১৬-২০. রঘুবীরের দীর্ঘ কাঠামো

রঘুবীরের দীর্ঘ কাঠামো বউবাজার স্ট্রিটের জনারণ্যে মিশে যাওয়ার পর আদিত্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তার ডেরায় নিয়ে যাওয়ার জন্য খুব ঝুলোঝুলি করছিল রঘুবীর, বহু কষ্টে কাটিয়েছে। আগেও বার কয়েক নিয়ে যেতে চেয়েছে, যাব যাব করেও আদিত্যের যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বাব্বাহ, মধুগড় কী কম দূর! শেয়ালদা থেকে ট্রেনে দমদম, সেখানে থেকে নাকি আধঘণ্টার হাঁটা পথ! ভাবলেই গায়ে জ্বর আসে আদিত্যর।

আজ রঘুবীর খুব খোশমেজাজে আছে। এনলিস্টমেন্ট হতে যদিও এখনও অনেক দেরি, তবে চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। রঘুবীরের লোক একটি চিঠি জোগাড় করে দিয়েছে। মন্ত্রীর খাস সহকারীর হাতচিঠি। এই চিঠি নিয়ে রঘুবীর যাবে উলুবেড়িয়া, সেখানে যেন কার কার সঙ্গে দেখা করে বাকি বন্দোবস্ত সারবে। ইতিমধ্যে আদিত্যরও কিছু কাজ থাকবে কলকাতায়। ট্রেড লাইলেন্স করানো, পার্টনারশিপ ডিডের কাগজপত্র তৈরি, আয়কর বিভাগের সার্টিফিকেট জোগাড় করা, এই সব। এতগুলো ধাপ বাকি তবু চিঠি একটা হাতে পেয়েই রঘুবীরের কী উচ্ছ্বাস! পারলে এখনই রাস্তায় রোডরোলার নামিয়ে দেয়।

আদিত্যও খুশি, তবে রঘুবীরের সঙ্গে মাতামাতি করার মতো মনমেজাজ নেই আজ। একে ছেলেটা চলে গেল, তার ওপর আসার পথে কন্দর্পের ওই সব মতলবি কথাবার্তা, নাহ, মনটাই খিঁচড়ে গেছে বড়।

আজকাল মাঝে মাঝেই এরকম হচ্ছে আদিত্যর। কোনও কারণে মন একটু খারাপ হতে শুরু করলেই ক্রমশ এক অবসাদে ছেয়ে যেতে থাকে শরীর। কিছুই আর ভাল লাগে না তখন। খুশির খবরও না।

দুপুর অবধি ঝরে ঝরে এতক্ষণে ক্ষান্ত হয়েছে আকাশ। মনে হয় বর্ষণের পালা আজকের মতো শেষ। মেঘেরা তাঁবু গোটাচ্ছে। এক চিলতে বিষণ্ণ সূর্যও বুঝি দেখা গেল। বর্ষাবিকেলে অফিসপাড়ার ব্যস্ততায় কেমন স্যাঁতানো ভাব। গুটি গুটি ভিড় বাড়ছে বাসে ট্রামে।

ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে থেকে ঢাকুরিয়ার মিনিবাসে উঠবে বলে এগোচ্ছিল আদিত্য। মন্থর পায়ে। জি পি ওর সামনে এসে কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাড়ি ফিরেই বা এখন কী লাভ?

দিব্যচক্ষে আদিত্য দেখতে পাচ্ছে, ঘর আঁধার করে শুকনো মুখে বসে আছে ইন্দ্রাণী, মনে মনে হিসেব করছে বাপ্পা এখন কত দূরে, তিতিরও নিশ্চয়ই বিকেলে বেরিয়েছে এদিক ওদিক, দীপুদের ঘর আগল তোলা, নীচে বাহান্নটা তাসের সঙ্গে একা একা পাঞ্জা লড়ে চলেছে বাবা, দুলর্ভদেরও ঝাঁপ ফেলার সময় হয়ে এল। কার কাছে এখন ফিরবে আদিত্য! কেনই বা ফিরবে?

হঠাৎ শংকরের কথা মনে পড়ে গেল আদিত্যর। হাসপাতালে তাকে দেখতে জয়শ্রীর সঙ্গে শংকর এসেছিল একদিন, তারপর অনেক কাল আর দেখাসাক্ষাৎ নেই। শংকর শ্বশুরবাড়ি বড় একটা আসে না, আদিত্যই বরং অবরে-সরে যায় বোন ভগ্নীপতির বাড়ি। বোনের থেকেও ভগ্নীপতির সঙ্গে তার হৃদ্যতা বেশি।

জয়শ্রী যখন শংকরের মতো সামান্য এক মোটর মেকানিককে বিয়ে করেছিল, তখন আদিত্যও চটেছিল খুব। কিন্তু রাগ ধারণ করে রাখা তার ধাতে নেই, ইন্দ্রাণীর গোপন পীড়াপীড়িতে সেই প্রথম যোগাযোগ করে বোনের সঙ্গে। লুকিয়ে লুকিয়ে শোভনার দেওয়া টাকা গয়নাও পৌঁছে দিয়ে আসত বোনকে। শংকরও তখন তাকে খাতির করত খুব, আসুন দাদা, বসুন দাদা করে তোয়াজ করত। এখনও যে করে না তা নয়, তবে শংকরের এখন ভোল পাল্টে গেছে। বারারবই সে করিৎকর্মা ছেলে, মোটর গ্যারেজে কাজ করতে করতেই এক বড় অফিসারকে জপিয়ে ঢুকে পড়ল তেল কোম্পানিতে। প্রথমে পিওন হয়ে চাকরির শুরু, তারপর বছর তিনেকের মধ্যে নাইট কোর্সে পড়ে ফিটারের সার্টিফেকেট জোগাড় করে ফেলল। আর তাকে পায় কে! তেল কোম্পানির পেট্রল পাম্পে ঘুরে ঘুরে মেশিনপত্র সারাইয়ের কাজ তার, পাম্প মালিকদের দৌলতে তার হাতে এখন প্রচুর কাঁচা টাকা। কেষ্টপুরে একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলেছে। জয়শ্রী মাঝে মাঝেই এসে ইন্দ্রাণী রুনাকে নিত্যনতুন শাড়ি গয়না দেখিয়ে যায়। গত বছর শংকর সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িও কিনেছে একটা। ভাড়া খাটায়।

শংকরের অফিস কাছেই, কিন্তু বাইরে ঘুরে কাজ তার, তাকে কি এখন অফিসে পাওয়া যাবে। গিয়ে একবার দেখলে হয়।

না, আদিত্যর কপাল ভাল। শংকর আছে অফিসে। ভীষণ ব্যস্তভাবে তোড়জোড় করছে বেরোনোর। আদিত্যকে দেখেই বলে উঠল, আরে দাদা, আপনি! চলুন চলুন, রোদ উঠে গেছে।

আদিত্য অবাক হল, রোদ! কোথায়? এই তো বৃষ্টি থামল।

— বৃষ্টি থামা মানেই রোদ ওঠা। সকাল থেকে যা ঢালছিল আজ! ভাবলাম বুঝি বানচালই হয়ে গেল।

কী বানচাল?

–ম্যাচ। ঝান্টুর আজ প্রথম বড় টিমের সঙ্গে খেলা। ইস্টবেঙ্গল। শংকর প্রায় টেনে বাইরে নিয়ে এল আদিত্যকে। ফুটছে উত্তেজনায়, চারটে বেজে গেল। সওয়া চারটেয় কিক অফ। পা চালান তাড়াতাড়ি।

শংকরের সঙ্গে তাল রাখতে প্রায় ছুটতে হচ্ছে আদিত্যকে। হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন ছুঁড়ল, ঝান্টু এবার ফার্স্ট ডিভিশনে খেলছে নাকি?

–কেন, আপনার বোন ও বাড়িতে বলেনি?

–শুনিনি তো!

খিদিরপুরে খেলছে। মোরগের মতো ঘাড় উচুঁ করে ঝুঁটি ফোলাল শংকর, ছেলেটাকে খুব গালমন্দ করতাম। পড়াশুনো নেই, সারাক্ষণ খালি ফুটবল আর ফুটবল। ছেলে বাপের মুখে ঝামা ঘষে এলেম দেখিয়ে দিয়েছে। গত হপ্তাতেও নাম উঠেছিল কাগজে। জুনিয়ার বেঙ্গলের ট্রায়ালে আছে।

আদিত্য বেশ লজ্জা পেল। একমাত্র ভাগ্নের সম্পর্কে এত খবর সে সত্যিই জানে না। শুধু জানে ঝান্টু একটু মাথামোটা, তিন-তিনটে টিউটরের কাছে পড়েও হায়ার সেকেন্ডারিতে ফেল মেরেছে। হাউ হাউ করে কথা বলে, যেখানে সেখানে উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে বসে, বাপ্পা তিতিরের কাছে ঝান্টু রীতিমতো হাসির খোরাক।

আদিত্য কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, দ্যাখো কাণ্ড! ঝান্টুটা এত সব করে বসে আছে, আমি জানিই না! আসলে আজকাল এত কম থাকা হয়…। একটা ব্যবসায় নামতে চলেছি…..

শংকর শুনছে না। ছুটছে। লম্বা পেটানো শরীর দৌড়ে পার হয়ে গেল রাস্তা। বল পায়ে গোষ্ঠ পালকে কাটিয়ে। আরও শয়ে শয়ে মাঠে ধাবমান মানুষের সঙ্গে।

মাঠের বাইরে মাঝারি লাইন। সর্পিল। পুলিশ পিঠে ঘোড়ারা কাদা ছেটাচ্ছে ছপছপ। এই জল কাদা ভেঙে মাঠে ঢুকতে ইচ্ছে হচ্ছিল না আদিত্যর, কিন্তু নাও করতে পারল না মুখ ফুটে। ঝান্টু তার ভাগ্নে বলে কথা!

খেলা শুরু হয়ে গেছে। এগারোটা লাল হলুদের সঙ্গে লড়ছে এগারোটা সাদা জার্সি পরা তরুণ। ছুটন্ত সাদা জার্সির ঝান্টুকে চিনতে পারছিল না আদিত্য। মাঝ-গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে নিম্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করল, এই শংকর, ঝান্টু কোথায়?

শংকর ঘাড় ফেরাল না। সামনে চোখ রেখেই উত্তেজিতভাবে বলল, ঝান্টুকে চিনতে পারছেন! ওই তো চার নম্বর। রাইট স্টপার।

–হ্যাঁ, তাই তো। ঝান্টুর স্বাস্থ্যটা তো বেশ ভাল হয়েছে!

–রোজ ওয়েট ট্রেনিং করে। ঊরু দাবনা এগুলো সব তৈরি করতে হবে না!

নেমেই ক্রমাগত আক্রমণ শুরু করেছে ইস্টবেঙ্গল। সাঁ সাঁ ধেয়ে আসছে লালহলুদ ফরোয়ার্ডের দল। সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাদা জার্সি। পিছল মাঠে সাররা কেটে এক ফরোয়ার্ডকে শুইয়ে দিল ঝান্টু।

শংকর চেঁচিয়ে উঠল, জিও মেরে লাল।

 আদিত্য সপ্রশংস ভঙ্গিতে তাকাল, ঝান্টুর গায়ে তো হেভি কষ হয়েছে!

–হবে না? ওয়েট ট্রেনিং করে যে!

কর্নার পেয়েছে লালহলুদ। শুন্যে উড়ন্ত বল গোঁত খেয়ে নামছে গোলপোস্টের সামনে। হেড করার জন্য লাফিয়ে উঠল তিনটে লালহলুদ ফরোয়ার্ড, সঙ্গে ঝান্টুও। ফরোয়ার্ডদের টপকে ঝান্টুই হেড করেছে।

শংকর পাগলের মতো হাত ছুঁড়ছে, সাবাশ ব্যাটা। চালিয়ে যা।

 আদিত্য হাঁ হয়ে দেখছে ঝান্টুকে, উফ, কতটা লাফাল!

লাফাবে না? ওয়েট ট্রেনিং করে যে!

বিশ-পঁচিশ মিনিট গড়িয়ে গেছে খেলা, গোল হয়নি এখনও। গ্যালারি ভর্তি ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক অধৈর্য হয়ে উঠছে ক্রমশ। শংকরের উচ্ছ্বাস দেখে দু-চারজন কটমট তাকাচ্ছে এদিকে।

তখনই প্রথম গোলটা হল। ঝান্টুকে ইনসাইড ডজে টলিয়ে দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ধেয়ে গেছে। লালহলুদ ফরোয়ার্ড। গোলকিপারের মাথার ওপর দিয়ে জালে ঠেলে দিয়েছে বল। পাঁচ মিনিট পর আবার গোল। এবারও ঝান্টুকে কাটিয়ে। গোটা গ্যালারি জুড়ে উল্লাসের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে।

আদিত্য ফিসফিস করে বলল, ইশ, ঝান্টুটা ঠিক সামাল দিতে পারছে না।

–হুঁ।

বুদ্ধিটা এখনও ঠিক তেমন পাকেনি তো।

–পাকবে কী করে? সারাক্ষণ ওয়েট ট্রেনিং করে যে। শংকর ম্রিয়মাণ। হাফটাইম অবধি আর গোল হল না। শালা ভগ্নীপতি বেজার মুখে ঝালমুড়ি চিবোচ্ছে।

হঠাৎ শংকর বলল, কি একটা বিজনেসের কথা বলছিলেন যেন?

–হ্যাঁ। রোড কনট্রাক্টরির ব্যবসা।

–আপনি করবেন রোড কনট্রাক্টরি? কে ঢোকাল মাথায়?

 –কে আবার ঢোকাবে! ঝপ করে রঘুবীরের নামটা করতে ইচ্ছে হল না আদিত্যর। বলল, –আমারই কয়েকজন চেনাজানা ছিল, তাদের থ্রু দিয়ে একটা কাজ বের করার চেষ্টা করছি।

–আমার কাছে কেন লুকোচ্ছেন দাদা? শংকর চোখ টিপল, –এ নিশ্চয়ই আপনার সেই রঘুডাকাতের প্ল্যান।

নির্ঘাত জয়ি গিয়ে লাগিয়েছে। আদিত্য বোনের ওপর মনে মনে একটু চটে গেল।

শংকর ফের বলল, লোকটা আজ পর্যন্ত আপনার কাছ থেকে কত টাকা খিঁচেছে?

–কিছু নেয়নি তো!

–হতেই পারে না!

আদিত্য হেসে ফেলল, মাইরি বলছি, আজ পর্যন্ত কিছু নেয়নি। উল্টে বাবার জন্য বিনে পয়সায় হার্টের ওষুধ এনে দিয়েছে, ফ্রি অফ কস্টে পলা দিয়েছে একটা।

তাই?

হুঁউউ। বিশ্বাস না হয় জয়িকে বোলো বাবাকে জিজ্ঞেস করতে।

–আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। শংকর মুখ বেঁকাল, –তবে আপনার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে লোকটা তেমন ঘোড়েল নয়। খুব একটা ক্ষতি করতে পারবে না।

কী করে বুঝলে?

 –যে লোক আপনার বাবাকে পটানোর আশায় থাকে, সে আর যাই হোক পাকা ঘোড়েল হতে পারে না। আমার শ্বশুরমশাই কি পটবার চিজ? আপনিই বলুন না?

রঘুবীরের সঙ্গে বাবার সাম্প্রতিক সম্পর্কটা চেপে গেল আদিত্য। জয়মোহনের ওপর শংকরের প্রচণ্ড রাগ আছে, আদিত্য জানে। শংকর যখন জয়শ্রীকে নিয়ে পালিয়েছিল তখন শংকরের পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিলেন জয়মোহন। পুলিশের লোক বেশ কিছুদিন উত্যক্ত করেছিল শংকরকে। উনিশ বছরের মেয়েকে নাবালিকা প্রতিপন্ন করে শংকরকে নাবালিকা হরণের চার্জেও ফেলা যায় কিনা তা নিয়েও উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন জয়মোহন। সে সব কথা শংকরও ভোলেনি, জয়মোহনও না। মেয়ে-নাতিকে মেনে নিলেও জয়মোহন এখনও সোজা চোখে তাকিয়ে কথা বলেন না শংকরের সঙ্গে। দেওয়ালের দিকে মুখ করে বিজয়ার প্রণাম সারে শংকর। জয়মোহনও ভাববাচ্যে আশীর্বাদ জানান জামাইকে।

বিরতির পর খেলা শুরু হয়েছে। খিদিরপুর বার কয়েক ক্ষীণ আক্রমণের চেষ্টা চালাল, সুবিধে হল না। উল্টে লালহলুদ আরও দুটো গোল পুরে দিল। দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায় ঝান্টু কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছে। হয়তো বা ওয়েট ট্রেনিং করার জন্যই!

গ্যালারি ফাঁকা হয়ে গেছে। সুনসান গ্যালারিতে বসে আছে শংকর। বিমর্ষ। হতাশ।

আদিত্য করুণ মুখে বলল, ভেবো না, ঝান্টু আমাদের ভালই খেলে। শুধু অভিজ্ঞতাটারই যা অভাব।

–অভিজ্ঞতাটা হবে কোত্থেকে? আট বছর বয়স থেকে হেড মেরে ঘিলুগুলো তো ইট করে ফেলেছে। শংকর ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, কোথায় ভাবলাম এ বছর বড় টিমের এগেনস্টে খেলা টেলা দেখালে সামনের বছর ভাল দর উঠবে ছেলেটার! সে গুড়ে কেরাসিন ঢেলে দিল পাঁঠাটা!

আদিত্যরও মনটা খারাপ লাগছিল। সামনে ক্ষতচিহ্নলাঞ্ছিত মাঠ, পাশে এক নিরাশ পিতা, মাথার ওপর মলিন আকাশ, দিনান্তের বিবর্ণ ভাব–সবই অবসন্ন ভাবটাকে ফিরিয়ে আনছিল তার। খানিক বসে থেকে বলল, চলো, এবার ওঠা যাক।

মাঠের বাইরে এসে একটানা কিছুক্ষণ গজগজ করল শংকর। তারপর বলল, চলুন দাদা, কোথাও একটা গিয়ে বসা যাক।

-কোথায় আর যাবে? চলো, তোমাদের বাড়িই ঘুরে আসি। জয়িটা বাড়িতে আসে, আমার সঙ্গে দেখা হয় না ….

–সে আরেক দিন যাবেন। আজ বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না দাদা। অ্যাদ্দিন পর দেখা হল, একটু সুখদুঃখের কথা হোক।

সুখদুঃখের কথা বাক্যবন্ধটি সাঙ্কেতিক। অর্থ, একটু পান টান করা যাক। কথাটা আদিত্যই ব্যবহার করত এক সময়ে। প্রথম প্রথম শংকর খুব হাসত, পরে কথাটা তারও লবজ হয়ে দাঁড়ায়।

আদিত্য প্রস্তাবে উৎসাহ দেখাল না, না ভাই, আমি ছেড়ে দিয়েছি।

-বলেন কী দাদা! কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে? হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়কে দিয়ে আপনি…

ভুল করেছিলাম ভাই। কষ্টও পেয়েছি। পেটে সে যে কী অসহ্য যন্ত্রণা।

–সে আপনি যেখানে সেখানে গিয়ে যা তা জিনিস খাবেন, তাতে তো লিভারের বারোটা বাজবেই। আমি কি আপনাকে আজে বাজে জিনিস খাওয়াই?

আদিত্য ঘাড় চুলকোল, –উপায় নেই রে ভাই। গিন্নিকে কথা দিয়ে ফেলেছি। মেয়েও মাথার দিব্যি দিয়ে রেখেছে।

শংকর চোখ পাকাল, –আপনি বলতে চান হাসপাতাল থেকে ফেরার পর আপনি আর মাল ছোঁননি?

–সত্যিই ছুঁইনি। বলতে গিয়ে আদিত্য বেশ আত্মপ্রসাদ অনুভব করল। রঘুবীর যে কতদিন কতভাবে টেনেছে তাকে, আর কী নির্বিকার ঔদাসীন্যে মদ খাওয়ার প্রলোভনটাকে সে জয় করেছে, এটা ভাবতেই গর্বে বুক ফুলে উঠছিল তার। বাবা বউ ছেলে মেয়ে সকলকে দেখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে করলেই নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে সে।

শংকর আদিত্যর পিঠে আলগা চাপড় দিল, –ঠিক আছে, আপনাকে জোর করছি না। আমার সঙ্গে যেতে তো অসুবিধে নেই?

আদিত্য আর আপত্তি জানাতে পারল না।

পার্ক স্ট্রিটের বারে দুজনে বসেছে মুখোমুখি। চার পাশে গ্লাস বোতলের টুং টাং, শংকরের হাতে রঙিন পানীয়, বাতাসে সুরার ঘ্রাণ, হঠাৎ যেন একটু আতুর করে তুলছিল আদিত্যকে।

শংকর বলল, একটু বিয়ার নিতে পারেন দাদা। বিয়ার তো ঠিক সেই সেন্সে মদ নয়।

আদিত্য এদিক ওদিক তাকাল, না থাক, একবার যখন ছেড়েইছি, কেন আর বিয়ার খেয়ে নাম খারাপ করা?

অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য এলোমেলো কথা শুরু করেছে আদিত্য। কখন যে বাপ্পা তিতিরের গল্প বলতে বলতে কন্দর্পের কথাটা তুলে ফেলেছে আদিত্য নিজেই জানে না।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিথিল শংকর পলকে টান টান। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পাঁচ মিনিটে আদিত্যর পেট থেকে বার করে নিল সব কথা। ঝুম হয়ে বসে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, –একদিক দিয়ে চাঁদু ঠিকই বলেছে। বাড়ি আপনাদের ভাঙা পড়বেই।

আদিত্য কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ল, –আমি বাড়ি ভাঙা মেনে নেব না।

–আমি কি বলেছি মেনে নিতে? আপনি বরং এমন একটা কিছু করুন যাতে সাপও মরে, লাঠিটাও আস্ত থাকে।

-কী রকম?

–একটা জুতসই পার্টি দেখে জমিবাড়ি সবসুদ্ধ বেচে দিন। তার থেকে আপনার ভাগটা আপনি নিয়ে নিন।

-যাহ, তা কী করে হয়! বাবা বেঁচে থাকতে সবটাই তো বাবার। আমি ভাগ পাব কেন? তাছাড়া বাড়ি ভাঙা বেচা কোনওটাই যে আমি চাই না ভাই।

–তাহলে আর কী! বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষুন। চাঁদু দীপু সবাই ওস্তাদ, প্রত্যেকে যে যারটি বুঝে নেবে। আপনাদের ওই বুড়ো কর্তা বেঁচে থাকতে থাকতেই। বুঝলেন? এই যে চাঁদু আজ দেখল আপনি রাজি হননি, ও এখন কি করবে জানেন? কালই দীপুর সঙ্গে প্যাক্ট করবে। ওরা দুজনে প্ল্যান করে বাড়ি ঠিক ভাঙবেই। বাবাকেও ঠিক কবজা করে নেবে। মাঝখান থেকে আপনার আর মুখ থাকবে না।

আদিত্য চিন্তায় পড়ল, –তাহলে আমার কী করা উচিত?

–গোটা ব্যাপারটাকে নিজের কনট্রোলে নিয়ে আসা উচিত। বলেন তো আপনার বোনকে বলে দিচ্ছি, সে আপনার দলে থাকবে।

জয়শ্রীরও যে বাবার বাড়িতে একটা ভাগ আছে, কথাটা আদিত্যর মাথাতেই ছিল না। দু-এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, –তাও তো বটে। জয়িরও তো ও বাড়িতে একটা শেয়ার আছে।

–শেয়ার আছে কি নেই, সে আপনাদের ভাইবোনদের ব্যাপার। আমি এর মধ্যে কিছু বলব না। তবে আমি একটা সাজেশান দিতে পারি।

কী?

–দেখুন, শ্বশুরমশাই বেঁচে থাকতে বাড়ি বেচে টাকা ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাবটা বোধহয় ধোপে টিকবে না। অথচ বাড়িটা ভাঙা পড়বেই। আর তাই যদি হয়, আপনি কেন ম্যাক্সিমাম লাভটা উশুল করে নেবেন না?

-না না, আমি না বড়ভাই! ওসব করা আমার ঠিক হবে না।

–আলবত হবে। দীপু ভাল চাকরি করে, চাঁদুও শুনি এখন সিনেমা করে ভালই কামায়, ওদের মধ্যে আপনার অবস্থাই তো সব থেকে খারাপ। টাকার দরকার আপনারই বেশি। শংকর নড়ে বসল, –একটা ভাল বুদ্ধি দেব? নিজেই আপনি দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট তৈরি করুন।

–ওরেব্বাস! সে তো প্রচুর টাকার ধাক্কা! অত টাকা আমি পাব কোথায়?

—আহা, টাকা তো আপনার কাছেই হেঁটে হেঁটে আসবে। মাছের তেলে মাছ ভাজবেন। অ্যাডভান্স নিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট তুলবেন। দাঁড়ান, হিসেব করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। আপনাদের জমি আছে আট কাঠা, ঠিক? ওখানে ফ্ল্যাট তুললে চারতলা অবধি তো তোলা যাবেই। প্রতি তলায় চারটে করে ফ্ল্যাট হলে মিনিমাম ষোলোটা। আপনাদের ওখানে এখন ফ্ল্যাটের যা রেট যাচ্ছে তাতে চার লাখ করে তো দাম পাবেনই।

–তা পাব। আমাদের পাশের ওই ছোট্ট ছোট্ট ফ্ল্যাটগুলোই তো চার, সওয়া চার লাখে বিক্রি হয়েছে।

–তাহলেই দেখুন, ষোলটা ফ্ল্যাট, অর্থাৎ চৌষট্টি লাখ টাকা। এর থেকে আপনাদের তিন ভাইয়ের তিনটে ফ্ল্যাট বাদ দিন। কত থাকল? বাহান্ন লাখ।

–শুধু তিন ভাই কেন? তোমরা ফ্ল্যাট নেবে না?

–আমার নাম কেন বলছেন দাদা? আমি কে? বলুন বোন।

–ওই হল। তুমি আর জয়ি কি আলাদা?

–পৈতৃক বাড়ি সম্পত্তি দাদা, যার যার তার তার। এখানে কোনও হাজব্যান্ড ওয়াইফ নেই। শুধু যদি আমার মত চলত, তাহলে আমি ফ্ল্যাট নিতাম না। তবে মনে হয় জয়ি নেবে। ফ্ল্যাট না নিলেও তার বদলে ক্যাশ নিয়ে নেবে।

বাপের জিনিস তো নেওয়াই উচিত।

–শুধু বাপের জিনিস বলে নয় দাদা, আপনি তো জানেনই, আপনার বোনের একটু খাই বেশি। এই যে দিবারাত্র ছুটছি, যে করে হোক পয়সা রোজগার করে আনছি, সবই তো তেনার চাপে।— আমাকে কোনওদিন সুতির প্যান্টশার্ট ছাড়া অন্য কিছু পরতে দেখেছেন? অথচ তার কি না চাই!

আদিত্য দু হাত তুলে বাধা দিল, থাক থাক, সে জয়ি না হয় নিলই কিছু। তারপর?

–তারপর আবার কি। হিসেব করে দেখুন ষোলোটা ফ্ল্যাট তুলতে কত খরচা হবে? ভাল মেটিরিয়াল দিয়ে, নিজে চব্বিশ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে করালে লাখ তিরিশ পঁয়ত্রিশে নেমে যাবে। ভাইদের আরও লাখ দুয়েক করে দিয়ে দিন। আপনার হাতে তাহলে কত লাখ থাকল?

ক্রমাগত লাখ শুনতে শুনতে মাথাটা কেমন গুলোতে শুরু করেছে আদিত্যর। এ যেন কুবেরের ধনভাণ্ডার উন্মুক্ত হচ্ছে সামনে। কত লক্ষ টাকা থাকছে তার হাতে? সাত লক্ষ? আট? দশ?

সংবিৎ হারিয়ে হঠাৎ শংকরের গ্লাস টেনে নিয়ে চোঁ চোঁ চুমুক মেরে ফেলল আদিত্য। অনেক দিন পর তরল আগুন নামছে কণ্ঠনালী বেয়ে। তৃষিত স্নায়ুরা পুলকে রিমঝিম নেচে উঠল। মুহূর্তে লাল হয়ে গেল মুখচোখ।

শংকর মিটিমিটি হাসছে, –আস্তে। ধীরে সুস্থে খান দাদা। আরেকটু বলি?

বলো। তুমি আজ আমার মাথা খারাপ করে দিলে শংকর।

–দেখুন দাদা, আপনি কিন্তু নিজেই খাচ্ছেন, বউদির কাছে গিয়ে কিন্তু আমার নাম করবেন না।

–কেন তোমার নাম করব? আমি কি নাবালক? আমি কি নিজে খেতে পারি না?

দ্রুত আরও পেগ দুয়েক হুইস্কি সাবড়ে আদিত্য সুস্থিত হল। নেশা আস্তে আস্তে ধরছে মাথায়। ঘোর লাগা স্বরে বলল, একটা কথা শুধু আমার মাথায় ঢুকছে না ভাই। নিজেরা তৈরি করলে যদি লাখ লাখ টাকা আসে, তবে লোকে প্রোমোটারের হাতে বাড়ি ছাড়ে কেন?

শংকরেরও গলা জড়িয়ে এসেছে, –সেসব আমি জানি না।

–প্রোমোটাররা কি আরও বেশি লাভ করে?

–আলবত করে। নইলে কি আর এমনি এমনি ছোঁকছোঁক করে বেড়ায়? ওদের মাল-মেটিরিয়ালের হাল দেখেননি? কদিন পরেই ঝুরঝুর করে সব খসে পড়ে।

–আমি কিন্তু এক নম্বর মেটিরিয়াল দেব।

–দেবেন। আগে লাইন থেকে ভাই দুটোকে হঠান। বুড়োকর্তাকে কবজা করুন। তার পর।

ও আমার বাঁয়ে হাত কা খেল। আদিত্য টুসকি বাজাল, –আমার কাছে বুড়োর একটা সিক্রেট আছে। তাই নিয়ে একটু চাপ মারলেই বুড়ো ধসে যাবে।

ওয়েটার আরও দু পেগ হুইস্কি রেখে গেছে। সঙ্গে সোডা। বরফ।

শংকর কাঁপা হাতে নিজের গ্লাসে সোডা মেশাল, কী সিক্রেট দাদা?

–তোমাকে বলব কেন? আদিত্য নিট গলায় ঢেলেছে, তুমি শালা আমার বাবাকে দেখতে পারো না, আমার ভাইদের দেখতে পারো না, আমার বোনের নিন্দে করো, আমার বউয়ের সঙ্গে তোমার বনিবনা হয় না…

–বেশ। বেশ। নাহয় নাই বললেন। আমাকে বলবেনই বা কেন? আমি শালা মিস্ত্রি মজুর মানুষ। তবে মনে রাখবেন বিপদের সময়ে আপনাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য কিন্তু গোটা দুনিয়ায় একজন মানুষই আছে। কে আপনাকে গ্যারেজ ঘরে প্রেস করার বুদ্ধিটা দিয়েছিল, অ্যাঁ? আমি না মনে করিয়ে দিলে বুড়োকর্তার ফিক্সড ডিপোজিটের কথা স্মরণে আসত আপনার! পারতেন প্রেস শুরু করতে?

নেশাচ্ছন্ন আদিত্য খানিকটা দমে গেল। তবু বাবা সম্পর্কিত কথাটা গিলে নিল প্রাণপণে। গ্লাস শেষ করে উঠে দাঁড়াল।

শংকরের ট্যাক্সি ভেতরে ঢোকেনি, বাস স্টপে ছেড়ে দিয়ে গেছে আদিত্যকে। মাতাল আদিত্য বাড়ি ফিরছে। তিন মাস পরে আবার আজ এলোমেলো পড়ছে পা।

আধখোলা গেটের সামনে এসে মত্ত কণ্ঠ গর্জে উঠল, –অ্যাই শালা দীপু, অ্যাই শালা চাঁদু, তোদের চালাকি আমি ছুটিয়ে দেব আজ। আমাকে তোমরা ঠকাতে চাও, অ্যাঁ?

.

৭.

বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘন ঘন সিগারেট টানছিল সুদীপ। আধ ঘণ্টা ধরে বাড়িতে যে তাণ্ডবটা চলল আজ, এখনও সেটাকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে উঠতে পারেনি সে। রগ দুটো দপদপ করছে, রক্ত চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলেও এক চাপা হুঙ্কার এখনও হামলা চালাচ্ছে শরীরে। কী বিশ্রী কাণ্ডটাই না হয়ে গেল আজ!

অ্যাটম ঘুমিয়েছে। শুধু যেন এটুকুরই প্রতীক্ষায় ছিল রুনা। বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে বারান্দায় এসেছে, ঢঙ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

সুদীপ খিঁচিয়ে উঠল, কী করব? নাচব?

–নাচলেই পারো। দুই ভাই জগাই-মাধাই হয়ে নাচো, পাড়াপড়শি ডুগডুগি বাজাক। কী কপাল করে যে এসেছিলাম এ বাড়িতে!

সুদীপ খানিকটা সতর্ক হয়ে গেল। এগুলো রুনার মিসাইল নয়, মিসাইলের ভনিতা। ওদিকের লঙ্কাকাণ্ড শেষ, এবার এদিকের কুরুক্ষেত্র মুখর হবে।

হলও। রুনা তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, –অনেক হয়েছে। অনেক দিন ধরে সহ্য করছি, আর নয়। তুমি যদি এর বিহিত না করো তা হলে কিন্তু কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।

কী বিহিত করব? বাঁশপেটা করব দাদাকে?

–আমি ভাই হলে তাই করতাম। পিটিয়ে বেলেল্লাপনা ছুটিয়ে দিতাম।

এ কাজ রুনার পক্ষে অসম্ভব নয়, সুদীপ জানে। রাগলে মারধর করে খানিকটা পৈশাচিক সুখ পায় রুনা। পরশু রাত্রে জাপানের রাজধানীর নাম টোকিওর বদলে প্যারিস বলেছিল অ্যাটম, ছেলেকে মেঝেতে শুইয়ে তার পিঠে স্কেল ভাঙছিল রুনা, ছেলের যে ককিয়ে দম আটকে আসছে, তাও রুনার নজরে ছিল না।

সুদীপের তুষ্ণী ভাবে গলার পর্দা একটু নামাল রুনা, বাবার সঙ্গে স্ট্রেট কথা বলো। অসভ্যতার একটা লিমিট আছে। মদ গিলে এসে যাকে যা খুশি বলে যাবে, ভাইদের শালা শুয়োরের বাচ্চা বলবে, তা তো চলতে পারে না। ছেলে এতদিন ছোট ছিল, এখন বড় হচ্ছে, এই পরিবেশে সে মানুষ হবে ভেবেছ?

বাবার সঙ্গে কথা বলে কী লাভ! কতবার তো বলেছি, বাবা বেঁচে থাকতে কিছু করা যাবে না। দেখলে না বাবা আমার লোকটাকে কেমন দুর দুর করে তাড়াল!

–তা হলে অন্য কোথাও চলো। তুমি তো অফিস থেকে বাড়িভাড়া পেয়ে যাবে, আমরা অন্য কোথাও ফ্ল্যাট দেখে উঠে যাই।

দু-এক সেকেন্ড কী যেন ভাবল সুদীপ, তারপর বলল, তাও হয় না। বাবার দায়িত্ব নিয়েছি, বাবাকে ফেলে যাওয়া যায় না।

বাবাকে নিয়ে চলো!

–খেপেছ? বাবা নিজের বাড়ি ছেড়ে নড়বে?

 –তা হলে এখানে পচে মরুন। হাগবও না, পথও ছাড়ব না, এ তো হয় না।

সুদীপ আবার ভাবল কিছুক্ষণ। পাঞ্জাবির পকেটের দেশলাইটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল আঙুলে, –নাহ্, তা হয় না। অনেক প্রবলেম আছে। একবার বাড়ির বাইরে গেলে পায়ের তলার মাটি সরে যায়। তখন কি আর বাড়ি ভাঙার ব্যাপারে আমার তেমন জোর খাটবে? যারা তখন বাড়িতে গেড়ে বসে থাকবে, সবই তখন তাদের হুকুম মতো হবে, এটা বোঝো?

–এই কুমিরছানা তুমি আমাকে অনেক দিন ধরে দেখাচ্ছ। আমি ছেলেকে আর এই পরিবেশে রাখব না ব্যস। কালই আমি অ্যাটমকে মার কাছে রেখে আসছি।

সুদীপ প্রমাদ গুনল। রুনা সব পারে। ছেলের বিষয়ে রুনা এতটুকু সমঝোতা করতে রাজি নয়। গত মাসে পুরীতে যেই একদিন হেঁচেছে অ্যাটম, ওমনি রুনার হুকুম জারি হয়ে গেল, সুদীপকে পর্যন্ত আর পা ছোঁওয়াতে দিল না জলে। চিলকা বাতিল, নন্দনকানন বাতিল, সারাক্ষণ শুধু হোটেলে বসে সমুদ্রের শোভা দেখো।

রুনাকে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করল সুদীপ, –দেখো, যা হয় না তা ভেবে তো লাভ নেই। আমাকে একটু ঘটনাটা ভাল করে খতিয়ে দেখতে দাও। দাদাকে তো আমি নিও বিল্ডার্সের নাম বলিনি, দাদা জানল কী করে?

–এই না হলে পুরুষমানুষের বুদ্ধি! চাঁদু বলেছে।

 চাঁদুই বা জানবে কোত্থেকে? তুমি গল্প করেছিলে?

–আমার অত পেট পাতলা নয়। তোমার ওই ছোট ভাইটি একটি মিটমিটে শয়তান। পেটে পেটে জিলিপির প্যাঁচ। শুনলে না তলে তলে নিজের প্রোমোটার ঢোকাচ্ছে?

সুদীপ গুম হয়ে গেল। চাঁদুও যে এই লাইনে নেমে পড়েছে, এটা তার কল্পনাতেও ছিল না। লাল্টু মার্কা ছেলে, গানবাজনা যাত্রা-থিয়েটার নিয়ে মজে থাকে, ফিলম, সিরিয়ালের লাইনে ঘষছে, সুবিধে হচ্ছে না–চাঁদুকে মনে মনে অনুকম্পাই করে সুদীপ। ছোট থেকেই উড়ুউড়ু ভাবের জন্য তেমন পছন্দও করে না। সেই ছেলেও যে এত শাহেনশা হয়ে উঠেছে কে জানত!

কেউ কোনও কথা বলছে না। রুনা হঠাৎ বলল, –তোমার প্রোমোটারের গল্প হয়তো তোমার বাবাও করে থাকতে পারেন। তিনি তো আবার আর এক কাঠি বাড়া। খাবেন পরবেন আমাদের, আর ঝোল টানবেন ওদিকের।

–যাহ্। বাবা দাদাকে বলবে? অসম্ভব।

-দাদাকে কেন বলবেন? তিনি তাঁর পিরিতের বউমাকে বলেছেন। সেখান থেকে দাদা শুনেছে।

বউদি দাদার সঙ্গে এসব কূটকচালি করবে না।

–ও হ্যাঁ, তাও তো বটে। তিনি তো আবার স্বামীর সঙ্গে গোপন কথা বলেন না! তাঁর তো গোপন কথা বলার লোক আছে!

প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইল সুদীপ। বলল, আজেবাজে কথা বলছ কেন? হচ্ছিল কোন কথা, কোথায় চলে গেলে!

বাড়ির কেচ্ছায় ওমনি গায়ে ছ্যাঁকা লেগে গেল? তোমরা সবাই কি ভাবো বলো তো? দুনিয়াসুদ্ধ লোক কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলে? বাপের বাড়িতে কৈফিয়ত দিতে দিতে আমার মাথা কাটা যায়।

সুযোগ পেলে শুভাশিস-ইন্দ্রাণীকে নিয়ে এই ইঙ্গিতটা দেবেই রুনা। বিয়ের পর প্রথম প্রথম হাসিঠাট্টার ছলে বলত, এখন প্রতিটি মনোমালিন্যের সময়ে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। সুদীপকে আহত করার জন্যে।

আর সুদীপ আহত হবে নাই বা কেন? শুভাশিসকে সে কি কম দিন দেখছে? সন তারিখ হিসেব করে বলতে গেলে রুনার সঙ্গে আলাপ হওয়ার অনেক আগে থেকেই তার শুভাশিসের সঙ্গে পরিচয়। সেই কোন কালে, যখন তিতির হল তারও পাঁচ-ছ মাস আগে এ বাড়িতে প্রথম এসেছিল শুভাশিস। কী শান্ত চেহারা, কী বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা, কী মার্জিত ব্যবহার! মাত্র কদিনের পরিচয়ে কিভাবে যেন আপন হয়ে গেল সংসারে। মা যে মা, যার অত খিটখিটে সন্দেহবাতিক স্বভাব ছিল, মা পর্যন্ত শেষের দিকে দুদিন শুভাশিসদা না এলে কেমন অস্থির হয়ে পড়ত। তারপর কত ঝড়ঝঞ্ঝা গেল সংসারের ওপর দিয়ে, একটু একটু করে অচল হয়ে পড়ল বাবা, সংসার পৃথক হল, শুভাশিসদা সব সময়ে পাশে পাশে থেকেছে তাদের। দাদাকে মদ ছাড়ানোর জন্য শুভাশিসদা কম উঠে পড়ে লেগেছিল! পারেনি, সে অন্য কথা। সে তো বউদি নিজে স্ত্রী হয়েও পারেনি। তারাই বা ভাই হয়ে কী করতে পেরেছে? যে রুনা বিশ্রী ইঙ্গিত করছে, তাকেও বিপদের সময় দেখেছে শুভাশিসদা। অ্যাটম হওয়ার সময়ে রুনার শরীরে কিছু মেয়েলি জটিলতা দেখা দিয়েছিল, এমন একটা অবস্থা হয়েছিল যখন মা বাঁচবে, না বাচ্চা বাঁচবে, সেই চিন্তায় সুদীপের পাগল হওয়ার জোগাড়, শুভাশিসদা নিজে থেকেই তিন-চারজন বড় গাইনির সঙ্গে পরামর্শ করে, মেডিকেল বোর্ড বসিয়ে, কীভাবে রক্ষা করেছিল দুজনকেই!

রুনা সব ভুলে যায়! কিছু মনে রাখে না রুনা। তার রাগ বড় চণ্ডাল!

সুদীপ বিষণ্ণভাবে বলল, তোমার মনটা বড় ছোট হয়ে যাচ্ছে রুনা।

 রুনা এতটুকু দমল না। উল্টে বলল, আমার মন তো ছোটই। যারা ছোট কাজ করে তারাই সব মহৎ মানুষ।

–শুভাশিসদা আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড।

–ফ্রেন্ডটেন্ড দেখিয়ো না। কে কী করে বেড়ায় সব জানা আছে।

সুদীপ দপ করে জ্বলে উঠল, একদম নোংরা কথা বলবে না। দশ বছর তো আছ সংসারে, কোনওদিন নিজের চোখে কোনও বেচালপনা দেখেছ দুজনের?

–তুমি বলতে চাও রোজ দুপুরবেলা দিদি বেরোয় সবই প্রেসের কাজে?

–নয়তো কি? অর্ডার, পেমেন্ট কালেকশান, দপ্তরিপাড়া, সবই তো বউদি একা সামলায়।

–তোমাদের বোঝায়, তোমরাও তুষ্ট থাক। রুনা গলায় বিষ আনল, এবং উগরে দিল, কোথায় কোন হোটেলে দুজনে ফুর্তি করে বেড়ায়, কে আর তার খোঁজ রাখে?

–চোপ। আচমকাই জান্তব গর্জন ঠিকরে এসেছে সুদীপের গলা থেকে, বউদির নামে তুমি একটাও নোংরা কথা বলবে না।

রুনা ভয় পেল না, –ওই সব মেজাজ অন্য জায়গায় ফলিয়ো। খুব তো গেছিলে আজ ল্যাঙ ল্যাঙ করে বউদির কাছে, ঝাড় খেয়ে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এলে কেন?

জোঁকের মুখে নুন পড়ল যেন, মিইয়ে গেল সুদীপ। দাদা যখন নিও বিল্ডার্সের নাম তুলে খিস্তিখাস্তা করছিল, বউদি তখন বিচিত্র চোখে দেখছিল তাকে। সে চোখে রাগ নেই, বিরক্তি নেই, ঘৃণা নেই, শুধু অবিশ্বাস আর সন্দেহ। সুদীপ বেশিক্ষণ ওই দৃষ্টি সহ্য করতে পারেনি। মিনমিন করে বলেছিল, –আমি কথাটা তোমাকে বলতাম বউদি। আসলে ব্যাপারটা ঠিক মেটিরিয়ালাইজ করছিল না….

ইন্দ্রাণী ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল, –এখনই বা বলছ কেন? আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছি? তোমাদের বাড়ি, ভাঙবে না রাখবে, সে তোমরা বোঝো। আমি তো বাইরের লোক।

সুদীপ করুণ মুখে বলেছিল, তা হলে অন্তত দাদাকে থামাও।

ইন্দ্রাণী বলেছিল, আমার ভারী দায় পড়েছে। তোমাদের ভায়ে ভায়ে খেয়োখেয়ি, এর মধ্যে আমি কেন নাক গলাব?

সুদীপের মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল, রাতদুপুরে এই হল্লা আর ভাল লাগে না বউদি।

–ভাল না লাগলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আমাদের রাস্তায় বার করে দাও।

রাত গভীর। রাস্তায় জনমনিষ্যি নেই। লাইটপোস্টের আলোর ফাঁকে ফাঁকে নির্জন অন্ধকারকে বড় বেশি নীলচে লাগে এখন। গাঢ় কালশিটের মতো। দিনভর ধকলের পর কালশিটে গায়ে নিয়ে ঝিমোচ্ছে রাস্তাটা।

সুদীপ ঘরে ফিরল।

 ঘরের এক দিকে অর্ধেক দেওয়াল জুড়ে টানা কাঠের ক্যাবিনেট। রুনা পছন্দ করে বানিয়েছে। অজস্র খোপে পুতুল, ফুলদানি, খেলনাপাতি, ছোট ছোট মূর্তি। ডান দিক বাঁ দিকে পর পর কটা ড্রয়ার। ওপরের ড্রয়ারটা খুলে ছোট্ট একটা হুইস্কির বোতল বার করল সুদীপ। আধ বোতলটাক আছে। ছিপি খুলে একটু খেয়ে রেখে দিল বোতল। জল ছাড়া খাওয়ার অভ্যেস নেই, গলাটা জ্বলে গেল। মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে এল নিশ্বাস।

শোওয়ার ঘরে রুনা শাড়ি ব্লাউজ ছেড়ে নাইটি পরছে। নাইটির বোতাম লাগাতে লাগাতে ড্রেসিংটেবিলের সামনে এল। বিদেশি নাইট ক্রিমের শিশি খুলে এক দলা ক্রিম লাগাল মুখে। বেঁটে টুলে বসল, কী করছ ও ঘরে? শুতে এসো। কাল সকালে অফিস আছে।

অন্য ঘরের বাহারি বেতের সোফায় হেলান দিয়েছে সুদীপ। বলল, – যাই।

বউদির কথা খুব গায়ে লেগেছে?

সুদীপ উত্তর দিল না। একটা কুশান কোলে নিয়ে সিগারেট ধরাল।

বউদির জন্য যদি এতই দরদ, প্রোমোটারের কথাটা বউদির কাছে গোপন করেছিলে কেন?

তরল আগুন অল্প অল্প ক্রিয়া শুরু করেছে মাথায়। কোণঠাসা বেড়ালের মতো ফ্যাঁস করে উঠল সুদীপ, –বেশ করেছি বলিনি। আমার ইচ্ছে।

-ইচ্ছে না হাতি! আসল কথা বলো, ভয় পেয়েছিলে।

কীসের ভয়?

–সে আমি কী করে বলব? কেন যে তোমরা দিদিকে এত ভয় পাও, তা তোমরা বাড়ির পুরুষরাই জানো। তোমার বাবা, অত যার হম্বিতম্বি, তাঁর চোখের সামনে রোজ বউমা ঘরে পরপুরুষ ঢুকিয়ে ফস্টিনস্টি করছে। একদিন নয়, বছরের পর বছর। তিনি ইন্দ্রদেবের লীলাখেলা ভেবে মোহিত হয়ে দেখছেন। আর তোমার হাড়েবজ্জাত ফিলমস্টার ভাইটি তো মহারানির হাতের পুতুল। যেমন নাচায়, তেমনি নাচে। আর তোমার দাদা ভেড়ারও অধম। মদ গিলে দেবদাস সেজে বসে আছেন।

কুশানটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে শোওয়ার ঘরে এসে দাঁড়াল সুদীপ, –আর কেন? এবার ক্ষান্তি দাও।

-কেন ক্ষান্তি দেব? তোমার দাদার মুখ আছে, আমার নেই?

দাদাকে যা খুশি বলো, বউদিকে নিয়ে পড়ছ কেন? তা ছাড়া দাদা তো তোমাকে কিছু বলেনি! যা খিস্তিখাস্তা করেছে, ভাইদের করেছে। তোমার অত গায়ে লাগছে কেন? দাদার এরকম চেল্লামিল্লি তুমি প্রথম দেখছ? কুশলী খেলোয়াড়দের মতো ডজ করে প্রসঙ্গটা কাটাতে চাইল সুদীপ।

কাটল, কিন্তু তেজ নিবল না রুনার, এই না হলে ভাই! থাকো সারাজীবন দাদাবউদির পাপোশ হয়ে। মাঝে মাঝে গায়ে জুতোর ধুলো ঝেড়ে যাবে, চেটে চেটে চরণামৃত ভেবে খেয়ো।

 নাহ্, রুনা আজ থামবে না। এবার ক্রমে অদম্য হয়ে উঠবে রুনা। সম্ভাব্য অসম্ভাব্য যা খুশি বলে যাবে, তূণ থেকে বাছা বাছা তীর নিক্ষেপ করে যাবে অবিরাম। ইতরের বংশ! অশিক্ষিতের ঝাড়! আনকালচারডের গুষ্টি! বনেদিআনার ঘোমটা টেনে খ্যামটা নাচছ! সাহেবদের চামচাগিরি করে কবে দাদু একটা বাড়ি বানিয়েছিল, তাই নিয়ে বারফাট্টাই! এখন জোর করে থামাতে গেলে আরও হিস্টিরিক হয়ে উঠবে রুনা। দুমদাম জিনিসপত্র ছুঁড়বে, ভাঙবে, আদরের ছেলেকেই হয়তো ঘুম থেকে ঠেলে তুলে ঠাস ঠাস চড় কষাবে মাঝরাতে। একবার নৈশযুদ্ধের সময়ে বারান্দা থেকে ঝাঁপ মারতে গিয়েছিল রুনা, কীভাবে যে সুদীপ আটকেছিল সেবার! রুনাকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনে শুইয়ে দিয়েছিল পাশের ঘরের ডিভানে, নিজের ভারী শরীরটা চেপে রেখে ছিল রুনার ওপর। তাকে আঁচড়ে কামড়ে ফালা ফালা করেছিল রুনা। তবে নরমও হয়েছিল। সব রাগ সাঙ্গ হয়েছিল এক মনোরম রতিক্রিয়ায়। সে যে কতদিন আগে!

আজ ওসবে এতটুকু উৎসাহ পাচ্ছে না সুদীপ। দরজা খুলে বাথরুমে গেল। বউদির ঘরে আলো জ্বলছে, দাদার ঘর অন্ধকার। বউদির ঘরের বাতি আজ নিববে না।

কেন যে বউদির ওপর রুনার এত রাগ তা সুদীপ বোঝে। যার বর সংসারে সব থেকে বেশি রোজগার করে, যে বউয়ের বাপের বাড়ি যথেষ্ট অর্থবান, তারই তো বাড়িতে বেশি দাপট থাকা উচিত। অথচ রুনা কোনওদিন সেভাবে নিজের দাপট প্রতিষ্ঠাই করতে পারল না। যখন হাঁড়ি এক ছিল তখনও না, এখনও না। এখনও রুনা যতই করে মরুক, একদম কিছু করে না যে তাও নয়, যথেষ্ট খেয়াল রাখে বৃদ্ধ শ্বশুরের, কিন্তু রুনার শ্বশুর আগে নাম করবেন বড় বউয়ের। বিয়ের পর চাঁদুকেও খুব বন্ধু করার চেষ্টা করেছিল রুনা। কারণে অকারণে হাতে টাকা গুঁজে দিত, একসঙ্গে সিনেমা থিয়েটার যেত দুজনে, হাই তুলতে তুলতে সারা রাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান শুনত চাঁদুর পাশে বসে। আজ এই শার্ট আনছে, কাল প্যান্ট পিস আনছে, কী না দিয়েছে। তবু চাঁদুর বন্ধুত্ব কিনতে পারল না রুনা। ভাগাভাগির সময়ে চাঁদু সুড়ৎ করে বড় বউদির ক্যাম্পে চলে গেল।

রুনা তো হীনম্মন্যতায় ভুগবেই!

থাক, এখন কিছুক্ষণ একা থাক রুনা, মাথাটা ঠাণ্ডা হবে। সুদীপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা ছাদে উঠে এল।

সকালের বৃষ্টিতে ভিজে আছে ছাদ। শ্যাওলা হয়ে কিছুটা পিছলও। পা টিপে টিপে মাঝখানটায় এল সুদীপ, ভেজা সিমেন্টের ধাপিতে বসল।

বুকের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছিল সুদীপের। কেন যে সে বাড়ি ভাঙার কথাটা বউদির সঙ্গে আলোচনা করেনি, তা কেউ জানে না। রুনাও না। জানলে আরও অনর্থ করত রুনা। নিও বিল্ডার্স ফ্ল্যাটবাড়ি তুলে তাদের প্রত্যেককে ফ্ল্যাট আর টাকা দেবে ঠিকই, কিন্তু বউদির প্রেসটা যে ভাঙা পড়বে তার জন্যে কিচ্ছুটি দিতে রাজি নয়। নতুন কোনও জায়গা তো নয়ই, ক্ষতিপূরণও না। এই অপ্রিয় কথাটা বউদিকে সুদীপ বলত কেমন করে? আর আজ যা অবস্থা দাঁড়াল, এর পর কি বললেও বিশ্বাস করবে বউদি?

শ্রাবণের রাত ভরে আছে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘে। চাঁদ নেই, তবু এক আলগা আলো ছড়িয়ে আছে আকাশে। একটা দুটো তারা দেখা যায়, কি যায় না। বাতাস নেই।

সহসা ছাদের প্রান্তে সুদীপের চোখ আটকে গেছে। ছায়ার মতো কে দাঁড়িয়ে ওখানে? তিতির না?

সুদীপ ডাকল, –এই তিতির, কী করছিস ওখানে?

 আলসেতে ঝুঁকে থাকা তিতির ফিরল পিছনে, কিছু না।

সুদীপ হালকা হওয়ার চেষ্টা করল, –ঘুমোসনি যে এখনও?

তিতির উত্তর দিল না। পায়ে পায়ে এসে পাশে বসেছে। মুখ নিচু করে চোখের জল মুছল।

 তিতিরের মাথায় হাত রাখল সুদীপ, কী হল রে তোর? কাঁদছিস কেন?

তিতিরের কান্নার দমক বেড়ে গেল। ফুলে ফুলে উঠছে শরীর, হেঁচকি উঠছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতেই বলল, আমরা কি আর কিছুতেই একসঙ্গে থাকতে পারব না বড়কাকা?

সুদীপের বুকে সাইক্লোন বয়ে গেল। ভিজে এল গলা, –এখনই কি আমরা একসঙ্গে আছি রে তিতির?

.

১৮.

সারা রাত ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখে আদিত্য। ঘুম এলেই অদৃশ্য কেউ যেন তার অবচেতনার ভিডিও অন করে দিয়ে চলে যায়, আদিত্য একের পর এক চলচ্ছবি দেখে যেতে থাকে। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে মনুমেন্টের মাথায় উঠেছে আদিত্য, ইন্দ্রাণী তার হাত চেপে রয়েছে সজোরে, মুখে নববধুর লাজ! মাঝগঙ্গায় ডুবে যাচ্ছে ইন্দ্রাণী, ঝাঁপিয়ে পড়ে আদিত্য টেনে তুলছে তাকে! একটা প্রকাণ্ড গাছের ডালে বাঁধা দোলনায় দোল খাচ্ছে দুজনে, মাথার ওপর গাছের পাতারা যেন হরেক কিসিমের নোট! আদিত্য পাতা ছিঁড়ে ছুঁড়ে দেয় ইন্দ্রাণীর দিকে! আরও কত কী যে দেখে! কোনওদিন এসব কিছু ঘটেনি, তবু দেখে। ভোরের দিকে ঘুমটা গাঢ় হয়, সকালে উঠে স্বপ্নরা বেবাক ফর্সা।

ঘুম ভাঙার পর বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় স্বপ্নগুলোকে খোঁজে আদিত্য। মনে পড়েও মনে পড়তে চায় না। লুকিয়ে থাকে মাতৃগর্ভের স্মৃতির মতো। তাদেরই খুঁটে খুঁটে জড়ো করে শুরু হয় দিন।

আজ সে সব কিছুই হল না। ঘুম ভাঙতেই আদিত্য টের পেল মাথা অসম্ভব ভারী হয়ে আছে। চোখের পাতায় যেন দু-মনি পাথর চাপানো, খুলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এরকম লাগছে কেন শরীরটা?

দরজায় তিতির। তার গম্ভীর স্বরে আদিত্য চমকে উঠল।

–তোমার চা নিয়ে আসব?

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেছে। কাল রাতে সে বেহুঁশ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল, তারই রেশ এখনও ঝনঝন করছে মাথায়। উত্তরের জানলা দিয়ে মলিন সূর্যরশ্মি এসেছে ঘরে, আলো খুব বেশি নয়, তবে তার রাতের ক্রিয়াকলাপের নমুনা দেখার জন্য যথেষ্ট। বাপ্পার শূন্য বিছানায় পড়ে আছে তার শার্ট। কোমরের বেল্ট আয়নার সামনে মেঝেতে গড়াচ্ছে। মাথার বালিশ পায়ের দিকে। ট্রাউজার কাদায় মাখামাখি। গা খালি। মাঝরাতে একবার বোধ হয় কারেন্ট গিয়েছিল, তখনই বুঝি গরমে খুলে ফেলেছে গেঞ্জি। মশারির তিনটে খুঁট লাগানো আছে ছত্রিতে, চতুর্থটি ঝুলছে, দুলছে ফ্যানের হাওয়ায়। কাল রাতে কি নিজের হাতে মশারি টাঙিয়েছে সে? তিতির টাঙালে তো এমন হওয়ার কথা নয়!

আদিত্য মশারির ভেতরে বসেই চোখ পিটপিট করল। জড়ানো গলায় বলল, কটা বাজে রে?

–তা জেনে তোমার কী হবে? চা খেলে বলো, এনে দিচ্ছি।

–তুই কেন? সন্ধ্যার মা আসেনি?

–চা দেওয়া ছাড়াও তার অন্য কাজ আছে। কবার করে ঘুরে যাবে?

বাব্বাহ্, তুই দেখি খুব রেগে আছিস!

 তিতির উত্তর দিল না। তার দু চোখ সহসা জলে ভরে গেছে। ক্ষণিকের জন্য সজল চোখে তীব্র দৃষ্টি হেনে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল মেয়ে।

আদিত্যর বেশ অপরাধী লাগছিল নিজেকে। কেন যে কাল শঙ্করের সঙ্গে বসতে গেল? বসলই যদি, এতটুকু সংযম রাখতে পারল না? হাসপাতালে মেয়ের এত অনুনয়, মেয়েকে ছুঁয়ে হাজারবার প্রতিজ্ঞা, সব অবলীলায় উপেক্ষা করল? সে এতই নরাধম!

বাথরুমে গিয়ে আদিত্য চেপে চেপে দাঁত ব্রাশ করল, কুলকুচি করল অনেকক্ষণ ধরে। যেন মুখ ধুয়ে ধুয়ে গত রাতের গ্লানি মুছে যাবে। বারবার জলের ঝাপটা দিল চোখে, আঁজলায় জল নিয়ে ঘাড়ে গলায় ছিটোল। যেন জল ছিটোলেই মিলিয়ে যাবে দুষ্কর্মের রেশ।

ভোরের দিকে মনে হয় জোর বৃষ্টি হয়েছিল, একটা শিরশিরে ভাব রয়েছে বাতাসে। আদিত্য বাথরুম থেকে বেরিয়ে প্যাসেজে দাঁড়াল কয়েক সেকেন্ড। সুদীপ-রুনারা বেরিয়ে গেছে। বেলা বেশ বেড়েছে বোঝা যায়।

ঘরে ফিরে অন্যমনস্কভাবে বাপ্পার খাটে বসল আদিত্য। ঝুম হয়ে। অন্যমনস্কভাবেই শার্টের পকেট থেকে একটা দুমড়োনো সিগারেট বার করল। ধরাতে যাচ্ছে, তার আগেই তিতির চা এনেছে। হাতে দুখানা বিস্কুট।

খালি পেটে চা খেয়ো না। পেটে ব্যথা উঠবে।

 আদিত্য খপ করে মেয়ের হাত চেপে ধরল, আমায় মাপ করে দে তিতির।

–তোমার বলতে লজ্জা করছে না বাবা?

আদিত্য করুণ চোখে তাকাল, –মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে রে।

হওয়ারই তো কথা।

–ওফ, ঘাড় নাড়াতে পারছি না। কেউ যেন ডাঙশ মারছে মাথায়।

–নেশার ডাঙশ। অবিকল ইন্দ্রাণীর গলায় কথা বলছে তিতির, মদ পেটে পড়লে তুমি আর মানুষ থাক না বাবা।

আদিত্য ভয়ে ভয়ে চায়ে চুমুক দিল, কাল খুব উল্টোপাল্টা কাণ্ড করেছি, না?

–জানো না তুমি কী করেছ?

কী করেছি?

–তোমার মনে নেই?

আদিত্য দু-এক পল চুপ করে রইল, –বিশ্বাস কর, ঠিক মনে পড়ছে না। শংকর ট্যাক্সি করে নামিয়ে দিয়ে গেল…তারপর..তারপর…

-তুমি কাল পিসেমশাইয়ের সঙ্গে ছিলে?

শংকরের নামটা বলে ফেলে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়েছে আদিত্য। চঞ্চল স্বরে বলল, বল না কী করেছি?

কী করোনি তাই বলো। বড়কাকাকে চোরজোচ্চোর বলেছ, ছোটকাকে তো মারতেই যাচ্ছিলে। আর যা যা বলেছ তা আমি মুখেও উচ্চারণ করতে পারব না।

মুহূর্তে রাতটা জ্যান্ত হয়ে গেল। সব স্পষ্ট। সব স্পষ্ট। বিকট পশুর মতো দাপাদাপি করছে আদিত্য। ইন্দ্রাণী আটকাতে এল, তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। দীপুদের দরজায় দুমদুম লাথি মারছে। তিতির সিঁটিয়ে আছে প্যাসেজে। মিনতি সিঁড়িতে মুখে আঁচল চেপে দাঁড়িয়ে। কে যেন চিৎকার করে কাঁদছিল? অ্যাটম কি?

ছি ছি ছি।

আদিত্যর হঠাৎ কী হয়ে গেল। তিতিরের হাত টেনে নিয়ে সেই হাতে ঠাসঠাস চড় কষাতে লাগল নিজের গালে, আমি একটা নরকের পোকা। আমি জানোয়ার। আমি কুলাঙ্গার।

তিতির মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল, পরক্ষণে জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে, কী করছ কি? তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?

— আমি পাগলই হয়ে গেছি। আমার মরে যাওয়াই উচিত। তুই আমাকে শাস্তি দে। মার আমাকে। মার মার, মেরে ফেল।

তিতিরের চোখ বেদনায় ভরে গেছে। একটু সময় নিল, শান্ত হতে দিল বাবাকে। কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, কেন তুমি আবার ওসব খেলে বাবা?

ক্ষণিক উত্তেজনার পর আদিত্য ঝিমিয়ে গেছে। বসে আছে নতমুখে। শ্রান্ত স্বরে বলল, আমি তো খাইনি রে। খেয়েছে সেই ভূতটা।

–ভূত!

আরও শ্রান্তি নেমেছে আদিত্যর গলায়, –তোকে বলেছিলাম না, আমার ভেতরে একটা ভূত আছে। সে যখন ভর করে আমার কিচ্ছুটি জ্ঞান থাকে না। সে যাই বলে, আমাকে তাই শুনতে হয়।

–সে কি শুধু তোমাকে আজেবাজে জিনিস খেতে বলে?

–তা কেন? আরও কত কথা বলে। তোদের কথাও বলে। বলে, তোর আমাকে নিয়ে খুব দুঃখ। বলে, আমার ওপর বাপ্পার খুব রাগ। আমার জন্য তোর মা যে একটুও সুখ পেল না, তাও বলে।

–হুঁহ। তুমি কত ভাব!

–আমি ভাবি না রে। আদিত্য মলিন হাসছে, ভূতটা ভাবে।

–ছাই ভাবে! ভূতটা কি জানে কাল সারা রাত্তির জেগে ছিল মা? জানে মার নিশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল?

আদিত্য ফস করে বলে ফেলল, সে কি আমার জন্য? তোর দাদার জন্য। তোর দাদা কাল চলে গেল।

–তুমি বড় নিষ্ঠুর বাবা।

আদিত্যর বুক টনটন করে উঠল। সে যে নিষ্ঠুর এ আর এমনকী নতুন কথা! তার চারপাশের মানুষজনকে কোনওদিন সে এতটুকু স্বস্তি দিতে পারেনি। তবু মেয়ের মুখে কথাটা শুনতে কেমন যেন লাগে আদিত্যর, শেলের মতো বিঁধে থাকে বুকে। মেয়ে কি জানে এই নিষ্ঠুরতা দুর্বলতারই নামান্তর।

নাহ, আর নয়। বদলাতেই হবে নিজেকে। আজ থেকেই।

জীবনে লক্ষবার উচ্চারিত শপথ আরেকবার মনে মনে আউড়ে লণ্ডভণ্ড জামা গায়ে চড়াল আদিত্য।

তিতির হাঁহাঁ করে উঠেছে, কোথায় যাচ্ছ তুমি?

–একটু রাস্তায় ঘুরে আসি। নইলে মাথাটা ছাড়বে না।

সন্ধ্যার মা জলখাবার করছে, খেয়ে বেরোও। কাল রাতে তো খাওয়া হয়নি।

–এখন ইচ্ছে করছে না রে। রান্না সেরে রাখতে বল, একটু পরে এসে ভাতটাত খেয়ে একেবারে বেরিয়ে যাব।

আবার কোথায় বেরোবে?

কাজ আছে।

–ওই লোকটার সঙ্গে?

–তুই যে আমার মার মতো জেরা শুরু করলি রে।

রঘুবীর লোকটা ভাল নয় বাবা।

–কেন ভাল নয়? লোকটা আমাদের কি ক্ষতি করেছে? আমার জন্য উদয়াস্ত ছুটে মরছে… আদিত্য গলার আওয়াজ ভারিক্কি করল, তুই ওর সম্পর্কে কোনও রিমার্ক করবি না। আমার খারাপ লাগে।

মুহূর্তে তিতিরের মুখ কালো, ঠিক আছে, যেখানে খুশি যাও। তবে বলে রাখছি সূর্য ডোবার আগে বাড়ি ফিরবে।

–আচ্ছা বাবা আচ্ছা। মেয়ের গালে আলগা টোকা মারল আদিত্য, –তোর স্কুল শুরু হচ্ছে কবে?

সামনের সোমবার থেকে। কেন?

–তোর পাহারাদারির হাত থেকে বাঁচা যাবে।

—পাহারাদারির দেখেছ কী? কালকের প্যান্ট জামা বদলাও। ওই পরে তুমি রাস্তায় যাচ্ছ!

 নীচে কন্দর্প নেই। জয়মোহন কাগজে নিমগ্ন। জামাকাপড় বদলে টুক করে বেরিয়ে পড়ল আদিত্য।

দিনটা কেমন মরা মরা। মেঘের বেড়াজাল এড়িয়ে আলো ঠিক পৌঁছতে পারছে না পৃথিবীতে। উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায় খানিকটা পায়চারি করে প্রেসের দরজায় এল আদিত্য। প্রেস নিয়ে তার আদৌ মাথাব্যথা নেই, প্রেসের ভবিষ্যৎ সে জানে, তবে দুর্লভকে তার বেশ পছন্দ। দুর্লভের সঙ্গে সময় অসময়ে কথা বলে মনটা অনেক হালকা করা যায়। আদিত্যর সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল আছে দুর্লভের।

কথায় কথায় রোড কন্ট্রাকটারির প্ল্যানের কথাটা বলল আদিত্য।

শুনেই দুর্লভ মহা খুশি, এবার আপনি ঠিক পারবেন দাদা।

বলছেন?

বলছি। আপনার মতো মানুষের কিছুতে একটা থিতু হওয়া দরকার।

–কিন্তু অত দূরে কাজ ….

কী এমন দূর দাদা? হাওড়া থেকে বাসে চাপলে দেড়-দু ঘণ্টার রাস্তা।

–দেড়-দু ঘণ্টা কি কম হল? তার ওপর চেনা জায়গা নয়, মানুষজন কেমন জানি না…

–আপনি ভাল তো দুনিয়া ভাল। আর উদয়নারায়ণপুর জায়গা তো কিছু খারাপ নয়, আমি জানি।

–আপনি উদয়নারায়ণপুর চেনেন?

–আমার মেজ মেয়ের বাড়ি তো আমতায়, ওখানে থেকে উদয়নারায়ণপুর আর কতটাই বা। গেছি এক-আধবার। বেশ বর্ধিষ্ণু জায়গা, চাষবাস ভাল হয়। যেখানে চাষবাস ভাল হয়, সেখানকার লোকজন বড় একটা মারকুটে বজ্জাত হয় না।

কাজেকর্মে অসুবিধে হবে না বলছেন?

–অসুবিধে কিসের দাদা? আপনি লোক খাটাবেন, তাদের ন্যায্য পাওয়া দেবেন, হুড়হুড় করে কাজ উঠে যাবে। দুর্লভ ঠোঁট টিপে হাসল, তবে হ্যাঁ, আপনাকে খাটতে হবে।

খাটতে আমি পারি দুর্লভবাবু, যদি টাকাপয়সা আসে। এই প্রেসের ব্যবসায়… চিটিংবাজে দেশ ভরে গেছে… আপনার বউদি জেদ করে লড়ে যাচ্ছে….

দুর্লভ তর্ক করল না। অমলিন মুখে বলল, আপনার যাতে মন লাগে দাদা, সেটাই করুন। কিন্তু করুন। ছাড়বেন না। লেগে থাকলে দুনিয়ায় কি না হয়! আর রাস্তা সারাই শুনি তো বেশ লাভের কাজ। কাজের মধ্যে থাকলে শরীর মন ভাল থাকবে আপনার।

আদিত্য নতুন করে মনে জোর পাচ্ছিল। শংকরের ওই সব মাথা-খারাপ করা ধান্দা থেকে সরে আসাই ভাল। ভাইদের সঙ্গে অনর্থক বিবাদ বাধিয়ে কী লাভ! তার থেকে বরং সে হবে এক কাজের মানুষ। আজ থেকেই।

ইন্দ্রাণী ফেরার আগেই স্নান-খাওয়া সেরে আদিত্য বেরিয়ে পড়ল। রাস্তায় এসে সামান্য ফাঁপরে পড়ল আদিত্য। ঠিক কি কাজ সে করবে আজ? রঘুবীরের আজই উলুবেড়িয়া চলে যাওয়ার কথা, অনেকগুলো দায়িত্ব মাথার ওপর চাপিয়ে দিয়ে গেছে রঘুবীর, সেগুলোই কি সারবে একে একে? ইনকাম ট্যাক্স অফিসে যাবে? কপোরেশান থেকে ট্রেড লাইসেন্স বার করা বেশ কঠোর পরিশ্রমের কাজ, সেটা করলে কেমন হয়? নাকি পার্টনারশিপের কাগজ তৈরি করতে কোর্টে ছুটবে? যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারটি নতুন অংশীদার হতে চলেছে, তার নাম, ঠিকানা, অফিসের হদিশ সবই রঘুবীর দিয়ে গেছে, তার সঙ্গে একবার আলাপ করে এলেও মন্দ হয় না। নতুন সঙ্গীর সঙ্গে চেনাজানা হওয়াটাও তো কাজের অঙ্গ, নয় কি?

খানিক ভেবে কোর্টের কাজটাই আদিত্যের বেশি মনে ধরল। তার স্কুলের বন্ধু অপুর্ব শেয়ালদা কোর্টের উকিল, এখনও ন মাসে ছ মাসে এক-আধদিন তার সঙ্গে দেখা হয়, বহুবার সে বলেছে, কাজ থাকলে চলে আসিস। করে দেব।

ভাবা মাত্রই আদিত্য স্টেশনে এসেছে। রেল লাইনের ধার ঘেঁষে, প্ল্যাটফর্মের গায়ে বিশাল বিশাল হরফে স্লোগান, কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। বহুদিন আগে লেখা, ধুলোকাদায়, রোদে জলে ঝড়ে বিবর্ণ হয়ে এসেছে লেখাটা, অথচ আদিত্যর আগে তেমন করে নজরে পড়েনি। আজই বা কেন পড়ল?

আজই আদিত্যর বাকি জীবনের প্রথম দিন, সেই জন্যই কি?

টগবগ করতে করতে স্টেশন চত্বরে হাঁটছে আদিত্য, ট্রেন আসছে না। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছটফট করছে আদিত্য, ট্রেন আসছে না। স্টেশনের পাথরের বেঞ্চিতে বসে ঘনঘন ঘড়ি দেখছে আদিত্য, ট্রেন আসছে না। চোখের পাতা ভাতঘুমে ভারী হয়ে এল আদিত্যর, ট্রেন আসছে না।

শুধু ট্রেন না আসার জন্যই যে কত উদ্যমী পুরুষের উদ্যম মরে যায়!

আদিত্যর ভাগ্য সুপ্রসন্ন, ট্রেন এল। কুমিরের মতো নিঃসাড়ে ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে। সর্বাঙ্গে ঝুলছে, কাতারে কাতারে লোক।

এই ট্রেনে উঠতে পারবে আদিত্য?

পারল। কীভাবে পারল জানে না। শুধু শেয়ালদায় পৌঁছে দেখল তার জামার দুটো বোতাম নেই, ঘড়ির ব্যান্ড খুলে ঝুলছে, মুখ চোখ চুলের দশা কহতব্য নয়। কনুইয়ের খোঁচা খোঁচায় বুঝি ফাটল ধরে গেছে পাঁজরে। বিজবিজে ঘামের কটু গন্ধে গুলিয়ে উঠছে শরীর।

এবং আরও আশ্চর্য সে মরেনি!

বেঁচে থাকা আদিত্য কোর্টে এল। সে আজ কাজের মানুষ।

কত বাধা! তবু কত বাধা! অপূর্ব তার ঘরে নেই, আছে তিন নম্বর কোর্টে। আধঘণ্টাটাক অপেক্ষা করে তিন নম্বর ঘরে গেল আদিত্য। মোটামুটি ভিড় ঘর, কোনও মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। মিনমিন করে প্রশ্ন করছে এক উকিল, ফিসফিস করে ঝিমোতে ঝিমোতে উত্তর দিচ্ছে এক সাক্ষী। তাদের রহস্যালাপ কান খাড়া করে শুনছেন গোমড়ামুখো ম্যাজিস্ট্রেট। কয়েকটা উকিলও, অপূর্ব সমেত।

আদিত্য সামনে গিয়ে যথাসম্ভব নিম্ন স্বরে ডাকল, – এই অপু।

পঁয়তাল্লিশে মাথা ভর্তি টাক অপূর্ব ভুরু কুঁচকে ঘাড় ঘোরাল। আদিত্যকে দেখে রাগবি বলের মতো মুখটিতে হাসি ফুটেছে, –তুই?

–তোর সঙ্গে একটা কাজ ছিল। অফিসিয়াল।

পেছনে বোস। এই মামলাটার পরে আমার কেস। সেরে নিয়ে কথা বলছি।

কতক্ষণ লাগবে। আমি কিন্তু অনেকক্ষণ এসেছি।

চালশে চশমা ঠিক করতে করতে সওয়াল জবাবে কান পাতল অপূর্ব, আহ বোস না। এক্ষুনি হয়ে যাবে।

একদম পিছনের বেঞ্চিতে বসল আদিত্য। লম্বা টানা ঘরে মাথায় ওপর বেশ কয়েকটা ঘুরন্ত ফ্যান। মেঘলা আবহাওয়ায় ভারী মিঠে লাগছে হাওয়াটা। আদিত্য আরামে চোখ বুজল। দু-এক মিনিটের মধ্যেই সাক্ষীর ঝিমোনো ভাবটা সুখের মতো চারিয়ে গেল মাথায়। লোকজনের গুঞ্জন অচিরেই ঝিঁঝি পোকার ডাক। দুলে দুলে স্বপ্ন এসে গেল চোখে। ……. দুধারে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সরু লম্বা রাস্তা। রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে রোডরোলার। ঢর ঢর ঢর। রোডরোলারে ব্লু জিনস আর লাল টিশার্ট পরে বসে আছে আদিত্য, মাথায় বেতের টুপি, চোখে সানগ্লাস। যত দূর চোখ যায় রাস্তা জুড়ে কাজ করে চলেছে শ্রমিকের দল, ঝুড়ি করে স্টোনচিপস ফেলছে পথে, তরল পিচের ঝারি বোলাচ্ছে পাথরকুচিতে। রোডরোলার চালাচ্ছে রঘুবীর। তার গলায় অসংখ্য পাথরে গাঁথা এক ইয়া লম্বা মালা, কপালে কাঁপালিকের সিঁদুর। রোদ পড়ে পাথরের মালা থেকে আলো ঠিকরোচ্ছে। হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে রঘুবীর, শীতে গড়ব, বর্ষায় ভাঙবে, হাহ হাহ হা। পাঁচ মাইলে কেটে যাবে জীবন, হাহ হাহ হা।……

পাশ থেকে কে যেন খোঁচাল আদিত্যকে, এই মশাই, ঘুমোচ্ছেন কেন?

আদিত্য মাথা ঝাঁকিয়ে সোজা হল। একটা অসুখী চেহারার রোগা পুলিশ রুলের হালকা গোঁত্তা মারছে পিঠে। চোখ রগড়ে হাসল আদিত্য, — ঘুমোইনি তো!

–নাকে ক্ল্যারিওনেট বাজছে, আবার বলে ঘুমোইনি! দেখুন, ম্যাজিস্ট্রেট আপনাকে দেখছেন। নাক ডেকে জেলে যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে?

আদিত্য উঠে পড়ল। পৃথিবীতে কোত্থাও শান্তি নেই! সর্বত্র পাহারাদার ঘাপটি মেরে আছে!

কাঁচাঘুম ভেঙে মাথা বিনবিন করছে, এক কাপ কষটে চা খেয়েও বিনবিনে ভাবটা যাচ্ছিল না আদিত্যর। ধ্যাৎতেরি, এর থেকে দুপুরে একটু গড়িয়ে নিয়ে বেরোলেই ভাল হত।

হন্তদন্ত হয়ে কোর্টরুম থেকে বেরিয়েছে অপূর্ব–কী বলছিলি বল।

আদিত্য হাই তুলে বলল, একটা পার্টনারশিপ ডিড তৈরি করে দিতে হবে।

 –কটা পার্টি?

–মানে?

–মানে কজনের মধ্যে পার্টনারশিপ?

–তিনজন। আদিত্য একটা সিগারেট ধরাল।

দূর থেকে এক তালঢ্যাঙা লোক ডাকছে অপূর্বকে। টুক করে আদিত্যর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে নিল অপূর্ব, — এই ফাইলগুলো নিয়ে আমার ঘরে যা। আমি আসছি।

দু-চার পা গিয়েও অপূর্ব ফিরে এসেছে, দু-এক সেকেন্ড জরিপ করল আদিত্যকে, — নাহ, ফাইলগুলো দে। তুই ঘরে গিয়ে বোস। চলে যাস না যেন।

উকিলদের ঘরে যথারীতি চিটচিটে ভিড়। তার মধ্যে এক কালো কোট চামচ করে মুড়ি খাচ্ছে। একজনকে ঘিরে মৌমাছির মতো চার-পাঁচটি মক্কেল, মূকাভিনয়ের ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে সকলে। কেউ ঘরে ঢুকেই বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ বেরিয়ে গিয়েই ঘরে ঢুকছে। একজন দেশলাই কাঠিতে ডিমসেদ্ধ গেঁথে গোটাটাই এক সঙ্গে মুখে পুরে দিল। আস্তে আস্তে নামছে ডিমটা। গাল থেকে কণ্ঠনালী, ক্রমশ মিলিয়ে গেল।

আদিত্য গোটা সাতেক জাম্বো সাইজের হাই তুলে ফেলল। পঁচিশ মিনিট কেটে গেছে, এখনও অপূর্বর দেখা নেই। এভাবে কী কিছু হয়! বসে বসে কেটে গেল দিনটা!

অষ্টম হাইয়ের তুড়িটা বাজাচ্ছিল আদিত্য, অপূর্ব এসে পাশে বসল, শেয়ার কি ইকুয়াল?

–মানে?

–মানে তোদের তিন পার্টনারের কি ইকুয়াল শেয়ার?

না না, দুজন ইকুয়াল। একজনের কম আছে।

–নাম ঠিকানা সব নিয়ে এসেছিস?

–এই তো, ডায়েরিতে আছে।

–ডাটাগুলো লিখে দিয়ে যা। সামনের রোববার বাড়িতে আয়। রাত নটার পর।

কী লিখে দেব?

–সব লেখ। কোম্পানির নাম লেখ, কার কত শেয়ার লেখ। পার্টনারদের বাবার নামও দিস।

–কিসের কোম্পানি জিজ্ঞেস করলি না? আদিত্য রাগবি বলের মতো মুখটার দিকে উৎসাহিত হয়ে তাকাল।

এবার অপূর্ব হাই তুলছে, কী হবে জেনে? বাঙালিদের পার্টনারশিপ টেকে না। ডিডগুলো ছাগলে খায়। আমি মাল পাব, কাজ করে দেব, আমার কি! বলেই টেরচাভাবে আদিত্যর দিকে তাকাল। ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে, তুই লেখ আমি একটু পাঁচ নম্বরের পেশকারের সঙ্গে কথা বলে আসছি।

আদিত্য ডায়েরি খুলে নাম-ঠিকানা লিখছে। লিখে বসে আছে। পাঁচ মিনিট। দশ মিনিট। কুড়ি মিনিট। আদিত্য বসেই আছে।

.

সন্ধের আগেই আদিত্য ফিরল।

 ইন্দ্রাণী একাই ছিল। ঘরে। আঁচলে চোখ ঢেকে চুপচাপ শুয়েছিল সে।

অন্ধকার নামছে সবে, আদিত্য ঘরে ঢুকে আলো জ্বালল, অসময়ে শুয়ে আছ যে? মাথা ধরেছে?

ভুরু কুঁচকে একঝলক আদিত্যকে দেখে নিয়েই পিছন ফিরে শুয়েছে ইন্দ্রাণী। পায়ের দিকের কাপড় অনেকটা উঠে গিয়েছিল, পা দিয়েই টেনে নামিয়ে দিল, আলোটা নিবিয়ে দাও।

আদিত্য তাড়াতাড়ি আলো নিবিয়ে দিল। একবার আলো জ্বলে নেবার পর ঘরের অন্ধকার যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে। মশার তাড়নায় বিকেলের আগেই সমস্ত জানলা বন্ধ করে দেয় ইন্দ্রাণী, আজ করেনি। জানলার গায়ে যেটুকু আলো লেপটে আছে, তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল আদিত্য। আবার ফিরল অন্ধকারে। বার দু-তিন পায়চারি করে খাটের এক কোণে বসেছে। সসংকোচে। যেন কাকপক্ষী শুনতে না পায় এমন স্বরে বলল, – ঝোঁকের মাথায় কাল একটা ভুল করে ফেলেছি। আর হবে না।

ইন্দ্রাণী কি শুনতে পেল? আদিত্য বুঝতে পারল না। আরেকটু গলা ওঠাল, আমি চাঁদু দীপুর কাছে মাপ চেয়ে নেব।

ইন্দ্রাণী নিঃসাড়। বাঁকাচোরা কোলবালিশটা হয়ে শুয়েই আছে।

আদিত্যও আর কথা খুঁজে পাচ্ছে না। খানিকক্ষণ হাতড়ে হাতড়ে অন্ধকার থেকে একটা কথা বার করল। জুতসই হবে ভেবে বলেও ফেলল, বাপ্পা এতক্ষণে পৌঁছে গেছে। অবশ্য ট্রেন যদি না লেট থাকে।… আজকাল ট্রেনের যা অবস্থা!… আজ শেয়ালদা যেতে গিয়েই আমার জামার দুটো বোতাম ছিঁড়ে গেল।

ইন্দ্রাণী চুপ।

আদিত্য এবার কথা বানাল, বিজনেসের পেপারস তৈরি করতে এক উকিলবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম, সে বলছিল, বম্বে যাওয়ার পথে আজকাল নাকি খুব ঠগজোচ্চোর উঠছে। ভুশাওয়াল থেকে। সেই যে গো যেখানে ভাল কলা হয়। তাস খেলার নাম করে ঢোকে, তাসের জুয়ায় সর্বস্ব হাতিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায়। ওর এক বন্ধু নাকি বম্বেতে আন্ডারপ্যান্ট পরে নেমেছিল। বাপ্পা তাস খেলা জানে না তো?

এতক্ষণে একটা হিমশীতল কণ্ঠ শোনা গেল, কানের কাছে আজেবাজে বকে যাচ্ছ কেন? আজ তোমার কোথাও আসর নেই?

আদিত্য ভয় তাড়াতে জোর করে হেসে উঠল, কাল একটা হয়ে গিয়েছিল বলে…. নেহাত একজন খুব ধরল……

জানি। জয়ি দুপুরে এসেছিল। সব বলে গেছে।

এই না হলে মায়ের পেটের বোন! একটা দিন তর সইল না, সব কথা এসে উগরে গেলি! শংকরকে যে ইন্দ্রাণী তেমন পছন্দ করে না, আদিত্য জানে। তার সঙ্গে বসে মদ খেয়েছে, তারই বুদ্ধিতে ভাইদের এসে তড়পেছে, এ কথা যখন জেনেই গেছে ইন্দ্রাণী, তখন আর কি করা! কাঁচুমাচু মুখে শাস্তির অপেক্ষায় বসে রইল আদিত্য।

ইন্দ্রাণী হঠাৎ উঠে বসল, আলোটা জ্বালো তো।

প্রায় দৌড়ে গিয়ে আলো জ্বেলেছে আদিত্য। ইন্দ্রাণী শান্তভাবে বলল, শোনো, একটা কথা তোমাকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি। ওসব মতলব তুমি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।

–আমি তো ঝেড়ে ফেলেছি। আদিত্য পলকে সুবোধ বালক, তোমাকে সেই কথাই তো বলতে চাইছি, তুমিই শুনছ না।

ঝেড়ে ফেলার ওই নমুনা!

আদিত্য ঘাড় চুলকোল, কাল শংকর এমন লাখ লাখ টাকার হিসেব দেখাল। আমারও মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। তাই না…..

–তার জন্য যা মুখ পোড়ানোর সে তো পুড়িয়েইছ। মাথাতে আর ওসব প্যাঁচ ঢুকিও না।

বলছি তো ঢোকাব না।

–হ্যাঁ। কথাটা মনে রেখো। ইন্দ্রাণী ঠাণ্ডা স্বরে বলল, বাবা আজ জয়ির ওপর খুব চেঁচামেচি করেছেন।

–জয়ি কী বলেছিল বাবাকে?

–আমাকে পুরো ভেঙে বলেনি। তোমরা, ভাইবোনেরা কেউ কি আমাকে পুরো কথা বলো? দরকারের সময়ে বউদি, অদরকারে আমি অন্য বাড়ির লোক। তবে শুনে মনে হল তোমার আর শংকরের প্ল্যানটার কথাই কায়দা করে পাড়তে গিয়েছিল। খুব ধমক খেয়েছে। ওপরে এসে মুখ চুন করে বসেছিল।

–ঠিক হয়েছে। কেন বাড়ি ভাঙা হবে। আমিও মোটেই বাড়ি ভাঙার পক্ষে নই। বিশ্বাস না হয় চাঁদুকে ডেকে জিজ্ঞেস করো। আমি কাল সকালেই চাঁদুকে মুখের ওপর কথাটা বলে দিয়েছিলাম।

বলেছিলে, অথচ এক বেলাও নিজের মতিতে স্থির থাকতে পারলে না।

–এবার পারব। নতুন ব্যবসাটা শুরু হতে দাও..

ইন্দ্রাণী মুখ টিপে হাসল, এবার কত টাকা জলে ফেলবে?

বলছি তো এবার টাকা লাগবে না। আদিত্য সামান্য লজ্জা পেয়েছে যেন, ঠিকাদাররা কাজ তুলবে, টাকাও তারাই লাগাবে। তা ছাড়া জলে ফেলার মতো টাকাই বা কোথায় এখন?

বলা যায় না, হয়তো আবার শুভাশিসের কাছে চেয়ে বসবে। ইন্দ্রাণী যেন কোনও শিশুকে সাবধান করছে, এমন ভঙ্গিতে বলল, – শুভাশিসের কাছে কিন্তু একদম চাইবে না বলে দিলাম। ওর আগের টাকাই এখনও শোধ করে উঠতে পারিনি। এখনও তিন-চার হাজার বাকি।

–অত হিসেব করে কড়ায়গণ্ডায় শোধ করারই বা কী আছে? ডাক্তার কি তোমার কাছে টাকা চেয়েছে কখনও? তুমিই তো জোর করে…..

–এমন ছেলেমানুষের মতো কথা বলো। যতই সে সংসারের ঘনিষ্ঠ হোক, সে বাইরের লোক। তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি, শোধ করতে হবে না? আমার কি এটুকু আত্মসম্মানও থাকতে দেবে না তুমি?

কোমল স্বরে কথাগুলো বলছে ইন্দ্রাণী, আদিত্য শুনছিল না। স্থির চোখে স্ত্রীকে দেখছিল। কেন যে হঠাৎ উথালপাতাল ঢেউ উঠছে বুকে।

ইন্দ্রাণীর চোখ জানলার বাইরে। আপন মনে বলল, –কারুর কাছে ঋণী থাকতে আমার ভাল লাগে না। কারুর কাছে না।

ইন্দ্রাণীর ঘাড় একটু ডান দিকে হেলে আছে, ঈষৎ ফাঁক হয়ে গেছে দুই ঠোঁট, চোখের পাতা কাঁপছে তিরতির। কী অপরূপ যে এই ভঙ্গিমা! শুভদৃষ্টির সময়েও ওইরকমই হেলানো ছিল ঘাড়টা, চোখের পাতা ওইরকমই কাঁপছিল তিরতির। তারপর কত দিন, কত মাস, কত বছর কেটে গেল, কই এখনও তো দৃশ্যটা এতটুকু আবছা হল না!

ইন্দ্রাণী অস্বস্তিভরা চোখে তাকাল, কী দেখছ?

আদিত্য ভেতর থেকে হাহা করে কেঁপে উঠল। ওরে বউ, তোকে দেখে দেখে যে তৃষ্ণা মেটে না আদিত্যর, এ কথা কি বুঝিস তুই?

আচম্বিতে আদিত্যর ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না কৈশিকা সব এক যোগে ঝটাপটি শুরু করেছে। বুকের ঢেউয়ে দুলছে এক ডিঙি নৌকো। আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে। কতকাল বউটা আর কাছে আসে না। বিয়ের পর যাও বা কিছুদিন ইন্দ্রাণীকে পেয়েছিল আদিত্য, সেও তো বরফের সঙ্গে সহবাস। নিজে থেকে কি ইন্দ্রাণী এসেছে কোনওদিন?

এসেছিল। একবার। একবারই। টানা তিন-চার রাত আদিত্যকে লতার মতো আঁকড়ে ধরেছিল ইন্দ্রাণী। তারপরেই না তিতির এল! তারপর একবারও তো আর……! কেন রে বউ, আদিত্যর কি কাম বাসনা ক্ষিধে কোনও কিছুই থাকতে নেই!

সম্মোহিত পতঙ্গের মতো হঠাই ইন্দ্রাণীর হাত চেপে ধরল আদিত্য। ইন্দ্রাণী সঙ্গে সঙ্গে হাত ছাড়িয়ে নিল না। যেন স্পর্শটাকে ঠিকঠাক বুঝে নিতে চাইছে। যেন শুষে নিতে চাইছে আদিত্যর উত্তাপ। শুধু হাতের ছোঁয়াতেই রক্তকণিকারা মাতাল ঘোড়সওয়ারের মতো ছুটছে আদিত্যর। নাচছে। হাসছে। টগবগ করে ফুটছে।

ইন্দ্রাণী ধীরে ধীরে হাতটাকে ছাড়িয়ে নিল। খানিকটা কেজো স্বরে বলল, -নীচে যাই। সন্ধ্যার মা তাড়াতাড়ি চলে গেছে, রাতের রুটি করতে হবে।

আদিত্য নিষ্পন্দ। যাস না রে বউ।

খাট থেকে নেমে ইন্দ্রাণী দরজায় এসে দাঁড়াল, চা খাবে?

আদিত্য উত্তর দিল না। ফ্যাকাসে হাসল। ওরে তিতির, দেখে যা কে বেশি নিষ্ঠুর!

.

১৯.

তিতির ঘুমোচ্ছিল।

স্কুলে বেরোনোর আগে তিতিরকে জাগিয়ে দিল ইন্দ্রাণী, –এই তিতির, ওঠ। উঠে পড়।

একবার চোখ খুলল তিতির। উম উম শব্দ করে আরও কুঁকড়ে শুল, –এখন কেন? আগে সন্ধ্যার মা চা দিক।

–আজ নয় একটু তাড়াতাড়ি উঠলি। আজ না তোর ক্লাস শুরু!

কথাটা কানে যেতেই তিতির তড়াক করে উঠে বসেছে। সত্যিই তো! আজই তার নতুন স্কুলে প্রথম দিন। আজ কি তার বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো সাজে!

আকাশ একেবারে মেঘমুক্ত। অনেক দিন পর ভারি সুন্দর একটা সকাল ফুটে আছে বাইরে। গাঢ় হলুদ রঙা রোদ্দুর আলোয় আলোময় করে রেখেছে সকালটাকে। ভ্যাপসা ভাব কেটে মিষ্টি বাতাস বইছে।

তিতির নতুন স্কুলে যাবে বলেই কি আজ এত আয়োজন?

তক্ষুনি আর একটা কথা মনে পড়ে গেল তিতিরের। নতুন স্কুলে টোটোও পড়ে। সেই নার্সারি থেকে। টোটোর সঙ্গে দেখা হবে আজ।

কতকাল যে টোটোর সঙ্গে দেখা হয়নি। খুব ছোটবেলায়, ছ-সাত বছর বয়স পর্যন্ত টোটোর সঙ্গে বেশ ভাবই ছিল। মাঝে মাঝেই মা বাবার সঙ্গে ভাইবোনে যেত ডাক্তার আঙ্কলের বাড়ি। টোটোর জন্মদিনে তো বটেই। তারিখটা ভারি মজার। ফার্স্ট এপ্রিল। গিয়েই তিতির চেঁচাত, এপ্রিল ফুল! এপ্রিল ফুল! খুব ঘটা হত টোটোর জন্মদিনে। এ তো আর তিতিরদের বাড়ির মতো নয় যে শুধু জুন মাসের আট তারিখে মেয়ের জন্য একটু পায়েস করে রাখল মা, আর ছোটকা বড় জোর রাত্রিবেলা বাইরে থেকে খাবার কিনে আনল! অনেক লোকজন আসত টোটোদের বাড়ি। খুব হইহুল্লোড় হত। একবার একটা ম্যাজিক শোও করিয়েছিল ছন্দা আন্টি। দাদার সঙ্গে টোটোর খুব বনত না, টোটোর নতুন খেলনায় দাদা হাত ছোঁওয়ালেই টোটো গলা ফাটিয়ে চেঁচাত। বাপস, কী জোর ছিল টোটোর গলায়! সেই টোটোই কিন্তু তিতিরকে খুশি মনে দিয়ে দিত সব কিছু। নিজের প্রিয় টয়গানটা পর্যন্ত অবলীলায় দিয়ে দিয়েছিল, নে তোকে একেবারে দিয়ে দিলাম।

কবে থেকে যে ডাক্তার আঙ্কলের বাড়ি যাওয়াটা একেবারে বন্ধ হয়ে গেল! বোধহয় সেই ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময়। সেও টোটোরই জন্মদিনে। কী যে হল সেদিন! ছবির মতো সুন্দর ফ্ল্যাট বেলুন আর রঙিন কাগজে সাজানো, সব্বার হাতে চপ কাটলেট কেক মিষ্টি ঘুরছে, তিতিররা টোটোর নতুন বাইসাইকেল নিয়ে দারুণ উত্তেজিত, হঠাৎ থমথমে মুখে মা এসে হাত চেপে ধরল দুই ভাইবোনের। অনেক হয়েছে। এবার বাড়ি চলো। পিছন থেকে ডাক্তার আঙ্কল ডাকছে। ইন্দ্রাণী যেয়ো না। একটু বোসো। আমার কথা শোনো। মা শুনেও শুনল না। উল্টে ধমকে বাবাকেও বার করে নিয়ে এল বাড়ি থেকে।

সেই শেষ। ডাক্তার আঙ্কলের আসাটা কমল না, কিন্তু তাদের যাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। তিতিরের এখনও মনে আছে, পরদিনই ডাক্তার আঙ্কলের সঙ্গে খুব কথা কাটাকাটি হয়েছিল মার। অনেক কষ্টে বাবা থামিয়েছিল মাকে। ছন্দা আন্টির সঙ্গে কি মার ঝগড়া হয়েছিল সেদিন! কে জানে! ছন্দা আন্টি তো তার পরেও ফোন করে, এবং তিতিরদের সঙ্গে তো বেশ ভালভাবেই কথা বলে। এই সেদিনও, যেদিন বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হল, ডাক্তার আঙ্কলকে ফোন করেছিল তিতির, ছন্দা আন্টির গলা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিল।

সে যাই হোক, মার মারপ্যাঁচ নিয়ে মা থাক, তিতির কিন্তু চিরকালই খোঁজ রেখে গেছে টোটোর। ডাক্তার আঙ্কলকে সব সময়ে টোটোর কথা জিজ্ঞাসা করে সে। ফোনে কথা হলে ছন্দা আন্টিকেও। টোটোর সঙ্গেও যে টেলিফোনে কথা হয় না এমন নয়, বছর কয়েক আগেও মাঝে মাঝেই হত। ইদানীং ফোনে টোটোকে কেমন গম্ভীর গম্ভীর লাগে। কি, কেমন আছ, ধরো বাবাকে দিচ্ছি, ব্যস।

টোটো কি অনেক বড় হয়ে গেছে? সেই পুচকে টোটো! তিতির নিজের মনে ফিক করে হেসে ফেলল। সে তো হয়েছেই। গত পুজোর আগের পুজোয় ডাক্তার আঙ্কলরা রাজস্থান বেড়াতে গেল, ফিরে এসে ছবি দেখিয়েছিল অনেক। উটের পিঠে রাজপুত বীরের মতো বসে আছে টোটো। সানগ্লাস পরে অনিল কাপুরের পোজে টোটো দাঁড়িয়ে আছে, শুধু বুরুশ গোঁফটাই নেই! হিহি। দাঁত মাজতে মাজতে বাথরুমের আয়নার তিতিরকে ধমকাল তিতির। হুবহু মার ভঙ্গিতে। হেসো না তিতির, তুমিও আর কচি খুকিটি নেই। তুমিও মেঘে মেঘে সিক্সটিন প্লাস। এই বয়সে তোমার ঠাকুমার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল সে খবর রাখো?

ইন্দ্রাণী নীচ থেকে ডাকছে তিতিরকে।

তিতির ব্রাশ মুখে সিঁড়িতে এল, কী?

ইন্দ্রাণী কর্তৃত্বের সুরে বলল, –শোনো, প্রথমদিন যদি একা অত দূরে যেতে অস্বস্তি হয়, বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যেয়ো।

তিতির আলগা ঘাড় নেড়ে সরে যাচ্ছিল, ইন্দ্রাণী আবার ডাকল, হুটোপাটি কোরো না, পুরো কথা শোনো। বইয়ের যদি কোনও লিস্ট দেয় ভাল করে লিখে আনবে। আর বিকেলে বাড়ি থেকো। আমার স্কুলের একজন আসতে পারেন। তোমার শেফালি মাসি। বসিও। আমি মানিকতলা থেকে সন্ধের আগেই ফিরব।

মা বেরিয়ে যাওয়ার পরও তিতির দাঁড়িয়েই রইল। মনে মনে ভ্রুকুটি হেনে চলল মাকে। উঁহ, একা স্কুলে যাবে না! এতদিন তো একা একাই গেছে, কে রোজ রোজ হাত ধরে পৌঁছে দিয়ে এসেছে তিতিরকে! বড় জোর ছোটকা স্কুটারে দু-চার দিন। তাও মেজাজ-মর্জি ভাল থাকলে। স্কুলটা অবশ্য কাছেই ছিল, দিব্যি হেঁটে হেঁটে রাস্তা দেখতে দেখতে চলে যাওয়া যেত। তা এই স্কুলই বা কি এমন দূর, বাসে চড়ে বেশি হলে দশ মিনিট! তিতির কি একা একা বাসে উঠতে ভয় পায়। ঝুলন যদি মার কথা শোনে তো খেপিয়েই মেরে ফেলবে তিতিরকে।

ঝুলনের কথা মনে পড়তেই তিতিরের মনটা অল্প ভারী হয়ে গেল। অনিতা ঋতশ্রী বিদীপ্তা মউ, স্কুলের বন্ধুরা আর কেউই তেমন সঙ্গে রইল না। শুধু ঝুলন আর হিয়া ছাড়া। তাও হিয়া চলে গেল সায়েন্সে, তিনি হবেন ডাক্তার! ঝুলন আর্টস নিয়ে সঙ্গে আছে এটুকুই যা সান্ত্বনা। দেবস্মিতারও খুব ইচ্ছে ছিল তিতিরদের সঙ্গে ভর্তি হওয়ার। ফর্ম ফিল আপ করল, ফার্স্ট লিস্টে নামও বেরিয়েছিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ওর পাকা দিদিটা বোনের ইচ্ছেয় পেরেক গেঁথে দিল। উনি মেয়েদের যে নামী কলেজটিতে পড়েছেন সেখানেই ঢুকতে হবে বোনকে। হুকুম। দেবস্মিতা বন্ধু হিসেবে একটু স্বার্থপর, তবু সঙ্গে থাকলে তিতিরের ভালই লাগত। হিয়া তিতির ঝুলন দেবস্মিতা চারজনে একটা টিম তৈরি হয়েছিল, ভেঙে গেল। কী আর করা, হয়তো বা এখন থেকেই জীবনে বিচ্ছেদের পালা শুরু!

কষ্টের মধ্যেও একটা চাপা গুরগুর ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল তিতির। বুকের ভেতরে।

উত্তেজনাটা বুকে নিয়েই সময় কেটে গেল তিতিরের। উত্তেজনাটাই ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিল টকটক।

সন্ধ্যার মাকে তাগাদা দিয়ে ভাতের থালায় বসে গেছে তিতির। পৌনে নটায়। খেতে খেতেই টের পেল বড়কাকা অফিস বেরোচ্ছে। অ্যাটমকে নিয়ে কাকিমাও। সে রাত্রের পর থেকে বড়কাকা ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে। কাকিমাও যেচে তেমন কথা বলছে না। তিতির খুব আশা করেছিল আজ অন্তত কাকা-কাকিমা তিতিরকে কিছু বলবে। নতুন স্কুলে যাওয়া নিয়ে। বলল না। শুধু অ্যাটম হেসে জিভ ভেঙিয়ে গেল একবার।

ঘরে এসে তিতির প্রস্তুত হচ্ছিল। প্রথম দিন বইখাতা না নিলেও চলে, তবু দুটো একটা খাতা ঢোকাল কাঁধঝোলা ব্যাগে। ইংরিজি বাংলার টেক্সট বই সদ্য কেনা হয়েছে, কি ভেবে বইগুলো ব্যাগে পুরল। আলমারি খুলে বার করল নতুন ইউনিফর্ম।

ইউনিফর্ম গায়ে চড়াতেই মন আবার কটকট করে উঠেছে। ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় ধূসর পোশাকে এ কোন তিতির? সেই কোন কেজি ওয়ান থেকে পরা চোখ ধাঁধানো নীলসাদা রঙ কেন হঠাৎ ধূসর হয়ে গেল আজ!

এ বাড়িতে এখনও প্রণামের রেওয়াজ আছে। পাশের ঘরে এসে তিতির বাবাকে ঢিপ করে প্রণাম করল একটা।

আদিত্য কাগজ পড়ছিল। চোখ কুঁচকে তাকাল, –এর মধ্যেই তৈরি?

হুঁ। দশটায় ক্লাস…প্রথম দিন…একটু আগেই বেরোই।

–আমি যাব সঙ্গে?

কী হবে? এই তো গিয়ে বাসে উঠব, আর নামব।

–ভেবে দ্যাখ। আমার কোনও অসুবিধে নেই…তোর মাও কিন্তু আমাকে বলে গেছে….

–কিচ্ছু লাগবে না বাবা। কারুর বাড়ি থেকে ইলেভেনের মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যায় না। বাপ্পা বম্বে থেকে ফেরেনি। তার শূন্য খাটটার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসল তিতির। থাকলে দাদাও আজ একটা প্রণাম পেয়ে যেত।

কন্দর্প নেই। আদিত্যর তাণ্ডবলীলার পর দিনই আউটডোর শুটিং-এর নাম করে কেটে পড়েছে, চার দিন হয়ে গেল এখনও তার ফেরার চিহ্ন নেই। ছোটকার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দাদুর ঘরে এল তিতির।

বাঁধানো দাঁতে খড়মড় টোস্ট চিবোচ্ছেন জয়মোহন। ঢোঁক গিলে বললেন, স্কুল পাশ করে গেলি, এখনও ইউনিফর্ম ঘুচল না?

–এটাও তো স্কুল। তিতির হাসল।

–এত বড় মেয়েদের এসব স্কার্ট-টাট পরানোর মানে হয়? ঠ্যাং বেরিয়ে থাকে।

চোখ নামিয়ে পায়ের দিকটা দেখল তিতির, –কেন, এ তো বেশ ভালই আছে।

–কিছু ভাল নেই। এই বয়সে শাড়ি পরা উচিত। যা। যাওয়ার আগে মিনতিকে চা দিতে বলে যা তো।

মিনতিকে বলে বেরিয়ে এল তিতির। গেট খুলে তরতর পায়ে হাঁটতে যাচ্ছিল, পোস্তদানা মনটা পিনপিন করে উঠল, –খুব যে ফুর্তি! অত ফুর্তি থাকবে না।

তিতির বলল, –কেন থাকবে না? নতুন স্কুল, নতুন ক্লাস…

–স্কুলটাই তোমার ভাল লাগবে না।

–বললেই হল! কত নামী স্কুল জানো? কত কষ্ট করে ভর্তি হতে হয়, কী বিশাল বিল্ডিং, প্রতি বছর দু-তিনজন স্ট্যান্ড করে ওই স্কুল থেকে।

করুক গে। তবু তোমার ভাল লাগবে না।

লাগবে। তুমি চুপ করো।

 স্কুলের সামনে এসে তিতির খানিকটা দিশেহারা হয়ে গেল। ওরে ব্বাস, এ তো স্কুল নয়, মহাসমুদ্র! কাতারে কাতারে ছেলেমেয়ে গেট দিয়ে ঢুকছে তো ঢুকছেই। ভিড়ের চোটে রাস্তাঘাটের গাড়িঘোড়া বন্ধ হওয়ার জোগাড়। তিতিরের চোখের সামনেই দৈত্যের মতো দুখানা স্কুলবাস এসে আরও ছেলেমেয়ে উগরে দিল। বড় স্কুল তো জানতই, কিন্তু কত হাজার ছেলেমেয়ে পড়ে এখানে? তাদের স্কুলটাও এমন কিছু ছোট ছিল না, নার্সারি থেকে ক্লাস টেন মিলিয়ে হাজার খানেক মেয়ে তো পড়েই, তবে এই মহাসমুদ্রের তুলনায় সেটা যেন বড় জোর একটা দিঘি।

সত্যিই দুটো স্কুল কোনও দিক দিয়েই এতটুকু মেলে না। তিতিরদের স্কুলের কম্পাউন্ডটা ছিল বিশাল। পাঁচিল ঘেরা। গায়ে গায়ে ইউ শেপে সাজানো তিনটে দোতলা বাড়ি। মাঝখানে ফুটবল গ্রাউন্ড সাইজের এক মাঠ। সারা বছর সেই মাঠের রঙ ঘন সবুজ। তিন বিল্ডিং-এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক্লাসরুম, মেয়েদের হোস্টেল, টিচার্স রুম। এক পাশে ধ্যানগম্ভীর চ্যাপেল। তাদের রেক্টর সিস্টার ভেরোনিকা মানুষটি গম্ভীর, কিন্তু ভারি শান্ত। রুচিটিও তাঁর ভারি মনোরম। শীতকালে তিন বিল্ডিং-এর সামনেটা জুড়ে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, জিনিয়ার প্লাবন বয়ে যায়। সিস্টার ভেরোনিকা নিজে তদারক করে মালিকে দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ঘাস ঘাঁটিয়ে মখমল করে রাখেন মাঠটাকে। আহা, কী অনির্বচনীয় লক্ষ্মীশ্রী ওই স্কুলটার! এই স্কুলের সব কিছুই কেমন অন্যরকম। স্কুল বাড়িটা প্রকাণ্ড, কিন্তু কেমন যেন বড্ড বেশি উঁচু, বড্ড বেশি খাড়া। বাড়িটা ঝকঝকে তকতকে, কিন্তু কেমন যেন বড় বেশি সাহেবি কোম্পানির অফিস অফিস ভাব। আর সবুজ এত কম। মাঠ নেই, লন নেই, তার বদলে একটা চাতাল। চাতালটা বড়সড়, কিন্তু সিমেন্টের। সেখানে সবুজের চিহ্নমাত্র নেই। গাছগাছালি যেটুকুনি আছে তা হল কিছু ছড়ানো ছিটোনো ফুলের টব।

ক্লাস খুঁজতেও তিতিরকে বেশ বেগ পেতে হল। এখানে এক একটা ক্লাসে অজস্র সেকশান, গুনতে গেলে ইংরিজি বর্ণমালা প্রায় শেষ হয়ে যায়। লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কোন তলায় যাবে, কোন ঘরে ঢুকবে ভাবছে তিতির, হঠাৎ ঝুলন এসে হাত ধরে টানল, চল চল, আমরা সেকেন্ড ফ্লোর।

–তুই ক্লাস দেখে এসেছিস? তিতির বেশ নার্ভাস বোধ করছিল।

–হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। আমি তোর মতো কেবলু নাকি?

ক্লাসে ঢুকে ঘাবড়ানো ভাব আরও বেড়ে গেল তিতিরের। ক্লাসের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই পরস্পরের চেনা, এই স্কুলেরই ছাত্রছাত্রী সব, বাকি মাত্র পনেরো জন এসেছে অন্যান্য স্কুল থেকে। যারা এ স্কুলের, তারা স্বচ্ছন্দে গল্পগুজব করছে নিজেদের মধ্যে, সে তুলনায় তিতিররা যেন একঘরে। তাছাড়া ছেলেদের সঙ্গেও আগে তো কখনও পড়েনি তিতির! এতগুলো ছেলে থাকবে ক্লাসে। এদের মধ্যে কয়েকজনের অবশ্য বেশ নিরীহ সুবোধ চেহারা, দেখে ভাই ভাই মনে হয়। কয়েকজন রীতিমতো পরিণতদর্শন। ভাল মতো গোঁফদাড়ি গজিয়ে গেছে। গলার স্বরও হেঁড়ে হেঁড়ে। এদের সামনে স্যার বা আন্টিরা যদি কোনও প্রশ্ন করে, আর তিতির উত্তর দিতে না পারে, তবে তো তিতির লজ্জাতেই মরে যাবে।

তা সেরকম কিছু হল না। ক্লাসই হল না ভাল করে। ম্যানেজিং কমিটির কে একজন মারা গেছে, দু পিরিয়ডের পর ছুটির ঘণ্টা পড়ে গেল।

ঝুলনের বন্ধু তৈরি করতে সময় লাগে না, ক্লাস শেষ হতেই সে ঘুরে ঘুরে আলাপ জমাচ্ছে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। দু-চার মিনিট ঝুলনের পাশে বোকা বোকা মুখে দাঁড়িয়ে রইল তিতির, তারপর সরে এল। ঝড়ের গতিতে নিচে নেমে এসেছে। স্কুলের মেন গেটের সামনে দাঁড়াল একটু। যেমন ঢুকেছিল তেমনই স্রোতের মতো বেরোচ্ছে সকলে। এদের মধ্যে টোটোরও তো থাকা উচিত!

উচ্ছল মেজাজে বেরোচ্ছে ছেলেমেয়েরা। হঠাৎ ছুটির আনন্দে হাসছে, ছুটছে, চিৎকার করে ডাকছে পরস্পরকে। এক দল দৌড়ে স্কুলবাসে উঠে গেল, কেউ কেউ নিজেদের গাড়ির অপেক্ষায়। তিন জন মধ্যবয়সী শিক্ষিকা কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসছেন, তাঁদের দেখে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দাঁড়াল কয়েকটা ছেলেমেয়ে। তিতিরও সরল একটু, কিন্তু গেট থেকে চোখ সরাল না।

এক ঝাঁক নতুন বন্ধু জোগাড় করে বেরিয়ে আসছে ঝুলন। দুটো ষণ্ডা চেহারার ছেলেও আছে তাদের মধ্যে। ঝুলনেরই একা মুখ চলছে, বাকিরা বেশির ভাগই শ্রোতা।

তিতিরের সামনে এসে ঝুলন থামল, –তুই কখন নেমে এলি? আমি তোকে খুঁজছি…

চোখ স্থির রেখে তিতির হাসল, এই তো।

কী করবি এখন?

বাড়ি যাব।

 কী হবে বাড়ি গিয়ে? বাড়িতে তো জানেই চারটে অবধি স্কুল।

–তো?

–সিনেমায় চল। নিউ এম্পায়ারে। এদের সঙ্গে দোস্তি হল, সেলিব্রেট করবি না? বলেই ওস্তাদ ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল ঝুলন, –ও, তোর সঙ্গে তো আলাপ হয়নি। অ্যাই, এই হল তিতির। সরি, মঞ্জিমা।  

একটা ছেলে হাত বাড়িয়ে দিল, — আমি সম্রাট।

একজন মাথা দোলাল, — আমি পাঞ্চালী।

একে একে নাম বলে যাচ্ছে সবাই, নামগুলো ঠিক ঠিক মাথায় ঢুকছিল না তিতিরের। বুকের কাঁপুনিটা যায়নি তখনও। তিনটে ছেলে হাত পা নেড়ে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। লম্বা ছেলেটা কি টোটো? উঁহু।

গেটের দিকে চোখ রেখেই তিতির বলল, না রে, আমি আজ বাড়িই যাই। বাড়িতে একজন আসার কথা আছে।

–ও কে। অ্যাজ ইউ প্লিজ। ঝুলন আবার কাঁধ ঝাঁকাল, ডাসটিন হফম্যানের ফিল্ম ছিল, তুইই মিস করলি।

ঝুলনরা চলে গেল।

আনমনে বিল্ডিংটার মাথার দিকে তাকাল তিতির। বড্ড উঁচু! বড্ড খাড়া! এর থেকে তাদের দোতলাবাড়ি স্কুলটাই ভাল ছিল। অনেক কাছের মনে হত স্কুলটাকে। এই অট্টালিকা কি তার আপন হবে কোনওদিন?

চারদিক ক্রমশ ফাঁকা হয়ে এল। চাতাল প্রায় নির্জন। দুটি মেয়ে সিঁড়িতে বসে কথা বলছে শুধু। টিফিনও খাচ্ছে। বাচ্চা মেয়ে, ফাইভ সিক্সে পড়ে বড় জোর। বাড়ির লোকের জন্য অপেক্ষা করছে মনে হয়।

আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াল তিতির। টোটোকে দেখতে পেল না।

পরের দিনও টোটোর দেখা পেল না তিতির। তার পরের দিনও না। গোটা সপ্তাহে একদিনও টোটোকে খুঁজে পেল না তিতির।

এই স্কুলে সায়েন্স সেকশান একেবারে ওপর তলায়। ফিফথ ফ্লোরে। ঝুলনকে নিয়ে সেদিকেও বার দুই-তিন গিয়েছিল তিতির। হিয়াকে ডাকার নাম করে। হিয়াদের ক্লাসে ছেলের সংখ্যা অনেক বেশি, এদের মধ্যে কোনটা যে টোটো! হিয়াকে জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও তিতির জিজ্ঞাসা করতে পারল না। কোথায় যেন বাধছিল। ডাক্তার আঙ্কলও কদিন ধরে আসছে না বাড়িতে, নতুন নার্সিংহোম নিয়ে দারুণ ব্যস্ত, এলে টোটোর সেকশান ফেকশান জেনে নেওয়া যেত।

ইতিমধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল। তিতির আর্টস নিয়ে পড়ছে, তার কম্বিনেশান ইতিহাস দর্শন আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান। সঙ্গে ইংরিজি বাংলা তো আছেই। দ্বিতীয় দিন ইতিহাসের ক্লাসে ঘটে গেল ঘটনাটা। ইতিহাসের শিক্ষিকার চেহারাটি বেশ রাগী রাগী, প্রথম দিন ক্লাসে এসে অন্য স্কুলের ছেলেমেয়েদের জ্ঞানের পরিধি পরখ করে দেখছিলেন তিনি। তিতিরকে প্রশ্ন করলেন, পলাশির যুদ্ধ কবে হয়েছিল। এত সোজা প্রশ্ন, তবু তিতির ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেলল, –এইটিন ফিফটি সেভেন। সঙ্গে সঙ্গে হাসির রোল উঠেছে ক্লাসরুমে। শিক্ষিকা বক্র চোখে দু-এক সেকেন্ড মাপলেন তিতিরকে, তারপর বিদ্রূপের সুরে বললেন, কী করে যে মাধ্যমিক পাস করো তোমরা! তোমাদের স্কুলে কি কিছু শেখায়নি?

ঝুলন দুম করে উঠে দাঁড়াল, ভুল করে বলে ফেলেছে ম্যাডাম। তার জন্য আপনি আমাদের স্কুলকে ইনসাল্ট করছেন কেন?

–অ। তুমিও ওই স্কুলের! শিক্ষিকা চোখ পাকালেন, দল পাকানোর চেষ্টা হচ্ছে? বোসো।

ঝুলন বসতেই শিক্ষিকাটি আরও তিনটি প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিতিরকে, আলেকজান্ডার কোন সালে ভারত আক্রমণ করেছিল? দাস ডাইনেস্টির শেষ সুলতান কে? তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধ ককে হয়েছিল?

কান দিয়ে তখন আগুন বেরোচ্ছে তিতিরের। একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারল না।

ঝুলনকেও দাঁড় করালেন শিক্ষিকাটি। সে অনেক মাথা চুলকে কোনক্রমে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের সালটা বলতে পারল, বাকি দুটো পারল না। নিষ্ঠুর হেসে গোটা পিরিয়ড ঝুলন তিতিরকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন শিক্ষিকা।

ঝুলন বেপরোয়ার মতো দাঁড়িয়ে রইল। তিতিরের মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল। প্রাণপণে প্রার্থনা করছিল এক্ষুনি অলৌকিক কিছু ঘটুক, ক্লাসরুম দ্বিধা হয়ে যাক, অথবা ভূমিকম্পে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ক বিল্ডিংটা।

অলৌকিক কি ঘটে? ক্লাসরুম অক্ষতই রইল। আর ছেলেমেয়েদের জোড়া জোড়া চোখ, অস্ফুট হাসি, পুড়িয়ে দিতে লাগল তিতিরকে। তাদের স্কুলের সিস্টার রেবতীর ক্লাসে একবার একটা বিশ্রী শব্দ করেছিল বিদীপ্তা, সিস্টার শব্দের উৎসটা বুঝতে পারেননি, মেয়েদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন কে ওই শব্দ করল। বিদীপ্তা বিপদে পড়বে এই আশংকায় ক্লাসের একটি মেয়েও বিদীপ্তার নাম করেনি। ক্লাসসুদ্ধ মেয়েকে সিস্টার রেবতী কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন মাঠে। তখন তিতিরদের ক্লাস এইট। যথেষ্ট উঁচু ক্লাস, স্কুলের ছোট ছোট মেয়েরা দেখছে, হাসছে, ভীষণ অপমানিত লেগেছিল তিতিরের। তবু যেন আজকের মতো নয়। এই অপমান কি এ স্কুলে থাকতে আর মুছবে কোনওদিন?

বাকি দিনটা স্কুলে মাথা নিচু করে বসে রইল তিতির। বাড়ি ফিরেই বিছানা নিল।

ইন্দ্রাণী বাড়িতেই ছিল, মেয়েকে দেখে সন্দেহ হল তার। বলল, কি হল, ফিরেই শুয়ে পড়লি যে!

তিতির থমথমে মুখে উত্তর দিল, এমনি।

–শরীর খারাপ?

–না।

মেয়েকে টেনে বসাল ইন্দ্রাণী। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, স্কুলে কিছু হয়েছে?

 দ্রুত দুদিকে ঘাড় নাড়ল তিতির, না তো।

ইন্দ্রাণীর চোখ তীক্ষ্ণতর, –টোটোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

না।

ইন্দ্রাণী যেন ঠিক বিশ্বাস করল না–এক স্কুলে পড়ছিস, অথচ দেখা হয়নি।

বলছি তো হয়নি। তিতির একটু ঝাঁঝিয়েই উঠল, –অত বড় স্কুল, কে কোথায় থাকে দেখা হয়?

ইন্দ্রাণী বিড়বিড় করে বলল, –কেন যে ওসব বড়লোকদের স্কুলে ভর্তি হওয়া! যেমন বাবার শখ, তেমন মেয়ের শখ…

তিতির জোর করে হাসতে লাগল, তুমি যে কি বলো না মা! বলছি স্কুলে কিছু হয়নি।

পরদিন স্কুলে যেতে ইচ্ছে করছিল না তিতিরের, গতকালের স্মৃতিটা সূঁচের মতো ফুটছে শরীরে। তবু তিতির গেল। মা কি ভেবে বসে এই মনে করে।

সেদিন স্কুলের রূপ অনেকটা বদলে গেল। ঝুলন সেদিন আসেনি, একা একা টিফিন খাচ্ছিল তিতির। দোতলার করিডোরে দাঁড়িয়ে। খেতে খেতে দেখছিল আকাশটাকে। দু-একটা খণ্ড মেঘ ধীর গতিতে ভাসছে, মেঘের রঙও পাঁশুটে নয়, ঘন সাদা। বৃষ্টি যেন চলে যাচ্ছে এবারের মতো।

হঠাৎ পিছন থেকে একটা লম্বা হাত নেমে এল তিতিরের টিফিনবক্সে, –একি, বাটার টোস্ট। এ তো চুয়িংগাম হয়ে গেছে রে! বাহ বাহ, একটা ডিমসেদ্ধও আছে দেখছি।

তিতির কিছু বোঝার আগেই টিফিনবাক্স ফাঁকা। ঘুরে অপরাধীকে দেখতে যাচ্ছিল, তার আগেই একটা হালকা চাঁটি পড়ল মাথায়, একা একা টিফিন খাচ্ছিস যে? স্কুলের বন্ধু আসেনি বলে আমাদের পাত্তা দিচ্ছিস না বুঝি?

মিতেশ সম্রাট পাঞ্চালী তৃণা দেবোপম। মিটিমিটি হাসছে পাঁচজন। লজ্জায় নিবে থাকা তিতির হঠাৎ জ্বলে উঠল, মাথায় চাঁটি মারলি কেন?

দেবোপম এখনই ছ ফুট। সুপুরি গাছের মতো শরীরটাকে নুইয়ে তিতিরের কানের কাছে মুখ এনেছে সে, –কেন, তুই বিছানায় হিসি করে ফেলবি নাকি?

পলকের জন্য লাল হয়ে গিয়েছিল তিতির, পরক্ষণেই পেট গুলিয়ে হাসি বেরিয়ে এসেছে। এ ভাবে যারা কথা বলে তাদের সামনে সঙ্কুচিত হয়ে থাকা যায়!

টিফিনের সময়টুকুর মধ্যেই অনেকটা সখ্য জমে গেল। কে কোথায় থাকে, কার কোন ফিল্মস্টারকে পছন্দ, পপ শুনলে কার মাথা ধরে, মাধ্যমিকে কার কত টোটাল ছিল, সবই কমিনিটে জেনে গেল তিতির। দেবোপমের বোন যে এই স্কুলেই ক্লাস নাইনে পড়ছে, সে কথা জানাও বাকি রইল না।

ছুটির পরও চাতালে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ আড্ডা দিল তিতির। সে কথা বলে কম, শোনে বেশি, আড্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতে তাই অসুবিধে হয় না তার। কথা শোনার ফাঁকে ফাঁকে আজও তিতিরের চোখ ঘুরছিল চারদিকে। যদি টোটোকে দেখা যায়!

আচমকা ঘুরন্ত চোখ গেটের দিকে আটকে গেছে। রাস্তার ওপারে, ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ঝুলনের সেই অনুসরণকারী প্রেমিক! আজও মোটরসাইকেলেই অধিষ্ঠান তার! তাকাচ্ছে ইতিউতি! তিতিরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল!

তিতির ছেলেটির দিকে পিছন ফিরে দাঁড়াল। খানিকক্ষণ পর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। মোটরসাইকেল নেই।

বাড়ি ফিরে মোটরসাইকেলটার কথা মনেও রইল না তিতিরের। নতুন বন্ধুদের কথাই ভাবছিল। প্রকাণ্ড চেহারার ছেলে মানেই বাঘ ভাল্লুক নয়, এটা ভেবে মনে মনে স্বস্তি পাচ্ছিল। পারিবারিক অবরোধ কুণ্ঠার ক্লেদ তৈরি করেছিল ভেতরে, সেটাও কেটে যাচ্ছে। ছেলেদের সঙ্গে ঝুলনের সহজ মেলামেশাও আর অস্বাভাবিক লাগছিল না।

বিকেলে বিপুল উৎসাহে জয়মোহনকে স্কুলের গল্প শোনাচ্ছিল তিতির। নাতনির সঙ্গে কথা বলতে জয়মোহন ভালইবাসেন, কিন্তু ইদানীং কী যেন হয়েছে তাঁর। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই ঝিমিয়ে আসতে থাকেন। খাওয়া দাওয়া নিয়ে তখন আর খিটমিট করেন না, বসে থাকেন গুম হয়ে। মিনতি তাঁর রাগ ভাঙাতে পারে না, ডাকতে হয় রুনাকে।

স্কুলে তিতির ধৈর্যশীল শ্রোতা, কিন্তু বাড়িতে সে একাই কথক। একটানা বকবক করতে করতে হঠাৎ থামল সে, –ও দাদু, শুনছ তো?

ঝিমন্ত জয়মোহন নড়ে বসলেন, –হ্যাঁ, শুনছি।

তিতিরের ঠোঁট ফুলে উঠল, কিচ্ছু শোনোনি। কী বললাম বলো তো?

–এই তো কী যেন বলছিলি। সপ্রতিভ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা-পড়া ভঙ্গিতে হাসলেন জয়মোহন, কানটা কেমন ভোঁ ভোঁ করে রে বুড়ি। কিছু ভাল করে শুনতে পাই না।

–আগে তো বলোনি কখনও?

কত আর বলি। শরীরের কলকবজাগুলো তো কম দিন সার্ভিস দিল না! এবার সব বিশ্রাম চাইছে।

দাদুর এ স্বর তিতিরের ভাল লাগে না। বড় নিরাশ, করুণ শোনায় যেন।

ডাক্তার দেখাবে? বড়কাকাকে বলব?

না, কাউকে বলতে হবে না। শোনা, তোর গল্প শোনা।

তারপরও গল্প বলছিল তিতির, কিন্তু তেমন আর উৎসাহ পাচ্ছিল না। রাস্তার বাতি জ্বলতেই দোতলায় চলে এল।

সন্ধে হতেই আদিত্য বাড়ি ফিরেছে। সে এখন বেশ বাধ্য মানুষ, সারাদিন কোথায় যেন ঘুরে ঘুরে ঠিক সন্ধের মুখেই ফিরে আসে।

বাবার সঙ্গেও তিতিরের গল্প ঠিক জমে না। মেয়ের গল্পের থেকেও মেয়ের হাত মুখ নাড়া আদিত্যকে টানে বেশি, মুগ্ধ চোখে মেয়েকেই শুধু দেখে আদিত্য। সেই রাত্রে তার ক্ষণিক বিস্ফোরণ মেয়ে যে ভুলে গেছে, তাতেই সে মহা খুশি। তবু বাবার সঙ্গে বহুক্ষণ কলকল করল তিতির। তার বয়স অন্যমনস্ক শ্রোতার চেয়ে মুগ্ধ শ্রোতাকেই বেশি পছন্দ করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলল সবই। শুধু দুটি কথা বাদ দিয়ে গেল।

ক্লাসে পড়া না পেরে দাঁড়িয়ে থাকার কথা। আর টোটোর সঙ্গে দেখা না হওয়া।

.

সেই রাত্রেই বাপ্পা ফিরল। প্রায় একটা নাগাদ।

বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সদরও আজ বন্ধ হয়েছে অনেক আগে। রাতদুপুরে ট্যাক্সি থেকে নেমে বেশ কিছুটা হাঁকডাক করার পর সাড়া মিলল বাড়ির। তিতিরই পড়িমরি করে নেমে দরজা খুলেছে।

বাপ্পার ট্রেন বিকেল চারটেয় হাওড়ায় পৌঁছনোর কথা, আট ঘণ্টা লেটে এসেছে। রাউরকেল্লার কাছে কোথায় যেন লাইনে ফিশপ্লেট সরানো ছিল, তারই জের। বাপ্পা ভীষণ ক্লান্ত, বম্বেতে কি হল, না হল, তা নিয়ে এখন কথা বলতে সে রাজি নয়, শশব্যস্ত বাবা মা বোনকে উপেক্ষা করে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়।

পরদিন সকাল থেকেই বাপ্পার অন্য মূর্তি। সারা ভারত থেকে নাকি দেড়শোর মতো ছেলেকে ডেকেছিল কোম্পানি, লিখিত পরীক্ষাতেই একশো জন বাতিল। ফিজিক্স অঙ্ক ইংরিজি, তিনটে পরীক্ষাই সে নাকি এত ভাল দিয়েছে, তার খাতায় হাত ছোঁয়াতে পারেনি কেউ। ইন্টারভিউ বোর্ডেও নাকি তাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলেছে নির্বাচকরা। বলে দিয়েছে, এক্ষুনি গিয়ে পাসপোর্ট রেডি করো, যে কোনওদিন ডাক যেতে পারে। আহা, অনীকও যদি চান্স পেত।

হাঁ করে দাদার কথা গিলছে, কিন্তু মনে মনে ছটফট করছিল তিতির। বাপ্পার ভাষণ শেষ হতেই নিজের গল্প বলতে গেল, বাপ্পা পাত্তাই দিল না। তার চোখের সামনে এখন নীল দরিয়া, সে কেন শুনতে যাবে কুয়োর ব্যাঙের কথা!

বোনকে নিষ্প্রভ করে ভারিক্কি চালে বাপ্পা বলল, –এখানকার প্যানপ্যানানি রাখ তো। বম্বেতে সমুদ্রের ধারে যখন মালার মতো আলো জ্বলে, তখন কী সুন্দর যে লাগে! কী বলে জানিস ওটাকে? কুইনস নেকলেস।

বাপ্পার ফেরার খুশিতে ইন্দ্রাণী আজ স্কুলে যায়নি। সেও তিতিরকে আলগা ধমক দিল, –তোর কথা তো রইলই। তা হ্যাঁ রে বাপ্পা, আর কোথায় কোথায় গেলি? এলিফ্যান্টা কেভ দেখেছিস? মালাবার হিল?

বিরস মুখে তিতির দাদার পাশ থেকে উঠে গেল। আর কক্ষনও সে দাদাকে স্কুলের গল্প বলতে যাবে না। কোনও বন্ধুর গল্পও না।

দু-তিন দিন কেটে গেল। আবার ফিরেছে বৃষ্টি। ঝরছে ঝমঝম।

সেদিন ছুটির পর বন্ধুদের সঙ্গে বেরোচ্ছিল তিতির, হিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়েই তিতির চমকে উঠেছে।

হিয়ার সঙ্গে টোটো!

এত দিন পর দেখা। কথা বলতে বাধো বাধো ঠেকছিল তিতিরের। রাজস্থানের ছবির থেকেও টোটো যেন আরও খানিকটা লম্বা হয়েছে, গালও ভেঙেছে। ডাক্তার আঙ্কলের মতোই টকটকে রঙ, পেটানো শরীর। কাঁধটাও কী চওড়া এর মধ্যেই!

সংকোচ ঝেড়ে তিতির বলেই ফেলল, কী হল, চিনতে পারছ না আমাকে?

হিয়ার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিল টোটো, তিতিরকে দেখেই ভুরুতে ভাঁজ, তুমি এখানে ভর্তি হয়েছ?

–ইশ, তুমি যেন জানো না! আঙ্কল বুঝি বলেনি তোমায়!

–না, বলেনি। টোটোর স্বরে প্রাণ নেই।

হিয়া দুজনকে দেখছিল, আর বিস্মিত হচ্ছিল, –তুই রাজর্ষিকে আগে থেকে চিনিস নাকি?

 তিতির মাথা নাড়ল। ধীরে, অতি ধীরে। এই টোটোকে সে কি সত্যিই চেনে!

.

২০.

শিবসুন্দর হাঁটছিলেন। প্রসন্ন ভোরে।

ভোরে উঠে প্রায়ই খানিকটা হাঁটেন শিবসুন্দর। অভ্যাসটি তাঁর দীর্ঘকালের নয়, মাধবপুরে এসেই শুরু। কাক ডাকার সঙ্গে সঙ্গে শিবসুন্দর বিছানা ছাড়েন, নিয়ম মতো যোগব্যায়াম প্রাণায়াম করেন, বৃষ্টিবাদলা না থাকলে পূরক কুম্ভক রেচক সেরে বেরিয়ে পড়েন বাইরে। খালপাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে, ছোট্ট সাঁকোটি পার হয়ে পৌঁছে যান শ্মশানে। নাহ, কোনও শ্মশানবৈরাগ্য জাগেনি তাঁর, তবু যান। অশ্বত্থ গাছের নীচের বাঁধানো চাতালে বসে থাকেন কয়েক দণ্ড। তারপর ফেরা। শুরু হয় তাঁর দিন।

ভাদ্র মাস পড়ে গেছে। আকাশ এখন প্রায় নির্মেঘ। দু-চারটে শিমুল তুলোর স্তূপ ভাসছে বেখেয়ালে। হঠাৎ উপর পানে তাকালে নবীন ভাদ্রেই শরৎকে বড় মায়াবী লাগে। ধরিত্রী এখন স্নান সেরে গা মুছছে, তার স্নিগ্ধ ত্বক জুড়ে ঘন সবুজ আভা। মাধবপুরে তুলি ছুঁইয়ে গেছে প্রকৃতি।

সাঁকোর মাঝখানটিতে এসে দাঁড়ালেন শিবসুন্দর। কাঠের সাঁকো ধনুকের মতো বাঁকা, নীচ দিয়ে চৈত্র বৈশাখের মজা খাল কিশোরী নদী হয়ে পশ্চিমে বয়ে চলেছে। সরু, কিন্তু বেগবতী। শিবসুন্দর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জলের শব্দ শুনলেন কিছুক্ষণ। ঘুমজড়ানো নিস্তব্ধ গ্রামে ওইটুকু ছলাতছলই বড় উচ্চকিত শোনাচ্ছে এখন।

আপন মনে শিবসুন্দর বলে উঠলেন, এ বছর বোধহয় আর বন্যা এল না রে তুফান।

ছায়াসঙ্গী তুফান পিছনেই রয়েছে। সেও জলের দিকে তাকাল, সময় এখনও যায়নি।

–এবার বর্ষা বড় কম হল।

কম কোথায়! চাষীদের তো খুশিই দেখছি।

দূর, শ্রাবণে তেমন বৃষ্টি হল কই!

–ভাদ্রে ঢালতে পারে।

–তাহলেই তো বিপদ। ডি ভি সি জল ছাড়বে….গত বছর বন্যায় কেমন আন্ত্রিকের ধুম পড়েছিল মনে আছে?

–নেই আবার! ছুটে বেড়াতে বেড়াতে জিভ বেরিয়ে গেছে। কম দিন তো হল না এখানে, কিন্তু গত বারের মতো হাল….বাব্বাহ খুব হয়রানি!

কপাল মন্দ থাকলে এ বছরও হবে।

মনে হয় না। তুফান আড়মোড়া ভেঙে হাসল, ইলেকশান আসছে। এ বছর রামনগর হেলথ সেন্টারে ওষুধপত্রের কমতি থাকবে না।

-হুম। সাঁকো পেরিয়ে এগোচ্ছেন শিবসুন্দর। এপারে রাস্তাটি মাটির। বেশ কদিন বৃষ্টি নেই, তবু মাটি এখনও বেশ তলতলে। একটু পা টিপে টিপেই হাঁটতে হচ্ছে শিবসুন্দরকে।

তুফান হাই তুলছিল। কাল খুব ধকল গিয়েছে তার। মনোরমার সারা মাসের ওষুধ ইনজেকশান, ডিসপেনসারির টুকিটাকি ওষুধপত্র, রুগীদের প্রাথমিক পরীক্ষার ছোটখাট কিছু সাজসরঞ্জাম কিনতে কলকাতা গিয়েছিল, ফিরেছে অনেক রাত্রে। শেষ বাসে। তার পরেও ঘুম ভাল হয়নি। মাঝরাতে কি একটা শব্দ শুনে তুফানকে জাগিয়ে দিয়েছিল অলকা। বলেছিল, পিছনের পুকুরে বোধহয় জাল ফেলছে কেউ। তুফান বেরিয়ে দেখে কেউ কোথাও নেই। শুধু নিশুত পুকুরে সরসর জল কাটছে রাতের হাওয়া। একটানা ঝিঁঝির ডাক, টিপটিপ জোনাকির জ্বলা-নেবা, জলের নির্জন শব্দ–মনটা যেন কেমন করতে লাগল তুফানের। এরকম হয় মাঝে মাঝে। বাকি রাত আর ঘুম আসে না। বসে থাকে দাওয়ায়। আধো তন্দ্রা মেখে।

তুফান কথা বলে খোঁয়ারি কাটাতে চাইল, টোটোর তো খুউব স্কুল চলছে বাবা।

–তোর দেখা হয়েছে টোটোর সঙ্গে?

-পাঁচ মিনিটের জন্য। স্কুল থেকে ফিরে দু-চারটে কথা বলতে না বলতে মাস্টার এসে গেল। অঙ্কের। রাস্তা থেকে একটা ইটের টুকরো কুড়িয়ে বহতা জলে ছুঁড়ল তুফান। গোল হয়ে ছড়াচ্ছে তরঙ্গ, পাড়ে এসে মিলিয়ে গেল।

তুফান ঢেউটাকে দেখছিল। হঠাৎ বলল, আচ্ছা বাবা, টোটোর তো খুব মাথা, ওর এত টিউটর মাস্টার লাগে কেন?

–পড়ার চাপ বেড়েছে না! ওদের সিলেবাস এখন কত কঠিন!

তার জন্য তো স্কুল আছে? টোটো তো আর গাঁ-গঞ্জের হেঁজিপেঁজি স্কুলে পড়ে না, শহরের ফাঁকিবাজ মাস্টারদের স্কুলেও না! ওর স্কুলের কত নাম, দুশো টাকা করে মাইনে! ওর স্কুলেরই তো সব সামলানোর কথা।

–ওরে গোমুখ্যু, স্কুলের পড়ানো হল রোজকার ডালভাত। ওতে শুধু প্রাণধারণ হয়। আর টিউটর-টিউটোরিয়াল হল ভিটামিন ইনজেকশান। ওগুলো নিলে শরীরের তাগদ বাড়ে।

তুমি, শুভদা, তোমরা তো লেখাপড়ায় খারাপ ছিলে না বাবা, তোমাদের কটা করে টিউটর ছিল?

আমরা ছিলাম হেলে চাষার মতো। স্কুলের মাস্টারদের কথাই থালা ভর্তি গিলে আমাদের শরীরে বল আসত। এখন সুষম আহারের যুগ। প্রোটিন ভিটামিন কার্বোহাইড্রেটের ব্যালান্স রাখতে হবে না? ক্যালোরি মেপে ব্রেনে খাবার পৌঁছনোর কাজ কি স্কুলকে দিয়ে হয়? তোর মাথায় এসব ঢুকবে না।

পিছন দিক থেকে একটা সাইকেল আসছে। শিবসুন্দররা সরে দাঁড়ানোর আগেই কাছে এসে থামল। মাধবপুরের কোনও বাসিন্দাই তাঁকে উপেক্ষা করে চলে যায় না, লক্ষ করেছেন শিবসুন্দর। দাঁড়ায়, দুটো কথা বলে, তারপর অনুমতি নিয়ে এগোয়। দশ বছর গ্রামে থাকার দৌলতে জোটা এই সম্মানটুকু উপভোগ করার চেয়ে শিবসুন্দর এতে মজাই পান বেশি।

–ডাক্তারবাবু কি মর্নিংওয়াকে?

শিবসুন্দর ফিরে তাকালেন। সোমেন। পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। রামনগর হাইস্কুলে বিজ্ঞান পড়ায়।

স্মিত মুখে শিবসুন্দর বললেন, –পুরনো লাঙসে একটু টাটকা অক্সিজেন ভরছি। তুমি এই ভোরে সেজেগুজে চললে কোথায়?

–একটু মুসলমান পাড়ায় যাব।

 বিশ বাইশ ঘর মুসলমান আছে গ্রামে। থাকে গ্রামের একদম শেষ প্রান্তে। শ্মশান পেরিয়ে আধ কিলোমিটারটাক যেতে হয়। কয়েক ঘর তাঁতি আছে, গামছা-টামছা বোনে। চাষের কাজও করে কেউ কেউ। কয়েকটি ঘর বেশ সম্পন্ন। শিক্ষিত। সম্প্রতি ওখানে একটা পোলট্রি ফার্মও হয়েছে। আরামবাগ হ্যাঁচারিজ থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি মুরগির ছানা আসে, বড় হয়ে চালান যায় কাটোয়ার দিকে। স্থানীয় বিভিন্ন হাটেও যায় কিছু। পোলট্রির মালিক রফিক আহমেদ বেশ অর্থবান, তারকেশ্বরেও তার কিছু ব্যবসা আছে, নিজের পয়সায় কিছুদিন আগে পাড়ার ছোট্ট মসজিদটার সংস্কারও করে দিয়েছে। তার ভাইটি উচ্চশিক্ষিত, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরিজির অধ্যাপক। গত মাসে ও পাড়ায় একটি বউ খুন হয়েছিল, পারিবারিক অশান্তির জের।

শিবসুন্দর খুব শঙ্কিত স্বরে বললেন, — আবার ও পাড়ায় কোনও বিপদ ঘটল নাকি?

–না, না। একটা সালিশির কাজ আছে। ল্যান্ড ডিসপিউট।

 গ্রামে থেকেও সালিশি, ল্যান্ড ডিসপিউট, এসব মাথায় ঢোকান না শিবসুন্দর। ঢোকাতে চানও না। আলগাভাবে বললেন, –তোমাদের এসবও করতে হয় নাকি?

–অনেক কিছুই করতে হয় ডাক্তারবাবু। সমাজ নিয়ে কাজ। কত ভাবে যে কমন পিপলের সঙ্গে ইন্টার‍্যাকশান বাড়াতে হয়।

–তা ঠিক।

–আপনি তো এলেন না আমাদের সঙ্গে। বছর পঞ্চাশের গোলগাল মুখে সামান্য অভিযোগের সুর, এত বার করে বললাম, অন্তত পনেরোই আগস্ট আমাদের স্কুলের ফাংশানে আসুন, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান তো আর পলিটিকাল মিটিং নয়।

সময় পেলাম না। ঘুঘুডাঙায় একটা কলে গেলাম, ফিরতে রাত হয়ে গেল।

–সামনের সপ্তাহে আসুন। আমরা পঞ্চায়েত অফিস থেকে একটা স্বাক্ষরতা ক্যামপেন শুরু করছি। আপনি এলে আমাদের ভাল লাগবে।

আবার আমি কেন? মধুর সকালটা তেতো হয়ে যাচ্ছিল শিবসুন্দরের, রোগ ব্যাধি নিয়ে পড়ে আছি, বেশ আছি।

সোমেন বিনয়ী হাসল। খানিকটা মুরুব্বির ভঙ্গিতে বলল, – ডাক্তারবাবু, আপনি যেমন শরীরের ডিজিজ কিওর করার জন্য কাজ করছেন, আমরাও তেমনি সোসাইটির ডিজিজ কিওর করার জন্য কাজ করছি। নিরক্ষরতা কি অসুখ নয়?

–সে তো বটেই। তবে কি জানো, আমি সারা জীবনের জানা বিদ্যে কাজে লাগিয়ে দু মুঠো পেটের ভাত জোটাই। আমার কাজের সঙ্গে তোমাদের কাজের তুলনা হয়? তোমরা অনেক মহৎ।

–এইভাবে বলবেন না ডাক্তারবাবু। আপনি কি টাকার জন্য এখানে এসে পড়ে আছেন? আপনি গ্রামের উচ্চ জন, আপনাকে সঙ্গে পেলে…..

শিবসুন্দর নিরুত্তর থেকে সামান্য অন্যমনস্ক ভাব ফোটালেন মুখে। ইঙ্গিত বুঝে সোমেন সাইকেলে উঠল, তাহলে আসি ডাক্তারবাবু। কথাটা একটু ভেবে দেখবেন। পারলে চলে আসুন…সামনের মঙ্গলবার বিকেলে।

খালধার বেয়ে যাচ্ছে সাইকেল। ক্রমশ ছোট হয়ে গেল।

তুফান গজগজ করে উঠল, কথার কী কায়দা! একটু ভেবে দেখবেন। ভেবে না দেখলে কী করবি তুই?

আহ, চটছিস কেন? শিবসুন্দর হালকা চাপড় মারলেন তুফানকে, রাজনীতির লোক, ওদের তো দল বাড়াতে হবেই।

–তুমি বোকো না তো বাবা! মুখে সমাজ সমাজ করে, এদিকে নিজের ছেলের বিয়েতে পঁচিশ হাজার টাকা নগদ নিয়েছে। পঞ্চায়েতে জিতে এক বছরে টিন পালটে ছাদ পাকা করে ফেলল।

–থাক, সক্কালবেলা ঘোঁট করিস না। ভাল লাগে না।

ইদানীং গ্রামে এক অদ্ভুত চাপ অনুভব করছেন শিবসুন্দর। সব পার্টির লোকই হঠাৎ হঠাৎ হাজির হচ্ছে বাড়িতে, পরামর্শ নেওয়ার ছলে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিচ্ছে। যখন প্রথম এখানে আসেন, তখন ঠিক এমনটা ছিল না। রুগী-ডাক্তারখানা নিয়ে জীবনটা বেশ নিরিবিলিই ছিল, কেউই তেমন ঘাঁটাত না। ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, পেশার সুবাদে অনেকের উপকার হয়েছে তাঁর হাতে। এতে হয়তো তাঁর মতামতের একটু মূল্য বেড়েছে গ্রামে। সেই মূল্যটাকেই রাজনৈতিক দলরা প্রভাব মনে করে। তাই বোধহয় তাঁকে দলে টানার আগ্রহও বেড়ে গেছে তাদের। কিন্তু তিনি তো এসব থেকে দূরে থাকতে চান। কেন তাঁকে একটু শান্তি দেবে না এরা?

শিবসুন্দর শ্মশানভূমিতে এসে থামলেন। শ্রাবণ সংক্রান্তির মেলা ভেঙেছে সবে, সাধুরা এখনও সবাই যায়নি। শিবমন্দিরের দাওয়ায় বসে আছে তিনজন। গুটি কতক কালোকুলো পোড়া কাঠ এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, ভাঙা কলসিও গড়াচ্ছে। অদূরে। দাহকাজের অবশেষ। অশত্থ গাছের ওপারের মাঠে এখনও নাগরদোলাটা রয়েছে। কালও ম্যাজিকঅলার তাঁবুটা ছিল, আজ নেই। কদিন আগের ভিড় একদম সুনসান।

শিবসুন্দর চাতালে বসলেন। খালের ওপারে বিস্তীর্ণ চাষভূমি। ধানচারা লকলকিয়ে উঠেছে। সতেজ। সবুজ। দিনের প্রথম আলোয় ওই অনন্ত হরিৎ বর্ণ বড় অপার্থিব লাগে শিবসুন্দরের। দেখতে থাকেন, দেখতেই থাকেন তিনি। যেন শস্যের বেড়ে ওঠা নয়, দেখছেন জীবনের স্তর। বিকাশ। তাঁর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।

এখনকার ভরা ক্ষেতটি যেন শিবসুন্দরের অতীত। দুঃখ আনন্দ শঙ্কা উদ্বেগ বিস্ময় আশা নৈরাশ্য সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ। সুখের জন্য তিনি কখনও লালায়িত ছিলেন না, তাই পূর্ণতায়ও কোনও ঘাটতি নেই। ধান কাটার পর যখন শূন্য হয়ে যাবে ক্ষেত্র, শুকনো খড়ের আগা বেয়ে কুয়াশার আস্তরণ জমবে ভূমিতে, তখন ওই প্রান্তরটিকে নিজের বর্তমান মনে হবে শিবসুন্দরের। রুক্ষ জমির মতোই নিরস বর্তমান। তবে আপাতরুক্ষ জমিও যে আদ্যন্ত নীরস নয়, এ কথাও জানেন শিবসুন্দর। জানেন মাটি তখন ভিজে থাকে শিশিরে। ওই শীতেই কোনও কোনওদিন প্রান্তরটি মিলিয়ে যায় নিবিড় কুয়াশায়। তখন মনে হয় চোখের সামনে যেন শুধুই তাঁর ভবিষ্যৎ। যার কোনও কিছুই তাঁর অজানা নয়, অথচ কুয়াশার অন্তরালে সে যেন আশ্চর্য রহস্যময়। চেনা হয়েও সম্পূর্ণ অচেনা।

কে ওই প্রান্তর সাজিয়ে রাখে শিবসুন্দরের জন্য?

ঈশ্বর? প্রকৃতি? মানুষ?

কেন রাখে?

তুফান সাধুদের সঙ্গে গল্পগাছা জুড়তে গিয়েছিল। তিন সাধুর একটি মৌনী, সে তুফানের প্রশ্নবাণে বিরক্ত হচ্ছে খুব। বেজার মুখে তুফান চাতালে এসে বসল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে উসখুস করতে শুরু করেছে, বাবা?

উঁ?

–মৌনীটাকে দেখেছ? একদম ছোকরা। এই বয়সে সন্নিসী হল কেন বলো তো?

দেবদ্বিজে ভক্তি নেই শিবসুন্দরের, সাধুসন্ন্যাসীদেরও খুব একটা ভাল চোখে দেখেন না তিনি। ক্কচিৎ কখনও দু-একটা সাধুর সঙ্গে আলাপ করে দেখেছেন, বিরক্তি বাড়া বই কমেনি। বেশির ভাগই একটা দুটো ভাবের কথা বলে বিড়ি সিগারেটের জন্য হাত বাড়ায়। ভাবের কথা মানেও ফাঁপা কথা, একই গতের তত্ত্ববাক্য। বেদ পুরাণ কোরান বাইবেল, সবই অল্পস্বল্প ঘাঁটা আছে শিবসুন্দরের, শাস্ত্রবাক্যের উদ্ধৃতি ছাড়া নতুন কিছুই সাধুরা বলে না। মাঝেমধ্যে শিবসুন্দর তাদের সঙ্গে ঠাট্টা রসিকতাও করেছেন, জ্ঞানের পরিধি মাপতে চেয়েছেন, সাধুরা তাতে বড় রেগে যায়। রাগই যদি জয় না করতে পারো, তবে সাধুসন্ন্যাসী হওয়া কেন?

হালকা চালে শিবসুন্দর বললেন– বিনি পয়সার ভোজ, যদি জোটে রোজ রোজ….

-হ্যাঁহ, রোজ কি চোর্বচোষ্য জোটে নাকি?

–ঠিক জোটে। নেশাটা তো জোটেই।

–তা যা বলেছ! তুফান হাসছে, — ভক্তের যে অভাব নেই।

 শিবসুন্দর হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, হ্যাঁরে তুফান, তোর বউদির ভক্তিভাব এখন কেমন? বেড়েছে, না কমেছে?

–এই বয়সে ভক্তিভাব এলে সে কি আর কমে বাবা? বাড়তেই থাকে। গত মাসে তো দেখে এলাম বিগ্রহ বসিয়েছে, কাল দেখি সব এলাহি ব্যাপার। সিংহাসন টিংহাসন করে …সামনে রুপোর পঞ্চপ্রদীপ…আবার একটা ইলেকট্রিকের শিখা জ্বলছে সব সময়….

–কোথায় করছে এসব?

–শুভদার ছোট ঘরটায়। যেখানে আলমারি আছে, তার পাশটাতেই।

তুই দেখলি?

–আমায় নিয়ে গিয়ে দেখাল। ছোট্ট একটা সোনার গোপালঠাকুর রেখেছে। তাকে খাওয়াচ্ছে, শোওয়াছে, তার জন্য বিছানা তৈরি হয়েছে, ছোট ছোট কোলবালিশ, মশারি, মাথার বালিশ…জরি বসানো লাল নীল সিল্কের জামাকাপড়ও বানানো হয়েছে।

–তুই কিছু বললি না? শিবসুন্দরের গায়ে যেন কাঁটা ফুটছে।

যার ভক্তি, তার ভক্তি। আমি কেন বলতে যাব? তুমি নাস্তিক বলে কি সবাইকে নাস্তিক হতে হবে!

তা নয়, তবে ছন্দার তো এসব ছিল না! বছরে একবার হইহই করে সরস্বতী পুজো করল, লক্ষ্মীর পট আছে, ন মাসে ছ মাসে সত্যনারায়ণ করছে…..হঠাৎ দু-তিন মাসের মধ্যে এত বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে গেল কেন?

–হয়তো টাকা বেশি এলে ভক্তিও বেড়ে যায়।

–কেন?

–হারাবার ভয়ে। তুফান ঠোঁট ওল্টাল, — তুমি হলে গিয়ে নাঙ্গা পুরুষ, তুমি এসব বুঝবে না বাবা।

তুফানের ঠাট্টায় হাসতে পারলেন না শিবসুন্দর। তুফান বোধহয় ঠিকই বলছে। ভক্তি তো এভাবেই আসে। হয় হারাবার ভয়ে, নয় পাওয়ার আশায়। শুভর চেম্বারেও নাকি ঠাকুরদেবতার বাঁধানো ছবি ঝোলে। তুফান গেছিল একদিন, নিজের চোখে দেখেছে। ঠাকুরদেবতায় কোনও অন্ধ বিদ্বেষ নেই শিবসুন্দরের, তবু বড় আফসোস হয় মনে মনে। বিজ্ঞান কি এই শিক্ষা দিল শুভকে? শরীরকে এতকাল ধরে কাটাছেঁড়া করেও কি বোঝে না, প্রাণ এক বিশুদ্ধ রাসায়নিক বিক্রিয়া মাত্র? অদৃশ্য শক্তির ওপর নির্ভরতা বুঝি এই বোধটাকেই দুর্বল করে দেয়।

বলব না বলব না করেও শিবসুন্দরের মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, শুভ এসব বাড়াবাড়ি নিয়ে কিছু বলছে না ছন্দাকে?

শুভদার সময় কোথায়! নার্সিংহোম নিয়ে যা ব্যস্ত। লাখ লাখ টাকা খরচা হচ্ছে। পুজোর আগেই বোধহয় শুরু হয়ে যাবে। দেখলে না, মেলায় আসব বলেও এল না!

-টোটো এলে পারত। ওর এত মেলা দেখার শখ। বাবা-মা না আসুক, একাই আসত। এখন তো আর শিশুটি নেই। রেজাল্ট বেরিয়েছে কদ্দিন হয়ে গেল, ছেলেটার সঙ্গে তারপরে একবারও দেখা হল না।

-টোটোও বলছিল সে কথা।

কী বলছিল?

বলছিল, আমি আর বাবা-মার ভরসায় থাকব না তুফানকাকা। ঠিক দলবল জুটিয়ে চলে যাব। হয় পুজোয়, নয় শীতে। খুব হুল্লোড় করব।

–ভালই তো। আসুক বন্ধুদের নিয়ে। আমাদের তো জায়গার কমতি নেই।

হুঁ, নাতি আসা তো ভালই। তবে ছেলে ওভাবে এলে তোমার আরও ভাল লাগত। নয় কি?

শিবসুন্দর উত্তর দিলেন না। শুভর সঙ্গে বন্ধনটা তাঁর গভীর হল না কোনওদিন, কেমন ছাড়া ছাড়া রয়ে গেল। কেমন ধারার যেন হয়েও গেছে ছেলেটা। ছুটছে। শুধু ছুটছে। এত অর্থ কী কাজে লাগে? অর্থ কি সত্যিই সুখ আনে! নাকি অর্থ উপার্জনের নেশাটাই সুখ?

ফেরার পথে আর তেমন কথা বললেন না শিবসুন্দর।

পুবের জানলা দিয়ে রোদ এসেছে দোতলার ঘরে। আলোমাখা বিছানায় শুয়ে আছেন মনোরমা, এখনও ঘুমন্ত। স্ত্রীর এই ঘুমন্ত রূপটি দেখে হঠাৎ হঠাৎ শিবসুন্দরের বুক ধক করে ওঠে। মনে হয়, ঘুমের ঘোরে চলে যায়নি তো মনোরমা! ভাল ভাবে ঠাহর করলে অবশ্য ভুল ভাঙে।

স্ত্রীর হাতটি নিজের হাতে তুলে নিলেন শিবসুন্দর। নাড়ি টিপলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রইলেন শুকনো কবজি। এই কবজি ধরে এক সময়ে হেঁটেছেন তিনি। অল্প দিন, কিন্তু বড় মধুর দিন। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে চলে গেছেন কাঁসাই নদীর পাড়ে। অথবা গির্জাঘরের দিকে। তখন এই বাহু কত মসৃণ ছিল। তাঁর হাতে ধরা থাকতে থাকতেই কবে যে শুকিয়ে গেল!

স্মৃতি থেকে শিবসুন্দর দ্রুত বর্তমানে ফিরলেন। ঝটপট যন্ত্র এনে মাপলেন স্ত্রীর রক্তচাপ। বারান্দায় এসে দেখলেন ডিসপেনসারির বাইরের বেঞ্চিতে রুগী এসে গেছে।

গম্ভীর নিশ্চিন্ত স্বরে শিবসুন্দর হাঁক দিলেন, অলকা, আমার চা দিয়ে যাও।

.

রাত্রের খাওয়া সেরে দু-চারটে কাজ সারছিলেন শিবসুন্দর। গত সপ্তাহে জলপাইগুড়ি থেকে ছন্দার বাবার চিঠি এসেছে। মামুলি কুশল বিনিময়ের চিঠি। এখনও উত্তর দেওয়া হয়নি, উত্তরটা লিখলেন আগে। বহুদিন বেয়াই বেয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় না, ভদ্রতা করে পুজোর সময় আসার জন্য আমন্ত্রণও জানালেন। লিখে মনে মনে একটু হাসিই পেল। পুজোর সময়েই আসতে লিখলেন কেন? রিটায়ার্ড মানুষের বারো মাসই তো পুজোর ছুটি! যে কোনও সময়ে এলেই তো হয়! কেটে কি লিখবেন আবার? থাক।

ডায়েরি লেখার একটা পুরনো অভ্যাস আছে শিবসুন্দরের। রোজ না হলেও, প্রায়শই লেখেন। মন্তব্যহীন। হৃদয়ের অনুভূতিবিহীন। শুধু কিছু ঘটনার উল্লেখ থাকে তাতে। তিনদিন পর শিবসুন্দর আজ আবার ডায়েরি লিখলেন।

…….তুফান গতকাল কলকাতা গিয়াছিল। শুভ নার্সিংহোম লইয়া অতিশয় ব্যস্ত। ছন্দার পূজাপাঠ বাড়িয়াছে। টোটো বন্ধুদের লইয়া পূজায় বা শীতে আসিবে বলিয়াছে। আজ এবং কাল বৃষ্টি হয় নাই। মনো ভালই আছে।….

শেষ বাক্যটি শিবসুন্দরের মনঃপূত হল না। কেটে লিখলেন।

 ….মনোর পালসবিট আর প্রেশার আজ নরমাল। সুগার কাউন্ট দেখি নাই।…..।

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হচ্ছে। গোপনীয় কিছু লেখা নেই, তাও সন্তর্পণে টেবিলের ড্রয়ারের একদম ভেতরে ডায়েরিটা ঢুকিয়ে দিলেন শিবসুন্দর। দরজার দিকে তাকালেন, কিছু বলবি?

তুফান দরজায় দাঁড়িয়ে ঘাড় চুলকোচ্ছে, হ্যাঁ, একটা কথা ছিল।

দাঁড়া, আসছি।

 মনোরমার মশারি ও মশারির মনোরমাকে ভাল করে দেখে নিয়ে শিবসুন্দর বারান্দায় বেরোলেন আলতোভাবে টেনে দিলেন দরজাটা, কি হয়েছে?

–একটা কথা ভাবছিলাম।

বল।

 –তোমাকে তো অনেক ঘোরাঘুরি করতে হয়…

–সে তো হয়ই।

না ভাবছিলাম একটা মোপেড স্কুটার এরকম কোনও টু হুইলার যদি কিনে নেওয়া যায়…

— কী হবে? সাইকেলেই তো দিব্যি চলে যাচ্ছে। 

–চলে যাচ্ছে না, কষ্ট করে চালিয়ে নিচ্ছ। তোমার আজকাল বেশিক্ষণ সাইকেল চালাতে কষ্ট হয়, আমি জানি।

–কিছু জানিস না। ওটা আমার এক্সারসাইজ।

পরশুও তুমি কল থেকে ফিরে অনেকক্ষণ হাঁপাচ্ছিলে। আজ মাত্র দু কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে নীচে চুপচাপ বসে রইলে অতক্ষণ এগুলো ভাল লক্ষণ নয় বাবা।

-বাহাত্তুরে ধরল, এখনও এনফিসিমা অফ লাঙস হবে না? বিড়ি সিগারেট খাওয়া বুক…শিবসুন্দর সস্নেহ চোখে তুফানের দিকে তাকালেন, এই বুড়ো বয়সে মোপেড-ফোপেড আমি চালাতে পারব না রে।

–তোমাকে কে চালাতে বলেছে? তুমি পেছনে বসে থাকবে, আমি চালাব।  

বুঝেছি। শিবসুন্দর হাসছেন, তোর নিজেরই শখ হয়েছে।

তুফানের মঙ্গোলিয়ান ছাঁচের মুখে লাজুক হাসি, – আমার নয়, অলকার শখ। টিভিতে বিজ্ঞাপন দ্যাখে…রোজ বলে….

–তাই বল। তা টিভির বিজ্ঞাপন দেখে শখ বাড়তে শুরু করলে তো বিপদ রে!

–এটা ঠিক শখ নয় বাবা, এটা প্রয়োজনও।

–প্রয়োজন তো ইলাস্টিক, টানলেই বাড়ে। যাক গে, যা ভাল বুঝিস কর। শিবসুন্দর হাসতে হাসতে তুফানের কাঁধে হাত রাখলেন, – পোর নামে পোয়াতিরই হোক। অলকা চুলে রঙিন ফিতে লাগিয়ে তোর পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াক।

চাঁদ উঠে গেছে। শুক্লপক্ষ। মিহি সরের মতো জ্যোৎস্না বিছিয়ে আছে চরাচরে। সামনের আমগাছে ঝিকঝিক করছে আলো, পাতার ফাঁক দিয়ে গাছতলাতেও লুটিয়ে পড়েছে চন্দ্ৰসুধা। আঁধারও আছে, তবে তরল। মায়াময়। বেড়ার ধারের শিউলিগাছে ফুল এসেছে সবে। স্নিগ্ধ কিরণে সাদা ফুল আসন বুনছে মাটিতে।

শিবসুন্দর বাতাসে কান পাতলেন, রুমকি কাঁদছে কেন? এখনও ঘুমোইনি মেয়েটা?

–ঘুমিয়েই তো ছিল। উঠে পড়েছে বোধহয়। তুফান সিঁড়ির দিকে এগোল, — আমি কিন্তু কাল থেকেই খোঁজখবর নিচ্ছি।

দু-চার ধাপ নেমেও ফিরে এসেছে তুফান, অলকা তোমাকে কিছু বলেছে?

কী বল তো?

–বিকেলে দেবনাথ এসেছিল।

ও হ্যাঁ, বলেছে। পুকুরটা বোধহয় ইজারা নিতে চায়। আগে একদিন বলেছিল।

–দিচ্ছ?

–ইচ্ছে তো নেই, দেখি কি করি। তুই তো কিছু সামলাতে পারিস না। অলকা বলছিল কাল রাতেও নাকি জাল ফেলার শব্দ শুনেছে।

না নাহ, অলকার মনের ভুল। পাতলা ঘুম, উল্টোপাল্টা শোনে। তুফান দু-এক সেকেন্ড কি যেন ভাবল, তুমি সোমেনকে পাত্তা দাও না, দেবনাথকেই বা দেবে কেন?

যা, শুতে যা। আমি কোনও পলিটিক্যাল পার্টিকেই পাত্তা দিই না। শুধু ভয়, পুকুর টুকুরে বিষ না মিশিয়ে দেয়। অত মাছ মরে যাবে…..

–সে সাহস হবে না। তুমি শুধু শক্ত থাকো।

তুফান চলে গেল।

শিবসুন্দর সিগারেট ধরালেন। সারা জীবন কোনও স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির ওপর আসক্তি ছিল না তাঁর। তবু অজান্তেই কত কী সম্পদ এসে যায় নিজের অধিকারে! দোতলা বাড়ি, পুকুর, শাকসবজির বাগান, কদিন আগে কয়েকটা হাঁস কিনেছে অলকা, তুফান টু হুইলার কিনবে, এরপর হয়তো রুমকির দুধের জন্য একটা গরুই কিনতে হবে। একেই কি সম্পন্ন গার্হস্থ্য জীবন বলে? এই সব তুচ্ছ সম্পদে ক্রমশ অধিকারবোধ জন্মাবে তাঁর, এক সময়ে এদের রক্ষা করতে আকুল হবেন তিনি, এই কি তাঁর নিয়তি?

সামনের পথ ধরে কয়েকটি যুবক ফিরছে। টুকরো ফিলমি গানের কলি উড়ে এল বাতাসে। রামনগরের ভিডিও হল থেকে ছেলেরা ফিরছে বোধহয়। শিবসুন্দরের জাঠতুতো দাদার নাতির গলাও শোনা যাচ্ছে না! টাপুও কি গিয়েছিল?

শিবসুন্দর ঘরে ফিরলেন। একটা মেডিকেল জানাল নিয়ে আধশোওয়া হলেন ইজিচেয়ারে। স্ত্রীর বিছানার পাশেই। রাত্রের দিকে বিদ্যুতের ভোল্টেজ ভালই থাকে, বইপত্র পড়তে অসুবিধা হয় না।

জানালটি বিদেশি, সদ্য এসেছে বাড়িতে। এলোমেলো উল্টোতে উল্টোতে একটি পাতায় শিবসুন্দরের চোখ আটকে গেল। বিভিন্ন ধরনের জেনেটিক অসুখ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। প্রধানত মাংসপেশির রোগসংক্রান্ত গবেষণা। কাল একটি শিশু এসেছিল ডিসপেনসারিতে, তারও এই একই অসুখ। মাত্র বছর চারেক বয়সেই শিশুটির হাঁটাচলার ভঙ্গি হাঁসের মতো হয়ে গেছে। খুব যন্ত্রণা পাচ্ছে বেচারা। শিবসুন্দর জার্নালের পাতাটিতে ডুব দিলেন।

হঠাই মগ্নতা ছিঁড়ে গেল। কথোপকথনের আবছা শব্দ ভেসে আসছে। তুফান আর অলকার। তুফান কী যেন বলল, অলকা হেসে উঠল খিলখিল। তুফানও হাসছে। কথা বলছে জোরে জোরে।

গ্রামদেশ নিশুত এখন। ওই হাসি, ওই কথা, সুতীক্ষ্ণভাবে কানে বাজছিল শিবসুন্দরের। বুক থেকে একটা উষ্ণ নিশ্বাসও গড়িয়ে এল যেন। শুভ আর ছন্দাকে ওইভাবে কথা বলতে, হাসতে কোনওদিন দেখলেন না শিবসুন্দর। বিয়ের পর থেকেই দুজনের মধ্যে বড্ড বেশি দূর দূর ভাব। প্রথম সন্তান দেখে বাবারা কত উৎফুল্ল হয়, অথচ টোটো হওয়ার পর শুভকে এতটুকু আনন্দিত মনে হয়নি। বলতে গেলে তাঁর চাপে পড়েই বউ বাচ্চাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল শুভ।

অথচ তিনি তো শুভকে জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসাননি। অত তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেও ছিল না তাঁর। নেহাত ছন্দার বাবার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল বালুরঘাটে, ছন্দাকে দেখেও মোটামুটি ভাল লেগে গেল, তাই না নিয়ম রক্ষার্থে বলেছিলেন ছেলেকে। শুভর আপত্তি থাকলে তিনি থোড়াই এগোতেন! তার পরও কত যুগ কেটেছে, টোটো মাধ্যমিক পাস করে গেল, তবু কেন দানা বাঁধল না সম্পর্কটা? ছন্দা যে হঠাৎ এত ঠাকুর-টুকুর শুরু করেছে, তার পিছনেও কি সেই ব্যবধান? অথচ তুফান অলকা…। শিবসুন্দর নিজেই বা কদিন প্রকৃত দাম্পত্যজীবন যাপন করেছেন! বড় জোর বছর দুয়েক। সেই কদিনের মধুর স্মৃতিই এখনও কী তীব্র বাঁধনে আটকে রেখেছে তাঁকে আর মনোরমাকে?

খট করে একটা শব্দ হল। চমকে তাকাতেই শীতল স্রোত বয়ে গেছে শিবসুন্দরের শিরদাঁড়ায়। মনোরমা বিছানায় উঠে বসেছেন! নিষ্পলক চোখে দেখছেন তাঁকেই!

শিবসুন্দরের কণ্ঠনালী শুকিয়ে এল। তালুতেও কেমন খরখরে ভাব। জিভ দিয়ে তালু ভিজিয়ে নিলেন শিবসুন্দর। ফিসফিস করে ডাকলেন, -মনো….

মনোরমার দৃষ্টি স্থির। একই রকম স্থির।

পুকুরপাড়ে ঝোপ হয়েছে হাসুহানার। ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ ঢুকে পড়ছে জানলা দিয়ে।

শিবসুন্দরের চোখ জ্বলজ্বল। গাঢ় স্বরে বলে উঠলেন, -মনোরমা, চিনতে পারো আমায়? আমি শুভর বাবা। শুভ, সেই যে তোমার ছেলে….তোমার কোলে ছিল….

উত্তর নয়, আর একটা শব্দ হল শুধু। মনোরমা ঝুপ করে শুয়ে পড়েছেন।

শিবসুন্দর আকুল স্বরে বলে চললেন, –মনো…মনো…একটি বারের জন্য অন্তত…। যদি মরে যাই….যদি মরে যাই…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *