১৫. জেলে ঢোকার পর

অধ্যায় ১৫

শুক্রবার, মে ১৬-শনিবার, মে ৩১

জেলে ঢোকার দু’মাস পর মিকাইল ব্লমকোভিস্টকে ১৬ই মে শুক্রবার রুলাকার জেল থেকে মুক্তি দেয়া হলো। যেদিন জেলে ঢোকে সেদিনই প্যারোলে মুক্তি পাবার জন্য একটা দরখাস্ত করেছিলো সে, তবে এ নিয়ে তার মনে খুব একটা আশা ছিলো না। এক মাস আগে কেন তাকে মুক্তি দেয়া হলো সে ব্যাপারেও তার স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। এসব আইনী ব্যাপার সে বোঝেও কম। তবে আন্দাজ করতে পারলো ছুটির দিনগুলো বাদ দেয়াতে হয়তো সাজার মেয়াদ কমে এসেছে নয়তো জেলে কয়েদীর চেয়ে আসনের সংখ্যা কমে এসেছিলো সেজন্যে। ঘটনা যাইহোক না কেন, চল্লিশ বছর বয়সী দেশত্যাগী পোলিশ পিটার সারোস্কি হলো তার জেলার, লোকটার সাথে ব্লমকোভিস্টের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিলো। ঐ ভদ্রলোকই তার সাজার মেয়াদ কমিয়ে আনার রিকমেন্ডেশন করেছিলো।

রুলাকারে থাকার সময়টি তার জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক আর চিন্তামুক্ত ছিলো। জেলারের মতে এই জেলখানাটি ছোটোখাটো অপরাধীদের জন্য বানানো হয়েছে, দাগী আসামীদের জন্য নয়। জেলের প্রতিদিনকার নিয়মকানুনগুলো তাকে তার যৌবনে হোস্টেলে থাকার দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো। তার সহকয়েদীরা, যাদের বেশিরভাগই দ্বিতীয় জেনারেশনের অভিবাসী, তাকে খুব সম্মান করতো। তাদের কাছে সে ছিলো বিরল একজন ব্যক্তি। কয়েদী হিসেবে তাকে দেখতো না তারা। সে-ই হলো একমাত্র বন্দী যাকে টিভিতে দেখা গেছে বেশ কয়েক বার। এটা তার স্ট্যাটাসকে বাড়িয়ে তুলেছিলো।

প্রথম দিন তাকে কথাবার্তা বলার জন্য ডেকে পাঠানো হয়। সেইসাথে থেরাপি, কমভাক্স থেকে ট্রেনিং কিংবা এডাল্ট এডুকেশন গ্রহণ করার প্রস্তাব দেয়া হয় তাকে। তবে এসব জিনিস তার দরকার ছিলো না। লেখাপড়ার পাঠ বেশভালোমতোই চুকিয়েছে সে, ভালো একটা চাকরিও করতো। সুতরাং এসব প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে কর্তৃপক্ষকে সে বললো তাকে জেলের মধ্যে ল্যাপটপ ব্যবহার করার সুযোগ দেয়া হোক যাতে করে সে একটা বই লেখার কাজ করতে পারে। সময়ক্ষেপন না করেই তার অনুরোধটি গ্রহণ করা হয়। সারোস্কি তার জন্যে তালাবদ্ধ করার ব্যবস্থা আছে এরকম একটি ডেস্ক জোগার করে দেয় যাতে করে নিজের সেলে ল্যাপটপটি নিরাপদ রাখতে পারে। অন্য কয়েদীরা তার ল্যাপটপটি চুরি করতে পারে সেজন্যে এই ব্যবস্থা করা হয় নি। সত্যি কথা বলতে কি তার সহকয়েদীরাই তার সব জিনিস দেখেশুনে রাখতো।

এভাবে প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে একটানা দু’মাস ভ্যাঙ্গার পরিবারের ইতিহাস লেখার কাজ করে গেছে সে। ব্লমকোভিস্ট আর চিলি বংশোদ্ভুত স্কভদি নামের এক কয়েদীর দায়িত্ব ছিলো প্রতিদিন জেলের জিমনেসিয়াম পরিস্কার করা। কাজ ছাড়াও টিভি দেখা, কার্ড খেলা আর ব্যয়াম করে সময় কাটাতো তারা। ব্লমকোভিস্ট বেশ ভালো পোকার খেলতে পারলেও প্রতিদিনই হেরে কিছু টাকা খোয়াতো।

*

সোজা হেডেবিতে নিজের ক্যাবিনে ফিরে গেলো ব্লমকোভিস্ট। ঘরের সামনের দরজায় পা রাখতেই মিউ শব্দ শুনে চেয়ে দেখে সেই বেড়ালটা তার পেছনে।

“ঠিক আছে, তুমি এবার ভেতরে আসতে পারো,” বললো সে। “তবে আমার কাছে কিন্তু দুধ নেই।”

নিজের ব্যাগ থেকে সব কিছু বের করে রাখলো যেনো দীর্ঘ ছুটি কাটিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলো জেলার সারোস্কি আর সহকয়েদীদের অভাব অনুভব করছে সে। আশ্চর্য হলেও সত্যি জেলের সময়টা দারুণ উপভোগ করেছে। তবে এতো আচমকা তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে যে কাউকে বলে আসতে পারে নি।

সবেমাত্র সন্ধ্যা ৬টা বাজে। দোকানপাট বন্ধ হবার আগেই কিছু কেনাকাটা করে এলো। বাড়ি ফিরে ফোন করলো বার্গারকে। মেসেজ বললো সে এখন অফিসে নেই। পরদিন যেনো তাকে ফোন করে সেই মেসেজটা দিয়ে ফোন রেখে দিলো রমকোভিস্ট।

এরপর ভ্যাঙ্গারের বাড়িতে গেলো সে। মিকাইলকে দেখে বুড়ো রীতিমতো অবাকই হলো মনে হয়।

“পালিয়ে এসেছো নাকি?”

“আগেভাগে মুক্তি দিয়ে দিয়েছে।”

“তাই তো অবাক হয়েছি।”

“আমিও অবাক হয়েছি।

একে অন্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বৃদ্ধ হঠাৎ করে ব্লমকোভিস্টকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলে সে একটু ভিমড়ি খেলো যেনো।

“আমি এইমাত্র খেতে বসেছিলাম। আসো, আমার সাথে খাওয়া দাওয়া করো।”

অ্যানার দেয়া সুস্বাদু খাবার খেয়ে ডাইনিংরুমে বসেই দু’ঘণ্টা ধরে তারা কথা বলে গেলো। ব্লমকোভিস্ট তাকে জানালো লেখার কাজ কতোদূর এগোলো, কি কি বিষয় তাকে এখনও জানতে হবে আর কি কি বাকি আছে, সব। তারা হ্যারিয়েটকে নিয়ে কোনো কথা বললো না, তবে ভ্যাঙ্গার মিলেনিয়াম-এর ব্যাপারে সবই তাকে জানালো।

“আমরা বোর্ড মিটিং করেছি। ফ্রোকেন বার্গার আর তোমার পার্টনার মাম কষ্ট করে আমার এখানে এসে দুটো মিটিং করে গেছে। আর স্টকহোমের মিটিংটায় আমার হয়ে উপস্থিত ছিলো ফ্রোডি। আমার যদি আরেকটু কম বয়স থাকতো তাহলে বেশ হোতো। এই বয়সে এতো লম্বা ভ্রমণ শরীরে কুলোয় না। গ্রীষ্মের মিটিংগুলোতে আমি ওখানে যাবার চেষ্টা করবো।”

“এখানে মিটিংটা করাই সঙ্গত হয়েছে,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমাদের ম্যাগাজিনের অংশ হতে পেরে কেমন লাগছে আপনার?”

মুচকি হাসি হাসলো ভ্যাঙ্গার।

“সত্যি বলতে কি আমার জীবনে এতোটা আনন্দ আর কোনো কাজে পাই নি। আমি ফিনান্সের ব্যাপারটা দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছি। ফিনান্সের অবস্থা এখন ভালোই আছে মনে হয়। যতোটা ভেবেছিলাম ততো টাকা বিনিয়োগ করতে হবে না-আয় আর ব্যয়ের ফারাক বেশ কমই আছে।’

“এরিকার সাথে আমি এই সপ্তাহে কথা বলেছিলাম। সে জানিয়েছে বিজ্ঞাপনের সংখ্যা নাকি বেড়েছে।”

“হ্যা, ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে বলতে পারো। তবে আরো সময় লাগবে। প্রথমে ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের কোম্পানিগুলো এগিয়ে এসেছে। পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা। তবে আশার কথা হলো পুরনো দুটো বিজ্ঞাপন দাতা-একটা ফোন কোম্পানি আর ট্রাভেল বুরো-আবার ফিরে এসেছে।” চওড়া একটা হাসি দিলো সে। “ওয়েনারস্ট্রমের শত্রুদের সাথে এক এক করে যোগাযোগ করা হচ্ছে। বিশ্বাস করো তালিকাটি অনেক বড়।”

“ওয়েনারস্ট্রমের কাছ থেকে সরাসরি কিছু শুনেছেন?”

“ঠিক সরাসরি শুনি নি। তবে আমরা একটা খবর ছড়িয়ে দিয়েছি যে ওয়েনারস্ট্রম মিলেনিয়াম-এর বিজ্ঞাপন বয়কটের পেছনে আছে। ডিএ-এর এক রিপোর্টার তার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সে খুব চটে যায়।”

“আপনি এটা খুব উপভোগ করছেন, তাই না?”

“উপভোগ শব্দটা যথার্থ হলো না। আরো অনেক বছর আগে এ ব্যাপারে আমার কাজ শুরু করা উচিত ছিলো।”

“আচ্ছা, ওয়েনারস্ট্রম আর আপনার মধ্যে ঘটনাটা কি?”

“এটা জানার চেষ্টাও কোরো না। এ বছরের শেষের দিকে এটা তুমি জানতে পারবে।’

*

ব্লমকোভিস্ট যখন ভ্যাঙ্গারের বাড়ি থেকে বের হলো তখন বাতাসে বসন্তের সুবাস টের পেলো সে। বাইরে ঘন অন্ধকার, কিছুক্ষণ ইতস্তত করলো। এরপরই আগের মতো গা টিপে টিপে সিসিলিয়ার দরজায় নক করলো সে।

ওখানে গিয়ে কি দেখবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নয় সে। তাকে দেখেই সিসিলিয়ার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে তাকে বাড়ির ভেতর আসতে বললেও অস্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো তার চোখেমুখে। ভেতরে ঢুকে দু’জনেই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, একটু দ্বিধার পর সেও তার কাছে জানতে চাইলো জেল থেকে পালিয়ে এসেছে কিনা। তাকে সব খুলে বললো ব্লমকোভিস্ট।

“তোমাকে শুধু হ্যালো বলতে এসেছি। আমি কি অসময়ে এসে পড়লাম?” তার চোখের দিকে সরাসরি তাকালো না সে। মিকাইল আঁচ করতে পারলো তাকে দেখে খুশি হয় নি সিসিলিয়া।

“না…না, তেরে আসো। কফি খাবে?”

“খাবো।”

তার পেছন পেছন রান্নাঘরে চলে এলো ব্লমকোভিস্ট। সিসিলিয়া কফিমেকারে পানি ঢালার সময় পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখতেই আড়ষ্ট হয়ে গেলো সে।

“সিসিলিয়া, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে না আমাকে কফি খাওয়াতে চাচ্ছো।”

“আমি মনে করেছিলাম তুমি আরো এক মাস পর আসবে, তাই তোমাকে দেখে একটু অবাক হয়ে গেছি।”

তাকে ঘুরিয়ে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালো সে। কয়েক সেকেন্ড কিছু বললো দু’জনে। এখনও তার চোখের দিকে তাকাচ্ছে না সিসিলিয়া।

“সিসিলিয়া। কফি বানানো বাদ দাও। কি হয়েছে?”

মাথা ঝাঁকিয়ে গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো সে।

“মিকাইল, আমি চাই তুমি চলে যাও। কিছু জিজ্ঞেস কোরো না। চলে যাও।”

.

মিকাইল প্রথমে কটেজে ফিরে যেতে উদ্যত হলেও গেটের সামনে এসে একটু থামলো। বুঝতে পারছে না কি করবে। বাড়িতে না গিয়ে বৃজের কাছে একটা পাথরের উপর বসে পানি দেখতে লাগলো। সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে লাগলো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের এমন কি পরিবর্তন হলো এই দু’মাসে।

আচমকা ইঞ্জিনের শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলো বৃজের নীচ দিয়ে বিশাল একটা সাদা রঙের বোট ঢুকে পড়েছে। তার কাছে আসতেই দেখতে পেলো হুইলে মার্টিন ভ্যাঙ্গার দাঁড়িয়ে আছে। সে অবশ্য তাকে দেখতে পায় নি। চৌচল্লিশ ফুট দৈর্ঘ্যের একটি মোটর ক্রুইজার। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আশেপাশে আরো অনেক ইঞ্জিনচালিত বোট আছে বৃজের কোল ঘেষে। তবে সবার সেরা বোটটি যে মার্টিনের সেটা দেখেই বোঝা যায়।

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের বাড়ির নীচে এসে একটু থেমে আড়চোখে উপরের দিকে তাকালো ব্লমকোভিস্ট। উপরতলার জানালাগুলোতে বাতি জ্বলছে। নিজের ঘরে এসে কফিপাত্র চুলায় বসিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো সে।

জেলে যাবার আগে হ্যারিয়েট সংক্রান্ত যাবতীয় ডকুমেন্ট ভ্যাঙ্গারের কাছে রেখে গিয়েছিলো। খালি বাড়িতে ওগুলো রাখার কোনো যুক্তি ছিলো না। এখন শেলফটা একেবারে ফাঁকা। তার কাছে কেবল ভ্যাঙ্গারের নিজের পাঁচটি নোটবুক আছে। জেলে ওগুলো সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলো। এখন সেগুলো তার প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে। শেলফের উপরের তাকে একটা ফটো অ্যালাবাম তার চোখে পড়লো, এটা ফিরিয়ে দিতে ভুলে গেছিলো।

অ্যালবামটা রান্নাঘরের টেবিলে নিয়ে এসে কফি খেতে খেতে দেখতে শুরু করলো ব্লমকোভিস্ট।

হ্যারিয়েট যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিনের তোলা কতোগুলো ছবি। প্রথমটি হলো হ্যারিয়েটের তোলা শেষ ছবি-হেডেস্টাডের শিশুদের প্যারেড ডে’র একটা ছবি। এরপর বৃজের দুর্ঘটনার ১৮০টি চমৎকার নিখুঁত ছবি আছে। এর আগেও সে ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে এইসব ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। এখন একেবারে উদাস ভঙ্গিতে ছবিগুলো দেখে গেলো। ভালো করে জানে এখানে এমন কিছু খুঁজে পাবে না যা এর আগে তার চোখে পড়ে নি। সত্যি বলতে কি হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার হতবুদ্ধিকর কাহিনীটা নিয়ে একেবারে তিতিবিরক্ত হয়ে গেছে। সশব্দে অ্যালবামটা বন্ধ করে রেখে দিলো।

অস্থির হয়ে জানালার দিকে গিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকালো সে।

এরপর আবারো অ্যালবামের দিকে নজর দিলো। অনুভূতিটা সে ব্যাখ্যা করতে পারছে না তবে একটা চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে যেনো এইমাত্র দেখা কোনো জিনিস নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে সে। যেনো অদৃশ্য এক প্রাণী তার কানে ফিসফিস করে কিছু কথা বলেছে। তার সারা শরীরের রোম খাড়া হয়ে গেলো।

আবারো অ্যালবামটা খুললো, প্রতিটি পাতা উল্টিয়ে সবগুলো ছবি আবারো ভালো করে দেখে নিলো সে। তেলে জবজবে তরুণ হেনরিক ভ্যাঙ্গার আর হেরাল্ডের ছবিটার দিকে তাকালো ব্লমকোভিস্ট। হেরাল্ডের সাথে এখনও তার দেখা হয় নি। ভাঙা রেলিং, ভবন আর জানালাগুলো, যানবাহন সবই ছবিতে আছে। কৌতুহলী লোকজনের মাঝে বিশ বছরের তরুণী সিসিলিয়াকে খুব সহজেই চিনতে পারলো সে। সাদা রঙের পোশাক আর কালো রঙের একটা জ্যাকেট পরা। কমপক্ষে বিশটি ছবিতে তার উপস্থিতি আছে।

প্রবল উত্তেজনা বোধ করছে ব্লমকোভিস্ট। নিজের স্বজ্ঞার উপর পূর্ণ আস্থা রয়েছে তার। এই স্বজ্ঞাই তাকে ছবির অ্যালাবামে কোনো কিছু আছে বলে তাড়া দিচ্ছে। তবে এখনও ধরতে পারছে না সেটা কি।

রাত ১১টা পর্যন্ত রান্নাঘরের টেবিলে থাকলো। একের পর এক ছবিগুলো দেখার সময় দরজা খোলার শব্দটা তার কানে গেলো সে।

“আমি কি ভেতরে আসতে পারি?” সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার। কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই তার বিপরীত দিকের একটা চেয়ারে বসে পড়লো সে। এই সাক্ষাতের ব্যাপারে ব্লমকোভিস্টের মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে যাচ্ছে। পাতলা আর হালকা রঙের ঢিলেঢালা একটা পোশাক এবং ধূসর রঙের জ্যাকেট পরেছে সে, ঠিক ১৯৬৬ সালে তোলা অ্যালবামের ছবিগুলোতে যেমন পোশাকে তাকে দেখা গেছে!

“সমস্যাটা হলো তুমি নিজে,” বললো সে।

ব্লমকোভিস্ট চোখ কপালে তুললো।

“ক্ষমা করবে আমাকে, এতো রাতে আমার এখানে তোমার আগমনে আমি অবাক হয়েছি। এখন আমি ঘুমাতে পারবো না বলে খুব অখুশি।”

“তুমি কেন অসুখী?”

“জানো না?”

মাথা ঝাঁকালো ব্লমকোভিস্ট।

“আমি যদি তোমাকে সেটা বলি তাহলে কথা দাও হাসবে না,” বললো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার।

“কথা দিলাম।”

“গত শীতে তোমাকে যখন প্রলুব্ধ করলাম সেটা ছিলো বোকার মতো একটি কাজ, একেবারে না বুঝে করা একটি কাজ। আমি একটু এনজয় করতে চাচ্ছিলাম, এই যা। প্রথম রাতে আমি বেশ মাতালও ছিলাম। তোমার সাথে দীর্ঘমেয়াদী কিছু করার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। কিন্তু পরে এটা বদলে গেলো। খণ্ডকালীন প্রেমিকা হিসেবে তোমার সাথে কাটানো ঐ কয়টা সপ্তাহ আমার জীবনে সবচাইতে সুখকর দিন ছিলো।”

“আমার কাছেও দিনগুলো বেশ ভালো লেগেছে।”

“মিকাইল, আমি তোমাকে গোড়া থেকেই মিথ্যে বলেছি। আমি কখনই সেক্স নিয়ে স্বস্তিতে ছিলাম না। আমার পুরো জীবনে পাঁচজন সেক্স পার্টনার ছিলো। একুশ বছর বয়সে প্রথম শুরু হয়। তারপর আমার স্বামী, আমার বয়স যখন পঁচিশ তখন তার সাথে আমার পরিচয়। পরে দেখতে পেলাম লোকটা আস্ত একটা হারামজাদা। এরপর কয়েক বছর বিরতি দিয়ে আরো তিনজন লোকের সাথে এ সম্পর্ক হয়। তবে তুমি আমাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছো। আমি পুরোপুরি তৃপ্ত হতে পারছি না। তুমি যে খুব সহজসরল সেই সত্যটা নিয়ে আমাকে কিছু একটা করতে হয়েছে।”

“সিসিলিয়া, সেটা তোমাকে করতে হবে না…“

“ইশশ-আমার কথার মাঝে বাধা দিও না, তাহলে হয়তো আর কখনও এটা বলতে পারবো না তোমাকে।”

চুপচাপ বসে রইলো ব্লমকোভিস্ট।

“তুমি যেদিন জেলে গেলে ঐদিনটা আমার জন্য খুবই পীড়াদায়ক ছিলো। এমনভাবে চলে গেলে যেনো কখনও তোমার অস্তিত্বই ছিলো না। আমার চারপাশটা অন্ধকার হয়ে গেলো। ঠাণ্ডা আর চরম শূন্যতা নেমে এলো আমার বিছানায়। আর আমি, ছাপান্ন বছরের এক বয়স্ক মহিলা একা পড়ে থাকলাম সেখানে।”

কয়েক মুহূর্ত কিছু না বলে ব্লমকোভিস্টের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।

“গত শীতে আমি তোমার প্রেমে পড়ে গেছি। আমি চাই নি তবে ব্যাপারটা ঘটে গেছে। এরপরই বুঝতে পারি যে তুমি এখানে কিছুদিনের জন্য এসেছো। একদিন তুমি চিরকালের জন্যেই এখান থেকে চলে যাবে অথচ আমাকে এখানে থাকতে হবে বাকি জীবনটা। এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি এতোটাই কষ্টে ছিলাম যে ঠিক করেছিলাম তুমি ফিরে এলে তোমার সাথে আর মেলামেশা করবো না।”

“আমি দুঃখিত।”

“এতে তোমার কোনো দোষ নেই। আজ আমার ওখান থেকে তুমি চলে আসার পর বসে বসে অনেক কেঁদেছি। আমি যদি আমার মতো করে থাকতে পারতাম সে কথাই শুধু ভেবেছি। এরপর আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

“সেটা কি?”

টেবিলের দিকে তাকালো সে।

“তুমি একদিন চলে যাবে সে কারণে তোমার সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিলে আমি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবো। মিকাইল, আমরা কি আবার শুরু করতে পারি? কিছুক্ষণ আগে যা ঘটেছে সেটা কি ভুলে যেতে পারবে তুমি?”

“ভুলে গেছি,” বললো সে। “তবে আমাকে সেটা বলার জন্য ধন্যবাদ।” এখনও সে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।

“তুমি যদি এখনও আমাকে চাও তাহলে আসো।

তার দিকে মুখ তুলে তাকালো সে। এরপর চেয়ার ছেড়ে উঠে সোজা চলে গেলো শোবার ঘরে। যেতে যেতে নিজের শরীর থেকে জ্যাকেট আর পোশাকটা খুলে মেঝেতে ফেলে দিলো।

*

দরজা খোলার শব্দে ব্লমকোভিস্ট আর সিসিলিয়া জেগে উঠলো। কে জানি দরজা খুলে রান্নাঘর দিয়ে ভেতরে হেটে আসছে। ফায়ারপ্লেসের কাছে ভারি কিছু রাখার শব্দ কানে এলো তাদের। এরপরই দেখা গেলো বার্গার শোবারঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখের হাসিটা বদলে অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো।

“ওহ্ ঈশ্বর।” এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললো সে।

“হাই, এরিকা,” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“হাই। আমি দুঃখিত। এভাবে না জানিয়ে ঢুকে পড়ার জন্য হাজার বার ক্ষমা চাইছি আমি, দরজায় নক করা উচিত ছিলো আমার।

“আমাদেরও সামনের দরজাটা বন্ধ করে রাখা উচিত ছিলো। এরিকা-এ হলো সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার। সিসিলিয়া-এরিকা বার্গার হলো মিলেনিয়াম-এর এডিটর ইন চিফ।”

“হাই,” বললো সিসিলিয়া।

“হাই,” কথাটা এমনভাবে বললো যেনো বুঝতে পারছে না ভেতরে ঢুকবে নাকি হাত মিলিয়ে এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাবে সে। “আহ্…..আমি…একটু হেটে আসি বাইরে থেকে।”

“তারচেয়ে একটু কফি বানালে কেমন হয়?” বিছানার পাশে রাখা অ্যালার্ম ঘড়িটা দেখে বললো ব্লমকোভিস্ট। বেশ বেলা হয়ে গেছে।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বার্গার শোবারঘরের দরজাটা বন্ধ করে চলে গেলে ব্লমকোভিস্ট আর সিসিলিয়া একে অন্যের দিকে তাকালো। সিসিলিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব বিব্রত বোধ করছে। সঙ্গম করে আর কথা বলতে বলতে ভোর ৪টা হয়ে গেছিলো। এরপর সিসিলিয়া বলেছিলো তার এখানেই সে ঘুমাবে। তবে ভবিষ্যতে কেউ যেনো জানতে না পারে সে ব্লমকোভিস্টের সাথে শুয়েছে সে ব্যবস্থাও তাকে করতে হবে। তারা একে অন্যেকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়েছিলো।

“শোনো, এটা কোনো ব্যাপার না,” বললো সে। “এরিকা বিবাহিত, সে আমার প্রেমিকা নয়। আমাদের সাথে মাঝে মাঝে ওসব হয় তবে আমি যদি কারো সাথে এরকম কিছু করি তাতে সে মোটেও মাইন্ড করে না…বরং এভাবে ঢুকে সে নিজেই এখন বিব্রত হয়ে আছে।”

তারা যখন রান্নাঘরে এলো দেখতে পেলো এরিকা তাদের জন্য কফি, লেমন মারমালাদি, পনির আর জুস সাজিয়ে রেখেছে। গন্ধটা দারুণ। সিসিলিয়া সোজা গিয়ে জড়িয়ে ধরলো এরিকাকে।

“হাই।”

“ডিয়ার সিসিলিয়া, হাতির মতো সোজা ঢুকে পড়ার জন্য আমি খুব দুঃখিত,” বিব্রত হয়ে বললো এরিকা বার্গার।

“বাদ দাও তো। চলো নাস্তা করি।”

নাস্তা করে বার্গার চলে গেলো এই বলে যে তাকে এখন হেনরিক ভ্যাঙ্গারের সাথে দেখা করতে হবে। সিসিলিয়া পেছন ফিরে টেবিল পরিস্কার করার সময় মিকাইল এসে তার কাঁধে হাত রাখলো।

“এখন কি হবে?” বললো সিসিলিয়া।

“কিছুই হবে না। এরিকা আমার খুব ভালো বন্ধু। প্রায় বিশ বছর ধরে আমরা একসাথে আছি। সম্ভবত আরো বিশ বছর তার সাথে থাকবো। তেমনটাই আশা করি। তবে আমরা কখনও প্রেমিক-প্রেমিকা ছিলাম না। আর নিজেদের রোমান্সের মাঝখানে কখনই বাধা হয়ে দাঁড়াই নি

“আমাদের মধ্যে কি রোমান্স চলছে?”

“জানি না কি চলছে, তবে মনে হচ্ছে সেরকম কিছুই হচ্ছে।”

“আজ রাতে এরিকা কোথায় শোবে?”

“তার জন্য আমরা একটা ঘর ঠিক করে দেবো। হেনরিকের অনেকগুলো খালি ঘরের একটা হতে পারে। আজ সে আমার সাথে আমার বিছানায় ঘুমাতেও চাইবে না।”

কথাটা কিছুক্ষণ ভাবলো সিসিলিয়া।

“আমি জানি না আমি এটা সামলাতে পারবো কিনা। তুমি আর ও এভাবেই চলো। তবে আমি জানি না…আমি কখনও…” মাথা ঝাঁকালো সে। “আমি আমার ঘরে ফিরে যাচ্ছি। এ নিয়ে আমাকে একটু ভাবতে হবে।”

“সিসিলিয়া, তুমি আগেই আমাকে এরিকার সাথে আমার সম্পর্কের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলে। তার উপস্থিতি নিয়ে তোমার এতোটা অবাক হবার কিছু নেই।”

“তা ঠিক। তবে যতোক্ষণ সে বহু দূরে স্টকহোমে ছিলো আমি তার কথা ভুলে ছিলাম।”

নিজের জ্যাকেটটা গায়ে চাপালো সিসিলিয়া।

“এই পরিস্থিতিটা একেবারেই আজব,” হেসে বললো সে। “আমার ওখানে আজ ডিনার করতে এসো। এরিকাকেও সঙ্গে নিয়ে এসো কিন্তু। মনে হচ্ছে তাকে আমার পছন্দ হতে শুরু করেছে

কোথায় ঘুমাবে সেই সমস্যাটা এরিকা নিজেই সামাধান করে ফেললো। এর আগে ব্লমকোভিস্ট জেলে থাকার সময় মিটিং করার জন্য যখন এখানে এসেছিলো তখন হেনরিকের একটা খালি ঘরে থেকেছিলো সে। এবার এসে সরাসরি তাকে বললো আবারও সেই ঘরে থাকতে চাচ্ছে। হেনরিক নিজের খুশি হওয়া ভাবটা লুকাতে পারলো না। সে জানালো তার ওখানে এরিকা থাকলে সে খুশিই হবে।

কাজকর্মের কথা সেরে এরিকা আর ব্লমকোভিস্ট বৃজের কাছে হাটতে বের হলো। সুসানের ক্যাফেটা বন্ধ হবার ঠিক আগে ওটার সামনের টেরাসে গিয়ে বসলো তারা।

“আমি একেবারে হতাশ,” বললো বার্গার। “এতোটা পথ গাড়ি চালিয়ে এসেছি তোমাকে জেল থেকে মুক্ত হবার জন্য স্বাগতম জানাতে আর এসে কিনা দেখলাম এই শহরের ফেমে ফ্যাটালের সাথে বিছানায় শুয়ে আছে।

“এজন্যে আমি দুঃখিত।”

“তুমি আর ঐ মিস্ বিগ টিট্স কতোদিন ধরে চালাচ্ছো…” তর্জনীটা নাচিয়ে বললো বার্গার।

“ভ্যাঙ্গার যতোদিন থেকে আমাদের অংশীদার ততোদিন থেকে।

“আহা।”

“আহা মানে কি?”

“এমনি বললাম।”

“সিসিলিয়া বেশ ভালো। তাকে আমি পছন্দ করি।”

“আমি সমালোচনা করছি না। আমার কেবল খারাপ লাগছে। খুবই বাজে লাগছে। হাতের নাগালে ক্যান্ডি থাকার পরও আমাকে ডায়েট করতে হবে। জেল কেমন লাগলো?”

“বড়সড় ঘটনাবিহীন ছুটির দিনের মতো। ম্যাগাজিনের অবস্থা কেমন?”

“ভালো। বছরে এই প্রথমবারের মতো বিজ্ঞাপনের রেভিনু ক্রমশ বাড়ন্ত বলতে পারো। গত বছরে এরচেয়ে অনেক নীচে ছিলো। মনে হচ্ছে খারাপ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। হেনরিককে সেজন্যে ধন্যবাদ। তবে আজব ব্যাপার হলো পত্রিকার কাটতিও বেড়ে যাচ্ছে।”

“ওঠানামা তো সব সময়ই করে।’

“কয়েকশ’র মধ্যে। কিন্তু বিগত তিন মাসে তিন হাজার বেড়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম এটা হয়তো সৌভাগ্য, কিন্তু নতুন সাবস্ক্রাইবার বেড়েই চলছে। এটাকে আমাদের পত্রিকার ইতিহাসে সবচাইতে বড় সাবস্ক্রাইবার জাম্প বলতে পারো। একই সময় দেশের বাইরে আমাদের নিয়মিত সাবস্ক্রাইবাররাও বেশ বিপুল পরিমাণে নবায়ন করছে। আমাদের কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। আমরা তো কোনো বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেইন করি নি। ক্রাইস্টার এক সপ্তাহ ধরে চেক করে দেখেছে আমাদের গ্রাহকদের ব্যাপারে। প্রথমত তারা সবাই একেবারে নতুন গ্রাহক। দ্বিতীয়ত, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই নারী। সাধারণত পুরুষের সংখ্যই বেশি হবার কথা। তৃতীয়ত, এইসব গ্রাহকদেরকে মধ্যম আয়ের শ্রমিক হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে : শিক্ষক, মধ্যমগোছের ম্যানেজমেন্টে যারা আছে, সরকারী কর্মচারি।

“মনে করো এটা বিশাল ক্যাপিটালিস্টের বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ?”

“জানি না। এটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে আমাদের গ্রাহকদের ধরণে বিরাট পরিবর্তন এসেছে বলতে হবে। দু’সপ্তাহ আগে আমরা একটি সম্পাদকীয় কনফারেন্স করেছি নতুন গ্রাহকদের উপযোগী ম্যাটেরিয়াল দেবার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আমি চাই বিভিন্ন পেশার উপর আরো বেশি বেশি আর্টিকেল ছাপা হোক, সেইসাথে নারীদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইসু নিয়েও লেখা হতে পারে।”

“খুব বেশি পরিবর্তন কোরো না,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমরা যদি নতুন গ্রাহক বেশি বেশি করে পেতে থাকি তার মানে আমাদের পত্রিকায় ইতিমধ্যে যা ছাপা হচ্ছে তা-ই ওদের ভালো লেগেছে।”

.

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারকেও ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। সম্ভবত আলোচনা যাতে অন্য কোনো দিকে না মোড় নেয় সেজন্যে। ভ্যাঙ্গার আর বার্গার মিলেনিয়াম-এর নতুন গ্রাহক আর উন্নতি নিয়ে অনেক সময় ধরে আলোচনা করে গেলেও এক সময় তাদের আলাপ আলোচনা ঠিকই অন্য দিকে মোড় নিলো। বার্গার আচমকা ব্লমকোভিস্টের দিকে ফিরে জানতে চাইলো তার এখানকার কাজ কেমন এগোচ্ছে।

“এক মাসের মধ্যে ভ্যাঙ্গার পরিবারের ইতিহাস লেখার খসড়া শেষ করে হেনরিকের কাছে দেখার জন্য দিতে পারবো ব’লে মনে করছি।”

“এডামস ফ্যামিলি টাইপের একটি পারিবারিক ইতিহাস,” বললো সিসিলিয়া।

“এতে নিশ্চিত কিছু ইতিহাসের খোরাক থাকবে,” ব্লমকোভিস্ট বললো। ভ্যাঙ্গারের দিকে তাকালো সিসিলিয়া।

“মিকাইল, হেনরিক কিন্তু আসলে পরিবারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে মোটেও আগ্রহী নয়। সে আসলে চায় আপনি হ্যারিয়েটের নিখোঁজ রহস্য উদঘাটন করুন।”

ব্লমকোভিস্ট কোনো কথা বললো না। তার সাথে সম্পর্ক তৈরি হবার পর থেকে হ্যারিয়েটের বিষয়টা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে তাদের মধ্যে। সিসিলিয়া এরইমধ্যে বলে দিয়েছে হ্যারিয়েটের রহস্য উদঘাটনই হলো তার আসল অ্যাসাইনমেন্ট, যদিও ব্লমকোভিস্ট কখনও তার কাছে এটা স্বীকার করে নি। হেনরিককে সে কখনও বলে নি যে সিসিলিয়ার সাথে এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছে। ভ্যাঙ্গার ভুরু কুচকে তাকালো ব্লমকোভিস্টের দিকে। এরিকা অবশ্য চুপ থাকলো।

“মাই ডিয়ার হেনরিক,” বললো সিসিলিয়া। “আমি অতো বোকা নই। আমি জানি না তোমার আর মিকাইলের মধ্যে কি ধরণের চুক্তি হয়েছে তবে সে এখানে এসেছে হ্যারিয়েটের উপর কাজ করার জন্য, তাই না?”

ভ্যাঙ্গার মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ব্লমকোভিস্টের দিকে তাকালো।

“আমি বলে রাখছি এই মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতি।” বার্গারের দিকে ফিরে বললো সে। “আমার মনে হয় তোমাকে মিকাইল বলেছে হেডেবিতে সে কি কাজ করতে এসেছে।

সায় দিলো এরিকা।

“আমার ধারণা তুমি মনে করছো এটা একেবারেই নির্বুদ্ধির একটি কাজ। তোমাকে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে না। এটা আসলেই নির্বুদ্ধিতা আর ফালতু একটি কাজ। তবে আমাকে এর রহস্য জানতে হবে।”

“এই বিষয়ে আমার কোনো মতামত নেই,” ডিপ্লোমেটিক জবাব এরিকার।

“অবশ্যই।” এরপর ব্লমকোভিস্টের দিকে ফিরলো সে। “আমাকে বলো তুমি কি এমন কিছু খুঁজে বের করতে পেরেছো যাতে করে আমরা কিছুটা অগ্রসর হতে পারি?”

ভ্যাঙ্গারের চোখে না তাকানোর চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। আগের রাতে তার যে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিলো সেটার কথা মনে পড়ে গেলো তার। এই অনুভূতিটা সারা দিন তার মধ্যে রয়ে গেছিলো তবে অ্যালবামটি নিয়ে কাজ করার মতো সময় আর পায় নি। অবশেষে ভ্যাঙ্গারের দিকে তাকিয়ে মাথা দোলালো সে।

“কিছুই খুঁজে পাই নি।”

বৃদ্ধ তার দিকে ভুরু কুচকে তাকালো, একেবারে অর্ন্তভেদী দৃষ্টিতে। কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত রাখলো নিজেকে।

তোমাদের মতো তরুণদের কথা আমি জানি না,” বললো সে। “তবে আমার কিন্তু বিছানায় যাবার সময় হয়ে গেছে। ডিনারের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, সিসিলিয়া। গুডনাইট, এরিকা। আগামীকাল চলে যাবার আগে কি আমার সাথে দেখা করে যাবে?”

ভ্যাঙ্গার চলে যেতেই ঘরে নীরবতা নেমে এলো। সিসিলিয়াই প্রথম ভাঙলো সেই নীরবতা।

“মিকাইল, ব্যাপারটা কি?”

“এর মানে হলো হেনরিক লোকজনের প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে সিসমোগ্রাফের মতোই স্পর্শকাতর এক ব্যক্তি। গতরাতে তুমি যখন আমার বাড়িতে এলে আমি তখন একটি ছবির অ্যালবাম ঘাটছিলাম।”

“হ্যা?”

“কিছু একটা দেখেছিলাম। কিন্তু কি সেটা জানি না। মনে হচ্ছিলো এমন একটা কিছু পেয়ে গেছি যেটা হতে পারে উল্লেখযোগ্য কোনো সূত্র। কিন্তু ধরতে পারি নি।”

“তুমি কি নিয়ে ভাবছিলে?”

“তোমাকে সেটা বলতে পারছি না। আমি গুলিয়ে ফেলেছি। ঠিক ঐ সময়টাতেই তুমি এলে।”

সিসিলিয়ার মুখ রক্তিম হয়ে গেলো। বার্গারের দিকে না তাকিয়ে কফি বানাতে চলে গেলো সে।

.

বেশ উষ্ণ আর রোদ্রোজ্জ্বল দিন। সবুজ ঘাস গজাচ্ছে। ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো বসন্তের একটি পুরনো গান গুন গুন করে গাইছে সে : ‘ফুল ফোঁটার দিন আসছে।’ আজ মঙ্গলবার, বার্গার অনেক সকালেই চলে গেছে।

মার্চের মাঝামাঝি যখন জেলে গেলো তখনও চারদিকে বরফ আর বরফ। কিন্তু এখন চারপাশে সবুজ আর সবুজ। এই প্রথম হেডেবি আইল্যান্ডটা ভালো করে দেখার সুযোগ পেলো সে। ৮টার দিকে আনার ওখানে গিয়ে তার কাছ থেকে একটা থার্মোস ধার করে নিয়ে এলো। সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ভ্যাঙ্গারের সাথে সংক্ষিপ্ত কথা বলেছে। তার কাছ থেকে আইল্যান্ডের একটা ম্যাপ চেয়ে নিয়েছে ব্লমকোভিস্ট। গটফ্রিডের কেবিনটা একটু ভালো করে দেখতে চাইছে সে। ভ্যাঙ্গার তাকে জানালো ঐ কেবিনটা এখন মার্টিনের, তবে বিগত কয়েক বছর ধরে সেটা খালি পড়ে আছে। মাঝে মধ্যে আত্মীয়স্বজনরা ওটা ব্যবহার করতো দিন কয়েকের জন্য।

মার্টিন কাজে চলে যাবার আগেই তাকে পেয়ে গেলো ব্লমকোভিস্ট। ক্যাবিনের চাবিটা সে পেতে পারে কিনা বলতেই মার্টিন তার দিকে তাকিয়ে আমুদে হাসি দিলো।

“মনে হচ্ছে পরিবারের ইতিহাসটা এখন হ্যারিয়েট অধ্যায়ে এসে পৌঁছেছে।”

“আমি একটু দেখতে চাচ্ছিলাম…”

মিনিটখানেকের মধ্যে মার্টিন ফিরে এলো চাবি নিয়ে।

“তাহলে আমি ওখানে যেতে পারি?”

“আপনার যখন খুশি ওখানে যেতে পারেন। শুধু মনে রাখবেন ওটা এই দ্বীপের একেবারে শেষপ্রান্তে অবস্থিত। আপনি এখন যে কটেজে আছেন তারচেয়ে ওটা অনেক ভালো।’

ব্লমকোভিস্ট কফি আর স্যান্ডউইচ বানালো নিজের হাতে। ব্যাগে এসব খাবার দাবার আর পানির বোতল নিয়ে রওনা হলো সে। এই গ্রাম থেকে গটফ্রিডের কেবিনটা দেড় মাইল দূরে। হেলেদুলে হেটে গেলেও মাত্র আধ ঘণ্টা লাগলো সেখানে পৌছাতে।

মার্টিন ভ্যাঙ্গারের কথাই ঠিক। কেবিনটার আশপাশ খুবই চমৎকার। হেডে নদীর অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায় সেখান থেকে। বামে হেডেস্টাড মেরিনা আর ডানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল হার্বার অবস্থিত।

গটফ্রিড ক্যাবিনে যে কেউ থাকে না তাতে খুব অবাক হলো ব্লমকোভিস্ট। কেবিনটা একেবারে গ্রামীণ অবকাঠামোয় নির্মিত। কাঠের তৈরি আর ছাদটা টাইলের। সামনের দরজার কাছে ছোট্ট একটা বারান্দা আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটার দেখাশোনা করা হয় না। দরজা আর জানালার রঙ একেবারে ফিকে হয়ে এসেছে। ক্যাবিনের সামনের লনটা বড় বড় ঘাসে ঢেকে আছে। এটা পরিস্কার করতে সারা দিন লেগে যাবে।

দরজার তালা খুলে ভেতর থেকে সবগুলো জানালার শাটারগুলোর স্ক্রু খুলে ফেললো ব্লমকোভিস্ট। পুরো কেবিনটার আয়তন ১৩০০ বর্গ ফুটের বেশি হবে না! ভেতরটা বেশ ভালো অবস্থায় আছে। একটা ঘরের বিশাল জানালা দরজার দু’দিকে থাকা জলরাশির দিকে মুখ করা। একটা সিঁড়ি দিয়ে ক্যাবিনের পেছনে থাকা মাচাঙের মতো একটি জায়গায় ঘুমানোর ব্যবস্থা আছে। সিঁড়ির নীচে একটা গ্যাসস্টোভ, কাউন্টার আর সিঙ্ক। দেয়ালঘেষা একটি বেঞ্চ আর ডেস্ক, তার উপরে আছে একটা বইয়ের শেলফ। তার ঠিক পাশেই লম্বা একটি ওয়ারড্রব দেখতে পেলো। দরজার ডান দিকে একটি টেবিল আর পাঁচটি কাঠের চেয়ার। পাশের দেয়ালের মাঝখানে ফায়ারপ্লেস।

ক্যাবিনে কোনো বিদ্যুৎ নেই; শুধু কয়েকটি কেরোসিনের ল্যাম্প দেখা যাচ্ছে। একটি জানালার পাশে পুরনো দিনের ট্রানজিস্টার রেডিও পড়ে আছে। ওটা চালু করলো ব্লমকোভিস্ট কিন্তু চললো না। নষ্ট হয়ে আছে বহু দিন আগে থেকেই।

সংকীর্ণ সিঁড়িটা বেয়ে মাচাঙের উপরে গেলো সে। একটা ডাবল বেড, চাদরবিহীন ম্যাট্রেস আর ড্রয়ার রয়েছে সেখানে।

কিছুক্ষণ পুরো কেবিনটা তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজে দেখলো ব্লমকোভিস্ট। বুরোটা একেবারে ফাঁকা। একটা হাত মোছার তোয়ালে আর লিনেনের কটূ গন্ধ পেলো সে। ওয়ারড্রবে কিছু কাজের পোশাক আর রাবারের বুট জুতা, ছেড়াফাড়া টেনিস সু আর একটা কেরেসিন স্টোভ আছে। ডেস্কের ড্রয়ারে লেখার কাগজ, পেন্সিল, খালি স্কেচপ্যাড, এক পাতা তাস আর কিছু বুকমার্ক খুঁজে পেলো। রান্নাঘরের কাপবোর্ডে প্লেট, মগ, গ্লাস, মোমবাতি আর প্যাকেটে করে রাখার লবন, টি-ব্যাগ এরকম কিছু জিনিস আছে। ড্রয়ারে আছে খাওয়াদাওয়া করার প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র।

ডেস্কের উপর বইয়ের শেলফে একমাত্র বুদ্ধিদীপ্ত আগ্রহের জিনিস খুঁজে পেলো সে। একটা চেয়ার এনে শেলফের সামনে বসে দেখতে লাগলো ব্লমকোভিস্ট। নীচের তাকে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সে, রেকর্ড ম্যাগাজিনেট, টিডসফোরড্রিভ আর লেকটির পত্রিকার কিছু কপি আছে। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত বিলজানালেন, ম্যাট লিভস নভেল আর কিছু কমিক বইও দেখতে পেলো : দ্য ৯১, ফ্যান্টোমেন আর রোমান্স। ১৯৬৪ সালের লেকটির একটা কপি খুললে ভেতরের পিনআপ ছবিটা দেখে মুচকি হেসে ফেললো সে।

বইয়ের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ওয়ালস্ট্রমের ম্যানহাটান সিরিজের রহস্য উপন্যাস : মিকি স্পিলেইনের কিস মি, ডেডলি নামের একটি বইও আছে তাতে। আধ ডজনের মতো কিটি বুক খুঁজে পেলো ব্লমকোভিস্ট, তাদের মধ্যে ইনিড ব্লাইটনের পাঁচটি আর সিজার আরডের টুইন মিস্টেরি নামের একটি বই। আবারো হেসে ফেললো সে, কারণ একটা বই তার অনেক চেনা। অ্যাস্ট্রিড লিন্ডগ্রেনের চিলড্রেন অব নয়েজি ভিলেজ, কাল ব্লমকোভিস্ট অ্যান্ড রাসমুস এবং পিপ্পি লংস্টকিং। উপরের তাকে শর্ট ওয়েভ রেডিওর উপর একটি, জ্যোর্তিবিদ্যার উপর দুটি, পাখি লালনপালন আর সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর ইভিল অ্যাম্পায়ার নামের একপি বই আছে। ফিনিশ যুদ্ধের উপর একটি বইয়ের পাশেই রাখা আছে এক কপি বাইবেল।

বাইবেলটা খুলে ভেতরের পাতায় একটি লেখা দেখতে পেলো : হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার, মে ১২, ১৯৬৩। এটা তার নিজের বাইবেল। আস্তে করে বইটা আবার তাকে রেখে দিলো সে।

ক্যাবিনের পেছনে কাঠ আর যন্ত্রপাতি আছে। করাত, হাতুড়ি এবং কাঠমিস্ত্রিদের যন্ত্রের একটি বাক্স। পোর্চে একটা চেয়ার নিয়ে এসে ব্যাগ থেকে ফ্লাস্ক বের করে কফি পান করলো ব্লমকোভিস্ট। দূরের হেডেস্টাড উপসাগরের দিকে দৃষ্টি তার। উদাস হয়ে একটা সিগারেট ধরালো।

যতোটা ধারণা করেছিলো গটফ্রিডের কেবিনটা তারচেয়েও বেশি ভালো। এখানে হ্যারিয়েট আর তার বাবা এসে অনেক দিন ছিলো। নিজের বিয়েটা ব্যর্থ হলে লোকটা এখানে এই কেবিনটা বানিয়ে দীর্ঘদিন নির্জন জীবনযাপন করেছে পঞ্চাশের দশকে। বসে বসে সারাদিন শুধু মদ্যপান করতো লোকটা। এক সময় এখানেই, ক্যাবিনের পেছনে থাকা বিস্তৃর্ণ জলরাশিতে ডুবে মারা যায় সে। সম্ভবত গ্রীষ্মে এই ক্যাবিনে বেশ ভালো সময় কাটে, তবে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়লে এই জায়গাটা বসবাসের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। হেনরিক ভ্যাঙ্গার তাকে বলেছে গটফ্রিড উন্মাদ হয়ে যাবার আগে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনে কাজ করেছে। তার মানে লোকটা এই ক্যাবিনেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতো। নিয়মিত শেভ আর গোসল করা এবং ভদ্র কাপড়চোপড় পরা, সবই করতো সে। বেশ গোছানোও ছিলো লোকটা।

আর এখানে হ্যারিয়েট এতোটাই ঘন ঘন আসতো যে নিখোঁজ হয়ে যাবার পর তাকে সবার আগে এখানেই খোঁজা হয়েছিলো। ভ্যাঙ্গার তাকে আরো বলেছে, হ্যারিয়েট তার শেষ দিকে এখানে প্রায়ই চলে আসতো। বিশেষ করে সপ্তাহান্ত আর ছুটির দিনগুলো শান্তিপূর্ণভাবে কাটানোর জন্য। নিজের শেষ গ্রীষ্মকালটায় এক নাগারে তিন মাস এখানেই ছিলো সে, অবশ্য প্রতিদিনই কিছু সময়ের জন্য গ্রামে ফিরে যেতো। সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের বোন আনিটা ভ্যাঙ্গার তার সাথে এখানে ছয় সপ্তাহ কাটিয়েছে।

এখানে সে কি করতো? ম্যাগাজিন আর রহস্য উপন্যাসগুলো অবশ্যই তার নিজের ছিলো। সম্ভবত স্কেচপ্যাডটাও। আর বাইবেলে তো তার নিজের নামই লেখা আছে।

হ্যারিয়েট তার হারিয়ে যাওয়া বাবার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলো-এক সুকঠিন শোকের ভেতর দিয়ে কি সে যাচ্ছিলো? নাকি ধর্মান্ধ হয়ে ওঠার সাথে এর সম্পর্ক আছে? কেবিনটা একেবারে জাঁকজমকহীন-এখানে এসে একটা কনভেন্টে থাকার ভান করতো কি?

দক্ষিণ-পূর্বের সৈকত ধরে হাটতে লাগলো ব্লমকোভিস্ট। তবে পথটা একেবারেই এবড়োখেবড়ো আর খানাখন্দে ভরা। হাটার অনুপযোগী। আবারো ক্যাবিনে ফিরে এসে হেডেবির পথে পা বাড়ালো সে। ম্যাপ অনুযায়ী বনের ভেতর দিয়ে একটা পথ চলে গেছে যাকে এখানকার লোকজন ‘দূর্গ’ বলে ডাকে। ওখানে যেতে তার মাত্র বিশ মিনিট লাগলো। দূর্গ বলতে যেটাকে বোঝানো হয়েছে সেটা আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার সৈকত ঘেষা বাঙ্কারের ভগ্নস্তুপ। সবটাই বড় বড় ঘাস আর আগাছায় ঢাকা।

একটি বোটহাউজের দিকে এগিয়ে গেলো। সেই বোটহাউজের পাশেই দেখতে পেলো একটা ভাঙাচোড়া প্যাটারসন নৌকা পড়ে আছে। দূর্গটা ধরে এগোতে লাগলো সে। এক সময় চলে এলো ওস্টারগার্ডেনে।

ওস্টারগার্ডেনের এই অংশটা জলাশয় আর ডোবানালায় ভরা। অবশেষে একটি বড় জলাশয়ের কাছে চলে এলো, তার ঠিক পরেই দেখতে পেলো একটি শস্যাধার। এই জায়গা থেকে সে অনুমাণ করে বুঝতে পারলো ওস্টারগার্ডেনের রোডটা সম্ভবত একশ’ গজ দূরে।

সেই রোডের পরেই আছে সোডারবার্গেট পর্বত। ব্লমকোভিস্ট একটা ঢালু পথ বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। সোডারবার্গেটের চূড়াটা একেবারে খাড়া, আর তার সামনেই আছে বিশাল জলরাশি। পর্বতের আঁকাবাঁকা পথ ধরে হেডেবির পথে এগোতে লাগলো সে। গ্রীষ্মকালীন কটেজগুলোর সামনে এসে একটু থেমে পুরনো ফিশিং হারবার আর তার নিজস্ব চার্চের সৌন্দর্য উপভোগ করলো কিছুক্ষণ। একটা চ্যাটানো পাথরে উপর বসে ফ্লাস্কের শেষ কফিটুকু পান করলো ব্লমকোভিস্ট। সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার দূরত্ব বজায় রেখে চললো। ব্লমকোভিস্টও তাকে বিরক্ত করলো না। ফলে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করলো সে। তারপর একদিন চলে এলো তার বাড়িতে। তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো সিসিলিয়া।

“তুমি নিশ্চয় ভাবছো আমি আস্ত একটা বোকা, ছাপান্ন বছরের একজন শ্রদ্ধেয় হেডমিস্ট্রেস একেবারে টিনএজারদের মতো আচরণ করছে।”

“সিসিলিয়া, তুমি বেশ পরিপক্ক একজন মহিলা। তুমি কি করবে না করবে সেই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার তোমার আছে।”

“আমি সেটা জানি আর সেজন্যেই ঠিক করেছি তোমার সাথে আর দেখা করবো না। আমি আর সহ্য করতে…”

“আমার কাছে ব্যাখ্যা করার কোনো দরকার নেই। আশা করি আমরা এখনও বন্ধুই আছি।

“আমিও চাই আমরা যেনো বন্ধু হিসেবেই থাকি। তবে তোমার সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে পারবো না। সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে আমি বরাবরই ভালো ছিলাম না। আমি চাইবো তুমি যেনো আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”

অধ্যায় ১৬

রবিবার, জুন ১- মঙ্গলবার, জুন ১০

ছয়মাস নিষ্ফল প্রচেষ্টার পর হ্যারিয়েট কেসটি উন্মোচিত হতে শুরু করলো। জুনের প্রথম সপ্তাহে সম্পূর্ণ নতুন তিনটি রহস্য উদঘাটন করলো ব্লমকোভিস্ট। দুটো সে নিজেই করেছে, আর একটি করেছে অন্যের সাহায্য নিয়ে।

মে মাসে বার্গারের চলে যাবার পর ছবির অ্যালবামটা নিয়ে আবারো স্টাডি করে দেখেছে সে। তিন ঘণ্টা ধরে বসে থেকে একের পর এক ছবি দেখার পর এর আগে যে জিনিসটা লক্ষ্য করে তার মধ্যে একটা অনুভূতি বয়ে গিয়েছিলো সেটিই যেনো আবার আবিষ্কার করার চেষ্টা করলো ব্লমকোভিস্ট। তবে পুণরায় ব্যর্থ হলে ছবির অ্যালবামটা সরিয়ে রেখে পরিবারের ইতিহাস লেখার কাজে আবার মনোযোগ দিলো।

জুনের এক দিনে হেডেস্টাডে ছিলো সে, একেবারে ভিন্ন একটি বিষয় নিয়ে ভাবছিলো। তার বাসটা যখন ইয়ার্নভাগগাটান এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলো তখনই হুট করে বিগত কয়েক দিন ধরে তার অবচেতন মনে যে বিষয়টা ঘুরপাক খাচ্ছিলো সেটা ধরা দিলো। ব্যাপারটা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো উদ্ভাসিত হলো তার মনে। এতোটা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো যে বাসটা যখন রেলস্টেশনে শেষ স্টপেজে থামলো তখনই সে নেমে পড়লো। ওখান থেকে আরেকটা বাস ধরে ঠিক মতো স্মরণ রাখতে পেরেছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখার জন্য ফিরে এলো হেডেবিতে।

এটা অ্যালবামের প্রথম ছবিটা, হেডেস্টাডে ঐ দূর্ঘটনার সময় তোলা হ্যারিয়েটের শেষ ছবি। বাচ্চাদের প্যারেড দেখার সময় ছবিটা তোলা হয়েছিলো।

অ্যালবামে এই ছবিটাই একটু অদ্ভুত। একই দিনে তোলা হয়েছিলো বলে ছবিটা ওখানে ঠাঁই দেয়া হয়েছে। এটাই একমাত্র ছবি যেটা কিনা বৃজের দুর্ঘটনার সময় তোলা হয় নি। এই অ্যালবামটি সে নিজে এবং যারাই দেখবে তাদের চোখ চলে যাবে বৃজের ঐ ঘটনার উপর তোলা নাটকীয় আর উত্তেজনায় ভরপুর ছবিগুলোর দিকে। কিন্তু বৃজের দুর্ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে তোলা বাচ্চাদের প্যারেডের ছবিটায় কোনো নাটকীয়তা নেই।

ভ্যাঙ্গার নিশ্চিত এই ছবিটা কয়েক হাজার বার দেখেছে। সে হয়তো ছবিটা দেখেছে আর বিষন্ন মনে ভেবেছে হ্যারিয়েটকে আর কখনই দেখতে পাবে না।

কিন্তু ব্লমকোভিস্টের বেলায় সে কথা খাটে না।

ছবিটা তোলা হয়েছে রাস্তার ওপারে থাকা সম্ভবত দোতলা কোনো বাড়ির জানালা থেকে। ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল লেন্সে প্যারেডের সম্মুখ ভাগটি ধরা পড়েছে। ফ্ল্যাটবেডে মহিলারা চকচকে স্নান-পোশাক আর হারেম ট্রাউজার পরে আছে। রাস্তার দু’পাশে ভীড় করা লোকজনের দিকে মিষ্টি ছুড়ে মারছে তারা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনের আনন্দে নাচছে। একেবারে সামনে তিনজন ক্লাউন লাফালাফি করছে।

দর্শক সারির একেবারে প্রথমে আছে হ্যারিয়েট। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার পাশে আছে তিনটি মেয়ে, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে তার ক্লাসমেট, তাদের পেছনে রয়েছে কমপক্ষে কয়েকশ’ উৎসুক দর্শক।

অবচেতন মনে এটাই ব্লমকোভিস্ট খেয়াল করেছিলো। আর বাসটা যখন ঠিক সেই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলো তখন আচমকাই তার মনে উদয় হয়ে ধরা দিয়েছে আবার।

দর্শকদের যেমন আচরণ করার কথা জনসমাগমটি তেমনি করছে। টেনিস ম্যাচে দর্শকের চোখ সব সময় টেনিস বলের দিকেই থাকে, অথবা ফুটবলে যেমন থাকে ফুটবলের দিকে। ছবির বাম দিকে যাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে তারা সবাই তাকিয়ে আছে ক্লাউনদের দিকে। খুব কাছে যারা আছে তারা চেয়ে আছে স্বল্পবসনা মেয়েদের দিকে। তাদের সবার চোখমুখই শান্ত আর স্বাভাবিক। বাচ্চারা হাত তুলে দেখাচ্ছে। কেউ কেউ হাসছে। সবাইকে খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে।

কেবল একজন বাদে।

হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার চেয়ে আছে অন্য দিকে। তার সঙ্গে থাকা বান্ধবীরা তাকিয়ে আছে ক্লাউনদের দিকে। হ্যারিয়েটের মুখটা তার ডান দিকে প্রায় ৩০° থেকে ৩৫° ঘোরানো। মনে হচ্ছে তার চোখ দুটো রাস্তার ওপারে কোনো কিছুর দিকে নিবদ্ধ।

ম্যাগনিফাইংগ্লাস নিয়ে মিকাইল ছবিটার ডিটেইল দেখার চেষ্টা করলো। ছবিটা বেশ দূর থেকে তোলা হয়েছে ব’লে সে নিশ্চিত হতে পারলো না তবে হ্যারিয়েটের চেহারার মধ্যে আনন্দের কোনো ছাপ নেই। তার মুখে বরং হালকা চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। চোখ দুটো বেশ বিস্ফারিত। হাত দুটো অসাড়ভাবে ঝুলে আছে দু’পাশে। তাকে বেশ ভয়ার্ত দেখাচ্ছে। ভয়ার্ত কিংবা ক্ষিপ্ত।

মিকাইল ছবিটা অ্যালবাম থেকে বের করে একটা প্লাস্টিক বাইন্ডারে ভরে পরের বাসেই হেডেস্টাডে ফিরে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ইয়ার্নভাগসগাটানে নেমে ঠিক যে জানালা থেকে ছবিটা সম্ভবত তোলা হয়েছিলো সেটার নীচে এসে দাঁড়ালো সে। হেডেস্টাডের টাউন সেন্টারের শেষ মাথায় ভবনটি অবস্থিত। দোতলার কাঠের একটি ভবন, একটি ভিডিও স্টোর আর সান্ডস্ট্রমের টেইলারিং শপ রয়েছে সেখানে। সামনের দরজার একটি সাইনবোর্ড বলছে ১৯৩২ সালে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলো শপটা দুটো লেভেলে অবস্থিত। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলার লেভেলে যাওয়া যায়।

ঘোরানো সিঁড়ির একেবারে উপরে রাস্তার দিকে মুখ করা দুটো জানালা আছে।

“আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” ব্লমকোভিস্ট যখন বাইন্ডার থেকে ছবিটা বের করছে তখন বয়স্ক এক সেলসম্যান তাকে বললো। শপে হাতে গোনা কয়েকজন রয়েছে।

“মানে, আমি দেখতে চাচ্ছিলাম এই ছবিটা কোত্থেকে তোলা হয়েছিলো। জানালাটা যদি কয়েক সেকেন্ডের জন্য খুলি তাহলে কি কোনো সমস্যা আছে?”

লোকটা খুলতে দিলো তাকে। হ্যারিয়েট ঠিক যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলো সেই জায়গাটা দেখতে পেলো ব্লমকোভিস্ট। তার পেছনে যে কাঠের একটি ভবন ছিলো এখন সেটা নেই, সে জায়গায় পাকা দালান উঠে গেছে। অন্য কাঠের ভবনটি ১৯৬৬ সালে একটি স্টেশনারি স্টোর ছিলো, এখন সেটা স্বাস্থ্যকর খাবার আর একটি ট্যানিং সেলুন হয়ে গেছে। জানালা বন্ধ করে লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলো ব্লমকোভিস্ট।

রাস্তা পার হয়ে হ্যারিয়েট যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো ঠিক সেখানে এসে দাঁড়ালো। হ্যারিয়েট যেভাবে, যে অ্যাঙ্গেলে তাকিয়ে ছিলো সেভাবে সেও তাকালো। তার কাছে মনে হলো হ্যারিয়েট সান্ডস্ট্রমের টেইলারিং শপের দিকে চেয়েছিলো। এটা ভবনের কোনাকোনি দিক, চার রাস্তার মোড়টি এর পেছনেই আড়াল হয়ে গেছে। এখান থেকে তুমি কি দেখছিলে, হ্যারিয়েট?

ছবিটা কাঁধের ব্যাগে ভরে স্টেশনের পাশে পার্কের দিকে চলে গেলো ব্লমকোভিস্ট। ওখানকার রাস্তার পাশে একটা ক্যাফেতে বসে কফির অর্ডার দিলো সে। আচমকাই নিজের ভেতরে একটা কাঁপুনি টের পেলো।

ইংলিশে এটাকে বলে ‘নিউ এভিডেন্স,’ তবে সুইডেনে এই কথাটাকেই বলা হয় ‘নিউ প্রুফ ম্যাটেরিয়াল।’ একেবারে নতুন কিছু দেখতে পেয়েছে সে। প্রায় সাইত্রিশ বছর ধরে চলে আসা তদন্তে এই বিষয়টা কারো চোখেই পড়ে নি।

সমস্যাটা হলো এই নতুন তথ্যের কি মূল্য আছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না। তবে তার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু

সেপ্টেম্বরের যে দিনটায় হ্যারিয়েট নিখোঁজ হয় সেটা অনেক দিক থেকেই নাটকীয়তায় ভরপুর ছিলো। হেডেস্টাডে একটা উৎসব ছিলো সেদিন, হাজার হাজার জনসমাগম হয়েছিলো সেই উৎসবে। যুবা-বৃদ্ধ সবাই অংশ নিয়েছিলো তাতে। হেডেবি আইল্যান্ডে পরিবারটির বার্ষিক মিলন মেলা ছিলো ঠিক সেই দিনই! তবে বৃজের দুর্ঘটনাটি সব কিছু ছাপিয়ে গিয়েছিলো।

ইন্সপেকক্টর মোরেল, হেনরিক ভ্যাঙ্গার এবং বাকি সবাই হেডেবি আইল্যান্ডের ঐ বৃজের ঘটানটি নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। মোরেল এমনকি লিখিতভাবে বলেছে যে, হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়া আর বৃজের দুর্ঘটনাটির মধ্যে যে সম্পর্ক আছে সেই সন্দেহ থেকে সে নিজেও মুক্ত হতে পারে নি। এখন ব্লমকোভিস্টের কাছে মনে হচ্ছে এই ধারণাটি ভুল।

ঘটনাগুলো হেডেবি আইল্যান্ডে শুরু হয় নি, তারও কয়েক ঘণ্টা আগে হেডেস্টাডে শুরু হয়েছে সেটা। হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার এমন ভীতিকর কিছু দেখেছিলো যে সোজা বাড়ি ফিরে গিয়ে তার চাচা হেনরিককে সেটা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু হেনরিক ছিলো ভীষণ ব্যস্ত। এ কথা শোনার মতো সময় ছিলো না তার। এরপরই বৃজের ঘটনাটি ঘটে। আর তারপরই ঘটে হত্যাকাণ্ডটি।

ব্লমকোভিস্ট থামলো। এই প্রথম তার কাছেও মনে হচ্ছে হ্যারিয়েটকে খুন করা হয়েছে। ভ্যাঙ্গারের বিশ্বাসটা মেনে নিলো সে। হ্যারিয়েট মারা গেছে, আর সে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার খুনিকে।

আবারো পুলিশের রিপোর্ট নিয়ে বসলো। হাজার হাজার পৃষ্ঠার মধ্যে হেডেস্টাডের ঘটনাটি একেবারেই অনুল্লেখযোগ্যভাবে এসেছে। হ্যারিয়েট তার তিনজন ক্লাসমেটের সাথে ছিলো, তাদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সকাল ৯টার দিকে তারা সবাই স্টেশনের কাছে পার্কে মিলিত হয়। তাদের মধ্যে এক মেয়ে আর তার ছেলেবন্ধু জিন্স কেনার জন্য চলে যায়। তারা সবাই ইএপিএ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ক্যাফেতে বসে কফি পান করে। তারপর উৎসবের মাঠে গিয়ে কার্নিভাল বুথ আর ফিশিংপণ্ডে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। সেখানে তাদের সাথে আরো কয়েকজন স্কুলবন্ধু যোগ দিয়েছিলো। দুপুরের দিকে তারা আবার শহরে ফিরে আসে প্যারেড দেখার জন্য। দুপুর ২টা বাজার ঠিক আগে দিয়ে হ্যারিয়েট আচমকাই বন্ধুদের বলে যে তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। ইয়ার্নভাগসগাটানের বাস স্টেশনে তাকে সবাই বিদায় জানায়।

তার কোনো বন্ধুর চোখেই অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়ে নি। তাদের মধ্যে একজন ছিলো ইঙ্গার স্টেনবার্গ, যেকিনা বলেছিলো বছরখানেক ধরে হ্যারিয়েটের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। সে বলেছে ঐ দিনটায় হ্যারিয়েট খুবই চুপচাপ ছিলো। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক ঠেকেছিলো সবার কাছে কারণ হারিয়েট সব সময় তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে বেশ উৎফুল্ল থাকতো।

ঐ দিন হ্যারিয়েটের সাথে যাদের দেখা হয়েছিলো তাদের সবার সাথেই ইন্সপেক্টর মোরেল কথা বলেছে। এমনকি তাকে শুধুমাত্র হ্যালো বলেছে এরকম লোককেও বাদ দেয়া হয় নি। তল্লাশী চালানোর সময় স্থানীয় সংবাদপত্রে হ্যারিয়েটের একটি ছবি ছাপা হয়েছিলো। হেডেস্টাডের অনেক বাসিন্দা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে জানিয়েছিলো প্যারেডের দিন মেয়েটাকে তারা দেখেছে, তবে তাদের কারো কাছ থেকে এর বেশি কিছু জানা যায় নি।

পরের দিন ভ্যাঙ্গারকে নাস্তার টেবিলে পেলো ব্লমকোভিস্ট।

“আপনি বলেছিলেন ভ্যাঙ্গার পরিবার এখনও হেডেস্টাড কুরিয়ার-এর ব্যাপারে আগ্রহী।”

“ঠিক।”

“আমি তাদের ফটোগ্রাফিক আর্কাইভে একটু ঢুকতে চাই। ১৯৬৬ সাল থেকে।“

দুধের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে মুখ মুছে নিলো ভ্যাঙ্গার।

“মিকাইল, তুমি কি খুঁজে পেয়েছো?”

বৃদ্ধের চোকের দিকে সরাসরি তাকালো সে।

“সলিড কিছু না। তবে আমার মনে হয় ঘটনা পরিক্রমার ব্যাপারে আমরা ভুল করেছি।”

ভ্যাঙ্গারকে ছবিটা দেখিয়ে ব্যাখ্যা করলো সে কি ভাবছে। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো ভ্যাঙ্গার, কিছুই বললো না।

“আমার ধারণা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে শুধুমাত্র হেডেবি আইল্যান্ডে কি ঘটেছিলো সেটা নয়, আমাদেরকে মনোযোগ দিতে হবে হেডেস্টাডে ঐ দিন কি ঘটেছিলো,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “এতো দিন পর কিভাবে এটা খুঁজে বের করবো বুঝতে পারছি না। তবে শিশুদের প্যারাডের দিনটায় অনেক ছবি তোলা হয়েছে যা কিনা কোনো দিনই প্রকাশিত হয় নি। আমি ওগুলো দেখতে চাচ্ছি।”

রান্নাঘরের টেলিফোনটা ব্যবহার করলো ভ্যাঙ্গার। মার্টিনকে ফোন করে জানালো সে কি চায়, তার কাছে আরো জানতে চাইলো ঐ দিন পিকচার এডিটর কে ছিলো। দশ মিনিটের মাথায় সঠিক লোকটিকে চিহ্নিত করা হলো সেইসাথে ব্লমকোভিস্ট পেয়ে গেলো ফটো আর্কাইভে প্রবেশের অধিকার।

.

হেডেস্টাড কুরিয়ার-এর পিকচার এডিটর হলো মেডেলিন ব্লুমবার্গ, তবে তাকে সবাই মায়া বলে ডাকে। ব্লমকোভিস্ট তার সাংবাদিক জীবনে এই প্রথম কোনো নারী পিকচার এডিটরের দেখা পেলো। এখনও ফটোগ্রাফি দুনিয়াটা পুরুষদের আধিপত্যে রয়ে গেছে।

শনিবার হবার কারণে নিউজরুমটা একেবারে খালি, মায়া ব্লুমবার্গ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো, ব্লমকোভিস্টের সাথে তার দেখা হলো অফিসের প্রবেশদ্বারের সামনে। জীবনের বেশিরভাগ সময় মহিলা হেডেস্টাড কুরিয়ার-এ কাজ করেই কাটিয়ে দিয়েছে। ১৯৬৪ সালে একজন প্রুফরিডার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে সে। এরপর পেশা বদল করে ফটো- ফিনিশার হিসেবে অনেকটা বছর ডার্করুমেই কাটিয়ে দেয়। ফটোগ্রাফারদের সংকট দেখা দিলে মাঝে মধ্যে তাকেই সেই কাজে পাঠিয়ে দেয়া হতো। এরপর একজন এডিটর হিসেবে পদোন্নতি পায় সে। তবে দশ বছর আগে বয়স্ক ফটো এডিটর অবসর নিলে তার স্থলাভিষিক্ত হয় মায়া।

তার কাছে ব্লমকোভিস্ট জানতে চাইলো পিকচার আর্কাইভটা কিভাবে অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে।

“সত্যি বলতে কি আর্কাইভটা একেবারে এলোমেলো আর বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। কম্পিউটার আর ডিজিটাল ফটোগ্রাফি চলে আসার পর থেকে বর্তমান আর্কাইভটি সিডি’তে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একজন ইন্টার্ন আছে যার কাজ হলো পুরনো দিনের ছবিগুলো স্ক্যান করে কম্পিউটারে রেখে দেয়া, তবে বেশ অল্প পরিমাণেই পুরনো সংগ্রহ ওভাবে রাখা সম্ভব হয়েছে এখন পর্যন্ত। পুরনো ছবিগুলো নেগেটিভ ফোল্ডারে তারিখ অনুসারে সাজানো আছে। ওগুলো হয় নিউজরুমে আছে নয়তো রাখা আছে অ্যাটিকরুমে।”

“১৯৬৬ সালের শিশুদের প্যারাডের দিন যে ছবিগুলো তোলা হয়েছিলো সেগুলো আর ঐ সপ্তাহে তোলা সবগুলো ছবি একটু দেখতে চাচ্ছিলাম।”

ফ্রোকেন ব্লুমবার্গ তার দিকে ভুরু কুচকে তাকালো।

“মানে যে সপ্তাহে হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার নিখোঁজ হয়েছিলো?”

“আপনি সেই কাহিনীটা জানেন?”

“আপনি কুরিয়ার-এ সারা জীবন কাজ করবেন আর এই কাহিনীটা জানবেন না তা হয় নাকি। মার্টিন ভ্যাঙ্গার যখন আজ সকালে ফোন করে জানালো আপনি আর্কাইভ দেখতে চাচ্ছেন তখনই আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। আপনি কি নতুন কিছু খুঁজে পেয়েছেন?”

সংবাদের গন্ধ টের পাওয়ার মতো নাক আছে ব্লুমবার্গের। একটু মুচকি হেসে ব্লমকোভিস্ট মাথা ঝাঁকালো। মহিলাকে বানোয়াট একটি গল্প বললো সে।

“আমার মনে হয় না এই রহস্যের সমাধান কেউ করতে পারবে। ব্যাপারটা গোপনীয় তবে আপনাকে বলছি। আমি আসলে হেনরিক ভ্যাঙ্গারের আত্মজীবনী লেখার কাজ করছি। ঘোস্টরাইটার বলতে পারেন। মেয়েটার নিখোঁজ হবার কাহিনী বাদ দিয়ে তো তার জীবনী লেখা হতে পারে না। এ নিয়ে একটা অধ্যায় থাকবে বইতে। আমি এমন কিছু ছবি খুঁজছি যা এর আগে কেউ ব্যবহার করে নি-মানে হ্যারিয়েট আর তার বন্ধুদের ছবির কথা বলছি আর কি

ব্লুমবার্গ সন্দেহের চোখে তাকালো তবে ব্যাখ্যাটা সঙ্গত বলেই মনে হলো তার কাছে। এ নিয়ে তাকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না সে।

সংবাদপত্রের একজন ফটোগ্রাফার দিনে দু থেকে দশ রোল ফিল্ম ছবি তুলতে পারে। বড়সড় ঘটনা ঘটলে এ সংখ্যা দ্বিগুনও হয়ে যায়। প্রতিটি রোলে থাকে ছত্রিশটি নেগেটিভ। সুতরাং কোনো স্থানীয় সংবাদপত্র দিনে তিনশ’র বেশি ছবি পেয়ে থাকে, তার মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই পত্রিকায় ছাপা হয়। নেগেটিভ বাইন্ডারের প্রতিটি পৃষ্ঠায় একটি রোলের ছত্রিশটি ছবি সংরক্ষণ করা হয় সাধারণত। একটি বাইন্ডারে মোট ১১০টি রোল সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকে। গড়ে প্রতি বছর পঁচিশটি বাইন্ডার ছবিতে ভরে থাকে। কয়েক বছরেই দেখা যায় বাইন্ডারের সংখ্যা অনেক হয়ে গেছে, আর সেগুলোতে থাকা ছবির কমার্শিয়াল মূল্যও খুব একটা থাকে না। কিন্তু প্রত্যেক ফটোগ্রাফার এবং সংবাদপত্র মনে করে যেকোনো ছবিরই ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে তাই কোনো ছবিই তারা ফেলে দেয় না।

১৯২২ সালে হেডেস্টাড কুরিয়ার পত্রিকাটির সূচনা হয়, আর এর পিকচার ডিপার্টমেন্টটি চালু করা হয় ১৯৩৭ সাল থেকে। পত্রিকাটির স্টোররুমে মোট ১২০০ বাইন্ডার রয়েছে। সবগুলোই সাজানো আছে তারিখ অনুসারে। ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের নেগেটিভগুলো চারটি সস্তা কাপবোর্ড বাইন্ডারে সংরক্ষিত করা হয়েছে।

“ওগুলো কিভাবে দেখতে পারবো?” জানতে চাইলো ব্লমকোভিস্ট। “বাতিসহ একটি টেবিল লাগবে আমার, আর প্রয়োজনীয় ছবিগুলো কপি করারও দরকার আছে

“আমাদের এখানে তো আর ডার্করুম নেই। সবই স্ক্যান করা হয়। আপনি কি নেগেটিভ স্ক্যান করতে জানেন? “

“হ্যা। আমি ছবি নিয়ে কাজ করেছি। আমার নিজস্ব একট স্ক্যানার রয়েছে। ফটোশপে কাজ করি আমি।”

“তাহলে আপনি যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন আমরাও সেসব নিয়েই কাজ করি।”

ব্লুমবার্গ ছোট্ট একটা অফিসে নিয়ে গিয়ে বসার জন্য চেয়ার আর লাইটসহ টেবিল দিলো তাকে। সেইসাথে একটা কম্পিউটার আর স্ক্যানারও চালু করে দিলো। ক্যান্টিনের কোথায় কফি মেশিন রয়েছে তাও দেখিয়ে দিলো মহিলা, আরো জানালো ব্লমকোভিস্ট নিজে নিজে কাজ করতে পারে এখানে বসে তবে চলে যাবার আগে তাকে যেনো জানিয়ে যায়, কারণ অ্যালার্ম সিস্টেমটা আবার চালু করে দিতে হবে। তার কাজের সফলতা কামনা করে মুচকি হেসে চলে গেলো ভদ্রমহিলা।

ঐ সময়টায় দু’জন ফটোগ্রাফার কাজ করতো কুরিয়ার-এ। ঐ দিন ডিউটিতে ছিলো কুর্ট নিলান্ড নামের একজন ফটোগ্রাফার। এই লোকটাকে ব্লমকোভিস্ট চেনে। ১৯৬৬ সালে নিলান্ডের বয়স ছিলো মাত্র বিশ। এরপর নিলান্ড স্টকহোমে চলে যায়, পরবর্তীতে বিখ্যাত একজন ফটোগ্রাফার হয়ে ওঠে সে। নব্বই দশকে বেশ কয়েক বার তার সাথে নিলান্ডের দেখা হয়েছে। মিলেনিয়াম তার কাছ থেকে অনেক ছবি কিনে নিয়েছিলো ব্যবহার করার জন্য। লোকটার চেহারা এখনও তার মনে আছে। প্যারেডের ঐ দিনে নিলান্ড ডে-লাইট ফিল্ম ব্যবহার করেছিলো। খুব বেশি গতিসম্পন্ন নয়, সাধারণ মানের ফিল্ম। নিউজ ফটোগ্রাফাররা এধরণের ফিল্মই বেশি ব্যবহার করে থাকে।

ব্লমকোভিস্ট তরুণ নিলান্ডের তোলা ঐ দিনের ছবিগুলোর নেগেটিভ টেবিলে মেলে রাখলো। প্রতিটি নেগেটিভ ম্যাগনিফাইং গ্লাসের সাহায্যে স্টাডি করে গেলো সে। নেগেটিভ পর্যবেক্ষণ এক ধরণের শিল্প, এরজন্য চাই অভিজ্ঞতা। ব্লমকোভিস্টের অবশ্য সেই অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। ভালোভাবে সবগুলো নেগেটিভ দেখতে হলে সবগুলো ছবিই স্ক্যান করে কম্পিউটারে নিয়ে দেখা দরকার কিন্তু তাতে অনেক সময় লাগবে। সুতরাং প্রথমে শুধু চোখ বুলিয়ে গেলো ইন্টারেস্টিং কিছু খুঁজে পায় কিনা দেখার জন্য।

দুর্ঘটনার সময় তোলা ছবিগুলে প্রথমে খতিয়ে দেখলো সে। ভ্যাঙ্গারের সংগ্রহটি পরিপূর্ণ নয়। সম্ভবত নিলান্ড নিজেই ছবিগুলো কপি করেছে। ত্রিশটির মতো ছবি হয় অস্পষ্ট নয়তো বাজে কোয়ালিটি হবার কারণে পত্রিকায় ছাপা হয় নি।

কুরিয়ার’র কম্পিউটার বন্ধ করে নিজের ল্যাপটপের স্ক্যানারটা চালু করলো ব্লমকোভিস্ট। বাকি ছবিগুলো স্ক্যান করতে দু’ঘণ্টা লাগলো।

একটা ছবি সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়লো তার। ৩:১০ থেকে ৩:১৫-এর মধ্যে তোলা, ঠিক যে সময়টায় হ্যারিয়েট নিখোঁজ হয়। তার ঘরের জানালা কেউ খুলে রেখেছে। এই কাজটা কে করেছে সেটা খুঁজে বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলো ভ্যাঙ্গার। ব্লমকোভিস্টের কাছে যে ছবিটা আছে সেটা ঠিক জানালা খোলার সময় একটি ছবি। ফোকাস ঠিকমতো না থাকলেও একটা অবয়ব আর চেহারা দেখা খাচ্ছে তাতে। সবগুলো ছবি স্ক্যান করার আগপর্যন্ত ডিটেইল অ্যানালিসিস করার জন্য অপেক্ষা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো সে।

এরপর শিশুদের প্যারেডের ছবিগুলো খতিয়ে দেখলো। মোট ছয়টি রোল ব্যবহার করেছে নিলান্ড। প্রায় দুশোর মতো ছবি। বেলুন হাতে শত শত বাচ্চাকাচ্চার দল, বাবা-মা, উৎসুক দর্শক, রাস্তাঘাটের লোকজন, হটডগের ভ্রাম্যমান দোকানি, প্যারেডের দৃশ্য, মঞ্চের শিল্পীরা, পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান ইত্যাদির ছবি।

পুরো সংগ্রহটি স্ক্যান করার সিদ্ধান্ত নিলো ব্লমকোভিস্ট। ছয় ঘণ্টা পর ৯০টি ছবির একটি পোর্টোফোলিও তৈরি ফেললো সে। তবে তাকে যে আবার এখানে ফিরে আসতে হবে সেটা বুঝতে পারছে।

৯টার দিকে ব্লুমবার্গকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাসে করে ফিরে এলো হেডেবিতে।

রবিবার সকালে আবারো ফিরে গেলো সেখানে। অফিসটি গতদিনের মতোই ফাঁকা। হুইটসানটাইড-এর সপ্তাহন্তের ছুটি চলছে সেটা বুঝতে পারে নি ব্লমকোভিস্ট। তার মানে মঙ্গলবারের আগে পত্রিকা বের হবে না। সারাটা দিন ব্যয় করলো নেগেটিভ স্ক্যান করার কাজে। সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেলেও প্যারেডের আরো চল্লিশটির মতো ছবি রয়ে গেলো স্ক্যান করার জন্য। ব্লমকোভিস্ট ঐ ছবিগুলো খালি চোখে দেখে বুঝতে পারলো এক দঙ্গল বাচ্চা-কাচ্চা আর লোকজনের ভীড় ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু নেই।

*

হুইটসানটাইড ছুটির সময়টা নতুন ম্যাটেরিয়াল নিয়েই কাটিয়ে দিলো ব্লমকোভিস্ট। দুটো জিনিস উদ্ঘাটন করলো সে। প্রথমটি তাকে হতাশ করলেও দ্বিতীয়টি তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিলো।

প্রথমটি হলো হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মুখটি। ছবিতে ভবন আর জানালাটি বেশ দূরে এবং অস্পষ্ট থাকার কারণে সেটাকে বড় করে পরিস্কার করে নিলো ফটোশপের টুল ব্যবহার করে।

আবছা আবছা একটি হাত আর জানালার পর্দা দেখা যাচ্ছে, মুখটার অর্ধেক ঘোলা হয়ে আছে ফোকাস আর আলোর স্বল্পতার কারণে।

সেই মুখটা হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের নয়, যার চুলের রঙ ছিলো কুচকুচে কালো। ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে তার চুলের রঙ হালকা।

মুখটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও ব্লমকোভিস্ট বুঝতে পারলো ছবিটা কোনো মেয়ের। কাঁধ অবধি চুল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। মেয়েটি পরে আছে হালকা রঙের পোশাক।

জানালার অনুপাতে মহিলার উচ্চতা হিসেব করলো সে : পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার একজন মহিলা।

এই বর্ণনার সাথে মিল আছে এরকম একজনের অন্য আরেকটি ছবিতে ক্লিক করলো ব্লমকোভিস্ট। ছবিটি দুর্ঘটনাস্থলের পেছন দিকের-বিশ বছর বয়সের সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের।

সান্ডস্ট্রমের টেইলারিং শপের জানালা থেকে মোট আঠারোটি ছবি তুলেছিলো নিলান্ড। তার মধ্যে সতেরোটিতে হ্যারিয়েট আছে।

সে আর তার ক্লাসমেটরা যখন ইয়ার্নভাগসগাটানে এসে পৌছায় ঠিক একই সময়ে নিলান্ডও সেখানে হাজির হয়ে ছবি তুলতে শুরু করে। ব্লমকোভিস্ট ধারণা করলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছবিগুলো তোলা হয়েছে। প্রথম ছবিতে হ্যারিয়েট তার বন্ধুদের নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। ছবির ফ্রেমের এক কোণে তাদের দেখা যাচ্ছে। ২ থেকে ৭ নাম্বার ছবিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যারেড দেখছে তারা। এরপর তারা আরো ছয় সাত গজ সামনে এগিয়ে আসে। শেষ ছবিটা সম্ভবত একটু বিরতি দিয়ে তোলা হয়েছিলো, সেখানে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে না।

ব্লমকোভিস্ট ছবিগুলো এডিট করলো। হ্যারিয়েটের ছবিগুলো থেকে তার উর্ধ্বাংশ ক্রপ করে আরো বেশি স্পষ্ট করে তুললো ফটোশপের টুল ব্যবহার করে। ছবিগুলো সে আলাদা একটি ফোল্ডারে রেখে স্লাইড শো’র মাধ্যমে এক এক করে দেখতে লাগলো আবার। অনেকটা নির্বাক যুগের ছবির মতো দেখালো। দুই সেকেন্ড পর পর একেকটা ছবি পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো ধীরে ধীরে।

হ্যারিয়েট এসে পৌছেছে মাত্র। হ্যারিয়েট থেমে রাস্তার দিকে চেয়ে আছে। রাস্তার দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে সে। বন্ধুদের কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছে। হাসছে। বাম হাত দিয়ে নিজের কান স্পর্শ করছে। হাসছে। হঠাৎ করেই তাকে খুব বিস্মিত দেখাচ্ছে এবার। তার মুখটা ক্যামেরা থেকে আনুমানিক ২০ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে আছে এখন। তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে আছে, এখন আর সে হাসছে না। তার মুখে চিন্তার ছাপ। চোখ কুচকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে…কি? দুঃখ, আতঙ্ক, ক্রোধ? চোখ নামিয়ে রেখেছে হ্যারিয়েট। এখন আর সে নেই।

ব্লমকোভিস্ট ছবিগুলো স্লাইডশো’র মাধ্যমে বার বার দেখে গেলো।

এসব দেখে একটা থিওরি দাঁড় করালো সে। ইয়ার্নভাগসগাটানে কিছু একটা হচ্ছিলো।

কিছু একটা দেখেছে সে-কিংবা কাউকে-রাস্তার ওপারে। দেখে ভড়কে গিয়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে ভ্যাঙ্গারের সাথে এ নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে নি। একেবারে উধাও হয়ে যায় সে।

একটা ঘটেছিলো তবে ছবিতে সেটার কোনো চিহ্ন নেই।

মঙ্গলবার সকালে কফি আর স্যান্ডউইচ নিয়ে ব্লমকোভিস্ট রান্নাঘরের টেবিলে বসে আছে। একই সঙ্গে তার মধ্যে হাতাশা আর তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে। সব ধরণের প্রত্যাশার বাইরে নতুন আলামত খুঁজে বের করেছে সে। একমাত্র সমস্যা হলো এর ফলে ঘটনাগুলোর উপর কিছুটা আলো ফেললেও রহস্যের কূলকিণারা করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অগ্রগতিও হয় নি।

এই নাটকীয় ঘটনায় সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের ভূমিকাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে সে। ঐ দিন উপস্থিত সবার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারেই ভ্যাঙ্গার বিস্তারিত বলেছে তাকে। তার মধ্যে সিসিলিয়াও রয়েছে। সে তখন উপসালায় থাকতো, তবে শনিবারের মর্মান্তিক ঘটনার মাত্র দু’দিন আগে হেডেবিতে এসে পৌছায়। ইসাবেলা ভ্যাঙ্গারের সাথে থাকতো সে। হ্যারিয়েটকে সম্ভাব্য সকালবেলায় সে দেখেছে বলে জানিয়েছে, তবে তার সাথে কোনো কথা হয় নি। কোনো একটা কাজে হেডেস্টাডে যাচ্ছিলো সে। ওখানে সিসিলিয়া হ্যারিয়েটকে দেখে নি, হেডেবি আইল্যান্ডে সে ফিরে আসে দুপুর ১টার দিকে, ঠিক তখনই ইয়ার্নভাগসগাটানে ছবি তুলছিলো ফটোগ্রাফার নিলান্ড। এরপর সে পজামা কাপড় বদলিয়ে দুপুর ২টার দিকে রাতের ডিনারের জন্য টেবিল সাজাতে সাহায্য করে।

একজন অ্যালিবাই হিসেবে-যদি সেরকম কিছু হয়ে থাকে আর কি-এটা বরং খুব দুর্বল। হেডেবি আইল্যান্ডে তার ফিরে আসার সময়টি আনুমাণিক, তবে ভ্যাঙ্গারের কাছে মনে হয় নি সে মিথ্যে বলেছে। এই পরিবারে সিসিলিয়া হলো হাতেগোনা কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম যাকে হেনরিক ভ্যাঙ্গার খুব পছন্দ করে। আর এই মহিলা ব্লমকোভিস্টের প্রেমিকা ছিলো। সে কিভাবে নিরপেক্ষ হতে পারবে? তাকে সে খুনি হিসেবে কল্পনা করতে পারছে না।

কিন্তু তারপরেও অজ্ঞাত ছবিটা বলছে হ্যারিয়েটের ঘরে ঐ দিন যায় নি বলে যে কথাটা বলেছিলো সেটা পুরোপুরি মিথ্যে। এই মিথ্যে বলার পরিণতি কি হতে পারে সেটা নিয়ে ভাবলো ব্লমকোভিস্ট।

তুমি যদি এ নিয়ে মিথ্যে বলে থাকো, আর কি নিয়ে মিথ্যে বলেছো তুমি?

সিসিলিয়াকে যেতোটুকু চেনে তা নিয়ে ভাবতে লাগলো সে। একজন অর্ন্তমূখী মেয়ে, নিজের অতীত তাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে। একা বসবাস করে, যৌনজীবন বলতে কিছু নেই, লোকজনের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারে না সহজে। নিজেকে সব সময় দূরে দূরে রাখে কিন্তু সেটা যখন খসে পড়ে একেবারে লাগামহীন হয়ে যায়। এক অচেনা ব্যক্তিকে প্রেমিক হিসেবে বেছে নিয়েছে। আর সেই প্রেমিককে পরিত্যাগ করেছে কারণ তার মতে যেভাবে সে এসেছে সেভাবেই একদিন তাকে ছেড়ে এখান থেকে চলে যাবে। ব্লমকোভিস্টের ধারণা সিসিলিয়া তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে কারণ সে এখানে সাময়িক বসবাস করার জন্যে এসেছে। দীর্ঘদিন তার জীবনে থেকে তার জীবনযাপনকে প্রভাবিত করবে বলে ভয় পাবার কিছু তার ছিলো না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শৌখিন মনোবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে দিলো।

সেই রাতে দ্বিতীয় আবিষ্কারটি করলো ব্লমকোভিস্ট। হেডেস্টাডে হ্যারিয়েট কি দেখেছিলো সেটাই হলো এই রহস্যের আসল চাবিকাঠি। টাইম মেশিনে চড়ে সময়ে ভ্রমণ না করে এটা কখনও বের করতে পারবে না।

হুট করেই এই ভাবনাটি তার মধ্যে জেঁকে বসলো। নিজের মাথায় চাটি মেরে ল্যাপটপটা আবার চালু করলো ব্লমকোভিস্ট। ইয়ার্নভাগসগাটানের একটা আনক্রপ করা ছবি ওপেন করলো…এই তো!

হ্যারিয়েটের প্রায় এক গজ পেছনে একজোড়া তরুণ দম্পতি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির হাতে ক্যামেরা। ছবিটি বড় করে দেখতে পেলো একটি কোডাক ইন্সটাম্যাটিক-সস্তা আর একেবারে সহজে ব্যবহার করা যায় এমন একটি ক্যামেরা।

মেয়েটি তার গাল বরাবর ধরে রেখেছে সেই ক্যামেরাটি। ঠিক হ্যারিয়েট যেখনে চেয়ে আছে সেদিকে অ্যাঙ্গেল করে ছবি তুলছে সে।

তার হৃদস্পন্দ বেড়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরালো। অন্য একজন একটি ছবি তুলেছে। এই তরুণীকে কিভাবে সে চিহ্নিত করতে পারবে? তার তোলা ছবিটা কি সে জোগার করতে পারবে? সেই ক্যামেরার রোলটা কি কখনও ডেভেলপ করা হয়েছিলো? যদি তাই করা হয়ে থাকে তাহলে সেই ছবির প্রিন্ট কি এখনও আছে?

নিলান্ডের তোলা ছবিগুলোর ফোল্ডার ওপেন করলো সে। সবগুলো ছবি তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে আরেকটা ছবিতে সেই দম্পতিকে দেখতে পেলো। এই ছবিটা নিলান্ড তুলেছিলো বৃজের দুর্ঘটনার সংবাদ শোনার পর পরই।

তরুণীকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না, তবে স্ট্রিপ শার্ট পরা তরুণকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে লোকজনের ভীড়ে। তার হাতে একটা চাবি, একটু ঝুঁকে গাড়ির দরজা খুলছে। ছবির মূল ফোকাস ছিলো একটা ক্লাউনের নৃত্যরত দৃশ্য তবে তার ঠিক পেছনেই এই দম্পতি চলে এসেছে ছবির ফ্রেমে। অবশ্য তাদের গাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। নাম্বারপ্লেটটা আংশিক দেখা যাচ্ছে, তবে সেটা যে ‘AC3’ শুরু সেটা দেখতে পাচ্ছে ব্লমকোভিস্ট।

ষাটের দশকে গাড়ির নাম্বারপ্লেটে কাউন্টি কোড লেখা থাকতো। ছোটোবেলায় সে সব কাউন্টি কোড মুখস্ত করেছিলো। AC3 হলো ফাস্টারবোথেনের কোড।

এরপরই সে অন্য একটা জিনিস দেখতে পেলো সেখানে। গাড়ির পেছনের কাঁচে স্টিকার জাতীয় কিছু সাটানো আছে। ছবিটা আরো বড় করলে অনেকটাই ঘোলা হয়ে এলো। স্টিকারটা ক্রপ করে কেটে আলাদা করে কনট্রাস্ট আর শার্পনেস বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলো সে। লেখাটা পুরোপুরি পড়তে না পারলেও কয়েকটা অক্ষর ধরতে পারলো। অনেক অক্ষরই দূর থেকে কিংবা অস্পষ্ট অবস্থায় দেখতে একই রকম লাগে। ‘O’ অক্ষরটি ভুলবশত ‘D’ বলে মনে হতে পারে। ‘B’ আর ‘E’ অনেক সময় একই রকম লাগে। এরকম আরো কিছু অক্ষর আছে। কিছু অক্ষর ধরতে পারলো না তবে যে কয়টা ধরতে পারলো সেগুলো কাগজে লিখে রাখার পর এক লাইনের দুর্বোধ্য একটা লেখা তার চোখের সামনে পড়ে থাকলো।

R JÖ NI K RIFA RIK

অনেকক্ষণ লেখাটার দিকে চেয়ে রইলো সে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে পানি এসে পড়লো। এক সময় বুঝতে পারলো লেখাটা আসলে কি : ‘NORSJÖ SNICKERIFABRIK,’ এই লেখাটার পর ছোটো অক্ষরে আরেকটা লেখা আছে তবে সেটা পড়ার অযোগ্য। সম্ভবত একটা টেলিফোন নাম্বার।

অধ্যায় ১৭

বুধবার, জানুয়ারি ১১-শনিবার, জুন ১৪

তৃতীয় জিগশ পাজলের টুকরোর সাহায্য অপ্রত্যাশিত একটি ক্ষেত্র থেকে পেয়ে গেলো ব্লমকোভিস্ট।

সারা রাত ধরে ছবিগুলো নিয়ে কাজ করে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমালো সে। হালকা মাথা ব্যথা নিয়ে জেগে উঠে গোসল করে সোজা চলে গেলো সুসানের ক্যাফেতে। তার উচিত ভ্যাঙ্গারের কাছে গিয়ে তার নতুন উদঘাটন সম্পর্কে বিস্তারিত বলা তবে সেটা না করে ক্যাফে থেকে চলে এলো সিসিলিয়ার বাড়িতে। সে কেন হ্যারিয়েটের ঘরে যাবার কথা অস্বীকার করেছে সেটা তাকে জানতে হবে। দরজা নক করলেও কেউ খুলতে এলো না।

যেই না চলে যেতে উদ্যত হবে তখনই শুনতে পেলো : “তোর বেশ্যা বাড়িতে নেই।”

গুহা থেকে গোলাম বের হয়ে এসেছে। এক সময় খুব লম্বা ছিলো সে, প্রায় ছয় ফুটের মতো। এখন বয়সের ভারে নুব্জ, ব্লমকোভিস্টের চোখ বরাবর তাকালো সে। তার মুখ আর ঘাড়ে কালচে লিভার স্পট আছে। পায়জামা আর ধূসর রঙের ড্রেসিং গাউন পরেছে, হাতে একটা লাঠি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সিনেমায় রূপদান করা জঘন্য এক বৃদ্ধ

“কি বললেন?”

“বললাম তোর বেশ্যা বাড়িতে নেই।”

ব্লমকোভিস্ট একেবারে কাছে এসে পড়লো হেরাল্ড ভ্যাঙ্গারের। দু’জনের নাক প্রায় কাছাকাছি চলে এলো।

“তুই নিজের মেয়ের সম্পর্কে বলছিস, বানচোত শূয়োর।”

“আরে আমি তো আর রাতের অন্ধকারে এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে আসি না,” দন্তবিহীন হাসি দিলো হেরাল্ড। তার মুখের গন্ধ খুবই বাজে। পিছু হটে তার দিকে আর না তাকিয়ে সোজা পথ ধরে হাটতে লাগলো ব্লমকোভিস্ট। ভ্যাঙ্গারকে তার অফিসেই পেয়ে গেলো সে।

“আপনার ভায়ের সাথে সুখকর মোলাকাত হলো এইমাত্র,” বললো মিকাইল।

“হেরাল্ড? তাই নাকি। তাহলে সে গর্ত থেকে বেরিয়ে এসেছে। বছরে মাত্র অল্প কয়েকবার এ কাজ করে সে।“

“আমি সিসিলিয়ার দরজায় নক করতেই সে কি বলেছে জানেন? বলেছে, ‘তোর বেশ্যা বাড়িতে নেই।“

“হেরাল্ডের মতোই কথা বলেছে,” শান্ত কণ্ঠে বললো ভ্যাঙ্গার।

“নিজের মেয়েকে বেশ্যা বলে, হায় ঈশ্বর।”

“অনেক বছর ধরেই সে এটা করে আসছে। এজন্যেই তারা তাকে পছন্দ করে না।”

“সিসিলিয়াকে কেন এ নামে ডাকে সে?”

“একুশ বছর বয়সে সিসিলিয়া তার কুমারিত্ব হারিয়েছিলো। হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার পর এখানে, এই হেডেস্টাডেই গ্রীষ্মকালীন এক রোমান্সে ঘটনাটি ঘটেছিলো।”

“আর?”

“যে লোকের প্রেমে পড়েছিলো সে তার নাম ছিলো পিটার স্যামুয়েলসন। ভ্যাঙ্গার কর্পোরেশনের ফিনান্সিয়াল অ্যাসিসটেন্ট ছিলো সে। বেশ মেধাবী একজন। বর্তমানে এবিবি’তে কাজ করছে। সিসিলিয়া যদি আমার মেয়ে হতো তাহলে এ রকম মেয়েজামাই পেয়ে আমি বেশ গর্বিত হতাম। হেরাল্ড ছেলেটার চৌদ্দগুষ্টির খবর নিয়ে বের করলো যে এক চতুর্থাং ইহুদি রক্ত বহন করছে সে

“হায় ঈশ্বর।”

“তখন থেকেই নিজের মেয়েকে বেশ্যা বলে ডাকে সে।”

“সে এমন কি এটাও জেনে গেছে যে সিসিলিয়া আর আমার সাথে…”

“সম্ভবত ইসাবেলা বাদে এই গ্রামের সবাই সেটা জানে। এ কথাটা তাকে বলার মতো সুস্থ কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ এখানে নেই। ভাগ্য ভালো যে সে রাত ৮টার পরই শুতে চলে যায়। অন্য দিকে হেরাল্ড সম্ভবত তোমার প্রতিটি পদক্ষেপের উপর কড়া নজর রাখছে।”

বসে পড়লো ব্লমকোভিস্ট। তাকে খুব বোকা বোকা লাগছে।

“আপনি বলতে চাচ্ছেন সবাই…”

“অবশ্যই।”

“আপনি এতে মনে কিছু করেন নি?”

“মাই ডিয়ার মিকাইল, এটা একেবারেই আমার বিষয় নয়।”

“সিসিলিয়া কোথায়? “

“স্কুল টার্ম শেষ হয়ে গেছে। শনিবার বোনকে দেখার জন্য লন্ডনে চলে গেছে সে। এরপর ছুটি কাটাতে যাবে…উমমম, মনে হয় ফ্লোরিডায়। এক মাস পর ফিরে আসবে।”

নিজেকে আরো বোকা লাগলো ব্লমকোভিস্টের।

“আমরা কিছু দিনের জন্য আমাদের সম্পর্কটা স্থগিত রেখেছি।’

“বুঝতে পেরেছি। তারপরও এটা নিয়ে ভাবা আমার কাজ নয়। তোমার কাজ কেমন এগোচ্ছে?”

ভ্যাঙ্গারের ফ্লাস্ক থেকে এক কাপ কফি ঢেলে নিলো ব্লমকোভিস্ট।

“মনে হচ্ছে নতুন কিছু এভিডেন্স পেয়েছি।”

কাঁধের ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করে ইয়ার্নভাগসগাটানের সেই ছবিগুলো দেখালো যেখানে হ্যারিয়েটের কিছু প্রতিক্রিয়া ধরা পড়েছে। কিভাবে ঐ তরুণ দম্পতি আর তাদের গাড়িতে Norsjö কার্পেন্টারি শপের সাইনটা বের করেছে সেটাও ব্যাখ্যা করলো সে। সব দেখানোর পর ভ্যাঙ্গার আবারো ছবিগুলো দেখলো। কম্পিউটার থেকে যখন মুখ তুলে তাকালো দেখা গেলো তার চেহারাটা একেবারে বিবর্ণ হয়ে আছে। ব্লমকোভিস্ট তার কাঁধে হাত রাখলো তাকে আশ্বস্ত করার জন্য। হাতটা সরিয়ে দিয়ে চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইলো হেনরিক ভ্যাঙ্গার।

“তুমি এমন কাজ করেছো যা আমার কাছে একেবারেই অসম্ভব বলে মনে হয়েছিলো। সম্পূর্ণ নতুন জিনিস বের করতে পেরেছো তুমি। এরপর কি করবে?”

“ঐ ছবিটা যদি এখনও টিকে থাকে তাহলে সেটা দেখতে চাইবো।”

হ্যারিয়েটের জানালায় যে সিসিলিয়ার ছবি পাওয়া গেছে সেটা তাকে বললো না ব্লমকোভিস্ট।

ব্লমকোভিস্ট বের হয়ে আসার আগেই নিজের গুহায় ফিরে গেলো হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার। মোড় নিতেই একেবারে অপ্রত্যাশিত একজনকে বসে থাকতে দেখলো সে। তার কটেজের পোর্টে বসে নিউজপেপার পড়ছে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার কাছে মনে হলো সিসিলিয়া, কিন্তু পোর্চে বসে থাকা কালো চুলের মেয়েটি তার নিজেরই মেয়ে।

“হাই পাপা,” পারনিলা আব্রাহমসন বললো।

মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলো সে।

“আরে, তুমি কোত্থেকে এলে?”

“কোত্থেকে আবার, বাড়ি থেকে! স্কেলেফটিয়ায় যাচ্ছিলাম। আমি আজ রাতটা তোমার সাথে থাকতে পারি?”

“অবশ্যই। এখানে এলে কিভাবে?”

“মা জানতো তুমি কোথায় আছো। ক্যাফেতে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে ওখানকার ভদ্রমহিলা বলে দিয়েছে কিভাবে এখানে আসতে হবে। আমাকে দেখে তুমি খুশি হও নি?”

“অবশ্যই খুশি হয়েছি। ভেতরে আসো। আমাকে আগেভাগে জানিয়ে এলে তোমার জন্য ভালো ভালো খাবার-দাবার কিনে রাখতাম

“হঠাৎ করেই মনে হলো তোমার এখানে আসি। আসলে জেল থেকে তোমার মুক্তি পাবার জন্য তোমাকে ওয়েলকাম করতে চাচ্ছিলাম। তুমি তো ওখান থেকে আমাকে ফোন করো নি।”

“আমি দুঃখিত।”

“ঠিক আছে। মা অবশ্য বলেছে তুমি সব সময়ই আত্মভোলা।”

“সে আমার সম্পর্কে এরকম কথা বলে নাকি?’

“অনেকটা সেরকমই। সেটা কোনো ব্যাপার না। আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি।”

“আমিও তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু তুমি তো জানোই…”

“জানি। এখন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।”

চা বানিয়ে কিছু প্যাস্ট্রি বের করলো সে।

তার মেয়ে যা বলেছে সেটাই সত্যি। এখন আর সে ছোট্ট মেয়েটি নেই। তার বয়স এখন সতেরোর মতো। পুরোপুরি নারী বলা যায় তাকে। তার সাথে বাচ্চামেয়ের মতো ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে।

“তাহলে কেমন ছিলো সেটা?”

“কিসের কথা বলছো?”

“জেলের।”

হেসে ফেললো সে। “আমি যদি বলি সময়টা ছিলো ছুটি কাটানোর মতো তাহলে কি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে? ইচ্ছেমতো ভেবেছি আর লিখেছি।”

“করবো। আমার মনে হয় না জেল আর মঠের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য আছে। লোকজন তো নিজেদের আত্মোপলব্ধির জন্য প্রায়ই মঠে যায়।

“ভালোই বলেছো। আশা করি তোমার বাবা যে জেলখাটা লোক তাতে তোমার জন্য কোনো সমস্যা হয় নি।

“মোটেই না। তোমার জন্য আমি গর্বিত। তুমি যে নিজের বিশ্বাসের জন্য জেলে গেছো সে কথা গর্বভরে বলতে ভুলি না কখনও।’

“বিশ্বাসের জন্য?”

“টিভি’তে আমি এরিকা বার্গারকে দেখেছি।”

“পারনিলা, আমি কিন্তু নির্দোষ নই। কি ঘটেছে সেটা তোমাকে বলি নি বলে আমি দুঃখিত। তবে আমাকে কিন্তু অন্যায়ভাবে সাজা দেয়া হয় নি। বিচারে যা যা বলা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই আদালত রায় দিয়েছে।”

“কিন্তু তুমি তো নিজের কথা খুলে বলো নি।”

“না, তার কারণ আমার কাছে জোড়ালো কোনো প্রমাণ ছিলো না

“ঠিক আছে। তাহলে একটা প্রশ্নের জবাব দাও আমাকে : ওয়েনারস্ট্রম কি একজন বদমাশ নাকি ভালো লোক?”

“তার মতো বদমাশ আমি খুব কমই দেখেছি।”

“আমার জন্যে এটুকু জানাই যথেষ্ট। তোমার জন্য আমি একটা উপহার এনেছি।”

ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেজ বের করলো সে। মিকাইল সেটা খুলে দেখতে পেলো দ্য বেস্ট অব ইউরিদমিক্স-এর একটি সিডি। মেয়ে জানে এটা তার বাবার খুবই প্রিয় ব্যান্ড। সিডিটা ল্যাপটপে ঢুকিয়ে ‘সুইট ড্রিমস’ গানটা তারা দু’জনে একসাথে বসে শুনে গেলো কিছুক্ষণ।

“তুমি স্কেলেফটিয়ায় যাচ্ছো কেন?”

“সামার ক্যাম্পে বাইবেল স্কুল হবে সেখানে, সেই সাথে লাইট অব লাইফ নামের একটি কংগ্রেশন,” এমনভাবে বললো পারনিলা যেনো এটা এ পৃথিবীর সবচাইতে সেরা পছন্দ।

ব্লমকোভিস্টের শিড়দাড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছে তার মেয়ে আর হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের মধ্যে কতোটুকু মিল আছে। পারনিলার বয়স এখন ষোলো। ঠিক এ বয়সে হ্যারিয়েট নিখোঁজ হয়। তারা দু’জনেই বাবার সাথে বসবাস করে না। তারা দু’জনেই ধর্মীয় উন্মাদনায় আচ্ছন্ন।

সে জানে না তার মেয়ের এই নতুন আগ্রহের বিষয়টি কিভাবে সামলাবে। মেয়েকে সিদ্ধান্ত নেবার বেলায় প্রভাবিত করার ব্যাপারে তার মধ্যে ভয় কাজ করে। আবার এটাও সত্যি লাইট অব লাইফ নামের এই ধর্মীয় সংগঠনটির বিরুদ্ধে মিলেনিয়াম-এ বিষোদগার করার ব্যাপারে সে মোটেও ইতস্তত করবে না। সবার আগে মেয়ের মা’র সাথে এ নিয়ে কথা বলবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো সে।

তার বিছানায় মেয়েকে শুতে দিয়ে নিজে একটা কম্বল মুড়িয়ে রান্নাঘরে ঘুমালো। সকালে পারনিলাকে নাস্তা করিয়ে স্টেশনে নিয়ে গেলো ব্লমকোভিস্ট। তাদের হাতে বেশি সময় নেই সেজন্যে শপ থেকে কফি কিনে স্টেশনের একটি প্লাটফর্মে বসে হালকা আলাপ করে নিলো মেয়ের সাথে। এক সময় পারনিলা তার বাবাকে বললো : “আমি যে স্কেলেফটিয়াতে যাচ্ছি সেটা তোমার পছন্দ হচ্ছে না, তাই না?”

হতভম্ব হয়ে রইলো মিকাইল।

“এটা বিপজ্জনক কিছু নয়। তবে তুমি তো খৃস্টান নও, তাই না?”

“কোনোভাবেই আমাকে ভালো খৃস্টান বলতে পারো না।”

“তুমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না?”

“না, ঈশ্বরে আমার বিশ্বাস নেই। তবে তুমি যা করছো সে ব্যাপারে আমার

শ্রদ্ধা আছে। সবাইকে কিছু না কিছুতে বিশ্বাস করতে হয়।”

ট্রেন চলে এলে তারা একে অন্যকে দীর্ঘক্ষণ জড়িয়ে ধরে অবশেষে বিদায় জানালো। এক পা ট্রেনের পাদানিতে রেখে পারনিলা ঘুরে তাকালো বাবার দিকে।

“পাপা, আমি তোমাকে উপদেশ দেরো না। তুমি কিসে বিশ্বাস করো না করো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তোমাকে সব সময়ই ভালোবাসবো। তবে আমার মনে হয় তোমার বাইবেল নিয়ে স্টাডি করে যাওয়া উচিত।”

“কি বললে?”

“আমি তোমার লেখা উদ্ধৃতিটা দেখেছি,” বললো সে। “কিন্তু এতোটা লুকোছাপা কেন? আমার চুমু রইলো। আবার দেখা হবে।”

হাত নাড়তেই ট্রেনটা চলে গেলো, মিকাইল দাঁড়িয়ে রইলো প্লাটফর্মে। হতবিহ্বল হয়ে অপসৃয়মান ট্রেনের দিকে তাকিয়ে রইলো সে।

স্টেশন থেকে দ্রুত বাড়িতে চলে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। কিন্তু পরের বাসটি আসবে এক ঘণ্টা পর, এতোক্ষণ অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার হুসেনের সাথে আবারো দেখা হয়ে গেলো তার।

দশ মিনিট পরই নিজের অফিসে পৌঁছে গেলো মিকাইল। তার ডেস্কের উপর রাখা নোটটা তুলে নিলো হাতে।

মাগদা-৩২০১৬

সারা-৩২১০৯

আর.জে-৩০১১২

আর.এল-৩২029 মেরি-৩২০১৮

ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো কোথায় একটা বাইবেল খুঁজে পাবে। নোটটা আর একটা চাবি সঙ্গে নিয়ে ছুটে চললো গটফ্রিডের ক্যাবিনে। শেলফ থেকে যখন হ্যারিয়েটের বাইবেলটা নামালো তার হাত রীতিমতো কাঁপতে শুরু করলো।

হ্যারিয়েট কোনো ফোন নাম্বার লিখে রাখে নি। এইসব সংখ্যা আসলে বাইবেলের তৃতীয় পুস্তক পেন্টাটেখ-এর লেভিটিকাস পুস্তকের অধ্যায় আর পংক্তি।

(মাগদা) লেভিটিকাস, ২০:১৬
কোনো নারী যদি পশুর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে তোমরা অবশ্যই সেই নারী এবং প্রাণীটিকে হত্যা করবে; তারা অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে। তাদের মৃত্যুর জন্য তারা নিজেরই দায়ি…”

(সারা) লেভিটিকাস, ২১:৯
“কোনো যাজকের কন্যা বেশ্যাগিরি করার মাধ্যমে নিজেকে অপবিত্র করলে সে তার পিতার লজ্জার কারণ হয় সুতরাং তাকে অবশ্যই তাকে আগুনে দগ্ধ হতে হবে।”

(আর.জে) লেভিটিকাস, ১:১২
“যাজক প্রাণীটিকে কেটে টুকরো টুকরো করবে, তারপর সেই টুকরোগুলো (মাথা ও চর্বিযুক্ত মাংস) বেদীর উপরে রাখা আগুনের কাঠের উপর সাজিয়ে রাখবে।”

(আর.জে) লেভিটিকাস, ২০:২৭
“কোনো নারী বা পুরুষ যদি শয়তানের মাধ্যম বা ডাইনী হয়ে থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। লোকেরা তাদেরকে পাথর মেরে হত্যা করবে। তাদের মৃত্যুর জন্য তারা নিজেরাই দায়ি।”

(মেরি) লেভিটিকাস, ২০ : ১৮
“কোনো পুরুষ যদি কোনো নারীর ঋতুস্রাব চলাকালীন সময় তার সাথে যৌনকর্ম করে তাহলে উভয়কেই তাদের নিজেদের লোকজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে হবে। সে পাপ করেছে কারণ সেই পুরুষ মহিলার রক্তের উৎসকে উন্মোচিত করেছে; আর সেই মহিলা তার রক্তের উৎসকে করেছে অনাবৃত। “

বাইরের পোর্চে গিয়ে বসে পড়লো ব্লমকোভিস্ট। হ্যারিয়েটের বাইবেলে প্রতিটি পংক্তির নীচেই দাগ দিয়ে রাখা হয়েছে। সিগারেট খেতে খেতে কাছের কোথাও পাখির গান শুনতে লাগলো সে।

তার কাছে নাম্বারগুলো আছে। কিন্তু নামগুলো নেই। মাগদা, সারা, মেরি, আর.জে এবং আর.এল।

আচমকা মিকাইলের মস্তিষ্কে একটা বিরাট গোলকধাধাতুল্য গহ্বর খুলে গেলো যেনো। ইন্সপেক্টর মোরেল তাকে হেডেস্টাডের আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া সেই মেয়ের কথাটি বলেছিলো। রেবেকা কেস। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে ঘটেছিলো সেটা। মেয়েটাকে ধর্ষণ করার পর খুন করা হয়। তার মাথাট কেটে জ্বলন্ত কয়লার উপর রেখে দেয়া হয়েছিলো। “প্রাণীটিকে কেটে টুকরো টুকরো করবে, তারপর সেই টুকরোগুলো বেদীর উপরে রাখা আগুনের কাঠের উপর সাজিয়ে রাখবে।” রেবেকা আর.জে। তার শেষ নামটা কি ছিলো?

কিসের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলো হ্যারিয়েট?

ভ্যাঙ্গার একটু অসুস্থ। ব্লমকোভিস্ট যখন তার সাথে দেখা করতে গেলো গৃহপরিচারিকা অ্যানা জানালো সে যেনো বেশিক্ষণ না থাকে।

“মনে হয় সর্দি,” নাক টেনে বললো হেনরিক। “তুমি কি চাও?”

“আমার একটা প্রশ্ন করার ছিলো?”

“বলো।”

“চল্লিশের দশকে হেডেস্টাডে একটা খুন হয়েছিলো তার কথা কি কখনও শুনেছেন? রেবেকা নামের এক মেয়ে তার মাথাটা কেটে আগুনের উপর রাখা হয়েছিলো।”

“রেবেকা জ্যাকবসন,” সঙ্গে সঙ্গে বললো সে। “এই নামটা আমি কখনও ভুলবো না। যদিও অনেক বছর ধরে নামটা কাউকে বলতে শুনি নি।”

“আপনি তাহলে মেয়েটার খুনের কথা জানেন?”

“অবশ্যই জানি। খুন হবার সময় রেবেকা জ্যাকবসনের বয়স ছিলো তেইশ কি চব্বিশ বছর। ঘটনাটা…১৯৪৯ সালের দিকে হবে। বিরাট শোরগোল পড়ে গিয়েছিলো। আমারও তাতে ছোট্ট একটি ভূমিকা ছিলো।”

“তাই নাকি?”

“হ্যা। রেবেকা ছিলো আমাদের প্রতিষ্ঠানেরই একজন কেরাণী। খুবই জনপ্রিয় আর দেখতে দারুণ আকর্ষণীয়া এক তরুণী। কিন্তু তুমি এসব জানতে চাচ্ছো কেন?”

“আমি ঠিক নিশ্চিত নই, হেনরিক। তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা ধরতে পেরেছি। এ নিয়ে আমাকে আরেকটু ভাবতে হবে।”

“তুমি কি মনে করছো হ্যারিয়েট আর রেবেকার ঘটনা দুটোর মধ্যে কোনো কানকশান আছে? ঘটনা দুটো কিন্তু…প্রায় সতেরো বছর ব্যবধানে ঘটেছে।”

“আমাকে একটু ভাবতে দিন, আপনি যদি আগামীকাল সুস্থ থাকেন তো এখানে এসে কথা বলে যাবো।”

ব্লমকোভিস্ট পরের দিন আর ভ্যাঙ্গারের সাথে দেখা করতে গেলো না। রাত একটার ঠিক পর পরই সে রান্নাঘরের টেবিলে বসে হ্যারিয়েটের বাইবেলটা পড়ার সময় শুনতে পেলো একটা গাড়ি দ্রুত গতিতে বৃজটা অতিক্রম করছে। জানালা দিয়ে উকি মারতেই একটা অ্যাম্বুলেন্স দেখতে পেলো সে।

কিছু একটা আশংকা করতে পেরে দৌড়ে বাইরে চলে এলো মিকাইল। অ্যাম্বুলেন্সটা এসে থেমেছে ভ্যাঙ্গারের বাড়ির সামনে। নীচ তলার সবগুলো বাতি জ্বলছে। পোর্চের কাছে আসতেই দেখতে পেলো অ্যানা রীতিমতো কাঁপছে।

“তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে,” বললো সে।। “কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে জেগে উঠে জানালো বুকে ব্যাথা করছে। তারপরই অজ্ঞান হয়ে যায়।”

গৃহপরিচারিকার কাঁধে হাত রাখলো ব্লমকোভিস্ট। অচেতন ভ্যাঙ্গারকে মেডিকরা স্ট্রেচারে নিয়ে আসা পর্যন্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। তাদের পেছনে চিন্তিত মার্টিন ভ্যাঙ্গার আস্তে আস্তে হেটে আসছে। অ্যানাই তাকে ঘুম থেকে জেগে ডেকে এনেছে। তার পায়ে স্লিপার আর ফ্লাইয়ের জিপার পর্যন্ত খোলা। মিকাইলের দিকে তাকিয়ে আলতো করে মাথা নেড়ে অ্যানার দিকে ফিরলো সে।

“আমি হাসপাতালে যাচ্ছি। বার্গারকে ফোন করে জানিও। পারলে লন্ডনে থাকা সিসিলিয়াকেও ফোন কোরো,” বললো মার্টিন। “ডার্চকেও জানাতে হবে।”

“আমি ফ্রোডির বাড়িতে যেতে পারি,” ব্লমকোভিস্ট বললে কৃতজ্ঞতায় অ্যানা মাথা নেড়ে সায় দিলো।

ব্লমকোভিস্ট তার দরজায় নক করলে বেশ কয়েক মিনিট পর ঘুম থেকে উঠে দরজা খুললো ফ্রোডি।

“একটা দুঃসংবাদ আছে, ডার্চ। হেনরিককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। মার্টিন আপনাকে খবরটা দিতে বললো।”

“হায় ঈশ্বর,” বললো ফ্রোডি। হাতঘড়িতে তাকালো সে। “আজ তো ফ্রাই ডে দ্য থার্টিন! শুক্রবার এবং তেরো তারিখ,” বললো ফ্রোডি।

.

পরদিন সকালে মোবাইলে ডার্চ ফ্রোডির সাথে তার অল্প একটু কথা হলো। তাকে আশ্বস্ত করা হলো যে ভ্যাঙ্গার এখনও বেঁচে আছে, সে কি বার্গারকে ফোন করে জানিয়েছিলো কিনা তাও জানতে চাইলো ভদ্রলোক। অবশ্যই। আর খবরটা শুনে মিলেনিয়াম-এর সবাই বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে আছে।

ঐদিন রাতে এসে ফ্রোডি তাকে ভ্যাঙ্গারের বর্তমান অবস্থার কথা জানালো বিস্তারিত।

“এখনও বেঁচে আছে তবে অবস্থা ভালো নয়। খুবই সিরিয়াস হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। সেইসাথে ইনফেকশনও হয়েছে।”

“তাকে কি দেখেছেন?”

“না। ইনটেন্সিভ কেয়ারে আছে। তার পাশে বসে আছে মার্টিন আর বার্গার।”

“তার সম্ভাবনা কতোটুকু?”

“অ্যাটাকটা সামলাতে পেরেছে সে, এটা ভালো লক্ষণ। হেনরিকের স্বাস্থ্য বেশ ভালো কিন্তু বয়স তো হয়েছে। আমাদেরকে একটু অপেক্ষা করতে হবে।”

তারা চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে চিন্তা করলো। কফি বানালো ব্লমকোভিস্ট। ফ্রোডিকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছে।

“এখন কি হবে সেটা আপনার কাছে জানতে চাইছি আমি?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

মুখ তুলে তাকালো ফ্রোডি।

“আপনার কাজের যে কন্ডিশন সেটার কোনো হেরফের হবে না। এটা চুক্তির মাধ্যমে করা হয়েছে। এ বছরের শেষে কাজটার মেয়াদ সমাপ্ত হবে। হেনরিক মরুক আর বাঁচুক তাতে কিছুই যায় আসে না। এ নিয়ে আপনি চিন্তিত হবেন না।”

“না, আমি আসলে সেটা বলতে চাই নি। আমি ভাবছি তার অবর্তমানে কার কাছে রিপোর্টটা দেবো?’

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ফ্রোডি।

“মিকাইল, আপনার মতো আমিও জানি হেনরিকের জন্য হ্যারিয়েটের ব্যাপারটা নিছক অবসরের ভাবনা ছাড়া আর কিছু না।”

“এটা বলবেন না, ডাৰ্চ।”

“আপনি কি বলতে চাচ্ছেন?”

“আমি নতুন এভিডেন্স পেয়েছি,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “গতকাল আমি হেনরিককে তার কিছুটা বলেছিলামও। আমার আশংকা এর ফলেই হয়তো তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।

তার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকালো ফ্রোডি।

“ঠাট্টা করছেন নিশ্চয়…”

মাথা দোলালো ব্লমকোভিস্ট।

“বিগত কয়েক দিনে আমি হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার ব্যাপারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ম্যাটেরিয়াল খুঁজে পেয়েছি। আমি আসলে চিন্তিত হেনরিকের অবর্তমানে কার কাছে এসব রিপোর্ট করবো সেটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কখনও আলোচনা হয় নি।

“আপনি আমার কাছে রিপোর্ট করবেন।“

“ঠিক আছে। তাই হবে। আমি কি আপনাকে এখনই বলবো কি খুঁজে পেয়েছি?”

ব্লমকোভিস্ট সবিস্তারে ফ্রোডির কাছে বললো। ইয়ার্নভাগসগাটানে ছবিগুলোও দেখালো তাকে। তার নিজের মেয়ে কিভাবে ডেটবুকের রহস্যময় নামগুলোর রহস্য উদ্ধার করতে সাহায্য করেছে সেটাও জানালো। শেষে বললো ১৯৪৯ সালে রেবেকা জ্যাকবসনের হত্যাকাণ্ডের সাথে কিভাবে হ্যারিয়েটের ঘটনার সম্পর্ক আছে।

শুধুমাত্র সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারকে যে হ্যারিয়েটের জানালায় দেখা গেছে সেটা বাদ দিয়ে প্রায় সবই বললো তাকে। সিসিলিয়ার সাথে কথা না বলে তাকে সন্দেহের তালিকায় ফেলতে চাইছে না সে।

ফ্রোডির চোখেমুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।

“আপনি সত্যি মনে করছেন রেবেকার খুনের সাথে হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হওয়ার সম্পর্ক আছে?”

“এটা একেবারেই বেখাপ্পা মনে হতে পারে সেটা আমি মানছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি হ্যারিয়েট তার ডেটবুকে আর.জে লেখার পর তার পাশেই ওল্ড টেস্টামেন্টের আগুনে পুড়ে মারার একটি পংক্তির উল্লেখ করেছে। রেবেকা জ্যাকবসনকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। ভ্যাঙ্গার পরিবারের সাথে তার আরেকটা কানেকশান আছে-মেয়েটা ভ্যাঙ্গারদের প্রতিষ্ঠানেই কাজ করতো।

“কিন্তু তার সাথে হ্যারিয়েটের সম্পর্ক কি?”

“এখনও সেটা আমি জানি না। সেটা আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। হেনরিককে যা বলতাম তার সবই আপনাকে আমি বলবো। তার হয়ে আপনিই সিদ্ধান্ত নেবেন।”

“সম্ভবত আপনার উচিত পুলিশকে ব্যাপারটা জানানো।”

“না। অন্তত হেনরিকের আর্শীবাদ ছাড়া তো নয়ই। রেবেকার কেসটা অনেক আগেই ক্লোজ হয়ে গেছে। চুয়ান্ন বছর পর তারা এরকম কোনো কেস পুণরায় চালু করবে না।”

“ঠিক আছে। তাহলে আপনি কি করবেন?

রান্নাঘরের ছোট্ট পরিসরেই পায়চারি করলো ব্লমকোভিস্ট।

“প্রথমে আমি ছবির ব্যাপারটা নিয়ে এগোতে চাই। হ্যারিয়েট কি দেখছিলো সেটা যদি আমরা দেখতে পাই…তাহলে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। নরসিও’তে গিয়ে ছবির ব্যাপারটা খোঁজ নেবার জন্য আমার একটা গাড়ির দরকার হবে। তার সাথে আমি লেভিটিকাসের প্রতিটি পংক্তি রিসার্চ করতে চাই। একটা খুনের সাথে অন্য আরেকটা খুনের সংযোগ আমরা পেয়েছি। আমাদের কাছে আছে চারটা পংক্তি। সম্ভবত আরো চারটা ক্লু। এটা করতে হলে…আমার আরো সাহায্য লাগবে। “

“কি ধরণের সাহায্য?”

“পুরনো দিনের পত্রিকা ঘেটে ‘মাগদা’ আর ‘সারা’সহ অন্য নামগুলো খুঁজে বের করার জন্য আমার একজন রিসার্চ সহকারী দরকার। আমার ধারণা রেবেকাই একমাত্র ভিকটিম নয়।”

“আপনি বলতে চাচ্ছেন এ কাজে আরো একজনকে চাচ্ছেন আপনি…”

“প্রচুর কাজ করতে হবে এখন, আর সেসব করতে হবে খুব দ্রুত। আমি যদি একজন পুলিশ অফিসার হতাম তাহলে এ কাজে প্রচুর লোকজনের সাহায্য পেতাম। অনেককে কাজে লাগাতে পারতাম। আমার দরকার একজন পেশাদার লোকের যে কিনা আর্কাইভের কাজে বেশ অভিজ্ঞ, সেইসাথে তাকে বিশ্বস্তও হতে হবে।”

“বুঝতে পেরেছি…মনে হচ্ছে সেরকম একজন অভিজ্ঞ রিসার্চারকে আমি চিনি,” বললো ফ্রোডি। “ঐ মেয়েটাই আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড তদন্ত করেছিলো

“কার কথা বলছেন, কি করেছিলো সে?” বললো ব্লমকোভিস্ট।

“আমি আসলে নিজের ভাবনার কথা মুখে বলে ফেলেছি,” ফ্রোডি বললো। “কিছু না।” বুড়ো হয়ে যাচ্ছি, ভাবলো আইনজীবি ভদ্রলোক।

“আপনারা আমার ব্যাপারে অন্য কাউকে দিয়ে তদন্ত করিয়েছেন? “এটা নাটকীয় কিছু না, মিকাইল। আমরা আপনাকে একটা কাজে নিয়োগ দিতে চাচ্ছিলাম তাই আপনি কি রকম ব্যক্তি সেটা একটু খতিয়ে দেখেছি।”

“এজন্যেই হেনরিক আমার সম্পর্কে এতো কিছু জানে। এই তদন্ত কতোটা ব্যাপক হয়েছিলো?”

“অনেকটাই।”

“মিলেনিয়াম-এর সমস্যাটাও কি খতিয়ে দেখা হয়েছিলো?”

কাঁধ তুললো ফ্রোডি। “তাতো হয়েছিলোই।”

আরেকটা সিগারেট ধরালো ব্লমকোভিস্ট। আজকের দিনে এটা তার পঞ্চম সিগারেট।

“লিখিত রিপোর্ট?”

“মিকাইল, এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই।

“আমি সেই রিপোর্টটা পড়তে চাই,” বললো সে।

“ওহ্। এমন কিছু তাতে নেই। আপনাকে ভাড়া করার আগে আপনার সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিতে চেয়েছিলাম আমরা, এর বেশি কিছু না।”

“আমি সেই রিপোর্টটা পড়তে চাই,” কথাটা আবারো বললো মিকাইল।

“এটা দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”

“তাই নাকি? তাহলে আমার কথাটা শুনে রাখুন : হয় এক ঘণ্টার মধ্যে সেই রিপোর্টটা আমার হাতে আসবে নয়তো আমি এ কাজ আর করবো না। ছেড়ে দেবো। সোজা স্টকহোমের ট্রেন ধরবো আজই। রিপোর্টটা কোথায়?”

তারা একে অন্যের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। এরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালো ফ্রোডি।

“আমার অফিসে, মানে আমার বাড়িতে।”

.

এ নিয়ে অনেক বাদানুবাদ করলো ফ্রোডি। অবশেষে সন্ধ্যা ছ’টার পর লিসবেথ সালান্ডারের রিপোর্টটা ব্লমকোভিস্টের হাতে তুলে দেয়া হলো। প্রায় আশি পৃষ্ঠা দীর্ঘ একটি রিপোর্ট, সেইসাথে কয়েক ডজন আর্টিকেলের ফটোকপি, সার্টিফিকেট আর তার জীবনের অন্যান্য রেকর্ডও জুড়ে দেয়া আছে।

অনেকটা জীবনী এবং ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টের মতো নিজের সম্পর্কে লেখাগুলো পড়া অদ্ভুত একটি অভিজ্ঞতাই বটে। রিপোর্টটা পড়ে সে বিস্মিত। এতোটা ডিটেইল তথ্য বের করেছে মেয়েটা! সালান্ডার তার অতীতের এমন কিছু অংশ বের করে এনেছে যা কিনা তার কাছে মনে হয়েছিলো এগুলো একেবারেই ইতিহাসের জঞ্জালে চাপা পড়ে গেছে। যৌবনে তার সাথে এক নারীবাদী তরুণীর সম্পর্ক ছিলো যে কিনা বর্তমানে উদীয়মান রাজনৈতিক, তার সম্পর্কেও রিপোর্টে অনেক কথা বলা আছে। এই মেয়েটা কার সাথে কথা বলে এসব জেনেছে? এক সময় যে সে রকব্যান্ড বুটস্ট্র্যাপ-এ ছিলো সেটা বর্তমানে কেউই জানে না এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত কিন্তু রিপোর্টে তারও উল্লেখ আছে। তার টাকা-পয়সার নিখুঁত হিসেবও বের করেছে মেয়েটা। এটা সে কিভাবে করতে পারলো?

সাংবাদিক হিসেবে ব্লমকোভিস্ট দীর্ঘদিন লোকজন সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটন করে গেছে। একেবারে পেশাদারী দৃষ্টিকোণ থেকে সালান্ডারের কাজের গুনগতমানের বিচার করতে পারছে সে। এই সালান্ডার নামের মেয়েটি যে অসাধারণ ইনভেস্টিগেটর সে সম্পর্কে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। সে নিজে কোনো ব্যক্তির ব্যাপারে এরকম কোনো তদন্ত করতে পারতো কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

আরেকটা কথা তার মনে হলো; ভ্যাঙ্গারকে তাদের পত্রিকায় অংশীদার করে ভালোই করেছে তারা। কারণ রিপোর্টে মিলেনিয়াম-এর আর্থিক যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে সেটা একেবারেই নাজুক! এমন কি এরিকা আর তার দীর্ঘদিনের সম্পর্কের কথাও অনেক আগে থেকেই জানতো ভ্যাঙ্গার এই রিপোর্টের বদৌলতে। বার্গারের সাথে যখন ভ্যাঙ্গার প্রথম যোগাযোগ করে তখনই লোকটা জানতো পত্রিকার অবস্থা কতোটা নাজুক ছিলো। লোকটা কি ধরণের খেলা খেলছে?

ওয়েনারস্ট্রমের ঘটনাটিও সংক্ষেপে আছে। তবে এই রিপোর্টটা যে-ই করে থাকুক না কেন সে মামলা চলাকালীন সময় আদালতে উপস্থিত ছিলো। মামলা চলার সময় ব্লমকোভিস্ট যে কোনো রকম মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলো সে সম্পর্কে রিপোর্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। স্মার্ট মহিলা।

সবটা পড়ে মিকাইল উঠে দাঁড়ালো। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। মামলা শেষ হবার পর কি হবে সে সম্পর্কে সালান্ডার নিজের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ণও করেছে। মিলেনিয়াম থেকে তার পদত্যাগের পর এরিকা প্রেসকনফারেন্সে যা বলেছে ঠিক তাই লিখেছে মেয়েটা।

কিন্তু সালান্ডার তো এটা করেছে সেই প্রেসকনফান্সেরও আগে। রিপোর্টের কভারটা দেখলো সে। ব্লমকোভিস্টকে সাজা দেয়ার তিন দিন আগে এই রিপোর্টটা করা হয়েছে। এটা তো অসম্ভব। প্রেসরিলিজটা তো তখনও শুধুমাত্র একটি জায়গায় সযত্নে রাখা ছিলো। রমকোভিস্টের কম্পিউটারে। তার অফিসের কম্পিউটারে নয়, একেবারে তার নিজের ল্যাপটপে। লেখাটা তো কখনও প্রিন্টও করা হয় নি। বার্গারের কাছেও এর কোনো কপি ছিলো না, যদিও বিষয়টা নিয়ে তারা কথাবার্তা বলেছিলো।

সালান্ডারের রিপোর্টটা রেখে দিলো ব্লমকোভিস্ট। গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাইরে। সৈকত ধরে সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের বাড়িটা অতিক্রম করে মার্টিনের বিলাসবহুল মোটরবোটটা পেছনে ফেলে আরো সামনে এগিয়ে গেলো সে। খুব আস্তে আস্তে হাটছে আর ভাবছে। অবশেষে একটা বিশাল পাথরের উপর বসে হেডেস্টাড উপসাগরের দিকে তাকিয়ে রইলো। এসবের একটাই জবাব আছে তার কাছে।

“তুমি আমার কম্পিউটারে ঢুকেছিলে, ফ্রোকেন সালান্ডার,” তার মুখ দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলো। “তুমি একজন হ্যাকার।”

অধ্যায় ১৮

বুধবার, জুন ১৮

স্বপ্নহীন একটা ঘুম থেকে জেগে উঠলো সালান্ডার। একটু অসুস্থ বোধ করছে। মাথা ঘুরিয়ে না তাকিয়েই বুঝতে পারছে মিম্মি ইতিমধ্যেই কাজে চলে গেছে। তারপরও বেডরুমের গুমোট আবহাওয়ায় মেয়েটার হালকা গন্ধ টের পাচ্ছে সে। মিল-এ ইভিল ফিঙ্গারসের সাথে গতরাতে অনেকগুলো বিয়ার খেয়েছিলো। মিম্মিকে নিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসেছে তারপর।

মিম্মির মতো সালান্ডার নিজেকে কখনও একজন সমকামী ভাবে না। তবে সে কি একজন স্ট্রেইট, গে, নাকি লেসবিয়ান সেটাও কখনও ভেবে দেখে নি। এ ব্যাপারটা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামায় না সালান্ডার। তার সাথে যে ঘুমাবে সে এটা নিয়ে ভাববে। তবে তাকে যদি বেছে নিতে বলা হয় সে একজন পুরুষকেই বেছে নেবে-তারাই এগিয়ে আছে, তার নিজের পরিসংখ্যান অন্তত তাই বলে। তবে সমস্যা হলো বিরক্তিকর নয় এবং বিছানায় বেশ পারঙ্গম একজন পুরুষ খুঁজে পাওয়াটাই বড় সমস্যা। মিম্মির বেলায় সে একটু ‘মধুর ছাড়’ দিয়েছে। সে- ই পটিয়েছে সালান্ডারকে। এক বছর আগে প্রাইড ফেস্টিভেলের বিয়ারশপে তার সাথে মিম্মির দেখা হয়। মিম্মি হলো একমাত্র মানুষ যাকে সে ইভিল ফিঙ্গারসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। তবে তাদের এই সম্পর্কটা এখনও অতোটা সিরিয়াস পর্যায়ে যায় নি। মিম্মির নরম আর উষ্ণ শরীরের সংস্পর্শে ঘুমাতে তার ভালোই লাগে, আরো ভালো লাগে একসাথে নাস্তা করতে।

তার ঘড়ি বলছে ৯:৩০ বাজে। দরজার বেলটা যখন আবারো বেজে উঠলো তখনই বুঝতে পারলো কেন তার ঘুমটা ভেঙে গেছে। অবাক হয়ে উঠে বসলো সে। এসময় কখনই তার ঘরের বেল বাজায় নি কেউ। সত্যি বলতে কি খুব অল্প সংখ্যক লোকই তার দরজায় বেল বাজিয়েছে। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দরজা খুলে তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। মিকাইল ব্লমকোভিস্ট দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। শিড়দাড়া বেয়ে শীতল একটি অনুভূতি বয়ে যেতেই আনমনে পিছিয়ে গেলো এক পা।

“শুভ সকাল, ফ্রোকেন সালান্ডার,” বেশ আন্তরিকভাবেই সম্ভাষণ জানালো তাকে। “মনে হচ্ছে এখনও ঘুম কাটে নি তোমার। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?”

জবাবের আশা না করে ভেতরে ঢুকে নিজেই দরজা বন্ধ করে দিলো ব্লমকোভিস্ট। হলের মেঝেতে স্তুপ করে রাখা কাপড় আর সংবাদপত্রে ঠাসা অনেকগুলো ব্যাগের দিকে কৌতুহলী চোখে তাকালো সে। এরপর যখন বেডরুমে তাকালো সালান্ডারের দুনিয়াটা তখন রীতিমতো ঘুরছে। ভেবেই পাচ্ছে না এসব কী হচ্ছে। কিভাবে? কি? কে? ব্লমকোভিস্ট তার দিকে বিস্ময় আর কৌতুহল নিয়ে তাকালো।

“মনে হচ্ছে এখনও নাস্তা করো নি, তাই সঙ্গে করে কিছু খাবার নিয়ে এসেছি আমি। গরু আর টার্কির রোস্ট, সাথে একটি ভেজিটেরিয়ান এভোকাডো। তুমি কি খেতে পছন্দ করো সেটা না জেনেই এগুলো নিয়ে এসেছি।” রান্নাঘরে ঢুকে তার কফিমেকারটা তুলে নিলো সে। “কফি কোথায় রাখো?” জানতে চাইলো ব্লমকোভিস্ট। ট্যাপ থেকে পানির শব্দ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বরফের মতো জমে রইলো সালান্ডার। দ্রুত এগিয়ে এলো তারপর।

“থামুন! এক্ষুণি থামুন!” বুঝতে পারলো বেশি জোরে চেঁচাচ্ছে তাই গলারস্বর নামিয়ে ফেললো সঙ্গে সঙ্গে। “আরে আপনি এমনভাবে এখানে ঢুকে পড়েছেন যেনো এটা আপনার নিজের ঘর। আমাদের তো পরিচয় পর্যন্ত নেই।”

ব্লমকোভিস্ট থেমে তার দিকে ঘুরে তাকালো। তার হাতে একটা জগ। “ভুল! অন্য সবার চেয়ে তুমি আমাকে অনেক বেশি চেনো। কি, সত্যি বলেছি না?”

আবারো ঘুরে কফিমেশিনে পানি ঢেলে তার কাপবোর্ড খুলে কফি খুঁজতে লাগলো সে। “তুমি এই কাজটা কিভাবে করেছো সেটা অবশ্য আমি জানি। আমি তোমার সব সিক্রেট জেনে গেছি। “

চোখ বন্ধ করে ফেললো সালান্ডার। তার কাছে মনে হচ্ছে মেঝেটা যেনো কাঁপছে। মানসিক প্যারালাইসিস অবস্থায় পড়ে গেছে সে। মাথা ঘুরছে তার। পরিস্থিতিটা একেবারেই অবাস্তব। কোনোভাবেই তার মাথা কাজ করছে না। যাদের উপর সে কাজ করে তাদেরকে কখনই সামনাসামনি মোকাবেলা করে নি। আমি কোথায় থাকি সেটা সে জানে! রান্নাঘরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এটা তো একেবারেই অসম্ভব। মারাত্মক একটি ব্যাপার। আমি কে সেটা সে জানে!

টের পেলো তার গায়ের চাদরটা পড়ে যাচ্ছে, ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিলো সেটা। লোকটা কিছু বললেও প্রথমে সেটা ধরতে পারলো না সালান্ডার। “আমাদের কথা বলতে হবে,” আবারো বললো ব্লমকোভিস্ট। “তবে আমার মনে হয় তার আগে তোমার গোসল করে নেয়া দরকার।

গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলো সে। “আমার কথা শুনুন আগে-আপনি যদি আমার সাথে কোনো রকম সমস্যা পাকানোর চিন্তা করে থাকেন তাহলে শুধু আমার সাথে নয় আপনাকে আরো অনেকের সাথে কথা বলতে হবে। আমি আমার কাজ করেছি। কিছু বলার থাকলে আমার বসের সাথে কথা বলুন।”

হাত তুললো সে। বিশ্বজনীন শান্তির প্রতীক, অথবা এর মানে হলো, আমার কাছে কোনো অস্ত্র নেই।

“আরমানস্কির সাথে আমি ইতিমধ্যে কথা বলেছি। ভালো কথা, সে

। চেয়েছিলো তুমি তাকে ফোন করবে-গতরাতে তার করা কোনো ফোনকলের জবাব দাও নি।”

তার কাছ থেকে কোনো রকম হুমকির আশংকা না করলেও ব্লমকোভিস্ট যখন তার কাছে এগিয়ে এলো একটু পিছিয়ে গেলো সালান্ডার। তার হাত ধরে তাকে বাথরুমের দরজার কাছে নিয়ে এলো সে। তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ তাকে স্পর্শ করলে তার ভালো লাগে না।

“আমি কোনো সমস্যা পাকাতে চাই না,” বললো সে। “তবে তোমার সাথে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি। তোমার জামাকাপড় পরতে পরতে কফি তৈরি হয়ে যাবে আশা করি। তবে সবার আগে ভালো করে শাওয়ার নিয়ে নাও।”

চুপচাপ তার কথা মতো কাজ করলো সালান্ডার। লিসবেথ সালান্ডার কখনও এভাবে কারো কথায় কাজ করে নি, ভাবলো সে।

.

বাথরুমের দরজায় হেলান দিয়ে চিন্তাভাবনা গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করলো সে। এর আগে আর কখনওই এতোটা কাঁপুনি হয় নি তার। তবে এটা বুঝতে পারছে তার এই অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য ভালো করে শাওয়ার নেবার দরকার আছে। গোসল সেরে বেডরুমে গিয়ে জিন্স আর টি-শার্ট পরে নিলো যার গায়ে একটা শ্লোগান লেখা আছে : গতকাল ছিলো কেয়ামত-আজকে আমরা আরো কঠিন সমস্যায় পড়েছি।

চেয়ারের উপর রাখা চামড়ার জ্যাকেটের পকেট থেকে ইলেক্ট্রক শক দেবার টেসারটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো ভালোমতো লোড করা আছে কিনা। হ্যা, পরিপূর্ণ লোড করা আছে। জিন্স প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখে দিলো সেটা। সারা অ্যাপার্টমেন্টে কফির সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। গভীর করে দম নিয়ে রান্নাঘরে ফিরে এলো সালান্ডার।

“তুমি কি কোনো দিন ঘরদোর পরিস্কার করো না?” জানতে চাইলো ব্লমকোভিস্ট।

এঁটো ডিশ আর অ্যাস্ট্রে সিঙ্কে রেখে দিয়েছে সে। পুরনো দুধের কার্টনগুলো বাস্কেটে ফেলে টেবিল থেকে পাঁচ সপ্তাহের সংবাদপত্রগুলো সরিয়ে সেটা পরিস্কার করে মগ রেখে দিয়েছে সেখানে। তাহলে সে ঠাট্টা করে নি। ঠিক আছে, দেখি ব্যাপারটা কোন্ দিকে গড়ায়। তার বিপরীতে ব’সে পড়লো সালান্ডার।

“তুমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দাও নি। গরুর কিংবা টার্কির রোস্ট নাকি ভেজিটেরিয়ান?”

“গরুর রোস্ট।”

“তাহলে আমি টার্কি নিচ্ছি।”

চুপচাপ খেয়ে গেলো আর একে অন্যেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেলো তারা। সালান্ডারের খাওয়া শেষ হয়ে গেলেও ব্লমকোভিস্ট সবেমাত্র অর্ধেক খেতে পেরেছে। জানালার কাছ থেকে এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে একটায় আগুন ধরালো সে।

ব্লমকোভিস্টই প্রথম কথা বললো। “তোমার মতো হয়তো অতো ভালো ইনভেস্টিগেটর আমি নই তবে নিদেনপক্ষে আমি এটা বের করতে পেরেছি যে তুমি ভেজিটেরিয়ান নও-অথবা হের ফ্রোডি যেমনটি মনে করে তুমি ক্ষুধামন্দা রোগে আক্রান্ত। এই দুটো তথ্য আমি আমার রিপোর্টে উল্লেখ করবো।”

তার দিকে চেয়ে রইলো সালান্ডার। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেও ব্লমকোভিস্ট বরং মজাই পেলো। পরিস্থিতিটা একেবারেই অবাস্তব ঠেকছে তার কাছে। নিজের কফিতে চুমুক দিলো সালান্ডার। লোকটার চোখ দুটোতে বেশ মায়া মায়া ভাব আছে। তার মনে হলো এই লোকটা আর যাই হোক না কেন বাজে লোক হবে না। এর সম্পর্কে যে তদন্ত করেছে তাতেও এমন খারাপ কিছু সে পায় নি যে লোকটাকে বান্ধবী ধর্ষণকারী কিংবা সেরকম কিছু বলা যাবে। নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলো যে সে-ই একমাত্র ব্যক্তি যে সব জানে। জ্ঞানই শক্তি।

“আপনি হাসছেন কেন?” জানতে চাইলো সালান্ডার।

“দুঃখিত। আসলে এভাবে ঢুকে পড়ার কোনো পরিকল্পনা আমার ছিলো না। তোমাকে ভড়কে দেবার ইচ্ছেও আমার ছিলো না। তবে দরজা খোলা আগে নিজের চেহারাটা দেখা উচিত ছিলো তোমার। একেবারে বিরল একটা অভিব্যক্তি ছিলো সেটা।”

নীরব। অবাক হয়ে বুঝতে পারলো লোকটার এভাবে ঢুকে পড়াটা তার কাছে খুব একটা অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না-অন্তত খারাপ তো লাগছেই না।

“এটাকে তুমি আমার ব্যাপারে নাক গলানোর প্রতিশোধ হিসেবে দেখতে পারো,” বললো সে। “তুমি কি ভয় পাচ্ছো?

“মোটেও না,” বললো সালান্ডার।

“ভালো। তোমাকে বিপদে ফেলার জন্য এখানে আমি আসি নি।”

“আপনি যদি আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করেন তো আমিও আপনাকে আঘাত করবো। এরজন্যে আপনাকে পস্তাতে হবে।”

মেয়েটাকে ভালো ক’রে দেখে নিলো ব্লমকোভিস্ট। উচ্চতা বড়জোর চার ফিট এগারো ইঞ্চি, দেখে মনে হয় না কেউ যদি তার ঘরে জোর করে ঢুকে পড়ে তাহলে খুব একটা বাধা দিতে পারবে। প্রতিরোধ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে মেয়েটার চোখ দুটো একেবারেই অভিব্যক্তিহীন আর শীতল।

“তার অবশ্যই কোনো দরকার পড়বে না,” অবশেষে বললো সে। “আমি শুধু তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। তুমি যদি চাও আমি এখান থেকে চলে যাবো সেটা মুখে বললেই হবে। ব্যাপারটা খুব হাস্যকর…তবে… কিছু না…

“কি?”

“শুনতে হয়তো উদ্ভট শোনাবে, তবে সত্যি হলো মাত্র চারদিন আগেও আমি তোমার অস্তিত্বের কথা জানতাম না। এরপর আমাকে নিয়ে তোমার তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়লাম।” কাঁধের ব্যাগ থেকে রিপোর্টটা বের করলো সে। “এটা পড়া আনন্দদায়ক কাজ ছিলো না।”

রান্নাঘরের জানালার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। “আমি কি একটা সিগারেট বাম করতে পারি?” প্যাকেটটা টেবিলের উপর দিয়ে ঠেলে দিলো।

“তুমি বলেছিলে আমরা একে অন্যেকে চিনি না, তখন আমি বলেছিলাম, না, আসলে আমরা একে অন্যেকে চিনি।” রিপোর্টটার দিকে ইশারা করলো ব্লমকোভিস্ট। “তোমার সাথে আমি প্রতিযোগীতা করতে পারবো না। আমি কেবল তোমার সম্পর্কে টুকটাক খোঁজখবর নিয়েছি। এই ধরো তোমার ঠিকানা, জন্ম তারিখ এসব কিছু। তবে তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানো। তার বেশিরভাগই একান্ত গোপনীয়, যা কিনা আমার ঘণিষ্ঠ বন্ধুরাই জানে। আর এখন আমি তোমার সাথে তোমারই ঘরে বসে খাওয়া দাওয়া করছি। আধ ঘণ্টা আগে আমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হয়েছি। তবে আমার মনে হচ্ছে আমরা অনেক বছর ধরে ঘণিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। তোমার কাছে কি কিছু মনে হচ্ছে?”

মাথা নাড়লো সে।

“তোমার চোখ দুটো খুব সুন্দর,” বললো সে।

“আপনার চোখও খুব সুন্দর,” পাল্টা বললো সালান্ডার।

দীর্ঘ নীরবতা।

“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”

কাল ব্লমকোভিস্ট—তার ডাক নামটা মনে পড়ে গেলো তার। জোর করে সেটা বলার প্রলোভন থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হলো। তাকে আচমকা খুব সিরিয়াস দেখাচ্ছে। চোখ দুটোতে ভর করেছে ক্লান্তি। এই অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার সময় যে আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব তার মধ্যে দেখা গিয়েছিলো এখন সেটা উধাও হয়ে গেছে যেনো। চটপট স্বভাবটা আর দেখা যাচ্ছে না। কিংবা সেটা হয়তো দমিয়ে রেখেছে আপাতত। তার কাছে মনে হলো ব্লমকোভিস্ট তাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।

সালান্ডারের কাছে মনে হচ্ছে সে তার নার্ভের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। তার কাজের যে ধরণ তাতে ক্লায়েন্টের এরকম হঠাৎ উপস্থিতিতে সে ভড়কে গেছে অনেকটাই। লোকজনের ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করাই তার রুটি রোজগার। অবশ্য আরমানস্কির জন্য এ পর্যন্ত যা করেছে সেটাকে সত্যিকারে কোনো কাজ বলেও সে মনে করে না। এটাকে নিছক শখ হিসেবে নিয়েছে সে।

সত্যি হলো অন্য লোকের গোপন কথা খুঁজে বের করা আর তাদের অতীত জীবন সম্পর্কে তথ্য জোগার করা কাজটা সে বেশ ভালোই উপভোগ করে। এ পর্যন্ত তার যতোটুকু মনে পড়ে এই একটা কাজই সে ক’রে গেছে। আজো এ কাজ করে যাচ্ছে সে। শুধু যে আরমানস্কি তাকে কাজ দিলে সে কাজ করে তা নয়, অনেক সময় আনন্দ পাবার জন্যও এ কাজ করে থাকে সে। এটা তাকে উজ্জীবিত করে। যেনো জটিল কোনো কম্পিউটার গেম। ব্যতিক্রম হলো এখানে তাকে সত্যিকারের লোকজনের ব্যাপারে কাজ করতে হয়। আর এখন কিনা তার সেরকম শখের একজন ব্যক্তি ঠিক তার সামনেই বসে আছে। ব্যাপারটা একেবারেই অবাস্তব।

“আমার একটা অসাধারণ সমস্যা হয়েছে.” বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমাকে বলো, তুমি যখন ফ্রোডি সাহেবের জন্য আমার উপর তদন্ত করছিলে তখন কি জানতে সেটা কি কাজে ব্যবহার করা হবে?”

“না।”

“আমার সম্পর্কে ফ্রোডি সাহেব, কিংবা নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে তার কর্তা এইসব তথ্য জানতে চেয়েছে তার কারণ আমাকে একটা ফুল্যান্স কাজ দিতে চেয়েছিলো সে।’

“আচ্ছা।”

তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো সে।

“অন্য কোনো দিন হলে তুমি আর আমি অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর নৈতিকতা নিয়ে কথা বলতাম কিন্তু এই মুহূর্তে আমার হাতে একটি ভিন্ন ধরণের সমস্যা আছে। যে কাজটা আমাকে দেয়া হয়েছে সেটা একেবারেই অদ্ভূত একটি কাজ। এরকম কোনো কাজ আমি জীবনেও করি নি। এ ব্যাপারে বেশি কিছু বলার আগে তোমাকে আমার বিশ্বাস করতে হবে, লিসবেথ।”

“কি বলতে চাচ্ছেন?”

“আরমানস্কি অবশ্য আমাকে বলেছে তুমি একশতভাগ বিশ্বস্ত। তারপরও তোমাকে জিজ্ঞেস করছি। আমি তোমাকে যে কথাটা বলবো সেটা কি তুমি গোপন রাখবে? যেকোনো পরিস্থিতিতেই পড়ো না কেন এই কথাটা কাউকে বলতে পারবে না।”

“দাঁড়ান। আপনি ড্রাগানের সাথে কথা বলেছেন? সে-ই কি আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে?” আমি তোকে খুন করবো, শালার বোকাচোদা আর্মেনিয়ান।

“ঠিক তা নয়। তুমি কিন্তু একমাত্র ব্যক্তি নও যে অন্যের ঠিকানা খুঁজে বের করতে পারে। এটা আমি নিজে নিজেই করেছি। ন্যাশনাল রেজিস্ট্রিতে খুঁজে দেখেছি মাত্র তিনজন লিসবেথ সালান্ডার আছে। বাকি দু’জনের সাথে ম্যাচ করে নি। তবে গতকাল আরমানস্কির সাথে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়েছে। সেও মনে করে তোমাকে না ঘাটানোই ভালো। শেষে আমি তাকে বোঝাতে পেরেছি আমার উদ্দেশ্যটা বেআইনী কিছু না।”

“সেটা কি জানতে পারি?”

“তোমাকে তো বলেছিই ফ্রোডির নিয়োগদাতা আমাকে একটা কাজের জন্য ভাড়া করেছে। এখন আমি এমন একটি জায়গায় এসে পৌছেছি যেখানে দক্ষ একজন রিসার্চার দরকার। ফ্রোডি তোমার কথা বললো, তুমি নাকি এ কাজে খুব দক্ষ। সে অবশ্য তোমার পরিচয় দিতে চায় নি তবে আমি যেভাবেই হোক সেটা বের ক’রে নিয়েছি। আমি কি চাই সেটা আরমানস্কিকে বলেছি। সব শুনে সেও বলেছে ঠিক আছে। তারপর তোমাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলো। এই তো…তারপর এখন আমি এখানে। চাইলে তুমি তাকে ফোন করে জেনে নিতে পারো।

নিজের মোবাইল ফোনটা খুঁজে পেতে বেশ কয়েক মিনিট লেগে গেলো সালান্ডারের। এই ফাঁকে পুরো ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিলো ব্লকোভিস্ট। তার সব আসবাবগুলোই ভ্রাম্যমান জাতীয়। তবে অত্যাধুনিক একটি ল্যাপটপ আছে তার। লিভিংরুমে আছে একটা ডেস্ক। শেলফে একটা সিডি প্লেয়ার আর মাত্র দশটার মতো সিডি আছে তার সংগ্রহে তাও আবার এমন একটি ব্যান্ডের যার নাম কখনও শোনে নি সে। সিডির কভারে যাদের ছবি আছে তাদের দেখে ভ্যাম্পায়ার বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত সঙ্গীত তার কাছে সবচাইতে বড় আকর্ষণ নয়।

সালান্ডার দেখতে পেলো আরমানস্কি তাকে আগের দিন মোট সাতবার আর আজ সকালে দু’বার ফোন করেছিলো। তার নাম্বারে ফোন করলো সে, ব্লমকোভিস্ট দরজার কাছে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলো তাদের কথা।

“আমি…দুঃখিত… হ্যা…বন্ধ করা ছিলো…জানি, আমাকে হায়ার করতে চাচ্ছেন তিনি…না, বালের আমার লিভিংরুমেই দাঁড়িয়ে আছেন এখন…” তার কণ্ঠটা চড়া হয়ে গেলো। “ড্রাগান আমার হ্যাঙ্গওভার হচ্ছে, মাথা ব্যাথা করছে খুব। সুতরাং ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে সরাসরি বলো…কাজটা কি নেয়া যাবে নাকি যাবে না?…ধন্যবাদ তোমাকে।”

লিভিংরুমের দরজা দিয়ে ভেতরে তাকালো সালান্ডার। ব্লমকোভিস্ট তার বুকশেলফ থেকে একটা সিডি বের করে দেখছে। লেবেল ছাড়া বাদামী রঙের একটি পিলের বোতল খুঁজে পেলে বোতলটা আলোর দিকে তুলে ধরলো সে। বোতলের মুখটা যেই না খুলতে যাবে অমনি সালান্ডার এসে তার হাত থেকে ছো মেরে সেটা কেড়ে নিলো। রান্নাঘরে ফিরে গিয়ে চেয়ারে বসে নিজের কপাল ঘষতে লাগলো সে। ব্লমকোভিস্ট চলে এলো তার কাছে।

“নিয়মগুলো খুব সহজ সরল,” বললো সালান্ডার। “আপনি আরমানস্কি আর আমার সাথে আলোচনা করেছেন এরকম কোনো কিছু কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। এ নিয়ে মিল্টন সিকিউরিটির সাথে একটা চুক্তি হবে। তবে কাজটা করবো কি করবো না তার আগে আমি জানতে চাইবো সেটা কি ধরণের কাজ। তার মানে কাজটা আমি করি আর না করি আপনি আমাকে যা যা বলবেন তার সবই গোপন রাখার ব্যাপারে আমি একমত। আপনি কোনো রকম মারাত্মক ক্রিমিনাল কাজ করলে আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা ড্রাগানের কাছে রিপোর্ট করবো। আর সে পুলিশের কাছে সেটা রিপোর্ট করে দেবে

“চমৎকার।” দ্বিধার সাথে বললো ব্লমকোভিস্ট। “কিন্তু তোমাকে ঠিক কোন কাজের জন্য ভাড়া করছি সেটা আরমানস্কি পুরোপুরি জানে না…“

“ঐতিহাসিক কোনো বিষয়ে রিসার্চ, সে আমাকে বলেছে।”

“উমমম…হ্যা। তা ঠিক। আমি চাই তুমি একজন খুনিকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে আমায়।”

.

হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের কেসটা সম্পর্কে বিস্তারিত সব কিছু খুলে বলতে এক ঘণ্টা লেগে গেলো। কোনো কিছুই বাদ দিলো না সে। মেয়েটাকে হায়ার করার ব্যাপারে ফ্রোডির কাছ থেকে তার অনুমতি নেয়া আছে। আর এটা করতে হলে সালান্ডারকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে হবে।

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার সম্পর্কেও সব বললো তাকে, এটাও জানালো যে হ্যারিয়েটের জানালায় যে মুখটা দেখা গেছে সেটা সিসিলিয়ার। যতোটুকু সম্ভব সালান্ডারের তার চারিত্রিক বর্ণনা দিলো সে। মহিলা তার সন্দেহের তালিকায় একেবারে শীর্ষে আছে সেটাও জানাতে ভুলে গেলো না। তবে এটাও ঠিক সিসিলিয়া কোনো হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কিংবা এরকম জঘন্য কাজে সহায়তা করেছে সেটা বিশ্বাস করে না সে। কারণ ঐ ঘটানা যখন ঘটে তখন তার বয়স অনেক কম ছিলো।

ডেটবুকের একটা কপি দিলো সালান্ডারকে : “মাগদা-৩২০১৬; সারা-৩২১০৯; আর.জে-৩০১১২; আর.এল-৩২০২৭; মেরি – ৩২০১৮।” সেইসাথে লেভিটিকাসের পংক্তিগুলোও দিলো তাকে।

“আপনি আমার কাছ থেকে কি চান?”

“আর.জে মানে রেবেকা জ্যাকবসন সেটা আমি চিহ্নিত করতে পেরেছি।” পাঁচ সংখ্যার নাম্বারটি দিয়ে কি বুঝিয়েছে সেটা তাকে বললো ব্লমকোভিস্ট। “আমার ধারণা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমরা আরো চারজন ভিকটিমকে খুঁজে পাবো মাগদা, সারা, মেরি আর আর.এল।

“আপনি মনে করছেন তাদের সবাইকে খুন করা হয়েছে?”

“আমি বলতে চাচ্ছি আমরা এমন একজন খুনিকে খুঁজছি যে কিনা পঞ্চাশ এবং সম্ভবত ষাটের দশকে অনেকগুলো খুন করেছিলো। যার সাথে হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের কোনো না কোনো সংযোগ ছিলো আমি হেডেস্টাড কুরিয়ার-এর পুরনো সংখ্যাগুলো ঘেটে দেখেছি। রেবেকার হত্যাকাণ্ডটিই একমাত্র আলোচিত খুন যার সাথে হেডস্টোডের সম্পর্ক ছিলো। আমি চাই তুমি এই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখবে, দরকার হলে সমগ্র সুইডেনে, যতোক্ষণ না নাম আর পংক্তিগুলোর সঙ্গতিপূর্ণ কিছু পাওয়া যাচ্ছে।”

অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ আর অভিব্যক্তিহীন বসে রইলো সালান্ডার, এদিকে অধৈর্য হয়ে উঠলো ব্লমকোভিস্ট। মেয়েটা মুখ তুলে তাকানোর আগ পর্যন্ত ভাবতে লাগলো এই মেয়েটার কাছে এসে ভুল করেছে কিনা।

“কাজটা আমি নিচ্ছি। তবে প্রথমে আপনাকে আরমানস্কির সাথে একটা কনট্র্যাক্ট করে নিতে হবে।”

.

আরমানস্কি কনট্রাক্টের একটা প্রিন্ট বের করে নিয়ে এলো। ব্লমকোভিস্ট এটা ফ্রোডির স্বাক্ষর নেবার জন্য হেডেস্টাডে নিয়ে যাবে। সালান্ডারের অফিসে ফিরে এসে দেখতে পেলো ব্লমকোভিস্ট আর মেয়েটা ল্যাপটপে ঝুঁকে কী যেনো দেখছে। সালান্ডারের কাঁধে হাত রেখেছে সে-তাকে স্পর্শ করছে রেখেছে ব্লমকোভিস্ট-একটা জিনিসের দিকে ইঙ্গিত করছে। করিডোরে একটু দাঁড়িয়ে রইলো আরমানস্কি।

মনে হলো ব্লমকোভিস্ট এমন কিছু বলেছে যার জন্য মেয়েটা খুবই অবাক হয়ে আছে। এরপরই উচ্চস্বরে হেসে ফেললো সালান্ডার।

এর আগে আরমানস্কি কখনই তাকে সশব্দে হাসতে শোনে নি। অনেক বছর ধরেই এই মেয়েটার বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। মাত্ৰ পাঁচ মিনিট ধরে ব্লমকোভিস্টের সাথে মেয়েটার পরিচয় অথচ কতো সহজেই না তার কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ব্লমকোভিস্টের প্রতি এতোটা ঈর্ষা অনুভব করলো যে ভেতরে ভেতরে নিজেই অবাক হলো সে। দরজার কাছে এসে গলা খাকারি দিয়ে কনট্র্যাক্টের ফোল্ডারটি নামিয়ে রাখলো আরমানস্কি।

দুপুরের দিকে অল্প সময়ের জন্য মিলেনিয়াম-এর অফিসে গেলো ব্লমকোভিস্ট। পদত্যাগ করার পর এই প্রথম সেখানে গেলো সে। অতি পরিচিত সিঁড়িগুলো দিয়ে উঠতে গিয়ে খুবই অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো তার। দরজার কোডে কোনো পরিবর্তন করা হয় নি। সবার অলক্ষ্যে ঢুকে পড়ে কিছুক্ষণ চারপাশে তাকিয়ে দেখলো।

মিলেনিয়াম-এর অফিসটি এল আকৃতির। প্রবেশপথেই আছে হলরুম, এটা বেশ বড় হলেও খুব বেশি কিছু সেখানে নেই। মাত্র দুটো সোফা রয়েছে, সুতরাং এক দিক থেকে দেখলে এটা তাদের রিসেপশন রুম। এরপরই আছে লাঞ্চরুম, কিচেন, টয়লেট আর দুটো স্টোরেজরুম। ইন্টার্নদের জন্য দুটো ডেস্কও আছে সেখানে। প্রবেশপথের ডান দিকে কাঁচের ঘরটা ডিজাইনার মামের। ওটার আয়তন ৫০০ বর্গফুটের মতো। তার রুম থেকে সোজা নীচের তলায় চলে যাবার একটা সিঁড়ি আছে। বামে আছে সম্পাদকীয় অফিস, ৩৫০ বর্গফুটের মতো হবে সেটি। গোথগাথানের দিকে মুখ করা জানালা রয়েছে সেই ঘরে।

সব কিছুর ডিজাইন করেছে বার্গার। তিনজন সংবাদকর্মীর কক্ষ গ্লাস দিয়ে বাকিদের থেকে আলাদা করেছে সে। একেবারে পেছন দিকে নিজের জন্য একটা বিশাল রুম নিয়েছে। এটাই একমাত্র রুম যেটা কিনা প্রবেমুখ থেকে দেখা যায়।

তৃতীয় রুমটি অন্যদের চেয়ে একটু দূরে অবস্থিত। এটা সনি ম্যাগনাসনের, দীর্ঘদিন সে মিলেনিয়াম-এর সবচাইতে সফল অ্যাডভার্টাইজিং সেলসম্যান ছিলো। তাকে নিয়োগ দিয়েছিলো বার্গার। ভালো বেতনসহ বিজ্ঞাপনের আয় থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন পাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো তার জন্য। কয়েক বছর ধরে সে যতোই চেষ্টা করুক না কেন তাদের বিজ্ঞাপনের হার কমে আসছে, সেইসাথে কমে আসছে ম্যাগনাসনের আয়। তারপরও এখানে পড়ে আছে সে পত্রিকাটির প্রতি তার মমত্ববোধের কারণে। আমার মতো নয় যে কিনা মিলেনিয়াম-এর বিপর্যয়ের কারণ হবার পরও দুর্দিনে তাদের ছেড়ে চলে এসেছে, ভাবলো ব্লমকোভিস্ট।

সাহস সঞ্চয় করে অফিসের ভেতর ঢুকে পড়লো সে। প্রায় ফাঁকা। বার্গারকে নিজের ডেস্কে বসে ফোনে কথা বলতে দেখলো। মনিকা নিলসনও তার ডেস্কে আছে। এই মহিলা রাজনৈতিক রিপোর্টের ব্যাপারে খুবই অভিজ্ঞ। তার মতো সিনিক মহিলা এই জীবনে সে দ্বিতীয়টি দেখে নি। নয় বছর ধরে এখানে আছে, ক্রমশ নামডাক ছড়িয়ে পড়ছে তার। হেনরি কোর্তেজ হলো এডিটোরিয়াল স্টাফদের মধ্যে সবচাইতে তরুণ। দু’বছর আগে সাংবাদিকতায় গ্র্যাজুয়েট করে এখানে ইন্টার্ন করার জন্য এসে বলেছিলো মিলেনিয়াম ছাড়া অন্য কোথাও নাকি কাজ করবে না। তাকে নেয়ার কোনো ইচ্ছে বার্গারের ছিলো না তারপরও তাকে একটা ডেস্ক দিয়ে দেয় কাজ করার জন্য। অল্প ক’দিন পরই তাকে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে নিয়ে নেয়া হয়।

তারা দু’জনেই তাকে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেয়ে পিঠ চাপড়ে দিলো তারা। এক সময় জানতে চাইলো সে আবার কাজে ফিরে এসেছে কিনা। না, এখান দিয়ে যাবার সময় সবাইকে হ্যালো বলার জন্য এসেছে সে। তাছাড়া তাদের বসের সাথে তার কিছু কথা আছে।

তাকে দেখে বার্গারও আনন্দিত হলো। ভ্যাঙ্গারের অবস্থা জানতে চাইলো সে। ফ্রোডি তাকে যা বলেছে তারচয়ে বেশি কিছু সে জানে না : তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন।

“তাহলে শহরে কি কাজে এসেছো?”

কথাটা শুনে একটু বিব্রত হলো ব্লমকোভিস্ট। এখান থেকে অল্প দূরে মিল্টন সিকিউরিটি’তে এসেছিলো সে। যাবার সময় এখানে আসার লোভ সংবরণ করতে পারে নি। একজন কম্পিউটার হ্যাকারকে নিজের কাজে ভাড়া করতে এসেছিলো এটা বলা হয়তো ঠিক হবে না। সুতরাং তাকে বলতে হলো ভ্যাঙ্গার সংশ্লিষ্ট একটা কাজে স্টকহোমে এসেছে। এক্ষুণি তাকে ফিরে যেতে হবে হেডেস্টাডে। ম্যাগাজিনের কাজকর্ম কেমন চলছে জানতে চাইলো সে।

“বিজ্ঞাপন আর সার্কুলেশনের ব্যাপারে সুসংবাদ থাকলেও আমাদের আকাশে একটি কালো মেঘ এসে ভর করেছে।

“সেটা কি?”

“জেইন ডালম্যান।”

“আচ্ছা।”

“হেনরিক ভ্যাঙ্গার আমাদের পার্টনার হচ্ছে সেই খবরটা প্রকাশ হবার পর এপ্রিলে তার সাথে আমার কথা হয়েছিলো। আমি জানি না জেইনের স্বভাবই এরকম কিনা, শুধু নেতিবাচক চিন্তা করে। নাকি সে কোনো মারাত্মক খেলা খেলতে চাচ্ছে।”

“কি হয়েছে?”

“তেমন কিছু না। বলতে পারো তাকে আর বিশ্বাস করতে পারছি না। হেনরিক ভ্যাঙ্গারের সাথে এগ্রিমেন্ট হবার পর আমি আর ক্রাইস্টার সিদ্ধান্ত নেই সব স্টাফকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেবো যে, আমরা আপাতত কোনো আর্থিক সংকটে নেই, অথবা…”

“অথবা হাতেগোনা কয়েকজনকে শুধু জানাবে।”

“ঠিক ধরেছো। আমাকে হয়তো একটু বেশি সন্দেহবাদী বলতে পারো কিন্তু আমি আসলে চাই নি ডালম্যান খবরটা ফাঁস করে দিক। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যেদিন এগ্রিমেন্টটা আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানানো হবে সেদিনই সব স্টাফকে খবরটা দেবো। তার মানে এই খবরটা আমাদেরকে এক মাসের মতো গোপন রাখার দরকার ছিলো।”

“তারপর?”

“খবরটা শোনার পর সবাই খুব উৎফুল্ল হলো। ডালম্যান ছাড়া সবাই চিয়ার্স করলো, একে অন্যেকে অভিবাদন জানালো। আমাদের তো আর বিশাল কর্মীবাহিনী নেই-মাত্র তিনজন এডিটোরিয়াল স্টাফ। তিনজন লোক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছিলো, তাদের সাথে কিছু ইন্টার্ন। কিন্তু একজন খুবই মুষড়ে পড়েছিলো কারণ খবরটা তাকে আগেভাগে জানাই নি।“

“তার রাগ করার যুক্তি আছে…”

“আমিও সেটা জানি। কিন্তু সমস্যা হলো এই ব্যাপারটা নিয়ে সে দিনের পর দিন গজগজ করেই যাচ্ছে। এটা অফিসের পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছিলো। এভাবে দু’সপ্তাহ চলার পর তাকে আমি নিজের অফিসে ডেকে ব্যাখ্যা করলাম যে কেন খবরটা গোপন রাখা হয়েছে। আমি তাকে বিশ্বাস করি না, খবরটা যাতে ফাঁস না হয় সেজন্যে তাকে আগে থেকে কিছু বলি নি।’

“কথাটা সে কিভাবে নিলো?”

“খুব আপসেট হয়ে পড়ে সে। আমি আমার যুক্তি তুলে ধরে তাকে একটি আলটিমেটাম দেই-হয় সে এসব বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দেবে নয়তো অন্য কোনো চাকরি যেনো খুঁজে নেয়।”

“তারপর?”

‘সে ভালোয় ভালো কাজে মন দিলেও অন্যদের সাথে তার এক ধরণের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। ক্রাইস্টার তো তাকে সহ্যই করতে পারে না। আর এ ব্যাপারটা লুকিয়েও রাখার কোনো চেষ্টাও সে করে না।

“ডালম্যান কি করবে বলে তুমি আশংকা করছো?”

“জানি না। এক বছর আগে তাকে কাজে নিয়েছিলাম, যখন ওয়েনারস্ট্রমের সঙ্গে আমাদের সমস্যার শুরু। আমার কাছে হয়তো জোড়ালো কোনো প্ৰমাণ নেই তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সে আমাদের হয়ে কাজ করছে না।’

“তোমার মন যা বলছে সেটাকেই বিশ্বাস করো।”

“হয়তো সে এমন এক লোক যে কিনা খামোখাই বিষোদগার করে বেড়ায়।”

“এটারও সম্ভাবনা আছে। তবে তাকে নেয়াটা যে আমাদের জন্য ভুল হয়েছিলো সেটা আমি আগেও বলেছি।“

আধ ঘণ্টা পর ফ্রোডির কাছ থেকে ধার নেয়া একটা পুরনো ভলভো গাড়ি নিয়ে হেস্টোডে ফিরে গেলো ব্লমকোভিস্ট।

.

এটা খুবই ছোট্ট একটা তথ্য, সে যদি খুব বেশি সতর্ক না থাকতো তাহলে ধরতেই পারতো না : তার ঘরের কাগজপত্রের স্তুপগুলো সে যেভাবে রেখে গিয়েছিলো ফিরে এসে সেভাবে দেখতে পেলো না। শেলফের একটা বাইন্ডার জায়গা মতো রাখা নেই। তার ডেস্কের ড্রয়ারটা বন্ধই আছে-কিন্তু সে একদম নিশ্চিত ঘর থেকে যখন বের হয়েছিলো তখন একটু ফাক করা ছিলো ড্রয়ারটা।

কেউ তার ঘরে ঢুকেছিলো।

দরজাটা লক করে গিয়েছিলো সে। কিন্তু সেটা এমন সাধারণমানের লক যে অনায়াসে খুলে ফেলা যাবে। পুরো অফিসটা ভালো করে খুঁজে দেখলো কোনো কিছু খোয়া গেছে কিনা। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলো সব ঠিক আছে।

তাসত্ত্বেও কেউ তার কটেজে ঢুকে সমস্ত কাগজপত্র আর বাইন্ডার ঘেটে দেখেছে। সঙ্গে করে ল্যাপটপটা নিয়ে গিয়েছিলো ফলে সেটার ভেতর ঢোকা সম্ভব হয় নি। দুটো প্রশ্নের উদ্রেক হলো : কে ঢুকেছিলো? তার এই অনাহূত অতিথি কতোটুকু জানতে পেরেছে?

ভ্যাঙ্গারের সংগ্রহে থাকা ফাইলের বাইন্ডারগুলো জেল থেকে ফিরে আসার পর এখানে আবার নিয়ে আসা হয়েছিলো। ওগুলোতে নতুন কিছু নেই। ডেস্কে রাখা তার নোটবুকটায় যা লেখা আছে তা অনেকটা অপরিপক্ক কোডের মতো-কিন্তু তার ঘরে যে লোক তল্লাশী করেছে সে কি অপরিপক্ক?

ডেস্কের মাঝখানে একটা প্লাস্টিক ফোল্ডারে ডেটবুকের তালিকা আর বাইবেলের পংক্তিগুলোর ফটোকপি রয়েছে। এটা অবশ্য খুবই সিরিয়াস একটি জিনিস। এটা বলে দেবে ডেটবুকে থাকা কোডের অর্থোদ্ধার করে ফেলেছে সে।

তাহলে কে ঢুকেছিলো?

ভ্যাঙ্গার আছে হাসপাতালে। আর অ্যানাকে সে সন্দেহ করে না। ফ্রোডি? ইতিমধ্যেই তাকে তো সবই বলে দিয়েছে সে। সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গার তার ফ্লোরিডা ভ্রমণ বাতিল করে দিয়ে লন্ডন থেকে ফিরে এসেছে-সঙ্গে তার বোন। মাত্র একবার তাকে দেখেছে ব্লমকোভিস্ট। গতকাল বৃজের উপর দিয়ে গাড়িয়ে চালিয়ে যখন যাচ্ছিলো। মার্টিন ভ্যাঙ্গার, হেরাল্ড ভ্যাঙ্গার আর বার্জার ভ্যাঙ্গার-হেনরিকের হার্ট অ্যাটাকের পর দিন বার্জারকে দেখা গেছে। তারা সবাই হেনরিকের বাড়িতে জড়ো হয়েছিলো, অবশ্য সেখানে ব্লমকোভিস্টকে আমন্ত্রণ জানানো হয় নি। আর আছে আলেকজান্ডার ভ্যাঙ্গার আর ইসাবেলা ভ্যাঙ্গার।

কার সাথে ফ্রোডি কথা বলেছে? কতোজনকে সে এটা জানিয়েছে? ব্লমকোভিস্ট যে হ্যারিয়েটের তদন্তে বিরাট অগ্রগতি সাধন করেছে সেটা এই পরিবারের কতোজন জানে?

রাত ৮টার পর হেডেস্টাডের তালামিস্ত্রিকে ডেকে এনে নতুন একটি ডোরলক বানিয়ে দেবার জন্য অর্ডার করলো সে। মিস্ত্রি জানালো পরদিন তাকে নতুন লক লাগিয়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু ব্লমকোভিস্ট তাকে বললো সে যদি এক্ষুণি সেটা বানিয়ে দেয় তাহলে তাকে দ্বিগুন টাকা দেয়া হবে। লোকটা রাজি হলো। জানালো রাত সাড়ে দশটার দিকে এসে তালা লাগিয়ে দিয়ে যাবে।

.

ব্লমকোভিস্ট সোজা চলে গেলো ফ্রোডির বাড়িতে। সবার আগে জানতে চাইলো হেনরিক ভ্যাঙ্গার কেমন আছে।

মাথা ঝাঁকালো ফ্রোডি।

“তারা তার অপারেশন করেছে। কয়েকটা ব্লক নাকি ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে আগামী কয়েকটা দিন তার জন্য খুব ক্রিটিক্যাল যাবে।

মদ পান করতে করতে এ নিয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বললো তারা।

“আপনার সাথে তার আর কথা হয় নি মনে হচ্ছে?”

“না। কথা বলার মতো অবস্থায় সে নেই। স্টকহোমে কাজ কতোদূর এগোলো?”

“সালান্ডার মেয়েটি কাজ করতে রাজি হয়েছে। এই যে মিল্টন সিকিউরিটির কনট্রাক্টটা। এটা সাইন করে পোস্ট ক’রে দিয়েন।”

ডকুমেন্টটা পড়ে দেখলো ফ্রোডি।

“মেয়েটা তো দেখছি খুবই ব্যয়বহুল,” বললো সে।

হেনরিক তাকে পোষার ক্ষমতা রাখে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ফ্রোডি। পকেট থেকে কলম বের করে স্বাক্ষর করে দিলো সে।

“এটা ভালোই হলো, হেনরিক বেঁচে থাকতেই আমি স্বাক্ষর করছি। বাড়ি ফিরে যাবার আগে আপনি কি এটা পোস্টবক্সে ফেলে দিতে পারবেন?”

.

মাঝরাতের মধ্যে ব্লমকোভিস্ট বিছানায় চলে গেলেও ঘুমাতে পারলো না। আজকের ঘটনার আগ পর্যন্ত হেডেবির কাজটা তার কাছে ছিলো অনেকটা ঐতিহাসিক ঘটনা রিসার্চ করার মতো। কিন্তু এমন কেউ যদি থেকে থাকে যে কিনা তার কাজের ব্যাপারে এতোটাই আগ্রহী যে তার ঘরে ঢুকে ডকুমেন্টগুলো ঘেটে গেছে তাহলে বুঝে নিতে হবে এই রহস্যের সমাধান খুব সন্নিকটেই হতে যাচ্ছে। অথচ তার ধারণা ছিলো সমস্যার সমাধান এতো জলদি হবে না।

এরপরই তার মনে পড়লো তার কাজের ব্যাপারে অন্য অনেকেরও আগ্রহ থাকতে পারে। মিলেনিয়াম-এ ভ্যাঙ্গারের অংশীদার হওয়াটা তো ওয়েনারস্ট্রমের চোখে এড়িয়ে যেতে পারে না। নাকি খামোখাই সন্দেহগ্রস্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে সে?

বিছানা ছেড়ে নগ্ন অবস্থায়ই রান্নাঘরের জানালার কাছে গিয়ে বৃজের ওপাড়ে চার্চের দিকে তাকালো মিকাইল। একটা সিগারেট ধরালো সে।

লিসবেথ সালান্ডারকে সে কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছে না। মেয়েটা একেবারেই আলাদা প্রজাতির। কথার মাঝখানে লম্বা বিরতি দিয়ে দেয়। তার অ্যাপার্টমেন্টটা একেবারে এলোমেলো আর অগোছালো। হলে ব্যাগ ভর্তি সংবাদপত্র। রান্নাঘরটা কয়েক মাস ধরেই পরিস্কার করা হয় নি। মেঝের এখানে সেখানে কাপড়চোপড় পড়ে আছে। রাতের অর্ধেকটা সময় যে মেয়েটি বারে কাটিয়েছে সেটা বুঝতে পারলো ব্লমকোভিস্ট। তার ঘাড়ে লাভ বাইটের চিহ্ন দেখেছে সে। অবশ্যই রাতে তার সাথে কেউ একজন ছিলো। মুখে আর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কতোগুলো টাটু আঁকা আছে আর কতো জায়গা যে ছিদ্র করে রিং পরেছে কে জানে। আজব একটি মেয়ে।

আরমানস্কি তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে এই মেয়েটাই নাকি তাদের সেরা রিসার্চার। তার উপরে মেয়েটা যে রিপোর্ট তৈরি করেছিলো সেটা ছিলো এক কথায় অসাধারন। অদ্ভুত এক মেয়ে।

.

সালান্ডার তার ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে কিন্তু ভাবছে মিকাইল ব্লমকোভিস্টের কথা। কোনো রকম আমন্ত্রণ ছাড়া এ জীবনে কাউকে সে নিজের ঘরে ঢুকতে দেয় নি। আমন্ত্রণ দিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসা লোকের সংখ্যাও নেহায়েত হাতে গোনা। ব্লমকোভিস্ট একেবারে সাবলীলভাবেই তার ঘরে ঢুকে পড়েছিলো। সেও খুব একটা বাধা দেয় নি। এ নিয়ে শুধু মৃদু প্রতিবাদ করেছে দু’একবার।

শুধু তাই নয়, লোকটা তাকে কথারছলে টিটকারিও মেরেছে।

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এ রকম ঘটনা ঘটলে মানসিকভাবে দারুণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতো সে। তবে লোকটার কাছ থেকে কোনো হুমকি কিংবা খারাপ কিছুও আশংকা করে নি। তার ব্যাপারে সব জেনে পুলিশকে জানিয়ে না দিয়ে সোজা চলে এসেছে তার ঘরে। কম্পিউটার হ্যাকিং নিয়ে তেমন একটা মাথাই ঘামায় নি সে। যেনো এটা মামুলি কোনো ছেলেখেলা।

তাদের কথাবার্তায় এটা ছিলো সবচাইতে স্পর্শকাতর বিষয়। ব্লমকোভিস্ট ইচ্ছাকৃতভাবে প্রসঙ্গটা টেনে না আনলেও সালান্ডার নিজেই তাকে সেটা জিজ্ঞেস না করে পারে নি।

“আপনি বলছেন আমি কি করেছি সেটা আপনি জেনে গেছেন।”

“তুমি আমার কম্পিউটারে ঢুকেছো। তুমি একজন হ্যাকার।”

“আপনি সেটা কিভাবে জানলেন?” সালান্ডার নিশ্চিত সে এমনভাবে অনুপ্রবেশ করেছে যে সেটা ট্রেস করা প্রায় অসম্ভব। শুধুমাত্র এ বিষয়ে অভিজ্ঞ সিকিউরিটি কনসালট্যান্টরা ব্লমকোভিস্টের হার্ডডিস্ক স্ক্যান করলে জানতে পারতো কখন সে অনুপ্রবেশ করেছে।

“তুমি একটা ভুল করেছিলে।”

সে এমন একটা উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছে যা কিনা শুধুমাত্র মিকাইলের কম্পিউটারেই সংরক্ষিত ছিলো।

চুপ মেরে বসে রইলো সালান্ডার। অবশেষে যখন মুখ তুলে তাকালো তার চোখে কোনো অভিব্যক্তি দেখা গেলো না।

“তুমি এটা কিভাবে করেছো?” জানতে চাইলো সে।

“এটা আমার সিক্রেট। এটা কিভাবে করেছি সেটা জেনে আপনি কি করবেন?”

মিকাইল কাঁধ তুললো।

“আমি কি করতে পারি?”

“ঠিক এই কাজটাই করেন আপনারা সাংবাদিকেরা

“অবশ্যই। আর সেজন্যেই আমরা কিছু নীতি মেনে চলি। আমি যখন কোনো ব্যাঙ্কিং জগতের বানচোতের উপর আর্টিকেল লিখি তখন তার ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপারগুলো বাদ দিয়ে লিখি। আমি কখনও বলি না ঐ জালিয়াত একজন লেসবিয়ান কিংবা নিজের কুকুরের সাথে সে সঙ্গম করে। এধরণের কিছু আমি উল্লেখ করি না। এমন কি সেটা সত্যি হলেও না। বানচোত হলেও তার নিজের ব্যক্তিগতজীবনের গোপনীয়তা বজায় রাখার অধিকার রয়েছে। বুঝতে পেরেছো কি?”

“হ্যা।”

“তাহলে তুমি আমার আত্মমর্যাদায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছো। আমি কার সাথে সেক্স করি না করি সেটা আমার চাকরিদাতার জানার কোনো দরকার নেই। এটা একান্তই আমার নিজস্ব ব্যাপার।

সালান্ডারের মুখটা তিক্ত হাসিতে বিকৃত হয়ে গেলো।

“আপনি মনে করছেন এইসব কথা আমার উল্লেখ না করলেও হতো?”

“আমার বেলায় অবশ্য এতে তেমন কিছু হয়ও নি। এরিকার সাথে আমার সম্পর্কের কথা এই শহরের অর্ধেক মানুষ জানে। তবে এটা হলো নীতির প্রশ্ন।”

“তাহলে জেনে রাখুন আমারও একটা নীতি রয়েছে। এটাকে আমি বলি সালান্ডারের নীতি। তার মধ্যে একটা হলো, বানচোত বানচোতই। আমি যদি কোনো বানচোতের ব্যাপারে খোড়াখুড়ি করে নোংরা কিছু বের করে ফেলি তাহলে ধরে নিতে হবে সেটা তার প্রাপ্যই ছিলো।”

“ঠিক আছে,” বললো ব্লমকোভিস্ট। “তোমার নীতের সাথে আমার নীতির খুব বেশি পার্থক্য নেই তবে…

“তবে আমি যখন কারো সম্পর্কে তদন্ত করি তখন সেই ব্যক্তি সম্পর্কে আমি নিজে কি ভাবি সেটাও জুড়ে দেই। আমি নিরপেক্ষ থাকি না। লোকটা যদি আমার কাছে ভালো মনে হয় তাহলে রিপোর্টে আমি তার ক্ষেত্রে একটু ছাড় দেই। “

“তাই নাকি?”

“আপনার বেলায় আমি সেটাই করেছি। আপনার যৌনজীবন নিয়ে আমি একটা বইও লিখতে পারতাম। আমি ইচ্ছে করলে ফ্রোডির কাছে উল্লেখ করতে পারতাম যে এরিকা বার্গার অতীতে ক্লাব এক্স-এর সাথে জড়িত ছিলো, আশির দশকে বিডিএসএম-এর সাথেও জড়িয়ে পড়েছিলো সে-এরফলে আপনার এবং তার যৌনজীবন সম্পর্কে এক ধরণের বাজে ধারণা পোষণ করা হতো।’

সালান্ডারের চোখের দিকে তাকিয়ে ব্লমকোভিস্ট হেসে ফেলেছিলো।

“তুমি আসলেই খুব হিসেবি, তাই না? এ কথাটা কেন রিপোর্টে উল্লেখ করো নি?”

“আপনারা প্রাপ্তবয়স্ক, অবশ্যই একে অন্যেকে পছন্দ করেন। বিছানায় আপনারা কি করেন সেটা অন্য কারোর জানার দরকার নেই। এরিকার সম্পর্কে যদি আমি কিছু লিখতাম সেটা কেবল আপনাদের কষ্টই দিতো অন্য কারোর লাভ তাতে হতো না। কিংবা জঘন্য কাউকে ব্লাকমেইল করার জন্য রসদ তুলে দেয়া হতো। ফ্রোডিকে আমি চিনি না-তথ্যটা শেষ পর্যন্ত ওয়েনারস্ট্রমের হাতেও চলে যেতে পারতো।”

“তুমি ওয়েনারস্ট্রমকে কোনো তথ্য দিতে চাও নি?”

“আপনার এবং তার মধ্যে যদি আমাকে একজনকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে আপনাকেই বেছে নিতাম।”

“এরিকা এবং আমার…আমাদের সম্পর্কটা…”

“প্লিজ। আপনাদের মধ্যে কী ধরণের সম্পর্ক আছে সেটা আমার না জানলেও চলবে। কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি : আমি যে আপনার কম্পিউটার হ্যাকিং করেছি সে ব্যাপারে আপনি কি করার পরিকল্পনা করছেন?

“লিসবেথ, আমি তোমাকে ব্লাকমেইল করার জন্য এখানে আসি নি। আমি এসেছি আমার কাজে সাহায্য করার জন্য তুমি কিছু রিসার্চ করে দেবে। খুব সহজেই হ্যা কিংবা না বলতে পারো তুমি। না বললেও ঠিক আছে। আমি অন্য কাউকে খুঁজে নেবো। তুমি আর আমার মুখ দেখবে না কখনও।”

অধ্যায় ১৯

বৃহস্পতিবার, জুন ১৯-রবিবার, জুন ২৯

ভ্যাঙ্গার সেরে উঠবে কিনা সেই খবরটা শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকা সময়টি ব্লমকোভিস্ট তার কাছে থাকা ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাটিয়ে দিলো। ফ্রোডির সাথে যোগাযোগ রাখলো সে। বৃহস্পতিবার রাতে ফ্রোডি তাকে জানালো ভ্যাঙ্গারের সংকটজনক অবস্থার অবসান হয়েছে।

“আজ তার সাথে কথা সুযোগ হয়েছিলো আমার। সে যতো দ্রুত সম্ভব আপনাকে দেখা করতে বলেছে।”

তো, মধ্যগ্রীষ্মের এক দুপুরে গাড়ি চালিয়ে হেডেস্টাড হাসপাতালে চলে গেলো ব্লমকোভিস্ট। কিন্তু হেনরিকের ওয়ার্ডে ঢোকার সময় ক্ষুব্ধ বার্জার ভ্যাঙ্গার তার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে হেনরিকের সাথে কেউ দেখা করতে পারবে না, বললো সে।

“আজব কথা,” ব্লমকোভিস্ট বললো, “হেনরিক আমার কাছে খবর পাঠিয়েছে যতো দ্রুত সম্ভব তার সাথে দেখা করার জন্য।”

“আপনি আমাদের পরিবারের কেউ নন; এখানে আপনার আসার কোনো দরকার নেই।”

“আপনার কথা ঠিক। আমি আপনাদের পরিবারের কেউ নই। কিন্তু আমি হেনরিক ভ্যাঙ্গারের একটা কাজ করছি। আমি কেবল তার কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে থাকি।”

তাদের মধ্যেকার এই উত্তপ্ত বাক্য বিনিয়মটি আরো বাজে কিছুতে গড়াতে পারতো কিন্তু তার আগেই ভ্যাঙ্গারের রুম থেকে বেরিয়ে এলো ফ্রোডি।

“ওহ্, আপনি এসে গেছেন। হেনরিক আপনাকে দেখতে চাচ্ছিলো।” ফ্রোডি রুমের দ্রজা খুলে দিলে ব্লমকোভিস্ট বার্জারকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

ভ্যাঙ্গারকে দেখে মনে হলো তার বয়স দশ বছর। আধখোলা চোখে বিছানায় শুয়ে আছে, তার নাকে অক্সিজেন টিউব। মাথার চুলগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি অবিন্যস্ত। এক নার্স ব্লমকোভিস্টের কাধে হাত রেখে তাকে থামালো।

“দুই মিনিট। এর বেশি না। তাকে এমন কিছু বলবেন না যাতে আপসেট হয়ে যায়।” ভিজিটর চেয়ারে বসলো ব্লমকোভিস্ট। বৃদ্ধলোকের হাতে আলতো করে পরশ বুলিয়ে দিতে লাগলো সে। নিজের এই আচরণে বেশ অবাকই হলো।

“কোনো সংবাদ আছে?” দুর্বল কণ্ঠে জানতে চাইলো বৃদ্ধ।

সায় দিলো ব্লমকোভিস্ট।

“আপনি সুস্থ হয়ে উঠলেই আপনার কাছে রিপোর্ট করবো আমি। এখনও রহস্যটার সমাধান করতে পারি নি তবে নতুন কিছু পেয়েছি আর সেটা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি এখন। এক কি দু’সপ্তাহের মধ্যে সম্ভবত ফলাফলটি বলতে পারবো।”

কোনো রকম চোখ দুটো পিট পিট করে ভ্যাঙ্গার তাকে জানালো সে বুঝতে পেরেছে।

“কয়েক দিনের জন্য আমি একটু বাইরে যাবো।“

ভুরু তুললো হেনরিক।

“জাহাজ থেকে আমি লাফ দিয়ে নেমে পড়ছি না। আমাকে কিছু রিসার্চ করতে হবে। ডার্চের সাথে আমি একটা এগ্রিমেন্ট করেছি যে তার কাছেই আমাকে রিপোর্ট দিতে হবে। এটাতে কি আপনার সায় আছে?”

“ডার্চ…আমার লোক…সব বিষয়েই।”

ভ্যাঙ্গারের হাতটায় কোমল পরশ বুলিয়ে দিলো ব্লমকোভিস্ট।

“মিকাইল…আমি যদি নাও থাকি…আমি চাইবো…তুমি কাজটা শেষ

করবে।”

“আমি কাজটা অবশ্যই শেষ করবো।”

“ডার্চের কাছে…”

“হেনরিক, আমি চাই আপনি ভালো হয়ে উঠুন। আমি কাজটা শেষ করার আগে যদি আপনি মারা যান তাহলে কিন্তু খুবই রাগ করবো

“দুই মিনিট,” পাশ থেকে নার্স বললো।

“পরের বার যখন আসবো অনেকক্ষণ আলাপ করবো।“

.

বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখতে পেলো বার্জার ভ্যাঙ্গার তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার কাঁধে একটা হাত রেখে তাকে থামালো সে।

“আমি চাই না আপনি আর হেনরিককে বিরক্ত করেন। তার শরীর খুব খারাপ। তাকে বিরক্ত করা কিংবা আপসেট করা ঠিক হবে না।”

“আপনার দুশ্চিন্তাটা আমি বুঝি। আমার সহমর্মিতাও আছে আপনাদের প্রতি। তাকে আমি মোটেও আপসেট করবো না।”

“সবাই জানে হেনরিক আপনাকে তার পুরনো শখের বিষয় হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার রহস্য উদঘাটনের জন্য নিয়োজিত করেছে। ডার্চ বলেছে হেনরিকের হার্ট অ্যাটাকের আগে আপনার সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলার পরই খুব আপসেট হয়ে যায় সে। তারপরই এই ঘটনা ঘটে। সে এমনকি এও মনে করে আপনিই তার হার্ট অ্যাটাকের জন্য দায়ি।”

“আমি অবশ্য কোনোভাবেই এটা মনে করি না। হেনরিকের ধমনীতে বেশ কয়েকটি ব্লকেজ ছিলো। খুবই মারাত্মক ব্লকেজ। প্রস্রাব করতে গিয়েও তার হার্ট অ্যাটাক হতে পারতো। আমি নিশ্চিত আগে না জানলেও এখন আপনি সেটা জানেন।”

“আমি চাই এই পাগলামির পরিপূর্ণ সমাপ্তি। এটা আমার পরিবার, আপনি এখানে হট্টগোল বাধাচ্ছেন।”

“আমি তো আপনাকে বলেছিই, আমি হেনরিকের হয়ে কাজ করছি, আপনাদের পরিবারের হয়ে কিছু করছি না।”

মনে হচ্ছে বার্জার ভ্যাঙ্গারের মুখের উপর কথা শোনার অভিজ্ঞতা নেই। ব্লমকোভিস্টের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো রকম সমীহ আদায় করতে না পেরে হেনরিকের রুমে ঢুকে পড়লো।

অনেক কষ্টে নিজের হাসি দমন করে রাখলো ব্লমকোভিস্ট। এটা হাসাহাসির কোনো জায়গা নয়।

হাসপাতালের লবিতে সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের সাথে তার দেখা হয়ে গেলো। লন্ডন থেকে ফিরে আসার পর অনেকবার তার মোবাইলে ফোন করেছিলো কিন্তু তার ফোন একবারের জন্যে ধরে নি। এমনকি ফিরে আসার পর তাকে তার বাড়িতেও পায় নি। বেশ কয়েকবার তার বাড়ির দরজায় নক করে কোনো সাড়া শব্দ পায় নি সে।

“হাই সিসিলিয়া,” সে বললো। “হেনরিকের যা হয়েছে তার জন্য আমি দুঃখিত।”

“ধন্যবাদ,” বললো সে।

“তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

“তোমাকে এড়িয়ে চলার জন্য আমি খুব দুঃখিত। বুঝতে পারছি তুমি অস্থির হয়ে আছো। তবে আমার দিনকালও ভালো যাচ্ছে না।”

মিকাইল তার হাতটা ধরে হেসে ফেললো।

“দাঁড়াও, তুমি হয়তো অন্য কিছু ভাবছো। আমি মোটেও অস্থির হয়ে নেই। এখনও আমি মনে করি আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি। আমরা কি একটু কফি খেতে পারি?” হাসপাতালের ক্যাফেটেরিয়ার দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

একটু ইতস্তত করলো সিসিলিয়া। “আজ নয়। এখন হেনরিককে দেখতে যেতে হবে।

“ঠিক আছে, তারপরও বলছি, তোমার সাথে আমার কথা আছে। এটা একেবারেই পেশাদার কাজে।”

“এর মানে কি?” হঠাৎ করেই চমকে উঠলো সে।

“আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি দরকার পড়লে তোমার কাছে আসবো কিছু প্রশ্ন করার জন্য। তুমিও রাজি হয়েছিলে, বলেছিলে যেকোনো সময় যেনো আমি চলে আসি। আসলে হ্যারিয়েটের ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছি, সিসিলিয়া।”

সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধে লাল হয়ে গেলো।

“তুমি আসলেই একটা বানচোত।”

“সিসিলিয়া, আমি এমন একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি যে তোমার সাথে কথা বলতেই হবে।”

তার থেকে একটু সরে গেলো সে।

“এখনও কি বুঝতে পারছো না এই অভিশপ্ত হ্যারিয়েট রহস্যটা হেনরিকের জন্য একধরণের সময় কাটানোর থেরাপি ছাড়া আর কিছু না? তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না লোকটা মরতে বসেছে? এ সময় তাকে মিথ্যে আশা দেখানো কিংবা আপসেট করা মোটেই উচিত হবে না…

“হেনরিকের জন্য এটা শখের বিষয় হতে পারে কিন্তু এই দীর্ঘ সময় পর এই কেসে নতুন আলামত পাওয়া গেছে। এখন কিছু প্রশ্নের জবাব জানা খুব জরুরি।”

“হেনরিক যদি মারা যায় তাহলে এই তদন্তটিও খতম হয়ে যাবে। তখন তুমি আর তোমার তদন্ত দুটোই পাততারি গোটাবে এখান থেকে,” কথাটা বলেই সিসিলিয়া চলে গেলো।

.

সব কিছু বন্ধ। হেডেস্টাড বলতে গেলে একেবারে ফাঁকা। এর অধিবাসীরা চলে গেছে মধ্যগ্রীষ্মের

মধ্যগ্রীষ্মের কটেজগুলোতে। স্ট্যাডসহোটেলের টেরাসে বসলো ব্লমকোভিস্ট। এই হোটেলটাই শুধু খোলা আছে। কফি আর স্যান্ডউইচ অর্ডার দিয়ে সান্ধ্যকালীন পত্রিকা পড়তে লাগলো সে। এই পৃথিবীতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটে নি।

পত্রিকাটা নামিয়ে রেখে সিসিলিয়া ভ্যাঙ্গারের কথা ভাবতে লাগলো এবার। সালান্ডার ছাড়া আর কাউকে সে বলে নি যে হ্যারিয়েটের জানালায় তাকে দেখা গেছে তার ভয় এতে করে তাকে সন্দেভাজনের তালিকায় ফেলে দেবে। সিসিলিয়াকে কোনো রকম বিপদে ফেলতে চায় না ব্লমকোভিস্ট। তবে আজ হোক আর কাল হোক এই প্রশ্নটা উঠবেই।

হোটেলের টেরাসে প্রায় এক ঘণ্টার মতো বসে থেকে সিদ্ধান্ত নিলো মধ্যগ্রীষ্মের এই সময়টায় ভ্যাঙ্গার পরিবারের ব্যাপা-স্যাপার থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে অন্য কিছুতে নিয়োজিত রাখবে। তার মোবাইলটা সাইলেন্ট মুডে আছে। বার্গার তার স্বামীর সাথে কোথাও ভালো সময় কাটাচ্ছে। কারো সাথে কথার বলার মতো কেউ নেই তার কাছে।

হেডেবি আইল্যান্ডে ফিরে গিয়ে বিকেল ৪টার দিকে আরেকটা সিদ্ধান্ত নিলো সে-ধূমপান করবে না। সিগারেট খাওয়া বাদই দিয়েছিলো সে কিন্তু ওয়েনারস্ট্রমের সাথে বিবাদের পর থেকে আবার নতুন করে ধরেছে। তবে রুলাকার জেলে যাবার পর মিলিটারি সার্ভিসে থাকার সময় যে অভ্যেসটি হয়েছিলো সেই ব্যয়াম করার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। তবে মুক্তি পাবার পর থেকে একটুও ব্যয়াম করে নি। সময় হয়েছে আবার সেটা শুরু করার। ট্র্যাকসুট পরে হাটতে হাটতে চলে এলো গটফ্রিড ক্যাবিনে। দূর্গের পথ ধরে না গিয়ে অপেক্ষাকৃত বন্ধুর পথ ব্যবহার করলো সে। মিলিটারি সার্ভিসের পর থেকে অনুশীলন করা একেবারে বাদ দিয়েছে, তবে সে জানে মসৃণ পথের চেয়ে বন- জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়ানোর মধ্যে মজা বেশি। অস্টারগার্ডেন হয়ে আবার ফিরে এলো নিজের গ্রামে। গেস্ট হাউজের কাছে পৌছাতেই দম ফুরিয়ে হাফিয়ে উঠলো, সেইসাথে টের পেলো সারা শরীরে চুলকানি হচ্ছে।

সন্ধ্যা ৬টার দিকে গোসল করে নিলো সে। কটেজের বাইরে একটা টেবিলে বসে বৃজের দিকে মুখ করে স্যান্ডউইচ আর পটেটো এগ খেতে শুরু করলো। শেষে পান করলো একটু মদ। খাওয়া শেষ করে ভ্যাল ম্যাকডামিডের দ্য মারমেইড সিংগিং নামের ক্রাইম থূলার নিয়ে বসলো মিকাইল ব্লমকোভিস্ট।

৭টার দিকে একটা গাড়ি চালিয়ে ফ্রোড়ি এসে উপস্থিত হলো তার সামনে। ব্লমকোভিস্ট তাকে একটু মদ ঢেলে দিলে চেয়ারে বসে পান করলো ভদ্রলোক।

“আপনি তো দেখছি আজ অনেককেই ক্ষেপিয়ে তুলেছেন,” বললো ফ্রোডি। “আমিও সেটা দেখতে পাচ্ছি।”

“বার্জার একজন উন্নাসিক বোকা।”

“আমি সেটা জানি।”

“তবে সিসিলিয়া সেরকম বোকা নয়। সে খুব রেগে আছে।”

মিকাইল মাথা নেড়ে সায় দিলো।

“আমাকে সে নির্দেশ দিয়েছে আমি যেনো এই পরিবারের ব্যাপারে আপনার নাক গলানো বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেই।”

“আচ্ছা। আপনি তাকে কি বললেন?”

গ্লাসে আরো মদ ঢেলে পান করলো ফ্রোডি।

“আমি তাকে বলেছি হেনরিক আমাকে পরিস্কার বলে দিয়েছে সে কি চায়। যতোক্ষণ না সে আমাকে অন্য কোনো নির্দেশ দিচ্ছে ততোক্ষণ পর্যন্ত আপনি চুক্তি অনুযায়ী আপনার কাজ চালিযে যাবেন। আরো চাইবো কাজটা যতো দূর সম্ভব ভালোভাবে করেন।”

আকাশের দিকে তাকালো ব্লমকোভিস্ট, মেঘ জমছে সেখানে।

“মনে হচ্ছে ঝড় হবে,” ফ্রোডি বললো। “বাতাস যদি প্রবল হতে শুরু করে আমি থাকবো আপনার পাশে।

“ধন্যবাদ আপনাকে।”

তারা কিছুক্ষণ বসে রইলো সেখানে।

“আমি কি আরেকটু পান করতে পারি?”

.

ফ্রোডি চলে যাবার মিনিটখানেক পরই মার্টিন ভ্যাঙ্গার তার গাড়ি পার্ক করলো ব্লমকোভিস্টের কটেজের সামনে। তারা একে অন্যকে সম্ভাষণ জানানোর পর মিকাইল তাকে মদ পান করার প্রস্তাব দিলো।

“না। না পান করাই ভালো। আমি আসলে পোশাক পাল্টানোর জন্য এসেছিলাম। এখান থেকে শহরে ফিরে যাবো, ইভার সাথে রাতে থাকবো আজ।

ব্লমকোভিস্ট অপেক্ষা করলো তার কাছ থেকে আসল কথাটা শোনার জন্য।

“সিসিলিয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে। একেবারে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে সে-হেনরিক আর তার মধ্যে দারুণ হৃদ্যতা ছিলো। আশা করি আপনি তার উল্টাপাল্টা কথাগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।”

“আমি সিসিলিয়াকে খুব পছন্দ করি।”

“আমি সেটা জানি। তবে সে মাঝেমধ্যে খুব কঠিন হয়ে ওঠে। আমি শুধু আপনাকে জানাতে চাই সে মোটেও চায় না আপনি আমাদের পরিবারের অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো ব্লমকোভিস্ট। মনে হচ্ছে হেডেস্টাডের প্রায় সবাই জানে ভ্যাঙ্গার তাকে কেন ভাড়া করেছে।

“এ ব্যাপারে আপনার কি অভিমত?”

“হ্যারিয়েটের ব্যাপারটা অনেক যুগ ধরেই হেনরিকের জন্য একটি বাতিক হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। আমি জানি না…হ্যারিয়েট আমার বোন ছিলো, তবে এসব ব্যাপার এখন অনেক দূরের বলেই মনে হয় আমার কাছে। ডার্চ বলেছে আপনার সাথে যে চুক্তি সেটা কেবলমাত্র হেনরিকই বাতিল করতে পারে। তার বর্তমান যে অবস্থা তাতে করে মনে হয় এটা করলে তার ভালোর চেয়ে খারাপই হবে বেশি।”

“তাহলে আপনি চাচ্ছেন আমি কাজটা চালিয়ে যাই?”

“আপনার কাজের কি কোনো অগ্রগতি হয়েছে?”

“আমি দুঃখিত, মার্টিন। হেনরিকের অনুমতি ছাড়া এ ব্যাপারে কিছু বললে সেটা চুক্তি ভঙ্গের শামিল হবে।”

“বুঝতে পেরেছি।” হঠাৎ করেই সে হেসে ফেললো। “ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাপারে হেনরিককে কিছুটা উগ্রপন্থী ভাবতে পারেন। তবে সব থেকে বড় কথা হলো আমি চাই না তাকে খামোখাই আশান্বিত করা হোক।“

“আমি সেটা করবো না।”

“বেশ…ভালো কথা, অন্য একটা প্রসঙ্গে বলি, আমাদের তো আরেকটা চুক্তি আছে। হেনরিক অসুস্থ থাকার কারণে মিলেনিয়াম-এর বোর্ড মিটিংয়ে খুব সহসাই থাকতে পারবে না বলেই মনে হয়। তার জায়গায় আমাকেই এখন কাজ করতে হবে।”

মিকাইল অপেক্ষা করলো। কিছু বললো না।

“আমার মনে হয় বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের একটা বোর্ড মিটিং করার দরকার আছে।

“ভালো কথা। তবে আমি যতোটুকু জানি পরবর্তী বোর্ড মিটিং অনুষ্ঠিত হবে আগস্ট মাসে।”

“আমিও সেটা জানি, তবে আমাদেরকে হয়তো আগেভাগেই সেটা করতে হবে।”

ভদ্রভাবে হাসলো ব্লমকোভিস্ট।

“আপনি আসলে ভুল মানুষের সাথে কথা বলছেন। এই মুহূর্তে আমি বোর্ডে নেই। ডিসেম্বরেই ঐ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছি। এ নিয়ে আপনার এরিকার সাথে কথা বলা উচিত। ও জানে হেনরিক বেশ অসুস্থ।”

মার্টিন ভ্যাঙ্গার এরকম জবাব পাবার প্রত্যাশা করে নি

“আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি তার সাথেই কথা বলবো।” ব্লমকোভিস্টের কাঁধে আলতো করে চাপড় মেরে তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো সে।

নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা হয় নি তবে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি ঠিকই ছিলো মার্টিনের কথার মধ্যে। মিলেনিয়াম’কে জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে মার্টিন। কিছুক্ষণ পর আরেকটু পান করে ভ্যাল ম্যাকডারমিডের বইটা তুলে নিলো সে।

বাদামী রঙের বেড়ালটা এসে তার পায়ের কাছে শরীর ঘষতে লাগলে বেড়ালটা তুলে নিয়ে আদর করলো ব্লমকোভিস্ট।

“আমাদের দু’জনেরই মধ্যগ্রীষ্মকালটা একবোরে বিরক্তিকরভাবে কাটছে, তাই না?” বললো সে।

বৃষ্টি শুরু হলে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে বিছানায় চলে গেলেও বেড়ালটা বাইরেই থেকে গেলো।

সালান্ডার কাওয়াসাকি মোটরবাইকটা নিয়ে বেরিয়ে মধ্যগ্রীষ্মের পুরোটা দিন কাটিয়ে দিলো বাইকটা সার্ভিস করার কাজে। ১২৫ সিসির ইঞ্জিন একেবারেই

সাদামাটা জিনিস। তবে জিনিসটা তার সুতরাং এটাকে সে উন্নত করে আরো শক্তিশালী করে নিয়েছে। ফলে লিগ্যাল লিমিটের চেয়ে বাইকটার ক্ষমতা এখন অনেক বেশি।

দুপুরে হেলমেট পরে বাইকটা নিয়ে চলে গেলো অ্যাপেলভিকেন নার্সিং হোমে। ওখানকার পার্কে নিজের মা’র সাথে কাটিয়ে দিলো পুরোটা সন্ধ্যা। তার খুব খারাপ লাগছে, এক ধরণের অপরাধবোধেও আক্রান্ত সে। তার মাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি অচেনা বলে মনে হচ্ছে। তিন ঘণ্টা সময়ে তাদের মধ্যে মাত্র দুয়েকটা কথাই হলো। কিন্তু সে যখন কথা বললো তখন মনে হলো না তার মা তাকে চিনতে পারছে।

*

ব্লমকোভিস্ট কয়েকটা দিন নষ্ট করলো এসি প্লেট সংবলিত নাম্বারপ্লেটের গাড়িটা খুঁজে বের করার জন্য। অনেক কষ্টে অবশেষে হেডেস্টাডের এক অবসরপ্রাপ্ত মেকানিকের সাহায্যে সে বুঝতে পারলো গাড়িটার মডেল ফোর্ড অ্যাঞ্জেলা, এই মডেলের কথা সে কখনও শোনে নি। এরপর যানবাহন ডিপার্টমেন্টের এক ক্লার্কের সাথে যোগাযোগ করে ১৯৬৬ সালের ফোর্ড অ্যাঞ্জেলা মডেলের এসিও দিয়ে শুরু হওয়া যতোগুলো গাড়ির নাম্বারপ্লেট ছিলো সেগুলোর লাইসেন্সের তালিকার খোঁজ করলো। কিন্তু তাকে বলা হলো এরকম ‘প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান’ কাজের জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন, তবে বড় কথা হলো এসব তথ্য জনগনকে দেবার নিয়ম নেই।

তার কয়েক দিন পর ব্লমকোভিস্ট একটা ভলভো ধার করে উত্তরের ই৪ মহাসড়ক ধরে হারনোসান্ড বৃজের কাছে চলে এলো। ওখানকার এক প্যাস্ট্রি শপ থেকে কফি খেয়ে নিলো সে।

এরপর উমিয়া নামক একটি জায়গায় থেমে ভালো একটা রেস্তোয়ায় গিয়ে লাঞ্চ ক’রে কিনেস্কেলেফটিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো ব্লমকোভিস্ট। ওখান থেকে সন্ধ্যা ৬টার দিকে চলে গেলো নরসিও’তে। হোটেল নরসিও নামক এক হোটেলেই উঠলো রাত্রিযাপন করার জন্য।

পর দিন সকালে উঠে তার অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করলো ব্লমকোভিস্ট। নরসিও কাঠমিস্ত্রি শপের নাম্বার টেলিফোনবুকে নেই। পোলার হোটেলের বিশ বছরের এক ডেস্কক্লার্কের কাছে জানতে চাইলে সে জানালো এ নামের কোনো দোকানের কথা সে শোনে নি।

“কার কাছে আমি জিজ্ঞেস করতে পারি?”

মেয়েটা কিছুক্ষণ ভেবে হাসিমুখে বললো তার বাবার কাছে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে। দু’মিনিট পর ফিরে এসে সে জানালো তার বাবা বলেছে নরসিও কাঠমিস্ত্রির দোকানটি আশির দশকেই বন্ধ হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে যদি সে আরো কিছু জানতে চায় তবে বুরম্যান নামের একজন আছে তার সাথে যোগাযোগ করলেই হবে। এই লোকটা ওখানকার ফোরম্যান ছিলো, এখন বসবাস করে সলভান্ডার নামের একটি রাস্তার পাশে।

নরসিও ছোট্ট একটি শহর, একটাই মাত্র প্রধান সড়ক। সেই সড়কের দু’পাশে বাড়িঘর আর দোকানপাট অবস্থিত। পূর্ব দিকের শেষ প্রান্তে ছোটোখাটো একটি শিল্প এলাকা আর ঘোড়ার আস্তাবল রয়েছে। পশ্চিমপ্রান্তে আছে কাঠের তৈরি চমৎকার একটি চার্চ। ব্লমকোভিস্ট লক্ষ্য করলো এই শহরে আরেকটি মিশনারি চার্চ আর পেন্টেকোস্টাল চার্চও আছে। বাসস্টেশনে টাঙানো একটি বুলেটিন দেখে জানতে পারলো হান্টিং আর স্কিয়িং মিউজিয়াম রয়েছে এই শহরে। একটা পড়ে থাকা ফ্লাইয়ারে দেখতে পেলো স্থানীয় এক মাঠে ভেরোনিকা নামের এক গায়িকা গান গাইবে। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই সে শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যেতে পারলো।

সলভান্ডান নামের রাস্তাটি তার হোটেল থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ। ব্লমকোভিস্ট যখন বেল বাজালো কোনো জবাব পেলো না। এখন বাজে সকাল ৯:৩০, বুঝতে পারছে বুরম্যান এতোক্ষণে কাজে চলে গেছে, অথবা সে যদি পুরোপুরি অবসর জীবনযাপন করে থাকে তাহলে অন্য কোনো কাজে বাইরে গেছে।

এরপর স্টোরগাথান নামের একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে গেলো সে। তার কাছে মনে হলো নরসিও’তে যারাই থাকে তারা একবারের জন্য হলেও হার্ডওয়্যারের দোকানে যাবে। দোকানে দু’জন সেলস-ক্লার্ক আছে। ব্লমকোভিস্ট পঞ্চাশোর্ধ লোকটাকেই বেছে নিলো।

“হাই। আমি এমন এক দম্পতিকে খুঁজছি যারা ষাটের দশকে নরসিও’তে থাকতো। লোকটা সম্ভবত নরসিও কার্পেন্ট্রি শপে কাজ করতো। তাদের নাম আমি জানি না। তবে আমার কাছে ১৯৬৬ সালে তোলা তাদের কিছু ছবি আছে।”

অনেকক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে ক্লার্ক অবশেষে মাথা দোলালো। জানালো ছবির কাউকেই সে চিনতে পারছে না।

লাঞ্চটাইমে ভ্রাম্যমান দোকান থেকে বার্গার কিনে খেয়ে নিলো সে। তারপর চলে গেলো মিউনিসিপ্যাল অফিস, লাইব্রেরি আর ফার্মেসিতে। পুলিশ স্টেশনটি একেবারে ফাঁকা। পথে বয়োবৃদ্ধ লোকজনদেরকে ছবি দেখিয়ে পরিচয় বের করার চেষ্টা করলো। দুপুরের দিকে অল্পবয়সী দু’জন তরুণীকে ছবিটা দেখিয়ে জানতে চাইলে তারা ছবির দম্পতিদের না চিনতে পারলেও ভালো একটি বুদ্ধি দিলো তাকে।

“ছবিটা যদি ১৯৬৬ সালে তোলা হয়ে থাকে তাহলে ছবির লোকদের বর্তমান বয়স হিসেবে নিলে তারা তো এখন অবসর জীবনযাপন করছে। আপনি কেন সলবাকার রিটায়ার্ড হোমে যোগাযোগ করছেন না?”

রিটায়ারমেন্ট হোমের ফ্রন্ট ডেস্কে থাকা বয়স্ক মহিলাকে নিজের পরিচয় দিয়ে সে কি খোঁজ করছে সেটা খুলে বলতেই মহিলা তার দিকে সন্দেহের দিকে তাকালো। তবে শেষ পর্যন্ত মহিলাকে বেঝাতে পারলো তার কাজের ধরণ সম্পর্কে। তাকে ডে রুমে নিয়ে গেলো সেই মহিলা। ওখানে থাকা একদল বৃদ্ধ নরনারীকে ছবিটা দেখানো হলে তাদের কেউই চিনতে পারলো না।

বিকেল ৫টার দিকে সলভান্ডানে ফিরে গিয়ে বুরম্যানের দরজায় নক করলে এবার লোকটাকে বাড়িতে পাওয়া গেলো। বউকে নিয়ে সে বাড়ির বাইরে ছিলো সারাটা দিন। তাকে তাদের রান্নাঘরে বসতে দিয়ে মিসেস বুরম্যান তার জন্য কফি বানাতে শুরু করলে ব্লমকোভিস্ট বুরম্যানের কাছে তার উদ্দেশের কথা ব্যাখ্যা করলো। এখানেও সে ব্যর্থ হলো বরাবরের মতো। মাথা চুলকে বুরম্যান জানালো ছবির নরনরীকে সে চিনতে পারছে না। বুরম্যান দম্পতি নিজেদের মধ্যে খাঁটি নরসিও টানে কথা বলার কারণে ব্লমকোভিস্ট তাদের খুব কম কথাই বুঝতে পারলো। তবে মিসেস বুরম্যান ছবিটা দেখে যখন বললো নভেলহারা তখন সে বুঝতে পারলো মহিলা আসলে ‘কোঁকড়ানো’ চুলের কথা বলছে।

“তবে আপনি কার্পেন্ট্রি শপের স্টিকারটা ঠিকই ধরতে পেরেছেন,” লোকটা বললো তাকে। “এটা ধরতে পারাটা সহজ কাজ নয়। তবে সমস্যা হলো এরকম স্টিকার আমরা কর্মচারী, কাস্টমার, কনট্রাক্টর মেকানিস্ট সবাইকেই দিতাম।”

“মনে হচ্ছে এই দম্পতিকে খুঁজে বের করাটা অনেক কঠিন কাজ হবে।”

“আপনি তাদেরকে খুঁজে বের করতে চাইছেন কেন?”

ব্লমকোভিস্ট সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কেউ যদি তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করে তবে সে সত্যি কথাই বলবে। মিথ্যে কথা বলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করার কোনো দরকার নেই।

“লম্বা একটি গল্প। ১৯৬৬ সালে হেডেস্টাডে একটি ক্রাইমের উপর তদন্ত করছি আমি। আমার মনে হচ্ছে এই ছবির দম্পতিরা ঘটনাটি ঘটতে দেখেছে। তাদেরকে কোনো রকম সন্দেহ করা হচ্ছে না, এমনকি আমার মনে হয় না তারা জানতো এরকম কিছু হচ্ছে। তবে ব্যাপারটা হয়তো তারা দেখেছে। তাদের কাছ থেকে তথ্য পেলো এই ক্রাইমের রহস্য সমাধান করা যাবে।”

“ক্রাইম? কি ধরণের ক্রাইম?”

“আমি দুঃখিত। এর বেশি আমি আপনাদের বলতে পারছি না। জানি প্ৰায় চল্লিশ বছর পর এখানে এসে ছবি দেখিয়ে দু’জন লোককে খুঁজে বেড়ানোটা অদ্ভুত ব্যাপারই বটে। তবে ঐ ক্রাইমটার রহস্য এখনও সমাধা করা হয় নি। এই তো কিছু দিন আগে নতুন কিছু আলামত আর এভিডেন্স পাওয়া গেলে পুরো তদন্তটি নতুন করে শুরু করা হয়েছে।”

“বুঝতে পেরেছি। আসলেই অদ্ভুত একটি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করছেন।

“ঐ কার্পেন্ট্রি শপে কতোজন লোক কাজ করতো?”

“সাধারণত চল্লিশ জনের মতো লোক কাজ করতো ওখানে। আমি সতেরো বছর বয়স থেকে শুরু করে পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত ওখানে কাজ করেছি। এরপর আমি একজন কনট্রাক্টর হিসেবে কাজ করেছি সেখানে।” একটু ভেবে নিলো বুরম্যান। “এই পর্যন্তই আমি আপনাকে বলতে পারবো। আপনার ছবিতে যাকে দেখতে পাচ্ছেন সে আমাদের ওখানে কোনোদিনই কাজ করে নি সেটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। সে হয়তো কনট্রাক্টর ছিলো। তবে কনট্রাক্টর হলেও তাকে আমি দেখে চিনতে পারতাম। অবশ্য একটা সম্ভাবনা আছে। হয়তো তার বাবা কিংবা নিকট কোনো আত্মীয় ওখানে কাজ করতো। আর গাড়িটা হয়তো তার নিজের ছিলো না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো মিকাইল ব্লমকোভিস্ট। “বুঝতে পারছি অনেক বেশি সম্ভাবনা আছে। আপনি কি বলতে পারেন কার সাথে কথা বললে কাজ হতে পারে?”

“হ্যা,” বললো বুরম্যান। “আগামীকাল চলে আসুন। কিছু পুরনো লোকজনের সাথে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবো। তাদের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন।”

.

সালান্ডার পদ্ধতিগত একটা সমস্যায় পড়লো। যেকোনো লোকের ব্যাপারে তথ্য খুঁজে বের করতে সে খুব সিদ্ধহস্ত, তবে সেক্ষেত্রে তার কাছে নাম আর সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বার থাকে, আর লোকটাও থাকে জীবিত। কম্পিউটারে লিস্টেড করা আছে এরকম কোনো লোকের তথ্য খুঁজে বের করতে তার খুব কম সময় লাগে। আর সেই লোকের কাছে যদি কম্পিউটার থাকে, নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে তাহলে একেবারে গভীরতম গোপন ব্যাপারগুলো পর্যন্ত বের করা সম্ভব।

কিন্তু ব্লমকোভিস্ট তাকে যে কাজটা দিয়েছে সেটা একেবারেই আলাদা। এই অ্যাসাইনমেন্টটা সোজা কথায় অল্প কিছু ডাটার সাহায্য নিয়ে চার চারজন ব্যক্তির সোশ্যাল সিকিউরিটি নাম্বার বের করার মতো একটি কাজ। তার উপরে এই সব ব্যক্তি সম্ভবত অনেক আগেই মারা গিয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। তার মানে কোনো কম্পিউটার ফাইলে তাদের পাওয়া যাবে না।

রেবেকা কেসের উপর ভিত্তি করে ব্লমকোভিস্ট একটি থিওরি দাঁড় করিয়েছে : এরা সবাই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর অর্থ হলো পুলিশের অমীমাংসিত তদন্তে এদের নাম পাওয়া যাবে। শুধুমাত্র ১৯৬৬ সালের আগে ঘটেছে এই তথ্যটি ছাড়া কখন, কোথায় হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের। এই তদন্তটি করতে গিয়ে সালান্ডার একেবারে নতুন একটি সমস্যায় পড়ে গেলো।

তাহলে, আমি কিভাবে কাজটা করবো?

গুগল সার্চ ইঞ্জিনে [Magda ] + [ murder] কি-ওয়ার্ড দুটো লিখে সার্চ করতে দিলো সে। এটা হলো তার করা সবচাইতে সহজ সরল সার্চিং। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে দুর্দান্ত ফল পাওয়া গেলো। সেটা পাওয়া গেলো কার্লস্টাডের ভার্মল্যান্ড টিভি’র অনুষ্ঠানের একটি তালিকায়। ১৯৯৯ সালে ‘ভার্মল্যান্ড মার্ডার্স’ অনুষ্ঠানটি প্রচার করা হয়েছিলো। এরপর এক টিভি অনুষ্ঠান তালিকায় ছোট্ট করে ভার্মল্যান্ড ফকরাড সংবাদটি খুঁজে পেলো সালান্ডার।

এবার ‘ভার্মল্যান্ড মার্ডারর্স’ সিরিজে রানমোটরাস্ক শহরের সিওবার্গের বাসিন্দা মাগদা লোভিশার হত্যাকাণ্ডের দিকে মনোনিবেশ করলো সে। কয়েক যুগ আগে কার্লস্টাড পুলিশের কাছে এই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডটি বেশ আলোচিত ছিলো। ১৯৬০ সালের এপ্রিলে ছেচল্লিশ বছরের এক কৃষকের স্ত্রীকে তাদের পারিবারিক শস্যাধারের ভেতর মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। রিপোর্টার ক্লেইস গুনার্স মহিলার শেষ কয়েক ঘণ্টা সময়ের বর্ণনার সাথে সাথে ব্যর্থ তদন্তের কথাও উল্লেখ করেছে। ঐ সময়ে এই হত্যাকাণ্ডটি বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলো। খুনির ব্যাপারে অসংখ্য তত্ত্ব উপস্থাপন করা হলেও খুনিকে ধরা সম্ভব হয় নি। এক তরুণ আত্মীয় টিভি শো’তে উপস্থিত হয়ে বর্ণনা দিয়েছিলো কিভাবে তাকে এই হত্যাকাণ্ডে সন্দেহ করার ফলে তার নিজের জীবনটা বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিলো।

‘লোভিশা কেস সমগ্র অঞ্চলে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে’ নামের একটি আর্টিকেলে আরো বেশি তথ্য খুঁজে পেলো সালান্ডার। ভার্মল্যান্ডকালচার নামের একটি ম্যাগাজিনে এটি প্রকাশিত হয়েছিলো তখন। ম্যাগাজিনের সবগুলো লেখাই নেটে লোড করা হয়েছে। কিভাবে লোভিশা সিওবার্গের স্বামী কাজ শেষে ফিরে এসে বিকেল ৫টার দিকে স্ত্রীর মৃতদেহ আবিষ্কার করে তার নিঁখুত বর্ণনা রয়েছে সেখানে। মহিলাকে যৌননির্যাতন আর ছুরিকাঘাত করার পর বেলচা দিয়ে খুন করা হয়েছে। খুনটা তাদের নিজেদের শস্যাধারেই সংঘটিত হয়। কিন্তু সবচাইতে বিদঘুটে ব্যাপার হলো হত্যাকারী নিহত মহিলাকে শক্ত করে বেধে ঘোড়ার আস্তাবলের ভেতর হাটু গেঁড়ে বসিয়ে রেখেছিলো।

পরে জানা যায় তাদের ফার্মের একটি গরুকেও ঘাড়ে ছুরি মেরে আহত করা হয়েছে।

শুরুতে তার স্বামীকে সন্দেহ করা হয়েছিলো, তবে সকাল ৬টা থেকে পঁচিশ মাইল দূরে কোম্পানিতে কাজ করেছে লোকটা, তার কলিগেরা এরকম সাক্ষী দিলে তার উপর থেকে সন্দেহটা দূর হয়। ধারণা করা হয় লোভিশা সিওবার্গ সকাল ১০টা পর্যন্ত জীবিত ছিলো কারণ তার এক বান্ধবী ঐ সময়টায় তার বাড়ি এসে তার সাথে দেখা করে গিয়েছিলো। ফার্মের আশেপাশে পাঁচশ’ গজ দূরে থাকা অন্যান্য প্রতিবেশীরা কিছুই টের পায় নি।

স্বামীকে সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে বাদ দেবার পর পুলিশের নজর পড়ে মহিলার এক ভায়ের ছেলের উপর। সেই ছেলেটার আইনভঙ্গ করার রেকর্ড ছিলো আগে থেকেই। স্বভাব চরিত্রও ভালো ছিলো না। ফুপুর কাছ থেকে ক’দিন আগে কিছু টাকাও ধার করেছিলো সে। ঐ ছেলেটাকে পুলিশ গ্রেফতার করে জেলে ভরলেও পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তারপরেও গ্রামের অনেক লোকেই বিশ্বাস করে এই ছেলেই খুনটা করেছে।

পুলিশ এরপর গ্রামের এক ভ্রাম্যমান হকারের উপর নজর দেয়। তবে এরকম গুজবও ছিলো যে, একদল ‘জিপসি ছিচকে চোর’ এ কাজ করেছে। তারা কেন কোনো রকম চুরি না করে এরকম বর্বর আর যৌননির্যাতন করে হত্যা করবে সেটার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি।

একটা সময় সন্দেহের তীর গিয়ে পড়ে পাশের গ্রামের এক তরুণের উপর। সেই তরুণের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো সে নাকি সমকা। – ঐ সময় সমকামীতাকে অপরাধ হিসেবে গন্য করা হতো-তাছাড়া সেই রুণের আচার আচরণও ছিলো একটু অস্বাভাবিক। কিন্তু একজন সমকামী তরুণ কেন যৌননির্যাতন করে কোনো মহিলাকে হত্যা করবে তার সদুত্তর কেউ দিতে পারে নি। এসব সন্দেহ নিছকই সন্দেহ হিসেবে থেকে গেছে, কারো বিরুদ্ধে কোনো চার্জ গঠন করা হয় নি।

সালান্ডার মনে করলো হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের ডেটবুকের তালিকার সাথে পরিস্কার একটি সংযোগ রয়েছে। লেভিটিকাস ২০:১৬ বলছে : “যদি কোনো স্ত্রীলোক কোনো প্রাণীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে তোমরা অবশ্যই সেই স্ত্রীলোক আর প্রাণীটিকে হত্যা করবে। তাদেরকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। আর তারা তাদের এই মৃত্যুদণ্ডের জন্যে নিজেরাই দায়ী।” মাগদা নামের সেই কৃষকের স্ত্রীকে যে হত্যা করে ঘোড়ার আস্তাবলে বেধে রাখা হয়েছিলো সেটা কাকতালীয় ব্যাপারও হতে পারে।

তবে প্রশ্ন হলো হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গার কেন তাকে লোভিশ নামে লিপিবদ্ধ না করে মাগদা নামে অভিহিত করেছে। মহিলার পুরো নামটা যদি টিভি লিস্টিংয়ে ছাপা না হতো তাহলে সেটা সালান্ডারের চোখেও পড়তো না।

অবশ্য আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও আছে : ১৯৪৯ সালে সংঘটিত রেবেকার হত্যাকাণ্ডের সাথে কি ১৯৬০ সালে খুন হওয়া মাগদা লোভিসার খুন আর ১৯৬৬ সালের হ্যারিয়েটের নিখোঁজ হবার কোনো সম্পর্ক আছে?

.

শনিবার সকালে ব্লমকোভিস্টকে নরসিও’র বুরম্যান বেশ সাহায্য করলো। বুরম্যানের বাড়ি থেকে হাটা দূরত্বে থাকে এরকম পাঁচজন সাবেক কর্মচারির কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। তারা প্রত্যেকেই তাদের কফি সাধলো। ছবিটা দেখে সেই পাঁজনও চিনতে পারলো না।

বুরম্যানের বাড়িতে হালকা লাঞ্চ করে তারা বেরিয়ে পড়লো গাড়ি নিয়ে। নরসিও’র চারটা গ্রামে গেলো তারা, সেখানে কার্পেন্ট্রি শপের কিছু সাবেক কর্মচারি বসবাস করে। সবখানেই বুরম্যানকে বেশ সমীহের সাথে অভ্যর্থনা জানানো হলো কিন্তু কেউই কোনো রকম সাহায্য করতে পারলো না। ব্লমকোভিস্ট আশা ছেড়ে দিতে শুরু করলো।

বিকেল ৪টার দিকে নরসিও’তে ফেরার পথে বুরম্যান একটা গ্রামে থামলো। সেখানে তার পরিচিত তাদের কার্পেন্ট্রির সাবেক এক মাস্টার কার্পেন্টার বসবাস করে। হেনিং ফোরসম্যান নামের লোকটা সাথে বুরম্যান ব্লমকোভিস্টকে পরিচয় করিয়ে দিলো।

“আরে, এটা তো অ্যাশার ব্রানলান্ডের ছেলে,” ছবিটা দেখামাত্রই ফোরসম্যান বললো। বিঙ্গো!

“ওহ্, তাহলে এটা অ্যাশারের ছেলে,” বললো বুরম্যান। “অ্যাশার একজন ক্রেতা ছিলো।”

“তাকে কিভাবে পাওয়া যাবে?”

“ঐ ছেলেটাকে? আপনাকে তাহলে মাটি খুড়তে হবে। তার নাম ছিলো গুনার। বলিডেন খনিতে কাজ করতো। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় খনিতে এক বিস্ফোরণ হলে সে মারা যায়।”

কথাটা শুনে ব্লমকোভিস্ট যারপরনাই হতাশ হলো।

“তবে তার বউ এখনও বেঁচে আছে। ছবিতে যে মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে তার নাম মিলড্রেড। বিওরসিলি’তে থাকে সে।”

“বিওরসিলি?”

“বাট্রাস্ক থেকে ছয় মাইল দূরে সেটা অবস্থিত। ঐ গ্রামেই ঢুকতেই লাল রঙের যে বাড়িটা আছে সেটাতেই থাকে। তিন নাম্বার বাড়িটার কথা বলছি। ঐ পরিবারকে আমি ভালো ক’রে চিনি।

.

“হাই আমার নাম লিসবেথ সালান্ডার, বিংশ শতাব্দীর নারীদের উপর হিংস্র আচরণ আর সহিংসতা নিয়ে আমি একটি থিসিস করছি। আমি ল্যান্ডসক্রোনার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে গিয়ে ১৯৫৭ সালের একটা কেসের ডকুমেন্ট দেখতে চাই। রাকেল লুন্ডি নামের এক মহিলা খুনের কেস সেটা। আপার কি কোনো ধারণা আছে ঐ ডকুমেন্টগুলো কোথায় আছে এখন?”

.

বিওরসিলি গ্রামটা ঠিক ছবিতে দেখা গ্রামের মতোই। লেকের তীর ঘেষে প্রায় অর্ধচন্দ্রাকারে বিশটি বাড়ি রয়েছে সেখানে। গ্রামের মাঝখানে একটি সরু চৌরাস্তার মোড় আছে। ওখান থেকে যে বাট্রাস্ক সাত কিলোমিটারের পথ সেটি অ্যারো সাইন দিয়ে চিহ্নিত করা আছে ঠিক মোড়ের দিকে। মোড় থেকে একটু সামনেই রয়েছে একটি বৃজ।

একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে গাড়িটা পার্ক করলো সে, তবে দোকানটা বন্ধ আছে। তার ঠিক বিপরীতে তৃতীয় বাড়িটা অবস্থিত। ঐ বাড়ির দরজায় নক করলেও কোনো সাড়া শব্দ পেলো না।

ঘণ্টাখানেক আশেপাশে ঘুরে বেড়ালো। কিছু বন্য প্রাণী চোখে পড়লেও জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। মিলড্রেড ব্রানলান্ডের বাড়ির সামনে যখন ফিরে এলো তখনও দরজাটা বন্ধই দেখতে পেলো।

১০টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে অবশেষে ফিরে এলো নরসিও’তে, সেখানে ডিনার সেরে বিছানায় গিয়ে ভ্যাল ম্যাকডারমিডের থ্রলার উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলো আবার।

খুবই পৈশাচিক একটি কাহিনী।

.

১০টার দিকে হ্যারিয়েটের তালিকায় আরো একটি নাম যুক্ত করলো সালান্ডার অবশ্য তার মনে এ নিয়ে একটু দ্বিধা আছে।

একটা শর্টকাট আবিষ্কার করেছে সে। অমীমাংসিত হত্যারহস্য নিয়ে নিয়মিত বিরতি দিয়ে আর্টিকেল ছাপা হয়। একটি সান্ধ্যকালীন পত্রিকার ১৯৯৯ সালের একটি সাপ্লিমেন্টারি সংখ্যার শিরোনাম খুঁজে পেলো : “অসংখ্য নারী হত্যাকারীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে।’ আর্টিকেলটা বেশ ছোটো তবে তাতে অনেকগুলো আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিবরণ আর ভিকটিমদের ছবি দেয়া আছে। নরটালি নামক এলাকায় সলভিগ নামের এক মেয়ের, নরকোপিংয়ের আনিটা, হেলসিংবর্গের মার্গারিটা, এরকম আরো অনেক হত্যাকাণ্ডের খবর তাতে রয়েছে।

এরমধ্যে সবচাইতে পুরনো খুনটি হলো ষাট দশকের। বাকি হত্যাকাণ্ডগুলো সালন্ডারকে দেয়া ব্লমকোভিস্টের তালিকার সাথে খাপ খায় না। তবে একটা কেস তার মনোযোগ আকর্ষণ করলো।

১৯৬২ সালে গোথেবর্গের লিয়া পারসন নামের এক পতিতা তার মা এবং নয় বছরের ছেলের সাথে সাথে দেখা করার জন্য উদেভাল্লায় গিয়েছিলো। কয়েক দিন ছেলে আর মা’র সাথে কাটিয়ে এক রবিবার তাদেরকে বিদায় জানিয়ে গোথেবর্গে ফিরে আসার জন্য ট্রেনে উঠে বসে সে। দু’দিন পর এক পরিত্যাক্ত শিল্পাঞ্চলের কন্টেইনারের ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তাকে ধর্ষণ করে চালানো হয় বিভৎস নির্যাতন।

লিয়া হত্যাকাণ্ডটি ঐ গ্রীষ্মে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় পত্রপত্রিকাগুলোতে। কিন্তু তার খুনিদের কখনওই চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি। হ্যারিয়েট ভ্যাঙ্গারের লিস্টে লিয়া নামের কোনো নাম নেই। তাছাড়া ঐ পতিতার হত্যার সাথে হ্যারিয়েটের ডেটবুকে বর্ণিত বাইবেলের উদ্ধৃতিরও তেমন মিল নেই বলেই মনে হলো তার কাছে।

তারপরও একটি অদ্ভুত কাকতালীয় জিনিস সালান্ডারের অ্যান্টেনাতে সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়লো। লিয়ার লাশ যেখানে পাওয়া যায় তার থেকে মাত্র দশ গজ দূরে একটি ফুলদানিতে একটি কবুতরও পাওয়া গিয়েছিলো। কেউ কবুতরটার গলায় তার পেচিয়ে সেটাকে ঠেলেঠুলে ফুলদানির ভেতর ঢুকিয়ে সেই ফুলদানি দুটো ইটের মাঝখানে রেখে নীচে আগুন দিয়ে দেয়। এই পৈশাচিকতার সাথে লিয়ার হত্যাকাণ্ডের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা সেটা অবশ্য জানা যায় নি। এটা বাচ্চাছেলেদের কোনো নির্মম খেলাও হতে পারে। তবে পত্রিকাগুলো এই হত্যাকাণ্ডকে কবুতর হত্যাকাণ্ড নামে অভিহিত করে।

সালান্ডার খুব একটা বাইবেল পড়ে নি-এমন কি তার কাছে এক কপি বাইবেলও নেই—তবে ঐদিন সন্ধ্যায় নিকটস্থ এক চার্চে গিয়ে একটা বাইবেল ধার করে সেই চার্চেরই বাইরে একটা পার্কের বেঞ্চে বসে লেভিটিকাস পড়তে শুরু করে সে। ১২ অধ্যায়ের ৮ নাম্বার পংক্তিটি পড়তেই তার ভুরু জোড়া কপালে উঠে গেলো। ১২ অধ্যায়ে সন্তান জন্ম দেবার পর মহিলাদের শুচি করার ব্যাপারে বলা হয়েছে :

স্ত্রীলোকটি যদি একটি মেষ দিতে অক্ষম হয় তবে সে দুটি ঘুঘু কিংবা দুটি বাচ্চা পায়রা আনতে পারে। একটি পাখি হবে হোমবলির জন্য; আর অন্যটি তার পাপ মোচনের নৈবেদ্যের জন্য। যাজক এসব নৈবেদ্য প্রভুর কাছে নিবেদন করে তাকে পাপমুক্ত করবে।

লিয়া খুব ভালোমতোই হ্যারিয়েটের ডেটবুকের ঐ অংশটার সাথে খাপ খেয়ে যেতে পারে : লিয়া-৩১২০৮

সালান্ডার ভাবলো তার আগে করা কোনো রিসার্চের সাথে বর্তমান অ্যাসাইনমেন্টের বিন্দুমাত্রও মিল নেই।

.

মিলড্রেড ব্রানলান্ড পুণরায় বিয়ে করে বর্তমানে মিলড্রেড বার্গরেন নামে পরিচিত। রবিবার সকাল ১০টায় ব্লমকোভিস্ট তার বাড়ির দরজায় নক করলে মহিলা দরজা খুলে দিলো। অনেক বয়স হয়ে গেছে মহিলার তারপরও দেখামাত্রই তাকে চিনতে পারলো মিকাইল।

“হাই, আমার নাম মিকাইল ব্লমকোভিস্ট। আপনি নিশ্চয় মিলড্রেড বার্গরেন।”

“হ্যা।”

“এভাবে আপনার দরজায় নক করার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। তবে আমি আপনাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা একটু জটিলই বটে।” মহিলার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো সে। “আপনার সাথে দেখা করে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।“

মিলড্রেডের স্বামীর এক ছেলে আছে যার বয়স প্রায় পয়ত্রিশ। ছেলেটা বাড়িতেই আছে। মহিলা তেমন কিছু জানতে না চেয়ে ব্লমকোভিস্টকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। তারা বসলো রান্নাঘরে। তাদের দুজনের সাথেই হাত মেলোলো সে। গত চব্বিশ ঘণ্টায় যে পরিমাণ কফি খেয়েছে এই জীবনে একদিনে তার সিকিভাগও খায় নি। তবে ইতিমধ্যেই জেনে গেছে নরল্যান্ডে না বলাটা অভদ্রতা। টেবিলে কফি কাপগুলো রেখে মিলড্রেড আগ্রহভরে জানতে চাইলো তার কাছে আসার কারণটা কি। নরসিও’র আঞ্চলিক ভাষা তার পক্ষে বোঝা কঠিন বুঝতে পেরে মহিলা প্রমিত সুইডিশে বলতে শুরু করলো।

গভীর করে দম নিয়ে ব্লমকোভিস্ট বললো : “এটা খুবই লম্বা আর অদ্ভুত একটি গল্প। ১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বরে আপনি আপনার স্বামী গুনার ব্রানলান্ডের সাথে হেডেস্টাডে ছিলেন।”

মহিলা বেশ অবাক হলো। কিছুক্ষণ পর মহিলা মাথা নেড়ে সায় দিলে ইয়ার্নভাগসগাটানে তোলা ছবিটা টেবিলের উপর রাখলো সে।

“এই ছবিটা কখন তোলা হয়েছিলো সেটা কি আপনার মনে আছে?”

“ওহ্ মাই গুডনেস,” বললো মিলড্রেড। “এটা তো সেই কবেকার কথা।” তার বর্তমান স্বামী আর ছেলে পাশে এসে বসে ছবিটার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে

তাকালো।

“আমরা হানিমুন করছিলাম তখন। স্টকহোম আর সিগটুনা হয়ে স্টকহোমে ফেরার পথে ওখানে থেমেছিলাম। জায়গাটার নাম কি হেডেস্টাড নাকি?”

“হ্যা। এই ছবিটা দুপুর ১টার দিকে তোলা। আমি বেশ কিছু দিন ধরে আপনাকে খুঁজে যাচ্ছি। কাজটা মোটেও সহজ ছিলো না

“আপনি একটা পুরনো ছবি নিয়ে আমাকে খুঁজে বের করেছেন। এটা আপনি কিভাবে করলেন ভাবতেও পারছি না।”

কার পার্কে তোলা ছবিটা টেবিলের উপর রাখলো ব্লমকোভিস্ট।

“এই ছবিটার কল্যাণেই আমি আপনাকে খুঁজে বের করতে পেরেছি। এটা আরেকটু পরে তোলা হয়েছিলো ঐ দিন।” কিভাবে নরসিও’র কার্পেন্ট্রি শপের স্টিকার দেখে অনেক কষ্টে তাকে খুঁজে বের করেছে সব বললো।

“এতো কষ্ট করে যে আমাকে খুঁজে বের করেছেন তার নিশ্চয় শক্ত কারণ রয়েছে।”

“তা আছে। ছবিতে আপনাদের পাশে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তার নাম হ্যারিয়েট। ঐদিনই মেয়েটা নিখোঁজ হয়ে যায়। তাকে আর পাওয়া যায় নি। সবাই ধারণা করছে তাকে হত্যা করা হয়েছে। আমি কি আপনাকে আরো কিছু ছবি দেখাতে পারি?”

ল্যাপটপটা চালু করতে করতে পুরো ব্যাপারটা সংক্ষেপে তাদের জানালো। এরপর হ্যারিয়েটের সিরিজ ছবিগুলোর স্লাইডশো’টা দেখালো ভদ্রমহিলাকে।

“এইসব ছবি নিয়ে কাজ করার সময়ই দেখতে পাই আপনারা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছেন। হ্যারিয়েট যেখানে তাকিয়েছিলো ঠিক সেখানেই আপনাদের ক্যামেরাটা তাক করা ছিলো। হ্যারিয়েট কিছু একটা দেখে প্রতিক্রিয়া করছিলো, আপনারাও ঠিক সেই জায়গার ছবি তুলছিলেন বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। আমি জানি এটা একেবারেই আন্দাজে ঢিল ছুড়ে মারা তারপরও আমি জানতে চাই ঐ সময় আপনাদের তোলা ছবিগুলো কি এখনও টিকে আছে কিনা।”

মিলড্রেড বার্গরেন মাথা ঝাঁকিয়ে বলবে যে ছবিগুলো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে বা নষ্ট হয়ে গেছে এরকম প্রত্যাশাই করছে সে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মহিলা জানালো বহু পুরনো ছবিগুলো এখনও তার কাছে আছে।

অন্য একটা ঘরে গিয়ে কয়েক মিনিট পর ফিরে এলো ভদ্রমহিলা, সাথে করে নিয়ে এলো এক বাক্স ভর্তি পুরনো ছবি। তাদের হানিমুনের সেই ছবিগুলো খুঁজে বের করতে কিছুটা সময় লেগে গেলো। হেডেস্টাডে তোলা তিনটি ছবি বের করলো মহিলা। একটা একেবারে ঘোলাটে, প্রধান সড়কটি দেখা যাচ্ছে। আরেকটাতে তার স্বামীকে দেখা যাচ্ছে। তৃতীয়টা প্যারেডের ক্লাউনদের ছবি।

আগ্রহভরে ব্লমকোভিস্ট ঝুঁকে দেখলো। ক্লাউনদের পেছনে রাস্তার ওপাড়ে একটা অবয়ব দেখতে পেলো। কিন্তু এছাড়া তেমন কিছু খুঁজে পেলো না ছবিটায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *