১৫. হেলমিথ গেম – লেভেল ৯

১৫. HellMyth Game-Level 9 (হেলমিথ গেম–লেভেল ৯)

বাবারে, ও বাবা! তোর চোখ দুটো তো দেখি ভেতরে বসে গেছে! খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করছিস না নাকি? আমি কয়েক মাস ধরে নেই, আর তাতেই এই অবস্থা! 

অপারেশনের পর ঢাকায় ফেরার কিছুদিনের মাঝেই আবরারের জোরাজুরিতে রিফ্রেশমেন্টের জন্য বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন সালমা বেগম। 

অপারেশনের ধকল কাটিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন বাপের বাড়ির সবার যত্ন-আত্তিতে। তিন মাস পরে ঢাকায় ফিরে এলেও কিছুদিন পর চাচাশ্বশুর মারা যাওয়ায় শ্বশুরবাড়িতে যেতে হয়েছে আবার কয়েক মাসের মাথায়। এত দিন পর কুটুমকে কাছে পেয়ে কিছুতেই যেতে দিচ্ছে না প্রিয় ছোট ননদ। শ্বশুরবাড়ির দিকে প্রায় সবাই ঢাকায় সেটেলড হলেও ছোট ননদ স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রামের বিশাল বাড়িতেই থাকে। 

বাইরে থেকে দেখে অবশ্য গ্রামের বাড়ি বলার উপায় নেই। আবরারের বাবা নিজের ভিটেমাটিকে ঢেলে সাজিয়ে পুরো রাজকীয় করে ফেলেছিলেন। মানুষটা আজ বেঁচে থাকলে পড়ন্ত বিকেলবেলায় উঠোনে বসে জোছনা রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতো, নবপরিণীতা দম্পতির মতো। আর ফেলে আসা জীবনে জমা করা সুখস্মৃতির বুদ্বুদের পরিধিজুড়ে পরিভ্রমণ করত। মাঝে মাঝে হুমায়ুন আহমেদের মতো আক্ষেপের স্বরে চিৎকার করে বলে উঠতে ইচ্ছে করে, কচ্ছপের মতো একটা প্রাণী কেন এত বছর বাঁচবে! মানুষ কেন এত স্বল্পায়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। জীবনের প্রারম্ভেও ঘুম, অন্তেও ঘুম। মাঝে ক্ষণিকের জন্য চোখ মেলে তাকানোর নামই হয়তো জীবন। আর এই ক্ষণিকের জীবন নিয়ে মানুষ নামের রঙিন ফানুসটার কত রঙা আয়োজন! ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে পা রাখলেন সালমা বেগম। 

আজকে তোকে টিভিতে দেখতে পেয়ে এলাকার সবাই যে কী খুশি। পুরো উৎসব উৎসব আমেজ চারপাশে! 

খুব সাবধানে নিজের মুখভঙ্গি পরিবর্তন করল আবরার। চলমান কিম্ভূতকিমাকার এই গেমের ভয়াবহতার রেশটুকুকে স্থান দিলো না অভিব্যক্তিতে। 

মায়েরা নাকি সব বুঝতে পারে। ভিডিও কলের শুরুতেই শুকনো মুখ দেখে মা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, আবরারের কিছু তো একটা হয়েছে। 

তুমি তোমার ওষুধপত্র ঠিকঠাক খাচ্ছো তো? কিছুদিন আগেই এত বড় একটা অপারেশন থেকে ফিরলে। 

আরে একেবারেই টেনশন করিস না। প্রতিদিন তিনবেলা প্রেসক্রিপশন দেখে দেখে নিয়ম করে আমাকে ওষুধ খাওয়ানো হয়। তোর ফুফুর কল্যাণে পায়ের উপর পা তুলে পাটরানির মতো আছি। ভালো তো! 

নার্গিসকে তো আমি সাথে করে নিয়ে এলাম। বুশরাও আমেরিকায় গেছে জামাই বাবাজির সাথে। তোর জন্য বড় চিন্তা হচ্ছে রে! রাহেলা ঠিকঠাক রান্না করে দিয়ে যাচ্ছে তো দুবেলা? 

আরে বাবা, তুমি নিজেই তো দিনের মাঝে তিনবার রাহেলা খালাকে ফোন দিয়ে আমার খাবারের ব্যাপারে ফুটফরমাশ দিতে থাকো। আমাকে জিজ্ঞেস করে আবার ভেরিফাই করে নেওয়ার কী আছে? 

তা বাবা, তোর ফুফু বলছিলেন এবার তোর বিয়েটা… 

বিয়েসংক্রান্ত আলাপটা আপাতত বাড়াতে ইচ্ছে করল না দেখে কল রাখার ফুরসত খুঁজতে লাগলো আবরার। কলিংবেলের শব্দ যেন সেই প্রচেষ্টায় প্রাণ দিল। 

মা, রাহেলা খালা এসেছেন সম্ভবত রান্নার জন্য। দরজা খুলতে হবে। পরে না হয় কথা হবে। ওষুধগুলো ঠিকমতো খেয়ো।

সালমা বেগমকে আর কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে ফোনটা রাখল আবরার। মেয়ে দেখাসংক্রান্ত আলাপ একবার শুরু করলে মা আর ফোন রাখবেন না, আগেভাগে রেখে দেওয়াই ভালো। দরজা খুলতেই তীক্ষ্ণ এক ঝাঁজে দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো আবরারের। চোখ তুলে তাকাতেই খানিকটা চমকে গেল। ডিআইজি আর অ্যাডিশনাল ডিআইজি দাঁড়িয়ে আছেন পাশাপাশি। অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে রাব্বি সাহেবের হাতে হলুদ রঙের গোল ফুলের তোড়া। শহিদ মিনারের বেদি একুশে ফেব্রুয়ারিতে যেমন পুষ্পস্তবকে ভরে ওঠে, অনেকটা তেমন। 

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করতেই বুঝতে পারল, সরিষা ফুল দিয়ে বানানো হয়েছে তোড়াটা। কী বিচিত্র! 

কী হে ইয়াং ম্যান! আমাদের দেখে অবাক হয়ে গেছ দেখছি। তা সারা দিন তো টেলিভিশন চ্যানেলে দৌড়াদৌড়ির ওপর ছিলে এই কদিন, আজকে ফ্রি তো? নাকি ভুল সময়ে এসে পড়লাম আমরা?

তামিম সাহেবের কথার প্রতি অবশ্য মনঃসংযোগ দিতে পারলো না আবরার। তামিম সাহেব আর ফজলে সাহেবকে দেখে রাতুলের প্রিয় কার্টুন মটু পাতলুর সংস্করণ বলে মনে হচ্ছে।

তামিম সাহেব বেঁটেখাটো, মোটা। ঠোঁটের উপর গোঁফের রেখা বয়সটাকে বেশ কমিয়ে দিয়েছে। বেশ প্রাণবন্ত আর ছটফটে। পদ আর পোশাকি গাম্ভীর্যের সাথে বাহ্যিক গঠনের সাযুজ্য নেই বলেই চলে। 

ফজলে রাব্বি সাহেবকে কী পাতলু কার্টুনের মতো শুকনো বলা যায়! নাহ। মানুষটা বেশ স্বাস্থ্যসচেতন, পাতলু অনেকটা বেমানান উপমা হয়ে যাবে তার জন্য। 

বরং জার্মান কোচ জোয়াকিম লোর উপমায় বেশ মানিয়ে যাবেন তিনি। ছিপছিপে, সুগঠিত শরীর মানুষটার। উচ্চতায় আবরারের কাছাকাছি হবেন। মাথাভরা কাঁচাপাকা চুল, গভীর মায়াবী বড় বড় দুটো চোখ, ঠোঁটের কোনায় সহজাত হাসি, গোছানো মার্জিত কথাবার্তা। নিদারুণ পরিমিতিবোধ আর চলনে বলনে অদ্ভুত সাধারণ্যই মানুষটাকে অসাধারণ করে তোলে। আবরার দরজার চারপাশে সামান্য উঁকি দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো চারপাশে, চোখের দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা। 

তুমি যাহাকে খুঁজিতেছ, তিনি বিশেষ ইনভেস্টিগেশনের কাজে ব্যস্ত থাকায় আজ আসিতে পারেন নি-সাধু ভাষায় পুরো একটা লাইন যে তামিম সাহেব বলে যেতে পারেন, সেটা তিনি নিজেই জানতেন না। আপাত আবিষ্কৃত এই প্রতিভায় নিজেই দারুণ প্রীত হয়ে গেলেন। আবরার সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, সংকোচ লুকানোর চেষ্টা করল কণ্ঠের গাম্ভীর্যকে মাত্রা দিয়ে, 

আমি আসলে রাহেলা খালাকে খুঁজছিলাম, মা তো বাসায় নেই কয়েক মাস হলো। রোজ এই সময়টাতে এসে উনি রান্নাটা করে দিয়ে যান। 

তা তোমার মায়ের শরীরটা ঠিক আছে তো? ফজলে সাহেবের কণ্ঠে পর্যাপ্ত আন্তরিকতা। 

জি স্যার, মা এখন আলহামদুলিল্লাহ পুরোপুরি সুস্থ আছেন। 

তা সাতসকালে না বলে কয়ে তোমার বাসায় চলে এসে কী বিব্রত করে ফেললাম আমরা? আসলে আর বোলো না, কয়েকদিন ধরেই সারাদিন তোমাকে নিয়ে এত এত নিউজ দেখে টিভি চ্যানেলগুলোর অতিরঞ্জনে বিরক্তি ধরে গেছিল। আসল খবরটা কিছুতেই জানতে পারছিলাম না। 

তামিম সাহেবের কথা শেষ হতেই চিন্তিত ভঙ্গিতে রাব্বি সাহেব বললেন, 

আবরার, আমার আসলে তোমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল। গেমের প্ল্যানাররা তোমাকে বলেছিল যে ওদের গেম সম্পর্কে মিডিয়ায় যদি কেউ কোনো কিছু জানতে পারে, ওরা তোমার ক্ষতি করবে! 

আসলে স্যার, মিডিয়ায় কেবল দুই গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মধ্যকার সংঘাতের খবরই বলা হয়েছে। এর পেছনের কারিগরদের নিয়ে টু শব্দও হয়নি। কারণ, ইন্ডাস্ট্রির মালিকেরা নিজেরা এই গেমের প্ল্যানারদের সম্পর্কে জানে না। আগন্তুকের মতো গেম প্ল্যানারদের মধ্য থেকে একজন প্রতিনিধি এসে কেবল তাদের হত্যাপদ্ধতি নিচ্ছিদ্র করতে বুদ্ধিপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে। 

হাঁটতে হাঁটতে তিনজন কখন যে লিভিং রুমের মাঝবরাবর এসে দাঁড়িয়েছে নিজেরাই লক্ষ করেনি। আবরারদের লিভিং রুমটা দারুণ ছিমছাম। দেখলে বোঝার উপায়ই নেই, এ ঘরের মালকিন কয়েক মাস ঘর থেকে দূরে আছেন। 

অগোছালো ব্যাচেলর তকমা আবরারের ক্ষেত্রে কখনোই প্রযোজ্য নয়, পুরুষালি যাবতীয় অনিয়ম আর উচ্ছঙ্খল স্বভাবদোষ আবরারের স্বভাবের মানচিত্রে কখনোই জায়গা পায়নি। লিভিং রুমের অয়েল পেইন্টিং বরাবর সোফায় বসতে বসতে আবরারের হাতে সরিষা ফুল দিয়ে বানানো তোড়াটা তুলে দিলেন তামিম সাহেব। 

সরিষা ফুল দিয়ে তোড়া বানাতে যা কষ্ট করতে হয়েছে! তা-ও ভাবলাম, এবারের বুকেটা যেন তোমার গেমের সাথে রিলেটেবল হয়। প্রত্যেকবার তোমার একেকটা লেভেল কমপ্লিট করার পর রাব্বি সাহেব তোমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। তাই ভাবলাম, এবার আমি একটু অন্যভাবে শুভেচ্ছা জানালে কেমন হয়! 

মৃদু হেসে ফুলের তোড়াটা নিয়ে টেবিলের উপর রাখল আবরার। অনেক ধন্যবাদ স্যার। 

আরে দাঁড়িয়ে কেন তুমি? বোসো বাবা। এখন আমাদের এই দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গার কো-অর্ডিনেটটা সম্পর্কে খুলে বলো তো দেখি। 

তামিম সাহেবের বক্তব্যে ঘোর আপত্তি জানালেন স্থিতধী ফজলে রাব্বি সাহেব। 

আরে বাবা, গ্রিক মিথথালজির কো-অর্ডিনেট সম্পর্কে না জেনে আগে থার্ড কো-অর্ডিনেটের ডিটেইল শুনে কী হবে! 

আবরার, প্রথম থেকেই লেভেল নাইন সম্পর্কে খুলে বলো। এ কয়েক দিন ধরে মিডিয়ার নিউজ শুনে মনে হচ্ছে, দুই দেশের মাঝে হতে যাওয়া যুদ্ধ তুমি বুদ্ধি করে থামিয়ে দিয়েছ! সত্যি, মিডিয়া আসলেই তিলকে তাল করতে পারে। 

ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দীর্ঘ বক্তব্যের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করলো আবরার, 

লেভেল নাইনের ফার্স্ট কো-অর্ডিনেট পাই ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে রেখে যাওয়া সকালের খবরের কাগজের ভেতর। 

সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের একটা রিসিট পেপার আর সাথে গেমের লোগো। পার্সেলটা বাসায় নিয়ে এসে দুটো অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাই। একটা তেলের বোতল আর সাথে আইফেল টাওয়ারের একটা ডামি শোপিস। শোপিসটা দারুণ জীবন্ত, যেন সত্যিকারের আইফেল টাওয়ারই কোনো হ্যাঁমিলনের জাদুকরের কলকাঠির ছোঁয়ায় নিজের আকার পরিবর্তন করে ছোট হয়ে গেছে। 

অবশ্য কো-অর্ডিনেট দিয়ে গ্রিক মিথোলজির কোনো চরিত্র আর ঘটনাকে নির্দেশ করা হয়েছে, বুঝতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। 

রাব্বি সাহেবের ভু হালকা কুঞ্চিত হয়ে এলো, ধারণা করার চেষ্টা করছেন কু দুটোর অর্থ। 

আইফেল টাওয়ার থেকে বুঝতে পারছি, গ্রিক মিখোলজির অন্যতম চরিত্র প্যারিসকে বোঝানো হয়েছে। কারণ আইফেল টাওয়ার অবস্থিত প্যারিসে। কিন্তু তেলের বোতল দিয়ে…উমমম… 

স্যার, তেলের বোতলটা ভালোভাবে লক্ষ করে দেখতে পাই, লেবেলে লেখা ক্যাস্টর অয়েল। এখান থেকে বুঝতে পারি, গ্রিক মিথোলজির আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ক্যাস্টরকে নির্দেশ করা হয়েছে। ক্যাস্টর হলো হেলেনের ভাই। হেলেন…ইউ মিন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী হেলেন! যার জন্য ট্রয়ের যুদ্ধ হয়েছিল? 

তামিম সাহেবের দিকে অনুমোদনের ভঙ্গিতে তাকাল আবরার। সঠিক অনুমানের সাফল্যে চকচক করছে মানুষটার দুচোখ। 

জি স্যার। ঠিক ধরেছেন। কিন্তু এরপর আমাকে ডামি ভিডিও হিসেবে কোনো শর্টফিল্ম পাঠানো হয়নি। 

কী বলছ কী? তবে?

এবার আমাকে ২০০৪ সালে নির্মিত হলিউডের মুভি ট্রয়ের ৪০ সেকেন্ডের কিছু বিচ্ছিন্ন ক্লিপ পাঠানো হয়েছে। হেলেনের সাথে প্যারিসের লাভ মেকিং সিনের ক্লিপ ছিল এর মাঝে একটা। 

আরেকটা ক্লিপে দেখানো হয়েছিল, আগামেমননের নেতৃত্বে গ্রিক রাজাদের বিশাল জোট ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, ট্রয়ের অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। তামিম সাহেব আর রাব্বি সাহেব-দুজনের চোখেই অপার বিস্ময়। আবরারের কথা শেষ হতে না হতেই তামিম সাহেব বলে উঠলেন, আগামেমননটা যেন কে? আর বোলো না, গ্রিক মিথোলজি নিয়ে যতই পড়াশোনা করি, এই ট্রয়ের যুদ্ধের ইতিহাস কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। সব চরিত্রগুলো কেমন যেন গুলিয়ে যায়। এত এত চরিত্র কি আদৌ মনে রাখা সম্ভব? 

