১৪. আরো কিছু চিন্তা–ভাবনা
সবার জীবনেই সমস্যা আছে। সমস্যা যেমন আছে তেমনি তার সমাধানের রাস্তাও। খোলা আছে। এই বই পড়ে আপনি আরো কিছু রাস্তা খুললেন, যেগুলো ব্যবহার করে আপনার অনেক সমস্যার সমাধান বের করতে পারবেন। এই বইয়ের এক থেকে বারো নম্বর পরিচ্ছেদের লক্ষ্য হলো, নিজের এবং অন্যান্যদের সমস্যা সমাধানে আপনার মনকে বিশেষ ভঙ্গিতে ব্যবহার করা শেখানো। আপনি এই বইতে যা পড়লেন তা একা। কোনো এক ব্যক্তির গবেষণার ফসল নয়। অনেক পণ্ডিত কঠোর পরিশ্রম করে যে সব সিদ্ধান্তে পৌচেছেন তারই নির্যাস এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার, এই বইয়ে এমন অনেক জিনিসও আপনি পড়েছেন যা একজন গবেষকের ত্রিশ বছর একটানা পড়াশোনা এবং কঠোর সাধনার ফসল।
যুগের সাথে সাথে দর্শন এবং বিশ্বাস পাল্টে যায়। মানুষ, মানুষের অস্তিত্ব, তার ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে নতুন নতুন ধারণার জন্ম হচ্ছে। কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, আমরা যারা এই পৃথিবীতে বসবাস করছি তাদের উন্নতির সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমে আসছে এবং খুব তাড়াতাড়ি এমন একটা সময় আসছে যখন আর উন্নতি করার কোনো উপায়ই থাকবে না, যদি উন্নতি করার নতুন কোনো পদ্ধতি আমরা খুঁজে বের না করতে পারি। এসব বিষয়ে এবং অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা সম্পর্কে মহাজনেরা কি ভাবনা-চিন্তা করছেন তাই নিয়ে আলোচনা করবো এই পরিচ্ছেদে।
মন-নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাঁদের কাছে সবচেয়ে যেটা আশ্চর্য বলে মনে হয়েছে, সেটা হচ্ছেঃ এই বিদ্যার সাথে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। এরা যা উদ্ভাবন বা আবিষ্কার করেছেন তার সাথে শুধু ধর্মের নয়, বিশ্বজনীন আবেদন আছে এমন কোনো দর্শন বা বিশ্বাসেরও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। বোধহয় সেজন্যেই বিদ্যাটা শেখার জন্যে হিন্দু-মুসলমান, খ্রীস্টান বৌদ্ধ সহ প্রায় সব ধর্মের লোকের মধ্যেই আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
এর মানে কি তবে এই যে যে-সব টেকনিক উদ্ভাবিত হয়েছে সেগুলো খারাপও নয় ভালোও নয়–মালটিপ্লিকেশন টেবিলের মতো? এসব প্রসঙ্গে পণ্ডি ত ব্যক্তিদের কিছু দৃঢ় বিশ্বাস আছে, সেগুলো এখানে আমরা প্রশ্নোত্তরের আকারে পরিবেশন করবো। এ থেকে অনেক কিছুই হয়তো আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। অন্তত এসব যে আপনাকে চিন্তার খোরাক যোগাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কি আইন আছে? –অবশ্যই, বিজ্ঞান সেগুলো আবিষ্কার করছে।
২। এই আইন কি আমরা ভাঙতে পারি?–না। পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দিলে আমরা মারা পড়বো, কিংবা আহত হবো। আইন ভাঙে না– ভেঙে যাই আমরা।
৩। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কি নিজের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে? –আমরা জানি অন্তত তার একটা অংশ পারে–আমরা। তাহলে কি এটা ধরে নেয়া অসঙ্গত হবে যে গোটা ব্রহ্মাণ্ডই তা পারে?
৪। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কি আমাদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত? –তা কিভাবে সম্ভব। আমরা তো। তারই একটা অংশ, এবং সে আমাদেরকে প্রভাবিতও করে।
৫। আমরা মূলত ভালো না মন্দ? –আমরা যখন নিজেদের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসিধ্যানমগ্ন অবস্থায়–ভালো ছাড়া কারো কোনো ক্ষতি করার শক্তি আমাদের থাকে না।
বাস্তবতার অনেক সংজ্ঞা আছে। তার মধ্যে একটা, বাস্তবতা হলো একটা স্বপ্ন যা আমরা সবাই দেখছি। বাস্তবতা আসলে কি, এ-সম্পর্কে আমাদের ধারণা একেবারেই অস্পষ্ট। আমরা যা উপলব্ধি করি, যে ভাবে দেখি, বেশিরভাগই নিজেদের সুবিধে মতো। দূরের কোনো জিনিস আসলেই ছোটো নয়, এবং নিরেট কোনো জিনিসই আসলে নিরেট নয়।
সব কিছুই এনার্জি। একটা রঙ আর একটা শব্দের সাথে, কসমিক রে. আর টি . ভি, র ছবির সাথে পার্থক্য হলো ফ্রিকোয়েন্সি–কিংবা এনার্জি কি করছে এবং কতো দ্রুত করছে।
এনার্জি সম্পর্কে একটা মজার ব্যাপার হলো, বৈপরীত্যের এই জগতে–উঁচু-নিচু, সাদা-কালো, দুত-মন্থর–এনার্জির উল্টো কিছু নেই। এর কারণ, জগতে এমন কিছু নেই যা এনার্জি নয়। আমি আপনি সহ সবকিছু, এবং আমরা যা চিন্তা করি তাও, সমস্তই এনার্জি। চিন্তা করতে গেলেও এনার্জি লাগে। চিন্তা এনার্জি খরচও করে, আবার তৈরিও করে।
এবার বোধহয় আমরা দেখতে পাচ্ছি, কোনো কোনো পণ্ডিত চিন্তা আর বস্তুর মধ্যে কেন মাত্র অল্প একটু পার্থক্য দেখতে পান।
চিন্তা কি বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারে? কেন পারবে না, এনার্জি তো পারে।
চিন্তা কি ঘটনাকে প্রভাবিত করতে পারে? –কেন পারবে না, এনার্জি তো পারে।
সময় কি এনার্জি? –এর উত্তর দেয়া কঠিন, কারণ সময় একটা নয়, অনেকগুলো মুখ নিয়ে রয়েছে আমাদের সামনে। এক দিক থেকে তার পানে তাকান, আপনার মনে হবে ওটাকে আপনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন, তারপর আরেক দিক থেকে তাকান, মনে হবে এ তো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।
সময় সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই, একে আমরা ভাগ করে নিয়েছি নিজেদের সুবিধে মতো। এই ভাগ যদি না করা হতো, দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে উঠতো আমাদের। আমরা ধরে নিয়েছি সময় একটা সরলরেখা ধরে ছুটছে, অতীত থেকে শুরু করে, বর্তমান হয়ে, ভবিষ্যতের দিকে। সময়কে এই ভঙ্গিতে ভাগ করে নিয়ে চিন্তা করলে যা ঘটে গেছে সেগুলোকে অতীত বলে চিহ্নিত করতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি বর্তমানকে, এবং বুঝতে পারি এরপর যা ঘটবে তা ভবিষ্যতের অন্ধকারে লুকিয়ে আছে।
কিন্তু অন্য পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপারটা তা নয়। আলফা এবং থিটায় আমরা শুধু অতীতকে দেখতে পাই না, দেখতে পাই ভবিষ্যৎকেও। যে ঘটনা ঘটেনি কিন্তু ঘটবে। তার ছায়া পড়ে আগেই, ট্রেনিং নেয়া থাকলে সে ছায়া আমরা দেখতে পাবো।
আলফা আর থিটা থেকে ভবিষ্যৎকে যদি এখানে এখনই দেখতে পাওয়া যায়, তারমানে ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই কোনো এক ধরনের এনার্জি সামনের দিকে পাঠাচ্ছে, যার আঁচ আমরা ওই লেভেলগুলোয় থাকলে পাই। ভবিষ্যৎ সময়ের একটা রূপ, সে যদি কোথাও কোনো রকম এনার্জি পাঠায়, তাহলে নিশ্চয়ই সময় নিজেই একটা এনার্জি।
এবার হাইয়ার ইন্টেলিজেন্স সম্পর্কে দুটো কথা। গবেষকরা হাইয়ার ইন্টেলিজেন্স বলতে কি সৃষ্টিকর্তাকে বোঝাতে চেয়েছেন? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁরা যুক্তি দিয়ে নয়, দিয়েছেন বিশ্বাস থেকে। এবং তাঁরা স্বীকার করেছেন, তাঁদের এই বক্তব্য তাঁরা প্রমাণ। করতে পারবেন না।
উত্তর হলো–না, হাইয়ার ইন্টেলিজেন্স বলতে তাঁরা সৃষ্টিকর্তাকে বোঝাতে চাননি। জিনিসটার অস্তিত্ব সম্পর্কে তাঁরা নিঃসন্দেহ, কিন্তু পরিচয় সম্পর্কে অতটা নয়। তবে সৃষ্টিকর্তা যে নয় সে-ব্যাপারে তাঁরা সবাই একমত। অনেক পণ্ডিত ইন্টেলিজেন্সের বিভিন্ন স্তরকে অবিচ্ছিন্ন একটা ধারা বলে মনে করেন–শুরু হয়েছে। জড় বস্তু থেকে, তারপর উদ্ভিদ, তারপর প্রাণী, তারপর মানুষ, তারপর হায়ার ইন্টেলিজেন্স এবং শেষ হয়েছে সৃষ্টিকর্তায়। তাঁদের ধারণা, প্রতিটি লেভেলের সাথে, জড় পদার্থ থেকে শুরু করে হাইয়ার ইন্টেলিজেন্স পর্যন্ত, বিজ্ঞান ভিত্তিক যোগাযোগ করার উপায় নিশ্চয়ই আছে।
আমাদের দীর্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে আমরা মানুষরা ক্রমবিকাশের একটা পর্যায় অতি সম্প্রতি শেষ করেছি। ওটা ছিলো আমাদের ব্রেনকে উন্নত করার প্রয়াস। এই কাজে আমরা সফল হয়েছি, অর্থাৎ কাজটা শেষ হয়েছে যতোগুলো ব্রেন সেল আমাদের পাবার ছিলো তার সবগুলোই আমরা পেয়ে গেছি। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে পরবর্তী পর্যায়ের কাজ–আর তা হলো, আমাদের মনের উন্নয়ন। এখন যেটাকে বিশেষ অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, অচিরেই আমরা সবাই সেই ক্ষমতার অধিকারী হতে পারবো। এর জনপ্রিয়তা এবং প্রসার ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই।
.
ব্যাস, এই পর্যন্তই। বই শেষ করবার আগে আপনাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। আপনার সাথে সময়টা আমার চমৎকার কেটেছে।
: সমাপ্ত :