উচ্চ জীবন – ডা. লুৎফর রহমান
১. নারী-পুরুষ
এমন মানুষ নেই যার নারীর প্রতি একটা টান নেই … এ টান মোটেই দোষের নয়। যখন আকাশ থেকে আদি পুরুষ পৃথিবীতে এলেন, তখন তাঁর বড় শূন্য বোধ হতে লাগলো। খোদা তাঁকে এক পত্নী দিলেন–যিনি হলেন তার সঙ্গিনী ও বন্ধু।
নারী তো পুরুষের বন্ধু। আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বিপদ ঝঞ্ঝার চাপে পড়ে কাঁপছে, কাছে তোমার পত্নী রয়েছে; তার হাত ধরলে তোমার বুকে বিপুল উৎসাহ আসবে। একার পক্ষে সে আঘাত সহ্য করা তোমার সম্ভব হতো না।
যে কারণে বেঁচে আছ সেই শুভ উদ্দেশ্যকে সার্থক করবার জন্যে তুমি নারীর সঙ্গে মিলিত হতে পার–অন্য কোনো কারণে নয়। অসত্য ও পাপকে অবলম্বন করে যদি প্রতিষ্ঠা চাও, তবে নারীকে তোমার সঙ্গিনী হবার জন্য আহ্বান করো না–এ জন্যে নারীর সৃষ্টি হয় নি। তোমার পুণ্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে নারী এসেছিল–তার সৌন্দর্য সুষমার অপব্যবহার করো না।
তারই নারীর সঙ্গে প্রেম করবার অধিকার আছে, যে নিজেকে সত্যের সৈনিকরূপে প্রচার করে। যে, এ জগতে পাপ ও অন্যায়কে দলিত করবার জন্যে বেঁচে আছে–সে মানুষ, সে মিথ্যার উপাসক নয়।
বড় কাজের পথে নারী অন্তরায় এ বিশ্বাস করো না। তোমাকে জয়যুক্ত করবার জন্যই তো নারীর আগমন। তোমার দুর্বল বাহুতে, তোমার ভাঙ্গা মনে শক্তি দেবার জন্যেই তো সে তোমার পাশে দাঁড়িয়ে।
যে নারী স্বামীর সাধনা পথের সহায় না হয়ে অন্তরায় হয়েছেন তিনি তার নারী জীবনকে ব্যর্থ করে দিয়েছেন।
লর্ড বেকন (Lord Bacon) বলেছেন, বিয়ে করলে বড় কাজ করবার ক্ষমতা থাকে না। রাতদিন তাকে ভাতের ভাবনা ভাবতে হয়–সে জীবনের কাজ কি করবে?
কতগুলি মানুষ সন্ন্যাসী থেকে মানব জাতির কল্যাণের জন্যে জীবন উৎসর্গ করুক, এ আমি চাই নি। সমাজের সেবায় কারো এত বড় ত্যাগ স্বীকারের আবশ্যকতা নেই। তিনি বড় হতে পারেন, কিন্তু তার এ নীরব জীবন দেখে আমার মনে কষ্ট হয়। আমি এ সেবা চাই নে।
পিতা, ভাই বা স্বামীরূপে যে মানব পরিবারে স্পর্শে আসে নাই। সে কোনো বিশেষ পথে জীবনকে সার্থক করতে পারে, কিন্তু মানুষের ব্যথা ঠিক ঠিক বোঝবার ক্ষমতা তার হয়তো হয় না। তার প্রকৃতিও তেমন সরস হয় না।
নারী পুরুষের রক্তে-মাংসে জড়িয়ে আছে, সে তাকে কেমন করে অস্বীকার করবে? দুঃখ বেদনা থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যে যে বিয়ে করে না–সে কাপুরুষ। উপবাসক্লিষ্ট পরিবারের দুঃখদগ্ধ উপাসনা খোদার দুনিয়াকে বড় মধুর করে তুলেছে। নারী-পুরুষ মিলিত হলে যদি জগতের দুঃখ বাড়ে, বাড়ুক–সে দুঃখ-ব্যথাকে জয় করতে হবে। আগেই একেবারে দুঃখ হতে পালাতে চেষ্টা করো না–তা হলে খোদার সঙ্গে প্রেম করাটাই মিছে হয়ে যাবে।
জগতের অনেক বড়লোক চিরকুমারই ছিলেন। তাঁদের জীবনের বিশেষ কাজকেই যেন তাঁরা বিয়ে করেছিলেন। গ্যালিলিও, ডেকাটে এবং ক্যাভেনডিস (Cavendish) ছিলেন অবিবাহিত। ক্যাভেনডিস নারী জাতিকে বড় ঘৃণা করতেন। বাড়ির কোনো মেয়ে ভূত্যের তার সামনে উপস্থিত হওয়া একেবারে নিষেধ ছিল, হঠাৎ কোনো গতিকে সামনে পড়লে তার তখন চাকরি যেত। তিনি ছিলেন একজন বৈজ্ঞানিক-প্রাণ ছিল তার নীরস ও কঠিন, যেখানে একরত্তি ভালবাসা বা মায়া স্থান পেত না।
ঐতিহাসিক হিউম (Hume) গীবন ও মেকলেও বিয়ে করেন নি। গীবন (Gibbon) একবার ভালবাসায় পড়েছিলেন, কিন্তু পিতার আদেশে প্রণয়িনীকে ত্যাগ করতে বাধ্য হন। যেখানে ভালবাসাটা তত গভীর নয়, সেখানেই কারো আদেশে এর হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায়।
জেরেমী বেনথাম Jeremy ventham) জীবনের প্রথম বয়সে এক নারীকে ভালবাসেন। বুড়োকালে যখন সেই বাল্য-প্রণয়িনীর কথা তার মনে পড়ত তখন তিনি বালকের মতো রোদন করতেন। ভালবাসার প্রতিদান না পেয়ে চিরকালই তিনি অবিবাহিত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন বড় দার্শনিক।
রাজনীতি বিশারদ পিট ফক্স (Pit Fox) কোনো নারীর পাণি গ্রহণ করেন নি। জীবনের সাধনার পথে পত্নী বাধা হবে ভেবে পিট কঠিন সংযম বরণ করে নিয়েছিলেন। যে নারীকে তিনি ভালবেসে ছিলেন তিনি ছিলেন খুব সুন্দরী। তাঁকে পত্নীরূপে গ্রহণ করতে পারেন নি, এজন্যে তাঁর প্রাণে বড় বেদনা বেজেছিল। তিনি ভাল করেছিলেন কি মন্দ করেছিলেন তা বলতে পারিনে : ছোট ছোট শিশুদের নিয়ে খেলা করা ছিল পিটের জীবনের একটা মহা আনন্দের বিষয়।
চিত্রকর র্যাফেলো (Raphaelo) মাইকেল এঞ্জেলো (Michael Angelo) নারীকে আমল দেন নি। রেনলড়সের (Raymlods) ধারণা ছিল বিয়ে করলে ভালো চিত্রকর হওয়া যায় না। সৌন্দর্য ও রসবোধ নষ্ট হয়ে যায়। এক বন্ধু চিত্রকরকে বিয়ে করতে দেখে তিনি চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, এই বারই তোমার চিত্র আঁকা শেষ হবে। বস্তুতঃ তাঁর এ মন্তব্যের মূলে কিছু সত্য থাকলেও চিত্রকর বন্ধুর বিয়ে করাতে বিশেষ। কোনো ক্ষতি হয় নি। কোনো বাস্তব সুন্দরীর স্পর্শে পাছে কল্পনা সুন্দরীর অন্তর্ধান হয় এই ভয়ে হয়তো বন্ধুকে সতর্ক করেছেন।
সঙ্গীতবিদ্যা বিশারদ বোভেন (Bethoven) যদি হতাশ প্রেমিক না হতেন তা হলে হয়তো তাঁর সঙ্গীত বিদ্যায় এত পারদর্শিতা ঘটত না। খুঁজেও সারা জীবন তিনি একটা মনের মানুষ পান নি। আশা ও আনন্দহীন হৃদয় নিয়ে তিনি গানের চর্চায় মন দিয়েছিলেন এবং তাতেই তিনি যথেষ্ট কীর্তি অর্জন করেছিলেন। অনেক নারীও চিরকাল কুমারী জীবন যাপন করে গিয়েছিলেন। কেউ হয়তো স্বাধীন থাকবার জন্যে, কেউ মানব সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। দাম্পত্য জীবনের সুখ ও দায়িত্ব হতে দূরে থেকে অনেকে সাহিত্য ও জ্ঞানের সেবা করে জীবন কাটিয়েছেন, কেউ কেউ প্রথম জীবনে কোনো যুবককে ভালবেসেছিলেন, প্রতিদান না পেয়ে আর কোনোকালে বিয়ে করেন নি।
নারী বহুভাবে নিজেদের জীবন সার্থক করতে পারেন। তাই বলে বিয়ে না করে অন্য পথে নারী জীবনকে সফল করতে চেষ্টা করুক, এ আমি বলছি নে। আমার কথা নারী ইচ্ছা করলে পুরুষদের ন্যায় নিজেদের জীবনকে মূল্যবান ও শ্রদ্ধেয় করে তুলতে পারেন। নীরবে অজানা অচেনা হয়ে, অসীম ধৈর্যে মঙ্গলময়ী নারী মানব জাতিকে যে সুখ ও আনন্দ দান করেন, তার তুলনা কোথায়?
বিদেশে কিরূপ হয় জানি নে, এদেশে কিন্তু নারীর সেবা ও স্নেহের কোনো মূল্য নেই। সমাজের অত্যাচার তাদের কর্মশক্তিকে একেবারে চূর্ণ করে ফেলেছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীদের হাসপাতালটি দুটি সামান্য দরিদ্র মেয়ে কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল। মানুষের দ্বারে দ্বারে যেয়ে তারা ভিক্ষা করেছিলেন।
অসম্মান ও অভাবের চাপে পিষ্ট হওয়ার চেয়ে বিয়ে না করাই ভালো। বিয়ে করে যদি কতকগুলি লোকের কষ্ট বাড়ান হয় তা হলেও নারী-পুরুষের মিলনের প্রয়োজন নেই। বিয়ে করে দাস জীবনের অগৌরব বাড়িয়ে আর লাভ কী?–এই কথা বলতে খুব ইচ্ছা হয়, কিন্তু কঠিনভাবে আদেশ করতে ভয় পাই। সতী স্ত্রী ও চরিত্রবান ব্যক্তির প্রণয় মিলন জগতের মর্যাদা ও শোভা বর্ধন করেছে।
নারীর যদি কর্মশক্তি থাকতো, সে যদি এত সরলা, এত ভীতা, চকিতা, এত কৃপার পাত্রী না হতো তাহলে তার সঙ্গ লাভ মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক হতো না। নারী যে মানুষের অসম্মানের তার সহানুভূতি চাই, অতএব কোনো অবস্থায় তাকে বাদ দেওয়া চলে না। আমার কাঁদবার সময় আমি নারীর চোখেও অশ্রু দেখতে চাই নইলে যে আমি মরে যাব।
যে দেশে নারীর কিছুমাত্র সম্মান নাই, যেখানে সে হাসল মানুষ তাকে চরিত্রহীন বলে সন্দেহ করে, সেখানে তার কর্মশক্তি, তার মনুষ্যত্ব তার বিবেক ও ব্যক্তিত্ব জাগ্রত হবে কেমন করে? সেখানে নারী পুরুষ জীবনে কর্মপথের একটা বাধা ছাড়া আর কি? নারীর চোখ-মুখের সম্মোহন বিভার পাশে শক্তির শিখা জ্বালাও। সে শুধু ফুলের মতো মানুষের আরাম বর্ধন করবে না। হাতের যষ্টি হয়ে পুরুষ-সমাজের কল্যাণ বর্ধন করবে।
আল্লাহর নামে নারী-পুরুষের মিলন পার্থিব সকল কিছু অপেক্ষা মূল্যবান ও শ্রদ্ধার জিনিস। নারী-পুরুষের যথার্থ মিলন অতীব দুর্লভ। সত্যিকার প্রণয় যারা করতে পেরেছে তারা সামান্য নয়।
ইসলাম কঠিন কর্তব্যের জন্যে প্রেম-প্রণয়কে প্রশ্রয় না দিলেও ইউসুফ-জোলেখার সুমহান আত্মদানকে অতীব উচ্চ স্থান দিয়েছে। মানুষের আত্মা প্রেম ও স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু নয়।
প্রেম-স্বাধীনতা বাদ দিলে মানুষের কিছুই থাকে না। বহির্জগৎ হতে ধরে এনে ঘরে আবদ্ধ রেখে নারীর জীবনকে বর্তমানকালে ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। তাকে মানুষের প্রেমহীন কামুকতার উপকরণ করে তোলা হয়েছে। ইসলাম এটা সমর্থন করে না। নারীর জীবন এত ছোট নয়।
কেউ কেউ শুধু রূপ দেখে বিয়ে করেন। নারী-জীবনে রূপ একটা শ্রেষ্ঠ সম্পদ তা স্বীকার করি, কোনো এক বিখ্যাত ইংরেজ মহিলা বলেছেন–আমি আমার জ্ঞান বিসর্জন দিতে রাজি আছি, যদি বিনিময়ে রূপ মেলে। এই মহিলা দেখতে তত ভালো ছিলেন না।
রূপ মানুষকে অভিভূত করে ফেলে সত্য, কিন্তু রূপের পাশে যদি গুণ না থাকে, নারীর রূপ যদি পুরুষের মনকে অধঃপতিত করে, তার রুচি ও মনুষ্যত্বকে খর্ব করে দেয়, তবে সে রূপকে বাদ দিতে হবে। নারী বলতেই সে রূপসী–তাকে ভালবাসার মতো মন ও মহত্ত্ব চাই। ভালবাসা না থাকলে শ্রেষ্ঠ রূপসীও মানুষকে আনন্দ দান করতে পারে না। নারী-পুরুষের মিলনের শুধু উদ্দেশ্য হচ্ছে–জীবনের দানকে সার্থক করে তোলা। শুধু ভোগের জন্যে রূপকে যে আদর করে সে খুব ছোট।
নারীর মনে যদি রূপ না ফোটে তবে মুখের রূপে কেউ সত্যিকারের সুখ পায় না, স্থায়ী করে তাকে ভালবাসে না। বিরক্ত হয়ে দূরে সরে যায়–যে পারে সে নিতান্তই অপদার্থ ও হীন। নারীর রূপ কয়দিন থাকে? তার মনের লাবণ্যই স্থায়ী। সে বিভা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কেবলই বাড়ে।
বস্তুত যাকে ঠিক বন্ধু বলে বরণ করে নিতে মন আপত্তি তোলে না, সেই নারীকেই বিয়ে করা যায়। শুধু ভোগের জন্যে নারী-পুরুষের মিলন নিরর্থক; কিন্তু আসলে কী দেখতে পাওয়া যায়? যে যুবক তাকে বিয়ে করতেই হবে। মেয়ে হলেই স্বামী গ্রহণ করতে হবে। নারী-পুরুষের মিলনের যে একটা উচ্চ রকমের সার্থকতা আছে, তা সমাজের কেউ মানে না। দেখতে পাই স্বামী পত্নী কেউ কারো হৃদয় বোঝে না। কেউ কারো সাধনার খবর রাখে, নারীরা পুরুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ব্যথা-বেদনা বোঝেন না, জীবনকে সার্থক করার জন্যে এ কী প্রকার আয়োজন? এমনভাবে নারী-পুরুষের মিলন অবৈধ।
ভোগ জিনিসটা দোষের এ আমি বলি না। বলি শুধু শরীরের ভোগেই যেন জীবন শেষ না হয়। মানব জীবন এত ছোট নয় যে ভোগের মাঝে কর্তব্য সম্পাদনের তৃপ্তি রয়েছে সে ভোগ অতি সুন্দর ও কাম্য। এ ভোগকে আনন্দের সঙ্গে বরণ করে নিতে হবে, না নেয়াটাই দোষের। পতির পাপে যদি পতির মনে দুঃখ না আসে, দুরাচার স্বামীর উপহারে যদি নারীর প্রাণ উৎফুল্ল হয়ে ওঠে তবে বুঝবো হে নারী নিজের জীবনকে তুমি ব্যর্থ করে দিয়েছে। পাপ নীচতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্যই নারী-পুরুষের মিলন। অতএব দাম্পত্য জীবনের কোনো অংশে যদি পাপ আদর পায় তবে সে দাম্পত্য বন্ধন নিরর্থক।
সৌন্দর্য সম্বন্ধে এক এক জাতির এক এক রকম ধারণা। কোনো এক দেশের লোক গলা ফোলা মানুষকে খুব সুন্দর বলে মনে করে। ফুললে মানুষকে কত বিশ্রী দেখায় তা সবাই জানেন। দেখতে দেখতে সেই অদ্ভুত প্রকৃতির লোকগুলির রুচি এমন বদলে গেছে যে, যাদের গলা ফোলা নয় তাদেরকে তারা অসুন্দর বলে ঘৃণা করে। স্বামীর প্রতি যদি পত্নীর প্রেম শ্রদ্ধা না থাকে তা হলে হাজার সৌন্দর্যও চোখে লাগে না। গ্রামে-শহরে সব জাগাতেই এর অনেক হৃদয়বিদারক দৃষ্টান্ত আছে।
অনেক সময় রূপে গর্ব বালিকা ও যুবতীদেরকে অহঙ্কারী ও দাম্ভিক প্রকৃতির করে তোলে। রূপ না থাকলে হয়তো তারা বিনয়ী হবেন, চিত্ত স্বভাব সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু রূপের অভিশাপে মন ও স্বভাব তাদের কলঙ্কাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছে। কথা ও ব্যবহারেই মানুষকে বেশি করে মুগ্ধ করে। মানুষ যখনই বোঝে রূপের মধ্যে প্রেম, সহানুভূতি ও সুরুচির পরশ নেই তখন সে সরে পড়ে। ক্ষণিক আমোদের জন্যে মানুষ সে রূপ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে পারে, কিন্তু সে রূপকে শ্রদ্ধা করে সে মাথায় তুলে নেয় না।
নারীর সম্বন্ধে যে সব কথা বলেছি, পুরুষ সম্বন্ধেও সেই কথা বলা চলে। কুৎসিত বাহিরের অন্তরালে উন্নত পুরুষ আত্মাটা অপদার্থ নারীর কাছে সম্মান না পেতে পারে, কিন্তু উন্নত হৃদয়া নারী তাকে শ্রদ্ধা করেন, তাকে ভালবাসেন, তার জন্যে প্রাণ দেন। মনুষ্যত্বকে আদর করবার ক্ষমতা নারীদের মধ্যে প্রায়ই নেই, কারণ তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে জ্ঞান। তারা অনেক সময় পুরুষকে অন্ধের মতো মমতা করেন। উন্নত আত্মা ছাড়া অন্য কোথাও প্রেমের উন্মেষ হয় না, মনুষ্যত্বের প্রতিও শ্রদ্ধা বোধ জাগে না।
মানুষের ভুল আছে। স্বামী-স্ত্রীর ভুল হবে। একজন আর একজনের ভুল নিয়ে যদি অনবরত টানাটানি করেন, তা হলে সে হয় বড় দোষের কথা।
অনেক জায়গায় দেখা যায় স্বামী-স্ত্রীতে সর্বদা ঝগড়া লেগে আছে। যেন দুই শত্রু এক পথের মাথায় হঠাৎ মুখোমুখি হয়েছেন, পুরনো রাগ মেটাবার জন্যে কোমর বেঁধে এখন তারা মারামারি করবেন। বিয়ের পর কিছুদিন ভালবাসার আদান-প্রদান, প্রণয়-চুম্বন, কবিতা পাঠ খুব চলতে থাকে, কিন্তু তারপর কঠিন ঘরকন্নার মাঝে সে প্রেম সোহাগ লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যায়। একজন আর একজনের দোষ অন্বেষণেই ব্যস্ত থাকেন। পত্নীর কর্তব্য বাড়ির সকল কাজ গুছিয়ে নেওয়া, স্বামীর সকল রকম সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা। স্বামীরও উচিত পত্নীর কাজে নিয়ত ভুল না ধরা। অতিরিক্ত ভুল ধরলে মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট হয়, বুদ্ধি নির্বুদ্ধিতায় পরিণত হয়। নারীর ভুল ধরে ধরে মানুষ তাকে আরও পাগল করে তুলেছে। নারীর স্বাধীনতা ও শক্তি অর্জন ছাড়া তার কল্যাণ অসম্ভব।
স্বামী যদি বাহিরের কাজে রাতদিন ঘুরে বেড়ান, পত্নীর সঙ্গে মোটেই মিশতে না পারেন তাহলে পত্নী অনেক সময় বিরক্ত হন। শুধু বাহিরের কাজে মজে থাকা এবং পরীর ভাবের প্রতি কিছুমাত্র দৃষ্টি না রাখাটা দোষের।
তুমি একজন বড় দরের লোক, পত্নী তোমার মর্যাদা বোঝেন না, তোমার সঙ্গে সম্ভ্রম করে কথা বলেন না, দাসীর মতো পদ চুম্বন করেন না–এ ভেবে যদি তোমার মন পত্নীর প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে তাহলে বলবো তুমি হীন।
শুধু প্রেম করবার সময় পত্নীকে নিয়ে টানাটানি করা এবং বাকি সময় তার সঙ্গে অভদ্রতা করা বা তাকে কেবল কঠিন ভাষা প্রয়োগ করা নিচাশয়তা। বস্তুতঃ পত্নী যত ছোটই হোক, যত অপরাধই করুক তার সঙ্গে হাসিমুখে ছাড়া অন্যভাবে কথা বলা কাপুরুষতা।
শুধু একটি কারণে পুরুষ জাতি নারীর উপর বিরক্ত হতে পারেন–সে হচ্ছে নারীর ব্যভিচার। নারীর শ্রেষ্ঠ গৌরব। ওটা যদি থাকে তবে আর কোনো গুণ দরকার নাই। পত্নী অভিমানী, তিনি তোমাকে গালি দেন, সেবা সুখ দেন না। তার শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা জ্ঞান নাই–এ সমস্ত কারণে পত্নীর উপর বিরক্ত হয়ো না। প্রয়োজন হলে নিজে রান্না করে খাবে তবু পত্নীর সঙ্গে ঝগড়া করবে না। পত্নীর সঙ্গে কলহ করবার মতো কাপুরুষতা আর নাই।
নারী-জীবনে আর একটা গুরুতর অপরাধ আছে–সেটা হচ্ছে স্বামীর কাছ ছাড়া হয়ে কোনো জায়গায় দীর্ঘদিন থাকা। স্বামীর বিন্দুমাত্র আপত্তিতে নারীর কোথাও যাওয়া নিষেধ। যে নারী স্বামীর সঙ্গে সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করে চলে যেতে চায়, তাকে জোর করে ধরে রাখা ঠিক হবে না।
স্বামী যেমন পত্নীর অন্যায়কে মেনে নেবেন, পত্নীরও কর্তব্য স্বামীর ভুলকে তিনি ক্ষমা করবেন।
পুরুষের চরিত্রহীনতাকে নারী ক্ষমা করবেন কিনা, কেমন করে বলবো? পুরুষ যখন নারীর চরিত্রহীনতাকে ক্ষমা করতে পারেন না, নারীও তেমনি পুরুষের চরিত্রহীনতাকে ক্ষমা করতে পারেন না। এই বিশ্বাসহীনতার দ্বারা বিবাহের মর্যাদা নষ্ট হয়ে যায়। মানব-জীবনে হঠাৎ কোনো সময় যদি কোনো দুর্বলতা আসে, তবে সেজন্য স্বামী এবং পত্নী উভয়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন–অনুতাপ ও পাপ স্বীকারে পাপের দোষ নষ্ট হয়ে যায়, এ যেন নারী-পুরুষ উভয়ের মনে থাকে। আশ্চর্যের বিষয় চরিত্রহীনতার দোষে স্বামী পত্নীকে হত্যা করেন, কিন্তু একই অপরাধে কোনো নারী স্বামীকে হত্যা করেনি। পুরুষের বহু বিবাহ করবার ক্ষমতা আছে বলেই কি নারীদের দাবীর প্রতি এই অমর্যাদা?
নারীর না আছে শিক্ষা, না আছে অর্থ, না আছে স্বাধীনতা। তার ভাব ও কথার কোনো মূল্য নাই। কন্যাকে জন্মদান করে পিতারা সব কর্তব্য শেষ করেন। কবির কাব্য পড়ে কল্পনার যুবকেরা মনের মাঝে যে নারী প্রতিমাকে গড়ে তোলেন, সংসার-ক্ষেত্রে ঢুকে তারা বিবাহিত পত্নীর মাঝে সে মানসীর সাড়া পেতে চান। কল্পনায় যা সম্ভব, কাজে তার সন্ধান। পেতে ঢের বিলম্ব হয়। পত্নীর মাঝে কল্পনা মানসীর দেখা না পেয়ে অনেক শিক্ষিত যুবকও নারীর উপর অত্যাচার করেন, এটা অন্যায়। মানসীকে জড় দেহে যদি পেতে চাও তবে এ যুগে বিয়ে না করাই মঙ্গল। কল্পনা সত্য হয়ে এ পর্যন্ত কোনো মানুষের সামনে খাড়া হয়নি।
শিক্ষাহীনতার জন্যে নারী কল্পনার নারী হতে পারেন না। স্বামীর সংসার কার্যে প্রকৃত সঙ্গিনী হবারও সুযোগ পান না। স্বামী সাখনা সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা কিছুরই খবর রাখতে জানেন না, কিন্তু এ জন্যে কি নারী দায়ী? কে তাকে পাগলিনী করেছে? নারী শত অপরাধ করুক, সংসারকার্যে শত বিশৃঙ্খলার পরিচয় দিক-বিরক্ত হয়ো না, কেবল একটু সরস সমালোচনা করতে পার। শুধু দেখবে সে তোমাকে ভালবাসে কি না।
অনেক সময় নারীরা খুব চাপা, প্রাণের ভালবাসা কেমন করে ব্যক্ত করতে হয়, তা জানেন না। এত অবোধ জীবন তাদের।
যুবক বয়সে নারীকে যে কত উপাদেয়, কত মনোহর মনে হয় তা ঠিক করে বলা কঠিন। সে যেন এক অজানা রাজ্যের রহস্যময়ী! যুগ যুগ ধরে তাকে তপস্যা করে পাওয়া কঠিন। সে মেঘের দোলায়, সাগর তরঙ্গ, বাতাসের মাঝে, দিগন্তের গায়, ঊষার শান্ত স্নিগ্ধ জ্যোতির ভিতরে ঘুরে বেড়ায়।
কেউ কেউ হঠাৎ কোনো নারীকে বিয়ে করে পরে অনুতাপ করতে থাকেন। বিবাহের এক বছর দু’বছর পরে পত্নীকে ত্যাগ করেন। ইহার মূলে কিছু সত্য থাকলেও পরীকে ত্যাগ করা লজ্জাজনক। ভুল যদি হয়েই থাকে তবে ভুলকে মেনে নিতে হবে। পরীর পিতামাতা বা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ না রেখে চলতে হবে। নারী যত বড় ছোটই হোক তার ভিতর যদি সতীত্ব গৌরব থাকে তাহলে আর দুঃখের কোনো কারণ নেই। পত্নী যদি নিরক্ষর এবং কিছু অভদ্র হন কিংবা কোনো অশিক্ষিত শ্রেণীর নারী হন তবে তাকে ভালো করবার জন্যে কখনও কঠিন কথা বলবে না; এতে তোমার সমূহ বিপদ হবে, পরিবারের অকল্যাণ হবে, বংশের অবনতি হওয়া সেখান হতেই শুরু হবে।
কোনো কোনো যুবক দূরদেশে কোনো নারীকে বিয়ে করে কিছুকাল পরে পালিয়ে আসে। এ যে কত বড় অপরাধ তা ভাষায় প্রকাশ করে বলা যায় না।
নারীর স্বাধীনতা সম্বন্ধে আমি অনেক স্থানে কথা বলেছি। নারী স্বাধীনতার অর্থ নারী শক্তিকে জাগিয়ে তোলা, তাকে শিক্ষিত করা, তার হাত পা ও মুখের ব্যবহার করতে দেওয়া। বাহিরে কুক্ৰিয়াসক্ত পুরুষ সমাজে বা অশ্লীল উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা নয়।
নারীর স্বাধীনতা নাই বলেই মানুষ তাকে ঘৃণা করতে সাহস পায়। যার স্বাধীনতা নাই তার সম্মানও নাই। সম্মান যে নিজের হাতের মধ্যে, এ জিনিস পরের কাছ থেকে লাভ হয় না, নারীকে নিজের সম্মান নিজে রচনা করতে হবে। চোখ লাল করে তাকে নিজের আসন নিজে পেতে নিতে হবে। যে মহত্ত্ব বা যে সত্য নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে না তার এ জগতে কোনো স্বীকার হয় না–তার মূল্য বেশি নয়। সম্মানের জন্যে মহত্ত্বের এ সংগ্রাম ভদ্র, মধুর ও ধীর হওয়া চাই।
নারীর প্রতি পুরুষের যে একটা আকর্ষণ রয়েছে তাকে অস্বীকার করলে চলবে না। নারী দেখলেই চমকে উঠা, তার সঙ্গে কথা বলা পাপ-তার সঙ্গে প্রেম করা তো মহাপাপ এইরূপ ধারণা নিতান্তই অন্যায়। প্রেমের সঙ্গে পাপের কোনো সংস্রব নাই–যেখানে থাকে তা আদৌ প্রেম নয়। শুদ্ধভাবে নারীর সঙ্গে প্রেম করায় মানুষের জীবন উন্নত হয় প্রেমিক প্রেমিকাকে আমরা মোটেই ঘৃণা করতে পারি না।
যে সত্য করে প্রেম করতে জানে সে মহাপুরুষ। যে শুধু কামনা নিয়ে নারীর সঙ্গে মিলিত হয় সে দরিদ্র। মন যখন নীরস ও শক্ত হয়ে উঠবে, জীবনের অর্ধেক যখন পেরিয়ে
গেছে, তখন আর বিয়ে করে লাভ কী? –ইংরেজ কবি শেলী বিয়ে করেছেন উনিশ বছরের সময়। মহাকবি শেক্সপীয়ার বিয়ে করেছিলেন মাত্র সতের বছরে।
অল্প বয়সে বিয়ে করলে পড়া মাটি হয়–এ কথা অনেকে বলে থাকেন। বাল্য বিবাহের কথা বলছি না। যৌবনের প্রারম্ভে বিয়ে করলে চরিত্র খারাপ হওয়ার ভয় থাকে না। বিয়ের পর এক বছর কোনো কোনো যুবকের পত্নীর সঙ্গ ত্যাগ করা কষ্টকর হতে পারে; কিন্তু নিজের জীবনের উন্নতি অবনতি কীসে হবে সে কথা বুঝিয়ে দিলে যুবক যুবতীরা বুঝবে না? যুবকের চরিত্রে যদি বিবাহের পর এরূপ কোনো দুর্বলতা আসে তবে অতি সাবধানতার সঙ্গে অতি মিষ্টভাষায় দম্পতিকে জীবনের উন্নতি অবনতির কথা বুঝিয়ে দিতে হবে। এই জায়গায় আরও একটা কথা বলে রাখি, যুবক যুবতীর প্রেম-চাঞ্চল্যের প্রতি কিছুমাত্র অশ্রদ্ধা যেন না দেখান হয়। এতে সমূহ বিপদ উপস্থিত হতে পারে। এই বয়সে মানুষের মন বড় চঞ্চল, বড় পাগল থাকে–সাবধান!
বিয়ের পর কিছুদিনের জন্য কার্যে অবহেলা আসতে পারে। কিন্তু সে অবহেলা স্থায়ী হবে না। চরিত্রহীনতার মতো মহাবিপদের হাত থেকে বাচাবার জন্য কর্তব্য কাজের প্রতি অবহেলা দেখিয়ে ছেলে বা ছোট ভাই যদি বিবাহিত বালিকা পত্নীর সঙ্গে কিছু সময় নষ্ট করেই থাকে তাতে বিশেষ দুঃখের কোনো কারণ নাই।
প্রেমের অর্থ কর্তব্য কাজের প্রতি অবহেলা? ইটালীয় মহাকবি দান্তের বয়স যখন নয়–তখন তিনি বালিকা বিয়াট্রিসকে ভালবাসেন।
এই ভালবাসা দান্তের সারা জীবনটা স্বর্গে-মর্তে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল। বিয়াট্রিসের রূপ, তার কথা, তার জীবনের অতি তুচ্ছ ঘটনাগুলি পর্যন্ত দান্তের হৃদয়-মন পরিপূর্ণ করে ফেলেছিল। বিয়াট্রিসের জন্য তার এই প্রেম তাকে অমর করে রেখেছে। আর যতদিন না পৃথিবীর শেষ হয় ততদিন মানুষকে আনন্দ দান করবে।
আমরা কতকগুলি হৃদয়ের বিনিময়ের কথা জানি।
কবি পিতারার্ক কোনো এক গীর্জায় গভীর অনুরাগ জেগেছিল যে, তিনি সে জন্যে একেবারে অধীর হয়ে যান। লরাকে আর একটি বার দেখবার জন্য তিনি কতবার গীর্জা ঘরের দুয়ারে এসে ঘুরে বেড়াতেন। হৃদয়-বেদনা কমাবার জন্য তিনি দেশে দেশে ভ্রমণ করেছিলেন। লরার যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সেই ভদ্রলোক অনেক সময় লরাকে এত গালি। দিতেন যে, তাকে সেজন্যে কাঁদতে হতো।
লরাকে ভালো না বাসলে পিতারার্ক এত বড় কবি হতে পারতেন না। লরার মৃত্যু হলে তার স্বামী সে জন্যে কিছুমাত্র দুঃখিত হন নি। পিতারার্ক কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত তার দেবীর সাধনা করেছিলেন। এছাড়া তার জীবনে আর কোনো কাজ ছিল না।
কবি ও সাহিত্যিক শো এক বড়লোকের মেয়েকে ভালবেসেছিলেন। তার ফলে তাকে কারাগারে অবদ্ধ হতে হয়েছিল। সাত বছর কারাগারে বসে বসেই তার প্রিয়তমার নামে কবিতা রচনা করেছিলেন।
এই সময়কার সর্বশ্রেষ্ঠ এক গায়িকার জন্যে পাগল হয়েছিলেন কবি মেতাশী। এই চারুহাসিনী খুব বিত্তশালিনী ছিলেন। ইনি স্বামীর সঙ্গে যেখানেই বাস করতেন মেতাতাশীও সেখানে থাকতেন–উদ্দেশ্য তার প্রিয়তমার সঙ্গে তাঁর জগতে মিলন না হলেও তিনি তার মুখ দেখে তৃপ্ত হবেন। এই মহিলা যখন মারা যান তখন তার সমস্ত সম্পত্তি স্বামীর মৃত্যুর পর মেতাতাশী ভোগ করবেন–এই কথা লিখে দিয়ে যান। বেঁচে থাকতে যার সঙ্গলাভ করবার ভাগ্য মেতাতাশীর হয়নি, মরে যাওয়ার পর তার সম্পত্তি নিয়ে লাভ কি? কবি এ সম্পত্তি গ্রহণ করেন নি।
কেমিওন আঠার বছর বয়সে এক উচ্চ বংশের নারীকে ভালবাসেন। মর্যাদায় নিজেকে প্রিয়তমার সমকক্ষ করবার জন্যে তিনি সৈন্য শ্রেণীতে নাম লেখান। যুদ্ধ করে বীরের কীর্তি অর্জন করে যখন তিনি বাড়ি এলেন, তখন তাঁর প্রণয়িনী মৃত্যুশয্যা গ্রহণ করেন।
স্পেনের বিখ্যাত লেখক স্যার ডেটেস এক নারীকে ভালবাসেন। এই নারীর ভালবাসা লাভ করবার পর তিনি তাকে ত্যাগ করে অন্য নারীকে বিয়ে করেন।
ওয়েল্যাভের কবিত্ব প্রতিভার কারণ হতাশ প্রণয়। যদি সোফিয়াকে ভালবেসে তিনি প্রত্যাখ্যাত না হতেন তাহলে তার কবি হওয়া হতো না।
ডেনমার্কের কবি ইভান্ড ছিলেন হতাশ প্রেমিক। প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে অনেক মানুষ বিশ্ববাসীর কল্যাণের জন্যে নিজদিগকে উৎসর্গ করেন। যে মহান আনন্দ হতে তাঁরা বঞ্চিত হন তার। আস্বাদ পেতে চান তারা ত্যাগে, সেবায় আর দীন-দুঃখী ও আর্তের জন্য প্রাণপাত করে।
যে প্রেমিক হয়েছে, তার হৃদয় যেমন উন্নত ও উদার হয়; যে প্রেমিক হবার পথে দাঁড়িয়ে ব্যর্থ ও হতাশ হয়ে ফিরে এসেছে, তার মনও কত বড় হয়ে যায়। প্রেম কত সুন্দর, কত পবিত্র। মানব আত্মার পক্ষে মহা কল্যাণকর এই প্রেমের সঙ্গে সম্বন্ধ না রেখে যারা নারীর সঙ্গে মিলিত হন তারা কত বড় হতভাগ্য।
পথের পাশে পতিতা রমণীর সাজসজ্জা দেখে মনে তরল ভাব আসে। যে ঐশ্বর্য নিয়ে নারী এ জগতে এসেছিল মানুষকে প্রেমের স্পর্শে মহৎ করে দিতে তা পয়সার বিনিময়ে বিক্রি! কি শোক ও দুঃখের কথা।
নারীর রূপের চরম সার্থকতা বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে ভালবেসে এবং বিশেষ কোনো মানুষের ভালবাসা পেয়ে। ফরাশি দেশে এক সময় এমন একটি অবস্থা হয়েছিল যে, মানুষ নারীকে শুধু ভোগের সামগ্রী মনে করতো। নারী-পুরুষ নিজেদের দুর্বলতা গোপনের জন্যে বিয়ে করতো। নারী সৌন্দর্যের এর চেয়ে অপব্যবহার আর কী হতে পারে?
জগতের অনেক প্রতিভাশালী ব্যক্তি নারীর রূপের দারুণ অপব্যবহার করে গিয়েছেন–তা ভেবে মনে আমাদের খুবই দুঃখ হয়।
যে নারীকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে পার, যার রূপের প্রতি মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বাসী না হয়ে থাকতে পার, সে রূপ স্পর্শ করবার অধিকার তোমার নাই।
যুবক বয়সে অনেক সময় মতিভ্রম উপস্থিত হয়। অপদার্থ হীনস্বভাব নারীর রূপ দেখে মুগ্ধ হবার পূর্বে খুব সতর্ক হওয়া চাই, কারণ রূপকে অতিক্রম করে যখন তার ভিতরের সঙ্গে তুমি পরিচিত হবে তখন মন তোমার বিদ্রোহী হয়ে উঠবে, জীবনে শান্তি থাকবে না–যেমন নারীই হোক একবার বিয়ে করলে তার ইচ্ছা ব্যতীত কিছুতেই তাকে ত্যাগ করা যায় না।
কবি গোল্ডস্মিথের এই প্রকার একবার মতিভ্রম উপস্থিত হয়েছিল। তাঁর বন্ধুরা কোনো রকমে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন।
যারা নারীর বাহির নিয়ে শুধু ডুবে থাকতে চায় তাদের কাছে নারীর ভিতরের রূপ দরকার হতে না পারে। ভিতরের মাধুরীকে বাদ দিয়ে যে পুরুষ হীন রমণী-রূপে ডুবে যেতে চায় তাকে খুব ছোট বলে মনে হয়। মানুষ প্রেম ছাড়া আর কিছু নয়–সে যে নারী পুরুষের গভীর অনুরাগের জমান মূর্তি। প্রেমের মূর্তরূপে মানব-শিশুকে জন্ম দিবার জন্যে খোদা। নারী-পুরুষের মাঝে এত অনুরাগ, এত আকর্ষণ দিয়েছেন। এই শুভ উদ্দেশ্যের কথা ভুলে নারীর রূপ ভোগ করবার জন্যে মানুষ ব্যস্ত। বিধাতার দানের কি পৈশাচিক অপব্যবহার।
কবি কাউপার চিরকাল অবিবাহিত ছিলেন। প্রথমে তার বোন সম্পর্কীয় থিওডোরার সঙ্গে তার প্রণয় জন্মে। তার মাথা খারাপ হয়েছে। সন্দেহ করে পরে থিওডোরার সঙ্গে কাউপারের বিয়ে নিষিদ্ধ হয়ে গেল। দু’জনই চিরকাল অবিবাহিত ছিলেন।
চার্লস ল্যাম্ব তার পাগলী বোনকে রেখে কোনো নারীকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন নি। সারা জীবন বোনের সেবা-যত্ন করেই তিনি আনন্দ লাভ করতে চেষ্টা করেছিলেন।
ফরাশি কবি বেরেঞ্জার এক ইংরেজ বালিকার প্রেমে পড়ে একেরারে পাগল হয়ে উঠেছিলেন। এক বন্ধু তার এই শোচনীয় অবস্থা দেখে তাকে এক নির্জন পাহাড়তলীতে নিয়ে সেখানে কিছুদিন বাস করেন। পাহাড়ের উদার গম্ভীর দৃশ্য দেখতে দেখতে কবির হৃদয়-ক্ষত অনেকটা শুকিয়ে ওঠে।
বিয়ের আগেই অনেক সময় সুযোগ হলে যুবক-যুবতীর মাঝে যথেষ্ট প্রণয় সঞ্চার হয়, কিন্তু শেষকালে বিয়ে হবার পর সে প্রেম যদি টেকসই হয় তবেই জানা যায় সে প্রেম সত্য।
এক ভদ্রলোক এক বালিকার প্রেমে পড়ে প্রায় উদাসী হয়ে জীবন কাটাতেন। বালিকার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়েছিল। ভদ্রলোক কত আঁখিজলে এই বালিকাটির কাছে গোপন পত্র লিখতেন। শেষকালে একদিন বালিকা বিধবা হলেন। পুরাতন প্রণয়ী তখন খোদাকে অশেষ ধন্যবাদ দিয়ে তার জীবনের পথহারা কুসুমকে আপনার করে নিলেন। আশ্চর্যের বিষয় কিছু কাল পরে এই প্রেমিক প্রভু তার প্রণয়ীকে ফেলে হাটে বাজারে জঘন্য স্থানে মাতলামি করে বেড়াতে শুরু করলেন।
প্রেম সত্য কিনা, এটা বিশেষ জেনে নিয়ে নারীকে স্বামীর গ্রহণ করতে হবে, নইলে জীবনে অনেক বিপদ হয়। কত সরলা যুবতী ও বালিকাকে দুষ্ট লোক বাড়ির বের করে ফাঁকি দিয়ে অন্যত্র বিক্রি করে যায়; সে সব কাহিনী শুনলে শরীর শিউরে উঠে।
বিবাহিত জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে উভয়ের প্রতি গভীর সহানুভূতি পোষণ করবেন; তাহলে দাম্পত্য জীবন ভারী সুখময় হবে। সহানুভূতিতে নিতান্ত অপরিচিতদের মধ্যে যে প্রণয় হয়, তা স্বামী-পত্নীতে হবে না, একি সম্ভব? স্বামী-স্ত্রী কেউ কারো প্রতি কোনো প্রকার অশ্রদ্ধাপূর্ণ কথা বা ব্যবহার জানাবেনা।
দূরদেশ থেকে নিশার আঁধার, বৃষ্টি-বিদ্যুৎ মাথায় নিয়ে স্বামী বাড়িতে আসেন; কার মায়ায়? বাড়ির নিশ্চয়ই। আর সে বাড়িরও প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে তার পত্নী। কাছে যদি যত্ন ও ভালবাসা না পাওয়া যায়, সে কি কম দুঃখের কথা? এ কথা অশ্রদ্ধাপূর্ণ কথা, একটা অবজ্ঞাভরা ব্যবহার প্রাণে কত বাজে? বাড়ি হবে শান্তি ও পুণ্যের কেন্দ্র। সেখানে যে আসবে তারই প্রাণ শান্তি ও পবিত্রতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। কোনো কোনো প্রতিভাশালী ব্যক্তির বিবাহিত জীবন মোটেই সুখময় হয় নি। পারস্যের মহাকবি সাদী ও গ্রিসের দার্শনিক সক্রেটিস পত্নী নির্বাচনে বিশেষ সুখী হতে পারে নি।
রাজনীতিবিশারদ বার্লের পত্নী ছিলেন বড় ভালো। তাঁর মৃত্যুতে বার্লে দুঃখ করে সদাই বলতেন, আমার পরীর মতো সতী-সাধ্বী রমণী জগতে অতি অল্প আছে।
কবি ম্যাসন একখানা মজলিশে এক নারীকে লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি সারা সন্ধ্যা কারো সঙ্গে একটি কথাও বলেন নি। এই কারণেই কবির মন এই নারীর প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠলো। শেষে তিনি একে বিয়ে করেছিলেন। ম্যাসনের জীবনও হয়েছিল সুখময়। বস্তুত এক একটা বিশেষ বিশেষ গুণে বিশেষ বিশেষ মানুষকে মুগ্ধ করে। সে গুণে হয়তো কালের কাছে বিশেষ প্রীতিপদ নয়।
ব্যস্তবাগীশ ক্যালভীন (Calvin) প্রেম, ভালবাসা বা নারী-সঙ্গের জন্যে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করতেন না। এক বন্ধুকে একটা বৌ খুঁজে দেবার জন্য তিনি একবার বলেছিলেন। বন্ধু কিছুদিন চেষ্টা করেছিলেন বটে কিন্তু কাজটা নিতান্ত অসম্ভব ভেবে চেষ্টার শেষে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন।
মার্টিন বোসার এক দশ-ছেলের মা বুড়িকে বিয়ে করেন। আশ্চর্যের বিষয় এতে তার কিছুমাত্র অসুবিধা হয় নি। বেশ সুখেই তিনি জীবন কাটিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে পুরুষের যেমন দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করবার ক্ষমতা আছে নারীর সেরূপ নাই। শিক্ষা ও শক্তিহীন নারী তার দাবি অনুযায়ী কাজ করতে শরমে মরে যান।
এক বিখ্যাত চিকিৎসক একদিন পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় তাঁর সামনে হঠাৎ একটি যুবতী স্ত্রীলোক মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ে যান। চিকিৎসক যত্ন করে যখন তার জ্ঞান সঞ্চয় করলেন তখন স্ত্রীলোকটির প্রতি তার একটা দয়ার সঞ্চার হল। শেষকালে তাকে তিনি একেবারে বিয়ে করে ফেললেন। দৈব ঘটনায়ও নারী-পুরুষে অনেক সময় প্রেমের সঞ্চার করে।
চিকিৎসক হান্টার (Flunter) এক বালিকাকে ভালবাসেন, কিন্তু আয় ভালো হচ্ছিল বলে তখন তাকে বিয়ে করতে পারেন নি। প্রণয়িনীর কথা মনে করে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমে মন দিয়েছিলেন। শেষে যখন অবস্থা ফিরলো তখন তিনি বিয়ে করলেন। কবি ক্রের দীর্ঘ আট বছর তার প্রণয়িনীর অপেক্ষায় কত না কষ্ট, কত না আশা-শঙ্কায় কাটিয়েছিলেন।
দরিদ্র ক্রেব প্রথমে চিকিৎসক ব্যবসা আরম্ভ করেন; সুবিধা হল না দেখে বই লিখে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করলেন। এতেও সুবিধা হলো না দেখে তিনি ধর্মযাজকের কাজে ঢুকলেন। এই সময়ে তাঁর একখানা বই বাজারে দাঁড়িয়ে গেল। অবস্থাও তার ভালো হল এবং তিনি জীবনের আনন্দ প্রতিমাকে এতকাল পরে ঘরে আনতে পারলেন।
প্রণয়িনীকে লাভ করবার আশায় কত মানুষ কত কঠোর সাধনা করছেন। চিত্রকর রিবলতর শিক্ষকের মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়েন। একটা অপদার্থ মূল্যহীন যুবক বলে গালি খেয়ে তিনি ইতালিতে পালিয়ে যান। সেখানে বহু সাধনা করে তিনি একজন বিখ্যাত চিত্রকর হতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার এই সফলতার মূলে ছিল একটা বালিকার মুখ। তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে শেষকালে শিক্ষক মহাশয় রিবলতের হাতে কন্যাদান করেছিলেন।
এক নারী লেখিকা একখানি ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখেছিলেন। একখানা বড় কাগজে পুস্তকখানি বেশ একটু গরম সমালোচনা হয়েছিলো। লেখিকা সমালোচকের ঠিকানা পাবার জন্যে সম্পাদককে পত্র লিখলেন। তারপর ঠিকানা পেয়ে এই সমালোচক ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয় নিয়ে তার পত্র ব্যবহার হতে লাগলো। শেষকালে দুজনার মধ্যে একটা প্রীতির ভাব দেখা দিলে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলেন।
ডাক্তার ডোনে গোপনে স্যার জর্জের মেয়েকে বিয়ে করেন। এর ফলে তাঁকে ভয়ানক কষ্টে পড়তে হয়েছিল। তিনি যেখানে চাকরি করতেন সেখানে জর্জের মেয়ে বেড়াতে আসতেন এবং উভয়ের মাঝে আলাপ হতো। জর্জ মেয়েকে সন্দেহ করে তখন-তখন অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেললেন কিন্তু এর আগেই ডাক্তার ও তার মেয়ের মাঝে এতটা প্রণয় সঞ্চার হয়েছিল যা চেপে রাখা দু’জনের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। গোপনে তারা এক গীর্জায় যেয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। জর্জ জানতে পেরে ভয়ঙ্কর ক্রুদ্ধ হয়ে জামাইকে চাকরি হতে ডিসমিস করলেন। যেদিন পাদরী তাদের বিয়ের মন্ত্র পড়িয়েছিলেন সেদিন তাদেরকে জেলে দিলেন। শেষকালে যখন জানতে পারলেন তার জামাই সামান্য তোক নন, তখন তাঁর ক্রোধ পানি হয়ে গেল। প্রতিভাশালী পণ্ডিত ডোনের পত্নী স্বামীকে বড় ভালবাসতেন। ডোনের জীবন বড় সুখময় হয়েছিল।
গলিতবেত্তা সিমসনের ঘরবাড়ি ছিল না। একটু আশ্রয়ের জন্যে তাঁর চেয়ে ত্রিশ বছরের বড় এক দর্জির বৌকে তিনি বিয়ে করেন। এই মহিলার দুই ছেলে ছিল। বৌটি সিমসনের চেয়ে বয়সে বড়। আশ্চর্যের বিষয় বিয়ের পর এদের মধ্যে কোনো প্রকার অশান্তির উদ্রেক হয় নি। উভয়ে বেশ সুখে জীবন কাটিয়েছিলেন। এই সময় মহাপণ্ডিত জনসনও এক আশ্চর্য বিয়ে করেন। এক মাতাল অসভ্য হাবসির মতো চেহারা বুড়ির প্রেমে তিনি পাগল হন। জনসনের বয়সী দুটি ছেলেকে নিয়ে রমণী তার পণ্ডিত প্রেমিকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। জনসন এ জন্যে কোনো দিন অনুতাপ করেন নি প্রশংসা ছাড়া কোনোদিন পত্নীর নিন্দা করেন নি। সাহিত্যিক জন উজলীর পত্নী ছিলেন ভয়ানক প্রকৃতির মহিলা। যেমন মুখরা তেমনি বদমেজাজী। তিনি কখনও কখনও স্বামীকে ধরে মার দিতেন। ধীর শান্ত উজলী সে জন্যে কিছুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। কোনো নারী কোনো প্রেমপত্র লিখছে কি না গোপনে গোপনে তা জানবার জন্যে স্বামীর পকেট খোঁজ করতেন। এই মহিলাটির হাতে অনেক টাকাকড়ি ছিল। তারই জোরে হয়তো তিনি স্বামীকে এতটা নাকাল করতেন।
দার্শনিক কমতির জীবনে কোনো সুখ ছিল না। মুখরা পত্নীর জ্বালায় তিনি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। শেষকালে একদিন তাকে ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন।
তারপর কমতি এক ভদ্রমহিলাকে ভালবাসতে আরম্ভ করলেন। এই পত্নীর ক্রোধে ভালবাসার সঙ্গে কোনো স্পর্শ-লিপ্সা ছিল না। ভদ্রমহিলার স্বামীর কোনো অপরাধে জীবনের জন্যে নির্বাসিত হয়েছিলেন। সেই মহিলার মৃত্যুতে কমতি তার কবরের পাশে অশ্রু বিসর্জন করতেন। সঙ্গীত-শাস্ত্রে পণ্ডিত ওয়েবারের পত্নী ছিলেন বড় ভালো। গান গেয়ে গেয়ে ওয়েবারকে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে হতো। পত্নীকে নিয়ে আমোদ করার সময় তার হতো না। পত্নী ছিলেন ইংরেজ মহিলা, তার স্বামী ওয়েবার জার্মানি স্বামীর কাছে উনি যেসব পত্র লিখতেন তাতে কত উৎসাহ, কত ভালবাসা মাখান থাকত। ওয়েবারও তাঁর পত্নীকে খুব শ্রদ্ধা-আদর করতেন।
কবি রেশাইন পত্নীকে নিয়ে খুব সুখের জীবন কাটিয়েছেন। এর সাহিত্য-প্রতিভা সম্বন্ধে পত্নী কোনোই খবর রাখতেন না। একখানা বই লিখে রাজার কাছ থেকে রেশাইন দশ হাজার টাকা পুরস্কার পান। মনের আনন্দে পত্নীকে খবর দেবার জন্যে দৌড়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করে বলেন, “ওগো আমার জীবনের আলোক; আজ আমাদের আনন্দ করার দিন। রাজা আমার প্রতিভাকে সম্মান করেছেন আর এই টাকা দিয়াছেন। এ আনন্দ শুধু আমার নয়; তোমারও এতে অংশ রয়েছে।” কবি-প্রিয়া সে কথায় আদৌ কান না দিয়ে ছেলেরা কী নিয়ে কলহ করছিল তাই বলা আরম্ভ করলেন। রেশাইন পত্নীর হাত ধরে বললেন,–“আজ ওসব কথা থাক, স্বামীর সম্মানে আজ তুমি আনন্দ কর।”
জন রিচারকে একজন ভাগ্যবান পুরুষ বলতে হবে। তার লেখার মধ্যে নারী-চিত্তকে গলিয়ে দেবার এমন একটা প্রভাব থাকতো যা পড়লে তার নারীদের একটা মমতা না হয়ে পারতো না। যে মহিলা বা বালিকা তাঁর লেখা পড়তেন রিচারের প্রতি তারই একটা অনুরাগের সঞ্চার হতো। একটা বিপদ আর কি! লেখা বের হলে দেশসুদ্ধ নারী গোপনে গোপনে তার কাছে অনুরাগের পত্র লিখতেন। যখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ এবং তিনি ছেলেমেয়ের বাপ তখন এক সতের বছরের বালিকা তার অনুরাগে একেবারে ক্ষেপে উঠলেন। শেষকালে প্রতিদানের কোনো আশা না দেখে বালিকা জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছিলেন–কী দুঃখের কথা!
বাগ্মী শেরিডন কুমারী লিনলেকে নিয়ে পালিয়ে যান। ভাগ্যিস, তাকে শেষে বিয়ে করেছিলেন, নইলে বালিকাটির মাথায় কি কলঙ্কই না চাপতো। তখন শেরিডনের বয়স মাত্র বাইশ।
দুঃখ অভাবের চাপে পড়ে তিনি প্রথমে বই লেখা আরম্ভ করেন। দেনাদারেরা অনেক সময় তার ঘরের দুয়ারে এসে হল্লা করত। বিখ্যাত বাগী শেরিডনের কথা সবাই জানেন। তাঁর পারিবারিক দুঃখ-ক্লেশ যথেষ্ট থাকলেও সে জন্যে তিনি কিছুমাত্র মিয়মাণ হতেন না। পত্নী লিনলের ব্যবহার তার সতী হৃদয়ের অসীম ভালবাসা শেরিডনকে পরিপূর্ণ আনন্দে সকল চিন্তা সকল ভাবনা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে। লিনলের মৃত্যুতে শেরিডন বালকের ন্যায় যখন তখন অশ্রু বির্সজন করতেন। তিনি বড় বাগ্মী হয়েছিলেন। তাঁর যশ কীর্তিতে দেশ ভরে উঠেছিল, কিনরউ লিনলের শোক তাঁকে অধীর করে তুলেছিল। কয়েক বৎসর পরে আবার বিয়ে করেছিলেন। পুত্র-পত্নী তার জীবনে সুখময় করে তোলার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। তবে শেরিডন জীবনে সুখ করতে পারেন নি। আয়-ব্যয়ের কোনোই হিসাব থাকত না। দুর্বহ। জীবনের টান সহ্য করতে না পেরে পরী সেবা-যত্নের মাঝে তিনি শেষকালে প্রাণত্যাগ করেন।
স্টিলের অবস্থাও অনেকটা শেরিডনের মতোই ছিল। পাওনাদারদের ভয়ে তিনি অনেক সময় বাড়ি হতে পালিয়ে কফিখানায় আড্ডা দিতেন। সেখানে তার আনন্দ উচ্ছ্বাসের সীমা থাকত না। পাওনাদাররা বাড়িতে পত্নীর কাছে এসে রিক্ত হস্তে ফিরে যেতে বাধ্য হতো। প্রাণে নানা দুঃখ অশান্তি থাকলেও পরীর সামনে স্টিলের মুখে সদাই হাসি লেগে থাকতো। পত্নীর সদ্ব্যবহার আদর ভালবাসা তাকে দুঃখ অশান্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। স্টিল বলতেন, আমার পরী হচ্ছেন বেহেশতের হুরী, তার স্নেহে জীবনের ব্যথা দূর হয়ে যায়। এরূপ পত্নী যার ভাগ্যে জুটেছে তার আর কিছুরই দরকার নাই।
কবিদের সঙ্গে বিয়ে জুড়তে নারীদের সর্বদাই সতর্ক হওয়া চাই। কারণ এদের সৌন্দর্য জ্ঞান অতি প্রবল। এই প্রকৃতির লোক কোন সময় যে কী করে বসে তা বলা কঠিন। কবি জীবন সম্বন্ধে এই অপ্রিয় কথাগুলি দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে। তারা অনেক সময় এমন কতকগুলি অন্যায় করে বসেন যার আঘাত সহ্য করা সরলা নারীদের পক্ষে খুব কঠিন। মিলটনের দাম্পত্য জীবন খুব বিশ্রী। অনেক নারীকেই ঘোল খেয়ে তার কাছ থেকে পোটলা বেঁধে বিদায় নিতে হয়েছে। চার্চিল সতের বছরের সময় বিয়ে করেন। বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে মনের দুঃখে বিষ খেয়ে মরেন। কবি শেলীর বৌ স্বামীর হৃদয়হীন ব্যবহারে জলে ডুবে প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। সকল কবির দাম্পত্য জীবনই যে খুব অশান্তিপূর্ণ নিরানন্দময় তা বলা যায় না। স্যার ওয়ালটার স্কট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বেশ সুখে পত্নীর সঙ্গে ঘর করে গিয়েছেন।
এক মায়ের পেটের তিন বোনকে বিয়ে করেছিলেন কবি সাদী, কোলরিজ এবং লভেল। সাদী বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তার দুই কবি বন্ধুর পরীরই ভরণ-পোষণ করতে হতো তাঁকে। কোলরিজ ছিলেন বেপেরোয়া। পত্নীকে সাদী ঘাড়ে ফেলে রেখে তিনি নিরুদ্দেশ হলেন। কয়েকটা ছেলেমেয়ে রেখে লভেল মারা গেলেন। সাদী তাদের সকলকে পরিবারের মতোই টেনে নিয়েছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত তাদের ব্যয়ভার নিজে বহন করেছিলেন। সাদীর দ্বিতীয় পত্নী সাদীর মতোই একজন খুব ভালো কবি ছিলেন।
টমাস উডের পত্নী মায়ের স্নেহে স্বামীকে যত্ন করতেন। স্বামীর রোগ শয্যার পাশে কত বিদ্রি রজনী কতদিন কাটিয়ে দিতেন। কতকগুলি স্বামী আছেন যাদের মেয়েরা প্রাণ দিয়ে ভালবাসলেও প্রতিদান পায় না। রোগশয্যায় ব্যাধিযন্ত্রণায় যে পত্নী কত আঁখিজলে স্বামীকে সেবা করেছে, কত গভীর নেশায় উঠে স্বামীর মঙ্গলের জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে, সেই স্বামী যখন ভালো হন তখন পত্নীর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া দূরে থাক রূঢ় ও কর্কশ ব্যবহার করতে লজ্জা বোধ করেন না। পত্নীর গুণ তার নজরে আসে না, আসে কেবল দোষগুলি। নিজের চরিত্রে কি কোনো দোষ থাকে না যে পরের দোষ ধরি? শুধু দোষ ধরে কোনো কালে কারো চরিত্র ভালো করা যায় না। ভুলগুলি উপেক্ষা করে সদ্ব্যবহার ও জ্ঞানপূর্ণ কথার দ্বারা মানুষকে ভালো করতে হবে। মানুষকে বড় করবার এক প্রধান পথ তাকে পুস্তকের সঙ্গে পরিচিত করে দেওয়া। বিপদকালে পত্নীর সেবা-যত্ব গ্রহণ করা আর পরে তাকে ব্যথা দেওয়া বড়ই অন্যায়। যে বিদ্রোহী হতে পারে না, নিজেকে রক্ষা করবার যার অধিকার নাই, তাকে ব্যথা দেওয়া নিতান্তই কাপুরুষতা। শক্তি ও অর্থ আছে বলে পত্নী অপমান করা মহাপাপ।
উড তাঁর পত্নীর কাছে নিয়ত কৃতজ্ঞতার সংগে বলতেন–তুমি আমার জীবনের শান্তি। তোমার মঙ্গল প্রভাবে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। সে কথা শুনে পত্নী আনন্দিত হতেন।
পত্নীকে ভালো হবার জন্যে উপদেশ দিলে চলবে না। পুরুষেরা যদি নিজেদের স্বভাব ও ব্যবহারগুলিকে সুন্দর না করেন তাহলে শুধু নারীকে ভালো হবার জন্যে যতই কথা বলা হোক না কেন, কোনো কাজ হবে না। যত আঘাত করবে মানব-আত্মা ততই বিদ্রোহী হবে। হীন নরপিশাচের স্পর্শে এলে অতি ভালো লোকও জঘন্য প্রকৃতি হয়ে ওঠেন। স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে যদি প্রেম ও শ্রদ্ধা করেন, তাহলে মানুষের জীবন কত সুখময় হয়।
প্রেমের কথা না ভেবে শুধু বয়সের খোরাক জোগাবার জন্যে যে বিয়ে হয় তা হয় বড় নিকৃষ্ট। প্রেমের স্পর্শে নারী-পুরুষের মিলন জগতে স্বর্গ রচনা করে। প্রেম মানুষকে নীচ ও দীন জীবন হতে বহু উর্ধ্বে নিয়ে যায়, তার দৃষ্টি হয় কত গভীর, তার হৃদয় হয় কত বিরাট, তার মমতা হয় কত ব্যাপক।
হজরত বলেছেন, তাকেই বিয়ে করো যাকে তুমি ভালবাসতে পারবে।
খুব ভালো