আমি সহজ করেই বলার চেষ্টা করছি, স্যার। হেলেন ছিলেন স্পার্টার রানি। হেলেনের স্বামী মেলেনাউস যখন দেখলেন, তার স্ত্রী অতিথি হিসেবে আগত ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসের সাথে নিজের সংসার ছেড়ে ট্রয়ে পালিয়ে গেছেন, তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে চাইলেন। 

আই সি! তখনকার ট্রয়ই তো এখনকার তুরস্ক, তাই না? 

ইয়েস ইয়েস। স্বল্পস্থিতি মৌনতা ছেদ করলেন ফজলে রাব্বি সাহেব, তবে যাই বলো আবরার, ট্রয় মুভির গল্প নিয়ে আমার যথেষ্ট অভিযোগ আছে। পুরো মুভির কোথাও গ্রিক দেবতাদের নিয়ে কোনো অংশই নেই। অ্যাপোলোকে নিয়ে যা বিটস অ্যান্ড পিসেস দেখানো হয়েছে, তা-ও ডেলফির মন্দিরের সেবাদাসী ব্রিসেইসের চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। মুভির অনেক অংশই প্রাসঙ্গিক নয়। যেমন অ্যাকিলিসের নায়িকা হিসেবে ব্রিসেইসকে দেখানো হয়েছে। অথচ অ্যাকিলিসের আগের পক্ষের স্ত্রী সন্তান নিয়ে কোনো দৃশ্যই ছিল না, যেন ব্রিসেইসই অ্যাকিলিসের জীবনের প্রথম প্রেম! আবার মিথোলজি অনুযায়ী, জাজমেন্ট অব প্যারিস-এর কারণেই না ট্রয়ের যুদ্ধ হলো! এখানে গ্রিক দেবীদের বিউটি কনটেস্টের ব্যাপারটা দেখানো কম্পালসরি ছিল। 

আবরার ফজলে সাহেবের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় পালক যুক্ত করল, ঠিক ধরেছেন স্যার। এমনকি মুভিতে হেক্টরের হাতে হেলেনের স্বামী মেলেনাউসের মৃত্যু দেখানো হয়েছিল! এটাও অতিরঞ্জন। ইলিয়াডে এমন কোনো কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায় না।

জাজমেন্ট অব প্যারিস, বিউটি কনটেস্ট-এসব তো আগে শুনিনি! এগুলো আবার কী? 

তামিম সাহেবের কণ্ঠে অনুসন্ধিৎসা! ফজলে রাব্বি সাহেব তার বিচক্ষণ চোখ দিয়ে প্রথমে আবরার, এরপর তামিম সাহেবের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, 

আসলে, গ্রিক মিথ অনুসারে ট্রয়ের যুদ্ধের পুরো ব্যাপারটাই ছিল দেবতাদের পূর্বনির্ধারিত। এখানে একটা বিউটি কনটেস্টের ব্যাপক অবদান। আছে। ডিটেইলে যদি বলি, অ্যাকিলিসের মা থেটিস আর মরণশীল পেলিয়াসের বিয়ের অনুষ্ঠানের সমস্ত দায়িত্ব নেন জিউস। এই বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় অলিম্পাসে। বিয়ে উপলক্ষ্যে আয়োজিত ভোজসভায় এরিস ছাড়া সব দেব-দেবীকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। 

আমন্ত্রণ না পেয়ে ঝগড়া-বিবাদ আর অনৈক্যের দেবী এরিস ক্ষুব্ধ হয়ে অযাচিতভাবে ভোজসভায় এসে হাজির হন, আর ভোজের টেবিলে স্বর্ণের একটি আপেল গড়িয়ে দেন। আপেলের গায়ে গ্রিক অক্ষরে খোদাই করে লেখা ছিল-সুন্দরী শ্রেষ্ঠার জন্য।

তার মানে ইংরেজিতে Apple of Discord বলে যেই বাগধারা আছে, সেটা এই মিথোলজি থেকেই নেওয়া হয়েছে? তামিম সাহেবের সপ্রশ্ন চোখের দিকে অনুমোদনের ভঙ্গিতে তাকালেন রাব্বি সাহেব। 

ঠিক ধরেছেন। প্রসঙ্গে আসি। এরিস আপেল ছুঁড়ে দেবার পর শুরু হলো গণ্ডগোল। দেবীদের মধ্যে হেরা, এথেনা এবং আফ্রোদিতি নিজেদেরকে অন্যদের থেকে বেশি সুন্দরী ভাবতেন। তারা তিনজনই আপেলটি নিয়ে ঝগড়া শুরু করলেন। ভোজসভায় শুরু হলো তুমুল হইচই। চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য সবাই জিউসের শরণাপন্ন হলে, জিউস কৌশলে এড়িয়ে যান। যত যাই হোক, নিজের স্ত্রী হেরাকে জিউস পারতপক্ষে রাগাতেন না। অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত বলে ওঠেন, মর্ত্যলোকে প্যারিস নামে এক ট্রোজান আছে, সে-ই ঘোষণা করবে দেবীদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী। 

জিউসের বার্তাবাহক হার্মিসের নেতৃত্বে তিন দেবী মর্ত্যলোকে নেমে এলেন। প্যারিস তখন ইডা পাহাড়ে অবস্থান করছিলেন। হার্মিস তিনজন দেবীসহ প্যারিসের সামনে দাঁড়ালেন, তাকে সোনার আপেলটি দিয়ে জিউসের আজ্ঞা শোনালেন। 

প্রথমে ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত প্যারিস রাজি হলেন। তিনজন দেবীকে আলাদা আলাদাভাবে নিরীক্ষণ করতে চাইলেন প্যারিস। প্রথমে হেরা এলেন প্যারিসের সামনে। গিভ অ্যান্ড টেক কেবল এই যুগে নয়, মিথোলজিতেও বহাল তবিয়তে ছিল, দেবীদের ক্ষেত্রেই বা পাওয়ার প্লে বাদ যাবে কেন!

হেরা প্যারিসকে লোভ দেখালেন, যদি তাকে বিজয়ী করা হয়, তবে প্যারিসকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী পুরুষ বানানো হবে। 

এরপর এলো এথেনার পালা। এথেনা প্যারিসের দিকে ঝুঁকে গিয়ে নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শন করে প্যারিসের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। এরপর প্যারিসকে লোভ দেখালেন, তাকে বিজয়ী ঘোষণা করলে প্যারিসকে তিনি পরিণত করবেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষে, যার ফলে প্যারিস সমর কৌশলে সবার থেকে এগিয়ে গিয়ে সকল যুদ্ধে বিজয়ী হতে পারবেন। 

সবার শেষে এগিয়ে এলেন আফ্রোদিতি। বহুগামিনী আফ্রোদিতি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এমনভাবে প্যারিসের গায়ে ঢলে পড়লেন যে ট্রোজান যুবরাজ লজ্জায় নুইয়ে গেলেন। এরপর আফ্রোদিতি নিজের সবচেয়ে মোক্ষম চালটি চাললেন। প্যারিসকে লোভ দেখালেন-যদি তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, তবে আফ্রোদিতি এমন ব্যবস্থা করবেন, যাতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারীটির সাথে প্যারিসের বিয়ে হয়। 

সবচেয়ে সুন্দরী নারীকে পাওয়ার লোভেই হয়তো শেষ পর্যন্ত প্যারিস এই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আফ্রোদিতিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। তবে যদি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হতো, তাহলেও আফ্রোদিতিই জয়লাভ করতেন। নিঃসন্দেহে, সব দেবীর মধ্যে আফ্রোদিতির রূপের স্বকীয়তা আলাদাভাবে চোখে পড়ার মতো। প্যারিসের এই সিদ্ধান্তের ফলে তিনি আফ্রোদিতির বন্ধুত্ব লাভ করলেও মড়ার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে লাভ করলেন হেরা আর এথেনার শত্রতা। 

তারপর? 

একটানা গল্প বলতে বলতে খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছেন ফজলে সাহেব। আবরার ডাইনিং থেকে পানি নিয়ে এসে তার দিকে এগিয়ে দিলো। এরপর তামিম সাহেবের উদ্দেশ্য মুখ খুলল, 

বাকিটা আমি বলছি। এ ঘটনা যখন ঘটে, প্যারিস ট্রয়ের রাজদরবারের বাইরে সাধারণ রাখালের জীবনযাপন করছিলেন। অনেক বছর পর নিজের রাজপ্রাসাদে ফিরে আসেন তিনি। তবে নিশ্চয়তা আর স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন তার সহ্য হচ্ছিল না। তাই বড় ভাই হেক্টরসহ দেশ-বিদেশে দুঃসাহসিক অভিযানে যাবার জন্য বাবা প্রিয়মের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। রাজা প্রিয়াম রাজি হলেন। এরপর ভাই হেক্টরের সাথে যাত্রা শুরু করলেন প্যারিস। 

প্রথমে সালামিস দ্বীপের দিকে যাওয়ার কথা থাকলেও আফ্রোদিতি নিজের কথা রাখার জন্য এই অভিযানকেই উপযুক্ত মনে করলেন। জাহাজের গতিপথ ঘুরিয়ে দিলেন দেবী। সালামিসের পরিবর্তে স্পার্টার দিকে যাত্রা শুরু করল জাহাজ। 

স্পার্টায় নেমে হেক্টর আর প্যারিস রাজদরবারে গেলেন। রাজা মেনেলাউস অসম্ভব আন্তরিকতার সাথে দুই ভাইকে বরণ করলেন। আগত অতিথিদের জন্য রাতের বেলা বিশাল এক ভোজসভার আয়োজন করা হলো। সেই ভোজসভায়ই প্রথম প্যারিসের সাথে দেখা হলো মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেনের। আফ্রোদিতি নিজের ছেলে ইরোসকে ছদ্মবেশে পাঠালেন রাজদরবারে। ইরোস অবশ্য রোমানদের দেওয়া কিউপিড নামেই বেশি পরিচিত। আফ্রোদিতি আর তার গোপন প্রেমিক যুদ্ধের দেবতা অ্যারিসের সন্তান ছিলেন ইয়োস। ইরোস সেই ভোজসভায় প্যারিস আর হেলেনের বুকে ভালোবাসার তীর বিদ্ধ করলেন। প্রথম দেখায় একে অপরের প্রেমে পাগল হয়ে গেলেন হেলেন আর প্যারিস। 

মেনেলাউস এক জরুরি কাজে ক্রিট দ্বিপে গেলেন, অতিথিদের সেবার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন হেলেনের উপর। কিন্তু প্যারিস বিশ্বাসভঙ্গ করলেন। হেলেনকে প্রলুব্ধ করলেন নিজের সাথে ট্রয়ে যাবার জন্য। 

অবশেষে প্যারিসের সাথে চুপিসারে ট্রয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী হেলেন। ফেলে আসেন নিজের এতকালের সংসার, স্বামী আর ৯ বছর বয়সি কন্যা হারমিওনেকে। 

এর পরের প্রেক্ষাপট মোটামুটি সবারই জানা। মেনেলাউস নিজের স্ত্রীর বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুব্ধ হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সাহায্য চান বড় ভাই আগামেমননের কাছে। 

সাম্রাজ্যবাদী, লোভী আগামেমননও রাজি হয়ে যান, পার্শ্ববর্তী সব রাজ্যের রাজাদেরও রাজি করিয়ে ফেলেন ট্রয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। বছর দুইয়ের মাঝেই শুরু হয়ে যায় পৃথিবী বিখ্যাত ট্রয়ের যুদ্ধ। 

এই যুদ্ধে হেরা আর এথেনা নিশ্চয়ই প্যারিসের প্রতি ক্ষোভের কারণে মাইসেনিয়ার সমর্থন করেছিলেন? 

ঠিক তাই স্যার। ঈষৎ অধৈর্য প্রকাশ পেল ফজলে রাব্বি সাহেবের কণ্ঠে। 

ইতিহাসের কচকচানি তো অনেক করে ফেললাম দুজন মিলে। তুমি কীভাবে মিনি ট্রয়ের যুদ্ধ থামিয়ে দিলে তা তো বলবে?

স্যার, হোয়াটসঅ্যাপে ট্রয় মুভির ক্লিপ দেখানো শেষে স্ক্রিনে ভেসে উঠল ভিকটিমের নাম-তানভীর ইসলাম। নামটা আমাদের সবারই খুব পরিচিত। বিখ্যাত GTIE গ্রুপের মালিকের একমাত্র সন্তান, বর্তমান ম্যানেজিং ডিরেক্টর। বেশ অনেকগুলো গার্মেন্টস কোম্পানির মালিক এই গ্রুপ। এ ছাড়া নিজেদের ফিল্ম প্রোডাকশন কোম্পানিও রয়েছে। 

আই সি! খোঁজখবর নিয়ে কী জানতে পারলে? ট্রয়ের যুদ্ধের রেফারেন্স কেন এ ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে? 

স্যার, এবার তানভীর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারি। ফিল্ম প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে GTIE গ্রুপের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী Red Spices Entertainment, RSI নামেই এই প্রোডাকশন হাউজ বেশি পরিচিত। 

এই হাউজের কর্ণধার আমিনুল হকের স্ত্রী আমাদের দেশের রুপালি পর্দার প্রখ্যাত এক নায়িকা। যৌথ প্রযোজনার অনেক কাজও করেছেন। তাকে আপনারা সবাই-ই চেনেন। রূপকথা।

চিনব না আবার! তিন প্রজন্মের ক্রাশ! এই সাইত্রিশ বছরে এসেও যে কীভাবে উনিশ বছরের টিনেজারদের মতো দেখতে লাগে আল্লাহ তায়ালাই জানেন! অবশ্য, মিডিয়াপাড়ায় বেশ কানাঘুষা-ষাটোর্ধ্ব আমিনুল হককে এই সুন্দরী কেবল অগাধ টাকার জন্যই বিয়ে করেছেন। 

রাব্বি সাহেবের কথায় সায় দিলেন তামিম সাহেব। 

সে আবার বলতে! ভারতের রানি মুখার্জিকেই দেখুন না। লিডিং প্রোডাকশন হাউস ইয়াশরাজ ফিল্মসের মালিক আদিত্যের বৌ। বয়সের ব্যবধান টাকার কাছে কিছুই না। পুঁজিবাদ ভালোবাসাও কিনে নিতে পারে, আমাদের দেশের ক্ষেত্রেই বা ব্যতিক্রম ঘটবে কেন? 

দুজন প্রবীণের যৌক্তিক আলোচনা বেশ উপভোগ করছে আবরার। 

স্যার, এবার প্রসঙ্গে আসি। এক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বার্লিনে গিয়ে রূপকথার সাথে সখ্য হয় তানভীরের। বাংলাদেশ থেকে এই দুই প্রোডাকশন হাউসের দুটো চলচ্চিত্র মনোনয়ন পেয়েছে এই বছর। আমিনুল হক পারিবারিক একটা জরুরি কাজের জন্য বার্লিন যেতে পারেননি। জার্মানিতে রূপকথা আর তানভীর একে অন্যের খুব কাছাকাছি আসেন। এর আগে 

অবশ্য কেবল একে অপরের মুখচেনা নামজানা ছিলেন। 

বার্লিন থেকে ঢাকায় ফিরে এসে দুজনের উথালপাথাল প্রেম শুরু হয়। শু্যটিংয়ের ফাঁকে, লেট নাইট পার্টিতে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে লাভবার্ডস বিভিন্ন রিসোর্ট আর হোটেলে সময় কাটাতে থাকে। 

রূপকথার বৃদ্ধ ধনকুবের স্বামীর চোখে অবশ্য প্রথম প্রথম স্ত্রীর আপাত পরিবর্তন ধরা পড়েনি, পর্দার অভিনেত্রী বাস্তব জীবনেও অভিনয় কম জানেন না। 

তবে একদিন সব বাধা পার হয়ে যায়। নিজের স্বামীকে ডিভোর্স না দিয়েই তানভীরের সাথে পালিয়ে কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করেন রূপকথা। মিডিয়াপাড়ায় সাড়া পড়ে যায় 

ডিভোর্স না দিয়েই বিয়ে? এ বিয়ে তো বৈধই নয়। 

হাহা! প্রেমের টানে প্যারিসের সাথে পালিয়ে আসার সময়ও কিন্তু হেলেন স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে আসেনি। 

অবশ্য ঐ সময়ে বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক ছিল কি না, সেটাও একটা আলোচনা বিষয় হতে পারে। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার আগের ঘটনা বলে কথা! 

বর্ষীয়ান দুজন সদস্যের গঠনমূলক আলোচনায় রসদ না জুগিয়ে প্রসঙ্গে ফিরে গেল আবরার। 

নিজের স্ত্রীয়ের এই বিশ্বাসঘাতকতায় আত্মসম্মানে প্রচণ্ড আঘাত লাগে বর্ষীয়ান প্রযোজক আমিনুল হকের। সিদ্ধান্ত নেন কঠিন প্রতিশোধ নেবেন। 

তামিম সাহেবের কণ্ঠের ডেসিবল বেড়ে গেল কয়েক গুণ। 

এ তো দেখছি ট্রয়ের যুদ্ধের এই যুগের ভার্সন। আমিনুল হক হচ্ছেন মেনেলাউস। রূপকথা হলেন সেই বিখ্যাত হেলেন। আর তানভীর হলো প্যারিস। সত্যি আবরার, যেই ক্রিমিনোলজিস্টরা বিভিন্ন গ্রিক মিথের সাথে মিল রেখে আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনাগুলো খুঁজে বের করছে, মানতেই হবে, সবাই এক্সট্রিম লেভেলের জিনিয়াস! কিন্তু হাজার তিনেক শতাব্দী পরে যুদ্ধের দামামা বাজল কীভাবে? অবন্তির থেকে শুনলাম থার্ড কো-অর্ডিনেটে শাহরুখ খান আর কাজলের DDL মুভির পোস্টার থেকেই তুমি সরিষা ফুল কি-ওয়ার্ড খুঁজে বের করেছ। তাই তো কষ্ট করে সরিষা ফুল দিয়ে বুকে বানিয়ে এনেছি।

মুখে জোরপূর্বক একটা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল আবরার, স্বেদবিন্দু ফুটে উঠেছে ঠোঁটের উপর।

স্যার, DDLJ ছবির পোস্টারটা দেখার পরে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দিন তিনেক পরে ইউটিউবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি দেখছিলাম। 

হঠাৎ ইউটিউবারের কণ্ঠে মাস্টার্ড গ্যাস টার্মটা শুনে থমকে যাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও ইরাক-ইরানের যুদ্ধেও কেমিক্যাল উইপন হিসেবে এই গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল। 

মাস্টার্ড শব্দের বাংলা অর্থ সরিষা। কেন যেন মন বলতে লাগল, শাহরুখ-কাজলের হিন্দি ছবির পোস্টারে সরিষা ক্ষেত দিয়ে মাস্টার্ড গ্যাসকেই বোঝানো হয়েছে। মাস্টার্ড গ্যাস উচ্চারণ করতেই আংটি থেকে সবুজ সংকেত পেলাম। বুঝতে পারলাম, ঠিক পথে এগোচ্ছি। 

এই মাস্টার্ড গ্যাসের মেকানিজমটা ঠিক কেমন? 

স্যার, মাস্টার্ড গ্যাসের আরেকটা নামও আছে। সালফার মাস্টার্ড। বহু যুগ আগ থেকেই যুদ্ধের সময় এই গ্যাস শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে ব্যবহার করা হতো। 

এই গ্যাস আমাদের শরীরে দগদগে ক্ষত, ফুসকুড়ি বা ঘায়ের সৃষ্টি করতে পারে, ইংরেজিতে যাকে বলে ব্লিস্টার। এ ছাড়া এটি জিনের মিউটেশন থেকে শুরু করে শরীরে নিশ্চিত ক্যান্সার বাসা বাঁধারও কারণ। এই গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। তবে ২৪ ঘণ্টা যদি এই গ্যাসের সংস্পর্শে কেউ আসে, তাহলে ভিকটিমের চামড়ায় প্রচণ্ড জ্বলুনি দেখা দেবে, পোড়া দাগে ছেয়ে যাবে শরীর। এই গ্যাস এতটাই ভয়ংকর যে কাপড়ের ফেব্রিক বা তুলা ভেদ করেও এটি চামড়ার সাথে বিক্রিয়া করতে পারে। ভিকটিমের চোখে বিক্রিয়া করে অন্ধত্ব সৃষ্টি করে। 

লো কনসেনট্রেশনে মৃত্যু না ঘটলেও যদি হাই কনসেনট্রেশনে মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করা হয়, ফলাফল দাঁড়ায় ভয়াবহ। ভিকটিমের শরীরের পঞ্চাশ থেকে সত্তর ভাগে সেকেন্ড আর থার্ড ডিগ্রি বার্ন দেখা দেয়, একদিন থেকে শুরু করে এক সপ্তাহের মাঝে নিশ্চিত মৃত্যু। বার্ন ছাড়াও পালমোনারি ইডিমার কারণেও মৃত্যু ঘটতে পারে আরও দ্রুত। 

এ তো দেখছি সর্বনাশা এলাহি কাণ্ড! চতুর্থ কো-অর্ডিনেট কবে পেলে? 

তৃতীয় কো-অর্ডিনেট পাওয়ার দিন পাঁচেক পরে। Toronto International Film Festival এ প্রদর্শিত মেড ইন বাংলাদেশ ছবিটা দেখানো হয়েছিল। এই মেড ইন বাংলাদেশ মুভির পোস্টার কো-অর্ডিনেট হিসেবে দেওয়া হয়। 

একজন গার্মেন্ট শ্রমিকের জীবনী নিয়ে মেড ইন বাংলাদেশ নির্মিত হয়েছে। লক্ষ করে দেখুন, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি কুয়ের মাধ্যমে টেক্সটাইল গ্রুপের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে। 

আর একই সাথে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিনোদন জগৎ বোঝানো হয়েছে। আর বাংলাদেশে একমাত্র GTIE-ই একমাত্র শিল্পপ্রতিষ্ঠান, যারা টেক্সটাইল বিজনেসের সাথে সম্পৃক্ত এবং একই সাথে তাদের মিডিয়াতে নিজস্ব প্রোডাকশন কোম্পানিও আছে। GTIE ছাড়াও আরও দু-তিনটি প্রোডাকশন হাউস আছে, যাদের অধীনে শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, তবে সেগুলোর একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, একটা লেদার ফ্যাক্টরি এবং আরেকটা অয়েল রিফাইনারি ম্যানুফ্যাকচারার। এই তিন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যবসার পাশাপাশি মিডিয়ায় আর প্রোডাকশন হাউসগুলোতে টাকা লগ্নি করে। তবে বস্ত্রশিল্পের সাথে সম্পৃক্ততা কেবল GTIE-এর। 

সাথে সাথেই বুঝে গেলাম ভেন্যু কী হতে চলেছে। ইনফ্যাক্ট, ভেতরে ভেতরে ভেন্যুটা তানভীর আহমেদের ছবি দেখার পরই বুঝতে পেরে যাই, Grand Textile Industries & Entertainment-ই হতে যাচ্ছে ক্রাইম ভেন্যু। তবু শিউর হবার জন্য চতুর্থ কো-অর্ডিনেটটার দরকার ছিল। 

চতুর্থ কো-অর্ডিনেটটা এবার আমাকে গেমের ফাইনাল দিন অর্থাৎ জুলাইয়ের ৩১ তারিখের চারদিন আগেই দেওয়া হয়েছিল। তাই নিজের প্ল্যান সাজাতে অসুবিধা হয়নি খুব একটা। প্রথমেই খুঁজে বের করলাম, GTIE-এর অধীনে মোট কয়টা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। এদের মিডিয়া প্রোডাকশন হাউস অবশ্য ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে অবস্থিত। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোর লোকেশন খুঁজে বের করতে বেশ পরিশ্রম হলো। গাজীপুরের কোনাবাড়ী, সাভার, আশুলিয়া আর টঙ্গিতে চারটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে GTIE গ্রুপের। প্রত্যেকটা ফ্যাক্টরিতে কম করে হলেও পাঁচশর বেশি কর্মী কাজ করে। এ ছাড়া প্রোডাকশন হাউসে শিফট হিসেবে ২০০ জনের বেশি কর্মচারী রয়েছে। হাই কনসেনট্রেটেড মাস্টার্ড গ্যাস দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য কমপক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা প্রয়োজন। গেমের নিয়ম অনুযায়ী মাসের শেষ দিন রাত বারোটার মাঝেই মৃত্যু কার্যকর হবার কথা। তার মানে, ৩০ জুলাই রাত ১২টার আগেই গ্যাস প্রয়োগ করা হবে GTIE-এর আওতাধীন সবগুলো প্রতিষ্ঠানে। 

কিন্তু কীভাবে? ওরা সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেই তো পারে? 

স্যার, আপনি ভুলে যাচ্ছেন, এই গেমের পরিকল্পনাকারীদের কাছে অসম্ভব বলতে কিছু নেই। সর্ষের ভেতরে ভূত ঢোকাতে এরা ভালোই পারদর্শী। হয়তো প্রতিষ্ঠান খোলা থাকার সময়ই কোনো না কোনো কর্মী বা সিকিউরিটি বা আয়ার মাধ্যমে কোনো টাইমার যুক্ত গ্যাস বম্বের আকারে প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল মারণ মাস্টার্ড গ্যাস। আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। 

মাস্টার্ড গ্যাসকে প্রশমিত করতে ব্যবহার করা হয় সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ। কেমিক্যাল ল্যাব থেকে কয়েক বাক্স ভর্তি সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট সলিউশন ম্যানেজ করলাম। সিআইডির অভিযানের নাম না করলে অবশ্য সম্ভব হতো না। হাসান সাহেবের কাছ থেকে আবেদনপত্র লিখিয়ে নিলাম। এরপরের ঘটনাগুলো সংক্ষিপ্তভাবেই বলা যায়। ৩০ তারিখ দিবাগত রাত ১২টার আগেই পাঁচ-পাঁচটি জায়গা সুরক্ষিত করাই ছিল আমার মিশন। সবগুলো গার্মেন্টসের ইনচার্জকে গুপ্ত হামলার ব্যাপারে বুঝিয়ে বললাম, পর্যাপ্ত পরিমাণ সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ দিয়ে প্রত্যেক রুমের প্রতি ইঞ্চি ভিজিয়ে রাখতে বললাম। সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট মাস্টার্ড গ্যাসের ব্লিস্টারিং এজেন্ট সালফারের সাথে বিক্রিয়া করে এটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। সবার শেষে গেলাম মতিঝিলের প্রোডাকশন হাউসে। ম্যানাজারকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ৩০ জুলাই দিবাগত রাত ১২টার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দুচোখ ভরা অপার মুগ্ধতা নিয়ে তামিম সাহেব বললেন,

কিন্তু এতগুলো জায়গায় তুমি একাই দৌড়াদৌড়ি করলে? কারো সাহায্য নিলেনা? 

গেমের প্ল্যানাররা কোড ডিকোডে অন্যের সাহায্য নেওয়া অ্যালাউ করলেও, ফাইনাল স্টেপ নেওয়ার সময় কখনোই অন্য কারো সাহায্য নেওয়া অ্যালাউ করেনি। তবে তিনদিন অনেক সময়। শরীরের উপর ধকল একটু বেশি গেলেও শেষ পর্যন্ত আমার প্ল্যান কাজ করল।

আমাজিং আবরার। কিন্তু মিডিয়ার লোকেরা এই মাস্টার্ড গ্যাস দিয়ে হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে কীভাবে জানতে পারল? আর কেস সলভ যে তুমিই মাস্টারমাইন্ড-এটা তানভীর আহমেদ কীভাবে জানলেন? 

আসলে, প্রোডাকশন হাউসের ম্যানেজার তানভীর আহমেদকে আমার ব্যাপারে খুলে বলে। তানভীর আহমেদ ঘটনার পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে পুরো হামলার পরিকল্পনা এবং আমিনুল হকের সম্পৃক্ততার ব্যাপার মিডিয়াকে জানান।

আর উদ্ধারকারী হিসেবে আমার নামটা মিডিয়ার কাছে তানভীর আহমেদই বলেন। তিনি জানান, সিআইডির কর্মকর্তা ডা. আবরার ফাহাদ গোপন সূত্রে এই হামলার ব্যাপারে জানতে পেরেছেন। ব্যাসিক্যালি, মিডিয়া এরপর থেকেই আমার পেছনে লাগে। 

কয়েক হাজার মানুষের জীবন তুমি বাঁচিয়ে দিয়েছ আবরার, ব্রাভো! আচ্ছা, আমিনুল হকের বিরুদ্ধে কী কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? 

প্রশ্নটা করেই বোকা বনে গেলেন ডিআইজি তামিম সাহেব। আমিনুল হকের মতো এত বড় ধনকুবেরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার বুকের পাটা পুলিশ প্রশাসনের নেই, এ কথা বলাই বাহুল্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছুদিন আলাপ-আলোচনা, তারপর আবার পুরোনো কাসুন্দি রেখে নতুন কাসুন্দির গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যাওয়া, পুঁজিবাদীরা বরাবরই পার পেয়ে যায়-এই তো পুঁজিবাদের অলিখিত নিয়ম। আবরার সফল না হলে যদি কারো প্রাণ যেত, তবে তা ধনকুবেরের বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রী কিংবা তার পরকীয়া প্রেমিকের নয়, খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের। নিজের অজান্তেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল তামিম সাহেবের। 

এত বড় একটা কাজ করলে, কিন্তু তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে। অমাবস্যার সবটুকু আঁধার নেমে এসেছে। কী হয়েছে আবরার? অ্যাডিশনাল ডিআইজি রাব্বি সাহেবের কণ্ঠে প্রগাঢ় অভিভাবকসুলভ মায়া, একই সাথে উকণ্ঠা। 

স্যার! দেখতে দেখতে নয়টা লেভেল পার হয়ে গিয়েছি ঠিকই, তবে এবার কেন যেন ভয় লাগছে। প্রথম দিনই বলে দেওয়া হয়েছিল, লেভেল টেনে আমাকে একটা স্পেশাল গেম খেলতে হবে। এই গেমে কে 

কো-অর্ডিনেট দেওয়া হবে। স্পেশাল শব্দটা শুনেই কেন যেন একটা অদ্ভুত ইনটুইশন কাজ করছে। মনে হচ্ছে, খুব খারাপ কিছু একটা হতে চলেছে। তার উপর আবার একটা উদ্ভট কো-অর্ডিনেট পাঠানো হয়েছে। আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। 

লেভেল টেনের ফার্স্ট কো-অর্ডিনেট পেয়ে গেছ! আগে বলবে তো? আবরার একটা হার্ডবোর্ড তুলে দিলো দুজনের হাতে। এখানে খোদাই করে লেখা 

Up 
16-22
13-19
25-33 

Down
23-31
14-18
17-23 

এর মাঝে ১৩-১৯ আর ১৪-১৮ সবুজ রঙের বোল্ড লেটারে লেখা, যেই প্যাকেটে কো-অর্ডিনেট পাঠানো হয়েছে, তার উপর খোদাই করা গেমের লোগোও সবুজ রঙের। 

হাসান সাহেব আর তামিম সাহেব একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন কয়েকবার। নাহ, এই কো-অর্ডিনেট ভেদ করা তাদের কম্মো নয়। হঠাৎ একটা ফোন কল পেয়ে শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন ডিআইজি, আবরার, সেদিন যে দাঁতের এক্স-রে করতে ধানমন্ডি গেলাম-বলেছি না? এক্স-রে রিপোের্টটা আজকে আনতে যেতে হবে। তুমি একেবারে টেনশন কোরো না। এই কো-অর্ডিনেটটাও তুমি ঠিক ডিকোড করতে পারবে। বেস্ট অব লাক। 

ফজলে রাব্বি সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন আবরারকে। শরীরের যত্ন নিও। আমরা তাহলে আজ আসি। অতিথিদ্বয়কে বিদায় দিয়ে লিভিং রুমের দরজা আটকাল আবরার। শূন্যে ডিগবাজি দেবার ছেলেমানুষি ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে দমন করল। তামিম সাহেবের হাত ধরে চুমু খাবার ইচ্ছেটাকেও দমন করল এরই সাথে। 

হার্ডবোর্ডে লেখা কোডটা শেষ পর্যন্ত আবরার ডিকোড করতে পেরেছে। দাঁতের এক্সরে-সামান্য দুটো শব্দই খুলে দিয়েছে সব রহস্যের জট। 

Up
16-22
13-19
25-33 

Down
23-31
14-18
17-23 

Up লেখার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে উপরের চোয়ালকে। ডাউন লেখার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে নিচের চোয়ালকে। আর রেঞ্জ আকারে যে নম্বরগুলো খোদাই করে লেখা, সেগুলোর মাধ্যমে মানুষের জন্মের পর কততম মাসের মাঝে কোন কোন দাঁত গজায়, সেগুলোরই গাণিতিক হিসাব বোঝানো হয়েছে। 

ডেন্টালের ছাত্রছাত্রী কিংবা ফরেনসিক অডোন্টলজির কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও প্রথম দর্শনে কোডটা ডিকোড করা খুব একটা সহজ ছিল না। 

চোখের সামনে কতগুলো নম্বরের রেঞ্জ দেখলে দাঁতের কথা মাথায় না এসে গাণিতিক বিভিন্ন ধারাপাত বা সূত্রের কথা মাথায় আসাই বেশি যুক্তিযুক্ত। 

১৬-২২ দিয়ে বোঝানো হয়েছে, জন্মের ১৬ থেকে ২২ মাসের মাঝেই বাচ্চার উপরের মাড়ির একটা দাঁত গজায়, এর নাম কেনাইন। ১৩-১৯ দিয়ে ফাস মোলার দাঁত, ২৫-৩৩ দিয়ে একইভাবে উপরের চোয়ালের সেকেন্ড মোলার দাঁত বোঝানো হয়েছে। Down লেখার মাধ্যমে নিচের চোয়ালের দাঁতগুলোরও একই পরিক্রম দেখা যায়। ২৩-৩১ দিয়ে নিচের চোয়ালের দ্বিতীয় মোলার দাঁত গজানোর সময়কাল বোঝানো হয়েছে। একইভাবে বিশ্লেষণ করলে ১৪-১৮ দিয়ে প্রথম মোলার আর ১৭-২৩ দিয়ে নিচের মাড়ির কেনাইন দাঁতের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

বোল্ড লেটারে ১৩-১৯ আর ১৪-১৮ লেখা। তার মানে হত্যাপদ্ধতিতে উপর আর নিচের চোয়ালের প্রথম মোলার দাঁতের কোনো না কোনো সম্পৃক্ততা আছে। 

কিন্তু কীভাবে? আর স্পেশাল গেমটাই বা কি হতে যাচ্ছে! এক অদৃশ্য গোখরা সাপের হিসহিস শব্দে আবরারের তলপেটের ভেতরটা পাক খেয়ে উঠলো, জাত-গোখরা যেন অশ্রুতপূর্ব কম্পাংকের মিশেলে বলে চলেছে, সর্বনাশের জন্য তৈরি হও! 

***

এর আগে এত কাছ থেকে মুখোশমানব হার্মিসকে দেখেনি আবরার। সাদা মুখোশে সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা সাপ দুটোকে দারুণ জীবন্ত লাগছে, যেন এখনই বাইরে বের হয়ে আসবে! ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, উচ্চতায় আবরারের প্রায় কাছাকাছি।

কালো আলখেল্লার মাঝে ঘাপটি মেরে থাকা ভয়েস চেঞ্জিং মডিউলটা এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হবে, ভাবেনি আবরার। মডিউলের গায়ে খোদাই করে লেখা আছে RIKEN। 

গেমের প্রথম দিনই জাপানের এই কোম্পানির নাম বলা হয়েছিল, মাথায় তখন থেকেই নামটা গেথে আছে। মুখোশমানব স্বয়ংক্রিয় রিমোট কন্ট্রোল স্পর্শ করতেই বরাবরের মতো হলঘরের দেয়াল দুদিকে সরে গেল। একনজর চোখ বুলিয়ে আবরারের মুখ হাঁ হয়ে গেল-প্রাগৈতিহাসিক কোনো কালের পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে আদিগন্তবিস্তৃত কোনো মাঠে। 

LED স্কাইলাইট প্রযুক্তি দিয়ে নির্মিত আকাশে গোধূলিবেলার আলো। চোখের সামনে দেখতে পাওয়া আধিভৌতিক দিগন্তের আবহকে কেন যেন খুব পরিচিত মনে হতে লাগলো। দুই পা সামনে এগোতেই যান্ত্রিক স্ত্রী কণ্ঠ শুনতে পেল, 

ওয়েলকাম টু লেভেল টেন অব হেলমিথ গেম। দিস ইজ আ স্পেশ্যাল রাউন্ড। দ্য থিম অব লেভেল টেন ইজ অর্ফিয়াস অ্যান্ড ইউরিডাইস। 

এতক্ষণ দূর থেকে পুরো সেটটা সম্পর্কে ঠিকঠাক ধারণা করতে পারছিল na আবরার। হঠাই বুঝতে পারল, গ্রিক মিথোলজির পাতালপুরীর অনুকরণে অসম্ভব নৈপুণ্যের সাথে কোনো দারুণ কারিগর এই সেট নির্মাণ করেছেন। আগে থেকে জানা না থাকলে যে কেউ ভাবতে বাধ্য হবে, আলাদিনের প্রদীপের সাহায্যে কেউ জাদুর দুনিয়ায় গ্রিক মিথোলজির জগতে পা রেখেছে। 

হার্মিস যেকোনো আত্মাকে পথ দেখিয়ে পাতালপুরীতে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। পার্থক্য শুধু এই, বাস্তবের জগতের হার্মিস আবরারের সাথে সেটের ভেতর প্রবেশ করেনি। আবরার পেছন ফিরে তাকাল একবার। 

অদ্ভুত ব্যাপার। এর আগে যতবারই গেম প্ল্যানারদের নির্বাচিত ভেন্যুতে খেলা হয়েছে, হলঘর থেকে প্রধান সেটে ঢোকার সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আজকে কেন ব্যতিক্রম ঘটল বুঝতে পারল না। 

অর্ফিয়াস আর ইউরিডাইসের থিম বলতেই বা কী বোঝানো হয়েছে, কে জানে! লেভেল টেনের ভিকটিম সম্পর্কে কোনো কিছু আবারকে জানানো। হয়নি। কেবল উপর আর নিচের মাড়ির প্রথম মোলার দাঁত আর ক্রাইম ভেন্যু-এই দুটো কুই দেওয়া হয়েছে। 

আবরার যতই সামনে এগোতে থাকল, চোখের দৃষ্টি ক্রমে পলকহীনে পরিণত হলো। কিছু দূর এগোতেই এক জলাশয় দেখে থমকে দাঁড়াল। দূর থেকে ঠিকঠাক ঠাহর করা যাচ্ছিল না। কৃত্রিম জলাশয় যে এতটা জীবন্ত লাগতে পারে, আগে কখনোই বুঝতে পারেনি। 

এটাকে পাতালপুরীর আকেরন নদীর আদলে তৈরি করা হয়েছে, ঘাটে ভেড়ানো নৌকা দেখে সহজেই বুঝতে পারল আবরার। 

নৌকার উপর এক প্রান্তে একজন বসে আছে। আবরারের বুঝতে কয়েক মুহূর্ত সময় লাগলো-আদতে অবয়বটি মানুষের নয়, নিপুণ দক্ষতায় কোনো কারিগরের হাতে গড়া এক মূর্তির। 

অন্যান্য গ্রিক দেবতা কিংবা সাধারণ পুরুষের মূর্তি অসম্ভব সুদর্শন পুরুষের আদলে তৈরি করা হলেও নৌকার মাঝির মূর্তি আতঙ্কজনকভাবে কুশ্রী। চোখ থেকে ফিনকি দিয়ে বের হওয়া লালরঙা আগুনের কুণ্ডলীকেও ঘেঁচেকুঁদে জীবন্ত রূপ দেওয়া হয়েছে। থুতনিতে কয়েক গাছা দাড়িকে যে কোনো ভাস্কর এত বাস্তবভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে, কাছ থেকে না দেখলে কখনোই বিশ্বাস করতো না। মূর্তির কাঁধ থেকে ময়লা একটা আলখেল্লা ঝুলছে। তারমানে, মূর্তিটি আর কারোর নয়, পাতালপুরীর মাঝি ক্যারনের।

গ্রিক মিথোলজি অনুযায়ী, যখন কারো মৃত্যু হয়, তখন তার আত্মা শরীর থেকে বের হয়ে পাতালপুরীর দিকে যাত্রা শুরু করে। আত্মাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে দেবতা হার্মিস। যাত্রা থেমে যায় দুঃখের নদী আকেরনে এসে, যেখানে বৃদ্ধ মাঝি ক্যারন মৃত আত্মাদের নৌকায় করে নদীর অপর প্রান্তে নিয়ে যান। 

ফেরিতে করে নদী পার হবার জন্য প্রত্যেকের ক্যারনকে একটা করে মুদ্রা দেওয়া লাগে। এ কারণে প্রাচীন গ্রিসে কেউ মারা গেলে তার আত্মীয়স্বজনেরা মৃতদেহের জিহ্বার নিচে একটা করে মুদ্রা রেখে দেন। 

গ্রিক মিথোলজির পাতালপুরীর আদলে যেহেতু পুরো সেট নির্মাণ করা হয়েছে, নৌকাতে মাঝির মূর্তিও আছে-তাহলে মুদ্রা দিয়ে নদী পার হবার ব্যাপারটাও বাদ যাওয়া উচিত নয়, মনে মনে ভাবল আবরার। 

এতক্ষণ পর নিজের শরীরের দিকে তাকাল। জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর আসন্ন গেমের ভয়াবহতার চিন্তায় এতটাই মগ্ন ছিল যে নিজের পরনের পোশাকের দিকে পর্যন্ত তাকায়নি একবারের জন্য! অবাক বিস্ময়ে আবরার লক্ষ করল, তার পরনের শার্ট-প্যান্ট খুলে বিচিত্র দর্শন একটা পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন গ্রিসের টেগোসদৃশ এক পোশাক, পুরোপুরি আলখেল্লা বলা যাবে না এটাকে। 

মাথায় একটা ছোট টুপি। টুপিটা মাথা থেকে খুলে নিবিষ্টমনে পরীক্ষা করতে লাগল। রাজা-বাদশাহের মাথার টুপির সাথে যেমন বিচিত্র পাখির পালক যুক্ত থাকে, এই টুপির মাথায় অর্ফিয়াসের বিখ্যাত সেই লায়ার নামের বীণার আদলে একটা ছোট অংশ যুক্ত আছে। কী দিয়ে এই টুপি তৈরি কে জানে! 

তার মানে গেমের থিম অনুযায়ী লেভেল টেনে অর্ফিয়াসের ভূমিকায় খেলতে হবে-বুঝতে পারল আবরার। 

হারকিউলিসের পরিবর্তে অর্ফিয়াসের থিম নিয়ে আসার কারণেই এই গেমকে স্পেশ্যাল বলা হয়েছে। নিজের অদ্ভুতদর্শন পোশাক খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল এবার। কোন ফ্যাশন ডিজাইনারকে দিয়ে এই পোশাক ডিজাইন করা হয়েছে কে জানে! অসংখ্য খোপ পুরো পোশাকজুড়ে, এগুলোকে প্রাচীন আমলের পোশাকের পকেট নাম দেওয়া যেতে পারে! 

দুহাত দিয়ে নিরীক্ষণ করতে গিয়ে হঠাৎ এক অংশে একটা মুদ্রার দেখা পেয়ে গেল। প্রাচীন গ্রিক মুদ্রা। অবশ্য, এই গেমের নেপথ্যের কারিগরদের যে পরিমাণ শক্তিমত্তা, তাতে দুর্লভ এবং প্রাচীন কোনো মহামূল্যবান নিদর্শন সংগ্রহ করা বিচিত্র কিছু নয়। 

মিথোলজি অনুযায়ী, ক্যারনকে মুদ্রা না দিতে পারলে তিনি আত্মাকে আকেরন নদী পার হয়ে অপর প্রান্তে পৌঁছাতে দেন না। কবর না দেওয়া আত্মা কিংবা ঠিকঠাক সৎকার করা হয়নি, এমন মৃতদেহের আত্মাকে ক্যারন নির্দয়ভাবে ফিরিয়ে দেন। তবে ক্ষমতাবানদের ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যত্যয় পাতালপুরীতেও ঘটানো হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে ক্যারন জীবিতদের নদী পার হতে দেন। মাঝে মাঝে ক্যারনের হৃদয়ে সহানুভূতি জেগে ওঠে। কিউপিডের স্ত্রী সাইকিকে করুণার বসে ক্যারন নদী পার হতে দিয়েছিলেন। হারকিউলিস শারীরিক শক্তির ভয় আর হুমকি দিয়ে নদী পার হয়েছিলেন। অর্ফিয়াস নিজের সুর আর সংগীত প্রতিভা দিয়ে বিমোহিত করে ক্যারনের থেকে সুবিধা আদায় করে নিয়েছিলেন। 

অর্ফিয়াস…আজকের গেমের থিম অর্ফিয়াস আর ইউরিডাইস। অর্ফিয়াস তো প্রাণপ্রিয় স্ত্রী ইউরিডাইসকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিলেন এই পাতালপুরীতে। অর্ফিয়াসের থিম কেন রাখা হয়েছে আজকের গেমে কিছুতেই বুঝতে পারছে না আবরার। মিথের অর্ফিয়াসের তো অসাধারণ সংগীত প্রতিভা ছিল। আবরার গিটার বাজানোর প্রতিভা আর তবলায় তাল দেওয়া ছাড়া সংগীতবিষয়ক অন্যান্য জ্ঞানে ক অক্ষর গোমাংস। তাই সংগীতবিষয়ক বিনিময় প্রথার মাধ্যমে এই জলাশয় পার হবার সুযোগ নেই, আর নৌকায় উঠে জলাশয় পার হওয়া ছাড়া সামনে যাবারও উপায় নেই। সাতপাঁচ ভেবে সময় নষ্ট না করে নৌকায় উঠে পড়ল আবরার। ছোটবেলায় মাটির ব্যাংকে পয়সা রাখার চতুষ্কোণ ফুটোর মতো একটা অংশ দেখা যাচ্ছে নৌকার ছইয়ের ওপর। সেখানে পোশাক থেকে পাওয়া মুদ্রাটা ঢুকিয়ে দিতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে নৌকাটি চলতে শুরু করল। সাদা চোখে পাল তোলা সাধারণ নৌকা বলে মনে হলেও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে নৌকাটির ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। 

কিছুক্ষণের মাঝেই নৌকা ওপারে ভিড়ল। নৌকা থেকে নেমে কিছুদূর হটতেই চোখে পড়ল রাজকীয় বিশাল এক ফটক। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা মিথোলজি-সংক্রান্ত দুই মলাটের নীরস বুলিগুলো এভাবে প্রাণ পাবে, আবরারের দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। গুটি গুটি পায়ে চারপাশে চোখ বোলাতে বোলাতে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। 

পথের দুই পাশে বেশ কিছু প্রাণীর মূর্তি-অবশ্য আগে থেকে গ্রিক মিথোলজি নিয়ে পড়াশোনা করে এসব প্রাণীর গঠনগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা না থাকলে, মূর্তিগুলো দেখে ঠিকঠাক অনুমান করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যেত। 

এই তো, পথের দুই প্রান্তে সারি সারি মূর্তির মাঝে প্রথমেই আছে সেন্ট্যরের মূর্তি। সেন্ট্যর মিথোলজির এক অদ্ভুত সৃষ্টি। শরীরের উপরের অর্ধাংশ মানুষের মতো হলেও কোমর থেকে নিচের অর্ধাংশ ঘোড়ার মতো। 

এই মূর্তিতে মানবীয় অংশকে অনিন্দ্যসুন্দর এক গ্রিক রাজপুত্রের আদলে তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া ড্রাগনের আদলে বহুমাথাবিশিষ্ট হাইড্র, এক চোখবিশিষ্ট বিশাল দানব সাইক্লোপসের মূর্তিও তৈরি করা হয়েছে দারুণ প্রাঞ্জলভাবে। 

হাঁটার পথ যেন আর ফুরোয় না। সারি সারি মূর্তি পেরিয়ে সামনে এগোতেই একপাশে কৃত্রিম গুহা। গুহার ঠিক সামনে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। অগ্নিশিখার চারপাশে প্রাচীনকালের বিভিন্ন হাতিয়ার-বর্শা, হারপুন, উঁচ, পশুর শিং পড়ে আছে বিচ্ছিন্নভাবে। গুহার দেয়ালে বিচিত্র গুহাচিত্র দারুণ নৈপুণ্যের দাবিদার। 

পথের আরেক পাশে স্টাফ করা হাতি, সিংহ আর বাঘও আছে। শেষ পর্যন্ত পায়ে হাঁটাপথ শেষ হলো। সামনে মুখ তুলতেই দুটো রাজসিংহাসন দৃষ্টি কেড়ে নিল আবরারের। সিংহাসন দুটোয় রাখা মূর্তি দুটোকে চিনতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না।

পাতালপুরীর রাজা হেডিস আর তার স্ত্রী পার্সিফোন। কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত হেডিসের হাতে একটি পাখির মূর্তি, মাথায় রাজদণ্ড। পার্সিফোনের হাতে সিসট্রাম নামক ইউ আকৃতির এক যন্ত্র, সৌম্যদর্শন গ্রিক নারীর আদলে ঘেঁচেকুঁদে বানানো হয়েছে পার্সিফোনের মূর্তিকে।

সিংহাসনের সামনে একটা সোনালি রঙের লম্বা কারুকার্যখচিত বাক্স। বাক্সের দৈর্ঘ্য, প্রস্থের অনুপাতে কয়েক গুণ হবে। নাহ ঠিক বাক্স নয়, কফিন…একটা কফিন রাখা সামনে। ভয়ের শীতল স্রোত পাকদণ্ড বেয়ে নেমে গেল। ওকে দিয়ে কী গেম খেলাতে চলেছে দানবেরা! অন্তরাত্মা কাঁপানো সেই হিমশীতল যান্ত্রিক স্ত্রীকণ্ঠ ঠিক এ সময় বলে উঠল, প্রিয় খেলোয়াড়, কফিনের ভেতর শায়িত অচেতন ভিকটিমকে উদ্ধারের জন্য আপনি এক ঘণ্টা সময় পাবেন। ঠিক এক ঘণ্টা পর এই পুরো গেমিং সেটসহ ৪০ মিটার ব্যাসার্ধের জায়গা সম্পূর্ণভাবে উড়ে যাবে। যান্ত্রিক কণ্ঠের গমগমে প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতেই কফিনের ডালাটা সরে গেল। দুই পা সামনে এগিয়ে কফিনের ভেতর উঁকি দিতেই সুনামির প্রবল জলস্রোত যেন ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র, পাকস্থলী ছাপিয়ে মুখবিবরে এসে ভাসিয়ে দিয়ে গেল অন্তরাত্মাকে। কফিনের ভেতরে অবন্তি অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে। 

প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিস্থিতেও এর আগে কখনোই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়নি আবরার, তবে দৃঢ়চেতা যুদ্ধংদেহী ব্যক্তিত্বের প্রাচীরে আজকের মতো অভিঘাত কখনো এসেছে বলে মনে পড়ছে না। এক মুহূর্ত স্থবির হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। 

তর্জনী আর মধ্যমা আঙুল দিয়ে অবন্তির ঘাড়ে ক্যারোটিড পালস খোঁজার চেষ্টা করল। খুব ঢিমেতালে চলছে রক্তপ্রবাহ। নিশ্চয়ই কড়া ডোজের সিডেটিভ দেওয়া হয়েছে। 

এবার দুহাত দিয়ে নিজের মাথার চুল শক্ত করে ধরে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল আবরার। অর্ফিয়াস আর ইউরিডাইসের থিমটা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। 

প্রচণ্ড শক্তিতে দুচোখ চেপে বন্ধ রেখে মস্তিষ্কের হিপ্পোক্যাম্পাসে রাখা দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতির ভান্ডার থেকে অর্ফিয়াসের কাহিনিটা হাতড়ে বের করার চেষ্টা করল। কেন যেন মনে হতে লাগল, কিছুক্ষণ আগে সেই শীতল কণ্ঠে লেভেল টেনের নিয়ম ঘোষণা করার মুহূর্তে কোনো একটা অংশ বাদ পড়ে গেছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো অংশ। জিগ-স পাজলের হারিয়ে ফেলা সেই ব্লকের ঠিকানা লুকিয়ে আছে অর্ফিয়াস আর ইউরিডাইসের গল্পগাথায়।

মিথোলজি অনুযায়ী, অর্ফিয়াস ছিলেন দেবতা অ্যাপোলো আর মিউজ ক্যাল্লিওপের সন্তান। বাবা আর মায়ের কাছ থেকে অর্ফিয়াস পেয়েছিলেন সংগীতের অসাধারণ দক্ষতা। লায়ার হাতে অর্ফিয়াস ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। 

অর্ফিয়াস একদিন ইউরিডাইস নামের এক বুনো অপ্সরীর প্রেমে পড়লেন, সে এক পাগলপারা ভালোবাসা। অর্ফিয়াস আর ইউরিডাইস বিয়েও করলেন। কিন্তু এই সুখ বেশি দিন চিরস্থায়ী হলো না। ইউরিডাইস একদিন সাপের কামড়ে মারা গেলেন। 

প্রেয়সীর মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না অর্ফিয়াস। অনেক সাধনার পর্ব মৃতদের জগৎ অর্থাৎ পাতালপুরীতে গেলেন তিনি। উদ্দেশ্য, প্রিয়তমাকে ফিরিয়ে আনবেন। 

লায়ারের সুরে মোহিত করে পাতালপুরীর সবাইকে বশ করে ফেললেন অর্ফিয়াস। রাজার কাছে মিনতি করলেন, ইউরিডাইসকে একবারের জন্য হলেও পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিতে। পাতালপুরীর রাজা হেডিস শেষ পর্যন্ত ইউরিডাইসকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন। কিন্তু অর্ফিয়াসকে জুড়ে দেওয়া হলো কেবলমাত্র একটি শর্ত। যতক্ষণ পর্যন্ত অর্ফিয়াস আর ইউরিডাইস পাতালপুরীর সীমানা অতিক্রম না করবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত ইউরিডাইস অর্ফিয়াসের পেছনে পেছনে যাবেন। কিন্তু অর্ফিয়াস পেছন ফিরে ইউরিডাইসকে দেখতে পারবেন না। 

মনের আনন্দে প্রেমিক যুগল এগিয়ে চললেন। চলতে চলতে পাতালপুরীর শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলেন দুজন। অল্প দূরেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে মর্ত্যলোকের আলো। কিন্তু অর্ফিয়াসের কী যেন হয়ে গেল। তার হৃৎস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল। মর্ত্যলোকের আলোতে পৌঁছেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অর্ফিয়াস পেছনে ফিরে তাকালেন। প্রিয়তমাকে একটিবার দেখতে চাইলেন, ছুঁয়ে আদুরে পরশ বুলিয়ে দিতে চাইলেন। 

ততক্ষণে যা সর্বনাশ ঘটার, ঘটে গেছে। ইউরিডাইস তখনো পাতালপুরীর সীমানা অতিক্রম করেননি। অর্ফিয়াস পেছনে তাকানোমাত্রই ইউরিডাইস চিরতরে হারিয়ে গেলেন অন্ধকার গহ্বরে। পাতালপুরীর দরজা অর্ফিয়াসের জন্য চিরজীবনের মতো বন্ধ হয়ে গেল।

পেয়ে হারানোর বেদনায় অর্ফিয়াস পুরোপুরি জীবন্মতের মতো হয়ে গেলেন। বনে-জঙ্গলে পাগলের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। এই অবস্থায় মেইনাড নামের কিছু নারীরা অর্ফিয়াসকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করলেন। টুকরো-টুকরো, টুকরো-টুকরো, টুকরো-টুকরো-বেশ কয়েকবার জোড় শব্দ উচ্চারণ করল আবরার। সবকিছু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে এখন। বিকৃত রুচির দানবেরা গেমের শেষ লেভেলে এসে আবরারের খুব নিষ্ঠুর এক পরীক্ষা নিতে চলেছে।

আর তাই লেভেল টেনের নিয়ম ঘোষণার সময় অন্যবারের মতো গেম খেলতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সম্পর্কে ন্যূনতম দিকনির্দেশনা দেয়নি। তার মানে, অর্ফিয়াসের মিথোলজিতে যেমন শেষ পর্যন্ত অর্ফিয়াসের শরীর টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, এই গেম শেষেও ৪০ মিটারের মতো জায়গা উড়ে যাবার পর আবরারের শরীরও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। 

অবশ্য, স্বার্থপরতা আর পরার্থপ্রবণতার যুদ্ধে আবরারের জন্য বাঁচার একটা পথও খোলা রাখা হয়েছে। এর আগে গেম ডেভেলপারদের নির্ধারিত গোপন গেমিং ভেন্যুতে যতবারই খেলা হয়েছে, সাদা হলঘর থেকে মূল ভেনুতে ঢোকার সাথে সাথে মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। 

কিন্তু আবরার বহুদুর থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, এবার সেই ফটক খোলা রাখা হয়েছে। অবন্তিকে ফেলে রেখে নিজের জীবন বাঁচাতে যাতে আবরার এক ঘণ্টার আগেই কাপুরুষের মতো পালিয়ে যায়, এই নিষ্ঠুর পুঁজিবাদীদের চাওয়া। অবন্তির মুখের দিকে ভালোভাবে তাকাল আবরার। কৃত্রিম ডেনচারের (প্রস্থেটিক কৃত্রিম দাঁত) এম্পুলসদৃশ কোনো অংশের সাথে নিশ্চিতভাবে কোনো টাইমার যুক্ত করা হয়েছে। এম্পুলের ভেতর বিস্ফোরক দ্রব্য রাখা হয়েছে। এরপর সেই এল ডেন্টাল ড্রিল মেশিন দিয়ে অবন্তির উপর আর নিচের মাড়ির প্রথম মোলার দাঁত দুটোতে ঢুকিয়ে আবার সদ্য ক্ষয়িষ্ণু দাঁত প্রস্থেটিক ডেনচার দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে। আবরার নিজের অনুকল্প নিয়ে নিশ্চিত। এ-ও নিশ্চিত, সেই ভয়ংকর বিস্ফোরক পদার্থ হিসেবে গানপাউডার ব্যবহার করা হয়েছে। 

৪০ মিটার ব্যাসার্ধের মাঝে সবকিছুকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে, এমন বিস্ফোরক নিয়ে ভাবতে গেলে গানপাউডারের কথাই প্রথম মাথায় আসে। ঠিক এক ঘন্টা পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে অবন্তির শরীর। কাপুরুষের মতো গেম ছেড়ে খোলা ফটক দিয়ে পালিয়ে না গেলে সত্যিকারের অর্ফিয়াসের মতো ছিন্নভিন্ন শরীরের ভাগ্য বরণ করতে হবে আবরারকেও। 

ন্যূনতম বিবেকবোধ আর মানবতাবোধ বিবর্জিত মহাপরাক্রমশালী কোনো এক পুঁজিবাদীর বিকৃত নেশার বলি হতে হবে অবন্তিকে। 

জানোয়ারেরা এবারের লেভেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো সুযোগই রাখেনি আবরারের জন্য, রাখেনি প্রাণ বাঁচানোর জন্য কোনো সরঞ্জাম বা যন্ত্র। এরই নাম তবে স্পেশ্যাল গেম! ভাবনাগুলো ক্রমশ জট পাকিয়ে যাচ্ছে, দলা পাকানো থুথু ছুঁড়ে ফেলল আবরার। ছুঁড়ে ফেলল ফুসফুসের সর্বশক্তি দিয়ে, অদৃশ্য এক পুঁজিবাদীকে উদ্দেশ্য করে! 

শূন্য দৃষ্টিতে সিংহাসনের উপরে রাখা হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের দিকে তাকালো এরপর। বিশ মিনিট ইতোমধ্যেই পার হয়ে গিয়েছে। এতটা অসহায় নিজেকে কখনো মনে হয়নি আগে। সর্বশক্তি দিয়ে দুচোখ বন্ধ করে রাখল কয়েক মুহূর্তের জন্য।

চোখ খুলতেই ৩৯:১০…৩৯:০৯… টিকটিক কাউন্টডাউনের হিম নিঃসীম শব্দ তরঙ্গের রূপ না ধরে বিষাক্ত তীরের রূপে বিদ্ধ হতে লাগল শরীরে। 

অচেনা উঠোনে ঘুড়ি হারানো বালকের মতো বয়স হলে হয়তো এখন তারস্বরে ডাক ছেড়ে কাদা যেত। এ কী! এখন আবার দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে কেন আবার, বুঝতে পারল না কিছুতেই। সেলফিশ জিন বইয়ের লেখক রিচার্ড ডকিন্সকে দেখতে পেল সামনে, পা দুলিয়ে বসে আছে। আবরারের দিকে মুখ ভেংচে বলল, সারা জীবন পরার্থপরতা নিয়ে লম্বা লম্বা বক্তৃতা দিয়ে আজকে ফেঁসে গেলে তো, মিস্টার? এক ঘণ্টা পর যখন নিজের প্রাণ বাঁচাতে এখান থেকে দৌড়ে পালাবে, তোমার ভালোবাসা জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ! চুরুট টানতে টানতে বিশ্রী ভঙ্গিতে হাসতে লাগল লোকটা। 

কোনো রকম মাদকদ্রব্য ছাড়াই প্রচণ্ড মানসিক চাপে মস্তিষ্কের অলীক কল্পনা যে সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে, আজকের দিনটা জীবনে না এলে জানাই হতো না। দিনদুপুরে হ্যালুসিনেশন! কী বলল মাত্র লোকটা? ভালোবাসা…আচ্ছা, আবরার কি অবন্তিকে ভালোবাসে! দাহ উৎসবে মত্ত শ্মশানপাড়ায় বসে নিজের কাছে নিজেকে এ প্রশ্ন করা অবান্তর। নাহ। এভাবে রণে ভঙ্গ দেবার ছেলে আবরার নয়। একটা না একটা উপায় বের করতে হবে। অবন্তিকে বাঁচাতে হবে। যেভাবেই হোক। 

মাথা থেকে নেতিবাচক সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল আবরার। ফেলে আসা পথের দিকে আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে নজর দিতে লাগল। অবন্তির উপরের আর নিচের মাড়ি থেকে খুব সাবধানে দাঁত দুটো তুলে ফেলতে হবে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। হাতের কাছে পাওয়া কোনো না কোনো উপাদান দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে একটা সাঁড়াশি তৈরি করতে হবে। 

চোখ বন্ধ করে আবার কয়েক মুহূর্ত ভাবল আবরার। প্রাগৈতিহাসিক গুহা, গুহাচিত্র, জ্বলন্ত আগুনের কুণ্ডলী, সামনে পড়ে থাকা বিভিন্ন হাতিয়ার, স্টাফ করা বাঘ, সিংহ, হরিণ-বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল আবরার। যেই সম্ভাবনার কথা মাথায় এসেছে, ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারলে অবন্তিকে বাঁচানো যাবে। দেরি না করে কাজে লেগে পড়ল। ধারালো হারপুনের ফলা দিয়ে স্টাফড হরিণের মাথার শিং ভাঙতে চেষ্টা করল। 

সময় খুব বেশি নেই, যা করার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে হবে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর দুটো শিংই খুলে এলো। দৌড়ে আগুনের শিখার কাছে ছুটে গেল এরপর। 

শিং দুটোকে আগুনে পুড়িয়ে হারপুন আর ছুঁচের মাধ্যমে বেশ করে কেটে আর হেঁচে সাঁড়াশির বাহুর মতো আকার দিলো আবরার। 

সাঁড়াশির মূলত তিনটি অংশ : বাহু বা হ্যাঁন্ডেল, সেফালিক কার্ভ, যেখানে টো নামের ধারালো একটি অংশ থাকে। মূলত এর মাধ্যমেই দাঁত তোলা হয়। এই অংশটাই মূল চিমটা। বাহু আর সেফালিক কার্ভের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে শ্যাংক নামের একটি দণ্ডাকার অংশ। বাহুর অংশটি তৈরির জন্য খুব বেশি বেগ পেতে না হলেও স্টাফ করা হরিণের শিং থেকে সেফালিক কার্ভের আকারে সাঁড়াশির নির্দিষ্ট অংশ বের করে নিয়ে আসতে বেশ পরিশ্রম হলো। 

প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল, হাতে বানানো সাড়াশির বাহু আর সেফালিক কার্ভের মাঝের অংশটি যদি ভেঙে যায়। তাহলে পুরো পরিশ্রমই বিফলে যাবে।

টাইমার টিকটিক করে জানান দিয়ে চলেছে, আর বাইশ মিনিটের মতো সময় বাকি আছে। কোনোমতে কাজ চালানোর মতো আদিম যুগের সাঁড়াশি বলা যায় কিম্ভুতকিমাকার যন্ত্রটাকে।

সময় নষ্ট না করে এক ছুটে অবন্তির কাছে গেল আবরার। অচেতন মুখটাকে দুহাতে তুলে নিল পরম যত্নে। প্রথমবারের মতো নিজ হাতে অচেতন কোনো মানুষের দাঁত তুলতে চলেছে সে। 

কিন্তু ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া, ক্যাভিটির সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নয়, বিস্ফোরণ থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে। 

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! মানুষটি আর কেউই নয়; বরং এমন একজন, যার চোখে গোধূলির আবছায়াও মৃন্ময়ী ভোর দেখতে পায় আবরার। অথচ সেই ভোর দর্শনের স্নাত স্নিগ্ধ অনুভূতি সম্পর্কে মানুষটাকে একবারের জন্যও জানতে দেয়নি! 

বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল আবরারের। যমরাজের ফাঁক গলে পুরোহিত সাজে রাজকন্যাকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে কি পারবে শেষ পর্যন্ত! খুব সাবধানে অবন্তির মুখ উঁচু করল। এক হাত দিয়ে উপরের ঠোঁট ধরে গুনে গুনে প্রথম মোলার দাঁতে নবনির্মিত সাঁড়াশির বাঁকানো চিমটার মতো অংশ বসাল আবরার। ঠিকঠাক কাজ করবে তো তাৎক্ষণিক বুদ্ধি দিয়ে বানানো যন্ত্রটা! 

ভয়ের শীতল স্রোত মেরুদণ্ড বেয়ে আরেক দফা মেরুর শীতলতা সঞ্চার করতে লাগল। না, ভয় পেলে চলবে না! আবরারকে পারতেই হবে। চোখ বন্ধ করে আয়াতুল কুরসি পড়ে নিলো একবার। প্রচণ্ড ভয়ে এই দোয়াটা বরাবর কীভাবে কীভাবে যেন কাজে লেগে গেছে। সাবধানে বাহু দুটোতে চাপ দিয়ে হেঁচকা টান দিলো। 

পেরেছে। আবরার শেষ পর্যন্ত সর্বনাশা দাঁতটা তুলে আনতে পেরেছে। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল আবরারের হাত, তবু রক্ত দেখে জীবনে কখনো এতটা খুশি হয়েছে বলে মনে পড়ছে না! আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রের বদলে আবেগীয় আপেক্ষিকতার নতুন এক সূত্রের জনক বলে মনে হতে লাগল নিজেকে। অবন্তির মায়াভরা মুখটা সোনামুখী বেদনার সুচে নীল হয়ে যাবার কথা এতক্ষণে। সম্ভবত অচেতনকারী গ্যাসের সাথে অ্যানালজেসিকও (ব্যথানাশক) দেওয়া হয়েছে, বার্বিচুরেট হবার সম্ভাবনা প্রবল। 

খুব সাবধানে নিচের চোয়ালের প্রথম মোলার দাঁতটাকেও বের করে আনতে পারল আবরার। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের টাইমারে সময় দেখাচ্ছে ১৫:৪৩…তার মানে বেশ কিছু সময় বাকি আছে। পনেরো মিনিট শেষ হবার আগে অবন্তিকে নিয়ে ভেন্য থেকে সাদা হলঘরে যেতে পারবে তো! অজানা আশঙ্কা বুকের মাঝে উঁকি দিতে না দিতেই যান্ত্রিক স্ত্রীকণ্ঠ শেষবারের মতো বলে উঠল, লেভেল টেনের স্পেশ্যাল গেমে উত্তীর্ণ হবার জন্য আপনাকে অভিনন্দন। গেমিং প্যানেলে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মাধ্যমে এম্পুলে রাখা গানপাউডারকে ধীরে ধীরে উত্তপ্তকরণ করার প্রক্রিয়াটি বন্ধ করা হয়েছে। 

বুকের ভেতর আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা সাবধানে বের করে দিলো আবরার। গানপাউডারকে বাইরে থেকে এমনভাবে উত্তপ্ত করা হচ্ছিল, যাতে ঠিক এক ঘণ্টার মাথায় বিস্ফোরণ ঘটে। তার মানে, পুরো প্রক্রিয়াটি থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। ৪০ মিটার ব্যাসার্ধের প্রতি ইঞ্চি জায়গা এখন নিরাপদ।

অবন্তির রক্তে ভেজা মুখটা দুহাতে নিজের কাছে নিল, গভীর চুমোর আলিঙ্গনে ভরিয়ে দিলো ঘুমকুমারীকে। নোনতা রক্তেও যে গত বর্ষার স্নাত কদমের সুবাস থাকতে পারে, আগে কী জানত? 

১৭. অশনিসংকেত এবং অপেক্ষা

দেয়ালে আটকে থাকা টিকটিকিটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবরার। খুব ছোটবেলায় বাবাকে একটা প্রশ্ন করে প্রায়ই ত্যক্ত-বিরক্ত করে ফেলত, 

বাবা, টিকটিকিগুলো দেয়াল থেকে পড়ে যায় না কেন! কীভাবে দেয়ালের সাথে আটকে থাকে? 

বাবা ছোট্ট আবরারকে যাহোক কিছু একটা উত্তর দিয়ে ভুলিয়ে দিতেন। বড় হবার পর যেদিন প্রথম জানতে পেরেছিল ভ্যান ডার ওয়ালস বলের কারণেই টিকটিকি দেয়াল আঁকড়ে ধরে থাকে, মাটিতে পড়ে যায় না, বাবার উপর দারুণ রাগ হয়েছিল। ভ্যান ডার ওয়ালস বেশ দুর্বল প্রকৃতির বন্ধন। টিকটিকির পায়ের নিচে লাখ লাখ চিকন চুলের মতো তন্তু আর দেয়ালের অণুর মধ্যে এই ভ্যান ডার ওয়ালস বন্ধন কাজ করে। 

ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আবরার। মানুষ যেই বন্ধনে এই নশ্বর পৃথিবীতে টিকে থাকে, সেই বন্ধনের ক্ষণকালের স্থায়িত্বের তুলনায় ভ্যান ডার ওয়ালস বলের দৌর্বল্য কিছুই না। 

কী ব্যাপার আবরার! একটানা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কী এত ভাবছ? তোমার মাইন্ড রিফ্রেশ করার জন্য ধরে বেঁধে আমার বাসায় নিয়ে এলাম, আর তুমি সেই ভাবের জগতে হারিয়ে গিয়েছ? 

হাত থেকে ট্রে নামিয়ে রাখলেন ফজলে রাব্বি সাহেব। ধোয়া ওঠা গরম গরম নুডলস নিজ হাতে রান্না করে এনেছেন আবরারের জন্য। আবরারের দিকে এগিয়ে দিলেন বাটিটা। 

স্যার, এই তো বিকেলেই ম্যাডামের হাতে কতগুলো পাকুড়া খেলাম। রাত আটটাও বাজেনি। এরই মাঝে আবার এত আয়োজনের কী দরকার ছিল?

তোমার ম্যাডাম বিকেলেই তার বোনের বাড়িতে গিয়েছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই তার বড় বোনের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। যাবার আগে আমাকে পই পই করে বলে গিয়েছেন কয়েকবার করে, তোমার আপ্যায়নে যাতে কোনো রকম অসুবিধা না হয়। তুমি জানো না, আমাদের বাসায় তো তুমি বিশাল সেলিব্রেটি! রোজ এতবার করে বাসায় তোমার কথা বলতে থাকি যে তোমাকে তো এ বাসার সবাই সুপার হিউম্যান মনে করে! 

স্যার! আপনি তো আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলেন। ম্যাডাম দুপুরে যে এলাহি আয়োজন করেছেন, তারপর আগামী কয়েক দিন কিছু না খেলেও চলবে। 

একসঙ্গে দেখব বলে কয়েকটা আর্টফিল্ম নামিয়ে রেখেছি। আজকে তোমার ডিপ্রেসড মুড ঝরঝরে করে তবে ছাড়ব। তার আগে ভূড়িভোেজ না হলে কী চলে নাকি?

স্মিত হাসল আবরার। দোতলার ছাদে চিলেকোঠার মতো এক ঘরে আয়েশ করে বসে আছে সে। টেবিলের পাশেই ছোট একটা কার্টুনে অনেকগুলো প্রস্থেটিক স্পাই ক্যামেরা আর রেকর্ডার। সিআইডি ডিপার্টমেন্টের ইনভেস্টিগেশনের মাননান্নয়নের জন্য অর্ডার দিয়েছিল জাপান থেকে। 

গেম থেকে RIKEN কোম্পানির ব্যাপারে জানার পর সেখান থেকে ডিভাইস অর্ডার করার জন্য অনেক চেষ্টা-চরিত্র করে আবরার। তবে আমজনতা বা প্রতিষ্ঠানের জন্য ওরা কোনো হাইটেক প্রোডাক্ট সরবরাহ করে না। শেষ পর্যন্ত অন্য একটা কোম্পানি থেকেই অর্ডার দিয়েছে বাধ্য হয়ে। স্যারের বাসায় আসার কিছুক্ষণ আগে ডেলিভারির জন্য DHL থেকে ফোন আসায় আবরার দেরি না করে আজই নিয়ে এসেছে। হেয়ার ফাইবার, চশমা, সিন্থেটিক তিল, লেন্স-সবকিছুর ভেতর হাইটেক ন্যানো প্রযুক্তির স্পাই ক্যামেরা আর অডিও রেকর্ডার ব্যবহার করা হয়েছে প্রতিটি প্রোডাক্টে। অপরাধীদের চব্বিশ ঘণ্টা মনিটর করার জন্য বাংলাদেশের সাপেক্ষে বেশ অগ্রগণ্য একটি প্রযুক্তি! 

ঘরের চারপাশে একবার চোখ বোলাল আবরার। পুরো ঘরজুড়ে স্যারের রুচির ছাপ পাওয়া যায়। আসবাবের বাহুল্য নেই, নেই দামি কোনো সরঞ্জাম। 

এক পাশে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার আর লেখার একটা খাতা। অবসর সময়ে কাব্যচর্চা করার অভ্যাস আছে ফজলে রাব্বি সাহেবের। এক পাশে বেশ বড় একটা বুকশেলফ। আবরারের মতো বিশাল সংগ্রহশালা না হলেও বাংলা আর ইংরেজি ক্ল্যাসিক সাহিত্যের বিচারে নিতান্ত কম নয় সংগ্রহ। ফজলে রাব্বি সাহেবের স্ত্রী নিলুফার ইয়াসমিনকে দেখলেই কেমন যেন ভক্তি হয়। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীদের মুখশ্রীর মাঝেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিলাসব্যসনের চিহ্ন দেখা দেয়। আজকালকার যুগে যে হারে সরকারি কর্মকর্তাদের কল রেকর্ড যখন-তখন ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, অল্প বেতনে রাজরাজড়ার মতো জীবনযাপনের সব গোমর সাধারণ মানুষের কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। 

একবার এক সাধারণ পুলিশ কর্মকর্তার বাড়িতে গিয়ে আভিজাত্যের বহর দেখে হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছিল। বাড়ির সামনে বিশালাকার সুইমিং পুল, রাজপ্রাসাদসম বিশাল ডুপ্লেক্স ভবন। 

বসার ঘরে কয়েক লক্ষ টাকার বিদেশি পিয়ানোর সেট। দেয়াল-সংলগ্ন তাকে অসংখ্য এন্টিক শোপিস। পদাধিকার বলে যোজন যোজন ব্যবধান। পিছিয়ে থাকলে কী হবে, আভিজাত্যের বহর দেখলে সম্পদ-প্রতিভার বলে বলীয়ান মনে হয়। অথচ… অথচ কী ভীষণ আকণ্ঠ দুর্নীতির ভারে নিমজ্জিত একেজন সরকারি কর্মকর্তা! ফজলে সাহেবের সাদাসিধে বসার ঘরে এক সেট বেতের সোফা, হাতে তৈরি কিছু নকশা কাটা ঘর সাজানোর সামগ্রী, দেয়াল-সংলগ্ন তাকে স্যারের বহু বছরের ক্যারিয়ারে কর্মদক্ষতা আর নিয়মানুবর্তিতার জন্য প্রাপ্ত কিছু পুরস্কার-ক্রেস্ট আর গোল্ডমেডেল। সামনে একটা টিভি সেট। 

ছিমছাম সাধারণ্যের মাঝে আভিজাত্য নিয়ে এসেছে দিয়েছে নিলুফার ম্যাডামের নিজ হাতে করা ওয়ালম্যাট, প্রতি ফোঁড়ে ফেঁড়ে পরম যত্ন আর মায়ার আস্বাদ-একনজর দেখেই বেশ বলে দেওয়া যায়। কিটি পার্টি করে বেড়ানো আর কয়েক আস্তরের মেকআপের আবরণে ঘুরে বেড়ানো পটের বিবিদের দেখে প্রথম দর্শনেই আলাদা করে ফেলা যায় মানুষটিকে। লেভেল টেন শেষ করার পর অবন্তি আর আবরার দুজনই বেশ অনেকটা দিন ট্রমায় ছিল। অবন্তি এখনো বেড রেস্টে আছে। ঈষৎ শূন্য মাড়ির শোক এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আবরারের মন ভালো করতে বলা যায় অনেকটা জোর করেই ফজলে রাব্বি সাহেব নিজের বাসায় নিয়ে এসেছেন। 

আবার কী ভাবছ বলো তো? 

না না স্যার! তেমন কিছু না। আপনাকে…

আবরারের কথা শেষ না হতেই হঠাৎ কাশির দমকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন ফজলে সাহেব। 

এ কী স্যার! আপনার অবস্থা তো দেখছি একেবারেই ভালো না! ম্যাডাম বোনের অসুস্থতার জন্য দূরে দূরে থাকায় আপনার যত্ন-আত্তি ঠিকঠাক হচ্ছে না, বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে। আপনি বসুন, আমি চট করে আদা-চা করে আনছি। অনেক কষ্টে কাশি থামিয়ে ধাতস্থ হলেন ফজলে সাহেব, আর বোলো না! ছাড়ব ছাড়ব করে সিগারেটটা কিছুতেই ছাড়া হচ্ছে। তোমার ম্যাডাম অবশ্য জানে না, লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাই। আবার সিজনাল ফুটাও ভোগাচ্ছে। 

আপনি আমাকে কিচেনটা দেখিয়ে দিন, এক্ষনি আদা-চা করে আনছি। আরে আরে, তুমি অতিথি মানুষ! তুমি কেন কষ্ট করবে? ও ঠিক সেরে যাবে। দরকার হয় আমিই বানিয়ে আনছি। 

চোখ পাকিয়ে স্যারের দিকে তাকাল আবরার, চোর সন্তানসুলভ আদুরে শাসনের ভঙ্গি। 

আচ্ছা বাবা আচ্ছা। কষ্ট করে নিচের রান্নাঘরে যেতে হবে না। ছাদের এই ঘরটার নাম দিয়েছি সেইন্ট-হাউস। তোমার ম্যাডামের সাথে ঝগড়া হলেই এখানে এসে পীর-ফকিরের মতো ধ্যান করি, হাহাহাহা। ঝগড়া চললে খাবারের উপরও অনশন করতে হয়। 

তাই চা-কফি আর টুকটাক রান্নার জন্য ছাদের ওপাশে একটা ছোটমতো রান্নাঘর করিয়ে নিয়েছি। সিলিন্ডার সিস্টেম। সাবধানে কাজ কোরো। আমি ততক্ষণে ভালো কোনো আর্টফিল্ম সিলেক্ট করে রাখি। পপকর্ন তো রেডিই আছে। 

মিনিট পনেরো পর দেখা গেল, মেঝেতে পাতা ম্যাট্রেসে দুই পা ছড়িয়ে বসে নবীন আর প্রবীণ দুজন সহকর্মী একসঙ্গে হেমলক সোসাইটি দেখছে। চা শেষ করে কয়েকটা পপকর্ন মুখে দিয়ে আবরারের দিকে একবার তাকালেন ফজলে সাহেব। চোখের দৃষ্টি আপাতদৃষ্টিতে কম্পিউটারের স্ক্রিনে বলে মনে হলেও আদতে তা নয়! মুখের ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, কোনো এক অশনিসংকেতের অপেক্ষায় আপাতদৃষ্টিতে হাস্যোজ্জ্বল মুখের অন্তরালে আবরারের ভেতরটা গুমরে উঠছে। 

কী হয়েছে জিজ্ঞেস করবে করবে করেও শেষ পর্যন্ত আর জিজ্ঞেস করলেন না ফজলে রাব্বি সাহেব। মুভি দেখার ক্ষেত্রে তিনি বড়ই আনাড়ি। শেষ কবে বিনা ক্লেশে একটা মুভি দেখা শেষ করেছেন মনে করতে পারলেন না। 

আজও বোধ হয় পারবেন না, দুচোখ ঘুমে জড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেকে বেশিক্ষণ জাগিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি, গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন। শুধু জানতে পারলেন না, মুভি দেখার অনভ্যস্ততায় নয়, আবরারের দেওয়া হাই ডোজ ডায়াজিপামের প্রভাবেই অসময়ে ঘুম পাড়ানি মাসি আর পিসি তার চোখের পাতায় আসন পেতে বসেছে। 

১৮. শেষ পর্ব- অ্যাকিলিসের টেন্ডন 

ওয়াশিংটন ডিসির প্রাণকেন্দ্রে ২০ একর জায়গার উপর স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক নির্মাণশৈলীর আদলে তৈরি বাড়িটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা বোধ হয় এর জোড়া টেরেস।

আবরার টেরেসের ঠিক মাঝখানে বসে আছে। পাশেই সবুজে ঘেরা বিশাল এক সুইমিংপুল। রাজকীয় টেবিলের উপর পড়ে থাকা American Express Centurion Card আর নোটবুকসদৃশ স্মার্ট ডিভাইস হাতে তুলে নিলো আবরার। 

কিছুক্ষণ আগেই গেমের মাস্টারমাইন্ড নিজে এসে আবরারকে পূর্বঘোষিত উপহার হিসেবে এ দুটো জিনিস দিয়ে গেছে। 

American Express Centurian Card-কে ব্ল্যাক কার্ড নামে ডাকা হয়। আমেরিকার অনেক প্রখ্যাত সিনেটর, শিল্পপতি এই কার্ড ব্যবহার করে। 

গেমের নিয়ম অনুযায়ী চ্যাম্পিয়ন হবার জন্য প্রধান পুরস্কার হিসেবে আবরারের জন্য এই বিশেষ ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। 

এর বিশেষত্ব হলো, আগামী পাঁচ বছরের মাঝে এর ব্যালেন্স কখনোই শেষ হবে না। যেকোনো জায়গা থেকে আবরার যখন ইচ্ছে তখন যত খুশি তত ডলার ব্যবহার করতে পারবে। স্বয়ং হেলমিথ গেমের মাস্টারমাইন্ডের নির্দেশে এই ব্ল্যাক কার্ডের ব্যালেন্স প্রতি মাসে রিইস্যু করা হবে। আবরারকে দেওয়া দ্বিতীয় উপহার হলো নোটবুকের আকারের একটি স্মার্ট ডিভাইস। স্মার্ট ডাইরেক্টরি বলা হয় একে। এর মাঝে আছে পৃথিবীর বিখ্যাত পঞ্চাশজন সুন্দরীর ঠিকানা এবং কনট্যাক্ট মেইল। এদের মাঝে হলিউড, ব্রিটেন, তুরস্ক, মিসরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চোখধাঁধানো সুন্দরী মডেল-নায়িকাদের ডিটেইল রয়েছে। কেবল একবার নামের পাশে স্পর্শ করলেই আগামী এক বছরের জন্য যেকোনো সুন্দরীকে নিজের সঙ্গী করতে পারবে আবরার। 

গেমের মাস্টারমাইন্ড সম্পর্কে নিজের মনের মাঝে একটা ছবি এঁকে রেখেছিল এত দিন। ভয়ংকর এক দানবের ছবি, যার চোখের কুটিল দৃষ্টি ভস্ম করে দেয় সবকিছু। চোখের সামনে সত্যিকারের মানুষটাকে দেখে হিসেবের খাতা বড় গোলমেলে লেগেছে। অসম্ভব রূপবান এক পুরুষ। আয়তকার মুখ, পটলচেরা গভীর দুটো চোখ, চোখের দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা। সত্যিকারের বয়স পঞ্চাশের কোঠায় হলেও সুগঠিত শরীর আর দারুণ উচ্চতা বয়সকে যেন কমিয়ে দিয়েছে গুণোত্তর ব্যবধানে। চেহারার গঠন আর গায়ের রং দেখে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা উত্তর ভারতের অধিবাসী বলে মনে হয়। 

মায়াভরা মুখটা দেখলে মনেই হয় না, মানুষটা কতটা ক্ষমতাশালী আর কতখানি ভয়ংকর। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মাফিয়া ডনদের মাঝে S.S.R একটা ব্র্যান্ড নেম। যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তার বাম হাতের খেল। তার আন্ডারওয়ার্ল্ডের সম্পদের হিসেব কোনো ওয়েবসাইটই ঠিকঠাক রাখে না। তাই S.S.R-এর ঠিক কী পরিমাণ সম্পদ আছে, তার দাপ্তরিক কোনো হিসেব নেই। আবরারের সাথে S.S.R এর কথোপকথন হলো খুবই সংক্ষিপ্ত। খাঁটি আমেরিকান অ্যাকসেন্টে আবরারকে অভিনন্দন জানিয়ে পুরস্কার দুটো তুলে দেবার পর পরই দুজন বডিগার্ড অনুগত সৈনিকের মতো পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল তাকে। আবরারের দুচোখের মাঝখানে চিনচিনে ব্যথাটা আবার বেড়ে গেছে। গেম অথরিটি নিজস্ব জেটপ্লেনে উড়িয়ে নিয়ে আসার পর থেকে জেট লেগের প্রভাবে সময়ের হিসাবটা গোলমেলে লাগছে। 

দুহাতে মারণখেলার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পাওয়া পুরস্কার দুটোকে আঁকড়ে ধরে রাখল, যেন মুঠো আলগা করলেই নিচে পড়ে যাবে। মুখে তেতো একটা অনুভূতি হলো, অবশ্য অনুভূতির পুরোটাই বিভ্রম। আলজিভ খসে যাওয়া মুখবিবরে নতুন করে আস্বাদ পাবেই বা কী করে! 

***

তিন মাস পর…

শ্বেতশুভ্র ঘরে মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেঝের সাথে শুভ্র বিছানার পাশে রাখা মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর, কৃত্রিম স্যালাইনের উপকরণ ঠিক মানানসই বলে মনে হচ্ছে না। ঘরের আভিজাত্যের মাঝে এক খণ্ড হাসপাতালের আবহই সৌন্দর্যের সুর-তাল-লয় কেটে যাবার প্রধান কারণ। 

বালিশে হেলান দিয়ে থাকা অবয়ব আবরারের দিকে হাত ইশারা করে বিছানার মুখোমুখি রাখা ধবধবে সাদা চেয়ারে বসতে বলল। হাতের ক্যানুলা ছাড়া অবয়বটির চোখেমুখে অসুস্থতার চিহ্ন নেই। দেরি না করে আবরার বসে পড়ল। প্রথম দিনের মতো মার্কিন অ্যাকসেন্টে বলে উঠল অবয়বটি, আই জাস্ট ওয়ানা নো দ্যাট হাউ দ্য হেল ডিড ইউ ডু দিস আনবিলিভেবল থিং? 

আবরারের মুখে বিস্তৃত এক হাসি, মাউন্ট এভারেস্টের প্রথম শেরপার হাসির ঔজ্জ্বল্যের সাথেই বোধ হয় তুলনা হতে পারে এই হাসির! দীর্ঘ বক্তব্যের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করল আবরার। মিস্টার S.S.R ওরফে শেহগিল শাহ রামসেস। আপনার বাবা মিশরীয় হলেও আপনার মা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একজন বাঙালি। আপনার জন্মও ভারতে। জীবনের প্রথম কিছু বছর ভারতে থাকার সুবাদে মাতৃভাষা বাংলাটা আপনার ভালোই রপ্ত আছে। দীর্ঘদিনের চর্চাহীনতায় দক্ষভাবে বাংলা না বলতে পারলেও আমার বাংলা কথা বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হবার কথা নয়। 

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছে হেলমিথ গেমের মাস্টারমাইন্ড শেহগিল। বেশ স্পষ্ট ভারতীয় বাংলা উচ্চারণে বলে উঠলেন, অসুবিধে নেই। বলে যাও। আমার সম্পর্কে এত কিছু তুমি কীভাবে জানো? মুখের হাসিটাকে আরও কিছুটা প্রশস্ত হতে দিয়ে পরক্ষণেই গম্ভীর হয়ে গেল আবরার। কণ্ঠে অনন্য গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বলে চলল,

আপনার বাবা ইয়াসের শাহ রামসেস ছিলেন জাতিসংঘের শান্তি মিশনের একজন ডাক্তার। অসাধারণ মানবপ্রেমী ছিলেন তিনি। জাতিসংঘ শান্তি মিশনের মাধ্যমে পুরো পৃথিবী ঘুরে মানুষের সেবার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গই ছিল তার জীবনের লক্ষ্য। জাতিসংঘের শান্তি মিশনের এক ট্রিপে আর্মিদের ডাক্তার হিসেবে অনেক অনেক বছর আগে আপনার বাবা ভারতে এসেছিলেন। মাদার তেরেসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নির্মল হৃদয় সেবাকেন্দ্রের এক ভারতীয় বাঙালি খ্রিস্টান নার্সকে প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলেন তিনি। নার্সের নাম ছিল আলিনা রোজারিও। কিছুদিন পর তারা বিয়ে করলেন। 

ইয়াসের শাহ কলকাতায় ডাক্তারি শুরু করলেন। সেখানেই ষাটের দশকের মধ্যভাগে আপনার জন্ম। অসম্ভব পরার্থপ্রবণ বাবা-মায়ের ঘরে আপনার জন্ম হলেও মেন্ডেলের জেনেটিক্সের সব সূত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপনি বেড়ে উঠতে লাগলেন। দেখতে অসম্ভব সুদর্শন হওয়ায় ছোটবেলা থেকে অনেকের আদর-ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে থাকেন। এর সাথে আপনার মধ্যে একধরনের সুপিরিওরিটি কমপেক্স গড়ে ওঠে। সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত রূপের সাথে সাথে আপনি ছিলেন অসম্ভব মেধাবী আর প্রতিভাবান। কিন্তু আপনার বাবা-মায়ের মাঝে মানবতাবোধের কোনো কমতি না থাকলেও আপনার ভেতরটা ছিল আশ্চর্যরকম শীতল। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, মায়া-আপনার মাঝে কখনোই এসবের কোনো কিছুরই উপস্থিতি ছিল না। আপনি ছিলেন সাধারণের থেকে আলাদা, একদম আলাদা। 

আপনি ছোটবেলা থেকেই চারপাশের পরিবেশের উপর সূক্ষ্মভাবে নিজের প্রভাব খাটাতে পছন্দ করতেন। আর নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য যতটুকু নিচে নামতে হোক, আপনি তাতে পরোয়া করতেন না। চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় আপনাকে একজন সাইকোপ্যাথ নামে অভিহিত করা যায়। জীবনের প্রথম খুনটা আপনি করেন বারো বছর বয়সে। 

স্কুলে আপনার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল একটি ছেলে। ক্লাসে প্রথম হবার পথে সবচেয়ে বড় কাঁটাটি সরিয়ে দিতে কৌশলে আপনি তাকে আর্সেনিক পয়জনিং করেন। ছেলেটি একসময় মারা পর্যন্ত যায়। আপনি নিজের চরিত্রের বিকারগ্রস্ত দিকটিকে বরাবর মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই আপনার নে প্রদানের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। আপনার চরিত্রের সব থেকে বড় বিকৃতি হলো, আপনি কোনো ক্ষেত্রেই প্রথম স্থান থেকে দ্বিতীয় স্থানে অবনমন সহ্য করতে পারেন না। যেকোনো ক্ষেত্রে প্রথম হবার ক্ষেত্রে নিজের পথের যেকোনো কাঁটাকে সরিয়ে দিতে আপনি দুবার ভাবেন না। 

চে গুয়েভারার সাথে আপনার দারুণ একটা মিল রয়েছে। আপনারা দুজনেই ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র, আপনারা দুজনেই প্রভাবশালী। কিন্তু একজন মানবতার জন্য প্রাণপাত করতে দুবার ভাবে না, আর আরেকজনের বুকে মানবতার ন্যূনতম স্থান নেই, পুরোটাজুড়ে নিরেট নিষ্ঠুরতা। চিকিত্সাবিজ্ঞানের পড়াশোনার জন্য আপনি মিশরে চলে যান। সেখানে পড়াশোনা শেষ করে ডাক্তারি বাদ দিয়ে রাজনীতির প্রতি আকর্ষিত হন আপনি। বাবা মিসরের অধিবাসী হবার কারণে আপনিও মিসরের নাগরিকত্ব পেয়ে যান। রাজনীতিই একমাত্র মাধ্যম, যা আপনাকে পৃথিবীতে প্রভুত্বের ঠিকানায় পৌঁছে দিতে পারে। এরপর থেকে শুরু হলো আপনার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। মেধার সাথে যখন নিষ্ঠুরতার মিশেল ঘটে, মানুষ তখন যেকোনো উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। আপনার ক্ষেত্রেও তাই হলো। আন্ডারগ্রাউন্ড আর মাফিয়াদের জগতে আপনি ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠতে লাগলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আপনার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক আর বিবেকহীনতা রাজনীতির ক্ষেত্রে আপনাকে এনে দিলে আশাতীত সাফল্য। 

অবৈধ ব্যবসার ক্ষেত্রেও সোনা ফলতে লাগল আপনার দুহাতে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ হিসেবেও আপনার নাম দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল। বর্তমানে পৃথিবীর পঞ্চাশটির বেশি দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডে আপনার ব্যবসা ডালপালা বিস্তার করে আছে। 

আপনার মধ্যকার অস্বাভাবিকতা সবার আগে আপনার মায়ের চোখে ধরা পড়ে। খুব নিষ্ঠুরভাবেই নিজের বাবা-মাকে ত্যাগ করেন আপনি। তিরিশের কোঠা স্পর্শ করার পর থেকেই তাদের সাথে আপনার আর কোনো যোগাযোগ নেই। অবশ্য আপনার বাবা মাঝে মাঝে আপনার অজান্তে আপনার খোঁজ রাখেন। আমি প্রথম থেকেই ভাবছিলাম, গ্রিক মিথোলজি নিয়ে আপনার এই অবসেশনের কারণ কি শুধুই গ্রিক গডের পাওয়ারপ্লে! উত্তর খুঁজে পাই ভারতে গিয়ে আপনার বাবার সাথে দেখা করার পরে। 

বিস্ফারিত চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে আছেন শেরগিল। আবরারের কণ্ঠে দ্বিধার লেশমাত্র নেই। শীতল কণ্ঠে বলে চলেছে, আপনার বাবা ছিলেন অসম্ভব নীতিমান একজন মানুষ। কিন্তু আপনার দাদার চরিত্রে একবার মেয়েঘটিত কলঙ্কের দাগ লেগে যায়। আপনার দাদাকে আপনার বাবা ইয়াসের শাহ একবার খুব কাছের কোনো এক আত্মীয়ের সাথে অজাচার করতে দেখে ফেলেন। এরপর নিজের বাবাকে নপুংসক করেন তিনি। পারিবারিক এই গোপন কলঙ্কের ইতিহাস কোনো না কোনোভাবে আপনার কানে আসে। গ্রিক মিথোলজি নিয়ে পড়াশোনার প্রাক্কালে একদিন আপনি জানতে পারেন, টাইটান ক্রনাস মা গায়ার সাহায্যে নিজের পিতা ইউরেনাসকে নপুংসক করেছেন। 

মিথোলজির এই ঘটনার সাথে আপনাদের পারিবারিক ঘটনার মিল আপনাকে দারুণ আলোড়িত করে। গ্রিক মিথোলজির সাথে নিজের ক্ষমতার লোভের সমসত্ব মিশ্রণ ঘটিয়ে দারুণ কিছু করার পরিকল্পনা করেন আপনি। হেলমিথ গেম সেই পরিকল্পনারই অংশ। 

ইউ ডিড ইওর রিসার্চ কোয়াইট ওয়েল। বাট আই ডিড নট গেট মাই আনসার!

সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলে উঠলেন শেহগিল। আবার কণ্ঠের শীতলতা ফারেনহাইটের শেষ স্তরে নিয়ে গেল, 

আমি পর্যায়ক্রমে সব প্রশ্নেরই উত্তর দেব। ঘটনাপ্রবাহকে গুছিয়ে বলতে আমি অভ্যস্ত।

গেমের শুরুতেই আমাকে জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য আপনাদের বিশেষ প্রতিনিধি আছে। হার্মিসের ছদ্মবেশে একজন আমার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছে। এই হার্মিসের খোঁজ না পেলে, সত্যি বলতে, আপনার সম্পর্কে এত রিসার্চ করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। 

যেকোনো দেশে নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য আপনাদের মতো ক্ষমতাধর মানুষদের প্রথম নিশানা হলো সেই দেশের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি, সরকারি-কর্মকর্তা, আমলা এবং শিল্পপতিরা। আপনি একজন অসম্ভব বুদ্ধিমান মানুষ। সর্ষের ভেতর ভূত ঢোকাতে হলে সাদা চাদরের ছদ্মবেশে সেই ভূতকে ঢেকে দেওয়াই আপনার পরিকল্পনার প্রথম অংশ। হার্মিসের ক্ষেত্রেও এই সাদা চাদরের অনুকল্পের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন আপনি। 

মেক ইট ক্লিয়ার। 

সিআইডি ডিপার্টমেন্টে সাদা চাদরের মোড়কে মোড়ানো এমনই এক ভুত হলেন অ্যাডিশনাল ডিআইজি ফজলে রাব্বি সাহেব। তার সাথে আপনার অনেক মিল রয়েছে। আপনারা দুজনেই লোকের চোখে ধুলো দিয়ে আড়ালে আবডালে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে পারদর্শী। আপনার লোকের সাথে ফজলে রাব্বি সাহেবের প্রথম পরিচয় দুবাইয়ে এক ক্যাসিনোতে। গিরগিটির মতো নিজের রং বদলাতে সক্ষম মানুষটিকে আপনি নিজের বাংলাদেশি প্রতিনিধি হিসেবে পছন্দ করে ফেলেন। 

কারণ, তার চোখেমুখে আছে অদ্ভুত সারল্য। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপনের ধোয়া তুলে তিনি নিজের ডিপার্টমেন্টের প্রত্যেকের কাছে নিজেকে পরিচিত করেছেন একজন নির্লোভ, সৎ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে। 

কিন্তু মুখোশের আড়ালে সন্ত্রাসবাদীদের কাছে বিভিন্ন সিক্রেট পাচার করে লাখ লাখ অবৈধ উপার্জন তিনি ছদ্মবেশে পাচার করতেন বাইরে। 

আপনার মতো বিশাল এক বটবৃক্ষের ছায়াকে মাথার উপর পেয়ে ফজলে রাব্বি সাহেব আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে সৎ, নির্লোভ এবং সাধারণ জীবনযাপনের অভিনয় করে সবার চোখের মণি হয়ে উঠলেন। 

আপনার প্রতিষ্ঠানের ছত্রচ্ছায়ায় অবৈধ সম্পদের ছোটখাটো পাহাড় থেকে মাউন্ট এভারেস্ট গড়ে তুললেন। কোনো পার্টিতে কখনো ছেলেমেয়েদের নিয়ে যোগ দিতেন না তিনি। সবাই জানত, তার দুই ছেলে বোর্ডিং স্কুলে পড়াশোনা করে। আদতে, ছেলেদের আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে পড়তে পাঠিয়েছিলেন তিনি। 

.

হার্মিসই যে ফজলে রাব্বি সাহেব, আমার জন্য এটা খুঁজে বের করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না, যদি সেদিন তার বাড়িতে না যেতাম। তার রান্নাঘরের গার্বেজে ভয়েস চেঞ্জিং মডিউল দেখে আমার প্রথম সন্দেহটা হয়। কয়েক রাত ঘুম হচ্ছিল না দেখে সেদিনই প্যান্টের পকেটে স্লিপিং পিল কিনে রেখেছিলাম। চায়ের মাঝে সুযোগ বুঝে গুনে গুনে চারটা ট্যাবলেট মিশিয়ে দিই। তিনি ঘুমিয়ে পড়তেই প্রস্থেটিক আঁচিলে সংযুক্ত ন্যানো স্পাই ক্যামেরাটা তার কপালের বড় আঁচিলের সাথে এমনভাবে মিশিয়ে দিই, যাতে তার কোনোক্রমেই সন্দেহ না হয়। থ্যাংকস টু ইউ। আপনার হেলমিথ গেমের কল্যাণে প্রস্থেটিক হাইটেক স্পাইং গ্যাজেট সম্পর্কে এত কিছু জানতে পেরেছি। 

বিভিন্ন দেশে আপনার প্রতিনিধিদের সাথে প্রতি মাসেই আপনার গোপন বৈঠক বসে। স্পাই ক্যামেরার সূত্র ধরে আপনাকে নিয়ে রিসার্চ করার পথটা সুগম হয়, বলতে পারেন। 

হাউ ডিড ইউ প্লেস দ্য সিলিকন এম্পুল অব পটাশিয়াম সায়ানাইড ইনসাইড মাই বডি? 

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বাক্যবিরতি ছেদ করল আবরার। 

হোল্ড অন আ সেকেন্ড ডিয়ার। আমি সেই প্রসঙ্গেই আসছি। আপনার মতো হাইপ্রোফাইল একজন মানুষের চুল স্পর্শ করার সুযোগ আমার নেই–এতটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে। কিন্তু আপনার মতো একটা বিবেকহীন দানবকে একটা উচিত শিক্ষা না দেওয়া পর্যন্ত বুকের ভেতরের চিনচিনে ব্যথাটা কিছুতেই কমছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আপনার দেওয়া উপহার গ্রহণ করব। তাহলেই না আপনার তীর ব্যুমেরাং হয়ে আপনার বুকে বিধবে। বুঝলেন না তো? বুঝিয়ে বলছি। আপনি নিজেও একজন ডাক্তার, তাই আশা করি বুঝতে পারবেন। আমাদের কাফ মাসলের সাথে গোড়ালির ক্যালকেনিয়াস নামক হাড়কে যুক্ত করে একটা বিশেষ টেন্ডন। আপনার প্রিয় গ্রিক মিথোলজির অ্যাকিলিসের নামেই রাখা হয়েছে এই টেন্ডনের নাম। আপনার দেওয়া কার্ডের সাহায্যে অচিন্তনীয় পরিমাণ অর্থ খরচ করে বিজ্ঞানীদের দিয়ে ক্যাপসুলের আকারের একটা সিলিকনের এম্পুল বানাই। এর ভেতরটা পরিপূর্ণ করাই পটাশিয়াম সায়ানাইড দিয়ে। বিশেষায়িত সিলিকনের ক্যাপসুলসদৃশ এম্পুলের বিশেষত্ব হলো, নির্দিষ্ট পরিমাণ চাপ পেলেই এটি ভেঙে যাবে। 

সাধারণত আমরা যখন হেভি এক্সারসাইজ করি, ১.১৫-০.২৩ থেকে শুরু করে সাধারণত সর্বোচ্চ ১.৩৮-০.২৩ kPa মডুলাস পর্যন্ত কাফ মাসলের চাপ বৃদ্ধি পায়। এম্পুলটাকে এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে কাফ মাসলের সংকোচন প্রসারণের ফলে ১.৩৮-০.২৩ kPa চাপ সৃষ্টি হলেই এম্পুল ভেঙে যায়, কিন্তু স্বাভাবিক হাঁটাচলা কিংবা কাজকর্মে যাতে কোনোভাবেই এঙ্গুল না ভাঙে। 

এরপর আছে আপনার দেওয়া ক্রেডিট কার্ডের সাথে সাথে স্মার্ট ডাইরেক্টরির অবদান। ব্রাজিলিয়ান এক সুন্দরী মডেল আপনার বর্তমান প্রমোদসঙ্গী, আপনার সম্পর্কে রিসার্চের সময়ই জানতে পারি। 

আপনার দেওয়া ক্রেডিট কার্ড থেকে এবারও খরচ করলাম বিপুল অঙ্কের টাকা। সেই মডেলকে ঘুষ দিলাম আপনার সাথে রাত কাটানোর পর আপনার খাবারের মাঝে কড়া ডোজের সিডেটিভ আর আন্যালজেসিক দেওয়ার উদ্দেশ্যে। 

এক বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিকও একইভাবে অর্থের লোভে রাজি হয়ে গেলেন আমার কথায়। 

কী কথা? দ্বিতীয়বারের মতো বাংলা উচ্চারণ করলেন শেহগিল। 

কাফ মাসলের শেষ প্রান্তে যেখানে অ্যাকিলিসের টেন্ডন শুরু হতে চলেছে, ঠিক সেখানে এপিডার্মিস আর ডার্মিসের স্তর ভেদ করে হাইপোডার্মিস স্তরের ফ্যাটি লেয়ারে (অ্যাডিপজ টিস্যু) সিলিকনের এম্পুলটা স্থাপন করে সেই অর্থোপেডিক। ব্রাজিলিয়ান মডেলের সাথে ঘটনার একদিন আগেই তার যোগসাজশ করিয়ে দিয়েছিলাম। গভীর রাতে সেই মডেলের বাড়িতে ঢুকতে খুব একটা সমস্যা হয়নি তার। 

ডোন্ট স্টপ। দেন? 

তারপর আপনার বাবার সাথে যোগাযোগ করে আপনাকে নিয়ে খেলা এই ডেথ গেমের কথা জানালাম। প্রথমে এক সমুদ্র অভিমানের কারণে আপনার ব্যাপারে ভীষণ শীতলতা দেখালেও কোনো এক আততায়ীর খেলার কারণে আপনার প্রাণ বিপন্ন জানতে পেরে আপনার অশীতিপর বাবা কেঁদে উঠলেন। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? আপনার দেওয়া ক্রেডিট কার্ডের বদৌলতে টাকা দিয়ে সবাইকে হাত করতে পারলেও আপনার বৃদ্ধ বাবাকে হাত করা গেল না। 

যত বোঝাতে চেষ্টা করলাম, আপনার মতো অমানুষ ডিজার্ভ করে, কিছুতেই আপনার সম্পর্কে অসম্মানজনক একটা কথাও শুনতে রাজি হলেন না তিনি। 

আপনার বাবা বেশ কষ্টেসৃষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। তাই তার সামনে রাখলাম দুটো শর্ত। হয় শেষ বয়সে রাজার হালে দিন কাটানোর জন্য তাকে আমি দেব কয়েক মিলিয়ন রুপি। বিনিময়ে আপনার হত্যাকাণ্ডকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হলো, তাকে দেওয়া কুয়ের ওপর ভিত্তি করে তিনি আপনার প্রাণ বাঁচাবেন। আপনার অশীতিপর পিতা এই বয়সে এসেও দ্বিতীয় শর্তে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি নিজ হাতে আপনার প্রাণ বাঁচাতে চান। 

আমি তাকে কেবলমাত্র একটা কু দিয়েছিলাম-অ্যাকিলিসের টেন্ডন। হেলমিথ গেম থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি প্রাণ বাঁচানোর পদ্ধতিকে সহজ করে দিলাম। আপনার বাবাকে আমেরিকায় উড়িয়ে নিয়ে এলাম। আপনার সাপ্তাহিক রুটিন অনুযায়ী আপনি কেবল শুক্রবার জিমে যান। আর সিলিকন এম্পুল স্থাপন করা হয় শনিবার। আপনার হাতে সময় ছিল বেশ অনেক দিন। 

ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ক্রেডিট কার্ড থেকে কিছু টাকা উৎকোচ হিসেবে দিই আপনার জিমের ম্যানেজারকে। জিম শুরু করার আগে আপনাকে কফির সাথে এনেস্থেটিক মেশানোর জন্য রাজি করাতে কিন্তু বেশি খরচা করতে হয়নি। ঘটনার দিন আপনার বৃদ্ধ ডাক্তার বাবা শল্যচিকিৎসার যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে জিমের ভেতরই তাৎক্ষণিকভাবে আপনার পায়ে সার্জারি করেন। অশীতিপর বৃদ্ধের ক্ষয়িষ্ণু ডাক্তারি বিদ্যের উপর ভর করে হলেও সন্তানের শরীর থেকে বের করে আনেন পটাশিয়াম সায়ানাইডের এল। 

আপনি জিম শুরু করলেই যেই সায়ানাইড আপনার শরীরে মিশে মুহূর্তেই আপনার কর্মবহুল জীবনটাকে শেষ করে দিত। 

শান্ত দৃষ্টিতে ঘটনাপ্রবাহের পুরোটুকু মনোযোগ দিয়ে শুনে চলেছে। শেহগিল। 

অ্যাকিলিসের গোড়ালির কাহিনিটা তো আপনি নিশ্চয়ই জানেন, তবুও একবার বলি। অ্যাকিলিসের মা থেটিস ছিলেন অমর। তার বাবা পেলিয়াস ছিলেন মরণশীল। অ্যাকিলিসের জন্মের পর তার মা ছেলের অমরত্বের জন্য তাকে স্টিক্স নদীতে নিমজ্জিত করেন। 

গোড়ালির নির্দিষ্ট অংশ ধরে অ্যাকিলিসকে অবগাহন করানোর কারণে তার পুরো শরীর অমরত্ব পেলেও গোড়ালির যে টেন্ডন ধরে মা তাকে নদীতে ডুবিয়েছেন, সে অংশটি হয় নশ্বর। ট্রয়ের যুদ্ধে গোড়ালিতে তীর বিদ্ধ হয়েই মৃত্যু ঘটে অ্যাকিলিসের। আপনারা যারা অসম্ভব ক্ষমতাশালী, তাদের কাছে অ্যাকিলিসের গোড়ালি বাদে সম্পূর্ণ শরীর অর্থ-ক্ষমতার অপর নাম। এই দুইয়ের জোরে আপনারা নিজেদেরকে বিশ্বের অধীশ্বর ভেবে বসেন। আর অ্যাকিলিসের টেন্ডন আপনাদের কাছে মধ্যবিত্তের কিছু গাধা আবেগ-হয়তো মায়ের অযৌক্তিক ভালোবাসা, প্রেমিকার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় প্রেমিক পুরুষের ফুঁপিয়ে কাঁদা। অ্যাকিলিসের টেন্ডন মানে আপনাদের কাছে বাবার দুষ্টু সন্তানকে দুটো চড় মেরে রাগ ভাঙাতে আবার প্রিয় খেলনা কিনে দেওয়া। অ্যাকিলিসের টেন্ডন মানে মানুষের প্রতি মানুষের অকারণ অযৌক্তিক ভালোবাসা আর মায়া। 

আপনারা ভাবেন, এসব অনুভূতি বাহুল্য, আগাছা। কিন্তু আপনারা জানেন না, এই অযৌক্তিক ভালোবাসার কারণেই পঙ্কিল পৃথিবী নামের গ্রহটায় আজও বিশুদ্ধ বাতাস আছে, জোনাকি জীবন আছে। এই অযৌক্তিক ভালোবাসার কারণেই আপনি এখনো বেঁচে আছেন! না হয় পটাশিয়াম সায়ানাইডই হতো আপনার মৃত্যুর কারণ। 

অ্যাকিলিসের টেন্ডন মানুষের দুর্বলতা নয়, অ্যাকিলিসের টেন্ডনই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। সবচেয়ে বড়!

মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়া ক্রেডিট কার্ড আর স্মার্ট ডাইরেক্টরি মাড়িয়ে আবরার সামনে এগিয়ে চলল। একবারও পিছনে ফিরে দেখল না। পেছনে। তাকালে হয়তো দেখতে পেত-সৌম্যদর্শন মানুষের আড়ালে এক দানব স্নাত চোখে অস্ফুটে বলে উঠছে, আব্বা… 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *