১৫. সন্ধের পর থেকেই

পনেরো

সন্ধের পর থেকেই আসতে শুরু করেছিল সবাই। ইউনিভার্সিটিতে চিরকাল যার লেটলতিফ বলে বদনাম ছিল, সেই সংঘমিত্রাই এল প্রথমে। বর ছাড়াই। বর গেছে অফিস ট্যুরে। সংঘমিত্রার পিছু পিছু চিনিদি আর বাদা। চিনিদিরা কাল গোটা রবিবার দীর্ঘ আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, বিবাহবার্ষিকীর আসরে গজা-নিমকি বেমানান, তাই ছেলেমেয়ে দুজনেই বাদ। তথাগত, কণাদ আর সুকন্যা আবির্ভূত হল একযোগে। উপহার কিনতে তিনজনে মিলেছিল গড়িয়াহাটে। অনসূয়াকে ডাকলে অফিসে আরও অনেক সিনিয়ারকে বলতে হয়, দেয়া তাই ক্রোড়পত্র বিভাগের শুধু জয়শ্রীকেই নেমন্তন্ন করেছে। সুইজারল্যান্ড বর প্রতিমকে নিয়ে সেও জলদি জলদি হাজির।

বাকিরাও এল পর পর। সব শেষে দেবাশিস আর সুস্মিতা। দেবাশিস নদিয়ার এক কলেজে পড়ায়, শেয়ালদা মেন লাইন ধরে তার যাতায়াত, আজ নাকি কোনও এক স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যের জেরে ট্রেন অবরোধ ছিল কাঁকিনাড়ায়, ফলত বাড়ি ফিরতে দেরি হয়েছে দেবাশিসের। আজকাল নাকি এমনই সব তুচ্ছ কারণে ট্রেন আটকে দিচ্ছে। গত সপ্তাহে ব্যারাকপুরের নিত্যযাত্রীরা ট্রেনে বসে তাস খেলার জায়গা পায়নি বলে গাড়ি আটকে দিয়েছিল। খানিকক্ষণ জোর হাসাহাসি চলল এই অবরোধ নিয়ে, প্রাণ ভরে চেঁচিয়ে গলা সাফ করে নিল অভ্যাগতরা।

আটটার মধ্যেই দেয়াদের ফ্ল্যাট জমজমাট।

ড্রয়িংহলের সোফা টেবিল সরানো হয়েছে আজ। জায়গা বাড়ানোর জন্য ঠেলে দেওয়া হয়েছে দেওয়ালে। দুপুর দুপুর চলে এসেছিল মহুয়া। দেয়া, শিউলি আর মহুয়া মিলে দিব্যি সাজিয়েছে ঘরখানা। জানলায় নতুন পরদা, ঘরের কোণে বড় বড় ফুলদানিতে গোছা গোছা রজনীগন্ধা, ফ্রিজের মাথায় ফুল, ক্ৰকারি কেসের মাথায় ফুল…। পুষ্পশোভিত ঘরের সোফায় কার্পেটে ডিভানে মোড়ায় এখন অবিরাম কলকল কলকল।

তথাগত ছটফট করছিল একটু। আজ তার নাইট ডিউটি, এখান থেকে অফিস ছুটবে। ঘড়ি দেখছে ঘনঘন। দেয়াকে সামনে পেয়ে খপ করে ধরল, দেয়া…এই…আমাকে তো এবার উঠতে হয় রে।

যাবি কী রে? খেয়ে যা।..আর দশ মিনিট। কেক কেটেই ডিনার সার্ভ করব।

—অশেষদাকে তো জানিস, হেভি খচে যাবে।

—কিচ্ছু হবে না, বোস তো।…আইসক্রিমটা আসুক। কেন যে এত দেরি করছে!

—আমায় যা হয় একটা কিছু দিয়ে দে। তথাগত চুলে আঙুল চালাল, আইসক্রিম লাগবে না। পরে একটা ভাউচার করে দেব, পেমেন্ট করে দিস।

—ঠিক আছে, দাঁড়া।

দেয়া রান্নাঘরে ছুটল। সে আজ পক্ষিণীর মতো উড়ে বেড়াচ্ছে ফ্ল্যাটময়। আজ সে পরেছে গাঢ় নীল বালুচরি শাড়ি, সূক্ষ্ম সুতোর কাজে পাড়ে আঁচলে কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ। বিয়েতে গয়না ছাড়াও এ শাড়িটা প্রেজেন্ট করেছিল কাকা। শাড়িটা দেয়ার ভারী প্রিয়। সকালে বিউটিপার্লার থেকে সে আজ ফেসিয়াল করে এসেছে, তার মোমমসৃণ মুখমণ্ডলে এখন যেন এক আলাদা ঔজ্জ্বল্য। বাহারি খোঁপা বেঁধেছে চুলে, জুঁইফুলের মালা জড়িয়েছে খোঁপায়। কপালে টিপ, আঁখিতে তুলির টান, গালে রক্তিম আভা, রঞ্জিত ওষ্ঠাধর। সৌম্য এ বছর তাকে মুক্তোর সেট উপহার দিয়েছে, তার কানে গলায় হাতে আঙুলে ফুটে আছে সাগরসেঁচা মুক্তোদানা। দেয়া যেন আজ অপরূপ এক মরালী।

মহুয়া রান্নাঘরে নেই। আজ আহার বিতরণের ঝক্কিঝামেলা স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নিয়েছে মহুয়া, খাওয়া দাওয়ার পাট শুরু হয়নি বলে সেও একটু নেচেকুঁদে বেড়াচ্ছে। লক্ষ্মী, শিউলি এখন পাকশালার পাহারাদার।

শাড়ি বাঁচিয়ে তথাগতর জন্য প্লেট সাজিয়ে নিল দেয়া। শিউলিকে বলল, জল নিয়ে আয় আমার সঙ্গে।

এত লোকের সমাগমে শিউলি যেন সামান্য জবুথবু। জলভরা গ্লাস টেবিলে রেখে সেঁধিয়ে গেল যথাস্থানে।

টেরিয়ে তাকাল তথাগত, সেই মেয়েটা?

দেয়া ঘাড় দোলাল।

—জম্পেশ ড্রেস মেরেছে তো!

হ্যাঁ, উৎসাহ ভরে শিউলিও আজ সেজেছে খুব। পরনে ঝকঝকে লাল-হলুদ সালোয়ার কামিজ, কপালে রুপোলি টিপ, চুলে ঝিকঝিকে ক্লিপ, কানে ঝোলা দুল, হাতে কাচের চুড়ি, গলায় পুতির মালা। দেয়ার কিনে দেওয়া লিপস্টিকটাও লাগিয়েছে ঠোঁটে, নখে গোলাপি নেলপালিশ। সব মিলিয়ে একটু যেন চড়া-ই।

সন্তুর হাতে মদিরার গ্লাস। আজকের অনুষ্ঠানের জন্য অল্পস্বল্প সুরার আয়োজন রেখেছে সৌম্য। হুইস্কি আর ভদকা। রাখতে হয়। রেওয়াজ নিমন্ত্রিতরা কেউই তেমন পানাসক্ত নয়, তবে অবরে সবরে প্রায় সকলেই খায়। সন্তু তো রীতিমতো ভালবাসে, বোনের বিবাহবার্ষিকীর দিন তো তার রঙিন হওয়া চাই-ই।

তৃতীয় পেগ চলছে সন্তুর। হাত নেড়ে ডাকছে দেয়াকে, কী রে মিমি, কী করছিস? তোরা এবার কেকটা কাট।

হইহই করে কেক এসে গেছে টেবিলে। চকোলেটের হৃৎপিণ্ড, দুখানা ক্রিমমাখা তির বিঁধে আছে তাতে। বোন-ভগ্নিপতির জন্য সন্তু স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে।

সৌম্য বাদার সঙ্গে কথা বলছিল। তাকে প্রায় হিড়হিড় করে টেনে আনল পিয়ালি আর মহুয়া। দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দেয়ার পাশে। অত নিপুণ সাজসজ্জা সত্ত্বেও অনিন্দ্যকান্তি সৌম্যর পাশে দেয়া যেন পলকে দ্যুতিহীন। অথচ সৌম্য আজ কিছুই সাজেনি, সাধারণ আলিগড়ি পাজামা আর লম্বা ডোরা পাঠান-পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রংটাও ম্যাড়মেড়ে, কেমন মেটে মেটে। শুধু সৌম্য পরার কারণেই বুঝি উজ্জ্বল লাগছে রংটাকে।

দেবাশিসেরও হাতে গ্লাস। সে ফস করে বলল, আর দু-পাঁচ মিনিট দেখলে হত না? ঋতমরা এসে গেলে নয় কেক কাটতিস।

সংঘমিত্রা বলল, ও পাগল আর এসেছে! দ্যাখ গে যা, কোথায় সাহিত্যসভা করে বেড়াচ্ছে!

দেয়ার বুকটা থমথম করে উঠল। ঋতম কি রাগ করে আসবেই না? উঁহু, আসবে আসবে। ঋতম দেয়ার ওপর রাগ করতেই পারে না।

সৌম্যর হাতে একখানা লম্বা ছুরি ধরিয়ে দিয়েছে মহুয়া। সুকন্যা দেয়ার হাত সৌম্যর হাতের ওপর চাপিয়ে দিল—নে, এবার দুজনে মিলে হৃদয়টাকে খণ্ড খণ্ড করে ফেল।

কেক কাটতেই হর্ষধ্বনি। সৌম্য একটুকরো কলজে খাইয়ে দিল দেয়াকে। দেয়াও হৃদয়ের ভগ্নাংশ দিয়েছে সৌম্যর মুখে। গ্লাসে গ্লাসে ঝংকার বেজে উঠল, চিয়ার্স।

ফের হাসিঠাট্টা শুরু। রঙ্গরসিকতা চলছে তো চলছেই।

পিয়ালি খেপাচ্ছে সৌম্যকে—এই, তোমাদের ক্রস কানেকশানের রহস্যটা কী ছিল বলো তো?

সৌম্য মুচকি হাসল, জেনে তুমি কী করবে?

—আমারই তো দরকার। বুড়ি হতে চললাম, এখনও বর জুটল না। টেকনিকটা বলে দিলে ফোন কোলে করে বসে থাকব।

প্রতিম টিপ্পনি কাটল, সমস্ত ক্রস কানেকশানগুলো ওপরঅলা ঠিক করে রাখে ম্যাডাম। যার যখন লাগার ঠিক লেগে যায়।

সুকন্যা চোখ ঘোরাল, আপনাদেরও ক্রস কানেকশান নাকি?

জয়শ্রী বলল, মোটেই না। আমাদের একেবারে ডাইরেক্ট। ছাঁদনাতলায় দুজনে দুজনকে প্রথম দেখেছি। নাপিতের খেউড় শুনতে শুনতে।

—তাহলে ডাইরেক্ট বলিস না। বল, কানেকশান থ্রু বাবা মা।

কণাদ অনুসন্ধিৎসু হয়েছে। যেন অন্ততদন্ত শুরু করছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ব্যাপারটা ভাল করে খুলে বল তো দেয়া। তোদের ক্রস কানেকশানটা ঠিক কীভাবে হয়েছিল? কবে হয়েছিল?

দেয়া হেসে বলল, তখন আমার বি.এ সেকেন্ড ইয়ার…

—কোখেকে কোথায় ফোন করছিলি?

—বাড়ি থেকেই ফোন করছিলাম। ওই তো, চিনিদিকে।

চিনির হাতে ভদকা। বলে উঠল, হ্যাঁ। আমি একটা কাজের কথা বলছি, হঠাৎ মাঝখানে হেঁড়ে গলা! সমানে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে!

—আপনি কি তখন জানতেন, ওটা সৌম্য?

—ওমা, তখন জানব কী করে? আমি তো রেগেমেগে ধেৎতেরি বলে ফোন রেখে দিয়েছিলাম।

—কিন্তু দেয়া নামিয়ে রাখেনি, তাই তো?

সৌম্য ফুট কাটল, —যদি নামিয়ে রাখত তাহলে কি তোমরা আজ এখানে আসতে পারতে?

বাচ্চু ঢাকাস করে হুইস্কি ঢালল গলায়, —রাইট। রাইট। ইন্টেলিজেন্ট রিপ্লাই।

কণাদ খবরের কাগজের লোক। অত সহজে তাকে দমানো যায় না। চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল, —প্রথম দিন ঠিক কী কী কথা হয়েছিল?

তথাগত চলে যাচ্ছে। মুখ দেখেই বোঝা যায় এমন জমাটি হল্লা ছেড়ে তার যাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। দরজা থেকে সবাইকে হাত নাড়তে নাড়তে বলল, —কণাদকে খবরদার বলিস না দেয়া। ও যা শোনে সব হুঁকোমুখোকে গিয়ে লাগিয়ে দেয়।

দেয়া তথাগতকে একটু এগিয়ে দিয়ে এসে বলল, —সেদিন আমাদের তেমন কোনও কথাই হয়নি রে। জাস্ট আলাপ। সেদিন ও শুধু আমার নাম্বারটা নিয়েছিল।

দেবাশিস সুস্মিতার বিয়ে হয়েছে সবে এই ফাল্গনে। সুস্মিতা রীতিমতো কৌতুহলী হয়ে পড়েছে, —ওমা, এটা জানতাম না তো! ক্রস কানেকশানে প্রেম? তোমাদের দেখা হল কবে?

—সে অনেক পর। তখন আমার পার্টওয়ান দেওয়া হয়ে গেছে। ফোনমিতালি করে করে আমিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একদিন স্ট্রেট বললাম, দেখা দাও।

সুকন্যা চোখ পাকাল, —কেন রে? তোর কি মনে হয়েছিল সৌম্য কানা খোঁড়া?

—হতেই পারে। সন্দেহ আসতেই পারে। শুধু ফোন করে যায়, দর্শন দিতে চায় না…

—দেখার পরে সৌম্যর রূপের ছটায় বিগলিত হয়ে গেলি তো?

—শুধু রূপ নয়। গুণের ছটাও দেখেছিলাম।…বলব সৌম্য? বলি?

—বলো।

—জানিস তো, প্রথম দিন দুজনের জন্য দুখানা ফিশফ্রাই নিয়েছে…ওমা, দাম দেওয়ার সময়ে পকেট থেকে একটার দাম বার করে দিল!

—কেন? কেন? কেন?

—যদি সম্পর্কটা মেটিরিয়ালাইজ না করে, ব্যাড ইন্‌ভেস্টমেন্ট হয়ে যাবে না?

হাসির ফোয়ারা ছুটেছে ঘরে। হাহা হাসি। হিহি হাসি। হুহু হাসি।

মহুয়া কেক নিয়ে রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে হাঁক পাড়ল, —এই মিমি, এবার ডিনার সার্ভ করি? আইসক্রিমও তো এসে গেল।

সন্তু হাঁ হাঁ করে উঠল, —এখনই কী? আগে গ্লাস শেষ হোক।

—তারপর বলবি বোতল শেষ হোক! চিনি গলা ওঠাল, —না রে মহুয়া, দিয়ে দে। তোদের বাচ্চুদা এর পর আর গাড়ি চালাতে পারবে না।

মহুয়ার তোড়জোড় সারা। প্লেটে খাবার সাজিয়ে মাইক্রোওভেনে গরম করছে, আর একটা একটা করে শিউলির হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যাদের হাতে মদিরা নেই, তারা আগে খাওয়া শুরু করল।

বার বার আনাগোনা করছে শিউলি। এতক্ষণ সে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল, হাসি মশকরার মাঝে কেউ তাকে সেভাবে খেয়াল করেনি। এখন তাকে দেখে অনেকেরই চিত্তচাঞ্চল্য ঘটছে।

চিনিই বলে উঠল, —মেয়েটা বেশ গেঁড়ে বসেছে দেখছি!

দেয়া কোল্ডড্রিঙ্কস খাচ্ছিল। মুখটা করুণ করে বলল, —কী করি বললা? এমন হ্যাপলেস সিচুয়েশানে তো মেয়েটাকে ফেলে দিতে পারি না।

সন্তুর মুখ অপ্রসন্ন। দুম করে বলল, —কী কুৎসিত সাজপোশাক করে ঘুরছে, অ্যাঁ! মেয়েটাকে আগে দেখিনি। এই প্রথম। দেখেই বোঝা যায় একেবারে ওই ক্লাস!

দেয়া প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুকন্যার মন্তব্য, —ওকে দোষ দেওয়া যায় না। বেশ কিছুদিন যৌনকর্মীদের মধ্যে ছিল, তার একটা না একটা ইনফ্লুয়েন্স তো পড়বেই।

—ছিল তো শুনেছি দশ পনেরো দিন। তাতেই এই?

—দশ পনেরো দিন অনেকটাই সময় দাদা। প্রদর্শনকামিতা মানুষের একটা ইনার ডিজিজ। সেক্সওয়াকারদের এটা স্বাভাবিক কারণেই খুব বেশি থাকে। মেয়েটা একটু কিছু তো তাদের কাছ থেকে আনবেই। সেক্সওয়াকারদের অসুখটা আনেনি, এই যথেষ্ট।

জয়শ্রী আপত্তি জানাল, —কী তখন থেকে বাজে বাজে টার্ম ইউজ করছিস? কীসের ওয়ার্কার ওরা? ওটা কি একটা কাজ নাকি?

—অবশ্যই কাজ। শ্রমের বিনিময়ে রোজগার। ওটাও তো একটা পেশা। প্রফেশান।

—সরি ভাই। মানতে পারলাম না। সংঘমিত্রা নাক গলাল, —প্রফেশান শব্দটার বাংলা হল বৃত্তি। বেশ্যাবৃত্তি প্রফেশান হলে চৌর্যবৃত্তিও তো তাহলে প্রফেশান। অতি আদিম পেশা। সম্ভবত গণিকাবৃত্তির চেয়েও প্রাচীন। চোরদের কি আমরা তাহলে লিফ্টওয়ার্কার বলব? নাকি চৌর্যকর্মী?

জয়শ্রী বলল, —শ্রম আবার কী? কীসের শ্রম? কিছু পারভার্ট লোক একদল মেয়েকে ইউজ করছে…তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে…এখানে শ্রম শব্দটাই বা আসে কী হিসেবে?

—সব সময়ে তো ইচ্ছের বিরুদ্ধে নয় ভাই! বাচ্চু ঠকাস করে টেবিলে গ্লাস রেখেছে, —আমি অনেক মেয়ের কাহিনী জানি যারা স্বেচ্ছায় এ লাইনে এসেছে। শখ করে কত মেয়ে এটাকে পেশা করে জানো?

—না বাচ্চুদা, আপনি ঠিক বলছেন না। দেয়াও সরব হল এবার, —পৃথিবীর কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে স্বেচ্ছায় এই পেশায় আসে না। হয় তারা বাধ্য হয়ে আসে, নয় পেট চালানোর আর কোনও উপায় না পেয়ে আসে।

—কেউ স্বেচ্ছায় আসে না বলতে চাও? শরীরটাকে ইউজ করে কত মেয়ে কত সুবিধে নিচ্ছে। তাদের তুমি কী বলবে?

—তারা কি জেনারেল রুলে পড়ে বাচ্চুদা? তাদের শ্রমিক বলা হবে কি হবে না, এ নিয়ে আলোচনাও তো অবান্তর। যেমন ধরুন, সমাজের নানান স্তরের মানুষ নানানভাবে চুরি করছে। কেউ ব্যাংকের টাকা মারছে, কেউ শ্রমিকের সঞ্চয় চুরি করছে, কেউ ঘুষ নিয়ে পেট মোটা করছে, কেউ জনগণের টাকা আত্মসাৎ করছে…। কিন্তু চোর বলতে বোদা বাংলায় আমরা যা বুঝি, তাদের কি আমরা সেই শ্রেণীতে ফেলি? মুখে চোর বললেও ঠিক ওই ক্লাসে ফেলি না। কেন ফেলি না? কারণ চুরি না করেও এদের বেঁচে থাকার অপ্‌শন আছে। ঠিক সেইরকমই, যে মেয়েদের অন্যভাবে বাঁচার উপায় আছে, তারা যদি শুধু স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রস্টিটিউশন করে, তাদের আমরা কখনই ট্রু সেন্সে গণিকা বলতে পারি না। এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলিও না। এই দুই শ্রেণীর লোকই সমাজে দাপটে ঘুরতে পারে। নয় কি?

—তার মানে এটুকু অন্তত মেনে নিচ্ছিস, যারা বাধ্য হয়ে ওই প্রফেশানে যায়, তাদের সেক্সওয়াকার বলা যায়?

—এই, বেশি ফড়ফড় করিস না তো। কণাদ দু পেগেই সামান্য টিপ্‌সি। সে প্রায় ধমকে উঠল সুকন্যাকে, —ভুলভাল বকছিস কেন? সেক্স ইজ নেভার এ ওয়ার্ক। ইটস অ্যান অ্যাক্ট। ক্রিয়া। খাওয়াটাকে যেমন শ্রম বলা যাবে না, পটি করাটাকেও যেমন শ্রম বলে না, অবশ্য আমি পাইল,স রুগিদের কথা বলছি না…তেমনই সেক্সঅ্যাক্টকেও কখনই শ্রম বলা যায় না।

—বিলকুল সহি বাত। দেবাশিস মাথা দোলাচ্ছে। প্লেট কোলে ধরে ক্লাসে লেকচার দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, —মৈথুন হল সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার অবশ্যম্ভাবী প্রসেস। ব্যক্তিগত সুখ সেখানে উপরি পাওয়া। ওটুকু না থাকলে রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমে নারীপুরুষ আকৃষ্ট হবে কেন?..আরও ভালভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। আজ যদি দুনিয়ার সমস্ত শ্রমিক কাজকর্ম বন্ধ করে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে, তাহলে কিন্তু সৃষ্টি নষ্ট হবে না। যদি আহার নিদ্রা মৈথুন সুষ্ঠুভাবে চলে। যেমন জীবজন্তুদের বেলায় হয়। পোকামাকড়দের ক্ষেত্রে হয়। যদি তারা বসে বসেই আহার জোগাড় করতে পারত, তাহলে তারা শ্রম করতই না। কিন্তু তার বিপরীতটা সত্যি নয়। যতই শ্ৰম করি না কেন, আহার মৈথুন বিনা সৃষ্টির অস্তিত্ব থাকবে না। কাজ আর ক্রিয়ার মধ্যে এইটাই তফাত। একটা হল চাহিদার প্রয়োজনে, অন্যটা প্রাকৃতিক নিয়মে। সুতরাং বেশ্যাবৃত্তিকে কখনই শ্রমের পায়ে ফেলা যায় না।

—কিন্তু তারা তো এটা দিয়েই জীবিকা চালাচ্ছে! রোজগার করছে! সুকন্যাও ছাড়ার পাত্রী নয়, —এবং তারা কোনও সুখ তৃপ্তির জন্যও করছে না। তাহলে এটাকে শ্রম বলবেন না কেন?

—আপনার প্রশ্নের মধ্যেই আপনার উত্তর রয়েছে। আপনি এক্ষুনি বললেন, তারা কাজটা কোনও প্রজনন প্রক্রিয়ার জন্য করছে না। কোনও সুখ তৃপ্তির জন্যও না। এক ভালবাসার কারণেও নয়। দৈবাৎ তাদের বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেলেও সেটা এই পেশার শর্তবিরোধী। অর্থাৎ ওই মেয়েরা প্রাকৃতিক নিয়মের বিরোধিতা করছে। অথবা বলতে পারেন তাদের প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে চলতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটা একটা বলপূর্বক তৈরি করা পরিস্থিতি। এবং কৃত্রিম। পুরুষতান্ত্রিক সমাজই এটা নির্মাণ করেছে। নিজের ফুর্তির জন্য। সামাজিক নিয়ম যৌনঅনুশাসনকে যেভাবে বেঁধে দিয়েছে, তার বাইরে গিয়েও পুরুষ যাতে সুখ খুঁজতে পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এখানে মেয়েদের কিস্যু ভূমিকা নেই। কেন তাদের এখানে শ্রমিক ভাবা হবে? শ্রমিক টমিক নয়, নিছক মেয়ে হিসেবেই তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে।

কণাদ বলল, —যেমন ধর, চিড়িয়াখানার জীবজন্তু। আমরা পয়সা দিয়ে চিড়িয়াখানায় ঢুকছি, বাঘসিংহ দেখে এক ধরনের আনন্দ পাচ্ছি, আমাদের দেওয়া পয়সায় বাঘসিংহের পেট চলছে। তার মানে কি এই, আমাদের দৃষ্টিসুখ দেওয়াটাই বাঘের পেশা? বরং বলতে পারি, বাঘটাকে আমরা খাঁচায় পুরে অতি স্কুল কারণে এক্সপ্লয়েট করছি। কেন যে তোরা মূল জায়গাটায় না গিয়ে সিস্টেমটার গায়ে একটা সামাজিক অধিকারের নামাবলি চাপাতে চাইছিস? কেনই বা এমন কেতাবি শব্দ? সেক্সওয়ার্কার! যৌনকর্মী!…এই যে মেয়েটা, যাকে দেয়া এনে রেখেছে…মেয়েটা যদি পালিয়ে আসতে না পারত, তাহলে ওকে যেটা করতে হত তা হল যৌনদাসত্ব। নয় কি?

ঘরের তরল আবহাওয়া কেমন যেন ঘনীভূত হয়ে গেছে। খাচ্ছে সবাই, বিরিয়ানির মটন ছিড়ছে, ফিশ ব্যাটারফ্রাই-এ কামড় দিচ্ছে, শুধু একটু আগের খুশি খুশি ভাবটা যেন কোথায় উধাও। সন্তু সহসা ভীষণ গম্ভীর। সৌম্যর কপালে বিরক্তির ভাঁজ। এতক্ষণ ধরে সুরা ছোঁয়নি সৌম্য, হঠাৎই উঠে গিয়ে হুইস্কি ঢালল গ্লাসে। জল না মিশিয়েই চুমুক দিল, বিকৃত হয়ে গেছে মুখ।।

সৌম্যকে নজরে পড়েছে দেয়ার। বুঝতে পারল আলোচনাটা পছন্দ হচ্ছে না সৌম্যর। দাদাও যেন ঠিক পরিপাক করতে পারছে না কথাগুলোকে। সম্ভবত বোনের বন্ধুদের মুখ থেকে এ ধরনের কথা শোনার জন্য সে প্রস্তুত নয়।

দেয়া পরিবেশটাকে সহজ করতে চাইল। দেবাশিসকে বলল, —কী রে, শুধু বক্তৃতা দিলেই হবে? খা ভাল করে। তোকে আর একটা ব্যাটারফ্লাই দিই?…এই সুস্মিতা, তুমি আর একটু বিরিয়ানি নাও।

সুস্মিতা আঁতকে উঠল, —ওরে বাবা না, একটুও না। যা দিয়েছ তাই বলে শেষ করতে পারছি না।

মহুয়া নিজের প্লেট নিয়ে বসে গিয়েছিল। চেঁচিয়ে বলল, —এই শিউলি, আমায় এক গ্লাস জল দিয়ে যাও তো।

এমন একটা মুহুর্তে আবার শিউলি?

দেয়া প্রমাদ গুনল। নিজেই জল আনতে যাবে কিনা ভাবছে, তার আগেই রঙ্গমঞ্চে শিউলির প্রবেশ। দুপুর থেকে মহুয়ার পায়ে পায়ে ঘুরছে, মহুয়ার কাছে সে এখন অনেকটাই অনাড়ষ্ট। সহজ গলায় বলল, —বউদি, লক্ষ্মীমাসি জিজ্ঞেস করছে এবার কি আইসক্রিম দেব?

—একটু পরে দিস। আমি বলব।

সৌম্য ক্রুদ্ধ চোখে দেখছে শিউলিকে। দেয়া লক্ষ করল।

পিয়ালির খাওয়া শেষ, আঙুল চাটছে। দেয়া তড়িঘড়ি বলে উঠল, —অ্যাই, ওই দিদির প্লেটটা নিয়ে যা। হাড়গোড়গুলো বালতিতে ফেলবি।

এবার শুধু সৌম্য নয়, ঘরসুদ্ধ সকলের দৃষ্টি অনুসরণ করছে শিউলিকে। ভোজনের মাঝে নেমে এসেছে এক অস্বস্তিকর নীরবতা।

কথা বলার জন্য কথা খুঁজল দেয়া। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, —দেখলি তো, ঋতমটা শেষ পর্যন্ত এলই না!

কেন ঋতমকেই এখন মনে পড়ল দেয়ার? তার অবচেতন কি তাকে বলে দিল, ঋতম থাকলে পরিবেশটা অনেক স্বাভাবিক থাকত আজ?

চিকেন চাপের মাংস আর হাড় পরিপাটি ভাবে পৃথক করছিল সংঘমিত্রা। হালকাভাবে বলল, —পাগলা ভুলে মেরে দিয়েছে।

দেবাশিস বলল, —উঁহু, ও নেমন্তন্ন ভোলার পাত্র নয়। খাওয়ার গন্ধ পেলে…অন্য কিছু হয়েছে।

—দ্যাখ হয়তো কোনও বন্ধুর সঙ্গে বলকাতা ছেড়ে ফুড়ুৎ। মনে আছে, সেবার কী ভাবে কাঁকড়াঝোড় চলে গিয়েছিল?

—সত্যি, কী বেআক্কেলে কাজটাই না করেছিল! পিয়ালির চোখ বড় বড়, —মাসিমাকে পর্যন্ত বলে যায়নি! কফি হাউসে কে নাচাল, তক্ষুনি ফুড়ৎ! বেচারা মাসিমা একবার একে ফোন করছেন, একবার তাকে ফোন করছেন…

—ও আর এখন অত বোহেমিয়ান নেই। বিয়ে থা করেছে, বাচ্চা হয়েছে…দ্যাখ আবার বাচ্চাটার শরীর টরির খারাপ হল কিনা!

—অ্যাই দেয়া, ওকে একটা ফোন কর না।

দেয়া গোমড়া মুখে বলল, —আমি কেন করব? তেমন কিছু হয়ে থাকলে ওই তো জানাতে পারত।

সৌম্য চকিতে উঠে গেল বাথরুমে। ফিরে এসে খানিকটা তফাতে বসেছে। আবার একটু হুইস্কি ঢালল গ্লাসে।

মহুয়া বলল, —অ্যাই সৌম্য, আবার ড্রিঙ্কস নিচ্ছ কেন? এবার খেয়ে নাও।

ঘড়ঘড়ে গলায় সৌম্য বলল, —খাব। আর একটু পরে।

দেয়া ঢোঁক গিলে বলল, —বুঝছিস না, ও আজ হোস্ট! আগে খেয়ে নিলে যদি তোরা ওর নিন্দে করিস?

দেবাশিস বলল, —লজ্জা পেয়ো না। অনেকক্ষণ আমাদের অ্যাটেন্ড করেছ…

বাচ্চু বলল, —সেই টায়ার্ডনেসটাই তো কাটাচ্ছে সৌম্য। গায়ের ব্যথা মারছে। বলেই চোখ টিপল, —রাত্তিরবেলা ফিট থাকতে হবে না?

সামান্য ভদ্‌কার প্রভাবেই চিনির মুখ আলগা। বলল, —বেশি গিললে কিন্তু সব মাটি। একদম কোলবালিশ হয়ে পড়ে থাকবে।

হাসির লহর ফিরেছে ঘরে। গুমোট হাওয়া আবার ছন্দোময়। অনেকেরই আহার শেষ, বাথরুম থেকে হাত মুখ ধুয়ে আসছে।

খাবার ঘেঁটে ঘেঁটে মহুয়ার আর তেমন খাদ্যে রুচি নেই, অর্ধেক খেয়ে দৌড়ল রান্নাঘরে। শিউলির হাতে আইসক্রিমের ট্রে চাপিয়ে ফিরেছে।

বাচ্চু নাক কুঁচকোল, —কী যে তোমাদের আজকাল আইসক্রিমের ফ্যাশান হয়েছে…! নেমন্তন্ন বাড়িতে রসগোল্লা করতে কী হয়?

চিনি চোখ পাকাল, —তুমি রসগোল্লার নাম করো কী করে? তোমার না আড়াইশো সুগার!

—বা রে, আইসক্রিম যেন মিষ্টি নয়!

—তুমি আইসক্রিমও ছোঁবে না। চিনি ফতোয়া জারি করে দিল, —মহুয়া, তোর বাচ্চুদার আইসক্রিমটা আমায় দে। আমি দুটো খাব।

—এ কী অন্যায় কথা! সুগার কি আমার আজ থেকে? বিয়ের পর থেকেই তো আমার চিনির রোগ ধরেছে!

বাচ্চুর রসিকতায় ঘর জুড়ে করতালি। সন্তুও হো হো হাসছে। সৌম্যর মুখের কাঠিন্যও যেন শিথিল হল। দেয়া নিশ্চিন্ত বোধ করছিল।

তখনই আবার ফিরে এল অপ্রিয় প্রসঙ্গটা। একটু ভিন্ন সুরে।

তর্কে যুত করতে না পেরে অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিল সুকন্যা। ট্রে থেকে আইসক্রিম নিয়ে ভাল করে জরিপ করল শিউলিকে।

কণাদকে বলল, —একটা জিনিস ভেবে দেখেছিস?

কণাদ ডে-শিফ্‌ট সেরে এসেছে, তার পেটে রাক্ষসের খিদে। শেষ পাতে আরও দুটো ব্যাটারফ্রাই নিয়ে এসেছিল, চিবোচ্ছে কচকচ। মুখ হাঁ করে বলল, —কী?

—এই যে মেয়েটা…দেয়ার কাছে শেল্‌টার পেয়েছে, ইটস ওয়েল অ্যান্ড গুড। এর জন্য দেয়ার সাহস উদারতা, সবেরই প্রশংসা করতে হয়। কিন্তু…। সুকন্যা একটু থমকাল। সামান্য ভেবে নিয়ে বলল, —ধর যদি প্রফেশানটার একটা সামাজিক স্বীকৃতি থাকত, আমরা যদি পেশাটাকে নাক কুঁচকে না দেখতাম…তাহলে দেয়ার আর দয়া দেখানোরও দরকার হত না। মেয়েটাও হয়তো এই পেশাতেই দু মুঠো অন্ন উপার্জন করে নিতে পারত। অফকোর্স আমি মানছি, মেয়েটাকে প্রতারণা করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মুম্বইতে ওর ওপর খুব টর্চারও করা হয়েছে…। ইনফ্যাক্ট, ব্রথেলগুলো তো এক একটা নরক। গুণ্ডা, বদমাশ, পুলিশ, দালাল, মাসি, এদের অত্যাচারে মেয়েগুলো একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। পেশাটা লিগালাইজড হয়ে গেলে এদের উপদ্রব তো বন্ধ হত। মেয়েগুলোকেও আর এত আতঙ্কিত থাকতে হত না। ওরা খোলা মনে ডিটারমাইন করত কোন খদ্দেরকে ওরা এন্টারটেন করবে, কোনও খদ্দেরকে ঢুকতেই দেবে না।

কণাদ চোখ পিটপিট করল, —এই…কী বলছিস তুই? তুই পাগল, না আমি পাগল? আমি.কি ঠিক শুনছি? যা বলছিস তার মানে বুঝিস?

—অবশ্যই বুঝি। আজ যদি প্রফেশানটার আইনি প্রোটেকশান থাকত, তাহলে ওই শিউলিকে ওরকম ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়তেই হত না।

—অর্থাৎ একটা সামাজিক দূরাচারকে আপনি আইনি স্বীকৃতি দিতে বলছেন? দেবাশিস আইসক্রিম খাওয়া বন্ধ করে ফের তর্কে প্রস্তুত।

সুকন্যা বলল, —দূরাচারই বলুন, আর যাই বলুন, যদ্দিন পুরুষতন্ত্র থাকবে, এ পেশাটাও ততদিনই বহাল থাকবে। এটা আপনারই কথা। মেয়েদের দুর্গতি কমানোর জন্যই তো স্বীকৃতিটার প্রয়োজন।

—বুঝলাম না।

—না বোঝার কী আছে? পুরুষতন্ত্র তো চাইলেই উঠিয়ে দেওয়া যাবে না। এবং পুরুষতন্ত্র থাকলে ওই প্রফেশানটাও থাকবে। তাই যদি হয়, তাহলে বেচারা মেয়েগুলোকে প্রোটেকশান দিতে আপনার আপত্তি কীসের? তাদের নিজেদের কিছু কিছু মৌলিক অধিকার থাকবে, তাদের ছেলেমেয়েরা সসম্মানে বড় হবে…

কথাটা যেন সংঘমিত্রার মনে ধরেছে এবার। বলল, —এটা অবশ্য একটা ভাবার কথা বটে। এতে যদি মেয়েগুলোর নরকযন্ত্রণা কিছুটাও লাঘব হয়…

—দাঁড়া দাঁড়া। সেন্টিমেন্টে গলে গিয়ে লজিকটাকে গুলিয়ে ফেলিস না। তোদের কথা শুনে মনে হচ্ছে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহনের আন্দোলন করাটাই ভুল হয়েছিল। আহা, বেচারা বউগুলো আগুনে পুড়ে মরছে, তাদের কষ্ট চোখে দেখা যায় না…অতএব মহামান্য হুজুর বাহাদুর, তাদের কষ্ট একটু লাঘব করুন, ওদের বিষ খেয়ে মরার সুবিধেটুকু করে দিন!

কণাদ সায় দিল, —ঠিকই তো। সিস্টেমটাকে অ্যাবোলিশ না করে সিস্টেমটাকে তোরা আরও পাকাপোক্ত করতে চাইছিস!

সুকন্যা রেগে গেল, —কে সিস্টেমটাকে অ্যাবোলিশ করবে? তুই? অত সোজা? আর তুই চেঁচালেই পিতৃতন্ত্র গর্তে ঢুকে যাবে? এই যে জয়শ্রী এত ফুটুর ফুটুর করছে, ওকে মেল ডমিনেশানের কাছে মাথা নোয়াতে হয়নি? ওর তো নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো জোর আছে! জয়শ্রী সামান্যতম প্রতিবাদটুকুও করে দেখাতে পেরেছে? বরং সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে, এমন একটা অ্যারেঞ্জমেন্ট করে নিয়েছে। আমরা তো ওইটুকু ব্যবস্থার কথাই বলছি।

প্রতিমের মুখ লাল। ঝাঁঝাঁলো গলায় বলল, —আপনি ভুল বললেন। জয়শ্রী অশান্তি এড়াতে চায় বলেই ওই পন্থাটা বেছেছে। ও যদি জেদ দেখাত, কে ওকে আটকাতে পারত? আমার মা বাবা? কক্ষনও না। কদিন হয়তো গজগজ করত, তারপর চুপ মেরে যেত। কিংবা হয়তো আমাকেই বউ নিয়ে সেপারেট হতে হত। এর বেশি কী? জয়শ্রী বেসিকালি আপসপন্থী বলেই না…

জয়শ্রী আহত মুখে বলল, —তুই ব্যাড এগ্‌জাম্পল দেখাস না সুকন্যা। সংসার করার জন্য ইগোটাকে সামান্য কমানো, আর দু মুঠো ভাতের জন্য নোংরাতম জীবন বেছে নিতে বাধ্য হওয়া…দুটোতে আকাশ পাতাল ফারাক। ওই মেয়েগুলোর যন্ত্রণা তুই কখনও ফিল করেছিস?

—বুলি কপচাস না। সুকন্যা তাও ফুঁসছে, —তোর ওই মিডল্‌ক্লাস মেন্টালিটি দিয়ে ওদের দুঃখকষ্টকে বিচার করিস না। নবপ্রভাতে জয়েন করার আগে আমি একটা এন জি ওতে ছিলাম, বেশ কয়েকটা ব্রথেলে স্ট্যাটিস্টিকাল সার্ভে করেছি। নিজের চোখে দেখেছি, ওদের আমরা যতটা দুঃখী মনে করি, ওরা কিন্তু মোটেই নিজেদের ততটা দুঃখী ভাবে না। অনেকে বেশ ভালভাবেই আছে। নরমাল ফ্যামিলির মতো তাদের মধ্যেও হাসি কান্না সুখ দুঃখ, কী নেই! ঘরসংসার করছে, বাচ্চা আছে, স্বামী আছে, প্রেমিক আছে…ওদের কাছে নেহাতই ওটা একটা কাজ। দশটা পাঁচটা অফিসের মতো।

—আবার আপনি ভুল কথাটাই বলছেন। দেবাশিস উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে, —আমি আপনাকে আগেই প্রমাণ করে দিয়েছি, দা ভেরি থিং যেটি একটি ব্রথেলের মেয়েকে পারফর্ম করতে হয় তা কোনও কাজ নয়, ক্রিয়া। খিধে থাকুক চাই না থাকুক, একটা মানুষকে দশটা থেকে পাঁচটা মুখ তেতো করে অবিরাম খেয়ে যেতে হবে, এটা কোনও চাকরি হয়? আর ওই মেয়েদের যে আপনি সুখী দেখেছেন, ওটাও আপনার অন্ধত্ব। মানুষের বেসিক নেচারটাই আপনি বোঝেননি। মানুষ যত জঘন্য পরিবেশেই থাকুক না কেন, তার মধ্যেই সে একটু মুক্তির বাতাস খুঁজতে চায়। সেটাকেই আপনি সুখের তকমা দিতে চান? ছি। গাছকে দেখেননি? ঘরে বন্ধ গাছ? কী ভাবে তারা জানলার দিকে ডালপালা বিস্তার করতে চায় লক্ষ করেছেন কখনও? এ সুখ নয়, এটাকে বলে অভিযোেজন। অ্যাডপ্টেশান। ওইভাবে তারা মানিয়ে নেওয়ার রসদ সংগ্রহ করে। যারা পারে না, তারা মরে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়। হয়তো দেয়ার ওই শিউলিরও সেই অবস্থাই হত।

—হ্যাঁ রে, সত্যিই তাই। দেয়া বলতে না চেয়েও বলে ফেলল, —মেয়েটার এখনও কী প্যানিক! ঘুমের মধ্যেও ককিয়ে ককিয়ে ওঠে!

সুকন্যা শুনলই না। গনগনে স্বরে দেবাশিসকে বলল, —তার মানে আপনি কোনও স্পেসিফিক সলিউশন চান না, তাই তো? আপনি চান মেয়েগুলোর কোনও উন্নতি না হোক! একই ভাবে তারা ওপ্রেসড হয়ে যাক!

দেবাশিস হেসে ফেলল, —আপনিই তো বললেন একা কিছুই চেঞ্জ করা যায় না। তার মানে কালেকটিভ ভয়েস দরকার। এখন তো রামমোহন বিদ্যাসাগর আর পাবেন না, সুতরাং মেয়েদেরকেই চাইতে হবে। তারাই এই সিস্টেমটার গোড়া ওপড়াক না। রাষ্ট্রকে যেন ফোর্স করতে পারে এই প্রথা, মাইন্ড ইট প্রথা বলছি, পেশা নয়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

—আশ্চর্য, আপনিই তো বললেন এটা নিশ্চিহ্ন করা যায় না? এটা আদিম পেশা?

—হ্যাঁ আদিম। কিন্তু মানুষের ইতিহাসের থেকে তো আদিম নয়। অনেক কুপ্রথাই তো সমাজে ছিল। কিন্তু চলে আসছে বলে চলতেই থাকবে? হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীতে দাসপ্রথা ছিল, এখন আছে কি? দেবদাসী প্রথাও তো বন্ধ হয়েছে।

—বড় বড় কথা বলে লাভ নেই ভাই। পেটে জ্বালা ধরলে মেয়েরা ওই পথে যেতে বাধ্য হবে। তোমার রাষ্ট্র তাদের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে না।

—পেটের জ্বালায় তো মানুষ চুরিও করে। রাষ্ট্র খেতে দিতে পারে না বলেই করে। চুরিটাও তবে আইনসিদ্ধ হয়ে যাক।

—কী সাংঘাতিক কাণ্ড ভাব! চুরি আইনসিদ্ধ! প্রস্টিটিউশান আইনসিদ্ধ! এ তো একেবারে রামরাজ্য! উঁহুহু, কামরাজ্য। কণাদ খিকখিক হাসছে, —পুলিশ ডিপার্টমেন্টের আশি ভাগ কাজ কমে গেল! বাড়ির দরজায় নেমপ্লেট ঝুলবে, মিস্টার সো অ্যান্ড সো, ডাকাত। যেমন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার লেখা থাকে, সেরকম। গর্বিত বাবা বুক ফুলিয়ে বলবে, আমার মেয়েটা প্রস্টিটিউশান কেরিয়ারে জয়েন করেছে। স্কুল কলেজে নতুন সাবজেক্টও ইন্ট্রোডিউস করতে হবে। হোম সায়েন্সের মতো। মেয়েদের জন্য। না রে সুকন্যা, তোদের আইডিয়াটা কিন্তু খুব রেভলিউশনারি।

সুকন্যা ভয়ানক রেগে গেছে। মুখে আর যুক্তি ফুটছে না। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বাচ্চু হঠাৎ সুকন্যার সমর্থনে মুখর হল, —তোমরা ওকে টিজ করছ কেন বলো তো? ও তো ওই ধরনের লিগালাইজেশানের কথা বলছে না। ও চাইছে যে মেয়েগুলো ওই ব্যবসায় রয়েছে বা থাকতে বাধ্য হয়েছে, তাদের একটু সুস্থভাবে বাঁচার জন্য কিছু কিছু অধিকার দাও।

—মানে ব্যাপারটাকে নরম সরম করে জিইয়ে রাখো! যাতে অন্য অনেক গরিব দেশের মতো সেক্স ট্রাকিস্টদের জন্য ফ্রেশ ট্রেডটা থাকে, অফ্‌কোর্স উইথ্‌ নো হ্যাজার্ডস্‌…

—আহ্‌, ফুট কাটছ কেন? আমাকে বলতে দাও। ওই মেয়েগুলো যে দালাল পুলিশদের হাতে পড়ে পড়ে মার খায়, ওদের বাচ্চাগুলো যে নরমাল লাইফ পায় না…এর তো একটা প্রতিবিধান দরকারই। যতক্ষণ না রাষ্ট্র বড় কিছু করে দেখাতে পারছে, ততক্ষণ তাদের কয়েকটা সুবিধে তো দিক।

—রাষ্ট্র কে দাদা? রাষ্ট্র তো কোনও একটা সলিড ম্যাটার নয়। রাষ্ট্র মানে তো আমি, আপনি, সুকন্যা, সংঘমিত্রা, দেয়া, সৌম্য…। এক কাজ করা যাক না। আমরা যদি সত্যি মেয়েগুলোর ভাল চাই, কেন আমরা তাদের পাঁকেই ফেলে রাখব? ওদের বাচ্চাগুলোর দায়িত্ব তো আমরাই নিতে পারি। প্রত্যেকে যদি একটা করে বাচ্চাকেও স্পনসর করি, বাচ্চাগুলো মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। আর প্রতিটি সক্ষম ফ্যামিলি যদি একটা করে প্রস্টিটিউটকে বাড়িতে রাখে…। যাদের সত্যিই ফিলিং আছে, তারা মেয়েগুলোকে বিয়ে দিয়ে ঘরের বউ করেও রাখতে পারে। আপনি ছেলের বিয়ে দিলেন, কণাদ একজনকে বিয়ে করল, সুকন্যা ভায়ের সঙ্গে একজনের সম্বন্ধ করল…তাহলে তো প্রেজেন্ট প্রবলেমটা অনেকটাই সল্‌ভড হয়ে যায়। আপাতত এভাবেই শুরু করা যাক। আপনারা যারা মেয়েগুলোর জন্য ভাবেন, তাদের তো আপনারা সম্মানের আসনটাও দিতে চাইবেন, না কী? অবশ্য যদি আপনারা হিপোক্রিট না হন। দেয়া তো তাও একটা জেসচার দেখিয়েছে, আপনারাও কিছু করুন। …কী সুকন্যাদেবী, এ লাইনে ভাবলে কেমন হয়?

তড়াক করে উঠে পড়ল সুকন্যা। হনহন দরজার দিকে যাচ্ছে, —আপনাদের সঙ্গে আমার মত মিলবে না। চলি।

দেয়া পিছন পিছন দৌড়ে এল, —এই সুকন্যা, দাঁড়া। চিনিদিরা তো কুঁদঘাট যাবে, তোকে নামিয়ে দেবে।

সুকন্যা দৃকপাত করল না, তরতর নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে।

দেয়া ফিরে এসে বলল, —ত্যাৎ, কোনও মানে হয়? তোরা কেন যে সবাই মিলে ওর পেছনে লাগলি!

কণাদ কাঁধ ঝাঁকাল, —ওই তো নিজে টপিকটা তুলল। বহুৎ হেডস্ট্রং মেয়ে, ওকে একটু ঝাঁকি দেওয়ার দরকার ছিল।

দেবাশিস দেয়াকে বলল, —প্রবলেমটা কী হয়েছে জানিস? মেয়েদেরই একটা সেকশান নির্বোধের মতো পুরুষদের পুতুল হয়ে নাচছে। ভাবছে এটাই বুঝি প্রগতিশীলতা! চিৎকার করে বলতে পারছে না, পুরুষরা ব্রথেলে গেলে তাদের গুলি করে মারা হোক।

—হয়েছে। এবার থাম। দেয়া আড়চোখে সৌম্যকে দেখে নিল। সৌম্যর দৃষ্টি সিলিংফ্যানে, এত তর্কের উত্তেজনা তাকে যেন স্পর্শই করেনি। বেশ সন্দেহজনক! দেয়া নার্ভাসনেস কাটাতে মহুয়াকে বলল, —হ্যাঁ রে, লক্ষ্মীদিদের খেয়ে নিতে বলেছিস তো?

—অনেকক্ষণ। মহুয়া ঘড়ি দেখছে। সন্তুকে ঠেলল, —এই, দশটা বেজে গেছে। এবার আস্তে আস্তে উঠবে তো?

সন্তু সোফায় হেলান দিয়ে। চোখ বুজেই বলল, —হুঁ।

বলল বটে, তবে উঠল না। বসেই আছে। একে একে বিদায় নিচ্ছে সবাই। বাচ্চু বসে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙল আয়েশ করে। পরিতৃপ্ত মুখে বলল, —সন্ধেটা আজ বেশ কাটল মিমি। পান আহার আচ্ছা, সবই এ ওয়ান। তোমার প্রফেসার বন্ধুটার তো জবাব নেই, দারুণ কথা বলে।

চিনি হাসি হাসি মুখে বলল, —তোর কবে যেন একটা লেকচার আছে, তা না মিমি?

—পনেরোই অগাস্ট। সামনের শুক্রবার।

—তোর বক্তৃতার পয়েন্টগুলো আজ তো সব পেয়েই গেলি।

—আমার তো অন্য বিষয় গো। মেয়েদের সামাজিক অবস্থান।

—ওই হল। এখান থেকেই একটু গুছিয়ে গাছিয়ে বলে দিতে পারিস।

চিনিদি মানুষটি ভারী সাদাসিধে। তার সরল উপদেশে মৃদু হাসল দেয়া। দরজা অবধি গিয়ে টা টা করে এল দিদি জামাইবাবুকে। ওপর থেকে শুনতে পেল চিনিদি সিঁড়িতে ধমকাতে ধমকাতে যাচ্ছে বাচ্চুদাকে, ঠিক করে নামো। টলছ কেন?

মহুয়া ব্যাগ গুছোচ্ছে। বলল, —তোদের কিন্তু অনেক খাবার বেঁচেছে মিমি।

—মা বাবার জন্য বেশি করে নিয়েছিস তো?

—তাও অনেক রইল। তুই আর সৌম্য খেয়ে কূল পাবি না।

—আমি আর খেতেই পারব না। গন্ধে গন্ধেই খিদে চৌপাট।…কী রে দাদা, তুই ভাল করে খেয়েছিস তো? খানা ঠিক ছিল?

সন্তু চোখ বন্ধ করেই বলল, —হুম্‌।

—তোর কি নেশা হয়ে গেল? চোখ খুলছিস না কেন?

—ভাবছি। তোর বন্ধুগুলো কী ডেঁপো!

সৌম্য হঠাৎই মন্তব্য করল, —তোমার আজ কত জ্ঞান বেড়ে গেল বলো? বেশ্যাবৃত্তির প্রস অ্যান্ড কন্‌স জানলে!

—সত্যি, কী ভালগার টপিক! ছিঃ।

মহুয়া বলল, —আহা, ভালগার ব্যাপারটা চলছে তাতে কোনও দোষ নেই…! ওঠো, ওঠো, ফুটকুটা কী করছে এতক্ষণ কে জানে!

সন্তুর বুঝি আরও কিছু বলার ছিল দেয়াকে। বলল না। হয়তো বা সৌম্যর গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়েই।

সন্তু মহুয়া চলে যাওয়ার পর দেয়া সৌম্যর পাশে এসে বসল। হাত রেখেছে সৌম্যর পিঠে। হালকা গলায় বলল, —তুমি তো কখনও এত ড্রিঙ্ক করো না? আজ হঠাৎ…?

সৌম্য ঘোলাটে চোখে ঘুরে তাকাল একবার। উত্তর দিল না। দেয়ার হাতটা নামিয়ে দিয়েছে আস্তে করে।

—চলো। খেয়ে নেবে চলো।

সৌম্য চুপ। নড়ছে না।

—কী হল? ওঠো।

—ইরিটেট কোরো না। ভাল্লাগছে না।

—তুমি আজ খুব বোর হয়েছ, তাই না?

—তুমি তো তাই চেয়েছিলে।

—ওরা এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করল…

—তুমি বাড়িতে বেশ্যা পুষে রেখেছ, তোমার বাড়িতে ওইসব আলোচনা হবে না তো কি ভজন কীর্তন হবে?

—ছি সৌম্য, ভাষা ঠিক করো।

—ভাষা শেখাচ্ছ? এতক্ষণ কী ভাষায় কথা হচ্ছিল? সৌম্য সহসা বিস্ফোরিত হয়েছে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করছে, —অ্যাই শিউলি, এদিকে আয়। শিগ্‌গির এদিকে আয়।

শুধু শিউলি নয়, লক্ষ্মীও সামনে।

সৌম্য হুংকার ছাড়ল, —কী ভেবেছিস কী? এটা কি বেশ্যাবাড়ি? কোন সাহসে এরকম নোংরা সেজে আমার বাড়িতে ঘুরছিস?

দেয়ারও গলা চড়ে গেল, —সৌম্য, বিহেভ ইওরসেল্‌ফ। আমিই ওকে ওভাবে সাজতে বলেছি। ওই ড্রেসটা আমি কিনে দিয়েছি।

—বাহ্? সোনায় সোহাগা! আর কী, এবার খদ্দের ঢোকাও।

—রাতদুপুরে কী মাতলামি আরম্ভ করলে?

—মাতাল আমি নই। তুমি। তুমি। তুমি। মহীয়সী সাজার নেশায় তুমি সব সেন্স লুজ করেছ। ওকে বেশ্যা সাজিয়ে না ঘোরালে তোমার ধ্বজাটা ওড়ে কী করে?

—ছি ছি, সৌম্য, তুমি এত মিন?

—মিননেসের তুমি দেখেছটা কী? আমি স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমার বাড়িতে এসব বেশ্যা নাচানো চলবে না। এনাফ ইজ এনাফ।

—তুমি কিন্তু খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছ সৌম্য!

—বাড়াবাড়ি? হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বাড়াবাড়ি? উইদাউট মাই পারমিশান তুমি একটা বাজারের মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে তুললে, এটা বাড়াবাড়ি নয়? তোমার পেয়ারের বন্ধু এসে আমারই ফ্ল্যাটে সারাদিন তাকে নিয়ে আহ্লাদ করছে, এটা বাড়াবাড়ি নয়? সৌম্য দাঁত কিড়মিড় করছে, —কাওয়ার্ড! দুটো ধমক দিতেই লেজ গুটিয়ে পালাল! হ্যাহ্‌।

দেয়া স্তম্ভিত হয়ে গেল, —তুমি…! ঋতমকে…! ঋতমকে তুমি কী বলেছ?

—ভদ্র ভাষায় একজন ভদ্রলোক একটা লোফারকে যা বলতে পারে, তাই। আমার ফ্ল্যাটে নোংরা মেয়েটাকে নিয়ে কারুর কোনও রকম ঢলাঢলি আমি বরদাস্ত করব না। আন্ডারস্ট্যান্ড?

—বার বার খারাপ মেয়ে, নোংরা মেয়ে বলছ কেন? তুমি জানো শিউলি খারাপ মেয়ে নয়!

—নয়? যাও, নিজের বাবা মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। পাড়াপ্রতিবেশীদের ডেকে জিজ্ঞেস করো। প্রত্যেকে এক কথা বলছে, কান পাতা যাচ্ছে না। শোনো দেয়া, আমি তোমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি। ওই মেয়েকে তোমায় তাড়াতে হবে।

দেয়ার মাথা টগবগ করে ফুটছে। মেঝেতে পা ঠুকে বলল, —যদি না তাড়াই? কী করবে তুমি? কী করবে?

লক্ষ্মী ঝাপটে এসেছে। দেয়ার মুখ চেপে ধরল, —চুপ করো মিমি, চুপ করো, বরের সঙ্গে ওভাবে কথা বলে না।

—কেন চুপ করব? আমি কি ওর খাই, না পরি?

—রোজগার করে বলে খুব তোমার তেল বেড়েছে, অ্যাঁ? আমার কথা শুনে থাকতে পারো তো থাকবে, নইলে ঘাড় ধরে বার করে দেব। সৌম্য সিংহরায় জীবনে কোনওদিন কারুর তোয়াক্কা করেনি। করবেও না। বুঝলে?

কার্পেটে পড়ে থাকা একটা কাচের গ্লাসে গদাম করে লাথি মেরে ঘরে ঢুকে গেল সৌম্য। মুহুর্তে গ্লাস ভেঙে খান খান। সামনেই শিউলি, পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। তার পায়ের কাছে গিয়ে পড়েছে একটা টুকরো, তাকিয়েও দেখছে না।

লক্ষ্মী উবু হয়ে কাচ পরিষ্কার করতে করতে হাউমাউ কাঁদছে, —এ কী হয়ে গেল গো ভগবান। এমন সোনার সংসারে এ কী আগুন জ্বলল গো? ও ঠাকুর…ওরে লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে…কী সব্বোনাশ করলি রে…

দেয়া ছোটঘরে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল। ফুঁসছে। খোঁপা থেকে হেঁচকা টানে ছিড়ল ফুলের মালা, কুচি কুচি করছে। মুক্তোর গয়না খুলে টান মেরে ফেলে দিল। কী তীব্র অপমান, পুড়ে যাচ্ছে বুকটা। পৃথিবীতে যাকে সব চেয়ে আপন ভেবেছে, তার কাছ থেকে এটাই কি প্রাপ্য ছিল? কেন সে মেনে নেবে সৌম্যর কথা? কেন শিউলিকে তাড়াবে? শিউলি কোনও অন্যায় করেনি। শিউলিকে এনে দেয়াও কোনও অন্যায় করেনি। …এত স্পর্ধা সৌম্যর, বলে ঘাড় ধরে বের করে দেব? দেয়াকে বলে? …উফ্‌, ঋতমটা কী! একবার যদি দেয়াকে বলত, দেয়া আজকের লোক দেখানো আয়োজন থোড়াই করত!

অপমান শরীরের শক্তি শুষে নিচ্ছে দ্রুত। দেয়া ক্লান্ত হচ্ছিল। ডিভানে শুয়ে পড়ল এক সময়ে। কান্না পাচ্ছে, চোখে এক ফোঁটা জল নেই।

শ্রাবণের আকাশে আজ ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। পরশু পূর্ণিমা, কানা ভাঙা থালার মতো চাঁদ উঠেছে। মেঘের আড়ালে বার বার হারিয়ে যাচ্ছিল চাঁদ। অনেক রাতে বাতাস উঠল একটা। ঝিমঝিমে। এলোমেলো। তারপর কখন যেন থেমেও গেল বাতাসটা। একা চাঁদ মেঘ ভেঙে ভেঙে পরিক্রমা করল আকাশটাকে। বৃথাই।

ভোররাতে একটু বুঝি তন্দ্রা নেমেছিল চোখে। আধো ঘুম আধো জাগরণে অস্ফুট একটা ডাক শুনতে পেল দেয়া, —মিমি…? মিমি…?

দেয়া ধড়মড় করে উঠল। সকাল হয়ে গেছে, আলো এসে পড়েছে ঘরে। চোখ রগড়াতে রগড়াতে দরজা খুলল দেয়া।

লক্ষ্মীর মুখে একগাল হাসি, —আপদটা গেছে।

দেয়ার অবশ মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকল না। জড়ানো গলায় বলল, —কে?

—শিউলি গো শিউলি। ঘুম থেকে উঠে দেখি, নেই। ভেগেছে।

ষোলো

শ্রান্ত পায়ে সিঁড়ি ভাঙছিল দেয়া। কোথায় না কোথায় ঘুরেছে দিনভর। বেলেঘাটা থানা, যাদবপুর থানা, লালবাজার, হাসপাতাল…। বেলেঘাটার বস্তিতেও ছুটেছিল, যদি শিউলি কোনওভাবে সেখানেও গিয়ে থাকে। শেয়ালদা স্টেশনেও ঢুঁ মেরেছে উদভ্রান্তের মতো। বলা কি যায়, শিউলি কোনও মাসির বাড়ি যাওয়ার কথা তো ভাবতে পারে।

মন অবশ্য বলছিল শিউলি ওসব কোথাও যাবে না।

দেয়া তাহলে কোথায় খুঁজে পাবে শিউলিকে?

ইচ্ছে করে হারিয়ে গেলে আর কি শিউলিদের সন্ধান পাওয়া যায়?

ফ্ল্যাটের দোরগোড়ায় এসে দেয়া একটু দম নিল। শিথিল হাত কলিংবেলে।

লক্ষ্মী নয়, সৌম্য দরজা খুলেছে।

ভরসন্ধেবেলা সৌম্য বাড়িতে কেন?

নাহ্‌, দেয়ার মনে প্রশ্নটা জাগলই না। তার বিস্ময়বোধ লোপ পেয়েছে।

খানিকক্ষণ হাঁ করে দেয়াকে দেখল সৌম্য। প্রায় আর্তনাদের সুরে বলে উঠেছে, —তোমার ব্যাপারখানা কী? কোথায় ছিলে সারাটা দিন? আমি অফিস বেরোতে পারিনি, সারাক্ষণ তোমার জন্য ছটফট করছি, কতক্ষণ রাস্তার মোড়ে গিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম… ফোন করলাম গোপালনগরে, তুমি সেখানেও নেই, অফিসেও যাওনি…?

প্রশ্ন করছে সৌম্য, না ফিরিস্তি শোনাচ্ছে? কোনও কথা না বলে সৌম্যকে পেরিয়ে এল দেয়া। সোফায় বসে ঘাড় গলা মুছছে, অনুচ্চ স্বরে ডাকল, —লক্ষ্মীদি, আমায় একটু জল দাও না!

লক্ষ্মী ফ্রিজ খুলে তড়িঘড়ি ঠাণ্ডা জলের বোতল বার করেছে। গ্লাস ভরে দ্রুত পায়ে এল, —ইস্‌, মুখ চোখ একেবারে বসে গেছে গো! কোথায় ঘুরে মরেছ বলো তো? পেটে কিছু পড়েছে? নাকি হাওয়া খেয়ে আছ?

দেয়া শুনতেই পায়নি এমনভাবে শেষ করল গ্লাসটা। তাপ জুড়োল কি? বুঝতে পারল না দেয়া। শারীরিক অনুভূতিগুলোও যেন ভোঁতা হয়ে গেছে।

সৌম্য একবার বসছে, একবার উঠছে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেটটা নিল, —এক সেকেন্ড। তোমাদের বাড়িতে আগে জানিয়ে দিই।

দেয়া হাত তুলে নিষেধ করল। হিমমাখা গলায় বলল, —পরে কোরো।

—কেন? পরে কেন? সৌম্য তবু ব্যস্তসমস্ত, —তোমার বাবা মা যা টেনশন করছেন, এক্ষুনি হয়তো দৌয়ে আসবেন।

—আগে একটু আমার সঙ্গে ও ঘরে এসো। দেয়ার স্বর আরও ঠাণ্ডা, —কথা আছে।

সৌম্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোওয়ার ঘরে। দেয়ার পিছু পিছু।

দেয়া দরজা ভেজিয়ে দিল। সৌম্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থমথমে গলায় বলল, —আমি কোথায় ঘুরছিলাম তুমি জানো না?

দৃষ্টি সরিয়ে নিল সৌম্য। আমতা আমতা করে বলল, —হ্যাঁ মানে… না মানে …খোঁজ পেলে শিউলির?

দেয়া জবাব দিল না। ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল, —আমি আর তোমার সঙ্গে থাকছি না সৌম্য।

কথাটার অভিঘাতে সৌম্য স্তব্ধ ক্ষণকাল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, —কী বলছ দেয়া?

—আমি কি হেঁয়ালি করেছি?

সৌম্য হাত ঝাঁকাল, —দেয়া, আয়াম সরি। এক্সট্রিমলি সরি। আই ওয়াজ নট ইন মাই সেন্সেস। রাগের মাথায় কী বলেছি না বলেছি…! তুমি আমার মুখের কথাটাই দেখলে দেয়া?

—কোনটা তোমার মুখের কথা সৌম্য? দেয়া যেন এক দিনেই আমূল বদলে গেছে। ঋজু গলায় বলল, —শিউলিকে এখানে রাখতে না চাওয়াটা?

—দেয়া প্লিজ, বোঝার চেষ্টা করো। ওরকম একটা মেয়েকে বাড়িতে এনে রাখা কেউই পছন্দ করবে না। করতে পারে না।

এখনও সেই অন্ধ মানসিকতা! এখনও সেই একগুঁয়েমি!

দেয়া নীরস গলায় বলল, —অন্যের কথা ছাড়ো। নিজের কথা বলো। কাজটা কি আমি অন্যায় করেছিলাম?

সৌম্য চুপ।

—আমি যদি শিউলিকে ফিরিয়ে আনি, তুমি আর আপত্তি করবে না তো?

সৌম্য চমকে তাকাল, —তুমি কি মেয়েটাকে…

—ধরো পেয়েছি। ধরো নিয়ে এলাম!

সৌম্য কেমন দিশেহারা বোধ করল। অস্থির মুখে পায়চারি করছে। হঠাৎ ঘুরে দেয়ার কাঁধ চেপে ধরল, —কেন তুমি এমন জেদ করছ দেয়া? কোথাকার একটা মেয়ে…থার্ড পার্টি… ননএনটিটি… তার জন্য আমাদের রিলেশানটাকে স্ট্রেন করবে?

—বারে, আমায় দেখতে হবে না, রিলেশানটা কীসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে? দেয়া কাঁধ থেকে সৌম্যর হাত নামিয়ে দিল, —তুমি ঠিকই বলেছ। শিউলি কেউ নয়। শিউলি সত্যিই আর ম্যাটার করে না। আমার প্রশ্ন, আমি যেটাকে উচিত কাজ বলে মনে করি সেটা সংসারে চলবে কি চলবে না? আমার বিশ্বাসটাকেই যদি তুমি সম্মান করতে না পারো, তাহলে মিছিমিছি সম্পর্ক টিকিয়ে রেখে কী লাভ?

—তুমি কিন্তু একটা তুচ্ছ ব্যাপারকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করছ দেয়া।

—তোমার কাছে ব্যাপারটা তুচ্ছ। আমার কাছে নয়।

সৌম্য ভার মুখে বলল, —আমার পছন্দ অপছন্দর কোনও মূল্য নেই?

—তোমার অপছন্দর কাজ কোনটা হয় সংসারে? তোমার প্রত্যেকটি ছোট ছোট পছন্দ অপছন্দ, ভাললাগা, খারাপ লাগা… তাই নিয়েই তো চলছে এই সংসারটা। তোমার ভূত ভবিষ্যৎ সব কিছুর সঙ্গে আমি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাসের জায়গাটা আলাদা সৌম্য। আমাদের পরস্পরের বিশ্বাসের জায়গাটাই যদি না মেলে, আমাদের ন্যায় অন্যায় বোধটাই যদি দুরকম হয়…। এই যে, আমার বন্ধু আমার আমন্ত্রণে আমার বাড়িতে এসেছিল, তুমি তাকে আমার অ্যাবসেলে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে, আমাকে সেটা জানানোরও প্রয়োজন মনে করলে না…। ক্যান ইউ ইম্যাজিন, এটা কোন স্তরের অপমান?

সৌম্য একটুক্ষণ গুম থেকে বলল, —ও কে। ও কে। সরি। আমি ঋতমের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।

—তাহলেই কি অপমানটা মিথ্যে হয়ে যাবে? নাকি অপমানের কারণটা মুছে যাবে? ঋতম তো এখানে জাস্ট একটা ডামি। আমার বিশ্বাসটাকে তুমি সম্মান করতে পারোনি বলেই তুমি ওই কাজটা করেছ। ক্ষমা চাওয়াটা তো এখানে মিনিংলেস।

—দেয়া… কাম অন।

—না, না আমি তোমার সঙ্গে থাকব না।

—তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সৌম্য ছটপঠ করে উঠল, —তোমার কাছে কোনটা বড়? শিউলি ইস্যু? না আমাদের ভালবাসা?

—দেখেছ, তুমি এখনও আমাদের ভালবাসা আর শিউলি ইস্যু দুটোকে দু পাল্লায় তুলছ! তুমি চাইছ ভালবাসাটা হবে আনকন্ডিশনাল। কিংবা সেটা হবে তোমার নিজের শর্তে। শোনো সৌম্য, ভালবাসা ব্যাপারটা অজয় অমর অক্ষয় কিছু নয়। ভালবাসাও ক্ষয়ে যায়, ভালবাসাতেও পলি পড়ে। তখন যা থাকে, তা হল অ্যাডজাস্টমেন্ট। বোঝাপড়া। পরস্পরের ওপর নির্ভর করতে শেখা। ওই বোঝাপড়াই আবার আস্তে আস্তে একটা নতুন ধরনের ভালবাসার জন্ম দেয়।

থেমে থেমে কথা বলছে দেয়া। যেন সৌম্যকে নয়, নিজেকেই বোঝাতে চাইছে কিছু। যেন এই মুহূর্তে তার মধ্যে কোনও রাগ নেই, ঘৃণা নেই, অপমান বোধ নেই, শুধু সে খুঁড়ে দেখতে চাইছে নিজেকে। সৌম্য যেন নেহাতই এক আয়না।

এই মুহূর্তের দেয়াকে দেখে বুঝি অস্বস্তি হচ্ছিল সৌম্যর। রাগে ফেটে পড়তে পারছে বলে অস্বচ্ছন্দ ভাবটা যেন বেড়ে যাচ্ছে আরও।

ফ্যাকাশে মুখে বলল, —বুঝেছি, তুমি খুব অফেন্‌ডেড হয়েছ। যাও, কদিন তাহলে ঘুরে এসো গোপালনগর থেকে।

—আমি কোথায় যাব না যাব, তুমি ঠিক করে দেবে? দেয়ার মুখ সহসা বিদ্রুপে বেঁকে গেছে? —আমিই যাব সেটা ধরে নি কী করে?

—মানে?

—মানে খুব সহজ। তুমি চলে যেতে পারো। সব সময়ে মেয়েদেরই ঘর ছাড়তে হবে তার তো কোনও মানে নেই। এ সংসার তুমি একা গড়োনি। এটা যতটা তোমার বাড়ি, ততটাই আমারও। এখানে আমি আবার একটা শিউলিকে নিয়ে আসতে পারি, তেমন হলে আবার আর একটা… তোমার না পোষালে তুমি…

—ব্যস, ব্যস, থামো। চুপ করো। সৌম্য ছিটকে সরে গেল। তার ফর্সা মুখ টকটকে লাল, নাসারন্ধ্র ফুলে ফুলে উঠছে। গলায় আগুন ঝরাল, —ভেবেছ কি তুমি, অ্যাঁ? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! দেখি তোমার কত বড় সাহস! আমি বাড়ি থেকে চলে যাব? আমি? হাউ ডেয়ার ইউ?

দেয়া একটুও ভয় পেল না। অচঞ্চল পায়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। পিছনে গর্জন করছে এক আদিম পুরুষ। নিজেরই নখ দাঁতে ফালা ফালা করছে নিজেকে। অদূরে এক ছায়া-ছায়া জলাশয়, হ্যালোজেনের দ্যুতিমাখা জনবহুল রাস্তা, শব্দময় পৃথিবী। সমস্ত ছায়া আলো আর শব্দকে বুঝি ছাপিয়ে গেল পৌরুষের মিথ্যে আস্ফালন।

দেয়ার কান্না পাচ্ছিল। দেয়ার হাসিও পাচ্ছিল।

_____

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *