আবার ভাব হয়ে গিয়েছে প্রভাস ও রবার্টসনের মধ্যে।
এটা ঘটিয়েছে জনসন, চারিদিকের অবস্থা সম্পর্কে সাদারল্যান্ডের সঙ্গে দুদিন নানারকম আলাপ আলোচনা চালাবার পর। দুজনেই প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান ও হিসাবী তো বটেই।
কিছুদিন থেকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল দুজনকে। চিন্তার কারণও ছিল।
পঁচটি কারখানাতে অসন্তোষ ধোঁয়াচ্ছে, বড়রকম ধর্মঘট ও গুরুতর হাঙ্গামার সম্ভাবনা আর গণনার বাইরে নেই।
এদিকে দেখা দিয়েছে দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা।
গত বর্ষার আগেও বধের জরুরি সংস্কার কেন হয় নি বলে, প্রাণের জ্বালায় টেবিলে ঘুসি মেরে মেরে সাদারল্যাণ্ড জনসনের কাছে আফসোস করেছে।
এভাবে চলতে দিলে আর বেশিদিন তাদের টিকতে হবে না এদেশে।
আগেরবার কিছু ক্ষেতে লোনা জল ঢুকেছিল, এবার আরো ব্যাপকভাবে বেশি পরিমাণে লোনা জল ঢুকেছে–বন্যা যে হয় নি তাই রক্ষা।
ক্ষেতে একবার লোনা জল ঢুকলে বছর তিনেকের মধ্যে সে ক্ষেতে ফসল একরকম ফলেই না।
ফলনও এবার ভালো হয় নি। এমন উর্বর এলাকা, একটু খেটে বীজ ছড়িয়ে দিলে অকৃপণ উদারতার সঙ্গে মাটি তার শতগুণ ফিরিয়ে দেয় এবার কি হয়েছে কে জানে, চাষীর ভাগ্যে ফসল হয়েছে অতি বিরূপা সৎ-মার দানের মতো।
হয়তো খারাপ বীজের জন্য, অথবা হয়তো এলোমেলো বর্ষার জন্য আবাদ করার কোনো অজানা এবং অনাবিষ্কৃত ত্রুটির জন্য।
কিন্তু ঘনায়মান বিপদটা অতি বাস্তব। চারিদিকে চাষীর ঘরে ছড়িয়ে পড়া খিদের আগুন মজুরদের রেয়াত করবে না। অনেক মজুর পরিবারগতভাগে আধাচাষী বলেই শুধু নয়, দুর্ভিক্ষের চড়া বাজার ষোল আনা খাঁটি মজুরকেও কাহিল করে ফেলবে, মরিয়া করে তুলবে।
এ অবস্থায় উসকানি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তোেলার ফিকিরে সেলফিশ বজ্জাত অপরচুনিস্ট ফেউয়ের দল তো পিছনে লেগেই আছে!
প্রভাসের সঙ্গে সমস্ত কলহ বিবাদ আপসে মিটিয়ে ফেলার নির্দেশমূলক সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েও একটু ইতস্তত করেছিল রবার্টসন। বলেছিল, যেচে ভাব করতে গেলে আমার সম্মান কোথায় থাকবে? আমি নীচু হয়ে যাব না?
শুনে জনসনের কী রাগ।
—তোমরা ইয়ংম্যানেরা গোল্লায় যাচ্ছ দিনকে দিন। ফাঁকা প্রেজুডিস আর মেয়েলি হিস্টিরিয়া তোমাদের পেয়ে বসেছে। সম্মানের হানি হবে। নীচু হয়ে যাবে। দি ইজ পিওর ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। তুমি মহৎ উদার মানুষ, দয়া করে প্রভাসকে ক্ষমা করেছ–এই হবে তোমার অ্যাটিচুড।
তারপর সুর নরম করে হেসে বলে, অলরাইট, অলরাইট তোমার প্রেস্টিজ ঠিক বজায় থাকবে ভেব না। মিনার্ভা তোমাদের ভাব করিয়ে দেবে।
মিনার্ভা।
মিনার্ভাকে তুমি জানলে না বুঝলে না ইয়ংম্যান।
মিসেস জনসনের ছোট বোনের নাম মিনার্ভা।
কুমারী জীবনে খুব নার্ভাস মেয়ে ছিল। বিয়ের পর তারই কপালগুণে যেন তারই নিরীহ গোবেচারি মিউ-মিউ করা স্বামীর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে যায়–মার্কিন মুলুকের বিরাট এক যৌথ প্রতিষ্ঠানে মস্ত এক কাজ জুটে যায়। ইণ্ডিয়া সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে গ্রেগরীর মতো এরকম। একজন স্মার্ট যুবকই তারা চাইছিল। বছর দুই তাদের খরচে তাদের দেশে গিয়ে যথারীতি ট্রেনিং নিয়ে পোক্ত হয়ে ইণ্ডিয়াতে ফিরে আসবে।
স্বামীর সঙ্গে দু বছর আমেরিকায় কাটিয়ে আসতে গিয়ে কিভাবেই যে কেটে গেল মিনার্ভার লাজুকপনা, একেবারে পাল্টে গেল তার ভীরু নরম স্বভাব!
কলকাতায় ফিরে সুন্দর সাজানো বড় ফ্ল্যাটে রানীগিরি শুরু করতেই তার দাপটে অস্থির হয়ে উঠল গ্রেগরী থেকে শুরু করে বয় খানসামা বাবুর্চিরা। কিছুদিনের মধ্যে গ্রেগরী ফ্ল্যাট তুলে দিয়ে আশ্রয় নিল হোটেলে। মিনার্ভার অধিকার রইল হোটেল কিংবা ছোটাখাটো ফ্ল্যাটে ভাড়া নিয়ে বাস করবার সমস্ত খরচ চলবার ব্যবস্থা অবশ্য করা হল গ্রেগরীর পৈতৃক পয়সায়।
কিছুদিন মিনার্ভা খুব হৈচৈ করে কাটায়, তারপর কিছুদিন আবার কেমন ঝিমিয়ে যায়, বিষণ্ণ মনমরা হয়ে থাকে।
এ ভাবটা কেটে যাবার জন্যে সে কিছুদিন বোনের কাছে কাটিয়ে যায়। বেশ শান্ত স্বাভাবিক ও ধাতস্থ মনে হয় এখন তাকে। হাসিখুশি ভাবও দেখা যায়।
প্রভাস সেদিন একটু দেরি করে ক্লাবে পৌঁছে কোন টেবিলে কাদের সঙ্গে ভিড়বে চিন্তা করার জন্য টাইটা নিয়ে অযথা নাড়াচাড়া করছিল, মিনার্ভা এসে সাদর আহ্বান জানায়, আমাদের টেবিলে আসুন না? অনেকদিন আপনার কাছে পুরোনো দিনের শিকার কাহিনী শুনি নি।
প্রভাস টাই নাড়া বন্ধ করে হাত নামিয়ে মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে অতি ধীর অতি মৃদু এবং অত্যধিক মার্জিত সুরে বলে, আমি একটা পেগ অফার করলে আপনাকে খেতে হবে কিন্তু!
আমি তো পেগ খাই না!
একটা ছোট কক্টেল?
তা দেবেন। সেজন্যে কি!
রবার্টসন বসেছে কোনার দিকের ঈষৎ আড়াল করা বড় টেবিলে। আরো কয়েকজন সেখানে বসেছে বটে কিন্তু প্রভাসের জন্য আসন মিনার্ভার দখলে ছিল। টেবিলের অপরদিকে একেবারে রবার্টসনের মুখোমুখি প্রভাসকে বসতে হয়। মিনার্ভা তখন রবার্টসনের কাঁধে হাত রেখে প্রভাসকে বলে, আমাকে পেগ খাওয়াবেন বলছিলেন, আপনার উচিত এ বেচারাকে একটা পেগ অফার করা। দেখুন দিকি, আপনার স্ত্রী কেমন ইভাকে বাগিয়ে নিয়ে গিয়ে একে একটি বসিয়ে রেখেছে।
রবার্টসন বলে, একলা কিরকম? তুমিই তো আছ!
প্ৰভাসকে জিজ্ঞাসা করতে হয় কোন জাতীয় মদের পেগ রবার্টসন পছন্দ করবে এবং রবার্টসনকেও জবাব দিতে হয় যে, ছোট একটা হুইস্কি হলেই যথেষ্ট হবে।
তারপর রবার্টসন এমনভাবে কথা বলে যেন তাদের মধ্যে কোনোদিন কোনোরকম বিবাদ বিসম্বাদ হয় নি, কিছুকাল দুজনের দেখা সাক্ষাৎ যেন বন্ধ ছিল–এই মাত্র।
নিয়ম রাখতে রবার্টসনকেও পেগ অফার করতে হয়, কিছু পানীয় পেটে যাবার পর দিলদরিয়া ভাবটা এসে গেলে তাদের আলাপের প্রাথমিক আড়ষ্টতাটুকুও কেটে যায়।
তাদের ভাব হওয়া দরকার। প্রভাসও যে এটা সত্যই মেনে নিয়েছে সে বিষয়ে সুনিশ্চিত হতে বেশি বিলম্ব হয় না রবার্টসনের।
পেগ আনতে হুকুম দিয়ে রবার্টসন গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বলে, বেশ একটু কাহিল লাগছে। ব্যাপার কি?
প্রভাস হেসে বলে, সেই চিরন্তন ব্যাপার ঝাট। ঘরে ঝাট, বাইরে ঝাটকত আর সইতে পারা যায় বল? তোমাকেও তো তেমন তাজা মনে হচ্ছে না?
রবার্টসন মুখ খোলার আগেই মিনার্ভা বলে ওই যা বললেন ওরও ঘরে-বাইরে ঝাট। ওকে আজ সবাই ঘেরাও করেছিল? খবর পেয়ে এমন ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি।
মিনার্ভা ছোট কক্টেল খেতে রাজি হওয়ামাত্র প্রভাস অর্ডার দিয়েছিল, ইতিমধ্যেই সেটা এসে গিয়েছে এবং মিনার্ভা এক চুমুকে গিলে ফেলেছে।
কত যে শক্ত সতেজ তাজা মনে হচ্ছে তাকে।
রবার্টসন নিজেই বলে, তুমি ছোট একটা অফার করেছ, আমি এবার বড় একটা আনিয়ে দিই। ছোটতে ওর মাথা ঘুরে যায় তারপর বড় একটা এলে সব ঠিক হয়ে যায়।
মিনার্ভা চটে বলে, কেন মিছে আমার নিন্দে করছ?
রবার্টসন মিষ্টি সুরে বলে, নিন্দে করছি? প্রশংসা করছি তোমার ছোটর পর বড় একটা খেয়েও তুমি ঠিক থাকতে পার।
প্রভাস কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে যোগ দেয়, এত কম বয়সে ওরকম ঠিক থাকতে না পারাই কিন্তু আপনার উচিত।
মিনার্ভার মুখে খুশির হাসি ফোটে।
বাঁকা কথা, ফাঁকা কথা। সবাই জানে রাত বাড়তে বাড়তে মিনার্ভার আরো কয়েকটা ককটেল চলবে রোজই চলে। অথচ মিনার্ভার খুশির ভাবটা কৃত্রিম নয়।
আগে ক্লাবে বনানীর পদার্পণ ঘটত কদাচিৎ বিশেষ কোনো উৎসব অনুষ্ঠানের ব্যাপার। থাকলে। ক্লাবের সভ্য হলেও সে বাইরের নিমন্ত্রিতাদের একজনের মতো আলগোছে গা বাঁচিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানে যোগদানের দায় সেরে বিদায় নিত।
ক্লাবের দৈনন্দিন মেলামেশা খেলাধুলা গল্পগুজব আনন্দ করার সঙ্গে কোনোদিন তার সম্পর্ক ছিল না।
আজকাল মাঝে মাঝে আসে, ক্লাবের সান্ধ্য জীবনে অংশগ্রহণ করে। কারো সঙ্গে মেলামেশা আলাপ আলোচনায় তার এতটুকু দ্বিধা সঙ্কোচের ভাব দেখা যায় না।
জমকালো রূপ, বেশভূষাতেও এদেশী আভিজাত্যের মার্জিত রুচির চরম নিদর্শন–নিজেকে জাহির করার জন্যেই বনানী যেন এভাবে সেজেগুজে ক্লাবে আসে।
বনানীকে দশজনের চেয়ে চেয়ে দেখা নিজের চোখে চেয়ে দেখেই প্রভাসের অহঙ্কার ও আনন্দ উল্লাসের যেন সীমা থাকে না। বনানীকে ভালবাসার জন্য, আদর করার জন্য এক অদম্য অদ্ভুত ব্যাকুলতা ও উন্মাদনা জাগে। বাড়িতে যাকে সর্বদা কাছে পাওয়া যায়, আদরে সোহাগে আপন করা যায়, আলিঙ্গনের বাঁধন মানতে যে সুখী হয় অনাত্মীয়া অলভ্যা প্রিয়ার মতোই তার চলাফেরা প্রভাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে দ্যাখে।
তবু কেন পেগ চালিয়ে যায়। কোনো তত বাধা নেই মদ গেলার পালা সাঙ্গ করে সজ্ঞানে ওই বনানীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরার–নানা বেশে সাজিয়ে অথবা সমস্ত সাজ খুলে ফেলে দুটি চোখ দিয়ে প্রাণ ভরে ওর রূপ দেখার।
কিন্তু প্রভাস জানে, বাড়ি যখন ফিরবে, বনানীর সঙ্গেই হয়তো ফিরবে, ততক্ষণে মন থেকে মিলিয়ে যাবে এই রঙিন মোহ নেশার রঙে জগৎ সংসারের মতো বনানীও অন্যরকম হয়ে যাবে।
মাতাল হয়তো সে হবে না, রোজ সে মাতাল হয় না। কিন্তু বনানীর জন্য এখানকার এখনকার এই মোহের ঘোরটাকে বাড়ি ফিরে মনে হবে হাস্যকর ছেলেমানুষি মমি।
ক্লাবে বনানী নানারকম কানাঘুষা শোনে। সে সমস্তের মোট কথাটা এই যে, চাষী মজুরেরা নাকি ক্ষেপে যাবার ফিকিরে আছে।
ইভা তাকে বলে, তোমার ভদ্রলোকটির হয়েছে দুদিক দিয়ে মুশকিল। একদিকে জমিদারি, আরেকদিকে কারখানা। অথচ ওর কিন্তু বেশ নিশ্চিন্ত ভাব। শুধু কারখানার ভাবনায় বার্টির রাত্রে ঘুম হয় না।
বনানী বলে, ঘুম পাড়িয়ে দিলেই পার।
একসাথে বাড়ি ফেরার সময় প্রভাস প্রায় প্রকৃতিস্থ থাকলেও বনানী ওসব কথা তোলে নাসকালবেলার জন্যে মুলতুবি রেখে দেয়। একথা ওকথা বলতে বলতে একসময় সহজভাবে জিজ্ঞাসা করে, আজ বাড়ি গিয়ে আর না খেয়ে পারবে না?
প্রভাস সরলভাবে বলে, বাড়ি গিয়ে চেষ্টা করে দেখি। কথা দিয়ে হয়তো কথা রাখতে পারব না।
বাড়ি ফিরে দোতলার মন্দিরের পাশে খোলা ছাদে আকাশের নিচে চুপচাপ বসে প্ৰভাস খানিকক্ষণ নিজের মনে কি যেন সব ভাবে।
তারপর মেঘনাদকে ডেকে বোতল গ্লাস দিতে বলে বনানীকে ডেকে পাঠায়। বনানীর সামনে নিজের হাতে গ্লাসে মদ ঢালে। বনানী লক্ষ করে, পেগের হিসাব বাতিল করে সে খুশির হিসাবে
মদ ঢেলেছে।
বনানী গা এলিয়ে দেয় না। জোরে একটু নিশ্বাস পর্যন্ত ফেলে না।
আশ্চর্য এই, এ অবস্থাতেও সে তুলতে পারে না যে, তার বড় খিদে পেয়েছে। প্রভাস ডেকে না পাঠালে সে খেতে বসে যেত।
প্রভাস গ্লাসে চুমুক দিয়েও আশ্চর্য রকম ধীর শান্ত স্বাভাবিক গলায় কথা বলে–বনানী ভাবে, আর কতক্ষণ বজায় থাকবে এই শান্ত সুস্থ ভাব?
প্রভাস বলে, আমি কি ভাবি না? বুঝবার চেষ্টা করি না? অনেক ভেবেছি, এটুকু বুঝেছি যে, আমার মধ্যে একটা সাংঘাতিক গলদ আছে–কিন্তু আসল ব্যাপার আজো বুঝতে পারি নি। বিশ্বাস কর, শুধু নেশার জন্যে আমি মদ খাই না, অন্য কারণ আছে। এটা আমার কল্পনা নয়, বানানো কথা নয়। তুমি যখন গঙ্গাসাগরে গিয়েছিলে, আমি কলকাতায় তিনজন বড় স্পেশালিস্টের সঙ্গে কনসাল্ট করেছি। অনেকরকম পরীক্ষা দরকার ছিল, সে সব ভবিষ্যতের জন্য রেখে আমি শুধু মোটামুটি ওপিনিয়ন চেয়েছিলাম। ওদের মতও তাই–আমার মধ্যে একটা গোলমাল আছে। শারীরিক মানসিক কারণ জড়ানো গোলমাল–জটিল ব্যাপার। ব্যাপারটা ধরতে সময় লাগবে, চিকিৎসা করে সারাতেও সময় লাগবে।
বনানী চুপ করে থাকে।
আরেকবার গ্লাসে চুমুক দিয়ে প্রভাস বলে যায়, মানে জানি না কিন্তু ব্যাপারটা জানি। আমার কিছু ভালো লাগে না। কোনো অভাব নেই, স্বাস্থ্য খারাপ নয়, তোমার মতো এমন আমার বৌ তবু আমার কিছু ভালো লাগে না। দুঃখ কষ্ট কিছু নয়, জ্বালা যন্ত্ৰণা টের পাই না, জীবনটা শুধু বিস্বাদ লাগে। অসুখ নেই কিন্তু সুখ বলেও আমার যেন কিছু নেই। সোজা কথায় ব্যাপারটা কি দাঁড়ায় জান? ধর দিন-রাত সবসময় তুমি কিছু চাওকী চাও তা জান না।
বনানী চুপ করে থাকে।
মনে মনে হাসছ না তো?
বনানী এ কথার জবাব না দিয়ে বলে, কিছুদিন বাইরে গিয়ে থাকলে, বিশ্রাম করলে–
প্রভাস একটু হাসে। বাইরে যাই নি আমি?–কতবার গিয়েছি তুমিও তো জান। একা গিয়েছি, তোমায় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছি, কিন্তু স্বস্তি পাই নি।
বনানী ভেবেচিন্তে বলে, এটাই হয়তো বৈরাগ্য–মানুষ যেজন্যে সংসার ছেড়ে চলে যায়, সন্ন্যাসী হয়ে যোগসাধনা করে।
প্রভাস গ্লাসটা খালি করে, বলে, সংসার ছাড়তে আমার একটুও ইচ্ছা করে না। আমি যে ভালো না লাগার কথা বলছি তার অন্যরকম মানে কোরো না। তোমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলে আমি কয়েকদিনের মধ্যেই মরে যাব।
বনানী চুপ করে থাকে।
প্রভাস এবার খানিকটা বিহ্বলতা, খানিকটা ব্যাকুলতার সঙ্গে বলে, বিশ্বাস কর, সত্যি মরে যাব। লোকে হয়তো বলবে মদ খেয়ে খেয়ে মরেছে কিন্তু আসলে তোমার জন্যেই মরে যাব।
বনানী বলে, তা জানি। মাতাল হয়েও নইলে আমার ধমকে ঠাণ্ডা হয়ে যাও।
নেশা জমাট বাঁধছিল, প্রভাস খুশি হয়ে উঠে এসে বনানীর মাথায় গাল রেখে দাঁড়ায়, একটু জড়ানো সুরে বলে, আঃ, কী সুন্দর গন্ধ তোমার চুলে।
বনানী বলে, আমি কিছু খাই নি কিন্তু–আমার ভারি খিদে পেয়েছে।
বনানীও মাঝে মাঝে লখার মাকে ডেকে পাঠাত।
খেয়ালের বশে ডেকে পাঠায়। অলস এবং অসহ্য দুপুরটা তার রূপকথা গল্পকথা শুনে কাটিয়ে দেবার জন্যে। দুপুরবেলা প্রভাস কাছারিতে বসে, কারখানায় যায়। কোনোদিন বাড়ি ফেরে, কোনোদিন সটান ক্লাবে গিয়ে হাজির হয়।
মেয়েদের ভিড় জমে কিন্তু লখার মার গল্প বলা যেন তেমন জমে না।
পাওনা গণ্ডা আর ভালোমন্দ খাওয়া জোটে ভালোই কিন্তু লখার মা কিছুমাত্র কৃতজ্ঞতা বোধ করছে বলে তো মনে হয় না।
ঈশ্বরের বাড়ির সামনের মাঠে মস্ত জমায়েতের হৃদয় জয় করে লখার মার খুব নাম ছড়িয়েছে। তার গ্ৰাম্য কথকতার জনপ্রিয়তার খবর উপরতলাতেও কিছু কিছু পৌঁছে গিয়েছে।
মেঘনাদের কাছে বনানী সব শুনতে চায় কত লোক হয়েছিল, কথকতার বিষয় কি ছিল ইত্যাদি বিবরণ। মেঘনাদ অন্য সব খবর জানায়, শুধু ফাঁস করে না পালা গানটির আসল মজা মজাদার ছড়াগান আর রূপকথার বানানো কথায় কেমন চানাচুরের ঝাল মসলার মতো মেশানো ছিল চাষী মজুরের প্রাণের জ্বালার ঝাঝ।
মেঘনাদ কি কম চালাক! কাহিনীটা একেবারে উল্টো দাড় করায়, বনের পরী খেয়ালের বশে মজা করতে খেলা শুরু করেছিল দুজনের সাথে।
বনানী বলে, হা হা জানি। সাধুর শাপে রাজার ছেলে দিনের বেলা কাঠুরে হয়ে যেত, রাত্রে হত শিকারি। সোনামুখীর কাছে সব শুনেছি।
শুনে মেঘনাদ চমৎকৃত হয়ে যায়। ইতিমধ্যে সোনামুখী তবে এসেছিল অর্থাৎ বনানী তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। কিন্তু সোনামুখীর কাছে সব জেনে নিয়ে থাকলে কিছু না জানার ভান করে তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা কেন?
বনানী একদিন লখার মাকে ডেকে বলে, রোববার বিকেলের দিকে একটা আসর বসাব ভাবছি। অন্য সব ব্যাপার থাকবে নানা রকম–তার মধ্যে ঘণ্টাখানেক ঘণ্টা দেড়েক তোমার কথকতা লাগিয়ে দেব। কয়েকজন শুনতে চেয়েছে–ভালো করে বলতে হবে কিন্তু সেদিন গৌরীদের বাড়ির বাইরে যেমন বলেছিলে। জোড়াতালি দিয়ে চালিয়ে দিও না যেন।
ঈশ্বরের কুঁড়ে নয়, গৌরীদের বাড়ি।
বনানী এত শুনেছে এত জেনেছে–ঈশ্বরের কুঁড়েঘরের একত্তি উঠোনে কুলোয় নি বলে। সেদিন কেন আর কিভাবে সামনের ফাঁকা জমিতে আসরের আয়োজন হয়েছিল, সে বর্ণনা কি শোনে নি বনানী?
লখার মা জিজ্ঞাসা করে, সবাই বড় ঘরের মানুষ? শুধু মেয়েছেলে না ব্যাটাছেলেও থাকবে?
বনানী হেসে বলে, শুধু মেয়েছেলে ব্যাটাছেলে নয়–দু-পাঁচজন সায়েব-মেমও থাকবে। তাই তো ডেকে পাঠিয়ে আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম ভালো করে তৈরি হয়ে এস! তোমার ওই পালাটা বোধহয় চলবে না, অনেকক্ষণ সময় লাগবে না?
ছোট করে চালিয়ে দিলে হয়, সে ঠিক করে নেয়া যাবে। মেমসায়েবরা মোর কথা বুঝবে?
বুঝলে বুঝবে, না বুঝলে না বুঝবে, শুধু শুনে যাবে। দশজনের কাছে বড়াই করবে, খাঁটি ফোক্ কালচারের নমুনা দেখেছে।
লখার মা খানিকক্ষণ নিজের মনে ভেবে বলে, ওদের তিনজনাকেও চাই কিন্তু মা–সেদিন যারা খোল ব্যায়লা বাজিয়েছিল, ধুয়ো ধরেছিল। একলা জমাতে পারব না।
কত দিতে হবে ওদের?
বেশি দিতে হবে না গো মা–যা দেবে তাই খুশি হয়ে নেবে। টের পেয়েছে সে দিনকাল আর নেই। তবে কিনা পেশাদার মানুষ তো নয় যে, পয়সাটাই বড় দেখবে।
তাই তো ভাবছি–তিনজনাকে নে আসতে পারলে হয়। গুণী মানুষ, পাগলাটে স্বভাব। ভূতনাথ যা গাজায় দম দেয়–শিবঠাকুর হার মানবে। রোজ টানে না তাই রক্ষা!
বনানী ভয় পেয়ে বলে, তবেই তো মুশকিল করলে। আমি ভাবছিলাম অন্য প্রোগ্রামগুলি আরো ছাটাই করে তোমারটাই আসল আইটেম করব, দরকার হলে আরো আধঘণ্টা টাইম তোমায় বেশি দেব–
লখার মা হেসে বলে, ভাবছ কেন বৌরানী-মা? দায় নিয়ে তোমায় ড়ুবিয়ে দেব–লখার মা তেমন মানুষ নয় গো, নয়। নিজে গিয়ে বলে আসব–না এসে যাবে কোথা? কটা দিন একটু তালিম দিয়ে নিতে হবে। এ তো আর গেঁয়ো ভূতদের পালা শোনানো নয়–সুর যাবে এক খাতে, বাজনা চলবে আর এক ধাতে, তাল কাটবে ফটাস ফটাস, সবাই ভাববে ওটাই বুঝি পালাগানের কায়দা। সমঝদার মানুষের কাছে ফাঁকি চলবে না মোটে। ভদ্র মানুষ, চুপটি করে শুনে যাবে জানি মনে মনে হাসবে আর টিটকারি দেবে লখার মাকে।
বনানী ভরসা পেয়ে বলে, হ্যাঁ সেটা খেয়াল রেখ–যাই গাও খেলো যেন না হয়ে যায়।
ভেব না বৌরানী-মা, আসর জমিয়ে দেব।
তখন একটু সঙ্কোচের সঙ্গে বনানী এক অদ্ভুত প্রস্তাব করে। বলে তুমি যদি চাও, আমি অর্গান নয় তো পিয়ানো বাজাতে পারি।
সে তো খাপ খাবে না মোটে।
আমিও তাই ভাবছিলাম।
আসর লখার মা সত্যই জমিয়ে দেয়।
কটা দিন মোটে সময় ছিল। ঈশ্বরকে দিয়ে রোস্তমকে ডেকে এনে লখার মা রাতারাতি ফরমাশী পালাগান দাবি করে বসে। বড় কিছু দরকার নেই–একঘণ্টা সোয়া একঘণ্টার মতো জমজমাট পালা তৈরি করে দেওয়া চাই। লখার মা তার সঙ্গে কথা গান জুড়ে নেবে।
বিষয় হবে বর্ষা এবং বাঁধ ভাঙা বন্যা। রোস্তমকে সাবধান করে দিয়ে লখার মা বলে, শুধু চেহারাটা তুলে ধরবে, ব্যাপারটাকে রূপ দেবে ব্য। যত ভয়ঙ্কর করতে পার আপত্তি নাই। কিন্তু হুঁশিয়ার ভাই, কাউকে খেচাবে না, কে দায়ী তাই নিয়ে ছেলেমানুষি প্যানপ্যানি জুড়বে না।
রোস্তম বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে চোখ বুজে তার ফরমাশ শুনে যায়। মনে মনে বোধহয় বর্ষাকে। আর বাঁধ ভাঙা বন্যাকে ভাষায় রূপ দেবার কসরত এখন থেকেই শুরু করে দেয়।
লখার মা বলে, বুঝলে তো ভাই আসল কথা? কি জন্যে কে দায়ী তা সবাই জানে, কচি খোকা তো কেউ নয়। রেগেমেগে কেঁদে কুঁদে নালিশ করা তোমার আমার কমো নয়। গায়ের জ্বালায় সস্তা ঝাল ঝড়তে গেলে ইদিক নষ্ট, উদিক নষ্ট।
বনানীর সঙ্গে কথা কয়ে কয়ে, তথাকথিত ঘরে তৈরী মাখন গলানো খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের লুচি তরকারি মিঠাই সন্দেশ খেয়ে নিরঞ্জনদের তিনজনের বাড়ি হয়ে ঘরে ফিরতে বেলা পড়ে এসেছিল।
এখন সন্ধ্যা নামছে।
নিজের তার ঘুম পাচ্ছিল। তবু লখার মা বলে, রাতভর না ঘুমোলে ঘুমিও না, ভোরবেলা খসড়াটা মোর চাই।
রোস্তম বলে, দেব। বেশি কাটছাট কোরো না কিন্তু।
না। লক্ষ্মী ছেলের মতো মোর কথাটাও খেয়ালে রেখ কিন্তু।
কদিন বাদে রামসুখলাল ক্লাবের পিয়ন দিয়ে লখার মাকে ডেকে পাঠায়।
লখার মা যায় না।
বলে পাঠায়, নানা কাজে সে নাকি বড় ব্যস্ত মোটেই তার সময় নেই মানুষের সঙ্গে দেখা করার।
অগত্যা রামসুখলাল নিজেই তার ঘরে আসে।
নিয়ে আসে গুরুতর প্রস্তাব।
প্রভাসের বাড়িতে যে পালাগানটি গেয়েছে সেটি ক্লাবে গাইতে হবে–আজ সন্ধ্যায় কিংবা আগামীকাল ছুটির দিন সকাল ছাড়া যে কোনো সময়।
তাড়াতাড়ি করার কারণ–কলকাতা থেকে কয়েকজন সিনেমা আর্টিস্ট ক্লাবের অতিথি হয়ে এসেছে–পালা গানটা শুনবার জন্যে তারা খুব উৎসুক।
পরশু তারা কলকাতায় ফিরে যাবে। পরদিন পাড়ি দেবে বোম্বাই।
লখার মা আশ্চর্য হয়ে বলে, সোনাতলার কেলাবে সিনেমার আদমি?
রামসুখলাল হাসে। তাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয়। সিনেমায় অভিনয় করতে নেমেছে কি এখানকার ক্লাবের কোনো সভ্য অথবা সভা? তা নয়, আসল কথা হল এই যে, ক্লাবের দু-একজন দিলদরিয়া খুঁটি সিনেমা কোম্পানিতে টাকা লাগিয়েছে। কাজেই তাদের জোর আছে।
যদি তারা কেউ মনে করে যে, লখার মার গল্প বলা লাগিয়ে দিলে বেশ লাগসই হবে, লখার। মা সিনেমা স্টার বনে যাবে বৈকি।
লখার মা ভয় পায়, বিব্রত হয়ে পড়ে। ক্লাবে গিয়ে বাবুদের মেমদের সায়েবদের গল্প শোনাতে হবে। তার সাধ্যে কি কুলোবে এই অসাধ্য-সাধন সম্ভব করা।
রামসুখলালকে বলে দিলেই হত সে যাবে না।
ভেবেচিন্তে কুল কিনারা না পেয়ে সে ঈশ্বরের সঙ্গে পরামর্শ করতে যায়, কি করা উচিত।
ঈশ্বর বলে, ডরাও কেন? তুমি যা বলবে, যেমন বলবে, তাই ওরা খুশি হয়ে শুনবে।
তারপর হেসে বলে, তবে একটা কথা তোমায় বলি, কোনি দেখাবার চেষ্টা কোরো না। বাবুর বাড়িতে যেমন বলেছ তেমনি গল্প বলবে। সেটাই ওরা শুনতে চায়।
গান শুনতে চায়?
কি জানি।