কাঁটা বেঁধা পায়ে
.
আধো ঘুম আধো জাগরণে শব্দটা শুনতে পাচ্ছিল শাশ্বত। কিরিরিং। কিরিরিং। এ কি কালের ঘণ্টাধ্বনি? মিইয়ে গিয়ে অমন শোনাচ্ছে? নাকি অনাগত ভবিষ্যতের মূর্ছনা? যে-ভবিষ্যৎ কিনা কড়া নাড়ছে তার দরজায়? নাকি স্মৃতিরা কোনও বিচিত্র সুর তুলছে শাশ্বতর মনে?
ধুস, এর একটিও নয়। কী বাজছে, শাশ্বত ভালমতোই জানে। তার খসকুটে মোবাইলের অ্যালার্ম। ইদানীং উত্তিষ্ঠত জাগ্রত হাঁকার ডিউটিটা সে পালন করছে কিনা। কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটায়। বলছে, আর আলস্য নয়, এখন শয্যা ছেড়ে উঠে শরীরকে খানিক তোয়াজ করো হে শাশ্বত। সর্বাগ্রে অবশ্য ঝটপট অ্যালার্মটি বন্ধ করা দরকার। নইলে দেবিকার ট্যাবলেট খাওয়া ঘুমটি ছিঁড়ে যাবে যে! আর তার পরিণাম যে কী ঘটতে পারে, তা শাশ্বতর চেয়ে বেশি কে-ই বা জানে।
হ্যাঁ, এই সময়ের নিদ্রাটি দেবিকার ভীষণ জরুরি। সুখেরও বটে। তা সে তো হবেই। রাত বারোটা অবধি টিভিতে সিনেমা সিরিয়াল দেখে, বড়ি গিলে সে বিছানায় আসে, অন্তত ছ’-সাত ঘণ্টা শান্তির ঘুম তো সে চাইতেই পারে। একটু বেশি রাত অবধি টিভি দেখাকে নিশ্চয়ই দূষণীয় ভাবা শোভা পায় না শাশ্বতর। দেবিকারও তো বিনোদন চাই। শাশ্বতর মতো একখানা থ্যাসথেসে বর নিয়ে সাড়ে বত্রিশ বছর যে ঘর করছে, সাতান্নয় পৌঁছে বাস্তবের মোড়ক লাগানো ওই অলীক জগৎটাই তো তার এন্টারটেনমেন্ট।
সামান্য কেতরে খাট থেকে নামল শাশ্বত। মোবাইল থামিয়ে ঘুরে এল বাথরুম। এবার দিনের প্রথম চিনি ছাড়া চা-টি বানানোর পালা। নিঃসাড়ে। এবং সাবধানে। একটি কাজও সে গুছিয়ে করতে পারে না যে। সাধে কী দেবিকা শাশ্বতর ওপর চেল্লায়! এই তো পরশু ভোরেই কাপ ভাঙল একখানা। গত পুজোয় মেয়ের কিনে দেওয়া দেবিকার সাধের টি-সেটখানা খোঁড়া হয়ে গেল।
শাশ্বত অবশ্য আজ এমনিতেই সাবধানি। আর মাত্র তিন দিন যার চাকরির মেয়াদ, তার কি আক্কুটে হওয়া চলে? হ্যাঁ, শাশ্বতর ওপর এই বিশেষণটি প্রয়োগ করে দেবিকা। আক্কুটে। আক্কুটে। শব্দটার যে কী অর্থ, কোত্থেকে এসেছে, বিদেশি শব্দের ভাঙা রূপ নাকি নিখাদ দেশি শব্দ… ব্যাকরণ ঘেঁটে ঘেঁটে এখনও তার নিখুঁত হদিশ পায়নি শাশ্বত। যা মিলেছে তার মানে তো আবদেরে। কিংবা জিদ্দি শিশু। শাশ্বতকে কি ওই গোত্রে ফেলা যায়?
শাশ্বত অলস ভাবনার মারপ্যাঁচে গেল না। প্লেটে ঢেলে তিন চুমুকে চা শেষ, বিয়োগ ব্যায়ামের পাট চুকিয়ে মনোযোগী হল যোগব্যায়ামে। সাতশো আট স্কোয়ার ফিট দু’কামরার ফ্ল্যাটের ষোলো বাই দশ ড্রয়িং-ডাইনিং হলের ফালি মেঝেয়। প্রথমে কয়েকটা আসন। উত্থিতপদাসন। ধনুরাসন। ভুজঙ্গাসন। পবনমুক্তাসন। শেষে শবাসন। ট্রেনিং নেই, ছবি দেখে শেখা, এই বয়সে কোনওটাই তাই নিখুঁত হয় না। একমাত্র শবাসনটি ছাড়া। তবু আসন মাস্ট। এরপর মিনিট তিনেক প্রাণায়াম, অন্যদিনের মতোই। এবার টি-শার্ট চড়িয়ে, ফুটপাথি স্নিকার গলিয়ে রোজকার মতো মর্নিংওয়াক।
তার আগে আর একটি নিত্যকর্ম আছে অবশ্য। আর একবার দেবিকার শ্রীমুখ দর্শন। তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেমনই হোক, এই অভ্যেসটি শাশ্বত ছাড়েনি। কাজটা এমন কিছু দুরূহ নয়, শোওয়ার ঘরের দরজায় একটু দাঁড়ানো, মিনমিনে গলায় বলা, বেরোচ্ছি… শুধু এইটুকুন। কোনও দিন সাড়া মেলে, কোনও দিন মেলে না, তবে শাশ্বতর তো ডিউটি খতম।
পাল্লা ঠেলে আজ একটু বেশিক্ষণ যেন দাঁড়াল শাশ্বত। কেন যে… সত্যি সত্যি দেবিকার মুখ দেখছে নাকি? বয়সের ছাপ থমকে থাকা ফোলা ফোলা গাল দু’খানায় কোনও সৌন্দর্য আবিষ্কার করছে? নাকি দেবিকার ওই পাশবালিশ আঁকড়ে শয়নদৃশ্যে সে বেপথু খানিক?
উঁহু। দীর্ঘশ্বাস ফেলা তো শাশ্বতকে সাজে না। দেবিকাকে নিয়ে তার এমন কিছু মধুর শয্যাস্মৃতি নেই যে ভোরবেলা ফোঁস ফোঁস বাতাস ছাড়তে হবে। সে দেবিকাকে কতটুকু দিয়েছে, পেয়েছেই বা কী— এই কী তার হিসেব করার সময়? তার চেয়ে বরং বসন্তের প্রভাতি হাওয়ায় রুটিনমাফিক হাঁটতে বেরিয়ে পড়ায় অনেক বেশি স্বস্তি।
ফ্ল্যাটের দরজায় গিয়েও শাশ্বত ফের থমকাল। বাবলার দুয়ার অমন হাট কেন? রাতে কি ফেরেনি ছেলে? বউ চলে যাওয়ার পর থেকে বাবলার বাড়ি ফেরার সময়ের কোনও স্থিরতা নেই। তবু ফেরে তো। কালও বেশি রাত্তিরে একবার বেল বাজল না? ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিল শাশ্বত, থমকে গেল চৌকাঠে। ওই তো বাবলা। বিছানায় উপুড়, দু’হাত দু’দিকে ছড়ানো, পরনে পোশাক বলতে শুধু একখানি জিনসের শর্টস। ওই হাপুস শোওয়াটাই যেন বলে দেয়, মাত্র তিরিশেই জোর ধাক্কা খেয়েছে ছেলে। কবে যে ঘা শুকোবে, কে জানে।
আলতো হাতে দরজা টেনে ফ্ল্যাট ছাড়ল শাশ্বত। সাধারণত সকালে পথে বেরিয়ে বাড়ির চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে রাখে। আজ কেন যে সুস্থির হতে পারছিল না! বাবলার ভাবনায় নয়, এ যেন অন্য কিছু। বারবার চোখ ঘুরছে এদিক-ওদিক। কী যে সে দেখছে! এই সময়ে শহরের দৃশ্য তো এরকমই থাকে রোজ। এখানে-ওখানে ঘুমন্ত কুকুর, ল্যাম্পপোস্টের নীচে গৃহস্থের আবর্জনা প্যাকেট প্যাকেট ডাঁই, দোকানপাট বেশির ভাগই ঝাঁপ বন্ধ, রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে দুধের গাড়ি দণ্ডায়মান, ভ্যানরিকশায় বস্তা চাপিয়ে বাজারে আসছে সবজিওয়ালা, সাইকেলে নিউজ়-পেপার বেঁধে আনাগোনা করছে হকার, ফুটপাথে প্লাস্টিক শিটে কাটাপোনা আর ট্যাংরা-খলসে-পুঁটি বিছিয়ে মেছুনিরা বিক্রির প্রতীক্ষায়…এমনই তো থাকে নিত্যদিন। মোড়ের নতুন ফ্ল্যাটবাড়ির খাঁচাটিও তো নজরে পড়ে প্রতি ভোরে। কেমন পটাপট উঠে যাচ্ছে তিনতলা চারতলা পাঁচতলা…। অমল বারিকদের চমৎকার একখানা বাড়ি ছিল ওখানে। ঘেরা বাগান সমেত। শরিকি বিবাদ মেটাতে এককাট্টা হয়ে বাড়িটাকে তুলে দিল প্রোমোটারের হাতে। গুঁড়িয়ে যাওয়া সেই জাফরিওয়ালা গোলবারান্দাটিকে মনে পড়ল হঠাৎ? তাই একটু উদাস? সে চিরকালের সেকেলেপন্থী, সহজে নতুন কিছুকে নিতে পারে না বলেই তো শাশ্বতর বদনাম। পুরনো রোগটাই কি সহসা হা-হুতাশ জাগাল প্রাণে?
হবেও বা। শাশ্বতর মেজাজমর্জি এখন ঠাহর করা দায়। হরনাথ বিদ্যাপীঠের বাংলা স্যার হয়ে সে চৌত্রিশ বছরের একটা লম্বা ইনিংস খেলেছে, পরশু বিকেলে মাঠ ছাড়বে পাকাপাকি। শেষের দিনগুলোতে এমন একটু-আধটু চিত্তবিক্ষেপ তো ঘটবেই। অকারণে স্মৃতিভারে জর্জরিত হতে পারে, কোনও যুক্তি ছাড়াই হঠাৎ হঠাৎ কান্না পাওয়া বিচিত্র নয়, যার ওপর সে বেজায় চটে আছে তাকে বেমালুম ক্ষমা করে দেওয়ার ইচ্ছে জাগলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এইসব উপসর্গ তো স্বাভাবিক। শাশ্বত যা ল্যাদলেদে টাইপ, তার ক্ষেত্রে অন্যথা হবে কেন?
পার্ক এসে গেছে। মাঝে বেশ জোরেই পা চালাচ্ছিল শাশ্বত, এখন কমেছে তার গতি। এক্ষুনি কি বেঞ্চিতে বসে পড়ার বাসনা? বছর দুয়েক আগে সুগার ধরা পড়েছে শাশ্বতর। বরের সঙ্গে ঝুমকির ঝামেলা বাধার সময় থেকেই খুব দুর্বল লাগত শরীর, তখনই রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে এই বিপত্তি। ডাক্তারের নিদান, শুধু ওষুধ নয়, নিয়মিত হাঁটা চাইই চাই। সময় মেপে হাঁটা শাশ্বতর ধাতে নেই। তবু অন্তত পার্কে দুটো চক্কর তো মারেই। আজ নিয়মরক্ষেটুকু না করলে দিনভর মন খুঁতখুঁত করবে না?
পাকটুকু সেরে শাশ্বত গুটিগুটি পায়ে বুড়োদের মজলিশে। হ্যাঁ, সকলেই হাজির। ঘ্যাম ঘ্যাম সব লোক। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়। কেউ ছিল রেলওয়ে ওয়ার্কশপের মানেজার, কেউ বা মাল্টিন্যাশনালের এক্স ভাইস প্রেসিডেন্ট। কলকাতার নামী বংশধরের পাশাপাশি সদ্য প্রাক্তন ওজনদার আমলাও সিমেন্টের বেঞ্চিতে মজুত। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রফেসরও আসীন। ভারী ভারী মানুষগুলোর সামনে শাশ্বত রীতিমতো কুঁকড়ে থাকে। তবে একবার এই আড্ডায় সে আসেই। বয়সে ঠিকঠাক খাপ খায় না, স্টেটাসেও সে অনেক খাটো, এই তথ্যগুলো মগজে সারাক্ষণ কিলবিল করে, তবুও।
সফল মানুষদের আঁচে শাশ্বত কি নিজেকে খানিক সেঁকে নিতে চায়? যদি তাতে যাপিত অকিঞ্চিত্কর জীবনটা একটু অর্থবহ হয়ে ওঠে?
শাশ্বতকে দেখামাত্র আটাত্তরেও টগবগে জোয়ান বিকাশ মান্নার গলা গমগম, “আরে, এসো হে শাশ্বত। আর একটু দেরি করলে তো তোমার সঙ্গে আজ দেখাই হত না।”
সংকুচিত স্বরে শাশ্বত বলল, “কোথাও যাবেন বুঝি?”
“আর বোলো না। সাতসকালে এয়ারপোর্ট ডিউটি পড়ে গেল।”
“কেউ আসছে নাকি?”
“হ্যাঁ ভাই। ছোটছেলে মিউনিখ থেকে একটা বিজ়নেস কনফারেন্সে দিল্লি এসেছিল। একদিন ফাঁক পেয়েছে, অমনি তার বাবা-মাকে দেখার জন্য কী ছটফটানি! বললাম, ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিই… শুনেই গিন্নির মুখ ভার। অগত্যা আমাকেই গাড়ি বের করতে হয়।”
শাশ্বত বিস্মিত স্বরে বলল, “এই বয়সে এতটা রাস্তা ড্রাইভ করবেন?”
“বয়স তো একটা ফিক্সেশন হে।” সত্তর ছুঁইছুঁই সজল গুপ্ত ফুট কাটল, “ভাবলে আছে, না ভাবলে নেই। এই তো কামিং স্যাটারডে আমি ড্রাইভ করে শান্তিনিকেতন যাব।”
“বেড়াতে?”
“ওই আর কী। অত বড় বাড়িখানা ফাঁকা পড়ে, মাঝেসাঝে না গেলে চলে?”
মোহন ব্যানার্জি উৎসাহী স্বরে বলল, “শান্তিনিকেতনে এখন প্রপার্টির রেট কেমন?”
“আমাদের তো তিন পুরুষের বাড়ি। ওরকম দু’-তিন বিঘের প্লট তো আর মিলছে না। তবে বাংলো প্যাটার্নের কিছু কিছু নাকি এখন হচ্ছে। বোধহয় লাখ তিরিশের মধ্যে পেয়ে যাবেন।”
“মেয়ে-জামাইয়ের বড় ইচ্ছে শান্তিনিকেতনে কিছু একটা কেনার। অ্যাসেটকে অ্যাসেট হল, উইকএন্ড কাটানোর একটা জায়গাও হাতে রইল।”
“তা ঠিক। এই শহরে তো তিনশো পঁয়ষট্টি দিন বাস করা যায় না। তবে ইনভেস্টমেন্ট না করে রিয়েল এস্টেটে টাকা রাখো। অ্যানুয়াল রিটার্ন বেশি হবেই।”
বছর পঁয়ষট্টির অনিরুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, “আপনার ছেলে গ্রিনকার্ড পেয়ে গেছে?”
“অনেকদিন। প্রায় তিন বছর। সজল কাঁধ ঝাঁকাল, তবে ও স্টেটসে খুব হ্যাপি নয়। রিসেশানের ধাক্কায় ও দেশের ইকনমি তো টলমল। স্পেশালি ব্যাঙ্কিং সেক্টর।”
বিকাশ বলল, “এখন তো তাও অনেকটা সামলেছে।”
“ওটা ওপর ওপর।” বিতনুর বিজ্ঞ মন্তব্য, “গ্লোবাল ইকনমিক্স তো কম দিন স্টাডি করছি না, পাল্সটা টের পাই। তেল নিয়ে ব্যাটারা জোর নাকানি-চোবানি খাচ্ছে। মন্দা পুরো কাটাতে চাইলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না বেঁধে যায়।”
“হুম্ম। খুবই ডামাডোল পরিস্থিতি। ইউরোপ তো থরহরি কম্পমান। গ্রিস পুরো শুয়ে পড়ল। ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল নড়বড় করছে। ওদিকে আবার ইউক্রেন নিয়ে নখরা। শুধু আমার ছেলের জার্মানিই যা মজবুত আছে এখনও।” বিকাশের গলায় পলকা গর্বের ছোঁয়া, “খুব ওয়াইজ় ডিসিশন নিয়েছিল। ইয়োকোহামা থেকে চাকরি বদল করে মন্ট্রিয়লে না গিয়ে মিউনিখটা বাছল…”
“দারুণ শহর। পোস্ট ডক্টরেট করার সময় গটিনজেনে তিন বছর ছিলাম। তখন ইউরোপের মোটামুটি সব বড় শহরেই গিয়েছি। প্যারিস, রটারডাম, রোম, মিলান, বার্লিন…। বাট মিউনিখ ইজ় ডিফারেন্ট। ভেরি সিরিয়াস আবার তেমনই বাবলিং… কী দুর্দান্ত অ্যাকাডেমিক অ্যাটমোস্ফিয়ার… নাইট লাইফও দারুণ।” বলতে বলতে হঠাৎ শাশ্বতর পানে ফিরেছে। ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমার না সামনেই রিটায়ারমেন্ট? কবে যেন?”
বিতনু-মোহন-সজল-বিকাশদের আলোচনার কিছুই সেভাবে বুঝছিল না শাশ্বত। এত অচেনা এক স্বপ্ন-স্বপ্ন জগৎ নিয়ে এরা কথা বলে! সফল মানুষদের যা রীতি আর কী! তবু দু’কান ভরে কথাগুলো গিলছিল শাশ্বত। এবং না বোঝার বিমল আনন্দে শিহরিত হচ্ছিল। এদেরই কেউ একজন শাশ্বতর মতো একটি কীটপতঙ্গসদৃশ মানুষের সম্পর্কে আগ্রহ দেখাচ্ছে, এ যে কী বিরল সৌভাগ্য!
শাশ্বত কৃতার্থ স্বরে বলল, “পরশু, স্যার।”
“বাহ্, ভেরি গুড। তারপর তো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ হে!”
“তা রিটায়ারমেন্টের পরে কী করবে কিছু ঠিক করলে?”
“না মানে… এখনও তো… তেমন কিছু…”
“ভেরি ব্যাড। লাইফে কোনও ফিউচার প্ল্যান থাকবে না? তা বয়স যা-ই হোক না কেন।” সজল আলগা ধমক দিয়ে উপদেশের সুরে বলল, “বসে যেয়ো না বুঝলে। স্টে অ্যাকটিভ। এই তো আমি স্টক মার্কেট খুললেই রোজ ল্যাপটপ নিয়ে বসে যাই। হোল ডে অনলাইনে শেয়ার নাড়াচাড়া করছি। সময়ও কাটে, দু’-চার পয়সা রোজগারও হয়।”
মোহন ঠাট্টার সুরে বলল, “দু’-চার পয়সা মানে তো দু’-চার হাজার, তাই না?”
“ওই হল। এ বয়সে যা আসে তাই লাভ।” হাসছে সজল। বিকাশ উঠে যাচ্ছিল, তাকে হাত নেড়ে ফের শাশ্বতকে বলল, “তা তোমাদের পেনশন-টেনশন আছে তো?”
“তা আছে। তবে…।” শাশ্বত হোঁচট খেল। পেনশনের জন্য কত যে টেনশন পোহাতে হবে এখন! কবে জুটবে, তার জন্য ক’খানা জুতোর সুকতলা খুইয়ে ফেলতে হবে, ততদিন সংসার কীভাবে গড়াবে, এই ভাবনাগুলোই বুঝি আটকে দিল শাশ্বতর বাক্যস্রোত। তবু গলা ঝেড়ে বলল, “শুধু পেনশন কেন, আরও কিছু পাওনাগন্ডা আছে।”
“বটেই তো। স্কুল টিচাররাও আজকাল অনেক কিছুই পায়।” বিতনু কপাল কুঁচকোল, “পি এফ, গ্র্যাচুয়িটি… বোধহয় ছুটির টাকা-ফাকাও…”
“হ্যাঁ, সব মিলিয়ে মন্দ হয় না। স্কুল মাস্টারদের আর সেই করুণাপীড়িত দশা নেই, স্যার।” মোহন স্মিত মুখে শাশ্বতকে বলল, “এবার গিন্নিকে নিয়ে জমিয়ে একটা ট্যুর করে আসুন দেখি। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ভাল ভাল প্যাকেজ দিচ্ছে। আর জমিয়ে টিউশন করুন।”
শাশ্বতকে নিয়েই বাক্যবিনিময়, কিন্তু অন্তর্নিহিত অসচেতন তাচ্ছিল্যের সুর যেন বড্ড প্রকট। নেহাত শাশ্বতর চামড়ায় অপমান-টপমান খুব-একটা বেঁধে না। নিজের নগণ্যতা জানে বলেই বোধহয় আমলও দেয় না সেভাবে। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর ভ্রমণের পরামর্শে একটু একটু হাসিও পাচ্ছিল শাশ্বতর। সে যাবে বিদেশ? শুধু দেবিকা আর শাশ্বত একসঙ্গে বেড়াবে? কোনও দূরতম কল্পনাতেও ভাবা যায় কি? দেবিকা তার সঙ্গে সংসারধর্ম করছে, তাতেই না ধন্য সে। এর বেশি কি আশা করতে আছে?
আর জমিয়ে টিউশন? শাশ্বত কি মুখ ফুটে বলতে পারে, বাংলার টিউশন বড় একটা কেউ নেয় না আজকাল? এই একটা ভাষায় বাঙালি নাকি জন্মদিগ্গজ। যদিও দুটো সঠিক বাক্য লিখতে কলম ভেঙে ফেলে। তা ছাড়া শাশ্বত টিউশানি পাবেই বা কোত্থেকে? হরনাথ বিদ্যাপীঠে যারা পড়ে, তাদের ক’জনের বা টিচার পোষার মুরোদ আছে? তাও আবার বাংলার? সবচেয়ে বড় কথা, প্রাইভেট না পড়ানোর ধনুর্ভঙ্গ পণ নিয়ে শাশ্বত এত বছর কাটাল, এই বয়সে এসে জাত খোওয়াবে?
অল্প হেসে প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল শাশ্বত। অবশ্য তাকে নিয়ে কেউ আর তেমন ভাবিত নয়। সজল আর মোহন সেনসেক্সের লাফঝাঁপ নিয়ে মত্ত। কাল বাজার যা চড়েছিল, তাতে নাকি অনেকে লাল হয়ে যাবে। বিতনুর সতর্কবার্তা, এমন হুস করে দর ওঠা নাকি সুলক্ষণ নয়, যে-কোনও মুহূর্তে ধসের সম্ভাবনা।
আদার ব্যাপারী শাশ্বত মন দিয়ে জাহাজের খবর শুনছিল। অনিরুদ্ধই শুধু আনমনা। মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। আচমকা তার পকেটে মোবাইল ঝনঝন। উঠে গিয়ে বনেদি বাড়ির কেতায় কথা বলছে নিচু স্বরে। ফোন পকেটে পুরে হাঁটা দিল অকস্মাৎ।
একটু অবাক হয়েই শাশ্বত জিজ্ঞেস করল, “সেনবাবু হঠাৎ চলে গেলেন যে!”
সজল আলগাভাবে বলল, “নির্ঘাত জরুরি ডাক পড়েছে। ওঁর দাদার সেরিব্রাল হয়েছে কিনা।”
“তাই বুঝি?” শাশ্বতর গলায় নিখাদ উদ্বেগ, “কবে হল?”
“পরশু সন্ধেয়। সেই জন্যই তো কাল বেঞ্চিতে অ্যাবসেন্ট ছিলেন।”
“দাদা আছেন কেমন?”
“বোধহয় ভাল না। একটু আগেই তো গজগজ করছিলেন।”
“কেন?”
“লোকবল নেই, ওঁকে একাই ডাক্তার নার্সিংহোম করতে হচ্ছে…”
“কিন্তু সেনবাবুদের তো বিশাল ফ্যামিলি! কত ফেমাস পরিবার!”
“রাখো তো। আজকাল সবাই যার যার তার তার। কার এত সময় আছে, কাজ়িন-মাজিনদের অসুখে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকবে?”
“ভাইয়ের ছেলেমেয়ে…”
“একটিই কন্যে। বরের সঙ্গে দুবাইতে। তার ছেলের কী যেন পরীক্ষা। আসতে তাই এক-দু’দিন দেরি হচ্ছে। মাঝখান থেকে অনিরুদ্ধ গেছেন ফেঁসে। ক্রাইসিসের সময়ে যদি বউদির পাশে না দাঁড়ান, সেন-পরিবারে তাঁর বদনাম রটবে না?”
ব্যাপারটা ঠিক মগজে সেঁধোল না শাশ্বতর। বাবার এখন-তখন অবস্থা শুনেও মেয়ে আসতে পারে না। বদনামের ভয়ে দাদার দেখভাল করে ভাই। আর সেই বদনাম রটাবে কারা? যারা সাহায্যই করবে না!
কে জানে! এই বুঝি সংসারের নিয়ম। শাশ্বতর বাবার যেদিন হার্ট অ্যাটাক হল, ভাগ্যের ফেরে বাবা সেদিন শাশ্বতর ফ্ল্যাটে। রাতে খেয়েদেয়ে পদ্মপুকুর ফেরার কথা। আটটা নাগাদ হঠাৎ বুকব্যথা। অম্বলের ওষুধে কমল না, ডাকা হল ডাক্তার। তিনি চেম্বার সেরে এলেন প্রায় এগারোটায়। তাঁর নির্দেশে ডাকতে হল অ্যাম্বুলেন্স। তারপর পড়িমরি করে হাসপাতাল। খবর পেয়েও দাদা সঙ্গে সঙ্গে এল কই? তার দেখা মিলল পরদিন সকালে। পনেরো দিন বেঁচে ছিল বাবা। তখন কে কখন হাসপাতালে থাকবে, কোন খরচাটা কে দেবে তাই নিয়ে কম টানাটানি! দিনে থাকার টাইমটা দাদার, রাত্রিটা পড়ল শাশ্বতর ভাগে। খুশিই হয়েছিল শাশ্বত, রাতে হাসপাতালে ঘুমোতে তো পারবে। কে জানত ওই নাক ডাকার সময়েই দেহ রাখবে বাবা! অন্যদিন কোনও ঘোষণা হলেই তড়াক লাফিয়ে ওঠে, কিন্তু সেই রাত্রেই কেন যেন ঘুম ভাঙল না। হয়তো বাবার ব্যাপারে একটু বেশি নিশ্চিন্ত হয়ে পড়েছিল। মাঝখান থেকে হাসপাতালে গাল খেল, দিদি-জামাইবাবু ছি ছি করল, দেবিকা পর্যন্ত কথা শোনাতে ছাড়েনি। অথচ যে-দাদা কিনা দিনে থাকার ভার নিয়েছিল, একটি দিনের জন্যও সে হাসপাতালে থাকেনি। শাশ্বত জানে। সকালে একবার খোঁজ নিয়ে অফিস দৌড়ত, আবার আসত সেই বিকেলে। কিন্তু তার কোনওই অপযশ রটল না। মা’র চোখেও কি অপরাধী হয়ে রইল না শাশ্বত? দায়িত্বজ্ঞানহীন আত্মসুখী, কী না তকমা লেগেছে গায়ে। যেন সেই রাত্তিরে জেগে থাকলে বাবা ফিরে আসত ওপার থেকে।
পুরনো কথা কচলাতে কচলাতে শাশ্বত পার্ক ছাড়ল। সাড়ে সাতটা বাজে, চৈত্রের রোদ বেশ গায়ে লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে মনে করার চেষ্টা করছিল কী কী নিতে হবে এখন। মাছ যা আছে এবেলা কুলিয়ে যাবে। সবজিও আছে মোটামুটি। শুধু নিতে হবে দুধ। এত বয়স হল, বাবলার এখনও দুধ-কর্নফ্লেক্সের অভ্যেসটি যায়নি। ওই খেয়েই অফিস যায় বাবু। সঙ্গে ডিমসেদ্ধ, কলা। একটা পেঁপে নেবে কি? বাঙ্গালোরের লাল পেঁপে দেবিকাও পছন্দ করে…
সহসা মস্তিষ্কে চিড়িক। আজ না শাশুড়িমা’র আসার কথা?
পঁচাত্তর পেরিয়েও দেবিকার মা যথেষ্ট ফিট। একা একাই যাতায়াত করে বাসে অটোয়। বাড়ির কারও সাহায্যের তোয়াক্কা না করেই। বছরখানেক হল সায়াটিকার ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে, হোমিওপ্যাথ দেখাতে মাসে দু’বার আসে গড়িয়ায়। মঙ্গলবার করে। মেয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করে মেয়ের সঙ্গেই বিকেলে যায় ডাক্তারখানায়। আশ্চর্য, এই ব্যাপারটা কিনা শাশ্বত ভুলতে বসেছিল! ইস, কী কেলেঙ্কারিটাই না হত আজ।
ঘড়ি দেখে শাশ্বত বাজারে ঢুকল। মাছ-মাংস সবই খায় মহিলা, তবে মাছটাই পছন্দ করে বেশি। গুনে গুনে চারখানা বড় সাইজ়ের পাবদা নিল শাশ্বত। আর কিছু হরিণা চিংড়ি। লাউ দিয়ে মন্দ লাগবে না নিশ্চয়ই।
লাউ কিনতে সবজি বাজারে পা রেখেছে শাশ্বত, অমনি খানিক দূর থেকে ডাক, “ও মাস্টারমশাই, এঁচোড় নিয়ে যান। একদম কচি আছে।”
শাশ্বত ঘুরে তাকাল। দেবেন। কীভাবে রটে কে জানে! বাজারের অনেক সবজিওয়ালাই তাকে ওই সম্বোধনে ডাকে। খুব যে পুলকিত বোধ করে শাশ্বত তা নয়। বরং ওই ডাক শুনে কোনও কোনও ক্রেতা টেরিয়ে তাকায় বলে একটু সংকুচিত বোধ করে।
পায়ে পায়ে গেল শাশ্বত। বেশ লোভনীয় চেহারা। গাঢ় সবুজ। বোঁটায় পাতা ঝুলছে। লাউয়ের বদলে এঁচোড় চিংড়িই বা মন্দ কী?
ওজন করার পর কেটেকুটে দিচ্ছে দেবেন। আলগা গল্প জুড়ল শাশ্বত, “কী রে, রোববার তোকে দেখতে পেলাম না যে?”
“এখন আর ক’টা রোববার আসা হবে না মাস্টারমশাই। কেত্তনের বায়না আছে।”
“তুই কীর্তন গাস নাকি?”
“একটু-আধটু। খোলও বাজাই।”
“পয়সা নিয়ে? না শখ?”
“মেলে কিছু। আশি, একশো। তবে টাকাটা আসল নয় মাস্টারমশাই। ডাক পেলে না বলতে পারি না। প্রাণ আনচান করে।”
“এদিকে ব্যাবসার তো সর্বনাশ। রোববারই তো বাজার গরম থাকে রে। ওইদিন না এলে তো হেভি লস।”
“কী করব মাস্টারমশাই? শুধু পেটের খিদে মিটলেই চলবে? মনের খিদে নেই?”
শাশ্বতকে কোথায় যে ছুঁয়ে গেল কথাটা। দেবেনও যা অবলীলায় পারে, সেটুকুও তো তার সাধ্যে কুলোল না! কত কী যে বাসনা ছিল, রয়েই গেল মনে। স্বপ্ন ছিল, গোটা দেশখানা পায়ে হেঁটে ঘুরবে। সে তো কবেই চুলোয় গেছে, এখন ওই পার্ক অবধি হেঁটেই না সে পরিতৃপ্ত! ইচ্ছে ছিল বিপ্লবী হবে, কাঁধে বন্দুক না তুলেও চেতনার বদল ঘটাবে ভুখাসুখা মানুষের। তার বদলে হয়েছে কিনা প্রায় বোবা, প্রতিবাদহীন, এক কীটাণুকীট স্কুলমাস্টার, যে কিনা নিজের বাড়িতেও আলো জ্বালানোয় অক্ষম। একটা পুরো জন্মই বৃথা গেল এভাবে!
বাজার নিয়ে ফিরছে শাশ্বত। ভার মনে। দামি পাতা-চা কিনল অল্প, শাশুড়িমা’র কথা ভেবে। মেয়ের মুখে অবিশ্রান্ত পতিনিন্দা শোনে মহিলা, সুগন্ধী চায়ে চুমুক দিতে দিতেই নয় উপভোগ করুক কথাগুলো।
পকেটে মোবাইল বাজছে। স্কুলের কেউ? নাকি দেবিকা? কোনও বিশেষ প্রয়োজনে?
বাজার সামলে তাড়াতাড়ি চোখ রাখল মনিটরে। আরে, ঝুমকি!
শাশ্বত উৎসাহভরে বলল, “কী রে, সকালবেলায়?”
জবাব না দিয়ে পালটা প্রশ্ন, “তুমি কি বাড়িতে?”
“না। হাঁটাহাঁটি সেরে ফিরছি। তোর গলা এমন ঘুম ঘুম কেন?”
“কাল একটা পার্টি ছিল প্রোডাকশন হাউসের। ফিরতে রাত হয়েছে।”
“কেন যে এসব অনিয়ম করিস! কিশোর অসন্তুষ্ট হয়…”
“হু কেয়ার্স?” “ঝুমকির গলা ঠিকরে উঠল,” আমি তোমায় ফোন করিনি। মাকে দরকার। সুইচড অফ দেখে তোমায় রিং করেছিলাম।
“ও। আমার দাদুভাই কোথায়? কী করছে?”
এবারও প্রাপ্য জবাব মিলল না, “বাড়ি গিয়ে মাকে রিং করতে বোলো। ছাড়ছি।”
দিন দিন কী অসভ্য হয়ে যাচ্ছে ঝুমকি! নাকি নিষ্ঠুর? উচ্চাশা কি স্বাভাবিক বোধ-টোধগুলোকে মেরে দেয়?
রোদ যেন সহসা প্রখর। বসন্তের সকাল হাকুচ তেতো।
দুই
শাশ্বত শার্টের বোতাম আটকাচ্ছিল। গলার বোতামটা ছিঁড়ে গেছে, জামাটা বদলে নেবে কি? থাক গে, স্কুলে বেরনোর মুখে আবার আলমারি খোলার ঝঞ্ঝাটের কী দরকার? গলার একটা বাড়তি বোতাম থাকা না থাকায় কী আসে যায়? বিশেষত, গলায় যার বকলস বাঁধাই থাকে দিনরাত!
দেবিকা ঘরে ঢুকেছে। পরনে নাইটি, কোমরে একখানা খুদে তোয়ালে জড়ানো। মা আসার দিন রান্নাবান্নার বেশিটাই নিজে হাতে করে, কমলার ওপর ছাড়ে না। মেয়ের সঙ্গে তখন কী যে কথা হল, মুখখানা তোলো হাঁড়ি হয়ে আছে যেন। দু’জনে কী গুজুরগুজুর হল, তা কি জানার অধিকার আছে শাশ্বতর? দেবিকা নিজে থেকে বললে ভাল, নইলে গিলেই ফেলবে কৌতূহল।
আপাতত বউকে একটু তোষামোদ করতে চাইল শাশ্বত। জিনসের ঝোলা ব্যাগখানা কাঁধে চাপিয়ে বলল, “তোমার গত দিনের পাবদাটা যা হয়েছিল না! শুধু কালোজিরে, বড়ি আর ধনেপাতা দিয়ে পাতলা ঝোল… আজও ওইভাবেই বানিয়ো, তোমার মা’র ভাল লাগবে।”
“ভাবনাটা আমার ওপরেই ছেড়ে দাও।” দেবিকা মোটেই গলেনি, “কুচো চিংড়িগুলো আনলে কোন আক্কেলে?”
“ভাবলাম যদি এঁচোড়ে দাও…”
“তার জন্য বাগদা চিংড়ি লাগে। বেশি দাম বলে আনোনি, তাই তো…”
দাম যে কারণ নয়, কেনার সময়ে তার অন্য প্ল্যান ছিল, এ কি বুঝবে দেবিকা? বরং পালটা আরও কিছু শোনাবে। শোনাবেই। সুতরাং চুপ থাকাই শ্রেয়।
“আমি তো জানি তোমার নেচার। কিপটের জাসু।” শাশ্বতর মৌনতাকেই সম্মতি বলে ধরে নিয়েছে দেবিকা। ঝনঝন করে উঠল, “এখন কে ওই চিংড়ি কুটবে? ডিপ ফ্রিজ়ে তুলে রাখছি, কাল বাজার থেকে কাটিয়ে এনো।”
ঘাড় নেড়ে সায় দিল শাশ্বত। এবার সরে পড়তে পারলে বাঁচে। এগোতে যাচ্ছিল, তার আগেই ফের দেবিকা সরব, “আজ ফিরছ কখন?”
যেমন ফিরি, মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল শাশ্বতর। গিলে নিয়েছে। বলল, “একটু দেরি হবে। হেড এগ্জ়ামিনারের বাড়ি যাওয়ার কথা। হায়ার সেকেন্ডারির খাতা আনার ডেট আছে আজ।”
“বেছে বেছে মা আসার দিনই তোমার কাজ পড়ে? আগের দিনও তোমার স্কুলে কী এক ছাতার মাথা মিটিং ছিল, তাই না?”
“সব কি আমার হাতে থাকে দেবিকা? সেদিন ম্যানেজিং কমিটির মিটিংয়ে আমার রিটায়ারমেন্টের ব্যাপারটা ছিল বলেই না আমাকে স্কুলে থাকতে হল।” শাশ্বত হাসার চেষ্টা করল, “আর তো তিনটে দিন। আজ, কাল, পরশু। তারপর থেকে তোমার মাকে আমিই না-হয় ডাক্তার দেখিয়ে আনব।”
“থাক। অত সুখ আমার সইবে না। বিয়ের এতগুলো বছর পরেও যাকে ‘তোমার মা তোমার মা’ করো…”
“ওটা জাস্ট একটা প্র্যাকটিস…”
“ও থেকেই একটা মানুষের মেন্টালিটি বোঝা যায়। জীবনে সবই তোমার ওপর ওপর… শুধুই কর্তব্য… সত্যি সত্যি প্রাণের টান যদি থাকত…”
এই অভিযোগ কী করে খণ্ডাবে শাশ্বত? তর্ক করে? যুক্তির শর হেনে? অতীতের তাক থেকে একটা একটা করে উদাহরণ পেড়ে এনে? সত্যি কি ওসব দিয়ে কাউকে কিছু বোঝানো যায়? যে বুঝবে, তার মনকেও তো তৈরি থাকতে হবে, নয় কী?
ছোট্ট শ্বাস ফেলে শাশ্বত বলল, “ঠিক আছে। চলে আসব। এগ্জ়ামিনারকে একটা ফোন করে দিলেই হবে।”
“কোনও প্রয়োজন নেই। তারপর মনে মনে আমাকে দুষবে, তাই তো? সেটি হচ্ছে না।” দেবিকার গলা হঠাৎই সামান্য নেমেছে, “যে-কথা বলতে আসা, বাবলার ব্যাপারটা নিয়ে ভাবলে?”
স্কুলে বেরনোর সময়েই কি আলোচনা করতে হবে? ঘড়ি দেখে নিয়ে শাশ্বত বলল, “যদি এই নিয়ে রাতে কথা বলি?”
“কাল রাত্তিরেও কথাটা পাড়তে দাওনি। মাধ্যমিকের খাতা দেখার ছুতো দেখালে।”
“না গো, বিশ্বাস করো। মার্কসগুলো মেলাতে পারছিলাম না…”
“ব্যাপারটা কিন্তু খুব সিরিয়াস দিকে গড়াচ্ছে, বলে দিলাম।”
পথে বেরিয়ে শাশ্বত হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যেন। বাবলাকে নিয়ে দেবিকা যথেষ্ট বিচলিত, সন্দেহ নেই। আর মা হিসেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। খারাপ কি শাশ্বতরই লাগে না? কিন্তু বাবলার দাম্পত্য অ-বনিবনায় শাশ্বতর কী ভূমিকা? সংহিতা কেন যে চলে গেল, তা কি সে ঠিকঠাক জানে? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের খাঁজখোঁজ কি অন্য কারও পক্ষে জানা সম্ভব? সেই অন্য কেউটা ছেলের বাবা-মা হলেও? দেবিকার সঙ্গে কেন যে শাশ্বতর মিলল না, আর কেউ কি তা অনুধাবন করতে পারবে?
তা ছাড়া বাবলার বিয়ে তো শাশ্বতর সমর্থন নিয়েও হয়নি। বিজ্ঞাপন দেখে সম্বন্ধ, বাবলাই প্রথম দেখতে গিয়েছিল মেয়ে। বন্ধুর সঙ্গে। তার পছন্দ হয়েছে জেনেই এক পা এক পা করে এগিয়েছিল শাশ্বত আর দেবিকা। মেয়েটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করে, বাবা ব্যাংক-কর্মচারী, মা গৃহবধূ, খড়দায় নিজেদের দোতলা বাড়ি… কোনওটাই তো বিয়েতে আপত্তি করার মতো তথ্য নয়। তবু পরিবারটির সঙ্গে আলাপ করে, মেয়েটিকে চাক্ষুষ দেখে যেন একটু খটকা লেগেছিল শাশ্বতর। মেয়ে তো শুধু স্মার্ট নয়, যেন চোখেমুখে বাক্যি ঝরে! বাবা-মাও যেন একটু বেশিই আধুনিক। না হলে প্রথম পরিচয়ের দিন কিনা ড্রিংকস অফার করে শাশ্বতকে!
বাড়ি ফিরে মন খুঁতখুঁতের কথাটা বলেছিল শাশ্বত। বাবলা তো আমলই দিল না, দেবিকাও হেসে কুটিপাটি। আজকালকার দিনে ওসব কেউ ধর্তব্যের মধ্যে আনে নাকি? একটু-আধটু ঢুকুঢুকু কোন পরিবারে না চলে! তুমি তোমার শুচিবাই নিয়েই থাকো। অকারণে ব্যাগড়া দিতে এসো না।
সেই বিয়ের ম্যাও সামলানোর দায়ও কি এখন শাশ্বতর ঘাড়ে চাপবে? কী কপাল!
অতি কষ্টে বাড়ির প্রসঙ্গটা শাশ্বত হঠাল মন থেকে। দাঁড়িয়েছে এসে বাসের প্রতীক্ষায়। রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের বাণী দিয়ে সাজানো বাসস্টপ। কী ভারী ভারী সব কথা, পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। মানার দায় নেই বলেই বোধহয় অত যত্ন করে লেখা। এক অশীতিপর বৃদ্ধ লেখাগুলো পড়ছে মন দিয়ে। মুখটা খুব চেনা চেনা। নিমাইদা না? পদ্মপুকুরের লোক হঠাৎ গড়িয়ায়?
কাছে গিয়ে শাশ্বত গলাখাঁকারি দিল, “নিমাইদা?”
“তুমি?” ঘোলাটে চশমার ওপারের চোখদুটো বুঝি একটু সময় নিল চিনতে। নিষ্প্রাণ স্বরে বলল, “ও, মন্টু? এখন বুঝি এখানেই থাকো?”
“অনেকদিন। চোদ্দো-পনেরো বছর। কাছেই ফ্ল্যাট। তা আপনি এ পাড়ায়?”
“এক পুরনো কমরেডের বাড়ি এসেছিলাম।”
“কাজ ছিল বুঝি?”
“হ্যাঁ, কাজই বলতে পারো। কমরেডের স্ত্রী গত হয়েছেন, খবর পেয়ে দেখা করে গেলাম।”
“ও। আপনি আছেন কেমন?”
“আর থাকা! বেঁচে আছি বলতে পারলে খুশি হই, কিন্তু পুরোপুরি বেঁচে আছি কি না ঠিক বুঝতে পারি না।” কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না শাশ্বতর। শুধু এইটুকু বোঝা গেল, মানুষটা ভাল নেই। বরাবরই খানিক জটিল ভাষায় কথা বলে নিমাইদা। সাধে কী পাড়ার ছেলেরা এক সময়ে এড়িয়ে এড়িয়ে চলত লোকটাকে?
শাশ্বত বলল, “বহুকাল পদ্মপুকুরের দিকে যাওয়া হয় না। ও পাড়ার খবর কী নিমাইদা?”
“পাড়া আর আছে কোথায়! ফ্ল্যাটবাড়ির ফাঁকে ফাঁকে দু’-চারজন টিকে আছে, এই যা। সীতেশরা নরেন্দ্রপুর উঠে গেল, অসীম তো পাকাপাকি মেয়ের কাছে দিল্লিবাসী, পুরনো লোক বলতে আছি শুধু আমরা আর নীতুরা।”
শাশ্বতর মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “পার্টি করছেন এখনও?”
কেমন করে যেন হাত উলটোল নিমাইদা, “উপায় কী? দাঁত মাজি, মুখ ধুই, খাবার খাই, টয়লেট যাই, পার্টিও করি।”
গলাটা যেন বেজায় হতাশ শোনাচ্ছে! তবে আর গল্পগাছার সময় নেই। বাস এসে গেছে, “চলি—” বলেই দৌড়ল শাশ্বত। বাসে উঠে ঝুঁকে দেখল নিমাইদাকে। এককালের টানটান মানুষটা কেমন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে। বয়সের ভার? নাকি প্রতাপ হারিয়ে নুয়ে গেছে শিরদাঁড়া? প্রায় তিন যুগ পর সরতে হয়েছে ক্ষমতা থেকে, এই রূঢ় সত্যি বুঝি জোশ ঝরিয়ে দিয়েছে দাপুটে নেতার। তবে নিমাইদা কোনওদিন ধান্দাবাজির লাইনে যায়নি। বিয়ে-থা করল না, পার্টি অফিসই ঘরবাড়ি, পার্টি অফিসই সংসার… শুধু পার্টির জন্যই ফুঁকে দিল জীবনটা। কী পেল? লাভটা কী হল? বিপ্লব বিপ্লব করে চেঁচাত, সেই বিপ্লব এখন কোথায়? জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে ছুটতে গিয়ে, পথ হারিয়ে, কোন খালেবিলে যে তলিয়ে গেল!
বাসের হ্যান্ডেল ধরে ভেতরে সেঁধোল শাশ্বত। দাঁড়িয়েছে সিটের সামনে। কপালজোরে সামনেই একটা আসন খালি হল, শাশ্বত বসতে যাচ্ছে, তার আগেই একজন সুকৌশলে শরীর বেঁকিয়ে দখল নিয়েছে সিটের। এবং চালাক চালাক মুখে দেখছে শাশ্বতকে।
একটু কি আহত হল শাশ্বত? তার প্রাপ্য আসনে অন্য কেউ বসে পড়বে, এ কী এখনও শাশ্বতর গা-সওয়া নয়?
শাশ্বত মেঘলা হেসে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। নিমাইদার কথাই ভাবছিল আবার। কত যে ছবি জমে আছে অ্যালবামে! উগ্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বন্ধুদের সংস্রব থেকে তখন অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে শাশ্বত। নিমাইদার বাঁধা গতের বুলিগুলোই কী যে টানত তখন! নিরাপদ পথ বলে? হয়তো বা। মনে পড়ে সেই দিনগুলো। ইলেকশনের দিন বুথ অফিসে চিরাচরিত রংজ্বলা পাঞ্জাবি পরে নিমাইদা দারুণ ব্যস্ত। ভোট দিয়ে বেরনো মাত্র বাছা বাছা কমরেডের আঙুল থেকে মুছে দেওয়া হল কালির দাগ, ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আর-একটা বুথের পোলিং স্লিপ। অন্য কারও হয়ে সেখানে ভোট দিয়ে আসছে কমরেড। শাশ্বতও তো সেবার পাঁচ-পাঁচখানা ভোট দিয়েছিল। প্রার্থী বিজন গোস্বামী ভোটের হালহকিকত দেখতে বেরিয়েছে, বিকেলের মুখে মুখে এল পোলিং অফিসে। নিমাইদা তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল শাশ্বতর। বিজন পিঠ চাপড়ে দিল শাশ্বতর। নিমাইদাও। কী বুলি! কমরেড, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে তোমার এই লড়াকু নির্ভীক অবদান মেহনতি মানুষ চিরকাল স্মরণে রাখবে।
দৃশ্যটা ভাবলে এখন নিজেকে কেমন জোকার মনে হয়। কাউকে ক্ষমতার সিঁড়িতে চড়াতে কী হাস্যকর বোড়েই না সেজেছে একদিন। আচ্ছা, নিমাইদা তো কট্টর সৎ, সেও কী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করত জাল ভোটে গদিতে এসে বিপ্লব সংঘটিত করা যায়? মহান লক্ষ্যে পৌঁছতে চুরি-জোচ্চুরি মোটেই দোষের নয়, সেই বিশ্বাস কি ভেঙে গেছে? তাই কি এত মনমরা? নাকি ইটের বদলে পাটকেল খেয়ে দিশেহারা এখন? গুন্ডামির পালটা ধাক্কায় বিক্ষত আদর্শ বহন করতে কি নিরুপায় বোধ করছে?
রোমন্থনে বাধা পড়ল। কনডাক্টর সেলিমপুর সেলিমপুর হাঁকছে। হুড়মুড়িয়ে নামতে যাচ্ছিল শাশ্বত, গেটের ছোকরা হাত আঁকড়ে ধরেছে, “টিকিট?”
শাশ্বত পলকের জন্য থতমত। তারপরেই বলে উঠল, “দিচ্ছি, দিচ্ছি।”
“হ্যাঁ, টাকাটা বের করুন। দিব্যি কেটে যাচ্ছিলেন, অ্যাঁ?”
“আমি… এই তো…”
“বুঝেছি। ঘাঘু মাল।” ভাড়াটা খামচে নিয়ে টিকিট শূন্যে ছুড়ে দিল কনডাক্টর। টিপ্পনী ভাসাল, বয়স তো অনেক হল জেঠু, এখনও স্বভাব গেল না?
শাশ্বতর কানদুটো কি ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল? কে জানে কেন, আজকাল প্রতিক্রিয়াই হয় না তেমন। ঘাড় নিচু করে হাঁটা লাগিয়েছে। বাসরাস্তা থেকে স্কুল অনেকটা পথ, সেই ট্রেনলাইন পেরিয়ে। জোরে পা চালালেও মিনিট দশেক তো লাগেই। রোদ আজ বেজায় চড়া, চাঁদি ফাটিয়ে দিচ্ছে। মেয়াদ তো আর তিন দিন, একটু বিলাসিতা করলে কেমন হয়? খানিক দোনামোনা করে রিকশা নিল শাশ্বত। মানুষের জঙ্গল কাটিয়ে কাটিয়ে চলছে রিকশা। লেভেল ক্রসিং-এ স্থবির হয়ে রইল খানিকক্ষণ। স্কুলগেটে যখন পৌঁছল, প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়ছে।
হ্যাঁ, স্কুল বসার আগে হরনাথ বিদ্যাপীঠে প্রার্থনার নিয়ম এখনও আছে বটে। তবে আদতে যা হয়, তা এক ধরনের মিশ্র কোলাহল। ‘জনগণমন’ যে কত বিচিত্র সুরে গাওয়া যেতে পারে, কান খাড়া করে না শুনলে বোঝা কঠিন। তবু গায় তো ছেলেগুলো। শিখছে তো। এবং প্রার্থনার শেষে যে-উল্লাসধ্বনি ওঠে, তাও কি কম চিত্তাকর্ষক!
তা প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি কী আশা করা যায়? আর হরনাথ বিদ্যাপীঠে এমন ছাত্রই তো জোটে এখন। অথচ একসময়ে এই স্কুলের নামডাক নেহাত কম ছিল না। বোর্ডের পরীক্ষায় স্ট্যান্ড পর্যন্ত করেছে, স্টার তো পেত ভূরিভূরি। আর এখন পাঁচজন ফার্স্ট ডিভিশন পেলে আনন্দে ছুটি ঘোষণা করা হয়। ছাত্রের সংখ্যাও হাজার থেকে কমতে কমতে সাড়ে চারশো।
সেই পুরনো গৌরবের দিনগুলোর ছিটেফোঁটা দেখেছে শাশ্বত। ক্রমাগত রক্তক্ষরণে একটু একটু করে অ্যানিমিক হয়ে যাওয়া তো তার চোখের সামনে ঘটল। তখন প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত, আস্তে আস্তে মাথা কখন যে অসাড়। এখন তো স্কুলে পা রাখলেই ঝিম মেরে যায় চেতনা।
তবু তো ক্লাসে যেতেই হয় শাশ্বতকে। অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার বগলে নিয়ে, চক-ডাস্টার হাতে। প্রথম পিরিয়ডে আজ ক্লাস এইট। অষ্টম শ্রেণির সে ক্লাস-টিচারও বটে। রোল কল করল রীতিমাফিক। আটত্রিশ জনের মধ্যে উপস্থিত মাত্র বাইশ। হাজিরা নিয়ে কড়াকড়ির জো নেই। কর্তৃপক্ষের নির্দেশ, অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে যেন হল্লাগুল্লা না হয়। তাতে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। আর ছাত্র কমা মানে সমূহ সর্বনাশ। সরকারি এড কমে যাবে, হাজারো কৈফিয়ত দিতে হবে। তার চেয়ে বরং যেমনটা চলছে, তেমনই চলুক। ধুঁকতে ধুঁকতে।
আজকের পাঠ্য শরত্চন্দ্রের একটা পিস। ‘পল্লীসমাজ’ থেকে। জমিদারের অত্যাচার, রমেশের প্রতিবাদ…। শাশ্বতর পড়ানোর ধারাটি একটু অন্যরকম। প্রথমে গোটা পিসটাকে বলে দেয় গল্পচ্ছলে। যদি শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা কোনও ছাত্রের আগ্রহ জন্মায়! তারপর কোনও একটি ছাত্রকে ডেকে নিয়ে জোরে জোরে রিডিং পড়তে বলে খানিকটা। পরের জনকে দিয়ে আর-একটু পড়ায়, তার পরের জনকে দিয়ে আর-একটু। এভাবে গোটা গদ্যটাই একবার শোনা হয়ে যায় ছেলেদের।
তৃতীয় জনে পৌঁছে আটকে গেল আজ। রাহুল মণ্ডল ছেলেটা বেণীপ্রসাদ উচ্চারণই করতে পারছে না। এখনকার যা দোষ, র-ফলা বেরোয় না জিভ দিয়ে। পুরো প্যারাগ্রাফ পড়বে কী, দুটো বাক্য শেষ করতে তার গলদঘর্ম দশা।
তাকে বসতে বলে শাশ্বতর চোখ আচমকা লাস্ট বেঞ্চে। সে যখন গল্পটা শোনাচ্ছিল, কেমন একটা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল শেখর। এখন হাইবেঞ্চে মাথা রেখে ভোঁসভোঁস ঘুমোচ্ছে।
অন্য শিক্ষকদের মতো ধমকাতে পারে না শাশ্বত। অল্প গলা উঠিয়ে বলল, “অ্যাই, অ্যাই…”
শেখর বেমালুম নিদ্রায়।
শেখরের পাশে মঈদুল। সে ঠেলল বন্ধুকে, অ্যাই, জাগছিস না কেন? স্যার ডাকছেন না?
ধড়মড়িয়ে দাঁড়িয়েছে শেখর। চোখ কচলাচ্ছে।
শেখরের চেহারাটি ডিগডিগে। কিন্তু বেশ লম্বা। চুলের ছাঁটে বাহার আছে। স্কুল ইউনিফর্মের নীল শার্টটি কোঁচকানো-মোচকানো।
শাশ্বত ভুরু ওঠাল, “ব্যাপারটা কী অ্যাঁ? রাতে ঘুমোসনি?”
পলক শাশ্বতকে দেখে নিয়ে শেখর জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল।
“কী করিস রাতে? টিভি দেখিস বুঝি?”
“না স্যার। ক্যাটারিং করতে গিয়েছিলাম।” শেখরের এবার সপ্রতিভ জবাব, “অনেক রাতে ফিরেছি।”
“তুই… ক্যাটারিং করে বেড়াস?”
“যাই একজনের সঙ্গে। পার ডে একশো দেয়।”
“পড়াশোনা শিকেয় তুলে তুই রোজগারে নেমে গেছিস?”
“কী করব স্যার? সংসারের পোয়োজনে তো করতেই হবে।”
“পোয়োজন না, বল প্রয়োজন—” শাশ্বত শুধরে দিতে যাচ্ছিল, তার আগে আর-এক বেঞ্চি থেকে ফচকে আওয়াজ, “ও ঢপ মারছে স্যার। টাকা দিয়ে মোবাইলে পয়সা ভরে।”
শাশ্বত কয়েক পা এগিয়ে এল, “কী রে, তাই?”
কঠোর চোখে একবার চুকলিখোরকে মেপে নিয়ে শেখর মাথা নামিয়ে গোঁজ। অর্থাৎ অভিযোগটা মিথ্যে নয়। তবু শাশ্বত বকতে পারল না শেখরকে। নামী-দামি স্কুলের বাচ্চাদের হাতে হাতে মোবাইল। দেখে শেখরদের তো লোভ জাগতেই পারে। তা সে সমাজের যে-তলা থেকেই আসুক না কেন। হয়তো ছেলেটার বাবা রিকশা টানে, মা কাজ করে লোকের বাড়ি, কিন্তু তার জন্য ওর ইচ্ছেটা কি মরে যাবে? টাকাটা সে খেটে জোগাড় করছে, এও তো নিন্দের কাজ নয়। শুধু একটা খেলনার নেশায় লেখাপড়াটা জলাঞ্জলি যেতে বসেছে, এটাই বিপদ। আরও বিপদ, এটা যে কত ভয়ংকর বিপদ সেটা শেখর বোঝেই না। তবে লেখাপড়া শিখেও যে একটা সুস্থ জীবন পাবে, এমনটাও এরা ভাবে কী? শাশ্বতরাই কি পেরেছে সেই বিশ্বাসটুকু জোগাতে? তাই ছড়ানো-ছেটানো সস্তা লোভের ফাঁদে শেখরদের পা পড়বেই। আর শাশ্বতদের তা ড্যাবড্যাব করে দেখতেও হবে।
বেল পড়ল। শাশ্বত চক-ডাস্টার নিয়ে বেরোতে গিয়েও কী ভেবে শেখরের সামনে এল আবার। কাঁধে হাত রেখে নরম করে বলল, “পড়াশোনা করতে একদম ইচ্ছে করে না, না রে?”
শেখর চুপ। দাঁড়িয়ে নখ খুঁটছে।
“সুযোগ জীবনে বারবার আসে না রে। বয়সটাও পালিয়ে যায়।” শাশ্বত মিনতির সুরে বলল, “আমার তো পরশুই শেষ। আর জ্ঞান দিতে আসব না। দিনগুলো হেলায় নষ্ট করিস না বাপ, পরে কিন্তু অনেক কাঁদতে হবে।”
এমন উপদেশ আগেও দিয়েছে শাশ্বত। আজও বিফলে যাবে জেনেও বলল স্বভাবমতো। ধীর পায়ে ফিরছে স্টাফরুমে। হঠাৎ একটা দরকারি কথা মনে পড়ল। পথ বদলে এল অফিসে।
হেডক্লার্ক নীলেশ তরফদার চা খাচ্ছিল। তার টেবিলে গিয়ে দাঁড়াল শাশ্বত। হাসি হাসি মুখ করে বলল, “ওটা পেয়েছেন বড়বাবু?”
শেষ চুমুক দিয়ে গ্লাস সরিয়ে রাখল নীলেশ। ভুরু তুলে বলল, “কোনটা?”
“ওই যে শনিবার বললেন, আমার সার্ভিসবুকটা ট্রেস করা যাচ্ছে না…”
“ও হ্যাঁ। পেয়ে যাব। আলমারি-টালমারিতে দেখতে হবে।”
“প্লিজ়, একটু দেখুন। কয়েকটা জায়গায় নাকি সই নেই…”
“করিয়ে নেব। অত ছটফট করছেন কেন?”
“সার্ভিসবুক না পেলে তো আমার পেনশনের কাগজপত্র আটকে থাকবে।” শাশ্বত নিচু গলায় বলল, “এখন তো নিয়ম হয়েছে, রিটায়ারমেন্টের অনেক আগে ওগুলো পাঠিয়ে দিতে হয়…”
“তো? আমি কি বসে আছি? কাজ করছি না?” নীলেশ খেঁকিয়ে উঠল, “খুব যে নিয়ম দেখাচ্ছেন, অ্যাঁ? কেন পাঠানো হয়নি হেডস্যারকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।”
“উনি তো বললেন আপনার কাছে খোঁজ নিতে।”
“আমার যা বলার সে তো বললাম। এবার আসুন। বারবার ডিসটার্ব করবেন না। তাতে কিন্তু কাগজপত্র পাঠাতে আরও দেরি হবে। সেই ভোগান্তির দায় কিন্তু আমি নিতে পারব না।”
কী বলবে ভেবে না পেয়ে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শাশ্বত। তারপর সরে এল আস্তে আস্তে। যেতে যেতে নীলেশের মন্তব্য কানে ঠেকল, “উফ, জ্বালিয়ে মারল। এখনও রিটায়ার করল না, এখনই গলা শুকিয়ে কাঠ। যেন কাগজ পেলেই পরদিন পেনশন পেয়ে যাবে, ফুঃ। কত মাইনে বাড়ল, তবু মাস্টারমশাইদের ভিখিরিপনা ঘুচল না!”
কেন যে এইসব বলছে নীলেশ! শাশ্বত কি অন্যায় কিছু দাবি করেছে? সত্যি বলতে কী, দাবিও নয়, সে তো শুধু অনুরোধ জানাতে গিয়েছিল। মানুষকে মিছিমিছি হেনস্তা করে বাড়তি কোনও তৃপ্তি মেলে কী? কে জানে!
মাঝারি সাইজ়ের টিচার্স রুম। দেওয়ালে তারকার ছড়াছড়ি। বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ, মাইকেল, বঙ্কিম, জগদীশচন্দ্র, সত্যেন বোস— কে আছেন আর কে নেই! এত তারকার বিচ্ছুরণেও ঘরখানা বেশ অন্ধকার অন্ধকার। দু’-দু’খানা টিউব জ্বলছে, তবু যেন ম্লান ভাব কাটছে না।
লম্বাটে টেবিল ঘিরে জনা বারো শিক্ষক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গুলতানি জুড়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই, এখন রীতিমতো ক্লাস চলছে স্কুলে। বড় ঘড়িতে চোখ পড়তে এক-আধজন উঠে দাঁড়াচ্ছে আচমকা। তারপর চক-ডাস্টার হাতে অলস পায়ে ছাড়ছে স্টাফরুম।
শাশ্বতর আজ সারাদিনে এই একটা পিরিয়ডই অফ। বাথরুম ঘুরে এসে জগ থেকে দু’ঢোঁক জল খেল। দেওয়ালের গায়ে সার সার লকার, গিয়ে নিজের প্রকোষ্ঠখানি খুলেছে। দু’-চারখানা বই রয়েছে, আর প্রচুর হাবিজাবি কাগজ। ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছে।
ঘরের উলটো কোণ থেকে সুবীরের গলা, “এত মন দিয়ে কী করছেন শাশ্বতদা?”
“কিছু না ভাই। চেম্বার সাফ করছি।”
“ও হ্যাঁ, পরশু তো আপনার… তা ভেতরে মণিমুক্তো কিছু আছে নাকি?”
“নাহ্। সবই পাথর।” একরাশ কাগজ জড়ো করে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে গুঁজে দিল শাশ্বত। হালকা সুরে বলল, “বইগুলো নিয়ে যাব কি না ভাবছি।”
“কী বই?”
“একটা মেঘনাদবধ কাব্য উইথ টীকা। আর কয়েকখানা পাবলিশারের উপঢৌকন। লাইব্রেরিতেই দিয়ে যাই, কী বলো?”
উৎপল ফোড়ন কাটল, “বাড়িতে তা-ও জ্বালানি হিসেবে কাজে লাগতে পারে। লাইব্রেরিতে সে চান্সও নেই।”
“সত্যি, কী হয়েছে লাইব্রেরির হাল! রেফারেন্স বই কেনে না, খালি মানেবই ঢোকাচ্ছে।” সুবীর গজগজ করছে, “আপনি খুব লাকি শাশ্বতদা, টাইমে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের যে কী দশা হবে!”
“কেন? খুব খারাপ আছেন নাকি?” উৎপল যেন তেড়ে উঠল, “আগে বুঝি স্বর্গে ছিলেন? এখন নরকযন্ত্রণা ভোগ করছেন?”
“গায়ে পড়ে এসব প্রসঙ্গ তুলছেন কেন? আমি তো আপনার সঙ্গে কথা বলছি না।”
“আপনার ইঙ্গিতটা তো আমি বুঝেছি। সেই ছড়ি ঘোরানোর দিন আর ফিরবে না। এটা মাথায় রাখুন।”
“দারুণ পালটি খেয়েছেন তো? আপনিই না তখন আমায় ধরেছিলেন, যাতে ইনক্রিমেন্টটা না আটকায়?”
ব্যস, লেগে গেছে ধুন্ধুমার। স্টাফরুম যেন রণক্ষেত্র। যারা খুচরো-খাচরা গল্পে মেতে ছিল, তারাও চেল্লাচ্ছে সমানে। অবলীলায় একে অপরের মুণ্ডুপাত করছে।
বিশ্রী লাগছিল শাশ্বতর। দিনের পর দিন একসঙ্গে চাকরি করেও সহকর্মীর সম্পর্কে এত বিষ জমিয়ে রাখা যায়, বিশ্বাস করা মুশকিল। ছাত্ররা শুনছে, দরজায় উঁকি মারছে, তবু কারও হুঁশ নেই। কেন যে থামতে জানে না!
হঠাৎই উৎপল চেয়ার ছেড়ে উঠে এল। পিঠে হাত দিয়ে শাশ্বতকে সরিয়ে নিয়ে গেল বাইরেটায়। চাপা গলায় বলল, “একটা কাজের কথা শুনুন। কাল আসছেন তো?”
“এখন অযথা কামাই করব কেন? আর কাল তো টিচার্স কাউন্সিলের ইলেকশন…”
“হ্যাঁ, ওটার জন্যেই ডাকা। জানেন তো অনেকে চাইছে এবার আমি সেক্রেটারি হই?”
“হুঁ। নীতীশ আর সর্বজিৎ বলছিল।”
“আপনার ভোটটা নিশ্চয়ই আশা করতে পারি?”
“সে দেখা যাবে’খন।” শাশ্বত এড়াতে চাইল, “আমাকে নিয়ে আর টানাটানি কেন? এই শেষ সময়ে… দলাদলিতে…”
“আপনি চলে যাচ্ছেন বলেই ভোটটা এগিয়ে আনা হয়েছে শাশ্বতদা। আমরা আপনার মতকে অনার করি কিনা।” উৎপল সামান্য চোয়াল ফাঁক করল, “আশা করব, আপনিও আমাদের মতকে সম্মান করবেন। মানে আমাকে যারা চাইছে আর কী। আপনাদের পেনশন-টেনশনগুলো যাতে তাড়াতাড়ি হয়, তার জন্য লড়ার সুযোগ তো আমায় করে দিন।”
ইশারা অতি স্পষ্ট। ভোটটি না পেলে শাশ্বতর পেনশনে যথেষ্ট ব্যাগড়া দেবে উৎপল। বর্তমানে যারা সরকার চালাচ্ছে, উৎপল এখন ডিগবাজি খেয়ে তাদের লোক। সুতরাং ভয় দেখানোর অধিকার তার আছে বই কী!
মেজাজ কষটে মেরে গেল শাশ্বতর। আতঙ্কে নয়, বিতৃষ্ণায়। পরের ক্লাসগুলো যন্ত্রের মতো সারল। স্কুল ছুটি হতেই বেরিয়ে পড়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে ইতিকর্তব্য স্থির করছিল শাশ্বত। দীনেশবাবুর বাড়ি যাবে কি আজ? খাতা আনতে? দেবিকা তো অনুমতি দিয়েই দিল। কিন্তু কিন্তু…
শাশ্বত খানিক বাতাস ভরল ফুসফুসে। পকেট থেকে বের করেছে মোবাইল। টকটক নাম্বার টিপছিল দীনেশবাবুর। মনে মনে তৈরি করছে অজুহাত।
ক্ষীণ আশা জাগছিল বুকে। যদি দেবিকা খুশি হয়…
তিন
বাঘাযতীন মোড়ে আটকে আছে মিনিবাস। কনডাক্টর কোথায় বেপাত্তা, চালকের সিটে ড্রাইভার মৌজসে সিগারেট ধরিয়েছে, এদিকে যাত্রীরা অন্দরে ঘেমেনেয়ে একসা। এক-আধজন টিপ্পনী ছুড়ছে, কেউ-বা রাগে গালিগালাজ ভাসাচ্ছে হাওয়ায়, বাকিরা নিরাসক্ত ভঙ্গিতে সেদ্ধ হচ্ছে গরমে। তবু কেউ নেমে খবর নিতে উৎসাহী নয়, কোন অপরাধে তাদের এই দুর্ভোগ। ভিড় বাসে যেটুকুনি স্থান জুটেছে, হোক না তা অস্বাচ্ছন্দ্যে দুঃসহ, পাছে সেটুকুও হারাতে হয়!
শাশ্বত ছটফট করছিল। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা এভাবে চটকে যাবে? দেবিকা কি বিশ্বাস করবে সে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছিল? তার কোন কথাতেই বা আস্থা আছে দেবিকার? পেনশন পেতে চার-ছ’মাস দেরি হলে সংসার চালাতে অসুবিধে হতে পারে, এটুকুও তো সে দেবিকাকে বুঝিয়ে উঠতে পারল না? ছেলে-ছেলেবউয়ের কোন্দলে সর্বদাই ছেলের হয়ে ওকালতি করাটা যে সঠিক কাজ নয়, বাবলারও অনেক দোষ আছে, এই রূঢ় সত্যটি কি মানাতে পারল দেবিকাকে? কিংবা ঝুমকি যে তার বরটির সঙ্গে মোটেই…
চিন্তার খেই হারিয়ে গেল। কনডাক্টর নিচ থেকে চেঁচাচ্ছে, “নেমে আসুন, নেমে আসুন, বাস আর যাবে না…”
একজন প্রশ্ন ছুড়ল, “কেন ভাই?”
“গাঙ্গুলিবাগানে কী সব লাফড়া হয়েছে। বাস অটো ট্যাক্সি কিচ্ছু যেতে দিচ্ছে না পুলিশ।”
“হয়েছেটা কী?”
“মামারা দাঁড়িয়ে আছে, গিয়ে জিজ্ঞেস করুন।”
অগত্যা অবতরণ। হুড়মুড়িয়ে। অকারণে ধাক্কাধাক্কি করে। নেমেই একজন ধরেছে কনডাক্টরকে, ভাড়াটা ফেরত দাও ভাই।
“বাসের তো কোনও ফল্ট নেই। রিটার্ন হবে না।” কনডাক্টর এক ফুঁয়ে নস্যাৎ করে দিল দাবি। গলা উঁচিয়ে বলল, “জলদি করুন, জলদি করুন। বাস ঘোরাতে হবে। স্সাল ট্রিপটাই মাইরি বেকার করে দিল।”
দুটো বাচ্চা আর এক মহিলাকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছে এক ভদ্রলোক। নার্ভাস মুখে জিজ্ঞেস করল, “পলিটিকাল ঝামেলা নাকি?”
“তা ছাড়া আর কী!” ভিড়ের মধ্যে থেকে তুরন্ত জবাব হাজির, “যা চলছে চারদিকে। আগে তাও দু’ পার্টিতে লাগত, এখন তো এক পার্টিতেই কামাল।”
সঙ্গে সঙ্গে সংযোজন, “কর্পোরেশন ইলেকশন আসছে মশাই, এখন বাড়বে বই কমবে না। দেখুন না, ক্যান্ডিডেট সিলেকশন নিয়ে কেমন কাজিয়া বাঁধে।”
অধৈর্য মানুষদের সংলাপ এলোমেলো কানে আসছিল শাশ্বতর। তবে শুনছিল না সেভাবে। মিনিট কয়েক নিশ্চল থেকে শুরু করল হাঁটা। দূর যতই হোক, পৌঁছতে তো হবেই। খানিকটা গিয়ে থোকা থোকা জটলা। দোকানপাট বন্ধ, উত্তেজিত কিছু মুখ ঘোরাফেরা করছে রাস্তায়। দু’খানা পুলিশভ্যানও মজুত। শাশ্বত বিন্দুমাত্র কৌতূহল বোধ করল না, ঘাড় নিচু করে পেরিয়ে এল জায়গাটা। দৈনন্দিন এই আকচাআকচির রাজনীতি তাকে তেমন টানে না আজকাল। সেও যে এককালে দলীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ সংস্রবে ছিল, ভুলে যেতে পারলেই যেন বাঁচে এখন।
বহু বছর আগে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ পড়েছিল শাশ্বত। খুবই জটিল তত্ত্ব, শাশ্বতর মগজও তেমন ধারালো নয়, তাই বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। তবে বস্তুবাদ যখন ভোগবাদে বদলে যায়, সে সময়ে দ্বন্দ্ব মানে যে শুধুই মারপিট এটুকু সে ভালমতোই হৃদয়ঙ্গম করেছে অ্যাদ্দিনে। হয়তো রাজনীতি নিয়ে তার এই উদাসীনতা তাই এত নিখাদ।
পাড়ার মুখটা শুনসান। যেন চৈত্রের দুপুরেই আটকে আছে বিকেলটা। একমাত্র সিগারেটের দোকানটাই যা খোলা, তারস্বরে এফ এম চালিয়ে গান শুনছে গোবিন্দ।
শাশ্বতকে দেখে গোবিন্দ নেমে এল দোকান ছেড়ে, “মাস্টারমশাই কি হেঁটে হেঁটে আসছেন?”
শাশ্বত ঘাড় নাড়ল।
“মরেছে-টরেছে কেউ? কিছু শুনলেন?”
মৃত্যুর খবরে মানুষের উৎসাহ যেন বাড়ছে দিনদিন! শাশ্বত অল্প মাথা দোলাল, “না তো!”
“যা বোমাবাজি হচ্ছিল, বাপ্স।” গোবিন্দর গলা আরও খাদে, “টকাই হালদার নাকি নমিনেশন পাচ্ছে না। তাই আজ ফুল ফোর্স নামিয়ে দিয়েছিল।”
কে টকাই, কেন যে তাকে কাউন্সিলার বনার জন্য ফুল ফোর্স নামাতে হয়, শুনতে চায় না শাশ্বত। কিন্তু কেন কে জানে গোবিন্দ তাকে জানাতে আকুল। সে গোবিন্দর খদ্দের নয়, পান-জরদা-সিগারেট কোনওটাই খায় না, তবু কেন যে তাকে পাকড়াও করল!
মুক্তিপণ হিসেবে শাশ্বত এক পাউন্ড পাউরুটি কিনে ফেলল। থাকলে তো লেগেই যাবে সংসারে।
শাশ্বতর ফ্ল্যাট তিনতলায়। নিয়মিত মর্নিংওয়াকের অভ্যেস সত্ত্বেও সারাদিন খাটাখাটুনির পর সিঁড়ি ভাঙতে একটু কষ্ট হয় আজকাল। তার ওপর এতটা হাঁটা। দরজায় পৌঁছে শাশ্বত দম নিল খানিক। নিশ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার পর বেল বাজিয়েছে।
দেবিকাই খুলল দরজা। একটু যেন অবাক, “তুমি! এত তাড়াতাড়ি?”
“বললামই তো চলে আসব।” ঢুকে চটি ছাড়ল শাশ্বত। ঈষৎ উজ্জ্বল স্বরে বলল, “কী ঝকমারিতে যে পড়েছিলাম! গাড়িঘোড়া বন্ধ, সেই কদ্দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসা…”
যেরকম প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল, তেমনটা যেন হল না। দেবিকা চিন্তিত স্বরে বলল, “হুম। কিন্তু মা তো ফিরবে বলে জেদ ধরেছে।”
এতক্ষণে দেবিকার পোশাক-আশাকে নজর পড়ল শাশ্বতর। পরনে ভাঁজভাঙা তাঁতের শাড়ি, কাঁধে খোঁপা, কপালে লাল চাকা টিপ। একটু যেন ঘাম লেগে আছে মুখে। বোঝাই যায় বাইরে থেকে ফিরছে এইমাত্র।
শাশ্বত তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, “ডাক্তার দেখানো হল?”
“হ্যাঁ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেই সাড়ে তিনটেয় গেছি, পাঁচটায় ডাকল।”
“খুব ভিড় ছিল বুঝি?”
“নয়তো কী এমনি এমনি বসে ছিল মা?” দেবিকা পলকা ভ্রুভঙ্গি করল— “গিয়ে মা’র সঙ্গে কথা বলো, চা নিয়ে আসছি।”
দেবিকার হাতে পাউরুটিখানা ধরিয়ে দিল শাশ্বত। রান্নাঘরে ঢুকতে গিয়েও ঘুরেছে দেবিকা, “টোস্ট-ফোস্ট কিছু খাবে? বানিয়ে দেব?”
“আমি? একা? তোমার মা-ও যদি খান…” দেবিকার ভুরুর ভাঁজ দেখে থমকাল শাশ্বত। ওফ, ‘তোমার’ শব্দটা বেরিয়েই গেল? দ্রুত সংশোধন করে বলল, “মা নিশ্চয়ই কিছু খাবেন এখন?”
প্রসন্ন হল কি দেবিকা? শাশ্বত ঠিকঠাক পড়তে পারল না। তবে ভুরুর ভাঁজ মিলিয়েছে, এই যা ভরসা। স্বরও যেন সহজ। বলল, “আজ অবেলায় খাওয়া হয়েছে। মা বোধহয় এখন কিছু খাবে না।”
“ও তা হলে দাও দু’ পিস।”
শোওয়ার ঘরে এল শাশ্বত। ইন্দিরা বিছানায়। বাজুতে হেলান দিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে মোবাইলে। শাশ্বত চেয়ার টেনে বসল। স্মিত মুখে।
জামাইকে দেখে ইন্দিরার ঠোঁটে পাতলা হাসি। আলাপচারিতার মাঝে হাত তুলল একবার। আবার ডুবেছে কথায়।
ইন্দিরার প্রতি এক বিশেষ ধরনের শ্রদ্ধা আছে শাশ্বতর। অত্যন্ত লড়াকু মহিলা, এই বয়সেও প্রাণশক্তিতে ভরপুর। দেবিকার বাবা যখন ক্যানসারে মারা যায়, মহিলার দুই ছেলেমেয়েই বেশ ছোট। দেবিকার ক্লাস নাইন, দেবল সবে সিক্স। স্বামী ছিল অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির ফোরম্যান, কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে ওখানেই অফিসে চাকরি পেয়েছিল ইন্দিরা, অনেক ঝড়ঝাপটা সয়ে প্রায় একা হাতেই মানুষ করেছে ছেলেমেয়েদের। দেবিকার মুখেই শোনা, অফিসে এক সহকর্মী নাকি প্রেমে পড়েছিল ইন্দিরার। আমল না পেয়ে সে নাকি ইন্দিরার সম্পর্কে কুত্সা রটিয়েছিল অনেক। ইন্দিরা শুধু উপেক্ষার বর্ম দিয়ে প্রতিহত করেছিল সেই সব বিষ তির। এমন সাহসী মহিলাকে তো বাড়তি সম্মান করতেই হয়।
ফোন ছেড়ে ইন্দিরাই কথা শুরু করল, “কী গো, কেমন লাগছে চাকরি-জীবনের শেষ দিনগুলো?”
শাশ্বত অল্প হাসল, “তেমন একটা কিছু ফিল করছি না। হয়তো রিটায়ারমেন্টের পর টের পাব।”
“তুমি তো স্কুলের চাকরিটা রেলিশ করো।”
“এখন খুব-একটা নয়।”
“তা হলে আর কী! কিচ্ছু মিস করবে না। প্রথম কয়েকদিন একটু ফাঁকা ফাঁকা লাগবে, তারপর দিব্যি নতুন লাইফটাও অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে।”
শাশ্বত মন থেকে মানতে পারল না কথাটা। প্রায় তিন যুগ স্কুলে পড়িয়েও কাজে সে তৃপ্তি পেল কই? না পারল মনের মতো করে পড়াতে, না পেল একটাও চমকে দেওয়া ছাত্র, না জুটল পছন্দমতো সহকর্মী, না মিলল পড়ানোর সুষ্ঠু পরিবেশ। হয়তো ত্রুটি তারও আছে, কিন্তু অপ্রাপ্তিটা তো সত্যি। এত বছর সংসার করল দেবিকার সঙ্গে, তাতেও কি ঠিকঠাক বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে? কোথাও কি একটা কাঁটা ফুটে থাকে না? জন্ম থেকেই তো ঝিমলি বাবলাকে দেখছে শাশ্বত। চোখের সামনে তারা একটু একটু করে বড় হল, গা ঘেঁষে রইল এত বছর, তারপরেও কি শাশ্বত তাদের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে চলতে পারছে? তা হলে অবসর জীবন মসৃণ গড়াবে, এমন ভাবনা কি দুরাশা নয়? প্রসঙ্গটা পালটে দিল শাশ্বত। হেসে বলল, “আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট ছিল।”
“বলো?”
“আজ আর যাদবপুরে নয় নাই ফিরলেন।”
“অ। ইন্দিরার চোখ সরু, খুকু বুঝি তোমায় দূত করে পাঠাল?”
“না, ঠিক তা নয়। বাইরে গোলমাল হচ্ছে, কোথায় কোন ঝামেলায় পড়ে যাবেন…”
“এ শহরে ওরকম খুচরো-খাচরা গণ্ডগোল হয়, মিটেও যায়… ও নিয়ে অত ভাবলে চলে?”
“তবু ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী?”
“বেঁচে থাকাটাই তো একটা বড় ঝুঁকি শাশ্বত। ভেবে দ্যাখো তো, জীবনে কতবার মৃত্যু তোমার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে? বাসে উঠতে যাচ্ছ, পা স্লিপ করে গেল কিন্তু তুমি চাকার নীচে গেলে না। ট্রেনে উঠতে গিয়ে হয়তো ছিটকে প্ল্যাটফর্মে পড়লে। ট্রেনের তলাতেও তো পড়তে পারতে। ছাদের কার্নিশে ঝুঁকে নিচটা দেখছ, মুহূর্তের জন্য ভারসাম্য টলে গেল, তুমি আর নেই। একসময়ের তীক্ষ্ণ চোখমুখ চেহারার রোগাসোগা ইন্দিরা মিটিমিটি হাসছে, গুনে বলো তো, রাস্তা পার হতে গিয়ে কতবার গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচেছ?”
শাশ্বত যেন চমকে উঠল। যে-রাতে ভাস্বর পুলিশের গুলি খেল, তার আধ ঘণ্টা আগেই তো শাশ্বতর সঙ্গে ছিল। পোদ্দার নগরের মোড়টায়। যদি আধ ঘণ্টা আগে পুলিশ ভাস্বরের সন্ধান পেত, বুলেট কার প্রাণ নিত তা নিশ্চিত বলা যায়?
বুঝি সেই রাতটাকে চোখ থেকে মুছতেই শাশ্বত বিড়বিড় করে উঠল, “ওগুলো তো অ্যাক্সিডেন্ট। যখন-তখন ঘটতে পারে।”
“ঝুঁকি আর অ্যাক্সিডেন্ট তো একই টাকার এপিঠ-ওপিঠ। ঝুঁকি না নিলে কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়? একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া?” ইন্দিরার শুকনো গালের হাসি ছড়িয়ে গেল, “আরে ঝুঁকি না নিলে জীবনটাই পানসে হয়ে যায় না?”
.
[‘দেশ’ শারদীয় সংখ্যায় সুচিত্রা ভট্টাচার্যের অনন্য উপন্যাস ‘দহন’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালে। সেই শুরু। তারপর ‘পরবাস’, ‘হেমন্তের পাখি’, ‘অলীক সুখ’, ‘ছেঁড়াতার’ প্রভৃতি জনপ্রিয় উপন্যাস একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে। পুজো সংখ্যায় তাঁর উপন্যাস প্রকাশের গৌরব আমরা আরও বহন করতে পারতাম। কিন্তু এবছর তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে (১২ মে ২০১৫) তাতে ছেদ ঘটল। ছোটদের জন্য একটি রহস্য উপন্যাস লেখা শেষ করেই ‘দেশ’-এর জন্য এই কাহিনিটি তিনি লিখতে শুরু করেছিলেন। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও অনেকটা লিখেওছিলেন। তাঁর অন্যান্য উপন্যাসের মতো এখানেও গৃহীত হয়েছে মধ্যবিত্তের চলমান জীবন। গল্পের প্রেক্ষাপটে আছে সমসময়। এমনকী, গ্রিসের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথাও প্রসঙ্গত এসেছে। দুঃখের বিষয়, তিনি কাহিনিটি সমাপ্ত করতে পারেননি। এই অসমাপ্ত উপন্যাসটি সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কথাসাহিত্য রচনার শেষ স্মরণীয় ফলক।]