১. খাতাটা পড়ে শেষ

এইমাত্র খাতাটা পড়ে শেষ করলাম। এটাকে একটা পাণ্ডুলিপি বলা যায় না। কারণ দোকানে কিনতে পাওয়া সাধারণ খাতা যে রকম পাওয়া যায়, সে রকম একটি খাতায় উদ্দেশ্যহীন ভাবে, কিছু কথা লেখা আছে। কোনও গল্প বা উপন্যাস না, একজন তার জীবন সম্পর্কে, যখন যে রকম সময় পেয়েছে বা মনের যখন যে রকম অবস্থায়, কিছু কিছু কথা লিখে রেখেছে। পড়লেই বোঝা যায়, অনেকেই যেমন আত্মজীবনী লেখার তাড়নায়(?) কাগজ কলম গুছিয়ে, বেশ কোমর বেঁধে শুরু করে, ভাবখানা তেমনই যে, একটি বৃহৎ কাণ্ডকারখানা না ঘটিয়ে ছাড়বে না। অর্থাৎ, নিজের জীবন সম্পর্কে সে এমনিই আত্মতুষ্ট গৌরবান্বিত বা নিজের অভিজ্ঞতায় সে এমনিই বিস্মিত আবিষ্ট, অপরকে আর না জানিয়ে পারছে না। সেইজন্যই, এ ক্ষেত্রে ‘তাড়না’ শব্দটি আমি ব্যবহার করছি।

আমাদের এই বর্তমান সময়েও, অনেক নাম করা পত্র-পত্রিকার পাতা খুললে, প্রায়ই অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, এমনকী মহিলাদেরও আত্মজীবনী-বিষয়ক নিবন্ধ, ঘটনাবলী ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। সেইসব লেখার মধ্যে না আছে জীবনের কোনও প্রকৃত রং বা রস, না আছে বর্তমান যুগের মানুষকে কোনও প্রকার কৌতূহলিত বা উৎসাহিত করার বিষয়বস্তু। অধিকাংশের রচনার রীতি ও ভঙ্গি, একশো বছরের পুরনো বস্তাপচা, জীবনের বিষয়ও তেমনই বিবর্ণ।

মুশকিল হল এই, এইসব ব্যক্তি বা মহিলারা, তাদের নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতাকে নিজেরাই অনেক বড় করে দেখেছে। এবং অধিকাংশ অনভিজ্ঞ সম্পাদকেরা সেগুলো ফলাও করে ছাপাচ্ছে, তার একমাত্র কারণ, সম্পাদকদের ধারণা, এতে তার পত্রিকার মর্যাদা বাড়ছে। কারণ, এ সব আত্মকাহিনী যারা লেখে, প্রথমত তারা কোনও এক যুগে হয়তো কয়েকটি দুঃসাহসিক কাজ করেছে অথবা বিশেষ। কোনও পরিবারে, যে ভাবেই হোক, যোগাযোগ ছিল। সে পরিবার কোনও এক যুগে বাংলা দেশে বিশিষ্টতা লাভ করেছিল। এবংবিধ বহু কারণেই, এইসব আত্মজীবনীগুলো লেখা হয়ে থাকে।

সব থেকে যা লজ্জার বিষয়, এবং ধিক্কারেরও, এইসব আত্মজীবনীগুলোতে, আসল ব্যক্তিটিকে কখনও ফুটিয়ে তুলতে পারে না। কারণ নিজের বিষয়ে সাতকাহন প্রশংসামূলক ঘটনা ও কাহিনী, মিথ্যাশ্রয়ী কিছু গল্প এদের সম্বল। নিজের অন্যান্য বিষয়ের ঘটনা সযত্নে গোপন করাই এদের বৈশিষ্ট্য। শুধু এদেরই বা বলি কেন, এটা আমাদের দেশের বৈশিষ্ট্য। আমরা যাদেরই আত্মজীবনী পাঠ করি, তারা অধিকাংশ ব্যক্তিই মহৎ, অকুতোভয়, নির্ভীক, উদার, মিষ্টস্বভাব, পরোপকারী, যাকে বলে একেবারে সর্বগুণান্বিত। এদের জীবনটা আলোয় আলো, কোথাও এক ফোঁটা অন্ধকার নেই, পাপ নেই। এ লোকগুলো নিজেরা বোঝে না, বোঝানোও হয়নি। যে রিয়ালাইজেশন থেকে, মানুষ আত্মজীবনী লেখবার প্রেরণা বোধ করে, এগুলোর কোনওটারই সে মূল্য নেই। এগুলো এক ধরনের পুরনো ফ্যাশান। জীবনের আলো অন্ধকারের যে গভীর সংগ্রাম, এগুলোর মধ্যে তার কোনও চিহ্নই নেই।

আমাদের দেশেই, মিথ্যাবাদীদের বিদ্রূপ করে বলা হয়, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। কিন্তু এইসব আত্মজীবনীকার বা এমনি জীবনীকারেরাও জানে না, যুধিষ্ঠিরের সত্যবাদিতার মূল কোথায় নিহিত ছিল। ‘সত্য বৈ মিথ্যা বলিবে না’ পাঠ গ্রহণ করে, এ দেশের ব্যক্তিরা যে পরিমাণ মিথ্যে কথা বলে থাকে, পৃথিবীতে তার তুলনা পাওয়া কঠিন। সেটা আমাদের ইতিহাসের ভাঙা-গড়া থেকেই প্রমাণিত। কোনও বিশেষ ব্যক্তির মন্তব্যের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতো ‘সত্য কথা কহিতে শিখিও’, এ কথা সচরাচর শেখানো হয় না, তা অতীব কঠিন। অথচ এই যুধিষ্ঠিরই, নিজের স্ত্রীকে পণ রেখে, জুয়া খেলেছিলেন। জীবনীকার কোথাও এ কথা গোপন করার প্রয়োজন বোধ করেননি। তারই ফলে যুধিষ্ঠির চরিত্র মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। কেন না, সাধারণ মানুষ, তার নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কিছু পরিচয় এইসব চরিত্রের মধ্যে দেখতে পেয়েছে। সেইজন্যই, সেই চরিত্রের উত্তরণ, সংগ্রাম ও সাহস, পাঠককে মুগ্ধ, বিস্মিত, উৎসাহিত করেছে।

এখানকার পত্র-পত্রিকার জীবনীকারদের লেখা পড়লে মনে হয়, সেই জীবনটি কোনও কালের স্পর্শে ছিল না, কালাকালের ঊর্ধ্বে। দেব-চরিত্রেও যদি কিছুমাত্র কলঙ্কের দাগ থেকে থাকে, এরা একেবারে নিষ্কলঙ্ক।

.

যাই হোক, এত কথা বলবার প্রয়োজন বোধ হয় ছিল না। প্রয়োজন হয়ে পড়ল ময়লা, মলাট-শিথিল সেলাই, একটি খাতার মধ্যে এলোমলো কিছু কথা পড়ে। হাতের লেখা তেমন কাঁচা না। অথবা নিয়মিত লেখার অভ্যাসে যে হস্তাক্ষরে বিশেষ একটি পাকা ছাপ পড়ে, তেমনও না, খুব অল্প সংখ্যক, দু-একটা শব্দ বাদ দিলে, বানান ভুল প্রায় নেই। এ খাতায়, যে তার নিজের সম্পর্কে এলোমেলো ভাবে কিছু ঘটনা, ব্যক্তিদের বিষয় লিখেছে, একসময় সে পড়াশুনা করেছে, বোঝা যায়।

এটা কোনও ডাইরি বা আজকাল যাকে দিনলিপি বলে, তা নয়। হঠাৎ হঠাৎ কয়েক পাতা লেখা। তার কোনও তারিখ নেই। কখনও কয়েক পাতা ছেড়েই চলে গিয়েছে। আবার হঠাৎ লেখা হয়েছে। যে দিন লিখেছে, বিশেষ করে সে দিনেরই কোনও ঘটনা যে ব্যক্ত হয়েছে, সে রকম কিছু না। অথবা তার আগের দিন কিছু ঘটেছে বলেই যে খাতা কলম পেড়ে বসেছে, তাও না। হয়তো ছ মাস কিংবা দু বছর আগের কোনও ঘটনা লিখতে শুরু করেছে।

এ রকম লেখার দরুনই বোঝা যায়, বেশ ভেবে-চিন্তে সাজিয়ে-গুছিয়ে নিজের জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশ করবার ইচ্ছের চেষ্টা কোথাও নেই। এ খাতা কেউ কোনও দিন পড়বে, এ আশঙ্কা সে এক বারও করেনি, ছাপা তো অনেক দূরের কথা। আমি ‘আশঙ্কা’ বললাম এই কারণে, খাতার এক জায়গায় লেখা আছে। ছি ছি খাতাটা যে খাটের পাশতলায় ছোট টিপয়টার ওপর পড়েছিল, একটুও খেয়াল ছিল না। হিমাংশু খাতাটা হাতে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী, এটা সংসারের হিসেবের খাতা নাকি? আমি তখন বুধনকে মাছের ঝালে কতটুকু কী মশলা দিতে হবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। হিমাংশুর হাতে খাতাটা দেখে, আমার গায়ের মধ্যে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল? মনে হল, আমার গায়ে জামাকাপড় নেই, একেবারে খাটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, হিমাংশুর হাত থেকে খাতাটা ছিনিয়ে নিলাম। বললাম, সব কিছুতে হাত দেওয়া কেন? একটু চুপচাপ বসতে পার না? হিমাংশু অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি খাতাটা বগলে চেপে, বুধনকে মাছের ঝালের মশলার কথা বলে দিলাম। হিমাংশু বলল, এমনভাবে খাতাটা ছিনিয়ে নিলে, যেন ওতে কোনও গুপ্তধনের সন্ধান লেখা রয়েছে। আমি হাসলাম, কোমরে গোঁজা রুমাল বাঁধা চাবি নিয়ে, খাতাটা আলমারিতে রাখতে রাখতে বললাম, তা এক রকম বলতে পার। মনে মনে ভাবি, না ছাই। তবে গুপ্তধন না হতে পারে, গুপ্ত বিষয় তো বটে। এ খাতা কেউ কোনও দিন পড়ুক, তা আমি চাই না। আমার যেমন মাথা খারাপ, তা-ই ছাই-ভস্ম আমি লিখি। তবু ছাই-ভস্ম যাই হোক। এ খাতা যেন আমার মরার পরে, আমার চিতাতেই যায়।

খাতায় এক কোণে কথাগুলো লেখা রয়েছে। কোনও তারিখ নেই। কবে কোন দিন, কখন হিমাংশু খাতাখানি খাটের পাশতলা থেকে তুলে নিয়েছিল, কোনও উল্লেখ নেই। যে দিন লিখেছে, তার কয়েক মাস আগের ঘটনা হতে পারে, কয়েক দিন আগের হতে পারে, আগের দিন রাত্রেরও হতে পারে। এই লেখাটুকু থেকেই বোঝা যায়, খাতার বিষয় কারোকে জানাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। নিজের জীবনের বিষয় ছাপা তো দূরের কথা।

নিজের জীবন সম্বন্ধে তার কোথাও কোনও গৌরব বোধ নেই। নানান সুখ-দুঃখ, কখনও কিছু বিচিত্র বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা আছে। খাতার একটা অংশে অনেকখানি লেখা, অনেকগুলো পাতা জুড়ে। এ অংশটা-ই খাতার লেখার সবকিছুতে ভরে আছে। কোথাও পরিষ্কার করে, নিজের কোনও পরিচয় লেখা নেই। বাবা মা বা দু-একটি আত্মীয়স্বজনের কথা লেখা আছে। তা থেকে, কোথাকার পরিবার বংশ-পরিচয়, কিছুই জানবার উপায় নেই। কেবল তার নিজের দুটি নাম উল্লেখ করা আছে।

.

খাতাটি যার লেখা, সে একটি মেয়ে। এখন সে সম্ভবত জীবিত নেই, থাকলেও এখন সে কোথায় আছে, তার পরিচিতদের কেউ জানে না।

মেয়েটি দেহোপজীবিনী। এক কথায় এটাই তার পরিচয়। তথাপি আমি প্রারম্ভেই যে সব কথা বলেছি আত্মজীবনীকারদের বিষয়ে, মনে হতে পারে, তাদের সঙ্গে একটি দেহোপজীবিনীর কী-ই বা তুলনা থাকতে পারে। একটি দেহোপজীবিনীর নিজের লজ্জাকর জীবনের বিষয়ে কী-ই বা গোপন করার থাকতে পারে।

কিছুই না। তথাপি, এই খাতারই এক জায়গার লেখা ইতিপূর্বেই উদ্ধৃত হয়েছে। হিমাংশুর হাতে খাতাটা দেখে, আমার গায়ের মধ্যে যেন কাটা দিয়ে উঠল। মনে হল, আমার গায়ে জামাকাপড় নেই, একেবারে খালি গায়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।অথচ হিমাংশু তার দেহেরই একজন ক্রেতা! তথাপি খাতাটা এবং হিমাংশুর প্রসঙ্গে, এ রকম কথা লেখার মানে খুবই গভীর এবং অর্থমূলক। যে দেহ সে হিমাংশুদের কাছে মেলে ধরে, সেই দেহটা সম্বন্ধে তার অনুভূতি মৃত। কিন্তু তার আর একটি দেহ আছে, দেহোপজীবিনী হওয়া সত্ত্বেও যে দেহে মন বলে বস্তু আছে, অনুভূতির তীব্রতা এবং গভীরতা আছে, লজ্জা-সংকোচ-ভয়, সবই আছে। খাতাটি সেই দেহেরই কতগুলো ছিন্ন ছবি। সেইজন্যই খাতাটা সে কাউকে কখনও দেখাতে চায়নি। এ খাতায় তার মনের কথা, তার ইচ্ছা-অনুভূতির কথা, তার রাগ ও ঘৃণার কথা, সুখ ও দুঃখের কথা। যে সব মানবিক বোধগুলো দেহোপজীবিনীদের আছে বলে সমাজ সংসার জানে না, সেইসব বোধবিষয়ক কথা খাতায় লেখা আছে।

লেখিকার ইচ্ছেনুযায়ী, খাতাটা আমারও পড়া হয়তো উচিত হয়নি। কিন্তু এই ঔচিত্যবোধ কোনও কাজের না। লেখিকার আপত্তির যে আসল কারণ ব্যক্ত হয়েছে, অন্তত আমার দিক থেকে, সে রকম কোনও ধারণাই সৃষ্টি হয়নি। আমি বিচলিত হয়েছি। কষ্ট পেয়েছি। আবার অবাক হয়েছি। মুগ্ধও হয়েছি।

আমার এক সরকারি কর্মচারী বন্ধু খাতাটি আমাকে দিয়েছেন। তিনি বিশেষ বিভাগে, বিশিষ্ট উচ্চপদে চাকরি করেন। নানান ঘটনা তার মুখে শুনে থাকি। এক দিন তিনি এই খাতাটি নিয়ে এলেন। খবরের কাগজে মোড়া, শাড়ির ফালি দিয়ে বাঁধা। বললেন, ভয় নেই, কোনও নতুন লেখকের পাণ্ডুলিপি পড়তে দিয়ে আপনাকে বিরক্ত করছি না। আমার মনে হয়, এটা পাণ্ডুলিপি নয়। খাতাটা পেয়ে, আমি কয়েক পাতা উলটেছিলাম। তারপর মনে হল, এটা আপনাকে পড়তে দিই। আপনারা তো সামান্য ব্যাপারেই, অনেক সময় অসামান্য ব্যাপার আবিষ্কার করতে পারেন। এতেও যদি পারেন, দেখবেন। তবে এটুকু আপনাকে বলতে পারি, এ খাতার মালিক সম্ভবত মারা গেছে। না মারা গেলেও, সে যে কোথায় আছে, কেউ বলতে পারে না।

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। একজন জলজ্যান্ত মানুষ পৃথিবী থেকে কোথায় হারিয়ে গেল, কেউ বলতে পারছে না?

সরকারি কর্মচারী বন্ধুটি বলেছিলেন, ‘তাই তো মনে হচ্ছে। যে মানুষ নিজেকে লুকিয়ে বেড়ায় অথবা যদি নিজের অস্তিত্বকে কেউ নষ্ট করতে চায়, সেইসব মানুষের পাত্তা কেউ দিতে পারে না।’

এক দিক থেকে কথাটা মানলেও, আইন ও বাস্তবের দিক থেকে কথাটা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমি একটু হেসেছিলাম। আমার বন্ধুটি সে কথা বুঝেছিলেন, বলেছিলেন, আপনার মনের কথা বুঝতে পারছি। কেউ যদি আত্মহত্যা করে বা আত্মগোপন করে, প্রয়োজনে তার দায়িত্বটা সরকারের বিশেষ বিভাগকে নিতেই হয়।

আমি বলেছিলাম, তা ছাড়া, একজন অপরাধীও আত্মহত্যা বা আত্মগোপন করতে চাইতে পারে। তাদের আটকানো বা খোঁজটাও একটা বিশেষ কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অবশ্যি আমি জানি না, এ খাতার মালিক কে, তার কী ঘটনা বা বিষয়, যার জন্য আপনি ও রকম কথা বললেন।

বন্ধুটি আমাকে খানিকটা আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘এ খাতার মালিক কোনও অপরাধ করে ফেরার হয়নি। এটা যেমন কোনও নতুন লেখকের লেখা পাণ্ডুলিপি নয়, তেমনি এটুকু আপনাকে আশা দিচ্ছি, কোনও অপরাধীর রোজনামচা বা ডকুমেন্টস আপনার হাতে তুলে দিইনি। এই খাতার মালিক বেঁচে আছে কি না, এ সন্দেহ কেন করেছি, অথবা বেঁচে থাকলেও সে কোথায় আছে, কেউ বলতে পারবে না কেন, সবই খাতার মধ্যে শেষপর্যন্ত যা লেখা আছে, পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন।’

তারপর আমরা অন্যান্য বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলাম। খাতা ও খাতার মালিকের বিষয় আমরা আর আলোচনা করিনি। বন্ধুটির কথায় বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি চাইছিলেন, এ বিষয়ে তাঁকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে খাতাটা পড়েই যেন তখনি আমার কৌতূহল মেটাবার বা যা বোঝবার বুঝে নিই।

খাতাটা কয়েক দিন দৃষ্টির বাইরে পড়ে ছিল। হঠাৎ কয়েকটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় খাতাটার কথা মনেই ছিল না। সম্ভবত মনে পড়ত না, যদি টেবিলের অন্যান্য অনেক কাগজপত্রের মধ্যে এক ফর্মা গ্যালি-ফের খোঁজ না পড়ত। সেটা খুঁজতে গিয়ে অন্যান্য কাগজপত্রে চাপা পড়া, খবরের কাগজে মোড়া পুরনো শাড়ির পাড় দিয়ে বাঁধা খাতাটা চোখে পড়ল। তখনই আমার বন্ধুটির কথা মনে পড়ে গেল, এবং খাতা খুলে দেখবার কৌতূহল হল।

প্রুফের গ্যালিগুলোর যথাবিহিত ব্যবস্থা করে, আমি খাতাটার বাঁধন খুলতে বসলাম। খুলে দেখলাম খাতাটা বাঁধানো, মোটা খাতা। সেলাই শিথিল হয়ে গিয়েছে। তবে পাতা খুলে যায়নি।

খাতাটা খুলে দেখলাম, প্রথম পাতায় লেখা আছে শ্রীশ্রীকৃষ্ণ। তার নীচে লেখা আছে ‘ভগবান’ একেবারে নীচে, এক কোণে লেখা আছে বিজলী চৌধুরী। তার পাশে আরও কিছু লেখা হয়েছিল, কিন্তু এমনভাবে কাটা, কিছুই পড়া যায় না। হয়তো কোনও জায়গার নাম ছিল, বিশেষ কোনও গ্রামের বা শহরের। তারিখ নিশ্চয়ই ছিল না। কারণ বিজলী নামে, এ খাতায় লেখিকার তারিখ লেখার অভ্যাস যে একেবারেই ছিল না, বোঝা যায়, তার সমস্ত খাতার কোথাও তারিখের বালাই নেই। মানুষের জীবনে। অনেক সময়েই বিশেষ কোনও দিন আসে, যা নানান কারণেই স্মরণীয়। বিজলীর ছাড়া ছাড়া লেখার মধ্যে, তার জীবনের অনেক চমকপ্রদ ঘটনা লেখা হয়েছে, যা হয়তো স্মরণীয়। কিন্তু সেখানেও তারিখের উল্লেখ নেই।

জানি না সে মারা গিয়েছে কি না, তথাপি এটা ঠিক, তার জীবনকালের মধ্যে কোনও ঘটনাকেই সে যেন তারিখ দিয়ে চিহ্নিত করতে চায়নি। সবই তার কাছে যেন সমান হয়ে গিয়েছিল। সবই স্মরণীয় অথবা কোনও কিছুই স্মরণীয় নয়। আর প্রথম পাতাটা দেখে মনে হয়েছিল, এক বিশেষ সংস্কারে অনেকেই যেমন প্রথমে ঈশ্বর বা অন্য কোনও দেবতার নাম উল্লেখ করে, স্মরণ করে, শ্রীশ্রীকৃষ্ণ বা ভগবানের কথা বোধ হয় সেইজন্যই লিখেছিল।

পরের কয়েক পাতা কেবল হিজিবিজি। একে হাতের লেখা মকশো করা বলে কিনা জানি না। এমন তো হতে পারে, খাতার পাতা খুলে, কলম দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে যখন যে কথা মনে এসেছে, তাই লিখেছে, কেটেছে, লিখেছে। সব কথাই যে কেটে দিয়েছে, তা না। যেমন এক জায়গায় বড় বড় অক্ষরে মোটা করে লিখেছে, আশা নিরাশা’ কিংবা ন্যাকামি দেখলে গা জ্বালা করে। এ কথাটা সে রকম মোটা করে লেখা না। হিজিবিজির মধ্যে অনেক কথা, কাটাকুটি ছাড়া যা লেখা আছে, পর পর একটা তালিকা। করলে, মনে হয় একটা চরিত্র আর একটা পরিবেশের অনেকখানি ধরা যায়। যথা–

ফুলবাসিয়া বাড়ীওয়ালি।

জয় বাবা তারকেশ্বর। মোটা বড় অক্ষর।

শখ দেখে বাঁচি না…পরের কথা কেটে দেওয়া।

মরিব মরিব সখী, নিশ্চয় মরিব।

 চন্দন ধূপ দীপবর্তিকা ও আলোকমালায় সজ্জিত হইয়া গৃহটি অপরূপ দেখাইতেছে।

‘পুসি আমার পুসি৷ পুসির বিয়ে দেব।’

শীতলপ্রসাদ।

৩২৭-৪৮=২৭৯।

লাগ ঝমাঝম।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

তারাশঙ্কর।

না।

চন্দ্রনাথ।

চুলে গুঁজে বেলফুল ধরে আনে অলিকুল।

পণ্যাঙ্গনা পণ্য হইয়াছে অঙ্গ যাহার অর্থাৎ বেশ্যা বা গণিকা–ইতি বিজলী চৌধুরী।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। বড় মোটা অক্ষর।

 বিলিতি মদ সোডা কুড়ি বোতল হরিদাসীর পান।

 জর্জেট।

তালিকা আরও বাড়ানো যায়। বাড়িয়ে লাভ নেই। কয়েক পাতা ব্যাপী, অনেক লেখা, অনেক হিজিবিজি কাটাকুটির মধ্যে এ ধরনের কথা যেন এক একটি দ্বীপের মতো জেগে আছে যাতে একটি মানুষের পরিবেশটা এবং তার পরিচয়টা যেন অনেকখানি ফুটে উঠেছে। এ সব ছাড়াও কোনও জায়গায় লেখা আছে, ভগবান সবই হিতে বিপরীত হল। মা বোধ হয় মরে যাবে। না কিছুই ভাল লাগে না ইত্যাদি।

তারপর দু-তিন পাতা কিছুই লেখা নেই। যেন মনে হয়, পাতা ওলটাতে গিয়ে খেয়াল ছিল না। লেখা অলস ভাবের, এই ভাবে শুরু হয়েছে:

ভাল লাগলেই তো হল না। ভাল লেগে তো এই ফল হল। নিজেকে ফতুর করে দিয়ে, সব বেচে বিক্রি করে, দেবদাসের খোঁজে যেতে হল। আজকালকার বেশ্যারা এ সব ফাঁদে আর পড়তে চায় না। তবে বেশ্যাই হই আর যাই হই, মেয়েমানুষ বড় বোকা। তালে তালে সবসময় অন্য চিন্তা। যা নাই তার চিন্তা। লোকেরা ভাবে, চন্দ্রমুখী বুঝি কেবল বইয়ে লেখা বেশ্যা মেয়েছেলের কথা। মোটেই না। শরৎচন্দ্র মহাশয় লোকটি বেশ বোঝদার। বোধ হয় ও রকম দেখে থাকবেন। ‘খাচ্ছিল তাতি তাঁত বুনে কাল হল এঁড়ে গোরু কিনে।’ বেশ্যাদের ভালবাসা হল তাঁতির এঁড়ে গোরু কেনা। ওই করে সব মরে বেশ্যা মরে জারে।

এই তো, ছট পুজোর কয়েক দিন আগে রেণুটার কী হাল হল। বছর দুয়েক ধরে, কোথা থেকে এসে জুটেছিল এক ছেঁড়া। ছেলেটা লেখাপড়া জানা ভদ্রলোকের বাড়ির। বিয়ে থাও নাকি করেছিল। বউয়ের সঙ্গে বনাবনতি ছিল না। রেণুর কাছে এসে, ছেলেটা নিজে মজল। রেণুও মজল। বেশ্যার মজামজি কী বাপু। বাবু এসেছে। তাকে খুশি করো। বাবুর প্রাণে ফুর্তি জোগাও। শরীর বলে কথা আজ আছে কাল নেই। যা পার, গুছিয়ে গাছিয়ে নাও।

তা না। ওই সেই, চিরকাল ধরে তলে তলে সাধ। মনের মতো পুরুষ, ঘর-সংসার, ছেলেমেয়ে। তা আবার হয় নাকি। এক বার যখন বেশ্যা হয়েছ, ও সব সাধ রেখে লাভ কী। সবাই মুখে অস্বীকার করবে। তলে তলে চাইবে। এক একজনের আবার ওটা বাতিক। যেমন রেণুর। খাতার নাম লিখিয়ে ব্যবসা করতে এলি। অথচ কথায় কথায় এ জীবন ভাল লাগে না, তেমন দিন এলে চলে যাব। এ। লাইন ভাল, কেউ মাথার দিব্বি দিয়ে বলেনি। খারাপ লাইনে আসা কেন।

সেটা একটা কথা বটে। আসা কেন? নিজের ইচ্ছায় আর কে আসে। যখন আসে, তখন কি আর মেয়েরা কেউ বুঝতে শেখে। শিখলেও উপায় থাকে না। বাধ্য হয়ে লাইনে আসে। আমার তো মনে হয়, টাকার জন্য মেয়েরা এ লাইনে আসে। কিন্তু যে বয়সে সে টাকার ধার ধারে না, তখনই তাকে লাইনে নিয়ে আসা হয়। বিয়ে হয়ে গেছে, একটু বয়স-টয়স হয়েছে, এমন মেয়ে এ লাইনে কম! ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরতে না পরতেই খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।

কাল বইটা দেখে মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেল। যেমন সমাজের মরণ, তেমনি বেশ্যাদের মরণ। দেবদাসের সঙ্গে পার্বতীর বিয়ে হল না। তার জীবনটা এ রকম হল। দেবদাস মরল। চন্দ্রমুখীকেও মজিয়ে গেল। সেই জন্য রেণুটার কথা মনে পড়েছে। এখনকার দিনেও যে এমন ঘটে, তাতেই অবাক লাগে। সেই ছেলেটা যখন প্রথম এল, রেণুকে সব উজার করে দিল। এইসব পুরুষও খারাপ। বউয়ের সঙ্গে না হয় বনিবনা নেই। ঘর-সংসার, আরও পাঁচজন আছে তো। নিজেকে শক্ত রেখে, সব দেখেশুনে চলতে হয়। তা না। ধ্যান জ্ঞান সব একখানে।

রেণুকে তখন কী সুখী মনে হত। রোজ সেই ছেলেটা আসে। রেণুর অন্য বাবুরা আর দরজা খোলা পায় না। পেলেও রেণু কাউকে ঘরে নিত না। তার বাঁধা বাবু আছে। অমন বাঁধাবাবু অনেকের থাকে। তা বলে, তার মুখ চেয়ে সন্ধে থেকে সেজে বসে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ খেটে নে। মনের মানুষ তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। আখেরের কথা তো ভাবতে হবে। এ সব সতীপনা ভাল লাগে না। মনের মানুষ এসে কি তোমার শরীর উলটে পালটে দেখবে, কারও সঙ্গে শুয়েছিলে কি না। বলে, কত হাতি গেল তল, মশা বলে কত জল।

মুখে বলছি মনে মনে খুব হিংসা হত। রেণু সেজেগুজে বসে থাকত, আর ওর মনের মানুষ আসতে দেরি করত। রেণু ঘরবার করে মরত। কেউ এলে তাকে ফিরিয়ে দিত। দেখলে রাগ হত। ঠোঁট উলটে মনে মনে গালাগাল দিতাম, মাগির ন্যাকামো দেখলে গা জ্বালা করে। জাত বেজাতের হাজার গণ্ডা পার করে, এখন ইয়ে শুদ্ধি হচ্ছে। আমি একা না, আমরা কয়েক ঘরের মেয়েরা একত্র হয়ে বলতাম। রেণুকে গালি দিতাম। তারপর যখন ছেলেটা আসত, তখন হিংসায় বুকটা ফেটে যেত। যেন আমাদের বুকে আগুন জ্বালিয়ে, ওদের মান ভাঙাভাঙি শুরু হত। মান ভাঙাভাঙির পরে খাওয়া দাওয়া চলত। সারা রাত্রি রেণুর ঘরে কথা। রাত পোহালে, ওর ঘরের দরজা খুলতেই, সবথেকে বেশি দেরি হত। রাত শেষ করে শুত কিনা তাই।

রেণু নিজের হাতে রান্না করত। ছেলেটা কোনও দিন বাজার করে নিয়ে আসত। রেণু নিজেও বাজার করত। অনেক সময় রান্না করে, ছেলেটাকে খাওয়াত। রেণু শাড়িতে গাছকোমর বেঁধে, খুন্তি হাতে রকে বেরোলে বুকটা ফেটে যেত। বেশ্যাবাড়িতে, এ সব দেখলে কার ভাল লাগে। যেখানকার যা। তা না, আমরা দশটা নাগর নিয়ে কারবার করছি, আর একজন মাগভাতারের ঘরকন্না করছে। তার জন্য এ জায়গা কী দরকার। ছেড়ে গেলেই হয়। রান্নাবান্না, সিনেমা-থিয়েটার, আজ এখানে, কাল সেখানে বেড়াতে যাও না। তারপর শোনা গেল, রেণু আর এ লাইনে থাকবে না; ছেলেটার সঙ্গে অন্য কোথাও গিয়ে থাকবে। সংসার করবে। আমাদের কী রাগ। মনে মনে রেণুকে পা দিয়ে পিষতাম। দাঁত দিয়ে ছিড়তাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত কী হল। ছেলেটার যা সম্বল ছিল, সব শেষ করে ফেলল। রেণু সোহাগ করে বলল, আমার যা আছে, তাতেই চলে যাবে। দেখ পীরিত। তা-ই কখনও হয়। তারপরেই মেজাজ খারাপ। মন কষাকষি। মন কষাকষি থেকে ঝগড়া। চোপাবাজির পরে হাতাহাতি। ছেলেটা টাকা পয়সা নষ্ট করল, শরীরটাও রাখতে পারল না। যখন চলে যাবে ঠিক করল, তখন রেণু বলল, ও সঙ্গে যাবে। একে বলে মরণ। তবে কথা কী, রেণুর নাম-খারাপ হয়ে গেছল। বাজারও খারাপ হয়ে গেছিল। বাড়িওয়ালা শীতল প্রসাদ তো অনেক দিন থেকেই চাইছিল, রেণু ঘর ছেড়ে দিক। বাড়িওয়ালি ফুলবাসিয়া দিন রাত রেণুকে গালাগালি দিত। বাজার খারাপ না হলেও যে রেণু এ লাইনে থাকত, তা না। রেণু যখন থেকে এ লাইনে এসেছে, তখন থেকে ভেবেছে, সুযোগ পেলে ছেড়ে যাবে। সে কথা আমাদের অনেক বার বলেছে।

আমরা মনে মনে হেসেছি। ভেবেছি, সাত মন ঘিও পুড়েছে, রাধাও নেচেছে। কিন্তু তা-ই সত্যি হল। রেণু চলে গেল। টাকা পয়সা অনেক খরচ হয়ে গেছল। গহনাগাটিও সামান্য ছিল। দুজন মানুষ অনেক দিন বসে খেয়েছে। কারোর কোনও রোজগার ছিল না। অথচ ঘরের ভাড়া তিনশো টাকা। চাকরের মাইনে, ধোপা নাপিত, ঘর করতে গেলে কত খরচ। কলসির জল কত দিন থাকে।

এমন না যে, মনের মানুষটি রইল, রেণু যতটা পারল রোজগার করল। তেমন মজে গেল, এ লাইনে তা-ই হয়। রেণুর মতো কে আবার সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে চলে যায়। এমন হতভাগ্য বেশ্যা দেখিনি বাপু। কত মেয়ে তো মনের মানুষকে সেই ভাবে রেখে দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, মনের মানুষের সঙ্গেও অনেককে লাইন ছেড়ে যেতে দেখেছি। সেটা মনের সঙ্গে মনও বটে, টাকার সঙ্গে টাকাও বেঁধেছে। তাতে পাওয়ানা বেশি। আখের পাকাঁপোক্ত। আর রেণুটা গেল সব ছেড়েছুঁড়ে। খাট আলমারি রেডিয়ো গ্রামোফোন সব বিক্রি করে দিল। যা নগদ আর অল্প কিছু সোনা দানা নিয়ে গেল। কেবল দেখলাম, দামি দামি শাড়ি-জামাগুলো বিক্রি করল না। ভাল ভাবে যদি না-ই থাকতে পারবে, তবে দামি শাড়ি-জামা নিয়েই বা কী করবে।

ওটা আলাদা কথা। আমাদের কারোকে ভাল শাড়ি পরতে দেখলে এমন হিংসে হয়, নিজেরটা ছেড়ে দিতেও তেমনি বুক টাটায়। কিন্তু রেণু যে তার লোকের সঙ্গে, এমন যোগিনীর মতো চলে গেল, তাতেও তাকে মনে মনে হিংসে করেছি। ভাবলে এখনও মনটা চির চির করে জ্বলে। তবে এখন হিংসের থেকে, রেণুর কথা ভাবলে, মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। রেণুর জন্য না, নিজের জন্য। আজকাল কোথায় কেমন আছে, কে জানে। ওর সেই লোকটা বেঁচে আছে কি না, তা-ই বা কে বলবে। কিন্তু কেমন ভাবে। রেণু চলে গেল।

আমাদের সেই এক রকম। কোনও দিকে একটু রকমফের নেই। কোনও দিন দুটাকা রোজগার বেশি, কোনও দিন দুটাকা কম। সিনেমা, থিয়েটার, বেড়াতে যাওয়া, হোটেলে খেতে যাওয়া, আর সব কিছুর মূলে পুরুষের সঙ্গে শোয়া। রাত হলে রাতে, দিনেও লোক আসে। তাই সকাল থেকেই ঢুকচুক মদ খাই। না খেলে পারব-ই বা কেন। এ তো একটা জেদের মতো। কত আসবে এসো। কত কাবু করতে চাও দেখি। ছেড়ে দেব না। খুব শরীর খারাপ থাকে কিংবা মাসিক হয়, সে আলাদা! তা না হলে। কেউ ছাড়ি না। তবে দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে সুবিধা। এইসব নিয়ে থাকি। না হয় তো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করি। অন্য বাড়ির মেয়েদের নিয়ে কুচ্ছো করি। কারোকে ভাল বলতে ইচ্ছে করে না। কেবল যে আমার মন রাখে, তার মন রেখে কথা বলি।

এ সব থেকে রেণু বেরিয়ে গেছে। কোথায় কী ভাবে আছে, কে জানে। কাল দুপুরে সিনেমা দেখে, চন্দ্রমুখীর জন্য রেণুকে খুব মনে পড়ছে। রাধারাণী দিদি বলছিল, ওটা নাকি অনেক কাল আগের বই যে লোকটা দেবদাসের পার্ট করেছে, তার নাকি আগে খুব নাম ছিল। আর শরৎচন্দ্রের নাম তো অনেক আগে থেকেই জানি। কতকাল আগের লেখা বই। এখনও এমন ঘটনা ঘটে। তাই ভাবি গেরস্থ ঘরের বউয়েরা তো অনেক কিছুই করে। ঘর সংসার স্বামী পুত্রের জন্য। বেশ্যারাও যে এমন করতে পারে, তা কি সবাই জানে। বইয়ে পড়লেও লোকেরা হয়তো বিশ্বাস করে না। এত যে হাজার গণ্ডা লোক সারা পৃথিবী ঝেটিয়ে দিন-রাত আমাদের কাছে আসছে, তারাও কি বিশ্বাস করে! আমার মনে হয়, এমনি লোকেরা যদি বা বিশ্বাস করে, তারা করে না। তারা আমাদের কাছে আসে, যা দরকার, তাই সেরে চলে যায়। কী পেল তারাই জানে। যাদের একটু তেমন বুদ্ধিশুদ্ধি আছে, তারা জানে, এখানে পাবার কিছুই নেই। আর আমরা জানি, কী দিয়েছি, কী দিইনি। অথচ আবার এখানেই, এমন ঘটনাও ঘটে। বাইরে চেনা চেনা গলা শোনা যাচ্ছে। কমলার সেই লোকটি এল বোধ হয়, এখনই…।

এখানেই এই পরিচ্ছেদের শেষ। যেমন শেষ না লিখেই, লেখিকা উঠে গিয়েছিল, আর শেষ করা হয়নি। যেখানে ছেড়ে গিয়েছে, সেখানেই এই পরিচ্ছেদের ইতি। তথাপি, সমগ্ৰ পরিচ্ছেদ থেকে, একটি আশ্চর্য ছবি, পরিবেশ, চরিত্র আর মনোভাবের কথা জানা যায়। কে এক বিজলীর লেখা এ পরিচ্ছেদ না পড়লে, একটা বিষয়ে আমি কখনও জানতে পারতাম না। শরৎচন্দ্র এখনও এতখানি বাস্তব? চন্দ্রমুখীর ভালবাসা আর ত্যাগকে এত কাল মিথ্যে বলেই জেনে এসেছি। কখনও কখনও, আধুনিক সাহিত্য সমালোচকরা তাই লিখেছে। এখন বুঝতে পারি, এই সব সমালোচকেরা অধিকাংশই পুঁথির কীট। জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাঠ্য লিখে, নিজেদের এরা সর্বজ্ঞ জ্ঞান করে বসে আছে।

শ্রীকান্তের পিয়ারী বাঈজীকে যখন প্রথম দেখা গেল, তখন তবু এক রকম। তারপরে আর কোথাও তাকে একটি বিশেষ পেশার স্ত্রীলোক বলে মনে হয় না। চন্দ্রমুখী তা না। সে বেশ্যা, তার কোনও ভাঁড়ামি নেই। গৃহস্থ সতীদের ভাড়ামি যাকে বলে। কিন্তু মনে মনে একটা সুপ্ত বাসনা চন্দ্রমুখীরও ছিল। তা সংসার না, সম্ভবত সন্তান না, একটু ভালবাসা। এক্ষেত্রে চন্দ্রমুখী একলা ভালবেসেই শেষ। সেটা এমন আশ্চর্যের ব্যাপার কিছু না। সংসারে অনেক স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেই এই লক্ষণ দেখা যায়। বিশেষ এক জনকে পাবার জন্য, সে সব কিছু ছাড়ে। পিয়ারী বাঈজী, উচ্চাঙ্গের বাঈজী চরিত্র, চন্দ্রমুখীতে নেই। চন্দ্রমুখী অনেক স্বাভাবিক রেণুর মতো। রেণুর আকাঙ্ক্ষা ছিল। চন্দ্রমুখীর আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পায়নি, দেবদাসের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছিল।

যাই হোক, এ সব প্রসঙ্গ আমার আলোচ্য না। আমি খাতাটা পড়ে মুগ্ধ হলাম। নিজেদের জগতের একটি মেয়ের কথা বলতে গিয়ে, নিজেদের মনের কথাগুলো সে সরল ভাবে প্রকাশ করেছে। পাতা উলটে দেখি, তেমনি দু-তিনটি পাতা ছেড়ে গিয়েছে। আবার হঠাৎ লিখতে আরম্ভ করেছে। পর পর সাজানো ঘটনা যে না, বোঝা যায়, হঠাৎ পরবর্তী প্রসঙ্গ দেখেই। একটি করুণ আর মর্মন্তুদ পরিচ্ছেদ।

এত বড় একটা পুরুষ মানুষ কেমন করে আমার সামনে লজ্জাটজ্জা সব ভুলে গেলেন, বুঝতে পারি না। কী ভয় যে আমার করছিল। এখনও সব কথা যথেষ্ট মনে আছে। বাড়িওয়ালি ফুলবাসিয়ার ঘরে মেয়েটিকে দেখেই সব কথা যথেষ্ট মনে পড়ছে। তখন কি ছাই জানতাম, মা আমার সর্বনাশ করছে। মায়ের সেই যে এক পাতানো ননদ জুটেছিল, সেই মায়ের কানে দিন-রাত মন্ত্র দিত। সে যে কী ছিল জানতাম! বলতে গেলে বুড়ো বয়সে মাকে সে-ই খারাপ রাস্তায় নামিয়েছিল।

এক এক জনের যেমন থাকে, একটু বয়সেই যেন শরীরে রূপ ফোটে। মায়ের সেই রকম। আমার আগে কম করে তিনটি না চারটে ভাই বোন মরেছিল। সেই হিসেবে আমি মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা মারা গিয়েছিল আমার সাত বছর বয়সে।

বাবাও মরল। পিসির আনাগোনাও বাড়ল। কলকাতার বাইরে একটা ছোট শহরে আমরা থাকতাম। বাবা সেই শহরের একটা ছোট অফিসে কাজ করত। সরকারি অফিস না। তবে সরকারি লোকেরা নাকি সেই অফিস চালাত। মুগা তসর কর্পাস সুতোর নানান রকমের জিনিস সেখানে তৈরি হত। অনেক মেয়েরাও সেখানে কাজ করত। বাবা সেখানে মেয়েদের কাজের হিসাব লিখত। বরাবরই শুনেছি, বাবা খুব ভালমানুষ, নিরীহ গোছের মানুষ ছিল।

পিসির নাম নন্দ। নন্দরাণী টানি হবে বোধ হয়। মা নন্দ দিদি বলে ডাকত। আর পিসি বাবাকে দাদা বলে ডাকত। শহরে মেয়েদের পাড়ায় গিয়ে না থাকলেও, তার ব্যবসা ছিল ওই রকম! সবাই জানত। আবার পাড়ার লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তাও বলত। বাড়ি বাড়ি দুধ দিত। তার গোরু গোয়াল ছিল। সে যে কুটনির কাজ করত কেউ জানত না।

পিসির ফোঁসলানিতেই মা রাস্তা ধরল। তবে শহরের পাড়ায় না, বাড়িতেই। আমার চোখে ফাঁকি দিতে চেষ্টা করলে কী হবে। আমি সাত-আট বছর বয়সেই সব বুঝতে পারতাম।

এখন আরও ভাল করে বুঝতে পারি। পাড়ার মধ্যে বলে, সন্ধেবেলা মায়ের কাছে কেউ আসত না। একটু বেশি রাত হলে আসত। যারা আসত, তারা সবাই তো চেনাশোনা লোক। শহরে যাদের নাম ধাম আছে, তারাই সব মায়ের কাছে আসত। তাদের অনেককেই আমি চিনতাম। আমাদের গলি থেকে বেরোবার মোড়ে পুকুর আর পিটুলি গাছ। পিটুলি গাছের ধার ঘেঁষে ইটের গাঁথনিয়ালা টালির ঘরটা ছিল ডাক্তারখানা! সবাই তাকে নবকেষ্ট ডাক্তার বলত। বাবার অসুখে অনেক বার দেখতে এসেছে। বড়লোকেরা কেউ তাকে ডাকত না। সবাই বলত, সে নাকি হাতুড়ে। কোথাকার হাসপাতালে নাকি কম্পাউন্ডার ছিল। ওষুধ চুরি করে ধরা পড়ে, তারপরে চাকরি চলে গেছে। সে আসত মায়ের কাছে।

তাই বা কেবল বলি কেন। ডাক্তার যদি বলতে হয়, শহরের বাজারের কাছে বড় রাস্তার উপরে অতবড় যার ডাক্তারখানা, সেই নীলমণি ডাক্তারকে আমাদের বাড়িতে আসতে দেখেছি। অমন সুন্দর ভদ্রলোকের মতো চেহারা। রিকশা, গাড়ি ছাড়া চলে না। যখন দেখবে, তখনই তার ডাক্তারখানা ভরে রুগি। মায়ের কাছে তাকে আসতে দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। প্রথম যেদিন শহরের নাম করা নীলমণি ডাক্তারকে আমাদের ছিটেবেড়ার আগলের ধারে, গামবিল গাছের তলায় দেখেছিলাম, ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, মায়ের বুঝি তবে কোনও ভারী রোগ হয়েছে। না হলে এত বড় ডাক্তার আসবে কেন?

আমি তখন ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এঁটো হাত ধুচ্ছিলাম। পিসির হাতে ব্যাটারির বাতি জ্বলছিল। তাতেই দেখতে পেয়েছিলাম, নীলমণি ডাক্তার কেঁচা ধরে সাবধানে পা ফেলে উঠোনের দিকে আসছে। তার হাতের আঙুলের আংটিতে ঝলক দিচ্ছিল। আমি ঘটি হাতে অন্ধকারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে কেউ দেখতে পায়নি। পিসির পেছু পেছু ডাক্তার মায়ের ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল।

আমাদের দুটো ঘর ছিল। দুটোই ইটের দেওয়াল, টালির চাল। যে ঘরটার সঙ্গে ছোট মতো রান্নার চালা ছিল, আমি সেই ঘরের মেঝেতে শুতাম। যখন থেকে মায়ের ঘরে লোক আসাআসি শুরু হয়েছিল, তখন থেকে আমি সেই ঘরেই শুতাম। একলা না, পিসি এসে আমার কাছে বসত। ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত বকবক করত, আর ভাজা মদ খেত। এখনও পর্যন্ত বুঝি না, ভাজা মদ কেন বলত? দেখতাম, বোতল থেকে অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে মদ ঢেলে আগুন জ্বেলে গরম করে নিচ্ছে। তারপর চায়ের মতো চুমুক দিয়ে দিয়ে খেত। তার নাম বুঝি ভাজা মদ। কে জানে ছাই। বলত, গা হাত পা বড্ড কামড়াচ্ছে। একটু ভাজা মাল খাই। খেতে খেতে আগড়ম-বাগড়ম বকত। কথার কোনও মাথামুণ্ডু ছিল না। আমি কিছুই বুঝতাম না। আমার বোঝবার মতো কথা সে বলত না। আমার কাছে এসে বসতে হত। তাই ইচ্ছে করলে আমার পাশে শুয়ে পড়ত। শুয়ে শুয়েও বকবক করত! পাড়ার লোকজনকে যখন গালি দিয়ে কথা বলত, তখন আমার বেশ মজা লাগত। ওই যে বাপভাতারি পুনি মুখ নেড়ে নেড়ে কথা বলতে আসে, ভেবেছে আমি ওর বিত্তান্ত সব জানি নে। যিদিন ফঁস করব, সিদিন বুঝবে। পুনি আমাদের পাড়ার দুলির মায়ের নাম ছিল। পিসি খুব লাগসই গালি দিতে পারত। কোনও ব্যাটাছেলেকে গালি দিতে হলে বলত, মেয়ে মেগো। আমার মায়ের মুখে কোনও দিন অমন একটা খারাপ কথা শুনিনি। মা তো এমনিতে খুব ভালমানুষ ছিল। পাড়াতেও মায়ের সঙ্গে কারোর ঝগড়া ছিল না। বরং মায়ের বেশ সুনাম ছিল।

সেই মা কেমন করে বেশ্যা হয়েছিল বুঝি না। পয়সার অভাব তো কত লোকের থাকে। তা বলে গরিব বিধবা ঘরে লোক ঢুকতে দেয় নাকি? পিসির ফোঁসলানি ছিল ঠিক। রাত পোহালে, মা বেটিতে কী খাব তারও ঠিক ছিল না। মাথার ওপরে একটা পুরুষ থাকা যে কত বড় কথা, সবাই বুঝবে না। তখন যদি আমার দশ বারো বছরের একটা ভাইও থাকত, তা হলেও বোধ হয় মা নষ্ট হতে পারত না।

এখন পুরুষে ঘেন্না। কিন্তু পুরুষ যে মেয়েমানুষের কত বড় শক্ত ঠাই, বুঝতে পারি। আজকাল দেখি কত মেয়েমানুষ, কত বড় বড় চাকরি করে কত লেখাপড়া শিখছে। তাদের কথা আমি ছাই কী বুঝি। কত জন্মের পুণ্যের ফল না জানি তাদের ভাগ্যে আছে। চাকরি করে, টাকা রোজগার করে, ইচ্ছে মতন বিয়ে করে। খেতে না পেয়ে শরীর তো বেচে না। তবে, অনেক অনাচারের কথাও শুনি সে সব আবার বেশ্যারও অধম। কেন বাপু, এত টাকা রোজগার করছ, দশজনে এত নাম করছে, এত লেখাপড়া শিখেছ, আবার দশটা পুরুষের সঙ্গে ঢলিয়ে বেড়ানো কেন? কী জানি, লেখাপড়া শিখে চাকরি করলে তাদের রকমসকম আবার বদলেও বা যায়। নিজে কি আর এ সব দেখতে যাই। লোকজন আসে, তাদের মুখেই শুনি। আমরা আর ও সব খবর জানব কোথা থেকে। এখনও পুরুষ মানুষের অভাব হয়নি। যত দিন শরীর গতর আছে, অসুখবিসুখ না থাকলে, তত দিন টাকাও আছে। রেবা যেমন বলে না, দেখিস, গেরস্থ ঘরের ছুড়িরা আমাদের ভাতে মারবে।

জিজ্ঞেস করলে বলে, ভয় তো পেট হবার। এমন তো না যে সব নিখাগির মা। ইচ্ছে ষোলো আনা। তা যা সব ওষুধবিষুধ আর ব্যবস্থা চালু হচ্ছে, তাতে আর কেউ আমাদের কাছে আসবে না।

কথাটা কতখানি সত্যি, আমি বুঝি না। তবে এদিকে ওদিকে তো যাই। হোটেলে বারে, নানানখানে, এত যে মেয়ে দেখতে পাই সব তো আর আমাদের মতো বেশ্যা না। কিন্তু তাদের চাল-চলন পোশাক। মদ খাওয়া ঢলানো সব দেখলে, আমারই এক একসময় তাক লেগে যায়। এ সব বেশি বাড়াবাড়ি হলে, জল ভাত হয়ে গেলে, আমাদের ব্যবসাও একদিন উঠে যাবে। এমনিতেই তো সব বড় বড় মানুষেরা আমাদের পেছুতে লেগেই আছে। যত দোষ নন্দ ঘোষ। আমাদের ব্যবসা তুলে দিতে পারলেই দেশটা যেন ভাল হয়ে যাবে। আর আন মেয়েমানুষের কাছে যাবে না, তাদের কথা ভাববে না। হয়তো তাই হবে। তা বলে কি মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করা বন্ধ হয়ে যাবে। হোটেলে, বারে, পার্কে, ময়দানে, গঙ্গার ধারে আমাদের পাড়ার মেয়ে আর কটা যাচ্ছে। তবু মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি কি আর চলছে না?

তবে সেই তো এক কথা না। আমি বলি, যে মেয়েমানুষরা লেখাপড়া করেছে, তাদের ভাগ্য অনেক ভাল। অনেক পুণ্যের ফল তাদের আছে। আমাদের কাছে যারা আসে, তাদের অনেককেও তো জানি! যা আয় সবই বেশ্যায়ঃ নমঃ। তাদের মতো লোকদের বউ, যারা লেখাপড়া জানে তাদের মাথায় তো ভগবানের হাত ছোঁয়ানো আছে। লেখাপড়া জানে বলে, তবু শরীর বিক্রি করে তো খেতে হয় না। তারপরে যার যা মনে আছে সে তা করবে, তাতে কার কী বলার আছে। এমন যে আমাদের বেশ্যার শরীর, মরণ নেই, তারও খিদে আছে। ময়রায় নাকি সন্দেশ খায় না। কে আর তা দেখতে যাচ্ছে। মাথার দিব্যি তো দেওয়া নেই। খায় না, ঘেঁটে ঘেঁটে আর ভাল লাগে না, বিশ্রী লাগে। তা বলে কি, খিদের মুখে কোনও সময় আর ভাল লাগে না। তাও কথা আছে। শরীর আর সন্দেশে তফাত আছে। মন বলে একটা কথা আছে তো! শরীর মনের বশ! যেদিক দিয়েই হোক। মন যদি না বলে তো না। হ্যাঁ বললে হ্যাঁ। শরীরের এইটাই যেন ধর্ম। এমনিতে বেশ আছি। নদীর জল নেমে চলেছে তো নেমেই চলেছে। আবার জোয়ারও আসে। জোয়ারের বেলা আলাদা কথা। যার যেমন, তার তেমন। কারোর কারোর একজন মানুষকে ভাল লাগে। সে খুব ভাল কথা। আমি তো আজ অবধি বুঝতে পারলাম না, ঠিক কোনটিকে ভাল লাগে। অল্প বয়স, শান্ত শিষ্ট, হাসি খুশি, লাজুক, পেটে একটু বিদ্যা আছে কিন্তু জামাই জামাই ভাব, আমার ভাল লাগে। ময়রা হলেও, তখন সেই সন্দেশের জন্য খিদে পায়।

আবার রাণুর মতো মেয়েও তো আছে। বিকেল থেকে সেজেগুজে তৈরি। লোক না এলেই মাথা খারাপ। যত সময় যায় রাণুর মেজাজ ততই চড়ে। আমরা মনে করি, যতক্ষণ কোনও খদ্দের না আসে, ততক্ষণ মদ হেঁব না। বলা তো যায় না, কেমন লোক আসবে। মদ খাওয়া পছন্দ করে কি না। তা ছাড়া, সন্ধেরাত্রে, সাত তাড়াতাড়ি নিজের গাঁটের পয়সা দিয়ে, মদ খেতেই বা যাব কেন? যাদের খাওয়াবার, তারাই খাওয়াবে। আর যদি দেখি, ও সবের নাম গন্ধ নেই, লোক আসছে, চলে যাচ্ছে, তখন দর নেবার জন্য গাঁটের পয়সায় মদ কিনতেই হয়। আদায় করেও নেওয়া যায়।

রাণুর তা না। লোক না আসতে থাকলেই মাথা খারাপ। তাও বলি, মাঝে মাঝে এমন দিন কার না যায়, ঘরেতে ছুঁচোটিও ঢোকে না। মা লক্ষ্মী কি আর সব দিন সহায় হয়। তার ওপর আজকাল তো এমনিতেই নানা গোলমাল লেগে আছে। রোজই যেন হাঙ্গামা বাড়ছে, দিনকাল খারাপ হয়ে পড়ছে। আর হাঙ্গামা-হুঁজ্জোত বাড়লেই, আমাদের পাড়ার দিকেই যত নজর। যেন যত বজ্জাত লোকেরা সব আমাদের পাড়াতে এসেই ঘাপটি মেরে আছে। সেইজন্য রেবার কথা এক এক সময় সত্যি বলে মনে হয়। ও সব হাঙ্গামা-হুঁজ্জোত যারা করে, তারা আজকাল আর এ পাড়ায় আসে না। মেয়েছেলের জোগান তাদের অন্য জায়গা থেকেই হয়। সেই জন্য বাড়িওয়ালারাও আজকাল খুব হুশিয়ার হয়ে গেছে। সব মেয়েকে ডেকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছে, দেখে শুনে লোকজন ঘরে নেবে। কোনও রকম বিপদে আপদে যেন পড়তে না হয়।

রাত দশটা বাজতে না বাজতে, রাণুর মাথা খারাপ। লোক না এলে, মন খারাপ হয়।

রাণুর মতো মাথা খারাপ কারও হয় না। শুরু হবে মদ খাওয়া। একটু মদ খেয়েই, গালাগালি দিতে। আরম্ভ করবে বনোয়ারী বেচারিকে। বনোয়ারী ওর চাকর! সকলেরই একজন করে চাকর থাকে। একটি ঘর, একজন চাকর। ব্যবসা করতে গেলে, এ দুটি না হলে একেবারে অচল। বনোয়ারী বেচারি কী করবে। এত বড় একটা তাগড়া জোয়ান, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালাগালি শুনতে থাকে। বনোয়ারী বাঙালি না হতে পারে, এ দেশে থেকে থেকে, আমাদের সঙ্গে কথা বলে বলে বাংলা সবই বুঝতে পারে। বলতেও পারে। রাণুর যা মুখ খারাপ। কী খিস্তিই না করে বনোয়ারীকে। শুনে আমাদেরই কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে। রাণুর গালাগাল খেউড় শুরু হয়। আমরা নিজেদের দিকে চোখে চেয়ে, মুখ টিপে হাসি। জানি তো, তার পরেই কী ঘটবে। তবে সে হাসি যদি এক বার রাণু দেখতে পায়, তা হলে আর রক্ষে নেই। তার চৌদ্দ পুরুষকে ধুয়ে দেবে।

বনোয়ারী বারে বারে রাস্তায় যায়, যদি কোনও তোক ধরে নিয়ে আসা যায়। চাকর হয়ে ওকে তখন দালালের কাজ করতে হয়। কিন্তু কপাল মন্দ থাকলে আর কী করা যাবে। খদ্দের তো আর রাণুর ইচ্ছে মতন আসবে না। গালাগালির পরে শুরু হয়, ঘরের মধ্যে থালা-বাসন ছড়ানো। বনোয়ারী তাড়াতাড়ি সব সামলাতে যায়। গেলেই মারধোর। বেচারি বনোয়ারীকে মেরেধরে আর কিছু রাখে না। সে কী যে সে মার! মারতে মারতে রাণুর জামা কাপড়ের হুশ থাকে না। দরজা খোলা অবস্থাতেও ওর কাপড় চোপড় খুলে পড়ে। বনোয়ারীকে তখন নিজের মালকাইনের শরম রক্ষা করার জন্য মার খেতে খেতেই দরজা বন্ধ করে দিতে হয়। দরজা বন্ধ হলেই সব ঠাণ্ডা। আর শব্দটি নেই। আমাদেরও শান্তি।

পরদিন রাত পোহালে, দেখতে হয় বনোয়ারী বেচারিকে। সে আর মুখ তুলে আমাদের কারোর দিকে তাকাতে পারে না। মাথা নিচু করে বাজারে চলে যায়। মালকাইনের ফাঁই ফরমাশ খাটে। আমাদের মধ্যে যারা একটু মুখফোঁড় মেয়ে, তারা ভয়ে রাণুর দরজার দিকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, কীরে বনোয়ারী, তোর মালকাইনকে ঠাণ্ডা করলি কী দিয়ে। বনোয়ারীর সে কী লজ্জা। আমরা হেসে বাঁচি না। তার মুখে কথাটি নেই। যেন শুনতেই পায় না। চুপচাপ নিজের কাজ করে।

তাই ভাবি, রাণুর মতো মেয়েও আছে। তার সঙ্গে আমাদের কারোর মেলে না। ওটা যেন ওর ডাল-ভাত খাবার মতো একটা অভ্যাস। সন্ধে হলেই লোক চাই। আমার মনে হয়, সে সময় ও টাকা পয়সা রোজগারের কথাও ভাবে না। একজন লোক এলেই হল। তারপরে আর সারা রাত্রের মধ্যে লোকজন না এলেও, রাণুর কোনও আপত্তি নেই। বেশ হেসে গল্প করে সময় কাটিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ভাবি, বনোয়ারীটা কী ভাবে। আমরা তো চাকরকে নিয়ে কিছু ভাবতেও পারি না। বনোয়ারীকে দেখে শুনে মনে হয়, বেশ খুশি। তবে একটা কথা কী, রাণুর সঙ্গে ওর যা সম্পর্কই থাকুক, আমাদের কারোকে কোনও দিন অন্যথা দেখেনি।

যাকগে ছাই, এখানে কত মেয়ের কত রোগ-ব্যামো আছে রাণুর মতো। ও সব কি ভেবে শেষ হয়। আমার মায়ের কথা বলি। কত রকম অভাবে অনটনেও তো মানুষ চালায়। সকলের ঘরে যে ছেলে হয় বা পুরুষমানুষ থাকে, এমন কথা নেই! তবু মা নষ্ট হয়েছিল। আমার যেন কেমন মনে হয়, আমার একটা ভাই থাকলে, মা তাকেও গ্রাহ্য করত না। তা না হলে, কেবল টাকার জন্যই মা ঘরে লোক আসতে দিত। আমার বিশ্বাস হয় না। টাকার দরকার ছিল, না হলে অন্য আর কীভাবে পেট চলত, আমি জানি না। মায়ের অন্য রকম ইচ্ছেও ছিল। সে সব আমি বুঝতে পেরেছি। ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে একটা জিনিস আছে। বোঝা যায় তো।

প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম না। পিসি কেন আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে শুয়ে বসে থাকে! বাবার ঘরে কেন আমাকে যেতে দেয় না! ও ঘরে একটা খাট ছিল। বাবা মরে যাবার পরে, আমি আর মা সেই খাটেই শুতাম। বুঝতাম না, মা কেন সন্ধে হলেই সাবান দিয়ে গা ধুয়ে শাড়ি পরে। বাবা মরে যাবার পরে তো মা থান কাপড় পরত। দিনের বেলা সবসময়ে থান পরেই থাকত। সন্ধে হলেই, শাড়ি জামা পরত। চোখে কাজল দিত। চুল আঁচড়ে খোঁপা বাঁধত। কপালে বা সিথেয় সিঁদুর পরত না। পায়ে আলতাও না। মায়ের তো এমনিতেই আঁটোসাঁটো মজবুত গড়ন ছিল। মুখ চোখের ছিরিও খারাপ ছিল না। ভাল খাওয়া-পরা জুটত না বলে, আগে একরকম পাঁচি পাঁচি দেখাত। তবু লোকে বলত, অমতাঁর বউটি দেখতে বেশ। পিতিমের মতো গড়ন পেটন।

বাবার নাম অমৃত ছিল। অমৃতলাল চৌধুরি। তা সে অমর্তের পিতিমের মতন বউটি, পরে সত্যি পিতিমের মতনই দেখতে হয়েছিল। ঘুরিয়ে কাপড় পরে, জামা গায়ে দিয়ে নিজেকে দেখত, তখন সত্যি ভাল লাগত। দিনের বেলা পাড়ার মেয়েমানুষেরা বলত, বিধবা হয়ে অমর্তের বউয়ের রূপ খুলেছে। এখন বুঝতে পারি, ও সব কথা আসলে ঠেস দেওয়া কথা। মুখের সামনে খোলাখুলি কেউ কিছু বলত না। তারপরে নীলমণি ডাক্তার সেই যখন এসেছিল, আমি ভাবলাম, মায়ের বুঝি কোনও ভারী অসুখ করেছে। আমি অন্ধকার উঠোন দিয়ে, সেই ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখেছিলাম, খাটের কাছে নীলমণি ডাক্তার দাঁড়িয়ে আছে। মা তার গায়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। নীলমণি ডাক্তার মায়ের চিবুক ধরে মুখটা তুলে দেখছিল, আর বলছিল, বাঃ খাসা। নন্দ তোমার ধুকড়ির মধ্যে এমন খাসা চাল ছিল, আগে কোনও দিন বলনি তো।

পিসিকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। সে ঘরের অন্য দিকে ছিল। আমি যে ছাই বাইরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, মায়ের অমন সাঙা দেখছি, তা আর কে জানবে বা দেখবে। পিসি তো বাইরের আগলে শেকল জড়িয়ে, তালা মেরে এসেছে। আমি ছোটখাটো মেয়েটা খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছি, কে আর দেখছে। নীলমণি ডাক্তারের কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মায়ের গুণ গাওয়া হচ্ছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আমি পিসির গলা শুনতে পেয়েছিলাম, খাসা চালের খাসা দাম দিতে হবে ডাক্তারবাবু। অভাবে গেরস্থ ঘরের সামৰ্থ বেধবা বুঝতেই তো পারছেন।

নীলমণি ডাক্তার কোনও জবাব না দিয়ে মাকেই দেখছিল। তার চওড়া মস্ত ফরসা মুখে হাসি। মায়ের চিবুক ধরে তেমনি দেখছিল। আর মা তখন লজ্জায় ডাক্তারের দিকে তাকাতে পারছিল না। চোখের তারা অন্য দিকে ছিল। তবে মায়ের ঠোঁটেও হাসি দেখতে পেয়েছিলাম। ডাক্তার মায়ের গলা জড়িয়ে সামনে টেনে নিয়েছিল। এমন ভাবে মায়ের গায়ে হাত দিচ্ছিল, আমি যে এতটুকু মেয়ে, আমারই যেন কেমন করছিল। ডাক্তারের কোঁচাটা মাটিতে লুটোচ্ছিল। একটু যেন টলছিলও। সেই সময়েই কী হল মা খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ঠেলে দিয়ে আড়ালে সরে গিয়ে বলল, দেখ তো নন্দদিদি, বাইরের উঠোনে ওটা কী। মানুষ না তো? নাকি শেয়াল কুকুর কিছু?

শোনা মাত্রই আমি অন্য ঘরের দিকে ছুট দিয়েছিলাম। অন্ধকার চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে দরজার কাছে পড়ে গেছলাম। পিসি আমার পেছনে পেছনে ছুটে এসেছিল। চিৎকার করে বলেছিল, অ মা, এ যে তোর মেয়ে। বলেই আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে গালের মাংসে অন্তর টিপুনি দিয়েছিল। খেঁকিয়ে বলেছিল, ওখানে কী করছিলি, অ্যাঁ?

আমার কী যে হয়েছিল ভগবান জানে। পিসির ওপর আমি কোনও দিনই খুশি ছিলাম না। তার ওপরে ও রকম গালে চিমটি, ধমক দেওয়া। আমার যেন মাথা খারাপ হয়ে গেছল। পিসি যে সব গালাগালি দিত, আমি সেই সবই তাকে চেঁচিয়ে বলেছিলাম, তবে রে বাপভাতারি মাগি, ছেলেভাতারি হারামজাদি, আমাকে তুই মারছিস? কুটনি। কুর্তি। সেই দিনের আগে আমি নিজেও জানতাম না, ও সব গালাগালি আমি জানি! কারোকে ও সব বলতে পারি। তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না।

পিসিও কম না। সে হল নন্দরাণী কুটনি। সে আমার চুলের মুঠি ধরে নেড়ে দিয়েছিল, পিঠে গুপ গুপ করে ঘুষো মেরেছিল, অ মা কী মেয়ে গো, কী সব্বেনেশে কথা গো। এ মেয়ে যে জগত ডোবাবে। কিন্তু আমি মার খেয়ে আরও মরিয়া। বুড়িটার হাত টেনে ধরে, এমন কামড়ে ধরেছিলাম, এক খাবলা মাংস তুলে নেবার দাখিল। তারপরে চেঁচামেচি চিৎকার। মা এসে আমাকে মেরেছিল! তবে। নীলমণি ডাক্তার চলে যায়নি! মায়ের মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

কত জানাশোনা লোক আসত মায়ের কাছে। নীলমণি ডাক্তার যে দিন প্রথম এসেছিল, সেইদিনের কথা আমি কোনও দিন ভুলব না। ও রকম ঘটনা তো আর কোনও দিন ঘটেনি। দেখেছি অনেক কিছু। মনে মনে বরাবরই রাগ হত। সাপের মতো ফুসতাম। বলতে সাহস পেতাম না। মুখ ভার করে থাকতাম। মা কী ভেবে, পরে আমাকে খুব আদর করত। রোজ সন্ধে হলেই যে মায়ের কাছে লোক আসত তা না। যে রাত্রে মায়ের কাছে লোক আসত না, সেই রাত্রে আমি মায়ের কাছে থাকতাম। আমার। বাবার খাটে শুতাম। তবে আমার ভাল লাগত না। কত লোক মায়ের কাছে সেই খাটে শুত। বাবা মারা যাবার পাঁচ মাসের মধ্যেই, পিসি মাকে রাজি করাতে পেরেছিল। বাবার মুখটা তখনও আমার এত মনে। ছিল, কিছুতেই ভুলতে পারতাম না। সেইজন্যই নতুন নরম রং-বেরঙের বিছানা পাতা সেই খাটে শুতে আমার ভাল লাগত না।

এই তো, আমার ঘরের দেয়ালে বাবার ছবি টাঙানো রয়েছে। অনেক দিনের পুরনো বাবার একটা। ছবি ছিল। হলদে হয়ে গিয়েছিল। টালির চালওয়ালা ঘরে ধোঁয়ায় আর ঝুলে ছবিটা একেবারে নষ্টই। হয়ে যাচ্ছিল। মনে হয়, বাবা কোনও সময় চৈতন্যদেবের মেলায় ফটোটা তুলেছিল। একলা, সঙ্গে কেউ নেই। আমার হঠাৎ কী খেয়াল হয়েছিল, বাবার একটা ছবি ঘরে রাখব। ছেলেবেলায় না, বড় হয়ে এ কথা আমার মনে হয়েছিল। কেন মনে হয়েছিল, তাও জানি না। এ লাইনে যখন পুরোপুরি চলে এলাম, পসার টসারও বেশ ভাল হয়ে উঠল, তখন মনে হল, বাবার একটা ছবি থাকলে আমার যেন ইজ্জত বাড়ে। এ পাড়ায় আরও কয়েক জনকে দেখেছি, তারা বাবা মা, এমনকী বিয়ে হয়ে থাকলে স্বামীর ছবিও দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। তাতে মনে হয়, বেশ্যা হলেও তাদের সব ছিল। আমারও মনে হচ্ছিল, বাবার একটা ছবি টাঙিয়ে রাখব। তাই সেই পুরনো ঝুলপড়া ছবিটা নিয়ে এসে, একজনকে দিয়ে ছবিটা বড় করে আঁকিয়ে রেখেছি। আমার তো আর স্বামী নেই, থাকলে তার ছবিও রাখতাম।

মনে আছে, দিনের বেলা মা এক রকম। আমাকে খুব আদর করত, ভালবাসত। রাত হলে মা আর আমার না। আমি সকালবেলা স্কুলে যেতাম। লেখাপড়ায় বেশ ভালই ছিলাম। আমার থেকে বয়সে বড়দের থেকে অনেক আগে আগে যুক্তাক্ষর শিখে নিয়েছিলাম। নামতা, যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ সব অঙ্কতেই প্রথম হতাম। আমি যখন ফোর ক্লাসে পড়ি, তখন সব ছেলেমেয়েরা আমার থেকে বড় ছিল। ননী মাস্টার আমাকে খুব ভালবাসত। সে জাতে বাগদি হলে কী হবে, মানুষটা খুব গুণের ছিল। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে ইস্কুলটা তৈরি করেছিল।

বাবা বেঁচে থাকতে, ইস্কুলে যাবার সময়, যা কোনও দিন পাইনি, মা তা-ই দিয়েছে। মা আমাকে অনেক পয়সা দিত। বাবা মারা গেল, মায়ের কাছে লোক আসতে লাগল, আমাদের অবস্থাও ভাল হতে লাগল। মা আমাকে আগে যত আদর করত, পরে তার চেয়ে বেশি করত। আমি একটু মুখ ভার করে থাকলে, মা আমাকে খুশি করার চেষ্টা করত। পয়সা দিত, খাবার দিত। ভাল ভাল জামা কিনে দিত। আমার একটু মুখ ভার করে, রাগ করে থাকার উপায় ছিল না।

কিন্তু এখন তো বুঝতে পারি, পেয়ে পেয়ে আমার নোলা বেড়েছিল। আমি আরও বেশি রাগারাগি করতাম। সবসময়েই কি আর তা বলে মেয়েকে খুশি করা যায়। সবকিছুর একটা সীমা আছে। তখন মার খেতাম। আর মা এক বার যদি রাগ করে, মার শুরু করত, একেবারে আধমরা না করে ছাড়ত না। সেই যে বলে, গোসাপে কামড়ে ধরলে মেঘ না ডাকলে আর ছাড়ে না, সেই রকম। কেউ এসে ধরে ছাড়িয়ে না দিলে চুলের ঝুটি ধরে আছড়ে, হাতের কাছে যা পেত তাই দিয়ে পিটিয়ে আর কিছু রাখত না। অমন রাক্ষুসি পিসি সেও বলত, দ্যাখ বউ, এই মেয়ে মেরে তুই কোনদিন জেলে যাবি। এ তো খুন করবার মার।

মা বলত, মরুক মরুক, এ হতচ্ছাড়া মরলে আমার হাড় জুড়োয়। জেলের ভাত খাব সেও ভাল। কোনও কিছুতে মেয়ের মন পাওয়া যায় না? পরে রাগের মাথায় মা মুখ খারাপ করতেও শিখেছিল, ভাতার খেয়ে এই খানকি-বিত্তি করছি, সে কি একলার পেট ভরাব বলে? চুঁড়ি ভেবেছে কী, অ্য। যখন তখন একটা না একটা কিছু চাই।

ও সব যাই হোক, মিছে বলতে পারব না, মা আমাকে ভালই বাসত। খাওয়া দাওয়া জামা কাপড়ে, কোনও রকম শখ আহ্লাদ, কোনও অভাব রাখেনি। আমিও মায়ের অনুগত ছিলাম। প্রথম প্রথম লোক আসা নিয়ে মায়ের ওপরে যে রাগ হত, সেটা কেমন যেন সয়ে গেল। একেবারে প্রথম দিকে কিছু। বুঝতে পারতাম না। সন্ধে রাত হলেই বাড়িতে কেন চুপিচুপি লোক আসে, মা কেন বাবার ঘরে দরজা বন্ধ করে দেয়, পিসি কেন আমার কাছ ছেড়ে নড়ে না, কিছু বুঝতে পারতাম না। আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছিলাম। তবে নিজের কাছে আর কি অস্বীকার করব, হতে পারে তখন আট বছর বয়স, সবই বুঝতে পারতাম। কুকুর বেড়ালের ব্যাপারও দেখেছি, মানুষের কাণ্ড-কারখানা দেখেছি। ওই বয়সেই।

কী ঘেন্নার কথা বাবা। নিজের কথাই বলছি। কিছু যে তেমন করে বুঝতে পারতাম তা না। কিন্তু হাঁ করে দেখতে দেখতে গায়ের মধ্যে কেমন করে উঠত। কেমন যেন বুক গুর গুর করে শিউরে শিউরে উঠত গায়ের মধ্যে। অথচ ভয় করত। কুকুর বেড়ালকে দেখে আবার ভয় করে নাকি। যদি একসঙ্গে কয়েকজন থাকতাম তা হলে ও রকম কিছু হত না। সবাই মিলে কুকুর বেড়ালকে ইট মারতাম। ছেলেগুলো ছিল আরও পাজি। তারা আবার কুকুরদের বাঁশ নিয়ে তাড়া করত। মারত। ছি ছি। এখন ভাবলেও খারাপ লাগে।

তবে একলা একলা দেখলেই কেমন যেন লাগত। আজ শরীরের যে অঙ্গ আমার ভাত কাপড়, সেখানেই যত অনাচ্ছিষ্টি ভাব। তারপরে কখনও মনে পড়ে আমাদের বাড়িটা পেরিয়ে গেলে, হাজরাদের পোড় ছিল। ভাঙাচোরা বাড়ি, জঙ্গল। ভিটের কাছাকাছি বিশেষ যেতাম না। ভয় ছিল ওখানে গোখরো সাপ আছে। সেই পোডোর খোলা জায়গায় আমরা এককা-দোককা কপাটি খেলতাম। এখন এই কলকাতার বেশ্যাপাড়ায় বসে সে কথা যেন ভাবা যায় না। হাজরাদের পোড়োয় কত খেলা খেলেছি। কত ফড়িং ধরেছি। প্রজাপতি ধরা মানা ছিল। প্রজাপতি ধরলে নাকি বিয়ে হয় না।

পোড়াকপাল! হয়তো যে মেয়ে ছেলেবেলায় প্রজাপতি ধরেছে, তার চারটে বিয়ে হয়ে গিয়েছে। গণ্ডায় গণ্ডায় ছেলেমেয়ে। ও সব কথার কোনও দাম নেই। কথার কথা। সেই ছেলেমানুষ বয়সে ও সব কথা বুঝতে পারতাম না। হাজরাদের পোডড়াটায় অনেক কাণ্ড হয়েছে। অকাজ কুকাজও কম হয়নি। কম হয়নি বলতে এমন না যে অনেক দিন অনেক কিছু করেছি। ভাবি, ভগবান কি সেই জন্যই আমাকে এমন অভিশাপ দিল। আমি কি সেই জন্যেই বেশ্যা হলাম। ভগবান সেই জন্যই কি সকলের কাছ থেকে আমার জামাকাপড় কেড়ে নিয়ে ল্যাংটো করে দিল। তাই যদি হবে, কণার কেন তা হল না। কণার তো কত ভাল বিয়ে হয়েছে। ভাল ঘর ভাল বর, কী না পেয়েছে। মায়ের কাছে শুনেছি। তিনটি ছেলেমেয়ে হয়েছে। স্বামী মস্ত বড় চাকরি করে। মনে হয় সুখেই আছে।

সুখে আছে কি না জানি না। বিয়ে করা কত বড় চাকুরে তো আমাদের কাছেও আসে! বুঝি তাদের। অনেকের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বিলেতে পড়তে গেছে। তবু আমাদের কাছে আসে। সেটা অবিশ্যি বউয়ের বয়স হয়ে গেছে বলেই তো আসে। ব্যাটাছেলেদের তো খেয়াল থাকে না। তাদেরও বয়স হয়, বুড়ো হয়। চাকরি বাকরিতে বাইরে থাকে, পকেটে পয়সাকড়ি থাকে। সে যা খুশি করে। তবে এক তরফা ভেবে তো লাভ নেই। অনেক গেরস্ত মেয়েছেলেও আছে, ঘরে তার দশ রকমের নাগর। ঘরে বাইরে বলে কিছু না। যার যেমন রুচি আর ইচ্ছে। মন করে আমার খাজনা খাজনা, কে করবে আমার হরি ভজনা, সেই গোত্র। মন যাদের খাজনা খাজনা করে, তারা খাজনার তালেই থাকে।

তা সে যার যাই হোক, আমার এখনও কেমন যেন মনে হয়, সে আমাকে কোনও দিন ভাল চোখে দেখেনি। ভগবানের কথা বলছি। সে কণাকে ক্ষমা করেছে। আমাকে ক্ষমা করেনি। কিন্তু আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, তখন কি আমার বোঝবার ক্ষমতা ছিল। কণার যদি কোনও পুণ্যে তাকে ক্ষমা করে থাক, আমি অবুঝ ভেবে আমাকেও ক্ষমা করতে পারতে। হাজরাদের পোড়োয় সেই যে আসশ্যাওড়ার জঙ্গলে জামা আর ইজের খুলে শুলাম, সেই থেকে আমাকে আর জামাকাপড় পরতে দিলে না। মনে হয় যেন। সেই সময়, সেই দুপুরবেলাতেই তুমি যেন আমাকে শাপ দিলে, এমনি করে, এই করেই তোর সারা জীবনটা কাটুক। আমার যেন তাই মনে হয়। আর তো কখনও নিজের ইচ্ছেয় কিছু করিনি। এখন মাঝে মাঝে যাকে ইচ্ছে বলতে ইচ্ছে করে সে তো আমার ইচ্ছে না। অনেক দিন খিদে মরে মরে হঠাৎ এক দিন একরকমের খাবার দেখলে যেমন খেতে ইচ্ছে করে, এ সেই রকম। তার মধ্যে মন থাকে না। যদি বা কোনও দিন কখনও কারোর জন্য মনটা একটু নাচে, তবে সেও পুতুল নাচের মতো। এ জীবনে ধরে রাখার কিছুই নেই। ধরা দেবার মতো ধরা কেউ কখনও দেয় না।

তখন সাত বছর সবে পার হয়েছি। তখন ইচ্ছে বা অনিচ্ছে, তাও কিছু জানি না। একটা খেলার মতো মনে হয়েছিল। ঈশ্বর, তোমাকে বলা যা, আমার এ খাতায় লেখাও তা-ই। মেয়েমানুষটা বসে আছি, তার সবকিছু সবাই দেখতে পায় না। তুমি দেখতে পাও। খেলা খেলবার দশ-বারো দিন আগে, হাজরাদের পোড়ো পেরিয়ে লক্ষ্মীদের বাড়ি যাচ্ছিলাম! লক্ষ্মীদের বাড়ি যাবার আগে, রাংচিতের বেড়া-ঘেরা বলাই কাকাদের বাড়ি পড়ত। বলাই কাকা যেমন তাগড়া জোয়ান তেমনি গোঁয়ার ছিল৷ দেখলে ভয় লাগত। একটা কারখানায় সে কাজ করত। কত দিন দেখেছি, চোখ লাল করে বাড়ি ফিরেছে। শুনেছি মদ খেত। কাকিমাকে নাকি মারধোর করত।

লক্ষ্মীদের বাড়ি যেতে গিয়ে দেখলাম, বলাই কাকার বাড়িটা নিঝুম চুপচাপ। এমনিতে ও বাড়িতে কোনও দিন যেতাম না। রাংচিতের বেড়ার মাথার ওপর দিয়ে দেখলাম, উঠোনের পেয়ারাতলায় একটা পাকা পেয়ারা পড়ে আছে। পেয়ারাটা দেখে কিছুতেই লোভ সামলাতে পারলাম না। বলাই কাকাদের বাড়ির পেয়ারাগুলো খুব ভাল। কাশীর পেয়ারার মতো সুন্দর আর মিষ্টি। বাড়িটাও নিঝুম। মনে করেছিলাম, বাড়িতে সবাই বুঝি ঘুমোচ্ছে। ভেতরে যাবার দরজাটাও খোলা। কিছুই তো না। পা টিপে টিপে যাব, টুক করে পেয়ারাটা কুড়িয়ে নিয়ে দৌড় দেব। তারপরে লক্ষ্মীকে অর্ধেক দেব, আমি খাব। তা ছাড়া টের পাবেই বা কে। বলাই কাকাদের বাড়িতে কে-ই বা আছে। বাড়িতে কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না। নতুন বিয়ে না হলেও ছেলেমেয়ে হবার মতো সময় হয়েছিল। বলাই কাকার মা সারা দিনই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পা টিপে টিপে গিয়ে পেয়ারাটা যেমনি তুলেছি, ঠিক পেতনির হাসির মতো একটা শব্দ শুনে চমকে গিয়েছিলাম। ভর দুপুরবেলা অমন হাসি শুনলে কার বুকের রক্ত না হিম হয়ে যায়। প্রথমে মনে হয়েছিল, শাঁকচুন্নিটা পেয়ারা গাছের ওপরেই বোধ হয় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। নড়লে ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। পেয়ারাটা আসলে একটা ফাঁদ। বুকের মধ্যে দিয়ে কী যে করছিল। আমি রাম রাম করছিলাম।

কিন্তু তারপরই গোঙানো মতো একটা শব্দ শুনে আবার চমকে উঠেছিলাম। সোজা খাড়া হয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। গাছের দিকে কিছুতেই তাকাইনি। দৌড় দেব ভাবছি, তখনই আবার সেই পেতনির মতো হাসিটা শুনতে পেলাম। তখন মনে হল, ওটা ঠিক কোনও পেতনির হাসি না, কোনও মেয়েমানুষের হাসি, আর হাসিটা আসছিল বলাই কাকাদের ঘর থেকে।

বলাই কাকাদের ঘর ছিল মাথায় টালি, মাটির দেওয়াল। সে দেওয়ালের মাটিও এক-এক জায়গায় ধসে পড়েছে। বাঁশ বেরিয়ে পড়েছে। কারখানার কাজ করে যে মানুষ এত মদ খায়, তার মাটির দেওয়াল খসে খসে পড়বে না তো, কার পড়বে। কিন্তু হাসিটা কার! কাকিমার নিশ্চয়ই। কাকিমা কি পাগল নাকি যে, একলা ঘরে হাসছে। তার ওপরে আবার সেই মোটা গলার গোঙানো স্বর। ঠিক যেন একটা হুমদো। কুকুরের মতো। কেমন মনে হয়েছিল, ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখি।

চারপাশে এক বার তাকিয়ে নিয়ে, পা টিপে টিপে এক দিকের দেয়ালের কাছে গিয়ে উঁকি দিয়েছিলাম। অনেকখানি ফঁক ছিল। মানুষের মাথা ছাড়ানো উঁচুতে দুটো ছোট ছোট জানালা ছিল। জানালা দুটো খোলা, ঘরে আলো পড়েছিল। কিন্তু হে ভগবান, উঁকি মেরে আমি যেন কেমন কাঠ হয়ে গেছলাম। আমার যেন একটুও নড়বার চড়বার ক্ষমতা ছিল না। দেখেছিলাম, বলাই কাকা আর কাকিমা, কারোর গায়ে এক চিলতে কাপড় বলতে কিছু নেই। ভেবে পাচ্ছিলাম না, দুজনে কি মারামারি করছে, নাকি হিন্দুস্থানিদের মতো কুস্তি করছে। সেই অবস্থায় দুজনে শুচ্ছে বসছে হুড়োহুড়ি দাপাদাপি করছে। কাকিমা থেকে থেকে হেসে উঠছে আর বলাই কাকার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কাকিমা যদি হেসে না উঠত, তা হলে আমি ভাবতাম, বলাই কাকা নিশ্চয়ই কাকিমাকে খুন করছে। যেভাবে জাপটে ধরে চেপে ধরছিল, তাতে মানুষের মরে যাবার কথা। আর বলাই কাকাকে যে অবস্থায় দেখেছিলাম, ভগবান, আর আমার সে বিষয়ে তো কোনও লজ্জাই রাখা হয়নি। কামুক উত্তেজিত ল্যাংটো পুরুষের শরীর দেখেই তো আমাদের সন্ধে লাগে। গেরস্থের বাড়িতে শাঁখ বাজে। যদি মন্দিরের ঠাকুরের কথা বলি, তবে তাও সেই ল্যাংটো পুরুষ দর্শন করেই আমাদের সন্ধে হয়। কিন্তু জীবনে সেই দিন প্রথম একজন পুরুষকে সেই অবস্থায় দেখেছিলাম। তখন সবে সাত পেরিয়েছি। আমার মনে কোনও পাপ ছিল না। শরীরে কোনও সাড়া ছিল না। না, তাই বা বলি কেমন করে। শরীরে যে আমার কিছু হয়নি, তা বলব কেমন করে। সেই জন্যই তো ভগবানকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, সে কি কেবল আমার, এই একটি মেয়ের, যার শরীরেই অনেক পাপ ছিল। নাকি সকল মেয়ে জাতের মধ্যেই এমনটি আছে। কতক্ষণ আমি ও রকম দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, এমন আর মনে করতে পারি না। বলাই কাকা আর কাকিমাকে ঠিক কুকুর বেড়ালের মতো দেখাচ্ছিল।

তবে কুকুর বেড়াল দেখে যেমন শরীরের মধ্যে কেমন একটা ভাব হত, তাদের দেখে সেই রকমই হয়েছিল। কিন্তু তার থেকে যেন বেশি কিছু। যতটা ভয়, ঠিক ততটাই শিউরোনি। আমার শরীরের মধ্যে। যেন কী হচ্ছিল। মেয়ে আর পুরুষ ওইসব করে। তার একটা এ রকম ধারণা ছিল। ধারণাটা কিছুই নয়। সমস্ত ব্যাপারটা যেন আরও ভীষণ অন্য রকম। কিছুক্ষণ পরেই আমার যেন গোটা শরীরে একটা ধাক্কা লাগল, আমি উঠোনের দিকে তাকালাম। কেউ না, কিছুই না। উঠোন, রোদ, গাছপালার দিকে তাকিয়েই আমি যেন শরীরে বল পেয়েছিলাম। একছুটে লক্ষ্মীদের বাড়ি চলে গেছলাম। তারপরে দেখেছিলাম, হাতের পেয়ারাটা বাদুড়ে খাওয়া। ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম।

এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, বাদুড়ে খাওয়া পেয়ারাটা দিয়ে কি ভগবান আমাকে ঠাট্টা করেছিল। এখন সমস্ত ঘটনাটা মনে হলে, মনে হয়, কী যেন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছিল। ভেবেছিলাম, লক্ষ্মীকে ঘটনাটা বলব। বলতে পারিনি। পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমার মনেও ছিল না। ইস্কুলে চলে গেছলাম। ইস্কুলে এক বার কথাটা হঠাৎ মনে হয়েছিল। তারপরেও সারা দিনে কয়েক বার মনে পড়েছিল।

কথাটা আমার মায়ের জন্য না। তবে, বলাই কাকা আর কাকিমার ব্যাপারটা মনে পড়ত মায়ের কাছে লোক এলে, যখন বাবার ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যেত। কী যে খারাপ লাগত। যাই হোক, আমার কথাই বলি। আমরা তো শুধু মেয়েরাই খেলা করতাম না, ছেলেরাও আমাদের সঙ্গে খেলত। সবাই আমরা সমবয়সি। আমাদের কারোরই নিজেদের মধ্যে তেমন লজ্জা ছিল না। তবে মেয়েদের লজ্জা একটু হয়ই। ছেলেরা যেমন পেচ্ছাব পেলেই, আমাদের সামনেই ইজের ফাঁক করে সেরে নিত, আমরা সাত-আট বছরের মেয়েরা তা কখনও পারতাম না। আমরা একটু আড়ালে আড়ালে গিয়ে কাজ সেরে আসতাম।

বেন্দা। ছেলেটার নাম বৃন্দাবন ছিল, গোঁসাই বাড়ির ছেলে। আমরা একসঙ্গে পড়তাম। আমরা বেলা বেন্দা বলেই ডাকতাম। বলাই কাকাদের ব্যাপারটা দেখার পরে, এক রবিবারে হাজরাদের পোড়ো পেরিয়ে লক্ষ্মীদের বাড়ি যাচ্ছিলাম। তখন দেখেছিলাম, বেন্দা পোড়োয় দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে ফিরে পেচ্ছাব করছে। আমাকে দেখে ওর লজ্জা করল না। আমারও কোনও রকম লজ্জা করার কথা না। কিন্তু বেন্দা যেন কী! ভেবেছিলাম, ওকে অমন দেখাচ্ছে কেন, ঠিক যেন বলাই কাকার মতো। অন্য ছেলেদের তো ও রকম থাকে না। সকলেই কেমন শান্ত আর ঠাণ্ডা। তাই যেন আমার কেমন একটু লজ্জা করে উঠছিল। আসলে ওটাকে খারাপ লাগাই বলা চলে। আমি চলেই যাচ্ছিলাম। বেলা হঠাৎ আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল, কোথায় যাচ্ছিস রে নুড়ি?

আমি বলেছিলাম, লক্ষ্মীদের বাড়ি।

দেখেছিলাম, ওর প্যান্টের কোমরের কাছে বোতামের সঙ্গে একটা সুতোয় তিন-চারটে ফড়িং বাঁধা। ফড়িংগুলো ফর ফর করছে। বুঝতেই পারছিলাম, রবিবারের সারা দুপুরটা হাজরাদের পোড়োয় বেলা কী করেছে। আমার লোভ হয়েছিল, চেয়েছিলাম, একটা ফড়িং দিবি?

বেন্দা কোনও জবাব না দিয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল। তারপরে হঠাৎ বলেছিল, জানিস নুড়ি, আজ একটা মস্ত দাঁড়াশ সাপ দেখেছি। ঝুপ করে আমার পায়ের কাছে পড়েই এক দৌড়।

আমি হকচকিয়ে উঠে বলেছিলাম, কামড়ে দিতে আসেনি?

বেন্দা হেসে উঠে বলেছিল, দাঁড়াশ সাপ বুঝি কামড়ায়। তোক দেখলেই দৌড়ে পালায়।

 সে রকম কথা আমারও শোনা ছিল বটে। তবু সাপ তো। সব সাপকেই আমার ভয় করত। ছেলেবেলায় করত, এখনও করে। রাস্তায়, বাড়ির উঠোনে হেলে, ঢোঁড়া তো অনেক সময়েই চলে ফিরে বেড়াতে দেখা যেত। কেউ গা করত না ভয় পাওয়া দূরের কথা। আমি ভীষণ ভয় পেতাম। সাপ দেখলেই আমার গায়ের মধ্যে যেন কিছু কিলবিলিয়ে উঠত। তবে দাঁড়াশ সাপের কথা শুনলেও, আমি বেন্দার কোমরের সঙ্গে সুতোয় বাঁধা ফড়িংগুলোকেই দেখছিলাম। বোটার আঙুলে যেন আঠা লাগানো। হাত বাড়ালেই ফড়িং ধরতে পারত। আমি পা বাড়াবার আগেই, বেন্দা আবার পোড়োর ভেতর দিকে চলতে আরম্ভ করেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আবার কোথায় যাচ্ছিস রে?

বেন্দা বলেছিল, যাই ফড়িং ধরি গিয়ে।

কথাটা শুনে আমার লোভ হয়েছিল। ভেবেছিলাম, লক্ষ্মীদের বাড়ি না হয় বিকেলে চুল টুল বেঁধে যাব। এখন গিয়ে কয়েকটা ফড়িং ধরি। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরলে, বেলা এক-আধটা নিজেই ধরে দিতে পারে। আমিও ওর সঙ্গে সঙ্গে গিয়েছিলাম। আজ আর সব কথা মনে নেই, আমরা দুজনেই অনেক কথা বকবক করেছিলাম। ইস্কুলের কথা, অন্য ছেলেমেয়েদের কথা। নেহাত দুপুরবেলা বলেই, আমাদের সঙ্গে অন্য ছেলেমেয়েরা ছিল না। সকালে বিকেলে হাজরাদের পোড়োয় আর জঙ্গলে ছেলেদের মেলা লেগে যেত।