১. প্রথম পর্ব – মা মারা গেলেন আজ

দি আউটসাইডার – আলবেয়ার কাম্যু
অনুবাদ মুনতাসীর মামুন

মুখবন্ধ

আলবেয়ার কাম্যু জন্মগ্রহণ করেছিলেন আলজিরিয়ায়, ১৯১৩ সনে। কৈশোর যৌবনের কিছুটা কেটেছিল তাঁর উত্তর আফ্রিকায় এবং প্যারিসে পা দেয়ার আগে জীবিকা অর্জনের জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন বিভিন্ন উপায়। এর মধ্যে একটি ছিল আলজিয়ার্স ফুটবল দলের গোলরক্ষক।

প্যারিসে এসে বৃত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি সাংবাদিকতাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ফ্রান্স অধিকার করলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি প্রতিরোধযুদ্ধে। ঐ সময় তিনি বের করেছিলেন প্রতিরোধযুদ্ধের একটি মুখপত্র ‘কমব্যাট’। ইতিমধ্যে যুদ্ধের আগেই প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রথম গ্রন্থ, একটি নাটক ‘ক্যালিগুলা’ (১৯৩৯)। যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময় প্রকাশিত হয়েছিল দুটি গ্রন্থ ‘দি আউটসাইডার’ এবং ‘মিথ অফ সিসিফাস’। এর মধ্যে প্রথমোক্তটি তাঁকে এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি।

পরবর্তীকালে কাম্যু রাজনীতি ও সাংবাদিকতা ত্যাগ করে সম্পূর্ণ সময়ের জন্যে লেখাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ফরাসি সাহিত্যে নতুন বাস্তবতা ও নতুন দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে জাঁ পল সার্ত্রর সঙ্গে তাঁর নামও উচ্চারিত হত। সাহিত্যের জন্যে ১৯৫৭ সনে কাম্যু লাভ করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। কাম্যু পরলোকগমন করেছিলেন ১৯৬০ সনের জানুয়ারি মাসে, এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায়।

‘দি আউটসাইডার’-এর নায়ক মারসো। আলজিয়ার্সে সে সামান্য এক চাকুরি করে। ফরাসি আলজিরীয় মধ্যবিত্ত অবিবাহিত যুবক হিসেবে তার দিন কেটে যায় নিরানন্দ ফ্ল্যাটে, সপ্তাহান্তে মেয়েবন্ধুকে নিয়ে। কিন্তু সমাজের চোখে সে দোষী, কারণ সমাজ মনে করে তার মধ্যে অভাব আছে মৌল আবেগ ও প্রতিক্রিয়ার। দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে সে পর্যবেক্ষণ করে জীবন, যৌনতা, মৃত্যু। তারপর ঘটনাচক্রে সে খুন করে, সোপর্দ করা হয় তাকে আদালতে। আদালতের বিচার ও অন্তিমে মুত্যুদণ্ডের রায় পর্যবেক্ষণ করে সে নিরাসক্তভাবে। এ-সম্পর্কে সিরিল কনোলি লিখেছিলেন, ‘সে (মারসো) একটি নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক শক্তি, যে তুলে ধরে বুর্জোয়া এথিকসের অবাস্তবতা।’

মূল বইটি লেখা হয়েছিল ফরাসিতে, নাম ‘ল্য এত্রানজার’। ১৯৪৬ সনে স্টুয়ার্ট গিলবার্ট ‘দি আউটসাইডার’ নামে তা অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে। বর্তমান অনুবাদক উপরোক্ত ইংরেজি অনুবাদ (পেঙ্গুইন ১৯৬১) ব্যবহার করেছেন। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ইংরেজি অনুবাদের রীতিটি অনুসরণের চেষ্টা করা হয়েছে, তবে সবক্ষেত্রে যে সে-প্রচেষ্টা সম্ভব হয়েছে এমন কথা বলা যায় না। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে ‘দি আউটসাইডার’ নামটিই ব্যবহৃত হল কারণ এ-নামেই গ্রন্থটি সমধিক পরিচিত।

অনুবাদ ও প্রকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে আমাকে সাহায্য করেছেন সর্বজনাব বশীর আলহেলাল, আবুল হাসানাত ও মুহম্মদ নুরুল হুদা। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ।

মুনতাসীর মামুন
ঢাকা, ১৯৭৩

.

প্রথম পর্ব

১.

মা মারা গেলেন আজ। হয়তোবা গতকাল; আমি ঠিক জানি না। আশ্রম থেকে টেলিগ্রাম এসেছে : তোমার মা মারা গেছেন। আগামীকাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। গভীর সমবেদনা। সুতরাং ব্যাপারটা ঘোলাটে; হয়তো তিনি মারা গেছেন গতকাল।

বৃদ্ধদের জন্যে আশ্রমটি আলজিয়ার্স থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে, মারেনগোতে। যদি দুপুরের বাস ধরি তবে হয়তো রাত হবার আগেই সেখানে পৌঁছে যাব। তা হলে শবদেহের পাশে প্রথামতো পুরো রাতটা জেগে আগামীকাল বিকেলে আবার। ফিরে আসতে পারব। কর্তাকে বলে দুদিনের ছুটি নিলাম আর স্বাভাবিকভাবে এ অবস্থায় তিনি ‘না’ও করতে পারেন না। তবুও মনে হল তিনি যেন খানিকটা বিরক্ত হয়েছেন এবং আমি কিছু না-ভেবেই তখন তাকে বললাম : ‘দুঃখিত স্যার, কিন্তু আপনি জানেন দোষটা আমার নয়।’

পরে অবশ্য আমার মনে হল, কথাটা না-বললেও চলত। কৈফিয়ত দেয়ার কোনো কারণই আমার থাকতে পারে না; বরং তারই উচিত ছিল আমাকে সমবেদনা ইত্যাদি জানানো। বোধহয় পরশু তিনি তা আমাকে জানাবেন যখন দেখবেন আমি কালো। পোশাক পরে অফিসে এসেছি। কিন্তু এখন প্রায় মনে হচ্ছে মা যেন মরেননি। এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, এই মারা যাওয়াটা সবার কাছে পরিষ্কার করবে।

দুটোর বাস ধরলাম। দুপুরটি ছিল গনগনে। রোজকার মতো, দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম সেলাস্তির রেস্তোরাঁয়। সবাই দুঃখ প্রকাশ করল এবং সেলাস্তি বলল, ‘মার মতো পৃথিবীতে আর কিছুই নেই।’ বিদায় নেওয়ার সময় সবাই আমাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল। রওনা দেওয়ার তাড়াহুড়োয়, শেষমুহূর্তে ইমানুয়েলের বাসায় যেতে হল কালো টাই আর শোকের কালো ফিতে ধার নেওয়ার জন্যে। মাত্র মাসখানেক আগে তার চাচা মারা গেছেন।

ছুটতে হয়েছিল বাস ধরার জন্যে। মনে হয়, অমনভাবে তাড়াহুড়ো করার জন্যে, এবং রাস্তা ও আকাশ থেকে ছিটকে-আসা আলোক-ঝলক, পেট্রোলের গন্ধ, বাসের ঝাঁকি সব মিলে আমাকে করে তুলেছিল তন্দ্রালস। যাহোক, প্রায় পুরোটা পথ ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল তখন দেখি পাশে এক সৈনিকের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছি। হেসে সে জিজ্ঞেস করল, আমি বহুদূর থেকে আসছি কি না। কথা কমাবার জন্যে খালি মাথা নাড়লাম। কথা বলার ইচ্ছে তখন আমার ছিল না।

আশ্রমটি গ্রাম থেকে মাইলখানেকের কিছু বেশি দূরে। হেঁটেই চলে গেলাম সেখানে। পৌঁছেই ঠিক তখন-তখনই আমি মাকে দেখতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু দারোয়ান জানাল, প্রথমে আমাকে ওয়ার্ডেনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওয়ার্ডেন তখন ব্যস্ত, সুতরাং আমাকে অপেক্ষা করতে হবে খানিকটা। দারোয়ান এ সময়টুকু আমার সঙ্গে কথা বলে কাটাল, তারপর নিয়ে গেল অফিসে। ওয়ার্ডেন মানুষটি ছোটখাটো, মাথার চুল ধূসর আর বাটন-হোলে লাগানো লিজিয়ন অফ অনারের গোলাপ। তিনি তাঁর টলটলে নীল চোখ মেলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। তারপর আমরা হাত মেলালাম এবং এত দীর্ঘক্ষণ তিনি। আমার হাত ধরে রাখলেন যে রীতিমতো অস্বস্তি লাগছিল। তারপর এক অফিস রেজিস্টার বের করে আমার সামনে রেখে বললেন :

‘মাদাম মারসো এ-আশ্রমে ভরতি হয়েছিলেন তিন বছর আগে। তার নিজের কোনো সামর্থ্য ছিল না এবং সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তিনি তোমার ওপর।‘

আমার মনে হল, তিনি বোধহয় আমাকে কোনোকিছুর জন্যে দোষ দিতে চাচ্ছেন, সুতরাং কৈফিয়ত দেয়া শুরু করলাম। কিন্তু আমাকে তিনি থামিয়ে দিলেন, “তোমায় কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না হে! আমি পুরো কাগজপত্র দেখেছি, তোমার এমন কোনো ভালো অবস্থা ছিল না যে তুমি তোমার মা’র যত্ন নিতে পারো ভালোভাবে। সবসময় দেখাশোনার জন্যে তাঁর একজনের দরকার ছিল। আর তোমরা ছেলে-ছোকরারা যা চাকরি করো তাতে মনে হয় না তো খুব একটা রোজগার করো। যাহোক তোমার মা এখানে বেশ সুখী ছিলেন।

‘জি স্যার, সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।’ বললাম আমি। তারপর তিনি যোগ করলেন : ‘এখানে তাঁর ভালো কিছু বন্ধু ছিল, তার মতোই বৃদ্ধ সব। আর বোধহয় জানো, সবাই নিজ নিজ জেনারেশনের লোকদেরই পছন্দ করে বেশি। বয়স তোমার কম সুতরাং তুমি তার খুব ভালো সঙ্গী হতে পারতে না।’

কথাটা আসলে ঠিক। যখন আমরা একসঙ্গে থাকতাম তখন মা সবসময় আমাকে নজরে রাখতেন ঠিকই তবে ক্বচিৎ আমরা কথা বলতাম। আশ্রমে প্রথম কয়েক সপ্তাহ তিনি বেশ কান্নাকাটি করেছিলেন, কারণ আশ্রমে তখনও তিনি অভ্যস্ত হননি। তার একমাস কি দুমাস পর যদি তাকে আশ্রম ত্যাগ করতে বলা হত তা হলে বোধহয় তিনি কাঁদতেন। তাই গত কয়েক বছর আমি তাকে চিৎ দেখতে যেতাম। কিন্তু তাতেও আমার রোববারটা নষ্ট হত বাস ধরার ঝামেলা, টিকিট করা, আসা-যাওয়ার দু-ঘণ্টার কথা নাহয় বাদই দিলাম।

ওয়ার্ডেন কথা বলে চলছিলেন। কিন্তু কান আমার সেদিকে ছিল না। অবশেষে তিনি বললেন, ‘এখন বোধহয় তুমি তোমার মাকে দেখতে চাও?’

কথা না বলে উঠে দাঁড়ালাম। দরজার দিকে তিনি আমায় নিয়ে চললেন। কথা বলতে বলতে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় তিনি বললেন :

‘মৃতদেহ আপাতত আমি আমাদের ছোট শবাগারে সরিয়ে রেখেছি–বুঝতেই পারছ যাতে অন্যরা উতলা না হয়। এখানে কেউ মারা গেলে দুএকদিন সবাই বড় উদ্বিগ্ন থাকে, যার অর্থ অবশ্যই আমাদের কর্মচারীদের জন্যে বাড়তি কাজ আর ঝামেলা।’

আমরা একটা উঠোন পেরুলাম যেখানে বেশকিছু বৃদ্ধ ছোট ছোট জটলা বেঁধে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আমরা কাছে আসতেই তারা চুপ মেরে গেলেন। তারপর আমাদের পিছে আবার কথা শুরু হল। তাদের কণ্ঠস্বর আমাকে খাঁচায় বন্দি টিয়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অবশ্য তাঁদের গলার স্বর তত তীক্ষ্ণ ছিল না। আমরা গিয়ে থামলাম ছোট এক নিচু বাড়ির সামনে।

‘সুতরাং, তোমাকে আমি এখানেই ছেড়ে যাচ্ছি সঁসিয়ে মারসো। কোনোকিছুর দরকার হলে বোলো, অফিসে আছি আমি। আগামীকাল সকালে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হবে বলে আমরা ঠিক করেছি। সুতরাং পুরো রাতটাই তুমি তোমার মার কফিনের পাশে কাটাতে পারবে এবং তোমার ইচ্ছেও বোধহয় তা-ই। হ্যাঁ, ভালো কথা, তোমার মা’র বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তার ইচ্ছে ছিল তাঁকে যেন চার্চের নিয়ম অনুযায়ী কবর দেয়া হয়। আমি অবশ্য এর বন্দোবস্ত করে রেখেছি। তবুও কথাটা তোমাকে জানানো দরকার মনে করলাম।‘

ধন্যবাদ জানালাম তাঁকে। যদুর জানি, আমার মা জীবদ্দশায় নাস্তিক ছিলেন না, তবে ধর্মের প্রতি মনোযোগ দেননি কখনও।

শবাগারে প্রবেশ করলাম। উঁচু স্কাইলাইট দেয়া, চুনকাম করা, পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে এক ঘর। আসবাবপত্রের মধ্যে আছে কয়েকটা চেয়ার আর কাঠের তৈরি কয়েকটা খুঁটি যার ওপর সাময়িকভাবে কিছু রাখা যেতে পারে। এরকম দুটো খুঁটির ওপর কফিনটা রাখা। কফিনের ঢাকনা বসানো কিন্তু আঁটা হয়নি স্ক্র এবং দাগপড়া আখরোট কাঠের ওপর সেগুলির ধাতুর মাথা জেগে আছে। একজন নার্স, বোধহয় কোনো আরব-রমণী, বসেছিল কফিনের পাশে, পরনে তার নীল স্মোক, চুল বাধা এক জমকালো স্কার্ফ দিয়ে।

ঠিক সে-সময় বুড়ো দারোয়ানটা এসে হাজির। বোধহয় দৌড়ে এসেছে, নিশ্বাস পড়ছে দ্রুত।

‘কফিনের ঢাকনা আমরা বন্ধ করে রেখেছি। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে আপনি এলে যেন ঢাকনা খুলে দিই যাতে আপনি তাকে দেখতে পারেন।’ বলে, যখন সে কফিনের দিকে যাচ্ছিল তখন আমি তাকে কষ্ট করতে মানা করলাম।

‘অ্যাঁ, কী?’ একটু অবাক হল সে, ‘আপনি চান না যে আমি ….?’

‘না’, বললাম আমি।

স্ক্রু-ড্রাইভারটা পকেটে রেখে সে তাকাল আমার দিকে। বুঝলাম, আমার ‘না’ বলা উচিত হয়নি এবং ব্যাপারটা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলল। কিছুক্ষণ আমাকে নিরীক্ষণ করে সে বলল, ‘কেন, না কেন?’ গলার স্বর তার ক্ষুব্ধ নয়, শুধুমাত্র জানতে চাওয়ার জন্যেই এ-প্রশ্ন।

‘দ্যাখো, আমি ঠিক বলতে পারছি না।’ উত্তর দিলাম আমি।

সে তার শাদা গোঁফজোড়া কিছুক্ষণ পাকাল। তারপর শান্তভাবে বলল: ‘আমি বুঝেছি।’

দারোয়ানটি দেখতে মন্দ নয়, চোখ তার নীল আর গালদুটো রক্তিম। আমাকে কফিনের পাশে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে নিজে ঠিক তার পিছে বসল। নার্স উঠে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। যখন সে যাচ্ছিল তখন দারোয়ানটি আমার কানে কানে বলল:

‘আহ বেচারির টিউমার হয়েছে।‘ আমি আরেকটু খুঁটিয়ে দেখলাম নার্সটিকে। তার চোখের নিচ দিয়ে মাথার চারপাশে ব্যান্ডেজ বাধা। কেউ তার মুখের দিকে তাকালে শাদাই দেখবে।

নার্স চলে যেতেই দারোয়ান উঠে দাঁড়াল। ‘এখন আপনাকে একলা ছেড়ে যাচ্ছি।’

জানি না আমি কোনো ইশারা করেছিলাম কি না কিন্তু দারোয়ান চলে যাওয়ার বদলে থামল। আমার পিছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে এ-অনুভূতিটা মনে জাগতেই অস্বস্তি লাগল। সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। পুরো ঘরে অস্তগামী সূর্যের নরম আলো। মাথার ওপর স্কাইলাইটের কাছে গুঞ্জন করছিল দুটি ভ্রমর। খুব ঘুম পাচ্ছিল আমার, চোখ খোলা রাখতে পারছিলাম না। পেছন না-ফিরেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম ক’বছর এই আশ্রমে সে চাকরি করছে। ‘পাঁচ বছর।‘ এবং উত্তরটা এমনভাবে এল যে শুনে মনে হল, সে বুঝি কোনো প্রশ্নের অপেক্ষায়ই ছিল।

তারপর সে মুখ খুলল। দশ বছর আগে যদি কেউ তাকে বলত যে, মারেনগোর এই আশ্রমে সে একজন সাধারণ দারোয়ান হয়ে দিন কাটাবে, তা, হলে তখন হয়তো সে তা বিশ্বাস করত না। বয়স তার চৌষট্টি, বলল সে, আর জন্ম প্যারিসে।

সে একথা বলার পর কিছু না-ভেবেই মাঝখানে বলে বসলাম, ‘ওহ্, তা হলে। তুমি এখানকার লোক নও।’

আমার হঠাৎ করে তখন মনে হল, ওয়ার্ডেনের কাছে নিয়ে যাওয়ার সময় মা’র সম্পর্কে আমাকে সে কিছু বলেছিল। বলেছিল, মাকে একটু তাড়াতাড়ি কবর দিতে, কারণ এ-জায়গায় গরমটা একটু বেশি। ‘প্যারিসে মৃতদেহ তারা তিনদিন পর্যন্ত রেখে দেয়, কোনো কোনো সময় চারদিন।‘ তারপর সে জানাল, জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে তার প্যারিসে, তাই প্যারিসকে সহজে সে ভুলতে পারে না। ‘এখানে সবকিছু তাড়াতাড়ি হয়। কেউ মারা গেলে সে যে মরেছে একথাটা ভাববার অবকাশ না দিয়েই মৃতদেহের সকার হয়ে যায়।‘ ‘অনেক হয়েছে।’ বলল ওর বউ, ‘এসব বাজে কথা এ-ভদ্রলোককে বলা কি তোমার উচিত হচ্ছে?’ সে তখন লজ্জা পেয়ে বারবার আমার কাছে ক্ষমা চাইতে লাগল। বললাম, ‘এমন কিছুই হয়নি যার জন্যে ক্ষমা চাইতে হবে।‘ আসল কথা, তার কথাবার্তা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলাম। কারণ, এসব কথা আগে কখনও আমার মনে হয়নি।

তারপর সে বলল, প্রথমে এই আশ্রমে ঢুকেছিল সে সাধারণ একজন আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু শরীর মন সজীব ছিল তখনও, তাই দারোয়ানের চাকরিটা খালি হলে সে নিজেই তাতে বহাল হতে চেয়েছিল।

বললাম, তা হলেও, অন্যদের মতো সে-ও একজন আশ্রমবাসী। কিন্তু তাতে সে কোনো উত্তর দিল না। সে ‘একজন কর্মচারীর মতো।‘ আগেই খেয়াল করেছিলাম, তার বয়সী বৃদ্ধদের সে ‘তারা’ বা ‘সেইসব বুড়ো’ বলে সম্বোধন করছিল। তবুও তার মনোভাব অনুভব করতে পারছিলাম। দারোয়ান হিসেবে ছিল তার খানিকটা দাপট আর খানিকটা কর্তৃত্ব।

