১. পৃথিবীর ওপর নজর

দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস ( The War of the Worlds ) – উপন্যাস – এইচ জি ওয়েলস। অনুবাদ – অদ্রীশ বর্ধন

[‘The War of the Worlds’ ওয়েলসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ধারাবাহিক আকারে ১৮৯৭ সালে ব্রিটেনে ‘Pearsons Magazine’ এবং মার্কিন দেশে ‘Cosmopolitan’ পত্রিকায়। ১৮৯৮ সালে এটি বই আকারে ছেপে বেরয় লন্ডনের ‘William Heinemann’ প্রকাশনী থেকে। মনুষ্য জাতি এবং এলিয়েন দ্বন্দ্বের সাহিত্য ধারার প্রথম দিককার নিদর্শন হিসেবে এই উপন্যাস এখনও উল্লেখযোগ্য। এই উপন্যাস অনুপ্রাণিত করেছিল এই ধারার আর অনেক গল্প, নাটক, উপন্যাস এবং চলচিত্র। ১৯৩৮ সালে উপন্যাসটি অনুসরণে অরসন ওয়েলেস কৃত রেডিয়ো নাটিকাটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অগাস্ট ১৯২৭ সালে গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘Amazing Stories’ পত্রিকায়। অদ্রীশের অনুবাদে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর মন পত্রিকায় ১-১৫ নভেম্বর ১৯৮৫ সংখ্যায়।]

১৮০০-র শেষের কবছরে কাউকে যদি বলা হত, মানুষের চাইতে অনেক বেশি চৌকস প্রাণী পৃথিবীর ওপর নজর রেখে চলেছে পৃথিবীর বাইরে থেকে–হেসেই উড়িয়ে দিত কথাটা। সত্যি সত্যিই কিন্তু মহাশূন্যে বহু দূরে বসে এই ধরনের প্রাণীরা খর-নজরে দেখে যাচ্ছিল পৃথিবীকে। সেই সঙ্গে ফন্দি এঁটে চলেছিল, কীভাবে আক্রমণ করা যায় আমাদের।

১৮০০-র শেষের দিকে বিশ্বের বেশ কজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বেজায় উত্তেজিত হলেন চাঞ্চল্যকর একটা খবর শুনে। মঙ্গল গ্রহের বুকে নাকি একটা বিস্ফোরণ দেখা গেছে। বিশালকায় একটা আগুনের গোলক নাকি বিষম বেগে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে। নানান খবরের কাগজে বেরল এই খবর। সাধারণ মানুষ কিন্তু বিচলিত হল না মোটেই। আসন্ন বিপদ উদবিগ্ন করল না কাউকেই।

খবরটা আমার কানে এসেছিল হঠাৎ। ওগিলভি নামে আমার এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী বন্ধু আছে। মানমন্দিরে বসে টেলিস্কোপ দিয়ে সে দেখেছিল ধাবমান অগ্নিগোলককে। রাস্তায় ওগিলভির সঙ্গে মুখোমুখি হতেই ব্যাপারটা বললে আমাকে।

সবশেষে বললে, স্বচক্ষে দেখতে যদি চাও, চলে এসো আজ রাতে। টেলিস্কোপের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাবে ধাত ছেড়ে যাওয়ার মতো কাণ্ডকারখানা।

শুনেই রীতিমতো উত্তেজিত হয়েছিলাম। বললাম, বেশ তো, আসছি আজ রাত্রে।

সেই রাতেই টেলিস্কোপের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল আর-একটা বিস্ফোরণ। গ্যাসের বিস্ফোরণ। তখন রাত ঠিক বারোটা।

টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে ওগিলভিই প্রথমে দেখেছিল সেই বিস্ফোরণ। মঙ্গলের বুকে। চিৎকার করে উঠেছিল বিষম উত্তেজনায়, লালচে ঝলক! কী যেন একটা ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে!

ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে টেলিস্কোপে চোখ রেখেছিলাম আমি।

 এবার দেখেছিলাম সেই আশ্চর্য দৃশ্য!

ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঠিকরে যাচ্ছে রক্তরাঙা গ্রহ মঙ্গলের বুক থেকে!

হতভম্ব গলায় বলেছিলাম, ওগিলভি! ওগিলভি! এ কাদের সংকেত? মঙ্গল গ্রহের প্রাণীদের নাকি? সত্যিই কি মঙ্গলে জীব আছে?

ননসেন্স!–বলেছিল ওগিলভি, মঙ্গলের বুকে মানুষের মতো প্রাণীর অস্তিত্বের সম্ভাবনা লাখে একটাও নয়। যা দেখছ, তা বোধহয় উল্কাবৃষ্টি অথবা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ।

মোটের ওপর, ওগিলভির মতো প্রত্যক্ষদর্শী বৈজ্ঞানিক ব্যাপারটাকে পাত্তাই দিল না। মঙ্গলগ্রহীরাও বিপুলবেগে ধেয়ে আসতে লাগল পৃথিবীর দিকে দিনে দিনে এগিয়ে আসতে লাগল কাছে… কাছে… আরও কাছে!

মঙ্গল গ্রহ যে রক্তরাঙা লাল গ্রহ, তা আমরা জানি অনেকদিন থেকেই। যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়েছি এই গ্রহকে। কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি, সে যুদ্ধ হবে আমাদের সঙ্গেই। সূর্য থেকে চোদ্দো কোটি মাইল দূরে বসেও তারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের হালচাল দেখেছে, নিজেদের গ্রহে বসবাস যখনই একটু একটু করে কষ্টকর হতে আরম্ভ করেছে–ফন্দি এঁটেছে মাত্র সাড়ে তিন কোটি মাইল দূরের পৃথিবী গ্রহটাকে কবজায় আনার।

মঙ্গল আর পৃথিবী কাছাকাছি এসেছিল ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে। ২ আগস্টের খবরের কাগজে বেরল, একটা দারুণ আলোর ঝলকানি নাকি দেখা গেছে মঙ্গলের বুকে, পরপর কয়েক রাত ধরে চলল এই একই ব্যাপার। রাত ঠিক বারোটায় ঝলসিত হয় একটা বিপুল আলোকপিণ্ড–অন্তর্হিত হয় মিনিট পনেরো পরে। স্পেকট্রোস্কোকোপের বর্ণালি দেখে একজন বৈজ্ঞানিক বলেছিলেন, মনে হচ্ছে যেন একটা গ্যাসের পিণ্ড জ্বলতে জ্বলতে নক্ষত্রবেগে ধেয়ে আসছে পৃথিবীর দিকে।

ওগিলভির সঙ্গে দেখা হয় ঠিক এই সময়ে। নিস্তব্ধ মানমন্দিরে বসে এক কোণে রাখা ম্যাড়মেড়ে আলোয় রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম দুই বন্ধু। দেখেছিলাম মঙ্গলের বুকে হঠাৎ আলোর ঝলকানি। ঠিক যেন আর-একটা আলোর ডেলা ধেয়ে আসছে এই পৃথিবীর দিকে।

পরপর দশ রাত একই কাণ্ড দেখা গেল রহস্যময় গ্রহ মঙ্গলের বুকে। রাত ঠিক বারোটার সময়ে। তারপর থেকেই কিন্তু রক্তরাঙা গ্রহ শুধু লাল গ্রহই হয়ে রইল–লালের ঝলক দেখিয়ে আর বিড়ম্বিত করেনি পৃথিবীবাসীদের।

কিন্তু আক্কেল গুড়ুম করে দেবার পরিকল্পনা যে চালু হয়ে গেছে, তখনও যদি তা কেউ ভাবতে পারত।

আমি কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে খুব ভেবেছিলাম। ওগিলভির কথায় মন মানতে রাজি হয়নি। ওই যে অগ্নিঝলক, তা কখনওই আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বা ঝাঁকে ঝাঁকে উল্কা খসে পড়ার ফলে হচ্ছে না। প্রকাণ্ড কামান দাগলে এমনি ঝলক দেখা যায়। এমনি ধূম্রবলয় ঠিকরে যায়। তবে কি পরপর দশ রাত ধরে গোলার মধ্যে মহাকাশযান পাঠাল মঙ্গলগ্রহীরা পৃথিবীকে টিপ করে?

তারপর এল সেই রাত। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ংকরতম রাত। একটা তারা খসে পড়ল আকাশ থেকে। শেষ রাতের দিকে। সবুজ আলোর একটা রেখা দেখা গেছে নাকি খসে পড়া তারার পেছনে। বেশ কয়েক সেকেন্ড সবুজ আলোটা ভেসেছিল আকাশে। একটা হিসহিস শব্দও শোনা গিয়েছিল খসে-পড়া তারা পৃথিবীর দিকে বেগে ধেয়ে আসার সময়ে।

উল্কাপাত নিয়ে কে আর মাথা ঘামায়। কিন্তু টনক নড়েছিল ওগিলভির। ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়েছিল। দেখেছিল, বিশাল একটা সিলিন্ডার বালির মধ্যে বেশ খানিকটা ঢুকে গেছে আকাশ থেকে বেগে নেমে আসার পর। জমি গর্ত হয়ে গেছে ধাক্কার চোটে। বালি আর পাথর ঠিকরে গিয়ে গোলাকার টিলা বানিয়ে ফেলেছে চারধারে।

উল্কা তো সচরাচর গোলমতো হয়। সিলিন্ডার আকারের তো হয় না। ব্যাস প্রায় নব্বই ফুট। ভেতরে গুড়গুড় করে কী যেন আওয়াজ হচ্ছে। এত গরম যে কাছে যাওয়াও সম্ভব নয়।

চোঙাটা যে ফাঁপা হতে পারে, এ ধারণা তখনও মাথায় আসেনি ওগিলভির।

স্তম্ভিতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল ওগিলভি। দেখেছিল, প্রচণ্ড বেগে মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে ফার গাছগুলোকে প্যাঁকাটির মতো ভাঙতে ভাঙতে নেমে এসেছে সিলিন্ডারটা। জঙ্গলেও আগুন লেগেছে। ধোঁয়া উঠছে।

হঠাৎ চমক ভেঙেছিল ওপর থেকে ঝুরঝুর করে কী পড়ছে দেখে। সিলিন্ডারের ওপরের দিকে ছাইয়ের মতো খোসা খসে খসে পড়ছে গর্তের মধ্যে। কেন পড়ছে? একদৃষ্টে চেয়ে থাকতেই রক্ত জল হয়ে গেল ওগিলভির।

সিলিন্ডারের ওপরের দিকে ঠিক যেন একটা ঢাকনা আঁটা রয়েছে। পেঁচিয়ে আঁটা। আস্তে আস্তে ঘুরছে সেই ঢাকনা। অর্থাৎ প্যাঁচ খুলে যাচ্ছে।

ভেতরে তাহলে কেউ রয়েছে। এখনও মরেনি! চোঙাটাও নিরেট নয়–ফাঁপা!

 হয়তো ভেতরে মানুষ আছে, আধমরা মানুষটাকে সাহায্য করা দরকার–এই ভেবেই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে টিলার গা বেয়ে গরম চোঙার দিকে এগিয়েছিল ওগিলভি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বিদ্যুৎ চমকের মতো সম্ভাবনাটা খেলে গিয়ে ছিল মাথার মধ্যে!

মঙ্গল গ্রহ থেকে আসেনি তো এই সিলিন্ডার? ভেতরে যে বা যারা রয়েছে, মঙ্গল গ্রহের জীব নয় তো তারা?

তবুও গুটিগুটি কাছে গিয়েছিল ওগিলভি। কিন্তু চোঙার গায়ে হাত দিতেই ছ্যাঁকা লেগে গিয়েছিল হাতে। দারুণ গরম। উন্মাদের মতো বেরিয়ে এসেছিল তৎক্ষণাৎ গর্তের বাইরে। সিলিন্ডার পড়ে ছিল শহরের বাইরে ফাঁকা জায়গায়। এখন ঊর্ধ্ব- শ্বাসে ছুটল দূরের শহরের দিকে। প্রথমেই দেখা হয়ে গেল হেন্ডারসনের সঙ্গে।

হেন্ডারসন পেশায় সাংবাদিক। লন্ডনের একটা খবরের কাগজের রিপোর্টার। বাড়ির সামনে বাগানের মাটি কোপাচ্ছিল কোদাল দিয়ে।

হন্তদন্ত হয়ে বাগানে ঢুকে পড়েছিল ওগিলভি। বলেছিল চিৎকার করে, হেন্ডারসন, কাল রাতে তারা খসে পড়া দেখেছিলে?

ওগিলভির মতো বৈজ্ঞানিকের এহেন উদ্ভ্রান্ত মূর্তি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল হেন্ডারসন। বলেছিল সাগ্রহে, দেখেছিলাম। কিন্তু ব্যাপারটা কী?

–দেখে এলাম জিনিসটাকে।

–কোথায় দেখলে?

–হর্সেল কমনে পড়ে আছে।

চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে হেন্ডারসনের। কোদাল ফেলে দিয়ে বলেছিল রুদ্ধশ্বাসে, উল্কাপিণ্ড! বল কী? চল, চল, দেখে আসা যাক। দৌড়াল দুজনে কমন প্রান্তরের দিকে। যেতে যেতে ওগিলভি হেন্ডারসনকে বললে যা যা দেখেছে এবং শুনেছে।

কথা বলতে বলতেই পৌঁছে গেল উঁচু টিলার ওপর। ওই তো পড়ে রয়েছে মহাকায়। চোঙা। একইভাবে হেলে বেশ খানিকটা গেঁথে গেছে জমির মধ্যে। ধোঁয়ার ফিকে রেশ দেখা যাচ্ছে এখনও। কিন্তু..

ডালাটা প্রায় খুলে এসেছে। সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে একটা সোঁ সোঁ শব্দ। যেন হাওয়া ঢুকছে ভেতরে… অথবা বেরিয়ে আসছে বাইরে।

কাছে এগিয়ে গিয়েছিল দুই মূর্তিমান। চোঙার ধাতব দেহে লাঠি ঠুকেছিল ঠনঠন শব্দে। কিন্তু কোনও সাড়াই আসেনি ভেতর থেকে।

গুম হয়ে গিয়েছিল ওগিলভি। বলেছিল চিৎকার করে, ভেতরে যারা আছ, চুপটি করে বসে থাক। আরও লোকজন নিয়ে আসছি।

হেন্ডারসন বলেছিল, বেচারা! ঠান্ডায় জমে গেছে, এমনও হতে পারে।

ঠান্ডায় জমুক আর গরমেই মরুক, নিজেদের দ্বারা আর কিছু সম্ভব নয় দেখে হেন্ডারসন আর ওগিলভি ফিরে এসেছিল শহরে–আরও লোকজন জোটানর আশায়। কোদাল-শাবল নিয়ে আসতে হবে প্রত্যেককে।

হেন্ডারসন তখন ভাবছে। এমন জবর খবরটা আগে পাঠানো দরকার নিজের খবরের কাগজে। তাই আগে টেলিগ্রামে পুরো ব্যাপারটা জানিয়ে দিল সম্পাদককে।

খবরটা যেন হাওয়ায় ছড়িয়ে গেল। খবরের কাগজ কিনতে হকারের কাছে গিয়েছিলাম আমি–চোঙা-সংবাদ শুনলাম তখনই।

কাগজের হকারই বললে, শুনেছেন? তাজা খবর! মঙ্গল গ্রহ থেকে মানুষ এসেছে। বেশি দূরে নয়–ওই কমনে?

অসম্ভব! বলেছিলাম আমি।

 বলা বাহুল্য, বিলক্ষণ চমকে গিয়েছিলাম খবরটা শুনে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়েছিলাম নিজের চোখে দেখবার জন্যে। চোঙার চারধারের উঁচু টিলায় ততক্ষণে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে গেছে। মজা দেখছে। কিছু লোক নেমে পড়েছে গর্তে। গাঁইতি-শাবল দিয়ে চাড় মারছে চোঙার তলায়। অদ্ভুত ধূসর রঙের অজানা ধাতু দিয়ে তৈরি বিশাল সিলিন্ডারটার দিকে চেয়ে ছিলাম আমি ভয়বিহ্বল চোখে।

আচমকা চেঁচিয়ে উঠল একজন শাবলধারী, হুশিয়ার! চোঙার ঢাকনা খুলে যাচ্ছে .. পেঁচিয়ে খোলা হচ্ছে ভেতর থেকে।

খুলে গেল ঢাকনা। দড়াম করে পড়ল চোঙার গায়ে। ঝুলতে লাগল চকচকে চাকার মতো।

সভয়ে সরে এসেছিল কৌতূহলী মানুষগুলো। হেঁকে সরিয়ে দিয়েছিল সবাইকে। কী আছে ভেতরে, তা যখন জানা নেই–তখন তফাত যাওয়াই ভালো।

হতভম্ব চোখে আমি চেয়ে ছিলাম ভোলা গর্তটার দিকে। হেলে-পড়া অদ্ভুত কারুকাজ করা বিশাল সিলিন্ডারের ওপরদিককার ছোট হ্যাঁচের মতো একটা ফোকর হঠাৎ উন্মুক্ত হয়েছে। না জানি এবার কী বিস্ময় আবির্ভূত হবে ফোকর দিয়ে।

মানুষই উঁকি মারবে, আশা করেছিল সবাই। আমি নিজেও তা-ই ভেবেছিলাম। কিন্তু ছায়ার মধ্যে দিয়ে যা দেখলাম, তা আর যা-ই হোক–মানুষের চোখ নয়।

গনগনে দুটো বস্তু, গোল চাকার মতো বস্তু, চেয়ে আছে আমাদের দিকে। তারপরেই ধূসর সর্পের মতো কী যেন একটা কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠল ফোকরের মধ্যে থেকে লকলকিয়ে শূন্যপথে এগিয়ে এল আমার দিকে।

হট্টগোলটা শুরু হল তৎক্ষণাৎ। বীভৎস ওই শুড়ের লকলকানি দেখেই ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল যাদের, তাদের মধ্যে সবার আগে গলার শির তুলে চিৎকার করে উঠল একটি মেয়ে। দুদ্দাড় করে পালাতে লাগল যে যেদিকে পারে।

আমি কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলাম থ হয়ে। দাঁড়িয়ে ছিলাম বলেই দেখতে পেলাম, অক্টোপাসের বাহুর মতো কদর্য শুড় বেরিয়ে আসছে একটার পর একটা। কিলবিল করছে ছোট্ট ফোকরের চারপাশে। শুড় দিয়ে চোঙার গা চেপে ধরে পরক্ষণেই বেরিয়ে এল একটা মূর্তিমান আতঙ্ক!

বীভৎস! কোনও প্রাণী যে এত কদাকার হয়, জানতাম না। ধূসর বর্ণের বৃহৎ বপুটাকে একটু একটু করে এবং বেশ কষ্টের সঙ্গে নিয়ে এল চোঙার বাইরে অমানবিক দুটো বিশাল চক্ষু। একদৃষ্টে চেয়ে রইল আমার দিকে। বিকটাকার চোখ দুটোর দিকে আমিও চেয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে। চোখ প্রত্যঙ্গ দুটো তো মুন্ডুতে থাকে জানি। কিন্তু এর মুন্ডু কোথায়? সবটাই তো ধড়। অথবা ধড়টাই ওর পুরো মগজ। নারকীয় জিঘাংসা-ধকধকে চোখ দুটো বসানো রয়েছে কুৎসিত এই ধড়ের ঠিক মাঝখানে।

পুরো অবয়বটাকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে ফেলেছিল পৈশাচিক এই প্রাণী। এবার আচমকা চোঙার গা বেয়ে হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়ল নিচের গর্তে। ধুপ করে আছাড় খেতেই কাতরে উঠল অদ্ভুত গলায়। সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা অবিকল বিকট প্রাণী আবির্ভূত হল ফোকরের বাইরে।

দু-দুটো কালান্তক প্রাণীকে কটমট করে চেয়ে থাকতে দেখে প্রাণ হাতে নিয়ে জনতা তখন দৌড়াচ্ছে। দৌড়েছিলাম আমিও। উন্মাদের মতো ধেয়ে গিয়েছিলাম একটা গাছের জটলার দিকে। তল্লাট ছেড়ে চম্পট দেবার অভিপ্রায় আমার ছিল না মোটেই। লোমহর্ষক ওই চাউনির আড়ালে থেকে দুঃস্বপ্নসম জীবগুলোকে খুঁটিয়ে দেখবার লোভ সামলাতে পারিনি মোটেই।

গাছপালার আড়ালে গিয়ে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিলাম ধুকপুকে বুকে। ভয়ে-বিস্ময়ে দুচোখ যে প্রায় ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল, তা না বললেও চলে। দূর থেকেই দেখেছিলাম, অক্টোপাসের কিলবিলে বাহুর মতো সরু কালো চাবুক যেন আছড়ে পড়ছে সূর্যাস্তের দিকে। তারপর ঠেলে উঠে এল একটা সরু রড। একটার পেছনে আর-একটা জোড়া লাগিয়ে বেশ লম্বা করে তোলা হল অনেক উঁচুতে। রডের ডগায় বনবন করে ঘুরতে লাগল গোলাকার একটা প্লেট।

হইচই শুনে ফিরে তাকালাম। একদল লোক সাহসে বুক বেঁধে ফিরে এসেছে। গুটিগুটি এগচ্ছে গর্তের দিকে। পুরোধা ব্যক্তির হাতে রয়েছে সাদা নিশান–লাঠির ডগায় বাঁধা। হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে।

টিলার ওপর এসে দাঁড়াল ছোট্ট দলটা। ডাইনে-বাঁয়ে পতাকা নেড়ে কথা বলার চেষ্টা করল মঙ্গলগ্রহীদের সঙ্গে।

রডের ডগায় বনবনে ঘুরন্ত চাকাটা আস্তে আস্তে ঘুরে গেল তাদের দিকে…

তারপরেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল তীব্র আলোর ঝলকে। ভক ভক ভক করে তিনবার সবুজ ধোঁয়া গর্তের ভেতর থেকে ঠিকরে গেল আকাশের দিকে।

খুব ধীরে ধীরে কিম্ভুতকিমাকার একটা আকৃতি উঠে এল গর্তের বাইরে। নিক্ষেপ করল একটা আলোকরশ্মি…

অদ্ভুত আকৃতিটার দিক থেকে বিচ্ছুরিত সেই আলোকরশ্মি এমনই জোরাল যে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার। শুধু রশ্মি না বলে তাকে রশ্মিপ্রবাহ বললেই ঠিক হয়। তীব্রবেগে আছড়ে পড়ল বন্ধুত্বের বার্তাবাহী মানুষ কজনের ওপর। নিমেষের মধ্যে শূন্যপথে ছিটকে গিয়ে আছড়ে পড়ল প্রত্যেকেই–আর নড়ল না। রশ্মিশক্তি এত প্রচণ্ড হয়? এমন সর্বনাশা হয়? এতখানি মারাত্মক হয়? দাউদাউ করে জ্বলে উঠল পেছনকার পাইনবন–আগুন লকলকিয়ে উঠল শুকনো ঘাসেও।

গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমি। তখন অন্ধকার নেমেছে। অত্যুজ্জ্বল আলোকরশ্মি নির্মমভাবে তাণ্ডবনৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে। কী ভাগ্যিস, আর-একটু এগিয়ে আসেনি। এলে, আমার দফারফাও হয়ে যেত। গাছপালা সমেত পুড়ে ছাই হয়ে যেতাম।

অর্ধচন্দ্রাকারে আমার লুকানোর জায়গার ঠিক সামনে দিয়ে সবকিছুতে আগুন লাগাতে ঘুরে গেল অকল্পনীয় সেই আলোকরশ্মি। গাঢ় তমিস্রা শিউরে উঠল যেন অপার্থিব সেই রশ্মি অন্ধকারের বুকে আছড়ে পড়তেই।

আচমকা বিষম আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছিলাম আমি। দৌড়! দৌড়! দৌড়! অন্ধকারের মধ্যে মাঠের ওপর হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়েও ফের ঠিকরে গিয়ে দৌড়েছিলাম পাগলের মতো।

আমি একাই জীবন নিয়ে শুধু ফিরে এসেছিলাম মৃত্যু-যজ্ঞ থেকে। আমার পেছনে তারার আলোয় গর্তের চারধারে দেখা যাচ্ছিল প্রায় চল্লিশটা মৃতদেহ।

ওগিলভি আর হেন্ডারসনও ছিল ওদের মধ্যে। পাশাপাশি দুজনে পড়ে ছিল নিথর চাহনি আকাশের পানে মেলে ধরে–শান্তির বাণী নিয়ে গিয়ে জীবন আহুতি দিয়েছিল চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে।

তখন, সেই পলায়নের মুহূর্তে, কোনও চিন্তাই আমার মাথায় ছিল না… কারও কথাই ভাবিনি… ভাবতে পারিনি… সমস্ত সত্তা জুড়ে বিরাজ করছিল অবর্ণনীয় এক আতঙ্ক… সে আতঙ্কবোধকে ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু মনে আছে, আমি দৌড়াচ্ছি… দৌড়াচ্ছি… দৌড়াচ্ছি! হোঁচট খাচ্ছি, আছড়ে পড়ছি, তেড়েমেড়ে উঠে আবার ছুটছি৷ দিগ্‌বিদিক জ্ঞান হারিয়ে আতঙ্ক-অঞ্চল থেকে নিমেষে দূরে সরে এসেছি। তারপর পুলের এপাশে রাস্তায় পৌঁছেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম। নাক-মুখ কেটে রক্তারক্তি হয়েছিল। বোধহয় বেহুশ হয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ।

অবশেষে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। টলতে টলতে এবং কাঁপতে কাঁপতে পুল পেরিয়ে গিয়েছিলাম এক হাতে কপাল খামচে ধরে। পেছনে পড়ে ছিল নিস্তব্ধ প্রান্তর। মনে হয়েছিল যেন দুঃস্বপ্নের ঘোরে ছুটে এলাম এতটা পথ।

কিছু দূর এসে দেখলাম, মেবেরি ব্রিজের ওপর দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ছুটছে একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে দক্ষিণদিকে। পাশের উঠোন থেকে বেশ কয়েকজনের কথাবার্তাও কানে এল। সবই চেনা, জানা এবং রোজকার দেখা–কিন্তু এইমাত্র যে লেলিহান মৃত্যুকে ফেলে এলাম পেছনে, তার সঙ্গে মিল নেই কোথাও!

ঢুকলাম শহরে। গ্যাসবাতির তলায় জনাকয়েকের জটলা দেখলাম। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম, কমনের নতুন কোনও খবর আছে কি না। আমার রক্ত-মাখা ধূলিধূসরিত উদভ্রান্ত মূর্তি দেখেই ওরা বুঝেছিল, কোত্থেকে আসছি আমি। তাই পালটা প্রশ্ন করেছিল আমাকে, আপনিই তো আসছেন ওখান থেকে? বলুন তো কী খবর?

খবর খুব খারাপ! মঙ্গল গ্রহের মানুষ এসে নেমেছে প্রান্তরে বলেছিলাম শুষ্ককণ্ঠে।

তাচ্ছিল্যের আর অবিশ্বাসের হাসি হেসেছিল রাস্তার লোকেরা। ধন্যবাদ জানিয়ে সরে পড়েছিল তক্ষুনি। বোধহয় পাগলই ভেবেছিল আমাকে আমার চেহারা দেখে।

মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল আমার। বোকার মতো অত কথা না বললেই হত। টিটকিরি সহ্য করতে হত না। কয়েকজনের পেছন পেছন ধাওয়া করেছিলাম রাগের মাথায়। স্বচক্ষে যা দেখেছি, তার বর্ণনা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেউ কর্ণপাত করেনি।

ভীষণ রেগে তখন বলেছিলাম, টের পাবেন শিগগিরই!

বাড়ি ফিরে এসে বউকে বলেছিলাম, এইমাত্র কী ভয়ানক কাণ্ড দেখে এলাম। টেবিলে রাতের খাবার সাজানো রয়েছে দেখে এক গেলাস সুরাপান করেছিলাম স্নায়ু চাঙ্গা করার জন্যে।

সব শেষে বলেছিলাম, একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গেল।

কী?–জিজ্ঞেস করেছিল স্ত্রী।

–গর্ত ছেড়ে নড়বে না মঙ্গলগ্রহীরা। ধারেকাছে কেউ গেলেই খতম করে দেবে।

–আসতেও তো পারে এখানে।

–না, না, আসবে না।

–কেন বল তো?

–নড়তেই পারে না। ওই গতর নিয়ে কোনওমতে বেরিয়েছে চোঙার বাইরে–সে যে কী কষ্টে, না দেখলে বুঝবে না। কেন জান? পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণের চেয়ে তিনগুণ বেশি। তার মানে, একজন মঙ্গলগ্রহীর মঙ্গল গ্রহে যা ওজন, পৃথিবীতে তার তিনগুণ বেশি ওজন। ওজন বাড়ছে, কিন্তু গায়ের জোর তো বাড়ছে না। কাজেই চলতে ফিরতে দম বেরিয়ে যাচ্ছে।

খেয়েদেয়ে ধাতস্থ হলাম।

বউ বললে, এতই যদি অসহায় তো এত লোক মারতে গেল কেন?

–আমার তো মনে হয় স্রেফ ভয়ে। ভীষণ ভয় পেলে মাথার কি ঠিক থাকে? হতভাগারা জানে না, বেশি বাড়াবাড়ি করলে গর্তে একটা বোমা ফেলে দিলেই ল্যাটা চুকে যাবে। ঝাড়েবংশে মারা যাবে প্রত্যেকে।

অনেক কথা হল খেতে খেতে। পরম শান্তিতে ডিনার-পর্ব শেষ করেছিলাম সেই রাতে। তারপর কেটেছে অনেক ভয়ংকর রাত অনেক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে। শেষ ডিনারের সেই সুখস্মৃতি ভুলতে পারিনি দুঃসহ উল্কণ্ঠা আর অবসাদের মধ্যে।

উত্তেজনার চোটে কিন্তু সেই রাতে একটা ব্যাপার একেবারেই খেয়াল করিনি। ভুলেই গিয়েছিলাম–যন্ত্রবিদ্যায় মঙ্গলগ্রহীরা এতই উন্নত যে, নিজেদের শরীর হঠাৎ গুরুভার হয়ে যাওয়ার বাধা কাটিয়ে নেওয়ার মতো যান্ত্রিক কৌশল নিশ্চয় ভেবে বার করবে। করেওছিল তা-ই। সমস্ত রাত ধরে ধু ধু কমন-প্রান্তরে চলেছিল সেই প্রস্তুতি। বানিয়েছিল একটার পর একটা মেশিন। যে মেশিনে চেপে অথর্ব দেহ নিয়েও তারা নরক। সৃষ্টি করবে সবুজ এই পৃথিবীতে। চোঙার বাইরে এসে গুরুভার দেহ নিয়ে কষ্টেসৃষ্টে তারা খাড়া করেছিল একশো ফুট উঁচু অদ্ভুত আকৃতির ভয়াল যন্ত্র!

রাত এগারোটা নাগাদ দুদল সৈন্যবাহিনী পৌঁছেছিল কমন প্রান্তরে। প্রান্তর ঘিরে সৈন্য সাজানো হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। অন্ধকারে শুধু ঠাহর করা গিয়েছিল, সারি সারি কামান নলচে ফিরিয়ে রয়েছে গর্তের দিকে। ঘোড়ায় চেপে তদারক করছে সেনাধ্যক্ষরা। সারি সারি সৈনিক বন্দুক হাতে তৈরি। শুধু হুকুমের অপেক্ষা।

রাত ঠিক বারোটার কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার খসে পড়েছিল একটা তারা। আবির্ভূত হয়েছিল দ্বিতীয় সিলিন্ডার!

পরের দিনটা কেটেছিল নিদারুণ উৎকণ্ঠার মধ্যে। রোজকার মতো সকালে দুধ দিতে এসেছিল গয়লা। দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি, নতুন কোনও খবর আছে?

সারারাত ধরে মঙ্গলগ্রহীদের ঘিরে রেখেছে আমাদের সৈন্যবাহিনী। খতম করার ইচ্ছে নেই আপাতত। বাড়াবাড়ি করলে অবশ্য মরবে।

দুধের ডোল গয়লার হাত থেকে নিতে নিতে বলেছিলাম, শুনলাম, কাল রাতে আর একটা সিলিন্ডার এসে পড়েছে। একটাতেই রক্ষে নেই, আরও একটা জুটল দেখছি!

যেতে যেতে বলে গিয়েছিল গয়লা, লোকসান তো ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির। ঝুটঝামেলা মেটবার পর ক্ষয়ক্ষতি মেটাতে ফতুর হয়ে যাবে।

প্রাতরাশ খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম কমন প্রান্তরের দিকে। পুলটার কাছেই মুখোমুখি হলাম দুজন সৈনিক পুরুষের সঙ্গে। ব্রিজ আগলে দাঁড়িয়ে বন্দুক হাতে।

রুখে দিল আমাকেও, দুঃখিত স্যার, আর এগনোর হুকুম নেই।

 গল্প জুড়ে দিলাম ওইখানেই দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, মঙ্গলগ্রহীদের স্বচক্ষে দেখেনি দুজনের কেউই। পাহারাই দিয়ে যাচ্ছে। আমি তখন বললাম, কী দেখেছি গত রাতে। তাপরশ্মির প্রলয়লীলা বর্ণনা করতে করতে ফের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল নিজেরই।

শুনেটুনে একজন সৈনিক বললে, মাটি ঘেঁষে গুঁড়ি মেরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেই বুঝবে বাছাধনরা।

অপরজন কাষ্ঠ হেসে বললে, তা না-হয় হল, কিন্তু তাপরশ্মি থেকে গা বাঁচাবে কী করে? ওভাবে হবে না হে–দূর থেকেই কামান দেগে শেষ করে দিতে হবে শয়তানের বাচ্চাদের।

বাড়ি ফিরে এলাম। নতুন খবর আর পেলাম না এত হাঁটাহাঁটি করেও। গরম পড়েছিল বেশ। সস্ত্রীক খেতে বসলাম ঘরের বাইরে–বাগানে।

দিব্যি শান্ত চারদিক। মোমবাতি জ্বলছে টেবিলে। খাচ্ছি নিশ্চিন্ত মনে। আচমকা শোনা গেল গুলিবর্ষণের শব্দ। একই সঙ্গে ভীষণ শব্দে হুড়মুড় করে কী যেন ভেঙে পড়ল। এত জোরে, যে মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে। জ্বলন্ত মোমবাতি তিনটে ছিটকে গেল টেবিল থেকে। আঁতকে উঠল আমার স্ত্রী।

ভয়বিহ্বল চোখে দেখলাম সেই ভয়াবহ দৃশ্য! কাছের গাছগুলোর চুড়োয় আগুন লাগছে একে একে–নিমেষে নিমেষে জ্বলে উঠছে দাউদাউ করে, আর…

ছোট গির্জের চুড়োটা ভেঙে আছড়ে পড়ছে মাটিতে।

তাপরশ্মি! প্রলয়ংকর তাপরশ্মি ঝলকিত হচ্ছে সবকিছুর ওপর! রাতের অন্ধকার চিরে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে করাল রশ্মির কোপে।

আমার বাড়ি একটা টিলার ওপর। উঁচু থেকে দেখলাম এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য। চকিতে বুঝলাম, যে উচ্চতায় ধেয়ে আসছে ওই রশ্মি, রেহাই দেবে না হয়তো পাহাড়চুড়োর এই বাড়িকেও। নাগালের মধ্যেই রয়েছে যে!

হলও তা-ই। বাগান থেকেই দেখতে পেলাম, বাড়ির মাথায় দুটো লম্বা চিমনির একটা আচমকা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল–ঠিক যেন কামানের গোলায় গুঁড়িয়ে গেল প্রস্তর চিমনি।

তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠে বলেছিলাম রুদ্ধশ্বাসে, অসম্ভব! এখানে থাকা আর যাবে না!

আতঙ্কে কাঠ হয়ে গিয়ে তারস্বরে বলেছিল স্ত্রী, কিন্তু যাবেটা কোথায়?

 লেদারহেডে তোমার ভায়েদের বাড়িতে বউকে ঠেলে বাড়ি থেকে বার করতে করতে বলেছিলাম গলার শির তুলে।

পাহাড় থেকে বেগে নামতে নামতেই দেখলাম, টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে একদল সৈন্য। দুজন তড়াক করে নেমে পড়ল ঘোড়ার পিঠ থেকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হেঁকে বলতে লাগল, পালান! পালান! মঙ্গল গ্রহের আতঙ্করা এদিকেই আসছে!

ঝটপট চলে গেলাম গাঁয়ের সরাইখানায়। মালিকের একটা এক-ঘোড়ার গাড়ি আছে জানতাম। আস্তাবলেই দেখলাম ভয়ার্ত ঘোড়াটাকে পা ঠুকতে। মালিকও বেরিয়ে এসেছিল আমাকে দেখে।

দ্রুতকণ্ঠে বলেছিলাম, দুপাউন্ড ভাড়া দেব–আজ রাতেই ফিরে পাবেন আপনার গাড়ি ঘোড়া সমেত।

ভাড়াটা খুব বেশি। কাজেই এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল সরাইখানার মালিক। ঝটিতি বাড়ি এসে দরকারি জিনিসপত্র প্যাক করে নিলাম। গাড়িতে এনে রাখলাম। বউকে নিয়ে পাশাপাশি বসলাম চালকের আসনে। চাবুক হাঁকড়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলাম তক্ষুনি।

দেখতে দেখতে এসে পড়লাম পরিচ্ছন্ন প্রশান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে। ধোঁয়া আর আওয়াজ পড়ে রইল পেছনে। রোদ ওঠার পর দেখলাম, দুপাশের ঝোপে অগুনতি গোলাপ ফুল। মিষ্টি রোদ্দুরে যেন হাসছে।

পাহাড়ের মাথায় উঠে তাকিয়ে দেখেছিলাম পেছনে। রাশি রাশি কালো ধোঁয়ায় আকাশ ছেয়ে গেছে। ধোঁয়ার মধ্যে থেকে ঝলসে উঠছে লাল আগুন। পূর্ব আর পশ্চিমে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে তাল তাল ধোঁয়া। তার মানে, মঙ্গলগ্রহীরা নারকীয় উল্লাসে অগ্নিসংযোগ করছে সবকিছুতেই। তাপরশ্মির পাল্লায় যা পড়ছে, ছারখার করে দিচ্ছে বিকট বিধ্বংসী লালসায়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে শুধু ধ্বংস আর ধ্বংস! চোখে জল এসে গেল আমার।

নির্বিঘ্নে পৌঁছালাম লেদারহেডে। সংবর্ধনা জানাল স্ত্রী-র ভায়েরা। ব্যাপার কী জানতে চাইল গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই।

সব বললাম। ঘণ্টাখানেক জিরেন দিলাম ঘোড়াটাকে। তারপরে স্ত্রী-কে ওদের হেপাজতে রেখে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির দিকে।

তখন রাত হয়েছে। আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার বেশ গাঢ়। মেঘপুঞ্জও যেন ভারী হয়ে ঝুলে পড়ছে। দরজার আলোর সামনে ম্লানমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। স্ত্রী-কে। মুখ সাদা। দূর হতে হতে দূরে মিলিয়ে গেল সেই মূর্তি।

ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেলাম একটার পর একটা বাড়ি। সব বাড়িই কালচে মেরে গেছে। সাড়াশব্দও নেই। চলেছি যেন গোরস্থানের মধ্যে দিয়ে। থমথম করছে চারদিক। ঠিক পেছনেই মধ্যরাতের ঘণ্টা বেজে উঠল একটা গির্জাতে।

আচম্বিতে সবুজ আলোয় সবুজ হয়ে গেল সমস্ত পথ। মাথার ওপরকার মেঘের রাশি চিরে সবুজ আগুন বর্শাফলকের মতো এসে পড়েছে সবুজ পৃথিবীর ওপর। আশ্চর্য সেই আগুন আর আলো দেখেই পলকের মধ্যে বুঝলাম, কী ঘটে গেল।

তৃতীয় সিলিন্ডার এসে পড়ল আমার ঠিক বাঁদিকের মাঠে।

একই সঙ্গে যেন রকেট বিস্ফোরিত হল মাথার ওপর। যুগপৎ বজ্রনাদ আর বিদ্যুতের ঝলকানিতে খেপে গেল আমার ঘোড়া। নক্ষত্রের বেগে ছুটল গাড়ি নিয়ে। বৃথাই রাশ টেনে ধরবার চেষ্টা করলাম আমি।

তুফান মাথায় নিয়ে ধেয়ে গেলাম এইভাবে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আশপাশে, বাজ পড়ছে কড় কড় কড়াৎ শব্দে, ছুঁচের মতো বৃষ্টি বিধছে মুখে। পাগলা ঘোড়া ছুটছে তো ছুটছেই। চাবুক মেরেও শায়েস্তা করতে পারছি না। নজর রেখেছি কেবল রাস্তার ওপর। মাঠেঘাটে না নেমে পড়ে।

হঠাৎ দেখলাম, কী যেন একটা সোত করে নেমে গেল পাহাড়ের গা বেয়ে উলটোদিকে।

যা দেখলাম, তা আমার রক্ত জমিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট! বর্ণনা করবার ভাষা কি আমার আছে? লম্বা লম্বা পাইন গাছের মাথা টপকে হনহন করে দৌড়াচ্ছে একটা তেপায়া দানব! মড়মড় করে গাছ ভেঙে যাচ্ছে ঠ্যাঙের ধাক্কায়। চকচকে ধাতু দিয়ে গড়া দেহ! দানব নিঃসন্দেহে–তবে রক্তমাংসের নয়–ধাতুর। বিশাল ইঞ্জিন হেঁটে চলেছে… ছুটে চলেছে… গাছপালা ভেঙে পথ করে নিচ্ছে .. কখনও সখনও লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে টপকে যাচ্ছে।

পরক্ষণেই আমার ঠিক সামনের গাছগুলো দুদিকে সরে গেল–ফাঁকে আবির্ভূত হল আর-একটা ধাতুময় তেপায়া দানব। টগবগিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে আমি চলেছি ঠিক তার দিকেই!

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাগাম টেনে ধরেছিলাম। শিরপা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বেচারি অশ্ব। নিমেষমধ্যে তার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম ডানদিকে।

আচমকা ওইভাবে বাঁক নিলে দুর্ঘটনা ঘটবে, এ আর আশ্চর্য কী! গাড়ি উলটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ওপরের আসন থেকে আমি ঠিকরে পড়লাম রাস্তার পাশে একটা খানায়।

জলে পড়েছিলাম বলেই বেঁচে গেলাম সে যাত্রা। হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসে লুকিয়ে রইলাম একটা ঝোপের মধ্যে। আমার পাশ দিয়েই একশো ফুট উঁচু চলন্ত আতঙ্কটা দমাস দুম শব্দে হাঁটতে হাঁটতে উঠে গেল পাহাড় বেয়ে ওপরদিকে।

ঝোপের মধ্যে থেকেই শুনতে পেলাম, হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে অদ্ভুত চিৎকার করছে তেপায়া দানব, আলু-উ-উ! আলু-উ-উ!

ডাক শুনেই বোধহয় ছুটে এল অন্য দানবটা মুখোমুখি হল দুজনে। আবার অপার্থিব সেই গর্জনে কেঁপে উঠল দিগদিগন্ত।

পাশাপাশি হেঁটে গেল দুজনে মাঠের মধ্যে। হেঁট হয়ে কী যেন খুঁজছে। নিশ্চয় তৃতীয় চোঙার সন্ধানে বেরিয়েছে। দূর থেকে মিনিটকয়েক ধরে দেখে গেলাম তাদের অন্বেষণপর্ব।

তারপরেই গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম খানার মধ্যে থেকে। অন্ধকারে গা ঢেকে পাঁইপাঁই করে দৌড়ালাম পাইন অরণ্যের দিকে।

উদ্দেশ্য আমার একটাই–বাড়ি পৌঁছাতে হবে যেভাবেই হোক। অনেক ছুটে, অনেক কষ্ট করে, অনেক বিপদ পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছালামও।

দরজা বন্ধ করে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম বটে, কিন্তু একটু পরেই বাইরে একটা আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়।

বাগানের অন্ধকারে দেখলাম একটা ছায়ামূর্তিকে। আমার দিকেই আসছে। একটু এগতেই দেখলাম তার ছন্নছাড়া বেশ। উদভ্রান্ত চেহারা। মঙ্গলগ্রহীদের কবলে পড়েছিল মনে হচ্ছে।

হেঁকে বললাম, ভেতরে আসুন–যদি লুকিয়ে বাঁচতে চান।

যা।–বলে দৌড়ে এল পুরুষমূর্তিটি।

 যা।-বলে দৌড়ে এল পুরুষমূর্তিটি।

 ঘরের আলোয় তাকে দেখলাম ভালো করে। বললাম সবিস্ময়ে, আপনি সোলজার? ব্যাপার কী বলুন তো?

যেন ককিয়ে উঠল জোয়ান সৈনিক পুরুষ, ব্যাপার অতি ভয়ানক! টিপে মেরেছে বলতে পারেন। মৃত্যু আর ধ্বংসের স্রোত বইয়ে দিয়েছে! কেউ আর বেঁচে নেই!

–বলছেন কী!

কামান গাড়ি চালাই আমি। কামান নিয়ে যাচ্ছিলাম বালির গর্তটার দিকে… একটা গর্তে পা পড়েছিল আমার ঘোড়ার… ছিটকে পড়েছিলাম খানায়–নিষ্প্রভ চোখে ক্লান্ত কণ্ঠে বলে চলে ছন্নছাড়া সৈনিক, আচমকা কামান গর্জন শুনলাম পেছনে–মাথার ওপর দিয়ে শনশন করে চলে গেল গোলার পর গোলা… বিস্ফোরণের আওয়াজে কান যখন ভোঁ ভোঁ করছে, ঠিক তখনই আগুন আর মৃত্যু দেখলাম চারপাশে। তেপায়া দানব!… তেপায়া দানব! মারণ রশ্মি ছুঁড়ে চোখের পলক ফেলতে-না-ফেলতে ধ্বংস করে দিল সবকিছু! ও ভগবান! কামান ঠিকরে গেল! মানুষ ছিটকে গেল! ঝলকে ঝলকে রশ্মি এসে আগুন জ্বালিয়ে দিলে চারধারে। মড়ার পাহাড় জমে উঠল আমার ওপর–বেঁচে গেলাম শুধু সেই জন্যেই।

তারপর? তারপর?–রুদ্ধশ্বাসে বলেছিলাম আমি।

কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম তারপরেও অনেকক্ষণ। দূরে দূরে দেখা যাচ্ছিল ভয়ংকর দানবদের কী বিরাট! কী বিকট! বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়ে গিয়েছিল কিম্ভুতকিমাকার ওই চেহারা দেখেই।

–শেষ পর্যন্ত হল কী?

-কী আর হবে? গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম মড়ার গাদা ঠেলে… অতি কষ্টে এসেছি এদূর।

সৈনিক পুরুষের ক্লান্ত, অবসন্ন মুখচ্ছবি দেখে মনটা মুচড়ে উঠল আমার। হতাশায় ভেঙে পড়েছে একেবারেই। পরাজয় যে এত নিষ্করুণ হতে পারে, ভাবতে পারেনি কামানচালক। কামানের গোলাও যাদের কিছু করতে পারে না, তারা যে কী বিভীষিকা, তা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার পর।

ওপরতলায় গেলাম দুজনে। জানলা দিয়ে তাকালাম মৃত্যু উপত্যকার দিকে। উষার আলোয় দেখা যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপ। মড়া ছড়িয়ে সর্বত্র। কামানগাড়িগুলো উলটে ভেঙেচুরে পড়ে আছে উপত্যকাময়। যেন খেলনার গাড়ি। ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মানুষ আর ঘোড়া, পোড়া গাছ আর ঘাস, ধোঁয়া আর আগুন–যেন শ্মশানভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো উপত্যকাটা। করাল আকৃতি নিয়ে দূরে দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা যন্ত্রদানব।

প্রান্তরব্যাপী মৃত্যুর হাহাকার। চোখে জল এসে গেল দুজনেরই। বেশ বুঝলাম, এ বাড়িও আর নিরাপদ নয়। চম্পট দেওয়া দরকার এখুনি।

সৈনিক পুরুষ বললে, আমি বরং ফিরে যাই আমার বাহিনীতে।

আর আমার কাজ হবে স্ত্রী-কে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া।–বললাম আমি।

পকেট ভরতি খাবারদাবার নিয়ে চুপিসারে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। গাছের পাতা নড়লেও চমকে উঠছি দুজনেই। ঘন ঘন দেখছি আশপাশে–বিশ্বাস নেই। যন্ত্রদানবদের-রশ্মি নিক্ষেপ করতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে।

ভয়ে কাঠ হয়ে পা টিপে টিপে পেরিয়ে এলাম একটা জঙ্গল। পৌঁছালাম একটা রাস্তায়। দেখলাম, ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে একজন সেনাধ্যক্ষ। দূরে সার বেঁধে যাচ্ছে একদল সেনানী।

ছুটে গেল আমার সঙ্গী, স্যার, ফিরে যাচ্ছি আমার বাহিনীতে। মঙ্গলগ্রহীরা কিন্তু এই রাস্তা বরাবর রয়েছে।

দেখতে কীরকম বেটাদের?–ভুরু কুঁচকে শুধায় অশ্বারোহী সেনাধ্যক্ষ।

-ধাতু দিয়ে তৈরি দানব। একশো ফুট উঁচু। আগুন ছুঁড়ে মারে মাথার ওপরকার বাক্স। থেকে।

ননসেন্স!

মোটেই না। সব সত্যি!–পাশ থেকে বললাম আমি।

 ব্যঙ্গের হাসি হেসে ঘোড়া ছুটিয়ে উধাও হল সেনাধ্যক্ষ। গ্রাহ্যের মধ্যেই আনল না আমাদের হুঁশিয়ারি। ঠেলা বুঝবেখন রশ্মিবর্ষণ শুরু হলে।

একটু এগতেই দেখলাম, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সৈন্যরা প্রত্যেককে বলছে জিনিসপত্র ফেলে রেখে এখনই চলে যেতে। কিন্তু শুনছে না কেউ। চরমে উঠেছে কথা কাটাকাটি। একজনের বড় মায়া ফুলের টবগুলোর ওপর। ব্যাগ ভরতি করে নিয়েছে। কড়া গলায় বারণ করছে। একজন সোলজার। কিন্তু কে কার কথা শোনে। প্রত্যেকেই কিছু-না-কিছু নিয়ে যেতে চায়। বাড়ি থেকে, অথচ খালি হাতে এখুনি তল্লাট ছেড়ে চম্পট দেওয়ার হুকুম দিয়ে যাচ্ছে সোলজাররা। হট্টগোলে কান পাতা দায়।

ফুলের টব না নিয়ে যে যাবে না, তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। ধমক দিয়ে বললাম, রাস্তার ওদিকে, জঙ্গলের ওপারে কী আছে জানেন?

না তো? টবগুলো আঁকড়ে ধরে অসহায়ভাবে বললে ফুল-পাগল লোকটা।

মৃত্যু! মৃত্যু! মৃত্যু! তেড়ে আসছে এদিকে। তীব্রস্বরে ফেটে পড়েছিলাম মৃত্যু-উপত্যকার মাঝে টহলদার যন্ত্রদানবগুলোর কথা মনে পড়তেই।

রাত হল। আকাশে তারা ফুটল। একটা মাঠের ওপর ছটা বিরাট কামানের পাশে গোলন্দাজদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। মাঠের শেষ প্রান্তেও সারি সারি কামান আর সৈন্য দেখা যাচ্ছে তারার ম্লান আলোয়।

পাশ দিয়ে যেতে যেতে শুনলাম গোলন্দাজবাহিনীর কথাবার্তা।

–একটা-না-একটা গোলা খেতেই হবে বাছাধনদের।

বিদ্যুতের চেয়েও জোরে ছোটে এই কামানের গোলা–ঠেলাটা বুঝবে এবার।

থমকে দাঁড়ালাম সেনাধ্যক্ষের পাশে। বয়স্ক পুরুষ। এক মুখ দাড়ি। চোখ কঠোর। চাহনি দূরে নিবদ্ধ। কথা বলছে আপন মনে। আত্মবিশ্বাস ক্ষরিত হচ্ছে প্রতিটি শব্দ থেকে। থামাবই–এই মাঠ পেরিয়ে আর এগতে হচ্ছে না লন্ডনের দিকে। কামানে কামানে ছেয়ে রাখা হয়েছে এখান থেকে লন্ডন পর্যন্ত। সব কটাকেই শেষ করব এখানেই।

আত্মশ্লাঘার অবসান ঘটল ঠিক সেই মুহূর্তে। আচম্বিতে মাটি কাঁপিয়ে অন্ধকার প্রান্তরে আবির্ভূত হল তিনটে প্রকাণ্ড যন্ত্রদানব। রুখে দাঁড়াল গোলন্দাজবাহিনী।

আমরা কিন্তু দৌড়াচ্ছিলাম। প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়ালাম। নিরস্ত্র কোনও নাগরিকই দাঁড়িয়ে রইল না ভয়াবহ লড়াইয়ের পরিণতিটা দেখবার জন্যে।

পেছন ফিরে আমি কিন্তু দেখেছিলাম, একসঙ্গে গর্জে উঠেছে ছটা কামান। শূন্যপথে প্রচণ্ড শব্দে ফেটে যাচ্ছে কয়েকটা বোমা। শনশন করে যন্ত্রদানবদের আশপাশ দিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে কামান-নিক্ষিপ্ত ধ্বংসদূতেরা। তারপরেই একটা গোলা আছড়ে পড়ল একটা ধাতুময় তেপায়া দানবের ওপর–নির্ভুল লক্ষ্যে!

অগ্নিঝলকে ক্ষণেকের জন্যে দেখেছিলাম, কালো কালো ছায়ামূর্তির মতো গোলন্দাজবাহিনী ক্ষিপ্তের মতো কামানের নল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেল দেগে যাচ্ছে। অনেক উঁচুতে রক্ত-জমানো আকৃতি নিয়ে মহাকায় একটা তেপায়া দানব তাদের ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল বলে। দূরে, পেছনে দেখা যাচ্ছে, নির্ভয়ে এগিয়ে আসছে আরও দুটো বিদঘুটে দানব। ঠিক সেই সময়ে একদম সামনের কিম্ভুত আকৃতিটার একটা পা খানখান হয়ে গেল শেল বিস্ফোরিত হতেই। দিকে দিকে বিচ্ছুরিত হল অগ্নিঝলক–টুকরো টুকরো যন্ত্রাংশ ঠিকরে গেল আশপাশে।

জয়োল্লাসে ফেটে পড়ল সেনাবাহিনী। এই প্রথম ঘায়েল করা গেছে একটা দানবকে! সত্যিই ঘায়েল হয়েছে অজেয় যন্ত্রদানব। মারাত্মক চোট পেয়েছে। ভাঙা পায়ের ওপর বিরাট দেহটা টলমল করে উঠেই আছড়ে পড়ল দড়াম করে।

মুহূর্তের মধ্যে কিন্তু বিপর্যয় ঘটিয়ে ছাড়ল জখম যন্ত্রদানবের সঙ্গী দুজন। তাপরশ্মি বর্ষিত হল ঝলকে ঝলকে সেনাবাহিনীর ওপর। কামান-বন্দুক-গোলাবারুদে আগুন ধরে গেল চক্ষের নিমেষে। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটল সঙ্গে সঙ্গে। ভয়াবহ সেই বিস্ফোরণের তুলনীয় বিস্ফোরণ জীবনে কখনও শুনিনি বা দেখিনি। সৈন্যসামন্ত পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হল ওই একটা বিস্ফোরণেই। অগ্নিঝলকের মধ্যে দিয়ে শুধু দেখলাম, বহু উঁচুতে ঠিকরে যাচ্ছে। সৈন্যদের লাশ!

সব শেষ! নিমেষমধ্যে যুদ্ধ খতম। খুব যে বড়াই করেছিল সেনাধ্যক্ষ-মৃত্যু যে এমন অতর্কিতে আসতে পারে, কল্পনাও করতে পারেনি। জানি না, এই মুহূর্তে তার পিঞ্জরশূন্য নশ্বর দেহটা আস্ত অবস্থায় আছে, না টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মাঠের নানা দিকে।

কিন্তু কী আশ্চর্য! মৃত্যু নেই কি তেপায়া দানরের? ভূপাতিত যন্ত্রদানবের ভেতর থেকে গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল বিকটাকার একজন মঙ্গলগ্রহী। কদাকার সেই দেহ-কমন প্রান্তরে যা দেখে রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল আমার। সেই বীভৎস চোখ। সেই কিলবিলে শুড়। গুটিগুটি বেরিয়ে এসে যন্ত্রপাতি মেরামতি নিয়ে ব্যস্ত হল মাঠের মধ্যেই। আমরা পৃথিবীর মানুষরা ছেঁড়া কাপড় যেভাবে সেলাই করে নিই ছুঁচ দিয়ে অনায়াসে, খণ্ডবিখণ্ড যান্ত্রিক পা খানাকেও সেইরকম অতি সহজে ঠিক করে নিল বিদঘুটে মঙ্গলগ্রহী। তুখড় কারিগর বটে। যন্ত্রশিল্পে কতখানি দক্ষতা থাকলে এত সহজে এত কম সময়ে মেশিন মেরামত করা সম্ভব হয়, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

ভগ্নপদ ঠিক হয়ে যেতেই এক ঝটকান দিয়ে ফের সিধে হয়ে দাঁড়াল যন্ত্রদানব!

গুলি-বারুদ-কামান-বন্দুক ফেটে উড়ে যেতেই এবং একই সঙ্গে আশপাশের বনভূমিতে আর ঘরবাড়িতে আগুন লেগে যেতেই লোকজন পালিয়েছিল যে যেদিকে পারে। পালিয়েছিলাম আমিও। তারপর একটা ঝোপের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ক্লান্ত দেহে৷ প্রান্তর জুড়ে তখন বিরাজ করছে ধোঁয়া আর আগুন। উকট গন্ধেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটেনি আমার–এতই ক্লান্ত হয়েছিলাম সেই রাতে।

ঘুম ভাঙার পর দেখলাম, আমার পাশে বসে একজন পাদরি। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছিল আমার। শুষ্ক কণ্ঠে জল চেয়েছিলাম তার কাছে। বিষমুখে ঘাড় নাড়তে নাড়তে পাদরি জানিয়েছিল, জল-টল কিছুই নেই তার কাছে। পরক্ষণেই ক্ষিপ্তের মতো হাত-পা ছুঁড়ে সে কী চিৎকার–মাথাটা সাফ করবার জন্যে পায়চারি করছিলাম মশায়–হঠাৎ এ কী কাণ্ড! আগুন, ভূমিকম্প, মৃত্যু!

হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম আমি। মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি পাদরি সাহেবের? দুই চোখ ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। মুখ বিকৃত হয়ে গেছে প্রচণ্ড উত্তেজনায়। ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে আপন মনে–শেষ… শেষ… পৃথিবীর শেষ! পাপে ভরে উঠেছিল এই পৃথিবী। তাই শেষ হয়ে গেল মানুষ জাতটা।

বেশ বুঝলাম, নারকীয় কাণ্ডকারখানা স্বচক্ষে দেখে মাথাটাকে বিগড়ে বসে আছে পাদরিসাহেব। পাগল হয়ে গেছে একেবারেই বদ্ধ উন্মাদ!

অন্ধকারের মধ্যে পাগলের প্রলাপ আরও কতক্ষণ শুনতে হত জানি না, আচমকা টনক নড়ল দুরে দুটো চলমান তেপায় দানবকে দেখে।

মনে পড়ল সেই সেনাধ্যক্ষের স্বগতোক্তি। লন্ডন পর্যন্ত সর্বত্র কামান সাজানো আছে যন্ত্রদানবদের রুখে দেওয়ার জন্যে। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে অনেকটা পথ এসেছি ঠিকই, কিন্তু ঝোপেঝাড়ে নিশ্চয় ওত পেতে আছে কামান আর গোলন্দাজবাহিনী। এখনই শুরু হবে গোলাবর্ষণ। প্রচণ্ড নির্ঘোষে এখনই খানখান হয়ে যাবে রাতের নৈঃশব্দ্য। যন্ত্রদানবরা যতই শক্তিধর হোক-না কেন, অপরাজের যে নয়, তার প্রমাণ তো দেখেই এসেছি। তাক করে আঘাত হানতে পারলে ওদের ধরাশায়ী করতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু এ কী হাল! রশ্মিবর্ষণের ধার দিয়েও যে গেল না বিকট দানবরা। ভেবেছিলাম, মারণরশ্মি ঝলকে ঝলকে নিক্ষিপ্ত হবে কামানবর্ষণ শুরু হলেই। কিন্তু তার আগেই আর একটা সাংঘাতিক অস্ত্র প্রয়োগ করল মঙ্গলগ্রহীরা।

কালো ধোঁয়া!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *