বলে, হিন্দুর দেবতাদের পূজা করে এবং শবদাহ ও শ্রদ্ধা প্রভৃতি হিন্দু ধৰ্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে। ইহাদের নাপিত ও ধোপ নিজ জাতিরই লোক কারণ উচ্চ জাতির লোকেরা ইহাদের কাৰ্য্য করিতে অস্বীকার করে।

সমস্ত মুচির মধ্যেই বিধবা বিবাহ প্রচলিত আছে। দুশ্চরিত্রা হইলে স্ত্রীকে ত্যাগ করা যায়। এইরূপে ত্যক্ত স্ত্রীলোক পুনরায় নিকা বিবাহ করিতে পারে।

ছোট ভাগিয়া ও বড় ভাড়িয়াদের মধ্যে পার্থক্য।

মোটামুটি বড় ও ছোট ভাগিয়াদের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয় সকলে পার্থক্য আছে বলিয়া ধরা যাইতে পারে :

ছোট ভাগিয়ারা গরু, শূকর ও মুরগীর মাংস খায়। বড় ভাগিয়ারা এই সকল মাংস স্পর্শ করে না।

বড় ভাগিয়াদের ব্রাহ্মণ পুরোহিত ও রীতিমত মন্ত্র আছে কিন্তু ছোট ভাগিয়াদের কোন নির্দিষ্ট উপাসনা নাই ও ইহারা ধৰ্ম্মকাৰ্য নির্বাহের জন্য নিজ জাতীয় লোককেই পুরোহিত নিযুক্ত করে।

নিকা বিবাহ দুই শ্রেণীর মধ্যেই আছে, কিন্তু ছোট ভাগিয়াদের নিকার স্ত্রী শাখা ও সিন্দুর পরে, আর বড় ভাগিয়াদের নিকার স্ত্রী তাহা পরে না।

দুই শ্রেণীর মধ্যে পরস্পর বিবাহ নাই এবং একজন বড় ভাগিয়া একজন ছোট ভাগিয়ার বাড়িতে খায় না।

ছোট ভাগিয়াদের ব্যবসা গো-মহিষাদির চর্ম ছাড়ান, চৰ্ম্ম সংস্কার করা, গো-মহিষাদির অণ্ডচ্ছেদ করা, জুতা তৈয়ারী করা এবং সাধারণ চামড়ার কাজ করা এবং বড় ভাগিয়ারা চাষ করে, ঝুড়ি তৈয়ারী করেও কখনও কখনও চামড়ার ব্যবসায় করে। ইহা ছাড়া ঢোল, সানাই প্রভৃতি বাজান ছোট ভাগিয়াদের পেশা।

দুর্ব্বৃত্ততা।

ছোট ভাগিয়ারা বিখ্যাত চোর এবং সিঁদচোর। ইহারা গো-মহিষাদিকে বিষ খাওয়াইয়া মারে এবং প্রায়ই রাহাজানি ও লোকের বাড়িতে ডাকাইতি করে। রাহাজানি ও লোকের বাড়িতে ডাকাইতিতে ইহারা প্রায়ই মুসলমান ও অন্যান্য জাতীয় লোকের সহিত মিলিয়া কাৰ্য্য করে।

ইহাদের নিজেদের এক প্রকারের ভাষা আছে। এই ভাষা ইহারা চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করিবার সময়ে ব্যবহার করে।

পার্শ্বের উঠান হইতে লাঙ্গলের ফাল লাইয়া তাহাদ্বারা দরজা ও বাক্স জোর করিয়া খোলা ছোট ভাগিয়াদের বড় অভ্যাস। ইহারা ঝাঁপের দড়ি কাটিয়াও দোকানের মধ্যে ঢোকে।

লুট বা ডাকাইতি করিবার সময়ে ছোট ভাগিয়ারা সঙ্গে লাঠি ডাকাতির সময়ে যে অস্ত্র রাখে। এই লাঠি ইহারা ইহারা ব্যবহার করে। রাস্তায় যাইতে যাইতে বাশের

ঝাড় হইতে কাটিয়া লয়। বসিরহাট মহকুমার মুচিরা ছোট বাঁশের লাঠি ব্যবহার করে। এই লাঠি ইহারা কাঁধের সহিত বাঁধিয়া বগলের নীচে রাখে ও গায়ে চাদর জড়াইয়া ঢাকিয়া ফেলে। ইহারা ডাকাইতির সময়ে তরবারি ও খাঁড়াও ব্যবহার করে। মুচিরা ডাকাইতির সুযোগের সংবাদ পাইলে বাড়ি হইতে ২০/৩০ মাইল পর্যন্ত হাঁটিয়া যায়। ইহা ছাড়া নিজ নিজ বাড়ির নিকটেও খুব ডাকাইতি করে। চুরি ডাকাতি করিবার জন্য ইহারা কদাচিৎ রেলে ভ্রমণ করে।

ইহাদের নৃশংসতা।

যে সকল বাড়ি ইহারা আক্রমণ করে সেই সকল বাড়ির লোকদিগকে চাবি ও মূল্যবান জিনিষ বাহির করিয়া দিবার জন্য অতিশয় নৃশংসভাবে যন্ত্রণা দেয়। হাত পা বাঁধিয়া কিংবা অনেক লোককে একত্র রাখিয়া নৃশংসভাবে প্রহার করা কিংবা জ্বলন্ত মশাল মুখে বা শরীরে চাপিয়ে ধরা ইহাদের বলপ্রয়োগের সাধারণ উপায় এবং ইহারা দাড়িতে কেরোসিন তৈল মাখাইয়া আগুন ধরাইয়া দেয় বলিয়াও জানা গেছে। ১৯০৮ সালে মুচিদের দ্বারা অনুষ্ঠিত এক ডাকাইতিতে এক ব্যক্তিকে কেরোসিনে ভিজান কম্বলদ্বারা জড়াইয়া পোড়াইয়া মারা হইয়াছিল।

গোমহিষাদিকে বিষ খাওয়ান।

২৪-পরগণার স্থানে স্থানে দেখা গিয়াছিল যে, যে সকল ছোট ভাগিয়া মুচিরা সদুপায়ে জীবিকা নির্ব্বাহ করিত তাহারাও ভিন্ন স্থানবাসী দুর্ব্বৃত্ত জাতি ভাইদিগকে স্থানীয় সংবাদ দিত। ছোট ভাগিয়া মুচিরা বিষ খাওয়াইয়া গো-মহিষাদিও মারে, কারণ কোন গ্রামে যে সকল গো-মহিষাদি মরে সেই সকল গো-মহিষাদির চৰ্ম্ম ঐ গ্রামের মুচির প্রাপ্য। ইহারা সাধারণতঃ কলার পাতার মধ্যে সেঁখো বিষ মুড়িয়া গো-মহিষাদিকে খাওয়ায়।

১৯১১ সালের আদমসুমারী।

১৯১১ সালে আদমসুমারী অনুসারে বাঙ্গালাদেশে পুরুষ মুচিদের মোট সংখ্যা ২৩৯৮৮৮। নদীয়া ও যশোহর জেলায় ইহাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী-নদীয়া ২০১১৬ ও যশোহরে ২৪৩৮৯।

.

সান্দার।

উৎপত্তি।

সান্দারগণ জলগামী ভ্রমণকারী জাতি। ইহাদিগকে প্রধানতঃ পাবনা, রাজসাহী, বগুড়া, ফরিদপুর, ঢাকা ও মৈমনসিং জেলায় দেখিতে পাওয়া যায়। ইহারা নীচ জাতীয় মুসলমান এবং যে সকল জেলায় ইহারা বাস করে সেই সকল জেলার গোঁড়া মুসলমানদিগের সহিত সমানভাবে মিশিতে বা পরস্পর বিবাহ করিতে পারে না। কখনও কখন অন্যান্য শ্রেণীর মুসলমানেরা সান্দার স্ত্রীলোকদিগকে নিকা বিবাহ করে, কিন্তু পুরুষ সান্দারগণ অন্যান্য শ্রেণীর মুসলমান স্ত্রীলোকদিগকে বিবাহ করিতে পারে বলিয়া জানা নাই।

ধৰ্ম্ম।

সান্দারগণ মুসলমান ধর্মের মত ও ধৰ্মকৰ্ম্ম অনুসরণ করে। মোল্লা ও মৌলভীরা ইহাদের ধর্ম্মসম্বন্ধীয় সকল বিবাদের নিস্পত্তি ও বিবাহকাৰ্য্য সম্পন্ন করে। ইহাদিগকে কিন্তু কদাচিৎ গোঁড়া মুসলমানদের মসজিদে নামাজ পড়িতে দেওয়া হয়।

গত আদমসুমারীতে সান্দারদিগকে বেদিয়া বলা হইয়াছে। সার হার্বার্ট রিজলী বলেন, “বেদিয়া শব্দটি কতকগুলি ভ্রমণকারী দলের নাম। ইহাদিগকে জাতি বলা যায় কি না তাহা বলা শক্ত।”

বৃত্তি।

সান্দারদিগের শরীরের গঠন সুন্দর ও ইহারা বড় দুঃসাহসী। শোনা যায় যে সান্দার শব্দটি তাঁতের “সানা” হইতে হইয়াছে। বঙ্গদেশে যখন বস্ত্রবয়ন কার্যের খুব উন্নতি ছিল যখন ইহারা বাঁশের সানা তৈয়ারী করিয়া বেচিত। তাহাদের জীবিকানির্বাহের এই উপায় নষ্ট হইলে সান্দারা বোধহয় আর অন্য কোন সদুপায়ে জীবিকানির্বাহের চেষ্টা করিল না। ইহারা ঘুরিয়া বেড়াইয়া, তাস খেলিয়া, অন্যান্য প্রকারের জুয়া খেলিয়া, কখনও কখনও নিজেদের আহারের জন্য ছিপ ও সুতা দিয়া মাছ ধরিয়া দিন কাটায়।

সস্তার মনোহারী জিনিষের ফেরী করা ভিন্ন ইহারা কোন ব্যবসা করে না। ইহাদের মধ্যে যাহারা অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন তাহারা কলিকাতার বড়বাজারে ও মুর্গিহাটায় মাড়োয়ারী ও মুসলমান দোকানদারদিগের নিকট হইতে এই সকল জিনিষ কিনিয়া স্বজাতীয় পুরুষদিগের নিকট বিক্রয় করে এবং ইহাদের স্ত্রী লোকেরা বাড়ি বাড়ি এই সকল জিনিষ ফেরী করে। ফেরী করিবার সময়ে এই স্ত্রীলোকেরা সর্বদা নজর রাখে কোন সুযোগে চুরি করিতে পারে কি না কিংবা কোন স্থানে সিঁদচুরি বা ডাকাইতি করিলে লাভ হইতে পারে কি না। ইহারা সাধারণতঃ দুশ্চরিত্রা এবং ঘুরিতে ঘুরিতে যে সকল পুরুষের সহিত ইহাদের সাক্ষাৎ হয় তাহারা ইহাদের প্রতি ভালবাসা জানাইলে তাহাদের প্রস্তাবে সম্মত হয় এবং সেই সুযোগে বাড়ির কোথায় টাকা ও মূল্যবান জিনিষ রাখা হয় তাহা জানিয়া লয়। ইদানীং কয়েক জন পুরুষও এই ফেরী কার্য করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ইহারা স্ত্রীলোকদের সঙ্গে যায় কিংবা স্ত্রী লোকদের আর এই কাৰ্য্য করিতে না দিয়া নিজেরাই উহা করে। বোধ হয় যে ইহারা অন্য মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের সামাজিক অবস্থার উন্নতি করিবার জন্য স্ত্রীলোকদিগকে পৰ্দানসীন করিবার অভিপ্রায়ে এইরূপ করিতেছে।

৯৬ নং পৃষ্ঠায় একদল সান্দার স্ত্রী ও তাহাদের ব্যবসার জিনিষপত্রে ছবি দেওয়া হইল।

বাসস্থান।

এপ্রিল হইতে নবেম্বর পর্যন্ত সান্দারগণ জলের উপর বাস করে। কম ব্যক্তিরই নির্দিষ্ট বাসস্থান আছে। মিষ্টার আর, কে, দেব যখন বগুড়ার জেলার মাজিষ্ট্রেট ছিলেন তখন তিনি সাধ্যসাধনা করিয়া কয়েক জনকে ঘর বাঁধিয়া স্থির হইয়া বাস করাইয়াছিলেন। অন্যান্য জেলায় কয়েক জনের জমির উপর বাড়ি আছে। কিন্তু এই সকল লোকও নৌকা রাখে এবং বৎসরের মধ্যে কয়েক মাস নদীতে নদীতে ঘুরিয়া বেড়ানর স্বভাব ছাড়ে নাই। সান্দারদের অধিকাংশ কেবল শীতের কয়েক মাস জমির উপর বাস করে।

ইহাদের নৌকা।

এই সময়ে ইহারা ইহাদের নৌকা জলে ডুবাইয়া রাখে ও নৌকার ছই খুলিয়া লইয়া তাহার দ্বারা চাল করিয়া জমি হইতে অল্প কয়েক হাত উঁচু ছোট ছোট ঘর বাঁধিয়া থাকে। এপ্রিল মাসে ইহারা জলে যায় এবং ৩০ বা তদধিক সংখ্যক– নৌকার বহরে ভ্রমণ করে। যেমন যেমন নৌকা ছাড়িয়া যায় বা পুনরায় যোগ দেয় তেমনি তেমনি বহরে নৌকার সংখ্যা দিন দিন কমিতে বাড়িতে থাকে। প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব নৌকা আছে। ইহাতে পুরুষ, স্ত্রী ও ছেলেপিলে বাস করে। এই সকল নৌকার গঠন প্রণালী এক বিচিত্র রকমের। সান্দারদিগকে বিশেষভাবে জানেন এরূপ একজন কর্মচারী বর্ণনা করিয়াছেন যে মোচার ন্যায় আকারের দুই এই সকল নৌকার বিশেষত্ব। কিন্তু এই বর্ণনা সব স্থানে খাটে না। কারণ সম্প্রতি যে সকল মান্দারের সঙ্গতি আছে তাহারা করগেট টিনের ছই ব্যবহার করে।

বড় বড় নৌকা ছাড়া প্রত্যেক বহরে কতকগুলি ছোট ছোট দ্রুতগামী পাসীশ্রেণীর নৌকা থাকে। যখন সান্দাররা কোন চুরি ডাকাইতি করিতে যায় তখন এই সকল ছোট নৌকা ব্যবহার করে।

ডাকাইতির প্রণালী।

আর, এল, ওয়ার্ড সাহেব যিনি ১৮৯৪ সালে পাবনার পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্ট ছিলেন তিনি বলেন, যে নদীর উপর যে সকল ডাকাইতি হয় তাহাদের মধ্যে শতকরা নব্বইটি সান্দারেরা এবং কেবল সান্দাররাই অন্যান্য বদমায়েসের বিনা সাহায্যে করে। তিনি আরও বলেন, নদীতে সান্দার দলের দ্বারা অনুষ্ঠিত ডাকাইতিসম্বন্ধে ভুল হইতে পারে না। সান্দার ডাকাইতরা নৌকার নোঙ্গরের কাছি কাটিয়া দেয় ও তৎপরে নৌকা চলিতে থাকিলে উহাকে আক্রমণ করে। কদাচিৎ ১২/১৪ জন ডাকাইতের কম থাকে (অর্থাৎ ২ খানা পানসী থাকে ও অন্ততঃ ৬ জন করিয়া লোক এক এক খানা পানসী চালায়), প্রায় সর্বস্থলেই নৌকার ছইয়ের উপর জোরে ঘা মারা হয়। যদি মারামারি হয় তাহা হইলে সান্দাররা খুব মারপিট করে। সান্দারদের মধ্যে এই নিয়ম আছে যে তাহারা কখনও নগদ টাকা ভিন্ন কিছু চুরি করিবে না। এই নিয়ম তাহারা কদাচিৎ ভঙ্গ করে।

আমার মনে হয় যে ওয়ার্ড সাহেব সান্দারদের ডাকাইতির যে সকল বিশেষত্বের কথা এখানে উল্লেখ করিয়াছেন সে সকল কথা সমগ্র বঙ্গদেশের অধিকাংশ নদীর উপর ডাকাইতিসম্বন্ধে খাটে। নোঙ্গর করা নৌকার উপর ডাকাইতির কথা কখনও শোনা যায় কি না সন্দেহ। ছইয়ের উপর জোরে ঘা দেওয়া এবং প্রয়োজন হইলে অত্যন্ত মারপিট করাও নদীর ওপর ডাকাইতির সাধারণ লক্ষণ। ওয়ার্ড সাহেব উল্লেখ না করিলেও আগুন চাহিবার ছলে নৌকার কাছে আসার ফিকির সান্দারগণ ও বঙ্গদেশের অন্যান্য সকল নদীর ডাকাইত অবলম্বন করে।

সান্দারদের বহর দুই তিনটা নদীর সংযোগ স্থলে নোঙ্গর করিয়া থাকে। ডাকইতি করিতে যাওয়া স্থির হইলে, একদল লোক বহর ছাড়িয়া তাহাদের হালকা নৌকায় নদীর ১০/২০ মাইল উজান চলিয়া যায়। তারপর তাহারা খুব শীঘ্ন পর পর ২/৩টা ডাকাইতি করিয়া তাড়াতাড়ি নৌকা বাহিয়া বহরে চলিয়া আসে। ইহারা এত উৎকৃষ্ট দাড়ি যে নৌকা করিয়া ইহাদের অনুসরণ করা একরূপ অসম্ভব। ধরা পড়িবার ভয় চলিয়া গিয়াছে বলিয়া যতক্ষণ না বিশ্বাস হয় ততক্ষণ ডাকাইতির মাল লুকাইয়া রাখা হয়। যাহারা নিজ হাতে ডাকাইতি করে তাহারা লুটের বার আনা লয় ও বক্রী বহরের অন্যান্য লোকের মধ্যে ভাগ করিয়া দেওয়া হয়।

সান্দাররা জলের উপর ডাকাইতি করিতে বেশি পছন্দ করিলেও, জমির উপরেও ডাকাইতি করিতে পারে। ১৮৯১ সালে লালজান সান্দার নামক এক ব্যক্তি একরার করে যে সে একটা দলের মধ্যে ছিল যে দল তামাক কিনিবার অছিলায় কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে রাহাজানি করিবার জন্য রেলে চড়িয়া প্রথমে পোড়াদহে যায় এবং পরে রঙ্গপুর ও কুচবিহার পর্যন্ত গমন করে।

সিঁদচোর ও চোররূপে।

ওয়ার্ড সাহেব লিখিয়াছেন, “ইহা যেন মনে করা না হয় যে সান্দাররা সিঁধচুরি বা নৌকা হইতে চুপিচুপি টাকা চুরি করা অপেক্ষা জোরজবরদস্তি করিয়া ডাকাইতি করিতে বেশী ভাল বাসে। জন্মাবধি সান্দার ছোট চোর এবং ইহাদের মধ্যে যাহারা সবচেয়ে বেশী নিপুণ ও সাহসী তাহারও কোনও জিনিষের জন্য লড়াই করা অপেক্ষা চুপিচুপি লওয়া পছন্দ করে। সান্দার পুরুষ বা স্ত্রীলোক অপেক্ষা বাড়ির বা নৌকার ঝাঁপ কাটিতে ও চুপিচুপি মূল্যবান জিনিষ সরাইতে অধিক পটু কেহ নাই”।

রীতিমত ডাকাইতিতে সান্দাররা কখনও স্ত্রীলোক সঙ্গে লয় না, কিন্তু ওয়ার্ড সাহেব বলেন, যে নদীর ধারে সিঁধচুরিতে, টাকা পয়সা ইত্যাদি ছিনাইয়া লইতে ও মেলায় ছোট ছোট চুরি করিতে পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোকেরা অনেক বেশি পটু। ইহারা কখনও কখনও ইরানি বেদেদের প্রণালী অবলম্বন করে। পুরুষরা একটা দোকানে ঢুকিয়া ঝগড়া বাধাইয়া দেয় ও স্ত্রীলোকেরা ইত্যবসরে কতকগুলি মূল্যবান জিনিষ টানিয়া লইয়া বাহিরে চালান করিয়া লয়।

ইহাদের চোরাই মাল গ্রাহক।

ওয়ার্ড সাহেব বলেন যে, সান্দাররা নগদ টাকা ভিন্ন কিছু চুরি করিব না এই সাধারণ নিয়ম ভঙ্গ করিলে সাধারণতঃ রসূয়া নামক এক নীচ শ্রেণীর বংশানুক্রমিক মুসলমান রৌপ্যকারদিগের হাত দিয়া তাহাদের জিনিষপত্র বেচিয়া ফেলে। এই রসূয়াদিগকে সাধারণতঃ বগুড়া সদর, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল মহকুমায় দেখিতে পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ ইহাদিগকেই সার হার্বার্ট রিজলি রাসিয়া বেদিয়া নামে উল্লেখ করিয়াছেন। ইহাদের অবস্থা প্রায় সান্দারদের মত।

চেহারা ও পোষাক।

সাধারণত চেহারায় ও পোষাকে সান্দারদের সহিত বাঙ্গালার অন্যান্য নীচ শ্রেণীর মুসলমানদের পার্থক্য নাই। সান্দাররা একটা টান দিয়া বাঙ্গালা বলে ও ইহাদের নিজেদের একটা চলতী ভাষা আছে।

সান্দারদের কাৰ্য্যক্ষেত্র ঢাকা, বাখরগঞ্জ, ফরিদপুর, দিনাজপুর, মালদহ, রঙ্গপুর, রাজসাহী, বগুড়া, জলপাইগুড়ি, পাবনা, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা জেলা এবং কুচবিহার রাজ্য ও আসামের কোন কোন জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। গায়েন, মিরশিকারী ও বড়মাসিয়াদের সহিত ইহাদের খুব সাদৃশ্য আছে। বস্তুতঃ, কোন কোন কর্মচারী বলেন যে, গায়েন, মিরশিকারী ও বড়মাসিয়া সান্দারের নামান্তর মাত্র। কিন্তু আমার নিজের তদন্ত হইতে আমি স্বীকার করিতে পারি না যে ইহাদের মধ্যে চালচলন, চরিত্র ও সম্ভবতঃ উৎপত্তিসম্বন্ধে নিশ্চিত সাদৃশ্য থাকিলেও ইহারা এক। মিরশিকারী ও বড়মাসিয়াদিগের দুর্ব্বৃত্ততার এরূপ যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নাই যাহাতে তাহাদিগকে এই পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *