১. তোকে যা-দেখাবে না

 মহড়া – উপন্যাস – বুদ্ধদেব গুহ

তোকে যা-দেখাবে না রুন! দুর্দান্ত! আসল দিনে।

বিশু বলল।

দেখাবে নাইই-বা কেন? আমার চেহারাখানা কী খারাপ?

বলেই, হেসে ফেলল রুন। নিজের-ই প্রতি, ঠাট্টায়।

চেহারাটাই বড়কথা নয়। স্টেজে যখন উঠবি, সুপ্রতীপ আলো ফেলে স্টেজটাকে একেবারে স্বপ্নময়, জীবন্ত করে দেবে, নবাব বাজবাহাদুর-এর মেকআপ নিয়ে তোর চেহারাই বদলে যাবে তখন। মনে হবে, তুই যেন সত্যিই নবাব।

কী জানি!

রুন বলল। হয়তো তাই-ই হবে। পোশাকটাও তো কম কথা নয়! মানুষ যখন যেমন পোশাক পরে, তখন মনও বোধ হয় তার তেমন-ই হয়ে যায়। ভিখারির পোশাকে ভিখারি; নবাবের পোশাকে নবাব।

ডিরেক্টর বোকাদা চেঁচিয়ে উঠলঃ এই। বড় কথা হচ্ছে। এই বিশু! রুন!

ওরা নিজেরা নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে অন্যকে চুপ করতে বলল। চা-খাওয়া মাটির কুলহার দুটো ঘরের কোণের ঝুড়িটার মধ্যে ফেলে দিল। সিগারেট ধরাল একটা করে। বড়োলোকের একমাত্র ছেলে বিশু ‘গোল্ড ফ্লেক’। রুন ‘চার্মস’। সিগারেটে বড়ো একটা টান লাগিয়ে ধুয়োর রিং বানিয়ে ঘাড় পেছনে করে শূন্যে ছুঁড়ে দিল রিংটা রুন!

মানুষের নামের সঙ্গে চেহারার বা ক্রিয়াকলাপের কিছুই মিল থাকে না হয়তো। স্বপন যার নাম তার মতো প্র্যাকটিকাল, লেগে-থাকা মানুষ হয়তো খুব কমই দেখা যায়। আর বিনয় যার নাম, তার মতো দুর্বিনীত হয়-ই না হয়তো। এবং বোকাদার মতো চালাকও। বুঝলি?

বিশু বলল, সিগারেটের ছাই ঝেড়ে। হাঁসীর মতো গ্রীবা তুলে মুখটি পনেরো ডিগ্রি ডান দিকে ঘুরিয়ে তখন মার রূপমতীর ডায়ালগ বলছিল রীতি।

রীতিকে ভারি সুন্দর দেখায়। সুন্দরীর নানারকম আছে। রীতি অন্যরকম সুন্দরী। যখন ডায়ালগ বলে না তখনও, ওকে দারুণ দেখায়। দীপ্তবুদ্ধির দ্যুতি সবসময়ে কোনো অদৃশ্য হাত যেন, মাখিয়ে রাখে তার ডিমের মতো মুখটিতে। মালোয়াঁর নবাব বাজবাহাদুরের সখী, রূপমতীর ভূমিকায় অভিনয় করছে ও!

স্টার্ট! সাইলেন্স! সাইলেন্স!

বোকাদা বলল।

আরম্ভ হল মহড়া আবার।

এই দৃশ্যে রূপমতী, মানে রীতি, গোপনে তার প্রেমপ্রার্থী, মাণ্ডুর নবাবের সেনাপতি একরাম খাঁকে বলছে, সেনাপতি, আপনি সারাজীবন রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করলেন তো অনেক-ই। অনেক যুদ্ধ জিতলেনও। হারালেনও কম নয়। কিন্তু নিজের সঙ্গে যে-যুদ্ধ, তাতে জেতার কথা কি ভেবেছেন কখনো? সেই যুদ্ধর কথা, আদৌ কি জানা আছে আপনার সেনাপতি?’

গোপেন, সেনাপতি একরাম খাঁর চরিত্রে অভিনয় করছে। গলাটা নাকি নাকি’। গতবছর ওকে নিয়ে দারুণ কেলো হয়েছিল। ব্যঞ্জন বর্ণ ‘র’ ‘প’ উচ্চারণ করতে গেলেই ওর জিভ স্লিপ করে যাচ্ছিল বার বার। ঘাট-কেটে-যাওয়া সেভেন্টি–এইট আর–পি–এম’ রেকর্ডের মতো। গতবছরে ‘বাল্মিকী প্রতিভা করার সময়ে একজন ব্যাধের রোল করেছিল ও। দেখ দেখ দুটো পাখি বসেছে গাছে’ এই কথা ক-টিই শুধু বলতে হত। কিন্তু যতবারই বলতে যেত, বলতে যেতেই ‘পাখি’ শব্দটাতে এসেই পপ-প-প, করে পাখির মতো ফরফর করত গোপেন। মুখ দিয়ে লাল গড়াত তখন ওর। এদিকে পার্টও ছেড়ে দেবে না কাউকে। ওর এককালীন গার্লফ্রেণ্ড পরি বলেছিল যে, ওর দ্বারা কিসসু হবে না।‘

কেসটা আসলে তোতলামির নয়। বোকাদা বলেছিল। পুরোপুরিই মেন্টাল কেস। মানসিক কমপ্লিকেশনের।

হতেও বা পারে। পিম্পল ঝারির ‘পরি’ নামের, সেই ছিপছিপে কালো মেয়েটাকে গোপেন সত্যিই ভালোবাসত। সে ডিচ করার পর থেকেই পরির ‘প’-তে এসেই আটকে গেছিল ও। জীবনে কখনো তোতলামি ছিল না ওর আগে। মঞ্জরি নামের এক নতুন গার্লফ্রেণ্ড এই বছরে হওয়ার পর থেকেই ‘প’ থেকে ‘ম’ অবধি স্মৃদলি বলছে। তবে, মাঝে মাঝে ‘প’-তে এখনও আটকায়। পুরোনো প্রেমের পেতনি ঘাড় থেকে নামেনি এখনও। সেনাপতি একরাম খাঁ, ওরফে গোপেন; বলল, বাই রূপমতী, নিজের যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি। এই নীরব অদৃশ্য এবং অন্তর্জগতের যুদ্ধে হার বা জিত কোনোটাই বড়োকথা নয়। নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধ চালিয়ে না গেলে যেকোনো মানুষের-ই অবস্থা হয়, মরচে পড়া তরোয়ালের-ই মতো। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই এই লড়াই চালিয়ে যেতে চাই। চালাব, যতক্ষণ জ্ঞান থাকে; আমৃত্যু। থামাতে চাই না কখনোই।

রূপমতী–অতিউত্তম। কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধেও তো হার-জিত থাকার কথা। পরিণামহীন যুদ্ধের কথা তো শুনিনি কখনো।

রূপমতী রীতি বলল, ভুরু তুলে, চোখ নামিয়ে।

একরাম খাঁ-সার্থকতা কিছু থাক আর নাই-ই থাক, যে, এই যুদ্ধে লিপ্ত নয়, সে, বোধ হয় মানুষ’ বলতে যা বোঝায়; তাই-ই হয়ে ওঠেনি।

রূপমতী-বাঃ। শুনে, খুব-ই খুশি হলাম সেনাপতি যে, আপনি নিজে অন্তত নিজেকে মানুষ বলে মনে করেন। যুদ্ধ করার চেয়ে কথাতেই আপনি বোধ হয় বেশি দড়। নইলে রানি দুর্গাবতীর সঙ্গে যুদ্ধে আপনাদের-ই অসীম সাহসের কারণে সুলতান বাজবাহাদুর সে-যুদ্ধে মান-সম্মান হারিয়ে আসতেন না, এমন করে।

রুন, রীতির মুখে চেয়েছিল মুগ্ধদৃষ্টিতে। যখন-ই ও ভুরু তুলে চোখ নাচিয়ে কথা বলে তখন-ই রুনের খুব ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে রীতির দুই বুকের মধ্যিখানের কাঁঠালি চাঁপার গন্ধকে শুষে নেয় নাক ভরে। গন্ধটা কীরকম যে, সে-সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই ওর। কল্পনায়, কাঁঠালিচাঁপার মতো হবে ভেবেই সুখী থাকে। কিন্তু…

একজন আধুনিক, শিক্ষিত ছেলের এই তো দোষ! তার আধুনিকতা–ভাবাবেগকে, স্বতঃস্ফূর্ততাকে চেপে রাখতে, এমনকী গলা টিপে মেরে ফেলতে পর্যন্ত শিখিয়েছে। নিজেকে কী অমন করে ছোটো করা যায়? কাউকে কি বলা যায়, আমি তোমাকে ভালোবাসি’? ইডিয়ট বা হাফ-উইটদের পক্ষেই অমন বলা সম্ভব।

নাঃ, শুধু কষ্ট, শুধুই…মিছিমিছি…

রীতির দিদি, গীতির বিয়ে হয়েছে এই ছোট্ট সাব-ডিভিশনাল শহরের এস-ডি-পি-ও সীতেশ সেনের সঙ্গে। রীতি ও গীতির দিদি, নীতির স্বামী এখন পাটনায় মস্ত উকিল। বনেদি পরিবারের ছেলে। রোজগারও প্রচুর। কে জানে? রীতিও শেষপর্যন্ত কোনো ব্যাঙ্ক-অফিসার বা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বা আই. এ. এস. ফাঁসাবে। ওদের পরিবারের মেয়েদের ছেলে-ধরা’র ব্যাপারে খুব-ইনাম-ডাক আছে। অনেক-ই বিবাহযোগ্য ছেলেকে বেদেনিরা যেমন করে সাপ ধরে নাচোরে, তেমন-ই নেড়েচেড়ে তারপর হঠাৎ অন্যদের সম্পূর্ণ অপরিচিতি একজনের গলা ধরে ঝুলে পড়ে। অন্যরা তখন একেবারেই গাধা বনে যায়। এই ঝিরাটোলিতে ওদের বাড়ির প্রত্যেকটি মেয়েই সকলের বিপন্ন-বিস্ময়।

গীতি-রীতির মৃতা মায়ের নামেও এখনও অনেক রসের গল্প আছে। রীতির মায়েরও ‘সুন্দরী’ বলে খুব-ই খ্যাতি ছিল ঝিরাটোলিতে। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়েসে হঠাৎ সেরিব্রাল স্ট্রোকে মারা যান উনি। পঞ্চাশ বছর বয়েসেও ওঁর শরীরের বাঁধন এমন ছিল যে, মনে হত বুঝি ফাস্ট-ইয়ারের ছাত্রী।

রীতির বাবা প্রসূনবাবু পাটনাতে অধ্যাপনা করতেন। ফিজিক্স-এর অধ্যাপক ছিলেন। বই পাগল মানুষ। মাইনাস টেন চোখের পাওয়ার। রিটায়ার করার পর তবুও এখনও সব সময়েই বই-এর মধ্যেই ডুবে থাকেন। মা যতদিন ছিলেন ততদিন, রীতির তাও শাসন ছিল, বাড়িতে একটু। মা তো নেই-ই, তার ওপরে দিদিদের বিয়ের পর ও এখন একেবারেই স্বাধীন হয়ে গেছে। ভয় করে রুন-এর খুব-ই রীতির জন্যে। এ-কারণেই। তবে মনে হয়, রীতির মতো মেয়েরা স্বাধীনতা’কে নির্বিঘ্নে রেখে জীবন উপভোগ করতে জানে। নিজেকে বাঁচাতেও। প্রচন্ড ব্যক্তিত্ব ওর। পড়াশুনোতেও ভালো ছিলো খুব-ই। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল ইংরেজিতে। অথচ এম. এ. পড়ল না ঝিরাটোলিতে বাবাকে একা রেখে পাটনাতে গিয়ে পড়তে হবে বলে।

মেয়ে হয়ে জন্মালে বেশ ভালোই হত। রুন ভাবে মাঝে মাঝেই। ছেলেরা আর মেয়েরা সবাই-ই তো সমান-ই আজকাল। তবুও মেয়ে হয়ে জন্মালে অনেক-ই সুবিধে, অ্যাডভান্টেজ; গীতি বা রীতির মতো মেয়েলিপনাকে যদি কোনো মেয়ে পুরোপুরি কাজে লাগাতে জানে। এখনকার বেশিরভাগ মেয়েই তো মেয়ে নয়। ন্যাকামি, মেয়েলিপনা এসব যে, একমাত্র মেয়েদের-ই মানায় এবং তাতে যে, লজ্জার কিছুই নেই –এই কথাটাই আজকালকার মেয়েরা ভুলে গেছে একেবারে সাজে, পোশাকে, চেহারাতে ওরা পুরুষ হয়ে ওঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। করতে করতে মেয়েলিপনা’ই যে, মেয়েদের বড়ো গুণ তাই-ই ভুলে গেছে। এবং অন্যরা পুরুষ হওয়ার চেষ্টা করছে বলেই গীতি-রীতিরা এমন করে হ্যাঁণ্ডস-ডাউন জিতে যায় ওইসব মেয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতাতে। হরিণীরা বাঘছাল পরলেই কী বাঘ হয়ে উঠতে পারে? মেয়েরা অনেকেই ভাবে যে, পারে। প্রত্যেক পুরুষ-ই মেয়েদের মধ্যে মেয়েলিপনা ও ন্যাকামি স্বাভাবিকভাবেই যে, প্রত্যাশা করে এ-কথাটা বেশির ভাগ মেয়েই মনে রাখেনি।

তবে, রীতির কথাই আলাদা। ও সবসময়ই দোনলা বন্দুক নিয়ে ঘোরে। এক নলে পোরা থাকে প্রাচীন মেয়েলি ন্যাকামির গুলি, যে-গুলি খেয়ে পুরুষমাত্রই নির্ঘাত কুপোকাত। আর অন্য নলে থাকে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতার স্ফেরিক্যাল বুলেট। সেই গুলি খেয়েও পুরুষেরা সবাই হলদে সবুজ ওরাংওটাং ইট-পাটকেল চিৎপটাং।

রীতি যদি সত্যি-ই কোনো পুরুষকে মারতে চায় তবে, সেই পুরুষের বাঁচা প্রায় অসম্ভব-ই।

হঠাৎ-ই বোকাদা বলল, ওক্কে। আজকের মতো রিহার্সাল শেষ।

বোকাদারা দুই-ভাই। তার দাদার নাম চালাক। চালাকদার বয়স প্রায় পঞ্চাশ হল। নাটক যিনি লিখেছেন, সেই তক্ষদার; তক্ষ রায়ের-ই কাছাকাছি বয়েস। নামে চালাক হলে কী হয়, আজ অবধি চালাকির কিছুমাত্র নমুনাও তিনি দেখাতে পারেননি। অথচ বোকাদা বহু চালাককেই, ইনক্লডিং চালাকদা; টুপি পরিয়ে ছেড়ে দিতে পারে। পারিবারিক সম্পত্তিও সাবড়ে দিয়েছে, নিজে চালাকদাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। বাংলা পড়িয়ে বেড়ায় সকাল বিকেল রাজ্যের লোককে। লেখাপড়া তেমন জানে না। কিন্তু বি.এ. এবং ‘ল’-এর ডিগ্রি আছে। লোকে বলে, অন্য লোককে দিয়ে পরীক্ষার খাতা লিখিয়েছিল। সংসারে কিছু অত্যুৎসাহী লোক থাকে যারা, তাদের ঐশ্বরিক উৎসাহ এবং ক্ষমতার জোরেই অন্য অনেক কিছুর ঘাটতি পূর্ণ করে নেয়। বোকাদা হচ্ছে সেই শ্রেণির লোক। প্রত্যেক ক্লাবে বা সংস্থায় বোকাদার মতো লোকেরাই যাত্রাদলের অধিকারীর মতো সমস্ত প্রতিষ্ঠানটিকে ধরে রাখে। বাঙালিদের প্রতি-প্রতিষ্ঠানেই যে, রাজনীতি এবং দুর্নীতি থাকে তার চাবিকাঠি থাকে বোকাদাদেরই হাতে। নিজেরা ভালোমানুষের মতো মুখ করে বসে, অন্যদের ভোটের মাধ্যমে নিঃশব্দে রাজা-উজির মারে। সেই মারামারিতে রক্তপাত হয় না। সততা মরে, ভালোত্ব মরে; গুণ নষ্ট হয়ে যায়। নীজে নিগুণ হওয়া সত্ত্বেও, অনেক মানুষকে এক শামিয়ানার নীচে একত্রিত করার ‘দুর্লভ’ ক্ষমতা দিয়েই এই স্বল্পসংখ্যক মানুষেরাই অনবরত দল-ভাঙা বাঙালিদের কাতর নড়বড়ে প্রতিষ্ঠানগুলিকে জিইয়ে রাখে।

নিজেদের-ই স্বার্থসিদ্ধির জন্যে।

বোকাদা বলল, এই বিশু এদিকে আয়, তোর কিসসু হসসে না। তুই হলি গিয়ে সুলতান। মাঁলোয়ার বাজবাহাদুর। তোর চলা, ফেরা, কথা–সব, সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের ‘আভিজাত্য থাকবে। নবাব বাজবাহাদুরের চরিত্রে তোকে ঠিক একটা গুড়ের হাঁড়িতে-পড়া নেংটি ইঁদুরের মতো মনে হচ্ছে। আরে যুদ্ধে-হারা সুলতান সুলতান-ই! মরা হাতি লাখ টাকা। তা ছাড়া তুই রীতির কাছে এসেই এমন কুঁকড়ে যাচ্ছিস কেন? রীতি কী তোর বউদি? শালা! ও হচ্ছে, তোর ওয়াইফ। বিবাহিতা, কী নয়, তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত নন যদিও। কিন্তু হাজব্যাণ্ড-ওয়াইফের রিলেশান তোদের। পিঠে-ফিঠে হাত দিয়ে কথা বল। শখের থিয়েটার করতে এসে, এইসব পাকুইজিটসও যারা নিতে শেখেনি তাদের আর কী বলব?

রীতি বিব্রতমুখে মুখ ঘুরিয়ে রইল বোকাদার কথাতে।

রুন বলল। সম্পর্ক যদি স্বামী-স্ত্রীরই হয় তাহলে খামোকা পিঠে খামচা-খামচি করবেই বা কেন? রোমান্টিক সম্পর্ক তো! স্বামী-স্ত্রী কি…

বিবাহিতা স্ত্রী! ছোঃ! বিয়ে যখন করবি, তখন বুঝবি। তার সঙ্গে এত রোমান্টিক হওয়ার দরকার-ই নেই। বউয়ের সঙ্গে কারো প্রেম থাকে? এই হাঁদাদের নিয়ে কী যে, করি আমি। রীতির সঙ্গে ডায়ালগ বলার সময়ে সর্বদা মনে করবি, মাছ নিয়ে, কেরোসিন তেল নিয়ে, ছেলের পরীক্ষা, ছোট্টমেয়ের হরলিক্স, এইসব নিয়ে প্রচন্ড টেনশান চলছে তোদের। কাঠ কাঠ কথা বলবি। ডাঁটের মাথায়। তুই হচ্ছিস গিয়ে সুলতান, তোর শালা যাচ্ছে-আসছে কী? যার হারেমভরতি পৃথিবীর সব দেশের মেয়ে, চকচকে জিয়োনো-শিঙির মতো ফরফর করছে সবসময়ে। বিরক্তিতে নাগরা টুকবি মাটিতে। তোর শরীরে আফগানি ব্লাড বইছে। বাজনা তোদের রাবাব। মেজাজে সবসময় রোয়াবি। অবলা রমণীর অবিমিশ্রীকারিতায়…

বোকাদাকে বাক্য সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে, থামিয়ে দিল রুন। বলল অবিমিশ্রীকারিতায় নয়, অবিমৃশ্যকারিতায় বোকাদা। তালব্য শ”। মিশ্রীও নয়। বুঝেছ?

রীতি মুচকি হাসল রুনের দিকে তাকিয়ে একঝলক।

বিশু বলল, এত কঠিন কঠিন শব্দ বলার-ই বা দরকার কী তোমার বিনা কারণে? যে ভাষায় কথা বলা অভ্যেস সেই ভাষাতেই কথা বলতে পারো। আমরা কী তোমাকে বুঝি না? না, জানি না? তুমিও কি তক্ষদার-ই মতো পন্ডিত? এইকথা কি মানাতে চাও নাকি, আমাদের দিয়ে। যদি তাই-ই চাও, তো সে গুড়ে বালি।

ধমকে বোকাদা বলল, দেখ বিশে, বাবা মা আমার নামটাই বোকা দিয়েছিলেন। আসলে তা নই। কথাটার বানান এবং মানে ঠিক-ই জানি। শুধু তাড়াতাড়ি বলতে গিয়েই জিভ জড়িয়ে গেল। তোর টাকাতে প্রোডাকশান হচ্ছে বলে কী তোকে ভয় করতে হবে নাকি?

অপ্রস্তুত হয়ে বিশু বলল, এ আবার কী কথা? বোকার মতো কথা বোলো না বোকাদা। এ-কথা আর একবার উচ্চারণ করলে, আমি আর আসছি না রিহার্সালে। এভরিথিং হ্যাঁজ আ লিমিট।

বিপদ বুঝে, অপমানটা নিজের থুথুর সঙ্গে গিলে ফেলে; বোকাদা বলল, বেশ! ও-কথা না হয় আর বলব না, কিন্তু তুই? তুইও এরকম ভুল করিস না? তুই তোর ডায়ালগ বলবার সময়ে উলটোপালটা বলছিস না? বলছিস না, যে, হানিফ ভীষণ ঝড় আসছে জিগগির জেহাজ মেহলের জরজা জানলা সব বন্ধ করতে বলে দাও।’ কী? বলিসনি?

বিশু হেসে ফেলল। বলল, রাইট। কিন্তু সে তো আমি স্লাইট তোতলা বলে। তাড়াতাড়িতে দরজা, জানলা–’জরজা-জানজা’ হয়ে যায়-ই অনেক সময়ে।

আমারও তাই-ই। এত স্ট্রেইন করতে হলে, তোদের মতো গোরু-গাধাদের নিয়ে, অনেকেই তোতলামি করত। সেটা দোষের নয়। ফর নাথিং আমার পেছনে লাগবি না। এইকথা রইল। মনে থাকে যেন।

তারপর-ই কথা ঘুরিয়ে বোকাদা হাততালি দিল। হঠাৎ।

তিনবার চেঁচিয়ে বলল, অ্যাটেনশান। সক্কলে শোনো। আজ এই অবধিই থাক। এবার থেকে সপ্তাহে কিন্তু তিনদিন করে রিহার্সাল না দিলে চলবে না। নেক্সট দিন তক্ষদা নাটকটিকে মেজে-ঘষে ফাইনাল স্ক্রিপ্ট দেবেন। মাদার-স্ক্রিপ্ট ওঁর কাছে দিয়ে এসেছি। অনেক জায়গা হয়তো একটু-আধটু বদলে যাবে। তবু নাটকের সঙ্গে তোদের পরিচিত করবার জন্যে, রিহার্সাল দেওয়ালাম এই দু-দিন। পুজো এবারে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে। কলকাতা থেকে খুব নামি যাত্রাপার্টি আনছে ইয়াং ক্লাব। তারা যাত্রা করবে একাদশীর দিন। আমাদের শো দ্বাদশীতে। পরের দিন বেঙ্গলি ক্লাব, ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারকে দিয়ে ফাংশান করাচ্ছে। মধ্যিখানে আমরা একেবারে স্যাণ্ডউইচড। ভ্রাতৃ সংঘ’-র মান একদম থাকবে না আমাদের এই নাটক ঝুলে গেলে। তা ছাড়া, পাটনার নাট্যজগতের অনেক মান্যগণ্য লোক। আসবেন এই নাটক দেখতে। তক্ষ রায়ের লেখা নাটক যে, সে-কথা ভুলে গেলে চলবে না। তোরা তোদের নাতিপুতিদের গর্ব করে বলতে পারবি যে, তক্ষ রায়ের লেখা নাটকে অভিনয় করার সুযোগ তোদের জীবনে একবার অন্তত এসেছিল। এ তো আর বটতলার লেখকের লেখা কোনো নাটক নয়। রগরগে বাজার-চলতি বেস্ট সেলার গল্প উপন্যাস লিখে যারা নাম করে তেমন সব কোনো লেখকেরও লেখা নয়। এ-নাটকের প্রেস্টিজ-ই আলাদা।

বোকাদার বক্তৃতা থামাবার জন্যে বিশু বলল, কখন হবে রিহার্সাল? আর কবে কবে, তাই-ই তো বললে না।

সকাল নটা থেকে তো হবেই, যেমন হচ্ছে। রবিবারে। আর মঙ্গল এবং শুক্র সন্ধে সাতটা থেকে। শেষ হতে রোজ-ই রাত হবে। মেয়েরা বাড়িতে বলে আসবে, যেন, চিন্তা না করেন।

এমন একটা প্লে বেছেছ-না, বোকাদা!

গোপেন বলল, বিরক্তির গলায়।

এটা কি নাটক হয়েছে?

যিশু বলল।

ফুঃ।

রীতি কলকলিয়ে বলল, সত্যি! ওর সঙ্গে গলা মেলাল মুন্নী এবং মিনিও।

কী বলিস কী তোরা? ইডিয়টস নাকি? এই নাটকের তোরা বুঝবি কী রে? ব্রেখট, ইবসেন, পিরানদিল্লো, সব ম্লান হয়ে গেছে। নাটকটা খারাপ কী লিখেছে তক্ষদা? লজ্জা হওয়া উচিত তোদের। তা ছাড়া, তক্ষদার সঙ্গে সমস্ত প্রেসের এবং ‘অশনি’ সাপ্তাহিকের যোগাযোগের কথা জানিস না তোরা? নাটক আমাদের যদি ঝুলও হয়, পাটনার সব কাগজে তবুও ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে। ছবি ছাপা হবে। রিপোর্টাররা লিখবে, আহা! কী নাটকীয় গুণসম্পন্ন নাটক! কী অভিনয়! কী সংলাপ! কী গান! বলবে, তক্ষ রায়ের মতো এতবড়ো বহুমুখী-প্রতিভা এই বিহারবাসী বাঙালিদের মধ্যে, এর আগে আর দেখাই যায়নি।

তবে আর ভয় পাচ্ছ কেন? রিহার্সাল দেওয়ার দরকার-ই বা কী?

আরে ভয়টা পাচ্ছি, ঝিরাটোলির মানুষদের-ই জন্যে। তোরা সত্যিই ইডিয়টস। ইয়াং ক্লাবের মেম্বারদের এবং বেঙ্গলি ক্লাবের মেম্বারদের জন্যেও। বাঙালি হয়ে জন্মেছ আর ‘খেয়োখেয়ি’ কাকে বলে জান না? দ্যাখোওনি কি কখনো? বাঙালিই একমাত্র কাকের জাত, যে-কাকেরা নিজেদের মাংস খায়। এ দুই ক্লাবের মেম্বারেরা তো নিজেদের চোখেই দেখবে নাটক। খবরের কাগজ, পত্রিকা, বাজেকেও ভালো বলে চালাতে পারে। কিন্তু যারা এই নাটক দেখবে না, শুধুমাত্র তাদের-ই কাছে। কিন্তু সত্যি তো সত্যিই থাকবে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে। তাই-ই তো এত ভাবনা। নাটকটা তক্ষদা অসাধারণ-ই লিখেছেন। তোরা এখন কী করিস তা নিয়েই ভয় এত আমার। ভালো হলে, সকলের-ই মুখ থাকে। মিথ্যে প্রশংসা পেতে কার-ই বা ইচ্ছে করে বল? ‘বিবেক’ বলে তো ব্যাপার আছে একটা!

আছে বুঝি? তোমারও?

সামু বলল।

বি কেয়ারফুল সামু। বোকাদা বলল।

খবরের কাগজে যাই-ই লেখা হয় তাই-ই তো সত্যর শেষকথা। পেপারে লিখলেই হল। কার সাধ্য তাকে মিথ্যে ভাবে? তবে তুমি যাই-ই বলো, এই নাটকটা বেশ যাত্রা-ঘেঁষা হয়েছে। আধুনিক নাটক বলে মনেই হচ্ছে না। অন্তত এখনও। জানি না, ঘষে-মেজে কী দাঁড় করাবেন তক্ষদা। এখন পর্যন্ত এই নাটকের মধ্যে নাটকীয় কোনো ব্যাপার-ই দেখতে পাচ্ছি না।

রুন বলল, বাজে কথা বলিস না। নাটকের কী বুঝিস রে তোরা? এ-পর্যন্ত তো শুধু একটা সিনের-ই রিহার্সাল হচ্ছে। নাটক যদি, গল্প-উপন্যাসের মতো গড়গড় করে পড়ে যাস তাহলে তার কিছুই বোঝা যায় না। ছাপা বা লেখা নাটক হচ্ছে খড়ের প্রতিমার-ই মতো। মহড়ার আখড়াতে এনে ফেললে তখন-ই সেই খড়ের ওপর মাটি লাগে, রিহার্সালের রং-তুলিতেই তার চোখ-নাক ফোটে। দেখতে দেখতে, সেই নাটক-ই জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভালো করে রিহার্সাল দে, একসঙ্গে যেদিন পুরো নাটকের রিহার্সাল হবে সেদিন-ই পুরো ব্যাপারটা তোরা ভিসুয়ালাইজ করতে পারবি। লেখা নাটক দেখে নাটকের কোনো গুণ বোঝা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কতখানি সময় নেবে, তাও না। গভীরে গেলে বুঝবি, কী হাইলি ই-ই-ই-ই-ন টলেকচু…

রীতি হেসে ফেলল বলল, ইশ। একচুলের জন্যে ‘ইনটেলেকচুয়াল’ হল না বোকাদা।

বোকাদা লজ্জিত মুখ নেড়ে বলল, এইজন্যেই বলে ‘লিটল লার্নিং ইজ ডেনজারাস’। যে নাট্যকার থিম বা পুরোনো মিডিয়ামের মধ্যে দিয়ে নতুন কিছু বলতে বা করতে পারবেন, তিনিই তো আসল নাট্যকার। তক্ষদার কী দোষ? আমার-ই বা কী দোষ? আসলে, তোদের অনেকের-ই পক্ষে এই নাটকের বাইরের সহজ ঢিলেঢালা পাঁচশো বছরের পুরোনো মোড়কের ভেতরে যে, প্রচন্ড ‘আধুনিক’ ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে তা বোঝাই সম্ভব হচ্ছে না। এই নাটক, তোদের দিয়ে করানোও মুশকিল। তবু, চেষ্টা করতে তো হবে। বোকা পাল, পাঁঠাদের অত সহজে ছাড়ে না।

সকলেই চুপ করে রইল। কেউ কেউ কথাটা মনে মনে মানল। কেউ বা মানল না। নিজেকে অন্য কেউ পাঁঠা বললে, সেইকথা মানতে কার-ই বা ইচ্ছে যায়। তার ওপর তাও যদি কোনো দুদে বোকাতে বলে। ওরা অনেকেই বোকা পালকে আড়ালে ‘দুদে বোকা’ বলে ডাকে।

রীতি বলল, হি হ্যাঁজ মেড আ পয়েন্ট।

রুন বলল, সত্যিই! বোকাদা যা-বলল, সেটা ভেবে দেখার। আমরা সত্যিই বিনা কারণে বেশি ফ্লাশ করছি বোধ হয়।

বোকাদা বলল, যা বললাম তা পরে মিলিয়ে নিস। তক্ষদাকে তোরা না চিনলেও আমি চিনি। যে-কাজ সে পারবে না, তা কখনোই হাতে নেয় না। ঠিক আছে। এর পরের দিন রিহার্সাল শুরু হওয়ার আগে এই নাটকের ইন্টারপ্রিটেশন নিয়েও আলোচনা করা যাবে তোদের সঙ্গে। দেখি, তক্ষদা যদি নিজেই তোদের বুঝিয়ে দেন তো খুবই ভালো হয়। এটা খুবই দরকার। তোরা সকলে নিজেরা কী বুঝেছিস না বুঝেছিস ভেবে আসবি। কে জানে, তক্ষদা বেশিক্ষণ থাকতে পারবেন কি না সেদিন। আমার-ই অনুরোধে-না, তিনি এত খাটনির একটা কাজে হাত দিলেন। তোরা কোথায় ওঁকে অ্যাপ্রিশিয়েট করবি, ধন্যবাদ দিবি, তা-না ওঁকে নিয়েই পড়লি। ওঁর কী দরকার ছিল রে? তক্ষ রায়ের কী আরও নামের দরকার ছিল? ধন্য হব আমরাই। যে-নাটক করতে যাচ্ছিস সেই নাটকে নাট্যকার কী বলতে চাইছেন, সেটা সম্বন্ধেই যদি তোদের সন্দেহ থাকে, ব্যাপারটা ভালো করে না বুঝিস; তাহলে তোরা অভিনয় করবি কী করে? অভিনয় বা আবৃত্তি আজকাল আর, পাড়ার মস্তানদের তাস পেটা, বিড়ি ফোঁকা ভাগ্যাবগুদের টাইম কিল করার ক্লাবের সভ্যদের ছেলেখেলা নেই। বুঝেছিস? আজকের নাটক, অ্যাজ এ মিডিয়াম একটা অন্য হাইটে উঠে গেছে। বাংলা নাটককে আমাদের বাঁচাতেই হবে। বাঙালি-ই একদিন পথ দেখিয়েছে সারাভারতকে এই নাটকের ক্ষেত্রেই। আর আজকে তারাই ব্রেখট আর ইবসেন করে মরছিস। ছিঃ ছিঃ।

বাঃ রেঃ, আমরা কোথায় করছি? আমরা তো ‘চলচিত্তচঞ্চরী’ করতে চেয়েছিলাম। নয়তো ‘ফাঁদ।

সত্যি! কী করে বোঝাই তোদের যে, ফার্স্ট হ্যাঁণ্ড ওরিজিন্যাল জিনিস বাজে হলেও সেটা ওরিজিন্যাল-ই! পুরোনো, তা যতই ভালো হোক-না-কেন; তা কখনো নতুনের সঙ্গে তুলনীয় হয়? ভাবতে শেখ। তোরা সব শিক্ষিত ছেলে-মেয়ে, তোরাও যদি এমন বলিস তাহলে সত্যিই দুঃখ হয়। তেণ্ডুলকারের হাবিব তানবীরের নাটক দেখে এসেছে আমাদের প্রদ্যুম্ন, কলকাতা থেকে। ওকে জিজ্ঞেস করিস দেখা হলে। কী অসাধারণ! কী ওরিজিন্যাল।

তক্ষদাকে কোনো রোল দিলে না?

উত্তেজিত-গলা নামিয়ে বোকাদা বলল, রাজি হচ্ছে না। তক্ষদা নিজেই বলেন, আমার যেমন চেহারা, ভিলেইন-এর রোল ছাড়া আর কোনো রোলে মানাবে না আমাকে। এই নাটকে ভিলেইন তত বাদশা আকবরের মোগল সেনাপতি আধম খাঁ। তার চরিত্র যেমন-ই হোক-না-কেন, মোগলাই ফিচার্স তো থাকতেই হবে। এ-জীবনে মঞ্চের আড়ালেই আমার জায়গা। পাদপ্রদীপের সামনে সকলের দাঁড়াবার ভাগ্য হয় না।

কিছুই করবেন না?

না। অভিনয় কোনো ভূমিকাতেই করবেন না। তবে মাণ্ডুর জেহাজ মেহালের চাঁদনি রাতের ম্যায়ফিলের দৃশ্যে হয়তো পুরুষ গায়কের ভূমিকায় একটি গান গেয়ে দেবেন। দেখি। সেই সিনে আলো এত কম থাকবে যে, মেকআপ নেওয়ার পর চেহারাটা যে, কেমন তা আর বোঝাই যাবে না। পুরুষমানুষের চেহারা লম্বা-চওড়া শক্তসমর্থ হলেই হল। মুখ দিয়ে কী হবে? তক্ষদা কি শোনপুরের মেলার সুলক্ষণা গাই?

রীতি বলল, গান নেই কোনো? এই নাটকে?

সৌম্য শুধোল।

ইয়ার্কি মেরো না সৌম্য।

বোকাদা বলল।

নাচ থাকা উচিত ছিল।

আবার নাচ? নাচবে কে? পায়ে ঘুঙুর-পরা আমাদের মোমফুলিওয়ালা? এইসব কথা তক্ষদার কানে গেলে আমার আর সাহিত্যিক হওয়া হবে না। এরপরের বছরে, পূজাসংখ্যার, একবিংশ শতাব্দী’-তে আমার একটা উপন্যাস ছাপা হবে। তক্ষদা সম্পাদককে বলে দেবেন বলেছেন। কথা প্রায় হয়েই আছে একরকম।

আজকাল কী লেখক আর এল. আই. সি-র এজেন্টে কোনো তফাত নেই? এর চেয়ে কম কাঠখড় পুড়িয়েই তো লাখ টাকার পলিসি গছিয়ে এসেছে হাঁদু। এইসব করার পরও কি তোমার লেখকত্ব’ বাঁচিয়ে রাখতে পারবে বোকাদা?

হা! হা! ইন লাইফ, নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস।

লেখা হয়ে গেছে?

রীতি শুধোল।

কব্বে। দু-বছর হয়ে গেল। তক্ষদার সম্পাদকীয় আলমারিতেই তোলা আছে। ছাপাবার সুযোগ-ই দিয়ে দেখুক-না একবার। দেখাব, প্রতিভা কাকে বলে। সুযোগ-ই যদি না পাই তো প্রতিভার কথা লোকে জানবে কী করে? চেপে রেখেছে দুনিয়া। কিন্তু ছেড়ে একবার দিলে, একেবারে ক্যান্টার করে বেরিয়ে যাব।

নাম কী দিয়েছ, তোমার উপন্যাসের? রুন শুধোল।

‘ঘটোৎকচ’।

মিথোলজিকাল?

স্টুপিড! এক্সপেরিমেন্টাল!

কীসের এক্সপেরিমেন্ট?

দেখবি দেখবি, ছাপা হোক।

তারপর-ই কথা ঘুরিয়ে বোকাদা বলল, তক্ষদা নিজে তো আর নাট্যকার নন। আমাদের কলকাতার সব নামিদামি গল্পকার আর ঔপন্যাসিকরা তো আমাদের জন্য দু-একটা নাটক লিখলেই পারতেন। কই? সে এলেম তো কারোর-ই দেখি না? তবু তো, আমি ধরে-করে একটা লেখালাম তক্ষদাকে দিয়ে।

আমি কিন্তু এবার যাচ্ছি বোকাদা।

সিরিয়াস, আলোচনার মধ্যে হঠাৎ-ই রসভঙ্গ করে রুন বলে উঠল।

কেন? এত তাড়া কীসের? ঘোড়ায় কি জিন দিয়ে এসেছ?

একটু হেসে রুন বলল, প্রায় সেরকম-ই। বাবার শরীরটা খারাপ হয়েছে। বাড়ি ফিরতে রোজ-ই দেরি করছি। ঝাড় খাব মায়ের কাছে আজও দেরি হলে।

রুন যাওয়ার কথা বলতেই ওকে, একপাশে ডেকে নিয়ে রীতি বলল; গলা নামিয়ে, অ্যাই! আমি কিন্তু তোর সঙ্গে যাব। নিয়ে যাবি তো? চারছকের মোড়ে কতকগুলো লোক নেশাটেশা করে থাকে। রাত হয়ে গেলে, একা একা চারছক দিয়ে যেতে ভয় করে। কী রে?

চল।

যেন, গভীর অনিচ্ছাতেই ওকে নিয়ে যাবে, এমন একটা ভাব করল রুন।

.

বাইরে বেরিয়েই ওর সাইকেলটা দঙ্গল থেকে টেনে বের করল রুন। বড়ো শিমুল গাছটার গোড়াতে সাইকেলগুলো সব একসঙ্গে হেলান দেওয়ানো ছিল। অনেকেই সাইকেলে আসে। দু-একজনের অবশ্য সাইকেলরিকশা ঠিক করা আছে। বিশেষ করে মেয়েদের। সময়ে এসে নিয়ে যাবে। তাদের আসার সময় এখনও হয়নি। বিশু আসে ওর জিপে। মাহিন্দ্রর জিপ। বোকাদা পাশে উঠে পড়ে। বিশু নিজেই চালায়।

ধাতব শব্দ হল সাইকেলে সাইকেলে ঠোকাঠুকি লেগে। এমন সময় একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। ফিয়াট। সাদা রঙের। গান্ধারীদির কি? না তো! ফিয়াট তো নেই ওঁর।

রুন পেছন দিয়েই বেরিয়ে যাবে। তাই-ই আর সামনের গেটে যাওয়ার গা করল না। গান্ধারীদি যখন ঝিরাটোলিতে থাকেন তখন রিহার্সালে চলে আসেন রিহার্সাল দেখতে। তাঁর গাড়িতে, সঙ্গে শিঙাড়া কী কাটলেট, কী দই-বড়া নিয়ে আসেন। সব-ই আছে গান্ধারীদির জীবনে। অথচ বড়ো একলা উনি। সবসময়েই হাসছেন, কিন্তু মনের মধ্যে কী-এক গভীর দুঃখ মাখামাখি হয়ে থাকে সবসময়ে। রীতির মুখে যেমন, বুদ্ধিমেশানো সৌন্দর্য, গান্ধারীদির মুখে দুঃখমেশানো। পাটনা থেকে গাড়ি করেই আসেন উনি এখানে। বছরে আট-দশবার আসেন। বিরাট বড়োলোকের একমাত্র মেয়ে। বিরাট ভদ্রলোকের বউও। ছেলে-মেয়েও নেই। মাসিমা এখানেই থাকেন। তাই-ই আসেন মাসিমাকে দেখতে। এখন পক্ষাঘাতে একেবারেই শয্যাশায়ী। গান্ধারীদি কিন্তু খুব ভালো অভিনয় করতেন। ঝিরাটোলির সব মানুষ এখনও সে কথা বলেন। পড়াশুনো গান-বাজনা সবেতেই দারুণ ছিলেন। বিয়ের পর কিছুই করেন না আর। ধার না দিলে, গুণেও বোধ হয় ‘মরচে পড়ে যায়। গান্ধারীদির চেহারাটা ভালো। কিন্তু ফিগারটা দারুণ। ছেলেরা বলে, সেক্সি। মেয়েরা বলে, ঢঙি। কিন্তু অসাধারণ সুন্দরী যে, এ কথা সকলেই স্বীকার করে।

সাইকেলটা সেই জমায়েত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, ঠেলে ঠেলে সেটাকে পেছনের গেটের কাছে নিয়ে এল রুন।

ফিয়াট গাড়ির পেছনের দরজা খুলে দিল ড্রাইভার।

আজ সত্যিই তাড়া আছে ওর। মুখ ফিরিয়ে আর দেখারও সময় নেই।

রীতিও ততক্ষণে পেছনের গেটের কাছে পৌঁছে গেছে।

রুন বলল, আয়; ওঠ। বলল, যেন, খুব বিরক্তির সঙ্গেই।

রীতি এসে সাইকেলের সামনের রড-এ বসল। সাইকেলটাতে ক্যারিয়ার নেই। ইচ্ছে করেই রাখেনি। পাছে ক্যারি করতে হয় একে-ওকে। ওর দু-টি পা-ই বাঁ-দিকে ঝুলিয়ে দিয়ে বসল রীতি। হ্যাঁণ্ডেলের মাঝখানে হাত দু-টি রেখে। রুনের নাকে রীতির চুলের গন্ধ এল। নাম-না-জানা কোনো ফুলের গন্ধের-ই মতো। ভালো লাগল খুব।

রুন বলল, দেখিস! শাড়ি আবার চেনে লেগে ছিঁড়ে না-যায়। তুই তো আবার পা দোলাস রডে বসে বসে। দস্যি মেয়ে আর কাকে বলে?

চুপ কর। ধমক দিল রীতি।

একটা মেরুন-রঙা শাড়ি পড়েছে। চাঁদের আলোয় কালো রঙের বলে মনে হচ্ছে সেটাকে। ছোটোহাতার সাদা ব্লাউজ। খাটো। নাভির কাছটা খোলা। নাভির নীচে শাড়ি পরে ও। ঝিরাটোলির মেয়েদের মধ্যে নাভি দেখাবার সাহস আর কারোরই নেই রীতির ছাড়া। এ তো আর কলকাতা নয়!

যখন-ই রীতির পেট থেকে শাড়ি সরে যায় তখন-ই রীতির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু হাতে কোমর জড়িয়ে ওর নূপুরের মতো নাভিতে চুমু খেতে ইচ্ছে করে রুনের। নাভির কিছুটা নীচেই যে, মসৃণ রোমশ কাঠবিড়ালিটির বাস, তার গায়ে আদরে হাত বোলাতে ইচ্ছে করে। কী পাউডার, কী সেন্ট মাখে রীতি; জানে না রুন। রুনের মা ও দিদি চিরদিনই ‘কিউটিকুরা’ পাউডার মেখে এসেছেন। আর, ক্যালকাটা কেমিক্যালের কী যেন, একটা সেন্ট। নামটা মনে করতে পারছে না। কোনো মেয়ের গায়ে অন্যরকম গন্ধ পেলেই নতুন নতুন লাগে। ওর মা আর দিদিও যে, নারীজাতির অন্তর্ভুক্ত এবং তার দিদির গায়ের গন্ধও যে সুবীরদা, মানে ওর জামাইবাবুর কাছে প্রাণঘাতী, এই খবর রুনের কাছে অজানাই। নতুন সবকিছুতেই সব মানুষের-ই ঔৎসুক্য। নতুন মানেই অজানা। নতুন মানেই অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ। নতুন মুখ, নতুন শব্দ, নতুন ঘ্রাণ এবং সঙ্গও। তাই…

পিচরাস্তা ছেড়ে কাঁচারাস্তায় পড়ল রুন। প্যাডল করা থামিয়ে ঢালু-কাঁকরের পথটা জোরে ‘কির কির’ করে নেমে গিয়ে সমতলে পড়ে বলল, তোর জামাইবাবু সীতেশদাকে বলে দিসনা কেন, একদিন যে, চারছকের মোড়ে মাতালগুলো ঝামেলা করে?

বলি না…

রীতি বলল দ্বিধাগ্রস্ত গলায়।

কেন? বলিস না কেন?

বলি না, এমনিই…

কেন? এস. ডি. পি. ও-র শালিকে কার্নিক মারে, এমন মাতালদের হাড্ডি তো আস্ত থাকার কথা নয়, কোনো সাবডিভিশনাল টাউনে? বলিস নাই-ই বা কেন?

আমি আমার নিজের সব সমস্যা নিজের হাতে, নিজেই সমাধান করতে ভালোবাসি।

বাঃ ঘরে ঘরে এমন মেয়ে হোক।

না রে রুন। সত্যিই বলছি। তা ছাড়া, জানিস; বলার অসুবিধাও আছে। মানে, কী যে, বলব…

কীসের অসুবিধে? সে কী রে?

অবাক হওয়া গলায় শুধোল রুন।

মানে, আজকাল কী হয়েছে জানিস? কারো কাছ থেকে একটু ফেভার নিলেই বদলে একটু ফেভার দিতেও হয়। চারছকের মোড়ের মাতালদের টিটকিরির হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে যদি, আবার অন্য কোনো বিপদে গিয়ে পড়ি? এইসব ভেবেই…

বলিস কী রে? সীতেশদার কথা বলছিস তুই? উনি না, তোর নিজের জামাইবাবু?

রীতি হাসল, ফিক করে।

বলল, হ্যাঁ। আমিও তো ওর নিজের-ই শালি।

তাহলে?

হলে কী হয়? তোদের-ই তো জাত! পুরুষমানুষ-ই তো রে। তা ছাড়া, স্ত্রীর সঙ্গে মানুষের যে-সম্পর্ক, সেই সম্পর্ক শালির সঙ্গে হওয়া তো সবচেয়ে সহজ। ক্লোজেস্ট টু ওয়াইফ। সীতেশদা তো আর একসেপশান নয়। তোরা, এই দেশের পুরুষরা যে, কোন ইডিয়টিক রোমান্টিক অথবা সেক্স-স্টার্ভড জগতে বাস করিস এই স্যাটেলাইট আর কম্পিউটারের যুগেও; সত্যিই তা ভাবা যায় না। অবশ্য সকলেই যে, ফেভার করলে ফেভার চাইবেই বদলে, এমন কোনো কথা নেই। তবে জানিস তো, শালি-জামাইবাবুর সম্পর্ক বলে ব্যাপার! আমার দিক দিয়েও আধখানা হ্যাঁ’ তো করেই আছি। তার ওপরে কি পারব সামলাতে নিজেকে, বাঁশি শুনলে? বল?

তুই বড়ো ফালতু কথা বলিস রীতি। নিজের জামাইবাবুর সম্পর্কে এইরকম বলা ঠিক নয়।

নিজের জামাইবাবু সম্বন্ধে তো বলিনি। জামাইবাবু ইন জেনারেল সম্বন্ধে বলেছি। আজকের পৃথিবীতে সবাই-ই বদলে চায়-ই রে কিছু-না-কিছু। সব সম্পর্কই এখন ‘গিভ অ্যাণ্ড টেক’ এর হয়ে গেছে। শুধু দেওয়া বা পাওয়ার দিন কবে যে, শেষ হয়ে গেল! ভাবলেও খারাপ লাগে। কী সুন্দর ছিল সেইসব দিন। নারে! একদিন তো ছিলই। তেমন বড়োকিছু নয়। তবুও পাঁচনয়াও কে ছেড়ে দেয় বল? এই দেখ-না, যেমন তুই-ই! যেই এগিয়ে দিতে, রিকোয়েস্ট করলাম তোকে, সঙ্গে সঙ্গে কেমন ঘোরাপথ ধরলি। তোর ধান্দা কী বুঝি না আমি? আমার চুলে নাক ডুবিয়ে বেশ উড়তে উড়তে যাবি নির্জন-পথে। বল? এই পথে বাড়িতে পৌঁছোতে পনেরো মিনিট বেশি তো লাগবেই কমসে কম। এই পনেরো মিনিট-ই তোর লাভ। তোর সামনে, তোর সাইকেলের রডে বসে থাকলে, তোর বুক আমার পিঠের সঙ্গে লাগিয়ে, তোর সুখ একটু বাড়বে না? কী রে? বাড়বে কি না, তা তো তুই জানিস-ই বল? বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার জন্যে, এই পনেরোটা মিনিট বেশি তুই নিলি কি না আমার কাছ থেকে? বদলে? এই রাস্তায় আলো নেই। তার ওপর পদ্মবিল পড়বে পথের বাঁ-দিকে। ডানদিকে গভীর শালবন। সাপখোপ। চাঁদের আলো। সঙ্গী কে? না, রুন। একেবারে সোনায় সোহাগা। বিপদ কী আর আমার একটা? যাইহোক, এমন চাঁদের আলোয় মরি যদি, সেও ভালো। কী বল?

রুন অস্ফুটে কী একটা বলল। শোনা গেল না।

কী রে! কথা বল। এরকম গম্ভীর হয়ে থাকলে ভালো লাগে না আমার।

বেশ তো তুই! যখন পিচের রাস্তাটা ছাড়লাম তখন এইসব তো বললি না। তোর মতো বাজে মেয়ে দেখিনি আমি। কী ভাবিস তুই আমাকে?

রাগ রাগ গলায় রুন বলল।

তুই যা তাই-ই! যা আমি ভাবি, ঠিক-ই ভাবি।

আমি সকলের মতো নয়। বরং তুই-ই অন্যরকম। সব মেয়েই বাজে।

স্বগতোক্তির মতো বলল রুন।

রীতি ফুলে ফুলে হেসে উঠল। কিন্তু সামান্য শব্দ করে। বলল, বাঃ রে! যখন-ই তোকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, তখন-ই তো জানতাম-ই যে, তুই এই-ই করবি। তোকে আমি চিনি না? শুধু তুই কেন? যাকেই বলতাম, সেই-ই এ-পথ ধরত। কিন্তু তবু যেহেতু, তুই সকলের মতো নোস তাই-ই তোকে আমি। তোকে আর কেউ না চিনুক, আমি চিনি।

আমাকে চিনিস? তুই আমাকে খুব-ই চিনিস দেখছি।

বিরক্তি ও অভিমানের গলায় বলল রুন।

পুরো কী আর চিনি? পুরো কে-ই বা কাকে চেনে বল? তুই কি নিজেকেই চিনিস?

রুন বলল, বেশি ডায়ালগ ঝাড়িস না। বলেই, প্যাডেল করা বন্ধ করে দিল ও। সাইকেলটা আবারও ঢালুতে গড়িয়ে যেতে লাগল। স্পোকে হাওয়া লেগে শব্দ উঠতে লাগল। চাকার তলায় সরে-যাওয়া কাঁকর মাটিতে ‘কির কির’ করে ফিসফিসে আওয়াজ হল। ‘পিউকাঁহা’ পাখির ঝাঁকি-দেওয়া ডাকের মধ্যে রীতি হঠাৎ বলে উঠল, আমি জানতাম।

কী জানতিস?

তুই যে, এই পথে আমাকে নিয়ে আসবি সে-কথা জানতাম।

জানতিস-ই যদি, তবে তুই এলি কেন আমার সঙ্গে? কত লোক-ই তো ছিল? তুই। বললেই তো সকলে লাফিয়ে উঠত। বিশুর জিপেও আসতে পারতিস।

ধুস! জিপ মেয়েদের বাহন-ই নয়।

তবে কী? মেয়েদের বাহন সাইকেল? আমাকে আর কোনোদিনও তুই পৌঁছে দিতে বলবি না।

রুন বলল।

রীতি দুষ্টুমির হাসি হেসে বলল, কী যে, বলিস। সকলে আর তুই এক হলি? তোকে না বললে কাকে বলব?

তারপর-ই বলল, সত্যিই রে রুন। তুই এত বোকা না! তুই কিছু বুঝিস না।

যাঃ যাঃ, আমি আবার একটা মানুষ নাকি?

অভিমানের গলায় বলল রুন।

তা অবশ্য ঠিক। মাঝে মাঝে আমারও সেরকম সন্দেহ হয়। সন্দেহ হয় যে, তুই মানুষ-ই নোস। যাকগে, আই. এ. এস. পরীক্ষায় বসবি কবে? এম. এ. পরীক্ষা দিয়ে কী এমনভাবে বাড়ি এসে বোকাদার ডিরেকশানে থ্যাটার করেই দিন যাবে? ওঃ বয়! মেক হে, হোয়াইল দ্যা সান শাইনস। বুঝলি?

জানি না। দাদা যদি কানাডা থেকে না ফেরে আর সংসারে টাকা না পাঠায়, তবে বাবার ব্যবসাই দেখতে হবে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে কোয়ালিফাই করলেও কোথায় পোস্টিং দেবে তার ঠিক তো নেই। এখন কয়েক বছর তো বিহারের বাইরেই থাকতে হবে। বিহারে যখন আনবে তখনও যে, মুজাফরপুর বা পূর্ণিয়া বা হাজারিবাগে পাঠাবে না, তা কে জানে? আমিও চলে গেলে বাবা-মাকে দেখবে কে?

বাঃ। এই তো ভালো ছেলে। মহৎ ছেলে। ঘরে ঘরে এরকম ছেলে হোক। কিন্তু ম্যা-গগা! বাঁশের ব্যবসা। ভাবতেও পারি না। শেষকালে বাঁশের ব্যবসা? ছিঃ তুই…রুন…? ক্লাসের ফাস্ট বয়…। তা ছাড়া…

দেখ রীতি। বেশি ‘ম্যাগো ম্যাগো’ করিস না।

কেন করব না? তোর দাদা কি বাবা-মাকে দেখছেন? কানাডা থেকে বছরে কটা চিঠি দ্যান? আজকালকার বাবা-মায়েদের দেখতে হবে, তাঁদের নিজেদের’-ই। একটা ছোকরা লোক রেখে দিবি। টাকা পাঠাবি। কার্ড পাঠাবি পয়লা বৈশাখে। নিউ-ইয়ার্সে। আর কী করার আছে? ইয়োর লাইফ ইজ ইয়োর লাইফ। ইউ মাস্ট লিভ ইয়োর লাইফ। আগেকার দিনের মতো ম্যাদামারাভাবে জীবন কাটানোর দিন চলে গেছে।

‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’। রুন বলল। ব্যবসা, যেকোনো চাকরির চেয়েই ভালো। তা ছাড়া, ক্লাসে অনেকেই তো ফাস্ট হয়। ‘জীবন’-এ কে কী হয়, সেটাই আসল কথা।

তাই বলে আই. এ. এস, আই. পি. এস-দের চাকরির চেয়েও বাঁশের ব্যবসা ভালো বলছিস? তোর বোধ হয় মাথাটাই গেছে।

নিশ্চয়ই ভালো। ঘুসঘাস যদি না খাই। আর ঘুসঘাস যদি খেতেই হয়, তবে তো পিলাটিলা স্টেশনের টিকিট, চেকারের চাকরি করলেই হয়। রাত জেগে পড়াশুনো করে কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসার হ্যাঁপা পোয়ানোর দরকার কী?

তা অবশ্য ঠিক। রীতি বলল। আজকাল ঘুস না খেয়ে ভদ্রলোকের মতো বাঁচাও যায় না। বাঁচা উচিতও নয়। চোরের ওপর রাগ করে মাটিতেই ভাত খাওয়া হয়, তা না হলে।

আচ্ছা রীতি, তোর সীতেশদা। মানে তোর জামাইবাবু; ঘুসঘাস খায়? না-রে? নইলে ওই তো মাইনে। এত ফুটানি কী করে করে বল তো? না খেলে?

জানিস রুন, আমাদের কলেজের অমিতাদি না; একটা কথা বলতেন প্রায়-ই। বলতেনঃ ‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু বি আ লেডি ডোন্ট ডিসকাস রিলিজন, সেক্স অ্যাণ্ড পলিটিকস।‘ এরসঙ্গে আমারও একটা সংযোজন আছে। সেটা হল, ডোন্ট ডিসকাস ঘুস-ঘাস। ঘেঁটে দিলে, পদ্মফুলেরও বাহার থাকে না। বুঝলি। আর এ তো, আমার সামান্য এস. ডি. পি. ও জামাইবাবু! বেচারি। তা ছাড়া, তোর এত্তসব খবরে দরকার-ই বা কী? তুই বড়োই ইনকুইজিটিভ। মেয়েদের মতো।

তুই কী? তুই তো ছেলেদের-ই মতো চ্যাটাং চটাং কথা বলিস সবসময়ে। মেয়েরা মেয়েদের মতো না-হলে ভালো লাগে?

‘মেয়ে মেয়ে’ করবি না বলছি বোকার মতো? কীসের লেখাপড়া শিখলি তা হলে? এই যুগে ছেলে আর মেয়েতে তফাত কীসে?

সব যুগেই ছিল। নইলে আমাদের না-হলে তোদের চলে না কেন?

ভাবিস তোরা তাই। সিলি। মেল শভিনিস্ট পিগস। ইডিয়টিক–

অন্য কথা বল। রুন বলল।

কী কথা? প্রেমের কথা? গান গাইব? ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে?’

এখন কি বসন্ত? ওটা তো বসন্তের গান। তাও জানিস না?

রাখ-না। চিত্তে যখন-ই সুখ তখন-ই বসন্ত। মন যখন-ই উথাল-পাতাল তখন-ই-তুই আর আমি যখন-ই একসঙ্গে; তখন-ই-।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্যাডল করতে করতে রুন বলল, বসন্ত’র মানে জানিস?

তা আবার জানি না? একবার আসল, আর দু-বার জল-বসন্ত হয়েছিল।

হেসে বলল, রীতি।

এমন ফাজিল না তুই।

অ্যা-ই! দেখ দেখ কী চমৎকার দেখাচ্ছে রে দেখ বাঁ-দিকে পদ্মবিলটাকে চাঁদের আলোতে। আহা! দারুণ! দাঁড়াবি একটু এখানে? অ্যাই রুন!

ব্রেক করে সাইকেলের গতি আস্তে করে পা-দুটি ঠেকাল মাটিতে রুন।

বলল, এখানে বসবি কোথায়? আচ্ছা ডাকসাইটে মেয়ে যা-হোক।

কেন? বিলের পাশেই বসব।

না, না। সাপখোপ থাকতে পারে। বর্ষা সবে শেষ হয়েছে, একদম-ই নয়। অত কাব্যিতে কাজ নেই।

রীতি, সাইকেলের রড থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল। রুনের মুখের দিকে তাকাল চাঁদের আলোয় চোখ তুলে। বলল, সাপখোপ না ছাই। আসলে তোর আমাকেই ভয়। মাসিমা জানলে বলবেন, রুন! ছিঃ ছিঃ রীতির সঙ্গে চাঁদনি রাতে পদ্মবনে? তোমার এতবড়ো অধঃপতন?

রুন কোনো উত্তর দিল না। বলল, এরমধ্যে আমার ভালোমানুষ মাকে একদম টানবি না।

বেশ! কিন্তু তুই কি জানিস পশ্চিমের দেশের ছেলে-মেয়েরা একসঙ্গে দু-জনে মিলে পৃথিবী ঘোরে? একঘরে থাকে।…

এটা তো নিউইয়র্ক বা টোরোন্টো নয়। এটা আমাদের ঝিরাটোলি। একটু ডাউন-টু-আর্থ হ। এই ইংরিজি ম্যাগাজিন আর সিনেমাগুলোই খেল তোদের। ঝিরাটোলির মতো মফসসল শহর থেকে গেছে বলেই তো আমার দাদাটার আদিখ্যেতার শেষ নেই। সাদা মেম দেখে যেন, সাপের পাঁচ-পা দেখেছে। নিজের বাবা-মা-ভাইয়ের কথা আর মনেও পড়ে না।

মন্দ কী! অন্য দেশ, অন্য জীবন; কত্ত স্বাধীনতা। এই ঝিরাটোলির জীবন আবার জীবন নাকি? হুস। তোর দাদাটা বড় কালো। আর তোর চেয়েও ক্যাবলা। নইলে তাকেই বিয়ে করে আমিও চলে যেতাম। আমার মায়ের তো আপত্তি থাকত না। ছেলেবেলা থেকেই অমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। তোর মায়েরও থাকত না, বল রুন? এখন ভাবি, গেলেই হত। তোর দাদার ঘাড়ে চেপে ওখানে একবার পৌঁছে গিয়ে তারপর নিজের পছন্দসই কোনো ব্যাচেলার বা ডিভোর্সিকে পাকড়ে নিতাম। নইলে কারো ঘর-ই ভাঙতাম। যারা ঘর না বাঁচাতে জানে, তাদের ঘর তো ভাঙেই। কী বল? ভাঙা উচিত। কী মেয়ে, আর কী ছেলে। আজকের পৃথিবীতে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী; পার্মানেন্ট নয়। বদলের আর এক নাম-ই তো জীবন।

তা, গেলি না কেন? আমার মা-বাবার তো আপত্তি হত না কোনোই তোকে বড়োছেলের বউ করতে। গেলেই পারতিস।

পারলাম কই? আসল ব্যাপারটা কী জানিস? তোর কথা ভেবেই যাওয়া হল না।

রুন হেসে ফেলল। রীতির কথার ধরনে। হয়তো কথার হাস্যকরতাতেও।

মুখে বলল, ফাজিল।

কিন্তু কথাটা সম্পূর্ণ মিথ্যে জেনেও, মনে মনে খুশি হল খুব-ই।

একটু চুপ করে থেকে রীতি আবার বলল, বুঝেছি। তোর এলেম আমার জানা আছে। নে, চল। হ্যাঁণ্ডেল শক্ত করে ধরে, উঠছি আবার। এবার সোজা বাড়ি চল। তাড়াতাড়ি। মিছিমিছিই ঘোরাপথ ধরতে গেলি।

সাইকেলের প্যাডলে দু-পা দিয়ে চাপ দিতেই গড়িয়ে গেল চাকা সামনে।

রুন বলল, তুই রাগ করলি রীতি? আমার ওপর?

আমি? কোন দুঃখে? তোর-ই বরং নাম লেখা থাকবে ইতিহাসে।

ইতিহাসে? কেন?

অবাক গলায় রুন বলল। পুরুষজাতের কুলাঙ্গার বলে, আর কেন? এমন সুযোগ কোনো পুরুষে ছাড়ে? একটা চুমু পর্যন্ত খেলি না তুই? তুই-না…সত্যি। অন্য যেকোনো ছেলে হলে কত কীই করতে চাইত। এমন নির্জনতা, ইন আ লাইফটাইম। তোর বোধ হয়, শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক নেই। কী রে? যাকগে, তুই যাই-ই বলিস, তোর সঙ্গে আমার কলকাতার ন-জ্যাঠাইমার স্বভাবের কিন্তু খুব ই মিল আছে।

তিনি আবার কে? দেখিনি তো কখনো, তোর…?

তুই আমার কতটুকু-ই বা দেখেছিস?

তোর ন-জ্যাঠাইমার কথা বল। তিনি তো মহিলা।

হ্যাঁ। তাই-ই তো। কিন্তু স্বভাবের খুব মিল তোর সঙ্গে। শুচিবায়ুগ্রস্ত! সবসময়েই সব কিছু ‘গেল গেল’ ভাব। নিয়মিত নীলের উপোস করেন। বাথরুমে গেলেই শাড়ি বদলান। বাথরুমে তো যান, খালি গায়েই গামছা পরে। সে কী দৃশ্য। কেলেঙ্কারি একেবারে। এমন চাঁদনি রাতে পদ্মবিলের পাশে পরপুরুষের সঙ্গে তিনি যদি আসতেন তবে হয়তো তোর-ই মতো বিহেভ করতেন। হুবহু।

আমি তোর ন-জ্যাঠাইমার সঙ্গে চাঁদনি রাতে পদ্মবিলে আসতে যাব কোন দুঃখে। আমার মাথা তো খারাপ হয়নি?

তোর সঙ্গে নাই-ই বা এলেন। ধর আমার সঙ্গেই যদি আসতেন, বলতেন বোস বোস রীতি, যাত্রা, মোটেই শুভ হয়নি। এখন যাওয়া একেবারেই নয়। তারপর-ই ‘গড় গড় করে বলে যেতেনঃ

মঙ্গলে উষা বুধে পা, যথা ইচ্ছা তথা যা।রবি শুরু মঙ্গলের উষা আর সব ফাসাফুসা। ডাকয়ে পাখি না ছাড়ে বাসা,উড়িয়ে বসে খাবে করি আশা।খনা ডেকে বলে সেই সে উষা,উড়ে পাখি খায় না। তখনও কেন যায় না?

কী বলছিস তুই এসব? রুন বলল বিস্ময়ের গলায়।

ন্যাকা! হিন্দুর ছেলে, খনার বচন জানিস না? সাধে কি দেশের আজ এই হাল!

তোর ন-জ্যাঠাইমা তোর সঙ্গে এলে, সত্যিই এইসব বলতেন? এখনও এমন মহিলা আছেন দেশে!

ইয়েস স্যার। ভারতীয় গন্ডার এবং খাণ্ডার রমণী যতই দুষ্প্রাপ্য হোক, কিছু কিছু স্যাম্পেল ঠিক-ই রয়ে যাবে। চিরদিন-ই। তবে শুধুই কি খনার বচন? হয়তো শনির পাঁচালি, সত্যনারায়ণের পাঁচালিও পড়তেন। এইখানে বসেই। ভূত-ডামরতন্ত্র থেকেও কিছু মন্ত্র ঝেড়ে দিতেন হয়তো, পদ্মবনের ভূত তাড়াবার জন্যে।

ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, ওর কথা শুনতে শুনতে মুগ্ধতা পেল রুনকে। ঠিক যে-মুহূর্তটিতে রুন নরম সুন্দর কিছু বলবে ভাবছিল রীতিকে, ঠিক সেই সময়েই রীতি বলে উঠল যাকগে যাক। বাজে কথা। একটা চুমু খাবি তো খা তাড়াতাড়ি। আমার সময় বড়ো কম। বলেই, মুখ বাড়িয়ে দিল রুন-এর দিকে।

ই-ই-ই ইয়ার্কি মারিস না! দেখ…

মুখ সরিয়ে নিয়ে, ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ভালো ছেলে রুন।

তারপর-ই একটু সামলে নিয়ে বলল, পরের বাড়ির মেয়ে, তার ওপর এস. ডি. পি. ওর শালি। চুমু খেয়ে মরি আর কী? চল চল যাই। তোকে নিয়ে এই পথে, আসাই ঠিক হয়নি। তুই কখন যে, কী করিস, তার কোনোই ঠিক-ঠিকানা নেই। তা ছাড়া, চিতি সাপের তো আর এস. ডি. পি, ও-র ভয় নেই। সুন্দরীদের পরোয়াও ওরা করে না। ওরা কী করে জানবে যে, তোর সুন্দর পায়জোরপরা পা দু-খানি কোনো জেলে কী চাষির, কী কাঠুরের পায়ের থেকে একটু আলাদা? যদি বা বুঝতেও পারত যে, তুই মেয়ে, তবুও জানত কী করে যে, তুই অন্য দশটা মেয়ের থেকে অনেক-ই আলাদা?

চিতি সাপের কথা ছাড়। তুই নিজেও কি জানিস?

ঠাট্টার গলায় রীতি বলল।

কী?

অবাক হয়ে বলল। রুন।

যে, আমি অন্য দশটা মেয়ের থেকে আলাদা?

ভাগ। আমি কি তোকে কামড়াতাম নাকি?

সত্যিই! তুই একটা ফাস্ট-ক্লাস ইডিয়ট। মেয়েদের ব্যাপারে অন্তত। পরের বাড়ির মেয়েকে চুমু না খেয়ে, নিজের বাড়ির মেয়েকে চুমু খেতে চায় এমন ছেলে তোর মতো আর দেখিনি। নিজের বাড়ির মেয়েটি কে? মাসিমা ছাড়া আর দ্বিতীয় মহিলা তো নেই বাড়িতে। সহেলি নাকি?

কে সহেলি?

চমকে উঠে বলল রুন। তারপর-ই বলল, কী রুচি! তা ছাড়া ওর নাম ঝারিয়া। ছিঃ।

সরি। তবু নাম, যাইহোক। বেশ তো চেহারাটি। তোর সঙ্গে তাকে বাজারে দেখিনি সেদিন? সহেলির মতো ব্যবহার যে, করে সেই তো সহেলি’।

তোর রুচি বড়ো খারাপ হয়ে গেছে, রীতি।

তা গেছে। নইলে তোর সঙ্গে এই পথে আসি? রিহার্সাল যারাই এসেছিল, তারা সকলে তো বলবেই, তুই আমাকে একেবারে চেটেপুটে খেয়েছিস, এই পথে একা পেয়ে। তারা কি আর বলতে ছাড়বে? তোর জন্যে মিছিমিছি আমার মানও গেল অথচ লাভও হল না কিছুই।

ঠিক এমন সময় পেছনে দ্রুত-আসা সাইকেলের চাকার ‘সর সর’ শব্দ শোনা গেল। তিন চারটে সাইকেল একসঙ্গে আসছে।

কারা রে? রিহার্সালের দল-ই কি?

ভয়ে, লজ্জায় মুখ শুকিয়ে গেল রুন-এর।

না। আহীরদের সাইকেল। বোধ হয় গাড়োয়াড়িতে দুধ বিক্রি করে ফিরে আসছে।

ওরা জোরে প্যাডল করে চলে যেতে যেতে, কৌতূহলে তাকালই শুধু! মুখে কোনো কথাই বলল না।

কলেজের ছেলেরা হলে বিচ্ছিরি আওয়াজ দিত না রে? আজকাল যারা লেখাপড়া শেখে, যারা শিক্ষিত; তারাই সব ছোটোলোক। আর যারা অশিক্ষিত, তারাই ভদ্রলোক। ব্যাপারগুলো কেমন উলটেপালটে গেছে।

রীতি বলল, স্বগতোক্তির মতো।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে রুন জোর প্যাডল করে বড়োরাস্তার দিকে এগোতে লাগল। এবারে আলো দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে শহরের ওপরের আকাশে একটি বৃত্ত আলোর আভাসে আভাসিত দেখা যায়। মনে হয় যেন, হাজার হাজার এমনি আর লাল-নীল দেশলাই জ্বালিয়েছে নীচে কেউ। রাতের বেলায়, বড়ো ছোটো সব শহরকেই দূর থেকে তাদের ওপরের আকাশের বলয়ের রং দেখে চেনা যায়।

রীতি বলল, অনেক ধন্যবাদ। এখানেই নামিয়ে দে। শহরে ঢুকে আর কাজ নেই। কলঙ্ক যা লেগেছে তা অন্ধকারেই ফেলে যাই।

কেন? বড়োরাস্তায় পৌঁছোই, তারপর-ই নাম না হয়।

যা বলছি, তাই-ই কর তো! বেশি বুঝিস তো তুই! আমার সঙ্গে বড়োরাস্তায় তোকে এই সাইকেলে এই পদ্মবিলের পথ থেকে এতরাতে উঠে আসতে দেখলে। তোর বদনাম হয়ে যাবে। বিয়ে হবে না কোনোদিনও! আমার তো বদনাম আছেই। আমার জন্যে তোর চরিত্রটা নষ্ট করবি কেন?

রুন ব্রেক করে সাইকেলটা থামাল।

রীতি লাফিয়ে নেমে পড়ল।

বলল, তুই এখানেই থাক। অন্ধকারে। আমি চলে গেলে তার পাঁচ মিনিট পরে এসে উঠিস রাস্তাতে। ততক্ষণে সিগারেট খেয়েনে একটা। ভেবেছিলাম আমিও খুব একটা। সময় নেই।

ধন্যবাদ। কী করব না করব সে, আমি বুঝব। এখন যা।

যাওয়া নেই রে রুন। আসি! ভালো থাকিস। চরিত্র সবসময়ে এমন-ই অকলঙ্ক রাখিস। ঘরে ঘরে তোর মতো ছেলে হোক। সিরিয়াসলি বলছি। যা তোর দোষ তাই-ই তোর গুণ। সত্যিই রে।

বলেই, রীতি চলে গেল।

পেছন থেকেও রীতিকে দেখতে দারুণ লাগে। ওর হাঁটা, চলা, কথা বলা, চোখ তাকানো, গলার স্বর, রুনকে বড়ো আচ্ছন্ন, অভিভূত করে দেয়। কে জানে? একেই ‘ভালোবাসা’ বলে কি না? ওকে রোজ-ই একবার অন্তত না দেখতে পেলে মন বড়ো খারাপ লাগে। আর দেখা হলে, ওর কাছ থেকে চলে আসতেও ইচ্ছে করে না। জেগে থাকার সময়ে, ঘুমের মধ্যে, ঘুমিয়ে পড়ার আর ঘুম ভাঙার মুহূর্তটিতেও রীতি। রীতিময় জীবন রুন-এর। অথচ মুখ ফুটে একটা কথাও বলতে পারে না। মন যা-কিছুই বলতে চায় মুখ ঠিক তার উলটোটাই বলে।

ভীষণ কষ্টে আছে রুন। কিন্তু রীতি যদি নিজেই না বোঝে, মানে রুনের মনের কথা, রুন কোনোদিন-ই বলতে পারবে না।

বলতে পারবে না মুখ ফুটে যে, আমি তোমাকে…

অনেক-ই রিহার্সাল দিয়েছে। দেয় প্রতিদিন-ই। কী করে কী বলবে রীতিকে কিন্তু বলতে পারে না কিছুতেই। রীতি হয়তো হেসেই গড়িয়ে পড়বে। হয়তো ওর মাথায় মেরে দেবে এক চাঁটিই। ওকে কিছুই বিশ্বাস নেই। ওকে তো বোঝা যায়-ই না, নিজেকেও যে, মেলে ধরবে ওর কাছে তাও হয়ে উঠল না…।

বলতে পারব না মুখ ফুটে যে…

দিন চলে যাচ্ছে একটার পর একটা। সপ্তাহ…মাস…বছরও।

.

তক্ষ রায় ‘চার্মস’ সিগারেটের অবশিষ্টাংশটি অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিল। তারপর-ই তার বুড়ো আঙুল এবং তর্জনীতে যতখানি বিরক্তি ও হতাশা ধরে তার সবটুকু দিয়ে সিগারেটের শেষাংশটিকে টিপে ধরে থেকে দমবন্ধ আগুনের প্রাণকে নিঃশেষ করে দিয়ে, চেয়ারটাতে এলিয়ে দিল নিজেকে। দু-টি হাত মাথার ওপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙল দু-বার। চেয়ারে, সেই সকাল থেকেই বসে আছে। ব্যথা করছে কোমরটা।

জানলা দিয়ে সামনের ঝাঁটি জঙ্গল-ভরা মাঠটি দেখা যাচ্ছে। এই মাঠ কিছুদূর ঢালুতে গড়িয়ে গিয়েই খোয়াইয়ে পৌঁছেছে। তারপর-ই ‘কারো নদীতে গিয়ে মিশে গেছে গাছগাছালির মধ্যে মধ্যে। মাঠ থেকে একঝাঁক শালিকের কিচিরমিচির ডাক উঠে আসছে শুকিয়ে যাওয়া গোবরের গন্ধের সঙ্গে। হাওয়ায় ভেসে নয়; কারণ হাওয়া এখন নেই। নদী থেকে জলের গন্ধ উড়ছে আলতো ডানায়। ছল-মেশানো গ্লাস থেকে রামের গন্ধ যেমন করে ওড়ে। শেষভাদ্রর সকালবেলায় ঝিকমিকে রোদকে তার গাঢ় নীল ডানা দুটি-র চকিত চমকে হেলাফেলায় হঠাৎ-ই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিল মাছরাঙাটি। তারপর-ই হিরের-ই মতো ছিটকে ওঠা জলের অসংখ্য কণাতে ভিবজোরের সাতরঙা রামধনু তুলে সেই তরুণী তার শিশুর জন্যে একটি পুঁচকি রুপোলি পাহাড়ি কুচোমাছ উড়িয়ে নিয়ে গেল ঠোঁটে করে বহুপুরোনো আমগাছটার গভীর কোটরের দিকে; এত রঙিন আলো ছেড়ে, প্রায়ান্ধকার কালো কোটরে, সেখানে তার নরম পালকভরা আত্মজা, পুলক-ভরে মুখ হাঁ করে আছে মাছরাঙার গায়ের গন্ধে ‘ম-ম’-করা কোটরভরা উষ্ণতায়।

‘রূপমতী’ নাটকের সংলাপের নবীকরণে গভীরভাবে ডুবে-থাকা তক্ষ রায়ের ক্লান্ত, অবসন্ন, বিরক্ত একা-মনকে এই প্রভাতি প্রকৃতির ছবিটি হঠাৎ-ই এক অনাবিল আনন্দে ভরে দিল। ভালো লাগল খুব-ই। অথচ এই আনন্দে তার এক্তিয়ার কিছুমাত্রই ছিল না।

আনন্দ, তক্ষ রায়ের এই একাকী জীবনে যে নেই, তা নয়; কিন্তু তার অনেকখানিই আবিলতা মাখা। এমন অনাবিল আনন্দ শুধু গর্ভধারিণী মা আর প্রকৃতি-ই কোনো মানুষকে দিতে পারে। উদাস হয়ে এল ওর চোখের দৃষ্টি। জানলার মধ্যে দিয়ে প্রতিসৃত হয়ে আসা সকালবেলায় আলোছায়ার ছবি আস্তে আস্তে ফেড-আউট করে যেতে লাগল মণি থেকে। আউট-অফ-ফোকাস হয়ে গেল সব।

তক্ষ রায়কে যখন ভাবনাতে পায়, অলস ভাবনায়; তখন এমন-ই হয়।

রীতি আজ আসবে বলেছিল।

কে জানে? আসবে কি? যদি আসে, হয়তো খেয়েদেয়েই আসবে। থাকবে, সারা দুপুরটাই।

বয়েসে, তক্ষ রীতির চেয়ে অনেক-ই বড়। কিন্তু ও বুঝতে পারছে ক্রমশই এই নবীন যুবতী রীতির প্রতি ওর এক তীব্র আসক্তি জন্মে যাচ্ছে। ওকে কেমন এক অসহায়তার বোধ আচ্ছন্ন করে ফেলে যখন-ই রীতি একা থাকে ওর কাছে। এই বোধ, কোনো রোমান্টিক আসক্তির নয়। শারীরিক। পুরোটাই। এবং সেটাই ভীষণ ভয়ের। তক্ষর কাছে।

এক নির্জনে, একা-বাড়িতে একা-পুরুষের শরীরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রুখু, উপপাসি তক্ষকটা যেকোনো মুহূর্তেই যে, ওকে ছোবল দিতে পারে তা যে, রীতি বোঝে না এমনও নয়। খুব-ই বুদ্ধি ধরে ও। মাঝেমাঝেই তক্ষর গোলমাল হয়ে যায় যে, রীতি মেয়েটিকেই ও পছন্দ করে, না তার বুদ্ধিকে!

রীতি আসে। ভয়ডর নেই ওর। রীতি কোনো রীতিনীতির-ই পরোয়া করে না।

তবু এই বেলা না এসে ভালোই করেছে। এই নাটকটা নিয়ে তক্ষ বড়োই কষ্টে আছে। বেশিটাই বিভ্রান্তি এবং সামান্য ভয়েও। অথচ কষ্ট থাকে বলেই, সৃষ্টিশীলতার কাজমাত্ৰতেই এত আনন্দ। টাকা রোজগার করতেও নিশ্চয়ই কষ্ট হয়। অনেক মানুষকেই অনুক্ষণ টাকার পেছনে হাঁসফাঁস করে দৌড়ে বেড়াতে দেখে, তাদের কষ্টর কথাটাও বোঝে তক্ষ। কিন্তু একটি উপন্যাস বা গল্প বা নাটক লেখার যে-কষ্ট, সেটা একেবারেই অন্যরকম কষ্ট। আনন্দময়; অনিকেত কষ্ট; যে-কষ্ট হৃদয়নন্দনবন থেকে উঠে হৃদয়নন্দনবনেই হারিয়ে যায়।

এই কষ্টে ও ক্লিষ্ট থাকে সবসময়েই অথচ ভাবে এই কষ্টটুকু না থাকলে, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার কোনো বিশেষ দাবি কী থাকত আদৌ?

যার মহড়া দিচ্ছে বোকারা তার স্ক্রিপ্টটাই ঘষা-মাজা করে দিচ্ছে ও। মাঁলোয়ার শাসকদের ওপরেই এই নতুন নাটকটির খসড়া করেছিল। বিশেষ করে রূপমতী আর বাজবাহাদুরকেই মুখ্য করে। কিন্তু এই নাটকে পুরোপুরি নতুন কিছু কথাও বলতে চেয়েছিল ও। এ নিছক-ই একটি ঐতিহাসিক নাটক নয়। অবশ্য প্রত্যেক নাটকেই নাট্যকাররাত্রের নতুন কিছু বলতে চান। কিন্তু শেষপর্যন্ত বলতে পেরে ওঠেন কি না এবং যা বলতে চাইছেন তা, দর্শকদের কাছে পৌঁছোচ্ছে কি না সেইটাই প্রশ্ন।

এই ছোট্ট নাটকটির ঘটনাকাল মাত্র চোদ্দো বছরের। পনেরো-শো সাতচল্লিশ থেকে পনেরো-শোএকষট্টি খ্রিস্টাব্দ। পিরিয়ড-কস্টিউমের-ই বা পিরিয়ড-ফার্নিচারের-ই মতো পিরিয়ড ড্রামারও এক বিশেষ ছাপ তক্ষ রায় এই নাটকে ফেলতে চেয়েছিল। এবং এই ঘষা-মাজা করার সময়েও সে-কথা মনে রাখছে।

বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ভূমিকায় দেখেছেন রূপমতীকে। এবং বাজবাহাদুরকেও। রূপমতীর মৃণালভুজে আশ্রয় নেওয়া বাজবাহাদুরকে ঐতিহাসিকেরা কেউই ক্ষমা করেননি। মার অপরূপ সুন্দর এবং প্রায়-দুর্ভেদ্য পৃথিবীবিখ্যাত দুর্গের বিস্তীর্ণ এলাকার সুপ্রাচীন খুরসানি ইমলি বা বাওবাব গাছগুলি এখনও সেইসব কথা এবং স্মৃতি মনে করে রেখেছে। তাদের মসৃণ অতিকায় বুকের গভীর সব গহ্বরে জমিয়ে রেখেছে রূপমতী আর বাজবাহাদুরের প্রণয়গাথা, গান-বাজনা, বর্ষারাতের জেহাজ-মেহালের আলোে-জ্বালা-রূপ। রাবাবের গম্ভীর আওয়াজ আর রূপমতীর গলার গান আজ ইতিহাস-ই হয়ে গেছে। মাঁলোয়ার গ্রামে-গঞ্জে আজও রূপমতী-জবাহাদুরের স্মৃতি লোকগীতি হয়ে বেঁচে আছে সাধারণ মানুষেরও কাছে। স্বয়ং জাঁহাপনা জাহাঙ্গিরও অনেকবছর পরে মার রূপবর্ণনা করে গেছেন তাঁর রোজনামচাতে।

আর্নেস্ট বার্নস-এর ‘ধার অ্যাণ্ড মাণ্ডু’, এল, এম. ক্যাম্পের বিখ্যাত বই ‘দ্যা লেডি অফ দ্য লোটাস’, ফরিস্তার ‘তারিখ-ই-ফরিস্তা’, ডাবলু হেইগের ‘দ্যা কিংডম অফ মালোয়া’, মেজর লুয়ার্ডের ‘ধার অ্যাণ্ড মা’ এবং জি. ইয়াজদানির ‘মা’ পড়ে দেখেছে তক্ষ এই নাটক লেখার আগে ।

পড়ে দেখেছে, কারণ ও বুঝেছে যে, ঐতিহাসিক নাটক লেখা যত সহজ ভেবেছিল, তত সহজ নয়। একটি বিশেষ সময়কে, সেই সময়ের তুচ্ছ এবং মহৎ ঘটনাবলি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুষঙ্গ, আবহাওয়া, নর-নারীর চেহারা, পোশাক, মেজাজ সবকিছুর-ই পটভূমিতে নাটকের মূলবক্তব্য বা প্রতিপাদ্য বিষয়কে নিপুণভাবে প্রতিভাত এবং প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে, নাটক লেখার মানেই হয় না কোনো।

সম্পাদক এবং নিউজ-চিফ-এর নির্দেশে পাতার পর পাতা লিখে যায় যে-হাতে, যে-হাত দিয়ে সব অর্ডারি অর্থহীন লেখালেখি করে, সেই হাতের মধ্যে বোধ হয়, কোনো অদৃশ্য ব্যাটারিই লাগানো আছে। তক্ষ রায়ের সমালোচকেরা অন্তত তাই-ই বলেন। কিন্তু সেই হাতটিকে তো জীবিকার জন্যে বিকিয়েই দিয়েছে ও। ওর সমালোচকেরা যা, জানেন না, তা হচ্ছে, এই-ই যে, তার ডান হাতটির-ই বাইরের অবয়বের মধ্যে একটি, অন্য হাতও লুকোনো আছে। যেবিশেষ হাতে ও কখনোই অর্ডারি লেখা লেখে না। লেখে না, অসুস্থ ‘তোল্লাই’ এবং ‘ফেল্লাই’ সমালোচনাও। সে হাতে ও ভাত মেখে খায় না। এমনকী আত্মরতিতেও লিপ্ত হয় না কোনোদিন। সিগারেটও ধরে না, সে-হাতে। সেই হাতে কোনো উচ্চাশা বা হতাশা লাগে না আজ পর্যন্ত। যে-হাত শুধুমাত্রই অনাবিল আনন্দ গ্রহণ ও বিকীরণের-ই হাত, সেই হাতটি দিয়েই ও মাঝে মাঝে অখ্যাত লিটল ম্যাগাজিনের জন্যে অবিজ্ঞাপিত কোনো ক্কচিৎ ধ্রুপদি উপন্যাস লেখে; অথবা লিখতে চায়। আর এই রূপমতী’ নাটকের-ই মতো কোনো নাটক।

সেই দ্বিতীয় হাতটির কথা, সে নিজে আর প্রথম হাতটি ছাড়া তৃতীয় কেউ-ই কিছুমাত্র জানে না।

তক্ষ রায় ‘রূপমতী’ নাটকের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে যা, প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তা কিন্তু রূপমতী-বাজবাহাদুরের প্রণয়গাথা নয়। তা একেবারেই অন্য। চোদ্দো বছরের ঘটনাকাল অথবা মূলঘটনাগুলিও এই নাটকের মধ্যে আসলে গৌণই করে তুলেছে ও। যা তক্ষ, এ নাটকে দর্শকদের বোঝাতে চাইছে তা হল, কোনো মানুষ-ই খারাপ নয় প্রত্যেক মানুষের-ই একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা ‘পয়েন্ট অফ ভিউ’ আছে। সেটি বুঝতে পারলে, তাকে আর খারাপ বলে মনে হয় না।

এ ছাড়াও ‘বাজবাহাদুরের’ চরিত্রর মধ্যে দিয়ে ও বোঝাতে চেয়েছে, কোনো পুরুষ-ই আসলে কোনো নারীকে কোনোদিনও স্বার্থহীনভাবে ভালোবাসেনি। সেই ধরনের ভালোবাসা, যুগে যুগে শুধুমাত্র মেয়েরাই বেসে এসেছে পুরুষদের। মেয়েরা যা পারে; পুরুষরা তা কোনোদিনও পারেনি।

দিল্লির বাদশা আকবরের পাঠানো সেনাপতির তাড়া খেয়ে বাজবাহাদুর যখন মা ছেড়ে পালিয়ে গেলেন প্রাণ বাঁচানোর জন্যে তখন, রূপমতীকে সঙ্গে নিয়ে যাননি। তাঁর গায়িকা সঙ্গিনী, তাঁর নমসহচরী হিন্দু রূপমতীকে সহজেই ভুলে গেছিলেন তিনি। রূপমতীর দাম যে, কত ছিল তাঁর কাছে তা, এ থেকেই বোঝা যায়।

বাজবাহাদুর একজন পুরুষ-ই তো!

চেয়ার ছেড়ে এবার উঠল ও। বুঝতে পারছে যে, চিন্তা বড়োই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাইরের প্রকৃতি যেদিন এমন শান্ত থাকে, স্নিগ্ধ সুগন্ধি নির্জনতা চারদিকে; কাছেও কেউ-ই নেই, থাকে না, তখন ঠিক সেই সময়েই, তার ভেতরে এমন এলোপাথাড়ি আঁধি বইতে থাকে।

নাটকের ‘প্রতিপাদ্য’ বিষয়ের-ই মতো একজন সৃষ্টিশীল মানুষের চিন্তাও যদি ‘প্রেমাইসলেস’ হয়ে ওঠে অথবা ‘অফ ডুয়াল-প্রেমাইস’, তাহলে নাটকের-ই মতো, চিন্তাও স্বভাবতই ‘কনফিউজড’ হয়ে যায়।

যেকোনো নাটকের-ই ‘থিম’ বা বক্তব্যটাই আসল। নাট্যকারেরা ও নাট্যশাস্ত্রবিদেরা বিভিন্ন নামে চিহ্নিত করেছেন নাটকের এই প্রতিপাদ্যকে। ডাবলু. টি. প্রাইস, ব্ৰাণ্ডার ম্যাথুজ এবং উইলিয়াম আর্চার তিনজন-ই এর নাম দিয়েছেন ‘থিম। হাওয়ার্ড লসন বলেছেন, রুট আইডিয়া’। লাগোস এগরি আবার একেই বলেছেন, প্রেমাইস’। মেলেভিনস্কি বলেছেন, বেসিক ইমোশান। কিন্তু যিনি যে-নামেই ডাকুন-না কেন, সকলেই একবাক্যে মেনে নিয়েছেন যে, আ প্লে উইথ মোর দ্যান ওয়ান প্রেমাইস ইজ নেসেসারিলি কনফিউজড’ । এ কথা তক্ষও ভালো করে জানে। এবং জানে বলেই ‘রূপমতী’ নাটকের মূলপ্রেমাইসটি করেছে। এইরকমঃ পুরুষ, সে রাজাই হোক কী প্ৰজাই হোক, গুণীই হোক কী নিগুণ-ই হোক ভালোবাসার বোঝে না কিছুই। মেয়েরা তাদের চোখে শুধুমাত্রই ভোগ্যপণ্য। রাবার ডল। পুরুষ, নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই ভালোবাসেনি কোনোদিনও।

এই প্রেমাইসটিকেই চোদ্দো বছরের সময়কালে নিবদ্ধ মাণ্ডুর পটভূমিতে মালোয়ার নবাবদের উত্থান, পতন, খুনখারাপি, ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্র-ফাঁস, মৃত্যুদন্ডাদেশ; ভোগ-বিলাস ইত্যাদি অনুষঙ্গর মধ্য দিয়ে দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছে ও।

সাধারণ দর্শক টিকিট কেটে দেখে যাবেন মাণ্ডুর অনিন্দ্যসুন্দর সেট, রূপমতীর রূপের ছটা। সুরেলা গান। বাজবাহাদুরের নবাবি বিলাসের রকমসকম। নাটক দেখে বেরিয়ে তাঁরা উৎফুল্ল মুখে বলবেনঃ ‘পয়সা উসুল’।

কিন্তু অসাধারণ, বাহ্যিক অভিব্যক্তিহীন; মুষ্টিমেয় দর্শক কিছু ভাবতে ভাবতে বাড়ি যাবেন। তাঁদের জন্যই নাটক লেখেন কোনো সিরিয়াস নাট্যকার। যেমন এইরকম মুষ্টিমেয় অসাধারণ পাঠকদের জন্যেই সৃষ্টি করেন সাহিত্য; একজন সৎ সাহিত্যিক।

তক্ষ রায় সেই শ্রেণির আঁতেলদের দলে কোনোদিন-ই পড়তে চাননি, যাঁদের সৃষ্টির অসাধারণত্বর বর্ম সাধারণ পাঠক বা দর্শকদের পক্ষে একেবারেই দুর্ভেদ্য। যাঁদের মানসিকতার কণ্টকাকীর্ণতা সাধারণের অন্বিষ্ট তো নয়ই বরং রীতিমতো অগম্যই। তাই-ই সাধারণ এবং অসাধারণ সবরকম দর্শকের জন্যে দুই-স্তরে ফুটিয়ে তুলতে চায় ‘রূপমতী’ নাটকটিকে তক্ষ।

যাঁর মস্তিক যতটুকু নিতে পারে, ততটুকু নিয়েই ফিরে যাবেন তিনি। কিন্তু খুশি হবেন। সকলেই।

তবেই না নাটক, নাটক হয়ে উঠবে।

‘নাটক’ ব্যাপারটির মধ্যে একধরনের সর্বজনীনতার গন্ধ পায় ও। লেখালেখির ক্কচিৎ ক্ষেত্রে ওর সাহিত্য তবু নাক-উঁচু, সাধারণের কষ্টবোধ্য হলেও বা হতে পারে; কিন্তু নাটক যখন লিখল, তেমন নাটক কখনোই লিখতে চায়নি যা সকলের পক্ষে একসঙ্গে বসে উপভোগ করা সম্ভব নয়। দ্বিস্তর হলেও; নাটক যেন, ছোঁয় সকলকেই, এই বাসনা ছিল।

সত্যিই খুব নার্ভাস লাগছে। নবীকরণের কাজ সবে শেষ হল। এরপর ফেয়ার করবে। তারপর একে মহড়াতে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে। মহড়ার ধোপে না ফেললে কোনো নাটকেই রং পাকা কী কাঁচা তা বোঝা পর্যন্ত যায় না। তার ওপরে বোকার ‘বোকা বোকা উত্তেজনাও থাকবে। ব্যাপারটাকে তালগোল পাকাবার জন্যে যা যথেষ্ট। অনেক-ই কথা বলবে বোকা, নাটক এবং পরিচালনা সম্বন্ধে, যেসবের মানেই হয় না। যেমন ও বলবেই যে, পনেরো দিন রিহার্সালের পর নাটক বদলাবার কি মনে হয়? ইত্যাদি ইত্যাদি…

যাই-ই হোক। যা হবে, তা হবে। ওর নাটক-ই যদি ভ্রাতৃসংঘ করতে চায় তবে এই ‘রূপমতী’ নাটক-ই করতে হবে তাদের। না করলে, অন্য আর কোনো নাটক-ই লিখে দেবে না বোকাদের কোনোদিনও।

এতখানি শক্ত ও পিটপিটে না হলেও চলত এ-ব্যাপারে। কিন্তু তক্ষর ব্যক্তিগত জীবন-ই তাকে, এমন অবুঝ, জেদি এবং একগুঁয়ে করে তুলেছে। জীবনে সে অনেক কিছুই পায়নি। অন্যভাবে বলতে গেলে ওর সমস্ত জীবনটাই ‘সমঝোতা’-রই সংজ্ঞা যেন। অথচ জীবনে শান্তি চেয়ে কেবল যুদ্ধই পেল। তবুও সাদা পতাকা তুলে পিছিয়ে আসতে আসতে এখন একেবারেই দেওয়ালে পিঠ লাগিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। আর একটুও পেছোনোর জায়গা নেই। জীবনের বেশিক্ষেত্রেই হেরে গেল বলেই সামান্য কিছুক্ষেত্রে অন্যর জমির জবরদখল নিয়ে একধরনের ভারসাম্য আনতে চায় তক্ষ ওর জীবনে।

ভেতরে গিয়ে এবারে র‍্যাপারটা নিয়ে এল। ঋতু বদলাচ্ছে। কিশোরীর মতো মেজাজ তার। সমীহ না করলেই নির্ঘাত জ্বর।

কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল। সকালে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়ে ঝকঝকে রোদও উঠেছিল। হাওয়াও ছিল না একটুও। এই সময়ে হাওয়া থাকার কথাও নয়। কিন্তু কিছুক্ষণ হল আবারও মেঘলা করে এসেছে। ঝিরঝিরে হাওয়া দিচ্ছে একটা। ভাদ্র-আশ্বিনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কেউ কলিংবেল টিপছে। দরজা খুলে দেবে কি সে? কাকে?

শরৎ এসে গেল। এসো শরতের অমল মহিমা।

.

বাবা। খেতে এসো। রীতি ডাকল প্রসূনবাবুকে।

আসছি মা।

সাবধানে এসো। রসিয়ার হাত থেকে সরষের তেল পড়ে গেছিল খাবার ঘরের দরজার কাছে। মেঝেটা এখনও পেছল হয়ে আছে।

সারাদিন-ই বইপত্রর মধ্যেই ডুবে থাকেন প্রসুনবাবু। যতদিন অধ্যাপনা করেছিলেন ততদিন যে-বিষয়ে অধ্যাপনা করতেন সেই বিষয়ের মধ্যেই গভীরভাবে ডুবে থাকতেন। যেসব ছাত্ররা তাঁর কাছ থেকে নিতে চাইত কিছু, তাদের যাতে অদেয় কিছুমাত্রই না থাকে; তার-ই আপ্রাণ চেষ্টা করতেন!

অধ্যাপনা আর অন্য জীবিকার মধ্যে যে-তফাত আছে গভীর, তা জেনেশুনেই তিনি অধ্যাপনার জীবন-ই বেছে নিয়েছিলেন। অন্য জীবিকাতে, কে কতটুকু নিংড়ে নিতে পারে জীবিকা থেকে তার-ই ক্রুর এবং নিষ্ঠুর প্রতিযোগিতাতে লিপ্ত হওয়ার আর এক নাম-ই ‘সাফল্য। আর অধ্যাপনাতে অধ্যাপক কত নিঃস্বার্থভাবে একটুও বাকি না রেখে, নিজেকে ‘নিঃস্ব’ করে দিতে পারেন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তাই-ই সাফল্যর সমার্থক। ইনক্রিমেন্ট নয়, পারকুইজিটস নয়, মুনাফা নয়, অর্থের জন্য, স্বাচ্ছল্যর জন্য, ক্ষমতার জন্য যূথবদ্ধ জানোয়ারদের মধ্যে, কে যূথপতি’ হবে, সেই যুদ্ধে পণ করা নয়; এ-জীবিকা, মানুষ গড়ার জীবিকা। সভ্যতার সংস্কৃতির জিগীষার পতাকাকে অসংখ্য উজ্জ্বল চোখের আর উন্মুখ মনের তরুণ-তরুণীদের মনের মধ্যে প্রোথিত করে দেওয়ার-ই জীবিকা।

এইসব নরম রঙের পতাকা দেখা যায় না। হাওয়াতে এই পতাকাগুলি আন্দোলিত হয় না কখনোই। পর্বত চুড়োয় অথবা সুমেরু কুমেরুর তুষারের ওপর গর্বভরে দাঁড়িয়ে রঙিন উইণ্ডচিটার আর সানগ্লাসপরা ফোটোতে কোনো ফোটোগ্রাফার বা ভিডিয়ো ক্যামেরাম্যান-ই তাঁদের দামি ক্যামেরার লেন্সে গেঁথে রাখেন না, সেই দুর্মর কৃতিত্ব। কলেজ ছেড়ে যাওয়ার দশ, বা কুড়ি বা তিরিশ বছর পরেও কোনো রেলগাড়ির কামরাতে, কোনো ধূলিধূসরিত পথে বা বাজারের চিৎকারের মধ্যে হঠাৎ কোনো কৃতী ছাত্র বা ছাত্রী মলিন বেশ-পরা, ছিঁড়ে যাওয়া চটি-পরা, বাহ্যিকভাবে জরাজীর্ণ কোনো একক প্রতিষ্ঠানের মতো প্রসূনবাবুর পায়ে যখন, হাত ছুঁইয়ে প্রণাম করে, শুধোয়; কেমন আছেন স্যার? তখন মাইনাস টেন পাওয়ারের চশমা-পরা প্রসূনবাবু সেই ছাত্র বা ছাত্রীর ভুলে-যাওয়া তরুণ মুখচ্ছবিকে খুঁজতে চেষ্টা করেন শেষযৌবন বা প্রৌঢ়ত্বর আঁচলাগা সামনে দাঁড়ানো মুখটির মধ্যে। মস্তিষ্কের মধ্যে আচম্বিতে ফ্ল্যাশব্যাক ঘটে যায়। অস্ফুটে বলেন, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কে তুমি? সুগত কি? প্রণতি?

না স্যার, আমি ধরণী।

আমি মৈত্রেয়ী স্যার।

জড়িয়ে ধরেন প্রাচীন বটবৃক্ষ তাঁর অলক্ষ্যে বেড়ে-ওঠা পুষ্ট ঝুরিগুলিকে! হাসিমুখে বলেনঃ কেমন আছ? আছ কেমন তোমরা?

কেউ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার। কেউ বা কোনো ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ। কেউ বা ডাকসাইটে ইঞ্জিনিয়ার। কেউ মস্ত বড়োডাক্তার। হাসি ফুটে ওঠে প্রসূনবাবুর মুখে। বলেন, বাঃ বাঃ। তাঁর সমস্ত জীবনের সাধনা এঁদের মধ্যে প্রতিফলিত দেখতে পান।

এই-ই তাঁর পুরস্কার।

‘আপনার জন্যে কি কিছু করতে পারি স্যার?’ কেউ হয়তো বলে!

আমার জন্যে?

অবাক হয়ে মুখ তুলে, চশমার মধ্যে দিয়ে তাকান প্রসূনবাবু!

ওরা কি ওঁর মলিন বেশ আর ধূলিধূসরিত ছেঁড়া চটিটুকুই দেখতে পেল? তাঁর বুকের মধ্যে কী অসীম ধনরত্ন, কত যে, মণিমাণিক্যের ভান্ডার এখনও সজাগ মস্তিষ্কর মণিকোঠায় তা কী অনুভব করতে পারল না? মানুষ কী ধনী বা দরিদ্র শুধুমাত্র অর্থ দিয়েই হয়? ‘অর্থ’ই কি সার্থকতার একমাত্র মাপকাঠি? হয়তো এ-যুগে তাই-ই। প্রসূনবাবুদের যুগে তেমন ছিল না। তখন গুণীরা সম্মান পেতেন। নিগুণ অর্থবানকে তার যথার্থ আসনেই বসাত সমাজ-সংসার। অধ্যাপক জামাতা পেলে শ্বশুর-শাশুড়ির গর্বে পা পড়ত না সেদিন।

দেশ যখন স্বাধীন হল, তখন প্রসূনবাবু প্রথম বর্ষর ছাত্র কলেজের। সেই সময়ে ভারতের বড়োলাট, ইংল্যাণ্ডের রাজা জর্জ দ্যা সিক্সথকে ভারতের স্বাধীনতার ঠিক প্রাক্কালে একটি রিপোর্টে বলেছিলেনঃ উই হ্যাভ ডান দ্যা ওয়ারষ্ট ইন দ্যা ফিল্ড অফ এডুকেশন ইন ইণ্ডিয়া। উই হ্যাভ গিভিন দেম এডুকেশন অফ লেটার্স বাট নট অফ ক্যারেক্টার।

বিদেশি শাসকের মুখপাত্রর লেখা এই কথা ক-টি পড়ে হাসি পেয়েছিল প্রসূনবাবুর। চরিত্র তৈরি হয়ে গেলে তো সেইসব চরিত্রবান মানুষদের প্রজা করে রেখে, শোষণ করতে তাদের ই বড়ো অসুবিধে হত! এবং সে-কারণেই এদেশীয়দের মধ্যে চরিত্র গঠনের কোনো চেষ্টাই ছিল না তাঁদের। প্রসূনবাবু যখন অধ্যাপক হলেন, স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তখন এই-ই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। চরিত্র তৈরি করা, নিছক ভালো ছাত্র-ছাত্রী, তোতাপাখি তৈরি করা নয়।

এই ‘চরিত্র’ শব্দটার প্রতিও প্রসূনবাবুর কোনো মধ্যযুগীয় শুচিবায়ুগ্রস্ততা ছিল না। কোনোদিনও। আজকের আমূল পরিবর্তিত সামাজিক ও অর্থনেতিক অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে প্রাকবিবাহ সহবাসকে তিনি যতখানি-না দূষণীয় মনে করেন, তার চেয়ে অনেক বেশি দূষণীয় মনে করেন যখন লক্ষ করেন অন্যান্য স্থলন। প্রসূনবাবু যখন দেখেন যে, ছাত্র ছাত্রীরা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বাবা-মাকে দেখে না; যখন দেখেন, কোনো স্বাস্থ্যবান ছাত্র ভিড়ের বাসের একটি সিট খালি হতেই, নিজের শারীরিক বলের কারণেই কোনো অশক্ত, বৃদ্ধা বা অবলা অপরিচিতা নারীকে কনুইয়ের গুঁতোয় সরিয়ে দিয়ে, সেই সিটে বসে পড়ছে, তখন-ই তাঁর মনে হয় যে, এরা চরিত্রহীন। চরিত্র’ কথাটার অর্থ, এই আধুনিক যুগে একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেছে। এই বাসযাত্রী ছাত্র, তাঁর চোখে অনেক-ই বেশি চরিত্রহীন। প্রাকবিবাহ সহবাসে দোষী ছাত্র-ছাত্রীদের চেয়ে।

বোসো বাবা।

রীতি চেয়ারটা টেনে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

বসলেন, প্রসূনবাবু।

রসিয়া! খাবার আমি গরম করে এনেছি। তুমি রুটিগুলো গরম গরম সেঁকে আনো। বাবার রুটি পাতলা হবে কিন্তু। খুব কড়া করে সেঁকবে। মনে আছে তো! রুটি হয়ে গেলে বাবার দুধটাও গরম করে দেবে। বুঝেছ?

জি দিদি!

রসিয়া রান্নাঘর থেকে গলা তুলে বলল।

ও-কি পারবে এতসব? নতুন লোক!

প্রসূনবাবু চিন্তার গলায় বললেন।

পারবে না কেন? শিখিয়ে নেব সব। এক এক বাড়ির এক একরকম নিয়ম। শিখে নিতে একটু সময় লাগে বই কী! মঞ্জুরিদিদির স্বামী মরে গেল তো কী করবে বেচারি? দ্যাখো, আর ফিরে আসতে পারে কি না আদৌ। এখন তো ছেলে-বউ যা বলবে, তাই-ই শুনতে হবে। হয়তো নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করতে বাড়িতেই রেখে দেবে তারা মঞ্জুরিদিদিকে। দু জনে, কামাই তো করে ভালোই। কারখানায় কাজ করে যে!

ভালোই তো রে! মঞ্জুরিও তো পঁয়তিরিশ বছর কাজ করল আমাদের বাড়ি, ক-টি টাকা আর মোটা ভাত-কাপড়ের জন্যে। আমি রিটায়ার করে কেমন ইতিহাসের রাজ্যে ডুবে গিয়ে, রোদ পুইয়ে আরামে আছি, তোর হাতের সেবাযত্ন পাচ্ছি। আহা! ওরও তো ইচ্ছে করতে পারে যে, নাতি-পুতি নিয়ে রোদ-টোদ পুইয়ে, একটু আরামে স্বাধীনভাবে শেষজীবনটা কাটায়! আহা! কাটাক, কাটাক।

বলছ বটে তুমি বাবা।

প্রসূনবাবুর প্লেটে তরকারি আর ছানার ডালনা তুলে দিতে দিতে রীতি বলল, আরাম; এ দেশের মেয়েদের কপালে নেই, যদি না, সে নিজে ‘স্বাধীন হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার কথাই বলছি। মঞ্জুরিদিদির তো কোনো সেভিংস-ই নেই। ছেলে-বউয়ের সংসারে তাকে সুখ করতে হলে সেও হবে আর এক আয়ার চাকরি; দাসত্বই। আমাদের সংসারে তবু সে, কাজের লোক হয়েও মালিকন-ই ছিল। এক বিশেষ সম্মানের আসনেই বসেছিল চিরদিন। মা তো কোনোদিনও কিছু দেখেনি সংসারের। শুচিবাইগ্রস্ত বলে, চেঁচামেচি করাকেই সংসার করা বলে জেনে এসেছিল চিরদিন। মঞ্জুরিদিদিকেই তো অনেক ব্যাপারে আমরা ছেলেবেলা থেকে মা বলেই জেনে এসেছিলাম। সেই-ই তো ছিল সব।

থাক! থাক! মা। আবার মরা মানুষটাকে নিয়ে পড়লি কেন?

রীতি গ্লাসে জল ঢালতে ঢালতে বলল, মরা মানুষকে তো কেউই ফিজিকালি টানাটানি করতে পারে না, এক, যদি-না কোর্টের অর্ডারে বডি তোলা হয় কবর থেকে। মরা মানুষের দোষ-গুণই থেকে যায় মৃত্যুর পরে। সেইগুলো নিয়ে টানাটানি হয়-ই। কেউ চাক আর নাই ই চাক। মানুষ, আসলে ‘মরে-বাঁচে’ তো মৃত্যুর পরেই। তাই-না, বাবা? অথচ যতদিন বেঁচে থাকি, এ-কথাটা একবারও মনেই হয় না।

প্রসূনবাবু বললেন, সেটা হয়ত ঠিক-ই। তবে, আমার সামনে তোর চলে যাওয়া মায়ের দোষের কথা নাই-বা বললি। সে মানুষটা কবে ছাই হয়ে গেছে।

কেন না? মা তোমার জন্যে কী করেছে? তোমার চাওয়ার মধ্যে তো ছিল এইটুকুই। তুমি যতটুকু সময় বাড়িতে থাকতে, তোমার ঘরে যাতে নিরিবিলিতে পড়াশুনো করতে পারো সে জন্যে শুধু একটু শান্তির পরিবেশ চাইতে। অন্য কোনোকিছু পাওয়ার কথা ছেড়ে দিলাম, সেই শান্তিটুকুও কি তুমি পেয়েছিলে কোনোদিন? তোমার চেয়ে, বাড়ির একটি আরশোলা অথবা পেতলের ছাইদানের প্রতিই মায়ের মনোযোগ ছিল অনেক বেশি। মা তোমার স্ত্রী বলে তো আর সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে না।

আরে। থাক। থাক রীতি! খেতে বোস মা।

মায়ের সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বলতে যা বোঝায়, তাও তো তোমার ছিল না কোনোদিনও। আমি এখন বড় হয়েছি বলেই বুঝি। তখন খুব-ই ছোটো ছিলাম।

প্রসূনবাবু কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন।

বলতে চেয়েছিলেন; দাম্পত্য সম্পর্কটা যে, কেমন তা স্বামী এবং স্ত্রী ছাড়া বাইরের কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় রে। এসব বিষয়ে তোর কথা না বলাই ভালো। আমার নিজের তো কোনোই অনুযোগ নেই, ছিলও না কখনো তার প্রতি। আজ যে-মানুষ নেই, যার প্রতিবাদ করার কোনো উপায়-ই নেই; তাকে নিয়ে পড়া কেন?

কিন্তু মুখে কিন্তু বললেন না কিছুই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই জীবনের একমাত্র স্বাধীনতা নয়। সেই স্বাধীনতা থাকলেও, বৃদ্ধ, অশক্ত মানুষের পরাধীনতা থাকে অনেক-ই। অপত্য স্নেহ এবং হয়তো প্রেমও অনেক মানুষকেই অনেকই বেশি পরাধীনতার জীবনযাপন করতে বাধ্য করে। এসব কথা রীতিকে বললেও এখন ও বুঝবে না। সবকিছু সব বয়েসে শেখা যায় না, শিখতে চাইলেও ‘জীবন’-এর কাছ থেকেই শিখতে হয়। জীবনের নিয়মকানুন রীতির কাছে যত সোজা মনে হয়, আসলে তা তো নয়।

কিন্তু ওকে এসব বলেও লাভ নেই কোনোই।

রসিয়া গরম গরম রুটি নিয়ে এল! রীতি নেড়েচেড়ে দেখে বলল, আরও একটু পাতলা হবে রসিয়া, বাবার রুটিগুলো। অন্যটা ঠিক-ই আছে। বাবা, মোটা রুটি একদম-ই হজম করতে পারেন না। আরও একটু কড়া করেও সেঁকতে হবে। নীচেরটা আমি নিচ্ছি, তুমি বরং বাবার জন্য আরও একটা রুটি নিয়ে এসো, যেমন করে বললাম তেমন করে বেলে ও সেঁকে।

প্রসূনবাবু রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, ব্যাপারটা আসলে কী জানিস? আমি আর তোর মা সারাজীবন-ই একটা দারুণ মিষ্টি, রোমান্টিক নাটকের রিহার্সাল-ই দিয়ে গেলাম। প্রত্যেক নাটকের রিহার্সালেই যা হয়, এই রিহার্সালেও তাই-ই হত। ভুল বোঝাবুঝি, ঝগড়া, মনের মধ্যে যে, অন্য মানুষটা বাস করে তার প্রম্পটিং-এর ভুল, চা আনতে দেরি, পার্ট ভুলে যাওয়া, অ্যাফেক্টেড ডিকশন, যা বলতে চাই, নাটকে যা আমার চরিত্র তাকে ঠিকমতো ফুটিয়ে তুলতে না পারা ইত্যাদি…ইত্যাদি…আমাদের জীবনের নাটকের রিহার্সালেও ঠিক তাই-ই হত। সমস্ত বিবাহিত জীবনটাই দারুণ কল্পনার সুখ ও শান্তিতে ভরপুর এক সুন্দর জীবনের রিহার্সাল দিয়েই কেটে গেল। সে-নাটক স্টেজ করার আগেই হঠাৎ-ই নায়িকা চলে গেল। আ ট্র্যাজেডি। আ রিয়াল ট্র্যাজেডি ইনডিড!

রীতি অবাক হওয়া চোখে বাবার চোখে চেয়ে রইল।

মুখে কিছু বলল না।

ও-ওর বাবার গ্রেটেস্ট অ্যাডমায়ারার। ‘ইলেকট্রা-কমপ্লেক্স’ বলে যে-কথাটা আছে তা, বোধ হয় সত্যিই। চোখের সামনে বাবাকে দেখে, বাবার কথা শুনে, বাবার পান্ডিত্যর গভীরতা ও শিশুসুলভ সারল্য দেখে ও মনে মনে ওর বাবার প্রেমে পড়ে আছে ছেলেবেলা থেকেই। এই জীবনে, অন্য কোনো পুরুষকেই ও দেখতে পাবে, বা জানতে পাবে বলে মনে হয় না, সে নিতান্তই জৈবিক শারীরিক দিক ছাড়া, অন্য কোনো দিক দিয়েই তার বৃদ্ধ, সুন্দর, পাকা চুলের বাবার ধারে-কাছেও আসতে পারে। রীতি জানে যে, ওর কপালে দুঃখ আছে। বাবার ঘনসান্নিধ্যে থেকেছে বলেই ও, ওর দুই দিদিদের মতো শুধুই শরীর-সর্বস্ব সুন্দরী হয়নি। ওর দিদিদের চরিত্রের সঙ্গে ওর মায়ের চরিত্রর মিল-ই ছিল বেশি। রীতি ব্যতিক্রম। বাবার চরিত্রই ও বেশি করে পেয়েছে। তা ছাড়া, মাকে তো বেশিদিন পায়ওনি কাছে। দিদিরাই পেয়েছিল। মায়ের সম্বন্ধে অনেক কথাই দিদিদের কাছে এবং কানাঘুসোয়ও শুনেছে। সেইসব শুনেও বাবার প্রতি, ওর সমবেদনা বেড়েছে বই কমেনি। বাবার মতো স্বামীকেও যে-মহিলা দাম দেননি, তাঁর প্রতি ‘অনুকম্পা’ ছাড়া আর কিছুই নেই রীতির। মা তো কী? প্রত্যেক মানুষকেই নিজের ‘যুক্তি’ দিয়ে ভালো করে যাচাই করে নিয়ে, তারপর-ই তাঁর বা তার সম্বন্ধে মতামত গড়ে ও। সেই মানুষ যিনি-ই হোন-না-কেন। তিনি তাঁর অবর্তমান মা-ই হোন অথবা অনাগত স্বামীই হোক।

নিজের সঙ্গে নিজের কথা থামিয়ে প্রসূনবাবুকে বলল, রসিয়া কেমন বেঁধেছে বাবা? ছানার ডালনাটা? আমি দেখিয়ে দিয়েছি অবশ্য। তবে, রসিয়া তো আগে পান্ডেবাবুদের বাড়িতে কাজ করত। অনেকদিন-ই করেছে। রান্নাবান্না তাই বিহারিদের মতোই হয়ে গেছে।

প্রসূনবাবু হেসে বললেন-আমরাও কি আর বাঙালি আছি? আমরা তো এখন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের-ই মতো ব্যাংলো-বিহারি। ইকনমিকস ডিপার্টমেন্টের শুভেন বলত কথাটা। ওদের বাড়ি ছিল ভাগলপুরে। মজার ছেলে ছিল। এ-বছরই তো ফাল্গুনে ওর মেয়ের বিয়ে দিল। চিঠিও পাঠিয়েছিল।

বলেই পুরোনো কথা মনে পড়াতে পুরোনো দিনেই ফিরে গেলেন যেন, মনে মনে। রুটি চিবোতে চিবোতে, জল খেয়ে, একটু পরে বললেন কোন পান্ডেবাবুর বাড়ি? ঝুমরিটোলির?

না, না। ঝুমরিটোলির নয় বাবা। ওই যে। গিরধারী পান্ডে। পলিটেকনিক-এর ডিরেক্টর যিনি।

ও। তা, ছাড়ল কেন কাজ রসিয়া? পান্ডেবাবুই ছাড়িয়ে দিলেন?

রীতি হাসল। বলল, সে নাই-ই বা শুনলে। অনেক কথা।

কেন?

ওসব নোংরা কথা। তোমার ভালো লাগবে না।

এইসব নোংরা-ঘাঁটা স্বভাবও নয় রীতির। অন্য দশজন মেয়ের মতো পরনিন্দা পরচর্চা করতে ভালোবাসে না আদৌও।

প্রসূনবাবু বললেন, তা হয়তো লাগবে না। নোংরা কথা শুনতে বা বলতে কোনো সুরুচিসম্পন্ন মানুষের-ই ভালো লাগে না। তবে মানুষ তো আর ভগবান নয়। সব মানুষের মধ্যেই নোংরা থাকে। খারাপ থাকে। খারাপ অথবা ভালোর ভারটা যেদিকে বেশি ভারী, মানুষকে আমরা সেই দলেই ফেলি। সেই তকমাই দিই। কিন্তু সংসারে অবিমিশ্র ভালো অথবা অবিমিশ্র খারাপ মানুষ কি সত্যিই একজনও আছে? আমি তো দেখিনি। যে, খুব ভালো, তারও অনেক খারাপ দিক থাকে। আবার যে, খুবই খারাপ তারও অনেক ভালো দিক থাকে। বল-ই শুনি, রসিয়া ছাড়ল কেন কাজ?

পান্ডেবাবু নাকি রসিয়াকে খুব-ই উত্যক্ত করত।

সে কী? কেন?

ওর শরীরের জন্যে। মেয়েদের যে অনেক-ই বিপদ!

তা ঠিক।

আর একটি রুটি তুলে নিয়ে প্রসূনবাবু বললেন, তবে ব্যাপারটা কী জানিস, তুই নিজে মেয়ে বলেই শুধু মেয়েদের দিকটাই বুঝিস। পুরুষদের বিপদও খুব কম নয়। আমরা কি কখনো ভেবে দেখব না যে, পান্ডেসাহেবের মতো এমন, পন্ডিত মানুষ ঠিক কতখানি অসহায় ও বিপদগ্রস্ত হলে তাঁর তুলনায় সবদিক দিয়েই নগণ্য রসিয়ার মতো একজন যুবতীর শরীর প্রত্যাশী হতে পারেন? বিধাতা পুরুষদের বড়োই দুর্বল, ভঙ্গুর, পরনির্ভর করে গড়েছেন রে মা! আমাদের দুর্বলতাটাই তাদের বল।

এমন করে অবশ্য কখনো ভেবে দেখিনি।

স্বগতোক্তির মতো বলল রীতি।

হ্যাঁ মা। ভাবিই না আমরা। কোনো মানুষকেই ‘বাতিল করার আগে তাকে বোঝার চেষ্টা করিস। কে, কোন দুর্বলতম মুহূর্তে কী করেছিল, সেটাই তার একমাত্র পরিচয় নয়। গিরধারী পান্ডেকে আমি জানি। একাহাতেই উনি হাটচামারিয়ার পলিটেকনিক গড়ে তুলেছেন। কত ছেলে যে, ওঁর-ই জন্যে, আজ সুস্থ স্বচ্ছল জীবিকাতে নিয়োজিত করতে পেরেছে নিজেদের, সে তো তোর আমার মতো বহুমানুষ-ই জানে। তিনি হয়তো তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে ন্যূনতম যা-প্রত্যাশা ছিল, তাও পাননি। অনেকের কাছেই শুনেছি যে, তাঁর স্ত্রী রাগি, রগচটা এবং অসভ্য প্রকৃতির একজন রমণী ছিলেন। অথচ সবসময়েই ‘সবজান্তা ভাব করতেন। রসিয়ার কাছে এসব কথা শোনা উচিত হয়নি মা। আর শুনলেও, সেই একতরফের কথা বিশ্বাস করা উচিত হয়নি আদৌ।

রীতি চুপ করেছিল। উত্তর দিল না কোনো। ভাবছিল, পুরুষরা বড়োই গোষ্ঠীবদ্ধ জীব। একে অন্যকে সবসময়েই সাপোর্ট করে। মেয়েরা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। একজনের মধ্যে খারাপ কিছু আছে শুনলেই, তা নিয়ে সরস আলোচনায় মাততে তাদের জুড়ি নেই। ভাবছিলই। বাবাকে মুখে কিছু বলল না। রীতি ছাড়া, কথা বলার লোক আজকাল বিশেষ পান-ই না, তাই বাবা আজকাল বেশ, বেশি কথা বলেন। বড়োই লম্বা লম্বা সেন্টেন্স।

রীতির বাবাও কি একদিন সেনাইল হয়ে যাবেন?

প্রসূনবাবু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললেন, তোদের রিহার্সাল কেমন হল? কী নাটক করছিস তোরা এবারে?

‘রূপমতী’। তক্ষ রায় লিখে দিয়েছেন ‘ভ্রাতৃসংঘর’ জন্যে। বোকাদা ডিরেক্টর।

কোন বোকা? চালাকের ভাই?

হ্যাঁ।

তা, এ কোন রূপমতী? মালোয়ার মাণ্ডুতে একজন রূপমতী ছিলেন। ইনি কি সেই রূপমতী?

হ্যাঁ। তুমি জান? রীতি আগ্রহের সঙ্গে শুধোল।

জানি মানে, পড়েছি। ইনফ্যাক্ট গতসপ্তাহ থেকেই ‘মাঁলোয়া’ শুরু করেছি। সারাজীবন তো পড়ালাম অন্য বিষয়। রিটায়ার করার পর যে-বিষয় পড়াতাম, সে-বিষয় সম্বন্ধে কিছু পড়তে বা লিখতে আর ভালো লাগে না। কোনো বিশেষ বিষয়ে বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করেছি এমনই এক মিথ্যেশ্লাঘা যখন-ই জন্মাল তক্ষুনি, সেই বিষয় ত্যাগ করা উচিত বলে মনে করলাম। একজন অধ্যাপকের জীবনের মূলপরিচয়, তাঁর জীবনের হংসধ্বনিই হচ্ছে এই-ই যে; তিনি একজন ছাত্র। যে-অধ্যাপকের ‘ছাত্র’ পরিচয় ঘুচে গেছে তাঁর সব-ই গেছে। তাই তো এখন ইতিহাসের ছাত্র হয়েছি বুড়ো বয়েসে এসে। এখন মনে হয়, প্রথম জীবনে ইতিহাস’কেই কেন বেছে নিইনি বিষয় হিসেবে। ইতিহাস পড়লে, মানুষকে, মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা, বল ও দৌর্বল্য, কামনা-বাসনা এবং নিবৃত্তি-নির্লিপ্তি সম্বন্ধেও যেমন ধারণা হয়, তেমন বোধ হয় সাহিত্য পড়েও হয় না।

রীতি বলল, সাহিত্যও তো ইতিহাস-ই।

কথাটা অবশ্য ঠিক-ই। এবং সমসাময়িক সাহিত্যও, যদি তা যথার্থ সাহিত্য হয়ে ওঠে। একদিন ক্লাসিক্স হয়ে ইতিহাসের পর্যায়েই পৌঁছে যায়।

আমার ভীষণ-ই বাজে লাগে। সন, তারিখ; কে কার পর রাজা হল? কে কাকে খুন করে গদিতে বসল। শুধু এই-ই সব।

রীতি বলল।

খুনখারাপি তো আমাদের চারদিকে নিঃশব্দেই ঘটে যাচ্ছে সবসময়েই। ‘গদি’র জন্যে যুদ্ধ তো শুধু রাজাদের-ই একচেটিয়া ব্যাপার নয়! সে-যুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ার নিয়েও হয়। তোরা জানতে পাস না, এই-ই যা। সাহিত্য বাদ দিয়ে তো মানুষের ইতিহাস হয় না। আমাদের আজকের এই আধুনিকতার সবচেয়ে বড়োবিপদ কী জানিস?

কী বাবা?

পেছন দিকে মুখ না ফেরানো। অতীতকে ভুলে যাওয়া। পরের ভুল দেখে নিজে না শেখা।

বাবার বক্তৃতায় রীতি ক্লান্ত বোধ করছিল, বলল, রূপমতী সম্বন্ধে কিছু বলো। আমাকে রূপমতীর ভূমিকাতেই অভিনয় করতে বলা হয়েছে। চরিত্রটি সম্বন্ধে ভালো করে জানলে তবেই তাকে ফুটিয়ে তোলা সহজ হবে।

বাজবাহাদুরের ভূমিকাতে কে করছে?

বিশু।

কে বিশু?

তুমি চিনবে না। মিত্তির বাড়ির ছেলে। ওই, যাদের লোহা-লক্কড়ের এবং রডের ব্যবসা আছে। কনস্ট্রাকশনের ব্যবসাও আছে। বিহার-শরিফ না কোথায়, কীসের যেন, কারখানাও।

করে কী ছেলেটি?

কী করে? ব্যবসা করে। বি. কম. পাশ করেছে বছর পাঁচেক হল। বাবার পার্টনার হয়েছে। ভালো ব্যবসা ওদের। তুমি চেনো না, কিন্তু এখানের সবাই-ই চেনে।

চেহারা কেমন? সুলতান-এর ভূমিকাতে মানাবে তো?

খারাপ নয়। আমাকে যদি রূপমতীর ভূমিকায় মানিয়ে যায় তবে, ওকেও বাজবাহাদুরের ভূমিকায় মানাবে।

তা নয়। তুই তো আমার সুন্দরীই! কেউই কি তা অস্বীকার করবে? ব্যবসাদারের পরিবারের ছেলেরা তো টাকা রোজগার করার জন্যে, যে-অভিনয়, শুধুমাত্র তাতেই নিজেদের দড় করে তোলে ছেলেবেলা থেকে। শুনে ভালো লাগল যে, নাটক-টাটক ককারো শখ আছে ছেলেটির। কী নাম বললি যেন? বিনু?

বিশু। একটু বিরক্তির গলায় বলল রীতি।

ও, পাঁচ হাজার টাকাও দিয়েছে বোকাদাকে। প্রোডাকশানের খরচ হিসেবে। শুনলাম, সবসুদ্ধ পনেরো হাজার দেবে। মাণ্ডুর সেট-এ নাকি খরচ অনেক। তার বদলেই নায়কের রোল পেয়েছে। টাকা না হলে নাটক হত না, আর নাটক করতে হলে নায়কও চাই।

বাঃ। ভালো বলেছিস। তবে টাকা আছে বলেই যে, ছেলেটি নির্গুণ হবেই, এমন কোনো মানে নেই। লক্ষ্মী থাকলেই যে, সরস্বতী পালাবেন এমন ক্লিশেতে বিশ্বাস করিস না। যাদের ওপর সরস্বতীর ভর আছে, তাদের ওপর লক্ষ্মীরও ভর থাকলে তার সমূহই বিপদ। সরস্বতীর পূজারিরা এদেশে, চিরদিন-ই লক্ষ্মীর কৃপাহীন। তাই-ই, তারা দলবদ্ধ হয়ে, পরম আক্রোশে এবং ঈর্ষায়, তেমন ক্কচিৎ ভাগ্যবানের পেছনে লেগে যায়, একথাই প্রমাণ করতে যে, সে-হতভাগার শুধুমাত্র লক্ষ্মীর দয়াই আছে; সরস্বতীর দয়ার ছিটেফোঁটাও নেই। বিশুকে এদেশের লক্ষ্মীহীন সরস্বতীসাধকদের চেয়ে অনেক-ই বড়োমাপের সাধক হতে হবে তাদের স্বক্ষেত্রে হারাতে হলে। অনেক উদ্দেশ্যমূলক সমালোচনার জন্যেও তৈরি থাকতে হবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা, মানে অভিনয়টা করছে কেমন?

নাটক এখন ফাইনালি লেখাই হয়নি। তক্ষদা আগামী সপ্তাহে ফাইনাল স্ক্রিপ্ট দেবেন।

তক্ষদাটি কে?

বাঃ। বলিনি বুঝি? তক্ষ রায়। নাম শোনোনি? কবি, প্রবন্ধকার; সাংবাদিক, নাট্যকার।

ওঃ। সেই তক্ষ রায়? তিনি তো বিখ্যাত লোক।

হ্যাঁ।

তা ভালো। তবে তুই নায়িকা, তাই তোর যে নায়ক, তার অভিনয়ক্ষমতার ওপরেই কিন্তু তোর নিজের অভিনয় অনেকখানিই নির্ভর করবে। ছেলেবেলায় আমিও কিছুদিন রমেন চাটুজ্যের পাল্লায় পড়ে অভিনয় করেছিলাম। অভিনয়ের মতো এমন ‘সুষম পরিপূরক’ বিদ্যা আর বোধ হয় নেই; বুঝলি রীতি। সত্যিকারের-ই গণতান্ত্রিক শিল্পমাধ্যম এটি। কোনো শিশির ভাদুড়ি বা অহীন্দ্র চৌধুরী কোনোদিনও একা একা কোনো নাটকের উৎকর্ষ আনতে পারতেন । পুরোটাই টিম-ওয়ার্ক। তোর নায়ক, কী যেন, নাম বিনু, সে নিজে যদি অভিনয়ের কিছু না বোঝে, নিজের অভিনয়কে এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দিতে না পারে; তবে তুই তোর সব অভিনয়ক্ষমতা নিয়েও ভালো অভিনয় করতে পারবি না। তোর প্রতিযোগীর সমতলেই এসে থেমে যাবি। এইখানেই সাহিত্য, বা সংগীত বা চিত্রকলার সঙ্গে নাটকের তফাত। অন্যর যোগ্যতার ওপরে তোর পূর্ণতা নির্ভর করে না সেইসব জগতে। এখানে করবে। বুঝলি মা।

রীতির ঘুম পাচ্ছিল। বাবা বড়োই কথা বলেন আজকাল খেতে বসে। হাই তুলল দুটো। বলল, রসিয়া সন্ধেবেলা তোমাকে প্রেশারের ওষুধটা দিয়েছিল?

অ্যাঁ? না তো। দেয়নি তো। সেইজন্যেই মাথাটা ভার ভার লাগছে না তো! ঘাড়টাও ব্যথা ব্যথা করছে।

দেখেছ! এতকরে বুঝিয়ে গেলাম! দাঁড়াও, ওকে ভালো করে তালিম না দিয়ে, আমি আর একটুর জন্যেও বাড়িছাড়া হচ্ছি না।

বলেই, চেয়ার ঠেলে উঠে, ঘরে গেল ওষুধ আনতে। হার্টের ওষুধটা এনে, রান্নাঘরে গেল, রসিয়ার কাছ থেকে প্রেশারের ওষুধটা আনতে। ওকেই জিম্বা করে দিয়েছিল রিহার্সালে যাওয়ার সময়ে।

রসিয়া বলল, বাবুর ওষুধ তো দিয়েছি, প্রেশারে।

মানে?

সরেজমিনে তদন্ত করে জানা গেল, প্রেশার কুকারে কালকের জন্যে, যে-মাংস রান্না করেছে তাতেই ফেলে দিয়েছে ওষুধটি রসিয়া।

ইরি বাবা! কী লোক গো তুমি?

হাসতে হাসতে খাওয়ার ঘরে এসে রীতি বলল, শুনেছ বাবা! রসিয়া কী করেছে?

কী?

হাসতে হাসতে, বলতে বলতে রীতি আবার বাবার ঘরে গেল, প্রেশারের আর একটি ট্যাবলেট আনতে।

আজকাল ওষুধ না খেলেই, প্রেশার বেড়ে যায় প্রসূনবাবুর।

রীতি যখন হাঁটে, যখন হাসে; তখন-ই প্রসূনবাবুর কেবল-ই মন্দিরার কথা মনে পড়ে যায়। উনি যখন ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হয়ে প্রথম ঢোকেন তখন মন্দিরা সেনও বাংলার লেকচারার হয়ে ঢোকেন। লম্বা, তম্বী; ভারি শার্প ফিচারসও ছিল তার। কালোর মধ্যে ভারি মিষ্টি চেহারা ছিল। বুদ্ধি’র প্রসাধনে সবসময়েই প্রসাধিত থাকত তার কালো মুখটি। খুব মজার মজার কথা বলত। সেই সময়ের মেয়েদের তুলনায় অত্যন্ত সপ্রতিভও ছিল। হাসত, হাসাত সকলকে অনুক্ষণ। প্রেমে, জীবনে একজনের সঙ্গেই পড়েছিলেন প্রসূনবাবু। ওই মন্দিরার সঙ্গে। কিন্তু মুখে মন্দিরাকে সে-কথা বলার সাহস তো বটেই, সময় ও সুযোগও আসেনি। ভালোবাসি’ কথাটা বলে ফেলার রিহার্সাল দিলেন দীর্ঘ তিনমাস মন্দিরার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরদিন থেকেই। তবু বলে ওঠা হল না। এরইমধ্যে বাবা, ছেলের বিয়ে ঠিক করে ছুটি নিয়ে এলেন পাটনাতে; প্রসূনবাবুর বিয়ে দেওয়ার জন্যে। বাবার-ই বন্ধুর ছোটোমেয়ে। বয়েসে প্রসূনবাবুর চেয়ে বছর বারোর ছোটো। মনের বয়েসেও আরও অনেক বেশি। শরীর, বড়োই প্রবল ছিল, রীতির মায়ের মধ্যে। কিছু কিছু মেয়ের মধ্যে থাকে। যেমন থাকে পুরুষেরও মধ্যে। মিল হল না তাই-ই। তবু দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘর করলেন। সহবাস করলেন। তিন মেয়েও জন্মাল। মেয়েরা দেখতে দেখতে বড়ড়াও হল। কী করে যে, চলে গেল এতগুলো বছর জীবনের রিহার্সালেই, ভাবলে অবাক লাগে। এ-জীবনে বাঁচা হল । পরের জীবনে বাঁচার মতো বাঁচবেন, যদি পরজন্ম থাকে। এই বুড়ো বয়সের ছোটোমেয়ে রীতিটা তাঁর-ই মনের মতো হয়েছে। আশ্চর্য! ওর মধ্যে আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগের পরিচিতা মন্দিরা সেনের মিল হল কী করে? কস্তুরীর সঙ্গে মিলনের সময়ে অন্ধকার ঘরে, দূর থেকে ভেসে আসা মহুয়ার গন্ধে, রাত-পাখিদের ডাক শুনতে শুনতে মন্দিরার মুখটিই কী ভাবছিলেন উনি? রীতির জন্ম হয়ে ছিল বৈশাখী-পূর্ণিমার দিনে। এক প্রথম বৃষ্টির রাতে কনসিভ করেছিলেন প্রসূনবাবুর স্ত্রী, রীতিকে।

বেচারি পান্ডে! গিরধারী পান্ডে! পরিচারিকার শরীর পেতে চেয়ে, এই ঝিরাটোলির সমাজের চোখে হাসির-ই পাত্র হয়ে উঠলেন। আর শ্রদ্ধাস্পদ অধ্যাপক প্রসূনবাবুর যে-এক বৃষ্টির রাতে জেগে-থাকা স্বপ্নে পরস্ত্রী মন্দিরার সঙ্গে সহবাস করে নিজের স্ত্রীর শরীরের কোরকেই এক সুগন্ধি বীজ গোপনে পুঁতে দিয়েছিলেন তার খোঁজ এতবছর কেউই রাখল না।

একদিন নয়। বিবাহিত জীবনের অসংখ্য রাতে প্রসূনবাবু মন্দিরা সেনের সঙ্গেই সহবাস করেছেন। স্বস্তির কথা, এটুকুই যে; সেইকথা ভেবে কোনো অপরাধবোধ জাগে না মনে। জাগে না; কারণ, সেই মুহূর্তটিতে রীতির জননীও তাঁর অসংখ্য পুরুষবন্ধুর মধ্যে কারো সঙ্গে যে, মনে মনে সহবাস করছিলেন না, সে-কথা প্রসূনবাবু জোর করে বলতে পারেন না।

সত্যিই মস্তবড়ো স্বস্তির কথা এই-ই যে, এই জীবনে দু-জনের পাপ, দু-জনের দোষ ক্রমান্বয়ে প্রতিনিয়ত কাটাকুটি হয়ে যেতে যেতে, হাতে থাকে শূন্য। শূন্য পবিত্রতা। অথবা পবিত্র শূন্যতা কী?

শূন্যমাত্রই বোধ হয় অসীম। শূন্য দিয়ে সহস্রবার গুণ করলেও, ভাগ্য ভালো! গুণফল শূন্যেই ফেরে। যে-অন্যায়, যে-পাপ, নজরসীমা অথবা শ্রবণসীমার মধ্যে ঘটে; শুধু সেইটুকুই ক্ষমার অযোগ্য। চাঁদের রাতে, অথবা জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে; রাতকানা, কান-ময়লা সমাজের অনুভূতির আঙুলের আওতার বাইরে অথবা প্রত্যেক মানুষ ও মানুষীর মননেও যা কিছু, অপরাধ-ই ঘটুক-না-কেন, তাদের গুণের গণনকে কোনোভাবেই কলঙ্কিত করে না। ভাগ্যিস।

নইলে এ-জীবন বড়োই কেলেঙ্কারির হত।

প্রত্যেক মানুষ ও মানুষীর-ই জীবন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *