১. দেড়হাজার বছর আগে

পেতবত্থু – অভীক সরকার
প্রথম প্রকাশ : পয়লা বৈশাখ ১৪২৭। এপ্রিল ২০২০

.

আমার ছোটবেলার ইস্কুল,
আমার মায়াবেলার গাছকোটর শিবপুর
শ্রীমৎ স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী বিদ্যালয়ের
সেই সমস্ত শিক্ষকদের,
যাঁদের পায়ের কাছে বসে
অনেক কিছু শেখার ছিল,
কিন্তু কিছুই শিখে উঠতে পারিনি।

.

কৈফিয়ত

আজ থেকে বছর দুয়েক আগেকার কথা। জনৈক বাংলা টিভি চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিরা আমার কাছে আসেন টাইম ট্রাভেল বা প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে ওয়েব সিরিজের উপযুক্ত একটি গল্প লিখে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। প্রস্তাবটি শুনে ভারী উৎসাহিত বোধ করি। তার কারণ, যৌবনের প্রারম্ভে পপুলার সায়েন্স নিয়ে সবিশেষ আগ্রহী ছিলাম। স্টিফেন হকিং বা কার্ল সাগানকে মনে হতো ঈশ্বরের সাক্ষাৎ বরপুত্র। পথিক গুহ’র প্রায় কোনও লেখাই ছাড়তাম না। ফলে সেই বিষয় নিয়ে লেখার প্রস্তাব এলে পুলকিত হওয়ার কারণ থাকে বইকি!

কিন্তু সে তো আগেকার কথা। এরমধ্যেই বিজ্ঞান এগিয়ে গেছে অনেকখানি। তাই পুরোনো বইপত্র ঝেড়েঝুড়ে নামাতে হল। স্কুল কলেজের ভুলে যাওয়া বন্ধুবান্ধবদের সাহায্যও নিতে হল অনেক। ফেসবুক সূত্রে আলাপ হয়েছিল বঙ্গবাসী কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক পার্থ ঘোষের সঙ্গে। পার্থদা প্রচুর তথ্য দিয়ে অনেক সাহায্য করলেন, এমনকী লেখার খানিকটা পড়ে কিছু পরামর্শও দিলেন।

কিন্তু এতসবের পরে যখন লেখা তৈরি, তখন জানা গেল সেই কর্তাব্যক্তিরা চাকরি ছেড়ে অন্যত্র বাসা বেঁধেছেন। অতঃকিম? লেখাটা তখনকার মতো ধামাচাপা রইল।

এর বছরখানেক পরে আমি এবং আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু পাবলিকেশন শুরু করি। প্রথমেই ঠিক হয় যে দু’হাজার উনিশ সালের দুর্গাপূজার সময়ে আমাদের প্রকাশনা থেকে একটি পূজাবার্ষিকী সংখ্যা বেরোবে। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে তার জন্য একটি উপন্যাস লিখে দেওয়ার। সেই সঙ্গে সম্পাদকদের কড়া আদেশ ছিল উপন্যাসটি আগমবাগীশ সিরিজের হতেই হবে।

সেই দিনই আমি পেতবত্থুর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ছকে ফেলি। ইতিমধ্যেই আমি দেবী ছিন্নমস্তা এবং দেবী মাতঙ্গীকে নিয়ে দুটি কাহিনি লিখে ফেলেছি। কাহিনিদুটি পাঠকমহলে সমাদৃতও হয়েছে। সেই সূত্রেই মাথায় এল দশমহাবিদ্যা’র সবচেয়ে বিখ্যাততম দেবী কালী’র কথা। দেবী কালী শুধু যে কৈবল্যদায়িনী তাই নন, তিনি সময় তথা কালের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও বটে। মহানির্বাণতন্ত্রমতে শিব জগতের সকল প্রাণীকে কলন বা গ্রাস করেন বলেই তিনি মহাকাল। আর এই মহাকালকেও যিনি গ্রাস করেন, তিনিই মহাকালী।

কাল সংগ্রহণাৎকালী সর্বেষমোদিরূপিনী।

কালত্বাদাদি ভূতত্বাদাদ্যাকালীতি গীয়সে।

ভয়ের আড়ালে তিনিই অভয়া, কালগ্রাসের মধ্যে তিনিই অনন্তজীবন, মৃত্যুর মধ্যে তিনিই অমৃতস্বরূপিনী।

ঠিক করলাম দেবী মহাকালীকে নিয়েই বাঁধব আমার পরের গল্প। প্রেক্ষাপটে থাকুক অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সময়বিকলন। সঙ্গে জুড়ে দিই আমার সেই পূর্বলিখিত টাইম ট্রাভেলের গল্পটি। সময়ের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে বেঁচে উঠুক এক বন্ধুর প্রতি আরেক বন্ধুর ভালোবাসার গল্প, পোষ্য প্রাণীটির প্রতি এক সর্বহারা যুবকের অনিঃশেষ ভালোবাসার কাহিনি, পিতৃস্নেহবঞ্চিত এক যুবকের বাবাকে ফিরে পাওয়ার মায়াময় আখ্যান।

উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরে তার কপালে বেশ কিছু প্রশংসাবাক্য জোটে। বলাবাহুল্য, এর পেছনে সম্পাদক ঋজু গাঙ্গুলীর কৃতিত্ব ছিল অনেকখানি। অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে, এবং প্রচুর মাজাঘষা করে উপন্যাসটিকে তিনি যথেষ্ট গতিশীল করে তোলেন। ইত্যবসরে পত্রভারতীর কর্ণধার ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় আমাকে ফোন করে বলেন যে উপন্যাসটি তিনি বই হিসেবে প্রকাশ করতে চান, কিন্তু বর্ধিত আকারে।

একদিন পত্রভারতীর অফিসে সেই নিয়ে একটি ছোটখাটো মিটিংও হয়ে যায়, গল্পের খামতিগুলো উনি মার্ক করে দেন। তাঁর আদেশ মেনেই গল্পের প্রয়োজনে আবির্ভাব ঘটে দুটি নতুন চরিত্রের। লোবসাং গিয়াৎসো এবং মেজর রাহুল মাত্রে! উনিশ হাজারি উপন্যাসটি আড়ে বহরে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ত্রিশ হাজারে।

আপাতত সেই পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত ‘পেতবত্থু’ আপনাদের সামনে। উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি পড়ে এবং মূল্যবান মতামত দিয়ে আমাকে ধন্য করেছেন শ্রীমতী অনুষ্টুপ শেঠ, শ্রীময়ী মৌপিয়ালি দে সরকার এবং শ্রীময়ী তমশ্রী মণ্ডল। উপন্যাসটির ভালোমন্দের সমস্ত দায় এই মহিয়সীত্রয়ীর। আমি আপাতত কালীনামহ্রদে জীবন ভাসিয়েছি। নাম অনামের দায় তাঁর, আমি কেবলমাত্র লিখেই খালাস।

অভীক সরকার
কলকাতা, গোরাবাজার
দোলযাত্রা। ৯ই মার্চ। ২০২০ খ্রিস্টাব্দ

প্রাককথন

ঘরের মধ্যে কোনো জানলা নেই। দেওয়াল, মেঝে, সিলিং সবই কাঠের। আসবাবপত্র বলতে দেওয়ালজোড়া ছোট-ছোট খোপ, ব্যাঙ্কের লকারের মতো। মাঝখানে একটা পালিশ-করা সেগুনকাঠের বড় টেবিল। টেবিলের দু’দিকে দুটো চেয়ার। মাথার ওপর বড়-বড় লাইট জ্বলছে। উজ্জ্বল হলেও সে আলোর কোনো তাপ নেই।

চেয়ারে দুজন মানুষ মুখোমুখি বসেছিলেন। টেবিলের ওপর রাখা একটি অতি জরাজীর্ণ পুঁথি। হাত দিয়ে তুলতে গেলে পাতা খসে পড়ে যেতে পারে, এমনই ঝুরঝুরে অবস্থা তার।

‘কিছু বোঝা গেল পুঁথিটা থেকে?’ প্রশ্ন করলেন একজন। তাঁর ছোটখাটো চেহারার মধ্যে নজরে পড়ে অত্যুজ্জ্বল চোখদু’টি।

‘হুঁ, মনে হয় বুঝতে পেরেছি চিফ।’ উত্তর দিলেন অন্যজন। পুঁথিটা তাঁর সামনেই খোলা।

‘এনিথিং সিরিয়াস?’ প্রশ্ন করলেন চিফ, ‘অনুবাদক তো এর মানেই বুঝতে পারছে না। বলছে কথাগুলো অদ্ভুতুড়ে, অর্থহীন। কোনো মানেই হয় না তাদের।’

স্মিত হাসলেন অন্যজন, ‘আছে চিফ, গভীর অর্থ আছে। সে অর্থ এতই গূঢ় যে তাকে গোপন করার জন্য এই হেঁয়ালিভরা সাংকেতিক ভাষার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। অনধিকারীদের নিরুৎসাহ করাই এর উদ্দেশ্য।’

‘কিন্তু কেন? এমনকী লেখা আছে ওখানে?’ ধারালো শোনায় চিফের গলা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মুখ খোলেন তিনি। পরের পনেরো মিনিট ধরে একটানা বলে যান। চিফ কোনো কথা না বলে চুপচাপ শুনে যান।

‘আপনার কী মনে হয়, এসব সত্যিই কি ঘটতে পারে?’ তাঁর বলা শেষ হলে প্রশ্ন করেন চিফ।

‘ঘটতে পারে নয় চিফ, ঘটতে চলেছে।’ শান্তস্বরে বলেন তিনি, ‘ভুলে যাবেন না, যিনি এই পুঁথি লিখে গেছেন তাঁর তুল্য প্রতিভাবান তন্ত্রবিদ এই পৃথিবীতে আজও জন্মাননি। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হতেই পারে না।’

একটু চুপ করে থাকেন চিফ, তারপর বলেন, ‘যদি ধরেও নিই যে ঘটনাটা ঘটবে, যার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, সেটা কখন আর কোথায় ঘটবে সে ব্যাপারে কিছু বলা আছে?’

‘আছে চিফ। যে গ্রহ ও নক্ষত্রের সন্নিবেশের কথা তিনি বলে গেছেন, তার ভিত্তিতে গণনা করে দেখেছি যে আর বেশি দেরি নেই। আগামী সপ্তাহেই ঘটতে চলেছে সেটি।’

‘কোথায় জায়গাটা? ম্যাপে দেখাতে পারবেন?’ এই বলে হাতে ধরা একটা ট্যাবে এশিয়ার ম্যাপ বার করে তাঁর সামনে ধরেন চিফ।

দুটো দীর্ঘ আঙুল খেলে গেল ট্যাবের স্ক্রিনের ওপর। ম্যাপ এদিক-ওদিক সরিয়ে, খানিক ছোটবড় করে এক জায়গায় অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন তিনি। সেদিকে তাকিয়ে খানিক চিন্তিত দেখায় চিফকে। অস্ফুটে বলেন, ‘দিস ইজ দ্য সেম প্লেস হোয়্যার উই আর গোইং টু কন্ডাক্ট সামথিং ভেরি সিরিয়াস নেক্সট উইক। দুটো একই জায়গায়? এত কো ইনসিডেন্স? স্ট্রেঞ্জ, ভেরি স্ট্রেঞ্জ! এরকম সমাপতন তো স্বাভাবিক না! আই অ্যাম হ্যাভিং এ ভেরি ন্যাস্টি ফিলিং অ্যাবাউট ইট।’

উঠে দাঁড়ান চিফ। অন্যজনের হাতটা চেপে ধরে বলেন, ‘আমি এসব তন্ত্রমন্ত্রে একেবারেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু সতর্কতা হিসেবে যদি আপনাকে ওখানে গিয়ে একটু নজরদারি করতে বলি, সেটা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে কি?’

ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ছিলেন অন্য মানুষটিও, বললেন, ‘আপনি না বললেও আমাকে ওখানে যেতেই হত চিফ। আমার মনে হচ্ছে একটা মহাদুর্যোগ আসন্ন।’

.

দেড়হাজার বছর আগে

 রাতে শুতে যাওয়ার সময়েই একটা খড়খড় আওয়াজ পেয়েছিল থুবতেন। শুকনো ডালপালার ওপর কেউ হেঁটে গেলে যেমন আওয়াজ হয় তেমন। কিন্তু তখন সেটাকে বিশেষ আমল দেয়নি। অবশ্য আমল দেওয়ার মতো শরীরের অবস্থাও ছিল না তার।

তিব্বতের এই ইয়াদং উপত্যকাটা উত্তরদিকের তুলনায় একটু বেশি সবুজ। একদিক দিয়ে বয়ে গেছে নিয়াংচু নদী, আরেকদিকে সিসামাংপা পর্বতশৃঙ্গ। নিয়াংচু-র তীরে বড় ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। সেখানেই ইয়াক চরাতে যায় থুবতেন। অবশ্য নিজের ইয়াক নয়, ওয়াংচুকের ইয়াক।

ওয়াংচুক শুধু এই গাঁয়ের মোড়লই নয়, বেজায় বড়লোক আর ক্ষমতাশালীও বটে। তিব্বতের রাজা ঠ্রিসং দেচেন-এর মহামন্ত্রী হলেন গিয়ে মাশাং, রাজার থেকে তাঁর ক্ষমতা কম কিছু নয়। ওয়াংচুক তারই তুতো ভাই, পোতালা প্রাসাদে প্রায়ই যাতায়াত আছে। পুরো শিগাৎসে অঞ্চল তার হাতের মুঠোয়। তার নজর এড়িয়ে একটা খচ্চরও মানজ্বালা, মানে পাহাড়ের ওপারের দেশে যেতে পারে না।

বছরের এই সময়টায় সারা ইয়াদং অঞ্চল জুড়েই রাতের দিকে একটা প্রবল উত্তুরে হাওয়া বয়। থুবতেন ভাবল হয়তো সেই হাওয়াতেই কাছেপিঠে কোথাও একটা ডালপালা খসেটসে পড়েছে। একেই এই অঞ্চলে রাতের বেলা উঠে এদিক-ওদিক দেখতে যাওয়াটা নেহাতই নির্বুদ্ধিতার কাজ, তাছাড়া আজ রাতে তার বাইরে না বেরোনোর আরও একটা কারণ আছে।

সারাদিন ধরে শিনজেকে খুঁজে খুঁজে খুব পরিশ্রান্ত সে। শিনজে হারিয়ে গেছে।

শিনজে হল থুবতেনের পোষা দ্রোক-খি। তিব্বতের পার্বত্য উপত্যকায় সিংহের মতো কেশরওয়ালা যে বিশাল আকারের লোমশ কুকুরগুলো ঘুরে বেড়ায়, তাদেরই একজন। কয়েকবছর আগে কাঠ কাটতে গিয়ে জঙ্গলের ধারে একে কুড়িয়ে পেয়েছিল থুবতেন। পাশেই বাচ্চাটার মায়ের চিতায় খাওয়া শরীরটা পড়েছিল। বাচ্চাটা কুঁই-কুঁই করে কাঁদছে দেখে থুবতেনের ভারি মায়া হয়, কোলে করে ঘরে নিয়ে আসে তাকে।

তারপর থেকে শিনজে তার সঙ্গেই আছে।

একা মানুষ থুবতেন, শিশুবয়সেই বাবা তাকে আর মা-কে ছেড়ে চলে যান। তার বছরখানেকের মধ্যেই থুবতেনের মা জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়ে চিতার পেটে যাওয়ার পর না খেয়ে প্রায় মরার উপক্রম হয়েছিল তার।

সেই থেকে প্রতিবেশীদের দয়াদাক্ষিণ্যেই মানুষ থুবতেন। তাই শিনজের প্রতি এত মায়া তার। শিনজে ছাড়া তার কেউ নেই, সে ছাড়া শিনজেরও কেউ নেই।

সারাদিন ইয়াক চরিয়ে আর ওয়াংচুকের বাড়ির ফাইফরমাশ খেটে এক গামলা যবের চমবা অথবা মাংসের খণ্ড যাই পায়, শিনজের সঙ্গে ভাগ করে খায় সে।

বাড়তে বাড়তে এখন শিনজে আকারে-প্রকারে প্রায় সিংহের মতোই বড়সড়। সারা শরীরে কুচকুচে কালো লোম, মাথা ভরতি কেশর, বড় থালার মতো থ্যাবড়া মুখ, আর উচ্চতায় প্রায় থুবতেনের কোমরের কাছাকাছি। শিনজেকে নিয়ে রাস্তায় বেরোলে অন্য কুকুর কেন, গ্রামের মানুষজনও সভয়ে পথের ধার ঘেঁষে হাঁটে। দ্রোক-খি এদিকটায় অনেকের বাড়িতেই আছে, কিন্তু শিনজের মতো অমন কুচকুচে কালো রোমওয়ালা বিশাল শরীরের কুকুর এই তল্লাটে আর কারও নেই।

আজ সকালে উঠে থেকে শিনজেকে দেখতে পায়নি থুবতেন। প্রথমে ভেবেছিল, এদিক-ওদিক ঘুরতে গেছে, তারপর বেলা বাড়তে চিন্তা হতে থাকে তার। এতক্ষণ বাড়ির বাইরে কখনোই থাকে না শিনজে। গেল কোথায় সে?

সেই থেকে আজ সারাদিন ধরে শিনজেকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছে থুবতেন। সূর্যোদয় থেকে শুরু করে অন্ধকার নেমে আসা অবধি সমস্ত গ্রাম, পাহাড়ের কোলের জঙ্গল, সর্বত্র তন্নতন্ন করে খুঁজেছে সে। তার পর ক্লান্ত অভুক্ত অবস্থায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরেছে। তার শরীরে আজ আর একফোঁটা শক্তি অবশিষ্ট নেই।

ঘুমটা আসি-আসি করছে, এমন সময় ফের সেই খড়খড়ে আওয়াজটা কানে এল। আওয়াজটাকে আমল না দিয়ে ফের শোয়ার উদ্যোগ করতেই একটা চাপা ভুক-ভুক ডাক যেন ভেসে এল কোথা থেকে। তারপর একটা ক্ষীণস্বরে গররর করে ডেকে উঠল একটা কুকুর।

শিনজের গলা না?

খানিকক্ষণ কান খাড়া করে আওয়াজটা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল থুবতেন। এই আওয়াজ কিছুতেই ভুল করতে পারে না সে। রাগে আর ক্ষোভে মাথাটা ঝাঁ-ঝাঁ করছিল তার। শয়তানটা ফিরে এসেছে তাহলে? কাল সকালে হতচ্ছাড়াটাকে আচ্ছা করে যদি না পিটিয়েছে তবে তার নাম থুবতেন নয়, বিড়বিড় করে শপথ নিল সে। বড্ড বাড় বেড়েছে হতচ্ছাড়ার। তার ওপর আবার নির্লজ্জের মতো ভুক-ভুক করে ডাকা হচ্ছে। এই ডাকের মানে বিলক্ষণ জানে থুবতেন, শিনজে মৃদুস্বরে বাইরে ডাকছে তাকে।

তবে রে শয়তান, আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন! চোয়াল শক্ত করে কোনোমতে উঠে কাঠের দরজাটা আস্তে করে খুলে বাইরের দিকে তাকাল থুবতেন।

অমাবস্যার ঘন অন্ধকার রাত। শীতের শুরু, আকাশ একেবারে পরিষ্কার থাকে এখন। তবু তারার মিটিমিটি আলোয় খুব অল্পই দেখতে পাচ্ছিল থুবতেন। কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করে সে, আওয়াজটা এল কোথা থেকে?

হাতের লাঠিটা নিয়ে বাইরে এল থুবতেন।

আশেপাশের সবকিছুই চুপচাপ। থুবতেনের বাড়িটা ঠিক গ্রামের মধ্যে নয়, একটু একটেরে, জঙ্গলের গা ঘেঁষে। ভাঙাচোরা কাঠের বাড়িটার একদিকে দ্রোমো গ্রাম, আরেকদিকে পাহাড়। ওর কুঁড়েঘরের পরেই শুরু হয়েছে ঘন পাইন আর ফার গাছের ঘন জঙ্গল, পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধাপে ধাপে উঠে গেছে সিসামাংপা-র চূড়ার দিকে।

দুইদিকেই চাইল থুবতেন, কই, শয়তানটা কই? আওয়াজটা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েছে, কিন্তু ব্যাটা লুকোল কোথায়?

এদিক-ওদিক তাকিয়ে জঙ্গলের কাছে একটা ছায়ার দিকে চোখ গেল তার। ছায়াটা ফের একবার ভুক-ভুক আওয়াজ করে জঙ্গলের দিকে হাঁটা লাগাল। অন্ধকারের মধ্যেই ভুরু কুঁচকে সেদিকে চেয়ে রইল থুবতেন। ওটা শিনজে না? অবশ্যই শিনজে, নইলে অত বড় শরীরের কুকুর এ অঞ্চলে আর ক’টাই বা আছে?

লাঠিটা হাতে নিয়ে পায়ে পায়ে ছায়াটাকে অনুসরণ করতে লাগল থুবতেন। ব্যাটা যাচ্ছে কোথায়?

ডিসেম্বর, ১৯৫৯। দিল্লি

.

ডিসেম্বরের কনকনে সন্ধে। কনট প্লেসের উত্তর পূর্ব দিকে একটা ন্যাড়া অমলতাস গাছ। তার ঠিক নীচে, অন্ধকারের সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মানুষটি।

সতর্ক চোখে চারিদিকে লক্ষ রাখতে রাখতে লাল অঙ্গবস্ত্রটি গায়ে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নিলেন তিনি। জায়গাটা একটু আবছায়া মতো, তার ওপর সেখানে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের হলদেটে মরা আলো পড়ে একটা অদ্ভুত আলো আঁধারির বিভ্রম তৈরি হয়েছে। তাতে চারিপাশের নির্জনতা আরও গাঢ়, আরও ঘন হয়ে এসেছে। এমনিতেই দিল্লির শীত অতীব কুখ্যাত, তার ওপর আজ উত্তুরে হাওয়ার দাপট যেন দেহের ভেতরকার অস্থিমজ্জাগুলো অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

আজ কি একটা কারণে দিল্লিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট স্ট্রাইক, তাই এই চত্বরে লোকজন নেই বললেই চলে।

যদিও এই স্ট্রাইক ব্যাপারটা ভালো বোঝেন না মানুষটি। ওঁদের দেশে তো স্ট্রাইক, হরতাল, চাক্কা জ্যাম, এসবের নাম গন্ধই ছিল না। এসব ঝুটঝামেলা এদেশে এসেই দেখেছেন।

ভাবতে-ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এই একাকী, উদ্বিগ্ন মানুষটি।

পাহাড়ের কোলে তো দিব্যি ছিলেন ওঁরা। কোথাও কোনও অসুবিধাই ছিল না! একদিকে উত্তুঙ্গ হিমালয়, আরেকদিকে সুগহীন উপত্যকা। তাদের কোল ঘেঁষে চঞ্চলা কিশোরীর মতো নেচে চলেছে পাহাড়ি নদী জাংপো। আরও দক্ষিণে সমতলে নেমে গৃহিণী হয় সে। তখন আরও ভারভাত্তিক হয় তার শরীর, অঙ্গে আসে সংসারী পৃথুল লাবণ্যের ছোঁয়া। তাকে ঘিরে থাকে পাইন, বার্চ আর জুনিপারের পরকীয়া ভালোবাসার ওম। সেই জাংপোর ধারে, সেই লেবুঘাস ছাওয়া জমিতে, সেই রডোডেনড্রন আর পাহাড়ি অর্কিডের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়েছেন তিনি। বড় হয়েছেন শাক্যসিংহের আশীর্বাদধন্য পবিত্র ভূমিতে। সে জীবন ছিল পাহাড়ের মতোই শান্ত, উপত্যকার মতোই উদার, জঙ্গলের মতোই সজীব।

আর আজ?

মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকালেন মানুষটি। ডিসেম্বরের ঘন নীল আকাশ থেকে, তারকাদের গা বেয়ে নেমে আসছিল ঘন কুয়াশার আস্তরণ। সেই কুয়াশাই যেন বিন্দু বিন্দু অশ্রু হয়ে জমে উঠছিল তাঁর চোখের কোণে। খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ রইলেন তিনি। এই তারাদের দল কি আজও তাঁর গাঁয়ের কুটিরটির ওপর এভাবেই করুণ স্নেহের চোখে তাকিয়ে আছে? তারও কি মন কেমন করে ঘরের ছেলেটির জন্য?

পরনের বস্ত্রখণ্ডটির খুঁটে চোখের জল মুছে নিলেন তিনি। মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিলেন। হবে হবে, একদিন অবশ্যই নৃশংস অত্যাচারী বিদেশিদের হাত থেকে উদ্ধার পাবে তাঁর প্রিয়তম জন্মভূমি।

কয়েক মাস আগে হঠাৎ করেই তাঁদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি গায়ের জোরে তাঁদের পবিত্র মাতৃভূমি দখল করেছে। সেই আক্রমণের মুখে তাঁদের প্রধান ধর্মগুরু দলাই লামা এবং অন্যান্য সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে প্রায় সহায় সম্বলহীন ভাবে এই দেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে তাঁদের। তখন এই দেশের গুপ্তচর সংস্থা, যার নাম ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আই বি, তারা নিঃশর্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁদের দিকে। সে উপকার জীবনে ভুলবেন না তিনি।

শুধু কি তাই? তাঁরা যে এই দেশে আদৌ রাজনৈতিক আশ্রয় পাবেন, সে বিশ্বাস তাঁদের একেবারেই ছিল না। তাঁরা শুনেছিলেন যে এই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেশের দখলদার দেশটির প্রধানের বিশেষ সখ্যতা আছে। তবুও, তবুও এই দেশের প্রধানমন্ত্রী সেসব কূটনৈতিক সখ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই তাঁদের বুকে টেনে নিয়েছেন। শুধু যে বুকে টেনে নিয়েছেন তাই নয়, তাঁদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে আবহাওয়া মেলে এমন একটি প্রদেশে তাঁদের থাকার বন্দোবস্তও করে দিয়েছেন। তিনি এও জানেন যে এই নিয়ে দুই বন্ধু দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাসের কালো ছায়া ঘনিয়ে এসেছে। তবুও এই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান তাঁদের আশ্রয় দিতে দুবার ভাবেননি।

এই আশ্রয়দাতা দেশটির প্রতি, এই দেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি, এই দেশের গুপ্তচর সংস্থাটির প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। হাজার হোক, শাক্যসিংহের জন্মভূমি বলে কথা। তারা এই উদার হৃদয়ের পরিচয় দেবে না তো কারা দেবে?

ঠান্ডাটা ক্রমেই বেড়ে উঠছিল। মাথাটা সাবধানে বার করে ইতিউতি তাকালেন লোকটি। মল্লিক সাহেব বলেছিলেন এখানেই গোপনে অপেক্ষা করতে। আইবি’র লোক এসে এখানেই দেখা করবে তাঁর সঙ্গে। তারপর তারাই তাঁকে পৌঁছে দেবে ধরমশালায়, কাল দুপুরের আগেই।

নইলে মহা অনর্থ হয়ে যাবে যে!

চোখ দুটো একবার বন্ধ করলেন তিনি। মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন যে আগামীকাল সকালে ধরমশালায় গোপন রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসছে। হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়েছে যে মহাপবিত্র পঞ্চজ্ঞানমঞ্জুশ্রীর মধ্য থেকে একটি অমূল্য মঞ্জুশ্রী উধাও! সেই নিয়ে কী করা হবে স্থির করতেই এই গোপন বৈঠক বা চক্র। স্বয়ং দলাই লামা এই চক্রানুষ্ঠানের পৌরোহিত্যের ভার নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই চক্রের পবিত্রতা রক্ষার্থে আহ্বান করা হয়েছে দলাই লামার আজ্ঞাধীন গোপনতম যোদ্ধৃবাহিনী, মহাকালচক্রকে!

তিনি এও জানেন যে যদি তিনি কাল দুপুরের মধ্যে সেই চক্রে উপস্থিত থাকতে না পারেন, তবে সমস্ত সন্দেহ তাঁর ওপরে এসেই পড়বে।

আর তার ফলাফল?

মহাকালচক্রের হাত থেকে বাঁচা শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভবও বটে।

একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি। মল্লিক সাহেব কি তাঁর প্রতিশ্রুতি ভুলে গেলেন?

হঠাৎ করেই তাঁর বাঁদিকে ছায়ার মতোই গজিয়ে উঠল কেউ। প্রথমে একটু চমকে উঠেছিলেন তিনি। তারপর ছায়াটি তাঁর কাছে এসে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, ‘মাচিস হ্যায়?’