ঠিক সে-সময় নার্স ফিরে এল। সন্ধ্যা নেমে এল যেন খুব তাড়াতাড়ি। স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে আকাশটাকে মনে হচ্ছিল কালো। দারোয়ান বাতি জ্বেলে দিল। বাতির প্রথম আলোয় চোখে ধাঁধা দেখলাম।

সে তখন প্রস্তাব করল খাবার-ঘরে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিতে। কিন্তু আমার খুব-একটা খিদে ছিল না। তখন সে প্রস্তাব করল, আমাকে সে এক কাপ কাফে অ ল্যা খাওয়াতে পারে। পানীয়টি আমার প্রিয়, তাই বললাম, ‘ধন্যবাদ’। কয়েক মিনিট পর সে ফিরে এল ট্রে-হাতে। কফি খাবার পর সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মা’র সামনে–এই অবস্থায় সিগারেট খাওয়া ঠিক হবে কি না। বুঝতে পারছিলাম না। খানিকটা ভেবে দেখলাম, না, এতে কিছুই যায় আসে না। তাই দারোয়ানকে একটা সিগারেট দিলাম, তারপর দুজনে তা টানতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পর আবার সে কথা বলা শুরু করল :

‘জানেন, আপনার মা’র বন্ধুরা এখুনি আসবে আপনার সঙ্গে মৃতদেহের পাশে বসে রাত জাগতে। আমাদের এখানে কেউ মারা গেলে আমরা তার মৃতদেহের পাশে বসে রাত জাগি। যাই দেখি, কিছু চেয়ার আর একপট কালো কফি জোগাড় করা যায় কি না।’

শাদা দেয়ালে বাতির উজ্জ্বল আলো প্রতিফলিত হওয়ায় চোখে লাগছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, একটা বাতি সে নিভিয়ে দিতে পারে কি না। ‘কিছুই করার নেই’, বলল সে, ‘তারা এমনভাবে বাতিগুলোর বন্দোবস্ত করেছে যে হয় সবকটিই জ্বলবে না-হয় একটিও জ্বলবে না।’ একথার পর আর তার দিকে নজর দিলাম না। সে বাইরে থেকে কিছু চেয়ার এনে কফিনের চারপাশে সাজিয়ে রাখল। একটিতে রাখল একপট কফি আর দশ-বারোটি পেয়ালা। সব গুছিয়ে রেখে, মা’র অন্যদিকে, আমার মুখোমুখি সে বসল। নার্সটি ঘরের অন্যপাশে, আমার দিকে ছিল তার পিঠ। সে কী করছিল তা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না।

কিন্তু তার হাত নড়া দেখে মনে হল সে কিছু-একটা বুনছে। খুব আরাম লাগছিল আমার, কফি তুলেছিল আরো চাঙা করে। খোলা দরজা দিয়ে ভেসে আসছিল। ফুলের সুবাস, স্পর্শ পাচ্ছিলাম রাতের ঠাণ্ডা বাতাসের। মনে হয়, কিছুক্ষণ ঝিমিয়েছিলামও।

সরসর এক আওয়াজে ঘুম ভাঙল। চোখ বন্ধ করার পর মনে হয়েছিল ঘরের বাতিগুলি যেন আরও জোরালো হয়ে জ্বলছে। কোথাও কোনো ছায়ার চিহ্নমাত্র নেই। এবং প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি বাঁক বা কোণের বহিঃরেখা ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। মা’র বন্ধু, বৃদ্ধরা সব ঘরে ঢুকছিলেন। গুনলাম, মোট দশজন। প্রায় শব্দহীনভাবে সন্ধ্যা ছটায় যেন তারা ভেসে এলেন। চেয়ারে যখন তারা বসলেন তখন বিন্দুমাত্র শব্দ হল না। আমার জীবনে এত পরিষ্কারভাবে আমি আর কাউকে দেখিনি; তাঁদের কাপড়চোপড় বা চেহারার কোনো ডিটেল আমার নজর এড়াল না। কিন্তু, তবুও তাঁদের কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না, এবং বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল যে তারা সত্যিই বিদ্যমান।

প্রায় প্রতিটি মহিলার পরনে অ্যাপ্রন। কোমরে শক্ত করে বাঁধা ছিল অ্যাপ্রনের দড়ি। এতে তাঁদের পেটগুলোকে বেশ বড় লাগছিল। বৃদ্ধাদের এতবড় পেট আগে আমার নজরে পড়েনি। তবে অধিকাংশ বৃদ্ধই বেতের মতো শুকনো, এবং সবার হাতে লাঠি। তাদের যে-জিনিসটা আমাকে সবচেয়ে অবাক করেছিল তা হল, তাদের মুখের দিকে তাকালে চোখ নজরে পড়ছিল না। চোখগুলিকে দেখা যাচ্ছিল বলিরেখার জালে আটকে-থাকা ঘোলাটে আলোর মতো।

চেয়ারে বসে তারা তাকালেন আমার দিকে। দাঁতহীন মাড়ি দিয়ে ঠোঁট চুষতে চুষতে অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়লেন তাঁরা। আমি বুঝতে পারছিলাম না, তারা কি আমায় শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, না কিছু বলতে চাইছেন, না এটা বয়সের দোষ। ভাবতে চাইলাম, তারা বোধহয় তাদের মতো করে আমায় শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ছিল অদ্ভুত। দারোয়ানকে ঘিরে-থাকা ঐ বৃদ্ধের দল নিষ্কম্প চোখে আমাকে দেখছে আর মাথা নাড়ছে। মুহূর্তের জন্যে মনে হল, তারা আমার বিচার করতে বসেছেন।

মিনিট কয়েক পর একজন মহিলা কাঁদতে শুরু করলেন। দ্বিতীয় সারিতে বসেছিলেন তিনি। তাঁর সামনে একজন মহিলা থাকায় তাঁকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাঁদতে কাঁদতে মাঝে মাঝে থেমে তিনি ঢোক গিলছিলেন। মনে হচ্ছিল, তার এ- কান্না বোধহয় আর কখনও থামবে না। অন্যেরা এর প্রতি তেমন নজর দিচ্ছিল না। নিথর হয়ে বসেছিল তারা চেয়ারে, তাকাচ্ছিল কখনও কফিনের দিকে, কখনও-বা নিজেদের লাঠির দিকে অথবা অন্য কোনো জিনিসের দিকে। আর যেটার দিকেই তাকাচ্ছিল সেটা থেকে আর চোখ ফেরাচ্ছিল না। মহিলাটি কাঁদছিলেন তখনও। তাকে আমি চিনিনে কিন্তু তবুও আমার মনে হচ্ছিল তার কান্না থামানো উচিত। কিন্তু কিছু করতে সাহস পাচ্ছিলাম না। খানিক পর, সেই দারোয়ানটি মাথা নুইয়ে ফিসফিস করে তাকে যেন কী বলল। তিনিও মাথা নেড়ে অস্পষ্টভাবে কিছু বললেন যা আমি বুঝতে পারলাম না। তিনি ঠিক আগের মতোই ফোঁপাতে লাগলেন।

দারোয়ান উঠে দাঁড়াল। চেয়ার নিয়ে এসে বসল আমার পাশে। প্রথমে সে রইল চুপ করে, তারপর আমার দিকে না-তাকিয়ে বলতে লাগল:

‘আপনার মা’র খুব ভক্ত ছিলেন এই মহিলা। তাঁর মতে, এ-পৃথিবীতে আপনার মা-ই ছিলেন তাঁর একমাত্র বন্ধু। কিন্তু এখন তিনি একেবারে একেলা।’

কিছুই বলার ছিল না আমার। নিস্তব্ধতা বিরাজ করল কিছুক্ষণ। আস্তে আস্তে মহিলার ফোঁপানি ও ঢোক গেলাও কমে এল। এবং একসময় থেমে গেল ফোপানিও। নাক ঝেড়ে বসে রইলেন তিনি চুপচাপ।

আমার ঝিমুনি কেটে গিয়েছিল, ক্লান্ত লাগছিল খুব আর পা-টাও কামড়াচ্ছিল। ভীষণভাবে। এখন বুঝলাম, এই লোকদের নিস্তব্ধতা চেপে বসেছে আমার স্নায়ুর ওপর। খালি অদ্ভুত ধরনের একটা শব্দ হচ্ছিল, বেশ থেমে থেমে এবং প্রথমে তা শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যাক, কিছুক্ষণ মনোযোগ দেয়ার পর বুঝলাম এ কিসের শব্দ।

বুড়ো লোকগুলি গালের ভেতরটা চুষছিলেন জিভ দিয়ে, তাই শব্দ হচ্ছিল অমন যা আমার কাছে হয়ে উঠেছিল রহস্যময়। নিজেদের চিন্তায় তারা এত মগ্ন ছিলেন যে, তারা কী করছেন তা তারা নিজেরাও খেয়াল করছিলেন না। আমার মনে একটা ধারণা জন্মেছিল যে, তাদের মাঝে রাখা মৃতদেহটাকে বুঝি তাঁরা আমল। দিচ্ছেন না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ধারণাটা ছিল ভুল।

দারোয়ান সবাইকে কফি দিলে আমরা তা পান করলাম। তারপর আমার আর তেমন কিছু মনে নেই; কোনোরকমে কেটে গেল রাতটা। একটা জিনিস শুধু মনে আছে। একসময় হঠাৎ আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম বুড়োরা সব ঘুমুচ্ছেন। জেগে রয়েছেন শুধু একজন। দুহাতে লাঠিটা চেপে ধরে তার ওপর থুতনি রেখে। কঠোরভাবে তাকিয়ে ছিলেন তিনি আমার দিকে যেন অপেক্ষা করছিলেন আমার ঘুম ভাঙার। তারপর আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর কিন্তু আবার ঘুম ভেঙে গেল কারণ পায়ে ঝিঁঝি ধরেছিল।

ভোরের ম্লান আলো দেখা গেল স্কাইলাইট দিয়ে। কয়েক মিনিট পর জেগে উঠলেন একজন, তারপর শুরু করলেন কাশতে। বড় একটা নকশা-করা রুমালে মুখ রেখে কাশছিলেন তিনি। কাশির শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল বুঝি তিনি বমি করার চেষ্টা করছেন। একে একে জেগে গেল সবাই তারপর। দারোয়ান বলল, যাবার সময় হয়েছে এখন।’ শুনে তারা সবাই উঠে দাঁড়ালেন। রাতে ভালো ঘুম না-হওয়ার ফলে মুখ তাদের হয়ে গেছে লম্বাটে আর পাঁশুটে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, যাবার আগে সবাই তাঁরা করমর্দন করলেন আমার সঙ্গে, যেন একরাতে আমরা কত অন্তরঙ্গ হয়ে গেছি যদিও সারারাত আমাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।

বেশ ক্লান্ত লাগছিল। দারোয়ান আমাকে তার ঘরে নিয়ে গেলে নিজেকে খানিকটা পরিপাটি করে নিয়েছিলাম। আমাকে সে আরও খানিকটা দুধ-মেশানো কফি দিল যা আমাকে তুলেছিল চাঙা করে। বাইরে যখন বেরোলাম, সূর্য তখন বেশ উপরে উঠে গেছে। মারেনজো আর সমুদ্রের মাঝে পাহাড়চুড়োয় আকাশ হয়ে উঠেছে রক্তিম। ভোরের বাতাস বইছিল, যাতে ছিল স্নিগ্ধ লোনা স্পর্শ। মনে হচ্ছিল, দিনটা খুব ভালো যাবে। অনেকদিন গ্রামে আসিনি আমি। এবং দেখলাম ভাবছি, মা’র এই ব্যাপারটা না থাকলে কী চমৎকারভাবেই-না খানিকটা হেঁটে বেড়াতে পারতাম।

উঠোনের এক প্লেনগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভিজে মাটির গন্ধ নিলাম আর তারপর দেখলাম, আমার আর ঘুম পাচ্ছে না। অফিসের সহকর্মীদের কথা চিন্তা করলাম এরপর। ঠিক এ-সময় ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার জন্যে তারা তৈরি হচ্ছে। এ-সময়টা ছিল আমার জন্যে সবচেয়ে বিশ্রী সময়। দশ মিনিট কি আরও কিছুক্ষণ আমি এসব ভাবলাম। তারপর ঘরের ভেতর বেজে-ওঠা ঘণ্টার শব্দ আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল। জানলার বাইরে থেকে দেখছিলাম কারা যেন ভেতরে চলাফেরা করছে। ফের সব শান্ত হয়ে গেল। সূর্য উঠে গেল আরেকটু ওপরে, পা তেতে ওঠা শুরু করেছে। উঠোন পার হয়ে দারোয়ান কাছে এসে জানাল ওয়ার্ডেন আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। গেলাম তার অফিসে। কিছু কাগজপত্র দিলেন তিনি সই করার জন্যে। পিন-স্ট্রাইপ পাতলুন পরনে তাঁর, সবকিছু কালো। ফোনের রিসিভারটা তুলে তাকালেন তিনি আমার দিকে : শববহনকারী লোকেরা এসেছে কিছুক্ষণ আগে। তারা এখনই কফিনের ভ্রু আটকাবে। আমি কি তাদের খানিকটা অপেক্ষা করতে বলব যাতে তোমার মাকে শেষবারের মতো দেখতে পাও?

‘না’, বললাম আমি।

গলা নামিয়ে কী যেন বললেন তিনি টেলিফোনে। ‘ঠিক আছে ফিজেক, লোকজনদের সেখানে যেতে বলো।’

তারপর তিনি জানালেন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তিনিও যাবেন। ধন্যবান জানালাম তাঁকে। খাটো পা-দুটি মেলে দিয়ে, ডেস্কের পেছনে, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন তিনি। বললেন, নার্স ছাড়া অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমি এবং তিনিই একমাত্র শোককারী। কারণ আশ্রমের নিয়ম অনুযায়ী আশ্রমের কেউ শবানুগমন করতে পারবে না। তবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আগের রাত্রিতে মৃতদেহের পাশে বসে তারা রাত জাগতে পারে।

‘এটা তাদের জন্যেই’, ব্যাখ্যা করলেন তিনি, যাতে তারা কাতর না হয়ে পড়ে। কিন্তু আজ আমি তোমার মা’র পুরনো এক বন্ধুকে শবানুগমনের বিশেষ অনুমতি দিয়েছি। থমাস পিরেজ তার নাম’, হাসলেন ওয়ার্ডেন, ‘গল্পটা বেশ করুণ বটে। সে আর তোমার মা অভিন্ন হয়ে উঠেছিল। আশ্রমের অন্য বৃদ্ধরা ঠাট্টা করে বলত যে, পিরেজ একজন ফিয়াসে পেয়েছে। তোমরা বিয়ে করেছ কবে? জিজ্ঞেস করত তারা। হেসে উড়িয়ে দিত সে প্রসঙ্গটি। অনেকটা তামাশার মতো হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটি। সুতরাং বুঝতেই পারছ, তোমার মা’র মৃত্যুতে সে কতটা আঘাত পেয়েছে। ভেবে দেখলাম, শবানুগমনের অনুমতি না দিলে খারাপ দেখাবে। তবে আমাদের ডাক্তারের পরামর্শে তাকে রাত জাগতে দিইনি।‘

তারপর আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। খানিক পর ওয়ার্ডেন চেয়ার ছেড়ে জানালার কাছে দাঁড়ালেন।

বললেন : ‘আরে ঐ তো মারেনগোর পাদরি চলে এসেছেন! অবশ্য সময়ের খানিকটা আগেই এসেছেন।‘ তিনি আমায় জানালেন, হেঁটে গির্জেয় পৌঁছতে লাগবে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা। কারণ, গির্জেটা গ্রামের একেবারে ভেতরে। তারপর নিচে নেমে এলাম আমরা।

সাময়িক শবাগারের দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাদরি। সঙ্গে তাঁর দুজন অধস্তন কর্মচারী। তাদের একজনের হাতে রুপোর ধূপধার। পাদরি তার উপর ঝুঁকে ধূপাধারের রুপোর শিকলটা ঠিক করছিলেন যেটার সঙ্গে তা লটকে ছিল। আমাদের দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, আমাকে ‘পুত্র’ বলে সম্বোধন করে কিছু কথা বললেন। তারপর আমাদের নিয়ে ঢুকলেন ভেতরে।

আমি সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, চারজন লোক কালো পোশাক পরে কফিনের পিছে দাঁড়িয়ে আর কফিনের ঢাকনাটা আটকানো স্কু দিয়ে। ঠিক সে-সময় ওয়ার্ডেন বললেন, শবাধার নেওয়ার গাড়ি এসেছে। পাদরি শুরু করলেন তার প্রার্থনা। তারপর সবাই যাবার জন্যে প্রস্তুত হতে লাগল। সেই চারজন একটুকরো কালো কাপড় নিয়ে এগিয়ে গেল কফিনের দিকে আর আমি, পাদরি এবং অন্যান্যরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন দরজার পাশে। আগে কখনও আমি দেখিনি তাকে। ‘ইনি মঁসিয়ে মারসো’, ওয়ার্ডেন বললেন। মহিলাটিকে। আমি তার নামটা ঠিক ধরতে পারলাম না, কিন্তু মনে হল তিনি বোধহয় এ-আশ্রমের নার্স। তার সঙ্গে যখন পরিচয় করিয়ে দেয়া হল তখন মাথা নিচু করে তিনি আমায় অভিবাদন জানালেন। তাঁর দীর্ঘ কৃশমুখে বিন্দুমাত্র হাসির রেশ ছিল না। আমরা সব দাঁড়ালাম দরজার একপাশে; কফিন বের করা হলে পর পিছুপিছু গিয়ে দাঁড়ালাম দরজার কাছে। সেখানে শবাধার নেয়ার জন্যে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। গাড়িটা আয়তাকার, মসৃণ এবং কালো রঙের। গাড়িটা আমাকে মনে করিয়ে দিল অফিসের কলমদানির কথা।

গাড়ির পাশে দাঁড়িয়েছিল ছোটখাটো এক মানুষ। পরনে সুন্দর অথচ অদ্ভুত পোশাক। বুঝলাম, তার কাজ হল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দেখাশোনা করা। অনেকটা অনুষ্ঠানের কোনো কর্তাব্যক্তির মতো। তার পাশে লাজুক এবং অপ্রতিভভাবে দাঁড়িয়েছিলেন মা’র বিশেষ বন্ধু থমাস পিরেজ। মাথায় তার নরম একটা ফেল্ট হ্যাট। চুড়োটা যার পুডিঙের মতো উঁচু আর ধারটা বেশ বড় কফিনটা দরজার কাছে আসতেই তিনি মাথা থেকে টুপি নামিয়ে নিলেন। পরনে তার কালো একটা টাই যা তাঁর উঁচু ডবল শাদা কলারের তুলনায় খুব ছোট। ব্রণময় গোল নাকের নিচে তার ঠোঁটদুটি কাঁপছিল। কিন্তু যা আমার দুষ্টি আকর্ষণ করল, তা হল তাঁর কান, দোদুল্যমান রক্তিম কান যা মোমের মতো হালকাভাবে তার গালের দুপাশে ঝুলে রয়েছে। আর কানের চারপাশে সিল্কের মতো শাদা পশম।

শববহনকারীদের একজন জায়গা ঠিক করে দিল আমাদের। শববহনকারীযানের আগে আগে পুরোহিত, দুপাশে কালো-পোশাক-পরা চারজন, তারপর আমি আর ওয়ার্ডেন এবং সবশেষে নার্স আর বুড়ো পিরেজ।

আকাশটা ভেসে যাচ্ছিল আলোর বন্যায়। বাতাসও উঠছিল তেতে। গরম বাতাসের হল্কা অনুভব করছিলাম পিঠে। আর আমার কালো স্যুট অবস্থা আরও শোচনীয় করে তুলেছিল। বুঝতে পারছিলাম না কেন এতক্ষণ সঙ্কারের জন্যে আমরা অপেক্ষা করলাম। টুপিটা পরেছিলেন বুড়ো পিরেজ, এখন আবার তা খুলে ফেললেন। একটু সরে আমি তাঁকে দেখছিলাম আর ওয়ার্ডেন আমাকে তার সম্পর্কে আরও কিছু বলছিলেন। মনে আছে, তিনি বলেছিলেন, প্রায়ই নমিত বিকেলে আমার মা আর বৃদ্ধ পিরেজ একসঙ্গে দীর্ঘপথ হাঁটতেন। মাঝে মাঝে গ্রাম পর্যন্ত যেতেন হেঁটে। অবশ্য সঙ্গে থাকত একজন নার্স।

গ্রামের দিকে তাকালাম। সাইপ্রেসের সারি যেন পাহাড় আর তারপর দিগন্তে গিয়ে ঠেকেছে। উষ্ণ লাল মাটি মিশে গেছে সবুজের সঙ্গে। এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দুএকটা নিঃসঙ্গ বাড়ি। মা’র অনুভূতিটা অনুভব করতে পারছিলাম। এদিকের বিকেলটা নিশ্চয় বোধহয় শোকের মতো। এখন সকালের প্রখর তাপে সবকিছু ঝলসাচ্ছে, তাই নিসর্গকে মনে হচ্ছে খানিকটা অমানুষিক, নিষ্ঠুর।

অবশেষে, আমরা একটা বাঁক পেরুলাম। আর তখনই লক্ষ করলাম, পিরেজ একটু খোঁড়াচ্ছেন। গাড়িটার গতি যতই বাড়ছিল বৃদ্ধ ততই তাল হারিয়ে ফেলছিলেন। আরেকজনও পিছিয়ে পড়ে আমার গতিতে চলে এলেন। সূর্যের খুব দ্রুত উপরে উঠে যাওয়া দেখে আশ্চর্য হলাম। বাতাসে পোকামাকড়ের শব্দ। ঘাসের তেতে ওঠার সরসর আওয়াজ। মুখ বেয়ে ঘাম ঝরছিল। যেহেতু সঙ্গে আমার কোনো টুপি ছিল না, তাই রুমাল দিয়ে বাতাস খাবার চেষ্টা করছিলাম।

সেই পিছিয়ে-পড়া ভদ্রলোক কী যেন বললেন আমাকে। ঠিক ধরতে পারলাম। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাত দিয়ে ধরে-থাকা রুমাল দিয়ে মাথা মুছলেন। ডান হাত দিয়ে ধরে রেখেছিলেন টুপিটা। জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে কী বলছিলেন। উপরের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন :

আজকের রোদটা খুব কড়া, তাই না?

‘হ্যাঁ’, বললাম আমি।

কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলেন, যাকে কবর দেয়া হচ্ছে তিনি আপনার মা?

‘হ্যাঁ’, আবার বললাম আমি।

‘তাঁর বয়স হয়েছিল কত?’

‘এই আর-কি…’ আসলে আমি ঠিক জানতাম না মা’র বয়স কত ছিল।

তারপর চুপ করে রইলেন তিনি। পিছন ফিরে দেখলাম, প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছেন পিরেজ। একহাতে রাখা টুপিটা দোলাচ্ছেন, গতির সঙ্গে তাল রাখার জন্যে। আমি ওয়ার্ডেনের দিকেও একবার তাকালাম। তিনি সতর্কভাবে মাপা পা ফেলে হাঁটছিলেন। কপালে তাঁর ঘামের ফোঁটা, কিন্তু তা মুছবার কোনো চেষ্টাই তিনি করছিলেন না।

মনে হল আমাদের মিছিলটা যেন একটু দ্রুত তালে এগুচ্ছে। যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম, সেদিকেই দেখছিলাম আলোর বন্যায় ভেসে-যাওয়া গ্রামের নিসর্গ। আকাশটা এত ঝকঝকে যে উপরের দিকে চোখ ভোলার সাহস পাচ্ছিলাম না। শেষে, আমরা আলকাতরা-দেয়া এক নতুন রাস্তায় এসে উঠলাম। গরমে গলে যাচ্ছে আলকাতরা। আর যিনিই আলকাতরায় পা রাখছেন তারই পায়ের ছাপ পড়ছে সেখানে। উজ্জ্বল কালো ছাপ। গাড়োয়ানের আঁকালো কালো টুপিটাকে শবযানের মাথায় ঐ চটচটে বস্তুর স্তূপের মতো লাগছে। এটা সবাইকে এনে দিচ্ছে এক স্বপ্নিল ভাব। নীল-শাদা তাপের তরঙ্গ উপরে, আর চারদিকে এই কালো : শবযানের চকচকে কালো, লোকদের পোশাকের ম্লান কালো আর রাস্তায় পায়ের ছাপের রুপোলি কালো। এ ছাড়া আছে গন্ধ। গরম চামড়া এবং শবযানের ঘোড়ার মলের গন্ধ, আর ধূপের ধোয়ার সরু রেখা। এগুলো এবং গতরাতে না ঘুমানোর দরুন আমার চোখ আর ভাবনাগুলি যাচ্ছিল জড়িয়ে।

আমি আবার পিছন ফিরে তাকালাম। পিরেজকে যেন মনে হচ্ছিল বহুদূরে, চোখ-ঝলসানো রোদে প্রায় অস্পষ্ট। তারপর তিনি মিলিয়ে গেছেন একেবারে। এটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম আমি। ভাবলাম, বুঝি পথ ছেড়ে তিনি ক্ষেতে নেমেছেন। সামনে নজর পড়ল রাস্তার একটি বাক। স্বাভাবিকভাবে পিরেজ, এ- অঞ্চল যার ভালোভাবে চেনা, আমাদের ধরার জন্যে শর্টকাট ধরছিলেন। বাঁক ঘোরার মুখে ধরে ফেললেন তিনি আমাদের, কিন্তু তারপর আবার পড়লেন পিছিয়ে। আরেকটা শর্টকাট মেরে আবার তিনি আমাদের ধরে ফেললেন। পরবর্তী আধঘণ্টা কয়েকবার এরকম হল। কিন্তু এর কিছুক্ষণ পরই তার গতিবিধির ওপর আমার নজর রাখার আগ্রহটা কমে গেল। কপালের দুপাশের রগদুটো দপদপ করছিল। আমি আর চলতে পারছিলাম না বললেই হয়।

তারপর সবকিছু হঠাৎ করে হয়ে গেল। আর এত নিখুঁত এবং স্বাভাবিকভাবেই যে তার তেমন কোনো বিবরণ আমার মনে নেই। তবে মনে আছে, আমরা যখন গ্রামটা ছাড়িয়ে এসেছি তখন নার্স আমায় যেন কী বলেছিল। গলার স্বর তার আমাকে অবাক করেছিল, কারণ মুখের সঙ্গে স্বরের কোনো মিল নেই। স্বরটা একটু কাঁপা-কাঁপা। সে যা বলেছিল তা হল, কেউ যদি খুব আস্তে হাঁটে তবে তার সর্দিগর্মি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার যদি কেউ খুব তাড়াতাড়ি হাঁটে তবে ঘেমে যায় এবং পরে গির্জের ঠাণ্ডা বাতাস তার শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। তার যুক্তিটা বুঝলাম। অর্থাৎ যে-কোনোভাবে সর্দিগর্মি হতে পারে।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আরও দুএকটা ঘটনা আমার মনে আছে। সেই বৃদ্ধটির কথা ধরা যাক যখন তিনি শেষবারের মতো গ্রামের ঠিক বাইরে আমাদের ধরে ফেলেছিলেন। অত্যধিক পরিশ্রম বা দুঃখ বা হয়তো দুটোর জন্যেই চোখ তার ভরে গিয়েছিল জলে। কিন্তু মুখের বলিরেখার জন্যে চোখের পানি গাল বেয়ে নামতে পারছিল না–বরঞ্চ তার জরাজীর্ণ মুখের চারদিকে পড়ছিল ছড়িয়ে এবং প্রাচীন জীর্ণ মুখে সৃষ্টি করেছিল এক চকচকে ভাবের।

মনে পড়ছে আরও–গির্জের চেহারা, রাস্তার গ্রামবাসী, কবরের ওপর লাল জেরানিয়াম; পিরেজের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কাপড়ের পুতুলের মতো কুঁকড়ে মুকড়ে গিয়েছিলেন তিনি, মা’র কফিনের ওপর ঝরে-পড়া লাল মাটি যার সঙ্গে মিশে আছে শাদা শেকড়ের টুকরো; তারপর আরও লোক, গলার স্বর, কাফের বাইরে বাসের জন্য অপেক্ষা, ইঞ্জিনের গুঞ্জন, এবং যখন প্রথম আমরা ঢুকলাম আলজিয়ার্সের ঝলমলে রাস্তায় তখন মনে আনন্দের অল্প শিহরন এবং তারপর সোজা বিছানায় গিয়ে একটানা বারো ঘণ্টা ঘুম।

.

২.

ঘুম থেকে উঠেই বুঝলাম, দুদিন ছুটি নিতে চাওয়ায় কেন আমার ওপরঅলা মুখভার করেছিলেন। আজ শনিবার। শনিবার যে আজ হবে একথা আগে আমার মনে হয়নি। মনে হল তখন, যখন বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ওপরঅলা বুঝেছিলেন, একাধারে চারদিন আমি ছুটি পাচ্ছি, এবং এটা তাকে খুশি করবে এমন আশা করা যায় না। তবু বলব, দোষটা আমার নয়। মাকে গতকাল কবর না দিয়ে যদি আজ দেওয়া হত তা হলেও আমি শনিবার আর রোববার–এ-দুদিন ছুটি পেতাম। কিন্তু যাহোক, আমি আমার ওপরঅলার দিকটাও বুঝতে পেরেছিলাম। ঘুম থেকে ওঠাটা ছিল কষ্টকর, কারণ গতকালের অভিজ্ঞতা সত্যিই আমাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। দাড়ি কামাতে কামাতে ভাবছিলাম, কীভাবে দিনটা কাটানো যেতে পারে। ভাবলাম, বাইরে গিয়ে খানিকক্ষণ সাঁতার কাটলে বোধহয় ভালো লাগবে। সুতরাং পোতাশ্রয়ে যাবার ট্রাম ধরলাম।

আগের মতোই আছে সবকিছু। সুইমিং পুলে ছেলে-ছোকরার ভিড়, আর ঐ ভিড়ে ছিল আমার অফিসের এককালীন টাইপিস্ট মারি কারদোনাও। ঐ সময় আমি তার প্রতি বেশ উৎসুক ছিলাম এবং মনে হয় সেও আমায় পছন্দ করত। কিন্তু আমাদের অফিসে ছিল সে মাত্র কয়েকদিন, তাই কিছুই আর দানা বাঁধেনি।

ভেলায় তাকে ওঠাবার সময় হাত দিয়ে তার বুক ছুঁয়ে দিলাম। তারপর সে। নৌকায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল আর আমি দাঁড় বাইতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর, পাশ ফিরে সে তাকাল আমার দিকে। চুলগুলি লুটোপুটি খাচ্ছিল তার চোখের ওপর এবং হাসছিল সে। দাঁড় রেখে দিয়ে এসে বসলাম তার পাশে। বাতাস বেশ আরামদায়ক-উষ্ণ। তামাশার ছলে আমার মাথা রাখলাম তার কোলে। সে কিছু বলল না দেখে আমিও আর মাথা সরালাম না। পুরো আকাশ আমার চোখে। নীল আর সোনালি। মাথার নিচে মারির পেটের ধীর ওঠানামা অনুভব করছিলাম। আধঘণ্টারও বেশি, আধো-ঘুমে, আধো-জাগরণে শুয়ে ছিলাম আমরা। তারপর রোদ আরও প্রখর হলে মারি ঝাঁপ দিল পানিতে। সঙ্গে সঙ্গে আমিও। সাঁতরিয়ে। আমি তাকে ধরে ফেললাম এবং হাত দিয়ে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরে দুজনে। পাশাপাশি সাঁতরাতে লাগলাম। সে তখনও হাসছিল।

সুইমিং পুলের কিনারে দাঁড়িয়ে যখন আমরা নিজেদের শুকোচ্ছিলাম তখন মারি বলল, ‘দ্যাখো, আমি তোমার চেয়েও বাদামি।‘ তাকে জিজ্ঞেস করলাম, বিকেলে সে আমার সঙ্গে সিনেমায় যাবে কি না। আবার হাসল সে। বলল, ‘হ্যাঁ’, যদি আমি তাকে ঐ হাসির বইটা দেখাতে নিয়ে যাই যাতে ফারনান্দল অভিনয় করছে এবং যার কথা এখন সবাই আলোচনা করছে।

কাপড় পরা যখন আমরা শেষ করলাম তখন সে আমার কালো টাই দেখে জিজ্ঞেস করল, আমি কারও জন্যে শোক পালন করছি কি না। জানালাম তাকে যে আমার মা মারা গেছেন। কখন?’ জিজ্ঞেস করল সে। গতকাল’, বললাম আমি। কিছু সে বলল বটে কিন্তু মনে হল খানিকটা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে সে। আমি তাকে প্রায় বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে দোষটা আমার নয়। কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলাম। কারণ, একথাটা আগেও একবার ওপরঅলাকে বলেছিলাম, এবং বুঝেছিলাম কথাটা শুনতে বোকার মতো। বোকামি হোক বা না-হোক, এরকম একটা ঘটনা ঘটলে সবাই নিজেকে খানিকটা দোষী মনে না করে পারে না।

যাহোক, বিকেলের দিকে মারি সব ভুলে গেল। মাঝে মাঝে ছবিটাতে কিছু হাসির খোরাক ছিল, কিন্তু পুরোটা যাচ্ছেতাই। সিনেমাহলে, সে তার পা দিয়ে আমার পা টা চেপে ধরছিল এবং আমি তার বুকে হাত বুলোচ্ছিলাম। ছবিশেষে তাকে চুমো খেলাম খানিকটা আনাড়ির মতো। তারপর সে আমার সঙ্গে ফিরে এল ঘরে।

ঘুম থেকে জেগে দেখি, মারি চলে গেছে। সে বলেছিল, সকালে উঠে প্রথমেই তার খালা খোঁজ করবে। মনে পড়ল, আজ রোববার; বিরক্ত লাগল। রোববারের। জন্যে আমি কখনও হা-পিত্যেশ করি না। মাথা ফেরালাম এবং অলসভাবে মারির ছেড়ে-যাওয়া বালিশের গন্ধ নিলাম। বালিশে সমুদ্রের জলের গন্ধ। ঘুমোলাম দশটা পর্যন্ত; তারপর দুপুর পর্যন্ত শুয়ে-শুয়ে সিগারেট টানলাম। ঠিক করলাম, প্রতিদিনের মতো সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় আজ আর খাব না। কারণ, সেখানে গেলেই তারা আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলবে এবং কেউ জেরা করুক তা আমার অপছন্দ। সুতরাং কড়াইয়ে কয়েকটা ডিম ভেজে খেয়ে নিলাম। রুটি ছাড়াই খেলাম ডিমগুলি। কারণ ঘরে রুটি ছিল না আর নিচে গিয়ে তা তামাকঅলার দোকানের পাশের ছোট রেস্তোরাঁ সে পিয়েরো-র বেয়ারা খালি রেস্তোরাঁর ধুলো ঝাড়ছে। রোববারের একটি আদর্শ বিকেল।

চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমি তামাকঅলার মতো বসলাম। এভাবে বসা আরামদায়ক। বসে বসে কয়েকটা সিগারেট শেষ করার পর ঘরে গেলাম। সেখান থেকে একটুকরো চকোলেট নিয়ে এসে বসলাম জানালার কাছে। খাবার জন্যে। একটু পরেই আকাশটা ঢেকে গেল মেঘে। ভাবলাম, বুঝি কালবৈশাখি এল। যাক, কিছুক্ষণ পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল, পরিষ্কার হল বটে কিন্তু মনে হতে লাগল যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। এবং এ-ভাবটা চারদিকে বেশ অন্ধকার করে তুলল। বেশ কিছুক্ষণ আমি আকাশ দেখলাম।

পাঁচটার সময় ট্রামের বিকট আওয়াজ শোনা গেল। শহরতলির স্টেডিয়াম থেকে তা আসছে যেখানে একটা ফুটবল ম্যাচ ছিল। পুরো ট্রামভরতি লোক, এমনকি পাদানিতে পা রেখেও লোক ঝুলছিল। তারপর আরেকটা ট্রামে এল খেলোয়াড়রা। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল একটা করে ছোট সুটকেস যা দেখে বুঝলাম এরা খেলোয়াড়। দলের গান গাইছিল তারা ‘কিপ দা বল রোলিং বয়েজ’। তাদের একজন আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, তাদের একচোট নিয়েছি। আমি হাত নাড়লাম। বললাম, ‘চমৎকার!’ তারপর প্রাইভেট গাড়ির স্রোত বইতে লাগল রাস্তায়।

আকাশটা গেল আবার বদলে; বাড়িগুলির চুড়োর পিছনদিকটায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল একটা লালচে আভা। সঁঝ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাগুলি আবার ভরে উঠতে লাগল। লোকজন তাদের বৈকালিক ভ্রমণশেষে ফিরছিল এবং এসব ফিরতি লোকদের মধ্যে আমি সেই ছোটখাটো ভদ্রলোক ও তার স্থূলাঙ্গী স্ত্রীকে দেখতে পেলাম। ছেলে মেয়ে দুজন মা-বাবার পিছে পিছে ক্লান্তস্বরে প্যানপ্যান করতে করতে আসছিল। কিছুক্ষণ পর, কাছেপিঠের সিনেমাহলগুলি তাদের দর্শকদের উগরে দিল। লক্ষ করলাম, ছেলে-ছোকরারা লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটছে এবং অন্যান্য সময় থেকে জোরেশোরে হাত নাড়ছে। তারা যে মার্কামারা একটি পশ্চিমা বুনো’ ছবি দেখে এসেছে সে-সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। শহরের মাঝখানের সিনেমাহলগুলির দর্শকরা ফিরল কিছুক্ষণ পর। তাদের বেশির ভাগেরই মুখ গোমড়া, যদিও কয়েকজন। তখনও হাসছিল। যাহোক, মোটকথা, তাদের পরিশ্রান্ত লাগছিল। কয়েকজন আমার জানালার নিচে ঘোরাফেরা করতে লাগল। একদল মেয়ে এল হাতে হাত রেখে। আমার জানালার নিচের ছোকরারা তাদের পাশ ঘেঁষে যাবার জন্যে তাদের দিকে মুখ করে হাঁটতে লাগল এবং চেঁচিয়ে মজার মন্তব্য করল যা শুনে মেয়েরা পিছন ফিরল, হাসল। মেয়েগুলিকে চিনলাম। পাড়ারই মেয়ে, তাদের দুএকজনের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, দেখে হাত নাড়ল।

ঠিক সে-সময় একসঙ্গে রাস্তার বাতিগুলি জ্বলে উঠল। রাতের আকাশে যে তারাগুলি মাত্র জ্বলে উঠেছিল সেগুলি আরও নিষ্প্রভ হয়ে গেল। বাতি এবং একটানা রাস্তার এত খুঁটিনাটি দেখার জন্যে চোখটা টনটন করছিল। বাতিগুলির নিচে খানিকটা জায়গা উজ্জ্বল। কোনো ট্রাম যখনই সে-জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল তখনই উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল কোনো মেয়ের চুল, বা হাসি বা রুপোর চুড়ি।

তার পরই কমে গেল ট্রামের আনাগোনা। বাতি আর গাছের ওপর আকাশকে দেখাচ্ছিল কালো ভেলভেটের মতো। রাস্তা খালি হতে লাগল। এবং এমন এক সময় এল যখন রাস্তায় কাউকে দেখা গেল না এবং বিকেলের দেখা প্রথম বেড়ালটা ধীরস্থিরভাবে নির্জন রাস্তাটা পার হল।

আমার মনে হল, এখন রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করা উচিত। চেয়ারে ঝুঁকে নিচে এতক্ষণ দেখছিলাম যে দাঁড়াতেই ঘাড়টা ব্যথা করে উঠল। নিচে নেমে খানিকটা রুটি আর স্নগেটি কিনলাম, তারপর রান্নাঘরে দাঁড়িয়েই খাওয়াটা সারলাম। ভাবছিলাম, জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আরেকটা সিগারেট খাব, কিন্তু হিমেল হয়ে আসছিল রাতটা। তাই ইচ্ছেটা দমন করলাম। জানালা বন্ধ করে যখন ফিরছিলাম তখন তাকালাম আয়নার দিকে, দেখলাম আয়নায় আমার টেবিলের এক কোনা, তার ওপর স্পিরিটল্যাম্প ও পাশে ছড়ানো কয়েক টুকরো রুটি ফুটে উঠেছে। হঠাৎ মনে হল, আরেকটা রোববার কোনোরকমে কাটিয়ে দিলাম। মাকে কবর দেয়া হয়ে গেছে এবং কাল থেকে আমি আবার আগের মতো অফিস যেতে শুরু করব। সত্যি, আমার জীবনের কিছুই বদলায়নি।

.

৩.

সকালটা খুব ব্যস্ত ছিলাম অফিসে। আমার কর্তাও ছিলেন বেশ খোশমেজাজে। এমনকি তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ক্লান্ত কি না এবং তার পিঠেপিঠেই প্রশ্ন, মার বয়স ছিল কত। খানিক ভেবে বললাম, ষাটের কাছাকাছি। কারণ, আমি আরেকবার ভুল করতে চাচ্ছিলাম না। এটা শুনে তিনি কেমন যেন নিশ্চিন্ত হলেন। কেন, আমি জানি না–ভাবলাম, যাক ইতি হল বিষয়টার।

টেবিলে আমার বিল অফ লেডিঙের পাহাড় আর এসবগুলি দেখতে হবে আমাকে। দুপুরে খেতে যাবার আগে হাত ধুলাম। প্রতিদিন দুপুরে হাত ধুতে আমার বেশ ভালো লাগে। বিকেলে ব্যাপারটা কিন্তু বিরক্তিকর। কারণ, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত লোকজনের ব্যবহারের ফলে তোয়ালেটা ভিজে জবজব করে। ব্যাপারটা একবার কর্তার নজরে এনেছিলাম। এটা যে নিতান্ত বাজে সে বিষয়ে তিনি একমত হয়েছিলেন আমার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর কাছে এটা সামান্য ব্যাপার। অন্যদিনের চেয়ে আর-একটু দেরি করে অফিস ছাড়লাম। সাড়ে বারোটায় ফরোয়ার্ডিং ডিপার্টমেন্টের ইমানুয়েলের সঙ্গে বেরোলাম। অফিস থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বন্দরের জাহাজের মালপত্রের ওঠানামা দেখলাম। সূর্য হয়ে উঠছিল উত্তপ্ত। ঠিক সে-সময় ইঞ্জিন ও শেকলের শব্দ করতে করতে একটা ট্রাক এল। ইমানুয়েল বলল ট্রাকটাতে লাফিয়ে উঠতে। দৌড়োতে শুরু করলাম আমি। ট্রাকটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। আমাদের তাই বেশকিছুটা পথ ধাওয়া করতে হল পিছু-পিছু। ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দের জন্যে সবকিছু খানিকটা গুলিয়ে ফেলছিলাম। সচেতন ছিলাম, শুধু একপাশে জাহাজগুলির গাঢ় রঙের নোঙর ও অদূরে দোলায়মান মাস্তুল এবং ক্রেন ও যন্ত্রপাতির ভিড়ের মাঝ দিয়ে জলের ধার-বরাবর পাগলের মতো দৌড় সম্পর্কে। আমিই প্রথম ধরলাম ট্রাকটাকে, তারপর লাফ দিয়ে ওপরে উঠে টেনে-হেঁচড়ে তুললাম ইমানুয়েলকে। ঘনঘন শ্বাস ফেলছিলাম আমরা। তা ছাড়া এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চলার ফলে ঝাঁকুনি অবস্থা আরও সঙ্গিন করে তুলল। ইমানুয়েল ঢোক গিলে কানে-কানে বলল, শেষ পর্যন্ত উঠলাম তা হলে।

সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় পৌঁছে দেখি দরদর করে ঘামছি আমরা। সেলেস্তে সবসময় যেখানে বসে সেই সেখানে ঢোকার দরজার সামনে বসে আছে। স্থূলকায়। পেটের ওপর তার শাদা অ্যাপ্রন আর শাদা গোঁফজোড়া পাকানো। আমাকে দেখে সহানুভূতি জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার খুব খারাপ লাগছে কি না। বললাম, ‘না’। কিন্তু ভীষণ খিদে পেয়েছিল আমার। গোগ্রাসে খাওয়ার পর কফি দিয়ে শেষ করলাম খাবার-পর্ব। তারপর ঘরে ফিরে খানিকটা ঘুমালাম, কারণ বেশ মদ গিলেছিলাম। ঘুম থেকে জেগে, বিছানা ছেড়ে উঠবার আগে সিগ্রেট খেলাম একটা। খানিকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল তাই ট্রাম ধরার জন্যে দৌড়াতে হল। পুরোদমে চলছিল অফিস আর সারাটা বিকেল কেটে গেল তার সঙ্গে তাল রাখতে রাখতে। অফিস-ছুটিটা তাই এল স্বস্তি হয়ে এবং ঠাণ্ডায় জেটির ধারে পায়চারি করছিলাম আস্তে আস্তে। আকাশটা সবুজ এবং এই নিরেট অফিসের পর বাইরে বেরনোটা ভীষণ আরামপ্রদ। যাক, সোজা ফিরলাম বাসায়, কারণ কিছু আলু সেদ্ধ করার দরকার ছিল।

হলঘরটা আঁধার, তাই যখন সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম তখন বুড়ো সালামানোর সঙ্গে প্রায় ধাক্কা খেলাম। সে আমার সঙ্গে একই তলায় থাকে। সবসময়ের মতো তার কুকুরটাও আছে তার সঙ্গে। আট বছর ধরে এ-দুজন অবিচ্ছিন্ন। সালামানোর স্প্যানিয়েলটা কুৎসিত এক জন্তু। সারা শরীরে চর্মরোগ; আমার মনে হয় খোসপাঁচড়া। কুকুরটার গায়ে এখন পশম নেই বিন্দুমাত্র, বদলে আছে বাদামি বাদামি চাকতি। মনে হয় কুকুরটার সঙ্গে ছোট ঘরটাতে একসঙ্গে থাকার দরুন সালামানোর আকৃতিও হয়ে গেছে অনেকটা এর মতো। তার চুল ভীষণ পাতলা আর গালে লালচে দাগ। আর কুকুরটাও মনে হয় মনিবের মতো বিশ্রী কুঁজোভঙ্গিতে হাঁটাটা আয়ত্ত করেছে। কারণ, সবসময় সে মাথাটা যতদূর সম্ভব সামনে বাড়িয়ে নাকটা মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে হাঁটে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে, তারা পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা করে।

দিনে দুবার, এগারোটা আর ছ’টার সময়, বুড়োটা তার কুকুরকে নিয়ে বেড়াতে বের হয় আর আট বছর ধরে এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। রু দ্য লিয়তে আপনি তাদের দেখতে পাবেন, কুকুরটা যত জোরে পারে তাকে টেনে নিয়ে। চলছে, যতক্ষণ-না বুড়ো মনিবটি পা হড়কে পড়ো-পড়ো হচ্ছে। তখন সে তাকে পেটায়, গাল দেয়। কুকুরটা দুটো পা পিছনে দিয়ে সটান শুয়ে পড়ে। এবার তার প্রভুর পালা তাকে টেনে নেয়ার। খানিক পর কুকুরটা আবার সবকিছু ভুলে গিয়ে ফের জোরে জোরে শেকল টানতে থাকে। ফলে, আরও কিছু প্রহার, গালিগালাজ। তারপর তারা দাঁড়ায় ফুটপাতে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে, কুকুরটার দৃষ্টিতে ভয় এবং মানুষটির দৃষ্টিতে ঘৃণা। যখনই তারা বের হয় তখনই এটা ঘটে। কুকুরটা যখন আবার কোনো ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়াতে চায় তখন তার মনিব তাকে দাঁড়াতে না দিয়ে টেনে নিতে থাকে। আর। হতভাগ্য স্প্যানিয়েলটা রাস্তায় ফোঁটা ফোঁটা জলের দাগ রেখে যায়। কিন্তু ব্যাপারটি যদি ঘরে ঘটে, তার অর্থ আরেকচোট প্রহার।

আট বছর ধরে হয়ে আসছে এরকম। সেলেস্তে তো এটাকে বিষম লজ্জার কথা বলে উল্লেখ করে। বলে, এ-ব্যাপারে কিছু করা উচিত। কিন্তু কোন ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। যখন হলের ভেতর সালামানোর সঙ্গে আমার দেখা হল। তখন সে কুকুরটার ওপর হম্বিতম্বি করছিল। কুকুরটা ঘেউঘেউ করছিল আর সে। জারজ ‘নোংরা খচ্চর ইত্যাদি বলে গাল দিচ্ছিল। “শুভ সন্ধ্যা’ বললাম আমি, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে সে কুকুরটাকে গাল দিয়ে যেতে লাগল। সুতরাং ভাবলাম, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখি কুকুরটা কী করেছে। কিন্তু এবারও কোনো উত্তর না দিয়ে সে চিৎকার করতে লাগল, ব্যাটা খেকি কুত্তা…’ ইত্যাদি। আমি স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু মনে হল, কুকুরটার গলায় সে কিছু লাগাবার চেষ্টা করছে। গলাটা খানিকটা উঁচুতে তুললাম। পিছন না-ফিরেই সালামানো চাপা রাগে স্বগতোক্তি করতে লাগল, ব্যাটা সবসময় এরকম করে। শিক্ষা দেয়া উচিত ব্যাটাকে। তারপর সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল, কিন্তু কুকুরটি চেষ্টা করল প্রতিরোধ করার, শুয়ে পড়ল সে মেঝেতে, ফলে তাকে শেকল ধরে ধাপে-ধাপে টেনে নিতে হল।

আমার সঙ্গে একই তলায় যে-লোক থাকে সে ঠিক এ-সময় নিচে থেকে উপরে উঠে এল। বেশির ভাগ লোকের মতে, সে একজন বেশ্যার দালাল। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞেস করে, সে কী করে, তখন সে উত্তরে বলে, মালগুদামের দারোয়ান। তবে এটা ঠিক, পাড়ায় সে লোকপ্রিয় নয়। কিন্তু প্রায়ই আমার সঙ্গে তার কিছু-না-কিছু কথা থাকে এবং মাঝে মাঝে ঘরে এসে অল্পস্বল্প কিছু বলে সে চলে যায়, কারণ আমি তার কথা শুনি। আসল ব্যাপার, তার কথা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে। সুতরাং তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। নাম তার সেনতেস; রেমন্ড সেনতেস। বেঁটে পুষ্ট গড়ন। নাক তার মুষ্টিযোদ্ধাদের মতো এবং পোশাকআশাকে সে ফুলবাবুটি। সেও আমাকে একবার সালামানোর কথা বলেছিল। সালামানো তার কুকুরের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করে তা খুবই লজ্জার বিষয় এবং তার এরকম ব্যবহারে আমি বিরক্ত হই কি না। উত্তরে আমি বলেছিলাম, ‘না’।

দুজনে সিঁড়ি বেয়ে একসঙ্গে উপরে উঠলাম। সেনতেস এবং আমি। তারপর আমি যখন ঘরের দিকে মোড় নিচ্ছি তখন সে বলল, আমার সঙ্গে খাবে খানিকটা? ঘরে একটা কালো পুডিং আর মদ আছে কিছু।

আমার তখন খেয়াল হল, এর ফলে আমাকে আর রাতের খাবার তৈরি করতে হবে না, সুতরাং বললাম, ‘অসংখ্য ধন্যবাদ।’

তারও ঘর একটা। সঙ্গে রান্নাঘর। জানালা নেই। দেখলাম, তার খাটের মাথায় গোলাপি আর শাদা প্লাস্টারের একটা পরী আর ওপাশের দেয়ালে কিছু চ্যাম্পিয়ান অ্যাথলেট ও নগ্ন মেয়ের ছবি সঁটা। বিছানাটা এলোমেলো, ঘরটা অপরিচ্ছন্ন। প্যারাফিনের একটা বাতি জ্বালাল সে; তারপর পকেট হাতড়িয়ে একটা ময়লা ব্যান্ডেজ বের করে ডানহাতে জড়াল। ‘ব্যাপারটা কী?’ জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে সে জানাল, এক ছোকরা তাকে খানিকটা বিরক্ত করায় তার সঙ্গে একচোট হয়ে গেছে।

‘গণ্ডগোল করার মতো লোক আমি নই’, বোঝাল সে, ‘শুধু খানিকটা রগচটা।‘ ছোকরা আমায় বলল, চ্যালেঞ্জ করল এভাবে, ‘যদি ব্যাটাছেলে হয়ে থাকো তবে। ট্রাম থেকে নেমে এসো।‘ বললাম, “চুপ থাকো। আমি তোমার কিছু করিনি।” তখন সে বলল, আমার সাহস নেই। ব্যস, তারপর মীমাংসা হয়ে গেল সবকিছুর। ট্রাম থেকে নেমে তাকে বললাম “ভালো চাও তো মুখ বন্ধ করো নয়তো তোমার ভালোর জন্য মুখ বন্ধ করে দেব।” “চেষ্টা করেই দ্যাখো-না!” বলল সে। তারপর মুখে এক জবর ঘুসি মেরে ভালো করে শুইয়ে দিলাম তাকে। খানিকপর তাকে ওঠাতে গেলাম। এর বদলে শুয়ে থেকেই সে আমায় লাথি মারল। সুতরাং একবার হাঁটু দিয়ে এবং তারপর হাত দিয়ে তাকে আরও খানিকটা ধোলাই দিলাম। যখন ধোলাই শেষ করলাম তখন শুয়োরের মতো তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “হয়েছে?” সে বলল, “হ্যা”।

সেনতেস কথা বলছিল আর ব্যস্তভাবে হাতে ব্যান্ডেজ জড়াচ্ছিল। আমি বসেছিলাম ওর বিছানায়।

‘সুতরাং তুমিই দ্যাখো, বলল সে, দোষটা আমার নয়। সে-ই চাচ্ছিল ব্যাপারটা, ঠিক না?’ আমি মাথা নাড়লাম এবং সে যোগ করল, ‘আসল কথা তোমার কাছে একটা পরামর্শ চাচ্ছি, এ-ব্যাপারটার জন্যেই। তুমি তো সংসারের কিছু জানো, সুতরাং তুমিই পারো আমায় সাহায্য করতে। তা হলে সারাজীবন আমি তোমার বন্ধু হয়ে থাকব। কেউ যদি আমার উপকার করে তার কথা আমি ভুলি না।’

আমি যখন কোনো উত্তর দিলাম না তখন সে জিজ্ঞেস করল বন্ধু হিসেবে নিতে তাকে কোনো আপত্তি আছে কি না। উত্তরে যখন জানালাম আপত্তি নেই তখন মনে হল সে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছে। কালো পুডিংটা বের করে সে ফ্রাইং প্যানে গরম করল, তারপর দু-বোতল মদ বের করে টেবিল সাজাল। এসব করার সময় সে। চুপ করে ছিল।

খেতে বসলাম আমরা। তারপর খানিক ইতস্তত করে সে পুরো ঘটনাটা আমাকে বলল। ‘সচরাচর যা হয়ে থাকে, তেমনি এ-ঘটনার সঙ্গে একটি মেয়ে জড়িত। প্রায়ই আমরা একসঙ্গে ঘুমোতাম। বলতে গেলে আমি তাকে রেখেছিলাম কারণ সে মোটামুটি মানানসই টাকা চাইত। যে-ছোকরাটিকে ধোলাই করেছি সে ওর ভাই।‘

লক্ষ করল সে আমি চুপ করে আছি। তখন বলল, প্রতিবেশীরা তার সম্পর্কে কী বলে তা সে জানে। কিন্তু কথাগুলি জঘন্য রকমের মিথ্যে। অন্য সবার মতো তারও নিজস্ব একটা নীতি আছে আর আছে গুদামঘরে একটা চাকরি।

‘হ্যাঁ’, বলল সে, ‘তারপর কী হল বলি… হঠাৎ একদিন দেখি মেয়েটা আর আগের মতো আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না। চলার মতো সে তাকে যথেষ্ট টাকা দিত, তবে হয়তো তা তেমন বড় অঙ্কের নয়; তার ঘরের ভাড়া গুনত, প্রতিদিনের খাওয়ার জন্যে দিত কুড়ি ফ্রা। তিনশো ফ্রা ভাড়া, আর ছ’শো ফ্রা খাওয়া এবং যখন-তখন ছোটখাটো উপহার, কখনও একজোড়া মোজা, কখনও-বা অন্যকিছু। ধরো মাসে এক হাজার ফ্রা। কিন্তু আমার ভদ্রমহিলার জন্যে তাও যথেষ্ট নয়। সবসময় প্যানপ্যান করে বলত, যা দিচ্ছি তাতে সে কুলোতে পারছে না। সুতরাং একদিন তাকে বললাম, ‘দিনে ঘণ্টাখানেকের জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করো না কেন? তাতে আমারও সুবিধা হয়। এ-মাসে আমি তোমায় একটা নতুন ফ্রক কিনে দিয়েছি। শুনছি ঘরভাড়া আর প্রতিদিন কুড়ি ফ্রা তো দিচ্ছিই। কিন্তু তুমি একদঙ্গল মেয়ে নিয়ে কাফেতে গিয়ে সব উড়িয়ে দাও। তাদের তুমি কিনে দাও কফি, চিনি। আর পয়সাগুলি তো আসে আমার পকেট থেকে। আমি তোমার সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার করি আর প্রতিদানে এই পাই।‘ কিন্তু সে কোনো কাজ করবে না। অথচ প্রতিদিন বলবে আমি যা দিচ্ছি তাতে আর কুলোচ্ছে না। তারপর একদিন দেখলাম সে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’

সে ব্যাখ্যা করতে লাগল। একদিন তার ব্যাগে একটা লটারির টিকিট দেখে সে জিজ্ঞেস করেছিল, লটারির টিকিট কেনার টাকা সে পেল কোত্থেকে? মেয়েটি চুপ করে রইল। তারপর আরেকবার তার কাছে পেয়েছিল সে দুটি ব্রেসলেট বন্ধক দেয়ার রসিদ। অথচ, ব্রেসলেট দুটি সে কোনোদিন দেখেনি পর্যন্ত।

‘সুতরাং বুঝলাম, ভিতরে ভিতরে নোংরা কিছু-একটা চলছে। তাই তাকে বললাম, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শেষ হওয়া উচিত। তবে তার আগে তাকে নিয়ে নিলাম একচোট, শক্ত শক্ত কিছু কথাবার্তাও শোনালাম। বললাম, একটিমাত্র জিনিসই তার প্রিয়, তা হল সুযোগ পেলে যার-তার সঙ্গে ঘুমানো। সোজাসুজি বললাম তাকে, বুঝলে বোকা মেয়ে, আমার জন্যে কষ্ট পেতে হবে একদিন। তখন আমার কাছেই ফিরে আসতে চাইবে। রাস্তার সব মেয়ে তোমাকে হিংসে করে, কেন জানো? খালি এজন্যে যে আমি তোমাকে রাখছি।’

রক্ত বের না-হওয়া পর্যন্ত পিটিয়েছিল সে মেয়েটিকে। এর আগে কখনও সে তাকে মারেনি। ‘মানে খুব জোরে নয় আর-কি, অনেকটা আদরের মারের মতো। কিছুক্ষণ চাঁচাত এবং আমাকে জানালাগুলি বন্ধ করে দিতে হত। তারপর সচারাচর যা হয় তেমনি ব্যাপারটার ইতি হত। কিন্তু এবার যা-ই বলো, তার থেকে আমার মন উঠে গেছে। খালি মনে হচ্ছে তাকে ভালো করে শাস্তি দেয়া হল না। আমি কী বলছি, বুঝছ তো?’

