মায়া রয়ে গেল – উপন্যাস – নবনীতা দেবসেন
প্রথম অধ্যায়। চিঠি লেখা
শিলুবাবা,
যেখানেই থাকো, ঈশ্বরের কৃপায় আশা করি ভালো আছ। বুড়ো বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে দুরে থেকো না। বাড়ি ফিরে এসো। দিদি যে তোমাকে কত ভালোবাসে, তা কি তুমি সত্যিই জানো না? খুকু আর তুমিও আমাদের প্রাণে আলাদা হতে পারো না। দুজনের সমান অধিকার। এটা তোমাদের দুজনেরই নিজস্ব ঘর। খুকু এখন বীরভূমে। তুমিও আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান একথা ভুলো না, সে তুমি যেমনই হও। আমরা তোমার ও বউমার পথ চেয়ে বসে রইলাম। আমাদের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
—সুরমা, আদিত্য রায়।
রায়-টা কেটে দিলেও হয়। শুধু নাম থাক, সুরমা, আদিত্য।
নাঃ, নামই বা থাকবার কী দরকার? শুধু মা, বাবা বললেই তো হয়। শিলু ঠিকই বুঝবে। না খুকুর বদলে শ্রাবস্তী বলবেন? শ্রাবস্তী এখন বীরভূমে। নাঃ খুকুই ভালো। অনেকবার কেটেকুটে অবশেষে আদিত্য একটা খসড়া খাড়া করলেন। তারপর সুরমার দিকে ফিরলেন।
হয়ে গেছে?
একরকম। ফার্স্ট ড্রাক্ট। দ্যাখো তো এটা চলবে কিনা? প্যাডটা সুদ্ধ সুরমার সামনে মেলে ধরলেন আদিত্য। পড়তে পড়তেই সুরমা উত্তর দেন–
কেন চলবে না? বেশ হয়েছে। তবে অত কথা লেখবার দরকার নেই। খুকু আর তুমি থেকে আলাদা হতে পারো না পর্যন্ত কেটে দাও। নাঃ, অধিকার পর্যন্ত কেটে দাও। কেমন লিগ্যাল টার্মিনোলজির মতন শোনাচ্ছে। বরং বলা যাক, তুমি আর খুকু আমাদের প্রাণ। আবার ওই এটা তোমাদেরই নিজস্ব ঘর।–এরপর লেখো বউমারও। তাহলে একটু বেটার হয়। তাই না।
ক্লান্ত চোখে সুরমা হাসলেন। আর ওই তুমি যেমনই হও অংশটা একদম কেটে দাও। ওটা বড্ড খারাপ শোনাচ্ছে। আর তুমিও আমাদের প্রাণাধিক চলবে না! শুধু তুমি বলো। খুকুর কথা বরং উহ্য থাক এখানে।
আদিত্য প্যাডটি টেনে নিয়ে আবার টেবিলে গিয়ে বসেন। সুরমা উঠে এসে তাঁর পিঠের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছেন। উষ্ণতায় আচ্ছন্ন আদিত্য ভাবলেন, পঞ্চান্নতেও সুরমা কত সুন্দরী! শিলুর বউ হিংসে করবে না? আদিত্য শিলুর বউটিকে অনুকম্পা করলেন মনে মনে। বিয়ে যদিও হয়নি। কিন্তু মনে হয়েছিল ওরা নিজেরা কথা পাকা করে ফেলেছে।
কী যে হল কিছু বোঝা গেল না। সুরমা আপত্তি করেননি, আদিত্যও বাধা দেননি। মেয়েটির চালচলন তাদের পছন্দ ছিল না, হাবভাবে অতিরিক্ত পশ্চিম-ঘেঁষা, পোশাক-পরিচ্ছদে তো বটেই, ভাষাও ইংরিজি, হাতে সর্বদা সিগারেট পুড়ছে। সুরমা-আদিত্যর সামনে শিলু সিগারেট খায় না, কিন্তু লিসা অসঙ্কোচ। লিসার পুরো নাম মোনালিসা গর্গ, পাঞ্জাবি মেয়ে, শিলাদিত্যর সঙ্গেই এন. এস. ডি-তে ছাত্রী। ছুটিতে ওকে শিলু নিয়ে এসেছিল গেলবার।
গ্রীষ্মে দু-মাস ছুটি থাকে। সেই দুটো মাসেই কী যে হল, সংসারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।
দু-ভাইবোনের ভাব সমাজে আলোচনার বিষয় ছিল। দিদির সঙ্গে শিলুর ঝগড়াও হতে দেখেনি কেউ। কিন্তু সেই শিলু, দিদির নাম শুনলে যেন ক্ষেপে উঠছিল। শ্রাবস্তীর দোষ, দিল্লিতে সে মোনালিসা গর্গের নামে কী সব নিন্দে শুনে এসেছিল, সেগুলো সব শিলুকে জানিয়েছিল। দিল্লিতে প্রচুর বন্ধু হয়েছে শ্রাবস্তীর–আই. এ. এস. ট্রেনিংয়ে গিয়ে। মোনালিসা গর্গকে চেনেনা এমন অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে দিল্লিতে বোধহয় নেই। একবার তাকে দেখলে মনে না রাখা কঠিন। শিলাদিত্য কথাগুলো শুনে দিদির ওপরেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। কথাগুলো কি তা কিন্তু শ্রাবন্তী তাদের জানায়নি। আজ অবধি সুরমা জানেন না, কী নিয়ে ভাইবোনে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ঝগড়ার পর শ্রাবস্তী বলল, যদি মোনালিসা গর্গ এ বাড়িতে থাকে আমি তাহলে অন্য জায়গায় গিয়ে থাকব। এ বাড়িতে ওরকম অসভ্যতা চলবে না।
কীরকম অসভ্যতা?
শ্রাবস্তী জবাব দেয়নি।
রাত্রে শিলুর ঘরে ওরা ড্রিংকস্ আনত, ওদের পার্টি চলত অনেক রাত অবধি। ছাদের ঘরে কী হচ্ছে, তাতে মাথা ঘামাতেন না আদিত্য। শিলু বাজনা বাজায়, গান করে, তার ঘরে হইচই-তে ছোটবেলা থেকে বাড়িসুদ্ধ অভ্যস্ত–গিটারের ঝঙ্কার, সিনথেসাইজারের বিচিত্র শব্দরূপ, সমবেত গলার প্রাণোচ্ছল গান, এতে খুকুরও তো যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। এবার আকস্মিক হলটা কি? খুকু যেন হঠাৎ খঙ্গহস্ত হয়ে উঠল ওই মোনালিসার ওপরে। এমন মূর্তি তার কখনও দেখেননি আদিত্য-সুরমা! কিছুতেই মিশতে দেব না ওদের দুজনকে–ওকে বাড়িতে রাখলে আমি এখানে থাকব না!
এ কী অদ্ভুত ঈর্ষা? কিন্তু শিলুর তো অনেকগুলি বান্ধবী আছে–প্রেমিকাও ছিল, শুভা। খুকুকে তো এমন কাণ্ড করতে দেখা যায়নি? তা যতই খুকুর অপছন্দ হোক, তাই বলে সুরমা তো শিলুর বান্ধবীকে তাড়াতে পারেন না? কটা দিনই তো মাত্র। একটু ধৈর্য ধরো–
বলে খুকুকে বোঝাতে গিয়েছিলেন। খ্যাপা পাগলের মতো কেঁদে ফেলে, রাগারাগি করে, খুকুটা সত্যি সত্যি চলে গেল। সে মেয়ে আই. এ. এস হয়ে গেছে, দিব্যি এম. এল. এ হোস্টেলে থাকতে লাগল। আর শিলাদিত্য সেই যে দিল্লিতে ফিরে গেল, আর বাড়ি আসেনি।
বাড়ি আসেনি, চিঠি লেখেনি, ফোন করেনি, এন. এস. ডি-তেও নেই। ছিল, কিছুদিন পর্যন্ত। নাকি ক্লাসও করেছিল। তারপর উধাও। দিল্লিতেও কেউ জানে না সে কোথায়। সঙ্গে সঙ্গে মোনালিসাও উধাও হয়েছে। দুজনে মিলেই ইলোপ করেছে।
অথচ ইলোপ করার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। মোনালিসা গর্গের মা-বাবার যদিও ডিভোর্স হয়ে গেছে, তার মা যদিও আবার বিয়ে করেছেন, দুজনেই কিন্তু মেয়ের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অঢেল ধনবর্ষা ঝরিয়ে যাচ্ছেন। পূর্ণবয়স্ক ছেলে-মেয়ে তারা, বিয়ে করে লিসা নিজের বাড়িতেই থাকতে পারত। শ্রাবস্তী খবর এনেছিল, এখান থেকে ফিরে গিয়ে শিলু আর হোস্টেলে যায়নি, লিসার সঙ্গেই ছিল। হঠাৎ কেন উধাও হয়ে গেল সেখান থেকে দুজনে? পালানোর কী ছিল? কার কাছ থেকে?
সুরমা-আদিত্য তো এখানে, কলকাতায়। শ্রাবস্তীও বীরভূমে। মোনালিসার মা দ্বিতীয় বিয়ের পর কানাডায় সেটলড। বাবার ব্যবসা চণ্ডীগড়ে। তিনি অবশ্য সাতরাজ্য ঘুরে বেড়ান। দিল্লির বাড়িতে মোনালিসা একাই রাজত্ব করে দাসদাসী, বন্ধুবান্ধব, সাঙ্গপাঙ্গো নিয়ে। শিলুর তো অসুবিধে হবার কথা ছিল না।
তবে হঠাৎ ইলোপ করা কেন? এ তো ওলড় ফ্যাশানের কাজ। অতিরিক্ত রোমান্টিকতাদুষ্ট–অনাবশ্যক পলায়ন।
প্রসেনজিতের ছেলে হলেও বা হয়তো তার এমন একটা ধাক্কার প্রয়োজন হতো পিতার ধর্মজ্ঞানের দড়িদড়া থেকে মুক্তি পেতে।
কিন্তু আদিত্য? সুরমা? এ বাড়িতে তো একত্রে বসবাস করেই গেল দুজনে বিয়ে না হতেই। সে মেয়ে কি নিজের ঘরে শুত? রোজ সকালে চা দিতে গিয়ে সুরমা দেখতেন শিলুর খাটেই দুজনে ঘুমোচ্ছে। কোনো লজ্জা-সঙ্কোচের বালাই নেই।
নতুন প্রজন্ম এরই নাম।
এমন আ-ঢাকা হয়ে গেলেই সুখ হয়?
সুখ বড় বালাই। না থেকেও থাকে। আবার থেকেও থাকে না।
প্রসেনজিতকে দ্যাখো। আর সুষিকে।
একজনের সব থেকেও সুখ নেই।
আরেকজনের সুখ কিছুতেই কেড়ে নেওয়া যাচ্ছে না। রাজশেখরবাবুর মেয়েরা দুঃখী হতেই শেখেনি। কি সুষমা, কি সুরমা। আনন্দ তাদের শ্বাসবায়ু।
অন্তত তাই তো ভেবেছিলেন সুরমা এতদিন। কিন্তু শিলুটা সব গোলমাল করে দিল। সাত-মাস খবর নেই–দিল্লি থেকে চলে গেছে। আর এখান থেকে গেছে তো আরও আগে। বছর পার হতে চলল–শিলু একটিবারও যোগাযোগ করেনি। না মা-বাবার সঙ্গে; না দিদির সঙ্গে। খবরের কাগজে এতদিন বিজ্ঞাপন দেননি। পুলিশে খোঁজ দিয়ে রেখেছেন। শ্রাবস্তী প্রচুর তল্লাশি চালাচ্ছে। কিন্তু শিলুর খোঁজ পাচ্ছে না পুলিশ। মোনালিসারও নয়। যেন উবে গেছে দুজনে।
.
মোনালিসারও সুরমাকে পছন্দ হয়নি। আদিত্য বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। পছন্দ হবে কেন? সুরমার পাশে মোনালিসাকে মলিন, কাঠখোট্টা দীনহীন দেখাত, তার উগ্র যৌবন, সাহেবী রং, কটা চোখ, কাটা কাটা নাক-চোখ নিয়েও।
শ্রাবস্তীর সঙ্গে ভাবও করল না। করবে কি? শ্রাবস্তী কথা বললে সেখানে মোনালিসাকে তো বাজ পড়ে ঝরে পড়া শুকনো গাছের মতন লাগত। ভিতর তো ফাঁকা। ওই মেয়ে অভিনেত্রী হবে, শিল্পী হবে? এখানে তো সৌজন্যের অভিনয়টুকুও করেনি। গোমড়ামুখে খাবারটেবিলে এসে বসত। সর্বক্ষণ ছাদের ঘরে দরজা বন্ধ করে দুজনের আড্ডা। শ্রাবস্তীও তো অল্পবয়সি মেয়ে। তার সঙ্গেও তো মেলামেশা করবে? তা নয়, শ্রাবস্তীর ধারে কাছে যেত না।
অন্য সময় শিলু এলেই ভাইবোনে জোর আড্ডা হয়। শিলু আবাল্য দিদিভক্ত, দুজনে কখনো কনসার্টে, কখনো থিয়েটারে, কখনো বা ব্ল্যাকে টিকিট কেটেও শাহরুখ খানকে দেখতে ছুটত। এবারে সেই ভাইবোনে কী আশ্চর্য ভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল লিসার কল্যাণে।
এবার শিলুর সময় ছিল না কোনোই। তার ওপরে খুকুর ওই কী সব কথাবার্তা!
খুকু, তুই শিলুকে কী বলেছিলি লিসার নামে? যার ফল এমন তীব্র বিষময়? কী বলেছিলি তুই? কেন চলে গেলি তুই বাড়ি ছেড়ে? কী ভূত ঢুকেছিল তোর মাথায়? তুই তো ঠান্ডা মেয়ে।
সুরমার এসব প্রশ্নগুলি করা হয়নি, কেননা খুকুও আসছে না ছুটিতে। তাই আদিত্য আর সুরমাই একবার গেলেন বীরভূমে। সেখানে মেয়ের প্রতিপত্তি–এস. ডি. ও সাহেবের খানদানি কাণ্ডকারখানা দেখে আনন্দের সুরটা নষ্ট করতে চাননি। বলবার হলে খুকু নিজে বলত। যা বলল তার মানে নেই। সর্বনাশী মেয়েটার পাল্লায় পড়ে এবার শিলু শেষ হয়ে যাবে! যাবে মানে? গেছেই তো! শিলু তো নেই। শিলু কোথায়? খুকুরে, শিলু কই? শিলু?
আছে তো কোথাও। ঠিক সারফেস করবে। টাকাকড়ি ফুরোলেই ফিরবে।
কিন্তু ফুরোবে কেন? লিসার তো অঢেল ঐশ্বর্য।
চাকরি-বাকরি না করলে অঢেল ঐশ্বর্যেও ঢিলে পড়ে, মা! ওরা করছে না তো কিছু।
সুরমার ধারণা খুকু জানে শিলু কোথায়। খুকুকে তেমন বিচলিত লাগছে না। সত্যি সত্যি শিলু হারিয়ে গেলে খুকু অমন শান্ত থাকত না। কিন্তু বলছেও তো না আমাদের কিছু! দেখছে আমরা এত ছটফট করছি। এত কষ্ট পাচ্ছি। শিলুও কি বুঝছে না? শিলুর মতো নরম স্বভাবের ছেলে কেমন করে এতদিন রইল চুপচাপ? ও খুব ভালো জানে ওর বাবার ওকে চক্ষে হারাই স্বভাব। সুরমা বরং সংযত। আদিত্যের তুলনায় তিনি কঠিন বেশি। শিলুটা নিজেও তার বাবার মতোই। ভেতরে ভেতরে খুব নরম। সেই নরম শিলু এত কঠোর হল কেমন করে? একটা চিঠি নেই। ফোন নেই। কোনো যোগাযোগ নেই। মা-বাবা মরে গেছে না বেঁচে আছে তাও জানতে চায়নি। কী এমন অপরাধ করেছিলাম আমরা? খুকুর ওপর রাগ করে তুই আমাদেরও পরিত্যাগ করলি শিলু?
.
দ্বিতীয় খসড়াটা লিখতে লিখতে আদিত্যর কী মনে হল, হঠাৎ মুখ তুলে বললেন, বাংলা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে কিই-বা হবে? শিলু কি আর ওখানে বসে বসে বাংলা কাগজ পড়ে? ওরা তো কিনবে ইংরিজি কাগজ-ইন্ডিয়ান এক্সেপ্রেস, টাইমস্ অফ ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান টাইমস্, হিন্দু, ডেকান হেরাল্ড–এই সবে বিজ্ঞাপন দেবার মানে হয়। বড় জোর কলকাতার এশিয়ান এজ, দি টেলিগ্রাফ, স্টেটসম্যান। বাংলা কাগজ ওদের নজরে আসবেই না। বাংলাদেশে কি আর ওরা আছে? লিসা শহুরে মেয়ে–মুম্বাই-দিল্লি-চেন্নাই-ব্যাঙ্গালোরের মধ্যেই থাকবে। বড় জোর হায়দ্রাবাদ কি চণ্ডীগড়। নাঃ, বাংলা বিজ্ঞাপনে কেবল আত্মীয়-বন্ধুদেরই নজর কাড়া হবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।
সুরমা চেয়ারের পিঠ ছেড়ে একটু সরে দাঁড়ান। ভুরু কুঁচকে যায়। চোখে পড়বে না? ইংরিজিতে বলতে হবে? কী ভাষায় এই বেদনার কথা বলা যাবে ইংরিজি কাগজে? সুরমা দ্বিতীয় খসড়াটি হাতে তুলে নিলেন।
শিলুবাবা,
যেখানেই থাক ঈশ্বরকৃপায় আশা করি ভালো আছ। বুড়ো বাবা-মায়ের ওপরে রাগ করে দূরে থাকতে নাই। বাড়ি ফিরে এস। তোমার দিদি তোমাকে কত ভালোবাসে তা কি তুমি জান না? দিদির মন খুব খারাপ। তুমি আমাদের প্রাণ। এ বাড়ি তোমাদের দুজনেরই নিজের ঘর। এবং লিসারও। খুকু এখন বীরভূমে। তুমি যে আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তান, একথা ভুলো না। আমরা তোমার ও লিসার পথ চেয়ে বসে রয়েছি। আমাদের কথা ভেবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে এসো। টাকা লাগলে জানাও।
—শুভার্থী মা, বাবা।
মা-বাবাই তো? নাকি সুরমা-আদিত্য লিখব? বউমা না লিখে লিসাই বললাম।
ভালো করেছ। কিন্তু ইংরিজি কাগজে তো এটা দেওয়া যাবে না!
নাঃ। ইংরিজিতে নোটিশ লিখতে হবে।
নোটিশ?
না, মানে এইরকম চিঠি। আদিত্য কিঞ্চিত অপ্রস্তুত।
ইংরিজি বললেই কেমন যেন নোটিশ নোটিশ মনে হয়না গো? সুরমা হেসে ফেলেন। আদিত্য মুগ্ধ হয়ে দেখেন। তারপর কলম কামড়ে আবার ভাবনা শুরু। এবার ইংরিজিতে।
সুরমা জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ান। আশ্চর্য একটা সময়। ঘোর বর্ষা নেমেছে। অথচ কৃষ্ণচূড়া গাছটা ফুলে ফুলে ভরা। গাছের তলার রাস্তাটা ভিজে লাল ফুলে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। এখন আদিত্যকে তাহলে ইংরিজিতে লিখতে হবে পথ চেয়ে আছি–লিখতে হবে–বুড়ো বাবা-মায়ের ওপর রাগ করে দূরে থাকতে নেই। প্রাণাধিক-এর ইংরিজি কী হবে? নাঃ, ইংরিজিতে মনের কথা কিছুই বলা যাবে না শিলুকে। কেবল বিজ্ঞাপনই দেওয়া যাবে। ওই যে বললেন, নোটিশ। সেটুকুই হবে। সুরমা দীর্ঘনিঃশ্বাসটা চাপতে পারলেন না। শিলুবাবা, ফিরে আয়–এর ইংরিজি কী?
.
আদিত্য বললেন, নাও, পড়ো।
তুমিই পড়ে শোনাও না।
শোনাব? পড়ছি তাহলে। শোনো।
আদিত্য একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে শুরু করলেন
Shilu, dearest,
Please come back, we are missing you every moment. There is no reason for Lisa to feel unwanted here in your own home. Do not misunderstand Didi, she loves you, you know it in your bones, She is posted in Birbhum, and is missing you terribly. Please excuse her if she has hurt your feelings. We all make mistakes, but never doubt our intentions. Please forgive us and come home. Lets know if you need money.
—Ma, Baba
বেশি বড় হয়ে গেল। না গো? এটা ঠিক আছে? আসলে আমি
উদ্বিগ্ন, অনিশ্চিত গলায় কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যান। কাগজ নামিয়ে রেখে মাথা তুলে সুরমার মুখে প্রশ্নভরা চোখ রাখেন আদিত্য। অনেকবার কেটেকুটে এই খসড়াটা প্রস্তুত করেছেন। সুরমা ঘরের উল্টোদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়ে মোড়া পেতে বসে জানলা দিয়ে বাইরে কৃষ্ণচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে শুনছেন।
হয়েছে?
সুরমা হাসি হাসি চোখে তাকালেন।
বেশ হয়েছে। শেষটাতে দুটো কথা যোগ করা যায়?
কেন যাবে না, কি লিখব বলো?
ওই If you need money-র পরে বরং লেখো, We are counting days for your return, আরও লেখো, Love and blessings,, ওই সবশেষে ঠিক মা-বাবার আগে।
সত্যি সুরমা। তুমি না হলে হয়? এই সুন্দর টাটা মায়ের হাতের না হলে হত কখনো? বাবাদের বড় কাঠখোট্টা, কেজো ভাষা!
মোটেই কাঠখোট্টা কেজো ভাষা হয়নি ওটার। হৃদ্প্লাবন বইয়ে না দিলেই বুঝি কাঠখোট্টা? আসলে ইংরিজি ভাষার গুণেই আমাদের আবেগকে সংযত ভদ্র করে দেয়। বাংলা, ঠিক তার উলটোটি। আহ্লাদে গদগদ ভাষা!
সুরমা উঠে পড়লেন।
কোথায় চললে?
রান্নাঘরে, রুটি করতে।
তার আগে একটু চা হবে না?
অতি অবশ্যই। কিন্তু এখন কটা বেজেছে?
চা খাবার ঢের সময় আছে। ডিনার খেতে এখন অনেক দেরি।
কোথায় কোথায় পাঠাবে চিঠিটা?
দেখি। ওই যে নামগুলো বললুম? আগে এটা টাইপ করতে হবে, তারপর আট-দশটা কপি করে প্রত্যেকটা কাগজের ঠিকানায় পাঠাতে হবে।
ও বাবা! একসঙ্গে আট-দশটা? সে অনেক খরচার ব্যাপার! একেই এত বড় সুদীর্ঘ চিঠি! একটু ছোট করো।
তাহলে কী সাজেস্ট করছ?
ওই তো। এক এক সপ্তাহে বরং এক একটা কাগজে দিয়ে দ্যাখো।
ওতে চোখে পড়বে না। ও যে কোন কাগজটা দেখবে–মাত্র একবারই বেরুলে, ব্যস–
শুধু রবিবারে রবিবারে বিজ্ঞাপনটা দিও। প্রতি রবিবারে, বিভিন্ন কাগজে বেরুতে থাকুক। একবার না একবার নজরে পড়বেই। প্রত্যেক সপ্তাহে ধরেই রাখো, শিলুর জন্য এই একটা বড় খরচ। কী বলো?
মন্দ বলোনি। রোববার রোববার। চিঠিটাকে বরং সংক্ষিপ্ত করা যাক। সংখ্যায় বেশিবার বেরুনোটা তার চেয়ে জরুরি।
তা ঠিক।
সুরমা রান্নাঘরে চলে গেলেন। আদিত্য আবার নতুন করে ঝুঁকে পড়লেন প্যাডের ওপরে। আরেকটা খসড়া চাই। ছোট চিঠি। কোন লাইনগুলো অতিরিক্ত? কোন কথাগুলো না বললেও চলবে? কী কী না বললেই নয়? Shilu, dearest; নাঃ–ঠিক শোনাচ্ছে না।
Shilu Baba,
We are sorry, Please come bask home and try to excuse our faults. We are getting old and silly but we love you, Didi is missing you terribly, She is posted in Birbhum. Please bring Lisa, this is her home as well. Let us know if you need money. Countings days, waiting for you, with love as ever, Ma & Baba.
কি সুরমা চা হল? এইটে কীরকম হয়েছে দেখে যাও। নিউ, ইমন্ড অ্যান্ড অ্যাব্রিজড় ভার্শন!
কাগজটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেন আদিত্য।
.
দ্বিতীয় অধ্যায়। যেতে নাহি দিব
সুষি, প্লিজ এখন বেরিয়ো না, আমার আজ মাথাটা ভীষণ ধরে আছে।
সুষমার ভুরুটা কুঁচকে উঠল। কপালে টিপটা এঁটে নিয়ে ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক লাগাতে থাকেন। লিপস্টিক লাগিয়ে ঠোঁট দুটো টিপে ঘষে নেন। চশমাটা পরে ভালো করে এদিক-ওদিক থেকে মুখটা দেখে নেন, তারপর আরেকবার সরু চিরুনিটা চালান সরু সিঁথির দু-পাশে। নিজের নুনমরিচ ছড়ানো চুলটা দেখতে বেশ লাগে আজকাল। চিরুনিতে সিঁদুর নিয়ে সিঁথিতে টানছেন। প্রসেনজিৎ আবার বলে ওঠেন, কথা বলছি, শুনছ না? বেরিয়ো না। আমার মাথা ধরেছে। সুষি প্লিজ। চশমার ওপাশ দিয়ে তাকালেন সুষমা। প্রসেনজিৎ শুয়ে আছেন তাকিয়া ঠেস দিয়ে। বিশাল মেহগনি কাঠের পালঙ্ক। প্রসেনজিতের হাতে জরিজড়ানো গড়গড়ার নল থাকলে খুব মানাত। কিন্তু ওর কোনো নেশা নেই, শুধু পান। মাঝে সিঁথি। চুল একটু পাতলা হয়ে এসেছে। কিন্তু গোঁফটা খুব ঘন। প্রতাপবান। চুল অনেকটাই সাদা, কিন্তু এখনো বেশ কিছু কালো চুল রয়েছে পেছন দিকটায়। গোঁফ কিন্তু অনেকদিনই পুরো সাদা। আগে আগে কত যত্ন করে কলপ লাগাতেন প্রসেনজিৎ। এখন ছেড়ে দিয়েছেন। প্রসেনজিতের পাশের খাটের ওপরে চারখানা খবরের কাগজ, দুটো ইংরিজি, দুটো বাংলা। আরও একটা। বাংলা কাগজ আসে। সেটা এখনও নীচে।
মাথা ধরল কেন? পেটটা পরিষ্কার আছে তো? ইসবগুল খেয়েছিলে?
তারপরেই ডাক, মণির মা! মণির মা!
থাক, আর ওকে ডাকতে হবে না। কিন্তু মণির মা এসে গেছে।–দাদাবাবুকে কি ইসবগুলের শরবৎ দিয়েছিলে?
কেন? দোবো না কেন?
ও আবার কি? বলো, হ্যাঁ দিয়েছি।
চা দিইচি, জলখাবার দিইচি, ফল দিইচি, বেলের পানা দিয়েছি, ইশগ্লুল দিইচি, সেই সক্কাল থেকেই তো দাদাবাবুর চলতেচে!
বাঃ, কথার কি ছিরি! আশ্চর্য! যাও নিজের কাজে যাও এবার। বড়ো বুড়ো হয়ে গেছ সত্যি!
কাজই তো কচ্ছিলুম। তুমি ডেকে আনলে তাই। বুড়ো হব না তো কি হুঁড়ি হব? বলি বয়সটা কত হল, সে খেয়াল আচে?
কী কাজ কচ্ছিলে?
পান সাজতিচি।
সাজো গে যাও। ভালো করে ধুয়ে নিয়েছ তো পটাশ পারমাঙ্গানেট দিয়ে?
ওই বেগনে ওষুধে তো? হ্যাঁ গো হ্যাঁ।
মণির মা চলে যেতেই প্রসেনজিৎ বললেন, পটাশিয়ান পারমাঙ্গানেটে বিশ্রি আঁশটে গন্ধ করে। ওতে কেন পান ধোও?
এবার সুষমা হেসে ফেলেন।
তুমি তো জর্দার সুগন্ধেই সব কুগন্ধ ঢেকে নেবে। কঁচা কাঁচা পাতাগুলো যে খাবে কে জানে কী বীজাণু আছে? তার ওপর পেস্টিসাইড থাকতে পারে। সতর্ক হওয়া ভালো। স্যালাড আর পানের বেলায় বিশেষ করে। তুমিই তো আমাকে এটা শিখিয়েছ! নিজে ডাক্তার–আর আমাকে জিগ্যেস করছ?
ব্যাগটা তুলে নিয়ে সুষমা কব্জির দিকে তাকান। তারপর দেওয়ালঘড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে প্রসেনজিতের চোখও যায় সামনে দেওয়ালঘড়িতে। তিনি বলে ওঠেন, এত করে বলছি, যেও না। তবু যাচ্ছ? বলছি মাথাটা ধরেছে, একটু বোসো না বাবা মাথার কাছটায়। তোমার বাইরে এত কী কাজ?
কী করে বসি বল তো? আজকে যে অ্যাডভাইজারি কমিটির মিটিং ঠিক এগারোটার সময়। তুমি ততক্ষণ চানটা সেরে নাও। লাঞ্চের পর বরং আমি আর থাকব না। বাড়িতে চলে আসব। কেমন?
সুষমার গলা কিঞ্চিত বিপন্ন।
গাড়ি নিয়ে যাচ্ছ?
নাঃ। ওরা গাড়ি পাঠাবে।
বলতে বলতেই গেটে বেল বেজে ওঠে। ওই এসে গেল তোমার জয়রথ।
জয়রথই বটে! সুষমা ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে যান।
বাচ্চু! রঘু! মণির মা! কে আছিস?
বাচ্চু, রঘু, মণির মা তিনজনেই এসে পড়ে প্রসেনজিতের হুঙ্কারে।
টাইগার বামটা কোথায়? মালিশ করে দে মাথাতে একটু
বাচ্চু, মণির মা, রঘু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর বাচ্চু যায় টাইগার বাম আনতে ড্রয়ারের দিকে। বাকি দুজন পালায়। পড়ার চশমা পরে নিয়ে প্রসেনজিৎ একটা কাগজ তুলে ধরেন চোখের সামনে। বাচ্চু টাইগার বামের ডিবে হাতে করে এসে দাঁড়াল। বাবু চশমা না খুললে কপালে মালিশ করবে কী করে? কিন্তু কথাটা বলবেই বা কী করে! মলমের কৌটো বাচ্চুর মুঠোয়। বাচ্চু দাঁড়িয়েই থাকে। প্রসেনজিৎ কাগজ পড়েন। কান খাড়া থাকে, কখন নীচে গাড়ি স্টার্ট করার শব্দ হবে।
.
এই যে মিতালি। ওদিকের সবাই এসে গেছেন?
ব্যাঙ্গালোরের প্লেন লেট দিদি। ডঃ এস. বি রাও এসে পৌঁছতে পারেননি এখনও। বাকিরা এসে গেছেন।
গাড়িতে পা দিতে দিতে সুষমা জিগ্যেস করেন, গেস্টহাউসে ওদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? এই নতুন গেস্টহাউসটা তো এবারই প্রথম ট্রাই করলাম আমরা।
না, না, এখানে সবকিছুই সুবিধের দিদি–একটাই শুধু মুশকিল, বাড়ির সামনের রাস্তায় বড্ড জল জমে যায়। কালকের বৃষ্টিতে বেশ জল দাঁড়িয়ে গেছে। তবে ওদের অসুবিধে হয়নি, টাটা সুমোটা গেছে তো–বেশ উঁচু আছে।
মিতালির বাকি কথাগুলো সুষমার আর কান আসছে না। প্রসেনজিৎ প্রচণ্ড গোলমাল বাধিয়েছেন রিটায়ার করার পর থেকে। বাড়িতে বসে বসে টি. ভি. দেখে, আর কাগজ পড়ে সময় কাটাচ্ছেন। কিছুতেই চেম্বারে বসবেন না। এতদিনের দীর্ঘ ডাক্তারির অভ্যাস ছিল। প্র্যাকটিস করলে সময় কাটে, ব্যস্ত থাকেন। মাথাটাও একটু পরিষ্কার থাকে। আর সুষমাও বাঁচেন। কিন্তু প্রসেনজিৎ প্র্যাকটিস করবেন না। রিটায়ার করবার আগেই সুষমা যত্ন করে নীচের তলায় তিনটে ঘর জুড়ে চমৎকার চেম্বার সাজিয়ে দিয়েছিলেন। সেসব কোনো কাজে লাগেনি। শূন্য পড়ে আছে। সমস্ত পরিশ্রম জলে গেল এবং খরচাপাতিও কম হয়নি। তাই সুষমা ভাবলেন ওঁদেন সংগঠনের কাজে লাগাবেন জায়গাটা। একটা ডাক্তারি পরীক্ষার কেন্দ্র খোলা যেতে পারে। বালিকা সুরক্ষা সমিতি ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ থেকে ক্রমশ সুষমার কাজে এসে পড়েছে যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে জাতীয় এড়স নিয়ন্ত্রণ সংস্থার মধ্যেও। কত জরুরি কাজে যে লাগানো যেতে পারে এই সাজানো ঘর কটিকে।
কিন্তু তাতেও বাদ সাধলেন প্রসেনজিৎ। তোমার ওসব বাইরের কাজ বাইরেই থাকুক, বাড়ির মধ্যে টেনে আনা চলবে না। আজ তোমার আদরের প্রস্টিটুটরা আসবে, কাল তোমার সোহাগের এক্স রুগিরা-ওসব এখানে চলবে না। ভট্টচায্যিবংশের বসতবাটি এটা। তোমার বোধহয় মনে নেই।
সত্যি, মনে ছিল না সুষমার। আটত্রিশ বছর হয়ে গেছে তাঁর এই বাড়িতে। এ বাড়ি প্রসেনজিতের। তার অনুমতি বিনা সুষমা এটা ব্যবহার করতে পারেন না। ঝকঝকে। ফার্নিশড। তিন তিনটে ঘর। এমন ভালো রাস্তায়। সাজানো।
তবে ভাড়া দিয়ে দাও কোনো নতুন ডাক্তারকে?
পাগল? ভাড়া দিই আর সে এখানে মৌরসী পাট্টা গেড়ে বসুক? ভাড়াটেই তো এযুগে মালিক। কেন, তোমার কি ভাত জুটছে না যে ঘরের মধ্যে ভাড়াটে ঢোকাতে চাইছো? তারপর একটু হেসে, নাকি এই বুড়ো ডাক্তারটাকে আর মনে ধরছে না–একটা ছোকরা ডাক্তারের দরকার হয়ে পড়েছে এই বাড়িতে?
চুপ করে যান সুষমা।
এই চিমটি কাটা কথাগুলো তিনি শুনছেন বহুকাল। সেই সতেরো বছরের মেয়ে এ বাড়িতে এসেছিলেন। প্রসেনজিৎ সদ্য এম. বি. বি. এস. করে এম. ডি. করছেন। সাতাশ বছরের ব্রিলিয়ান্ট যুবক–মহেন্দ্ৰনিন্দিত কান্তি, রাজেন্দ্রদর্শন। এমন সুপুরুষ কিশোরী সুষমা তার জীবনে আর দেখেননি।
মা-হারা মেয়ে দুটিকে বুকে করেই মানুষ করেছিলেন রাজশেখরবাবু যদিও তাকেও সরকারি চাকরিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। বাইরে বাইরেই মানুষ সুরমা আর সুষমা। যমজ বোন, কিন্তু অবিকল একরকম দেখতে নয়। মুখ-চোখ-চুল গড়ন সব এক–শুধু সুষমার রংটি দুধে-আলতায় ধোয়া, আর সুরমা শুধু গৌরী।
কচি মেয়ে দুটিকে ফেলে ওদের মা চলে গেলেন কদিনের জ্বরে। মফস্সল টাউনে ঠিকমতো চিকিৎসা হয়নি। ওরা তখন পাঁচ বছরের। রাজশেখরবাবু মেয়েদের মানুষ করায় কোনো অবহেলা করেননি। মা-বাপের যত্ন-স্নেহ একাই উজাড় করে দেবার চেষ্টা করেছেন। বদলিতে ঘুরে বেড়ানোর চাকরি বলে আত্মীয়-স্বজনের বলটাও ছিল না হাতের কাছে। যদিও তাঁর দিদি বলেছিলেন মেয়েদের তার কাছে জলপাইগুড়িতে রেখে মানুষ করতে। রাজশেখরের শ্বশুর-শাশুড়িও তখন বেঁচে। তারাও চেয়েছিলেন নাতনিদের ভার নিতে। কিন্তু সন্তান-অন্ত প্রাণ পিতা তিনি নিজেই কিছুতেই ছাড়তে পারেননি ছোট ছোট মেয়েদের।
অবশ্য সুষমা-সুরমা মানুষ হয়েছেন ভালোই–বাবার আদরে-আহ্লাদে নষ্ট হয়ে যাননি। বরং ছোটবেলা থেকেই তারা একই সঙ্গে লেখাপড়া, ঘরকন্নার কাজ শিখেছেন। নিজেদের ভার যেমন নিজেরা নিতে শিখেছেন, তেমনি বাবার দায়িত্বও ভালোবেসে অনায়াসে বহন করেছেন দুই বালিকাতে।
দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলেন রাজশেখর। প্রথম যে ভালো সম্বন্ধটি এল, দুই রূপসী মেয়েকেই দেখালেন; বড়লোকের ডাক্তারছেলের সঙ্গে বেশি ফর্সা মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। একটু কম ফর্সা বলে সুরমার বিয়ে হল তার পরের বছর। পাত্র অধ্যাপক। দুই বোনই বিয়ে হয়ে কলকাতাতে সংসার পাততে এলেন। বাবা দূরে থাকলেও ভাগ্যগুণে বোনেরা রইলেন কাছাকাছির মধ্যেই। এখনও আছেন। এটা তাদের মস্ত জোর।
দিদি একটু দেখে নামবেন, এখানটায় একটু কাদা রয়েছে–
মিতালির সতর্কবাণীতে সুষমার খেয়াল হয়। এসে গেছেন সভাগৃহে। ঘড়ি দেখলেন। এখনও দশ মিনিট সময় আছে। তার মধ্যে অ্যাজেনডাটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে হবে। ডাঃ, রাওয়ের প্রতিবেদনটি তো এসে পৌঁছল না, অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
.
তৃতীয় অধ্যায়। কচুপাতার টুপি
সুষমার ফোন এসেছিল। তুমি কি থাকবে কাল বিকেলে?
চা ঢালতে ঢালতে সুরমা মুখ তুলে তাকান স্বামীর দিকে
কেন? সুষি আসবে বলল?
বোধহয়। তুমি একটু জেনে নাও। মনটন ভালো মনে হল না।
চিড়েভাজার প্লেট এগিয়ে দিয়ে সুরমা বলেন,
মন ভালো থাকবে কেমন করে? জামাইবাবু যা কাণ্ডকারখানা শুরু করেছেন, সুষির কাজকর্ম সব বন্ধ করে দেবার জোগাড়। সত্যি সত্যিই যদি কোনোদিন, ভগবান না করুন–উনি যদি কখনো কোনো রোগে পড়েই যান–তখনই যে কী করবেন!
তখন প্রসেনজিৎ যাই বলুক, সুষমা বেচারি যে কী করবে! সত্যি মেয়েটার ভাগ্য বটে! কপাল করে এসেছে একখানা!
মানুষ যা যা চায় সুষির কপালে সবই তো জুটেছিল। বাবা তো দেখেশুনেই বিয়ে দিয়েছিলেন। যদি আমি ওর মতন দুধে-আলতায় গোলা হতুম–তাহলে আজ প্রসেনজিতের ঘরে হয়তো আমিই থাকতুম।
ভাগ্যিস! দুধে-আলতায় নয়, আমে-দুধে গোলা রূপসী তুমি! অবশ্য প্রসেনজিতের ঘর করার সুযোগ তোমার চাইলে এখনো হতে পারে। প্রসেনজিতের যা আত্মগত তুরীয় অবস্থা, সে এখন আর সুরো-সুষির মধ্যে তফাত করতে পারবে না। যমজ কন্যা বলে কথা। দুজনেই তন্বী, গৌরী; সুন্দরী, হৃদয়বিদারিনী
হয়েছে হয়েছে। চুপ করো। এদিকে বলছ ওর মনটন ভালো নেই—
কিন্তু আমার মনটন ভালো নেই তো বলিনি-আদিত্য সুরমার হাতটা জড়িয়ে ধরেন।
খালি ঠাট্টা!
আস্তে হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নেন সুরমা। আদিত্য হাসতে হাসতে চিড়েভাজা মুখে দেন। তারপর বলেন,
কিন্তু কেন বললে সুষমার কপালে সবই জুটেছিল? সবই মানে কী?
মানে, মেয়ের বিয়ে দেবার সময় বাপ-মায়ে কী কী খোঁজে? সেই সব।
যেমন?
যেমন ধরো, বংশ। তা কোন্নগরের ভট্টাচায্যি। আর কী চাই? জমিদার বংশ, তায় পণ্ডিত। তারপর, শিক্ষা। শ্বশুর ইঞ্জিনিয়ার। পাত্র ডাক্তার। এম. ডি. করছে। আর কী চাও? তিন–স্বাস্থ্য। অটুট যৌবন। ছফুট দুইঞ্চি হাইট। মনের ভেতরটা তো দেখা যায়নি? চার, রূপ–অনিন্দ্যসুন্দর, রূপবান পুরুষ। এত সুন্দর পুরুষ আমি তো আর দেখিনি সুষির বিয়ের আগে!
তার পরে তো দেখেছ? জবাকুসুমসংকাশংকে দেখছ না? কোথায় লাগে প্রসেনজিৎ? সূর্যের মতো ভিরিলিটি আর কিসের আছে? নিজের ঘরে এমন আদিত্যবর্ণং পুরুষং মহান্তম্ নিয়ে, বোনের দিকে
সুরমা কথার মাঝপথেই ঢুকে পড়েন,
জামাইবাবুর মতো অমন একমাথা চুল কি তোমার আছে? সুষির টাকে বেদম আপত্তি ছিল। হল তো? আর ধর্ম? পড়ো তুমি গায়ত্রী মন্ত্র চোখ মেলে? উনি গায়ত্রী না পড়ে জলস্পর্শ করেন না! তারপরে, জামাইবাবু সংস্কৃত জানেন, শাস্ত্রটাস্ত্র পড়েছেন। ডাক্তার হলে কী হবে তিনবেলা আহ্নিক করেন। তখন কি বুঝেছি এর মানে কী? আর তারপরে ধরো-পরিবারে শুধুই শ্বশুর-শাশুড়ি। এক ননদ। সে বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। এর চেয়ে ঝাড়াঝাঁপটা শ্বশুরবাড়ি কোথায় পাবে?এতগুলো প্লাস পয়েন্টের পরেও যেটা সবচেয়ে জরুরি, তাও ছিল–ধনৈশ্বর্যে লক্ষ্মী লাভ হবে। কোনোদিন অর্থাভাব হবার কথা নয়। শ্বশুরের এত সম্পত্তি আছে। এমনি আইডিয়াল সম্বন্ধেও মেয়ে না দিলে, কি তোমাকে দেবেন?
এবার হেসে উঠে এক হাতে সুরমার কোমরটা সহসা জড়াবার চেষ্টা করেন আদিত্য। তখুনি উল্টোপাক খেয়ে তরুণীর দ্রুততায় নিমেষে নিজেকে মুক্ত করে নেন সুরমাও। আদিত্য কিন্তু আবার পাকড়াও করেন স্ত্রীকে।
আর আমি? আমি কেমন পাত্র?
কোনো গুণ নাহি তার কপালে আগুন!
আহা সে তো শিবঠাকুর! আমি কি শিবঠাকুর?
তুমি তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের একজন।
নন্দী, না ভৃঙ্গী?
দুটোই একসঙ্গে!
আচ্ছা সুরো, আমি একেবারে প্রসেনজিতের বিপরীত মেরু, না? শুনতে শুনতে হঠাৎ স্ট্রাইক করল ব্যাপারটা। কী দেখে তোমাকে দিলেন উনি আমার হাতে? আমার তো ছিল না কিছুই, শুধু দূর আশা ছাড়া।
তাই বা খারাপ কী? একটু থেমে সুরমা বলেন, ইনফ্যাক্ট, তোমাদের বারদির ভিটেবাড়িটা একবার গিয়ে দেখে আসার ইচ্ছে আছে। ওটা তো লোকনাথ বাবারও ভিটে।
জ্যোতি বসুর বাবারও ভিটে বারদি।
কিসের সঙ্গে কী!
কেন গুরুর সঙ্গে গুরুই তো!
লোকনাথবাবা শুধু গুরু নন। অনেক বেশি।
জ্যোতিবাবুও তাই।
ঠাট্টা রাখো। জ্যোতিবাবুকে আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা হয়। হি ইজ অ্যান অনেস্ট ম্যান। নির্লোভ। ঘুষ খান না। পার্সোনাল গেইনের জন্য রাজনীতি করেন না। কত বছরের অভিজ্ঞতা বলো তো ভারতীয় রাজনীতিতে? ওঁর সঙ্গে তুলনীয় আরেকটা নাম দেখাও দেখি? কেউ নেই!
কেন, প্রিন্স অব কারগিল? কবি অটল বিহারী বাজপেয়ী!
তোমাকে নিয়ে পারা গেল না।
আরে, গিভ দ্য ডেভিল হিজ ডিউ? ও-ও পার্সোনাল গেইনের জন্য রাজনীতি করে না, অনেক বছরের অভিজ্ঞতা আছে, অ্যান অনেস্ট, অ্যান্ড লার্নেড় ম্যান, ঘুষটুষ খায় না, উপরন্তু কবিতা লেখে। ওয়ান আপঅন জ্যোতিবাবু কিনা?
আরে? তুমিও কি বেজেপি হয়ে গেলে নাকি? জামাইবাবুর মতন? কি সর্বনাশ!
আজ্ঞে না, আমি যা ছিলুম ছাত্রবয়স থেকে এখনও তাই আছি। তাই থাকব ম্যাডাম। এম. পি. তো নই, যে ফ্লোরক্রসিং করলে জীবনে উন্নতি হবে? আমার ইনসেটিভষ্টা এতে কী, বলুন? আপনি দেখছি ঠাট্টা বোঝেন না।
তবু ভালো! ঠাট্টা!
চা শেষ? যাও, তবে সুষমাকে ফোনটা করে ফ্যালো এইবারে?
ওঃ হো! থ্যাকিং য়ু–ভুলেই যাচ্ছিলাম–
চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি ফোনটা তুলে নেন সুরমা। নিজের কাপে আর একবার চা ঢালতে ঢালতে আদিত্য জিগ্যেস করেন, তোমাকে আরেক কাপ দিই? সুরমা বলেন, হ্যাঁ, প্লিজ!
.
কি রে সুষি ফোন করেছিলি?
তুই বেরিয়েছিলি কোথায়? আজ তো তোর গানের ক্লাস নেই?
নাঃ, এই একটু খুচরো বাজার করতে, দু-একজনের জন্য দু-একটা শখের জিনিস–রাস্তায় ঘুরে ঘুরে–ওই আরকি–তোরা কেমন আছিস বল? তোকে কাল রাতের খবরে টিভিতে দেখলাম। মঞ্চে বসে আছিস। পুলিশ কমিশনার আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর সঙ্গে।
ওঃ! পথের শিশুদের জন্য ওঁরা একটা প্রকল্প করেছেন নবদিশা বলে। CINI, CARE বালিকা সুরক্ষা খেলাঘর এমনি অনেকগুলো NGO নিয়ে কাজ করবেন–তারই উদ্বোধনী সভা
সুন্দর লাগছিল তোকে।
সেই তো হয়েছে ঝামেলা। যত সিম্পলই সাজি না কেন, টিভিতে সুন্দর দেখাবেই। আর তোর জামাইবাবু বিচলিত হয়ে পড়াবেনই। কী যে করি, বুড়ো হয়ে মরতে চললুম, এখনও এই যন্ত্রণা কাটল না। ওঁর স্বভাব আর বদলাল না। বরং বয়স যত বাড়ছে মন্দ গুণগুলোও তত বাড়ছে।
আসলে জামাইবাবুর সেই স্বর্গ-মর্ত্য কাঁপানো রূপটা তো আর নেই। ভুঁড়ি হয়ে, নাদুসনুদুস, অন্যরকম দেখতে হয়েছেন–তায় মাথাভর্তি অত পাকাচুল। পুরো গোঁপটা সাদা! এদিকে তোকে বয়সের চেয়েও অনেক বেশি ছোট দেখায়। ফিট আছিস। টাইট, হালকা সুশ্রী আছিস তো। তাই ওঁর চোখ টাটায়। হি ইজ জেলাস অফ ইউ। হি ফিলস্ ইনসিকিয়োর।
কিসের জন্যে জেলাস হবে বল্ তো? আমি কী করেছি?
অফ ইয়োর ইয়ুথফুলনেস। ফিগারই তো শুধু নয়, মুভমেন্টস, রেসপন্সেস, তোর অ্যাটিটুড টু লাইফসবকিছুর মধ্যেই অল্পবয়সটা সারাক্ষণ ফুটে বেরোয়।
আর ইয়ুথ! তুই তো জানিস বাড়িতে কিসের মধ্যে থাকি!
থাকলেই বা? এনার্জিটাই যৌবনের আসল কথা। তুই তো হাজার কাজে সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়াচ্ছিস একটা আরবি ঘোড়ার মতন। আর জামাইবাবু ভুড়িদাস হয়ে খাটে শুয়ে শুয়ে শরবৎ খাচ্ছেন, আর পান চিবোচ্ছেন, টি. ভি. দেখছেন আর কাগজ পড়ছেন। নড়ে বসছেন না। ওঁর তোকে হিংসে হবে না তো কি! ওটুকু এখনও তোর অভ্যেস হল না? তুই এখনও ওই নিয়ে কাঁদবি? সুষি!
…
অ্যাই?-আমি এবার বকব। আচ্ছা, ওই যারা তোকে এত ভক্তি করে, তোর সঙ্গে কাজ করে, সেইসব ছেলেমেয়েগুলো যদি তোকে এখন দেখতে পায়? তারা যে দিদি বলতে শ্রদ্ধায় মুচ্ছো যাচ্ছে, সেই দিদি ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছেন,–দেখলে ওরা কী ভাববে তোকে? বল তো?
…
তুই অনেকটা ওপরে উঠে গেছিস সুষিজামাইবাবুর নাগালের মধ্যে তুই নেই, সেইজন্যেই ওঁর এত রাগ! তুই কিচ্ছু বুঝিস না? ইগনোর করতে শেষ। ইগনোর হিম। ইগনোর হিজ ট্যানট্রামস। সব আপনিই ঠিক হয়ে যাবে।
আদিত্য এগিয়ে এসে স্ত্রীর শূন্য চায়ের কাপটা এক হাতে তুলে নিয়ে, ফোনের দিকে অন্য হাত বাড়িয়ে দেন
আমাকে একটু দেবে? সুরমা রিসিভার হাত বদল করেন। আদিত্য শুরু করেনঃ
কী গো সুষমিবাঈ? ক্যা হুয়া? দিলমে দর্দ? মেরে পাস আ যাও, সব কুছ ঠিকঠাক কর দেগা। ফার্স্ট ক্লাস দাওয়াই হ্যায়। আসবে? নাকি ইগনোর হিম করবে? না এলে আমিও কিন্তু ট্যানট্রামস ছুঁড়ব। আমি তোমার জন্যে কাল বিকেলে। ৫টা-৫ মিনিটে। খিড়কির পুকুরের সামনে। মানকচুপাতা মাথায় দিয়ে। অতি অবশ্যই। নো অন্যথা! সেই কথাই তবে রইল? ওকে? সুরমা ফোন টেনে নেন,–ওদিকে সুষমার হাসির শব্দ পেয়ে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
সেই কথাই রইল সুষি। তোর জামাইবাবু মানকচু বনে তোর পথ চেয়ে বসে থাকবেন। চলে আসিস। ঠিক তো? বিকেল বেলায়।
রিসিভার ক্রেডলে নামিয়ে রেখে সুরমা আদিত্যর দিকে হাসিমুখটি ফেরান। দুই চোখে কৃতজ্ঞতা ছলছল। আদিত্য স্ত্রীর সামনে গরম চায়ের পেয়ালাটি নামিয়ে দিয়ে সহাস্য ভুরু নাচান, ভাবখানা–কী? কেমন বলেছি?
.
সুরমা চিরদিন গম্ভীর, স্বল্পবাক্। আদিত্য তাকে ভালোবেসে, ভয় ভয় করে মেনে চলেছেন। সুষমা যেমন ভীরু, কোমল ছিলেন, কড়াকথা বলতেই পারতেন না, একটুতেই কেঁদে ফেলতেন, কেউ অন্যায় করলে ভয়ে প্রতিবাদ করতেন না, সব অত্যাচার মেনে নিতেন, সুরমা ঠিক তার বিপরীত। নিজে যেটা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। স্বল্পবা, কিন্তু নির্ভয়ে সত্য বলবেন। প্রিয় হোক, বা না হোক, তা নিয়ে ভাববেন না। গুরুজনকেও রেয়াৎ করবেন না। অথচ ব্যক্তিগত অনুভূতির বেলায় চাপা। অপ্রকাশ। আদিত্যর এই মেয়েকে চিনতে দেরি হয়নি।
শ্রাবস্তী অনেকটাই তার মায়ের স্বভাব পেয়েছে। সোজাসুজি স্পষ্ট কথা বলে দেয়। আদিত্য তো বেশ ভয়ে ভয়ে থাকেন–মেয়ে যে কেরিয়ারে গেছে, সেখানে এই খোলাখুলি স্বভাবচরিত্র বড় ধাক্কা খায়। শ্রাবস্তী আই. এ. এস হয়েছে। এখন সে বীরভূমের এস. ডি. ও। এতটা রূপসী হয়নি সে মা-মাসির মতন, যদিও যথেষ্ট শ্রীময়ী, ব্যক্তিত্বময়ী–বাবার মুখশ্রী, বাবার গড়নই মেয়ে পেয়েছে।
মায়ের রূপটি পুরোপুরি পেয়েছে শিলাদিত্য। কিন্তু স্বভাবটা তার নিজস্ব। সুরমা অবশ্য বলেন মাসির মতো স্বভাব। ভীতু, নরম, কোমলপ্রাণ ছেলে সে ছোট থেকেই। চেহারাটি দেবদূতের মতো। স্বভাবের সঙ্গে মিল আছে। ছোটবেলায় ওকে মেয়ে মনে করত সকলে। এখন লম্বা হয়ে গেছে অনেকখানি, ছফুটের কাছাকাছি। কিন্তু এখনও যেন মেয়েদের মতোই কোমল তার মুখচ্ছবি, ভাবুক, দীর্ঘপ চোখ।
শিলাদিত্য গান গায়। তার মায়ের মতোই সুর আছে তারও ভিতরে। গিটার বাজিয়ে ইংরিজি গান গায় সে। অনেক গান তার নিজেরই লেখা। তানপুরা নিয়ে মায়ের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। শিলু কবিতাও লেখে। সেও ইংরিজি ভাষাতে। আদিত্যর তাতে আপত্তি নেই। সর্বভারতীয় পাঠক পাবে; সারা পৃথিবীর পাঠক। ইংরিজিও তো একটা ভারতীয় ভাষাই। লিখলে সারা পৃথিবীর জন্যেই লেখা উচিত। যদি হাতে সে ক্ষমতা থাকে। আজকাল তো ওতেই নামডাক!
সুরমার কিন্তু তাতে মন খুঁত খুঁত। বাঙালি ছেলে বাংলায় কবিতা লিখবে না? কবিতা কখনও অন্যের ভাষাতে লেখা যায় নাকি? প্রাণের ভাষাতে ছাড়া? ইংরিজিটাই যে শিলুর প্রাণের ভাষা, আদিত্যর কাছে সেটা স্পষ্ট, কিন্তু সুরমার এটা মেনে নিতে প্রাণ চায় না। শিলুর বাংলা ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল–চমৎকার বাংলা লিখত ছেলেটা। মা-র কাছে এসে আদর কাড়বার সময়ে তো শিলু ইংরিজি বলে না? দিব্যি পষ্ট বাংলাই বলে। তবে কেন লেখে না?
.
বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন সাহেব বিয়ে করে, তখনও সুরমার ঠিক এই ভাবনা হয়। ওরা ইংরিজিতে প্রেমের কথা বলে কেমন করে? কবিতা লেখাও তো প্রেম করাই।
কিন্তু সুরমার মনের এই কথাগুলি মনেই থাকে। শিলু কি জানে, তার ইংরিজিতে কবিতা লেখাটা মায়ের পছন্দ নয়? বোঝে কি? শিলুও তো চাপা। সেও বলবে না। তার মনের মধ্যে কী কী কথা আছে, সেটা তাকে লক্ষ্য করে বুঝে নিতে হয় সুরমাকে।
শ্রাবস্তী রাশভারী বটে, কিন্তু স্পষ্টবক্তা। শিলাদিত্যর স্পষ্ট নয় কিছুই। যদিও সে। নরম। তার ভাষা ইঙ্গিতের। একটুখানি ধরিয়ে দেবে মাত্র। তোমাকে বাকিটা বুঝে নিতে হবে। আদিত্যর সে ধৈর্য নেই। তিনি চেষ্টাও করেন না। সুরমা চেষ্টা করেন। তবে আগে যতটা করতেন এখন ততটা পারেন না। ছেলে বাইরে বাইরে ঘোরে, দূরে দূরে থাকে, এখন তো শহরেই নেই। দিল্লিতে National School of Drama-তে ভর্তি হয়েছে। অভিনয় শিক্ষা করছে। শিল্পী স্বভাব তার, ছবিও আঁকে। সুন্দর সুন্দর পোস্টার বানায়। তার ইচ্ছে অভিনয় করবার। আদিত্য বাধা দেননি। যদিও এটা তার মনোমতো হয়নি। নিজের মনের ভাষাকে সে মুখে প্রকাশ না করুক, অন্যের মনের ভাষাকে সে প্রাণ দিতে পারবে বলেই শিলাদিত্যর বিশ্বাস।
গত ছুটিতে শিলু এসেছিল। লম্বা লম্বা চুল পেছনে টেনে রবার ব্যান্ড দিয়ে ঝুঁটি বেঁধে রেখেছে। গলায় একটা ছোট্ট সুতোর তৈরি লকেট, না তাবিজ। বাঁ-হাতে পাঞ্জাবিদের মতন লোহার কড়া। বাঙালি ছেলে বলে মনেই হচ্ছিল না ওকে। আজকাল প্রায় সব ছেলেমেয়েকেই একইরকম দেখতে। সুরমা চেয়ে চেয়ে দেখেন কলেজে, টিভিতে, রাস্তাঘাটে। সেই ঝকের কই হয়ে গেল তাঁর শিলুও।
.
চতুর্থ অধ্যায়। কার ফোন
কাল রাত্রে কে ফোন করেছিল?
কই কেউ তো করেনি?
আমি শুনলুম, ফোন বাজল, তুমি ধরলে, তারপর অনেকক্ষণ ফুসুর ফুসুর হল। কেউ করেনি?
ও সে তো সুরো।
সুরো তো বিকেলে করেছিল। তুমি তো আমাকে বললে এসে।
রাত্রে? কে আবার রাত্রে ফোন করল আমাকে? মনে পড়ছে না তো?
মণিদীপা কি? মিতালি? ডঃ সাহা?
কই ওরা তো ফোন করেনি? কত রাত্রে বলো তো?
খাবার পরে? করেনি?
আমি কী করছিলুম তখন? শুয়ে পড়েছি?
আমি শুয়ে পড়েছি। তুমি ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছ। ফোনের আশায়। আর আমি জেগে আছি। তোমার আশায়। দেরিতে বিছানায় এসে মশারি তুলে ঢুকলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। জানোই তো একসঙ্গে শুয়ে পড়া আমি পছন্দ করি। তা ফোনের আশায় যদি
কী যা তা বলছ, ফোনের আশায় মানে? কার ফোন? আমার মনেই পড়ছে না।
মনে করে দ্যাখো। চেষ্টা করো একটু? পারবে।
পারব না। পারব না। আমি পাগল হয়ে যাব এবারে। কেউ ফোন করেনি। তুমি কল্পনা করেছ। আমি আজকের স্পিচটা লিখছিলুম। ফুসুর ফাসুর করছিলুম না। তুমি ঘুমচোখে ভুল শুনেছ। ওটা টেবিলফ্যানের শব্দ।
স্পিচ লিখতে ওঘরে?
আলো জ্বাললে তুমি চ্যাঁচাবে তো।
কিসের স্পিচ?
রবিবার মিটিং আছে টালিগঞ্জের ইনার হুইলের। আমাকে স্পেশাল গেস্ট করেছে– স্পিচ দিতে হবে না? সেইটে লিখছিলুম।
এখনও তোমাকে লিখে বক্তৃতা দিতে হয়? এখন কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নাও? গোড়ায় গোড়ায় তো আমাকে এক্সপ্লয়েট করেছ।
এক্সপ্লয়েট করেছি? তোমাকে? আমি? পরম বিস্ময়ে সুষমার ভুরু কপালে উঠে গেল।
নাকি ঠিক তার উল্টোটা? আমার তো একটুও ভালো লাগত না তোমার হিন্দু জাগরণীর ব্যাপার-স্যাপার। ফ্যাসিস্ট মনে হত।
গেলেই বা কটা দিন? ওই তো নিজের রুচিমাফিক কাজ বেছে নিয়েছ, যত রাজ্যের ভিকিরি আর বেশ্যাদের নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি। সাধু-সন্ন্যাসিনীদের সঙ্গ তোমার তো মোটে ভালোই লাগল না।
বালিকা সুরক্ষাশ্রয় বুঝি কেবল ভিকিরি আর বেশ্যা নিয়ে চলে? গরিব মেয়েরা সবাই হয় ভিকিরি নয় বেশ্যা, না?
নয় তো দুটোই। তুমি তো হিন্দুনারী সুরক্ষা সমিতি ভেঙেচুরে তোমার নিজের ম্লেচ্ছ বালিকা আশ্রম গড়ে তুললে, যেখানে সব ধর্মের পতিতা মেয়েদের আড্ডা! আমি যা চেয়েছিলুম, তা কি তুমি করলে? হিন্দুত্ব হেঁটে বাদ দিয়ে কি হিন্দুধর্মের সেবা হয়?
তোমাদের হিন্দুনারী সুরক্ষা সমিতি যেমন ছিল তেমনি আছে, আমি কিছুই ভাঙচুর করিনি। কেবল নিজে ওখান থেকে সরে এসেছি–এসে গড়েছি নিজস্ব নারী নির্যাতন প্রতিরোধ সংঘ। তাতে অনেক হিন্দু নারীও, প্রধানত হিন্দু নারীরাই, আশ্রয় পাচ্ছে। কেননা সংখ্যায় তারা বেশি।
হিন্দু বালিকা আশ্রমটা তুলেই দিলে?
তুলব কেন? ওটার নাম পালটেছি, বালিকা সুরক্ষাশ্রম করেছি। সেকুলার। ভারতীয় সংবিধান মতো চলাটা কি অন্যায়? কোনো ধর্মেরই উল্লেখ রাখিনি। আমি ভালো করে কাগজপত্র চেক করে নিয়েছি, বালিকাশ্রমের শুরুতে যাঁরা অর্থ অনুদান দিয়েছিলেন দেখলাম তারা কেউই হিন্দু কথাটা রাখতেই হবে, এমন কোনো শর্ত দেননি। তোমার এত আপত্তি কিসের? হিন্দুধর্মের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি এতে?
আমার আপত্তির কথা হচ্ছে না। তোমারই বা এত হিন্দু শব্দে আপত্তি কেন? হিন্দু নারী, হিন্দু বালিকা, সবই তোমার অপছন্দ।
কেননা নির্যাতিত কেবল হিন্দু নারীরাই হয়না। নিরাশ্রয় শুধু হিন্দু বালিকারাই হয় না। নিজের চোখে সেটা দেখলে আর ওভাবে হিন্দু বলে কপাট বন্ধ করতে পারা যায় না। তুমি হাতে-কলমে কিছু করোনি। শাস্ত্রে সবকিছু লেখা থাকে না। সুষমার মুখে-চোখে বিরক্তি। খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে এবার উঠে পড়লেন সুষমা। সকালের চায়ের আসর এবারে ভঙ্গ হবে। প্রসেনজিৎ বললেন, তুমি খুব বদলে গিয়েছ, সুষি!
বাঃ, বদলাব না? সময়ের তো সেটাই কাজ। না বদলালেই বরং খুব চিন্তার বিষয় হত। জ্যান্ত জিনিস, প্রাণ আছে, বদলাব না? বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে গাছটা, ঘাসটা পর্যন্ত বদলে যায়। আর আমি মানুষ, বদলাব না?
আমি তো বদলাইনি।
কে বলল বদলাওনি? ধুতি-পৈতে পরলেই বুঝি মানুষ অপরিবর্তিত থেকে যায়? রিটায়ার করার পরে তুমিও তো অনেক বদলে গেছে। সারাক্ষণ ঘরে বসে বসে তোমার মাথার মধ্যে মর্চে ধরে যাচ্ছে।
আমার স্ত্রী কেবল বাইরে বাইরে ঘুরে লেকচার দিয়ে মিটিংবাজি করে বেড়াচ্ছেন, আর অসুস্থ আমি ঘরে পড়ে আছি; সেই নিয়ে আহ্লাদে নাচছি না বলেই বুঝি আমার মগজে মর্চে ধরেছে? আর ছেলেটাও হয়েছে তেমনি। এই তোমার প্রশ্রয়েই উচ্ছন্নে গেছে। রুগ্ন বাপকে ফেলে ফুর্তি করবে বলে বিদেশে বসে আছে। বউ নিয়ে যত রাজ্যের অনাচারের মধ্যে ডুবে আছে। ইচ্ছে করে আঁটকুঁড়ো হয়ে রইল। বাঁজা বউ আনল ঘরে। আমার চোদ্দোপুরুষকে জল দিলে না। ছেলের দোষ বললেই বলবে মগজে মর্চে।
কেবলই ছেলে-বউয়ের দোষ না ধরে একটু বরং ওদের ভালো দিকটা ভাবো না। তাহলে মনটাও অনেক ভালো থাকত। ভালোও তো ওদের কম নেই? শুধুই লোককে মন্দ ভাবতে হয়? নিজেরই ওতে শরীর খারাপ করে।
থাক–আমার শরীরের কথা আর তোমাকে ভাবতে হবে না। ঢের হয়েছে। তুমি তোমার সংগঠনের কথা ভাবো। কটা বেশ্যার ছেলে ইশকুলে গেল। কটা ভিকিরির মেয়েকে রাস্তা থেকে তুলে আনা গেল। এইসব ভাববা। তোমাকে কি এইজন্যেই ঘরের বাইরে বের করেছিলুম? পাঠিয়েছিলুম তো হিন্দুধর্মের সেবা করতে।
হিন্দুধর্মটা কী বস্তু বলো তো? দীনদুঃখীর সেবায় বুঝি হিন্দুধর্মের ব্যাঘাত ঘটে? দরিদ্রনারায়ণটা কে তবে?
সুষি, আজকাল তুমি বড্ড আমার মুখে মুখে কথা বলতে শিখেছ!
তা শিখেছি! ছাপ্পান্ন বছর বয়েস তো হল! তোমার মায়ের তো কোনো কথারই উত্তর দিয়ে উঠতে পারিনি। একটু থেমে, একটু হেসে বললেন, বলতে পারো, তোমারই ক্রেডিট এটা। আমার মুখের ভাষা তো তুমিই জুগিয়েছ।
প্রসেনজিৎ চুপ করে থেকে বললেন,-বিকেলে আজ কোথাও বেরুচ্ছ?
একটু সুরোর কাছে যেতে হবে।
আদিত্য থাকবে?
থাকতেও পারেন। যাবে তুমি? চলো না–দুজনে মিলে যাই।
আমি? ওরে বাবা! কোথায় পদ্মপুকুর-চক্রবেড়ে, আর কোথায় সেই সল্টলেক। নাঃ, তুমি যাও। আমি থাকি।
চক্ৰবেড়ে-সল্টলেকের প্রবলেমটা কী? যাব তো গাড়িতে। বাইপাস দিয়ে আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। চলো, বিকেল বিকেল চলে যাই। দুপুরে বরং তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো আজ।
এখন তো সবে সকালবেলা। নটা বাজেনি। বিকেলের কথা বিকেলে ভাবা যাবে।
কী মনে পড়তে সুষমা যেতে যেতে দাঁড়িয়ে যান।
অশোক তোমার সঙ্গে কথা বলেছে কি? ফোন করেছিল?
কোন অশোক?
ভৌমিক? ওদের নার্সিংহোমে ওরা বসতে বলেছিল হপ্তায় একদিন, সকাল হোক কিংবা বিকেলে। তোমার নামটা থাকলে ওদের নার্সিংহোমের মর্যাদা বাড়বে। যা রোজগার হবে সবই তোমার। জায়গার জন্য কিছু চার্জ করবে না। ভেবে দেখতে পারো। হপ্তায় তো মাত্র একটাই দিন। বেড়িয়ে আসবে একটু। এ তোমার নিজের বাড়িতে প্রাত্যহিক দুবেলা চেম্বার করা নয়। এতে স্ট্রেস অনেক কম।
অশোক-গৌরী দুজনেই তো ডাক্তার। ওদের নার্সিংহোমের মধ্যে আবার আমাকে টানা কেন? আমি বাবা কিছুর মধ্যে ঢুকতে পারব না। নার্সিংহোমগুলো আজকাল যত করাশনের ডিপো, নানারকমের ইল্লিগাল কাজকর্ম হয় সেখানে, কিসের সঙ্গে কখন জড়িয়ে পড়ব, কে জানে? না বাবা, ওতে আমি নেই। হঠাৎ কী ভেবে, আমাকে জড়াতে চাইছে? ওদের উদ্দেশ্যটা কী?
কিছুই না। ওরা তোমারই ছাত্রছাত্রী, তোমার সম্মান করে, তোমার সুনামটা যদি ওদের একটু কাজে লাগে। হপ্তায় একদিনেই তোমার রোজগার কিন্তু খুব কম হবে না, ঘরের খরচ নেই, রুগি পাবেই। বসলে ভালোও লাগবে। লোকজনের মুখ দেখবে, কাজকর্মে মনটাও ব্যস্ত থাকবে–এ্যাকটিসটা চালু থাকা সর্বদাই ভালো–
আমাকে ঘর থেকে টেনে বের করে দিতে পারলেই তুমি বাঁচো না? কেন? আমি কি তোমার চক্ষুশূল হয়েছি?
.
পঞ্চম অধ্যায়। সামুদ্রিক শাস্ত্র
মানুষ কী ভাবে, আর কী হয়। কোন বিষয়টা ঠিক? শুধু তো রূপ দেখেই নয়।
বাবা অনেক কিছুই মিলিয়েছিলেন। জন্ম পত্রিকা তো বটেই। বিবাহে প্রধানত দেখতে হবে পাঁচটা জিনিস। ঘরে বউ আনতে হলে জানতে হবে, তার অকালবৈধব্য আছে কিনা, অকালমৃত্যু আছে কিনা, দারিদ্রদোষ আছে কিনা, চরিত্রদোষ আছে কিনা, অনপত্যদোষ আছে কিনা। এই পাঁচটার যে কোনো একটা যদি থাকে, তাহলে সে সম্বন্ধ খারিজ করে দিতে হবে।
আমাদের ক্ষেত্রে বাবা নিজে আমাদের কোষ্ঠী বিচার করিয়েছিলেন। রাজযোটক মিল। পরম সুলক্ষণা বউ। শুধু কোষ্ঠী মিলিয়েই হয়নি বাবার। একটামাত্র ছেলে, তার বউ বলে কথা। আবার সামুদ্রিক জ্যোতিষ মতে বধূর লক্ষণগুলো মিলিয়েছিলেন–যা যা মেলানো সম্ভব। সব তো মেলানো সম্ভব নয়? যে নারীর বাহু রেখাযুক্ত, অধরোষ্ঠ সরলরেখা, মুখে তিলচিহ্ন আছে, তার বৈধব্যযোগ। কপালটি যার প্রলম্বিত, সে হবে শ্বশুরঘাতিনী। উদর প্রলম্বিত হলে দেবরঘাতিনী। অবশ্য বাবার পুত্রবধূর ক্ষেত্রে শেষোক্ত আশঙ্কা অমূলক, যেহেতু তার দেবরই নেই। কিন্তু বাবা সুষমার হাত ধরে আঙুলগুলি নেড়েচেড়ে দেখেছিলেন–আদর করতে নয়, হাতের আঙুলের মধ্যে ফাঁক থাকা দুর্লক্ষণ। চামড়া কর্কশ হওয়া, নাকের ডগায় তিল থাকা এসবই দুর্লক্ষণ। যে নারীর বাঁ-কপালে, বাঁ-হাতে, বাঁকানে, বাঁ-গলায়, বা-ঠোঁটের বাঁ-দিকে তিলচিহ্ন আছে সে নারী অতীব সৌভাগ্যবতী। বিশেষ করে বাঁ-কানে কি বাঁ-কপালে, বা গলার বাঁ-দিকে তিলচিহ্ন থাকলে তার প্রথম গর্ভে পুত্রসন্তান আসেই। এই সব চিহ্নগুলি মিলিয়ে বাবা দেখেছিলেন সুষমার আঙুলের মধ্যে ফাঁক নেই। ঠোঁটের বাঁ-দিকে তিল আছে, গলার বাঁ-দিকেও তিল আছে। সর্বসুলক্ষণা বধূ। সৌভাগ্যবতী পুত্রবতী হবে। একে সুন্দরী তায় সর্ব সুলক্ষণা, বাবা তো মত দিয়েই এলেন। সুষমাকে আমি প্রথম দেখলাম শুভদৃষ্টিতে। মা দেখলেন একেবারে বউ বরণের সময়ে। আজকাল এসব মানা হয় না বটে, কিন্তু আমাদের বংশে ঐতিহ্যের মূল্য খুব বেশি।
বাবা ছিলেন হিন্দু মহাসভার কর্মী। আমার পক্ষে সরকারি চাকরি করে এরকম রাজনৈতিক দলের কর্মী হওয়া মুশকিল। তাছাড়া আমি মুখচোরা মানুষজনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতেও পারি না। রাজনীতির মঞ্চ আমার নয়। অনিল যখন বলল, বউদিকে মেম্বার করে দিন না কেন। এক টাকার তো মামলা, আমার মনে হল চমৎকার! সুষমাকেই সদস্য করে দিলাম হিন্দু জাগরণী সংঘের। জোর করে পাঠালাম দু-একটা মিটিঙে। একটা মেয়েদের ইশকুলে আলোচনা সভাতে অংশও নিল সুষমা। তখনও কি বুঝেছি ওর মধ্যে নেতৃত্বের মালমশলা দেখতে পাবে পার্টি?
হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্যরা যতটা সংস্কৃত জানে তত ইংরিজি জানে না, সুষমা কনভেন্টে পড়া মেয়ে। রূপসী। অভিজাত আচরণ। ইংরিজিতে কিছু বলবার দরকার হলেই ওরা সুষমাকে ডাকতে লাগল। সেসব বক্তৃতা অবশ্য লিখে দিতে লাগলাম আমিও।–শাস্ত্র থেকে কোটেশান দিয়ে বক্তৃতা লেখা সুষমার সাধ্য নেই। তখনও ছিল না, এখনও নেই। কিন্তু এখন তো সুষমা সরে যেতে শুরু করেছে। হিন্দু শব্দটাকেই হেঁটে ফেলেছে তার কাজকর্ম। থেকে। এখন তার শাস্ত্রবাক্য লাগে না।
সুষমার যে ভেতরে ভেতরে এত উচ্চাশা ছিল, এত জেদ, তা কে জানত। হিন্দু জাগরণী সংঘের কাজকর্ম থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে সম্পূর্ণ ছড়িয়ে নিয়ে সুষমা কী সব নিজস্ব নারী সংগঠন তৈরি করে ফেলেছে, তারই কাজে হিল্লি-দিল্লিও করছে মন্দ নয়। আজ সোনিয়া গান্ধী তো কাল মানেকা গান্ধী। কিছু না কিছু লেগেই আছে। এই টি.ভি.-র খবরে সুষমা ভটচায্যি দেখা যাচ্ছে, এই খবরের কাগজে পড়ছি সুষমা ভটচা লেকচার দিচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনেও কী যেন হয়েছে সে, কাগজে পড়লাম। সে বলেনি!
অনিলের মুখে শুনলাম আর সুষমা হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্যই নেই মোটে। যেজন্য ওকে বাড়ি থেকে বের করলাম সে উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ করে দিয়েছে সুষমা। আমাকে কিছু বলেওনি। আসলে ওর কাজকর্মের বিষয়ে কিছু বলতে চায় না সুষি আজকাল। নিজের জন্যে ক্রমে ওর একটা আলাদা জগৎ, একটা আলাদা জীবন গড়ে তুলেছে। সেখানে আমার ঠাই নেই।
মা বেঁচে থাকলে এসব কিচ্ছুটি চলত না। মা চলে গিয়েই এই সংসারের সর্বনাশ হয়ে গেল। মা ছিলেন বংশের কল্যাণস্বরূপিনী স্বয়ং মা লক্ষ্মী। আজ মা থাকলে শুভও কি এরকম করতে পারত?
সুষমার দোষেই আমার অমন ছেলে বিগড়ে গেল। শুভ আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্যটা রাখলে না। আমাকে গ্রাহ্যই করলে না। পূত্রবধূ নির্বাচনে আমার কোনো ভূমিকাই ছিল না। আমার সঙ্গে তার তো যোগই ছিল না বিশেষ। সারাদিনই ইশকুল, টিউটোরিয়াল হোম, আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কাটাত। সুষমার তো সায় ছিলই, আমার মা-রও নাতির বেলায় অন্যরকম হাবভাব দেখলাম। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বাড়িতে আসছে, হইচই করছে, সুষমা সমানে তাদের জলখাবার বানিয়ে দিচ্ছে এসব আমার বেলাতে ছিল না। মার শরীর খারাপ হলে বাড়িতে কোনো গোলমালই চলত না। বাড়ি ফিরে ঠাকুর্দার কাছে বসতাম, শাস্ত্রপাঠে অবসর সময় কাটত। যতটুকু ইশকুলে-কলেজে কেটেছে, পড়াশুনোতেই কেটেছে। বাকি সময় বাড়িতে। মা-র কাছে। ঠাকুর্দার কাছে। বন্ধু-বান্ধব হয়নি। বন্ধুত্বের অভ্যাসও হয়নি।
এখনও আমার কোনো বন্ধু নেই। চাকরি থেকে যখন অবসর নিলাম, একটা ফেয়ারওয়েল পার্টি দেওয়া হয় সকলকে। আমার বেলায় সেটা কেবল নামমাত্র হয়েছিল। সেদিনকার মিটিঙে ছিল কেবল একমুঠো লোক, যারা যারা সেদিন মেডিক্যাল কলেজে এসেছিল, তারাও সকলে। ছিল না, আমি নজর করেছিলাম। সুষমাকে বলতেই সে অম্লানবদনে বলল, আসবে কেন, তারা তো কেউ তোমার বন্ধু নয়, কোলিগ মাত্র। তুমি তো একজনের সঙ্গেও বন্ধুত্ব পাতাওনি।
বন্ধুত্ব কেমন করে পাতায়? যতদিন মা ছিলেন, ব্যাপারটা আলাদা ছিল। মা-ই ছিলেন আমাদের বাড়ির দীপশিখা। মা-ই ছিলেন আমাদের জীবনযাত্রার সর্বময়ী কত্রী, কেন্দ্রস্বরূপা, মাকে ঘিরেই বেঁচে থাকতাম আমরা সকলে। ঠাকুর্দা, বাবা, আমি। ঠাকুমাকে দেখিনি। মা-ই ছিলেন সংসারের একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী। ঠাকুর্দা, বাবা দুজনেই মাকে কাবলি আঙুরের মতন তুলোর বাক্সে বসিয়ে রেখেছেন,–সারা জীবনই মায়ের স্বাস্থ্যের জন্য বাড়িতে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন হয়েছে। মা-র আয়ুষ্কাল কম, এই কোষ্ঠিবিচার ছিল বলে, আমার বাবা অতি সাবধানে, ভয়ে ভয়ে রাখতেন মাকে। আমিও তাই রেখেছি। মা-র যাতে মনে উত্তেজনা না হয়, মা-র যাতে মনে কষ্ট না হয়। মা-র যাতে শরীরে স্ট্রেন না হয়। সবসময় সেইদিকে নজর রাখতেন বাবা।
অথচ বাবা নিজেই চলে গেলেন আগেভাগে। তার যে এতটা প্রেশার ছিল, হার্টের অবস্থা এত খারাপ, বাবা আমাদের তো জানতেই দেননি। মা পাছে ভয় পান, সেটা ভেবেই বোধহয়। সেবার সুযোগটুকুও বাবা দিলেন না আমাদের। কদিনের মধ্যে সব শেষ।
তা ঈশ্বরের দয়ায় মা চুয়াত্তর বছর পর্যন্ত আমাদের মধ্যে ছিলেন। মা-র মহাপ্রয়াণের পরেই আমার অবসর গ্রহণের দিন এসে পড়ল। একটি ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই আরেকটি।
.
মায়ের ষোলো বছর বয়সে আমার জন্ম। বাবার আদরে মাকে সবসময় রঙিন শাড়িতে অলঙ্কারে সেজেগুজে থাকতে হত। আমার বিয়ে ঠিক হবার পর মা যখন বললেন এবার থেকে সাদা শাড়ি পরবেন, বাবা ঘোষণা করলেন, আমার চোখের সামনে নয়। বিধবা হবার পরে তুমি তোমার যা খুশি কোরো। বউমাকে আর শাশুড়িকে একই রকম কাপড়-গয়না এনে দিতেন বাবা। সুষমা পরমা সুন্দরী। কিন্তু সেই বয়সেও আমার মায়েরও ছিল মা দুর্গার মতো রূপ। লালপাড় হলুদ ডুরে জড়িয়ে শাশুড়ি-বউ পান সাজতে বসলে, ঠিক মনে হত, দুটি বোন।
সুষমা কনভেন্ট থেকে পাশ করে সবে আই. এ-তে ভর্তি হয়েছিল, তখন বিয়ে হয়ে কলকাতায় চলে এল। ওর বাবা যখন ওকে এখানে কলেজে ভর্তি করতে অনুমতি চাইলেন, মায়ের তাতে মত ছিল না। ঘরে বউকে পথে বের করলেই বিপদ। তায় এমন রূপের ডালি বউমা। কিন্তু সুষমা প্রত্যেক রাত্রে পড়তে চাইত। শেষকালে, আমিও ভাবলাম ও তো ঠিকই বলছে। স্ত্রীর শিক্ষিত হওয়ারই প্রয়োজন। হিন্দুধর্মের সেবায় শিক্ষিত নারীর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। বাবাকে বললাম, বাবাও অনুমতি দিয়ে দিলেন। কী ভেবে জানি না মা বাবার মতটা ফেরালেন না। কেননা, মা জোর করে না বললে, বাবাও ঠিক না বলতেন!
বাবাকে কখনো মায়ের কোনো অনিচ্ছাকে অসম্মান করতে আমি দেখিনি। এজন্য সুষমারও কোনো অনিচ্ছাকে আমি অবহেলা করতে পারি না। আমার বাবার কাছ থেকে এটাই আমার শিক্ষা যে পত্নীর ইচ্ছাকে, তার পছন্দ-অপছন্দকে সম্মান করতে হয়। ধর্মপত্নীকে আমরা বিবাহের সময়ে কথা দিই, নাতিচরিষ্যামি–তোমাকে অতিক্রম করে যাব না। সে যেমন আমার সংসারে ধ্রুব হবে, আমিও তেমনি তাকে কদাচ অতিক্রম করে যাব না এই প্রতিজ্ঞা আমি রক্ষা করে চলেছি। সুষমাও ধ্রুব হয়ে আছে। আমরা কেউ আমাদের বিবাহ মন্ত্রের শপথ অবজ্ঞা করিনি।
কিন্তু ইদানীং সুষমার আমার প্রতি সেই মনোযোগ নেই, যা আগে ছিল। আমার মাকে, আমার বাবাকে যেভাবে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে সেবা-শুশ্রূষা করেছে, মাঝে মাঝে বৃদ্ধ বয়সের দোষে, মা হয়তো একটুখানি অবুঝপনাও করে ফেলেছেন, তাতেও হাসিমুখে প্রশ্রয় দিয়েছে সুষমা। আমার বেলাতে কিন্তু তার সেই সেবাময়ী রূপটি আমি দেখতে পাচ্ছি না। তখন সুষমা ছিল পুরোপুরি ঘরণী। ঘরকন্নার বাইরে কিছু জানত না।
মায়ের মৃত্যুর পরে ওকে যেই হিন্দু জাগরণী সংঘে ভর্তি করে দিলাম, সেই হল আমার কাল। মায়ের মৃত্যুর পরে এ সংসারে দুটো বদল হল। সুষমা বাইরে বেরিয়ে পড়ল। আর আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম। আর তৃতীয় বদলটি আরও জরুরি–সেটা অবশ্য তক্ষুনি হয়নি, আরও পরে শুভ বিয়ে করল। বিয়ে করে ম্লেচ্ছ দেশে চলে গেল। মা বেঁচে থাকলে এসব কখনো হতে দিতেন না।
সুষমাও ঘরে থাকত। শুভও। চিররুগ্না, শয্যাশায়ী মা-র সেই প্রবল ব্যক্তিত্বের জোর ছিল। আমারই বুদ্ধির ভুলে, আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সুষমা বাইরের জীবনে মিশে গেল। আর সুষমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শুভ বাইরের বিশ্বে হারিয়ে গেল।
আর আমি এলুম ঘরে। এই শরীরে কোথায় যাব? থাকবই বা আর কটা দিন? ঠাকুরঘরে সময় কাটাই। নইলে টিভি দেখি। আজকাল বই-টই পড়তে তত ভালো লাগে না। কথামৃত ছাড়া। কী পড়ব? পড়ার মতন আছেটা কী?
রোববার রোববার তাস খেলি। সুষমাই কোথা থেকে তিনজন খেলুড়ে জোগাড় করেছে, তারা দারুণ ব্রিজ খেলে। ওদের ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে নিয়ে আসে সুষমা, সারাদিন রাখে, এক পেট খাওয়ায়। আবার পৌঁছে দেবার খরচ দেয়। এবং আমার সন্দেহ ওদের একটা কিছু দক্ষিণাও দেয় আমার সঙ্গে খেলতে আসার জন্যে। এই তিনজন মানুষের সঙ্গে এমনিতে আমার কথা কওয়া উচিত নয়, কথা বলবার মতো প্রসঙ্গ কিছু নেই। বিদ্যায় আভিজাত্যে তারা একটু নিচু শ্রেণীর। কিন্তু হিন্দু জাগরণী সংঘের সদস্য ওরা, একজনের কাপড়ের দোকান আছে, একজন মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ, আর একজন রিটায়ার্ড। পোস্টমাস্টার ছিল কোনো ছোট পোস্টাপিসের। তবে, হ্যাঁ! দারুণ ব্রিজ খেলে তিনজনই–কোথা থেকে যে সুষমা পাকড়াও করল এদের! পারেও বটে সুষি!
সপ্তাহে এই একদিন আমার কিঞ্চিৎ বাধ্যকরী সামাজিকতার অভ্যেস হয়। বাকি সবটা সময় একলা। সুষি আর আমি।
.
ষষ্ঠ অধ্যায়। জননী জন্মভূমিশ্চ
কী যে অবুঝ হয়েছেন ছেলেমানুষের মতো, কিছুতেই বুঝবেন না। ছোট বাচ্চা যেমন মাকে আঁকড়ায়, তেমনি করে আঁকড়াবেন আমাকে। তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারি না! তোমাকে না দেখতে পেলে শরীর খারাপ হয়ে যায়! তুমি কাছে থাকলেই আমি সুস্থ বোধ করি। এগুলো ব্ল্যাকমেইলিংয়ের টেকনিক সেটাও কী বোঝেন না? নিজে এত বড় চিকিৎসক, মনের অসুখ চিনতে পারছেন না?
অবশ্য কোনোদিনই চিনতে পারেননি। নিজের মায়েরও মনের অসুখ ছিল। সারাটা জীবন মা রুগ্ন হয়ে সারা পরিবারের পরিপূর্ণ মনোযোগ টেনে নিয়ে ভি. আই. পি. হয়ে রইলেন। বিয়ে হয়ে এসে দেখলাম পরমা সুন্দরী শাশুড়ি। নতুন বউয়ের মতোই সাজগোজ করে,শাড়ি গয়নায় মোড়া হয়ে, বধূবরণ করলেন। তা বধূবরণে বিয়ের বেনারসি পরার নিয়ম আছে, কিন্তু শাশুড়ির সাজগোজটা ওই এক বিকেলের জন্যে নয়। প্রত্যহই তিনি আমার সঙ্গে মিলিয়ে ঠিক দুই জায়ের মতন সাজতে লাগলেন। আমার ননদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সেও এল একইরকম সেজেগুজে। আমি নতুন বউ বলে আমার কোনো বৈশিষ্ট্যই ছিল না। বিয়েবাড়ির হুল্লোড়ের মধ্যেই তিনি পালঙ্কে হঠাৎ শুয়ে পড়লেন। আর বাড়িসুদ্ধ জ্ঞাতিকুটুম্বের মাঝখানে শ্বশুরমশাই গিয়ে তার হাত ধরে মুখের কাছে মুখ নিয়ে লীলাবতী! লীলাবতী! করতে লাগলেন। ছেলেও দৌড়ে গিয়ে মা-র পায়ে হাত বোলাতে লাগলেন, মা! মা! করে অস্থির হয়ে। ননদ পাখা নিয়ে বাতাস করতে লাগলেন। আমি বুঝতেই পারছি না কী করব। একপাশে চোর হয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি। শেষে স্বামীই লুকিয়ে ইঙ্গিত করলেন মা-র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। সেই শুরু।
সমানেই তিনি মা এবং বউয়ের মধ্যে সেতু-বন্ধনের চেষ্টা করে চলেছেন। এ বাড়িতে তিনিই আমার বন্ধু, আমার শুভার্থী, আমার নিজের লোক। তারই চেষ্টায় আমার কলেজে ভর্তি হওয়া। ইন্টারমিডিয়েট, বি. এ., সবই তার চেষ্টায়। শ্বশুর-শাশুড়ি দুজনেরই অমত ছিল। উনিই পৌঁছে দিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম শ্বশুর আনতে যেতেন। এইভাবে চার বছর অবশ্য চলেনি। আমার স্বামী মাইনে এনে পুরোটা মায়ের হাতে তুলে দিতেন। মা ওঁকে হাতখরচ দিতেন দৈনিক হিসেবে। বিয়ের পরেও তাই। হাতখরচ বাড়াননি। আমাকে কিছু কিনে দেবার ইচ্ছে হলে মা-র কাছ থেকে টাকা চাইতে হত ওঁকে। কৈফিয়ৎ দিতে হত কেন টাকা চাই। দুজনে সিনেমা যেতে হলে মা-র কাছে টাকা নিয়ে, বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে তবে যেতে হত। প্রথম প্রথম নিয়ে এলেও, শ্বশুর আর কলেজ থেকে আমাকে আনতে গেলেন না। শাশুড়ি তখন আমাকে তিনদিনে এক টাকা করে দিতেন। বাসে করে বাড়ি ফেরবার ভাড়া। বৃষ্টি পড়লে, কী শরীর খারাপ করলে একদিন রিকশা নেবার উপায় ছিল না। খিদে পেলে কিছু কিনে খাবার টাকা ছিল না। স্বামীকে বললেও উনি নিরুপায়। ওঁর হাতে টাকা নেই। অথচ তখন ইনি মেডিক্যাল কলেজে চাকরি করছেন। বাড়িতে দুটো গাড়ি। একটি উনি নিয়ে যেতেন। একটা থাকত। কিন্তু আমার জন্য যেত না।
সকালবেলা শাশুড়ি আমাকে রুটি-গুড় দিতেন সব কাজের লোকদের সঙ্গে। বাসিরুটি খেতে পারতাম না, ফেলে দিয়েছিলাম। উনি রান্নাঘরের ময়লা ফেলার ঝুড়িতে সেটা আবিষ্কার করে এত রেগে গেলেন, যে তারপর থেকে আমি ব্লাউজে ভরে নিয়ে গিয়ে বাইরে ফেলে দিতাম। কিন্তু স্বামীকে বলতে পারিনি। মা-র প্রতি ওঁর মুগ্ধ ভক্তি দেখে বলতে সাহস হয়নি। মনে হয়েছিল উনি বিশ্বাস করবেন না। আমার ওপরেই বিরক্ত হবেন। ভগবানের দয়ায় আমি বি.এ. পাশ করবার আগে বাচ্চা চাননি উনিই। আমার বয়েসও অল্প ছিল। ওঁর এম.ডি শেষ হয়নি। শাশুড়ি প্রবল অশান্তি শুরু করলেন, বাঁজা বউ। ঠিক এখন লোপাকে নিয়ে ইনি যেমন করছেন। সব ভুলে গেছেন নিজের মায়ের কীর্তির কথা। মা বলতেন, আমার মেয়ের দুই ছেলে হচ্ছে দুই বাহু–তোমাদের মতন হাত-পা কাটা নয় সে, আমার বাঁজা বউ নিয়ে ঘর করার দুর্ভাগ্য ছিল। কিন্তু যখন অন্তঃসত্ত্বা হলাম, শাশুড়ি তখন অনবরত ঠেশ দিতে লাগলেন, হবে তো মেয়ে। মায়ের যেমন যমজ মেয়ে হয়েছিল, তোমারও যমজ মেয়েই হবে দেখো! শ্বশুরমশাই অবশ্য মৃদু আপত্তি করতে থাকলেন, না লীলা, বাঁ কপালে তিল আছে, গলার বাঁ দিকেও তিল আছে, বউমার নির্ঘাৎ প্রথম সন্তান পুত্র হবেই। তুমি দেখে নিও। বাবা আমাকে নিতে এলেন যখন, আমার শ্বশুর তাঁকে বললেন, আপনাদের বাড়িতে স্ত্রীলোক নেই, বউমার যত্ন হবে না, ও বরং এখানেই থাকুক। বাবা বললেন, আমিই তো ওদের শিশু থেকে মানুষ করেছি, আমি স্ত্রীলোকের বাড়া। এই তো প্রথমবার, ওর মনের আরাম হবে হয়তো আমার কাছে থাকলে। ওর বোনও চলে আসবে সেই সময়ে। আপনারা ওর জন্যে ভাবনা করবেন না– বলতে না বলতেই হঠাৎ আমার শাশুড়ি বলে বসলেন, নিয়ে যান, নিয়ে যান, আমাদের কোনোও ভাবনা নেই আপনার মেয়েকে নিয়ে। হবে তো। মায়ের মতনই যমজ মেয়ে,-ও থাকল কি গেল, আমাদের এসে যাবে না– এমন নির্মম বাক্য শুনে আমার শ্বশুরও থ হয়ে গেলেন। কিন্তু কিছুই স্ত্রীকে বলতে পারলেন না। বাবা আমাকে নিয়ে চলে গেলেন। স্বামীকে কখনও বলতে পারিনি, মা-র কথাগুলি। স্বামী তো সেখানে ছিলেন না। তিনি শোনেননি। বিশ্বাস করতেন কি? চার মাস পরে শুভ জন্মাল আরও চারমাস পরে উনি গেলেন আমাদের কলকাতায় নিয়ে আসতে।
কিন্তু গাড়ি ভবানীপুরের বাড়িতে গেল না। আমরা গেলাম বালিগঞ্জে, লেক রোডের ভাড়া বাড়িতে। অচেনা জায়গায়।
কী ব্যাপার।
অনেক কিছু।
আমার ননদ তার বাচ্চা দুটিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে এসে রয়েছেন ছমাস হল। স্বামী ও শাশুড়ির নামে এফ.আই.আর করে এসেছেন, আসার আগে। তাঁরা নাকি আলমারি খুলে, ওঁর নিজস্ব স্ত্রীধন, ওঁর দশ লক্ষ টাকার গয়নাগাঁটি চুরি করেছিলেন, নিজেদের সম্পত্তি বন্ধক থেকে ছাড়াবেন বলে। থানা থেকেই সোজা বাপের বাড়ি। তারপর মায়ের অপূর্ব সেবা। মাকে তো পালঙ্ক থেকে উঠতেই দিচ্ছেন না। বাচ্চারাও দিদিমার মন ভুলিয়ে ফেলেছে–খুবই মিষ্টি তারা। শাশুড়ি ছেলেকে ডেকে জানিয়েছেন, তিনি মনস্থির করেছেন, তাঁর যা কিছু নিজস্ব সম্পত্তি সব দুই দৌহিত্রকে দেবেন। বসত বাড়ির আধখানাও তার মেয়েকে লিখে দেবেন, কেননা তাদের এখন কোনো বসতবাটি নেই।
শুনে উনি মাকে বললেন, কিন্তু আমারও তো এখন ছেলে হয়েছে, তার ঠাকুমার স্ত্রীধনের জিনিস তাকেও কিছু দিও; আর আমি যে গত দশ বছর ধরে তোমাকে পুরো মাইনেটা দিয়ে দিচ্ছি এখন এ বাড়িতে আমার অধিকার হয়তো বোনের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি, সমান সমান নয়। তাছাড়া বোনের বিয়ের সময়ে তোমাদের দেড় লাখ টাকা খরচা হয়েছিল। তখনকার দিনে অনেক টাকা সেটা। আমার বিয়েতে শ্বশুরবাড়ি থেকেই দুলাখ খরচ করেছিল, তোমাদের কিছুই খরচা হয়নি। আমার বউয়েরও তাই একটু অধিকার বেশি তোমার বাড়িতে।
বিতর্কে মা খেপে উঠলেন, যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। যাও তোমার শ্বশুরের দেয়া সবকিছু যৌতুক সঙ্গে নিয়ে অন্যত্র উঠে যাও। এ বাড়ি আমার। আমি যাকে খুশি তাকে দেব। জানি না, নিজের জীবৎকালে কেন যে তার স্ত্রীর নামে পৈত্রিক বাড়িটা লিখে দিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। আমার স্বামী তারপরই জিনিসপত্তর নিয়ে আর মণির মাকে নিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার ভিটে ছেড়ে লেক রোডে উঠে এসেছেন। ও বাড়িতে যান না। শ্বশুরমশাই নিজেই এটা-ওটা হাতে করে ছেলেকে দেখতে মাঝে মাঝে চলে আসেন। আমার শাশুড়ি-ননদের সঙ্গে স্বামী মুখ দেখাদেখি নেই। পৌত্র তো এল। শ্বশুর এসে আকবরী মোহর দিয়ে নাতির মুখ দেখে গেলেন। শাশুড়ি কিন্তু এলেন না। শেষে উনি আমাকে বললেন, যা হয়েছে হয়েছে। চলো, আমরা এবার একদিন মাকে ছেলে দেখিয়ে আনি। গেলাম শুভকে নিয়ে। মিষ্টি নিয়ে। শাড়ি-ধুতি নিয়ে। মা-বাবার জন্য প্রণামী। শাশুড়ি শুভকে আদর করলেন, কোলে নিলেন। নিজের গলার হারটি পরিয়ে দিয়ে নামিকে যথারীতি আশীর্বাদও করলেন। কিন্তু আমার সঙ্গে একটিও কথা কইলেন না। ছেলের সঙ্গেও না। চোখ বুজে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন একটু পরেই। যেন বড় ক্লান্ত। উনি খুবই লজ্জিত মায়ের আচরণে। কিন্তু করবেনই বা কী? এহেন আচরণের তো কোনো জবাব নেই। সেই থেকে আমরা আর যাই না ভবানীপুরে।
হঠাৎ খবর এল শ্বশুরমশাইয়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। নার্সিং হোমে ভর্তি হয়েছেন। শ্বশুরের কোমার খবর পেয়েই আমরা আবার ছুটে গেছি। পাঁচ দিন অজ্ঞান। তারপর সব শেষ। শাশুড়ির তখন তার ছেলেকে খুব দরকার। বাড়িতে ওঁরা দুটি স্ত্রীলোক একা, দুটি নাবালক শিশুসমেত। আমরা আবার যাতায়াত করতে লাগলাম। শ্বশুরের শ্রাদ্ধের পর শাশুড়ি বললেন বাড়িতে ফিরে আসতে। ননদ নিজেও বলল, ফিরে এস বউদি। যা হয়েছে হয়েছে দাদার সঙ্গে। তোমার সঙ্গে তো হয়নি?
ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এলাম। শ্বশুরের মৃত্যুর পর থেকেই শাশুড়ির রূপ। আরেক ধাপ বদলাল। আরও শুয়ে পড়লেন। আরও মিছে কথা বলা শুরু করলেন। ভঙ্গি আরও অসহায় হল আর আমার প্রতি একটা নতুন শত্রুতা দেখা দিল। আস্তে আস্তে আমার স্বামীর ওপরেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করল।
.
ডায়াবেটিসের রুগি, তাকে মিষ্টি খেতে দিই না, চায়েও চিনি দেওয়া বারণ। মা তো জোর করে চিনি নিয়ে নেন। বাধা দেবে কে? না ননদ না আমি পেরে উঠি তার সঙ্গে। ইতিমধ্যে ননদের শাশুড়ির মৃত্যু হল, নন্দাই এসে স্ত্রী-পুত্রদের নিয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ির হাওয়া বদলে গেল, অনেক ফুরফুরে হল। মেয়ে নেই, এখন শাশুড়ি জোর করে বাইরে বেরিয়ে রোজ বিকেলে সামনের ভীমনাগের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে খাবেন। হাতে টাকা আছে, হাত-পা চালু আছে, যাবেন না কেন। বারণ করি, শোনেন না। একদিন মা সেজেগুজে দোরগোড়ায় গেছেন, মিষ্টির দোকানে যাবেন বলে, হঠাৎ আমার স্বামী ফিরলেন।
এ কি মা, তুমি রাস্তায়? কোথায় যাচ্ছ?
এই তো বাবা, এই একটু পানের দোকানে যাচ্ছি। ঘরে পান নেই। বউমা তো দুটো পানও সেজে দেয়না, বুড়ো বয়সের নেশা তো? মরণও হয়েছে আমার, নেশা করে মরেছি!–উনি তাড়াতাড়ি মাকে ওপরে নিয়ে এলেন। পান কেন সেজে দিইনি বলে চেঁচালেন। আমি তো অবাক, বললাম, কেন? একডিবে পান মা-র এই তো সাজা রয়েছে? পান দেখে উনি থমকে গেলেন। মাকে কী যে বলবেন, ভেবে পেলেন না। চুপ করে গেলেন।
আরেকদিন, ওঁর আসার সময় হয়ে গেছে, মা আমাকে বললেন, বউমা, ছেলের ফেরার সময় হল, যাও ওপরে গিয়ে, গা ধুয়ে কাপড় পরে, চুল বেঁধে রেডি হয়ে থাকো। ছেলে অফিস থেকে ফিরে এমন হতক্লান্ত বউ দেখুক আমি চাই না। বেশ সুন্দর, ফিটফাট হয়ে থাকো দিকি? শাশুড়ির নির্দেশে আমি তো আহ্লাদে আটখানা হয়ে গা ধুতে ওপরে গেছি–এমন সময় উনি ফিরলেন। আমি তখনও বাথরুমে। মা হঠাৎ শুয়ে পড়েছেন ইতিমধ্যে।
এ কি মা, তুমি একা একা? সুষি কই?
বউমা তো ওপরে। ও তো খেয়েই ওপরে শুতে চলে যায় বাবা! বউমার কি আমার কাছে বসে থাকার সময় আছে? ঘুম থেকে উঠে তো ওর কত কাজ। এখন সাজগোজই করবে কতক্ষণ ধরে। আমি তো সারাদিন একাই পড়ে থাকি। শুনে উনি তো ক্ষিপ্ত। ধুপধাপ ওপরে এলেন। আমি সদ্য স্নান সেরে বেরিয়েছি। বকুনি শুরু হয়ে গেল।রুগ্ন মাকে একা ফেলে রেখে সাজগোজ করছ দিনরাত কার জন্য? লজ্জা করে না সুষি? সারাদিন নীচের ঘরে একা অসুস্থ মানুষটা পড়ে রয়েছেন, আর তুমি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ?
আমি তো ঘরে বোমা পড়ার মতন জব্দ। এ কী? হঠাৎ মণির মা কোথা থেকে এসে খরখর করে বলতে শুরু করল, এই তো সারাদিন বউমা নিচে ছিল। ভাগবত পড়ে শোনাচ্ছেল আমাদেরকে–এক্ষুনি মা বললে, যাও বউমা আমার ছেলে আসবে, সারদিন খেটেখুটে, তুমি একটু পোস্কের-পোচ্ছন্ন হয়ে, গা ধুয়ে, চুল বেঁধে থাকো–তাই তো বউ ওপরে এয়েছে, আর দাদাবাবু এসেই বকতে শুরু করে দিয়েছ? শুনে উনি চুপ করে গেলেন।
সেই পান সাজার দিনের কথাটাও ওঁকে তখন বললাম যে, তখন আসলে মিষ্টি কিনতে যাচ্ছিলেন। রোজই যান। বললে শোনেন না। তারপর যখন সুগার বাড়ে, তখন দিব্যি বলেন, কী জানি কী যে খেতে দেয়? বউমা যা দেয় তাই-ই তো খাই! মা যান কিনা, ভীম নাগের দোকানে গিয়ে জিগ্যেস করলেই জানতে পারবে। উনি আমাকে বিশ্বাস করলেও, পুরোপুরি করেননি। মিষ্টির দোকানেও জিগ্যেস করেছিলেন। তবুও আচরণে দোষ না ধরে বললেন, আহা বেচারি! সারা জীবন বঞ্চিত হয়ে অমন একটু-আধটু ছেলেমানুষি করেই ফেলে মানুষ!
এরকম যে কতবার।
একবার উনি মা-র কাছে বই রাখবার জন্যে একটা আলমারি চাইলেন ওঁর পড়ার ঘরে। শাশুড়ি আমাকে বললেন, এই কাঠের আলমারিটা খোকার জন্যে নিয়ে যেও। সেটা
আমারই বিয়েতে বাবার দেয়া জোড়া আলমারির একটা। এটা থাকত শ্বশুরের ঘরে। আরেকটা আমাদের ঘরে। তখন বাড়িতে মিস্ত্রি লেগেছে, মজুররা খাটছে, আমি মজুরদের আলমারিটা ওঁর পড়ার ঘরে দিয়ে আসতে বলেছি। ওপরে তোলা হবে, আলমারিটা খালি করছি, ভেতরে তেমন কিছু ছিলও না। শাশুড়ি হঠাৎ চেঁচাতে লাগলেন, বউ এত নিজের জিনিস চিনেছে, যে উনি স্বর্গে যাওয়া মাত্র শ্বশুরের জিনিসপত্তর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাপের দেওয়া আলমারিটি নিজের ঘরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে– আমি স্তম্ভিত। চোখ ফেটে জল এসে গেল। এমন সময়ে উনি এসে হাজির। মা-র চেঁচামেচি তখনও চলেছে। তুমুল কাণ্ড। আমাকে কিছু বলতেই হল না।
উনি অবাক!–সে কি মা? তুমি তো নিজেই আমাকে বললে, আমার পড়ার ঘরে এই আলমারিটা তুলে দেবার কথা!
কিন্তু লজ্জা পাবার মানুষই নন মা।–বলেছিলাম। কিন্তু তোমার বাবার জামা-কাপড়গুলো কি ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে বলেছিলাম? যিনি চলে গেছেন তাঁর স্মৃতির প্রতি কি কোনো সম্মানই নেই বাকি আর?
জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে খাটে রাখা। নীচে ট্রাঙ্ক খোলা। ভরা হবে তাতে। উনি দেখলেন। কিন্তু বললেন না। সরে এলেন।
বারবার আমার ওপরে মা-র অদ্ভুত অত্যাচারের উনি সাক্ষী হয়েও, চোখ বুজে থেকেছেন। অসুস্থ অবস্থায় নার্স, আয়াদের বসিয়ে রেখে, মা আমাকে দিয়ে তার পায়খানা পরিষ্কার করাবেন। পেচ্ছাপ হয়ে যাওয়া চাদর কাঁচাবেন। উনি শুনে ধন্য ধন্য করে বলবেন, আহা, মা কেবল সুষমার হাতের সেবাটুকুই গ্রহণ করে তৃপ্তি পান। সুষি, তোমার অপার পুণ্যি হচ্ছে!
এমনি করে করে সুষির অনেক পুণ্যার্জন করা হয়ে গেছে এ জীবনে, এত পুণ্য আর আমার সহ্য হচ্ছে না–এবার একটু-আধটু পাপ করা খুব দরকার হয়ে পড়েছে। মন্দ কপাল আমার, ভাগে সেইটেই পড়ে গেল। শাশুড়িসেবায় সব এনার্জি শেষ, এখন পতিসেবাতে তাই ঘাটতি পড়ে যাচ্ছে।
কি অদ্ভুত মানুষ! এই যে শিলুকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না, ছমাসের ওপর ছেলেটা নিরুদ্দেশ, তা নিয়ে ওঁর বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই, মনোকষ্ট নেই। কেবল ওই একই কথা মুখে–
-বুড়ো বাপ-মায়ের দায়িত্ব নেবে না, তাই ভেগে পড়েছে। কিসসু হয়নি, দেখবে আমেরিকায় গিয়ে বসে আছে।
মায়া-দয়াও কি নেই? চিন্তা-ভাবনা তো নেই-ই। বাপ-মায়ের দায়িত্ব নেবার জন্যে শ্রাবস্তীর মতন একটা মেয়ে রয়েছে, সেটাও খেয়াল নেই। সুরো শক্ত হয়ে আছে, জামাইবাবু এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু আমি তো বুঝতে পারছি ওদের ভেতরে কী হচ্ছে? উনি কেন বুঝবেন না?
দৃষ্টিটা আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে এমনই সংকীর্ণ হয়েছে যে নিজের বাইরে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, শিলুকে কেন, শুভকেই কি দেখতে পাচ্ছেন? নিজেকে বাদ দিয়ে নিজের সন্তানের কথাও ভাবতে পারছেন না আজকাল। আশ্চর্য অন্ধতা! কী সন্তান-স্নেহই যে এঁকে শেখালেন এঁর মা-জননী!