প্রথমে ভয়ে কাঠ হয়ে গেছিলেন। তারপর সাজানো সংকেত বাক্যের উপযুক্ত উত্তরটি, যা তাঁকে পইপই করে শেখানো হয়েছিল, সেইটি ক্ষীণ স্বরে পেশ করলেন, ‘থা, লেকিন ওঁস মে ভিগ গ্যায়া।’

লোকটা একটিও কথা না বলে নিজের পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ঠোঁটে চেপে ধরল। লাইটার বার করে আগুন ধরালো তাতে। সেই অল্প আগুনের আঁচে ক্ষণমুহূর্তের জন্য লোকটির মুখ দেখতে পাওয়া গেল। একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি।

ভয় পাওয়ার মতো চেহারাই বটে। বুলডগের মতো মোটা থ্যাবড়া মুখ। ঘন জোড়া ভ্রূ, তার নীচে শান্ত অথচ সতর্ক দুটি চোখ। ডানদিকের কপালের ওপর থেকে ডানগাল অবধি একটা ক্ষতের দাগ নেমে এসেছে। চওড়া কব্জিতে মোটা বালা পরা, তাতে আগন্তুকের বাহুবলের আভাস পাওয়া যায়।

আগন্তুক চাপাস্বরে বললো, ‘মেজর কুলদীপ শর্মা, আই বি। মুঝে চুপচাপ ফলো কীজিয়ে। দোনোকে বীচ দশ মিটার কী দূরী রেহনি চাহিঁয়ে।’

মিনিট দশেক ধরে আগন্তুককে অনুসরণ করতে লাগলেন লোকটি। এমনিতে রাস্তায় লোকজন বেশি নেই। দোকানপাট বেশিরভাগ বন্ধই। মাঝেমধ্যে জনহীন রাস্তা দিয়ে উল্কার গতিতে উড়ে যাচ্ছে শৌখিন বড়লোকের অস্টিন আর স্টুডিবেকার। রাস্তার পাশে ছোট ছোট গুমটি। সেখানে আপাদমস্তক মোটা কম্বলে ঢেকে আড্ডা জমিয়েছে মজদুর কিসানের দল। তাদের ঠাট্টা ইয়ার্কির সঙ্গে ভেসে আসছে রেডিওতে খবর পড়ার শব্দ।

একটু পর হঠাৎ থেমে গেলেন আগন্তুক। তারপর সট করে সরে এলেন বাঁদিকে, একটা পিপুলগাছের ছায়ায়।

একটু ইতস্তত করে সেদিকেই হেঁটে গেলেন লোকটি। হিমালয়ের কোলে বড় হয়েছেন, এই ঠান্ডা তাঁর কাছে কিছুই না। তবুও ভেতরে ভেতরে একটা কাঁপুনি টের পাচ্ছিলেন।

পিপুল গাছের নীচে আড়ালে রাখা একটা জিপ। তাতে উঠে বসলেন আগন্তুক। তারপর লোকটিকে ইশারা করলেন তাঁর পাশে উঠে বসতে।

দুজনের কেউই জানলেন না যে জিপ স্টার্ট করে তাঁরা বেরিয়ে যাওয়ার পর অন্ধকার থেকে সেখানে উদয় ঘটল চারটি ছায়ার। চারজনেই নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া জিপের দিকে।

‘আইটেমকা অগলা ড্যান্স পার্টি কাঁহা হ্যায়?’ ভারিক্কি স্বরে প্রশ্ন করল একজন।

‘পাণিপথ।’ অন্য আরেকজনের উত্তর।

‘উঁহা সে ফির কাঁহা? চিড়িয়া কাঁহা যায়েগা?’ ভারিক্কি স্বরের প্রশ্ন।

‘আপনে ঘোঁসলে মে, জনাব।’

‘খবর পাক্কি হ্যায় না?’ আবার সেই ভারিক্কিস্বর।

‘জি জনাব।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর এল বাকি তিনজনের মধ্যে একজনের কাছ থেকে।

‘বড়ে সা’ব কাঁহা হ্যায়?’

‘জি উসি কে আসপাস।’

‘বঢ়িয়াঁ। ভাই নে চিঠঠি আপনে সাথ হি রখখা হ্যায়, ইয়া অলরেডি পোস্ট কর দিয়া?’

‘ব্যস, উওহি পতা নেহি চল পায়া জনাব। আপনা এজেন্টলোগ কাম পর লগে হুঁয়ে হ্যায়। আজ রাত তক পতা চল যায়েগা।’

‘বেওকুফ,’ চাপা গলায় ধমকে উঠল, ‘তুম লোগোঁ কো কীস চিজ কা প্যায়সা দেতে হ্যায় হাম? ইতনা সা ইনফরমেশন ভি ঠিকঠাকসে নেহি লা পায়া? বড়ে সা’ব কো কেয়া জবাব দুঁ ম্যায়?’

বাকি তিনজনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

‘চিড়িয়া ঘোঁসলে তক পহোঁচ নে সে পেহলে আপনি হাথ মে আনি চাহিয়ে।’ ঘোর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শীতল ইস্পাতের মতো আদেশ ভেসে এল।

‘লেকিন অগর চিঠঠি নেহি মিলি তো…চিঠঠি অওর চিড়িয়া, দোনো একসাথ চাহিয়ে না?’ মৃদু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে একজন।

‘উও মুঝে সোচনে দিজিয়ে জনাব, সোচনে কা কাম মেরা হ্যায়।’ ছদ্মবিনয়ের আড়ালে ঝলসে উঠল তীব্র ব্যঙ্গোক্তি, ‘আপ ব্যস আপনা কাম কীজিয়ে।’

‘জি জনাব।’ চুপ করে যায় তিনজনেই। তারপর ছায়ার মতোই অন্ধকারে মিশে যায় চারজন।

দেড়হাজার বছর আগে

অন্ধকারে চোখ জ্বলে বলে সুনাম আছে থুবতেনের। এই জঙ্গল আর জঙ্গলের সুঁড়িপথ হাতের তালুর মতোই চেনে সে। তা সত্ত্বেও আজ সবকিছু ভালো ঠাহর হচ্ছিল না তার। পাহাড়ি পাকদণ্ডীর ধার ঘেঁষে নেমে আসছে থকথকে নীল কাদার মতো কুয়াশার চাদর। তার মধ্যে শিনজে এক-একবার হঠাৎ করে দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে গাছের আড়ালে। হাতের লাঠিটা সম্বল করে কোনোমতে দিশা ঠিক রেখে পথ হাঁটছিল থুবতেন।

থুবতেন বুঝতে পারছিল, যে রাস্তায় শিনজে তাকে নিয়ে যাচ্ছে সেটা জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে গেছে। খুব প্রয়োজন না থাকলে এই দ্রোমো গ্রামের কেউই যায় না সেদিকে।

খানিকক্ষণ বাদে থুবতেন টের পায় যে, কোনো একটা চাতালের ওপর এসে পৌঁছেছে সে। সেখানে দাঁড়িয়ে চারিদিকে তাকাতে থাকে থুবতেন। গেল কই শয়তানটা?

হঠাৎ করেই যেন থুবতেনের চারিপাশ থেকে কুয়াশার চাদর উঠিয়ে নিল কেউ। সবকিছু বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল তখন। তখনই থুবতেন বুঝতে পারল যে, শিনজে হতচ্ছাড়া কুয়াশার আড়ালে তাকে এমন জায়গায় এনেছে, যেখানে মেরে ফেলার ভয় দেখালেও দ্রোমো গ্রামের একটাও লোক আসতে চাইবে না।

এটা ইদিয়াগ তাল, প্রেতদের মিলনভূমি। লোকে বলে ডাইনিচাতাল। দ্রোমো গ্রামের অধিবাসীদের এই এলাকায় আসা কঠোরভাবে মানা। এখানে পথ ভুলে এসে কত লোকই যে ডাইনিদের শিকার হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। জায়গাটা চেনার কথা নয় থুবতেনের, চিনল চাতালটার আকৃতি দেখে। লোকে জায়গাটার নাম দিয়েছে ডাইনির ঝাঁটা। একটু ওপর থেকে দেখলে চাতালটা ঝাঁটার মতোই দেখায় বটে। ঝাঁটার লেজের দিকে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখতে লাগল থুবতেন।

হতচ্ছাড়া শিনজেটা এই ডাইনিচাতালে তাকে ডেকে এনে নিজে লুকোল কোথায়?

এইবার চাতালের মাথার দিকে চোখ যায় থুবতেনের। হালকা কুয়াশা আর তারার আলোয় তার মনে হয় কারা যেন নড়াচড়া করছে সেখানে। এত দূর থেকেও তাদের মধ্যে একজনকে তার মাথার লম্বাটে টুপিটা দেখে চিনতে পারে থুবতেন।

ওর মনিব, ওয়াংচুক।

এত রাতে ডাইনিচাতালে কী করছে ওয়াংচুক? সঙ্গে ওরাই বা কারা?

থুবতেন ভয় পাচ্ছিল খুবই। তবে তার থেকেও উদগ্র হয়ে উঠছিল তার কৌতূহল। গাছের আড়ালে লুকিয়ে, অতি ধীরে ডাইনি চাতালের মাথার দিকে এগোতে থাকে থুবতেন।

ডিসেম্বর, ১৯৫৯। দিল্লি

রাত্রির অন্ধকারের বুক চিরে দ্রুত উত্তরদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল কালো রঙের উইলিস জিপটা। গাড়ির নাম্বারটা দিল্লির কোনও এক সর্দারজির নামে রেজিস্ট্রেশন করা আছে বটে, তবে সেটা ভুয়ো। শুধু নাম্বার কেন, পুরো সর্দারজিই ভুয়ো, নাম ঠিকানা সুদ্ধু।

ডিসেম্বরের ঠান্ডার থেকেও মানুষটাকে বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলছিল ভেতরের গোপন উত্তেজনা। গাড়িতে ওঠার পর থেকে এই অজানা আগন্তুক তাঁর সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। তাতে অবশ্য তাঁর সুবিধাই হয়েছে একদিক থেকে। গত দুদিন ধরে যা যা করেছেন তিনি, সেই নিয়ে নিজের ভেতরেই একটা পর্যালোচনা করছিলেন তিনি।

তিনি লোবসাং গিয়াৎসো, দলাই লামার ঘনিষ্টতম মহলের একজন। শুধু তিনি নন, তাঁর উত্তরপুরুষেরাও কদম্পা ধর্মমত এবং দলাই লামা’র সেবা করে এসেছে বংশপরম্পরায়। তবে তাঁর সময়েই পোতালা প্রাসাদের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের দহরম-মহরম বেশি বেড়েছে। তার অবশ্য একটা অন্য কারণও আছে।

কিংবদন্তী অনুযায়ী তাঁর এক পূর্বপুরুষ স্বয়ং গুরু রিন পো চে’র আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। গুরু রিন পো চে’র স্বহস্তলিখিত একটি পুঁথি তাঁদের কাছে বংশপরম্পরায় বহুদিন অবধি রয়ে গেছিল। লোবসাং এর পূর্বপুরুষরা গৃহী ছিলেন। লোবসাং সন্ন্যাস নেন। সেই সঙ্গেই মহামূল্যবান পুঁথিটি তিনি দলাই লামার কাছে হস্তান্তরিত করেন।

তারপরেই পুঁথিটি পঞ্চজ্ঞানমঞ্জুশ্রীর একটি বলে গণ্য হয়। পঞ্চজ্ঞানমঞ্জুশ্রী হচ্ছে কদম্পা ধর্মমতের এমন পাঁচটি পবিত্রতম পুঁথি যা একমাত্র স্বয়ং দলাই লামা বা তাঁর মনোনীত ব্যক্তি ছাড়া আর কারও দেখার অধিকার নেই। আর পঞ্চজ্ঞানমঞ্জুশ্রীর একটি মঞ্জুশ্রীকেও যদি দলাই লামার গুপ্তকক্ষ থেকে অপসারণ করা হয় তবে তার উদ্ধারকল্পে একটিমাত্র পন্থাই নেওয়া হয়।

আহ্বান করা হয় মহাকালচক্রকে!

কেউ জানে না কী এই মহাকালচক্র। কারা এর সদস্য, কী তাদের পরিচয়, কীভাবে কাজ করে তারা। লোকে শুধু জানে এরা একমাত্র দলাই লামার আজ্ঞাধীন। তিনি ছাড়া এদের পরিচয় আর কেউ জানে না। অন্ধকারের গহীনতম শক্তি এই মহাকালচক্র। এরা পারে না হেন কোনো কাজ নেই। গুপ্তহত্যায় এদের সিদ্ধি প্রবাদপ্রতিম, আর মহাকালচক্রের হাতে মৃত্যু বড় ভয়ঙ্কর, বড় নৃশংস।

চোখ বুঝলেন লোবসাং। শীতের দিল্লির রাত যেন অন্ধকার স্রোতের মতো ঝাপটা মেরে যাচ্ছিল তাঁর মুখে। কিন্তু তাতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছিলেন না। তাঁর মনের মধ্যে যে ঝড় বইছিল, তার তুলনায় এ হাওয়ার ঝাপটা এমন কিছুই না।

অনেক ভেবেছেন তিনি, নিজের সঙ্গে যুক্তিতর্ক দিয়ে অনেক লড়াই করেছেন, তবে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন। এখন এই সিদ্ধান্তের দায় ও দায়িত্ব একমাত্র তাঁর।

পূর্বপুরুষেরা তাঁর সহায় হবেন তো?

যতদিন পঞ্চজ্ঞানমঞ্জুশ্রী পোতালা প্রাসাদে ছিল, সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু এখন বিদেশবিভুঁইতে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে তিনি একেবারেই নিশ্চিন্ত নন। যদিও এদেশের সরকার আশ্বাস দিয়েছেন যে তাঁদের ও তাঁদের ধর্মীয় সম্পত্তির কোনও ক্ষতি হবে না, তবুও সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান তিনি। চীনের গুপ্তচরেরা যে ইতিমধ্যেই ধরমশালা পৌঁছে যায়নি তার নিশ্চয়তা কী?

দেড়হাজার বছর প্রায় শেষ হওয়ার দিকে। আর মাত্র সত্তর বছর বাকি। যদি কিছু হয়ে যায় তাঁর বা এই পুঁথির, তাহলে কী করে উদ্ধার পাবেন তাঁর পূর্বপুরুষের আত্মা?

বড় ঝুঁকি নিয়ে মল্লিক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। করেছিলেন রতনলালের মাধ্যমে। দলাই লামার দেখভালের জন্য ভারত সরকার যে কয়েকজন সরকারি অফিসার নিয়োগ করেছেন, রতনলাল তাঁদেরই একজন। ইনি দলাই লামার সেক্রেটারি।

বেশ দ্রুতগতিতেই চলছিল জিপটা। পাণিপথ আসতে আর মিনিট দশেক বাকি। সেখানে কিছু ডিব্রিফ করার কাজ আছে। তারপর লোবসাং-এর হ্যান্ডলার-এর হাতে লোবসাংকে তুলে দিয়েই মেজর শর্মার ছুটি।

তাই হয়তো স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন মেজর শর্মা। ফলে হঠাৎ করে যখন ব্রেকটা একটু জোরে কষতে হল তাঁকে, তখন মুখ দিয়ে একটা কাঁচা খিস্তি বেরিয়ে এল।

রাস্তার ডানদিকে একটা বড় গাড্ডা, তাতে কাকচক্ষুর মতো জল জমে আছে। সেটা দেখেই ব্রেক কষেছিলেন মেজর শর্মা। তারপর রাস্তার দিকে তাকাতে তাকাতে সাবধানে গাড্ডাটার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলেন তিনি। জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার পর স্টিয়ারিং সোজা করে ধরে সামনের দিকে তাকালেন তিনি।

এরপর গিয়ার চেঞ্জ করে গাড়ির স্পিড উঠতে থাকার কথা। স্পিড উঠতে শুরুও করেছিল। কিন্তু গতিবেগ বাড়াবার মুখেই হঠাৎ করে জিপটা রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে সজোরে ব্রেক কষে থেমে যায়।

উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করলেন লোবসাং, ‘কেয়া হুয়া?’

‘উই আর বিইং ট্র্যাকড,’ দাঁত চিপে বললেন মেজর শর্মা, ‘কোই পিছা কর রহা হ্যায় হামারা।’ তারপর হোলস্টার থেকে একটা রিভলভার বার করে শ্বাপদের ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে নামলেন গাড়ি থেকে। চাপা গলায় আদেশ দিলেন, ‘কাম অ্যালং।’ তারপর সেঁটে গেলেন রাস্তার ধারের অন্ধকারে।

লোবসাং এর নামতে একটু দেরি হল। কারণ, ব্যাপারটা তাঁর মাথায় সেঁধোয়নি ঠিকঠাক। প্রথমত তাঁদের গাড়ির পিছনে দূর দূর অবধি কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এভাবে কারও পিছু নেওয়া যায় কী করে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি। দ্বিতীয়ত যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়াও যায় যে কেউ পিছু নিয়েছে সেটা মেজর শর্মা বুঝলেন কী করে?

মেজর শর্মা বোধহয় লোবসাং এর মনের জিজ্ঞাসাটা বুঝতে পারলেন। একটু নীচু হয়ে বসে গাড়ির চেসিসের দিকে ইঙ্গিত করলেন।

প্রথমে ব্যাপারটা বোঝেননি লোবসাং। তারপর খানিকটা লক্ষ্য করে দেখতে পেলেন চেসিসের ঠিক নীচে একটা লাল আলোর বিন্দু একবার জ্বলছে আর নিভছে। আর সেই সঙ্গে একটা অতি ক্ষীণ বিপ-বিপ আওয়াজ ভেসে আসছে।

‘রেডিও রিসিভার!’ ফিসফিস করে বললেন মেজর শর্মা, ‘কোই ইসকো ফিক্স কিয়া হ্যায় মেরে গাড়িকে নীচে।’

যন্ত্রটা যে ঠিক কী সেটা মাথায় ঢুকল না লোবসাং-এর। তবে তিনি বুঝলেন যে খেলা শুরু হয়ে গেছে। যে বিপদ এড়াবার জন্য এত তোড়জোড়, সেটা এখন তাঁর ঘাড়ের ওপর থাবা চাটতে চাটতে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। এখন তাঁরা শিকার ছাড়া আর কিছু নন। সেই শিকারের খোঁজে ইতিমধ্যেই মাঠে নেমে পড়েছে হিংস্র হায়েনার দল।

তবুও একটা প্রশ্ন কিছুতেই তাঁর কাছে পরিষ্কার হচ্ছিল না, মেজর শর্মা এই যন্ত্রটার অস্তিত্ব বুঝতে পারলেন কী করে?

জল। ভাবতে ভাবতেই কেউ যেন উত্তরটা মাথার মধ্যে গেঁথে দিল লোবসাং-এর। রাস্তায় জমে থাকা জলে নিশ্চয়ই ওই লাল আলোর প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলেন মেজর শর্মা। অভিজ্ঞ আইবি অফিসারের চোখ এড়ায়নি সেই বিপদের সংকেত। দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করছিলেন মেজর শর্মা, ‘ইসকা মতলব কিসি কো পতা হ্যায় ইস মিশন কে বারে মে। দিস মিশন ইজ কম্প্রোমাইজড নাউ। উই হ্যাভ আ মোল ইনসাইড আই বি…কওন হো সকতা হ্যায়, কওন হো সকতা হ্যায়…’

যেখানে মেজর শর্মা গাড়ি থামালেন, সেখান থেকে ঠিক আট কিলোমিটার দূরে, পাণিপথ শহরে ঢোকার ঠিক আগে বিশাল বড় বটগাছটার নীচে একটা ধাবা আছে। লোকে বলে লল্লন সিং-এর ধাবা, এই লাইনের ট্রাক ড্রাইভার আর খালাসিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তাদের ভিড়ে সদাসর্বদাই জমজমাট থাকে জায়গাটা। তাছাড়া লল্লন সিং নিজেও রোজ সন্ধে হলেই ইয়ার দোস্ত নিয়ে মদ মাংসের আসর বসায় ধাবার পিছনদিকটায়। তাদের হইহল্লা আর গজল্লায় চাকনাচুর হয়ে থাকে ধাবাটা।

তবে আজ শীতের দাপটের জন্যই হোক, বা স্ট্রাইকের কারণেই হোক, জায়গাটা বেশ ফাঁকা। কোনও এক অজানা কারণে পুরো জায়গাটা জুড়ে ভারী নিস্তব্ধতা চেপে বসে আছে।

ধাবার ঠিক সামনে আলো নিভিয়ে দাঁড়িয়েছিল একটা মস্ত বড় জিপ। তার পেছনের সিটে মোটা কম্বল মুড়ি দিয়ে, অলসভাবে গা এলিয়ে বসেছিল তিনজন লোক। ড্রাইভারের সিটে বসে একজন লোক হাতে একটা যন্ত্র নিয়ে কী যেন খুটখাট করছিল। আর তার পাশে স্থির হয়ে বসেছিলেন একজন।

হঠাৎ করেই সজাগ হয়ে উঠল ড্রাইভারের সিটে বসা লোকটা। যন্ত্রটা সজোরে বন্ধ করে পেছনে ফিরে রুদ্ধশাসে বলল, ‘লগতা হ্যায় কে সালোঁ নে পকড় লিয়া আপনা টেকনিক। রেডিও রিসিভার কা সিগন্যাল পিছলে পন্দরহ মিনিট সে একহি জগাহ পে রুকি হুই হ্যায়। মেশিন নিকাল বৈজনাথ, ভাগ রাহা হ্যায় দোনো। ভাগনে সে পেহলে পকড়না পড়েগা সালোঁকো’, বলেই জিপ থেকে লাফিয়ে নামল লোকটা। তার হাতে উঠে এসেছে একটা আধহাত লম্বা জার্মান মাউজার হ্যান্ডগান।

বাকি লোকজনের জড়তাও কেটে গেল মুহূর্তেই। তিনজোড়া পা যেন হিংস্র চিতাবাঘের মতোই লাফিয়ে নামল মাটিতে। প্রত্যেকের হাতেই উঠে এসেছে একটা করে রিভলভার। তাদের পরনে আঁটোসাঁটো পোষাক, পেশিতে খুনে ক্ষিপ্রতা, চোখেমুখে উদগ্র হিংসার ছায়া। তাদের নিয়ে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতোই সামনের দিকে ধেয়ে গেল তাদের দলনেতা।

সামনের সিটে স্থির বসে থাকা লোকটা নড়ল না বিন্দুমাত্র। সবাই দৌড়ে চলে গেলে ধীরেসুস্থে নামল সে। তারপর গাড়ির পেছনে এসে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল একবার।

গাড়ির পিছনে একটা চাইনিজ মিলিটারির অ্যাডভান্সড প্ল্যাটুন রেডিও সিস্টেম ফিট করা আছে। চালুই ছিল যন্ত্রটা। সেখান থেকে রিসিভারটা তুলে নিয়ে ভারী স্বরে বলল লোকটা, ‘এজেন্ট আর এল এম, কোড সিক্স ওয়ান নাইন। পুট মি টু হিজ হোলিনেস প্লিজ।’

লোবসাং জানতেও পারলেন না, কোন অলৌকিক উপায়ে পঞ্চজ্ঞানমঞ্জুশ্রীর হারানো পুঁথির খবর দলাই লামার আগেই মহাকালচক্রের কাছে পৌঁছে গেল!

দেড়হাজার বছর আগে

ডাইনিচাতালের মাথার কাছাকাছি একটা পাইন গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল থুবতেন। তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে উবু হয়ে কী যেন একটা করছিল ওয়াংচুক। ওদিকটা একটু অন্ধকার থাকায় সেটা ঠিক ঠাহর হচ্ছিল না থুবতেনের। ওয়াংচুককে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে একজনের চওড়া কাঁধ দেখে চেনা-চেনা মনে হচ্ছিল তার, কিন্তু এতদূর থেকে ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, কে সেই লোকটা।

প্রহরখানেক এইভাবে কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ করেই মেঘ সরে গিয়ে আকাশটা বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়। ক্ষীণ চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পুরো ডাইনিচাতাল। আর তখনই ওয়াংচুক বড়ো ছুরির মতো কী একটা যেন বেশ উঁচুতে তুলে ধরে, তাই দেখে হর্ষধ্বনি করে ওঠে বাকিরা।

বড় ছুরিটা দেখেই আঁতকে উঠল থুবতেন। ওটার নাম ফুর-পা, মন্ত্রপূত ছুরি। অপদেবতার পুজোয় ইয়াক বলিদান দিতে কাজে লাগে ও জিনিস।

এবার বাকিদেরও বেশ পরিষ্কার চেনা যাচ্ছিল, এমনকী চওড়া কাঁধের লোকটাকেও। লোকটাকে চেনামাত্র থুবতেনের হৃৎপিণ্ডটা একলাফে তার গলার কাছে এসে আটকে যায়।

মহামন্ত্রী মাশাং? এখানে? এই সময়ে?

সম্রাটের পরেই তিব্বতের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ এই মাশাং। তাঁর প্রতিপত্তিই আলাদা। দলবল, দেহরক্ষী ইত্যাদি ছাড়া তিনি বাইরে বেরোনই না। এমন গুরুত্বপূর্ণ একজন গ্রামে এলে তো হুলস্থুল পড়ে যাওয়ার কথা। কই, সারাদিন শিনজেকে খোঁজার সময় এসব কিছুই তো কানে আসেনি ওর? এত রাতে মন্ত্রীমশাই এখানে কী করতে এসেছেন চুপিচুপি?

ওয়াংচুক আর মহামন্ত্রীকে ছাড়া আরও দু’একজনকে চিনতে পারল থুবতেন, যেমন গাঁয়ের পুরোহিত রাবগিয়াল। বাকিরা ওয়াংচুকের সাঙ্গোপাঙ্গ, গাঁয়েরই লোক। নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলছিল ওরা। অর্থাৎ ওরা জানে যে এখানে গ্রামের কারও আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।

একজন এসে একটি ছোট মশাল পাশেই পাথরের খাঁজে গুঁজে দিতে সব কিছু বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল থুবতেন।

খানিক পরে মাশাং তাঁর পরনের জোব্বাটি খুলে, মাটিতে পেতে রাখা একটি চামড়ার আসনে ধ্যানের ভঙ্গিতে বসলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করলেন ‘এই উত্তুঙ্গ পাহাড়, এই গহীন উপত্যকা আর এই অগণন নক্ষত্রশোভিত আকাশকে সাক্ষী রেখে শুরু করছি এই জিজিদ। আমাদের এই প্রেতসাধনা যেন সফল হয়। আজ যে জিজিদ আমরা পৃথিবীর বুকে নামিয়ে আনব, তা যেন এই অত্যাচারী রাজার কবল থেকে মুক্তির স্বাদ নিয়ে আসে।’

জিজিদ কী তা শুনেছে থুবতেন, কিন্তু কখনও দেখেনি। এ নাকি মানুষের আত্মার মধ্যে কোনো অপদেবতাকে গেঁথে দেওয়ার মন্তর। তারপর যে জিজিদ করে, সেই আত্মা তার বশ হয়ে যায়, তাকে দিয়ে তখন যা খুশি করানো যায়। এ খুব সাঙ্ঘাতিক ভূতবিদ্যা, কোটিতে গুটিক পুরোহিত পারেন। মহামান্য মাশাংও পারেন নাকি?

ওয়াংচুক ধীর পায়ে মাশাঙের সামনে এল। তারপর একটা ছোট জিনিস বার করে আনল জোব্বার ভেতর থেকে।

ইয়াকের শিং। একপাশটা বোধহয় ঘষে ঘষে ধারালো করা হয়েছে, মশালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল সেটা। মাশাং তাঁর বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে ধরলেন ওয়াংচুকের সামনে।

তারপর ওয়াংচুক যেটা করল সেটা দেখে আরেকটু হলেই একটা আর্তস্বর বেরিয়ে আসছিল থুবতেনের মুখ থেকে। বহুকষ্টে মুখের মধ্যে নিজের হাতটা ঢুকিয়ে চিৎকারটা থামালো সে।

কী একটা মন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে নির্বিকার মুখে ইয়াকের ধারালো শিংটা মাশাঙের কনুইয়ের নীচে গেঁথে দিল ওয়াংচুক। তারপর সেটা টেনে নিল কব্জি বরাবর।

ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছিল মাশাং-এর বলিষ্ঠ বাঁ-হাত থেকে। তবে তাঁর মুখে সামান্যতম বিকারও দেখা যাচ্ছিল না। দ্রুতলয়ে অথচ শান্ত মুখে মন্ত্রপাঠের মতো কিছু বলছিলেন তিনি। সেই গড়িয়ে পড়া রক্তের স্রোত যেন একটি ছোট কুণ্ডের সৃষ্টি করছিল মাশাং এর পায়ের কাছে।

রক্তকুণ্ডটিতে ওয়াংচুক তার হাতে ধরা শিঙের ডগাটি চুবিয়ে নেয় একবার। তারপর মাশাং যেখানে বসেছিলেন ঠিক তার সামনে মাটিতে কী যেন একটা আঁকতে থাকে। আঁকা শেষ হলে স্থিরদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন মাশাং। তারপর প্রসন্নস্বরে বললেন, ‘অতি উত্তম যন্ত্র এঁকেছিস ওয়াংচুক। কইরে তোরা, দেরি হচ্ছে কেন? নিয়ে আয় জিজিদকে।’

দূর থেকে সাড়া আসে রাবগিয়ালের, ‘নিয়ে আসছি প্রভু, এখনই।’

একটু পরেই দেখা যায় যে তিনটি মানুষ একটি বড়ো পাথরের টুকরোর ওপর কী যেন একটা চাপিয়ে নিয়ে এসে রাখে মাশাং-এর পায়ের কাছে। তারপর দূরে সরে যায়। কালো কাপড়ে ঢাকা গোলমতো জিনিসটা কী, দূর থেকে বুঝতে পারে না থুবতেন।

এর পর একটি পাত্র থেকে খানিকটা জল নিয়ে সবকিছুর ওপর ছিটিয়ে দিতে থাকেন মাশাং আর ওয়াংচুক। সঙ্গে চলতে থাকে গম্ভীরস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ। বাকিরা হাঁটু গেড়ে বসে সেই সুরে গলা মেলায়। সেই ভূতুড়ে সুরে মাতালের মতো দুলতে থাকে সিসামাংপা র বাতাস।

সব কিছু শেষ হলে ফুর-পা’টা তুলে গোলমতো বস্তুটির মধ্যে ঢুকিয়ে দেন মাশাং। তারপর গম্ভীর ও কর্কশস্বরে বলেন, ‘হে মৃত্যুর অধীশ্বর খ্যুং গংপো, আজ আপনি আমাদের সহায় হোন। এই পবিত্র ত্রিকোণ ভূমিতে মন্ত্রপূত রক্ত দিয়ে এঁকেছি বজ্রকীলকযন্ত্র। মৃত্যুপ্রহরী যমান্তককে আহ্বান করছি তাঁর শূল নিয়ে নেমে আসতে। যে জিজিদকে আমরা নামিয়ে এনেছি এই পৃথিবীর মাটিতে, তার হিংস্র নখরে যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সম্রাট মে অগছোমের অপবিত্র দেহ। তার তীক্ষ্ন দাঁত যেন ছিঁড়ে ফেলে রাজকুমার ঠ্রিসং দেচেনের কণ্ঠনালী। মহান পোন ধর্মের জয়পতাকা যেন চিরউড্ডীন থাকে আমাদের মাতৃভূমির বুকে। বৌদ্ধধর্ম নামক এই নপুংসকের ধর্ম যেন আমাদের গ্রাস না করতে পারে, আমাদের যেন অহিংসার নামে নির্বীর্য না করতে পারে।’

বলতে-বলতেই একটানে সেই গোলবস্তুটির ওপর থেকে কাপড়ের টুকরোটি সরিয়ে ফেলেন মাশাং।

হয় থুবতেন তখন খুব ভয় পেয়েছিল, ভয়ার্ত স্বেদের কিছু ফোঁটা দৃষ্টি রুদ্ধ করে রেখেছিল তার। অথবা উত্তেজনায় চোখদুটো ঘোলাটে হয়ে গেছিল। তাই প্রথমটা সে ঠিকঠাক দেখতে পায়নি, বৃত্তের মধ্যে রাখা বস্তুটি কী। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের ওপর জমে থাকা ঘাম মুছে নেয় সে, তারপর তার দৃষ্টি চলে যায় সেই বৃত্তটির মধ্যে।

ওখানে কী ওটা? কার একটা কাটা মাথা বলে মনে হচ্ছে না?

এরপর হঠাৎ করেই যেন মশালের নীলচে কালো আলোগুলো দপ করে জ্বলে ওঠে। আর সেই আলোয় থুবতেন স্পষ্ট দেখতে পায় মাথাটাকে। ওটা কোনো মানুষের মাথা নয়।

ওটা একটা দ্রোক-খি’র মাথা।

সেই দ্রোক খি’টা আর কেউ নয়, শিনজে!

স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল থুবতেন। ভয়ে, বিস্ময়ে, ক্রোধে আর দুঃখে সারা গা থরথর করে কাঁপছিল তার। মনে হচ্ছিল তার দুই হাঁটুতে যেন কোনো সাড় নেই। কে যেন একটানে কেড়ে নিয়েছে তার বুকের বাতাস।

শিনজে? শিনজে? শিনজে? শিনজেকে ওরা খুন করেছে?

উল্লসিত কণ্ঠে বলে ওঠেন মাশাং, ‘শাবাস ওয়াংচুক, শাবাস। এর থেকে মন মতো কোনো জিজিদ হয়তো আমি নিজেও খুঁজে পেতাম না। আমি সম্রাট হলেই তোর কপালে মন্ত্রী হওয়া বাঁধা রে ওয়াংচুক।

এখন চল রে তোরা, চল ঝরনার জলে হাত-পা ধুয়ে আসি। একবার শুধু এই জিজিদ প্রেতদেহ পাক, তাকে পোতালা প্রাসাদে রেখে আসার যা অপেক্ষা, তারপরেই…!’

বেশ কয়েকজোড়া পায়ের শব্দ মিলিয়ে যায় ডাইনিচাতালের অন্যদিকে।

কিছু বোঝার আগেই থুবতেন দেখল, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি যেন তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনুষ্ঠান ভূমির দিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেল থুবতেন। তারপর গেঁথে থাকা ফুর-পা-টা একটানে খুলে ফেলে শিনজের মাথাটা তুলে নিল নিজের হাতে।

শিনজের মাথাটা সেই কালো কাপড়ে জড়িয়ে দ্রুত জঙ্গলে ঢুকে পড়ে থুবতেন। যে রাস্তা তাকে নিয়ে যাবে তার গ্রামের দিকে, সে দৌড়তে থাকে তার সম্পূর্ণ উল্টোদিকে।

মাশাং-এর লোকগুলো যদি তাকে ধরতেও আসে, তারা জানবে না সে পালিয়েছে সম্পূর্ণ অন্য রাস্তা ধরে। থুবতেন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়তে থাকে পাহাড়ের ওপারে এক দেশের দিকে, মানজ্বালার দিকে। অনেক দিন আগে সেই জাদুকর লোকটা এসে তাকে বলে গেছিল না, খুব বিপদে পড়লে কোথায় যেতে হবে তাকে?

ওখানেই যাবে থুবতেন।

পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে থুবতেন। শুধু একটা খটকা রয়ে গেছে তার মনে।

শিনজেকে যদি ওরা খুনই করে থাকে, তাহলে ওকে এখানে ডেকে আনল কে?

খেরি নঙ্গল। পাণিপথ। ১৯৫৯

লোকটা প্রাণপণে দৌড়চ্ছে। দৌড়চ্ছে খানাখন্দভরা পিচের রাস্তা পেরিয়ে, পাহাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে, টিলা আর পাথর ভরা ঊষর প্রান্তর পেরিয়ে। আশ্চর্যভাবে প্রতি বাঁকে বদলে যাচ্ছে তার পথ। আর সেই বদলে যাওয়া পথের স্রোত ধরে প্রাণভয়ে উদভ্রান্তের মতো দৌড়চ্ছে লোকটা। কীসের একটা পুঁটুলি বুকে জড়িয়ে নিয়েছে সে। কোনওভাবেই হাতছাড়া করা চলবে না সেটা। সেটা হাতছাড়া হলে মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে।

দৌড়তে-দৌড়তেই একবার থমকায় লোকটা। একটু দাঁড়িয়ে কুকুরের মতো হাঁপাতে থাকে। এবার মনে হচ্ছে যেন ফুসফুসদুটো ফেটে যাবে তার, চোখদুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাঁপাতে-হাঁপাতেই কান দুটো পেতে কীসের একটা শব্দ শোনার চেষ্টা করল সে একবার।

ওই তো, ওই তো ওরা আসছে। পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে ওদের। শিকারের গন্ধ পেয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে আসছে হিংস্র চিতাবাঘের দল।

ফের দৌড়তে থাকে সে। থেকে থেকে তার পথ বদলে যায়। পাইন আর রডোডেনড্রন ঘেরা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ওপরে উঠতে থাকে সে। তাকে পৌঁছতেই হবে কোথাও একটা। কোথায় পৌঁছতে হবে সেটা ভালো করে জানে না সে। কিন্তু তার রক্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জন্মজন্মান্তরের ইঙ্গিত যেন তাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে কোন এক অজানা উদ্দেশ্যে…

মুখের ওপর জলের ঝাপটা এসে পড়তেই যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলেন লোবসাং গিয়াৎসো। একটা বড় শ্বাস নিয়ে ধড়ফড় করে উঠলেন। তারপর যেভাবে পেঁজা তুলোর মতো বরফ নিঃশব্দে নেমে আসে মাটির ওপর, সেভাবেই তাঁর চেতনা ফিরে আসতে লাগল।

অতি কষ্টে চোখদুটো খোলার চেষ্টা করলেন তিনি। চোখের সামনেটা ঝাপসা দেখাচ্ছিল। সেটা তাঁর দৃষ্টিশক্তির জন্য, নাকি তাঁর মুখের ওপর ঝাপটা দেওয়া জলের জন্য সেটা ঠিক ঠাহর হল না লোবসাং-এর। তিনি শুধু এটুকু অনুভব করলেন যে গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া জলের প্রতিটি ফোঁটা তাঁর শরীরে তুষের আগুনের মতো বিঁধছে।

শরীরটা একবার থরথর করে কেঁপে উঠল লোবসাং-এর। বরফের দেশের মানুষ তিনি, তবুও শরীর জুড়ে এই ঠান্ডা বরফশীতল জলের ধারা যেন তাঁর অস্থিমজ্জা অবধি কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

হাত দিয়ে মুখটা মোছার চেষ্টা করলেন লোবসাং। কিন্তু হাতদুটো একটা ক্ষীণ অস্পষ্ট ঝনঝন আওয়াজ তুলে থেমে গেল।

হাতদুটো আরেকটু টানলেন তিনি। ফের সেই ঝনঝন আওয়াজ উঠল, কিন্তু হাতদুটো এগোল না। কীসের একটা বাধা পেরিয়ে ও দুটো এগোতে চাইছে না একেবারেই।

অতি কষ্টে চোখদুটো খুললেন লোবসাং।

প্রথমে যেটা নজরে পড়ল সেটা হচ্ছে পাথর। পাথর মানে এমনি পাথরের টুকরো না, মসৃণভাবে পালিশ করে করা পাথর। এদেশে এরকম পাথর চৌকো করে কেটে কেটে ঘরের মেঝেতে লাগায়, দেখতে সুন্দর লাগবে বলে। তাকে বলে মার্বেল। এ হচ্ছে সেইরকম মার্বেল পাথরের মেঝে।

তার মানে তিনি এখন মেঝেতে শুয়ে আছেন। কারণ, তাঁর চোখটা মেঝের একদম কাছে, মেঝের সমান্তরালে। আর তাঁর ডানদিকের গালটা মেঝের ওপর ঠেকানো। আর সেই গালের নীচে একটা ছোট পুকুর তৈরি হয়েছে। জলের পুকুর।

সেই জলের রঙ লাল।

চোখের দৃষ্টিটা একটু প্রসারিত করে নিজের হাতদুটোর দিকে তাকালেন লোবসাং। এবার তিনি বুঝতে পারলেন কেন অনেক টানার পরেও তাঁর হাতদুটো কাছে আসছিল না।

তাঁর দুটো হাতই, লোহার শেকল দিয়ে বাঁধা। হাতদুটো টানার সময় শেকলেরই ঝনঝন শব্দ শুনছিলেন তিনি।

কেন? তাঁর হাত বাঁধা কেন? তিনি মেঝেতে শুয়ে কেন? এত জল ঝাপটাচ্ছে কে তাঁর ওপর? আর সেই জলের প্রতিটি কণা তাঁর চামড়ার স্বেদগ্রন্থি ছুঁয়ে হাড়মাংস কাঁপিয়ে দিচ্ছে কেন? তাঁর পোশাকআশাক গেল কোথায়?

গায়ের ওপর একটা শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাওয়ার পর এর কারণটা বুঝলেন লোবসাং। সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ সজাগ হয়ে উঠলেন তিনি।

তিনি নগ্ন। সম্পূর্ণ নগ্ন! আর তাঁকে এই অবস্থায় দু-হাত-পা বেঁধে এই মার্বেল পাথরের ঠান্ডা মেঝেতে শুইয়ে রেখে গায়ে জলের ঝাপটা দিচ্ছে ওরা।

কিন্তু ওরা কারা?

হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চমকের মতো সব কথা মনে পড়ে গেল লোবসাং-এর।

অন্ধকার রাস্তায় খানাখন্দ পেরিয়ে দৌড়চ্ছিলেন দুজনে। দৌড়তে-দৌড়তেই নিজের পরিকল্পনাটা জানিয়েছিলেন মেজর শর্মা।

যে জায়গায় ওঁরা গাড়িটা ছেড়ে এলেন, তার নাম সেওয়া। সেখান থেকে মাইলখানেক আগে একটা চৌমাথা। চৌমাথা থেকে বাঁয়ের রাস্তা ধরে নামলেই একটা ছোট গাঁও, তার নাম খেরি নঙ্গল। সেখানে ওঁর চেনা একজনের বাড়ি আছে। আপাতত রাতটা সেখানেই কাটাতে হবে। শুধু তাই নয়, সেখানে পৌঁছতে হবে যথাসম্ভব নিঃশব্দে, কোনও সূত্র না রেখে।

তবে এই পরিকল্পনায় অসুবিধা শুধু একটা জায়গাতেই। সেওয়া থেকে খেরি নঙ্গল অবধি রাস্তাটা গেছে খোলা মাঠ আর ক্ষেতের মধ্য দিয়ে। রাস্তাটা যে শুধু ভয়ানক নির্জন তাই-ই নয়, রাস্তায় ডাকাতের উৎপাতও সাঙ্ঘাতিক। ডাকাতের ভয় মেজর শর্মা পান না, দু-দশটা ডাকাতের মহড়া নেওয়া ওঁর কাছে তেমন কিছু নয়। কিন্তু ভয় হচ্ছে যে ডাকাতের মোকাবিলা করতে গেলে যে পরিমাণ গোলাগুলি চলবে তাতে শত্রপক্ষের জন্য ওঁদের লোকেট করা খুব সহজ হয়ে যাবে।

কিন্তু কে সেই শত্রুপক্ষ? হাঁপাতে-হাঁপাতেই প্রশ্ন করেছিলেন লোবসাং।

‘ব্যস, এক উও হি তো পতা করনা হ্যায়,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলেন মেজর শর্মা, ‘কোই তো পিছা কর রহা হ্যায় হামারা। দেয়ার মাস্ট বি আ মোল ইন দ্য ডিপার্টমেন্ট…আই মাস্ট রিপোর্ট ইট টু ক্যাপ্টেন…’

কিন্তু রিপোর্ট করার আগেই…

ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করলেন লোবসাং।

খেরি নঙ্গলে ঢোকার ঠিক আগে একটা বড় ঝাঁকড়া গাছ আছে। এদেশের লোক বলে পিপল। সেখান অবধি পৌঁছতেই কারা যেন ঝাঁপ দিয়ে পড়ল ওঁদের ওপর।

এই অতর্কিত আক্রমণের সামনে হতচকিত হয়ে গেছিলেন ওঁরা দুজনে। তাই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে একটু দেরি হয়ে গেছিল। অন্ধকারের গা চুঁইয়ে যেটুকু তারার আলো নেমে আসছিল, তার মধ্যেই লোবসাং দেখতে পাচ্ছিলেন যে মেজর শর্মা একাই লড়ে যাচ্ছেন সিংহবিক্রমে। লোবসাং নিজেও মার্শাল আর্টে সিদ্ধহস্ত, লড়াইটা তিনিও কম দেননি।

কিন্তু লড়াইটা ক্রমেই অসম হয়ে আসছিল। প্রতিপক্ষ সাধারণ গুন্ডা নয়, খালি হাতের লড়াইতে তারাও যথেষ্ট পারদর্শী। তার ওপর তারা সংখ্যাতেও যথেষ্ট বেশি।

লড়তে লড়তেই মাথার পেছনে একটা চোট পেলেন লোবসাং। মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই দেখলেন তিনজন মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেজর শর্মার ওপর।

‘চেয়ার পর ব্যয়ঠাও ইস হারামজাদেঁ কো। বেড়িয়াঁ ভি খোল দো,’ কোথা থেকে একটা গম্ভীরস্বরে আদেশ ভেসে এল।

আচ্ছন্ন অবস্থাতেই লোবসাং বুঝতে পারলেন যে তাঁর হাতের শিকল খুলে নিচ্ছে কেউ। তারপরে একজোড়া বলিষ্ঠ হাত তাঁকে টেনে একটা বরফের মতো ঠান্ডা লোহার চেয়ারে বসিয়ে দিল।

এবার চোখ খুলে তাকালেন লোবসাং।

তাঁর সামনে একটা লোহার গোল টেবিল। তার ঠিক ওপরে সিলিং থেকে ঝুলে আছে একটা বালব। সেখান থেকে একটা হলদেটে জোরালো আলো বৃত্তাকারে অল্প দুলছিল টেবিলটার ওপর।

‘অওর মিস্টার লোবসাং গিয়াৎসো, কেয়া হাল হ্যায়? সব ঠিক ঠাক না?’

ঘরের কোণা থেকে ফিকফিক করে কয়েকজনের হাসার শব্দ ভেসে এল।

চুপ করে রইলেন লোবসাং। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না তাঁর। শেষ পর্যন্ত এই মানুষটা? এই লোকটা তাঁকে শিকার করার জন্য এতদূর নীচে নেমেছে? একেই তিনি এতটা বিশ্বাস করেছিলেন? হা ঈশ্বর!

টেবিলের ওদিকটা অন্ধকার। সেখানে কে যেন ধীরপায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল। তার কোমর থেকে পেটের খানিকটা দেখা যাচ্ছিল। সেখানে একটা হোলস্টার ঝুলছে, তাতে একটা রিভলভার গোঁজা।

‘নাহানা হো গ্যায়া? বহুত বঢ়িয়াঁ। তো আভি ডিনার পে চলেঁ?’

আবার সেই খুকখুক হাসি। এবার আরেকটু জোরে।

নিজেকে বজ্রধ্যানে সন্নিহিত করলেন লোবসাং। এই মুদ্রায় সমস্ত পাশবিক অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা জন্মায় সাধকের। সেই ধ্যানমুদ্রায় লীন হয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলেন লোবসাং, হে তথাগত, আপনি বলে দিন প্রভু, এই ঘোর সঙ্কটকালে কী করা উচিত আমার!

দুটো হাত নেমে এল টেবলের ওপর। মোটা মোটা আঙুল, তাতে অনেক কাটাছেঁড়ার দাগ। এ হাত লোবসাং চেনেন, খুব ভালো করে চেনেন।

‘জনাব, অভি আপ জরা কৃপা করকে বতায়েঙ্গে কে উও কিতাব কাঁহা রাখখে হ্যাঁয় আপ?’

দেড়হাজার বছর আগে

অন্ধকার রাত। বৌদ্ধবিহারের প্রতিটি প্রাণী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শুধু একটিমাত্র ম্লান প্রদীপশিখা জেগেছিল আচার্যর ঘরে। ঘোর আতঙ্ক ও বিস্ময় মিশ্রিত চোখে তিনি তাকিয়ে ছিলেন তাঁর সামনে রাখা বস্তুটির দিকে।

‘এ জিনিস কোথায় পেলি তুই?’ আতঙ্কতাড়িত চাপা স্বরে প্রশ্ন করলেন আচার্য।

‘বললাম তো, দেশ থেকে নিয়ে এসেছি।’ ভাবলেশহীন মুখে বলে তাঁর সামনে বসা বিদেশি যুবকটি।

‘হায়-হায়! এ যে মহা সর্বনাশা বস্তু রে! সাক্ষাৎ শমন। নরকের কোন অতল থেকে এ জিনিস তুলে এনেছিস তুই? এ যে মূর্তিমান ঘোর অমঙ্গল!’ আচার্যের হাহাকারে গমগম করতে থাকে ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠখানি।

‘কী করব? ওকে বড্ড ভালোবাসতাম যে।’ নিরাসক্ত মুখে বলে ওঠে সেই তরুণ, ‘তাই নিয়ে এলাম।’

‘কে ও? কাকে নিয়ে এলি? কার কথা বলছিস তুই?’ স্থবিরের স্বরে তখনও আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

ক্লান্ত, রিক্ত, শূন্য চোখদুটো তুলে ভন্তের দিকে তাকায় যুবক। তারপর তর্জনী দিয়ে নির্দেশ করে সেই ঘোর অভিশপ্ত বস্তুটির দিকে, ফুরিয়ে যাওয়া স্বরে বলে, ‘শিনজে।’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন দু’জন। হিমালয়ের এই সানুদেশে রাতের দিকে একটা চমৎকার মৃদুমন্দ হাওয়া ভেসে আসে, কবিরা যাকে সুমধুর মলয় সমীরণ বলেছেন। কিন্তু আজ যে হাওয়া বয়ে আসছে তাতে হাড়মজ্জা অবধি থরথর কেঁপে উঠছে দু’জনেরই। এই সময়ে বাতাসে শীতের কামড় এত তীব্র হওয়ার কথা নয়।

ধীরে ধীরে নিজের আসন থেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন আচার্য। শিনজের জন্য বুকটা মুচড়ে উঠছিল তাঁর। ভয়াল দর্শন সারমেয়টিকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন তিনি।

গুরুর আদেশে কয়েক বছর আগেই একবার তিব্বতে যেতে হয়েছিল তাঁকে। তিব্বতের রাজনীতিতে এখন উথালপাথাল চলছে। পোন ধর্মাবলম্বী সামন্তচক্র এবং বৌদ্ধ ধর্মানুরাগী সম্রাটের মধ্যে ক্ষমতার সংগ্রাম প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। সম্রাট মে অগছোমের সঙ্গে তাঁরই মহামন্ত্রী মাশাং-এর বিরোধিতার কাহিনি মোটামুটি সবাই জানে। পোতালা প্রাসাদের আনাচেকানাচে এখন শুধু ষড়যন্ত্র আর অভ্যুত্থানের গন্ধ।

বৌদ্ধ আচার্য সেই সূত্রে গিয়েছিলেন সেদেশে। সম্রাট মে অগছোম তাঁকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পোতালা প্রাসাদে, সঙ্গে ছিল সমগ্র তিব্বত ঘুরে দেখার আহ্বান। বলা বাহুল্য, ঘোষিত উদ্দেশ্যের পেছনে একটি গোপন উদ্দেশ্যও ছিল। সম্রাট চেয়েছিলেন তিব্বতের বিভিন্ন প্রান্তে বৌদ্ধ অনুরাগীদের নিয়ে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তুলতে। যারা প্রয়োজনের সময় সম্রাট এবং ভারতীয় বৌদ্ধপন্থীদের সাহায্য করবে।

সেই সফর সেরে ফেরার পথে ভারত তিব্বত সীমান্তবর্তী শেষ যে গ্রামটিতে এক পক্ষকাল অতিবাহিত করেন তিনি তার নাম দ্রোমো। সেখানকারই বাসিন্দা ছিল থুবতেন, আর শিনজে। শিনজে’কে সেখানেই প্রথম দেখেন তিনি।

রাজবাড়িতে জীবন কাটালে কী হবে, আচার্য রাহুলবজ্র প্রকৃতপক্ষে নিজে একজন অনাথ। তাই অন্য কোনো অনাথ মানুষ দেখলে তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন তিনি। থুবতেন নামের এই নিঃসহায় দরিদ্র যুবকটির সঙ্গে তিনি দ্রুত আলাপ জমিয়ে ফেলেন। ভাষা অন্তরায় হয়নি একেবারেই। তিব্বত ভ্রমণের প্রথম কয়েকমাসের মধ্যেই তিনি সেই দেশের ভাষা আয়ত্ব করে ফেলেছিলেন যে!

প্রথম থেকেই রাহুলবজ্র লক্ষ করেছিলেন যে থুবতেন ভালোবাসার কাঙাল। শৈশবেই পিতৃ-মাতৃহীন সে, তারপর আর কারও কাছ থেকে সেভাবে স্নেহ ভালোবাসা পায়নি। তাই তার বুভুক্ষু ও অতৃপ্ত হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসাটুকু ঢেলে দিয়েছে তার কুড়িয়ে পাওয়া পোষ্যটির ওপর।

সারমেয়টিকে প্রথমে দেখে ভয়ই পেয়েছিলেন আচার্য রাহুলবজ্র। অমন সিংহসদৃশ সারমেয় জীবনে আর দুটি দেখেননি তিনি। তবে তিনি নিজেও অসীম সাহসী মানুষ, বিবিধ কলাকুশল ও জাদুবিদ্যায় বিশেষ পারঙ্গম। লোকে বলে তন্ত্রসাধনায় ঐশ্বরিক সিদ্ধি আছে তাঁর। তিনি নিজেও জানেন যে কথাটা সর্বাংশে মিথ্যে নয়।

তাই থুবতেনের পোষ্যটির সঙ্গে ভাব জমাতে তাঁর দেরি হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যে তিনি অনুভব করেছিলেন, এই বিশাল জীবটিও তার প্রভুকে কতটা ভালোবাসে। সারমেয়দের প্রভুভক্তি সম্পর্কে তিনি সম্যকরূপে অবগত, কিন্তু এই নিঃসম্বল তরুণ আর অনাথ প্রাণীটির মধ্যে ভালোবাসার যে অচ্ছেদ্য বন্ধন আছে, তেমন আশ্চর্য সম্পর্ক কমই দেখেছেন তিনি।

আজ যে মুহূর্তে থুবতেন তাঁর সামনে শিনজের কর্তিত মস্তকটি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল, সেই মুহূর্তেই টের পেয়েছিলেন তিনি, ভালোবাসার উন্মাদনা কোন চরম পর্যায়ে গেলে এই কাজ করা সম্ভব। থুবতেনকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ভেতরে-ভেতরে নিঃশেষ হয়ে গেছে সে। শুধুমাত্র ক্লান্তি নয়, এক উদাসীন ও লক্ষ্যহীন অবসাদ প্রতি মুহূর্তে নিংড়ে নিচ্ছে তাকে।

রাহুলবজ্র এও বুঝেছিলেন যে ভয়ঙ্কর কোনও অপরাশক্তির আধার তাঁর সামনে এনে উপস্থিত করেছে থুবতেন। বস্তুটি দেখামাত্র তাঁর শরীরের প্রতিটি রোম খাড়া হয়ে গেছিল। চৈতন্যের প্রতিটি তন্ত্রী টানটান হয়ে তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে সংকেত পাঠাচ্ছিল, সাবধান! তাঁর সামনে যেটি রাখা আছে সেটি একটি ঘোর অমঙ্গল বস্তু।

‘আপনি তো সব পারেন প্রভু। পারেন না? সত্যি কথা বলুন, পারেন না আমার শিনজেকে বাঁচিয়ে তুলতে?’ মানুষ যে শুকনো গলা নিয়েও কাঁদতে পারে, সে কথা এই প্রথম অনুভব করলেন আচার্য।

থুবতেনের মাথার ওপর জমাট বাঁধছিল একদলা কালো ছায়া। একবার সেদিকে তাকালেন রাহুলবজ্র। তারপর তাকালেন তাঁর সামনে রাখা বিশাল আকারের করোটিটির দিকে। তার রঙ ঘোর কালো।

ফিসফিস করে বললেন মহাস্থবির, ‘না রে থুবতেন, তা আর সম্ভব নয়। কারণ ও আর শিনজে নেই। ও এখন একটা পেতবত্থু।’

খেরি নঙ্গল। পাণিপথ। ১৯৫৯

রক্ত পড়ছিল লোকটার সারা গা থেকে, তবুও বিন্দুমাত্র টসকায়নি লোকটা। পাহাড়িদের সহনশীলতা একটু বেশিই হয়। তবে এর সহনশীলতা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন রতনলাল।

সিলিং এ বাঁধা লোহার চেইন আর পুলি থেকে ঝুলছিল লোবসাং গিয়াৎসোর দেহটা। সারা শরীরে দগদগ করছে আগুনে সাঁড়াশির ছ্যাঁকার দাগ। লোহার কাঁটা লাগানো চাবুক দিয়ে ফালাফালা করে দেওয়া হয়েছে তাঁর পিঠ। উপড়ে নেওয়া হয়েছে দুপায়ের সব নখ, বাঁ-চোখের নীচে একটা মস্ত বড় ক্ষত হাঁ করে আছে। টানা ইলেক্ট্রিক শক পেয়ে পেয়ে কালো হয়ে আছে অণ্ডকোষদুটো।

তবুও, রতনলালের প্রশিক্ষিত হায়েনার গ্যাং-এর পাশবিক অত্যাচার সহ্য করেও, একটা কথাও বার করা যায়নি লোকটার মুখ থেকে। একটা আওয়াজ অবধি করেনি লোকটা, সামান্য উফ অবধি শোনা যায়নি। কিছুতেই ওকে দিয়ে বলানো যায়নি যে কোথায় রাখা আছে রিন পো চে’র নিজের হাতে লেখা সেই পুঁথি, পঞ্চজ্ঞানমঞ্জুশ্রীর অন্যতম রত্নটি।

মুশকিল হচ্ছে যে রতনলালের আজই জানতে হবে কার হাতে আছে সেই মহামূল্যবান পুঁথি। লোকটা তাঁর থ্রু দিয়েই আই বি’র সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলো বটে। কিন্তু তাঁকে না জানিয়েই যে দুম করে দিল্লি চলে যাবে এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। রতনলাল তো আশ্বাস দিয়েইছিলেন যে একটা শুভদিন দেখে লোবসাংকে উনিই নিয়ে যাবেন আই বি’র সদর দপ্তরে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রতনলাল। লোকটা হুট করে এই কাজটা করে না বসলে আজ এত হাঙ্গামা হুজ্জতের দরকারই হতো না। আর যদি পুঁথিটা আই বি’র প্রধান ভোলানাথ মল্লিক, ওরফে ক্যাপ্টেনের হাতে পড়ে, তাহলে কথাই নেই। ও জিনিস উদ্ধার করা অসম্ভব। বাঙালির বাচ্চাটা যেমন ধুরন্ধর, লোকটার দেশের প্রতি আনুগত্যও তেমনই প্রশ্নহীন। যদি পুঁথিটা এখনও এই লোবসাং বা ওই মেজর শর্মার হাতে থাকে তো তাও একটা ক্ষীণ আশা আছে ওটা উদ্ধার করার।

আর সেটা না করতে পারলে যেটা হতে পারে সেটা ভাবতেও ঘাম ছুটে যাচ্ছিল রতনলালের। হিজ হোলিনেসের আদেশ পালন করাটাই মহাকালচক্রের একমাত্র কাজ। এর কোনও ব্যত্যয় হওয়া মানে হিজ হোলিনেসের হাজার বছরের প্রাচীন ডিক্রি অমান্য করা। মহাকালচক্রের কোনও সদস্যের পক্ষে এই আদেশ অমান্য করা আর স্বয়ং যমরাজকে দ্বৈরথে আহ্বান জানানো একই ব্যাপার।

তবে রতনলালের মাথার মধ্যে ক্রমাগত একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি জাগিয়ে রেখেছিল লোকটার দৃষ্টি। অমানুষিক মার খেতে খেতেও একটা অদ্ভুত পাথুরেদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়েছিল এই তিব্বতিটা। সেই দৃষ্টিতে মার খাওয়ার যন্ত্রণা যতটা না ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল অন্য একটা বোধ।

ঘেন্না। বিশ্বাসঘাতকের প্রতি সমস্ত অস্থিমজ্জা রক্তঘাম উজাড় করে দেওয়া ঘেন্না। সমস্ত অসহায় ক্রোধ বমি করে দেওয়া ঘেন্না।

এখন ঘরে কেউ নেই। মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে রতনলালের পোষা হিংস্র হায়েনার দল বাইরে একটু বিশ্রাম নিতে গেছে। অল্প হাওয়ায় দুলছে লোবসাং-এর ঝুলে থাকা রক্তাক্ত শরীরটা, আর রক্তভেজা কষ বেয়ে চুঁইয়ে নামছে একটা অদ্ভুত হাসি। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু শিরশির করে উঠল পোড় খাওয়া এজেন্ট রতনলালের শিরদাঁড়াটা।

‘ভাউ।’

চমকে উঠল রতনলাল। মারাঠিতে ভাউ মানে শ্রদ্ধেয় বড় ভাই। এই নামে ডাকতে একসময় রতনলালই শিখিয়েছিলেন লোবসাংকে। দুজনের মধ্যে তরল ঠাট্টা ইয়ার্কির সময় লোবসাং ভাউ বলেই ডাকতো রতনলালকে।

আর আজ এই রক্তাক্ত হিংস্র মধ্যরাতে এই ভাউ ডাকটা যেন লোবসাং-এর ভাঙা চোয়ালের মধ্য থেকে গায়ে কাঁটা দেওয়া এক অপার্থিব অশরীরী ফিসফিস হয়ে ভেসে এল।

‘মেরা নাহানা হো গ্যায়া ভাউ। খানা খানে নেহি চলোগে? হি হি হি…’

ঘাড়ের সমস্ত রোঁয়া দাঁড়িয়ে গেল রতনলালের।

খানিকক্ষণের নৈঃশব্দ। শুধু লোহার চেনের টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। আর লোবসাং এর শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ার টুপটাপ শব্দ।

‘উস কিতাব কে বারে মে জাননা চাহতে হো ভাউ?’ ফিসফিস করে বলে উঠলেন লোবসাং, ‘জাননা চাহতে হো উসমে ক্যায়া লিখখা হ্যায়?’

চিত্রার্পিতের মতো সেদিকে চেয়ে রইলেন রতনলাল।

‘তো ফির পুরা সুনো ভাউ, ধ্যান সে সুননা। হাম বাতাতে হ্যায় উস কিতাব মে কেয়া লিখখা হ্যায়। বাদমে ইয়ে মত বোলনা কে আপকা ভাই লোবসাংনে আপকো কুছ নেহি বাতায়া… খি খি খি খি…’

মধ্যরাতের অন্ধকারে সিলিং থেকে নেমে আসা লোহার চেনে বাঁধা অবস্থায় দুলছে একটা শীর্ণকায় রক্তাক্ত নগ্ন শরীর। আর তার সামনে দাঁড়িয়ে, ভূতুড়ে গলায় বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে পাথর হয়ে যেতে লাগল আই বি’র এজেন্ট, তথা মহাকালচক্রের গোপন সদস্য রতনলাল বাবুরাও মাত্রের পা দুটো।

দেড়হাজার বছর আগে

‘প্রেতবস্তু বলতে তুই কী বুঝিস থুবতেন?’

ঘন অন্ধকার রাতে, বিহারের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটির পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দু’জন। যে মশাল এই অন্ধকার রাত্রিতে তাঁদের পথ দেখিয়ে এনেছে, সেটি প্রোথিত ছিল সামনের মাটিতে। তার আলোতে মাটিতে সদ্য-সদ্য আঁকা অষ্টভুজ ক্ষেত্রটি উদ্ভাসিত। সেদিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন আচার্য রাহুলবজ্র, ওরফে প্রভু পদ্মসম্ভব।

‘খুব অল্পই বুঝি প্রভু।’ নিরাসক্ত স্বরে বলে থুবতেন ‘যার ভেতরে কোনো প্রেতাত্মাকে লুকিয়ে রাখা হয়। যার জন্য এই প্রেতবস্তু বানানো হয়, তার সর্বনাশ ঘটে, সে সবংশে নিহত হয়।’

কথাটা পদ্মসম্ভবের কানে গেল কি না বোঝা গেল না। ধীরে-ধীরে অষ্টভুজ ক্ষেত্রটিকে প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে পূর্ব থেকে শুরু করে দক্ষিণ হয়ে পশ্চিমপ্রান্ত ছুঁয়ে উত্তর দিকে এলেন তিনি। সেখানে দাঁড়িয়ে ভ্রূকুঞ্চিত দৃষ্টিতে সমগ্র ক্ষেত্রটিকে দেখলেন তিনি। তারপর সঙ্গে আনা পেটিকাটি খুলে চেয়ে রইলেন ভেতরে রাখা করোটিটির দিকে।

‘শিনজে কি প্রেত হয়ে গেছে প্রভু?’ নির্জীব স্বরে প্রশ্ন করে থুবতেন, ‘শিনজের প্রেত কি আমাকে মেরে ফেলবে? তাহলে কি শিনজের সঙ্গে আমার ফের দেখা হতে পারে?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আচার্য পদ্মসম্ভব। যা ভয় করছিলেন তাই হতে চলেছে। উন্মাদ হয়ে যাওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে থুবতেনের আচরণে।

‘শোন থুবতেন।’ গম্ভীর মুখে বলেন পদ্মসম্ভব, ‘তোর মনিব আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা এক অতি শক্তিশালী, অতি ভয়ঙ্কর প্রেতবস্তুর জন্ম দিয়েছে। এই বিশেষ প্রেতকায়া নির্মাণের প্রধান উপকরণ হচ্ছে কোনও হিংস্র পশুর জীবনীশক্তি। সেইজন্যই তারা হত্যা করেছে শিনজেকে।

তোর শিনজে আর সে শিনজে নেই রে থুবতেন। এখন সে এক হিংস্র প্রেতশক্তি মাত্র। তার বোধ নেই, বিবেক নেই, দৃষ্টি নেই। সে শুধু জানে মৃত্যুর করাল ছায়া বিছিয়ে দিতে। জেনে রাখ থুবতেন, যতদিন এই প্রেতবস্তু পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াবে ততদিন তোর, আমার, আমাদের কারও জীবনই আর নিরাপদ নয়।’

বোবা চোখে থুবতেন তাকিয়ে রইল আচার্য পদ্মসম্ভবের দিকে।

‘এই প্রেতবস্তুকে রোধ করা আমাদের আশু কর্তব্য থুবতেন। এখনও সে জাগ্রত হয়নি। আমার ধারণা আজকালের মধ্যেই তার প্রেতচিত্ত সক্রিয় হবে।’

‘তারপর?’ নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করে থুবতেন।

‘তারপর?’ চাপা গলায় বললেন পদ্মসম্ভব, ‘তারপর এক ভয়াবহ, অপ্রতিরোধ্য মহামার নেমে আসবে প্রকৃতির বুকে। একের পর এক মৃত্যু ঘটবে মানুষের। মারীতে উজাড় হয়ে যাবে গ্রামের পর গ্রাম। অপঘাতে মৃত মানুষের প্রেতদল পাতাল থেকে তুলে আনবে মহানরক। বজ্রখড়গ আর নরকপাল হাতে নেমে আসবেন দেবী চামুণ্ডা স্বয়ং। একবার যদি এই প্রেতকায়ার মুক্তি ঘটে, তাহলে মহা সর্বনাশ। তখন তাকে প্রতিরোধ করা স্বয়ং ঈশ্বরেরও অসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে।’

অস্ফুটে একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করে থুবতেন, ‘তাহলে?’

চিন্তিত দেখায় ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ তন্ত্রবেত্তাকে। অন্যমনস্ক স্বরে বলেন, ‘সাধারণ কোনো উপায়ে এই প্রেতবস্তুর বিনাশ সম্ভব নয় থুবতেন। যে মন্ত্রবীজের দ্বারা এই প্রেতবস্তুর অন্তর্কায়া নির্মিত তা এই দেশের নয়। একমাত্র পোন পুরোহিতরাই এই প্রেতবন্ধনমন্ত্রে সিদ্ধ। আর যতদিন এই বন্ধন বজায় থাকবে, ততদিন শিনজে’র আত্মার মুক্তি নেই। অনাদিকাল পর্যন্ত সে এই প্রেতচক্রের অধীন হয়ে থাকবে। নরকের অগ্নি অনন্তকাল ধরে জ্বলতে থাকবে তার বুকে। এই বীভৎস প্রেতদেহ থেকে তার পরিত্রাণ নেই, তার মুক্তি নেই, তার উদ্ধার নেই।’

‘কিন্তু… ওরা যে আমাকে বলেছিল, আপনি নাকি জীবন্ত অবলোকিতেশ্বর?’ থুবতেনের ক্লান্ত বিবর্ণ চোখদুটির কোণে জেগে ওঠে দু’টি অশ্রুকণা। ‘আপনি পারেন না প্রভু? পারেন না শিনজেকে উদ্ধার করতে? আমি ছাড়া যে ওর আর কেউ নেই প্রভু।’

চোখদু’টি বন্ধ করলেন পদ্মসম্ভব। হায় তথাগত, কী ঐশ্বর্যই না তুমি দিয়েছ এই অনাথ যুবককে! এক অবলা পশুর প্রতি এত প্রেম কে কবে দেখেছে জগতে?

করুণাঘন চোখে থুবতেনের দিকে তাকালেন পদ্মসম্ভব। তারপর ধীরস্বরে বললেন, ‘উপায় আছে থুবতেন। একটি উপায় আছে একে নিবৃত্ত করার। তবে সে বড় কঠিন, বড় দুরূহ। বড় জটিল বিদ্যা। মাত্র গুটিকতক মানুষই এর অধিকারী। শুধু তাই নয়, বিগত পাঁচশো বছরের মধ্যে কখনও এর প্রয়োগও হয়নি। এর বিন্দুমাত্র ভুল প্রয়োগে মহাসর্বনাশ উপস্থিত হতে পারে। উল্টে যেতে পারে প্রকৃতির নিয়মকানুন, সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমাদের চেনা এই জগৎ।’

‘কী সেই বিদ্যা, প্রভু?’

স্থিরদৃষ্টিতে থুবতেনের দিকে তাকিয়ে থাকেন পদ্মসম্ভব, তারপর গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করেন একটিমাত্র শব্দ, ‘কালচক্র নির্মাণ।’

এরপর দুজনেই একটু চুপ করে থাকেন। আকাশে ঝুলে থাকা চাঁদের ক্ষীণ টুকরোটি নির্বাক শৈত্যের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে এই পাহাড়ি উপত্যকার দিকে, তার বুক চিরে চলে যাওয়া নদীটির দিকে, বৌদ্ধবিহারটির সংলগ্ন ছোট গ্রামটির দিকে। মনে হয় শীতল ধাতব আলো যেন এক অপার্থিব স্তব্ধতার চাদর বিছিয়ে রেখেছে এই উপত্যকার উপর।

‘শাম্ভালার সম্রাট কালধর্মরাজ সুভদ্রর আশীর্বাদে মহান কালতন্ত্রবিদ্যা আমার অধিগত।’ পদ্মসম্ভবের গম্ভীরস্বর ধ্বনিত হয় আদিগন্ত নিসর্গ জুড়ে, ‘আজ আমি এই অতি গুহ্য, অতি শক্তিশালী, অতি জটিল বিদ্যার প্রয়োগ করব। এই প্রেতবস্তুকে আজ আমি এমন গহীন গহ্বরে লুকিয়ে রাখব যাতে অন্তত সহস্রাধিক বৎসরের জন্য এ হারিয়ে যায়।’

‘কোথায় লুকিয়ে রাখবেন ভন্তে?’ উদ্বেগে আর ভয়ে স্বর কেঁপে যায় থুবতেনের।

তার প্রশ্নের উত্তর দেন না পদ্মসম্ভব, গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘এখন তুই গ্রামে ফিরে যা থুবতেন। গিয়ে ঘরে-ঘরে বলে দিস কেউ যেন আজ রাতে ঘরের বাইরে না থাকে। জানিয়ে দিস, এটি আচার্য পদ্মসম্ভবের কঠোর নির্দেশ।

আজ রাত্রে প্রবল প্রলয় আছড়ে পড়বে এই জনপদ ঘিরে। তখন যদি পৃথিবী বিদীর্ণ হয়ে যায়, নগাধিরাজ হিমালয় চূর্ণ হয়ে যায়, দাবানল গ্রাস করে এই ভূমি, তবুও যেন একটি প্রাণীও ঘরের বাইরে পা না রাখে। ভয়ের কিছু নেই, আমার কর্ম সুসম্পন্ন হলে সব কিছু পূর্ববৎ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু কোনোভাবেই, কিছুতেই যেন একটি প্রাণীও আজ ঘরের বাইরে না আসে।’

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল থুবতেনের। ‘আজ রাতে কী হবে ভন্তে?’ জানতে চাইল সে, ‘এমন আদেশের মানে কী? কোন সে অন্ধকার গহ্বরের কথা বলছেন আপনি?’

খানিকক্ষণ ঊর্ধ্বাকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন পদ্মসম্ভব। অনিমেষ অনন্ত আকাশের আঁচলে উজ্জ্বল হীরকচূর্ণের মতো ছড়িয়ে আছে অনিঃশেষ নক্ষত্রপুঞ্জ। সেদিকে তাকিয়ে চোখদুটি মুহূর্তের জন্য বন্ধ করলেন তিনি।

‘শোন রে থুবতেন, আজ আমি এই অষ্টভুজক্ষেত্রে নির্মাণ করব কালচক্রমণ্ডল। অষ্ট দিকপাল রক্ষা করবেন এর প্রতিটি বাহু। অন্তর্দেহ রক্ষা করবেন ষড়ভুজ মহাকাল। মূলচক্র বীজ স্থাপন করব দেবী শ্বানাস্যাবাকুক্কুরমুখী’র নামে। আর তারপর…’ লম্বা শ্বাস নিয়ে বললেন পদ্মসম্ভব, ‘এরপর গুরুর আশীর্বাদে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করব স্বয়ং মহাকালকে।’

যেন এক ঘোরের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিল থুবতেন। তাও সে প্রশ্ন করল, ‘তাতে কী হবে প্রভু?’

‘সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে আমার লক্ষ্য হবে দেব মহাকালকে ক্ষণমাত্রের জন্য হলেও পরাস্ত করা। যে অনাদি, অনন্ত সময়প্রবাহ আমাদের ঘিরে বয়ে চলেছে, গুরুদত্ত তন্ত্রজ্ঞানে তার দেহে একটি রন্ধ্রপথ সৃষ্টি করব। উন্মুক্ত করব সময়ের সিংহদ্বার, কালজঠর। তখন বিপুল বিক্ষোভে পৃথিবী আন্দোলিত হবে, আকাশ হতে উৎক্ষিপ্ত হবে নক্ষত্রসমূহ, রুষ্ট মহাকালের পাশদণ্ড আছড়ে পড়বে পৃথিবীর বুকে। তারই মধ্যে, মুহূর্তের জন্য উন্মুক্ত হবে সেই রন্ধ্রপথ, আর সেখানেই আমি নিক্ষেপ করব এই প্রেতবস্তু। তারপরেই রুদ্ধ হয়ে যাবে সেই কালরন্ধ্র, হারিয়ে যাবে এই মূর্তিমান পাপ।’

‘আর শিনজে? তার মুক্তি হবে না?’ কোন পাহাড়ি ঝরনা যেন নেমে এলো অনাথ, অসহায়, নিঃসম্বল যুবকের দু’চোখের শুকনো গিরিখাত বেয়ে, ‘ওকে ছাড়া আমি যে নরকে গিয়েও শান্তি পাবো না প্রভু। আমি ছাড়া ওর যে আর কেউ নেই। পশু বলে কী আপনার করুণাস্পর্শের অধিকার নেই তার? বলুন প্রভু, আপনার ধর্ম কী শুধু মানুষের জন্য?’

কঠোর হৃদয় তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ তিনি, অসম্ভব সব আধিদৈবিক ও অলৌকিক কার্যকলাপে তাঁর প্রসিদ্ধি আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষব্যাপী। তবুও এই মুহূর্তে এক অনির্বচনীয়ভাবে হৃদয় দ্রব হল পদ্মসম্ভবের।

‘হবে রে বাছা, হবে।’ থুবতেনের মাথায় হাত রেখে বললেন পদ্মসম্ভব,’এই বন্ধনের আয়ুষ্কাল সহস্রাব্দের কিছু অধিকমাত্র। তারপর দৈবের অমোঘ নিয়মে তোর আর শিনজের সাক্ষাৎ হবে। আমি তোকে লিখে দিয়ে যাব এই বন্ধনমোচনের উপায়। দৈবের নির্বন্ধে তোর কোনও উত্তরপুরুষ বা তার পরমবান্ধব জাগ্রত করবে এই মহাকালবন্ধন।

সেইদিন অবধি যেন এই অতীব গোপন আদেশ সযত্নে রক্ষা করে তোর উত্তরপুরুষেরা।

তারপর কোনও এক ঐশী উপায়ে উন্মুক্ত হবে সময়ের দ্বার। আমি জানি না কীভাবে সম্ভব হবে সেই অসম্ভব ঘটনা। তবুও বলছি হবে রে থুবতেন, হবে। তোর সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাৎ হবে শিনজের, আর তদ্দণ্ডেই উদ্ধার হবে সে। এইখানেই ঘটবে সেই ঘটনা, এই অষ্টভুজক্ষেত্রেই। জীবনমৃত্যুর আবর্তনে আবার জন্ম নিবি তুই। তখন তোর সঙ্গে আবার তার দেখা হবে, হবে, হবেই!’

আট মাস আগে

দৈত্যের মতো বিশাল বড় এক্সক্যাভেটার আর বুলডোজারগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল একপাশে। অন্যপাশে বড় বড় যন্ত্রচালিত চেইনস’ আর ক্রস কাট স’ নিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করছিল একদল মানুষ। একটু দূরে তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে ডায়না নদী। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে তার ছলাৎচ্ছল জল মৃদু গর্জনের শব্দ তুলছিল। মাথা তুলে তাকালে দেখা যায় যে একটু দূরেই ভুটানের পর্বতমালা। সেখান থেকে ভারী মোলায়েম ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসছিল।

যন্ত্রপাতিগুলো ঘিরে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল বস্তির মেয়েমদ্দ আর বাচ্চাদের দল। এমন নয় যে এই এলাকায় আগে এসব যন্ত্রপাতি তারা কখনও দেখেনি। গত দশ বছরের মধ্যেই এদিক-ওদিক করে দেখতে দেখতে বেশ ক’টা রিসর্ট গড়ে উঠেছে এই লাল ঝামেলা বস্তির কাছে-পিঠেই। শহরের বাবুবিবিরা সেখানে প্রতি সপ্তাহান্তে পরের বর অথবা বউ নিয়ে এসে ঘোরতর মোচ্ছব মেহফিল উদযাপন করে যান। তা সেসব শৌখিন রিসর্ট বানানোর সময়েও তো কাজকম্ম, হই হট্টগোল এসব কম হয়নি। তাহলে এখন এদের এত উৎসাহিত হওয়ার কারণ কী?

তার কারণ একটাই। এই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোর মতো রাক্ষুসে জিনিস আর আগে কখনও এই চত্বরে ঢোকেনি, এ কথা হলফ করে বলতে পারে এখানকার লোকজন।

‘এবার এই এখানেও আবার হোটেল মোটেল তৈরি হবে নাকি রে অভিরাম?’ নিমের দাঁতন নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে এলাকার উঠতি নেতা অভিরাম বেসরার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল বুড়ো ভগত মাঝি।

মুখখানা তুম্বো করে সেদিকে তাকিয়েছিল অভিরাম বেসরা। বুড়োর কথার উত্তর দিল না সে। মেজাজটা তার বড্ড টকে আছে।

তার মেজাজ টকে থাকার কারণও আছে অবশ্য। এই এলাকায় এত বড় একটা প্রজেক্ট হচ্ছে, তাও আবার তাকে না জানিয়ে, ব্যাপারটা ঠিক হজম হচ্ছিল না তার। নাগরাকাটা থেকে দেবপাড়া হয়ে বানারহাট, এই টোটাল এরিয়ায় যত প্রজেক্ট হবে, তার ইট বালি সাপ্লাইয়ের টেন্ডার তার একার, এ হচ্ছে চন্দ্র-সূর্য উদয় অস্তের মতোই বাঁধা নিয়ম।

অবিশ্যি তার একার টেন্ডার কথাটা ভুল, এই এলাকার এম এল এ পালবাবুর জন্য কুড়ি পার্সেন্ট আলাদা করে রাখাই থাকে। আজ অবধি এ নিয়মের কোনও ব্যত্যয় হয়নি।

হল আজ।

তাকে না জানিয়েই জঙ্গল সাফা হচ্ছে শুনে গতকাল সকালে সাইটে লোক পাঠিয়েছিল অভিরাম। লোক বলতে বাবলু আর ট্যারা নিতাই। দুজনেই বলিয়ে কইয়ে লোক, চেম্বার ছাড়া ঘোরে না। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর দুপুরের মধ্যেই কনস্ট্রাকশন কোম্পানির লোকজন হেঁ-হেঁ করতে করতে তার দরবারে এসে উপস্থিত হয়। একটু তেড়িয়া পার্টি হলে বিকেল। তারপর বাকিটা মাল্লুর বখরা নিয়ে নেগোসিয়েশন। তবে এসব ক্ষেত্রে অভিরাম বড়ই নির্মম। পালবাবুর রেকোমেন্ডেশন নিয়ে এলে আলাদা কথা, নইলে এসব ব্যাপারে সে পাই পয়সা ছাড়ে না কাউকে।

গতকাল দুপুরে ওর বাড়ির সামনে বাবলুর বাইক দাঁড় করানোর শব্দ শুনেই বারমুডার ওপর একটা টি শার্ট চাপিয়ে বেরিয়ে এসেছিল অভিরাম। তখনই হাফ বোতল হুইস্কি তার পেটে। কিন্তু বেরিয়ে আসার পর তার নেশা কাটতে দেরি হয়নি বেশি।

দুটোকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে ওদের ওপর দিয়ে ছোটখাটো একটা ঝড় বয়ে গেছে। মারটা নিতাই-ই খেয়েছে বেশি। ঠোঁটের কষ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, বাঁ-চোখটাও ফোলা। গাল দুটোও ফুলে রয়েছে বীভৎসভাবে। বরং বাবলুর ধোলাইটা কমই হয়েছে একটু। ওকে নাকি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে বাইকটা ঠিকঠাক চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

‘তোদের কে মারল এইভাবে?’ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জানতে চেয়েছিল অভিরাম। তার লোকের গায়ে হাত তোলে, এই এলাকায় কার ঘাড়ে ক’টা মাথা?

প্রজেক্টের সিকিউরিটির লোকজন। এই উত্তরই এসেছিল কোঁকাতে থাকা বাবলুর কাছ থেকে।

ওয়েবলি স্কটটা লোড করে বাইক স্টার্ট দিয়েছিল অভিরাম। প্রজেক্ট পরে, আগে থানায় যাওয়াটা দরকার। শুয়োরের বাচ্চা বড়বাবুটার সঙ্গে একটা মহড়া নেওয়া খুব জরুরি। শান্তিপূর্ণভাবে তোলা আদায় করার জন্য সিন্ডিকেটের লোকজনকে যদি এভাবে প্রকাশ্যে মার খেতে হয়, তাহলে মাসে মাসে থানায় মাসোহারাটা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কেন?

প্রবল রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে থানায় পৌঁছে অভিরাম আরও অবাক। বড়বাবু হাসানসাহেব রাতারাতি বদলি হয়ে গেছেন। তার বদলে কে এক মুখুজ্জে না চাটুজ্জে থানার চেয়ারে বসে।

এসব ক্ষেত্রে অভিরাম সচরাচর ধীরে চলো নীতি নেয়। মানে আগে আলাপ পরিচয় হোক, ভাব ভালোবাসা হোক। তারপর না হয় সেটিং এ আসা যাবে। ম্যারিনেট না করেই মুরগি রাঁধতে যায় কোন আহাম্মক? তাতে টেংরির টেস্ট খারাপ হয় না?

কিন্তু দামি হুইস্কির প্রভাবেই হোক বা কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে থাকার কারণেই হোক, প্রথমেই একটু রঙ নিতে গেছিল অভিরাম।

ভগত খুড়োর প্রশ্নটা শুনে বাঁ-গালে নিজের অজান্তেই হাতটা চলে গেল অভিরামের। গালটা এখনও টনটন করছে ব্যাথায়। কানের ভোঁ-ভোঁ-টা অবশ্য অনেকটাই কমেছে, খালপাড়ের বস্তির মালতীর চুন হলুদের দৌলতে। তবে অপমানের জ্বালাটা এখনও কমেনি অভিরামের। এই এলাকার বেতাজ বাদশা সে। তাকেই কিনা কানের গোড়ায় থাবড়ে দেয় থানার নতুন বড়বাবু?

অপমানটা গায়ে আরও বিঁধে রয়েছে সাতসকালে পালবাবুর ফোন পাওয়ার পর। যে লোকটা আজ অবধি ‘মেরা বাচ্চা, মেরা শের’ এইসব বলে তোল্লাই দিয়ে এসেছে ওকে, আজ তারই গলার স্বর সম্পূর্ণ আলাদা। শুধু স্বর? আর বাকি খিস্তিগুলো?

‘জানি না খুড়ো, হবে কিছু একটা।’ তিক্তস্বরে উত্তর দিল অভিরাম, কাল থেকে কী যে হচ্ছে সেটা এখনও মাথায় সেঁধোয়নি তার। সকালে পালবাবু ফোন তুলেই বলেছিলেন, ‘বাঞ্চোত, আমার সঙ্গে কথা না বলে তোকে কে বলেছিল ওখানে রংদারি করতে যেতে? কীসের প্রজেক্ট জানিস কিছু?’

মিউমিউ করে কিছু একটা বলতে গেছিল অভিরাম। এক ধমকে ওকে চুপ করিয়ে দেন পালবাবু, তারপর গলা নামিয়ে বলেন, ‘এই প্রজেক্ট থেকে একশো হাত দূরে থাক অভিরাম। এ অনেক ওপরের লেভেলের ব্যাপার, তোর মতো খুচরো ছুঁচোদের কাজ কারবার না। যদি তুই বা তোর টেনিয়াদের কেউ ওদিকে পা রেখেছে, তোদের লাশ অবধি খুঁজে পাওয়া যাবে না, কথাটা যেন মাথায় থাকে তোদের, এই বলে দিলাম, হুঁ।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *