১৫. আদর্শ–জীবন্ত আদর্শ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
আদর্শ
জীবন্ত আদর্শ

যা দেখি তাই করি। —যা শুনি তা করতে মন চায় না। কতকাল ধরে বইয়ে পড়ে আসছি, মিথ্যা কথা বলে না— তবুও তো এ বদভ্যাস গেল না। এটা যে বদভ্যাস তাও কোনদিন চিন্তা করি না।

একটা বালক তার মাকে দোষারোপ করেছিল— তুমি মিথ্যা বলছো, মিথ্যা বলছে। মা ঘৃণার সঙ্গে বলে উঠলেন—আমি এতো ছোট, মিথ্যা বলবো? বালক মায়ের ঘৃণাব্যঞ্জক মুখখানি দেখে ভােবল মিথ্যা তাহলে কত ছোট।

তুমি উপাসনা করো না-ভক্ত প্রেমিক মানুষের সঙ্গে থাক, খোদার সঙ্গে প্রেম করবার তোমারও প্রবৃত্তি হবে।

মহামানুষের জীবনী পড়— তোমার মহামানুষ হতে ইচ্ছা হবে। কতকাল আগে এক যুবক সীমাহীন কষ্টকে জয় করে, কত ব্যথা-বেদনার ভিতর দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; যখনই তা তুমি জানতে পারলে তখন তোমার দুঃখ সাইবার শক্তি দ্বিগুণ হলো।

এক ব্যক্তি পথের আবর্জনা কুড়িয়ে রাখতেন— তেল কেনার পয়সা তাঁর জুটতো না। রাতের বেলা সেই আবর্জনায় আগুন ধরিয়ে তিনি বই পড়তেন। আর এক যুবক রাস্তার বাতির আলোতে বই পড়তেন। এ সব যখন তুমি শোন, তখন তোমার মনে কি শক্তি আসে না? তোমার ভাঙ্গা মন উৎসাহের দীপ্তিতে জ্বলে উঠে না?

মানুষের উপকার করা খুব ভাল। কথাটা যদি শুধু বইয়ে থাকত, তাহলে হয়ত অতি অল্প লোকই মানুষের উপকার করতো!

পোর্টস মাউথ শহরের এক মুচি পথের এক শিশুকে পয়সা দিয়ে লোভ দেখিয়ে তাঁর ছোট দোকানটিতে ডেকে এনে পড়াতেন। হীন দুৰ্ভাগ্য মানব সত্তানের কল্যাণ করে তিনি তৃপ্তি লাভ করতেন। এর নাম ছিল জন ফাউন্ডস। এই অজ্ঞাত মহাপুরুষের নিঃস্বাৰ্থ অতি বিস্ময়াবহ মানবসেবার কাহিনী যখন তুমি শোনো তখন তোমার মনে হয়ত একটু লজ্জা উপস্থিত হবে।

ফরাসী দেশের এক প্রদেশে এক সময়ে অত্যন্ত জলকষ্ট হয়েছিল। এইজন্য সেখানকার অধিবাসীদিগের কষ্টের সীমা ছিল না। বছরের পর বছর এইভাবে যাচ্ছিল। অথচ এই দুঃখের কোন প্ৰতিকারের আশা ছিল না।

ঐ প্রদেশে গেয়ো বলে একটা অসভ্য চপল স্বভাব যুবক বাস করতো। হাসি আর গানই ছিল তাঁর জীবন। একদিন হঠাৎ গ্রামবাসীরা দেখলো এই যুবক কি কারণে একটু বেশী গভীর ও বিষন্ন হয়েছে। এই চিন্তাশূন্য গেয়ো যুবক একদিন তার উল্লাস-আনন্দের ভিতর শুনেছিল অনেক টাকা-লক্ষ টাকা ব্যয় ছাড়া তার জন্মভূমির জলকষ্ট দূর হবার নয়। গা:েস্ট্রয়োর বালকচিত্তে সহসা প্রশ্ন জেগেছিল-সে কিছু করতে পারে না? এরপর সে কারো সঙ্গে বেশী কথা বলতো না। গেয়োর গাম্ভীৰ্য ভাব দেখে তার বন্ধুগণ অবাক হয়ে গেল।

কয়েক বছর অধ্যয়ন করে গেয়ো ব্যবসা আরম্ভ করলো। তারপর অনেক বছর কেটে গেলো। ব্যবসাতে তার ক্রমশঃ শ্ৰীবৃদ্ধি হতে লাগলো। ক্রমে ক্রমে বড় ধনী বলে গেয়োর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। এত অর্থ হওয়া সত্ত্বেও গেয়ো পায়ে হেঁটে, ছেড়া কাপড় পরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতালে। লোকে বলা আরম্ভ করলো, গেয়ো কৃপণ। এ অপবাদের কারণ যথেষ্ট ছিল। অর্থ বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে তার নীচ কৃপণতাও বেড়ে যেতে লাগলো। এমন কি, খরচের ভয়ে সে বিয়ে পর্যন্ত করলো না। এই পৈশাচিক জীবনের জন্য অনেকে তাকে ঘৃণা করা আরম্ভ করলো। কেউ কেউ তার নাম পর্যন্ত সকাল বেলা উচ্চারণ করতে সঙ্কোচ বোধ করতো— পাছে সেদিন তার আহার না জুটে।

গেঁয়োর গায়ে ছেলেরা থুথু দিত। সে যখন বৃদ্ধ তখন তার বিপুল অৰ্থ কোটি কোটি টাকা, কিন্তু কেউ তাঁকে সম্মান করতো না। তার মতো নরপিশাচ সে দেশে আর ছিল না।

গেঁয়োর যখন মৃত্যু হলো তখন লোকে দেখলো— সে একখানা উইল করে গিয়েছে। তাতে লেখা—জন্মভূমির জলকষ্ট নিবারণের জন্য আমি সারাজীবন অর্থ সংগ্রহ করেছি। জীবনে ব্রত করেছিলাম এই প্রদেশের জলকষ্ট দূর করবো। আমার সব টাকা এই উদ্দেশ্যে গভর্নমেন্টের হাতে দিয়ে গেলাম।

এই সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মানুষ দলে দলে এই মহাপুরুষের মৃতদেহকে সম্মান জানাতে এলো। যারা তাকে ঘৃণা করতো, তারা আঁখিজলে গেয়োর পবিত্ৰ স্মৃতিকে পূজা করলো। এই নিঃস্বর্থ পরোপকারের কথা শুনে তোমার মন কি অবশ হয়ে উঠবে না? পথের ধারে একটা দরিদ্র কৃষক বোঝা নিয়ে বসে আছে। বোঝাটি তুলে দিলে তার উপকার করা হয়— তোমার ইচ্ছা হয় তা করতে, কিন্তু পার না-তোমার অপদাৰ্থ বন্ধুগণের উপহাসের ভয়ে। কারণ, তেমন কেউ করে না। মহাপুরুষদের সাদাসিধে সরলতাকে অনুকরণ করতে তোমার ইচ্ছা হয়, কিন্তু কাৰ্যক্ষেত্রে তা পার না। কারণ তোমার চারিদিকে তুমি দেখ, বিলাস-আড়ম্বরের ছড়াছড়ি। তোমার মনের বল চুৰ্ণ হয়ে যায়।

যখন দেখ, একজন শ্ৰেষ্ঠ মানুষ ছেড়া কাপড় পরে হাসিমুখে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন ছেড়া কাপড় পরতে তোমার লজ্জা হয় না, বরং গৌরব বোধ হয়! যখন জন্মগ্রহণ করে তখন সকল শিশুই নিম্পাপ ও নিষ্কলঙ্ক থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোন শিশু দেবতার প্রবৃত্তি লাভ করে, কোন শিশু পিতা-মাতার মতই শয়তান ও নরপিশাচ হয়। কে বলবে, হিন্দুর ছেলে কেন হিন্দু হয়, যা দেখে তাই শেখে।

মানব সেবার ন্যায় ধর্ম আর নাই। মুখে বলতে পারি এবং বলে থাকি। যখন দেখি, তুমি নগণ্য সংসারের এক কোণায় মানব-সন্তানকে শিক্ষিত ও জ্ঞানী করবার জন্যে খাটছ, তখম সম্ভ্রমে আমার মাথা তোমার সামনে নত হয়ে পড়ে। আমারও ইচ্ছা হয়, মানবের সেবায় জীবনকে ধন্য করি।

ঔপন্যাসিকেরা তাদের বইয়ে বড় বড় চরিত্র সৃষ্টি করেন, উদ্দেশ্য, সে সব কথা পড়ে তোমার মন উন্নত হবে। সেই সব আদর্শকে রক্ষা করে তোমার জীবনকে গঠন করতে চাইবে। উপন্যাসের মূল্য এইখানে। অতি বড় হতভাগাও উপন্যাস পড়ে মানুষ হয়। জীবনকে মহত্ত্বের পথে টেনে নেয়।

যুদ্ধে যাবার আহ্বান এসেছে, কেউ যাচ্ছে না। কে যুদ্ধক্ষেত্রে যেয়ে সহজে প্ৰাণ দেবে? জনসঙ্ঘ হতে একজন বললো, আমি যাবো-সঙ্গে সঙ্গে আরও কতকগুলি যুবক বলে উঠলো, আমরাও যাবো।

মেষের পাল তাড়িয়ে এক নদীকূলে যেয়ে দাঁড়িয়েছ। কত মারামারি করছ, তবু একটা মেষও জলে নামছে না। নদী পার না হলেও হবে না। হঠাৎ একটা মেষ জলের ভিতর লাফিয়ে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে এক এক করে সবগুলি মেষ জলের ভিতর লাফিয়ে পড়তে শুরু করলো।

মনে তোমার অনেক চিত্তা আছে, কিন্তু কাজ করতে পারছি না। কারণ, তুমি দেখা নাই কাউকে সেই কাজ করতে, যা তুমি করতে চাও! তুমি বুঝতে পােচ্ছ, এটা তোমার দুর্বলতা। তবুও তুমি পার না। কি বিস্ময়৷

ব্যবসা করা খুব ভাল। ছাড়, অর্থহীন চাকরিতে তোমার দুঃখ-বেদনা, অভাব-দৈন্য বেড়ে যাচ্ছে; কিন্তু তবু তুমি এর নাগপাশ ত্যাগ করে ব্যবসা করতে পার না। কারণ, তোমার বন্ধু-বান্ধবদের কেউ ব্যবসা করে তোমার সামনে দৃষ্টান্ত ধরে নাই।

দার্শনিক সক্রেটিসের মতো হাটের ভিতরে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে সপ্তাহে সপ্তাহে মহত্ত্বের কথা বলতে তোমার ইচ্ছা হয়। প্রতি রবিবারে গ্রামের কৃষকদিগকে ডেকে এনে তাদের কাছে খবরের কাগজ পড়ে তাদের জীবনকে অপেক্ষাকৃত ভাল করতে তুমি চাও। তোমার কোন কাজ নেই, নিষ্কর্ম জীবনের ভার তোমার কাছে দুৰ্বহ হয়ে উঠেছে, তোমার ইচ্ছা হয়, প্রতিবেশী ছোটলোক, হীন লোকগুলোকে নিয়ে তুমি নৈতিক কথার আলোচনা কর, তাদের ছেলেগুলোকে ধরে এনে একটু একটু পড়াও, ভবিষ্যৎ জীবনে যাতে তারা অপেক্ষাকৃত ভাল হয়। কিন্তু তা তুমি পার না, কারণ কাউকে এসব কাজ করতে তুমি দেখা নাই। তোমার এই সব উন্নত ও মহৎ কল্পনা জল বুদবুদের মত মিথ্যা হয়ে যায়।

পুণ্য ও মহত্ত্বকে যেমন অনুকরণ করি, পাপ ও হীনতার স্পর্শে তেমনি হই। একদল বন্ধু ছিলেন। তাদের ভিতর পাপ কথার আলোচনা কোনকালে হতো না, তাদের জীবন মহৎ না। হলেও হীন ছিল না। মাঝে মাঝে ভাল কথার আলোচনাও তাদের মধ্যে হতো।

হঠাৎ এক লম্পট তাদের বন্ধু হয়ে দেখা দিলো। আশ্চর্য, কিছুদিনের ভিতর এই লম্পটের স্পর্শে এসে সবগুলি যুবক হীন ও নীচাশয় হয়ে গেল। হীন রমণীয় রূপযৌবন নিয়ে ছিলো তাদের সব সময়ের কথা।

তোমার পত্নী খুবই বিলাসিনী। হাতে হাঁড়ি ধরতে ঘৃণা বোধ করেন। দাসীতে যা রান্না করে তাই তিনি খান। পাছে সম্মান নষ্ট হয়, এই ভয়ে কোন কিছুর হিসাব নেন না। তিনি যদি সম্রাট নাসিরদিনের মহিষীর সরল জীবনকথা শোনেন, তাহলে তাঁর অহঙ্কার অনেক কমে যাবে।

মানুষ কি করে মানুষকে অনুকরণ করে প্রাণ পর্যন্ত দিতে যায়, তা নিম্নলিখিত গল্পে ফুটে উঠেছে। সমুদ্রে একবার ভয়ানক ঝড় হচ্ছিল। হঠাৎ এই ঝড়ের ভিতর একখানা জাহাজ ড়ুবে গেল, উপকূলের কাছেই।

কে যাবে যাত্রীদিগকে দেখে উদ্ধার করতে? উপকূলে অনেক লোক দাঁড়িয়েছিল। একজন একখানা বোট খুলে বললেন, কে যাবে আমার সঙ্গে। প্ৰাণ যদি দিতে হয়, কে তা দিতে আমাকে অনুসরণ করবে? আমনি একজন বললেন, আমি যাবো। সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেক লোক বললে, আমরাও যাবো।

ঝড়ের ভিতর ডুবোজাহাজের যাত্রীদিগকে দেখে গ্রেস ডারলিঙ্গের পিতা দুঃখ করেছিলেন, ব্যথিত হয়েছিলেন সত্য, সেই দারুণ দুর্যোগে তাদের উদ্ধার করার জন্যে কিন্তু তিনি সাহস করেননি। মহামনা কন্যা গ্রেস যখন বললেন, বাবা, আমি আপনার সঙ্গে যাবো, আমরা হতভাগ্য যাত্রীদলকে বাঁচাতে পারবো, তখনি পিতা অগ্রসর হলেন। বিক্ষুব্ধ তরঙ্গে পিতাপুত্রী নৌকা ভাসালেন।

যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ সৈন্য দেখাদেখি প্ৰাণ দেয়, আগুনের সামনে দাঁড়ায়, সঙ্গীন তরবারিকে উপহাস করে।

জীবন্ত আদর্শের মূল্য বেশী। অশরীরীভাবে ভাল কাজ হয় না। বিলেতে গেলে বড় বড় উন্নত শক্তির জীবন্ত আদর্শে আমরা নিজদিগকে শক্তিমান করতে পারি, তাই সেখানে যাই। শক্তির স্পর্শে এসে নিজের শক্তি জেগে উঠে।

সেই কোরআন আছে। তবু মুসলমান জাতি উন্নত হল না কেন? অতীত হিন্দু-মুসলমান মানুষ হই না কেন? কত কথা শুনি আর পড়ি, কিন্তু কই, তাতে ভাল কাজ হয় কই?

চাই মানুষ, জীবন শক্তিময় আদর্শ। যার স্পর্শে প্ৰাণে জাগরণ আসে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *