অস্থিকেশবসাকীর্ণং শোণিতৌঘপরিপ্লুতম্।
শরীরৈর্বহুসাহস্রৈর্বিনিকীর্ণং সমন্ততঃ॥
সেই রণক্ষেত্র, অস্থি, কেশ, চর্বিসমূহে পূর্ণ ছিল, রক্তের প্রবাহে আপ্লুত ছিল, কয়েক হাজার মৃতদেহ সেখানে চারিদিকে পতিত ছিল। গজারোহী, অশ্বারোহী, রথারোহী যোদ্ধাগণের রক্তে মলিন মস্তকহীন অগণিত মৃতদেহ, দেহহীন অসংখ্য মস্তকে সেই রণভূমি আবৃত ছিল। হস্তী, অশ্ব, মনুষ্য ও স্ত্রীগণের আর্তনাদে সমগ্র রণস্থল প্রতিধ্বনিত। শৃগাল, বক, দাঁড়কাক, হাড়গিলা, কাকদের মহাভোজ।
কুরুক্ষেত্রের বীভৎস ছবি। যুদ্ধ শেষ। ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজা, মহারাজা নিহত। শরশয্যায় আহত পিতামহ ভীষ্ম বিদায়ের প্রহর গুনছেন। ভগবান বেদব্যাসের আদেশে রাজা ধৃতরাষ্ট্র, যুধিষ্ঠিরাদি সব পাণ্ডব রণস্থলের দিকে চলেছেন। একেবারে সামনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ধৃতরাষ্ট্র। পেছনে কুরুকুলের স্ত্রীগণ-স্বামীহারা, পুত্রহারা, স্বজনহারা দুর্ভাগার দল। বেদব্যাসের বরে গান্ধারী দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছেন। রণস্থলে না গিয়েও তিনি সব দেখছেন। তিনি ভাষ্যকার। তাঁর কথা সবাই শুনছেন। তিনি সর্বস্ব হারিয়েছেন। শোকের সীমা নেই, কিন্তু সংযত; কারণ তিনি সাধিকা, পতিব্রতা। প্রতিটি মৃত্যুর পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিচ্ছেন। একটুও ভেঙে পড়ছেন না। কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হচ্ছে না। সাধনলব্ধ সংযম। নারকীয় দৃশ্য। নারীদের হাহাকার। মৃত্যু, চতুর্দিকে মৃত্যু, ছিন্নভিন্ন মরদেহ, জীবদেহ, শোণিত স্রোত, স্খলিত অস্ত্র, ভগ্ন রথ,
সমাসাদ্য কুরুক্ষেত্রং তাঃ স্ত্রিয়ো নিহতেশ্বরাঃ।
অপশ্যন্ত হতং স্তত্র পুত্রান্ ভ্রাতৃন্ পিতৃন্ পতীন্॥
ক্রব্যাদৈর্ভক্ষ্যমাণান বৈ গোমায়ু-বল বায়সৈঃ।
ভূতৈঃ পিশাচৈরক্ষোভির্বিবিধৈশ্চ নিশাচরৈঃ॥
এই সেই কুরুক্ষেত্র। রাত্রি সমাগত। স্বজনহারা পুররমণীদের হাহাকার, বিলাপ। পুত্র, ভ্রাতা, পিতা ও পতিদের দেহ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। পালে পালে এসে গেছে মাংসভক্ষণকারী পশুর দল। শৃগাল, দ্রোণকাক, কাক, ভূত, পিশাচ, রাক্ষস। দেহ খণ্ড খণ্ড করে মহা উল্লাসে ভক্ষণ করছে।
‘কোথায় আমার সেই কমলনয়ন মাধব?’ গান্ধারী খুঁজছেন তাঁকে। আর কারওকে নয়।
‘আমার এই বিধবা পুত্রবধুদের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করো। কেশ উন্মুক্ত করে কুররী পক্ষীদের মতো বিলাপ করছে। মাধব! তাকিয়ে দেখো, পুরুষশ্রেষ্ঠ প্রজ্বলিত অগ্নিতুল্য তেজস্বী কর্ণ, ভীষ্ম, অভিমন্যু, দ্রোণ, দ্রুপদ ও শল্যের মতো বীরদের দ্বারা এই রণভূমি যেন বিশোভিত। দেখো, দেখো জনার্দন, ভাল করে দেখো।’
গান্ধারী সেই পাশাখেলার ভয়ংকর প্রসঙ্গ শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। দ্রৌপদীর চরম হেনস্থা। ভীমসেনের রোষে দুঃশাসনের শোচনীয় পরিণতি। ‘আমি পুত্র দুর্যোধনকে সাবধান করেছিলুম, পুত্র! মৃত্যুপাশপরিক্ষিপ্তং শকুনিং পুত্র বর্জয়। শকুনি মৃত্যুর পাশে আবদ্ধ হয়েছে। তুমি এর সঙ্গ পরিত্যাগ করো। কলহপ্রিয় নীচমতি এই মাতুলকে সত্বর পরিত্যাগ করো। আরও বলেছিলুম, পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করো। কর্ণপাত করেনি; কারণ-দৈব। দৈবের পক্ষে কোনও কাজই কঠিন নয়। দৈবই ক্ষত্রিয়গণের দ্বারা এইসব ক্ষত্রিয়দের সংহার করিয়েছে।’
‘সেই সকাল, মনে আছে আমার। সেই সকালেই কৌরবদের ধ্বংসের বীজ বোনা হয়ে গিয়েছিল। তুমি এসেছিলে শান্তির প্রস্তাব নিয়ে। মাত্র পাঁচটি গ্রাম পাণ্ডবদের বসবাসের জন্য দিতে বলেছিলে। আমার স্বামী, উচ্ছন্নে যাওয়া আমার ছেলেরা তোমার কথা শুনবে কেন? তুমি কে, তা কি ওই মূর্খ পাপীরা জানত! দুর্যোধন, কর্ণের সঙ্গে তখন চক্রান্ত করছে, তোমাকে বন্দি করবে। তুমি দুর্যোধনকে বললে, ‘দুর্যোধন, আমি একা নই।’ সাত্যকিকে বললে, ‘সরিয়ে নাও তোমার সৈন্যদের। আসুক দুর্যোধন তার বন্ধুদের নিয়ে। আমাকে বন্দি করুক। দেখি তাদের কত বিক্রম!’
‘তারপর তোমার সেই ভয়ংকর অট্টহাসি। সভা কেঁপে উঠল। এ কোন কৃষ্ণ! হঠাৎ তোমার চেহারা বদলে গেল। ভয়ংকর এক মূর্তি। তোমার বিশ্বরূপ। রাজারা সব ভয়ে চোখ বুজলেন। আজই কি সৃষ্টির শেষ দিন— তাঁরা ভাবছেন। ঋষিরা স্তব শুরু করে দিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র স্তম্ভিত। দেব ও গন্ধর্বগণ কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রার্থনা করছেন, ‘প্রভু! প্রসন্ন হও, তোমার এই ঘোররূপ সংবরণ করো, নইলে সৃষ্টি যে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ ধীরে ধীরে তুমি তোমার স্বাভাবিক রূপে ফিরে এলে। আমার মূর্খ পুত্র বললে, ‘এসব কৃষ্ণের জাদুবিদ্যা!’ হায় পুত্র! তুমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিরে গেলে বিদুরের গৃহে। তুমি ফিরে গেলে উপপ্লব্যে। সেই রাত! ধ্বংসের আগেই ধ্বংস!’
গান্ধারী কিছুক্ষণের জন্যে সংজ্ঞা হারালেন। ফিরে এলেন ক্রোধাবেশ নিয়ে। তাঁর দৃষ্টির সামনে কুরুক্ষেত্রের থই থই মৃত্যু। তিনি তাঁর বাক্যসংযম হারালেন। ব্যাসদেব লিখছেন,
ততঃ কোপোপরীতাঙ্গী পুত্রশোকপরিপ্লুতা।
জগাম শৌরিং দোষেণ গান্ধারী ব্যথিতেন্দ্রিয়া॥
কৃষ্ণ! জনার্দন! সব দোষ তোমার, তোমার, তোমার! এই ধ্বংসের রূপকার তুমি। পাণ্ডুপুত্র আর ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা পরস্পর যুদ্ধ করে দগ্ধ হয়ে গেল, তুমি দেখেও উপেক্ষা করলে। মহাবাহু মধুসূদন! তুমি তো খুব শক্তি শালী পুরুষ! তোমার নিজস্ব কত সেবক, কত সৈন্য! অসাধারণ বলে তুমি বলবান! উভয়পক্ষকে শান্ত করার ক্ষমতা তোমার ছিল। তুমি শাস্ত্রজ্ঞ, মহাত্মাদের বাণী তুমি শুনেছ, তুমি জানো। তবু তুমি স্বেচ্ছায় কুরুকুলের এই বিনাশে উদাসীন রইলে, অর্থাৎ তুমি জেনেশুনে এই বংশকে বিনষ্ট হতে দিলে। এ তোমার মহাপরাধ, এর ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে। চক্র ও গদাধারী কেশব! আমি পতির সেবাতে যা কিছু তপস্যা অর্জন করেছি, সেই দুর্লভ তপোবলে আমি তোমাকে অভিশাপ প্রদান করব।’
শ্রীকৃষ্ণের মুখে মৃদু হাসি। ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে গান্ধার রাজ্য। রাজা সুবল। তাঁরই কন্যা গান্ধারী। ভীষ্ম ঘটকের মুখে শুনেছিলেন, মহাদেবের বরে গান্ধারী শতপুত্রের জননী হবেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাবে সুবল প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু বংশগৌরব, আভিজাত্য ইত্যাদি কারণে রাজি হন। গান্ধারীর শক্তি সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণের কোনও সংশয় নেই। শ্রীকৃষ্ণ মানসিকভাবে অভিশাপ গ্রহণে প্রস্তুত।
গান্ধারী বললেন, ‘গোবিন্দ! যেহেতু পরস্পর সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত জ্ঞাতি কৌরব ও পাণ্ডবগণকে তুমি উপেক্ষা করেছ, সেই কারণে তুমিও নিজের জ্ঞাতি-বান্ধবদের বিনাশ করবে।
‘মধুসূদন! আজ থেকে ঠিক ছত্রিশ বছর পরে তোমার জ্ঞাতি, মন্ত্রী ও পুত্রগণ সকলে পরস্পর যুদ্ধ করে ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি সকলের অপরিচিত ও অদৃষ্ট হয়ে অনাথের মতো বনে বিচরণ করবে। তারপর কোনও এক নিন্দিত উপায়ে নিধনপ্রাপ্ত হবে।
‘ভরতবংশের স্ত্রীদের মতো তোমার বংশের স্ত্রীরাও তাদের পুত্র, জ্ঞাতি ও বন্ধু-বান্ধবরা নিহত হলে অধীর শোকে ঠিক এইভাবেই ভূতলে পতিত হবে।’
শ্রীকৃষ্ণ শুনছেন আর মৃদু মৃদু হাসছেন। গান্ধারীকে বললেন, ‘ক্ষত্রিয়ে! আমি জানি, আমি সব জানি; এইরকমই হবে। তুমি নতুন কিছু বললে না। যা লেখা হয়ে আছে সেইটাই পড়লে। কোনও সন্দেহ নেই, বৃষ্ণিবংশের যাদবরা দৈবকারণেই বিনষ্ট হবে। এইটাই তাদের দৈবনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ। শুভে! বৃষ্ণিকুলের সংহারকারী আমি ছাড়া আর কেউ নেই। অন্য কোনও মানুষ, দানব বা দেবতা তাদের বিনাশ করতে পারবে না। অতএব তারা পরস্পর সংগ্রাম করে নিজেরাই নিজেদের মারবে। আর এই পরিণতি আমার হাতে।’
শ্রীকৃষ্ণ ভগবান এতক্ষণ শ্রোতা ছিলেন, এইবার তিনি ভগবান। গান্ধারীকে বললেন, ‘অনেক শোক হয়েছে, এইবার ওঠো। জেনে রাখো, তোমারই অপরাধে কৌরবদের বিনাশ হল। তোমার পুত্র দুর্যোধন দুরাত্মা, ঈর্ষাপরায়ণ, অতিশয় অভিমানী, দুষ্কর্মকারী, নিষ্ঠুর, শত্রুতার প্রতিমূর্তি, বৃদ্ধ জ্ঞানী পুরুষদের আদেশ অমান্যকারী। তুমি তাকে অগ্রগামী নেতা করে যে অপরাধ করেছ, তাকে কি তুমি উত্তম কাজ বলে মনে করছ? নিজের কৃত দোষ তুমি আমার ওপর চাপাতে চাইছ কেন?’
শ্রীকৃষ্ণ এইবার ভগবান। ব্যাসদেব যা প্রথম থেকেই জানেন। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ-কথাকে তিনি বলছেন, ‘শ্রীভগবানুবাচ।’ ভগবান কৃষ্ণ গান্ধারীকে দুঃখ সম্পর্কে চমৎকার একটি উপদেশ দিলেন, ‘গান্ধারী! যদি কোনও মানুষ মৃত স্বজন, নষ্ট বস্তু অথবা অতিক্রান্ত বিষয়ের জন্য শোক করে, তবে সে এক দুঃখ থেকে অপর আর এক দুঃখ লাভ করে। এইভাবে সে একটির জায়গায় দুটি অনর্থ প্রাপ্ত হয়। দুঃখেন লভতে দুঃখং। দুঃখের পাওনা আরও দুঃখ।’
শ্রীকৃষ্ণ এইবার আর একটি সত্য প্রকাশ করলেন, ‘গান্ধারী! এইবার শোনো, ব্রাহ্মণী তপস্যার জন্য, গাভী ভার বহনের জন্য, অশ্বী তীব্র বেগে দৌড়োবার জন্য, শূদ্রা সেবার জন্য, বৈশ্যকন্যা পশুপালন করবার জন্য আর তোমার মতো রাজকুমারী যুদ্ধে সংগ্রাম করে মৃত্যুবরণ করবার জন্য গর্ভধারণ করে থাকে।’
ধৃতরাষ্ট্র এতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে ছিলেন। এখন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে হতাহতের সংখ্যা জানতে চাইলেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘রাজন্! এই যুদ্ধে এক অর্বুদ (দশ কোটি), ছেষট্টি কোটি, বিশ হাজার যোদ্ধা নিহত। এ ছাড়া চব্বিশ হাজার একশত পঁয়ষট্টি জন বীর সৈন্যের কোনও সন্ধান নেই।’ এত মৃত্যু! মৃত্যুর উৎসব! শ্রীকৃষ্ণ ভগবান! আপনি যে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে সখা অর্জুনকে বললেন, মৃত্যু বলে কিছু নেই, ধারণাটাই ভুল। যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে অর্জুন তো জীবন দেখতে পাননি, মৃত্যুই দেখেছিলেন, আপনাকে বলেছিলেন,
দৃষ্ট্বেমান স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসূন্ সমবস্থিতান্।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি॥
বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিদহ্যতে॥
সখা! সামনে এ আমি কাদের দেখছি? এরা সবাই আমার স্বজন। আমার শরীর ক্রমশ অবসন্ন হয়ে আসছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, সারা শরীর কাঁপছে, রোমাঞ্চ হচ্ছে, হাত থেকে গাণ্ডীব পড়ে যাওয়ার মতো হচ্ছে, সর্বাঙ্গ জ্বলছে, আমি স্থির থাকতে পারছি না, আমার মাথা ঘুরছে, নানা দুর্লক্ষণ দেখছি। হে কৃষ্ণ, যুদ্ধে স্বজনদের বধ করে আমি তো কোনও মঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না। ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ। আমি যুদ্ধে জয়লাভ করতে চাই না। রাজ্যে প্রয়োজন নেই, সুখভোগেরও বাসনা নেই। সুখ কাকে বলে? শ্মশানে সিংহাসন? কেউ নেই, কিছু নেই, চিতার আগুন। যাদের জন্যে রাজ্যভোগ, যাদের নিয়ে আমাদের যত সুখ, সেইসব আচার্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক, স্বজনবৃন্দ প্রাণের আশা, ধনের আশা পরিত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্রে সমবেত হয়েছেন। হে মধুসূদন, যদি এরা আমাকে মেরেও ফেলে, তবু এদের আমি হত্যা করার ইচ্ছা করি না, এই পৃথিবীর কথা ছেড়ে দিন, ত্রৈলোক্যের জন্যেও আমি যুদ্ধ করতে চাই না।
শুধু মৃত্যুভয় নয়, অর্জুনের মধ্যে পাপবোধও জেগেছে। আপনি তাঁকে বলার স্বাধীনতা দিয়েছেন। আপনি শ্রোতা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অর্জুনের যুদ্ধরথে। উভয় পক্ষের সৈন্যরা থমকে আছেন। অর্জুন আপনাকে প্রশ্ন করছেন, ‘ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বধ করে আমাদের কি সুখ হবে? জানি এরা আততায়ী, তবু এদের হত্যা করলে আমাদের পাপ হবে।’ আততায়ীদের বধ করলে পাপ হয় না— একথা শাস্ত্রে আছে। শাস্ত্রে ছ’রকমের আততায়ীর কথা বলা হয়েছে। যেমন, ‘অগ্নিদ’— যে ঘরে আগুন দেয়, ‘গরদ’— বিষ প্রয়োগে হত্যাকারী, অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে যে মারার জন্যে ছুটে আসছে, ধন অপহরণকারী, জমি দখলকারী আর স্ত্রী অপহারক। অর্জুন জানেন। তিনি বলতে চাইছেন, কৌরবরা অবশ্যই আততায়ী; কিন্তু এরা যে আমাদের আত্মীয়-স্বজন। অর্থশাস্ত্রের বিধান ধর্মশাস্ত্র খণ্ডন করে দিয়েছেন। ধর্মশাস্ত্রের প্রথম কথা-‘অহিংসা পরমোধর্মঃ, গুরুজনরা অবধ্য। সামনে বিপক্ষে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা প্রায় সকলেই আমার শ্রদ্ধেয় গুরুজন। এঁদের হত্যা করলে ধর্মশাস্ত্রের বিধানে আমাদের পাপ হবে।’
মৃত্যু আছে। জীবনের বিপরীতে। দুটি সত্য-জীবন, আর জীবনের অভাবই হল মৃত্যু। দেহ গেল তো জীবনও গেল। জীবনের প্রত্যক্ষ প্রমাণ— আকার, আকৃতি, বর্ধন, গতি। অর্জুন স্বীকার করছেন, প্রতিপক্ষে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা রাজ্যলোভে প্রমত্ত। কুলক্ষয় হবে— এ এক মহাপাপ, বিরোধীপক্ষ জেনেও উদাসীন। কারণ তাঁরা রাজ্যলোভী। মিত্রদ্রোহও পাপ। হে জনার্দন, শাস্ত্রকে উপেক্ষা করে আমরা কেন পাপে লিপ্ত হব? শাস্ত্র নির্দেশ অমান্য করব? অর্জুন বলছেন, ‘কুলক্ষয় হলে সনাতন কুলধর্ম নষ্ট হয়। কুলধর্ম নষ্ট হলে অনাচার ঘনিয়ে আসে। ধর্ম বলে তখন আর কিছু থাকে না। কুলস্ত্রীরা ব্যভিচারিণী হয়। কুলস্ত্রীরা বিপথগামিনী হলে বর্ণসংকর জন্মায়। বর্ণসংকর কুলনাশকারী। কুল হয়ে দাঁড়ায় এক-একটি নরক। কারণ, শ্রাদ্ধ, তর্পণ ইত্যাদি লোপ হয়ে যায়। এদের পিতৃপুরুষ নরকে যায়।’
তা হলে মৃত্যু সত্য। মৃত্যুর পর মানুষ হয় স্বর্গে, না হয় নরকে যায়। এই মানুষ কোন মানুষ? শ্রাদ্ধ তর্পণে নাম, পূর্বপুরুষের নাম, গোত্র, ধর্মের উল্লেখ করা হয়। উদ্দেশে পিণ্ড আর জলদান করা হয়। বছরের পর বছর। যতদিন তাঁর উত্তরপুরুষরা জীবিত থাকেন। তা হলে মুক্তি কোথায়! একটি সিঁড়ি যেন ঊর্ধ্বদিকে উঠছে— পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ। পৃথিবীতে প্রবেশ খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়, মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
বীর অর্জুন শেষে এই সিদ্ধান্তে এলেন,
যদি মামপ্রতীকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেৎ।
নিজের প্রাণরক্ষায় নিশ্চেষ্ট ও নিরস্ত্র আমাকে যদি শস্ত্রধারী ধৃতরাষ্ট্রপুত্ররা যুদ্ধক্ষেত্রে বধ করে, তাও আমার পক্ষে অতি মঙ্গলজনক।
অর্জুন ধনুর্বাণ ত্যাগ করে বিষণ্ণ চিত্তে রথের ওপর বসে পড়লেন।
আপনার আর অর্জুনের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। আপনারা হলেন নর ও নারায়ণ। পূর্ব জন্মের সম্পর্ক। পূর্বজন্মে আপনারা দু’জনে বদরিকা আশ্রমে দীর্ঘকাল তপস্যা করেছিলেন। আপনাদের আত্মীয়তা দীর্ঘকালের। বনপর্বে আপনি অর্জুনকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তুমি আর আমি অভিন্ন। আমাদের পারস্পরিক ভেদ অসম্ভব।’
সেই রাতে অরণ্যচারী পাণ্ডবগণ আপনাকে ঘিরে বসেছিলেন। এই ঘটনা চিরকালের ইতিহাস। ভারত কোনওদিন ভুলবে না এই মহাভারত। কাম্যক বনে আপনি এসেছেন আপনার পাণ্ডব সখাদের দেখতে। ভারতের রাজা ভাগ্যদোষে বনবাসী। রাজসভায় পাশা খেলা, দ্রৌপদীর জঘন্য নির্যাতন, আপনার অবর্তমানে ঘটেছে। আপনার জীবনে এত যুদ্ধ, দৈত্য দানব বধ, আপনাকে স্বাভাবিক সুন্দর অবস্থায় পাওয়াই যায় না। বৃন্দাবনে ওই কয়েক বছরের গোষ্ঠলীলা। তাও কি নিষ্কৃতি আছে! পুতনা রাক্ষসীকে দিয়ে জীবন শুরু। তখন আপনি মাতা যশোদার স্তন্যপান করেন। বাল গোপালের যাবতীয় মধুর দুষ্টুমি শুরু হয়নি। এরপর একে একে বৃষাসুর, বকাসুর, ধেনুকাসুর, অঘাসুর, কালিয় দমন! অসুরে অসুরে ছয়লাপ। সারাজীবন যুদ্ধ যুদ্ধ।
যুধিষ্ঠিরের মাথায় জটা, পরিধানে কৌপীন। তাঁকে ঋষিদের মতো দেখাচ্ছে। তাঁকে ঘিরে সবাই বসেছেন। শ্রীকৃষ্ণ একা আসেননি। সঙ্গে এসেছেন ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশীয় বীরগণ। এসেছেন পাঞ্চালরাজকুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু, মহাপরাক্রমশালী, লোকবিখ্যাত কেকয় রাজকুমারগণ। এঁরা কৌরবদের বিপক্ষ। সবাই ছি ছি করছেন। পাণ্ডবদের কী উপকার করা যায়, সেই বিষয়ে আলোচনা করছেন নিজেদের মধ্যে। দ্রৌপদী এসে বসেছেন। বাসুদেব আপনি খুব বিষণ্ণ। আহত। এ কী অবস্থা! আপনি ক্রুদ্ধ। প্রথমেই যে কথাটি বললেন— ‘হে রাজগণ, দুর্যোধন, কর্ণ, দুরাত্মা শকুনি, দুঃশাসন এই চারজনের রক্ত পৃথিবী পান করবে।’ ওই অরণ্যের রাতেই আপনি ভারতের ভবিষ্যৎ বলে দিলেন— ‘এই চারজন, আর এদের যারা সাহায্য করবে, যুদ্ধে আমরা তাদের পরাজিত করে যুধিষ্ঠিরকে ভারতের সিংহাসনে অভিষিক্ত করব। অধর্মের পথে যারা সুখভোগ করতে চায়, তাদের বধ করাই সনাতন ধর্ম।’
ক্রোধে আপনি জ্বলছেন। উপস্থিত সকলে ভয় পেয়ে গেছেন। কোথায় আপনার সেই মুরলীমনোহর মূর্তি। তাঁদের মনে হতে লাগল, আপনি এখনই সমস্ত প্রজাধ্বংস করে ফেলবেন। সৃষ্টি ধ্বংস করার শক্তি আপনার আছে। এক লহমায় ভারত শ্মশান। অর্জুন আপনার স্বরূপ জানেন। আপনিই তাঁকে জানিয়েছেন। ক্রোধের বশে পাছে আপনি আপনার স্বরূপ ভুলে যান, তাই তিনি আপনার পরিচয় আপনাকে দিচ্ছেন। প্রশমিত করার প্রচেষ্টা। রাজন্যবর্গও শুনছেন। শ্রীকৃষ্ণকে চিনুন। অর্জুন একে একে বলছেন অনাদিকালের কথা। শ্রীকৃষ্ণকথা। কলিতে বসে সময়ের এই বিস্তারের হিসেব পাওয়া কঠিন। অর্জুন প্রথমেই বললেন ‘হে কৃষ্ণ! তুমি পূর্বকালে গন্ধমাদন পর্বতে ‘যত্রসায়ংগৃহ’ মুনিরূপে, অর্থাৎ নারায়ণ ঋষিরূপে দশহাজার বছর বিচরণ করেছিলে।’ ‘যত্রসায়ংগৃহ’ মানে, যেখানেই সন্ধ্যা হবে সেখানেই তিনি বাস করবেন। আর চলা নয়, স্থির হয়ে বসা। সে যে স্থানই হোক। অর্জুন বলছেন, ‘কৃষ্ণ পূর্বকালে তুমি মর্তধামে অবতীর্ণ হয়ে এগারো হাজার বছর পুষ্করতীর্থে শুধু জলপান করে অবস্থান করেছিলে।
সখা অর্জুন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পূর্ব পূর্ব জন্ম। আপনার আবার জন্ম কী? আপনি তো ভগবান। আপনার জন্ম হল লীলা করার জন্য, সব ঠিকঠাক করে দেওয়ার জন্য আগমন। এক-একটি রূপ পরিগ্রহ করা। এই তো কিছুকাল আগে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞস্থলে আপনি যখন স্বেচ্ছায় আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের পা ধুইয়ে দিচ্ছিলেন তখন মহামতি ভীষ্ম বললেন, ‘এই সভাতে তেজ, বীর্য ও পরাক্রমে শ্রীকৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ। ইনি জ্যোতিষ্কদের মধ্যে যেন সূর্য। এঁর উপস্থিতিতে এই সভা গৌরবান্বিত।’ ভীষ্মের এই প্রশংসা শুনে চেদিরাজ শিশুপাল তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। উপস্থিত অনেক রাজাও তাঁকে সমর্থন করলেন। শিশুপাল ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির ও আপনাকে জঘন্য ভাষায় গালাগাল দিতে লাগলেন। ইন্দ্রপ্রস্থের সেই যজ্ঞস্থল আলো করে বসে আছেন ভারতের যত জ্ঞানী, গুণীজন। যেন নক্ষত্রমণ্ডল। ব্যাসদেব আমাদের জন্যে লিখে রেখে গেছেন ভাগবতে :
গৌতম সুমন্ত ভরদ্বাজ দ্বৈপায়ন।
অসিত বশিষ্ঠ কণ্ব মৈত্রেয় চ্যবন॥
কামদেব বিশ্বামিত্র সুরথ সুমতি।
পৈল পরাশর আর গর্গ মহামুনি॥
অথর্ব কশ্যপ ধৌম্য ও বৈশম্পায়ন।
ভার্গব পরশুরাম আর যত জন॥
দামু ঘোষের ছেলে শিশুপাল। তার কী বোলচাল! চারটে হাত নিয়ে জন্মেছিল শিশুপাল। দামু ঘোষ দেখেই বললেন, ‘একে কোথাও ফেলে দিয়ে এসো।’ তখন দৈববাণী হল, ‘শিশুপালজনক, তোমার এই পুত্র মহা বলশালী হবে। তবে যার দর্শনে এর দুটি বাড়তি হাত খসে পড়বে, তারই হাতে এর বিনাশ। অন্য কেউ একে নিধন করতে পারবে না।’ শিশুপালের মা তখন আত্মীয় স্বজন, অন্য রাজাদের আমন্ত্রণ করলেন। প্রত্যেকের কোলে তাঁর শিশুটিকে পর্যায়ক্রমে দিতে থাকলেন এই আশা নিয়ে, দৈববাণী যদি ফলে যায়। না হল না। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে সেই দৈব মানুষটি নেই। এর পরে আপনি গেলেন ভ্রাতুষ্পুত্রের কর্তব্য পালন করতে। আপনি উপস্থিত হওয়ামাত্রই শিশুপালের অতিরিক্ত হাতদুটি খসে পড়ল। শিশুপালের মা তখন আপনার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘তুমি আমার পুত্রের শত অপরাধ নিজ গুণে মার্জনা কোরো এই আমার অনুরোধ।’ আপনি বললেন, ‘আপনার বাক্য আমি লঙ্ঘন করব না।’ শিশুপাল সাবালক হয়ে সব জেনেছিল। ফলে দুঃসাহস বেড়ে গেল। একদিকে তার অসীম শক্তি, অবধ্য। অপরদিকে একমাত্র যাঁর হাতে তাঁর জীবন মরণ তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অতএব সভাস্থলে শিশুপালের লাগামহীন অসভ্যতা আপনাকে সহ্য করতে হবে। ভীষ্ম আপনাকে শ্রেষ্ঠ বলে বন্দনা করলে কী হবে! শিশুপাল নেচে নেচে আপনাকে যাচ্ছেতাই সব কথা বলে চলেছে। ধীর শান্ত হয়ে আপনি শুনছেন। সহদেব আপনার প্রশংসা করেছিলেন। তিনি উচ্চস্বরে বলেছিলেন, ‘সভ্যজন, আপনারা স্থির হয়ে শুনুন, আমি সবিনয়ে বলছি, এই দেব যদুপতি সর্বশ্রেষ্ঠ। সবার আগে এঁর পূজা। এঁর হৃদয় হল বিশ্বের আত্মা। এই জগতে সব যজ্ঞের কারণ দেব যদুপতি। সব মন্ত্রই এঁর মন্ত্র। ইনিই সৃষ্টি, ইনিই সংহার। সর্ব ধর্মের সার। সমস্ত কর্মের আশ্রয়। কৃষ্ণ তুষ্ট হলে জগৎ তুষ্ট। এঁকে পূজা করলেই সকলের পূজা। সেই কারণে সবার আগে আমি শ্রীকৃষ্ণের পূজা করব।’ সকলে একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘সাধু। সাধু।’ সবার আগে রাজা যুধিষ্ঠির এগিয়ে এসে শ্রীকৃষ্ণের শ্রীচরণ পূজা করলেন। পাদ প্রক্ষালন করে সেই জল মস্তকে ধারণ করলেন। তারপর, আপনাকে সাজালেন। অঙ্গে পট্ট পীতবাস। নানা রত্নখচিত মালা। সকলের পুষ্পবর্ষণ। সে কী শোভা! আপনি যে দেবতা!
এইবার শিশুপাল, কৃষ্ণ জ্বালায় তাথই, তাথই, ‘এই যে এই যে শুনুন, শুনুন, সভাসদগণ! ওই একটি বালকের আবোল তাবোল কথায়, আপনাদের পাকা বুদ্ধি টলে গেল। বৃদ্ধরা জ্ঞান হারালেন, সকলেরই বুদ্ধি নাশ হল। অর্বাচীন এক বালক বললে, কৃষ্ণই সকলের সার, সবার আগে কৃষ্ণের পূজা। যত মুনি ঋষি, মহান্ত, গন্ধর্ব, বিদ্যাধর, পুরবাসীরা এক পাশে পড়ে রইলেন, কৃষ্ণকে নিয়ে মাতামাতি, কৃষ্ণ কৃষ্ণ! কে সে? একটা গোয়ালার ছেলে। কুলের অধম, হীন মতি। যজ্ঞঘৃতে বায়সের অধিকার? কুলধর্ম আদি করে কোনও গুণ নাই/স্বধর্মহীন বেটা ধর্মের বালাই। যযাতির শাপে যদুকুলে কেউ রাজা হল না। কদাচারী। লোকালয় ছেড়ে সাগর মাঝে বাস। মথুরায় গোয়ালাদের ঘরে গোয়ালার অন্ন খায়। গোয়ালাদের সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়ায়। তাদের ছেলেদের সঙ্গে খেলা করে। গোরু চরায়। কৌশলে কংসবধ করেছে।’
আপনার নিন্দা শুনে অনেকেই সভা ছেড়ে চলে গেলেন। ভগবানের নিন্দা শোনা মহাপাপ। পাণ্ডবরা ধনুর্বাণ হাতে উঠে দাঁড়ালেন। আর সহ্য করা যায় না। আপনি তাদের শান্ত করলেন। দৈববাণী বলেছিলেন, অন্যের হাতে শিশুপাল মরবে না। তার মৃত্যু কৃষ্ণের হাতে। আপনি আর সময় নষ্ট করলেন না। যজ্ঞ শুরু করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আপনি সুদর্শন চক্রকে আহ্বান করলেন। শত্রু যত বলবানই হোক, আপনার হাতে নিধন মুহূর্তের ব্যাপার। জীবন আর মৃত্যু নিয়ে আপনার ছিনিমিনি খেলা। শিশুপালের মুণ্ড দেহচ্যুত হয়ে মাটিতে পড়ল। আকাশে একই সঙ্গে শত বজ্রের গর্জন। শিশুপালের দেহ হতে একটা মহাতেজ নিষ্ক্রান্ত হয়ে আপনার শরীরে প্রবেশ করল। প্রভু! এ কি সাধারণ মৃত্যু! আপনি আপনাকে পাওয়ার কত পথই না খোলা রেখেছেন! তাই না? শত্রু ভাবি শিশুপাল মুক্তি পদ পায়, যে-ভাবে যে ভাবে কৃষ্ণ সেই ভাবে পায়। কী, তাই তো? মাত্র তিন জন্মে শিশুপাল জন্মচক্র থেকে মুক্তি পেল। আর ক্ষেত্রটা কী? রাজসূয় যজ্ঞস্থল।
কিন্তু, অপরাধ নেবেন না প্রভু, বলতে বাধ্য হচ্ছি, আপনি যেখানে মৃত্যুও সেখানে। আপনার বরাত। অর্থাৎ ভগবানেরই বরাত। যজ্ঞের উদ্দেশ্য, শান্তি, সামগ্রিক কল্যাণ। দেবতারা উপস্থিত। সেখানেও শিশুপাল উপদ্রব। বাঁশি ফেলে চক্রধারণ। রক্তপাত। আসলে আপনি তো পৃথিবীতে সুখ ভ্রমণে আসেননি। এসেছেন বেঠিককে ঠিক করতে। আপনার আগমনের উদ্দেশ্য আপনি নিজ মুখেই বলেছেন আপনার বিখ্যাত সেই ঘোষণা-
যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।
এই কথা আপনি অর্জুনকেই বলেছিলেন, হে ভারত, যখনই যখনই ধর্মের গ্লানি, অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি দেহ ধারণ করে অবতীর্ণ হই। জীবমাত্রই ধর্মাধর্ম কর্মবশে জন্মগ্রহণ করে, আমি কিন্তু কর্মপরতন্ত্র নই শুধু জগতের কল্যাণ সাধন করব এই সংকল্প নিয়ে নিজের ত্রিগুণাত্মিকা মায়াকে আশ্রয় করে নরদেহ ধারণ করে জগতে আবির্ভুত হই। মুক্তিকামী সাধুদের পাপ থেকে পরিত্রাণ করে মুক্তি পথের সন্ধান দিতে, দুষ্কৃতীদের দুষ্কৃতির বিনাশ করে মুক্তিপথে আনা, ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই, নরদেহ ধারণ করি।
কাম্যকবনের সেই অরণ্য সন্ধ্যায় অর্জুন ধীরে ধীরে প্রকাশ করছেন আপনাকে। কেন বলুন তো? আপনি যে তাঁর আত্মবিশ্বাস। আপনি যে একই সঙ্গে মৃত্যু জীবন, জীবন মৃত্যু। আপনি একই সঙ্গে পথ ও পথ চলা। প্রভু! কেউ বদলায় না। সাজঘরে ফিরে যায়, সাজ বদল করে আসে। সেই কারণেই কুরুক্ষেত্র। এই যাওয়া আসার পথ আপনারই ভেতর দিয়ে। যজ্ঞসভায় শিশুপাল বধের অব্যবহিত আগে ভীষ্ম কী বললেন? যা শুনে শিশুপাল তেড়েফুঁড়ে উঠলেন। প্রভু, একটি কথা আমার এই ক্ষুদ্র মুখে আপনাকে বলি, শিশুপালরা অমর। কারণ, মানুষের মনে প্রোথিত ‘অবিশ্বাসের’-ই নাম ‘শিশুপাল।’ ভীষ্মের বিশ্বাস, শিশুপালের অবিশ্বাস, চিরকালের দ্বন্দ্ব। ভীষ্ম বলেছিলেন,
কৃষ্ণ এব হি লোকানামুৎপত্তিরপি চাপ্যয়ঃ।
কৃষ্ণস্য হি কৃতে বিশ্বমিদং ভূতং চরাচরম্।
অয়ন্তু পুরুষোবালঃ শিশুপালো ন বুধ্যতে।
সর্বত্র সর্বদা কৃষ্ণং তস্মাদেবং প্রভাষতে।
মৃত্যু আবার কী? মৃত্যু বলে তো কিছু নেই। প্রকাশ আর অপ্রকাশ। লয় আর বিলয়। আপনার বিশ্বরূপ। স্বরাট, বিরাট, চিদঘন। বিশাল আর বিপুল একটি দেহ। অসংখ্য কোষের মতো, অগণ্য জীবন। কিছু মরে গেলেই সঙ্গে সঙ্গে নতুন জীবনে সেই স্থানটি ভরে গেল। একটিই শব্দ, ‘আছে।’ ‘নেই’ বলে কিছু নেই।
আসুন অর্জুন কী বলছেন শুনি। এখনও তিনি আপনার বিশ্বরূপ দর্শন করেননি। আপনার অতীত বলছেন। ‘মধুসূদন! তুমি বিশালনগরীর বদরিকাশ্রমে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে শতবছর এক পায়ে দাঁড়িয়ে তপস্যা করেছিলে। তুমি উত্তরীয় পর্যন্ত পরিত্যাগ করে সরস্বতী নদীর তীরে ধমনিসার কৃশ শরীরে দ্বাদশবর্ষব্যাপী যজ্ঞ করেছিলে। তুমি পুণ্যপুরুষগণের নিবাসস্থান প্রভাস তীর্থে নিয়ম অবলম্বন করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে দিব্য সহস্র বছর তপস্যা করেছিলে। ব্যাসদেব আমাকে বলেছেন, তুমি সমস্ত মানুষের প্রবৃত্তির হেতু। তুমিই সমস্ত প্রাণীর হৃদয়ে ক্ষেত্রজ্ঞ। তুমিই সর্ব ভূতের আদি ও অন্ত। তুমিই সব তপস্যার আধার। তুমিই সনাতন যজ্ঞস্বরূপ।’
অর্জুন আজ ভাব মথিত। রাজ্যহারা যুধিষ্ঠির, ধর্মরাজ। তিনি শকুনির চক্রান্তে নিঃসম্বল বনবাসী। কয়েক হাত ব্যবধানে স্বয়ং ভগবান বসে আছেন। তিনি স্বচক্ষে তাঁর অতি প্রিয়জনদের অবস্থা দেখতে এসেছেন। আমি অর্জুনের আবেগে বাধা দিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করব না, কিন্তু প্রশ্ন আছে। অর্জুন আরও কী বলছেন শুনুন। তিনি বলছেন, বলছেন আপনার সংগ্রামের কথা, ‘হে কৃষ্ণ! তুমি সর্বলোকের হিতের জন্য অলৌকিক কর্ম করতে গিয়ে যেসব দৈত্য-দানবদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছ তুমি তাদেরই বধ করেছ। হে মহাবাহো কেশব, তারপর তুমি তোমার সর্বেশ্বরত্ব ইন্দ্রকে প্রদান করে এই মর্তলোকে আবির্ভূত হয়েছ। তুমিই প্রথমে নারায়ণরূপ ধারণ করে পরে হরিরূপ ধারণ করলে। ব্রহ্মা, চন্দ্র, সূর্য, ধর্ম, ধাতা, যম, অনল, বায়ু, কুবের, রুদ্র, কাল, আকাশ, পৃথিবী, দিকসমূহ, অজ আর চরাচর জগতের গুরু ও সৃষ্টিকর্তা-এ সবই তুমি।
‘তুমি দেবগণের শিরোমণি, সকল লোকের আশ্রয়, মহাতেজস্বী, তবু চৈত্ররথ বনে লোকশিক্ষার জন্যে অনেক যজ্ঞ করেছ। তুমি আবার অদিতির পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করে সর্বত্র বিষ্ণু নামে বিখ্যাত হয়েছ। তুমি বামনাবতারে শিশু হয়েও নিজের তেজে তিনটি মাত্র পাদক্ষেপে স্বর্গ, মর্ত ও অন্তরীক্ষ পরিব্যাপ্ত করেছ।
‘সহস্র সহস্রবার তুমি এইভাবে মর্তে আবির্ভূত হয়েছ। প্রত্যেক আবির্ভাবেই তুমি অধর্মে আসক্ত শত শত অসুরকে বিনাশ করেছ। সুর-অসুরের লৌহশৃঙ্খল ছেদন করেছ, নিসুন্দ নরকাসুরকে বধ করে প্রাগজ্যোতিষপুরের পথ সুগম করে দিয়েছ। জারুথী নগরীতে আহুতি, ক্রাথ, সহায়কগণের সঙ্গে শিশুপাল, জরাসন্ধ, শৈব্য ও শতধন্বাকে পরাজিত করেছ। তুমি রুক্ষ্মিণীকে পরাজিত করে রুক্ষ্মিণীকে ভার্যা হিসেবে লাভ করেছ। ইন্দ্রদ্যুম্ন, যবন কসেরুমানকেও তুমি বধ করেছ। অবশেষে সৌভপতি শ্বাল্বের সৌভবিমান ভূতলে নামিয়ে তাকে বধ করেছ। আরও অনেক অসুরভাবাপন্ন রাজাদেরও একই পরিণতি হয়েছে। ইরাবতী নগরীতে বীর ভোজ কার্তবীর্যার্জুনকেও তুমি বধ করেছ।’
পরিশেষে কী হবে? এবারের লীলা আপনি কীভাবে শেষ করবেন, অর্জুন সেকথাও বললেন। ‘সমস্ত ভোগ্য সামগ্রীতে পরিপূর্ণ, ঋষিদের প্রিয় পুণ্যময়ী নগরী দ্বারকা যখন ঋষিদের অপমান করবে, তখন তুমি এই দ্বারকানগরীকে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়ে ইহলোক থেকে অন্তর্ধান করবে।’
অরণ্য রাত্রি এমনিতেই বিষণ্ণ। অন্ধকারে গুটিয়ে আসে। দিনের প্রাণীরা নিদ্রায়। ইতস্তত ভ্রাম্যমাণ নিশাচরেরা। মুনি ঋষিরা ধুনি জ্বেলে প্রাচীন বৃক্ষতলে ধ্যানমগ্ন। ছায়া ছায়া মূর্তি। অর্জুনের শেষ কথায় বাতাসও যেন স্তব্ধ হল। নীরব অর্জুন : একসময় শ্রীকৃষ্ণ থাকবেন না। যদুবংশ ধ্বংস হবে। স্বপ্ননগরী চলে যাবে সমুদ্রের অতলে। এইবার আপনি বললেন, সেই কথা যা পাণ্ডবরা পূর্বে কখনও শোনেননি। অর্জুনের প্রকৃত পরিচয়। এই কথায় স্তব্ধ হয়ে আছে তিনটি কাল। আপনি একটি মোড়ক খুলে দিলেন, ‘অর্জুন !’ তুমি আমারই, আমিও তোমারই। যারা আমার অনুগামী, তারা তোমারও অনুগামী। সেই কারণে যারা তোমাকে দ্বেষ করে, তারা আমাকেই দ্বেষ করে, যারা তোমার অনুকূল, তারা আমারও অনুকূল। আমি যেমন নারায়ণ তুমিও তেমনই নর। আমরা দু’জনেই পূর্বে নর ও নারায়ণ ঋষিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলুম।
অনন্যঃ পার্থ মত্তস্তং ত্বত্তাশ্চাহং তথৈব চ।
নাবয়োরন্তরং শক্যং বেদিতুং ভরতর্ষভ॥
আমি যেমন তোমা হতে অনন্য, সেইরকম তুমিও আমা হতে অনন্য। আমাদের দু’জনের মধ্যে ভেদ ঘটানো কারও পক্ষে সম্ভব নয়। দুঃসাধ্য।
প্রভু! দ্রৌপদী এতক্ষণ অন্তরালে ছিলেন। এইবার তিনি তাঁর ভ্রাতাদের সঙ্গে আসছেন। তিনি কে আপনি জানেন। অর্জুন আপনার সখা, দ্রৌপদী আপনার সখী। যজ্ঞাগ্নি থেকে তাঁর জন্ম। কী কাণ্ডই না তখন হত এই ভারতে। হরিদ্বারে গঙ্গার তীরে মহাপ্রাজ্ঞ, মহাতপস্বী ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম। আকুমার ব্রহ্মচারী, তিনি একদিন গঙ্গায় স্নান করতে গেছেন। সেখানে আগে থেকেই অপ্সরা ঘৃতাচী স্নান করছিলেন। তীরে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এমন সময় তীব্র বাতাসে তাঁর বস্ত্র উড়ে গেল। তিনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ। আকুমার ব্রহ্মচারী ভরদ্বাজ সেই অপূর্ব নগ্ন নারীশরীর দর্শনে এতটাই উত্তেজিত হলেন রেতঃপাত হয়ে গেল। সেই বীর্য তিনি একটি কলসে ধারণ করলেন। যজ্ঞকলসে বীর্য। যজ্ঞকলসকে বলা হয় দ্রোণ। ধীমান ঋষি ভরদ্বাজের সেই অমোঘ বীর্য থেকে দ্রোণের জন্ম হল। ভরদ্বাজের সখা রাজা পৃষতেরও এই একই সময় দ্রুপদ নামে একটি পুত্র হল।
‘আপনি অবাক হচ্ছেন, এসব কেন বলছি। ধ্রুপদ আর ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রমে গিয়ে খেলা করত। আর একটু বড় হয়ে ঋষির কাছে অধ্যয়ন করত। অটুট বন্ধুত্ব; কিন্তু থাকবে না। আপনার হাজার হাজার বছরের আসা যাওয়ায় অবশ্যই লক্ষ করেছেন, সদ্ভাব, সদ্ভাবনা, সম্পর্ক বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন বজায় থাকে না। ধমনির রক্তে সাপের বিষ। ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ পৃষতকুমার দ্রুপদ। পৃষতের মৃত্যুর পর রাজা হলেন। এইসময় দ্রোণাচার্য শুনলেন, পরশুরাম তাঁর সমস্ত ধন ব্রাহ্মণকে দান করে বনবাসে যাচ্ছেন। দ্রোণাচার্য ছুটলেন। গিয়ে বললেন, ‘আমি ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণ, আমাকে ধনদান করুন।’ পরশুরাম বললেন, দেরি করে ফেলেছ। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মাত্র দুটি বিদ্যা পড়ে আছে, শরীরবিদ্যা আর অস্ত্রবিদ্যা। এর যে-কোনও একটা তুমি নিতে পারো।’
দ্রোণ চেয়ে নিলেন ধনুর্বিদ্যার সঙ্গে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও তার প্রয়োগ আর সংহার বিদ্যা।
‘প্রভু! অহংকারের চেয়ে অবিদ্যা আর কী আছে?’
‘তুমি কি তা বুঝেছ?’
‘অবশ্যই।’
‘বেরোতে পেরেছ?’
‘পারিনি প্রভু।’ রোগটা ধরা পড়েছে, তবে এর মনে হয় কোনও ওষুধ নেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের রথে দাঁড়িয়ে আপনি বলেছিলেন,
অহঙ্কারং বলং দর্পং কামং ক্রোধঞ্চ সংশ্রিতাঃ।
মামাত্মপরদেহেষু প্রদ্বিষন্তোঽভ্যসূয়কাঃ॥
অহংকার, বল, দর্প, কাম, ক্রোধ— ধোঁয়ায় ধোঁয়া। আপনিই যে ক্ষেত্র, অর্থাৎ আপনি, আপনিই আবার ক্ষেত্রজ্ঞ, অর্থাৎ ‘আমি’, সেইটিই যে ভুল হয়ে যায় প্রভু!’
‘ওহে! এই ভুলটাই তো জগৎ জীবন। যা নেই যা থাকবে না, তার পেছনে দৌড়োদৌড়ি। একটা জিনিস লক্ষ করো। ঘটনার পর ঘটনা সময়কে কীভাবে কুরুক্ষেত্রের দিকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। দেখো, দ্রোণের হঠাৎ কী অহংকার! বাল্যবন্ধু রাজা দ্রুপদকে গিয়ে বলছে, ‘হে রাজন! দ্রোণকে তোমার সখা বলে জানবে।’ ভরদ্বাজমুনির আশ্রমে তাদের বাল্যকালের সেই দিনগুলি।
রাজা দ্রুপদেরও প্রবল অহংকার। দ্রুপদ ভয়ংকর প্রত্যুত্তর দিলেন,
নাশ্রোত্রিয়ঃ শ্রোত্রিয়স্য নারথী রথিনঃ সখা।
নারাজা পার্থিবস্যাপি সখিপূর্বং কিমিষ্যতে॥
সরাসরি অপমান! নীতিজ্ঞানের মোড়কে পাদুকা প্রহার। ‘অবেদবিদ্ বেদবিদের, অরথী রক্ষীর আর অরাজা কখনও রাজার সখা হতে পারে না। অতএব পূর্বের বন্ধুত্ব স্মরণ করে কী লাভ?’
‘প্রভু! কথাটা চিরকালের সত্য! তাই না! এইবার আমি আপনাকে বোকার মতো প্রশ্ন করছি।
আপনি বললেন, আপনিই সব। চরাচর বিশ্ব আপনারই প্রকাশ, যে তেজ সূর্যে, যা এই অখিল উদ্ভাসিত করে, যে তেজ চন্দ্রের, অগ্নিতে যে তেজ, সব তেজই আপনার। আমি আপনাকে উদ্ধৃত করি।’
‘কোথা থেকে করবে?’
‘অর্জুনকে বলছেন গীতায়। এই তো এই রাতের ক’দিন পরেই তো কুরুক্ষেত্র। আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে চরাচর ভূতসকলকে ধারণ করি, রসাত্মক চন্দ্ররূপে যবাদি, ওষধিক পুষ্ট করি। আমি জঠরাগ্নি। প্রাণ ও অপান বায়ুর সঙ্গে মিলিত হয়ে চর্ব্য, চুষ্য, লেহ্য ও পেয়, এই চারপ্রকার খাদ্য পরিপাক করি। আমি প্রাণীর হৃদয়ে অন্তর্যামী, আমিই স্মৃতি ও জ্ঞান। আমি অজ্ঞান।’
‘তুমি বিশ্বাস করো!’
‘আপনি বলছেন, আমি বিশ্বাস করব না। সেই বিশ্বাস থেকেই বলছি, আপনি বক্তা, আপনিই শ্রোতা, আপনিই বাদী, আপনিই বিবাদী, আপনিই দাত্য, আপনিই গ্রহীতা, এই বিরাট বিশ্বে একাই পুতুল খেলছেন। দ্রোণ আর দ্রুপদের মাধ্যমে আপনি বিশেষ কিছু একটা করতে চাইছেন।’
‘কীরকম?’
‘দ্রৌপদীর জন্ম।’
‘এই রে ধরে ফেলেছ।’
‘আপনি কী বলবেন জানি না। জাতিভেদ, ধর্মভেদ, ধনী ও দরিদ্রভেদ, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ভেদ, সাদা ও কালো ভেদ, এইসব ভেদাভেদ কোনও দিন দূর হবে না। দ্রুপদ তাঁর বাল্যবন্ধুকে স্পষ্ট মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের বন্ধুত্ব হয় না।’ শুধু তাই নয়, একরাতের বেশি থাকতেও দিলেন না। পরের দিন বিদায় করে দিলেন। প্রথম জীবনে দ্রোণ দরিদ্র ছিলেন। ঋষিপুত্র ও রাজপুত্রের জীবনে অনেক তফাত। মৃত্যুর সময় পিতা ভরদ্বাজ বলেছিলেন বিবাহ কোরো। শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে বিবাহ করলেন।
‘দ্রুপদের কুৎসিত ব্যবহার হজম করে হস্তিনাপুরে এলেন, তাঁর শ্যালক কৃপাচার্যের গৃহে। কৃপাচার্য হস্তিনাপুরের রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষক।
‘ভীষ্ম সংবাদ পেয়ে দ্রোণাচার্যকে ডেকে পাঠালেন। আপনি সবই জানেন, তবু বলছি। ঋষি আর রাজাদের ভারতের দারিদ্র্যের করুণ চিত্র। দ্রোণ ভীষ্মকে বলছেন, ‘আমি জটাধারী ব্রহ্মচারীরূপে ধনুর্বেদ শিক্ষার জন্য অনেক বছর মহর্ষি অগ্নিদেবের কাছে ছিলুম। পাঞ্চালকুমার দ্রুপদ আমার সতীর্থ, আমার পরম বন্ধু। তিনি বাল্যকালে আমাকে বলেছিলেন— ভবিষ্যতে আমি রাজা হলে সে রাজ্য তোমারও হবে। তাঁর কথা আমার মনে ছিল। কালক্রমে পিতৃআজ্ঞায় আমি বিয়ে করি। আমার ধর্মপত্নী সব কাজে আমার সহায়ক। এক পুত্র আমার। তার নাম দ্রোণি, অত্যন্ত তেজস্বী। আমার শিশুপুত্র ধনীপুত্রদের দুধ-পান দেখে, দুধ খাওয়ার জন্য আমার কাছে খুব বায়না করত। আমি সারা দেশ ভ্রমণ করেও সদুপায়ে একটি দুগ্ধবতী গাভী সংগ্রহ করতে পারিনি। ধনীপুত্ররা একদিন তাকে দুধ বলে পিটুলিগোলা জল খাওয়াল। শিশু দুধ খেয়েছে মনে করে আনন্দে দু’হাত তুলে নৃত্য করছে, আর তারা হা হা করে হাসছে। এই ঘটনা এতটাই মর্মান্তিক আমি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে বাল্যসখা দ্রুপদের কাছে আসি। সেখানেও উপহাস। সেই কারণেই আমি হস্তিনাপুরে।
‘ভীষ্ম, তাঁর কোনও তুলনা নেই। তিনি মহানন্দে বললেন, ‘ভাবনা কীসের! আপনি কুমারগণের অস্ত্রশিক্ষক হয়ে এখানে সসম্মানে রাজার হালে থাকুন। এ রাজ্যের আপনিই মালিক। কৌরবরা আপনার অধীনে বাস করবে।’
দ্রোণ বললেন, ‘তা হয় না। কৃপাচার্য দুঃখ পাবেন, আমাকে বরং কিছু ধন দান করে বিদায় করুন।’ ভীষ্ম বলে উঠলেন, ‘সে উপায় নেই, কৃপাচার্য আর দ্রোণাচার্য দু’জনেই সসম্মানে এই রাজ্য আলো করে থাকবেন।’
‘প্রভু! এসবই আপনার খেলা! কী চমৎকার ঘুঁটি সাজাচ্ছেন। একই অস্ত্রগুরুর কাছে অস্ত্রবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা শিখছে দুই রাজবংশের কুমাররা। বিদ্যার চরম পরীক্ষা হবে কুরুক্ষেত্রে।
‘প্রভু! এ আপনার কী খেলা! গড়া জিনিস ভাঙা! মহাকালে বসে কালকে চিবোচ্ছেন। ছিবড়ে ফেলে দিচ্ছেন এদিকে ওদিকে। প্রেমিক নিষ্ঠুর! গোপীরা দেখল এক, ঋষিরা দেখলেন আর এক, দেবতারা ভীত।
অর্জুনের সখা! অর্জুন তুমিও বুঝবে— আসছে সেদিন। দেখবে, আকাশ-পাতাল আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে আছেন শ্যাম নয় শ্যামা। নির্দয়, নিষ্ঠুর কণ্ঠে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন,
কালোঽস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো।
লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ।
ঋতেঅপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে
যেঽবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ॥
ধ্বনি-প্রতিধ্বনি— আমি কাল, অতিভীষণ লোকক্ষয়কারী কাল। আমি সংহারকারী। তুমি যুদ্ধ করো আর নাই করো বিপক্ষদলের যোদ্ধাদের কেউই জীবিত থাকবে না। আমি মহাকাল। আপনার বিশ্বরূপ দর্শনে ভীত অর্জুন তখন বলবেন, হে সর্বাত্মন্, আপনাকে সম্মুখ হতে নমস্কার, পশ্চাৎ দিক হতে নমস্কার, সকল দিক হতে নমস্কার, অনন্তবীর্যানিত বিক্রমস্তং হে অনন্তবীর্য, আপনি অসীম বিক্রমশালী, সমগ্র বিশ্বকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন, আপনি ছাড়া আর কিছুই নেই, সবই আপনি, আপনি সর্বস্বরূপ।’
‘প্রভু! অনেক অনেক ব্যাখ্যা! আপনার গীতার একশো আঠারোটা ভাষ্য। কে আপনি, কী আপনি? পথ কোথায়? যুদ্ধ, ধর্মযুদ্ধ, শাস্তি, লয়, প্রলয়? আপনার খুব কাছে এসে আজ এই অরণ্যের রাত্রে একটি সহজ সমাধান পেলুম বুঝি? আমি পণ্ডিত নই, ভীরু মানব। দৈত্যের মতো আকাঙ্ক্ষা, থকথকে কালো মৃত্যু, জীবন ঝরে পড়ছে অরণ্যের বৃক্ষপত্রের মতো! কতটুকু সময়ের জন্যে বেঁচে থাকার অনুভূতি! ছোট্ট ছোট্ট আলোর জোনাকি। টুস টুস করে জ্বলছে আর নিবছে।’
‘আসল কথাটা বলো।’
‘জন্ম আর মৃত্যু যেখানে এক, তিনিই ভগবান। জীবে এই দুই অবস্থা ভিন্ন। মৃত্যু একরকম, জীবন আর একরকম অবস্থা। ঈশ্বর এটি একটি ত্রিভুজ। যজ্ঞবেদিতে যে যন্ত্র আঁকা হয়, সে তো এই ত্রিভুজ, সেটিকে ঘিরে একটি বৃত্ত, সেটিকে ঘিরে একটি আয়তক্ষেত্র। এইটিই তো আপনার ক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রেই জীবনরূপ অগ্নির আবাহন। জীবনের এক-একটি দিনের আহুতি। অবশেষে বিসর্জন। ত্রিভুজটিকে ঘিরে যে বৃত্ত, ওটি হল জন্মচক্র। বারে বারে আসা আর যাওয়া। তাই না প্রভু!’
‘রহস্যটা রহস্যই থাক। আমিও জানি না সমাধান কী? আমাকেও মাতৃগর্ভে আসতে হয়েছে কারাগারে। বরং দ্রৌপদীর আসাটা অলৌকিক। পুরুষ আর প্রকৃতির মিলনের প্রয়োজন হয়নি। অযোনিসম্ভুতা।’
‘দ্রোণাচার্যই পথ করে দিলেন। দ্রুপদের অপমান বিস্মৃত হতে পারেননি তিনি। তিনি এখন অস্ত্রাচার্য। কৌরব ও পাণ্ডব রাজপুত্ররা তাঁর বীর শিষ্য। তিনি তাঁর এই শিষ্যদের কাছ থেকে এইবার গুরুদক্ষিণা চাইলেন। কী সেই দক্ষিণা?
দ্রোণ বললেন, ‘দ্রুপদকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসো। প্রথম যুদ্ধে কৌরবকুমাররা প্রায় পরাজিত। তখন পঞ্চপাণ্ডব রণাঙ্গনে নামলেন। দ্রুপদ পরাজিত, বন্দি। দ্রোণের সামনে তাঁকে হাজির করা হল। দ্রোণ বললেন, ‘দ্রুপদ! তোমার রাজ্য জয় করেছি। তোমার জীবন-মৃত্যু এখন আমার হাতে। আমি তোমার বাল্যসখা। প্রাণের ভয় কোরো না। আমরা ক্ষমাশীল ব্রাহ্মণ। তোমাকে অর্ধরাজ্য প্রদান করছি। এখন ইচ্ছা করলে আমাকে সখা বলে মনে করতে পারো।’ দ্রুপদ বললেন, ‘এ ধরনের আচরণ শক্তিমান মহাত্মারাই করতে পারেন। আমি প্রীত হয়েছি। তোমার বন্ধুত্ব যেন চিরদিনই পাই।’
‘দ্রোণের কথায় প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ। তিনি বলছেন, ‘তুমি ভাগীরথীর দক্ষিণ তীরের রাজা থাকবে, আর আমি উত্তর তীর শাসন করব। এবার বোধহয় তোমার সঙ্গে আমার সখ্যতা হতে পারে।’
‘এই দ্রোণাচার্য কী সাংঘাতিক! ব্রাহ্মণের ব্রহ্মতেজের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকারের ব্রহ্মাস্ত্র, দিব্যাস্ত্রের প্রযুক্তি একত্রিত হয়ে ভারতবর্ষের এক অদ্বিতীয় অস্ত্রগুরু। কৌরবপক্ষীয় এক মহাযোদ্ধা। দ্রুপদকে বন্ধনমুক্ত করে দিলেন। দ্রোণ কোনওদিন রাজ্যশাসন করেননি। দ্রুপদই প্রকৃত রাজা রইলেন।
‘প্রভু! আপনি অর্জুনকে বলেছিলেন, সুখ আর দুঃখ আলাদা কিছু নয়, জয়, পরাজয় দুটিই সমান, জন্মের সঙ্গে মৃত্যু, মৃত্যুর পরে আবার জন্ম, আপনি স্বয়ং উপস্থিত, আপনি স্বয়ং ভগবান— এ বোধও অনেকের হয়েছে, তবু দেখুন, মান, অপমানবোধ, ঈর্ষা, দ্বেষ, শোধ, প্রতিশোধ, ক্রোধ, প্রতিহিংসা। দ্রুপদ বন্ধনমুক্ত হলেও মুখে তাঁর চুনকালি। দ্রোণের প্রভাব, বিনয়, শিক্ষা চরিত্র, ক্ষাত্রবল অতিক্রম করা দুঃসাধ্য। অথচ প্রতিশোধের, দ্রোণকে যুদ্ধে পরাস্ত করার মতো বীর ভারতে কোথায়! সমস্ত বীর রাজকুমার তো তার শিবিরে। সেখানে অর্জুন। অস্থির দ্রুপদ গঙ্গার তীর ধরে ভ্রমণ করতে করতে এলেন কল্মাষী নগরে। তাঁর মনে হল, স্থানটি ভারী পবিত্র। ব্রাহ্মণের বাস। প্রত্যেকেই ব্রহ্মচর্য পালন করে বেদ, বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করে স্নাতক হয়েছেন। এইখানেই দ্রুপদ পরিচিত হলেন দু’জন তেজস্বী, শান্তপ্রকৃতির ব্রাহ্মণের সঙ্গে। একজনের নাম যাজ, আর একজনের নাম উপযাজ। দু’জনেই সংহিতা অধ্যয়ন করেন, কাশ্যপ গোত্রীয়, সূর্যোপাসক।
‘রাজা প্রথমে কনিষ্ঠ উপযাজককে আমন্ত্রণ করলেন। অর্চনা করলেন যথোচিত মর্যাদায়। তারপর বললেন, ‘আপনি যদি আমাকে এমন একটি পুত্র দান করতে পারেন যে দ্রোণকে বধ করতে পারবে, তা হলে আমি আপনাকে দশ কোটি গাভী প্রদান করব। তা ছাড়া আপনার যদি আরও কামনা থাকে তাও পূরণ করব।’
উপযাজ বললেন, ‘আমি পারব না। আপনি আমার দাদা যাজকে বলুন।’
উপযাজ বললেন, ‘দাদার মনে এখনও কামনা আছে। আমি দেখেছি, অরণ্যে ভ্রমণকালে ভূমির শুদ্ধতা বিচার না করেই পড়া ফল কুড়িয়ে নিলেন। আমার ধারণা, তিনি শুচি-অশুচির সংস্কার হতে মুক্ত । খাদ্যের স্পর্শদোষ মানেন না। গুরুকুলে অধ্যয়নের সময় দেখেছি, অন্যের পরিত্যক্ত ভিক্ষালব্ধ অন্ন নির্বিচারে ভক্ষণ করতেন। নির্লজ্জভাবে সেই অন্নের বারবার প্রশংসাও করতেন। অর্থাৎ তাঁর ঐহিক ফলের কামনা অবশ্যই আছে। আপনি তাঁর আশ্রমে যান। তিনি আপনার জন্যে যজ্ঞ করবেন।’
‘যাজের আচরণ সমর্থন করা যায় না। অশাস্ত্রীয়। রাজা তবু গেলেন। দ্রোণের বিনাশ না হলে মনের অশান্তি কমবে না। তিনি যাজকে বললেন, ‘আপনাকে আশি হাজার গোদান করব, আমাকে এমন একটি পুত্র দিন যে দ্রোণের মতো অবধ্যকে বধ করতে পারবে। এই দ্রোণ ব্রাহ্মণ হয়েও ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ। মহাধনুর্ধর।’
‘উত্তেজিত দ্রুপদ বললেন, আমি আপনাকে দশ কোটি গাভী দান করব।’
‘যাজ, ‘তথাস্তু’ বলে যজ্ঞের জন্যে প্রস্তুত হলেন। যাজ আর উপযাজ দু’জনে একসঙ্গে শুরু করলেন মহাযজ্ঞ। একসময় সেই বৃহৎ যজ্ঞ শেষ হল। যাজ ধ্রুপদের পত্নীদেবীকে ডাকলেন, ‘হে রাজ্ঞী আপনি শীঘ্র আসুন। মিথুন, অথাৎ সন্তান যুগল আপনার সামনে আবির্ভূত হয়েছেন।’
‘এত বড় একটা যজ্ঞ হচ্ছে, রাজ্ঞীদেবী কেন এতটা অপ্রস্তুত। তাঁর মুখে পান। মুখভরতি পানের রস। শরীরে গন্ধদ্রব্য ধারণ করছেন। তিনি বললেন, ‘আমি অপ্রস্তুত। যজ্ঞস্থলে গিয়ে এখনই পুত্রগ্রহণ করতে পারছি না। অপেক্ষা করতে হবে।’
‘যাজ বললেন, ‘যে হবিঃ আমি পাক করেছি, যা উপযাজ অভিমন্ত্রিত করেছে, তা ফলপ্রদান করবেই। হয় আপনি আসুন, অথবা ওইখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।
‘যাজ সংস্কৃত অগ্নিতে আহুতি প্রদান করলেন। তখনই অগ্নির মধ্যে প্রকাশিত হলেন এক দেবকল্প পুত্র। দৃশ্যটি কী সাংঘাতিক! অগ্নির ন্যায় বর্ণবিশিষ্ট, ঘোরাকার, উত্তম কিরীটধর্মধারী সেই কুমার খড়্গ, শর ও ধনু হাতে মুহুমুর্হুঃ গর্জন করতে করতে অগ্নি হতে উঠল। সেই বালক এক উত্তম রথে চড়ে তখনই যুদ্ধে অগ্রসর হল। তাই দেখে পাঞ্চালরা আনন্দে ‘সাধু’, ‘সাধু’ বলে উঠলেন। দৈববাণী হল, এই রাজকুমার রাজা দ্রুপদের শোকহারী, পাঞ্চালগণের ভয়নাশকারী,যশস্কর, দ্রোণবধের জন্যেই জন্মেছে।
‘এরপর যজ্ঞবেদি হতে প্রকাশিত হলেন কুমারী পাঞ্চালী। দেখলেই বোঝা যায়, কন্যা সৌভাগ্যবতী, অঙ্গসমূহ দর্শনীয় লোচন অতিকৃষ্ণ বিস্তৃত। ব্যাসদেবের বর্ণনা,
শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী নীলকুঞ্চিত মূর্ধজা।
তাম্রতুঙ্গনখী সুভ্রূশ্চারু পীনপয়োধরা॥
মানুষং বিগ্রহংকৃত্বা সাক্ষাদমনবর্ণিনী।
নীলোৎপলসমো গন্ধো যস্যাঃ ক্রোশাৎপ্রধাবতি॥
যা বিভর্তি পরং রূপং যস্যাঃমাস্তাপমা ভুবি।
দেবদানব যক্ষাণামী পিসতাং দেবরুপিণীম্॥
‘প্রভু! ব্যাসদেব পাঞ্চালীকে কত যত্নে গড়েছেন! তিনি কৃষ্ণবর্ণা, নয়নদ্বয় পদ্মপত্রের মতো বিশাল, কেশ নীলবর্ণ কুঞ্চিত, নখসমূহ, তাম্রবর্ণ, উন্নত, ভ্রূযুগল ও স্তনদ্বয় সুন্দর ও স্থূল। সাক্ষাৎ অমরকন্যা যেন মানুষের রূপ ধারণ করে অবতীর্ণ হলেন। তাঁর শরীর থেকে নীলপদ্মের গন্ধ এক ক্রোশ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল।
‘আবার আকাশবাণী, ‘সর্বনারীশ্রেষ্ঠা এই কৃষ্ণা সমস্ত ক্ষত্রিয়কে ধ্বংস করবে। দেবগণের কার্যসাধনের জন্যেই এঁর জন্ম। এঁর আবির্ভাবে কৌরবগণ ভীত।
‘বেদব্যাস এলেন। পাঞ্চালীর পূর্বজন্মের ইতিহাস বললেন, ‘কোনও তপোবনে এক মহাত্মা ঋষির এক কন্যা ছিল, বিলগ্নমধ্যা সুশ্রোণী সুভ্রূঃ সর্বগুণান্বিতা। কৃশমধ্যা, সুশ্রোণী, সুভ্রূ, সর্বগুণে অলংকৃতা। এই কন্যাটিরও পূর্বজন্ম। সেই জন্মের কোনও দুষ্কর্মের ফলে, এই জন্মে তার পতিলাভ হল না। তখন সে পতিলাভের জন্যে মহাদেবের উপাসনা শুরু করল। ভগবান শঙ্কর সন্তুষ্ট হয়ে দর্শন দিলেন, বললেন, ‘তোমার কল্যাণ হোক, আমি সন্তুষ্ট হয়ে তোমাকে বর দিতে এসেছি।’ তখন সেই কন্যার প্রার্থনা,‘আমাকে সর্বগুণালংকৃত পতি প্রদান করুন, পতি প্রদান করুন, পতি প্রদান করুন, পতি প্রদান করুন, পতি প্রদান করুন।’
‘শঙ্কর তাকে বললেন, ‘কল্যাণী! তোমার পাঁচটি পতি হবে।!
‘প্রভু! আমি আপনার কাছে একজন পতিই প্রার্থনা করি।’
‘শঙ্কর বললেন, ‘ভদ্রে! তুমি পতিং দেহি’ বলে পাঁচবার প্রার্থনা করেছ। সুতরাং তোমার পাঁচ পতিই হবে, তবে এ জন্মে নয়, পরের জন্মে।’ দ্রুপদের যজ্ঞাগ্নিতে সেই কন্যারই আবির্ভাব।
‘ব্যাসদেব পঞ্চপাণ্ডবদের বললেন, ‘তোমরা পাঞ্চাল নগরে গিয়ে বাস করো। দ্রৌপদীকে পত্নীরূপে পেয়ে তোমরা সুখী হবে।’
প্রভু! সময় চলতে চলতে এই কাম্যকবনে এসে আপাতত আপনার চরণপ্রান্তে স্থির হয়েছে। পরিণতি আপনার জানা। আপনি গোপালক গোপাল। সময়ের রাখাল। ওই দেখুন অগ্নিকন্যা দ্রৌপদী আসছেন আপনার কাছে। অনেক অভিযোগ। তিনি কী বলছেন শুনুন, ‘প্রজাসৃষ্টির প্রারম্ভে সর্বলোকের স্রষ্টা তুমিই ছিলে একমাত্র প্রজাপতি। তুমিই বিষ্ণু, তুমিই যজ্ঞ, যষ্টা, যষ্টব্য। ঋষিগণ তোমাকে ক্ষমা, সত্যস্বরূপ বলেছেন। কাশ্যপ মুনি তোমাকে বলেছেন, সত্য হতে যজ্ঞরূপে তোমার আবির্ভাব। বালক খেলনা নিয়ে খেলা করে, তোমার খেলা ব্রহ্মা, শঙ্কর, ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতাদের নিয়ে। তুমি সেই সনাতন পুরুষ, তোমার মস্তকের দ্বারা স্বর্গ, পাদসমূহের দ্বারা পৃথিবী আর জঠরের দ্বারা এই লোকসমূহ পরিব্যাপ্ত। তুমি সর্বব্যাপক, সর্বজীবের প্রভু, সর্বজীবের আত্মা। নানা প্রকারের নানা কাজ তুমিই সম্পাদন করছ।’
দ্রৌপদী অনর্গল বলে চলেছেন, আপনি স্থির হয়ে শুনছেন, কারণ আপনিই শ্রবণ, আপনিই ভাষণ।
দ্রৌপদী বলছেন, ‘দিব্য ও মানুষ সকল জীবের তুমিই একমাত্র প্রভু, তবু তুমি আমাকে স্নেহ করো, তাই আজ আমি তোমাকে আমার দুঃখের কথা শোনাব। ভগবান! আমি ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন, পাণ্ডবদের স্ত্রী, তোমার সখী। এত বড় আমার পরিচয়, সম্মান, অহংকার। সেই আমাকে ওরা কেমন করে কেশাকর্ষণ করে সভায় সর্বসমক্ষে নিয়ে গেল।
স্ত্রীধর্মিণী বেপমানা শোণিতেন সমুক্ষিতা।
একবস্ত্রা বিকৃষ্টাস্মি দুঃখিতা কুরুসংসদি॥
‘রজস্বলারক্ত দুষিত একমাত্র বস্ত্রপরিহিতা, ভয়ে কম্পমানা, দুঃখে অভিভূতা! আমাকে কেন আকর্ষণ করা হল? সেই সভায় রাজাদের সামনে অসহায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। রক্তসিক্ত বস্ত্র, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের পৈশাচিক উল্লাস, উপহাস, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি। মধুসূদন! কী তাদের স্পর্ধা! পাণ্ডুপুত্রগণ, পাঞ্চালরাজপুত্রগণ, বৃষ্ণিবংশীয়গণ জীবিত থাকতেই তারা দাসীভাবে আমাকে ভোগ করতে চাইল।
‘কৃষ্ণ! আমি ধর্মত ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র উভয়েরই পুত্রবধূ। তবু আমাকে তাঁদের সামনেই জোর করে দাসী করা হল।
যুদ্ধে মহাবলশালী, শ্রেষ্ঠ হলে কী হবে আমি পাণ্ডবদের নিন্দা না করে পারছি না। আমি তাদের ধর্মপত্নী, আমাকে অপমান করছে, আমার ওপর জঘন্য নিগ্রহ চলছে, তারা দেখছে। প্রতিকারের কোনও চেষ্টা নেই। হে জনার্দন! ভীমের বাহুবল, অর্জুনের গাণ্ডীবকে ধিক, কারণ একদল নরাধম আমাকে ওইভাবে অপমান করছে দেখেও তা সহ্য করছে।
অল্প বলসম্পন্ন হলেও স্বামী নিজের ধর্মপত্নীকে সর্বতোভাবে রক্ষা করবে— এইটাই তো সনাতন ধর্মপথ, সজ্জনগণ তাই করে থাকেন। শাস্ত্র বলছেন-
ভার্যায়াং রক্ষ্যমাণায়াং প্রজা ভবতি রক্ষিতা।
প্রজায়াং রক্ষ্যমাণায়ামাত্মা ভবতি রক্ষিত॥
ধর্মপত্নীকে রক্ষা করলে প্রজা রক্ষিত হয়, প্রজা রক্ষিত হলে সকলের নিজের আত্মাই রক্ষিত হয়।’ বিদুষী দ্রৌপদী! একথা আপনি অস্বীকার করবেন কী করে? তিনি যে অগ্নিকন্যা। দ্রৌপদী এইবার সেই সত্যটি উদ্ঘাটন করছেন। বলছেন, ‘যেহেতু পতির আত্মাই পত্নীতে জন্মগ্রহণ করে, সেই কারণেই তাকে জায়া বলে। ভার্যাও ভর্তাকে রক্ষা করে, সেই জন্যেই সে তার উদরে জন্মগ্রহণ করে। এরা শরণাগতকে কখনও ত্যাগ করে না, কিন্তু আমি ওই অবস্থায় এদের শরণাগত হলে এরা কেন আমাকে রক্ষা করেনি?’
‘হে জনার্দন। আমার পাঁচটি পতির দ্বারা আমার গর্ভে মহাবলবান অনুরূপ পাঁচটি পুত্র জন্মেছে। ওদের পালনের জন্যেও আমাকে রক্ষা করা উচিত ছিল।’
‘প্রভু! দ্রৌপদী তেজস্বী রমণী। পাঞ্চালরাজ অর্জুনের মতো অতিসুদর্শন বীর জামাতা চেয়েছিলেন। পরিবর্তে পেয়েছেন বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন গুণসম্পন্ন পাঁচ জামাতা। এই পাঁচজন আপনার আশ্রিত, স্নেহধন্য আপনারই শক্তিতে সুরক্ষিত, কিন্তু দ্রৌপদী আজ তাঁদের ধিক্কার জানাচ্ছেন। জমে থাকা সমস্ত অভিযোগ আপনার কাছে উজাড় করে দিচ্ছেন, কারণ আপনি তার সখা। ভগবান! আপনি সকলেরই সখা। সেই বৃন্দাবন, আর এই কাম্যকবন— সময় কতটা চলে এসেছে। দ্রৌপদী পাঁচটি সন্তানের জননী হয়েছেন ইতিমধ্যে। তাঁরা বড় হয়েছেন। প্রত্যেকেই বীর। মায়ের গর্ব। দ্রৌপদী তাঁদের পরিচয় দিচ্ছেন, যুধিষ্ঠির হতে প্রতিবিন্ধ্য, ভীম হতে সুতসোম, অর্জুনের শ্রুতকীর্তি, নকুলের শতানীক, সহদেবের শ্রুতকর্মা।’
‘দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় আপনি উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন বলরাম। ছিলেন শাম্ব। দ্রৌপদী কর্ণকে সূতপুত্র বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অর্জুনকে ক্ষত্রিয় রাজারা চিনতে পারেননি। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করায় তাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন এই প্রতিযোগিতায় ব্রাহ্মণের অংশগ্রহণের অধিকার নেই। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। ছোটখাটো কুরুক্ষেত্র। কর্ণের সঙ্গে অর্জুনের বাণযুদ্ধ। ভীমের সঙ্গে শল্যের মল্লযুদ্ধ।’
‘ছদ্মবেশী পঞ্চপাণ্ডবদের আপনি চিনতে পেরেছিলেন অবশ্যই। কথা হল, দ্রৌপদী এক সমস্যা। ব্যাসদেব কতভাবে তাঁর পূর্ব পূর্ব জন্ম বলার চেষ্টা করেছেন। কিছুতেই যেন তাঁর তৃপ্তি হচ্ছে না। দ্রুপদকন্যা দ্রৌপদী ভারতের ক্ষত্রিয়কুলের নিয়তি। তিনি কি কল্যাণী! আপনি অবশ্য এইসব নিয়ে কখনওই বেশি মাথা ঘামাতে চাননি। আপনি সবেতেই আছেন আবার নেইও। আর কতদিন! সময় তো চরম পরিণতির দিকেই এগোচ্ছে। আপনি কী চাইছেন, আপনিই জানেন, দুটি শব্দ আপনি সখা অর্জুনকে বলবেন, ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ আর ‘ব্রাহ্মী স্থিতিঃ। দুটি চমৎকার অবস্থা। যে অবস্থায় থেকে আপনি দীর্ঘ একটি কাল কাটাবেন। যার সবকটি ইন্দ্রিয় শব্দাদি বিষয় হতে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত হয়েছে সে-ই ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’। সমস্ত বাসনা যে নিঃশেষে পরিত্যাগ করেছে, শরীরের পর, জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় বিষয়ের উপরেও যার কোনও মমতা নেই, ‘আমি এই’ আমি ওই’, ‘জ্ঞাণী-গুণী কেউকেটা’ এই অহংকারও যার গেছে, ‘শরীর জীবন থাকে থাক যায় যাক, এই যার ভাব, সেই মানুষের সংসারে দুঃখ থাকে না, থাকে শুধু পরম শান্তি। এই অবস্থাকেই বলে ব্রহ্মস্বরূপে সুপ্রতিষ্ঠা। কী চমৎকার! আপনার সেই অবস্থা। আপনাকে ঘিরে কী ভয়ংকর ভয়ংকর কাণ্ড ঘটছে— আপনি কিন্তু অবিচলিত। আপনি যে পুরুষোত্তম, আপনি যে ‘কৃষ্ণ।’
ব্যাসদেব রাজা দ্রুপদের সংশয় দূর করার জন্যে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের কথা সবিস্তারে বলছেন। এ যে আবার অন্য কথা। তবে দ্রৌপদীর কারণে পঞ্চপাণ্ডবের পূর্বজন্মের পরিচয় পাওয়া গেল। আপনি অবশ্যই জানতেন, বলেননি। কাকেই বা বলবেন, কখন বলবেন? আপনার জীবনে শুধু সমস্যা, আর থেকে থেকে যুদ্ধ। বড় জীবনের বড় সমস্যা। এখন শুনুন সেই জটিল কাহিনি। পুরাকালে দেবতারা নৈমিষারণ্যে সত্রযজ্ঞ করছিলেন আর একদিকে সূর্যপুত্র যম শামিত্র যজ্ঞ করছিলেন।
যমরাজ যজ্ঞে ব্যস্ত। তাঁর দপ্তরের কাজকর্ম বন্ধ। পৃথিবীতে মানুষ আর মরছে না। তারা অমর হয়ে লোকসংখ্যা বাড়িয়েই চলেছে। সে এক চমৎকার অবস্থা। দেবতারা সব লোকগুরু ব্রহ্মার কাছে গেলেন। তাঁকে বললেন, ‘মানুষের সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে, আমরা উদ্বিগ্ন, আপনার শরণাগত।’
ব্রহ্মা বললেন, ‘কী আশ্চর্য! তোমরা সবাই অমর হয়ে মরণশীল মানুষকে ভয় পাচ্ছ?’
দেবতারা বললেন, ‘মানুষ আর মরণশীল নেই, সব অমর হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে তাদের আর বিশেষ পার্থক্য নেই। আমরা তাই ছুটে এসেছি আপনার কাছে। আমাদের প্রশ্ন, মানুষের সঙ্গে আমাদের একমাত্র ভেদ ছিল, আমরা অমর, মানুষ মরণশীল, এখন সেই ভেদ আর রইল না, তা হলে আমাদের কী বৈশিষ্ট্য?’
ব্রহ্মা বললেন, ‘উতলা হওয়ার কারণ দেখছি না। যমের যজ্ঞ শেষ হলেই মৃত্যু আবার ফিরে আসবে। তবে তোমরা একটা কাজ করতে পারো, তোমাদের প্রভাবে যমের শরীর যদি বিভক্ত করে দিতে পারো, তা হলে যম আবার তার কাজে ফিরে আসবে, মানুষ আবার আগের মতো মরতে শুরু করবে।’ ‘দেবতারা নৈমিষারণ্যে যজ্ঞস্থলে ফিরে এলেন। একদিন তাঁরা ভাগীরথীতে স্নান করতে গিয়ে দেখলেন, স্রোতে একটি সোনার কমল ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার। এর উৎস কোথায়! বীর ইন্দ্র ওই স্বর্ণকমলের মূল খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলেন গঙ্গার উৎস গঙ্গোত্রীতে। সেখানে অদ্ভুত এক দৃশ্য! গনগনে আগুনের মতো এক রমণী অবগাহন করছেন। আর কাঁদছেন! চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। এক-একটি অশ্রুবিন্দু জলে পড়েই এক-একটি সোনার পদ্ম হয়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে হরিদ্বারের দিকে।
ইন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, কে তুমি? কাঁদছ কেন?
সেই নারী ইন্দ্রকে চিনতে পেরেছেন। তিনি বললেন, ‘বলার কিছু নেই, দেখার আছে। আমাকে অনুসরণ করো।’
আগে আগে চলেছেন সেই জ্যোতির্ময়ী, ইন্দ্র তাঁকে অনুসরণ করছেন। উত্তুঙ্গ হিমালয় শিখর ক্রমশই কাছে আসছে, ইন্দ্র দূর থেকেই দেখছেন, শিখরে সিদ্ধাসনে বসে আছেন অপূর্ব সুন্দর এক পুরুষ। তাঁর বাঁদিকে বসে আছেন এক সুন্দরী যুবতী। দু’জনে খুব ঘনিষ্ঠ, পরস্পর পরস্পরকে আদর করছেন। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ইন্দ্র ভীষণ রেগে গেলেন। প্রকাশ্য স্থানে এ কী রঙ্গ। তিনি বুঝতে পারলেন, তিনি যে রমণীকে অনুসরণ করছেন তাঁর ক্রন্দনের কারণটা কী? ইন্দ্র তাঁদের সামনে গিয়ে বললেন, ‘এই সমগ্র ভুবন আমার বশীভূত। আমি এর প্রভু।’
দেবরাজকে ক্রুদ্ধ দেখে সেই দেবপুরুষ হা হা করে হাসতে লাগলেন। ইন্দ্রের দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। আর দেবরাজ হয়ে গেলেন সম্পূর্ণ নিশ্চল কাঠের পুতুল। সেই দেবপুরুষ তাঁর সঙ্গিনীর সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ উপভোগ করে যেন পরিতৃপ্ত হলেন। তারপর ক্রন্দনরতা দেবীকে বললেন, ‘তুমি ওই ইন্দ্রকে আমার কাছে এইবার নিয়ে এসো, তা হলে ওর মধ্যে আর অহংকারের উদয় হবে না।’
সেই রমণী ইন্দ্রকে স্পর্শ করামাত্রই তাঁর শরীর শিথিল হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এইবার সেই দেবদেব তাঁর উগ্র তেজে বললেন, ‘ওহে ইন্দ্র, তুমি আর এইরকম দর্প দেখিয়ো না। আমি জানি তোমার মধ্যে অতুলনীয় বল ও বীর্য আছে। তুমি ওই বিশাল পাথরটাকে সরিয়ে গুহায় প্রবেশ করো। দেখতে পাবে সূর্য তুল্য তেজের অধিকারী তোমার মতো আরও ইন্দ্র ওখানে বসে আছেন।’
ইন্দ্র সেই গুহায় প্রবেশ করলেন, দেখলেন তাঁরই মতো আরও চারজন ইন্দ্র সেখানে বন্দি হয়ে রয়েছেন। এই পঞ্চম ইন্দ্রের ভীষণ ভয় হল— এই রে! ওদের মতো আমারও এই দুর্দশা হবে না তো, দেবাদিদেব শঙ্কর ক্রোধে তাঁর চোখ দুটিকে বড় বড় করে বললেন, ওহে ইন্দ্র। তুমি বাল্যকাল থেকেই আমাকে অবহেলা করে আসছ। অতএব এই গুহায় তুমিও কিছুদিন থাকো। ইন্দ্র ভয়ে কাঁপছেন। তিনি হাতজোড় করে কাঁপতে কাঁপতে শঙ্করকে বললেন, ‘আপনি এই জগতের আদিভূত, সকল ভুবনের স্রষ্টা।’ শঙ্করের সর্বশরীর দিয়ে তেজ নির্গত হচ্ছে। কিন্তু তিনি হাসছেন, হাসতে হাসতে বলছেন, ‘তোমার মতো যার স্বভাব তার এখানে কোনও কৃপালাভের সম্ভাবনা নেই। ওই যে চারজনকে দেখছ তারাও অত্যন্ত অহংকারী ছিল। কথা না বাড়িয়ে এইখানে শুয়ে পড়ো। পরে একটি ঘটনা ঘটবে— তোমরা সকলে মানুষ হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে। বহু অসাধ্যসাধন করবে, দুষ্টের বিনাশ করবে আর অর্জিত সে পুণ্যের বলে ইন্দ্রলোক আবার ফিরে পাবে।’
মহাদেবের কথা শুনে, ইন্দ্ররা সমস্বরে বললেন, ‘মনুষ্যলোকে আমাদের এই দুর্দশা থেকে কবে মুক্তি হবে? তা হলে আমরা অবশ্যই দেবলোক থেকে মনুষ্যলোকে গমন করব। শুধু এই কৃপা করুন, যেন আমরা জননীর গর্ভে— ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারের ঔরসে জন্মগ্রহণ করি, আর দিব্যাস্ত্র সমূহের দ্বারা দুষ্ট মানুষদের সঙ্গে যুদ্ধ করে আবার ইন্দ্রলোকে ফিরে আসতে পারি।’
‘হে কৃষ্ণ! ব্যাসদেব এই কাহিনিকে কীভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তা আপনি শুনুন। আপনি ক্ষত্রিয় বীর, অসীম আপনার বল ও বীর্য, আসলে তো আপনি একজন কবি। আপনি জগতের মাধুর্য, আপনি প্রেম। কত যুগ হল আপনাকে আমরা মানুষরা আজও নিষ্ঠাভরে পূজা করি প্রেমের দেবতারূপে। শ্রী আর শ্রীমতীর যুগল চরণে পৃথিবীর উদ্যানের সব ফুল সঞ্চিত হয়েছে। মন্দিরে মন্দিরে আজও আপনার যে পূজা তার সবটাই ভক্তের মাধুর্যরসে ভরপুর। এই শুনুন, শ্রীবল্লভাচার্য কী রচনা করে রেখে গেছেন—
‘অধরং মধুরং বদনং মধুরং নয়নং মধুরং হসিতং মধুরম্।
হৃদয়ং মধুরং গমনং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥
বচনং মধুরং চরিতং মধুরং বসনং মধুরং বলিতং মধুরম।
চলিতং মধুরং ভ্রমিতং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম।
বেণুর্মধুরো রেণুর্মধুরঃ পানিরর্মধুরঃ পাদৌ মুধুরৌ।
নৃত্যং মধুরং সখ্যং মধুরং মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্॥
আপনি হাসছেন, কী মধুর আপনার হাসি। এ যে চক্রধারী মধুসূদন নয়, আমার বংশীধারী। এইবার শুনুন, ব্যসদেব কী জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করলেন। দেবরাজ ইন্দ্র মহাদেবকে বললেন, ‘আমি দেবকার্য সম্পাদনের জন্য নিজের বীর্যে এদের মধ্যে অন্যতম পঞ্চম পুরুষের জন্মদান করব। প্রথমজনের নাম হবে— বিশ্বভুক, দ্বিতীয়ের নাম ভুতধামা, তৃতীয় প্রতাপীইন্দ্রশিবি, চতুর্থ শান্তি ও পঞ্চম তেজস্বী।
ভগবান উগ্রধন্ব্য তাঁদের অভিলাষ পূর্ণ করার জন্য সুন্দরী নারীদের তাঁদের স্ত্রী হবার বিধান দিলেন। এরা সকলেই স্বর্গলোকের। মহাদেব এই পরিকল্পনা অনুমোদন করাবার জন্য নারায়ণের কাছে গেলেন। তিনি শঙ্করের বিধান অনুমোদন করলেন। মর্তে ইন্দ্রগণের জন্ম হল। এইবার শুনুন, স্বয়ং নারায়ণ কী করলেন, তাঁর মাথা থেকে দুটি চুল ছিঁড়লেন— একটি সাদা, অপরটি কালো। এই দুই কেশের মধ্যে শুক্ল কেশটি যদুকুলে রোহিণীর কাছে আর কৃষ্ণকেশটি পেলেন দেবকী। প্রথম কেশটি থেকে রোহিণীর গর্ভে বলদেব এলেন। আর দ্বিতীয়টি থেকে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন কে? আপনি, আপনি। দেবকীর অষ্টম গর্ভে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। আর ওই যে পাঁচ ইন্দ্র পর্বতগুহায় বন্দি ছিলেন তাঁরাই হলেন বীর্যবান পঞ্চপাণ্ডব। তাঁদেরই মধ্যে ইন্দ্রের অংশ হলেন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন।
এখন শুনুন, এই পাণ্ডবরা, যাঁদের মাঝখানে এই মুহূর্তে আপনি বসে আছেন। তাঁরাই সেই পঞ্চইন্দ্র। আর এ যে দিব্যরূপা ভার্যা দ্রৌপদীই সেই দিব্যকান্তিময়ী স্বর্গলক্ষ্মী। তা না হলে এমন কোন নারী আছেন যিনি স্বকর্মরূপে বেদিমধ্য হতে আবির্ভূত হতে পারেন। যাঁর রূপ চন্দ্র ও সূর্যের মিলিত প্রকাশ। যাঁর শরীরের পদ্মগন্ধ এক ক্রোশ দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যাসদেব দ্রুপদকে দিব্যচক্ষু দান করলেন। বললেন, ‘এ দৃষ্টির সাহায্যে তুমি কুন্তী পুত্রগণের ভূতপূর্ব পঞ্চেন্দ্রমূর্তি দেখতে পাবে। রাজা দেখলেন। তিনি দেখলেন-পাণ্ডবগণের মস্তকে সুবর্ণ কিরীট, গলদেশে সুবর্ণ মালা, ইন্দ্রের মতো তাঁদের আকৃতি, অগ্নি ও সূর্যের মতো তাঁদের গাত্রবর্ণ, শরীরে নানা অলংকার, অতি সুন্দর রূপ, সকলেই যুবক, বিশাল বক্ষদেশ, আর তাঁদের উচ্চতা তালবৃক্ষের মতো। পরিধানে দিব্যবস্ত্র। রাজার মনে হল, তাঁরা সাক্ষাৎ ত্রিলোচন রুদ্র অথবা অষ্টবসু কিংবা সর্বগুণ সম্পন্ন আদিত্যগণ।’
দ্রুপদ তাঁর কন্যাকেও দিব্যচোখে দেখলেন। চন্দ্র ও সূর্যের মতো দীপ্তিশালিনী। তাঁর কন্যার রূপ তেজ ও যশে পাণ্ডবগণের অনুরূপা। আনন্দ, আনন্দ! ব্যাসদেবের কাহিনি এইখানেই শেষ নয়— আরও আছে। সেই কাহিনি হল, পূর্বজন্মে দ্রৌপদীর পতিলাভের আকাঙ্ক্ষা আপনাকে যা আগেই বলেছি। ব্যাসদেব এইবার রাজা দ্রুপদের সংশয় নিরসন করলেন, কেন দ্রৌপদী পাঁচজন পতিকে বরণ করবেন? এ তো পূর্ব নির্ধারিত। স্বয়ং শঙ্করের বিধান। ব্যাসদেব বলছেন, ভাগ্যে যা লেখা আছে তা খণ্ডন করবার শক্তি কারও নেই। নিজের প্রযত্নে খণ্ডন করা যায় না। বরপ্রাপ্তির জন্য দ্রৌপদীর তপস্যাই তাঁর পঞ্চপতিপ্রাপ্তির কারণ। শঙ্কর কেন তাঁকে পাঁচটি পতি দিলেন তার কারণ আমরা কী করে বলব! আমরা তো মানুষ! ভগবানের রহস্য ভগবানই জানেন। ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে বললেন, ‘হে পাণ্ডবেয়! আজই পুণ্যতিথি, চন্দ্র পুষ্যা নক্ষত্রে আসছেন। সুতরাং তুমি আজ প্রথম কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ করো।’ শুরু হল বিবাহের আয়োজন। রাজকন্যার বিয়ে। বিশাল বিপুল আয়োজন। সেসব আপনাকে আর বলছি না। তবে দ্রৌপদীর জন্য ব্যাসদেব আরও একটি কাহিনি মজুত রেখেছেন। সেটি হল, ঠিক আগের জন্মে দ্রৌপদীর নাম ছিল নালায়নী। ভারতবর্ষের পাঁচজন আদর্শ রমণীর একজন। এক ঋষির সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছিল। ঋষির নাম মৌদগল্য। তিনি আবার কুষ্ঠরোগগ্রস্ত। বীভৎস তাঁর রূপ এবং সেইরকম তাঁর স্বভাব। স্ত্রী নালায়নী এইসব গ্রাহ্য করতেন না। যতদূর সম্ভব পতিপ্রাণা, কর্তব্যপরায়ণা। যত বিচিত্র আদেশই তাঁর পতি করুন না কেন, বিনা দ্বিধায়, বিনা প্রতিবাদে প্রসন্ন মনে তিনি পালন করতেন। মাঝে মাঝে সেইসব আদেশ হত অত্যাচারেরই নামান্তর। স্ত্রী হিসাবে তিনি পতির ভুক্তাবশেষ গ্রহণ করতেন। কোনও অহংকার, কোনও দ্বিধা তাঁর সেবার কাজে ব্যাঘাত ঘটাত না। এইভাবেই অনেক বছর কেটে গেল। একদিন স্বামী বললেন, ‘সুন্দরী, পৃথিবীর আদর্শ পত্নী, তুমি একটি দীর্ঘ, অতি দুরূহ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, শোনো, আমি বৃদ্ধ নই, কুষ্ঠরোগগ্রস্ত নই, অত্যাচারী, অবুঝ নই। এসবই আমার অভিনয়। আমি তোমাকে পরীক্ষা করছিলাম। আমি এখন বলছি, তোমার মতো এমন আদর্শ সেবাপরায়ণা পত্নী পৃথিবীর সমস্ত পুরুষের কাম্য। তুমি আমার কাছে তোমার ইচ্ছামতো যে-কোনও বর প্রার্থনা করো। আমি এখনই তা পূর্ণ করব।’
নালায়নী তখন অদ্ভুত একটি বর চাইলেন, বললেন, ‘হে স্বামী আপনি পাঁচজন স্বতন্ত্র পুরুষের মতো ভালবাসবেন, পাঁচজনের পাঁচরকম চেহারা। শেষে পাঁচজন হয়ে যাবেন সেই একজন। এক হবেন পাঁচ, পাঁচ হবেন এক।’ মৌদগল্য সঙ্গে সঙ্গে বললেন ‘তথাস্তু।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি পরিবর্তিত হলেন এক অতি সুন্দর তেজস্বী যুবকে। দেখা গেল তিনি অক্লেশে আরও চারটি রূপ ধারণ করতে পারেন। এইভাবেই কাটতে লাগল দু’জনের অপূর্ব প্রেমজীবন। সুন্দর সুন্দর জায়গায় ভ্রমণ, মিলন। শুধু ভালবাসা আর ভালবাসা। অফুরন্ত প্রেম। প্রেমিকার ক্লান্তি নেই, প্রেমিক অবশেষে বিরক্ত । না আর নয়। সাধন জগতের শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে এসে দীর্ঘদিন যে জীবন কাটানো হল, এইবার তার বিরতি। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘এইবার আমি ফিরে যাব আমার নিভৃত জীবনে, আত্মানুসন্ধানের সাধনায়। বিদায়।!’ প্রেমিকার ক্রন্দন, ‘না না, তা হতে পারে না। আমি এখনও অতৃপ্ত। তোমার সঙ্গে আমি অত্যাশ্চর্য এক জীবন কাটালুম। আমি চাই তুমি চিরকাল আমার সঙ্গে থাকো। বিচ্ছেদ আমি চাই না! আমি তোমার সঙ্গ চাই, চির অবিচ্ছেদ্য জীবন।’
মৌদগল্য তাঁর প্রিয়তমাকে পরিত্যাগ করে সাধনজীবনে ফিরে গেলেন; তখন সেই পরিত্যক্তা সুখের স্বর্গ থেকে ফিরে এলেন জীবনের কঠিন বাস্তবে। বুঝতে পারলেন, একমাত্র সত্য ঈশ্বর। তিনি কখনও কারওকে পরিত্যাগ করেন না। মানুষই তাঁকে বারে বারে ভুলে যায় আমোদে প্রমোদে। হে মুনি! সাধনপথ সকলের জন্যেই উন্মুক্ত । ঈশ্বরের দুয়ার সকলের জন্যেই উদার। তিনিও ডুবে গেলেন গভীর ধ্যানে। দেখা দাও ভগবান। সেই ডাকে ঈশ্বর সাড়া দিলেন। বলো কন্যা, কী তোমার কামনা?
এরপর সেই একই কথা। ‘আমি পতি কামনা করি, পতি, পতি, পতি।’
‘পাবে পাবে পাবে, একজন নয়, পাঁচজন।’
আপনার মুখের ওপর এই সহজ সরল গোপীদের কথা বলার সাহস ছিল, কারণ ভক্তি, কারণ প্রেম। আমিও যে তাঁদের সঙ্গে একমত। কোথাও আপনার মন বসে না। কেমন যেন উড়ুউড়ু। তবে একটা কথা খুব খাঁটি। ভারতধর্মে আপনি এক নম্বর দেবতা। মহেশ্বরও খুব খোলামেলা, লোকপ্রিয় দেবতা। ভারতবর্ষের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার মতো। পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, মাথার ওপর চালা নেই, নিরাপত্তা নেই। ‘রাখাল রাজা’ ও আপনার বাল্যলীলা। আপনি আসলে রাজা। এত সোজা নয়, ভাই রে! শ্রীকৃষ্ণ এক রহস্য! গোপীরা বলছেন, ‘আমাদের প্রাণ তোমার কাছে আছে। তুমি চিরন্তন, তুমি চিরকাল থাকবে, তা হলে আমরাও থাকব; কারণ তুমিই আমাদের প্রাণের আধার। আধার থাকলে আধেয় আমাদের প্রাণও থাকবে। ফলটা তা হলে কী হল? চিরটাকাল ধরে তুমি আমাদের দুঃখ দেখবে। মরে উদ্ধার পাব— সেপথ খোলা নেই। প্রাণ আমাদের দেহে নেই, তোমাতে আছে। আর তুমি কী করছ, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছ। এদিকে আমাদের যত যন্ত্রণাই হোক, আমাদের মৃত্যু হচ্ছে না। মনের সুখে, প্রাণের সুখে আমাদের বিরহ বেদনা প্রত্যক্ষ করো। তোমার জন্যে আমরা কেমন ছটফট করছি। বাঃ সখা! কী তোমার বিচার! চিরকাল তুমি আমাদের দুঃখ দেবে, আমরা দুঃখ ভোগ করব, তুমি পরমানন্দে তাই দেখবে। সেই আনন্দটা পাওয়ার জন্যেই আমাদের এই অবস্থা করেছ।
এই কন্যাই বর্তমান জন্মে দ্রৌপদী। প্রভু। আপনার সখী। পাঁচজন ইন্দ্রতুল্য বীর পতি পেয়েছেন; রাজার মেয়ে কিন্তু রাজমহিষী এখনও হতে পারেনি কৌরবদের চক্রান্তে। পতিদের অনুসরণ করে এসেছেন কুমোর পল্লিতে! এরপর যাবেন পাঞ্চালে পিতার আলয়ে! ধুমধাম উৎসবের মাধ্যমে পঞ্চপাণ্ডবকে পতিত্বে বরণ করবেন। হে কৃষ্ণ! চাকা তো আপনার নিয়ন্ত্রণে! যাই বলুন, আপনি অতি নিষ্ঠুর, নির্দয়। নীল নিষ্ঠুর। পাতলা ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। বৃন্দাবন লীলায় গোপীদের কাঁদিয়েছেন। মুখরা গোপবালাদের সঙ্গে আপনার কত মধুর কলহ! আজও যা আমাদের উপভোগ্য। পণ্ডিতরা কত ভাবে এই লীলার ব্যাখ্যা করেছেন। আপনার গীতার কত ভাষ্য!
আপনি আত্মরক্ষার জন্যে সেদিন বলেছিলেন, ‘তোমরা যে এইভাবে আমাকে ভর্ৎসনা করছ, এটা কি ঠিক হচ্ছে? আমি কি তোমাদের দুঃখ দিতে ইচ্ছা করছি?’
গোপীরা তখন বলেছিল। বলেছিল বেশ বাঁকা সুরেই ‘না-না, দুঃখ দিতে ইচ্ছা করবে কেন? দুঃখ তো সামান্য ব্যাপার, তুমি আমাদের হত্যা করতে চাইছ।’ আপনি প্রতিবাদ করলেন, ‘সে কী কথা! আমি তরোয়াল ধরি, নাকি অস্ত্র ধরি যে আমি তোমাদের হত্যা করছি!’ গোপীদের উত্তর, ‘হত্যা কি শুধু তরোয়াল দিয়েই হয়, অন্য কোনও জিনিস দিয়ে হয় না! হত্যা নিয়েই তো কথা।’ আপনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘সে কীরকম?’ তুমি নয়ন দিয়ে আমাদের বধ করেছ। অতএব তোমার কোনও দায় নেই। তুমি যে সুরতনাথ। তোমার ওই নয়ন দুটি দেখলে শরৎকালের পদ্মের সৌন্দর্য আর কেউ দেখবে না। নয়নভঙ্গি দ্বারা আমাদের সুরত প্রার্থনা করেছ। ‘আঃ, গোপীরা চারদিক থেকে আপনাকে চেপে ধরেছে। ধরবে না কেন? আপনি মধুরখুনি। মরণ রে তুঁহু মন শ্যাম সমান! বড় নটঘট। গোপীরা এই শ্লোকটি বলছে,
শরদ্দাশয়ে সাধুজাত সৎ সরজিজোদর শ্রীমুষাদৃশা।
সুরতনাথ! তেঽশুল্কদাসিকা বরদো! নিঘ্নতো নেহ কিংবধঃ॥
আমাদের দোষ নেই ওহে! নটঘট শ্যাম! তুমিই আমাদের ঘর থেকে টেনে এনে বস্ত্রহরণের দিনে বরদান করে গ্রহণ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছ। তাতে তোমার সঙ্গে আমাদের যে মিলন সেটা তো সামাজিক ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আত্মীয়স্বজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ইহলোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। পরলোকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তবু আমরা তোমার সঙ্গে মিলিত হয়েছি। আমরা যে ইচ্ছা করে মিলিত হয়েছি তা তো নয়। তুমি আমাদের নিজের রূপে-গুণে-চূড়া-বেঁধে নয়নের চাউনিতে সেই পথে টেনেছ। আমাদের কোনও দোষ নেই। তোমার অস্ত্র তরোয়াল নয়। তোমার অস্ত্র নয়ন। দৃষ্টি দিয়ে আমাদের বধ করেছ। তুমি চোর। চোরের তিনটি দোষ। প্রথম দোষ, সাধুর জিনিস চুরি করা, আর সেটা যে মহা অপরাধ, তা বোধ না করা। দ্বিতীয় দোষ, নিগূঢ় বস্তু জেনেও নেওয়া। তৃতীয় হল দুর্লঙ্ঘ লঙ্ঘন করা। তুমি পদ্মের শ্রীহরণ করেছ, কর্ণিকার মধ্যে গোপন বস্তু আছে জেনেও নিয়েছ। আর জলরাশি দুর্লঙ্ঘ তার ভেতর পদ্ম, সেই পদ্মের অঙ্কস্থা শ্রীরূপ নায়িকাকে চুরি করে তোমার নয়নে বন্দি করেছ। সেই তুমি! তুমি যে সরলা বালার মন চুরি করতে এ আর বেশি কথা কী?
গোপীরা আপনাকে মহা প্যাঁচে ফেলেছে প্রভু! ওরা সাংঘাতিক। সরাসরি আপনাকে তো বলা যায় না। বাবা রে! আপনি ভগবান। আমরা কাতরে প্রার্থনা করি—
সংসারসাগরে মগ্নং মামুদ্ধর জগদ্গুরো,
কেশব ক্লেশহরণ নারায়ণ জনার্দন।
গোপীরা যে আপনার আত্মস্বরূপ। যা খুশি তাই বলার অধিকারী। তারা আপনাকে মোহন বলতে চায়, উন্মাদন বলতে চায়, মহাচৌরচক্রবর্তী বলতে চায়। কায়দা করে। আপনাকে বলছে না, বলছে আপনার নয়নকে। লক্ষ্য কিন্তু আপনি। তুমিই আমাদের মুগ্ধ করেছ, উন্মাদ করেছ। এই দুটি ব্যাপারে তুমি অতুলনীয়। উন্মাদের তো কিছু ঠিক থাকে না, তাই সর্বস্বত্যাগ করে আমরা স্বেচ্ছায় আমাদের শরীর, মন, প্রাণ কোনও বিনিময় মূল্য ছাড়াই তোমায় দিয়ে ফেলেছি। আমাদের সুরতধন তুমি কেড়ে নিয়েছ। তোমার প্রেমানলবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে আমাদের বধ করেছ। এতে তোমার সহস্রের অধিক স্ত্রীবধের পাপ হচ্ছে। বুঝেছ। পাপের ভয় থাকলে আমাদের দর্শন দাও। কেননা আমরা মরে গেলে তোমাকে পাপ স্পর্শ করবে।
মুখের বাঁধন খুলে গেছে। সমানে ঝগড়া চলেছে। জানি, আপনার খুব মজা লাগছে! সাধন জগতে এরই নাম, ভক্ত আর ভগবানের লীলা। পৃথিবীর মাটিতে এর পা নেই। গোপী বলছে, ‘আমাদের উপর তোমার যদি স্বত্ব থাকে, দাবি থাকে, তা হলে তুমি নিজের ধন রক্ষা করো বা জ্বালিয়ে দাও, তাতে কোনও দোষ হয় না। কিন্তু আমরা তো তোমার নিজস্ব সম্পত্তি নই। তুমি তো আমাদের মূল্য দিয়ে কেনোনি। বিবাহের দ্বারাও আমাদের গ্রহণ করোনি। আমরা নিজেরাই বিনামূল্যে দাসী হয়েছি। মুগ্ধ হয়ে দাসী হয়েছি। আমাদের বিবেচনা কম কিনা, তাই তোমাকে বুঝিনি।
বাবা রে! এ যে ভক্তি মার্গের মস্ত সাধন। কৃষ্ণভজনের চমৎকার অবস্থা কিছুই জানলুম না, বুঝলুম না, কৃষ্ণমাধুর্যে বিকিয়ে গেলুম। সাধন ভজনের জগতে আপনার চিরন্তন অবস্থান। সেখানে এই কথাটি শোনা যাবে, কিছু বোঝার দরকার হচ্ছে না, মুগ্ধতায় বিকিয়ে গেছ, এইটাই কৃষ্ণভজনের সৌন্দর্য। গোপীদের কাছে যেটা বিবেচনাহীনতার দোষ, সাধকপক্ষে সেটা সর্ববিবেচনার পরে গ্রাহ্য। গোপীর এই মুগ্ধতা।
প্রভু! শুধু গোপীদের কাছে নয় নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্যদেবের কাছেও আপনার প্রচুর ঋণ। তিনি রাধাভাবে বিভাবিত হয়ে গম্ভীরার এতটুকু একটা ঘরে জীবনের শেষ বারোটি বছর অতিবাহিত করেন। আপনার বিরহজ্বালা। সে জ্বালা কেমন জ্বালা? সেই দহন পার্ষদ রামানন্দ রায়, স্বরূপ দামোদরকে বলেছিলেন। আপনিও শুনুন সর্বকালের নায়ক আপনি, হে কৃষ্ণ চৈতন্যদেবের অবস্থা—
বাহিরে বিশ্বজালা হয়, ভিতরে আনন্দময়,
কৃষ্ণপ্রেমের অদ্ভুত চরিত।
এই প্রেমা আস্বাদন তপ্ত-ইক্ষু-চর্বণ,
মুখ জ্বলে, না যায় ত্যজন।
সেই প্রেমা যাঁর মনে তার বিভ্রম সেই জানে,
বিষামৃতে একত্র মিলন ॥
হে প্রভু! কী করে রেখে গেলেন! আজও মানুষ নীরবে-নিভৃতে কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে কাঁদছে। সুখে কৃষ্ণ, দুঃখে কৃষ্ণ। এইবার আপনি দ্রৌপদীর অভিযোগ শুনুন, ‘আমাদের প্রধান পুরোহিত ধৌম্য। তিনিই অগ্রবর্তী হয়ে আমাদের এই বনবাসে এনেছেন। মাতা কুন্তীকে একটি আশ্রয়ে রেখে এসেছি। এই ক্লেশ তাঁর সহ্য হবে না। সখা কৃষ্ণ! এইবার তুমি বলো, সিংহের ন্যায় বিক্রমশালী দুর্যোধনদের চেয়ে পাণ্ডবরা অনেক বীর্যসম্পন্ন তবু সবাই মিলে যখন আমাকে সকলের সামনে নগ্ন করার চেষ্টা করছে, দাসী, দাসী বলে অশ্লীল যৌন ইঙ্গিত করছে, সেই বীরেরা প্রতিকারের চেষ্টা না করে কাঠের পুতুল— ধিক ধিক! পাপকর্মকারী অত্যন্ত দুর্বল ওই পাপীরা বলবাল পাণ্ডবদের কীভাবে হেনস্তা করলে, এই ক্ষত আজও আমার ভেতরে দপদপ করছে। আমি ভুলতে পারছি না। আমার ভেতরটা জ্বলছে।
তুমি জানো— দৈবের বিধানে আমি মহাকুলে জন্মলাভ করেছি। পঞ্চপাণ্ডবদের আমি প্রিয়তমা পত্নী, মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ আমি। হে কৃষ্ণ মধুসূদন! নারীকুলে আমি বরণীয়া সতী, মহাত্মা পাণ্ডুপুত্রদের সামনেই দুঃশাসন আমার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। হায়!’
‘ওই দেখুন, পদ্মের মতো কোমল দুটি করে নিজের মুখ ঢেকে মৃদুভাষিণী কৃষ্ণা ফুলে ফুলে কাঁদছেন। এই দৃশ্য ব্যাসদেব চিরকালের জন্য ধরে রেখেছেন, ‘পাঞ্চালরাজকুমারী দ্রৌপদী তার পীনোন্নত গোলাকার শুভলক্ষণ স্তনদ্বয়কে দুঃখজন্য অশ্রুবিন্দু সমূহের দ্বারা অভিষিক্ত করিলেন। চোখ দুটি মুছিতে মুছিতে, পুনঃ পুনঃ দীর্ঘশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে বাষ্পপূর্ণ কণ্ঠে ক্রোধের সহিত বলিলেন,
নৈব মে পতয়ঃসন্তি ন পুত্রা ন চ বান্ধবাঃ।
ন ভ্রাতরো ন চ পিতা নৈব ত্বং মধুসূদন॥
‘আমার পতিও নেই, পুত্রও নেই, বান্ধবও নেই, ভ্রাতাও নেই। হে মধুসূদন তুমিও আমার নও।’
উঃ, সেই রাত! প্রভু! আপনিও ভুলতে পারবেন না, যুগ-যুগান্তরের আমরাও পারব না। সমাজে নারীর স্থান নারীর প্রতি পুরুষদের মনোভাব। নারী কি কেবলই সুন্দর-সুচারু দেহ। ভোগের বস্তু, যৌন নির্যাতনের সহজ উপাদান? আমি দেখতে পাচ্ছি অন্যান্যদের সঙ্গে আপনি স্তম্ভিত হয়ে বসে আছেন। দ্রৌপদী তাঁর অভিযোগ শেষ করছেন, ‘হে কৃষ্ণ! যেহেতু তোমার সঙ্গে আমার আত্মীয়তা আছে, যেহেতু আমার যজ্ঞ হতে উৎপন্ন হওয়ার গৌরব আছে, যেহেতু আমি তোমার চিরসখী, যেহেতু তুমি আমাকে রক্ষা করতে সমর্থ, কেশব! সেই হেতু সম্পর্ক, গুরুত্ব, সখিত্ব, প্রভুত্ব, এই চারটি কারণে আমি তোমার দ্বারা রক্ষিত হওয়ার যোগ্য।’
কেউ কোনও কথা বলছেন না, কী বলবেন? পাশার জুয়ায় সর্বহারা পাণ্ডবরা সেদিনও দ্রৌপদীর প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। দ্রৌপদী প্রশ্ন করেছিলেন, যুধিষ্ঠির তো আগের দানেই রাজ্যের অধিকার হারিয়েছেন, নিজেকে বাজি রেখে কৌরবদের দাস হয়েছেন। নিজের ওপরে অধিকার হারিয়েছেন। এমন রিক্ত মানুষ শেষ দানে কেমন করে তাঁর স্ত্রীকে বাজি ধরতে পারেন? কোন অধিকারে? আমার আর একটি প্রশ্ন এ কী ধরনের পাশাখেলা, যে খেলায় বিপক্ষ কোনও বাজিই রাখল না। পুরোটাই একটা প্রহসন, কারণ তারা জানত শকুনি জোচ্চুরি করে জিতবেই জিতবে— বাজি ধরার প্রশ্নই নেই। একদিকে শূন্য অপরদিকে যথাসর্বস্ব। খেলার নেশায় মত্ত যুধিষ্ঠির এতবড় একটা ফাঁকি লক্ষ করলেন না। এই সভায় জ্ঞানী-গুণী, সাধু-সন্তের অভাব নেই, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।
কোথায় কী? ভীষ্মের কৌশলী জবাব, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র বিদুর মুখ ফিরিয়ে নিলেন, সভাস্থলে একা দ্রৌপদী। ভারতের নারী আজও একা। ঘরে বাইরে নিরাপত্তাহীন অরক্ষিত। রাশি রাশি দুঃশাসন, দুর্যোধন। রাজা অন্ধ। সেই রাতে ওই অরণ্যসমাবেশে আপনি ধ্বংসের ভবিষ্যতের কথাই বললেন। সেই কথায় যেন একটু প্রতিহিংসার সুর ধরা পড়ল। আপনি তো ভগবান, আপনারও ক্রোধ হয়! সেই ক্রোধই কি জীবজগতে ছড়িয়ে আছে? প্রভু জানি না, সৃষ্টির অন্তরালে কী আছে? আপনি বলেছিলেন, ‘হে ভাবিনী! যাদের ওপর তোমার এত রাগ তাদের পত্নীরাও তাদের পতিদের যুদ্ধে অর্জুনের শরাঘাতে শয্যায় নয় মাটিতে শোবে। তাদের নিহত দেখে তোমার মতোই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়বে। তোমাদের হিতের জন্য আমার পক্ষে যা করা সম্ভব তা আমি সবই করব।’
‘হে দ্রৌপদী, আমি নিশ্চয় করেই বলছি তুমি সম্রাজ্ঞী হবে। হে কৃষ্ণে! যদি স্বর্গও ভূমিতলে পতিত হয়, যদি হিমালয় বিদীর্ণ হয়, যদি পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, সমুদ্র শুকিয়ে যায় তা হলেও আমার এই কথা মিথ্যা হবে না।’ আপনার এই কথা শুনে দ্রৌপদী অর্জুনের দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন। কেন! সম্ভবত মধুর দাম্পত্য সম্পর্কের কারণেই এই চঞ্চলতা। অর্জুন বললেন, ‘দেবী! তুমি কেঁদো না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যা বলেছেন তা কখনও মিথ্যা হবে না।’ দেখুন, আপনি যে ভগবান অর্জুন তা জানেন। উপস্থিত ছিলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। তিনি বললেন, ‘আমি বধ করব দ্রোণকে, শিখণ্ডী, পিতামহ ভীষ্মকে। ভীম দুর্যোধনকে, আর অর্জুন আপনি বধ করবেন কর্ণকে। হে ভগিনী! শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামকে আশ্রয় করে আমরা যুদ্ধে ইন্দ্রেরও অজেয়। সুতরাং ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা আমাদের কী করবে!’
শ্রীকৃষ্ণ সব শুনলেন। ভবিষ্যতে কী হবে তা চোখের সামনে দেখতে পেলেন। আপনি ত্রিকালদর্শী। সবই তো ঘটে আছে। শুধু কালের পরদাটা সরিয়ে দেওয়া। প্রভু, আপনি তখন বিস্তারিতভাবে বললেন, ওই সভায় আপনার অনুপস্থিতির কারণ। আপশোস করলেন, আপনাদের এই সংকট হত না যদি আমি তখন দ্বারকায় বা কাছাকাছি কোথাও থাকতাম। পাশা খেলার কথা জানতে পারলে আমি অনাহূত হয়েই তখন আসতাম। ধৃতরাষ্ট্র আর দুর্যোধনকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতাম পাশা খেলার সর্বনাশা দিক। খেলা বন্ধ করে দিতাম। আমি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য বাহ্লীক আর রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে এক জায়গায় বসিয়ে বলতাম, কুরুবংশধর ধৃতরাষ্ট্র! আপনার ছেলেদের পাশা খেলায় প্রবৃত্ত হওয়া উচিত নয়। এই খেলার বহু দোষ। বীরসেনের পুত্র নল পূর্বে এই পাশা খেলায় নিজের রাজ্য হারিয়েছিলেন। এ এক ভয়ংকর নেশা। শুনুন আপনারা, রমণীর প্রতি আসক্তি, পাশা খেলা, মৃগয়ার নেশা আর মদ্যপান— এই চারটি সর্ব দুঃখের কারণ। এ আমার কথা নয়, শাস্ত্রের কথা। এই চারটির মধ্যে পাশা খেলাই সবচেয়ে বড় দোষ। একদিনেই মানুষ সর্বস্বান্ত হতে পারে। আমার ধারণা, আমি এ কথা বললে তিনি শুনতেন। আপনাদের এই অনর্থ ঘটত না। কৌরবরাও ধর্মভ্রষ্ট হত না। যদি আমার কথা উপেক্ষা করত তা হলে ওই সভাতেই আমি তাদের শেষ করে দিতাম। তাদের উপস্থিত বন্ধুরা যদি তাদের সমর্থনে সওয়াল করত তা হলে তাদেরও একই পরিণতি হত। দুর্ভাগ্য আমি ঠিক ওই সময়ে দ্বারকায় ছিলাম না। ফিরে এসে সাত্যকির কাছে সমস্ত শুনে আপনাদের এখানে এসেছি। দেখছি বড়ই সংকটে পড়েছেন। চতুর্দিক থেকে বিপদ ঘিরে আসছে।
প্রভু, দ্রৌপদী আপনাকে যা বললেন তা কিছুই নয়। আপনি যদি উপস্থিত থাকতেন তা হলে দেখতেন কী অসহ্য অসভ্যতা। শকুনি পাশার এক-একটি দান চালছেন। ঘুঁটি ছকে পড়ার আগেই চিৎকার করছেন—জিতেছি, জিতেছি। শেষ দানের আগের দানে শকুনি ব্যঙ্গের গলায় বলছেন, ধর্মরাজ সবই তো গেল। একজনই শুধু আছেন পাঞ্চালের রাজকুমারী দ্রৌপদী। কী ব্যঙ্গ! পাঁচটি পতিই যার দাস হয়ে গেল, সে যদি একা থাকে তা হলে বড় নিসঙ্গ বোধ করবে না কি? যুধিষ্ঠির সেই সময় তাঁর সমস্ত বিচার হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি সমর্থন করে বললেন, ‘ঠিকই তো, ঠিকই তো। পাঞ্চালী স্বয়ং লক্ষ্মীদেবী, এই পাঞ্চালী যদি আমাদের সঙ্গে থাকে তা হলে আমরা আমাদের সৌভাগ্য ফিরে পাবই। তাই তাকেই আমি বাজি ধরলাম।
যুধিষ্ঠিরের এই অদ্ভুত কথা শুনে বিদুর মাথা নিচু করলেন। দুঃশাসন আর কর্ণ বীভৎস গলায় হেসে উঠলেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র বারে বারে বলতে লাগলেন, ওরা কি দ্রৌপদীকে জিতেছে? পাশা তখন মাটিতে শব্দ করে গড়াচ্ছে। শকুনি মহা উল্লাসে উত্তর দিচ্ছেন, হ্যাঁ মহারাজ, আমি দ্রৌপদীকেও জিতেছি। দুর্যোধন লাফিয়ে উঠে মাতুলকে জড়িয়ে ধরে থেমে থেমে বলতে লাগলেন, আপনি, আপনি এক নম্বর, এক নম্বর। পৃথিবীতে আপনার তুলনা আপনিই। তারপর বিদুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, যান, পাণ্ডবদের অতিপ্রিয় স্ত্রীকে এই সভায় নিয়ে আসুন। তাকে তো এইবার শিখতে হবে ঝাড়ু দেওয়া, শিখতে হবে বড় বড় মানুষদের সঙ্গ দেওয়া। দেরি নয়, দেরি নয়, দাসীটাকে টেনে আনুন। কৌরবদের আশ্রিত বিদুর অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি একটি মানবরূপী শৃগাল। কথা বোলো না, তুমি বাঘের গুহায় ঢুকে তাকে খোঁচা মারছ। ধ্বংস যখন শুরু হবে জেনে রাখো তা নিঃশেষে হবে। আর কারণটা হবে তুমি। এখনও সময় আছে, এই ধরনের কাণ্ডজ্ঞানশূন্য অসভ্য কথা বলা বন্ধ করো।’
দুর্যোধনের কী মতিভ্রম! তিনি তখন তাঁর এক পরিচারককে বলছেন, এই বিদুরের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই আমাদের চোখ রাঙাচ্ছে। এ আমাদের পছন্দ করে না। এ আমাদের মাঝখানে একটি শৃগাল। তুমি এখনই গিয়ে পাঞ্চালীকে বলো, সে আর রাজকুমারী নয়; একটি দাসী। আমরা তাকে জয় করেছি। সে একটুও দেরি না করে এখানে আসুক। পরিচারক ছুটলেন দ্রৌপদীর ঘরে এবং এই বার্তাটি জানালেন। এরপর যা ঘটেছে তা আপনি পাঞ্চালীর কাছে শুনলেন। দ্রৌপদী যে দৃশ্যটি আপনাকে দেখাননি সেইটি এইবার আপনি আমার কাছে শুনুন। সভায় সকলের সামনে একেবারে মধ্যস্থলে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে বসে রয়েছেন প্রবীণরা, আর নিমন্ত্রিতেরা। দুঃশাসন তাঁকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করছেন। কর্ণ, শকুনি, দুঃশাসন হা হা করে হাসছেন। অশ্লীল রঙ্গ-রসিকতা করছেন। দাসী, দাসী বলে নৃত্য করছেন। একমাত্র বিকর্ণ প্রতিবাদ করেছিলেন। তারপরে দুর্যোধনের হুকুমে পাণ্ডবরা তাঁদের পোশাক খুলে ফেললেন, দাঁড়ালেন কৌপীন পরে। দুর্যোধন আবার বললেন, দ্রৌপদীর শাড়িটা খুলে নাও। দ্রৌপদী বুঝেই গেলেন, কেউ তাঁকে সাহায্য করবেন না। তখন তিনি আপনাকেই স্মরণ করলেন। গিরিধারী, আমার লাজ রাখো। এতক্ষণ তিনি তাঁর শাড়িটি দু’হাতে খামচে ধরেছিলেন। এইবার হাত দুটি ছেড়ে দিলেন। পদ্মপলাশের মতো চোখ দুটি বুজিয়ে তিনি ধ্যানে ডুবে গেলেন। প্রভু, এইবার শুরু হল আপনার খেলা। একটি শাড়ি খুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল তলায় আর একটি রয়েছে। আর একটি, আর একটি, আর একটি..। ক্লান্ত দুঃশাসন। ওদিকে জমেছে স্তূপাকার শাড়ি। দ্রৌপদীর প্রকৃত শাড়িটি তখনও তাঁরই অঙ্গে।
সভায় এতক্ষণ যাঁরা মূক হয়ে বসে ছিলেন তাঁরা দুর্যোধনের প্রতি ধিক্কারে ফেটে পড়লেন। আর ভীম চিৎকার করে বললেন, আমি একদিন এই দুঃশাসনের বুক ফেড়ে রক্তপান করব। এইবার দুর্যোধনের আর এক ফরমান। কনিষ্ঠ পাণ্ডবরা এখানে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করুক যে তারা যুধিষ্ঠিরের কোনও আদেশ আর পালন করবে না। তা হলেই আমরা পাঞ্চালীকে মুক্তি দেব। ভীমসেন চিৎকার করে বললেন— দাদা যুধিষ্ঠির আমাকে যদি আদেশ করেন তা হলে এই মুহূর্তে আমার এই দুটো হাত দিয়ে এই সভার সকলকে হত্যা করব। ইঁদুর মারার জন্য আমার তরোয়ালের প্রয়োজন নেই। দুর্যোধন তখন তাঁর ঊরুটি নগ্ন করে দ্রৌপদীকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমার কোলে এসো, আমার কোলে।’ ভীমসেন তখন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘আমি যদি তোমার ওই ঊরুটিকে একদিন না একদিন থেঁতো করতে পারি তা হলে আমার নাম ভীম নয়।’ কৌরবরা হা-হা করে হেসে উঠলেন। দুর্মতি কর্ণ হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘সুন্দরী, তোমার এই পাঁচটি প্রভু আমাদের দাস। তোমার ওপর তাদের আর কোনও অধিকার নেই। যাও অন্তঃপুরে গিয়ে দাসীবৃত্তি শুরু করো।’ বিদুর বলেছিলেন, রাজা ধৃতরাষ্ট্র এই অসভ্যতা বন্ধ করো। পাণ্ডবরা আপাতত অসহায় হলেও ভগবান তাঁদের রক্ষা করবেন। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে বললেন, ‘কন্যা, কাছে এসো। এই ভয়ংকর নির্যাতনেও তুমি অচল, অটল। তোমার ধর্মকে রক্ষা করেছ। কী উপকার চাও বলো?’ পাঞ্চালী তখন বলেছিলেন, মহারাজ আপনি যুধিষ্ঠিরকে এই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘তথাস্তু। তুমি আর একটি বর প্রার্থনা করো।’ পাঞ্চালী বললেন, ‘তাঁর অপর ভ্রাতাদের মুক্তি দিন।’ রাজা বললেন, ‘তথাস্তু, তুমি আর একটি বর চাও।’ পাঞ্চালী বললেন, ‘আমি আর কিছু চাই না।’ ধৃতরাষ্ট্র তখন যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি যা হারিয়েছ সব ফিরিয়ে নিতে পারো। ধন, ঐশ্বর্য, মানসম্মান এবং রাজত্ব। দ্রুত ফিরে যাও ইন্দ্রপ্রস্থে। শান্তিতে রাজ্যশাসন করো। দুর্যোধন, দুঃশাসনের প্রতি কোনও বিদ্বেষ রেখো না। ভুলে যেয়ো না আমরা সবাই একই পরিবারের। শান্তিতে ফিরে যাও রাজধানীতে।’ তখন পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদীকে নিয়ে রথে উঠলেন। রথ ধাবিত হল ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে।
পাণ্ডবরা চলে যাওয়ার পর দুর্যোধন, শকুনি আর কর্ণ বসলেন পরামর্শে। কর্ণ বললেন, ‘একটি নারীর শক্তিতে পাঁচটি ভাই বেঁচে গেল। ওদের কোনও লজ্জা নেই। ওদের এইভাবে ছেড়ে দেওয়া উচিত হল না। একদিন না একদিন আমরা আক্রান্ত হবই।’ দুর্যোধন পিতার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ক্রোধের গলায় বললেন, ‘আপনি সব পণ্ড করে দিলেন!’ এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে চারপাশে পায়চারি করতে করতে পিতাকে কেবলই বলতে লাগলেন, ‘পণ্ড করে দিলেন, পণ্ড করে দিলেন। আমরা একটা গোখরো সাপকে সপরিবারে ঝাঁপির মধ্যে বন্ধ করে ঢাকনা দিয়েছিলুম। ঠিক সময়ে বিষদাঁত ভেঙে দেব বলে। আপনি সেই ঢাকনাটা খুলে দিলেন। আপনার ধারণা ওরা আর ফিরবে না। তা কিন্তু নয়। ওরা এইবার সদলে এসে আমাদের শেষ করে দেবে।’ ধৃতরাষ্ট্র কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে বললেন, ‘এ আবার কী গল্প!’ দুর্যোধন তখন পিতাকে বোঝালেন, ‘আপনার এই ভাইপোরা আপনার খুবই প্রিয়। তারা চলল ইন্দ্রপ্রস্থে। সেই রাজধানী দেখে আমাদের চোখ কপালে উঠে গেছে। ভাবা যায় না সে কী সুন্দর নগর। আগামীকাল তারা সেখানে পৌঁছোবে, তার পরের দিন এই সময় সসৈন্যে তেড়ে আসবে আমাদের হস্তিনাপুরে। সঙ্গে থাকবে তাদের অনুগামীরা। আমরা প্রস্তুত হওয়ার আগেই ধ্বংস করে দেবে। ওই যুধিষ্ঠিরটাকে বোঝা খুব মুশকিল। ওর মন খুব জটিল। নিজের সম্মান ফিরে পাওয়ার জন্য যুদ্ধ সে করবেই। আর ওই যে মেদের মৈনাক ভীমটা, সে কী করবে তা নিজের কানেই শুনলেন।’ ধৃতরাষ্ট্র ইতস্তত করে বললেন, ‘তা হলে আমরা এখন কী করব!’ দুর্যোধন বললেন, ‘এখনই ওদের ডেকে পাঠান। আর একবার আমরা পাশাখেলায় বসি। এই শেষ চালে ওদের আমরা সর্বস্বান্ত করব। এখনও বেশি দূর যায়নি। ওদের ফিরিয়ে আনুন। আমাদের এলাকা পেরিয়ে গেলে আপনার আদেশ নাও শুনতে পারে। সবচেয়ে দ্রুতগামী দূতকে পেছনে ধাওয়া করতে বলুন। আমরা শেষ চালটা একবার চালি।’ ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ‘সেটা কীরকম?’ দুর্যোধন ধমকে উঠলেন, আপনি অত মাথা ঘামাবেন না। ওটা আমাদের ওপর ছেড়ে দিন। যা করার শকুনি মামাই করবেন। আপনি শুধু ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন। ধৃতরাষ্ট্র ব্যস্ত হয়ে দূতকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘ওদের পেছনে ধাওয়া করে এখানে ফিরিয়ে আনো।’ গান্ধারী তাঁর ছেলেদের পরিকল্পনা শুনে আর্তনাদ করে উঠলেন। বললেন, ‘আমি জানতুম, এই দুর্যোধন কুরুবংশের সর্বনাশ করে ছাড়বে। সন্তান জন্মগ্রহণ করে কাঁদে, ও শৃগালের মতো ডেকে উঠেছিল। বিদুর তখনই বলেছিলেন, ওকে দূর করে ছুড়ে ফেলে দাও, বেঁচে থেকে দরকার নেই। বড় হয়ে ওর চক্রান্তেই কুরুবংশ ধ্বংস হবে। তখন বুঝিনি, এখন বুঝতে পারছি। রাজা, আপনি ওকে উপেক্ষা করুন। দূর করে দিন। আমাদের জাতিটাকেই ধ্বংস করে দেবে।’
হে কৃষ্ণ! সেদিন ধৃতরাষ্ট্র একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন। সেই কথাতেই ভবিষ্যৎ স্পষ্ট। গান্ধারীকে বললেন, কৌরবদের ধ্বংসই যদি নিয়তি হয় তা হলে কে তাঁদের রক্ষা করবে। স্বয়ং ভগবানও পারবেন না। আমি আমার ছেলেদের অখুশি করতে পারব না। পাণ্ডবরা ফিরে আসুক। শুরু হোক পাশাখেলা। ভগবান! আপনিও পারবেন না নিয়তিকে ঠেকাতে। বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহে অন্ধ হলেও তাঁর জ্ঞানচক্ষু খোলা ছিল। কে আপনি! স্পষ্ট না জানলেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি অবশ্যই ছিল। ধ্বংসের আগেই সত্য কথাটি কেমন বলে দিলেন। প্রভু, আমিও বোধহয় ভুল করছি। সংকল্প, বিকল্প— সবই তো আপনার ইচ্ছায়। ভ্রম, মতিভ্রম— সবই তো আপনার খেলা। কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের রথে দাঁড়িয়ে আপনি বলবেন এই কথাই— আমি সমস্ত জীবের মন, প্রাণ, বুদ্ধি, বিকাশ, অস্তিত্ব, ধ্বংস। আপনার ওই মুচকি হাসি বড় মধুর লাগে। তখন মনে হয় আপনি এক বিরাট মানুষ। আপনার বিশেষণ হল— ‘দুষ্টু মিষ্টি’! আহা! তা না হলে আজও কেন মানুষ আপনাকে এত ভালবাসে। কেন পুজো করে। এই ভারতবর্ষ আজও কৃষ্ণময়। কত কাহিনি, কত গান, কত নৃত্য, কত নাটক। যুদ্ধ-টুদ্ধ সব ফেলে দিয়ে আপনার প্রেমটিকেই এই অপ্রেমের পৃথিবী গ্রহণ করেছে। সব মানুষই একবাক্যে প্রার্থনা করে— কৃষ্ণকেশব পাহিমাং। যদি বলি, হস্তিনাপুরের সভায় কৌরব, পাণ্ডবে পাশা খেলেছিল! শকুনি দান ফেলেছিল! না, খেলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। কেন আপনার এত রাগ! তিল তিল করে যা গড়ে উঠেছিল তাকে চুরমার করতে চাইলেন কেন! বুঝেছি, বুঝেছি! দুরারোগ্য ব্যাধির একমাত্র দাওয়াই হল ধ্বংস। কংসকে তো আপনি রক্ষা করেননি। আপনার স্বজন। কারণ আপনি জানতেন কংস নিজের কৃতকর্মের জন্যই ধ্বংস হবে।
এই প্রসঙ্গে আমি আপনাকে একটি কথা বলি। সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে আপনি লীলা সংবরণ করেছেন। পাণ্ডব কৌরব কেউ কোথাও নেই। শুধু আছেন রাজা পরীক্ষিৎ। উত্তরার গর্ভে প্রবেশ করে আপনি তাঁকে ব্রহ্মাস্ত্র থেকে রক্ষা করেছিলেন। আপনার তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে দ্বাপর শেষ। কালের দরজায় দাঁড়িয়ে কলি। পরীক্ষিৎ দেখছেন, এক দুর্দান্ত প্রকৃতির নিষ্ঠুর মানুষ তাঁরই সামনে একটি গাভী ও একপদ বিশিষ্ট একটি বৃষকে নিপীড়ন করছে। বৃষের আর তিনটে পা গেল কোথায়! আর ওই লোকটিই বা কে! তিনি ধ্যানে জানতে পারলেন, বৃষটি হলেন ধর্ম, আর গাভীটি হলেন পৃথিবী। পরীক্ষিৎ নিপীড়নকারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’ উত্তর হল কলি। আমি এসে গেছি। পরীক্ষিৎ বললেন, ‘আমার রাজত্বে তোমার স্থান হবে না। তুমি এখনই বিদায় হও।’ কলি বললেন, ‘তা বললে তো হয় না। আপনি রাজা। আমি কালের নিয়মেই এসেছি। আমাকে থাকার স্থান দিন।’ পরীক্ষিৎ বললেন, ‘তুমি দেখতেই পাচ্ছ আমার হাতে রয়েছে শাণিত খড়্গ। আমি তোমাকে এখনই শেষ করে দিতে পারি।’ কলি বললেন, ‘আমি আপনার চরণাশ্রিত।’ রাজা থমকে গেলেন। শরণাগতকে তো হত্যা করা যায় না। কলিকে বললেন, ‘আমি তোমাকে চারটে স্থান দিচ্ছি— দ্যুতক্রীড়া, সুরাপান, প্রাণীহিংসা, স্ত্রীসঙ্গ।’ কলি বললেন, ‘আর একটু।’ রাজা বললেন, ‘বেশ! সুবর্ণও নাও।’ কলি বললেন, ‘আরও একটু।’ পরীক্ষিৎ বললেন, ‘বেশ, এই কটি স্থানও তুমি নাও— মিথ্যা, গর্ব, কাম, হিংসা ও শত্রুতা।’ কলি বললেন, ‘মহারাজ আমি খুশি। আমি এইসব স্থানেই বাস করব, আর আপনার আজ্ঞা পালন করব।’
রাজা পরীক্ষিৎ তখন বৃষরূপী ধর্মের দিকে নজর দিলেন। চারটি পায়ের একটি মাত্র পা রয়েছে। সেই পা-টি হল সত্য। বাকি তিনটে পদ উধাও। প্রভু, এইবার আমি আপনাকেই প্রশ্ন করি! ওই তিনটি পায়ের একটি হল তপঃ, আর একটি হল শৌচ ও অন্যটি হল দয়া। ধর্ম তা হলে চতুষ্পদ। বাকি তিনটি পদ, আপনি যখন পৃথিবীতে রয়েছেন দ্বাপরের শ্রীকৃষ্ণ হয়ে তখনই তো উধাও হয়েছে। শকুনি পাশা খেলছেন, ধৃতরাষ্ট্র সন্তানপ্রেমে অন্ধ, গান্ধারীর চোখে ফেট্টি, দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র উন্মোচনে তৎপর। ট্র্যাজিক হিরো ভীষ্ম নীরব। তাঁকে মহামতি বললেও, দুর্মতিদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আপনি স্বয়ং উপস্থিত সর্বত্র। অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাটের গৃহে কীচক ওই দ্রৌপদীকেই ভোগ করতে চাইলেন। তিনি বিরাটের শ্যালক। কীচক বধ হলেন। তা হলে কী দেখছি! জুয়া, মদ্যপান, হিংসা, কাম, নারী নিগ্রহ— যাচ্ছেতাই অবস্থা। কী খেলা আপনার! এখানে ছোট্ট করে আপনাকে একটা কথা বলি। গীতায় আপনি ‘উপনিষদ’, ব্রজলীলায় ‘প্রেমিক ব্রজেশ্বর’, দ্বারকায় ‘কর্তব্যপরায়ণ সংসারী ও প্রজাপালক’ আপনি ধর্ম। কেতাবি ধর্ম নন। বসে আছেন বাস্তবের আসনে, যা প্রতি মুহূর্তে পালটাচ্ছে। সত্যযুগে একরকম, ত্রেতা যুগে আর একরকম, দ্বাপরে আর একরকম, আর কলিতে ধর্ম উধাও। আপনি জানতেন এমন হবে। কথাটি হল এই— চিরকালের সরল সাধারণ মানুষের জন্য আপনি যে ধর্মটি এগিয়ে দিলেন তা বড় মধুর। কোনও জটিলতা নেই। আপনি সকলের কাছে কত সহজ। আমি আপনার প্রেমিক হতে পারি, সখা হতে পারি, ভৃত্য হতে পারি। আর দেখুন, পরীক্ষিৎ কলিকে বধ না করে, কী সুন্দর তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তার মানে আমরা কলিতেও থাকতে পারি, আপনার ভজনাও করতে পারি। এই নয় যে, সব ত্যাগ করে অরণ্যে যেতে হবে। সাহস করে এমনও বলতে পারি, এক হাতে মদের গ্লাস আর হৃদয়ে আপনার অবস্থিতি। আপত্তি নেই। কত সহজ করে দিলেন কলির ধর্মকে। এই যে বলা হচ্ছে, এই যুগের বিশেষত্ব হল, ‘পুণ্য কর্মের সংকল্প মাত্রেই ফললাভ হয়। এবং পাপের ফল কর্মের অনুষ্ঠান সাপেক্ষ।’ এমন বিতর্কেরও অবকাশ রয়েছে যখন ওই বৃষরূপী ধর্ম রাজা পরীক্ষিৎকে প্রশ্ন করছেন। ‘রাজা বলুন, কোন পুরুষ থেকে আমাদের এই ক্লেশ উৎপন্ন হচ্ছে! দায়ী কে! যোগী বলেন, আত্মাই আত্মার মিত্র এবং শত্রু, দৈবজ্ঞ বলেন, গ্রহই জীবের সুখ দুঃখের কারণ, মীমাংসক কর্মকেই কারণ রূপে নির্দেশ করেন। আর নাস্তিকের মতে স্বভাবই সকল সুখ-দুঃখের নিদান।’ তা হলে দেখুন, স্বয়ং ধর্মই সংশয় প্রকাশ করছেন।’
দ্বাপরে ধর্মের যা ব্যাখ্যা ছিল— যাগ, যজ্ঞ, তপস্যা, সেইসব কলিতে লয় হয়ে গেল। আপনি তো বলেছিলেন, শ্রীকৃষ্ণ হলেন অনন্ত কাল, অনন্ত জীবন। আর জীবনের সঙ্গেই তো ধর্ম। ধর্ম মানে মানুষের আদর্শ আচরণ বিধি। ধর্ম কতটা উদার হল। এটা আপনিই করে গেছেন। গোপীদের সমর্পণ, সাধুদের ভক্তি, জ্ঞানীদের অন্বেষণ, নির্বোধের কুসংস্কার— সব মিলিয়ে একটি বাস্তব অনুপান। এইজন্যই আপনাকে ভাল লাগে। বৃন্দাবনে রাখাল আর গোপীদের সঙ্গে কী অপূর্ব লীলাটি করলেন! আর আপনার সবকিছু ছাপিয়ে সেইটাই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বৈষ্ণবের প্রেম ও ধর্ম হয়ে। শ্রীচৈতন্য অবতারে আপনি আরও সহজ। শুধু নাম করো নাম। নামই নামী। শুধু হরে-কৃষ্ণ বলো। নামই ব্রহ্ম। এমন ধর্ম পৃথিবীর কোথায় আছে! ধনী, দরিদ্র, জ্ঞানী, মূর্খ— সকলেই রয়েছেন একটি পাত্রে। তা হতে পারে ব্রহ্ম, ভক্তি, প্রেম, কর্ম, বিচার, যোগ।
আমার প্রশ্ন শেষ হল। উত্তর আপনি দিয়েই রেখেছেন। যে সময়ে হস্তিনাপুরে নানা জঘন্য কাণ্ড হচ্ছে, তখন আপনি নেই। আবার আছেনও। আপনিও তো ছকে সাজানো ঘুঁটিতে চাল দিচ্ছেন। আপনি অবশ্যই সেই দিকে এগোচ্ছেন, যেখানে পুরনো যা কিছু থাকবে না। নতুনকে আসতেই হবে। পীতবসনধারী প্রভু আমার, আপনি যে চির নবীন।
পাণ্ডবদের আবার ফিরিয়ে আনা হল হস্তিনাপুরের রাজসভায়। আবার পাশা। শকুনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, আপনারা বাজি ধরে যা হারিয়েছেন রাজা সবই আপনাদের ফিরিয়ে দিয়েছেন। সে ভাল। রাজার ইচ্ছায় যা হয় তার ওপর প্রশ্ন চলে না। কিন্তু এখন আবার আর এক দান খেলা হবে। এবারের বাজি একটু অন্যরকম। এই খেলায় যে পক্ষ হারবে তাদের নগ্ন পদে বনবাসে যেতে হবে। পোশাক মৃগচর্ম। বারো বছর অরণ্যবাস আর এক বছর কোনও নগরে থাকতে হবে। কেউ যেন চিনতে না পারে। যদি চিনে ফেলে তা হলে আবার বারো বছরের জন্য বনবাস। আপনি যদি আমাদের পরাজিত করেন আমরাও এই শর্ত স্বীকার করে বনবাসে চলে যাব। খেলা শেষ হওয়া মাত্রই এই নির্দেশ পালন করতে হবে। শকুনি মনে হয় সম্মোহনও জানতেন। যুধিষ্ঠির বললেন, ‘হয়ে যাক।’ শকুনি সঙ্গে সঙ্গেই পাশা চাললেন। আর চিৎকার করে বললেন, ‘আমার জিত। এমনটাই যে হবে সে তো জানা কথা।’ এইবার আপনি দৃশ্যটা ভাবুন। একে একে সবাই তাঁদের ঝলমলে রাজপোশাক খুলে ফেললেন। কোমরে জড়ালেন মৃগচর্ম। অরণ্য গমনে প্রস্তুত। আবার দুঃশাসনের দুষ্ট কথা। দ্রৌপদীকে বলছেন, ‘তোমার পিতা চেয়েছিলেন তোমাকে সুন্দর কোনও পাত্রে দান করতে। সুন্দর একটি জীবন। এইবার দেখো, তুমি কাদের সঙ্গে আছ। একদল হতচ্ছাড়া ভিখারি। এদের পরনে মৃগচর্ম, হাতে ভিক্ষাপাত্র। কী সুখ পাবে সুন্দরী? এখনই সময়, এখানে অনেক মহান ব্যক্তি উপস্থিত রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে থেকে একজনকে স্বামী হিসেবে বেছে নাও। যিনি তোমাকে বেচে দেবেন না। এই যে পাঁচটি ভাই এরা কীরকম বলো তো! শস্যের দানা, যার মধ্যে কোনও শাঁস নেই।’
ভীম এই কথা শুনে দুঃশাসনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন আর কী! ভীম বললেন, ‘তোমার কথা আমাদের হৃদয় বিদ্ধ করেছে। আমি আজ এইখানে দাঁড়িয়ে এই প্রতিজ্ঞা করছি, তোমার হৃদয় আমি প্রকৃত অস্ত্র দিয়ে বিদ্ধ করে তোমাকে স্মরণ করিয়ে দেব, তোমার ছিল কথা আর আমার হল কাজ।’ দুঃশাসন চপল মানুষের মতো হাততালি দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে লাগলেন। আর বললেন— গোরু, গোরু। এরপর পাণ্ডবরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন দুর্যোধন ভুলেই গেলেন যে তিনি রাজপুত্র। ভীমের হাঁটা নকল করে তাঁর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলেন। ভীম ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোমার এই ভাঁড়ামি তোমাকে কিছুই দেবে না। শুধু মনে রাখো, আমার গদার আঘাতে একদিন তোমার ঊরুভঙ্গ হবে। আমি তোমার ওই মাথা পা দিয়ে থেঁতলে দেব।’ অর্জুন, নকুল, সহদেবও চুপ করে রইলেন না, বললেন, ‘উচিত সময়ে উচিত শাস্তি পাবে।’ এত উত্তেজনার মধ্যেও পাণ্ডবরা তাঁদের সহবৎ ভুললেন না। ধীরে ধীরে ধৃতরাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে গেলেন, প্রণাম করে বিদায় চাইলেন। অন্যান্য বয়স্কদেরও প্রণাম করলেন। বিদুর বললেন, ‘তোমাদের মা কুন্তীকে আর কষ্ট দিয়ো না। তোমরা যতদিন না ফিরে আসো ততদিন তিনি আমার কাছেই থাকবেন।’
এই ঘটনার পর অদ্ভুত ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন। প্রশ্নটি হল, তুমি বলো, পাণ্ডবরা কী মনের অবস্থা নিয়ে এইভাবে চলে গেল। অর্থাৎ তিনি শুনতে চান পাণ্ডবরা খুশিমনেই বনে গেলেন। সুযোগ্য পুত্র দুর্যোধন কোনও অন্যায় করেননি। ধৃতরাষ্ট্র কেবলই ভাবতেন, একদিন না একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। এ একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। বিদুর কিন্তু স্পষ্টবক্তা। তিনি বললেন, যুধিষ্ঠির রাস্তা পেরোলেন মাথা নিচু করে। একটি কাপড়ে মুখ ঢেকে। ভীম কোনও দিকেই তাকাচ্ছিল না। তার দৃষ্টি স্থির হয়েছিল হাতের গদাটির দিকে। অর্জুন কোনও দিকেই তাকাচ্ছিল না। হাতে একমুঠো বালি নিয়ে এদিকে ওদিকে ছড়াচ্ছিল। দ্রৌপদী তার খোলা চুল দিয়ে মুখটি ঢেকে রেখেছিল। পরনে ছিল যে শাড়িটি পরে এসেছিল, সেইটিই। নকুল আর সহদেব মুখে মেখেছিল মাটি। যাতে কেউ না চিনতে পারে। ওদের পুরোহিত ধৌম্য আগে আগে হাঁটছিলেন। হাতে ছিল পূর্বা ঘাসের একটি খোঁচা। তিনি পূর্বদিক নির্দেশ করছিলেন। আর জোরে জোরে সামবেদের মন্ত্র বলছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র ছেলেমানুষের মতো জিজ্ঞেস করলেন, এইসব করার অর্থ। বিদুর বললেন, যুধিষ্ঠির হলেন ধার্মিক, ধর্মরাজ। মুখটি ঢেকে রেখেছিলেন এই কারণে, তিনি জানতেন, তাঁর দৃষ্টি যাঁর ওপর পড়বে তিনি পুড়ে ছাই হয়ে যাবেন। এই অবস্থাতেও তিনি চেয়েছিলেন, আপনার পুত্র ও বন্ধুদের যেন কোনও বিপদ না ঘটে। ভীম তার গদার দিকে তাকিয়ে ছিল এই কারণে, তার প্রবল ইচ্ছা ঠিক চোদ্দো বছর পরে এই গদা তার কাজ করবে। আর অর্জুন চতুর্দিকে বালি ছড়াচ্ছিল এই বোঝাতে, একদিন তার শর এইভাবেই ঝাঁকে ঝাঁকে বর্ষিত হবে শত্রুদের দিকে। ধৌম্য এইটিই বোঝাতে চেয়েছেন, আবার সেই সুযোগ আসবে যখন তিনি সামবেদ আবৃত্তি করতে করতে পাণ্ডবদের বিজয় মিছিল করে ফিরিয়ে আনবেন।
আতঙ্কিত ধৃতরাষ্ট্র হায় হায় করে উঠলেন, উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন, ‘এই ভুল সংশোধনের কোনও উপায় নেই? যাও না কেউ যাও না, ওদের ফিরিয়ে আনো। ওদের বলো, যা হয়েছে সব ভুলে যাও। বলো, আমি বলেছি ওরা শান্তিতে আমার ছেলেদের সঙ্গে বাস করুক। উভয়পক্ষেরই কোনও অভাব থাকবে না।’
প্রভু কেমন লাগল! আপনি তো ছিলেন না। আপনি সকলকে ‘বিশ্বরূপ’ দেখান। পৃথিবীর এই রূপ আপনি কি দেখেছেন? না দেখার তো কোনও কারণ নেই, আপনি তো অন্তর্যামী। আপনি তো ফিরে আসবেন আবার শ্রীক্ষেত্রে। তখন আপনি জগতের প্রভু জগন্নাথ। সঙ্গে ভ্রাতা বলরাম ও ভগ্নী সুভদ্রা। জগন্নাথদেবের বিরাট দুটি নয়নে এই জগৎ দৃশ্য দেখছেন। কিছু বলছেন না, কিছু করছেন না। ওই যে একটু আগে ধর্ম বললেন, কর্ম আর কর্মফল। বললেন, নিয়তি। প্রভু জগন্নাথদেবের হাতও নেই, পা ও নেই। তিনি কোথাও যান না, কিন্তু তিনি সর্বত্রই আছেন। ব্রহ্মস্বরূপ। এই ভয়ংকর ভয়ংকর ঘটনা আপনি ঘটাচ্ছেন নিজের পরিকল্পনা মতো। ঠিক তেরো বছর পরে উভয়পক্ষ মুখোমুখি হবে কুরুক্ষেত্রে। এইটি আপনার প্রথম পদক্ষেপ। কুরুকুল ধ্বংস হবে। ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আপনার কথায় রাজসিংহাসনে বসবেন, আপনি সানন্দে তিনটি যজ্ঞ করাবেন। তারপর আপনার রথে আরোহণ করে চলে যাবেন দ্বারকায়।
প্রভু আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। দ্বারকা আপনার স্বপ্নের নগরী। আচ্ছা বলতে পারেন, আপনি কার ভয়ে মথুরা ত্যাগ করলেন। আপনি যেখানে শক্তি সেখানে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবপক্ষে যুদ্ধ না করেও আপনি একাই ছিলেন যোদ্ধা। আপনার কৌশলে, আপনার নির্দেশে ভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা পরাজিত হয়েছেন। একবার মাত্র উত্তেজিত হয়ে সুদর্শন ধারণ করেছিলেন। তখন অর্জুন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন আপনার প্রতিশ্রুতি— ‘আমি যুদ্ধ করব না।’
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ভারত অঙ্গনে আপনি এক অদ্ভুত খেলা খেলে গেলেন। আপনি অবশ্য বলেই ছিলেন, ভারতবর্ষে যখন ধর্মের গ্লানি ঘটবে তখন আপনি আসবেন। যতবার প্রয়োজন হবে ততবার মনুষ্যদেহ ধারণ করে আসবেন। দুষ্কৃতীদের বিনাশ করে তাদের হাত থেকে সাধুদের পরিত্রাণ করবেন। প্রভু! এই দুষ্কৃতী আর সাধু বলতে আপনি কী বুঝিয়েছেন। আমি যতটুকু বুঝেছি, যাঁরা সৎ আচরণ করেন, যাঁদের জীবনে মানবিকতা জাগ্রত থাকে তাঁরাই সাধু। তাঁরা গৃহে থাকতে পারেন, আবার কেউ কেউ গুহাতেও থাকতে পারেন। দুষ্কৃতী হল মানুষ হয়েও যাঁরা মানুষ নন। যাঁদের আচার আচরণ উচ্ছৃঙ্খল। যাঁরা দেশ, সমাজ এবং মানুষের ক্ষতিকারক। আপনার সময়ে এই অবক্ষয়ের শুরু। আপনি জানতেন এইসব ঘটবে। সেই কারণেই সম্পূর্ণ ধ্বংসের অনেক আগেই আবির্ভূত হয়ে ধ্বংসের কাজটি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। যেন বলতে চেয়েছিলেন— তোদের পায়ের তলা থেকে জমিটা আমিই কেড়ে নেব, ধ্বংস কাকে বলে দেখিয়ে দেব। ভীষণ তামসিকতা তাই নয়! নির্বিচার ভোগ, নির্যাতন, বিপথগামিতা, স্বেচ্ছাচারিতা, প্রায় অন্ধের মতো আচরণ, বিবেক বুদ্ধিহীন একদল হৃষ্টপুষ্ট বলিষ্ঠ। শেষ করে দেব। একাই করব।
অরণ্যে পাণ্ডবরা। বারো বছর অরণ্যে, এক বছর অজ্ঞাতবাসে। তার পরে? তাঁরা কি রাজত্ব ফিরে পাবেন! বিনা যুদ্ধে? শান্তিতে। না, তা কখনওই নয়। আপনি চেষ্টা করবেন। কৌরবরা বলবেন, বিনা রণে সুচ্যগ্র মেদিনীও দেব না। তা হলে যুদ্ধ। প্রভু! আপনারও স্বপ্ন ছিল, বৃন্দাবনের সেই অপূর্ব লীলা, মথুরায় আপনার রাজসিংহাসন, বৃন্দাবন থেকে মথুরায় চলে আসবেন, গোপীদের হাহাকার। এখন প্রশ্ন হল, মথুরায় কেন আপনি থাকতে পারলেন না। কংস-বধ করলেন। এটি আপনার একটি মহাকাঙ্ক্ষিত কাজ। কংসের কারাগারে পিতা ও মাতা বন্দি। কংসের দুই স্ত্রী— অস্তি ও প্রাপ্তি। তাঁরা জরাসন্ধের কন্যা। বিধবা দুই কন্যা পিতাকে কংসবধের কথা জানালেন। জরাসন্ধ রেগে আগুন। সঙ্গে সঙ্গে তেইশ অক্ষৌহিণী সৈন্য নিয়ে মথুরা অবরোধ করলেন। এইবার কী হবে! আপনার আবার ভয় কীসের! দিব্যাস্ত্র নিয়ে দুটি রথ আকাশ থেকে নামল অবরুদ্ধ মথুরায়। সঙ্গে সঙ্গে বলরাম ও আপনি যুদ্ধবেশে ওই রথে আরোহণ করে অল্প সৈন্য নিয়ে রাজপুরী থেকে বেরোলেন। জরাসন্ধ আপনাকে বললেন, তুমি বালক, তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব না। তোমার দাদা বলরামের ইচ্ছা হয় তো আসুক। ভীষণ যুদ্ধে মগধ সৈন্য, হস্তী-অশ্বাদির রক্তের স্রোত বইল। জরাসন্ধ রথ থেকে পড়ে গেছেন। বলরাম তাঁকে বেঁধে বধ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। আপনি বললেন, যথেষ্ট হয়েছে, ওকে ছেড়ে দাও। বলরাম বললেন, তাই হোক! ওর যত সৈন্য আছে নিয়ে আসুক। আমাদেরই ভাল। আরও কিছু আপদকে মেরে পৃথিবীটাকে ভারমুক্ত করি। আপনারা দু’জনে বিরাট সংবর্ধনার মধ্যে মথুরায় প্রবেশ করলেন। জরাসন্ধ এইভাবে সতেরো বার মথুরা আক্রমণ করেছিলেন। অষ্টাদশ বারে নারদ পাঠিয়ে দিলেন মহাবীর কালযবনকে। তিনি এক কোটি সৈন্য নিয়ে মথুরা অবরোধ করলেন। বলরাম ও আপনি ভাবলেন, কালযবনের সঙ্গে দু’জনেই যদি যুদ্ধে ঢুকে যাই এবং তখন যদি জরাসন্ধ আবার আসে তা হলে মথুরার কী অবস্থা হবে! আপনি তখন পশ্চিম সমুদ্র মধ্যে দ্বাদশ যোজন বিস্তৃত দুর্গ নির্মাণ করে অতি আশ্চর্য নগর নির্মাণ করালেন। এই দ্বারাবতী বা দ্বারকা নির্মাণ সম্বন্ধে হরিবংশে বিস্তারিত বিবরণ আছে—
‘ততঃ প্রভাতে বিমলে ভাস্করে উদিতে তদা।
কৃতজাপ্যো হৃষীকেশো বনান্তে নিষসাদ হ॥’
প্রভু! সেই সকালটি কী সুন্দর! আশ্চর্য শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ী হতে আমার চলেছেন। সেদিন আবহাওয়া ছিল সুনির্মল। মেঘমুক্ত ভোরের আকাশ, পুব গগনে সূর্য উদিত হচ্ছেন। আর আপনি জপ শেষ করে অরণ্য পথে চলেছেন দুর্গ নির্মাণের স্থানটি দেখতে। সঙ্গে রয়েছেন যাদব প্রধানরা। দুর্গ স্থান চিহ্নিত হল। তারপর একটি শুভদিনে রোহিণী নক্ষত্রে দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করলেন। ব্রাহ্মণরা স্বস্তিবাচন করতে লাগলেন। দৃশ্যটি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আপনি যাদবদের সম্বোধন করে বললেন, ‘দেখুন, আমি স্বর্গভূমিসদৃশ এই পুরস্থান নির্বাচন করেছি। নামকরণও করা হয়েছে। এই পুরী নির্মিত হলে এর নাম হবে দ্বারাবতী। ইন্দ্রের অমরাবতীর মতোই রমণীয়।’ আপনি যেন স্বপ্ন দেখছিলেন সেদিন। অমরাবতীর যে আয়তন, যেমন প্রাঙ্গণ, যেরকম রাজপথ, অন্তঃপুর— অবিকল দ্বারাবতীতেও সেইরকম হবে। একই প্রকার লক্ষণ ফুটে উঠবে। আপনারা দেবতাদের মতো নিরুপদ্রবে, পরমানন্দে এখানে অবস্থান করুন। সবার আগে হবে গৃহ, রাজপথ, রাজপথের দু’পাশে ত্রিকোণ ও চতুষ্কোণ দুটি পণ্যপঙ্ক্তি, তারপর হবে প্রাচীর। সুদক্ষ শিল্পীদের গৃহনির্মাণে নিযুক্ত করুন। অন্যান্য কারিগরদের স্থানে স্থানে নিযুক্ত করে দিন।
‘আপনি এই আদেশ করার পর যাদবরা পরম উৎসাহে কাজে লেগে গেলেন। নিশ্চয় আপনার দেখতে ভাল লাগছিল। তাঁরা সুতো হাতে নিয়ে একটি স্থান পরিমাণ মতো ঘিরে দিলেন। শুভদিনে ব্রাহ্মণরা এলেন বাস্তুপূজা হল। আপনি স্থপতিদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা আমাদের জন্য চত্বর, পথ ও মন্দির নির্মাণ করে দাও।’ দুর্গ ও নগর নির্মাণের প্রচুর উপকরণ এসে গেল। যথা নিয়মে দ্বারদেশ নির্মিত হল। প্রতিটি দ্বারদেশে বিভিন্ন দেবতার স্থান। যেমন, ব্রহ্মা, বরুণ, ইন্দ্র, দৃষদোলুখল। আর চারটি দ্বার নির্মিত হল চারজন দেবতার নামে। তাঁরা হলেন শুদ্ধাক্ষ, ঐন্দ্র, ভল্লাট আর পুষ্পদন্ত। চারদিকে মহাতৎপরতা। আপনার ইচ্ছা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাদবদের নিয়ে নতুন নগরীতে প্রবেশ করবেন। কারণ আপনার প্রাচীন রাজধানী মথুরা বিপন্ন। আপনার ইচ্ছামাত্রে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার আবির্ভাব হল। তিনি এসে বললেন, দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। আপনি আমার প্রভু। আমি আপনার কিঙ্কর। আপনি খুশি হয়ে বিশ্বকর্মাকে বললেন, ‘আমরা যেমন স্থানে থাকায় অভ্যস্ত তা জানো। এখানেও আমাদের জন্য ঠিক সেইরকম স্থান প্রস্তুত করতে হবে। এই পুরীটি তুমি এমনভাবে নির্মাণ করো যাতে আমাদের মাহাত্ম্য প্রকাশ পায়। আমার প্রভাবের কথা স্মরণে রেখো। এটি হবে মর্তের অমরাবতী। তুমি মর্তবাসীর নিকট আমার এবং যদুকুলের ঐশ্বর্য প্রকাশ করার মতো আশ্চর্যজনক কিছু করো।’ বিশ্বকর্মা বললেন, ‘আপনি যা চাইছেন আমি ঠিক সেইরকমই করে দেব। তবে আরও কিছুটা স্থান চাই, তবেই এর সৌন্দর্য খুলবে। আমার পরিকল্পনা, সাগর যেন এই নগরীর মধ্যে বিচরণ করতে পারে। সুতরাং বুঝতে পারছেন আরও কতটা জায়গার প্রয়োজন।’ আপনিও এইরকমই ভেবেছিলেন— সমুদ্রের কাছে আরও কিছুটা স্থান চাইবেন। আপনি তখন সাগরকে সম্বোধন করে বললেন, ‘সমুদ্র! আমার আরও দ্বাদশ যোজন স্থানের প্রয়োজন। তা হলে আমার পুরীর পরিসর বাড়বে। সৈন্যরা সুখে বাস করতে পারবে। আমার প্রতি যদি তোমার ভক্তি থাকে তা হলে আমাকে এই দ্বাদশ যোজন স্থান প্রদান করো।’
আপনার প্রার্থনায় সমুদ্র তখনই দ্বাদশ যোজন দূরে সরে গেলেন। বিরাট একটা ঝড় বয়ে গেল, সেই বাতাসই যেন সমুদ্রকে ঠেলতে ঠেলতে দূরে পাঠিয়ে দিল। কী অপূর্ব দৃশ্য। আমি যদি ওইসময় ওখানে থাকতুম। সমুদ্রের তলদেশ উন্মোচিত হল। কত সম্পদ সেখানে। বিশ্বকর্মা খুব খুশি হয়েছিলেন। অনেকটা জায়গা পেয়েছেন। তিনি যাদবদের বললেন, ‘আপনারা আজ থেকে পুরী প্রবেশ আরম্ভ করুন। আমি এখনই মানসগৃহে পরমরমণীয় পুরী নির্মাণ করে দিচ্ছি। এর দ্বার, তোরণ, অট্টালিকা অতি উৎকৃষ্ট হবে। পৃথিবীমধ্যে এই পুরী পর্বতচূড়া সদৃশ সমুন্নত হয়ে উঠবে।’
প্রভু! দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার কী ক্ষমতা! এমন ঘটনা ওইকালেই হত। তিনি অতি যত্নে মানসে সেই দ্বারাবতী পুরীর নির্মাণ শুরু করলেন। কী কী হল! আপনার জন্য সুপ্রশস্ত অন্তঃপুর, স্নানগৃহ নির্মিত হল। তার দ্বার, তোরণ, প্রাচীর ও পরিখাসমূহের কী অপূর্ব শোভা! স্ত্রী, পুরুষ,বণিক ও নানা পণ্যদ্রব্যে নগরী পরিপূর্ণ হল। যেন অমরাবতী স্বর্গ থেকে ভূমিতে নেমে এসেছে। জলপানস্থান, বাতি ও উদ্যানে পরিপূর্ণ হল সেই পুরী। চারিদিকে উৎকৃষ্ট অট্টালিকা। সহস্র সহস্র সুপ্রশস্ত রাজপথ। পৃথিবীর যাবতীয় রত্ন সেই নগরীতে। দেবতারা আহাঃ আহাঃ করে উঠলেন। আর সামন্ত রাজাদের ঈর্ষা বাড়তে লাগল। অট্টালিকাগুলি এত উঁচু যে আকাশপথ পর্যন্ত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ল। প্রভু! কী কাণ্ডটাই হল। সর্বদা মানুষের কোলাহল। সমুদ্র তরঙ্গ নিরন্তর তার মধ্যে প্রবাহিত হওয়াতে শীতল বায়ু সর্বদাই বইতে লাগল। দেবতারা দেখছেন, সজল স্থান আর উপবনের শোভায় মনে হতে লাগল আকাশ নক্ষত্র মালায় পরিপূর্ণ হয়েছে। তাঁরা যে ওপর থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে আছেন, সাধু ভাষায় বর্ণনা না করলে ঠিক হবে না। কারণ এই নগরী যিনিই দেখবেন তিনি সোচ্চারে বলে উঠবেন, সাধু, সাধু। বর্ণনাটি এইরকম, ‘রক্তবর্ণ সুবর্ণময় প্রাচীর হেমদাম পরিপূর্ণ গৃহ, শ্বেত মেঘ সদৃশ শুভ্র দ্বারদেশ ও অট্টালিকা এবং স্থানে স্থানে মহোন্নত প্রাসাদচ্ছায়া সমাবৃত রাজপথ সকল পুরী সুশোভিত করিয়া তুলিল।’ আর আপনার সম্পর্কে বলা হল, ‘যাদবানন্দ বর্ধন কৃষ্ণ নভোমণ্ডল স্থিত শশাঙ্কের ন্যায় দ্বারাবতীপুরী উদ্ভাসিত করিয়া পরম সুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন।’ দ্বারাবতীকে ইন্দ্রপুরীর মতো অতি মনোহর করে বিশ্বকর্মা স্বর্গে ফিরে গেলেন। এরপর আপনি কী করলেন! এত সুন্দর একটি নগর তৈরি হল, দান-ধ্যান তো করতে হবে! তাই একদিন রাতে কুবের পালিত নিধিপতি শঙ্খকে নিজের ভবনে ডেকে পাঠালেন। তিনি তখনই এসে অবনত মস্তকে প্রণাম করে হাতজোড় করে একপাশে দাঁড়ালেন। জানতে চাইলেন, কী করতে হবে, আমাকে আদেশ করুন। আপনি বললেন, ‘শোনো, এই নগরীতে আমি কারওকে অভুক্ত, মলিন, দরিদ্র ও ভিক্ষাযাচক হিসাবে দেখতে চাই না। অতএব যারা দরিদ্র তাদের ধনদান করো।’
নিধিপতি শঙ্খ তাঁর সহযোগীদের ডেকে বললেন, ‘তোমরা দ্বারাবতীর প্রতি গৃহে প্রচুর পরিমাণে ধনবর্ষণ করো।’ দ্বারাবতীর কেউই আর নির্ধন থাকল না। প্রতিটি নাগরিকের ভাগ্য ফিরে গেল। এবার আপনি ডেকে পাঠালেন সমীরণকে। বললেন, মারুতদেব, তুমি এখনই স্বর্গের দেবেন্দ্র সভায় চলে যাও। দেবতাদের বলো, সুধর্মা নামে যে সভাটি ওখানে আছে সেটিকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ওই সভাটি এখানে চাই। কারণ, বিক্রান্ত ও ধার্মিক শ্রেষ্ঠ যাদবরা দেবতাদের মতো এখানে সেই সভার সভ্য হবেন। পবনদেব আপনার আদেশ পালন করলেন। সুধর্মা সভা ভুলোকে অবতীর্ণ হল। এইভাবে ক্রমে ক্রমে স্বর্গীয়, পার্থিব ও জলজাদি বিবিধ দ্রব্যে প্রমদার মতো সেই পুরীর ভুষণক্রিয়া সম্পাদন হল। প্রভু! আপনি যে কত বড় ব্যবস্থাপক তা ওই নগরীর জনগণের বিন্যাসেই বোঝা যায়। আপনি যেন এক নতুন পৃথিবী তৈরি করলেন। শ্রেণি বিভাগ, প্রকৃতি বিভাগ, সেনাপতি বিভাগ ও শাসনপতি বিভাগ শুরু করে দিলেন। রাজার আসনে বসালেন উগ্রসেনকে। রাজপুরোহিত হলেন কাশ্যক। অনাসৃষ্টিকে করলেন সেনাপতি। বিকদ্রু মন্ত্রী। প্রবীণ ও প্রধান দশজন যাদবকে করলেন সর্বাধ্যক্ষ। সুনিপুণ দ্বারুক হলেন সারথি। রণদক্ষ সাত্যকি হলেন সৈন্যাধ্যক্ষ। তারপরে আপনার জীবনে যেন পরমানন্দের একটি সময় এল। এইবার আপনি নিশ্চিন্তে কিছুকাল বিহার করবেন। বলদেবের বিবাহ দিলেন রেবতকন্যা রেবতীর সঙ্গে। প্রভু! কী নিষ্ঠুর আপনি নিজের প্রতি! রাজা হয়েছেন তাই না! অতএব রাজোচিত কিছু ঘটনা তো ঘটাতে হবে। রুক্মিণীকে হরণ করবেন। জরাসন্ধ চেদিরাজ দমঘোষের একটি প্রিয় কাজ করবেন। শিশুপালের সঙ্গে ভীষ্মকদুহিতা রুক্মিণীর বিবাহ ঘটাবেন। জরাসন্ধ ভীষ্মককে সেই কথা বললেন। ভীষ্মক রাজি হলেন। চতুর্দিকে ঘোষণা হল বিবাহের দিন। আমন্ত্রিত রাজারা এসেছেন। আপনিও বলদেবকে নিয়ে সেখানে গেছেন। সঙ্গে আছেন বৃষ্ণিরা, সৈন্যরাও রয়েছেন। কেউ জানে না আপনি কী করবেন! আগামীকাল বিয়ে। আজকে রুক্মিণী শচী ও শচীপতিকে অর্চনা করার জন্য বিবাহসূত্র হাতে নিয়ে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রথে আরোহণ করলেন। সৈন্যরা রথটিকে ঘিরে রেখেছে। রুক্মিণী চলেছেন মন্দিরে পুজো দিতে। মন্দির দেখা যাচ্ছে, আর সামান্য দূর। এমন সময় আপনি তাঁকে দেখতে পেলেন। এ কী রূপ! যেন প্রদীপ্ত অনল শিখা, যেন মূর্তিমতী পৃথিবী, যেন চন্দ্রের কিরণমালা। তাঁর বর্ণ শ্যামশুক্ল। চোখ দুটি দীর্ঘ। অপাঙ্গ ওষ্ঠ। আঙুলের নখ তাম্রবর্ণ। ভ্রূদুটি অতি মনোহর। কেশজাল নীল, কুঞ্চিত। নিতম্ব ও পয়োধর অতি পীন। দন্তগুলি সমান, সূক্ষ্ম ও অতিশয় শুভ্রবর্ণ। মুখকমল পূর্ণ চন্দ্রের মতো। রাজকন্যার এই রূপ। আপনাকে আমরা পুজো করি, আর আপনি হলেন রূপের পূজারি। এই রূপের কাছে আপনি পরাজিত হলেন। ভ্রাতা বলদেবকে বললেন, কী করা যায়! বড় উতলা হয়েছি আমি। বলদেব বললেন, ‘হরণ করাই একমাত্র পথ।’
দূর অতীতে চলে গিয়ে দৃশ্যটি দেখি। পুজো শেষ করে রুক্মিণী দেবমন্দির থেকে বেরিয়েছেন। আর আপনি চিলের মতো ছোঁ মেরে তাঁকে তুলে নিয়েছেন নিজের রথে। সৈন্যরা হে-রে-রে-রে করে তেড়ে এল। বলদেব গাছ উপড়ে তাদের আটকাতে লাগলেন। আপনার সঙ্গে যেসব বৃষ্ণি গিয়েছিলেন তাঁরা কেউ রথে, কেউ ঘোড়ায়, কেউ হাতিতে আরোহণ করে বলদেবকে সাহায্য করার জন্য একটি বৃত্ত রচনা করলেন। তাঁরা সৈন্যদের আটকাচ্ছেন আর আপনি রুক্মিণীকে নিয়ে রথ ছোটালেন দ্বারকার দিকে। অপহরণের খবর পেয়ে জরাসন্ধ হাওয়ার গতিতে ঘটনাস্থলে এলেন। শুরু হল যুদ্ধ। ছোটখাটো যুদ্ধ নয়, বিরাট যুদ্ধ। হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। রুক্মিণীর ভাই রুক্মী যুদ্ধ করতে এসেছিলেন। প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, আপনাকে বধ করে বোনকে রাজপ্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তা সম্ভব হল না। তাঁকে সশস্ত্র আপনার দিকে আসতে দেখে তাঁর বুক বিদীর্ণ করে দিলেন। রুক্মী যখন ভূমিতে পড়লেন তখন সেই শব্দে পৃথিবী কেঁপে উঠল। আর রুক্মিণী শ্রীকৃষ্ণের চরণে পতিত হলেন। এমনই লেখা আছে। তিনি প্রার্থনায় কাতর। মারবেন না, মারবেন না। আপনি রুক্মিণীকে আলিঙ্গন করে আশ্বাস দিলেন, আমি তোমার ভাইকে ক্ষমা করলুম। শ্রীকৃষ্ণের রথ ছুটল দ্বারকার দিকে। এই দৃশ্যটি আজও আমি দেখতে পাচ্ছি। বিরাট এক যুদ্ধ করে আপনার প্রিয়তমাকে লাভ করলেন। তিনি হবেন আপনার প্রধানা মহিষী। ওদিকে সমরাঙ্গণে শ্রুর্তব্য রুক্মীকে রথে তুলে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনতে চাইলেন। রুক্মী বললেন, প্রতিজ্ঞা করেছিলুম, ভগিনীকে না নিয়ে রাজপুরে প্রবেশ করব না। আমার অন্য স্থানে থাকার ব্যবস্থা করো। তখন একটি নতুন নগর নির্মাণ করা হল। পরে যা প্রসিদ্ধ হবে ভোজকট নামে। এরই দক্ষিণ দিকে কুন্তী নগরে রাজা ভীষ্মকের বাস। প্রভু, এইবার দ্বারকায় ফিরি। বলদেব এসেছেন, বিবাহের আয়োজন হচ্ছে। আপনি রুক্মিণীর পাণিগ্রহণ করলেন। এইরকম বলা হয়— রামের যেমন সীতা, ইন্দ্রের যেমন ইন্দ্রাণী, কেশবের সেইরকম রুক্মিণী। হে কৃষ্ণ, কী বলব আপনার লীলার কথা। আপনার কত সহধর্মিনী! প্রধানা হলেন রুক্মিণী। এরপর সূর্যপুত্রী কালিন্দী, রাজাধিদেবের কন্যা মিত্রবৃন্দা, অযোধ্যাপতি নগ্নজিৎ-এর কন্যা সত্যা, রাজা জাম্ববতের কন্যা জাম্ববতী, কেকয়রাজের কন্যা রোহিণী, মদ্ররাজ দুহিতা লক্ষ্মণা এইবার আরেকজন বিখ্যাতা— সাত্রাজিতী সত্যভামা, অপ্সরাপ্রতিমা শৈব্য পুত্রী তন্বী। এই আটজন প্রথম সারিতে। এ ছাড়া আরও ষোলো হাজার রমণীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন আপনি।
দেবলীলা আর মনুষ্যলীলা। দেবতা যখন মানুষ হন তখন তাঁরও কোনও কূলকিনারা থাকে না। আপনি হবেন আদর্শ গৃহী। কিন্তু আপনি যে ভগবান। সেই কারণেই আপনার পত্নীর সংখ্যা ষোলো হাজারেরও বেশি। এই ষোলো হাজার পত্নীর সঙ্গে শয্যাগ্রহণ করতেন। সূর্যোদয়ের তিন ঘণ্টা আগেই শয্যা ত্যাগ করতেন। প্রকৃতির বিচিত্র ব্যবস্থাপনা। মোরগের ডাকে সূচিত হত ব্রাহ্মমুহূর্ত। একে কী বলতে পারি, প্রকৃতির অ্যালার্ম ঘড়ি। আপনিও এই ডাক শুনেই শয্যা ত্যাগ করতেন। আপনার পত্নীরা এই শেষ রাতে আপনার শয্যা ছেড়ে চলে যাওয়া একদমই পছন্দ করতেন না। মোরগ ডাকার আগেই শয্যাসঙ্গিনী আপনাকে জড়িয়ে ধরে থাকতেন। আর মোরগদের গালাগাল দিতেন।
আপনাকে একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে। মথুরার সঙ্গে দ্বারকার যোগ ছিল সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে। শ্রীমদ্ভাগবতে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হচ্ছে, আপনি সমুদ্রের মধ্যে এক পুরী নির্মাণ করেছিলেন। দেখুন এই যে কথা বলছি তার প্রমাণও পাওয়া গেছে। আপনার সেই দুর্গপুরীর ধ্বংসাবশেষ আজও দ্বারকার উপসাগরে রয়েছে। অলৌকিক বিশ্বকর্মা সমুদ্রের মধ্যে ছিয়ানব্বই বর্গমাইল ব্যাপী দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন। একালের কোনও ইঞ্জিনিয়ার পারবেন কি! বিশ্ববাসীরা বলেন, ভগবানের ব্যবস্থাপনায় অন্তরীক্ষে যদি অসংখ্য বিশাল গ্রহমণ্ডলী ভাসমান থাকতে পারে, তা হলে সমুদ্রগর্ভে ছিয়ানব্বই বর্গমাইল ব্যাপী এক শিল্পকলাময় পুরী নির্মাণ করা তেমন কোনও আশ্চর্য ব্যাপার নয়!
প্রভু! আপনার ওই দ্বারকা আজ যদি থাকত তা হলে এটি হত পৃথিবীর প্রথম আশ্চর্য। ব্যাসদেব দেখেছিলেন। নারদ দেখতে এসেছিলেন। ওখানে যেসব গাছ ছিল সেগুলি ছিল কল্পবৃক্ষ। বৈকুণ্ঠেই তা দেখা যেত। আপনার ইচ্ছায় সবই হয়। বৈকুণ্ঠ থেকে চারা এনে রোপণ করা হয়েছিল। অসংখ্য গোপুর ও প্রাসাদ। মঙ্গলসূচক স্বর্ণকলস দিয়ে অতি নৈপুণ্যে রচিত তোরণদ্বার বা গোপুর। এই গোপুর এখনও দেখা যায় বড় বড় মন্দিরে, প্রাসাদে। দ্বারকার অধিকাংশ প্রাসাদই ছিল গগনস্পর্শী। প্রতি গৃহের গর্ভকক্ষে বড় বড় সোনা ও রুপোর পাত্রে প্রচুর শস্য সংগ্রহ করে রাখা হত। প্রতি গৃহেই বহু স্বর্ণকলস। শয়নকক্ষ ছিল মণিরত্নময়। কক্ষপ্রাঙ্গণ তৈরি হয়েছির মরকত মণি সমন্বিত প্রস্তরে। প্রতি গৃহে প্রতিষ্ঠিত ছিল শ্রীবিষ্ণুবিগ্রহ। বর্ণাশ্রম সযত্নে রক্ষিত হত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্ররা নিজের নিজের এলাকায় বাস করতেন। কেন্দ্রস্থলে মহারাজ উগ্রসেনের বসবাসের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত একটি আবাসিক অঞ্চল ছিল। এই প্রাসাদটি ছিল দ্বারকাপুরীর সবচেয়ে বিস্ময়কর নির্মাণ।
দেবতারা এত খুশি হলেন তাঁরা স্বর্গলোক থেকে পাঠিয়ে দিলেন বিখ্যাত পারিজাত ফুলের গাছ। আপনি চেয়েছিলেন সুধর্মা নামে এক রাজসভা। দেবতারা সেটিও পাঠিয়েছিলেন। এই রাজসভা কক্ষের বিশেষ একটি গুণ ছিল। সভায় যোগদানকারীকে জরা ও বার্ধক্য স্পর্শ করতে পারবে না। বরুণদেব কৃষ্ণবর্ণ কর্ণ বিশিষ্ট একটি শ্বেত অশ্ব আপনাকে উপহার দিলেন। সেই অশ্বটি যদি একবার দেখতে পেতাম প্রভু! ধনরক্ষক কুবের যৌগিক ঐশ্বর্য, অষ্টসিদ্ধিলাভের কলাটিও আপনাকে শিখিয়ে দিলেন। সমস্ত দেব-দেবতার উপহারে উপহারে দ্বারকাকে ভরে দিলেন।
প্রভু! আপনার মহিষীর সংখ্যা ছিল ষোলো হাজার একশো আট। সকলেই রাজকন্যা। আপনার অলৌকিক খেলা, কখনও আপনি এক, কখনও আপনি, ষোলো হাজার একশো আট। মহিষীদের প্রত্যেকেরই একটি করে নিজস্ব প্রাসাদ, উদ্যান, ক্রীড়াঙ্গন, স্নানঘর, সবরকম বিলাসিতার চরম ব্যবস্থা। প্রত্যেক মহিষীর কাছে একজন করে শ্রীকৃষ্ণ। তাঁদের প্রাসাদ পরিত্যাগ না করে সর্বদাই সেখানে অবস্থান করায়, রানিরা সকলেই মনে করতেন আপনি তাঁদের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ও স্ত্রৈণ। প্রত্যেক রানিই মনে করতেন তিনি আপনার সবচেয়ে প্রিয়। আপনি যে কতটা নিরাসক্ত তা তাঁরা পরে বুঝবেন। এ এক অদ্ভুত সাধনা। ইচ্ছাশক্তি র বিচিত্র খেলা। এক থেকে বহু বহু থেকে এক। এটি একটি বিশেষ তত্ত্ব। এইখানেই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে সেই সত্য, একই বহু হচ্ছেন। আবার বহু মিলিত হচ্ছে এক-এ। এরই নাম ব্রহ্ম ও জীবজগৎ। জাদুদণ্ডটি রয়েছে মায়াদেবীর হাতে। তিনি যেন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। এক একটি সুতো ধরে টানছেন আর এক রকমের নৃত্য শুরু হচ্ছে। অসাধারণ এক ছায়াবাজি। আপনি ভগবান, বাজিকরের খেলা দেখার মতোই নিজের জীবন নিয়ে খেলা করছেন। পত্নীদের সন্তুষ্ট করার জন্য আদর্শ পতির ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাঁদের সঙ্গে লীলাবিলাস। একজন পত্নীরও প্রয়োজন ছিল না আপনার। আপনার খেলাটাই হল চিরকালের একটা শিক্ষা। পত্নীর অবলম্বন পতি। প্রেম, ভালবাসা, সেবা— এসবই হল পূজা। বিগ্রহটি কে! তিনিই হলেন পতি। ভারতধর্মে পতি-পত্নীর উচ্চ আদর্শ স্থাপন করে দিয়ে গেছেন আপনি। এই ভিতের ওপর গড়ে উঠবে মানব সমাজ, সুখী পরিবার, সুসন্তান, যা দ্বারকার চেয়েও বিরাট, বিশাল, গগনস্পর্শী।
প্রভু! কী বড় অভিনেতা আপনি! রাজমহিষীরা প্রত্যেকেই পরমাসুন্দরী। আপনার মধুর পরিহাসপূর্ণ কথা, প্রেমময় হাসি, আপনার দীর্ঘ বাহু, প্রশস্ত কর্ণ, অরবিন্দ লোচন, সুন্দর বদন, মনোহর দৃষ্টিপাত। মহিষীরা এইসব শরের আঘাতে স্বভাবতই কাবু। তাঁরা সকলেই চাইতেন রূপের জালে আপনাকে জড়িয়ে রাখতে। অপূর্ব সাজপোশাক, ভ্রূভঙ্গি, হাস্যকটাক্ষ, রমণীর এইসব লক্ষণ দিয়ে আপনার কামভাব জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন। তাঁরা কেউই আপনার মন, জয় করতে পারেননি। আপনি শুধু অভিনয় করে গেছেন। তাঁদের সেবা নিয়ে সেবা শিখিয়ে গেছেন, অসংখ্য পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা নিজেরাই চমৎকার আসন পেতে দিতেন, নানা উপকরণ দিয়ে আপনার পুজো করতেন। তাম্বুল দান করতেন। পাদসংমাহন করতেন। বাতাস করতেন। সুগন্ধ তেল ও চন্দন লেপন করতেন। গলায় মালা পরিয়ে দিতেন। কেশবিন্যাসেও তাঁরা পটু ছিলেন। আপনার পুত্রের সংখ্যা— ষোলো হাজার একশো আট রানির প্রত্যেকের দশটি করে পুত্র ছিল। শ্রীকৃষ্ণ পরিবার। প্রভু! সবিস্ময়ে বলতে ইচ্ছা করে— বাবা রে! কারণ আমি এতটাই ক্ষুদ্র, আপনার মতো জগৎ কারণকে বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। কোথা থেকে কী করছেন, কেন করছেন— এই প্রশ্নের উত্তর যে ধ্যানে জানা যেতে পারে তা আমার নেই। সমুদ্রের ঢেউ খেলে যাচ্ছে দ্বারকার অন্দরে। প্রতিটি প্রাসাদে একজন করে শ্রীকৃষ্ণ রাত্রিবাস করছেন, যখন বেরিয়ে আসছেন তখন হয়ে যাচ্ছেন একজন। আপনার অপূর্ব রথে আরোহণ করে চলেছেন রাজকার্যে, গোদানে, ব্রাহ্মণ সেবায়, সভাপরিচালনায়। কিন্তু আপনি বড় একা। এই একাকিত্বই আপনাকে বাধ্য করবে সব বিস্তার গুটিয়ে এনে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। শেষের জন্য আপনার প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা সঙ্গেই ছিল। ধরতে পেরেছিলেন আপনার দক্ষিণ হস্ত অতি প্রিয় সুপণ্ডিত উদ্ভব।
আপনি কেন এসেছিলেন? সরেজমিনে দেখতে এসেছিলেন। মায়াই হোক, আর সত্যই হোক, জগৎ ক্রমশ ঘটনাবহুল ও বহু জনসংখ্যায় ভরে উঠবে। ভগবানের নিয়ন্ত্রণ কতটা? আর মানুষের কর্মফল কতটা শক্তিশালী। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কী হাল হবে আপনার সময়েই আপনি দেখলেন, রাজাদের অহংকার, কপটতা, চাতুরি, সাধারণ মানুষের শান্তি ও অশান্তির সংসার, দেখলেন ধর্ম ও ভ্রষ্টাচার, আপনি দেখলেন জগৎ ঘুরছে কাম ও কাঞ্চনে। আবার আপনি আসতে পারেন, তবে অন্যরূপে, অন্য মহিমায়, সত্য চিরকালই এক। কিন্তু চশমার অনেক রকম রং। বুঝেছি প্রভু! যতই ডাকাডাকি করি, বাইরে আপনাকে দেখতে পাব না, হৃদয়ে পেতে পারি। চলুন একবার দেখে আসি পাণ্ডবদের কী হল! কুরুক্ষেত্র হয়ে গেছে। যোদ্ধারা অনেকেই মৃত। যুধিষ্ঠির এতটাই শোকার্ত যে নিজেকেই কেবল নিজে প্রশ্ন করে চলেছেন— আমি এখন কী করব? যা হয়ে গেল তা আমি কেমন করে মুছে দেব। কোথায় শান্তি, কোথায় শান্তি? তিনি কেবল ভীষ্মের কথা বলছেন, শৈশবে আমি তাঁর কোলেপিঠে চড়েছি। যুদ্ধক্ষেত্রে শিখণ্ডি যখন তাঁকে আক্রমণ করল, আমি লক্ষ করছি, সেই প্রবীণ মানুষটি থরথর করে কাঁপছেন। একের পর এক তীক্ষ্ন শরে তাঁর শরীর বিদ্ধ হচ্ছে। শিখণ্ডির লিঙ্গ তিনি জানতেন। তাই তার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন না। বাণের পর বাণে জর্জরিত হচ্ছেন। তারপরে দেখলুম, সেই বিশাল স্তম্ভ রথের ভূমিতে পড়ে গেলেন। উঃ, আমার মাথা ঘুরছে। যন্ত্রণায় আমার হৃদয় যেন নিংড়ে যাচ্ছে। তিনি আমাদের বড় করেছিলেন। আমি তাঁর ধ্বংসের কারিগর। আমারই কৌশলে শিখণ্ডি সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আচার্য দ্রোন আমার শিক্ষক। আমাকে ধনুক ধরতে শিখিয়েছিলেন। এইসব দৃশ্য আমাকে উন্মাদ করে দিচ্ছে। তোমরা আমাকে রাজা করবে! রাজার পোশাক পরে আমি স্বর্ণসিংহাসনে বসব। না, না এ অসম্ভব! এতক্ষণ আপনি পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন। কঠোর কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আপনার শোকে কোনওরকম প্রশ্রয় দিতে পারছি না। বাকি জীবন কি আপনি অনুশোচনা করে কাটাতে চান। নিজেকে ভুলে যান। আবেগ সংযত করুন। যারা আপনার জন্য যুদ্ধ করেছে, আপনার আদেশ পালন করেছে, তাদের কথা ভাবুন। কী যন্ত্রণা তারা সহ্য করেছে। রাজ্যভার আপনাকে গ্রহণ করতে হবেই। যুধিষ্ঠির সংযত হলেন। আপনাকে বললেন, হে কৃষ্ণ! আমার মন এখন পরিস্কার হয়েছে। আমি আপনার আদেশ মান্য করব। পিতামহ ব্যাসের কথাও আমাকে শুনতে হবে। অতএব চলো, যা করার করি। যুধিষ্ঠির ঈশ্বরকে স্মরণ করে রথে আরোহণ করলেন। রাজরথ যেমন হয় ঠিক সেইরকম। ভীম ধরলেন লাগাম। অর্জুন মাথার ওপর ধরলেন রাজছত্র, নকুল আর সহদেব দু’পাশে দাঁড়িয়ে চামর ব্যঞ্জন করতে লাগলেন। আর একটি রথে কুন্তী ও দ্রৌপদী, সারথি বিদুর। আপনি সাত্যকি এবং আরও অনেকে সেই শোভাযাত্রায় সামিল হলেন। পথ সাজানো হয়েছে তোরণে, ফুলে, পতাকায়। ছড়ানো হচ্ছে সুগন্ধী জল। যুধিষ্ঠির বিপুল সমারোহে রাজধানীতে প্রবেশ করলেন। চতুর্দিকে সুর ও সংগীত, জনগণের উচ্ছ্বাস ধ্বনি। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। তিনি এখন রাজা। প্রথমেই গেলেন ঠাকুরঘরে। পুজো করলেন, তারপর পূর্বদিকে মুখ করে বসলেন স্বর্ণসিংহাসনে। আর একটি স্বর্ণ আসনে আপনি এবং সাত্যকি বসলেন যুধিষ্ঠিরের দিকে মুখ করে। সিংহাসনের দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ভীম ও অর্জুন। একটি হাতির দাঁতের আসনে বসেছেন কুন্তী। পাশেই রয়েছেন নকুল ও সহদেব। ধৃতরাষ্ট্র বসেছেন বিশেষ একটি আসনে। তাঁর একমাত্র জীবিত পুত্র যুযুৎসু বসে আছেন তাঁর পাশে। ওই দিকেই রয়েছেন সঞ্জয় এবং গান্ধারী। সম্মানিত নাগরিকরা এসেছেন দামি দামি উপহার নিয়ে। যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদী পূত অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করলেন। অগ্নিতে আহুতি দিলেন। পুরোহিতরা উদাত্ত কণ্ঠে মন্ত্র পাঠ করলেন। আপনি আপনার পবিত্র শঙ্খ থেকে পবিত্রবারি সিঞ্চন করলেন যুধিষ্ঠিরের মস্তকে। বেজে উঠল তুরী-ভেরি। সবাই যুধিষ্ঠিরের জয়ধ্বনি করলেন। যুধিষ্ঠির তাঁর ভাষণে বললেন, ‘রাজা ধৃতরাষ্ট্র এখনও এই দেশের সর্বময়। আমাকে আপনারা যদি খুশি করতে চান তা হলে আপনারা তাঁকে সম্মান জানান এবং আগের মতো তাঁর আদেশ পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ হন। আমার এই কথা মনে রাখবেন। এই বিশাল বিশ্ব এবং আমরা তাঁরই অধীনে।’ রাজা যুধিষ্ঠির ভীমকে যুবরাজ ঘোষণা করলেন। বিদুর হলেন পরামর্শদাতা। সঞ্জয় হলেন অর্থমন্ত্রী, নকুল সশস্ত্র বাহিনীর হিসাবরক্ষক, অর্জুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ধৌম্য প্রধান পুরোহিত, সহদেব হলেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী। এবং যুযুৎসু হলেন, বৃদ্ধ রাজার রক্ষণাবেক্ষণের সচিব।
প্রভূ! ব্যাসদেব মহাভারত শেষ করতে চাননি, শেষ করা যায় না। ঘটনা চলতেই থাকবে। রাজ্যপ্রাপ্তিতে শেষ হল না মহাভারত পর্ব। যুধিষ্ঠির বেশ বুঝতে পারছিলেন আপনি কেমন যেন অন্তর্মগ্ন। নিজের ভাবেই যেন রয়েছেন। কয়েকদিন দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘কৃষ্ণ! আমি বুঝতে পেরেছি বিষণ্ণতার কারণ কী! উত্তরায়ণ এল বলে। ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত। তিনি প্রাণত্যাগ করবেন। তিনি জ্ঞানের ভাণ্ডার। তিনি জানেন, রাজার কর্তব্য কী! মানুষের আচরণ কী হওয়া উচিত! তাঁর সঙ্গে এই জ্ঞানও হারিয়ে যাবে। পৃথিবী দরিদ্র হয়ে পড়বে। আমি চাই তুমি তাঁর সঙ্গে দেখা করো। খুব বেশি সময় আর নেই।’ যুধিষ্ঠিরের সন্দেহ ছিল ভীষ্ম কৃষ্ণকে কীভাবে গ্রহণ করবেন। কিন্তু আপনি সোজা তাঁর কাছে চলে গেলেন। সঙ্গে যুধিষ্ঠিরও। শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম বড় আদরের সঙ্গে তাঁদের আহ্বান করলেন। শুরু হল আলোচনা। ভীষ্ম বলতে লাগলেন, রাজার কর্তব্য কী! ব্যাসদেব মহাভারতের শান্তিপর্বে এই আলোচনা যুগের জন্য ধরে রেখে গেছেন। বেশ কয়েকদিন ধরে এই কথোপকথন চলল। সবশেষে ভীষ্ম সকলকে বিদায় জানিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। যুধিষ্ঠির শরশয্যা থেকে তুলে নিলেন তাঁর শরীর। সম্পাদন করলেন শেষকৃত্য। অনুষ্ঠানটি হল গঙ্গার তীরে। ভীষ্মের মাতা গঙ্গাদেবী আর একবার দর্শন দিলেন। পুত্রের আত্মা গ্রহণ করে নিয়ে গেলেন তাঁর আসল আবাসে। অন্তরীক্ষে।
প্রভু! যুধিষ্ঠির রাজ্যশাসন করবেন ছত্রিশ বছর। এইকাল শেষ হলে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, আমি এইবার বাণপ্রস্থে যাব, গান্ধারীকে সঙ্গে নিয়ে অরণ্যে। আমার ভ্রাতৃবধূ কুন্তীও থাকবে সঙ্গে। জীবনের শেষটা আমরা মননে ও ধ্যানে কাটাব। যুধিষ্ঠির সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলেন, যাতে তাঁদের কোনও অসুবিধা না হয়। তাঁরা চলে গেলেন অরণ্য নিবাসে। তাঁদের শেষটা লেখা ছিল এইভাবে— একদিন দাবানলে তিনজনই দগ্ধ হলেন।
প্রভু! এইবার আপনার দিকে আসি। বৃষ্ণি কুলেও ঘোর সংকট। যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন। আপনি যোগদানের জন্য জ্ঞাতিবন্ধুদের নিয়ে হস্তিনাপুরে গেলেন। পঞ্চম পাণ্ডব ওই সময় ওখানে ছিলেন না। সেনা সংগ্রহের জন্য হিমালয়ে গিয়েছিলেন। অভিমন্যুর মৃত্যুতে উত্তরা শোকে আহার ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর গর্ভস্থ সন্তান ক্ষীণ হয়ে পড়ে। আপনি যখন গেলেন তখন উত্তরা একটি মৃতপুত্র প্রসব করলেন। কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা ও অন্য নারীদের কান্না শুনে আপনি সাত্যকির সঙ্গে সূতিকাগৃহে প্রবেশ করেন। একমাত্র আপনিই জানতেন, উত্তরার মৃত শিশু প্রসব অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রের ফল। আপনি অত্যন্ত ব্যথিত হলেন। সকলের বিশেষ প্রার্থনায় করুণাময় ভগবান আপনি, মৃত শিশুর দিকে তাকিয়ে বললেন, যদি আমি কখনও মিথ্যা না বলে থাকি, যুদ্ধে বিমুখ না হই, যদি ধর্ম ও ব্রাহ্মণগণ আমার প্রিয় হন তবে অভিমন্যুর এই পুত্র জীবন লাভ করুক। মৃত শিশু জীবিত হল। পাণ্ডব বংশে আর তো কেউ নেই। এই শিশুটিই একমাত্র বংশধর। আপনি নিজেই তার নাম দিয়েছিলেন ‘পরীক্ষিৎ।’
সাংঘাতিক পরিকল্পনা। পৃথিবীর ভার কমাবেন আপনি। কী ভার! পৃথিবীতে দুষ্ট-দুর্জন ব্যক্তিরাই দুর্ভার। মীরাবাইয়ের একটি গানে অনেক প্রশ্নের মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল— পৃথিবীর চেয়ে ভারী কী বস্তু! উত্তর পাপ। পাপ ভুমিসে ভারী। কলঙ্ক কাজল সে কালি। অনেক বধ করেছেন। কংস, শিশুপাল, জরাসন্ধ, দুর্যোধন সহ কুরুকুল। কেন এমন মনে হল আপনার, যাদবদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে! আপনারই বংশ। নিজেকে নির্বংশ করতে চাইছেন। আপনি বলেছেন, ‘এই যাদবরা ক্রমশই দুঃসহ পাপী হয়ে উঠছে। মদ্যপ, লম্পট, উচ্ছৃঙ্খল, অত্যাচারী। প্রবীণ যাদবরা ততটা নন যতটা নবীন প্রজন্ম।’ একটি প্রশ্ন করব প্রভু! কিছু মনে করবেন না। দ্বারকা নির্মাণ করলেন, বিলাস বৈভবের প্রবাহ ছোটালেন। সেই প্রাচুর্যের মধ্যে যারা বড় হচ্ছে তাদের আপনি মানুষ করার ব্যবস্থা করলেন না কেন! শিক্ষা, সু-সংস্কৃতি, সংযম, আত্মত্যাগ, দয়া, সেবা—এসবের কোনও ব্যবস্থা ছিল কি! শুধুই তারা জলে জলকেলি করবে, প্রমদাদের সঙ্গে রতিক্রীড়া, অপরিমিত মদ্যপান, জুয়া ঘোড়দৌড়— এই তো ছিল তাদের বিলাসী জীবনের অবলম্বন। চতুর্দিকে সুবেশা, সুন্দরী রমণী, ক্রীড়া কৌতুক। আপনার মহিষীরা তাঁদের প্রাসাদের ছাদে বল নিয়ে খেলা করতেন। অতি-সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করতেন। এইসব দেখলে মনে মদনভাব আসবে না কি! আপনি তো যাদবদের স্বভাব জানতেন। তাদের মদ ও রমণীর প্রতি অনেকদিনের আকর্ষণ। এইটাই তো হয়ে উঠেছিল তাদের সংস্কার। বুঝেছি, এসবই আপনার পরিকল্পনা। আপনার মায়া। যোগমায়া তো আপনার সঙ্গে সঙ্গেই ঘোরেন। এই বংশে অবতীর্ণ হওয়ার পর আপনি একশো পঁচিশ বছর অতিবাহিত করেছেন। এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, এখন আপনার বয়স একশো পঁচিশ বছর। কিন্তু আপনি তরুণ।
আমি জানি, আপনি একদিন ভাবলেন, এই যাদবেরা আমার রক্ষিত। কেউ এদের নির্মূল করতে পারবে না। আপনি এমনও ভাবলেন, এরা আমারই শক্তিতে শক্তিমান। কিন্তু কী সাংঘাতিক উদ্ধত হয়ে উঠেছে। এরা বেঁচে থাকলে পৃথিবীর ভার দূর হবে না। তবে এদের ধ্বংস করতে হবে ব্রহ্মশাপ চাই। তারপর এদের মধ্যে বিবাদ বাধিয়ে দেব। একে অপরকে দিয়ে এই যদুবংশের বিনাশ করতে হবে। তারপর? আমার মুক্তি । ব্রহ্মশাপের জন্য যে পরিকল্পনাটি করলেন তা এক কথায় অসাধারণ।
আপনার প্রিয়সখা উদ্ধব আগেই আঁচ করেছিলেন বিশ্রী কিছু একটা ঘটতে চলেছে। দ্বারকার আকর্ষণে মুনি ঋষিরা প্রায়ই আসতেন বসুদেবের অতিথি হয়ে। আপনি হঠাৎ তাঁদের বললেন, আপনারা এখনই যাঁর যাঁর জায়গায় ফিরে যান। এই ঋষিদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বামিত্র, ভৃগু, কণ্ব, দুর্বাসা, অঙ্গীরা, অত্রি, বামনদেব, বশিষ্ঠ, ও নারদ। দ্বারকার কাছেই একটি তীর্থ ছিল, নাম পিণ্ডারক। ঋষিরা ঠিক করলেন সেখানেই যাবেন। প্রভু! আপনার বংশের কিছু যুবক, তাদের তো সারাদিনে বিশেষ কোনও কাজ নেই। তারা খেলা করছিল। খুবই অশালীন খেলা। শাম্বকে তারা নারী সাজিয়েছে। তার উদরে অনেক কাপড় জড়িয়ে তাকে গর্ভবতীর আকার দিয়েছে। মুনিদের আসতে দেখে তাদের মাথায় যেন ভূত চাপল। তাঁদের কাছে শাম্বকে নিয়ে গেল। অত্যন্ত বিনীতভাব। ঋষিদের প্রণাম করে তারা বললে, আপনারা ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান— সবই বলতে পারেন। আপনারা মহাঋষি। এই নারী গর্ভবতী। খুবই ইচ্ছা একটি পুত্রসন্তান লাভ করে। আসন্নপ্রসবা। দয়া করে বলুন, এর কন্যা হবে না পুত্র। মুনিরা সর্বজ্ঞ, অন্তর্যামী, ওই যুবকরা তা জানত। এই ছলনা ধরা পড়বেই। এ যেন তাঁদের হেয় করা। ইতর কৌতুক। মুনিরা ভীষণ রেগে গিয়ে আরক্ত লোচনে অগ্নিবর্ষণ করলেন। তাঁরা কাঁপছেন। তাঁরা বললেন, ‘কী আর কহিব সবে ওহে মন্দগণ। মুষল হইবে গর্ভে কুলের নাশন!!’ মুনিরা ধীরে ধীরে রাজপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দূর থেকে দূরে অদৃশ্য হলেন। যাদব যুবকদের মাথায় হাত। শাম্বের কৃত্রিম উদর তারা উন্মোচন করে দেখল— প্রকাণ্ড একটি মুষল। নিরেট লোহা। তারা ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেল। ওঁরা বললেন, মুষল, আর সঙ্গে সঙ্গে মুষল বেরোল। প্রথমটি সত্য হল, তা হলে দ্বিতীয়টিও সত্য হবে—যদুকুল ধ্বংস হবে। তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাজসভায় হাজির হল। প্রবীণরা সেখানে বসে আছেন। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ রয়েছেন। আছেন যদুরাজ আহুক। পুরো ঘটনা তারা বর্ণনা করল। আহুক বললেন, এতে ভয় পাওয়ার কী আছে! একটু কাজ বাড়ল এই যা! তাড়াতাড়ি সাগরের তীরে চলে যাও। এটাকে ঘসে ঘসে নির্মূল করে দাও। তা হলে আর কোনও আশঙ্কা থাকবে না।
হে কৃষ্ণ! আপনি বসে আছেন, আপনি শুনছেন, আর মনে মনে হাসছেন। যদুপতিরা বলছেন, আশঙ্কা। আশঙ্কাটা কী! তাঁরা কি জানেন, এর পর কী হবে! একমাত্র আপনিই জানেন, এই মুষলের পরিণতি। যুবকরা ছুটল সমুদ্রের কূলে। সেখানে বড় একটি পাথরের ওপর তারা পালা করে ঘসতে লাগল। ধীরে ধীরে আকার কমে আসছে। আর মিহি লৌহচূর্ণ ফেনার আকারে তীরে জমছে। ঘসতে ঘসতে যখন এতটুকু হয়ে গেল তখন তারা সেটিকে উপেক্ষা করে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করল। এই টুকরোটিই যে হবে সর্বনাশের কারণ। ফেলামাত্রই একটি মাছ গপ করে সেটিকে খেয়ে ফেলল। যে মাছটি খেল সেটি ধরা পড়ল এক ধীবরের জালে। মাছের পেট থেকে বেরুল মুষলের ক্ষুদ্র অংশটি। ভারী সুন্দর একটি লোহার টুকরো। দীর্ঘ ঘর্ষণের ফলে ঝকঝক করছে। এক ব্যাধ, তার নাম লুব্ধক। টুকরোটি কিনে নিয়ে গেল। সেই টুকরো দিয়ে তৈরি হল একটি বাণের ফলা।
প্রভু! এদিকের কাজ সব শেষ। আপনার ব্যবস্থাপনা, গোছগাছ একেবারে ছবির মতো। শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্যটি নিখুঁত সাজালেন। এইবার ওদিকে গিয়ে দেখি। মুষল ঘর্ষণের ফলে যে থকথকে লৌহচূর্ণ জলে গুলে গিয়েছিল তা সমুদ্রের তীর ধরে চলে গেল দ্বারকা থেকে প্রভাস পর্যন্ত। সেকালের অলৌকিক ব্যাপার, লোহা তো বীজ নয়, তবু জন্মাল এক ধরনের কুশ। ভীষণ শক্ত এবং ধারালো। যার আরেক নাম এরকা। এই তৃণগুলিরও যদুবংশ ধ্বংসের বিরাট এক ভূমিকা থাকবে। সেকথা পরে। এখন দ্বারকায় যে নৈসর্গিক উৎপাত শুরু হল সেও তো আপনারই খেলা। দিনের বেলায় উল্কাপাত, বিনামেঘে বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ, সমুদ্রের ঢেউয়ের তাণ্ডব। চতুর্দিকের আলো কেমন যেন ছমছমে। বাতাস শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলছে না। পাখি ডাকছে না। দিনের বেলায় শৃগালের চিৎকার। এইসব লক্ষণ আপনি তৈরি করলেন। স্বর্গে, মর্তে, অন্তরীক্ষে— সর্বত্রই মৃত্যুর সংকেত। আপনি তখন সুধর্মার সভায় বসে যদুপ্রধানদের ডেকে ভয় দেখালেন। বললেন, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন প্রকৃতিতে কী শুরু হয়েছে। নিশ্চয় বুঝতেও পারছেন, সবই যমের স্বরূপ। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা উচিত নয়। আমার উপদেশ, রমণী, বালক ও বৃদ্ধরা শঙ্খদ্বারে চলে যান, এখনই যান। আর আমরা যাব প্রভাসে। সেখানে সরস্বতী নদী পশ্চিমবাহিনী। আমরা স্নান করব, উপবাস করে একটি ব্রত উদ্যাপন করব। দেবতাদের পূজা করে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের দিয়ে শান্তি-স্বন্ত্যয়ন করাব। তারপর যথারীতি স্বর্ণবস্ত্র দান করে ভোজন করিয়ে তাঁদের সন্তুষ্টি বিধান করব। আপনারা জানেন, শাস্ত্রে অরিষ্ট-অমঙ্গল নাশের এইরকমই ব্যবস্থা আছে।’
আপনার কথা অনুসারে যাদবরা চলে গেলেন প্রভাসতীর্থে। প্রভু! সেই দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। দ্বারকাপুরীর সমস্ত যাদব রমণী, বালক, বালিকা ও বৃদ্ধ নগরী ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন। একের পর এক রথ— পুরীর বিভিন্ন তোরণদ্বার দিয়ে বেরিয়ে ছুটছে শঙ্খদ্বারের দিকে। আর আপনাদের রথ চলেছে প্রভাস তীর্থে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরব, উৎসব মুখর অমরাবতী নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বিশাল বিশাল প্রাসাদ শূন্য। কোথায় গেলেন সেই সুন্দরীরা, নাচ, গান, আমোদ-প্রমোদ। বহু সম্পদে ভরা বাজার, দোকান। মন্দিরের অলংকৃত দেবতারা— সবই রয়েছে। মানুষ নেই। সমুদ্র ধীরে ধীরে ওপর দিকে উঠছে। পরিখা অতিক্রম করে ঢুকছে নগরীতে। সফেন ঢেউ তীব্র আঘাত করছে প্রাকারে। একটু পরেই গ্রাস করবে দ্বারকাবতীকে। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা আপনার!
আবার ফিরে যাই প্রভাসে। অনুষ্ঠান শেষ। ব্রাহ্মণদের দানধ্যান করা হয়ে গেছে। ভোজন সমাপ্ত। নিজেরাও আহারাদি করলেন, আপনি এবং আপনার ভ্রাতা বলরাম— সেদিন আহার করেছিলেন কী! এইবার আপনার শেষ কাজ। সাহায্য নেবেন মদিরার। যাদবদের ওপর মায়া ঢেলে দিলেন। তারা আকণ্ঠ মদ্যপান করেছে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য। গুরুভোজন ও আকণ্ঠ মদ্যপান। শুরু হল মাতালদের মাতলামি। প্রভাস একটা কত বড় তীর্থ। পবিত্র সরস্বতী নদী পশ্চিম বাহিনী। যাদবদের তা মনেই রইল না। প্রথমে শুরু হল নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি। তারপর উচ্চকণ্ঠে ঝগড়া। এরপর বেরোল অস্ত্র। শুরু হল নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ। যাঁরা অংশ নিলেন তাঁরা কেউ কম নন। আমি তো দেখতে পাচ্ছি তাঁদের। প্রদ্যুম্ন, শাম্ব, অক্রুর, ভোজ, অনিরুদ্ধ, সাত্যকি প্রমুখ সব যাদব প্রধানদের। তাঁরা সবাই সম্মানিত, শ্রদ্ধেয়। নিজেদের মধ্যে তাঁরা যুদ্ধ করছেন। এ কোনও নকল যুদ্ধ নয়, প্রকৃত যুদ্ধ। আপনার মায়ায় সব মুগ্ধ। একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে। তাই যুদ্ধ হচ্ছে—পিতা-পুত্রে, ভাইয়ে-ভাইয়ে, মামা-ভাগনে, বন্ধুতে-বন্ধুতে। সবাই ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। অস্ত্রশস্ত্র যা সঙ্গে এনেছিলেন তা বিনষ্ট হয়ে গেছে। তখন তাঁরা সমুদ্রের তীরে জাত এরকা-গাছ তুলে একে অপরকে মারতে লাগলেন। যাদবদের সংস্পর্শে এসে মুষল-চূর্ণ থেকে উৎপন্ন এরকা-গাছ হয়েছে বজ্রের মতো কঠিন অতি মারাত্মক ধারালো অস্ত্র।
এইবারে আপনার একেবারে শেষ চাল। সম্পূর্ণ ধ্বংসের জন্য এই যুদ্ধ আপনারই সৃষ্টি। কিন্তু আপনি বলরামকে নিয়ে ওই মদ্যপ যোদ্ধাদের থামাবার চেষ্টা করতে গেলেন। ফল কী হল! তাদের হাতে আপনারা দু’জনেও আক্রান্ত হলেন। বলরামের ক্রোধ আমরা জানি। এখন দেখছি আপনিও ভীষণ রেগে গেছেন। আপনারা দু’জনে ওই এরকা অস্ত্র দিয়ে যাদবদের বেধড়ক মারতে লাগলেন। প্রভু! ভাগবতে সুন্দর দুটি লাইন আছে—
‘ব্রহ্মশাপোপসৃষ্টানাং কৃষ্ণমায়াবৃতাত্মনাম্।
স্পর্দ্ধাক্রোধঃ ক্ষয়ং নিন্যে বৈণবোঽগ্নির্যথাবনম্॥
একটি বাঁশের সঙ্গে আর একটি বাঁশের ঘর্ষণের ফলে যে অগ্নির উৎপত্তি হয়, সেই অগ্নিই যেমন সমস্ত বনকে দগ্ধ করে, সেইরকম ব্রহ্মশাপ গ্রস্ত কৃষ্ণমায়ায় মোহিত যাদবদের স্পর্ধাজনিত ক্রোধ সমস্ত যদুকুলকে ধ্বংস করল।
ওঁ শান্তি। যা চেয়েছিলেন তাই হল। পৃথিবী এখন সম্পূর্ণ পাপভার থেকে মুক্ত হল। অসংখ্য অহংকারী দেহ এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়ে আছে, রক্তাক্ত, বীভৎস। অস্ত্রের ভাঙা টুকরো। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া এরকার দণ্ড। সবাই আপনার সম্মানিত বংশ পুঙ্গব। পরস্পর পরস্পরের শত্রু। প্রত্যেকেরই উদরে প্রচুর মদ। ভোজ্যবস্তু নানা সুখাদ্য। একটু আগে যা তাঁরা গ্রহণ করেছিলেন, পৃথিবীতে শেষ আহার। মদ তাঁরা সঙ্গে এনেছিলেন। এতটাই আসক্তি । প্রভাসের পূণ্যতীর্থে স্বর্গ সুরধ্বনি সরস্বতীর তীরে পূজানুষ্ঠানে আসছেন মদের পিপে নিয়ে! ওই মদের নাম মৈরেয়।
প্রভু! আমি সব দেখতে পাচ্ছি। কোথাও না কোথাও আছি আমি। আপনি যে আমার মিষ্টি দেবতা। সুরের দেবতা। যমুনার দেবতা। একা আপনাকে যে ভাবা যায় না। সদাই যুগলে— ‘রাধা গোবিন্দ’। সমগ্র ভারত আপনাতে আচ্ছন্ন। কত কীর্তন, পালা কীর্তন— জ্ঞানদাস, চণ্ডীদাস, মুকুন্দদাস, জয়দেব, পদাবলি। মধুর রসের মাধুরী। ওই হত্যাভূমিতে আপনি আর বলরাম দাঁড়িয়ে আছেন। জোরে বাতাস বইছে। নদীর শব্দ। মৃতদের পোশাকের প্রান্ত বাতাসে নড়ছে। বাকি সব নিথর, নিস্পন্দ। আপনারা দু’জনে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন কিছুটা হতবাক। চারপাশে পড়ে আছে বিশিষ্ট যাদবদের মৃতদেহ। প্রভু! দ্বারকায় আপনার সুধর্মা সভায় যাঁরা বসবেন তাঁরা অমর হবেন, কই তা তো হল না। সবাই মৃত। তা হলে চলুন, এইবার আমরা নিভৃত শান্ত কোনও স্থানে যাই। এইবার একটু বিশ্রাম। আকাশের রং কেমন যেন অনুজ্জ্বল। এখন সময় কত! সন্ধ্যা কি আগত?
ওই দেখুন, ভ্রাতা বলরাম একান্তে সমুদ্রের তীরে ধ্যানাসনে বসেছেন। আপনার সঙ্গে একটিও কথা বললেন না। এ কী ভয়ংকর দৃশ্য। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে একটি সাপ। এই তো সেই সহস্র শীর্ষ অনন্তনাগ। নিষ্ক্রান্ত হয়ে চলে গেল সমুদ্রে। ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে তটে। আত্মায় আত্মসংযোগ করে বলরাম মানুষী দেহ ত্যাগ করলেন। ওই তিনি চলেছেন আকাশ পথে, লোক থেকে লোকান্তরে। একটি আলোর রেখা।
রামঃ সমুদ্রবেলায়াং যোগমাস্থায় পৌরুষম্।
তত্যাজ লোকং মানুষ্যং সংযোজ্যাত্মনেমাত্মনি॥
ভাগবত এর বেশি কিছু বললেন না। এতক্ষণের একমাত্র সঙ্গী বলরাম চলে গেলেন। কোনও কথা হল না, শেষ কথা। খুব বিষণ্ণ দেখাচ্ছে আপনাকে। একেবারে একা। অরণ্যের ছায়ান্ধকার। দিবা দ্বিপ্রহর। বেলাভূমির সামনে এসে অরণ্য থমকে গেছে সমুদ্রের শাসনে। মনে পড়ছে গান্ধারীর অভিশাপ— স্বজন শ্মশানে কৃষ্ণ তুমি মরবে, তোমাকে মরতে হবে, মরতে হবে, একেবারে একা, অতি হীন মৃত্যু।
না, না, প্রভু ভয় পাবেন না, আপনার সঙ্গে শুধু আমি নই, সমগ্র ভারতের ভক্তকুল। স্তবে, গানে, বন্দনায় মুখর। চলুন, ওই অশ্বত্থ বৃক্ষতলে এইবার আপনি বসুন। আমার ভক্তির বেদিতে। কৃষ্ণ স্পর্শে হয়ে যাই রোমাঞ্চিত তৃণ। দেখি না, সেদিনকার সেই ঘটনা, কী লেখা আছে ভাগবতে হঠাৎ চতুর্ভুজ মূর্তি ধারণ করলেন। বসলেন বৃক্ষতলে। প্রভায় আলোকিত হল চতুর্দিক। ভাগবতকার কী কাণ্ডটাই না করে রেখে গেছেন! শেষবারের মতো আপনার অপার্থিব রূপের বর্ণনা। যুগের মানুষকে ডাকছেন। এসো, এসো, শেষবারের মতো দেখে যাও আমার প্রভুর রূপ, ছবি করে তুলে রাখো কালের ঘরে। আমিও দেখি। একটু পরেই আপনি চলে যাবেন। পড়ে থাকবে ঝরাপাতা, গাছের ভাঙা ডাল। দেখি তা হলে সেই রূপ:
শ্রীবৎসাঙ্কং ঘনশ্যামং তপ্তহাটকবর্চসম্।
কৌশেয়াম্বরযুগেন পরিবীতং সুমঙ্গলম্॥
সুন্দরস্মিতবক্ত্রাব্জং নীলকুন্তলমণ্ডিতম্।
পুণ্ডরীকাভিরামাক্ষং স্ফুরন্মকরকুণ্ডলম্॥
শ্রীকৃষ্ণের বুকে শ্রীবৎসচিহ্ন শোভা পাচ্ছে, তাঁর গায়ের রং ঘন মেঘের মতো নীল; তপ্তকাঞ্চনের মতো উজ্জ্বল রেশমি বস্ত্রে তাঁর মঙ্গলময় দেহ আবৃত। ঈষৎ সহাস্যযুক্তমুখকমল অতি মনোহর এবং মস্তকে নীল কুণ্ডল শোভমান; নয়ন যুগল পদ্মের মতোই মনোহারী এবং কর্ণযুগল অতি উজ্জ্বল মকর কুণ্ডলে অলংকৃত। বনমালায় শোভিত শ্রীকৃষ্ণ চতুর্হস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম ধারণ করে নিজের দক্ষিণ ঊরুর উপর তাঁর ঈষৎ রক্তিমাভ বামপদ স্থাপন করে অশ্বত্থবৃক্ষের নীচে উপবিষ্ট হলেন।
এইবার খুব দ্রুত ঘটতে থাকবে ঘটনার পর ঘটনা। অরণ্য নির্জন। আপনি বসে আছেন একা। দেবমহিমা আপনিই প্রকাশিত হয়েছে। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী নারায়ণ। কেন প্রভু কার জন্যে? ….জানি মায়ার অবগুণ্ঠনে আর কিবা প্রয়োজন? শেষ খেলা তো খেলা হয়ে গেছে। এখন তো শুধু বিদায় নেওয়ার পালা। এসেছিলেন কংসের কারাগারে। নিষ্ঠুর রক্তাক্ত এই পৃথিবীতে রেখে গেলেন প্রেমযমুনা। শ্রীমতী তো আপনারই হ্লাদিনী শক্তি। চাঁদের যেমন কিরণ। কোথা বৃন্দাবন, কোথা গোপীগণ, কোথা কৃষ্ণ! এ তো আমাদের ক্রন্দন। আপনার তো কিছু নয়। নিজেই গড়লেন, নিজই ভাঙলেন। আপনার অতি প্রিয়, একান্ত বিশ্বস্ত উদ্ধবই বুঝতে পেরেছিলেন আপনি চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি সর্বশক্তি মান, সমর্থ হওয়া সত্ত্বেও বিপ্রশাপ নিবারণ করলে না তাইতেই মনে হয় তুমি নিশ্চয় এই বংশ নাশ করে ইহলোক ত্যাগ করবে।’ আপনি বলেছিলেন, ‘মহাভাগ্যবান উদ্ধব, আমার অভিপ্রায় সেইরকমই। ব্রহ্মা, শংকর এবং অন্য লোকপালগণের ইচ্ছা যে আমি নরলীলা শেষ করে বৈকুণ্ঠে ফিরে যাই। ব্রহ্মার অনুরোধে যে উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে অংশাবতার বলরামের সঙ্গে আমি অবতীর্ণ হয়েছিলাম।’
আপনি শেষের কথা বললেন, জ্ঞানী উদ্ধব কিন্তু ভবিষ্যৎ শ্রীকৃষ্ণের কথা বলে রাখলেন। অনন্ত কাল, অনন্ত জীবন, অনন্ত পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। হে মহাযোগিন্! এই সংসারের কর্মচক্রে পরিভ্রমণ করতে করতে আমরা তোমার ভক্তগণের সঙ্গে তোমার আচরণ, তোমার বাক্য, তোমার চলন, দৃষ্টিপাত হাস্য পরিহাস এবং মানুষের আচরণের অনুকরণে তোমার বিচিত্র লীলাসমূহ স্মরণ করে, বর্ণনা করে, তোমার বিষয় অনুস্মরণের ফলে অপার সংসার দুঃখ অতিক্রম করব। যারা তোমার একান্ত ভক্ত তাদের কঠোর তপস্যার কোনও প্রয়োজন নেই। তোমার চিন্তায় তন্ময় থাকার ফলে তাদের সকল বন্ধন আপনিই খসে পড়ে।
চুপ! সে এসে গেছে। জরা ব্যাধ। পাতার আড়ালে, চুপিচুপি। ধনুকে সেই তির, যার ফলায় সেই মুষলের ক্ষুদ্রাংশটি। কোনও বিষ লাগানো আছে নাকি? প্রভু সাবধান! তার ভ্রম হয়েছে। সে আপনার পুরো অবয়ব দেখতে পাচ্ছে না। আপনার রক্তিমাভ শ্রীচরণকেই হরিণের মুখ ভেবেছে। ছেড়ে দিয়েছে বাণ। যাঃ, সব. শেষ। বৃক্ষতলে বাণবিদ্ধ ভগবান।
‘আমি এ কী করলুম! হায়, আমি এ কী করলুম! হে মধুসূদন! আমি না জেনে এই পাপ কাজ করে ফেলেছি। আমার এই পাপ আপনি ক্ষমা করুন। যাঁকে স্মরণ করলেই মানুষের অজ্ঞান অন্ধকার দূর হয়, আমি কিনা তাঁকেই আঘাত করেছি। আপনি আমাকে এখনই বধ করুন।’
আহত ভগবান বললেন, ‘জরা! তুমি ভয় পেয়ো না ওঠো। তুমি আমার ইচ্ছানুসারেই এই কাজ করেছ। এখন তুমি আমার আজ্ঞায় সুকৃতকারীদের প্রাপ্য স্বর্গলোকে গমন করো।’
শিকার নিয়ে জরার আর ঘরে ফেরা হল না। ভগবানকে শিকার করে সে স্বর্গলোকে চলে গেল।
শ্রীকৃষ্ণের সারথি দারুক খুঁজতে খুঁজতে প্রভুর গলায় তুলসী মালার গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে এসে উপস্থিত। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থমূলে উপবিষ্ট। ‘হে প্রভু! আপনার শ্রীপাদপদ্ম দর্শন করতে না পেরে আমি চারিদিক অন্ধকার দেখছিলাম।’
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘দারুক! তুমি দ্বারকায় গিয়ে, পরস্পর যুদ্ধ করে জ্ঞাতিগণের নিধন, বলরামের মহাপ্রস্থান আর আমার অবস্থার কথা আত্মীয়-বন্ধুদের বলো। আরও বলবে, তারা যেন আর দ্বারকায় না থাকে, আমার পরিত্যক্ত যদুপুরী গ্রাস করবে সমুদ্র। তারা সকলে যেন অর্জুনের দ্বারা রক্ষিত হয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে চলে যায়।’
অরণ্যে অশ্বত্থমূলে একা ভগবান ও মৃত্যু। অন্ধকার আরও অন্ধকার। প্রভু, আমি আছি। ক্ষতস্থানে কষ্ট হচ্ছে! রক্তক্ষরণ! মনে পড়ছে? অন্ধকার কুরুক্ষেত্রে শব সমারোহে শরশয্যায় শুয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় ভীষ্ম, অষ্টবসুর এক বসু। আপনি অপেক্ষা করছেন। আপনার গরুড়ধজ রথ অশ্ব ও ধ্বজসহ আকাশে অদৃশ্য হল। রথের আর প্রয়োজন কী। দিব্য অস্ত্রও সব চলে গেল। ওই দেবতারা আসছেন, ব্রহ্মা, প্রধান প্রধান দেবগণ পিতৃগণ সিদ্ধ গন্ধর্ভ বিদ্যাধর চারণ যক্ষ রাক্ষস কিন্নর অপ্সরা ও দ্বিজগণ। শ্রীভগবানের নির্বাণ দেখতে এসেছেন। স্তবগানে আকাশ মুখর। পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে।
এতক্ষণ আপনি চোখ চেয়েছিলেন, হঠাৎ সেই পদ্মনেত্রদ্বয় নিমীলিত হল। নেই, শ্রীকৃষ্ণ নেই। ভগবান অদৃশ্য। পুষ্পবৃষ্টি, দুন্দুভি নিনাদিত। আপনাকে অনুসরণ করে চলে গেল সত্য ধর্ম ধৃতি কীর্তি ও শ্রী। যাবেন কোথায় প্রভু! ভক্তদের বন্ধন! সমুদ্রের তীরেই চির অবস্থান— প্রভু জগন্নাথ, ভ্রাতা বলরাম মধ্যে সুভদ্রা। কোটি কণ্ঠের আকুল আহ্বান,
জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে॥
Asdaran. Monta kono karate khub bisana o vara Kanta Chilo book ta prar par, Monta Dhire Dhire shanto hoei gelo.