সে জানাল, এ-ঘটনাটার জন্যেই আমার পরামর্শ চাচ্ছে। ধোঁয়া বেরুচ্ছিল বাতি থেকে। বাতির সলতেটা কমিয়ে দেয়ার জন্যে সে পায়চারি করতে করতে থামল। আমি কিছু না বলে খালি শুনলাম। পুরো এক বোতল মদ খেয়েছি। মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। কারণ, আমার ব্রান্ডের সিগারেট শেষ হয়ে যাওয়ায় রেমন্ডেরটা খাচ্ছিলাম। রাতের শেষ ট্রাম চলে গেল, এবং এর সঙ্গে রাস্তার কলরবও থেমে গেল। রেমন্ড কথা বলে চলছিল। যে-জিনিসটা তাকে খোঁচাচ্ছিল তা হল মেয়েটার ওপর তার খানিকটা ঝোঁক ছিল। কিন্তু মেয়েটিকে যে একচোট শিক্ষা দিতে হবে সে-ব্যাপারে সে দৃঢ়।

তার প্রথম পরিকল্পনা হল, বলল সে, মেয়েটিকে একটি হোটেলে নিয়ে তোলা এবং স্পেশাল পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশদের সে তাল দেবে যাতে মেয়েটার। নাম খাতায় সাধারণ পতিতা হিসেবে তোলা হয়। মেয়েটা তা হলে নিশ্চয় খেপে যাবে। তারপর, অন্ধকার জগতের বাসিন্দা তার কয়েকজন বন্ধুর কাছে সে। পরামর্শ চেয়েছিল যারা মেয়ে রাখে তাদের থেকে যা পারে নিংড়ে নেয়ার জন্যে। কিন্তু, তারাও এমন কোনো পরামর্শ দিতে পারেনি। তবুও সে দেখল, তারা যা বলছে তা তাদের লাইনে হয়তো ঠিক; কিন্তু যখন তুমি জানো না, তোমার সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাকে কী করবে তখন ঐ লাইনে গিয়ে লাভ কী? এটা যখন সে তাদের জানাল তখন তারা পরামর্শ দিল তার শরীরে ‘দাগ’ দিয়ে দিতে। কিন্তু এটাও সে চাচ্ছে না। এর জন্যে অনেক চিন্তাভাবনা দরকার…কিন্তু, প্রথমে, সে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চায়। তবে তা জিজ্ঞেস করার আগে যে কাহিনীটা সে শোনাল সে-সম্পর্কে সাধারণভাবে সে আমার মতামত জানতে চায়।

বললাম, আমার কোনো মতামত নেই তবে গল্পটা বেশ মজাদার।

তোমার কি মনে হয় মেয়েটা সত্যিই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে?

আমাকে স্বীকার করতে হল যে ব্যাপারটা অনেকটা ঐরকমই বইকি। তখন সে জিজ্ঞেস করল, মেয়েটার শাস্তি হোক এ যদি আমি না চাই তবে তার জায়গায় আমি হলে কী করতাম। বললাম, এ-অবস্থায় পড়লে কী করা উচিত সে-সম্পর্কে কেউই কিছু বলতে পারে না। তবে আমি এটা বুঝেছি যে সে চায় মেয়েটা কষ্ট পাক।

আমি আরও কিছু মদ খেলাম আর রেমন্ড আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে সে কী করতে চায় তার ব্যাখ্যা শুরু করল। সে তাকে একটা চিঠি লিখতে চায়, সত্যিকারের জঘন্য ভাষায় যা তাকে অকূল পাথারে ফেলবে আর সঙ্গে সঙ্গে এটা পড়ে সে আগের ঘটনার জন্যে অনুশোচনা করবে। তারপর মেয়েটি যখন ফিরে আসবে তখন সে তার সঙ্গে বিছানায় যাবে এবং মেয়েটি একটু তেতে উঠলেই সে তার মুখে থুতু দিয়ে ঘরের বার করে দেবে। আমি তার সঙ্গে একমত হয়ে বললাম, প্ল্যানটা মন্দ নয়; এই তার উপযুক্ত শাস্তি।

কিন্তু রেমন্ড বলল, যেরকমভাবে চিঠিটা লেখা উচিত সেরকমভাবে তা সে লিখতে পারছে না এবং এখানেই আমি তাকে সাহায্য করতে পারি। যখন আমি চুপ করে রইলাম তখন সে বলল, এটা করতে কি আমি কিছু মনে করব। বললাম, ‘না’। চেষ্টা করে একবার দেখতে পারি।

এক পাত্তর মদ খেয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর প্লেট এবং কিছু ঠাণ্ডা পুডিং যা পড়ে ছিল সরিয়ে টেবিলে জায়গা করে দিল। এরপর যত্ন করে অয়েলক্লথটা মুছে বেডসাইড টেবিল থেকে একটুকরো কাগজ আনল। তারপর আনল একটি খাম, ছোট লাল কলমদানি এবং চৌকো এক দোয়াতদানি যাতে কালো কালি ভরা। যে মুহূর্তে সে মেয়েটার নাম বলল সে-মুহূর্তে বুঝে ফেললাম যে মেয়েটি একজন মুর।

লিখলাম চিঠিটা। খুব বেশি ঝামেলা হল না। কিন্তু রেমন্ডকে আমি খুশি করতে চাইছিলাম যেহেতু ওকে অখুশি করার কোনো কারণ নেই। তারপর আমি কী লিখছি তা পড়লাম। সিগারেট টানতে টানতে এবং মাথা নাড়তে নাড়তে শুনল সে। ‘দয়া করে আবার পড়ো’, বলল সে। মনে হল সে খুশি হয়েছে। ‘আহ্ এই তো চাই।’ জিভ দিয়ে শব্দ করল সে। আরে ইয়ার তোমার তো দারুণ বুদ্ধি, কত ধানে কত চাল তা দেখি তুমি জানো।

‘ইয়ার’ শব্দটি প্রথমে খেয়াল করেনি। সেটা খেয়াল করলাম তখন, যখন সে আমার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ‘এখন থেকে আমরা বন্ধু, কী বলো?’ চুপ করে রইলাম। কথাটা আবার বলল সে। অবশ্য এতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু যখন সে কথাটার উপর জোর দিল তখন মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ’।

চিঠিটা সে খামে পুরল এবং আমরা মদ শেষ করলাম। তারপর নিঃশব্দে আমরা কয়েক মিনিট সিগ্রেট টানলাম। রাস্তা বেশ শান্ত, খালি কখনও কখনও দুএকটা গাড়ি চলে যাওয়ার শব্দ। অবশেষে বললাম, রাত হয়ে যাচ্ছে। রেমন্ডও তা স্বীকার করল। ‘আজকের বিকেলটা বেশ দ্রুত কেটে গেল’, যোগ করল সে, এবং একদিক থেকে কথাটা সত্যি। আমি বিছানায় যেতে চাইছিলাম যদিও মনে হচ্ছিল ওঠার কোনো শক্তি নেই। আমাকে নিশ্চয় খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, কারণ রেমন্ড বলল, ‘একজনকে অযথা বিরক্ত করা উচিত নয়।‘ প্রথমে কথাটার মানে বুঝলাম না। তখন সে জানাল আমার মায়ের মৃত্যুর খবর সে শুনেছে; যাক, বলল সে, এটা একসময়-না-একসময় ঘটতই। কথাটা আমার পছন্দ হল এবং তাকে তা জানালাম।

যখন উঠে দাঁড়ালাম তখন রেমন্ড বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে আমার করমর্দন করে বলল যে, মানুষ সবসময় একে অন্যকে বুঝতে পারে। দরজা ভেজিয়ে ল্যান্ডিঙে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। সমস্ত বাড়িটা কবরের মতো নিঃশব্দ। সিঁড়ির অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ। আমি আমার কানে রক্তের দপদপানি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাচ্ছিলাম না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তা ই শুনলাম। তারপর বুড়ো সালামানোর ঘরে তার কুকুরটা ফোঁপাতে লাগল। এবং এই ঘুমন্ত বাড়ির মাঝে শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল, অন্ধকার আর নৈঃশব্দে একটি ফুল ফুটে ওঠার মতো।

.

৪.

পুরো সপ্তাহটা বেশ ব্যস্তভাবে কাটল অফিসে। রেমন্ড একবার এসে বলে গেল যে, চিঠিটা সে ডাকে দিয়েছে। ইমানুয়েলের সঙ্গে দুবার গিয়েছিলাম সিনেমায়। পরদায় কী ঘটছে তা সে প্রায়ই বুঝতে পারে না এবং অনবরত তাকে তা বুঝিয়ে বলার অনুরোধ করে। গতকাল ছিল শনিবার এবং কথামতো মারি এল। পরনে তার চমকার লাল-শাদা ডোরাকাটা পোশাক, পায়ে স্যান্ডেল, এত সুন্দর লাগছিল যে, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল তার ছোট দৃঢ় স্তনরেখা আর তার রোদে-পোড়া মুখটাকে লাগছিল বেগুনি বাদামি রঙের ফুলের মতো। বাসে করে, আলজিয়ার্স থেকে কয়েক মাইল দূরে এক পরিচিত সৈকতে গেলাম আমরা। দুপাশে ছোট টিলার মাঝে বালির একটা টুকরো যেন, জলের ধার-ঘেঁষে পেছনে নল-খাগড়ার ঝোঁপ। গরম লাগছিল না তেমন আর পানিটাও ছিল কুসুম কুসুম। ছোট ছোট ঢেউগুলি অলসভাবে হামাগুড়ি খাচ্ছিল বালির ওপর।

মারি আমাকে নতুন এক খেলা শেখাল। খেলাটা হল, সাঁতার কাটার সময়, ঢেউ থেকে ফেনাটা মুখে নেয়া এবং মুখভরতি ফেনা নিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কুলকুচা করা। পানিটা শূন্যে কেমন একটা আবছায়া ভাব সৃষ্টি করত, নয়তো উষ্ণ প্রস্রবণের স্রোতের মতো মুখে এসে পড়ত। কিন্তু শীঘ্রই নুনের জন্যে আমার মুখ জ্বালা করতে লাগল; তারপর মারি এসে জলের ভিতর আলিঙ্গন করে আমায় চুমো খেল। তার জিভ শীতল করে তুলল আমার ঠোঁট এবং সাঁতরে তীরে ফেরার আগে মিনিট দুএক ঢেউগুলিকে খেলা করতে দিলাম আমাদের নিয়ে।

কাপড় পরা হলে পরিপূর্ণ চোখে মারি তাকাল আমার দিকে। জ্বলজ্বল করছিল তার চোখ। চুমো খেলাম তাকে; তারপর বেশ কিছুক্ষণ আমরা কেউ কথা বললাম না। মারির কোমর জড়িয়ে এগোতে লাগলাম। দুজনই ব্যস্ত ছিলাম বাস পরার জন্যে। এবং বাসায় ফিরে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে। আমি আমার জানালা খুলে রেখেছিলাম, এবং খুব আরাম লাগছিল যখন অনুভব করলাম আমাদের সূর্যস্নাত শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া।

মারি জানাল, আগামীকাল সকালে তার কোনো কাজ নেই, সুতরাং দুপুরের খাবারটা আমার সঙ্গেই সারার প্রস্তাব করলাম। রাজি হল সে, এবং আমি নিচে নেমে গেলাম কিছু মাংস কিনতে। ফেরার সময় রেমন্ডের ঘরে এক মেয়ের গলা শুনলাম। কিছুক্ষণ পর বুড়ো সালামানো শুরু করল তার কুকুরের ওপর হম্বিতম্বি এবং খানিক পরই কাঠের সিঁড়িতে বুট এবং থাবার শব্দ, তারপর ‘নোংরা জানোয়ার! চল ব্যাটা খেকি কুত্তা। তারা দুজনই বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। মারিকে বুড়োর এই অভ্যাসের কথা জানালাম এবং তা শুনে সে হাসল। পরনে তার আমার একটা পাজামা সুট এবং জামার হাতা গোটানো। সে যখন হাসল তখন আমি তাকে আবার চাইলাম। খানিক পর সে আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে ভালোবাসি কি না। বললাম, এরকম প্রশ্নের সত্যিই কোনো মানে হয় না; তবে আমার মনে হয় না তাকে আমি ভালোবাসি। একথা শুনে সে কিছুক্ষণের জন্যে মুখভার করে রইল। কিন্তু যখন আমরা দুপুরের খাবার ঠিক করছিলাম তখন সে আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং হাসতে শুরু করল। সে যখন হাসে তখন তাকে আমার চুমো খেতে ইচ্ছে করে। আর ঠিক তখন রেমন্ডের ঘরে শুরু হল চাচামেচি।

প্রথমে শুনলাম গলা চড়িয়ে উত্তপ্তস্বরে একটি মেয়ে যেন কী বলল; তারপর রেমন্ডের তর্জনগর্জন, তুই আমাকে অপমান করেছিস্ কুত্তি। এর শোধ কীভাবে নিতে হয় তা তোকে শেখাচ্ছি। ধুপধাপ কিছু আওয়াজ শোনা গেল, তারপর এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ-এ-ধরনের চিৎকার মানুষের রক্ত হিম করে দেয়–কিছুক্ষণের মধ্যে ল্যান্ডিঙে ভিড় জমে গেল। মারি এবং আমি বের হলাম দেখতে। মেয়েটা তখনও চাঁচাচ্ছিল এবং রেমন্ড তখনও তাকে পেটাচ্ছিল। মারি বলল, ব্যাপারটা কি বীভৎস নয়? উত্তরে কিছুই বললাম না। তারপর সে আমায় বললে পুলিশ ডেকে আনতে, কিন্তু আমি জানালাম, পুলিশ আমি মোটেই পছন্দ করি না। যাহোক, একজন এল অবশেষে, তার সঙ্গে দোতলার বাসিন্দা এক মিস্ত্রি। দরোজায় টোকা পড়তেই ভেতরের হৈচৈ থেমে গেল। আবার সে টোকা দিল, কয়েক মুহূর্ত পর মেয়েটা ফের কান্না শুরু করল এবং রেমন্ড খুলে দিল দরজা। ঠোঁটে তার আলগোছে ধরা একটা সিগারেট, মুখে পাঞ্জু হাসি। তোমার নাম?’ নিজের নাম বলল রেমন্ড। আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মুখের সিগারেট নামাও।’ বিরক্তির সঙ্গে বলল পুলিশটা। ইতস্তত করল রেমন্ড, তাকাল আমার দিকে এবং সিগারেট মুখেই রাখল। পুলিশটা নিপুণভাবে তার বা চোয়ালে ঘুসি চালাল। সিগারেটটা তার ঠোঁট থেকে ছিটকে গিয়ে পড়ল কয়েক গজ দূরে। বিনীতভাবে তারপর সে জিজ্ঞেস করল, সিগারেটটা কি সে মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিতে পারে? অফিসারটি বলল, ‘নাও’, এবং যোগ করল, ‘খেয়াল রেখো, এরপর এধরনের কোনোকিছু সহ্য করতে আর আমরা রাজি নই, বিশেষ করে তোমার মতো ব্যাটাচ্ছলে থেকে।‘

মেয়েটা ইতিমধ্যে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিল, ‘কাপুরুষটা আমায় মেরেছে। বেশ্যার একটা দালাল।’

‘মাপ করবেন অফিসার’, বলল রেমন্ড, ‘আইনে কি আছে যে সাক্ষীদের সামনে একটি লোককে বেশ্যার দালাল বলা যেতে পারে?

পুলিশ তাকে তার ‘রকবাজি’ থামাতে বলল।

রেমন্ড তখন মেয়েটার দিকে ফিরে বলল, ‘কিছু ভেবো না সজনী, আবার দেখা হবে।‘

‘ব্যস, যথেষ্ট’, বলল পুলিশটি এবং মেয়েটিকে সেখান থেকে চলে যেতে হুকুম করল। যতক্ষণ থানা থেকে সমন না আসছে ততক্ষণ রেমন্ডকে ঘরে থাকতে হবে। ‘তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।’ বলল পুলিশটি, ‘এত কী টেনেছ যে দাঁড়াতেও পারছ না! কী ব্যাপার, টলছ কেন এত?’ রেমন্ড বলল, ‘টানিনি। যখন দেখি আপনাদের কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তখন কাঁপতেই হয়। সেটাই স্বাভাবিক।‘

তারপর সে দরজা বন্ধ করল এবং আমরা সবাই চলে এলাম। মারি আর আমি আমাদের দুপুরের খাবার ঠিক করলাম। কিন্তু তার খিদে ছিল না তাই প্রায় পুরোটাই আমি খেলাম। একটার সময় সে চলে গেল এবং তারপর আমি খানিকক্ষণ ঘুমোলাম।

তিনটের সময় দরজায় টোকা, রেমন্ড ঢুকল ভেতরে। বসল সে আমার খাটের কোনায় এবং দুএক মিনিট কিছু বলল না। কীভাবে সব হল, জিজ্ঞেস করলাম তাকে। বলল সে, পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে বেশ মসৃণ গতিতেই কাজ এগোচ্ছিল; কিন্তু মেয়েটা যখন তাকে চড় মারল এবং চোখে সে সর্ষেফুল দেখতে পেল, ঠিক তখনই মেয়েটাকে ধরে সে পেটাতে লাগল। তার পরের ঘটনা। আমাকে বলার কোনো দরকার নেই। কারণ তখন আমি ছিলাম সেখানে।

‘ভালো’, বললাম আমি, ‘তুমি তাকে একচোট নিয়েছ এবং তোমার ইচ্ছেও ছিল তা-ই, ঠিক না?’

একমত হল সে এবং বোঝাল, পুলিশ যা-ই করুক না কেন তার শাস্তি সে। পেয়েছে। পুলিশের কথা ধরলে, তাদের কীভাবে ঢিট করতে হয় তা তার ভালো জানা আছে। কিন্তু সে জানতে চাইল, পুলিশ যখন তাকে ঘুসি মেরেছিল তখন কি আমি ভেবেছিলাম যে বিনিময়ে সেও একটা মারবে।

আমি তাকে বললাম যে আমি কিছুই ভাবিনি এবং পুলিশের ব্যাপারে মাথা ঘামাতেও আদৌ রাজি নই। মনে হল সন্তুষ্ট হয়েছে রেমন্ড। জিজ্ঞেস করল, আমি তার সঙ্গে বেড়াতে যাব কি না। বিছানা ছেড়ে উঠে আমি চুল আঁচড়াতে লাগলাম। তারপর রেমন্ড বলল, সে যা চায় তা হল আমি যেন তার হয়ে সাক্ষী দিই। জানালাম, আমার কোনো আপত্তি নেই; তবে আমি বুঝতে পারছি না তার হয়ে আমাকে কী বলতে হবে।

‘এ তো সামান্য ব্যাপার’, উত্তর দিল সে, তোমাকে শুধু তাদের বলতে হবে যে মেয়েটা আমাকে অপমান করেছিল।

সুতরাং আমি তার সাক্ষী হতে রাজি হলাম।

একসঙ্গে বেরুলাম আমরা এবং রেমন্ড এক কাফেতে আমাকে ব্রান্ডি খাওয়াল। তারপর এক গেম বিলিয়ার্ড খেলোম আমরা; খেলাটা বেশ জমেছিল এবং মাত্র কয়েক পয়েন্টে হারলাম। তারপর সে প্রস্তাব করল বেশ্যালয়ে যাওয়ার। কিন্তু আমি আপত্তি জানালাম; আমার ইচ্ছে করছিল না। আস্তে আস্তে হেঁটে যখন আমরা ফিরছিলাম তখন সে বলল, তার রক্ষিতাকে একচোট নিতে পারায় সে খুব সন্তুষ্ট হয়েছে। নিজেকে সে অত্যন্ত আন্তরিক করে তুলল আমার কাছে এবং আমাদের বেড়ানোটা আমি বেশ উপভোগ করলাম। বাসার কাছে যখন এলাম তখন দেখি বুড়ো সালামানো দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাকে। দেখলাম তার কুকুরটা নেই তার সঙ্গে। লাটুর মতো ঘুরে ঘুরে সে দেখছিল চারদিক এবং মাঝে মাঝে রক্তিম চোখ নিয়ে তাকাচ্ছিল হলঘরের অন্ধকারের দিকে। এবং তারপর বিড়বিড় করে পায়চারি করছিল রাস্তায়।

রেমন্ড ব্যাপারটা জানতে চাইল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর পেল না। তারপর শুনলাম, ঘোঁতঘোঁত করে সে বলছে, ‘জারজ নোংরা জানোয়ার!’ যখন জিজ্ঞেস করলাম তার কুকুরটা কোথায় তখন ভ্রুকুটি করে সে আমার দিকে তাকাল এবং রুক্ষস্বরে বলে উঠল, ‘চলে গেছে!’ খানিক পর হঠাৎ করে সে সব বলতে লাগল।

‘যথারীতি আমি তাকে প্যারেড গ্রাউন্ডে নিয়ে গেছিলাম। আজ এক মেলা বসার দরুন সেখানে দারুণ ভিড় হয়েছিল। এত ভিড় যে চলাফেরা করাই মুশকিল। আমি এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম হাতবন্ধ রাজাকে দেখতে। তারপর যখন আবার রওনা হব তখন দেখি কুকুরটা উধাও। ভাবছিলাম ছোট্ট একটা কলার কিনব কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি ব্যাটা এভাবে কলারের ফাঁক দিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে।‘

রেমন্ড তাকে আশ্বাস দিল যে কুকুরটি পথ খুঁজে ফিরে আসবে এবং তাকে সে সেইসব কুকুরের গল্প শোনাল যারা মাইলের পর মাইল হেঁটে ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ মনিবের কাছে। কিন্তু এসব শুনে মনে হল বুড়োটা আরও চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

‘বুঝতে পারছ না, তাকে তো মেরে ফেলবে; মানে পুলিশের কথা বলছি। আর ঐ ঘেয়ো কুকুরটাকে নিয়ে গিয়ে কেউ যত্নআত্তি করবে তাও তো মনে হয় না।’

আমি তাকে জানালাম, পুলিশস্টেশনে একটি খোয়াড় আছে। সেখানে সব হারানো কুকুর নিয়ে রাখা হয়। তার কুকুর নিশ্চয় আছে সেখানে। কিছু জরিমানা দিলেই তারা কুকুর দিয়ে দেবে। জিজ্ঞেস করল সে, কত জরিমানা দিতে হবে। কিন্তু আমি তা বলতে পারলাম না। সে আবার রেগে গেল। ‘ঐ হতচ্ছাড়া কুত্তাটার জন্যে বুঝি আমি টাকা দেব? মোটেই না। তাকে মেরে ফেললেই আমি খুশি হব।’ অতঃপর কুকুরটাকে সে তার পুরনো গালিগালাজ শুরু করল।

রেমন্ড হেসে ঢুকে পড়ল হলে। দোতলা পর্যন্ত আমি অনুসরণ করলাম তাকে এবং ল্যান্ডিঙের কাছে এসে আলাদা হলাম দুজনে। মিনিট দুএক পর সিঁড়িতে শোনা গেল সালামানোর পদশব্দ। তারপর আমার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ।

আমি যখন দরজা খুলোম তখন সে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত।

‘মাপ করো… আমি বোধহয় তোমাকে বিরক্ত করছি না।’

ভিতরে আসতে বললাম তাকে, কিন্তু সে মাথা নাড়ল। সে তাকিয়ে ছিল তার পায়ের দিকে এবং শিরাবহুল হাতটা তার কাঁপছিল। আমার চোখ এড়িয়ে সে বলতে লাগল :

‘তারা নিশ্চয় আমার কাছ থেকে তাকে নিয়ে যাবে না, তাই না সঁসিয়ে মারসো? নিশ্চয় তারা ও-ধরনের কোনো কাজ করবে না। যদি তারা তা করে তবে আমার যে কী হবে তা আমি ভাবতেও পারছি না।’

তাকে বললাম, যদুর জানি, হারানো কুকুর তারা তিনদিন খোয়াড়ে রাখে তাদের মনিবদের জন্য। তারপর তাদের ইচ্ছেমতো কুকুরগুলির ব্যবস্থা করে।

একমুহূর্ত নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘শুভরাত্রি’। তারপর বেশ কিছুক্ষণ তার ঘরে পায়চারির আওয়াজ পেলাম। এরপর তার বিছানার শব্দ। দেয়ালের ওপাশ থেকে শোনা গেল ফোঁপানির আওয়াজ। অনুমান করলাম, সে কাঁদছে। কী কারণে জানি না, হঠাৎ আমি আমার মার কথা ভাবতে লাগলাম, কিন্তু আগামীকাল আমাকে উঠতে হবে খুব ভোরে, এবং খিদে যেহেতু ছিল না, সেহেত খাবার না-খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

.

৫.

অফিসে টেলিফোন করল রেমন্ড। তার এক বন্ধুর কাছে আমার কথা বলেছিল সে, জানাল রেমন্ড, এবং সেই বন্ধু আলজিয়ার্সের বাইরে সমুদ্রতীরে তার ছোট বাংলোয় আমাকে আগামী রোববারটা কাটাতে নিমন্ত্রণ করেছে। জানালাম আমি, যেতে পারলে খুবই খুশি হতাম, কিন্তু একটি মেয়েকে কথা দিয়েছি রোববারটা তার সঙ্গে কাটাব বলে। সঙ্গে সঙ্গে রেমন্ড জানাল, তাকে নিয়ে এলেও ক্ষতি নেই। আসলে মেয়েটিকে নিয়ে এলে তার বন্ধুর বউ খুবই খুশি হবে, পুরুষদের পার্টিতে একা মেয়ে না-হওয়ার জন্যে।

তখুনি আমি ফোনটা রেখে দিতে চাচ্ছিলাম। কারণ, আমার কর্তা ব্যক্তিগত আলাপের জন্যে অফিসের ফোন ব্যবহার করা পছন্দ করেন না। কিন্তু রেমন্ড আমায় ধরে রাখতে বলল; আমাকে আরও কিছু তার বলার আছে এবং সেজন্যেই আসলে টেলিফোন করা, নয়তো নিমন্ত্রণটা পৌঁছে দেয়ার জন্যে বিকেল পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারত। ব্যাপারটা হল, বলল সে, সকাল থেকে কয়েকটা আরব আমাকে অনুসরণ করছে। তার মধ্যে সে-মেয়েটির ভাইও আছে যার সঙ্গে আমার। একচোট হয়ে গিয়েছিল। বাসায় ফিরে যদি তাকে তুমি বাসার সামনে ঘোরাফেরা করতে দ্যাখো, তা হলে আমাকে জানিয়ো।’

বললাম, ঠিক আছে।

আর ঠিক ঐ সময়ই কর্তা আমাকে ডেকে পাঠালেন। অল্পক্ষণের জন্যে অস্বস্তি লাগল, কারণ মনে হল, তিনি আমায় ডেকে বলবেন বন্ধুর সঙ্গে গালগল্প করে অযথা সময় নষ্ট না করে নিজের কাজ করতে। যাহোক, সেরকম কিছুই হল না। একটি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করার জন্যে তিনি আমায় ডেকেছিলেন, কারণ তিনি নিজে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলেন না। পরিকল্পনাটা হল, ডাকের ঝামেলা এড়িয়ে, বড় বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে তাৎক্ষণিক লেনদেনের জন্যে প্যারিসে একটা শাখা খোলা হবে এবং তিনি জানতে চান, আমি সেখানে কাজ করব কি না।

‘তোমার বয়স কম’, বললেন তিনি, ‘এবং আমি নিশ্চিত যে প্যারিসে তুমি চমৎকারভাবে দিন কাটাতে পারবে। তা ছাড়া বছরের কয়েক মাস তো ফ্রান্সের এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে পারছই।’

বললাম, যেতে আমার বিশেষ কোনো আপত্তি নেই, তবে সত্যি বলতে কি আমাকে পাঠানো হোক বা না-হোক তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

তারপর তিনি, জীবন বদলানো, কথাটাকে ওভাবেই বললেন তিনি, কি আমার কাছে কোনো আবেদন সৃষ্টি করে না। উত্তরে বললাম, কেউ কারো সত্যিকার জীবন বদলাতে পারে না; যাহোক, এক জীবন আরেক জীবনের মতোই ভালো এবং আমার বর্তমান চমৎকারভাবে খাপ খাচ্ছে আমার সঙ্গে।

এতে মনে হল, তিনি ক্ষুব্ধ হলেন এবং বললেন, আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি না এবং কোনো উচ্চাশাও নেই আমার, যা তার মতে অতি মারাত্মক দোষ, বিশেষ করে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে।

নিজের কাজে ফিরে এলাম। তাকে অসন্তুষ্ট করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই, কিন্তু জীবন-বদলাবার’ কোনো কারণও খুঁজে পেলাম না। আমার বর্তমান জীবন মোটেই অসুখী নয়। তিনি যে-ধরনের উচ্চাশার কথা বলেছিলেন, ছাত্র থাকাকালীন সে-ধরনের প্রচুর উচ্চাশা আমার ছিল। কিন্তু পড়াশোনায় যখন ইস্তফা দিতে হল তখন শীঘ্রই বুঝলাম এ সবকিছুই নিরর্থক।

মারি সেদিন বিকেলে এসে আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে বিয়ে করব কি না। জানালাম, আমার কোনো আপত্তি নেই; বিয়েতে সে যদি এতই ইচ্ছুক হয় তা হলে আমরা বিয়ে করব।

তখন সে আবার আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি তাকে ভালোবাসি কি না। প্রায় আগের মতোই আমি উত্তর দিলাম, তার প্রশ্নের সত্যিই কোনো মানে হয় না– তবে আমার মনে হয় তাকে আমি ভালোবাসি না।

‘তুমি যদি তাই মনে করো’, বলল সে, ‘তবে আমায় বিয়ে করছ কেন?’

বললাম, এর কোনো গুরুত্ব নেই। তবে বিয়েটা যদি তাকে আনন্দ দেয় তা হলে এক্ষুনি আমরা বিয়ে করতে পারি। তাকে জানালাম, প্রস্তাবটা তার কাছ থেকেই এসেছে; আমার কথা ধরলে আমি শুধু বলব ‘হ্যাঁ।‘

তখন সে বলল, বিয়েটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার।

উত্তরে আমি বললাম : ‘না’।

তারপর সে নিঃশব্দে বিচিত্র দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। এবং খানিক পর জিজ্ঞেস করল :

‘আরেকটি মেয়ে এসে যদি তোমাকে বিয়ে করতে বলে তাকে, মানে, এমন একটি মেয়ে যাকে তুমি আমার মতোই পছন্দ করো তা হলে কি তুমি “হাঁ” বলবে?’

‘স্বাভাবিকভাবেই।‘

তখন সে বলল, ভেবে সে অবাক হচ্ছে সত্যিই কি সে আমাকে ভালোবাসে, না বাসে না। আমার পক্ষে এ-ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা সম্ভব ছিল না। তারপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে ‘আমি যে এক অদ্ভুত লোক’ সে-সম্পর্কে সে কিছু বলল। বলতে বাধ্য হচ্ছি যে সেজন্যই আমি তোমাকে ভালোবাসি’, বলল সে, কিন্তু একদিন এজন্যেই বোধহয় তোমাকে ঘৃণা করা শুরু করব।’

এর উত্তরে আমার আর কিছুই বলার ছিল না, সুতরাং আমি কিছুই বললাম না।

কিছুক্ষণ চিন্তা করল মারি। তারপর হাসতে শুরু করল এবং আমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, সে অত্যন্ত আন্তরিক; সত্যিই সে আমাকে বিয়ে করতে চায়।

‘ঠিক আছে’, বললাম আমি, ‘তুমি যে-সময় বলবে সে-সময়ই আমাদের বিয়ে হবে।’ তারপর আমার কর্তা আমাকে যে-প্রস্তাব জানিয়েছেন মারিকে তা বললাম। এবং মারি জানাল, প্যারিস যেতে পারলে সে খুবই খুশি হবে।

আমি যখন তাকে জানালাম, প্যারিসে আমি কিছুদিন ছিলাম তখন সে জিজ্ঞেস করল, শহরটা দেখতে কেমন। শহরটা ঘিঞ্জি বলেই তো আমার মনে হয়। বিষণ্ণ প্রাঙ্গণ এবং অসংখ্য কবুতর। লোকগুলোর মুখ ফ্যাকাশে যেন সবাই ব্যর্থ হয়েছে সব কাজে।

তারপর শহরের মাঝ দিয়ে যে সদর রাস্তা চলে গেছে সে-রাস্তা ধরে আমরা বেড়াতে বের হলাম। মহিলারা বেশ সেয়ানা এবং মারিকে জিজ্ঞেস করলাম এটা সে লক্ষ করেছে কি না। হ্যাঁ, বলল সে, আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি তা সে বুঝেছে। এরপর কয়েক মিনিট আমরা কোনো কথা বললাম না। যাহোক, আমি চাচ্ছিলাম না মারি আমাকে এখন ছেড়ে যাক। তাই প্রস্তাব করলাম, সেলেস্তের রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে। আমার সঙ্গে খেতে পারলে খুবই খুশি হত সে, জানাল মারি, কিন্তু আগে থেকেই বিকেলে তার প্রোগ্রাম করা আছে। আমরা প্রায় আমার বাসার কাছাকাছি এলে আমি বললাম; তা হলে বিদায়!

আমার চোখে চোখ রাখল সে।

তুমি কি জানতে চাও না আজ বিকেলে আমি কী করছি?

জানতে চাচ্ছিলাম না আমি এবং সেটা তাকে জিজ্ঞেস করতেও আমার মনে ছিল না, কিন্তু মনে হল এজন্যে বুঝি মারি অভিযোগ জানাচ্ছে। নিশ্চয় আমাকে অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল কারণ হঠাৎ সে হাসতে শুরু করল এবং আমার দিকে নুয়ে চুমোর জন্যে ঠোঁট বাড়িয়ে দিল।

সেলেস্তের ওখানে আমি একাই গেলাম। তখন মাত্র আমি খাবারে হাত দিয়েছি। এমন সময় কুৎসিত ছোটখাটো এক মহিলা এসে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি আমার টেবিলে বসতে পারেন কি না। নিশ্চয় পারেন। মুখ তার গোলগাল, পাকা আপেলের মতো। উজ্জ্বল চোখ, এবং চলাফেরা করছিলেন তিনি অদ্ভুত এক লাফানোর ভঙ্গিতে, যেন দাঁড়িয়ে আছেন তারের ওপর। নিজের আঁটসাট জ্যাকেটটা খুলে তিনি বসে মনোযোগের সঙ্গে খাবারের দাম দেখছিলেন। তারপর সেলেস্তেকে ডেকে অর্ডার দিলেন বেশ দ্রুতভাবে, কিন্তু পরিষ্কার করে; প্রত্যেকটি শব্দ বোঝা যায় মতো। হর্স দ্য অভরের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে তিনি তার ব্যাগ খুলে একটা পেনসিল আর একটুকরো কাগজ বের করে খাবারের দাম হিসেব করলেন। তারপর আবার ব্যাগ হাতড়িয়ে ছোট একটি পার্স বের করে নির্দিষ্ট দামের সঙ্গে অল্পকিছু বখশিশ যোগ করে রাখলেন নিজের সামনে কাপড়ে।

ঠিক তখুনি ওয়েটার ‘হর্স দ্য অভর’ এনে হাজির করলে মহিলা প্রায় নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত ভঙ্গিতে তা খেতে শুরু করলেন। তারপর দ্বিতীয় পদের জন্যে অপেক্ষা করার সময় আরেকটা পেনসিল, এবারেরটা নীল রঙের এবং সামনের সপ্তাহের একটা রেডিও ম্যাগাজিন বের করে প্রতিদিনের প্রায় প্রতিটি প্রোগ্রামের পাশে দাগ দিতে লাগলেন। ম্যাগাজিনে প্রায় ডজনখানেক পৃষ্ঠা ছিল এবং খাবারের পুরোটা সময় তিনি তা দেখলেন অতীব মনোযোগের সঙ্গে। আমি যখন আমার খাবার শেষ করলাম তখনও তিনি সেই অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে দাগ দিয়ে চলেছেন। তারপর উঠলেন, ঠিক আগের মতোই রোবটের ভঙ্গিমায় জ্যাকেট গলিয়ে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।

কিছুই করার ছিল না বলে আমি তাকে খানিকটা পথ অনুসরণ করলাম। ফুটপাতের ধার ঘেঁষে সোজা তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন, পিছন না-ফিরে, কোনো দিকে না-তাকিয়ে এবং ছোটখাটো আকার সত্ত্বেও যেরকম দ্রুতভাবে তিনি হাঁটছলেন তা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। আসলে তার গতির সঙ্গে আমি তাল রাখতে পারছিলাম না এবং শীঘ্রই আমি তাঁকে হারিয়ে ফেললাম। তাই ফিরে বাসার দিকে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণের জন্যে এই ‘ছোট রোবট’ (তাঁকে দেখে আমার তা-ই মনে হয়েছিল) আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু শীঘ্রই আমি তার কথা ভুলে গেলাম।

যখন আমি আমার ঘরের দিকে এগোচ্ছি তখন দেখা হল সালামানোর সঙ্গে। আমি তাকে ঘরে আসতে বললাম এবং সে জানাল তার কুকুরটা নিশ্চয় হারিয়ে গেছে। সে গিয়েছিল খোয়াড়ে খোঁজ নিতে কিন্তু ওখানে কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি এবং কর্মচারীরা জানিয়েছে, কুকুরটা বোধহয় মারা পড়েছে রাস্তায়। যখন সে জিজ্ঞেস করল, থানাতে খোঁজ নিলে কোনো লাভ হবে কি না তখন তারা জানাল, রাস্তার কুকুর মারা পড়ল কি পড়ল না তার খোঁজ রাখার চেয়েও জরুরি কাজ তাদের করতে হয়। আমি প্রস্তাব করলাম আরেকটি নতুন কুকুর আনতে। কিন্তু যুক্তিসহ সালামানো বোঝাল এটার সঙ্গে থাকতে থাকতে সে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল; আর নতুন একটা আনলেও ঠিক আগের মতো হবে না।

আমি আমার বিছানায় বসেছিলাম পা তুলে আর সালামানো বসেছিল টেবিলের পাশে হাঁটুতে হাত রেখে। তার জীর্ণ ফেল্টহ্যাটটা ছিল তার কাছেই এবং ধুলোটে ও হলদেটে গোঁফের আড়ালে সে বিড়বিড় করছিল। আমার কাছে বিরক্তিকর লাগছিল তার সান্নিধ্য, কিন্তু কিছুই করার ছিল না এবং ঘুমও আসছিল না। সুতরাং কথোপকথন চালিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি তাকে তার কুকুর সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম–কতদিন কুকুরটা তার কাছে ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। বলল সে, তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরই কুকুরটা পেয়েছিল সে। বিয়ে করেছিল সে বেশ বয়সে। যুবক থাকাকালীন সে চেয়েছিল অভিনেতা হতে; সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার সময় প্রায়ই সে সৈন্যদের মঞ্চে অভিনয় করত এবং অভিনয় মোটামুটি ভালোই করত, অন্তত লোকে তা-ই বলত। শেষে সে চাকরি নিয়েছিল রেলওয়েতে এবং সেজন্যে তার মনে কোনো আক্ষেপ নেই, কারণ এ-চাকরির জন্যেই সে এখন ছোটখাটো একটা পেনশন পাচ্ছে। স্ত্রীর সঙ্গে বনাবনি তার ছিল না, কিন্তু তারা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল একে অন্যের সঙ্গে থাকতে এবং স্ত্রী মারা গেলে সে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকে। তার রেলওয়ের এক বন্ধুর কুকুরের কয়েকটা বাচ্চা হওয়াতে সে তাকে একটি বাচ্চা দিতে। চেয়েছিল এবং সঙ্গী হিসেবে তখন সে তা গ্রহণ করেছিল। প্রথমে সে বাচ্চাটাকে বোতলে করে দুধ খাওয়াত। কিন্তু মানুষের চাইতে কুকুরের জীবন ছোট, তাই বলতে গেলে তারা বুড়ো হয়ে গিয়েছিল একসঙ্গে।

‘কুকুরটা ছিল বদমেজাজি’, বলল সালামানো, ‘যখন-তখন আমাদের মধ্যে একচোট হয়ে যেত, কিন্তু তবুও বদমাশটা ছিল ভালো।’ বললাম, কুকুরটাকে দেখে বেশ ভালো জাতের মনে হত এবং একথা বুড়োকে বেশ সন্তুষ্ট করল।

‘আহ্, তার অসুখের আগে তাকে দেখা তোমার উচিত ছিল’, বলল সে, ‘যা চমৎকার পশম ছিল ওর এবং ঐটেই ছিল দেখার জিনিস। অনেক চেষ্টা করেছি তাকে ভালো করতে। চর্মরোগ হওয়ার পর প্রতিরাতে তার চামড়ায় আমি মলম লাগাতাম। কিন্তু আসল কথা হল বয়স এবং তার কোনো ওষুধ নেই।’

ঠিক সে-সময় আমি হাই তুললাম। এবং বুড়ো বলল, তার এবার ওঠা উচিত। তাকে বললাম, আরও খানিকটা সে বসতে পারে এবং তার কুকুরের ব্যাপারটার জন্যে আমি দুঃখিত। ধন্যবাদ জানিয়ে সালামানো জানাল, আমার মা কুকুরটাকে খুব পছন্দ করতেন। মাকে সে ‘তোমার বেচারি মা’ বলে উল্লেখ করল এবং বলল তাঁর মৃত্যু নিশ্চয় আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। আমি যখন বললাম, না, তখন সে খানিকটা দ্রুত এবং খানিকটা অপ্রতিভভাবে বলল, রাস্তায় কিছু লোক আমার সম্পর্কে বেশ আজেবাজে কথা বলছে যেহেতু মাকে আমি আশ্রমে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে তো জানে আসল ব্যাপারটা; মা’র আমি কী দারুণ ভক্ত ছিলাম।

উত্তর দিলাম–কেন, আমি এখনও জানি না লোকদের মনে যে আমার। সম্পর্কে এরকম বাজে ধারণার সৃষ্টি হয়েছে তা আমাকে অবাক করছে। আমি যেহেতু তাঁকে এখানে রাখতে পারছিলাম না সেহেতু বাধ্য হয়েই তাঁকে আশ্রমে পাঠাতে হয়েছিল। সে যাহোক, বললাম, বহু বছর ধরে আমাকে বলার আর তার কোনো কথা ছিল না এবং আমি লক্ষ করছিলাম কথাবলার লোকের অভাবে তিনি। সদা অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন।

‘হ্যাঁ’, বলল সে, ‘আশ্রমে যে-কেউ সহজেই বন্ধু যোগাড় করে ফ্যালে।

উঠে দাঁড়াল সে। বলল, অনেক রাত হয়েছে। এখন তার ঘুমানো দরকার। এবং এই নতুন ব্যবস্থা তার জীবনে খানিকটা জটিলতার সৃষ্টি করেছে। এতদিনের পরিচয়ের মধ্যে এই প্রথম সে হাত বাড়িয়ে দিল–খানিকটা লাজুকভাবে–তাই মনে হল আমার এবং আমি তার চামড়ার কর্কশতা অনুভব করতে পারছিলাম। দরজার বাইরে পা রাখার সময় ঘুরে দাঁড়াল সে, একটু হেসে বলল : ‘আশা করি আজ রাতে কুকুরগুলি আর চাচাবে না। আমার সবসময় মনে হয় আমারটার ডাকই বোধহয় শুনছি—’

.

৬.

রোববার সকালে ওঠা যে কী কষ্টকর; মারিকে তো আমার খানিকক্ষণ নাম ধরে কাঁধ ঝাঁকাতে হল। ভোরে-ভোরেই আমরা পানিতে নামতে চাচ্ছিলাম, তাই নাশতার ঝামেলা আর করলাম না। মাথাটা আমার একটু কামড়াচ্ছিল এবং প্রথম সিগারেটের স্বাদ বিস্বাদ লাগল। মারি বলল, আমাকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শোককারীদের মতো লাগছে এবং আমার সত্যিই অবসাদ লাগছিল। মারির চুল খোলা এবং পরনে শাদা পোশাক। আমি বললাম, এ-পোশাকে তাকে দারুণ লাগছে এবং এতে সে খুশি হয়ে হাসল।

যাবার পথে ধাক্কা মারলাম রেমন্ডের জায়গায় এবং সে চিৎকার করে বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নামছে। রাস্তায় নেমে এলাম আমরা। আমার ঘরের পরদা ছিল টানা আর তা ছাড়া এ আবহাওয়ায় খানিকটা অস্বস্তিও লাগছিল, তাই সকালের সূর্য যেন মুষ্ট্যাঘাতের মতো বাড়ি মারল আমার চোখে।

মারি কিন্তু আনন্দে প্রায় নাচছিল এবং বারবার বলছিল, ‘কী চমৎকার দিন!’ কিছুক্ষণ পর ভালো লাগতে লাগল আমার এবং নিজেকে মনে হল ক্ষুধার্ত। মারিকে কথাটা জানালাম কিন্তু সে তা কানেই তুলল না। হাতে তার একটা অয়েলক্লথের ব্যাগ যার মাঝে আছে আমাদের স্নানের পোশাক আর একটা তোয়ালে। একসময় শুনলাম রেমন্ড তার ঘরের দরজা বন্ধ করল। পরনে তার নীল প্যান্ট, শাদা হাফশার্ট এবং মাথায় খড়ের টুপি। লক্ষ করলাম হাতটা তার বেশ লোমশ কিন্তু হাতের নিচের দিকটা ফরসা। খড়ের টুপি দেখে মুচকি হাসল মারি। তার পোশাকআশাক দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হল, বেশ স্ফুর্তিতেই আছে সে এবং শিস দিতে দিতে সে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। আমাকে ‘কী খবর ইয়ার’ আর মারিকে ‘মাদমায়োজেল’ বলে সম্বোধন করল সে।

আমরা থানায় গিয়েছিলাম আগের দিন বিকেলে, সেখানে রেমন্ডের হয়ে সাক্ষী দিয়ে আমি বলেছিলাম–মেয়েটা ঠকিয়েছিল রেমন্ডকে। সুতরাং তারা তাকে সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছিল। আমার বিবৃতিটাকে খতিয়েও দেখেনি।

দরোজার সামনে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর ঠিক করলাম বাসে যাব আমরা। অতি সহজে সেখানে হেঁটেও যাওয়া যায়। তবে যত তাড়াতাড়ি যেতে পারি তত ভালো। আমরা যখন বাসস্টপের দিকে এগোচ্ছি তখন রেমন্ড আমার জামার হাত ধরে টান দিয়ে বলল রাস্তার অপরদিকে তাকাতে। দেখলাম, কয়েকজন আরব দাঁড়িয়ে আছে তামাকঅলার জানলার সামনে। তারা নীরবে আমাদের দেখছিল যেন আমরা পাথরের চাঙড় বা মরা গাছ। ফিসফিস করে রেমন্ড বলল, বামদিকের দ্বিতীয় লোকটিই হল তার সেই লোক এবং মনে হল। সে বেশ চিন্তিত। যাহোক, বোঝাতে চাইল সে, এগুলি সব পুরনো ব্যাপার। মারি এ-মন্তব্যটা ধরতে পারেনি তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললে?’

ব্যাখ্যা করে বললাম, রাস্তার ওপাশের আরবগুলি রেমন্ডের ওপর খেপে আছে। মারি আমাদের সেখান থেকে জলদি চলে যাওয়ার ওপর জোর দিল। রেমন্ড তখন হাসল, কাঁধ ঝাঁকাল। ‘ভদ্রমহিলা ঠিকই বলেছেন’, বলল সে, ‘এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না।’ বাসস্টপে যাওয়ার অর্ধেক রাস্তায় পিছন ফিরে তাকাল সে এবং বলল, লোকগুলি অনুসরণ করছে না। আমিও ঘুরে তাকালাম। তারা ঠিক আগের মতোই আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিকে তাকিয়ে আছে একইভাবে।

বাসে ওঠার পর স্বস্তি পেয়ে রেমন্ড মারিকে হাসাবার জন্যে ঠাট্টা করতে লাগল। মনে হল, মারিকে তার ভালো লেগেছে। কিন্তু মারি তাকে পাত্তাই দিল না। যখন-তখন সে হাসছিল আমার চোখে চোখ রেখে।

আলজিয়ার্সের ঠিক বাইরে নামলাম আমরা। সমুদ্র বাসস্টপ থেকে খুব দূরে নয়; শুধু মালভূমির মতো একটা উঁচু জায়গা পেরুতে হয় যার ওপর থেকে দেখা যায় সমুদ্র। তার পরেই মালভূমি ঢালু হয়ে মিশে গেছে বালিতে। এখানকার জমি ভরা। বন্য লিলি আর হলদে নুড়িতে। নীল আকাশের পাশে বন্য লিলিগুলিকে লাগছিল শাদা। তুষারের মতো। গরমের দিনে আকাশটা যেভাবে ঝলসায় ঠিক সেভাবে ঝলসাচ্ছিল। মারি ফুলগুলির ওপর ব্যাগ দুলিয়ে বেশ আনন্দ পাচ্ছিল আর ফুলের পাপড়িগুলি ব্যাগের বাড়ি খেয়ে ছিটকে পড়ছিল চারদিকে। তারপর আমরা দুপাশে সবুজ বা শাদা খুঁটির বেড় দেয়া, কাঠের ব্যালকনিসুদ্ধ ছোট ছোট বাড়ির মাঝ দিয়ে হেঁটে এলাম। কিছু আবার ঝাউঝোঁপের আড়ালে আধা-লুকানো। আমরা সে-সারি পেরুতে-না পেরুতে সমুদ্র পুরো শরীর নিয়ে দেখা দিল; কাঁচের মতো মসৃণ হয়ে পড়েছিল সমুদ্র; কিছুদূরে একটা বড় অন্তরীপ বেরিয়ে এসেছে তার কালো ছায়া নিয়ে। মৃদু বাতাসে ভেসে আসছিল একটা মোটর-এঞ্জিনের অস্পষ্ট গুঞ্জন এবং দেখলাম, বহুদূরে একটা জেলে-নৌকা অতীন্দ্রিয়ভাবে সেই ঝলসানো মসৃণতার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। মারি কিছু ছোট নুড়ি কুড়োল। সমুদ্রে যাবার ঢালুপথ ধরে নামবার সময় দেখলাম সৈকতে ইতোমধ্যে বেশকিছু মানার্থী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে।

সৈকতের প্রায় শেষ মাথায় রেমন্ডের বন্ধুর নিজের কাঠের বাড়ি। টিলার কোলে বাংলোটি, সামনের দিকটা স্থাপিত কাঠের স্তম্ভের ওপর, সমুদ্রের জল স্পর্শ করছিল তখন যেখানে। রেমন্ড তার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল আমাদের। নাম তার ম্যাসন। কাধ তার প্রশস্ত, দেখতে সে লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। বউ তার মোটাসোটা ছোটখাটো এক হাসিখুশি মহিলা, কথা বলেন প্যারিসীয় ঢঙে।

ম্যাসন তক্ষুনি তার বাড়িকে নিজের বাড়ি মনে করে নিতে বলল। বলল সে, সকালে উঠেই প্রথম সে গিয়েছিল মাছ ধরতে। আমাদের দুপুরের খাবারে মাছভাজা থাকবে। আমি তার ছোট বাংলোটার জন্যে তাকে অভিনন্দন জানালাম এবং বলল সে, তার সপ্তাহান্ত এবং ছুটিছাটা এখানে কাটায়। ‘অবশ্যই বউয়ের সঙ্গে’ যোগ করল সে। আমি তার বউয়ের দিকে তাকালাম, দেখলাম মারি এবং তার মধ্যে বেশ খাতির হয়ে গেছে; কথা বলছে তারা, হাসছে। এই প্রথম। বোধহয় সিরিয়াসলি আমি চিন্তা করলাম তাকে বিয়ে করার।

ম্যাসন তখুনি সাঁতার কাটতে যেতে চাইছিল কিন্তু তার বউ বা রেমন্ডের নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। সুতরাং আমরা তিনজন মারি, আমি এবং সে সৈকতের দিকে এগোলাম। মারি সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল পানিতে কিন্তু আমি আর ম্যাসন অপেক্ষা করলাম খানিকক্ষণ। কথা বলে সে ধীরে ধীরে এবং কথার ফাঁকে ফাঁকে এবং তা ছাড়া কথাটা বলবেই সংগতি থাকুক বা না থাকুক। মারি সম্পর্কে সে বলল, সে খুব সুন্দর মেয়ে এবং তা ছাড়া মিষ্টিও।

এরপর আমি আর তার এ-ধরনের কথাবার্তার প্রতি নজর দিলাম না; নিজেকে ছেড়ে দিলাম রোদের কাছে এবং তাতেও বেশ ভালো লাগতে লাগল। পায়ের নিচে তপ্ত হয়ে উঠছিল বালি, পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য হয়ে উঠেছিলাম উগ্রীব, কিন্তু তবুও আরও মিনিট দুএক অপেক্ষা করলাম। শেষে ম্যাসনকে জিজ্ঞেস করলাম, এবার আমরা নামব কি?’ এবং ঝাঁপিয়ে পড়লাম পানিতে। ম্যাসন হাঁটতে লাগল ধীরস্থিরে এবং যখন আর থই পেল না তখন ধীরে ধীরে সাঁতার কাটা শুরু করল, সুতরাং আমি তাকে ছাড়িয়ে চলে এলাম মারির কাছে। পানিটা ঠাণ্ডা এবং সেজন্য বেশ ভালো লাগছিল। আমি আর মারি সাঁতার কাটলাম। বেশ দূর পর্যন্ত পাশাপাশি এবং আমাদের একই রকম সাঁতার কাটার ভঙ্গি দেখে ভালো লাগছিল। মনমেজাজ দুজনেরই ছিল একই রকম এবং প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছিলাম।

সাঁতারশেষে বালুতে শুয়ে পড়লাম, তাকালাম আকাশের দিকে এবং অনুভব করছিলাম সূর্য আমার ঠোঁটের গালের লবণজল শুষে নিচ্ছে। দেখলাম, ম্যাসন সাঁতার কেটে তীরে ফিরে সূর্যের নিচে শুয়ে পড়ল। দূর থেকে তাকে লাগছিল অনড় এক বিশাল তিমির মতো। তারপর মারি প্রস্তাব করল আমাদের আগুপিছু সাঁতার কাটা উচিত। মারি আগে, পিছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরেছি আমি এবং সে যখন হাত দিয়ে পানি ঠেলে সামনে এগোচ্ছিল তখন আমি পিছন থেকে পা মেরে তাকে সাহায্য করছিলাম।

জল ছিটাবার আওয়াজ এতক্ষণ ধরে কানে বাজছিল যে, মনে হল যথেষ্ট হয়েছে। সুতরাং মারিকে ছেড়ে দীর্ঘ এবং গভীর শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে ফিরে এলাম। তীরে পা ঠেকতেই ম্যাসনের পাশে বালিতে মুখ রেখে উলটো হয়ে শুয়ে পড়লাম। তাকে বললাম, জায়গাটা বেশ চমৎকার এবং সে একমত হল। একসময় ফিরে এল মারি। তাকে দেখার জন্যে মাথা তুললাম। চুল তার পিছে ঠেলে দেয়া এবং নোনাজলের জন্যে তাকে দেখাচ্ছে চকচকে। তারপর সে শুয়ে পড়ল আমার পাশে এবং সূর্য ও আমাদের শরীরের মিলিত উত্তাপের জন্যে মনে হল আমি ঘুমিয়ে পড়ব।

কিছুক্ষণ পর আমার হাত টেনে ধরে মারি বলল, ম্যাসন তার বাসায় চলে গেছে; এবং এখন নিশ্চয় দুপুরের খাবার সময়। ক্ষুধার্ত থাকায় আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম কিন্তু মারি বলল, সকাল থেকে তাকে আমি একটি চুমোও খাইনি। কথাটা আসলে ঠিক–যদিও কয়েকবার তাকে আমার চুমো খাবার ইচ্ছে হয়েছিল। চলো ফের জলে নামি’, বলল সে এবং দৌড়ে সমুদ্রে নামলাম ও ছোট ছোট ঢেউয়ের মাঝে কিছুক্ষণ চিৎ হয়ে পড়ে রইলাম।

ফিরলাম যখন, তখন দেখি ম্যাসন তার বাংলোর সিঁড়িতে বসে আমাদের ফিরে আসতে বলে চিৎকার করছে। বললাম তাকে আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত এবং সে তখুনি তার বউয়ের দিকে ফিরে বলল আমাকে তার বেশ মনে ধরেছে। রুটিটা ছিল চমৎকার আর আমার ভাগের পুরো মাছই আমি সাবাড় করলাম। তারপর আনা হল ‘স্টিক’ এবং চিপস’। খাবার সময় আমরা ছিলাম নিশ্চপ। ম্যাসন প্রচুর মদ খেল এবং যখনই আমার গ্লাস খালি হতে লাগল তখুনি সে তা পুরো করে দিতে লাগল। সবাইকে যখন কফি দেয়া হচ্ছিল তখন আমার কেমন ঝিমঝিম লাগছিল এবং আমি একটার পর একটা সিগারেট খাওয়া শুরু করলাম। ম্যাসন, আমি এবং রেমন্ড সবাই মিলে খরচা ভাগ করে পুরো আগস্ট মাসটা এখানে কাটাবার একটা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করলাম।

হঠাৎ মারি অবাক সুরে বলল, এই দ্যাখো! বলো তো কটা বাজে? মাত্র সাড়ে এগারো।

একথায় আমরা অবাক হয়ে গেলাম এবং ম্যাসন মন্তব্য করল, আমাদের খাওয়াটা খুব সকাল-সকাল হয়ে গেছে, কিন্তু যা-ই বলো লাঞ্চ হল ‘মোভেবল ফিস্ট’, যখন যার ইচ্ছে তখন সে খেল।

একথায় মারি হাসতে লাগল। জানি না কেন। মনে হল বেশ একটু টেনেছে।

তারপর ম্যাসন জিজ্ঞেস করল, সৈকতে তার সঙ্গে আমি একটু বেড়াতে বের হব কি না।

‘দুপুরের খাবারের পর আমার স্ত্রী সবসময় একটু ঘুমোবে’, বলল সে, ‘আমার আবার তা পছন্দ নয়, আমার দরকার অল্প একটু বেড়ানো। সবসময় তাকে বলে আসছি স্বাস্থ্যের জন্যে এটা ঢের উপকারী। কিন্তু স্বভাবতই সে নিজের মত আঁকড়ে থাকে।‘

মারি জানাল সে ঘরেই থাকবে এবং ধোয়ামোছায় সাহায্য করবে। ম্যাসনের বউ হাসল, বলল, ‘তা হলে সবচেয়ে প্রথম কাজ হচ্ছে পুরুষদের বের করে দেয়া।’ সুতরাং একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম আমরা তিনজন।

রোদ এখন প্রখর এবং জলের ওপর তার প্রভাব যে-কোনো লোকের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেবে। সৈকত প্রায় খালি। তীরের বাংলো থেকে খালি ছুরি-কাটা, বাসনকোসনের মৃদু শব্দ শোনা যাচ্ছে। টিলাগুলি থেকেও যেন ভাপ বেরুচ্ছে এবং বেশ কষ্ট হচ্ছে নিশ্বাস নিতে।

প্রথমে রেমন্ড এবং ম্যাসন এমন সব লোকের কথা আলোচনা করল যাদের আমি চিনি না। মনে হল তারা বেশ কিছুদিন ধরে পরস্পরের পরিচিত, এমনকি একসঙ্গে থেকেছেও কিছুদিন। জলের ধার ঘেঁষে আমরা হাঁটতে লাগলাম, যখন-তখন ঢেউ এসে আমাদের ক্যানভাসের জুতোগুলি ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কিছুই ভাবছিলাম না আমি। সূর্যের পুরো উত্তাপ আমার খালিমাথায় পড়ায় তন্দ্রালস হয়ে উঠলাম।

ঠিক তখন রেমন্ড ম্যাসনকে কিছু বলল যা আমি ধরতে পারলাম না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম দূর-সৈকতে দুজন আরব নীল পোশাক পরে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। রেমন্ডের দিকে তাকালাম এবং সে মাথা নেড়ে বলল, এই সে’। আমরা দৃঢ়ভাবে হাঁটতে লাগলাম। কীভাবে তারা আমাদের খুঁজে পেয়েছে সেকথা ভেবে ম্যাসন অবাক হল। আমার মনে হল তারা আমাদের বাসে চড়তে দেখেছিল এবং মারির স্নানের অয়েলক্লথ ব্যাগও নজরে পড়েছিল তাদের, কিন্তু কিছু বললাম না।

আরবরা যদিও হাঁটছিল আস্তে আস্তে কিন্তু তবুও তারা প্রায় চলে এসেছিল আমাদের কাছে। আমরা হাঁটার গতি পরিবর্তন করলাম না; কিন্তু রেমন্ড বলল :

‘শোনো যদি কিছু হয়, ম্যাসন তুমি দ্বিতীয়টাকে সামলিয়ো, আমার পিছনে যে লেগেছে তাকে আমি সামলাব। আর যদি আরেকটা আসে তা হলে মারসো। তুমি সামলাবে।‘

বললাম, ঠিক আছে। এবং ম্যাসন পকেটে তার হাত পুরল।

বালু আগুনের মতো গরম এবং শপথ করে বলতে পারি সবকিছু কেমন লালচে ঠেকছিল। আমাদের সঙ্গে আরবদের দূরত্ব ক্রমশ কমে আসছে। যখন আমরা মাত্র কয়েক পা দূরে তখন তারা থামল। ম্যাসন আর আমি পদক্ষেপ ধীর করলাম আর রেমন্ড সোজা এগোল তার প্রতিপক্ষের দিকে। কী বলল সে তা শুনতে পেলাম না, কিন্তু দেখলাম লোকটা মাথা নিচু করছে যেন রেমন্ডের বুকে গুতো মারবে। রেমন্ড সঙ্গে সঙ্গে চড় লাগিয়ে ম্যাসনকে ডাকল। ম্যাসন এতক্ষণ যার দিকে নজর রাখছিল তার বরাবর গিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে দুবার ঘুসি মারল। লোকটা সটান চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল এবং সেকেন্ড কয়েক চারপাশে ফেনিয়ে-ওঠা বুদবুদ নিয়ে পড়ে রইল। ইতিমধ্যে রেমন্ড বেশ করে দাবড়াচ্ছিল বাকিটাকে এবং তার মুখ ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। লোকটার ঘাড়ের ওপর দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল :

‘খালি নজর রেখো; আমি এখনও একে শেষ করিনি।’

‘সাবধান!’ চিৎকার করে বললাম, ‘ওর কাছে ছুরি আছে।’

চিৎকারটা একটু দেরিতে হয়েছে। লোকটা ইতিমধ্যে রেমন্ডের হাতে এবং মুখে ছুরি বসিয়ে দিয়েছে।

ম্যাসন লাফিয়ে এগিলে এল। অন্যজন পানি থেকে উঠে এসে দাঁড়াল ছুরি হাতে-ধরা লোকটার পিছে। নড়বার সাহস পেলাম না আমরা। আমাদের দিক থেকে নজর না সরিয়ে এবং ছুরিটা সামনে ধরে লোকদুটো আস্তে আস্তে পিছু হটতে লাগল, যখন তারা বেশ নিরাপদ দূরত্বে তখন পিছন ফিরে দে দৌড়। প্রখর রোদের নিচে আমরা নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। রক্ত ঝরছিল রেমন্ডের হাতের ক্ষত থেকে এবং মোচড়াচ্ছিল সে কনুইয়ের উপরদিকটা।

ম্যাসন বলল, একজন ডাক্তার আছেন যিনি প্রতি রোববার এখানে কাটান। রেমন্ড বলল, বেশ, চলো তার কাছে যাওয়া যাক। কথা বলতে পারছিল না সে, কারণ তার মুখের অন্য ক্ষত থেকে রক্তের বুদবুদ উঠছিল।

আমরা দুজন দুদিক থেকে ধরে তাকে বাংলোয় নিয়ে এলাম। সেখানে পৌঁছলে সে বলল, ক্ষতটা তত গভীর নয় এবং ডাক্তারের কাছে সে হেঁটেই যেতে পারবে। মারি বেশ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল আর মাদাম ম্যাসন তো কাঁদছিলেন।

ম্যাসন এবং রেমন্ড চলে গেল ডাক্তারের কাছে এবং আমি রয়ে গেলাম মহিলাদের কাছে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করার জন্যে। এ-ব্যাপারে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না, তাই কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানতে লাগলাম।

ম্যাসনের সঙ্গে রেমন্ড ফিরে এল প্রায় দেড়টার সময়। হাতে তার ব্যান্ডেজ বাধা এবং মুখের এককোণে একটা স্টিচিং প্লাস্টার। ডাক্তার তাকে আশ্বাস। দিয়েছেন জখম তেমন গুরুতর কিছু নয়, কিন্তু তাকে বেশ বিষণ দেখাচ্ছিল। ম্যাসন তাকে হাসাবার চেষ্টা করে বিফল হল।

খানিক পর রেমন্ড বলল, সে একটু সৈকতে বেড়াতে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাচ্ছে সে। এতে একটু আমতা আমতা করে বলল, এই একটু হাওয়া। খেতে যাচ্ছি। তখন আমরা ম্যাসন এবং আমি বললাম, তা হলে আমরাও তার সঙ্গে যাব। কিন্তু সে চটে উঠে আমাদের নিজের চরকায় তেল দিতে বলল। ম্যাসন তার অবস্থা দেখে বলল আমাদের জোর করা উচিত নয়। যাহোক, যখন সে বের হল তখন আমি তাকে অনুসরণ করলাম।

ঘরের বাইরের অবস্থা তখন জ্বলন্ত চুল্লির মতো এবং সূর্যের আলো আগুনের ফুলকির মতো সমুদ্র আর বালিতে ঝরছে। নিচুপে আমরা হাঁটলাম বেশ কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছিল আমার, রেমন্ড কোথায় যাবে সে-সম্পর্কে নিশ্চয় সে কিছু ভেবেছে; কিন্তু এ-সম্পর্কে আমার ধারণা বোধহয় ছিল ভুল।

সৈকতের শেষমাথায় একটা ছোট ঝরনার সামনে এসে পৌঁছলাম যেটা বেশ বড় একটা টিলার পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেখানে আমরা আরব দুজনকে দেখলাম নীল আলখাল্লা পরে শুয়ে আছে বালিতে। যে-লোকটি রেমন্ডকে ছুরি মেরেছিল সে নীরবে তাকাল রেমন্ডের দিকে। অন্যজন ছোট এক বাঁশিতে একটি সুরের তিনটি গত বাজাচ্ছে। বারবার সে এটা বাজাচ্ছিল এবং আড়চোখে দেখছিল আমাদের।

কিছুক্ষণ আমরা কেউই নড়লাম না। শুধু ঝরনার কলতান এবং বাঁশির সেই তিনটি বিরহী শব্দ ছাড়া চারদিকে শুধু সূর্যের আলো আর নৈঃশব্দ। তারপর রেমন্ড হাত দিল তার রিভলবার-রাখা পকেটে, কিন্তু আরব দুজন নড়ল না বিন্দুমাত্র। খেয়াল করে দেখলাম, যে-লোকটা বাঁশি বাজাচ্ছিল তার বিরাট পায়ের পাতা ডান কোণ-বরাবর পায়ের কাছে উলটানো।

তখনও তার প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে রেমন্ড আমায় জিজ্ঞেস করল : ‘শোধটা নিয়ে নেব নাকি?’

দ্রুত চিন্তা করলাম। যদি না’ বলি তা হলে সে যে-অবস্থায় আছে তাতে চটে উঠে হয়তো রিভলবার ব্যবহার করতে পারে। সুতরাং মাথায় এখন যা এল তা ই বললাম, ‘সে এখনও তোমায় কিছু বলেনি। সুতরাং ঠাণ্ডা মাথায় তাকে গুলি করা অতি নীচ কাজ হবে।‘

আবার কয়েক মুহূর্ত সব চুপ, খালি উষ্ণ ধীর বাতাসে বাঁশির শব্দ আর ঝরনার কলতান।

‘বেশ, বলল রেমন্ড আমাকে, যদি তুমি তা-ই মনে করো তবে প্রথমে তাকে কিছু অপমানকর কথা বলব। এবং সে যদি উত্তর দেয় তবে গুলি করব।’

‘বেশ’, বললাম আমি, ‘কিন্তু যতক্ষণ-না সে ছুরি বের করছে ততক্ষণ গুলি ছোঁড়ার কোনো অধিকার তোমার নেই।’

রেমন্ড অস্থির হয়ে উঠেছিল। যে-লোকটা বাজাচ্ছিল সে তখনও বাজিয়ে চলছে। এবং দুজনই নজর রাখছে আমাদের অবস্থানের দিকে। ‘শোনো’, বললাম রেমন্ডকে, তুমি ডান দিকেরটাকে সামলাও আর রিভলবারটা দাও আমাকে। যদি অন্যজন কিছু করে বা ছুরি বের করে তা হলে আমি গুলি করব।

রেমন্ড রিভলবারটা যখন আমার হাতে দিল তখন তা সূর্যের আলোয় ঝকমক করে উঠল। কিন্তু তখনও কেউ কিছু করেনি। মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন চেপে বসছে আমাদের ওপর এবং তাই যেন কেউ নড়তে পারছি না। চোখ না-নামিয়ে শুধু আমরা নজরে রাখছি একে অপরের প্রতি : পুরো পৃথিবী যেন এসে থেমে গেছে সূর্যের আলো আর সমুদ্রের মাঝখানে এই ছোট সৈকতে, নলখাগড়া এবং ঝরনার দ্বিগুণ নৈঃশব্দে। এবং ঠিক তখন আমার মনে হল গুলি করা বা না-করা সমান, কারণ ফলাফল একই হবে।

তারপর হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল লোক দুজন; টিলার আড়ালে মিলিয়ে গেছে দুজন গিরগিটির মতো। সুতরাং আমি আর রেমন্ড আবার পিছু ফিরে হাঁটা শুরু করলাম। বেশ খুশি মনে হচ্ছিল তাকে এবং আমাদের ফেরার বাস সম্পর্কে সে কথা বলতে লাগল।

বাংলোয় যখন পৌঁছলাম তখন রেমন্ড দ্রুতগতিতে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল উপরে, কিন্তু আমি বসে পড়লাম নিচের সিঁড়িতেই। মনে হচ্ছিল, রোদ আমার মাথায় বাড়ি মারছে এবং সেই উপরে উঠে মহিলাদের কাছে নিজেকে অমায়িক করে তোলাটা মনে হচ্ছিল কেমন যেন দুঃসাধ্য। কিন্তু রোদ এত কড়া যে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে দাঁড়ানোটাও ছিল কষ্টসাধ্য। আকাশ থেকে ঝরে-পড়া এই অন্ধ-করা আলোর বন্যার নিচে থাকা বা বাইরে যাওয়া–একই কথা। কয়েক মুহূর্ত পর আমি সৈকতে ফিরে হাঁটা শুরু করলাম।

যতদূর চোখ যায় ততদূর সেই লাল ঝকঝকে আলো এবং ছোট ছোট ঢেউগুলি খানিক পরপর গড়াগড়ি খাচ্ছে গরম বালিতে। সৈকতের শেষমাথায় সেই পাথরগুলির কাছে যখন হেঁটে যাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিল কড়া রোদের জন্যে আমার কপালের দুপাশের শিরা যেন ফুলে উঠছে। এটা আমাকে চেপে ধরে যেন আমার গতি রুদ্ধ করতে চাচ্ছে। এবং যখনই গরম বাতাসের ঝাঁপটা আমাকে বাড়ি মারছিল তখনই আমি দাঁতে দাঁত চেপে, পকেটে হাত মুঠি করে, প্রত্যেকটি স্নায়ুকে তৈরি রাখছিলাম সূর্য এবং যে অন্ধ-করা আলো আমার ওপর ঝরছে তাকে প্রতিহত করতে। যখনই বালিতে পড়ে-থাকা ঝিনুক বা ভাঙা কাঁচে আলো পড়ে ঝলক উঠছিল তখনই আমার চোয়াল হয়ে উঠছিল কঠিন। নিজেকে আমি কাবু হতে দিচ্ছি না। দৃঢ়ভাবে আমি হেঁটে যেতে লাগলাম।

সেই কালো ছোট কুঁজের মতো টিলাটা সৈকতের দূরে দেখা যাচ্ছে। ঝকঝকে আলোর বৃত্ত তার চারদিকে, কিন্তু আমি ভাবছিলাম এর পিছনের সেই ঠাণ্ডা পরিচ্ছন্ন ঝরনাটার কথা আর উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছিলাম বহতা পানির সেই মৃদু কলতান শোনার জন্যে। এই আলোর তীব্রতা কান্না-পাওয়া মহিলা, ক্লান্তি সবকিছু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে সেই টিলার ছায়ায়, ঝরনা আর তার শীতল নৈঃশব্দে।

কিন্তু যখন কাছে পৌঁছলাম তখন দেখি রেমন্ডের সেই আরব ফিরে এসেছে। সে তখন একলা, চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। হাতদুটি মাথার পেছনে, মুখটা টিলার ছায়ায়। বাকি শরীর কড়া রোদে। তার কাপড় মনে হচ্ছিল যেন সূর্যের আলোয় সিদ্ধ হচ্ছে। একটু আশ্চর্য হলাম। আমি ভেবেছিলাম, ঘটনাটার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং এখানে আসার পথে এ-ব্যাপারটার কথা আমার একবারও মনে হয়নি।

আমাকে দেখে আরবটি একটু উঁচু হল এবং হাত ঢোকাল পকেটে। স্বভাবতই পকেটে রেমন্ডের রিভলবারটা চেপে ধরলাম। তারপর আরবটা আবার শুয়ে পড়ল, হাত কিন্তু পকেটেই থাকল। আমি ছিলাম খানিকটা দূরে, দশ গজ হবে, এবং বেশির ভাগ সময়ই তাকে কালো এক টলটলায়মান বস্তুর মতো মনে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে আবার নজরে পড়ছিল আধবোজা পাতার নিচের জলন্ত চোখদুটো। ঢেউয়ের শব্দগুলিকে মনে হচ্ছিল দুপুর থেকেও মদালসা এবং নমিত। রোদ কিন্তু কমেনি; তা তখনও সেই টিলা পর্যন্ত বিস্তৃত সৈকতকে ঝলসাছিল। দু-ঘণ্টায়ও সূর্যের কোনো হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না, যেন নিথর গলানো। ইস্পাতের সমুদ্র। লোকটার দিকে নজর রাখছিলাম এবং দূর দিগন্তে যে একটি স্টিমার যাচ্ছিল, আড়চোখে সেই চলন্ত কালো বিন্দুটাকে দেখছিলাম।

হঠাৎ মনে হল আমার এখন যা করা দরকার তা হল পিছু ফিরে চলে যাওয়া এবং এ ঘটনার কথা না-ভাবা। কিন্তু পুরো সৈকতটা যেন তাপে টগবগ করে পিছন থেকে আমাকে চেপে ধরছে। ঝরনার দিকে এগিয়ে গেলাম কয়েক পা। নড়ল না আরবটা। তখনও আমাদের মধ্যে দূরত্ব আছে খানিকটা। তার মুখের ওপর ছায়া। পড়ার জন্যে মনে হচ্ছিল সে যেন ভেংচি কাটছে আমার দিকে তাকিয়ে।

অপেক্ষা করছিলাম। উত্তাপে আমার গাল যেন ঝলসাচ্ছিল, ঘামের ফোঁটা জমছিল ভুরুতে। মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন ছিল যেরকম রোদ, এখনও রোদ ঠিক সেরকম এবং আমার মনে ঠিক সেরকম একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি জাগছিল, বিশেষ করে কপালে, সেখানে মনে হছিল প্রত্যেকটি শিরা যেন চামড়া ফেটে বেরুবে। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না, এগিয়ে গেলাম আরেক পা। জানতাম বোকামি হচ্ছে কাজটা; দুএক পা এগিয়ে গেলেই তো আর সূর্যের আড়াল হব না। তবুও এক পা এগোলাম সামনে, ঠিক এক পা। আর তখুনি আরবটা ছুরি বের করে সামনে ধরল।

ইস্পাত থেকে একঝলক আলোর রশ্মি লাফিয়ে উঠল আর আমার মনে হল, যেন লম্বা একটি পাতলা ব্লেড স্থির হয়ে আছে আমার কপালে। সে-সঙ্গে আরও মনে হল চোখের ভুরুতে যত ঘাম জমেছিল সেসব চোখ বেয়ে ঝরছে। পানি ও ঘামের পরদার নিচে চাপা পড়ে গেছে দুই চোখ। সূর্য যে আমার করোটিতে দামামা বাজাচ্ছে সে-সম্পর্কে আমি সচেতন, কেবল ঝাঁপসা লাগছে ছুরি থেকে উৎক্ষিপ্ত তীক্ষ্ণ সেই আলোর রশ্মি, যেন তা ভুরু ফেড়ে গেঁথে যাচ্ছে চোখের মণিতে। তারপর সবকিছুই ঘুরতে শুরু করল আমার চোখের সামনে। সমুদ্র থেকে বেরিয়ে এল আগুনের হলকা আর আকাশটা দিগন্ত থেকে দিগন্তে যেন হয়ে গেল দু-টুকরো। আর সেই গহ্বরে ঝরতে লাগল আগুনের শিখা। আমার শরীরের প্রতিটি তন্তু যেন ইস্পাতের মতো তীক্ষ্ণ আর তীব্র, রিভলবারের ওপর আমার মুঠি দৃঢ় হয়ে এল। ট্রিগার টিপলাম আর মসৃণ একটা ধাক্কা এসে স্পর্শ করল করতল। ঐ শব্দ থেকেই শুরু। আমি ঝেড়ে ফেললাম ঘাম আর আলোর পরদা। আমি। জানি, দিনের এই নিটোলতা আর সমুদ্রতীরের এই বিশাল প্রশান্তি আমি ফেলেছি ছিঁড়েখুঁড়ে যেখানে ছিল আমার সুখ। ঐ নিস্পন্দ শরীরে আমি আরও চারবার গুলি করলাম। আর প্রতিটি গুলি ছিল আমার নিয়তির দিকে সোচ্চার আওয়াজ।

1 Comment
Collapse Comments
পর্দা করা ফরজ October 8, 2022 at 10:57 am

পড়লাম

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *