১. ক্লাস শেষের ঘণ্টা

সাইক্লোন – কিশোর উপন্যাস – মুহাম্মদ জাফর ইকবাল

উৎসর্গ

বেশ কয়েক মাস আগে একজন বাবা আমার সাথে যোগাযোগ করে বললেন, তাঁর মেয়েটি আমার সাথে খুব দেখা করতে চাইছে। তারপর যেটি বললেন সেটি শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বাবা আমাকে বললেন, মেয়েটি হাসপাতালে এবং আগামী এক-দুদিনের ভেতর সে মারা যাবে। মেয়েটি নিজেও সেটি জানে।

আমি তখন সিলেট থেকে ঢাকা এসেছি, যখন হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তখন মনে হলো, আমার জীবনে এর চাইতে কঠিন কোনো কাজ হয়তো আর কখনো করতে হবে না।

যখন তার সাথে দেখা হবে তখন তাকে কী বলব, আমি জানতাম না। কিন্তু সেই ছোট মেয়েটি অসাধারণ বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে ছিল, তাই তার সাথে কথা বলার কাজটি খুব সহজ হয়ে গেল। আমি ভাণ করলাম সবকিছু ঠিক আছে, জীবন খুব আনন্দময় এবং সেই মেয়েটিও আমার সাথে অভিনয় করে গেল। আমরা হাসি-তামাশা করলাম, গল্প করলাম। সে কোনো এক অলিম্পিয়াডে আমার সাথে তোলা তার ছবি দেখাল। আমি নিজের কিছু বই উপহার দিলাম, সে তার বইগুলোতে আমার অটোগ্রাফ নিয়ে নিল। গল্প করে করে আমরা সময়টি কাটিয়ে দিলাম।

চলে আসার সময় আমি তার একটি বইয়ের পেছনে লিখে এলাম, সে যেন ভালো হয়ে ওঠে, আমি তাকে একটি বই উৎসর্গ করব।

মেয়েটি ভালো হয়ে ওঠেনি, দুদিন পর খবর পেয়েছি সে মারা গেছে।

মেয়েটির নাম নভেরা। আমি তাকে আমার এই বইটি উৎসর্গ করতে চাই।

নভেরা, তোমার জন্যে অনেক অনেক ভালোবাসা।

***

শেষ পর্যন্ত ঢং করে ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। বিজলী আশা ছেড়েই দিয়েছিল, একটু আগে তার মনে হচ্ছিল আর কোনোদিন বুঝি ঘণ্টাটা পড়বে না, ক্লাসটাও শেষ হবে না। এই ক্লাসটা অঙ্ক ক্লাস, ক্লাস নেন আজীজ স্যার–যদিও কেউ তাকে আজীজ স্যার ডাকে না। কথা বলার সময় গলার কাছে একটা রগ ফুলে যায় বলে সবাই আড়ালে তাকে রগু স্যার বলে ডাকে। রপ্ত স্যার ক্লাসে এসে বোর্ডে একটার পর একটা অঙ্ক লিখতে থাকেন। তাদেরকে সেগুলো খাতায় তুলতে হয়। পরীক্ষার আগে সেই অঙ্কগুলো মুখস্থ করতে হয়। এই অঙ্কগুলো থেকে কয়েকটা অঙ্ক পরীক্ষায় আসে, পরীক্ষার খাতায় দাড়ি-কমাসহ সেগুলো মুখস্থ লিখে দিয়ে আসতে হয়। যারা রপ্ত স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে রপ্ত স্যার আগে থেকে বলে দেন পরীক্ষায় কোন কোন অঙ্কটা দেবেন। তাদের বেশি অঙ্ক মুখস্থ করতে হয় না, যেগুলো পরীক্ষায় আসবে শুধু সেগুলো মুখস্থ করলেই হয়। পরীক্ষাতেও তারা বেশি নম্বর পায়। বিজলী কোনো স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে না। প্রাইভেট পড়তে যে টাকার দরকার তার সে টাকা নাই। টাকা থাকলেও কোনোদিন তাকে বাবা-মা সেই টাকা দেবেন না। সত্যি কথা বলতে কী অনেক চেষ্টাচরিত্র করে স্কুল থেকে তার টিউশন ফ্রি করা হয়েছে বলে সে স্কুলে আসতে পারছে। যদি কোনোদিন তার টিউশন ফি আবার দিতে হয় সাথে সাথে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।  

ঘণ্টা পড়ার পর অঙ্ক স্যার চক ডাস্টার নিয়ে ক্লাস থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভেতরে কথা বলতে শুরু করে। তাদের দেখে মনে হয় একটা ঘণ্টা কথা বলতে না পেরে তাদের বুকটা বুঝি ফেটে যাচ্ছিল। বিজলী চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। জানালার পাশে এই সিটটা তার খুব প্রিয়, আগে আসতে পারলে সে সব সময় এই সিটটা দখল করে নেয়। এখানে বসে বাইরে তাকালে দূরে সমুদ্রটা দেখা যায়। ছেলেমেয়েরা যদি কথা বন্ধ করে তাহলে সমুদ্রের গর্জনটাও আবছাভাবে শোনা যায়। সমুদ্রের এই চাপা গর্জনটা শুনে বিজলী সব সময়েই বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করে, তার কারণটা কী কে জানে? ভাটা শুরু হয়েছে, বিজলী এখানে বসেই দেখতে পায় সমুদ্রের পানি নিচে নামতে শুরু করেছে, গাংচিলগুলো আকাশে উড়ছে। পানি নেমে যাওয়ার পর শামুক কাঁকড়া বের হতে শুরু করেছে আর গাংচিল সেগুলো খাওয়ার জন্যে ভিড় করে এসেছে।

ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কথা হঠাৎ করে থেমে গেল, বিজলী মাথা ঘুরিয়ে দেখল তাদের বিজ্ঞান স্যার ক্লাসে ঢুকছেন। এই স্যার নতুন এসেছেন, তাই এখনো তার কোনো নাম দেয়া হয়নি। সবাই স্যারের নাম অনুযায়ী শ্যামল স্যার বলে ডাকে। বিজলীর যতগুলো ক্লাস করতে হয় তার মাঝে এই ক্লাসটা সবচেয়ে প্রিয়। স্যার একটা কিছু পড়াতে শুরু করে সেখান থেকে অন্য কিছুতে চলে যান, সেখান থেকে আবার অন্য কিছুতে চলে যান, তারপর হঠাৎ করে থেমে গিয়ে মাথা চুলকে বলেন, তোমাদের কী যেন পড়াচ্ছিলাম? স্যার কী পড়াচ্ছিলেন সেটা বলে দিলে স্যার তখন আবার সেখান থেকে পড়াতে শুরু করেন। তবে বিজলীর অবশ্যি বইয়ের পড়া থেকে স্যারের উলটাপালটা গল্পগুলো শুনতেই বেশি ভালো লাগে।

শ্যামল স্যার চক ডাস্টার টেবিলের উপর রেখে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালেন। দূরে সমুদ্রটার দিকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, সমুদ্রটা কী সুন্দর দেখেছ?

স্যারের কথা শুনে সবাই জানালাটা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালো। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সমুদ্রের ধারেকাছে থাকে, তারা প্রত্যেক দিন সমুদ্রটাকে দেখে। যে জিনিস প্রত্যেক দিন দেখতে পায় সেটা আসলেই সুন্দর কি না সেটা মনে হয় কেউই ঠিক করে বুঝতে পারে না। শ্যামল স্যার বাইরে থেকে এসেছেন, তাই সমুদ্র দেখে এরকম মুগ্ধ হয়ে যান।

শ্যামল স্যার জানালা থেকে সরে হেঁটে হেঁটে টেবিলের কাছে। ফিরে এলেন, অন্যমনস্কভাবে টেবিল থেকে চকটা হাতে নিতে নিতে বললেন, এত সুন্দর শান্ত-শিষ্ট একটা সমুদ্র কিন্তু সাইক্লোনের সময় এটাই কী ভয়ংকর হয়ে যায়। সত্তর সালে এই সমুদ্র দশ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলেছিল।

বিজলী আবার জানালা দিয়ে সমুদ্রটার দিকে তাকালো। তাদের পাঠ্যবইয়ে সত্তর সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথাটা লেখা আছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে দশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল, সেটাও বিজলী পড়েছে। কিন্তু স্যার বলার পর আজকে হঠাৎ করে বিজলী প্রথমবার বুঝতে পারল দশ লক্ষ আসলে অনেক বড় সংখ্যা! সেই ঘূর্ণিঝড়ে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল।

শ্যামল স্যার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনো মাঝে মাঝে সাইক্লোন হয় কিন্তু এখন আর এত মানুষ মারা যায় না।

একজন জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার?

সাইক্লোন শেল্টার তৈরি হয়েছে। যখন সাইক্লোন আসে তখন সবাই শেল্টারে চলে যায়। একটা বেলা কষ্ট করে শেল্টারে থাকে, কিন্তু সবাই জানে বেঁচে যায়।

সামনে থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, সাইক্লোন কেন হয় স্যার?

স্যার এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর সাইক্লোন কেন হয় সেটা বোঝাতে শুরু করলেন। সমুদ্রের পানি যখন গরম থাকে তখন জলীয় বাষ্প উপরে উঠে গিয়ে কীভাবে পানির ফোঁটাতে পাল্টে গিয়ে তাপ ছেড়ে দেয়, সেই তাপ কীভাবে সাইক্লোনকে শক্তি দেয় এই রকম কথা। বিজলী ঠিক ভালো করে বুঝতে পারল না, কিন্তু ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে সাথে বুঝে ফেলার ভাণ করে মাথা নাড়ল।

স্যার বোঝানো শেষ করে আবার জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সব সময় কী মনে হয় জানো?

ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয় স্যার?

আমার মনে হয় সমুদ্রটা বুঝি জীবন্ত। সে জন্যে এটা কখনো থেমে যায় না। একটার পর একটা ঢেউ পাঠাতেই থাকে। পাঠাতেই থাকে!

কয়েকজন ছেলেমেয়ে হি হি করে হাসল, তাদের কাছে মনে হয়েছে স্যারের কথাটা বুঝি হাসির একটা কথা। বিজলী অবশ্যি হাসল না, স্যার আসলে এটা মোটেই হাসির কথা হিসেবে বলেননি।

স্যার ছেলেমেয়েদের হাসিটুকু লক্ষ করলেন বলে মনে হলো না, অনেকটা আপন মনে বললেন, শুধু যে ঢেউয়ের পর ঢেউ পাঠাতে থাকে তা নয়, দিনে দুইবার জোয়ারের সময় পানি ফুলেফেঁপে উঠে আবার ভাটার সময় পানি নেমে যায়! কখনো ভুল হয় না!

একজন জিজ্ঞেস করল, জোয়ার-ভাটা কেন হয় স্যার?

চাঁদের আকর্ষণে। কত দূরে চাঁদ কিন্তু সেটা পৃথিবীর পানিকে আকর্ষণ করে ফুলিয়ে দেয়, আমরা বলি জোয়ার। আবার যখন চাঁদ সরে যায়, পানিটা সরে যায় আমরা বলি ভাটা।

বিজলী জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটা একটু চিন্তা করল, তার হঠাৎ করে একটু খটকা লাগল। যদি চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার হয় তাহলে তো দিনে একবার জোয়ার হওয়ার কথা। চাঁদ তো দিনে একবার পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে আসে, দুইবার নয়। কিন্তু দিনে তো সব সময় দুইবার জোয়ার হয়, দুইবার ভাটা হয়। কেন দুইবার?

স্যারকে প্রশ্ন করে জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটা কী একবার বুঝে নেবে? ক্লাসে সে কখনোই প্রশ্ন করে না, তার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে। কিন্তু আজকে সাত পাঁচ ভেবে বিজলী শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করার জন্যে হাত তুলল।

স্যার বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কোনো প্রশ্ন করবে?

জি স্যার।

কর।

চাঁদের আকর্ষণে যদি জোয়ার-ভাটা হয় তাহলে তো দিনে একবার জোয়ার আর একবার ভাটা হওয়ার কথা। কিন্তু স্যার

কিন্তু?

কিন্তু স্যার দিনে তো দুইবার জোয়ার আর দুইবার ভাটা হয়।

স্যার ভুরু কুঁচকে বিজলীর দিকে তাকালেন, মনে হলো প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছেন না।

বিজলী প্রশ্নটা আরেকটু ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করল, বলল, মানে স্যার আমি বলছিলাম কী চাঁদ তো পৃথিবীকে দিনে একবার ঘুরে আসে কিন্তু দুইবার জোয়ার হয় কেন? মানে–

শ্যামল স্যার বিজলীকে থামালেন, বললেন, তোমাকে আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি।

বিজলী উত্তরটা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল। স্যার ভুরু কুঁচকে কীভাবে জানি চিন্তা করতে লাগলেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না। এভাবে খানিকটা সময় পার হয়ে গেল, স্যার তখন বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! এই সহজ একটা জিনিস আমি কখনোই খেয়াল করিনি! তুমি ঠিকই বলেছ, দিনে একবার জোয়ার আর একবার ভাটা হওয়ার কথা।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, তাহলে দুইবার কেন হয় স্যার?

আমি জানি না।

বিজলী স্যারের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। স্যার এই প্রশ্নের উত্তরটা জানেন না? কী আশ্চর্য।

স্যার মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, তোমার প্রশ্নটা খুবই ক্লেভার একটা প্রশ্ন। অসাধারণ প্রশ্ন!

বিজলী থতমত খেয়ে গেল। প্রশ্ন তো প্রশ্নই–সেটা আবার অসাধারণ হয় কেমন করে? বরং উল্টোটা সত্যি, স্যারদের যদি কখনো কোনো প্রশ্ন করা হয় যার উত্তর স্যারেরা জানেন না তখন স্যারেরা রেগেমেগে ধমক দিয়ে তাদের বসিয়ে দেন। শ্যামল স্যার মোটেও রাগলেন না, মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, তুমি খুবই সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছ। আমি কখনোই এটা চিন্তা করিনি। এখন চিন্তা করেও উত্তরটা বের করতে পারিনি।

বিজলী বসে যাচ্ছিল, তখন স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

বিজলী।

বিজলী? বাহ্ কী সুন্দর নাম!

বিজলী আবার থতমত খেয়ে গেল, বিজলী একটা সুন্দর নাম হতে পারে? তার মা সব সময় বলেন, তাকে এই নামটা দেওয়াই ভুল হয়েছে, এই নাম দেওয়ার জন্যই সে নাকি সব সময় এত যন্ত্রণা করে।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার অন্য ভাইবোনদের কী নাম? ঝড় বৃষ্টি সাইক্লোন?

ক্লাসের সব ছেলেমেয়ের সাথে বিজলীও হেসে ফেলল, বলল, না স্যার। আমার খালি একটা ছোট ভাই আছে তার নাম খোকন।

স্যার বললেন, ভেরি গুড! ভেরি গুড!

বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না কোনটা ভেরি গুড। তার ছোট ভাই থাকাটা নাকি তার নাম ঝড় বৃষ্টি সাইক্লোনের বদলে খোকন হওয়াটা। যেটাই হয়ে থাকুক সে আর মাথা না ঘামিয়ে বসে পড়ল।

স্যার হাসি হাসি মুখে বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার খুব ভালো লাগছে যে তুমি ছোট একটা মেয়ে কিন্তু তোমার এত সুন্দর এনালিটিকেল মাইন্ড। যে জিনিসটা কখনো আমার মাথায় আসেনি কিন্তু তুমি সেই প্রশ্নটা করেছ। তুমি কখনো লেখাপড়া বন্ধ করো না। অবশ্যই পড়াশোনা করবে, ডিগ্রি নেবে। ঠিক আছে?

বিজলীর একবার মনে হলো সে জিজ্ঞেস করে এনালিটিকেল মাইন্ড কথাটার মানে কী। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে তার লজ্জা লাগল, তাই শেষ পর্যন্ত আর জিজ্ঞেস করল না। সে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে স্যার।

সে মুখে বলেছে ঠিক আছে, কিন্তু আসলে এটা মোটেও ঠিক নেই। তার পড়াশোনা যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে। বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ক্লাসে স্যার পড়াতে শুরু করেছেন বিজলী মন দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু একটু পরে পরে সে আনমনা হয়ে যেতে লাগল।

.

ছুটির ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে ক্লাস থেকে বের হতে শুরু করল। বিজলীও তার বই-খাতাগুলো বুকে চেপে ধরে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসে। এই স্কুলে আশেপাশের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই একজন অন্যজনকে চেনে। সে আসে বহুদূর একটা চর থেকে, কেউ তাকে চেনে না। তাকে আলাদা করে ক্লাসে কেউ কখনো লক্ষ করেনি কিন্তু আজকে সবাই তাকে আলাদাভাবে লক্ষ করল, তার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এমনকি একটা মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল, বিজলী তোমার বাড়ি কোন গ্রামে?।

বিজলী বলল, আমার বাড়ি অনেক দূর। কাজলডাঙ্গা চর।

মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বলল, কাজলডাঙ্গা চর? ইয়া আল্লাহ! সেইটা তো অনেক দূর!

বিজলী মাথা নাড়ল, হ্যাঁ অনেক দূর।

প্রত্যেকদিন সেইখান থেকে আস?

হ্যাঁ।

জোয়ারের সময় পানিতে রাস্তা ডুবে যায় না?

হ্যাঁ ডুবে যায়। সেই জন্যেই তো জোয়ার-ভাটা হিসাব করে আসতে হয়। দেখো না, মাঝে মাঝে আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যায়?

আরেকজন বলল, ইয়া মাবুদ।

কথা বলতে বলতে তারা স্কুল থেকে বের হয়ে এল, এখন তাকে হেঁটে হেঁটে কাজলডাঙ্গা চরে যেতে হবে। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এখনো কমপক্ষে দুই ঘণ্টা! বিজলী একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল, যদি তাদের চর থেকে আরো কেউ এই স্কুলে আসত তাহলে দুজনে মিলে হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে বাড়ি চলে যেতে পারত। এতটা পথ একা একা হেঁটে যেতে তার কেমন জানি লাগে।

স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ পেছন থেকে বিজলী ডাক শুনতে পায়, বিজলীবু! বিজলীবু!

বিজলী মাথা ঘুরিয়ে অবাক হয়ে দেখতে পেল স্কুলের সামনে যে বিশাল বটগাছ তার মোটা একটা শিকড়ের ওপর খোকন বসে আছে। বিজলী চোখ কপালে তুলে বলল, খোকন? তুই এইখানে?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ বিজলীবু! তুমি এত দেরি করছ? আমি কখন থেকে বসে আছি!

আমি দেরি করছি? এই মাত্র না ছুটি হলো। তুই কোন সময় থেকে বসে আছিস?

দুপুর থেকে?

বাড়ি যাস নাই? এইখানে চলে আসছস?

হ্যাঁ।

কেন? বাড়ি যাস নাই কেন?

খোকন লাজুক মুখে বলল, ভাবলাম তোমার লগে এক সাথে যাই।

কেন? কিছু হইছে স্কুলে?

খোকন মুখ টিপে হাসল, বলল, হ্যাঁ।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, কী হইছে?

আমি একটা প্রাইজ পাইছি।

সত্যি? বিজলী চোখ বড় বড় করে বলল, কী প্রাইজ?

আজকে স্কুলে সবাইরে রচনা লিখতে দিছে। আমারটা সবচেয়ে ভালো হইছে সেই জন্যে আমারে প্রাইজ দিছে। ফাস্ট প্রাইজ!

বিজলী আনন্দে কী করবে বুঝতে পারল না, খোকনকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ফাস্ট প্রাইজ? ফাস্ট প্রাইজ!

হ্যাঁ।

কী দিছে প্রাইজ?

একটা বই।

দেখি বইটা দেখা। দেখা তাড়াতাড়ি।

খোকন তখন তার বইগুলোর ভেতর থেকে একটা বই বের করে আনল, বইয়ের নাম ছোটদের মহাপুরুষ। প্রচ্ছদে অনেকগুলো মহাপুরুষের ছবি।

বিজলী বইটি এমনভাবে হাতে নিল যে দেখে মনে হতে পারে সে একটা বই হাতে নিচ্ছে না, অমূল্য কোনো সম্পদ হাতে নিচ্ছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বইয়ের প্রচ্ছদটা দেখে বইয়ের পাতা ওল্টাল, প্রথম পৃষ্ঠায় হাতে লেখা, প্রথম পুরস্কার : রচনা প্রতিযোগিতা, তারপর খোকনের নাম। বিজলী বইয়ের আরো পৃষ্ঠা ওল্টাল। ভেতরে অনেক মহাপুরুষের ছবি আর জীবন কাহিনী।

বিজলী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার ছোট ভাইটির দিকে তাকালো, আনন্দে দাঁত বের করে হাসল, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরল।

ঠিক তখন তাদের পাশ দিয়ে তাদের ক্লাসের কয়েকজন ছেলেমেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বিজলী তখন খোকনকে ছেড়ে দিয়ে ঐ ছেলেমেয়েগুলোকে বলল, এই যে খোকন। আমার ছোট ভাই। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। রচনা লিখে ফাস্ট প্রাইজ পাইছে!

ছেলেমেয়েগুলো বিজলীর কথা শুনে প্রথম একটু অবাক হয়ে যায়, কিন্তু তারপর হাসি হাসি মুখ করে বলে, সত্যি? কী প্রাইজ পাইছে?

বই। এই দেখো কী সুন্দর বই।

স্কুলের ছেলেমেয়েরা বইটা দেখে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সুন্দর বই। অনেক সুন্দর।

আনন্দের উত্তেজনা কমে যাবার পর বিজলী খোকনকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। স্কুলের রাস্তাটা পার হতেই লোকজন কমে আসে। বিজলী আর খোকন হেঁটে হেঁটে তখন সমুদ্রের কিনারায় যেতে থাকে। শুকনো বালুর উপর দিয়ে হাঁটা যায় না, তাই দুজন ভেজা বালুতে নেমে আসে। সমুদ্রের ঢেউ একটু পরে পরে প্রায় তাদের পা স্পর্শ করতে চলে আসছিল। খালি পায়ে ভেজা বালুতে পা ফেলে ফেলে দুজন হাঁটতে থাকে।

খোকন একটু শান্ত এবং চুপচাপ। খোকনের জন্মের পর মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছিল তখন বিজলীই খোকনকে বেশির ভাগ সময় কোলে নিয়ে বড় করেছে। বিজলী মাঝে মাঝে অবাক হয়ে খোকনকে দেখে, এইটুকুন মানুষ তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, এখন সেই ছোট বাচ্চাটা স্কুলে যায়, রচনা লিখে ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে বিজলী বলল, আজকে কী হইছে জানিস?

কী হইছে বিজলীবু?

আমাদের একজন নতুন বিজ্ঞান স্যার আসছে। খুবই ভালো স্যার। স্যার কী বলছে জানস?

কী বলছে?

বলছে আমার এনালিটিকেল মাইন্ড।

সেইটার মানে কী?

বিজলী নিজেও সেটার মানে জানে না, তাই আন্দাজ করে বলল, যারা খুব চিন্তা করতে পারে তারা হচ্ছে এনালিটিকেল মাইন্ড।

তুমি খুব বেশি চিন্তা করতে পারো বিজলীবু?

নিশ্চয়ই পারি। আমি স্যারকে একটা প্রশ্ন করছিলাম, স্যার সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নাই। সেই জন্যে বলছে আমার এনালিটিকেল মাইন্ড।

স্যার তোমার উপরে রাগ হয় নাই।

না। রাগ হয় নাই। রাগ হবে কেন?

আমাদের স্যাররে প্রশ্ন করলে স্যার রাগ হয়।

বিজলী বলল, আমাদের এই স্যার রাগ হয় না।

তুমি কী প্রশ্ন করছিলে বিজলীবু?

বিজলী তখন অনেক ডালপালা লাগিয়ে তার প্রশ্ন করার কাহিনীটা খোকনকে বলল। খোকন পুরোটুকু শুনে মাথা নেড়ে বলল, তোমাদের স্যার মনে হয় ঠিকই বলছে। তোমার অনেক বুদ্ধি, তাই না বিজলীবু।

বিজলী হাসল, বলল, আমি কি বুদ্ধি ধুয়ে পানি খাব? বুদ্ধি দিয়ে কী করব?

মনে নাই একবার একটা বিড়ালের মুখ কৌটার মাঝে আটকে গেছিল, বিড়ালটা ভয় পেয়ে কী করছিল–তখন তুমি বিড়ালটারে ছুটায়ে দিছিলা?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, মনে আছে!

তারপর কাঁঠালগাছটাতে এত বড় একটা বোলতার চাক হইছিল, বোলতার কামড় খেয়ে বাবার মুখটা কেমন ফুলে উঠছিল, মনে আছে?

মনে আছে। বিজলী মাথা নাড়ল।

কেউ কাছে যেতে সাহস পায় না–তুমি তখন ধোয়া দিয়ে বোলতাগুলা সরায়ে বোলতার চাক কেটে ফেললে! মনে আছে?

বিজলী বলল, মনে আছে।

তারপর সেই ঘণ্টার অঙ্কটা? কেউ করতে পারে না, তুমি করে দিলা?

বিজলী হি হি করে হাসল, বলল, ধুর ঐটা তো সোজা অঙ্ক ছিল।

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, না বিজলীবু! ঐটা সোজা অঙ্ক ছিল না, অনেক কঠিন ছিল।

বিজলী কথা না বলে সমুদ্রের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ করে পা ফেলে। হেঁটে যেতে থাকে। খোকন অনেকটা আপন মনে বিজলীর সাথে কথা বলতে থাকে। এমনিতে খোকন খুব বেশি কথা বলে না। আজকে কী হয়েছে কে জানে, সে অনেক কথা বলছে। খোকনের কথা শুনতে শুনতে বিজলী চোখের কোনা দিয়ে মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। তার এই ছোট ভাইটিকে বিজলী খুব আদর করে।

বিজলী যখন ছোট, তখন নদী ভেঙে এক রাতের মাঝে তাদের বাড়িঘর জমিজমা সবকিছু পানিতে ভেসে গিয়েছিল, তখন বাবা জানি কেমন হয়ে গিয়েছিলেন। কথা বলেন না, নদীর ঘাটে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গ্রামের কিছু লোক তখন বাবাকে বলল, দক্ষিণের এই চরে এসে ঘর বাঁধতে। বাবা তখন সবাইকে নিয়ে এই চরে এসে ঘর বেঁধেছেন। বাবা এখানে এসেও বেশি কথাবার্তা বলেন না, দেখে মনে হয় মাথার কিছু একটা দোষ হয়েছে। বাবা যখন কেমন হয়ে গেছেন তখন বাধ্য হয়ে মা সংসারের অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু মায়ের শরীর সব সময়ই খারাপ থাকে, শরীরের সাথে সাথে মেজাজটাও খারাপ থাকে। তাই দিনরাত তাদেরকে বকাবকি করেন। বিজলীকে মা মনে হয় একেবারে সহ্যই করতে পারেন না। কোনোদিন তার সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন, বিজলী সেটা মনেই করতে পারে না।

বাড়িতে বিজলীর একমাত্র সাথী হচ্ছে খোকন। তাকে ছোট থেকে সে মানুষ করেছে, কোলে নিয়ে কাটিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে, রাত্রে পাশে নিয়ে ঘুমিয়েছে। যখন একটু বড় হয়েছে তখন রাজ্যের গল্প শুনিয়েছে। এই ছোট ভাইটাই বিজলীর একমাত্র আপন মানুষ। খোকন না থাকলে বিজলীর জীবনটা কেমন হতো সে চিন্তাও করতে পারে না।

প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর তারা নিচু জায়গাটাতে এসে হাজির হলো। ভাটির সময় এই জায়গাটা পানির নিচ থেকে বের হয়ে আসে। বড় বড় পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, পাথরগুলোর ধারালো কোনা বের হয়ে থাকে। জোয়ারের সময় এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে লাফিয়ে বিজলী জায়গাটা পার হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তারপরেও শরীর না ভিজিয়ে পার হওয়া যায় না।

বিজলী খোকনের হাত ধরে এই নিচু এলাকাটা পার হয়ে আসে। এখানে-সেখানে পানি জমা হয়ে আছে, তার কোনো কোনোটিতে ছোট তারামাছ তিরতির করে নড়ছে।

নিচু জায়গাটা পার হয়ে দুজনে একটা বড় পাথরের মাঝে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিল। জায়গাটা আশ্চর্য রকম নির্জন, আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। বহুদূরে ঝোঁপঝাড় গাছপালা, তার পেছনে আরো দূরে মানুষের জনবসতি। এরকম আশ্চর্য রকম নির্জন জায়গায় বসে থাকতে বিচিত্র এক ধরনের নিঃসঙ্গ অনুভূতি হয়।

.

খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর বিজলী উঠে দাঁড়াল, বলল, খোকন, উঠ, এখনো অনেকদূর যাইতে হবে। দেরি হলে মা বকবে।

খোকন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেরি না হলেও মা বকবে।

।বিজলী কিছু বলল না, খোকন ভুল বলেনি। মায়ের বকুনি খেতে খেতে এত দিনে বিজলীর অভ্যাস হয়ে যাবার কথা, কিন্তু কেন জানি বিজলীর অভ্যাস হয়নি। প্রত্যেকবার সে যখন মায়ের বকুনি খায় তার

মনটা খারাপ হয়ে যায়।

*

বাড়ি পৌঁছানোর পর মায়ের বকুনি খাওয়ার কথা, আজকে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই বিজলী বকুনী খেলো। বকুনি দিল আমিন মোল্লা।

বিজলী আর খোকন যখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসছে তখন আমিন মোল্লা তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরনে লম্বা আলখাল্লা। মাথায় টুপি আর চোখে সুরমা, মুখে লম্বা দাড়ি। গালে একটা কাটা দাগ, লম্বা দাড়ি দিয়েও সেই কাটা দাগ ঢেকে রাখা যায় না। কীভাবে আমিন মোল্লার গাল কেটেছে কে জানে, তাকে কেউ সেটা কখনো জিজ্ঞেস করেনি। বিজলীর ধারণা আমিন মোল্লা এই চরে আসার আগে ডাকাত ছিল, ডাকাতদের এরকম গাল কাটা থাকে। খুন জখম করে পালিয়ে এসে এখানে মোল্লা সেজে লুকিয়ে আছে। মানুষটাকে দেখলেই বিজলীর বুকটা কেমন জানি কেঁপে ওঠে।

আমিন মোল্লার দুজন বউ কিন্তু কোনো ছেলেমেয়ে নাই। বিজলী অনুমান করতে পারে যদি ছেলেমেয়ে না হয় তাহলে কয়েক দিন পর সে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে।

আমিন মোল্লা আরো একটা কেন আরো বেশি বিয়ে করতে চাইলে করে ফেলুক, তাতে বিজলীর কিছু এসে যাওয়ার কথা না। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিটা দেখলেই তার বুকটা কেমন জানি হিম হয়ে যায়। আজকেও যখন খোকন আর বিজলী হেঁটে হেঁটে আসছিল তখন আমিন মোল্লা তার সেই ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে বিজলীর দিকে তাকালো, কালো

জিব বের করে ঠোঁট চেটে বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, কই থেকে আসতাছস?

খোকন আর বিজলী দুজনের হাতেই বই খাতা, কাজেই তারা যে স্কুল থেকে আসছে সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। তারপরও বিজলী বলল, স্কুল থেকে।

স্কুল? আমিন মোল্লা এমন ভঙ্গি করল যেন স্কুল অত্যন্ত কুৎসিত নোংরা একটা জায়গা।

বিজলী মাথা নাড়ল। আমিন মোল্লা চোখ পাকিয়ে বলল, তোর বাপের এত বড় সাহস, এত বড় বেগানা মেয়েরে স্কুলে পাঠায়?

বিজলী ভেবেছিল সে চুপ করে এই মানুষটার কথা সহ্য করে যাবে, কিন্তু হঠাৎ কী হলো কে জানে সে জিজ্ঞেস করে বসল? কেন? স্কুলে গেলে কী হয়?

আমিন মোল্লা হঠাৎ খেপে গেল, মুখ খিঁচিয়ে বলল, কী? তোর এত বড় সাহস? আমার মুখের উপর কথা?

বিজলী তখন চুপ করে গেল। আমিন মোল্লা চোখ পাকিয়ে দাঁত বের করে মুখ খিঁচিয়ে বলল, আমি দেখুম, কেমন করে এই কাজলডাঙ্গা চরের মেয়ে হয়ে তুই স্কুলে যাস। এই কাজলডাঙ্গায় বেপর্দা বেগানা মেয়েছেলের জায়গা নাই। তোর বাপ মনে করে কী? তুই বড় হয়ে জজ বেরিস্টার হবি? শুনে রাখ, মেয়েলোকের জায়গা একটাই সেইটা হচ্ছে স্বামীর ঘর। আদব লেহাজ নিয়ে স্বামীর সেবা করা ছাড়া মেয়েলোকের আর কুনো কাম নাই।

বিজলী কেমন যেন অবাক হয়ে এই ভয়ংকর মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। খোকন বিজলীর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, বিজলীবু! চলো, যাই।

বিজলী তখন আর কোনো কথা না বলে খোকনের হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকে। হেঁটে যেতে যেতে টের পেল আমিন মোল্লা পেছন থেকে তার চোখ দিয়ে তাকে যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে।

বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে মা চিৎকার করতে শুরু করলেন, এতক্ষণে বেগম সাহেবের বাড়ি ফিরে আসার সময় হলো? বেগম সাহেব লেখাপড়া করে মহারানী হবেন? খোকন যে দুপুরবেলা বাড়ি আসে নাই সেইটার কথা মনে আছে? বাড়ির মানুষজন যে চিন্তা করতে পারে একবার সেই কথাটা মনে হইছে? মনে হইছে একবার?

বিজলী চুপ করে রইল। খোকন যে দুপুরবেলা বাড়ি আসে নাই সেইটা বিজলী জেনেছে বিকেল বেলা, তার কী করার আছে? একটা প্রাইজ পেয়ে বেচারা খুশি হয়েছে, সে জানে বাড়ির আর কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সেই জন্যে সে বিজলীর কাছে তার স্কুলে চলে গিয়েছে, সেইটা সে কেমন করে তার মাকে বোঝাবে? তাছাড়া সেজন্য বাড়ির মানুষজন যে খুব চিন্তা করেছে সেইটাও তো মনে হয় না। বাবা চুপচাপ বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তারা দুজন যে বাড়ি এসেছে, সেইটা মনে হয় দেখেন পর্যন্ত নাই।

মা আরেকবার এক পশলা গালি দেওয়ার জন্যে মুখ খুলছিলেন তখন বিজলী বলল, মা, খোকন একটা প্রাইজ পেয়েছে।

মা ভুরু কোঁচকালেন, কী পেয়েছে?

প্রাইজ। ফাস্ট প্রাইজ।

মা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হলো ঠিক বুঝতে পারছেন খবরটা শুনে খুশি হবেন নাকি রাগ হবেন। তার গালাগাল করার স্রোতটা হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে বলে মনে হয় একটু রেগেই উঠলেন, রাগটাকে কোনোরকমে চেপে রেখে বললেন, কী প্রাইজ?

বিজলী বলল, একটা বই। কী সুন্দর একটা বই। বিজলী খোকনকে বলল, খোকন, দেখা। তোর বইটা দেখা।

খোকন তার হাতের বইগুলোর ভেতর থেকে ছোটদের মহাপুরুষ বইটা বের করে আনল। বাবা কিংবা মা কেউই বইটা হাতে নিয়ে দেখার উৎসাহ দেখাল না। অপ্রস্তুত বিজলী তখন নিজেই বইটা হাতে নিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে দিল, বাবা খুবই অনিচ্ছার সাথে বইটা হাতে নিলেন, একটু উল্টেপাল্টে দেখলেন, কিন্তু খুলে ভেতরে দেখলেন না। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বইটা বিজলীর হাতে ফিরিয়ে দিলেন। বিজলী বইটা হাতে নিয়ে খুলে ভেতরের ছবিগুলো বের করে মাকে দেখানোর চেষ্টা করল, বলল, দেখো মা, কী সুন্দর ছবি।

মা একটুখানি দেখলেন, বিজলী বলল, খোকন সবচেয়ে ভালো রচনা লিখেছে, সেই জন্যে পুরস্কার পেয়েছে। তাই না রে খোকন?

খোকন মাথা নাড়ল। মা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হয়েছে। এখন যা, গরুটারে লইয়া আয়। মুরগির খোপ খুলে দে। কুপি বাতিগুলোতে তেল ভরে আন। আমাকে তো বান্দি পাইছস। সব মহারাজা মহারানীদের সেবা করার জন্য আমার জন্ম হইছে। সংসারের কাজ সব আমার করতে হবে? অন্য সবাই ড্যাং ড্যাং করে খালি গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরে বেড়াবি?

মা ক্যাট ক্যাট করে কথা বলতেই থাকলেন। সারাদিন স্কুলে থেকে বাড়ি এসেছে, খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। বিজলী সহ্য করে যেতে পারবে কিন্তু খোকনের মুখটা শুকিয়ে আছে দেখে বিজলীর মায়া হলো। বিজলী ইতস্তত করে বলল, মা, খোকনের দুপুরে খাওয়া হয় নাই–

মা ছ্যাৎ করে উঠলেন, বললেন, খাওয়া হয় নাই তো খাওয়া দে। চূলার উপরে দেখ ভাত-তরকারি আছে।

বিজলী মাকে আরো কিছু বলার সুযোগ দিল না, ঘরের বেড়ার উপর ঝুলিয়ে রাখা তাকটাতে বইগুলো রেখে খোকনের হাত ধরে পাকঘরে নিয়ে গেল। একটা পিঁড়িতে খোকনকে বসিয়ে তার সামনে একটা টিনের থালাতে ভাত বেড়ে দিল। শুঁটকির একটুখানি তরকারি ভাতের উপর দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি একটুখানি খেয়ে নে।

তুমি খাবা না বিজলীবু?

নাহ্। দুপুরের যেটুকু ভাত তরকারি রয়ে গেছে সেটা দিয়ে দুজনের হবে না, বিজলী তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার খিদা পায় নাই।

খোকনের খাওয়া শেষ হলে বিজলী কলসি থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, আয় খোকন।

বিজলীর পিছু পিছু খোকন হেঁটে হেঁটে যায়। চরের মাঝামাঝি নিচু জায়গাটাতে অনেক ঘাস। চরের মানুষেরা এখানে তাদের গরু ছাগল ছেড়ে যায়। বিজলী তাদের কালো গাইটাকে দূর থেকে দেখতে পেল, ঘাস খেতে খেতে মাঝে মাঝে গলা তুলে ডাকছে, মনে হয় বাছুরটাকে খুঁজছে।

বিজলী গরুর খুঁটিটা টেনে তুলে দড়িটা পাকিয়ে ছোট করে নেয়। তাকে আর কিছু করতে হয় না, কালো গাইটা কেমন করে নিজেই জানি বুঝে গেছে এখন বাড়ি যাবার সময় হয়েছে। গাইটা আবার গলা ছেড়ে ডাকল তখন ছোট বাছুরটা অনেকটা লাফাতে লাফাতে হাজির হলো। খোকন বাছুরটাকে একটু আদর করার চেষ্টা করল, বাছুরটা অনেকটা খেলার ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যায়। খোকন তখন দাঁত বের করে হেসে বলল, দেখছ বিজলীবু বাছুরটা কী করে?

বিজলী বলল, তোর সাথে খেলছে!

আমার সাথে কেন খেলছে বিজলীবু?

তুই তো একটা গরু, বাছুরটাও একটা গরু, সেই জন্যে তোর সাথে খেলে!

খোকন বিজলীকে ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও! আমি গরু না, তুমি গরু!

বিজলী হাসল, বলল, ঠিক আছে। তুইও গরু, আমিও গরু। বিজলী তখন গরুর মতো করে ডাকল, হাম্বা!

খোকন অকারণেই হি হি করে হাসতে থাকে।

বাড়িতে এসে বিজলী গরু আর বাছুরটাকে গোয়ালঘরে ঢোকাল। বাছুরটাকে আলাদা করে বেঁধে রাখল যেন রাতের বেলা দুধ খেয়ে না ফেলে। মাটির মালসায় তুষের আগুন করে গোয়ালঘরে মশা তাড়ানোর জন্যে ধোয়া দিল। তারপর মোরগের খোঁপটা পরিষ্কার করে নিচে এক প্রস্ত ছাই দিয়ে ঢেকে দিয়ে মুখে কঁক কঁক করে শব্দ করল। মোরগ মুরগিগুলো তখন মাথা তুলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে এগিয়ে এসে একটি একটি করে খোপের ভেতর ঢুকে যায়! একটা মা মুরগি এদিক সেদিক তাকিয়ে তার ছোট ছোট ছানাগুলোকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল।

বিজলী তখন বাইরে নেড়ে দেওয়া কাপড়গুলো তুলে ভেতরে নেয়, তারপর কুপি বাতিগুলো পরিষ্কার করে তার মাঝে কেরোসিন ঢেলে নেয়। বাতিগুলো সে বারান্দায় সাজিয়ে রাখে আরেকটু অন্ধকার হলে বাতিগুলো জ্বালাবে।

ঘরের কাজ শেষ করে বিজলী খোকনকে নিয়ে সমুদ্রের বালুবেলায় দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্য অস্ত যাবার পর পশ্চিম আকাশটা লাল হয়ে গেছে। কোনো কোনোদিন আকাশটা বেশি লাল হয়ে থাকে, কোনোদিন কম। তার কারণটা কী কে জানে।

সমুদ্রের ঢেউগুলো একটার পর একটা এসে তীরে আছড়ে পড়ছে। শ্যামল স্যার মনে হয় ঠিকই বলেছেন, সমুদ্রটা যেন সত্যিই জীবন্ত, প্রত্যেকটা ঢেউ যেন সমুদ্রের একটি একটি করে নিঃশ্বাস। জোয়ার শুরু হয়েছে, দেখতে দেখতে পুরো বালুবেলাটা পানিতে তলিয়ে যাবে। সমুদ্রের একধরনের গর্জন আছে। কোনো কোনোদিন সমুদ্র শান্ত থাকে, তখন গর্জনটি হয় মৃদু। কোনো কোনোদিন মনে হয় সমুদ্রটি রেগে আছে, তখন সমুদ্রের গর্জনটিও হয় ক্রুদ্ধ গর্জন। আজকে মনে হয় সমুদ্রটি শান্ত, তাই তার গর্জনটার মাঝে একধরনের শান্ত শান্ত ভাব।

বিকেলের বাতাসটি বইতে শুরু করেছে। বাতাসের মাঝে একধরনের লোনা গন্ধ, বিজলী বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নিল। খোকন বালুর উপর পা ছড়িয়ে বসে গালে হাত দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝেই খোকন গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবে। কী ভাবে কে জানে।

দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে, বাড়ি যেতে হবে। একটু দেরি হলেই মা বকাবকি শুরু করবেন। বিজলী বলল, খোকন, আয় বাড়ি যাই।

খোকন উঠে দাঁড়াল, তারপর বিজলীর হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

.

রাত্রি বেলা বেশ তাড়াতাড়ি বিজলী খোকনকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রতি রাতেই তাই হয়, রাত জেগে থাকলেই কুপি বাতি জ্বালাতে হয়, কুপি বাতি জ্বালালেই বাড়তি কেরোসিনের খরচ, তাই তাদের সকাল সকাল ঘুমিয়ে যেতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও রাত জেগে বিজলী লেখাপড়া করতে পারে না।

তাদের ছোট বাড়িতে পাকঘর ছাড়া মাত্র দুটি ঘর। একটা ঘরে বাবা-মা ঘুমায়, অন্য ঘরে ছোট একটা বিছানায় বিজলী খোকনকে নিয়ে ঘুমায়। বিছানায় শুয়েই খোকন ফিসফিস করে বলে, বিজলীবু, একটা গল্প বলো।

খোকন যখন তার কাছে গল্প শুনতে চায় বিজলী মনে মনে খুশি হয়, কিন্তু সে মিছি মিছি রাগের ভঙ্গি করে বলে, এত রাত হইছে, এখন আবার গল্প কিসের, ঘুমা।

খোকন তখন বিজলীকে জড়িয়ে ধরে বলে, বলো না একটা গল্প! মাত্র একটা–

বিজলী তখন বলে, একটা কিন্তু! একটার বেশি না।

ঠিক আছে বিজলীবু।

কিসের গল্প শুনবি?

খোকন লাজুক মুখে বলে, আমার গল্প।

বিজলী প্রতি রাতেই খোকনকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। কীভাবে খোকন কখনো দুর্ধর্ষ ডাকাত দলকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ধরে ফেলছে কিংবা কীভাবে খোকন একটা ভেলায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অজানা কোনো দ্বীপে গিয়ে হিংস্র বন্য মানুষের সাথে যুদ্ধ করছে, কিংবা একটা রকেট বানিয়ে কীভাবে মহাকাশে গিয়ে ভয়ংকর কোনো প্রাণীর মুখোমুখি হচ্ছে এরকম গল্প। আজকে বিজলী খোকন কীভাবে অনেক বড় বৈজ্ঞানিক হয়ে ভয়ংকর একটা অস্ত্র আবিষ্কার করেছে এবং সেই অস্ত্র চুরি করার জন্য কীভাবে আমেরিকা থেকে মানুষ এসেছে সেটা নিয়ে গল্প শুরু করল। বিজলীকে ফিস ফিস করে গল্প বলতে হয়, পাশের ঘরে মা যদি শুনতে পান তাহলে খুব বিরক্ত হয়ে বকাবকি শুরু করেন।

গল্প শুনতে শুনতে খোকন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে যায়। গল্প শেষ হলে সে বিজলীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। বিজলী একা একা জেগে থাকে। জেগে জেগে সে খোকনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে। মা সারাদিন কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যান। বাবা জেগে থাকেন, জেগে বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলেন। কী বলেন বোঝা যায়। বাবার জন্যে বিজলীর কষ্ট হয় কিন্তু কী করবে সে বুঝতে পারে। রাত জেগে জেগে সে সমুদ্রের গর্জন শোনে।

সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে বিজলী একসময় ঘুমিয়ে যায়।

*

বিজলীদের স্কুল দুপুর বেলাতেই ছুটি হয়ে গেল। কয়দিন থেকেই আবহাওয়া খারাপ, ঝিরঝির করে বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া। সমুদ্র পাড়ের মানুষ এরকম আবহাওয়া দেখলেই ভুরু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকায়। যতগুলো বড় সাইক্লোন হয়েছে তার আগে সব সময় এরকম খারাপ আবহাওয়া ছিল।

স্কুল ছুটির আগে শ্যামল স্যারের ক্লাস ছিল। শ্যামল স্যার আজকে ক্লাসে কিছু পড়াননি, বেশির ভাগ সময় খুব গম্ভীর মুখে জানালা দিয়ে দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিলেন। এক সময় ক্লাসে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই সবাই জানো একটা সাইক্লোন আসছে। সাইক্লোন যারিনা। সাইক্লোনকে সবসময় একটা নাম দেয়, মানুষের নামে নাম। আগে শুধু মেয়েদের নাম দিত–এখন একবার মেয়ের নাম আরেকবার ছেলের নাম। আগেরটা ছেলেদের নামে ছিল তাই এইবারে মেয়েদের নামে। যারিনা।

অন্যদিন হলে কেউ না কেউ সাইক্লোনের এই নাম দেওয়া নিয়ে কিছু না কিছু বলত, আজকে কেউ কিছু বলল না। সবাই শুকনো মুখে বসে রইল। আজকে ক্লাসে ছেলেমেয়ে বেশি নেই। যারা আছে তাদের বেশির ভাগ সাইক্লোনের কথা জানত না। বিজলীও জানত না। সাইক্লোন আসছে শুনে হঠাৎ করে ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল।

স্যার বললেন, গতকাল পর্যন্ত সাইক্লোনটা আরো উত্তর দিকে যাচ্ছিল, আজকে সকালে হঠাৎ করে দক্ষিণে নেমে সোজাসুজি আমাদের দিকে আসছে। স্যার চুপ করলেন আর বিজলীর বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে উঠল।

আজ শেষ রাতের দিকে সাইক্লোনটা এসে আমাদের এলাকায় আঘাত করবে। কাজেই তোমরা এখন সবাই বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে ফেমিলির সবাইকে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারে চলে যাবে। সাইক্লোনটা যখন আসবে তখন ভরা জোয়ারের সময়, তার মানে অনেক বড় স্টর্ম সার্জ হতে পারে।

একজন জিজ্ঞেস করল, স্টর্ম সার্জ মানে কী?

স্টর্ম সার্জ মানে হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস। পানি ফুলে উঠবে। এই দেশের সাইক্লোনে পানি অনায়াসে ত্রিশ চল্লিশ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। মনে রেখো কিছু বোঝার আগে কিন্তু পানি চলে আসবে, কয়েক মিনিটে সবকিছু পানিতে ডুবে যেতে পারে। সাইক্লোনের প্রচণ্ড ঝড়, তার সাথে পানি–এর থেকে ভয়ংকর কিছু হতে পারে না। কাজেই কেউ কোনো রিস্ক নেবে না। আজ রাতে সবাই সাইক্লোন শেল্টারে কাটাবে। সবাই। বুঝেছ?

ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে বিজলীও মাথা নাড়ল।

স্যার বললেন, তোমাদের ফেমিলি যেহেতু সারা জীবন সমুদ্রের তীরে থেকেছে তাই তারা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারগুলো আমার থেকেও ভালো জানে। তারা নিশ্চয়ই তাদের জীবনে অনেক সাইক্লোন দেখেছে, কিন্তু তোমরা ছোট তোমরা দেখো নাই। তাই আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে বাবা মাকে বলবে অবশ্যই অবশ্যই যেন সাইক্লোন শেল্টারে যায়।

বিজলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার বাবা-মা সমুদ্রের তীরে জীবন কাটায়নি, সাইক্লোন দেখেনি। সাইক্লোন হলে কী করতে হয় জানে না। নদীর পাড় ভেঙে ঘরবাড়ি ভেসে যাবার পর এই চরে এসেছে। এই চরের সব মানুষই এরকম। তারা স্থানীয় মানুষ না।

শ্যামল স্যার আবার জানালার কাছে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আবার ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, সাইক্লোনে বাতাস ঘুরতে থাকে। বিশাল এলাকা নিয়ে সাইক্লোন হয়। সাইক্লোনের বাতাসের বেগ একশ-দেড়শ মাইল হয়ে যেতে পারে। সাইক্লোনের ঠিক মাঝখানে কোনো বাতাস থাকে না, অনেক সময় উপরে মেঘও থাকে না। সেটাকে বলে সাইক্লোনের আই। আমি শুনেছি যে সাইক্লোনের আইয়ের ভেতর দিয়ে যাবার সময় সবকিছু একেবারে সুনসান নীরব হয়ে যায়। কোনো ঝড়বৃষ্টি কিছু নেই। আইটা পার হওয়ার পর আবার ঝড় শুরু হয়, বাতাস তখন উল্টোদিকে বইতে থাকে…

স্যার সাইক্লোন নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। বিজলী কিছু শুনল কিছু শুনল না। কিছু বুঝল কিছু বুঝল না।

ক্লাসের ঘণ্টা বাজার আগেই স্যার ছুটি দিয়ে দিলেন। অন্যদিনের মতো চিৎকার করতে করতে ছেলেমেয়েরা ক্লাস থেকে বের হলো না। সবাই চাপা স্বরে নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে প্রায় নিঃশব্দে ক্লাসঘর থেকে বের হয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিল। বিজলী একবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটার রং কেমন যেন ছাই বর্ণের। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকালো, এমনিতে নীলচে সবুজ রঙের সমুদ্রটা এখন কেমন যেন কালচে হয়ে আছে–দেখে মনে হয় সমুদ্রটা বুঝি রাগ হয়ে আছে। দূর থেকেই বোঝা যায় ঢেউগুলো অনেক উঁচু।

বিজলী বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাস্তাঘাটে মানুষজন খুব বেশি নেই, যারা আছে তারাও নিঃশব্দে তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছে। বিজলী শুনতে পেল একটা রিকশার মাঝে মাইক লাগিয়ে কেউ একজন কিছু বলতে বলতে যাচ্ছে। লোকটার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, বিজলী তাই তার কথাটা ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। মানুষটি বলছে :

সাত নম্বর মহা বিপদ সংকেত।

সাত নম্বর মহা বিপদ সংকেত।

সবাইকে জানানো যাইতেছে যে অদ্য রাত্রি তিন ঘটিকার সময় ঘূর্ণিঝড় যারিনা উপকূলে আঘাত হানিবে। জলোচ্ছ্বাসের কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্য সবাইকে মধ্যরাত্রি বারোটার ভিতরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে। সবাইকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে।

একই কথা বলতে বলতে রিকশাটি দূরে চলে গেল। এখন দুপুর বারোটা, রাত বারোটা হতে এখনো হাতে বারো ঘণ্টা সময়। সবাইকে নিয়ে এর মাঝে সাইক্লোন শেল্টারে চলে আসতে পারবে। বিজলী পা চালিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।

বিজলী যখন বাড়ি পৌঁছেছে তখন সে ভিজে চুপসে গেছে। এখনো পুরো জোয়ার আসেনি কিন্তু নিচু জায়গাটা এর মাঝে তলিয়ে গেছে, বুক পানিতে তাকে হেঁটে আসতে হয়েছে। মাঝামাঝি আসতে আসতে ঝির ঝির বৃষ্টিটা ঝম ঝম বৃষ্টিতে পাল্টে গেছে। বাড়ি এসেই সে খোকনের খোঁজ নিল, খোকনও স্কুল থেকে সকাল সকাল চলে এসেছে। তাদের স্কুলে ছেলেমেয়েরা কেউ আসেনি, তাই স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে।

বাবা বাড়ি নেই, বিজলী মাকে পাকঘরে দেখতে পেল। চুলোয় কয়টা ভেজা কাঠ দিয়ে ধোঁয়ার মাঝে বসে আছেন। বিজলী তার ভেজা কাপড় না পাল্টেই বলল, মা, আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।

কই যেতে হবে?

সাইক্লোন শেল্টারে।

মা অবাক হয়ে বললেন, সেটা কী?

সাইক্লোনের সময় সেখানে থাকতে হয়।

কেন?

যখন পানি উঠে আসবে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেজন্যে তখন সাইক্লোন শেল্টার–মানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়।

মা সমুদ্রের মানুষ না, এইসব জানেন না, একটু অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিজলী বলল, সব জায়গায় মাইক দিয়ে বলতেছে। সাত নম্বর মহাবিপদ সংকেত দিছে। আমাদের যাইতে হবে।

মা কেমন করে জানি তাকিয়ে রইলেন, মনে হয় বিজলীর কথা বুঝতে পারলেন না। চুলার মাঝে লাকড়িগুলো ঠেসে দিতে দিতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি এইসব জানি না, তোর বাবারে বল।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, বাবা কই?

জানি না। মনে হয় তোর আমিন চাচার বাড়ি।

আমিন মোল্লার বাড়িতে যাওয়ার তার কোনো ইচ্ছা নাই কিন্তু বিষয়টা অনেকই জরুরি। তাই সে রওনা দিল, বের হওয়ার সময় বিজলী খোকনকে সাথে নিয়ে নেয়। একা একা আমিন মোল্লার বাড়িতে যাওয়ার তার সাহস নাই।

বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, বিজলী আর খোকন দুজনে ভিজতে ভিজতে হেঁটে যেতে থাকে। আমিন মোল্লার বাড়িতে গিয়ে মনে হলো সেখানে অনেক লোকজন।

বাইরের ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গ্রামের বড় মানুষ সবাই গাদাগাদি করে বসে আছে। সবাই মিলে কথা বলছিল, বিজলীকে দেখে সবাই চুপ করে গেল। বাবা বিজলীর দিকে তাকালেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না। কথা বলল আমিন মোল্লা, অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে বলল, কী চাও?

বিজলী বলল, বাবার সাথে কথা বলতে আসছি। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা বাড়ি চল।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

কথা আছে বাবা, জরুরি কথা।

কী কথা?

মাইকে সবাইরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যাইতে বলছে। আজ রাতে সাইক্লোন আসবে।

ঘরের সবাই তখন এক সাথে কথা বলতে থাকে, আমিন মোল্লা তখন ধমক দিয়ে বলল, চোপ।

সবাই তখন চুপ করে গেল। আমিন মোল্লা বলল, আমার কথার উপর তোমাগো বিশ্বাস নাই?

একজন বলল, তা আছে, কিন্তু—

কিন্তু কী?

এই তুফান তো মারাত্মক। তুফানের সাথে পানি আসে, শুনছি লাখ লাখ লোক মারা যায়।

লাখ লাখ লোক কী মুখের কথা? আমিন মোল্লা বলল, তোমাদের আমি বলছি কি না যে আমি চাইরটা পানিবন্দী তাবিজ চরের চাইর কোনায় পুঁইতা আসছি। এই চরের উপর দিয়ে ঝড় যাইব না, এই চরের ওপর পানি আসব না।

একজন বলল, কিন্তু—

কিন্তু কী?

সরকার ঘোষণা দিছে সেইটা এমনি এমনি তো দেয় নাই।

আমিন মোল্লা গর্জন করে উঠল, এমনি এমনিই দিছে, সরকারের কোন কামটা ঠিক? সব বেঠিক। সব বেদাত।

একজন হঠাৎ করে আমিন মোল্লার পক্ষে কথা বলল, ভাইজান কথাটা মিছা বলে নাই। মনে নাই গেল বছর ঘোষণা দিল তুফান আসব পানি আসব, আমরা গিয়া সারারাত কেন্দ্রের ছাদে বৃষ্টির মাঝে বইসা থাকলাম। কিছুই হইল না, বাড়ি আইসা দেখি আমার গরুটা চুরি কইরা নিছে!

অনেকে তখন এই মানুষটার সাথে মাথা নাড়ল, একজন বলল, মিয়া ভাই কথাটা মিছা বলে নাই।

বিজলী মানুষগুলোর কথা না শোনার ভান করে বাবার দিকে বলল, বাবা বাড়ি চলো। তাড়াতাড়ি।

বাবা নিরাসক্ত চোখে বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, কেন? তাড়াতাড়িটা কী জন্যে?

আশ্রয়কেন্দ্র অনেক দূর বাবা, যেতে সময় লাগবে।

আমিন মোল্লা খেঁকিয়ে উঠল, এই ছেমড়ি, আদব লেহাজ নাই? বড় মানুষেরা কথা বলতেছে তার মাঝে কথা বলিস?

বিজলী মুখ শক্ত করে বলে, আমি আমার বাবার সাথে কথা বলি।

আমিন মোল্লা হুংকার দিল, কত বড় বেয়াদপ, আবার মুখে মুখে কথা?

বিজলী আমিন মোল্লার কথা না শোনার ভান করে বলল, বাবা। বাড়ি চলো।

তুই যা। আমি আসতেছি।

আশ্রয়কেন্দ্রে যাবা না বাবা?

বাবা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, খামোখা দৌড়াদৌড়ি করে কী হবে? হায়াত মউত আল্লাহর হাতে।

কী বলো বাবা?

ঠিকই বলি।

বিজলী প্রায় আর্তনাদ করে বলল, আমাদের স্যার বলেছে অবশ্যই অবশ্যই যেন আশ্রয়কেন্দ্রে যাই।

বাবা কিছু বলার আগেই আমিন মোল্লা খেঁকিয়ে উঠল, স্কুলের স্যার! স্কুলের স্যার বেশি জানে? তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কামটা তুমি ঠিক করো নাই। এত বড় মেয়ে আদব লেহাজ নাই, ড্যাং ড্যাং করে স্কুলে যায়? নাউজুবিল্লাহ্!

বাবা কিছু বললেন না, মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আমিন মোল্লা তখন গলা উঁচিয়ে বলল, ঠিক আছে তাহলে, সবার সাথে কথা থাকল। কেউ চর ছেড়ে কোথাও যাইবা না। আমি এই চর পানিবন্দী তাবিজ দিয়ে বেন্ধে রাখছি। কারো কোনো ভয় নাই। হায়াৎ মউত আল্লার হাতে।

সবাই মাথা নাড়ল, একজন বলল, হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে। যার মরণ যেইখানে নাও বাইয়া যায় সেইখানে! যদি এই চরে আমার মউৎ থাকে তাহলে কি এখান থেকে আমি বের হতে পারুম। পারুম না।

আমিন মোল্লা ধমক দিয়ে বলল, কী সব মরণের কথা বলো! মরবা কেন? কেউ মরবে না।

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না। কেউ মরব না।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যখন বিজলী ফিরে আসছে তখন দেখল আমিন মোল্লার বাড়ির উঠানের বেড়া ধরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল। বিজলী একটু এগিয়ে যায়, মহিলাটি আমিন মোল্লার ছোট বউ। বয়স বিজলী থেকে খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না।

বিজলী কাছে যেতেই মহিলাটি ফিস ফিস করে বলল, তুমি তোমার আমিন চাচারে রাজি করাইতে পারো নাই?

কী রাজি করানোর কথা বুঝতে বিজলীর সমস্যা হলো না। মাথা নেড়ে বলল, না।

বউটি মাথা নেড়ে বলল, আমার তুফানরে খুব ভয় করে। অনেক বেশি ভয় করে। আরেকবার বলে দেখো না রাজি করাতে পারো কি না।

বিজলী বলল, লাভ নাই। আমিন চাচা বলছে সে চরের চার কোনায় পানিবন্দী তাবিজ পুঁইতা রাখছে। এই চরে কিছু হবে না।

বউটি শাড়িটি সরিয়ে তার গলায় ঝোলানো অনেকগুলো তাবিজ দেখাল, বলল, সন্তান হয় না দেখে এই দেখো কত তাবিজ দিছে। লাভ হইছে? হয় নাই। তাবিজে কাম হয় না।

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না। বউটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়া মাবুদ। আজ রাতে কী হবে কে বলতে পারে!

বিজলী কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। খোকন বিজলীর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, বাড়ি চল বিজলীবু। শীত করে।

বিজলী বলল, চল যাই। বিজলী বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছনের দিকে তাকালো। বউটি তখনো উঠানের বেড়া ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

*

সন্ধ্যেবেলা থেকে ঝড়ের বেগ বাড়তে লাগল। প্রথম দিকে এটা দমকা হাওয়ার মতো ছিল, আস্তে আস্তে সেটা সত্যিকার ঝড় হয়ে গেল। বাতাসটা পুব দিক থেকে পশ্চিমে বইছে। বিজলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায়। নিশ্চয়ই আজ পূর্ণিমার রাত, আকাশের মেঘ ফুটে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে কেমন যেন একটা অপার্থিব আলো। সেই আলোতে সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব স্বপ্নের মতো দেখায়। বাতাসের একধরনের শব্দ শোনা যায়, শিস দেওয়ার মতো শব্দ। শব্দটা কোথা থেকে আসে কে জানে। সেই শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে সমুদ্রের গর্জন শোনা যেতে থাকে। বিজলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বাতাসের প্রচণ্ড আঘাতে গাছগুলো কেমন যেন মাথা কুটছে। বাড়ির সামনে নারকেলগাছের পাতাগুলো ঝাঁপটে পড়ছে, পুরো গাছটাই মাঝে মাঝে নুইয়ে পড়ছে। বিজলীদের বাড়িটা বাতাসে থরথর করে কেঁপে উঠছে, মনে হয় যেকোনো সময় বুঝি উড়ে যাবে।

যত সময় যেতে থাকে ঝড় তত বাড়তে থাকে। বাতাসের শিস দেওয়ার মতো শব্দ আরো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। সবকিছু ছাপিয়ে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। গোয়ালঘর থেকে তাদের কালো গাইয়ের ডাক শোনা যেতে থাকে, ভয় পেয়ে কেমন জানি ডাকছে। অবলা পশুটি কেমন করে জানি বিপদটুকু টের পেয়েছে।

বাবা ঘরের মাঝখানে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। সামনে একটা কুপি বাতি জ্বলছে, বাতির শিখাঁটি বাতাসের ঝাঁপটায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠতে থাকে। বাবাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়, মনে হয় ঠিক বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে। মা ঘরের ভেতর ছটফট করছিলেন, প্রত্যেকবার বাতাসের ঝাঁপটায় যখন বাড়িটা থর থর করে কেঁপে উঠতে থাকে মা উপরের দিকে তাকান তারপর শুকনো মুখে বলেন, হায় খোদা! হায় পরওয়ার দিগার। হায় মাবুদ। হায় মাবুদ।

খোকন বিজলীকে ধরে রাখছে, বিজলী বুঝতে পারে খোকন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সেও খোকনকে শক্ত করে ধরে রাখে, তাকে নিচু গলায় একটু পরে পরে বলে, ভয় নাই। কোনো ভয় নাই খোকন।

হঠাৎ করে মনে হলো বাতাসের বেগ প্রচণ্ড বেড়ে গেল। পুরো বাড়িটা মনে হয় একদিকে কাৎ হয়ে যায়–সবকিছু থরথর করে কাঁপতে থাকে। ঝনঝন শব্দ করে মনে হয় আকাশ দিয়ে কিছু উড়ে গেল। বৃষ্টির ঝাঁপটায় ঝমঝম শব্দ হতে থাকে। প্রথমবার মনে হলো মানুষ চিৎকার করছে, দূর থেকে তাদের চিৎকার শোনা যেতে থাকে। গোয়ালঘরের ভেতর থেকে কালো গাইটা গলা ছেড়ে ডাকছে, মাঝে মাঝে বাছুরটার চিৎকারও শোনা যেতে থাকে।

বাবা কিছু একটা বললেন, ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে কী বললেন শোেনা গেল না। তখন গলা উচিয়ে আবার বললেন, গাই আর বাছুরটাকে ছেড়ে দিতে হবে।

মা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে ছাড়বে?

দড়ি কেটে দিতে হবে। একটা দা দাও।

মা পাকঘর থেকে একটা দা এনে দিলেন। বাবা দাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, বোঝা যাচ্ছে ঝড়ের ভেতর বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। বিজলী চিৎকার করে বলল, আমাকে দাও। আমি দড়ি কেটে দিয়ে আসি।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, পারবি?

বিজলী মাথা নেড়ে বলল, পারব।

বাবার হাত থেকে দাটা নিয়ে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা খুলতেই ঘরের ভেতর বাতাসের একটা ঝাঁপটা ঢুকে মনে হয় সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে, তার মাঝে বিজলী বের হয়ে গেল। প্রচণ্ড বাতাস মনে হয় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, বৃষ্টির ঝাঁপটায় সে ভিজে চুপসে গেল।

বারান্দা থেকে নিচে নামতেই বৃষ্টির ঝাঁপটাটি আরো তীব্রভাবে তার শরীরে লাগতে থাকে, পানির একেকটা ফোঁটা মনে হয় সুইয়ের মতো তার শরীরে গেঁথে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে, প্রচণ্ড বাতাসের জন্যে এগোতে পারে না। তার মাঝে মাথা নিচু করে সে কোনোভাবে এগিয়ে গেল, গোয়ালঘরের দরজাটা উড়ে গেছে, ভেতরে কালো গাই আর বাছুরটা হুটোপুটি করছে। বিজলী আবছা অন্ধকারে ভেতরে ঢুকে গেল, গাইটা কী বুঝল কে জানে বিজলীকে দেখে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বিজলী দা দিয়ে ঘষে ঘষে গাইয়ের দড়িটা কেটে দেয়, তারপর তার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, যা, যা, বাইরে যা।

গাইটা বাইরে বের হলো না, বাছুরটার দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে ডাকল। বিজলী তখন বাছুরটার দড়ি কেটে দিয়ে সেটাকে ধাক্কা দিল। গাইটা এবারে গোয়ালঘরের খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে ডাকতে ডাকতে সামনে ছুটে যায়। পেছনে পেছনে বাছুরটা ছুটতে থাকে।

ঠিক তখন বাতাসের প্রচণ্ড একটা ঝাঁপটা ছুটে এল এবং গোয়াল ঘরটা বিচিত্রভাবে নড়ে ওঠে। সবকিছু ছিঁড়ে ছুঁড়ে যাবার একটা শব্দ হলো এবং মনে হলো বিজলী বুঝি আকাশে উড়ে যাবে। সে গোয়ালঘরের বেড়াটা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে টের পেল গোয়ালঘরের ছাদটা খুলে গেল, তারপর বিকট শব্দ করে উড়ে গেল। উপরে তাকিয়ে সে খোলা আকাশ দেখতে পায়। মনে হলো এবারে গোয়ালঘরটা পড়ে যাবে আর সে তার ভেতরে বুঝি চাপা পড়ে যাবে।

প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে বিজলী বের হয়ে এল। বৃষ্টির পানিতে সবকিছু কাদা হয়ে আছে, তার মাঝে পা ফেলে সে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

প্রচণ্ড বাতাসের ঝাঁপটায় সে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল, কোনোভাবে নিজেকে রক্ষা করে সে এগিয়ে গেল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মনে হয় তার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।

হঠাৎ সে একটা ভয়াবহ গর্জন শুনতে পায়, কিসের গর্জন বোঝার জন্যে সে পেছন ফিরিয়ে তাকানোর আগেই পানির একটা দেয়াল গর্জন করতে করতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানির ঝাঁপটায় সে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বিজলী বুঝতে পারে তার উপর দিয়ে পানির ঢল বয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নেবার জন্যে সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ায়, তখন পানির ঢলটা তার উপর দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবে নেমে গেল। পুরোটা নেমে গেল না–সে দেখল তার হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। স্কুলে তার স্যার যে জলোচ্ছ্বাসের কথা বলেছিলেন এটি সেই জলোচ্ছ্বাস। এই জলোচ্ছাসে সবকিছু ভাসিয়ে নেবে।

বিজলী চিৎকার করতে থাকে, পানি! পানি! পানি আসছে। বান আসছে!

সে কোনোভাবে বাড়ির দরজায় হাজির হলো, পানির ঢলটা তাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। যে কুপি বাতিটা জ্বলছিল সেটি অনেক আগেই নিভে গেছে। আকাশ থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সেই আবছা আলোতে দেখতে পেল ঘরের দরজা ধরে তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। খোকনকে সে দেখতে পেল না, ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, খোকন! খোকন!

বাড়ির ভেতর থেকে খোকন বের হয়ে আসে, কাঁপা গলায় বলে, এই যে আমি।

বিজলী ছুটে গিয়ে খোকনকে জাপটে ধরল, বলল, পানি আসছে! পানি।

খোকন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এখন কী হবে? কী হবে এখন?

এখন কী হবে বিজলী জানে না। বাতাসের ঝাঁপটা সহ্য করে কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কিন্তু পানির ঝাঁপটা সহ্য করে কিছু টিকে থাকতে পারে না।

বাতাসের তীব্র একটা ঝাঁপটায় সবকিছু থরথর করে উঠল আর ঠিক তখন আগের মতো ভয়াবহ গর্জনটি শুনতে পেল। আবার পানির একটা দেয়াল তার পথে সবকিছু ভেঙেচুরে গর্জন করতে করতে একটা হিংস্র পশুর মতো ছুটে আসছে। কিছু বোঝার আগে পানির সেই বিশাল দেয়ালের আঘাতে তাদের বাড়িটা টলমল করে উঠল। পানির ঝাঁপটায় বিজলী আর খোকন নিচে পড়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বুঝতে পারে না–পানির দেয়ালটি যেভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক সেভাবে আবার ফিরে গেল, আগের মতো পুরোটুকু ফিরে গেল না, কোমর পর্যন্ত পানি রয়ে গেল। দেখতে দেখতে চারদিক পানিতে ডুবে যাচ্ছে।

বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না, মা চিৎকার করে খোদাকে ডাকছেন, বাবা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খোকন হাউমাউ করে কাঁদছে।

বাঁচতে হবে। বিজলী দেখল সে বিড় বিড় করে নিজেকে বলছে, যেভাবে তোক বাঁচতে হবে।

বাঁচার একটি মাত্র উপায়, কোনো একটা উঁচু জায়গায় যেতে হবে। এই চরে কোনো উঁচু জায়গা নেই, কোনো দালান নেই, বিল্ডিং নেই। উঁচু জায়গা বলতে আছে গাছ। তাদেরকে একটা শক্ত বড় গাছে উঠতে হবে। বাড়ির পেছনে যে বড় কাঁঠালগাছটা আছে সেটি হচ্ছে একমাত্র বাঁচার জায়গা।

বাতাস আর বৃষ্টির শব্দের সাথে সমুদ্রের প্রচণ্ড গর্জন, তার মাঝে বিজলী চিৎকার করে বলল, গাছে উঠতে হবে। গাছে। তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি আসো।

বিজলী খোকনের হাত ধরে উঠানে নেমে আসে, সেখানে এখন কোমর পানি। প্রচণ্ড বাতাসের মাঝে পানি ঠেলে হেঁটে যেতে যেতে সে পেছনে ফিরে তাকালো, বিজলীর কথা শুনে তার বাবা মাও পানিতে নেমে এসেছেন। বিজলী খোকনকে নিয়ে ছুটে যেতে যেতে আবার পানির ভয়ংকর গর্জন শুনতে পেল। পানির একটা ভয়াবহ দেয়াল ছুটে আসছে। বিজলী চিৎকার করে খোকনকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। গাছটার কাছে পৌঁছানোর আগে পানির ঝাঁপটা তাদেরকে আঘাত করল। দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, পানির ধাক্কায় দুজনে ভেসে যেতে শুরু করেছে, বিজলী তার মাঝে খোকনকে ছাড়ল না, শক্ত করে ধরে রাখল।

পানি সরে যাবার পর বিজলী উঠে দাঁড়াল।

একটু আগে কোমর পানি ছিল, এখন সেটা বুক পানি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজলী খোকনকে দাঁড় করিয়ে এদিক-সেদিক তাকালো, আবছা আলোতে সে তার বাবা মাকে খুঁজল কিন্তু তাদের খুঁজে পেল না। চিৎকার করে ডাকল, বাবা! মা!

ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে তার গলা চাপা পড়ে গেল, কেউ তার ডাকের উত্তর দিল না। বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না, সে ভালো করে চিন্তাও করতে পারছিল না। বহু দূর থেকে সে আবার পানির গর্জন শুনতে পায়। খোকনকে ধরে সে আবার ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে, বুকসমান পানি ভেঙে ছোটা সহজ নয়, পায়ের নিচে কাঠ কুটো জঞ্জাল তার মাঝে খোকনকে টেনে কাঁঠালগাছটার নিচে পৌঁছে যায়, তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ওঠ। খোকন, গাছের উপর ওঠ।

খোকন গাছের ডালের নাগাল পায় না, বিজলী তখন তাকে ধরে উঁচু করল, খোকন ডালটা ধরে গাছে উঠে গেল। বাতাস খোনকে প্রায় উড়িয়ে নিতে চাচ্ছিল, তার মাঝে খোকন শক্ত করে গাছের ডালটা ধরে রাখল। খোকনকে উঠিয়ে দিয়ে বিজলী নিজে গাছে ওঠার চেষ্টা করল, সেও ডালটা নাগাল পায় না। যখন ভিজে গাছটা বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে ঠিক তখন আবার পানির বড় একটা ঝাঁপটা গর্জন করতে করতে ছুটে এল। পানির প্রবল স্রোতে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, বিজলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে গাছটাকে আঁকড়ে ধরে রাখল। বিজলী শুনতে পেল গাছের উপর থেকে খোকন চিৎকার করছে। পানির গর্জন আর বাতাসের শব্দে সে কিছু বুঝতে পারে না। পানিটা নেমে যাবার পর বিজলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে কোনোভাবে গাছের উপর উঠে পড়ল। বড় ডালটা ধরে সে মুখ হাঁ করে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে খোকনকে বলল, আরো উপরে উঠে যা খোকন, আরো উপরে।

বাতাসে পুরো গাছটি উন্মত্তের মতো হুটোপুটি করছে। গাছের ডাল আর পাতা চাবুকের মতো তাদের শরীরে আঘাত করছে। ভিজে পুরো গাছটা পিচ্ছিল হয়ে আছে, তার মাঝে দুজন গাছের আরো উপরে উঠে গিয়ে একটা বড় ডালকে শক্ত করে ধরে রাখল। প্রচণ্ড বাতাস মনে হয় তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তার মাঝে দাঁতে দাঁত কামড়ে দুজনে গাছটাকে ধরে রাখে।

খোকন চিৎকার করে কিছু একটা বলছিল, কী বলছে বিজলী শুনতে পাচ্ছিল না; বাতাসের শব্দ একটু থামতেই শুনতে পেল, খোকন চিৎকার করে বলছে, বাবা কই? মা কই?

বিজলী কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না, সমুদ্রের পানি কি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? তারা কি কোনো কিছু ধরে কোথাও ভেসে আছে? কে উত্তর দেবে? খোকন কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে গেল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকল, বাবা, মা–

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। বাতাসের বেগ বাড়তেই থাকে, গাছের ডাল ভেঙে পড়ে, বিজলীর একসময় মনে হয় পুরো গাছটাই মনে হয় ভেঙে পড়বে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাদের শরীরে এসে সুইয়ের মতো বিধতে থাকে, মনে হয় পুরো শরীর বুঝি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।

একটার পর একটা পানির ঝাঁপটা আসতে থাকে আর প্রত্যেকবার পানির উচ্চতা আগের থেকে আরেকটু বেড়ে যেতে থাকে। পানির স্রোত গাছে এসে আঘাত করে, পানির ঝাঁপটায় সবকিছু ভেসে যেতে থাকে।

বিজলী আকাশের দিকে তাকালো, বিচিত্র একধরনের আলোর আভায় সারা আকাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার অশরীরী আলোতে চারদিকে কেমন যেন ভৌতিক আর অলৌকিক মনে হয়। উপরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি, নিচে পানির স্রোত। বিজলীর মনে হয় এটাই কি সত্যিকারের নরক? নাকি এটি নরক থেকেও ভয়ংকর।

পানিতে নানা কিছু ভেসে যাচ্ছে। ভাঙা ঘর বাড়ি, দরজা, কাঠ কুটো, বাক্স, হাঁড়ি পাতিল। হঠাৎ হঠাৎ কোনো গরু কিংবা বাছুর। কোনো কোনোটি এখনো বেঁচে আছে, বেশির ভাগ মৃত।

পানি আরো বাড়তে থাকে। শুধু যে পানি বাড়ছে তা নয় মনে হয় যতই সময় যাচ্ছে পানিটা বুঝি আরো ক্রুদ্ধ হয়ে ফুঁসে উঠছে। বিজলী আর খোকন গাছটার আরো উপরে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু খুব বেশি দূর উপরে উঠতে পারে না। নিচের ডালগুলো মোটা, দুজন মানুষ বসে থাকতে পারে। উপরের ডালগুলো সরু, বাতাসে সেগুলো ভয়ংকরভাবে দুলতে থাকে। যেকেনো মুহূর্তে তাদের নিয়ে ভেঙে পড়তে পারে।

পানি বাড়তে বাড়তে একসময় তাদের পা স্পর্শ করে। বাতাসের ঝাঁপটায় সেই পানি অনেক সময় ফুঁসে উঠে তাদের উপর দিয়ে বয়ে যায়। পানিটুকু মনে হয় জীবন্ত এবং ক্রুদ্ধ। একটু পর পর প্রচণ্ড আক্রোশে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

পানিতে মাঝে মাঝেই মানুষ ভেসে যেতে থাকে। বেশিরভাগ মানুষ মৃত। মাঝে মাঝে এক দুজন জীবন্ত মানুষ পাওয়া যায়, তারা গাছটি ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু দুর্বল হাতে গাছটি ধরে রাখতে পারে না, পানির ঝাঁপটায় তারা ছিটকে পড়ে। বিবস্ত্র একটি মেয়ে একবার একটি ডাল ধরে ফেলে চিৎকার করতে থাকল। বিজলী তাকে ধরে গাছে তোলার আগেই মেয়েটি পানির টানে ছুটে গেল, অন্ধকারে তাকে আর দেখতে পেল না। কিন্তু বিজলীর মনে হলো মেয়েটি আমিন মোল্লার সেই কমবয়সী বউটি। যে তুফানকে সে খুব ভয় পায় সেই তুফান তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

খোকন আর বিজলী গাছের ডাল ধরে ঝুলে রইল। বাতাসের তীব্র ঝাঁপটায় মাঝে মাঝে হাত ছুটে যেতে চায়, কিন্তু তারা হাত ছাড়ল না। গাছের ডাল তাদের চাবুকের মতো আঘাত করে, বৃষ্টির পানি ধারালো বর্শার মতো তাদেরকে বিদ্ধ করে তবু তারা হাত ছাড়ল না। মাঝে মাঝেই পানি ফুঁসে উঠে তাদের ডুবিয়ে ফেলে। পানির নিচে থেকে একসময় হাঁসফাঁস করে উপরে ভেসে ওঠে, তবু তারা গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে রইল।

ভোর রাতের দিকে ঝড়ের তীব্রতা কমে আসতে থাকে। মাঝে মাঝে আকাশ চিরে আলো ঝলসে ওঠে, বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যায়। পায়ের নিচে ছলাৎ ছলাৎ করে পানি বয়ে যেতে থাকে। একসময় ঝড় থেমে আসে, আকাশের খোলা আলোতে চারদিকে অস্পষ্ট একটা ছবির মতো দেখায়। ধীরে ধীরে আকাশের মেঘ কেটে পূর্ণিমার ভরা চাঁদটিকে দেখা যায়। পূর্ণিমার ভরা আলোতে পানিতে ডুবে থাকা পুরো চরটিকে একটি অপার্থিব জগৎ বলে মনে হয়। চারদিকে সুনসান একটি অবিশ্বাস্য নীরবতা।

খোকন জিজ্ঞেস করল, বিজলীবু, ঝড় থেমে গেছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না।

কেন না?

ঝড়ের ঠিক মাঝখানে এই রকম হয়। একটু পর আবার ঝড় শুরু হইব।

আবার?

হ্যাঁ। আবার।

আগের মতো?

হ্যাঁ। আগের মতো। খালি বাতাসটা এইবার উল্টাদিক দিয়া আসব।

খোকন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আকাশে তো মেঘ নাই।

মেঘ আসব। ঝড় আসব।

বিজলী ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিল না, সে খোকনের সাথে কথা বলছিল কিন্তু নিজেই জানে না কী বলছে, কেন বলছে? মনে হচ্ছে সবকিছু যেন তার অজান্তে ঘটে যাচ্ছে।

বিজলীর কথা সত্য হলো। দেখতে দেখতে আকাশের চাঁদ আবার মেঘে ঢেকে গেল। আবার আকাশ চিরে আলো ঝলসে উঠল, বজ্রপাতের শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বাড়তে থাকল, বৃষ্টির ধারালো ফোঁটা আবার তাদের ক্ষতবিক্ষত করতে থাকল। পায়ের নিচে ক্রুদ্ধ পানি আবার ফুঁসে ফুঁসে উঠতে থাকল।

তার মাঝে খোকন আর বিজলী গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলে রইল। ক্লান্তিতে তাদের সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে ওঠে, তবু তারা গাছের ডাল ছাড়ল না। প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে তারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, একসময় তাদের বোধশক্তি লোপ পেয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে না সত্যিই তারা কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।

একসময় মনে হতে থাকে বেঁচে থেকে কী হবে?

তবু তারা গাছের ডাল ধরে বেঁচে রইল। কেন তারা বেঁচে রইল তারা নিজেরাও জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *