3 of 11

১৬.৩৩ ভক্তসঙ্গে

ত্রয়স্ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ১৬ই অক্টোবর

ভক্তসঙ্গে

হরিভক্তি হইলে আর জাতবিচার থাকে না। শ্রীযুক্ত মণি মল্লিককে বলিতেছেন, তুমি তুলসীদাসের সেই কথাটি বল তো।

মণি মল্লিক — চাতক, তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যায় — গঙ্গা, যমুনা, সরযূ আর কত নদী ও তড়াগ রয়েছে, কিন্তু কোন জল খাবে না। কেবল স্বাতিনক্ষত্রের বৃষ্টির জলের জন্য হাঁ করে থাকে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — অর্থাৎ তাঁর পাদপদ্মে ভক্তিই সার আর সব মিথ্যা।

[Problem of the untouchables — অস্পৃশ্য জাতি হরিণামে শুদ্ধ ]

মণি মল্লিক — আর একটি তুলসীদাসের কথা — অষ্টধাতু পরশমনী ছোঁয়ালে সোনা হয়ে যায়। তেমনি সব জাতি — চামার, চণ্ডাল পর্যন্ত হরিনাম করলে শুদ্ধ হয়। “বিনা হর্‌নাম চার জাত চামার।”

শ্রীরামকৃষ্ণ — যে চামড়া ছুঁতে নাই, সেই চামড়া পাট করার পর ঠাকুরঘরে লয়ে যাওয়া যায়।

“ঈশ্বরের নামে মানুষ পবিত্র হয়। তাই নামকীর্তন অভ্যাস করতে হয়। আমি যদু মল্লিকের মাকে বলেছিলাম, যখন মৃত্যু আসবে তখন সেই সংসার চিন্তাই আসবে। পরিবার, ছেলেমেয়েদের চিন্তা — উইল করবার চিন্তা — এই সব আসবে; ভগবানের চিন্তা আসবে না। উপায় তাঁর নামজপ, নামকীর্তন অভ্যাস করা। এই অভ্যাস যদি থাকে মৃত্যু সময় তাঁরই নাম মুখে আসবে। বিড়াল ধরলে পাখির ক্যাঁ ক্যাঁ বুলিই আসবে, তখন আর ‘রাম রাম’ ‘হরে কৃষ্ণ’ বলবে না।

“মৃত্যু সময়ের জন্য প্রস্তুত হওয়া ভাল। শেষ বয়সে নির্জনে গিয়া কেবল ঈশ্বরচিন্তা ও তাঁহার নাম করা। হাতি নেয়ে যদি আস্তাবলে যায় তাহলে আর ধুলো কাদা মাখতে পারে না।”

বলরামের বাবা, মণি মল্লিক, বেণী পাল, এদের বয়স হয়েছে; তাই কি ঠাকুর, বিশেষ তাঁহাদের মঙ্গলের জন্য, এই সকল উপদেশ দিতেছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ আবার ভক্তদের সম্বোধন করিয়া কথা কহিতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — নির্জনে তাঁর চিন্তা ও নাম করতে বলেছি কেন? সংসারে রাতদিন থাকলে অশান্তি। দেখ না একহাত জমির জন্য ভায়ে ভায়ে খুনোখুনি। শিখরা (Sikhs) বলে, জমি, জরু আর টাকা এই তিনটির জন্য যত গোলমাল অশান্তি।

[রামচন্দ্র, সংসার ও যোগবাশিষ্ঠ — “মজার কুটি” ]

“তোমরা সংসারে আছ তা ভয় কি? রাম যখন সংসারত্যাগ করবার কথা বললেন, দশরথ চিন্তিত হয়ে বশিষ্ঠের শরণাগত হলেন। বশিষ্ঠ রামকে বললেন, রাম তুমি কেন সংসার ত্যাগ করবে? আমার সঙ্গে বিচার কর, ঈশ্বর ছাড়া কি সংসার? কি ত্যাগ করবে, কি বা গ্রহণ করবে? তিনি ছাড়া কিছুই নাই। তিনি ‘ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ’ রূপে প্রতীয়মান হচ্ছেন।”

বলরামের পিতা — বড় কঠিন।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সাধনের সময় এই সংসার “ধোঁকার টাটি”; আবার জ্ঞানলাভ হবার পর, তাঁকে দর্শনের পর, এই সংসার “মজার কুটি”।

[অবতার পুরুষে ঈশ্বরদর্শন — অবতার চৈতন্যদেব ]

“বৈষ্ণবগ্রন্থে আছে, বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ তর্কে বহুদূর।

“কেবল বিশ্বাস!

“কৃষ্ণকিশোরের কি বিশ্বাস! বৃন্দাবনে কূপ থেকে নীচ জাতি জল তুলে দিলে, তাকে বললে, তুই বল শিব। সে শিবনাম করার পর অমনি জল খেলে। সে বলত ঈশ্বরের নাম করেছে আবার কড়ি দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত! এ কি!

“রোগাদি জন্য তুলসী দিচ্ছে, কৃষ্ণকিশোর দেখে অবাক্‌!

“সাধুদর্শনের কথায় হলধারী বলেছিল, ‘কি আর দেখতে যাবো — পঞ্চভূতের খোল।’ কৃষ্ণকিশোর রাগ করে বললে, এমন কথা হলধারী বলেছে। সাধুর চিন্ময় দেহ জানে না।

“কালীবাড়ির ঘাটে আমাদের বলেছিল, তোমরা বলো — রাম! রাম! বলতে বলতে যেন আমার দিন কাটে।

“আমি কৃষ্ণকিশোরের বাড়ি যাই যেতাম, আমাকে দেখে নৃত্য।

“রামচন্দ্র লক্ষ্মণকে বলেছিলেন, ভাই, যেখানে দেখবে ঊর্জিতাভক্তি সেইখানে জানবে আমি আছি।

“যেমন চৈতন্যদেব। প্রেমে হাসে কাঁদে নাচে গায়। চৈতন্যদেব অবতার — ঈশ্বর অবতীর্ণ।”

শ্রীরামকৃষ্ণ গান গাইতেছেন:

ভাব হবে বইকি রে ভাবনিধি শ্রীগৌরাঙ্গের।
ভাবে হাসে কাঁদে নাচে গায়! (ফুকুরি ফুকুরি কান্দে)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *