১৬-২০. স্ত্রীকে স্বামীর মত নিয়েই চলতে হবে

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

কুলসুম : স্ত্রীকে স্বামীর মত নিয়েই চলতে হবে। নইলে স্বামীর শ্রদ্ধা হারাতে হয়, ফলে স্বামীর সঙ্গে মিল হয় না।

হালিমা : যা কোনো দিন করি নি, হঠাৎ স্বামীর ইচ্ছায় তা কি করা সম্ভব?

কুলসুম : বাপের বাড়ির সকল সংস্কার, সকল অভ্যাস ভুলে যেতে হবে; নইলে রমণী জীবনে সমূহ বিপদ উপস্থিত হয়। দুটি লোক দু রকমের হলে তাদের কি করে মিল হবে?

হালিমা : স্বামী স্ত্রীর ইচ্ছায় চললেই পারেন।

কুলসুম : মেয়েরা সাধারণত পুরুষ অপেক্ষা কম বুদ্ধিমতী, তাদের রুচি স্বামী অপেক্ষা কম মার্জিত। মানসিক শক্তি ও দৃষ্টিতে মেয়েরা পুরুষ অপেক্ষা হীন, সুতরাং নারীকে স্বামীর ইচ্ছানুযায়ী কাজ করা উচিত। স্ত্রী যদি স্বামী অপেক্ষা অধিক শিক্ষিত হন তা হলে স্বামী স্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে পারেন, তাতে কোনো দোষ নেই। স্বামী সম্ভবত স্ত্রীর মন যুগিয়ে কাজ। করবেন; স্ত্রী ও সর্বদা স্বামীর ইচ্ছা মেনে চলবেন। বন্ধুজনের মধ্যে এইরূপ কার্যনীতিই প্রশস্ত। মনে কর স্বামী ইচ্ছা করেন স্ত্রী বিশেষ কোন রকমের কাপড় পরেন; স্ত্রী সেরূপ কাপড় পছন্দ করলেও তাই পরতে হবে, কোনো স্বামী ছাড়া অন্য কারো জন্য স্ত্রীর রূপ নয়।

হালিমা : সেকালের মেয়েদের সঙ্গে বর্তমান কালের মেয়েদের চালচলন অনেক তফাত।

কুলসুম : অনেক তফাৎ ঠিকই। তবে অনেকে আছেন, তাঁরা মা-দাদীর উপদেশ অনুযায়ী বাপের বাড়ি চালচলনের দস্তুর অনুসারে সেকালেন বুড়ী সাজতে যান; স্বামীর কথা উপেক্ষা করেন, মা যা শিখিয়েছেন সেই রকমই চলেন। আজকালকার ছেলেরা ইচ্ছা করেন, মেয়েরা কিছু চটপটে হয়–বেশ বই পড়তে পরে, উচ্চাসনে বসতে লজ্জা করে না, গুছিয়ে কথা বলতে জানে, একটা ফুটফুটে পরিষ্কৃত পরিচ্ছন্ন বাবু পরীর মত বধূ সামনে ঘুরে বেড়ায়, লজ্জাবতী ধানের বস্তার মতো এক পাশে ঘোমটা টেনে পড়ে না থাকে, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতে জানে, পৃথিবীর খবর রাখে, হাতের লেখাটা খুব ভালো হয়। কিছুকাল আগে, যা তা একটু লিখতে পারলেই স্বামী এবং পাড়া প্রতিবেশীর কাছে মেয়েরা প্রশংসা লাভ করতো, আজকাল আর তা হবার যো নেই। কোনো কোনো হতভাগিনী বলে থাকে, মেয়ে যখন চাকুরীর জন্যই লেখাপড়া, পরের পদলেহন করার জন্যেই বিশ্বে লক্ষ লক্ষ জ্ঞানকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা এত স্কুল, কলেজ।

হালিমা : তা হলে স্বামী যেরূপ ইচ্ছা করেন সেই মতোই চলতে হবে।

কুলসুম : নিশ্চয়ই, তা না করলে স্বামীর সঙ্গে মিল হবে না। ভিতরে ভিতরে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হবে। লেখাপড়া না জানলে নিজের মধ্যে যথেষ্ট জ্ঞান না থাকলে, অনেক সময় স্বামীর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করার প্রবৃত্তি মেয়েদের হয় না। স্বামীর ইচ্ছামতো চলতে, পাড়া-প্রতিবেশী বা অন্য লোকের কাছে লজ্জাবোধ হয়। এতে লোককে ভয় করবার বা লজ্জা করবার কোনো দরকার নেই। মেয়েরা যদি জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী হন তা হলে তাঁরা স্বামীর মত অনুসারে কাজ করতে লজ্জা করেন না।

হালিমা : প্রাতঃকালে উঠেই স্বামীর সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে?

কুলসুম : স্বামী যদি সে সময় ঘুমিয়ে থাকেন, তা হলে ধীরে ধীরে পদে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। নামাজ পড়বে, তৎপর কোরান শরীফ আস্তে পড়বে। কোনো কোনো স্বামী অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকেন। যদি স্বামী বেনামাজী হন, তা হলে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া না করে নামাজ পড়ার জন্য তাকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করবে, উপদেশ দেবে। স্ত্রীর ব্যবহার ও পবিত্র জীবন দেখে স্বামীও পবিত্র হয়ে উঠবেন। সুপ্ত স্বামীর কাছে জিনিস পত্রের খুটখাট শব্দ করা উচিত নয়। স্বামী জাগলে হাসিমুখে তার কুশল জিজ্ঞাসা করবে।

শীতকালে বাড়ির দাসীকে প্রাতঃকালে পানি গরম করে রাখতে বলবে; দাসী না থাকলে নিজেকেই এই কাজ করতে হবে। রাত্রির রান্না শেষে খানিক পানি চুলোর উপর দিয়ে রাখলেও পানি গরম থাকে।

হালিমা : কতকগুলি স্বামী স্বভাবত খিটখিটে মেজাজের হয়ে থাকেন, কিছুতেই তাঁরা সন্তুষ্ট হন না।

কুলসুম : অনেক লোক খিটখিটে হয়ে থাকে; এর কোনো প্রতিকার নেই। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া না করে স্ত্রী নিজের কর্তব্য করে যাবেন। বুদ্ধি, ভালো কথা, সৎস্বভাবে ও মিষ্ট ব্যবহারের জয় হবেই হবে। স্বামী কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলেন, মনে রাগ থাকলেও চট করে কথার উত্তর দিতে হবে। অভিমান করে ঘাড় ও মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে, দরাজায় ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে না। স্বামীর ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে হাঁড়ি, বাসন মাটির উপর শব্দের সঙ্গে রাখতে নেই।

হালিমা : পরিবারে যখন কাজের সাড়া পড়ে যায়, তখন স্বামীর কীরূপ ব্যবহার করতে হবে?

কুলসুম : বিবাহের অব্যবহিত পরে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মনই উদ্দাম আবেগপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্ত্রীর ইচ্ছা হয়, সব সময় স্বামীর সঙ্গে গল্প করেন। ঘরের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে হাসাহাসি ও আলাপ করেন। একটু পুরোনো হল অর্থাৎ বিয়ের দু-এক বছর পর, এ আবেগ। থাকে না। এরূপ দেখে অনেক অনুন্নত-হৃদয় ব্যক্তি বিরক্ত হন। যুবক-যুবতীর পবিত্র মধুর প্রেমের প্রতি এদের মোটেই সহানুভূতি নেই। ইংরাজেরা বিয়ের পরে মানুষের কুদৃষ্টি হতে ছেলেমেয়েকে ২/১ মাসের জন্য দূরে পাঠিয়ে দেন। মনের আবেগ কমলে যুবক-যুবতী বাড়ি ফিরে আসেন–এ প্রথাটা মন্দ নয়। যা তুমি বলছিলে–প্রাতঃকালে যখন সংসারের কাজকর্মের সাড়া পড়ে যায়–গাছপালা যখন স্বর্ণ রৌদ্রে অভিসিক্ত হয়ে ওঠে তখন স্বামীর কাছে বসে হাসাহাসি গল্প করতে নেই, তাতে দুষ্ট লোকের মন একটা ঈর্ষা এবং অপবিত্রভাবে পূর্ণ হয়। এইরূপ করলে কোনো দোষ হয়, এ আমি বলি না! উন্নত ও শিক্ষিত পরিবারে এরূপ করা দোষের বলে মনে করে না। আবার কাজ নষ্ট করে স্বামীর সঙ্গে গল্প কারও ঠিক নয়। যদি এই সময়ের মধ্যে মানুষের অগোচরে স্বামীর সঙ্গে দেখা হয় তা হলে স্বামীকে একটা মমতার কটাক্ষ, একটু ওষ্ঠের মৃদু হাসি দেখাতে ছাড়বে না। স্বামীর সঙ্গে দেখা হলে জীবনের কোনো সময় গম্ভীর হয়ে থাকবে না। লোক থাকলে স্বামীর সামনে গম্ভীর হয়ে থাকা ভালো। গৃহে যদি স্বামী ছাড়া আর কেউ না থাকে, তবে সঙ্কোচ বোধ করাবার দরকার নেই।

হালিমা : দুপুরবেলা স্বামী এলে তার গায়ে বাতাস দিতে হবে নাকি?

কুলসুম : দুপুরবেলা ঘুমানো অন্যায়; বাতাস দিয়ে ঘুম আনা কাজেই তত ভালো কাজ নয়। স্বামীর যদি একই ঘুমাবার অভ্যাস হয়ে থাকে, তবে একটু আধটু বাতাস দিতে পার। বাতাস দিতে নিজের ক্লান্তি বোধ হলে বাড়িতে ছোট চাকর-বাকর থাকলে তাকে বাতাস দিতে বলবে। আর বাতাস তারই দেওয়া ভালো-স্ত্রী বা অন্য কোনো নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কারো দ্বারা বাতাস খাওয়া বা জুতা খোলা বর্বরতার লক্ষণ। কোনো মেয়ে চাকরাণীকে কখনও স্বামীকে বাতাস দিতে বলবে না। দুপুরবেলা কখনও স্বামীর কাছে শোবে না, এতে স্বামীর শরীর খারাপ হতে পারে। কথা বললে, গল্প করলে কোনো দোষ নেই। শ্বশুর-শ্বাশুড়ী যদি বিরক্ত হন তবে তাঁদের সামনে বা তারা শুনতে পান, এমন স্থানে স্বামীর সঙ্গে কথা বলবে না। স্বামী যদি বাহির হতে পরিশ্রম করে আসেন তবে তাড়াতাড়ি পাখা নিয়ে তাঁকে বাতাস করলে মমতার পরিচয় দেওয়া হয়–এতে মোটেই লজ্জা করবে na। স্বামীর সেবায় অপমান নেই। বাড়িতে যদি একখানা ছোট চালানো পাখা তৈরি করে নেওয়া যায়, তবে বড়ই ভালো হয়। পরিশ্রান্ত হয়ে তার নিচে একখানা আসন নিয়ে বসে কাউকে দু’মিনিটের জন্য পাখা টানতে বললে সকল ক্লান্তি দূর হয়। স্ত্রীও কাজ করতে পারেন। এই টানা-পাখা তৈরি করতে বিশেষ খরচ হয় না। গ্রীষ্মকালে শোবার ঘরেও এরূপ পাখা ব্যবহার করা যায়। প্রাচীর বা বেড়ার ভেতরে দিয়ে পাখার দড়ি বের করে দিতে হয়। বাইরে হতে ঘুম আসা পর্যন্ত বা আধঘণ্টা মতো চাকর বসে বসে পাখার দড়ি টানতে পরে। আর শহরে যাদের বৈদ্যুতিক পাখা আছে তাদের এইসব ঝামেলার কোনো বালাই নেই।

হালিমা : মাঝে মাঝে স্বামীকে পান সেজে দেওয়া কেমন?

কুলসুম : পান-তামাক খাওয়া অনেক স্বামীর অভ্যাস নেই। স্বামীর পান-তামাক খাওয়ার অভ্যাস থাকলে, প্রয়োজন আছে কিনা নিজেই জিজ্ঞাসা করবে। কোনো কোনো সময় জিজ্ঞাসা না করেই তার কাছে পান-তামাক নিয়ে উপস্থিত হবে। নাস্তা থাকলে স্বামীকে যেন তা জিজ্ঞাসা করে, খুঁজে না নিতে হয়। খাবার জন্য স্বামীকে সময় সময় অনুরোধ করবে। খেতে দাও, নাস্তা খেতে দাও এরূপভাবে চেয়ে যেন স্বামীকে না খেতে হয়। স্বামী যখন ইচ্ছা তখন খাবে–এতএব স্ত্রীর উদ্যোগের কোনো কারণ নেই, এরূপ ব্যবহার অন্যায়। বেলা হয়ে গেলে স্বামীকে খাবার জন্য অনুরোধ করবে। ভালো জিনিসপত্র স্বামীকে খেতে দিতে যেন কখনও ভুল না হয়। পরী যেমন স্বামীর সুখের ব্যবস্থা করতে সদা ব্যস্ত থাকবেন, স্বামীও যেন তেমনি স্ত্রী সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখেন।

হালিমা : নারীর কর্তব্যই আমি বেশি করে শুনতে চাই। স্বামীর কর্তব্য স্বামীই পালন করবেন।

কুলসুম : স্বামীর কাপড়-চোপড়, গামছা, জুতা গুছিয়ে আলাদা করে রাখা ভালো। অনেক সময় জিনিসপত্র খুঁজে বের করা যায় না–কাজের বড় ক্ষতি হয়, বিরক্তও কম হয় না।

স্বামীকে পানি দিতে হলে সব সময় গ্লাস মেজে দেবে। পানি দেওয়ার সময় দেখে নিও গ্লাসের ভিতর ময়লা পড়ছে কিনা। চাকরানীরা ঘাট থেকে যে পানি তুলে আনে তা স্বামীকে দিতে নেই। স্বামী বলে নয়, চাকরানীর তোলা পানি খাওয়ার জন্য ব্যবহার না করাই ভালো। পরিবারের প্রতি যিনি মায়া পোষণ করেন তারই হাতে খাবার পানি ঠিক রাখবার ভার দেওয়া উচিত। তাঁরই রান্না করা উচিত। এ সমস্ত কথায় মনে করো না, দাসীদের হুঁতমার্গ সেবাকারী হিন্দুদের মতো দূর দূর করতে হবে! বস্তুত খাবার পান ও রান্নার উপর নিজের বিশেষ দৃষ্টি থাকা চাই।

স্বামীর ভাত খেতে বিলম্ব হলে, নিজেরও স্বামীর জন্য অপেক্ষা করা ভালো। মুখে যাই বলুন মনে মনে স্ত্রীর এই অপেক্ষায় স্বামী সন্তুষ্ট হন।

হালিমা : খুব যদি ক্ষুধা লাগে তা হলেও কি স্বামীর জন্য বসে থাকতে হবে?

কুলসুম : স্বামীর প্রতি সাধারণত স্ত্রীরা খুব ভালবাসা পোষণ করেন। স্বামীর জন্য অপেক্ষা করলে তাদের কোনো কষ্ট হয় না। বিশেষ কষ্ট হলে বা স্বামীর কোনো জায়গা হতে ফিরে আসবার কোনো কথা আগে না হয়ে থাকলে, স্বামীর আগে খাওয়া যেতে পারে।

স্বামী কোনো জায়গা হতে বাড়িতে এলে স্ত্রীর কর্তব্য উঠে দাঁড়ান, দাসীর মতো সম্ভ্রম দেখাবার জন্য নয়, বন্ধুর ন্যায় প্রীতি-ভালবাসার চিহ্ন দেখাবার জন্যে স্বামীর হাতে কোনো জিনিস থাকলে নিজের হাতে নেবে। হাসিমুখে তার কুশল জিজ্ঞাসা করবে। কথা না বলে আপন মনে দূরে, মাথা গুঁজে থাকা অন্যায়। সাদর সম্ভাষণ ও প্রীতির আহ্বান জানান ভালো। স্ত্রীর মনে করা উচিত নয়–এসব করলে তার সম্মান নষ্ট হবে শরীরের রূপ অপেক্ষা কথা ও আলাপ ব্যবহারের রূপ বেশি।

কুলসুম আবার বলিলেন–স্বামীর গায়ের বা পরনের কাপড় যদি ময়লা হয় তা হলে তার কোনো কথা বরবার আগে সেগুলি নিজ হাতে পরিষ্কার করে দেবে। পরিষ্কার করবো কি না, এ কথা স্বামীকে জিজ্ঞাসা করবে না। এসব ব্যবহারে স্বামী সন্তুষ্ট হন।

হালিমা : দরিদ্র পরিবার হলে এত সাবান কোথা হতে পাওয়া যাবে?

কুলসুম : কাপড়, শরীর ও ঘর-দুয়ার পরিষ্কৃত রাখতেই হবে। যেমন করে হোক পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন থাকা চাই।

কুলসুম পুনরায় কহিলেন–স্বামী কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে হয়। অনেক বধূর অভ্যাস আছে তারা কথার উত্তর দিতে দেরি করেন, নিজের গৌরব প্রচার করবেন-বস্তুত এইভাবে গৌরব বা মান বাড়ে না।

স্বামী যদি কোনো রকমে বেদনা পান, তা হলে তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করবে। স্বামীর হাত কাটলে বা কোনো আঘাত পেলে তাকে কিছু সমবেদনার কথা জানান ভালো। স্বামী যদি স্ত্রীর কোনো ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হন, কিংবা কোনো কাজের জন্য স্ত্রীকে দোষারোপ করেন, তা হলে স্ত্রীর মুখ বুজে বসে থাকা উচিত। নিজের ভুল নিজে স্বীকার করা ভালো। স্বামীর দোষারোপ অন্যায় হলে তাকে বুঝিয়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করা চাই। চুপ করে বসে থাকা–যারপরনাই বোকামি। জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতীর মতো যদি স্বামীর দোষ ধরে দেওয়া। যায় তা হলে স্বামীর অসন্তুষ্ট হবার কারণ নেই। কথায় কোনো ক্রোধ বা দুঃখের আবেগ যেন ফুটে বের না হয়। ধীর প্রশান্ত কণ্ঠে যুক্তির সঙ্গে কথা বললে মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করে চুপ করে বসে থাকা ভাগ্যহীনার লক্ষণ।

স্বামী যদি কোনো কারণে ক্রুদ্ধ হয়ে বসে থাকেন তা হলে তাকে দেখে দূরে থাকতে নেই। তাঁর কাছে যেয়ে কথা বলবে ও আলাপ করবে। যে অতি বড় লম্পট, সেও স্ত্রীর সদ্ব্যবহার ও মধুর আলাপে মনে মনে সন্তুষ্ট হয়। সাত্ত্বিক জিনিসের জন্য মানুষের আত্মার একটা স্বভাবজাত ক্ষুধা আছে। প্রবৃত্তির মুখে আনন্দ যোগাবার জন্যে যে পতিতার পা চাটতে পারে, কিন্তু হৃদয়ের পুণ্য ক্ষুধা ও আনন্দের জন্য সে স্ত্রীর কাছে আসা! অতি হীন ব্যক্তির ভিতরের একটি সাত্ত্বিক ক্ষুধা থাকে, সেই ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় সদ্ব্যবহারে, করুণা ও মায়ায়-যা জননী ও স্বাৰ্ব্ব স্ত্রীর অঞ্চলে জড়ানো থাকে। যা সকল স্থানে পাওয়া যায় না।

স্বামী যদি বাজার বা হাট হতে কোনো জিনিস ক্রয় করে আনেন তা দেখে কখনও ঘৃণা বা অবজ্ঞা প্রকাশ করবে না, প্রশংসা করবে। অগ্রসর হয়ে তার হাত হতে জিনিসপত্র নামিয়ে নেবে।

স্বামী যদি নিকটে আসেন তা হলে মাথা তুলে কিছু কথা আছে কি না জিজ্ঞাসা করবে।

স্বামী যদি কোনো দুঃখ কষ্টের কথা বলতে থাকেন, তা হলে আপন মনে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকবে না। স্বামীর কথা শুনতে ও বুঝতে চেষ্টা করবে। তার কথার উত্তর দেবে।

স্বামী যদি কোনো অন্যায় বা পাপ কাজে রত হতে যান, যদি তিনি নীচ ও হীন প্রকৃতির লোক হন তা হলে, স্ত্রীর কীভাবে তাঁর সঙ্গে চলতে হবে তা বলা বড়ই শক্ত। সর্বদা মিষ্ট কথায়, স্নেহ মায়ায় স্বামীকে উন্নত করতে চেষ্টা করবে। তাকে সাধু পবিত্র ও পর দুঃখকাতর হতে উদ্বুদ্ধ করবে। দরিদ্র হওয়া ভালো, তবু পাপের পথে, অন্যায়ের পথে হাঁটা কর্তব্য নয়, এই কথা স্বামীকে বারবার শুনাবে। স্ত্রীর মঙ্গল শক্তিতে স্বামীর চিত্ত মহত্ত্বে ভরে উঠতে পারে। বহু স্বামী ঘুষ খেয়ে, অন্যায় করে সাংসারিক অবস্থাকে উন্নত করতে চেষ্টা করে। স্বামীর এই প্রকার উন্নতিতে স্ত্রীর সহানুভূতি না থাকা নিতান্ত দরকার। দালান দিয়া কাজ নেই। গয়না ও শাড়ী দিয়ে কি লাভ? যদি তাতে স্বামীর আত্মা কলঙ্কিত হয়। স্বামী যাতে অন্যায় না করে, হারামি পয়সা উপায় না করেন, সেদিকে স্ত্রীর লক্ষ্য থাকা আবশ্যক। মানুষের আশীর্বাদ পবিত্রতার মঙ্গল শক্তিতে পরিবার যাতে শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে স্ত্রীর সেই চেষ্টা করা কর্তব্য। স্বামীকে পাপ পথে টেনে নেবার জন্যে স্ত্রী যেন সহায়ক না হয়ে দাঁড়ান।

হালিমা : স্ত্রীর অনুরোধ ও অশ্রুজলে স্বামী যদি অন্যায়ের পথ পরিত্যাগ না করেন?

কুলসুম : তা হলে স্ত্রীর মনে অসীম দুঃখ এসে উপস্থিত হবে। সেরূপ স্বামীকে কিরূপ ভাবে গ্রহণ করতে হবে, তা চিন্তার কথা। স্ত্রীলোকের জীবনে এর মতো দুঃখ আর নেই। পাপীও অপদার্থ স্বামীর সঙ্গে বাস করে বহু পবিত্র হৃদয় নারীর আত্মার পতন হয়। স্বামীর আত্মার পতন হলেও স্ত্রীর নিজের আত্মার যেন পতন হয়। স্বামীর নীচতার প্রতি ভিতরে ভিতরে সহানুভূতি পোষণ করবে না। স্বামীকে ভালো ও উন্নত করতে চেষ্টা করবে, না পারলে কি করা যায়? নিজের দুঃখ বেদনা নিজের ভিতরে গোপন করে রাখাই ঠিক।

কুলসুম আবার বলিলেন–স্বামী যদি কোনো বিশেষ কাজে বিদেশে থাকেন তা হলে তাকে অনবরত কাজ ফেলে বাড়িতে আসতে অনুরোধ করবে না। বিরহের কথা জানাবে না, এতে স্বামীর কাজে অমনোযোগ আসতে পারে-কর্মশক্তি নষ্ট হতে পারে।

স্বামী যদি কলেজের ছাত্র হন, তা হলে তাকে আদৌ পত্র না দেওয়া উচিত। যদি পত্র লেখা নিতান্ত দরকার হয়, তা হলে, অল্প কথায় লিখবে। প্রণয়ের কথা ভালবাসার কথা লিখতে নেই। পত্রে স্বামীকে উপদেশ দিতে লজ্জা করা উচিত নয়। ঠিক উপদেশ রূপে কথা না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিষ্টি করে কথা বলতে হবে। কর্তব্য কার্যে অবহেলা করে স্বামী যেন স্ত্রীর কাছে কখনও না আসেন, সে দিকে লক্ষ থাকা চাই। পত্র না লেখার কারণ স্বামীকে পূর্ব হতেই বলে রাখবে নইলে স্বামী রাগ করতে পারেন।

স্বামীর কাজ বা কথার প্রশংসা করা উচিত। অনর্থক তর্ক করা বড় খারাপ ও অভদ্রতা, এরূপ করলে স্বামী-স্ত্রীতে প্রণয় হয় না। স্বামী কোনো কারণে ক্রুদ্ধ হলে কখনও তাঁর সামনে হাসতে নেই। হাই তোলাও দোষের।

স্বামীর সঙ্গে বিদেশে যেতে কোনো প্রকার লজ্জা বা সঙ্গোচ করা ভালো নয়। বিশেষ বাধা না থাকলে স্বামীর সঙ্গে থাকতে বরং পীড়াপীড়ি করা উচিত। স্বামীর নিকট হতে চলে আসবার জন্যে কোনোরূপ জেদ কখনও করতে নেই। এটা বড় দোষের কথা। এতে স্বামীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস নষ্ট হতে পারে।

কোনো কোনো পুরুষ স্ত্রীকে ফেলে বিদেশে থাকে। পাঁচ বৎসরেও দেশে ফেরে না। স্ত্রী-পুত্রের জন্য অর্থ উপায় করার উদ্দেশ্যে তারা সাধারণত দূর দেশে যায়, এ খুব প্রশংসার কথা। দুঃখের বিষয়, অনেক লোক চরিত্র হারিয়ে অর্থ উপার্জন করে। যদি এইরূপ কোনো ভয় থাকে, তা হলে স্বামীকে বিদেশে না যেতে দেওয়াই ভালো। চরিত্র হারিয়ে অর্থ উপার্জন। করা মূর্খতা ছাড়া আর কি?

.

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

কুলসুম বলিলেন–প্রিয় বোন, পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি অনেক পরিমাণে হাতে। এ যেন সব সময় মনে থাকে। বধূর মনোযোগে দরিদ্র পরিবারেও প্রেম, শান্তি ও সচ্ছলতা বিরাজ করে। পাড়া-প্রতিবেশী সকলেই পরিবারের মঙ্গলকাক্ষী হয়।

বধূকে সব কাজে বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। স্বামী ভালবাসেন বলে বধূ যেন উজ্জ্বল এবং সংসারের কাজে অমনযোগী হয়ে বা অহঙ্কারে নিজের সুনাম নষ্ট না করেন। কাজের শৃঙখলা-সৌকর্যের প্রতি সব সময় তার নজর থাকা চাই।

হালিমা : দরিদ্র পরিবারে কেমন করে মেয়ে মানুষের চেষ্টায় সচ্ছলতা আসে শুনতে চাই।

কুলসুম : কোনো জিনিস নষ্ট হতে দিতে নেই। দেখে-শুনে হিসাব করে খরচ করলে, সব জিনিসই বেশি দিন চলে। টাকা পয়সা বেশি আছে বলে অনর্থক ভাত, তরকারী বেঁধে পচিয়ে ফেলে দেওয়া উচিত নয়।

কাপড়-চোপড় ছিঁড়ে গেলে একটু রিপু করে নিতে হয়। কাপড়-চোপড় অবহেলা করে ফেলে না দিয়ে যদি একটু-আধটু সেরে দরিদ্রকে দেওয়া যায়, তা হলে তাদের যথেষ্ট উপকার হয়। সতরঞ্চি কেনবার সঙ্গতি না থাকলে ধোয়া পুরনো কাপড় দিয়ে কাঁথা সেলাই করে নিতে হয়। কাঁথা তৈরি করতে অনেক মেয়ে আলসেমি বোধ করেন; কত দিনে শেষ। হবে, এই ভয়ে অনেকে কাঁথা তৈরি করার নাম শুনে চমকে ওঠেন। এতে অনেক সময় লাগে তা ঠিক, কিন্তু গল্প ও হাসি-তামাসা করার সময় যদি একটু আধটু বা একটা লাইন করে দৈনিক সেলাই করা যায়, তা হলে সতরঞ্চি ও অল্প শীতে রাত্রে গায়ে দেবার কাপড় কেনবার জন্য পয়সা ব্যয় করতে হয় না। নিজেরা বড় মানুষ হলেও গল্পে সময় নষ্ট না করে কাঁথা তৈরি করে, দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন অথবা দরিদ্র মানুষকে দেওয়া যায়। পরখে সুখ দিয়ে মনে যে আনন্দের সঞ্চার হয়, তার তুলনা কোথায়? মূল্যবান কাজ নষ্ট করে কাঁথা সেলাই করতে বলছি না। অবস্থার উপর লক্ষ রেখে কাজ করতে হবে। পরিবারের সকলে ও ছেলেপেলেদের শোবার কষ্ট দেখে বধূদের বিবেচনা চাই।

বাড়িতে তরকারি গাছ লাগিয়ে দেওয়া উচিত, এতে সংসারের অনেক খরচা বেঁচে যায়। কুমড়া, লাউ, সীম, বরবটি, বড় কচু, মেটে আলু প্রভৃতি অনেক প্রকার তরকারি বিনা চাষাবাসে হয়। অনেক দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা মুরগি, ভেড়া, ছাগল পালন করেন। এতে বেশ লাভ হয়। ছাগল ভেড়ায় পরের অনিষ্ট করে, সে দিকে নজর রাখা চাই। দারিদ্রভার ঘুচাতে গিয়ে যদি সহানুভূতিহীন প্রতিবেশীর গালি খেতে হয়, তবে সেও বড় কষ্টের কথা। কেরোসিন তেল, লবণ, মরিচ, সাগুদানা কিনে যদি পাড়ার লোকদের কাছে বিক্রি করা যায় তা হলেও দরিদ্র গৃহিণীর অনেকটা উপকার হয়। আজকালকার লোক বড় ধূর্ত–কাউকে বাকি দিতে নেই। কোনো ভদ্রলোকের কর্তব্যও নয় দরিদ্র মেয়েদের কাছ থেকে কোনো জিনিস বাকি নেন। ফসলের সময় কালই, পেঁয়াজ বা গুড় কিনে রেখে দিলে বেশ ভালো। হয়। অবশ্য কিছু মূলধন চাই।

যে সমস্ত মেয়ে বাল্যকালে কোনো শিল্প বা সেলাই-এর কাজ শিখে রাখেন, ভবিষ্যৎ জীবনে দুঃখে পড়লে তাহাদের ভয়ের কোনো কারণ থাকে না।

বাড়ির পার্শ্বে হলুদ ও আদার গাছ লাগিয়ে দেওয়া ভালো। আনারসের গাছ জঙ্গলের মধ্যেই হয়। চেষ্ট থাকলে যেমন করেই হউক, গাছের বীজ অথবা গাছ সংগ্রহ করে নেওয়া যায়। দুই-চারটা তরকারি, কলাগাছ থাকলেও পয়সা হয়। এসব কাজ করতে পুরুষের সাহায্য প্রয়োজন হয় না। মূলা শাকের ক্ষেত করতে মাটি তৈরি করার দরকার হয়, মাটি কোপান শুরু পুরুষ লোকেই পারে, এমন কোনো কথা নয়। জোছনা রাত্রে কোমরে কাপড় জড়িয়ে মাটি কোপালে কি ক্ষতি? এতে সম্মান নষ্ট হয় না। সম্মান নষ্ট হয় অন্যায় কাজে-পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকায়, আর ভিক্ষা করায়। ধান ভানলে বা কাজ করলে জাতি যায়, এ যারা মনে করে তারা অপদার্থ।

বড় বড় শহরে কলমের চারা পাওয়া যায়। পোস্টকার্ড লিখে অর্ডার দিলেও নিজের নামে নিকটস্থ রেল স্টেশনে বাক্সে চারাগাছ এসে উপস্থিত হয়। টাকা দিয়ে ডাকঘর হতে রসিদ দিয়ে স্টেশন থেকে কোনো সহৃদয় প্রতিবেশী দিয়ে গাছগুলি নিয়ে এসে বাড়ির ধারে পুঁতে দিলে দুই-চার বৎসরের মধ্যেই লাভ ভোগ করা যায়। ভালো কুল, লিচু এবং বড় কাশীর পেয়ারার দাম বাজারে বেশি। বাড়ি থেকেও লোকে কিনে নিয়ে যেতে পারে।

দুই-মর জোড়া পায়রা পুষলে দুই-চার মাসের মধ্যে এক একখানা কাপড়ের দাম সংগ্রহ করা যায়। মুরগী ও ডিম বিক্রি করলেও পয়সা হয়। দুঃখিনা সহায়হীনা রমণীর বাঁচবার অনেক পথ আছে–তার ভয় কি? কেবল চেষ্টা ও বিশ্বাস চাই।

হালিমা : পরদানশীন স্ত্রীলোকের পক্ষে এতগুলি কাজ করা কি সম্ভব? এত বুদ্ধি করে কাজ করলে লোকে যদি বেহায়া বলে?

কারো প্রতি যেন কোনোও প্রকার অশ্রদ্ধা না দেখান হয়। মেয়েরা অনেক সময় স্বামীর আত্মীয়-কুটুম্বকে রান্না ঘরে বসে এরূপ অন্যায় কথা বলে থাকেন যা শুনলে বন্ধু অবাক হয়ে অবিলম্বে বন্ধুর বাড়ি ত্যাগ করেন। ভাগ্যে তারা শোনেন না। সাবধান-এরূপ কথা কখনও বলবে না। বাজে লোকের অত্যাচার বেশি হলে একটি বিরক্ত মেয়েরা না হয়ে পারেন না তাও ঠিক। যাদের বাড়ি শহরে তাদের এখানে বহু অবিবেচক লোকের সমাগম হয়। শহরে থেকে সকলকে পরিতুষ্ট করা অসম্ভব, এটা সকলের বোঝা উচিত। দুটি পান, একটু নাস্তা অন্তত তাদের দেওয়া যায়।

টাকা দিয়ে কেউ যদি কারো বাড়ি খেতে চায় তাহলে বন্ধুরা অসম্মানের ভয়ে, তাতে স্বীকৃত হয় না। পাছে লোকে হোটেলখানা বলে বা অতিথি মনে করেন পরিবারের লোকেরা তার দেওয়া টাকায় লাভবান হচ্ছেন এই ভয়ে বধূরা সরে দাঁড়ান।

হালিমা কলিলেন, এতে বধূদের কিছু অসম্মান হয় বৈকি?

কুলসুম বলিলেন কিছুই না, যে কোনো দ্ৰসন্তানকে টাকা নিয়ে বাড়িতে রাখা যায়। এতে বধূদের কোনো অসম্মান নেই। পক্ষান্তরে বহু ভদ্র সন্তানকে উপকার করা হয়। উন্নত দেশে এরূপ প্রথার প্রচলন আছে। বিদেশীদের উপকার করা হয়।

বাইরে কোনো জিনিস যদি পড়ে থাকে তা ঘরের মধ্যে তুলে রাখতে হবে। সন্ধ্যার আগে বাইরে কাপড় আছে কিনা একবার চিন্তা করে দেখা উচিত।

যেখানকার জিনিস ঠিক সে জায়গায় রাখা একান্ত কর্তব্য। যেখানে সেখানে বাড়িতে কেউ যেন গৃহস্থের আবশ্যক জিনিসপত্র ফেলে না রাখে, এতে কাজের বড় অসুবিধা হয়। পরিবারের কেউ যদি এ নিয়ম পালন না করে, তবে তার উপর ক্ষুদ্ধ হবে।

বধূকে সব কাজে বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। তা হলে বধূর সুনাম বের হবে। ছেলে ম্যাচ নষ্ট করে জেনেও তার হাত থেকে ম্যাচ কেড়ে না নেওয়া, শুধু ছেলেকে মন্দবলা। বুদ্ধিমতী স্ত্রীলোকের কাজ নয়। ম্যাচ কাটি এলিয়ে ফেলবার আগে, ঘড়া হতে পানি ঢেলে ফেলবার পূর্বেই সতর্ক হওয়া উচিত। কুকুরে ভাত খেয়ে ফেলবার পরে বিরক্তির পরিচয় দিয়ে লাভ কি?

বাক্সের উপর কখনও কোনো জিনিস রাখতে নেই। এতে হঠাৎ বাক্সের কভার খুলতে গিয়ে জিনিস নষ্ট হয়।

বিছানা-পত্র দিনে রোদ থাকতে শুকিয়ে নিতে হবে–সন্ধ্যাকালে সিক্ত বিছানাপত্র হাতে করে, খোকা-খুকুদের সঙ্গে রাগারাগি করে কোনোই লাভ নেই।

গৃহস্থালীর কোনো জিনিস ফুরালে, পূর্ব হতেই সতর্ক হওয়া উচিত। পল্লী-গ্রামে, হাটের দিন স্বামীকে কী কী জিনিস কোনো দরকার, আগেই মনে করিয়ে দেওয়া উচিত। খালি হাত হবার পূর্বে জিনিসপত্র নতুন করে আনার নিয়ম।

বধূরা অনেক সময় বেলা পর্যন্ত শুয়ে থাকে। ছেলে-পিলে হলে মেয়েদের সারারাত্রি অনিদ্রায় কেটে যায়, সেইজন্যই সকাল সকাল ওঠা কঠিন হয়। রাত্রি অনিদ্রার জন্য, দিনে একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই সুবিধা। সকাল বেলা নামাজ নষ্ট করে না ঘুমানই ভালো।

মনে রেখ, নামাজ নষ্ট করা বড়ই অন্যায়। ছেলেপেলের অত্যাচারে অনেক সময় নামাজের বড় ক্ষতি হয়। ছোট শিশু হলে তাকে ফিডিং বোতলে অভ্যস্ত করানো উচিত। গো-দুগ্ধ ছাড়া বাজারের কোনো খাদ্য কখনও ব্যবহার না করাই উচিত। ছেলের হাতে মিষ্টি বিস্কুট দিলে অনেক সময় তাদের কান্না থামে। ( কখনও নতুন জুতো যেন বাইরে না পড়ে থাকে। শেয়াল বা কুকুর নতুন জুতো পেলেই নিয়ে পালায়।

পরিবারের বিছানাপত্র ও লেপ দুই-চারটা বেশি করে তৈরি করে রেখে দিতে হয়। লেপ ও বিছানাপত্রের দিকে স্বামী যেন বিশেষ মনোযোগ দেন। বধূরও সম্ভব হলে কাঁথা তৈরি করে স্বামীকে সাহায্য করা উচিত। বাজারের তৈরি লেপ ভালো নয়। ধুনকারদের সেলাই করা লেপ আবার নতুন করে সেলাই করলে সহজে তুলা সরে না; নইলে এক বছরেই লেপ নষ্ট হয়ে যায়। প্রত্যহ একটু একটু করে সেলাই করলে কয়েক দিনেই একটা লেপ সেলাই করে ফেলা যায়।

হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন-তোষক না কিনলে কি চলে না?

কুলসুম : খুব চলে। ছেলেপেলেদের তোষকের কোনো দরকার নেই। স্বাস্থ্য যাদের ভালো, মনে যাদের চিন্তা–উদ্বেগ নাই, যারা ঘুমে আকুল, তাদের তোষক না হলেও চলে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘুমকে কাজ রূপে গ্রহণ করতে হয় তখন কিছু নরম বিছানার দরকার হয়। যাদের বেশি মানসিক পরিশ্রম করতে হয়, তাদের জন্য যত নরম বিছানা হয় ততই ভালো।

দরজার গোড়ায় আঁধারে অনেক সময় কুকুর দাঁড়িয়ে থাকে, অন্ধকারে হঠাৎ তাদের গায়ে পা দিলে কামড়াতে পারে। না দেখে তাদের গায়ে পানি ফেললে গা ঝেড়ে হঠাৎ কাপড়-চোপড় নষ্ট করে দেয়। কুকুর-বিড়ালকে কখনও শুধু মুখে দূর দূর করতে নেই তাতে লাভ হয় না। সর্বদা লাঠি দিয়ে ভয় দেখাবে।

বাড়িতে স্বতন্ত্র পায়খানার ব্যবস্থা থাকা চাই। স্ত্রীলোকের পায়খানায় কখনও যেন পুরুষ যায়, নিজের ছেলে বা অন্য কোনো পুরুষ কেউ নয়। অবশ্য একথা শহরে খাটে না।

অনেক সময় বাড়ির দাসীদের পেশাব-পায়খানা করবার বড় অসুবিধা হয়! সেদিকে গৃহিণীর বিশেষ দৃষ্টি থাকা আবশ্যক। দাসদাসী বলে তাদের জীবন ও অভাব-অসুবিধা উপেক্ষিত হবার নয়।

হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন-ধোপার কাপড় ও দুধের হিসাব কে রাখবে? বাজার খরচ কার হাত দিয়ে হওয়া ভালো?

কুলসুম : কাপড় ও দুধের হিসাব স্ত্রীদের রাখা উচিত। খরচপত্র স্বামীর হাতে থাকাই ভালো। অনেকে বুদ্ধিমতী স্ত্রীর হাতে মাসের প্রথমে বা শেষে বাজার খরচের টাকা দিয়ে থাকেন। স্ত্রী পরিবারের খাওয়ানোর ভার নিজের হাতে নেন। বাজার খরচ নিজের হাতে নিলে রীতিমতোভাবে খরচের হিসেব রাখা চাই।

কুলসুম আবার কহিলেন–অনেক সময় তাড়াতাড়ি বসবার টুল, হুঁকার কলকে বা গ্লাসের পিঠে বাতি রাখেন, এটা অন্যায় ও কদর্য রুটির পরিচায়ক।

রান্না ঘরে ল্যাম্প না জ্বালানোই ভালো। ঝুলানো বাতি ব্যবহার করলে ঘরে বা কাপড়ে কালি পড়ে না।

অনেক বাড়িতে সংসারের জিনিসপত্র কেবল গড়িয়ে বেড়ায়, এ ভালো নয়। হয় জিনিসপত্র ব্যবহার করতে হবে না হয় যত্ন করে তুলে রাখতে হবে।

পরিবারের মধ্যে যদি কেউ শৃঙখলা ও ভালো রুচির পরিচয় না দেয়, তাহলে নিজে ভালো বলে নিরন্তর তার সঙ্গে ঝগড়া-ঝাটি করাও ঠিক নয়। তার দোষ বা আর সকলে সেরে নেবে। ক্ষমাশীল, দয়ার্দ্র হৃদয়, শান্ত স্বভাব ও হওয়া ভদ্রমহিলার স্বভাব। বেশি কড়াকড়ি নিয়মে ফল খারাপ হতে পারে।

রোজার দিনে পূর্ব হতেই চাকর পরিচারিকা দিয়ে হোক অথবা নিজ হস্তে অথবা ছেলে-মেয়ে দিয়ে এফতারী প্রস্তুত করবে। রোজার সময় সন্ধ্যাকালে রাগারাগি করা দোষ।

কারো কাছে কিছু পাওনা থাকলে মাঝে মাঝে তাগাদা দিতে হয়। নইলে তা আদায় হয় না। তাগাদার জোরে অনেক সময় নিতান্ত বদ লোকের কাছে থেকেও টাকা আদায় হয়। প্রথমেই রূঢ় ব্যবহার নিষেধ।

ঘরের মেটে দাওয়ার ধান গড়ান ধরনের হলে, ভাঙ্গে না। নদীর ধারের মতো করতে হয়। টিনের ঘর তো স্বাস্থ্যকর নয়। তুলতে নিচে ছাত দেবে।

.

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

কুলসুম বলিলেন-হালিমা অনুন্নত সংসারে অনেক সময় শিক্ষিতা মার্জিত রুচি বালিকাঁদের বড় দুরবস্থা হয়। অনুদার, বহির্জগৎ সম্বন্ধে খবরহীন অথচ অহঙ্কারী পরিবারের বধূদের বড় জ্বালা হয়। শ্বশুর-শাশুড়ী, পাড়া প্রতিবেশী সকলেই বধূকে বিব্রত করে তোলেন। স্বামী এতগুলি লোকের কথা ও মতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না। স্বামী ও আত্মীয়-স্বজনের হয়ে স্ত্রীর উপর অত্যাচার আরম্ভ করেন। বধূকে চূর্ণ করে স্বামী মনুষ্যত্বের পরিচয় দেন। বধূ কি চাকরি করতে যাবে?

হালিমা : চাকরি করলে দোষ কী?

কুলসুম : অসভ্য দুর্মতি লোক যারা তারা দুনিয়ায় পশুর মতো বেঁচে থাকতে পারলেই যথেষ্ট মনে করে। তারা যে নিজে একটু লেখাপড়া শেখে, সে কেবল ঘুষ খেয়ে লোকের তোষামোদ করে বা পরকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরা সুবিধা করে নেবার জন্যে। জ্ঞানী, সভ্য ও ভদ্র হবার জন্যে তারা লেখাপড়া শেখে না। নারীকে লেখা-পড়া শিখতে দেখলে তারা তো রাগবেই।

কুলসুম পুনরায় বলিলেন–কোনো দুঃস্থ নারীকে দেখে যদি বধূ সহানুভূতি প্রকাশ করতে যান, তা হলে শঙ্কীর্ণ হৃদয় শাশুড়ী বধূর উপর রেগে থাকেন। বাড়িতে দুপুর বেলা বা অন্ধকার রাত্রির সন্ধ্যায় অতিথি এসে উপস্থিত–বধু তাদের কারো দিয়ে সাদর অভ্যর্থনা। জানাতে ইচ্ছে করবে, স্বামী-শ্বশুরের জ্বালায় তা পিরবার যো নেই। কোনো দরিদ্র আত্মীয় স্বজন বাড়িতে এলে তাকে যত্ন করা দরকার, না করলে অনেক স্বামী বিরক্ত হন। এই প্রকার ব্যক্তিদের মধ্যে থাকা অনেক বধূর কষ্টকর হয়ে পড়ে। যাদের মধ্যে বাস করতে হয়, তাদের ব্যবহার ও প্রবৃত্ত যদি বেশি নীচ হয়, তাহলে বধুর জীবনে কোনো সুখ থাকে না। কোনো কোনো পরিবারে অশ্লীল ও কুৎসিত কথা অসঙ্কোচে উচ্চারিত হয়; এই সমস্ত লোকের মধ্যে বসা করাও বড় কঠিন।

একই ভাব ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট লোকের মিল হয় ভালো। যে মেয়ে বাল্যকাল হতে অন্য রকমে গঠিত হয়েছে তার পক্ষে দুর্মতি লোকদের সঙ্গে বাস করা কঠিন নয় কি? হয় তাকে নিচে নেমে আসতে হবে, নইলে ভিতরে ভিতরে মৃত্যু পর্যন্ত প্রাণে দুঃখে পোষণ করতে হবে। সে দুঃখের কোনো মীমাংসা নেই। শয়তান প্রকৃতির স্বামীর স্পর্শে এসে কত শুভ্র। নারী–আত্মার শোচনীয় পতন হয়। কোনো কোনো আড়ী ভদ্রবংশের মেয়ে বিয়ে করে ভদ্র হতে চেষ্টা করে। কন্যার পিতার তাকে বলে দেয়া উচিত–এইভাবে ভদ্র হতে চেষ্টা করে, নিজে চরিত্রবান ও শিক্ষিত হয়ে ভদ্র হতে চেষ্টা করুন। ইতর ও অর্ধ শিক্ষিত ব্যক্তির হাতে মেয়ে পড়লে তার জীবনে দুঃখ বাড়ে।

কুলসুম : কথা শুনে মর্মাহত হলাম। জান বাঁচান ফরজ, পরদা অপেক্ষা প্রাণের মূল্য বেশি। যে সমস্ত কথা বললাম, এসব কথা কাজে পরিণত করার জন্য, বেপরদা হবার তো কোনো দরকার নেই। স্ত্রীলোক বুদ্ধির পরিচয় দিলে লোকে তাকে বেহায়া বলে, এ আমি কোনো দিন শুনি না।

হালিমা : সময় সময় মুরগীর অত্যাচার বড় বেশি হয়ে পড়ে।

কুলসুম : মেঝের উপর দাওয়া না করলে মুরগীর অত্যাচার থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যায়। উঁচু স্থানে হাঁড়ি রাখবে। ঘরের মধ্যে মুরগীকে যেতে দিতে নেই। এঁটো ফেলার সম্বন্ধে বিলক্ষণ সাবধান হবে। মাটির উপর বসে না খেলে শুধু মুরগী নয়-বিড়াল, কুকুর, ধুলাবালি অনেক কিছুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সকলের এক সময় খাওয়া উচিত। এতে এঁটো কম হয়। যখন তখন হাঁড়িতে হাত দেবে না। বিশেষ কারণ না থাকলে ঘরের দুয়ার বন্ধ রাখবে।

কুলসুম পুনরায় কহিলেন–প্রাতঃকালেই থালা মেজে ফেলা উচিত। ছেলেপেলের ঘরে চীনা মাটির কিংবা কাঁচের বাসন ব্যবহার না করাই ভালো।

ছেলেরা কখনও মাটিতে খাবে না। এদের জন্য মেঝের পার্শ্বে ছোট ছোট টুল রেখে দিলে ভালো হয়। মাটিতে খেলে মুরগীর উপদ্রব বড় বাড়ে। জায়গা বাড়ি নোংরা হয়ে ওঠে।

চালের হাঁড়ি নিচে রাখতে নেই চালের গন্ধে ঘরের মধ্যে মুরগী এসে হল্লা করে।

বদনা, বাটী, থালা কখনও মেঝেয় বা হাঁটবার পথে যেন না থাকে। ছেলেরাই এই অপরাধ বেশি করে। এই কু-অভ্যাসগুলো সংশোধিত না হলে, চিরকাল তারা কষ্ট ভোগ করে।

কোনো জিনিস যদি মাটির উপরে পড়ে থাকে, তাহলে তৎক্ষণাৎ সেগুলি তুলে রাখতে হবে। চাকর-বাকরের সুবুদ্ধির উপর নির্ভর করলে চলবে না। সকল কাজে চাকর-বাকর সুবুদ্ধির পরিচয় দেবে, এ আশা করা যায় না।

গোছল করে অনেক সময় কাপড় পানিতে ভিজিয়ে রাখেন। যখন তখন ধুয়ে ফেললে আপদ চুকে যায়। বেশিক্ষণ পানিতে কাপড় থাকলে পচে যাবার সম্ভাবনা।

অনেক পরিবারে বদনা, ঘড়া এক মাসেও মাজা হয় না। প্রতিদিন বদনা মাজা উচিত।

বাড়িতে দাস-দাসী না থাকলে খাবার পর যার যার থালা, এঁটো সেই সেই পরিষ্কার করে ফেলা ভালো। এঁটোব্লুটো, ফেলে রাখলে মেজাজ ভালো থাকে না, দুর্গন্ধও সৃষ্টি হয়।

কখনও অন্ধকারে জিনিসপত্র খুঁজতে নেই।

শোবার সময়, বাতি ও ম্যাচ ঠিক করে শুতে হয়। বৃষ্টি-বাদলার দিনে ম্যাচ কাপড়ের ভিতর রেখে দেওয়া উচিত-নইলে ম্যাচ জ্বলে না। বিদেশে, বৃষ্টি বাদলের দিনের জন্যে পূর্ব হতে জ্বালানি কাঠ ঠিক করে রেখে দিতে হয়, নইলে অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। চুলো ও অগম্ভীর হলে কম খড়িতেই রান্না হয়।

হালিমা : খড়ি কাঠ ঠিক করে রাখা কি মেয়ে মানুষের কাজ?

কুলসুম : না, স্বামীকে পূর্ব হতেই হুশিয়ার হতে বলতে হবে। ধানের খোসা এবং গোবরে জ্বাল দেবার সাহায্য হয়। পল্লী ছাড়া এসব সংগ্রহ করতে পারা যায় না।

হালিমা : গোবরে হাত দিতে আমার বড় ঘৃণা বোধ হয়।

কুলসুম : অবস্থা নিয়ে ব্যবস্থা। খড়ি কেনার পয়সা না থাকলে, গোবরে হাত দিলে দোষ কি? গোবর নোংরা জিনিস নয়।

হালিমা : গোয়াল ঘরের ভিতরে এবং কাছে যে আবর্জনা জন্মে তা দেখলে ঘৃণায় গা বমি করে। এমন জঘন্য দৃশ্যও মানুষকে দেখতে হয়। ছি!

কুলসুম : গরুতে অনেক উপকার হয়। প্রত্যেক জ্বগৃহে দু’একটা ভালো গাভী থাকা নিতান্ত দরকার। অন্য কোনো জিনিস থাক বা না থাক, একটা গাভী এবং কয়েকটি মুরগী পোষা উচিত। দুধ-ঘিতেই মানুষের জীবন; মুরগীর ডিম শরীরের পক্ষে বড় উপকারী। যে কথা বলছিলাম, গোয়াল ঘরের ধারে যে আবর্জনা হয় তা অনেকটা বিরক্তিকর বটে। আষাঢ় মাসে কোনো কোনো বাড়ির ঘর বড় জঘন্য হয়ে ওঠে।

গোয়ালঘর বাড়ি হতে দূরে হওয়া ভালো। ভদ্রগৃহে একটি বা দুইটি গাভীর বেশি থাকা উচিত নয়। এতে বাড়ির পার্শ্বে বড় নোংরা হয়ে ওঠে। দেশে ভালো দুধ-ঘি তৈরি করবার জন্য ব্যবস্থা থাকলে গৃহস্থকে আর কষ্ট করতে হয় না। গ্রাম হতে দূর মাঠের মাঝে মাঝে কেউ যদি দুধ-ঘি সরবরাহের ব্যবসা খোলে তা হলে সে ব্যবসায় বেশ লাভজনক হতে পারে। এই কাজে দেশের লোক যেন বড় উদাসীন। শিক্ষিত নর-নারী যদি এদিকে মনোযোগ দেন তবে লোকের বড় মঙ্গল হয়। দুধ-ঘিতেই মানুষের জীবন।

হালিমা : দরিদ্র মেয়েরা যদি দুধ হতে ঘি তৈরি করে বিক্রি করেন, তাহলে ক্ষতি আছে কি?

কুলসুম : ক্ষতি নেই। একটা রাখাল রেখে মেয়েরা বাড়িতেও এ ব্যবসা করতে পারেন। দূরে গোয়ালঘরে রাখালের তত্ত্বাবধানে গাভীগুলি থাকবে; প্রয়োজনমতো গাভী বাড়িতে সে নিয়ে এ মূলধন নিয়ে একবার পরীক্ষা করে দেখলে মন্দ হয় না। রাখাল চাকরকে কঠিন কথা বলবে না, তা হলে ব্যবসা মাটি হবে।

হালিমা : কি প্রতিক্রিয়ায় ঘি তৈরি করা সুবিধা?

কুলসুম : জমানো দুধ হতে ঘি তৈরি করাই বড় সুবিধা।

হালিমা : কোনো কোনো গৃহিণী গাভীর বাচ্চার উপর বড় অত্যাচার করেন।

কুলসুম : সে আর বলো না বোন। সারাদিন সারারাত্রি বাচ্চা বেঁধে রাখা বড় অন্যায়। দিনে দুবার দুধ বের করা নিষ্ঠুরতা। সন্ধ্যায় বাচ্চা ধরে রাখতে হয়। প্রাতঃকালে নামাজ সেরেই দুধ টানা নিয়ম। দিনের মধ্যে মাত্র একবার দুধ নেবে, আর নয়।

হালিমা : বধূরা কি দুধ টানতে জানে?

কুলসুম : গাভীর তত্ত্বাবধান ও যত্ন বধূদের হাতেই থাকা ভালো। দুধ টানা বন্ধুদেরই কাজ। দুগ্ধ, ঘি, অমৃতসুষমা, মাধুরীশক্তি–এসব জিনিসের মালিক বধূ।

কুলসুম বলিলেন–সন্ধ্যাকালে বাতি পরিষ্কার করা ও বাতিতে তেল ভরা নিয়ে একটা সোরগোল পড়ে যায়। প্রত্যহ স্নানের পূর্বে বাতি ঠিক করে রাখলে সন্ধ্যাকালে হৈ-চৈ হয় না।

হালিমা : পরিবারের সদস্যগণের শোবার ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত?

কুলসুম : স্বামী-স্ত্রী, ঘরের মধ্যে আর কারো থাকা অন্যায়। প্রত্যেক দম্পতির স্বতন্ত্র ঘর থাকা একান্ত কর্তব্য। এক কামরায় কথা বললে অন্য কামরা হতে শোনা যায় এরূপ স্থানে থাকাও অবৈধ। স্বামী-স্ত্রীর জন্যে একই ঘরে স্বতন্ত্র কিন্তু পাশাপাশি বিছানা হওয়া উচিত। ছেলেমেয়ে সেয়ানা হলে তাদের আলাদা প্রকাষ্ঠে শুতে দেবে। তাতে ছেলেমেয়েকে অবজ্ঞা করা হলো, এ মনে করা ভুল।

কুলসুম আবার কহিলেন–তি পরিষ্কার করে বা মাছ ধুয়ে ছাই বা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হয়, নইলে হাতে কাপড়ে গন্ধ থাকে। হাতে, পায়ে বা কাপড়ে ময়লা জড়ালে তা ভালো করে ধুয়ে ফেলা উচিত। একটা ছোট পাত্রে সাবান রাখা নিয়ম, নইলে অসুবিধা হয়।

হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন–বাড়িতে ফুলের গাছ থাকা কেমন?

কুলসুম : একান্ত দরকার। লতা-পাতা ও ছোট ছোট ফুলের গাছ দেখলে মনের রূঢ়তা নষ্ট হয়। সঙ্কীর্ণ মন উদার হয়ে ওঠে। বাড়ির পার্শ্বে ছোট বাগান ছাড়া বারান্দায়; দরজার ধারে এবং উঠানে টবে করে দুই একটা গাছ রেখে দেওয়া খুব ভালো।

গ্রীষ্মকালে ছারপোকার জ্বালায় অনেক সময় অস্থির হয়ে উঠতে হয়। দারুণ–গ্রীষ্ম তার উপর মশা আর ছারপোকার অত্যাচার প্রাণকে অতিষ্ঠ করে তোলে। খাট-পালঙ্কের মাপে একটা কাগজের চাঁদর প্রস্তুত করবে। দুই পরদা বা তিন পরদা কাগজ আটা দিয়ে এঁটে একটা বিছানায় চাঁদরের মতো বড় আবরণ করবে। তার পর খাটের উপর সেইটা পেতে তার উপর তোষক বিছাবে। কাগজের চাঁদরের ধারগুলি আধ হাত বা তারও খানিক বেশি প্রত্যেক দিকে ঝুলে পড়া চাই এতে ছারপোকার উপদ্রব কমে। বিছানাপত্র রৌদ্র দেওয়া উচিত-খাট পালঙ্কও রৌদ্র দেওয়া কিংবা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা উচিত।

কোনো কোনো পরিবার ঘরে আদৌ জানালা রাখেন না। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এরূপ ঘরের সংখ্যা অনেক। ঘরে প্রচুর জানালা থাকা উচিত। যে ঘর অন্ধকার, জানালাহীন সে ঘরে বাস করবে না। পাছে লোকে ঘুমঘোরে সরমের অবস্থা দেখে এই ভয়ে অনেকে সামান্য ছিদ্রটুকু পর্যন্ত কাগজ দিয়ে বন্ধ করে রাখেন। ঘরে প্রচুর জানালা থাকা চাই। ইজ্জত বাঁচানোর অন্য ব্যবস্থা করতে হবে। ঊষাকালে একটু হুঁশিয়ার হয়ে শুলে ভয়ের কোনো কারণ নেই। ভদ্র পরিবারে বাড়ির সকলেই সাবধান ও হিসেবী হয়ে থাকেন। বাড়ির ঘরগুলি এমন ভাবে বিন্যস্ত হওয়া উচিত যাতে কাউকে সরমের মধ্যে না পড়তে হয়।

ছেলেদের প্রত্যেকের জন্য স্বতন্ত্র কাপড় রাখার স্থান করে দেওয়া মন্দ নয়। তাদের জিনিসপত্রের খোঁজে অনেক সময় হয়রান হয়ে যেতে হয়। প্রত্যেক জিনিসপত্রের হিসেব নিজেই রাখবে। একজনকে একটা বাক্স দেওয়া মন্দ নয়। ছেলেদের জন্য স্বতন্ত্র দস্তরখানা থাকাও ভালো। এ সম্বন্ধে বিশেষ সতর্ক হওয়া উচিত।

পরিবারের কেউ যদি ভাত খেতে বসেন, সর্বপ্রথম তার সামনে পানি দেবে, তারপর ভাত দিবে। ছেলেরা অনেক সময় ঘরের মধ্যেই হাত ধোয়–এরূপ করতে তাদের নিষেধ করবে।

কাউকে পান দিলে, সঙ্গে সঙ্গে পানের টুকরায় খানিক চুন পাঠিয়ে দেবে। অতিথি বা স্বামীকে চুনের জন্য যেন দ্বিতীয় বার না বলতে হয়।

সুপারীগুলি বাক্সে বন্ধ করে রেখে দিও নইলে নষ্ট হয়।

বাড়িতে কোনো ভালো জিনিস তৈরি হতে থাকলে, ছেলেদের তা বলতে নেই; প্রস্তুত, হলে তাদের সামনে দেবে। ভালো জিনিস খাব বলে যদি তারা আনন্দ করতে থাকে, তাহলেও বাধা দেওয়া ঠিক নয়।

প্রতিবেশীকে সব সময়ই বাড়ির ভালো জিনিসের অংশ দেবে। তোমার উপহার অল্প হলেও প্রতিবেশী তাতে সন্তুষ্ট হবে।

বেশি করে কোনো জিনিস কোনো অতিথিকে দিতে নেই–তাতে তোমার রান্না করা জিনিসের উপর অতিথির অবজ্ঞা হবে। মানুষের স্বভাবই বোধ হয়–এই সুতরাং অতিথির উপর বিরক্ত হতে নেই।

অসময়ে স্বামীর কোনো বন্ধু বা অতিথি-কুটুম্ব বাড়িতে এলে কোনো কোনো বন্ধু বিরক্ত হন–এটা ভালো কথা নয়। স্বামীর বন্ধুকে ছেলে দিয়ে বা স্বামী দিয়ে নিজের সাদর অভ্যর্থনা জানাবে। স্বামীর বন্ধুর সাধুতার দ্বারাই শ্রেষ্ঠতর হওয়া যায়। এইসব কথা ভুলে বাঙালি জাতি নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। বোয়া কাপড় ও জুতা পরলে, কিংবা কুঁচিয়ে কাপড় পরলে কোনো কোনো শ্বশুর মনে মনে বিরক্ত হন। এদের সম্মুখে আতর মাখা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাও দোষের বলে মনে হয়। এই সমস্ত লোকের মধ্যে যে সব মাতা পিতা মেয়েকে ফেলে দেন, তারা বড় হৃদয়হীন। কোনো কোনো পরিবার বধূর ভাত খাওয়ার মধ্যে পর্যন্ত দোষ খোঁজেন।

বধূর সুখের প্রতি অনেক শাশুড়ী ঈর্ষা পোষণ করেন। তারা সন্দেহ করেন, পুত্র মায়ের কথা ভুলে বধূতেই আত্মসমর্পণ করেছে। তাই বধূর গৌরব, সাজসজ্জা, ও রূপ দেখে শাশুড়ী বিরক্ত হন। পুত্রবধূ যে তাদের কন্যাসদৃশ, একথা তারা ভাবতে পারে না। অনুন্নত পরিবারে পরস্পরের মনোমালিন্য ও ভুল ধারণার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। বধূ এবং পুত্র যদি গৃহের মুরুব্বীদের সম্মান ও সুখের প্রতি কিছু চিন্তা ও দৃষ্টিশূন্য অমার্জিত পরিবারে বাস করা বিড়ম্বনা।

কোনো কোনো হীন পরিবারে স্ত্রীলোকদের পায়খানা-প্রস্রাব করার সুবন্দোবস্ত নেই।

হালিমা বিস্ময়ে কহিলেন–ছিঃ ছিঃ লজ্জা, ঘৃণার কথা!

কুলসুম : নিশ্চয়! স্ত্রীলোকদের পায়খানা-প্রস্রাব করবার বিশেষ বন্দোবস্ত থাকা। আবশ্যক। যেন কোনো প্রকার অশ্লীলতা প্রকাশ না হয়, সেদিকে প্রত্যেক ভদ্রলোকের নজর থাকা চাই।

.

উনবিংশ পরিচ্ছেদ

কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, মানুষের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে এ জানতে হলে পূর্ব হতে প্রভৃতি জ্ঞান লাভ করা চাই। কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার আবশ্যক, এ জানা খুব শক্ত কথা।

লোকের সঙ্গে ব্যবহারে মনের বল যেন কোনো সময় নষ্ট না হয়। স্ত্রীরা যখন চাকরি করতে যায় না, তখন তাদের মনের বল বাড়াবার বিশেষ আশঙ্কা নেই। অলঙ্কারপরা ধনী গৃহিণীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক মনে দুর্বলতা অনুভব করেন, অতএব সেরূপ লোকের স্পর্শে না যাওয়াই ভালো। মনের দুর্বলতা বোধ না করলে যাওয়ায় দোষ নেই।

কুলসুম আবার বলিলেন–হালিমা, জিহ্বাই সকল অনিষ্টের মূল। জ্ঞানী ব্যক্তিরা অল্প কথা বলেন। যে বেশি কথা বলে না তার অপরাধও অল্প। বিচক্ষণ ব্যক্তির মতো কথা বলতে না পারলে চুপ থাকাই শ্রেয়। অবশ্য একেবারে কথা বন্ধ করা অনুচিত। স্বামী ও পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলা ও আলাপ রহস্য করাও নিতান্ত প্রয়োজন।

স্ত্রীলোকে স্ত্রীলোকে দেখা হলে সাধারণত এক দফা পদচুম্বন হয়ে থাকে। একটা সঙ্গত নয়। কোলাকুলি করা, দুই হাত দিয়ে না হোক অন্তত এক হাতে মোসাফা বা সালাম আলেকুম করাই বাঞ্ছনীয়। পায়ের উপর উপুড় হয়ে পড়ে–এসব হিন্দুয়ানী চলন। এরূপ কখনও করবে না।

হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, মুরুব্বীদের সঙ্গে কি মোসাফা করা বেয়াদবী নয়?

কুলসুম বলিলেন–আমাদের মুরুব্বীরা সাধারণত ছোটদের ব্যক্তিত্বকে চূর্ণ করেই সুখী হন। ছোট যে, সে পশু, তার জন্য জ্ঞান নাই, মুরুব্বীদের মুখের দিকে চেয়ে কথা বললে পাপ হয়, এ সমস্ত কথা মুরুব্বীদের সব সময় বলা উচিত নয়। মাতাপিতা এবং মুরুব্বীরা যদি পুত্র কন্যাদের সঙ্গে করমর্দন করেন বা তাদের হৃদয়ে ধারণ করেন তা হলে তাদের কোনো সম্মান নষ্ট হয় না। কেহ যদি পায়ের উপর উপুড় হয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসে, তবে কদাপি সুখী হবে না–ক্ষিপ্র হস্তে তাকে বাধা দেবে। সে আত্মীয় বেগানা যেই হোক না। মধুর নম্র ভাষায় তাকে এমন কাজ করতে নিষেধ করবে।

কারো সঙ্গে দেখা হলে কোনো না কোনো প্রীতির চিহ্ন দেখাই চাই। নিতান্ত বন্ধু যে, তার সঙ্গে ভদ্রতা না দেখালে ক্ষতি নেই।

হালিমা কহিলেন-বধূ স্বামীর পদচুম্বন করবার জন্য সাধারণত আদিষ্ট হয়ে থাকেন।

কুলসুম : এরূপ শ্রদ্ধার কোনো দরকার নেই। স্বামী যদি বন্ধু রূপে পান তাহলে তিনি বেশি সুখি হবেন। ভক্তির দ্বারা মানুষকে জয় করা যা না, মূল্য ও গুণই মানুষ জয় করবার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র।

হালিমা স্বামী দাঁড়িয়ে আছেন, স্ত্রীর কি তখন বসে থাকা বা আসন অধিকার করে থাকা উচিত?

কুলসুম : স্বামী তো আর কোনো রাজকর্মচারী নন্ যে তাকে ভয় করে চলতে হবে। স্বামীর যদি বসবার দরকার হয় তাহলে তিনি স্ত্রীকে সরে যেতে বলবেন। স্বামীর বসার দরকার থাকলে, স্ত্রী নিজেই আসন ছেড়ে দূরে যাবেন।

কুলসুম আবার কহিলেন-বাড়ির দাস-দাসী বা ছোটদের সঙ্গে নিরন্তর ঝগড়া-ঝাটি করা ভালো নয়। প্রত্যেক কাজেই যে মানুষ সর্বাঙ্গ সুন্দর হবে এমন আশাও করতে নেই। কারো চরিত্রে কোনো দুর্বলতা আছে; তাই নিয়ে হৈ-চৈ করা নির্বুদ্ধিতা। সে হয়তো অন্য কোনো কাজে বিশেষ গুণের পরিচয় দেবে।

হালিমা : কোনো কোনো বধূর ভয়ানক ক্রোধ থাকে। তারা যখন বড় গৃহিণী হন তখন তাদের জ্বালায় বাড়িময় অশান্তি হয়।

কুলসুম : মুরুব্বীদের সব সময়ে ছোটদের ভুল ও দুর্বলতার প্রতি সহানুভূতি থাকা চাই–নইলে ফল খারাপ হয়। বধূরা অনেক সময় গাল ফুলিয়ে বসে থাকেন। স্বামী সেই চেহারার মধ্যে মাধুরী দেখলেও অন্য লোক সে চেহারাকে ঘৃণা করে। মানুষের ঘৃণা এবং অভিশাপকে ভয় করা উচিত।

কোনো কোনো বন্ধু শব্দের সহিত গলা ঝেড়ে থাকেন। এই অভ্যাসটি বর্জন করতে হবে। এতে লোক সন্দেহ করে, বধূ হয়তো দাম্ভিক প্রকৃতির।

হালিমা জিজ্ঞাসা করিলেন-শ্বশুর-শাশুড়ীকে সাধারণত কীরূপভাবে সম্মান করতে হবে? তাদের কেমনভাবে অভ্যর্থনা করতে হবে।

কুলসুম : পদচুম্বন যখন দেশের রেওয়াজ হয়ে পড়েছে, তখন বর্তমান যুগের বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হলে পদচুম্বন করবে। নিজে যদি কোনো কালে শাশুড়ী হও, তাহলে বধূকে হৃদয় ধারণ করো বা তার হাতখানি নিজের হাতে নিয়ে প্রীতির চিহ্নরূপে চাপ দিও, পদচুম্বন গ্রহণ করো না।

দুই ঈদের নামাজের সময় বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে স্নেহ, প্রীতি ও মমতার আদান-প্রদান হয়ে থাকে। এই সময় শ্বশুর-শাশুড়ীকে শ্রদ্ধা জানাবে। পদচুম্বন করা যদি একান্তই আবশ্যক হয় তাহলে বাপ-মা ও শ্বশুর শাশুড়ীকে করবে, অন্য কাউকে না। পীর-দাস-দাসী, নানা-নানী সকলকেই বাদ দেবে। তারা যদি জ্ঞানী হন, তাহলে এই অপমানে ক্ষুণ্ণ হবেন না।

হালিমা : স্বামীকেও কি মাঝে মাঝে সম্মান জানানো দরকার?

কুলসুম : কিছু না। স্ত্রী তো আর স্বামীকে কোনো দাসী নয়। স্বামীর সঙ্গে আলিঙ্গন করে মাঝে মাঝে প্রীতি-মমতার চিহ্ন দেখাতে পার। দুই ঈদ ছাড়া বৎসরের অন্য সময় ঊষাকালে হাসিমুখে স্বামীর সঙ্গে হাত মিলান ভালো। সুপ্রভাত বলা, সালাম আলেকুম করাও উত্তম।

গাল ফুলিয়ে থাকা, সর্বদা রাগে রাগে কথা বলা, দাম্ভিকজনেরই কাজ! অহঙ্কার ও দাম্ভিকতার পরিচয় দিলে, পেটের ছেলেপিলে জগতে উচ্চাসন লাভ করতে পারে না।

ছোট ও নিম্নশ্রেণীর লোক যদি তুমি করে বলে তাহলে রাগ করো না, তারা যদি এসে বাড়ির চেয়ার বা বিছানায় বসে তাহলেও ক্রুদ্ধ হয়ো না। তাদের সঙ্গে এক বিছানায় বসতে অনেকে লজ্জা বোধ করেন, এও অন্যায়।

বাড়ির দাসীকে বা দরিদ্র রমণীকে কঠিন ভাষায় গালি দিও না। খানকী ও নটি পেশাকার বলে গালি দেওয়া অনেক মেয়ের অভ্যাস। এরূপ কঠিন কথা মুখ দিয়ে বের করে মানুষের অভিশাপ মাথায় নিও না। অভিশাপ ভয় করা উচিত। সেয়ানা, ছোটকে কঠিন ভাষায় গাল দিও না। ইতর ও নিচ ভাষায় কোনো তাম্বি, কোনো ফল হয় না বরং যাদের উদ্দেশ্যে সেইসব ইতর ভাষা প্রয়োগ করা হয়, তাদের আরও নৈতিক অধঃপতন হয়। কখনও বংশগৌরব করো না। এতে আত্মার ও বংশের অধঃপতন হয়।

কোনো কোনো স্ত্রীলোক বাড়ির মধ্য হতে বা বুঝে সামান্য কারণে ভদ্রলোকদের অযথা জঘন্য ভাষায় গালি দিয়ে থাকেন। এটা খুবই অন্যায় কথা।

নৈতিক বলে ছোট যারা, তাদের সঙ্গে বাচালতার পরিচয় দিতে নেই; তারা তোমাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন না; তোমার কথাকে তারা শ্রদ্ধার সঙ্গে শুনবে না। তবে নির্দোষ রসিকতায় কোনো দোষ নেই।

তোমার কথার মূল্য যদি কেউ না বুঝে তাহলে হঠাৎ অগ্নিশর্মা হয়ে যাওয়া ভালো নয়। মানুষের মূর্খতাকে সহানুভূতির চোখে দেখা মনে হয় ভাল। শান্ত, স্থিরচিত্তে মানুষের সঙ্গে কথা বলা উচিত।

কোনো কোনো মেয়ের অভ্যাস আছে পরের কথা নিয়ে খুব করে আলোচনা করা। পরনিন্দা করা, কথা লাগান মেয়েদের চরিত্রের বড় খারাপ দোষ। শশুর শাশুড়ী বা দেবরদের নিন্দা করে স্বামীর ভালবাসা লাভ করতে যেও না। অগোচরে অনেকে অনেক কথা বলে, সেইসব কথা কুড়িয়ে নিয়ে স্বামী ও শাশুড়ীর কাছে বলা দোষ।

কথা লাগালে নিজের সম্মান নষ্ট হয়, এ জানা উচিত। যার কাছে পরের কথা বলা যায় সে সেই সময়ের জন্য তোমার উপর কিছু সন্তুষ্ট হতে পারে, কিন্তু জেনো, তার কাছে তোমার আর সাবেক সম্মান রইল না। যার নিন্দা করা গেল সেও তোমার স্বভাব বুঝতে পারলে তোমাকে ঘৃণা করবে।

পরের নিন্দা করে কারো সঙ্গে ভাব করতে যাওয়া মূর্খতা।

যুবতী বয়সে স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে হেসে কথা বলতে নেই। কি দেবর, কি শ্বশুর, কি দেবরপুত্র, কারো সম্মুখে হাসবে না। দেবরের সঙ্গে রসিকতা করা একান্ত বর্জনীয়। দেবরকে ছোট ভাইয়ের মতো মনে করবে।

কেউ তোমাকে দেখে ভয় করুক, তোমাকে আগে আগে সালাম জানাক, তোমার পদচুম্বন করুক এরূপ আশা পোষণ করো না। যারা হীন প্রকৃতির লোক তারাই এরূপ আশা করে! সকলে তোমার বন্ধু হোক এইরূপ আশা করো না। সকলে তোমার গোলাম হবে, এরূপ ইচ্ছা করা পিশাচ ও যথেচ্ছাচারীদের কাজ। দুঃখের দিনে যারা তোমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী ছিল, সুখের দিনে তাদের অপরাধের কথা মনে করে তাদের সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করা নীচতা। যাকে এক সময় ন্যায় মত হোক, অন্যায় মত হোক সম্মান করেছ বা পিতার আসন দিয়েছ, সম্পদের সময় মনুষ্যত্বের খাতিরে তার সঙ্গে তেমনি ব্যবহার করাই উচিত। অন্যায় ও অপমানের বেদনা সয়ে চুপ করে থাকা অধর্ম, কিন্তু যখন একবার থেকেছ তখনই চিরকালই চুপ করে থাকা বোধ হয় ভালো। এ সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলা শক্ত। সুযোগ পেলেই সাধারণত মানুষ প্রতিশোধ নেয়, পীড়িতের শ্রদ্ধা ভালবাসা ও ভক্তি-কথা মিথ্যা হয়ে যায়।

অবস্থাপন্ন ঘরের স্ত্রীরা ছোট লোক, বান্দীর বাচ্চা, গোলামজাদী বলে লোককে গালি দেয়। মানুষের উপর এরূপ অবিচার করলে মুসলমান জাতি শেষ যুগে রাজত্ব ও স্বাধীনতা হারিয়েছে।

স্ত্রীরা অনেক সময় গয়না দেখাবার জন্য মেয়েমানুষের সঙ্গে আলাপ করতে যায়, এটা বড়ই নীচতা। যার গয়না নাই তার সামনে পরো না। গয়না না পরলে রমণীর শোভা অনেকটা কম পড়ে কিন্তু গুণ ব্যতীত গয়নার কোনো মূল্য নেই। যার গুণ আছে তার গয়নার দরকার নেই।

কোনো কোনো মেয়ে মনে করেন ভালো রান্না করতে পারা; কাপড়ে ফুল তুলতে জামাই রমণী জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ! নারী বলে শুধু রান্না শিখলেই বা দুখানা রুমাল তৈরি করতে পারলেই তার জীবন সার্থক হয়ে গেল–এটা মূর্খের ধারণা। গরু, হাতী এবং অশ্ব রান্না করা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কাজ করে থাকে, তাদের সম্মান তাহলে নারী অপেক্ষা বেশি। ভালো রান্না করতে জানা খুব ভালো, কিন্তু এই কারণেই নিজেকে বড় মনে করা দোষ। বিদ্যা, চরিত্র ও বুদ্ধি ছাড়া আর কোনো জিনিসকে গুণ বলা উচিত নয়।

শ্বশুরবাড়িতে কখনও বাপের বাড়ির গল্প করবে না। স্বামীর বাড়িতে নিজের ভাই বোনকে রাখবে না, এতে নিজের অকল্যাণ হয়, স্বামীর কাছে এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় স্বজনের কাছে নিজের সম্মান নষ্ট হয়।

পুরুষেরা বলে থাকে স্ত্রীলোকে স্ত্রীলোকে কখনও প্রণয় হয় না। নিরন্তর ঝগড়া করা এবং পরস্পরের কুৎসা রটনা করাই তাদের স্বভাব–এ কথাটা প্রায় ক্ষেত্রে সত্য। এর একমাত্র কারণ, স্ত্রীলোকেরা সর্বদা ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকে মুক্ত বাতাসে না বেড়ালে, অনেক মানুষের সঙ্গে না মিশলে, চরিত্র উন্নত হয় না, মন সঙ্কীর্ণ, অনুদার ও অহঙ্কারী হয়ে ওঠে। নারীর অধঃপতনের প্রধান কারণ শিক্ষার অভাব-ভালো কথা এবং বহির্জগতের খবর সম্বন্ধে একদম অনভিজ্ঞ থাকা।

বাইরে বের হবার সুবিধা না থাক; স্ত্রীরা যেন তাদের চরিত্রের এই কলঙ্ক দূর করতে চেষ্টা করেন।

নিজের কানে শোনা এবং নিজের চোখে দেখা ব্যতীত কোনো গুজবে বিশ্বাস করবে। এই কথাটি স্বর্ণাক্ষরে প্রাণের পাতায় লিখে রেখো। অনুমান ও কল্পনার দ্বারা পরিবারের পনেরো আনা অনর্থ সৃষ্টি হয়। বালকের কথা যাচাই না করে সব সময় বিশ্বাস করতে নেই।

রমণীরা অনেক সময় অভিশাপ দেয়। অভিশাপ দেওয়া অন্যায়, এরূপ করা নীচ ব্যক্তির কাজ। ব্যথিত আর্তের মুখ দিয়ে যে অভিশাপ বের হয় তা স্বতন্ত্র। কথায় কথায় পাগলের মতো অভিশাপ দেওয়া নীচতা।

অনেক সময় বাইরের স্ত্রীলোকেরা সম্বন্ধ পাতিয়ে আসে। বালিকা বয়সেও অনেকে সই পাতায়। সম্বন্ধ পাতান কাজটা খারাপ। কেউ বলে, ‘তুমি আমার মা’, কেউ বলে তুমি আমার বুবু। এছাড়াও ধর্মের মা-বোন বা অন্য কোনো সম্বন্ধ পাতিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়। এসব ভালো নয়। বুবু বা মা ডাকতে দোষ নেই। ঘটা করে সম্বন্ধ করা দোষের। এর শেষ ফল মনোমালিন্য ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রীলোকেরা সরলা কুলবধূদের সঙ্গে ‘মা’ বা ‘বোন’ পাতিয়ে অনেক সময় অনেক ক্ষতি করে। ইসলামের সবাই ভাই-বোন, এর উপর আবার সম্বন্ধ পাতাবার ঘটা কেন?

প্রতি বৈকাল বা সন্ধ্যাকালে পরিবারের সবাইকে ডেকে এক জায়গায় খানিক বসা মন্দ নয়। মেলামেশা, আলাপ ও হাস্য-পরিহাসে পরিবারের সকলের মধ্যে মনোমালিন্য দূর হয়। শুধু শুধু সকলকে এক জায়গায় ডেবে বসান একুট বিরক্তিকর। কিছু নাস্তার বন্দোবস্ত করা উচিত। দু’চামচ দুধ আর কিছু চিনি আর আর মুড়িতে বিশেষ খরচ হয় না। গুড় হতে নিজেরাই চিনি তৈরি করে নেয়া যায়। পরিবারের বারে বারে ভাত খাবার ব্যবস্থা না করে একবার নাস্তা আর দুবার ভাত খাবার ব্যবস্থা থাকা উচিত। চা ব্যবহার করাও মন্দ নয়।

বেলা ১টা হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করা যেতে পারে। কোনো কোনো অত্যাচারী পরিবার আছে, যেখানে দিবারাত্রি কাজ করতে হয়। অর্থের লোভে স্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীন হওয়া ঠিক নয়।

কুলসুম পুনরায় বলিলেন–পরিবারের কারো কোনো ভুলের সমালোচনা পুনঃ পুনঃ করবে না। এতে উদ্দেশ্য পণ্ড হয়।

পরিচিত সকলের কাছে চিঠিপত্র লেখা চাই। এজন্য ঘরে কতক ভালো চিঠির কাগজ রাখা উচিত। মানুষের সঙ্গে আদান-প্রদান হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। ভাত, মাছ ও কাপড়ের জন্য যেমন পয়সা ব্যয় হয়, তেমিন পোষ্ট কার্ড অর্থাৎ চিঠিপত্র লেখার জন্যে কিছু পয়সা রেখে দিও। সামান্য ক’টি পয়সার মাথায় কি একটা বন্ধু হারান উচিত? সর্বদা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চিঠিপত্র বিনিময় হওয়া আবশ্যক। মানুষের সংবাদ নেওয়া সভ্যতার লক্ষণ। মাসে এক ব্যক্তির কাছে একখানা পত্র লেখাই যথেষ্ট। পরপর দুই পত্র কারো কাছে লিখবে না। পত্রের উত্তর না পেলে পুনরায় পত্র লিখতে নেই। পত্রে-আদাব হাজার হাজার, বাদ কদম বুছি, পাক কদমে আরজ, এই যে ফিদবী, খাকছার, এসব না লেখাই ভালো। মোটের উপর লেখা জীবনের চমৎকার গুণ।

বিদার নেওয়ার সময় মেয়েরা সাধারণত কাদাকাদি করেন, এরূপ করা ছেলেমি। কোনো জায়গায় যাবার দরকার হয়েছে চলে যাও। কাদাকাদির বা বিদায় নেবার দরকার নেই।

অনেক দিন পরে অনেক দিনের জন্য কোথাও যেতে হলে যাবার সময় প্রীতি-উৎফুল্ল চিত্তে হাতের সঙ্গে হাত বা হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয় মিলাবে। বিদায়কালে চোখের পানি ফেলবে না।

স্বামীর যদি পড়াশুনা থাকে, তাহলে তার কাজের সময় কখনও তার কাছে যাবে না। অন্য সময় যাবে। দিনের বেলায় স্বামীর খুব কাছে বসবে না। পুরাতন হলে, এ নিয়ম মানবার দরকার নেই। দূরে থাকবার কারণ স্বামীকে বুঝিয়ে বলবে, নইলে স্বামী মনে মনে কোনো কিছু ভাবতে পারেন। কখনো কোনো কাজে চুপ করে থাকতে নেই; চুপ করে। থাকাতে জীবনে অনেক বিপদ ঘটে। স্বামীর কাছে নিজের কাজের ব্যাখ্যা দিলে, তার মনে কোনো গোল আসে না।

কেউ যদি হঠাৎ কোনো অন্যায় কথা বলে ফেলে, তাহলে রেখো না। হতে পারে যে, কথাটা সে হঠাৎ ভুল করে বলে ফেলেছে। কোনো কাজে বা কথায় হঠাৎ লাগলে নিজের সম্মান নষ্ট হয়, এ যেন মনে থাকে।

বাড়িতে এক ডাকে চাকরে যদি উত্তর না দেয়, তাহলে তাকে যাচ্ছে তাই গালি দিও। চাকরকে বেত দিয়ে পিটান এবং শুয়রের বাচ্চা বলা বিদেশীদের ফ্যাসন। এ যেন মনে। থাকে যে যারা চাকর তারা আমাদেরই দেশের মানুষ। সদ্ব্যবহার ও যুক্তিতে মানুষ উন্নত হয়, ভয় দেখিয়ে মানুষকে শুধু দুর্মতি দাসে পরিণত করা হয়। দাস অর্থ চাকর নয়, নীচ ও হীন, সে সুযোগ ও ক্ষমতা পেলে মানুষকে জবেহ করে। ইংরেজিতে দাসকে টাইরেন্ট বলে।

মানুষের সহিত সদ্ব্যবহার করাই ভালো। এমন কি বাড়ির কুকুর বিড়ালের সঙ্গেও নিষ্ঠুর ব্যবহার করা অনুচিত।

স্বামীকে যদি নিজের পিতা মাতা অপমান করেন, খবরদার মাতাপিতার হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে কোনো কথা বলো না–কি সামনে কি অগোচরে। এটা স্ত্রীলোকদের জন্য শ্রেষ্ঠ উপদেশ। স্বামীর জন্য মাতাপিতার সঙ্গে যদি সম্বন্ধ ত্যাগ করতে হয়, তাও করবে।

হালিমা : জিজ্ঞাসা করিল-নারীর জীবন বড় নিঃসহায়। বাপ-মাকেই বা কি করে। অসন্তুষ্ট করবে? সে বিধবা হলে বাপ-মার বাড়িতে তো তাকে ফিরে আসতে হবে।

কুলসুম বলিলেন-বাস্তবিক, জীবনে নারীকে সব সময়েই হীন ও ছোট হয়ে থাকতে হয়। মুখ ফুটে প্রাণের কথা বলা তার পক্ষে অসম্ভব। সে নিজে নিঃসহায়, তার নৈতিক শক্তি ঠিক রাখা খুব কঠিন। জোর করে কথা বাও তার সাজে না। স্বামী যদি বুদ্ধিমান হন তবে স্ত্রীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিজের মৃত্যু হলে স্ত্রীকে যাতে পথে না দাঁড়াতে হয়, তার ব্যবস্থা করে যেতে হবে। বালিকাঁদের বাল্যকাল হতেই লেখাপড়া শিখাতে হবে–তাদের কোনো হাতের বা শিল্প-বিষয়ক কাজ শিখান চাই–যাতে সে বিপদে পড়ে নিজেকে একেবারে অনাথ মনে না করে। নারীর চিত্তে শক্তি ও স্বাধীনতা দিতে হবে। এই দুই জিনিস যেখানে নাই, সেখানে মনুষ্যত্ব থাকে না। নারীর এই দুই জিনিসে আদৌ নাই, সুতরাং তার মনুষ্যত্ব নাই। সে পিতা, স্বামী ও পুত্রের খরিদা দাসী। পুরুষ ভাবে নারী জীবন মোনাফেকিতে পূর্ণ। নারীর প্রেম মুখস্থ করা। আহা, নারীর কি দুঃখের জীবন, তা কে। ভাবে? এ ব্যাপারে সমাজদরদীরা চুপ করে আছে। পীরেরা আধারে বসে তছবী টিপছে।

নারীর দুরবস্থার জন্য তার বাপ-মাই দায়ী। নারী জীবনে কখনও তারা ঘৃণা ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে সাহস পায় না; যা না করতে পারলে মানুষ পশু হয়। মেয়েকে বড় করতে হলে মেয়ের মাকে পূর্ব হতে সতর্ক হতে হবে। নারীর বেদনা নারী ছাড়া আর কেউ বোঝে না।

দেশে ছেলে ও মেয়ের বিয়ের সময় পাড়ার বউ ঝি নেবার প্রথা আছে। বর্তমান সময় কোনো বিয়ে বাড়িতে না যাওয়াই ভালো; বিয়ে বাড়িতে অনেকে অনেক সময় অনেক রকমে অসম্মানিত হয়। যদি অসম্মানের ভয় না থাকে, থাকবার এবং শোবার রীতিমতো ব্যবস্থা থাকে, তাহলে যাওয়া যেতে পারে। অনেক লোকের সঙ্গে মেলামেশা করলে জ্ঞান বাড়ে।

যেখানে সম্মান হয় না, সেখানে কখনও যাবে না। নিজের মর্যাদা অনুযায়ী বসবার স্থান না পেলে সেখানে বসবে না। গরিবের বাড়ি নিরহঙ্কার চিত্তে ঘেঁড়া মাদুরে বসবে। জেনো, অহঙ্কারী লোককে ছোট করে দেন।

মাঝে মাঝে বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীকে দাওয়াত করে খাওয়ান একান্ত কর্তব্য। স্বামী পুরুষ লোককে, স্ত্রী-নারী সমাজকে দাওয়াত করবেন। নারী পুরুষকে একই সময়ে বাড়িতে আনতে হবে, এমন কোনো কথা নয়। হাজার হাজার লোককে খাইয়ে, হাজার হাজার টাকা ব্যয় করলে বিশেষ লাভ নাই। বাঙালীর অনেক টাকা এইভাবে মাটি হচ্ছে। ফলে সমাজ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। কয়েকজন বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীকে প্রীতিভোজ দেওয়ায় বৃথা পয়সা নষ্ট হয় না। অতিথিকে পরিতোষপূর্বক আহার করাতে পারবে না বলে, একদম কাউকে না খাওয়ান ঠিক নয়।

যার খাওয়ার সঙ্গতি নেই তার কাছ থেকে জোর করে খাওয়া আদায় করতে নেই–আর যে কৃপণ, জোর করে তার বাড়িতে খেয়ে লাভ কি? অবস্থা খারাপ হলে প্রীতিভোজ দিয়ে পরিবারের দুঃখ বাড়ান ভালো নয়।

প্রতিবেশীর বাড়িতে মাঝে মাঝে তোমার বাড়ির ভালো জিনিস পাঠিয়ে দেবে। অল্প হলে ক্ষতি কি?

অত্যাচারী, সুদখোর, জালেমের বাড়িতে পুরুষের খেতে নেই। নারীর অন্য কোনো নারীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করাতে দোষ নেই-কারণ নারীর বহির্জগতের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নেই। আধুনিকাঁদের কথা স্বতন্ত্র।

বধূকে সকল কাজে নিজের বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে। জীবনকে চালানোর জন্যে কতগুলো বাধাধরা নিয়ম দেওয়া অসম্ভব।

কোনো কথার প্রতিবাদ করলে কোনো কোনো মানুষ চটে। তবুও ভুল দেখলে মানুষের প্রতিবাদ করা উচিত। স্বামীর কোনো কথার প্রতিবাদ তখন করবে না। স্বামীর ভাবকে মেনে নেওয়া স্ত্রী জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যে। স্বামীর মধ্যে কোনো ভুল পেলে মিষ্টি কথায় যখন তখন না হোক, অন্য সময় বলবে।

অনেক সময় লোকে খামাখা কতগুলি কথা বলে, তার প্রতিবাদ না করলেও বিশেষ আসে যায় না।

স্বামীর ভাব ও চিন্তার প্রতি সর্বদা সহানুভূতি রাখতে চেষ্টা করা কর্তব্য। তর্ক করার খাতিরে বা খারাপ উদ্দেশ্যে স্বামীর সঙ্গে তর্ক করবে না; এরূপ করলে দাম্পত্য জীবনের সুখ নষ্ট হয়। স্ত্রীর কার্য সম্ভবত অন্ধ বন্ধু হওয়া–গুরু হওয়া নয়।

নারীরা ঘরের কোণায় বসে অনেক সময় বড় বড় লোককে পর্যন্ত গালি দিয়ে বসেন; শিক্ষিত ভদ্র নারীদের কর্তব্য নয় পণ্ডিত ও সজ্জন ব্যক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান।

স্বামী ও কয়েকজন নিকট মুরুব্বী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ দেখে কখনও আসন ছেড়ে সম্ভব জানাতে উঠবে না। নারী সর্বদা সকল পুরুষের সম্ভ্রমের পাত্রী, সে আবার কাকে সম্ভব জানাবে?

অনেক সময় সৎ অনুষ্ঠানের জন্য সেবক সম্প্রদায়রা মুষ্টি চালের জন্যে হাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তাদের হাঁড়িতে ভাত রান্নার আগে এক-আধ মুঠা চাল রাখতে ভুলবে না। এতে গৃহিণীদের বিশেষ লোকসান হয় না। চালগুলি কোনো সৎ অনুষ্ঠানে না দিলেও এক মাস পরে তাতে সংসারের অনেক উপকার হয়।

অন্ধকার রাত্রে বাইরে থেকে বা হাট-বাজার থেকে যদি বাড়ির কেউ আসে, তবে তাড়াতাড়ি একটা প্রদীপ নিয়ে পথে এসে দাঁড়াতে হয়। এতে আগন্তুকের অভ্যর্থনা করা, তার পরিশ্রান্ত মনে আনন্দ দেওয়া, সব কাজই হয়।

স্বামী যদি বাইরে থেকে পরিশ্রমের কাজ করে আসেন, তবে তাকে দুটি তৃপ্তিদায়ক কথা বলতে ভুলবে না। স্বামীর কোনো ভালো কাজে খুব আনন্দ প্রকাশ করবে।

আমাদের দেশে কোনো কোনো পরিবারের স্ত্রী স্বামীর কর্মের কোনো খবর রাখতে ভালোবাসেন না, এসব নারীর জীবন বড় ছোট।

কোনো কোনো নারীর বাল্যকাল হতে কতগুলি বদভ্যাস থাকে। সেগুলি দেখে স্বামী যদি কোনোরকম বিরক্তি প্রকাশ না করে, তাহলে সে কু-অভ্যাসগুলি পরিহার করতে সচেষ্ট। হবে জেনো, একই ভুল পুনঃপুনঃ হওয়া দোষের। মনের মতো বউ না হলে স্বামী মনে কড় কষ্ট অনুভব করেন। স্বামীকে সুখ দেওয়া নারী জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যে। স্ত্রীর স্বভাবে বিরক্ত হয়ে অনেক স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং কখনও স্ত্রীকে একদম বর্জন করেন। স্ত্রী বর্জন করা অত্যন্ত হীন নরপিশাচের কাজ। ভদ্রলোক এরূপ কাজ করে না; দ্বিতীয় বার বিয়ে। করাও পুরুষের বোকামি।

স্বামী তো বন্ধু। বন্ধুর হৃদয়ে যত সুখ দেওয়া যায় ততই ভালো। তার বিরুক্তি উৎপাদন করলে গোনাহ হয়। বিবাহিত জীবনের কর্তব্য সর্বাংশে পালন করবেন বলেই স্ত্রী বিবাহ দিনে খোদাকে সাক্ষী করে স্বামী গ্রহণ করেন; কেমন?

কুলসুম পুনরায় বললেন-কোনো স্ত্রীলোক যদি তোমার খুব তোষামোদ আরম্ভ করে, তাহলে আহ্লাদে গদগদ হতে নেই। স্তাবককে বন্ধু মনে না করে, উচিতবাদীকে বন্ধু মনে করাই ভালো। মানুষ তোষামোদে নিজের শক্তি হারিয়ে ফেলে–অন্ধ হয়ে যায়। শঠ ও দুষ্ট লোক অনেক সময় তোষামোদ করে করে নিজের কাজ আদায় করে। তোষামোদ ও আহ্লাদে আটখানা হওয়া অনুন্নত স্বভাব। কোনো কোনো হৃদয়বান সরল মনে তোমার কোনো গুণের কথা উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করতে পারেন, তার উপর অবশ্য লাগবে। না। বস্তুত তোষামোদ করা বা তোষামোদ গ্রহণ করা, উভয়ই দুর্বল হৃদয় ব্যক্তির কাজ।

রেল স্টীমারে ভ্রমণকালে অনেক পাজী মেয়ে অভদ্র ব্যবহার করে। এদের মুখের উপর চড়া কথা শুনিয়ে দেওয়াই বিধি। নিজের অন্যায় কথা সহ্য করা বোকামি ও কাপুরুষের কাজ। দুষ্ট ও অন্যায় কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করা উচিত। রেল স্টীমারে ভ্রমণকালে রাস্তার যদি রুটি গোস্ত নিয়ে যেতে হয়, তাহলে প্রয়োজনমতো, বের করে খাবে, কে কী ভাববে একথা ভাববার কোনো দরকার নেই। সঙ্গে ভাত নিয়ে গেলে ছেলেপেলেকে খেতে দেবে; তাতেও কোনো সঙ্কোচবোধ করবার নেই। খোকারা যাতে কারো গায়ে ভাত ছুঁড়ে না মারে। সেদিকে লক্ষ্য রাখবে।

যাদের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ আছে, অত্যধিক ভক্তির সঙ্গে তাদের ডাকবার কোনো দরকার নেই। সম্বোধনের শেষে ‘জান’ শব্দ ব্যবহার করবে না। মামাজান, খালুজান, চাচাজান, এরূপ না বলে মামা, খালা, চাচা, বলাই ভালো। কাউকেই অতিরিক্ত ভক্তি দেখানো ভালো নয়। অত্যধিক ভক্তি দেখাতে গিয়ে অনেক সময় মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এবং অগোচরে আত্মীয়-স্বজন কুৎসা গ্লানি প্রচার করবার প্রবৃত্তি জাগে।

কারো সঙ্গে অতিরিক্ত ভদ্রতার আদান প্রদান করবে না, এতে জাতির জীবন ভুলময় হয়ে ওঠে। মনের অসন্তোষ মুরুব্বীর সামনে প্রকাশ করবার অভ্যাস থাকা চাই–অগোচরে কুৎসা রটনা করা দোষের। অত্যধিক ভক্তি দেখানোতে মন শক্তিহীন ও অবশ হয়ে যায়।

একশ’বার মুরুব্বী বা গুরুজনকে দেখে চেয়ার ছেড়ে ওঠা আর বসায় বৃথা সময় নষ্ট হয়। কোনো কাজের বাড়াবাড়ি ভালো নয়। অবশ্য মুরুব্বী সামনে এলে আসন ছেড়ে ওঠা ভাল। চকিত-ভীতি বিহ্বল ভাব দোষের।

আলাপ রহস্য করা জীবনের একটা আব্যশক কাজ। তবে যে সমস্ত মানুষ ভিতরে হীন, তাদের সঙ্গে সংযমের কথা বলবে, নইলে অপদস্ত হতে হবে।

বৈকাল বেলা পান খাচ্ছ এমন সময় কোনো মেয়ে বন্ধু এসে উপস্থিত হলেন। তার সঙ্গে খানিক গল্প করার যদি, যদি অন্য জায়গায় যাবার দরকার হয়, তবে চলে যাব। অনিচ্ছায় বন্ধুর সঙ্গে বসে থেকে তাকে অপদস্থ করবে না। কিংবা নিজের ক্ষতি করবে না। মিষ্ট কথায় তার কাছ থেকে বিদায় নিলেও চমৎকার হয়।

দাম্পত্য-জীবনে একটা গুরুতর বিপদ আছে। অনেক সময় স্বামী আপন মনে স্ত্রীর সম্বন্ধে অনেক কথা ভাবেন। স্বামীর মুখ ভার দেখলে, ডেকে তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করবে। লজ্জায় সঙ্কোচে তুমিও আপন মনে মুখ ভার করে বেড়াবে না। স্বামীকে দুঃখিত করে কোনো কাজে মন দেওয়া উচিত নয়। নিজের যদি কোনো অপরাধ হয় তবে স্বামীর কাছে ত্রুটি স্বীকার করবে। স্বামীর পা ধরবার কোনো দরকার নেই। জোড় হাত করে দাঁড়াবার কোনো দরকার নেই। বলবে মাপ কর। এই মাপ কর কথাটি বড় মধুর! এ বললে নিজের সম্মান স্বামীর কাছে খুব বেড়ে যায়।

কোনো কথা পুনঃপুনঃ বলা নিষেধ। এতে কথার মূল্য নষ্ট হয় এবং নিজের হালকামির পরিচয় দেওয়া হয়।

নিতান্ত বন্ধুদের সঙ্গে ভদ্রতার আদান-প্রদানের কোনো দরকার নেই। তাদের দেখে উঠে দাঁড়াবারও কোনো দরকার নেই।

দুর্বল, শক্তিহীন প্রতিবেশী যেন তোমার ব্যবহারে নিজেকে বেশি করে দুর্বল ও শক্তিহীন মনে না করে সেদিকে লক্ষ রাখবে।

কথা সর্বদা মিষ্টি ও মধুর হওয়া উচিত। সর্বদা যেন রেগে আছে, কথায় অসন্তোষ ও রাগ ভরা এরূপ যেন কেউ না ভাবে। খোদা অহঙ্কার সহ্য করেন না। অহঙ্কারী মানুষের হাত পা আপনা আপনি ভেঙে যায়।

কারো উপর অসন্তুষ্ট হলে তোমার অসন্তোষের কারণ তাকে জানাবে। এতে ভয় বা লজ্জা করবে না। কারো কাছে তার নিন্দা করা ভালো নয়। নিজেরা গরিমা অন্যের উপর জোর করে চেপে দেওয়ার নাম অহঙ্কার।

ন্যায্যমতো মনে মনে অহঙ্কার থাকা কিন্তু আবার নিতান্ত দরকার। নইলে মনুষ্যত্ব থাকে না। সে জগতে কোনো কাজ করতে পারে না। এই অহঙ্কার হবে বিনয় মধুর এবং অত্যন্ত শান্ত। এটা ঠিক অহঙ্কার নয়, এর নাম আত্মবিশ্বাস।

কখনও সচেতন পদার্থের উপর ক্রোধ প্রকাশ করতে নেই, অথচ মেয়ে মানুষের এ একটা স্বভাব।

হালিমা বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন–সে কেমন?

কুলসুম বলিলেন–প্রাণহীন বস্তুর উপর রাগ। বদনা, থালা, কাপড় বা খন্তা, কুড়োলের উপর রাগ করা অনেক মেয়ের স্বভাব। যদি দাসী বা নিজের অমনোযোগিতায় টেকিতে হাত কেটে যায়, তা হলে পেঁকিতে গালি দেওয়া ভালো কি? এরূপ করলে বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হয় না, নিজের দোষে কোনো খারাপ করে ফেলে অন্যের উপর রাগ করা নীচতা।

মেয়েমানুষ কারণে অকারণে অনেক সময় শাশুড়ী বা স্বামীর প্রশ্নের উত্তরে বলে থাকেন, আমি কি জানি? আমি কি করবো? সংসারের কেন্দ্র যখন ঘরের বধূ, তখন তার মুখে এরূপ উত্তর শোভা পায় না। কিছু না জানলেও প্রশ্নের উত্তর খুব মোলায়েম করে। দেওয়া ভালো। মনে রাগ থাকলে অনেক সময় এরূপ উত্তর আসে সত্য, কিন্তু স্বামীর যেরূপ স্ত্রীর অপরাধ মনে করে রাখা অবৈধ, স্ত্রীরও তেমনি স্বামীর অপরাধ মনে করে রাখা অবৈধ। অভদ্র ব্যবহার করাও নারী জীবনের একটি গুরুতর অপরাধ।

অনেক নারী স্বামীর শরীর খারাপ হলে তাকে মোটেই গ্রাহ্য করে না। ভদ্রমহিলা কখনোও এমন করে না, দুর্বল ও রুগ্ন হলে তাকে ঔষধ খেতে উপদেশ দেবে। কোনো আনাড়ী মানুষের ঔষধ স্বামী না খান, তাতে বিপরীত ফল ফলবে। স্বামীর শরীর যাতে ভালো থাকে, সে দিকে সর্বদা দৃষ্টি রাখা উচিত। দুগ্ধ ও ঘি শরীর রুক্ষার প্রধান উপকরণ। বিলাসিতার জন্যে পয়সা ব্যয় না করে যাতে স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো খাবারের জন্য পয়সা ব্যয় হয় সেদিকে নজর চাই।

আর একটি কথা–বিলাসের কথা বলতে গিয়ে একটা ভালো কথা মনে পড়ে গেল। বিদেশী বিলাস-দ্রব্য কিনে কিনে আমাদের দেশের লোক ক্রমশ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। দেশী জিনিস পেলে বিদেশী জিনিস ব্যবহার করবে না। নারীরা যদি প্রতিজ্ঞা করে বলেন, আমরা

বিদেশী দ্রব্য হারাম বলে ত্যাগ করলাম, তাহলে অল্প দিনে আমাদের দেশের লোকের। অবস্থা ভালো হয়। আমাদের ভাই, স্বামী ও পিতার অর্থে বিলাত ও জাপানের লোকেরা এত বাহাদুরী করছে, অথচ আমরা দিন দিন না খেয়ে না পরে ক্ষুধায়, শীতে, পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে মরে যাচ্ছি। বলতে পার, আমরা নিজে তো না খেয়ে মরছি না? আমরা না। মরি আমাদের দেশের ভাই-বোন মরে যাচ্ছে। অন্ন-কাঙ্গাল দেশের ভাই-বোনকে ভিখারী। করে নিজেরা কোর্মা-পোলাও খেয়ে লাভ কী? রাস্তায় মোটর গাড়ি হাকিয়ে বাহাদুরী কি? দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতির জন্যে নারীকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সিল্কের শাড়ী পরে ক্ষুধিত পেটে না থেকে, মোটা কাপড়ে খালি পায়ে ঘি-মাংস খাওয়াই ভালো।

স্বামীর ভালবাসায় অনেক সময় নারীরা দাম্ভিক হয়ে পড়েন। বাড়ির বধূ সকলের ভালবাসার পাত্রী, সুতরাং সকলের সঙ্গে তার সদ্ব্যবহার থাকা চাই। আসলে অহঙ্কার খারাপ জিনিস। লোকে অহঙ্কারীর স্পর্শে আসতে ঘৃণা বোধ করে। সকলের সঙ্গে স্নেহ-মধুর ব্যবহার করা কর্তব্য।

মোটে কথা না বলা ভালো নয়। মাঝে মাঝে লোকের সঙ্গে আলাপ করা উচিত। আবার প্রয়োজনে বাচালতার পরিচয় দেওয়া ভালো নয়। অনেক মেয়ের গরম বলে গায়ে জামা দেবার অভ্যাস নাই.। স্বামী ছাড়া অন্য কারো সামনে খালি গা হয়ে না বেরোনো উচিত। অন্তঃপুর ছাড়া মেয়েদের সব সময় শরীরে জামা ব্লাউজ থাকা দরকার।

মাঝে মাঝে পাড়ার মেয়েদের ডেকে যদি ভালো কথার আলোচনা করা যায়, তাহলে তাদের বড়ই উপকার করা হয়। মেয়েমানুষ অমানুষতার গভীরে আঁধারে পড়ে আছে। মানুষ কি এত ছোট হতে পারে, তা ভেবে ঠিক পাই নে। অবরোধ এর এক গুরুতর কারণ হতে পারে।

রাত্রিতে ছোট ছোট মেয়েদের একটু একটু যদি পড়াতে পার, চেষ্টা করো। না বুঝে মাথা কুটে কোরান পড়তে পারলেই কাজ হল, এরূপ মনে করা ভুল। ইংরেজি না হোক। বাংলা সাহিত্যের বিলক্ষণ জ্ঞানলাভ করতে হবে, নইলে চরিত্র ও স্বভাবের কোনো উন্নতি হবে না। রুচি মার্জিত হওয়াও অসম্ভব। বর্তমান শিক্ষা ও সভ্যতার সঙ্গে যোগ না রাখলে মেয়েদের ভালো বিয়ে হওয়া সুকঠিন। বধূর শিক্ষা চরিত্র ও মানের উন্নতির উপর ভবিষ্যৎ বংশের উন্নতি নির্ভর করে। অশিক্ষিতা, অমার্জিতা হৃদয়, চরিত্র ও মানের উন্নতির উপর ভবিষ্যৎ বংশের উন্নতি নির্ভর করে। অশিক্ষিতা, অমার্জিতা হৃদয়, নীচ প্রকৃতির মেয়ের ছেলে কখনও বড় হয় না। অশিক্ষিত মাতৃদলের জন্য আমাদের পুরুষ সমাজের জীবন মিথ্যা ও ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। নারীর শক্তিতে জাতি অল্প সময় মহা জাতিতে পরিণত হয়।

বিশেষ গুরুতর কারণ না থাকলেও সর্বদা স্বামীর দোষ ধরতে চেষ্টা করো না। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাই অনুরাগের ভিত্তি। কলহ ও দোষ অনুসন্ধান করলে একে অন্যকে ঘৃণা করে।

সংসারে নিরানন্দের ছায়া আসতে দিতে নেই; দুঃখের মধ্যেও আশার কথা বলা উচিত। পরিবারে কেউ কোনো ভুল করছে–করুক না, কিছুই হয় নাই বলে দাঁড়াতে হবে, এতেই জয়ী হওয়া যায়। বসে বসে কাঁদাকাদি করে দরকার নেই। আশা, উৎসাহ ও আনন্দই উন্নতি ও জীবনের মূল।

.

বিংশ পরিচ্ছেদ

কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, গৃহস্থালী সম্বন্ধে বলেছি আরও কিছু বলতে চাই। হালিমা কহিলেন-বলুন, আমি মন দিয়ে শুনছি।

কুলসুম বলিলেন–দোকান থেকে বাকি করে জিনিস আনলে সংসারে শ্রী থাকে না। মহাজনদের কাছে যেমন কৃষক সম্প্রদায় নিজেদের স্বাধীনতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিক্রয় করে। ফেলে, যে সমস্ত ভদ্রলোক দোকান হতে বাকি নেওয়া আরম্ভ করে, তারাও প্রকারান্তরে দোকানদারদের খরিদ গোলাম হয়ে পড়েন।

স্বামীকে দোকানদারের গোলাম হতে একদম নিষেধ করবে। তাকে স্বাধীন উৎফুল্ল দেখাতেই নারীর ইচ্ছা হওয়া দরকার। ঋণদানে জড়িত চিন্তাক্লিষ্ট স্বামীর মলিন মুখ দেখে নারীর রাত্রে ঘুম না হওয়া উচিত। যেদিন থেকে সংসারে টাকা হাওলাত এবং দোকান হতে বাকি জিনিসপত্র আনা শুরু হয়েছে, সেই দিন হতে পরিবারে উন্নতির পথে একটা ভয়ানক বাধা এসেছে, এটা বিশ্বাস করো। না খেয়ে শুয়ে থাকো, বিনা তেলে তরকারি খেও, ছেঁড়া কাপড় পরো। তবু কাপড়ের বা মুদীর দোকান থেকে কোনো বাকি জিনিস এনে শরীরের শোভা বর্ধন করে বা রসনাকে তৃপ্ত করে দরকার নেই।

বাজে কাজের জন্য স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া না করে এই সব ভুল কাজের জন্য ঝগড়া করা ভালো। বাকি করে হাতি কেনা অনেক পুরুষ মানুষের অভ্যাস। সর্বদা বাকি জিনিস কিনতে নিষেধ করবে।

ঋণগ্রস্ত লোক বা ভয়-ভীতি বিপন্ন স্বামীর পত্নী হওয়া কি অসম্মানের বিষয় নয়?

সংসারে অপব্যয় একদম নিষেধ, আবার পয়সা একদিক দিয়ে বাঁচিয়ে অন্যদিকে বৃথা খরচ করাও মূর্খতা। অতিথি-কুটুম্বের জন্যে সর্বদা আলাদা করে কয়েকটি টাকা রেখে দিলে ভালো হয়। অনেক পরিবার অতিথি-কুটুম্ব দেখে ভীত হয়; এটা যারপর নাই লজ্জা ও ঘৃণার কথা। অতিথি-কুটুম্বের সমাদর করা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।

বেশি করে লেপ ও বিছানা তৈরি করে রেখে দিতে হয়। করছি করবো বলে অপেক্ষা করলে কোনোকালে হবে কিনা সন্দেহ। শীতের সময় মানুষকে লেপ-কাঁথা না দিতে পারলে, বড়ই দুঃখের বিষয়।

আজকাল কতকগুলি লোকের ধারণা হয়েছে, ইংরেজি ফ্যাসনে ঘরে ডিস ও পেয়ালা, রাখলেই ভদ্রলোক হওয়া যায়। এই সমস্ত জিনিসে মানুষ ভদ্র হয় না। মানুষ ভদ্র হয় জ্ঞানে, চরিত্রে ও মনুষ্যত্বে। মানুষের বাপ যেই থাক, সে বর্তমানে যে ব্যবসাই করুক–দেখবার দরকার নেই। দেখতে হবে তার আত্মা, তার রুচি, কথা ও ব্যবহার।

চীনে মাটির বাসন না কেনাই ভালো। একে এগুলি বিদেশী জিনিস, তার উপর ঠোকা লাগলেই ভাঙ্গে। এসব জিনিস না দেখে যে সমস্ত বোকা নারীর দল নাক ছিটকায়, তাদের কথায় ভ্রূক্ষেপ করবার দরকার নেই। শুনছি, আজকাল দেশী চীনে বাসনের কারখানা হয়েছে। দেশী চীনে বাসন ঘরে ২/১ খান রাখা হয়।

কাবুলীদের কাছ থেকে প্রাণ গেলেও ধারে জিনিস কিনতে নেই। দু’টাকার জিনিস এরা। পাঁচ টাকায় বিক্রি করে। অনেক সময় এদের হাতে ভদ্রলোকদের অপমান হয়। এদের সাহসকে কিন্তু খুব ধন্যবাদ দিতে হয়। কোনো দূর দেশ থেকে এসে এরা বাংলার মানুষের গলা চেপে ধরতে ভয় করেন না।

বাড়িতে ফুল কপি, বাঁধা কপি ও গোল আলুর চাষ করতে পারলে ভালো হয়। চাকর রেখে বাগান তৈরি করবার সখ অনেকের হয়ে থাকে, তাতে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। নিজের হাতে সব কাজ করতে হবে। ছেলেপেলে এবং স্বামী যদি নিজের হাতে পানি টানে বা কোদাল কোপায়, তাহলে তাদের সমান নষ্ট হবে না। কাপুরুষ ভদ্রলোক যারা, তারাই। হাতে কাজ করতে লজ্জা বোধ করে; ঘুষ খেতে পাপ করতে তাদের লজ্জা হয় না! পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, নির্ভীক ও জ্ঞানী আত্মার মূল্যই বেশি।

স্ত্রীলোকদের ঠাণ্ডা লাগান অভ্যাস। শীতে কাঁপবেন তবুও গায়ে কাপড় দেবেন না। পায়ে গায়ে ঠাণ্ডা লাগলে পীড়া হয়। দরিদ্র স্বামী এবং সংসারশুদ্ধ সকল লোককে ব্যস্ত করা বড়ই অন্যায়।

চাকু, কাঁচি ছুরি প্রায়ই হারিয়ে যায়। এগুলি সর্বদা সাবধানে রাখতে হয়। কাজ সেরে যখন তখন বাক্সে বন্ধ করে রাখবে। ছেলেদের হাতে চাকু দেবে না।

ঘরের কাপড়-চোপড় সব সময় গুছিয়ে ঠিকঠাক করে রাখবে। যার যার কাপড় আলাদা করে রাখাই ভালো। কাপড় গামছা খোঁজবার জন্যে যেন সময় নষ্ট না হয়।

দোয়াত-কলম বই-খাতা সব গুছিয়ে রাখবে। ঘরের জিনিসপত্রের ধুলো সব সময় ঝেড়ে ফেলতে হয়।

ছেলেপেলেরা যেন বই-পুস্তক ও কালি কলম নষ্ট করে না ফেলে, সেদিকে নজর রাখবে।

সুঁই ঠিক থাকে না; কাজ হয়ে গেল যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়। কাজ শেষে যত্ন করে ভালো জায়গায় তুলে রাখাই উচিত। নিত্য নূতন করে সুঁই কিনে সংসারে পয়সা নষ্ট করে লাভ কি? একটি পয়সা বৈধ নয়, একথা কোনো বধূর মুখ থেকে বের হওয়া উচিত নয়। একটা একটা পয়সা দিয়েই তৈরি হয়।

অবস্থা যদি ভালো না হয় তাহলে একবারে বেশি জিনিস কিনবে না। বেশি আনলে, বেশি খরচ হয়।

আহারের জন্য যত সম্ভব ব্যয় করা ভাল, তবু নিজের আয়ের কথাও ভাবতে হবে। হাতে টাকা নেই বা আয় বেশি নয় এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কম কম খরচ করতে হয়। নইলে উপায় তো নেই। আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করলে জীবন শেষে শাক-ভাতও জোটে না।

নিজেদের যদি বাড়ি না থাকে তাহলে একটা বাড়ি প্রস্তুত করা ভাল, নইলে স্বামীর অবর্তমানে নিজের ইজ্জত হুরমত থাকে না, অপমানে জীবন যাপন করতে হয়। টাউন অপেক্ষা পল্লীগ্রামে কম খরচ লাগে। টাউনে থেকে দারুণভাবে অনেক বিপন্ন অভাব। পীড়িতা নর-নারী দুষ্ট বদমাইশ হয়, চরিত্র হারায়। পল্লীগ্রামে মানুষের সহানুভূতি বেশি। পাওয়া যায়, অল্প খরচে সংসার চলে।

পয়সা থাকতে কিছু সম্পত্তি কিনা উচিত–পল্লী টাউন যেখানেই হোক। দেশে মাটির মূল্যই বেশি। এ দেশ কৃষিপ্রধান। যার দু’বিঘা জমি আছে, তার ভাবনা নেই। জলে মাছ, মাঠে সোনা-বাঙালির নাই একটু ভাবনা। রাস্তা ঘাট ছাড়া বহির্জগতের সঙ্গে সম্বন্ধহীন নিতান্ত পল্লীগ্রামে বাস করলে আবার পরিবারের উন্নতি হয় না।

মাসে মাসে কিছু কিছু জমা করা চাই। স্বামীকে কিছু জমা করবার জন্যে পুনঃপুনঃ অনুরোধ করবে। পুরুষের অভ্যাস কেবল খরচ করে যাওয়া। সঞ্চয়ী হবার জন্যে স্বামীকে বিশেষ করে বলবে। স্বামী যদি কিছু না রাখেন তবে তার সঙ্গে ঝগড়া করাও ভালো। জমানো টাকা যেন কিছুতেই খরচ না করা হয়। নিজের নামে ডাকঘরে টাকা রাখলেও মন্দ হয় না–স্বামীর কাছ থেকে মাঝে মাঝে কিছু কিছু আদায় করে ডাকঘরে নিজের লোক দিয়ে জমা রাখবে।

হাতে পয়সা আছে বলেই অনবরত খরচ করতে নেই। সর্বদা কিছু কিছু জমাতে চেষ্টা করবে। তাই বলে নরপিশাচের মতো না খেয়ে, না পরে, টাকা জমানো ভালো নয়।

বিপদের দিনের জন্য কিছু কিছু টাকা রেখে দিতে হবে।

টাউনের পার্শ্বে যেখানে স্কুল ও শিক্ষিত সমাজ আছে, অথচ পল্লী, সেখানেই দরিদ্র পরিবারের বাসের উত্তম স্থান।

মেয়েমানুষের কিছু হুনর হেকমত শিখে রাখা নিতান্ত প্রয়োজন। স্বামী বিহনে যাতে একেবারে পথে না দাঁড়াতে হয় আগেই তার বন্দোবস্ত করতে হয়। ঘরে বসেই যাতে দু’পয়সা উপায় করা যায় তার জন্য ব্যবস্থা হওয়া চাই। নারীরা ঘরের মধ্যে বসে বই বাঁধাই, সোনা, রূপা, কাপড় ও কাঠের কাজ করতে পারেন। নারী না খেয়ে মরবে কেন? কত ইংরেজি মহিলা জামা-কাপড়ের কাজ করে কত টাকা উপায় করেন, তার খবর। আমাদের মেয়েরা কি রাখেন? কত নারী অভাবে দুঃখে পল্লীগ্রামের অন্ধকার ম্লান প্রদীপের। পাশে কাঁদছে! নারীরা দুঃখে কে কাঁদে? তারা যেন বিধাতার জীবন নয়! তাদের কথা চিন্তা করলে মানুষের পতন হতে পারে। তারা ধর্ম পথের কণ্টক। কী বিড়ম্বনা!

কুলসুম আবার বলিলেন–প্রিয় হালিমা, বাড়ির কর্তাকে ভাত দিলে, শুধু ভাত ডাল সামনে রেখে দিলেই বধূর কর্তব্য শেষ হয় না। আগে জায়গা ঠিক করতে হয়; ধুলা বালি থাকলে ঝেড়ে দিতে হয়, তারপর দস্তরখানা ও পানি দিয়ে ভাত দেবে।

রান্না হলেই স্বামী ও মুরুব্বীদের স্নান করে আসতে অনুরোধ করবে। সকলকে এক সঙ্গে ভাত দেবে। ভাতের জন্য কর্তাকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। যদি বিশেষ দেরি থাকে, তাহলে মিষ্টি কথায় অপেক্ষা করতে বলবে।

বাড়িতে বেশি কেরোসিন তেল রাখবে না; দৈবাৎ যদি টিনে আগুন ধরে তাহলে সমূহ বিপদ হতে পারে।

নাইট্রিক এসিড, কার্বলিক এসিড বা কোনো বিষ জাতীয় ওষুধ খুব সাবধানে রাখবে। ইঁদুর মারবার জন্যে অনেকে ট্রিনিয় বিষ ব্যবহার করেন এরূপ করা নিষেধ।

বাড়িতে অনেক সময় গৃহিণীকে রাশি রাশি কাপড় সাফ করতে হয়। যার কাপড় সেই পরিষ্কার করলে একজনের মাথায় পাহাড় চাপে না।

পরিবারের সব কাপড় ধোপর বাড়িতে দেওয়া পল্লী-গৃহস্থের সাজে না। নিজেরাই মাড় ছাফ করলে কোনো ক্ষতি নাই। কাজের ক্ষতি না হলে এবং সময়ে কুলালে নিজেরাই অপরিষ্কার না থেকে ধুয়ে নেবে। ধোয়া কাপড় নীল লাগালে কাপড় শীগগীরই ময়লা হয় না। একটা ইস্ত্রি করবার যন্ত্র কিনে ঘরে রাখলে অনেক সময় নিজেরাই সার্ট-কোর্ট পলিশ করে নেওয়া যায়। ধোপারা কী প্রতিক্রিয়ায় কাপড় ধোয় এবং ইস্ত্রী করে তা ধোপার কাছে জিজ্ঞাসা করলেই সে বলে দেবে।

আজকাল এক রকম যন্ত্র বেরিয়েছে, দাম বেশি নয়, তাতে ৫/৬ মিনিটে নাকি ৬০/৭০ খানা কাপড় কাঁচা হয়, তা একটা কিনে পরীক্ষা করে দেখলে হয়।

বেশি বাসি খাদ্য কখনও ব্যবহার করতে নেই। এক দিনের বেশি মাছ জ্বালিয়ে খাবে না। সরু সাদা চাল ব্যবহার না করে লাল চাল ব্যবহার করা উচিত। সাদা চাল উপকারী নয়।

কৃপণতা করে বা বাজে খরচ করে কখনও খাওয়া-দাওয়ার ব্যয় কমাবে না। খারাপ খেলে শরীর টেকে না।

অবস্থা ভালো না হলে, কখনও লজ্জার খাতিরে, লোকে কি বলবে, এই ভেবে কোনো কিছু কিনো না, দরকার নেই অথচ অনুরোধে জিনিসপত্র কেনা মূর্খতা। যেমন অবস্থা তেমনি চলবে কারো পরোয়া করবার দরকার নাই।

বিক্রেতার মুখে জিনিস-পত্রের অন্যায় দাম শুনে রেগে ওঠা অভদ্রতা। বিক্রেতার মিষ্ট কথায় মুগ্ধ হয়ে অনুচিত মূল্যে কোনো কিছু কেনা বোকামি। বিক্রেতার ঠাট্টা উপহাস যতই কড়া হোক না, কানে তুলতে নেই। জিনিসপত্র এক দামে কিনতে চেষ্টা করা উচিত।

সোডা দিয়ে কাপড় না ধুলে বেশি টেকে। কলার পাতার ছাই উত্তম।

ঘর ঝাঁট দেবার সময় যেখানে সেখানে জুতো টান দিয়ে ফেলে। এরূপ করতে নিষেধ করবে।

কুলসুম বলিলেন-বোন, একটা অতি মূল্যবান কথা বলা হয় নি। পরিবারের কারো রোগ-ব্যামো হলে নারীরা সারারাত্রি জেগে কাটান, এটা নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ গুণ। ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ যেই হোক, প্রাণ দিয়ে তাকে সেবা করবে রক্তের সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধ নেই বলে যে পীড়িতাকে অবহেলা করতে হবে এমন যেন কখনও না হয়। সেবা করবার লোক। যদি যথেষ্ট থাকে, তাহলে অনবরত একজনের রাত্রি জাগরণ ঠিক নয়। কিন্তু রাতে যদি দরকারই হয়, তবে তা জাগাতেই হবে। ছোট অন্য কাউকে জোর করে রোগীর পার্শ্বে বসিয়ে রাখা ঠিক নয়। অনেক মানুষ আছেন যারা নিজে নাক ডেকে ঘুমিয়ে, পরকে সারারাত্রি জেগে থাকতে বলেন, একটু ত্রুটি হলে গালাগালি দিয়ে নিজের হীনতার পরিচয় দেন। মানুষকে দেবার জন্যে দুঃখী রোগাক্লিষ্ট মানুষের সেবার জন্যে রাত জাগাতে যে কী আনন্দ হয়, তা কি এক মুখে বলা যায়?

নিথর নৈশ আকাশ,তারাগুলি মৃত্যুর গান শোনাচ্ছে,-করুণ শোকের মূর্ধনা দিয়ে বাতাস বিশ্বজোড়া যৌনতার বুকের উপর দিয়ে হা হা করে ছুটছে–এমন সময় রোগজীর্ণ মরণ পথের যাত্রীকে দেখে কে ঘুমাতে পারে? কেউ না! হালিমা! সহানুভূতি, স্নেহ আর আঁখিজল নারীকে যে কত, বড় করেছে, তা আমি ঠিক করে বলতে পারি নে। কে বলে ভাগ্যহীনরাই নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে? নারীর দেহলাবণ্যে স্বর্গের সংবাদ এনে দেয়, তার হৃদয়ে বিশ্বজীবনের প্রাণরস নিহিত, তার হাসিতে আলোক-বাতাস অধীর আবেগে ছোটে, সাগর কল্লোলে নারীর জয়-সঙ্গীত শোনা যায়, তার চোখে মুখে প্রভাতের স্নিগ্ধ শান্তি-উৎসব হাসে, তার ললাটে গগনপ্লবী জোছনার মাধুরী ফোটে, সে কি সহজ? এহেন নারীকে যে অশ্রদ্ধা করে, সে নরাধম, সে নরপিশাচ।

নারীদের কিছু কিছু ঔষধের জ্ঞান থাকা নিতান্ত আবশ্যক। এতে কত নারীর যে উপকার করা যায়, তা বলে শেষ করা যায় না। নারীরা অনেক কষ্টে বিনা চিকিৎসায় মরে যায়, কেউ তাদের দেখবার থাকে না। কাউকে ঔষধ দিতে হলে কিছু মূল্য নিতে হয়। আর সেধে কাউকে ঔষধ খাওয়াবে না। কেউ তোমার নিতান্ত যে দয়া ভিক্ষা করে এবং ঔষধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখায় তার কাছ থেকে দাম কম নেবে। অক্ষমতা প্রকাশ করলে মোটেই নেবে না। আমি চিকিৎসার কি জানি, এরূপও মনে করবে না, সব কাজেই সাহস ও বিশ্বাস চাই। গ্রামসুদ্ধ লোককে সেবা করে বেড়াতে হবে, এ আমি বলছি নে। যার কেউ নেই, তুমি হবে তার আত্মীয়। যেখানে সেবা-যত্ন করবার যথেষ্ট লোক আছে সে ক্ষেত্রে জোর করে সেবা করবার দরকার নেই।

খ্রিষ্টানদের ভিতরে একদল নারী আছেন যারা চিরকাল অবিবাহিতা থেকে রোগী বা। আর্তের সেবা করে বেড়ান। বাইরে এতে এদের জীবন নিয়ে কল্পনা করতে মনে খুব শ্রদ্ধার ভাব জাগে, কিন্তু স্বভাবকে অস্বীকার করে মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়াও দোষের। এদের জীবনে বহু গোপন পাপ রয়েছে। ইসলামের প্রত্যেককে পরিপূর্ণ মানুষ হতে হবে। যিনি রানী, তিনিই পত্নী, তিনিই মা, তিনিই দাসী, তিনিই সেবিকা, তিনিই আর্তের বন্ধু।

কুলসুম আবার বলিলেন–যদি কোনো বিপন্ন আত্মীয়া বা স্বামীর বোন অনাথিনী হয়ে বাড়িতে আসেন, তবে তার সঙ্গে কখনও কঠিন ব্যবহার করবে না।

হালিমা মুখ ভার করিয়া বলিলেন–ওমা, এমন ধারা কি কখনও হয়ে থাকে?

কুলসুম-বোন, হয় বই কি? অভাব হলে সংসারে আপন জনের মধ্যে কলহ বিবাদ উপস্থিত হয়। তবে এরূপ হওয়া মোটেই বাঞ্ছনীয়। আল্লা রুজির মালিক, তিনি সকলকে খোরাক দেন, মানুষ উপলক্ষ মাত্র। অনেক সময় অভাব না থাকলেও, যে অনাথিনী, যে দরিদ্র, তার উপর বড় চাপ দেওয়া হয়। আহা, অনাথিনী হওয়া, আর অভাগিনী হয়ে ভাই এর বাড়ি অনুগ্রহ চাইতে আসার মতো কষ্ট কি আর আছে? এ অবস্থায় যে নারী স্বামী ও সন্তানের গর্বে আশ্রিতাকে কঠিন কথা বলেন তিনি বড় হীন। বাড়িতে যে আশ্রয় নিয়েছেন তার অপরাধটা স্নেহের চোখে দেখো। তার ছেলেমেয়েকে কখনও অনাদর করবে না,–বিশেষ করে সে নিজের আত্মীয় কেউ হলে।

অসভ্য বর্বর শ্রেণীর রমণীকে বাড়িতে স্থান দিলে জীবনে অশান্তি বেড়ে ওঠে। তাদের জন্য কোনো স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করে দেবে। স্বভাব যাদের ভালো, তাদের প্রতি শত রকমে করুণা প্রকাশ করলেও কোনো ক্ষতি নেই। তবে স্বভাব ঠিক মন্দ কি ভালো, এ ঠিক করা অনেক সময় কঠিন। যার কিছু নেই, যে পরমুখাপেক্ষী, তার দোষের অন্ত নেই, মানুষ তাকে খেয়ে ফেলতে চায়, তার গুণ কারো নজরে পড়ে না। যার নিতান্ত কপাল পুড়েছে, জীবনে বেঁচে থাকবার কোনো পৰ্থ যার নেই, সে-ই পরের দ্বারস্থ হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *