১৬.
যে যেখানে ছিলাম তেমনি আছি। অটুট নীরবতা চারদিকে। হতাশ চোখে লিওর দিকে তাকালাম। ও-ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অসম্ভব আশা করছিলাম আমরা। ভাবছিলাম, এই সুন্দর করুণ প্রার্থনার জবাব বোধহয় দেবে প্রকৃতির। বোবা আত্মা। অলৌকিক কিছু ঘটবে। কিন্তু সময় গড়িয়ে চললো, অলৌকিক কেন, কিছুই ঘটলো না।
না, অনেক অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ জানি না, একটা ব্যাপার ঘটলো। ধীরে, ধীরে অস্পষ্ট হতে শুরু করলো অগ্নিগিরির জ্বালামুখ থেকে উঠে আসা আগুনের পর্দা। ক্রমশ নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। যেখান থেকে উঠেছিলো সেখানেই ডুবে যাচ্ছে। একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে জায়গাটা।
কমতে কমতে একেবারে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে আলো। আর কয়েক সেকেণ্ডের ভেতর একদম নিভে যাবে। এই সময় উঠে দাঁড়ালো আয়শা। ধীরে ধীরে এগোলো কয়েক পা। বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকা এক টুকরো পাথরের ওপর গিয়ে দাঁড়ালো। নিচ থেকে উঠে আসা ধোঁয়াটে আভার বিপরীতে কালো প্রেতের মতো দেখাচ্ছে ওর, অবয়ব। আমার মনে হলো অসহনীয় গ্লানির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে ও মরণকে আলিঙ্গন করতে চাইছে। লিওর-ও সম্ভবত তাই মনে হলো। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ও ছুটলো ওকে ঠেকানোর জন্যে। কিন্তু পূজারী অরোস আর পূজারিনী পাপাভ এগিয়ে এসে বাধা দিলো ওকে। দুজন দুপাশ থেকে ধরে টেনে নিয়ে গেল পেছনে। পুরোপুরি আঁধার নেমে এলো সেখানে। অন্ধকারের ভেতর শুনতে পেলাম আয়শার গলা। অদ্ভুত পবিত্র সুরে কিছু একটা স্তবগান করছে।
একটু পরে একটা আগুনের ফুলকি দেখতে পেলাম। একটু একটু করে বড় হচ্ছে, আর পাখির মতো এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে উঠে আসছে। কিন্তু—কিন্তু–
হোরেস! ফিসফিস করে বলে উঠলো লিও, দেখেছো, বাতাসের উল্টো দিকে আসছে ওটা।
বাতাস বদলে গেছে হয়তো, বললাম আমি। জানি যা বললাম, ঠিক নয়, বরং একটু বেড়েছে বাতাসের বেগ, তবু বললাম।
ক্রমশ কাছে আসছে ওটা। এখন আরও ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি। পাখির ডানার মতো দুটো আগুনে ডানা দুপাশে নড়ছে, মাঝখানে রয়েছে কালো কিছু একটা, অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। উঠতে উঠতে একেবারে আয়শার সামনে। এসে পৌঁছুলো ওটা। গনগনে ডানা দুটো ঢেকে ফেললো ওর কুঁচকানো দেহটাকে। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল আগুন। নিকষ কালো অন্ধকার সামনে, পেছনে, উপরে, নিচে। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
কিছুক্ষণ কেটে গেল। এক মিনিট হতে পারে, দশ মিনিটও হতে পারে। তারপর হঠাৎ পূজারিনী পাপাভ অদৃশ্য, অশ্রুত কোনো সঙ্কেত পেয়ে যেন পা টিপে টিপে এসে দাঁড়ালো আমার পাশে। ওর পোশাকের স্পর্শ পেলো আমার শরীর। আবার কিছুক্ষণ নীরবতা এবং নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। টের পেলাম পাপাত চলে যাচ্ছে। ক্ষীণ একটা ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পেলাম। নিঃসন্দেহে আয়শা ঝাঁপ দিয়েছে জ্বালামুখের ভেতর! বিয়োগান্তক ঘটনাটার পরিসমাপ্তি হলো বোধহয়!
ভোর হতে আর বাকি নেই। ধূসর হতে শুরু করেছে আকাশ। এমন সময় সেই আশ্চর্য সঙ্গীত ভেসে এলো নিচ থেকে। নিশ্চয়ই নিচে যে পূজারীরা রয়েছে তারা গেয়ে উঠেছে। সে-সঙ্গীতের বর্ণনা দেয়ার সাধ্য আমার নেই। পৃথিবীর অনেক ধর্মের অনেক মন্দিরে অনেক ধরনের গান আমি শুনেছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত সুর, লয় কখনও শুনিনি। ক্রমশ উঁচগ্রামে উঠছে সঙ্গীত। উঠতে উঠতে এক সময় উচ্চতম গ্রামে পৌঁছুলো, তারপর নামতে শুরু করলো আবার। কমতে কমতে অবশেষে মিলিয়ে গেল একসময়।
তারপর, পুবদিক থেকে একটা মাত্র আলোকরশ্মি লাফিয়ে উঠলো আকাশে।
ভোর হচ্ছে, শান্ত গলা শোনা গেল অরোসের।
আমাদের মাথা ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেল আলোকরশ্মি। ক্ষুরধার তরবারির মতো অগ্নিশিখা যেন। তারপর নেমে আসতে লাগলো। নামতে নামতে সামনের ছোট্ট পাথর খণ্ডটার ওপর পড়লো আলো।
ওহ! সেখানে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গীয় অবয়ব। একটা মাত্র বস্ত্রে আবৃত। চোখ দুটো বন্ধ, যেন ঘুমিয়ে আছে। নাকি মরে গেছে? প্রথম দর্শনে মুখটা মৃতের। মতোই লাগলো। সূর্যের প্রথম রশি খেলা করছে ওর শরীরে, পাতলা আবরণ ভেদ করে পৌঁছে যাচ্ছে ভেতরে। চোখ দুটো খুললো। অপার বিস্ময় তাতে, নবজাত শিশুর দৃষ্টিতে যেমন থাকে। প্রাণের প্রবাহ বইতে শুরু করেছে, মুখে, বুকে, শরীরে। কালো ঢেউ খেলানো কুন্তলদল উড়ছে বাতাসে। মণিখচিত সোনার সাপ ঝিকিয়ে উঠছে কোমরে।
একি মায়া, না সত্যি আয়শা? কোর-এর গুহায় ঘূর্ণায়মান প্রাণ-আগুনে ঢোকার আগে যে আয়শাকে দেখেছিলাম সে না অন্য কেউ? আর ভাবতে পারলাম আমি; সম্ভবত লিও-ও না। একটু পরে যখন কানের কাছে নিঝরের মতো মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে উঠলো তখন সচেতন হয়ে দেখলাম, আমি লিও দুজনই মাটিতে পড়ে আছি। জড়িয়ে ধরে আছি একজন অন্যজনের গলা।
এখানে এসো, ক্যালিক্রেটিস, স্বর্গীয় সঙ্গীতের মত মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, আমার কাছে এসো।
অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালো লিও। মাতালের মতো টলমলে পায়ে এগোলো আয়শার দিকে। তারপর আবার বসে পড়লো হাঁটু ভেঙে।
ওঠো, বললো আয়শা, তুমি কেন? আমিই তো হাঁটু গেড়ে বসবো তোমার সামনে। লিওকে ওঠানোর জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলো ও।
এবারও উঠতে পারলো না লিও। ধীরে ধীরে একটু একটু করে ঝুঁকে এলো। আয়শা। ঠোঁট দুটো আলতো করে ছোঁয়ালো লিওর কপালে। তারপর ইশারায় ডাকলো আমাকে। আমি গেলাম, লিওর মতোই হাঁটু গেড়ে বসলাম।
না, বললো সে, তুমি ওঠো। চাইলে এমন কি না চাইলেও প্রেমিক বা পূজারী অনেক পাবো। কিন্তু হলি তোমার মতো বন্ধু কোথায় পাবো? তারপর ঝুঁকে আমার কপালেও আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো ও,কেবল ছোঁয়ালো, আর কিছু না।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেই মুহূর্তে অদ্ভুত এক আকুলতা বোধ করলাম মনে। ওকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা হলো আমার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। আমি বৃদ্ধত্বের কথা, এধরনের আকুলতা প্রকাশ করার দিন পেরিয়ে এসেছি অনেক। আগে। তাছাড়া আয়শা আমাকে সত্যিকারের বন্ধু হিসেবে স্বীকার করেছে, এলোক ছাড়িয়ে অন্যলোকে গিয়েও সে বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। এর বেশি আর কি চাইবার আছে আমার?
লিওর হাত ধরে ছাদের নিচে ফিরে এলো আয়শা।
নাহ শীত লাগছে, বললো সে। পাপাভ, আমার আলখাল্লাটা দাও তো।
কারুকাজ করা লাল পোশাকটা যত্ন করে পরিয়ে দিলো ওকে পূজারিনী। রাজকীয় ভঙ্গিতে ওটা ঝুলে রইলো ওর কাঁধ থেকে, অভিষেকের পোশাক যেন।
ও প্রিয়তম, প্রিয়তম, লিওর দিকে তাকিয়ে বলে চললো সে, ক্ষমতাবানরা একবার খেচা খেলে সহজে ভুলতে পারে না। জানি না কদিন তুমি আমি এক সাথে থাকতে পারবো এপৃথিবীতে, হয়তো সামান্যক্ষণ। সুতরাং সময়টুকু হেলায় নষ্ট করবো কেন? চলো আনন্দের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে একে গৌরবময় করে রাখি। এ জায়গা আমার কাছে অসহ্য লাগছে। এখানে যত কষ্ট, যত যাতনা সহ্য করেছি, পৃথিবীতে কোনো নারী তা কখনও করেনি। আর এক মুহূর্ত এখানে। থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না আমার। তারপর আচমকা শামান সিমব্রির দিকে ফিরে বললো, বলো তো, যাদুকর, আমার এখন কি মনে হচ্ছে?
বুকের ওপর দুহাত ভাঁজ করে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো বৃদ্ধ শামান। জবাব দিলো, সুন্দরী, তোমার যা নেই আমার তা আছে, ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা। আমি একটা মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছি। পড়ে আছে- আর একটা কথা বলেছো কি, সেটা তোমার মৃতদেহ হবে! গর্জে উঠলো আয়শা। আগুন ঝরছে যেন ওর। চোখ থেকে। গর্দভ, আমাকে মনে করিয়ে দিও না আমি আমার হারানো শক্তি ফিরে পেয়েছি। ইচ্ছে করলেই এখন আমি যাদের ঘৃণা করি সেই সব পুরনো শত্রুদের ধ্বংস করে দিতে পারি।
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল বুড়ো যাদুকর। পিছাতে পিছাতে দেয়ালে গিয়ে ঠেকলো তার পিঠ।
ম–মহামহিমাময়ী! এখনও আমি-আমি আপনাকে আগের মতোই ভক্তি করি, তো-তো করে বললো বৃদ্ধ। আমি-আমি শুধু বলতে চাইছিলাম, কালুনের এক ভাবী খামকে এখানে শুয়ে থাকতে দেখছি।
নিঃসন্দেহে কালুনের অনেক খানই এখানে শুয়ে থাকবে, সেটা আবার বলার মতো ব্যাপার হলো? যাক, ভয় পেয়ো না, শামান, তোমাকে কিছু বলবো না। আমার রাগ পড়ে গেছে। চলো আমরা যাই।
সূর্য এখন পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছে দিগন্তের আড়াল থেকে। আলোর বন্যায় প্লবিত পাহাড়ের পাদদেশ, দূরে কালুনের সমভূমি। মুগ্ধ চোখে দেখলো আয়শা। লিওর দিকে তাকিয়ে বললো, পৃথিবীটা খুব সুন্দর। আমি এ-সব তোমাকে দিয়ে দিলাম।
মানে তুমি আমার রাজ্য দিয়ে দিচ্ছো ওকে, হেস, প্রীতি উপহার হিসেবে? অনেকক্ষণ পর কথা বললো আতেন। কিন্তু এত সহজে তো তা সম্ভব নয়, আগে ওটা জয় করতে হবে তোমাকে।
নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো আয়শা আতেনের দিকে। অবশেষে বললো, অন্য সময় হলে এই অশিষ্ট কথার জন্যে ভয়ানক শাস্তি পেতে হতো তোমাকে। কিন্তু এবারও ক্ষমা করে দিলাম। আমিও প্রতিদ্বন্দীর চরম লজ্জার সময় দুঃখ বোধ করি। যখন আমার চেয়ে সুন্দর ছিলে তখন তুমিই ওকে দিতে চেয়েছিলে তোমার রাজ্য। কিন্তু এখন কে বেশি সুন্দর? সবাই দেখ, বলো কে বেশি সুন্দর? হাসি মুখে আতেনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
খানিয়া রূপসী সন্দেহ নেই। পৃথিবীতে এত রূপ খুব কম নারীরই আছে। তবু আয়শার স্বর্গীয় সৌন্দর্যের পাশে কি স্নান লাগছে ওকে!
আমি নিছক নারী, বললো আতেন। কিন্তু তুমি পিশাচী না দেবী তুমিই ভালো জানো, ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফেঁপাচ্ছে ও। স্বীকার করছি তোমার আগুনের মতো রূপের কাছে আমি প্রদীপের মতোই নিস্প্রভ, আমার মরণশীল রক্ত-মাংসের সঙ্গে তোমার অশুভ গৌরবের তুলনা চলে না। পারলে সাধারণ হয়ে এসো, নারী হয়ে এসো, দেখি আমি আমার হারানো প্রেম ফিরে পেতে পারি কিনা। একটা কথা মনে রেখো, মানুষের সঙ্গেই মানুষের মিলন সম্ভব, পশু বা দেবী, বা পিশাচীর সঙ্গে নয়।
অস্থিরতার ছাপ পড়তে দেখলাম আয়শার মুখে। লাল ঠোঁট দুটোতে একটু যেন ধূসর ছোপ লাগলো, চোখ দুটো যেন চঞ্চল। পরমুহূর্তে চঞ্চলতা, শঙ্কা, অস্থিরতা দূর হয়ে গেল। রুপালি ঘণ্টার মৃদু টুং-টাং-এর মতো বেজে উঠল ওর কণ্ঠস্বর: কেন প্রলাপ বকছো, আতেন? জানো না গ্রীষ্মের ক্ষণজীবী ঝড় যতই চেষ্টা করুক, পর্বতশৃঙ্গকে টলাতে পারে না, নিজেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এখন শোনো, খুব শিগগিরই আমি তোমার রাজধালীতে যাবো। তুমি ঠিক করো, শান্তিতে যাবো না যুদ্ধ করে যাবো।
চলো, অতিথিরা, আমরা এবার বিদায় নিই।
আতেনকে পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আয়শা, লিওর হাতটা এখনও ওর হাতে। এই সময় নড়ে উঠতে দেখলাম খানিয়াকে। পরমুহূর্তে তার হাতে ঝিক করে . উঠলো একটা ছুরি। পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুরিটা সে গেঁথে দিলো আয়শার। পিঠে। স্পষ্ট দেখলাম ছুরির ফলা আমূল ঢুকে গেল ওর শরীরে। কিন্তু এ কি! আর্তনাদ তো দূরের কথা ভুরুটাও সামান্য কুঁচকালো না আয়শার। যেমন। যাচ্ছিলো তেমনি হেঁটে যেতে লাগলো।
ব্যর্থ হয়েছে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আবার চেষ্টা চালালো আতেন। দুহাত বাড়িয়ে ছুটে গেল আয়শাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ার জন্যে। আশ্চর্য! আয়শাকে ও স্পর্শই করতে পারলো না। আয়শার শরীরের সামান্য দূরে থাকতে অদৃশ্য কিছুর প্রভাবে সরে গেল ওর হাত। বাতাসে ধাক্কা মারলো আতেন এবং তাল হারালো। হোচট খাওয়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল এক পা, তারপর আরও এক পা। আতেনের একটা পা এখন মাটিতে অন্য পা শূন্যে। এখনই উল্টে পড়বে। কিন্তু না, বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়েছে আয়শা। আতেনের এক হাত ধরে অবলীলায় তুলে আনলো ওপরে।
বোকা মেয়েমানুষ! করুণা মেশানো স্বরে বললো আয়শা। পাগল নাকি, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে! আবার যখন আসবে পৃথিবীতে, সাপ হয়ে না বিড়াল হয়ে ঠিক আছে কোনো? বাকি জীবনটা ভোগ করে নাও।
এই বিদ্রূপ সইতে পারলো না আতেন। ফুঁপিয়ে উঠে বললো, তুমি মানুষ নও, কি করে তোমার সাথে আমি লড়বো? ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিলাম তোমার শাস্তির ভার। মুখ গুঁজে বসে কাঁদতে লাগলো ও।
লিও সহ্য করতে পারলো না বেচারির কষ্ট। এগিয়ে গিয়ে দুহাতে ধরে তুললো ওকে। দু’একটা সান্ত্বনাবাক্য শোনালো। কয়েক সেকেণ্ড ওর হাতে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলো আতেন। তারপর ছাড়িয়ে নিলো নিজেকে। শামান সিমব্রি এসে ধরলো ভাইঝির হাত।
এখনও দেখছি তোমার সৌজন্যবোধ আগের মতোই টনটনে, প্রভু লিও, আয়শা বললো। কিন্তু উচিত হয়নি কাজটা, ওর কাপড়ের ভেতর আরও ছুরি লুকানো থাকতে পারে। যাক, চলো, অনেক বেলা হলো, এবার নিশ্চয়ই বিশ্রাম দরকার তোমাদের।
.
১৭.
নিচে নেমে এলাম আমরা। আয়শা বিদায় নিলো আপাতত। বলে গেল, অরোস তোমাদের সাথে থাকবে, সময় হলেই আবার আমার কাছে নিয়ে যাবে। ততক্ষণ আরাম করোগে যাও।
অবোস সুন্দর একটা বাড়িতে নিয়ে গেল আমাদের। সামনে আরও সুন্দর একটা বাগান। মাটি থেকে এত উঁচুতেও তরতাজা সবুজ গাছে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আছে।
ওহ! ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে। আমি এখন ঘুমাবো, লিও বললো।
বিনীত ভঙ্গিতে একটা কামরায় নিয়ে গেল আমাদের পূজারী-প্রধান। ধবধবে চাদর পাতা বিছানা সে ঘরে। প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠলাম আমরা। শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে গেলাম।
ঘুম ভাঙলো বিকেলে। উঠে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া সেরে গিয়ে বসলাম বাগানে। আমাদের বিশেষ করে লিওর বর্তমান, ভবিষ্যত নিয়ে টুকটাক আলাপ করলাম কিছুক্ষণ। হঠাৎ দেখি অরোস আসছে। লিওর সামনে এসে কুর্নিশের ভঙ্গিতে মাথা নুইয়ে সে বললো, মন্দিরে আপনাদের উপস্থিতি আশা করছেন হেসা।
উঠে ঘরে এলাম আমরা। কয়েকজন পূজারী অপেক্ষা করছিলো। প্রথমেই আমাদের চুল দাড়ি ঘেঁটে দিলো ওরা। লিও বাধা দেয়ার চেষ্টা করলো একবার, ওরা শুনলো না। এরপর সোনার কারুকাজ করা পাদুকা পরিয়ে দিলো পায়ে। গায়ে পরিয়ে দিলো অত্যন্ত জমকালো পোশাক। আমারটার চেয়ে লিওরটা বেশি সুন্দর, সাদার ওপর সোনালি আর লাল-এ কাজ করা। সবশেষে লিওর হাতে একটা রুপোর দণ্ড ধরিয়ে দেয়া হলো আর আমাকে সাধারণ একটা ছড়ি।
ওসিরিসের দণ্ড! লিওর কানে কানে বললাম। এখন থেকে বোধইয় ওসিরিসের অভিনয় করতে হবে তোমাকে।
দেখ, বলে দিচ্ছি, কোনো উদ্ভট দেবতার অভিনয় আমি করতে পারবো না, সোজাসাপ্টা জবাব লিওর। যা হয় হবে, আমি যা বিশ্বাস করি না তা করবো না।
আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম ওকে, ব্যাপারটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিছুক্ষণ চোখ কান বুজে থাকলেই চুকে যাবে, না হলে আয়শা হয়তো অসন্তুষ্ট হবে, তখন কি ঘটবে কেউ বলতে পারে? ধর্মসংক্রান্ত ব্যাপারে লিওর কোনো গোড়ামি নেই, ভণ্ডামিও নেই। তবু কিছুতেই ও রাজি হলো না যা বিশ্বাস করে না তার অভিনয় করতে। অবশেষে অরোসের কাছে জিজ্ঞেস করলো ও, কি হবে মন্দিরে? একটু রুক্ষ ওর কণ্ঠস্বর।
থতমত খেয়ে প্রথমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো অরোস। তারপর বললো, বাগদান।
এবার শান্ত হলো লিও। প্রশ্ন করলো, খানিয়া আতেন থাকবে?
না। যুদ্ধ এবং প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে উনি কালুনে ফিরে গেছেন।
রওনা হলাম আমরা। উঠান, সড়ক, সিঁড়ি, বারান্দা পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম মন্দিরের সেই উপবৃত্তাকার কক্ষে। শুধু আয়শা নয়, পূজারী পূজারিনীরাও উপস্থিত সেখানে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে সবাই। এক সারিতে পূজারীরা, অন্য সারিতে পূজারিনী। আমাদের দেখেই সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে উঠলো তারা। আনন্দের গান। দুই সারির মাঝ দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। সামনে অরোস, পেছনে পাশাপাশি আমি আর লিও। সারির শেষে দাঁড়িয়ে পড়লো। অরোস। আমরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম আয়শার মুখোমুখি।
সিংহাসনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে আয়শা। লিওর গায়ে যেমন তেমনি জমকালো সুন্দর একটা আলখাল্লা ওরও পরনে। হাতে মণিখচিত সোনার সিস্ট্রাম। আমরা দাঁড়িয়ে পড়তেই সিস্ট্রামটা উঁচু করলো আয়শা। থেমে গেল সমবেত সঙ্গীত।
হের পছন্দের মানুষকে দেখ? জলতরঙ্গের মতো বেজে উঠলো আয়শার কণ্ঠস্বর।
সমবেত পূজারী-পূজারিনীরা সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো, হেসার পছন্দের মানুষ, স্বাগতম!
ফাঁকা মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনি তুলে গমগম করতে লাগলো আওয়াজটা। আমাকে তার পাশে দাঁড়ানোর ইশারা করে লিওর হাত ধরলো আয়শা। কয়েক পা এগিয়ে গেল সাদা পোশাক পরা পূজারী-পূজারিনীদের দিকে। তারপর ওভাবেই লিওর হাত ধরে থেকে বলতে লাগলোহেস-এর পূজারী ও পূজারিনীরা, শোনো। এই প্রথমবারের মতো আমি আমার রূপে তোমাদের সামনে এসেছি। কেন জানো? এই লোকটাকে দেখছো, তোমরা জানো ও বিদেশী, ঘুরতে ঘুরতে ও আমাদের মন্দিরে এসে পড়েছে। কিন্তু না, ও আগন্তুক নয়। অনেক অনেক শতাব্দী আগে ও ছিলো আমার প্রভু, এখন আবার আমার প্রেমের প্রত্যাশায় এসেছে। তাই না, ক্যালিক্রেটিস?
হ্যাঁ, জবাব দিলো লিও।
হেস-এর পূজারী ও পূজারিনীরা, তোমরা জানো, আমি যে পদ অধিকার করে আছি সে-পদের অধিকারী ইচ্ছে করলে একজন স্বামী বেছে নিতে পারে। এরকমই রীতি, তাই না?
হ্যাঁ, ও হেস, ওরা জবাব দিলো।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো আয়শা। তারপর অপূর্ব মিষ্টি এক ভঙ্গিতে লিওর দিকে ফিরে মাথা ঝোঁকালো পর পর তিনবার। তারপর হাঁটু গেড়ে বসলো। মুখ উঁচু করে বিশাল দু’চোখ মেলে লিওর চোখে চোখে তাকালো। মৃদু মিষ্টি স্বরে বললো: বলো তুমি সমবেত সবার সামনে, এবং যাদেরকে দেখতে পাচ্ছো না তাদের সামনে, আবার তুমি আমাকে বাগদত্তা বধূ হিসেবে গ্রহণ। করছো।
হ্যাঁ, দেবী, গাঢ়, একটু কম্পিত স্বরে বললো লিও, এখন এবং চিরদিনের জন্যে।
নিঃশব্দে দেখছে সবাই। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। সিসট্রামটা পড়ে গেল ওর হাত থেকে। টুং-টাং আওয়াজ উঠলো ঘণ্টাগুলো থেকে। দুহাত বাড়িয়ে দিলো ও লিওর দিকে।
লিও-ও ঝুঁকে এলো ওর দিকে। দুজনের ঠোঁট এক হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম, রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে লিওর মুখ। অদ্ভুত এক আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে আয়শার কপাল থেকে, সেই আভায় সোনার মতো দেখাচ্ছে লিওর উজ্জ্বল চুল। আমি দেখলাম, বাতাস লাগা পাতার মতো কেঁপে উঠলো বিশালদেহী লিও, পড়ে যাবে এক্ষুণি।
আয়শাও খেয়াল করলো ব্যাপারটা। ঠোঁট দুটো এক হয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্তে লিওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো ও। মুখে নেমে এসেছে ভয়ের কালো ছায়া। অবশ্য ক্ষণিকের জন্যে। তারপরেই লিওর আলিঙ্গন থেকে বেরিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে ধরলো ওকে। ধরে রইলো যতক্ষণ না কাপুনি দূর হলো লিওর।
অবোস সিসট্রামটা আবার ধরিয়ে দিলো আয়শার হাতে। ওটা উঁচু করে সে বললো–
প্রিয়তম, তোমার নির্ধারিত আসন গ্রহণ করো। চিরদিন ঐ আসনে আমার পাশে, বসবে তুমি। ও হেস-এর প্রিয়তম প্রভু, বসো তোমার সিংহাসনে, গ্রহণ করো তোমার পূজারীদের পূজা।
না, বললো লিও, কেউ আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে না। এই প্রথম এবং শেষবারের মতো বলে দিচ্ছি, তোমাদের অদ্ভুত সব দেবতা অপদেবতা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমার, ওসব আমি বিশ্বাসও করি না। কেউ আমাকে পূজা করবে এটা অসম্ভব!
সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা পূজারীদের অনেকের কানে গেল লিওর এই দৃঢ় বক্তব্য। একে অন্যের ভেতর কানাকানি করতে লাগলো তারা। একজন তো বলেই ফেললো-সাবধান, পছন্দের মানুষ! মায়ের ক্রোধ থেকে সাবধান।
আবার ক্ষণিকের জন্যে ভয়ের ছায়া পড়লো আয়শার মুখে। তারপর একটু হেসে ব্যাপারটাকে হাল্কা করার জন্যে বললো–ঠিক আছে, প্রিয়তম, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। কেউ তোমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে না, আমার ভাবী স্বামী হিসেবে তুমি বসো সিংহাসনে।
উপায়ান্তর না দেখে বসলোঁ লিও। পূজারী-পূজারিনীরা আবার সেই অদ্ভুত গানটা শুরু করলো। একসময় আচমকা থেমে গেল গান। আয়শা তার সিসট্রাম নেড়ে ইশারা করলো। পরপর তিনবার মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো পূজারী পূজারিনীরা। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল সারি বেঁধে। অবোস আর পাপাভ কেবল রইলো।
চমৎকার না গানটা? বললো আয়শা। স্বপ্নালু দৃষ্টি চোখে, গানের মায়ায় এখনও যেন আচ্ছন্ন ও। মিশরের বেহবিট-এ আইসিস আর ওসিরিসের বিবাহ উৎসবে গাওয়া হয়েছিলো এ গান। আমি উপস্থিত ছিলাম সে উৎসবে। চলো প্রিয়তমা—আচ্ছা, কি নামে ডাকবো তোমাকে? ক্যালিক্রেটিস না।
আমাকে লিও বলে ডেকো, আয়শা। আগে ক্যালিক্রেটিস ছিলাম না কি ছিলাম এখন কিছুই মনে নেই। এখন আমি লিও, এটাই আমার এখনকার পরিচয়।
বেশ, প্রিয়তম লিও। চলো তোমাদের এগিয়ে দিই মন্দিরের দুয়ার পর্যন্ত। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। আমাকে ভাবতে হবে। আর—আর কয়েকজন দেখা করতে আসবে, তাদের সাক্ষাৎ দিতে হবে।
.
১৮.
আয়শা এলো না কেন? ঘরে ফিরে প্রথম প্রশ্ন লিওর।
আমি কি করে জানবো? অরোসকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, দরজার বাইরেই আছে ও।
আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারছি না, হোরেস। মনে হচ্ছে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য কিছু যেন ওর দিকে টানছে আমাকে। যাই, অরোসকে জিজ্ঞেস করি, কেন এলো না আয়শা।
অরোস মৃদু হাসলো শুধু। বললো, হেস। এখনও তার ঘরে যাননি। তারমানে এখনও মন্দিরেই আছেন।
তাহলে চললাম ওকে খুঁজতে। অবোস,এসো; তুমিও, হোরেস।
আপনারা যেখানে খুশি যেতে পারেন, সবিনয়ে বললো পূজারী, সব দরজা খোলা আপনাদের জন্যে। কিন্তু আমার ওপর নির্দেশ আছে, আপনাদের দরজা ছেড়ে যেন না নড়ি।
চলো, হোরেস, বললো লিও। নাকি আমি একাই যাবো?
ইতস্তত করছি আমি। অবশেষে বললাম, যেতে পারি, কিন্তু পথ খুঁজে পাবে না তো।
দেখা যাক, পাই কিনা।
একটু আগে যে পথে গিয়েছিলাম সে পথেই আবার মন্দিরের দরজার কাছে পৌঁছুলাম। লোহার দরজা পেরিয়ে বৃত্তাকার কক্ষের কাঠের দরজার সামনে এলাম। বন্ধ দরজা। ঠেলা দিতেই নিঃশব্দে খুলে গেল। জীবন্ত আগুনের শুভগুলো নেই এখন। গাঢ় অন্ধকার প্রায় গোল কামরাটায়। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো আমার। কামরাটা যেন লোকে গিজ গিজ করছে। তাদের পোশাকের স্পর্শ পাচ্ছি গায়ে। ওদের নিঃশ্বাসও অনুভব করছি, কিন্তু তা উষ্ণ নয়, শীতল। মানুষগুলো চলে ফিরে বেড়াচ্ছে যেন। কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো আমার। গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেছে।
অবশেষে অনেক দূরে আলোর দেখা পাওয়া গেল। অকস্মাৎ জ্বলে উঠেছে দুটো অগ্নিস্তম্ভ প্রতিমা-বেদীর দুপাশে। কিন্তু খুব একটা উজ্জ্বল ভাবে নয়। আমরা ৩০৪
এখনও দরজার কাছে রয়েছি, এত দূরে আলো এসে পৌঁছাই না।
ওখানে সিংহাসনে বসে আছে আয়শা। ও আমাদেরকে দেখতে না পেলেও ওকে আমরা ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। অগ্নিস্তম্ভের অস্পষ্ট নীল আলো খেলা করছে ওর অনিন্দ্য শরীরে। খাড়া বসে আছে ও, অদ্ভুত এক অহঙ্কার চেহারায়, দুচোখ থেকে ঠিকরে পড়ছে ক্ষমতার দ্যুতি।
আবছা ছায়ার মতো একটা মূর্তি হাঁটু গেড়ে বসলো তার সামনে। তারপর আরেকটা, আরও একটা, এবং আরও। হাঁটু গেড়ে বসে সবাই একসাথে মাথা নোয়ালো। হাতের সিট্রামটা উঁচু করে তাদের সম্মানের জবাব দিলো আয়শা। ওর ঠোঁট নড়তে দেখলাম, কিন্তু কোনো শব্দ পৌঁছুলো না আমাদের কানে। নিশ্চয়ই পরলোকের আত্মারা পূজা নিবেদন করতে এসেছে!
শুধু আমার নয়, লিওর মনেও সম্ভবত এই একই সম্ভাবনার কথা উঁকি দিয়েছে। কারণ যে মুহূর্তে আমি ওর হাত আঁকড়ে ধরতে গেলাম ঠিক সেই মুহূর্তে ও-ও আঁকড়ে ধরলো আমার হাত। দ্রুত অথচ নিঃশব্দ পায়ে বেরিয়ে এলাম আমরা মন্দির থেকে।
.
প্রায় ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছুলাম আমাদের ঘয়ের কাছে। অরোস এখনও দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। স্বভাবসুলভ মেকি হাসিটা ধরা আছে মুখে। ওর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকলাম আমরা। একে অপরের দিকে তাকালাম।
কি ও? হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো লিও। দেবদুতী?
হ্যাঁ। বা ঐ ধরনের কিছু।
আর ওগুলো-ছায়ার মর্তো-কি করছিলো?
রূপান্তরের পর শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল হয়তো। হয়তো ওগুলো ছায়া নয়, ছদ্মবেশী পুরোহিত, গোপন কোনো আচার পালন করছিলো!
কাঁধ ঝাঁকালো লিও, কোনো জবাব দিলো না।
.
অবেশেষে দরজা খুললো। অবোস ঢুকে বললো, হেসা তার ঘরে যেতে বলেছেন আমাদের।
একটু আগে যে দৃশ্য দেখেছি তা মনে হতেই গা শিরশির করে উঠলো, তবু গেলাম।
বসে আছে আয়শা। একটু যেন ক্লান্ত। পূজারিণী পাপাভ এইমাত্র খুলে নিয়েছে তার রাজকীয় আলখাল্লা। ভেতরের সাদা পোশাকটাই শুধু এখন ওর পরনে। ইশারায় লিওকে কাছে ডাকলো। এবার ওদেরকে একটু একা থাকতে দিতে হয়, ভেবে ঘুরে দাঁড়ালাম আমি।
কোথায় যাচ্ছো, হলি, আমাদের ফেলে? মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলো আয়শা। আবার মন্দিরে? অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো ও। কেন, মায়ের প্রতিমার কাছে কোনো প্রশ্ন আছে? নাকি মা-কে জানাতে চাও জায়গাটা খুব ভালো লেগে গেছে?
আমি কোনো জবাব দিলাম না, সম্ভবত ও আশাও করেনি। কারণ না থেমেই ও বলে চললো, না, তুমি এখানেই থাকো। আমরা তিনজন সেই অতীতের মতো আজ একসাথে খাবো। অরোস, পাপা, তোমরা এখন যাও, দরকার হলে ডাকবো তোমাদের।
খুব বড় নয় আয়শার ঘর। ছাদ থেকে ঝোলানো প্রদীপের আলোয় দেখলাম, চমৎকার, দামী সব আসবাবপত্র সাজানো। পাথরের দেয়ালগুলোয় সুন্দর কারুকাজ করা পর্দা ঝুলছে। টেবিল চেয়ারগুলো রূপা দিয়ে বাঁধানো। এই ঘরে একজন নারী বাস করে তার একমাত্র প্রমাণ-বেশ কয়েকটা পাত্রে ফুল সাজানো।
টেবিলে খাবার দেয়াই ছিলো। সামান্য জিনিস; আমাদের জন্যে ডিম ভাজি, দই আর ঠাণ্ডা হরিণের মাংস; ওর জন্যে দুধ, ছোট্ট কয়েক টুকরো ময়দার পিঠে আর পাহাড়ী জাম। আয়শা বসে উল্টোদিকের দুটো চেয়ারে আমাদের বসতে ইশারা করলো।
আমি বসে পড়লাম। কিন্তু লিও বসার আগে গায়ের জমকালো আলখাল্লাটা খুলে ছুঁড়ে দিলো একদিকে, হাতের রুপালি দণ্ডটাও-একটু আগে অবোস জোর করে ওর হাতে গুঁজে দিয়েছিলো ওটা।
এসব পবিত্র জিনিসপত্রের ওপর খুব একটা শ্রদ্ধা নেই তোমার তাই না? হেসে জিজ্ঞেস করলো আয়শা।
একটুও না, জবাব দিলো লিও। মন্দিরে যা বলেছিলাম নিশ্চয়ই শুনেছিলে, আয়শা? আমি তোমার ধর্মের কিছুই বুঝি না, এপর্যন্ত যেটুকু দেখেছি তাতে ভক্তি জাগেনি আমার মনে। তারচেয়ে এসো একটা চুক্তি করি, আমরা কেউ কারও ধর্মবিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করবে না। রাজি?
আমি ভাবছিলাম রাগে ফেটে পড়বে আয়শা। কিন্তু না, ও সামান্য মাথা ঝোকালো শুধু। নরম করে বললো, তোমার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা, লিও, তোমার ধর্মবিশ্বাস তো আমারও ধর্মবিশ্বাস।
মানে! আমার ধর্মবিশ্বাস তোমার ধর্মবিশ্বাস হবে কেমন করে?
পৃথিবীর সব মহান বিশ্বাস কি এক নয়? সামান্য যেটুকু পার্থক্য তা বহমান সময় আর জনগোষ্ঠীর ভিন্নতার কারণেই। আমি-আমরা বিশ্বাস করি সুমহান এক শুভশক্তি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই শক্তিই ঈশ্বর। তোমার বিশ্বাস কি এর থেকে আলাদা?
না, আয়শা। কিন্তু তোমার? হেস বা আইসিস হলো তোমার দেবী। তার সঙ্গে দূর অতীতে তোমার কি চুক্তি হয়েছিলো তা কখনও বলোনি আমাদের। ভাগ্যক্রমে বা দুর্ভাগ্যক্রমে-যা-ই বলো, কাল রাতে জানলাম। কে এই দেবী হেস?
আমি তার নাম দিয়েছি প্রকৃতির আত্মা। পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান ও রহস্য লুকিয়ে আছে তার ভেতর।
ভালো কথা। ভক্তরা কেউ অবাধ্য হলে উনি নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নেন? যেমন নিয়েছেন আমার—দূর অতীতের আমার ওপর।
টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে ঝুঁকে বসলো আয়শা। শান্ত, পূর্ণচোখে তাকালো লিওর দিকে। তোমার যে বিশ্বাস তাতে নিশ্চয়ই দুজন ঈশ্বর আছেন, একজন শুভের অন্যজন অশুভের, একজন ওসিরিস অন্যজন সেট?
মাথা ঝাঁকালো লিও। অনেকটা।
এবং অশুভের দেবতাই শক্তিশালী বেশি, তাই না?
কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
তাহলে বলো, লিও, এখনও কি পৃথিবীর নশ্বর মানুষ তুচ্ছ জাগতিক মোহে অশুভের কাছে আত্মবিক্রি করে না?
হ্যাঁ, করে। সেরকম বদলোকের সংখ্যা কম নয় আজকের দুনিয়ায়।
এবং অতীতে যদি কোনো নারী অমন করে থাকে? রূপ, দীর্ঘজীবন, জ্ঞান এবং প্রেমের মোহে পাগল হয়ে–
নিজেকে বিক্রি করলো সেট নামের অপদেবতার কাছে? এইতো তুমি বলতে চাইছো, আয়শা? কম্পিত স্বরে বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো লিও। তুমি-অমন এক নারী?
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। যদি হই?
যদি হও–ভেঙে গেল লিওর গলা, ওহ!-সেক্ষেত্রে আমাদের বোধহয় আলাদা হওয়ার সময় এসেছে।
আহ! আর্তনাদ করে উঠলো আয়শা, আচমকা যেন ছুরি বিধেছে তার বুকে। তারপর কি আতেনের কাছে যাবে? উই, তা তুমি পারবে না। আমার আছে ক্ষমতা, আছে লোকবল। আমি-আমি-না না, আর হত্যা করবো না তোমাকে। জীবিত অবস্থায়ই আটকে রাখবো। লিও, লিও, আমার রূপের দিকে তাকাও– একটু ঝুঁকে মোহনীয় ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ শরীর দোলালো সে। তারপর হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়ালো। না, এভাবে তোমাকে প্রলুব্ধ করবো না, প্রিয়তম। তুমি যাও। আমার একাকীত্ব, আমার পাপের মধ্যে আমাকে রেখে তুমি যাও। এক্ষুণি যাও। আতেন তোমাকে আশ্রয় দেবে। দেখো, লিও, আমি আবার ঘোমটা টেনে দিচ্ছি, যাতে আমার রূপ তোমাকে প্রলুব্ধ করতে না পারে। সত্যিই ও আলখাল্লার কোনা দিয়ে আড়াল করে ফেললো মুখ। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলোতুমি আর হলি
আবার মন্দিরে গিয়েছিলে না? মনে হলো তোমাদের দেখলাম দরজায়।
হ্যাঁ, তোমাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।
এবং গিয়ে যা খুঁজছিলে না তা-ও পেলে?
কি ওগুলো আয়শা? ছায়ার মতো, তোমার পায়ে মাথা ঠেকাচ্ছিলো?
আমি অনেক রূপে অনেক দেশ শাসন করেছি, লিও। হয়তো ওরা আমার অতীত পূজারীদের কয়েকজন, হয়তো ওরা তোমার নিছক উত্তপ্ত মস্তিষ্কের কল্পনা, আগুনের পর্দায় যেমন ছবি দেখেছিলে তেমন।
লিও ভিনসি, সত্যি কথাটা এবার শোনো, পৃথিবীর সবকিছুই মায়া, দৃষ্টিবিভ্রম। অতীত, ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। আমি আয়শা এক কুহকিনী। আমি অসুন্দর যখন তুমি আমাকে অসুন্দর দেখ, আমি সুন্দর যখন তুমি আমাকে সুন্দর দেখ। কল্পনা করো সেই সিংহাসনে বসা রানীর কথা, যার পায়ে মাথা ঠেকাতে দেখেছো ছায়াময় শক্তিদের। সে আমি। আবার সেই কুৎসিত আতঙ্কজনক চেহারার কথা স্মরণ করো। সে-ও আমি। পাপ পুণ্য দুয়ে মিলিয়ে-ই আমি। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নাও আমাকে ফেলে চলে যাবে, না আমাকে জড়িয়ে ধরে, ভালোবেসে আমার পাপের ভাগ তোমায় মাথায় তুলে নেবে?
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো লিও। দু’তিনবার ঘরের এমাথা ওমাথা পায়চারি করলো। অবশেষে বললো, হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, পাপপুণ্যে মেশানো তোমাকে। তোমারিওপ ভালোটুকু যদি গ্রহণ করতে পারি, মন্দটুকুও পারবো—পারতে হবে। আমি জানি আমি নিরপরাধ। তবু যদি শাস্তি পেতে হয় তোমার জন্যে, সে শাস্তি আমি মাথা পেতে নেবো।
শুনলো আয়শা। মাথা থেকে আলখাল্লার প্রান্তটা কখন নেমে এলো খেয়ালই করলো না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো হতভম্বের মতো। তারপর হঠাৎ ভেঙে পড়লো কান্নায়। লিওর সামনে গিয়ে বসলো। আস্তে আস্তে মাথাটা নামিয়ে ঠেকালো মাটিতে, ওর পায়ের কাছে।
লিও তাড়াতাড়ি কুঁকে হাত ধরে তুললো আয়শাকে। ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলো গদিমোড়া একটা আসনে। এখনও কাঁদছে আয়শা।
কি করেছে তা যদি জানতে! অবশেষে বললো ও। ওহ, লিও, তুমি–তুমিই একমাত্র বাধা আমার আর তোমার মিলনের মাঝে। কত কষ্ট করে, কত বিপদ পেরিয়ে, কত মোহ-লোভ জয় করে এখানে এসেছে আমাকে পাওয়ার জন্যে! এসে দেখলে এখানে আমার মাঝেই লুকিয়ে আছে তোমার সবচেয়ে ঘৃণার জিনিস। বুঝতে পারছো কি বলতে চাইছি?
সামান্য, পুরো নয়, আস্তে জবাব দিলো লিও!
তোমার চোখে তাহলে বুলি আঁটা বলতে হবে, অস্থির আয়শার কণ্ঠস্বর। আমার ভয়ঙ্কর কুৎসিত চেহারা দেখেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে চেয়েছে, আতেনের রূপ চোখের সামনে থাকতেও ভালোবাসার অমরত্বের অজুহাতে তুমি কুৎসিত আমাকেই নিলে এবং সেজন্যে আমি আমার রূপ, যৌবন, নারীত্ব ফিরে পেলাম। লিও, কাল তুমি যদি আমাকে গ্রহণ না করতে, ঐ ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে অনন্তকাল আমাকে ধুকে যেতে হতো।
প্রতিদানে আমি কি দিলাম। আমার মনের কুশ্রী দিকটা উন্মোচন করলাম তোমার সামনে। তারপরও তুমি দমলে না, ভালো মন্দ মিলিয়ে আমি যা তাকেই তুমি গ্রহণ করলে। এতখানি মহত্ত্ব তোমার! এখন আমার কারণে যদি তোমার ওপর ভয়ানক অতিলৌকিক কোনো দুর্ভোগ নেমে আসে, হয়তো–
যদি আসে ভোগ করবো, বললো লিও। একদিন না একদিন শেষ হবে দুর্ভোগ। না হলেও ক্ষতি নেই, তোমাকে ছেড়ে চলে গেলেই বা কি সুখটা আমি পাবো? যাক, এখন কয়েকটা ব্যাপার পরিষ্কার করবে আমাদের সামনে? কাল রাতে চূড়ার ওপর তুমি বদলালে কি করে?
আগুনের মাঝ দিয়ে আমি তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিলাম, লিও, আগুনের ভেতর দিয়েই আবার ফিরে এসেছি। অথবা–অথবা, পরিবর্তন বলে যা তোমরা দেখছো তা তোমাদের চোখের ভুল, আসলে আমি যা ছিলাম তা-ই আছি। ব্যস, এর চেয়ে বেশি জানতে চেয়ো না।
আরেকটা কথা, আয়শা, একটু আগে আমাদের বাগদান হলো, বিয়ে নয় কেন? কবে তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
এখনও সময় হয়নি, বললো আয়শা। একটু কি কেঁপে গেল ওর গলা? একটু ধৈর্য ধরতে হবে তোমাকে, লিও, কয়েক মাস বা এক বছর। ততদিন আমরা বন্ধু বা প্রেমিক-প্রেমিকা হিসেবেই থাকবো।
কেন? একগুয়ের মতো বললো লিও। আমার বয়স তো কমছে না, আয়শা। তাছাড়া মানুষের মৃত্যু কখন কোন্ দিক থেকে হাজির হয় কেউ বলতে পারে? তোমাকে পাওয়ার তৃষ্ণা নিয়েই হয়তো ঝরে যাবে আমার জীবন।
না, না। অমন অলক্ষুণে কথা বোলা না। আবার ভয়ের ছাপ পড়লো আয়শার মুখে। কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বললো, ঠিকই বলেছো, সময়ের বাঁধন তো ছিড়তে পারোনি তুমি। ওহ! আমাকে জীবিত রেখে তুমি মারা যাবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে! আগামী বসন্তেই যখন বরফ গলতে শুরু করবে, আমরা লিবিয়ায় যাবে। প্রাণের অগ্নিধারায় স্নান করবে তুমি। তারপর আমাদের বিয়ে হবে।
ও জায়গা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে আয়শা।
হতে পারে, তবে তোমার আমার জন্যে নয়। ভয় পেয়ো না, প্রিয়তম, ঐ পাহাড়ে যাওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে গেলেও আমার দৃষ্টি দিয়ে আমি পথ তৈরি করে নেবো। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, বরফ গলতে শুরু করলেই আমরা রওনা হয়ে যাবো।
তার মানে এপ্রিল-আটমাস, রওনা হওয়ার আগেই এতদিন বসে থাকতে হবে! তারপর পাহাড় পেরিয়ে, সাগর পেরিয়ে, কোর-এর জলাভূমি পেরিয়ে যেতে হবে, তারও পরে খুঁজে বের করতে হবে পাহাড়টাকে। দুবছরের আগে কিছুতেই হবে না, আয়শা।
জবাবে আয়শা কেবল না, না আর না ছাড়া আর কিছু বললো না। অবশেষে, আমার মনে হলো, একটু বিরক্ত হয়েই ও আমাদের বিদায় করে দিলো।
নাহ! হলি, আমরা বিদায় নেয়ার আগে ও বললো, আমি বলছি, কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নাও, শান্ত সুখে কয়েকটা ঘণ্টা কাটাও, দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। কাল সকালেই দেখবে সব আর সুন্দর লাগছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কাল সকালেই আমরা সুখী হবো, হ্যাঁ, কাল সকালেই।
.
কেন ও এখনি আমাকে বিয়ে করল না? ঘরে পৌঁছার পর লিওর প্রথম প্রশ্ন।
কারণ ও ভয় পেয়েছে, জবাব দিলাম আমি।
.
১৯.
বেশ কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেছে, বিশেষ কিছু ঘটেনি। আয়শার প্রতিশ্রুতি মতো সুখ পেয়েছি কিনা বলতে পারবে না। সুখের সংজ্ঞা আমার জানা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি কোনো কিছুর অভাব বোধ করিনি এই কদিন। মন্দিরের যেখানে খুশি যখন ইচ্ছা যাওয়ার স্বাধীনতা তো আছেই, সেই সাথে পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি, পূজারী-পূজারিনীদের অপরিমেয় আন্তরিক সম্মান, তার ওপর আছে আয়শার সাহচর্য। তিন বেলাই আয়শার সাথে আহার করি আমরা।
আয়শা কেন এখনি আমাকে বিয়ে করলো না, আমার অনন্তজীবন পাওয়ার ব্যাপারটা তো বিয়ের পরেও হতে পারতো?—এ প্রশ্নের জবাব এখনও পায়নি লিও। আর আমার প্রশ্ন, এই সে হেস বা আয়শা নামের মেয়েলোকটার চেয়ে হতভাগিনী কেউ কি জন্ম নিয়েছে পৃথিবীতে?
আরও কিছু প্রশ্ন ভীড় করে আছে আমার মাথার ভেতর। আয়শার ক্ষমতা আসলে কতটুকু? ও-কি সত্যিই নারী না অশরীরী আত্মা? কি করে কোর-এর গুহা থেকে ও বা ওর আত্মা এখানে—এই মধ্য এশিয়ার পাহাড় চূড়ায় এলো? শুধুই কি ওর আত্মা এখানে এসেছে, না শরীরও এসেছে? যদি শরীরও এসে থাকে তাহলে হেস-এর পূজারিনী সেই বৃদ্ধার মৃতদেহ কোথায় গেল? অবোস বলেছে, ওরা সকারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে দেখে সিংহাসনে বসে আছে আয়শার কুৎসিত রূপ। তাহলে? পুরনো পূজারিনীর দেহ গেল কোথায়? আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—আয়শা যদি এতই ক্ষমতাশালী হয়, ও কেন আমাদের বা তার হারানো ক্যালিক্রেটিসকে খুঁজতে গেল না? কেন আমরাই তার কাছে আসবো আশা করে বসে রইলো? আতেন যে মিসরীয় আমেনার্তাসের পুনর্জন্ম নেয়া রূপ তা কি ও জানতো না? যদি জানতো তাহলে কেন আতেনকে পাঠিয়েছিলো আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে? কেন নিজে যায়নি বা নিজের বিশ্বস্ত কাউকে পাঠায়নি? ধরে নিলাম পাহাড়ের কারও কানের সমভূমিতে পা রাখা বারণ, সেক্ষেত্রে ওর গুপ্তচররা যখন দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় আড়ি পেতে আমাদের কথা শুনে এসে ওকে জানায় তখনি কেন ও অন্য পথে আমাদের এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলো না?
নানা ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভেবেছি, জবাব পাইনি প্রশ্নগুলোর। আয়শাকে জিজ্ঞেস করেছি। ও হয় এড়িয়ে গেছে নয়তো ঘোরানো প্যাচানো কথার তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে প্রশ্নগুলো কখনও কখনও সরাসরি বলেছে, এসব প্রশ্নের জবাব আমার কাছে জানতে চেয়ো না।
.
লিওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই আয়শার। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখতে চায় ঠিক তেমন লিওকে সবসময় আগলে রাখতে চায় ও। তবু মাঝে মাঝে লিও বেরিয়ে যায় বাইরে, জংলীদের দু’একজন সর্দার বা পূজারী সঙ্গে থাকে। পাহাড়ী হরিণ, ভেড়া বা ছাগল শিকার করে ফেরে। যতক্ষণ লিও মন্দির এলাকার বাইরে থাকে ততক্ষণ দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে থাকে আয়শা।
একদিনের কথা আমার মনে আছে। সেদিনও লিও শিকারে গেছে। আমি যাইনি। বাগানে বসে আছি আয়শার সাথে। দেখছি ওকে। হাতের ওপর মুখ রেখে বসে আছে ও। বড় বড় চোখগুলো তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেই কেবল মানুষের দৃষ্টি এমন হতে পারে।
হঠাৎ চমকে উঠে দাঁড়ালো আয়শা। পাহাড়ের এক দিকে মাইল মাইল দূরে ইশারা করে বললো-দেখ!
তাকালাম। কিন্তু সাদা তুষারের স্তর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না।
কানা কোথাকার, দেখছো না আমার প্রভু বিপদে পড়েছে? চিৎকার করে উঠলো ও। ওহহো, ভুলেই গেছিলাম, তুমি সাধারণ মানুষ, আমার মতো দেখার ক্ষমতা তোমার নেই। নাও আমি দিচ্ছি তোমাকে। আবার দেখ, বলে আমার। কপালের পাশে হাত রাখলো ও। মনে হলো, অদ্ভুত এক অবশ করে দেয়া স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে আমার মাথার ভেতর দিয়ে। দ্রুত বিড়বিড় করে কয়েকটা কথা বললো আয়শা।
মুহূর্তে চোখ খুলে গেল আমার। দেখলাম পাহাড়ের ঢালে একটা তুষার চিতাকে জাপটে ধরে গড়াগড়ি করছে লিও। অন্য শিকারীরা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে ওদের। বল্লম উঁচিয়ে সুযোগ খুঁজছে চিতাটাকে গেঁথে ফেলার। কিন্তু সুযোগ পেলো না ওরা, তার আগেই লিও ওর হান্টিং নাইফটা আমূল ঢুকিয়ে দিলো চিতার পেটে, তারপর উপর দিকে হ্যাচকা এক টান। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল চিতাটা। উঠে দাঁড়ালো লিও। গর্বিত হাসি মুখে। যেন কিছুই হয়নি।
দৃশ্যটা যেমন হঠাৎ এসেছিলো তেমন হঠাৎই মিলিয়ে গেল। আমার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালো আয়শা। অতি সাধারণ ভয় পাওয়া রমণীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে বললো– যাক, বাবা, বিপদ কেটে গেছে, কিন্তু আবার আসতে কতক্ষণ?
এরপরই ওর যত রাগ গিয়ে পড়লো লিওর শিকারসঙ্গী জংলী সর্দারের ওপর। তক্ষুণি ক্ষত সারানোর মলম আর পালকি বেহারা পাঠিয়ে দিলো লিওকে নিয়ে আসার জন্যে। আর বলে দিলো, সর্দার আর তার চেলাদেরও যেন ধরে আনা হয়।
.
চারঘণ্টা পর ফিরলো লিও, পালকির পেছনে, খোড়াতে খোড়াতে। সঙ্গী শিকারী দের কষ্ট বাঁচাতে একটা পাহাড়ী ভেড়া আর চিতার চামড়াটা পালকিতে দিয়ে হেঁটে এসেছে নিজে। আয়শা তার শোবার ঘরের পাশে বড় হলঘরটায় অপেক্ষা করছিলো। লিও ঢুকতেই এগিয়ে গেল। হারানো ছেলেকে খুঁজে পেলে মা যেমন করে তেমন আকুল গলায় সমানে দোষ দিয়ে গেল, পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করলো। লিও চুপ করে শুনলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো-তুমি জানলে কি করে এত কথা? চিতার চামড়াটাই তো তুমি এখনও দেখনি।
আমি জানি, বললো আয়শা। আমি দেখেছি। হাঁটুর উপরেই সবচেয়ে মারাত্মক জখম হয়েছে। মলম পাঠিয়েছিলাম, লাগিয়েছে?
না। কিন্তু তুমি মন্দির ছেড়ে বেরোওনি, এসব জানলে কি করে? যাদু?
যেভাবেই দেখি; দেখেছি, হলিও দেখেছে।
তোমার এই যাদু দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। এক ঘণ্টার জন্যেও কি আমি একটু একা—তোমার খবরদারী ছাড়া থাকতে পারবো না? এই সাহসী মানুষগুলো
এই সময় অবোস ঢুকে ফিসফিস করে কিছু বললো আয়শার কানে।
তোমার এইসব সাহসী মানুষদের সাথে আমি আলাপ করবো, বলে মুখের ওপর ঘোমটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল আয়শা। পাহাড়ীদের সামনে ও ঘোমটা ছাড়া যায় না।
কোথায় গেল ও, হোরেস? জানতে চাইলো লিও। মন্দিরে কোনো ক্রিয়া কর্ম করতে?
জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, যদি হয় তো ঐ বেচারা সর্দারের শেষক্রিয়া হতে পারে।
তাই? বলেই ছুটলো লিও আয়শার পেছন পেছন।
এক বা দুমিনিট পর মনে হলো, আমিও গেলেই বুদ্ধিমানের কাজ করবো।
মন্দিরে পৌঁছে দেখলাম, কৌতূহলোদ্দীপক এক দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে সেখানে। প্রতিমার সামনে বসে আছে আয়শা। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পাঁচ জংলী শিকারী আর তাদের সর্দার ভয়ে কাঁপছে সব কজন। এখনও বর্শাগুলো রয়েছে তাদের হাতে। ওদের পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে বারোজন মন্দির রক্ষী। পাশে পড়ে আছে মরা চিতাটার চামড়া। কম্পিত গলায় সর্দার ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছে কি করে জন্তুটা একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে লাফিয়ে এসে পড়েছিলো প্রভু লিওর ওপর, ওদের কিছুই করার ছিলো না।
উঁহুঁ, বললো আয়শা, আমি সব জানি, তোরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর। জন্যে কাপুরুষের মতো আমার প্রভুকে ঠেলে দিয়েছিলি হিংস্র জন্তুটার সামনে। মন্দির রক্ষীদের দিকে তাকালো আয়শা, যাও, পাহাড়ে ছেড়ে দিয়ে এসো এদের। আর ঘোষণা করে দাও, যে ওদের আশ্রয় বা আহার দেবে সে মরবে।
কোনোরকম দয়া ভিক্ষা করলো না, করুণা প্রার্থনা করলো না, ধীরে ধীরে উঠে মাথা ঝোকালো সর্দার আর তার সঙ্গীরা। তারপর ঘুরে দাঁড়ালো চলে যাওয়ার জন্যে।
একটু দাঁড়াও। বাধা দিলো ওদের লিও। সর্দার, আমাকে একটু ধরো।
হাঁটুর নিচে বেশ ব্যথা করছে, সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারবো না। আমাকে ফেলে কি শিকার করবে তোমরা?
কি করছো? চেঁচিয়ে উঠলো আয়শা। পাগল হয়েছো?
জানি না পাগল হয়েছি কিনা, তবে এটুকু জানি তুমি বড় পাজী মেয়েমানুষ, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো বোধ নেই। এদের মতো সাহসী মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ঐ যে ও, এক জংলীর দিকে ইশারা করলো লিও, আমার নির্দেশে ও-ই প্রথমে এগিয়ে গিয়েছিলো চিতাটাকে মারার জন্যে। ও যখন পড়ে যায় তখন আমি এগিয়ে যাই। ওদের মতো সাহসী আর ভালো মানুষ হয় না, আর তুমি কিনা ওদের খামোকা হত্যা করার নির্দেশ দিচ্ছো! ওদের যদি মরতে হয় আমাকেও মরতে হবে। ওরা যা করার আমার নির্দেশেই করেছে।
বিস্ময়ের দৃষ্টিতে শিকারীরা তাকালো ওর দিকে। আর আয়শা, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কি যেন ভাবলো। তারপর বেশ চালাকের মতো বললো-সত্যি কথা বলতে কি, প্রিয়তম লিও, পুরো ঘটনাটাই আমি দেখেছি, যেটুকু দেখতে পাইনি, ওদের মুখে শুনেছি, এবং তারই ভিত্তিতে ওদের শাস্তি দিতে যাচ্ছিলাম। ঠিক আছে, তুমি যখন তা চাও না, ওদের মাফ করে দিচ্ছি। যা তোরা।
মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেল জংলী কজন। আয়শা উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে গেল লিওর দিকে, কতখানি ব্যথা পেয়েছে না পেয়েছে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগলো। অরোসকে ডাকবে কিনা ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার জন্যে জানতে চাইলো।
না, বললো লিও।
তাহলে আমিই পরিষ্কার করে দি, বললো আয়শা।
না। আমাকে নিয়ে দুর্ভাবনা না করলেও চলবে, আমাকে কি দুধের বাচ্চা পেয়েছো? শান্তভাবে কথাক’টা বললো, পর মুহূর্তে তীব্র রোষে ফেটে পড়লো লিও: ভেবেছো কি তুমি, হ্যাঁ, আমি যা পছন্দ করি না তোমার সেই যাদু দিয়ে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছো কেন? কেন ঐ নিরপরাধ ভালো মানুষগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করতে চাইছিলে? কেন আমি বাইরে বেরোলে আমার নিরাপত্তার ভার অন্যের ওপর দাও? তুমি কি ভাবো আমি নিজেকে রক্ষা করতে পারি না? বলো, জবাব দাও, আয়শা!
কিছুই জবাব দিলো না আয়শা। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। জলে থৈ থৈ করে উঠলো তার বিশাল দুচোখ। মুখ নিচু করতেই বৃষ্টির ফোঁটার মতো টপ টপ করে পড়লো মর্মরের মেঝেতে।
ভোজবাজির মতো একটা ব্যাপার ঘটলো এবার। লিও প্রায় ছুটে গিয়ে ধরলো আয়শাকে। করুণ কণ্ঠে ক্ষমা চাইতে লাগলো বার বার।
দুনিয়ার যে যা ইচ্ছে বলুক কিছু এসে যায় না, কিন্তু, লিও, তুমি যদি শক্ত কথা বলো আমি সইতে পারি না। ওহ, তুমি নিষ্ঠুর, তুমি নিষ্ঠুর। কেন আমি তোমাকে এমন আগলে রাখতে চাই, যদি বুঝতে প্রাণের আগুনের কাছে যাওয়ার আগেই যদি তুমি বিদায় নাও এ পৃথিবী থেকে, আমার অবস্থা কি হবে একবার ভাবো; কি করবো আমি তখন? বলো, লিও, একবার দুহাজার বছর অপেক্ষা করেছি, আবার বিশ বছর, এরপর কত বছর অপেক্ষা করবো?
যতদিন আমি তোমার মতো অনন্ত জীবন না পাচ্ছি ততদিন তো সে ভয় থাকবেই, বললো লিও, সুতরাং ও নিয়ে দুশ্চিন্তা না করাই কি ভালো নয়? দুশ্চিন্তা কোরো না, বললেই কি নিশ্চিন্তে থাকা যায়? বলে দ্রুত পায়ে চলে গেল আয়শা।
.
২০.
সারা দুনিয়ার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে আয়শা। প্রতি সন্ধ্যায় খেতে বসে ও আলোচনা করে আমাদের অপার সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কথা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্তমান বিশ্ব, তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চায়। আমি বলি। তারপরও পরিকল্পনা করে, কিভাবে বিভিন্ন দেশের ওপর শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। ব্যপারটা ওর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রতিটা দিন ঐ এক কথা। আমি ওকে কয়েকটা খসড়া মানচিত্র এঁকে দিয়েছি, যতটা সম্ভব ওতে চিহ্নিত করেছি পৃথিবীর দেশ ও মহাদেশগুলো। ওগুলোও নেড়ে চেড়ে দেখে ও। এখন যেখানে আছে সেখান থেকে কি করে ওসব দূরের দেশে পৌঁছুবে তার জল্পনা কল্পনা করে। এবং সব জল্পনার শেষে ঘোষণা করে। এসব সে করবে তার প্রভু লিওর জন্যে। লিওকে ও পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি বানাবে।
একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, পৃথিবীর সব রাজা, রাষ্ট্রনায়কদের কিভাবে তুমি রাজি করাবে ক্ষমতা তোমার হাতে ছেড়ে দিতে? বললেই তো আর তারা তাদের মুকুটগুলো তোমার মাথায় পরিয়ে দেবে না।
ওহ! কি স্বল্প বুদ্ধি তোমার, হলি! মৃদু হেসে বললো আয়শা। জনগণ যখন স্বেচ্ছায় আমাদের বরণ করবে তখন রাজা বা রাষ্ট্রনায়করা বাধা দেবে কি করে? আমরা যখন ওদের মাঝে যাবো আমাদের জ্যোতির্ময় সৌন্দর্য আর অনন্ত পরমায়, নিয়ে এবং ওদের সব জাগতিক চাহিদা পূরণ করবো ওরা চিৎকার করে উঠবে না এসো আমাদের শাসন করো বলে?
হয়তো। সন্দেহের সুর আমার গলায়। কোথায় তুমি প্রথম আবির্ভূত হবে?
আমার আঁকা পূর্ব গোলার্ধের একটা মানচিত্র টেনে নিলো ও। পিকিং-এর উপর আঙুল রেখে বললো, প্রথমে এখানে কয়েক শতাব্দী বসবাস করবো আমরা-ধরো তিন বা পা বা সাত শতাব্দী। আশা করি এর ভেতর ওখানকার মানুষদের আমার মনের তো করে গড়ে নিতে পারবো। এই চীনাদের পছন্দ করেছি কেন জানো? তুমি বলেছো, ওরা সংখ্যায় অগুণতি, ওরা সাহসী, সহনশীল, বুদ্ধিমান। যদিও এখন সঠিক শিক্ষার অভাব আর কুশাসনের কারণে ক্ষমতাহীন, তবু আমার বিশ্বাস ওদের দিয়ে পূরণ হবে আমার উদ্দেশ্য। ওদেরকে জ্ঞান দেব, নতুন ধর্মবিশ্বাস দেবো। আর আমার হলি ওদের ভেতর থেকে বাছাই করা সব মানুষ নিয়ে গড়ে তুলবে অপরাজেয় এক সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনীর সহায়তায় সারা দুনিয়ার ওপর শাসন প্রতিষ্ঠিত করবো আমরা। আমার প্রভু লিও হবে পৃথিবীর সম্রাট।
.
আর একদিন সন্ধ্যার পর এই একই বিষয়ে আলাপ করছি আমরা। আলাপ ঠিক না, আয়শা বলে যাচ্ছে আমি আর লিও শুনছি। বলতে বলতে তন্ময় হয়ে গেছে আয়শা। ভবিষ্যতের কল্পনায় উজ্জ্বল দুচোখ। এই সময় অরোস ঢুকলো ঘরে। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সম্মান জানালো।
কি চাই, পূজারী? প্রশ্ন করলো আয়শা।
মহামহিমাময়ী হেসা, গুপ্তচররা ফিরে এসেছে।
তো আমি কি করবো? নিরাসক্ত ভঙ্গিতে বললো ও। কেন পাঠিয়েছিলে ওদের?
আপনি নির্দেশ দিয়েছিলেন তাই।
এতক্ষণে যেন সচেতন হলো আয়শা। বেশ, কি খবর এনেছে ওরা?
দুঃসংবাদ, হেস। কালুনের লোকেরা মরীয়া হয়ে উঠেছে। ওখানে এখন যে খরা চলছে তার জন্যে ওরা ওদের দেশের ওপর দিয়ে আসা বিদেশীদের দায়ী করছে। খানিয়া আতেনও প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। দিন রাত পরিশ্রম করছে। এর ভেতরেই নাকি দুটো বিরাট বাহিনী প্রস্তুত করে ফেলেছে। একটা চল্লিশ হাজারের অন্যটা বিশ হাজারের। খানিয়া তার চাচা শামান সিমব্রির অধিনায়কত্বে বিশ হাজারি বাহিনীটা পাঠাবে পবিত্র মন্দির জয়ের উদ্দেশ্যে। কোনো কারণে যদি ঐ বাহিনী পরাজিত হয়, ও নিজে আসবে বড় বাহিনীটা নিয়ে।
খবর বটে যাহোক, তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো আয়শা। ও কি পাগল হয়ে গেছে। আমার বিরুদ্ধে লড়বে! হলি, আমি জানি আমাকে মনে মনে পাগল। ভাবো তোমরা, এবার দেখবে আসলে কে পাগল, আর আমি কি মিথ্যে বড়াই করি না, যা বলি তাই করি?
হঠাৎ কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল আয়শা। চোখ দুটো দেখে মনে হয় এখানকার কিছু নয়, বহু দূরের কিছু দেখছে-সম্মোহিত হয়ে দেখছে।
মিনিট পাঁচেক একটানা একদিকে অমন তাকিয়ে রইলো ও। অখণ্ড নিস্তব্ধতা কামরায়। আমরা তাকিয়ে আছি ওর দিকে।
ঠিকই বলেছে তোমার গুপ্তচররা, অরোস, হঠাৎ বলে উঠলো আয়শা। এখন যত তাড়াতাড়ি আমি তৎপর হবো তত কম মরবে আমার মানুষ। প্রভু লিও, যুদ্ধ দেখবে? না, তোমার কোনো বিপদ ঘটুক তা আমি চাই না। তুমি এখানে মন্দিরের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকবে। আমি যাবো আতেনের মোকাবেলার জন্যে।
তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো, সাফ সাফ জানিয়ে দিলো লিও। না, না, আমার মিনতি শোনো, তুমি এখানেই থাকবে।
আবার সেই আগলে রাখার প্রবণতা। লাল হয়ে উঠলো লিওর মুখ, লজ্জায় না রাগে জানি না। কাটা কাটা গলায় বললো, আমি যা বলেছি তার নড়চড় হবে না।
তুমি যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাবো।
হতাশ চোখে লিওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আয়শা। তারপর ফিরলো অরোসের দিকে।
যাও, পূজারী! সব কজন সর্দারকে জানিয়ে দাও হেস-এর নির্দেশ। আগামী চাঁদের শুরু যে রাতে সে রাতে ওরা যেন জড়ো হয়। না, সবাই না, বিশ হাজার হলেই চলবে। বাকিরা মন্দির পাহারা দেবে। বলে দেবে, বাছাই করে সেরা লোকগুলোকে যেন নেয়। আর পনেরো দিনের মতো খাবার যেন নিয়ে আসে সঙ্গে করে।
কুর্নিশ করে বিদায় নিলো পূজারী-প্রধান।