১৫. অফিসে ফোন করল জয়া

১৫.

পরদিন বিকেলের দিকে নিখিলকে অফিসে ফোন করল জয়া।

টিফিনের পর এই সময়টাতেই ঘণ্টাখানেক নিখিল পাগলের মত কাজে ডুবে থাকে। সরকারি অফিসের রীতিমাফিক এখনও টিফিনের রেশ চলছে সর্বত্র। কেউ খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছে, কেউ ঝিমিয়ে নিচ্ছে টুক করে, নিছক অলস মুখেও বসে কেউ কেউ। একদল সামনের ইলেকশানে ভি পি সিং, রাজীব, চন্দ্রশেখর, আদবানির ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা জুড়েছে। রাজ্য নির্বাচন নিয়ে এবার কেউ তেমন আগ্রহী নয়, যেন ফলাফল সবারই জানা। দু চারটে ছেলেছোকরা সিনেমা ফুটবল নিয়ে যে মেতে নেই, তা নয়। মেয়েরা সজ্জা, রান্না আর পরনিন্দা পরচর্চায় মুখর। এই পরিবেশে নিখিলকে কর্মরত দেখলে কেমন বেমানান লাগে। অবশ্য বাকি কোন সময়ই অফিসে নিখিলের টিকি দেখা যায় না।

নিখিল বিরক্ত হল। কাজের সময় কোনরকম বাধা সে পছন্দ করে না। তার টেবিল জুড়ে ডিজাইনিং পেপার, কম্পাস, সেট্-স্কোয়্যার, স্কেল। কয়েকটা তুলি, দুচারটে ছোট রঙের শিশি, টিউব। একটা শাড়ির ডিজাইনের কাজ আজ তাকে শেষ করতেই হবে। তার মাঝে এই ফোন…।

নিখিল অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠল। জি এম-এর দশ বাই ছয় কিউবিক্‌লের সুয়িং ডোর ঠেলেছে। জি এম সামনে বসা লোকটার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই রিসিভারের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন। ইঙ্গিতে বললেন, ভদ্রমহিলা।

নিখিল টেবিলের দিকে পিছন করে দাঁড়াল।

—কি ব্যাপার জয়া! তুই!

—কি করছিস্?

নিখিল আড়চোখে একবার জি এমকে দেখে নিল,

—ভীষণ সিরিয়াসলি কাজ করছি।

—একটু আসতে পারবি? আজ?

—কোথায়? তোর বাড়িতে?

—না। কলেজে চলে আয়। তোকে আমার খুব দরকার। নিখিলের সন্দেহ হল,

—তোর গলাটা এরকম লাগছে কেন রে? কিছু হয়েছে নাকি? এনি অ্যাক্সিডেন্ট?

—না, না, তেমন কিছু নয়। তুই একবার আয় না প্লিজ্।

নিখিল ঘড়ি দেখল,—ঠিক আছে, চারটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি।

ফোন রেখে জি এম-এর দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল নিখিল। ভদ্র লোক গোমড়া হয়ে গেছেন। দশ আঙুলে বিলি কাটছেন নকল চুলে,

—আজকেও তাহলে ডিজাইনটা পাচ্ছি না?

—কাল দিয়ে দেব। এত তাড়া করছেন কেন? সবে নতুন ফিনানশিয়াল ইয়ার পড়েছে, তার ওপর কদিন পরেই ইলেকশন, এখন কি আর তাঁতীদের দিয়ে কাজ ওঠাতে পারবেন?

—কাল ঠিক দিচ্ছেন তো?

—নিখিল দত্ত রায় যা বলে তাই করে।

নিখিল দরজা দুলিয়ে বেরিয়ে এল। এই সব সরকারি আমলাগুলোর পাকা পাকা ভাবভঙ্গি দেখলেই তার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। লোকটার মাথার পরচুলটা একদিন টেনে খুলে দেওয়ার ইচ্ছা আছে নিখিলের। তারপর রিজাইন করবে চাকরি থেকে। মাথায় চুল না লাগানো থাকলে কী বিকট যে লাগে লোকটাকে। একদিন বাথরুমে নিখিল দেখে ফেলেছিল। রুমাল দিয়ে চকচকে টাক মুছছিলেন ভদ্রলোক। একটা গোল হুলো বেড়ালের মত মুখ, মাছি-গোঁফ…! এই অফিসেই কি না কাজ করে যেতে হয় তাকে।

আরতি জেদ না করলে থোড়াই করত এ চাকরি। আজকাল আর্টিস্টদের বাজার খুব খারাপ না। অনেকগুলো আর্ট গ্যালারি হয়ে গেছে। বছরে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকার ছবি তো হেসে খেলে বিক্রি হয়ে যায়। সঙ্গে দু চারটে ফরমাইশি কাজ করতে পারলে তো কথাই নেই! জয়াও চাকরিতে ঢুকল, তাদের ইন্টিরিয়ার ডেকরেশনের ব্যবসাটাও উঠে গেল। জয়টা দিব্যি এখন ছবির জগতে ডুবে গেছে। মিডিয়ার সঙ্গেও যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক রেখে চলে। রমেন সাহা আর সফিকুল হোসেন তো এক সময় দারুণ ব্যাক্ করেছিল জয়াকে। নিখিলের বরাবরই কপালটা খারাপ। লাস্ট এগজিবিশনেও জয়ার ছবি বিক্রি হল আঠেরো হাজারে, পোলিশ কনস্যুলেট থেকে কিনল। আর নিখিলের ছবি নিল বাংলাদেশ কনস্যুলেট। এগারোতে। ভাবতে গেলেই বুকটা মাঝে মাঝে চিনচিন্ করে ওঠে নিখিলের। পরক্ষণেই নিজেকে ধমকায়, ছিঃ নিখিল, জয়া না তোমার কত দিনের বন্ধু।

জয়ার জন্য নিখিলের সব সময়ই খারাপ লাগে। কি করে যে ওইরকম একটা হাম্‌বাগের পাল্লায় পড়েছিল। প্রথম দিন থেকেই তার সুবীরকে চালিয়াত ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। কথার যাদুতে বশ করে ফেলতে ওস্তাদ। বিয়েটা ভেঙে শাপে বর হয়েছে। কত স্বাধীন ভাবে কাজ করছে জয়া। এক সময় যা দিন গেছে বেচারির। তার মধ্যেও মনের জোর কি সাংঘাতিক। রাতের পর রাত জেগে ছবি এঁকে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, নিখিলের মনে হয়, মানসিক বিপর্যয়ের সময় থেকেই জয়ার ছবি অনেক বেশি পরিণত হয়েছে। এমন চমৎকার রঙের কাজ করে একেক সময়।

বাথরুম থেকে মুখে জল দিয়ে এসে ব্রাশ, তুলি, স্কেল সব ড্রয়ারে ঢুকিয়ে চাবি দিল নিখিল, শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। কি হতে পারে জয়ার? বাবলুর কিছু হল নাকি? না বৃষ্টির? সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে জয়ার জীবনের সমস্ত ওঠা পড়া তার চোখের সামনে ঘটে গেছে। বিয়ের সাক্ষী তো বটেই, ডিভোর্সেরও। বৃষ্টির কাস্টডি নিয়ে মামলা চলাকালীন জয়া যখন মাঝে মাঝে হতাশায় ভেঙে পড়ত, এক মুহূর্তের জন্যও সে দুর্বল হতে দেয়নি জয়াকে। জয়াও কম করেনি তার জন্য। জয়া না থাকলে আরতির সঙ্গে বিয়েটাই ভেঙে যেত তার। হিস্টেরিক আরতিকে জয়াই ঠাণ্ডা মাথায় সামলেছে। একেই কি বন্ধুত্ব বলে? যদি তাই হয় তবে কেন জয়ার খ্যাতিকে ঈর্ষা করে সে? হীনম্মন্যতাবোধ?

ওয়েলিংটন থেকে বাসে এসে বাকি রাস্তা হেঁটেই মেরে দিল নিখিল। জয়া স্টাফরুমে ছিল। নিখিলকে দেখেই বেরিয়ে এসেছে। জয়াকে দেখে রীতিমত ঘাবড়ে গেছে নিখিল। তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল কলকাতা তিনশ’র এগজিবিশনে। একটু অন্যমনস্ক ছিল যেন সেদিন। নিখিল জিজ্ঞাসাও করেছিল; এড়িয়ে গেছে জয়া। সেদিনও তো এত খারাপ লাগেনি জয়ার মুখ চোখ!

—কি হয়েছে তোর? এরকম দেখাচ্ছে কেন তোকে? চোখের নিচে কালি! মুখ শুকনো?

কলেজের গেট থেকে বেরিয়ে জয়া এক নিশ্বাসে বলে ফেলল,

—বৃষ্টিকে নিয়ে খুব প্রবলেমে পড়েছি। ও একদম পাগল হয়ে গেছে।

—কেন? কি হয়েছে?

—উন্মাদের মত আচরণ করছে। কোন কথা শুনছে না। চল্, কোথাও বসে বলছি।

রাসেল স্ট্রিটের ছোট রেস্তোঁরায় বসে সব শুনে নিখিল একেবারে রুদ্ধবাক। বৃষ্টি নেশা করে বাড়ি ফিরছে। গালিগালাজ করছে জয়াকে! সুবীরের কাছে চলে যেতে চেয়েছিল! উত্তেজনায় পর পর কয়েকটা সিগারেট খেয়ে ফেলল নিখিল,

—তাই তোকে কদিন কোথাও দেখা যাচ্ছে না! ফিরোজের কলোনি শিলান্যাসের দিনও যাস্‌নি। সবাই তোর কথা বলছিল।

—ছাড়্ ওসব। এখন কি করা যায় তাই বল্। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমারই হয়ত ভুল হয়েছে কোথাও। জয়ার গলা ধরে এসেছে। চোখের জল আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে।

এই কি সেই বৃষ্টি যে আরতির গায়ের সঙ্গে লেপটে ছিল বৌভাতের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা? আরও ছোটবেলায় ঝুলে পড়ত নিখিলের দাড়ি ধরে? ডায়মণ্ডহারবারের পিকনিকে গিয়ে কি নাচই না নেচেছিল ছোট্ট মেয়েটা। বড় নিশ্বাস ফেলে অ্যাশট্রেতে সিগারেট নেভাল নিখিল। মেয়েটার কি অসাধারণ ছবি আঁকার হাতও ছিল!

—শান্ত হ’। ভেঙে পড়লে চলবে নাকি? ভেবে চিন্তে একটা রাস্তা বার করতে হবে। সুবীরের সঙ্গে এই নিয়ে আর তোর কোন কথা হয়েছে?

—না। রোজই চার পাঁচবার করে ফোন করে মেয়েকে। মেয়ে ফোন ধরেই না। ধরবেই বা কখন? বাড়ি থাকলে তো। আমি কিছুই বলিনি আর। যদি কিছু একটা ভালমন্দ করে বসে! যদি হুট্ করে বাড়ি থেকে চলে যায়!

—দাঁড়া, দাঁড়া। যাবে কোথায়? গেলেই হল?

নিখিল গভীর ভাবে ভাবার চেষ্টা করছিল ব্যাপারটাকে। হয়ত বৃষ্টি ডিপ মেলানকলিয়ায় ভূগছে। অনেক সময় এরকম হয়। ডিপ্রেশন মনে অনেক দিন চেপে রাখলে হঠাৎ এভাবেই এক্সপ্লোড্ করে। নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ ভাবতে ভাবতে…

—আচ্ছা, কাদের সঙ্গে মেশে বল্ তো?

—ঠিক বলতে পারব না। কলেজেরই বন্ধুবান্ধব হবে। সেদিন একটা ছেলে ওর খোঁজ করতে এসেছিল বাড়িতে, দেবাদিত্য না কি যেন নাম, দেখে তো ভালই মনে হল ছেলেটাকে। মাঝে কদিন বৃষ্টি বাড়ির থেকে বেরিয়েও কলেজ যায়নি। সেসময়ই খোঁজ নিতে এসেছিল। পাড়াতেও একটা নতুন ছেলের সঙ্গে কথা বলে মাঝে মাঝে। কাল যখন ঝড় উঠল, তখন সেই ছেলেটাই তো বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেল বৃষ্টিকে। বাবলু বলছিল ছেলেটা নাকি ভাল ক্রিকেট খেলে।

—ওদের ডেকে কথা বলা যায় না?

—কে বলবে? বাবলু? ওকে তো তুই জানিস্‌ই। কখন কি মুড থাকে। আমারই হয়েছে জ্বালা, সবার মেজাজমর্জি বুঝে চলতে হয়। আমি কাউকে ডেকে কিছু বললে বৃষ্টি কি ভাবে রিঅ্যাক্ট করবে!… এদিকে পাড়াতেও তো টি টি পড়ে গেছে। পাশের বাড়ির অবিনাশ উকিল সেদিন তো রাস্তায় আমাকে ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কত কথাই শোনালেন। আমি কি করি বলতো?

নিখিল চুপ করে রইল। পাড়ার কোন ছেলে বা মেয়ে হঠাৎ বিপথে গেলে প্রতিবেশীরা মজাই পায়। যেন রসের খোরাক। তার ওপর সেই ছেলেমেয়ের মা যদি ডিভোর্সি হয় তবে তো সোনায় সোহাগা।

—তুই নরম করে ওর সঙ্গে একবার কথা বলে দেখেছিস? সমস্ত ব্যাপার জানতে চেয়ে?

জয়া দু দিকে মাথা নাড়ল। কি করে বোঝাবে বৃষ্টিকে দেখলেই এখন তার হাত পা কাঁপে। সব সময় যে অত উগ্র মেজাজে থাকে তার সঙ্গে নরম করে কথা বলা যায়ই বা কি ভাবে? চোখের সামনে মুহুর্মুহু সেই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। মেয়ে তার মুখের ওপর পা দোলাচ্ছে। কানে ওয়াকম্যান।

জয়ার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল। তাড়াতাড়ি রুমাল চেপেছে মুখে। মনে মনে বলছে, তোর জন্য সময় দিইনি কোনদিন। খুব অন্যায় হয়ে গেছে। সব সময় ফিরিয়ে দেব তোকে। একবার সুযোগ দে বৃষ্টি।

একটা সুযোগ দিবি না বৃষ্টি? আমি তোকে আমার কথাগুলো বুঝিয়ে বলতাম।

রিসিভার নামিয়ে নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠল সুবীর। মেয়েটা আজকেও বাড়ি নেই। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে সুবীরের নিজের ওপর। কী কুক্ষণেই যে জয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল। মেয়েটা বোধহয় সারা জীবনের মত নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

সুবীর আলগাভাবে চেয়ারে হেলান দিল। ঝুঁকে জল খেল টেবিলের গ্লাস থেকে। মাথার ভেতরটা দপদপ করছে। এয়ার কণ্ডিশনড় ঘরে বসেও ঘামছে বিশ্রী ভাবে। টাইএর নট্ আলগা করল। বেল টিপে ডাকল বেয়ারাকে,

—এসিটা ফুল্ করে দাও।

—ফুল তো করাই আছে সার।

—তাই? ঠিক আছে যাও।

সুবীর শার্টের উপরের বোতামটা খুলে দিল। টয়লেটে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিল খানিকটা। আয়নায় মার্কেটিং ম্যানেজার সুবীর রায়কে কী বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে! পারচেজের নায়ার আজ সকালেই বলছিল,

—ইউ আর লুকিং সিক। টেক সাম্ রেস্ট ম্যান্।

সুবীর রায়ের বিশ্রাম কোথায়? বিশ্রাম, অবসর শব্দগুলো কবেই তো মুছে গেছে সুবীরের অভিধান থেকে। সেই ন্যায়রত্ন লেনের গলি থেকে একুশ বছর বয়সে সেলস্‌ম্যান হিসাবে জীবন শুরু। তারপর আর কোনদিন দাঁড়াবার সময় পেল কোথায়! সুবীর কোনদিনই স্রোতের মানুষ হতে চায়নি। স্রোতের মানুষ ভাসতে ভাসতে চড়ায় আটকে গেলে আটকেই থাকে। স্রোতের সঙ্গে নয়, সুবীর চেয়েছিল সে যেদিকে যাবে স্রোতকেও যেতে হবে সেদিকে। হায় রে মানুষের স্পর্ধা।

সুবীর আবার টেবিলে এসে বসল। কোয়ার্টারলি মার্কেটিং প্রজেকশানটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।

বেয়ারা নিজেই ঢুকল,

—স্যার, আপনার দাদা এসেছেন দেখা করতে। আসতে বলব?

সুবীর ফাইল বন্ধ করল,—বলো।

সামনের চেয়ার টেনে বসেছে প্রবীর। মুখচোখ উসকো খুসকো, দু তিন দিন মনে হয় দাড়ি কামায়নি। নীল শার্ট বেশ ময়লা।

প্রবীরকে দেখেই সুবীরের মনে পড়ে গেছে কাশীপুর জুট মিলে লকআউট শুরু হয়েছে; কদিন আগেই কাগজে দেখছিল। তখনই মনে হয়েছিল একবার দেখা করে আসবে বাবা মা দাদা বৌদির সঙ্গে।

প্রবীর হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে,

—ভাবিইনি তোকে এখন অফিসে পাব। এখানে হেড অফিসে আমাদের আজ গেট মিটিং ছিল। ফেরার পথে ভাবলাম একবার ঢু মেরে যাই। তুই তে অনেক সময় সন্ধের পরও থাকিস্।

—মিটিং-এ কি হল? চান্স আছে খোলার?

প্রবীর উত্তর দিল না। তাদের জুট মিল প্রায়ই বন্ধ থাকে। ছ মাস খোলা, তা ছ মাস বন্ধ থাকে। সে সময় দ্বারস্থ হতে হয় এই ভায়েরই। ভাই যদিও বিরক্ত হয় না তবু তার খুব খারাপ লাগে। কি করবে? এই বয়সে কোথায় আর…?

সুবীর জিজ্ঞাসা করল —বৌদির কি খবর? টুকাই বুকাই-এর পরীক্ষা কেমন হল?

—ওই এক রকম। বাবা মার শরীরটাই ভাল না। বাবাকে তো আজকাল না ধরলে হাঁটাচলাই করতে পারে না।

সুবীর নিজের হাতের দিকে অজান্তে তাকিয়ে ফেলল। তার কাঁপাটাও বাড়ছে একটু একটু করে। মানিব্যাগ থেকে টাকা বার করল,

—এটা রাখ্।

প্রবীর হাত বাড়াল না,—থাক্ না। এখনও আছে হাতে। লাগলে চেয়ে নেব।

—রাখ্। বাবার ওষুধও তো কিনতে হবে। পারলে মাকে একটা টনিক কিনে দিস।

প্রবীর মাথা নিচু করল। সুবীরের বুকটা কটকট করে উঠেছে। দাদাকে দেখলে আজকাল তার বড় মায়া হয়। কিছুই করে উঠতে পারল না জীবনে। খুব ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে মারপিট লাগলে কিভাবে বুক দিয়ে তাকে আগলে রাখত দাদা। সেই সম্পর্ক আলগা হতে হতে এখন শুধুই দায় ওঠানো। সম্পর্কের তবে এটাই কি শেষ ধাপ? মনে হলেই আবেগ প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করা সুবীর, কেমন বিহ্বল হয়ে পড়ে।

—আয় না একদিন আমার ওখানে। টুকাই বুকাই আর বৌদিকে নিয়ে। তোরা তো আর আসিস্‌ই না। দাদাদের সঙ্গে রাজার তো…

প্রবীর তবু মাথা নামিয়েই আছে। বৃষ্টির মতই তার মনের ছাপ অতি সহজেই মুখে ফুটে ওঠে। প্রবীর একটুও পছন্দ করে না রীতাকে। কেন যে করে না? জয়া ওর বেশি পছন্দের ছিল বলেই কি?

সুবীরও চুপ করে রইল।

প্রবীর খানিক পরে মাথা তুলেছে। একটু ভয়ে ভয়ে নিচু গলায় বলল,—তুইও তো বাড়িতে আসতে পারিস্। সেই লাস্ট কবে ডাক্তার নিয়ে গিয়েছিলি। বাবা মা তোকে খুব আশা করে। শোকাতাপা মানুষ, কবে আছে, কবে নেই।

সুবীর মৃদু হাসল,—ঠিক আছে, আজকালের মধ্যেই যাব একবার।

বেয়ারা চা দিয়ে গেছে। প্রবীর চায়ে চুমুক দিল।

—হ্যাঁরে, আমাদের মেয়েটা কেমন আছে রে? ফার্স্ট ইয়ার চলছে তাই না?

মা, বাবা, দাদা, বৌদি সকলের কাছেই বৃষ্টি এখনও ন্যায়রত্ন লেনের বাড়িরই মেয়ে। হক না সে মানুষ বালিগঞ্জে তার মায়ের কাছে। সম্পর্কের এই ধারাটা কি অদ্ভুত! সুবীর নিজেকে আর ন্যায়রত্ন লেনের বাড়ির ছেলে বলে ভাবতে পারে না, বৃষ্টিও থাকে না সুবীরের কাছে তবুও…।

হয়ত সম্পর্কের নিয়মই এরকম। অসংখ্য ঝুরিনামা বৃদ্ধ বট ভাবে সমস্ত ঝুরিগুলো তারই অংশ। এদিকে ঝুরিরা নিজেদের প্রাণরস নিজেরাই মাটি থেকে আহরণ করে চলেছে। তাদের মধ্যে দিয়েই বেঁচে আছে বৃদ্ধ বট। কখন যে তার নিজের কাণ্ড মরে গেছে, সে খেয়ালও নেই। তাছাড়া পুরোপুরি কোন সম্পর্ক বোধহয় ছেঁড়েও না। অদৃশ্য তন্তুতে কোথাও রেশ থেকেই যায়। নাহলে বাবা মা এতদিন পরেও কোন প্রসঙ্গে জয়ার কথা উঠলে বৌমা সম্বোধন করে কথা বলেন! অথচ রীতাকে রীতা।

সুবীর অন্যমনস্ক ভাবে মাথা নাড়ল,—ভালই আছে। চল্, উঠবি তো? তোকে ধর্মতলার মোড়ে নামিয়ে দিই। এখন তো এখান থেকে বাসফাসও পাবি না। সাড়ে সাতটা বাজতে যায়।

প্রবীরকে নামিয়ে দেওয়ার পর ড্রাইভারকে রেড রোড হয়ে, রেসকোর্স ঘুরে বাড়ি যেতে বলল সুবীর। হঠাৎ দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। অনেক দিন আগে, জয়ার সঙ্গে ডিভোর্স হওয়ার পর পরই, ছোট বৃষ্টিকে নিয়ে বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাদের দেখে চিৎকার করে দোতলার বারান্দা থেকে জ্যাঠতুতো দাদা বলছিল জ্যাঠাইমাকে,

—ফেরিঅলাটা মেয়ে নিয়ে এসেছে দেখলাম? তা তোমাদের আদরের সুবুর বউটা আর কোন বেটাছেলে পাকড়াও করতে পারল?

ওইটুকু মেয়ে ঠিক বুঝে নিয়েছিল বিদ্রূপটা। তারপর থেকে কিছুতেই আর ও বাড়িতে যেতে চাইত না। সুবীর বললেও নয়। মেয়েটা বড্ড বেশি অভিমানী। সিটে হেলান দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করল সুবীর। জানলার নামানো কাচে হাত রাখছে বার বার। আজ এত হাওয়া কম কেন?… মেয়েটা কি আর কোনদিন কথা বলবে না তার সঙ্গে?

বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। সুবীর ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়েই আছে।

ড্রাইভার ডাকল,—সার, এসে গেছি।

সুবীর চমকে তাকিয়েছে। কখন এত ঘুমিয়ে পড়েছিল! থতমত চোখে তাকাল চারদিকে। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে।

সুবীর ক্লান্ত পায়ে লিফ্‌টের সামনে এসে দাঁড়াল।

এখনও আর কত ওঠা নামা বাকি আছে জীবনের!

.

১৬.

রাজীব চেঁচিয়ে ডাকল বৃষ্টিকে,

—কাম অন্ বেবি, উই’ল বি টুগেদার হিয়ার হোল নাইট।

বৃষ্টি শুনতে পেল না। প্রচণ্ড শব্দে লেকের জল থরথর কাঁপছে। পাখিরা চমকে উঠছে আতঙ্কে। শব্দের ধাক্কায় পৃথিবীর হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়ার জোগাড়। শব্দ নয়, নাদ। এখানে এলে বোঝা যায় শব্দকে কেন পুরাণে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। প্রবল দাপটে ড্রাম বাজাচ্ছে এক ঝাঁকড়াচুল দাড়িঅলা যুবক! তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাওয়াইয়ান গিটার, জ্যাজসেট্‌, সিন্থেসাইজার। কমনীয় মেয়েলি চেহারার একটি ছেলে জমকালো পোশাক পরে, স্প্যানিশ গিটার হাতে গোটা স্টেজে নেচেকুঁদে গান গেয়ে চলেছে। মুক্ত অডিটোরিয়ামে প্রকৃতির নীচে রাতভর আজ পশ্চিমী রকের জলসা। শ্রোতাদের বয়স পনেরো থেকে পঁয়ত্রিশ। প্রত্যেকেই এমন ভাবে তাল দিচ্ছে যেন সে না তাল দিলেই বাজনার ছন্দ কেটে যাবে।

বৃষ্টি অনেকক্ষণ ধরেই তার দলবলকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। চতুর্দিক এমন ধোঁয়াটে আর শ্রোতার ভিড় এমন জমাট, যে পাঁচ-সাত হাত দূর থেকেও নিজের বন্ধুদের চিনে নেওয়া কঠিন।

রাজীব উঠে এসে টানল বৃষ্টিকে,

—হোয়াটস্ রঙ? কখন থেকে চিল্লাচ্ছি!

—আমিও তো খুঁজছি তোদের। শুভ আসেনি?

—ডোন্ট্ নেম দ্যাট বাগার। রকে নাকি ওর মাইগ্রেন হয়।

কথার সঙ্গে দুলে চলেছে রাজীব। বৃষ্টিও এক পায়ে তাল দিচ্ছে। সিগারেট ধরিয়ে বড় করে ধোঁয়া ছাড়ল। মাইগ্রেন না আরও কিছু। আসলে বাড়িতে বসে শুভ এখন অ্যানুয়ালের প্রিপারেশন চালাচ্ছে। চালাক ছেলে। পরীক্ষার কথা মনে হতেই বৃষ্টি আরও বড় করে ধোঁয়া ছাড়ল। সামনেই একদল ছেলেমেয়ে হাই হুই চিৎকার করছে।

—ওফ্, আজ ওয়েদার যা স্টাফি। আর কে কে এসেছে রে?

—ওই তো জিমি, জিন্ডা, পেপসি, রানা…আরও তিনচার জন আছে, তুই চিনবি না।

জিন্ডা, জিন্‌সের পকেট থেকে একটা চ্যাপ্টা বোতল বার করল, এক চুমুক খেয়ে এগিয়ে দিল রাজীবকে। রাজীব গলায় অল্প ঢেলে বোতল ফেরত দিল,

—আহ্, ইউ সুইটি পাই, সব সময়ে পকেটে মজুত রাখিস্ কি করে?

—দ্যাটস দি আর্ট! ইউ হ্যাভ টু ইনভেন্ট্ ইট ডিয়ার।

জিমির চোখ স্টেজের দিকে। দু হাত মাথার ওপর তুলে জোর জোর তালি বাজাচ্ছে, তার কানের ঝোলা দুল একই সঙ্গে নাচছে টিং-টিং। বৃষ্টির মন প্রথমে সামান্য খুঁত-খুঁত করছিল। আজই প্রথম সারা রাত বাড়ির বাইরে কাটাবে। সুধাকে অবশ্য বলে এসেছে কেউ যেন তার জন্য চিন্তা না করে। কেন যে বলতে গেল! নিখিলমামার কথাতেই কি!…

পরশু দিন হঠাৎই নিখিল বৃষ্টির কলেজে হাজির। বৃষ্টি সামনেই বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল। কাল থেকে মীনাক্ষি এক মাথা সিঁদুর পরে কলেজে আসা শুরু করেছে। এই নিয়ে বৃষ্টির বন্ধুবান্ধবরা দারুণ উত্তেজিত। বাড়ির অমতে সেই ছেলেটাকেই বিয়ে করেছে মীনাক্ষি, চলে গেছে ছেলেটার বাড়িতে। তাই নিয়ে জোর তুফান চলছিল। বৃষ্টিকে অবশ্য অলোচনাটা তেমন স্পর্শ করছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে কলেজে থাকতে হয়, সেই জন্যই থাকা এখন।

বৃষ্টিকে দেখে নিখিলমামা স্বভাবমতই হৈ-চৈ করে উঠেছিল,—এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। হঠাৎই মনে হল, আরে তুই তো এখন কলেজে। তাই একটু ঢুঁ মেরে গেলাম। বাড়ি গেলে আজকাল তো তোর দেখাই পাওয়া যায়

—গিয়েছিলে বুঝি? বৃষ্টি নিখিলমামাকে দেখে কম অবাক হয়নি, —কবে গিয়েছিলে?

—এই তো পর পর দু’দিন সন্ধেবেলা ঘুরে এলাম। একদিন তো তোদের পার্কে জোর ইলেকশন মিটিং চলছিল। বাবলু বলল এর মধ্যে কবে নাকি রাজীব গান্ধীও আসছে মিটিং করতে। কবে রে?

—কি জানি। এখন তো রোজই মিটিং মিছিল।

বৃষ্টি এখন পরিপার্শ্বের কোন খবর রাখে না। এই তো সুদেষ্ণা, তৃষিতা আর দেবাদিত্য সেদিন জোর তর্ক জুড়েছিল বি জে পি কংগ্রেস নিয়ে।

দেবাদিত্য বৃষ্টিকে প্রশ্ন করেছিল, —কাকে ভোট দিবি রে বৃষ্টি?

তৃষিতা বলে উঠেছিল, —আমি বাবা স্টেট্ অ্যাসেমব্‌লিতে কাকে দেব ঠিক করে ফেলেছি।

সুদেষ্ণা বলল,—অ্যাই বলবি না। সিক্রেট। সিক্রেট।

এবার প্রথম ভোটার লিস্টে নাম উঠেছে বলে সুদেষ্ণা তৃষিতারা রীতিমত রোমাঞ্চিত। ছেলেমানুষি। বৃষ্টির এখন কলেজের বন্ধুদের আর ভাল লাগে

না। একদিন দেবাদিত্য জ্ঞান দিতে এসেছিল, বৃষ্টি, শুভকে যা মানায় তোকে তা মানায় না।

বৃষ্টি বিরক্ত হয়েছে,—তুই তোর মত ছ্যাবলামি নিয়ে থাক্ না। আমায় নিয়ে কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না।

বৃষ্টির স্নায়ু আজকাল খুব বেশি টান-টান থাকে। সায়নদীপ ছেলেটা তাকে যখন তখন ধরছে রাস্তায়। একদিন হাত ধরে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই গার্জেন হয়ে বসেছে। আজও বিকেলে বেরোনোর সময় পথ আটকেছিল,

—চললে কোথায়?

বৃষ্টি কটকট করে তাকিয়েছে,—তাতে তোমার কি দরকার?

—কখন ফিরছ?

—সেটাও তোমাকে বলতে হবে নাকি?

—তা নয়, আমি তো আর রোজ মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকব না, বাড়ি চিনে ফিরতে পারবে তো?

বৃষ্টি খেপে লাল। তখনই ঠিক করেছে রাত্রে আজ ফিরবেই না। সুধাকে যদিও সে কথা বলেনি। তবু যা বলেছে, তাই ঢের। নিখিলমামা বার বার না বললে হয়ত সেটুকুও…

নিখিলমামা বলেছিল,—কোথায় যাস্ বাড়িতে বলে যাস্ না কেন রে? কেউ তোর খবর দিতে পারে না! কিডন্যাপড্ হয়ে গেলে আমরা কোথায় খোঁজ করব?

বৃষ্টির মনের কোণে চোরা সন্দেহ। মা নিখিলমামাকে খোঁজ নিতে পাঠায়নি তো? নিখিলমামার মুখ দেখে অবশ্য সন্দেহের মেঘ কেটে গেছে। নিখিলমামা গোয়েন্দা হতেই পারে না। সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে রাখলে যে খুঁজে বার করতে পারে না, সে হবে গুপ্তচর? কপটতা করবে? ছোটবেলায় না তার সঙ্গে নিখিলমামার চুক্তি হয়েছিল দু’জনে মিলে পায়ে হেঁটে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা ঘুরবে! হাসতে হাসতে বলেছিল,

—শাঁকচুন্নিকে কিডন্যাপ্ করবে এমন ভূত আছে নাকি কলকাতায়?

—আছে রে আছে। ভূত সর্বত্র আছে।

বৃষ্টি সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল। ভূত যে আছে সেটা সেও টের পায়। এই জিমিরই হাবভাব ভাল নয়। কারণে অকারণে বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। দু একদিন আনন্দের অছিলায় তাঁকে জড়িয়ে ধরারও চেষ্টা করেছিল। এইসব ভূতেদের সামলানোর ক্ষমতা বৃষ্টির আছে।

আরেকটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে বৃষ্টি থামল। গাঁজার নেশা রপ্ত হওয়ার পর সাদা সিগারেটে আর তেমন আরাম পায় না। পার্ক স্ট্রিটের এক পানের দোকান থেকে সে প্রায়ই অল্প অল্প গাঁজা কিনে আনে। জিমি তাকে চিনিয়ে দিয়েছে দোকানটা। বিশেষ একটা কোড বলে চাইতে হয়।

বৃষ্টি ঠুকে ঠুকে সিগারেট থেকে তামাক বার করে ফেলল। ব্যাগে রাখা গাঁজাটুক সযত্নে ভরল সে জায়গায়, দেশলাই কাঠি দিয়ে চেপে চেপে কাগজে ঠেসে দিল, দু হাতের তালুতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোল করে নিল ভাল করে।

জিমি পাশে উঠে এসেছে। বৃষ্টি দেশলাই জ্বালানোর আগেই হাত ধরে থামাল,

—ওয়ান্ট সামথিং মোর হার্ড? ম্যাসকুলাইন?

বৃষ্টির ভুরু জড়ো।

প্যান্টের হাঁটুর চেন খুলে জিমি প্লাস্টিকের ছোট্ট মোড়ক বার করল। রাজীব দেখেই চিনে ফেলেছে,

—তুই কোন্ ঠেক থেকে রোজ ম্যানেজ করছিস্ রে? আমাদের ওদিকে পুলিশ হেভি ঝামেলা করছে, পাড়াগুলোও হয়েছে তেমনি, দোজ বাগারস্ আর সিম্পলি মেকিং ইট্ হেল্।

জিমি রাজীবের দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাল। সব রহস্য সকলকে জানাতে নেই। বৃষ্টিকে ইশারায় স্টেজের পিছনে যেতে বলল,

—এখানে কেমন ঠাণ্ডা মেরে যাচ্ছি। বাইরে একটা দারুণ গলতা আছে, চল্।

জিমির সঙ্গে রাজীবও উঠেছে,—যাবি বৃষ্টি?

বৃষ্টি দোমনা। জিমির সঙ্গ তার একদম ভাল লাগে না। এদিকে আজ আরও চড়া নেশার জন্য তার শরীর ছটফট করছে।

মেয়েলি ছেলেটার গান থেমেছে। পরের জনের প্রস্তুতি শুরু হল। রাজীব একবার জিজ্ঞাসা করল,

—কে উঠছে রে এবার? মার্কো রেঙ্গান্? ফার্টাডোর প্রোগ্রাম কি পরে?

জিমি উত্তর দিল না। সামনের ছেলেমেয়েদের সরিয়ে সে বাইরে যাওয়ার রাস্তা করছে। চারটে ছেলেমেয়ে একসঙ্গে গান ধরেছে,

ফিফটিন্ মেন ইন ডেড ম্যানস্ চেস্ট…ইয়ো হোহো হো…

অ্যান্ড এ বটল্ অফ রাম্।

জলদস্যুদের গানের কি পরিণতি!

অডিটোরিয়ামের বাইরে এসে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে শব্দগুলো। লেকের জলের ধারে, তিনটে প্রকাণ্ড গাছের মাঝখানে ছোট্ট ঝোপের আড়াল। কেউ এখানে বসে থাকলে আট-দশ হাত দূর থেকেও দেখা যায় না। জিমি রাজীব অভ্যস্ত পায়ে পৌঁছে গেছে সেখানে। পিছনে সম্মোহিতের মত বৃষ্টি।

জিমি পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। গোল করে কাগজ পাকাচ্ছে। রাংতার ওপর এক চিমটে ব্রাউন সুগার রাখল। অন্ধকারে জিমির মুখ যেন অরিজিতের মত। অরিজিৎ আজকাল সর্বক্ষণ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে, মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কবিতা আওড়ায়।

রাংতার ধোঁয়া নাকে টানার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি প্রথমটা কেমন অনুভূতিশূন্য হয়ে গেল। অন্ধকার দুলে উঠল নাগরদোলার মত। অসংখ্য নীল বুদবুদ নাচছে। চোখের সামনে।

জিমি বৃষ্টির কাঁধে হাত রাখল,—এনজয়িং?

বৃষ্টি অভ্যাসমত হাত সরিয়ে দিল। আবার নাক ডোবাল ধোঁয়ায়। রাজীবের কাঁধে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ল আস্তে আস্তে। বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করল, জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে।

রাজীব মাথায় হাত রাখল,—কি বলছিস্ রে?

বৃষ্টি কিছুতেই চোখ খুলতে পারছিল না। জড়ানো স্বরে তবু বলতে চাইছে, আই হেট দেম, আই হেট দেম, আমি ওদের ঘেন্না করি।

তিনটে ছেলে মেয়ে আচ্ছন্ন অবস্থায় এমনভাবে একে অন্যের গায়ে পড়ে আছে যে কাউকে পৃথক করা যায় না। বৃষ্টি বারকয়েক উঠে বসার চেষ্টা করেছিল, আপনা থেকেই পড়ে গেছে। রাজীব বা বৃষ্টির তুলনায় জিমি অনেক পাকা নেশাড়ু। বৃষ্টিকে সে কাছে টেনে নিল। তার কাঁপা কাঁপা হাত বৃষ্টির বুকের ওপর। বৃষ্টির কোন অনুভূতিই নেই। তার চোখ লেকের জলে স্থির।

ওপার থেকে সোনালি আলো এসে পড়েছে জলে। দেখতে দেখতে বৃষ্টির মনে হচ্ছিল জলটা বুঝি এখখুনি লাফ দিয়ে চলে যাবে পৃথিবীর বাইরে। মাঝে মাঝেই জল ফিনকি দিয়ে উঠছে। বৃষ্টি একা সেই দুরন্ত জলের মাথায় ভাসতে থাকল। ঘন ঘন রঙ বদলাচ্ছে অন্ধকার। কালো। সাদা। নীল। সোনালি। সবুজ। কাল্পনিক তুলি দিয়ে বৃষ্টি রঙগুলোকে ধরার চেষ্টা করল অন্ধকারের ক্যানভাসে। অনেক অনেকদিন পর সে ছবি আঁকছে।

আচমকাই বৃষ্টির বুক হুহু করে উঠল। নিজের খেয়ালে আঠেরো বছরের বৃষ্টি একটা খেলা শুরু করতে চেয়েছিল। মাকে না মানার খেলা। বাবাকে যাচাই করার খেলা। সেই খেলাই তার কাছে বুমেরাং হয়ে আসছে। কি করে এখন সে বাবা মাকে বোঝায় এভাবে কষ্ট পেতে তার একটুও ভাল লাগছে না। এই জিমি, রাজীব, সবাই, সবাই খুব খারাপ। তার একটাও বন্ধু নেই। একটাও। সায়নদীপ কি সত্যি তার বন্ধু হতে চায়?

বৃষ্টির নির্জীব চোখ বিশ্ব ঘুরে খুঁজছে কাউকে। কে সে?

রাত্রি দশটায় তিনজনকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে লেক থানার সাবইন্সপেক্টর থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অঞ্চলটা ভাল নয়। প্রায়শই রাতে তাঁকে রাউন্ডে বেরোতে হয়।

—কে রে? কে ওখানে?

মুখে জোরালো টর্চের আলো পড়তে বৃষ্টির চোখ আরও ধাঁধিয়ে গেল। আবছা আবছা একটা স্বর কানে আসছে। শেষ পর্যন্ত কে তাকে নিয়ে যেতে এল?

বৃষ্টি আলোর পিছনে শুধু কয়েকটা অস্পষ্ট কায়া দেখল।

সাবইন্সপেক্টরের সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন প্লেন ড্রেসে।

—দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্র বাড়ির ছেলে মেয়ে! এত রাতে এখানে বসে হচ্ছেটা কি, অ্যাঁ? পাতা-খাওয়া পার্টি।

—ওঠ। ওঠ্।

—আরে, ওই ছেলেটা না! এই শালা…

বৃষ্টির মুখের আরও কাছে আলো এগিয়ে এল।

গভীর রাতে থানা থেকে ফোন পেয়ে জয়া প্রথম ধাক্কায় হতবুদ্ধি হয়ে গেল। রিসিভার ক্রেডলে রাখতেও ভুলে গেছে। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে মুর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল।

কাল পরশু দু দিন বৃষ্টি খুব একটা রাত করে ফেরেনি। আজ সন্ধেবেলা জয়া সুধার মুখে শুনেছিল বৃষ্টি নাকি কোথায় ফাংশান শুনতে গেছে, ফিরতে রাত হবে। মনে মনে নিশ্চিন্ত হয়েছিল একটু। যাক্, তবু বলে তো গেছে। এটাই এখন জয়ার কাছে বিরাট পাওয়া।

ফোনের শব্দ শুনে বাবলু সুধাও উঠে এসেছে। দুজনেই জয়ার দিকে নির্বাক তাকিয়ে। জয়ার মুখ কাগজের মত সাদা। ঠোঁট কাঁপছে। কোনক্রমে বলতে পারল,

—বৃষ্টিকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।

দিশাহারা জয়া নিজের ঘরে ঢুকল একবার। বেরিয়ে এল। কাকে ডাকে এখন? নিখিলের বাড়িতে ফোন নেই। ফিরোজকে ডাকবে? রমেনদাকে? রমেনদার চারদিকে অনেক জানাশুনো আছে। সিনিয়ার আর্টিস্ট কাউকে বললেও সাহায্য পেতে পারে। প্রকাশদা। মাস্টারমশাই। সুনীলদা। ফোনের কাছে গিয়ে নোটবুক উল্টোতে লাগল জয়া। পরমূহুর্তে হাত থেকে পড়ে গেল নোটবুকটা।

জয়া ভিতরের প্যাসেজে বার তিন-চার পায়চারি করল। মনে হচ্ছে কেউ তার পাঁজরে তীক্ষ্ণ শলাকা ঢুকিয়ে দিয়েছে। প্রথমে অনুভূতি অসাড় হয়ে গিয়েছিল, তারপরই অসহ্য যন্ত্রণা। এই পরিস্থিতিতে কি যে করতে হয়?

অস্থির কাঁপা কাঁপা হাতে জয়া ডায়াল ঘোরাল।

রীতা ঘুম চোখে বিছানা থেকেই হাত বাড়িয়েছে,

—হ্যালো।

—সুবীরকে একটু ডেকে দেবেন?

—কে বলছেন আপনি?

—আমি বৃষ্টির মা। জয়া। খুব আরজেন্ট দরকার। যদি কাইন্ডলি…

—এখখুনি দিচ্ছি, ধরুন।

মাঝে কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। জয়ার মনে হল কয়েক যুগ।

সুবীর ফোন ধরল,—কি হয়েছে? কি হয়েছে বৃষ্টির? কোন অ্যাক্সিডেন্ট?

জয়া প্রাণপণে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছে।

—কি হল? কিছু বলছ না কেন? বৃষ্টি কোথায়?

—এখখুনি একবার লেক থানায় আসতে পারবে? বৃষ্টিকে পুলিশে তুলে নিয়ে গেছে। লেকে বসে ড্রাগ নিচ্ছিল।

এত রাত্রে…! সুবীর প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল। এখন আর ওসব জানার সময় নেই।

—আমি এখখুনি পৌঁছে যাচ্ছি।

ঘর থেকে ব্যাগ নিয়ে জয়া দৌড়ে বেরিয়েছে রাস্তায়। ল্যান্সডাউনের দিকে একটা মাত্র ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। চারদিকে রাত্রি শুনশান। একটা দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছে দুর্দম গতিতে। মোড়ের পানের দোকান বন্ধ হল এইমাত্র। কলকাতা ঘুমিয়ে পড়ছে।

জয়া ট্যাক্সির দরজা ধরে দাঁড়াল,

—খুব আর্জেন্ট ভাই। লেক থানা।

থানার নাম শুনেই বোধহয় ড্রাইভার আপত্তি জানানোর সুযোগ পেল না।

জয়া পৌঁছনোর আগেই সুবীর পৌঁছে গেছে থানায়। ইতিমধ্যেই সে ডিউটি অফিসারের সামনের চেয়ারে বসে। কোণে, একটা বেঞ্চিতে ঘাড় গোঁজ করে বসে রয়েছে বৃষ্টি। পাশে ঢুলছে দুটো ছেলে। জয়ার পিছন পিছনই পাজামা পাঞ্জাবি পরা মধ্যবয়সী এক সুদর্শন ভদ্রলোক হস্তদন্ত হয়ে ঢুকেছেন। তাঁরও উত্তেজিত চোখ ঘুরে ফিরে বেঞ্চির দিকে। সুবীরের পাশের চেয়ারে বসে পড়লেন ধপ করে,

—কি করি বলুন তো এই ছেলেকে নিয়ে?

ডিউটি অফিসার ভদ্রলোককে দেখে লেখা বন্ধ করেছেন।

—সো মিস্টার মুখার্জি, দিস্ ইজ থার্ড টাইম। এভাবে তো অনন্তকাল চলতে পারে না। আপনার মুচলেকায় আর ভরসা করি কি করে?

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে অফিসারের হাত চেপে ধরলেন,

—এবারের মত ছেড়ে দিন প্লিজ্। নেক্সট্ টাইম হলে আপনি যা খুশি করবেন। লকআপে পেটাবেন, কোর্টে চালান দেবেন, যা আপনাদের ইচ্ছে। …আমি কিছু বলতে আসব না। এবার। প্লিজ এবারকার মত।

ডিউটি অফিসার হাত ছাড়িয়ে নিলেন,

—আমি স্যারকে ফোন করে দেখছি। বাট দিস্ ইজ লাস্ট টাইম। অ্যান্ড আই মিন ইট।

ভদ্রলোকের চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। দেখেই বোঝা যায় বেশ প্রভাবশালী মানুষ।

ডিউটি অফিসার ফোন করছেন; ভদ্রলোক সুবীরের দিকে তাকালেন,

—ছেলেটা এরকম ছিল না জানেন। জয়েন্টে চান্স না পাওয়ার পর থেকেই…কোথা থেকে যে সব ড্রাগ পেড্‌লারগুলোর সঙ্গে ভাব হল! লোকগুলোকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে মেরে ফেলা উচিত।

ডিউটি অফিসার রিসিভার কানে রেখে মিটিমিটি হাসছেন। ফোন নামিয়ে চোখ রাখলেন ভদ্রলোকের দিকে,

—কিছু মনে করবেন না স্যার, লাস্ট সেপ্টেম্বরে তিনটে ড্রাগ পেড্‌লার ধরেছিলাম, এমনভাবে কেস বেঁধেছিলাম সেন্টেস্ হতই, অন্তত পাঁচ বছর; আপনিই তাদের হয়ে মামলা লড়ে… আপনার মত নামি মানুষ, দামি লইয়ার…গ্রিপের থেকে বেরিয়ে গেল লোকগুলো…বলতে বলতে নিস্পৃহ স্বরে ডেকেছেন কনস্টেবলকে,—বিমল, ওই জীয়ন মুখার্জি মানে সাহেবের জিমিকে সাহেবের গাড়িতে তুলে দিয়ে এসো তো।

ভদ্রলোক তবু মাথা নামিয়ে বসে রইলেন অল্পক্ষণ। তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে ঘাড় নিচু করেই বেরিয়ে গেছেন।

পাশের টেবিলের সাবইন্সপেক্টর হাই তুললেন,

—ভাল দিয়েছিস মাইরি। শালা যত সব চোর ছাঁচোরের হয়ে মামলা লড়বে…আর এখানে এসে…ছেলেটাকে একটু পিটিয়ে নিতে পারলি না? আলালের ঘরের দুলাল। আলালটি এবার নমিনেশন পেলে যে কি হত! এম পি হলে…

জয়া চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে। ডিউটি অফিসার চোখে প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে এতক্ষণে তাকিয়েছেন তার দিকে।

সুবীর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল,

—জয়া রায়। মেয়ের মা।

ডিউটি অফিসার চেয়ারে হেলান দিলেন। টেবিলের ওপর রাখা রুলটা তুলে নিজের তালুতে ঠুকছেন আস্তে আস্তে,

—কি করেন বলুন তো আপনারা? একটা মেয়েকে সামলাতে পারেন না? একটাই তো মেয়ে আপনাদের, না কি?

সুবীর জয়া নীরব। জয়া একবার শুধু মেয়ের দিকে তাকাল। মেয়েরও চোখ এদিকে। ভাষাহীন চোখ।

—দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে নতুন ধরেছে। অফিসার গলা ওঠালেন,—রোজ তো এসব কম দেখছি না। ভদ্র বাড়ির মেয়ে, দেখে তো মনে হয় বাড়িতে আপনাদের লেখাপড়া, কালচার টালচার আছে, কি করে ওইসব বজ্জাত পাংকগুলোর সঙ্গে মেশে? কিরকম বাপ মা মশাই আপনারা? মেয়ের খোঁজখবর রাখেন না?

সুবীর জয়া পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়েছে। কি করে বলে তাদের মেয়েকে তারা ভয় পায়। সুবীরের বুকের ব্যথাটা হঠাৎই চাড়া দিয়ে উঠল।

—আজকের মত ছেড়ে দিচ্ছি। নিয়ে যান। এবার কিছু নোট্‌ফোট করলাম না। ডিউটি অফিসারের বোধহয় সুবীর জয়াকে দেখে এবার করুণা হয়েছে। গলার স্বর কোমল হল,—এখনও সময় যায়নি। একটু গাইড করুন মেয়েকে। আমিও তো বাবা। আমারও ওই বয়সী একটা মেয়ে আছে। বুঝি কোথায় লাগে। তার ওপর মেয়ে বলে কথা,…বড় হয়ে গেছে। কত কি ঘটে যেতে পারে জানেন? বলতে বলতে গলা আরও নামিয়েছেন,—কি অবস্থায় পেয়েছি ওকে জানেন? ওপেন এয়ারে রক ফক কি সবের ফাংশন চলছিল, তার একটু দূরে ওই দুটো পাংকের সঙ্গে লেকের ধারে জড়াজড়ি করে পড়েছিল। নেশায় বুঁদ হয়ে। ছি ছি ছি।

সুবীর জয়ার কানে যেন কেউ গরম সিসে গলিয়ে ঢেলে দিচ্ছে। জয়ার মনে হল এসব শোনার পরও সে বেঁচে আছে কি করে? সুবীরের চোখ মাথার ওপর ঘুরন্ত পাখার দিকে। কী ভীষণ উত্তাপ!

ডিউটি অফিসার হাত নেড়ে ডাকলেন বৃষ্টিকে,

—অ্যাই, এদিকে শোন, এসো এখানে।

বৃষ্টি উঠল না। বোবা চোখে প্রতিক্রিয়াই হল না কোন।

রাজীব জুল-জুল করে তাকাচ্ছে চার পাশে। ডিউটি অফিসারের দিকে চোখ পড়তে জড়ানো প্রশ্ন করল,

—আমি?

—না, তুই না। তোর বাপ্ তো এখনও এল না। যদি না আসে তুই আজ গেছিস্।

বলেই ডিউটি অফিসার হাসি হাসি মুখে সুবীরের দিকে ফিরলেন,

—দেখেছেন মেয়ের অবস্থা! ব্রাউনসুগার নিয়েছে। এখন ঘণ্টাতিনেক মুখে বাক্যি আসবে না। প্রথম দিনের কিক্ তো। তবে বুঝছে সব। একটু আগে তো কাঁদছিল ফোঁচ ফোঁচ করে। কি পড়ে আপনার মেয়ে?

জয়া অস্ফুট উচ্চারণ করল,—ফার্স্ট ইয়ার। হিস্ট্রি অনার্স।

—কোন্ কলেজ?

—প্রেসিডেন্সি।

—বাহ্! কি মেয়ের কি অধঃপতন!

ডিউটি অফিসার কপাল চাপড়ে হায় হায় করে উঠলেন।

—গাড়ি আছে সঙ্গে?

সুবীর মাথা নাড়ল। আছে।

—যান্, মেয়েকে দুজনে মিলে ধরে তুলে নিয়ে যান। ফর হেভেনস্ সেক, ওই মেয়েকে আর যেন থানায় দেখতে না হয়। তাহলে কিন্তু আপনাদের কপালেও দুঃখ আছে।

এর পরও দুঃখ বাকি থাকে!

সুবীর মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। জয়াও।

দুজনে দু’হাত ধরে টেনে তুলেছে মেয়েকে। বৃষ্টির বোধহীন চোখে ভাষা ফুটল। স্বপ্নের মধ্যে বাবা মার হাত ধরে হাঁটছে। হাঁটছে…হাঁটছে…দু চোখ টলটল করে উঠল। এত বছর ধরে তবে কি এই দিনটার প্রতীক্ষায় ছিল সে!

গাড়ির সামনে এসে সহসা ঘোরটুকু কেটে গেছে। এই স্বপ্ন তো মুহূর্তের।

গোটা রাস্তা বৃষ্টি গাড়িতে কাঠ হয়ে বসে রইল। প্যান্টশার্ট পরা রক্ত মাংসের স্ট্যাচুর মত। গাড়ি থেকে নেমে দুজনকেই ঠেলে সরিয়ে, সুধার হাত ধরে চলে গেছে নিজের ঘরে। একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকাল না।

জয়া ডাইনিং টেবিলে এসে বসে পড়ল। এতক্ষণ ধরে বাঁধ দিয়ে রাখা কান্না প্রবল বেগে ছিটকে আসতে চাইছে। টেবিলে মাথা রেখে হুহু করে কেঁদে ফেলল জয়া।

সুবীর ভেতরে ঢুকতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিরে গিয়ে গাড়িতে বসেছে। বেশ খানিকক্ষণ স্টিয়ারিং-এ মাথা রেখে বসেই রইল। তারপর কাঁপা হাতে গাড়িতে স্টার্ট দিল।

.

১৭.

সায়নদীপের দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারছিল না বৃষ্টি। দু-তিন দিন প্রাণপণ চেষ্টা করেছে যেন মুখোমুখি না হতে হয়। কিন্তু আজ এমনভাবে ঝট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল!

শহর জীবনের একটা মস্ত গুণ অনেক ঘটনা দিনের আলোতে ঘটলেও অপ্রকাশ্য থেকে যায় বহু দিন। তেমন আবার বড় দোষ যত গোপনেই ঘটে যাক না কেন, বিশেষ করে সেই ঘটনায় যদি কেলেংকারির গন্ধ থাকে, কেউ না কেউ তার সাক্ষী থাকবেই। সেদিন রাত্রি একটার সময় থানা থেকে ফিরলেও বৈশাখের খোলা জানলা দিয়ে এক আধটা চোখ উকি দেয়নি, এ তো হতেই পারে না। অবিনাশবাবুর ছেলের বউ অথবা বৃদ্ধ বিশুদাদু নিদেনপক্ষে কোন মানদা বা রামু। বৃষ্টি সেটা জানে বলেই কেমন একটা লজ্জা ভর করেছে তাকে। অথচ তার তো এমন হওয়ার কথা নয়। সেই রাতই বৃষ্টির নেশা করে ফেরার প্রথম রাত নয়। আগেও অনেক বেসামাল অবস্থায় বাড়ি ফিরেছে। তার জন্য তার কোন লজ্জাবোধ ছিল না, আত্মগ্লানি তো নয়ই।

পুলিশে ধরার পরেই বৃষ্টি বুঝতে পারল, সংকোচ কুণ্ঠা সবটুকু বোধহয় এখনও মুছে দিতে পারেনি সে। নাহলে পুলিশ অফিসারের অশ্রাব্য গালিগালাজে, নেশার ঘোরেও, কেন অপমানিত বোধ করছিল!

সে প্রথমে বাড়ির ঠিকানা, ফোন নাম্বার বলতে চায়নি। পুলিশ অফিসার রুল তুলে ভয় দেখিয়েছিলেন তাকে,

—লেকে বসে পাতা খেয়ে ছেলেদের সঙ্গে লদকালদকি করার সময় বাড়ির লোকের কথা মনে ছিল না? এখন তাদের নাম শুনেই খুকিপনা? ন্যাকামো? একটা রুলের ঘা পড়লে…

শুধু অপমান নয়, ভয়ও অসাড় স্নায়ুর ভেতর শুঁয়োপোকার মত ওঠানামা করছিল সে সময়! ফোন নাম্বার বলার পর বার বার মনে হচ্ছিল কতক্ষণে মা আসবে; তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে ওই নরক থেকে। মার আগে বাবা এল।

বাবা মার অমন বিবর্ণ পাংশু মুখ, বাবা যেন এক ভাঙাচোরা মানুষ, মা দুমড়ে যাওয়া প্রতিমা, কল্পনারও অগোচরে ছিল বৃষ্টির। তুরীয় অবস্থাতেও মনে হচ্ছিল বিধ্বস্ত দুটো মানুষ তাকে কালো খনির অন্ধকার থেকে তুলতে এসেছে। এখন সায়নদীপের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে, এই ছেলেটাও কি পূর্বাভাস পেয়েছিল কিছু? নাহলে সেদিনই বা ওরকম ইঙ্গিত করে কি করে?

দগ্ধ দিনের পর বৈশাখের উত্তাপ কমাতে ফিনফিনে বাতাস বইতে শুরু করেছে। বৃষ্টি মাথা নিচু করে জিজ্ঞাসা করল,

—তোমাদের বাড়িতে নাকি দু-তিন বার ডাক্তার এসেছিল? সুধামাসি বলছিল। তোমার মার কি শরীর খারাপ?

—তা জেনে তোমার কি লাভ? নিজের বাড়ির লোকেদের ব্যাপারেই তোমার চিন্তা আছে কোন?

বৃষ্টি মুখ তুলল,—কেন থাকবে? কেউ তো খারাপ নেই।

নিজের কথাতে নিজেই আজ তেমন সায় পেল না বৃষ্টি। যেন কথাটা তার মনের কথা নয়।

সায়নের মুখে বিদ্রূপের হাসি। বৃষ্টি সব সময় এমন হাবভাব করে যেন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মানসিক অবস্থা তার নখদর্পণে। সমগ্র মানুষজাতির সুখের সমুদ্রে বৃষ্টি যেন একাই শুধু নিঃসঙ্গ দুঃখের দ্বীপ।

পার্কের রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়েছে দুজনে। পিকলু রনিরা পার্কের ঘাসে বসে আড্ডা মারছে। বৃষ্টির সঙ্গে সায়নের কথা বলা, মাখামাখি তারা পছন্দ করে না। সায়নের মত ছেলে বৃষ্টির সঙ্গে মিশবে কেন?

সায়ন বলল,—খারাপ নেই? নিজের মা বাবার কতটুকু খবর রাখো? জানো তাদের অবস্থা?

ভেতরে রাগ দপ্ করে উঠলেও বৃষ্টি রাগতে পারল না, —এটা আমার পারসোনাল ব্যাপার নয় কি?

—যখন একটা কলেজে পড়া মেয়ে রোজ রাত দশটায় বাড়ি ফেরে, মাঝে মাঝে টলতে টলতে, তখন ব্যাপারটা পারসোনাল থাকে না। তোমার কি মনে হয়, যখন কোন বাবা মা ড্রাগ নেওয়া মেয়েকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে আসেন, তখনও ব্যাপারটা পারসোনাল থাকে?

বৃষ্টি কোণঠাসা বেড়ালের মত তাকিয়ে। সায়ন ভ্রূক্ষেপও করল না,

—কি এত দুঃখ তোমার? বাবা মার ডিভোর্স হয়ে গেছে? স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকতে পারেননি, আলাদা হয়ে গেছেন। সেটা সম্পূর্ণ তাঁদের পারসোনাল ব্যাপার। এই যে রনির মা বাবা সকাল-সন্ধে দু’জনে দু’জনকে অভিশাপ দ্যান্, এটাই ঠিক? এক সঙ্গে থাকা কি দু’জনে দু’জনকে দুরমুশ করার জন্য?

কোণঠাসা বেড়াল আর সংযত থাকতে পারল না। রাস্তার আলোয় তার ছায়া মৃদু কাঁপছে,—রনির বাবা মা আলাদা হয়ে গেলেই সব সমাধান হয়ে যেত? রনির বাবা আরেকটা বিয়ে করে ফেলতেন আর রনির মা…

—তোমার বাবা আবার বিয়ে করেছেন?

—করেছেন মানে? একটা ছেলেও আছে। মার নেহাত হয়ে ওঠেনি তাই। নইলে আমি ওদের কে? ফালতু।

সায়ন নয়, যেন নিজের সঙ্গে ঝগড়া শুরু হয়েছে বৃষ্টির।

সায়ন বলল,—ও। সেই জন্য তুমি মদ খাও? ড্রাগ নাও? একটা গ্রোন্‌আপ মেয়ে তার এতটুকু বোধ নেই, কোন মানুষই শুধু স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে পারে না। নিজের মত করে আরেকবার জীবনটাকে গড়ে তুলতে চাওয়া অন্যায়? অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে সারা জীবন আপস করে চলতে হলে তার পরিণতি কি হয় জানো? জানো না। আমি জানি। তুমি তো জান আমার বাবা মারা গেছে, কিভাবে মারা গেছে জানো? সায়নের স্বরে উত্তেজনার ছাপ।

বৃষ্টি বলল,—পিকলু রনিদের কাছে শুনেছিলাম। অ্যাক্সিডেন্ট।

—না। পিকলু রনি কিছুই জানে না। আমার বাবা সুইসাইড করেছিল। কেন করেছিল জানো? মায়ের চাওয়ার সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে।

অতর্কিতে ধাক্কা খেয়েছে বৃষ্টি।

সায়নের গলা কেঁপে গেছে,—আমার মাকে তো দেখেছ? মনে হয়নি শান্ত, ঘরোয়া? আমার মা কিরকম ছিল জানো? অত্যন্ত লোভী, স্বার্থপর টাইপ। নিজের সুখ ছাড়া কিছু চিনত না পৃথিবীতে। শুধু টাকা, গয়না, টিভি, ফ্রিজ, ভিসিআর…। মায়ের সঙ্গে তাল দিতে গিয়ে ঘুষ নিতে শুরু করেছিল বাবা। লোভ বাড়তে বাড়তে ক্যাশ থেকে চুরি। ধরাও পড়ল। তারপর অ্যারেস্ট, হাজত, সাসপেনশন্। যেদিন বেলে ছাড়া পেল তার পরের দিনই ট্রেনে গলা দিল বাবা। এরকম বাবা মার ছেলে হয়ে কি করা উচিত ছিল আমার? ছিনতাই? ওয়াগন ভাঙা? মদ? ড্রাগ? তোমার বাবা মা তোমার জন্য ভাবেননি, তাই তোমার এত অভিমান, এত দুঃখ। আর আমার? চোর বাবা আর লোভী মাকে দেখে কি শিক্ষা পেতে পারতাম আমি?

আমূল বদলে গেছে সায়ন। অন্য কেউ যেন সায়নের গলায় কথা বলছে। পূর্বপুরুষের পাপের কথা, অসহিষ্ণুতার কথা, অনুশোচনার কথা, সন্তাপের কথা।

—আমি কিন্তু বাবা মার ওপর রাগ করে বসে থাকিনি। ওই ঘটনার পর মা একদম পাল্টে গেছে, বুঝতে পেরেছে অন্যের ওপর নিজের লোভ লালসা চাপিয়ে দিলে কি হয়। আমার বাবার সেই ডেডবডিটার মুখ আমি এখনও চোখ বুজলে পরিষ্কার দেখতে পাই। সাদা চাদরে ঢাকা শরীর…শ্মশানের হাওয়ায় চাদর উড়তেই বীভৎস মুখ..ক্ষত বিক্ষত…

হঠাৎই নিজের অজান্তে সায়নের হাত চেপে ধরেছে বৃষ্টি। সায়নের চোখের দিকে তাকাবার চেষ্টা করছে।

সায়ন মুখ ঘুরিয়ে নিল,

—আমি তো সেই পুরনো দুঃখ আঁকড়ে ধরে বসে থাকিনি। একটাই তো জীবন মানুষের। সেটাও যদি অন্যের অপরাধের বিচার করতে গিয়ে, প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শেষ করে ফেলি তবে আমার রইল কি? বাবা মার ডিভোর্স হয়ে গেছে বলে তোমার বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে হয়ত অস্বস্তি হয়েছে, এড়িয়ে যেতে চাও তাদের আর আমার বাবার অ্যারেস্ট হওয়ার খবর নিউজপেপারে বেরিয়েছিল। স্কুলে সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে দেখাত। যেমন চিড়িয়াখানায় দেখায় আর কি। একটা বন্ধুও ছিল না আমার। নট এ সিঙ্গল্ ওয়ান। কাউকে মনের কথা বলতে পারিনি। নিজের মাকেও না। এ পাড়ায় এসে তাও দু-একজনের সঙ্গে মিশতে পারি, কথা বলতে পারি। কতটা রাগ হওয়া উচিত ছিল আমার? বাবা মার ওপর?

সূক্ষ্ম সর্ষে দানার মত কষ্ট বুকের ভেতর ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে বৃষ্টির। এই বয়সের একটা ছেলে এক দিনের জন্যও বুঝতে দেয়নি কি ভয়ানক এক অন্তর্দাহের পাহাড় বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সারাক্ষণ! তাই বোধহয় ছায়ার মত পাহারা দিতে চেয়েছে বৃষ্টিকে। তার খারাপ হওয়ার ইচ্ছাগুলোকে। তার যন্ত্রণা পাওয়ার শৌখিন খেলাটাকে।

সায়ন রেলিঙে ভর রেখে নিশ্চল।

ঝুপ করে আলো নিভে গেল। অনেক দিন পর আজ আবার লোডশেডিং! সঙ্গে সঙ্গে নাগরিক অন্ধকার দুটো ছায়াকে আরও আবছা করে দিয়েছে।

বৃষ্টি সায়নের হাতে চাপ দিল,

—আয়াম সরি। আমি জানতাম না।

—জানার তো কথাও নয় তোমার। কিন্তু যাদের তুমি চেষ্টা করলে জানতে পারতে, বুঝতে পারতে তাদেরকেও তো তুমি…বলতে বলতে এক ঝটকায় সায়ন হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। দ্রুত চলে গেছে নিজেদের ফ্ল্যাটবাড়ির ভেতর।

বৃষ্টি তবু দাঁড়িয়ে আছে। টেরও পায়নি কখন চোখে জল এসে গিয়েছে তার। রুমাল বার করে এদিক ওদিক তাকিয়ে মুছে নিল মুখটা। বাড়ির দিকে ফিরছে।

তিন-চার দিন কেটে গেছে। অ্যানুয়াল পরীক্ষার জন্য বৃষ্টিদের ক্লাস বন্ধ হব হব। বৃষ্টি ক্লাসে গিয়ে চুপ করে বসে থাকে, কারুর সঙ্গে তার কথা বলতে ভাল লাগে না। বন্ধুরা তাকে দেখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ফিসফাস করে আড়ালে,

—কি ব্যাপার বল্ তো? সেদিন থানা থেকে কিছু …

সবাই জেনে গেছে সেদিনের ঘটনাটা। রাজীব মারফত শুভই জানিয়েছে। ক’মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া বৃষ্টির আবার কি হল! এ কি কোন নতুন পর্বের সূচনা!

সুদেষ্ণা বলেছে,—থাক গে। ঘাঁটাস না ওকে। কি বলতে কি উল্টোপাল্টা বলে দেবে। যা চণ্ডালের মত রাগ!

দেবাদিত্য বার বার ভেবেছে, তাদের কি কিছুই করার ছিল না? চোখের সামনে মেয়েটা ভুল রাস্তায় চলে গেল! ভেবেছেই শুধু, সাহস সঞ্চয় করে বৃষ্টিকে গুছিয়ে বলতে পারেনি কিছুই। তার ভাবনাগুলো সব ভাবনার স্তরেই থেকে যায়। প্রকাশ করতে গেলেই ঠাট্টা হয়ে পড়ে।

শুভই সাহস করে কথা বলার চেষ্টা করেছিল দু-এক বার।

—তুই রাজীবদের সঙ্গে সেদিন ড্রাগ নিতে গেলি কেন? দেখেছিস্ তো আমিও ওদের অ্যাভয়েড করি আজকাল।

বৃষ্টি শুকনো চোখে তাকিয়ে থেকেছে। সন্ধ্যার আড্ডাটা একবারের জন্যও আকর্ষণ করেনি তাকে। কলেজ থেকে সোজা বাড়ি চলে আসে। বাস থেকে নেমে বার বার এদিক ওদিক তাকায়। পার্কের ভেতরে, বাইরে, রাস্তায়, ফুটপাথে কোথথাও সায়ন নেই। সেদিন হনহন করে বাড়িতে ঢুকে যাওয়ার পর কর্পূরের মত উবে গেছে শহর থেকে।

বৃষ্টি পর দিনই, রাস্তায় না দেখে, গিয়েছিল সায়নকে খুঁজতে।

করবী বৃষ্টিকে আদর করে ডেকেছিল,

—এসো। কেমন আছ তুমি?

বৃষ্টি অবাক। সায়নের মা এমনভাবে কথা বলছিলেন, যেন একদিন নয়, বৃষ্টি তাঁর অনেক দিনের চেনা।

বৃষ্টি করবীকে দেখে ভাবছিল এই সেই মহিলা যার কথা বলতে গিয়ে সায়ন…

—সায়ন নেই?

—না। বুবলু তো আজ সকালেই দিশেরগড় চলে গেল খেলতে। এসো না, ভেতরে এসো।

—না। আজ যাই। বৃষ্টি ইতস্তত করেছিল,—কবে ফিরবে সায়ন?

—ঠিক নেই। আমার শরীর ভাল নেই বলে যেতেই চাইছিল না। ক্লাবের সবাই জোর করল, প্রসপেক্টের ব্যাপার, ওখানে নাকি টাটার স্পটার আসবে।

—আপনার এখন শরীর কেমন?

—এখন আমি ভালই আছি। যাওয়ার আগে শাসিয়ে গেছে, যেন ঘর থেকে না বেরোই। আমিও দিব্যি ছুটি নিয়ে বসে আরাম করছি।

—তাহলে দু-চার দিনের মধ্যে ফিরছে না?

—কে জানে। টিম্ হেরে গেলে হয়ত পরশুই ফিরে আসবে। নইলে আরও কয়েক দিন…

কত দিন? আর কত দিন? বৃষ্টির যে এখখুনি সায়নকে দরকার। হারছে না কেন? হেরেও তো ফিরে আসতে পারে।

বাড়িতে ফিরে বৃষ্টি সারাক্ষণ সায়নের কথাগুলোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। সত্যিই কি বৃষ্টির বেঁচে থাকা, বৃষ্টির জীবন, অন্যেরা তার সঙ্গে কি রকম আচরণ করছে তার ওপরেই নির্ভর করবে? সে কি একটা শিশু? বাবা হাঁটতে হাঁটতে হাত ছেড়ে দিল, সে পড়ে গেল। মা হাত ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল, বৃষ্টি দাঁড়িয়ে রইল। যেন নিজের অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রণের কোন ক্ষমতাই গড়ে ওঠেনি তার!

বৃষ্টির প্রতি দিনই মনে হয় আজ তাকে বাবা ফোন করবে। সুধাকে জিজ্ঞাসা করেছে দু একবার। ভালমামার ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে থেকেছে সন্ধেবেলা। অ্যানুয়াল পরীক্ষা নিয়ে টুকিটাকি আলোচনা করেছে। সব সময় চাপা অস্থিরতা, বাবার ফোন আসবে। টেলিফোন বাজলে চমকে উঠেছে। কার সঙ্গে কথা বলছে মা, ভালমামা বা সুধামাসি?

জয়ার সঙ্গে বৃষ্টি মুখোমুখি হয়েছে খুবই কম। কয়েকবার মনে হয়েছে মা বুঝি কিছু তাকে বলতে চায়। জয়া কয়েক পলক থমকেছে। বৃষ্টিও। তারপর দুজনে দু দিকে চলে গেছে। জয়ার রাতের খাবার সুধা স্টুডিওতেই দিয়ে আসে। এক সঙ্গে টেবিলে বসে খাওয়ার পাট এ বাড়ি থেকে উঠে গেছে।

বৃষ্টির কান্না পায়। মা যেন আর কোনদিনই কথা বলবে না বৃষ্টির সঙ্গে! বাবাও আর জীবনে কখনও ফোন করবে না!

এখন একা একা বৃষ্টিকে সারা রাত শুধু জাগতে হবে।

.

১৮.

থানা থেকে ফেরার পর সব শুনে রীতা যে অত রেগে যাবে সুবীর ভাবতেও পারেনি।

—হল তো? আমি জানতাম ওই মেয়ে বাপ মাকে না ফাঁসিয়ে ছাড়বে না। সুবীর থামানোর চেষ্টা করেছিল। কিচ্ছু ভাল লাগছিল না তার। বৃষ্টি কি ভাবে ঘোলাটে চোখে তার হাত ছাড়িয়ে চলে গেল! এই অভিমান কি শুধু সে মেয়ের সঙ্গে থাকতে রাজি হয়নি বলেই? যদি তাই হয়, তবে তাকে যে কোন একটা জীবন বেছে নিতে হবে। হয় মেয়ের ভবিষ্যৎ, নয় এভাবে ধুকপুক ধুকপুক করে, এক পা জলে ডুবিয়ে, অন্য পা জমিতে রেখে, কোনরকমে বেঁচে থাকা। সারা রাত সেদিন জেগে কাটিয়েছিল সুবীর।

পর দিন সকাল থেকেই ভেবেছে মেয়েকে ফোন করে। বৃষ্টির সঙ্গে তার একবার দেখা হওয়া খুব দরকার। রিসিভার তুলে ডায়াল ঘুরিয়েছে, ফোর সিক্স ফাইভ সেভেন….অর্ধেক নম্বর ঘুরিয়ে থেমে গেছে। মেয়ে যদি ফোন না ধরে। নিশ্চয়ই ধরবে না। ফোন করার আগেই তাকে সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।

সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সুবীর সারাক্ষণ রীতা আর রাজার সামনে বসে রইল। বার বার সে রাজাকে দেখছিল। কী ঘন কালো চোখের পাতা, মায়াকাড়া জাপানী পুতুলের মত মুখ। রীতাও কেমন নিরুদ্বেগ।

সুবীরের সিদ্ধান্তটা বার বার পিছলে যাচ্ছিল। রীতা জয়া নয়। রীতার নিজস্ব কোন চাহিদা নেই, নিজস্ব কোন লক্ষ্য নেই, নিজস্ব কোন স্বপ্ন পর্যন্ত নেই। যা কিছু আছে সবই সুবীরকে কেন্দ্র করে। অথবা রাজাকে। উদ্বেগহীন মানুষকে কি নির্মম আঘাত করা যায়?

আরও কয়েকটা দিন দ্বিধায় কেটে গেল সুবীরের।

রীতাও বোধহয় কিছু আঁচ করতে পারছিল। কদিন ধরেই সুবীর কি যেন ভাবে সর্বক্ষণ। যেন কিছু বলতে চায়, বলতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত রীতা ধৈর্য রাখতে পারল না,

—কি ভাঁজছ বলো তো কদিন ধরে?

সুবীরের দৃষ্টি শূন্য।

রীতা আবার প্রশ্ন করল,

—কি চাও বলো তো পরিষ্কার করে?

সুবীর হঠাৎই মরিয়া। যদি রীতাকে রাজি করানো যায়।

—মানে বলছি আর কি, তুমি যদি মাস দুয়েকের জন্য রাজাকে নিয়ে বাপের বাড়িতে ঘুরে আসো…

—কেন?

—না, এমনিতেও তো রাজার বড় একটা মামারবাড়িতে যাওয়া হয় না। আমি সে কদিন বৃষ্টিকে এখানে এনে, মানে এই দুমাসে…. মেয়েটার নেশা টেশা যদি ছাড়ানো যায়……

রীতা হতবাক মুখে সুবীরের দিকে তাকিয়ে রইল। সে ঠিক এই কথা একদম আশা করেনি। ছ বছরেও মানুষটা তার আপন হল না। কত নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করল কথাটা। যে নিঃসঙ্গ সুবীরকে সে বিয়ে করেছিল, তার অনুরাগ, আবেগ সব মরে ভূত হয়ে গেছে। ছোটবেলায় দেখা শীতকালের হুড্রু ফলসটার কথা মনে পড়ল রীতার। এক গভীর নিঃস্ব জলপ্রপাত। জলের দাগ আছে, অস্তিত্ব নেই। সে না হয় এখন ব্যবহার করা একটা পুরনো শরীর। কিন্তু রাজা! রাজাকেও তেমন করে সুবীর ভালবাসতে পারল কোথায়! বৃষ্টিই সবটুকু জুড়ে বসে আছে। বৃষ্টি! না বৃষ্টির মা! মেয়ের মধ্যে দিয়ে সুবীর বোধহয় এখনও মাকেই খোঁজে। এ নিয়ে যুদ্ধ করা ছায়ার সঙ্গে লড়তে যাওয়ারই সামিল। ছায়াকে যুদ্ধে জিততে দেবে না রীতা।

রীতা মুখ ভাবলেশহীন রাখার চেষ্টা করল,

—কবে যেতে হবে? কাল, না আজই?

সুবীরের মুখে মুহূর্তের জন্য রঙমশাল জ্বলে উঠল। রীতা এত সহজে রাজি হবে ভাবতেও পারেনি। সুবীর রীতার হাত জড়িয়ে ধরল,

—তুমি… তুমি আমাকে…..

রীতা হাত ছাড়িয়ে নিল।

—আজ গোছগাছ করে নিই, কাল সকালেই চলে যাব।

সত্যি সত্যি রীতা জামাকাপড় গোছানো শুরু করল সে রাত্রেই। নিজের শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ, স্যুটকেসে থাক থাক সাজাল, ছেলের জামাকাপড় একটা একটা করে ভাজ করে তার ওপর। ওইটুকু ছেলে কি বুঝল কে জানে, সাঁড়াশির মত আঁকড়ে ধরে আছে রীতাকে। বাবার দিকে সভয়ে তাকাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে লুকিয়ে পড়ছে মার পিছনে।

সুবীরের বুকটা মুচড়ে উঠল। একি দেখছে সে! রাজা তো নয়, যেন বৃষ্টি জয়াকে আঁকড়ে ধরে আছে। মেয়ের চোখে আতঙ্ক।

পলকে সুবীরের কি যে হয়ে গেল। মনে হল ভীষণ জোরে কেউ মুগুর চালাচ্ছে তার বুকে। সেই আঘাত তীব্র যন্ত্রণা হয়ে কাঁকড়াবিছের কামড় বসাল হৃৎপিণ্ডে। গলগল করে সুবীর ঘামতে শুরু করল। বুক চেপে কোনক্রমে বসে পড়ল বিছানায়।

রীতা প্রথমটা খেয়াল করেনি। রাজা ডুকরে ওঠায় চমকে তাকাল,

—একি! কি হল তোমার! অত ঘামছ কেন?

সুবীরের মুখ থেকে অস্ফুট কিছু শব্দ ছিটকে এল। অনেক কষ্টে বুকটাকে দেখাতে পারল শুধু।

রীতা কম্পিউটারের গতিতে মস্তিষ্কে ছকে ফেলল তাকে এখন কি কি করতে হবে। প্রথমেই ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে ফোন করল। এখখুনি আসুন।

ডাক্তার এসেই ই সি জি করল। অ্যাটাক তত মারাত্মক নয়। হৃদয়ে ধাক্কা লাগলেও প্রাচীর এখনও অক্ষত। বেশ কয়েক দিন বিশ্রাম প্রয়োজন। টোটাল বেডরেস্ট। শরীর ও মনের। ডাক্তারবাবুর মতে ওয়াচে রাখার জন্য এখন কিছুদিন নার্সিংহোমই নিরাপদ।

রীতা ঠিক এই আশঙ্কাটাই করছিল। যেভাবে মনের ভেতর উত্তাল ঝঞ্ঝা চলছে সুবীরের! ভয়ঙ্কর রাগ হল বৃষ্টি আর জয়ার ওপর। সুবীরকে মেরে না ফেলা পর্যন্ত ওদের বোধহয় শান্তি নেই।

মস্তিষ্কের ছক মতই প্রথম দিন খবর দিল না বৃষ্টিকে। বাপের বাডিতে টেলিফোন করল, ন্যায়রত্ন লেনের বাড়িতে খবর পাঠাল বিজয়কে দিয়ে। ছোট বোন আর মা খবর পেয়েই তার কাছে চলে এসেছে, বাবা ভাই নার্সিংহোমে দৌড়াদৌড়ি করছে, বোন অফিস কামাই করে দু দিন ধরে সামলালো রাজাকে। প্রবীর, প্রবীরের বউও ছুটে এসেছিল সঙ্গে সঙ্গে।

সুবীর কোন সময়ই পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। কড়া ট্রাংকুলাইজার তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে মাত্র। ঘুম ভাঙলেই তার চোখ কাউকে খুঁজছে। রীতা হাঁ হাঁ করে উঠছে,

—উঁহু, কোন কথা নয়। এখন একদম কথা নয়। পরে সব শুনব। প্লিজ।

রীতার বাবা বললেন, —হ্যাঁরে, এরকম হঠাৎ কেন হল রে! এত সুস্থ সবল ছিল!

প্ৰবীর বলল,—সেদিন অফিসেই ওর মুখচোখ আমার ভাল লাগেনি। আমি জানতাম একটা কিছু…..

রীতার একবার মনে হল বাবাকে সব কথা খুলে বলে। পারল না। তার স্বামী আগের পক্ষের মেয়ে নিয়ে বিষম সমস্যায় আছে, তাকে চলে যেতে বলছে। বাড়ি ছেড়ে, এ কথা বলে বেড়ানো তার পক্ষে খুবই অপমানজনক। আত্মমর্যাদা নেই তার? বিয়ের ছ বছর পর বাবা মাকে কি বলা যায় কি ভয়ঙ্কর নিরাপত্তার অভাব বোধ করে সে? হয় ওই মেয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে সুবীরকে, নয়ত মানুষটা নিজের আগুনে নিজেই দগ্ধে মরবে যার পরিণাম হবে এইরকম। এই ভবিতব্যই কি তার ভাগ্যে লেখা ছিল?

সুবীরকে অবশ্য আটচল্লিশ ঘণ্টার বেশি ভুলিয়ে রাখতে পারল না রীতা। তৃতীয় দিনই সুবীর প্রশ্ন করল,

—বৃষ্টি আসেনি? বৃষ্টিকে খবর দিয়েছ?

কি নিষ্ঠুর লোক। রাজা নয়, সুবীর বৃষ্টিকে খুঁজছে। রীতা অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো,

—কাল সবাই খুব ব্যস্ত ছিল তো, তাছাড়া তোমার অফিসের লোকজন এসে গেল অনেক, আজ ফোন করে দেব।

কথাটা বলেই রীতা বুঝল সে ধরা পড়ে গেছে। সুবীর তার দিকে নিনিমেষ তাকিয়ে। রীতা অফিসে ফোন করেছে, নিজের বাবা মাকে ডেকেছে, প্রবীরদেরও খবর পাঠিয়েছে, শুধু বৃষ্টিকেই…..

রীতার মা বললেন,—ঠিকই তো, মেয়েটাকে খবর দিসনি তুই?

রীতা কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে রইল। তারপর ফোন করল নার্সিংহোম থেকেই।

টেলিফোন পেয়ে বাবলু প্রথমে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করল। সুবীরদার মত প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষের হার্ট অ্যাটাক! একটু সময় নিয়ে প্রশ্ন করল,

—কবে হয়েছে বললেন? তিন দিন আগে?

—হ্যাঁ, …মানে ডাক্তাররা বলছিলেন খুব একটা ভয়ের কিছু নেই তাই….. হয়ত দু-চারদিনের মধ্যে ছেড়েও দেবে।

বাবলু ফোন রেখে কয়েক মিনিট চুপ করে চিন্তা করল। খবরটা কাকে আগে দেবে? জয়া? না বৃষ্টি? বৃষ্টি এখন অনেকটা শান্ত হয়েছে তবু কিভাবে সে খবরটাকে নেবে কে জানে!

বাবলু হুইল চেয়ার চালিয়ে জয়ার ঘরেই ঢুকল।

.

১৯.

বৃষ্টির হাত বুকে চেপে চুপ করে শুয়ে আছে সুবীর। বাথাটা তার এখন অনেক কম।

গতকাল সকালেই টেলিফোন পেয়ে বৃষ্টি উদ্‌ভ্রান্তের মত ছুটে এসেছিল নার্সিংহোমে। করিডোরে দাঁড়িয়ে রীতা তখন কথা বলছিল প্রবীরের সঙ্গে। রীতার চোখের নীচে কাজলের চেয়েও ঘন কালো দাগ, দেখেই বোঝা যায় তার ওপর দিয়ে একটা বড় সড় ঝড় বয়ে গেছে। প্রবীরের হাতে ছোট্ট একটা প্লাস্টিক ব্যাগ। মুখে অশান্ত উদ্বেগ। প্রবীর উত্তেজিত ভাবে বলছিল,

—কেন, এখনও লিকুইড্ ডায়েট কেন? ডাক্তার তো কাল বলছিলেন এবার একটু একটু করে… মা সেই জন্যই তো গলা মুরগি পাঠিয়ে দিল। এটা দিতে অসুবিধে কি আছে?

রীতা কিছু বলতে যাচ্ছিল, সামনে হঠাৎ বৃষ্টিকে দেখেই সে ত্ৰাসতাড়িত।

বৃষ্টি চঞ্চল চোখে তাকাল,

—কেমন আছে বাবা?

রীতা তাড়াহুড়ো করে বলে ফেলল,—একটু বেটার। তুমি যাও না ভেতরে গিয়ে দেখে এসো। এমন ভাবে বলল যেন বৃষ্টি চোখের সামনে থেকে সরে গেলেই সে বাঁচে।

প্রবীর নির্বাক হয়ে দেখছিল বৃষ্টিকে। কত দিন পর দেখল তাদের বাড়ির মেয়েটাকে? প্রায় ন দশ বছর। সময় কি দ্রুত সব বদলে দেয়! শুককীট থেকে রঙিন প্রজাপতি ডানা মেলেছে। প্রবীরের হঠাৎই মনে হল, এ মেয়েকে বোধহয় তাদের ন্যায়রত্ন লেনের গলিতে মানাতও না। ওখানে আলো বাতাস এত কম!

বৃষ্টি ততক্ষণে পর্দা সরিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়েছে। ঢুকতেই নাকে মৃদু ওষুধের গন্ধ। সাদা চাদরে ঢাকা সুবীরের লম্বা ফর্সা শরীর যেন বিছানায় নিষ্প্রাণ, মুখ জানলার দিকে ফেরানো। আকাশ দেখছে। টানা পর্দার ফাঁক দিয়ে, কাঁচের শার্সির ওপারে, যতটা আকাশ দেখা যায় ততটুকুই। গোটা আকাশটাকেই যে হাতের মুঠোয় ধরতে চেয়েছিল, তার ওইটুকু আকাশের ফালিই সম্বল এখন।

খুব আস্তে, যেন দেওয়ালও না শুনতে পায়, এভাবে ডেকেছে বৃষ্টি,

—বাবা…

সুবীরের মুখ ঘুরল, এক পলক খুঁজল শব্দের উৎসকে, তারপরেই বৃষ্টির দিকে চোখ আটকেছে। সঙ্গে সঙ্গে বুক উথলে উঠেছে তার। পরক্ষণেই প্রবল ভয়ের আলোড়ন। মুখ বিকৃত হয়ে গেল, দাঁতে ঠোঁট কামড়ে, সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চেষ্টা করল সুবীর।

বৃষ্টিও আতঙ্কে জমে গেছে। কয়েক সেকেন্ড। তারপরই ছুটে এসেছে বাইরে,

—তাড়াতাড়ি এসো, বাবা কিরকম করছে!

প্রবীর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটেছিল ডাক্তারকে খবর দিতে। রীতা ধড়মড় করে সুবীরের কেবিনে। তার মিনিটখানেকের মধ্যেই নার্স। কর্তব্যের সঙ্গে বিরক্তির ঝাঁঝ মিশিয়ে বলেছিল,

—আপনারা বাইরে দাঁড়ান। ডক্টর আসছেন।

বাইরে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি আর রীতা। পাশাপাশি। দুজনের মনেই তখন এক চিন্তা, তবু দুজনের মন যেন কত আলোকবর্ষ দূরে। দুজনেই চায় কেবিনের ভেতরের মানুষটা ভাল হক, সুস্থ হক, একজনের বুকে অজানা ভবিষ্যতের জন্য একরাশ আশংকা, অন্যজনের মধ্যে জমে থাকা অপরাধের গ্লানি। বৃষ্টির মনে হচ্ছিল, সেই কি তবে তার বাবার একমাত্র মানসিক চাপ? সে আসতেই রীতাও কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেল, যেন বৃষ্টি একটা হিংস্র জন্তু। বাঘের হাত থেকে গ্রামের লোক যেভাবে নিরীহ গরু ছাগল বাঁচায়, সেভাবেই রীতা যেন আগলে রাখতে চায় সুবীরকে।

রীতাকে দোষ দিতে পারল না বৃষ্টি। গত কয়েক মাসের উন্মত্ত আচরণের প্রতিটি দৃশ্যই তার চোখের সামনে। দিনের পর দিন অত্যাচারের শাবল চালিয়ে সেই তো রীতার শক্ত মাটিটাকে আলগা করে দিয়েছে। নাহলে রীতা সুবীরের স্ট্রোক হওয়ার তিন দিন পরে খবর দেয় তাকে! এই মহিলার ওপর বিদ্বেষ আর ঈর্ষা ছাড়া আর কোন অনুভূতি ছিল না বৃষ্টির। কিন্তু ঈষা আর বিদ্বেষ থেকে সত্যিই কি কিছু পাওয়া যায়! বৃষ্টি কি পেল!

প্রবীরের সঙ্গে হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তার ঢুকলেন ঘরে। বৃষ্টির কনুই-এর কাছে হাতের চাপ। রীতা নিজের অজান্তেই বৃষ্টির হাত আঁকড়ে ধরেছে। খরস্রোতা নদীতে ডুবন্ত মানুষ যেভাবে ভাসমান কচুরিপানাকেও খামচে ধরে।

নিজের মনের আশঙ্কা ছাপিয়ে হাতটার অসহায়তা ছুঁয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টিকে। এখ্‌খুনি যদি সুবীরের কিছু হয়ে যায়, যতই কষ্ট হক, কতটুকুনি বিপদ হবে বৃষ্টির? তার নিজস্ব আশ্রয় আছে, খাওয়াপরার চিন্তা নেই, মাকে যতই নির্লিপ্ত মনে হোক সেই মা মাথার ওপর ছাতার মত রয়েছে, রীতার কি আছে? অভ্যস্ত সুখের জীবন ছেড়ে রাজাকে নিয়ে কিভাবে কাটাবে বাকি জীবনটা? রীতার বাবা মার অবস্থা ভাল নয়, নিজের চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছে, জয়ার মত বিশেষ কোন গুণও নেই তার। হাতটা যেন এই সব কথাগুলোই বলতে চাইছিল বৃষ্টিকে। শিকড়-ওপড়ানো অসহায়তার কাছে নিজের কষ্ট, অভিমান সব কিছুই কি ক্ষুদ্র মনে হল বৃষ্টির। সে কি তবে সেই কাশীর মহিষী করুণা যে নিজের শীত কমাতে অন্যের ঘরে আগুন লাগিয়ে উত্তাপ জোগাড় করতে চেয়েছিল!

বৃষ্টিও নিজের অজান্তে হাত রেখে ফেলেছিল রীতার হাতে,—চিন্তা কোরো না, বাবা ভাল হয়ে যাবে।

মিনিট দশেক পর ডাক্তার আর প্রবীর বেরিয়ে এল,

—ঘাবড়াবার কিছু নেই, সাডেন টেনশন থেকে একটা এক্সাইট্‌মেন্ট্ এসেছিল, সিডেটিভ দিয়েছি, এখন ঘুমোবেন কিছুক্ষণ।

প্রবীর এসে বৃষ্টির মাথায় হাত রাখল,—আমাকে চিনতে পারছিস্? আমি তোর জেঠু।

চিনেছে বৃষ্টি। কিছু কিছু মানুষকে চিনিয়ে দেওয়ার দরকার হয় না। দেখলেই চিনে ফেলা যায়। বাবার সঙ্গে মিলও আছে অনেক। অতটা লম্বা ছিপছিপে না হলেও মুখের ধাঁচ একই ধরনের। একই রকম গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি।

বৃষ্টি নিজেও বুঝতে পারল না কেন যে চোখে আচমকা জল এসে গেল তার। একেই কি তবে নিকটজনের টান বলে?

প্ৰবীর বলল,—মন খারাপ করছিস কেন? তোকে দেখে সুবু একটু বেশি খুশি হয়েছিল তো…

খুশি, না ভয়? বাবার সেই ভয়ার্ত মুখটা বৃষ্টির বুকে গেঁথে গেছে। বোধহয় চিরজীবনের মত।

সেই মুখ এখন অনেক শান্ত, স্বাভাবিক। মাঝে মাঝে ঠোঁট দুটো অল্প নড়ে উঠছে। আলগা তন্দ্রায় ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখছে সুবীর।…একটা বাচ্চা ছেলে শ্যামবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞাপনের নিয়ন বাতি দেখছে। জ্বলছে নিভছে বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপন… বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং বদলে হয়ে গেল স্কুলের ক্লাস। বাংলা ক্লাসে অমূল্যস্যার লিখতে দিয়েছেন, বড় হয়ে তোমরা কে কি হতে চাও। বাচ্চা ছেলেটা লিখেছে, বড়লোক হব, অনেক বড়লোক। মাস্টার মশাই বলছেন, প্রথমে টাকাটাই চিনলি রে বাপ? পড়াশুনো করে আগে কিছু তো একটা হ, তারপর বড়লোক হবি।…ক্লাসশুদ্ধ সবাই হাসছে। সব্বাই। … দৃশ্য বদলে গেল। ছেলেটার কাঁধে পাউডার লিপস্টিকের ব্যাগ, জ্যাম জেলি আচারের শিশি, ওষুধে ভরা ভারী ব্রিফকেস্‌…দৌড়চ্ছে, দৌড়চ্ছে, দৌড়চ্ছে…অসংখ্য গলিখুঁজি…হঠাৎ একটা চওড়া রাস্তার মোড়ে জয়া। রাস্তাটা ঘন সবুজ, রাস্তার দুদিকে মৃতদেহের স্তৃপ ..জয়া আর সুবীর দুজনে মিলে দৌড়ল কিছুক্ষণ। তারপর অন্য রাস্তায় চলে গেল জয়া, সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে, আধফোটা ফুলের মত। বৃষ্টি।…আবার দৌড়। এবার পাশে রীতা, রাজা…কোন কোন মোড়ে আচম্বিতে দেখা হচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে। অজানা বাঁকে এসে এক পলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টি। …আবার দৌড়…রীতা, রাজা…জঙ্গলের গাছপালার ফাঁকে বৃষ্টির মুখ…নদীর জলে ভেসে উঠল বৃষ্টির মুখ…সেই ছেলেটা ছুটতে ছুটতে আয়নায় দেখা সুবীরের মত পুরোদস্তুর লোক হয়ে গেছে…হঠাৎ তার মুখটা একটা ঘোড়ার মুখ হয়ে গেল…আবার সুবীর… বৃষ্টি নেই, রীতা নেই, রাজা নেই…ঘোড়া একা দৌড়চ্ছে সরু গলি দিয়ে…ন্যায়রত্ন লেনের গলি, অন্তহীন গলি..গলি ক্রমশ অন্ধকার হচ্ছে…ঘোড়ার মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠছে..হাঁটু ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ঘোড়া…

সুবীর চোখ খুলল।

বৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকেছে,

—কিছু বলবে?

সুবীর দু’দিকে মাথা নাড়ল।

—কি অসুবিধে হচ্ছে?

—একটু জল খাব।

মাথার পাশের টেবিলে রাখা কাটগ্লাসের জগ থেকে বৃষ্টি জল গড়িয়ে দিল। সুবীর দু চুমুক খেল মাত্র। আবার চোখ বুজেছে।

—তোর মাকে একটা কথা বলতে পারবি?

বৃষ্টি স্থির চোখে তাকাল সুবীরের দিকে।

—তোর মার সমস্ত ইজেল, ক্যানভাস, রঙ, তুলি আমি ফেরত পাঠিয়েছিলাম তবু একটা স্কেচ আমার কাছে রয়েই গেল। আমাকে এঁকেছিল তোর মা। পার্ক স্ট্রিটের পুরনো কবরখানায় বসে। আমাদের প্রথম পরিচয়ের দিন।

বৃষ্টিকে কেউ যেন সমূলে নাড়িয়ে দিল। বাবা মার সম্পর্ক নিয়ে তার এতদিনকার ধারণা, বিশ্বাস চিড় খেয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কের সব সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার পরও এ কোন্ গ্রন্থিতে বাঁধা পড়ে আছে তার বাবা মা! গ্রন্থিটা কি বৃষ্টি!

নাকি আরও গভীর কোন চেতনা! বৃষ্টি বুঝতে পারছে না।

কাল রাত্রে নার্সিংহোম থেকে ফিরবার সময় দেখেছিল মা ছাদে অন্ধকারে একা দাঁড়িয়ে। তাকে দেখেই নীচে নেমে এসেছিল। ভালমামা তখন তাকে জিজ্ঞাসা করছে,

—কেমন আছে এখন সুবীরদা? কি দেখে এলি?

ভালমামার গলায় উৎকণ্ঠা। তবে তার থেকেও বেশি উদ্বেগ যেন মার মুখে। বৃষ্টির চোখে চোখ পড়তেই মা মুখ ঘুরিয়ে নিল। নিজের মুখোশপরা ছবির মানুষগুলোর মতই লুকিয়ে ফেলল নিজেকে।

বৃষ্টি বলেছিল,—এখন একটু বেটার। ডাক্তার তো বলছেন ভয়ের কিছু নেই।

মা নিঃশব্দে ঢুকে গিয়েছিল নিজের ঘরে। বৃষ্টি বুঝেছিল তার জন্য নয়, তার উত্তরটা শোনার জন্যই এতক্ষণ ছাদে দাঁড়িয়েছিল মা।

অনেক রাত অবধি বিছানায় ছটফট করেছিল বৃষ্টি। সায়নদীপই ঠিক। শুধু একটা দৃষ্টিকোণ থেকে কোন সম্পর্ককেই বিচার করা যায় না। করাটা বোকামি। প্রতিটি মানুষই কোন এক নির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে নিজের কাছেই অসহায়। বাবা মার ঝগড়া, হিংস্রতা, একসঙ্গে থাকতে না পারা যতটা সত্যি, ততটাই সত্যি অন্ধকার ছাদে মার একা দাঁড়িয়ে থাকা অথবা বাবার কাছে গোপনে থাকা মার পুরনো স্কেচ্।

বৃষ্টি খাট থেকে নেমে পড়েছিল। শৈশবের মত কখন পায়ে পায়ে ছাদে উঠে গেছে টেরও পায়নি।

জয়ার স্টুডিওতে এখন প্রায় সারা রাতই আলো জ্বলে। বেশির ভাগ দিন স্টুডিওতে পাতা ক্যাম্বিসের খাটেই ঘুমিয়ে পড়ে জয়া। নীচে আর নামে না।

বৃষ্টি কাচের শার্শিতে চোখ রেখেছিল। চতুর্দিকে রঙের দোয়াত, টিউব, তুলি ব্রাশ নিয়ে জয়া ক্যানভাসের সামনে নিথর বসে।

অনেকদিন পর স্টুডিওটাকে দেখছিল বৃষ্টি। ধুলোপড়া কয়েকটা ক্যানভাস কোণে জড়ো করা। দেওয়ালের পিঠে অবহেলায় পড়ে বহুদিন আগের পেন্টিং। কন্টি পেনসিলগুলো ঘরময় গড়াগড়ি খাচ্ছে। জয়া কি ঝকঝকেই না রাখত তার স্টুডিওটাকে!

বৃষ্টি দেখল মার সামনে রাখা ক্যানভাসে একটা দুটো রঙের আঁচড় পড়েছে মাত্র! রঙ তুলিতে কি যেন ধরতে চাইছে মা; পারছে না।

কতক্ষণ যে দাঁড়িয়েছিল বৃষ্টির মনে নেই। হঠাৎ মা তাকিয়েছে তার দিকে। প্রথমে দৃষ্টি দূরমনস্ক, দেখছে কিন্তু দেখছে না। ক্রমে চোখ পলকহীন। সেই পলকহীন চোখ ভেদ করে চলে গেল বৃষ্টিকে। সেই দৃষ্টির টানে বৃষ্টি কখন ঢুকে গেছে স্টুডিওতে। দুজনে পাশাপাশি বাক্যহীন বসে রইল। দীর্ঘক্ষণ।

জীবন তো একটাই। সেই জীবন কতভাবেই না ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে মানুষ। জীবনের মানে খুঁজছে। নিজেদের মত করে। জয়া, সুবীর, রীতা, ফিরোজ, নিখিল, শিপ্রা, বৃষ্টির বন্ধুবান্ধব। সায়নদীপও। অন্যের ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে বৃষ্টিই শুধু হারিয়ে ফেলছিল নিজেকে।

সুবীর আবার চুপ করে শুয়ে আছে। বৃষ্টি তার মাথায় হাত রাখতে গেল। ঠিক তখনই রীতা এসেছে। সঙ্গে রাজা। বৃষ্টিকে দেখেই রাজা মুহূর্তে ভয়ে কাঠ। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। ফর্সা মুখ আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে।

বৃষ্টি হাসার চেষ্টা করল।

রাজা একটুও ভরসা পেল না। মাকে আঁকড়ে ধরে আছে।

বৃষ্টির চোখ ঝাপসা হয়ে এল। রাজার মুখ আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। বদলাতে বদলাতে কখন বৃষ্টির মুখ হয়ে গেল। সেই ছোট্ট বৃষ্টি! মার হাত চেপে ঠকঠক করে কাঁপছে। বাবা ফিরেও তাকাচ্ছে না।

বৃষ্টি আর দাঁড়াল না। মন্থর পায়ে বেরিয়ে এল নার্সিংহোম থেকে। বিকেল ফুরিয়ে আসছে। এবার বৃষ্টির জনসমুদ্রে একলা হাঁটার পালা। বৃষ্টিকে পাশে রেখে একটা লম্বা মিছিল চলে গেল। আর চারদিন পরে ভোট। বৃষ্টি এবার প্রথম ভোট দেবে।

সন্ধ্যা নামল শহরে। রাস্তার বাতিগুলো সব একে একে জ্বলে উঠেছে। সায়নদীপ।

সায়নদীপ এখনও দিশেরগড়ে। জিতছে। অবিরাম জিতছে! সায়ন হারতে জানে না। তার জন্য এই শহরে অপেক্ষা করছে বৃষ্টি। একজন দুঃখী মানুষই শুধু তার বন্ধু হতে পারে এখন।

হৃদয়ের জমা কষ্ট হৃদয়েই রয়ে গেল। থাক। অভিমান আর যন্ত্রণার দানা না হয় মুক্তো হয়েই জমা থাক বুকে। রাজা ভাল থাকুক।

আর একটাও বৃষ্টি যেন তৈরি না হয় কোথ্‌থাও।

——

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *