মধুর এক প্রেমকাহিনি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
ইংরেজের কলকাতা তখন বেশ সরগরম। মনে হচ্ছে বাংলার একটা নতুন ইতিহাস তৈরি হতে চলেছে। অতীতের যাবতীয় শাসক ও শাসন ঘটিত অশান্তির অবসান ঘটেছে। বর্গিদের হাঙ্গামা বাগে এসেছে। ফাঁসুড়ে ও ঠেঙাড়েরা ইংরেজ দাপটে জব্দ। তিনটি বিভাজন–সুতানুটি, কলকাতা ও গোবিন্দপুর আর নেই। এখন শুধুই কলকাতা ইংরেজের রাজধানী। কলকাতার যুবকরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন। তাঁদের মানসিকতায় দ্রুত পরিবর্তন আসছে। প্রাচীনপন্থীদের দ্বারা অনুসৃত হিন্দুধর্ম তাঁদের সহ্য হচ্ছে না। শুধু শিক্ষা নয়, ধর্ম নিয়েও একটা দাপাদাপি শুরু হয়েছে। আদি ভট্টপল্লির কট্টর ব্রাহ্মণরা বলতে শুরু করেছেন–ফিরিঙ্গিদের সংস্পর্শে এসে উচ্ছন্নে যাওয়া কটা ছোঁড়া আমাদের ধর্মের পিণ্ডি চটকে দেবে দেখছি। পাদরিও এসে গেছেন। গির্জায় চলছে যিশুর ভজনা। আর চেষ্টা চলছে হিন্দুদের কীভাবে খ্রিস্টান করা যায়।
বাঙালির প্রথম সারির কয়েকজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গুণী মানুষ জাতির জাগরণে অগ্রণী হয়েছেন। রাজনৈতিক স্বাধীনতা হারালেও মনে প্রাণে দাস হতে বাঙালি যে রাজি নয় তা তাঁরা প্রতিপন্ন করবেন। বাহুবলে শাসন দখল করলেও আমাদের মনোবলের কাছে তোমরা পরাজিত হবে। তোমরা সভ্য হওয়ার বহু আগেই হিন্দুরা সর্ব অর্থে সুসভ্য হয়েছে। আমাদের ধর্ম, আমাদের সংস্কৃত ভাষা, আমাদের দর্শন তোমাদের এমন কিছু দিতে পারে যা তোমাদের কোনও কালে ছিল না। সভ্যতার সংজ্ঞা আমাদের কাছেই জানতে হবে। সুপ্রাচীন কাল থেকে আমাদের ওপর দিয়ে বিদেশি আক্রমণের যে ঝড় বয়ে গেছে তার ফলে আমরা কোণঠাসা। আত্মরক্ষার জন্য এমন কিছু সংস্কার তৈরি করতে হয়েছে যা হয়তো কুসংস্কার। নারী স্বাধীনতা আমরা হরণ করতে চাইনি, বিদেশি লালসার হাত থেকে সুরক্ষার জন্য তাঁদের অন্তঃপুরে থাকার নিরাপদ ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
জাগরণের কালের যুবকদের এইটিই হল প্রধান আক্রমণের স্থল। এর জন্য অপরিণত বুদ্ধিই হয়তো দায়ী। এই শতাব্দীতে, এই কলকাতা এমন একজন তরুণ শিক্ষককে পেয়েছিলেন। যাঁর সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ তাঁকে ভালো চোখে
দেখলেও তিনি এই ইতিহাসের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও জাতিতে ফিরিঙ্গি। তাঁর শরীরে বিদেশি রক্ত। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে তাঁর মতো স্বদেশপ্রেমিক ভারতীয় আর কে ছিলেন! একমাত্র ডিরোজিও বলতে পারেন,
স্বদেশ আমার, কিবা জ্যোতির মণ্ডলী
ভূষিত ললাট তব; অস্ত গেছে
চলি
সেদিন তোমার হায়, সেই দিন-যবে
দেবতা সমান পূজ্য ছিলে এই ভবে।
কোথায় সে ব্যপদ! মহিমা কোথায়!
গগনবিহারী পক্ষী ভূমিতে লুটায়।
এই ডিরোজিওকে ঘিরে গড়ে উঠল শক্তিশালী এক যুবাগোষ্ঠী–ইয়ং বেঙ্গল। এই দলে যাঁরা ছিলেন পরবর্তীকালে তাঁদের সকলের নামের আগেই একটি করে বিশেষণ যুক্ত হয়েছে। যেমন, সত্যের উপাসক জ্ঞানবীর আচার্য কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ভারতের ডিমস্থিনিস রামগোপাল ঘোষ। বঙ্গদেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রবর্তনের পুরোহিত, অদ্বিতীয় রাজনীতিক রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী রাজা দিগম্বর মিত্র, অকৃত্রিম সাহিত্যসেবক অদ্ভুতকর্মা প্যারীচাঁদ মিত্র, পরহিব্রত সাধু শিবচন্দ্র দেব, মনীষী রসিক কৃষ্ণ মল্লিক, নিষ্কলঙ্ক চরিত্র রামতনু লাহিড়ী। উনবিংশ শতাব্দীতে পরপর এতগুলি আলোকস্তম্ভ। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একই সঙ্গে আলোকপাত। তাঁদের মধ্যে থেকে আমাদের সামনে একজন এসে দাঁড়াবেন, তিনি ইতিহাসের নায়ক রাজা দক্ষিণারঞ্জন।
এইবার যেতে হবে দূর অতীতে। দুটি পরিবার একটি পরিবার ভট্টপল্লির মুখোপাধ্যায় বংশ, আর একটি কলকাতার গোপীমোহন ঠাকুরের বংশ। দুটি পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক আদানপ্রদান হতে পারে না, কিন্তু হয়েছিল অতি নাটকীয় পরিস্থিতিতে। অনেকটা সেকালের উপন্যাসের মতো। পাত্রকে ধরে এনে প্রায় বন্দি করে কন্যা সম্প্রদান। মুখোপাধ্যায় বংশের পাত্র সম্রান্ত কুলীন আর ঠাকুর বংশ হল পিরালি। অর্থাৎ কোনও সময়ে, কোনও কারণে সামাজিকভাবে তাঁরা তাঁদের জাতি খুইয়েছিলেন। কোনও অপরাধ, সে অপরাধ স্লেচ্ছসংসর্গও হতে পারে। বল্লাল সেন যে কুল তালিকা ও মেল তৈরি করেছিলেন সেখানে পরবর্তীকালে দুটি বিভাজন ঘটেছিল। একটি হল, বিশুদ্ধ কুলীন, অন্যটি হল ভঙ্গ কুলীন। দ্বিতীয় বিভাজনটি একটু অদ্ভুত। এটি নেতিবাচক। কুল হারালেও কুলীন। সেই সময় বিশুদ্ধ কুল বজায় রাখা সম্ভব হত না। কারণ সমাজ জীবন তখন প্রসারিত হচ্ছে। বিদেশি সংমিশ্রণ ঘটছে, বিদেশি সংস্কৃতি ঢুকছে।
কলকাতায় স্বতন্ত্র একটি ইতিহাস তৈরি করে গেছেন ঠাকুর পরিবার। একদিকে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর বংশ আর একদিকে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার। এই পরিবারকে জগৎ বিখ্যাত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শুরুতে দুই ঠাকুর পরিবারই অর্থবিত্তে সমান ছিলেন। ঠাকুররা কলকাতায় এসেছিলেন যশোহর থেকে। তাঁদের আদি পুরুষ ভট্টনারায়ণ। আদিশূর কান্যকুজ থেকে যেসব ব্রাহ্মণদের এনেছিলেন তাঁদের মধ্যে ভট্টনারায়ণের পূর্বপুরুষরাও ছিলেন। ধাপে ধাপে নেমে এসেছেন। এই অবরোহণে এসে দাঁড়ালেন পঞ্চানন। তিনিই প্রথম ঠাকুর পদবি গ্রহণ করে কলকাতায় গোবিন্দপুরে এলেন। তাঁরই পুত্র জয়রাম। ইংরেজরা গোবিন্দপুর ফোর্ট তৈরি করবেন। জয়রামকে ইংরেজরা জায়গা দিলেন পাথুরিয়াঘাটাতে। ঠাকুর পরিবার তখনও দুই শাখাতে বিভক্ত হয়নি। জয়রামের চার পুত্র আনন্দীরাম, নীলমণি, দর্পনারায়ণ আর গোবিন্দরাম। একসময় নীলমণি পৃথক হয়ে সরে গেলেন জোড়াসাঁকোতে। অতিবিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সূত্রপাত এইখানেই। অধস্তন চতুর্থ পুরুষে এলেন রবীন্দ্রনাথ। দর্পনারায়ণ সেকালের এক অতি সমৃদ্ধশালী ব্যক্তি–চন্দননগরের ফরাসি সরকারের প্রতাপশালী দেওয়ান। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র গোপীমোহন।
গোপীমোহন ঠাকুরের বিশাল বংশ। তাঁর ছয় পুত্র-সূর্যকুমার, চন্দ্রকুমার, নন্দকুমার, কালীকুমার, হরকুমার ও সুবিখ্যাত প্রসন্নকুমার ঠাকুর (সি.এস.আই)। দক্ষিণারঞ্জনের জন্য আমরা গোপীমোহন ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র সূর্যকুমারেই থাকব। তাঁর দুই কন্যা। ত্রিপুরাসুন্দরী ও শ্যামাসুন্দরী। গোপীমোহন ঠাকুরের ছয়পুত্রের কথা বলা হলেও তাঁর একটি কন্যা ছিল। নাম রেখেছিলেন ব্রহ্মময়ী। এখন গোপীমোহন সম্পর্কে আরও বলার আছে। তিনি শুধু ধনী ছিলেন না। অতি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। শুধু ধনী নন তাঁকে বলা হত ধনকুবের, আবার দানবীর। তিনি ছিলেন শক্তিসাধক। সেইখানেই এলেন এক কন্যা, নাম রাখলেন ব্রহ্মময়ী–মা এসেছেন, সেই চোখেই তিনি কন্যাকে দেখতেন। স্বভাবতই পিতার সমস্ত স্নেহ কন্যার ওপর আরোপিত হল। যখন পূজায় বসতেন তখন ধ্যানদৃষ্টিতে আজ্ঞাচক্রে যে মুখটি ফুটে উঠত, সেই মুখটি কন্যা ব্রহ্মময়ীর। তিনি বলতেন আমি বিশ্বজননীকে বলেছিলুম, তুমি কন্যারূপে আমার কাছে এসো। ব্রহ্মময়ীকেই তিনি অলংকারে ভূষিত করে মা কালীকেই প্রত্যক্ষ করতেন। প্রাসাদের সর্বত্র নূপুর পায়ে ঝমঝম করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গৃহে আনন্দের হিল্লোল তুলছেন। সকলেই তাঁকে চোখে চোখে রাখতেন। সকলেই জানতেন তিনি জ্যান্ত মা।
গোপীমোহন নিজে পণ্ডিত মানুষ। তিনটি ভাষায় সমান পারদর্শী সংস্কৃত, ফারসি ও উর্দু। ইংরেজিও জানতেন। ফরাসি ও পর্তুগিজ ভাষাও শিখেছিলেন। মহাসমারোহে তাঁর বাড়িতে যে দুর্গাপুজো হত, আকারে প্রকারে তার কোনও তুলনা ছিল না। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান স্বীকৃত। দেশীয় শিল্প ও সাহিত্যের উন্নতির দিকে তাঁর বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি নিজে সংগীত অনুরাগী ছিলেন। যেসব বিশিষ্ট শিল্পীর সেবা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন–কালি মির্জা (কালীদাস মুখোপাধ্যায়), ল-কে কানা (লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস), অঞ্জু খাঁ, লালা কেবল কিষণ। তিনি নিজে সুন্দর গান লিখতেন। নিজের বংশ সম্পর্কে তাঁর অত্যন্ত অভিমান ছিল। কোনওরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে পারতেন না। সেই মজার কলকাতায় বড়লোকদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চরিত্র ছিল। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন রাজা। রাজকৃষ্ণ। শোভাবাজারের মহারাজা রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের পুত্র। হিন্দু ধর্মে তাঁর কোনও আস্থা ছিল না। হিন্দু আচার-ব্যবহার প্রকাশ্যে পদদলিত করে এক মুসলমান রমণীর সঙ্গে থাকতেন। সহবাসই বলা চলে। মুসলমান বাবুর্চি তাঁর আহারাদি প্রস্তুত করতেন। মুসলমানরাই তাঁর সভাসদ ও সহচর ছিলেন। মুসলমান কবিদের দিয়ে মহরমের গান রচনা করাতেন। প্রচুর খরচ করে মহরমে মিছিল বের করতেন। আর সেই শোভাযাত্রার একেবারে সামনে তিনি স্থান গ্রহণ করে ধার্মিক মুসলমানদের মতো বুক চাপড়াতে চাপড়াতে পদব্রজে শহর ভ্রমণ করতেন। আসল কথা কোনও ধর্মেই তাঁর বিশ্বাস ছিল না। মুসলমানরা ভাবতেন রাজা রাজকৃষ্ণ আমাদেরই সমাজের একজন। কিন্তু হিন্দুরা এই উচ্চবংশীয় ধনী মানুষটিকে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। সেই সময়কার হিন্দু দলপতিরা রাজা রাজকৃষ্ণকে হিন্দু। পৰ্বাদির উৎসবে সাদরে নিমন্ত্রণ করতেন। রাজকৃষ্ণ উপেক্ষা করতেন না। এইবার সেই কথাটি গোপীমোহনের বংশঅভিমান, তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে হিন্দু পর্বের একটি শোভাযাত্রা চলেছে জাঁকজমকে ভরা। রাজা রাজকৃষ্ণও রয়েছেন। গোপীমোহন বারান্দায় বসে দেখছিলেন। থাকতে না পেরে রাজকৃষ্ণকে জিগ্যেস করলেন, রাজা আপনি কোন। দলের। কখনও দেখি হিন্দুর মিছিলে, কখনও আবার মুসলমানের। রাজা রাজকৃষ্ণ একটি চিমটি কাটা উত্তর দিলেন যাতে লুকিয়ে আছে গ্লানিসূচক একটি ভাব। অর্থাৎ তুমি তো পিরালি। রাজা হাসতে হাসতে বলছেন, সত্যিই তাই, আমাকে দু-দলেই দেখতে পাবেন। কিন্তু আপনি কোন দলে। কোনও দলেই তো আপনাকে দেখতে পাই না। আহত গোপীমোহন তাঁর পৈতেটি তুলে রাজাকে দেখিয়ে সগৌরবে বললেন, আশ্চর্য নয় রাজা, কিছুমাত্র আশ্চর্য নয়, আমার স্থান যেখানে, অতটা উঁচুতে আপনি কখনওই উঠতে পারবেন না।
গোপীমোহন তাঁর বংশগৌরব সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন। তিনি শুধু ধার্মিক ছিলেন না, সাধনভজন করতেন। সংগীতচর্চা করতেন। দান-ধ্যান ও সংগীতের পৃষ্ঠপোষণ করতেন। –এতগুলি গুণের ধারা একত্রিত হয়ে তাঁর বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। এইটিই ঠাকুরদের বৈশিষ্ট্য। জোড়াসাঁকোয় যার বিকাশ হয়েছিল পুরোমাত্রায়।
গোপীমোহনের ঐতিহাসিক কীর্তি মূলাজোড়ে মা ব্রহ্মময়ী মন্দির। সেকালেই যত অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড ঘটত। কোথায় কলকাতা আর কোথায় মূলাজোড়। আর মা কালী পেলেন। ব্রহ্মময়ী নাম। এর অন্তরালে অদ্ভুত এক ইতিহাস। গোপীমোহন তাঁর আদরের কন্যাটিকে সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করতেন না। কন্যাটিকে রেখেছিলেন তাঁর ধ্যানে। এদিকে তাঁর খেলাধুলা ও লেখাপড়ার ব্যবস্থাও করেছিলেন। সেখানে কোনও ত্রুটি রাখেননি। পরিবারের সবাই অনুভব করেছিলেন ব্রহ্মময়ীর জন্মের পর থেকেই ঠাকুর পরিবারের যশ ও ঐশ্বর্য শতগুণ বেড়ে গেছে।
সেই সময় গৌরীদানের প্রথা ছিল। অল্পবয়সেই মেয়েদের পাত্রস্থ করা হত। স্ত্রী এবং স্বামীর বয়সের যথেষ্ট ফারাক থাকত। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির বিবাহের বয়স এবং পাত্রীর বয়সের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। সকলেই সেইকালের বিখ্যাত ব্যক্তি। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চোদ্দো বছর বয়সে বিবাহ করেছিলেন। স্ত্রীর বয়স ছিল ছয়। কেশবচন্দ্র সেন আঠারো। বছর বয়সে যাঁকে বিবাহ করলেন, তাঁর বয়স নয়। এগারো বছরের বঙ্কিমচন্দ্র বিবাহ করলেন পাঁচ বছরের এক বালিকাকে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স উনিশ, স্ত্রীর বয়স আট। ভূদেব মুখোপাধ্যায় মোলো বছর বয়সে এগারো বছরের এক বালিকাকে বিবাহ করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স সতেরো, পাত্রীর বয়স সাত। উনিশ বছরের নবীনচন্দ্র সেন দশ বছরের একটি কন্যাকে বিবাহ করলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর চোদ্দো, তাঁর স্ত্রীর বয়স আট। পনেরো বছরের অমৃতলাল বসু নয় বছরের এক বালিকাকে গ্রহণ করলেন।
ব্রহ্মময়ী আট বছরে পড়েছেন। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ গোপীমোহন শাস্ত্রবিধি লঙ্ঘন করতে পারবেন না। শাস্ত্রে বলছেন, অষ্টম বর্ষে ভবেৎ গৌরী। পাত্র নির্বাচন হয়ে গেল। বিবাহের দিনক্ষণ স্থির। গোপীমোহন শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। তাঁর আদরের কন্যার বিবাহ সে এক রাজকীয় ব্যাপার। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কাজের লোকে রাজবাড়ি উৎসব মুখর। আজ ব্রহ্মময়ীর বিবাহ। পুরনারীরা জল সইতে যাচ্ছেন গঙ্গায়। কন্যাটিকেও স্নান করাবেন। সেকালের নিয়মানুসারে ব্রহ্মময়ী চলেছেন সুসজ্জিত পালকিতে আহিরিটোলার ঘাটে। পালকি জলে নামানো হল। সেকালের প্রথা অনুসারে ব্রহ্মময়ী পালকিতে বসেই স্নান করবেন। সঙ্গে এসেছেন বিশাল এক নারী বাহিনী। শঙ্খধ্বনি, উলু, অন্যান্য বাদ্যবাজনায় ভরা গঙ্গার কূলে সে এক মহা উৎসব। কারও কোনওদিকে খেয়াল নেই। প্রচুর হুড়োহুড়ি, জল ছোঁড়াছুঁড়ি। গঙ্গা আলোড়িত। হঠাৎ দেখা গেল ব্রহ্মময়ী পালকিতে নেই। সকলের অজ্ঞাতসারে জলে তলিয়ে গেছেন। তখন জোয়ার এসেছে গঙ্গায়। স্রোত চলেছে উত্তরদিকে। কোথায় ব্রহ্মময়ী! নিমেষে আনন্দ উৎসব স্তব্ধ। মুহূর্তেই সেই দুঃসংবাদ পৌঁছে গেল ঠাকুরবাড়িতে। উৎসব মুখর বাড়িতে নেমে এল শ্মশানের নীরবতা। উদ্ধারকারীর দল গঙ্গা তোলপাড় করে ফেললেন। কোথাও পাওয়া গেল না ব্রহ্মময়ীকে। দিন শেষ, রাত নামল। এল আর একটি দিন। এমন সময় খবর এল বহুদূরে মূলাজোড়ের গঙ্গার বাঁকে ব্রহ্মময়ীর প্রাণহীন দেহ পাওয়া গেছে।
এই কন্যাটিই গোপীমোহনের প্রাণ ছিলেন। এক মুহূর্ত তাঁকে না দেখে থাকতে পারতেন না। কলকাতার সব মানুষই শোকস্তব্ধ। নিয়তির কী খেলা! গোপীমোহন সেই যে ঘরের দরজা বন্ধ করেছেন আর খোলানো যাচ্ছে না। আহার, নিদ্রা ত্যাগ। ভূমিতে শয্যা। সংকল্প করেছেন। জৈনরা যেমন করেন সেইভাবেই অন্নজল ত্যাগ করে প্রাণত্যাগ করবেন। একদিন গেল, দুদিন গেল, তিনদিনের দিন গভীর রাতে তাঁর অন্ধকার ঘরটি আলোয় বিচ্ছুরিত হল। ব্রহ্মময়ী দাঁড়িয়ে আছেন আলোর শরীর নিয়ে। অভিমান ভরে পিতাকে বলছেন, আমি তো তোমার কাছে থাকব বলেই এসেছিলাম, তুমিই আমাকে দূর করে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে। তাই তো আমি পালিয়ে এসেছি। আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। আমি মূলাজোড়ের গঙ্গাতীরে পাষাণ মূর্তিতে অবস্থান করছি। তুমি আমাকে সেখানেই প্রতিষ্ঠা করো। আমি তোমার হয়েই থাকব।
গোপীমোহন অন্ধকারে আলোর দিশা পেলেন। তাঁকে স্বপ্ন দিয়েছেন। হঠাৎ বাঁচার উৎসাহ ফিরে এল। পরের দিনই তাঁর লোকজন নিয়ে সাত সকালেই বেরিয়ে পড়লেন মূলাজোড়ের উদ্দেশে। গঙ্গারতীরে জঙ্গলাকীর্ণ জনবসতিহীন নির্জন একটি স্থান। অনুসন্ধান করে সেইখানেই অতি অপূর্ব মূল্যবান কষ্টিপাথরে নির্মিত একটি বিগ্রহ পাওয়া গেল। বিস্ময়কর তাঁর রূপ।
মূলাজোড় স্থানটি অখ্যাত না বিখ্যাত! প্রাচীন ইতিহাস কী বলছে! বাংলার ইতিহাসে একটি অন্ধকার যুগ আছে। শুরু ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। বকতিয়ার খিলজি নদিয়া দখল করলেন। সেই থেকে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশো উননব্বই বছরকাল বাংলার ইতিহাসের এক অন্ধকারময় যুগ, গৌড়ের সিংহাসনে হুসেন শাহের রাজত্বকাল পর্যন্ত। এই ইতিহাসের অনেকটাই হারিয়ে গেছে। একটু একটু কোথাও পাওয়া যায়। কিন্তু কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা বলা শক্ত। একটি সত্য পাওয়া যায় যা অস্বীকার করার উপায় নেই–সর্বস্তরে নিরবচ্ছিন্ন অকাল। লুণ্ঠন, পীড়ন, নরহত্যা, নারী নির্যাতন, দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, এসব প্রতিদিনের ঘটনা। রাজশক্তি তাকিয়েও দেখত না। কারণ তাদের নিজেদের অবস্থাও শোচনীয়। সেখানে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র, বিদ্রোহ, গুপ্তহত্যা–সিংহাসনে নিশ্চিন্তে বসে থাকাটাই অসম্ভব। এই সময়কালের মধ্যে বাহান্ন জন রাজা গৌড়বঙ্গ শাসন করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মধ্যে ঊনত্রিশ জন সিংহাসনে বসেছেন আর নেমেছেন। কখনও। কয়েকদিন, কখনও বড়জোর চার বছর। আঠারো জন মরেছেন গুপ্ত ঘাতকের হাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে যানজিরবিহীন। একথা মোগল সম্রাট বাবরের।
নবদ্বীপেই প্রথম আঘাত, আর এই নবদ্বীপেই প্রথম জাগরণ। ১৪৮৬ সালের ফাগুন পূর্ণিমা। আবির্ভূত হলেন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য। আলো হাতে এসে দাঁড়ালেন এক অমেয় পুরুষ সিংহ। শক্তির একটা তরঙ্গ খেলে গেল। ১৫১০ সালে তিনি সন্ন্যাস গ্রহণ করে মানুষের কল্যাণে। নিজেকে উৎসর্গ করলেন। এরপর তাঁকে আর পাওয়া গেল না। শ্রীক্ষেত্রের সাধন জগতে নিজেকে বিলীন করে দিলেন। কিন্তু রয়ে গেল যে তরঙ্গ তিনি তুলেছিলেন সর্বক্ষেত্রে তার অভিঘাত। মহাপ্রভু গৌরবঙ্গ ত্যাগ করলেন, আর মাত্র সাত বছর পরেই শুরু হল আর এক সংকটের কাল। এবার বিদেশিদের হামলা। তারা সবাই বণিক, প্রথমে পর্তুগিজ। শুরু হল তাদের অবাধ বাণিজ্য। ১৫৭০ সালে সরস্বতী নদী বেগ হারাল। সপ্তগ্রামের ঐশ্বর্য ও বোলবোলা শেষ হল। এইবার হুগলি। পর্তুগিজরা এখানে জমিয়ে বসতে চাইল। স্বভাবে তারা হার্মাদ জলদস্যু। স্থায়ী কোনও পরিকল্পনা ছিল না। বাইরে তারা বণিক, অন্তরালে তারা দস্যু। এদের লুণ্ঠন ও উৎপীড়নে বাংলার ছোট ছোট গ্রামে দেখা দিল আতঙ্ক। জাহাজ বোঝাই নরনারী ও শিশু ইউরোপের বাজারে পাঠাতে লাগল ক্রীতদাস করে। নারীহরণ। এদের নিত্যকর্ম। প্রায় একশোটা বছর এইভাবেই কাটল। বাংলা হল শ্মশান। সেই সময় ভাগীরথীর দুই তীরে হুগলি থেকে দক্ষিণের শেষ মাথা পর্যন্ত বৃহৎ বন্দর ও বন্দরকেন্দ্রিক জনপদ ছাড়া গোটা অঞ্চলটাই ছিল জনশূন্য অরণ্য। ত্রাতা হিসাবে দেখা দিলেন মোগল। সম্রাট শাহজাহান। ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দ। তিনি পর্তুগিজদের নির্মূল করলেন। ১৬৫০ইংরেজ বণিকদের আবির্ভাব। আবার হুগলি, সেখানেই তাদের কুঠি স্থাপিত হল।
বড় ইতিহাসের আড়ালে ছোট ছোট ইতিহাসও থাকে। মূলাজোড়ের কথা বলতে গিয়ে এসব প্রসঙ্গ আসছে কেন? কারণ একটাই, কোনও ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে একক থাকতে পারে না। গোপীমোহন ব্রহ্মময়ীর নির্দেশে মূলাজোড়ে মন্দির স্থাপন করবেন। অনেকটা জায়গা চাই। নদীর বাঁকে বিগ্রহটি বসেছিলেন ইঙ্গিত বহন করে। এই সেই স্থান। স্থান কোথায়! এ তো জলা আর জঙ্গল। ত্রিসীমানায় কোনও মানুষ নেই। এর চেয়ে শ্মশান যে ছিল ভালো।
অতীত ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায়, এই মূলাজোড় স্থানটি একসময় বিরাট কুখ্যাত জঙ্গলের একটি দিক। জঙ্গলটির নাম জয়চণ্ডীর জঙ্গল। তৎকালীন সীমানা ছিল এইরকম–উত্তরে প্রাচীন নদী বন্দর নবহট্ট, এখন যার নাম নৈহাটি। দক্ষিণে বর্তমানের বারাকপুর পর্যন্ত। এই জঙ্গলেরই বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে ছিল বর্তির বিল। দীর্ঘকাল ধরে এই জঙ্গলে আচার অনাচার উভয়ই চলছিল পুরোদমে। একদিকে কাঁপালিক আর অঘোরীদের হাড়হিম করা যত কাণ্ডকারখানা, আর অন্যদিকে কুখ্যাত সব ডাকাতের দল। এই উভয় সম্প্রদায়েরই লোক সমাজে বিচরণের কোনও সম্ভাবনা ছিল না। এই কাঁপালিকরা নরবলি দিতেন আর ডাকাতরা ডাকাতির আগে এই নরবলিতে উৎসাহ দিত। এই ধারা থেকেই মা কালীর আর একটি রূপ প্রকাশিত হল–ডাকাত কালী। এই অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী জয়চণ্ডী। সেই কারণেই বলা হত জয়চণ্ডীর জঙ্গল। এই দেবী কাঁপালিক ও ডাকাতদের দ্বারা পূজিত হতেন। গঙ্গার তীরে অবস্থান, তীরে বাঁধা থাকত দ্রুতগামী ছিপ। ডাকাতদের বাহন। গঙ্গার বুকে ডাকাতি করে নোয়াই খাল অথবা মুক্তাপুরের খাল ধরে এই অরণ্যে এসে আত্মগোপন করে থাকত। প্রয়োজন হলে জলপথেই পালাত।
হুসেন শাহের রাজত্বকালে দেশে শাসন ব্যবস্থার উন্নতি হল। পলাশির যুদ্ধের পর শুরু হল প্রকৃত সুশাসন। কাঁপালিক, অঘোরী, ডাকাত সব উধাও। জয়চণ্ডীর জঙ্গল ক্রমশ ছোট হতে লাগল। চারপাশে শুরু হল সাধারণ মানুষের বসবাস। ডাকাত আর কাঁপালিকরা পালাবার সময় অষ্ঠধাতু নির্মিত মা জয়চণ্ডীর মূর্তিটি বিলের জলে বিসর্জন দিয়ে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই মূর্তি উদ্ধার করে মন্দিরে স্থাপিত হয়। বহু মানুষের বিশ্বাস এই দেবী জাগ্রত, মানুষের কল্যাণসাধন করেন। চতুর্দিক থেকে মানুষ আসেন উৎসবে শামিল হতে। জয়চণ্ডীর মন্দির নৈহাটির একটি প্রসিদ্ধ স্থান।
গঙ্গা নদীর বাঁকে যেখানে ব্রহ্মময়ীকে পাওয়া গেল, মন্দিরটি সেই জায়গায় হবে। হবে না হতেই হবে। জঙ্গলাকীর্ণ কিন্তু এর তো একজন অধিকারী থাকবেন! সেই সময়টা তো জমিদারদের কাল। জানা গেল এই অঞ্চলটি বিখ্যাত ভূস্বামী রামদেব নাগের বংশধরদের মৌজাভক্ত। বর্ধমান রাজার দেওয়ান রামদেব নাগ প্রজাপীড়নের জন্য বিখ্যাত। এই রামদেবের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। তিনি বর্ধমান মহারাজকে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন। লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষায় কবিতাতে। শিরোনাম নাগাস্টক। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। যথারীতি গোপীমোহন রামদেবের বংশধরদের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পেলেন না। জঙ্গলই হোক আর যাইহোক, জমি আপনাকে দেওয়া হবে না। আমাদের সম্পত্তি আমাদেরই থাকবে। বিষণ্ণ গোপীমোহন রাতে তাঁর কন্যাকে নিবেদন করলেন, মা, তুই বললি ওইখানে মন্দির করতে, ওরা যে জায়গা দিচ্ছে না। অবশেষে বহু অনুনয়, বিনয়ের পর জমি পেলেন। কী আনন্দ! চতুর্দিকে জঙ্গল। উলুখাগড়ার বন। আধুনিক দস্যু-তস্করও আছে। অজস্র সাপ। পাল পাল শেয়াল। জোয়ারের সময় চুঁইয়ে চুঁইয়ে গঙ্গার জল ঢুকে জলাভূমির মতো করে রেখেছে। ভাগীরথীতে প্রথমে দিলেন বাঁধ। দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে যেমন পোস্তা তৈরি হয়েছিল ঠিক সেইরকম। তারপর প্রচুর মাটি ফেলে ঢালাই করে তৈরি হল মন্দিরের ভিত। অর্থের অভাব নেই। দক্ষ শিল্পী, কয়েক হাজার শ্রমিক হাজির করলেন সেই জায়গায়। গড়ে উঠল অতি সুন্দর নবরত্ন মন্দির। ১৮০৯ সাল। একটি পবিত্র দিনে মন্দিরের সিংহাসনে মহাসমারোহে আরোহণ করলেন দেবীব্ৰহ্মময়ী। গোপীমোহনের আদরিণী কন্যা, মহাশক্তিরূপিণী দেবী কালিকার রূপ ধারণ করলেন। কতদিন হয়ে গেল, আজও তিনি শত শত ভক্তের পূজা। পাচ্ছেন।
এতবড় মন্দির পশ্চিমবঙ্গে খুব কমই আছে। সমতল ভিত্তির ওপর স্থাপিত এই নবরত্ন মন্দিরটি। এর দুদিকে, এপাশে-ওপাশে ছটি, ছটি করে দ্বাদশ শিবমন্দির। দক্ষিণে প্রশস্ত অঙ্গনে তিনটি দেউল। তিনজন শিব। হর, শঙ্কর ও শিব। প্রত্যেক বছর পৌষমাসে আজও বসে বিরাট মেলা। সহস্র ভক্ত নরনারী জোড়ামুলো দিয়ে মাকে পুজো করেন। এখানেই শেষ নয়। মন্দিরের পেছনে রাধাকৃষ্ণ মন্দির ও আর একটি শিবদেউল। কালীমন্দিরের সামনে নাটমন্দির। তারপর বলিদানের স্থান। আর তারই নীচে গঙ্গার প্রবাহ।