১. থানায় ভিড়

স্বর্ণচঞ্চু – উপন্যাস – সমরেশ বসু

সকাল থেকেই আজ থানায় ভিড়। একটা বিশেষ উত্তেজনাও আছে। দুটি পুরুষের মৃতদেহ থানার বারান্দায়, কাপড় ঢাকা দেওয়া রয়েছে। ঢাকা দেওয়া কাপড়গুলো রক্তাক্ত। বাসি শুকনো রক্ত। তাতেই বোঝা যায় মৃত্যুর ঘটনা গতকাল রাত্রে বা অন্য কোনও সময়ের, আজ সকালের নয়।

থানায় মেয়ে পুরুষের ভিড়। বাঙালি অবাঙালি, উভয় পক্ষই সেখানে রয়েছে। মেয়েদের কারুর কারুর কোলে বা সঙ্গে শিশুরাও রয়েছে। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ কান্নাকাটি করছে। তাদের প্রবোধ দেবার চেষ্টা করছে সঙ্গী পুরুষেরা। সেপাইরাও কান্না থামাতে বলছে।

থানার হাজত ভরতি বন্দিদের ভিড়। একটু আগেই একদল বন্দিকে, মহকুমা হাজতে, পাঠানো হয়েছে জাল ঘেরা গাড়িতে ভরে। সেই দলটা সবাই বাঙালি। এখন যারা হাজতে রয়েছে তারা সকলেই অবাঙালি। সম্ভবত তারা, বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং মধ্য প্রদেশের মানুষ। কিন্তু বাঙালিদের ভাষায়, তারা সবাই বিহারি। মারামারি, নিহত, আহত, গ্রেপ্তার, উত্তেজনা, সবকিছুই ঘটেছে বিহারি বাঙালি দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে।

যে মৃতদেহ দুটি বারান্দায় গলা অবধি ঢাকা দেওয়া রয়েছে, তাদের একজনের মুণ্ডিত মস্তক, মোটা গোঁফ। বয়স চল্লিশ-পঞ্চাশের মধ্যে। আর একজনের বয়স তিরিশ-বত্রিশ হতে পারে। মাথায় বড় বড় চুল, গোঁফদাড়ি কামানো। দেখলেই মনে হয়, যেন, একজন অবাঙালি, আর একজন বাঙালি। দুজনই দুটো আলাদা আলাদা এলাকায় খুন হয়েছে।

দুজনেরই আত্মীয় স্বজনেরা এসেছে। তারাই কান্নাকাটি করছে। মৃতদেহ আত্মীয় স্বজনকে ফিরিয়ে না দেবারই মনস্থ করেছে থানার কর্তৃপক্ষ। কারণ, তাতে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে পারে। এ অঞ্চলের অবস্থার আরও অবনতি হতে পারে। অবিশ্যি এখনই ফিরিয়ে দেবার কোনও প্রশ্নই নেই। কারণ দুটি মৃতদেহই আগে পোস্টমর্টেমে পাঠাতে হবে–আইন মোতাবেক।

গত পরশু থেকেই গোলমালের সূত্রপাত হয়েছে। পরশু রাত্রি থেকেই একটা মুখোমুখি দাঙ্গা বেঁধে গিয়েছিল। কারণ, রাজনৈতিক। রাজনৈতিকই বলতে হবে। কারণ, একটা কারখানার ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে, দুই দলের সংঘর্ষ বেঁধেছিল। প্রথম সংঘর্ষটা ছিল, আরও কয়েকদিন আগের। কারখানা কর্তৃপক্ষের কিছু পোষা লোক, তারাও শ্রমিক বলেই পরিচিত। আর অধিকাংশ, যারা ধর্মঘট করেছে, তাদের মধ্যেই সংঘর্ষ লেগেছিল। পরিণতি, পোষা লোকগুলোর মার খেয়ে পলায়ন। ধর্মঘটিরা নিশ্চিন্ত হয়েছিল, দালালগুলো আপাতত আর মুখোমুখি হবে না, এই আশায়।

কিন্তু জলে বাস করে, কুমির সম্পর্কে যেমন নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না, এও খানিকটা সেইরকম। সহসা, বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো, আবার ওরা দল বেঁধে এসেছিল। আবার সংঘর্ষ। তাতেই একজনের মৃত্যু হয়। আর সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করেই, বিহারি বাঙালি দাঙ্গা লেগে যায়।

দাঙ্গার পরিণতি, প্রচুর গ্রেপ্তার। অনেকের পলায়ন। এবং সর্বোপরি সমাধানহীন ধর্মঘট সম্পর্কে সংশয়, হতাশা। একদিক থেকে বলতে গেল, ধর্মঘট বানচাল হয়ে যাবার সম্ভাবনাই বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ধর্মঘটিদের পরাজয় আসন্ন বলে মনে হয়। কারণ একবার যখন বাঙালি অবাঙালি দাঙ্গা বাঁধানো গিয়েছে, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস আর ঘৃণা অনেকখানি জাগানো গিয়েছে, যারা একসঙ্গে ধর্মঘট করেছিল, একই কারখানার লোক, তখন ধর্মঘট টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

কেমন করে সহসা এমন আশ্চর্য ঘটনা ঘটল, কোন জাদু বলে, তার হদিস দেওয়া কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলা যায়, শিল্পাঞ্চলে এরকম ঘটনা নতুন নয়। এবং এ সবই পূর্ব পরিকল্পিত। এই কুৎসিত দুষ্টক্ষত যে কখন কীভাবে, তার গলিত পুঁজ রক্ত নিয়ে বেরিয়ে পড়বে, আগে থেকে যেন কিছুই জানা যায় না।

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে, শাসনের স্বার্থে জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ নতুন নয়। বর্তমানে, শিল্পাঞ্চলে প্রাদেশিক বিবাদ আর দাঙ্গা হল, একটা সাধারণ ঘটনা। সবথেকে সহজ কিস্তিমাতের কৌশল। কারখানার মানুষদের ঐক্য যাদের সমস্যা, যে কারখানা কর্তৃপক্ষ বা রাজনৈতিক দলের, তাদের সবথেকে সহজতর সমাধান হল, এই শ্রেণীর দাঙ্গা।

অতঃপর, যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে, এই দাঙ্গার সূত্রপাত, সেই ধর্মঘটের কথা আর কারুর বিবেচ্য নয়। একদিকে বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে থাকে একদল, অন্যেরা শান্তির বাণী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। স্বাভাবিক ভাবেই তখন শান্তির প্রয়োজনটাই সকলের কাছে বেশি হয়ে ওঠে। অন্য বিষয় পরে।

এখানেও বর্তমানে সেই অবস্থা চলেছে। ধর্মঘটের নেতৃস্থানীয় লোকেরাই সবথেকে আগে গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি গুণ্ডা বদমায়েশ এবং সাধারণ যুবকেরাও বাদ যাচ্ছে না। আশেপাশের অন্যান্য কারখানাগুলোও যাতে সংক্রামিত হয়ে না পড়ে, সেই চেষ্টা চলেছে। যদিও, সমস্ত কারখানাতেই হাজিরার সংখ্যা কম। যেখানে অবাঙালির সংখ্যা বেশি, সেখানে বাঙালিরা যেতে সাহস পাচ্ছে না। যেখানে বাঙালিদের ভিড় সেখানে অবাঙালিরা ঢুকছে না। এলাকাগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পাড়া এবং মহল্লাগুলোরও সেই অবস্থা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় বা রাত্রে, দুটি মৃতদেহই পাওয়া গিয়েছে দুটো বিভিন্ন জায়গায়। একজনকে পাওয়া গিয়েছে গঙ্গার ধারের ময়লা ফেলা ডিপোর কাছে। আর একজনকে একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তার ধারে একটা পোডড়া জমির আঁসশ্যাওড়ার জঙ্গলে। এগুলোকে ঘুপচুক খুনই বলা যায়। সেই জন্যই, এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না, আরও নিহত হওয়ার সংবাদ আসবে কি না।

.

এখন সকাল আটটা প্রায়। তার মধ্যে ছটি মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এখনও হয়তো কোথাও কেউ খুন হয়ে পড়ে আছে, লোকের চোখে পড়েনি। গতকাল রাত্রি থেকে যারা বাড়ি ফেরেনি, তাদের আত্মীয় স্বজনেরাও অনেকে থানায় এসেছে। যদি কোনও সংবাদ পাওয়া যায়। কারফু-তে গ্রেপ্তার হয়ে, থানায় থাকলে, সেটাকে সুখবরই বলতে হবে। কিন্তু দেখতে না পাওয়া গেলে বা তার চেয়েও ভয়ংকর, যদি মৃতদেহ দেখতে হয়, সেই ভয়ও অনেকের চোখে মুখে রয়েছে। ভয়ও ভয়ংকর সততদখত তম

নানান কারণেই, থানা সরগরম। স্থানীয়, বাঙালি অবাঙালি ব্যক্তিদের যাতায়াত চলেছে। তাঁদের মধ্যে, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও আছে। পুলিশকে, যাঁর যা বলবার বলে যাচ্ছেন। যাঁর যা পরামর্শ দেবার আছে, দিয়ে যাচ্ছেন। তবে, সকলেই যে পুলিশের কাছে আসছেন, তা নয়। তাঁদের কাছে পুলিশ মোটেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। দাঙ্গার পিছনে, তাদেরও হাত আছে কি না, এ বিষয়ে তাঁরা নিঃসন্দেহ নন।

তবুও, থানায় অনেকেরই আনাগোনা চলছে। ঘন ঘন টেলিফোন বাজছে। এস. ডি. ও. এস; ডি. পি. ও; ডি. এম. ঊর্ধ্বতনেরা সকলেই গতকাল ঘুরে গিয়েছেন। আজও কেউ কেউ আসবেন, সন্দেহ নেই। থানার নিজস্ব পুলিশ বাহিনী ছাড়াও, রিজার্ভ পুলিশের সংখ্যাই এখন এ এলাকায় বেশি। তাদের গাড়িগুলো শহরে টহল দিচ্ছে। স্পেশাল অফিসার যারা এসেছে, তাদের নিয়ে জিপ ছুটোছুটি করছে।

প্রায় তিন মাইল এলাকা জুড়ে, ভীতির ভাব সর্বত্রই বর্তমান। দিনের বেলাও রাস্তাঘাটে লোক চলাচল বিশেষ নেই। একমাত্র নিজেদের এলাকাতেই যা একটু ভিড়। মিশ্রিত এলাকাগুলোর অবস্থা সবথেকে খারাপ। সেই সঙ্গেই, গুজবের ছড়াছড়ি চারদিকে। নিহতের সংখ্যা, গুজব রটনাকারীদের মুখে মুখে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডজনের ওপর দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অগ্নি সংযোগ, লুটের খবরও কম নয়। সেই সঙ্গে নারীধর্ষণের সংবাদও আছে।

.

থানা ইনচার্জ-এর ঘরে কয়েকজন বসেছিল। ইনচার্জ নিজেও তার চেয়ারে বসে আছে। লোকটির বয়স বেশি নয়। বছর দুয়েক আছে এ অঞ্চলে। অবিবাহিত, যদিও বিয়ের বয়স হিসেবে, এখন বেশিই হয়েছে। চুলে কিছু কিছু পাক ধরেছে দু পাশের রগের কাছে। চোখ দুটো যত উজ্জ্বল, আর তীক্ষ্ণ, সেই তুলনায় মুখটা থলথলে। তার অভিব্যক্তি একটু বোকাটে। নাম শ্যামাচরণ।

এ অঞ্চলের একটা, সুনাম দুর্নাম, যা-ই হোক, আছে। সেটা হল, বছর দুয়েক কোনও থানা ইনচার্জ এ থানায় টিকে থাকতে পারলে, লাখ দুই তিন টাকা সে পকেটে করে নিয়ে যেতে পারে। কী ভাবে, এবং কথাটা কতখানি সত্যি, এ বিষয়ে কিছু জানা যায় না। কথাটা একটা কিংবদন্তির মতোই প্রচলিত। শ্যামাচরণের কতখানি হয়েছে, কে জানে! বাইরে থেকে তাকে দেখলে কিছুই বোঝা যায় না। সে মদ খায় না, বিড়ি সিগারেটের নেশাও নেই। চালচলনও সে রকম ফিটফাট স্মার্ট নয়।

তার ঘরে যারা বসেছিল, ওরা সকলেই এ অঞ্চলের নাম করা গুণ্ডা আর ছিনতাই পার্টির লোক। তাদের মধ্যে বাঙালি অবাঙালি, দু পক্ষই আছে। তারা বসেছিল, দেয়াল ঘেঁষে একটা কাঠের বেঞ্চিতে।

আর একজন, শ্যামাচরণের টেবিলের সামনে, প্রায় মুখোমুখি, চেয়ারেই গা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। সে বেঞ্চির দলের নয়, বোঝা যাচ্ছে। শ্যামাচরণ তা হলে তাকে এখানে বসতেই দিত না। এমনকী, পঁচিশ থেকে তিরিশের মধ্যেই বয়স, ছোকরা যে ভাবে সিগারেট খাচ্ছে চোখ আধ বোজা করে, তাতে মনে হয়, বড় দারোগাকে নিয়ে, ওর কোথাও কোনও সমস্যা নেই। টেরিটের অলিভ-গ্রিন সরু ট্রাউজার ওর পরনে। গায়ে তন্তুজ কাপড়েরই হাওয়াইয়ান শার্ট। তেমন পরিষ্কার নয়। পায়ের স্যান্ডেল জোড়া টেবিলের তলায় খোলাই রয়েছে। দুটো খালি পা মাটিতে ছড়ানো। রোগা রোগা, এক-হারা গোছের মাঝারি লম্বা গড়ন। চুল ছোট করে ছাঁটা, প্রায় কপালের দিকেই সামনে টেনে দেওয়া। অথবা চিরুনি ছোঁয়ায়নি, হাত দিয়েই কোনওরকমে কাজ সেরেছে।

এমন একটা নির্বিকার ভাব ওর যে, বেঞ্চির লোকগুলোর সঙ্গে কোনও মিলই নেই। বেঞ্চির লোকগুলোর চেহারা, পোশাক, চাউনি, সবই ভিন্ন ধরনের। হয়তো তাদেরও শার্ট প্যান্ট সবই আছে, তথাপি রং চং, চোখ মুখের অভিব্যক্তি, সবই আলাদা। একটা ভয় বিব্রত সংশয়ের ভাব তাদের মুখে।

শ্যামাচরণ সেইদিকেই, একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল কাল্লু, জিজ্ঞেস করলাম যে, কাল রাত্রে তুই কোথায় ছিলি?

কাল্লুর চোখ লাল, নিদ্রার অভাবেই একটু ঢুলু ঢুলু। চোখের কোল বসা। বলল, বাতালাম সাব, কাল রাত মে তো ঘরেই ছিলাম।

শ্যামাচরণ ধমক দিয়ে ওঠে, বাজে কথা ছাড়। কে জানে, তুই বাড়ি ছিলি?

বাড়িতে বহুকে পুছিয়ে দেখেন না।

 চেয়ারে বসা ছেলেটি ঘাড় ফিরিয়ে বলে উঠল, তোর কটা বহু আছে, তা-ই আগে বল কাল্লু।

কথা শেষ হবার আগেই, শ্যামাচরণ ধমকে ওঠে, তুমি চুপ করো অশোক, তোমার কথা আমি শুনতে চাই না। তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করব, তখন জবাব দিয়ে।

অশোক হাত উলটে বলল, যাঃ বাবা, ভাল কথা বলতে গেলুম আপনি চটে গেলেন। কাল্লু বললে, ওর বউকে জিজ্ঞেস করতে, তা-ই আমি বলছি, কটা বউ আছে ওর, কোন বউকে আপনি জিজ্ঞেস করবেন। ন নম্বর গলির বউ, না তেরো নম্বর গলির বউ।

শ্যামাচরণ তার থলথলে মুখের চামড়ায় ঢেউ তোলে। হুমকে উঠে বলে, তার মানে?

অশোক বলল, তার মানে ওকেই জিজ্ঞেস করুন।

শ্যামাচরণ বাঘের মতো চোখ করে কাল্লুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কটা বউ তোর?

কাল্লু বোধ হয় একটু লজ্জিত হল। মাথা নিচু করে বলল, তিন।

শাট আপ রাসকেল। কী করে তুই তিনটে বিয়ে করেছিস, বে-আইনি না? আমি এখনই তোর হাতে হাতকড়া লাগাব।

কাল্লু রীতিমতো চমকিত শঙ্কিত। শ্যামাচরণ টেবিলে চাপড় মেরে আবার বলল, এটা মগের মুলুক পেয়েছিস তোরা, আইন বলে কিছুই নেই? তিনটে বিয়ে করেছিস, আবার সে কথা বলা হচ্ছে। চাবকে তোর পিঠের ছাল তুলে দেব।

কাল্লু গুণ্ডার শঙ্কিত মুখটা ক্রমে, অসহায় বোকাটে হয়ে ওঠে। বলে, সাব শাদি আবার হামকো কেয়সে হবে, কে দেবে?

তবে?

ওদের হামি খাওয়াই পিয়াই, কাপড় চোপড়া দেতা, ঘর ভাড়া দেতা…।

কথা শেষ হবার আগেই শ্যামাচরণ বলে ওঠে, তার মানে রক্ষিতা।

কাল্লু চুপ করে থাকে। শ্যামাচরণও বুঝতে পারে, এই পর্যন্তই তার সীমা। কিন্তু রাগ আর ঘৃণা সে সামলাতে পারে না বলেই, দাঁতে দাঁত পেষে, আর মুঠি পাকাতে থাকে।

অশোক আস্তে আস্তে বলে, আর তিনটি স্ত্রীলোক পুষতে হলে, বুঝতেই পারছেন, কত টাকা দরকার। তাই একটু ছিনতাই গুণ্ডামি করতে হয়।

শ্যামাচরণ টেবিলের ওপর ঘুষি মেরে, প্রায় দেয়াল কাঁপিয়ে বলল, তুমি চুপ করবে কি না জানতে চাই।

অশোক চুপচাপ সিগারেট টানতে থাকে। শ্যামাচরণ ওর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আবার বলল, কোনও রকবাজের কাছ থেকে আমি জ্ঞান নিতে চাই না।

অশোক বললে, তা বাড়ির রক থাকলে তাতে বসতে পাব না?

না।

 জানেন আমাদের ঠাকুরবাড়ির কী রকম বিখ্যাত রক। ওই রকে আমার বাবা ঠাকুরদা বসতেন, অনেক বড় বড় পণ্ডিত বসতেন এক সময়ে, কত শাস্ত্র আলোচনা হত।

শ্যামাচরণের রাগ এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, সে চোয়াল শক্ত করে, প্রায় থিয়েটারের রাজার মতো, গলার স্বর হঠাৎ নিচু করে, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, জানি। আর এখন যারা বসে, তারা কতগুলো বেকার বদমাইশ লোচ্চা ছোঁড়ার দল।

অশোক বলল, এটা আপনার রাগের কথা হল বড়বাবু। চাকরি না করলেই বেকার হয় না, আর বাড়ির রকে বসে থাকলেই গুণ্ডা বদমাইশ হয় না। বাবা ঠাকুরদারা রেখে গেছে, এরকম একটু একটু কলসি গড়িয়ে খেলে, আরও দু-এক পুরুষ চলে যাবে। আর জানেন তো, আমার দুই দাদা আর আমি কেউই বিয়ে করিনি, দরকার নেই।

শ্যামাচরণ একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল টেবিলের ওপরে। বলল, বড় যে ফুটানি করছ, সেদিনও যে তোমার নামে ডায়েরি হয়ে গেছে। দশ দিনও হয়নি, বটা ঠাকুরের ছেলে নরেশকে মেরে আধমরা করেছ, জামিনে খালাস আছ। অ্যাটেম্পটেড টু মার্ডার কেস তো ঝুলছে। খুব যে বড় বড় কথা হচ্ছে? ভদ্রলোকের ছেলে বলে যা খাতির করে চেয়ারে বসতে দিয়েছি, এখনও গারদে পুরিনি, সেই যথেষ্ট। বেশি কথা না বলে চুপ করে বসে থাকো।

অশোক সিগারেটে টান দিয়ে, নিরীহ ভঙ্গিতে বলল, তা চুপ করে থাকতে বলেন, থাকছি। তবে, আপনাকে তো আগেই বলেছি, নরেশের মতো ছেলেকে সরকার আর সমাজ যখন শাসন করতে পারছে না, তখন আমাদেরই ঢিট করতে হবে।

বটে?

তা আর কী করা যাবে। পাড়ার মেয়েকে একলা পেলেই যদি কেউ টানাটানি করে, খিস্তি করে, শিস দেয়, তাদের কী করা যাবে। তাও যদি, মেয়েটার সায় থাকে, তবু একরকম।

আদর্শবাদী, অ্যাঁ? নিজের হাতেই শাসন তুলে নিচ্ছ?

বলতে বলতে শ্যামাচরণের থলথলে মুখটা শক্ত আর চৌকো হয়ে ওঠে। অশোক এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, শাসন হাতে তুলে নেবার কথা হচ্ছে না। এ সব হল পাড়ার ব্যাপার। ছেলে ছোকরারা অন্যায় করলে, পাড়ার লোকেরাই শাসন করে।

ওর মুখে ছেলে ছোকরা কথাটা প্রায় হাস্যকর শোনায়। একটু পাকা পাকাও লাগে। কিন্তু শ্যামাচরণের চিত্ত একেবারে জ্বলে যায়। চোখও ধকধকিয়ে জ্বলে। তেমনি চিবিয়েই বলে, চালুনি বলে ছুঁচকে, তোর ইয়েতে কেন ছ্যাদা, তাই? নিজেরা দিন রাত্রি রকে বসে ইতরামো করছে যারা, মেয়েদের পেছনে লাগছে, ইশারা করছে।

একদম মিথ্যে কথা।

অশোক বাধা দিয়ে বলে ওঠে।

 মিথ্যে কথা?

শ্যামাচরণ গর্জে ওঠে। অশোক বলে, নিশ্চয়ই। আমাদের গ্রুপের ছেলেদের ইতরামো যদি প্রমাণ করতে পারেন, তা হলে আমরা সবাই চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে, কান ধরে ওঠবোস করব, মাইরি বলছি।

ওর মাইরি বলার ধরনটাও এমনই হাস্যকর শোনায় যেন, শ্যামাচরণ এর কথার ওপরে কোনও গুরুত্বই দিতে চায় না। শ্যামাচরণ অত্যধিক রেগে ওঠে, আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে। অর্থাৎ তার মুখে কয়েক মুহূর্ত প্রায় কোনও কথা জোগায় না। তারপরে হাত তুলে, যেন চাপা গর্জনে গরগর করে বলে, তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, আমার সামনে ভাল ভাবে কথা বলবে, নইলে।

দাঁতে দাঁত পেষার চাপে, আর কথাই ফোটে না তার মুখে। অশোক ঘাড়ে একটা আলতো ঝাঁকানি দিয়ে বলে, আপনি খালি রেগেই যান। কী আর করব বলুন।

শ্যামাচরণ হঠাৎ অত্যন্ত চিৎকার করে দ্রুত বলতে আরম্ভ করে, তোমরা ইতরামি কর না? আমার কাছে কোনও খবর আসে না ভেবেছ? হরিহর চক্রবর্তীর পেছনে তোমরা লাগ না? তাকে দেখলেই টিটকারি দাও না? হরিহর চক্রবর্তী নিজে আমাকে বলেছে, তোমাদের বদমাইশগুলোর জ্বালায় সে রাস্তায় বেরুতে পারে না।

অশোক প্রায় উৎকণ্ঠিত হতাশায় বলে ওঠে, ছি, ছি, সকালবেলাই লোকটার নাম করলেন? আজ ভাত জুটলে হয়। ওরকম একটা চশমখোর সুদখোর ফেরেববাজ কিপটে লোকের নাম করলে, হাঁড়ি ফেটে যায়। সেটা বলতে পারেন, ওকে আমরা টিটকারি দিই। তাও এমন কিছু না, পদ্মমধু পদ্মমধু বললেই লোকটা খেপে যায়।

কেন?

কেন আবার। সত্তর বছরের হরিহর চক্রবর্তী যদি এখন ঘোষালদের ষোলো বছরের মেয়ে পদ্মকে টাকা দিয়ে কিনতে চায়–মানে, ঘোষালদের তো কেউ নেই, এক বিধবা গিন্নি ছাড়া। অবস্থাও খুব খারাপ। বাড়িটা হরিহর চক্রবর্তীর কাছেই বাঁধা। মর্টগেজ লাইসেন্স তো নেই, তাই বাড়িটা বিক্রি কোবালা করেই বাঁধা দেওয়া আছে। ঘোষালদের বিধবা গিন্নি, মাসে মাসে তিরিশ টাকা করে যেন ভাড়া দেন, মানে সুদটা এ ভাবেই দেওয়া হয়। আপনিই বলুন, তিন হাজার টাকা ঋণ দিয়ে, পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্পত্তি এখন সে বিক্রি করে দিতে চায়। তা যদি না হয় তা হলে ঘোষাল গিন্নিকে সে স্রেফ জানিয়ে দিয়েছে, পদ্মকে সে রাখতে চায়। ঘোষাল গিন্নি আমাদের সেটা বলে দিয়েছেন। এর পরেও যদি বুড়োর পেছনে একটু না লাগি, তা হলে চলে কেমন করে বলুন। এতে আপনারা কিছু করতে পারবেন না। শত হলেও শহরের একটা ধনী লোক, মান্যগণ্য।

শ্যামাচরণ সমস্ত ঘটনাটা শুনতে শুনতে, একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এতক্ষণ পরে বলে ওঠে, তাতে তোমাদের কী? হরিহর চক্রবর্তী যদি কোনও অন্যায় করে, সেটা আমরা দেখব। ঘোষাল গিন্নির কোনও অভিযোগ থাকে, তিনি থানায় বলতে পারেন।

অশোক বলে ওঠে, ওই আপনাদের পুলিশের মুশকিল। আপনারা সব ব্যাপারটা থানায় টেনে আনতে চান। আজ যদি ঘোষাল গিন্নি থানায় এসে অভিযোগ করেন, কালকেই তাঁর মেয়ের নামে শহরে ঢি ঢি পড়ে যাবে। তাই আবার কেউ চায় না কি? ও সব আমরা পাড়ার ছেলেরাই ঠিক করব। চক্রবর্তীর দৌড় আমরা দেখে নেব। সে রকম ঘটনা ঘটলে, আপনাদের ডাকা হবে।

শ্যামাচরণ যেন অশোককে খুবই বেকায়দায় ফেলবার জন্যে বলে ওঠে, তা হলে তোমরাই টাকাটা দিয়ে বাড়িটা খালাস করে দাও না কেন, সব মিটে যায়।

অশোক পিছনে এলিয়ে পড়ে বলে, অত টাকা আমাদের নেই, সবাই জানে। ঘোষাল গিন্নি তো তা চাইছেন না। তিনি চান, বাড়িটা বিক্রি হোক, চক্রবর্তী তার ন্যায্য পাওয়ানা নিয়ে বিদায় হোক, উনি যেন না ঠকেন। কিন্তু চক্রবর্তী হয় দাঁও মারবে, না হয় পদ্মমধু খাবে, দেখুন দিকি হরির কী রকম খচড়ামি। ও সব আমরা হতে দিচ্ছি না।

ওর কথা এত স্পষ্ট যে, শ্যামাচরণ কিছুতেই রাগ সামলাতে পারে না। বলে ওঠে, তবে মনে রেখো, কোনও রেসপেকটেবল সিটিজেন যদি হিউমিলিয়েটেড বা ইনসালটেড হয়ে থানায় কোনওরকম অভিযোগ করেন, আমি ছেড়ে কথা কইব না। আর তোমার ওই সব মাইরি, খচড়ামি বাজে বাজে ছোটলোকদের মতো কথাগুলো আমার সামনে কখনও বলবে না।

অশোক একইভাবে বলে, তা বলতে বারণ করেন, বলব না। তবে এ সব তো আজকাল সবাই বলে। আপনিও আমাকে কয়েকবার খচ্চর উচ্চর বলেছেন।

শহরের নাম করা পেশাদার গুণ্ডা কয়েকজন যারা বসেছিল, তারা দুজনের কথাবার্তা শুনে অনেকক্ষণ থেকেই মুখ টিপে টিপে হাসছিল। এবার অশোকের কথা শুনে, কার গলায় শব্দ করে হাসি বেজে ওঠে। শ্যামাচরণ বাঘের মতো চকিতে ফিরে তাকায় বেঞ্চির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সকলের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। শ্যামাচরণ জিজ্ঞেস করে, কোন হারামজাদা হাসল?

কেউ কোনও কথা বলে না। শ্যামাচরণ গর্জে ওঠে, কে?

কাল্লু বলে ওঠে, বাতা না রে সন্তোষ, তুহি তো হাসলি?

সন্তোষ রোগা, শক্ত হাড়ের চেহারা। গুণ্ডা ছিনতাই, দুয়েতেই তার নাম আছে। তাড়াতাড়ি দুহাতে দুকান মলে বলে ওঠে, অন্যায় হয়ে গেছে বড়বাবু। মাপ করে দেবেন। আপনারা আপসে এমন লড়ছেন, তাই আর কী।

তাই বড্ড হাসি পাচ্ছে, না? যখন পাতলুন খুলে ছ্যাঁকা দিয়ে দেব, তখন বোঝা যাবে।

সন্তোষ চুপ করে মাথা নামিয়ে নেয়। চেনাশোনা জাত অপরাধীরা যেরকম ভাব করে, সেই রকম তার ভাব।

অশোক আবার বলে ওঠে, আসলে আপনাদের কী হয়েছে, পুলিশের অক্ষমতা ঢাকবার জন্যে, যতরকমের–।

হোয়াট?

শ্যামাচরণের গর্জন। অশোক বলে, আসল কালপ্রিটদের ধরতে ।

 গেট আউট, গেট আউট, আই স্যে।

অশোক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে, সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই পকেটে নিয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে বলে, সেই ভাল। আমিও তো তাই চাইছিলুম। মিছিমিছি গুণ্ডা ছিনতাইয়ের সঙ্গে ভদ্রলোকের ছেলেকে বসিয়ে রাখার কোনও মানে হয়?

বলতে বলতে ও দরজার দিকে যায়। শ্যামাচরণ আবার খেঁকিয়ে ওঠে, কিন্তু বাড়ি যাবে না এখন। বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা করো, এদের ছেড়ে দিয়ে, তারপরে আমি তোমাকে দেখছি।

অশোক ফিরে না তাকিয়ে শরীরের একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে, আবার! বেশ তাই হবে। শহরে একটা হাঙ্গামা চলছে, একটা ছুতো করে অ্যারেস্ট করলেই হল। থেকেই যাব।

ও বাইরে গিয়ে, চারদিকের লোকজন দেখতে থাকে। আবার একটা সিগারেট ধরায়। লোকজনের যাতায়াত, মেয়ে পুরুষের কান্নাকাটি, উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত মুখের ভিড়, সেপাইদের ব্যস্ত আনাগোনা, কোনও কিছুতেই যেন ওর তেমন বিকার নেই। নির্বিকার ভাবে দেখে আর সিগারেট ফোঁকে। কেবল এক বারই ওর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফোটে, যখন দেখতে পায়, পুরুষোত্তম সিং আর বিজয় লাহিড়ী, দুই শান্তি কমিটির নেতা, একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে, হাত নেড়ে কথা বলছে। হয়তো, এ লোক দুটোই দাঙ্গার আসল কলকাটি নাড়ছে, বাঙালি অবাঙালিদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে। এদের কে না চেনে যে, এরা কোম্পানির দালাল ছাড়া কিছু নয়। আর শ্যামাচরণ দারোগা ঘরের মধ্যে চেঁচাচ্ছে।

চেঁচালেই যেন সব হয়ে যাবে। শ্যামাচরণ নিজেও কি কিছু জানে না? এ অঞ্চলে সে দু বছর প্রায় দারোগাগিরি করছে। হয় তো, জেনে শুনে আসল জায়গায় হাত দেবার কোনও উপায় নেই তার। কথাটা বললে হয় তো শাসনের অমর্যাদা হয়। পুলিশের দুর্নাম হয়। কিন্তু পুলিশের দুর্নাম হওয়ার অপেক্ষা আছে নাকি? পুলিশকে কি লোকে সৎ ভাবে? আসলে তাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ধরতে চাইলেই তারা সবাইকে ধরতে পারে না। তারপরে দেখা যাবে, কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। আসলে এটা সরষের মধ্যে ভূতের মতো, শাসনতন্ত্রের মধ্যেই শঠতা আর অসততা রয়েছে।

কিন্তু শ্যামাচরণ তাকে ডেকে পাঠাল কেন। এখন যে সব কথাবার্তা হচ্ছে, এ সব তো প্রস্তাবনা। আসল কথায় নিশ্চয় এখনও আসেনি। অশোককে সে খুব ভালই জানে! ওদের পাঁচ-সাতজন বন্ধুদের যে গ্রুপ আছে, তাদেরও ভাল জানে যে, এ সব দাঙ্গার মধ্যে অশোক অংশ গ্রহণ করবে না। অন্য কোনও কথা নিশ্চয়ই আছে। ৬৫২

শ্যামাচরণের কী রকম একটা অবিশ্বাস আর সংশয় আছে অশোক সম্পর্কে। সেটাও অশোক ভালই বোঝে। অশোককে যেন সে কোনও রকমেই বিশ্বাস করতে পারে না। এর প্রথম কারণটা এখনও মনে আছে ওর। ওদের এই শহরেরই শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, হঠাৎ খুন হয়ে। খুনই যে হয়, সেটা প্রথম জানা যায়নি। শ্রীনিবাস চক্রবর্তীকে একদিন সকালবেলা থেকে আর পাওয়া গেল না।

লোকটার বয়স হয়েছিল প্রায় ষাট। মোটামুটি শক্ত সমর্থ চেহারাই ছিল। তা হলেও, ডাক্তার তাকে উপদেশ দিয়েছিল, রোজ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে, যতটা সম্ভব পায়ে হেঁটে বেড়াতে। তাই বেড়াতেন শ্রীনিবাস। তবে একলা নয়। সমবয়সি আরও কয়েকজন জুটেছিল, যারা তার প্রতিবেশী। সকলের প্রতিই ডাক্তারের প্রায় এক রকমই নির্দেশ ছিল। নিতান্ত একলা একলা মুখ বুজে বেড়ানোর থেকে, সে তবু একরকম মন্দ ছিল না। ষাট বাষট্টি বছর বয়সের কয়েকজন বৃদ্ধ একসঙ্গে, হাতে ছড়ি নিয়ে, পুরনো দিনের প্রশংসা, সম্প্রতিকালের সবকিছুই নিন্দা করতে করতে হেঁটে বেড়াতেন।

তবে, শহরের বড় রাস্তাটা বেড়াবার মতো তেমন সুবিধের নয়। ভোর হতে না হতেই, সে রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া চলা শুরু হয়ে যায়। মিল কলের শ্রমিকদের ভিড় করে যাতায়াত। এ সবও বৃদ্ধদের একটা নিন্দার বিষয়। আগের কালে এ রাস্তা কত নিরুপদ্রব ছিল। ছেলেরা খেলা করলেও ক্ষতি ছিল না। আর গঙ্গার ধারটা মফস্বল অঞ্চলে বরাবরই অত্যন্ত অনাদৃত। ধারে ধারে রাস্তা বলে কিছু নেই। আছে গুচ্ছের ঘাট। সেখানে একমাত্র স্নান করতেই যাওয়া যায়। সে জন্য রেল লাইন পেরিয়ে, গাড়ি ঘোড়া নেই, এমন রাস্তাতেই তারা বেড়াতে যেতেন।

যাই হোক, প্রথম যখন শ্রীনিবাসের খোঁজ পড়ল, তখন তার বেড়িয়ে ফেরবার সময় চলে গিয়েছে। বাড়ির লোকেরা বলাবলি করছিল, এত দেরি তো কোনওদিন করেন না। তবে হয়তো আজ আরও বেশি দূরে চলে গেছেন, তাই ফিরতে দেরি হচ্ছে।

কিন্তু যত দেরিই হোক, তারও একটা সীমা আছে। তখন বাড়ির বড় ছেলে, শ্রীনিবাসের ভ্রমণসঙ্গীদের কাছে খোঁজ করতে গেল। সেখানে গিয়ে শুনল, শ্রীনিবাস সেদিন তাদের সঙ্গে বেড়াতেই যাননি, যে কারণে ধরেই নিয়েছেন তারা, শ্রীনিবাস বোধ হয় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হঠাৎ, তাই আজ আর বেরোননি।

রাস্তার একটা কালভার্টের কাছে, একটা আলের নীচে, সবাই তারা মিলিত হতেন। সেখান থেকে হাঁটতে আরম্ভ করতেন।

শ্রীনিবাস মোটে বেড়াতেই যাননি, এ কথা শুনে বাড়ির লোকেরা সকলেই অবাক হয়ে গেল। তা কী করে হয়। শ্রীনিবাসের স্ত্রী নিজে দরজা খুলে দিয়েছেন এবং দরজা বন্ধ করেছেন। উনি যখন বেরুতেন, তারপরেও গিন্নি খানিকক্ষণ ঘুমোতেন বা শুয়ে থাকতেন। বাড়িতে ছেলে বা ছেলের বউয়েরা, ঝি চাকরেরা তখন কেউই ওঠে না। একমাত্র, পুরনো দিনের বুড়ো চাকর, সে গেটের সামনেই একটা বেড়ার ঘরে শোয়। সে উঠে শ্রীনিবাসকে গেট খুলে দেয়, আবার বন্ধ করে।

সেউ বুড়ো চাকর বলেছিল, দরজা আমি খুলে দিয়েছিলাম বাবুকে। আবার বন্ধও করেছিলাম। বাবু নিশ্চয়ই বেরিয়েছিলেন।

গিন্নি এবং বুড়ো চাকর, দুজনেই নিশ্চয় ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেনি। অথচ ভ্রমণসঙ্গীরা সবাই বলেছিলেন, শ্রীনিবাস সে দিন কালভার্টের কাছে আসেননি। শ্রীনিবাসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, মিনিট তিনেকের রাস্তা সেই কালভার্ট। তার বাড়িও অবিশ্যি বড় রাস্তায় নয়, বড় রাস্তা থেকে, একটা ভিতরের রাস্তায় খানিকটা গেলে, চক্রবর্তীদের মস্ত বড় বাড়ি।

শ্রীনিবাসের অবস্থা খারাপ ছিল না। নানা ধরনের ব্যবসা ছিল। তার মধ্যে রঙের ব্যবসাটাই প্রধান। এমনিতে কোনও দুর্নামও ছিল না। কোনও নেশা ছিল না। তবে স্ত্রীলোক ঘটিত একটা কথা কখনও কখনও শোনা গিয়েছে, তাও সেটা বাইরে কোথাও নয়, পাড়ার মধ্যেই, বিশেষ ঘনিষ্ঠ এ বাড়ি ও বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বেলা দশটার পর পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। ছোটখাটো শহর, বাড়িতে বাড়িতে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। পুলিশ নানাভাবে খোঁজ করছিল। ভদ্রলোক এভাবে হাওয়া হয়ে গেলেন কোথায়। পুলিশ তো হিমসিম খেয়ে গিয়েছিল। এ সব অঞ্চলে, ছেলে বুড়ো, কেউ নিখোঁজ হলেই, আগে গঙ্গায় খুঁজে দেখা হয়। পোর্টকমিশনারের কাছে খবর চলে যায়। জাল ফেলে দেখা হয় চারদিকে। আর তা নইলে, রেল লাইনে খোঁজ পড়ে, যদি আত্মহত্যা বা অন্য কিছু ঘটে থাকে। শ্রীনিবাসের বেলায় যা যা করা উচিত, সবই করা হয়েছিল। কিন্তু তিনদিনের মধ্যেও তার কোনও খবর পাওয়া যায়নি।

.

অশোক শুধু বেকার নয়। তার জীবনটা বাইরের থেকে এমনিতেও খুব মন্থর বলেই মনে হয়। ওদের তিন ভাইয়েরই খাওয়া পরার ভাবনা ছিল না। অথচ, ঠাকুরবাড়ির যা চালচলন, সাদা সিধে জীবনযাত্রা, তা-ই ছিল। একটা সময় পর্যন্ত সকলেই পড়াশুনা করেছে। তারপরে যে যার নিজের নেশা নিয়ে আছে।

বড় ভাইয়ের নেশা হল, গান বাজনা। ধ্রুপদ-ধামারেই তার চেষ্টা। মেজ ভাইয়ের নেশা হল জ্যোতিষী। যত রাজ্যের জ্যোতিষী শাস্ত্র নিয়ে তার কারবার। কিন্তু কোনওটাই তাদের পেশা নয়। নিতান্ত নেশা।

একমাত্র অশোকের নেশা, বন্ধুদের নিয়ে রকে বসে আড্ডা দেওয়া। তবে তার মধ্যে কথা আছে। যে কোনও অপরাধ সম্পর্কেই, ওর একটা বিশেষ কৌতূহল আছে। এ সব নিয়ে ওর গবেষণার অন্ত নেই, থিসিসও প্রচুর। কিন্তু শোনবার লোক বিশেষ নেই। ওর বন্ধুরা ছাড়া। খবরের কাগজের সংবাদে, বা এই শহরে, কোথাও কোনও অপরাধ ঘটলে, বন্ধুদের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করে। দেখা যায়, প্রায়। সময়েই, ও যা বলে, সেই সিদ্ধান্তই খাটে।

বিশেষত অপরাধ কী ভাবে ঘটেছে, অপরাধী তার জন্য কী কী পন্থা অবলম্বন করতে পারে, এ সব প্রায় নিখুঁত বলে দিতে পারে। সব ক্ষেত্রে নয়, তবে প্রায় ক্ষেত্রেই। যে কারণে ওর বন্ধুরা বলে, তুই নিজেই দেখছি একটা ক্রিমিনাল। নইলে, এ সব চিন্তা তোর মাথায় আসে কী করে।

অশোকের জবাবও সেইরকম। পরিষ্কার বলে, আমি নিজেই অপরাধী হয়ে চিন্তা করি। দুটো জিনিস তো চাই। ঠিক মতো কাজ হাঁসিল করা। কোনও কারণেই ধরা না পড়া।

কিন্তু কোনও অপরাধী একেবারে নিরঙ্কুশ ভাবে কোনও ছাপ না রেখে, অপরাধ করতে পারে না। ধরা সে পড়বেই।

অশোকের জবাব, এ সব থিয়োরি বাজে। সেকেলে গোয়েন্দা গল্পেই ও সব থিয়োরির কথা শোনা যায়। আজ পর্যন্ত যত খুন হয়েছে, তার অধিকাংশই ধরা পড়েনি। নেহাত ফালতু চোর ডাকাত না হলে, মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করতে পারলে, কোনও সাধ্য নেই অপরাধীকে খুঁজে বের করে। আসলে, এর জন্য দরকার কল্পনা করার শক্তি আর আইনের পরিবর্তন।

সেটা আবার কী?

সেটা হল, কে অপরাধ করেছে, সবই জানা গেল, অথচ যেহেতু কোর্টে প্রমাণ করা গেল না, আর অপরাধী আগের মতোই সকলের সামনে বুক ফুলিয়ে বেড়াতে লাগল। আইনের এ সব নিয়ম চলবে না। জুরি মানেই থিয়েটারের দর্শক। আর উকিল, যত বলে কয়ে বোঝাতে পারবে, দরকার হলে রাগাতে পারবে, কাঁদতে পারবে, সেই পক্ষের হয়েই জুরিরা রায় দেবে। তার মানে, দুজন অভিনেতার অভিনয়েই সব কুপোকাত। জুরি যাদের করা হয়, তাদের চরিত্রও তো জানা আছে। অনেক সময়ই ভুসিমাল। একমাত্র জজের ওপর খানিকটা নির্ভর। ওই একজন লোককেই একলা ভেবে অনেকসময় রায় দিতে হয়। সেজন্য তাঁর দায়িত্ব অনেক বেশি। তাও ব্যক্তিগত ভাবনা চিন্তার ঊর্ধ্বে আর কজন জজ উঠতে পারে।

তবে, অশোক যে এ সব চিন্তা করে, তা ওর বন্ধুরা ছাড়া বিশেষ কেউ জানত না। আর এ বিষয়টাই ওদের, ঠাকুরবাড়ির রকে একমাত্র আলোচনার জন্য ছিল না। নেহাত কোনও ঘটনা ঘটলেই এ সব কথাবার্তা উঠত। তাতেই জানা যেত, অশোকের এ সব ভাবনা চিন্তা একটা নেশার মতো। যে কোনও অপরাধের ঘটনা ঘটলেই, সেটা নিয়ে ভাবা, তার একটা সমাধানের চিন্তা ওর মাথায় ঘুরে বেড়াত।

অশোকের এই সব গবেষণার কথা প্রথম বাইরের লোকেরা জেনেছিল, শ্রীনিবাসের ব্যাপারে। শ্যামাচরণের সঙ্গে, অশোকের এ সব নিয়ে যোগাযোগও সেই প্রথম। আর এই যোগাযোগ থেকেই, অশোক শ্যামাচরণের কাছে কিছুটা রহস্যজনক, সন্দেহজনক, হয়ে আছে। প্রাণ ভরে কিছুতেই সে অশোককে বিশ্বাস করতে পারে না। কারণ, শ্রীনিবাসের নিখোঁজ হবার ঠিক চারদিনের দিন অশোক ওদের বাড়ি থেকে টেলিফোন করে, থানায় শ্যামাচরণকে জানিয়েছিল, যে কালভার্টের কাছে শ্রীনিবাসবাবু বন্ধুদের সঙ্গে একত্র হতেন, সেদিক থেকে উত্তরে, রাস্তার ওপরে গোটা তিন-চারেক ম্যানহোল খুলে দেখুন, বোধ হয় ডেডবডি পাবেন!

শ্যামাচরণ তো থ। সে জিপ নিয়ে সোজা অশোকের কাছে এসেছিল। তাকে নিয়ে, মিউনিসিপ্যালিটি থেকে ধাঙড় ডেকে, নির্দিষ্ট জায়গার পর পর দুটো ম্যানহোল খুলতেই একটার মধ্যে শ্রীনিবাসের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল। মৃতদেহ ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ঘাড়ে মাথায় ও বুকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল।

একদিক থেকে এ ব্যাপারে অশোকের বিপদই বেড়েছিল। শ্যামাচরণ আর তাকে ছাড়তে পারেনি। এতটা অব্যর্থ ভাবে, অশোক জানল কেমন করে যে, ম্যানহোলের মধ্যেই শ্রীনিবাসের ডেডবডি আছে এবং ঠিক নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যেই।

অশোক ভেবেছিল, তাই তো, ভাল করতে গিয়ে যে নতুন বিপদ ডেকে নিয়ে এল। শ্যামাচরণের প্রশ্নের জবাবে সে জানিয়েছিল, সে তিনরকম সন্দেহ করেছিল। হয় শ্রীনিবাস বাড়িতেই খুন হয়েছেন এবং সেখানেই তাঁকে কোথাও পুঁতে রাখা হয়েছে। অথবা, বাইরের কোনও খুনি, কোথাও ডেকে নিয়ে গিয়ে, তার নিজের ঘরে বা বাড়ির সীমানায় লাশ গুম করে রেখেছে। অন্যথায় এই শহরের মধ্যে, খুন করে, একমাত্র ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে রাখতে পারে। আর সেটাই সবথেকে বেশি সম্ভব ছিল। কারণ, শ্রীনিবাস বাড়ি থেকে নিশ্চয় বেরিয়েছিলেন। কিন্তু কালভার্টের দিকে যাবার আগেই, আততায়ী তাঁকে ধরেছিল। কালভার্ট রয়েছে রাস্তার দক্ষিণে। সেদিকে গেলে তাঁকে দেখতে পাওয়া যেত। আর, আততায়ীও ওদিকে যাবে না, তা হলে শ্রীনিবাসের বন্ধুদের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যেত। কিন্তু কেউ যায়নি, কাউকে দেখাও যায়নি।

শহরে ভীষণ চাঞ্চল্য দেখা গিয়েছিল। কিন্তু শ্যামাচরণ কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি, এই সামান্য কল্পনা থেকেই অশোক এরকম একটা সঠিক সংবাদ দিতে পারে। অতএব তার যত সন্দেহ আর অবিশ্বাস এসে পড়েছিল অশোকের ওপরে। নিশ্চয়ই সে কিছু জানে, অথবা তার বিশেষ যোগাযোগ আছে এ ব্যাপারে। শ্যামাচরণ অশোককে অ্যারেস্ট করেনি, তবে শহর ছেড়ে যেতে বারণ করেছিল এবং রীতিমতো চোখে চোখে রেখেছিল।

নিজের জালে, নিজেই জড়িয়ে পড়ায়, অশোককে অতএব, জাল ছাড়াবার চেষ্টা করতে হয়েছিল। আর সেই জাল ছাড়াতে গিয়েই, প্রায় একুশদিন পরে সে আবার শ্যামাচরণকে টেলিফোন করে বলেছিল, শ্রীনিবাসবাবুর ভোরবেলা বেড়াবার সঙ্গী, নরেশ হালদারকে অ্যারেস্ট করুন, বাড়িতে সার্চ করুন, তা হলেই সব জানতে পারবেন।

শ্যামাচরণের মনে হয়েছিল, সমস্ত ব্যাপারটা প্রায় ভোজবাজি। সে বিশ্বাস তো করেইনি, উপরন্তু শহরের একজন প্রাচীন পরিবারের ভদ্রলোক সম্পর্কে এ কথা বলাতে অশোককেই সে হুমকে উঠে যা তা বলেছিল। অশোক নিজের অপরাধ ঢাকবার জন্যই এ সব করেছিল, এই ছিল তার বিশ্বাস। এবং এর প্রমাণ ও কার্যকারণ জানতে চাওয়ায়, অশোক খালি বলেছিল, আপনাকে যা বলছি, আগে তা করুন, তা নইলে কিছুই বলব না। তবে মনে রাখবেন, নরেশ হালদারের বাড়ি যাবার আগে, বাইরে যেন কোনও খবরই জানাজানি না হয়। হালদার এখনও আত্মবিশ্বাসে নিশ্চিন্ত আছে, জানলে সব গোলমাল হয়ে যাবে।

শ্যামাচরণ ধমকে বলেছিল, ইয়ারকি কোরো না। এনকোয়ারির রিপোর্ট বলেছে, খুনের সময়, চার-পাঁচ দিন ধরে হালদার মশাই অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়েছিলেন। বেড়াতেই বেরোননি।

অশোক বলেছিল, সেই খবরটাই তো আমাকে সাহায্য করেছিল। অসুস্থ তিনি ছিলেন না। খুনের দিন বেড়াতে তিনি বেরোননি ঠিকই, তবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। বাড়ির পুরনো বুড়ো চাকরের একটা কথা বোধ হয় মনে রাখেননি, তার মনে হয়েছিল, বাইরে বেরিয়ে শ্রীনিবাস যেন কার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। চাকর ভেবেছিল, বেড়াবার বাবুরাই কেউ হবে। দরজা বন্ধ করার সময় সে কাউকে দেখতে পায়নি। তখনও বেশ অন্ধকার, তা ছাড়া শীত, মনে হচ্ছিল যেন অনেক রাত। শীতের রাত তো। আপনি আর দেরি করবেন না, তাড়াতাড়ি পুলিশ নিয়ে যান। হয়তো রক্তমাখা জামাকাপড়সহ, অস্ত্রটাও পেয়ে যেতে পারেন। অপেশাদার খুনি তো, ভুলচুক অনেক থাকবে।

শেষ পর্যন্ত অশোকের কথাই সত্য হয়েছিল। রক্তমাখা জামাকাপড় পাওয়া গিয়েছিল, হালদারদের ঠাকুরঘরে। অস্ত্রটা পাওয়া যায়নি। জামাকাপড়গুলো নরেশ হালদারেরই। রক্ত পরীক্ষা করেও, শ্রীনিবাসের গ্রুপ মিলেছিল।

পরে, শ্যামাচরণের অবাক প্রশ্নের জবাবে অশোক জানিয়েছিল, তার প্রথম খটকা লাগে, হালদারকে ভোরে অনুপস্থিত থাকতে দেখে, এবং পরে জানতে পারে, সে শয্যাশায়ী নয়, একটু নাকি প্রেশার বেড়েছে, তাই বেড়াতে আসছিল না কয়েকদিন। তারপরে খবর নিয়ে জেনেছিল, হাজার চল্লিশ টাকা গোপন ঋণ ছিল হালদারের, শ্রীনিবাসের কাছে। অনেকদিনের ঋণ, শোধ হবার আশা ছিল না। তার সুযোগ নিয়ে, শ্রীনিবাস হালদারের বাড়িতে রোজ যেত না শুধু, তার বিবাহযোগ্যা মেয়েকে নিয়ে, আজ এখানে কাল সেখানে বেড়াতে যাবার বায়না করত। শ্রীনিবাসের ব্যবহারটা ঠিক, শ্রীনবীন খুড়োর মতো ছিল না। শেষপর্যন্ত একটা খারাপ প্রস্তাব দিতেও শ্রীনিবাস দ্বিধাবোধ করেননি।

গোপন ঋণের জ্বালা, পারিবারিক সম্মানই ছিল, শ্রীনিবাসকে সুপরিকল্পিত খুন করার কারণ। হালদার অন্য রাস্তা দিয়ে, প্রায় মাঝরাত্রেই শ্রীনিবাসের বাড়ির সামনে অন্ধকারে লুকিয়েছিল। বুড়ো চাকর যে কথা শুনতে পেয়েছিল, সেটা নরেশ হালদারের সঙ্গেই। শীতের ভোররাত্রে চাকরটা যদি ঘরের মধ্যে কাঁথা মুড়ি দিয়ে না শুত, তবে প্রথম আঘাতের আর্তনাদটা হয়তো শুনতে পেত।

শ্রীনিবাসের খুন রহস্যের ব্যাপারে অশোকের বিষয়, শ্যামাচরণ কাউকেই বলেনি। অশোকও তা চায়নি। শ্যামাচরণের খুবই সুনাম হয়েছিল এই মামলায়। এবং আরও, দু তিনটি ক্ষেত্রে শ্যামাচরণ অশোকের দ্বারস্থ হয়েছে। অশোক যতটুকু পেরেছে, বলেছে। কিন্তু শ্যামাচরণের অবিশ্বাসটা ঠিকই আছে। অশোক যেন তার দু চক্ষের বিষ। তার কারণ, অশোককে সে ঈর্ষা না করে পারে না। সে অশোককে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বী বলে চিন্তা করে। অথচ তার বুদ্ধি ধার করতে চায়।

তা ছাড়া, অশোক যেহেতু বেকার, সারাদিন রকে আড্ডা মারে, বয়স অল্প, সেই হেতু ও ছেলেটাকে সে কিছুতেই, চিন্তাশীল বুদ্ধিমান বলে মূল্য দিতে পারে না। বরং হেয় করবারই চেষ্টা করে। কখনওই তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না, এবং শ্যামাচরণের ধারণা, কোনও না কোনও একদিন অশোক ধরা পড়বেই। কারণ ওর ভিতরে নিশ্চয়ই অপরাধবোধের প্রবণতা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *