দ্বাদশ
পরিচ্ছেদ
অর্ধ পৃথিবী অতিক্রম
১৮৯৯ খ্রীস্টাব্দের ২০ জুন স্বামীজী ও তাহার গুরুভ্রাতা স্বামী তুরীয়ানন্দের সহিত এক জাহাজে আমি কলিকাতা ত্যাগ করিয়া লণ্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি, এবং ৩১ জুলাই প্রাতঃকালে লণ্ডনে উপনীত হই। কয়েক সপ্তাহ পরে স্বামীজী ইংলণ্ড পরিত্যাগ করিয়া আমেরিকা যাত্রা করেন এবং সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে আমি সেখানে আর একবার তাহার সাক্ষাৎলাভ করি। তাহার সহিত একই ভবনে অতিথিরূপে যে পাচ-ছয় সপ্তাহ এবং পর বৎসর (১৯০০ খ্রীস্টাব্দে) ব্রিটানিতে যে একপক্ষ কাল অতিবাহিত করি, তাহার পর আর দীর্ঘকাল ধরিয়া তাহার সহিত একত্র বাসের সুযোগ আমার ভাগ্যে ঘটে নাই। ১৯০০ খ্রীস্টাব্দের শেষভাগে তিনি ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন, কিন্তু আমি ১৯০২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত পাশ্চাত্যেই অবস্থান করি। অতঃপর যখন ভারতবর্ষে আসিয়া পৌঁছিলাম, তখন যেন তাহার জীবননাট্যের শেষ দৃশ্যের অভিনয়ে উপস্থিত থাকিবার জন্য, তাহার শেষ আশীর্বাদ গ্রহণ করিবার জন্যই। এই দেড়মাসব্যাপী সমুদ্রযাত্রা আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা বলিয়া মনে করি। এই কালে স্বামীজীর সহিত মিশিবার যে-কোন সুযোগ উপস্থিত হইলে গ্রহণ করিতাম। অপর কাহারও সহিত একপ্রকার মিশিতাম না বলিলেই চলে। অবশিষ্ট সময় লেখা ও সূচীকর্মে কাটিত। এইরূপে দীর্ঘকাল অবিচ্ছিন্নভাবে তাহার অপূর্ব চরিত্র ও মনের সংস্পর্শ লাভে ধন্য হইয়াছিলাম। এ সম্পদের কি তুলনা হয়?
.
এই সমুদ্রযাত্রার প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত ভাব ও গল্পের একটা অবিরাম স্রোত চলিয়াছিল। কেহই জানিত না, কখন সহসা স্বামীজীর উপলব্ধির দ্বার উদঘাটিত হইবে, এবং তাহার ফলে আমরা জ্বলন্ত ভাষায় নূতন নূতন সত্যের বর্ণনা শুনিতে পাইব। প্রথম দিন অপরাছে আমরা ভাগীরথীবক্ষে জাহাজে বসিয়া কথাবার্তা বলিতেছি, এমন সময়ে সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন, “যত দিন যাচ্ছে, তত আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, পৌরুষই (manliness) জীবনের সার বস্তু। এই আমার নূতন বার্তা। পাপ করবে, তাও যথার্থ মানুষের মতো কর। যদি দুষ্টই হতে হয়, তবে বড় রকমের দুষ্ট হও।” এই কথাগুলির সঙ্গে সঙ্গে আর একদিনের কথা মনে পড়িতেছে। আমি তাহাকে মনে করাইয়া দিই যে, ভারতে অপরাধীর সংখ্যা খুব অল্প। আমার দিকে ফিরিয়া দুঃখিত অন্তঃকরণে তিনি উত্তর দিলেন, “ঈশ্বরের ইচ্ছায় আমার দেশে যদি এর বিপরীত হতো! কারণ প্রকৃতপক্ষে এ ধর্মভীরুতা মৃত্যুর লক্ষণ!” শিবরাত্রির গল্প, পৃথ্বীরাজ, বিক্রমাদিত্যের বত্রিশ সিংহাসন, বুদ্ধ ও যশোধরার গল্প এবং অনুরূপ শত শত গল্প তিনি অবিরত বলিয়া যাইতেন। লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, একই কাহিনী কদাপি দুইবার কেহ শোনে নাই। জাতিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা তো সর্বদাই ছিল; ইহা ব্যতীত ছিল অবিরত নানা চিন্তার বিশ্লেষণ ও পুনর্বিন্যাস; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মপ্রণালী সম্পর্কে নানা কথা এবং সর্বোপরি দৃঢ়ভাবে আপামর জনসাধারণের পক্ষ সমর্থন; কদাপি এই প্রসঙ্গে তিনি বিরত হইতেন না। যাহাদের সমর্থন করিবার কেহ নাই, সেই দুর্বল ব্যক্তি অথবা জাতিকে রক্ষা করিবার জন্য সর্বদা অগ্রসর হইতেন, তাহাদের দোষ উদঘাটন করিয়া অধিকতর দুর্বল করিয়া ফেলিতেন না, শতমুখে তাহাদের গুণ বর্ণনা করিতেন।
আমাদের গুরুর আর্বিভাব এবং তিরোভাব উভয়ই আজ অতীতের ঘটনা, কিন্তু যে অমূল্য স্মৃতিসম্ভার তিনি অন্তরঙ্গগণের হৃদয়ে রাখিয়া গিয়াছেন, তাহার মধ্যে তাঁহার এই বিশ্বমানবপ্রেম অপেক্ষা মহত্ত্বর আর কিছুই নাই।
একদিন কোন ইউরোপীয় নরমাংসভোজন কোন কোন জাতির মধ্যে নিত্যকার ব্যাপার, এই উক্তি করিলে, তিনি যে ক্রোধ প্রকাশ করেন, তাহা কখনও ভুলিবার নয়। ঐ ব্যক্তির সমস্ত বক্তব্য শুনিবার পর তিনি বলেন, “এটা সত্য নয়। ধর্মভাবের প্রেরণায় পূজা উপলক্ষে বলিদান অথবা যুদ্ধে প্রতিহিংসা গ্রহণ, এই উভয় স্থল ব্যতীত কোন জাতি কোথাও নরমাংস আহার করে না। বুঝতে পারছনা, ওটা দলবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ জীবদের রীতি নয়?
“ঐ প্রকার কার্যের দ্বারা সামাজিক জীবনের মূলোচ্ছেদ করা হবে যে!” এই কথাগুলি যখন বলা হয়, তখন পর্যন্ত ক্রপটকিনের “পারস্পরিক সাহায্য (Mutual Aid)” সম্পর্কে মূল্যবান পুস্তকখানি বাহির হয় নাই। বিশ্বমানবের প্রতি প্রেম এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার দেশকাল-অবস্থা অনুযায়ী বিচার করিবার স্বাভাবিক প্রেরণা স্বামীজীকে এই প্রকার গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।
তিনি লোকের ধর্মপ্রবণতার বিষয় আলোচনা করিতেছিলেন। সহসা বলিয়া ওঠেন, “অধিকাংশ ধর্মের মূলে স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ এবং বংশবৃদ্ধির আকাঙক্ষা বিদ্যমান। ভারতবর্ষে এই মত বৈষ্ণবধর্ম এবং পাশ্চাত্যে খ্রীস্টধর্ম রূপে অভিহিত। মৃত্যুকে, অথবা মা কালীকে উপাসনা করতে অতি অল্প লোকেই সাহসী হয়েছে। এস, আমরা মৃত্যুর উপাসনা করি। এস, আমরা ভয়ঙ্করকে ভয়ঙ্কর বলেই আলিঙ্গন করি, তাকে কোমল হবার জন্য প্রার্থনা করে নয়। এস, আমরা দুঃখের জন্যই দুঃখকে বরণ করি।”
সাগরসঙ্গমে উপস্থিত হইবার পর আমরা বুঝিতে পারিলাম, সমুদ্রকে কেন ‘কালাপানি’ (কালোজল) এবং নদীকে সাদাপানি বলা হয়। স্বামীজী বুঝাইয়া দিলেন, সমুদ্রের প্রতি হিন্দুদের প্রগাঢ় ভক্তিই তাহাদের উহাকে লঙ্ঘন করিয়া অপবিত্র করিতে বাধা দিয়াছে এবং তাহার ফলেই বহু শতাব্দী ধরিয়া সমুদ্রযাত্রাকে জাতিচ্যুত হইবার অপরাধ বলিয়া গণ্য করা হইয়া থাকে। জাহাজ নদীর সীমা অতিক্রম করিয়া প্রথম সাগর স্পর্শ করিবামাত্র স্বামীজী বলিলেন, “নমঃ শিবায়! নমঃ শিবায়! ত্যাগবৈরাগ্যভূমি পরিত্যাগ করে ভোগৈশ্বর্যভূমিতে পদার্পণ করতে চললাম!”
বড় হইতে গেলে বহু দুঃখভোগ সহ্য করিতে হয়, এবং কাহারও কাহারও অদৃষ্ট এইরূপ যে, ইহজগতের সকল সুখই জ্বলিয়া পুড়িয়া ভস্মে পরিণত হয়–এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়া স্বামীজী বলিলেন, “সারা জীবনটাই দুঃখের বিনিময়ে অল্প সুখভোগ! এই কথাগুলি কখনও ভুলো না—মর্মান্তিক আঘাত পেলেই সিংহ ভীষণভাবে গর্জন করে ওঠে; মাথায় আঘাত পেলেই সাপ তার ফণা তুলে দাঁড়িয়ে ওঠে; তেমনি মানুষ নিদারুণ মর্মবেদনা পেলেই আত্মার বিপুল মহিমা প্রকাশ পায়।”
কখনও তিনি অসীম ধৈর্যসহকারে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতেছেন, পরক্ষণেই ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক কল্পনা-জল্পনায় মাতিয়া উঠিতেছেন। আবার বার বার তাঁহার মন বৌদ্ধযুগের প্রতি আকৃষ্ট হইত, কারণ ভারতীয় ইতিহাসের সম্যক জ্ঞানলাভের জন্য প্রয়োজন বৌদ্ধযুগের সবিশেষ অধ্যয়ন।
একদিন তিনি বলেন, “বৌদ্ধধর্মের তিনটি যুগ-বিভাগ আছে—পিচশ বছর তন্ত্রপ্রাধান্য। মনে করো না যে, ভারতে কোনকালে বৌদ্ধধর্ম নামে কোন পৃথক ধর্ম ছিল, এবং তার নিজস্ব মন্দির ও পুরোহিত প্রভৃতি ছিল। মোটেই তা নয়! বৌদ্ধধর্ম চিরকাল হিন্দুধর্মেরই অন্তর্ভুক্ত! কেবল এক সময়ে বুদ্ধের প্রভাব একাধিপত্য লাভ করার ফলে সমগ্র জাতি সন্ন্যাসমার্গ অবলম্বন করেছিল।” বৌদ্ধধর্মের অভ্যুদয়ে কাশ্মীরের নাগগণ (যে সকল মহাসৰ্প কুণ্ডের অভ্যন্তরে বাস করে বলিয়া লোকের বিশ্বাস ছিল) বলপূর্বক দেবত্বপদবী হইতে বিচ্যুত হয়। পরবর্তী শীতকালে অত্যধিক শীত পড়ায় তাহারাই আবার বৌদ্ধসম্প্রদায়ের সিদ্ধপুরুষ হিসাবে বৌদ্ধধর্মের অঙ্গীভূত হইয়া যায় কি না—এই বিষয় লইয়া স্বামীজী আলোচনা করিতেছিলেন।
প্রসঙ্গতঃ সোমলতার কথা আসিয়া পড়ে। স্বামীজী বর্ণনা করিতে লাগিলেন কিভাবে ‘হিমালয়’-যুগের সহস্র বৎসর পর্যন্ত ঐ লতা ভারতের প্রতি গ্রামে প্রতি বৎসর রাজার ন্যায় অভ্যর্থনা লাভ করিত, এক নির্দিষ্ট দিনে গ্রামবাসিগণ সমবেতভাবে মহাসমারোহে উহাকে গ্রামের ভিতর লইয়া আসিত। আর এখন লোকে উহাকে চিনিতেও পারে না।
আবার তিনি শের শা সম্পর্কে বলিতে লাগিলেন—যিনি হুমায়ুনের রাজত্বকালে ত্রিশবৎসর ধরিয়া এক বিচ্ছেদ ঘটাইয়া দেন। “বাল্যকালে তিনি বাংলার পথে পথে দৌড়াদৌড়ি করিতেন”—এই কথা বলিবার সময় তিনি কিরূপ আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিলেন তাহা এখনও আমার মনে আছে। তিনি এই বলিয়া প্রসঙ্গ শেষ করেন যে, চট্টগ্রাম হইতে পেশোয়র পর্যন্ত বিস্তৃত এ্যাণ্ড-ট্রাঙ্ক নামক রাজপথ, ডাক বিভাগের বন্দোবস্ত এবং সরকারী ব্যাঙ্কস্থাপন—প্রভৃতি শের শার কীর্তি। তারপর কয়েক মিনিট নীরব থাকিয়া তিনি গুরু গীতা হইতে আবৃত্তি আরম্ভ করিলেন
“গুরুব্রহ্মা গুরুবিষ্ণুগুরুদেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ॥”
***
“গুরুরাদিরনাদি গুরুঃ পরমদৈবত।
গুরোঃ পরতরং নাস্তি তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ ॥”
মনে মনে তিনি কোন একটি বিষয় লইয়া চিন্তা করিতেছিলেন, যাহার সহিত শ্লোকের এই অংশগুলি সংশ্লিষ্ট ছিল। ক্ষণকাল পরে সহসা তাহার গভীর চিন্তাভঙ্গ হইল এবং তিনি বলিলেন, “হাঁ, বুদ্ধ ঠিকই বলেছেন। কার্যকারণসম্পর্কই সর্বপ্রকার কর্মের মূল। পৃথক ব্যক্তিগত সত্তা বলে যা আমরা দেখছি তা নিশ্চয়ই ভ্রমাত্মক।” পরদিন প্রাতঃকালে তিনি চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়াছিলেন, আমার মনে হইতেছিল তিনি তন্দ্রাচ্ছন্ন, এমন সময়ে সহসা তিনি বলিয়া উঠিলেন, “দেখ তো, এক জীবনের স্মৃতিই যেন মনে হয়, লক্ষ লক্ষ বছরের কারাবাস; আবার লোকে পূর্ব পূর্ব জন্মের স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে চায়! এই জন্মেরই ধাক্কা কে সামলায় তার ঠিক নেই, আবার অন্য জন্ম!”
একদিন সকালে চা খাইবার পূর্বে আমাকে ডেকের উপর দেখিতে পাইয়া তিনি বলিলেন, “এইমাত্র আমি তুরীয়ানন্দের সঙ্গে রক্ষণশীল ও উদারনীতিক ভাবসম্পর্কে কথা বলছিলাম।” তারপরই তিনি গভীর ভাবে ঐ বিষয়ে আলোচনা আরম্ভ করিলেন।
“রক্ষণশীল ব্যক্তির একমাত্র আদর্শ বশ্যতাস্বকার। তোমাদের আদর্শ সংগ্রাম। সুতরাং আমরাই জীবনকে উপভোগ করে থাকি, তোমরা কখনো তা পার না। তোমরা সর্বদা চেষ্টা করছ, আদর্শটা বদলে একটা নূতন কিছু করবার, আর ঐ পরিবর্তনের লক্ষভাগের একভাগ ঘটবার পূর্বেই তোমরা ইহলোক পরিত্যাগ কর। পাশ্চাত্যবাসীর আদর্শ—উন্নতির জন্য একটা কিছু কর; প্রাচ্যবাসীর আদর্শ–নির্বিবাদে সহ্য করে যাও। কিছু করা এবং সহ্য করে যাওয়া—এই উভয়ের মধ্যে অপূর্ব সামঞ্জস্য-বিধান থাকলেই তা হবে সর্বাঙ্গসুন্দর জীবন। কিন্তু তা হওয়া অসম্ভব।
“আমাদের ধর্ম মেনেই নেয় যে, মানুষের সব বাসনা পূর্ণ হতে পারে না। জীবনে অনেক অপ্রীতিকর জিনিসকে সংযত করতে হবে। এটা অপ্রীতিকর সন্দেহ নেই, কিন্তু এর দ্বারাই শক্তি ও আলো পাওয়া যায়। উদারনীতিক ব্যক্তিগণ এর মন্দ দিকটাই দেখেন, এবং ভেঙেচুরে ফেলতে চান। কিন্তু পরিবর্তে তারা যা প্রবর্তন করেন, তাও তেমনি মন্দ এবং ঠিক ভাল ফল পেতে গেলে পুরানো প্রথায় আমাদের যতদিন লেগেছিল, নূতন রীতিনীতির সাহায্যে অগ্রসর হলে ঠিক ততদিন সময় লাগবে।
“পরিবর্তনের দ্বারা ইচ্ছাশক্তির বল বৃদ্ধি পায় না, বরং আরও দুর্বল ও পরনির্ভর হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের সর্বদা সব জিনিস আত্মসাৎ করতে হবে—অর্থাৎ নিজের করে নিতে হবে। এর দ্বারা ইচ্ছাশক্তি প্রবলতর হয়ে ওঠে। আর জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে হোক, জগতে ইচ্ছাশক্তিই একমাত্র জিনিস, আমরা যার আদর করে থাকি। সমগ্র জগতের দৃষ্টিতে সহারণপ্রথা এত মহৎ কেন? তার কারণ ওর দ্বারা। ইচ্ছাশক্তির বিকাশ ঘটে।
“আমাদের স্বার্থপরতা বিসর্জন দিতে শিখতে হবে। আমি দেখতে পাই, যখনই জীবনে আমি কোন ভুল করেছি, তার একমাত্র কারণ—তাতে স্বার্থগন্ধ মিশ্রিত ছিল। যেখানে স্বার্থের কোন সংস্রব নেই, সেখানে আমার বিচারবুদ্ধি ঠিক লক্ষ্যস্থলে পৌঁচেছে।
“এই স্বার্থ না থাকলে জগতে কোন ধর্মমতই থাকত না। মানুষ নিজের জন্য যদি কিছু না চাইত, তাহলে তুমি কি মনে কর, সে প্রার্থনা, পূজা, আরাধনা প্রভৃতি কখননা করত? কখনো না। ঈশ্বর সম্বন্ধে সে চিন্তাই করত না বললে হয়। হয়তো কদাচ কখনো কোন সুন্দর স্বাভাবিক দৃশ্য অথবা অন্য কিছু দেখে একটু আধটু স্তুতিবাদ মাত্র করত। ঈশ্বর সম্পর্কে আমাদের ঐ রকম দৃষ্টিভঙ্গিই থাকা উচিত—কেবল গুণগান ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। আমরা নিঃস্বার্থ হতে পারলেই তা সম্ভব, নচেৎ নয়।”
তিনি আবার বলিলেন, “তোমরা মনে কর, লড়াই করাটা শ্রীবৃদ্ধির লক্ষণ। এটা সম্পূর্ণ ভুল। অপরকে নিজের করে নেওয়াই প্রকৃত উন্নতির লক্ষণ। এ ব্যাপারে হিন্দুধর্ম সিদ্ধহস্ত। আমরা কোনকালে যুদ্ধবিগ্রহের ধার ধারিনি। অবশ্য গৃহপরিজন রক্ষার জন্য কখনো কখনো উত্তম মধ্যম দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের ছিল। কিন্তু যুদ্ধের জন্য যুদ্ধ করার পক্ষপাতী আমরা কদাচ ছিলাম না। প্রত্যেককেই তা শিক্ষা করতে হতো। সুতরাং এই সব আগন্তুক জাতির দল আসুক! নিজের নিজের পথে চলুক! কালচক্রের আবর্তনে সকলেই শেষে হিন্দুধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে যাবে।”
তাহার মাতৃভূমি অথবা মাতৃরূপা হিন্দুধর্মকে মহাপ্রভাবশালী ব্যতীত অন্য কোনরূপ চিন্তা করিতে পারিতেন না। কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা সম্পর্কে চিন্তা করিতে গিয়া বার বার তিনি স্বভাবগত খেয়ালী ভাষায় বলিয়া উঠিলেন, “হাঁ, একথা সত্য। ভারতে কোন ইউরোপীয় পুরুষ অথবা নারীকে কিছু করতে গেলে, তাঁকে কালা ভারতবাসীর অধীনেই তা করতে হবে।”
সমগ্র জাতি হিসাবে ভারত কি মহাকাৰ্য সাধন করিয়াছে, সে বিষয়ে তিনি যথেষ্ট চিন্তা করিতেন। মধ্যে মধ্যে বলিতেন, “দেখ, আমরা একটা জিনিস করেছি, যা অন্য কোন জাতি কখনো পারেনি। একটা সমগ্র জাতিকে আমরা দু-একটা ধারণার বশবর্তী করতে পেরেছি—যেমন গোমাংস বর্জন। কোন হিন্দু গোমাংস আহার করবে না।, এটা ইউরোপীয়দের বিড়ালের মাংস আহার না করার মতো নয়, কারণ গোমাংস প্রাচীনকালে এদেশের খাদ্য ছিল।”
একদিন তাহার জনৈক প্রতিপক্ষের সম্পর্কে আমরা আলোচনা করিতেছিলাম, এবং আমি বলি যে, তিনি তাহার সম্প্রদায়কে তাঁহার দেশের উর্ধ্বে স্থাপন করিয়া অন্যায় করিতেছেন। স্বামীজী সানন্দে উত্তর দিলেন, “এটা এশিয়ার লক্ষণ, এবং চমৎকার জিনিস। কেবল ব্যাপারটা যথার্থভাবে ধারণা করবার মতো তার মাথা নেই, এবং অপেক্ষা করবার ধৈর্যও নেই।” তারপরেই তিনি আপন মনে মা কালীর চিন্তায় ডুবিয়া গেলেন।
তিনি আবৃত্তি করিলেন–
“মুণ্ডমালা পরায়ে তোমায়, ভয়ে ফিরে চায়,
নাম দেয় দয়াময়ী।
***
চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান,
নাচুক তাহাতে শ্যামা।”
তিনি বলিতে লাগিলেন, “আমি ভয়ঙ্করকে ভয়ঙ্কর বলেই ভালবাসি, নৈরাশ্যকে নৈরাশ্য বলেই ভালবাসি। দুঃখদারিদ্রকে দুঃখস্বরূপ বলেই ভালবাসি। ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাও; প্রতিপদেই পরাজয়, ক্ষতি নেই। তবু সংগ্রাম কর। ঐটেই আদর্শ–ঐটেই আদর্শ।”
একবার তিনি বলিয়াছিলেন, “শুধু মানবাত্মার নয়, সকল প্রাণীর আত্মার সমষ্টিই সগুণ ঈশ্বর। এই সমষ্টীভূত বিরাটের ইচ্ছাশক্তিকে কোন শক্তি প্রতিরোধ করতে পারে না। একেই আমরা নিয়ম বলে জানি। শিব, কালী ইত্যাদির অর্থও তাই।”
জগতের কতকগুলি শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যময় দৃশ্য আমার নিকট অধিকতর সুন্দররূপে প্রতিভাত হইয়াছে; কারণ, ঐ সকল স্থানে স্বামীজীর নিকট দীর্ঘকাল ধরিয়া এইরূপ ধরনের কথাবার্তা শ্রবণ করিবার সুযোগ আমি পাইয়াছি।
আমরা যখন সিসিলি দ্বীপের নিকটবর্তী হইলাম, তখন সূর্য সবে অস্ত গিয়াছে, পশ্চিম গগনে অস্তমান সূর্যের শেষ রক্তচ্ছটা, এবং তাহারই সম্মুখে এটনা আগ্নেয়গিরি হইতে অল্প অল্প ধূম নির্গত হইতেছে। মেসিনা প্রণালীতে প্রবেশ করিবামাত্র চন্দ্রোদয় হইল। ডেকের উপর স্বামীজীর সহিত পায়চারি করিয়া বেড়াইতেছি তিনি বুঝাইতে লাগিলেন যে, সৌন্দর্য বাহিরের বস্তু নহে, উহা পূর্ব হইতেই আমাদের মনের মধ্যে থাকে। একদিকে ইটালীর উপকূলের ধূসরবর্ণের বন্ধুর পাহাড়গুলি যেন ভূকুটি করিতেছিল, অপরদিকে রজতকৌমুদীধারায় স্নাত সিসিলি উপদ্বীপ। স্বামীজী বলিলেন,”মেসিনা আমাকে ধন্যবাদ দেবেই, কারণ আমিই তাকে ঐ অতুল সৌন্দর্য দান করেছি।”
অতঃপর বাল্যকালেই তাহার মনে ভগবানলাভের জন্য যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জন্মিয়াছিল, সেই সম্পর্কে বলিতে লাগিলেন, কেমন করিয়া তিনি একাসনে বসিয়া কোন একটি মন্ত্র উদয়াস্ত জপ করিতেন। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি তপস্যার অর্থ কি, তাহা বুঝাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। প্রাচীন প্রথানুযায়ী পঞ্চতপার কথা বলিলেন, চারিপাশে চারিটি অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া তাহার মধ্যে সাধক উপবিষ্ট থাকেন, মাথার উপর অনলবর্ষী সূর্য—এই অবস্থায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা মন স্থির করিয়া বসিয়া থাকিতে হয়। অবশেষে তিনি এই বলিয়া শেষ করিলেন, “ভীষণের পূজা কর, মৃত্যুর উপাসনা কর। আর সব মিথ্যা। সব চেষ্টা, সব সংগ্রাম বৃথা! এই হলো শেষ শিক্ষা। কিন্তু এ কাপুরুষের মৃত্যুকে ভালবাসা নয়, এ ভালবাসা দুর্বলের বা আত্মঘাতীর নয়। এ হলো শক্তিমান ব্যক্তির মৃত্যুকে সাদর সম্ভাষণ—যে অতলান্ত পর্যন্ত সব কিছু পরীক্ষা করে দেখেছে, এবং জানে যে, এ ছাড়া গত্যন্তর নেই!”