১. এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে

তিন ভুবনের পারে – উপন্যাস – সমরেশ বসু

এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে, যেন সেদিনের কথা। অবিশ্যি সেদিন ছাড়াই বা কী। সাকুল্যে আট বছরও হয়নি। যদিও, কারুর জীবনে আট বছর আট যুগ, কারুর জীবনে আট বছর আট পল, মুহূর্ত মাত্র। জীবনের বেগ যেখানে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে, তা সেই বেগ যে-কোনওরকমেই হোক, সেখানে আট বছর সময়ের হিসেবে সামান্য। সরসীর জীবনেও আট বছরটা তেমনি। জীবনের বেগটা এই আট বছরের মধ্যে, শুধু যে বাইরের দিকে ছুটিয়েছে, তা নয়। বরং বাইরেটাকে অনেকখানি ছোট করেই দেখা যায়। কারণ সেখানে ছিল জীবনধারণের নিতান্ত নিয়মে বাঁধা প্রাত্যহিকতা। তেমন একটা গ্লানি যদিও বোধ করেনি সেই বাঁধাধরা নিয়মতান্ত্রিকতায়, তবু কখনও কখনও শুষ্ক বোঝা বলে মনে হয়েছে বইকী।

আসল বেগটা ছিল সরসীর মর্মে। বেগ ছিল ওর প্রাণে, জীবনের সকল স্বপ্নের মূলে। আরও গভীর করে বলতে গেলে, বলতে হয়, বেগ ছিল ওর রক্তে। জীবন ও যৌবন, একত্রে সফল করে তোলার সাধনা, কত জনের ভাগ্যে জুটেছে। প্রতিটি ধাপে ধাপে, তাকে সার্থক করে তোলার অমন সুখের ব্যথা সুখের যাতনা কজনেই বা ভোগ করেছে। না, ব্যথা ভাবছে কেন সরসী, যাতনা ভাবছে কেন। প্রতিটি ধাপের সার্থকতা তাকে তো গভীর আনন্দই দিয়েছে। আট বছরের প্রতিটি মুহূর্তের সংগ্রাম ও উত্তেজনা তো তাকে কোনও ব্যর্থতার মুখোমুখি নিয়ে যায়নি। তবে কেন ব্যথা ভাবে সরসী, যাতনা ভাবে। আট বছরের প্রতিটি দিনে ও মুহূর্তে, সে যা চেয়েছে, তা-ই হয়েছে। এই সার্থকতার পিছনে যে কষ্ট ছিল, তাকে কষ্ট বলে কেউ ভাবে নাকি। মিন্টুকে, ছেলেকে যে সে জন্ম দিয়েছে, এখন ছেলের মুখ দেখে কি একবারও সেই শারীরিক কষ্টের কথা মনে হয়। ব্যথা ও যাতনা, হাসপাতালের আটচল্লিশ ঘণ্টার সেই দূঃসহ কষ্টের কথা, চোখের ওপরে, বুকে পাষাণভার চাপিয়ে যেন অন্ধকার মৃত্যু নেমে আসছিল, সে কথা কি এখন একবারও মনে হয়। এখন যেন মনে হয়, মিন্টুর কচি কোমল মুখ,নতুন দাঁতের দুষ্টু পবিত্র উজ্জ্বল হাসিটুকুই সব। আর সবকিছুই মিথ্যা।

না, যাতনা নয়, ব্যথাও নয়, আট বছরের অতীত, সরসীর সফল স্বপ্নের সুখ। সার্থক হয়েছে বলেই তো, আট বছর আটটি পল মাত্র মনে হয়। মনে হয়, এই ঘরে, এই খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সে দেখেছিল, বন্ধুদের ডাক শুনেই সুবীর লাফিয়ে উঠেছিল বিছানা থেকে। চিৎকার করে জবাব দিয়েছিল, যাই, তোরা বাইরের ঘরে বোস।

বলেই সে নতচোখের কোণ দিয়ে চকিতে একবার সরসীর দিকে দেখে নিয়েছিল। সরসী ওর দিকেই স্থিরচোখে তাকিয়ে ছিল। সুবীর আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল। আর সেই আড়ষ্টতাকে ঝেড়ে ফেলবার জন্যেই যেন, কপালের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া চুলের গুচ্ছে একটা ঝাঁকানি দিয়ে নিয়েছিল। বুক-খোলা শার্টের বোতামগুলো ছিল ভোলা। পায়জামা ময়লা কোঁচকানো। বাইরের ধুলোবালি-ময়লা তখনও হাতে-পায়ে লেগে। তাড়াতাড়ি আলমারির পাল্লা খুলে, তাসের বাকস বের করে, পা বাড়িয়েছিল বেরিয়ে যাবার জন্যে।

সরসী ওর ডাক নাম ধরে ডেকে উঠেছিল, মন্টু, আজ খেলতে যেও না। আমি ওদের বারণ করে দিয়ে আসছি।

সুবীর রাগে ফেটে পড়েছিল। বলেছিল, তুমি বারণ করলে কী হবে, আমি নিজেই তো ওদের আসতে বলেছি। পাঁচ দিন তো একদম বসিনি। আজ আমি একটু খেলবই।

সরসী চোখ নামায়নি। স্থিরচোখে তাকিয়েছিল। সুবীরও তাকিয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই, ভুরু সিদুরের টিপ কাঁপিয়ে সরসী হেসেছিল নিঃশব্দে, অনুনয়ের হাসি। বলেছিল, লক্ষ্মীটি, বোঝ না কেন, আজ ওদের ফিরে যেতে বলে। তুমি নিজেই বলেছিলে, ইংরেজির নোটটা আজ যেমন করেই হোক, তুমি তুলবেই তুলবে। জান তো, পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই।

কিন্তু সুবীর মোটেই নরম হয়নি, বরং পা দাপিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল, এঃ, কোথাকার মাস্টারনি এলেন, উনি আমাকে এখন পরীক্ষার পড়া পড়াতে বসাবেন। খেলতে আমি যাব, দেখি তুমি কী করো।

তুমি জান, আমি কিছুই করব না। আমার চেয়ে তুমিই ভাল জান, না পড়লে তুমি ফেল করবে।

করি করব। পৃথিবীতে সবাই কিছু লেখাপড়া শিখে দিগজ হবার জন্যে জন্মায়নি। তুমি দয়া করে আমার পেছনে অষ্টপ্রহর ফ্যাক ফ্যাক কোরো না।

সরসী গম্ভীর দৃঢ় গলায় বলেছিল, তা আমি করব মন্টু, যতক্ষণ এ বাড়িতে আছি, এঘরে আছি, ততক্ষণ আমি চুপ করে থাকব না। তাতে তুমি আমাকে মাস্টারনি বলল, আর যা খুশি বলো।

সরসীর অনমনীয়তায় সুবীরের রাগ পড়েনি, বরং আরও নির্দয় হয়ে উঠেছিল। যা খুশিটা আবার শুনলে কোথায়, মাস্টারনিকে মাস্টারনি বলব না তো, মেথরানি বলব নাকি?

সুবীর যত বাধা পাচ্ছিল, ততই সরসীকে অপমান করার জন্যে রাগে অন্ধ হয়ে উঠছিল। সরসী সে কথা বুঝতে পারছিল, তবু, কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেনি, চুপ করে সরে যেতে পারেনি। তার মুখে রক্ত ছুটে এসেছিল। বলেছিল, তোমার ভাষা যেরকম ইতরের মতো, তাতে যা খুশি তুমি তা-ই বলতে পারো। তবু আমি বলব, আই এ পরীক্ষা তুমি যদি এবার দিতে চাও, তা হলে এখন তোমার তাস-পাশা নিয়ে থাকলে চলবে না। তোমাকে পড়তে বসতে হবে। কিন্তু তুমি কচি খোকা নও যে তোমাকে ধরে ধরে পড়তে বসাতে হবে। তোমার যা ইচ্ছে তাই করো।

সুবীর চেঁচিয়ে উঠেছিল, তাই যাচ্ছি। তুমিই কথা বলাচ্ছ আমাকে।

সুবীরের সেই উগ্র মূর্তির দিকে চেয়ে সরসী গলা নামিয়ে বলেছিল, বেশ, তা হলে তাই যাও, চেঁচিও না।

সুবীর চেঁচিয়ে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই সরসী গম্ভীর দৃঢ় গলায় বলে উঠেছিল, যাও, আর কথা বাড়িও না, তুমি খেলতে যাও।

দুচোখে আগুন জ্বেলে দুপ-দাপ শব্দে সুবীর চলে গিয়েছিল। যদিও সে জানত, সুবীরের পক্ষে আর খেলা সম্ভব ছিল না, তার সে মেজাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তার প্রমাণ, তাসের পেটি ছুঁড়ে ফেলার শব্দ শুনতে পেয়েছিল সরসী। এবং এ কথাও জানত, সুবীরের বন্ধুরা, সুবীরের চিৎকার শুনে, ঘটনা অনুমান করে, আগেই পলাতক। তবু অপমানে ও দুঃখে, সরসীর চোখে তখন কান্না উথলে উথলে উঠেছিল। আলনা থেকে কোনওরকমে একটা পাতলা স্কার্ফ টেনে নিয়ে, গায়ে জড়িয়ে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। বেরিয়ে পড়ার সময় টের পেয়েছিল, বাইরের অন্ধকার ঘরে সুবীর একলা বসে ফুঁসছিল। পিছন থেকে ঠাকুরের ডাক শুনতে পেয়েছিল সরসী, মা, রাতের রান্নার ব্যবস্থা

সবটুকু শোনবার জন্যে অপেক্ষা করেনি সে। রাস্তায় বেরিয়ে রিকশায় উঠেছিল। অথচ তখন কোনও বান্ধবীর বাড়ি যাবার মতো মনের অবস্থা ছিল না ওর। আধ ঘণ্টা কেবল পথে পথে ফিরেছিল। আর ভেবেছিল,কেন আমি এমন আশা করি, সুবীরের মতো ছেলে লেখাপড়া করবে। এই ভাবনার ভূত কেন আমি ঘাড় থেকে নামাতে পারি না। যার চিরটা জীবন কেটেছে রকে, মাঠে ঘাটে, ইয়ার্কি আর আড্ডা মেরে নিচু ধরনের ছেলেদের সঙ্গে, যার নিজের কোনও ইচ্ছে নেই, আত্মসম্মানবোধ নেই, তাকে কেমন করে শিক্ষিত ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন করে তুলবে সে। এখনও যে তার অশ্লীল ভাষা ভঙ্গি কিছুই বদলাতে পারেনি, এখনও যে রকে বসতে পেলে ঘরে ফিরতে চায় না, তাকে লেখাপড়া শেখাবে সরসী! অসম্ভব! ঈশ্বর সরসীকে এই আশার বিলাসিতা থেকে মুক্তি দিক।

কিন্তু আধঘণ্টার বেশি সরসী বাইরে থাকতে পারেনি। তার মন পড়ে ছিল বাড়িতে। কী জানি। বাড়ি গিয়ে হয়তো দেখবে সুবীর বেরিয়ে গিয়েছে। আধঘণ্টা বাদে যখন সে বাড়ি ফিরেছিল, দেখেছিল শোবার ঘরে আলো। সুবীর পড়ছিল। তন্ময় হয়ে পড়ছিল, ওর ঠোঁটের কোণে ছিল সিগারেট। কপালের ওপর অবিন্যস্ত চুলের গোছায়, ওর চোখে ছায়া পড়েছিল। নিঃশব্দ পায়ে এসে সরসী দরজায় দাঁড়িয়েছিল, সুবীর টের পায়নি। সরসী দেখেছিল, নতুন শীত, তবু সুবীরের বুকের বোতাম তেমনি খোলা। পায়জামার একদিকে হাঁটু অবধি গোটানো। কোনও খেয়াল নেই। ছাইদানিতে কোনওদিনই ছাই ফেলতে শেখেনি, নোংরা করেছে নিজেরই চারপাশ। টেবিলটাও বাদ যায়নি। কতদিন বারণ করেছে। সরসী, পড়াশুনোর সময় যেন সুবীর বিড়ি-সিগারেট না খায়। কিন্তু বারণ শোনেনি। শুনবে না, হয়তো শোনা সম্ভবও নয়, এ কথা পরে মনে হয়েছে সরসীর। বরং কোনও কিছুতে মনোযোগ দিতে হলে, সুবীরের ধূমপান অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।

টেবিল-ল্যাম্প জ্বেলে, পিছন ফিরে পড়ছিল সুবীর। ওর ছায়াটা বড় হয়ে পড়েছিল দরজার কাছে, সেই ছায়ান্ধকারে দাঁড়িয়ে সুবীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, সরসীর সমস্ত ক্ষোভ ও উদ্বেগ দূর হয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠেছিল ওর মুখে, খুশির হাসি শুধু নয়, করুণ বিষণ্ণ ও মমতায় চোখে জল আসছিল। অবাধ্য দুরন্ত দুর্মুখ নির্দয় সুবীরকে তখন যেন চেনা যাচ্ছিল না। ঠোঁট নেড়ে নেড়ে নিঃশব্দ উচ্চারণে ও পড়ছিল, আর পেনসিল দিয়ে মাঝে মাঝে লিখছিল। সবকিছুই মনে রাখবার এই পদ্ধতি সরসীই ওকে শিখিয়েছিল। কিছুটা করে পড়া, তারপর নিজের থেকে, মনে আছে কিনা দেখবার জন্যে না-দেখে লেখা। সুবীর যে গভীরভাবে ডুবে গিয়েছিল, ওর মুখ-চোখ-বসার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ফাঁকিবাজি বলতে যা বোঝায়, তা ওর মধ্যে একটুও ছিল না। মন না চাইলেই বিদ্রোহ করে বসত। বেচারি! কোথায় তখন বাইরের ঘরে গরম চায়ের পেয়ালায় ঝড় উঠত, হার্টস-ক্লাবস-ডায়মন্ডসের হাঁক-ডাকে সরগরম হয়ে উঠত, তার বদলে, ওকে ইন্টারমিডিয়েটের ইংরেজির নোট নিয়ে বসতে হয়েছিল। তাও কিনা, সারাদিন এক কারখানার ডিপার্টমেন্টের কেরানিবৃত্তির পরে। সে সময়ে, স্বাভাবিক ভাবেই ওর পাওয়ানা ছুটি, একটু আড্ডা, একটু বিশ্রাম।

কিন্তু কী করবে সরসী। পড়া ও পরীক্ষা, সরসীর ইচ্ছা ছিল বটে, স্বপ্ন ও সাধও বলা যায়, সিদ্ধান্ত সুবীরেরই। যে পড়বে, তার সিদ্ধান্ত না থাকলে, পড়া শুরু করা সম্ভব ছিল না। যদিচ, সরসী জানত, সুবীরের সিদ্ধান্তের পিছনে, সরসীর ইচ্ছাই কাজ করেছিল বেশি। তা ছাড়া, সুবীরের একটা সাময়িক আবেগও ছিল। কিন্তু অপরের ইচ্ছা, নিজের আবেগ, এই দুয়ে মিলে কখনও কেউ কষ্টের ও ধৈর্যের কোনও কাজের সংকল্পে অটল থাকতে পারে না। সুবীরও পারেনি। ওর সমস্ত অতীতটা তখন ওর বর্তমানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে বসেছিল। তার জন্যে, সুবীরকে সবসময় দোষ দিতে পারেনি। ও যে সাহস করে পড়া শুরু করতে চেয়েছিল, সেটাই তো আশ্চর্যের। সতেরো বছর বয়সে যে কোনওরকমে থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করে সরস্বতাঁকে বিসর্জন দিয়ে বসেছিল, তারপরে রকবাজি আচ্ছা এবং নিতান্ত বাড়ির তাড়নায় কারখানার ডিপার্টমেন্টের কেরানির কাজ করতে গিয়েছিল, সে যে পঁচিশ বছর বয়সে বিসর্জিত সরস্বতাঁকে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইবে, সে সিদ্ধান্ত আবেগের হলেও সাহসের বইকী।

কিন্তু অতীত ছেড়ে কথা কয় না। দীর্ঘদিনের অভ্যাস, জীবনধারণের রীতিপ্রণালী একদিনেই ছেড়ে যায় না। সেজন্যে সবসময়ে সুবীরকে সে দোষ দিতে পারেনি। কিন্তু, সুবীর ওর পুরনো অভ্যাসগুলোর সঙ্গে সজ্ঞানে লড়তে রাজি ছিল না। অথচ, তা ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। তাই নিরুপায় হয়ে সরসীকে ভিন্ন মূর্তি ধারণ করতে হত। ওকে সিদ্ধান্তে অটল রাখবার জন্যে, ওর সমস্ত বিদ্রোহ, দুর্ব্যবহার ও কটু কথার সামনে, সরসীকেও অটল থাকতে হত। কান্না এবং অভিমান নিরর্থক ছিল, কেননা, সুবীরের মতো দুর্জয় ছেলেকে তা দিয়ে ফেরানো সম্ভব ছিল না।

কতদিন, কতদিন আগের কথা সে সব? বছর গুনতিতে আট বছর বটে, কিন্তু সরসীর মনে হয়, এই সেদিন, এই তো সেদিনের কথা! ওই যে দিগবিজয়ী ভদ্রলোক বাইরের ঘরে গায়ে শাল জড়িয়ে তাঁর বিশিষ্ট পণ্ডিত বন্ধুদের সঙ্গে রহস্যালাপে মুগ্ধ, আর্ট ও ফিলজফির নানান দুরূহ সমস্যার সমাধানে ব্যস্ত, যিনি এখন বিদগ্ধ, শ্রদ্ধেয়, খ্যাতিমান, তিনি কি সেই ডাক নামের মন্টু নন? সরসীর এই শোবার ঘরেই কোণের ওই টেবিলে যে অবাধ্য বিদ্রোহী যুবকটি ইংরেজির নোট নিয়ে বসত, বিড়ি-সিগারেটের ছাইয়ে ঘর ময়লা করত, কটু কথায় ঝগড়া করত, ইনি কি সেই মানুষটিই নন?

কত তফাত, অথচ এই তো যেন সেদিনের কথা, এখনও সমস্ত ঘটনা ছবির মতো ভাসছে। স্পষ্ট ছবির মতো, সরসী দেখতে পাচ্ছে, সুবীর মাথা নিচু করে, পিছন ফিরে পড়ছিল। আর সরসীর ক্ষুব্ধ বুকে তখন করুণ মমতার অনুভূতি ঘনিয়ে এসেছিল। সে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে পিছন ফিরে অন্য ঘর দিয়ে রান্নাঘরে গিয়েছিল। ঠোঁটে আঙুল চেপে, ঠাকুরকে জোরে কথা বলতে বারণ করেছিল। দেখেছিল ঠাকুর ভাত বসিয়ে দিয়েছে উনুনে। কাছে ডেকে, চুপি চুপি তাকে পয়সা দিয়ে বাজারে পাঠিয়েছিল। বলেছিল, তুমি একটু মাছ নিয়ে এসো, আমি ততক্ষণে কুটনো কুটে ভাত নামাচ্ছি। কিন্তু ঠাকুরকে বাজারে পাঠিয়েও কুটনো কুটতে বসতে পারেনি সরসী। রান্নাঘরের যে জানালা দিয়ে শোবার ঘর দেখা যায়, সেখানে দাঁড়িয়ে সে সুবীরকেই দেখছিল। সেখান থেকে ওর মুখ দেখা যাচ্ছিল। না, কোনও রাগ বা অমনোযোগের চিহ্ন ছিল না ওর মুখে। সত্যি, পড়ার মধ্যে সুবীর গভীরভাবেই ডুবে গিয়েছিল।

তারপর উথলে-ওঠা ভাতের শব্দেই যেন চমকে উঠেছিল সরসী, যদিও, ভাতের জন্যে সে চমকায়নি। তাড়াতাড়ি ভাত নামিয়ে চায়ের জল বসিয়েছিল সে। সুবীরের কাছে যে তখন তার ভীষণ যেতে ইচ্ছে করছিল। সে জানত, ইংরেজির নোটটা একটু বুঝিয়ে না দিলে, সুবীরের খুবই অসুবিধে হচ্ছিল। নিজের থেকে সব বুঝে নেবার জন্যে বেশি কষ্ট করতে হচ্ছিল। অথচ, সেই মুহূর্তেই অন্য কোনও অছিলায় যাবার উপায় ছিল না।

কুটনো কোটার কথা আর মনে ছিল না সরসীর। চা তৈরি করে, উনুন খালি রেখেই, সে শোবার ঘরে গিয়েছিল। নিঃশব্দ পায়ে গিয়ে, টেবিলের ওপর ধূমায়িত চায়ের কাপ নামিয়ে দিয়েছিল। সুবীর প্রায় চমকে উঠেই মুখ তুলে তাকিয়েছিল। সরসীকে দেখামাত্রই ওর অন্যমনস্ক মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। ছেলেমানুষি অভিমান ও রাগে মুখ ফিরিয়ে আবার ও পড়ায় মনোনিবেশ করেছিল। কোনও কথা বলেনি।

সরসী আর একটা চেয়ার টেনে কাছেই বসেছিল। সহসা কিছু বলতে ভরসা পায়নি। বলা যায় না, সুবীর হয়তো আরও রেগে উঠতে পারত। সরসী দেখছিল সুবীরের খাতার দিকে। সূবীরের নিজের লেখার মধ্যে কিছু ভুল দেখতে পেয়ে, বলতে গিয়েও চুপ করে ছিল, তাতেও ফল উলটো হবার সম্ভাবনা ছিল। অথচ সরসীর উপস্থিতিতে, সুবীরের লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

সরসী আস্তে আস্তে বলেছিল, চা-টা জুড়িয়ে যাবে, খেয়ে নাও।

সুবীর বলেছিল, আমি চা চাইনি।

চাওনি, পড়তে বসলে তো খেতে ইচ্ছে করে তোমার, তাই করে এনেছি।

সুবীর কোনও কথার জবাব দেয়নি, আর-একটা সিগারেট ধরিয়েছিল ও।

সরসী খানিকটা কুণ্ঠিত গলায় বলেছিল, আমাকে কোনও দরকার নেই তো?

না। সুবীরের গলায় তখনও ঝাঁজের রেশ।

তা হলে আমি রান্নাঘরে যাব?

যা খুশি।

সরসী উঠে দাঁড়িয়েছিল। আয়নায় সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিল। বিকেলে তার চুল বাঁধা হয়নি। জল ছোঁয়ানোও হয়নি ইস্কুল থেকে এসে। সন্ধ্যাবেলা ফিরে, সুবীর তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করেছিল। ও যে বলত, তুমি বেশি সাজলে-গুজলে আমার ভাল লাগে না, কথাটা মনে রাখত সরসী। ক্রিমের ওপর একটু হালকা পাউডারের প্রলেপ, খুব সরু করে একটু কাজল, আর কপালে একটি টিপ, এই ছিল তার প্রসাধন। যদিচ, নিজের সম্পর্কে একেবারে অচেতন ছিল না সরসী। তার সেই চব্বিশের দেহে স্বাস্থ্য ও যৌবন অকৃপণভাবে আপনাকে ঢেলে দিয়েছিল। তার সঙ্গে তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণে কিছু কিঞ্চিৎ রূপের ছিটেফোঁটাও ছিল। কৃতি ছাত্রী সে ছিল না, তবু অনায়াসেই ইংরেজিতে এম. এ. পাশ করেছিল।

চেয়ার থেকে উঠে, আয়নায় নিজেকে দেখে, নিজেকেই সে বড় ক্লান্ত দেখেছিল। তখন তারও মুখে নেমে এসেছিল ঈষৎ অভিমানের ছায়া। এই সুবীরই সন্ধ্যাবেলা, বন্ধুরা আসার আগে, আদরে সোহাগে সরসীকে গভীর উন্মাদনায় ব্যাকুল করে তুলেছিল, গা ধুতেও যেতে দেয়নি। আসন্ন পড়তে বসার কথা মনে থাকলেও, সরসী নিজেই লোভী হয়ে উঠেছিল, আবেশে ডুবে গিয়েছিল। দস্যু সুবীর, ঠাকুর-চাকরের উপস্থিতি পর্যন্ত মানতে চাইত না। রক্তে ওর প্রচণ্ড উদ্দামতা। পলকে সরসীকে বুকের কাছে টেনে নিবিড় করে নিত, অগোছালো করে তুলত। সরসী বুঝতে পারত, সুবীর ওর প্রাণের নেশা তার রক্তেও ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আকাঙ্ক্ষায় সে-ও উদ্বেল হয়ে থাকত।…

সরসী বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিল। সুবীর বলে উঠেছিল, শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত থেকে যে পঁচিশ লাইন ট্রানস্লেশন করতে বলা হয়েছিল, তা হয়ে গেছে।

বলেই সে একটা খাতা টেবিলের একপাশে ঠেলে দিয়েছিল। সরসী থমকে দাঁড়িয়েছিল, অবাক হয়েছিল। সরসীর দেওয়া হোম-টাস্ক যে সুবীর অমন ভাল ছেলের মতো সত্যি করে ফেলেছিল, যেন বিশ্বাস করতে পারেনি। বলেছিল, কোথায় বসে করলে? অফিসে?

সুবীর জবাব দেয়নি।

সরসী আবার বলেছিল, কেন করতে গেলে অফিসে বসে? তুমি তো জান, তোমার সেকশনের ফোরম্যান টের পেলে রেগে যাবে। টিফিনের এক ঘণ্টায় নিশ্চয় অতটা ট্রানস্লেশন করতে পারোনি?

সুবীর বলে উঠেছিল, অত কথার জবাব আমি দিতে পারব না। আমার যা করবার ছিল, আমি করে দিয়েছি।

তখন সরসীর মনে হয়েছিল, সঙ্গত কারণেই সুবীর সন্ধ্যাবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে তাদের আড্ডায় বসতে চেয়েছিল। সারাদিন অফিসের কাজ, সেই সুদীর্ঘ স্বরচিত অনুবাদ, যে কোনও মানুষের পক্ষেই অনেকখানি। বিশেষ করে, যে সুবীরকে টেনে আনা হয়েছিল রকের আড্ডা থেকে, তার পক্ষে সে কাজ ছিল বিস্ময়কর অবিশ্বাস্য। তখন নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল সরসীর। তবু, হ্যাঁ যদি অপরাধই হয়, তবু সরসীর কোনও উপায় ছিল না। অনেক অনিচ্ছাতেও তাকে শক্ত থাকতে হয়েছে। জানত, সে-ই তার ব্রত। সুবীর তখন জানত না, আজ জানে।

সরসী আবার বসেছিল, সুবীরের ট্রানস্লেশন দেখেছিল। এত কম ভুল ছিল যে সুবীরের ক্রমোন্নতিতে বিস্মিত মুগ্ধ হয়েছিল সরসী, তবু তৈরি চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, সুবীর স্পর্শ করছিল না দেখে কষ্ট পাচ্ছিল। বলেছিল, খেয়ে নাও, একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

সুবীর সে কথার কোনও জবাব দেয়নি। রাগে ওর মুখ তখনও থমথম করছিল। যদিও সরসী জানত, ট্রানস্লেশন সম্পর্কে তার মন্তব্য শোনবার জন্যে সুবীর মনে মনে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সরসী বলেছিল, একটু মনোযোগ দিলে তুমি কত ভাল রেজাল্ট করতে পারো, এটা তার প্রমাণ। খুব ভাল হয়েছে।

সুবীর গোমড়া মুখ করে শুনেছিল, মুখ তোলেনি। সরসী তখনও বলছিল, যে কটা ভুল হয়েছে, সবই ভার্ব আর টেনস নিয়ে। কনস্ট্রাকশন চমৎকার।

সুবীর তেমনি রাগি অভিমানী ছেলেটির মতোই মাথা নিচু করে ছিল।

সরসীর মুগ্ধ চোখে আস্তে আস্তে ব্যথা ফুটে উঠেছিল। সুবীরের রাগ তখনও যায়নি। কেন, সুবীরের কি একটু বোঝা উচিত ছিল না, কেন সরসী ওরকম করে? মুখ তুলে সরসীর দিকে একটু তাকানোও কি যেত না?

সে উঠে গিয়েছিল সামনে থেকে। কিন্তু কোথায়ই বা যাবার জায়গা ছিল? রান্নাঘরে তার কোনও কাজ ছিল না। ছোট গৃহস্থের গৃহস্থালির কাজও তেমন ছিল না যে, সরসী ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র সুবীরকে নিয়েই সে ব্যস্ত হতে পারত। সুবীর ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান কর্ম। সুবীর তার স্বামী, তার চেয়ে বড়, সুবীর তার প্রেমিক, প্রিয়তমা।

আজ যে সব ঘটনা ও কথা মনে পড়ছে, বাইরে থেকে দেখলে বা শুনলে সহসা হয়তো তাদের স্বামী-স্ত্রী বলে চিনতে ভুল হত। কারণ ওদের সম্পর্কটা আর দশটা সাধারণ স্বামী-স্ত্রীর মতো ছিল না। তাদের যোগাযোগটাও সাধারণ নিয়মের মধ্যে দিয়ে ঘটেনি। তাদের জীবনটা কেবলমাত্র একটি খেয়ে-পরে বাঁচার নিটোল সংসার তৈরির পিছনে কাটেনি। চলতি অর্থে, একটি সম্পন্ন সুখী পরিবার-গঠনের চিন্তায় তারা ঠিক নিজেদের উৎসর্গ করেনি। তার চেয়ে বেশি, একটি মানুষকে গঠন, মানুষটির নিজেকে গঠন, যে মানুষ নতুন সংসার তৈরি করবে, সেই গঠনের চিন্তাতেই তাদের দিনগুলো কেটেছিল।

কেটেছিল, তবু তারা ছিল স্বামী-স্ত্রী, গঠনের মূলে যে সম্পর্কটা ছিল প্রাথমিক ভিত্তির বুনিয়াদ, শক্তির আধার। জীবন-গঠনের পথে সে সম্পর্কের বনিয়াদ মাঝে মাঝে কেঁপে উঠেছে, মনে হয়েছে, বুঝি ধসে পড়বে, চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। ভয়ংকর তিক্ততা, দুঃসহ গ্লানি, তীব্র অপমান-অসম্মানের অন্ধকার কখনও কখনও যে রকম নিষ্ঠুরভাবে গ্রাস করেছে, মনে হয়েছে, আর কখনও আলোর মুখ দেখা যাবে না। শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকারেই সব কিছু শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু যায়নি। তখন, সেই আট বছর আগে, যে আলোকের স্বপ্ন দেখেছিল সরসী, সেই আলোকে সে আজ রয়েছে। ওই তো, তার সেই আলোক, সুবীর, তার স্বপ্ন, তার আকাঙ্ক্ষার প্রতিমূর্তি, বাইরের ঘরে অনেকের সঙ্গে বসে রয়েছে, গভীর তত্ত্বালোচনায় সে নির্ভীক হাসিমুখে সহজ অথচ ব্যস্ত। সুবীর, না শুধু সুবীর না, ডক্টর সুবীর, ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র। যাকে ঘিরে বাইরের ঘরে বসে আছেন নবীন ও বর্ষীয়ান স্কলাররা। অধ্যাপক-পণ্ডিত-তাত্ত্বিকের দল, যেখানে মধ্যমণির মতো বসে দ্যুতি ছড়াচ্ছে হেনা ব্যানার্জি। বংশমর্যাদায়, পাণ্ডিত্যে ও রূপের ত্রিবিধ আয়ুধ যাকে চারিদিকে বেষ্টন করে আছে। সরসীর অনেক অন্ধকার অতিক্রান্ত আলোয় যেন, একটু গভীর ও তীক্ষ্ণ কালো রেখা, যার পেছনে রয়েছে। পুঞ্জীভূত আগ্রাসী অন্ধকার। অন্ধকারের পর আলো, আবার অন্ধকার। কিন্তু না, বড় ক্লান্ত সরসী, অসীম অবসন্নতায় যেন ভেঙে পড়ছে। বাইরের ঘরে সে যায়নি, তার শরীর খারাপ জানিয়ে অন্ধকার ঘরে সে নিজেকে নিয়ে রয়েছে। আজ এই অন্ধকার ঘরে, একলা থাকাতেই যেন অনেক শান্তি। শুধু শান্তি নয়, সম্মানও বটে। সরসীর পক্ষে বাইরের ঘরে আজ যেন একটা তীব্র যন্ত্রণা ও অপমান মাত্র আছে। তার চেয়ে, এ ঘর তার ভাল। এ ঘর, তার সেই পুরনো আট বছরের ঘর, অনেক স্মৃতি এখানে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে। আজ এ ঘরে একলা না, একলা নয়, মিন্টু আছে, সরসীর হাত রয়েছে নিদ্রিত ছেলের গায়ে। মিন্টু, এই নামও সরসী আর সুবীর অনেক হাসাহাসি করে রেখেছিল। সুবীরের ডাকনাম মন্টু, মন্টুর ছেলে মিন্টু। এই মিন্টুকে ঘিরে…।

কিন্তু না, আজকের কথা ভাববে না সরসী। আজ যে অন্ধকার অগ্রসরমান, তার মধ্যে আজ যুঝতে যেতে চায় না সে। আজ তার সকল মন-প্রাণ পুরনো দিনের দিকে ধাবমান। যে দিনগুলোর মধ্যে ভয় তিক্ততা লাঞ্ছনা সবই ছিল, দুঃসহ সংগ্রাম ছিল, তবু তার মধ্যে অবিশ্রান্ত উৎসাহ উদ্দীপনা আপন বেগে ছুটত। হার মানতে জানত না। সেই হার না-মানা দিনগুলোর মধ্যেই সরসী নিজেকে আপন রূপে দেখতে পাচ্ছে আজ, সেই দিনগুলোর চিন্তাতেই এখন সে শক্তি সুখ ও শান্তি পাচ্ছে।

অথচ, কবেকার সেই দিনগুলো। আট বছর বটে, কিন্তু সরসীর মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা। যদিও আজ দেহে-মনে, গৃহস্থালির এই ছবিতে, আপাতচোখে তার চিহ্ন দেখা যাবে কম-ই, তবু যেন সেদিনের কথা।

এই তো যেন সেদিনেই, ক্রুদ্ধ সুবীরের স্পর্শহীন ভরা পেয়ালা চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে, সরসী আস্তে আস্তে বাইরের ঘরে চলে গিয়েছিল। ইতিমধ্যে, বাজার থেকে ঠাকুর মাছ নিয়ে এসে পড়েছিল। রান্নাঘরে যাবার দরকার ছিল না। মিন্টুর তখনও জন্ম হয়নি। একলা আর কোথায় যেতে পারত সে। বাড়ির বাইরে গিয়েও, কোথাও শান্তি পেত না। তাই সে বাইরের ঘরে গিয়ে একলা ভূতের মতো অন্ধকারে বসে ছিল। বাতি জ্বালতে ইচ্ছে করেনি। নিজে কোনও বই-পত্র নিয়ে বসতে পারত। কিন্তু সারাদিন ইস্কুলে মেয়েদের পড়িয়ে, নিজের জন্য পড়াশুনোয় তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ থাকত না! যদিও, সুবীর তাকে নিষ্ঠুর বিদ্রুপে মাস্টারনি বলত।

একলা অন্ধকারে বসে সরসী ভেবেছিল, আমার কি ইচ্ছে করে না, সুবীরের উদ্দামতার মধ্যে সর্বক্ষণ ডুবে থাকি। সারাদিন কাজের পর, দুজনে বেরিয়ে যাই, যেখানে খুশি বেড়িয়ে বেড়াই, সকলের সঙ্গে একত্র হয়ে আড্ডা মারি। এ সব কি কেবল সুবীরেরই ইচ্ছা করে? তবে জীবনে কোনও ব্রত গ্রহণ করার কী প্রয়োজন ছিল? আর দশটা সাধারণ দম্পতির মতো কাটিয়ে দিলেই তো হত। ও কেন আমার মনে আশা দিয়েছিল? সরসী জানত, যদিচ লোকের ধারণা ছিল, সে তার শিক্ষা-দীক্ষা-রুচি সবকিছু ত্যাগ করে, তার জীবন ও যৌবনের সকল কিছু নিয়ে, কেবল সুবীরের যৌবনোত্তাল তরঙ্গেই ভাসছে।

কতক্ষণ তেমনি চুপ করে বসেছিল সরসী, মনে নেই। এক সময় দেখেছিল, সুবীর এসে দাঁড়িয়েছে বাইরের ঘরের দরজার কাছে। পায়ের শব্দ আগেই পেয়েছিল সরসী। সুবীর অন্ধকার বাইরের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে একটু যেন ইতস্তত করেছিল, তারপর ডেকেছিল, সরসী! সরো!

সুবীরের গলায় তখন আর রাগের চিহ্নমাত্র ছিল না। বরং খুশি ও আদরের সুর ছিল। তাই সরসীর বুকটা মুচড়ে উঠেছিল। গলাটা কান্নায় বন্ধ হয়ে আসছিল। সে জবাব দেয়নি।

সুবীর ফিরে গিয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, রান্নাঘরের কাছে গিয়ে ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করেছিল, গৌরাঙ্গ, তোমার বউদি কোথায় গেলেন?

কেন, ঘরে নেই?

সুবীরের যেন একটু চিন্তিত গলাই শোনা গিয়েছিল, না তো।

পিছনের বাগানের বারান্দায় যেতে পারেন।

বাইরে যাননি তো?

না, আমাকে কিছু বলেননি তো। বারান্দায় দেখব?

থাক, আমিই দেখছি।

সরসী শুনতে পেয়েছিল, বাইরের ঘরের পাশ দিয়েই সুবীর বাগানের দিকে গিয়েছিল। যদিও নামে মাত্র, তবু ছোট বাড়িটির একটু জমি ছিল, যেখানে গৌরাঙ্গের চেষ্টায় কিছু গাছপালা লাগানো হয়েছিল। সুবীর সেখানে গিয়ে আলো জ্বেলে দেখে, আবার নিভিয়ে ফিরে এসেছিল। বাইরের ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলেছিল।

সরসী মুখ ফেরায়নি। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, মাথা নিচু করে সে যেমন ছিল, তেমনি বসে ছিল।

সুবীর বলেছিল, একী, তুমি এখানে অন্ধকারে বসে আছ। আর আমি গোটা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি।

সরসী কান্না রোধ করে বলেছিল, কেন?

সুবীর তখন কাছে এগিয়ে আসছিল। সরসী বলে উঠেছিল, আলোটা নিভিয়ে দাও, আমার ভাল লাগছে না।

সুবীর আলো নিভিয়ে দিয়ে, কাছে এসে সরসীর কাঁধে হাত রেখে বলেছিল, নোটটা আমি মুখস্থ করার জন্যে নিজে লিখেছি। খুব অল্প ভুল হয়েছে, জান?

ভালই তো।

সরসী নিচু স্বরে জবাব দিয়েছিল। সুবীরের হাত ক্রমেই তার গলা জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করেছিল। বলেছিল, তুমি একবার দেখবে না?

দেখব পরে, এখন রেখে দাও।

আর ট্রানস্লেশন কেমন হয়েছে, তা বললে না?

বললুম তো, খুব ভাল হয়েছে।

 তা হলে, আমার যা পাওয়ানা হয়েছে, তা তো দিলে না।

বলে, দুহাত দিয়ে তাকে জোর করে বুকের কাছে তুলে নিয়েছিল সুবীর। সরসীর উদগত চোখের জল তখন ঝরে পড়েছে। সে বাধা দিতে চেয়েছিল সুবীরকে। যদিও, কোনওদিনই বাধা দিতে পারেনি। আর সেই পাওয়ানার কথা মনে করে, আট বছর পরে, আজ এই মুহূর্তে আবার চোখে জল আসতে চাইছে। সত্যি, সুবীর সুবীর যেন ব্যাকুল ও মত্ত যৌবনের একটা মাতঙ্গ। ওর খুশির পাওয়ানা কোনও বস্তুর ভার নয়, সরসীর সর্বাঙ্গে ছিল ওর প্রাণের প্রাপ্যের ঠিকানা। বলত, যদি পড়া ভাল হয়, তবে দশ চুমু খারাপ হলে দশ কানমলা।কানমলা খেতেও ওর আপত্তি ছিল না। সরসী যদি বলত, এটা তোমার যাচ্ছেতাই ভুল হয়েছে, কিছু পারোনি, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে নিজের কান মুলতে আরম্ভ করত। সরসী তাড়াতাড়ি বাধা দিত, সে শান্তি ও পুরস্কার, দুই ব্যাপারেই বাধা দিত। কিন্তু সুবীরকে বাধা দিয়ে দাবিয়ে রাখা কোনওকালেই সম্ভব ছিল না।

সেই রাত্রেও পারেনি। সুবীর জোর করেই সরসীর মুখের ওপর মুখ নামিয়ে এনেছিল। সরসী অস্ফুট গলায় আপত্তি করে বলেছিল, না।

কিন্তু সুবীরের গলায় তখন সোহাগ। বলেছিল, সরো, রাগ কোরো না, প্লিজ।

 সরসী বলেছিল, রাগ তো আমি করিনি, তুমিই করেছ।

তখন সুবীর খানিকটা অসহায় ভাবেই বলেছিল, সে তো অনেক আগে, এখন তো দেখছি, তুমিই রাগ করেছ।

তা করেছি। কিন্তু আমি করেছি কারণে, তুমি করেছ অকারণে। পড়া তো তোমার, অথচ আমি কিছু বললেই রেগে যাও।

সরসীকে বুকে জড়িয়ে ধরে, সুবীরের গলা যেন উত্তাপে ভারী হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, তুমি খালি আমার রাগটাই দেখছ, কষ্টটা দেখছ না। কতদিন আমি একটু ওদের সঙ্গে আড্ডা মারিনি।

প্রায় ছেলেমানুষের মতো অসহায় অভিযোগ ফুটে উঠেছিল সুবীরের গলায়। ওর কথার মধ্যে কোনও লুকোচুরি ছিল না। কিন্তু সে কষ্ট কি সরসী বুঝত না? তবু, উপায় কী ছিল? সরসী বলেছিল, তা বলে তুমি আমাকে অমনি করে বলবে, ও রকম যা-তা কথা? চিৎকার করে, চেঁচিয়ে তুমি একেবারে বাড়ি মাথায় করে তোল।

বলতে বলতে সরসীর গলা কান্নায় বন্ধ হয়ে এসেছিল। সুবীর আরও তাকে নিবিড় করে নিয়ে বলেছিল, সত্যি, মাইরি, আমি একটা ছোটলোক একেবারে। শালা আর যদি

সরসী তাড়াতাড়ি রুদ্ধ গলাতেই বাধা দিয়ে বলে উঠেছিল, থাক, ও সব কথা আর বলতে হবে না।

তখন ওই রকমই কথাবার্তার ধরন ছিল সুবীরের, সে সব বচন শুনলে সরসীর কানের মধ্যে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠত। সরসী জানত, ও ধরনের কথাবার্তা ছিল সুবীরের আশৈশব জীবনধারণের মধ্যে। সরসীর কাছে আসবার পর, আপ্রাণ চেষ্টা করেও, রাগ বা আবেগের মুহূর্তে পুরনো বাক-ভঙ্গি চেপে রাখতে পারত না।

আর আজ? আজ কি ভাবা যায়, বাইরের ঘরের সেই লোকটিই, ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র।

সুবীরের সেই শপথবাক্য শেষ হবার আগেই, সরসীর গ্লানি ও কষ্টের স্রোত তখন উজানে বইতে শুরু করেছিল। স্বামীর সোহাগ গ্রহণের কামনা তখন ওর রক্তে জেগে উঠেছিল। তবু, সরসী যে মেয়ে, তাই আবার বলেছিল, চা করে নিয়ে গেলুম, মুখের চা-টুকু পর্যন্ত ছুঁলে না।

দাঁড়াও তা হলে খেয়ে আসি।

তখন ত্রস্ত শঙ্কিত হয়ে সরসীকেই বলে উঠতে হয়েছিল, না না, পাগল নাকি, ও চা আর খেতে হবে না, কখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।

হোক, লোকেরা তো কোল্ড টীও খায়।

সরসীকেই তখন জোর করে ধরতে হয়েছিল সুবীরকে। ওকে যে বিশ্বাস ছিল না। বলেছিল, লোকেরা খাক, তুমি খাবে না। ও চা এখন বিষ হয়ে গেছে।

তা হলে।

আর কথা বলেনি সুবীর। দস্যুর মতো আগ্রাসী চুম্বনে, সরসীকে যেন এক অতলান্ত গভীরতায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল। লজ্জা ছিল না, ভয় ছিল না সুবীরের। রান্নার ঠাকুর গৌরাঙ্গ যে কোনও মুহূর্তে এসে আলো জ্বালিয়ে দিতে পারত। গৌরাঙ্গের কাছে কত ছোটখাটো মুহূর্তে ধরা পড়ে গিয়েছে। সরসী লজ্জায় কাঁটা হয়ে গিয়েছে। রাগ করেছে। সুবীর নিতান্ত গা ঝাড়া দিয়ে বলেছে, তা কী করব। বাঁদরটা এ সময়ে এখানে এসেছিল কী করতে? (হায় ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র, বাইরের ঘরে বসে, এখন আপনি য়ুং-ফ্রয়েড-লাইসেঙ্কো-পাভলভ আওড়াচ্ছেন, হেনা ব্যানার্জি দেবতা-দর্শনের মতো মুগ্ধ চোখে আপনার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন, ডক্টর হেনা ব্যানার্জি, ডক্টর কালীকিঙ্কর দেব, ডক্টর সৈয়দ ফয়জউদ্দীন, অধ্যাপক নীতিশ জোয়ারদার, সরকারি হোমরা-চোমরা শ্রী পি. কে বাকায়, সবাই আপনাকে ঘিরে বসে আছেন, আপনার কি সে সব কথা একটিবারও মনে পড়ছে?) তবু লজ্জা হোক রাগ হোক, সেই সব মুহূর্তে সরসীর মর্মমূল পর্যন্ত সুবীরের আলিঙ্গনে আপ্লুত হয়ে উঠত।

অথচ, কতকাল–কতকাল আগেকার কথা সে সব? এই তো যেন সেদিনের কথা। এই তো সেদিনের কথা, সুবীর তখন আই এ পরীক্ষায় পাশও করেছে। খুব ভাল না হলেও, মোটামুটি রেজাল্ট খারাপ করেনি। কিন্তু উপায় ছিল না সুবীরকে তখন কোনওরকম গা শিথিল করতে দেবার। ওর মনকে ধরে রাখা, টেনে রাখা, সবথেকে বড় কর্তব্য ছিল, আর সে কর্তব্যের প্রায় সব দায়িত্বটাই ছিল সরসীর। তার কাছে তখন অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ডের একটি খণ্ড আবিষ্কৃত হয়েছিল, স্বপ্নের প্রথম অধ্যায় বাস্তবে রূপ পেয়েছিল। মিথ্যা আত্মবিশ্বাসের দ্বারা চালিত তুষ্ট সেনাপতির মতো সরসী শৈথিল্যকে প্রশ্রয় দেয়নি। সে আরও সতর্ক হয়ে উঠেছিল।

তাই, কয়েকদিন ক্লাবের থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি করার পর যখন, সুবীর দল নিয়ে তিনদিন উত্তর বঙ্গে নাটক করতে যেতে চেয়েছিল, সরসী বাধা দিয়েছিল। না দিয়ে সে পারেনি। সরসী জানত, ও সব যত বেশি করা যাবে, ততই মন যেতে থাকবে অন্যদিকে। তা ছাড়া, সুবীরের সে সব বন্ধুদের প্রতি সরসীর বিশ্বাস ছিল না। পরিবেশ ও সঙ্গ মানুষকে তার কর্তব্য থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারে। যেতে পারে না, যাবেই। সুবীরকে তখনও জোর করেই ধরে রাখতে হচ্ছিল। অতএব, শৈথিল্য প্রকাশ করলেই সে ভেসে যেত।

কিন্তু বাধাপ্রাপ্ত সুবীরের সে কী ভীষণ মূর্তি! এখন যেন ভাবাই যায় না। সরসী জানত, বন্ধুরা ওকে নানারকম টিটকারি দিত। স্ত্রৈণ বলাটা ছিল সবথেকে ভদ্র ও সভ্য। তার থেকে অনেক বেশি নোংরা কথা বলে তারা সুবীরকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত, তাতে ওর মিথ্যা আত্মসম্মানবোধে আঘাত লাগত।

সুবীর ক্রুদ্ধ চিৎকারে ফেটে পড়েছিল, আমি যাবই, দেখি তুমি কী করতে পার।

সরসী বলেছিল, করতে আবার কী পারব, কিছুই করতে পারব না, কিন্তু তুমি তোমার নিজের ক্ষতিটা ষোলো আনাই করতে পারবে।

পারি পারব। আমার ক্ষতির কথা তোমাকে ভাবতে হবে না, তোমার ইস্কুলের খুকিদের জন্যেই ও ভাবনাটুকু তুলে রাখোগে।

সুবীরের কথার মধ্যে, ভঙ্গির মধ্যে একটা ভালগারিটির ছাপ ফুটে উঠেছিল। কিন্তু সরসী থামেনি, বরং সে আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, চেঁচাও আর যা খুশি বলল, এ যাওয়া তোমার আমি কিছুতেই ভাল চোখে দেখব না–

সুবীর তখন বিশ্রীস্বরে ও ভঙ্গিতে বলে উঠেছিল, দিদিমণি যেন দয়া করে তা হলে চোখ বন্ধ করে রাখেন। কিন্তু সুবীর মিত্তির কথা যখন দিয়েছে, সে যাবেই।

না, যাবে না।

যাবে, তোমার ও সব মাস্টারনিগিরি গার্জেনি অন্য জায়গায় গিয়ে ফলাও, আমার কাছে নয়। আমি তোমার কেনা গোলাম নই, তোমার খাই-পরিও না। বাইরে যতই গলাবাজি করে বেড়াও।

বাইরে গলাবাজি করে বেড়াই?

নিশ্চয়। আমাকে খাইয়ে পরিয়ে, লেখাপড়া শিখিয়ে তুমি মানুষ করছ, সবাইকে তো এ কথাই বলে বেড়াও। কিন্তু ও সব আমি থোড়াই কেয়ার করি, আমার কাচকলা।

মুখের সামনে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তুলে দেখিয়ে, ক্রুদ্ধ উত্তেজনায়, অস্বাভাবিক খেপে উঠেছিল সুবীর।

 ভিতরে ভিতরে সরসীর কান্না পেলেও আত্মসম্মানবোধ তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। সে তীব্র গলায় বলেছিল, ও সব কথা তোমার ওই রকবাজ ইতর মিথ্যুক বন্ধুরাই বলে বেড়ায়, আমি নয়। কিন্তু ও সব কথা বলে তুমি আমাকে নিরস্ত করতে পারবে না। এখন তোমার কোথাও যাওয়া চলবে না। চাকরি আর পড়া ।

সুবীর গর্জে উঠেছিল, থাক। লেকচার মারতে হবে না। তুমি কি জোর করে আমার যাওয়া আটকাবে?

গায়ের জোর থাকলে, তা আটকাতুম।

তা হলে আমিও হাড় মাস এক করে ছাড়তুম।

জানি, ওই গায়ে হাত তোলাটুকুই এখনও বাকি রেখেছ। কিন্তু তা-ই বা আর বাকি রাখছ কেন? তোমার ও সব কথার থেকে, গায়ে হাত তোলাও ভাল।

সুবীর সে কথার কোনও জবাব দেয়নি, সে তার জেদের কথাই আবার বলেছিল, মোটের ওপর, আমি যাচ্ছি।

সরসীর তখন চোখ ভিজে উঠেছিল, কিন্তু মন শক্ত হয়ে উঠেছিল আরও বেশি। সে বলেছিল, না, যেতে পারবে না। থিয়েটার করা তোমার পেশা নয়, তুমি না গেলেও ওদের থিয়েটার হবে।

সুবীর বলেছিল, সে তুমি না-থাকলেও, তোমার কাজ আটকে, থাকবে না।

সে-তর্ক আমি তোমার সঙ্গে করব না। আমি জানি, তিন দিন বাইরে থিয়েটার করতে যাওয়া মানে, তিন মাস পেছিয়ে যাওয়া। এ সব করলে আর লেখাপড়া মাথায় থাকবে না।

তীব্র বিদ্রুপে থিয়েটারের ভঙ্গিতেই সুবীর বলেছিল, ও সব উপদেশ, দয়া করে আপনার ছাত্রীদেরই দেবেন। আমি যাবই।

তা হলে তোমার অফিসারকে টেলিফোন করে, আমি ছুটি ক্যানসেল করিয়ে দেব।

 শোনামাত্র সুবীর যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠেছিল। বলেছিল, বটে? ছুটি ক্যানসেল করবে তুমি অফিসারের সঙ্গে পিরিত করে? দেখে নেব আমিও, তোমার আর তোমার ওই অফিসারের কত হিম্মত।

যদিচ কথাটা ও ভাবে সরসী বলতে চায়নি। সে শুধু ভয় দেখাবার জন্যে, যেন-তেন প্রকারে সুবীরকে নিরস্ত করবার জন্যেই ও রকম একটা কথা বলেছিল। সুবীর তাকে যতটা জানত, তাতে নিশ্চয় বোঝা উচিত ছিল, সরসী ও রকম কিছুই করতে পারে না। তা ছাড়া, সুবীর যে প্রকৃতির ছেলে ছিল, সেরকম কিছু ঘটলে ও চাকরি ছেড়ে দিতেও দ্বিধা করত না।

ঠিক সে সময়েই গৌরাঙ্গ তার সামনে এসে কী বলতে চাইছিল। সুবীর এমনই খেপে উঠেছিল, সরসীর প্রতি সমস্ত আঘাতটা গৌরাঙ্গর গালেই সপাটে পড়েছিল। চেঁচিয়ে উঠেছিল, বেরিয়ে যাও হারামজাদা আমার সামনে থেকে, কিছু শুনতে চাই না আমি।

সরসী তৎক্ষণাৎ বলে উঠেছিল, খবরদার ওরকম কোরো না। মনে রেখো, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।

না ভদ্রলোক নয়, ভদ্রমহিলার বাড়ি, দিদিমণির বাড়ি।

তবে তাই, ভদ্রমহিলার বাড়িতেও এ সব চলবে না।

কেন, বাড়ি কি একলা তোমার? আমার পয়সাতেও কি ভাড়া দেওয়া হয় না? আর ভদ্রমহিলার তখন মনে ছিল না, যখন তিনি ছোটলোকের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চেয়েছিলেন?

অপমানে ব্যথায় ও রাগে গলা বন্ধ হয়ে এসেছিল সরসীর। তবু সে বলেছিল, ভুল হয়েছিল, খুবই ভুল হয়েছিল। তুমি আমার সামনে থেকে যাও, যাও বলছি।

সরসী নিজেই সেখান থেকে চলে গিয়েছিল। কিন্তু সুবীর তখনও জ্বলছিল। গৌরাঙ্গ বেগতিক দেখে, বউদির পিছুপিছুই পালিয়েছিল, আর সুবীর চিৎকার করতে করতে, হাতের সামনে যা পেয়েছিল, তা-ই ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল, বইপত্র, টেবিলল্যাম্প, জলভরতি গেলাস। চিৎকার করেছিল, আমি কারুর চোখরাঙানিতে ভয় পাই না। আমি খোকন নই। কিছু চাই না আমি, এখানে থাকতেও চাই না। চুরমার করে দেব সব। দিনরাত্তির উনি আমাকে শাসন করবেন, আর চোটপাট করবেন। নিকুচি করেছে লেখাপড়া আর ভদ্রলোকের।…

পরমুহূর্তেই দরজাটা দড়াম করে টেনে দিয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। সরসী চুপ করে পড়েছিল, ওঠেনি। গোটা বাড়িটা পোড়োবাড়ির মতো থমথম করছিল। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। কোনও ঘরেই আলো জ্বলেনি। গৌরাঙ্গ কোথায় গিয়ে বসে ছিল, কে জানে। সরসীও উঠে আলো জ্বালেনি। আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে এসেছিল, নিবিড় হয়ে এসেছিল। সরসী জানত, কাছাকাছি বাড়ির লোকেরা অনেকেই সেই কলহ উপভোগ করেছিল, এবং তারা সবাই উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছিল। সুবীরসরসীকে তারা সবাই চিনত, তাদের বিচিত্র বিবাহ, জীবনধারণের রীতিনীতিও জানত, এবং নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করত। কারণ, স্ত্রী স্বামীকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে, এটা তাদের কাছে অনেকটা বিদ্রূপ হাসি ও মজার ঘটনার মতো ছিল। এমনকী, সম্ভবত নানান অশ্লীল চিন্তাও তাদের মধ্যে ছিল। তাদের কোনওদিন সে ভাবে দোষ দেয়নি সরসী, কারণ অন্ধরা কখনও নিজেদের দেখতে পায় না। তাদের প্রতি করুণা করা ছাড়া, আর কিছু করার ছিল না। তা ছাড়া, সেই তো নতুন নয়। সুবীর ও রকম ঘটনা আগেও ঘটিয়েছে, পরেও ঘটিয়েছে। সবাই যেমন সংসার করে, তারা চায়, তাদের মতোই আর সবাই করুক। ব্যতিক্রম কিছু দেখলেই, লোকে ওরকম করে। প্রথম প্রথম সরসীর ভীষণ লজ্জা করত, মরমে মরে যেত। কিন্তু পরে আর অতখানি লাগত না। কেন না, লাগলে তার চলত না।

সেই অন্ধকার ঘরের মধ্যে, সরসীর তখন চোখে জলও ছিল না। অথচ বুকের কাছে একটা অসহ্য ব্যথা বোধ করছিল। সে তার জীবনটার কথা পূর্বাপর ভেবেছিল। (ওই যে ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র বসে আছেন, আপনিই কি সেই লোক, সেই সন্ধ্যাবেলার লোক, যিনি পাড়া মাথায় করে, ঘরদোর তছনছ করে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন? আপনার কি সে সব কথা একটুও মনে পড়ে? এখন আপনাকে দেখলে, পাড়ার মানুষেরা বিস্মিত শ্রদ্ধায় তাকিয়ে থাকে, পুরনো সেই সব দিনের কথা তাদেরও আর মনে নেই। আপনার কি আছে? আপনি এখন সাইকোলজিতে ডক্টরেট, গত বছর আপনি রেকর্ড-ব্রেক রেজাল্ট করেছেন, ছমাস অধ্যাপনা করলেন, এখন ভারত সরকারের সামরিক সিক্রেট সার্ভিসের অফিসারদের শিক্ষা দেবার জন্যে নতুন চাকরি করতে চলেছেন, আপনি সুদূর সিমলা চলেছেন কয়েক দিনের মধ্যেই। সেই সব মর্মন্তুদ সন্ধ্যা, তিক্ত উত্তেজিত ইতর সন্ধ্যাবেলাগুলো, মুহূর্তগুলোর কথা কি আপনার একবারও মনে উদয় হচ্ছে?)

একটু পরেই, থমথমে পরিবেশে, অন্ধকারের মধ্যে গৌরাঙ্গর গলা শোনা গিয়েছিল, বউদিদি।

বলো।

গৌরাঙ্গ সহসা কথা বলেনি। সরসী জানত, গৌরাঙ্গর একটু সান্ত্বনা দরকার, এবং সরসীকেই তা দিতে হবে। সে বলেছিল, আমার খুবই খারাপ লাগছে গৌরাঙ্গ, জান তো দাদা রেগে গেলে কী রকম হয়ে যান। আমার মুখ চেয়ে তুমি কিছু মনে কোরো না।

গৌরাঙ্গর বয়স হয়েছিল, তবু বোধহয় সে কাঁদছিল। একটু পরে বলেছিল, কী আর করব বউদিদি। দাদাকে তো আমি জানি।

ঠাকুর-চাকর যেরকম দুষ্প্রাপ্য, তাতে যতটা সম্ভব গৌরাঙ্গকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল সরসী, এবং নিজে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। গৌরাঙ্গ তাতেই তুষ্ট হয়েছিল। গৌরাঙ্গকে সে বলেছিল, নিজের রান্না করে তুমি খেয়ে নাও।

আপনাদের?

আপনাদের বলতে সে সরসী-সুবীরের কথাই বলেছিল। সুবীরকে যতটা জানা ছিল, তাতে সে যে রাত্রে ফিরে খাবে না, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না সরসীর। সে নিজেও, পাশের পাড়াতেই বাপের বাড়িতে চলে যাবে কিনা ভাবছিল। কারণ ও বাড়িতে একলা থাকতে তার কষ্ট হচ্ছিল। ওই পরিবেশ থেকে তার বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল।

সরসী বলেছিল, মিছে রান্না করে কী হবে। তোমার দাদা আজ রাত্রে ফেরেন কিনা তাই দেখ। আমার খাবার ইচ্ছে একেবারেই নেই।

আপনি কি বাপের বাড়ি চলে যাবেন?

একই চিন্তা গৌরাঙ্গেরও হয়েছিল। সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরসী, বাপের বাড়িতেও সে যাবে না। কারণ পিত্রালয়েও তার শান্তি ছিল না। সেখানেও তার জন্যে ছিল কেবল নিষ্ঠুর বিদ্রূপ ও প্রতিবাদ। সুবীরকে বিয়ে করার ব্যাপারে, ও বাড়ির কোনও সমর্থন বা সমবেদনা বিন্দুমাত্র ছিল না। বরং উলটোটাই ছিল। মা ছাড়া তার সঙ্গে কেউ কথা পর্যন্ত বলত না। বাবা মারা গিয়েছিলেন অল্পবয়সেই। দাদারা কেউ তার সঙ্গে কথা বলত না। সুবীর আই এ পাশ করার পরও তাদের জমাট শক্ত বরফ-স্তব্ধতায় ও নির্বিকারত্বে একটুও ফাটল ধরেনি। মা খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে তা জানাবার চেষ্টা কখনও করেননি।

আসলে কোথাও গিয়ে শান্তি ছিল না সরসীর। সুবীরের সঙ্গে ঝগড়া করে, কোথাও গিয়ে সে মন খুলে ভাল করে কথা বলতে পারত না। সে গৌরাঙ্গকে বলেছিল, তুমি একজনের মতো রান্না করো। আর নিজেরটা করে খেয়ে নাও। আমি ও বাড়িতে যাব না।

গৌরাঙ্গ কাজে চলে গিয়েছিল। তারপরে কতক্ষণ সময় কেটে গিয়েছিল, সরসীর মনে নেই। কেবল সুবীরেরই প্রতিটি কথা, প্রতিটি ভঙ্গি মনে পড়ছিল। সেই প্রথম দিন থেকে, যেদিন সে প্রথম রকের আচ্ছায় তাকে দেখেছিল, এবং তার কানে এসেছিল, অন্য কারোর গলা নতুন আমদানি।

সুবীরের গলা, (পরে সে জানতে পেরেছিল) কোন বাড়িতে রে?

দশের দুই, মিস্টার কেষ্টলাটওয়ালার প্যালেসে।

প্যালেস বলার কারণ ছিল, পুরনো সেকালের বাড়ি বলে। যদিচ বাড়িটার ঘরদোর, প্রশস্ত বারান্দা, সব মিলিয়ে ঠাট্টা করার কিছু ছিল না।

সেই সব দিনের খুঁটিনাটি কথা মনে পড়েছিল সরসীর, আর বুকের কাছটা যন্ত্রণা করছিল। গৌরাঙ্গ এসে যখন তাকে আবার ডেকেছিল, তখন চোখের জলে ভাসছিল সে। কথা বলতে গিয়ে টের পেয়েছিল, তার গলায় স্বর নেই। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে, চোখ মুছে বলেছিল, কী বলছ গৌরাঙ্গ?

রাত তো এগারোটা বেজে গেল, দরজা-টরজা সব বন্ধ করে দেব?

সরসীর মনটা নানান অশুভ চিন্তায় চমকে উঠেছিল। কোথায় আছে সুবীর, কী করছে সে এখন? ওইরকম উত্তপ্ত মস্তিষ্ক নিয়ে, কোথায় কী করছে না জানি। সে বলেছিল, তুমি এক কাজ করো গৌরাঙ্গ, ক্লাবে গিয়ে একবার দেখ, দাদা আছেন কি না। না থাকলে, ওঁর বন্ধু অবনীবাবু আর বিকাশবাবুর বাড়িতে খোঁজ করে দেখো। যদি না পাও–

থেমে গিয়েছিল সরসী। পরমুহূর্তেই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলেছিল, যদি না পাও, তবে বাবুদের বলল, দাদা রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন, আপনারা একটু দেখুন, কোথায় গেছেন, বউদি খুব চিন্তা করছেন।

গৌরাঙ্গ চলে গিয়েছিল, কিন্তু আবার সরসীর চোখ ছাপিয়ে জল এসেছিল। মনে মনে বলেছিল, সুবীর কি আমাকে একটুও বুঝতে পারে না? চিরদিনই কি এমন অবুঝ থাকবে, আমাকে অপমান করবে?

প্রায় এক ঘণ্টা পরে ফিরে এসে গৌরাঙ্গ জানিয়েছিল, সুবীর কোথাও নেই, তাকে বন্ধুরা কেউ দেখতেও পায়নি। এদিক-ওদিক খোঁজ করে দেখেছে, কোথাও পায়নি।

সরসী বলেছিল, আচ্ছা, তুমি শোওগে।

দরজা বন্ধ করে দিই?

 আমি করছি।

গৌরাঙ্গ চলে গিয়েছিল। সরসী উঠে বাইরের ঘরে গিয়ে, রাস্তার দরজাটা খুলে, নিঝুম রাস্তাটার দিকে একবার দেখেছিল। তারপর দরজা খুলে রেখেই, অন্ধকার ঘরে সে চুপচাপ বসে ছিল। ঘুম তার চোখে ছিল না। উদ্বেগ এখন তার বেশি। কেবল চুপচাপ বসে থাকতেও পারেনি, পায়চারি করছিল, আর মাঝে মাঝে বসছিল।

একবার মনে হয়েছিল, সুবীর হয়তো ওদের নিজেদের বাড়িতে গিয়েছে, খেয়েদেয়ে, সেখানেই শুয়ে পড়ে, অঘোরে ঘুমোচ্ছে। আর সরসী দরজা খুলে, একলা অন্ধকার ঘরে রাত্রি জেগে, উদ্বেগে অপেক্ষা করছে। সুবীরদের বাড়িও তো সরসীর পিত্রালয়ের পাড়াতেই। যে বাড়িটার রকে বসে ওরা আড্ডা মারত, পুরনো মিত্তির বাড়ি। যদিও, সরসীকে বিয়ে করার জন্যে, সুবীরের বাড়িতেও একই অবস্থা, কোনও সম্পর্কই ছিল না। বরং, দরিদ্র ভাড়াটে পরিবার, এম এ পাশ করা মেয়ে সম্পর্কে, ওদের নানান রকম দ্বিধা ও সন্দেহই ছিল। কারণ ও বাড়ির মেয়েদের সবথেকে বেশি দৌড় স্কুল ফাইন্যাল পর্যন্ত। তা ছাড়া, সরসীর মতো একটি এম এ পাশ করা মেয়ে কেনই বা সুবীরের মতো ছেলেকে বিয়ে করবে, এ রহস্য ওদের বাড়িতে প্রায় বীভৎস অশ্লীলতার পর্যায়েই পড়ে। অনেক নোংরা কথাবার্তাই ওরা সরসী সম্পর্কে বলত। বিশেষ করে, কলকাতার আদিবাসিন্দা, বনেদিয়ানার মূঢ় অহংকারও কম ছিল না। আধুনিক জীবনের যে কোনও অবস্থাকে হীন ভাষায় সমালোচনা করাটাকে ওরা গৌরবের মনে করত। অতএব, সরসীর সঙ্গে সুবীরের বিয়েটাও ওদের কাছে অনাচার ছাড়া আর কিছু ছিল না। ওরা মনে করত, সুবীর আগে যতটা খারাপ ছিল, সরসীকে বিয়ে করে একেবারে অধঃপাতের শেষ অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। ওর মনুষ্যত্বের আর কোনও অবশিষ্ট ছিল না। (আহা, ওই তো, ওই তো বাইরের ঘরে সেই সুবীরই বসে আছে, সেই মন্টু মিত্তির। রকের জাঁহাবাজ ছেলেটি, মিত্রবাড়ির জ্ঞাতি-গোষ্ঠী সবাই আজ যে ছেলের জন্যে গৌরব বোধ করে, তাদের সেই সব থেকে অধঃপতিত ছেলেটিই তো আজকের ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র। সুবীরের যাবার দরকার হয় না, তারা নিজেরাই এগিয়ে এসে, তাদের অস্তিত্বের কথা আজ স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়, এবং পরম সৌভাগ্য এই, সুবীরের সেইটুকু অহংকার জন্মায়নি, তাকে যারা একদা ঘৃণা করেছিল, তাদের প্রতি সে কোনওরকম বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করবে। বরং আপন আত্মীয়স্বজনকে ও এমনভাবে আজ গ্রহণ করেছে, যা অনেক সময় সরসীর পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাদের নানান দাবি ও আবদার সরসীকে বিরক্ত করে তোলে। অথচ সুবীর যেন নিজেই কৃতজ্ঞ।)

কিন্তু না, ভুল ভেবেছিল সরসী, মনে মনে বলেছিল, না, ও কখনও ওদের বাড়িতে যাবে না। সরসীর প্রতি যত নির্দয় নিষ্ঠুরই হোক, নিজেদের বাড়ি সম্পর্কে ওর কোনও মোহ ছিল না। ওখান গিয়ে, খেয়ে শুয়ে থাকা একেবারে অসম্ভব ছিল। তখন বরং সরসীর মনে হয়েছিল, নিজেদের বাড়ি গেলে তবু ভাল। কিন্তু সুবীরের যে সমস্ত বাজে আচ্ছা ছিল ওর অতীত জীবনের পরিক্রমায়, সেখানে যেন না যায়।

এমনি সব চিন্তার মধ্যেই, এক সময়ে, খোলা দরজা দিয়ে, রাস্তার স্বল্পালোকে সুবীরের মূর্তি ভেসে উঠেছিল। তখনও সুবীর দরজা পর্যন্ত আসেনি। সরসী তৎক্ষণাৎ নিঃশব্দ পায়ে শোবার ঘরে চলে গিয়েছিল। কেন না, সে যে সুবীরের জন্যে অপেক্ষা করছিল, তখন সে কথাটা জানতে দিতে যেন মরমে মরে যাচ্ছিল। সে খাটে উঠে শুতে না শুতেই, বাইরের ঘরে আলো জ্বলে উঠেছিল। সরসী তার মানসচক্ষে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, সুবীর এত রাত্রে দরজা খোলা দেখে অবাক হয়েছে, বিরক্তও। একটু পরে দরজা বন্ধ করার শব্দ হয়েছিল, আলো নিভেছিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই, শোবার ঘরের দেয়ালের আলো জ্বলে উঠেছিল। সরসী তখন উপুড় হয়ে, বিছানায় মুখ গুঁজে রেখেছিল। সুবীরের জামা খোলা টের পেয়েছিল সে। কয়েক মুহূর্ত পরেই আলো নিভে গিয়েছিল, এবং দরজা বন্ধ করে, যথেষ্ট দূরত্ব রক্ষা করে সে শুয়ে পড়েছিল। তার নিশ্চয় ধারণা হয়েছিল, সরসী ঘুমিয়ে পড়েছে।

সরসী চুপ করে শুয়ে থাকতেই চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। তার গলার স্বর শোনা গিয়েছিল, খেতে হবে না?

বোঝা গিয়েছিল, সুবীর চমকে উঠেছে। বলেছিল, অ্যাঁ! না, আমি খেয়ে এসেছি।

খেয়ে যে আসেনি, তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না সরসীর। সুবীর তাকে জিজ্ঞেস করেনি, সে খেয়েছে কিনা!না করুক, সরসী আর কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। সে একটা শান্তি ও স্বস্তি বোধ করছিল। রাত্রি দুটোয় সে আর কেঁচে গণ্ডুষ করে, কোনও কিছুর সূত্রপাত করতে চায়নি। মনে মনে তার কষ্ট হচ্ছিল বটে সুবীরের না-খাওয়ার জন্যে, কিন্তু একথাও সে জানত, একদিন না খেলে মানুষের এমন কিছু ক্ষতি হয় না। তার চেয়ে নিরুপদ্রবে রাত্রিবাস করা ভাল। উদ্বেগ অশান্তি ও উত্তেজনায় এমনিতেই সরসী ক্লান্তি বোধ করছিল। মনে মনে একটা স্বস্তি পাওয়ায়, সে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে সে দেখেছিল, সুবীর তখনও ঘুমোচ্ছে। তখন নতুন করে আবার সেই প্রশ্নটাই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, সুবীর আজই সন্ধ্যাবেলা তার দলবলের সঙ্গে বাইরে চলে যাবে, যে বাইরে যাওয়া নিয়ে এত কলহ-বিবাদ।

কিন্তু আর কিছুই বলবার ছিল না সরসীর। সে জানত, বাধা দিতে গেলে, কটু কথা রাগারাগি ও উত্তেজনারই বাড়াবাড়ি হবে। যে রুদ্রমূর্তি তার দেখা গিয়েছিল আগের দিন, তারপরে আর সে প্রবৃত্তি ছিল না। জোর করে সবকিছু সম্ভব হয় না। সরসী বিশ্বাস করেছিল, সে বিষয়ে তার হার হয়েছে।

সরসীর সকালবেলাই ইস্কুল ছিল। সে তাড়াতাড়ি স্নান করে গৌরাঙ্গকে সমস্ত নির্দেশ দিয়ে, তৈরি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। গৌরাঙ্গের অনুরোধে, এক কাপ চা খেয়েছিল, সুবীরের খাবারের ব্যবস্থা করে গিয়েছিল নিজেই। জানত, সুবীরের সেদিন কোনও তাড়া নেই, সে কাজে যাবে না। এক সপ্তাহের ছুটি নেওয়া তার হয়ে গিয়েছিল।

বেলা এগারোটায় বাড়ি ফিরে সে দেখেছিল, সুবীর বেরিয়ে গিয়েছে, তখনও বাড়ি ফেরেনি। স্বভাবতই, যতক্ষণ সুবীর ফেরেনি, ততক্ষণ সরসীও অভুক্তই ছিল। বেলা দুটোয় বাড়ি এসে, সুবীর গৌরাঙ্গর কাছে খেতে চেয়েছিল। খেয়েই আবার বেরিয়ে গিয়েছিল। কেউ কারোর সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। সুবীর সরসীর দিকে ফিরেও তাকায়নি। সরসী অবিশ্যি দু-একবার লুকিয়ে না-তাকিয়ে পারেনি। সুবীর আবার তখন কেন বেরুচ্ছে, এ কথা একবার জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছে হলেও জিজ্ঞেস করেনি। সরসী জানত, ছটার সময়েই সুবীর স্যুটকেস নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। হয়তো, তখনও সে যাবার জোগাড়যন্ত্রেই বন্ধুদের কাছে গিয়েছিল।

সরসীর বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণ একটা কষ্ট তেমনই বিধে ছিল, তবু নীরবে সবকিছু সহ্য করা ছাড়া তার কোনও উপায় ছিল না তখন। একটা অস্বস্তি ও যন্ত্রণার মধ্যেও, সে খাওয়া-দাওয়া করেছিল, বিশ্রাম করতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভেঙে সে চমকে উঠেছিল। ঘরে ঘনায়মান অন্ধকার, বেলা অনেকক্ষণ পড়ে গিয়েছিল। সে প্রথমেই ভেবেছিল, সুবীর চলে গিয়েছে এবং তাকে না জানিয়ে, না বলেই গিয়েছে। খাটে বসেই সে ডেকেছিল, গৌরাঙ্গ।

বাইরে দরজার কাছ থেকেই গৌরাঙ্গর গলা শোনা গিয়েছিল, হ্যাঁ বউদিদি।

একী, এত দেরি হয়েছে আমাকে ডাকোনি কেন?

গৌরাঙ্গ একটু ইতস্তত করে বলেছিল, ভাবলাম, কাল রাত্রে ঘুমান নাই, একটু ঘুমিয়ে নিন।

সরসী উঠে নিজেই বাতি জ্বালিয়ে, টাইমপিস-এর দিকে দেখেছিল, ছটা বাজতে আর কয়েক মিনিট মাত্র বাকি। সরসী চকিতে গৌরাঙ্গর মুখের দিকে তাকিয়েছিল, এবং পরমুহূর্তেই ঘরের কোণের স্যুটকেসের দিকে। দেখেছিল যেখানকার স্যুটকেস সেখানেই আছে। তবে? সে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার দাদা কোথায়? বেরিয়ে গেছেন?

হ্যাঁ, দাদা তো সেই বেলা তিনটেতেই খেয়ে বেরিয়ে গেছেন, আর আসেন নাই।

সুটকেস নিতেও আসেননি?

না তো।

অস্বস্তি ও কষ্ট আরও জমাট বেঁধে উঠেছিল সরসীর মনে। ভেবেছিল, কোনও খবর না দিয়েই সুবীর চলে গিয়েছে। বন্ধুদের দলের সঙ্গে সে ভাবে চলে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু বাড়িতে এসে নিজের স্যুটকেসটা নিয়ে যেতেও তার আপত্তি ছিল? গৌরাঙ্গকে ক্লাবে বা বন্ধুদের কাছে খবর নিতে পাঠাবে কিনা ভাবছিল, পাঠাতে পারেনি। তার লজ্জা করেছিল, অভিমান তাকে। বাধা দিয়েছিল।

গৌরাঙ্গ জিজ্ঞেস করেছিল, তা হলে এবেলা কী রান্নাবান্না হবে বউদিদি? বাজারে যেতে হবে নাকি?

গৌরাঙ্গ তার কর্তব্যের কথাই বলেছিল। যদিচ, সে কথা ভাববার মতো মন তখন সরসীর ছিল না। বলেছিল, কী করে কী বলি। তোমার দাদা বাইরে যাবেন বলেছিলেন, চলে গেলেন কিনা, কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার শরীর তেমন ভাল না। আমি কিছু খাব না।

গৌরাঙ্গ খানিকটা অসহায়ভাবে ইতস্তত করছিল। সরসী বলেছিল, পরে তোমাকে বলছি, এখন যাও।

একটা অসহ্য শূন্যতা যেন সরসীকে গ্রাস করেছিল। এ ঘরে, ও ঘরে, বাগানে, কোথাও গিয়ে শান্তি পাচ্ছিল না। তবু বাগানের অন্ধকার বারান্দাতেই সে চুপ করে বসে ছিল। একরাশ এগজামিনের খাতা জমা হয়ে পড়েছিল। দেখা দূরে থাক, স্পর্শও করতে ইচ্ছা করছিল না। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত করেছিল, কোনও বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে যাবে। গৌরাঙ্গকে নির্দেশ দিয়ে যাবে, রান্না করে খেয়ে নিতে। ঠিক সে সময়েই বাইরের ঘরে কড়া বেজে উঠেছিল।

সরসী উঠতে গিয়েও, উদগ্রীব আড়ষ্ট হয়ে বসে ছিল। গৌরাঙ্গ দরজা খুলে দিয়েছিল। একটু পরেই শোবার ঘর থেকে সুবীরের গলা শুনতে পেয়েছিল, বউদিদি কোথায়?

বাগানের বারান্দায় বসে আছেন।

আমাকে একটু চা করে দে তো, আমি বাথরুম থেকে আসছি।

আবার, আবার একবার একটা অস্পষ্ট স্বস্তির ভাব ফিরে এসেছিল সরসীর মনে। সংশয়ে ও আশায়, তার মনটা বারবার দুলে উঠেছিল। কেন, সুবীর এখন বাথরুমে গেল কেন, চা চাইল কেন? ওর চলে যাবার সময় তো উতরে গিয়েছে। না কি এখনও যাবার সময় হয়নি? প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে যাবার জন্যেই এসেছে? হয়তো তাই। কিন্তু ও যে বলেছিল, গাড়ি হাওড়া থেকে সাড়ে সাতটায় ছেড়ে যাবে? সময় তো পার হয়ে যেতে বসেছে, আর কখন যাবে? না কি, আরও কোনও গাড়ি ছিল? একটা সংশয় অস্থিরতার মধ্যেও নিশ্চল স্থির হয়ে বসে ছিল সরসী। ওভাবে অপেক্ষা করা ছাড়া তার কোনও উপায় ছিল না।

কিছুক্ষণ পরে, অন্ধকারে গৌরাঙ্গ এসে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, বউদিদি, দাদাকে চা দিয়েছি, আপনাকেও কি দেব?

সরসী জিজ্ঞেস করেছিল, দাদা কি বেরোচ্ছেন?

না তো। দাদা তো টেবিলের বাতি জ্বালিয়ে পড়তে বসলেন।

 ও!

কথা আটকে গিয়েছিল সরসীর গলায়। চোখ ছাপিয়ে জল এসে পড়েছিল। গৌরাঙ্গ আবার বলেছিল চা আনব?

সরসী কোনওরকমে উচ্চারণ করেছিল আনো।।

তখন সরসীর সমস্ত মান-অভিমান রাগ-ব্যথা ছাপিয়ে একটা নিবিড় আনন্দ কেবল চোখের জল হয়ে প্লাবিত হচ্ছিল। যে জলকে তার একটুও বাধা দিতে ইচ্ছে করেনি। গৌরাঙ্গ এসে চা দিয়ে গিয়েছিল। সে চায়ের স্বাদ ও গন্ধ তার কাছে অন্যরকম লেগেছিল। তারপর একসময়ে সে নিজে উঠে, আস্তে আস্তে গিয়ে দেখেছিল, সুবীর আপন মনে পড়ছে।

সেই মুহূর্তে একটা ব্যথা একবার খচ করে উঠেছিল সরসীর বুকের মধ্যে। পরমুহূর্তেই মনে মনে বলেছিল, থাক, আমার সঙ্গে সুবীর কথা না-ই বলুক, আমার কাছে না-ই আসুক, ও যে ভাবে শান্তি পায় পাক। কেবল ও যেন ওর প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে না যায়, রক্ষা করতে ব্যর্থ না হয়। আমাদের দুজনের মিলিত সমস্ত পরিকল্পনাকে যেন ও ভাসিয়ে না দেয়। কারণ, সুবীরের লেখাপড়া আজ আর কেবল, এক ঘরে দুই মানুষের বিষয় নয়। পিত্রালয়, শ্বশুরালয়, পাড়া-প্রতিবেশী ও সমাজের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিচ সেটাই স্বামী-স্ত্রীর বড় কথা নয়, কিন্তু যেহেতু আত্মীয়-প্রতিবেশীরা ঘটনাটিতে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে, সেই হেতু, সে কথা ভুলে থাকাও যায় না। ঘটনা নিশ্চয়ই একটা অতি অসাধারণ কিছু নয়, কিন্তু প্রত্যহের চলমানতায় নিশ্চয় একটি বিশেষ ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রমকে যদি সার্থক করে তোলা না যায়, তবে সে লজ্জা আজ আর শুধু বাইরে নয়, দুটি প্রাণের লজ্জা, অনেক কালিমা পুঞ্জীভূত করে তুলবে। তাই, সুবীর কথা না বলুক আমার সঙ্গে, না-ই ডেকে নিক আমাকে, ও যেন কোনওরকমেই আপন যাত্রা ভঙ্গ না করে। তাতে যদি চিরদিন ওর দুচোখের বিষ হয়ে উঠি, আমি যেন তা সহ্য করতে পারি।

একটা স্বস্তি, তবু একটা কষ্ট, এ দুয়ে মিলে সরসী চোখের কোল শুকনো রাখতে পারেনি। দরজার কাছ থেকে আস্তে আস্তে সরে এসে, বাইরের ঘরে গিয়ে বসেছিল। দুদিনের উত্তেজনায়, অস্বস্তি, অশান্তিতে ক্লান্ত ছিল সরসী। টেবিলের ওপর মাথা রেখে, ঘুম ঘুম তন্দ্রায়, আচ্ছন্ন হয়েছিল। এক সময়ে, গৌরাঙ্গর ডাকে সে চকিত হয়ে উঠেছিল। গৌরাঙ্গ বলেছিল, দাদা খেতে চাইছেন।

সরসী বলেছিল, ও হ্যাঁ, খেতে দাও তা হলে। কটা বেজেছে গৌরাঙ্গ?

 এগারোটা।

এগারোটা? তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল সরসী। এত রাত্রি হয়েছে সে ভাবতে পারেনি। সরে গিয়ে, শোবার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, সুবীর তখনও ওর পড়ার টেবিলে মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। সামনে বইয়ের পাতা খোলা। সরসী বলেছিল, এত রাত হয়েছে, আমাকে ডাকোনি কেন?

ডেকেছিলাম দুবার, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ভাবলাম, দাদা খেতে চাইলে আবার এসে ডাকব।

সরসী গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, দাদা আমাকে ডাকতে বলেছেন?

না। খালি খেতে চাইলেন।

ও!

বুকের মধ্যে টনটনিয়ে উঠেছিল সরসীর। একটু চুপ করে থেকে বলেছিল, আচ্ছা, তুমি দাদাকে খেতে দাও, আমি পরে যাচ্ছি। দাদার খাওয়া হয়ে গেলে, তোমাকে খেতে দিয়ে আমি খেয়ে নেব।

গৌরাঙ্গ চলে গিয়েছিল। সরসী বসে ছিল বাইরের অন্ধকার ঘরেই। তখন অভিমানটাই বড় হয়ে বেজেছিল সরসীর মনে। সুবীর তাকে খেতে দেবার জন্যে ডাকেনি, তার কাছে খেতে চায়নি। সরসী খেয়েছে কিনা, সে কথাও জিজ্ঞেস করেনি। কেন, বাধা দিয়ে অন্যায় কি কেবল সরসীই করেছিল?

তবু, একবার মনে হয়েছিল, না, আমি যাই। পরমুহূর্তেই, সেই চির-স্ত্রীর বুক দুলে ওঠা অভিমানই বড় হয়ে উঠেছিল। না, ওর যদি ভাল না লাগে, ওর যদি ইচ্ছে না হয়, তবে কেন আমি ওর খাবার সময় সামনে গিয়ে দাঁড়াব। এই কথা মনে মনে বলেছিল সরসী। কারণ ওদের সংসার পাতা থেকে, যাপনের দিনগুলোর ইতিহাস তো তাই। সুবীরের খিদে পেলে, ডাক দিয়ে বলেছে, সরো, আমায় খেতে দাও, খিদে পেয়েছে। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। আর স্বাভাবিক ছিল বিচ্ছিন্নতা, অসহযোগিতায় নির্বাক স্তব্ধতা। সব মিলিয়ে এক দুঃসহ অবস্থা। সুবীর ডাক দিয়ে খেতে না চাইলেও, সরসী তাকে ডেকে কি খাওয়ায়নি? সেই স্বাভাবিক অবস্থার চেহারাই আলাদা। কিন্তু রাগারাগির অস্বাভাবিক অবস্থায়, হাতে-পায়ে ধরে সাধাসাধি করে, কোনওদিনই সে সুবীরকে ডেকে আনতে পারেনি। যে আচরণকে সরসীর মনে হত, যেচে মান কেঁদে সোহাগ-এর মতো। তার জন্যে কেউ কি বলবে, সুবীরকে সে ভালবাসেনি? হাতে-পায়ে ধরে টানাটানির মধ্যেই কি কেবল ভালবাসা প্রকাশ পায়? বরং সরসীর চিরদিনই মনে হয়েছে, অমন করে টানাটানির মধ্যে কেমন যেন একটা হীনম্মন্যতা প্রকাশ পায়। মনের উদ্বেগব্যাকুলতার সংবাদ যার অগোচরে থেকে যায়, যে মনকে চিনতে পারে না, জানতে পারে না, তার হাতে-পায়ে ধরে টানলেই কি সে প্রাণের কথা টের পায়? তা ছাড়া, কার হাতে-পায়ে ধরে টানতে হবে? স্বামীর, প্রেমিকের? যার জন্যে সকলই বিসর্জন, তার কাছে অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ার মধ্যে কি প্রেমের অসম্মান হয় না?

এই ছিল সরসীর চিন্তার ধারা, সুবীরের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্রগুলো এই বিশ্বাস ও ধারণাতেই যুক্ত ছিল। প্রেমের মান-অপমানটা যেহেতু তার চিন্তার মূলে ছিল, সেই হেতু, আর দশটি সাধারণ নারীর মতো সুবীরের কাছে সে সস্তা (তার ধারণা) হয়ে উঠতে লজ্জাবোধ করেছে। তা ছাড়া, সরসী যে নিজের দিক থেকে কখনও কোনও অন্যায়ই খুঁজে পায়নি। সে যা চেয়েছিল, তার মধ্যে কোনও অন্যায় ছিল না। তার জন্যে যে আচরণ সে করত, তার মধ্যে কোনও অন্যায় বা ত্রুটি ছিল না। এ চিন্তাটাও কখনও ভুলত না সরসী। ভুলত না বলেই, সুবীরের সকল অন্যায় আচরণের কাছে, জেদের সামনে, ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ ব্যবহারের সামনে মাথা নত করতে পারেনি। যদি বা কখনও কখনও সুবীরকে তার অসহায় দুর্বল বোধ হয়েছে, মনে মনে করুণ হয়ে উঠেছে, তথাপি, শিথিল ও নত হতে গিয়ে কোথায় যেন তার শিরদাঁড়ায় আটকে গিয়েছে। অন্তস্রোতে যদি বা ফর্মু টলটলিয়েছে, তার সকল বহিরাঙ্গনের বুক জুড়ে বালিয়াড়ির রুক্ষতা ও গাম্ভীর্যই বিরাজ করেছে।

সুবীর বিবাদে অবিবাদে কতদিন অভিযোগ করেছে, তুমি কখনও ভুলতে পার না, তুমি এম এ পাস, ইস্কুল-টিচার, সুন্দরী (আর আমি একটা আকাট মুকখু)।

এ অভিযোগ শুনলেই সরসীর বুকের মধ্যে জ্বলে উঠত। তখন সে সত্যিই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠত। পরিণতি, আর এক প্রস্থ রাগারাগি ও মান-ভাঙাভাঙিতে গিয়ে পৌঁছত। এ অভিযোগ শুনলেই, সরসীর মনে হত, সুবীর ওর আপন অন্যায়কে ঢাকবার জন্যে, সব থেকে সস্তায় বাজিমাত করার উপায় হিসাবে ওই কথাগুলো বলত। সরসী নিজে ও কথাটা মানত না, ওর মন ওকে সেই সাক্ষীই দিয়েছে। মনে মনে বলত, তাই যদি ভাবব, তবে ওকে সমকক্ষ করে তোলার কথা কেন চিন্তা করব? যেমন ছিল, তেমনই তো চলতে পারত। এ ব্যতীত, বস্তুত সুবীর তো আকাট মূর্খ সত্যি ছিল না। সে কথা ভাববার যুক্তিই বা কোথায় ছিল সরসীর? সে কি তার সকল জ্ঞান চিন্তা ভাবনা বিসর্জন দিয়ে গ্রহণ করেছিল সুবীরকে? কেবলমাত্র মূঢ় নারী মন নিয়ে কি সে একটি পুরুষকে চেয়েছিল?

তবু সুবীর তাকে ক্রোধে আত্মহারা করে তুলত, যখন সে ক্রুদ্ধ বিদ্রুপে বলত, নেহাত আমার মতো ছেলের সঙ্গে ফেঁসে গেছ, এখন পস্তাচ্ছ। মনে মনে চাও, বিদ্বান গুণবান রূপবান স্বামী, আমাকে তাই মানতে পার না।

কোনও মেয়ের মনে সে আকাঙ্ক্ষা থাকা অস্বাভাবিক বা বিচিত্র কিছুই নয়, তবু যখন অমনি করে সুবীর বলত, তখন সরসীর মস্তিষ্ক জুড়ে আগুন জ্বলত। তার মধ্যে একটা অপমানের জ্বালা অতি তীব্র হয়ে বাজত। কারণ যে কথাটা তার ইস্কুলের বান্ধবীদের কূট সন্দেহ বিদ্রুপের মধ্যে শোনা যেত, যে প্রশ্নটা বাইরের লোকের মুখে মুখে চলত, তথাকথিত বিদূষী ভার্যার সে রকম ব্যবহার বা মনোভাব কখনও তার ছিল না, ব্যক্তও করেনি। ওইসব কথার মধ্যে কেবল যে ইতরতা ছিল তা নয়, তার মানসিক কষ্টকে হীন করা হত, তার দুঃখকে বিদ্রুপে খোঁচানো হত। তাই সে-ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠত, নিষ্ঠুর ভাবে মর্মান্তিক ভাষায় সুবীরকে অপমান করত। তাতেও যন্ত্রণা কমত না, বাড়ত। এবং শেষ পর্যন্ত সকল যন্ত্রণার অবসান হত, সুবীরের ক্ষমাপ্রার্থনায়। যে ক্ষমাপ্রার্থনা ন্যায্য ও উচিত ছিল। যদিচ, ও বিষয়ে সুবীর কখনও পরাজুখ ছিল না। যতক্ষণ রাগ, ততক্ষণ ওর মুখে বিষ। রাগ শেষ হয়ে গেলেই, ও হয়ে উঠত অন্য মানুষ। অসহায় দুর্বল অপরাধীর মতো শিশুর সারল্যে ভেঙে পড়ত। ওর ভিতরে কোনও দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা এবং বিষের বাষ্প ছিল না। এই বিশেষ কারণটিতে মনে মনে সে সৌভাগ্য মানত, যে সৌভাগ্যের কথা আজও সে গোপনে উচ্চারণ করে, মুখ ফুটে বলে না।

এই সব ভাবনার মধ্যে, যে ধারণাটা প্রধান হয়ে ওঠে, তা ছিল এই, সরসী আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করত, অন্যায় যা কিছু ছিল, সুবীরের নিজের। সে ছিল ন্যায়ের পক্ষে। তাদের দ্বন্দ্বের মাঝখানটায় ছিল ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন। এবং এ কথাও সত্যি, সুবীর চিরদিনই অন্যায় মেনে নতি স্বীকার করেছে। আর সে স্বীকৃতিতে ও কখনও বিলম্ব করেনি। কারণ সেটা ওর চরিত্র ছিল না। সরসী রাগে দুঃখে অপমানে যদি বা দীর্ঘস্থায়ী যাতনায় ভুগেছে, সুবীর ক্ষমা আদায় না করে ছাড়েনি। তখন সুবীর সরল, শিশুর মতো বর্বর, ব্যাকুলতা নিয়ে সরসীর কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ত, যে সমর্পণের কাছে সরসীর প্রতিটি রুদ্ধ দুয়ার ভেঙে পড়বার জন্যে থরথরিয়ে উঠত। তার প্রাণে প্রাণে, রক্তে রক্তে, সেই ভেঙে পড়ার প্রতীক্ষা যেন স্তব্ধ হয়ে থাকত। যদিচ মনের গ্লানি ঘুচতে তার সময় লাগত। হয়তো তার কারণ ছিল, যে কারণটা সরসীর নিজেরও জানা ছিল না, সুবীরের থেকে তার নিজের অন্তর ছিল জটিল। হয়তো সেই কারণেই, সুবীরের অপেক্ষাকৃত সহজ, অজটিল সেই সরল ব্যাকুল রূপটিকে সরসী চিরদিন বেশি ভালবেসেছে। সেই রূপের মধ্যেই আসল সুবীর যেন ফুটে উঠত, যে রূপের মধ্যে সরসীর সকল বিশ্বাস আশা আশ্বাস লুকিয়ে ছিল।

নিতান্ত কি ভুল ভেবেছিল সরসী? ওই তো, তার বিশ্বাস, আশা, আশ্বাসের প্রতিমূর্তি বাইরের ঘরে বসে, পণ্ডিত ও গুণীজনদের সঙ্গে প্রাজ্ঞ আলোচনায় মগ্ন।

খাটের ধারে এলায়িত শরীর আর একটু সরিয়ে নিয়ে এল সরসী। অন্ধকারে তাকে তো কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু সুবীরকে যে আর একটু ভাল করে দেখতে ইচ্ছে করছে। সুবীর নয়, মন্টু, পাড়ার সেই বখাটে রকবাজ মন্টু মিত্তিরকে। ওই তো, ও কথা বলছে, যে মুখের মধ্যে আজ যেন সেই মন্টু মিত্তিরকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। সে মুখ আর এ মুখ যেন আলাদা। আট বছর আগে, এ মুখ ছিল কিছু শীর্ণ, এক জোড়া সরু গোঁফ, এবং গোটা মুখে কোথাও যেন বুদ্ধি ও গাম্ভীর্যের ছাপ ছিল না। ছিল অসুখী অথচ মূঢ় আত্মসুখপরায়ণতার ছাপ। এখন এই মুখে বিদ্যা বুদ্ধি অনুসন্ধিৎসা প্রসন্নতা ও গাম্ভীর্যের বিচিত্র মিশ্রণ ঘটেছে, মুখ বদলে গিয়েছে। যে মুখের দিকে, হেনা ব্যানার্জি অপলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। অথচ সুবীরের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই, এক মুহূর্ত পরেই চোখ নামিয়ে নিচ্ছে। আর সেই মুহূর্তেই, একটা তীক্ষ্ণ বিদ্ধ কষ্ট সরসীর সমস্ত চেতনাকে যেন গ্রাস করছে। হেনা ব্যানার্জি, আট বছর পরে, আর একটা অন্ধকারের পরদা, যে পরদার অন্তরালে কী আছে, সরসী জানে না।

সরসী সরে এল একটু। আবার, আবার সেই দিনটিতে, সেই রাত্রিটিতে ফিরে গেল সরসীর মন। আজ আর মনকে পিছন থেকে কিছুতেই টেনে রাখা যাচ্ছে না। আজ আট বছর পরে, জীবনের হিসাব-নিকাশে, সেই দিনগুলোই বারে বারে ভেসে উঠছে। যার মধ্যে ছিল অনেক যন্ত্রণা ব্যথা অপমান, অথচ সুখ-হ্যাঁ, সুখ, শান্তি, স্বস্তি।

সেই রাত্রে, আজ থেকে আট বছর নয়, বছর ছয়েক হবে বোধহয়, তখন সুবীর আই এ পাস করেছিল, যে কারণে সরসীর আশা আরও বেড়েছিল, সেই রাত্রে, গৌরাঙ্গ খেতে দিয়েছিল সুবীরকে। বাইরের ঘরের অন্ধকারে চুপ করে বসেছিল সরসী। দেখেছিল, খুব তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে, সুবীর শোবার ঘরে গিয়েছিল। কোনওদিকে দৃকপাত মাত্র না করে, আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছিল। দরজা খুলে রেখে শুয়ে পড়ার অর্থ, ও জানত, বাগানের বারান্দায় বা বাইরের ঘরে, কোথাও সরসী ছিল। সময় ও ইচ্ছে হলে গিয়ে শুয়ে পড়বে।

লুকোচুরি করার কোনও মনোবৃত্তি ছিল না সরসীর। সে খাবার ঘরে গিয়ে, গৌরাঙ্গকে খেতে দিয়েছিল। নিজেও নিয়ে বসেছিল, কিন্তু খেতে পারেনি। যদিচ, সে বেশি সময় কাটাতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল, সুবীর ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘরে ঢুকবে সে। সুবীরের যেমন নিরবচ্ছিন্ন অসহযোগিতা ছিল, সরসীও তেমনি অসহযোগীই থাকতে চেয়েছিল। তখন শোবার ঘরে গিয়ে, একই খাটে, পর্বতপ্রমাণ বাধার এপারে ওপারে, শুয়ে পড়তে, শুধু লজ্জাই করেনি, সমস্ত অন্তঃকরণও যেন বিমুখ হয়েছিল। অথচ আর কোনও শোবার ঘর ছিল না যে, সুবীরের মতো সে-ও গিয়ে, বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়বে। বাইরের ঘরে শোবার বন্দোবস্ত করা যায় কিনা, সেকথাও ভেবেছিল সরসী। কিন্তু গৌরাঙ্গর সামনে সে রকম একটা দৃশ্যের অবতারণা করতেও রুচিতে বাধছিল। অনন্যোপায় হয়ে, খাবার ঘরের দায়িত্ব গৌরাঙ্গকে দিয়ে, সে আবার বাইরের ঘরে গিয়ে বসেছিল। দরজা বন্ধ করে আলো জ্বেলে বই নিয়ে বসেছিল। কিন্তু দেহ জুড়ে ছিল তার অপরিসীম ক্লান্তি। রাত পোহালেই ছিল ইস্কুলে ছোটা। এবং তখন, যদিও তার মন মোটামুটি শান্ত হয়ে এসেছিল, কারণ সুবীর থিয়েটারের দল নিয়ে চলে যায়নি, তবু শেষ বাধাটুকু আটকে ছিল। আর সেই বাধা অতিক্রম করে, সুবীরের কাছে সরসী কখনও যেতে শেখেনি। কারণ সেই ন্যায় ও অন্যায়ের প্রশ্ন। সেটুকু ছিল সরসীর শেষ পাওয়ানা, সেটুকু না পেলে, তার আভ্যন্তরীণ সকল বাধার অপসারণ হত না।

তবু সেইভাবে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। শোবার ঘরে তাকে আসতে হয়েছিল। সে যে কী ভীষণ অস্বস্তি! যেন এক জয়-পরাজয়ের খেলা। প্রায় নিঃশব্দেই দরজা বন্ধ করেছিল সে। বাতি জ্বালায়নি। মনে মনে চাইছিল, সুবীর যেন ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছিল কি না সে টের পাচ্ছিল না। তাতে তার অস্বস্তি আরও বাড়ছিল। এবং সেই অবস্থার জন্যে, তার মনের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছিল। একমাত্র ভাগ্য, জানালার কাচের ভিতর দিয়ে ছিটেফোঁটা আলোয়, অন্ধকারের মধ্যে অতি অস্পষ্টভাবে প্রায় সবকিছুই দেখা যাচ্ছিল। সুবীরের অবস্থান লক্ষ করে, সরসী তার নিজের জায়গায় আস্তে আস্তে শুয়ে পড়েছিল। কয়েক মুহূর্ত তার শরীর শক্ত ও আড়ষ্ট হয়ে ছিল। জানত না, যেটাকে সে সেই মুহূর্তে কেবল লজ্জাজনক মনে করছিল, আসলে, সেটা তার অবচেতনে একটা স্পর্শের প্রতীক্ষা। হ্যাঁ, প্রতীক্ষাই, আশঙ্কা নয়, যদিচ সেই প্রতীক্ষার মধ্যেও একটা বিমূঢ়তা নিশ্চিতরূপেই ছিল। সেই মুহূর্তের জন্যে অন্তত ছিল। একটু পরে আস্তে আস্তে তার নিশ্বাস সহজ হয়ে এসেছিল। মন সহজ না হলেও, ঘুম যে তার ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে উদ্যত হচ্ছিল, সেটা অনুভব করছিল।

আগের রাত্রিও নির্বাক অসহযোগের মধ্যে কেটেছিল। কিন্তু আগের রাত্রে, উভয় পক্ষের উত্তেজনা ও তিক্ততার মাত্রা ছিল অনেক বেশি। তাই কোনও পক্ষই সন্ধির কথা চিন্তা করতে পারেনি। সেই রাত্রে যেহেতু নতুন ঘটনা ঘটেছিল, সেই হেতু, একটা সংশয়, অস্বস্তি, (আশা কিনা, সে জানত না) সরসীকে চেপে ধরেছিল। তবু নিদ্রার জন্যেই যখন দেহে-মনে প্রস্তুত হয়েছিল সরসী, সেই মুহূর্তেই সুবীরের ডাক শোনা গিয়েছিল, সরসী।

সরসীর সহজ নিশ্বাস মুহূর্তে আবার অসহজ হয়ে উঠেছিল। তার শরীর আড়ষ্ট ও শক্ত এবং নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুবীরের ওই গলার স্বর তার চেনা ছিল। প্রতিটি দরজা খোলা বন্ধের খেলায়, রুদ্ধ দুয়ারে হাত পড়ার সেই প্রথম সংকেত, চিরদিনই অমনি করে বাজত। আর তার ভিতরে নিঃশব্দে উচ্চারিত হত, না। মুখ ফুটে সে কিছুই বলত না, বলতে পারত না। ওর বুকের কাছে, গলার কাছে যেন কোনও কঠিন ভারী বস্তু চেপে বসত।

সুবীর আবার ডেকেছিল, সরো।

ডেকে পাশ ফিরে সরসীর কাছে এগিয়ে এসেছিল। আর সরসী তেমনি নিজেকে শক্ত করে, মনে মনে বারে বারে উচ্চারণ করেছিল, না না।

দেখলে তো আমি গেলুম না, তবে এখনও তুমি রাগ করে রয়েছ কেন?

তখন আর সেই ক্রুদ্ধ দুর্মুখ সুবীর নয়। ওর কথার স্বর ও ভঙ্গি বদলে গিয়েছিল। অনুতাপ প্রকাশ করবার ও ক্ষমা চাইবার, ও-ই রকম ছিল ওর ধরন। কিন্তু সুবীর যতই অগ্রসর, সরসী যেন ততই শেষ শক্তি নিয়ে, বারে বারে উচ্চারণ করত, না না না। কেননা, তখন সরসীর যেন মনে হচ্ছিল, না যাওয়ার থেকেও, সুবীরের অপমানকর উক্তিগুলো তার বুকের মধ্যে আরও বেশি করে বিধেছিল। সন্ধ্যারাত্রে সুবীরের পড়তে বসায়, আনন্দে যে তার চোখ ফেটে জল এসে পড়েছিল, সে কথা আর মধ্যরাত্রের অন্ধকার শয্যায় মনে ছিল না। তখন স্ত্রীর দাবি দুর্জয় অভিমানে শক্ত হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু কতক্ষণ! সুবীর তার আহত প্রাণের সকল বন্ধ দুয়ারে আঘাত করে, বুকের কাছে টেনে নিয়েছিল। কান্না তখন অবাধ হয়ে উঠেছিল সরসীর। কান্নাটার মূলে তখন, একদিকে আহত প্রাণের বিমূঢ়তা, আর একদিকে প্রিয়তম পুরুষের আলিঙ্গনে প্রতীক্ষিত আকাঙ্ক্ষার সুখ। সুবীরের যে রূপটিকে দেখবার জন্যে তার সকল অনুভূতি ব্যাকুল হয়ে থাকে, সে সেই রূপ, সরল দুর্বল, অথচ সবল নিষ্পাপ। অসহায় করুণ অথচ শিশুর মতো দুরন্ত দুষ্ট।

সুবীর বলেছিল, কী করব বলো, তখন রাগ হয়ে গিয়েছিল, তাই যা-তা বলে ফেলেছিলুম। ক্ষমা করে দাও সরো।

অমনি ভাষাতেই সুবীর তখন বলত, আর যত বলত, সরসীর কান্না ততই বাড়ত, এবং অভিমানের রাগের কাঠিন্য গলে গলে প্রাণের সকল স্রোত উজানে প্রবাহিত হত। তবু কথা বলতে চেয়েছিল সরসী, স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল, কী বলেছে সুবীর। কিন্তু সুবীর তার সকল কথা, স্নেহ ও আদরের মত্ততায় স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

.

সহসা গালের পাশে উষ্ণ বিন্দুর স্পর্শে চমকে উঠল সরসী। স্মৃতিচারণের প্রবাহে তার চোখে জল এসে পড়েছে। তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সে ভাবল, এমন কতদিনের কত ঘটনা ও ছবি তার প্রাণে আঁকা রয়েছে। একদিন নয়, দুদিন নয়, একটি-দুটি ঘটনা নয়। এমন শত শত দিনের, শত ঘটনা আট বছরের অতীতে ছায়া ফেলে রেখেছে। কোন দিনের কথা ভাববে সরসী? কোন দিনটিকে ফেলে, কোন দিনটিকে স্মৃতিপটে তুলে নিয়ে আসবে! আট বছরের সেই সব অতীত দিনগুলো, আজ সবই হুড়মুড় করে মনের দর্পণে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। আগে পরে মানতে রাজি নয়।

কিন্তু ওই যে ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র, বাইরের ঘরে বসে পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত, তাঁর কি এ সব কথা এক বারও মনে পড়ছে? তাঁর স্মৃতির ইতিহাসে সেই সব দিনের ছবি কি আর জীবন্ত হয়, কথা বলে?

সরসী শুনতে পাচ্ছে, ডক্টর ফয়জউদ্দিনের কথার জবাবে, ডক্টর মিত্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানবদের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে কথা বলছেন। আর হেনা ব্যানার্জি মুগ্ধ বিস্ময়ে শুনছে। হেনা ব্যানার্জিও গত বছরই ডক্টরেট পেয়েছে। কলকাতার স্বনামধন্য ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ, সরসীর ধারণা, ভারতবর্ষে যে কয়জন ভাগ্যবান লোক ভারতবর্ষের দণ্ডমুণ্ডের কথা, ইনি তাঁদেরই একজন, ধীরানন্দ ব্যানার্জি, তাঁর মেয়ে হেনা। সুবীরের ওপর হেনার এই মুগ্ধ বিস্মিত দৃষ্টির সূত্র ধরে, ধীরানন্দ ব্যানার্জির স্নেহের দৃষ্টিও সুবীরের প্রতি আয়ত ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। (হায় ডক্টর মিত্র, আপনার এত শুভার্থী, যাঁদের মুগ্ধতা বিস্ময় স্নেহ শ্রদ্ধা আপনাকে প্রতি মুহূর্তে আরতি করছে, তাঁরা কেউ কি আপনার সেই অতীত প্রত্যহগুলোর সংবাদ রাখেন? সেইদিনের আপনি, আপনার চেহারা আচরণ কোনও কিছুরই সংবাদ কি এঁরা জানেন? এঁরা জানেন, আপনি বেশি বয়সে, কত কষ্ট করে বিদ্যার্জন করেছেন। তা জানুন, তাতে কোনও আপত্তি নেই, তাঁদের জানাটাই সব নয়। কিন্তু আপনি? আপনিও কি সেই দিনগুলোর কথা একেবারে ভুলে গিয়েছেন?) যদিচ হেনার ইচ্ছেয় নিঃসন্দেহে, তবু ধীরানন্দ ব্যানার্জি নিজেই উৎসাহিত হয়ে, সুবীরকে ডেকে আলাপ করেছেন। শুধু আলাপ করেননি, জীবনের সুবর্ণ-দরজার পাল্লা খুলে দিয়েছেন, যেখানে সুবীর জীবনে উন্নতির অনেক উচ্চ সোপানে উঠতে পারে।

না, এ কথা সরসী ভাবে না, সুবীর অযোগ্য। বরং যথাযযাগ্য পাত্র। ধীরানন্দ ওকে যে চাকরি নিতে বলছেন, সে চাকরি গ্রহণ করবার সকল যোগ্যতাই ওর আছে। যদি না থাকত, তবে মন্টু মিত্তির আজ ডক্টর সুবীররঞ্জন মিত্র হয়ে উঠতে পারত না..আঃ, এই কথাটা ভাবতেই যেন সরসীর বুকের মধ্যে একটা অসহ্য যন্ত্রণা তীব্র হয়ে উঠছে। কেন, সে জানে না। সে জানে না, এই যন্ত্রণার মধ্যে তার মনের কী জটিলতা আশ্রয় করে আছে। সে জানে না, বর্তমান সুবীরকে নিয়ে যখন তার বক্ষণ প্রশস্ত হয়ে ওঠে, তখনই কেন একটা তীব্র কষ্ট তাকে দহন করতে থাকে। এক এক সময়, নিজের মনের দিকে তাকিয়ে আতঙ্কে আড়ষ্ট ও স্থবির হয়ে যায় সরসী। যখন সে তার মনের মধ্যে একটি অস্পষ্ট ভয়ংকর আকাঙ্ক্ষা লক্ষ করে, তার মনের এক অজ্ঞাত অপরিচিত স্বর বেজে ওঠে, সুবীর কেন সেই মন্টুই রইল না। মনের অজ্ঞাত অপরিচিত স্বরে সেই কথা শুনলেই, তার বুকের মধ্যে চমকে ওঠে, আতঙ্কে সে বলে ওঠে, না না, আমি তা চাইনে, কখনও চাইনি। চাইনি বলেই কি প্রতিটি মুহূর্ত সুবীরকে টেনে ধরে রাখিনি? ওকে কি আমিই গঠন করিনি? ও কি আমারই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ নয়? তবে? তবে, তবু অমন হীন চিন্তার উদয় হয় কেন?

সরসী নিজেও বিদুষী। তবু আপন মনের এই বিচিত্র আলো-আঁধারের কার্যকারণের যুক্তি সে খুঁজে পায় না। কেবল এইটুকু সে অনুভব করে, যখন সার্থকতায় তার প্রাণের সকল কূল ছাপামাপি হয়ে ভরে ওঠবার কথা, তখনই যেন সেখানে কী এক অপূর্ণতার ব্যথা বাজছে। সেই অপূর্ণতার স্বরূপ কী, কী তার ব্যাখ্যা, তার নিজের কাছে স্পষ্টরূপে ব্যক্ত হয় না। এমনকী, ব্যাখ্যা করতেও যেন তার মন রাজি হতে চায় না, ব্যবস্থা করতে বসতে সাহস পায় না। কেবল এই মনে হয়, পুরনো সেই দিনের মধ্যে, যেখানে অনেক লাঞ্ছনা গঞ্জনা অপমান তিক্ততা চোখের জল ছিল, তার মধ্যেই যেন প্রাণের সকল প্রবাহ অতি বেগে ও উচ্ছ্বাসে বহমান ছিল। তার মধ্যে জীবনকে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করা যেত, আপন আপন শক্তিকে অনুভব করা যেত, দু হাত দিয়ে সমস্ত কিছুকেই বেষ্টন করা যেত।

আজ সে কথা মনে হয়। কেন, আজ কি তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে? আজ কি সে সবকিছুই দু হাত দিয়ে বেষ্টন করে ধরতে পারে না, জীবনকে পরিপূর্ণ রূপে অনুভব করতে পারে না? অথচ সেই দিনগুলোকে তখন কী ভয়ংকর মনে হত, গ্লানিকর, কষ্টকর, যন্ত্রণাদায়ক। তার মধ্যে যে আনন্দ সুখ লুকিয়েছিল, আজ তা আবিষ্কৃত হচ্ছে। কেন? আজই বা কী নেই?

তা জানে না সরসী। সবই আছে, অনেক বেশি আছে, সার্থকতা আছে। তবু আজ এই মুহূর্তে সেই ভয়ংকর কথাটা, অজ্ঞাত স্বরে যেন একবার বেজে উঠল, ও যদি সেই মন্টুই থাকত। বেজে ওঠা মাত্র, বারে বারে মাথা নেড়ে, অস্ফুটে উচ্চারণ করল, না না, এ পাপ-চিন্তা যেন আমি না করি। ওই মানুষটিকে, ওই যে ভ্রুকুটি-গাম্ভীর্যে, অথচ প্রসন্নতার আভাস নিয়ে নিজের বক্তব্য বোঝাতে ব্যস্ত মানুষটি, তাকে আমি আগের জীবনের সেই স্তরে কেন টেনে নিয়ে যেতে চাই? না না…।

যেন নিজের মনকে দমিত করবার জন্যেই সরসী জোর করে চোখ বুজল। আর বন্ধ চোখের আয়নায় পুরনো আর একটা দিন ফুটে উঠল। গভীর রাত্রে, তার চলচ্ছক্তিরহিত স্থাণুর মূর্তি অপলক চোখে অজস্র ঘৃণা বিদ্বেষ ও বিস্ময়ের সামনে এসে মন্টু দাঁড়িয়েছিল। বাইরের দরজা খুলে দিয়ে, সরসী রাগ করে শোবার ঘরের দিকেই ফিরে যাচ্ছিল। কারণ কোনও খবরাখবর না দিয়েই সুবীর অনেক রাত্রি করে বাড়ি ফিরেছিল। রাগ অনেকক্ষণ ধরেই জমা হয়েছিল।

কোন সময়ের কথা হবে সে সব? বিশেষ করে সেই রাত্রিটি? দিনগুলোর পূর্বাপর আর ভাল স্মরণ থাকতে চাইছে না। সম্ভবত সুবীরের আই এ পাস করার আগেই। সুবীর সেই রাত্রে ফিরতে যত দেরি করছিল, ততই এই ভেবেই দুঃখ ও রাগ হচ্ছিল, যেহেতু সরসী শিক্ষিতা, শিক্ষিকা, সেই হেতু তাকে কি যতক্ষণ খুশি একলা বাড়িতে ফেলে রাখা যায়! আর নিজে যতক্ষণ খুশি বাইরে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ইয়ার্কি আর আড্ডা মেরে ফিরবে? একলা বাড়িতে সরসী ভয় পায় কিনা, সেটাই একমাত্র প্রশ্ন ছিল না। প্রশ্ন ছিল একলা সময় কাটাবার। অবিশ্যি, রাত্রি করে বাড়ি ফেরা যে সুবীরের রীতিমতো নিয়ম ছিল তা নয়। বিয়ের আগে তা ছিল যদিচ, পরে আর সেটা নিয়মিত ছিল না। মাঝে মধ্যে হয়ে যেত, কিন্তু না জানিয়ে হলেই সরসীর রাগ হত, ভয়ও হত। আর সেই ভয়ের মধ্যে একটা শঙ্কার ছায়াও থাকত। শঙ্কার কারণ, অন্য কোনও বিপদ-আপদ নয়, সুবীরের বন্ধুবান্ধব পরিবেশ কোনও কিছুকেই সে সুচক্ষে দেখত না। কটু খেউড়, বাজি রেখে তাস খেলা, পাড়ার দলাদলি, যা শেষ পর্যন্ত হাতাহাতি মারামারিতে পৌঁছতে পারে, কিংবা আশ্চর্য নয়, হয়তো বন্ধুদের মধ্যে স্থির হয়ে গেল, অধিক রাত্রি পর্যন্ত শহরের কোনও প্রান্তে একটু বেড়িয়ে আসা যাক, যার কোনও উদ্দেশ্য নেই, যে আনন্দের মধ্যে একটা ঘরবিমুখ ছন্নছাড়া অসামাজিক মনোবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নেই, কিংবা অন্য কিছু যা স্থির করে কিছুই অনুমান করা যেত না, ওদের আড্ডা, দায়দায়িত্বহীন কর্তব্যবোধহীন মনোবৃত্তিমূলক আচার-আচরণ যে কোনও সীমা পর্যন্ত যেতে পারত।

বিয়ের আগে, সরসী কিছুটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিল, কিন্তু সম্যক উপলব্ধি করতে পারেনি, যার পুরনো জীবনটাকে সে নিতান্ত একটা বেঢপ পুরনো জামার মতো গায়ের থেকে খুলে নিয়ে ফেলে দেবে মাত্র ভেবেছিল, ব্যাপারটা মোটেই তা ছিল না। সুবীরের আজন্ম জীবনযাপনের সমস্ত আচরণ ও অভ্যাসগুলো ত্যাগ করানো নিতান্ত একটা পোশাক খুলে ফেলার মতোই নয়, এ অভিজ্ঞতা সে সঞ্চয় করেছিল প্রতিটি দিনে, প্রতিটি মুহূর্তে। যদিচ, এ কথা আজও সত্য, সরসীর প্রেম ও বিশ্বাসের মধ্যে, সুবীরের পুরনো শিক্ষা-দীক্ষা জীবনযাপনের মর্মমূলের সকল বিড়ম্বনার বিষয় চিন্তা করার মতো গভীরতা ছিল না। তার বিশ্বাসগুলো ছিল, প্রথমত সুবীরের প্রতি ভালবাসাজাত। অর্থাৎ, তার সঙ্গে সুবীরের বিয়ে হয়ে গেলেই, জীবনযাপনের ধারাগুলো বদলে যাবে। কারণ দায়িত্ব ও সম্মানবোধ বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, তার বিশ্বাসগুলো ছিল, সমাজের তথাকথিত মাথাভারী সংশোধনবাদীদের মতো। অনেকটা রিফরমেটরি জেলরদের মতো বলা যায়, কিংবা যদি এই ভাবে বলা যায়, দেহোপজীবিনীদের আশ্রয় ও পুনর্বাসন দিলেই তারা সংশোধিত হয়ে যায়, অথবা অবাধ্য বাউণ্ডুলে ভিক্ষাজীবী ছেলেদের খেতে-পরতে দিলেই তারা আত্মসম্মানবোধযুক্ত নাগরিক হয়ে ওঠে, তার বিশ্বাস ও ধারণাগুলো ছিল এমনি ধরনের চলতি ছকে বাঁধা, যে কারণে সুবীরকে বিয়ে করে, ঘর করতে গিয়ে, এক পরম বিস্ময় ও যন্ত্রণার মুখোমুখি হয়েছিল সে। তা ছাড়া, যা কিছু ভাববার এবং বোঝবার দায়িত্ব ও অধিকারগুলো, সব সে নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিল, যে কারণে সুবীরের সবকিছুই অন্যায়, তাকে ঠিক জায়গায় নিয়ে আসতে হবে, এই ধরনের সিদ্ধান্ত করতে পেরেছিল সে। এবং ওর প্রেমের মধ্যেও সেই ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন জড়িয়ে ছিল, যে জন্যে, ভালবাসা যখন বুকের মধ্যে কেঁদে মরেছে, তখনও ন্যায়-অন্যায়ের পাল্লার সামনে, নীরস কঠিন মুখে সে দাঁড়িয়ে থেকেছে। ভুলেই গিয়েছিল, সেখানে একটা চরম বিপদের সম্ভাবনা থেকে যেতে পারত। সেই বিপদ, সুবীরের অন্যায়বোধের স্বীকৃতিটা শেষ পর্যন্ত, ভিতর থেকে না হয়ে, বাইরের মৌখিকতাতেই পর্যবসিত হত। এই সত্য আজও যে উপলব্ধি করতে পারে, তা নয়। তার পরম সৌভাগ্য, এই উপলব্ধি আজ আর তার জীবনের সমস্যা নয়।

সরসীর নিজের অন্তরে জটিলতা ছিল; যে জটিলতার অর্থ, সে ব্যতিক্রমকে জীবনে গ্রহণ করেছিল। তার মতো মেয়ের পক্ষে, তার রূপ শিক্ষা পারিবারিক পরিচয় যে মেয়ের আছে, সাধারণ নিয়মে সে মেয়ের পক্ষে এই প্রত্যাশাই স্বাভাবিক ছিল যে, তার বিয়ে হবে কোনও অধ্যাপক বা শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির সঙ্গে। কিন্তু যে মুহূর্তে সে সুবীরকে স্বামী বলে চিন্তা করতে পেরেছে, সে মুহূর্তেই বুঝে নিতে হবে, তার চরিত্রের মধ্যে জটিলতা আছে। জীবন সম্পর্কে চিন্তিত যে কোনও মানুষেরই, আজকের এই। জগতে, মানবিকবোধসম্পন্ন যে কোনও মানুষেরই জটিলতা স্বাভাবিক। যাদের তা নেই, এক হয় তারা গড্ডালিকা প্রবাহে অজস্রের সারিতে নিতান্ত ঢালু পথের শেষ সীমার দিকে চলমান, অন্যথায় তার সহজ স্বপ্নটা মূঢ় নিদ্রায় আবদ্ধ। অনেকটা বোধহয় বাউল গানের মতোই বলতে হয় সহজেরে চিনলিনে মন, (রইলি) অসহজের হাওড়ে।সহজ থেকে সহজে যাওয়া যায় না, অসহজের তীব্র দ্বন্দ্ব ও বেদনা থেকেই সহজে যাওয়া যায়। অন্যথায় সহজ শব্দটা মূঢ়ের মুখের বুলি হয়ে ওঠে। সহজকে আয়ত্ত করতে হয়, উপার্জন করতে হয়। এই অর্থেই অন্তরের জটিলতার কথা ওঠে।

সরসীর নিজের অন্তরে জটিলতা থাকলেও, অপরের জটিলতাকে সে স্বীকার করে নিতে পারেনি। পারেনি নয়, সে অনবহিত ছিল। আপাতদৃষ্টিতে মিথ্যা সুখসন্ধানী, অগভীর মনোভাবাপন্ন, অন্ধকার রোয়াকের প্রাণীদের সে, আপন-দায়িত্ব-অস্বীকার করা, তথাকথিত নীতিবাগীশদের মতোই, নিতান্ত রকবাজ বলেই জেনেছে। আত্মমর্যাদাহীন পারিবারিক পরিবেশ, স্নেহহীনতা, দারিদ্র্য ও চারপাশের অন্যায়ের বেড়াজালে, পরাজয় ও হতাশায় ব্যথিত ও বিক্ষুব্ধ প্রাণকে সে আবিষ্কার করতে পারেনি। যে কারণে, নিতান্ত একটা পোশাক বদলাবার মতোই, সুবীরের পরিবর্তনের আশা করেছিল সে। তা ছাড়া, তার সমস্ত চিন্তাটা ছিল একান্ত ব্যক্তিগত, তার প্রেমিক, তার স্বামীকে কেন্দ্র করে। অপর দিকের সবটুকুই সে খুব সহজে আয়ত্তে আনার কথা চিন্তা করছিল। তার সমস্ত দাবিকে সে খুব সরাসরি পেশ করেছিল, এবং অবলীলাক্রমে আদায়ের কল্পনা করেছিল।

হয়তো সেটাও খুব অসম্ভব ব্যাপার ছিল না, যদি মনে মনে প্রেমের প্রতি কোনও শর্ত আরোপ না করে, সুবীরের অনুভূতির দরজায় সে আপন গ্লানি যন্ত্রণা ও কষ্টকে বিদ্ধ করতে পারত। কিন্তু প্রেম যেখানে শর্তসাপেক্ষ, সেখানে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ তার অবচেতনে যে মেয়েটি ছিল, সে মেয়েটির সমগ্র অনুভূতি, সেই বেপরোয়া শিশুর মতো আকাঙ্ক্ষাপরায়ণ ব্যাকুল বর্বর পুরুষটি আচ্ছন্ন করেছিল।

.

সেই রাত্রে, সেই মধ্যরাত্রে, রাগ করে দরজা খুলে দিয়ে, শোবার ঘরে দ্রুত চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সরসী। নিজের সেই রূপ সে তাকিয়ে দেখেনি। রুক্ষ চুলের গোছা তার গালের পাশ দিয়ে এলিয়ে পড়েছিল। তার সংশয়মথিত, অনিশ্চিত অপেক্ষাজনিত রাগের ওপরে ঘৃতাহুতি পড়েছিল। আরক্ত ক্রুর চোখে সে দেখেছিল, সুবীর মদ খেয়ে এসেছে।

বিয়ের আগে সরসী শুনেছিল, সুবীরের কোনও গুণে ঘাট নেই। অন্ধকারের সকল অলিগলিতে নাকি তার আনাগোনা। এখনও দাদার কথা তার মনে আছে, সুবীরকে তিনি নেশাখোর রকবাজ মন্টু বলতেন। এবং সে কথাও এখনও মনে আছে, সরসী সুবীরকে জিজ্ঞেস করেছিল, সবাই বলে, তুমি নাকি মদ খাও, মাতাল?

সুবীর প্রথমটা এক মুহূর্ত দ্বিধা করেছিল জবাব দিতে। তারপর হঠাৎ রেগে উঠেছিল, কে বলেছে আমি মাতাল?

কে বলেছে, সেটা বড় কথা নয়। তুমি মদ খাও কি না আমি জানতে চাই।

তবু সুবীর ঘুরিয়ে জবাব দিয়েছিল, পাড়ার কোন লোক বলতে পারবে, আমাকে কেউ কোনওদিন ড্রিঙ্ক করতে দেখেছে?

সরসী ওর চোখ থেকে চোখ নামায়নি। বলেছিল, কেউ না দেখলে বুঝি ড্রিঙ্ক করা যায় না? সুবীর আবার সুযোগ নিয়েছিল, আজ এক বছর হতে চলল, তুমি দেখছ, তুমি তা হলে টের পেতে?

না। কী করে পাব? তুমি কি সব সময় আমার কাছে থাক? তোমার এই পাড়ার বন্ধুদের একটাকেও আমি বিশ্বাস করি না। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে তুমি কখন কী করছ, আমি জানব কী করে?

সুবীর চুপ করে ছিল। সরসী বলেছিল, তুমি বলতে চাও, তোমার ওই সব বন্ধু, যাকে তোমরা জয়ন্ত থেকে জনি বলে ডাক, বা মৃগাঙ্ককে ম্যাক বললো, তারা কেউ মদ খায় না?

সুবীর এক কথাতেই স্বীকার করেছিল, হ্যাঁ, ওরা মাঝে-মধ্যে খায়।

আর তুমি খাও না?

সুবীর তখন আর গোপন করেনি। বলেছিল, খেয়েছি কয়েক দিন। কিন্তু তুমি যে ভাবে বলছ, আমি যেন প্রায়ই ড্রিঙ্ক করি, তা মোটেই নয়। সেই তো কমাস হয়ে গেল, বিজয়া দশমীর দিন, সবাই মিলে ঠিক হয়েছিল, তাই ড্রিঙ্ক করেছিলাম।

তোমার বন্ধুরাও কি তাই?

তখন সুবীরের চেহারা গলার স্বর বদলে গিয়েছিল। বলেছিল, কে, জয়ন্ত-মৃগাঙ্করা? ওরা প্রত্যেক সপ্তাহে একদিন খায়।

 তুমি খাও না?

কী করে খাব? ওদের যত পয়সা আছে, আমার কি তা আছে? তোমাকে তো বলেছি, একশো পঁচিশ টাকা মাইনের মধ্যে আমাকে একশো টাকাই বাড়িতে দিয়ে দিতে হয়। আর ওরা তো বাড়িতে টাকাই দেয় না।

তবে ওদের বাড়িতে থাকতে দেয় কেন? কিছু বলে না?

কী বলবে? ওদের চলে যায়।

 তবে তোমারও চলে গেলেই হয়। তুমিই বা বাড়িতে টাকা দাও কেন?

সুবীর তখন বিমুগ্ধ বিস্ময়ে সরসীর দিকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, কী বলছ তুমি? টাকা না দিলে বাড়িতে আমার একবেলা আশ্রয় জুটবে না। তা ছাড়া, আমি ওদের মতো পারি না। থাকা-খাওয়ার খোঁটা আমি সহ্য করতে পারি না। তিন বছর আগে, যদি নিজে না রোজগার করতে পারি, তবে বাবা বেরিয়ে যেতে বলেছিল। সেই থেকে রোজগার না করে, বাড়ির অন্ন মুখে তুলিনি।

কথাগুলো যে মিথ্যে নয় সরসী তা জানত। কয়েক মুহূর্ত সুবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। মনে মনে ঠিক ব্যাখ্যা করতে না পারলেও সুবীরের জন্যে তার মনটা টনটনিয়ে উঠেছিল। এবং সুবীরের সেই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিল। যাদের সঙ্গেই মিশুক, কোথায় যেন প্রাণের একটা শক্তি ও আত্মসম্মানবোধ ওর ভিতরে থেকে গিয়েছিল। সম্ভবত বিদুষী সরসীর মনে, সুবীরের প্রতি সেই সব কারণেই একটা বিশ্বাস ও আশা বাসা বেঁধেছিল। ওর মধ্যে একটা অপরিসীম সারল্যও ছিল, প্রাণ-চঞ্চলতা, ওর ভিতরে ও বাইরে।

সরসী বলেছিল, তোমার বন্ধুদের সঙ্গে তো তোমার এ ব্যপারে মিল নেই দেখছি।

সুবীর বলেছিল, তা যদি বলল, সে তো অনেক ব্যাপারেই মিল নেই। জান, ওদের বাপ-দাদারা পর্যন্ত ওদের ভয় করে, কিছু বলতে পারে না।

কথাটা শুনে, সরসীর গ্লানি ও বিস্ময় বোধ হয়েছিল। বলেছিল, ওরাই তোমার বন্ধু।

মাথাটা নুয়ে পড়েছিল সুবীরের। পরমুহূর্তেই বলেছিল, কী করি বলো, ছেলেবেলা থেকে আমি ওদের সঙ্গেই মিশে আসছি। ওরা আমাকে ভালবাসে, আমি ওদের ভালবাসি।

সত্যি কথা সহজ করেই বলেছিল, এবং সরসী দেখেছিল, তার পরবর্তী প্রশ্নটা আন্দাজ করেই সুবীর আবার বলে উঠেছিল, আর তুমি যাদের ভাল ছেলে বলবে, তাদের আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। বাইরে কোঁচার পত্তন, ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন। ওই যে ব্ৰজেন হালদার এঞ্জিনিয়ার হয়েছে, পাড়ায় খুব নাম-ডাক, ওর কেচ্ছা যদি শোন। সে কোম্পানিতে চাকরি করে সেখানকার সত্তর হাজার টাকার পার্টস মেরে দিয়েছে। পাড়ার লোকেরা বলে বাহাদুর ছেলে, এখন গাড়ি হাঁকায়, আমাদের সঙ্গে কথা বলে না। আর ওই যে বোধ, এদিকে তো এম এ পাস, একটা গরিবের মেয়ের বারোটা বাজিয়ে, তারপরে শাঁসালো ঘরে…।

সরসীর শুনতে খারাপ লেগেছিল ওসব কথা। বলেছিল, ওদের সকলের কথাই থাক, তোমার কথা বলল শুধু। আমি শুধু তোমার কথা জানতে চাই, তোমার কথা শুনতে চাই। আমি তোমাকে ওরকম ভাল ছেলেও হতে বলছি না, তোমার বন্ধুদের মতোও না, যাদের বাবা-দাদারাও ভয় করে চলে।

সুবীর যেন অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য ভাবেই উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, তুমি খালি ওদের ভয় করে চলাটাই দেখলে। জান, ম্যাক-এর গালে একটা পোড়া দাগ দেখতে পাবে। সেটা ওর দাদা লোহা পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে দিয়েছিল।

সে কী, কেন?

ও চাকরি পায়নি বলে, ওকে খেতে দিতে হত বলে। জয়ন্তকে ওর বাবা মারতে মারতে একতলার ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছিল। লেখাপড়া শিখতে পারেনি বলে, চাকরি পায়নি বলে, সব দোষ কি ওর? চাকরি কি হাতের মোয়া, ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায়? একদিনের কথা নয় এ সব। গায়ে হাত তোলা ছাড়া ওদের বাবা-দাদারা কথা বলতে জানত না। তখন ওদের হাতে-পায়ে শক্তি ছিল না, ওরা ভয় করে চলত। এখন ওদের ভয় করে চলে। কারণ জানে, এখন কিছু করতে গেলে ওরাও ছেড়ে কথা কইবে না।

সরসী বলেছিল, কিন্তু এখন তো আর গোলমাল হবার কিছু নেই। এখন তো ওরা চাকরি-বাকরি করে।

ওদের বাড়ির লোকেরা চায়, এখনও ওদের মারধর করবে।

 তার কারণ তো ওদের ব্যবহার। ওরা ভাল হয়নি কেন? এখন ওরা ভাল হয়ে চললেই পারে।

সুবীর সহসা জবাব দিতে পারেনি। অথচ তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে চাইছিল, যে কথাটা ওর মনে আসছিল, মুখে আসছিল না। কেবলি মাথা নাড়ছিল, তারপর বলে উঠেছিল, হ্যাঁ, ওরা সত্যি খারাপ হয়ে গেছে। ওদের কেউ ভাল করতে চায়নি, ওরা আর ভাল হতে চায় না।

সরসী বুঝতে পেরেছিল, ওরা বলতে সুবীর নিজেকেও বুঝিয়েছিল। সে নিজের কথাও বলতে চেয়েছিল, সরসীর মুখের সামনে বলতে ওরা দ্বিধা হয়েছিল, তাই কেবল ওদের দিয়েই বলেছিল।

সরসী বলেছিল, কিন্তু, বাপ-মা ভাল করতে চায় না, ওর ভাল হতে চায় না, এ কি কখনও হতে পারে? এ তো গায়ের জোরের কথা।

সুবীর বারে বারে মাথা নেড়েছিল, কিন্তু কী বলতে চায়, সেটা ঠিক করতে পারছিল না। বলেছিল, আমি তোমাকে বোঝাতে পারছি না সরসী। তুমি কি মনে কর, জয়ন্তর বাবা ভাল লোক? জয়ন্ত ওর বাবাকে কোনওদিনই মানত না। মৃগাঙ্কর দাদাদের তো কথাই নেই। বয়সে বড় বলেই কেবল ওরা ছোট ভাইদের শাসন করে। কিন্তু তারাই কি ভাল? ম্যাক-এর থেকে ওর দাদারা কোনও কিছুতে ভাল নয়। তফাত, তারা বিয়ে করেছে, ছেলেমেয়ের বাবা হয়েছে, আর রকে বসে আড্ডা দেয় না। তাতেই কি সবাই ভাল হয়ে যায়?

সরসী গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, তুমি কি বলতে চাও সংসারে সবাই খারাপ?

না, আমি তা বলতে চাই না। কিন্তু যাদের ভাল বলা হয়, তারা যে সবাই ভাল নয়, তা আমি জানি। তবে সে সব কথা আমি বলতে চাই না। আমি যে তোমাকে ঠিক বোঝাতেই পারছি না। দাঁড়াও বলছি, আমি কী বলছি জান, আমরা কেউই খুব মজায় নেই। বাইরের থেকে দেখলে আমাদের যে রকম মনে হয়, তা নয়। সবাইকে যদি তুমি আলাদা আলাদা করে দেখ, দেখবে কারুর সুখ নেই। আমরা আড্ডা মারি, ইয়ার্কি করি, সবই করি, কিন্তু সত্যি বলছি, কারুর কিছুই ভাল লাগে না। একটা কিছু করতে হবে তো।

সরসী বুঝতে পারছিল, কিছু একটা বোঝাতে চাইছে সুবীর। কিন্তু সে খুশি হতে পারছিল না। ওদের খারাপ হয়ে যাবার পিছনে কোনও যুক্তি বা ওদের ভালত্ব অবশিষ্ট থাকার পিছনে কোনও সমর্থন, কোনওটাই মেনে নিতে পারছিল না সে। অথচ সেটাই সে মেনে নিয়েছিল সুবীরের বেলায়। সেটা মেনে নেবার পিছনে, তার নারীমনের বৈচিত্র্য ও হৃদয়ের ক্রিয়াশীলতা কাজ করেছিল। সুবীর তার মনের কোথাও সাড়া জাগাতে পেরেছিল, তার হৃদয় আবর্তিত হয়েছিল। আর মন এমনই বস্তু, সর্বদাই তার সকল কার্যকারণের যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। যে কারণে হয়তো প্রবাদের উৎপত্তি, মন গুণে ধন, দেয় কোন জন। এ সেই অনেকটা, মানুষের একদিকে পুঞ্জীভূত অন্ধকার, আর এক দিকে অসীম আবিষ্কারের মতো। আধুনিক পৃথিবীতে, মানুষ ভূমণ্ডলের গভীর তলদেশের অন্ধকার থেকে, সৌরমণ্ডলের ভিন্ন গ্রহ-গ্রহান্তরে যাত্রা করেছে, কিন্তু আপনাকে আবিষ্কারের দায় সে কখনওই শেষ করতে পারেনি। আধুনিক মানুষের বুকেই জমা রয়েছে পুঞ্জীভূত অন্ধকার।

সম্ভবত সরসী, সুবীরকে তার বন্ধুদের মধ্য থেকে আলাদা করে চিনতে পেরেছিল। সম্ভবত, তার মন বলেছিল, সুবীরের কথায় যারা খারাপ হয়ে গেছে তাদের মধ্য থেকে সুবীরের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সুবীরের বন্ধুদের প্রতি সমর্থন ও যুক্তি আদায়ের চেষ্টা দেখে সরসী ভয় পেয়েছিল। তাই তার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। গম্ভীর মুখে আস্তে আস্তে অভিমানের ছায়া ফুটে উঠেছিল, চোখে দেখা দিয়েছিল আসন্ন বর্ষণের মেঘ।

আসলে, সুবীর কী বলতে চেয়েছিল, তা সম্যক বোঝবার মতো মনের অবস্থা সরসীর ছিল না। সুবীরেরও আপন বক্তব্য বোঝাবার সঠিক বোধ ও ভাষা আয়ত্তে ছিল না। সে বোঝাতে পারেনি, তার বন্ধুরা একটা সমাজব্যবস্থার শিকার। আপাতদৃষ্টিতে বাইরে থেকে তাদের যে চেহারাটা দেখা যায়, সেটাই সব নয়। তাদের ভিতরে যে ব্যথিত বিক্ষুব্ধ মানুষটি রয়েছে, যাদের অন্তরে সৌন্দর্য ও শুভ সমস্ত কিছুর প্রতিই গভীর আকাঙ্ক্ষা লুকিয়ে রয়েছে, এ কথাই সে ব্যক্ত করতে চেয়েছিল। সে নিজেকে ও বন্ধুদের চিনত বলেই, সে কথা বলবার অধিকার তার ছিল। সে বলতে চেয়েছিল, তার বন্ধুদের পিছনে ও সামনে সবটাই অন্ধকার ছিল, আর সেই অন্ধকারের দায়িত্ব যারা শুধু ওদের ঘাড়ের ওপর চাপিয়েই বেশ নিশ্চিন্ত ছিল, এবং সমালোচনা ও বাণী বিতরণ করছিল, তাদের ভাল বলবার কোনও কারণ নেই। কোনও পাপ থেকেই তারাও মুক্ত নয়।

সরসী তাই, মুখ ফিরিয়ে নিচু গম্ভীর স্বরে কথার সূত্র ধরে বলেছিল, একটা কিছু করতে হবে, তাই মদ খেতে হবে, পাড়ার বেলেল্লা করতে হবে, ইতরামি করতে হবে, যা খুশি বেআদবি চালিয়ে যেতে হবে, আর লোকের কাছে টেরর হয়ে উঠতে হবে, না?

সুবীর তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল, না না, তা নয়, কথাটা

কথাটা সে বলতে পারেনি। কথাটা সম্যক ওর জানাও ছিল না, এবং ততক্ষণে ওর চোখ পড়েছিল সরসীর মুখের ওপর। দেখেই ও চুপ করে গিয়েছিল। সরসীর হাত ধরে বলেছিল, তুমি রাগ করছ সরসী?

সরসী কোনও জবাব দেয়নি। চুপ করেই বসে ছিল। সুবীর হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নিতে চেয়েছিল। আবার বলেছিল, সরসী, রাগ কোরো না, মাইরি বলছি।

সুবীর থেমে গিয়েছিল। সরসী কথায় কথায় মাইরি ইত্যাদি বলা পছন্দ করত না। কিন্তু তখন সেকথায় কিছু মনে করেনি। সে বলেছিল, আমি রাগ করিনি, ভয় পাই। তুমি এখনও জয়ন্ত-মৃগাঙ্কদের সাপোর্ট করতে চাও।

না না, সাপোর্ট কোথায় করতে চাইলুম। তুমি

সরসী বলে উঠেছিল, তুমি তো জান, তোমার জন্যে আমি সকলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। তার জন্যে কোনও অপমান-লাঞ্ছনাকেই আমি গ্রাহ্য করছি না।

বলতে বলতে সরসীর চোখে জল এসে পড়েছিল। সুবীরের কছে তখন সরসী পরম ধন, জীবনের সেই পরম লগ্নে সে তার আজীবন হতাশার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার একটা নির্দেশ নিশ্চয়ই খুঁজে পেয়েছিল। তা ছাড়া যৌবন তার আপন ধর্মে, অধর ধরার ব্যাকুলতায় উদ্বেল। সে দু হাত দিয়ে সরসীকে বেষ্টন করে বলেছিল, এ সব কথা কেন বলছ? তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।

সরসী বলেছিল, আমি ভুল বুঝছি, কিন্তু তুমি যাদের হয়ে কথা বলছ, তুমি নিজেই জান, আজ তারা তোমার আমার দুজনের নামেই কী বলছে। তারা তোমারই বন্ধু ছিল, এখনও নিশ্চয়ই আছে, অথচ তুমিই বলেছ, আমার নামে কত নোংরা কথা তারা বলে।

তখন সুবীর বুঝিয়ে বলতে পারেনি, ওর বন্ধুরাও অমনি একজন সরসীকে মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করত, ভালবাসতে চেয়েছিল। ওর বন্ধুরাও নিঃসঙ্গ একাকী একঘেয়ে হতাশ জীবন থেকে পরিত্রাণ চেয়েছিল। জীবনের আর একটা দিকে ওরাও যেতে চেয়েছিল, যেদিকের দরজা প্রায় অপ্রত্যাশিত রূপেই সুবীরের সামনে খুলে গিয়েছিল। ওরাও জীবনে প্রত্যাশা করত প্রেম ও সহানুভূতি। ওরা যা পায়নি, ওদেরই একজন বন্ধু তা পেয়েছিল, এবং এই সমাজের স্বাভাবিক নিয়মে, ওরা একজন বন্ধুকে সেই কারণে হারিয়েছিল। সেই মুহূর্তে ওদের প্রাণে নতুন কোনও আশার সঞ্চার হয়নি, যেটা গল্পে-উপন্যাসেই সম্ভব। বরং হতাশা ও ব্যথাটা অতি তীব্র হয়েই বেজেছিল। এবং হতাশা ও ব্যথা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ঈর্ষা ও বিদ্বেষ। সে সময়ে স্বাভাবিক নিয়মেই সুবীরকে সরে আসতে হয়েছিল বন্ধুদের কাছ থেকে। যদিচ, সেটাকে জীবনে প্রতিষ্ঠার নির্দেশ মনে করবার কোনও কারণ নেই। তার চেয়ে বেশি, সুবীর তখন যৌবন দরিয়ায় উত্তাল তরঙ্গের মাতাল মাঝি, যেন সসাগরা ধরণী তার বাহুর সীমায়, তৃষ্ণার অসীম বারিধি ওষ্ঠপুটে বন্দি। কূল ছেড়ে সে অকুলের নির্দেশে ভেসেছে। যে মাঝি পুরনো কূলে ফেরে না, নতুন কূলে তার যাত্রা। যদিচ, বস্তুত পুরনো কূলের জীবন ও হাতছানি সহসা ছেড়ে যায় না।

সুবীর বলেছিল, তুমি তো জান, ওরা আমাকে হিংসে করে।

 সরসী বলেছিল, তবু তারাই এখনও তোমার বন্ধু। তাদের সঙ্গে তুমি ড্রিঙ্ক করতে যাও।

সুবীর বলে উঠেছিল, কে বলেছে তোমাকে আমি ওদের সঙ্গে ডিস্ক করতে যাই? কবে কী করেছি, সে কথা তো তোমাকে বললুম। তা ছাড়া পাড়ায় থাকে, কথা বললে, একেবারে কথা না বলে পারা যায়?

কিন্তু আমার মুখরক্ষা করতে হলে, তোমার নিজের মুখরক্ষা করতে হলে, পারতে হবে।

সুবীর বলেছিল, পারব তো বটেই। তুমি তো জান, আমার কী আছে ওদের সঙ্গে।

সরসী আবার বলেছিল, কিন্তু তুমি যে মদ খাও, এ কথা আমি জানতাম না।

সুবীর খানিকটা অস্বস্তি-বিব্রত ভাবে বলেছিল, খাই, একথা বলছ কেন? কয়েকবার খেয়েছি। আমার পয়সা কোথায় আছে যে খাব?

সরসী বলেছিল, বড়লোকদের থেকে গরিবেরাই বেশি মদ খায়। পয়সার জন্যে লোকে নেশা করে না, নেশা করার জন্যেই নেশা করে।

সেদিনও সুবীর বুঝিয়ে বলতে পারেনি, জীবনধারণের হতাশার মধ্যে দিয়েই, আত্মহননের সুখে ও এবং ওর বন্ধুরা লুকিয়ে মদ খেয়েছিল।

সরসী আবার বলেছিল, তোমাকে তো বলেছি, তুমি যে কোনও একটাকে বেছে নাও। হয় তোমার পুরনো জীবনটাকে, নয় আমাকে। দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না।

তখন সরসীর কথার মধ্যে যে অনুরাগ ও ব্যথা উঠেছিল, তাতে বুকে তুফান লেগেছিল সুবীরের। সুবীর বারে বারে আবেগ ভরে বলেছিল, তোমাকে চাই, তোমাকে, তোমাকে, তুমি কি তা জান না?

জানতে দিচ্ছ কোথায়? আমি যে ভয় পাই। মদকে আমি ঘৃণা করার চেয়ে ভয় পাই বেশি।

কিন্তু তুমি যে রকম মদ্যপ বা মাতাল ভাবছ, আমি তো তা নই সরসী। আমি কেবল তোমার হতে চাই, তোমার।

বলতে বলতে সে তার ওষ্ঠপুটের আগুনে সরসীর সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পুড়িয়ে দিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *