১. কর্সিকা ভ্রমণ

দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স

১.

১৮৪১ সাল। মার্চ মাসের শুরু। কর্সিকা ভ্রমণে আমি বেরিয়ে পড়লাম। ছবির মতোই সুন্দর দেশ কর্সিকা। এ দেশে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অনেক কিছুই আছে।

কর্সিকা যেতে হলে ঠুলো থেকে জাহাজে চাপবেন। আজাইচো পৌঁছে যাবেন বিশ ঘণ্টার মধ্যে, বাস্তিয়ায় পরের দিন।

বাস্তিয়ায় পৌঁছে চলাচলের সুবিধার্থে একশো ফ্রা খরচ করে ঘোড়া কিনতে পারেন। আবার ঘোড়া ভাড়াও করতে পারেন। পাঁচ ফ্রা ভাড়া প্রতিদিন। দাম কম মনে হলেও ঘোড়াগুলো ফেলে দেবার মতো নয়। দুর্গম পাহাড় বা নড়বড়ে সেতু, কোনো কিছুই ওই ঘোড়াদের অজানা নয়। আরোহীরা নিশ্চিন্তে ওদের পিঠে চাপতে পারেন। তাদের পিঠে চাপলে আরোহীদের আর অন্যকিছু করার দরকার নেই। রাশ আলগা করে, চোখ বুজে থাকলেই হলো। ভয়ডর গ্রাহ্য না করে বাহন আপনাকে ঠিক পৌঁছে দেবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আর শক্তিশালী ঘোড়াগুলো টানা পঁয়তাল্লিশ মাইল চলতে পারে কোনো রকম খাবার ছাড়াই।

যাবার পথে চোখে পড়বে কোনো ভাঙা দুর্গ, মনে চাইলে ঘোড়া থামিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরে আসতে পারেন দুর্গ থেকে। অথবা মন চাইলে দুর্গের বাইরের ছবিও আঁকতে পারেন। ঘোড়ার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ওটা ছাড়া পেলেও পালিয়ে যাবে না। আশপাশেই ঘুরবে। ঘাসটাস পেলে খাবে, নয়তো চিবোবে ঝোঁপঝাড়ের পাতা, আর তাও না মিললে পাথরের শ্যাওলা চেটেই খুশি সে।

পথে যেতে যেতে রাতের আঁধার ঘনিয়ে এলেও ভয় নেই। দুশ্চিন্তা করতে হবে না রাত কাটাবার। কারণ খুবই অতিথিপরায়ণ কর্সিকার মানুষ। যে কোনো গ্রামের যে কোনো বাড়িতে গিয়ে রাত কাটানোর জন্য আশ্রয় চাইলে পাবেনই। আপনার যে বাড়িটা পছন্দ হয় সে বাড়ির সামনে নেমে কড়া নাড়লেই হলো, আদর অভ্যর্থনা করে গৃহস্বামী নিয়ে যাবে ঘরে। খাবার কিছু থাকলে সেটুকু অতিথিকে দিয়ে আপ্যায়িত করবে। আর একটি মাত্র বিছানা থাকলে তাতে শোবার বন্দোবস্ত করে দেবে। পরের দিন অতিথিকে ঘোড়ায় তুলে দেয়ার সময় বিনীত ভঙ্গিতে বলবে, ‘আমার বাড়িতে এসে আমাকে ধন্য করে গেলেন। এ অনুগ্রহ মনে রাখব আমি।’

ভুলেও আতিথ্যের বিনিময়ে টাকা দিতে যাবেন না। গৃহস্থ খুবই অপমান বোধ করবে তাহলে, মনে চাইলে বাড়ির চাকরানীকে একটা রঙিন রুমাল দিতে পারেন, সে সালাম করবে ওটা মাথায় বেঁধে। যদি চাকর থাকে তাকে চাকু বা ভেজোনি দিতে পারেন। শত্রু ঘায়েল করতে কাজে লাগবে।

চাকর চাকরানীকে উপহার দেয়ার আগে একটা ব্যাপার জেনে নেয়া দরকার–গৃহকর্তার সাথে ওদের কোনোরকম আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে কি না। যদি থাকে উপহার দেয়া চলবে না।

কর্সিকায় ধনী আত্মীয়ের কাছে গরিব আত্মীয়রা এসে আশ্রয় নেয়। তবুও গলগ্রহ হয়ে থাকে না। ঘর সংসারের কাজ করে দেয়। বিনিময়ে থাকা-খাওয়া ছাড়াও পারিশ্রমিক কিছু পায়। কিন্তু কারও কাছ থেকে বকশিস নেবে না। কাজেই বকশিস দেয়া যাবে না ওদেরকে।

চাকরের কাজ করলেও আত্মীয়রা কখনও কাজে ফাঁকি দেয় না। ফরাসি দেশ নয় কর্সিকা দেশটা, যদিও দুটো দেশই আজ রাজনীতি সূত্রে বর্তমানে এক সাথে গাঁথা।

পথ চলার কথা বলছিলাম। পথে চোর ডাকাতের কোনও ভয় নেই। ঘোড়ার জিনেই সোনার মোহর ঝুলিয়ে নিয়ে যেতে পারেন আজাইচো থেকে বাস্তিয়া পর্যন্ত। সম্পূর্ণ দ্বীপ এলাকা ঘুরতে পারেন নিশ্চিন্তে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে দ্বীপের বাসিন্দা কারো সাথে আপনার বংশগত বিবাদ না থাকে।

যদি সেটা থেকেই থাকে, আপনি সেডাকো থেকে ওশিয়ানা এ পথটুকুও নিরাপদে চলতে পারবেন না। যদিও মাত্র ছয় মাইল এর দূরত্ব।

আমার কর্সিকা ভ্রমণের কথাই এবার বলি। মার্চ মাসের শুরু। আমি একা বন্ধু সারাদিন রোমেই থেকে গেছে।

এলবা থেকে আসছি আমি। একটা ঘোড়া কিনেছি বাস্তিয়া থেকে নির্দিষ্ট দামে, কোটে, আজাইচো দেখে এগিয়ে যাচ্ছি সার্টেন অঞ্চল দিয়ে। এবার সুন্না কারো যাব আমি।

সার্টেন থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরত্ব সুন্না কারোর। দ্বীপের মধ্য দিয়েও পাহাড়গুলোর মাঝখান দিয়ে সোজা যাওয়া গেলে পথ অনেক কম হতো। একজন গাইড নিয়েছি সাথে, পাহাড় অঞ্চলে পথ হারানোর ভয় থাকে। বিকেল ৫টার সময় পাহাড়ের মাথায় উঠলাম। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে অলমোটা আর সুল্লাকারো।

এখানে বিশ্রাম নেবার সময় গাইড জানতে চাইল–আমি রাতে কোথায় থাকবো। নিচের সমতলে গ্রামগুলো একবার দেখে নিলাম।

গ্রামের পথ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু মানুষ দেখা যাচ্ছে না। ভয়ার্ত ভাবভঙ্গির কয়েকজন মহিলা শুধু চোখে পড়ল।

মনে হলো গ্রামে বাড়ির সংখ্যা হবে একশো থেকে একশো বিশটার মতো। দেশের নিয়ম অনুযায়ী এর যে কোনো বাড়িতে আমি আশ্রয় নিতে পারি। সুতরাং আমার এখন কাজ হলো এর মধ্যে থেকে এমন একটা ঘর বেছে নেয়া যাতে একটু আরামের পরিমাণ বেশি থাকবে।

নজর কাড়ল একটা পাথুরে বাড়ি। একটা ছোট কেল্লার মতো দেখতে চারদিকে উঁচু দেয়াল, তার গায়ে বন্দুক চালাবার ছিদ্র।

সাধারণ বাড়িকে দুর্গের মতো করার চেষ্টা আমি এই প্রথম দেখলাম। অবাক হলাম না, কারণ আমার জানা আছে, বংশগত মারামারির মূল হচ্ছে সার্টেন প্রদেশ এই কর্সিকা দ্বীপে।

বাড়িটা দেখার পরে, গাইড বলল, আপনার পছন্দ-অপছন্দ আছে, কোথায় সুবিধা হবে, তা বেশ ভালো বুঝতে পারেন। চলুন–মাদাম ম্যাভিলিয়া দ্য ফ্রাঞ্চির বাড়িতেই আমরা যাই।

একটা খটকা লাগল আমার মনে, মহিলা যদি বাড়ির মালিক হয়, তাহলে তার ওখানে উঠতে গেলে সে আপত্তি করতে পারে।

‘আপত্তি কেন করবে?’ গাইড সে আশংকা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল।

আমার ভয়ের কারণ আমি তখন তাকে খুলে বললাম, বাড়ির মালিক যদি তরুণী হয় আর আমি তার ওখানে রাত কাটাই তাহলে তার বদনাম হতে পারে?

‘বদনাম!’ গাইড অবাক হলো।

‘মহিলা যদি বিধবা হয়।’

গাইড জানাল–‘বিধবাই তো’।

‘আমার মতো একজন যুবককে তিনি তাহলে কি বলে বাড়িতে থাকতে দেবেন।’

‘১৮৪১ সালে এই ডুমার বয়স ছিল সাড়ে ছত্রিশ। সুতরাং নিজেকে আমি যুবক বলেই মনে করতে পারি।’

‘আমার কথাগুলোই গাইড হুবহু আউড়ে গেল, আপনার মতো যুবককে কি বলে বাড়িতে থাকতে দেবেন?’ তারপর উল্টো প্রশ্ন করল,–‘আপনি যুবক হোন বা বৃদ্ধ, তার সঙ্গে অতিথি হওয়ার সম্পর্ক কী?’

এভাবে প্রশ্ন করে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই আমাকে অন্য পথ ধরতে হলো।

‘মাদাম ম্যাডিলিয়ার বয়স কত?’

‘প্রায় চল্লিশ তার বয়স।’

‘মনটা খুশি হয়ে গেল, বাঁচা গেল। তাহলে তার ছেলেমেয়েও আছে?’ নিশ্চিত মনে বললাম।

‘দুই ছেলে, দুজনেই যুবক।’

‘তাদের সঙ্গে দেখা হতে পারে?’

‘যে ছেলেটি ওখানে থাকে, তার সাথে দেখা হতে পারে।‘

‘অপরজন?’

‘সে প্যারিসে থাকে।‘

‘ওদের বয়স কত?’

‘একুশ।’

‘দুজনেরই?’

‘কী করে ওরা?’

‘যে থাকে প্যারিসে, সে উকিল।’

‘আর দ্বিতীয়জন?’

‘সে আসল কর্সিকাবাসীর যেরকম হওয়া দরকার সেরকমই। অন্যজন ঠিক তেমনই।’

একটা আলাদা অর্থ আছে উত্তরটার। গাইড কিন্তু সে ব্যাপারে মোটেই সচেতন নয়। বললাম, ‘চলো তাহলে মাদাম ম্যাভিলিয়ার বাড়িতে যাই।’

মিনিট দশেক সময় লাগল গ্রামে পৌঁছাতে। পাহাড়ের উপর থেকে যা দেখা যায়নি। তা এখন চোখে পড়ল। প্রত্যেকটা বাড়িতেই ছোট ছোট আত্মরক্ষার ব্যবস্থা আছে। মাদাম ম্যাভিলিয়ার বাড়ির মতো না হলেও সবাই জানালার পিছনে মোটা মোটা কাঠ খাড়া করে রেখেছে। আততায়ী জানালা। ভাঙলেও কাঠের বেড়া দিয়ে ঢুকতে পারবে না। কিন্তু কাঠের ফাঁক দিয়ে বাড়ির বাসিন্দা বন্দুক চালাতে পারবে। অনেক জানালা আবার সম্পূর্ণ ইট দিয়ে গেথে বন্ধ করে দিয়েছে।

গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম–বন্দুক চালানোর ওই ফাঁকগুলোকে ওদের ভাষায় কী বলে?

‘তীর ফাঁক। সে জানাল। বংশগত মারামারি যে এদেশে অনেক পুরানো তা নাম শুনেই বোঝা যায়। যখন বন্দুকের আবিষ্কার হয়নি, তীর ছিল যুদ্ধের একমাত্র অস্ত্র তখন থেকেই কর্সিকাবাসীরা তীর-ধনুক দিয়ে লড়াই করত।

গ্রামের পথে চলার সময় মনে হয় একটা ঠাণ্ডা থমথমে ভাব। অনেক বাড়ির দেয়ালেই গুলির চিহ্ন দেখতে পেলাম।

মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে–‘তীর ফাঁক দিয়ে ভেতরের বাসিন্দাদের চাউনি, এক পলক আমাদের দেখে নিয়েই সরে যাচ্ছে। এরা পুরুষ না মেয়ে তা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না।

উপর থেকে গাইডকে যে বাড়িটা দেখিয়েছিলাম, সেখানে এসে থামার পর দেখলাম গ্রামের সবচেয়ে ভালো বাড়িই এটা।

আশ্চর্য হয়ে গেলাম কাছে এসে। উঁচু থেকে খুব সুরক্ষিত মনে হয়েছিল বাড়িটাকে, কিন্তু আসলে তা না! দেয়াল আছে, গম্বুজ আছে, তীর ফাঁক সব ঠিক আছে। কিন্তু জানালা? জানালাগুলো শুধু রুইতন আকৃতির কাঁচের টুকরো দিয়ে ঢাকা। তার পিছনে কাঠের বেড়া তো দূরের কথা কাঠের পাল্লা পর্যন্ত নেই। কোনো জানালা ইট দিয়ে বন্ধ করা নেই। অথচ আশেপাশের দেয়ালের গায়ে বহু গুলির চিহ্ন রয়েছে। অন্তত দশ বছরের পুরনো হবে সে দাগগুলো।

গাইড দরজায় নক করতেই দরজা খুলে গেল। উঁকি দেয়ার বা দ্বিধার ভাবে নয় একেবারে দরজা পুরো খুলে একজন খানসামা বেরিয়ে এল।

খানসামা বলে মনে হয় ভুল করলাম, খানসামা না বলে বলা উচিত ছিল–মানুষ। পোশাক না থাকলে কেউ তাকে খানসামা বলতে পারবে না। এর পরনে একটা শুধু ভেলভেটের জ্যাকেট ও পাজামা। একটা ডোরাদার রেশমি বেল্ট দিয়ে আটকানো। সেই বেল্টে আছে আবার বড় একটা স্পেনীয় ছোরা।

আমি তাকে লক্ষ করেই বললাম–‘বন্ধু আমি এদেশে নতুন। সুন্না কারাতে কাউকেই চিনি না। তোমার মালিকের বাড়িতে অতিথি হতে চাওয়া কি আমার পক্ষে অবিবেচনার কাজ হবে?’

‘না, মালিক, না’–লোকটি সবিনয়ে জবাব দিল–কারও বাড়িতে অতিথি হওয়া মানে তাকে সম্মানিত করা।’

এরই মধ্যে একজন দাসী এসে দাঁড়িয়েছে তার পিছনে, লোকটি তাকে বলল, ‘যাও মেরায়া মাদাম ম্যাভিলিয়াকে বলো, একজন ফরাসী পর্যটক তার গৃহে অতিথি হতে চান।

কথা বলতে বলতে সে বাঁশের মইয়ের মতো খাড়া সেই সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে আমার ঘোড়ার লাগাম হাতে তুলে নিল।

‘ভেতরে চলে আসুন আপনি। আমরা আপনার জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছি ।’

খুশি হলাম কথাটা শুনে। পথ চলার এই পরিশ্রমের পর এই কষ্টটুকু থেকে বাঁচাও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার।

মইয়ের মতো সেই সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির ভেতর উঠে গেলাম। সামনেই একটা লম্বা বারিন্দা। তার শেষ মাথায় এক মহিলার সঙ্গে দেখা হলো। পরনে কালো ড্রেস, বেশ লম্বা।

মনে হলো এর বয়স হতে পারে ৩৮ বা ৪০। এই বয়সেও বেশ সুন্দরী ইনি। বাড়ির মালিক বোধ হয়। থেমে গিয়ে সালাম দিলাম। তাকে ভদ্রভাবে বললাম, ‘মাদাম আমাকে হয়তো অবিবেচক ভাববেন আপনি। তবে দেশের নিয়মে এবং আপনার চাকর বাকরের আমন্ত্রণ–এই দুয়ের কথা চিন্তা করে আমাকে আপনি ক্ষমাও করতে পারেন।

‘আমি আনন্দিত আপনাকে স্বাগত জানাতে পেরে উত্তর দিলেন মাদাম ফ্রাঞ্চি ‘আপনাকে পেয়ে আমার ছেলেও খুশি হবে। এ বাড়িতে নিজের বাড়ি মনে করেই থাকুন।

‘ম্যাডাম, আমি কেবলমাত্র এক রাতের জন্যেই আশ্রয় চাই, কাল ভোরেই আমাকে চলে যেতে হবে। আবার তাকে সালাম দিয়ে আমি বললাম।

‘সে আপনার ইচ্ছে। যাতে আপনার সুবিধা হয়। তবে আমার আশা আপনি আপনার মত বদলাবেন এবং আরও দুই-চারদিন থেকে যাবেন এখানে।

আমি তৃতীয়বারের মতো তাকে সালাম দিলাম।

মাদাম ফ্রাঞ্চি তখন মেরীয়াকে বললেন–ভদ্রলোককে লুইয়ের ঘরে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি ঘরে আগুন জেলে গরম পানি পৌঁছে দাও। চাকরানি আদেশ শুনে চলে গেল।

মাদাম আমার দিকে ফিরে বললেন-’পরিশ্রান্ত পর্যটকের প্রথম দরকার হলো পানি আর আগুন। আপনি দয়া করে ওর সঙ্গে যান। যা কিছু দরকার হবে, ওকে বলবেন। এক ঘণ্টার ভেতরেই আমাদের রাতের খাবার খাবো। ততক্ষণে আমার ছেলেও এসে যাবে। আপনাকে দেখে সে খুশিই হবে।

সংকোচে জিজ্ঞাসা করলাম–‘আমার ভ্রমণের পোশাক পড়েই যদি খেতে যাই। বেয়াদবি হবে না তো?

মাদাম হেসে বললেন–‘না–কিন্তু বিনিময়ে আপনাকেও স্বীকার করতে হবে যে, আমাদের গ্রাম্য আচার-ব্যবহারকে আপনি বেয়াদবি বলে ভাববেন না।’

উপর তলায় যাচ্ছে দাসী। আমি মাদামকে চতুর্থবারের মতো সালাম দিয়ে তার পিছনে চললাম।

দোতলায় একটা ঘরে আমরা গেলাম। জানালা দিয়ে বাড়ির পিছনটা চোখে পড়ে। পিছনে একটা ছোট বাগানে বিভিন্ন ফুল ফুটে আছে–পাশে ছোট একটি খাল, সেটা কিছুদূরে গিয়ে টাভারা নদীতে মিশেছে।

ফারগাছগুলো বাগানের শেষে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তা ভেদ করে পিছনে আর দেখা সম্ভব নয়। ঘরের ভেতর দেখা গেল, যা সাধারণত ইতালির সব ঘরেই দেখা যায়। বিভিন্ন দৃশ্যের ফ্রেস্কো দেখা গেল দেয়ালের চুনকামের উপর।

এই ঘরটা মাদাম ফ্রাঞ্চির যে ছেলে ফ্রান্সে থাকে তার ঘর। বাড়ির মধ্যে মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর ঘর। সেই জন্যে অতিথিকে দিয়েছেন। মালিকের রুচি ও অভ্যাসের খানিকটা আভাস পাওয়ার জন্য ঘরটা পরীক্ষা করলাম।

আধুনিক আসবাব সবই। কর্সিকার এতটা ভেতরে এই আধুনিক পরিবেশ তৈরি করতে যে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয়েছে, সেটা বুঝতে সময় লাগলো না। লোহার একটা পালঙ্ক, তাতে একটার উপর আর একটা গদি। তার উপরও আর একটা। একটা লম্বা সোফা, চারটি ছোট সোফা, ছয়টি সাধারণ চেয়ার। বইয়ের আলমারি সংযুক্ত করা লেখার টেবিলের সাথে। প্রত্যেকটি ফার্নিচার দামি মেহগনি কাঠের, এগুলো শুধু আজাইচোর প্রথম শ্রেণির ফার্নিচারের দোকানেই পাওয়া যায়।

সবগুলো সোফা আর চেয়ারে ফুল তোলা দামি কাপড়ের ঢাকনা দেয়া। জানালার এবং বিছানার পর্দাও সেই একই কাপড়ের।

মেরায়া ভেতরে থাকার সময় শুধু চোখ দিয়ে দেখেছি, ও বাইরে চলে গেলে, বইয়ের আলমারিটা খুলে দেখলাম, কী আশ্চর্য। ভেতরে আমার দেশের সেরা কবি ও লেখকদের বই–কর্নিল, ব্যসিল, মলেয়ার, লা-ফান্তন, রসনার্ড, ভিক্তর হুগো, লা মাতিন–ঐতিহাসিক সেজার, স্যাটু ব্রায়ান্ড, থিয়েরি, দার্শনিক–মন্তেল, প্যাস্কান, লা ব্রইয়ের বিজ্ঞান কুভিয়ের, বেনদান্ট, এলিক দ্য বোমান্ট সব বই আছে আলমারীতে। উপন্যাসও আছে। কিছু। আমার সমুদ্রের স্মৃতি বইটাও রয়েছে দেখে মনটা ভরে উঠল। আলমারিগুলো চাবি দেয়া। আমি সবগুলো খুলে দেখলাম। একখণ্ড কর্সিকার ইতিহাস আছে। ভ্যান্ডেটা (বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসা) বন্ধ করার উপায়টি যে বিষয়ে প্রবন্ধ, ফরাসি ভাষায় লেখা কিছু কবিতা। ইতালীর ভাষায় লেখা সনেট–কিছু আছে পাণ্ডুলিপি।

এসব দেখেই আমি প্রবাসী লুই দ্য ফ্রাঞ্চির রুচি ও চরিত্রের একটা ছবি তৈরি করে ফেললাম।

যুবকটি অবশ্যই আলাপী এবং পড়ুয়া। কর্সিকায় ফরাসি সভ্যতা প্রচলন করতে ইচ্ছুক, তাতে সন্দেহ নেই। এখন এটাও বোঝা যাচ্ছে, উকিল হওয়ার জন্য কেন সে ফ্রান্সে গিয়েছে।

পোশাক পাল্টাতে গিয়ে আমি এগুলো চিন্তা করছিলাম। আমার পোশাক একদম খারাপ না হলেও, এগুলো পরে কোনো অনুষ্ঠানে গেলে কিছু লোকের উদার মনের প্রয়োজন আছে। কালো ভেনভেটে টাইট জামা হাতার দিকে সেলাই খোলা। যাতে গরমের দিনে বাতাস লাগে। ভেতরের রেশমি শার্ট নজরে পড়ার জন্য জ্যাকেটের গায়ে মাঝে মাঝে ফারা। পাজামা ও জ্যাকেটের একই রং। হাঁটুর নিচে স্প্যানিশ ফ্যাশনের পট্টি জড়ানো। সেখানে রঙিন রেশমের কাজ করা। মাথায় পশমী কাপড়ের নরম টুপি, সেটা বিভিন্ন আকার দেয়া যায়। ভ্রমণকারীদের পক্ষে এই পোশাক খুব আরামের এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।

আমি তৈরি হবার সাথে সাথে আমাকে যে লোকটি প্রথমে স্বাগত জানিয়েছিল সে ভেতরে ঢুকে জানাল, তার তরুণ মালিক মঁসিয়ে লুসিয়েন দ্য ফ্রাঞ্চি এই মাত্র ফিরে এসেছেন এবং আমার অসুবিধা না হলে তিনি আমার সাথে আলাপ করতে চান।

আমি তাকে বললাম, মঁসিয়ে লুসিয়েনের যদি সুবিধা হয় তাতে আমি রাজি। তার সাথে দেখা হলে আমি-সম্মানিত বোধ করব।

একটু পরেই তাড়াতাড়ি পা ফেলে কেউ এদিকে আসছে শুনতে পেলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম আমার গৃহকর্তা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

.

২.

হলো গাইডের কথাই। এর বয়স বিশ/একুশ। কালো চুল, কালো চোখ গায়ের রং তামাটে–বলা চলে একটু বেঁটেই। খুবই ভালো স্বাস্থ্য।

অতিথিকে শুভেচ্ছা জানাতে সরাসরি বাইরের পোশাকেই চলে এসেছেন আমার কাছে। তার পরনে সবুজ সুতি ছোট জামা, ছাই রং সুতি পাজামা, পায়ে কাঁটাওলা বুট, কোমরে বুলেট বেল্ট থাকায় চেহারাতে মিলিটারি ভাব এসেছে, মাথায় টুপি-অনেকটা ফরাসি বাহিনীর আফ্রিকার সেনাদের মতো।

বুলেট বেল্টের ভেতরে বুলেট। বাইরের একপাশে পানির বোতল, অন্য পাশে পিস্তল। কাঁধে ঝুলানো একটা বন্দুকও রয়েছে।

একটু দৃঢ় ভাব তার চলাফেরায়, চোখের দৃষ্টি তার স্থির। কাজের লোক তাতে সন্দেহ নেই।

আমার পোশাক, বাক্স-সবই। সেও একপলকে সবকিছুই দেখে নিয়েছে।

‘নিশ্চয় বিরক্ত করিনি মঁসিয়েকে? এ দিয়েই শুরু করল সে–মাফ করবেন। আপনার কোনো কিছুর দরকার আছে কি না, জানার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এলাম। এবার একটু হেসে বলল, ‘আসলে বাইরে থেকে কেউ আমাদের গরিবের ঘরে এলে, আমি ভয়ানক ঘাবড়ে যাই। সত্য কথা, আমরা কর্সিকার লোকেরা এখনও অসভ্য। তাই সুসভ্য ফরাসিদের কথা ছেড়েই দিলাম, যে কোনো লোককে আমাদের পুরানো ধরনের আতিথ্যের জন্য ভয় করে। অবশ্য আমরা প্রাচীন এই মত পাল্টাতে রাজি না, কারণ আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য সবই তো চলে গেছে। শুধু এটাই আছে।

আমি জবাব দিলাম, আপনি অকারণে ভয় পাচ্ছেন। মাদাম ফ্রাঞ্চি যেভাবে সব ব্যাপারে দেখাশুনা করেছেন এবং এই ঘরে বসে বাইরে না চাইলে মনে হয় না যে আমি বিদেশে আছি। ফ্রান্সের রাজধানীতে নেই। কাজেই নিজেকে অসভ্য বলে যা বলতে চেয়েছেন সেটা শুধু রহস্য ছাড়া আর কিছুই না।’

লুসিয়েন হেসে বলল, এই ঘরটা ফ্রান্সের ঘরগুলোর মতো করেই সাজানো। এটা ভাই লুইয়ের জন্য। সে ফরাসি ফ্যাশনে বাস করতে ভালোবাসে। তবুও আমার মনে হয় এই ঘর তাকে এবার ফ্রান্স থেকে ফিরে এলে আর তৃপ্তি দিতে পারবে না।

আমি জানতে চাইলাম–‘অনেক দিন থেকেই কি আপনার ভাই প্যারিসে আছেন?’

‘না। মাত্র দশ মাস।’

‘তাড়াতাড়ি কি ফেরার কথা আছে?’

‘তিন-চার বছরের ভেতর না।’

‘আপনাদের দুই ভাইয়ের মনে হয় আগে কখনও ছাড়াছাড়ি হয়নি। এখন এই দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে কষ্ট হবে না?

‘অবশ্যই হবে। আমরা যে এক সাথে ছিলাম তাই না, একে অন্যের জন্য টানও বেশি।

‘তাহলে–সে অবশ্য পড়াশোনা শেষ হবার আগে আপনার সাথে দেখা করে যাবেন।

‘যেতে পারে। আমাকেও সে কথাই বলে গিয়েছে।

‘কিন্তু সে এলো না। আপনিও তো তার সাথে গিয়ে দেখা করতে পারেন।

‘আমি? আমি কখনও কর্সিকার বাইরে যাই না।’

দেশপ্রেমিক অনেক আছে। লুসিয়েনের বলার ভাব থেকে এটাই মনে হলো, তাদের জন্মভূমিই সবার চেয়ে সেরা অন্য সব দেশ তুচ্ছ। তার দেশ প্রেম একটু উগ্রই মনে হলো।

আমি হেসে ফেললাম।

লুসিয়েনও হেসে ফেলল তা দেখে, ‘আপনি, এমন অদ্ভুত লোক দেখেননি, যে কর্সিকার মতো হতভাগা দেশ ছেড়ে বেড়াতে যায় না, তাই হাসছেন। কিন্তু কি আশা করেন আপনি? আমার জন্ম এই মাটিতেই। এই সমুদ্রের বাতাসেই আমি বাঁচি। এখানের পাহাড়ের কুয়াশায় আমার চোখ যেমন পরিষ্কার হয়। সেটা আর কোথায়ও হয় না। ঝরনা-পাহাড় ঘুরে বেড়িয়ে জঙ্গলের রহস্য আবিষ্কার করে আমি যে আনন্দ পাই–সেটা অন্য কোথায়ও নেই। আমরা চাই অবাধ স্বাধীনতা। আমাকে যদি শহরে যেতে হয়, তাহলে বোধহয় মারাই যাব।’

আমি তাকে তাদের দু’ভাইয়ের এই পার্থক্যের কারণ জানতে চাইলাম।

‘তাকে সামনে দেখলে, অন্য কিছু বলতেন আপনি। চেহারায় এমন হুবহু মিল থাকার পরেও, প্রকৃতি কেমন করে এত আলাদা হলো।

‘দুজন বুঝি একই রকম দেখতে?

‘একদম। ছোটকালে মা আমাদের জামায় আলাদা চিহ্ন দিয়ে রাখতেন। যাতে সহজে চেনা যায়।

‘বড় হবার পর?

বড় হওয়ার পর গায়ের রং একটু সামান্য তফাৎ হলো। আর কিছু নয়। সব সময় ঘরে বসে বই পড়া আর ছবি আঁকার জন্য ভাইয়ের রঙ একটু ফ্যাকাসে হয়ে গেল, ওদিকে আমি পাহাড়, জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার ফলে গায়ের রং হলো তামাটে।

‘নিজের চোখে দুজনকেই পরীক্ষা করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। যাওয়ার সময় মঁসিয়ে লুই দ্য ফ্রাঞ্চির কাছে কোনো চিঠি দেন, তাহলে সেটা দেয়ার সুযোগে তাকে দেখতে পাব বলে আশা করি।

‘আপনি যদি অনুগ্রহ করে সে কষ্ট স্বীকার করেন। অবশ্যই দেব। আনন্দের সঙ্গে দেব। কিন্তু আপনার পোশাক পরা প্রায় শেষ। আর আমি শুরু করিনি। কিন্তু আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা খেতে বসব।’

আমি জানতে চাইলাম, পোশাক বদল কি আমার খাতিরে?

উত্তর দিল, সে যদি হয়, দোষ আপনার। নিজে পোশাক পাল্টিয়ে আমাকে পথ দেখিয়েছেন। আমার পরা আছে ঘোড়ার চড়ার পোশাক। এগুলো বদলে পাহাড়ে চড়ার পোশাক আমাকে পড়তে হবে। রাতের খাবারের পর আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। এই কাটাওলা বুট তাই পাল্টাতে হবে।

‘খাবার খেয়েই বের হবেন?’

‘একজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে।’

আমি হাসলাম।’

‘না, না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। এটা অন্য কাজ।’

‘আমাকে সবকিছু খুলে বলবেন–এটা অবশ্যই আশা করি না।’

‘কেন করবেন না? আমার লুকোবার কিছু নাই। এমন ভাবি আমি চান না যাতে কোনো কিছু আমার লুকোবার প্রয়োজন হয়। আমার কোনো প্রেমিকা ছিল না। হবেও না কোনোদিন। তাই যদি বিয়ে করে, তার বাচ্চা হয়। তাহলে সম্ভবত আমি বিয়েও করব না। তবে সে যদি বিয়ে না করে। তখন বংশ রক্ষা করতে আমাকে বিয়ে করতেই হবে।’

এখানে কথা থামিয়ে একটু হেসে ফেলল। তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘আমি রীতিমতো বর্বর একজন মানুষ। পৃথিবীতে আসতে আমার ১০০ বছর দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু এভাবে যদি কথা বলতে থাকি, তাহলে খাওয়ার আগে পোশাক বদলানো হবে না আমার।’

‘কিন্তু পোশাক বদলাতে বদলাতেও তো কথা বলা যায়–এক মিনিটের জন্যও ওকে আমার ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। ঐ সামনের ঘরটা তো আপনার। দরজাটা খুলে রেখে আপনার ঘর থেকে কথা বলুন, আমার ঘর থেকে আমি বলি।

‘তার চেয়েও ভালো হয়, আপনি যদি আমার ঘরে আসেন। ঘরের সাথেই আমার পোশাকের ঘর। আপনি অস্ত্রশস্ত্র ভালোবাসেন তো? আমার অস্ত্রশস্ত্র দেখুন। এর ভেতর কিছু ঐতিহাসিক মূল্যও আছে।’

এটাই চাইছিলাম আমি। দুই ভায়ের দুইটা ঘর দেখাতেই ওদের রুচি পার্থক্য সহজেই আমার চোখে পড়বে। এ সুযোগ ছাড়া যায় না। কাজেই লুসিয়েনের মুখ দিয়ে কথা বেরুবার সাথেই আমি তার পেছনে চললাম।

নিজের ঘরের দরজা খুলে লুসিয়েন আমাকে তার ঘরে ঢুকার জন্য ইশারা করল। এক পা ভেতরে ঢুকে আমার মনে হলো–ঢুকে পড়েছি একটা অস্ত্রাগারে।

এখানের সব ফার্নিচার পনেরো/ষোলো শতাব্দীর। পালঙ্কের চারদিকে চারটি মোটা কাজ করা দামি কাঠের খুটি, তাদের মাথার উপরে সবুজ ভেলভেটের চাদোয়া, চাদোয়ার গায়ে সোনালি ফুলের বুটি। জানালাতেও ওই একই কাপড়ের পর্দা।

দেয়ালে স্পেনের চামড়ার আবরণ। যেখানে একটু ফাঁক রয়েছে, উঁচু টেবিলে বা ব্রাকেটের উপর আধুনিক বা মধ্য যুগীয় কোনো বিশেষ অস্ত্র রেখে দেয়া হয়েছে। যে লোক এ ঘরে থাকে তার রুচির ব্যানারে বুঝতে আর বাকি থাকে না। এর ভাই যেমন শান্তি প্রিয়, এ তেমনি যুদ্ধবাজ।

পোশাকের ঘরে ঢোকার সময় লুসিয়েন বলল, ‘ভালো করে এসব দেখুন। তিন শতাব্দীর অস্ত্রের নমুনা এখানে পাবেন। আমি ততক্ষণে পাহাড়ে চড়ার পোশাকটা পরেনি খাওয়ার পরেই বের হতে হবে।

আপনি বলেছিলেন কোনো কোনো অস্ত্রের ঐতিহাসিক মূল্য আছে, সে কোনগুলো? তরোয়াল, না বন্দুক, না ভোজালি?

সে ধরনের তিনটি আছে। এক নম্বর ওই ভোং টা যেটা আমার বিছানার মাথার কাছে রয়েছে, লম্বা হাতল বাটের উপর সীল মোহর আঁকা।

‘হ্যাঁ দেখেছি। বলুন এবার।’

‘ওটা হলো স্যামপিত্রোর ভোজালি।’

‘বলেন কি? সেই কুখ্যাত স্যামপিত্রো? ভ্যানিলাকে যে হত্যা করেছিল?

‘হত্যা করেছিল বলবেন না, বলুন ভ্যানিলার উপর প্রতিহিংসা নিয়েছিল।’

‘আমার কাছে তো দুটোই এক রকম লাগে।’

‘যারা কর্সিকার বাইরের লোক, তারা ওই রকমই ভাবে। স্যাসলিত্রো কর্সিকাবাসীদের চোখে অন্যরকম।

‘সে কথা থাক–ভোজালিটা সত্যি তার তো?’

‘লক্ষ্য করুন, স্যাসলিব্রোর বংশ পরিচায়ক অস্ত্র চিহ্ন খোদাই করা আছে। শুধু বাদ পড়েছে ফ্রান্সের রাজকীয় লিলি ফুল। পার্পিসার অবরোধের পরে স্যাসলিত্রোকে লিলি ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়।

‘আমি কিন্তু এটা জানতাম না। কিন্তু আপনার হাতে এল কি করে এ ভোজালি?

‘আজ তিনশো বছর আমাদের বংশে রয়েছে এই ভোজালি। স্যাসপিত্রো নিজেই ওটা দিয়েছিলেন আমার পূর্ব পুরুষ লেলোলি’র দ্য ফ্রাঞ্চিকে।

‘উপলক্ষ্য?

‘উপলক্ষ্য হলো এই। স্যাসপিত্রো আর আমার ওই বুড়ো পূর্ব পুরুষ এক সময়ে একসঙ্গে জেনোয়াবাসীদের পাল্লায় পড়েন। জেনোয়ার সৈন্যরা ওত পেতে ছিল, হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের ওপর। অসাধারণ বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন দুজনে, স্যাসপিত্রোর শিরস্ত্রাণ খুলে পড়ে যায় এক ঘোড়সওয়ার শক্ত লোহার মুগুর তোলে তার মাথার উপরে। ঠিক সেই সময়ে বুড়ো পিতামহ তার ভোজালি ঢুকিয়ে দেয় শত্রুর লৌহবর্মের জোড়ের মুখ দিয়ে। আহত হয়ে লোকটা তো ঘোড়া ছুটিয়ে দে দৌড়। কিন্তু বুড়ো পিতামহ আর তার ভোজালি খুলে নিতে পারলেন না তার দেহ থেকে। এত গভীরভাবে অস্ত্রটা ঢুকে গিয়েছিল, অত তাড়াতাড়ি তা বের করে আনা গেল না। তখন তাঁর আপসোস দেখে কে! তার বড় শখের হাতিয়ার ছিল ওটা, ভদ্রলোকের ক্ষতিটা অপূরণীয় মনে হতে লাগল। তার দুঃখ দেখে স্যামপিত্রো তাঁকে নিজের ভোজালি উপহার দিলেন, খাস স্পেনের তৈরি। দুটো পাঁচ ফ্রাঙ্ক মুদ্রা রেখে এই ভোজালি দিয়ে কোপ দিলে দুটোই কেটে যাবে।

‘বলেন কি?’

‘পরীক্ষা করেই দেখুন না।

আমি মেঝেতে দুইটা মুদ্রা একটার উপর আর একটা রেখে ভোজালি দিয়ে জোরে কোপ দিলাম। দেয়ার পর দেখা গেল, লুসিয়েনের কথাই ঠিক। দুটো মুদ্রা কেটে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে।

হেসে বললাম, ‘সন্দেহ নাই, এটা স্যামপিত্রোর ভোজালি, কিন্তু ভাবতে অবাক লাগছে, এরকম ধারালো অস্ত্র থাকতেও তিনি স্ত্রীকে মারার জন্য দড়ির ফাঁস ব্যবহার করলেন।

‘বাঃ এ অস্ত্র তখন কোথায়? অনেক আগেই এটা আমার বুড়ো পিতামহকে দিয়ে দিয়েছেন।

‘হ্যাঁ, কথাটা ঠিক।

‘তার বয়স তখন ষাট। পৃথিবীকে একটা মূল্যবান শিক্ষা দেয়ার জন্য স্যামপিত্রোকে কনস্ট্যাল্টিলোপন থেকে আই-তে ছুটে আসতে হলো। শিক্ষাটা এই, রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কোনো মহিলাকে নাক গলাতে দেয়া উচিত না।

এর উত্তর আমার কাছে ছিল না। নীরবে আগের জায়গায় ভোজালি রেখে দিলাম। লুসিয়েনের তখন পোশাক পরা হয়নি। আমি অন্য দুইটি ঐতিহাসিক জিনিস জানতে চাইলাম।

‘পাশাপাশি ওই দুটি ছবি দেখেছেন?’

‘হ্যাঁ, পাওনি আর নেপোলিয়ন।’

‘ঠিক, পাওলির পাশে একটা তরোয়াল।’

‘হ্যাঁ।’

‘তারই তরোয়াল।

‘বলেন কি তারই তরোয়াল? এটাও নিশ্চয়ই স্যামপিত্রোর ভোজালির মতো মূল্যবান।

‘হ্যাঁ, এটাও মালিক নিজে থেকে দিয়েছেন। তবে ওটা দিয়েছেন কোনো বুড়ো পিতামহ কে না, দিয়েছেন বুড়ো মাতামহীকে।

‘এক মহিলাকে তরোয়াল উপহার?

‘তাঁর কথা আপনি শুনতে পারেন। সুল্লাকারোর দুর্গে এক মহিলার আবির্ভাব হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। তার সঙ্গী ছিল এক যুবক।

‘না। যদি আপনি ঘটনাটা বলেন।

‘সুল্লাকারোতে এসে মহিলা আর এই যুবক পাওলির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন, পাওলি তখন লেখার কাজে ব্যস্ত ছিল, বলে দিলেন দেখা হবে না। মহিলাটি চাপাচাপি করতে লাগল, প্রহরীরা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পাওলির কানে এই গোলমালের গেলে, তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

মহিলা জানালেন, ‘আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।

পাওলি জানতে চাইলেন, কী বলতে চান?

‘আমার দুটি ছেলে, কাল খবর পেলাম যে বড় ছেলে স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে, শুনে আমি ষাট মাইল হেঁটে আপনার কাছে এসেছি, ছোট ছেলেটিকে আপনার সৈন্য দলে দেবার জন্য। সে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

‘এক কালে স্পার্টার মহিলাদের সম্পর্কেই এ ধরনের কথা শোনা যেত। এ মহিলাটি কে?

‘আমার পিতামহ, নিজের কোমর থেকে খুলে পাওলি তরোয়াল তুলে দিয়েছেন আমার দাদীর হাতে। বলুন সে এই তরোয়াল পাওয়ার যোগ্য কি না?

‘নিঃসন্দেহে যোগ্য। কিন্তু ওপাশের তরোয়ালটি–

‘এটা তো নেপোলিয়নের তরোয়াল। পিরামিডের যুদ্ধে এটাই তিনি ব্যবহার করেছিলেন।’

‘এটাও নিশ্চয়ই আপনার পরিবারে ওইভাবে এসেছিল।’

‘তখন পিরামিডের যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তখনও এক দল মামলুক সৈন্যরা তাদের আহত সর্দারকে নিয়ে যুদ্ধ করবার জন্য তৈরি। আমার পিতামহ ছিলেন গাইড সৈন্য দলের এক সেনাপতি। নেপোলিয়ন তাকে ওই দলটাকে আক্রমণ করতে আদেশ দিলেন। যুদ্ধে পরাজিত করে, আহত সর্দারকে বন্দি করে নিয়ে এলেন নেপোলিয়নের সামনে। তারপর তরোয়াল যখন খাপে ভরতে যাবেন, দেখলেন, মামলুকদের কারণে তরবারির আঘাতে আঘাতে তার তরোয়াল এমনভাবে বাঁকা হয়েছে যে, তা আর খাপে ঢোকানো যাচ্ছে না। পিতামহ তখন খাপ আর তরোয়াল দুটোই ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বোনাপার্টি তখন নিজের তরোয়ালটিই তাকে দিয়ে দিলেন।

একটু সময় আমি চুপ থেকে বললাম–নেপোলিয়নের তরবারিটা আপনারা যত্ন করে টানিয়ে রেখেছেন, কিন্তু আমি হলে এ দেয়ালে আমার পিতামহের বাঁকা তরোয়ালটাই শোভা পেত।’

‘ওই উল্টো দিকে তাকিয়ে দেখুন। নেপোলিয়নের ঠাকুরদার ভাঙা তরোয়ালটা যত্ন করে কুড়িয়ে নিয়েছিলেন। তারপর তার হাতলে একটা হীরা বসিয়ে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ওতে একটা লাইন লিখে দিয়েছিলেন, পড়ে দেখুন।

সামনে গেলাম, দুই জানালার মাঝখানে ভাঙা তরোয়ালটা রয়েছে। যতটা খাপের মধ্যে ঢোকে ততটা ঢোকানো বাকিটা বাইরে।

সামনে গিয়ে পড়ে দেখলাম–সেই বাকানো পাত্রের উপরে সোজা একটা লাইন খোদাই করা।

‘২১ জুলাই, ১৭৭৮ পিরামিডের যুদ্ধ।

সেই চাকরটি এবার এসে দেখা দিল, যে এর আগে আমাকে দরজা খুলে দিয়েছিল এবং লুসিয়েনের ফেরত আসার খবরও জানিয়েছিল।

সে লুসিয়েনকে জানাল–মঁসিয়ে, মাদাম ফ্রাঞ্চি আপনাকে জানাতে বলল, যে খাবার তৈরি।

লুসিয়েন বলল–‘গ্রিফো–তুমি মাকে গিয়ে জানাও আমরা এক্ষুণি যাচ্ছি ।’

পাহাড়ে চড়ার পোশাক পড়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, ভেলভেটের ছোট জামা, পাজামা আর পট্টি। কোমরে তার আগের দেখা কার্তুজ ভরা বেল্ট। এদিকে আমি তখন দুটি বন্দুক দেখছি। সামনের দেয়ালে ও দুটো ঝোলানো আছে। দুটোরই বাঁটের উপরে একই তারিখ খোদাই করা। ২১ সেপ্টেম্বর ১৮১৯ সকাল ১১টা।’

‘এ দুটোরও কোনো ঐতিহাসিক মূল্য আছে নাকি?’ বন্দুক দুটো দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম।

‘আছে, অন্তত আমাদের কাছে। একটি ছিল বাবার। সে থামল।’

‘দ্বিতীয়টি।

সে হেসে বলল। অন্যটি মায়ের। কিন্তু খাবার দিয়েছে। চলুন নিচে যাই।’

.

৩.

‘মায়ের বন্দুক।’

নিচে নামার সময় ওই কথাটাই আমার কানে বাজতে লাগল বারবার, মায়ের বন্দুক। খাওয়ার ঘরে ঢুকে, মাদাম ফ্রাঞ্চিকে ভালো ভাবে দেখলাম। প্রথম দেখায় এভাবে খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি। তার ছেলে ঘরে ঢুকেই মায়ের হাতে চুমু খেল। মাও সে শ্রদ্ধা নিবেদনকে সম্রাজ্ঞীর মর্যাদা দিয়েই গ্রহণ করলেন।

‘বড় দেরি হয়েছে, মা মাফ কর।

আমি সালাম দিয়ে বিনিতভাবে বললাম, ‘দোষটা আমারই। সিয়ে লুসিয়েন এত মূল্যবান ঐতিহাসিক জিনিস আমাকে দেখাচ্ছিলেন–তার ফলে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই ওর এত দেরি হয়েছে।’

মা হাসিমুখে বললেন–‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমিও তো এই মাত্র নিচে নেমেছি। তারপর লুসিয়েনের কাছে জানতে চাইলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম তোমার কাছে লুইর খবর পাব।

আমি মাদাম ফ্রাঞ্চি না বলে পারলাম না। আপনার ছেলে কি অসুস্থ?’

‘লুসিয়েনের ধারণা তো তাই।’

‘চিঠি এসেছে নাকি?’

‘না, চিঠি পাইনি বলেই তো ভাবছিউত্তর দিল লুসিয়েন।’

‘কিন্তু অসুস্থ হয়েছেন। এমনটা ভাবছেন কেন?’

‘ভাবনা এ কারণে যে, কয়েকদিন ধরে নিজেই ভালো নেই।’

মাফ করবেন, বার বার প্রশ্ন করে বিরক্ত করছি। কিন্তু আপনি ভালো নেই বলে কীভাবে বোঝা গেল আপনার ভাইও অসুস্থ।

‘আপনি তো জানেন, আমরা যমজ ভাই।’

‘হ্যাঁ তা জানি, গাইড আমাকে জানিয়েছিল।

‘কিন্তু এটা শোনেননি জন্ম হবার সময় আমরা জোড়া লাগানো অবস্থায় ছিলাম?

‘না, এটা শুনিনি।’

‘ডাক্তার এসে অপারেশন করে আমাদের দুই ভাইকে আলাদা করে।’ এর ফলে আমরা দুই ভাই যত দূরেই থাকি। একজনের সাথে অন্যজনের একটা মানসিক যোগ রয়েছে। একজন শারীরিক মানসিক যে কোনো ভাবান্তর হলে, অপরজন তা সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করবে। বেশ কয়েকদিন থেকেই আমার মনটা ভালো লাগছে না-তার একটাই মানে হতে পারে যে, ভাই-এর নিশ্চয়ই কোনো অসুখ হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে যে, লুই কোনো বিপর্যয়ে পড়েছে।

‘এই সুস্থ সবল তরুণের দিকে তাকিয়ে আমি দেখছিলাম। এই সম্পূর্ণ অদ্ভুত ব্যাপারটা তার কাছে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে, তার মাও তার এই বিশ্বাসকেই সহযোগিতা করে যাচ্ছে।

মাদাম ফ্রাঞ্চিই নীরবতা ভেঙে হালকা হেসে বললেন। সে আমাদের সামনে নাই, সেও সৃষ্টিকর্তার সামনে রয়েছে, এটাই সান্ত্বনা। তোমার কোনো সন্দেহ নেই তো, সে বেঁচে আছে।

লুসিয়েন শান্তভাবে জানাল–‘তার মৃত্যু হলে তাকে আমি দেখতে পেতাম।

‘তাহলে তুমি নিশ্চয়ই আমাকে জানাতে।’

‘নিশ্চয়ই, সাথে সাথে, আমি শপথ করে বলছি মা।

তারপর তার মনে হয় খেয়াল হলো, আমার পক্ষে এই আলাপে অবাক হওয়ার কথা। তাই আমার দিকে ফিরে তিনি বললেন–‘মঁসিয়ে, ক্ষমা করবেন। বোঝেনই তো মায়ের মন। দুশ্চিন্তা চেপে রাখতে পারছি না। লুই আর লুসিয়েন আমার দুই সন্তান। এ বংশের শেষ বংশধর। আপনি আমার ডান দিকে বসুন। বাদিকে লুসিয়েনকে বসালেন।

বেশ বড় লম্বা একটা টেবিলের এক পাশে আমরা তিনজন বসেছি। অন্য পাশে ছয়টা প্লেট সাজানো আছে তাদের জন্য–কর্সিকান ভাষায় যাদের সব মিলিয়ে নাম হলো–সংসার। বড় বাড়িতে মালিক এবং চাকরের মাঝামাঝি যে লোক থাকে, সংসার বলতেই তাদের বোঝায়।

টেবিলে প্রচুর আয়োজন–কিন্তু খাবারের দিকে আমার মন নেই। অনেকগুলো অবাস্তব চিন্তা আমার মনে আসা যাওয়া করছে, যার ফলে খাওয়ার দিকে মন দিতে পারছি না। জোরালো ক্ষিদে পেয়েছে, তাই কিছু খেতে হলো ঠিকই, তাতে খাবারের আনন্দ পেলাম না।

আমি এ বাড়িতে আতিথ্য নিয়ে মনে হচ্ছে একটা অন্য পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছি। অন্য জগতে আছি। এ মহিলা–সৈন্যদের মতো বন্দুক ব্যবহার করে। এ ভাই (এক লীগ তিন মাইল) তিনশো লীগ দূরের ভাই ব্যথা-বেদনা টের পায় এখানে বসে। মা শপথ করিয়ে নেয়, মৃত ভাইকে দেখতে পেলে সাথে সাথে তাকে জানাবে।

এই সব মনে করেই অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর মনে হলো, এভাবে মাথা নিচু থাকা অসৌজন্যর পরিচয়। শেষ পর্যন্ত মনকে ফিরিয়ে, মাথা তুলে ওঁদের দিকে তাকালাম।

তাকাতেই লুসিয়েন কথা শুরু করল–ঠিক যেন পুরানো কথার রেশ ধরে শুরু করল। তাহলে এ ব্যাপারে কর্সিকায় এলেন।

‘দেখতেই পাচ্ছেন, ভাবনাটা বেশ কিছুদিন থেকেই মাথায় ছিল, তাই বেরিয়ে পড়লাম।

‘আর দেরি না করে ভালোই করেছেন। যেভাবে ফরাসি রুচি ও আচার আচরণ এদেশে এসে পড়েছে তাতে যারা আর কিছুদিন পড়ে এখানে আসবেন। তাঁরা কর্সিকান দেখতে পাবেন না।

‘যদি কোনোদিন সে সময় আসে, ফরাসি সভ্যতার তাড়া খেয়ে প্রাচীন কর্সিকা আসা বৈশিষ্ট্য যদি দেশের দূরে কোথাও আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় তবে যে কোনো কোথায় হবে, তা আমি ভাবিনি। সে হবে ট্যাভরো উপত্যকার সার্টেন প্রদেশে। আমি উত্তর দিলাম।

লুসিয়েন হেসে ফেলল–‘আপনার তাই ধারণা?

‘কেন হবে না সেই ধারণা? আমার সামনেই যে বসে আছে তার উজ্জল নমুনা।

তা, ঠিক, কিন্তু দেখুন, আমার মা আছেন, আমি আছি, চারশো বছরের পুরনো ঐতিহ্য আছে, তবে তার ফাঁক দিয়ে ফরাসি সভ্যতা ঢুকে পড়েছে, কেড়ে নিয়েছে আমার ভাইকে দূর প্যারিসে, যেখান থেকে সে উকিল হয়ে ফিরে আসবে, দেশে ফিরে এসে থাকবে আজাইচোতে, নিজের পিতার বাড়িতে না। সে ওকালতি করবে, হয়তো সরকারি উকিল হবে, মামলা চালাবে সেসব লোকের বিরুদ্ধে যারা বংশানুক্রমিক প্রতিহিংসার পালা উদ্ধার করতে গিয়ে শত্রুকে নিজ হাতে হত্যা করেছে। অর্থাৎ প্রতিজ্ঞাপালনকারীকে সে সাধারণ খুনির পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা যে কাজকে অবশ্য করণীয় বলে প্রচার করে গিয়েছেন, সেই কাজকে সে মহাপার বলে ঘোষণা করবে। শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করবে তার আদেশ পালনকারীকে। সৃষ্টিকর্তার বিচার বাদ দিয়ে চালিয়ে দেবে মানুষের বিচার এবং প্রতিজ্ঞাপালনকারী একজনকে যদি সে ফাঁসি দিতে পারে। এই বলে সেদিন তার আত্ম প্রসাদ হবে যে সভ্যতার দেয়ালে একটা ইট সে গেঁথে দিয়েছে। হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর। ভাবাবেগের জন্য লুসিয়েনের কথা বন্ধ হয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা ডাকতে ডাকতে উপর দিকে এমনভাবে চোখ তুলে চাইল মনে হলো এ ঠিক এভাবে পরাজিত অনিবার্য (কার্থেজীয় বীর, রোমের পরম শত্রু) চেয়েছিল জামা যুদ্ধের পর।

আমি তার ব্যথায় সান্ত্বনা দিলাম, ‘সৃষ্টিকর্তা কিন্তু সুন্দর ভাগ করেছেন। আপনার ভাই যেমন নতুনের পক্ষে-তেমনি আপনি হয়েছেন প্রাচীন যুগের ভক্ত।

‘প্রাচীন যুগের অনুসারী? সেটা কোথায়? আমি তো এমন সব কাজ করি যা ফ্রাঞ্চি বংশধরের উপযুক্ত কাজ না।

সবিস্ময়ে বললাম, আপনি বলেন কী?

‘আপনি হাসবেন না, আমি জানি আপনি কেন এসেছেন এদেশে? বলল কি সে উদ্দেশ্য।

‘বলুন।’

আপনি পৃথিবী দেখতে বেরিয়েছেন, আপনার কর্সিকায় আসার প্রধান উদ্দেশ্য ওই প্রাচীন প্রথা ভেলডেটা’ এটাই আপনি দেখতে চান সচক্ষে কর্সিকা বাসীদের মধ্যেই মেরেসি ‘কলবা’ বইয়ে যে ধরনের চরিত্র এঁকেছে।

আমি তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, আমার সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি। এ গ্রামে তো দেখেছি আপনাদের বাড়ি ছাড়া অন্য সব বাড়ি দুর্গের মতো সুরক্ষিত।

‘ঠিক, আমার বাড়ি ছাড়া অন্য সব বাড়ি সুরক্ষিত। এতেই কি প্রমাণ হয় না আমি এ বংশের মর্যাদা ধরে রাখতে পারিনি? এই গ্রামে গত দশ বছর ধরে একটা হানাহানি চলছে। গ্রামের সব লোক দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে, একমাত্র আমি কোনো দলে নেই। আমার বাবা যদি বেঁচে থাকতেন, কিংবা পিতামহ–তবে তারা যে কোনো একটা দলে ভিড়ে যেতেন। আর আমি এখন মিমাংসা করছি। একজন ছোরা মারছে, একজন গুলি চালাচ্ছে। আমি মাঝখানে থেকে দুজনকেই বলছি, থামো, থামো।’ আপনি সার্টেন প্রদেশে এসেছেন খুনি দেখতে, চলুন এখন আমার সঙ্গে, দেখাব আপনাকে খুনি?

‘আমাকে সঙ্গে নেবেন?

‘কেন নেব না? আপনার যদি কৌতূহল থাকে। তবে যাবেন কিনা সেটা আপনার উপর নির্ভর করে।

‘আমি তাহলে আনন্দের সঙ্গেই যাব।

মাদাম ফ্রাঞ্চি বললেন–‘উনি কিন্তু খুব ক্লান্ত। তার ইতস্তত ভাব দেখে মনে হয়। কর্সিকার প্রাচীন প্রথা ভেলডেটা বর্তমানে কমে যাওয়াতে ছেলের মতো তিনিও লজ্জিত।

মা তাতে কী হয়েছে? উনি গিয়ে দেখুক। পরে যখন প্যারিসে ফিরে গিয়ে গল্পের আসরে যোগ দিয়ে, কর্সিকার ভেলডেটা আর কর্সিকার এই খুনিদের নিয়ে অবাস্তব গল্প চলবে, তখন উনি সত্য কথা বলে লোকের ভুল ভাঙিয়ে দিতে পারবেন।

এইমাত্র আপনি যে দশ বছর ধরে ঝগড়ার কথা বলেছিলেন, যার। মিমাংসা আপনি করছেন, তার শুরু হয়েছিল কীভাবে?

‘শুরু যেভাবেই হোক, সেটা কোনো বিষয় না, ঝগড়ার পরিণাম কী হলো মানুষ সেটাই দেখে, মনে করুন একটা মাছি কোনো লোকের সামনে দিয়ে উড়ে গেল। সেই কারণেই মানুষটা মারা গেল। এখানে গুরুত্ব মৃত্যুর মাছির না। সামান্য মাছির কারণে মারা গেলেও মৃত্যুটাই সত্য।

আমি দেখলাম, লুসিয়েন সুল্লাকারোর পুরুষেরা যেটা নিয়ে দশ বছর ধরে একে আরেকজনকে খুন করছে, তার কারণ আমাকে নিজের মুখে জানাতে চাচ্ছে না। কিন্তু তার দ্বিধাই আমার কৌতূহলকে বাড়িয়ে তুলল।

‘কিন্তু ঝগড়াটার একটা কারণ তো ছিল, তবে ব্যাপারটা যদি গোপনীয় কিছু হয়

‘আরে না, গোপন কিছু না, অলাৰ্ত্তি আর কলোনাদের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়।’

‘কীভাবে?

‘কারণ একটা মুরগি, অলাৰ্ত্তিদের বাড়ি থেকে একটা মুরগি গিয়েছিল কলোনাদের বাড়িতে। অলাৰ্ত্তিরা মুরগি আনতে গেলে, কলোনারা মুরগি। তাদের বলে দাবি করল। তাতে অলাৰ্ত্তিরা বিচারের ভয় দেখাল, তাতে। কলোনাদের এক বুড়ো মহিলা রেগে গিয়ে সবার সামনেই মুরগিটা ধরে। এনে গলাটা মুচড়ে ভেঙে দিয়ে অনাৰ্ত্তিদের এক মহিলার মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, নে তোদের মুরগি তোরা খা। তখন ঐ মহিলার ভাই মরা মুরগি। দিয়েই কলোনা বুড়িকে ঘা মারতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভাগ্য খারাপ এক কলোনা তার বন্দুক দিয়ে গুলি ছুড়ল, মরা মুরগি হাতে নিয়েই অলাত্তি যুবক মারা গেল।’

‘তাহলে এভাবেই শুরু হলো খুনাখুনি? এ পর্যন্ত কতজন মারা গেছে?’

‘মারা গেছে নয়জন, আহত হয়েছে আরও—’

‘সামান্য একটা মুরগির জন্যে-যার দাম—’

‘সেটাই তো বলেছিলাম–কারণটার কোনো গুরুত্ব নেই, পরিণামই হলো আসল।’

‘নয়জন মারা গেছে বলেই কি দশম জনকে মরতে হবে?’

‘না, তা হবে না, আমি মিমাংসার ভার নিয়েছি বলেই দশম লোকটা বেঁচে যাবে।’

‘কোন দল আপনাকে মিমাংসার জন্য অনুরোধ করেছিল?’

আরে, তাদের কেউ না। আগ্রহটা আমার ভাইয়ের। প্যারিসের বিচারমন্ত্রীর কাছে সে এ ব্যাপারটা জানিয়েছে। কর্সিকার এ গ্রামে কি ঘটেছে

তা নিয়ে প্যারিসের লোকের মাথা ঘামানোর কি দরকার বলুন তো? মূল। কাজই হলো ওই অঞ্চল শাসকটির। সে কিনা প্যারিসে চিঠি লিখে জানাল, একমাত্র আমার পক্ষেই নাকি এর একটা মধুর মিলন করা সম্ভব, আমার একটা কথাতেই–সবার রাগ উড়ে যাবে। শাসকের চিঠি পৌঁছানোর সাথে সাথে আমার ভাই আমাকে চিঠি লিখল, সে বিচার মন্ত্রীকে কথা দিয়েছে, এ ভেলডেটার মীমাংসা আমি করে দেব। এই হলো অবস্থা।

এরপর মাথায় একটা ঝাঁকানি দিয়ে লুসিয়েন বলল, আমার ভাই যখন কথা দিয়ে এসেছে, তখন আমাকে সে কথা রক্ষা করতে হবেই। না করলে সে ফ্রাঞ্চি বংশের যোগ্য হবে না।

হতাশ হয়ে বললাম, তা হলে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, ভেলডেটা দেখার সম্ভাবনা নাই।

বিরক্ত হয়েই জবাব দেয় লুসিয়েন, ‘সেটাই তো মনে হয়।

মনের হতাশ ভাব চেপে, উৎসাহ দেখিয়ে প্রশ্ন করলাম, এখন তাহলে ওই দু-দলের কারও সাথে আপনার আলাপ করার কথা আছে?

‘হ্যাঁ–এক দলের সাথে কালকে কথা বলা হয়েছে।’

‘আজকে যার সাথে কথা বলবেন, সে কি অলাৰ্ত্তি না কলোনা?’

‘অলার্তি।’

‘কোথায় দেখা হবে? কাছেই?’

‘ইস্ত্রিয়া দুর্গে।’

‘ইস্ত্রিয়া! গাইড জানিয়েছিল কাছেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ।’

‘তিন মাইলের মতো।’

‘তাহলে তো তিন কোয়ার্টারের মধ্যে যাওয়া যাবে।’

‘হ্যাঁ, বেশি হলে তিন কোয়ার্টার।

এবার মাদাম ফ্রাঞ্চি বললেন, ‘লুসিয়েন, তোমার নিজের জন্য তিন কোয়ার্টার ঠিক হলেও। এই পাহাড়ি রাস্তায় ইনি কি ঠিক তোমার সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবেন?’

লুসিয়েন মাথা নেড়ে বলল, ‘সেটা ঠিক তাহলে অন্তত দেড় ঘণ্টা ধরে রাখতে হয়।’

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাদাম বললেন, ‘তাহলে এবার রওনা দিতে হয়।’

মাদাম হাত বাড়িয়ে দিলে, লুসিয়েন আগের মতোই সম্মানের সাথে হাতে চুমু খেল, তাহলে আমরা যাই মা?

লুসিয়েন আমার দিকে ফিরে বলল, ‘এখনও ভেবে দেখুন! আমার সঙ্গে পাহাড়ে ঘুড়ে না বেরিয়ে, এখানে বসে আস্তে খাবারটা শেষ করেন। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আগুনে আরামে হাত পা গরম করে—’

আমি এখানেই বাঁধা দিয়ে উঠলাম, ‘আমাকে খুনি দেখাবেন বলেছেন। আমি খুনি দেখবই।’

.

তাড়াতাড়িই রেডি হয়ে গেলাম।

প্যারিস থেকে বের হবার সময় একটা বিশেষ ধরনের বেল্ট আমি বানিয়েছিলাম। সেটাই এবার কোমরে বেঁধে নিলাম। তার এক পাশে ঝোলানো একটা শিকারের ছোরা, আর এক পাশে গুলি। লুসিয়েনের কোমরে বুলেট ভরা ব্যাগ এবং কাঁধে দোলনা ম্যান্টন বন্দুক। তার মাথায় চুড়া জােড়া টুপি, তাতে সুন্দর ফুলের কাজ করা।

গ্রিদো জিজ্ঞাসা করল, ‘মালিক, আমি কি আসব?

না, দরকার নেই-বলল, লুসিয়েন তবে ডায়ামন্টকে ছেড়ে দাও। পাখিটাখি ধরতে পারে, চাঁদের যা আলো, তাতে দিনের মতোই গুলি চালানো যাবে।

এক মিনিট পরেই একটা কুকুর লাফাতে লাফাতে আমাদের কাছে চলে এলো। বাড়ি থেকে কিছুদূর গিয়েই লুসিয়েন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, গ্রামের ভেতর জানিয়ে দাও পাহাড়ের উপর যদি বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পায়, বুঝবে আমি গুলি চালিয়েছি। সে অন্য কেউ না।

‘আমি এক্ষুণি যাচ্ছি’ বলল গ্রিদো।

সামনে চলতে চলতে আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল লুসিয়েন, ‘এ কথাটা না বললে সমস্যা ছিল, আমরা পাহাড়ে পাখি মারছি। ওদিকে সুল্লাকারোর রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীরা তার শব্দ শুনে ভাববে আবার কলোনা আর আলৰ্ত্তিদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। সমস্ত গ্রাম আবার জড়িয়ে পরবে তাতে।’

আমরা একটু সামনে এগিয়ে ডাইনে একটা সরু রাস্তা ধরলাম। সেটাই সোজা পাহাড়ে গিয়ে উঠেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *