নতুন যুগের ভোরে
১.
দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল–দিনকুড়ি আগরতলায় থেকে ডেরা বেঁধেছিলাম কলকাতায়। বাংলাদেশের মুক্তির ক্ষণ থেকেই দেশে ফিরতে মন চাইছে। পথঘাট এবং পরিস্থিতির বিবেচনায় দেরি করছি দু চারদিন। ২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করে পরিকল্পনা-কমিশনের সদস্যপদ ত্যাগ করে লেখা আমার চিঠিটা তার হাতে সমর্পণ করলাম। তাতে লিখেছিলাম, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পূর্বপদে ফিরে যেতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ঢাকায় ফিরে গেলেন ২২ ডিসেম্বরে। কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রীর পুরোনো দপ্তরের সূত্রে খবর পেলাম, তিনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন ঢাকায়। ভারতীয় এক কর্মকর্তা ফোনে। জানালেন, পরদিন ঢাকাগামী বিমানে একটা আসন রাখা হয়েছে আমার জন্যে। কলকাতায় পরিবার ফেলে এতদিন পরে একলা দেশে ফিরতে ইচ্ছে হলো না। তাছাড়া ভয়ও ছিল মনে, একা ঢাকায় একবার এসে পড়লে কলকাতায় ফিরে পরিবার নিয়ে আসা অনিশ্চিত হয়ে যাবে; প্রশাসনে একবার জড়িয়ে গেলে তার জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। তাই মাফ চেয়ে নিলাম।
তার আগে ২৩ ডিসেম্বরে যশোরে গিয়েছিলাম। আমার গাড়িতে অনিল সরকার ও অনিরুদ্ধ রায়, আমার শ্যালক আজিজের গাড়িতে আবদুল আউয়াল ওরফে সুবা ভাই ও অনিরুদ্ধের ভাই চন্দন। সীমান্ত পেরোবার সময়ে কী যে রোমাঞ্চ আমাদের–স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছে গেলাম! যশোর সার্কিট হাউজে সহজে জায়গা পাওয়া গেল, খাওয়াদাওয়ারও সুব্যবস্থা হলো। আমাদের অতিথিরা খুশি।
যশোরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে, তার দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা (পরে ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে নিহত হন)। আমার। পরিচয় দেওয়ায় চিনলেন। আমি যেতে চেয়েছিলাম খুলনায়। তিনি সন্ধ্যার পর দূরপাল্লায় যাত্রা নিষেধ করলেন–কোথায় কখন কী ঘটে, বলা যায় না। তারপর বললেন, তিনি অপেক্ষা করছেন মেজর জলিলকে গ্রেপ্তার করার জন্যে–এই পথেই তার আসার কথা।
চমকে উঠলাম। মাত্র সাতদিন হয় যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি। এরই মধ্যে একজন সেক্টর কমান্ডারকে বন্দি করতে বলা হয়েছে তার অধস্তন সামরিক কর্মকর্তাকে! ক্যাপ্টেন হুদা জানালেন, মেজর জলিল প্রধান সেনাপতির আদেশ অমান্য করায় ১০/১১ তারিখেই এই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
রাতটা মন খারাপ করেই কাটলো। পরদিন সকালে একাই খুলনা গিয়ে মেজোবুদের সকলের সঙ্গে দেখা করে এলাম। যুদ্ধের ক মাসের মধ্যে বড়ো ভাগ্নিটির বিয়ে হয়ে গেছে–তার বাড়িও ঘুরে এলাম।
খুলনায় নতুন জেলা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকীর সঙ্গে দেখা হলে দুটি অভিযোগ শুনতে পেলাম। একটি মেজর জলিল ও তার মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধার বিরুদ্ধে অবাঙালিদের সম্পত্তি লুঠপাট ও অবাঙালি মেয়েদের প্রতি অত্যাচারের, অপরটি ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সম্পদ-অপহরণের। জানলাম, বিষয় দুটি সম্পর্কে তিনি সরাসরি অবহিত করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে একজন ডিসির পক্ষে দেশের ও বিদেশের প্রধানমন্ত্রীকে এরকম চিঠি লেখা শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল বিবেচিত হয়েছিল এবং পরে এ-নিয়ে অনেক গোলযোগ হয়েছিল।
আমার কিন্তু হতবাক ও হতোদ্যম হওয়ার পালা! এসব আবার কী আরম্ভ হলো! খুলনা থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এলাম যশোরে, তারপর সবাইকে নিয়ে একটু রাত করেই পৌঁছোলাম কলকাতায়।
ফেরার প্রস্তুতি নিতে আরো কটি দিন কেটে গেল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপকুমার চক্রবর্তী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে বললেন, দেশে ফিরে যাচ্ছেন–হাতে কিছু টাকাপয়সা রাখা দরকার। সমিতি যে-সামান্য টাকা দিতে পারে, আপনাকে তা নিতে বলতে পারি না। ভাই, এই হাজার পাঁচেক টাকা ঋণ হিসেবে নিন, পরে একসময়ে পাঠিয়ে দেবেন।’ এই বলে হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।
এ-রকম পরিস্থিতিতে অভিভূত না হয়ে পারে, এমন কে আছে! টাকাটা সমিতিরই ছিল, কিন্তু তিনি ধার দিয়েছিলেন নিজের দায়িত্বে। বোধহয় জুন মাসের দিকে, দিলীপদা ঢাকায় এলে, এই ঋণ পরিশোধ করেছিলাম।
৫ জানুয়ারি সকালে আজিজ ও আমি যার যার গাড়িতে পরিবার নিয়ে কলকাতা থেকে রওনা হলাম খুলনায়।
সীমান্ত পেরিয়েই একবার থামলাম। গাড়ি থেকে নেমে বেবী ও আমি দেশের ধুলোমাটি নিলাম দুহাত ভরে।
যে-পথে যাচ্ছি, তার দুপাশের বাড়িঘরে গোলাগুলির চিহ্ন; ভাঙা পুল; বিকল্প পথ; পাকিস্তানিদের তৈরি বাঙ্কার; ভারতীয় বা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছোটোখাটো ছাউনি। লোকজন কিছু কিছু ফিরছে তখনো; বিধ্বস্ত ঘরের পাশে তুলছে নতুন আশ্রয়; দোকানপাট সাজাচ্ছে নতুন করে। ফুলতলার কাছে পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত একটি ট্যাংক পড়ে আছে। সেদিকে কেউ কেউ কৌতূহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে মাত্র।
খুলনায় বোনের বাড়িতে দুদিন কাটিয়ে ৮ তারিখে আবার দুই গাড়ির বহর ঢাকার পথে। এবারে মেজো দুলাভাই আছেন আমার গাড়িতে। ঢাকার পথ অনেক বেশি দুর্গম মনে হলো। ভাঙা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচ দিয়ে ফেরিতে নদী পার হলাম। কোথাও নৌকা জুড়ে পন্টুনের মতো করা হয়েছে, তার ওপর দিয়ে গাড়ি পার করার ব্যবস্থা। কোথাও ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে মজুররা কাজ করছে তখনো, ইট জোগাচ্ছে গাড়ির চাকার নিচে। জায়গায়-জায়গায় অনেকক্ষণ দেরি হচ্ছে–বেশ ভিড় জমে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় এমন ভিড়, সেখানে দোকানও খুলে বসেছে কেউ কেউ। দোকানে রেডিও বেজে চলেছে সর্বক্ষণ।
তখনো সন্ধ্যা হয়নি। এইরকম অপেক্ষায় আছি অনেকে। হঠাৎ জনতার মধ্যে চাঞ্চল্য, উল্লাস, ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি।
কী হয়েছে? বেতারের সংবাদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়েছেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে। রাওয়ালপিন্ডি থেকে তিনি রওনা হয়েছেন অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। সেই মুহূর্তে কী যে আনন্দ আমাদের! সকলে সকলকে জড়িয়ে ধরছেন, কেউ জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, কেউ কেঁদে ফেলছেন। অনতিবিলম্বে সেই অনির্দিষ্ট গন্তব্যেরও খোঁজ পাওয়া গেল : লন্ডন।
৮ জানুয়ারি যখন ঢাকায় এসে পৌঁছোলাম, তখন রাত অনেক হয়েছে। প্রথমে গেলাম স্বামীবাগেশ্বশুরবাড়িতে। আমার শ্বশুর আবদুল ওয়াহাবকে দেখলাম, কেমন যেন বদলে গেছেন এই ক মাসে। আশ্চর্য নয় যে, ১৯৭১-এর দিনগুলো সম্পর্কে যে-বই তিনি লিখেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ওয়ান ম্যান’স অ্যাগনি (ঢাকা, ১৯৭২) : এটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর শহীদ অনুজ আবদুল আহাদকে। ভাইয়ের সম্পর্কে যতটাসম্ভব খোঁজখবর করছেন তিনি তখনো। জানেন, তিনি নেই, তবু আশা ছাড়তে পারেন না।
আজিজরা রয়ে গেল স্বামীবাগে। সেখানেই খবর পেলাম, আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ও সহকর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক, গিয়াসউদ্দিন আহমদের শার্ট দেখে তার লাশের খানিকটা শনাক্ত করা গেছে এবং পরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে তা সমাধিস্থ হবে।
স্বামীবাগ থেকে এলাম ঠাটারিবাজারে–পিতৃগৃহে। দেখি, একতলা লোকে লোকারণ্য। পাড়ার বেশ কয়েকটি এবং পাড়ার বাইরের একটি অবাঙালি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে আমাদের বাড়িতে। আমরা ফিরে এসেছি জেনে, মনে হয়, তাদের দুশ্চিন্তা কিছু বেড়েছিল।
এই ন মাসের অনেকটা সময় আমার ছোটোভাই আখতারকে পালিয়ে থাকতে হয়। আখতারের একটা ছোটো প্রেস ছিল বাড়ির নিচতলায়। নির্বাচনের সময় থেকে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কমিটি সেই প্রেসে অনেক কিছু ছাপিয়েছিল। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না হলেও, অনেকের মতো, আখতারও ওই সময়টায় এবং অসহযোগ আন্দোলনের কালে ঝুঁকেছিল আওয়ামী লীগের দিকে। এপ্রিলের ১ তারিখে তার প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই পাড়ার কিছু অবাঙালি লোকজন তার বিরুদ্ধে লেগে যায়। এলাকার মুরুব্বি হিসেবে আব্বা তাদের কোপানল এড়াতে সমর্থ হলেও আখতারকে পালিয়ে যেতে হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে বাড়ি ফিরে আসে।
আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল এক পূজামণ্ডপ। তার পাশের বাড়িটা বিহারিদের। সে-বাড়ির সকলেই আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু আখতারেরই প্রায় সমবয়সী, সে-বাড়ির বড়ো ছেলে, মাহবুব ১৬ ডিসেম্বরের পরে ভয়ে পালিয়ে যায়। তার মা নিরুদ্দিষ্ট পুত্রের জন্যে কেবল অশ্রুবিসর্জন করেন।
আব্বার সঙ্গে দেখা হলো এক বছর পরে। আখতারের ছেলেকে প্রথম দেখলাম তার ন মাস বয়সে। আব্বা বললেন, স্বাধীন বাংলা বেতার-কেন্দ্র থেকে যেদিন তিনি শোনেন যে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাকারী বাংলাদেশের শিক্ষক প্রতিনিধিদলে আমি ছিলাম, সেদিন নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে ভয় না পেয়ে তাঁর বরঞ্চ খুব গর্ব হয়েছিল এই ভেবে যে, তার ছেলে দেশের জন্যে কিছু করছে। আব্বার বয়স তখন ৭৪। আমাদের বাড়ির মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যেরা যে গুলি চালিয়েছিল, সেই গুলিতে আহত আব্বার কমপাউনডার এরফান যে এখনো পঙ্গু, প্রতিবেশীদের একজনকে পাকিস্তানি সেনারা যে গুলি করে রাস্তায় ফেলে রেখে তার লাশ সরাতে নিষেধ করেছিল, তারপর বাঙালিরা সকলেই যে পাড়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, আব্বা এসব বৃত্তান্ত জানালেন।
৯ তারিখ সকালে এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে। অনেক বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলো : বাংলার রফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সমাজবিজ্ঞানের সাদউদ্দিন, গণিতের শহীদুল্লাহ্। আমাদের বন্ধু ও গিয়াসউদ্দিনের ভগ্নিপতি নুরুল হক তো ছিলেনই, আরেক বন্ধু মসিহুর রহমানও ছিল। যাদের লাশ কিংবা মরদেহের অংশবিশেষ পাওয়া গিয়েছিল, তাদের জানাজা হলো, তারপর মসজিদ-প্রাঙ্গণে গোর হলো। আমার দুই শিক্ষক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর দেহাবশেষ পাওয়া যায়নি। সহকর্মী আনোয়ার পাশা, রাশীদুল হাসান ও আবুল খায়েরের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সবকিছুর শেষে প্রায় সবাই যখন চলে গেলেন, তখন আমি গিয়াসের কবরের পাশে বসে পড়ে কেঁদে ফেলি। বন্ধুরা কেউ কেউ আমাকে ধরে উঠিয়ে নিয়ে যান।
ওই সন্ধ্যায়ই দেখা করতে যাই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তখন বোধহয় তিনি দেশের সবচাইতে ব্যস্ত মানুষ–সেই ব্যস্ততার মধ্যেও কথা হলো। আমি আগে আসিনি বলে অনুযোগ করলেন না, তবে তার বিচিত্র অনুভূতির কিছুটা তুলে ধরলেন আমার কাছে : দেশের সমস্যার বিপুলতা, পুনর্বাসন প্রয়াসের প্রাথমিক সাফল্য, বেআইনি অস্ত্রের ভয়, দেশের মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার বৈপরীত্য, প্রশাসন ও দলের মধ্যে তাঁর অনভিপ্রেত কাজ, বঙ্গবন্ধুর মুক্তিতে স্বস্তি, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা ও সংশয়।
আমি নিজেই দেখলাম, অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কতোজন, নবাবপুরে-ঠাটারিবাজারে দোকানপাট লুঠ হচ্ছে–পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। থানা বলছে, পাঠাবার মতো পুলিশ নেই সেখানে। কয়েকদিন পরে গিয়েছিলাম বেগম সুফিয়া কামালের বাড়িতে। তাঁদের লনে বসে কামাল ফুপা ও আমি কথা বলছি–এমন সময়ে পাশের বাড়িতে হইচই। ফুপা ও আমি এক দৌড়ে সেখানে হাজির হলাম। দেখি, কয়েকজন অস্ত্রধারী তাদের বাড়ির জিনিসপত্র লুঠ করছে। তারা দাবি করলো, তারা মুক্তিযোদ্ধা। আমি ফুপার পরিচয় দিয়ে ভাবলাম, কাজ হবে। কিছুই হলো না। তারা আমাদের বাধা-নিষেধ অনুনয়-বিনয় কিছুই মানল না। ওই বাড়ির বাসিন্দারা পুরোপুরি না হলেও অংশত অবাঙালি ছিলেন। অতএব তাদের সম্পত্তি লুঠ করার অধিকার অর্জন করেছে তথাকথিত ওই মুক্তিযোদ্ধারা। যখন আমি তাদেরকে বললাম আমার সঙ্গে নিকটবর্তী মুক্তিযোদ্ধা-ক্যাম্পে যেতে, তারা বললো, আমাদের কাজ আমরা করছি, আপনি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারেন।
আমাদের বাড়ির আশ্রয়প্রার্থীরা সময় ও সুযোগমতো চলে যেতে শুরু করলেন। মাহবুবের মা আমার সাহায্যে যেতে চান মিরপুরে–আত্মীয়ের বাড়িতে। বিহারি-অধ্যুষিত অঞ্চলে আমার যাওয়াটা বাড়ির কারো অভিপ্রেত নয়। তবু কথা দিলাম, পরদিন নিয়ে যাবো।
১০ তারিখে সূর্যোদয় হলো অনেক প্রত্যাশা নিয়ে। এদিনে বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। প্রথমে ভেবেছিলাম, বিমানবন্দরের দিকে যাবো। পরে ভাবলাম, বেতারেই বরঞ্চ শুনি তাঁর প্রত্যাবর্তনের ধারাভাষ্য, তারপর যাবো তার জনসভায়। তাই করলাম। ৭ মার্চ ঢাকায় ছিলাম না, কিন্তু ১০ জানুয়ারির মতো বড়ো সমাবেশ আমি কখনো দেখিনি। বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম দূর থেকে। তিনি যেন এই ক মাসে খানিকটা কৃশ হয়েছেন, কিন্তু কণ্ঠের তেজ বিন্দুমাত্র কমেনি। বক্তৃতায় তিনি জানিয়ে দিলেন ভুট্টোকে : কোনো বন্ধন নয় আর পাকিস্তানের সঙ্গে; বাংলাদেশ স্বাধীন, এর রাষ্ট্রীয় নীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র।
জনসভায় এত লোক, কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা নেই কোথাও। সভাশেষে শেরওয়ানি-টুপি-পরা এক ভদ্রলোককে কিছু ছেলে ঘিরে ধরেছিল–পরিচয় জানতে চায়, তার প্রমাণ চায়। শেষ অবধি অবশ্য বিনা গোলযোগেই ছেড়ে দিলো তাকে। এত মানুষের সুশৃঙ্খল আচরণ দেখে ভরসা হলো, আমরা ব্যর্থ হবো না, এত ত্যাগ বিফল হবে না।
রাত একটু গম্ভীর হলে মাহবুবের মা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের আমার গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে চললাম মিরপুরের দিকে। ওই রাতে তরুণ অস্ত্রধারীদের অধিকাংশই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনে আনন্দ-উল্লাসে ব্যস্ত। পাড়ায় তাদের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে না। এই সুযোগে আশ্রয়প্রার্থীদের নিয়ে নিরাপদে বের হওয়া গেল। মিরপুরের কাছাকাছি গিয়ে সকল ইন্দ্রিয় সজাগ করে রাখলাম, নিজের নিরাপত্তার চিন্তা মনে এলো। এক জায়গায় ভারতীয় সেনারা গাড়ি থামিয়ে গন্তব্য জানতে চাইলেন। ব্যাখ্যা করলাম। তারা আমাকে যেতে দিলেন, তবে বড়ো রাস্তা ছেড়ে ভেতরে যেতে নিষেধ করলেন। বড়ো রাস্তার ওপরেই যাত্রীদের নামিয়ে দিলাম। আর ভেতরে ঢুকতে সাহস হচ্ছিল না, ওঁরাও ব্যাপারটা বুঝলেন বলে মনে হলো।
বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি, দোতলার বারান্দায় ওই মধ্যরাত্রিতে উৎকণ্ঠিতচিত্তে আব্বা এবং আর সবাই দাঁড়িয়ে–আমার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়।
পরদিন ড. কামাল হোসেন ও তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটলাম ধানমন্ডিতে জিয়াউল হকের (টুলু) বাড়িতে। বন্দিদশা থেকে কামাল মুক্তি পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের একদিন পরে, তবে লন্ডন হয়ে ঢাকায় ফিরেছেন একই সঙ্গে। টুলু ভাইয়ের বাড়িতে কামাল ছিলেন না, তবু লোকে লোকারণ্য। এক ফাঁকে হামিদার সঙ্গে কুশলবিনিময় করে চলে এলাম।
ফাঁকে ফাঁকে যাচ্ছি শহীদ শিক্ষক ও সহকর্মীদের বাড়িতে, দেখা করছি মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, রাশীদুল হাসান, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সারের পরিবারের সঙ্গে। যখন ফিরে আসছি তাদের কাছ থেকে, দেশটাকে স্বজনহারানো শ্মশান বলেই মনে হচ্ছে।
২.
জানুয়ারির ১১ তারিখ সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখনই জানলাম, পরদিন বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন, জিজ্ঞাসা করায় তাজউদ্দীন বললেন, কালই জানতে পারবেন।
সংসদীয় পদ্ধতির সরকার যেখানে আমাদের অভীষ্ট, সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রধানমন্ত্রী হওয়াই স্বাভাবিক ও সংগত। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকলে পাকিস্তানের সূচনাকালের মতো মন্ত্রিসভার চেয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রভাব ও ক্ষমতা থেকে যেত বেশি, তা সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুকূল হতো না। দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারই উচিত হাল ধরা। তাজউদ্দীন নানা গুণে গুণান্বিত মানুষ, কিন্তু বাংলাদেশের। অগুনতি সমস্যার মোকাবেলায় তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পেতেন না। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল তখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার উল্লেখ না করেই তাজউদ্দীন ঘোষণা দেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে, সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত, সর্বদলীয় উপদেষ্টা-পরিষদ স্বাধীনতালাভের পরেও বহাল থাকবে। উপদেষ্টা-পরিষদের কোনো নির্বাহী ক্ষমতা ছিল না, তাই তাঁদের বহাল থাকার বিষয়টা সর্বদলীয় সরকার গঠনের আহ্বান যাঁরা জানাচ্ছিলেন তাঁদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু দেখা গেল, আওয়ামী লীগের তরুণ কোনো নেতা, প্রধানমন্ত্রীর অজান্তেই, সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়ে বসলেন। এতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হলো মাত্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দলের প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সরকার গঠিত হতে পারত, কিন্তু আওয়ামী লীগের বাইরের কেউই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন না। সংসদীয় গণতন্ত্রের হিসেবে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য, আবার মুক্তিযুদ্ধকে বিপ্লব হিসেবে গণ্য করলে ওই প্রশ্ন গৌণ হয়ে যায়। তবে এ কথা তো সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই জনসাধারণের নির্বাচিত দল বলেই আওয়ামী লীগের দেশ শাসনভারলাভের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়েছিল।
ওদিকে মুজিব বাহিনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নেতারা বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তাঁরা মুজিব বাহিনীর অস্তিত্ব বজায় রাখবেন এবং অস্ত্র বা গোলাবারুদ সমর্পণ করবেন না। তাজউদ্দীন যদিও তার আগেই বলেছিলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করার প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে মুজিব বাহিনীর ওই ঘোষণা তাঁর সরকারের প্রতি বিরূপতার প্রকাশ বলেই মনে হয়েছিল। মন্ত্রিসভার দু দফা সম্প্রসারণ ঘটেছে–পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব খন্দকার মোশতাক আহমাদের কাছ থেকে নিয়ে দেওয়া হয়েছে আবদুস সামাদ আজাদকে, তাতে মোশতাক খুশি হননি।
যুদ্ধাপরাধীদের আর তাদের দোসরদের বিচারের দাবি প্রবল হচ্ছে, সরকারের তরফ থেকেও তেমন বিচারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কোনো কোনো মন্ত্রী। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পরে কলকাতায় বসে এ-বিষয়ে তাজউদ্দীন আমাকে যা বলেছিলেন, আমার মনে পড়ছে সেসব কথা : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে আর ভারতকে চাপ দিচ্ছে যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে। যুদ্ধবন্দিদের বিচারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইচ্ছুক নয়, ভারতও উৎসাহী নয়। এই অবস্থায় কার জোরে আপনি বিচার করবেন? আর মূল অপরাধীদের বিচার করতে না পারলে তাদের সহযোগীদের বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য। সেদিন আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম, তবু আশা ছাড়িনি যে, যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের বিচার হবে।
পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরিয়ে আনার জন্যেও সরকারের ওপর চাপের সৃষ্টি হচ্ছে। সিভিল সার্ভিসের সাবেক সদস্য, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি, আহমদ ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়েছে এ-বিষয়ে নানা উদযোগ নিতে। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, কাজটা সহজ হবে না। বাঙালিদের আটকে রেখে পাকিস্তান দর-কষাকষি করবে যুদ্ধবন্দিদের ছাড়িয়ে নিতে।
শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীদের অনেকে আশ্রয় নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে–সেখান থেকে মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করবে বলে। তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনী। মিলিতভাবে অভিযানও চালিয়েছে সে-অঞ্চলে।
১১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তাজউদ্দীনের সঙ্গে এত বিষয়ে আমার কথা হয়নি। তিনি বঙ্গভবনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমার সঙ্গে কথা সেরে যেই তিনি বেরিয়ে এলেন, অমনি বহু লোক তাঁকে ঘিরে ধরল–সবারই কিছু না কিছু আরজি আছে। প্রথমে বিনীতভাবে, শেষে রাগতস্বরে তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন–সময়মতো তাঁর কাছে না গিয়ে আমি আপনাদের। কথা শুনব, এই কি আপনারা আশা করেন?’ যিনি বলছিলেন এবং যাদের বলছিলেন, উভয় পক্ষের প্রতিই আমি সহানুভূতি বোধ করছিলাম।
৩.
পরদিন বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীরূপে শপথ নিলেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হলেন রাষ্ট্রপতি।
এবারে বঙ্গবন্ধু সকল মুক্তিযোদ্ধাকে আহ্বান জানালেন অস্ত্র সমর্পণ করতে। কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী, মুজিব বাহিনী, ছাত্র ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধারা, মায়া গ্রুপ–একে একে অস্ত্র সমর্পণ করলো নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শুনেছিলাম, মুক্তিবাহিনীর মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি ও সিরাজুল আলম খানের অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে–শেষোক্তরা সমাজতন্ত্রের যত অনুরাগী, প্রথমোক্তরা তত নয়। তবে অস্ত্র সমর্পণ করলেন তারা একজোট হয়ে। সেদিনই নতুন স্লোগান শোনা গেল : মুজিববাদ জিন্দাবাদ। মুজিববাদ বলতে যে কী বোঝায়, তা আমার জানা ছিল না; দেখা গেল, অনেকেরই জানা নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে কথাটা খুব চালু হয়ে যায়, এমনকি, মুজিব বাহিনীর তরুণ নেতারা মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে দ্বিতীয়বার সংগ্রামের আহ্বানও জানিয়েছিলেন। সরকারি পর্যায়ে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘোষিত তিন নীতিকে দেশের লক্ষ্য বলে প্রচার করা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী, বড় একটা রাষ্ট্রায়ত্ত খাত গঠিত হতে চলেছে, এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তা পরিচালনার মতো দক্ষ ও নির্লোভ জনশক্তি আমাদের আছে কি না সে-সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে। আমি আশা করছি, দেশপ্রেম দিয়ে সব সংকট পার হওয়া যাবে।
১৩ তারিখে দুপুরে বাড়ি ফিরে শুনি, বাংলা একাডেমি থেকে কয়েকবার আমার খোঁজ করা হয়েছিল। কারণ জানতে পরিচালক কবীর চৌধুরীকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে আমার সোনার বাংলা’–এটা স্থির হয়ে গেছে, তবে গানটির কয় চরণ জাতীয় সংগীতরূপে গৃহীত হবে, সেই পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল বাংলা একাডেমির কাছে। পরামর্শের জন্যে তিনি ডেকেছিলেন কয়েকজনকে, আমাকেও যুক্ত করতে চেয়েছিলেন তার সঙ্গে। তাঁরা সুপারিশ করেছেন, গানটির প্রথম দশ চরণ জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হোক। আমি বললাম, যথার্থ হয়েছে। কিন্তু মনে আফসোস রয়ে গেল, এত বড়ো একটা সিদ্ধান্তের অংশভাগী হওয়া থেকে বঞ্চিত হলাম। ওইদিনই নতুন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়, সেই সঙ্গে রণসংগীত নির্ণীত হয় ‘চল্ চল্ চল্। তার আগে, জানুয়ারির ৪ তারিখে, বাংলাদেশের মানচিত্র-অঙ্কিত পতাকার বদলে সবুজ জমিনের ওপরে লাল সূর্য আঁকা নতুন জাতীয় পতাকার নকশা গৃহীত হয়। মন্ত্রিসভায়। যতদূর জানি, নকশাটা করেছিলেন কামরুল হাসান।
একবার চট্টগ্রামে যেতে হয়। ১৭ বা ১৮ তারিখের সকালে, এক গাড়িতে উপাচার্য ড. এ আর মল্লিক আর পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক এবং আমার গাড়িতে রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান আর আমি রওনা হলাম। অসংখ্য রাস্তাঘাট, পুল ও কালভার্ট ভাঙা–বিকল্প পথ ধরে এগোতে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। প্রথমে এক জায়গায় থামতেই দেখি সামনের গাড়িতে খান শামসুর রহমান ওরফে জনসন এবং আবদুল বারেক চৌধুরী ওরফে এবিসি। অপেক্ষমাণ অবস্থায় গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করা ছাড়া করণীয় কিছু ছিল না। সারাপথ শামসুর রহমান আশপাশের পরিবর্তমান ভূচিত্রের কথা বলে গেলেন। তাঁর মুখে সেদিন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভূগোলের যে-পরিচয় লাভ করেছিলাম, তা ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
চট্টগ্রামে ফেরাটা ছিল খুব আবেগময় ব্যাপার। আমরা ক্যাম্পাসে পৌঁছেছিলাম প্রত্যাশিত সময়ের অনেক পরে। তখনো অধ্যাপক থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করছেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাবেন বলে। আমরা উঠলাম উপাচার্যের বাসভবনে। ওই বাড়িতেই ক্যাম্পাসের সর্বশেষ রাত কাটিয়েছিলাম ড. মল্লিক ও আমি। আমার আবাসের অনেক কিছু লুষ্ঠিত হয়ে গেছে। কাপড়-চোপড়, হাঁড়ি-বাসন, বিছানা-বালিশ গেছে–তবে লুটেরারা একটি কফি সেট এবং তিনটি প্লেট (বোধহয় আমার, বেবীর ও রুচির জন্যে) রেখে গেছে। বইপত্র কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে মেঝেতে, কিন্তু আসবাবপত্র সব আছে, রেফ্রিজারেটর অক্ষত, কেবল গ্যারাজের ওপরের ঘরে সাত্তারের চৌকিটা নেই। কিছু লুঠপাট যে নিম্নশ্রেণির কর্মচারীরা করেছে, সে-খবর পাওয়া গেল, এমনকি চৌকিটা কে নিয়েছে তাও জানা গেল। সে অবশ্য বললো, পাছে লুঠ হয়ে যায়, তাই নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে, আমি বললেই ফেরত দিয়ে যাবে। আমি বলেছিলাম, তবে চৌকি ফেরত পাইনি। তার নতুন মালিক পরে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা হয়েছিল।
তার চেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা একটা শুনলাম। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল দেশে ফিরে ক্যাম্পাসের একটি অংশে জায়গা করে নেয় বিজয়লাভের দিন দুই পরে। তখন তাঁদের সমাদরের লেশমাত্র অভাব হয়নি। কয়েকদিন পরে দলটি যখন ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যায় তখন ট্রাকে করে নিয়ে যায় কয়েকটি শ্রেণিকক্ষের আসবাবপত্র, টাইপরাইটার এবং ফিল্ড টেলিফোন-মার্কা আমাদের কয়েকটি টেলিফোন সেট। বিবরণ শুনে আমি যৎপরোনাস্তি লজ্জিত হই। যিনি এই দলের অধিকর্তা ছিলেন, পরে তিনি বেশ পদোন্নতি লাভ করেছিলেন এবং সময়ের আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন।
একটি ট্রাজিক ঘটনার কথাও এ-সময়ে জানতে পারি। আমার অনুপস্থিতিতে এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্ট নিযুক্ত হয়েছিলেন ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. জাকিউদ্দীন আহমদ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে বাড়ির সামনে পায়চারি করার সময়ে তিনি আকস্মিকভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং ১৩ দিন পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্ত্রী ও শিশুপুত্র তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসে আছেন। ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বারবার স্বামীর হয়ে আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে লাগলেন–আমার অবর্তমানে প্রোভোস্টের পদটি তিনি গ্রহণ করেছিলেন বলে। আমি বারবার তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে, এটি একটি প্রশাসনিক ব্যাপার, কাউকে না কাউকে ওই দায়িত্ব পালন করতে হতো, এবং তা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু আমার মুখ থেকে ‘ক্ষমা করেছি’ না শোনা পর্যন্ত ভদ্রমহিলা ক্ষান্ত হলেন না। আমি আর কখনো এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি।
আমরা চট্টগ্রামে পৌঁছোবার পরদিন বিকেলে মুসলিম ইনসটিটিউট হলে আমাদের–‘বাংলার সংগ্রামী বুদ্ধিজীবীদের’–বীরোচিত সংবর্ধনা। আয়োজন করেছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু)–যার সাধারণ সম্পাদক আবদুর রব মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শহীদ হয়েছিল। বক্তৃতায় যেসব অতিশয়োক্তি করা হয়েছিল, তা অপ্রত্যাশিত ছিল না কিন্তু জনসমাগমের ব্যাপকতা এবং আবেগ ও আন্তরিকতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশের মাত্রা আমাদের প্রত্যাশার অতীত ছিল।
মুসলিম ইনসটিটিউটে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহের কনিষ্ঠ পুত্র প্রফুল্ল সিংহ। এই ক মাসে তার পৃথিবী সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সেই ধাক্কা সামলাচ্ছেন তিনি–এখন সবই আবার তাকে নতুন করে শুরু করতে হবে। সভার শেষে লোকজনের সঙ্গে কথা বলার এক পর্যায়ে লক্ষ করলাম, আমার মামাতো ভাই সৈয়দ কামরুজ্জামান এবং বন্ধু আবদুল আলী ও মীর মোজাম্মেল হোসেন দাঁড়িয়ে আছেন। দ্রুত তাদের কাছে গেলাম এবং কামরু ভাইয়ের গাড়িতে করে বাটালি হিলে রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে এসে পৌঁছোলাম। একই বাড়ির একতলায় আলীর এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ এ জেড এম আবদুল আলিমের পরিবারের সঙ্গে দেখা করে দোতলায় মোজাম্মেলের বাড়িতে উঠলাম। সেখানে তাঁর মা থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই ভেতর থেকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মিসেস আতাউর রহমান।
আমার দীর্ঘদিনের পরিচিত এবং মোজাম্মেলের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু আতাউর রহমান ছিলেন রেলওয়ের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে তার ভূমিকা ছিল সক্রিয় এবং জনসংযোগ বিভাগের লোক হওয়ায় সবার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও ছিল কিছু বেশি। চট্টগ্রাম শহর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে চলে গেলে রেলের অবাঙালি কর্মীরা তাঁর প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। আতাউর তখন আত্মগোপন করেন এবং অফিসে যোগদান করার সরকারি নির্দেশ জারি হওয়ার পরেও কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসেননি। এক পীরসাহেব আতাউরের স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, অফিসে যোগ দিলে আতাউরের কোনো ক্ষতি হবে না। অফিসে যাওয়ার পরপরই পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায়–তিনি আর ফিরে আসেননি। শুনেছি, টাকাপয়সা-গয়নাগাটি নিয়ে আরো কাউকে কাউকে পীরসাহেব এরকম পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং তাঁদের সবার একই পরিণতি ঘটেছিল। এখন এক ছেলে, এক মেয়ে এবং একরাশ মনস্তাপ নিয়ে আতাউরের স্ত্রী দিশেহারা। তাঁকে আমি কিছুই বলে উঠতে পারছিলাম না।
চট্টগ্রামে গিয়ে মনে হলো, পূর্বপদে ফিরে আসার তেমন আগ্রহ যেন ড. মল্লিকের নেই। তার কয়েক দিন পরে তিনি শিক্ষাসচিব হিসেবে যোগ দেওয়ায় তাই অবাক হইনি, যদিও মনে হয়েছিল যে, ওটি তাঁর পক্ষে উপযুক্ত পদ নয়। তবে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাঁকে এই নিয়োগ গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিলেন। সদ্যস্বাধীন দেশে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্বিন্যাসে তার চিন্তা ও অভিজ্ঞতা দেশের কাজে লাগবে বলে এবং সেই আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভবপর ছিল না তাঁর পক্ষে। নতুন ভূমিকায় তাঁকে দেখলাম ২২ জানুয়ারিতে শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলীর দপ্তরে আহূত এক সভায়। শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে ইউসুফ আলী যে-নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন, সে-কথাটা এখানে বলে নিই। পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে শিক্ষাবিষয়ে আমি যে কয়েকটি কাগজ তৈরি করেছিলাম, তার একটিতে প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে যে-ক্লাসে পড়ত, ১৯৭২ সালের ১ মার্চে তাকে আবার সেখান থেকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে; এই একটি বছর জাতীয় ক্ষতি হিসেবে পরিগণিত হবে; এবং সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়ঃসীমা এক বছর বাড়িয়ে। দেওয়া হবে। কিন্তু মন্ত্রিসভায় এ-প্রস্তাব বিবেচিত হওয়ার আগেই জাতীয় পরিষদ-সদস্য ইউসুফ আলী এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গণউন্নতি দেওয়া হলো, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে যে যেখানে পড়ত, ১৯৭২ সালে তার পরবর্তী শ্রেণিতে সে উন্নীত হবে। এই ঘোষণার বিষয়ে তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করেননি, সে-কথা আমি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে জেনেছিলাম। বলা বাহুল্য, ঘোষণাটি ছাত্রদের কাছে খুব জনপ্রিয়। হয়েছিল এবং তা প্রত্যাহার করার মতো সাহস সরকারের হয়নি। এতে যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে কী সর্বনাশ হলো, অনেকে তা ভেবে দেখেননি। এই কারণে ইউসুফ আলীর প্রতি মনটা বিমুখ হয়ে থাকলেও তাঁর আহ্বানে তাঁর দপ্তরে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা সম্পর্কে আলোচনা করতে। শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিব ছাড়া তাতে উপস্থিত ছিলেন মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল ফজল, কবীর চৌধুরী, সৈয়দ আলী আহসান ও মযহারুল ইসলাম, আর ছিলাম আমি। সেখানে সুপারিশ করা হয় যে, দেশে একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে এবং একই মাধ্যমে শিক্ষাদান করা হবে, আর এসব বিষয়ে বিস্তারিত সুপারিশ প্রণয়নের জন্য সরকার একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করবেন। বাংলা ভাষায় উচ্চ শিক্ষাদানের ব্যবস্থা যে তখনই চালু করা সম্ভব, এ-সম্পর্কে সবচেয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন কুদরাত-এ-খুদা। তবে অভিন্ন শিক্ষাপদ্ধতি-প্রবর্তনের প্রশ্নে আবুল ফজল একমত হলেন না, তিনি চাইলেন, সংস্কার করে হলেও মাদ্রাসা শিক্ষার স্বতন্ত্র ধারাটি অব্যাহত রাখতে। তিনি মনে করছিলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় বোধহয় সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে একীভূত করার প্রস্তাব উঠেছে। আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, শিক্ষাগত বিবেচনায়ই এটি কাম্য, তিনি তা মানলেন না। কয়েক দিন পরে দৈনিক বাংলায় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মাদ্রাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্যরক্ষার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।
২৭ জানুয়ারি আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে। নতুন পরিস্থিতিতে সংস্কৃতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছিল এর লক্ষ্য। এতে সভাপতিত্ব করেছিলেন বেগম সুফিয়া কামাল আর অংশ নিয়েছিলেন ঢাকার অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সভায় একটি কমিটি গঠিত হয় সুফিয়া কামালকে আহ্বায়ক এবং কামরুল হাসান, খান সারওয়ার মুরশিদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, জহির রায়হান, সৈয়দ হাসান ইমাম, ডা. সারোয়ার আলী ও আমাকে সদস্য করে। এই উদযোগে একটা বড়ো ভূমিকা ছিল বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের।
২৯ তারিখে এই কমিটির আহ্বানে আরেকটি সভা আয়োজিত হয় বিএমএ ভবনে। উদ্দেশ্য, বিশদ আলোচনা এবং আরো বড়ো করে মতবিনিময়। সকালবেলায় বোরহান আমাকে ফোন করে জানালো, বিকেলের সভায় জহির আসতে চাইছে না, তুমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলো। ফোন করতেই জহিরকে পেয়ে গেলাম। আমি তাকে সভায় আসতে বলি, সে আসতে পারবে না বলে মিনতি করে। শেষে জানায়, নিরুদ্দিষ্ট অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার-সম্পর্কিত একটা খবর পেয়েছে সে, তার সূত্র ধরে সে অনুসন্ধানে যাচ্ছে, ফিরে এসে সবটা বলবে আমাকে।
নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের সভা হয়ে গেল, জহিরের কোনো খবর নেই। পরদিন খোঁজ নিয়ে শুনি, সঙ্গীদের ফিরিয়ে দিয়ে জহির একাই ঢুকে গেছে মিরপুরের কোনো বাড়ির মধ্যে। সেখানে গোলাগুলি হয়েছে–আমাদের পুলিশ ও সেনা সদস্য জখম হয়েছে, কিন্তু জহির ফিরে আসেনি। কী সর্বনাশ! এমন খবর তো কাগজেও পড়িনি! না, ইচ্ছে করেই খবর দিতে দেওয়া হয়নি; এখনো চেষ্টা চলছে শহীদুল্লা কায়সারকে না পাওয়া গেলেও জহির রায়হানকে উদ্ধার করার।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জহির সরকারকে আহ্বান জানিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠন করতে। সরকার কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সে নিজেই গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিল নিজেকে আহ্বায়ক করে। গুছিয়ে কাজ করার মতো মানসিক অবস্থা তার তখন ছিল না। দাদার অন্তর্ধানে সে একেবারে উদ্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। সরকারের বিরুদ্ধেও তার যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল–কিছুটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা ঘটনায়, কিছুটা বুদ্ধিজীবী-হত্যার তদন্তে সরকারের উদযোগহীনতায়। তাই সে একা একাই যতটা সম্ভব করতে চেয়েছিল এবং তা করতে গিয়ে নিজেই হারিয়ে গেল।
৪.
স্বাধীনতালাভের আনন্দের মধ্যেও নানা ক্ষেত্রে মানুষে-মানুষে সম্পর্কে এক ধরনের জটিলতা ও উত্তেজনা দেখা দিলো। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যারা বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন, তারা দেশে ফিরে যখন প্রশাসনের হাল ধরলেন, তখন অনেক সময়ে দেশে কর্মরত তাঁদের জ্যেষ্ঠ বা সমসাময়িক কর্মকর্তাদের তারা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেটা কারা কীভাবে মেনে নিয়েছিলেন, তা বলা শক্ত, তবে মুজিবনগর-প্রত্যাগত কর্মকর্তাদের অনেকে সহকর্মীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। প্রশাসনে পাকিস্তান সরকারের সোৎসাহী সমর্থক কেউ কেউ ছিলেন, সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্যদের থেকে তাঁদের স্বতন্ত্র করে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াটা সহজ ছিল না। কাগজে দেখলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে খেতাব নেওয়ার দায়ে বেশ কয়েকজন কর্ম থেকে অপসারিত হয়েছেন। এদের মধ্যে একজন, ড. এরফান আলী, অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়েকদিনে, চট্টগ্রামে সর্বতোভাবে আমাদের সাহায্য করেছিলেন। এই তালিকায় আরো কেউ কেউ ছিলেন যাঁদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতার অভিযোগ ছিল না। আবার সত্যি যাঁরা সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে বহাল তবিয়তে কাজেই থেকে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন, এমন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চিহ্নিত করার জন্যে পরে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটিতে ছিলেন সাবেক পিএসপি এ বি এম সফদার। সফদার পাকিস্তানের প্রতি অনুগত কর্মকর্তা বলে সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন। বেতার-টেলিভিশনের শিল্পীদের মধ্যে পাকিস্তানের সহযোগী খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল, নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন তার প্রধান। তাঁর রিপোর্টের ভিত্তিতে পরে কিছু শিল্পীকে বেতার-টেলিভিশনে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণে অনেকের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছিল, অনেক প্রকৃত সহযোগী টাকাপয়সা দিয়ে বা প্রভাব খাঁটিয়ে অভিযোগ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন।
এভাবে, জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে মানুষ যেন নানাভাগে বিভক্ত হতে শুরু করেছিল। মুজিবনগর-প্রত্যাগতদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছিল অন্যদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, শুনেছি, আমাদের দুজন সহকর্মীর ব্যবহারে তাঁদের ব্যক্তিগত বন্ধুরাও আহত বোধ করেছিলেন। সরকারবিরোধীরা এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি। সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকা প্রথম পাতায় একটি রিপোর্টের ব্যানার হেডিং দিয়েছিল : সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন কোলাবরেটরস্। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া এক কোটি লোক বাদে আর-সবাই পাকিস্তানিদের সহযোগী। বলা বাহুল্য, এমন মনোভাব কারো ছিল না, কিন্তু অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ওই শিরোনাম অনেকের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কর্তাদের নির্দেশে বুলবুল ললিতকলা একাডেমীকে ঢাকা সেনানিবাসে কয়েকটি নৃত্যগীতানুষ্ঠানে অংশ নিতে হয়। এখন সেই দায়িত্ব এসে পড়ল তার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহমদ হোসেনের ওপরে। মুক্তিযোদ্ধা ও সংগীতশিল্পী মোরাদ আলী অভিযোগ আনে আহমদের বিরুদ্ধে এবং তাদের দুজনকে নিয়ে আমি দিনতিনেক বৈঠক করি। শেষ পর্যন্ত স্থির হয়, বাফার সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে আহমদ ইস্তফা দেবে। ব্যাপারটা আহমদের জন্যে গভীর দুঃখের কারণ হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এতজন শিক্ষক-কর্মকর্তা শহীদ হয়েছেন, অনেকে কারাভোগ করেছেন, পাকিস্তান-সমর্থকেরা বেশ দাপটও দেখিয়েছেন–ফলে উত্তেজনটা সেখানে ছিল কিছু বেশি। অনেকেই আশা করছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণ করলে এসব বিষয়ে প্রত্যাশিত সুরাহা হবে।
জানুয়ারি মাসের শেষদিকে সৈয়দ আলী আহসান আমাকে বললেন, শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী চান আমাকে বাংলা একাডেমির পরিচালক নিযুক্ত করতে। আমি সম্মত কি না, তা জেনে নেওয়ার ভার দিয়েছেন তিনি আলী আহসান সাহেবকে। আমি নির্দ্বিধায় বললাম, শিক্ষকতার বাইরে কিছু করার ইচ্ছে আমার নেই, বোধহয় যোগ্যতাও নেই; সুতরাং শিক্ষামন্ত্রীকে তাঁর প্রস্তাবের জন্যে ধন্যবাদ জানানো ছাড়া আমার করণীয় নেই, আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই ফিরে যাবো।
ফেব্রুয়ারি মাসে কিছু আগে-পরে সব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে গেল। তার আগে নতুন উপাচার্য নিযুক্ত হলেন–ঢাকায় মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, রাজশাহীতে খান সারওয়ার মুরশিদ, জাহাঙ্গীরনগরে সৈয়দ আলী আহসান, চট্টগ্রামে এম ইন্নাছ আলী। সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগরে চলে আসায় কর্মে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষরূপে আমি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী শহীদ হয়েছেন–ওই পদে কে নিয়োগলাভ করবেন, তা নিয়ে কিছুটা জটিলতা দেখা দিলো। কর্মে জ্যেষ্ঠতার দিক দিয়ে বিভাগে মুনীর চৌধুরীর পরে ছিলেন কাজী দীন মুহম্মদ–পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার দায়ে তিনি কারারুদ্ধ। তাঁর পরে ছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী–তিনিও শহীদ হয়েছেন। তাঁর পরে ছিলেন আহমদ শরীফ–অতএব অধ্যক্ষের পদটি স্বাভাবিকভাবে তারই। প্রাপ্য ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি বিভাগের কাজে যোগ দিয়েছিলেন, তাও আবার পাকিস্তানের দালাল এক রাজনীতিবিদের সঙ্গে এসে–এই নিয়ে একটা প্রচারণা-অভিযান চললো তার বিরুদ্ধে। জ্যেষ্ঠতায় আহমদ শরীফের পরে ছিল নীলিমা ইব্রাহিমের স্থান। তিনি যদিও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাঁর এক জামাতা ছিল ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ-দলীয় সদস্য অর্থাৎ ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গণপরিষদের সদস্য। এই সূত্রে ক্ষমতাসীন দলের অনেকের সঙ্গে তার সম্ভাব গড়ে উঠেছিল। বিভাগের জনকয়েক শিক্ষকও তাঁর পক্ষে কাজ করতে নামলেন। ফলে, নীলিমা ইব্রাহিম অধ্যক্ষ হলেন। আহমদ শরীফ ব্যাপারটিকে দেখলেন ব্যক্তিগতভাবে তাঁর প্রতি সরকারের বিরূপতা বলে। অচিরেই তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন সরকারের কঠোর সমালোচকরূপে। বাংলা বিভাগে তাঁর ও নীলিমা ইব্রাহিমের অনুসারীরা কার্যত দুটি দলে ভাগ হয়ে রইলেন বহুদিন পর্যন্ত।
৫.
চট্টগ্রামে এসে নতুন করে সংসার পাততে হলো। হাঁড়িকুড়ি বাসনকোশন সব কিনতে হবে। নিউ মার্কেটে টি-সেট কিনতে গেছি, অনুপম সেন কোত্থেকে আবির্ভূত হয়ে বাধা দিলেন। বললেন, তার প্রতিবেশী তার দুটি টি-সেট রক্ষা করেছেন, তার একটা উনি আমাকেই দান করবেন। খুব যে আপত্তি করেছিলাম, তা মনে হয় না। অনুপমের দেওয়া সেই চায়ের পাত্র বহুদিন আমাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মানবসম্পদের হানি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি–তাই এখানে উত্তেজনা ছিল অপেক্ষাকৃত কম। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক অবনীমোহন দত্তকে চট্টগ্রাম শহরে সেনাবাহিনী হত্যা করেছিল। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক, সেই হিসেবে আমাদের একমাত্র শহীদ শিক্ষক। আমাদের কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে জেলেও যেতে হয়নি। তবু দেখা গেল, অনেক সহকর্মী এসে বলছেন, এই ক মাসে শিক্ষকদের মধ্যে কারা বেতারে কথিকা পড়েছিলেন, কারা পাকিস্তান কাউনসিলে সেমিনার-সিম্পোজিয়মে বক্তৃতা করেছিলেন, কারা কাগজে বিবৃতি দিয়েছিলেন–আর এসব কথিকা-বক্তৃতা-বিবৃতিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার আহ্বান জানানো হয়েছিল। আমি তাঁদের বলেছি, দেখুন, দেশে থেকে গেলে হয়তো আমিও অমন কিছু করতে বাধ্য হতাম। সরাসরি পাকিস্তান সরকার বা সেনাবাহিনীকে সাহায্য না করে থাকলে কিংবা তাদের কোনো কাজের ফলে অন্য কেউ নির্যাতিত না হয়ে থাকলে এসব বিষয় নিয়ে আন্দোলন না করাই ভালো। অভিযোগকারীরা ক্ষুণ্ণ মনে চলে গেছেন। একই মর্মে স্বনামে-বেনামে লিখিত অভিযোগপত্র পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, তার প্রতিলিপি ব্যক্তিগতভাবে আমাদের তিনজনের কাছেও পাঠানো হয়েছিল : পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক, গণিত বিভাগের অধ্যক্ষ রশিদুল হক আর আমার কাছে–মুক্তিযুদ্ধকালে আমরা তিনজনই ছিলাম ভারতে শরণার্থী।
তবে অন্য একটি বিষয়ে কিছু করা উচিত বলে আমাদের মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ন মাসে অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগলাভ করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর মধ্যে কেউ কেউ নিযুক্ত হন ডা. মালেক-মন্ত্রিসভার কোনো কোনো সদস্য থেকে শুরু করে আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের মুসলিম লীগ-দলীয় চেয়ারম্যানের (স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তিনি নিহত হন) লিখিত সুপারিশে। অনেক ক্ষেত্রে, নির্দিষ্ট পদটি বিজ্ঞাপিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকেরা যথারীতি আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নির্বাচনী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ায় যারা দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন তারা আর সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকার সুযোগ পাননি, ফলে প্রতিযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের কনিষ্ঠেরা প্রার্থিত পদ লাভ করে তাদের ডিঙিয়ে গিয়েছিলেন। উপাচার্য ইন্নাছ আলী মুক্তিযুদ্ধকালীন সব নিয়োগ পরীক্ষা করে দেখে এ-বিষয়ে সুপারিশ করার জন্যে মোহাম্মদ শামসুল হক, রশিদুল হক আর আমাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। আমরা সব কাগজপত্র দেখে মতামত দিই যে, রাজনৈতিক সুপারিশের জোরে যেসব নিয়োগদান করা হয়েছিল, তা বাতিল করা হোক; মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচক কমিটির সভায় যেসব আবেদনকারী উপস্থিত হতে পারেননি, তাঁদেরকে আবার ডাকা হোক এবং ওইসব পদে নিয়োগের ব্যাপারে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হোক; একটি বিভাগে পাকিস্তান প্রত্যাগত একজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে নিয়োগদান করা হয়েছিল, সেই নিয়োগ বহাল রাখা হোক।
ওইসব সুপারিশ যখন সিন্ডিকেটে বিবেচিত হতে যাচ্ছে, তখন মহা আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শামসুজ্জামান হীরা ছিল চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নেরও সভাপতি। তার নেতৃত্বে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা সিন্ডিকেটের সভা ঘেরাও করে বসলো। তাদের একটিই দাবি : মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর নিয়োগ বাতিল করা চলবে না। আমাদের সুপারিশের বিবেচনা বন্ধ রেখে উপাচার্য পরে ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, শেষ পর্যন্ত আরেকটি সিন্ডিকেট-সভায় তার মতামত দিলেন : আমাদের সুপারিশ যুক্তিসংগত হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বেলায় তা প্রয়োগ করা সম্ভবপর নয়। আমরা মনে করলাম, এক যাত্রায় পৃথক ফল হওয়াও সংগত নয়। যদি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সুপারিশ কার্যকর না হয়, তাহলে শিক্ষক-কর্মকর্তা কিংবা তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা কার্যকর করা সংগত হবে না। সুতরাং আমরা নিজেদের সুপারিশ নথিবদ্ধ হয়ে থাকতে দিলাম।
আরেকটি বিষয়ে আমি বিচলিত হয়েছিলাম। আমি এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্টের দায়িত্ব আবার গ্রহণ করেছি। ছাত্রেরাই তখনো হলের মেসের ব্যবস্থাপনায় থাকে। একদিন কিছুসংখ্যক ছাত্র আমার বাড়িতে এসে দেখা করে বললো, তারা হলের মেসে গরুর গোশত খাওয়ার ব্যবস্থা করতে চায়। হলটি যেহেতু সকল সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্যে উন্মুক্ত এবং পাকিস্তান-আমলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আবাসিক হলে গোমাংস-সরবরাহের ব্যবস্থার কথা কখনো ওঠেনি, সুতরাং এ-দাবিতে বিস্মিত হলাম এবং তাদেরকে সেকথা বললাম। বিষয়টি ভেবেচিন্তে পরে আবার আলোচনা করবো বলে তাদের বিদায় দিলাম। দিন দুই পরে হলের অফিসে বসেই আলোচনা হলো। দেখলাম, যারা দাবি করছে, তারা বেশ সংগঠিত এবং ব্যাপারটি কেবল বিশেষ খাদ্যপ্রীতি থেকে উদ্ভূত হয়নি। হাউজ-টিউটর এবং আরো কিছু ছাত্রের সঙ্গে আলোচনা হলো।
মেসের ব্যবস্থাপনা যেহেতু ছাত্রদের হাতে, তাই তাদের মতের প্রতিকূলে কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া চলে না। ঘটনাক্রমে দেখা গেল, কিছু মুসলমান ছাত্র গোমাংস খাওয়ার পক্ষপাতী নয়। তখন দুটি মেস চালু করার সিদ্ধান্ত হলো : একটিতে গোমাংস চলবে, অন্যটিতে তা থাকবে না।
৬.
ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু গেলেন কলকাতায়। সেখানে। তিনি অভূতপূর্ব সংবর্ধনা পেলেন। কলকাতার জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ কথাটা যোগ করলেন তিনি। এই সফরের সময়েই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে আলোচনাক্রমে স্থির হয় যে, ২৫ মার্চের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করবে। ১৯৭১ সালে যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, ইতোমধ্যে তাঁদের অনেকেই আবার এই সেনাদের প্রত্যাবর্তনের জন্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলেন। আবার অনেকে মনে করলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুরোপুরি গঠিত না হয়ে থাকলেও, ভারতীয় সৈন্যদের স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম সত্তাকে স্বচ্ছ করে তুলবে।
ফিরতি সফরে ইন্দিরা গান্ধি ঢাকায় এলেন ২৭ মার্চে। ঢাকায় তার নাগরিক সংবর্ধনাও জমকালো হয়েছিল। রেসকোর্সে বড়ো মঞ্চ তৈরি হলো, বিশাল জনসভা হলো। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে অল্পসংখ্যক সংস্কৃতিকর্মীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বঙ্গভবনে। ইন্দিরা গান্ধি বেশ সলজ্জভাবে কথা বলছিলেন ও চলাফেরা করছিলেন। আমার অনুরোধে আমন্ত্রিতদের পক্ষ থেকে কবীর চৌধুরী ভাষণ দিলেন–সংক্ষিপ্ত, মনোজ্ঞ ও উদীপ্ত। ইন্দিরাও জবাবে সুন্দর বললেন। তার এই সফরের সময়েই ভারত বাংলাদেশের মধ্যে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি হয়। এই চুক্তি নিয়ে যত সমালোচনা হয়েছিল, চুক্তি তার সামান্য ভাগও কার্যকর হয়নি।
তার আগে একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসেছিলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা একাডেমিতে বিকেলে যে-সভা হলো, তাতে নির্ধারিত কর্মসূচির বাইরেই বক্তৃতা করলেন এম এ জি ওসমানী, কে এম সফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, মীর শওকত আলী, সি আর দত্ত প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা-কর্মকর্তা। জনসাধারণের তুমুল হর্ষধ্বনি আর স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের প্রকাশে মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই এক হয়ে গেছি, এক হয়ে আছি, এক হয়েই থাকবো।
৭.
ড. কামাল হোসেন এত্তেলা পাঠালেন : বাংলাদেশের সংবিধান-রচনার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি খসড়া তৈরি করবেন ইংরেজিতে, আমাকে তার বাংলা করে দিতে হবে, শেষ পর্যন্ত বাংলাটাই গৃহীত হবে প্রামাণ্য ভাষ্য বলে। বললাম, একা পারবো না, একটা দল চাই। তিনি বললেন, আপনি লোক বেছে নিন।
প্রথমেই যার কথা আমার মনে হয়েছিল, সে নেয়ামাল বাসির। সে আমার আবাল্য বন্ধু, বাংলা-উর্দু-ফারসিতে তার অগাধ অধিকার, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সে ছিল দোভাষী, ওই পরিষদের দপ্তর ঢাকায় চলে আসার পরে হয়েছে সহকারী বিতর্ক-সম্পাদক। ভাষাজ্ঞানের সঙ্গে সংসদীয় বিষয়ে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সংবিধান-রচনায় কাজে আসবে। নেয়ামালকে প্রস্তাবটা দিতেই সে রাজি হয়ে গেল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কাকে সঙ্গে পাওয়া যায়? সে তার এক সহকর্মীর কথা বললো, ভদ্রলোকের নাম বোধহয় এ কে এম শামসুদ্দীন। স্থির হলো, আমরা তিনজনে মিলে কাজটা করবো।
মনে পড়ে, আইনমন্ত্রীর দপ্তরে এক দুপুরে কামাল আর আমি মুখোমুখি বসে। প্যাডের কাগজে খসখস করে কামাল লিখতে শুরু করলেন সংবিধানের প্রস্তাবনা! এক স্লিপ লেখা হলে সাদা কাগজের সঙ্গে সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি অনুবাদ করতে শুরু করলাম। একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগলো দেহে-মনে : এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান-রচনার কাজে হাত দিয়েছি।
কামালকে বললাম, অনুবাদটা মাজাঘষা করতে হবে, বাড়ি নিয়ে যাই। তিনি বললেন, মূলটারও কিছু উন্নতি ঘটাতে হবে, কাল আবার বসবো একসঙ্গে।
১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসলো। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে যারা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই এর সদস্য। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ শহীদ হয়েছেন; পাকিস্তানের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগে জহিরুদ্দীন, ফয়জুল হক, ওবায়দুল্লাহ মজুমদার, এস বি জামানের মতো কয়েকজন দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন–তাঁরা আর সদস্য নন গণপরিষদের। তাও চার শতাধিক সদস্য। গণপরিষদের অধিবেশনের শুরুতেই কয়েকটি কমিটি গঠিত হলো, তার মধ্যে শাসনতন্ত্র কমিটি’ একটি। আইন ও সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কামাল হোসেন তার সভাপতি, আর সদস্য ৩৩ জন। তারা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমাদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আব্দুর রহিম, আবদুর রউফ, মোহাম্মদ লুতফর রহমান, আবদুল মমিন তালুকদার, আবু সাইয়িদ, মোহাম্মদ বয়তুল্লাহ, আমীরউল ইসলাম, বাদল রশীদ, খোন্দকার আবদুল হাফিজ, নূরুল ইসলাম মনজুর, শওকত আলী খান, হুমায়ূন খালিদ, আছাদুজ্জমান খান, এ কে মোশারাফ হোসেন আকন্দ, আবদুল মমিন, শামসুদ্দীন মোল্লা, আবদুর রহমান, ফকির শাহাবুদ্দীন আহমদ, আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী, খোরশেদ আলম, সিরাজুল হক, দেওয়ান আবুল আব্বাছ, হাফেজ হাবীবুর রহমান, আবদুর রশীদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নূরুল ইছলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ খালেদ, রাজিয়া বাণু ও ডা. ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল। রাজিয়া বাণু ছিলেন একমাত্র মহিলা সদস্য, আর সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন বিরোধী দলীয় একমাত্র সদস্য–তিনি তখন ছিলেন মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে। শাসনতন্ত্র কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছিল ১৭ এপ্রিলে।
সংবিধানের কাজে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে পনেরো দিন আমি ঢাকায় থেকেছি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাশে পুরো সময়টাই কাটিয়েছি ঢাকায়। এক-আধবার ছাড়া সড়কপথে নিজেই গাড়ি চালিয়ে সপরিবারে আসা-যাওয়া করেছি। গণপরিষদ-ভবনে–পরে যা রূপান্তরিত হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে–আমাকে একটা কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কেটেছে। কখনো বেশি রাত হয়ে গেলে কামালের বাড়ির বসার ঘরে শুয়ে বাকি রাত যাপন করেছি, সকালে সে বাড়িতেই নাশতা করে দ্রুত চলে এসেছি গণপরিষদে।
কমিটির বৈঠকে কামালের ইংরেজি ভাষ্য এবং আমাদের অনুবাদ গণপরিষদের সচিবালয়ের মারফত বি জি প্রেস থেকে মুদ্রিত হয়ে উপস্থাপিত হতো। কমিটির সদস্য না হয়েও আমি প্রতি বৈঠকে উপস্থিত থেকেছি, অনেক সদস্যের উপস্থিতির হার তুলনায় অনেক কম ছিল। মন্ত্রীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও এইচ এম কামারুজ্জামান খুব কমই আসতেন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদ আসতেন মাঝে মাঝে। তাজউদ্দীন যেদিন আসতেন, সেদিন আলোচনায় যোগ দিতেন সাগ্রহে। কোনো কমিটিতেই সব সদস্য অংশ নেন না–এটিও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
সংবিধানের বিষয়ে পরামর্শ দিতে বঙ্গবন্ধু দুবার ডেকে পাঠিয়েছিলেন কামালকে–সঙ্গে আমিও ছিলাম। তাঁর প্রথম বক্তব্য ছিল রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংযোগ ছিন্ন করার একটা বিধান থাকতে হবে সংবিধানে। ১২ অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে কিছুটা বলা হয়েছিল, তবে বঙ্গবন্ধু যা চেয়েছিলেন, তা সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্ত অংশে রূপ পেয়েছিল। দ্বিতীয়বারে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান-আমলে সরকার অস্থিতিশীল হয়েছিল মূলত পরিষদ-সদস্যদের দলবদলের ফলে কিংবা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে দলের বিপক্ষে ভোটদানের ফলে। এটা বন্ধ করা দরকার। নির্বাচিত সদস্য যদি দলের কোনো সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন কিংবা কোনো ক্ষেত্রে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে তার পদত্যাগ করা উচিত হবে কিংবা তার সদস্যপদ চলে যাবে–এমন একটা নিয়ম করা দরকার। তবে এমন ক্ষেত্রে তিনি উপনির্বাচনে বা পরবর্তী কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হবার অযোগ্য হবেন না, সে-ব্যবস্থাও থাকতে হবে। এই অভিপ্রায়ই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে প্রকাশ পেয়েছিল।
১২ অনুচ্ছেদের বিধান নিয়ে শাসনতন্ত্র কমিটিতে বেশ বিতর্ক হয়েছিল। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর সম্পাদক মোহাম্মদ খালেদ এবং আরো দু-একজন সদস্য কথাটা উঠিয়েছিলেন। তারা বেশ জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন যে, মুসলমান হিসেবে তারা এক অখণ্ড জীবনবিধানের অধীন–সেখানে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা চলে না, তাদের রাজনৈতিক জীবনও ধর্মবিশ্বাস দ্বারা। পরিচালিত। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, বাংলাদেশকে তারা ধর্মীয় রাষ্ট্ররূপে দেখতে চান। বাংলাদেশে পালিত ধর্মের মধ্যে রাষ্ট্র কোনো পক্ষপাত করুক কিংবা ধর্মীয় কারণে নাগরিকদের মধ্যে কোনো বৈষম্য ঘটুক, তা তাঁদের অভিপ্রায় নয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় বিষয়ে–যেমন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে–তাঁরা ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারাই পরিচালিত হতে চান। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অধিকাংশের মত তারা মেনে নিয়েছিলেন।
তর্ক প্রবল হয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রশ্নে। এতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আছাদুজ্জামান খান। ৪২ অনুচ্ছেদে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বা না দিয়ে রাষ্ট্রের পক্ষে সম্পত্তি অধিগ্রহণের বিধান করা হয়েছিল এবং সেই বিধানের আওতায় প্রণীত আইনে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই বলে বা ক্ষতিপূরণ অপর্যাপ্ত হয়েছে বলে তেমন আইনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছিল। এ-বিষয়ে যারা আপত্তি তুলেছিলেন, তাঁরা বলেছিলেন যে, বিনা ক্ষতিপূরণে সম্পত্তির অধিগ্রহণ মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী; তাছাড়া নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে রাষ্ট্র যদি সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে, তাহলে সম্পত্তির মালিকের আদালতে সুবিচার প্রার্থনা করার অধিকারও থাকা দরকার–এই অধিকারও তার মৌলিক অধিকার বলে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে না নিয়ে কমিটিতে তারা ভিন্নমতপোষক লিখিত মন্তব্য দিয়েছিলেন কার্যবিবরণীর অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে। পরবর্তীকালে, মনে হয়, কামাল বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে এসব সদস্যকে বুঝিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করা থেকে তাঁদের বিরত করেছিলেন।
সংবিধান-রচনার কাজে সাহায্য হবে মনে করে বিচারপতি এফ কে এম মুনীমকে আইন-সচিব নিযুক্ত করা হয়েছিল। তিনি মনে করেছিলেন যে, প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ অংশে যেসব বিধান করা হচ্ছে, তাতে উচ্চমেধাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে যোগ দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিসের সদস্যেরা যেমন জ্যোতির্ময় ছিলেন, আমাদের সিভিল সার্ভিস সে-তুলনায় হীনপ্রভ হয়ে পড়বে। কামাল তাঁকে বলেছিলেন যে, উচ্চমেধাসম্পন্নেরা সিভিল সার্ভিসে যোগ না দিয়ে পেশাগত জীবনে গেলে দেশ বেশি উপকৃত হবে।
কামাল খসড়া তৈরি করে যাচ্ছিলেন আর আমরা অনুবাদ করে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে বাংলা ভাষ্যের প্রয়োজনে কামাল তার ইংরেজি বাক্য বা তার বিন্যাস পরিবর্তন করতেন। নেয়ামালের পটুত্ব খুব কাজে এসেছিল। শব্দের উদ্ভাবনে তার নৈপুণ্য ছিল। ওমবুড়সম্যানের প্রতিশব্দ ন্যায়পাল তারই তৈরি। তবে তার মধ্যে এক ধরনের রক্ষণশীলতা ছিল। যেমন, ইংরেজিতে বহুবচন থাকলে বাংলায় সে বহুবচনই ব্যবহার করবে; মূলে যদি পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স থাকে, তাহলে অনুবাদে সে সংসদ-বিষয়াবলি করবে, কিছুতেই সংসদ-বিষয়ক করতে রাজি হবে না। সে বারবার বলতো, দেখো, এক জায়গায় গিয়ে তুমি হয়তো দেখবে, বাংলায়ও বহুবচন ব্যবহার না করে উপায় নেই, তখন কী হবে? ইংরেজির বহুবচন বাংলায় কোথাও একবচন করবো, আবার কোথাও বহুবচন করবো, এতে সংগতি থাকে না। তবে সংবিধানে সে আরো বাংলা পারিভাষিক শব্দ ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিল, আমিও ছিলাম। কিন্তু শাসনতন্ত্র কমিটিতে আমি সেগুলোর অনুমোদন নিতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। শাসনতন্ত্রের বদলে সংবিধান শব্দটা গ্রহণ করাতেই আমাকে বেগ পেতে হয়েছিল। তা যখন গৃহীত হলো, তখন কমিটিও পরিচিত হলো সংবিধান প্রণয়ন কমিটি বলে। স্পিকারের প্রতিশব্দ হিসেবে কেউ অধ্যক্ষ মেনে নিতে চাইলেন না। একজন বললেন, ওতে মফস্বল কলেজের অধ্যক্ষ মনে হয়। তিনি নিজেই মফস্বল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তুমুল হাস্যরোল আর করতালির মধ্য দিয়ে তার কথা প্রায় সকলেই অনুমোদন করেছিলেন। সংবিধান গৃহীত হওয়ার পরে এর ভাষার আলোচনায় আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেফাঁকে লিখেছিলেন, পার্লামেন্টারি ডিমোক্রেসির কনসেপ্টটাই পাশ্চাত্যের, তাই ইংরেজি পরিভাষা ব্যবহার করলে দোষ হতো না, বরঞ্চ জাতীয় সংসদ না বলে পার্লামেন্ট কিংবা রাষ্ট্রপতি না বলে প্রেসিডেন্ট বলাই আমাদের উচিত ছিল। আমরা যতদূর পারি, একই ইংরেজি শব্দের জন্যে একই বাংলা শব্দ ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত-অনুযায়ী অবশ্য ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কামাল হোসেন এক পর্যায়ে স্থির করলেন, তার ইংরেজি খসড়ার চূড়ান্ত রূপদানের জন্যে একজন পেশাদার আইনি খসড়া-প্রণেতার-ইংরেজিতে যাকে legislative draftsman বলা হয়, তেমন একজনের–সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। দেশে তেমন কেউ ছিলেন না। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রাইভেট মেম্বারস বিল তৈরি করতো একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। তার এক সদস্যকে এই কাজে নিযুক্ত করা হলো কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সৌজন্যে। রবার্ট গাথরি ছিলেন একজন আইরিশ আইনজীবী। ভালো মানুষ এবং স্বভাবত পরিশ্রমী। তবে আমাদের দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তেমন ধারণা তার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ শুনে কামাল যখন ৩৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে একটা শর্ত জুড়ে দিলেন, তখন গাথরি আমাকে বললেন, ‘ইট’স স্টিফলিং দি অপপাজিশন’। পাকিস্তান-আমলে ধর্মের রাজনৈতিক অপব্যবহার সম্পর্কে আমি তাঁকে অবহিত করলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ধর্মের নামে কেমন সব অত্যাচার হয়েছে, তাও জানালাম, কিন্তু তাতে তাঁর মনের দ্বিধা কাটেনি। তবে যেহেতু তাঁকে একটা বিশেষ পেশাগত কাজ করতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, সে-কাজটি তিনি যত্নের সঙ্গেই করে গেলেন। বাংলা পাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন। তাই তিনি আমাকে একাধিকবার বলেছিলেন যে, ইংরেজি ভাষ্যের বাংলা রূপান্তরে অসুবিধে হলে আমি যেন তাঁকে জানাই, তিনি তা পুনর্লিখন করে দেবেন। এক-আধবার তেমন। করেও দিয়েছিলেন।
সংবিধান-রচনার প্রথম পর্যায় থেকেই সকল রাজনৈতিক দলের এবং অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির প্রস্তাব, পরামর্শ বা মতামত চাওয়া হয়েছিল, পাওয়াও গিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি লিখিত প্রস্তাব দিয়েছিল এবং তা নিয়ে তার নেতাদের সঙ্গে কামাল আলাপও করেছিলেন। বিচার বিভাগের অংশটা প্রধান বিচারপতি আবুসাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেখানো হয়েছিল। আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে একটি সুপ্রিম কোর্ট-গঠনের ধারণা তার ভালো লাগেনি; তিনি চেয়েছিলেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট আলাদা থাকবে। বাংলা ভাষ্যে জাস্টিস শব্দের বাংলা করা হয়েছিল বিচারপতি, কিন্তু যেখানে সুপ্রিম কোর্টের জাজ বলা হয়েছে, সেখানে আমরা বিচারক করেছিলাম। বিচারপতি সায়েম চাইলেন, বাংলায় উভয় ক্ষেত্রেই বিচারপতি শব্দের প্রয়োগ করা হোক। আমি তাকে বললাম, জাজ ও জাস্টিস শব্দের পার্থক্যরক্ষার খাতিরে যথাক্রমে বিচারক ও বিচারপতি করা হয়েছে এবং সে-পার্থক্য থাকা দরকার। তিনি বললেন, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকেরা সর্বত্র বিচারপতি বলে। পরিচিত, তুমি তাদের মর্যাদা কমাতে চাও? আমি আর তর্ক করিনি, তবে তাঁর কথা মেনেও নিইনি। কিন্তু তার অপ্রসন্নতা দূর হয়নি। বহুকাল পরেও তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে ক্ষমা করবো না, তুমি বিচারপতিকে বিচারক করে দিয়েছে।’ তার সঙ্গে আমাদের দূরসম্পর্কের একটা আত্মীয়তাসূত্র ছিল, তিনি আমাকে আবাল্য দেখে আসছেন, সুতরাং আমাকে তিরস্কার করার অধিকার তাঁর ছিল। সৈয়দ ইশতিয়াক আহমদ এবং আরো কারো কারো সঙ্গেও সংবিধানের খসড়া নিয়ে কামাল হোসেন আলাপ করেছিলেন।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির সদস্য নন, মন্ত্রিসভার এমন সদস্যদের সঙ্গেও সংবিধানের খসড়া নিয়ে একদিন বৈঠক হয়েছিল। তাতে মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানী উপস্থিত ছিলেন, তিনি তখন মন্ত্রী। ৪৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও কর্তব্য যেখানে নির্দেশ করা হয়েছে, সেখানে তিনি যোগ করার প্রস্তাব দিলেন যে, রাষ্ট্রপতি সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাকে কমিশন করবেন অর্থাৎ কর্মভার দেবেন। কামালের এতে প্রবল আপত্তি। তিনি বললেন, এটি রাষ্ট্রপতির নিত্যনৈমিত্তিক নির্বাহী দায়িত্বের অন্তর্গত এবং তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ হওয়ার মতো বিষয় হতে পারে না। ওসমানী খুব ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়লেন, ইংরেজিতে বললেন, রাজার স্বাক্ষরিত একটা পার্চমেন্টই তো একজন সেনা কর্মকর্তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি–এটার প্রেরণায়ই সে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে যায়। আমাদের দেশেও তো রাষ্ট্রপ্রধান এই কাজটি করেন, ভবিষ্যতেও করবেন। সংবিধানে তা লিখতে আপত্তি কেন? দেশের জন্যে যারা প্রাণ দিতে প্রস্তুত, ওতে তাদের মর্যাদা একটু বৃদ্ধি পাবে মাত্র। পরে কারো কাছ থেকে সমর্থন না পেয়ে ওসমানী চুপ করে গেলেন। এক সময়ে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রফেসর, আপনি সশস্ত্রবাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী এসব শব্দ ব্যবহার করেছেন, বাহিনী ছাড়া ফোর্সেস বোঝাতে আর কোনো বাংলা শব্দ নেই?’ আমি একটু বিচলিতই হলাম। বললাম, এগুলো বাংলায় বহুব্যবহৃত শব্দ–এর বিকল্পের কথা ভাবিনি।’ এবার উনি আসল কথাটি বললেন, ‘লালবাহিনী নীলবাহিনী শুনতে শুনতে এখন কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। এদের যদি বাহিনী বলা হয়, তবে আর্মড ফোর্সেসকে সশস্ত্রবাহিনী বললে তাদের অপমান করা হবে।’ লালবাহিনী ছিল শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের একটি সংগঠন–অঙ্গসংগঠন ঠিক নয়, কিন্তু তার নেতা আবদুল মান্নানের প্রচণ্ড দাপট ছিল। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, এক লক্ষ সদস্য নিয়ে লালবাহিনী গড়ে তোলা হবে। লালবাহিনী তখনই এখানে-ওখানে অন্যায় কর্তৃত্ব ফলাতে শুরু করেছিল।
সংবিধানের যে-মূল কপিতে গণপরিষদের সদস্যেরা স্বাক্ষরদান করবেন, কামাল চেয়েছিলেন, তা বাংলা হস্তাক্ষরে লিখিত হবে এবং দেশীয় ধাচে অলংকৃত হবে। হাতে লেখার জন্যে আমি এ কে এম আবদুর রউফের নাম প্রস্তাব করলাম। রউফ এক সময়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি দেশের কাজে লেগে পড়েন, স্বাধীনতালাভের পরে লন্ডনে আমাদের হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে আনাতে হবে। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, অলংকরণের দায়িত্ব জয়নুল আবেদিন নেবেন। কামাল বললেন, রউফের বিষয়টি আবেদিন সাহেবকে জিজ্ঞেস করে নিলে ভালো হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এক সকালে জয়নুল আবেদিন এলেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। তার সঙ্গে হাশেম খান, জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আবুল বারক আলভী প্রমুখ কয়েকজন শিল্পী ছিলেন। তিনি বললেন, পুস্তানিতে নকশি কাঁথার অলংকরণ থাকবে, শিল্পীরা প্রতি পৃষ্ঠার চারপাশ অলংকৃত করে দেবেন। রউফের নাম তিনি অনুমোদন করলেন, ওই অলংকৃত পাতার মধ্যে তার হস্তাক্ষরে সংবিধানের পাঠ লিখিত হবে। পরে তাই হয়েছিল। অলংকরণ করেছিলেন হাশেম খান, জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায়চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। রউফ বহু পরিশ্রম করে পুরো সংবিধান হাতে লিখেছিলেন। তাঁর লেখা প্রতি পৃষ্ঠা আমি দেখে দিয়েছিলাম, একটা বর্ণলোপের জন্যে তাঁকে গোটা পাতা নতুন করে লিখতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই হাতে-লেখা কপিতে সদস্যেরা (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্রনারায়ণ লারমা ছাড়া–এ-প্রসঙ্গে পরে বলব) স্বাক্ষর করেছিলেন এবং বি জি প্রেসে তার পাঁচ শ কপি ছাপিয়ে চামড়ার বাঁধাই করা হয়েছিল। চর্মশিল্পের কাজ করেছিলেন শাহ সৈয়দ আবু শফি। তিনি বেবীর দূরসম্পর্কের মামা, চামড়ার কাজ শিখেছিলেন শ্রীনিকেতনে। চর্মশিল্পী হিসেবে তাকে আবিষ্কার করেছিলেন হামিদা হোসেন–দারিদ্র্য ও দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবনে তিনি যতটুকু কর্মসংস্থান ও সম্মানলাভ করতে পেরেছিলেন, তাও সম্ভবপর হয়েছিল হামিদার জন্যে।
৮.
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাবার কথা চলছে। ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারি নীতিনির্ধারক–সকলেই চাইছেন, এ-ক্ষেত্রে একটা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। সেই যে জানুয়ারি মাসে শিক্ষামন্ত্রীর দপ্তরে একটা সভা হয়েছিল আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে, তখনই কথা হয়েছিল, যতশীঘ্ৰসম্ভব একটা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। কিন্তু তা আর হয়ে উঠছে। না। শিক্ষাসচিব ড. এ আর মল্লিক কয়েক সপ্তাহ কাজ করে ভারতে আমাদের হাই কমিশনার নিযুক্ত হয়ে দিল্লি চলে গেলেন মার্চ মাসে (ইন্দিরা গান্ধির বাংলাদেশ সফরকালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন), নতুন সচিব হলেন এ এন এম ইউসুফ। শিক্ষা কমিশনের বিষয়ে সরকারের উচ্চবাচ্য নেই। ওদিকে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ দাবি করেছে, শিক্ষা কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি থাকতে হবে। শোনা যায়, সরকার এ-দাবি মানতে পারছে না, আবার ছাত্রসমাজকে অসন্তুষ্ট করেও কমিশন-গঠনের ঘোষণা দিতে পারছে না।
এর মধ্যে মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আকস্মিকভাবেই যেন হইচই পড়ে গেল। এপ্রিল মাসের শেষদিকে মুদাররেসিনের এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মাদ্রাসা-শিক্ষার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের উদবেগের কথা জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাঁদের এই বলে আশ্বস্ত করলেন যে, মাদ্রাসা-শিক্ষা বিলোপ করা হবে না, প্রয়োজনীয় কারিগরি বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থা যোগ করে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে কিছু রদবদল করা হবে মাত্র। বঙ্গবন্ধু আরো বললেন যে, সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রেরা যাতে কুরআন-হাদিস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানলাভ করে, তারও ব্যবস্থা করা হবে। এ-রকম নীতিগত ঘোষণা তিনি হঠাৎ করে কেন দিলেন, তা ভেবে পেলাম না। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তো একই ভাষামাধ্যমে একই পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা-প্রবর্তনের বিষয়ে একটা মতৈক্য হয়েছিল। পরে শুনলাম–সত্যমিথ্যা জানিনা–মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ মাদ্রাসা-শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝান যে, মাদ্রাসা-শিক্ষাব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে, নইলে দেশের গ্রামাঞ্চলে এমন প্রতিক্রিয়া হবে যে, সরকার সামাল দিতে পারবেন না। মাদ্রাসা-শিক্ষা বহাল রাখতে যে বড়োরকম তৎপরতা চলছে, তা বোঝা গেল কয়েকদিন পরে মওলানা ভাসানীর এক বক্তৃতায়। তিনি সরকারকে সম্বোধন করে বললেন, চারমাস হয় দেশ স্বাধীন হয়েছে; সরকার, তুমি মাদ্রাসা-শিক্ষার কিছু করো নাই। ব্রিটিশ সরকার এদেশের মানুষের ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, আর বাংলাদেশ সরকার সে-ব্যবস্থা চালু রাখতে পারবে না? আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার ভার আমাদের সরকারকেই বহন করতে হবে। কয়েকদিনের মধ্যে আবার মওলানা ভাসানী অবিলম্বে মাদ্রাসা-শিক্ষা চালু করার দাবি জানালেন এবং ন্যাপ ও সিপিবি যে ধর্ম মানে না, দেশবাসীকে তাও জানিয়ে দিলেন (এই বক্তৃতাতেই তিনি সেই বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন : ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতে আমি বন্দি ছিলাম’)। শিক্ষা কমিশন গঠনের আগেই শিক্ষানীতি সম্পর্কে যে রাজনৈতিক চাপের সৃষ্টি হতে শুরু হয়েছে, এ-বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ রইল না।
মে মাসের মাঝামাঝি সংবাদপত্র থেকে জানা গেল যে, সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা তার সভাপতি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. সুরাত আলী খান সহ সভাপতি এবং অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সদস্য-সচিব। আর কোনো সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়নি। লোকপরম্পরায় শুনছি, আমিও একজন সদস্য, কিন্তু আমার কিছু জানা নেই। বোঝা যায়, শিক্ষা কমিশন নিয়ে সরকারের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে এবং ওই সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশের পরে কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি নেওয়ার দাবি প্রবল হওয়ায়, অনুমান করা যায় যে, এই বিষয়টি রয়েছে টানাপোড়েনের মূলে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই। কমিশনের গঠন নিম্নরূপ :
সভাপতি : ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা; সহ-সভাপতি : ড. সুরাত আলী খান; সদস্য-সচিব : অধ্যাপক কবীর চৌধুরী; পূর্ণকালীন সদস্য : অধ্যাপক এম ইউ আহমদ (অবসরপ্রাপ্ত সদস্য, পূর্ব পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন) ও জনাব মাহমুদ মোকাররম হোসেন (অধ্যক্ষ, কে বি এম কলেজ, দিনাজপুর); খণ্ডকালীন সদস্য : জনাব আব্দুর রাজ্জাক (অধ্যক্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরী (অধ্যক্ষ, ফলিত রসায়ন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়); ড. আবদুল হক (গণপরিষদ সদস্য এবং প্রাক্তন অধ্যক্ষ, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়); ড. আনিসুজ্জামান (অধ্যক্ষ, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়); ড. স্বদেশরঞ্জন বসু (গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন-অর্থনীতি ইনসটিটিউট, ঢাকা); ডা. নূরুল ইসলাম (পরিচালক, স্নাতকোত্তর চিকিৎসা ইনসটিটিউট, ঢাকা); ড. এম শামসুল ইসলাম (অধ্যক্ষ, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ); ড. আ মু জহুরুল হক (অধ্যক্ষ, তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়); অধ্যাপক সিরাজুল হক (অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, আরবি ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); শ্ৰীমতী বাসন্তী গুহঠাকুরতা (প্রধান শিক্ষয়িত্রী, মনিজা রহমান বালিকা বিদ্যালয়, ঢাকা); অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান (অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ); ড. মযহারুল ইসলাম (মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমি); ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন (পরিচালক, শিক্ষা-সম্প্রসারণ কেন্দ্র, ঢাকা); ড. মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ (অধ্যক্ষ, বাণিজ্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); শ্রীমতী হেনা দাস (প্রধান শিক্ষয়িত্রী, নারায়ণগঞ্জ বালিকা বিদ্যালয়), জনাব আশরাফউদ্দীন খান (সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি)।
কমিশন তো গঠিত হলো, কিন্তু এর কাজ আর শুরু হয় না। অথচ ছ মাসের মধ্যে প্রাথমিক রিপোর্ট এবং এক বছরের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট দেওয়ার কথা। শোনা গেল, প্রধানমন্ত্রী কমিশন উদ্ববাধন করবেন, কিন্তু তিনি সময় করে উঠতে পারছেন না। মনে হলো, যে-টানাপোড়েনের কথা আগে ভেবেছি, সে-কারণেই বোধহয় অগ্রসর হওয়া যাচ্ছে না। কমিশনে ছাত্র-প্রতিনিধি গ্রহণের অব্যাহত দাবির মুখে শিক্ষামন্ত্রী একদিন ঘোষণা করলেন যে, শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে সরকার তা অনুমোদন করবে না। গ্রহণযোগ্য হওয়া না-হওয়ার যৌক্তিক ভিত্তির কথা কেউ মুখে আনলেন না।
অবশেষে ১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন উদ্ববাধন করলেন। তিনি খুব আবেগময় বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক সমাজগঠনের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যেন তেমন সমাজের উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে সমর্থ হয়, সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। বক্তৃতা শেষ করে তিনি জানতে চাইলেন, আমাদের কারো কিছু বক্তব্য বা জিজ্ঞাস্য আছে কি না। প্রথমটায় আমি চুপ করে ছিলাম, কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না দেখে উঠে দাঁড়ালাম। আমি বললাম, আমার একটি প্রশ্ন ও একটি দাবি আছে। প্রথম কথা, সরকার শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের কত শতাংশ বরাদ্দ করতে পারবেন, তা যদি আমরা জানতে পারি, তাহলে আমাদের পক্ষে শিক্ষানীতি তৈরি করা সহজ হয়। দ্বিতীয় কথা, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ছাত্রসমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কমিশনের রিপোর্ট সরকার গ্রহণ করবে না। কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার অধিকার সরকারের আছে। কিন্তু আমরা এই প্রতিশ্রুতি চাই যে, আমাদের রিপোর্ট–তাতে দ্বিমতপোষক মন্তব্য থাকলে সেসব সুদ্ধ–জনসাধারণ্যে প্রকাশ করা হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, টাকাপয়সার কথা আপনারা ভাববেন না। দেশের জন্য যেটা ভালো মনে করবেন, তেমন শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করবেন। আমি ধার করে হোক, ভিক্ষা করে হোক, টাকা জোগাড় করব। অর্থের অভাবে উপযুক্ত শিক্ষা যদি মানুষ না পায়, তাহলে তো সে স্বাধীনতার ফললাভ থেকেই বঞ্চিত হবে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের ভূমিকায়–যা আমরা সই করেছি–কিন্তু তাঁর সেদিনের এ কথাগুলো নেই, বরং তার মুখে যা বসানো হয়েছে, তা তিনি তখন বলেননিঃ আমাদের সীমিত সম্পদের কথা স্মরণ রেখে কমিশন এমন এক দীর্ঘমেয়াদী রূপরেখা প্রণয়ন করবেন যা শিক্ষাক্ষেত্রে সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সাধনে সাহায্য করবে। এই অসংগতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেও কমিশনে আমি কোনো ফল পাইনি। শুনেছি, কমিশন যখন প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করতে যায় (সেদিন আমি উপস্থিত ছিলাম না), তখন সীমিত সম্পদের কথা উঠেছিল।
আমার দ্বিতীয় বক্তব্যের জবাবে বঙ্গবন্ধু সহাস্যে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার এমন এক সরকার যার কিছুই গোপন থাকে না। এমনকী যে-বিষয় গোপন থাকা উচিত, তাও প্রকাশ পেয়ে যায়। সুতরাং রিপোর্ট প্রকাশের বিষয়ে আপনারা চিন্তা করবেন না।’ আমি আবার উঠে বললাম, ‘না, সেরকম প্রকাশের কথা নয়, সরকারিভাবে ছেপে প্রকাশ করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু একটু অধৈর্য হয়েই বললেন, ‘হবে, হবে, মুদ্রিতরূপে হবে।’
চা খাওয়ার সময়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকলেন, জানতে চাইলেন, আমি এখন কী করছি। আমি একটু অবাক হয়ে দ্রুত জানালাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। তিনি বললেন, আমি বলছি, চট্টগ্রামে কী করছ? ঢাকায় অনেক কাজ পড়ে আছে–ঢাকায় চলে এসো।’ আমি আমতা আমতা করছি দেখে তিনি বললেন, আমি চাই, বাংলায় অনেক কাজ হোক। আমাদের রাষ্ট্রদূতরা যেসব ক্রিডেনশিয়াল দেয় বিদেশে, আমি চাই, সেসব বাংলায় লেখা হবে। তাছাড়া আরো অনেক কাগজপত্র বাংলায় হতে হবে। কনসটিটিউশনের কাজ শেষ হলে এসব কাজে তোমাকে হাত দিতে হবে। এই বলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে তাঁর কাছে ডেকে আনালেন। তাঁকে বললেন, ‘সার, আনিসুজ্জামানকে আমার দরকার। আপনি ওকে ঢাকায় আনার ব্যবস্থা করুন।’ মুজাফফর আহমদ চৌধুরী বললেন, ‘আমি ওঁকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই আনতে চাই। মাঝখানে আমি শুধু ক্ষীণকণ্ঠে বলতে পারলাম, চট্টগ্রামে থেকেও তো আমি সংবিধানের কাজ করছি, বাজেট ও প্ল্যানিংয়ের কাজে সাহায্য করছি।’ কথাটা ওখানেই শেষ হলো।
এরপরে গ্রিন রোডের একটা বাড়িতে শিক্ষা কমিশনের কাজ শুরু হয়। কমিশনের কার্যকালে এর গঠনে যে-পরিবর্তন ঘটে, এখানে তারও উল্লেখ করা দরকার। অধ্যাপক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান পূর্ণকালীন সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের মার্চে, সে-বছর জুলাই মাসে কবীর চৌধুরী শিক্ষা-সচিব নিযুক্ত হলে ফেরদাউস খান কমিশনের সদস্য-সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের মে মাসের শেষে সুরাত আলী খানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। সে-বছর জুনে অধ্যাপক মোহাম্মদ নূরুস সাফা (ঢাকার উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান) এবং নভেম্বরে পাকিস্তান-প্রত্যাগত অধ্যাপক এম এ সাত্তার (সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের প্রাক্তন কারিগরি শিক্ষা পরিচালক) পূর্ণকালীন সদস্য নিযুক্ত হন। আমার এক সময়ে মনে হয়েছিল যে, শিক্ষা বিভাগের যেসব কর্মকর্তাকে সরকার অন্য কোথাও নিয়োগদান করতে পারছে না, শিক্ষা কমিশনই তাদের একমাত্র ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। শিক্ষা কমিশনের কর্মকর্তাদের বেলায় বোধহয় একথা আরো সত্য। কমিশনের কর্মকাল জুড়েই বোধহয় পরিচালক ও সহ-পরিচালক নিযুক্ত হয়ে চলেছিলেন, একজন সহ-পরিচালক নিযুক্ত হন আমাদের রিপোর্ট জমা দেওয়ার একমাস আগে–যখন লেখালিখির সব কাজ শেষ হয়ে গেছে। খণ্ডকালীন সদস্যদের মধ্যে ফজলুল হালিম চৌধুরী ও আবদুল্লাহ আল-মুতী শেষ পর্যন্ত কাজ করতে পারেননি। তাদের জায়গায় নিয়োগ পেয়েছিলেন যথাক্রমে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং শিক্ষা সম্প্রসারণ কেন্দ্রের নতুন পরিচালক মুহম্মদ নূরুল হক। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক দু-একটি সভায় যোগদান করার পর আর আসেননি, এমনকী রিপোর্টে স্বাক্ষরও দেননি। স্বদেশ বসু, মযহারুল ইসলাম এবং এম এ সাত্তারও রিপোর্ট স্বাক্ষর করেননি।
শিক্ষা কমিশন নানা বিষয়ে অনুধ্যান কমিটি গঠন করেছিল এবং তাতে খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞদের জড়িত করেছিল। এঁদের মধ্যে অনেকে আগ্রহ করে কাজ করেছিলেন, অনেকে ছিলেন উদাসীন। কেউ কেউ আমাকে বলেছিলেন, কমিটির সদস্যেরা সব কাজ করে দেবে, আর কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে যাবেন কমিশনের সদস্যেরা–দিস ইজ নট ফেয়ার। শিক্ষা কমিশনের খণ্ডকালীন সদস্যের কাজ করা ছাড়াও ছাত্রকল্যাণ ও জাতীয় সেবা-সম্পর্কিত অনুধ্যান কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছিল। সেখানেও এক তৃতীয়াংশ সদস্যের কোনো ভূমিকা ছিল না।
শিক্ষা কমিশন জনসাধারণের কাছ থেকেই উল্লেখযোগ্য সাড়া পায়নি। আমরা একটা প্রশ্নমালা তৈরি করেছিলাম, তা পাঠানো হয়েছিল ৯,৫৫১ জনের কাছে, জবাব পাওয়া গিয়েছিল ২,৮৬৯ জনের কাছ থেকে অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশেরও কম প্রাপকের কাছ থেকে। আনুপাতিক হারে সবচেয়ে বেশি সাড়া দিয়েছিলেন মাদ্রাসার সুপারিটেনডেন্টরা-৩০৩ জনের মধ্যে ১৫৯ জন। সবচেয়ে উদাসীন ছিলেন গণপরিষদের সদস্যেরা–৩১৫ জনের কাছে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়, ২৯ জন মাত্র জবাব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপক এবং ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপকদের ৩০৩ জনের মধ্যে জবাব পাওয়া গিয়েছিল ৮৯ জনের কাছ থেকে। ছাত্র-সংসদ ও ছাত্র সংস্থার কাছে প্রেরিত ২১০টি প্রশ্নমালার মধ্যে জবাবসুদ্ধ ফিরে এসেছিল চারটি মাত্র। তবে সে চারটিই যত্নের সঙ্গে লিখিত হয়েছিল।
কমিশনের সুপারিশের কথা যখন বলব, তখন এর কাজের কথা আরো বলতে হবে। এত রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা কমিশন যতটুকু করতে পেরেছিল, তাকে শ্লাঘনীয় বলতে আমার এতটুকু দ্বিধা নেই। এর মূলে কুদরাত এ-খুদার নেতৃত্ব বড়ো ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁর নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও কষ্টস্বীকারের তুলনা হয় না।
৯.
স্বাধীনতালাভের পরে ছাত্রনেতাদের, বিশেষ করে, ছাত্রলীগের নেতাদের প্রভাব খুব বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো জাতীয় নেতার প্রতি তখন তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পায়নি এবং সরকারের বাইরে একটা বড়ো সমান্তরাল শক্তিকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়াস তাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তায় ধরা পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন আর ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ সাধারণ্যে পরিগণিত হয়ে ওঠে চার খলিফা বলে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে তাদের অবস্থান দূরে থাকায় সে ভাবমূর্তিকে মালিন্য স্পর্শ করে না। বোধহয় এপ্রিল মাসেই ছাত্র ইউনিয়ন প্রস্তাব দেয় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলে একটি ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলার। পঞ্চাশের দশকে একবার এরকম প্রচেষ্টা হয়েছিল, তাও কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে। এরকম সিদ্ধান্তের ফলেই তখন জহির রায়হান ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিল যাতে ঐক্যপ্রয়াসে ওই সংগঠনের ভেতর থেকে সমর্থন পাওয়া যায়। সেবারের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছিল মূলত ছাত্রলীগের মনোভাবের। জন্যে। এবারও ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যের আহ্বান ছাত্রলীগ ফিরিয়ে দেয়।
কিন্তু তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা ঘটে, তা ছাত্রলীগের মধ্যে বিভেদ। এ-বিভেদের অঙ্কুর, মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই উদ্গত হয়েছিল। এখন, ১৯৭২ সালের গোড়ায়, নূরে আলম সিদ্দিকী ও মাখন একদিকে, আর রব ও শাহজাহান সিরাজ অপরদিকে নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে ভাগ হয়ে গেল। ছাত্রলীগে থেকেই প্রথমোক্তরা গঠন করলো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, তাদের লক্ষ্য। দেশে মুজিববাদের প্রতিষ্ঠা; শেষোক্তরা পরিচয় দিলো জয় বাংলা বাহিনী বলে, তাদের উদ্দেশ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রমতে দেশকে গড়ে তোলা। একটু-একটু করে দু-দলের মতপার্থক্য সবার কাছে ধরা পড়তে লাগলো। প্রথমদিকে উভয় পক্ষই ছিল বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপ্রার্থী। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা তো একসময়ে বঙ্গবন্ধুকে আহ্বান জানালো দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করতে, সর্বদলীয় বিপ্লবী সরকার গঠন করতে এবং গণপরিষদ ভেঙে দিয়ে একক দায়িত্বে দেশকে সংবিধান দিতে। এ আহ্বান, আর যাই হোক, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাপ্রসূত ছিল না। শ্রমিক লীগের একাংশ অন্তত এই প্রস্তাব সমর্থন করে; তার মানে, সেখানেও দ্বিধাবিভক্তির সূচনা হয়। ছাত্রলীগের অপর পক্ষ এই বক্তব্যের প্রবল বিরোধিতা করে। জুলাই মাসে ছাত্রলীগের দুই অংশ একই সময়ে দুটি সম্মেলন করে। নূরে আলম-মাখনরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, রব-শাহজাহানেরা পল্টনে। উভয় পক্ষের আমন্ত্রণ পেলেও বঙ্গবন্ধু প্রথমটিতে যোগ দেন প্রধান অতিথি হয়ে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতারাও সেখানে গেলেন। এখন ভাগাভাগি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে, অপর পক্ষ ঘোষণা করে দিলো, বর্তমান সরকারকে উৎখাত করাই তাদের আশু লক্ষ্য। কোথায় ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগের মিলনের স্বপ্ন আর কোথায় ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তি, সংঘর্ষ, হানাহানি, রক্তপাত!
এর আগে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদগুলোর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন জয়ী হয়, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সহ-সভাপতি এবং মাহবুব জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। প্রকৌশল ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র ইউনিয়ন সাফল্যলাভ করে। ক্যাম্পাসে কয়েকদিন ধরে উপর্যুপরি গোলাগুলির কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন স্থগিত রাখতে হয়। আমাদের ধারণা হয়, ছাত্রলীগের কর্মীরাই ওরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। সেখানে নির্বাচন হয় মাসখানেক পরে, কিন্তু তা নির্বিঘ্ন হয়নি।
উত্তেজনাটা আগে থেকেই তৈরি হচ্ছিল। আমি তখন এ এফ রহমান হলের প্রোভোষ্ট। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময়ে আমি হল অফিসে উপস্থিত ছিলাম। হল সংসদের নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার ছিলেন হাউজ টিউটর রণধীর বড়ুয়া। তিনি আমাদের বিভাগেই পালির শিক্ষক ছিলেন। অত্যন্ত মৃদু স্বভাবের সজ্জন মানুষ, খুবই কর্মনিষ্ঠ ও পরিশ্রমী। একবার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে সকল শিক্ষকের নাম ও শিক্ষাগত যোগ্যতার একটা ফর্দ পাঠাতে হয়েছিল। রণধীর বড়ুয়া একটা কাগজে লিখে দিয়েছেন, তিনি পালিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ। আমি তাকে বললাম, রণধীরবাবু, আপনার না একটা আমেরিকান এম এড ডিগ্রি আছে? উনি বিব্রত হয়ে পালটা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সেটাও লিখে দেবো?’ এহেন মানুষকে এই দুর্দিনে এমন ঝামেলা সইতে হলো, কেননা, হাউজ টিউটরদের মধ্যে তিনিই সিনিয়র। মনোনয়ন বাছাই শেষ করে রণধীরবাবু একটু ভীতভাবে আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন। বললেন, ‘ছাত্রলীগের ক্রীড়া-সম্পাদকের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছি তাতে ক্যান্ডিডেটের সই নেই বলে, কিন্তু ওরা মানতে চাইছে না। মানতে না চাইবার কোলাহল অফিসঘরে বসেই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম; ব্যাপারটা যে কী, তা বুঝতে পারিনি। রণধীরবাবুকে বললাম, আপনি ওদের বলুন, আপনার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হল সংসদের সভাপতির (অর্থাৎ প্রোভোস্টের) কাছে আপিল করতে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমি দেবো।’ খবর পেতে থাকলাম, ছাত্রলীগ-নেতারা ওই মনোনয়নপত্রই বৈধ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে; প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র ইউনিয়ন-প্রার্থীর কাছ থেকে তারা এই মর্মে একটা চিঠি আদায় করেছে যে, অপর প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করলে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। এবারে ঘর থেকে আমাকে বেরোতেই হলো। ছাত্রদের বললাম, ‘রিটার্নিং অফিসার যথারীতি কাজ করেছেন, তোমরা তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নিয়মমাফিক আমার কাছে আপিল করতে পারো, শেষ সিদ্ধান্ত আমার। তারা আমাকে বললো যে, তারা সহযোগিতা ও বন্ধুত্বমূলক প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে নির্বাচন করতে চাইছে; মানুষমাত্রের ভুল হয়, প্রার্থী খেলাধুলা যত বোঝে, নিয়মকানুন তত বোঝে না; বেচারা একটা সই করতে ভুলে গেছে, এর বেশি তো কিছু নয়; তার নমিনেশন পেপার ভ্যালিড ঘোষণা করলে প্রতিপক্ষের যেখানে আপত্তি থাকবে না, সেখানে রিটার্নিং অফিসার শুধু শুধু আমলাতান্ত্রিক মনোভাব দেখাচ্ছেন; নিয়ম মানুষের জন্যে, না নিয়মের জন্যে মানুষ? আমি বললাম, ‘তোমরা ওঁকে ওঁর মতো কাজ করতে দাও–আমার কাছে আপিল করলেই কেবল বিষয়টা নিয়ে তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, তার আগে নয়। আমার কথায় কোলাহল কমলো না, কিন্তু রিটার্নিং অফিসারের ওপরে চাপ কমলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রার্থী আপিল করলো। রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে আমি আপিলের মীমাংসা করলাম। সংক্ষুব্ধ ছাত্রেরা আমাকে তাদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করতে বললো। আমি যখন তাতে সম্মত হলাম না, তখন হইচই বাড়লো মাত্র। হলের দারোয়ান ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিলো যে, অদূরে কয়েকজন অস্ত্রধারী অপেক্ষা করছে, আমি যেন হল থেকে বের না হই। হাউজ টিউটররা আমাকে ঘিরে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন। এর মধ্যে উৎকণ্ঠিত হয়ে উপাচার্য ফোন করলেন, তাঁর কানেও কী সব কথা পৌঁছেছে। আমি তাকে বললাম, একটু পরে তার অফিসে এসে সব জানাবো। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পর সকলের মতের বিরুদ্ধে আমি বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার আরদালি গাড়ি চালাতো। তাকে প্রস্তুত থাকতে খবর দিয়ে আমি অফিস থেকে বারান্দায় পা দিলাম। আমাকে কেউ বাধা দিলো না বটে, কিন্তু এত ছাত্র আমার সামনে-পেছনে চলতে থাকলো যে গাড়িতে ওঠা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। আমি ছাত্রদের বললাম, ‘তোমরা সারারাত আমাকে বসিয়ে রাখতে পারো, কিন্তু সিদ্ধান্ত পালটাবে না। ভাইস-চান্সেলর আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন, আমি তার কাছে যাবো, তোমরা আমার পথ ছেড়ে দেবে। এতক্ষণে নেতৃস্থানীয় কজন ছাত্র এসে আমার বেরোবার পথ করে দিলো, তবে তারাও জানাতে কসুর করলো না যে, পুরো ব্যাপারটায় তারা দুঃখিত হয়েছে।
উপাচার্যকে পরিস্থিতি জানালাম। তিনি সত্যিই উদবিগ্ন। কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে দুটি গাড়িতে আমার গাড়ির সামনে-পেছনে দিয়ে ঘুরপথে তিনি আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা হলো প্রশাসন-ভবনের নিচে বাণিজ্য বিভাগের শ্রেণিকক্ষে। প্রত্যেক ঘরে তিনটি করে ব্যালট-বাক্স–কেন্দ্রীয় সংসদের, আলাওল হল সংসদের এবং এ এফ রহমান হল সংসদের। দুই হলের ছাত্রছাত্রীদের ভাগ করে বিভিন্ন কক্ষে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। সবকিছু ভালো মতোই চললো। দুপুরে বাড়ি গেছি খেতে। একটু পরে খবর এলো, কয়েকজন অস্ত্রধারী ভোটকক্ষে ঢুকে একটা ব্যালট-বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। দ্রুত অকুস্থলে ফিরে এলাম। দেখা গেল, আলাওল হল সংসদের একটা ব্যালট বাক্স নেই। সহকর্মীরা বললেন, এ এফ রহমান হলের বাক্স নিতে ভুল করে আলাওল হলের বাক্স নিয়ে গেছে। আলাওল হলে ছাত্রলীগের বিজয় সুনিশ্চিত, এ এফ রহমান হলে পরাজয়ের আশঙ্কা, অতএব। আমি যখন বাণিজ্য বিভাগের কাছে পৌঁছোলাম, তখন দেখি, এক নিষ্ঠাবান কর্মী মাথার ওপরে বন্বন্ করে লাঠি ঘোরাচ্ছে–কাউকে আঘাত করছে না–তবে লাঠির আওতার মধ্যে কেউ যেতেও পারছে না। আমাকে দেখে সে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে অভিবাদন করলো : লাঠির গতি কমিয়ে সেটাই কপালের মাঝখানে ধরে মাথা একটু নত করলো। তাকে কিছু বলার আগেই, ঘটনার হোতা বলে সন্দেহ করা হয়েছিল এমন এক ছাত্রনেতা কোত্থেকে আবির্ভূত হয়ে বললো, ভোট দিয়ে সে হলে গিয়েছিল একটু বিশ্রাম নিতে, এই অভাবিত ঘটনার বিবরণ শুনে এখনই দৌড়ে আসছে; সে একেবারেই বিমূঢ়, তবে শিক্ষকরা যা বলবেন তা করতে সে এবং তার দল প্রস্তুত।
আলাওল হলের নির্বাচন স্থগিত করা হলো, তবে কেন্দ্রের ও আমার হলের নির্বাচনের কাজ চলতে থাকলো। ভোটগণনায় দেখা গেল, কেন্দ্রে জয়ী হয়েছে ছাত্র ইউনিয়ন (শামসুজ্জামান হীরা সহ-সভাপতি), এ এফ রহমান হলে ছাত্রলীগ (গোলাম জিলানী সহ-সভাপতি, নূরনবী সাধারণ সম্পাদক)। উপাচার্য নির্দেশ দিলেন আমাকে, নির্বাচনের ফল যেন ঘোষণা না করি। তাঁর সঙ্গে প্রোভোস্ট, প্রক্টর ও কয়েকজন শিক্ষকের বৈঠকে স্থির হলো, আলাওল হলের ভোটগ্রহণের বিষয়টা স্থির না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদের নির্বাচনের ফল দেওয়া হবে না। আমি এটা সংগত মনে করলাম না, কিন্তু সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম।
এদিকে ছাত্র ইউনিয়নের বিজয়ী প্রার্থীরা সংসদের দায়িত্ব নিতে উন্মুখ, ওদিকে ছাত্রলীগ যদিও আলাওল হলের নির্বাচনের পরে ফলপ্রকাশের পক্ষপাতী তবু আমার হলে যারা নির্বাচিত হয়েছে, তারা হাসি-হাসি মুখ করে রোজ একবার দেখা করে। দু-তিন দিন পরে আমি উপাচার্যকে বললাম, সংসদ নির্বাচনের ফল ঘোষণা না করার মতো কোনো আইনগত কর্তৃত্ব আমার আছে বলে মনে করি না, তাই তিনি অনুমতি দিলে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করতে চাই। অধ্যাপক ইন্নাছ আলী আমার কথাটা বুঝলেন। সম্পূর্ণ সন্তুষ্টচিত্তে না হলেও তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমিও চাকসুর রেজাল্ট অ্যানাউন্স করে দেই।
আমার খুব মজা লেগেছিল যখন একজন প্রবীণ শিক্ষক আমাকে বললেন যে, এ এফ রহমান হলের নির্বাচনে ছাত্রলীগের বিজয় একেবারেই অপ্রত্যাশিত, কেননা, তিনি ওটাকে ছাত্র ইউনিয়নের ঘাটি বলে মনে করতেন। বুঝলাম, তিনি ভেবেছেন, আমি বেছে বেছে ছাত্র ইউনিয়নের সমর্থকদের হলে নিয়েছি।
নিজের উদ্যোগে আসলে আমি মাত্র কয়েকজন ছাত্রকে আমার হলে নিয়ে এসেছিলাম। এদের সবাই অনার্স পরীক্ষায় খুব ভালো করেছিল, কিন্তু আলাওল হলের একটা বর্ধিত অংশে এরা থাকছিল একটু কষ্টে। আমি তাদের বলেছিলাম, এ এফ রহমান হলে তারা বদলি নিয়ে এলে আমি তাদের সিংগল সিট দিতে পিরবো। তারা এসেছিল। তাছাড়া, ৬০ শতাংশ সিট আমি বরাদ্দ করেছিলাম মেধার ভিত্তিতে, প্রার্থীদের তালিকা তাদের দেখার জন্য উন্মুক্ত রেখেছিলাম; আমাদের হিসাবে কোনো ভুল আছে কি না, তা তারা দেখতে পারতো এবং আর কতজনের পর একজনের পালা আসবে, তাও জানতে পারতো। ৪০ শতাংশ সিট রেখেছিলাম বিভাগের অধ্যক্ষের সুপারিশে ভর্তি করার জন্যে। দূরদূরান্ত থেকে আগত কিংবা বিশেষ বিবেচনা করার যোগ্য প্রার্থীরা বিভাগের মাধ্যমে এভাবে সুযোগ পেতে পারতো। অনেক বিভাগের অধ্যক্ষ অবশ্য এ-ব্যবস্থায় খুশি হননি, তারা এটা বাড়তি ঝামেলা মনে করেছিলেন। তবে আমি যে নিজস্ব বিবেচনার জন্যে কিছু হাতে রাখিনি, তা ছিল স্পষ্ট। তাতে অনেক বন্ধু ও পরিচিতজনের অনুরোধ রাখতে পারিনি, তাঁরা দুঃখিত হয়েছিলেন। এরপরও যারা মনে করেছিলেন, বিশেষ কোনো ছাত্র-সংগঠনের প্রতি আমি পক্ষপাত করেছি, এ-বিষয়ে প্রমাণ বা যুক্তির চেয়ে তাঁদের বিশ্বাসই ছিল বড়ো।
১০.
শিক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ ইউসুফ আলীর সঙ্গে অধ্যাপক মযহারুল ইসলামের বন্ধুত্ব ছিল। মযহারুল ইসলাম তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমি ও কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড একীভূত করতে। বিষয়টি বিবেচনার জন্যে সরকার একটি কমিটি গঠন করে। বাংলা একাডেমির পরিচালক (কবীর চৌধুরী), ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ (যথাক্রমে নীলিমা ইব্রাহিম, মযহারুল ইসলাম ও আমি), শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (আ. কা. মো. যাকারিয়া) এর অন্তর্ভুক্ত। বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের গ্রিন রোডের বাড়িতে দুদিন সভা হলো। প্রথম সভায় উপস্থিত হয়ে দেখি, দুই প্রতিষ্ঠান একীভূত করার। উদ্দেশ্যে আইনের একটি খসড়া আমাদের বিবেচনা করতে দেওয়া হয়েছে। কবীর চৌধুরী ও আমি আপত্তি করলাম। আমরা বললাম, বিষয়টির নীতিগত দিক আলোচনা করার আগে আইনের খসড়া দেখবো কেন? দুটি প্রতিষ্ঠানের চরিত্র দুরকম–দুটিকে এক করা সংগত কি না, আগে তো তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। একজন বললেন, দুটো প্রতিষ্ঠান এক হোক, এটা বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা। কবীর চৌধুরী বললেন, বঙ্গবন্ধুকে যথাযথ পরামর্শ দেওয়া আমাদের কর্তব্য। যাকারিয়া বললেন, ‘একত্রীকরণের বিষয় একরকম স্থির হয়ে গেছে, আপনারা এই খসড়ায় কিছু পরিবর্তন আনতে চান কি না দেখুন।’ আমি বললাম, আমরা আইনজ্ঞ নই, আইনের খসড়া দেখে কী করবো? আমি মনে করি, দুটি প্রতিষ্ঠান। স্বতন্ত্র থাকাই সংগত। যাকারিয়া মৃদু হাসলেন।
আমি দ্বিতীয় সভায় আর গেলাম না। সুতরাং কোনো সুপারিশে স্বাক্ষর করিনি। তাতে অবশ্য কিছু আসে যায়নি। বাংলা একাডেমির সঙ্গে বাংলা উন্নয়ন বোর্ড এক হয়ে গেল। এতদিন বাংলা একাডেমির একজন পরিচালক ছিলেন, এবারে একজন মহাপরিচালক ও কয়েকজন পরিচালকের পদের সৃষ্টি হলো। মযহারুল ইসলাম মহাপরিচালক হলেন। মিলিত বাংলা একাডেমিতে পূর্বতন দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে কে কার চেয়ে কর্মে জ্যেষ্ঠ, এই সমস্যার সমাধান হতে অনেকদিন লেগে গেল। সংবাদপত্রে খবর বের হলো, এই দ্বন্দ্বে বাংলা একাডেমিতে কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়নের ভার দেওয়া হলো বাংলা একাডেমিকে। তার জন্যে অনেক অস্থায়ী নিয়োগের ব্যবস্থা হলো। এই প্রকল্পের জন্যে যে-কমিটি গঠিত হলো, কপালগুণে আমি তারও সদস্য। সব সভায় আসতে পারি না, এলেও সবকিছু বুঝতে পারি না। এক সভায় কমিটির আরেক সদস্য সিকান্দার আবু জাফর ক্রুদ্ধ হয়ে মহাপরিচালককে (তিনিই প্রকল্প-পরিচালক) কীসব বললেন, আর জানালেন, তাকে বঙ্গবন্ধু সদস্য করেছেন এখানে কোনো অনিয়ম হচ্ছে কি না দেখতে। মাঝপথে সভা শেষ হলো। জাফর ভাই তাঁর গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে একটা ছোটো বোতল বের করে তার গর্ভস্থ পানীয় গলায়। ঢালতে ঢালতে বললেন, ‘শোন, যা উচিত মনে করবি, তা বলবি। মাস্টার বলে খাতির করবি না, বাপকেও উচিত কথা বলতে ছাড়বি না।’
১১.
অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ অধ্যাপক হননি। ১৯৩৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন লেকচারার ক্লাস টু পদে। ক্লাস ওয়ান আর ক্লাস টু লেকচারার পদ যখন মিশে লেকচারার হয়ে গেল, তখন তিনি লেকচারার হলেন। তারপর যখন সিনিয়র লেকচারার নামে নতুন শ্রেণির পদ সৃষ্ট হলো। ১৯৬৫ সালে, তখন আমাদের সঙ্গে তিনিও হয়ে গেলেন সিনিয়র লেকচারার। স্বাধীনতার পরে সিনিয়র লেকচারারের নাম বদলে হলো অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্য নিযুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সর্বজ্যেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে রাজ্জাক সাহেব হলেন বিভাগের অধ্যক্ষ।
আব্দুর রাজ্জাক কখনো উচ্চপদে নিয়োগলাভের আবেদন করেননি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ কে জে নিউম্যান একবার রিডার পদে খালিদ বিন সাইদের নিয়োগে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে রাজ্জাক সাহেবকে ওই পদের প্রার্থী হতে বলেছিলেন এবং এও বলেছিলেন যে, তাঁর প্রার্থিতা তিনি সমর্থন করবেন। রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, খালিদ বিন সাইদের পিএইচডি আছে, আমার নেই; তুমি তার বদলে আমাকে সমর্থন করতে চাও–তার মানে তুমি লোক সুবিধার নও। তাঁদের দুজনের বিরোধের বোধহয় শুরু এইখানে। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী উপাচার্য হয়ে রাজ্জাক সাহেবকে অধ্যাপক করার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার প্রবল আপত্তি দেখে শেষে নিরত হন।
আমি একবার রাজ্জাক সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডিগ্রিকে তিনি অত মূল্য দেন কেন? কত মেধাহীন মানুষও তো পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করে থাকে। তিনি বলেছিলেন, তা করে, কিন্তু অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য মানদণ্ডের অভাবে ওই কাগজগুলোকে মূল্য দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। অন্যথায় সিদ্ধান্ত খেয়ালখুশিমাফিক হয়ে পড়বে।
মুজাফফর আহমদ চৌধুরী গুরুর প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ১৯৭২ সালে আব্দুর রাজ্জাক কেবল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যক্ষ হলেন না, সিন্ডিকেটের সদস্য হলেন, অনেকগুলো বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপকপদে নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য হলেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সম্পর্কে তিনি অনেককাল ধরেই ভাবনাচিন্তা করে এসেছেন। যেমন, এখানে প্রশাসনিক পদ কমানো উচিত, নিজস্ব প্রকৌশল বিভাগ না রেখে তার কাজের দায়িত্ব চুক্তির ভিত্তিতে বাইরের প্রতিষ্ঠানকে দিলে আর্থিক সাশ্রয় হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানো দরকার। উপাচার্যকে যে তিনি এসব বিষয়ে পরামর্শ দিতেন, তা সবাই জানতো। এসব পরামর্শ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেননি উপাচার্য, কিন্তু তাতেও রাজ্জাক সাহেবের প্রতি অনেকের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।
তিনি আরো চেয়েছিলেন যে, পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক কারণে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ত্যাগ করেছিলেন বা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের ফিরিয়ে আনা হোক। সরদার ফজলুল করিম দর্শনের শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে তিনি নিয়ে এলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। এ-নিয়ে কিছু সমালোচনা হলো, কিন্তু তা সামান্যই। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর সমাজতত্ত্ব বিভাগ থেকে কর্মচ্যুত হয়েছিল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে। তার ডিগ্রি ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানে, সেখানেই তাকে ফিরিয়ে আনা হলো। সে একটু বেশি বাধার সম্মুখীন হয়েছিল এই অর্থে যে, এক তরুণ শিক্ষক তাকে পিস্তল দেখিয়ে অনুরোধ করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ না দিতে। বদরুদ্দীন উমর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কর্ম ত্যাগ করেছিলেন তাঁকে নিয়ে তাঁর ভাইস চ্যান্সেলরের ওপরে গভর্নর তথা চান্সেলর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করায়। রাজ্জাক সাহেব তাকেও বিভাগে আনতে চাইলেন–এতে যে উমরের আগ্রহ ছিল, তা নয়। এবারে কাগজে লেখালেখি শুরু হলো যে, একজন নকশালপন্থী ব্যক্তিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে। অথচ একই কাগজে অন্য প্রসঙ্গে রাজ্জাক সাহেবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী কিংবা সিআইএর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলেও অভিহিত করা হয়।
আমার প্রতি স্নেহবশত রাজ্জাক সাহেব চাইলেন, আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলা বিভাগে অধ্যাপক-পদপূরণের লক্ষ্যে বিজ্ঞপ্তি বের হলো। সার আমাকে দরখাস্ত করতে বললেন। আমি বললাম, আমি চট্টগ্রামে গেছি এখনো তিন বছর হয়নি–এখন ঢাকায় আবার চাকরির আবেদন করলে অস্থিরচিত্ততার পরিচয় দেওয়া হবে মাত্র। আমি দরখাস্ত না করায় রাজ্জাক সাহেব পরামর্শ দিলেন, নির্বাচকমণ্ডলীর সভায় উপাচার্য যেন আমার নামটাও বিবেচনা করতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম-অনুযায়ী আবেদনকারীদের বাইরেও কারো বিষয় নির্বাচকমণ্ডলীকে বিবেচনা করতে বলার অধিকার উপাচার্যের ছিল।
ওদিকে হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে দেখি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অস্থায়ী অধ্যাপক-পদ বিজ্ঞাপিত হয়েছে। আমি বিভাগের অধ্যক্ষ, অথচ কিছুই জানি না। গেলাম উপাচার্যের কাছে। বললাম, আর কিছুকাল পরে পদটি বিজ্ঞাপিত হলে বোধহয় ভালো হতো। ইন্নাছ আলী আমার কথা বুঝলেন। বললেন, কেন, পদ যখন খালি হয়েছে, তখন বিজ্ঞাপিত হওয়াই ভালো, আপনি অবশ্যই আবেদন করবেন। সৈয়দ আলী আহসান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়ে চলে যাওয়ায় ওই পদটি অস্থায়ীভাবে শূন্য হয়। যথারীতি আবেদন করলাম। আরো দুজন প্রার্থী ছিলেন। নিয়োগ আমিই পেলাম। একই সঙ্গে মোহাম্মদ আলী হলেন ইংরেজির স্থায়ী অধ্যাপক। আমরা যেদিন নিয়োগপত্র পাই, সেদিনই নতুন পদে যোগ দিতে পারতাম। কিন্তু সপ্তাহের ওই দিনটি শুভকাজের অনুকূল নয় বিবেচনা করে মোহাম্মদ আলী আমাকে অনুরোধ করলেন পরদিন যোগ দিতে। সেদিন আমি যোগ দিলে তার চেয়ে একদিনের জ্যেষ্ঠ হয়ে যেতাম, তবে আমি স্থিতাবস্থা রক্ষার পক্ষে। তাই পরদিন, ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট অধ্যাপক-পদে যোগ দিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সচিব একদিন আমাকে পাকড়াও করে বললেন, ‘ভিসি আপনার একটা সিভি চেয়েছেন, এই সপ্তাহেই দিয়ে যাবেন। কদিন পরে আমার জীবন তার হাতেই সমর্পণ করলাম। তিনি পাকা লোক, জানতে চাইলেন, ওতে আমার স্বাক্ষর আছে কি না। উত্তর শুনে বললেন, এখনই স্বাক্ষর করে দিয়ে যান।
অক্টোবর মাসের কোনো এক সময়ে নির্বাচকমণ্ডলীর সভা বসলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফ, রাজশাহী থেকে কাজী আবদুল মান্নান, সরকারি কলেজ থেকে আলাউদ্দিন আল আজাদ। তার ওপর উপাচার্য আমার জীবনবৃত্তান্ত উপস্থাপন। করেছেন। আবদুর রাজ্জাকের মুখে শুনলাম, আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
অন্যেরাও নিশ্চয় এমনই শুনেছিলেন। তার প্রতিক্রিয়া হলো প্রবল। একদল ছাত্র অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উপাচার্যের বাড়ি চড়াও হলো, নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাকের ফুলার রোডের বাসায় গিয়েও তার খোঁজ করলো। নির্বাচকমণ্ডলীর আরেকজন সদস্য সৈয়দ আলী আহসানকে ফোন করে গালমন্দ করলো কেউ কেউ, জানতে চাইলো, আমি কেন আমার স্ত্রীকে বিধবা করতে চাই। আমাকে অনেকে পরামর্শ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে দূরে থাকতে। এদিকে অ্যাকাডেমিক কাউনসিলের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যাপকের আরো ২৪টি পদ সৃষ্টি হলো, তার মধ্যে একটি বাংলায়। বাংলা বিভাগে অধ্যাপকের দুটি পদে দুজন নিয়োগ পাবেন–এরকম সম্ভাবনায়ও ক্ষোভ প্রশমিত হলো না–বাড়লো হয়তো। বিভাগে ছাত্রদের আনুষ্ঠানিক সভায় ‘একজন প্রভাবশালী সহকারী অধ্যাপকের প্রিয় পাত্রকে’ ‘পেছন দরজা দিয়ে নিয়োগের চেষ্টার প্রতিবাদ করা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে স্বজনপ্রীতি, অবৈধ নীতি ইত্যাদি পরিত্যাগ করার আহ্বান জানানো হলো, অন্যথায় সচেতন ছাত্রসমাজ যে চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সে-সংকল্পও ব্যক্ত হলো। উপাচার্য প্রমাদ গুনলেন। রাজ্জাক সাহেবের অনুরোধ ছাড়াও, তিনি নিজে থেকেই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে চেয়েছিলেন। অল্প কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসতে বলেছিলেন তাঁকে, তাও তাঁর মনে। ছিল। এখন দেখলেন, ছাত্রলীগের মধ্যম সারির নেতারাই আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখতে চায় না। অবস্থা এমন হলো যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে অধ্যাপক-নিয়োগের নীতিমালা ব্যাখ্যা করার দাবি জানালো। তাদের পর্যবেক্ষণ : ‘বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে। …কেউ কেউ ব্যক্তিগত পদোন্নতি ইত্যাদির আকাঙ্ক্ষায় দলাদলি করার চেষ্টা করছেন। তারা ছাত্রদেরকেও তাদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। কর্তৃপক্ষও কোন প্রকার দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করছেন না, বরং দলাদলির সুযোগ করে দিচ্ছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সাধারণ ছাত্রদের নামে মুদ্রিত একটি প্রচারপত্র এ-সময়ে বিতরণ করা হলো। তার ভাষা বেশ অগ্নিগর্ভ। মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, মীর্জা নূরুল হুদা, আব্দুর রাজ্জাক ও সৈয়দ আলী আহসান তার আক্রমণের লক্ষ্য–আমি তো আছিই। এবারে আমি বিচলিত না হয়ে পারলাম না। আমার কারণে আমার শ্রদ্ধেয় মানুষেরা এভাবে অপমানিত হবেন, তা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগতে লাগলো। ভাবলাম, যথেষ্ট হয়েছে, এবারে জনসমক্ষে একটি বিবৃতি দিয়ে বলা দরকার যে, এই প্রতিযোগিতায় আমি আর নেই। মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে আমার অভিপ্রায় টেলিফোনে জানালাম। স্বভাবতই উনি ক্ষুণ্ণ হলেন, আমি মাফ চাইলাম। উনি বললেন, ‘ইট ইজ ইওর ডিসিশন, আফটার অল, তবে, প্লিজ, সারের সঙ্গে কথা বলে নেবেন বিফোর ইউ গো পাবলিক।’ সৈয়দ আলী আহসানকে ফোন করলাম–ওঁর কথাও প্রায় তাই। এদিকে রাজ্জাক সাহেবকে বাড়িতে ধরতে পারছি না। একবার গিয়ে পেলাম ওঁর অব্যবহিত কনিষ্ঠ আবদুল খালেককে। তিনি বাড়িতেই বেশির ভাগ থাকেন–ছাত্রদের রোষের ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেছেন। তিনি আমার সঙ্গে একমত। তবে কারণটা একটু ভিন্ন : আপনার সারের বউ-বাচ্চা নাই, দুনিয়াদারির খবর নাই–তার কথা আলাদা। আপনে ক্যান এই রিস্কের মধ্যে যাইবেন? যা দিনকাল, বলা যায় না।’
সেদিন নভেম্বরের ২ তারিখ। আমাদের অগ্রজস্থানীয় বন্ধু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, জয়নুল আবেদীন দীর্ঘ রোগভোগের পর মারা গেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-প্রাঙ্গণে বাদ আসর জানাজা। গণপরিষদ ভবন থেকে সেখানে এলাম এবং যেমন ভেবেছিলাম, রাজ্জাক সাহেবকেও পেয়ে গেলাম। জানাজার পরে সারুকে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’ উনি। জানতে চাইলেন, গাড়ি আছে? হাঁ-সূচক উত্তর শুনে বললেন, ‘তবে কামালের বাড়ি চলেন। যেতে যেতে আমার কথাটা বললাম। বিবৃতির খসড়া আমার পকেটে ছিল, কামাল হোসেনের বাড়িতে গিয়ে সেটা ওঁর হাতে দিলাম। হামিদাও আমার অভিপ্রায় সমর্থন করলেন। বিবৃতিতে কোন শব্দের প্রয়োগ জুতসই হয়েছে, সেটাই সার বললেন আমাকে; আমার কী করণীয়, সে-বিষয়ে কিছুই বললেন না। জিজ্ঞাসা করলাম, এটা প্রেসে পাঠিয়ে দিই?’ সার বললেন, ‘আপনি তো মন ঠিক কইরাই কাগজটা লিখছেন। আমি সে-রাতেই দৈনিক বাংলা, সংবাদ ও পূর্বদেশে প্রকাশের জন্যে বিবৃতিটা পাঠিয়ে দিলাম। অন্য কোনো কাগজে বেরিয়েছিল কি না, মনে নেই, তবে পূর্বদেশে তা পরদিন ছাপা হয়েছিল। আমার পক্ষে তাই ছিল যথেষ্ট, কেননা আক্রমণাত্মক বিষয়গুলো মূলত পূর্বদেশেই পত্রস্থ হয়েছিল।
আমার বিবৃতিটি ছিল এরকম:
গত দুদিনে কোন কোন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এবং একটি মুদ্রিত প্রচারপত্রে স্বনামে ও অনামে আমি উল্লিখিত হয়েছি। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে বাংলা বিভাগের অধ্যাপকপদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন ভেবে অনেকে বিচলিত বোধ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন পদের জন্য আমি আবেদন করিনি, সেখান থেকে কোন নিয়োগও লাভ করিনি। এই অবস্থায় স্বাভাবিক নিয়মে এ প্রসঙ্গে আমার কিছু বলার কথা নয়। কিন্তু মুদ্রিত বিষয়বস্তুর ভাষার তীব্রতা ও ভাবের গভীরতা এমন পর্যায়ের যে, আমি এই স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে বাধ্য হচ্ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র, শিক্ষক ও হিতৈষীদের আমি এই বলে আশ্বস্ত করতে চাই যে, অদূরভবিষ্যতে এরকম নিয়োগগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। আশা করি যে, এই বিবৃতির পরে চরিত্রহননের পালা সাঙ্গ হবে।
এই বিবৃতি দিয়ে আত্মসম্মান রক্ষা করতে পেরেছিলাম কি না জানি না, কিন্তু আমার জন্যে গুরুজনদের সম্মানহানি রোধ করতে পারিনি। সেদিক দিয়ে ওই বিবৃতির সঙ্গে আমার স্বার্থপরতা জড়িত হয়েছিল। তবে উপাচার্যের জন্যে তা একটু স্বস্তিকরও হয়ে থাকতে পারে। তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যাপকের দুই পদে নীলিমা ইব্রাহিম ও আহমদ শরীফকে নিয়োগ দিতে পেরেছিলেন। নভেম্বর মাসেই তারা নতুন পদে যোগ দিয়েছিলেন। ততদিনে শুনেছি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে তৃতীয় একটি অধ্যাপকের পদও বাংলা বিভাগে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তা হতে হতে অবশ্য আমি আর দৃশ্যপটে ছিলাম না।
এই ঘটনা থেকে আরো কিছু ধূলিরাশি সঞ্চারিত হয়েছিল। সেবারে বাংলা বিভাগে এমএ শেষ পর্বের পরীক্ষা কমিটির বহিরাগত সদস্য ছিলাম আমি। সংবিধানের কাজে তখন ঢাকায় ছিলাম। পথে এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা। কুশলাদি বিনিময়ের পরে তার কাছে জানলাম, পরদিন এম এ পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা। আমি কিছুই জানতে পারিনি। রাতে ওই কমিটির এক সদস্যকে ফোন। করলাম। তিনি বললেন, তোমার চিঠি বোধহয় চট্টগ্রামে গিয়ে পড়ে আছে, কাল সকালে চলে এসো।’ তাঁরা সবাই জানতেন, আমি ঢাকায় আছি এবং কোথায় আছি। কেউ যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি আমার সঙ্গে। পরে চট্টগ্রামে ফিরে। গিয়েও কোনো চিঠি পাইনি। সেই সদস্যের মৌখিক আমন্ত্রণ পেয়ে বললাম, ‘সকালে পারবো না, লাঞ্চের পর পৌঁছতে পারি।’ তিনি বললেন, পরীক্ষা তো দুদিন ধরে চলবে, তুমি এক বেলা থাকতে না পারলেও আমরা ম্যানেজ করে নেবো। ম্যানেজ করেছিলেন ঠিকই। আমি গিয়ে দেখলাম, ইতস্ততবিক্ষিপ্তভাবে অনেক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়া হয়ে গেছে; সকালে-বিকেলে বা পরদিন যাদের পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তাদের মধ্যেও অনেকে পরীক্ষা দিয়ে গেছে এবং ভালো নম্বর পেয়েছে। শুনলাম, নানারকম অসুবিধের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে এরা আসতে পারবে না, তাই এই ব্যবস্থা। এরকম বিবেচনা সব সময়েই করা হয়। তবে সাধারণত একসঙ্গে এতজনের অসুবিধে ঘটে না। আমি বোধহয় শুধু বলেছিলাম, ‘ভালো ছাত্রেরা সবাই দেখছি আগে পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছে। পরদিন দু-বেলা পরীক্ষা। মধ্যাহ্নবিরতির সময়ে যে-যার বাড়িতে খেতে চলে। গেলেন, আমার এতদিনের বন্ধু, হিতৈষী ও সহকর্মীরা কেউ জানতে চাইলেন না, আমি খাবো কি না কিংবা কোথায় খাবো।
চট্টগ্রামে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় নীলিমা ইব্রাহিম ছিলেন বহিরাগত পরীক্ষক। পরীক্ষার আগের দিনও তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছিল, তিনি আসবেন এবং আমার বাড়িতে থাকবেন। আমি নিজেই গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে গেছি ওঁকে আনতে। উনি আসেননি। শহরে এসে ফোন করে শুনি, উনি সুস্থ নেই। সেদিন সকালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে পরীক্ষা। বহিরাগত পরীক্ষক ছাড়া মৌখিক পরীক্ষা হয় না। সেখান থেকে ফোনে পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং উপাচার্যের অনুমতি নিয়ে সেই কলেজেরই এক শিক্ষককে বহিরাগত পরীক্ষকের জায়গায় অভিষিক্ত করে পরীক্ষা নিলাম।
সমস্ত ঘটনার দুটি পাদটীকা আছে। যেসব ছাত্র ১৯৭২ সালে আমার নিয়োগের বিরোধিতা করে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল, অনেক বছর পর তাদের অন্তত দুজন আমার কাছে নিজেদের আচরণের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল এবং অন্তত আরো দুজন তাদের ব্যবহারের দ্বারা বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, তারা অনুতপ্ত।
পরবর্তীকালে রাজ্জাক সাহেব কখনো এই ঘটনা নিয়ে আমাকে কিছু বলেননি।
১২.
বাংলাদেশের সংবিধান-প্রসঙ্গে বাকি কথা বলার সময় হয়ে গেছে। সংবিধান প্রণয়নকালীন বিভিন্ন পর্যায়ের খসড়া, বিল আকারে উপস্থাপিত সংবিধানের পাঠ এবং সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টের যে-কপি নিজের কাছে রেখেছিলাম, সৌভাগ্যক্রমে তা পেয়ে গেলাম। এর ফলে অনেক কথা এসবের ওপর নির্ভর করে বলা যাবে এবং স্মৃতিনির্ভর দু-একটা বলা কথাও এই সুযোগে সংশোধন করে নেওয়া যাবে।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির বৈঠক বসে একাদিক্রমে ১৭ থেকে ২৯ এপ্রিল, ১০ থেকে ২৫ মে, ৩ থেকে ১০ জুন, ১০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর। মোট ৮৫ দিন। তৃতীয় দফার বৈঠকে অর্থাৎ ১০ জুনে সংবিধানের একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া অনুমোদিত হয়। পূর্ণাঙ্গ মানে বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ। তারপরে বাকি রয়ে যায় ইংরেজি ভাষ্যের আইনি দিক এবং বাংলা ভাষ্যের ভাষাগত দিকের উন্নতিসাধন।
১৩ জুন কামাল হোসেন ভারত হয়ে ইংল্যান্ডে রওনা হন। উভয় দেশেই সংবিধান-বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আমাদের প্রস্তাবিত সংবিধানের মূল কাঠামো সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেন। আলোচনা যে হয়েছে, সে-খবর কাগজে বের হয়, যদিও তার মর্মবস্তু কী, তা প্রকাশিত হয়নি। এতেই দেশে রটে গেল যে, ভারত সরকারকে দিয়ে সংবিধানের খসড়া অনুমোদন করিয়ে আনতে কামাল হোসেন দিল্লি গেছেন–বিলেত যাওয়াটা আসলে কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে এই যাত্রায় লন্ডনে গিয়েই আইনি খসড়া-প্রণেতা রবার্ট গাথরিকে আমাদের সংবিধান-রচনায় সহায়তাদানের জন্যে নিয়োগ করে আসেন কামাল।
আমরা তিনজন যে ভাষান্তরের কাজ করছিলাম, তার একটা আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছিল। আমার পরামর্শে খসড়া-প্রণয়ন কমিটিকে দিয়ে কামাল একটি ভাষা-বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করিয়ে নিয়েছিলেন–ইংরেজির সঙ্গে বাংলা পাঠ মিলিয়ে এই কমিটি ভাষাগত উন্নতিসাধনের প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে। এই কমিটি গঠিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম ও আমাকে নিয়ে, আমি ছিলাম কমিটির আহ্বায়ক। ৩ থেকে ২০ জুলাইয়ের মধ্যে ১১টি বৈঠক করে (শেষ চারটিতে মযহারুল ইসলাম থাকতে পারেননি) বাংলা পাঠ সম্পর্কে এই কমিটি সুপারিশ প্রদান করে ১৯ আগস্টে।
তখনো ইংরেজি ভাষ্য চূড়ান্ত হয়নি। গাথরি তার কাজ মোটামুটি শেষ করেন সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখের দিকে। তিনি অবশ্য যখন যতটুকু সম্পন্ন করছিলেন, তা দিয়ে যাচ্ছিলেন আমাকে। তবু তাঁর পরিমার্জিত ভাষ্য-অনুযায়ী বাংলা পাঠ পরিবর্তন করতে হয়েছিল আমাদের। সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির চতুর্থ বৈঠকে মূলত বাংলা পাঠ এবং পঞ্চম বৈঠকে মূলত গাথরির পরিমার্জিত পাঠ চূড়ান্ত করা হয়।
১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বিল-আকারে খসড়া সংবিধান উপস্থাপিত হলো এবং সেই সঙ্গে সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টও পেশ করা হলো। কমিটির ছ জন সদস্যের ভিন্নমতসূচক মন্তব্য রিপোর্টে যুক্ত হয়। এঁদের মধ্যে আ ক মোশাররফ হোসেন আকন্দ সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতে ‘সর্বশক্তিমান পরম করুণাময় ও দয়াময়ের নামে’ কথাগুলো যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। ৪২ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে তিনি আপত্তি করেন এবং ৭০ অনুচ্ছেদ বর্জন করতে চান। ৪২ ও ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বড়োরকম আপত্তি করেন। আছাদুজ্জামান খান। তিনি নিজেকে সমাজতন্ত্র কায়েমের বিরোধী নন বলে অভিহিত করে বলেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার মৌলিক অধিকার, তার রক্ষাকবচ থাকতে হবে এবং কারো সম্পত্তি রাষ্ট্র অধিগ্রহণ করলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের বিরোধিতা করে আবদুল মুস্তাকীম চৌধুরী বলেন যে, সাধারণ আইনদ্বারা সাময়িকভাবে এই বিধান রাখা যেতে পারে, এটি সংবিধানের অংশ হওয়া উচিত নয়, সংবিধানে রাখতে চাইলে তা সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে উপস্থিত করতে হবে। তিনি চতুর্থ তফসিলে পরবর্তী নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ জ্ঞাপন করার প্রস্তাব করেন। ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে সবচেয়ে কড়া ভাষায় আপত্তি জানান হাফেজ হাবিবুর রহমান–তাঁর মতে, এতে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টি হবে। তাঁর একটি বড়ো প্রস্তাব ছিল দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের–একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটে নিম্নপরিষদ ষাটজন সদস্যবিশিষ্ট উচ্চপরিষদ গঠন করবে, অর্থবিল উত্থাপনের একক অধিকার থাকবে নিম্নপরিষদের, বাকি সব বিষয়ে দুই পরিষদের থাকবে সমান ক্ষমতা, কোনো বিল সম্পর্কে দুই পরিষদের মতানৈক্য ঘটলে দুই পরিষদের যুক্ত বৈঠকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিষয়ের মীমাংসা হবে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রায় পুরো সংবিধান সম্পর্কেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন। রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি থেকে তিনি চার নীতি বাদ দিতে চেয়েছিলেন প্রস্তাবনার পুনরুক্তি হয় বলে; মূলনীতিগুলো যে আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য নয়, তাতে তিনি আপত্তি করেছিলেন; মৌলিক অধিকারের মধ্যে শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল পরিচালনা ও ধর্মঘটের অধিকার যোগ করতে চেয়েছিলেন; প্রত্যেক নাগরিকের সীমিত পরিমাণ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পত্তি অর্জন, ধারণ বা বিলিব্যবস্থার অধিকার থাকবে, তবে সম্পদের সামাজিকীকরণের প্রয়োজনে ক্রমান্বয়ে সমুদয় সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত করা যাবে, এমন বিধান সংযোজন করতে চেয়েছিলেন; তিনি মহিলাদের জন্যে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন, তা নারীপুরুষের সমকক্ষতার ধারণার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ বলে; তিনি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের জায়গায় চার বছর করতে চেয়েছিলেন; আইনজীবীদের মধ্য থেকে বিচারক নিয়োগের বিরোধী ছিলেন তিনি; সংবিধান প্রবর্তনের দিন থেকে মন্ত্রিসভা ভেঙে যাবে এবং ন্যাপ, আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি আর নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে–এই সরকারই নির্বাচন পরিচালনা করবেন, এমন একটি বিধান সংযোজন করতে চেয়েছিলেন। পেছন ফিরে মনে হয়, সুরঞ্জিতের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশের সকল উপজাতীয় জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সামগ্রিক বিকাশের উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা। ক্ষিতীশচন্দ্র মণ্ডল তফসিলি সম্প্রদায়, তফসিলি উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির নাগরিকদের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বার্থের উন্নতিবিধানের ব্যবস্থা সন্নিবেশ করতে চেয়েছিলেন রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতিতে।
সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির কাছে গণপরিষদের বাইরে থেকে নানা ধরনের পরামর্শ-সংবলিত ৯৮টি স্মারকলিপি এসেছিল। সদস্যদের বিবেচনার জন্যে তা যথারীতি বিলি করা হয়েছিল।
গণপরিষদে সংবিধান-বিল উত্থাপিত হলে সংশোধনীর প্রস্তাব আসে ১৩৪টি, তার মধ্যে আওয়ামী লীগ-দলীয় সাংসদদের ৬০টি এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি সংশোধনী গৃহীত হয়। ৭০ অনুচ্ছেদ শেষ পর্যন্ত সংশোধিত হয়। খসড়ায় যেখানে বলা হয়েছিল যে, দল থেকে পদত্যাগ করলে কিংবা বহিষ্কৃত হলে সেই দলের মনোনয়নলাভকারী সংসদ-সদস্য সংসদে তার সদস্যপদ হারাবেন, সেখানে সংশোধিত অনুচ্ছেদে বলা হলো, দল থেকে পদত্যাগ করলে বা দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তিনি সদস্যপদ হারাবেন। এই অনুচ্ছেদক্রমে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে আদালত প্রশ্ন করবেন না, মূলের এই বিধানও বাদ পড়ল।
একটা বড়োরকম পরিবর্তন এলো ৬ অনুচ্ছেদে। সংবিধান-বিলে এতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। সরকারদলীয় সদস্য আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া সংশোধনী এনে এর পরে যোগ করতে চাইলেন : বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ-সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বললেন যে, পার্বত্য এলাকার অধিবাসীরা বাঙালি নয়; বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তারা নিজেদের বাংলাদেশি বলে বিবেচনা করে, কিন্তু তাদের কখনো বাঙালি বলে অভিহিত করা হয়নি; এই সংশোধনী গ্রহণ করলে চাকমা জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সংসদ-সদস্যদেরা এক কথায় সংশোধনীটি সমর্থন করলেন, এটি গৃহীত হলো, মানবেন্দ্র লারমা প্রতিবাদে সংসদ-কক্ষ ত্যাগ করলেন।
পাহাড়ি জনসমষ্টির স্বাতন্ত্রের বিষয়টি সেদিন আমরা বুঝতে পারিনি। মানবেন্দ্র লারমাও সেদিন পাহাড়ি ও চাকমা প্রায় সমার্থক করে ফেলেছিলেন, অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেননি। ২৪ বছর ধরে বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ ঘটছিল; মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে। পাকিস্তান আমলে পাহাড়িরা কখনো নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার কথা বলেনি। মুক্তিযুদ্ধে পাহাড়িদের কিছুসংখ্যক অংশগ্রহণ করেছিল–মিজো জাতিসত্তার সংগ্রাম তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাহাড়িদের প্রথাগত নেতৃত্ব ছিল পাকিস্তান সরকারের মিত্র। তখনো রাঙামাটির রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী এবং বাংলাদেশ-বিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত। বাংলাদেশ-বিরোধী অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী স্বাধীনতার পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং তাদের বিতাড়ন করতে সেখানে দুবার অভিযান পরিচালিত হয়–একবার ভারতীয় বাহিনীর সাহায্য নিয়ে। এই অবস্থায় ১৯৭২ সালের জুন মাসে মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংহতি দল গঠিত হয়, সেটাও অনেকে ভালোভাবে দেখেনি।
পাহাড়িদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র যে সেদিন আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হইনি, এ ছিল নিজেদের বড়োরকম এক ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেরণা পেয়েও যে পাহাড়ি জাতীয়তাবোধের বা চাকমা জাতীয়তাবোধের সূচনা হতে পারে, এ-কথা একবারও আমাদের মনে হয়নি। নিজেদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সাফল্যে আমরা তখন বেশিদূর দেখতে পারছি না, মুক্তিযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির পরে অন্য কোনো জাতীয়তাবোধ স্বীকার করতে পারছি না, বরঞ্চ তাকে সন্দেহের চোখে দেখছি। ৬ অনুচ্ছেদের ওই ছোট্ট সংশোধনীকে উপলক্ষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতিত্বের সঙ্গে পাহাড়িদের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার যে-বিরোধ সেদিন সূচিত হলো, তার ফল কত সুদূরপ্রসারী হয়েছিল, তা এখন আমরা জানি।
এখানে একটি কথা বলা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না। খসড়া সংবিধান-প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে যারা ভিন্নমতসূচক মন্তব্য যুক্ত করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এবং গণপরিষদে সংবিধান বিল উত্থাপনের পরে যারা সংশোধনী এনেছিলেন, তাঁদের অনেকেই কিন্তু নেয়ামাল বাসির বা আমাকে দিয়ে তাদের বক্তব্য বা সংশোধনীর ভাষা পরিমার্জনা করে নিয়েছিলেন। এতে কামাল হোসেন বা আর কেউ কিছু মনে করেননি। সেই উদারতার বাতাবরণ কখন যেন হারিয়ে গেল। হাফিজ হাবিবুর রহমান যে তখন প্রকাশ্যে দলীয় একনায়কত্বের ও দলীয় নেতার একনায়কত্বের সৃষ্টির আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সে-কথাটাও মনে রাখার যোগ্য।
সংবিধান বিলের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ নিয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বেশ দীর্ঘ ও তীব্র বক্তৃতা দিতেন। বঙ্গবন্ধু একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি সুরঞ্জিতের বক্তব্য শুনছি কি না। গণপরিষদের অধিবেশন চলাকালে আমি প্রায়ই সদস্যদের পেছনে আমলাদের সারিতে বসতাম–কোনো প্রশ্নে আইনমন্ত্রীর সাহায্য প্রয়োজন হলে সেখান থেকেই চিরকুট চালাচালি করতাম। তবে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকতে পারতাম না। গণপরিষদ-ভবনে আমাকে যে-কক্ষটি বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানে বসে বিতর্ক শোনার ব্যবস্থা ছিল, শুনতামও। বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে বললাম, মাঝে মাঝে শুনি। তিনি হেসে বললেন, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান। গণপরিষদে কনস্টিটিউশন নিয়ে আমি যেসব কথা বলেছি, সেসব কথাই এখন। সুরঞ্জিত আমাকে শোনাচ্ছে। তখনকার হাউজের ডিবেট পড়ে দেখো।
৪ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হলো। পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করতে লেগেছিল প্রায় নয় বছর, আমরা তা এক বছরের মধ্যেই পারলাম। এতে আত্মসন্তুষ্টির কারণ ছিল বই কী! একটা ভালো সংবিধান-রচনার জন্যে কামাল হোসেন দেশ-বিদেশের প্রশংসা পেয়েছিলেন, লর্ড ডেনিং তো উচ্ছ্বসিত ভাষায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতালাভের পরে নিজেদের যে ঐক্য নষ্ট হতে শুরু করেছিল, সংবিধান-রচনার সাফল্যও সে-ঐক্য রক্ষা করতে পারল না। গণপরিষদে সংবিধান বিল উপস্থাপনের ঠিক আগে মওলানা ভাসানী দাবি করলেন, গণপরিষদে উত্থাপনের আগে, জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করে সেখানে সংবিধানের খসড়া আলোচনা করতে হবে। একই সময়ে আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ বিবৃতি দিয়ে দাবি করলো, সংবিধান গণভোটে দিতে হবে। গণপরিষদে যখন খসড়া সংবিধানের আলোচনা চলছে, তখন, ২৩ অক্টোবরে, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রতিষ্ঠা ঘটলো। আত্মপ্রকাশের মুহূর্তেই এটি হয়ে দাঁড়ালো বৃহত্তম বিরোধী দল। কাদের প্রেরণায় এবং কোন লক্ষ্যে এই নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠলো, এ-নিয়ে অনেক কানাঘুষো শোনা গেল। সরকার কী বুঝলো, জানিনা, কিন্তু মনে হয়, একটা শক্ত অবস্থান নিলো অর্থাৎ সহনশীলতার মাত্রা কমলো।
এদিকে সংবিধানে বলে দেওয়া হলো যে, সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য বাংলা পাঠ ও একটি নির্ভরযোগ্য ইংরেজি পাঠ থাকবে এবং উভয় পাঠের মধ্যে বিরোধ ঘটলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। এতে একইসঙ্গে গৌরব ও দায়িত্বের বোধ জেগেছিল আমার, ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভীতি ও শঙ্কার ভাবও যে জাগেনি, তাও নয়।
১৩.
নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো ১৯৭২ সালের ২৪ মে। উদ্যোগটা সম্পূর্ণতই বাংলাদেশ সরকারের। কলকাতা থেকে যাকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে এলেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিল আমাদের বন্ধু মোস্তফা সারোয়ার। বিমানবন্দরে এবং তার জন্য বরাদ্দ বাড়িতে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। পরদিন তাঁর জয়ন্তীও পালিত হয়েছিল জাঁকজমকের সঙ্গে। সরকারিভাবে কথাটা না বলা হলেও সবাই জানত যে, তিনি পাকাপাকিভাবেই এখানে থেকে যাবেন। তবু দ্রুত তাকে দেখার জন্যে মানুষের ছিল অদম্য উৎসাহ। সে-যাত্ৰা আমি তাকে দেখতে যেতে পারিনি। বস্তুতপক্ষে তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম বেশ দেরিতে, তাও বেশিক্ষণ থাকিনি–আমার খুব অস্বস্তিবোধ হচ্ছিল। যদিও কলকাতায় অসুস্থ কবিকে দেখতে গিয়েছি একাধিকবার, এবারে খারাপ লাগছিল বেশি। সে কি আমার অনুভূতি আগের চেয়ে তীক্ষ্ণ হয়েছে বলে, না তাঁকে দেখার কৌতূহল আগেই মিটে গিয়েছিল বলে? কলকাতায় একবার দেখেছি তাকে একান্তে–পারিবারিক পরিমণ্ডলে, আরেকবার বহুজনের মধ্যে–জন্মোৎসবের উদ্দীপনায়। এবারে উপলক্ষ ছাড়াই অনেক অনুরাগীর দলভুক্ত হয়ে তাঁকে দেখলাম। এখানে তার প্রাণধারণের উপকরণ উন্নত হয়েছে বটে, কিন্তু পারিবারিক পরিবেশ-রচনার প্রয়াস তত সফল হয়নি। পরে তাঁর জন্মদিনে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তার সম্পর্কে কিছু বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু যেভাবে সেদিন গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে তাঁকে বাংলা একাডেমির সভামঞ্চে তোলা হয়েছিল, তা দেখার বেদনায় আমার সৌভাগ্যলাভের আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সে-কথা যথাস্থানে।
১৪.
১৯৭২ সালের ৬ জুন। গণপরিষদ ভবনে বসে কাজ করছি। টেলিফোনে খবর পেলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের শিক্ষক, কবি হুমায়ূন কবির আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমায়ূন আমার সরাসরি ছাত্র ছিল। তার সাহিত্যচর্চা ও সমাজচিন্তা এবং মন ও মননের যেটুকু পরিচয় পেয়েছিলাম, তাতে আমি প্রীত হই। বইপত্র ঘটতে ও নিয়ে যেতে সে প্রায় আমার বাসায় আসত এবং সে-উপলক্ষে নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। পরে তার কোনো আচরণে আমি বিরক্ত হয়েছিলাম এবং সেও তা টের পেয়েছিল। ফলে আমার সঙ্গে তার একটা দূরত্ব রচিত হয়। আমি যে-বছর চট্টগ্রামে চলে যাই–১৯৬৯ সালে–সে-বছরে সে এম এ পাশ করে। তারপর বাংলা একাডেমির বৃত্তি নিয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা সম্পর্কে গবেষণায় প্রবৃত্ত হয়। সে বিয়ে করেছিল তার সহাধ্যায়ী, আমার প্রিয় ছাত্রী, সুলতানা রেবুকে। আমি চট্টগ্রামে থাকায় এ-সময়টায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়।
হুমায়ূনের নিহত হওয়ার খবর পেয়ে তার বাড়ি যেতে চাইলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এমন কাউকে পাওয়া গেল না।
পরে শুনতে পাই, হুমায়ূন ছিল পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির একজন নেতা। সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মতানৈক্য হওয়ায় সে দল থেকে সরে আসে। এ সময়েই, ১৯৭২ সালের গোড়ায়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম গ্রহণ করে। তার পূর্বতন রাজনৈতিক সহকর্মীরা তা অনুমোদন করেনি। দলের জন্যে সে বিপজ্জনক বিবেচিত হয়। তাকে বাড়ির বাইরে ডেকে নিয়ে গুলি করে অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী।
হুমায়ূনের মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে যে-শোকসভা হয়, তাতে যোগ দিয়েছিলাম। বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে তখন আমার সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ। তাঁদের অনুরোধে হুমায়ূন সম্পর্কে আমিও দু-চারটি কথা বলি। তার অপমৃত্যুতে আমি প্রকৃতই গভীর শোক উপলব্ধি করেছিলাম।
১৫.
তাজউদ্দীন আহমদ আহ্বান জানালেন, তাঁর বাজেট-বক্তৃতা-প্রণয়নে সাহায্য করতে হবে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম। বিমানবন্দর থেকে অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে সরাসরি নিয়ে গেলেন রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা ‘পদ্মা’য়। বাজেট পেশ না হওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে আর বের হওয়া যাবে না। যে-তিন বছর তাজউদ্দীন বাজেট দিয়েছিলেন, সে-তিন বছরই আমি একবার করে সরকারি অতিথি হয়েছিলাম।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট-বক্তৃতার একটা খসড়া মন্ত্রণালয় থেকে করে দেওয়া হতো। প্রথম বছরে খসড়াটা ছিল ইংরেজিতে, পরের দুবার ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর তার বাংলা ভাষ্য তৈরি করে রেখেছিল। আমি প্রথমবার সেটা অনুবাদ করেছি, পরের দুবার বাংলা ভাষ্য খানিকটা সরল করেছি। তারপর অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন এবং পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম একযোগে এসে তাতে কিছু যোগ-বিয়োগ করেছেন। আমি অন্যত্র বলেছি, বাংলা ও ইংরেজি দুটো ভাষাই তাজউদ্দীন খুব ভালো জানতেন। বাক্যগঠনে ও শব্দপ্রয়োগে একটু খুঁতখুঁতেই ছিলেন তিনি। জুতসই শব্দ না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা মনমতো বাক্য গঠন না হওয়া পর্যন্ত তিনি পরবর্তী বাক্যে যেতে চাইতেন না। বিষয় ও ভাষা উভয় ক্ষেত্রেই তাঁর মনোযোগ ছিল সম্পূর্ণ। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখতেন, মাঝে মাঝে বাংলা প্রতিশব্দের দুরূহতা সম্পর্কে নালিশ করতেন। আমার কাজ সম্পূর্ণ হলে ড. কামাল হোসেন বাজেট-বক্তৃতার ইংরেজি পাঠ তৈরি করতেন–খানিকটা মন্ত্রণালয়ের আদি খসড়ার সাহায্যে, বাকিটা তাজউদ্দীন, নূরুল ইসলাম ও আমার সঙ্গে আলোচনা করে। নূরুল ইসলাম একবার হাসতে হাসতে তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন, আমরা এত ঘুরপথে যাই কেন? প্রথমে মিনিস্ট্রির ড্রাফট, তারপর ড. আনিসুজ্জামানের বাংলা, তারপর আমাদের সংশোধন, সবশেষে ড. কামাল হোসেনের ইংরেজি। প্রসেসটা আরেকটু ডাইরেক্ট করলে হয় না?
১৯৭২ সালে আমাদের জাতীয় সংসদ ছিল না। গণপরিষদে বাজেট উত্থাপনের কথা নয়। তাই বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উপস্থাপিত হয়েছিল বেতার-টেলিভিশনে, পরে সংবাদ-সম্মেলনে যথারীতি এ-সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় তিনি এজন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন এবং আশা পোষণ করেছিলেন যে, এরপর থেকে জনপ্রতিনিধিদের সামনেই বাজেট পেশ করা হবে। সে আশা বাস্তবে রূপ নিয়েছিল।
১৯৭২ সালের বাজেট-বক্তৃতার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বিশেষ বিশেষ শিল্প ও বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। তাছাড়া ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় এবং তার আগে-পরে নানা দলের ইশতেহারে কিংবা নানারকম সম্মেলনের প্রস্তাবে ব্যাংক, বীমা, চা ও পাট শিল্প প্রভৃতি রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি ছিল। এ নিয়ে বড় একটা আপত্তিও শোনা যায়নি। কিন্তু ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে যখন প্রধান প্রধান শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত হলো, তখন ‘গেল গেল’ রব পড়ে গেল এবং এই ব্যবস্থাগ্রহণের মধ্যে ভারতের স্বার্থ বা ইঙ্গিত আবিষ্কৃত হলো। সমালোচনা প্রবল হয় বাঙালি মালিকানাধীন শিল্প অধিগ্রহণ করায়। কিন্তু ব্যাংক-ব্যবস্থা রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি পরিচালনাধীন ব্যাংক তার থেকে বাদ দেওয়া কিংবা পাটশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করলে বাঙালি মালিকানাধীন পাটশিল্প তার আয়ত্তের বাইরে রাখা তো সম্ভবপর ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান আমলের সরকারি উদ্যোগ এবং পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি–এক-চতুর্থাংশেরও কম ছিল বাঙালি উদ্যোক্তাদের সম্পদ। এসব কথা তখন আমরা আলোচনা করেছিলাম, সব যে বাজেট-বক্তৃতার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তা নয়।
আরো একটি কথা সেদিন আলোচনায় এসেছিল। সমালোচকদের একটি বক্তব্য ছিল এই যে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষ জনশক্তি সরকারের নেই। তাজউদ্দীন ও নূরুল ইসলাম উভয়েই মনে করতেন যে, বেসরকারি অবস্থায় প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষ ব্যক্তি যদি দেশে থেকে থাকেন, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করলে তাদের সাহায্যেই তা চালানো যেতে পারবে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে যদি বিদেশি বিশেষজ্ঞ আনাবার প্রয়োজন হয়, সরকারও তাহলে সে-কাজটি করতে পারে। এই নীতিই বাস্তবে অনুসৃত হয়েছিল। ফল হয়তো আশানুরূপ হয়নি। তার অনেক কারণও ছিল।
পরে শুনেছি, রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বিষয়ে মন্ত্রিসভায় মতানৈক্য ছিল, কিন্তু এটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অতএব পালনীয়, বঙ্গবন্ধুর এই যুক্তি খণ্ডন করা যায়নি। মুজিববাদ সম্পর্কে প্রশ্ন করায় বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রীয় চার নীতিতে বিশ্বাসী, আবার আলাদা করে বলেছিলেন, তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সমাজতন্ত্র বলতে তিনি ঠিক কী বুঝতেন, আমরা তা কখনো স্পষ্টভাবে জানতে পারিনি। তবে এক ধরনের সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন তিনি দেখতেন। শিল্প-বাণিজ্যের রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পাশাপাশি ভূমি সংস্কারের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১০০ বিঘা হবে জমির ব্যক্তিগত মালিকানার সীমা, খাসমহলের জমি ভূমিহীনদের বিতরণ করা হবে। এসবের কিছু কিছু কার্যকরতার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু জমির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মধ্য থেকেই বাধা ছিল অনেক বেশি, কেননা তার সংস্কার ঘটলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, তাঁদের মধ্যে ওই দলেরই লোকজন ছিলেন অধিক। তাই রাষ্ট্রায়ত্তকরণ শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে এবং তার পাশাপাশি বেসরকারি খাতে ছোটো ও মাঝারি ধরনের শিল্প বাণিজ্যের উদযোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। উৎসাহিত করার এই নীতির কথা প্রথম বাজেট-বক্তৃতায় ছিল।
এখানে একটি শোনা কথা বলি–কাগজপত্র যাচাই করে নিতে পারলে ভালো হতো। ১৯৭০-৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানের বাজেটে মাদ্রাসা শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রণীত ১৯৭১-৭২ সালের বাজেটে তা বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটের খসড়া প্রণয়নের সময়ে মাদ্রাসা শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ১৯৭০-৭১ সালের স্তরে ফিরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। পরে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, অব্যবহিত পূর্ববর্তী অর্থবছরের বরাদ্দের চেয়ে তা কমানো যাবে না। সুতরাং যথাপূর্বং তথাপরং।
বাজেট-বক্তৃতা-রচনায় সাহায্য করতে গিয়ে তখন একটি বিষয় উপলব্ধি করি। তা হলো, পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আমলাদের বিরোধ। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা কিংবা অনেক কর্মকর্তার সচিবের পদমর্যাদা এবং তাঁদের সার্বিক কর্তৃত্ব উচ্চপদস্থ বেসরকারি আমলাদের পছন্দ ছিল না। ভেতরে হয়তো আর কিছু ছিল। মহীউদ্দীন খান আলমগীর তখন সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক, তার শিক্ষক নূরুল ইসলাম আমার সামনেই তাকে বলেছিলেন, সিভিল সার্ভিস বনাম পরিকল্পনা কমিশনের অকারণ এই বিরোধ মীমাংসার জন্যে উদযোগ নিতে পারো না? তিনি তাদের সমিতির সভাপতি সৈয়দ আবুল খায়েরের সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনায় বসতে রাজি।
বাংলাদেশ সার্বিক সমস্যার মধ্য দিয়ে পথ চলছিল। বড় বড় সমস্যার মধ্যে কত ছোটো ছোটো সমস্যা লুকিয়ে থাকে, বাইরে থেকে তা বোঝা যায় না।
প্রথম বাজেট-বক্তৃতার কাজ শেষ হওয়ার পরে নূরুল ইসলাম আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার বাংলা ভাষ্য দেখে দেওয়ার। অবশ্য এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনই পুরো পরিকল্পনার বাংলা ভাষ্য তৈরি করে দেন। একাধিক হাতের রচনা হওয়ায় তাতে অল্পস্বল্প অসংগতি থেকে যায়। চট্টগ্রামে বসেই আমি পাণ্ডুলিপি দেখে দিই। খুব বেশি যে কিছু করেছিলাম, তা নয় সময়ও ছিল খুব সংকীর্ণ। তবু ওই দলিলের সঙ্গে আমার একটা সংযোগ ছিল, তা ভাবতে ভালো লাগে।
এখানে আরেকটি উদ্যোগের কথা বলে রাখি। বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম শাখার দুই কর্মী স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ব্যাংকের ফরম বাংলায় অনুবাদ করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। এজন্যে কোনো পারিশ্রমিক তারা পেতেন না। প্রতি রোববার তারা আমাকে তাদের অনুবাদ দিয়ে যেতেন, পরের রোববারে নিয়ে যেতেন। শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়-ক্যম্পাসে আসা-যাওয়ার জন্যে কেবল তারা অফিসের গাড়ি ব্যবহার করতে পারতেন। আমাকে যে-কোনো সম্মানী দেওয়া যাচ্ছে না, তা নিয়ে তাঁদের কুণ্ঠার অবধি ছিল না। তারা যে-মনোভাব থেকে কাজে নেমেছিলেন, সেই মনোভাব থেকে আমিও তাদের সহযোগিতা করেছিলাম। আমার পরামর্শ যদি তাঁদের কাজে লেগে থাকে, তবে তাদের কাছ থেকে আমিও কিছু শিখেছিলাম। তবে প্রকৃতই মুগ্ধ হয়েছিলাম তাদের নিষ্ঠায়।
১৬.
১৯৭২ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকায় অধ্যাপক এ এফ এম নূরুল ইসলামের ক্লিনিকে আমার পুত্রের জন্ম হয়। সবাই খুশি। ওর নাম আনন্দ রাখায় আমার আব্বা বেশ সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি কলকাতার সিটি স্কুলের ছাত্র ছিলেন, সেই সূত্রে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রথম সভাপতি এবং ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আনন্দমোহন বসুর প্রতি তাঁর প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। তিনি বললেন, র্যাংলারের নামে ওর নাম রেখেছ, বড় হয়ে বিদ্বান হবে। বিদ্যার প্রতি আনন্দের যে বিশেষ অনুরাগ হয়েছে, তা নয়, তবে ওর সব পরীক্ষার ফলাফল ভালো এবং এ-পর্যন্ত সে তিনটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছে–একটি বিদেশি। তবে তা নামমাহাত্মের ফল নয় নিশ্চয়।
১৭.
বাংলাদেশের জন্যে ১৯৭৩ সালের সূচনাটা ভালো হয়নি। ১ জানুয়ারি ঢাকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে, প্রাণহানি ঘটে।
যখন মনে হয়েছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে, প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হতে যাচ্ছে শান্তিপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, তখনই ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ বোমাবর্ষণ করে উত্তর ভিয়েতনামে। তারই প্রবল প্রতিবাদ হয়েছিল বাংলাদেশে। বাংলাদেশ সরকারও এই বোমা হামলার নিন্দা করেছিলেন। সবাইকে জানিয়েই বিক্ষোভ মিছিল আয়োজিত হয় ঢাকায়। তার নেতৃত্বে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-কর্মীরা। পুরানা পল্টনের দিক থেকে তোপখানা রোড ধরে মিছিল অগ্রসর হয়। প্রেস ক্লাবের উলটোদিকে ছিল ইউ এস আই এসের দপ্তর। বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল ছুঁড়েছিল সেই দপ্তর লক্ষ করে। তখনই পুলিশ গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন। বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র মীর্জা কাদের। আহত হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি আবুল কাসেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আমিরুল ইসলাম ও ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ফরিদ হোসেন, কোনো স্কুলের ছাত্র পরাগ, দৈনিক বাংলার আলোকচিত্রী রফিকুর রহমান এবং হয়তো আরো কয়েকজন। স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রথম গুলি চলল মিছিলে। আমরা হতবাক, বিমূঢ়। ঘটনাক্রমে আমি সেদিন ঢাকায়। দিভ্রান্তের মতো একবার অকুস্থলে যাই, একবার যাই কামাল হোসেনের বাড়িতে। কামাল শোকার্ত ও ক্ষুব্ধ। তিনিও বলতে পারেন না, গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিলেন। কেউ আমলাদের দোষ দেয়। কিন্তু আমলাদের এত সাহস হবে, তা বিশ্বাস হয় না। প্রধানমন্ত্রী নাকি জানতেন না। তাহলে অন্তত মন্ত্রী-পর্যায়ে কেউ না কেউ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা বা ম্যাজিস্ট্রেটকে।
গুলি চলে বারোটা-সাড়ে বারোটায়। সারা শহরের মানুষ বিক্ষুব্ধ। বিকেল নাগাদ দৈনিক বাংলা এই খবর দিয়ে বের করে টেলিগ্রাম। খবর, প্রতিক্রিয়া আর ছবি। সরকারি ভাষ্য তখনো পাওয়া যায়নি। পরদিনের সংবাদপত্রে তা বেরিয়েছিল। সেই গতানুগতিক ব্যাখ্যা। বিদেশি দূতাবাসের দপ্তর রক্ষা করতে, আক্রান্ত পুলিশ আত্মরক্ষা করতে নিরুপায় হয়ে গুলি ছুঁড়েছে। বঙ্গবন্ধু দুঃখ প্রকাশ করলেন, বিচারবিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দিলেন। কিন্তু তখনই যে তদন্তের ভার কোনো বিচারপতিকে দেওয়া হয়েছিল, এমন মনে পড়ে না।
প্রতিবাদে সি পি বি, ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন হরতাল আহ্বান করে ৩ জানুয়ারিতে। মওলানা ভাসানী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল নিন্দাজ্ঞাপন করেন। ৩ তারিখে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উলটোদিকের গোল চত্বরে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয় (ফলকটি এখনো আছে, অনাদরে ধুলো সঞ্চয় করেছে বছরের পর বছর ধরে; তবু আছে, এই যা)। শিল্পী-সাহিত্যিকদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদসভা আহ্বান করেন সুফিয়া কামাল, জসীমউদ্দীন, রণেশ দাশগুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, কামরুল হাসান, (স্থপতি) মাজহারুল ইসলাম, সরদার ফজলুল করিম, সজীদা খাতুন, জাহেদুর রহিম, সৈয়দ হাসান ইমাম, কায়সুল হক, আলী আকসাদ, আবদুল হালিম, বজলুর রহমান (আপসো), সাইফুদ্দৌলা (ছায়ানট), ইকরাম আহমদ (উদীচী), আরিফুল হক (আমরা কজন)। এঁদের আহ্বানে সমাবেশ হয়, মিছিল হয়।
প্রথমে মনে হয়েছিল, সরকার নিজের ভুল ধরতে পেরেছে। মন্ত্রীরা কেউ কেউ নিহতদের পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে গেলেন, দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি দিলেন। তারপরই সরকারদলীয় রাজনৈতিক নেতা, যুবনেতা, ছাত্রনেতাদের কণ্ঠে নিঃসৃত হলে কঠোর ভাষায় সাবধানবাণী। তারা জানালেন, বঙ্গবন্ধুর কুৎসা জাতি সহ্য করবে না, এই ঘটনাকে উপলক্ষ করে কাউকে ফায়দা লুঠ করার সুযোগ দেওয়া হবে না, চক্রান্ত বরদাশত করা হবে না। হাসান হাফিজুর রহমান তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক, তোয়াব খান তার নির্বাহী সম্পাদক। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা প্রশাসনযন্ত্রের ঘটানো ঘটনার নিন্দা করে টেলিগ্রাম বের করেছে, তা গণ্য হলো শোচনীয় বলে এবং তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গিয়ে পড়ল ওই দুজনের ওপরে। ৬ তারিখে উভয়েই দৈনিক বাংলা থেকে অপসৃত হলেন। নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী নিযুক্ত হলেন পত্রিকার সম্পাদক ও প্রশাসক। পত্রিকার সব বিভাগের কর্মীরা প্রতিবাদ করলেন, তাঁদের প্রতিনিধিরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ওই আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালেন। বঙ্গবন্ধু তাদের অনুরোধ বিবেচনার আশ্বাস দিলেন, কিন্তু হুকুম নড়ল না। তোয়াবকে নেওয়া হলো সরকারে আর খানিকটা দেরি করে হাসানকে পাঠানো হলো মস্কোতে, আমাদের দূতাবাসে প্রেস কাউনসেলর করে।
১৮.
সেই যে বিনা পরীক্ষায় পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নীত করে দেওয়া হলো। ছাত্রছাত্রীদের, তার ফল আমরা অচিরেই ভোগ করতে শুরু করলাম। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসেই ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে দাবি উঠলো সিলেবাস কমানোর। উঠবে নাই বা কেন? আগের ক্লাসের পড়া যে শেখেনি, পরীক্ষাগারে নির্ধারিত পরীক্ষা করেনি, পরের ক্লাসের পড়া কিংবা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষা তার কাছে তো দুরূহ মনে হবেই। এর প্রতিকার না-পড়া বিষয় জেনে নেওয়া নয়–সেই সময় ও সুযোগ কারো নেই–প্রতিকার আরো না-শেখা। অতএব, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করার আন্দোলন শুরু হলো। প্রথম-প্রথম কেউ গা করেননি এতে, কিন্তু দেখা গেল ছাত্রেরা না-শেখার পণ করেছে। মাস ছয়েক পরে ছাত্র হিতৈষী শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্থির করলো, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যসূচি অর্ধেক করে দেওয়া হবে। জয়ধ্বনি করতে করতে আন্দোলনকারী ছাত্রেরা ক্লাসে ফিরে গেল। ওদিকে গণপরীক্ষার ফলও সেবার হলো খুব সন্তোষজনক। অত উচ্চহারে পাশ এর আগে আর দেখা যায়নি, কারণ পরীক্ষার্থীরা বেশ স্বাধীনভাবে পরীক্ষা দিয়েছে।
১৯৭০ সালে একবার ডিগ্রি পরীক্ষা কেমন চলছে, তা দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে আমরা কজন শিক্ষক গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে। আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো হয়নি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে পরীক্ষার্থীরা আমাদের কাজকর্মে এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার শাহেদ লতিফের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এবারো ওই কাজে অভিজ্ঞতা ভালো হলো না। ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলার শিক্ষক আলী আসগর ভুইয়া যে-গল্প শুনিয়েছিলেন, তা-ই ছিল এবারকার সেরা সঞ্চয়। পরীক্ষার খাতায় যে-রচনা লিখেছে এক পরীক্ষার্থী–সম্ভবত সে পরীক্ষার্থিনী–তার শেষ বাক্য ছিল : তুমি লিখিয়া সুফিয়াকে দিবে। অর্থাৎ বাইরে থেকে যিনি নকল সরবরাহ করেছিলেন, তিনি। প্রচুরতম লোকের প্রভূততম হিতসাধনের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে সেই কাগজটি যাতে আরো একজন পায়, তার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম প্রাপক সেই নির্দেশ প্রেরিত রচনার অংশ বিবেচনা করে সেটাসুদ্ধ লিখে দিয়েছে। দ্বিতীয় গল্পটি ছিল এক পরীক্ষার্থীকে নিয়ে, যে পরীক্ষাগৃহ থেকে বেরিয়ে শৌচাগারে গেছে সেখানে রেখে-আসা বইপত্র দেখে আসতে। তত্ত্বাবধায়ক তা টের পেয়ে পিয়ন পাঠিয়েছেন তাকে ধরে আনতে। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে পিয়ন ফিরে এলো। তত্ত্বাবধায়ক তাকে দিয়ে এবারে বলে পাঠালেন, পরীক্ষার্থী বেরিয়ে না এলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ছেলেটি গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এলো : গোলমালে-গোলমালে সারা বছরটা কেটে গেল, এখন যে একটু পড়াশোনা করে পরীক্ষা দেবো–তারও উপায় নেই।
সকল শিক্ষক অবশ্য ওই তত্ত্বাবধায়কের মতো নিষ্ঠুর ছিলেন না। অনেকেই, ছাত্রদের ভাষায়, বেশ সহযোগিতা করেছেন পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে।
আমরা যখন অন্যের ঘর সামলাতে ব্যস্ত, তখন যে আগুন লেগেছে নিজের ঘরেই, তা বুঝতে একটু দেরি হয়েছিল। টের পেলাম যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রেরা দাবি করে বসলো, এম এ ফাইনালে তারা লিখিত পরীক্ষা দেবে না, মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তাদের ফল নির্ণয় করতে হবে। আমাদের শিরে বজ্রাঘাত। শিক্ষকেরা এ-দাবি মানবেন না, পরীক্ষার্থীরাও ছাড়বে না। আবেদন নিবেদন শেষ হলে শুরু হলো সংগ্রামের পালা। উপাচার্যের দপ্তরে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা পর্যবসিত হয় ঘেরাওয়ে। আমরা না-খেয়েদেয়ে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাই, ছাত্রেরা পালা করে খেয়েদেয়ে এসে আমাদের ঘেরাও করে রাখে, কটুকাটব্য করে, স্লোগান দেয়। একসময়ে তারা পাহারা উঠিয়ে নেয়। আবার আলোচনা, আবার ঘেরাও। উত্তাপ বাড়তে থাকে। শেষে উপাচার্য ইন্নাছ আলী নিজেই সিদ্ধান্ত নেন : লিখিত পরীক্ষা হবে, তবে সে-পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হবে না; যারা লিখিত পরীক্ষা দেবে না, তারা কেবল মৌখিক পরীক্ষা দেবে। অর্থাৎ কেউ লিখিত ও মৌখিক দুটো পরীক্ষা দিয়ে, আর কেউ শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে, এম এ ডিগ্রি অর্জন করবে। ডিপ্লোমায় কোনো পার্থক্য থাকবে না, তবে নম্বরপত্রী দেখলে তফাৎটা বোঝা যাবে।
আমি এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারলাম না। অমন পরীক্ষার সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখবো না বলে ছুটি নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে গেলাম। বিভাগের দায়িত্ব বর্তালো ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালের ওপরে। তিনিই অন্য সহকর্মীদের সাহায্যে পরীক্ষা নিলেন। বেশির ভাগই শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিলো। তার একটা কারণ, লিখিত পরীক্ষা না-দেওয়ার জন্যে পরীক্ষার্থীদের ওপর আন্দোলনকারীদের চাপ। একজন ভালো ছাত্র–তার অন্য গুণও ছিল–সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছিল। তার প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে আমি তার আনুকূল্য করতে পারিনি–করিনি বললেই ঠিক বলা হয়। সেজন্যে আমার মনে আজো দুঃখ আছে, কিন্তু আবারো ওই অবস্থায় পড়লে আমি ঠিক ওই আচরণই করতাম।
আমার কলকাতায় যাওয়ার আগে, ৭ মার্চ, দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আমাদের ভোটকেন্দ্র ক্যাম্পাসের সন্নিহিত এলাকায়। দুই গাড়ি করে আমরা একসঙ্গে ভোট দিতে গেলাম–উপাচার্য ইন্নাছ আলী, রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান, ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী আর আমি। স্বাধীন দেশে এই প্রথম ভোট দিতে যাচ্ছি–মনের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সে-উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। জানলাম, আমাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।
আমাদের এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। নিজের ভোটটা আমি তাকেই দিতাম। তিনি এমনিতেই জিততেন। তবে উৎসাহী রাজনৈতিক কর্মীরা সে-আশার ওপর ভর করে নিশ্চেষ্ট থাকতে চায়নি।
পরীক্ষা না দিয়ে পাশ করতে চাওয়া আর ভোট না দিতে দিয়ে নিজেদের প্রার্থীকে পাশ করাতে চাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য আমি দেখতে পাইনি।
এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৯৩টি। প্রায় দশটা আসনের ফলাফলের যথার্থতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল।
১৯.
শেষবার কলকাতায় এসেছিলাম শরণার্থী হিসেবে, এবার এলাম স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে। একটু গর্ববোধ তো ছিলই। আগের মতো এবারেও উঠলাম ছোটোফুপুর বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চান। বলি, সমস্যা পর্বতপ্রমাণ, মন্দ অনেক কিছু ঘটছে, কিন্তু ইতিবাচক ব্যাপারও যা হচ্ছে, তা থেকে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে।
১৯৭১-এ বেবী প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সে কোনো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে যাবে না। আমি একবার নাটক দেখতে গিয়েছিলাম, তাকে নিতে পারিনি। এবারে সে জানালো, সে নাটক দেখতে যাবে এবং আমাকে তখন ঘরে বসে বাচ্চাদের সামলাতে হবে। তাই হলো। একাদিক্রমে সে চারটি নাটক দেখে খুশি হয়ে ফিরেছিল : টিনের তলোয়ার, শের আফগান, পাগলা ঘোড়া, তিন পয়সার পালা।
এবার কলকাতা সফর ছিল পুনর্মিলনের আনন্দে পরিপূর্ণ, ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতাপ্রকাশের সুযোগ তাতে ছিল। আড়াই সপ্তাহ কলকাতায় আনন্দময় সময় কাটিয়ে যথাস্থানে ফিরে এলাম।
২০.
অধ্যাপক ড্যানিয়েল থরনার জাতিতে মার্কিন, কিন্তু সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন সোরবোনের ইকোল প্রাতিক দেজৎ ইতুদের দিরেক্তর দেতুদ। এই অর্থনীতিবিদ ছিলেন আমাদের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন ও ড. স্বদেশরঞ্জন বসুর বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি নূরুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানদের বাংলাদেশের বাইরে নিতে সাহায্য করেছিলেন, তাছাড়া নিজে প্যারিস থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের খোঁজখবর করতে। তখনই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। ১৯৭৩ সালে স্বদেশ বসু যখন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক, তখন তাঁর কাছে জানতে পারি, সে-বছরেই প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ওরিয়েন্টালিস্টের দ্বিশতবর্ষপূর্তি উদ্যাপিত হবে এবং ড্যানিয়েলের ইচ্ছা, আমি তাতে যোগ দিই। আমি এই প্রস্তাবে একটু অবাকই হই, তবে সাগ্রহে সম্মতি দিই। যথাসময়ে আমন্ত্রণপত্র এবং টিকিট এসে গেল এবং আমি ফরাসি জাতীয় দিবসে ঢাকা থেকে রওনা হলাম–তবে দিল্লিতে। সেখানে আমাদের হাই কমিশনার ড. এ আর মল্লিকের বাড়িতে একদিন থেকে যাত্রা করলাম বোম্বাইয়ে, সেখান থেকে। সোজা প্যারিস।
ঢাকা বিমানবন্দরে এসে দেখলাম, অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিচালক ড. এম এ গফুর সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে কংগ্রেসে যোগ দিতে যাচ্ছেন। বোম্বাইতে পেলাম ভারতীয় প্রতিনিধিদলের পশ্চিমবঙ্গীয় সদস্যদের ইতিহাসবিদ ড. বরুণ দে, ড. অনিরুদ্ধ রায়, ড. হিতেশরঞ্জন সান্যাল, ড. কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত এবং সাহিত্যিক ও তুলনামূলক সাহিত্যবিশারদ ড. নবনীতা দেবসেনকে। বিমানভ্রমণ আনন্দে কাটল। প্যারিসে আমাদের কারো থাকবার জায়গা নির্দিষ্ট নেই। কংগ্রেস-উপলক্ষে সারা দুনিয়া। থেকে লোক এসেছে–থাকার জায়গা সুলভ নয়। নগরটা অনিরুদ্ধের নখদর্পণে–সুতরাং সে-ই ভরসা। দুই ট্যাকসি করে বঙ্গসন্তানেরা জায়গা খুঁজতে বেরোলাম। অনিরুদ্ধ প্রথমে হবিবুল্লাহ্ ও গফুরের ব্যবস্থা করলো, তারপর অদূরে আমাদের দুজনের। হোটেলে ওঠার পর টের পাওয়া গেল, জায়গা পাওয়ার আনন্দে ট্যাকসি থেকে মালপত্র নামানো হলেও ডিউটি ফ্রি থেকে কেনা পানীয় নামানো হয়নি। বরুণ দে খুব আশায় ভর করে এখানে-ওখানে ফোন করলেন, কিন্তু অনিরুদ্ধ বলতে লাগলো, প্যারিসের ট্যাকসি-চালকেরা বেকুব নয় যে, অমন জিনিস সেধে ঘরে পৌঁছে দেবে।
কংগ্রেস যেখানে পরদিন শুরু হবে, সেখানে ড্যানিয়েলের দেখা পাওয়া গেল। তার হাতে হাতখানেক লম্বা একটা তার। ওটা দিয়ে কী করছেন, জানতে চাওয়ায় বললেন, তাঁর ইচ্ছে, কংগ্রেসের সেক্রেটারির গলায় ওই তার পেঁচিয়ে তাকে হত্যা করা। আমি বললাম, কংগ্রেস হয়ে যাওয়ার পর আমরা যে-যার বাড়ি চলে গেলে কাজটা করলে ভালো হয়। ড্যানিয়েল বললেন, যাক, তুমি অন্তত কাজটা ভালো হয় বললে। আমি বললাম, ওটা একটা কথার কথা–ভদ্রলোককে আমি চিনিই না, তার ভালোমন্দের কী জানি! ড্যানিয়েল বললেন, লোকটা আমার সঙ্গে প্রথম থেকে শত্রুতা করছে। যা হোক, তুমি কিন্তু একটা অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছ–প্রোগ্রাম দেখে নিও। আমি বললাম, সেকি! বাংলাদেশ থেকে সভাপতি চাইলে প্রফেসর হবিবুল্লাহকে করো–আমি নগণ্য লোক, আমাকে কেন? তিনি বললেন, ওই সেক্রেটারি ব্যাটার সঙ্গে ঝগড়া করে তোমাকে সভাপতি বানিয়েছি; এখন তুমি যদি দোনামনা করো, তাহলে এই তার তোমার গলায় পরাব।
এত বড় সম্মান তখন পর্যন্ত আমার ভাগ্যে জোটেনি। ওই অধিবেশনে অনিরুদ্ধ, হিতেশ আর কল্যাণ প্রবন্ধ পড়েছিলেন, অন্যান্য দেশ থেকে আরো তিনজন কৃতবিদ্য ব্যক্তি প্রবন্ধ পেশ করেছিলেন। প্রবন্ধপাঠের সময় বেঁধে দিয়েছিলাম কিন্তু পাবনা-বিদ্রোহ সম্বন্ধে লেখা পড়তে গিয়ে কল্যাণ সময় ঠিক রাখতে পারছিলেন না। আমি তাকে ইংরেজিতে বলি শেষ করতে, বাংলায় বলি পড়ে যেতে। কল্যাণ পরে বলেছিলেন, আমার সহৃদয়তায় তিনি কৃতার্থ হয়েছিলেন। আমার একেবারে সামনের বেঞ্চে ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব বসে ছিলেন। তিনি, মনে হয়, এই চালাকি ধরে ফেলে মৃদু মৃদু হাসছিলেন। প্রবন্ধপাঠে এত সময় চলে গেল যে, সভাপতির ভাষণ দেওয়ার সুযোগ আর রইল না। দু মিনিট ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে অধিবেশন শেষ করে দিলাম। যাদের খিদে পেয়েছিল, তারা আমার কাণ্ডজ্ঞানের প্রশংসা করলেন।
সম্মেলনের প্রথম দিনে এক সিঁড়ির মুখে দেখা হয়ে গিয়েছিল অধ্যাপক আহমদ হাসান দানীর সঙ্গে। তিনি তখন পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, পাকিস্তানের প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে এসেছেন সম্মেলনে যোগ দিতে। আমাকে দেখেই আমার নাম ধরে ডেকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর সানয়নে জানতে চাইলেন, মুনীরকে নাকি ওরা মেরে ফেলেছে? আমার জবাব শুনে অধোবদনে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের খোঁজখবর নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি যে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন, সে-বন্ধন বুঝি কাটেনি। বাংলাদেশের তিনি যে অকৃত্রিম বন্ধু, তা তাঁর কথায় ও ভঙ্গিতে স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছিল।
পরের দিন এসে পৌঁছোলেন নীহাররঞ্জন রায়–সোভিয়েত ইউনিয়নে কী একটা সভা ছিল, তা শেষ করে। বিমানবন্দর থেকে প্রায় সোজা এসেই তিনি অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে বসলেন। তাঁর প্রিয় ছাত্রী অমিতা রায়চৌধুরী সেখানে প্রবন্ধ পড়েছিলেন। কী অপূর্ব ভাষণ দিয়েছিলেন নীহাররঞ্জন–সকলেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিলাম।
অধিবেশনে যোগ দিয়ে কূল পাইনে। একসঙ্গে সাত-আটটা অধিবেশন চলছে কয়েকটা বাড়ি মিলিয়ে। অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি এসেছেন, যাদের কথা শোনার ইচ্ছে, তাদের সকলের কথা শোনাও সম্ভব হয়নি। ড. ফিলিওজার বক্তৃতা শুনতে চেয়েছিলাম–তিনি মূলত চিকিৎসক, ভারতীয় চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে কৌতূহল থেকে পরে ভারততত্ত্ববিদ হয়েছিলেন। তাঁর বক্তৃতা শোনা হয়নি, সে-দুঃখ তাঁকে জানাতে তিনি এমন সদাশয়তার সঙ্গে কথা বললেন যে, এবারে আমার কৃতার্থ হওয়ার পালা।
পশ্চিমবঙ্গীয়দের সঙ্গেই সময় কাটাই বেশি, তাই কেউ কেউ আমাকেও পশ্চিমবঙ্গীয় ঠাহর করলেন। আমাদের সঙ্গে প্রায়ই যোগ দেন কলকাতার প্রত্নতত্ত্ববিদ অমিতা রায়চৌধুরী, দিল্লির ইতিহাসবিদ রমিলা থাপার আর ভূগোলবিদ ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস-চান্সেলর মুনিস রাজা। মুনিস রাজার একটা ফুসফুস কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তাই চড়াইয়ে উঠতে তার কষ্ট হয়, একটুতেই হাঁপিয়ে পড়েন। আমার হাঁটার অভ্যাস কম, আমি ধীরে ধীরে হেঁটে তাঁকে সঙ্গ দিই।
অনিরুদ্ধের পরামর্শমতো নিজে নিজেই খানিক ঘুরে বেড়াই–লুভ দেখতে একাই গিয়েছিলাম। এসব জায়গায় দলেবলে গিয়ে লাভ নেই। সেখানে ভেনাস দ্য মিলো এবং মোনালিসাকে দেখার আকাঙ্ক্ষা বহুদিন মনে সঞ্চিত ছিল। টুরিস্টের মতোই দেখতে যাই ইফেল টাওয়ার, আর্ক দ্য ব্রায়াম্ফ, নেপোলিয়নের সমাধি। পিগেল এলাকাও ঘুরে আসি এক চক্কর। প্যারিস–বিশেষত রাতের আলোকিত প্যারিস-বড়ো সুন্দর লাগে। এক সকালে সদলে বেরিয়েছি–খবরের কাগজের হেডলাইন, আফগানিস্তানে বাদশাহ জহির শাহ ক্ষমতাচ্যুত। বরুণ বললেন, আশা করি, কাজটা আমাদের (অর্থাৎ ভারত সরকারের) নয়। তার খানিক পরই ফুটপাথে বসে কফিপানরত এক ভদ্রলোককে দেখে বরুণ তাঁকে সম্ভাষণ করলেন, প্রায় একই সঙ্গে তিনিও দরাজগলায় বরুণ এবং তাঁর সঙ্গীদের স্বাগত জানালেন। আমরা কফি খেতে বসে গেলাম। বরুণ পরিচয় করিয়ে দিলেন, ভদ্রলোকের নাম আনোয়ার আবদেল-মালেক, জাতে মিশরীয়, তখন তার বয়স পঞ্চাশ হবে। মিশরের জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল। জামাল আবদেল নাসের যখন বামপন্থীদের দমন করতে শুরু করেন, তখন তিনি পালিয়ে চলে আসেন প্যারিসে। সেখানে সি এন আর এস নামে পরিচিত প্যারিসের একটি বড় প্রতিষ্ঠানে তিনি গবেষণা-অধ্যাপক। পরে আনোয়ারের প্যারিসের অ্যার্টমেন্টে নাসেরের বাধানো ছবি দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি না নাসেরের দ্বারা নির্যাতিত? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, আমার প্রতি তিনি অন্যায় করেছেন, কিন্তু মিশরের জন্যে যা করেছেন, তার জন্যে তাঁর প্রতি সকল মিশরীয়ের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। আনোয়ার আবদেল-মালেকের সঙ্গে প্যারিসের ফুটপাথের কাফেতে সেদিন আমার বেশ ভাব হয়ে গেল এবং গত তিরিশ বছরে আমাদের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
আমরা দল বেঁধে চলি, প্রয়োজন হলে একটু আলাদা হই। যেমন, নবনীতা সাহায্য করেছিল একটা মুলিনেকস ফুড প্রসেসর এবং একটা সনি টেপরেকর্ডার কিনতে। টেপরেকর্ডারে তার কণ্ঠস্বরই প্রথমে ধারণ করা হয়েছিল। আবার, রাতে খাওয়ার জায়গা সাধারণত অনিরুদ্ধই বেছে দিত। প্যারিস ছাড়ার আগের রাতে স মিশেল অঞ্চলে এক রেস্তোরাঁয় খেয়েদেয়ে বেরিয়ে কিছুদূর আসার পর টের পেলাম, আমার মানিব্যাগ ফেলে এসেছি সেখানে। কেউ আমার সঙ্গে ফিরে যেতে রাজি হলো না–অনিরুদ্ধও নয়। নিজে নিজে খুঁজতে গিয়ে কেবলই ঘুরলাম অনর্থক, হোটেলে ফিরে আসতেও ঝামেলা হলো। পরদিন ফেরার পথে বিমানবন্দরে এসে জিনিসপত্র কেনা বাবদ যে-কর দিয়েছিলাম, তা ফেরত পেলাম। পথে প্লেনে একটু ঝাঁকুনি খেতে হলো। হিতেশ বললেন, গাড়োয়ান বড় এবড়ো-খেবড়ো পথ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে।
ইলেকট্রনিক জিনিস নিয়ে আসছি বলে ভারতীয় কাস্টমসের ভয়ে ছিলাম। প্লেনে বসে মুনিস রাজা বললেন, কোনো অসুবিধে হবে না। জানতে চাইলাম, কেমন করে বলছেন একথা? তিনি বললেন, দেখো, পরীক্ষার হলে গেলে আমরা যেমন বুঝতে পারি কে নকল করছে, কাস্টমসের লোকও তেমনি বুঝতে পারে কে স্মাগল করছে। তাঁর কথা ঠিক হয়েছিল। দিল্লিতে কাস্টমসের জিম্মায় জিনিসগুলো রাখতেও আমি তৈরি ছিলাম। ওঁরাই রাজি হলেন না। বললেন, যাওয়ার সময়ে এগুলো সংগ্রহ করতে আপনার অসুবিধে হতে পারে। আপনি সঙ্গে নিয়ে যান, তবে এগুলো দেশে নিয়ে যাবেন নিশ্চিতভাবে, এই অনুরোধ।
দিল্লিতে আবার মল্লিক-দম্পতির সহৃদয় আতিথ্যগ্রহণ। তারপর ঘরে ফেরা।
২১.
হঠাৎ করে আমন্ত্রণ পেলাম ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মস্কোতে অনুষ্ঠেয় বিশ্বশান্তি-তরঙ্গে (ওয়র্লড পিস ওয়েভ) যোগ দেওয়ার আর তার আগে বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় গণসংহতি পরিষদের দলভুক্ত হয়ে হাঙ্গেরি যাওয়ার। আমার পাসপোর্টে ভ্রমণযোগ্য দেশের তালিকায় হাঙ্গেরির নাম ছিল না। সেটা–এবং সেই সঙ্গে আরো কয়েকটি দেশের নাম-যুক্ত করে এরোফ্লোতের বিমানে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। সফরসঙ্গী বাংলাদেশ আপসোর সাধারণ সম্পাদক ডা. এ এইচ সাইদুর রহমান, ওই সংগঠনের ডা. সারোয়ার আলী, বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার বাদল রশীদ এম পি এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নিরোদ নাগ (তিনি এভাবেই নিজের নাম লিখতেন)-ছাত্রজীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি। সারোয়ার আলীকে তার বাল্যকাল থেকে জানি, সাইদুর রহমান অনেকদিনের পরিচিত; বাদল রশীদের সঙ্গে নতুন পরিচয়–দেখলাম, অতি সজ্জন মানুষ, দোষের মধ্যে এই যে, তার উচ্চারণে হাঙ্গেরি হাংরি হয়ে যায়।
তাসখন্দে যাত্রাবিরতির পরে মস্কো পৌঁছোলাম। বিমানবন্দরে খুব ভিড়। ইমিগ্রেশনের লোকজনের সঙ্গে একদল যাত্রী ঝগড়া করছে। যাত্রীদের মধ্যে এক-আধজন ইংরেজি জানে। তাদের কাছ থেকে জানলাম, ওরা এসেছে চিলি থেকে। সেখানে প্রেসিডেন্ট আয়েন্দে সদ্য নিহত হয়েছেন সামরিক অভ্যুত্থানে। এরা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। তাদের পাসপোর্ট আছে, ভিসা নেই। ভিসা ছাড়া ইমিগ্রেশন এদের ঢুকতে দেবে না সোভিয়েত ইউনিয়নে। এরা বলে, চিলিতে কী হচ্ছে, তা জানো না তোমরা? আমরা তো টুরিস্ট নই–রিফিউজি। ডাকো তোমাদের বড়ো কর্তাকে–সে কী বলে, শুনি। আমাদের ঢুকতে না দিলে চিলিতেই ফিরে যাবো মরতে, তার আগে সমাজতান্ত্রিক ভ্রাতৃত্ববোধের শেষটা দেখে যেতে চাই।
বিষয়টা নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই আমাদের ডাক এসে গেল। হেথ ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আমরা পথপ্রদর্শকের সাহায্যে হোটেলে এসে উঠলাম। সেখানেই চারটি খেয়ে ঘুম–কোথাও আর বের হইনি। মস্কোতে প্রচণ্ড ঠান্ডা।
পরদিন সাতসকালে দরজায় আঘাত। এক তরুণী কঠোর মূর্তি ধারণ করে আদেশ দিচ্ছে–এয়ারপোর্ট, এয়ারপোর্ট। বললাম, আমাদের প্লেন তো দুপুরবেলায়, এখন কেন বিমানবন্দরে যেতে হবে? তরুণী বিরক্তমুখে ‘নো ইংলিশ–এয়ারপোর্ট’ বলে আর কাউকে সাহায্য করতে অন্তর্হিত হয়ে গেল।
আমাদের সকলের টিকিটেই বুদাপেস্টের ফ্লাইটের সময় দেওয়া আছে দুপুরের। হয় এরোফ্লোতের ঢাকা অফিস ভুল সময় দিয়েছে, নয় আমাদের অভিভাবিকারা নিস্তার পেতে চাইছে আমাদের থেকে। যতদ্রুতসম্ভব তৈরি হয়ে লাউজে এসে বসলাম এবং তখনই আবিষ্কার করলাম যে, আমার হেল্থ সার্টিফিকেটটা পাওয়া যাচ্ছে না। রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে আরেকবার ঘরে খুঁজলাম, কোনো লাভ হলো না। নিচে নামতেই দেখি, এয়ারপোর্টের বাস রওনা দিচ্ছে। তাড়াতাড়ি তাতে উঠে পড়লাম। খানিক যাওয়ার পরে বোধোদয় হলো যে, ঘরে হেল্থ সার্টিফিকেট খুঁজতে গিয়ে এবারে ওভারকোটটাও ফেলে এসেছি–হয় ঘরে, নয়তো লাউজে। বাসের নিয়ন্ত্রককে বলে কিছু বোঝাতে পারলাম না।
মস্কো থেকে বুদাপেস্টে এলাম হাঙ্গেরির মালিভ এয়ারলাইনসে। আমাদের অঞ্চলে চলাচলকারী এরোফ্লোতের চেয়ে তা অনেকগুণে উন্নত। খাওয়া দাওয়া ও যাত্রীসেবাও ভালো। তবে হেল্থ কার্ড হারিয়ে আমার কিছুই ভালো লাগছিল না।
বুদাপেস্ট বিমানবন্দরে আমি একটাই যুক্তি দেখাই, গতকাল হেলথ সার্টিফিকেট দেখিয়েই তো মস্কোতে ঢুকেছিলাম–তোমরা মস্কো বিমানবন্দরে খোঁজ করলেই তার প্রমাণ পাবে। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। যারা আমাদের নিতে এসেছিলেন, তারাও বললেন, ও-কথায় কাজ হবে না। আর অবাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মস্কোর শীতে তুমি কোট ছাড়া বাইরে পা দিলে কী করে!
কয়েক মিনিটের মধ্যেই অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল এবং আমি তাতে বসে কোয়ারান্টাইনে চললাম।
২২.
কোয়ারান্টাইনে যেখানে আমাকে রাখা হলো, সেটি একটা লম্বামতো দালান। সেখানে একপ্রান্তের একটা ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেওয়া। হলো। ঘরের একপাশে কাঁচের জানলার মতো–খোলা যায় না, কিন্তু তা দিয়ে হাসপাতালের অপর প্রান্তের ঘরগুলো দেখা যায়। দরজার উলটো দিকের দেওয়ালে একটা ছোটো কাঠ লাগানো-বাইরে থেকে সেটা খুলে খাবারের ট্রে। তার মধ্য দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ছেলেবেলায় পশু-হাসপাতাল দেখেছিলাম–সেখানে কুকুরদের এমনি করে খাবার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
খানিক পরে ডাক্তার এলেন–ভিয়েতনামি, পরিষ্কার ইংরেজি বলেন। বললেন, তোমার বিষয়টা জেনেছি। কী করব বলো, তোমাকে আবার ইনজেকশন নিতে হবে, তাতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। দুদিন পরে তুমি ছাড়া পাবে। কিছু মনে কোরো না, একটা কথা জানতে চাই–হোটেলের বাইরে পা দিয়ে মস্কোর ঠাণ্ডায় তুমি কোটের অভাব অনুভব করোনি?
সন্ধে নাগাদ আমি অস্থির হয়ে উঠি। না আছে কিছু পড়ার, না আছে কিছু দেখার, না আছে কিছু শোনার, না আছে কথা বলার সুযোগ। সারোয়ার আলীকে চিরকুট পাঠাই, আমার আর কিছুই দেখার সাধ নেই–আমাকে ঢাকায় ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করো। সে আমার এমন অস্থিরতা বা ব্যাকুলতা আশা করেনি।
পরের দিন সকালে কাঁচের জানলায় টোকা। পাশের ঘরের বন্দি ইশারা দিচ্ছে, দাড়ি কামাবে, আমার কাছে আয়না আছে কি না?
আমি আয়না ধরলাম এ পাশে, ওপাশে সে দাড়ি কামাতে লাগলো। বললো, সে পেশায় অ্যাডভোকেট, রোমে থাকে। ইতালির দক্ষিণে কী মহামারী হচ্ছে, আর সেজন্যে তার মতো রোমবাসীকে ধরে এরা কোয়ারান্টাইনে পাঠিয়েছে। এদের ভূগোলজ্ঞান নেই, তারও বুদাপেস্টে পেশাগত দায়িত্বপালনের আর ইচ্ছে নেই। সে এখন রোমে ফিরে যেতে চায়। এই বলে সে জানতে চাইলো, আমি ইতালি গেছি কি না।
আমি যাইনি শুনে সে বললো, তাহলে আমার অতিথি হয়ে রোমে চলো। ইতালি ধ্বংস হওয়ার আগে দেশটা একবার দেখা উচিত।
জানতে চাইলাম, ইতালি ধ্বংস হবে কেন?
বললো, আমরা সবাই মিলে দেশটা ধ্বংস করতে খুব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
খানিক পরে ডাক্তার এলেন। বললেন, মস্কোর হোটেলের লাউজে তোমার কোট পাওয়া গেছে। আর তার পকেটে পাওয়া গেছে তোমার হেল্থ সার্টিফিকেট। সন্ধে নাগাদ ওগুলো বুদাপেস্টে পৌঁছে যাবে। এখন তুমি দুটো হেল্থ সার্টিফিকেটের মালিক–কাল সকালে আমাদেরটাও তৈরি হয়ে যাবে।
বুঝলাম, মস্কো বিমানবন্দরে জ্যাকেটের পকেট থেকে হেলথ কার্ড বের করে দেখিয়ে ভুলে সেটা ভরে ফেলেছিলাম ওভারকোটের পকেটে। সেখানে কিছু রাখি না বলে আর খোঁজ করিনি। নিজেকে ধিক্কার দিলাম।
এবারে বুদাপেস্টের আরামদায়ক হোটেলে।
বুদাপেস্ট শহরটি অতি মনোরম। দানিউব নদীর একধারে বুদা, অন্যতীরে পেস্ট। নদীর ওপরে বড়ো একটা সেতু দুটি অংশকে যুক্ত করে বুদাপেস্ট বানিয়েছে। একটা দিক পাহাড়ি, বিভিন্ন উচ্চতায় ঘরবাড়ির অবস্থান, আলোকিত হলে তা দেখতে খুব ভালো লাগে। অন্যদিকটা সমতল, তবু সেখানেও রয়েছে। অনেক দর্শনীয় বস্তু। এদের ইতিহাস পুরোনো–তারই ছাপ রয়েছে মধ্যযুগীয় দুর্গ ও গির্জা থেকে আধুনিককালের পার্লামেন্ট ভবনের নির্মাণে।
আমরা আপসোর নিমন্ত্রণে গেলেও প্রকৃতপক্ষে সরকারি অতিথি। যিনি আমাদের দেখাশোনার জন্যে নিযুক্ত, তিনি খুবই আন্তরিক। ইংরেজি অত ভালো বলেন না বলে একজন তরুণী দোভাষী রেখেছেন সঙ্গে। সে-মেয়েটি ইংরেজি ভালো জানে, প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও বলে না, হাসতেও চায় না। সে কর্তব্যবোধে চালিত, আত্মসম্মানরক্ষায় সদা-সতর্ক। দুপুরবেলায় আমরা একসঙ্গে খাই–আমাদের অভিভাবক, দোভাষী ও গাড়িচালকসহ। রাতে মেয়েটি কিছুতেই খাবে না আমাদের সঙ্গে, বাড়ি চলে যাবে। তার এহেন সংকল্পের কারণ জানতে আমি পীড়াপীড়ি করায় সে তিক্ততার সঙ্গে বলেছিল, তুমি কি ভাবো, এত ভালো খাবার সামর্থ্য আমার আছে? দিনের বেলায় নিরুপায় হয়ে তোমাদের সঙ্গে খাই, রাতে বরঞ্চ ঘরে গিয়ে যা থাকে, তা খেলেই ভালো লাগে। আমি বলি, মুখবদলের জন্যেও তো এক-আধদিন ভালো খাওয়া চলে। সে বলে, না, যা আমার সতত অপ্রাপনীয়, এক-আধদিনের জন্যে তা পেতে চাই না।
হোটেলে একটা রাজসিক খাওয়া খেয়েছিলাম–অন্য টেবিলে কাউকে তা খেতে দেখে জিনিসটার নাম জেনে নিয়ে পরদিন ফরমাশ করেছিলাম। এই খাবার পরিবেশনকারী অসিচালকের পোশাকে সজ্জিত হয়ে আসে। হাতে খোলা তলোয়ার–তাতে টুকরো টুকরো গোমাংস গাঁথা। টেবিলের কাছে এসে ফরমাশকারীর অনুমতি নিয়ে অল্প ওয়াইন ঢেলে দেয় ওপর থেকে। মাংসখণ্ডগুলো ভিজিয়ে দিয়ে ওয়াইন এসে জমা হয় তরবারির হাতলের কাছে একটা বাঁকানো জায়গায়। তারপর তার সহকারী দেশলাইয়ের একটা বড়ো কাঠি জ্বালিয়ে সেই বাঁকানো জায়গায় ধরে। মুহূর্তে ওই হাতল থেকে তরবারির অন্য প্রান্ত পর্যন্ত একটা অগ্নিশিখা জ্বলে উঠে মুহূর্তেই নিভে যায় খাবার ঘরের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর তলোয়ারটা উলটো করে ধরে পরিবেশনকারী। গোশতের টুকরোগুলো ঢেলে দেয় প্লেটে। খাবারটা খুব ভালো, ততোধিক ভালো তার পরিবেশনের কায়দা।
হাঙ্গেরি মদ-প্রস্তুতকারক দেশ। যেখানে ওয়াইন তৈরি হয়, সেখানে যাওয়া গেল। আঙুরভর্তি বড়ো বড়ো কাঠের গামলায় একেক দল সুসজ্জিত মেয়ে রবারের গাম-বুট পায়ে তালে-তালে আঙুর পিষছে। মনে হয়, তারা কাজ করছে না, নাচছে। এ-দৃশ্য বড়ো মনোহর। শেষ পর্যন্ত এই শ্রমের ফসল যা দাঁড়ায়, তাও সুস্বাদু।
বুদাপেস্টে যেখানেই কথাবার্তা বলতে যাই, সেখানেই টোস্টের+অর্থাৎ যার পারিভাষিক নাম আমরা দিয়েছি স্বাস্থ্যপান, তার ব্যবস্থা। যত অল্প পরিমাণই। হোক, সকাল দশটার সময়ে মদ্যপান পোষায় না। তবু সৌজন্যের খাতিরে পানপাত্র ঠোঁটে ছোঁয়াতে হয়। এরকম এক আলোচনার সময়ে আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা বললেন, হাঙ্গেরির এক নম্বর সমস্যা জনসংখ্যার হ্রাস। বিবাহবিচ্ছেদের হারে আমাদের জায়গা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। বিকেলে বিয়ে। হয়েছে, পরদিন সকালে ছাড়াছাড়ি, এমন আকছার ঘটে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পেয়ে নিশ্চল থাকলেও হতো, কমে যাওয়াতেই সমস্যা।
আমি বলি, জনসংখ্যার এই সমস্যার সমাধানে আমরা সাহায্য করতে পারি–বলো তো বাংলাদেশ থেকে তোক পাঠিয়ে দিই।
এক অ্যানিম্যাল-ফার্মে গেলাম। খামারে ঢুকে ওভারশু পরতে হলো। হাত ধুতে হলো ওষুধ দিয়ে, তারপর পরতে হলো গ্লাভস। মাথায় টুপি, নাকে মাস্ক বাঁধতে হলো। তবে শুয়োরশাবকদের সঙ্গে দেখা। বললাম, মানুষের বাচ্চা দেখতেও আমরা এত কষ্ট করি না।
আমাদের অভিভাবক জানতে চেয়েছিলেন, আমরা বিশেষ কিছু দেখতে চাই কি না। আমি বললাম, লেক বালাতন দেখতে চাই–তার তীরে এক স্বাস্থ্যনিবাসে আমাদের কবি একটি কাব্যের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। শুনে তিনি অবাক হন। খোঁজখবর নিয়ে বলেন, ওখানে এক ভারতীয় কবির স্মারক আছে–বাংলাদেশের কবির কথা তো কেউ জানে না। বলি, তিনি রবীন্দ্রনাথ, ভারতের কবি, আমাদেরও কবি, এই দুই দেশের জাতীয় সংগীতই তাঁর রচনা। শুনে তিনি আরো অবাক হন।
বালাতন হ্রদের তীরে যাই। রবীন্দ্রনাথ যে-বাড়িতে বসে লেখন কাব্যের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন–তার হাতের লেখা দিয়েই বইটি বেরিয়েছিল–সে বাড়ি দেখি। বাড়ির সামনে তিনি একটি গাছ লাগিয়েছিলেন–সেটি তখন বেশ বড়ো। সেখানে তাঁর একটি স্মারক আছে।
কবির কথায় আমাদের অভিভাবক বলেন হাঙ্গেরির জাতীয় কবি সান্দর পেতোফির (হাঙ্গেরীয়রা বলে পেতোফি সান্দর) কথা। তিনি শুধু কবি নন, ওদের জাতীয়তাবাদী চেতনার উদ্গাতা। ১৮৪৮ সালে হাঙ্গেরির বিপ্লবে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সান্দর তাঁদের একজন। কবি হিসেবে তিনি খুব উঁচুদরের–বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্ভারের মধ্যে গণ্য হয় তাঁর কাব্য। অথচ তাঁর কবিতা ও গান ওদেশে খুবই জনপ্রিয়। আশ্চর্য নয় যে, সান্দর বলতে পেরেছিলেন, জনপ্রিয় কবিতাই হলো আসল কবিতা। হাঙ্গেরির কাগুঁজে মুদ্রায় তার প্রতিকৃতি আছে। আমাদের অভিভাবক তাঁর মূর্তির কাছে নিয়ে যান আমাদের, তাঁর সুমুদ্রিত কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন, প্লাস্টার অফ প্যারিসে তৈরি তাঁর মুখাবয়ব দান করেন।
বালাতন হ্রদ থেকে ফেরার পথে আমি লেখন থেকে দু-চরণের একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছিলাম :
বিদেশে অচেনা ফুল পথিক কবিরে ডেকে কহে–
‘যে-দেশ আমার, কবি, সেই দেশ তোমারো কি নহে?’
এর একটা অক্ষম অনুবাদ করেছিলাম ইংরেজিতে। তা শুনেই ওঁরা বলেন, ভারি চমৎকার, এই উপলক্ষে খুবই মানানসই।
বিদায় নেওয়ার আগে আমাদের অভিভাবক, দোভাষী ও গাড়িচালককে আমরা সামান্য উপহার দিয়েছিলাম। অন্যেরা খুশি হয়ে তা নিয়েছিলেন, দোভাষী অস্বস্তির সঙ্গে। মনে হয়, কেবল অসৌজন্য হওয়ার ভয়ে সে তা নিতে অস্বীকার করতে পারেনি।
২৩.
বুদাপেস্ট থেকে মস্কোতে নির্বিঘ্নে ফেরা গেল। এবারে স্থান হলো হোটেল রসিয়ায়। হোটেলটি যেমন বিশাল, তেমনি মানসম্পন্ন। বিশ্ব শান্তি তরঙ্গের জন্যে ততদিনে নানা দেশ থেকে প্রতিনিধি এসে এখানে জড়ো হয়েছেন। আমাদের দেশ থেকে অনেকে গেছেন : আলী আকসাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, নীলিমা ইব্রাহিম, শেখ ফজলুল হক মনি, শামসুজ্জোহা, ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। আমরা হোটেলের যে-তলায় থাকি, তার দায়িত্বে যে-মহিলা, তিনি করিডোরের এক প্রান্তে চেয়ার ও ডেস্ক নিয়ে বসেন। আলী আকসাদ এক সকালবেলায় তাঁর কাছে গিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলেন, মাসিমা, জুতোর বুরুশ হবে?’ হাত দিয়ে ব্রাশ করার ভঙ্গি দেখে মহিলা সম্মতিসূচক ধ্বনি করে আকসাদকে একটা শু-ব্রাশ দেন। আকসাদ এবারে একটা হাতে গোলাকার ভঙ্গি করে বাংলায় জিজ্ঞেস করেন, ‘কালি হবে না?’ মহিলা মাথা নেড়ে কালি বের করে দেন। আকসাদ বলেন, ইংরেজি আমার ভাষা নয়, এ-মহিলাও তা ঠিকমতো বোঝে কি না সন্দেহ। কষ্ট করে ইংরেজি বলতে যাব কেন? ইশারা বুঝতে পারলে আমার বাংলা আর ওর রুশিতেই কাজ চলবে।’ খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস একদিন খুশি হয়ে এসে খবর দেন : রুশরা তাঁর মুজিববাদ বইটির ৫০ কপি কিনতে যাচ্ছে। আমি বলি, ইলিয়াস ভাই, আপনি যদি মার্কসবাদ সম্পর্কে লিখতেন, এরা হয়তো এক কপিও কিনতো না। এক রাতে পানাহার সেরে ফেরার পথে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী লিস্ট থেকে বেরোতে গিয়ে পড়ে যান মেঝেতে, নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর বিরক্তি চেপে রাখতে পারেন না–হ্যাঁলিম চৌধুরীর সঙ্গে তার ভাগ পান শামসুজ্জোহাও, কিছু না বলে তিনি কেবল চেয়ে থাকেন তিরস্কারকারীর দিকে। শেখ মণি আমার ছাত্র–তাই সরাসরি মশকরা করতে পারে না, অন্যকে ইশারা করে আমাকে একটু বেশি পানীয় ঢেলে দিতে, তবে রঙ্গ দেখার বাসনা তার পূরণ হয় না। আমরা টের পাই, আমাদের সবার মধ্যে শেখ মণিকেই বেশি খাতির করছে সোভিয়েত-কর্তৃপক্ষ। মস্কোর এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, তার ধারণা–এবং নিশ্চয় আরো অনেকের–যে, মণি আসলে কমিউনিস্ট এবং বাংলাদেশে যদি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে তার নেতৃত্বেই হবে। ঢাকায় রুশ দূতাবাসের অতি সজ্জন কাউনসেলরকে দেখি মণির সেবায় সদাব্যস্ত। মস্কোর নানাজন আসেন মণির সঙ্গে দেখা করতে-কাউনসেলর দোভাষীর কাজ করেন, হাবেভাবে মনে হয়, দর্শনপ্রার্থীরা সকলেই কমিউনিস্ট পার্টির বিশিষ্ট জন।
যে-সুদর্শন যুবাটি আমাদের কয়েকজনের দোভাষীর কাজ করতো, সে বোধহয় ইয়ং কমিউনিস্ট লিগের সদস্য ছিল। ছেলেটি বুদ্ধিমান, সপ্রতিভ, রসিক এবং সেবায় অকুণ্ঠ। তার যত পরিহাস ছিল, তা গ্রামবাসী, চাষাভুষো আর কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের নিয়ে। ঠিক আদর্শ কমিউনিস্টসুলভ ব্যাপার নয়, তবে খুব উপভোগ্য। ব্রেজনেভ সম্পর্কে সেই গল্পটা তার কাছেই প্রথম শুনিঃ ব্রেজনেভ নিজের বক্তৃতা সম্পর্কে মতামত চেয়েছেন পার্টির হোমরা-চোমরাদের কাছে। সবাই একবাক্যে প্রশংসা করছেন। ব্রেজনেভ বলেন, না, আমি মন-রাখা কথা শুনতে চাই না, সত্যি কথা শুনতে চাই। সকলে মুশকিলে পড়েন, কী বলবেন এখন! শেষে একজন সাহসে ভর দিয়ে বলেন, কমরেড, বক্তৃতা তো আপনার খুব ভালো হয়, তবে কিনা– –তবে কী?–তবে কিনা একটু লম্বা হয়ে যায়। তাহলে বক্তৃতা কতক্ষণের হওয়া উচিত? ব্রেজনেভের প্রতিক্রিয়ায়। লোকটির সাহস বেড়ে যায়, বলেন, বড়োজোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ব্রেজনেভ তার বক্তৃতা-লেখককে বলে দিলেন, বক্তৃতা যেন পঁয়তাল্লিশ মিনিটের চেয়ে বেশিক্ষণের না হয়।’তথাস্তু। এরপরের বার বক্তৃতা দেওয়ার পরে তিনি আবার জানতে চাইলেন, কেমন হয়েছে? সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো। শুধু সেই সাহসী লোকটি বললো, একটু বেশি লম্বা লম্বা? কতক্ষণ হয়েছে?–পাক্কা দেড় ঘণ্টা!–ডাকো বক্তৃতা-লেখককে। সে ঢোঁক গিলতে গিলতে বললো, হুজুর, আমি তো পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বক্তৃতাই লিখে দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি কার্বন-কপিসুদ্ধ পড়ে দিয়েছেন।
এক বিকেলে প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় ছাত্রদের সমাবেশ। রেক্টর স্ট্যানিস সভাপতিত্ব করবেন, ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ থেকে একজন করে বক্তৃতা দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হওয়ার অপরাধে বাংলাদেশ থেকে বক্তা নির্বাচিত হলাম আমি। পাকিস্তান থেকে নির্ধারিত বক্তা তাহেরা মজহার আলি। তিনি অসাধারণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি ছাত্রদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের ভূমিকা কী ছিল। বলেছিলেন, যারা পাকিস্তানে ছিল, তাদের অনেকের কাছেই বহির্বিশ্বের প্রচারমাধ্যম ছিল দুরধিগম্য, কিন্তু তোমরা যারা দেশের বাইরে ছিলে, তারা তো বাংলাদেশের বিভীষিকার খবর পেতে, তোমরা কি বিবেকের দংশন অনুভব করো নি? তোমরা কি যথেষ্ট প্রতিবাদ করেছিলে? নিজের নিজের পরিবারকে জানিয়েছিলে, কী হচ্ছে সেখানে? দেখো, আমি লাহোরে বিভিন্ন পার্টিতে সুশিক্ষিত সুসজ্জিত মহিলাদের বলতে শুনেছি, পূর্ব বাংলায় মেয়েদের ওপর যা হচ্ছে, তা ঠিকই হচ্ছে–ওতে বাঙালিদের রক্তশোধন হবে। এদেরকে শিক্ষিত বলতে, ভদ্রমহিলা বলতে, মানুষ বলতে আমার বাধে। তোমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে এসেছে–আশা করি, খালি ডিগ্রি অর্জন করতে নয়, মানুষ হতে, মানুষের প্রতি সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা নিতে। তা করতে কতটুকু সমর্থ হলে, সেটা বোঝা যাবে তোমাদের আচরণ থেকে।
প্যাট্রিস লুমুম্বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে পুলিশ আমাদের ট্যাকসি থামালো। ড্রাইভার চললো পুলিশের পিছু পিছু–কোথায়, কে জানে! দোভাষী বললো, পুলিশ এক রুবল নেবে ওর কাছ থেকে। এবারে আমার চমকাবার পালা। বললাম, বলো কী? তোমাদের দেশেও পুলিশ ঘুস খায়? আমার কথায় দোভাষী যে কতটা কৌতুকবোধ করেছে, তা তার হাসি থেকে বোঝা গেল। আমি কিন্তু বিষণ্ণ না হয়ে পারলাম না। সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে আমার ধারণা চিড় খেলো।
সম্মেলন আরম্ভ হতে হতে শুনলাম, সাখারভ একটি আবেদন প্রচার করেছেন, তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নে মানবাধিকার-প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়েছে। সাখারভ কৃতী বিজ্ঞানী, পরমাণুর শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্যে অনেক দিন ধরে অভিযান চালাচ্ছেন, কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার গণতন্ত্রীকরণের জন্যে দেশের ভেতরে থেকেই আন্দোলন করছেন। তখনই শোনা যাচ্ছিল, তিনি নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন–তবে তা বোধহয় পদার্থবিজ্ঞানে নয়, শান্তির ক্ষেত্রে। তাঁর এই আবেদনজ্ঞাপনের আশু লক্ষ ছিল যে আমাদের বিশ্ব শান্তি তরঙ্গ, তাতে সন্দেহ নেই। এর ফলে আয়োজকদের মধ্যে, বিশেষ করে সোভিয়েত কর্মকর্তাদের মধ্যে, কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলা বিশারদ গ্লাতুক দানিলচুককে জিজ্ঞেস করে কিছু জানতে পারলাম না–সাখারভ কিংবা সরকারি ভাবাদর্শের অন্য কোনো সমালোচকের প্রতি তার সহানুভূতি নেই। অন্যের কাছে শুনলাম, সাখারভ স্বগৃহেই আছেন, খানিকটা নজরবন্দির মতো, সেখান থেকেই বিবৃতিটা দিয়েছেন–মূলত বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে।
২৪.
বিশ্ব শান্তি তরঙ্গ-উপলক্ষে মস্কোতে আয়োজিত সম্মেলনে অনেকগুলো কমিশন গঠিত হয়েছিল এবং একাধিক কমিশন একসঙ্গে বসেছিল। আমি যে-কমিশনে ছিলাম, সেখানে সাখারভের উল্লেখ না করে তাঁর মূল বক্তব্যের প্রসঙ্গটা উঠেছিল পরোক্ষে। আমি বোধহয় বলেছিলাম, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমরা অস্ত্র নিয়ে ও না নিয়ে সংগ্রাম করেছি। তবে আমরাও জানি, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কতটা জরুরি। আবার শুধু জীবনধারণের উপকরণগুলো পেলেও মানুষের চলে না, তার রাজনৈতিক অধিকারগুলোও পূরণ হওয়া চাই। এসবের মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটা দরকার। আমার বক্তব্যে আমাদেরই কেউ কেউ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন–কেন আমি জোরালোভাবে সমাজতন্ত্র-বিরোধীদের আক্রমণ করলাম না। তবে, সৌজন্যের খাতিরে কি না জানি না, অন্তত দুই সোভিয়েত কর্মকর্তা আমার কাছে প্রশংসাসূচক কিছু বলেছিলেন আমাকে বিস্মিত করেই।
আমার সঙ্গে এই কমিশনে যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহাশূন্যে প্রথম মহিলা ভালেনতিনা তেরেশকোভা। আমি কখনো কারো স্বাক্ষর যাচনা করিনি, এবারে করলাম আমার ছেলেমেয়েদের জন্যে তাঁর স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে ইচ্ছে হলো। ভদ্রমহিলা ইংরেজি জানেন না, কিন্তু আমি কী চাই, তা সহজেই বুঝলেন এবং নির্দ্বিধায় দান করলেন।
এসব সম্মেলনে যেমন হয়, এক সময়ে উৎসাহে ভাটা পড়ে, ক্লান্তিবোধ হয়, এবং একাকী বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে হয়। ঠিক তখনই সারোয়ার আলী জানালো, যে-অধিবেশনটা আমি ফাঁকি দেবো ভেবেছিলাম, তাতে ব্রেজনেভের বক্তৃতা দেওয়ার সম্ভাবনা। সত্যিই সে-অধিবেশনে ব্রেজনেভ এলেন এবং বক্তৃতা দিলেন। তার বক্তৃতায় মনোমুগ্ধকর কিছু ছিল না, বরঞ্চ সেই তুলনায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্রের বক্তৃতা ছিল অনেক চিত্তাকর্ষক, তবু পৃথিবীর দুই মহাশক্তিধরের একজনের ভাষণ সামনাসামনি শোনার একটা রোমাঞ্চ ছিল বই কী!
সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তান থেকে কিছু পরিচিত মুখ এসেছিলেন–তাহেরা মাজহার ছাড়া এখন মনে করতে পারছি শুধু সুচিত্রা মিত্রের কথা। চিত্ত বিশ্বাসের সঙ্গে সেখানেই প্রথম আলাপ হয়েছিল।
মস্কোতে তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত খান শামসুর রহমান। তার সঙ্গে আলাপ হলেও গল্পসল্প হয়নি। আমাদের ইকনমিক মিনিস্টার গোলাম কিবরিয়া একদিন হোটেলে এলেন–আমার ঘরে এ জি স্টকের মেমোয়ার্স অফ ঢাকা ইউনিভার্সিটি বইটা দেখে তিনি আগ্রহান্বিত হওয়ায় সেটা তাঁকে উপহার দিলাম। মস্কোতে আমাদের এডুকেশন কাউনসেলর আবদুলাহ আল-মুতী এবং প্রেস কাউনসেলর হাসান হাফিজুর রহমান। দুজনে একই বাড়ির দুই ফ্ল্যাটে থাকেন। আলাদা করে দুজনের বাড়িই যেতে হলো। আমার আগ্রহাতিশয্যে সম্মেলনের উদ্যযাক্তাদের একজন আমার জন্যে বলশয় থিয়েটারের অতি দুষ্প্রাপ্য টিকিট। জোগাড় করেছিলেন। যে-সন্ধ্যায় বলশয়ে যাওয়ার কথা, সেই সন্ধ্যায় হাসান। তার ঘরে আমন্ত্রণ জানালেন। আমি যখন বললাম, বলশয় থিয়েটারে যাবো, হাসান জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে আমার চেয়ে বলশয় বড়ো হলো? এ প্রশ্নের পরে আর বলশয়ে যাওয়া যায় না।
হাসানের সঙ্গে বেরিয়ে মস্কোর এক শুল্কমুক্ত বিপণিতে গিয়েছিলাম। সেখানে তা ডলার শপ নামে পরিচিত–বিদেশিরাই সেখান থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারে মার্কিন ডলার বা পাউন্ড স্টার্লিং দিয়ে। আমি একটা টাই কিনেছিলাম। দোকানের বাইরে দু-একজন কাঁচের দরজা দিয়ে ঔৎসুক্যভরে জিনিসপত্র দেখছে। হাসান বললেন, ‘ওরা লুব্ধদৃষ্টিতে জিনিস দেখছে, আর আমাদের দেখছে ঘৃণার চোখে। জানতে চাই, ঘৃণার দৃষ্টিতে কেন? জবাব পাই, ওদের দেশে যে-দোকানে ওদের প্রবেশের অধিকার নেই, শুধু ডলারের জোরে সেখানে ঢুকে আমরা কেনাকাটা করছি–ওরা ঘৃণা করবে না কেন?
এখানে অতি আধুনিক আরামদায়ক চায়কা গাড়ি চড়েন রাষ্ট্র ও পার্টির আমলারা। সেসব গাড়ি যখন পথ দিয়ে যায়, তখন যে-দৃষ্টিতে সাধারণ লোক সেদিকে তাকায়, শুনতে পাই, তাও প্রসন্নতার নয়।
মস্কোয় যা দর্শনীয়, তার কিছু কিছু দেখা হলো। ক্রেমলিন শ্রদ্ধার উদ্রেক করে। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির স্থাপত্যকর্ম আকর্ষণীয়–ওই নকশার মোট চারটি ভবন আছে মস্কোয়। লেনিনের শব যেখানে রাখা রয়েছে, সেখানে বহু মানুষের সুশৃঙখল উপস্থিতি এবং নীরব শ্রদ্ধানিবেদন আপ্লুত করার মতো। লেনিনের মরদেহ যে এতদিন ধরে রেখে দেওয়া সম্ভবপর হয়েছে, তার কৃতিত্ব দাবি করেন সমাজতন্ত্রী বিজ্ঞানীরা। নাৎসি সৈন্যেরা মস্কোর উপকণ্ঠে পৌঁছে, যে-জায়গায় প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পর্যদস্ত হয়, সেখানে খুব সরল একটি স্মারক আছে–দুটি কাঠ কোনাকুনি করে রেখে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার প্রতীক–সেখানে গিয়ে মাতৃভূমি-রক্ষার জন্যে অসংখ্য মানুষের আত্মাহুতির কথা আপনা থেকেই মনে জাগে।
দোকানপাটও কিছু ঘুরলাম। একটি বিশাল দোকান আছে–সেখানে বাচ্চাদের সবরকম জিনিস বিক্রি হয়। সেখান থেকে সেই বিখ্যাত রুশ পুতুল কিনলাম–একটার মধ্যে আরেকটা, এই করে মোট বারোটা। আরো একটি বিশাল ডিপার্টমেন্টাল স্টোর–অনেক জিনিসেরই চাকচিক্য কম, তার পাশ্চাত্য রকমফেরের তুলনায়, কিন্তু দামও অবিশ্বাস্যরকম কম। মস্কোর রাস্তা দিয়ে বড়ো বড়ো ট্রাক-ভ্যানে বাড়িঘরের প্রি-ফ্যাবরিকেটেড অংশসব নিয়ে যেতে দেখলাম একাধিক দিন। শহরতলিতে কোথাও আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে–এসব জুড়ে অল্পসময়ে বাড়ি তৈরি হয়ে যাবে। মস্কোর মেট্টো চড়লাম–তখন লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড বা প্যারিসের মেট্রোর চেয়ে মস্কোর পাতালরেল ও তার। স্টেশনগুলো বেশি পরিষ্কার ও সুন্দর।
আমাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হলো লেনিনগ্রাদে। মস্কো থেকে রাতের ট্রেন, ঘুমিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। দোভাষী যুবকটি আর ওই ট্রেনের টিকিট পেলো না। সে বললো, পরের ট্রেনে আসছি–আপনারা রেলগাড়ি থেমে নেমে প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমি খুঁজে নেবো আপনাদের, পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না। সত্যি তাই হলো। মস্কো ও লেনিনগ্রাদের মধ্যে এত সহজে যাতায়াত করা যায়, এত ঘনঘন ট্রেন যায় দিনরাত্রি এবং তা খুবই সময়মতো পৌঁছোয়–তাতে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। আমার প্রশংসার কথা শুনে স্মিতহাসি হেসে আবদুল্লাহ আল-মুতী বলেছিলেন, তবে মস্কো থেকে লেনিনগ্রাদে চিঠি পৌঁছতে পাঁচ দিন লাগে। আমি আবারো বিস্মিত হই।
লেনিনগ্রাদে প্রথম দেখলাম আর্মিতাজ। এককালে সেটা ছিল রাজপ্রাসাদ, এখন চিত্রশালা। জার আমলের সংগ্রহ বেশি, পরে কিছু যোগ করা হয়েছে–তাতে সোভিয়েত শিল্পীদের কাজের প্রাধান্য। ইমপ্রেশনিস্টদের এত ছবি সেখানে সযত্নে রক্ষিত, আমার তা জানা ছিল না। সংগ্রহ দেখে শেষ করা যায় না, হাতে সময় কম, তাই সবটা দেখার আশা ছাড়তে হলো।
রাতে গেলাম নাটক দেখতে। ব্যঙ্গরসাত্মক কমেডি। দর্শকেরা বেশ উপভোগ করছে, বোঝা গেল। আমার কাছে তেমন ভালো লাগেনি। মনে হলো, কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে র্যাবলের কালে ফিরে গেছি। সেকালের রচনার পুনরভিনয় হলে ক্ষতি ছিল না, কিন্তু এটি প্রায় সমকালীন রচনা, তার মধ্যে নতুন কোনো উদ্ভাবন নেই।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নিহতদের সমাধিস্থল অতি যত্ন করে, সুন্দর করে রাখা। একদিকে লাল ফৌজের সদস্যদের কবর, অন্যদিকে বেসামরিক লোকজনের। যুদ্ধের অপূরণীয় ক্ষতির একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সুসজ্জিত সেনাদল নিহতদের শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছে সামরিক কায়দায়, বেসামরিক পোশাকেও আসছে অনেকে। একটি শিশু বা কিশোরের সমাধির ওপরে দুটো চকোলেট-বার আর একটি লাল গোলাপ রেখে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে–দু-চোখ বয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কত বছর হলো যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তার ক্ষত এখনো বহন করে চলেছেন তিনি। তা দেখে আমার অন্তর থেকে উচ্চকিত হলো একটি প্রার্থনা : আমার সন্তানের মাথায় যেন এমনি করে বোমা না পড়ে কখনো।
দেশে ফেরার সময়ে মস্কো থেকে তিবলিসির পথে এরোফ্লোতের বিমান পড়ল মহা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায়। ক্রমাগত ডাইনে-বায়ে ওপর-নিচে করতে লাগলো, উলটে যায়-যায় অবস্থা। আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। এমনকী, কেবিন-ত্রুদের মুখেও আশ্বাসের কোনো লেশ ছিল না। শুধু সারোয়ার আলী বললো, ভয় পাবেন না। এই ফ্লাইটে এদের জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়রা যাচ্ছে। পাইলট জানে, তাদের কিছু হলে ওকে ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠাবে কর্তৃপক্ষ। যেমন করেই হোক ও যাত্রীদের প্রাণ বাঁচাবে।’
মৃত্যুভয়ের মধ্যেও যে হাসা সম্ভবপর, তা সেদিনই প্রথম জানলাম।
২৫.
১৯৭২ সালেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক এবং রসায়ন বিভাগের অধ্যক্ষ সৈয়দ জহির হায়দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলেন। তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হলেন যথাক্রমে ড. এখলাসউদ্দীন আহমদ ও ড. শামসুদ্দীন আহমদ। অর্থনীতি বিভাগের অধ্যক্ষ এস এম আতহার অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে গেলেন, তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে সদ্য প্রত্যাগত ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কিছুকাল পরে উপাচার্য ইন্নাছ আলীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে নিজের পদে ফিরে গেলেন। চট্টগ্রামে তাঁর ভালো লাগছিল না, এখানকার দু-একটি ঘটনায় তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন–যদিও তাঁর সঙ্গে কেউ অসদাচরণ করেনি। উপাচার্যের পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে তাঁকে রীতিমতো চেষ্টা করতে হয়েছিল। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন অধ্যাপক আবুল ফজল।
আমি অধ্যাপকপদে নিযুক্তিলাভ করায় রিডারের পদটি শূন্য হলো। সে জায়গায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে আনবার কথা ভাবলাম। একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকনিয়োগ সংক্রান্ত কাজে গিয়ে দেখে এসেছিলাম, তিনি ভালো নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং রাজশাহী বেতারকেন্দ্র থেকে তাঁকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কথিকা নিয়মিত প্রচার করায়। আবু হেনার ক্ষুরধার জিহ্বাগ্র থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে-বাক্যধারা নির্গলিত হতো, তাতে অনেকের ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ ঘটতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে আনলেন পাকিস্তানের হয়ে দালালির অভিযোগ। উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি, ফলে আবু হেনার প্রতিপক্ষ অন্যত্র অভিযোগ করে ফল পাওয়ার চেষ্টা করলেন। আবু হেনার জন্যে সমস্ত পরিবেশটি খুব অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছিল। তার সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝলাম যে, চট্টগ্রামে আসতে তাঁর বাধা নেই। আমি পদটি বিজ্ঞাপিত করার ব্যবস্থা করলাম। ঠিক এমনি সময়ে তিনি গ্রেপ্তার হলেন। রাজশাহীতে অধ্যাপক সারওয়ার মুরশিদের এবং ঢাকায় আবু হেনার ভগ্নিপতি, বঙ্গবন্ধুর অশেষ আস্থাভাজন, বিশিষ্ট সাংবাদিক কে জি মুস্তাফার চেষ্টায় আবু হেনা ছাড়া পেলেন। আমি তাঁকে আবেদনপত্র পাঠালাম, তিনি যথারীতি আবেদন করলেন। সাক্ষাৎকারের দিনে আমি নিজে বিমানবন্দর থেকে তাঁকে নিয়ে এলাম এবং সাক্ষাৎকার-শেষে আবার ওই পর্যন্ত তাকে পৌঁছে দিলাম। আরো একজন প্রার্থী ছিলেন বটে, কিন্তু আবু হেনার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকৃতপক্ষে কেউ ছিলেন না। আবু হেনার আশঙ্কা ছিল, নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য ড. মুহম্মদ এনামুল হক কোনো কারণে হয়তো তার নিয়োগের বিরোধিতা। করবেন। এনামুল হক তা করেন নি–হয়তো উপাচার্য ও আমার আগ্রহের কথা জেনে। তবে নির্বাচকমণ্ডলীর সভায় আমার দিকে তাকিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আবু হেনার যোগ্যতার বিষয়ে তো সন্দেহ নেই, তবে কোথাও সে বেশিদিন থাকতে পারে না। তুমি তাকে আনতে চাও, আনো, কিন্তু কিছুদিন পরে সে হয়তো আবার এখান থেকে ঢাকায় যেতে ব্যগ্র হয়ে উঠবে। সর্বসম্মতিক্রমেই আবু হেনাকে নিয়োগদানের সুপারিশ করা হয়ে গেল। তবে আমার সহকর্মীদের মধ্যে যারা কর্মে জ্যেষ্ঠ, তাঁদের কেউ কেউ যে এতে খুশি হননি, সে কথা আমি পরে বুঝেছিলাম। আর ঢাকা ও রাজশাহীতে যারা আবু হেনার প্রতি বিরূপ ছিলেন, চট্টগ্রামে তাঁর নিয়োগে তারাও আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
আমি নিজের মতো করে বিভাগ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। অধ্যক্ষ হয়েই আমি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাতে কারো কারো পক্ষে অসুখী হওয়ার কারণ ঘটেছিল। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরদিন আমাদের ছাত্রপ্রতিম একজন অ্যাডহক নিয়োগ নিয়ে লেকচারার পদে যোগ দেয়। তার চাকরি যাতে পাকা হয়, তা দেখতে আমাদের এক সহকর্মী। অনুরোধ করলো আমাকে। আমি বললাম, এমন যুদ্ধের মধ্যে যে-চাকরিতে যোগ দেয়, তার বিবেচনাশক্তির ওপরে আমার আস্থা নেই। পদ বিজ্ঞাপিত হবে, তাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আসতে হবে। আমি তার প্রার্থিতা সমর্থন করবো, এমন আশ্বাস না পেয়ে সে বিভাগে আসা বন্ধ করে দেয় এবং পরে ওই পদ বিজ্ঞাপিত হলে সে আবেদনও করেনি। ১৯৭০ সালের এম এ পরীক্ষায় ছ জন প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল–তার মধ্যে মাহবুবুল হক ছিল একজন। আমি তাকে আবেদন করতে বলেছিলাম। তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে তখন আগ্রহী হয়নি। তার সঙ্গে প্রথম শ্রেণি পাওয়া। আরেকজন ছিল শিপ্রা রক্ষিত–সে গহিরা কলেজে শিক্ষকতা করছিল। সে আবেদন করে এবং নিয়োগলাভ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভাগের গবেষণা-সহায়ক মাহবুব তালুকদার বাংলাদেশ সরকারের কর্মে যোগ দিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সে আর চট্টগ্রামে ফিরে আসেনি–ঢাকায় সরকারি চাকরিতে স্থায়ী হয়েছিল। এতে আমাদের বিভাগের পিয়ন আলম মন্তব্য করেছিল যে, মাহবুব সার খুব চালাক–ঢাকায় সরকারি চাকরি পেয়েছে; আমাদের সার (অর্থাৎ আমি) চালাক নয়–আগের চাকরিতেই চট্টগ্রামে ফিরে এসেছে। মাহবুবের শূন্যপদে নিয়েছিলাম খায়রুল বশরকে-রশীদ আল ফারুকী ছদ্মনামে তার তখন দুটি বই বেরিয়েছে। পরে সে লেকচারার পদে উন্নীত হওয়ায় গবেষণা-সহায়ক পদে ভূঁইয়া ইকবাল যোগ দেয়।
১৯৭২ সালে ঢাকায় ঘন ঘন আসতে হওয়ায় এ এফ রহমান হলের প্রোভোস্ট হিসেবে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারিনি। আবহাওয়াজনিত কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের ফ্লাইট বাতিল হওয়ার ফলে যেদিন হল ছাত্র-সংসদের অভিষেক-অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারলাম না, সেদিন আমার খুবই খারাপ লেগেছিল। যদিও আমি ওই পদ ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আমাকে ছাড়তে চাননি ইন্নাছ আলী। ১৯৭২ সালের শেষদিকে প্রোভোস্ট হিসেবে আমার দু-বছরের কার্যকাল শেষ হওয়ার আগে উপাচার্যকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম আমার নিয়োগের মেয়াদ বৃদ্ধি না করতে। উপাচার্য সে অনুরোধ রেখেছিলেন।
২৬.
এপ্রিলের শেষে বাংলাদেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু আঁদ্রে মালরো ঢাকায় এলেন। মালরো বিশিষ্ট সাহিত্যিক, দু-দুবার মন্ত্রী হয়েছেন ফ্রান্সে। তিনি সংস্কৃতিমন্ত্রী থাকতে প্যারিসের সব ঘরবাড়ির বাহ্যরূপটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তা সত্যি বাহ্য। বিশের দশকে তিনি চীনের বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িত করেছিলেন, তিরিশের দশকে আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দিয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষে লড়াই করেছেন, চল্লিশের দশকে মাতৃভূমি রক্ষায় যুদ্ধ করেছেন হিটলারের জার্মানির বিরুদ্ধে। চীনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন, স্পেনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি, জার্মান কমিউনিস্টদের নাৎসি-প্রতিরোধ নিয়ে আরেকটি। তিনি এসব বিষয়কে বিশেষ বিশেষ দেশের রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে অতটা দেখেননি, যতটা দেখেছেন ভাগ্যের সঙ্গে মানুষের প্রতিনিয়ত সংগ্রামের অধ্যায়রূপে। শিল্প সম্পর্কে তাঁর লেখায়ও দেখা যায়, শিল্পকলাকে তিনি দেখছেন মহতের পথে মানুষের যাত্রা বলে। তাঁর স্মৃতিকথাও অসাধারণ রচনা বলে স্বীকৃত।
এহেন মালরো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘোষণা করেছিলেন, স্পেনের গৃহযুদ্ধকালের মতো আবার আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবীরূপে তিনি লড়তে চান আমাদের হয়ে। তখন তাঁর বয়স ৭০। তার এই ঘোষণা বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগিয়েছিল। সেই কথা মনে রেখেই বাংলাদেশ সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল এই সফরে। বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভের পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ-বিষয়ে উপাচার্য খান সারওয়ার মুরশিদের উদ্যোগ ছিল প্রধান। মালরো এ সম্মান স্বীকার করতে সম্মত হন। এবারের সফরের একটি উদ্দেশ্য ছিল তা গ্রহণ করা। বাংলাদেশে মালরোর অবস্থানকালে তার সার্বক্ষণিক সহচর ছিলেন মাহমুদ শাহ্ কোরেশী।
রাষ্ট্রীয় অতিথি-ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেন তাকে নৈশভোজে আপ্যায়িত করেন। তাতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন লেখক-শিল্পী। জসীমউদ্দীন ছিলেন আমাদের নেতৃস্থানীয়। নৈশভোজের আগে মালরোর সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। তখন মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠল, সেইসঙ্গে এ দেশের সাহিত্য-শিল্পের প্রসঙ্গ এবং অনিবার্যভাবে রবীন্দ্রনাথের বিষয়। উল্লেখযোগ্য যে, রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিক উদ্যাপনের জন্যে গঠিত ফরাসি জাতীয় সমিতির সভাপতি ছিলেন মালরো। ঢাকায় সে-সন্ধ্যায় মালরো বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির আঁদ্রে জিদকৃত ফরাসি অনুবাদ পড়ে তিনি চমৎকৃত হয়েছিলেন বটে, তবে রবীন্দ্রনাথের যে-রচনাটি তাকে সত্যি সত্যি নাড়া দিয়েছিল, তা ঘরে-বাইরে। মালরো ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসটির নাম বলেন দি হোম অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড। অনেকে সেটা ধরতে পারেননি, জসীমউদদীন আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চান, কোন উপন্যাসের কথা বলছেন মালরো। বলি, ঘরে-বাইরে। মালরোর প্রশংসায় আমি একটু বিস্মিত হই। এর আগে পৃথীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের ফরাসীদের চোখে রবীন্দ্রনাথ (কলকাতা, ১৯৬৩) বইতে ঘরে-বাইরে সম্পর্কে লুই জিলের আলোচনা পড়েছিলাম। তাতে উপন্যাসটির প্রশংসা ছিল না, সৌজন্যস্বরূপ যতটা বলতে হয়, তার অবশ্য অভাব হয়নি। কিন্তু মালরো, দেখলাম, বলছেন, আধুনিক জীবন ও রাজনীতির যে-সংকটের কথা আছে ওই উপন্যাসে, যৌবনকালে তাঁর মনে হয়েছিল, তা সর্বজনীন এবং সে-ধারণা পালটাবার কোনো কারণ পরে তার ঘটেনি।
ঢাকায় এসে মালরো বলেছিলেন, স্বাধীনতার জন্যে বাংলাদেশে যত রক্তপাত হয়েছে, বিশ্বের আর কোথাও তা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রসমাজের ভূমিকার প্রশংসা করেছিলেন তিনি, ছাত্রদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, একইরকম নিষ্ঠার সঙ্গে তারা যেন দেশের পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করে। রাজশাহী ছাড়াও তিনি চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে আবুল ফজলের সভাপতিত্বে তাঁকে দেওয়া হয় নাগরিক-সংবর্ধনা। স্বদেশে ফিরে যাওয়ার আগে মালরো বলে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হওয়া উচিত। প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে পাকিস্তান যদি সেখানে আটকে-পড়া বাঙালিদের বিচার করতে চায়, সেটা হবে তাদের পক্ষে নির্বুদ্ধিতার শামিল।
পাকিস্তান অবশ্য আটক বাঙালিদের বিচার করতে পারেনি। আর মাস ছয়েকের মধ্যেই তারা ফিরে আসতে আরম্ভ করেছিলেন। অবশ্য তার আগে অনেকেই পালিয়ে আফগানিস্তান ও ভারত হয়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তবে আমরাও তখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে সমর্থ হইনি।
২৭.
ইতিহাস পরিষদের তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন হলো ঢাকায়, মে মাসে। এটাই বোধহয় ছিল পরিষদের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলন। রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সম্মেলন উদ্বোধন করেন, অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী, মূল সভাপতি মুহম্মদ এনামুল হক। সারা দেশ থেকে শ দুয়েক প্রতিনিধি এসেছিলেন, ভারত থেকে ২৮ জন, পূর্ব জার্মানি থেকে দুজন, অস্ট্রেলিয়া থেকে একজন। ঢাকা জাদুঘরে আয়োজিত বিশেষ প্রদর্শনী উদ্ববাধন করেন কামাল হোসেন। তিনদিনব্যাপী এই সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এ এল ব্যাশাম, দীনেশচন্দ্র সরকার, পরমাত্মা শরণ ও আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ। প্রবন্ধ পাঠ করেন দীনেশচন্দ্র সরকার, জিয়াউদ্দীন দেশাই, কমলাকান্ত গুপ্ত, অরুণ দাশগুপ্ত, অনিরুদ্ধ রায়, সৈয়দ মুর্তজা আলী, সৈয়দ ইমামুদ্দীন, অমলেন্দু দে, এম এল দাশ, ভূপেন কানুনগো, সালাউদ্দীন আহমদ, রজতানন্দ দাশগুপ্ত, হান্স পিয়াজা, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, বাদলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সনকুমার সাহা, আলী আনোয়ার ও যতীন সরকার (তিনি অবশ্য অনুপস্থিত ছিলেন)। বিশেষ ভাষণ দেন নীহাররঞ্জন রায়। অতিথিদের পক্ষ থেকে সমাপনী অধিবেশনে বক্তৃতা করেন এ এল ব্যাশাম, গুনটার সনটাইমার ও রমিলা থাপার।
সম্মেলনে যোগ দিতে পারিনি বলে আমার খুব আফসোস হয়েছিল। তবে আমার বন্ধু অনিরুদ্ধ রায় সম্মেলনশেষে রমিলা থাপার ও অধ্যাপক গ্রোভারকে নিয়ে চট্টগ্রামে আমার বাড়িতে বেড়াতে আসে। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ঘুরে বেড়ানো ও আড্ডা দেওয়া। অনিরুদ্ধ বলেই রেখেছিল, কোথাও যেন কোনো বক্তৃতার আয়োজন না করি, আমি সেই ইচ্ছে মেনে নিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে বোধহয় তাতে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ইতিহাসবিদ আসছেন, অথচ ইতিহাস বিভাগে যাবেন না এবং থাকবেন বাংলার শিক্ষকের বাড়িতে, এটা তাদের পছন্দ হয়নি। অনিরুদ্ধ তো বন্ধুই, রমিলার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারাভিযান চালাতে দিল্লিতে যাই এবং জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা করি। গ্রোভার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তাঁর এক ভাই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে ১৯৭১ সালে পূর্ব রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছিলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে তাই তাঁর বিশেষ ঔৎসুক্য ছিল। ওঁদের নিয়ে আমার যুদ্ধফেরত ফোক্সওয়াগনে করে গেলাম কাপ্তাই ও রাঙামাটিতে। ওঁরা খুব উপভোগ করেছিলেন। ক্যাম্পাসের নিরিবিলি আবহাওয়া এবং আমার বাড়ির অনানুষ্ঠানিক পরিবেশ ওঁদের ভালো লেগেছিল। এক সন্ধ্যায় বাড়ির লনে বসে গল্প করছি। আমার প্রতিবেশী শিল্পী রশিদ চৌধুরী এসে পানীয়ের একটা বোতল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনার অতিথিরা হয়তো এটা পছন্দ করবেন।’ রশিদ বসলেনও না, সকলের সঙ্গে সৌজন্য-বিনিময় করে চলে গেলেন। আমার অতিথিদের জন্যে তার এমন উদ্বেগ দেখে আপ্লুত না হয়ে পারিনি।
অতিথিদের নিয়ে গিয়েছিলাম ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবদুল করিমের বাড়িতে। চা খেতে খেতে তাঁদের সাম্প্রতিক গবেষণা নিয়ে আলাপ করলেন–অনেকটাই আনুষ্ঠানিক, তবে সৌজন্যপূর্ণ। মুশকিলে ফেললেন ওই বিভাগেরই এক শিক্ষিকা–তিনি একবেলা রমিলাকে খাওয়াবেনই, অথচ রমিলা একেবারেই রাজি নয় খেতে। শেষ পর্যন্ত রফা হলো, শহরে তাঁর বাড়িতে চা খাব। অতি সুসজ্জিত ভবন, চায়ের আয়োজন রাজসিক, ভদ্রমহিলার আন্তরিকতাও অকৃপণ, তবে সেখানে দেখা দিল এক বিব্রতকর পরিস্থিতি। নিমন্ত্রণকত্রী দাবি করছেন, তিনি রমিলার বই পড়েছেন, অথচ সে বইয়ের নাম মনে করতে পারছেন না। রমিলার লেখা যে-বইটা সহজে পড়া সম্ভবপর–পেলিক্যান পেপারব্যাক বলে–আমি তার নাম মনে করিয়ে দিই, কিন্তু বাংলার ছাত্রের কাছ থেকে ইতিহাসের বইয়ের নাম নিতে তিনি রাজি হন না। ‘না, না’ বলে তিনি অন্য নাম ভাবতে থাকেন, বলেও ফেলেন বোধহয় এক-আধটা, তবে তা লাগসই হয় না। ফেরার পথে রমিলা ক্ষোভের সঙ্গে বলে, আমার নামটি ছাড়া তোমার সহকর্মীর কোনো ধারণাই নেই আমার। সম্পর্কে, তবু কেন যে খাওয়াবার জন্যে এত জোর করলেন–!’ সবটা লঘু করতে বললাম, ‘ওই নাম-মাহাত্ম্যের কারণেই, নইলে কি ডিনার না খেয়ে ফিরতে পারতে!’
২৮.
বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদকে ভূষিত করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। স্থির হয়েছিল, পরবর্তী এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ঢাকায় এবং পদকটা প্রদান করা হবে সেখানে। ১৯৭৩ সালের মে মাসে দুদিনব্যাপী এই সম্মেলন আয়োজিত হলো। ইতিহাস সম্মেলনের সময়ে মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক দাবিপূরণের লক্ষ্যে অনশন করেছিলেন, এবারে বিদেশি প্রতিনিধিরা যেদিন আসতে আরম্ভ করলেন, বাম রাজনৈতিক দলগুলো সেদিন ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলো। হোটেল পূর্বাণীর সামনে ছোটো চত্বরটায় ভিয়েতনাম-মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছিল, কারা জানি সেটাও ভেঙে দিল। সবটা নিয়ে কিছুটা উত্তেজনাও দেখা দিয়েছিল। তবে শেরে বাংলা নগরে বেশ বড়ো করেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। বাংলাদেশের বাইরে প্রতিনিধি এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, শ্রীলঙ্কা, লাওস, কম্বোডিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, জাপান, ইরাক, সিরিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন, ওমান, জর্দান, প্যালেস্টাইন, মিসর, দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, গায়েনা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, পোল্যান্ড, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে। বিশিষ্টজনের মধ্যে ছিলেন ডিন রিড, মিসেস চেডি জাগান ও কৃষ্ণ মেনন, বিশ্বশান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ্র তো ছিলেনই। রমেশ চন্দ্রই বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি পদক পরিয়ে দেন। সকলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে কথা বলেছিলেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সভাপতি, তকালীন কৃষিমন্ত্রী, আবদুস সামাদ আজাদ। সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের দাবি জানানো হয়েছিল। সম্মেলনটি সত্যিই আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছিল এবং আমাদের মনে এর রেশ লেগে ছিল বেশ কিছুদিন ধরে।
২৯.
শহর থেকে দূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অপেক্ষাকৃত নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হতো অতিথির আগমনে। চাঞ্চল্যটা পারিবারিক পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকতো যদি না অতিথি সামাজিকভাবে সুপরিচিত হতেন। ১৯৭৩ সালের শেষে আমার বাসায় সপরিবারে কামাল হোসেনের আগমনে তাই গোটা ক্যাম্পাসেই মৃদু তরঙ্গ বয়ে গিয়েছিল। কামাল তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কর্মজীবনের কোলাহলের বাইরে নিজের এবং বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এত ব্যস্ত মানুষ যে কেবল বেড়াতে আসবেন এই পাড়াগাঁয়ে–তা অনেকের বিশ্বাস হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই, আমি কোন পদ অধিকার করতে যাচ্ছি, সে-সম্পর্কে জল্পনা ছিল সহকর্মীদের মধ্যে। এবারে তাঁরা নিশ্চিত ধারণা করলেন যে, আমি রাষ্ট্রদূত হতে যাচ্ছি। কেউ কেউ বোধহয়, কোন দেশে যাচ্ছি, তাও স্থির করে ফেলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, কাউকে রাষ্ট্রদূত বানাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তার বাড়ি যেতে হয় না। সে-কথায় বেশি কাজ হয়নি।
হামিদা বরাবরই অনাড়ম্বর জীবনযাপনের পক্ষপাতী। তিনি কামালকে বলেই নিয়েছিলেন যে, বেড়াতে যদি যেতে হয়, তাহলে মন্ত্রিত্বের আনুষঙ্গিক অলংকার অফিসে ফেলে রেখেই যেতে হবে। কামালও জেলা-প্রশাসনকে জানিয়েছিলেন, এটা একেবারেই বেসরকারি সফর। কিন্তু প্রশাসনের তো একটা দায়িত্ব আছে মন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেওয়ার। সুতরাং মন্ত্রী মহোদয় সন্ধ্যার পরে নিরাপত্তা রক্ষী পরিবেষ্টিত হয়েই পৌঁছালেন আমার বাড়িতে। আর সঙ্গে সঙ্গেই রক্ষাকর্তাকে বলে দিলেন, যান, আপনারা এখন ফিরে যান। রক্ষীপ্রধান মুখ খুলতে গিয়ে সামলে নিলেন। খানিক পরে আমার কাজের ছেলে এসে আমাকে খবর দিলো, কেউ একজন কথা বলতে চায় আমার সঙ্গে। বেরিয়ে দেখি, সেই পুলিশ কর্মকর্তা। কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, ‘মিনিস্টার সাহেব আমাদের বিদায় দিলেন; কিন্তু সার, ওঁর সিকিউরিটির দায়িত্ব আমার–আমি কী করে চলে যাই! আপনার গ্যারাজের ওপরের ঘরটায় যদি রাতটা আমাদের থাকতে দেন, তাহলে সারও জানতে পারবেন না, আমাদেরও ডিউটি দেওয়া হবে। আমরা আপনাদের কোনোরকম বিরক্ত করবো না। সেই ব্যবস্থাই করা গেল।
সহকর্মীদের কেউ ফোনে খবর দিয়ে, কেউ কিছু না জানিয়েই, মান্যবর অতিথির সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করতে এলেন এবং কিছু আবশ্যক রাজনৈতিক প্রশ্ন ও কিছু অনাবশ্যক ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে তাঁকে বিব্রত করে তুললেন। যাঁরা দর্শন দিতে এলেন, তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিথির কথা বলার সুযোগ সীমিত হয়ে এলো। কেউ তাঁকে প্রশ্ন করলে আরেকজন তার উত্তর দেন; কেউ প্রশ্ন করতে গেলে তাঁকে থামিয়ে আরেকজন নিজের মতামত শোনাবার তাগিদ অনুভব করেন। তারপর এক সময়ে কারো খেয়াল হয়, অতিথির খাওয়া দাওয়ার পালা তো এখনো বাকি। উঠতে উঠতে আরো কিছুক্ষণ যায়।
কামাল যতই বলুন না কেন ব্যক্তিগত সফর, রাজনীতি কি পেছন ছাড়ে রাজনীতিবিদের? পরদিন জনসভায় তাঁকে বক্তৃতা করতে হলে চট্টগ্রাম শহরে। তার পরদিন সকালবেলায় আমরা কাপ্তাই রওনা হলাম। ব্যবসায়ী ইসলাম খার শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটা ঢাউস গাড়ি প্রশাসন চেয়ে নিয়েছিল–তাতে আমরা সপরিবারে। আর ডি সি-পুলের পতাকাশোভিত সংকীর্ণপরিসর ও কান্তিহীন গাড়িতে মন্ত্রীর পরিবার। কাপ্তাইতে ওয়াপদার রেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা উত্তম, খাওয়ার ব্যবস্থা তার চেয়েও ভালো। কামাল একবার সখেদে বললেন হামিদাকে, ‘আমি অল্প খেয়েও মোটা হয়ে যাই, আর আনিসকে দেখো, এত খেয়েও তার গায়ে কিছু লাগে না। কাপ্তাই-অবস্থান খুব উপভোগ করেছিলাম আমরা। কামালের বড়ো মেয়ে সারা রুচির চেয়ে বয়সে কিছু ছোটো; দীনা আর শুচি একেবারেই সমবয়সী-কামালের ভাষায়, সিক্সটিনাইন মডেল। ওরা খুব মিলেমিশে খেলাধুলা করে কাটালো। এখানে অতিথি-অভ্যাগতের ভিড় ছিল না। আমরা দেশের হাল-হকিকত আর বন্ধু-বান্ধবদের বিষয়ে আলাপ করে দিনাতিপাত করলাম।
হঠাৎ করে বেতারের খবরে শুনলাম, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করেছেন এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার মোহাম্মদউল্লাহ্ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। কামালের সঙ্গে কথা বলে ধারণা হলো, আবু সাঈদ চৌধুরী যে পদত্যাগ করবেন কিংবা তাকে যে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে, তা তিনি জানতেন; তবে কে যে তার স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন, তা তখনো তার অজানা। আবু সাঈদ চৌধুরী সম্পর্কে আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধাবোধ ছিল–বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যে-ভূমিকা তিনি পালন করেছিলেন, তা শ্লাঘার যোগ্য। তাই তাঁর বিদায়ে খুব খারাপ লাগলো। স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করছেন তা সাংবিধানিক বিধানের কারণে। তাও বললাম, লোকটার বরাত বটে! আওয়ামী লীগের দপ্তর-সম্পাদক থেকে ডেপুটি স্পিকার হলেন। কেউ ভাবেনি, উনি স্পিকার হবেন; হঠাৎ করে শাহ আবদুল হামিদের মৃত্যুতে সেই পদ লাভ করলেন। এখন আবার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি। ভাগ্যবিধাতা নিশ্চয় আমার কথা শুনে হেসেছিলেন। কেননা মাসখানেক পরে তিনি রাষ্ট্রপতির স্থায়ী আসনে অভিষিক্ত হন।
তবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীও আমাকে হতাশ করলেন। অল্পকাল ব্যবধানে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে তিনি জেনেভায় গেলেন। তারপর ইউরোপ ও আফ্রিকার নানা দেশে দৌত্যকর্ম করলেন। যিনি রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেছেন, তিনি আবার অন্য পদে নিয়োগগ্রহণ করবেন কেন? তখন কি আর জানতাম যে, তিনি এবং তাঁর সাক্ষাৎ উত্তরাধিকারী পরে মন্ত্রিত্ব নেবেন?
যাহোক, কাপ্তাইয়ের আনন্দিত দিনগুলির শেষে ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। পরদিন রাতে–এবারে ট্রেনে করে–অতিথিরা ঢাকায় ফিরে গেলেন। রেলের সেলুন দেখে তো রুচি-শুচি বেজায় খুশি, প্রলুব্ধও বটে। বলে, এমন গাড়ি করে আমরা ঢাকায় যেতে পারি না? যতক্ষণ পারলো, তারা সারা-দীনার সঙ্গে একবার বিছানায়, একবার চেয়ারে বসে নিলো।
৩০.
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য-সম্মেলন আয়োজন করলো বাংলা একাডেমি ১৯৭৪ সালের ১৪ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটদিন ধরে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী, ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শামসুজ্জোহার মৃত্যুবার্ষিকী। মনে হয়, এ দিনগুলো এড়িয়ে ২১ থেকে ২৮ পর্যন্ত সম্মেলন করলে ভালো হতো। আয়োজনটা অবশ্য হয়েছিল বিশাল। অভ্যর্থনা পরিষদের। সভাপতি মযহারুল ইসলাম এবং সম্পাদক রাহাত খান ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি রাখেননি। ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরি, পূর্ব জার্মানি, রুমানিয়া, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম–এসব দেশের প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। অন্নদাশঙ্কর রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধিদলের। তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অজিতকুমার ঘোষ, আশুতোষ ভট্টাচার্য, গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জগন্নাথ চক্রবর্তী, জীবেন্দ্র সিংহরায়, দুলাল চৌধুরী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বাণী রায়, বিনয় সরকার, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ সেন, মনোজ বসু, মন্মথ রায়, রমা চৌধুরী, লীলা রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সবিতাব্রত দত্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও হরপ্রসাদ মিত্র। আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষও ছিলেন সেইসঙ্গে।
সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, মূল সভাপতি ছিলেন জসীমউদ্দীন, বিশেষ অতিথি শিক্ষা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। তিনটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল। মোহাম্মদ সাইদুরের সংগ্রহ নিয়ে লোকশিল্পের প্রদর্শনী, উদ্ববাধন করেন জয়নুল আবেদিন। তাছাড়া, মুরাল প্রদর্শনী উদ্ববাধন করেন আবদুল মতিন চৌধুরী এবং গ্রন্থ প্রদর্শনী উদবোধন করেন আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ্। নৃত্যগীতবাদ্যনাট্যের কোনো-না-কোনো অনুষ্ঠান হয়েছিল প্রতি সন্ধ্যায়।
জসীমউদ্দীনের ভাষণে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছিল। তিনি বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন; কাগজ ও মুদ্রণের ব্যয় এবং বিজ্ঞাপনের উচ্চহার যে ভালো প্রকাশনার অন্তরায় সে কথা বলেছিলেন; ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বইপত্রের অবাধ আদানপ্রদানের প্রস্তাব এনেছিলেন; বাংলাদেশে রবীন্দ্ররচনাবলি মুদ্রণের বিষয়ে বিশ্বভারতীর অনুমতি ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগ দাবি করেছিলেন।
সম্মেলন বিভক্ত হয়েছিল অনেকগুলি শাখা-অধিবেশনে এবং কয়েকটি সাধারণ অধিবেশনে। আবুল ফজল, শওকত ওসমান, আবদুল গনি হাজারী, কাজী মোতাহার হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান ও কবীর চৌধুরী সাধারণ অধিবেশনে এবং মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, রোকনুজ্জামান খান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, রণেশ দাশগুপ্ত, মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, কাজী আবদুল মান্নান, সৈয়দ মুর্তজা আলী, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, নীলিমা ইব্রাহিম, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবদুল আহাদ, কামরুল হাসান ও আমি শাখা-অধিবেশনে সভাপতিত্ব করি। কবিতাপাঠের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলেন সুফিয়া কামাল এবং সমাপ্তি-অধিবেশনে ম্যহারুল ইসলাম। আমি একটি সাধারণ অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলাম, আর বাংলাদেশের গবেষণা-সাহিত্য শাখা-অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছিলাম। ওই অধিবেশনে প্রবন্ধ পড়েছিলেন সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, আর আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন আ কা মো যাকারিয়া, মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল, মুহম্মদ আবদুর রহীম, মাহমুদ শাহ কোরেশী, নেয়ামাল বাসির, আব্দুর রাজ্জাক ও মনিরুজ্জামান। সভাপতির ভাষণের সূচনায় আমি সেই গল্পটি বলেছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে আমাদের এক সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি বিদেশে গিয়ে সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগীরা কীভাবে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। তখন শ্রোতাদের একজন উঠে বললেন, আপনাদের দেশ যে একেবারে বুদ্ধিজীবীশূন্য হয়ে গেছে, আপনার কথা শুনে সে-সম্পর্কে আমাদের সম্পূর্ণ প্রত্যয় জন্মেছে। আমি বলেছিলাম, সেই শূন্যতার সুযোগে সভাপতির আসনটি আমার দখলে এসেছে। মনোজ বসু আমার কথা খুব উপভোগ করেছিলেন।
এই সম্মেলনে অন্নদাশঙ্কর রায়, আশুতোষ ভট্টাচার্য, মনোজ বসু, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিনয় সরকার, বাণী রায়–এঁদের সঙ্গে পুরনো পরিচয় ঝালিয়ে নেওয়া গেল। নতুন পরিচয় হলো লীলা রায়, রমা চৌধুরী, হরপ্রসাদ মিত্র–এঁদের সঙ্গে। বাণী রায় অনিরুদ্ধের পিসিমা–সেই সুবাদে তাঁকে চট্টগ্রামে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। শুনলাম, হরপ্রসাদ মিত্র চট্টগ্রামে আসবেন–তাঁকে আমন্ত্রণ জানালাম আমাদের বিভাগে বক্তৃতা দিতে।
সাহিত্য-সম্মেলনের মাঝখানেই খবর পাওয়া গেল, আমাদের পররাষ্ট্র-সচিব এনায়েত করিম ১৬ ফেব্রুয়ারিতে ইন্তেকাল করেছেন। অফিসেই ছিলেন, সেখানে হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হয় তৃতীয়বারের মতো। ১৯৫৯ সালে আমার পিএইচ ডি গবেষণার কাজে কলকাতায় গিয়ে তারই আশ্রয়ে ছিলাম। তারপরেও অনেকবার দেখা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত অবস্থায় যখন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন, তখনো তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবু বাংলাদেশের স্বাধীনতা-অর্জনের পর পররাষ্ট্র সচিব হয়ে শারীরিক অসামর্থ্য অগ্রাহ্য করে আপ্রাণ সেবা করেছেন দেশের। তার স্ত্রী হুসনা করিম অতি চমৎকার মানুষ। খবর পেয়ে দৌড়ে গেলাম তাঁদের ধানমন্ডির বাসায়। এনায়েত করিমের দাফন হয়ে গেছে ততক্ষণ। হুসনা ভাবির সঙ্গে দেখা করে ফিরে এলাম। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার ছিল না।
এদিকে অনেক কিছু ঘটছিল দেশে। জানুয়ারি মাসে যখন আওয়ামী লীগের কাউনসিল-অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তখন বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, তিনি দলীয় প্রধানের দায়িত্বে আর থাকবেন না। সেই সিদ্ধান্ত-অনুযায়ী এ এইচ এম কামারুজ্জামান দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার ফলে তিনি আবার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এটাও ঘটে সাহিত্য-সম্মেলন চলাকালে। আমরা অনেকেই এতে খুশি হই, দল আর সরকারের মধ্যে একটা সীমারেখা টানা হচ্ছে বলে। তবে এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সর্বব্যাপী ভূমিকায় পার্থক্য ঘটে না। দল ও সরকারের ভেদ কিছুটা তাত্ত্বিক হয়ে পড়ে।
সাহিত্য-সম্মেলন শেষ হলো একুশে ফেব্রুয়ারিতে। তার পরদিনই পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলো বাংলাদেশকে। আর ২৩ তারিখেই ইসলামি রাষ্ট্র-সংস্থার সম্মেলনে যোগ দিতে বঙ্গবন্ধু উড়ে গেলেন। লাহোরে। আমরা তো ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে ইসলামি দেশ হিসেবে দেখিনি, দেখার পক্ষপাতীও নই। কিন্তু কয়েকদিন ধরেই শুনছিলাম, অনেক বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক চাইছিলেন বাংলাদেশ এই সম্মেলনে যোগ দিক। সরকারের পক্ষ থেকে নাকি বলা হয়েছিল যে, তার আগে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি পেতে হবে। ও আই সির প্রভাবশালী সদস্যদের চাপে পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। লাহোর বিমানবন্দরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাদকেরা আমার সোনার বাংলা বাজিয়ে অভ্যর্থনা জানায় শেখ মুজিবকে, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল টিক্কা খান তাঁকে অভিবাদন জানান। এইসব দরকষাকষির বিষয়ে ভারতকে কিছুটা অন্ধকারে রাখে বাংলাদেশ, যদিও আমার সন্দেহ, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাদের সরকারকে পরিস্থিতি অবহিত করতে কার্পণ্য করেনি। ভারতের প্রভাববলয় থেকে আমরা যে স্বাধীন, তা প্রমাণ করতে যথাসাধ্য করছিলেন আমাদের কূটনীতিকেরা–হয়তো রাষ্ট্রের কর্ণধারেরাও। আমাদের মনে হলো, তারই ফলে, পাকিস্তানের স্বীকৃতির বিনিময়ে ও আই সির সদস্যপদ নিলো ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। তবে যখন ভাবি, ভারতও এক সময়ে। ও আই সির সদস্যপদপ্রার্থী ছিল যদিও তাকে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়, তখন আমাদের সরকারের কাজ আর বিস্ময়কর মনে হয় না। কূটনীতিতে বোধহয় সবই চলে।
আমি চট্টগ্রামে ফিরে যাওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই বাণী রায় এলেন। বিমানবন্দরে তাঁকে আনতে গেলাম। দ্রুতপদে বিমান থেকে নেমে তিনি আমার সন্নিকটবর্তী হয়ে বললেন, ‘হরপ্রসাদ মিত্রও এই ফ্লাইটে এসেছেন, তবে তাঁকে আপনার কিছু বলার দরকার নেই। তারা দুজনেই প্রায় সমবয়সী। বাণী রায় কবি; ছোটোগল্প, উপন্যাস ও নাটকেও তিনি সিদ্ধহস্ত। হরপ্রসাদ মিত্র খ্যাতনামা। কবি ও সমালোচক, প্রেসিডেন্সি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। যৌবনকালে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প সম্পর্কে লেখা তাঁর প্রবন্ধ পড়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ খুব আপ্লুত হয়েছিলেন। আমি যখন এম এ পড়ি, তখন তাঁর পিএইচ ডি অভিসন্দর্ভের মুদ্রিতরূপ সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ও কাব্যরূপ পড়েছি পরীক্ষাপাশের জন্যে। তিনি চট্টগ্রামে আসবেন জেনে তাকে আমাদের বিভাগে বক্তৃতা করতে আমন্ত্রণও জানিয়ে এসেছি ঢাকায়। এখন বাণী রায়ের কথা শুনে তাঁকে অবজ্ঞা করি কী করে এবং কেনই বা! আমি আমতা-আমতা করছি, তখন বিমান থেকে নেমে হরপ্রসাদ মিত্র হাত নাড়ছেন আমার উদ্দেশে। বাণী রায়কে বললাম, ‘পিসি, উনি এসে পড়েছেন। একসঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া তো যাক, তারপর যা হয় হবে। যেহেতু গাড়ি আমিই চালাই, হরপ্রসাদ বসলেন আমার পাশে, বাণী রায় পেছনে বসলেন আর বিশেষ শব্দ করলেন না। মনে হলো, হরপ্রসাদ ব্যাপারটা খানিক আঁচ করতে পেরেছিলেন। ওঁদেরকে বিভাগে নিয়ে গিয়ে বক্তৃতা করালাম, তারপর তিনি আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলেন, বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন না। বাণী রায় এবারে খুশি হয়ে আমার সঙ্গে চললেন।
খেতে খেতে বাণী রায় জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কিসের ডাল?’ বেবী চটপট উত্তর দিলো, মাধবীলতার ডাল। আমাদের খাবার টেবিলের পাশে জানলা, সে জানলার ওপারে মাধবীলতার গাছ। তার একটা ডাল বেঁকে ওই জানলা ঘেঁষে আছে। বাণী রায় জানতে চেয়েছিলেন, যে-ডাল তাঁকে খেতে দেওয়া হয়েছে, সেটা কী। আর বেবী ধরে নিয়েছিল, জানলার ধারে উঁকি দিচ্ছে যে-ডাল, তিনি তার পরিচয় জানতে চাইছেন। বেবীর জবাব শুনে বাণী রায় অস্ফুটস্বরে বলতে লাগলেন, জীবনে কত ডাল খেলুম, কখনো মাধবীলতার ডাল তো শুনিনি। তাঁর এই উক্তি শুনে বেবীর চৈতন্যোদয় হলো। তখন সে ডাল এবং ডালের ভেদনিরূপণতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে প্রবৃত্ত হলো।
কলকাতায় ফিরে গিয়ে ভ্রাতুস্পুত্র অনিরুদ্ধের কাছে আমাদের আতিথেয়তার প্রশংসা করেছিলেন বাণী রায়। হরপ্রসাদ মিত্রের সঙ্গে আমার আর জীবনে দেখা হয়নি।
৩১.
চট্টগ্রামে আসার পরে গবেষণার কাজে আমার কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রস্তাবিত প্রবন্ধের জন্যে অনেকখানি শ্রম ও সময় দিয়েছিলাম। সেটা যথাসময়ে শেষ করতে পারলাম না, পরে আর তাতে হাত দেওয়ার তাগাদাও অনুভব করিনি। তাছাড়া, অন্যের বইয়ের ভূমিকা লিখেছি, স্মারকগ্রন্থের জন্যে প্রবন্ধ লিখেছি, খানিক গবেষণামূলক-খানিক সাধারণ পাঠযোগ্য শ্রদ্ধাঞ্জলি লিখেছি মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুতে। কিন্তু প্রকৃত গবেষণার কাজে হাত দিতে পারিনি। সময় যে বৃথা ক্ষেপণ করেছি, তাও নয়। সংবিধান বা অন্যান্য যেসব কাজ করেছি বাংলার প্রয়োগ নিয়ে, সেও তো আমার কাজ। শিক্ষা কমিশনের জন্যে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মে যে-সময় দিয়েছি তাও তো অকাজে নয়। তবু অনুভব করেছি, অন্যান্য দায়িত্ব থেকে সরে এসে গবেষণায় ফেরা দরকার।
মনের মধ্যে একটা কাজের পরিকল্পনাও ছিল। সুশীলকুমার দে-র হিস্ট্রি অফ বেঙ্গলি লিটারেচর ইন দি নাইনটিথ সেঞ্চুরি (কলকাতা, ১৯১৯) বইতে পুরোনো বাংলা গদ্য সম্পর্কে একটি পরিশিষ্ট আছে। সেটা পড়ে মনে হয়েছিল, এ-বিষয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সুকুমার সেনের বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য (কলকাতা, ১৯৩৪) থেকেও সে-ধারণার সমর্থন পাই। স্থির করি, ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের, অর্থাৎ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ-প্রতিষ্ঠার আগের, বাংলা গদ্য নিয়ে। গবেষণা করব। কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপের জন্যে যখন আবেদন চাওয়া হলো ১৯৭৩ সালে, তখন সেই প্রস্তাব দিয়ে দরখাস্ত করে দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোনয়ন পেতে দেরি হলো না।
এর মধ্যে বিভাগ থেকে এক দুপুরে বাড়ি ফিরছি গাড়ি চালিয়ে। পথের মধ্যে দেখি সেনাবাহিনীর কয়েকজন জওয়ান দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে একজন হাত দেখিয়ে গাড়ি থামালো। তারপর এগিয়ে এসে বাঙালি উচ্চারণ-ভঙ্গিতে জানতে চাইলো, ‘কিধার জাতা হ্যায়?’ বাংলাদেশের সৈনিকের মুখে উর্দুতে এমন প্রশ্ন শুনে ভয়ানক বিরক্ত হলাম। তবে বিরক্তি চেপে রেখে বললাম, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক–এখানে কোয়ার্টারে থাকি, বাসায় যাচ্ছি। সে এবারে আমার ফোকসওয়াগেনের পেছন দিকে গিয়ে বললো, ‘ডিব্বা খুলো।’ বললাম, ‘ওখানে ইনজিন–আপনি সামনে দেখুন।’ সে কিছুমাত্র লজ্জিত না হয়ে সামনে পেছনে-মধ্যে সব দেখে আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিলো।
ঘরে ফিরে রেজিস্ট্রারকে ফোন করলাম। তার কাছ থেকে জানলাম, দেশে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের ধরতে এবং বেআইনি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে বেসামরিক প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্যে সামরিক বাহিনী নিয়োজিত হয়েছে। একজন কর্নেলের নেতৃত্বে একদল সৈন্যকে মোতায়েন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকায়। সামরিক-কর্তৃপক্ষের অনুরোধে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসন তাদের সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সেনাবাহিনী ছাত্রদের হলগুলি অনুসন্ধান করে তেমন কিছু পায়নি। কিন্তু ক্যাম্পাসের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও গ্রেনেড বা গোলাগুলি পেয়েছে। দু-চারজন ছাত্র ও কর্মচারীকে নিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপিত সেনাবাহিনীর ইন্টারোগেশন সেন্টারে। সন্ধে নাগাদ শোনা গেল, আমাদের সহকারী মেডিক্যাল অফিসার ডা. আখতারুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে। আখতারুজ্জামান একই সঙ্গে সফল চিকিৎসক ও ভালো মানুষ। সুতরাং তার জন্যে আমরা অনেকেই উৎকণ্ঠিত হলাম। উপাচার্যকে তার শহরের বাসভবনে ফোন করে আমাদের উদবেগের কথা জানালাম। তিনি বললেন, রেজিস্ট্রারকে তিনি খোঁজ নিতে বলছেন এখনই, আর পরদিন সকালে অফিসে এসে তিনি। নিজেই এ-বিষয়ে কথা বলবেন।
রেজিস্ট্রারের খোঁজখবরে কোনো কাজ হলো না। পরদিন উপাচার্যের দপ্তরে আমরা অনেকে সমবেত হলাম। কর্নেল কুদ্স এলেন–তিনি প্রকৌশলী, কথাবার্তায়ও কুশলী। বললেন, তাঁদের কাছে খবর আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামবুলেন্সে অস্ত্রশস্ত্র আনা হয়েছে ক্যাম্পাসে এবং সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা তাতে শহর ও ক্যাম্পাসে যাতায়াত করেছে। ওই চিকিৎসককে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার, প্রয়োজনের এক মুহূর্ত বেশি তাকে আটক রাখা হবে না। না, তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আটক করা হয়েছে মাত্র। আনুষ্ঠানিক ভাষা ব্যবহার করলে বলতে হবে, আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি আমাদের কাজে সাহায্য করছেন।
সেদিন শোনা গেল, ইন্টারোগেশন সেন্টারে আটক ব্যক্তিদের কাউকে কাউকে শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে। কর্নেল কুদুসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বললেন, আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন। তবে নিশ্চিত থাকুন, বেআইনি কিছু করা হচ্ছে না, আবার কেউ আইন-বিরোধী কিছু করে থাকলে তাকেও ছাড়া হবে না। আটক ব্যক্তি কিছু কিছু ছাড়া পেতে লাগলো। তাদের কাছ থেকে সেনা-কর্তৃপক্ষ এই মর্মে লিখিত ঘোষণা নিয়ে রাখলো যে, তাদের প্রতি কোনো শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি–যাদের প্রতি নির্দয় আচরণ করা হয়েছিল, তারাও এরকম প্রত্যয়ন করলো। ডা. আখতারুজ্জামান ছাড়া পেলে। আমাদের ধারণা হয়, তিনি এই শেষ দলভুক্ত।
আমরা আবার উপাচার্যের কাছে গেলাম। তিনি খবর দিলে কর্নেল কুদুস এলেন। আমিই বললাম, ‘দেখুন, আমরা জানতে পেরেছি, যাদের নির্যাতন করা হয়েছে, তাদেরকেও আপনারা লিখে দিতে বাধ্য করছেন যে, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়নি। এটা কী ধরনের কথা?’ কর্নেল বললেন, ‘আমি এই চার। দেয়ালের মধ্যে আপনাদের বলছি, তবে বাইরে স্বীকার করবো না, প্রকৃত তথ্য বের করার জন্য উই হ্যাভ অ্যাপ্লায়েড থার্ড ডিগ্রি টু সাম ইনডিভিজুয়ালস, বাট ফর আওয়ার সেফটি, যাতে কেউ আমাদের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় না নিতে পারে, উই আর অবটেনিং ফ্রম দেম এ স্টেটমেন্ট টু দি ইফেক্ট দ্যাট দে ওয়্যার নট ট্রিটেড হার্শলি। প্রফেসর সাহেব, আমি বুঝতে পারছি, আপনার খারাপ লাগছে, বাট দিস ইজ দি রিয়্যালিটি–নিজেদের প্রটেকশনের জন্য পুলিশ এটা করে, প্রয়োজন হলে আমরা করি। আপনি কি মনে করেন যে, আমরা জিজ্ঞাসা করলেই কেউ সত্যি কথা বলবে? সত্যি কথা বলাতে হয়, তার জন্য জোর খাটাতে হয়। কিন্তু আইনত জোর খাটানো যায় না, তাই তাদের কাছ থেকে ওসব লিখিয়ে নিতে হয়।
আমরা এরপর উপাচার্যকে পীড়াপীড়ি করলাম, সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করার জন্যে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করতে। একটু ভেবে নিয়ে আবুল ফজল টেলিফোন করলেন বঙ্গবন্ধুকে। আমরা বিভাগীয় অধ্যক্ষ যারা উপস্থিত ছিলাম–যতদূর মনে পড়ে, ইংরেজির মোহাম্মদ আলী, বাংলার আমি, অর্থনীতির মুহাম্মদ ইউনূস, পদার্থবিজ্ঞানের এখলাসউদ্দীন আহমদ, গণিতের ফজলী হোসেন, পরিসংখ্যানের এম জি মোস্তফা, হিসাববিজ্ঞানের আলী ইমদাদ খান, ব্যবস্থাপনার শামসুজ্জোহা-তাদের সকলের নাম বললেন। জানালেন, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার চাইছি এবং তিনি আমাদের সঙ্গে একমত। উপাচার্যের অনুরোধ বিবেচনা করবেন বলে প্রধানমন্ত্রী কথা দিলেন। পরদিন সেনাবাহিনীর কাউকে আর ক্যাম্পাসে দেখা গেল না।
৩২.
প্যারিস থেকে আনোয়ার আবদেল-মালেক চিঠি লিখলেন। ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে ‘ইনইকুয়ালিটি সম্পর্কে সেমিনার হবে। তার আয়োজক ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন আমাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। আমি যেন অবশ্যই যাই।
এতদিন বামপন্থার সঙ্গে জড়িত আছি, বিষয়টি আমার নয় বলতে দ্বিধা হয়। আবার বিষয়টি সম্পর্কে যেমন বিশেষ জ্ঞান থাকলে অ্যাকাডেমিক সেমিনারে অংশ নেওয়া যায়, তা আমার নেই, এটা ভেবেও সংকোচ হয়। আনোয়ার আবদেল-মালেককে তা-ই লিখলাম, তবে তার আদেশ শিরোধার্য করতে আমি প্রস্তুত, সেকথা জানালাম। বললাম, তার সঙ্গে দেখা হবে, এই সম্ভাবনাও আমাকে টানছে। তিনি লিখলেন, তিনি যাচ্ছেন না, তবে আমাকে যেতে হবে এবং বিশিষ্টজনদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে আসতে হবে।
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর চিঠিতে জানলাম, কুবেক সেন্টার অফ ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস এবং ইন্টারন্যাশনাল সোসিওলজিকাল অ্যাসোসিয়েশনের ন্যাশনাল মুভমেন্টস অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম-সম্পর্কিত রিসার্চ কমিশনের যৌথ উদযোগে ১৯৭৪ সালের মে মাসের মধ্যভাগে মন্ট্রিয়লে ওয়ার্লড ইনইকুয়ালিটি শীর্ষক একটি কলোকিয়াম অনুষ্ঠিত হবে। তাতে সংস্কৃতি-বিষয়ে একটি অধিবেশন। থাকবে। ব্রাজিলের এক বিশিষ্টজন যে-প্রবন্ধ পড়বেন সেখানে, তার কপি আমাকে আগাম পাঠিয়ে দেওয়া হবে। আমার দায়িত্ব, ওই প্রবন্ধ সম্পর্কে সুচিন্তিত আলোচনা করা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, একটা অবলম্বন পাওয়া গেল।
কিন্তু প্রবন্ধটি শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছোলো না। ঝাড়া হাত-পা নিয়ে রওনা হলাম। লন্ডনে যাত্রাবিরতি, থাকার ব্যবস্থা হিথরো বিমানবন্দর-এলাকার একটি হোটেলে। সেখানে স্যুটকেস রেখে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের শিল্পীবন্ধু এ কে এম আবদুর রউফ বাংলাদেশ হাই কমিশনে দ্বিতীয় সচিব। তাঁর সঙ্গে ব্যবস্থা করে এলাম, মন্ট্রিয়ল থেকে ফেরার পথে লন্ডনে তাঁর বাড়িতে সপ্তাহখানেক থাকবো। আমার ভাগ্নে ডা. মামুন ফেরদৌসীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না। আমাদের সহকর্মী আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন তখন নাফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করছেন লন্ডনে এবং সপরিবারে থাকছেন সেখানে। তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করে এলাম।
ফেরার পথে কিংস ক্রসে টিউব-লাইন বদলাতে হবে। সেকথা যখন খেয়াল হলো, তখন কিংস ক্রস ছাড়িয়ে গেছি। অ্যানজেলে নেমে ফিরতি ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম প্ল্যাটফর্মে। এক শ্বেতাঙ্গিনী হাতে সিগারেট নিয়ে আমার কাছে আগুনের সন্ধান করলো। লাইটার দিয়ে তার সিগারেট ধরিয়ে দিলাম। সেই অবকাশে সে জানতে চাইলো, আমার বান্ধবী চাই কি না। সবিনয়ে বললাম, এখন নয়। তরুণীর কোনো ভাবান্তর দেখলাম না। আমি কোত্থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি, জিজ্ঞেস করলো। যথাযথ উত্তর দিলাম। হোটেলের নাম শুনে বললো, ওদিকটায় খুব যাওয়ার ইচ্ছা, কখনো যাওয়া হয়নি। বললাম, আশা করি, তোমার মনোবাঞ্ছ অচিরে পূর্ণ হবে। সে বললো, কেউ না নিয়ে। গেলে হবে না, একা-একা যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশের হয়রানিতে পড়তে হয়। তার কথার জবাব না দিয়ে এবারে আমি জানতে চাইলাম, খদ্দেরের কাছে সে কত দাবি করে। মেয়েটি বললো, দশ পাউন্ড পেলে খুশি হই, তবে অবস্থাভেদে কম নিয়েও সন্তুষ্ট থাকি। এর মধ্যে ট্রেন এসে গেল। আমরা একই কামরায় উঠলাম এবং পরের স্টেশনে বিনা বাক্যবিনিময়ে আমি নেমে গেলাম।
অধ্যাপক মুশারফ হোসেন তার বন্ধু, পরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব এবং পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রতিনিধি, ইয়েন মার্টিনকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন আমার হাতে। ইয়েন যখন ঢাকায় ফোর্ড ফাউন্ডেশনে কাজ করতেন, তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ১৯৭১ সালে তিনি কর্মরত ছিলেন করাচিতে। পূর্ব বাংলায় তার পরিচিতজনের খবর নিতে তিনি ব্যাংকক হয়ে কলকাতায় আসেন সম্পূর্ণ নিজের উদযোগে। তখন আমরা কথা বলতে বলতে এবং নিঃশব্দে রাস্তায় অনেকক্ষণ পায়চারি করেছিলাম একসঙ্গে। ইয়েন এখন লন্ডনে, ব্রিটিশ লেবার পার্টির কাজে স্বনিয়োজিত। রাতে হোটেল থেকে ফোন করে তাঁকে পেলাম। তিনি বললেন, মন্ট্রিয়ল থেকে আমি যেদিন ফিরব, সেদিন তিনি বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিয়ে পৌঁছে দেবেন গন্তব্যে, তখন কথা হবে, চিঠিটাও নেবেন।
মন্ট্রিয়ল রওনা হওয়ার সময়ে দেখি, এয়ার কানাডার কম্পিউটার কাজ করছে না। অতএব, যে যেখানে পারো বসে যাও। ধূমপান করা চলে, এমন এলাকায় আসন পেলাম না। ফলে, আমার আসন থেকে খানিক হেঁটে গিয়ে ধূমপায়ীদের এলাকায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অভ্যাসের দাসত্ব করতে হলো। এক বয়স্ক শ্বেতাঙ্গেরও একই অবস্থা। তিনি খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, যখন কম্পিউটার ছিল না, তখন এরা হাতে লিখে যেভাবে আসন বণ্টন করতে পারতো, যন্ত্র খারাপ হলে সেটা করতে পারবে না কেন? আমার মনে হয়, যন্ত্র এদের দক্ষতা বাড়াচ্ছে না, বরঞ্চ অলস করে দিচ্ছে।
মন্ট্রিয়লের হোটেলে পৌঁছোলাম বিকেলবেলায়। আমার আলোচ্য প্রবন্ধ তখনো হাতে পেলাম না। নিজেকে দোভাষী পরিচয় দিয়ে একটি মেয়ে এসে বললো, ব্রাজিলিয়ান অংশগ্রহণকারী প্রবন্ধটি লিখেছেন পর্তুগিজে; সে একটা টেপ-রেকর্ডারে তা মুখে মুখে অনুবাদ করে দেবে; রাতে টেপ শুনে আমার মন্তব্য তৈরি করতে হবে। তারা দুঃখিত, কিন্তু এখন লিখিত অনুবাদ প্রস্তুত করার সময় নেই। রাতে একবার টেপ শুনে কিছু কথা টুকে রাখলাম, ভোরবেলা আরেক দফা কসরত করলাম। সেদিন সকালের অধিবেশনে ওই প্রবন্ধ-পাঠ এবং আমার মৌখিক আলোচনা। পরে দোভাষী আমাকে বলেছিল, প্রবন্ধ-উপস্থাপনের সময়ে ভদ্রলোক বেশ কিছু কথা বাদ দিয়েছেন, নতুন দু-একটি কথা যোগ করেছেন। আগে টেপে অনুবাদ শোনায় আমি আর ওঁর তাৎক্ষণিক উপস্থাপনের অনুবাদে মনোযোগ দিইনি। ফলে, দোভাষীর মতে, প্রবন্ধে ও আলোচনায় কিছু গরমিল রয়ে গেছিল। প্রবন্ধের সঙ্গে আমার মন্তব্যের যোগ যেখানে শ্রোতারা খুঁজে পাননি, সেসব জায়গা হয়তো তারা আমার মৌলিক বক্তব্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। যারা আমার আলোচনায় প্রীত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সিক্স ভিলেজেস অফ বেঙ্গল (কলকাতা, ১৯৪৪)-খ্যাত রামকৃষ্ণ মুখার্জি। তিনি তখন কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিকাল ইনস্টিটিউটে ডিসটিংগুইশড সাইনটিস্ট পদের অধিকারী এবং সম্ভবত ওই কলোকিয়ামের সবচেয়ে প্রবীণ অংশগ্রহণকারী। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাকে তার পক্ষপুটের আশ্রয়ে নিয়েছিলেন। আমাকে দেওয়া তাঁর একটি পরামর্শ ছিল এই : ‘এদের আমন্ত্রণে আসবে এবং এদের কষে গাল দেবে, তবেই এদের সমাদর পাবে। এই ডাকসাইটে সমাজবিজ্ঞানী সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। এই সেমিনারে যোগ দেওয়ায় আমার সবচেয়ে লাভ হয়েছিল সেই থেকে অবিরাম ধরে তাঁর। আনুকূল্য পাওয়া।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে গিয়েছিলাম বলে ওই কলোকিয়ামে আমি কিছু বাড়তি সমাদর পেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ভালো আলাপ হয়েছিল সংস্কৃতি বিষয়ক অধিবেশনের আর দুই অংশগ্রহণকারীর। একজন দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাসিত কবি ডেনিস ব্রুটাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। অপরজন মোহাম্মদ সালাহ স’ফিয়া–তিউনিসিয়ার মানুষ, কানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্ব পড়ান। এঁদের সৌজন্য মনে রাখার মতো। সালাহ্ সফিয়ার সঙ্গে পরবর্তীকালে আমার আরেকবার দেখা হয়েছিল–তাঁর হৃদয়ের উত্তাপ তখনো অনুভব করেছি।
ইমানুয়েল ওয়ালারস্টাইন যে কত বড়ো পণ্ডিত, তা আমার জানা ছিল না, তাঁর ‘ওয়র্লড-সিস্টেমে’র তত্ত্বের সঙ্গেও আমার পরিচয় ছিল না। তার তত্ত্ব অনুসরণ করে লিখিত এবং অন্য অধিবেশনে উপস্থাপিত একটি প্রবন্ধের প্রসঙ্গে আমি যখন জানতে চাইলাম, ‘ওয়র্লড-সিসটেন্স’ না বলে ‘ওয়ার্লড সিসটেম’ বলা হচ্ছে কেন, তখন নিজের অজ্ঞতাই জাহির করা হয়েছিল। ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্ব-অনুযায়ী সারা পৃথিবী এক অর্থনীতির অধীন। আমি যেহেতু পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রকে দুই পৃথক ব্যবস্থা বলে গণ্য করতাম, তাই জানতে চেয়েছিলাম, বিশ্ব-ব্যবস্থা কি এক না একাধিক? ওয়ালারস্টাইনের তত্ত্ব সম্পর্কে আরো না জেনে আমার কিছু বলা ঠিক হয়নি। এমনকী, রামকৃষ্ণ মুখার্জিও পরে বললেন, ‘ও-প্রশ্ন না করলেই পারতে। সকালে তুমি এত ভালো বললে!’ অর্থাৎ নিজেকে ডুবিয়েছি। আসলে গোটা কলোকিয়ামই পরিচালিত হয়েছিল ওয়ালারস্টাইনের তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ব্যাপারটা আমি আগে বুঝিনি।
ওয়ালারস্টাইনের ব্যবহারে অবশ্য কোনো তারতম্য দেখিনি। এই কলোকিয়ামের প্রবন্ধগুলি সংগ্রহ করে যখন ওয়ার্লর্ড ইনইকুয়ালিটি (মন্ট্রিয়ল, ১৯৭৫) নামে বই বের হয়, তখন একটি দীর্ঘ চিঠিতে তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, ব্রাজিলের সেই প্রবন্ধটি তত সন্তোষজনক বিবেচিত না হওয়ায় তা মুদ্রিত হয়নি এবং মূল প্রবন্ধ মুদ্রিত না হওয়ার কারণে আমার আলোচনাও বইতে স্থান পায়নি–আমি যেন কিছু মনে না করি। পরে তিনি ফার্ডিনান্ড ব্রডেল সেন্টারের পরিচালক হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেলে দীর্ঘকাল ওই সেন্টারের কাগজপত্র আমাকে পাঠাতেন। তাছাড়া, আনোয়ার আবদেল মালেক আয়োজিত অন্য একটি সেমিনারে তাঁর সঙ্গে আমিও অংশগ্রহণ করি। সেখানেও তিনি খুব সহৃদয় আচরণ করেছিলেন।
ওই কলোকিয়ামে উপস্থিত দুই বাঙালি শ্রোতা আমার খুব সমাদর করেছিলেন এবং একজন নিজের গাড়িতে করে মন্ট্রিয়ল শহর ঘুরে দেখিয়েছিলেন।
৩৩.
মন্ট্রিয়লে সেমিনার শেষ করেই আমি লন্ডনে ফিরে এলাম। ইয়েন মার্টিন হিথরো থেকে আমাকে নিয়ে চললেন এ কে এম আবদুর রউফের বাড়িতে। তার আগে মুশারফ হোসেনের চিঠি পড়ে বললেন, মুশারফ তোমাকে কিছু পাউন্ড দিতে বলেছে–এটা তুমি আগে জানালে আমি এখানেই তা দেওয়ার ব্যবস্থা করতাম। ঠিক আছে, কাল দেওয়া যাবে। চিঠিতে মুশারফ কী লিখেছেন, তা আমার আদৌ জানা ছিল না, সুতরাং ইয়েনকে কিছু জানাবার সুযোগই ছিল না। মুশারফ হোসেন যে বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমাকে অর্থসাহায্য করার কথা ভেবেছেন, তাও অপ্রত্যাশিত ছিল।
রউফের বাড়ি পৌঁছে কলিং বেল টিপে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। একটা টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করলাম। ফোন বাজছে, কেউ ধরে না। ইয়েনের প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল, বাড়ির নম্বর ভুল হয়েছে কি না, টেলিফোনে সাড়া না পেয়ে বললেন, কিছু একটা হয়েছে–ওরা কেউ বাড়ি নেই। আমি খুব লজ্জিত হয়ে বললাম, দুঃখিত। তুমি আমাকে একটা শস্তা হোটেল বা গেস্ট হাউজে নিয়ে চলো। ইয়েন বললেন, তুমি আমার বাড়ি চলো। আমি খুব অগোছালো থাকি, তোমার অসুবিধে হবে। তবে তোমাকে হোটেলে নেওয়ার চেয়ে নিজের বাড়িতে নেওয়া ভালো। আমার মৃদু আপত্তি কোনো কাজে এলো না। ইয়েন থাকতেন এসেক্সে। দক্ষিণ-পশ্চিমে বিমানবন্দর থেকে আমাকে নিয়ে উত্তরে রউফের বাড়ি হয়ে পুবে নিজের বাড়িতে ফিরতে হলো বেচারাকে। সরাসরি বাড়িতে নেওয়া অনেক সহজ হতো।
সকালবেলা ইয়েনের বাড়িতে খেয়ে, তাঁর কাছ থেকে পাউন্ড নিয়ে, আলমগীর সিরাজুদ্দীনের বাড়িতে স্যুটকেস রেখে, গেলাম আমাদের হাই কমিশনে। সেখানে রউফ নেই, তাঁর হদিস ঠিকমতো পেলাম না। মামুনের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারিনি। আলমগীর বললেন, তাঁদের নাফিল্ডের ফ্ল্যাটে অতিথি রাখার নিয়ম নেই। তবে তাঁর পাকিস্তানি শ্যালক বন্ধুদের নিয়ে যে-ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে, সেখানে রাত কাটাতে পারি। সেখানেই গেলাম। গভীর রাতে ঘরের দরজায় করাঘাত। আশ্রয়দাতা জানালো, আমার খোঁজে কে যেন এসেছে। নিচে নেমে দেখি, মামুন। সেই দণ্ডেই আসমা সিরাজুদ্দীনের ভাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে মামুনের গাড়িতে উঠে পড়লাম। তার কাছ থেকে জানা গেল, রউফের পুরো পরিবার খাদ্যের বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ভাবি কোনোমতে টেলিফোনের কাছে এসে এমারজেন্সির নম্বর ডায়াল করেন। তারপর অ্যামবুলেন্স এসে বাড়ির পাঁচজনকেই নিয়ে যায় হাসপাতালে। আজই বন্ড দিয়ে তারা বিকেলে ঘরে ফিরেছেন–তাও আমার জন্যে। মামুনকে বলেছেন, আমাকে খুঁজে বের করে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে। মামুন প্রায় গোয়েন্দার মতো অনুসন্ধান চালিয়ে আমাকে ধরতে পেরেছে।
রউফের বাড়িতে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর অপরিসীম যত্নে এক সপ্তাহ আনন্দে কাটানো গেল। তার মধ্যে এক সন্ধ্যায় আবু রুশদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ। তিনি বাংলাদেশ হাই কমিশনে এডুকেশন কাউনসেলর। বেশ বড়োসড়ো পার্টির আয়োজন করেছেন, তবে তা নারীচরিত্র-বর্জিত। প্রধান অতিথি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে সৈয়দ হোসেন, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব, তবে বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি হওয়ার সূত্রে পদমর্যাদা যতটা দাবি করে, তার প্রভাব তার চেয়ে অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। সিভিল সার্ভিসের দুই জ্যোতিষ্ক–মনোয়ারুল ইসলাম ও সৈয়দ শামীম আহসান–উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা তিনজন সম্ভবত কোনো সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন। আলমগীর সিরাজুদ্দীন আর আমি ছিলাম। আরো কয়েকজন ছিলেন। সৈয়দ হোসেন সদ্যপরিচিতদের প্রত্যেকের কাছেই জানতে চাইছিলেন, কে কেন কতদিন বিদেশে আছেন এবং কবে দেশে ফিরে যাবেন। তার কণ্ঠের দৃঢ়তাহেতু মনে হচ্ছিল, তিনি ধমক দিয়ে কথা বলছেন–সেটা আমার ভালো লাগেনি। আবু রুশদ যখন এরপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কী পান করবেন, তখনো তিনি অনাবশ্যক জোরের সঙ্গে বললেন, ‘সফট ড্রিংক, অফ কোর্স। তারপর যাকেই জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনিই বলেন, কোমল পানীয় খাবেন; এমনকী যার সুরাসক্তির খ্যাতি আছে, তিনিও বলেন, হালকা কিছু খাবেন। তাঁদের কথায় গৃহকর্তা বিব্রত হতে থাকলেন, কেননা, মনে হলো, তার প্রশ্নটাই ছিল অনাবশ্যক ও অনুচিত। সুতরাং আমি যখন বললাম, শক্তমতো কিছু খাবো, তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি একটা ককটেল বানিয়েছিলেন। আমাকে দিলেন, নিজে নিলেন, এবং বললেন, ‘আনিসুজ্জামান সাহেব, খান, কারো পরোয়া করবেন না।’
বেপরোয়া খেতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে গেলাম এবং সেটা কারো অগোচর রইলো না। নিজে কুণ্ঠিত হলাম এবং গৃহকর্তাকেও বিব্রত করলাম। শামীম আহসান পকেট থেকে কী-একটা বড়ি বের করে খেতে দিলেন। আমি খেতে চাইছিলাম না, তিনি বললেন, এটা আপনার খাওয়া দরকার। খেলাম। শেষে লজ্জিতমুখে ও অবনতমস্তকে বসে রইলাম চুপ করে। ওই অবস্থায় ঘুম পেতে লাগল। তারপর এক সময়ে আলমগীর এবং আমি বিদায় নিয়ে পদব্রজে টিউব স্টেশনে চললাম। একই ট্রেনে উঠে আমি নেমে গেলাম অদূরে। রউফের বাড়িতে বাকি পথ হেঁটেই ফিরলাম।
এর মধ্যে বেবীর পাঠানো খবর এলো : আমাকে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমিক স্টাফ ফেলোশিপ মনজুর করার চিঠি চট্টগ্রামে পৌঁছে গেছে। সুতরাং অ্যাসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটিজে গিয়ে আলাপ করে এলাম। সেখানে কমনওয়েলথ বৃত্তির দায়িত্বে ছিলেন রেবেকা জেমস-মহিলা অতি সদাশয়। সত্যিকার উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম তার কাছে আর পেলাম বহুরকম প্রয়োজনীয় পরামর্শ। তাঁর সহকারী ক্যাথির সঙ্গে পরিচয় হলো–খুব হাসিখুশি মেয়েটি। তার পদবি এখন মনে নেই, তবে অল্পকাল পরে বিয়ে করে সে ক্যাথলিন রবার্টস নামে পরিচিত হয়েছিল। আমার কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন করেছিলাম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস)। সেখানকার বাংলার প্রফেসর টি ডব্লিউ ক্লার্ক কিছুকাল হলো গত হয়েছেন। এখন বাংলা পড়ান ড. তারাপদ মুখোপাধ্যায় এবং বাংলা ও ওড়িয়া পড়ান ড. জে ভি বোলটন–উভয়েই লেকচারার। সুতরাং আমার গবেষণাকর্মে কোনো উপদেষ্টা নিযুক্ত হননি, তবে আমাকে যুক্ত করা হয়েছে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ও সিলোন বিভাগের প্রধান এবং সংস্কৃতের প্রফেসর জে সি রাইটের সঙ্গে। সোয়াসে গিয়ে প্রফেসর রাইটকে পেলাম না, বোলটনও লন্ডনের বাইরে, কিন্তু তারাপদ মুখোপাধ্যায়কে পাওয়া গেল। তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। আমার শিক্ষক শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। সেকথা বললেন, অনেকের খবরাখবর নিলেন। আমাকে নিয়ে লাইব্রেরি দেখাতে গেলেন। সেখানে সহকারী গ্রন্থাগারিক ডোগরা অনুরোধ করলেন, যখন সোয়াসে যোগ দিতে আসবো, তখন যেন বাংলাদেশ থেকে বই কিনে নিয়ে আসি যতটা পারি। ওঁরা আমাকে তার মূল্য এখানে পরিশোধ করে দেবেন।
খুশিমনে লন্ডন থেকে রওনা হলাম। দিল্লিতে ড. মল্লিকের বাড়িতে থাকলাম দুদিন। ভাবির আতিথেয়তার তুলনা হয় না। তারপর থাই এয়ারওয়েজযোগে ঢাকায় আসার পালা। ঢাকায় নামবার সময় হয়ে গেছে, তখনো দেখি বিমানটির উচ্চতার কিছু লাঘব হচ্ছে না। এয়ারহোস্টেসকে ডেকে জানতে চাইলাম, কী ব্যাপার। সে একটু দেরি করে ফিরে বললো, ক্যাপ্টেন জানাবেন। আমি তো বুঝে গেছি যা বোঝার। তার বেশ খানিকক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন ঘোষণা করলেন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ঢাকায় অবতরণ করা সম্ভবপর হলো না। আমরা সোজা ব্যাংকক যাচ্ছি। সেখান থেকে পরদিন যাত্রীদের ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাবে। আমার পকেটে তখন ৪০ ব্রিটিশ পেনি এবং বাংলাদেশের ৫০ টাকা আছে মাত্র।
ব্যাংককের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়টা ভালো হয়নি। সেই ১৯৭৪ সালে ব্যাংকক আজকের মতো উন্নত হয়নি। তার ওপর এতজন যাত্রী একসঙ্গে চলতে প্রতিপদে বিলম্ব হতে লাগল। বিমানবন্দর থেকে গাদাগাদি করে বাসে যাওয়া হলো হোটেল এশিয়ায়। কর্তৃপক্ষ বললো, একেক ঘরে দুজন যাত্রীকে থাকতে হবে–সবাইকে আলাদা ঘর দেওয়ার মতো প্রচুর ঘর খালি নেই। তবে আমরা সকলে ঢাকায় ফোন করে খবর দেওয়ার সুবিধে পাবো।
যার সঙ্গে আমাকে ঘর ভাগ করতে হলো, সে একজন গ্রিক নাবিক। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে সে জাহাজ ধরবে। মাঝখানে বিনা পয়সায় ব্যাংককে আসতে পেরে সে খুশি। তার ইচ্ছে হলো, একটু ফুর্তি করবে। খানিক পরে এক হাড়-জিরজিরে স্বদেশিকে ধরে নিয়ে এসে সে বললো, ও খানিক রাত আমার বিছানায় ঘুমাবে, আমি ফিরে এলে আবার নিজের ঘরে চলে যাবে। আমি দরজায় করাঘাত করলে ও খুলে দেবে, তবে ও ঘুমিয়ে গেলে তুমি খুলে দিও একটু কষ্ট করে। আমি কোনো কথাই বললাম না।
হাড়-জিরজিরে বোধহয় একেবারেই ইংরেজি বলে না। বিনা বাক্যব্যয়ে সে বিছানায় চলে গেল এবং মৃদু নাক ডাকতে আরম্ভ করলো। আমাকে জাগিয়ে রাখতে সেই শব্দই যথেষ্ট। খানিক পরে দরজায় টোকা। আমি খুললাম। গ্রিক নাবিক ফিরে এসেছে স্যুটকেস থেকে কিছু একটা নিতে। প্রচুর দুঃখপ্রকাশ করে সে বিদায় নিলো। খানিক পরে আবার টোকা। দরজা খুলে দেখি, শুধু তোয়ালে পরা একটি থাই মেয়ে পাশের ঘরের দরজায় আঘাত করছে। আবার টোকা। এবারে করিডোরে কেউ নেই। অনেক পরে গ্রিক নাবিকের প্রত্যাবর্তন এবং হাড়-জিরজিরের প্রস্থান। আশা করলাম, এবার শান্তিতে ঘুমোতে পারব, কিন্তু মেজাজ খিঁচিয়ে গেছে বলেই বোধহয় ঘুম আর এলো না।
পরদিন ঘটনাবর্জিত ভ্রমণ এবং ঢাকা-প্রত্যাবর্তন।
৩৪.
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরে আবু হেনা মোস্তফা কামাল থাকছিলেন আমার সঙ্গেই। তাতে আমাদের খুব আনন্দ হচ্ছিল, তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও সরসতা সবসময়ে একটা উপভোগ্য পরিবেশ রচনা করে চলত। তবে দুপুরবেলায় তাঁর অভ্যস্ত বিশ্রাম ঠিকমতো নেওয়া হতো না। দিবানিদ্রাকালে তার বাড়ি যেমন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকত, আমাদের বাড়িতে। ততখানি হতো না। একবার কোনো এক অবকাশে রাজশাহীতে রওনা হওয়ার সময়ে তিনি আমার ছেলেমেয়েদের বিদায়-সম্ভাষণ জানিয়েছিলেন এই বলে : ‘চাচা, আমি চললাম, এখন আপনারা যত খুশি আওয়াজ করতে পারেন।’ আমার ছেলেমেয়েদের প্রত্যেককেই তিনি আপনি করে বলতেন।
স্বভাবতই বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় একটা বাসা বরাদ্দ পাওয়ার জন্যে আবু হেনা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। উপাচার্য আবুল ফজল একদিন আমাকে। ডেকে বললেন, ‘পাহাড়ের ওপরে একটা বাড়ি খালি হয়েছে। তুমি যদি সেটায় যেতে সম্মত হও, তাহলে তোমার বাসাটা আবু হেনাকে দিতে পারি। পাহাড়ের ওপরে উপাচার্যের বাসভবন-সংলগ্ন একটি দোতলা বাড়িতে রেজিস্ট্রার থাকতেন, অদূরে আরো দুটি বাড়ি ছিল অধ্যাপকদের জন্যে। একটিতে থাকতেন। ইতিহাসের আবদুল করিম। সব শেষেরটিতে প্রথমে সৈয়দ আলী আহসান, তারপরে মোহাম্মদ শামসুল হক। বাড়িটি চমৎকার। তবে গাড়ি ছাড়া সেখানে যাতায়াত করা মুশকিল। মেয়েদের পায়ে হেঁটেই স্কুলে যেতে হবে। সামান্য কিছুর প্রয়োজন হলে হয় নিজেকে গাড়ি নিয়ে ছুটতে হবে, নইলে কাউকে পায়দল ছোটাতে হবে।
দুশ্চিন্তার আরো একটি কারণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িসংক্রান্ত নিয়মাবলি প্রণয়নের জন্যে উপাচার্য একটি কমিটি তৈরি করেছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক মোহাম্মদ আলীকে সভাপতি করে। সেই কমিটির সুপারিশে বলা হয়, তিন মাসের বেশি সময়ের জন্যে কেউ ক্যাম্পাসের বাইরে চলে গেলে তাকে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে (অবশ্য পরের বছরে মোহাম্মদ আলীর যখন বিদেশে যাওয়ার সময় হয়, তখন এই মেয়াদ বাড়িয়ে এক বছর করা হয়েছিল, কিন্তু সে পরের কথা)। কিছুকাল পরে সপরিবারে বিলেত যাবো বলে আশা করছি। এখন একবার বাড়ি বদলাবো, তারপর তখন আবার বাঁধাছাদা করে বাড়ি ছাড়া–চাপটা বেবীর ওপরে অতিরিক্ত হয়ে যাবে। তবু, আমি বাড়ি বদলালে আবু হেনা বাড়ি পাবেন এবং পরিবার নিয়ে আসতে পারবেন, একথা ভেবে বেবী সম্মতি দিলো। সমতলে যে-বাড়িতে ছিলাম, তার একটি স্মৃতি অবিস্মরণীয়। সেখানে এক দুর্ঘটনায় গরম পানিতে আনন্দের পিঠ পুড়ে গিয়েছিল এবং জখমটা হয়েছিল মারাত্মক। চিকিৎসকদের ক্লান্তিহীন প্রয়াসে সে ভালো হয়ে ওঠে। সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শ্রেণির মানুষের যে-সহমর্মিতার পরিচয় পাই, তা ভোলবার নয়। আবাসিক এলাকার মসজিদে আমার যাতায়াত ছিল না, অথচ আমার সন্তানের আরোগ্যকামনায় সেখানে বিশেষ মোনাজাত হয়েছিল–তাতে আমি খুবই অভিভূত হয়েছিলাম।
পাহাড়ের বাড়িতে গিয়ে আমি একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে পেরেছিলাম অনেকদিন পরে। চর্যাগীতির সমাজচিত্র’ নামে এই লেখাটি আমাদের বিভাগীয় সমিতির এক সেমিনারে পড়েছিলাম অধ্যাপক আবদুল করিমের সভাপতিত্বে। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল আমাদের বিভাগীয় গবেষণাপত্র পাণ্ডুলিপিতে, পরে তা আমার স্বরূপের সন্ধানে (ঢাকা, ১৯৭৬) বইতে স্থান পায়।
এ-সময়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষকমণ্ডলীর শক্তি বেশ বৃদ্ধি পেলো। মোহাম্মদ আবদুল কাইউম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ ডি করে ফিরে এলেন। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ ফিরলেন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে–অল্পকাল পরে তার এম এ ডিগ্রিলাভের খবর এলো। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষকদের হিসেব নিলে আমাদের স্থানটা বেশ গৌরবজনক হবে।
এর মধ্যে মাহমুদ শাহ কোরেশীকে অধ্যক্ষ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা বিভাগ খোলা হয়েছে। প্রথমে তার শিক্ষকসংখ্যা দুই-ফরাসিতে কোরেশী, রুশ ভাষায় প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ড. শফিক হায়দার চৌধুরী–উভয়েই খণ্ডকাল শিক্ষক। কেবল খণ্ডকাল-শিক্ষক নিয়ে বিভাগ প্রতিষ্ঠার আর দৃষ্টান্ত আছে কি না, আমার জানা নেই। নিজের বিবেচনায় উপাচার্য যা করেছেন, তাতে আমাদের কী বলার থাকতে পারে! পরে বাংলা বিভাগে কর্মরত পালির শিক্ষক রণধীর বড়ুয়া এবং সংস্কৃতের শিক্ষক ভুবনমোহন অধিকারীকে ওই বিভাগে বদলি করা হয়। আমি একবার কোনো কাজে ঢাকায় এসেছিলাম, ফিরে গিয়ে শুনি, নির্বাহী আদেশে এই দুই সহকর্মীকে বদলি করা হয়েছে। তা হোক, কিন্তু উপাচার্য যে সৌজন্যের খাতিরেও তাঁদের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে এ-বিষয়ে আমার কোনো মতামত চাইলেন না, তাতে আমি একটু ক্ষুব্ধ না হয়ে পারলাম না। মনে হয় এই স্বাভাবিক নিয়ম পালন না করার পরামর্শ উপাচার্যকে কেউ দিয়েছিলেন।
অথচ অধ্যাপক আবুল ফজলের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ভালো। সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহু কাজে একযোগে শরিক আমরা। রশিদ চৌধুরী যখন উদ্যাগ নিলেন চট্টগ্রামে একটা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে, তখন স্থানীয় বিশিষ্টজনদের জড়ো করা হয় সাহিত্য-নিকেতনে। সেখানে আমিও ছিলাম। চট্টগ্রাম চারুকলা কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে যে-কমিটি হয়, তাতে আমারও নাম থাকে। তাছাড়া, আরো কতরকম সভা-সমিতিতে আবুল ফজলের সহচর ছিলাম আমি। তিনি সবসময়েই আমাকে হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সম্পর্ক মোটের উপর আনুষ্ঠানিক পর্যায়েই রয়ে গিয়েছিল। সেই আনুষ্ঠানিকতারও হানি যে কখনো কখনো হয়েছে, তার দৃষ্টান্ত দিয়েছি। তবে আমার বিশ্বাস, তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক কখনো ক্ষুণ্ণ হয়নি। আমি বরাবরই তাঁর স্নেহলাভ করেছি।
৩৫.
শিক্ষা-কমিশনের কাজ শেষ হয়ে এলো। ১৯৭৩ সালের জুন মাসে কমিশন। একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করে এবং চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার জন্যে সময় চেয়ে নেয়। এখন সেই চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার সময় এসে গেল।
ত্রিশ বছর পেছনের দিকে তাকিয়ে আমি এখনো মনে করি, এই কমিশন একটি ভালো রিপোর্ট দিতে পেরেছিল। এর কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়তো বাহুল্য হবে না। আমরা জোর দিয়েছিলাম সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ওপরে এবং প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ পাঁচ থেকে বাড়িয়ে আট বছর পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেইসঙ্গে এই যুগান্তকারী সুপারিশ করা হয়েছিল যে, আট বছরের এই প্রাথমিক শিক্ষায় সর্বক্ষেত্রে–স্কুলে ও মাদ্রাসায়–অভিন্ন পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হবে। এ-বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষকদের সম্মত করতে বেগ পেতে হয়েছিল, কিন্তু কুদরাত-এ-খুদা তা করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁর অসীম ধৈর্য ও প্রবল প্রত্যয়ের কারণে। মাদ্রাসায়–এবং সেইসঙ্গে (সংস্কৃত) টোল ও পালি টোলে–এই অভিন্ন পাঠ্যসূচি এক ও অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি হতে পারত। মাদ্রাসা-বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এর বিনিময়ে একটা ছাড় আদায় করে নিয়েছিলেন, তা হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মশিক্ষার বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা। আদিতে আমরা নীতিশিক্ষার সুযোগ রেখেছিলাম। ধর্মশিক্ষার পণ্ডিতেরা যখন ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে চান, তখন আমি আপত্তি করি। আমার সঙ্গে আরো কেউ কেউ মতৈক্য পোষণ করেছিলেন। কুদরাত-এ-খুদা যদিও আমাদের বুঝিয়েছিলেন, ধর্মশিক্ষার বিকল্পে নীতিশিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে, তবু আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে, বিকল্প থাকলে নীতি আর পড়ানো হবে না, ধর্মশিক্ষাই দেওয়া হবে এবং অনেক জায়গায় ইসলাম ছাড়া। অন্য ধর্মশিক্ষার সুযোগ থাকবে না, অমুসলমান ছাত্রকেও ইসলাম ধর্মশিক্ষা নিতে হবে। তারপরও কুদরাত-এ-খুদা বলেছিলেন, মাদ্রাসায় যদি বাংলা মাধ্যম ও অভিন্ন পাঠ্যসূচি অবলম্বন করা হয়, তাহলে যে-লাভ হবে, সেই তুলনায় ধর্মশিক্ষার প্রবর্তন হবে অল্প ছাড়।
প্রাথমিক স্তরের পরে বৃত্তিমূলক শিক্ষা হিসেবে ধর্মশিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। মাদ্রাসার ছাত্রেরা ইচ্ছে করলে এটাও নিতে পারবে এবং উচ্চতর স্তরে ধর্ম বা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব শিক্ষালাভের সুযোগ তাদের থাকবে। আরো কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল যাতে মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষার ভেদ কমিয়ে আনা যায়। মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত, এই সুপারিশ তাঁরা যে মেনেছিলেন, তাতে কমিশনের সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সিরাজুল হকের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল।
বৃত্তিমূলক শিক্ষার ওপরে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল কমিশনের রিপোর্টে। দেশে শিল্পের বিকাশ কত দ্রুত ও ব্যাপক হতে পারবে, তার কোনো ইঙ্গিত ছিল না। ফলে কৃষিভিত্তিক বৃত্তিশিক্ষার কথা ভাবা হয়েছিল। শিক্ষক-শিক্ষণকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্যারামেডিক তৈরির একটা পরিকল্পনাও ছিল। এছাড়া, এমন সব বৃত্তিশিক্ষার প্রস্তাব ছিল যা লাভ করলে স্বনিয়োজিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকত। শিক্ষাখাতে জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ নিয়োগ করার পরামর্শ ছিল এবং পরে তা আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়েছিল। তবে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্রদের বেতন বাড়াবার প্রস্তাব ছিল।
রিপোর্টের হতাশাব্যঞ্জক দিক ছিল নারীশিক্ষার বিষয়ে ভাবনায়। তখনো আমরা মেয়েদের উপযোগী শিক্ষার কথা ভেবেছি, দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনে কোন শিক্ষা তাদের কাজে আসবে, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি।
সংবিধানে যে অভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষার কথা বলা হয়েছিল, তা পুরোপুরি অর্জনের সম্ভাবনা এই রিপোর্টে দেখা যায়নি। তবে এই রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়িত করার পরে অল্পকালের মধ্যে শিক্ষা-পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করার সুপারিশ করা হয়েছিল। নিজেদের সুপারিশকে আমরা অজর, অমর, অক্ষয় বলে দেখিনি।
৩৬.
১৯৭৪ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধুর কাছে আমরা শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করতে গেলাম। সভাকক্ষে এসে আসনগ্রহণের পরে তিনি আমার দিকে। তাকিয়ে বললেন, সভার পরে আমি যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাই।
সভার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। তখন দেশের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে যে-অর্থের প্রয়োজন হবে, তার সংস্থান কীভাবে হবে, তার মনে সে-চিন্তাও দেখা দিয়েছে। আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, তখন সেখানে শিক্ষামন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমরা নাকি এমন রিপোর্ট লিখেছ যা ইমপ্লিমেন্ট করতে আমার পুরো বাজেট চলে যাবে। আমি জানতে চাইলাম, আপনি কি ইন্টারিম রিপোর্ট পড়েছেন? তিনি বললেন, ‘রিপোর্ট পড়ার সময় কই আমার! সেক্রেটারিরা আমাকে যা বলেছে, আমি তার ভিত্তিতে বলছি।’ আমি বললাম, আপনার কি মনে পড়ে, কমিশন উদবোধন করার সময়ে আমি অর্থ-সংস্থানের বিষয় জিজ্ঞেস করেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, টাকা-পয়সার বিষয়ে আমরা যেন চিন্তা না করি। তবু আমরা চিন্তা করেছি। আপনাকে একটা উদাহরণ দিই। সব স্কুলে ভালো লাইব্রেরি থাকা উচিত। তবু বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে আমরা বলেছি, ইউনিয়ন-পর্যায়ে একটা ভালো লাইব্রেরি থাকবে। সেখান থেকে স্কুলগুলো বই লেনদেন করবে। আদর্শ অবস্থার কথা ভাবলে আমরা অন্যরকম বলতাম।
তিনি একটু ভাবলেন। আমি সেই অবকাশে জানতে চাইলাম, তিনি কেমন আছেন। কিছুকাল আগে তিনি মস্কোতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তনের পরে আমার সঙ্গে এই প্রথম দেখা। আমার প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বললেন, তিনি খুব ভালো নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে মস্কো থেকে চলে এলেন কেন? তিনি বললেন, আমি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যাকে ভাইস চান্সেলর ঘেরাও হলে তাঁকে উদ্ধার করতে যেতে হয়। মস্কোতে থাকতে খবর পেলাম, সূর্য সেন হলে সাতজন ছাত্র খুন হয়েছে। তখন চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখে চলে এলাম। বললাম, আপনি বিশ্রাম নিন না কেন? এখানে না পারেন, সপ্তাহান্তে ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যান। তিনি বললেন, দেশে কোথাও গিয়ে বিশ্রাম হবে না। যেখানে যাবো, সেখানেই লোকজন ভিড় করবে। বললাম, ‘লোকজনকে দেখা দেবেন না। এবার তার চোখে পানি এসে গেল। বললেন, ‘লোককে খেতে দিতে পারি না, পরতে দিতে পারি না, দেখাও যদি না দিতে পারি, তাহলে আমার আর থাকলে কী?’ আমি এবারে অপ্রস্তুত হলাম।
এবারে তিনি কাজের কথা পাড়লেন। কবীর চৌধুরী শিক্ষা-সচিবের দায়িত্ব ছাড়তে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা, একজন শিক্ষাবিদকে এই পদে নিয়োগ দেবেন। তাঁর অন্যতম দায়িত্ব হবে শিক্ষা-কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া। রিপোর্টের বিষয়টা আমার ভালো জানা আছে। তিনি আমাকে শিক্ষা-সচিবের দায়িত্ব দিতে চান এবং অবিলম্বে।
শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন। আমি আঁতকে উঠলাম। বললাম, প্রশাসনিক কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
বঙ্গবন্ধু বললেন, বুঝেছি, তুমি সি এস পিদের অসহযোগিতার ভয় করছ! তুমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসতে পারবে–আমি সে-ব্যবস্থা করে দেবো।
আমি প্রমাদ গনলাম। বললাম, আমি মাস্টারি করে এসেছি, তা-ই করতে চাই। সচিব হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। ও-কাজ পারবো না।’
বঙ্গবন্ধু একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, আমার চারপাশে চোর-ডাকাত ভিড় করে আছে। আস্থা রাখতে পারি এমন সৎ লোক চাই কাজের জন্য। তাই তোমাকে বলছি। চোরদের থেকে রেহাই পেতে চাই।’
আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। বললাম, ‘লোকে তো তাই বলে, আপনার চারপাশে অনেক অসৎ লোক, আপনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না।
এবারে তিনি রাগ করলেন। বললেন, ‘কে বলে আমি ব্যবস্থা নেই না? কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের এক বিশিষ্ট মহিলা-কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাঁর নাম করে বললেন, ‘ওকে আমি এক্সপেল করিনি? কত কাল ধরে সে আওয়ামী লীগ করে এসেছে। তাকে যেদিন এক্সপেল করি, সে রাতে আমি ঠিকমতো ঘুমোতে পারিনি। ওর চেহারা, ওর মা-বাপের চেহারা, ওর ভাইবোনের চেহারা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।
এরকম কোনো সময়ে শিক্ষামন্ত্রী উঠে পড়লেন। তিনি লন্ডন যাচ্ছেন–তাঁকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। পরে শুনেছিলাম, লন্ডনে আমাদের দূতাবাসের কাউকে কাউকে তিনি বলেছিলেন, আমি শিক্ষা-সচিব হতে যাচ্ছি।
আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘লন্ডনে গবেষণার জন্যে আমি বৃত্তি পেয়েছি। আমাকে এই কাজটি করতে দিন। ফিরে এসে আমি সরকারি কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।’
বঙ্গবন্ধু তবু বললেন, তখুনি ‘না’ না বলে ভাববার সময় নিতে। তাঁর প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খানকে বলে দিলেন, পরদিন এই সময়ে আমি আবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসবো–সে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রাখে।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বেরিয়ে আমি সোজা এলাম অর্থমন্ত্রীর তাজউদ্দীন আহমদের দপ্তরে। সেখানে অর্থসচিব মতিউল ইসলাম ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে আমি তাজউদ্দীনকে আদ্যোপান্ত জানালাম। অনুরোধ করলাম, তিনি। যেন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।
তাজউদ্দীন বললেন, তিনি সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। কথাচ্ছলে বঙ্গবন্ধু যদি বিষয়টা উল্লেখ করেন, তাহলে তিনি হয়তো তাঁকে নিরস্ত করতে পারবেন। তবে কথা না তুললে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি কিছু বলবেন না। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথা তোলার সম্ভাবনাই বেশি।
সত্যি তা-ই হয়েছিল। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আমাকে শিক্ষা সচিব করলে একজন ভালো শিক্ষক হারিয়ে মন্দ প্রশাসক পাওয়া যাবে–তাতে লাভ কী?
পরদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন, আমি মত পালটেছি কি না। আমি হাসলাম। বললাম, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগটা ছাড়তে চাই না। আপনি যদি অনুমতি দেন।
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে কথা দিয়ে যাও, ফিরে এসে চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবে। তখন আমি যা বলব, তা কিন্তু শুনতে হবে।
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। যা কখনো করিনি, এরপর আমি তাই করলাম। বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।
তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বিদেশ থেকে ফিরেই দেখা করবে আমার সঙ্গে। তারপর অস্ফুটস্বরে বললেন, ততদিনে আমাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখবে কি না, কে জানে!
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি গলা এত নামিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো কথাটা বলেছিলেন। তাই আর কিছু বলতে চাইলাম না। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
সেই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
৩৭.
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এলেন। ১৯৭৪ সালের ২৭ জুনে। এর আগে ভুট্টো ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চে–সে-বছরের পূর্বাপর তার যে-ভূমিকা তা বিস্মরণযোগ্য ছিল না। ভুট্টোর আগমন–অন্তত আমার মনে–সে-তিক্ত স্মৃতিই জাগিয়ে তুলেছিল।
আমি অবশ্য ঢাকায় ছিলাম না, ছিলাম চট্টগ্রামে। খবরের কাগজে পড়েছিলাম, বিমানবন্দর থেকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পর্যন্ত রাস্তার দু ধারে ভিড় করে মানুষ তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছে। লোকমুখেও শুনেছিলাম, বাংলাদেশের নাগরিকেরা তাঁর ও তাঁর দেশের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছে, তার উদ্দেশে পুষ্পবৃষ্টি করেছে। অবাক হয়েছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম, কারা এই উল্লসিত জনসমষ্টি?
বঙ্গবন্ধু অবশ্য বক্তৃতায় বলেছিলেন ভুট্টোকে–ধ্বংসস্তূপের ওপরে দাঁড়িয়ে তিনি অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন অতিথিকে। বলেছিলেন, প্রতিশোধের বা প্রতিহিংসার মনোভাব থেকে তিনি একাত্তরের ঘটনার স্মৃতিচারণ করছেন না, কিন্তু সে দিনগুলো ভুলে যাওয়া যায় না। বাংলাদেশের লক্ষ্য যে পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা–সেকথা তিনি বলেছিলেন। আর বলেছিলেন, নিষ্পত্তির উপায় হলো দু-দেশের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো মীমাংসা করে ফেলা।
যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭১এর ঘটনাবলির জন্যে ভুট্টো অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু যারা তার কথা শুনেছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল, এবং ঠাণ্ডা ছাপানো বিবরণ পড়ে আমাদেরও মনে হয়েছিল, সে-অনুশোচনা আন্তরিক নয়, আনুষ্ঠানিক ছিল মাত্র। ভুট্টো বরঞ্চ বলছিলেন, সেই মর্মান্তিক ঘটনার ইতি হোক এখানেই। আর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের জের ধরে বলেছিলেন, তিনি চান উভয় দেশের মধ্যে শর্তহীনভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে।
শর্তহীনতার কথা থেকে ভুট্টো আর নড়েননি। বক্তৃতায় বা সরকারি আলোচনায় কিংবা সাংবাদিক সম্মেলনে যতবার ১৯৭১ সালের নৃশংসতার কথা উঠেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা উঠেছে, পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনার কথা উঠেছে, আটকে-পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা উঠেছে, ভুট্টো ততবারই সেসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন, বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। তবে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে, পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে যা তাঁর কর্তব্য ছিল, একাত্তরে তিনি তা-ই করেছিলেন।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে ভুট্টো চরম অসৌজন্য প্রদর্শন করেছিলেন। রংচঙে পোশাকে ও বেমানান ক্যাপে সজ্জিত হয়ে তিনি গিয়েছিলেন সেখানে। চাঁদ সদাগর যেমন বা হাতে ফুল দিয়ে মনসাকে পুজো করেছিলেন, প্রায় তেমনি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পুষ্পস্তবক দিয়েছিলেন স্মৃতিসৌধে। আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার আগেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন ফিরে আসার জন্যে–বোধহয় আমাদের চিফ অব প্রোটোকলই শিষ্টাচার বিসর্জন দিয়ে হাতে ধরে ঘুরিয়ে বিদেশী অতিথিকে আবার নিজের জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরও তিনি ওই স্থান ত্যাগ করার জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অভ্যাগতদের মন্তব্যের খাতায় তিনি কিছু লিখতে অস্বীকার করেছিলেন, বাংলাদেশ বেতারের প্রতিনিধির কাছেও কোনো মন্তব্য করতে স্বীকৃত হননি।
তবে ভুট্টো যখন স্মৃতিসৌধে যান, তখন তাঁর বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। তাঁর সমালোচনা করে একটা প্রচারপত্রও বিলি করা হয় এ-সময়ে।
দু-পক্ষের আলোচনা সম্পর্কে যে-সরকারি বিবরণ বেরিয়েছিল, তাতে উভয়পক্ষের কোনো মতৈক্যের উল্লেখ ছিল না। তবে পত্রিকার ভাষ্যমতে, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছিল। এই সফরকালে ভুট্টোর আচরণ আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়েছিল।
৩৮.
দেশের অবস্থা বেশি ভালো লাগছে না। এদিকে-ওদিকে খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে। তার মধ্যে জাতীয় সংসদে পাশ হয়ে গেল বিশেষ ক্ষমতা আইন। ইংরেজিতে যাকে বলে ড্রেকোনিয়ান ল–এই আইনটি ঠিক তেমন। অথচ জাসদ-দলীয় ও স্বতন্ত্র সদস্যেরা মিলিয়ে মোট পাঁচজন মাত্র তার প্রতিবাদ করলেন। এই আইনে আমাদের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলো–অথচ সে-সম্পর্কে সরকারদলীয় কোনো সদস্য মুখ খুললেন না। আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধরের কথায় মনে হলো, এই আইন পাশ করে তিনি বড় ধরনের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
ওদিকে বিদেশ সফরের ওপরে সরকার বাধানিষেধ আরোপ করেছে। এখন বিদেশযাত্রার জন্যে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাড়পত্র ছাড়াও সরকারের অনুমতি সংগ্রহ করতে হবে। অধ্যাপকদের ক্ষেত্রে অনুমতি দেবেন প্রধানমন্ত্রী। ফাইলটা তাঁর চোখে পড়লে অনুমতি পাবো, তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিষয়টা তাঁর নজরে আনছে কে? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিঠি এসেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে, নথিভুক্ত হয়ে সেসব কাগজ গেছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। মন্ত্রণালয় থেকে জানলাম, ফাইল পড়ে আছে সেখানে। একদিন গেলাম সেখানে। যেতেই তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কেন গেছি সেখানে, জানতে চাইল তোফায়েল। আশ্বাস দিলো, সে দেখবে বিষয়টা।
দেশ ছাড়ার আগে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। সেপ্টেম্বরের একেবারে গোড়ায় গেলাম তার কাছে। তিনি তখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন মাসকালব্যাপী বিদেশ সফরের। অনেকক্ষণ কথা হলো। বললেন, তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, অক্টোবরে দেশে ফিরে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করবেন।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বললেন এই কারণে যে, পদত্যাগের কথা আগেও তিনি ভেবেছিলেন। মনে আছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্পকালের মধ্যেই তিনি হতাশা ব্যক্ত করতে শুরু করেছিলেন। প্রশাসনের বিষয়ে কিছু হতাশা ছিল, তবে রাজনৈতিক কারণেই তার হতাশা ছিল বেশি। সেই ৭২ সালেই-তখনো বাজেট দেওয়ার সময় আসেনি–তাঁর বাসভবনের অফিসঘরে বসে এক সন্ধ্যায় কথা বলছিলাম। টেবিলের ওপরে রাখা একটা ফাইলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এটা তার জন্যে এক উভয়সংকট। বিদেশ থেকে সার আমদানি করতে হবে। নানা কারণে তাঁর মতে, অকারণেই–উদ্যোগ নিতে দেরি হয়ে গেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। এখন প্রস্তাব এসেছে, আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান না করেই, গত বছর যারা সার সরবরাহ করেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানকেই কার্যাদেশ দেওয়া হোক। তিনি বললেন, ‘প্রস্তাবে সম্মত হওয়া মানে আমার পক্ষে নিয়মভঙ্গ করা, সম্ভবত দুর্নীতিতে সাহায্য করা; আর টেন্ডার আহ্বান করতে বলা মানে সময়মতো সার-সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়া। যেটাই করি, সেটাই অসংগত হবে। এইভাবে দেশ চালানো যায় না।
তবে রাজনৈতিক হতাশা ছিল প্রগাঢ়। তার একটা দুঃখ ছিল এই যে, মুক্তিযুদ্ধের ন মাসের কথা বঙ্গবন্ধু কখনো তার কাছে জানতে চাননি। দলের মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধাচরণ যে চলছিল, সে-কথা তাজউদ্দীন প্রথম থেকেই জানতেন। তাঁর মনে হয়েছিল, একদিকে খন্দকার মোশতাক আহমাদ, অন্যদিকে শেখ ফজলুল হক মনি তাঁর বিপক্ষে কাজ করছেন, বঙ্গবন্ধুকেও নানা কথা বলছেন তাঁরা। আমি তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা না করলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি কিছু বলবেন না। আমি জানতে চাইলাম, এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তবে পরিণামে কী হবে? তিনি একটু উদাস কণ্ঠে বললেন, ‘জানি না।’ তাঁর সুরে কিন্তু ঔদাসীন্য ছিল না, অভিমান ছিল।
১৯৭৩ সালের গোড়ার দিকে এক সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদের বাসভবনে গিয়েছিলাম। বারান্দায় দেখা হলো আরহাম আহমদ সিদ্দিকীর সঙ্গে–তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠতা। তাঁর সঙ্গে কুশলবিনিময়ের পরে আমি ভেতরে ঢুকলাম। তাজউদ্দীন প্রথমেই বললেন, মন্ত্রিসভা ও দল থেকে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে ভাবছেন। আমি জানতে চাইলাম, তারপর তিনি কী করবেন? তিনি বললেন, দেখা যাক। জিজ্ঞেস করলাম, রাজনীতি ছেড়ে দেবেন?’ খানিকটা ম্লান হাসি হেসে বললেন, তা পারব না। প্রশ্ন করলাম, তিনি কি অন্য দলে যোগ দেবেন? জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ তিনি পেয়েছেন বলে কানাঘুষো ছিল–সেকথা স্বীকার করলেন তিনি, কিন্তু তাতে যে যাবেন না, তাও স্পষ্ট বললেন। বললাম, তাহলে তো তার বিকল্প নতুন দল গড়া–তিনি কি তা ভাবছেন? তাজউদ্দীন একটু চুপ করে রইলেন, কিন্তু মনে হলো সেটাই তাঁর অভিপ্রায়। জানতে চাইলাম, তিনি যদি আওয়ামী লীগ ছাড়েন, তাহলে দলের কতজন তাঁর অনুবর্তী হবেন? তিনি একটা আনুমানিক সংখ্যা বললেন। বললাম, তাজউদ্দীন ভাই, আজ আপনি অর্থমন্ত্রী। অনেকে নানা কাজে আসেন আপনার কাছে–নানাভাবে আপনাকে সমর্থন করে যান। যেদিন আপনি আর ক্ষমতায় থাকবেন না, সেদিন এদের অধিকাংশকে আপনার ধারেকাছে পাবেন না। আমি জানি, আপনার অকৃত্রিম বন্ধু ও অনুরাগী আছেন অনেকে-তারা আপনার পাশে থাকবেন। যতজন সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ ছাড়বেন বলে আপনি ভাবছেন, তার দশ ভাগের এক ভাগ হয়তো পাবেন আপনার সঙ্গে। এটা আমার অনুমান–প্রকৃত অবস্থা আমার চেয়ে আপনি ভালো বুঝবেন। যদি মনে করেন, দল ছাড়লে দেশের লাভ হবে, আপনার রাজনৈতিক জীবনের উপকার হবে, তবে তা করুন। নইলে দলের ভেতরে থেকে রাজনৈতিক লড়াই করুন। তিনি চুপ করে থাকলেন। আমার কথা তার মনঃপূত না হলেও তিনি ফেলে দেননি।
তার বাড়িতে নানা সময়ে নানাজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতো। একবার ওপরের বারান্দায় ডেকে পাঠালেন। গিয়ে দেখলাম, গাজী গোলাম মোস্তফা বসে আছেন। গাজী শাহাবুদ্দীনের কাকা হিসেবে ১৯৪৯ সাল থেকে তিনি আমারও মানিক কাকা। তিনি তখন রেডক্রসের চেয়ারম্যান–দেশজুড়ে তাঁর নিন্দাবাদ। আমি তাঁর মধ্যে ক্ষমতার দর্প দেখিনি, দুর্নীতির কথা বলতে পারব না। তাজউদ্দীনের সঙ্গে তিনি খুবই সৌজন্যপরায়ণ ছিলেন। আরেক সন্ধ্যায় দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেক্ষাকৃত এক তরুণ শিক্ষক বেরিয়ে আসছেন তাজউদ্দীন আহমদের ড্রয়িংরুম থেকে। ভেতরে ঢুকে তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চাইলাম, ওই ব্যক্তি তার বাড়িতে কেন? তিনি একটু বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘ও তো আমাদের অনেক পুরোনো কর্মী–আপনি চেনেন না ওকে? বললাম, ‘চিনি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে সম্প্রতি অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যারা গোলযোগ করেছিল–এ তাদের মধ্যে একজন।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের যোগদানে বাধা দিতে তাকে পিস্তল। দেখিয়েছিল। তাজউদ্দীন আরো বিস্মিত, তাঁর চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছায়া। বললেন, এ হতে পারে না, আপনি ভুল শুনেছেন। বললাম, আপনিই না বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর নিকটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনতে চান না, বিশ্বাস করেন না। আপনিও তো তাই করছেন। তিনি চুপ করে গেলেন, বেদনার্তচিত্তে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় একা এলে আমি উঠতাম কাকরাইলে আমার বড়বোনের বাড়িতে। অনেক সময়ে নিরিবিলিতে কথা বলার জন্যে সন্ধ্যার পরে তাজউদ্দীন সেখানে চলে আসতেন। আমার সৌভাগ্য, আমার প্রতি তিনি আস্থা রাখতেন। তাঁর সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতার কারণে আমি তরুণ প্রজন্মের অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলাম না।
আগের কথায় ফিরে যাই। আড়াই বছরের মন্ত্রিত্বের বেশির ভাগ সময় তাজউদ্দীনের কেটেছিল দ্বিধাদ্বন্দ্বে, সংশয়ের দোলায়, অনুকূল পরিবেশের অভাবে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে গৃহীত সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর মনে হয়েছিল, আমরা গণতন্ত্র চর্চা করছি না, সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হতে পারছি না। এখন, ৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে এসে, তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন–অনেক হয়েছে, আর নয়। এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে তাকে নিরুৎসাহিত করার মতো কোনো কথা আমি আর এবারে বলিনি। আমি তাঁকে জানালাম, সেপ্টেম্বরের শেষে সপরিবারে আমি লন্ডন রওনা হচ্ছি। তিনি বললেন, অক্টোবরে তিনি লন্ডন হয়ে ফিরবেন–তখন যেন সেখানে দেখা করি।
তাজউদ্দীনের সফরসূচিতে এবারে অনেকগুলি দেশ ভ্রমণের কথা ছিল। প্রথমে তিনি যাবেন বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নে, তারপর কানাডায়, সর্বশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই প্রথম তিনি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে তাঁদের দরবারে যাচ্ছেন। বৈদেশিক সাহায্য–বিশেষ করে মার্কিন সাহায্য–গ্রহণ করার বিষয়ে তাজউদ্দীনের অনীহার কথা সর্বজনবিদিত ছিল। বিশ্বব্যাংকের প্রতিও তার মনোভাব অনুকূল ছিল না এবং তার প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারাকে মার্কিন প্রশাসনের একটা বড় খুঁটি জ্ঞান করে তিনি বেশ অপছন্দ করতেন। বাংলাদেশে ম্যাকনামারা যখন প্রথম বেসরকারি সফরে আসেন, বোধহয় ১৯৭২ সালে, তখন তার সঙ্গে তিনি সৌজন্যপ্রকাশেও কুণ্ঠিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যে-আলোচনা হয়েছিল ঢাকায়, শুনেছি, সেখানেও তাজউদ্দীনের অনাগ্রহ স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে, সমাজতন্ত্রের প্রতি তাজউদ্দীনের পক্ষপাতের কথা জেনেও ম্যাকনামারা নাকি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য সম্পর্কে শ্লেষাত্মক মন্তব্য করতে ছাড়েননি। এখন সমাজতান্ত্রিক দেশ সফরশেষে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তাকে বাধ্য হয়ে বিশ্বব্যাংকের আনুকূল্য চাইতে হবে। এই সম্ভাবনা যে তিনি খুব উপভোগ করছিলেন, তা নয়; কিন্তু দেশের পরিস্থিতি–বিশেষ করে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি–যেদিকে যাচ্ছে তাতে তার সামনে বিকল্প পথও খোলা ছিল না।
তাজউদ্দীনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন বেরিয়ে এলাম, তখন আমার বারেবারে ১৯৭১-এর দিনগুলি মনে পড়ছিল।
৩৯.
যেহেতু যুক্তরাজ্যে এক বছর মেয়াদি ভিসার জন্যে আবেদন করবে, তার একটি আবশ্যকীয় শর্ত ছিল ব্রিটিশ হাই কমিশন-মননানীত প্যানেলের একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে সন্তোষজনক মেডিক্যাল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা। আমার স্ত্রীপুত্রকন্যার জন্যেও একই শর্ত প্রযোজ্য। প্যানেলের প্রথম নাম ছিল ড. ব্যাসেটের–তিনি জাতে ইংরেজ, বহুকাল ঢাকায় আছেন। তাঁর কাছেই গেলাম। তিনি আমার ভ্রমণের উদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করায় বললাম, গবেষণা। তিনি খানিকটা উত্তেজনার সঙ্গে বললেন, কিসের গবেষণা! ব্রিটিশ করদাতাদের অর্থে, আমার পয়সায়, তুমি বিলেত যাবে গবেষণা করতে! আমি থতমত খেয়ে বললাম, ব্যাপারটা ওরকমই। তিনি বললেন, আর তোমার পরিবার? বললাম, তারা আমার সঙ্গে থাকবে সেখানে। তিনি বললেন, আমি তোমাকে পরীক্ষা করবো, তোমার পরিবারের সদস্যদের করবো না। আমার মুখে কথা জোগালো না। তিনি একটা ছাপা কাগজে কয়েকটা ঘরে দাগ দিয়ে বললেন, এই পরীক্ষাগুলো করিয়ে নিয়ে এসো, তারপর তোমার শারীরিক পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেবো। তাঁর সহকারীকে ডাক্তারের ফি বাবদ এক শ টাকা দিয়ে বললাম, আমি আর এখানে ফিরে আসছি। পরে ওই প্যানেলভুক্ত একজন স্বদেশি চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভিসা সংগ্রহ করি।
ড. ব্যাসেট কেন অমন অপমানজনক আচরণ করেছিলেন, তা রহস্যাবৃত রয়ে গেল। এক বছর পর দেশে ফিরে শুনেছিলাম, একদল ইংরেজ নার্স তাঁর বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহারের নালিশ করেছিল ব্রিটিশ হাই কমিশনে। তারই জের ধরে ড. ব্যাসেটকে ঢাকায় তাঁর প্র্যাকটিস গুটিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে হয়।
এর পরের অধ্যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাড়ি ছেড়ে দেওয়া–অর্ধেক মালপত্র আমার ভাগ্নি সেলির নাসিরাবাদের বাসায় রেখে দেওয়া; অর্ধেক রেলযোগে ঢাকায় এনে শ্বশুরবাড়িতে ফেলা। সোয়াসের গ্রন্থাগারের জন্যে ঢাকায় বই কেনা এবং শিপিং ট্রাংক কিনে তাতে বোঝাই করা। সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া এবং চূড়ান্ত গোছগাছ করা।
এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপকের সেই পূরণ-না-হওয়া পদটি বিজ্ঞাপিত হয়েছে। মোহাম্মদ আবু জাফর বিভাগের আরো কয়েকজন তরুণ শিক্ষককে নিয়ে স্বামীবাগে আমার শ্বশুরবাড়িতে–যেখানে আমি থাকছিলাম, সেখানে–এসে হাজির। তাদের ইচ্ছা, আমি যেন এবারে পদপ্রার্থী হই। আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিলাম যে, কাগজে বিবৃতি দিয়ে আমি সকলকে আশ্বস্ত করেছি যে, ‘অদূরভবিষ্যতে এ রকম নিয়োগগ্রহণের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই।’ এরপর দু বছরও হয়নি–ভবিষ্যৎ এখনো দূরস্থিত হয়নি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানও এক সন্ধ্যায় সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, ‘পদটি আপনার জন্যে সৃষ্ট হয়েছিল–আপনারই প্রাপ্য। এখন আপনি আবেদন করবেন কি না? সবিনয়ে বললাম, না।’ তিনি বললেন, ‘আপনি আবেদন করলে আমি করবো না, তবে আপনি যদি আবেদন না করেন, তাহলে আমি করবো।’ রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পে ফটিক চক্রবর্তী যেমন কলকাতা যাওয়ার আগে তার ছিপ ঘুড়ি লাটাই সমস্তই ছোটোভাই মাখনকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ভোগদখল করার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছিল, আমিও তেমনি লন্ডন যাওয়ার প্রাক্কালে অনুজপ্রতিম মনিরুজ্জামানকে পুত্রপৌত্রাদিক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপকপদে আবেদন করার সম্পূর্ণ অধিকার দিয়ে দিলাম।
২৪ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ এয়ারওয়েজযোগে স্ত্রীপুত্র ও দুই কন্যা নিয়ে রওনা হলাম। চার সপ্তাহ আগে আনন্দের বয়স দু বছর পূর্ণ হওয়ায় তার জন্যেও একটা আধমূল্যের টিকিট কাটা হয়েছে। ফলে আমরা পাঁচটি আসন দখল করতে পেরেছি। তখনো ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ প্রচুর খাওয়াতো–ছেলেমেয়েরা কেউই অতটা খেতে পারেনি। বিমানবালারা যখন খাবারের ট্রে সরিয়ে নিয়ে যায়, রুচি তখন জানতে চেয়েছিল, উদ্বৃত্ত খাবার তারা কী করবে। বেবী যখন বললো, ফেলে দেবে, তখন সে ছলছল চোখে বলেছিল, ‘কত লোকে খেতে পায় না–তাদের দেয় না কেন?’
রুচির বয়স তখন দশ। দেশে অন্নাভাবের বিষয়টা সে যে লোকালয় থেকে অত দূরে বাস করেও টের পেয়েছিল, তা আগে জানতে পারিনি।
ওই একই ফ্লাইটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের ড. মুনিবুর রহমান চৌধুরী একই বৃত্তি নিয়ে সপরিবারে বিলেত যান। আমরা যেদিন রওনা হই, তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। আর আমাদের যাত্রার পরদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দেন। বাংলায়। সেই প্রথম অমন আন্তর্জাতিক সভামঞ্চে বাংলা ভাষা উচ্চারিত হয়েছিল।