নিরস্ত্র – উপন্যাস – বিমল কর
০১.
দরজা খুলতে দেরি হল।
দরজা খুললেন বিনুর মা। বোধনকে দেখলেন। ও, তুমি! বিনুর শরীর ভাল নেই।
বোধন বিনুর মাকে দেখছিল। কী হয়েছে?
জ্বর।
বিনুর মা দরজা পুরোপুরি খোলেননি। এক পাট খুলে পাললায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে। ভেতরের দিকে বাতি জ্বলছিল। বিনুর মার মুখের ওপর অন্ধকার পড়ছে।
বোধন বিনুর মার মুখ দেখতে দেখতে বলল, সকালে আসতে পারিনি তাই এখন এসেছিলাম। আমি তা হলে যাই।
আচ্ছা, এসো।
বিনুর মা অপেক্ষা করছিলেন; বোধন পিঠ ফেরালেই দরজা বন্ধ করবেন। ভেতর থেকে বিনুর গলা শোনা গেল। কে এসেছে, মা?
বোধন।
বোধনদা! ওকে একটু বসতে বলল না।
ঘাড় ঘুরিয়ে বিনুর মা ঘরের দিকে তাকালেন। বসতে বলব?
হ্যাঁ বলো। আমার খুব দরকার। একটু বসুক।
বিনুর মা বলতে যাচ্ছিলেন, তোমার না জ্বর–না বলে বোধনের দিকে মুখ ফেরালেন আধাআধি। হয়তো বিরক্ত। তুমি তা হলে বসো।
বোধনকে ভেতরে আসতে জায়গা দিলেন বিনুর মা। বোধন ভেতরে আসতেই আবার দরজার ছিটকিনি তুলে দিলেন।
কয়েক পা এগিয়ে ডান দিকে বসার ঘর বিনুদের। বিনুর মা ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালালেন। পাখা চালাবার আগে ইতস্তত করলেন। তুমি তবে বসো।
ঘরটা অগোছালো হয়ে আছে। চায়ের কাপ, জলের গ্লাস, কাচের প্লেট পড়েছিল সেন্টার টেবিলের ওপর, সোফার পিঠে পাট করা সুজনি। হয়তো কেউ রেখে গিয়েছে।
বিনুর মা এটা ওটা তুলে নিচ্ছিলেন। সারাদিনের একটা লোক পাই না এখানে! ঠিকে ঝি দিয়ে কত আর হবে! কী জায়গায় যে এসেছি!
বোধন বিনুর মাকে অন্যমনস্কভাবে দেখছিল। দেখতে ভাল লাগে। অনেক ছিমছাম। আঁটোসাঁটো চেহারা, বাঁধা গড়ন। মোটা-সোটা বেয়াড়া নয়। মাথায় বেশ লম্বা। গায়ের রং ধবধবে ফরসা নয়, তবে ফরসাই, গালের এক পাশে সামান্য নীলচে দাগ। বিনুর মার নাক উঁচু; চোখ বড় বড়। চোখে চশমা। রূপোলি ফ্রেমের চশমায় বিনুর মার মুখ ঝকঝক করছিল। বোধহয় সামান্য আগে গা ধুয়েছে। চোখমুখ পরিষ্কার, ঝরঝরে। মুখে গলায় পাউডার বুলোনো। গলার ভাঁজে গুড়ো জমে আছে। পরনে কালো পাড়ের শাড়ি। ধবধব করছে জমি। গায়ে মিহি সাদা কাপড়ের জামা। মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা।
বাইরে অনেকক্ষণ থেকে মেঘ ডাকছিল, বিনুর মা বললেন, তুমি কি বৃষ্টির মধ্যেই এলে?
না মাথা নাড়ল বোধন, গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছিল। ও কিছু না।
বিনুর মার হাতে সব আঁটছিল না। কিছু নিলেন, কিছু পড়ে থাকল। আবার আসবেন। উনি চলে গেলেন।
বোধন এতক্ষণে বসল।
বিনুর মাকে দেখলে বোধন আড়ষ্ট বোধ করে। নিজেদের কাছাকাছি মনে হয় না। সম্ভ্রম হয়। অমন সুশ্রী চেহারা, বয়সও কম নয়। বিনুর মা এলোমেলো, আলগা কথা বলেন না। গলায় জোর নেই, ঠাণ্ডা স্বরে কথা বলেন। হাসাহাসি করা মুখ নয়, খানিকটা গম্ভীরই বরং। বোধন বিনুর মার সঙ্গে মাঝে মাঝে নিজের মার তুলনা করে। আকাশ পাতাল তফাত। বোধনের মা অন্যরকম। রাগী, বদমেজাজি, রুক্ষ। মুখে কিছু আটকায় না, গালিগালাজ খারাপ কথা–কিছুই নয়। মায়ের চেহারার সঙ্গেও বিনুর মার চেহারার মিল নেই। বোধনের মা মাথায় মাঝারি। থলথলে, জলেভরা চেহারা। বেমানান মোটা দেখায়, ফোলা ফোলা মুখ-চোখ। রক্ত কম থাকলে নাকি ওই রকম হয়। অ্যানিমিয়া। বোধন জানে না। তবে মার মুখ-চোখ খড়ির মতন সাদাটে, বিবর্ণ। গায়ের চামড়া খসখসে। মাথার চুল পেকে যাচ্ছে মার, গালে দাগ পড়ছে কালো কালো। মা যখন অফিসে যায়–বোধন দেখেছে, হাঁফাতে হাঁফাতে, চোখ-মুখ লাল করে ঘামতে ঘামতে।
পায়ের চটি চট চট করতে করতে বিনু এল। গায়ে সেই আলখাল্লা জামা, কাঁধ থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত মাটিতে লুটোনো। বিনুর হাতে রুমাল, গলায় পাতলা মাফলার জড়ানো, রুক্ষ চুল, শুকনো মুখ। ছল ছল করছে।
সকালে কী হল ঘরে পা দিয়েই বিনু বলল। বলে উলটো দিকের সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। নাক টানল। গলার টাগরায় শব্দ করল। সেন্টার টেবিলের দিকে তাকিয়ে নাক কোঁচকাল। এতক্ষণ কী জ্বালাই জ্বালিয়ে গেল!
কে?
মার দুই বন্ধু। কেদার যেতে গিয়ে ভাব হয়েছিল মার সঙ্গে। বেড়াতে এসেছিল। কোথা থেকে এসেছিল জান? রিজেন্ট পার্ক। ওখান থেকে ঠেঙিয়ে কেউ এত দূর আসে! মাথা খারাপ! এসেছে সেই বিকেলের গোড়ায়, আর এই উঠল।
বিনু আর বিনুর মা আলাদা। বিনু রোগা, টিংটিং করছে, রং ময়লা। পাতলা, ছোট্ট মুখ বিনুর। কাটা কাটা নাক-চোখ। বিনুর চুল ঘাড় পর্যন্ত। কোঁকড়ানো। কথা বলার শেষ নেই বিনুর। সরু গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলে। এখন অবশ্য ভাঙা, বসে-যাওয়া গলায় কথা বলছিল। নাক বোজা।
তোমার তো জ্বর! বোধন বলল।
শুধু জ্বর! বাব্বা, এ একেবারে হাড্ডি জ্বর বিনু নাক টেনে গলা পরিষ্কার করল।
কেমন করে হল, শোনো! বিনু বলল, পরশু দিন নুন শোয়ে লোটাস সিনেমায় গিয়েছিলাম, চার বন্ধু। বেরিয়ে দেখি, বন্যা। কী বৃষ্টি কী বৃষ্টি! চার বন্ধু হাবুডুবু খেতে খেতে, ভিজে ন্যাতা হয়ে সন্ধেবেলায় বাড়ি। আর যাবে কোথায়! রাত্তির থেকেই হুহু…।
বিনুর মা আবার এলেন। বাকি জিনিসগুলো তুলে নিতে নিতে মাথার ওপরে তাকালেন। পাখা কম করে নাও।
নিবিয়ে দাও না! আমার শীত করছে।
গায়ে জড়ালেই আবার গরম লাগছে।
বিনুর মা সামান্য বিরক্ত হলেন হয়তো। পাখা নিবিয়ে দিলেন। দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন।
তুমি কি চা বসিয়েছ? বিনু বলল।
চা? …না। কেন!
আমাদের খেতে ইচ্ছে করছে।
আমাদের কথাটায় বোধন অপ্রস্তুত হল। বিনুর মার দিকে তাকাতে পারল না।
এই তো খেলে খানিকটা আগে, বিনুর মা বললেন।
এই তো কোথায়, সে অনেকক্ষণ! তাও সবটা খাইনি। তোমার বন্ধুরা যা গলগল করছিল, উঠে এসে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিলাম। একজন তো দেখলাম, চিনি ছড়িয়ে দিয়ে লুচি বেগুনভাজা খেল। বিনু হেসে কুটোকুটি।
তুমি বড় অসভ্য হয়ে উঠেছ! যে যেমন খায়–। বিনুর মা মেয়েকে ধমকালেন।
উনি আবার চলে যাচ্ছেন, বিনু চায়ের কথা মনে করিয়ে দিল।
কাকা এলে হবে, বিনুর মা ঘর ছেড়ে চলে গেলে।
বিনু নাক কোঁচকালকাকা এলে। পা তুলে নাচাতে গিয়ে এক পায়ের চটি খুলে গেল, যেন ছুঁড়েই দিল বিনু। বিড় বিড় করার মতন ঠোঁট কাঁপল, কিছু শোনা গেল না।
সকালে তোমার কী হয়েছিল? বিনু দুমুহূর্ত অন্যমনস্ক থেকে আবার ঠিক হয়ে গেল।
বাড়ির একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম বোধন বলল, বলে আবার কিছু মনে পড়ে গেল। এলেই বা কী হত! তোমার জ্বর।
আজ আর তেমন জ্বর কোথায়! কাল যা গিয়েছে, যত জ্বর, তত মাথা ব্যথা। গা হাত চিবিয়ে খাচ্ছিল। পটাপট ওষুধ খেয়েছি। যায় নাকি! এ হল খাঁটি ইউনিফ্লুয়েঞ্জা। জাপান থেকে এসেছে।
বোধন হেসে উঠল।
হাসছ! হাসার কী দেখলে। জাপান থেকে হংকং থেকে কত কী আসছে। কাগজ পড় না।
বোধন মাথা নাড়ল। মজা করে। বিনুকে তেমন দুর দূর মনে হয় না। সত্যি, ভাল লাগে।
আজ জ্বর কত? বোধন কথা ঘুরোতে চাইল।
আজ কম! সকালে একশো ছিল। দুপুরেও তাই। এখন জানি না।
আমার সঙ্গে কী দরকার ছিল বলছিলে? বোধন বলল।
ধ্যুত, দরকার আবার কী! সারাদিন বিছানায় শুয়ে আছি, ভাল লাগছিল না। বিবিধ ভারতী শুনতে শুনতে কানে তালা লেগে গেল। গল্পর বই পড়তেও ভাল লাগছিল না–,বলেই বিনু আচমকা থামল, তারপর পরম বিস্ময়ের চোখ করে বলল, ও হরি! বলতেই ভুলে গিয়েছি। তুমি ওটা কী লিখেছিলে খাতায়? গোঁজামিল যা চালাচ্ছো!
বোধন অবাক। গোঁজামিল?
সিলিকনের অ্যাটমিক ওয়েট কত?
কেন?
টুয়েন্টি সেভেন পয়েন্ট ওয়ান নয়; টুয়েন্টি এইট পয়েন্ট থ্রি। বইয়ে আছে।
বোধন বোকার মতন তাকাল। নাকি? ভুল হয়েছিল আমার। বই ঠিক দেখেছ তো?
দেখবে তুমি?
না না, আমার দেখার দরকার নেই। তুমি তো দেখেছ! বোধন যেন ব্যাপারটা এড়াতে চাইল।
আর-একটা গোঁজামিল বলব?
বোধন অপ্রস্তুত, কুণ্ঠিত হল। রাগও হল সামান্য। বলল, দেখো, আমি কিন্তু আগেই বলেছি আমি গাধাবোট। পাস কোর্সের বি এস সি৷ কিচ্ছু জানি না। যেমন ফিজিক্স, তেমনি কেমিস্ট্রি সবেই মাস্টার।
বিনু মুঠো তুলে বুড়ো আঙুল দেখাল। আমারও তো ওই দশা হচ্ছে। পাস কোর্সে বি এস সি পড়ছি। আমারও কাঁচকলা হবে। এর চেয়ে বটানি পড়লে ভাল হত। দিস ইজ কচু, দিস ইজ মোচা বলে চালাতাম। সুষমি কি মজাসে আছে! বিনু সর্দি জড়ানো বসা গলায় হাসতে গিয়ে কাশতে লাগল।
বোধনের হাসি পাচ্ছিল না। বিনুকে পড়াবার জন্যে সে যেচে আসেনি। তেমন যোগ্যতা যে তার নেই–বাধন জানে। সাধারণ ছেলে সে, মাথা মোটা। রগড়ে রগড়ে পরীক্ষায় পাস। বন্ধুদের সঙ্গে হল্লা করে বি এস সি পড়তে ঢুকেছিল। পাস কোর্স। কোনও রকমে টপকে গিয়েছে। নিজের লেখাপড়া সম্পর্কে তার কোনও অহঙ্কার নেই। বিনুও ভাল ছাত্রী নয়, লেখাপড়াতেও তার মন নেই। এখন সবে ফার্স্ট ইয়ার। শখের পড়া পড়তে ঢুকেছে। শখের পড়া বলেই শখের মাস্টার। আসলে মাস্টার নয় বিনুর হেলপার: এটা টুকে দাও, ওটা খুঁজে দেখো-এই আর কী! বোধনকে এই বাড়িতে এনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। সুকুমারদা। মাস্টারি নয়, অল্পস্বল্প দেখিয়ে দেবার জন্যে। বিনুর মা পঞ্চাশটা করে টাকা দেন মাসে। গত মাসে পেয়েছে বোধন, প্রথম। এ-মাসেও পাবে। আজ সেই টাকার জন্যে এসেছে বোধন। টাকাটা বড় দরকার। দরকার বলেই সন্ধেবেলায় আসা। নয়তো তার আসার সময় সকাল।
বোধন অন্যমনস্কভাবে বিনুর দিকে তাকাল। আগের বার বিনুর মা নিজেই ঠিক সময়ে টাকাটা দিয়েছিলেন। সাত তারিখে। তারপর পুজো পড়ল। এবারেও দেবেন এই আশা নিয়ে বোধন এসেছে। বিনুর মা তো কিছু বললেন না। ভুলে গিয়েছেন নাকি?
বিনু সামান্য চুপ করে ছিল; হঠাৎ বললে, তুমি কেন আলতু-ফালতু পড়তে গেলে! ছেলেদের পাস কোর্সে পড়ে কিছু হয় না।
আমারও কিছু হবে না, বোধন বলল; পুরোপুরি ঠাট্টা করে নয়।
বিনুর মা ডাকছিলেন।
উঠে গেল বিনু।
বোধন বুঝতে পারল না বিনুর মা কেন ডাকলেন? তিনি কি বিনুর গল্প করা পছন্দ করছেন না? গায়ে জ্বর নিয়ে এতক্ষণ বকবক করা যে বিনুর ভাল হচ্ছে না–হয়তো মেয়েকে সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বা, বোধনের হঠাৎ মনে হল, বিনুর মার হয়তো টাকার কথা মনে পড়ে গিয়েছে। বিনুর হাত দিয়েও টাকা পাঠিয়ে দিতে পারেন। বোধনের একটু আশা জাগল। যদি টাকা না আনে বিনু, বোধন কি একবার মুখ ফুটে বলবে? সেটা কি ভাল দেখাবে? বিনুর জ্বর, এখন কি টাকার কথা তোলা উচিত? তা ছাড়া টাকা পয়সার ব্যাপারটা বিনুর কাছে না তুলে বিনুর মার কাছে ভোলাই উচিত।
বিনু এল। হাতে দু কাপ চা। ধরো শীঘ্রি…!
বোধন খানিকটা থতমত খেয়ে গিয়েছিল, হাত বাড়িয়ে চা নিল।
চা আমার দরকার ছিল না, বোধন বলল।
আমার গলায় ব্যথা, গরম চা খেলে আরাম লাগে, বিনু বলল।
চা খেতে খেতে বিনু আরও পাঁচটা কথা বলল, এলোমেলো হালকা কথা।
বোধন চা শেষ করল। আমি তা হলে যাই।
কবে আসবে?
দেখি তোমার তো জ্বর।
ধ্যুত, এ সেরে গেছে। কাল ঠিক হয়ে যাব। …তুমি পরশু এসো।
বোধন হতাশ হয়ে পড়েছিল। টাকাটা কত পিছিয়ে গেল। বলবে নাকি বিনুকে। বিনু বড় সাদামাটা সরল। সে কিছু মনে করবে না। টাকার দরকার মানুষের হতেই পারে। লজ্জার কী রয়েছে?
উঠে পড়ল বোধন। বিনুও।
সদরে এসে বোধন হঠাৎ বলল, মাসিমার সঙ্গে একটু দরকার ছিল।
মার সঙ্গে? ডাকব মাকে?
বোধন আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল। না, থাক; আমি বরং কাল একবার আসব।
তাই এসো।
বোধন বাইরে পা বাড়াল।
.
০২.
এখন বর্ষা নয়, যখন তখন বৃষ্টি আসার কথাও না। তবু আজ কদিন ধরেই বর্ষার ভাব চলছে। কার্তিক মাস শেষ হয়ে গেল। আর ভাল লাগে না বৃষ্টি বাদলা।
বোধন খানিকক্ষণ ঘুরে ফিরে, তারা ইলেট্রিকস-এ গিয়ে বসল, ততক্ষণে হালকা বৃষ্টি নেমেছে, পাড়াও ঘুটঘুঁটে। আলো আসতে আসতে রাত নটা দশটা।
তারা ইলেকট্রিকস-এ সুকুমারদা আর জগৎ দাবা খেলছে মোমবাতি জ্বালিয়ে। দোকানটা সুকুমারদার।
বোধনকে দেখল সুকুমার। দেখেও কিছু বলল না। ঘোড়ার চাল নিয়ে মগ্ন। খেলা প্রায় শেষ।
জগৎ তার গজ সামলাচ্ছে।
বোধন একটা টুলের ওপর বসল।
দোকানটা ছোট। থাকার মধ্যে একটা পুরনো কাউন্টার টেবিল, পেছন ভাঙাচোরা আলমারি, ডান দিকে লোহার এক র্যাক। গোটা তিনেক নানান ধরনের চেয়ার, ছোট বেঞ্চি। ঘরাঞ্চিটা একপাশে দাঁড় করানো আছে। সামনেই রাস্তা। লোকজন, সাইকেল রিকশা যাচ্ছে অনবরত।
জগৎ সুকুমারের দোকানের লোক বয়েস কম। জগতের কাজ হল দোকান আগলে বসে থাকা।
সুকুমার বেয়াড়া একটা চাল দিয়ে জগৎর্কে আরও ঝঞ্জাটে ফেলে দিল যেন। দিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। বোধনের দিকে তাকাল আবার। কী রে, কাজটা করে দে।
এখন?
এখন না কখন? তোর জন্যে বিল ছাড়তে পারছি না। নে লেগে যা…
সুকুমারদার অনেক কিছুতেই বোধনের মজা লাগে। যেমন এই বিল। কোন বাড়িতে একটা সুইচ পালটেছে, কার বাড়িতে লাইনের গণ্ডগোল মেরামত করেছে, কার ইস্ত্রি সেরেছে, কিংবা পাখা মেরামত করে দিয়েছে সব কিছুতেই বিল। তারা ইলেকট্রিকসের ছাপানো পাতায় দুটাকা চার টাকা আট টাকা সব কিছুর বিল লিখতে হবে। হাতে নাতে কাজটা হতে পারত, কিন্তু সুকুমারদা করবে না। বিলে নাকি ইজ্জত বাড়ে। সুকুমারদার দোকানে বালব, ফিউজের তার, প্লাগ, চোক–এসবও কিছু না কিছু বিক্রি হয়। তার বেলাতেও কাঁচা ক্যাশ মেমো। জগৎ ঠিক মেমো লিখতে পারে না,কাঁচা হাতের লেখা, অদ্ভুত বানান–তবু ইংরেজি হরফে ওসব তাকে লিখতেই হবে। সুকুমারদার নিজের হাতের লেখা এবং বানান জগতের বাড়া। ক্যাশ মেমো যেমনই হোক বিল গবেটের মতন লেখা যায় না। তাতে নাকি দোকানের এবং দোকানের মালিকের প্রেস্টিজচলে যায়। কাজেই সুকুমারদা বোধনকে দিয়েই কাজগুলো করিয়ে নেয়, বিল লেখা, খুচরো বিক্রির হিসেব তুলে খাতায় ভরা। বোধনকে সুকুমারদা যখন যেমন পারে পাঁচ দশ দিয়েও থাকে।
এক একজন মানুষ থাকে যাদের হাজার বললেও কিছু বোঝে না। সুকুরমারদা সেই রকম। তার ধারণা, বোধন একজন দিগগজ। বি এস সি পাস করেছে বোধন, সুকুমারদার ধারণা সে সায়েন্স মাস্টার।
আসলে বোধনকে ভালবাসে সুকুমারদা। ভালবাসে, কারণ এই পাড়ার বেশির ভাগ ছেলের মতন বোধন হললাবাজ, রুক্ষ, নেশাখোর, হতচ্ছাড়া নয়। এই ভালবাসার দৌলতেই বোধনের ভাগ্যে বিনু বা বিনুর মার পঞ্চাশটা টাকা জুটেছে একমাস। এ-মাসেও জুটবে। কিন্তু টাকাটা আজ পাওয়া গেল না।
কোথায় কী আছে দোকানের বোধন জানে। খাতাপত্র, তারা ইলেকট্রিকস-এর ছাপানো প্যাড বার করে নিল বোধন।
কটা বিল হবে?
খাতা দেখ। লেখা আছে।
জগৎ পালটা চাল দিল।
সুকুমার মুঠো পাকিয়ে শব্দ করে করে বার দুই টান দিল সিগারেট। পালটা চাল দেখল। নিজের চাল ভাবল। তারপর হঠাৎ মজার গলায় গান গেয়ে উঠল: আয় মা তারা নেচে নেচে…। গান শেষ না করেই জগতের পালটা চাল নষ্ট করে দিয়ে বলল, তোর দ্বারা দাবা হবেনা, জগৎ। তুই বেটা চাইনিজ চেকার খেল। উল্লুক তুই।
জগৎ কিছু বলল না। মাথা চুলকোল। সুকুমারদার ভয়ে তাকে দাবা খেলতে হয়। সুকুমারদার ধারণা, বোকা জগতকে দাবায় নামিয়ে সুকুমারদা তার মাথা সাফ করে দেবে।
বৃষ্টি পড়ছে। খেলা চলছে। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে রিকশা যাচ্ছে ঘন্টি বাজিয়ে।
বোধন একটা পকেট সাইজের খাতা থেকে সুকুমারের হাতের লেখা কাজের ফিরিস্তি উদ্ধার করছিল। এটা কী লিখেছ?
সুকুমার খাতা দেখল। নিজেই যেন বুঝতে পারল না। ঘাড় চুলকোল। ছ নম্বর বাড়িতে কী হয়েছিল রে, জগৎ?
ছ নম্বর! …ওই শ্বেতিবাবুর বাড়ি?
শ্বেতি তো তোর কী শালা। কার শ্বেতি, কার মেতি–তোকে কে দেখতে বলেছে! খদ্দের খদ্দের। খদ্দেরের নামে ফালতু কথা বলবি না।
জগৎ ঘাবড়ে গেল। বলল, বাড়ির কাজ আমি কী জানব?
বারে শালা, দোকান থেকে মাল গেছে, তুই কী জানবি?
বাচ্চু কাজ করেছে ছ লম্বরে। বলেই জগতের মনে পড়ে গেল ছনম্বরে নতুন টিউব লাইট লাগানো হয়েছে। বলল, টিউব লাইট।
বোধন হেসে ফেলল। সুকুমারদা দারুণ লিখেছে খাতায়। ফিশিংটা বোধহয় ফিক্সিং তুমি এসব লিখলে আমি কী বুঝব? বাংলায় লিখে রেখো।
সুকুমার গম্ভীর মেজাজে বলল, বাংলা মুদির দোকানে লেখে। আমাদেরটা ইলেকট্রিক।
বোধন আরও জোরে হেসে উঠল।
খেলা বন্ধ করে দিল সুকুমার। আর দু তিনটে দান হলেই খেলা শেষ হত। জগতের কিছু করার ছিল না। তুই বেটা কাল থেকে লুডো এনে রাখবি দোকানে, তোর সঙ্গে লুডো খেলব। উল্লুক।
জগৎ যেন বেঁচে গেল। সুকুমারদার সঙ্গে দাবা খেলাটাই তার শাস্তি।
সিগারেট খাবি? সুকুমার বলল বোধনকে।
দাও।
জগৎ উসখুস করল। বাইরে যাবে একবার। দোকানের এদিক ওদিক হাতড়ে একটা ভাঙা ছাতা বার করল। তারপর ছুটল।
বোধন সিগারেট ধরিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে কাজ করতে লাগল।
সুকুমার বলল, একটা বড় কাজ ধরেছি রে? উনিশ নম্বরে বাড়ি হচ্ছে। চাটুজ্যেবাবুর বন্ধু। ইলেকট্রিকের সব কাজ আমার।
বাঃ, ভাল কথা।
আসছে মাসে বিয়েও আছে। পাড়ায় তিনটে বিয়ে, একটা অন্তত পাব, কী বল!
পাবে না কেন! তুমি যে-ভাবে পয়সা ফেলে রাখো বাপিরা পারবে না।
তুই বিজনেসের ঘণ্টা বুঝিস। সুকুমার বলল, আমার বাপও বিজনেস করত। আমি বিজনেসের বাচ্চা। বাবা সাইকেল বেচত। মাসে পাঁচ সাত হাজার টাকার কারবার। ডুবল যখন কাটা ঘুড়ির মতন ফক্কা হয়ে গেল। কিন্তু তোকে বলছি পয়সা ফেলে না রাখলে ব্যবসা হয় না। যার কাছে তুই পয়সা পাবি জানবি সে তোর হাতে আছে।
এটা কী লিখেছ?
লেখাপড়া শিখেছিলি কেন? সব সময়ে এটা কী ওটা কী? বুঝে নিতে পারিস না?
বোধন হাসল। ইস্ত্রি মেরামত করেছিলে ধরবাবুর?
হ্যাঁ।
বোধন বিল লিখতে লাগল। লিখতে লিখতে বলল, সুভাষ ক্লাব কালী পুজোর টাকা দিয়েছে?
এই হপ্তায় দেবে বলেছে। না দিলে ফকিরের পেন্টুন খুলে নেব। সুকু দত্তকে চেনে না!
বোধন কিছু বলল না।
সুকুমার বাইরের বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলল, একটা কথা ভাবছি। দোকানে একটা রেডিও সারাই ডিপার্টমেন্ট রাখলে কেমন হয় রে?
বোধন মজা পেল। দশ হাতের দোকান, তার আবার ডিপার্টমেন্ট। ছোট কথা সুকুমারদা বলবে না। সারাবে কে? তুমি?
তুই।
আমি? বোধন অবাক।
লেখাপড়া শিখলি কেন ফালতু? যেদো মেধো রেডিয়ো সারায়–তুই পারবি না? ম্যাডান স্ট্রিটে যা–দেখবি পানের দোকানে রেডিয়ো সারাচ্ছে। তুই বলিস কীরে? গলায় দড়ি দিগে যা!
বোধন হাসল না। সুকুমারদা এইরকমই। বলল, শিখলে সব কাজই পারা যায়।
তুইও শিখে নিবি। কী আছে শিখতে। আমি একটু আধটু জানি। তোকে দীনুর সঙ্গে লাগিয়ে দেব। দীনু তোকে একমাসে মাস্টার করে দেবে।
বোধন কিছু বলল না।
সুকুমার যেন স্বপ্ন দেখতে দেখতে বলল, দোকানটা বড় করতে হবে রে, বোধন। আমার মা আর বউয়ের মধ্যে রোজ খেচামেচি। মা বর্ধমানে দেশ বাড়িতে চলে যেতে চায়। তা ধর, সেখানে কীই বা আছে। মা যদি যায়–আর একটা বাড়তি খোরপোশর ব্যবস্থা চাই।
বোধন হঠাৎ বলল, তোমার কাছে টাকা আছে?
টাকা! কত?
গোটা দশেক অন্তত।
কী করবি?
মার পা মচকে গিয়েছে। গোড়ালির কাছটায়। ফুলে ঢোল হয়ে আছে। একটা মালিশ কিনব, আর একটা ক্রেপ ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজ দিয়ে বেঁধে রাখলে ব্যথা কম লাগবে।
সুকুমার পকেট হাতড়াচ্ছিল। খুচরো নোট, পয়সা সব রাখতে রাখতে বলল, মাসিমা অফিস যাচ্ছে?
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়েছে আজ।
ছুটি নিতে বল। দশটা তো হচ্ছে না রে, সাত হচ্ছে। সাতে হবে?
কী জানি!
না হলে বুড়োবাবুকে বলবি, কাল নেবে। তুই সাহা ফার্মেসিতে যাবি তো? বলবি বুড়োবাবুকে। আমার নাম বলবি।
এইভাবে টাকা নেওয়ায় অস্বস্তি হচ্ছিল বোধনের। কৈফিয়ত দেবার মতন করে বলল, বিদের টাকাটা পাইনি এখনও। আজ গিয়েছিলাম।
পেলি না কেন?
বিনুর জ্বর। ওর মা কিছু বললেন না।
তুই চাইলি না কেন?
বাঃ, কেমন করে চাইব। বিনুর জ্বর!
সুকুমার হঠাৎ হেসে উঠল। তুই যে আমার লাইনে বিজনেস করছিস, বোধন। টাকা ফেলে রাখছিস। তোর হবে।
বোধন লজ্জা পেল। কথাটার কী মানে? বলল, না, সুকুমারদা, আজ আমার টাকার খুব দরকার ছিল। চাইব ভেবেছিলাম। পারলাম না।
সুকুমার টাকা পয়সার সঙ্গে পকেট-চিরুনি বার করেছিল। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলল, তা দরকার পড়লে চাইবি না? তোর দরকার। চাইলে কিছু মনে করত না। ওরা তোক ভাল।
বোধন ইস্ত্রি মেরামতের বিল লেখা শেষ করল।
বৃষ্টি কমে আসছে। ছাড়েনি। ঘুটঘুঁটে ভাব যেমন ছিল সেইরকমই।
বলব কি বলব না করে বোধন বলল, তুমি আমায় অ্যায়সা ঝাটে ফেলেছ। পড়ানো-টড়ানো আমার হয় না। ছেড়ে দিতে হবে।
কেন? মাসে পঞ্চাশটা টাকা আসছে।
পড়াতে পারি না। ভুল হয়।
হোক। সুকুমার বলল, কোথায় ঠিক ঠিক পড়ায় রে? স্কুলে পড়ায়? আমাদের এখানকার স্কুলটার হাল দেখছিস না। মাস্টারগুলো ইট মারামারি করে স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে পুজোর আগে থেকেই।
বোধন এখানকার স্কুলের ব্যাপারটা জানে। দু দল মাস্টারে মারপিট করেছে। দলাদলির ব্যাপার। স্কুলের কর্তৃত্ব কে করবে তাই নিয়ে লড়াই। পলিটিকস।
নতুন করে একটা বিল লেখা শুরু করল বোধন। এই লেখাটা আন্দাজে পড়তে পারছে সে। হিটার মেরামতি। লিখতে লিখতে বোধনের মনে হল, সুকুমারদার কাছে সে পুরো সত্যি কথাটা বলেনি। আজ তার টাকার দরকার মায়ের জন্যে তেমন ছিল না। বোধনের প্যান্ট নেই, মানে–যা আছে দু তিনটে তার মধ্যে দুটোই ভেঁড়া, রং বলে আর কিছু নেই। বোধন একটা প্যান্ট করতে দিয়েছে। গত হপ্তায় নেবার কথা। নিতে পারছে না। তিরিশটা টাকা লাগবে। টাকা পেলে আজ নিত। নেব বলেছিল দোকানে। হাতে বাকি যা থাকত তাতে মার জন্যে মালিশ হয়ে যেত।
সুকুমার বলল, তুই ও বাড়িতে কবে যাবি রে? কাল?
যাব ভাবছি।
ও বাড়ির মাসিমাকে বলবি, আমি আসছি হপ্তায় গিয়ে মেগার টেস্ট করে দেব। বহুত বিল যাচ্ছে।
বোধন নিচু মুখে কাজ করতে লাগল।
আবার কিছু মনে পড়ল সুকুমারের। আরে বোধন, তুই বিনুর কাকাকে ধর না।
মুখ তুলে তাকাল বোধন। কাকা?
ভদ্রলোক বড় চাকরি করে। সুকুমার বলল, কোন অফিসে যেন! চৌরঙ্গিতে অফিস।
জবাব দিল না বোধন।
নিজের মনেই সুকুমার বলল, ভদ্রলোকের স্যাকরিফাইস আছে। বিয়ে থা করেনি। বউদি আর তার মেয়েকে টানছে। তাও নিজের বউদি নয়।
বিনুর নামটা বোধনের মনে এল, বিনতা মজুমদার। বিনুর কাকার নামও জানে বোধন: গিরীন সরকার। বিনু একদিন বলেছিল, তার বাবার পিসতুতো না মাসতুতো ভাই হয় কাকা। বিনুর বাবা আজ দশ বারো বছর হল মারা গিয়েছেন৷
একটা ব্যাপার কিন্তু বোধনের ভাল লাগে না। বিনুর কাকা বিনুর মাকে নাম ধরে ডাকে। অনুপমাকে ছোট করে অনু বলে। কেন বলে? তা ছাড়া বিনুর মা বিধবা। তবু মাছটাছ, পিয়াজ সবই খান। বিনুর মুখেই শুনেছে বোধন।
বোধন বিনুর মাকে ঠিক বুঝতে পারে না।
.
০৩.
বোধন অন্য দিনের তুলনায় আগে আগে বাড়ি ফিরল। দরজা ভেজানো ছিল। আলো এসেছে। কিছুক্ষণ আগে। বাড়িতে পা দিয়ে বোধন বাবাকেই দেখল।
বাবা নিজের জায়গায় বসে। মিটমিটে আলোটা যেমন জ্বলে তেমনই জ্বলছিল মাথার ওপর।
পায়ের চটিটা খুলে রাখছিল বোধন, দরজার কাছে পায়ের শব্দ পেল। চুয়া। চুয়া ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করল।
নিচু গলায় বোধন বলল, কোথায় গিয়েছিলি?
হট ওয়াটার ব্যাগ আনতে। তল্লাট খুঁজে বনোদের বাড়ি থেকে নিয়ে এলাম।
কী হবে ব্যাগে?
মা পায়ে সেঁক দেবে।
চুয়া রান্নাঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল বোধন বলল, একটা মালিশ এনেছি, মাকে দিয়ে আয়।
চুয়া মাথা নাড়ল। তুমি দিয়ে এসো। চুয়া দাঁড়াল না, রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
মাকে এড়াতে চাইছিল বোধন। মার সামনাসামনি দাঁড়াতে তার অস্বস্তি হয়, বিশেষ করে এখন মা কেমন মেজাজে আছে বোঝাই যায়।
একটু দাঁড়িয়ে থাকল বোধন। বাবাকে আবার দেখল। নিজের কাঠের চেয়ারটিতে বসে বাবা টেবিলের ওপর খানিকটা ঝুঁকে পড়েছে। হাতে পেনসিল। দু টুকরো কাগজ ছড়ানো। সামনে মোটা-সোটা ওয়েবস্টার, একটা পত্রিকা। বাবার পিঠের দিকে দেওয়াল আর চেয়ার ঠেস দিয়ে ক্রাচটা দাঁড় করানো।
বোধন আড়ষ্ট পায়ে মার ঘরে ঢুকল।
মা বিছানায়। পায়ের শব্দেও চোখ খুলল না। শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ করে।
বোধন মালিশ আর ক্রেপ ব্যান্ডেজ বার করল। একটা মালিশ এনেছি। লাগিয়ে দেখো।
সুমতি তাকালেন। মুখ ঘুরিয়ে ছেলেকে দেখলেন। মালিশের কথা কে বলল?
সকলেই বলল। এটা খুব ভাল। লাগাও, ব্যথা কমে যাবে।
ওষুধ খেয়েছি হোমিওপ্যাথি। অফিসে বলল।
তবু তুমি লাগাও। চুয়া গরম জল করছে। আগে একটু সেঁক দিয়ে নাও। দিয়ে লাগাও। বেশি রগড়ো না। আস্তে আস্তে মালিশ করো। তারপর হট ওয়াটার ব্যাগ দিয়ে রাখো। ব্যথা কমে যাবে।
সুমতি শুয়েই থাকলেন।
বোধন ব্যান্ডেজ দেখাল। বলল, কাল অফিস যাবার আগে এটা পায়ে বেঁধে নিও। আরাম পাবে।
আরাম? সুমতি বিরক্তিকর মুখ করলেন, আরামের কপাল নিয়েই এসেছি! আরাম দিচ্ছ তোমরা!
বোধন মাকে চটাতে চাইছিল না। বেশি কথাবার্তা মার সঙ্গে বলা যায় না। কীসের থেকে কী হয়ে যায় কে বলবে! কম ঘাঁটানোই ভাল।
বোধন চলে আসছিল। সুমতি যন্ত্রণার শব্দ করতে দাঁড়াল। মার পায়ের দিকটা দেখল। মা এমনিতেই গুছিয়ে শোয় না। আজ কাপড়-চোপড়ের কোনও ঠিক নেই। গোড়ালির অনেক ওপর পর্যন্ত কাপড় উঠে রয়েছে, ফোলা ফোলা পা। ডান পায়ের গোড়ালির ওপর চুন হলুদ মাখানেনা। মনে হল, পায়ের পাতা বেশ ফুলে আছে।
বলবে না বলবে না করে বোধন বলল, একবার দেখিয়ে নিলে হত?
থাক… সুমতি আরও বিরক্ত।
না, অনেক সময় হাড়-টাড় চিড় ধরে যায়, বোধন বলল, কী সব ছিঁড়ে যায় শুনি। ভোগায়।
সে তোমাদের হয়, সুখের শরীরে। আমার হাড়ে কিছু হয় না। আর হলেই বা কী! খাটের ওপর পা তুলে বসে থাকতে তো পারব না। যেমন বরাত করে এসেছি তেমন করেই তো থাকতে হবে।
বোধন চুপ করে থাকল। মার কথার পিঠে কথা বলা মুশকিল। বোবা থাকাই ভাল। বিনুদের বাড়ি থেকে পঞ্চাশটা টাকা আজ পেলে বোধন বলতে পারত, চলোকাল তোমায় ডাক্তারখানায় নিয়ে যাচ্ছি। কাল যদি টাকা পায় বোধন মাকে বলবে। দশ পনেরো টাকা যায় যদি যাক, তবু একবার দেখিয়ে নেওয়া ভাল। জংলির ঠিক এইরকম পা মচকে গিয়েছিল বাস থেকে নামতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্লাস্টার করে রাখতে হল মাসখানেক।
বোধন চলে আসছিল, সুমতি বললেন, পরের বেগার খাটছ, নিজের বাড়ির বেগার খাটতে পারো না? এই পাখাটা কদিন ধরে গোরুর গাড়ির মতন চলছে। চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেরে দিলেও তো পারো। গরমে মরি। ঘুম হয় না রাত্তিরে।
পাখাটা বোধন দেখেছে। সুকুমারদাও দেখে গিয়েছে। এ-পাখা সারার নয়। সারাতে গেলে যা খরচ হবে তাতে ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবে। অনেককালের পাখা। ঠেকা দিয়ে দিয়ে এতকাল চলছে। আর চলবে না।
বোধন কান চুলকোল। সারাতে গেলে অনেক খরচা পড়বে। সুকুমারদার ওখানে হবে না।
যেখানে হবে সেখানে যাও। বাড়ির কাজ করতে বললেই তোমাদের সকলের মুখে এক বুলি, হবে, হচ্ছে না। অকর্মার ধাড়ি যত! .
বোধন জবাব দিল না কথার। দিয়ে লাভ নেই। মা কিছু বোঝে না, বুঝবে না।
চুয়া এল। হাতে গরম জলের ব্যাগ।
সুমতি উঠে বসলেন। দু পা দুপাশে ছড়ানো। পিঠে কাপড় নেই। গায়ের আঁচল কোমরের কাছে জমে আছে। মোটা মোটা হাত, ঘাড়-পিঠ কুঁজো মতন, পেট কী বিশ্রিভাবে ফুলে আছে। এত চর্বি মার হয় কেমন করে। এ সবই জল। জলভরা শরীর।
চুয়া বিছানার কাছে দাঁড়াল। দিয়ে দেব?
দাও। সুমতি পিঠের ওপর ছড়ানো এলো চুল জড়িয়ে নিতে বললেন।
বোধন আর দাঁড়াল না। বাইরে এল। বাবা একইভাবে বসে। ডান হাতে পেনসিল, বাঁ হাতে বিড়ি। বিড়ি হাতে বাবা কাগজের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে। কী ভাবছে বাবা বোধন জানে। বাবা ক্রস ওয়ার্ডের শব্দ মেলাচ্ছে, মোর, না সোর, ম্যারি হবে না ক্যারি হবে, অথবা হাউস না মাউস? একটা লোক সারাদিন বসে বসে এই সব করছে। শব্দ সাজাচ্ছে মেলাচ্ছে। এটা না ওটা করছে! ক্রস ওয়ার্ড না থাকলে অঙ্ক মেলাবার ধাঁধা। বাবা কত রকম খোঁজই রাখে এই সব পাজল-এর। রাখে, কারণ বাবার ধারণা একদিন, নিশ্চয় একটা সলিউশান লেগে যাবে, লেগে গেলেই বরাত খানিকটা ফিরে যাবে। ক্রস ওয়ার্ড ছাড়াও বাবা মাঝে মাঝে লটারির টিকিট কেনে। কোথাও কোনও টাকার গন্ধঅলা কিছু চোখে পড়লেই বাবা তাতে লেগে পড়ে। মা গালাগাল দেয় নিত্য। গালাগাল খেয়েও এইভাবে লেগে আছে বাবা। অন্য কোনও উপায় খুঁজে পায় না মানুষটা। অথর্ব, অক্ষম মানুষ আর কী করতে পারে! বাবা রাস্তায় বেরোতে পারে না, ঘুরতে পারে না, ঘরে বসে বসে টাকার স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কী করবে! মাঝে একবার খেয়াল চেপেছিল টাইপ করবে বাড়িতে বসে তাতে যা দু-চার টাকা হয়। পুরনো একটা টাইপ মেশিন কিনে দেবার জন্যে মাকে অনেক বলেছিল। মা দেয়নি। টাকা কোথায় পাবে মা? তা ছাড়া ঘরে বসে টাইপের কাজ চলে না। কে আসবে তোমায় বাড়ি বয়ে টাইপ করতে দিতে।
প্যান্ট জামা ছাড়ার জন্যে বোধন পাশের ঘরে গেল। এবাড়িতে দুটো ঘর। একটা মা বাবার, অন্যটা তাদের। তাদের মানে বোধন আর চুয়ার। অবশ্য ঘরটায় বোধনের দাবি থাকলেও দখল নেই। প্যান্ট, শার্ট, লুঙ্গি, গামছা–এই যা রাখতে পারে বোধন, নিজের এক সময়কার পুরনো দু একটা বই বা টুকটাক, তা ছাড়া আর কিছু নয়। বোধন এ-ঘরে থাকতে পারে না। থাকা সম্ভব নয়। জায়গা নেই।
জামা খুলে প্যান্ট ছাড়ল বোধন। লুঙ্গি পরল। তারপর গামছা টেনে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
হাত মুখ ধুয়ে বোধন বাথরুম থেকে আসছে, বাবা ডাকল, নিচু গলায়। এমন করে ডাকল যেন মার কানে না যায়। দাঁড়াল বোধন।
দাশুবাবুকে মনে আছে?
বোধন মনে করতে পারল না। কে দাশুবাবু? কোথায় থাকে? মাথা নাড়ল বোধন।
দাশরথিবাবু! কালোমতন দেখতে। লম্বা। ছড়ি হাতে ঘুরতেন। কবিরাজ।
বোধন মনে করতে পারল। কারবালা ট্যাংক লেনের কাছে থাকতেন?
হ্যাঁ। কাল একবার যাও না কবিরাজমশাইয়ের কাছে।
বোধন কিছুই বুঝল না। হঠাৎ কবিরাজের কাছে কেন যাবে!
কবিরাজমশাই একটা মালিশ-তেল দিতেন। আমায় একবার দিয়েছিলেন। হাত মচকে ফেলেছিলাম। গাছগাছড়া দিয়ে তৈরি। তেলের নামটা ঠিক মনে নেই আমার। খুব ভাল ওষুধ। তখন বোধ হয় দেড় কি দু টাকা দাম ছিল। এখন একটা টাকা বাড়তে পারে। দু দিন লাগালেই পায়ের ফোলা ব্যথা সব সেরে যাবে।
বোধন এতক্ষণে বুঝতে পারল। অবাক হয়ে দেখল বাবাকে। মানুষটা পাগল না অন্য কিছু! কোন দাশরথি কবিরাজ, কোনকালে বাবা তাকে চিনত, তার মালিশ আনতে ছুটতে হবে বোধনকে।
মালিশ আমি এনে দিয়েছি, বোধন বলল।
কী মালিশ?
নাম বলল বোধন।
সন্দিগ্ধ হলেন শিবশঙ্কর। ওতে কি কাজ হবে? তার ওপর তোমার মার পায়ে একজিমা ছিল। বেড়ে না যায় অ্যালপ্যাথিতে! অনেক সময় আয়োডিন কম্পাউন্ড মিশিয়ে দেয় মালিশে। একজিমা থাকলে ক্ষতি হয়।
বিরক্ত হল বোধন। দু একদিন দেখা যাক। তাতে আর কী বাড়বে!
কবিরাজমশাইয়ের তেলে বাড়ত না। উপকার হত চট করে।
পরে দেখব।
বোধন আর বাবার সামনে দাঁড়াতে চাইছিল না।
শিবশঙ্কর কিছু বললেন না আর।
মুখ মুছতে মুছতে বোধন ঘরে এল। বাবা যে কোন জগতে থাকে কে জানে! কোথাও কিছু নেই দুম করে দাশরথি কবিরাজের কথা খেয়াল হল। লোকটা এতদিন বেঁচে আছে কি না তাই বা কে জানে! বোধনরা যখন মানিকতলায় থাকত, সারকুলার রোডের গা ঘেঁষে, লাহাবাবুদের ফ্ল্যাট বাড়িতে–তখন কবিরাজমশাইকে সে দেখেছে। তখনই বেশ বয়েস কবিরাজমশাইয়ের। বাবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় ছিল। আজ বছর পাঁচেক হল বোধনরা মানিকতলা ছাড়া। কবিরাজমশাইয়ের কেউ কোনও খবর রাখেনি। হঠাৎ তাঁর কাছে এক শিশি মালিশ-তেলের জন্যে কেন যাবে বোধন! ও-সব কবিরাজি-টবিরাজিতে বিশ্বাস নেই বোধনের। সে যে-মালিশটা এনে দিয়েছে তাতেই বোধহয় সেরে যাবে মা।
চুয়া ঘরে এল। তাকাল বোধন।
মালিশটা লাগাল মা? বোধন জিজ্ঞেস করল।
লাগাবে পরে।
পায়ের ফোলা কালকের চেয়ে বেড়েছে না কমেছে রে?
কী জানি আমি কিছু বুঝলাম না! চুয়া বিরক্ত। এমনিতেই মরছি, তার ওপর এই এক উপসর্গ হল।
বোধন অসন্তুষ্ট হল। চুয়া আজকাল মার ব্যাপারে গা লাগায় না। যেন মার কী হল না হল তাতে তার আসে যায় না।
তুই কিছুই বুঝিস না? মেয়ে হয়েছিস কেন? বোধন বলল।
হয়েছি তো কী হয়েছে। আমার ইচ্ছেয় হয়েছি! তুমিও তো ছেলে হয়েছ।
বোধন কী যেন বলতে যাচ্ছিল। রীতিমতো রেগেই। বলতে গিয়েও হঠাৎ থেমে গেল। চুয়া কী যেন বলল? আমার ইচ্ছেয় হয়েছি–? কথাটা কানে বিশ্রি শোনাল। নোংরা লাগল। কিন্তু কথাটা মিথ্যে নয়। চুয়া চুয়ার ইচ্ছেয় হয়নি, বোধনও। নিজের ইচ্ছেয় মার ছেলে মেয়ে হয়ে তারা জন্মায়নি। নিজের ইচ্ছেয় জন্মাতে পারলে চুয়া কার মেয়ে হয়ে জন্মাত?
বোধন অন্যমনস্কভাবে বোনের মুখ দেখছিল।
.
০৪.
কড়া নাড়ার শব্দে বোধনের ঘুম ভাঙল। জবাদি এসে কড়া নাড়ছে। সকাল হয়েছে। ভোরের দিকেই আসে জবাদি, রোদ ওঠার আগে।
বোধন উঠল। মশারি সরিয়ে বাইরে আসতেই বুঝল, জবাদি ঠিক সময়ে এসেছে, আলো এসময়ে যেমন হয় তেমন।
দরজা খুলে দিল বোধন।
জবা ভেতরে এল। পায়ের চটি খুলে এক কোণে রাখল, রেখে মাথা নিচু করে মশারির দড়ির তলা দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল।
বড় বড় হাই তুলল বোধন। হাত মাথার ওপর তুলে ডাইনে বাঁয়ে হেলে আড়মোড়া ভাঙল। ক্যাম্প খাটে শুয়ে শুয়ে ঘাড় পিঠ মেরুদণ্ড বেঁকে গেল কিনা কে জানে। সকালের দিকে রোজই পিঠ ব্যথা করে।
চোখে ঘুম থাকলেও বোধন আর শোবার চেষ্টা করল না। মশারির দড়ি খুলতে লাগল। দড়ি খুলে বিছানা গুটিয়ে নেবে। তারপর ক্যাম্প খাট। ক্যাম্প খাটটা ভাঁজ করা, ফড়িংয়ের মতন পা। এটা ওটা খুলে, দুমড়ে, ভাঁজ করে গুটিয়ে নিলেই ছোট হয়ে যায়।
বোধন তার বিছানা গোটাতে লাগল।
জবা রান্নাঘর থেকে এঁটো বাসনপত্র বার করে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছে। বাসন-কোষন বার করা হয়ে গেলেই উনুন ধরিয়ে দেবে। দিয়ে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করবে। তাতেও রক্ষে নেই, ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া এসে এই জায়গাটা ধোঁয়াটে করে তুলবে।
এক একজনের হাত পা খুব চটপটে হয়। জবাদিরও সেই রকম। উনুন ধরিয়ে কিছু বাসনপত্র তখনকার মতন যা লাগবে–মেজেঘষে তুলে দিতে তার বেশিক্ষণ লাগবে না। এইটুকু সেরে জবাদি নীচের তলায় ঝুমুরদের বাড়িতে কাজ করতে নেমে যাবে, আবার ওপরে আসবে ঘণ্টা দেড়েক পরে।
এই সময়টুকু বোধনদেরও দরকার। জবাদি প্রথম দফার বাসন তুলতে না তুলতেই চুয়া উঠবে, উঠে পড়িমরি করে বাথরুমে ছুটবে। চুয়া বেরিয়ে আসতে না আসতেই বাবা। ততক্ষণে মা উঠে পড়বে।
বাড়ির সবাই জেগে ওঠার পর যা কিছু করণীয়বসা, চা খাওয়া, তরকারি কোটা, মাথার চুলের জট ছাড়ানো–আরও কত কী–সবই প্রায় এই জায়গাটুকুতে। এটা অবশ্য খাবার জায়গা। হাত কয়েক মাত্র লম্বা-চওড়া। উত্তর দিকে একটা জানলাও রয়েছে। জানলা আর দেওয়াল ঘেঁষে সস্তা কাঠের ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর প্লাস্টিকের শিট। গোটা তিনেক চেয়ার, একটা হাতলঅলা–অন্য দুটো মামুলি। সংসারের আরও টুকিটাকি এখানে জমা হয়েছে, তেল চিটচিটে মিটসেফ, লকপকে একটা র্যাক, আনাজের ঝুড়ি, বঁটি।
রাত্রে বোধনকে এখানেই শুতে হয়, ক্যাম্প খাট পেতে। রাত্রে সবার সব কিছু সারা হয়ে গেলে শোও, আর সকালে সবার আগে ওঠো। বোধন উঠে ক্যাম্প খাট না তুললে হাঁটা চলার জায়গা থাকে না। রাত্তিরে চুয়া, মা কিংবা বাবা যখন বাথরুমে যায়–বোধনের টাঙানো মশারির দড়ি মাথার ওপর তুলে গলে যায়, এতে অনেক সময় টান পড়ে বোধনের মশারি খুলে যায়, মশা ঢোকে, ঘুম ভেঙে যায় বোধনের।
এই রকমই চলছে আজ চার পাঁচ বছর। উপায় কী! জায়গা কই এ বাড়িতে? দুটি মাত্র তো ঘর। ছোট ছোট। মা-বাবার ঘরে জায়গা নেই। দু জনের মতন একটা গোবদা খাট, কাঠেরই এক আলমারি, বাক্স তোরঙ্গ! জায়গা কি মাটি খুঁড়ে গজাবে! চুয়ার ঘরেও তাই। সংসারের দশ রকম জিনিস তার ঘরে। কাজের অকাজের। ছোটখাটো একটা তক্তপোশে শুয়ে থাকে চুয়া।
এ বাড়িতে এসে বোধন প্রথম প্রথম ঘরে জায়গা করে নিয়েছিল। চুয়াকে ঠেলাঠেলি করে একপাশে সরিয়ে দিত। চুয়া তার গায়ে পা তুলে দিয়ে দিব্যি ঘুমোত। মাঝেসাঝে বোধন বোনকে গুঁতো মেরে খাট থেকে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সেই চুয়া আর নেই তার তেরো-চোদ্দ বছর বয়েস এখন কুড়িতে এসে ঠেকল। আর দেখতে দেখতে বোধন হল বাইশ।
উপায় নেই, জায়গা নেই বলে বোধনের এখানে শোওয়া, ভাঁজ করা দুমড়োনো ক্যাম্প খাটে। ভাল লাগে না। লাগার কথাও নয়। গরমে ভেপসে মরো, পুরনো টেবিল পাখাটা আর চলে না, বাতাসও আসে না উত্তরের জানলা দিয়ে, সারারাত ঘেমে মরা। বর্ষায় সব স্যাঁতসেঁতে, বাড়ির যত রাজ্যের না-শুকনো শাড়ি সায়াও এখানে মেলে দেয় ওরা; সেই ভিজে কাপড়ের স্যাঁতসেঁতানির সঙ্গে তার দুর্গন্ধও নাকে নিয়ে ঘুমোতে হয় বোধনকে। আর শীত হলে তো কথাই নেই, কী কনকনে ঠাণ্ডা, হবে না কেন? সারাদিনে রোদ ঢোকে না এখানে, পড়ন্ত বেলায় যা ছিটেফোঁটা রোদ। মানুষের শোবার মতন জায়গা এটা নয়। গণ্ডা গণ্ডা আরশোলা উড়ছে, দেওয়ালে টিকটিকি বাড়ছে, বাথরুম থেকে অনবরত দুর্গন্ধ আসছে ভেসে। এখানে রাতের পর রাত কেউ শুতে পারে না। তবু বোধনকে শুতে হয়।
মানিকতলা ছেড়ে আসার পর থেকেই শোওয়া বসার আরাম ফুরিয়ে গিয়েছে। বোধনরা আগে মানিকতলায় থাকত। সারকুলার রোড ঘেঁষে। লাহাবাবুদের ফ্ল্যাট বাড়িতে। দোতলা-তেতলা মিলিয়ে। তেতলায় একটা বড়সড় ঘর, পাশে খোলামেলা খানিকটা চাতাল, একদিকে রান্নাঘর, অন্যদিকে জলের ট্যাংক, বাথরুমও ছিল টিনের দরজা দেওয়া। স্নানের ব্যবস্থা তেতলায় ছিল না। বরং বারণ ছিল। সেবারণ অনেক সময় মানা হত না। স্নানের ব্যবস্থা ছিল দোতলায়। দোতলায় পাশাপাশি দুটো ঘর। আর-একটা খুপরি মতন, ভাঁড়ার-টাঁড়ার রাখো। তারই গায়ে ঢাকা বারান্দা আর বাথরুম। বারান্দায় কল ছিল স্নান-টানের জন্যে। তবে পুবের দিকটা ছিল খোলামেলা। বড় বড় টিনের জানলার মতন ব্যবস্থা ছিল পুব দিকে। মেয়েরা স্নানের সময় সেটা টেনে ভেজিয়ে দিত। ঝড়জলেও বন্ধ রাখতে হত জানলাগুলো। শীতের হাওয়া বইলেও।
তেতলায় থাকত মা বাবা। দোতলার দুটো ঘরের একটাতে দিদি আর চুয়া, অন্যটাতে বোধন। তখন সবাই বাড়তি ছিল। মানে বাড়তি হয়ে গিয়েছিল। লাহাবাবুদের এই রকম দশ বারোটা ভাড়া বাড়ি। নীচের তলায় এক ভাড়াটে, দোতলা-তেতলা মিলিয়ে অন্য-এক। বাবা বাড়িটা ভাড়া নেয় সংসার বড় হয়ে উঠেছিল বলে। শোভাবাজার থেকে মানিকতলা। ঠাকুমা তখন বেঁচে, পিসিমা বিধবা হয়ে ভাইয়ের কাছে এসেছিল মেয়ে নিয়ে। ততদিনে বোধনরাও সবাই মোটামুটি বড়সড়। লাহাবাবুদের বাড়ি পাওয়া খুব শক্ত। সবাই পুরনো ভাড়াটে, আশি একশো টাকায় শেকড় গেড়ে বসে আছে। কখনওসখনও দু একজন উঠত। বাবার ব্যাঙ্কের একজন বাড়ি ছাড়তেই বাবা সেটা ধরে ফেলল, অবশ্য লাহাবাবুদের সরকারমশাইকে হাত করে। সেই বাড়িতে কত কী হল পর পর। ঠাকুমা মারা গেল। পিসিমা মেয়ে নিয়ে শেষ পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ি অণ্ডালেই ফিরে গেল। বাড়ি তখন থেকেই ফাঁকা। অঢেল জায়গা।
সুখের দিন বলতে সেই সময়টা। বাবা চাকরি করছে ব্যাঙ্কে। পকেটে যেন লক্ষ্মী বাসা বেঁধেছিল। দশ পঁচিশ টাকা কিছুই নয়। বাবা খানিকটা শৌখিন গোছের মানুষ ছিল। মা ভাল শাড়ি জামা পরত, গয়না থাকত গায়, ভাল জরদা দেওয়া পান খেত, বাবার সঙ্গে রিকশা চড়ে থিয়েটার সিনেমা দেখতে যেত শ্যামবাজারে। এমন তরতরে জীবনটা হঠাৎ পালটে গেল। কোন দিক থেকে একটা কালো মেঘ ধীরে ধীরে এসে সব তছনছ করে দিল। কোনদিনই আর ভোলা যাবে না বাবার যা হয়েছিল। ট্রাম ধরতে গিয়ে পড়ে পায়ের ওপর দিয়ে চাকা চলে গেল। হাসপাতালে কত কাল যে! বাঁচবে কি মারা যাবে বাবা কিছুই ঠিক নেই। একটা পাবাঁ পা হারিয়ে বাবা বাড়ি ফিরল। সেই সঙ্গে মেরুদণ্ড আর কোমরের কাছে কীসের গণ্ডগোল। হাঁটা চলা গেল। চাকরিও আর নেই, থাকলেও কি বাবা আর অফিস যেতে পারত। আসলে বাবা একটা গণ্ডগোলে পড়ে গিয়েছিল আগেই, চাকরি যাব-যাব করছিল, ব্যাঙ্ক বাবাকে সাসপেন্ড করেছিল। ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিল বাবা, উকিলবাড়ি ছুটোছুটি করছিল। ওই রকম মানসিক উদ্বেগের সময়, প্রচুর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে কাগজপত্র সমেত উকিলবাড়ি ছুটতে গিয়েই ট্রামের পা-দানি থেকে পা পিছলে পড়ল।
অতবড় দুর্ভাগ্য এসেছিল বলেই বাবা খানিকটা বেঁচেও গেল। ব্যাঙ্ক বাবাকে যতটা পারল মায়া-দয়াও দেখাল। চাকরি অবশ্য গেল। কিন্তু যেখানে যা পাওনা ছিল মিটিয়ে দিল।
বাবার চাকরি যাওয়া আর পাকাটা পড়া মানে মাথার ওপর সমস্ত আকাশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া। বাড়িতে তখন টাকা-টাকা করে মা মাথা খুঁড়ছে। বাবার যা ছিল শেষ, মার যেখানে যেটুকু সোনাদানা ছিল তাও প্রায় ফুরিয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে ধার, ধার ধার। মুদিখানায়, বাজারে, ওষুধের দোকানে পাড়াপড়শির কাছে। লজ্জায় মাথা নিচু করে পাড়ায় ঘুরতে হত। বাড়ি ভাড়া বাকি পড়তে পড়তে বছরে গিয়ে ঠেকল। লাহাবাবু বললেন, ভাড়া চাই না; বাড়ি ছেড়ে দিন।
দিন বললেই কি বাড়ি ছাড়া যায়? মা তখন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। মায়ের লেখাপড়া বলতে স্কুল ফাইন্যাল। কোনও রকমে। তাও কোন কালে। সবই ভুলে গেছে। থাকার মধ্যে হাতের লেখা। গোটা গোটা, পরিষ্কার। ওতে চাকরি হয় না। তার ওপর মায়ের বয়েস হয়ে গিয়েছিল; তিন ছেলেমেয়ের মা। মায়ের অবশ্য হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। এর জন্যে মায়ের উদ্যম যতটা প্রায় ততটাই তার দুর্ভাগ্যের কাহিনী। কুমুদকাকা বলে বাবার এক বন্ধুও পেছনে ছিল। মা চাকরি পেল সরকারি এক দোকানে। কাপড়চোপড়, পুতুল, মুখোশ, এটা-ওটা বিক্রি হয়।
মা চাকরি পেয়ে একটু-আধটু গুছিয়ে নেবার আগেই দিদি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেল। যার সঙ্গে পালাল তাকে বোধনরা চিনত। বদ্যিনাথ। কোনও কারখানায় কাজ করত। দিদির সঙ্গে বদ্যিনাথের মেশামেশি চলছিল অনেকদিন ধরেই, তবু একেবারে এতটা হবে মা বোঝেনি। চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি করে মা ধাক্কাটা সামলে নিল। সংসারে একজন তোক কমল। সেই যে দিদি চলে গিয়েছিল তারপর আজ পর্যন্ত তার কোনও খবর কেউ জানল না। দিদি চলে যাবার হপ্তা খানেক পরে একটি মাত্র পোস্টকার্ড এসেছিল, পেনসিলে লেখা। আঁকাবাঁকা করে দিদি লিখেছিল, তারা বিয়ে করেছে। তোমরা ভেব না।
না, কেউ আর ভাবেনি। বোধনের তো তাই মনে হয়। কী হবে ভেবে? সে কোথায় কেউ তো জানে । বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে–তাই বা কে বলবে!
দিদি পালিয়ে যাবারও চার পাঁচ মাস পরে এই বাড়িতে উঠে আসতে হল। মা লেগে থেকে থেকে, এর ওর হাতে-পায়ে ধরে বাড়িটা জোটাল। সরকারি হাউসিং। ভাড়া কম। ভাড়ার জন্যে মাথার ওপর বাড়িঅলা বসে নেই। রোজ তাগাদাও দিচ্ছে না।
মা কেমন আশ্চর্য ভাবে মানিয়ে নিল এই বাড়িটার সঙ্গে। বাবার মানিয়ে নেওয়া না-নেওয়ার কথাই নেই। অক্ষম, পঙ্গু মানুষ। যেখানে থাক-সবাই সমান।
বোধন প্রথম প্রথম কিছুতেই এই পাড়া, এই বাড়ির সঙ্গে নিজেকে মানাতে পারত না। মানিকতলায় যেন তার নাড়ি পোঁতা ছিল। বন্ধুবান্ধব, স্কুল, কলেজ, পাড়ার আড্ডা, মানিকতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে হললা, ছায়া সিনেমা, বিডন স্ট্রিটে মধুদার চায়ের দোকান, তাদের পাড়ার কালী পুজো, সরস্বতী পুজো-সমস্ত যেন মনের সঙ্গে পাকে পাকে জড়ানো ছিল। তেরো চোদ্দ বছর একটানা থাকার পর পাড়া ছেড়ে চলে আসা। বোধনের কান্না পেত। বুক টনটন করত। তবু তাকে আসতেই হল। না এসে উপায় কী!
এখানে এসে সে প্রথম প্রথম মানিকতলায় ছুটত। সেই ছোটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল। রোজ অত বাসভাড়া কে দেবে? মাঝে-সাঝে এক আধদিন এখনও যায়। খুব কম। এখানে থাকতে থাকতে তার সবই সয়ে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবও জুটেছে। দিন কেটে যাচ্ছে বইকী। কোন জিনিস না সয়ে যায় মানুষের। বাবা মাত্র একটা পা নিয়ে, এই ঘরের মধ্যে বসে জীবন কাটাচ্ছে। মা, যে-মানুষ বরাবর সংসার, রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা, ছেলেপুলে আগলে দিন কাটিয়েছে–সেই মানুষ আজ সকাল নটা সাড়ে নটা বাজতে না বাজতেই নাকে-মুখে গুঁজে থলথলে শরীর নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ছোটে, ফিরতে ফিরতে সেই সন্ধে সাত আট–কিছুই ঠিক নেই। কলকাতায় গাড়িঘোড়া ধরে বাড়ি ফেরার কি কোনও ঠিক আছে।
বোধনও তো সবই মেনে নিয়েছে, সয়ে যাচ্ছে। এই যে সারা বছর নিত্যদিন খাবার জায়গাটুকুতে ক্যাম্প খাট পেতে শুয়ে থাকা, যেখানে কোনও হাওয়া আসে না বাইরের, ফরফর করে সারা রাত আরশোলা ওড়ে, টিকটিকি ডাকে, ময়লা কাপড়ের, নোংরা বাথরুমের গন্ধ আসে, সেখানেও তো বোধন কেমন ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখে, মন্দ স্বপ্ন, ভাল স্বপ্ন দু রকমই।
আজ সে বাবাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্নই দেখেছিল। শেষ রাতে। তখনই ঘুম ভেঙে গেল। তারপর আর ভাল করে ঘুম হয়নি। পাতলা ছেঁড়া-ছেঁড়া ঘুম ছিল। জবাদি কড়া নাড়তেই আজ সে সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেয়েছে। শোনামাত্র উঠেছে। উঠে দরজা খুলে দিয়েছে।
.
বিছানাপত্র তোলা হয়ে গিয়েছিল বোধনের। ক্যাম্প খাটও ভাঁজ করে গুটিয়ে ফেলল।
রান্নাঘরের ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া আসছে। এই জায়গাটা এখন বেশ কিছুক্ষণ কয়লার ধোঁয়ায় ভরে থাকবে। সাত সকালে ধোঁয়া নাকে মুখে গেলে কাশি লাগে। বোধন উত্তরের জানলাটা খুলে দিল। যত তাড়াতাড়ি ধোঁয়া বিদেয় হয়।
জানলা খুলতেই উলটো দিকের বাড়ির বন্ধ দরজা জানলা, ময়লার পাইপ, নীচের মাঠে আবর্জনার গাদা চোখে পড়ল। এত সকালেও একজোড়া কুকুর ছোটাছুটি শুরু করেছে।
দরজা খুলে চুয়া বেরোল। তাকাল বোধন।
বাসি মুখ, এলোমেলো চুল, পায়ের দিকে চিট সায়া, একটা আধ ঘেঁড়া শাড়ি আলগাভাবে জড়ানো, চুয়া বাথরুমের দিকে যাচ্ছিল।
জবা বাসন মাজছে কলঘরে।
চুয়া বাথরুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ছটফটে গলায় বলল, তোমার দেরি হবে, জবাদি?
জবা কী জবাব দিল শোনা গেল না।
চুয়া হাই তুলতে তুলতে টেবিলটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বিরক্ত মুখ। দু একবার শব্দ করল বিরক্তির।
জবাদি এত দেরি করে আজকাল– চুয়া বেশ অসহিষ্ণু।
দেরি কোথায়, ঠিক সময়েই এসেছে, বোধন বলল।
একটু চুপচাপ। চুয়া মাথা চুলকে নিল। এই যে ছাই একটা বাথরুম–পারা যায় না।
বোধন কিছু বলল না! দোমড়ানো ক্যাম্প খাটটা চুয়ার তক্তপোশের তলায় রেখে আসতে হবে। বিছানা ঘরের কোণে বাক্সর ওপর।
কাল রাত্তিরে অত হই হই হচ্ছিল কীসের? চুয়া বলল।
কখন?
অনেকটা রাত্তিরে। সি ব্লকের দিকেই মনে হল।
আমি কিছু শুনিনি। চারদিক বন্ধ, এখানে কিছু শোনা যায় না।
চুয়া কাশল, আবার মাথা চুলকোল। চোর ধরেছিল বোধ হয়।
জবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। চুয়া যেন সারাক্ষণ চোখ রেখেছিল, জবা বেরিয়ে আসতেই ধড়মড় করে এগিয়ে গেল।
জবাদি?
বলো।
বাসনগুলো একপাশে সরিয়ে রাখলাম। দরজা বন্ধ করার শব্দ হল।
বোধন তার গোটানো বিছানা আর খাট নিয়ে ঘরে ঢুকল। জানলার একটা পাট বন্ধ। চুয়া বন্ধ করে শুয়েছিল, না বন্ধ হয়ে গিয়েছে নিজের থেকেই কে জানে! কার্তিক মাস শেষ হল। ঠাণ্ডা মোটেই পড়েনি।
যেখানে যা রাখার রেখে বোধন জানলাটা ভাল করে খুলে দিল। এদিকের জানলা খুললে মাঠ, জলের ট্যাংক, পাঁচিল ডোবা এইসব চোখে পড়ে। দূরে বস্তি, পাঁচিলের ওপাশে, কবেকার একটা ভাঙাচোরা বাগানবাড়ি, কলোনি। আজ আর আকাশ ঘোলাটে নয়। রোদ উঠছে।
বোধন চোখ সরিয়ে ঘরের মধ্যে একবার তাকাল। ভাঙা তোরঙ্গ, চালের টিন, অচল রেডিয়ো, পুঁটলি বাঁধা পুরনো তুলো, কৌটোবাটা, কাচের বয়াম, ঝুড়ি, জুতোর বাক্স, মায় একটা ইঁদুর মারা কল।
বোধন ব্রাশটা তাক থেকে তুলে নিল। ব্রাশটার কিছু আর নেই, দাঁত মেজে মেজে ছেতড়ে গিয়েছে, ডাঁটিটাও বাসি হলুদের মতন রঙ ধরেছে।
বাইরে এল বোধন। জবাদি রান্নাঘরের দরজা খুলে দিয়েছে। রান্নাঘরের বন্ধ ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। তবে ধোঁয়াটা এখন পাতলা।
তাকের ওপর মাজনের কৌটো। সস্তা মাজন। বলে আয়ুর্বেদের মাজন। বাঁ হাতে খানিকটা মাজন ঢেলে নিয়ে বোধন দাঁত মাজতে শুরু করল ব্রাশ দিয়ে। ব্রাশটা এবার ফেলে দিয়ে আঙুল চালাতে হবে। একটা ব্রাশ কিনতে ক পয়সা! তবু কেনা হচ্ছে না।
জবাদি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। এক প্রস্থ বাসন রেখে, রান্নাঘর মুছে দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এবার ঝুমরুদের বাড়ি যাবে।
চলে যেতে গিয়ে দরজার কাছাকাছি থামল জবা। দাদা আমার চিঠি লিখে দিলে না?
ব্রাশ চালাতে চালাতে মুখে থুতু নিয়ে বোধন বলল, দেব। আজই লিখে দেব।
জবাদি চলে গেল। বোধন দেখল। যখন আসে জবাদির পায়ে রবারের ক্ষয়ে-যাওয়া চটি থাকে। এই যে এখন নীচে গেল, চটি পরল না, রেখেই গেল। নীচের বাড়ির কাজ সেরে ওপরে আসবে, বাকি কাজকর্ম সারবে, তারপর যাবার সময় চটিজোড়া পায়ে দেবে। বোধন এক-আধ বার ঠাট্টাও করেছে। জবাদিকে–তোমায় বুঝি চটি পায়ে ওরা ঢুকতে দেয় না জবাদি? তাতে জবাদি যেন লজ্জা পেয়ে বলেছে–জলে জলে কাজ পায়ে কি রাখা যায়
জবাদি মানুষটা বড় ভাল। এই বাড়িতে তার কোথায় যেন এক মায়া পড়ে গিয়েছে। এক-পা কাটা খোঁড়া বাবু, অফিস-ছোটা মা, নিষ্কর্মা দুই দাদা দিদি–সব যেন কেমন মন্দ কপালের ব্যাপার। বোধ হয় জবাদির করুণা হয়। মমতাও। অন্তত বাবার ওপর জবাদির যে করুণা বেশি সেটা বোঝা যায়। বাবাকে কখনওই ছেড়ে কথা বলে না মা। যখন তখন খোঁচা মারে। কারণে অকারণে চেঁচামেচি, গালমন্দ করে। বোধন দেখেছে, মা যখন বাড়াবাড়ি শুরু করে, জবাদি চোখের ইশারায়, কখনও বা নিচু গলায় মাকে চুপ করতে বলে। মা অবশ্য পরোয়া করে না, কিন্তু জবাদিকেও তেমন কিছু বলে না। হয়তো স্বার্থের জন্যেই। পঁচিশ টাকা মাইনে আর দু বেলা দু কাপ চা, খান দুয়েক শুকনো রুটির বদলে জবাদির মতন কাজের লোক মা কোথায় পাবে! কাজ তো কম নয় জবাদির: বাসন মাজে, একবেলা শুধুই ঘর ঝাট, অন্য বেলায় ঘর মোছা, মশলা বাটা, দায়ে-অদায়ে তরি-তরকারি কুটে দেওয়া, এমনকী রান্না বান্নাতেও অল্প-স্বল্প সাহায্য। জবাদি ছাড়া এত আর কে করবে!
চুয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।
বোধন মুখ ধুতে যাবার সময় দেখল, রান্নাঘরে উনুন ধরে গিয়েছে। চুয়া খেয়াল করেনি, চায়ের জল না বসিয়ে ঘরে চলে গিয়েছে চোখমুখ মুছে, কাপড় চোপড় ঠিক করে পরে আসতে। মার চোখে পড়লে গালাগাল খেত। মা এসব একেবারে দেখতে পারে নাঃ উনুনের আঁচ নষ্ট হবে আর তুমি ঘরে দাঁড়িয়ে গাল মুছবে–কোন নবাবের বেটি তুমি৷ কেন, চোখ চেয়ে দেখতে পারো না একটু। কয়লা কি বিনি পয়সায় আসে!
মা কথা শুরু করলে থামে না, একটা থেকে আর-একটায় লাফিয়ে লাফিয়ে চলে যায়। বাড়ি ভাড়া, ইলেকট্রিক বিল, কয়লা কেরোসিন তেল, চাল, গম–পর পর মুখে এসে যায় মার। যায়, কেন না এ-সংসার মা চালায়, মার হাড়ভাঙা খাটুনি, গায়ের রক্তে তাদের খাওয়া-পরা।
বোধন মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখল, চুয়া রান্নাঘরে। চায়ের জল চাপাচ্ছে।
খুট করে শব্দ হল দরজায়। বাবা। দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বোধন মুখ তুলে বাবাকে দেখল।
বাঁ বগলে ক্রাচ নিয়ে বাবা ক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল। জানলার দিকে তাকাল। তারপর অভ্যেস মতন বলল, বাথরুম ফাঁকা?
হ্যাঁ।
বাবা একদিকে হেলে সামান্য দুলতে দুলতে বাথরুমে চলে গেল।
বোধন ঘরে গিয়ে ব্রাশ রাখল। মুখ মুছল। বাবার জন্যে বড় কষ্ট হয় বোধনের। কষ্ট এবং ঘেন্না। কে বলবে এই বাবা সেই মানুষ! বছর ছয় আগেও বাবা স্বাভাবিক ছিল, সুস্থ ছিল। সেই সক্ষম, লম্বা চওড়া মানুষটা আজ কেমন অথর্ব, অক্ষম, দীন হয়ে গিয়েছে। দেখতেও নোংরা-নোংরা লাগে। মুখে দাড়ি জমে তিন চার দিন, তারপর একদিন সস্তা ব্লেডে দাড়ি কামাবার পরও মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি জমে থাকে, কোনওদিনই আর বাবার মুখ পরিষ্কার হয় না। মাথার চুল রুক্ষ, লালচে হয়ে গিয়েছে। ঘাড় কাঁধ কালো, ময়লা জমছে তো জমছেই। বাবার গলাও কেমন ভাঙা ভাঙা, জড়ানো শোনায়। গলার স্বর দিন দিন নিচু হয়ে যাচ্ছে, আজকাল প্রায়ই কথা বলতে গিয়ে তোতলায়। নিজের ওপর আর কোনও আস্থা নেই, কোনও কর্তৃত্ব নেই বলেই বোধ হয়। বাবার চোখ দেখলে বোধনের মনে হয়–মানুষটার চোখ ফাঁকা, মন ফাঁকা, গ্লানি আর লজ্জায় মরা-মরা, কুণ্ঠিত। বড় অসহায় আর অপরাধীর মতন দেখায় বাবাকে। আবার ঘেন্নাও হয়! কেন, কেন মানুষটা এরকম হল?
বোধন বাইরে এল। বাথরুমে বাবার গলা পরিষ্কারের শব্দবমি করার মতন।
বোধন টেবিলের একপাশে বাবার চেয়ারটা ঠিক করে রাখল। কাঠের চেয়ার। হাতল আছে। এই চেয়ারটায় বাবা বসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে এখন বসবে, আর বেলা বারোটা পর্যন্ত একটানা এখানেই বসে থাকবে। দরকার না পড়লে বাবা উঠবে না। এই চেয়ার আর এই টেবিলটাই বাবার সব। সকাল থেকে বেলা পর্যন্ত এখানে, দুপুরে এক দু ঘণ্টা হয়তো নিজের ঘরে বিছানায়, তারপর আবার বিকেলের গোড়া থেকে রাত পর্যন্ত যতক্ষণ না খাওয়া-দাওয়া শেষ হচ্ছে। এই কাঠের চেয়ার, ওই টেবিল আর সামনের জানলাটুকুই বাবার জগৎ। কেমন জগৎ কে জানে! বোধন জানে না। তবে মনে মনে বোঝে, এইটুকুর মধ্যে বাবা নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে আজ যেন খাঁচায়-পোরা জীবজন্তুর মতন নির্জীব হয়ে গিয়েছে।
বাবা বাথরুম থেকে বেরিয়ে নিজের জায়গায় এসে বসল।
বোধন রান্নাঘরে ঢুকল।
চা হয়েছে রে?
ভিজিয়েছি।
চুয়া একটা ভাঙা কাপে গুঁড়ো দুধ গুলছিল। গঁড়ো চা, গুঁড়ো দুধ, এক রত্তি চিনিনা থাকলে গুড়ের বাতাসা দিয়ে চা। এক বোতল হরিণঘাটা আগে আসত, অনেকদিন আগে, তাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
তোর কাছে, বোধন নিচু গলায় বলল, টাকা পয়সা কিছু আছে?
টাকা! কেন?
মার গোড়ালিটা একবার সাহা ডাক্তারকে দিয়ে দেখিয়ে নিতাম। ডিসপেনসারিতে গেলে চারটে টাকা নেবে।
না, আমার কাছে নেই।
একেবারে নেই?
যা আছে তাতে আমায় চালাতে হবে। বাবা গত হপ্তায় পাঁচটা টাকা নিয়েছে। বলেছিল দেবে। দেয়নি।
বাবা কোথা থেকে দেবে?
তা আমি কী জানি! মার কাছ থেকে চেয়ে দেবে।
বোধন বোনের মুখ দেখল। অবাক হল না। চুয়া এই রকমই হয়েছে। স্পষ্ট, ঠোঁট কাটা, জেদি। আজকাল সে টাকা-পয়সা রোজগার করে। অল্প-স্বল্প। একটু-আধটু গানের গলা ছিল ছোটবেলা থেকে। মানিকতলায় থাকার সময় একজন মাস্টারও ছিল কিছুদিন। তারপর পাড়ার স্কুলে যেত। শেষে সব বন্ধ হয়ে গেলেও চুয়া নিজের মতন রেকর্ড রেডিয়ো শুনে-টুনে গান শিখত। এই করে করে শেষে, এখানে আসার পর একদিন চুয়া গেল থিয়েটার করতে। কোন ক্লাব নিয়ে গেল। তারপর থেকে ডাক পাচ্ছে। আজকাল মাঝেমাঝেই। টাকাও পায়।
বোধন মার গলা শুনতে পেল। উঠেছে। চুয়া তাড়াতাড়ি চা ঢালতে লাগল।
.
০৫.
বোধন দরজায় এসে দাঁড়াতেই বিনুর মার গলা পেল। তার পরই দরজা খুলে গেল। অবাক হল বোধন।
তোমার কথাই ভাবছিলাম, অনুপমা বললেন, আসছ দেখলাম। একটা ট্যাকসি ডেকে দিতে পারো?
ট্যাক্সি?
বিনুকে নিয়ে ওর কাকা বিবেকানন্দ রোড যাবে। ডাক্তারের কাছে। দেরি হয়ে গিয়েছে।
বিনুর কি আবার জ্বর এসেছে?
না, যাবার কথা ছিল।
বোধন কিছু বুঝল না। আবার ফিরে চলল ট্যাক্সি ডাকতে। আজ দিন ভাল। বৃষ্টি মেঘ কোথাও কিছু নেই৷ সন্ধে হয়ে গিয়েছে। মোড়ে ট্যাক্সি পাওয়া কঠিন হবে না। কলকাতার দিকে ফিরতি যেতে হলেই ট্যাক্সি যেতে চায়।
কিন্তু বিনুর কী হয়েছে? জ্বর যদি না হয়, কী হতে পারে। ডাক্তার দেখাতে বিবেকানন্দ রোডই বা কেন? এখানেই তিন চারজন ডাক্তার রয়েছে। সাহা মন্দ ডাক্তার নয়। হয়তো বিবেকানন্দ রোডের ডাক্তার বিনুদের পরিচিত, পুরনো। কিন্তু বিনুরা তো আগে বিবেকানন্দ রোডে থাকত না। প্রাচী সিনেমার দিকে থাকত।
বোধন হাঁটতে হাঁটতে মোড়ের দিকে চলল। যাবার সময় মনুয়াকে দেখতে পেল। একা একা একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, মুখ ভরতি দাড়ি, রোগা, গায়ের জামা ঢলঢল করছে, এলোমেলো প্যান্ট। মনুয়াকে এই রকমই দেখা যায়, মুখ নিচু করে হেঁট মাথায় হাঁটছে একা একা। কাছে গিয়ে ডাকলে তাকাবে। চোখ ফাঁকা, বাঁ চোখের পাতা মণি ঢেকে ফেলেছে, নাক বেঁকা, মনুয়া তাকাবে, চিনতে পারবে হয়তো, কিন্তু চিনলেও কথা বলবে না। বড় জোর ঠোঁটে পাতলা, বিষণ্ণ একটু হাসি ফুটবে।
মনুয়া আজকাল নেশা করে। বোধন শুনেছে, গাঁজা খায়। এ-পাড়ায় ড্রাগসও চলে। চলতি নাম আচার। অনেকেই খায়, মদও মারে।
যারা খায় খাক, বোধন তাদের জন্যে ভাবে না। কিন্তু মনুয়াকে এই অবস্থায় দেখলে তার বড় কষ্ট হয়। মনুয়া যে বোধনের বন্ধু ছিল তা নয়, চেনাজানা ছিল। মনুয়া ডাক্তারি পড়ত। সেকেন্ড ইয়ার। ঝকঝকে ছেলে ছিল। ক্রিকেটে নেশা ছিল। বল করত বেশ। সেই মনুয়া রাতারাতি পালটে যেতে যেতে একেবারেই অন্য রকম হয়ে গেল। তাকে আর পাড়ায় দেখা যেত না। মনুয়া বাড়ি ছেড়ে দিল। তারপর একদিন শোনা গেল, মনুয়াকে ব্যারাকপুরে পুলিশ ধরেছে। বছর আড়াই পরে মনুয়া বাড়ি ফিরল, একেবারে অন্যরকম, বাঁ চোখ প্রায় নষ্ট, নাকের হাড় ভাঙা, ডান হাতের বুড়ো আঙুল থেঁতলানো। রোগা কাঠি হয়ে গিয়েছে মনুয়া, পা টেনে টেনে হাঁটে। বাড়ি ফিরে মনুয়া দেখল, বাবা মারা গিয়েছে, মা আগেই গিয়েছিল, বাড়ির অভিভাবক দাদা। মনুয়া বাড়িতে ফিরল, কিন্তু স্নেহ, মমতা, আন্তরিকতা পেল না। বাবা নেই; দাদা কোনও টান দেখাল না। বরং মনুয়া আসায় বিরক্ত, বিব্রত, অসন্তুষ্ট হল। দাদা ভাল চাকরি-বাকরি করছে, বাহারি বউ, ছোট ভাইকে পরিবারের পক্ষে স্বস্তিদায়ক মনে করতে পারল না। নিজেদের সুখস্বস্তি শান্তির পক্ষে মনুয়া যেন কেমন বিয়ের মতন। বাড়িটা বাবার, মানে বাবা করেছিল, কাজেই মনুয়াকে তাড়াতে পারে না, সে-অধিকার তার নেই বলেই বাধ্য হয়ে ঠাঁই দিতে হয়েছে ভাইকে নয়তো দিত কিনা কে জানে! বোধন এসব কথা নিজে জানে না, সুকুরমারদার কাছে শুনেছে।
মনুয়া এখন কিছু করে না। বাড়িতেই থাকে। সকালের দিকে কদাচিত তাকে বাইরে দেখা যায়। সে বাজারে আসে না, আড্ডা মারে না, বন্ধুদের সঙ্গে বসে না, রাস্তায় ঘোরাফেরা করতেও দেখা যায় না। সন্ধের দিকে কিন্তু মনুয়াকে চোখে পড়ে, একা একা আপন মনে, মুখ নিচু করে, নেশায় কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে। যেন মাঝ রাস্তাটা সে অন্যদের জন্যে ছেড়ে দিয়েছে, যাও তোমরা-যাও, আমি তফাতেই থাকলাম।
বোধন মোড়ে আসতে না আসতেই ট্যাক্সি পেয়ে গেল। ধরল ট্যাক্সিটাকে।
ফেরার সময় দেখল মনুয়া ঠিক আগের মতনই হেঁটে যাচ্ছে।
বিনুরা তৈরি হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল।
ট্যাক্সি আসতেই বিনুর কাকা গিরীন ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এলেন। ঘড়ি দেখলেন। নাও, বিনু নাও, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো। অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করব। বলে ড্রাইভারকে বললেন, ভাই, একটু তাড়াতাড়ি। আমার ডাক্তার না চলে যায়। বিবেকানন্দ সেন্ট্রাল অ্যাভিন ক্রসিং।
বিনু এসে ট্যাক্সিতে উঠল। পরনে শাড়ি। উঠতে উঠতে বলল, কাল নিশ্চয় আসবে।
গিরীন উঠে পড়লেন।
ট্যাক্সিটা চলে গেল।
বোধন দু মুহূর্ত ট্যাক্সি দেখল, তার পর মুখ ফিরিয়ে বিনুর মাকে।
বিনুর মা পাছে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যান বোধন কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই অনুপমা বললেন, এসো, ভেতরে এসো।
বোধন অবাক হল। বিনুর মা এমন করে ডাকবেন সে আশা করেনি। টাকার কথা বলবে বলে বোধন আজ এসেছে। উনি দরজা বন্ধ করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলে বোধনকে সদরে দাঁড়িয়েই টাকার কথা বলতে হত। যাক, ভালই হল।
বোধন ভেতরে এল। দরজা বন্ধ করলেন অনুপমা।
বসার ঘরে আলো জ্বলছিল। তোমার কোনও তাড়া নেই তো! একটু তা হলে বসো। চা খেয়ে যাও। বলেই আবার অন্যমনস্ক হয়ে নিজের মনে কথা বলার মতন করে বললেন, কোথায় যে চাবিটা ফেললাম। খুঁজে আলমারিটা বন্ধ করে আসছি।
অনুপমা চলে গেলেন।
বোধন বিনুর মাকে ঠিক এতখানি সহজ হতে আগে বিশেষ দেখেনি। মহিলা অবশ্য কোনওদিনই অভদ্রভাবে কিছু বলেননি বা করেননি, তবু আজ তাঁর ব্যবহার আরও নরম, সহজ মনে হচ্ছিল। কেন, কে জানে!
সোফায় বসে বোধন ঘরের চারদিক দেখতে লাগল। নতুন করে দেখার কিছু নেই। চেনা ঘর। সাধারণ সোফা সেট, বাড়তি চেয়ার, জানলা ঘেঁষে রাখা অর্ধেক গোল টেবিল, বুক কেস, ক্যালেন্ডার, ছবি, বড়সড় রেডিয়ো সেট, প্লাস্টিকের ফুল–মোটামুটি এই। বোধন এমন কিছু এখানে দেখে না যা নতুন দেখলে তাকে অবাক হতে হবে। বোধন এসমস্তই দেখেছে, তাদের বাড়িতেও এক সময় এসবই ছিল, উনিশ বিশ তফাত থাকতে পারে, তবে ছিল আজ নেই।
বিনুদের বাড়ির আসবাবপত্র দেখে বোধনের কোনওদিনই মনে হয় না, ওরা তেমন পয়সাঅলা লোক। সচ্ছল নিম্নমধ্যবিত্ত যেমন হয় তেমন। এই বাড়িও কোনও প্রাসাদ নয়। তবে নতুন বাড়ি, খানিকটা তকতকে হয়ে আছে, বেশ খানিকটা ফাঁকাও। ভাড়াও শ চারেক। আজকাল বাড়িভাড়া এই রকমই। বরং বিনুরা চার ঘরঅলা, খাবার জায়গা রান্নাঘর, বাথরুম সমেত বাড়িটা কমেই পেয়ে গিয়েছে। আরও একশো বেশি হতে পারত।
ভেতরে শব্দ-টব্দ হচ্ছিল। বিনুর মা হাঁটাচলা জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছেন। কাশলেন। বোধন বসে থাকল। আজ সে টাকাটা বিনুর মার কাছে চাইবে। লজ্জা করবে না। টাকাটা দরকার বোধনের। মা আজ অফিস যায়নি। পায়ের ব্যথা বেড়েছে। দাঁড়াতেও কষ্ট হচ্ছে মার। বোধন যদি পারে আজ একবার সাহা ডাক্তারের কাছে যাবে, কাল সকালেই মাকে দেখিয়ে নেবে। প্যান্টটা আনার কী হবে কে জানে! যদি মার জন্যে কুড়ির মধ্যে খরচ হয়–বোধন প্যান্ট নিয়ে নেবে। নয়তো পারবে না।
আমার যে কী হয়েছে কে জানে! বিনুর মার গলা পেয়ে বোধন তাকাল।
অনুপমা বসার ঘরের চারদিকে তাকালেন, আলমারি খুললাম। রিপোর্ট বার করে দিলাম, টাকা দিলাম–তারপর চাবিটা যে কোথায় রাখলাম–আর পাচ্ছি না।
বোধন অকারণে ঘরের চারদিকে তাকাল, যেন চাবিটা খুঁজছে।
অনুপমা রেডিয়োর আশপাশ, টেবিল, ফুলদানি, সোফা দেখলেন। আছে কোথাও, পাব ঠিকই।
মেঝেতে পড়ে যায়নি তো?
মেঝেতে? না, মেঝেও তো দেখলাম। অনুপমা যেন মনে মনে আরও একবার ঘরের মেঝে দেখে নিলেন। যাকগে, পরে খুঁজব। আচ্ছা তোমায় একটা কথা বলি, আমাদের বাড়ির পেছন দিকে ওই যে একটা টিনের চালা আছে, লোহা-লক্কড় পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে একটা ভাঙাচোরা টেম্পো এসে দাঁড়ায়–ওটা কীসের ঘর? কথা বলতে বলতে চশমা খুলে রেখে দিলেন অনুপমা।
বোধন বুঝতে পারল। বাড়ির পেছনে মানে অন্তত চল্লিশ পঞ্চাশ গজ দুরে টিনের চালাটা। বলল, পুরনো লোহা স্টক করে, আবার বেচে দেয়।
দু তিনজনকে দেখেছি, আমাদের এদিকে ঘুরোঘুরি করে। তাদের মধ্যে একটাকে দেখলে ভয় হয়। গুণ্ডা বদমাশের মতন দেখতে। বলে অনুপমা একটু থেমে আবার বললেন, বিনুর কাকা বলছিল, ওখানে নেশাভাঙ চলে।
বোধন অবাক হল না। চলতেই পারে নেশাভাঙ। কোথায় চলে না!
তুমি একটু থেকে যাও। কোনও কাজ নেই তো? আমার শরীরটাও আজ ভাল নেই। দাঁড়াও তোমার চা নিয়ে আসি। অনুপমা চলে গেলেন।
বোধন বুঝতে পারল, বিনুর মা তাকে আটকে রাখতে চাইছেন, যতক্ষণ পারা যায়। মহিলা একটু ভয় পেয়েছেন বোধ হয়। ভয়ের যে একেবারেই কিছু নেই তা নয়, তবে এই সন্ধেবেলায় দরজা ভেঙে চুরি ডাকাতি হবে যে তারও কোনও কারণ নেই। গায়ের পাশে বাড়ি না থাকলেও কাছাকাছি বাড়ি আছে। লোকজন চলছে রাস্তায়। দুর্গা মিষ্টান্ন, মধুসূদন ভাণ্ডার খোলা। বোধনের অবশ্য বসতে আপত্তি নেই। বসে থাকলে কথায় কথায় টাকার ব্যাপারটা সহজে তুলতে পারবে। বিনুর কথাই আবার মনে পড়ল। বিনুকে তো ভালই দেখাল আজ কালকের তুলনায়। তবে ডাক্তারের কাছে কেন গেল?
অনুপমা চা নিয়ে ফিরে এলেন। চায়ের সঙ্গে প্যাষ্ট্রি। বললেন, খাও, বিনুর কাকা এনেছে। ভাল জায়গা থেকে।
আবার চলে গেলেন। ফিরেও এলেন সামান্য পরে। নিজের জন্যে চা এনেছেন। বসলেন মুখোমুখি।
আমাকে একজন সারাদিনের লোক জোগাড় করে দাও না। বড় অসুবিধে হয়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত থাকবে। অনুপমা বললেন।
আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে তাকে বলব। বলল।
আমি কম টাকা দেব না। …টাকায় আটকাবে না। তবে একশো দুশো চাইলে অন্য কথা।
টাকার কথাটা উঠে পড়ায় বোধন ইতস্তত করে বলল, একটা ব্যাপারে আমার কিছু টাকার দরকার পড়েছে।
অবাক হতে যাচ্ছিলেন অনুপমা, সঙ্গে সঙ্গে কিছু মনে পড়ে গেল বোধহয়।
তোমাকে তো টাকাই দিইনি এ মাসে। তাই না। ছিছি, মনেই পড়েনি। তুমিও কিছু বলোনি৷ কী লজ্জার কথা বলো তো! তা তুমি একবার মনে করিয়ে দিলে পারতে। আজকাল পাঁচ ঝামেলায় আমার সব কথা মনে থাকে না। অনবরত ভুল হয়। মেয়েই আমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে।
কী হয়েছে বিনুর? বোধন জিজ্ঞেস করল।
কী জানি! কমাস মাত্র আগে টানা ভুগে উঠল। তখন বুকের এক্সরে হল দু দফা, রক্ত থুতু কত কী পরীক্ষা করানো হল। কিছু পায়নি। এম গাঙ্গুলী–খুব বড় ডাক্তার, তিনি দেখেছিলেন। তাঁর কাছেই আবার পাঠালাম, বুক ব্যথা বুক ব্যথা বলছে।
বোধন চা খেতে লাগল। বিনু বড় রোগা। টিবি হয়ে যাবে নাকি? সঙ্গে সঙ্গে বোধন এই খারাপ চিন্তাটাকে সরিয়ে দিল। না, না; তা কেন হবে। বুকে ব্যথা বোধনেরও হয়েছিল। কার না হয়। ঠাণ্ডা লেগেছে।
চা খেতে খেতেই, অনুপমা বললেন, তোমার টাকাটা এনে দিই।
যাবার সময় নেব।
তা নেবে। আগে দেখি বাইরে অত টাকা রেখেছি নাকি? বিনুর কাকাকে টাকা বের করে দিলাম আলমারি থেকে। রাখতেও পারি। না রাখলে চাবি খুঁজতে হবে।
একেই বলে কপাল। বোম টাকা পাবে, চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এখন। বিনুর মা চাবি না পাওয়া পর্যন্ত বোধনকে বসে থাকতে হবে। আর যদি বরাত ভাল হয় বোধনের বিনুর মা টাকা এমনিতেই পেয়ে যাবেন।
ধীরে সুস্থে অলসভাবে চা খাচ্ছিলেন বিনুর মা। বোধন তাঁকে দেখছিল বার বার। আজও তাঁর পরনে কালকের সেই কালো পাড় শাড়ি, জমি ধবধব করছে। গায়ে মিহি সাদা জামা। আজকের জামার হাত ছোট। গলায় হার। হাতে দুগাছা করে সরু চুড়ি। সাজগোজ যেমন থাকে তেমনই তবে মুখ একটু শুকনো দেখাচ্ছিল। মেয়ের চিন্তায় বোধ হয়। তবু বোধনের ভাল লাগছিল। আজ বিনুর মাকে বেশি ভাল লাগছে। উনি কখনও এত বেশি কথা বলেন না, এতটা ঘনিষ্ঠ ব্যবহারও করেন না। আজ করছেন। বোধ হয়, বোধনকে বসিয়ে রাখতে চান বলে। খানিকটা ভয় আছে ওঁর। আবার মেয়ের জন্যে উদ্বেগ। একা থাকলে উদ্বেগ আরও বাড়ে।
বিনুর মাকে এতটা ভাল, সহজ হতে দেখে বোধন একবার সুকুমারদার কথা ভাবল। বলবে নাকি ওঁকে কথাটা? বিনুর কাকা কি বোধনকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন না?
সঙ্কোচ কাটিয়ে বোধন বলল, আপনাকে একটা কথা বলব বলব ভাবি। বোধন লজ্জা পাচ্ছিল।
অনুপমা বোধনের মুখ দেখছিলেন। কী কথা?
বোধন আবার ইতস্তত করল। সুকুমারদা বলছিল, কাকার যা হাত তাতে একটা যেমন-তেমন চাকরি আমার করিয়ে দিতে পারেন।
অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে কোনও জবাব দিলেন না। ভাবলেন। বলব।
বোধন খুশি হল। বোধ হয় প্রশ্রয়ও পেল। বলল, আমার বাবা একরকম ইনভ্যালিড। অথর্ব। মা চাকরি করেন। আমার একটা কিছু হলে ভাল হয়। বেকার বসে আছি।
অনুপমা সামান্য মাথা নাড়লেন। শুনেছেন তিনি। জানেন।
তুমি বসো, আসছি। অনুপমার চা খাওয়া শেষ হয়েছে। উঠলেন, হাতে চায়ের কাপ। বোধনের কাপ প্লেটও তুলে নিলেন। নিয়ে চলে গেলেন।
আজ দিন ভাল যাচ্ছে বোধনের। বিনুর মাকে মনে করিয়ে দিতেই টাকা পেয়ে যাচ্ছে। চাকরির কথাটাও বলতে পারল মুখ ফুটে। বিনুর মা বললে কাকা কি চেষ্টা করবেন না?
মোটর বাইকের শব্দ আসছিল। শব্দটা যেমন হয় বাড়তে বাড়তে বাড়ি কাঁপিয়ে কিছুটা দূরে চলে গেল। এ নিশ্চয় সেই কালোয়ার টাইপের লোকটা, যে টিনের শেড বানিয়ে স্ক্র্যাপ আয়রনের কারবার করছে। লোকটা আগে সাইকেল চেপে আসত, এখন পুরনো মোটর বাইক কিনেছে বোধ হয়। ওদেরই হয়। ছেঁড়া কাগজ, ভাঙা কাঁচ, ফুটো গামলা থেকেও এরা টাকা করে নেয়। বোধনরা পারে না। বিনুর মা কি এই লোকটাকে দেখে ভয় পান? কেন? বেটা কি এখানে কোনও বেয়াদপগিরি করছে? চোখ রাখতে হবে তো! সুকুমারদাকে বলবে বোধন।
আর ঠিক এই সময় ঝপ করে অন্ধকার হয়ে গেল। এই ছিল, এই নেই। পলকের মধ্যে সব ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আলো চলে গেল। তার মানে সাত সাড়ে সাত হল। মোটামুটি এই সময় যায় এ-পাড়ায়, আসতে আসতে নটা তো বাজবেই। দেরিও হতে পারে।
অন্ধকারে বসে থাকল বোধন।
বিনুর মা এবার লণ্ঠন জ্বালবেন। কিংবা মোমবাতি।
বোধন অপেক্ষা করতে লাগল। ভেতর থেকে কোনও সাড়া শব্দ আসছে না। আলো নিবলে এই যাঃ কিংবা গেল এবার এরকম একটা আঁতকে ওঠার শব্দও শোনা যায় বোধন তেমন কোনও শব্দ শুনতে পেল না। বিনুর মা কি লণ্ঠন খুঁজছেন? মোমবাতি পাচ্ছেন না? কিন্তু কোনও শব্দ নেই কেন? হাঁটাচলার শব্দ, পায়ের শব্দ, হাতড়ানোর শব্দ–কোনও কিছুই শোনা যাচ্ছে না! একফোঁটা আলোও আসছে না ভেতর থেকে। আশ্চর্য।
বোধন অপেক্ষা করতে লাগল। কান পেতে রাখল।
অদ্ভুত তো! বিনুর মা কি বাড়িতে নেই। বাড়ি ছেড়ে যাবেনই বা কোথায়? কেনই বা যাবেন?
প্রথমে গলার শব্দ করল বোধন, আশা করল ভেতর থেকে সাড়া আসবে। এল না।
রীতিমতো অবাক হয়ে বোধন এবার ডাকল, মাসিমা?
কোনও সাড়া নেই।
মাসিমা? বোধন আরও জোরে ডাকল।
এবারও কোনও জবাব এল না।
হঠাৎ কেমন ভয় পেয়ে গেল বোধন। কী হল বিনুর মার।
বোধনের পকেটে দেশলাইও নেই। এখন সে কী করবে? উঠে পড়ল বোধন। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে ঘরের বাইরে এল। সদর বন্ধই মনে হচ্ছে। পাশের ঘরের দরজা খোলা বোধ হয়, ওটা বিনুর ঘর। তারপর মাঝখানে একটু প্যাসেজ, প্যাসেজের গায়ে পাশাপাশি দু ঘরে বিনুর মা আর কাকা থাকেন। বোধন এবাড়িতে নতুন নয় বলে ঘরগুলো চেনে। শোওয়া, বসা, রান্না, এই তো ঘর। বিনুর মা কোথায়? কোন ঘরে? মাসিমা, বোধন ডাকল, দু পা সাবধানে এগিয়ে আবার মাসিমা? …অদ্ভুত বাড়ির মধ্যে কোথাও কোনও শব্দ নেই, আলো নেই। মানুষটা কি হারিয়ে গেল? বোধনকে ভয় দেখাচ্ছেন? মজা করছেন? বিনুর মা মজা করার মানুষ নন। কেনই বা করবেন! বোধন ভয়ে, উৎকণ্ঠায় দিশেহারার মতন হয়ে পড়েছিল। একটু আলো থাকলেই কী হয়েছে দেখা যেত। কিন্তু আলো কই? বোধন কেন যে একটা দেশলাই রাখে না পকেটে!
আন্দাজে, হাতড়ে হাতড়ে বোধন রান্নাঘরের দিকে চলল। বাঁ দিকে রান্নাঘর। বোধন দেখেছে। দেশলাই রান্নাঘরেই থাকবে। আলো না জ্বালা পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারছে না।
বোধ হয় পথে একটা মোড়া ছিল; পায়ে লেগে উলটে গেল, একটা পাপোশ-গোছের কিছু, প্লাস্টিকের বালতি বা ঝুড়িতে পা আটকাল। কিছু একটা হয়েছে বিনুর মারনয়তো এতক্ষণ কেন তিনি সাড়া দেবেন না, আলো জ্বালবেন না!
রান্নাঘর খুঁজে পাবার পর বোধন দেশলাই খুঁজতে গিয়ে বাসনপত্র ফেলে দিল, কাপ প্লেট ভাঙল, চিনির কৌটো হোক বা অন্য কিছু উলটে ফেলল। শেষে হাতড়ে হাতড়ে দেশলাই পেল। এতক্ষণে খানিকটা ভরসা পেল বোধন।
দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে লণ্ঠন খুঁজল। পেল না। বাইরে আসতেই দেরাজের মাথায় লণ্ঠন দেখল। পর পর দুটো লণ্ঠন। ছোট মোমদানে একটা মোমবাতি।
বোধন মোমবাতি জ্বালিয়ে নিল। সদরের দরজা বন্ধ। বিনুর মার ঘরের দরজা খোলা। বিনুর ঘরে ঢুকল বোধন, কেউ নেই।
বেরিয়ে এসে বিনুর মার ঘরে ঢুকতেই বোধনের হাত থেকে মোমবাতি পড়ে যাচ্ছিল। বিছানার পাশে মেঝেতে আড়াআড়ি হয়ে পড়ে আছেন বিনুর মা। বোধনের বুক ধক করে লাফিয়ে উঠল, ভয়ে পা কাঁপছিল, কাঠ হয়ে গেল সর্বাঙ্গ। কী সর্বনাশ! বিনুর মা কি মারা গেলেন?
বোধনের হাত পা ঠাণ্ডা, অসাড়। বুকে নিঃশ্বাস আটকে কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল। অসহায়, ভীত, বিভ্রান্ত অবস্থা বোধনের। মোমবাতি হাতে নিয়ে ঝুঁকে পড়ল বোধন। দেখল। না, মারা যাননি।
এবার বোধন মোমবাতি পাশে রেখে বসল। বিনুর মার শরীর কেমন বেঁকে আছে, পায়ের পাতাও বাঁকা, হাত মুঠো করা, চোখ বন্ধ, দাঁত দাঁত লেগে রয়েছে। ঠোঁটের তলায় ফেনা। থুতু উঠছিল। শুকিয়ে যাচ্ছে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন বিনুর মা। মৃগী বোধ হয়, ফিটের ব্যারাম। বোধন তার পিসিকে ফিট হতে দেখেছে।
যাক, মানুষটা বেঁচে আছে। কী ভয় যে পাইয়ে দিয়েছিলেন বিনুর মা।
আলো রেখে দিয়েই বোধন উঠল। জল এনে চোখেমুখে ঝাঁপটা দিলেই হুঁশ ফিরে আসবে। ধোঁয়া নাকে লাগালেও আসে। পিসির বেলায় তারা ব্লটিং পেপার পুড়িয়ে নাকের কাছে ধরত। ধোঁয়া লাগলেই পিসি নড়েচড়ে উঠত।
বাইরে এসে বোধন দেরাজের মাথার ওপর রাখা লণ্ঠনটা এবার জ্বেলে নিল। আলোয় অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল রান্নাঘর।
জল নিয়ে বোধন আবার ঘরে এল। লণ্ঠনও এনেছে। বিনুর মা এখন আর বেঁকে বা কুঁকড়ে যাচ্ছেন না। শরীরটা আগেই ধনুকের মতন যা বেঁকে গিয়েছিল খানিকটা। চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা দিল বোধন। কপালে জল দিল। কপালে, মুখে, গলায়। জোরে জোরে ঝাঁপটা দিতে লাগল। হাতের মুঠো ভীষণ শক্ত। বোধন জানে দাঁতে দাঁত লাগা খুলতে হলে জোরে গাল টিপতে হবে, না হয় চামচ এনে মুখ হাঁ করাতে হবে। হাতের মুঠোও জোর করে খুলে আঙুলগুলো টেনে দিলে ঠিক হয়ে যাবে। পায়ের পাতা ম্যাসেজ করলে ওই শক্ত বাঁকানো ভাবটাও চলে যায়। কিন্তু বোধন বিনুর মাকে এ-সব কিছু করতে পারে না। সে চোখেমুখে জল দিয়ে খানিকটা বাতাস করতে পারে।
বোধন সেরকমই করছিল। কাগজ খুঁজে এনে বাতাস করছিল, ঝাঁপটা মেরে মাঝেমাঝে জল দিচ্ছিল চোখেমুখে। থেমে থেমে ডাকছিল, মাসিমা-মাসিমা।
বিনুর মা শেষ পর্যন্ত চোখের পাতা খুললেন। সামান্য। আবার বুজলেন। খানিক পরে তাকালেন দু মুহূর্তের জন্য। চোখ ফাঁকা, কিছুই হুঁশ করতে পারছেন না। শুধু যন্ত্রণার ভাব ফুটল।
মাসিমা?
কোনও সাড়া নেই।
মাসিমা–! কী হয়েছিল?
বিনুর মা চোখের পাতা খুললেন না। বাঁ হাতটা টেনে গলা বুকের কাছে আনলেন। কাপড় সরিয়ে দেবার ইশারা করলেন যেন।
বোধন আড়ষ্ট হয়ে গেল। বিনুরা কেন এখনও আসছে না? চোখ সরিয়ে নিল বোধন। এদিক-ওদিক তাকাল। মেঝেতে দশ টাকার নোট ছড়িয়ে আছে, আলনার পায়ার কাছে চাবির গোছা। বোধন বুঝতে পারল, ওটাই আলমারির চাবি। তার ধারণা হল, বিনুর মা ঘরে এসে বোধনের জন্যে পঞ্চাশটা টাকা খুঁজে নিয়ে চলে যাবার সময় হঠাৎ ফিট হয়ে পড়েন। আর তখনই আলো চলে যায়। উনি কোনও সাড়াশব্দ করতে পারেননি। শুধু কোনও রকমে মেঝেয় শুয়ে পড়েছিলেন।
এই ভাবে চাবি হারানো উচিত নয়। কিংবা বিনুর মার মতন মৃগী রোগীর বাড়িতে একা থাকাও অনুচিত। ধরো যদি অন্য কেউ হত, যেমন গোপেন কিংবা দুলু–তা হলে আজ কী হত বিনুর মার? আলমারি সাফ হয়ে যেত। টাকাপয়সা, সোনা-দানা সব। বোধনও ইচ্ছে করলে নিয়ে নিতে পারে যা খুশি। বিনুর মার কোনও হুঁশ নেই এখনও।
বিনুর মা গলায় কেমন কষ্টের শব্দ করলেন। তাকাল বোধন।
গলা আটকে গিয়েছে। বোধ হয় জল খেতে চাইছেন।
বোধন উঠল। ওঠার সময়েই ভেবে নিল, একটা চামচও আনবে।
গ্লাসে জল এনে বোধন দেখল, বিনুর মা হাতের মুঠো আলগা করতে পেরেছেন। তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টি ঘোলাটে।
মাসিমা, জল?
দাঁতে দাঁত লেগে আছে তখনও। চোখের ইশারায় কিছু বোঝাতে চাইলেন। বোধন বুঝল না। চামচে করে মুখে ঠোঁটে জল দিল। শেষে চামচটা দাঁতের ফাঁকে গলাবার চেষ্টা করল, পারল না।
কিছুক্ষণ পরে বিনুর মার দাঁত খুলল। জল খেলেন চামচে করে।
বুকের কাপড় খুলে ফেললেন অনুপমা। যেন সহ্য করতে পারছেন না। মেঝেতে পুঁটলির মতো পড়ে থাকল আঁচল। গলগল করে ঘামছেন। মিহি জামাটা ঘামে ভিজে গিয়েছে। কিছু জলও পড়েছে গালমুখ গড়িয়ে জামায়। শ্বাস নিচ্ছিলেন ধীরে ধীরে। কষ্ট হচ্ছে কোথাও। বুকে। জামার ওপরটা খুলে ফেললেন। নিজেই। নীচের জামার খানিকটা, বুকের ওপর দেখা যাচ্ছিল।
অনুপমার মুখ ফ্যাকাশে, ঠোঁট মাঝেমাঝে কেঁপে উঠছিল। নীলচে দেখাচ্ছে যেন।
বোধন যে কী করবে বুঝতে পারছিল না। অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকতে তার লজ্জা করছিল, অস্বস্তি হচ্ছিল।
হঠাৎ চোখে পড়ল বোধনের বিনুর মার বোজা চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। গাল নাক সামান্য কুঁচকে উঠেছিল, ঠোঁট কাঁপছিল–তারপর আর কিছু কাঁপল না, শুধু জল গড়াতে লাগল।
বোধন তার পিসিকেও কাঁদতে দেখেছে। তবে পিসি ফিট ছেড়ে যাবার পর হুশ ফিরে পেয়ে কাঁদত। বিনুর মার জ্ঞান এখনও পুরোপুরি ফিরেছে বলে তার মনে হচ্ছিল না। এখনও ঘামছেন।
ঘামে জামা জবজবে হয়ে গেল।
বোধন বাতাস করতে লাগল কাগজ দিয়ে।
আরও একটু পরে বিনুর মা চোখ খুললেন। তাকালেন। যেন হুশ করতে লাগলেন। মাথা ফেরালেন। দেখলেন। ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিলেন।
এবার সব খেয়াল হল অনুপমার। বোধনকে দেখলেন। ওরা ফিরেছে?
না।
লোডশেডিং।
হ্যাঁ। অনুপমার উঠে বসতে কষ্ট হচ্ছিল। পারছিলেন না। তবু উঠে বসলেন সামান্য। দেখলেন যেন নিজেকে। তারপর খুব মৃদু ক্লান্ত গলায় বললেন, তুমি ও-ঘরে গিয়ে বসো৷বলতে বলতে মাটি থেকে আঁচল উঠিয়ে বুকের কাছটা আড়াল করলেন।