সূর্য থেকে পৃথিবীর জন্ম
কিন্তু পৃথিবী থেকে সূর্য যতো দূরেই থাকুক না কেন, বৈজ্ঞানিকেরা বলেছেন, এ কথা না মেনে উপায় নেই যে কোনো এককালে ওই সূর্য থেকেই পৃথিবীর জন্ম হয়েছিলো। সে যে কতোকাল আগেকার ঘটনা হতে পারে, তার আলোচনা একটু পরে তোলা যাবে। আগে দেখা যাক, বৈজ্ঞানিকেরা কেন এই রকমের একটা কথাই সত্য বলে মনে করছেন।
ওঁরা বলছেন, সূর্য আর পৃথিবীর ব্যাপারে অনেক বিষয়ে মিলের দিকে নজর রাখা দরকার।
প্রথমত, সূর্যও লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে, পৃথিবীর লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। লাট্টু যখন ঘোরে তখন তার আলটা নিচের দিকে থাকে, মণিটা বরাবরই মাথার দিকে—ঘোরে শুধু তার গায়ের দিকগুলো বা পাশের দিকগুলো। কিন্তু এই ঘোরবার দিক দু রকমের হতে পারে—এখানে উলটো-মুখ-বরাবর ঘুরন্ত দুটো লাট্টুর ছবি এঁকে দেওয়া গেলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সূর্য আর পৃথিবী যে-ঘুরপাক খাচ্ছে তাও কি এই রকম উলটো-দিক-বরাবর নাকি? তা নয়। পৃথিবী ঘুরপাক খাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুব-বরাবর ভাবে, আর সূর্যও ঠিক তাই।
দ্বিতীয়ত, পৃথিবী শুধু লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে না, সূর্যকে প্রায় ন-কোটি-তিরিশ-লক্ষ মেইল দূরে রেখে প্রদক্ষিণও করছে। আর, এইভাবে প্রদক্ষিণ করবার সময়েও, পৃথিবী ছুটে চলছে পশ্চিম থেকে পুব-মুখ-বরাবরই—অর্থাৎ কিনা, যে মুখে সূর্য আর পৃথিবী দুজনেই লাট্টু মতো ঘুরপাক খাচ্ছে সে-মুখ-বরাবরই।
তৃতীয়ত, পৃথিবী একা নয়। পৃথিবী ছাড়াও সূর্যের আরো আটটি গ্রহ আছে, পৃথিবীর তুলনায় তাদের কোনোটি বেশি বড়ো কোনোটি বেশি ছোটো, কোনোটি সূর্যের বেশি কাছে, কোনোটি সূর্য থেকে বেশি দূরে। এই গ্রহগুলির কোনোটিও স্থির নয় এবং এগুলির গতির মধ্যে খুব আশ্চর্য মিল দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকটিই লাট্টুর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে আর প্রত্যেকটিরই লাট্টু-ঘোরার দিকটা সূর্যের মতো বা পৃথিবীর মতো,–অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূব-বরাবর। তাছাড়া প্রত্যেকটিই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে, এবং শুধুই যে প্রত্যেকটির ওই প্রদক্ষিণ-পথের চেহারায় মিল আছে তাই নয়, প্রত্যেকটিই সূর্যের চারপাশে ঘুরে চলেছে পশ্চিম থেকে পুব মুখে।
আরো লক্ষ্য করা করবার বিষয় হলো, বৈজ্ঞানিকেরা বলছেন, প্রতিটি গ্রহই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে একই তল বা ‘প্লেন’-এ। তার মানে কী? যদি কল্পনা করা যায়, একটা প্রকাণ্ড চাদর আকাশের উপরে টান করে ধরা হয়েছে আর সে-চাদরের মাঝখানে সূর্যকে রেখে পৃথিবী তারই উপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুরছে, তাহলে দেখা যাবে বাকি আটটি গ্রহের কেউই চাদরটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে না, অর্থাৎ কিনা তারাও সকলেই পৃথিবীর মতো চাদরটার উপর দিয়ে গড়াতে-গড়াতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। একই তল বা ‘প্লেন’-এ ঘোরা আর আলাদা ‘তল’-এ ঘোরা বলতে কী বোঝায় তা দু রকম ছবি এঁকে দেওয়া হলো।
চতুর্থতা, সৌরজগতে মোটের উপর তিরিশটি চাঁদ বা উপগ্রহর খবর পাওয়া গিয়েছে, তারা প্রদক্ষিণ করছে যে যার গ্রহকে।
এবং এদের বেশির ভাগের বেলাতেও (যদিও সকলের বেলাতেই নয়) প্রদক্ষিণ-পথের দিকটা পশ্চিম থেকে পুব-বরাবর—অর্থাৎ কিনা যে-মুখ সূর্যও লাট্টুর মতো ঘুরছে, গ্রহরাও লাট্টুর মতো ঘুরছে আর যে-মুখে সমস্ত গ্রহই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।
তাছাড়া, এ কথা তো রয়েছেই যে গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে সূর্যের যে-পরিবার, তার মধ্যে কখনই ছাড়াছাড়ি হয় না। অন্যান্য নক্ষত্রদের মতোই সূর্যও প্রচণ্ড বেগে আকাশের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে, কিন্তু ছুটে চলেছে স-পরিবারে অর্থাৎ নিজের গ্রহ-উপগ্রহের ঝাঁকটিকে নিয়ে।
সৌর-জগতের মধ্যে এতো যে মিল, এর তো একটা ব্যাখ্যা থাকা চাই। যদি কল্পনা করা হয়, সূর্য আর গ্রহ-উপগ্রহরা আকাশের আলাদা-আলাদা জায়গায় আলাদা-আলাদা ভাবে জন্মেছিলো—তাহলে সে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। প্রথমত, তারা আলাদা জায়গায় আলাদা ভাবে জন্মালে এ-রকম একটা ঝাঁক বাঁধলো কেমন করে? দ্বিতীয়ত, যদিই বা কোনোমতে ঝাঁক বেঁধে থাকে তাহলে তাদের মধ্যে তো আশ্চর্য মিল কী করে সম্ভব হলো? বৈজ্ঞানিকেরা তাই বলছেন, এ-কথা মানতেই হবে যে সূর্য থেকেই এককালে গ্রহ-উপগ্রহগুলির জন্ম হয়েছিলো, কিংবা অন্তত, এই গ্রহ-উপগ্রহগুলির জন্মকথার সঙ্গে সূর্যের জন্মকথার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য।
সূর্য আর পৃথিবী
রাত পোয়াতে-না-পোয়াতে স্বর্গের রাজহাঁস আকাশের গায়ে একটি সোনার ডিম পাড়ে। ডিমটি ফুটে যে-বাচ্চা বেরোয় সেই আমাদের সূর্য। এই ভাবে প্রতিদিনই সকালে একটি করে সোনার সূর্যের জন্ম, রাত্রির অন্ধকারে প্রতিদিনই তার মৃত্যু। পরদিন সকালের স্বর্গের সেই রাজহাঁস আর-একটি সোনার ডিম পাড়বে, ডিম ফুটে বেরুবে আর-একোটি নতুন সূর্য…
কাদের কল্পনা? কতোদিন আগেকার কল্পনা?
হাজার কয়েক বছর আগে মিশরের পুরোহিতেরা বুঝি এই ভাবেই সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের রহস্য বোঝবার চেষ্টা করেছিলো। আর তখনকার কালে তারাই নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো জ্ঞানী!
গত কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মানুষের জ্ঞান কী অসম্ভবই না বেড়ে গিয়েছে! আজকের দিনে ইস্কুলের কচি কচি ছেলেমেয়েরাও সেকালের ওই সবচেয়ে বড়ো বড়ো জ্ঞানীদের কথা শুনলে খিলখিল করে হেসে উঠবে। কেননা, ওরা জানে ভোর আকাশে আমরা ওই যে সোনার থালার মত জিনিসটিকে উঠে আসতে দেখি ওটি আসলে হলো প্রকাণ্ড বড়ো একটি আগুনের গোলা—এতো বড়ো যে তার মধ্যে আমাদের এই পৃথিবীর মতো তেরো-লক্ষ-ন-হাজারটি পৃথিবীর জায়গা হতে পারে। তবুও আকশে সূর্যকে দেখতে অতোটুকু মনে হয়, কেননা সূর্য রয়েছে পৃথিবী থেকে অনেক দূরে—প্রায় ন-কোটি-তিরিশ-লক্ষ মাইল দূরে। তার মানে, ট্রেনে চেপে পৃথিবী থেকে সূর্যে যাবার যদি কোনো ব্যবস্থা করা যেতো আর সে-ট্রেন যদি দিনরাত অবিরাম ঘণ্টায় ষাট মাইল বেগে ছুটতে পারতো—তাহলে পৃথিবী ছেড়ে সূর্য পর্যন্ত পৌঁছুতে সময় লাগতো প্রায় আড়াই শো বছর।