উনবিংশ পর্ব
অ্যাগামেমনন ও অ্যাকেলিসের পুনর্মিলন
স্বর্গ ও মর্ত্যলোকে আলোর প্লাবন আনার জন্য গায়ে রাঙা জামা পরে ঊষাদেবী যখন ওসিয়ানাস নদীর গর্ভ হতে উঠে আসছিলেন ধীরে ধীরে, থেটিস তখন সেই দেবদত্ত বর্ম ও বর্শা নিয়ে উপস্থিত হলেন গ্রীকরণতরীগুলোর মাঝে। গিয়ে দেখলেন, তাঁর পুত্র প্যাট্রোক্লাসের মৃতদেহটি জড়িয়ে ধরে তখনো কাঁদছে আকুলভাবে। তার কয়েকজন অনুচরও কাঁদছিল অ্যাকেলিসের সঙ্গে। থেটিস গিয়ে অ্যাকেলিসের একটি হাত ধরে বললেন, হে আমার পুত্র, দেবতাদের ইচ্ছানুসারে যখন এর মৃত্যু ঘটেছে তখন যতই দুঃখই আমাদের হোক না কেন, এ মৃত্যুকে সহজভাবে অবশ্যই মেনে নিতে হবে আমাদের। এখন ওঠ, হিফাস্টাননির্মিত এই আশ্চর্য বর্ম গ্রহণ করো। আজ পর্যন্ত কোন মর্তমানব এ বর্ম পরিধান করতে পায় নি।
এই কথা বলতে বলতে অ্যাকেলিসের গায়ের উপর বর্মটি চাপিয়ে দিলেন থেটিস। সে বর্ম দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলে মার্মিনরা, ভয়ে তাকাতে পারল না তার দিকে। দেবদত্ত কেউ উপহারটি লাভ করে একদিকে যেমন আনন্দিত হয়েছিলেন অ্যাকেলিস মনে মনে, অন্যদিকে তেমনি তার সুহৃদহন্তার প্রতি এক প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়লেন। এক ভীষণতীব্র আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চোখ দুটো। বর্মটি ভালো করে দেখে অ্যাকেলিস বললেন, হে মাতঃ, যে বর্ম দেবশিল্পী নির্মাণ করে আমাকে দান করেছেন সে বর্ম কোন মানুষ নির্মাণ করতে পারে না। আমি এবার অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হব। কিন্তু আমার একমাত্র ভাবনা মীনোতিয়াসপুত্রের দেহে মাছি বসে যদি ডিম পাড়বে তার ক্ষতগুলোতে। তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহের মাংসের পচন ধরবে এবার।
থেটিস উত্তর করলেন, হে আমার পুত্র, এবিষয়ে কোনরূপ চিন্তা করবে না। মৃতদেহে ঝাঁকে ঝাঁকে যে সব মাছি বসে সেই মাছির হাত থেকে আমি তার দেহটিকে রক্ষা করব। তার দেহ একটি বছর পুরো থাকলেও তার মাংস শক্ত থাকবে। সুতরাং তুমি গ্রীকবীরদের এক সভা আহ্বান করো। অ্যাগামেমননের প্রতি তোমার সব ক্রোধের অবসান ঘটাও। তারপর অস্ত্র ধারণ করে যথাশক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করো।
এই কথা বলার পর থেটিস শক্তি ও সাহস সঞ্চার করলেন অ্যাকেলিসের অন্তরে আর প্যাট্রোক্লাসের দেহের মধ্যে যাতে পচন না ধরে, তার জন্য তার নাসারন্ধ্রে মন্ত্রপূত লাল মদ ও তেল ঢেলে দিলেন।
জাহাজ থেকে সোজা সমুদ্রকূলে চলে গিয়ে অ্যাকেলিস এমন জোরে গ্রীকবীরদের ডাকতে লাগলেন যাতে যারা কোনদিন যুদ্ধে যায় নি সেই নাবিক ও ভৃত্যগণও বেরিয়ে এল জাহাজ থেকে। যেহেতু বহুদিন যুদ্ধ থেকে বিরত ছিলেন অ্যাকেলিস সেইহেতু তার ডাক শুনে রণদেবতা অ্যারেসের ভৃত্য সহ আহত ওডিসিয়াস ও টাইডেউসপুত্র খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসতে লাগলেন। তাঁদের দেহের ক্ষতস্থানে তখনো যন্ত্রণা হওয়া সত্ত্বেও তারা এসে সভার সামনে বসলেন। সবশেষে এলেন অ্যান্টিনর পুত্র কুনোর দ্বারা আহত রাজা অ্যাগামেমনন।
গ্রীকবীরেরা সকলে সমবেত হলে অ্যাকেলিস বললেন, হে আত্রেউসপুত্র, যেদিন আমি লার্নেসাস নগরী ধ্বংস করে ব্রিসেইসকে বন্দিনী হিসেবে আমার জাহাজে নিয়ে আসি সেদিন যদি আর্তেমিসের শরে নিহত হত ব্রিসেইস তাহলে তোমার আমার দুজনের পক্ষেই ভাল হত। তাহলে আমার ক্রোধহেতু এত গ্রীকসেনানী অকালে নিহত হত না। আর তাতে হেক্টর ও ট্রয়বাসীদের ভালই হয়েছে। সে যাই হোক, তোমার আমার দুজনের মধ্যে এই কলহ দীর্ঘকাল স্মরণ করবে গ্রীকরা। সে ক্রোধ আজ আমার অপগত, প্রয়োজনের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে আমার ক্রোধ। আমি আর ক্রোধকে লালন করব না। এখন গ্রীকসেনাদের অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হতে বল। আমি যুদ্ধ করব। যারা আমার বর্শার আঘাত হতে পরিত্রাণ পাবে তারাই সানন্দে বিশ্রাম লাভ করতে পারবে।
অ্যাকেলিস তাঁর ক্রোধ সংবরণ করেছেন জানতে পেরে উল্লসিত হয়ে উঠল গ্রীকরা। উঠে না দাঁড়িয়ে সবার মাঝখানে বসে বসেই অ্যাগামেমনন বললেন, হে রণদেবতার ভৃত্যগণ, কেউ উঠে দাঁড়িয়ে কথা বললে তার কথা শুনতে হয়, বাধা দিতে নেই তার কথায়। গোলমালের সময় কেউ কারো কথা শুনতে পায় না। সভায় গোলমাল হলে বড় বড় বক্তারাও হতবুদ্ধি হয়ে যায়। আমি অ্যাকেলিসকে আমার কথা বুঝিয়ে বলব, তোমরাও সব শোন। গ্রীকরা আমাকে বহুবার ভৎর্সনা করেছে, কিন্তু আমার এবিষয়ে কোন দোষ নেই। জিয়াস, নিয়তি ও অন্ধকারচারিণী ইউরিনায়েসের চক্রান্তেই আমি উন্মাদের মত অ্যাকেলিসের কাছ থেকে তাঁর পারিতোষিক ছিনিয়ে নিই। আমি কি করব, সবকিছুই দেবতাদের হাতে। জিয়াসকন্যা নির্বুদ্ধিতা পৃথিবীর মাটির উপর দিয়ে না চলে মানুষের মাথার মাথায় গিয়ে তাদের মন বিগড়ে দেয়। ফলে তারা নিজেদের আসন্ন ধ্বংসের কথা নিজেরাই জানতে পারবে না। এইভাবে নির্বুদ্ধিতার ফাঁদে পড়ে অনেক মানুষের মন।
একদিন জিয়াসকন্যা নির্বুদ্ধিতা দেবরাজ জিয়াসকে বোকা বানিয়ে তুলেছিল। যেদিন সুন্দরী থবস নগরীতে অ্যালসিমেনি হেরাকলসকে প্রসব করে সেইদিন হেরার দ্বারা প্রতারিত হন জিয়াস। সেদিন দেবতাদের ডেকে জিয়াস বলেন, হে দেবদেবীগণ, আমার মনের কথা শোন তোমরা, আজ প্রসবের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ইতিসিরা আমার ঔরসজাত এমন এক মানবসন্তানকে ভূমিষ্ঠ করাবে যে হবে সমস্ত পৃথিবীর অধিপতি। তখন ছলনাময়ী হেরা বললেন, তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি দাও, আজ তোমার যে মানবসন্তান ভূমিষ্ঠ হবে সে হবে সারা মানবজগতের অধীশ্বর।
হেরার কথায় কোন সন্দেহ করলে না জিয়াস। তিনি তাঁর কথামতই শপথ করলেন। হেরা তখন সঙ্গে সঙ্গে অলিম্পাস পর্বত হতে তীরবেগে আর্গসে চলে গেলেন। তার ধারণা ছিল সেখানে স্থেনেলাসপত্নী ছিল। স্থেনেলাসপত্নী তখন সাত মাস অন্তঃসত্তা। তাঁর প্রসবের সময় তখন না এসে হেরা অকালে তাঁর সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করালেন এবং অ্যালসিমেনির প্রসবকার্য স্থগিত করলেন। তারপর হেরা জিয়াসের নিকট গিয়ে বললেন, হে বিদ্যুতাধিপতি পরম পিতা জিয়াস, তোমার নিকট আমার এক নিবেদন আছে, পার্সিয়াসপুত্র স্থেনেলাসের এক পুত্র সন্তান আজ জন্মগ্রহণ করবে। সে তোমারই বংশধর। সুতরাং সে সে-ই হোক গ্রীকদের রাজা।
একথায় জিয়াস এক ভুলের দংশন অনুভব করলেন। ক্রোধে উত্তপ্ত হয়ে তিনি নির্বুদ্ধিতার চুলের মুঠি ধরে শপথ করলেন, নির্বুদ্ধিতাকে আর কখনো নক্ষত্রখচিত আকাশ বা অলিম্পাস পর্বতের শিখরে আসতে দেবেন না। তারপর তিনি তার হাতটাকে মুচড়ে দিয়ে স্বর্গ থেকে এমন জোরে ঠেলে ফেলে দিলেন যে নির্বুদ্ধিতা মর্ত্যভূমির এক মাঠে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। তার পুত্রের কষ্ট দেখে তখন জিয়াস নির্বুদ্ধিতার উপর অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে পড়লেন। এইভাবে আমিও হেক্টরের দ্বারা গ্রীকদের নিহত হতে দেখে অতিশয় দুঃখিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন নির্বুদ্ধিতার কথাই ভাবছিলাম। আমি তখন রাগে অন্ধ হয়ে পড়েছিলাম এবং জিয়াস আমার যুক্তিবোধ হরণ করে নিয়েছিলেন। আমি এবার প্রায়শ্চিত্ত করব এবং ক্ষতিপূরণস্বরূপ আরো বেশি ধনরত্ন উপহার দেব। সুতরাং এখন যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, ওডিসিয়াস যেসব উপহার দেবার প্রতিশ্রুতি দান করেছিল আমি তা সব দেব। যদি তোমরা একটু অপেক্ষা করো তাহলে এখনি আমার লোকজন আমার জাহাজ থেকে সেই সব উপহার এনে দেবে। দেখ সেই সব উপহার তোমাদের পছন্দ হয় কিনা।
অ্যাকেলিস উত্তর করলেন, হে আত্রেউসপুত্র রাজা অ্যাগামেমনন, তুমি ইচ্ছা করলে তোমার প্রস্তাবিত উপহার দিতে পারবা নাও দিতে পার। এখন চল আমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করিগে। হাতে অনেক কাজ থাকতে বাজে কথা বলে কালক্ষেপণ করে লাভ নেই। মনে রেখো, অ্যাকেলিস আবার সম্মুখসারিতে যুদ্ধ করবে।
ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, হে দেবোপম বীর অ্যাকেলিস, গ্রীকসেনাদের এই মুহূর্তে যুদ্ধে পাঠিও না, কারণ একবার যুদ্ধ শুরু হলে দেবতাদের চক্রান্তে উভয় পক্ষই উন্মত্ত হয়ে উঠবে। প্রথমে তাদের পানাহার সেরে নিতে দাও। কোন মানুষ ক্ষুধিত অবস্থায় যুদ্ধের প্রয়োজন সত্ত্বেও যথাশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধ করতে পারে না। অবিলম্বে অবসন্ন হয়ে আসে তার দেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। কিন্তু কোন মানুষ তৃপ্তি সহকারে ভোজন করলে সে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ করে শত্রুদের উচ্ছেদ সাধন করতে পারে। সুতরাং এখন প্রথমে গ্রীকসেনাদের আহার্য প্রস্তুত করতে বল। ইতিমধ্যে রাজা অ্যাগামেমনন তোমাদের সব উপহার এনে দেবেন। সে উপহার দেখে সকলেই সন্তুষ্ট হবে। অধিকন্তু অ্যাগামেমনন সর্বসমক্ষে শপথ করুন, তিনি ব্রিসেইস এর শয্যায় গমন করে তার সঙ্গে কোনদিন সহবাস করেন নি। রাজা অ্যাগামেমনন তোমাদের এই পুনর্মিলন উপলক্ষে তাঁর শিবিরে এক ভোজসভার আপ্যায়িত করুন তোমাকে। আর তোমাকেও বলি আত্রেউসপুত্র, ভবিষ্যতে যে কোন মানুষের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করবে। কোন রাজা যদি কারো প্রতি অন্যায় ব্যবহার করার পর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রায়শ্চিত্তত করে তাহলে তাতে আর কোন অপমান হয় না।
রাজা অ্যাগামেমনন উত্তর করলেন, লার্তেসপুত্র তোমার কথায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। আমি শপথ করে বলছি, তুমি যা বলছ আমি তাই করব। দেবতার নামে কখনো মিথ্যা শপথ করব না। অ্যাকেলিস এখনি যুদ্ধ করতে চাইলেও আমার শিবির হতে উপহারসমূহ না আসা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করুন। আমার শপথের সমর্থনে পশুবলিও দেব। হে লার্তেসপুত্র, তোমার সঙ্গে কয়েকজন বীরযুবককে নিয়ে আমার শিবির হতে প্রস্তাবিত উপহারসমূহ ও বন্দিনী নারীদের নিয়ে এস। একটি শূকর এনে আমার পক্ষ থেকে জিয়াস ও সূর্যদেবতাদের কাছে বলি দেবারও ব্যবস্থা করো।
অ্যাকেলিস তখন বললেন, হে আত্রেউসপুত্র রাজা অ্যাগামেমনন, শান্তির সময়ে এসব দান-প্রতিদানের কাজ সম্পন্ন করবে। তুমি কি বলতে চাও হেক্টর দ্বারা নিহত হয়ে আমাদের প্রিয়জনরা যখন শায়িত থাকবে ভূমিপরে, তখন গ্রীকরা পান ও ভোজনে মত্ত থাকবে? আমাদের শত্রুদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা করা পর্যন্ত গ্রীকসেনাদের অনাহারে যুদ্ধ করে যেতে বল। তারপর সূর্য অস্ত গেলে যুদ্ধ শেষ করে তারা আহারকার্য সম্পন্ন করবে। প্যাট্রোক্লাস এখনো মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, তার দেহটা শুকিয়ে গেছে, তার সহকর্মীরা তাকে ঘিরে শোক করছে। এমত অবস্থায় আমি শত্রুরক্ত আর শক্তহত্যা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।
ওডিসিয়াস উত্তর করলেন, সে সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রীকবীর পেলেউসপুত্র অ্যাকেলিস, যুদ্ধে তুমি আমার থেকেও পারদর্শী ঠিক, কিন্তু মন্ত্রণাকার্যে আমি তোমার থেকে বিজ্ঞ, কারণ, আমি তোমার থেকে বয়সে বড় এবং জ্ঞানেও বড়। সুতরাং ধৈর্য ধরে আমার কথা শোন। যুদ্ধ এমনই জিনিস যা মানুষকে শীঘ্র ক্লান্ত করে তোলে এবং সমস্ত যুদ্ধের বিচারকর্তা জিয়াসের মানদণ্ড যখন যেদিকে ঝোঁকে সেই পক্ষের লোকেরাই জয়ী হয়, অপর পক্ষের লোকেরা তখন কোন সুফলই লাভ করতে পারে না। গ্রীকসেনারা কখনো খালি পেটে ক্ষুধিত অবস্থায় শোক করতে পারে না। ক্রমাগত সৈন্যরা যদি অনাহারে যুদ্ধ করে মরতে থাকে তাহলে কখন তারা বিশ্রাম করবে? আমরা পুরো একদিন ধরে শোক করে মৃতকে সমাধিস্থ করব, কিন্তু তার আগে পানাহার করতে দাও যাতে তারা আরও ভয়ঙ্করভাবে যুদ্ধ করতে পারে। পানাহারে তৃপ্ত হয়ে তারা যখন যুদ্ধ করবে তখন যেন পিছন ফিরে না থাকায়, তখন যেন আমরা সকলে একমনে আমাদের পুঞ্জীভূত সব ক্রোধ ঢেলে দিতে পারি ট্রয়বাসীদের উপর।
এই কথা বলে ওডিসিয়াস তাঁর সঙ্গে নেস্টর, মেদিস, থোয়াস, মেরিওনস, নাইকোমেদিস ও মেলানিপ্পাসকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাগামেমননের তাঁবুতে চলে গেলেন। তাঁরা অ্যাগামেমননের শিবির থেকে সাতটি ত্রিপদবিশিষ্ট কাষ্ঠাধার, কুড়িটি ধাতব কড়াই, ব্রিসেইসসহ বন্দিনী নারী আর বারোটি ঘোড়া নিয়ে এলেন। অন্যান্য গ্রীকযুবকেরা অন্যান্য উপহারগুলো এনে সবার মাঝখানে রাখল। ওডিসিয়াস দশটি স্বর্ণমুদ্রা গুণে নিলেন।
রাজা অ্যাগামেমনন উঠে দাঁড়াতেই ট্যালথিবিয়াস একটি শূকর নিয়ে এল। অ্যাগামেমনন কটিবন্ধনী হতে একটি বড় ছুরি বার করে দেবরাজের উদ্দেশ্যে দুহাত তুললেন প্রার্থনার ভঙ্গিতে। অন্যান্য গ্রীকবীররা সারিবদ্ধভাবে নীরবে বসে রইলেন শূন্য আকাশের পানে তাকিয়ে। অ্যাগামেমনন বললেন, ধরিত্রী, সূর্যদেব ও শক্তিমান জিয়াস ও পাতালবাসী দেবতা ইউরিনায়েসকে সাক্ষী রেখে শপথ করছি যে আমি কখনো কোনভাবে ব্রিসেইসের দেহ স্পর্শ করিনি। সে আমার তাবুতে অস্পৃশ্য অবস্থায় ছিল। যদি আমি মিথ্যা করে শপথ করে তাহলে যে পাতালবাসী ইউরিনায়েস সমস্ত শপথভঙ্গকারীকে শাস্তি দেন তিনি আমাকেও শাস্তি দেবেন।
এই কথা বলে বলির শূকরের গলা কেটে ফেললেন অ্যাগামেমনন আর ট্যালথিবিয়াস সেই কাটা মুণ্ডটি ঘুরিয়ে সমুদ্রের জলে ফেলে দিলেন। তখন অ্যাকেলিস উঠে দাঁড়িয়ে গ্রীকদের উদ্দেশ্যে বললেন, পরম পিতা জিয়াসই মানুষের বিচারগত দৃষ্টিশক্তি হরণ করে তাঁকে চোখ থাকতেও অন্ধ করে দেন। তা না হলে আত্রেউসপুত্র আমার বন্দিনীকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেড়ে নিয়ে গিয়ে আমার মধ্যে এমন প্রচণ্ড ক্রোধের উদ্রেক করতেন না। নিশ্চয় দেবরাজ জিয়াসই বহু গ্রীকবীরের ধ্বংসের এক পরিকল্পনা করেন। এখন যাও তোমরা সব আহার করে নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
এই বলে সভা ভঙ্গ করে দিলেন অ্যাকেলিস। সকলেই আপন আপন জাহাজে চলে গেল। মার্মিডনরা অ্যাকেলিসের উপহারগুলো তাঁর শিবিরে বহন করে নিয়ে গেল। ঘোড়াগুলো নিয়ে গিয়ে আস্তাবলে রেখে দিল।
প্যাট্রোক্লাসের বিকৃত দেহটি দেখে ব্রিসেইস তার উপর পড়ে বুক চাপড়াতে লাগল। শোকে আকুল হয়ে ঘাড় ও মুখ ছিঁড়তে লাগল। সৌন্দর্যে সাক্ষাৎ অ্যাফ্রোদিতে বিসেইস কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, হে রাজকুমার প্যাট্রোক্লাস, আমি এখান থেকে যাবার সময় তোমার জীবিত দেখে যাই, কিন্তু ফিরে এসে দেখি তুমি মৃত। দুঃখের উপর দুঃখ বেড়ে গেল আমার। যার সঙ্গে আমার পিতামাতা বিবাহ দেন আমরা সেই স্বামীকে আমাদের শহরেই আমার চোখের সামনে হত্যা করা হয়, সেই একই দিনে আমার তিন ভাইকে হত্যা করা হয়। অ্যাকেলিস যখন আমার স্বামীকে হত্যা করে তখন তুমিই বলেছিলে অ্যাকেলিস তোমাকে পিথিয়ায় নিয়ে গিয়ে বিবাহ করবে। তুমি সব সময় আমার প্রতি ছিলে দয়ালু, আমি তোমার জন্য চিরদিন দুঃখ করে যাব।
এই কথা বলে ব্রিসেইস কাঁদতে লাগল এবং অন্যান্য বন্দিনী রমণীরা শোক বিলাপে অংশগ্রহণ করল। তারা উপরে প্যাট্রোক্লাসের জন্য শোক প্রকাশ করলেও আসলে তারা আপন আপন নিহত প্রিয়জনের জন্য দুঃখ করতে লাগল। তখন গ্রীকদের মধ্যে বয়োপ্রবীণ ব্যক্তিরা এসে অ্যাকেলিসকে খাবার জন্য অনুরোধ করতে লাগল। কিন্তু অ্যাকেলিস খেলেন না। তিনি বললেন, আমার অনুরোধ, কেউ তোমরা আমাকে খেতে বলবে না। কারণ এখনো গভীর দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে আমার অন্তর এবং সূর্য অস্ত না যাওয়া পর্যন্ত আমি অনশন করব।
এরপর দুই আত্রেউসপুত্র নেস্টর, ওডিসিয়াস, আইডোমেনেউস ও বৃদ্ধ ফোনিক্স ছাড়া অন্য সব রাজন্যবর্গকে সরে যেতে বললেন অ্যাকেলিস। ফোনিক্স বারবার তার দুঃখে সান্ত্বনা দিচ্ছিল অ্যাকেলিসকে। কিন্তু অ্যাকেলিস শুধু প্যাট্রোক্লাসের জন্য শোকে একের পর এক করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যাচ্ছিলেন যুদ্ধে গিয়ে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে না পড়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবেন না তিনি। হে আমার হতভাগ্য প্রিয়তম সহকর্মী, গ্রীকসেনারা যখন যুদ্ধে ছুটে যেত তুমি তখন আমার জন্য কত শীঘ্র খাবার প্রস্তুত করতে। তাই তোমার দুঃখে আজ আমার শিবিরে প্রচুর খাদ্য থাকা সত্ত্বেও আমি আর কিছুই খাব না। আজ আমি যদি আমার পিতার অথবা পুত্রের মৃত্যুর সংবাদ শুনতাম তাহলেও এত দুঃখ অনুভব করতাম না। এর আগে এতদিন ভেবে আসছিলাম আমি যুদ্ধে মৃত্যুমুখে পতিত হব আর তুমি আমার পুত্রকে সঙ্গে করে জাহাজে চড়ে আমার দেশে ফিরে গিয়ে তাকে আমার বিষয়-সম্পত্তি সব বুঝিয়ে দেবে। কারণ আমার পিতা বৃদ্ধ পেলেউস হয় এখন মৃত অথবা বার্ধক্যে জর্জরিত বা আমার দুঃখে জীবন্ত। তিনি আমার দুঃসংবাদ শোনার অপেক্ষায় সব সময় কাতর হয়ে আছেন।
এই বলে অ্যাকেলিস শোকে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন আর বয়োপ্রবীণ গ্রীকসেনারাও আপন আপন ঘরবাড়ির কথা স্মরণ করে কাঁদতে লাগলেন। তাদের দুঃখ দেখে জিয়াসের দয়া হলো এবং তিনি এথেনকে বললেন, বৎসে, তুমি কি তোমার অনুগ্রহভাজন সেই বীরের কথা বিস্মৃত হয়েছ? তার অন্যান্য সহকর্মীরা পানাহার করতে গেলেও সে তার জাহাজে অশান্ত অবস্থায় বসে আছে। সে যাতে কোন ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করতে না পারে তার জন্য বুকে কয়েক ফোঁটা লাল মদ ঢেলে দিয়ে এস।
দেবী এথেনও তাই ভাবছিলেন। স্বর্গ থেকে তিনি বাজপাখির মত তীরবেগে নেমে গেলেন মর্ত্যভুমির মধ্যে। ইতিমধ্যে গ্রীকরা অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে এগিয়ে গেল শত্রুপক্ষের দিকে। এথেন অ্যাকেলিসের বক্ষে পবিত্র দেবশক্তিসম্পন্ন লাল মদ ঢেলে দিয়ে যথাসময়ে ফিরে এলেন দেবরাজের কাছে। জিয়াসহস্তবিচ্ছুরিত উত্তরের তীক্ষ্ণশীতল বায়ুপ্রবাহবাহিত তীক্ষ্ণ তুষারকণার মত অসংখ্য বর্শা ছুটে যেতে লাগল গ্রীকরণতরীগুলো হতে। তূর্যধ্বনিতে ঘন ঘন নিনাদিত হতে লাগল সমগ্র আকাশ। সমস্ত রণক্ষেত্র প্লাবিত হয়ে উঠল গ্রীকবীরদের বর্মবিচ্ছুরিত উজ্জ্বলতায়। দেবশিল্পী হিফাস্টাসনির্মিত সেই আশ্চর্যসুন্দর বর্ম পরিধান করে গ্রীকসেনাদের মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন অ্যাকেলিস। ক্রোধের প্রচণ্ডতায় দাঁতগুলো কড়কড় করছিলেন তিনি, আগুনের মত জ্বলছিল তার চোখগুলো। বক্ষে ধাতব বক্ষাবরণী বেঁধে, স্কন্ধে রৌপ্যখচিত ব্রোঞ্জনির্মিত তরবারি ঝুলিয়ে চন্দ্রের মত উজ্জ্বল ঐশ্বর্যবিশিষ্ট ঢালটি হস্তে ধারণ করলেন। সমুদ্রমধ্যস্থিত কোন পর্বতের উপর পার্বত্যদ্বীপনিবাসী কোন ব্যক্তির দ্বারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকাণ্ডে আলো যেমন বহুদূর হতে বাত্যারঙ্গতাড়িত কোন নাবিক দেখতে পায় তেমনি অ্যাকেলিসের ঢাল হতে বিচ্ছুরিত উজ্জ্বল ছটা বহুদূর হতে পরিদৃষ্ট হতে লাগল। অ্যাকেলিস যে শিরস্ত্রাণটি পরিধান করলেন তার উজ্জ্বলতাও নক্ষত্র-প্রভাসন্নিত। সেই শিরস্ত্রাণ সংলগ্ন পালকগুলো ইতস্তত সঞ্চালিত হতে লাগল চারিদিকে।
অ্যাকেলিস একবার তার বর্মটি পরীক্ষা করে দেখলেন ঠিক হয়েছে কি না। দেখলেন তার দেহগাত্রের সঙ্গে হিফাস্টাননির্মিত বর্মটি কোন এক উক্ৰমণণান্মুখ পাখির দুটি উদ্ধত পাখা যা অ্যাকেলিসকে নিয়ে যাবে এক বিরল জয়ের গৌরবময় শিখরে। অ্যাকেলিস তাঁর পিতার প্রকাণ্ড বর্শাটিও হস্তে ধারণ করলেন। এই বর্শাটি এত বড় এবং ভারী ছিল যে, তা একমাত্র অ্যাকেলিস ছাড়া অন্য কোন গ্রীকবীর সে বর্শা ধারণ করে সঞ্চালিত করতে পারত না। এই বর্শাটি পেলিয়ান পর্বতের উপর শিরণ দান করেন পেলেউসকে। অটোডীমন প্রথমে চাবুক হাতে রথে চাপলেন। বর্মপরিহিত অ্যাকেলিস সূর্যদেবতা হাইপীরিনসদৃশ প্রভায় মণ্ডিত হয়ে রথে চেপে চিৎকার করে তাঁর পিতার অশ্বগুলোকে সম্বোধন করে বললেন, হে পোদারগেসন্তান জ্যানথাস ও বেলিয়াস এবার যখন আমরা যুদ্ধে যাব তখন যেন তোমরা তোমাদের রথীকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনো গ্রীকশিবিরে। প্যাট্রোক্লাসের মত তাকে মৃত অবস্থায় রণভূমিতে ফেলে রেখে এসো না।
জ্যানথাস তখন কন্ধে জোয়াল নিয়ে হেরাপ্রদত্ত কণ্ঠস্বরের সাহায্যে বলল, হে ভয়ঙ্কর অ্যাকেলিস, আমরা তোমাকে এ যাত্রা রক্ষা করব ঠিকই, তবে তোমার মৃত্যুর দিন এগিয়ে এসেছে। তাতে আমাদের কোন দোষ নেই; নিয়তি ও দেবতাদের চক্রান্তেই তোমার ধ্বংস হয়ে উঠবে অনিবার্য। আর জেনে রেখো, আমাদের কোন শৈথিল্য বা অবহেলার জন্য প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যু হয় নি, প্যাট্রোক্লাসের মৃত্যু হয়েছে লীটোপ্রসূত এক দেব-সন্তানের আঘাতে। সেই দেবতার হস্তক্ষেপের ফলেই জয়ী হয় হেক্টর। আমরা সর্বাপেক্ষা দ্রুতগামী, তথাপি একজন দেবতা ও মানবসন্তানের হাতে মৃত্যু ঘটবে তোমার।
এরিনায়েস তাকে থামিয়ে দিলেন। অ্যাকেলিস উত্তর করলেন, হে জ্যানথাস, কেন তুমি আমার মৃত্যু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করলে? আমি জানি, আমার পিতামাতার কাছ থেকে বহুদূরে এই বিদেশেই আমার মৃত্যু ঘটবে। তবু আমি ট্রয়বাসীদের যুদ্ধপিপাসা চিরতরে নিবৃত্ত না করে ক্ষান্ত হব না।
এই কথা বলে এক রণহুঙ্কার ছেড়ে যুদ্ধক্ষেত্রাভিমুখে রথ চালনা করতে লাগলেন অ্যাকেলিস।