পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
সীতার সতীন-পোকে চিঠি লিখে নিজের শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে অন্তত মাসখানেকের জন্যে সীতা আর তার ছেলেকে এখানে আনিয়ে নেবে কিনা–এই প্রাচুর্যের মধ্যে মাসখানেক থাকলেও শরীর খানিকটা সেরে যাবে ওদের–এই যখন ভাবতে শুরু করেছে ঐন্দ্রিলা, তখন একটা অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটল।
এখানে এসে পর্যন্ত ডাক্তারবাবুর কোন আত্মীয়স্বজনের দেখা যায় নি কোনদিন। তবে তাদের কথা অনেক শুনেছে তাঁর কাছে। ছেলে ভাল চাকরি করে, বোম্বের কোন্ সওদাগরী আপিসে, হাজার টাকার ওপর মাইনে পায়, বাড়ি গাড়ি দিয়ে রেখেছে তারা। খুবই দায়িত্বপূর্ণ কাজ, এক মিনিটের ফুরসৎ নেই তার। শেষ প্রায় তিন বছর আগে দেখা পেয়েছিলেন ছেলের। সে লেখে সেখানে গিয়ে থাকতে–কিন্তু তাঁর পোষায় না। আর যেন শহরে থাকতে পারেন না তিনি। তাছাড়া অমন করে হাত-পা গুটিয়ে বসে খেলে দুদিনে বুড়ো হয়ে যাবেন। আর কেনই বা মিছিমিছি জড়ানো? তাঁর কর্তব্য তিনি করেছেন, মানুষ হয়ে গেছে, সেও স্বাধীনভাবে নিজের সংসার নিজে করুক। তিনিও স্বাধীনভাবে থাকুন। ওরা আজকালকার ছেলে ওদের একরকম পছন্দ–তিনি সেকেলে মানুষ তাঁর একরকম- কাছে থাকলেই দুটো কথা বলতে যাবেন, তারা শুনবে না–তখনই অশান্তি। এই বেশ আছেন!
মেয়ে তাঁর দুটি। দুটি মেয়েই ভাল পাত্রে পড়েছে। বড় জামাইও ডাক্তার, সরকারি চাকরি করে, দিল্লীতে থাকে। তার আবার চাকরির বড় ভয়–এর মধ্যেই নাকি দুবার হুমকি দিয়ে শ্বশুরকে চিঠি লিখেছে, তিনি নাকি কী সব স্বদেশী-ওলাদের গোপনে সাহায্য- টাহায্য করেন–এসব দুর্মতি যেন অবিলম্বে ছেড়ে দেন। জানাজানি হ’লে তার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে যে!
‘বোঝ ব্যাপার!’ ডাক্তারবাবু বলেন, ‘তা আমিও তাকে লিখে দিয়েছি বুঝেছ, যে– বাপু আমি যা কর্তব্য বলে মনে করি তা করবই, করেও এসেছি চিরকাল। সে সময় বাপকেও ভয় করি নি, তা তুমি।…এখন যদি তোমার চাকরির ভয়ে আমাকে কর্তব্য থেকে পিছিয়ে আসতে হয় তাহলে আমার বেঁচে ফায়গা কি, গলায় দড়ি দেওয়াই ভাল।…আর আমিও তো সরকারি পেনসন খাই–আমি বুড়ো মানুষ যদি পেন্সন খোয়াবার ভয় না করি–তুমি জোয়ান ছোকরা, তোমার চাকরি খোয়াবার এত ভয় কেন? ডাক্তারি করে খেতে পারবে না, নিজের বিদ্যের এটুকু ভরসা নেই?…আমাকে হুমকি দিতে আসে নিজের চাকরির ভয়ে!…কেন রে বাপু, না হয় সম্পর্কই রাখিস নি এতই যদি ভয়–বলে দিস ও আমার শ্বশুর নয়, ও অন্য কোন লোক! কী বলো, খারাপ লিখেছি কিছু?’
প্রশ্ন করেন কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা করেন না–হ্যাঁ হা ক’রে হেসে ওঠেন তার আগেই।
দেখা হয় যা ছোট মেয়ের সঙ্গেই মধ্যে মধ্যে। সে কলকাতায় থাকে, কী তেলের কোম্পানিতে জামাই কাজ করে। মস্ত বড়লোক শ্বশুর–তবু ছেলেকে কোন ব্যবসা ক’রে দিতে পারেন নি, নগদ এক লাখ টাকা জমা দিয়ে ছেলেকে কেশিয়ার ক’রে দিয়ে গেছেন। বছরে দু-একবার ওষুধ আনতে কলকাতা যেতে হয় তাঁকে। সেই সময়ে দেখা হয়। তা মেয়ের বাড়ি থাকেন না তিনি, সে বান্দাই নন–এখানে থেকে থেকে ওঁর তো এই চাষার মতো চালচলন হয়ে গেছে, তারপর কী করতে কী করবেন, শেষে কুটুমবাড়ির লোক হাসবে, মেয়ের মাথা হেঁট হবে। কী দরকার, তিনি হোটেলেই ওঠেন। নিজের একটা ছোট বাড়িও আছে কলকাতায়, সে ভাড়া দেওয়া থাকে, ভাড়াটেরাও বলে গিয়ে উঠতে, বিশিষ্ট ভদ্রলোক তারা–কিন্তু অমনভাবে যখন তখন গিয়ে উৎপাত করতে ইচ্ছে করে না তাঁর। তার চেয়ে হোটেলেই ভাল–স্বাধীনভাবে থাকা যায়।…
এদের কথা এসে অবধিই শুনছে ঐন্দ্রিলা, অনেকবার শোনা হয়ে গেছে। কিন্তু কখনও যে কাউকে দেখবে সে সম্ভাবনা ছিল না। যা বিবরণ শুনছে, নেহাৎ বাপের অসুখ না করলে এত কাণ্ড ক’রে কেউ দেখতে আসবে বলে মনেও হয় নি। ও তো এই কদিন এসেছে– মঙ্গলাও বলে, ‘বাবুর যে সাত কুলে কেউ আছে তা মনে হয় না, কেউ কোনদিন খোঁজখবর করে না। যা করে ঐ চিঠি। তাও কৈ মাসে মোট পাঁচখানা চিঠি আসে তো ঢের, অথচ শুনেছি বাবুর একঘর আপ্তস্বজন। বৌই নেই, তা বই আর সব তো আছে!’
কেউই কোনদিন আসে না–শুধু ঐন্দ্রিলার কপালেই হঠাৎ একদিন কোথা থেকে ডাক্তারবাবুর ছোট শালা এসে হাজির হলেন। তিনি নাকি রেলের কি একজন হোমরা-চোমরা, কোলাঘাটে এসেছিলেন রেলের পুল দেখতে, মাঝে রবিবার পড়ে গেছে দেখে ভগ্নীপতির খবর নিতে এসেছেন। ডাক্তরবাবু অবশ্য খুবই খুশি হয়ে উঠলেন, হৈচৈ চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন, ঐন্দ্রিলাকে ডেকে বললেন, ‘আজ কিন্তু মাছ রাঁধতে হবে বাপু, আমাদের রঘুনাথ আবার মাছ-মাংসের বড় ভক্ত, অক্রূরকে পাঠিয়েছি জেলের বাড়ি–জাল ফেলতে বলেছি পুকুরে দ্যাখো কী পায়।…তা না পেলেও কোন ক্ষতি নেই বুঝলে রঘু, আমাদের এই বামুন ঠাকরুনের নিরিমিষ রান্না অমৃত। খেলে বুঝবে। যা ধোঁকা করে, মাছ ফেলে খাবে!’
রঘুনাথের কিন্তু ঐন্দ্রিলাকে দেখেই ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিল। তিনি তেমনি ভাবেই ঈষৎ বক্রদৃষ্টিতে আর একবার তাকিয়ে বললেন, ‘তা ইনি–মানে এঁকে তো ঠিক চিনতে পারছি না। ইনি কবে এলেন, কৈ আমাকে কিছু লেখেন নি তো!’
‘কাউকেই লিখি নি।’ বোধ করি ওর কথার ধরনটা ভোলানাথ ডাক্তারবাবুরও ভাল লাগল না; তিনি বললেন, ‘হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাচ্ছিলুম নিজে সে কথাও তো তোমাকে কখনও লিখি নি। রাধবার একটা লোক পেয়েছি–এ আর এমন ঘটা করে জানাবার মতো কী খবর। আমার বন্ধু এক স্টেশন মাস্টারের কি জানা-শুনো, তিনিই চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন, সেই থেকে আছে। বড় স্যাড হিস্ট্রী হে মেয়েটির, শুনলে চোখে জল রাখতে পারবে না। একটিমাত্র মেয়ে জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই বিধবা হয়েছিল, সে মেয়ের এক বুড়োর সঙ্গে বিয়ে হয়–সেও বিধবা হয়েছে কুড়ি বছর না পেরোতেই। সমস্ত ইতিহাসটা যদি ওদের শোন তো অবাক হয়ে যাবে, একেবারে উপন্যাসের মতো।’
ঐন্দ্রিলা প্রথম একটু দোরের সামনে দাঁড়িয়ে ওঁর ভ্রূকুটি দেখেই সরে গিয়েছিল, কিন্তু চোখের আড়ালে গেলেও শ্রুতি-সীমার বাইরে যায় নি। সে শুনতে পেল রঘুনাথ চাপা গলায় বললেন, ‘মতো কেন–খুব সম্ভব উপন্যাসই। সত্যিমিথ্যে কে আর যাচাই করছে!
‘ছিঃ, অত সিনিক হয়ো না হে। মানুষকে অত অবিশ্বাস করতে নেই। আর আমি এতকাল এত মানুষ চরাচ্ছি, এটুকু কি আর বুঝি না–কে সত্যি বলছে আর কে বানিয়ে বলছে!’
ডাক্তারবাবু মৃদু অনুযোগের সুরেই বলেন কথাগুলো।
রঘুনাথ আর কথা বাড়াল না, শুধু একটা ‘হুঁ’ বলে চুপ ক’রে যান। সে দীর্ঘছন্দে উচ্চারিত ‘হুঁ’-র অর্থ ঢের; অনেকখানি অবিশ্বাস, বিদ্রূপ এবং মানব-চরিত্রে ভগ্নীপতির জ্ঞান সম্বন্ধে অনাস্থা প্রকাশ পায় তাতে। অমরবাবু অত বোঝেন কিনা কে জানে, তিনিও চুপ ক’রে যান তখনকার মতো।…
রঘুনাথ পরের দিন ভোরে উঠে চলে গেলেন, কিন্তু ঐন্দ্রিলার অস্বস্তির ভাবটা যেতে চাইল না। ওর কেমন মনে হ’ল এ ব্যাপারের এইখানেই শেষ হ’ল না–এর পরের জন্যেও কিছু তোলা রইল।
কথাটা অমরবাবুর কাছেও একবার পাড়ল সে, ‘আপনার শালাবাবুর বোধহয় আমাকে রাখাটা খুব মনঃপূত নয়। আপনি একা থাকেন এখানে–
ওর বক্তব্য শেষ হবার আগেই হো-হো ক’রে হেসে উঠলেন অমরবাবু, ‘ও হো, তুমি বুঝি ওর কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলে? সিলি! চিরকালটা ওর অমনি গেল, যেখানে সেখানে যা-তা বলে বসে দুম্ ক’রে।…ও কিছু না, ও নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না। যখন যা মনে আসে বলে ফেলে–ও পাগল একটা।’
কিন্তু সদাশিব অমরবাবু যত সহজে উড়িয়ে দিলেন তাঁর শালাকে, তত সহজে উড়ে যাবার লোক বলে ঐন্দ্রিলার মনে হ’ল না। আশঙ্কা একটা থেকেই গেল মনে মনে। আর সেটা যে নিতান্ত অমূলক নয়–বোঝা গেল মাত্র কদিন পরেই।
চিঠি আসেই মধ্যে মধ্যে ডাক্তারবাবু পড়ে কোথাও গুঁজে রেখে দেন, নাতি- নাতনীদের চিঠি পেলে আনন্দ ক’রে শোনান ঐন্দ্রিলাকে। সেদিন যখন চিঠিটা এল তখন দুটো বাজে। খাওয়া-দাওয়ার পর কী একটা জরুরি কাজে বেরোচ্ছিলেন সেই মুখে ডাকঘর থেকে চিঠিটা এনে দিল অক্রূর। খামের চিঠি–স্বাভাবিকভাবেই হাসি হাসি মুখে চিঠিখানা নিয়ে খুলে পড়লেন ডাক্তারবাবু, কিন্তু ঐন্দ্রিলা লক্ষ করল চিঠিটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সদাপ্রফুল্ল মুখ অন্ধকার হয়ে উঠল। ঐন্দ্রিলা বাইরে দোরের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল–সে তখন নিজে খেতে যাচ্ছে–হয়ত কোন দুঃ-সংবাদ মনে ক’রে খানিকটা দাঁড়িয়েই রইল সে। সেরকম হলে ডাক্তারবাবু এখনই ডেকে বলবেন–কিন্তু তিনি কোন উচ্চবাচ্যই করলেন না যে জরুরি কাজে যাচ্ছিলেন তার কথাও মনে পড়ল না বোধহয়–চুপ ক’রে যেন গুম হয়ে বসে রইলেন।
খানিকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঐন্দ্রিলা এসে খেতে বসল। রান্নাঘর থেকে ডাক্তার-খানার ঘরটা–সেইটেই অমরবাবুর বসবার ঘরও বটে–পরিষ্কার দেখা যায়। আরও বহুক্ষণ চুপ ক’রে বসে রইলেন তিনি, তারপর উঠে তেমনি অন্যমনস্কভাবেই বেরিয়ে গেলেন। অন্যদিন যাবার সময় ওকে বলে যান, দোর দিতে বলেন–আজ তাও বললেন না, এমন কি চিঠিখানা খামে পুরে কোথাও সরিয়ে রাখা কি ছিঁড়ে ফেলার কথাও মনে রইল না। সেটা বাতাসে উড়তে লাগল, হয়ত একটু পড়ে উড়ে বাইরেই চলে যাবে।
কোনমতে তাড়াতাড়ি ভাত কটা নাকে-মুখে গুঁজে উঠে পড়ল ঐন্দ্রিলা, নেহাৎ বিধবা মানুষ, একবার পাত থেকে উঠলে আর ফিরে সে পাতে বসতে নেই তাই–নইলে তখনই গিয়ে চিঠিটা কুড়িয়ে পড়ত। কৌতূহলে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। কৌতূহল আর সেই সঙ্গে একটু আশঙ্কাও। কে জানে কে কি লিখেছে, কোন সাংঘাতিক রকমের দুঃসংবাদ কিনা।
আঁচিয়ে এসে চিঠিখানা মেজে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে পড়ল। লেখা-পড়া তার বিশেষ জানা নেই, ছেলেবেলায় ছোট মাসী অনেক চেষ্টা ক’রেও সেদিকে এগোতে পারেন নি, বই পড়ার থেকে রান্না-বান্নার কাজই বেশি ভাল লাগত তার–তখন কে জানে যে একদিন এই কাজ ক’রে খেতে হবে!–তবু এ চিঠির হাতের লেখা বেশ পরিষ্কার, গোটা গোটা, পড়তে কোন অসুবিধাই হ’ল না। চিঠিটা লিখেছে রেণু, অমরবাবুর ছোট মেয়ে- নিচে নাম-সই দেখে বুঝতে পারল।
লিখেছে–’শ্রীচরণেষু বাবা, ছোট মামার মুখর শুনিলাম বৃদ্ধবয়সে তুমি একটি মেয়ে- মানুষ রাখিয়াছ, তাহাকেই গৃহিণীর পদে বসাইয়া সুখে ঘর-সংসার করিতেছ। হয়ত বিশ্বাস করিতাম না, কিন্তু বলিতে বলিতে ছোট মামার মুখে যে বিজাতীয় ঘৃণ্য ও রাগের ভাব ফুটিয়া উঠিল, তাহাতে কথাটা বিশ্বাস করিতে বাধ্য হইলাম। ছি ছি, তোমার এই অধঃপতনের কাহিনী শোনার আগে আমাদের মরণও ঢের ভাল ছিল। ইঁহারা–আমার শ্বশুরবাড়ির লোক জানিতে পারিলে কী বলিবেন, আমি কি আর লজ্জায় মুখ দেখাইতে পারিব! আমাদের মুখ না চাও, এত শীঘ্ৰ তুমি আমাদের সতীলক্ষ্মী মায়ের কথা ভুলিয়া যাইবে তাহা স্বপ্নেও ভাবি নাই। তিনি যে স্বামী-অন্ত-প্রাণ ছিলেন। ২৫ বছরেরও উপর তিনি তোমার সহিত ঘর করিয়াছেন, তোমার জন্যই সারা জীবন পাত হইয়াছে তাঁর! এই কাজ করার আগে আমাদের সেই মার কথা মনে পড়িল না। আশ্চর্য! এই জন্যই তাহা হইলে তুমি ওখানে থাক–এই তোমার দেশের কাজ, নরনারায়ণের সেবা! তুমি ভাবিয়াছিলে যে কলিকাতায় বসিয়া এই কীর্তি করিলে বড় জানাজানি হইবে–ঐ বন-জঙ্গলে বসিয়া যা-খুশি করিবে কেহ টের পাইবে না! কিন্তু ধর্মের কল যে বাতাসেই নড়ে, সেটা বুঝি ভাবিয়া দেখ নাই। যাক্––তোমাকে আমরা দেবতার মতো ভক্তি করিতাম, তোমাকে লইয়া কত গর্ব আমাদের। সে গর্ব ধুলায় মিশাইয়া গেল। তুমি এসব করার আগে একবার ছেলে-জামাইদের কথাও ভাবিলে না। ভালই হইল, তোমার জন্য কোন চিন্তা কি কর্তব্যবোধ রহিল না। আমাদের সঙ্গে সম্পর্কেরও এই শেষ। আজই দাদা ও দিদিকে চিঠি লিখিয়া দিলাম, যাহাতে তাহারাও না তোমাকে চিঠি দিয়া বা সংবাদ লইয়া বিরক্ত করে। আজ হইতে শুধু তোমার মৃত্যু-সংবাদেরই অপেক্ষা করিব। আর কোন সংবাদে কাজ নাই। ইতি–রেণু।’
চিঠিটা পড়তে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল ঐন্দ্রিলার। বার দুই চেষ্টা ক’রে পড়তে হ’ল। তারপর পূর্ণ অর্থটা বোঝবার সঙ্গে সঙ্গে মাথা আগুন হয়ে উঠল তার। সেই আগুন, যার সামনে লোকের সমস্ত সহানুভূতি জ্বলে-পুড়ে যায়–ওর অদৃষ্টের আগুন! সেই প্রচণ্ড দিদাহকারী ক্রোধ–যা এখানে এসে পর্যন্ত এই কমাস, ওর পক্ষে বহুদিন, অনুভব করে নি–সেই চণ্ডাল ক্রোধে ফেটে পড়ল সে। শূন্য ঘরেই চিৎকার ক’রে গালাগাল দিতে লাগল,–
‘মুখে আগুন তোমার। তোমার মরণ হয় নি কেন এ চিঠি লেখার আগে। শয়ে চড়ো নি কেন! বেশ তো, এত যদি ঘেন্নাপিত্তি, এ চিঠি না লিখে কড়িকাঠে ঝুললে না কেন! সেই তো ভাল হ’ত।…মর্ মর্ মর্। নিমতলায় যা। নিমতলায় গেলে উদ্ধার হয়ে যাবি –খাল ধারে যা। ভাতার পুত নিয়ে যা একেবারে। ওলা-উঠায় মর তোরা গুষ্টিসুদ্ধ। প্লেগে মর্। মুখে যেন জল দেবার কেউ না থাকে মরবার সময়ে। তোদের বংশের নামসুদ্ধ শয়ের জলে ধুয়ে-মুছে যাক! বংশে বাতি দিতে কেউ যেন না থাকে ত্রিভুবনে। মেয়েমানুষ! কত বড় আস্পদ্দার কথা! বাজারের মেয়েমানুষ আমি! আমার মতো শুধু-হাত সাদা-সিঁথে হোক, সব্বস্ব খুইয়ে পথে বোস্–তবে বুঝবি কী দুঃখে এই কাজ করতে আসে লোকে।…আমি যেখানে পা ধোব সেখানে তোদের মা-শাশুড়ীরা দাঁড়াতে পারবে না। আমাকে মেয়েমানুষ বলা! আমি রাঁড়, আমি খাকী? তোদের চোদ্দপুরুষে যে যেখানে আছে খাকীগিরি করুক।…খাকীগিরি করার কত মজা টের পা!
অনেকক্ষণ ধরে সেই শূন্য বাড়িতে ভয়াবহ চিৎকার করে চলল ঐন্দ্রিলা। মেয়েকে গালাগাল দেওয়া শেষ হ’তে মেয়ের মামাকে নিয়ে পড়ল। তারও সর্বনাশ হবে। ওর হাতে চব্যচোষ্য খেয়েগিয়ে ওর নামে এই অপবাদ রটানো। ওর অবীরে সদ্য-বিধবা কচি মেয়েটাকে তবু যা হোক দয়াধর্ম করছে লোকটা–সেই পথ বন্ধ করার চেষ্টা করা! ধর্মে সইবে না এ- সব। ওরও যদি সপুরী এক গাড়ে না যায় তো ঐন্দ্রিলা কী বলেছে! কেউ কারও মুখে জল দিতে থাকবে না, মরবার সময় কারুর সঙ্গে কারুর দেখা হবে না–ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিঠি আসা, চিঠি পড়া এবং তার এই প্রতিক্রিয়া যখন ঘটছে, তখন আশপাশে কেউই ছিল না। অক্রূর হাটে গেছে, মঙ্গলাও গিয়েছিল পাশের গাঁয়ে মেয়ের বাড়ি। সে যখন ফিরল তখনও ঐন্দ্রিলার আস্ফালন এবং চিৎকার চলছে। তার এ চেহারা মঙ্গলা কখনও দেখে নি। শান্তশিষ্ট ভালমানুষ না হোক, দজ্জালও নয় সে–এই ছিল মঙ্গলার ধারণা। সে মনে করল নির্ঘাৎ বামুন-দি পাগল হয়ে গেছে, নয় তো ভূতে পেয়েছে। সে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ল ডাক্তারের খোঁজে, ডাক্তার যদি এসে সামলাতে পারে।
কিন্তু মঙ্গলাকে ঐ ভাবে মাঠের ওপর দিয়ে ছুটতে দেখে ঐন্দ্রিলার কতকটা হুঁশ হ’ল। বোধহয় ক্লান্তও হয়ে পড়েছিল খুব। এইবার চুপ করল সে। খানিকটা চুপ ক’রে বসে থেকে, মাথায় খুব ক’রে জল থাড়ে থাড়ে দিয়ে একটু প্রকৃতিস্থ হ’ল। তারপর উঠে স্বাভাবিক নিয়মে কাজকর্ম করতে শুরু করল।
প্রথমটা মনে হয়েছিল আজই কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু উম্মার উন্মত্ততাটা কমতে, যখন মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এল–তখন মনে পড়ল সীতার কথাটা। ভদ্রলোক ওকে মাস মাস মাইনে বলে পনেরো টাকা দিচ্ছেন। তা ছাড়াও সীতাকে আলাদা টাকা পাঠাচ্ছেন — কোন মাসে দশ, কোন মাসে পনেরো। ঐন্দ্রিলা ভদ্রতার খাতিরে একটু ক্ষীণ প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল–উনি শোনেন নি। বলেছেন, ‘ওর ভার যখন আমি নিয়েছি, তখন আমার দায়িত্ব। তোমার পাঠাতে হয় তুমি আলাদা পাঠাও গে।’
বলা বাহুল্য ঐন্দ্রিলা তা পাঠায় নি। ওর মাইনের টাকা সবই জমছে। এ রকম এর আগে আর কখনও হয় নি। একটা বাড়তি পয়সা পর্যন্ত থাকত না। কম দুর্ভোগ ভোগে নি তার জন্য। মেয়েটাকেও কম ভুগতে হয় নি। দুঃসময়ে মার কাছে দুটো ভাত মিলেছে বটে–কিন্তু সে শুধুই দুটো ভাত, তার বেশি কিছু নয়। কেঁদে-ককিয়েও কখনও একটা টাকা বার করতে পারে নি মার কাছ থেকে। যদি দু-চারটে টাকা হাতে জমে তো জমুক– বলা তো যায় না–কখন দুঃসময় আসে। অসুখেই যদি পড়ে, সে কিম্বা মেয়ে কিম্বা নাতি–তখন চিকিৎসা লাগবে। এখন বেশি টাকা পাঠালে সতীনপোরা এলাকাঁড়ি দেবে।
না, এ যদি সাধারণ চাকরি হ’ত তো আজই চাকরিতে লাথি মেরে চলে যেত ঐন্দ্রিলা। এ চাকরি ছাড়া চলবে না। অন্তত সে নিজে থেকে ছাড়বে না এটা ঠিক, উনি যদি ছাড়ান সে আলাদা কথা। তবে তাও সহজে ছাড়বে না সে।
সেদিন আর বিশ্রাম নেওয়া হ’ল না ঐন্দ্রিলার। মাঠের দিকে চেয়ে বুঝল বেলা পড়ে এসেছে। তখনই কাজে লেগে গেল। আরও পরিপাটী ক’রে সেদিন ঘরদোর ঝাড়ল মুছল সাজাল। ডাক্তারখানাও যতটা সাফ্ করা সম্ভব করল। তারপর রান্নাঘর নিকিয়ে নিয়ে বিকেলের রান্নায় মন দিল।
ততক্ষণে মঙ্গলা ফিরেছে। ডাক্তারকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে সে ভয়ে ভয়েই আসছিল; কিন্তু দূর থেকে বাড়ি নিস্তব্ধ শুনে ভরসা করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল। বামুনদিকে সহজ মানুষের মতো কাজকর্ম করতে দেখে প্রথমটা বেশ একটু অবাকও হয়ে গেল তবে কোন প্রশ্ন করল না। সে শুনেছে এই ‘ক্ষ্যাণে-পাগল’ লোকগুলোকে তাদের পাগলামীর কথা মনে করিয়ে দিলেই তারা আবার ক্ষেপে ওঠে। কিছু বলল না বটে, তবে একটু দূরে দূরেই রইল। সে রকম লক্ষণ আবার দেখলে সোজা ‘রড়’ দেবে।
তবে আর তেমন কিছু দেখা গেলও না। স্বাভাবিকভাবেই কথা-বার্তা বলল ঐন্দ্রিলা, কাজ যা করতে হবে তাও বাৎলে দিল। বরং মঙ্গলা দেখল আজ খাওয়ার জুৎ খুব। ছানা কাটানো হচ্ছে, ছানার ডালনা হবে, ভাল করে ছোলার ডাল হচ্ছে। এই মানুষই যে চার দণ্ড আগে অমন ক’রে তুড়ি-লাফ খাচ্ছিল তা মনে হয় না। কে জানে পাগল না ভূতে-পাওয়া রাম রাম!…বার বার রাম নাম স্মরণ করতে লাগল মঙ্গলা।
সেদিন ডাক্তার ফিরলেন বহু রাত্রি ক’রে। ঐন্দ্রিলা আড়ে চেয়ে দেখল, উস্কো-খুস্কো উদ্ভ্রান্ত চেহারা। চোখ-মুখ বসে গিয়েছে এই ক’ ঘণ্টাতেই। কে জানে হয়ত এতক্ষণ শুধু শুধুই মাঠে-মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
একটু প্রমাদ গুণল ঐন্দ্রিলা। আঘাতটা যদি এতখানি লেগে থাকে তাহ’লে কী হয় বলা মুশকিল। হাজার হোক ছেলেমেয়ের টান। মা-মরা ছেলে-মেয়ে সব। একটা রাঁধুনী বামনীর জন্যে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করবে তা সম্ভব নয়। কিন্তু সেও সহজে ছাড়বে না। এক কথাতেই বা সে যাবে কি জন্যে! তাদের সন্দেহ হয় এসে দেখে যাক না, মামা একবেলা দেখেই সব বুঝে ফেলল একেবারে! বুড়ো তাই কেন লিখুক না, এসে দেখে যেতে!
কিন্তু তখনই মুখে কিছু বলল না। তাড়াতাড়ি গাড়ু আর গামছা এগিয়ে দিল, মঙ্গলাকে বলল একটু বাতাস করতে। তারপর মুখ-হাত ধোওয়া হ’লে পরিপাটী ক’রে সাজিয়ে খেতে দিল।
খেতে বসে তৃপ্ত হলেন অমরবাবু। ছানার ডালনা তিনি ভালবাসেন কিন্তু এ বামুন ঠাকুরুণের মতো কেউ রাঁধতে পারে না। আর এই ছোলার ডাল, মাংস ফেলে খাওয়া যায় খেতে খেতে সমস্ত ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তার ছাপ মিলিয়ে গেল কপাল থেকে–সে জায়গায় ফুটে উঠল একটি প্রসন্ন পরিতৃপ্তি।
তৃপ্ত হয়েছেন বাড়িতে পা দিয়েই। বহুদিন লক্ষ্মীছাড়ার মতো বাস করছেন, তবু সাজানো ঘর, শুভ্র শয্যা দেখলে আজও মনটা প্রফুল্ল হয়।
খেয়ে উঠে প্রাচুর্যের উদ্গার এবং পরিতৃপ্তিসূচক শব্দ করতে করতে বাইরের বারান্দায় বসে সবে একটি বিড়ি ধরিয়েছেন–ঐন্দ্রিলা গিয়ে দাঁড়াল।
‘ওকি, তুমি খেলে না?’
যাচ্ছি। আর খাওয়া তো একেবারে উঠল এখান থেকে। সেই কথাই বলতে এসেছি, আমাকে কালই যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিন, আমি চলে যাই–’
‘চলে যাই? তার মানে?’ ডাক্তার তখনও বুঝতে পারেন না।
‘কী করে আর থাকব বলুন! গতর খাঁটিয়ে খেতে এসেছি, এমন দুর্নাম কিনে পড়ে থাকব কেন! আমাদের যতদিন খাটবার শক্তি আছে–চার দোর খোলা। বড় বংশের মেয়ে–বড় বংশের বৌ, পেটের দায়ে কাজ করতে এসেছি বলে এ-সব কথা শুনতে রাজি নই!’
ঠিক এভাবে হয়ত বলবার ইচ্ছে ছিল না, হঠাৎ বলার ঝোঁকে বলা হয়ে গেল। একটু ভয়ও করতে লাগল, বুড়ো যদি রাজি হয়ে যায়।
যদি রাজি হয়ে যায় তো কথাটা কীভাবে ঘোরাবে ভাবছে–কিন্তু তার আগেই অমরবাবু তার দুশ্চিন্তার অবসান করে দিলেন, ‘ওঃ, সেই চিঠিটা পড়েছ বুঝি! আমারই উচিত ছিল ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে যাওয়া…ননসেন্স।…যে মেয়ে বাপের চেয়ে মামাকে বেশি বিশ্বাস করে, এতকালের পরিচয়ের থেকে শোনা কথাকেই বড় মনে করে–তার ও চিঠি আমি গ্রাহ্যই করি না। তার সঙ্গে সম্পর্ক না থাকে তো বড় বয়েই গেল। একবার জিজ্ঞেসা করাও দরকার মনে করল না গুজবটা সত্যি কিনা! তুমি ও নিয়ে মাথা ঘামিও না। তাদের দিন তারা কিনে নিয়েছে–তাদের প্রতি আমার কর্তব্যেরও শেষ। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কই বা কতটুকু–দেখছই তো, তারা কি আমার খোঁজ নিচ্ছে, না কেউ নিজের সংসার ছেড়ে আমার কাছে এসে দুদিন থাকছে। হ্যাঁ, আমি যদি যাই তো তারা দেখবে–ভাত- হাঁড়ির ভাত দুটি দেবে।…না, আমার তাতে দরকার নেই! ঢের করেছি তাদের জন্যে, এখন আমি আমার মতো ক’রে একটু বাঁচতে চাই। আমার যা কর্তব্য বলে মনে করি তাই করব। তাদের ইচ্ছে হয় তারা বাবা বলবে, না ইচ্ছে হয় বলবে না। যদি মরে যাই–এরাই দেখবে। তাদের ইচ্ছা থাকলেও হয়ত তারা আসতে পারবে না।…হুঁ!…নাও, নাও তুমি খেয়ে-দেয়ে নাও গে। ওসব বাজে কথা নিয়ে মাথা ঘামিও না!’
সোজাসুজি কথাটা পাড়াতেই বোধহয় ভাল হ’ল। অমরবাবুর মনে যেটুকু দ্বিধা ছিল সেটুকু কেটে গেল। এসব লোককে তাতালেই কাজ হয়, আর তাতাবার পক্ষে এই সোজাপথই ভাল।
ঐন্দ্রিলা মনে মনে নিজের বুদ্ধির তারিফ করে।
॥২॥
শীতের গোড়ার দিকে একদিন শ্যামার একখানা চিঠি পেল ঐন্দ্রিলা। বহুদিন পরে দেখলেও মার হাতের লেখা চিনতে কোন অসুবিধা হ’ল না। মা চিঠি লিখল কেন? কখনও তো লেখে না! চিঠিই তো আসে না তার নামে। কখনও-কখনও যা মেয়ে লেখে। তার সেই আঁকাবাঁকা গোল গোল হরফ দেখতেই চোখ অভ্যস্ত। এ মায়ের মুক্তোর মতো অক্ষর সাজানো, সোজা লাইন–দূর থেকে দেখলেই চেনা যায়। বয়সে এবং অনভ্যাসে হরফের রেখাগুলো একটু এঁকেবেঁকে গেছে–ঠিক আগের মতো নেই বটে, তবু ছাঁদটা সেইরকমই সুন্দর আছে। ছাপার মতো লেখা ছিল এককালে, এখনও সে আদলটা ধরা যায়।
কিন্তু কী লিখল মা?
নিশ্চয় নতুন কোন দুঃসংবাদ। দুঃসংবাদ ছাড়া মা পোস্টকার্ডের একটা পয়সা খরচ করে নি।
কিন্তু দুঃসংবাদটাই বা কার?
মার কোন খবর–যত খারাপই হোক, কখনও তো তাকে জানায় না। তবে কি তারই কিছু? সীতার–!
অকস্মাৎ যেন গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। বুকে ঢেঁকির পাড় পড়তে থাকে ভয়ে। হেমন্তের সেই প্রায়-শীতল দিনেও কপাল গলা ঘেমে ওঠে
হাতেই পোস্টকার্ড খানা–তবু পড়তে সাহস হয় না।
বহুক্ষণ সেইভাবে বসে থাকে। শেষ যখন ডাক্তারবাবুই ডেকে বলেন, ‘কার চিঠি, কই পড়ছ না তো!’ তখন অপ্রতিভ হয়ে ওঠে। মনে করে, যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্ন– দুঃসংবাদ শুনে শুনে তো কানে কড়া পড়ে গেছে, কত আর খারাপ হবে! সে জোর করে চিঠিখানা তুলে ধরে চোখের সামনে।
দীর্ঘ চিঠি, ক্ষুদি ক্ষুদি লেখা। সমান লাইন আর সমান হরফ বলে অনেক কথাই ধরেছে একখানা কার্ডে। এক পয়সায় দুপয়সা খরচের কাজ সেরেছেন শ্যামা।
তিনি লিখেছেনঃ–
‘কল্যাণীয়াসু, খেঁদি তোমাকে একটি বিশেষ প্রয়োজনে লিখিতেছি। তোমার ছোট বোন তরু এতদিন গুম্-পাগল ছিল এবার সে রীতিমত পাগল হইয়া উঠিয়াছে। সেদিন মল্লিকদের পুষ্করিণীতে মাছ ধরানো হইয়াছিল, আমার বাড়ি আজকাল ও পাট নাই বলিয়া তাহারা কান্তি ও বলাইয়ের মতো মাছ রান্না করিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল। উহারা খাইতে বসিয়াছে এমন সময়ে তরু কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া কান্তির পাত হইতে দুইখানা মাছই তুলিয়া লইয়া খাইতে শুরু করিয়া দিল। আমরা হাঁ হাঁ করিয়া ওঠায় হাসিতে হাসিতে কাপড়ের মধ্যে করিয়া লইয়া ঘরে চলিয়া গেল। ইহার পর হইতে উপদ্রব বাড়িয়াই চলিয়াছে। এটা-ওটা ভাঙ্গিতেছে, পগারে ফেলিয়া দিতেছে–চুরি করিয়া খাওয়া তো আছেই, ভাত-ব্যঞ্জন ফেলিয়া ছড়াইয়া নষ্ট করিতেছে প্রত্যহ। মধ্যে মধ্যে হা-হা করিয়া হাসিয়া ওঠে, ডাক ছাড়িয়া কাঁদেও। সেদিন কখন বাহির হইয়া গিয়া মহাদেবের মার ঘর হইতে মাছের টক চুরি করিয়া খাইয়াছে। আমি একা লোক, কান্তি বাড়ি থাকে না–সে দিনরাত চাকরির খোঁজে টো টো করিয়া ঘোরে, পাগলকেই বা কে দেখে, আর দুটো ভাতই বা কে ফুটাইয়া দেয় তাহার ঠিক নেই। সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম তো আছেই। ধোওয়া মোছা ঝাঁট দেওয়াই আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে। মহা কান্তির জন্য একটা সম্বন্ধ আনিয়াছিল, মা-মরা মেয়ে–কান্তি কিছুতেই রাজি নয়। এমতাবস্থায় একমাত্র উপায় হয়, তুমি যদি আসিয়া কিছুদিন থাকো। ইতিপূর্বে তোমার দুঃসময়ে আমি অনেকবার ঠাঁই দিয়াছি, এখন আমার দুঃসময়ে তোমার দেখা উচিত। যদি মেয়ের কথাই বড় হইয়া ওঠে তো আমি তাহার জন্যও মাসে মাসে চার টাকা করিয়া দিতে রাজি আছি। আর তোমার কোন আপত্তির কারণ থাকিতে পারে বলিয়া আমি মনে করি না। তুমি পত্রপাঠ চলিয়া আসিবে। আমার আশীর্বাদ লইও। হেমরা পত্র লেখা বন্ধ করিয়াছে আজকাল। ইতি–আশীর্বাদিকা মা।’
চিঠি পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল ঐন্দ্রিলা। বিশ্বাস হচ্ছে না, নিজের চোখকেও বিশ্বাস হচ্ছে না তার। চোখে দেখেও মনে হচ্ছে না যে সেই ঠিক দেখছে। …..আর একবার উল্টেপাল্টে দেখল চিঠিটা। মারই হাতের লেখা তো?
মা মাসে মাসে সীতাকে চার টাকা করে পাঠাতে রাজি হয়েছেন- এ যে কতখানি নাচারে পড়ে তা একমাত্র সে-ই বুঝেছে। কোথাও কোন উপায় না দেখেই এই চিঠি লিখেছেন। বাইরের লোক, ঝি-চাকর দিয়ে তাঁর সংসারের কাজ হবে না –তা মা বিলক্ষণ জানেন।
প্রাথমিক স্তম্ভিত ভাবটা কাটতে ঐন্দ্রিলার সর্বপ্রথম যে প্রতিক্রিয়া হল সেটা হচ্ছে উল্লাসের। একটা পৈশাচিক উল্লাস বোধ করতে লাগল সে। বেশ হয়েছে। ….. এই মেয়ের জন্যে এক এক সময় বিপদে পড়ে দুটো একটা টাকা চেয়েছে সে, কাকুতিমিনতি করেছে তবু মা দেন নি–টাকার আন্ডিলের ওপর থাকেন–ওর সামনেই কত লোককে শুধু হাতে ধার দিয়েছেন, তবু ওকে দেন নি। ওর কচি মেয়েটা সেখানে শুকিয়ে উপোস করে মরছে জেনেও তাঁর এমন স্বত্ব পোরে নি যে একটা টাকা বার করে দেন। কত টাকা তো মারাও যাচ্ছে, সুদ ছেড়ে আসল পর্যন্ত ডুবছে, না হয় নিজের নাতনীকে দানই করতেন! ….বেশ হয়েছে, মাথার ওপর যে ভগবান আছেন, তা এইতেই প্রমাণ হয়।
ঐন্দ্রিলা চিঠিখানা রান্নাঘরের চালের বাতায় গুঁজে রেখে কাজে লেগে গেল। মরুক গে, ও চিঠির জবাবও দেবে না সে।
কিন্তু কাজ করতে করতে বারবারই অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে লাগল সেদিন।
হাজার হোক মা। অনেক করেছেনও–তাতে সন্দেহ নেই। নিজেরই মা ভাই বোন সমস্ত কথা ছাপিয়েও, সমস্ত দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও–রক্তের টানটা যেন মনে মনে প্রবল হয়ে ওঠে। বস্তুত রক্তের টান যে এমন হয়, রক্তের টান যে কথার কথা নয়–একটা কিছু সত্যিই আছে–আজ প্রথম অনুভব করল সে। খুবই নাচারে পড়েছেন মা, খুবই বিব্রত হয়ে উঠেছেন। সত্যিই গোটা বাড়িটা ধোয়ামোছা করা নিকোনোই তো একটা মানুষের পক্ষে কষ্টকর। মার শরীরটাও ইদানীং ভাল যাচ্ছে ন, কুঁজো হয়ে পড়েছেন। আজকাল বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়ে চলেন সামনের দিকে। তার বয়সটাই কি কম হল! তার ওপরে চারটে ভাইবোন হয়েছিল–দাদার বয়সই বোধ হয় পঞ্চাশের ওপর হয়ে গেল। কে জানে, অত হিসেব থাকেন না, কেমন যেন গুলিয়ে যায় সব। তবে মার বয়সও ঢের হয়েছে, তার ওপর কী দুঃখকষ্টটাই না করেছেন সারাজিবন–সেই দশ এগারো বছর বয়স থেকে। কবে ভেঙ্গে পড়বার কথা, অন্য মানুষ হলে মরেই যেত–নয়তো শয্যাশায়ী হয়ে থাকত। এ শুধু ওঁর অসাধারণ মনের জোরেই চলে ফিরে বেড়াচ্ছেন, এখনও খাটছেন। ….
ভাবতে ভাবতে কখন হাতের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা মনেও নেই ঐন্দ্রিলার। অকস্মাৎ এক সময় হুঁশ হল মঙ্গলা অবাক হয়ে মুখের পানে চেয়ে আছে দেখে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আবার জোরে জোরে হাত চালাতে লাগল সে।
কী গো, দেশঘাট থেকে কী খবর এল? সেই থেকে অমনি করতে লেগেছ? মঙ্গলা প্ৰশ্ন করে, ‘কে লিখেছে পত্তর?’
‘মা লিখেছেন, আমার মা। বোনের খুব অসুখ। তাই লিখেছেন।’
কুটনো কুটতে কুটতে আবারও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ঐন্দ্রিলা। তরুটারই বা কি কপাল! সত্যি বোনে বোনে কপাল নিয়ে ওরা জন্মেছিল বটে। মার গর্ভেরই দোষ। দিদিমার রক্ত। দিদিমার রক্ত যেখানে আছে সেখানে কেউ সুখী হবে না। ….শুধু দিদিমার দোষ দিয়েই বা কি হবে–তার বাপের বংশ তো আরও চমৎকার।
একসময়ে তরুকে সে হিংসে করত। ছিছি! সে তো তবু যে কদিন হরিনাথকে পেয়েছে পরিপূর্ণভাবেই পেয়েছে, কাউকে ভাগ দিতে হয় নি! শ্বশুরের ভালবাসাও। তার মতো শ্বশুর জন্ম জন্ম তপস্যা করলে তবে পাওয়া যায়। অদৃষ্টে নেই, গেল জন্মে কার পরিপূর্ণ সুখের বাসায় আগুন লাগিয়েছিল, তাই এ জন্মে তারও সুখের বাসায় আগুন লাগল।
না, তরুটা তার চেয়েও হতভাগা। সে তো তবু গতর খাঁটিয়ে করে কম্মে খাচ্ছে, নিজের পায়ে ভর দিয়ে আছে–স্বাধীনভাবে। তরুটার কী হাল! সবচেয়ে অভিশাপ পাগল হয়ে যাওয়াটা। তরুটা শেষে পাগল হয়ে গেল। বরাবরই ঐরকম ছিল, গুম্পাগল মতো– ঐন্দ্রিলা মনে করত কল্লা (এখন কথাটা মনে হয়ে লজ্জাই করতে লাগল তার)–কেন অমন হল কে জানে। এই ডাক্তারবাবু বলছিলেন সেদিন–কী সব খারাপ ব্যামো থাকলে, লোকে হঠাৎ পাগল হয়ে যায়। কে জানে হারানের ওসব ছিল কিনা। ডাক্তারবাবু বলেন, হঠাৎ পাগল হয়ে যাওয়া, হঠাৎ কালা হয়ে যাওয়া–ওসব রক্তে দোষ থাকার ফল। অবশ্যি অন্য কারণেও হয়–কিন্তু যেখানে সেসব কারণ নেই–? মা তো বলে বাবারও কী সব খারাপ ব্যামো ছিল। বাবা গো, ভাবলেই যেন মাথার মধ্যে কেমন করে। সেও ঐরকম পাগল হয়ে যাবে নাকি কোনদিন?
আবারও একসময় খেয়াল হল যে হাত থামিয়ে সে বসে বসে ভেবেই চলেছে!
দূর হোক গে ছাই। ভেবে আর কী করবে সে! যা হবার তা হবেই। কিন্তু মার চিঠিটা। চলেই যাবে নাকি? সে নিজেও বুড়ো হ’তে চলেছে, বুড়ো মার অবস্থাটা বুঝতে পারছে বৈকি! বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন নিশ্চয় মা, নইলে এ চিঠি কিছুতে লিখতেন না। বিশেষ করে ঐ টাকার প্রস্তাবটা। এ যে কতখানি কারে পড়ে লিখতে হয়েছে তাঁকে! এক একটি টাকা তাঁর এক-একখানি বুকের পাঁজরা। সেই টাকা মাসে মাসে চারটে করে বার করতে চেয়েছেন–এখন বেগ দিলে হয়ত পাঁচেও রাজি হ’তে পারেন–এ কী কম কথা!
না হয় ডাক্তারবাবুকে লোক দেখতে ব’লে, একটু সময় দিয়ে চলেই যাবে। মেয়েটার লোকসান হবে তা হোক। এখন তো সীতা লিখেছে–ওর সতীনপোদের সংসারেই একসঙ্গে খাচ্ছে পরছে,–শুধু হাতখরচা আর ছেলেটার জন্যে–তা যেমন ক’রে হোক ঐ চার টাকাতেই চালিয়ে নেবে না হয়।
কিন্তু ডাক্তারবাবু? ডাক্তারবাবু কি ছাড়তে চাইবেন? উনি যা করছেন তা কোন নিকট- আত্মীয়ও করে না। মাইনে ছাড়াও সীতার টাকা প্রতি মাসে দিয়ে যাচ্ছেন, চাইতে বা মনে করাতে হয় না। শুধু তাই নয়–এখানে সে রাজার হালে আছে। সে-ই যেন কর্ত্রী, ডাক্তারবাবু ওর কর্মচারী, তিনিই সর্বদা জোড়হস্তে থাকেন যেন, ভয়ে ভয়ে। এ সুখ কোথায় পাবে সে স্বামীর ঘরেও শ্বশুর-শাশুড়ী জা-ননদ থাকলে এত স্বাধীনতা পাওয়া যায় ন। এর মধ্যে ভদ্রলোক ওষুধ আনতে কলকাতা গিয়েছিলেন–ওর জন্যে একখানা তসরের থানধুতি আর একটা সরু হার, ঘষা গোট, কিনে এনেছেন। প্রথমটা চমকে উঠেছিল ঐন্দ্রিলা, কিছুতেই নিতে চায় নি–মনে মনে কেমন যেন একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল ওর মনে–কিন্তু ডাক্তারবাবুই সব শঙ্কার কারণ দূর করে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘তুমি এর জন্যে এত ‘কিন্তু’ হচ্ছ কেন? সুতির কাপড় পরে সন্ধ্যে-আহ্নিক করো, সেইজন্যেই ওটা আনা। পুরানো লোককে তো দিতে হয় এসব। আর হার–বলে সন্তানের মাকে শুধু গলায় জল খেতে নেই, তাই। তা ওটা ইচ্ছে না হয় নিও না। যাকে হোক দিয়ে দেব। কিন্তু মনে করো না যে ঘুষ দিয়ে তোমার পালাবার পথ বন্ধ করছি। তোমার কোন বাধ্যবাধকতা রইল তাও ভেবো না। প্রতিবারই কলকাতায় গেলে মেয়েটাকে কিছু না কিছু কিনে দিই–তা এবার তো ওর সঙ্গে দেখাও করি নি–সেই পয়সাতেই কিনে এনেছি। এমন কিছু বেশি খরচা করি নি তোমার জন্যে
এর পর নিতে হয়েছে জিনিসগুলো। অথবা বলা যায় বিবেককে শান্ত ক’রেও নিতে পেরেছে। ওর মতো দুঃখীর এমন সব জিনিস স্বপ্নে-দেখা দুরাশার ধন–ছাড়াও মুশকিল বৈকি! তবু বলেছে যে, ‘দেখুন দিকি–কী বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হয়ে গেল আমার জন্যে, আপনাদের বাপবেটির মধ্যে–‘
হেসে উঠেছেন অমরবাবু, ‘শুধু একটা বেটি কেন গো, বেটাবেটিরা সবাই পর হয়ে গেল। কেউ তো আর চিঠি দেয় না। ……কিন্তু তার জন্যে তুমি লজ্জা পেয়ো না–এ ভালই হল, ভগবান যে এত সহজে পিছটানটা কাটিয়ে দিলেন–এই মঙ্গল। মিছিমিছি মায়ায় বদ্ধ হয়ে ছিলুম বই তো নয়। ভগবানই দেখিয়ে দিলেন, সন্তানের স্নেহ কৃতজ্ঞতা কী ঠুনকো জিনিস–কত সহজে অকারণে ভেঙ্গে যায়।…. যাক্, ও নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই, তারা তো ছেড়েছেই, আবার তার জন্যে তুমিও ছেড়ে যেয়ো না। তাহলে আমার সেই যাকে বলে–’বল মা তারা দাঁড়াই কোথা।’
আবারও হা-হা করে হেসেছে অমরবাবু।
ওঁর কথা বলার ধরনই এই, ভাল করেই চিনেছে ঐন্দ্রিলা। এর মধ্যে কোন গূঢ়ার্থ নেই। এই দীর্ঘকালের মধ্যে কোনদিন কোন-মুহূর্তে এতটুকু অশোভনতা বা কোন মন্দ অভিপ্রায় দেখে নি ওঁর মধ্যে; নির্মল চরিত্র, দেবতুল্য বললে ছোট করা হয়- দেবতাদের চেয়েও নির্মল। নদীর জলের মতোই–কোথাও কোন ময়লা নেই।
এ লোককে ছেড়ে যেতেও ইচ্ছে করে না। সত্যিই, আবার সেই অর্ধেক দিন উপবাস শুরু হবে। এমনিতেই তো উনি ঠাট্টা ক’রে বলেন যখন তখন, ‘যেটুকু ক’রে-কম্মে নেবার অব্যেস ছিল সেটুকুও তো চলে গেল। এরপর যেদিন চলে যাবে –ঠায় উপোস ক’রে শুকিয়ে মরতে হবে–নয়তো মঙ্গলা ভরসা। তা ও বেটী যা নোংরা, হাতে জল খেতেও ইচ্ছে করে না। বড্ড আয়েস ধরিয়ে দিচ্ছ তুমি!
কিন্তু সে যতই হোক, ও ধারেও মা বোন ভাই। তাদের ওপরও কি একটা কর্তব্য নেই? ডাক্তারবাবুর কথাই আবার মনে আসে, ‘বাপমার ঋণটা কি সোজা জিনিস? অনেক ভাগ্য থাকলে তবে মানুষ বাপমায়ের সেবা করতে পারে, খানিকটা ঋণ শোধ করতে পারে। রাম বাপের জন্যে কী না ত্যাগ করলেন, কৈ, অন্যায় জেনেও তো প্রতিবাদ করেন নি। এগুলো লেখা হয়েছে মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্যেই। আর আমার ছেলেমেয়েরা–খুব শিক্ষা পেয়েছে সব! খুব শিক্ষা দিয়েছি!…’
কী করবে সে, কী করা উচিত? নিজেকে সহস্রবার জিজ্ঞাসা করেও কোন সদুত্তর পায় না ঐন্দ্রিলা, খুঁজে পায় না গ্রহণযোগ্য কোন পথ। কঠিন দোটানায় পড়ে ছট্ফট্ করে শুধু মনে মনে।
অবশেষে, সেই দ্বিধা ও ভিন্নমুখী আবর্তের মধ্যে অনবরত ক্লিষ্ট হ’তে হ’তে, সেই অবশিষ্ট সারাদিন ও সারারাত অতন্দ্র কাটাবার পর, পরদিন সকালে হঠাৎ একসময় স্থির ক’রে ফেলল ঐন্দ্রিলা। ডাক্তারবাবুকেই বলবে সে, তাঁরই মতামত জিজ্ঞাসা করবে। আশ্চর্য, এই সহজ কথাটা এতক্ষণে মনে আসে নি কেন! নিজের স্বার্থের জন্য তাকে অসৎ পরামর্শ দেবেন বা কর্তব্যভ্রষ্ট করতে চাইবেন সে লোকই নন। যা উচিত, যা তার করা দরকার– সেই কথাটাই নিশ্চয় তিনি বলবেন।
সে সমস্ত সঙ্কোচ কাটিয়ে চিঠিখানা নিয়ে গিয়ে কাছে দাঁড়াল।
‘কী চাই গো–হঠাৎ আমার ডাক্তারখানায়? ওষুধ দিতে হবে?’
জিজ্ঞাসু সহাস্য দৃষ্টিতে চান ওর মুখের দিকে।
‘হ্যাঁ, ওষুধই একরকম। এই চিঠিটা পড়ে দেখুন, তারপর বালান কী করব আমি।’ চিঠি দেখেই ভ্রূ কুচকে উঠেছিল, পড়তে পড়তে গম্ভীর হয়ে গেলেন অমরবাবু। চিঠি শেষ ক’রেও অনেকক্ষণ চুপ ক’রে বসে রইলেন বাইরের তৃণশূন্য মাঠের দিকে চেয়ে। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, ‘তাহ’লে তো যেতে হয় তোমাকে?’
‘কী করব বলুন। আমি কিছু ভেবে ঠিক করতে পারছি না বলেই তো আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে এলুম।’
‘যাওয়াই তো উচিত। মা যে রকম চিঠি লিখেছেন তোমায়–খুবই বিপন্ন মনে হচ্ছে। মা যাই করুন, মা মা-ই–মায়ের বিপদে যথাসাধ্য করাই সন্তানের উচিত।…… তোমার মুখে যা শুনেছি, কিপ্পন মানুষ ঝাঁ করে টাকার লোভ দেখিয়েছেন যখন–তখন খুবই আতান্তর অবস্থা… তুমি কাল-পরশুই চলে যাও!’
না না, কাল পরশু যাব কি!’ কণ্ঠস্বরে জোর দিয়ে বলে ঐন্দ্রিলা, ‘আপনি লোকজন দেখুন, আপনাকেই বা এই আতান্তরে ফেলে যাব কী ক’রে?’
‘লোকজন!’ হাসলেন ডাক্তারবাবু, ‘এই বনদেশে লোকজন পাব কোথায়, খুঁজবে কে? নিহাৎ কদিনের সুখভোগ কপালে লেখা ছিল তাই সে ছোকরার সঙ্গে তোমার দেখা হয়ে গিয়েছিল–আর তুমিও অমনি দৈন্য-দশায় পড়েছিলে, নইলে তুমিই কি আসতে নাকি? ওসব ছেড়ে দাও, আমার নতুন লোক পাবার আশায় থাকতে গেলে এ জন্মে আর তোমার যাওয়া হবে না। ….তুমি তোমার সুবিধামতো চলে যাও। অক্রূরকে সঙ্গে দিচ্ছি, কোলাঘাট পর্যন্ত গিয়ে তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে’খন।’
‘উঁহু’–ঐন্দ্রিলাও দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘আপনার কোন সুব্যবস্থা না হ’লে আমি যাব না। সে মার যা-ই হোক!’
‘এই দ্যাখো পাগল! আমি যেমন খাচ্ছিলুম তেমনি খাবোনা হয় শেষ অবধি মঙ্গলাই যা পারে ফুটিয়ে দেবে।… আর ওখানে যদি অন্য কোন ব্যবস্থা হয়, তোমার ভায়ের বিয়েই যদি হয়ে যায় এর মধ্যে–তুমি সঙ্গে সংগে ফিরে এসো। একদিনও সেখানে বেশি থাকতে হবে না। আর তোমার মা পাঠান ভালই, আমি যদ্ধিন আছি –সীতার দশটা টাকা বন্ধ হবে না, তুমি নিশ্চিন্ত থেকো।’
শেষের দিকে ডাক্তারবাবুর গলাটা কি কেঁপে যায় একটু? না–ওটা ঐন্দ্রিলার শোনবারই দোষ?
কিন্তু অকস্মাৎ–এতদিন পরে ঐন্দিলার দু চোখ জ্বালা ক’রে জল ভরে আসে। এ ভাবে যে কোন অপরিচিত–ওদের ভাষায় নিষ্পর–মানুষের জন্যে ওর চোখে জল আসা সম্ভব, তা-ই কে ভাবতে পেরেছিল। নিজের দুর্বলতায় নিজেই যেন লজ্জিত হয়ে সে তাড়াতাড়ি চলে এল সেখান থেকে। আর সারাদিন ধরে বার বার এই কথাটাই মনে হ’তে লাগল–এই দেবতার মতো মানুষটাকে এমন আতান্তরে ফেলে যাওয়াটাই কি তার উচিত হচ্ছে? মার তবু আরও অনেক আপনার লোক আছে–এর যে কেউ নেই। তার জন্যেই যে সবাই ত্যাগ করেছে একে!
সারাদিন ধরে তবু এটা ওটা গুছোতে হয়। মঙ্গলাকে ডেকে ভাঁড়ারে কোথায় কী থাকে বুঝিয়ে দেয়। মঙ্গলা তো কেঁদেই আকুল, ‘ওগো বামুনদি, তুমি গেলে বাবুর আমার খাওয়া- দাওয়া কিচ্ছু হবে নি, বাবুকে আর বাঁচাতে পারব নি।’
ঐন্দ্রিলা তাকে ধমক দেয়, ‘আ মর্ মাগী, তা বলে আমি বাপের বাড়ি যেতে পাবো না? মার কন্না করতে পারব না! তুই–তোরা আছিস কী করতে? একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে চানটান ক’রে এসে সব গুছিয়ে দিবি–বুঝলি? একটু চালিয়ে নিবি–যদ্দিন না আমি ফিরি!’
‘ও, তুমি আবার আসবে তা হ’লে! তাই বলো। ধড়ে পেরানটা এল তবু। সে আমি যতটা যা পারব ক’রে দুবো। তার জন্যে ভেবো নি।’
মঙ্গলা কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ মোছে।….
বোধহয় দুপুরে ঘুম হয় নি বলেই বিকেলের দিকে মাথাটা ধরেছিল। সন্ধ্যার সময় রান্না করতে করতে খুব যন্ত্রণা হ’তে লাগল। ডাক্তার সেদিন একটু সকাল সকাল এসেছিলেন– বোধহয় পরের দিন ঐন্দ্রিলা চলে যাবে বলেই–সকাল ক’রেই তাঁকে খাইয়ে হেঁশেল সেরে নিল ঐন্দ্রিলা। তারপর বাইরের রকে ডাক্তারবাবুরই বেঞ্চির এক পাশে এসে বসল।
‘এরই মধ্যে চলে এলে–তুমি খেলে না?’
‘না, মাথায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছে–মাথা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। আজ আর খেতে পারব না কিছু। একটু ঠাণ্ডায় বসে যদি কমে–গিয়ে শুয়ে পড়ব।’
কেন–হঠাৎ এত মাথার যন্ত্রণা? জ্বরটর আসছে না তো?’ ডাক্তারবাবু উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, ‘কই, নাড়িটা দেখি।’
না না। জ্বরটর নয়। বোধহয় দুপুরে একটু গড়ানো হয় নি বলেই–মঙ্গলাকে সব দেখিয়ে-শুনিয়ে দিচ্ছিলুম কিনা, কোথায় কি থাকে!’
একটু অপ্রতিভ ভাবে হাসে সে।
‘কী আশ্চর্য! কেন, ও কি খুঁজে-পেতে নিতে পারত না! না না, কাজটা ভাল করো নি। তোমার যখন ঘুমনো অভ্যেস।… তা এতক্ষণই বা বলো নি কেন, আজকাল মাথা-ধরার খুব ভাল ভাল ওষুধ বেরিয়েছে যে, একটা বড়ি খেলে কখন ছেড়ে যেত। দাঁড়াও, একটা বার করে দিই–’
তিনি উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু ঘরে যাবার আগেই–উঃ, মাগো-–’উঃ, মাগো–মা!’ বলে বেঞ্চি থেকে উঠতে গিয়ে যেন হুমড়ি খেয়ে মেজেতে পড়ে গেল ঐন্দ্রিলা।
‘কী হ’ল কী হ’ল–ওরে ও মঙ্গলা–’, বলতে বলতে ডাক্তারবাবু উঠে বসতে গেলেন, বসানো গেল না, মাথাটা কেমন নড়নড় করতে লাগল। অগত্যা সেইখানেই শুইয়ে রেখে ছুটে গিয়ে আলোটা নিয়ে এলেন ঘর থেকে–দেখলেন এর মধ্যেই কখন ওর নাক মুখ দিয়ে প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে, ওর কোন জ্ঞানও নেই, অচৈতন্য হয়ে পড়ে আছে।
ডাক্তারবাবু পাগলের মতো মঙ্গলা আর অক্রূরকে ডাকতে লাগলেন।
’ইস্–এ যে –তাইতো। ওরে মঙ্গলা, ও অক্রূর, শিগগির আয় বাবা!’
॥৩॥
বাঁচবার নাকি কথা নয়,–বাঁচলেও একটা অঙ্গ পড়ে যাবার কথা, কিংবা কথাবার্তা জড়িয়ে যাবার কথা–ডাক্তার যা বললেন। এ রোগে যা হোক একটা গুরুতর ক্ষতি হয়- যদি বা রোগী বেঁচে ওঠে। নিহাৎ ওর বাপমায়ের আশীর্বাদের জোর, অথবা আরও বহু দুঃখভোগ অদৃষ্টে আছে–ঐন্দ্রিলার তাই ধারণা–তাই এমনভাবে গোটা দেহটা সুদ্ধ বেঁচে উঠতে পেরেছে। কিংবা, ডাক্তারবাবু আরও বললেন, খুব খেটে খাওয়া দেহ, ছেলেবেলা থেকেই নিদারুণ পরিশ্রম করেছে বলে দেহটা টন্কো আছে–কিছুতেই কাবু করতে পারে নি, স্নায়ুগুলো প্রাণপণে লড়াই ক’রে ঠেলে উঠেছে আবার–ওকেও তুলেছে।
তা ভুগেছেও নাকি অনেকদিন। মঙ্গলার হিসেবে প্রায় একমাস। ডাক্তারবাবু বললেন, পাঁচ সপ্তাহেরও বেশি। ঐন্দ্রিলার এ সব কোন হিসেবই ছিল না। কিছুই বুঝতে পারে নি সে। সেদিনকার সেই মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার পর থেকে আর কোন হুঁশ নেই। যেদিন প্রথম ভাল ক’রে জ্ঞান হ’ল, ভাল ক’রে চোখ মেলে দেখতে এবং সবাইকে চিনতে পারল, সেদিন মনে হ’ল যেন সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠল সে। তবে বোধহয় একটু অসাধারণ রকমের ঘুম, বহুক্ষণব্যাপী গাঢ় সুষুপ্তি থেকে জেগে উঠলে যেমন হয় তেমনি।… মনে হ’ল, বাবা, কতবেলা অবধি ঘুমিয়েছে সে, বাইরের দিকে চাইতেই চোখে পড়ল ঝলমল করছে রোদ জানালার পাশের বড় সজনে গাছটায় –সে ধড়মড় ক’রে উঠে বসতে গেল তাড়াতাড়ি। কিন্তু ওঠা গেল না, ভালরকম চেষ্টা করবার আগেই ডাক্তারবাবু জোর করে ওর দুটো কাঁধ চেপে ধরে শুইয়ে দিলেন আবার। বললেন, ‘উঁহু উঁহু, উঠে বসতে এখনও ঢের দেরি, তার আগে এখন অন্তত আরও এক মাস শুয়ে থাকো, শুয়ে শুয়েই খাও–তারপর ভেবে দেখা যাবে!’
প্রথমটা যারপরনাই বিস্মিত–পরে একটু বিরক্তও হ’ল ঐন্দ্রিলা। এ আবার কী–ফট্ ক’রে গায়ে হাত দেওয়া! ….. তারপর আরও বিস্মিত হ’ল এই দেখে যে, ঐটুকু ওঠবার চেষ্টা করতেই যেন মাথার মধ্যে ঝিমঝিম ক’রে উঠল, সমস্ত শরীর বিবিন্ ক’রে ঘেমে উঠল দেখতে দেখতে।… অনেকক্ষণ চোখ বুজে থেকে ব্যাপারটা ভাববার চেষ্টা করল। তারপর আবার আস্তে আস্তে যখন চোখ খুলল তখন দেখল, ডাক্তারবাবু মুচকি হাসছেন তার দিকে চেয়ে। গা জ্বালা ক’রে ওঠবারই কথা–লোকটার সকাল থেকে এই অসভ্য চালচলন দেখে, জ্বালা ক’রে উঠেও ছিল প্রথমে –কিন্তু তারপরই যেন আব্ছা আবছা মনে পড়ল কথাটা। মনে পড়ল সেই অসহ্য মাথার যন্ত্রণা আগের রাত্রের; মনে পড়ল সেই উঠতে গিয়ে যেন কী একটা–তারপর আর কিছু মনে নেই। তাহলে বোধহয় সে তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল, এঁরা ধরাধরি ক’রে এনে শুইয়ে দিয়েছেন। সেইজন্যেই বোধহয় এতবেলা অবধি ঘুমিয়েছে সে। কিন্তু–আর একটু ভাল ক’রে চেয়ে দেখে চিনতে পারল–এটা যে ডাক্তারবাবুর ঘর! এ ঘরে, এ বিছানায় কেন সে?…… ও মা, কী মনে করবে লোকে দেখলে! ……
সে আবারও ধড়মড় করে উঠে বসতে গেল, পারল না। আবারও সেই মাথা ঝিমঝিম-করা, সর্বাঙ্গ-গুলিয়ে-ওঠা ভাবটা।
ডাক্তারবাবু কঠিন কণ্ঠে ধমক দিয়ে ওঠেন, ‘ও কী হচ্ছে কি? ….. অনেক কাণ্ড ক’রে যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে–সে সব পরিশ্রম কি পণ্ড করতে চাও? মরবার এত শখ কেন? এখন মুখটি বুজে চুপচাপ শুয়ে থাকো কিছুদিন–যদি বেঁচে থেকে আবার মেয়ে-নাতিকে দেখতে চাও!’
যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে!
সে কি!
তবে কি সে অনেকদিন ধরে ভুগছে? এমনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে রয়েছে বহুদিন? কতদিন তার এমন চলছে?…. বহু প্রশ্ন একসঙ্গে যেন মনের মধ্যে ঠেলাঠেলি ক’রে উঠল–কিন্তু বলতে পারল না। কথা কইতেও যেন কষ্ট হচ্ছে।
এইবার মনে হ’ল–আবার চোখ মেলে দেখে–ডাক্তারবাবু যেন ইতিমেধ্য খুব রোগা হয়ে গেছেন। একরাত্রে বা দুরাত্রে তো এমন হ’তে পারে না। সত্যিই তো। তাহ’লে অনেকদিন ধরেই ভুগেছে নিশ্চয়। আশ্চর্য, কী এমন রোগ হয়েছিল তার?… মঙ্গলা এগিয়ে এল বিছানার কাছে।
‘এই যে, বামুনদির হুঁশ হয়েছে দেখছি।…. বাবা কী কাণ্ডটাই না করলে বাপু, চৌঘুড়ি মাত্ দেখিয়ে দিলে একেবারে। ….খুব বরাতজোর আর বাপমার পুণ্যির জোর–তাই আমাদের বাবুর এখানে এটা হ’ল–অপর জায়গায় হ’লে আর বাঁচতে হ’ত না। সাক্ষে যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে বাবু–টানাটানি করেছে দিবেরাত্র, যম একদিকে আর বাবু একদিকে। আহার নিদ্রা কি ছিল এই কদিন? পর পর ঠায় বসে রাত জেগেছে অমন পনেরো দিন। দিনে ঘুম নেই রাতে ঘুম নেই–খাওয়াদাওয়া সে তো ধরো চুলোর দোরে গেছেই– মানুষটা বোধহয় সঞ্জে-আহ্নিক করতেও তোমার শেষের ধার ছেড়ে ওঠে নি
‘আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে!’ ধমক দিয়ে ওঠেন ডাক্তারবাবু, ‘ওকে খেতে দিতে হবে এই সময়–বলে রেখেছি না!…. যা যা, নেবুর রস নিয়ে আয়।’
‘দুবো। দুবো। …খেতে তো দুবোই। …না তাই বতিছি–যা করলে, মানুষে পারে নি বাবু, হক্ কথা যা বলব–এমন সেবা মানুষে করতে পারে–!’
মঙ্গলা বকতে বকতেই চলে যায়।
আবারও যেন মাথাটার মধ্যে কেমন করে ওঠে ঐন্দ্রিলার।
এমন শক্ত অসুখ হয়েছিল তার? এত কঠিন? ….. কী অসুখ?–ডাক্তারবাবু দিনরাত জেগে সেবা করেছিলেন?…. ইস! ….. যতই হোক–পুরুষমানুষ, মেয়েদের সেবা করবেন কী ক’রে। –বিশেষ এমন অজ্ঞান-অচৈতন্য অবস্থা, যখন নিজের কোন কাজই নিজের করবার ক্ষমতা থাকে না!
যেন ওর মনের কথা টের পেয়েই ডাক্তারবাবু বলে উঠলেন, ‘বাঁচিয়েছে আসলে ও-ই, আমি আর কি করতে পেরেছি, সময়মতো ওষুধ-ইঞ্জেকশন দেওয়া আর বসে থাকা, মাঝে মাঝে নাড়ি দেখা, এই তো! আসল সেবা যেটা–সেটা তো ওকেই করতে হয়েছে। এই ঘরেই শুতে বলেছিলুম, রাত্রেও যে কতবার উঠতে হয়েছে ওকে, তার কি ঠিক আছে!’
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে আস্তে আস্তে। তবুও কতকটা রক্ষা। নইলে– নইলে সে এরপর লোকের কাছে মুখ দেখাত কী করে! ….
এবার ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলঐন্দ্রিলা, ‘আমার মেয়েকে কেন খবর দেন নি?…. কিম্বা মাকে–?’
ইচ্ছে করেই দিই নি। মেয়ে তো তোমার শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসতেই চায় না। তার ক্ষতি হতে পারে তাতে–এই তো তার ভয়, হয়ত একবার ছেড়ে এলে আর কখনও ঢুকতেই পাবে না সেখানে। সে ক্ষেত্রে তাকে খবর দিয়ে আনানো কি ভাল হ’ত? তারপর এই দুর্গম-পথ, তাকে আসতে হলে চার-পাঁচবার গাড়ি বদলাতে হবে- কে আনবে সঙ্গে করে, কার সঙ্গে আসবে–সে সব প্রশ্নও তো আছে। যদি আসতে না পারে, খবরের জন্যে ছটফট করবে, কান্নাকাটি করবে, মিছিমিছি সেই এক আতান্তর। কী লাভ তাকে খবর দিয়ে বলো?… তবে তেমন তেমন বুঝলে খবর দিতুম বৈকি, সে ঝুঁকি কি নিজের ঘাড়ে রাখতুম! কিন্তু আর কথা নয়–একেবারে মুখ বুঝে ফেলো। মঙ্গলা ফলের রস করে আনছে, লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে নাও, আর যতটা পারো ঘুমোও। যা দরকার ওরেই বলবে, কাপড়-চোপড় ছাড়তে হ’লে ও-ই ছাড়াবে; যা করতে হবে ওকে বলো। তবে তোমার নিজের কিছু করা চলবে না। একটিও কথা কইবে না, উঠবে না। এখনও অনেকদিন এমনি শুয়ে থাকতে হবে।…
দীর্ঘকাল সময় লাগল উঠে বসতেই। এত দুর্বল যে হাত-পা নাড়তেই যেন ক্লান্তি বোধ হয়। শুনল যে মঙ্গলার এক বোনঝিকে আনানো হয়েছিল পরের দিনই। সে-ই রান্নাবান্না করেছে, এ কদিন তো মঙ্গলাও ওদিকে যেতে পারে নি। ডাক্তারবাবুকেও তার হাতে খেতে হয়েছে। অবশ্য, উনি বলেন নাচারে দোষ নেই, হাসপাতালে গেলে কার ছোঁওয়া না খেতে হয়, তাতে কি আর কারও জাত যায়!
সে বোনঝি এখনও আছে। সে-ই রাঁধছে, কাজকর্মও করছিল সব, মঙ্গলা তো দিনরাত ওর ঘরেই থাকত বলতে গেলে –এই তো সবে কদিন একটু-আধটু ওদিকে যেতে পারছে। তবে রাত যা জাগবার ডাক্তারবাবুই জেগেছেন, কিছু দরকার হলে ওকে ডেকে দিয়েছেন মধ্যে মধ্যে। ওকে কাছে রাখা–মঙ্গলা গলাটা নামিয়ে চুপি চুপি বললে,–’নিহাৎ একা মেয়েছেলের ঘরে থাকলে খারাপ দেখায় বলেই। তা ধরো মানুষটার বিবেচনা তো চারদিকেই! সবদিকে নজর।
মঙ্গলা বলে, ‘এমন সেবা আর এমন চিকিচ্ছে কেউ কখনও দেখে নি বামুনদি। যমরাজও ছাড়বে নি আর ইনিও নিয়ে যেতে দেবেন নি। তোমার জীবন বাবু চিরদিনের তরে কিনে নিয়েছে।… যাকে বলে মরা মানুষ ফিইরে আনা–তাই। অন্য লোক ডাকে নি, সদর থেকে–কি সব বলে ধাই না কি–আনাতে পারত, তাও আনায় নি। বলে, তাতে ‘নানান কথা উঠবে। আমার আর কি, ল্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়–ও ভদ্দলোকের মেয়ে কি শেষে আমার উপকার করতে এসে বদ্নাম কিনবে? সে আমি পারব নি।… তা করেছেও বটে। একাই তো সব করলেগো, এই বয়েসে এত খাটুনি কাউকে খাটতে দেখি নি। আমি তো শুধু নিতান্ত সকাল-বিকেলের দরকারগুলো, সরা দেবার কাজটা করেছি। আর যা করেছে উনিই করেছে। তা একটুকু বিরক্তি ছিল না বাপু, হাসিমুখে সব করেছে। সঙ্গে সঙ্গে কত কি ঠাট্টা-তামাশা। বলে, তোর বামুনদির তো এত মেজাজ, এত কথা–তোরা তটস্থ থাকতিস দিনরাত, ভয়ে ভয়ে জীবন যেতো–তা এখন তো তোর হাতে উনি, দেনা এবার খুব ক’রে দুটো অন্তর-টিপুনি, জব্দ হয়ে যাবে।… বলে আর হাসে।… এই খাটুনি, কিন্তু তার জন্যে নিত্যিকারের কাজ তো একদিনও বন্ধ নেই গো। সাতখানা গাঁয়ের রুগী দেখা তো সমানে চলেছে। তবে হ্যাঁ–ঘোরঘুরি করতে পারত নি, যা হ’ত এখানে বসেই।…. তবু, নিত্যি পঁচিশ তিরিশটা করে রুগী দেখা–তার ওপর ঘরে তুমি বেঁহুশ হয়ে পড়ে! এর ভেতর আবার বইপড়া আছে, তোমার জন্যে কত মোটা মোটা বই ঘেঁটেছে কদিন–বয়ের পাহাড় জমে গিছল। কী খাটুনিটাই না খেটেছে কদিন। চেহারা দেখতেছ না, আধখানা হয়ে গেছে একেবারে।
খুবই দেখছে। যত দেখছে আর যত শুনছে তত যেন লজ্জায় মাটির সঙ্গে সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ঐন্দ্রিলার। ওর মতো একটা সামান্য মেয়েছেলের জন্যে কী না করেছেন ভদ্রলোক! নিজের ছেলেমেয়ের জন্যেও বোধহয় কেউ করে না এত! খুব বেশি দয়া হ’লে উনি নিয়ে গিয়ে কোলাঘাটের হাসপাতালে রেখে আসতে পারতেন। তাতেই কৃতজ্ঞ থাকত সে। যথেষ্ট করা হ’ল বলে মনে করত। ঝি-চাকরের জন্যে আর কীই বা করে লোকে। সে ভদ্রলোকের মেয়ে হতে পারে–কিন্তু রাঁধুনী-বামনীর কাজ করে যখন, তখন বিবেচনা আশাই বা করবে কেন? রাঁধুনী-বামনীকে লোকে ঝি-চাকরের সামিলই মনে করে। ওরই মধ্যে হয়ত একটু উঁচু। নিহাৎ জাতটা উঁচু বলেই সামান্য একটু তফাৎ ধরে। তবে সে সামান্যই। তাদের জন্যে কেউ পয়সা খরচ করে ডাক্তার দেখায় না। সেই যে উকিলবাবুর বাড়ি ছিল সে, যেখান থেকে চুরি করার জন্যে তার চাকরি গেল–সেখানে থাকতে খুব একবার সর্দি-কাশির শব্দে তাঁদেরও কারও কারও ঘুমের ব্যাঘাত হয়েছিল বলে –তার একটা চিকিৎসা করা দরকার মনে করেছিলেন তাঁরা। তা ক’রেও ছিলেন চিকিৎসার ব্যবস্থা। পাড়ার কী এক ক্লাবে এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার সকালে বিনা পয়সায় রোগী দেখতেন ও ওষুধ দিতেন–সেইখানেই পাঠিয়েছিলেন ওকে ঝি সঙ্গে দিয়ে। অবশ্য সে ওষুধে উপকারও হয়েছিল ওর। আর সেজন্য সে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতাও বোধ করেছিল। সেইটুকু বিবেচনাই পর্যাপ্ত বলে মনে হয়েছিল।
কৃতজ্ঞ বোধ করার কারণও ছিল। অনেক দেখেছে সে। যতক্ষণ কাজের ক্ষমতা থাকে–ততক্ষণই মনি বাড়ির আদর–অসুখ করলে তাকে কোনমতে সরিয়ে দিয়ে নতুন লোক খোঁজাই সাধারণ রীতি। তার জন্যে ঝি-চাকররাও মনিবদের দোষ দেয় না।
মনি বাড়ির কথাই বা কি? যদি তার মার কাছে থাকতে অসুখ করত, মা কি ডাক্তার দেখাতেন? হয়ত হাসপাতালে দেবার উদ্যমটুকুও প্রকাশ করতেন না। কে-ই বা অত করে? ঘরে পড়ে থেকে বেঘোরে প্রাণটা যেত। এ যা রোগ হয়েছিল তাতে হাসপাতালে গেলেও বাঁচত না হয়ত–এতকাণ্ড সেখানে কে করবে আর কেনই বা করবে–তবু তাতে সান্ত্বনা থাকত একটা। কিন্তু মার বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি এ রকম হ’লে সেটুকুও করত না কেউ।
না, মঙ্গলা ঠিকই বলেছে। তার জীবন–অবশিষ্ট জীবনটাকে কিনেই নিয়েছেন ডাক্তারবাবু। যমের কাছ থেকে কিনেই নিয়েছেন–নিজের ঐকান্তিকতার মূল্যে। তার তরফ থেকে সে যতই করুক এ ঋণ শোধ হবার নয়।….
কিন্তু কেন এত করলেন উনি? কেন এত করছেন! ঐন্দ্রিলা নিজেকে প্রশ্ন করে। প্রশ্নটা বারবার মনে এসে মনটাকে যেন কী একটা অজ্ঞাত কারণে আলোড়িত ক’রে দিয়ে যায় তার।
কীই বা তার দাম। কীই বা করেছে সে!
চিরকাল সর্বত্র শুনে এসেছে সে–শ্বশুরবাড়ির সেই স্বল্প-স্থায়ী কটি সৌভাগ্যের দিন ছাড়া যে–সে অবাঞ্ছিত, কোথাও তার স্থান নেই, তাকে কেউ চায় না। সে মুখরা, সে প্রখরা–সে দুর্ভাষিণী, সে দুর্ভাগিনী। যেখানে যায় শুধুই অভিশাপ আর অশান্তি ছড়িয়ে বেড়ায়। তাই সে চলে এলেই সকলে বাঁচে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আর তাদের সে মনোভাব যে একেবারে অকারণ, তা-ও বলতে পারে না। নিজের জ্বালা নিজেই যে অনুভব করে। ….
সেই চির-অবাঞ্ছিত মানুষকে উনি কী যত্নই না করছেন।
তার জন্যই সন্তানরা পর হয়ে গেছে ওঁর–হয়ত বা চিরকালের মতোই। মাতৃহারা সন্তান সব ওঁর। তবু, যে এই অনভিপ্রেত অবস্থার জন্য দায়ী তাকেই গৃহিণী করে, সংসারের কর্ত্রী করে রেখে দিয়েছেন বাড়িতে। কিন্তু সেজন্য কোন কিছু অতিরিক্ত দাবি করেন নি। কোন ঘনিষ্ঠতা করতে চান নি। বরং যথেষ্ট সম্ভ্রমের সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছেন। স্নেহ করেছেন–তার পরিবর্তে কিন্তু স্নেহ আশা করেন নি। শুধু সামান্য সাধারণ যেটুকু, বাধ্যবাধকতার মধ্যে যা পড়ে– নিতান্তই যেটুকু মাইনে-করা দাসী- চাকরের করার কথা, তার বেশি আশাও করেন না, তার বেশি করেও নি কিছু ঐন্দ্রিলা। তার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কার মতোই রান্নাবান্না করেছে, আর অবসর সময়ে–নিহাৎ অসহ্য হয়েছে বলেই এবং হাতে কোন কাজ থাকত না বলেই–ঘরদোর বিছানা-মাদুর ঝেড়ে মুছে একটু ভদ্রস্থ করেছে। এর জন্যেই উনি কী পর্যন্ত না খুশি হয়েছেন, কী পর্যন্ত না কৃতজ্ঞ বোধ করেছেন! সেই কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর উপহার দেওয়া পট্টবস্ত্রে, গলার হারে এবং সম্ভ্রম ব্যবহারে।
কিন্তু ঐন্দ্রিলা জানে যে এর কোন কারণ নেই। সে এমন কিছু করে নি। এ ওঁরই সৌজন্য। ওঁরই ভদ্র মনের পরিচয়। সে নিজে এ যত্ন এ বিবেচনার কিছুই –এক ভগ্নাংশ মাত্রও–দাবি করতে পারে না। বরং আগাগোড়া সে-ই কৃতজ্ঞ। অনেকখানি স্বাধীনতা পেয়েছে সে এখানে এসে, অনেকখানি স্বাচ্ছন্দ্য। এ অবাধ কর্তৃত্ব ওর কাছে অভিনব শুধু নয়–অপ্রত্যাশিত।…
তা হ’লে উনি এত করলেন কেন? …..
সেই মূল প্রশ্নটা যে অমীমাংসিতই থেকে যায়। প্রশ্নটা করে নিজেকেই, ক’রেই যায় বারবার, কিন্তু তবু উত্তরটা খুব বেশি খুঁজতেও যেন সাহস হয় না। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে থাকে, বুকের মধ্যে কাঁপন লাগে একটা….
তবু ঘুরে ফিরে মনটা সেই প্রশ্নেই ফিরে যায়।
সম্ভাব্য উত্তরটাও সে এড়াতে পারে না বেশি দিন।
তবে কি, তবে কি–
তবে কি ওঁর আত্মীয়দের, ওঁর ছেলেমেয়েদের সন্দেহ একেবারে ভিত্তিহীন–একেবারে অমূলক নয়? কোথায় একটা অদৃশ্য এবং ওদের কাছে অজ্ঞাত কারণ ছিল সন্দেহের, যে সম্বন্ধে ওরা সচেতন না হ’লেও অপরের সন্দেহ গড়ে ওঠবার মতো কিছু ভিত্তি ছিল? …..
আচ্ছা–যদিই তাই হয়–এক সময় মরীয়া হয়েই বোঝায় নিজেকে ঐন্দ্রিলা, যদি তাই হয়, ক্ষতি কি? ঋণ শোধ করার সুযোগ সে ছাড়বে কেন? ঋণ শোধ করাই তো কর্তব্য। যে প্রাণ উনি কিনে নিয়েছেন, বলতে গেলে হাতে ক’রে উপহার দিয়েছেন তাকে–সে প্রাণ এবং প্রাণের আধার এই দেহটাতে তো ওঁর সম্পূর্ণই অধিকার। সে তো একভাবে দেখতে গেলে ওঁর ক্রীতদাসীই। ক্রীতদাসীর স্বাধীনতা কি আত্মরক্ষা করার?
তাছাড়া কীইবা এমন দায়-দায়িত্ব তার, কার কাছে? সমাজের ঋণ, ধর্মের ঋণ অনেক বহন করেছে সে, অনেকদিন ধরে অনেক দুঃসহ মূল্যে শোধ হয়েছে তা। আর কেন?
সুখী হবার অধিকার সকলকারই আছে–শুধু তার নেই?
না, অন্য কোন সুখ নয়। অন্য কোন সুখে আর তার প্রবৃত্তি নেই। সে প্রবৃত্তির উৎস পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে বুঝি–কোন্কালে। এই মানুষটাকে এই দেবতার মতো পবিত্র, ভগবানের মতো দয়াময় মানুষটাকে সুখী করেই সুখী হ’তে চায় সে। এখন শুধু সেইটুকুই তার কাম্য।
এমন দেবতার পায়ে, তাঁর প্রীতিকামনায়, অর্ঘ্যরূপে নিবেদিত হ’তে পারলে জীবন ধন্য সার্থক হয়ে যাবে।
॥ 8 ॥
কথাটা জিজ্ঞাসা করব করব ক’রেও জিজ্ঞাসা করতে পারেনি। সঙ্কোচে বেধে ছিল। এই যে প্রায় দু-মাস ও বিছানায় পড়ে––এর মধ্যে কী সীতার টাকাটা পাঠাবার কথা মনে ছিল ওঁর? থাকার কথা নয়, না থাকলে বিন্দুমাত্র দোষ দিতে পারে না ঐন্দ্রিলা, আর খরচও যে কী পরিমাণ হয়েছে বা হচ্ছে–জলের মতো–তা তো সে নিজের চোখেই দেখছে। এখন যা হচ্ছে তার পরিমাণ দেখেই, যা হয়েছিল তা অনুমান করতে পারে সে। এ ক্ষেত্রে সে টাকার কথা তোলাটাও অন্যায়। উনি অপ্রতিভ হয়ে পড়ে হয়ত এর মধ্যেই ধার-কর্ম ক’রে কিছু পাঠাতে চেষ্টা করবেন–কিন্তু তাতে বিব্রত করেই তোলা হবে ওঁকে। দু-হাত পেতে এত নেবার পরও এ প্রার্থনা জানানো অসঙ্গত শুধু নয়–নির্লজ্জও।
তবু চুপ ক’রেই থাকতে পারে কই!
ঘুরে ফিরে কেবলই কথাটা মনে পড়ে–কী হচ্ছে মেয়েটার কে জানে। ….দু-মুঠো ভাতের অভাব বোধহয় হবে না। সে তারা দিচ্ছে হয়ত ঠিক, ওর সতীন-পোরা। তার কারণও আছে। ভূতের মতো খাটে সীতা তাদের সংসারে এক মিনিটও হাতপায়ের বিশ্রাম নেই ওর। ছেলেটার দিকে চাইতেই সময় পায় না একটু। বিনা মাইনেয় এমন বিশ্বস্ত ও বিনীত বাঁদী আর কোথায় পাবে তারা।…. সুতরাং খেতে দেবে তারা–তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু শুধু খেতেই দেবে, আর কোন খরচ দেবে না, সেটা ঐন্দ্রিলা ভাল করেই জানে। আর তার জন্যে পরোক্ষতঃ সে-ই দায়ী। সে নিয়মিত টাকা পাঠিয়ে পাঠিয়েই এই বিশ্বাসটা জন্মিয়ে দিয়েছে তাদের। তারা জেনে গেছে–বদ্ধমূল বিশ্বাস হয়ে গেছে তাদের যে–ওর মা যেমন ক’রেই হোক টাকা পাঠাবে, ধার দেনা ক’রে ভিক্ষে করে–যেভাবে পারুক। মাঝখান থেকে তারা যদি ঘর থেকে কিছু বার ক’রে দেয় তো সেটাই লোকসান, সে আর ফেরত পাবে না তারা।
মেয়ের সেই অসহায় অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতেই মাথা গরম হয়ে যায়। কিছুতেই যেন স্থির হ’তে পারে না। দুর্বল শরীরে এই অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা আরও অসহ্য লাগে, সারা শরীর যেন ঝিম্-ঝিম্ করে ওঠে কথাটা মনে পড়লেই।
শেষে একদিন আর থাকতে পারে না। পেড়েই ফেলে কথাটা। অসুখ থেকে সেরে জ্ঞান হবার পরও কেটে গেছে বেশ কটা দিন। উঠে হেঁটে বেড়াতে পারে ঐন্দ্রিলা। সে আর ডাক্তারবাবুর ঘরে থাকে না, জোর করেই নিজের ছোট ঘরে চলে এসেছে সে। মঙ্গলারও আর থাকবার দরকার হয় না, তাকেও ছুটি দিয়েছে। অর্থাৎ অনেকটা আবার আগের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে যেন।
সেদিনও খাওয়া-দাওয়ার পর বাইরের বেঞ্চে এসে বসেছিলেন ডাক্তারবাবু। ঐন্দ্রিলা ও এসে কাছে বসল। আজকাল প্রতি রাত্রেই প্রায় এমনি বসে ওরা, একই বেঞ্চে বসে–তবে একটু ব্যবধান রেখে।
নানা গল্প চলে অন্য দিন। কিন্তু আজ ঐন্দ্রিলা প্রথম থেকেই নীরব। কী একটা বলবে বলেই যেন উশখুশ করছে। একটু পরে ডাক্তারবাবুও সেটা লক্ষ করলেন। স্নিগ্ধ কণ্ঠে প্ৰশ্ন করলেন, ‘কিছু কি বলবে? কোন কথা জিজ্ঞাসা করতে চাও?’
ঐন্দ্রিলা মাথা হেঁট করে বেঞ্চির কাঠটা নখে খুঁটতে খুঁটতে বলল, ‘বলছিলুম কি, আমার কাছে কিছু টাকা ছিল, এখানে তো এক পয়সা খরচ নেই, মাইনের টাকা সবই তো জমেছে তা তাই থেকে গোটা-কতক টাকা সীতাকে পাঠাব ভাবছি। একটা মনিঅর্ডার ক’রে দেবেন?’
যেন চমকে উঠলেন ডাক্তারবাবু। বললেন, ‘কেন, তার বাড়তি টাকার দরকার কিছু জানিয়েছে? কৈ, চিঠি তো আসে নি এর মধ্যে —
‘না, বাড়তি নয়। এমনি–এ দু-মাস তো বোধহয় পাঠানো হয় নিতাই বলছিলুম।’
‘কে বললে পাঠানো হয় নি। যেমন হয় তেমনই হয়েছে।… ওর টাকা পাঠাতে ভুলে যাব, ছেলেমানুষ, অমন অসহায় অবস্থায় আছে–! আমাকে এত কাণ্ডজ্ঞানহীন ভাবলে কী ক’রে!
হঠাৎ মনে হ’ল ঐন্দ্রিলার যে হেঁট হয়ে ওঁকে একটা প্রণাম করে। কিন্তু সম্ভবত অতিরিক্ত আবেগেই মাথাটা কেমন করছে আবার, হেঁট হ’তে সাহস হ’ল না। যদি সেদিনের মতো কিছু হয়? তাছাড়া লজ্জাও করতে লাগল। কখনও প্রণাম করে না–হঠাৎ এত ভক্তির বাড়াবাড়ি কেন–যদি জিজ্ঞাসা ক’রে বসেন।
অনেকক্ষণ চুপ ক’রে বসে রইল, সহসা কোন ত্তর যোগাল না তার। তারপর ঈষৎ গাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমার জন্যে এত টাকা খরচ হয়ে গেল আপনার–আবার ও টাকটা পাঠাতে গেলেন কেন? আমার তো মাইনের টাকা ছিলই–’
‘তা তো জানতুম না।…. আর এত টাকাই যেখানে খরচ হয়েছে–অন্ততঃ তুমি তো তাই বলছ–সেখানে আর ওর কটা টাকাতে কী এমন ইতর-বিশেষ হবে বলো!’
বেশ সহজ ও স্বাভাবিকভাবেই বলেন ডাক্তারবাবু।
কিন্তু ঐন্দ্রিলার চোখে বারবার যেন জল আসতে চায়। চুপ করে বসে অন্য দিকে চেয়ে থেকে প্রাণপণে সেই জলটাই সামলাবার চেষ্টা করে সে।
অনেকক্ষণ পরে–যেন বেশ একটু ঝোঁক দিয়েই আবার বলে ওঠে হঠাৎ, ‘কাল থেকে আমিই রান্নাবান্না করব কিন্তু। ও মেয়েটিকে ছুটি দিয়ে দেব–মঙ্গলার ঐ বোনঝিকে, মিছিমিছি আর ওকে আটকে রাখার দরকার নেই!’
‘সে কি?…. না না, ও সব গোঁয়ার্তুমি করতে যেও না। শরীর তোমার তত মজবুত হ’তে এখনও ঢের দেরি। এর মধ্যে আগুন-তাতে যাওয়া তোমার চলবে না!’
ডাক্তারবাবু যেন ব্যাকুল হয়ে ওঠেন।
‘না না, শরীর আমার বেশ সেরেছে, আর বেশি সারবার দরকার নেই। কতকাল আর বসে বসে খাব! অন্য জায়গা হ’লে কী করতুম? সে তো কবেই কাজে জুততে হ’ত। তাছাড়া খেটেই যখন খেতে হবে–তখন অভ্যেসটা খারাপ করে লাভ কি?’ গলায় অস্বাভাবিক জোর দেয় ঐন্দ্রিলা।
‘না না –ও সব কী বলছ! পাগলামি করছ কেন?’ মৃদু ধমক দিয়ে ওঠেন ডাক্তারবাবু, আমার খরচটা ঐভাবে গতরে খেটে উশুল করতে চাও বুঝি?…. তারপর? আবার যদি পড়ো তখন–? সবই তো বাজে খরচ হবে! সে তো আরও এক গাদা টাকা খরচ!’
‘এবার হ’লে আমাকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে রেখে আসবেন।
ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ নিরুত্তর থাকেন। তার পর–যা কখনও করেন না, আজ পর্যন্ত যা করেন নি–তাই করে বসেন। বাঁ হাতটা বাড়িয়ে বেঞ্চিতে রাখা ঐন্দ্রিলার একখানা হাতের ওপর বেখে বলেন, ‘হাসপাতালে দিয়ে আসব বলেই কি এত কাণ্ড করে তোমাকে বাঁচালুম ঐন্দ্রিলা?…. হাসপাতালে গেলে বাঁচতেও না–এটা ঠিক।…. আবার যদি পড়ো–এখানেও বাঁচাতে পারব কিনা সন্দেহ!’
সে স্পর্শে শিউরে কেঁপে ওঠে ঐন্দ্রিলা–এই বয়সেও। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস তার, বহু দিনের অপরিচয় এ স্পর্শের সঙ্গে–তবু সমস্ত দেহের রক্ত উদ্বেল হয়ে ওঠে যেন। কিন্তু সে হাত সরিয়েও নেয় না, শুধু পূর্ববৎ গাঢ়কণ্ঠে বলে, ‘কেন আমাকে এত করে বাঁচাতে গেলেন, এত খরচ করলেন কেন আমার জন্যে? আমার জীবনের কী দাম!–কারও কাছে কানাকড়িরও তো দাম নেই! কী সুখ ভোগ করতেই বা বাঁচালেন! সেই অজ্ঞান অবস্থায় শেষ হয়ে যেতুম, সে-ই তো ভাল ছিল।’
ডাক্তারবাবু ওর হাতখানার ওপর যেন সন্তর্পণে–খুব মৃদু একটা চাপ দিয়ে বললেন, ‘এমন কোন মানুষ আজও জন্মায় নি ঐন্দ্রিলা যার প্রাণের মূল্য এ পৃথিবীতে কারও কাছে নেই! প্রতিটি মানুষ–তা সে যে দেশে যে ঘরেই জন্ম নিক্ না কেন –যখনই জন্মায়
তখনই তার জন্যে এমন মানুষও কাউকে না কাউকে ভগবান পাঠান –যে তার জন্যে উদ্বিগ্ন হবে, চিন্তিত হবে–চাইবে যে এ বেঁচে থাক দীর্ঘদিন।… কারও না কারও কাছে প্রাণের দাম থাকেই–প্রত্যেকটি লোকের!
কে জানে সব কথা বুঝল কি না ঐন্দ্রিলা–তবে ওঁর বলবার সেই শান্ত সংযত ভঙ্গিতে ওঁর সেই মৃদু
অর্ধ-স্বগত কণ্ঠস্বরে–ওঁর আন্তরিকতাটা তার অনুভূতির অগোচর রইল না। সেও আস্তে আস্তে বলল, ‘তবু–মরতে তো একদিন হবেই–না হয় আপনার মতো দেবতার পায়েই মরতুম!’
একটু কি শিউরে উঠলেন ডাক্তারবাবু?
সামান্য একটুখানি?
অন্তত ঐন্দ্রিলার তাই যেন মনে হ’ল। কিন্তু তিনি একটু হেসে কথাটাকে লঘু ক’রে দেবারই চেষ্টা করলেন, ‘বাঃ, বেশ লোক তো!… আমাকে ফাঁকি দিয়ে, আমাকে রেখে এই বয়সে পালিয়ে যেতে চাও?…. তুমি চলে যাবে আর আমরা–বুড়ো হাবড়ারা বেঁচে থাকব?’
তারপর একটু থেমে কেমন যেন এক রকমের বিকৃত কণ্ঠে বললেন, ‘না না– দ্যাখো সবাই আমাকে ত্যাগ করেছে, ছেলেমেয়ে আত্মীয়স্বজন সবাই! তুমি অন্তত আমার মরবার সময়টা একটু কাছে থেকো।…. যাতে তোমার হাতের সেবাটা খেয়ে যেতে পারি।’
‘ছিঃ, কী একটা হৃদয়াবেগে এবার ঐন্দ্রিলাই ওঁর হাতটা দুহাতে চেপে ধরে। বলে, ওসব কথা আমার সামনে কোনদিন মুখে আনবেন না। আমরা কতগুলি প্রাণী আপনার মুখ চেয়ে আছি বলুন তো! কত লোকের কত উপকারে লাগছেন, কত লোকের জীবনদান করছেন, কত লোককে সুখী করছেন। আপনার এখন দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা দরকার। …..আপনার সব আপদ-বালাই নিয়ে বরং আমরা যেন মরি–’
‘আবার! তুমিই বা ও কথাটা বারবার বলছ কেন?’ ডাক্তারবাবু মৃদু ধমক দিয়ে ওঠেন। কিন্তু আর না। আর কোন মতেই না।…. বার বার এই অর্থহীন কথাটাই মনে মনে বলতে থাকেন তিনি। আর কিছুমাত্র সুযোগ দেওয়া এবং নেওয়া উচিত নয়। ঐন্দ্রিলার ঐ হাত দুটো চেপে ধরাতেই তাঁর মাথার মধ্যে কেমন যেন গোলমাল শুরু হয়েছে। দেহেও। যেন কী একটা উন্মত্ততা অনুভব করছেন তিনি রক্তের মধ্যে–
‘অনেক রাত হয়েছে। এবার শুয়ে পড়গে।’ বলেন ডাক্তারবাবু। নিজেও উঠে দাঁড়ান। কিন্তু গলার আওয়াজটা নিজের কাছেই কেমন যেন অস্বাভাবিক শোনায়। ঐন্দ্রিলাও বিস্মিত হয়ে তাকায় একটু।
সে বলে, ‘আপনি যান। আমি একটু পরে যাচ্ছি।’
‘না না, সে কী কথা। এখানে এই অন্ধকারে একলা–’, ডাক্তারবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
‘ও আমার খুব অভ্যাস আছে। একা বিদেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াই, ভয়ডর রাখলে কি চলে। তাছাড়া এখনও মঙ্গলাদের ঘরে আলো জ্বলছে। ওরাও ঘুমোয় নি এখনও—’
‘আহা, সে ভয় কেন। তোমার শরীরটাই কি একেবারে সেরে উঠেছে পুরোপুরি! ….এত রাত করা ঠিক নয়। দশটা বাজে বোধ হয়। চল চল শুয়ে পড়বে চল–’
কেমন যেন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন শেষের দিকে।
অগত্যা ঐন্দ্রিলাকে উঠতে হয়। সে ওঁর বসবার ঘর দিয়ে ডাক্তারবাবুর শোবার ঘরে আসে আগে। বলে, ‘দাঁড়ান আপনার মশারিটা ফেলে গুঁজে দিয়ে যাই।’….
‘আঃ–কী হচ্ছে তোমার আজ! এতদিন যদি নিজে গুঁজে নিতে পেরে থাকি তো আজও পারব। যাও–শুতে যাও!’
একটু কর্কশই শোনায় গলাটা। বিরক্তিটা স্পষ্ট।
ঐন্দ্রিলা ভয় পেয়ে যায়। ডাক্তারবাবুর এ চেহারাটা যেন একেবারে অপরিচিত। উনি কি রাগ করলেন তা’হলে?
ঐভাবে ঘুরিয়ে সীতার কথাটা তোলা হয়ত উচিত হয় নি। উনি হয়ত তাতেই দুঃখ পেয়েছেন–ওঁর বিবেচনায় সন্দেহ প্রকাশ করেছে বলে। কিংবা হয়ত একটু বেশি লোলুপতাই প্রকাশ ক’রে ফেলেছে!
সে ভয়ে ভয়ে বলে, আপনি –আপনি যেন বড্ড রাগ করছেন আজ। আমি তো তেমন কিছু বলি নি।… জানি,––আমার বরাতটাই এই, বেশিদিন কেউ সহ্য করতে পারে না আমাকে–’
সে বাইরের দিকে মুখ ফেরায়, নিজের ঘরের দিকেই যেতে উদ্যত হয় বুঝি।
কিন্তু তার আগেই ডাক্তারবাবু এগিয়ে এসে ওকে ধরে ফেলেন। একটা হাত ওর কাঁধে রেখে যেন সামান্য একটু আকর্ষণের মতোই করেন নিজের দিকে–তারপর বিকৃত ভগ্নকণ্ঠে বলেন, প্রায় চুপি চুপি, ‘তুমি আমাকে বড্ড ভুল বুঝছ ঐন্দ্রিলা, আমি–আমি যে তোমার জন্যই তোমাকে সাবধান হ’তে বলছি, তোমাকে বাঁচাতেই চাইছি যে আমি। তোমার দাম যে আমার কাছে সত্যিই অনেক–এ কি তুমি কিছুতেই বুঝবে না?’
ওঁর বলবার সেই দীন অনুনয়ের ভঙ্গিতে, চোখের সেই করুণ অসহায় চাহনিতে অকস্মাৎ ঐন্দ্রিলার চোখেও জল এসে যায়। সে ওঁর মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলবার চেষ্টা করে–বলতে পারে না।
কথা আর বলতে পারে না কেউই। কিন্তু ঐন্দ্রিলার আয়ত বিস্ফারিত সুন্দর দুটি চোখের কূলছাপানো জল প্রৌঢ় ডাক্তারবাবুর শেষ বিবেচনা শেষ সতর্কতাটুকু–নিজেকে প্রতিহত করার শেষ শক্তিটুকুকেও বিনষ্ট ক’রে দেয়। তিনি অভিভূতের মতো ওকে আকর্ষণ করেন শয্যার দিকে, ঐন্দ্রিলাও স্বপ্নাবিষ্টের মতো এগিয়ে যায় ওঁর সঙ্গে
তারপর একসময় তার হাত ধরে টেনে বসান বিছানায়। সেও সেই ভাবেই বসে। একেবারে ওঁর পাশে, কাছাকাছি। এত কাছে যে ওঁর বুকের শব্দটাও শুনতে পায় যেন।
ডাক্তারবাবু তেমনি অভিভূতের মতোই তাকে আরও কাছে টেনে নেন–একেবারে বুকের মধ্যে। ঐন্দ্রিলা বাধা দেয় না। প্রতিবাদ করে না, বরং যেন সে ওঁর সেই আকর্ষণের মধ্যে এলিয়ে পড়ে। অবশ্য তার সেই তখনও অসুস্থ-দুর্বল-শরীরে বাধা দেবার, প্রতিবাদ করবার, এ আকর্ষণ প্রতিনিরোধ করবার মতো শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না। এইটুকু উত্তেজনাতেই ঘেমে উঠেছে সে, মাথার মধ্যে যেন একটা যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে- কিন্তু তখন, সেই মহূর্তে বাধা দেবার বুঝি ইচ্ছাও ছিল না তেমন।
সে তো মন স্থির ক’রেই ফেলেছে। ভগবান যদি সুযোগ দেন তো সে তা প্রত্যাখ্যান করবে না। নিজের জীবনে সার্থকতা লাভ করার ও অপর একটি মহৎ জীবনকে সার্থক ক’রে তোলার এ সুযোগ সে ছাড়বে না কিছুতেই। কেন ছাড়বে? বরং তার এত বড় ঋণের কিছুটাও যদি শোধ করতে পারে তো সে-ই তার পরম লাভ বলে মনে করবে সে। পাপপুণ্য?… না, ওসব কুসংস্কার তার নেই। এ জীবন তাকে বিগত দীর্ঘকাল ধরে বারবারই শিখিয়েছে যে ওগুলো কথার কথা মাত্র। ওর কোন সত্যকারের প্রভাব নেই মানুষের জীবনে।….
.
আরও একটু আকর্ষণ অনুভব করে সে। ঐন্দ্রিলা চোখে ঝাপসা দেখছিল অনেকক্ষণ থেকেই। সে চোখ বোজে এবার। নিশ্চিন্তেই চোখ বোজে বুঝি। এ জীবনে আর কোনদিন কিছু ভাববার দরকার হবে না, ভাববেও না সে।…নিজেকে ছেড়ে দেয় সেই বাহুবন্ধনের মধ্যে-
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে–দীর্ঘকাল পরে–হরিনাথের চেহারাটা পরিষ্কার স্পষ্টভাবে ভেসে উঠল ওর দৃষ্টির সামনে। এত স্পষ্টভাবে অনেক-দিন দেখতে পায় নি সে। ইদানীং তার মুখটাই যেন ভাল ক’রে মনে পড়ত না। কেমন একটা আব্ছা আব্ছা মনে আসত শুধু, আদল একটা মনে পড়ত–এই মাত্র। আজ কিন্তু ভাল ক’রেই দেখতে পেল সে। যেন মনে নয়, সত্যি সত্যিই চোখের সামনে এসেই দাঁড়িয়েছে। সেই হরিনাথ, কোথাও কোন অস্পষ্টতা নেই। সেই হরিনাথ, ওর স্মৃতি মন্থন ক’রে আবেগের সমুদ্রে আলোড়ন জাগিয়ে একেবারে প্রত্যক্ষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই, স্বামী সম্বন্ধে পুরাতন বহু পরিচিত সেই আবেগটা তার পূর্ব পূর্ণশক্তিতে জেগে উঠেছে।
আঃ! আর ঠিক সেই সঙ্গেই হঠাৎ কেন মনে পড়ে যায় স্নেহময় পিতার মতো –বরং পিতার অধিক–শ্বশুর মাধব ঘোষালকে! মনে পড়ে দিদিমা রাসমণির মহিমময়ী মূর্তিটা, মনে পড়ে ছোট মাসীকে…..
ধড়মড় ক’রে উঠে বসে ঐন্দ্রিলা। নিজের প্রতি ঘৃণায়, আত্মগ্লানিতে, আত্মধিক্কারে, অনুশোচনায় সর্বাঙ্গে বিছার কামড় অনুভব করছে সে। আর কোন শারীরিক দুর্বলতাও যেন অনুভব করে না। প্রবল এক ঝটকায় বাহুর বন্ধন ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় সে, তারপর এ ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটে নিজের ঘরে চলে গিয়ে সশব্দে দোর বন্ধ করে দেয়….
.
পরের দিন সকালে উঠে আর ডাক্তাবাবুকে দেখতে পেল না ঐন্দ্রিলা। তারও সারারাত ঘুম হয় নি, কেঁদেছে আর ছট্ফট করেছে–ক্ষমা চেয়েছে বারবার মৃত স্বামীর কাছে। মনে মনে নয়–অস্ফুটে হ’লেও উচ্চারণ ক’রেই বলেছে মুখে–যে, ‘আমাকে মাপ করো আমাকে মাপ করো। তুমি তো চিরকাল আমার সব অন্যায় মাপ করেছ, সমস্ত ভুল ত্রুটি মানিয়ে নিয়েছ–এবারেও তাই নাও। তুমি তো জানতে পারছ আমার সব অবস্থা, আমি কত দুর্বল কত অসহায় তা তো তোমার জানতে বাকি নেই–সেটা বুঝে আমাকে মাপ করো এবারের মতো। আমি আর পারছি না গো, আমি আর পারছি না। তুমি এবার আমাকে টেনে নাও। যখন দেখা দিয়েছ, একবার মহাবিপদে রক্ষা করেছ তখন আর ভুলে যেও না, আমাকে, নিয়ে যাও–লক্ষ্মীটি’ ….
সারারাতের অনিদ্রা কান্না এবং বিলাপের ফলে মাথার যন্ত্রণা শুরু হ’ল আবার। ভোরে যখন ঘর ছেড়ে বাইরে এল তখন দেহ আরও দুর্বল, আরও অবসন্ন হয়ে পড়েছে।
কিন্তু তবুও আর দেরি করল না সে। ডাক্তারবাবুর ফেরবার জন্যেও অপেক্ষা করল না। তখনই স্নান সেরে নিজের সামান্য যা কাপড়চোপড় ছিল গুছিয়ে নিল। টাকা ওর কাছেই থাকত–বিছানার নিচে, সেজন্যেও ডাক্তারবাবুর মুখাপেক্ষা করতে হ’ল না। স্নান আহ্নিক সেরে সামান্য একটু মিশ্রীর-জল খেয়েই রওনা হ’য়ে পড়ল জাহাজঘাটার দিকে। বিকেলের দিকে একটা স্টীমার ছাড়ে, সেটা ধরা দরকার–নইলে আবার সেই কাল সকালে। জঙ্গলের মধ্যে একা বসে রাত কাটাতে হবে।
গোরুর গাড়ি আগেই ডাকিয়ে আনিয়েছিল, সেই গাড়িতে চেপেই রওনা হ’ল। মঙ্গলাকে বললে, ‘আমার মার খুব অসুখ, খবর এসেছে। ডাক্তারবাবু জানেন তবে আমার শরীর বুঝেই উনি বলেছিলেন আর কটা দিন থেকে যাবার জন্যে কিন্তু আমার মন আর মানছে না। কে জানে গিয়ে আর দেখতে পাব কিনা সন্দেহ–মনটায় যা করছে ….তুই ডাক্তারবাবুকে একটু বুঝিয়ে বলিস।
মঙ্গলা সরল হ’লেও নির্বোধ নয়। সে বলল, ‘তা মাকে দেখতে যাচ্ছ–সব কাপড়– চোপড় নিয়ে যাচ্ছ কেন? তুমি কি আর আসবে নি এখানে?’
ঐন্দ্রিলা সহজভাবেই জবাব দিল, ‘তা মার যদি বাড়াবাড়ি হয়ে পড়ে–কি শেষ পর্যন্ত বলা তো যায় না–ভালমন্দই যদি হয় কিছু–আমি কি আর ঘরবাড়ি ছেড়ে আসতে পারব? ….
গাড়ি যখন গ্রাম ছাড়িয়ে মাঠে পড়েছে তখন ডাক্তারবাবু ছুটতে ছুটতে এসে ধরলেন ওকে।
দুই হাত জোড় করে বললেন, ‘আর কখনও এমন ভুল হবে না ঐন্দ্রিলা, আমি কথা দিচ্ছি। তুমি আমাকে এভাবে ছেড়ে যেও না। আমার আর কেউ নেই, বুড়ো বয়সে তোমার ওপর অনেকখানি ভরসা ক’রে ছিলুম–লক্ষ্মীটি, আর একবার আমাকে বিশ্বাস ক’রে দ্যাখো!’
ওঁকে দেখেছিল আগেই। দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিল। এই গত কয়েক ঘণ্টাতেই যেন অনেকখানি বুড়ো হয়ে গেছেন ভদ্রলোক! সেই সদাপ্রফুল্ল উৎসাহোজ্জ্বল মুখে কে যেন দু বুরুল কালি লিপে দিয়েছে। খুব ক্লান্তও দেখাচ্ছে। ক্লান্ত ও অবসন্ন। উনিও নিশ্চয় সারারাত ঘুমোতে পারেন নি।
মনটা দুলে ওঠে বৈকি। ফিরে যেতেই মন চায়। নতুন রকমের একটা উল্টো অনুশোচনাও দেখা দেয়। এই লোকটাকে আঘাত দেবার, অসহায়ভাবে ছেড়ে আসবার জন্য অনুশোচনা–
কিন্তু সে অল্পক্ষণের জন্যেই। তারপরই নিজেকে সামলে নেয় ঐন্দ্রিলা। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সর্বপ্রকার আবেগহীন নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, ‘মায়ের অসুখ আপনি তো জানেনই অনেক আগেই যাওয়া উচিত ছিল হয়ত… কাল একটা ভারী খারাপ স্বপ্ন দেখেছি তাইতেই মনটা খুব উতলা হয়ে উঠেছে। আমাকে আজ যেতেই হবে।’
গোরুর গাড়ির পিছু পিছু যাচ্ছিলেন ডাক্তারবাবু। খুব চুপি চুপি, ভগ্নকণ্ঠে–প্ৰায় কান্নার মতো করে বললেন, ‘আর একবার আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না! কিন্তু এবার করলে আর ঠকতে না। আমার তরফ থেকে আর কোন অন্যায় হ’ত না কোনদিন। তাও যদি ভরসা করতে না পারো, তোমার মেয়েকে এনে রাখো। আমার এখানাকার বাড়ি জমি জায়গা সব তাকে লিখে দিচ্ছি। আশ্রয়ের ভয়েই তো সে শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে চায় না–এখানে তার ঢের ভাল আশ্রয় মিলবে। আমাকে শুধু দুটি খেতে দিও–আর কিছু ই চাই না!’
ওঁর বলার ভঙ্গিতে ঐন্দ্রিলার চোখে জল এসে পড়ে। লোভও বড় প্রবল। চিরকালের মতো নিশ্চিন্ত হওয়া–মেয়ের চিন্তা থেকেও নিজের চিন্তা থেকেও। নিরাপদ আশ্রয়, নিষ্কণ্টক জীবনযাত্রা…. ক্ষণেকের জন্যে দ্বিধাগ্রস্ত, অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে যেন। তারপরই আবার প্রবল বেগে ঘাড় নাড়ে। বলে, ‘সে হবে না। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসবে না। তাছাড়া মার শরীর যদি সত্যিই খুব খারাপ হয়ে পড়ে, আমিই কি তাঁকে ছেড়ে আসতে পারব! আপনি আমাকে মাপ করুন, আমার ভরসা আর করবেন না। আমি চিরকালের বেইমান–আপনার সঙ্গেও বেইমানী করে গেলুম–কিন্তু থাকা আর সম্ভব নয় এখানে ওরে যজ্ঞেশ্বর, একটু হেঁকে চলে বাবা। আর মোটে সময় নেই। আচ্ছা আসি। শরীরের যত্ন নেবেন। চলে গেছি জানলে মেয়েরা আসবে নিশ্চয়ই, তাদেরই কাউকে আনিয়ে নেবেন!’
ডাক্তারবাবু আর কথা কইলেন না, সঙ্গে গেলেনও না আর। সেইখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন। গাড়িখানা শুষ্ক কঠিন তৃণশূন্য মাঠের ওপর দিয়ে এঁকে বেঁকে চলতে চলতে একসময় তাঁর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল, কিন্তু তিনি তেমনি সেই প্রখর রৌদ্রের মধ্যে একভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন, বহুক্ষণ পর্যন্ত বাড়ি ফেরার কথাও মনে রইল না তাঁর।