আমেদপুর স্টেশনে কাকা গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন, লিখেছিলেন। ট্রেন থেকে নেমেই তপন দেখল, স্টেশনে কাকা-কাকিমা এবং তাঁর দুই ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ভারতবর্ষে ফেরার পর এই প্রথম তপনকে কেউ অভ্যর্থনা জানাল। কামরার দরজায় তাকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল টুকু আর সন্দীপ, কুলি না ডেকে নিজেরাই নামাতে লাগল তপনের মালপত্র।
প্রণাম-ট্রনামের পাঠ তপন বহুদিন চুকিয়ে দিয়েছে, মানুষের পা স্পর্শ করতে তার গা শিরশির করে। এখানে আসবার আগে তপন ঠিক করে রেখেছিল একমাত্র ঠাকুমা ছাড়া আর কারুকেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে না। কিন্তু সে ইচ্ছে টেকেনি। অনেককেই প্রণাম করতে হয়েছে, এমনকী সুবীরের মেসোমশাই সেই মন্ত্রীকেও-কেন-না, সুবীর প্রণাম করার পর তিনি এমনভাবে পা-জোড় করে দাঁড়িয়েছিলেন, যেন তপনের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। তখন আর না করে পারা যায় না। এখানেও তাই হল, টুকু আর সন্দীপ ঢিপ ঢিপ করে তপনকে প্রণাম করে ফেলতেই, তপন কাকার দিকে তাকাল, বুঝতে পারল, প্রণামের পর কাকা কী আশীর্বাদ করবেন তাও তৈরি করে রেখেছেন। তপন বাধ্য হয়ে নীচু হল।
টুকু বলল, বড়দা, সাহেবদের মতন লালচে রং হয়েছে তোমার!
কাকিমা বললেন, কী সুন্দর স্বাস্থ্য হয়েছে তপনের!
কাকা বললেন, কী রে তপু, তোকে যে প্রায় চেনাই যায় না।
সন্দীপ কথা না বলে লাজুকভাবে হাসল শুধু।
কাকিমার ব্যবহার দেখেই তপন মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছিল। কাকিমা কোনোদিনই তপনকে সেরকম পছন্দ করতেন না, কলেজ ছুটির সময় তপন মাঝে মাঝে সিউড়িতে আসত, কাকিমা নানা ছুতোয় তপনকে খাটিয়ে মারতেন। একবার তো দুবরাজপুর থেকে খেজুর গুড়ের হাঁড়ি বয়ে আনতে হয়েছিল তপনকে। এখনও তপনের স্পষ্ট মনে আছে, ছেলেবেলায় তপনকে বাদ দিয়ে কাকিমা শুধু তাঁর ছেলে-মেয়েদের ভাতের থালায় ঘি দিতেন, খুব লুকিয়ে কৌশলে ব্যাপারটা করতেন কাকিমা, কিন্তু ঘিয়ের গন্ধ তপন ঠিক টের পেয়ে যেত, আর তখন তার খুব খারাপ লাগত। সেই কাকিমাই আজ কী দারুণ আদিখ্যেতা করছেন তপনকে নিয়ে–তপন প্রণাম করার পর তপনের থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে চুমু খেলেন পর্যন্ত।
মায়ের সঙ্গে কাকিমাও খুব ভালো ব্যবহার করতেন না, কিন্তু মায়ের সঙ্গে কারুর ঝগড়াঝাঁটি হওয়াই ছিল অসম্ভব। ছেলেবেলা থেকেই দুঃখকষ্ট পেয়ে পেয়ে মায়ের যেন কোনো প্রত্যাশাই ছিল না। এক মুহূর্ত বিশ্রাম নিতেন না মা, ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে সারাদিন খাটতেন মুখ বুজে, ঘুমোতে যেতেন সবার শেষে, কারুর কিছু বলার দরকার হত না-কাজ করা ছিল মায়ের নেশা। কাকিমা বড়োলোকের মেয়ে, বিয়ে হবার পরও তাঁকে কিছুই করতে হয়নি–মা-ই গোটা সংসারটা সামলে রেখেছিলেন–সুতরাং কাকিমা মা-কে বেশি আঘাত দিতে সাহস পেতেন না। টুকু আর সন্দীপও তো তপনের মায়ের হাতেই মানুষ।
তপন ভেবেছিল সেসব পুরোনো কথা আর ভাববে না, সেসব তো সব চুকেবুকে গেছে, এখন এসেছে দিন কয়েকের জন্য বেড়াতে, টুকুর বিয়েতে হইচই আনন্দ করে চলে যাবে। কিন্তু মনে যে পড়ে যাচ্ছে সব। কাকিমার উচ্ছ্বাসে সহজভাবে সাড়া দিতে পারছে না।
লাল ধুলোর রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটছে। এসব রাস্তা তার বড়ো চেনা, এই মাঠের ওপারে আকাশ, পুকুর পাড়ের তালগাছের সার, খড় বোঝাই গোরুর গাড়ির দল–এসব কিছুই বদলায় নি। এসব দেখলে অকারণেই বুক টনটন করে ওঠে।
টুকু আর সন্দীপ হাজার প্রশ্ন তুলেছে বিলেত-আমেরিকা সম্পর্কে। এ-পর্যন্ত তার বিদেশের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কেউ এত কথা জানতে চায়নি। টুকু বলল, আচ্ছা বড়দা, আমেরিকায় নাকি এমন আছে, একটা দরজা বন্ধ, কিন্তু তুমি যেই তার সামনে দাঁড়ালে, অমনি আপনি আপনি সেটা খুলে গেল? সত্যি? তপন হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ আছে। আমি ওই সব দরজার কলকজা শিখে এসেছি, ইচ্ছে করলে সিউড়ির বাড়িতেও বানিয়ে দিতে পারি।
সত্যি বানিয়ে দেবে?
কাকিমা বললেন, আঃ চুপ কর না ছেলেটা এই মাত্র এসেছে, আগে একটু বিশ্রাম নিতে দে। তপু, তুমি কয়েক মাস থাকছ তো?
না কাকিমা, দিন সাতেক থাকব। এই টুকুর বিয়ের ক-টা দিন।
ওমা, সে-কী! মোটে একই দিনের জন্য–এত পয়সা খরচ করে এলে।
না, বড়দা, তুমি যেতে পারবে না। তোমাকে আমরা আটকে রাখব।
তুই আর কোথায় থাকবি? তুই তো বিয়ের পরই পালিয়ে যাবি। তোর বর কোথায় যেন থাকে, দুর্গাপুরে?
সন্দীপ বলল, বড়দা, তুমি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এ উঠেছ? আচ্ছা, সমুদ্রের ওপর দিয়ে যখন জেট প্লেন আসে, তখন কেমন লাগে?
কাকা বললেন, তুই কি আবার ফিরে যাবি, ঠিক করেই এসেছিস? কেন, এখানে যদি কোনো চান্স-টান্স পাস
না, কাকা, এখানে আমি কাজ করব না।
-এখানে অবশ্য স্কোপও তেমন নেই, তুই ফিরে গিয়ে দেখিস যদি সন্দীপটার জন্যে কোনো ব্যবস্থা করতে পারিস।
এখনই কী? সন্দীপ আগে পড়াশুনো শেষ করুক।
আগে যা ছিল, কাকা তার থেকে বাড়িটাকে আরও বাড়িয়েছেন। সামনে অনেকখানি বাগান, পেছনে গোয়ালঘরে দুটো মুলতানি গোরু, সারাবাড়ির চারদিকে পাঁচিল উঠেছে, লোহার গেট, বাথরুমে রঙিন টালি আর সিঙ্ক বসানো হয়েছে–কাকার অবস্থা আগের থেকেও অনেক ভালো। কাকার শ্বশুর এখানকার নামকরা ডাক্তার ছিলেন, তিনিই কাকাকে এখানে এনেছেন, কাকা তাঁর শ্বশুরের প্র্যাকটিশ পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে।
ঠাকুমার বয়েস আশি পেরিয়ে গেছে, এখন আর হাঁটা-চলা করতে পারেন না ভালো করে। এক তলার বাগানের দিকে নিজের ঘরেই বেশিরভাগ থাকেন। জুতো খুলে ঠাকুমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তপন চেঁচিয়ে বলল, কী বুড়ি, কেমন আছ–! ঠাকুমা বললেন, এসেছিস, আয়–আমার সোনা! প্রণাম করল না, তার আগেই তপন ঠাকুমাকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরল।
ঠাকুমার দৃষ্টি খানিকটা ফাঁকা ফাঁকা বোঝা যায়। তিনি চোখে আর ভালো দেখতে পান না। তপনের মুখে-গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কতদিন দেখিনি রে আমার সোনাটাকে। মনে ছিল এই বুড়িটার কথা? খাওয়া হয়নি তো এখনও? যা আগে স্নান-খাওয়া করে আয় নইলে পিত্তি পড়ে যাবে।
বাড়ির সবচেয়ে ভালো ঘরটা দেওয়া হয়েছে তপনকে। তপনের সবচেয়ে হাসি পেল শুনে যে শুধু তারই জন্যে কয়েকদিন আগে দো-তলায় বাথরুমে কমোড বসানো হয়েছে, যাতে দিশি কায়দার পায়খানায় তার অসুবিধে না হয়। সিউড়িতে তপনের আগেকার চেনাশুনো যারা ছিল, তাদের কারুর সঙ্গেই দেখা করতে গেল না। তপনের মনে আছে, এই সিউড়িরই একটা ছেলে একবার বিলেত থেকে ফিরেছিল মেম বিয়ে করে, কিন্তু সে যে সাহেব হয়ে যায়নি, সেটা প্রমাণ করার জন্য কী বাড়াবাড়িই না করত। ঘুরে ঘুরে সবাইকার বাড়ি গিয়ে মাসিমা, কাকিমা বলে ডাকাডাকি করত। চেয়ার এগিয়ে দিলেও তাতে না বসে মাটিতে বসে পড়ে বলত–আমার মাটিতে বসতেই খুব ভালো লাগে–চা-টোস্টের বদলে খেতে চাইত মুড়ি আর তেলেভাজা।
সন্দীপ আর টুকুর অসংখ্য প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তর দেওয়া হয়ে গেছে। এখানে এসে তপনের খেয়াল হল, ওদের জন্য কিছু উপহার আনা উচিত ছিল, তপন কিছুই আনেনি। কাকিমা বেশ নিরাশ হয়েছে বোঝা যায়। তপন নিজের হাতঘড়িটা উপহার দিয়ে দিয়েছে সন্দীপকে, তার দাড়ি কামাবার সেট, কলম–এসব দিয়ে যাবে ঠিক করেছে। তার নতুন সুদৃশ্য সুটকেশ দুটোই দিয়েছে টুকুকে বিদেশি যেকোনো জিনিসই ওদের কাছে আঃ কী ভালো, কী সুন্দর দেখতে, না? টুকু সবচেয়ে খুশি হয়েছে তপনের ওডি-কোলনের শিশিটা পেয়ে ওরকম সুন্দর শিশি আর ওরকম খাঁটি ওডি-কোলোনের নাকি টুকুর বন্ধুরা কেউ কোনোদিন স্বপ্নেও দেখেনি। কী চমৎকার স্প্রে করা যায়।
টুকুর হাবভাব দেখে তপনের খুব ভালো লাগে। পাঁচ-ছ বছর আগে টুকু খানিকটা নির্জীব নিরীহ মেয়ে ছিল। এখন সুন্দর স্বাস্থ্য হয়েছে, চরিত্রে এসেছে চঞ্চলতা, বিয়ের আনন্দে সবসময় ছটফট করছে। এই ঘরে বসে গল্প করছে, আবার ফুড়ুৎ করে চলে যাচ্ছে কোথায়–সকাল বেলার শিশির ভেজা ফুলের মতন ওর মুখে সবসময় একটা পাতলা খুশি মাখানো। মেয়েদের রূপ এই সময়টাতেই সবচেয়ে বেশি খোলে।
ছাদে একটা ঘর বানানো হয়েছে, এখনও সেখানে কোনো আসবাবপত্র আসেনি। যেখানে ঘরটা হয়েছে, আগে ওখানেই থাকত জলের ট্যাঙ্ক। প্রথম সিগারেট খেতে শিখে তপন ওই জলের ট্যাঙ্কের ধারে বসেই দুপুরে সিগারেট খেত। সেই কথা মনে পড়ায়, তপন এখনও মাঝে মাঝে সিগারেট খাবার সময় ছাদে উঠে আসে। নতুন ঘরটায় তপন পায়চারি করছিল, হঠাৎ কাছেই পায়ের শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখল টুকু। একটু আগেই টুকু নীচে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, কখন যেন উঠে এসেছে। তপন জিজ্ঞেস করল, কী রে, ঘুমোলি না?
টুকু গম্ভীরভাবে বলল, বড়দা, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
কী কথা?
বলো, তুমি কারুকে বলবে না?
কী ব্যাপার, বল না।
না, তুমি আমার গা ছুঁয়ে বলল, কারুক্কে বলবে না?
আরে, কী হল কী তোর। আচ্ছা, কারুকে বলব না, কী ব্যাপার?
বড়দা, একটা ব্যাপারে আমার খুব ভয় করছে। তুমি আমাকে সাহায্য করবে? তোমার বিমান দত্তকে মনে আছে?
কে বিমান দত্ত?
ওই যে লাইব্রেরিতে বই দিত, তোমার কাছে আসত মাঝে মাঝে।
ও হ্যাঁ, বিমান, মনে আছে। কী হয়েছে?
টুকু একটু চুপ করে রইল আঙুল দিয়ে আঁচল জড়াতে লাগল। কাঁচা-হলুদ রঙের একটা শাড়ি পরে আছে, টলটলে মুখখানায় আশঙ্কার ছায়া। তপন ওর থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, কী হয়েছে ব্যাপারটা বল তো?
বিমান আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল।
তপন হা-হা করে হেসে বলল, তাতে দোষের কী হয়েছে? তুই যেমন সুন্দরী তোকে তো অনেকেই বিয়ে করতে চাইবে। এতে আর আশ্চর্য কী!
ও খুব রেগে গেছে!
তোর অন্য জায়গায় বিয়ে হচ্ছে বলে? তা তো রাগবেই। তোর হাত ধরে গদগদভাবে তোকে বিয়ে করতে চেয়েছিল তো? তুই কী বলেছিলি?
বড়দা, তুমি ঠাট্টা কোরো না। আমার মনের মধ্যে এমন হচ্ছে, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আমি যা ভুল করেছি। আমি ওকে চার-পাঁচখানা চিঠি লিখেছি। ওর বোন সবিতা তো আমার বন্ধু, গরমের ছুটিতে ওদের বাড়িতে রোজ পড়তে যেতাম।
কী লিখেছিলি চিঠিতে? তুইও ওকে ভালোবাসিস এই তো! তা কী হয়েছে তাতে। তোর বর জেনে ফেলবে? আরে, তোর বরও কি ওরকম দু-চারটে চিঠি অন্য কোনো মেয়েকে লেখেনি? নিশ্চয়ই লিখেছে। ওতে কিছু হয় না। আর কিছু করেছিস নাকি? চিঠি লেখা ছাড়া?
না, না, সেসব কিছু না, সত্যি বলছি বিশ্বাস করো।
যাকগে ওসব নিয়ে এখন ভাবতে হবে না, যা!
বড়দা, তুমি জান না, ও বলেছে বিয়ে ভেঙে দেবে। ও যা গোঁয়ার–দীপুটা আবার ওকে বিয়েতে নেমন্তন্ন করেছে, সেদিন ও যদি কিছু করে। আমি আত্মহত্যা করব!
আচ্ছা টুকু, একটা কথা বলত! বিমানকে তো দেখতে খারাপ নয়, ভালোই চেহারা, লেখাপড়াতেও ভালো–ওর সঙ্গে তোর ভাব হয়েছিল, তা ওকেই বিয়ে করলি না কেন তুই? আর যে ছেলেকে তুই এখনও দেখিসনি–তাকেই বিয়ে করতে কেন রাজি হলি?
তুমি তো জানো না, গত বছর কী কান্ড হয়েছে! মিউনিসিপ্যালিটির ইলেকশানের সময় বিমানদা-র বাবার সঙ্গে আমার বাবার কী দারুণ ঝগড়া! মুখ দেখাদেখি বন্ধ। কোর্টে কেসও হতে যাচ্ছিল। মা আমার ব্যাপারটা একটু একটু জানত-বাবাকে বলেছিল, বাবা নাকি বলেছিলেন, আমার মেয়েকে কেটে ফেলে দেব, তবু ওই রাস্কেলের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব না!
লুকিয়ে বিয়ে করলেই পারতিস! বাবাতে বাবাতে তো আর বিয়ে হবে না। বিয়ে হবার কথা তোর সঙ্গে বিমানের–তোর বয়সও কম না, তেইশ হয়েছে তো, না। দুই বাবার ঝগড়া বলে তোদের ভালোবাসা কেন মিথ্যে হয়ে যাবে।
না, বড়দা, তুমি ওকথা বোলো না!
তপনের নিজের কথাই নিজের কানে খট করে লেগেছে। টুকুকে যে ব্যাপারে সে উপদেশ দিতে চাইছে, সে ব্যাপারে তো সে নিজের সম্পর্কে মানেনি! অ্যালিসকে অত অপমান করেছিল কেন সে, অ্যালিসের কী দোষ? তার বাবার সঙ্গে অ্যালিসের বাবার শক্রতা হয়েছিল তার জন্য তারা দুজনের কেউ-ই তো দায়ী না! কিন্তু, না, না, সেটা অন্য ব্যাপার।
না, না, অ্যালিসের ভালোবাসা তার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব না, সেও অ্যালিসকে ভালোবাসতে পারবে না।
বড়দা, তুমি আমার কোনো কথা শুনছ না! ও যদি এখন সেই চিঠিগুলো–
ধুৎ বোকা মেয়ে! আমি কি এখন গুণ্ডা লাগিয়ে চিঠিগুলো কাড়িয়ে আনব নাকি! চিঠি লিখেছিস তো কী হয়েছে। চিঠিতে শুধু ভালোবাসার কথা লিখেছিস তো? ওতে কোনো দোষ নেই।
কিন্তু আমার ভয় করছে।
কোনো ভয় নেই। আচ্ছা, শুধু তোর ভয়ই করছে; দুঃখু হচ্ছে না বিমানের জন্য?
মোটেই না! ও এখন আমার নামে যা-তা কথা বলে বেড়ায়। চিঠির কথাও অনেককে বলেছে, ওদিন যদি কিছু একটা করে।
অকারণেই তপন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর ইয়ার্কির সুরে বলল ঠিক আছে, বিয়ের দিন আমি বিমানকে চোখে চোখে রাখব। যদি পকেট থেকে চিঠি-ফিটি বার করার চেষ্টা করে, খপ করে ওর হাত চেপে ধরব? কিন্তু কোনো ছেলে আজকাল ওরকম করে না রে!
বড়দা, তুমি কোনোক্রমে ওর কাছ থেকে চিঠিগুলো চেয়ে নিয়ে নষ্ট করে ফেলতে পার না? ও তোমাকে ভক্তি করে।
আমি দাদা হয়ে ওর কাছে গিয়ে বলব, কী হে, আমার ছোটে বোন তোমার কাছে কি সব প্রেমপত্র-টত্র লিখেছে, সেগুলো দাও হে!
টুকু তাড়াতাড়ি তপনের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, বড়দা, প্লিজ, ওরকম ভাবে বোলো, আমি তাহলে ঠিক মরে যাব।
তপন তার পিঠে হাত রেখে বলল, দূর পাগলি! ওসব কিছু না। বিমান দেখ গিয়ে এখন তোর বিরহে পদ্য লিখছে–চিঠি দেখানোর মতন নোংরা কাজ ছেলেরা করে না। নে, মন খারাপ করিস না, কিছু যদি হয়ই, আমি ম্যানেজ করে দেব। নে, সিগারেট খাবি? খা না একটান!
টুকু চোখ গোল গোল করে বলল, তুমি আমাকে সিগারেট খেতে বলছ?
হ্যাঁ। খা না একটান। মেয়েদের সিগারেট খেতে দেখলে আমার বেশ লাগে। তুই আগে খেয়েছিস নাকি?
হ্যাঁ, ও-ই তো আমায় খাইয়েছে?
মানে? বিমান?
তপন আবার প্রচন্ড হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, দেখিস একথা ভুল করে যেন তোর বরকে বলে ফেলিসনি!
তপন বেশিরভাগ সময় ঠাকুমার সঙ্গেই গল্প করে। ঠাকুমার এখন আর একটাও দাঁত নেই, তবু সেই ফোকলা মুখে হাসিটাও সুন্দর দেখায়। এবাড়িতে শুধু ঠাকুমার কথাতেই এখনও বাঙাল টান আছে। ঠাকুমার ধারণা, তপন এত উন্নতি করেছে বিদেশে সে যেন কোনো একটা রাজ্যের রাজা হয়ে গেছে।
ঠাকুমা হাসতে হাসতে বলেন, আমি তো ভাবছিলুম, ভাই, তুই একটা মেম বিয়ে করে আনবি! মরার আগে আমার নাত-বউকে আশীর্বাদ করে যাব।
তপন বলল, বলো কী ঠাকুমা, ওই বেড়াল-মুখো মেম বিয়ে করব! সেই মেমবউ কি আমার এই বুড়িকে খাতির করত।
আহা, তা কেন হবে রে! মেম কি ভালো হয় না! তাও হয়। ওই তো আমাদের উকিলবাবুর ছেলে পরেশ মেম বিয়ে করেছিল। কী ভালো মেয়েটি! সাত সমুদুরের পারে থাকিস, সেখানে আর অন্য মেয়ে পাবি কোথায়?
না, বুড়ি, সেখানে অন্য অনেক জাতের মেয়ে আছে। বাঙালিও আছে।
তাহলে তাদেরই একটাকে বিয়ে কর না! ওখানে তোকে রান্নাবান্না করে দেয় কে?
নিজেই রান্না করি। খুব ভালো শিখে গেছি এখন!
ঠাকুমা হঠাৎ চোখের জল মোছেন। কোঁচকানো মুখের চামড়া বেয়ে জল গড়ায়, ঠাকুমা ভাঙা গলায় বলেন, তুই এত উন্নতি করলি কিন্তু তোর মা দেখে যেতে পারল না–কত আনন্দ করত সে আজ–সারাজীবন দুঃখ পেয়েছে–আজ এমন রাজার মতন ছেলে তার– বড়ো কাঁদত শেষ দিকে।
নিজের দুই মৃত ছেলে কিংবা স্বামীর কথা উচ্চারণ করলেন না একবারও, শুধু তপনের মা-র কথা বলে কাঁদতে লাগলেন! তপন স্থিরভাবে বসে রইল। সবাই তো দুঃখ পেয়ে গেছে। তাদের পরিবারে–জ্যাঠামশাই বাবার কথা তো বাদই, ঠাকুরদাও বলতে গেলে প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই মারা গেছেন টি বি-তে। সারাজীবনভরা শুধু দুঃখ আর দুঃখ। একমাত্র ছোটোকাকাই এখন বেশ গুছিয়ে বসেছেন। কিন্তু তার মায়ের দুঃখটাই বেশি করে মনে পড়ছে ঠাকুমার।
তপন বলল, মা কাঁদত? কিন্তু আমি যখন বিদেশে যাই, তখন তো মা খুশি হয়েই রাজি হয়েছিলেন। মা রাজি না হলে কি আমি যেতাম?
রাজি হবে না কেন! তুই বড়ো হবি, উন্নতি করবি–কত আনন্দের কথা, কিন্তু তবু চক্ষে না দেখলে বুকটা পোড়ায়, আর তো কেউ নেই–একটামাত্র ছেলে, আমি তাকে কত বোঝাতাম, ওলো, তোর ছেলে ভালো আছে, আমি জানি ভালো আছে।
ঠাকুমা তাঁর একটা অদ্ভুত বিশ্বাসের কথা বললেন তপনকে। তপন যখন মাসের পর মাস চিঠি লেখেনি–তখনও ঠাকুমা তার জন্য চিন্তিত হননি। ঠাকুমা নাকি চোখ বুজে তাকে দেখতে পেতেন। বেশ জোর দিয়ে ঠাকুমা বললেন, যখনই ওরা চিন্তা করত তোর জন্য, আমি চোখ বুজে ঠাকুরকে ডাকতাম। অমনি ঠাকুর আমায় দেখিয়ে দিতেন। আমি স্পষ্ট দেখতাম তুই ঠিক সময়ে হেঁটে হেঁটে অফিসে যাচ্ছিস কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিস, আমি সেকথা ওদের বলতাম। আমি মনে মনে ঠাকুরকে বলতাম, ঠাকুর, তুমি আমাদের ওই ছেলেটাকে দেখো। ওর মা নেই, বাবা নেই, কেউ নেই, বিদেশ-বিভূয়ে, তুমি যদি ওকে না দেখো তা হলে আর কে দেখবে। ওর মা বড়ো দুঃখ পেয়ে মরেছে, মরার পর যেন ছেলের ভালো খবর জেনে একটু শান্তি পায়!
একথা শুনে তপন ঘাড় হেঁট করে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। এ-রকম কথার কোনো উত্তর হয় না। একটু বাদে আস্তে আস্তে বলে, ঠাকুমা, আমার ওপর তোমার কোনো রাগ বা অভিমান হয় না?
কেন রে, রাগ হবে কেন?
যে সাহেবরা তোমার দুই ছেলেকে মেরেছে সেই সাহেবদের দেশে আমি ভিখিরির মতো পড়ে আছি!
ঠাকুমার সমস্ত আকৃতিই হঠাৎ বদলে গেল, সোজা হয়ে বসলেন, ঘষা কাচের মতন চোখ দুটোও যেন বারেক উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন, ওকথা বলিসনি তপু, ওসব কথা আর মনে রাখতে নেই। ওসব পুরোনো কথা আর কক্ষনো ভাববি না– তখন দিনকাল ছিল আলাদা–মানুষের ওপর রাগ রাখতে নেই, আয়, এদিকে আয়, আমার গা ছুঁয়ে বল, ওসব ভাববি না আর।
তপন এগিয়ে এসে ঠাকুমার গায়ে হাত রাখল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, ঠাকুমা একটা অদ্ভুত কথা শুনবে? বিলেতে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
সম্পূর্ণ কাহিনিটা ঠাকুমাকে বলল তপন, শুনতে শুনতে ঠাকুমার চোখ দিয়ে অবিরল জল পড়তে লাগল। রীতিমতো ফুঁপিয়ে উঠে তিনি বললেন, আহা, কেন অত কষ্ট দিয়েছিস ওকে। কেন, তাকে নিয়ে এলি না, আমি তাকে আশীর্বাদ করতাম! আহা, সে হতভাগীও তো কত কষ্ট পেয়েছে জীবনে–তার তো কোনো দোষ নেই রে।
তপন ভাবতেই পারেনি, ঠাকুমা এ-রকম কথা বলবেন। ব্রাহ্মণ বংশের মেয়ে, সামান্য কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন যদিও, কিন্তু কখনো বাড়ির বাইরে বেরোননি, বাইরের জগৎ সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই, সব দুঃখের সান্ত্বনা খুঁজেছেন শুধু রামায়ণ-মহাভারতে, সেই ঠাকুমাও যে এমন সংস্কার মুক্ত হতে পারবেন, তপন কল্পনাই করেনি। কঠিন দুঃখ বুঝি মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়, অনেক মহত্ত্বের স্তরে নিয়ে যায়।
ঠাকুমা বললেন, তারও তো বাপ মরেছে, সে তো রাগ পুষে রাখেনি, সে ভুলতে পেরেছে, আর তুই পারলি না? তুই তার কাছে হেরে গেলি?
কী করব, ঠাকুমা, ব্যাপারটা যেই জানতে পারলাম, তখন থেকেই আমার শরীর যে রাগে জ্বলতে লাগল। আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। তা ছাড়া ওদের জাতটার ওপরেই আমার রাগ। ওদের জাত এখনও অনুতাপ করে না, এখনও আমাদের ঘেন্না করে। তাই আমিও ওদের ঘেন্না করি।
কিন্তু মেয়েটা তো তোকে ঘেন্না করেনি! তুই যদি তাকে বিয়ে করতিস, তাহলে তোদের যে ছেলেপুলে হত, তারা কোনো জাতকে ঘেন্না করত না। তাদের কোনো রাগ থাকত না!
থামো ঠাকুমা, ওকথা আর বোলো না।
.
টুকুর বিয়ে নির্ঝঞ্ঝাটেই হয়ে গেল। কাকা প্রচুর টাকা খরচ করলেন মেয়ের বিয়েতে, আলোর মালা, সানাই কিছুই বাদ যায়নি। প্রায় হাজার দেড়েক লোকের নেমন্তন্ন। সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, এজন্য কাকার মুখে আজকাল বেশ-একটা গর্বের ভাব ফুটে উঠেছে। তবু কাকা একবার কেঁদে ফেলেছিলেন। মেয়েকে সম্প্রদান করার সময় পুরুত যখন কাকাকে তাঁর পূর্বপুরুষদের নাম বলতে বললেন, তখন কাকা তাঁর নিজের বাবার নামটা বলেই হঠাৎ মুখ নীচু করে উত্তরীয়তে চোখ মুছলেন।
টুকুও একবার কেঁদেছিল। দারুণ জমকালো সাজে, বেনারসি আর গয়নায় মুড়ে, বিয়ে আরম্ভ হবার আগে একটা ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছিল তাকে। ঘর ভরতি মেয়ে, নিমন্ত্রিতরা তাকে দেখে উপহার দিয়ে যাচ্ছে, মিষ্টি হাসি দিয়ে হাত পেতে সেগুলো নিচ্ছিল টুকু। বিয়ের লগ্ন মধ্য রাতে। একসময় তপনকে দেখে টুকু উঠে দাঁড়াল, সামনের মেয়েদের বলল, এতক্ষণ চেয়ারে বসে থেকে থেকে পা ধরে গেছে! একটু দাঁড়াই! তপনকে জানলার পাশে এনে টুকু ফিসফিস করে বলল, বড়দা আর কিছু বলল না, শুধু তপনের মুখের দিকে চেয়ে রইল। তপন বুঝতে পারল ওর চোখের ভাষা। তপন হাসতে হাসতেই ফিসফিস করে বলল, ভয় নেই, কিছু ভয় নেই, বিমান আসেইনি নেমন্তন্ন খেতে! এত রাত হয়ে গেছে, আর আসবে না।
সেই কথা শুনে অকস্মাৎ টুকুর চোখে জল এসে গেল। ভয়ের ছায়ামাত্র নেই মুখে। জলভরা চোখে জানলার বাইরে দূরের অন্ধকারের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকেই আবার নিজেকে সামলে নিল!
বাংলার মফসসলের মেয়ে, নিজে কী চায়, তাই-ই জানে না। একটু বাদেই সম্পূর্ণ অচেনা একজন লোকের সঙ্গে বিয়ে হবে, চলে যাবে অচেনা জায়গায় শ্বশুরবাড়ি। তপনের মনে হল, টুকু শেষপর্যন্ত ছেলে-মেয়ে নিয়ে সুখেই ঘর করবে। শুধু একটা ছোট্ট কাঁটা বিঁধে থাকবে মনের মধ্যে। মাঝে মাঝে মনে পড়বে, বিমান নামে একটি ছেলে ওকে ভালোবেসেছিল, সেও ভালোবেসেছিল বিমানকে, কিন্তু সেই ভালোবাসার কোনো মূল্য দেয়নি। সে বিমানের কাছে কথা রাখেনি।
.
১২.
আমি জানতাম, তুমি ফিরে আসবে।
কী করে জানতে?
আমি জানতাম, তুমি আমাকে দুঃখ দেবার জন্য ফিরে আসবে।
অ্যালিস, তুমি কী বিশ্বাস করবে, আমি নিজেও দুঃখ পেয়েছি অনেক।
তাও জানতাম, দুঃখকে চাপা দেবার জন্যই তো তুমি অত বেশি রাগ দেখাচ্ছিলে।
অ্যালিস, তুমি আমার ওপর দারুণ প্রতিশোধ নিয়েছ। আমি তোমাকে সম্পূর্ণ ভুলতে চেয়েছিলাম, মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি প্রতি রাত্রে ফিরে এসেছ স্বপ্নে। আমার ঘুম খুব গাঢ়, সাধারণত আমি বেশি স্বপ্ন দেখি না, কিন্তু গত একমাস ধরে তুমি স্বপ্নে এসে দাঁড়াচ্ছিলে আমার কাছে, তোমার মুখে কোনো রাগের চিহ্ন নেই– যেন আর একটা কী কথা বাকি থেকে গেছে।
টপন, আমি তোমাকে ওরকমভাবে স্বপ্ন দেখিনি, জাগ্রত অবস্থাতেই তোমার কথা ভেবেছি। অনেক ভেবেছি, ভেবে বুঝতে পেরেছি তোমার আমার দু-জনের সঠিক সত্য।
সেটা কী? তুমি কি বুঝতে পেরেছ?
টপন, তুমি চা খাবে, না কফি? আমার কাছে কোনো ড্রিংকস নেই।
না, এই সকাল বেলাতেই আমি মদ খেতে চাই না। আমি চা কফিও কিছু খাব না।
তুমি ব্রেকফার্স্ট সেরে এসেছ? খাও-না কিছু? কফির জল বসানোই আছে।
না, আমার কিছু লাগবে না। তুমি বোসো, আমার কথাটার উত্তর দাও।
দাঁড়াও, হিটারে কফি-পট চাপানো আছে নামিয়ে আসি।
আবার লণ্ডনে ফিরে হিথরো বিমান বন্দর থেকেই তপন ফোন করেছিল অ্যালিসকে। তখনও ভালো করে ভোর হয়নি। কিন্তু তপন জানে অ্যালিস খুব ভোরেই ঘুম থেকে ওঠে। টেলিফোন বেজে উঠলে ল্যাণ্ডলেডি শুনতে পাবার আগে অ্যালিসই এসে ফোন ধরবে। অ্যালিসের গলা শুনেই তপন বলেছিল, অ্যালিস, আমি ফিরে এসেছি, আমি একটু বাদেই তোমার বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি বাড়িতে থেকো, আজ আর অফিসে যেয়ো না।
অ্যালিসের কণ্ঠস্বর একটু নিরুত্তাপ, একটু সংযত, সে জিজ্ঞেস করেছিল তুমি কোথা থেকে কথা বলছ? কবে ফিরেছ?
এই মাত্র। এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করছি। হোটেল ডোমিনিক-এ আমার রিজার্ভেশান আছে, ওখানে প্রথম গিয়ে আমার মালপত্র রেখেই তোমার বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি থাকবে তো?
কথা বলার সময় কিছুটা শঙ্কা ও উত্তেজনায় তপন ভেতরে ভেতরে কাঁপছিল। এতখানি জোর দিয়ে সে অ্যালিসের সঙ্গে কথা বলছে, কিন্তু সে অধিকার কি তার আছে? অ্যালিসের সঙ্গে যে-রকম ব্যবহার সে করেছে, তাতে অ্যালিস যদি এখন কথার মাঝখানে টেলিফোন নামিয়ে রাখে কিংবা তাকে বিদ্রূপ করে কিছু বলে ওঠে। অ্যালিস তা অবশ্য করল না, কিন্তু প্রবল কোনো উচ্ছ্বাসও দেখাল না, শান্ত গলায় বলল, তুমি এক্ষুনি ফিরলে, এবেলা হোটেলে বিশ্রাম করে নাও, বিকেলে দেখা হবে।
তপন নিজেই অ্যালিসকে আগেরবার বলেছিল, আর কখনো আমাদের দেখা হবে না, কিন্তু এখন বলল, না, বিকেলে নয়, এখন বাজে ছ-টা পনেরো, আমি ন-টার মধ্যে তোমার বাড়িতে পৌঁছোব। তুমি ব্রেকফার্স্ট খেয়ে নিয়ে, আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না।
-কিন্তু, আমার অফিস।
তপন অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছিল, আজ অফিসে যাবে না তুমি। যেন তপনই অ্যালিসের অফিসের বড়ো সাহেব, সে অ্যালিসকে ছুটি নেবার হুকুম দিচ্ছে।
কলকাতা থেকে ভিসার ওপর নতুন স্ট্যাম্প মারিয়ে আনেনি বলে খানিকটা অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু তপনের দেরি সইছিল না আর, তাড়াতাড়ি পাঁচ দিনের ট্রানজিট ভিসা করিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল। এয়ার টার্মিনাল পর্যন্ত বাসেই যেতে পারত, তা গেল না, ওখান থেকেই ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চলে এল হোটেলে। দ্রুত দাড়ি কামিয়ে পোশাক পালটে তক্ষুনি অ্যালিসের অ্যাপার্টমেন্টে।
অ্যালিস ফিরে এসে আবার বসল। পুরোনো কোনো কথাই তুলল না। মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল, অনেকদিন বাদে দেশে ফিরেছিলে, কেমন লাগল বলো!
তপন সূক্ষ্ম চোখে অ্যালিসের সর্বাঙ্গের দিকে চেয়ে দেখল, অ্যালিস সামান্য একটু রোগা হয়েছে এই ক-দিনে। মুখে ফুটে উঠেছে একটা করুণ উদাসীনতা। তপনের টেলিফোন পাবার পরও অ্যালিস বাইরে যাবার পোশাক পরে নিয়েছে, চুল আঁচড়ানো থেকে আরম্ভ করে সমস্ত প্রসাধন শেষ, এমনকী মোজা এবং দস্তানাও বাদ রাখেনি, অ্যালিসকে বোধ হয় অফিসে যেতেই হবে। আগেরবার, এমন সকালে তপন অ্যালিসকে ফোন করলে অ্যালিস হয়তো বিছানা ছেড়ে উঠতই না, বিছানায় শুয়ে শুয়েই তপনকে অভ্যর্থনা জানাত। আলস্যে শরীর মুচড়ে বলত, কাম ডার্লিং, গিভ মি আ কিস ফর ব্রেকফার্স্ট। তপন অবশ্য এবার সেরকম ব্যবহার আশাও করেনি, বড় নিষ্ঠুর, বড়ো আনশিভালরাস ব্যবহার করেছিল সে অ্যালিসের সঙ্গে।
তপন মৃদু গলায় বলল, অ্যালিস তুমি আমার ওপর এখনও খুব রাগ করে আছ, না?
উত্তর না দিয়ে অ্যালিস একটু হাসল। তপন এবার দেয়ালের দিকে চেয়ে বলল, সেই ছবিটা কোথায়?
নেই। নষ্ট করে ফেলেছি!
একেবারে নষ্ট করে ফেললে? কেন?
আমার ঘরের ইনটিরিয়ার ডেকরেশনের সঙ্গে মানাচ্ছিল না। তুমি লক্ষ করনি, আমি পর্দার রং, বেডকভার সব পালটে ফেলেছি? কেমন হয়েছে, বলো!
তুমি কথা এড়িয়ে যাচ্ছ। ছবিটা নষ্ট করে ফেললে কেন?
সত্যি কথা বলব? ঝোঁকের মাথায়। এখন অবশ্য একটু একটু অনুতাপ হচ্ছে–একটা পুরোনো নির্দোষ ছবি–একেবারে নষ্ট করে ফেলার কোনো মানে হয় না।
তপন মুখে বলল, নিশ্চয়ই! কিন্তু ঠিক বুঝতে পারল না অ্যালিস কী বোঝাতে চাইছে। সে নিজেও অ্যালিসকে কী বলবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। খাবার টেবিলের দু-পাশে দুটো চেয়ারে বসেছে ওরা–এখন পর্যন্ত তপন একবারও অ্যালিসকে স্পর্শ করেনি। তার বুকের মধ্যে মাঝে মাঝে আকুলি-বিকুলি করে উঠেছে অ্যালিসের মাথাটা তার বুকে টেনে নেবার, কিন্তু ঠিক মুহূর্তটা খুঁজে পাচ্ছে না।
অ্যালিস, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আমি কি তোমার কাছে ক্ষমা চাইব আনুষ্ঠানিকভাবে?
না, টপন, ক্ষমা চাওয়া তোমাকে মানায় না। তোমার রাগী নিষ্ঠুর স্বভাবই বেশি মানায়!
আমাকে ব্যঙ্গ করছ?
না, সত্যি বলছি। রাগলে তোমাকে আরও সুন্দর দেখায়! টপন, এবার তুমি লণ্ডনে কতদিন থাকবে?
তুমি যখন জানতেই যে আমি ফিরে আসব, তখন এটাও জানতে পারনি, আবার এসে আমি কতদিন থাকব?
না, তুমিই বলো।
আমি দু-দিনের ট্রানজিট ভিসা নিয়ে এসেছি, ইচ্ছে করলে অবশ্য বাড়ানো যায়।
বাড়াবে।
সেটা নির্ভর করছে–অ্যালিস, আজ বাইরে খুব সুন্দর রোদ উঠেছে, চলো আমরা বেড়াতে বেরোই। কোথাও লাঞ্চ খেয়ে নেব, তোমাকে আমার ক-টা কথা বলার আছে।
অ্যালিস সামান্য হেসে, বলল, না, আজ বেড়াতে যাব না। কী বলবে, এখানেই বলো।
হঠাৎ তপনের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল, তার মনে পড়ল আর একটি সকালের কথা। অ্যালিস এসেছিল তার হোটেলে, অ্যালিস বলেছিল, তপনকে তার কিছু বলার আছে। তপন গ্রাহ্য করেনি, নিষ্ঠুরভাবে হোটেলের বারোয়ারি লবি দেখিয়ে বলেছিল, কী বলবে এখানেই বলো না! অ্যালিস কি আজ তার শোধ নিচ্ছে? সেই অ্যালিস, যে বলেছিল, তপনকে ভালো না বেসে তার আর উপায় নেই! দুঃখ পাবার বদলে তপন একটু রেগে উঠল। ঝাঁঝালো বলায় বলল, তোমাকে বুঝি আজ অফিস যেতেই হবে? না গেলে চলে না?
তা না গেলেও চলে একদিন। একদিন তো আমার অসুখ করতে পারে।
কিন্তু অফিস যাবার জন্য তো পোশাক পরে তৈরি হয়েই আছ?
অফিস যাবার জন্য পোশাক পরিনি!
তবে? অন্য কেউ আসবে? আর কারুর সঙ্গে বেরোবে? ঠিক আছে, আমি চলে যাচ্ছি। আগে বললেই পারতে!
না, অন্য কেউ আসবে না। আমি পোশাক পরে রয়েছি, তার কারণ তুমি যাতে ঘরে ঢুকেই একটা জিনিস দেখতে না পাও!
কী দেখতে পাব? আমি আর কিছু দেখতে আসিনি, আমি শুধু তোমাকেই দেখতে এসেছি।
টপন, তোমাকে আমার একটা সংবাদ দেবার আছে।
অ্যালিস আস্তে আস্তে বাঁ-হাতের দস্তানাটা খুলল। হাতখানা তপনের মুখের সামনে এনে বলল, এই যে, দেখো! অ্যালিসের অনামিকায় একটা মুক্তো বসানো আংটি।
ওই আংটির মর্মার্থ তপন জানে, তবু এখন তার খেয়াল হল না, বিস্মিতভাবে জিজ্ঞেস করল কি দেখব? আংটি? কীসের? বলতে বলতেই তপনের মনে পড়ে গেল! যেন সে ভয়ংকর একটা খাদের মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল, একটুর জন্য সামলে উঠল। মুখে তৎক্ষণাৎ হাসি ফুটিয়ে বলল, আরে তাই নাকি! কবে হল? কনগ্রাচুলেশানস! কার সঙ্গে? হু ইজ দা লাকি ফেলো?
অ্যালিস বিনা উত্তেজনায় বলল, এখনও হয়নি, আমার বিয়ের তারিখ এই শনিবার। তুমি যদি ততদিন থাকো, তোমাকে নেমন্তন্ন করছি।
কে? কে সেই ভাগ্যবান?
ডনাল্ড। ডনাল্ড স্মার্ট, হয়তো তোমার মনে আছে।
তপনের মনে পড়ল, অ্যালিসেরই অফিসের এক ছোকরা– কেনসিংটনে একদিন অ্যালিসের সঙ্গে বেড়াবার সময় দেখা হয়েছিল ওর সঙ্গে। ছেলেটি এমনভাবে তপনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, যেন অ্যালিস একজন ইণ্ডিয়ান ছেলের সঙ্গে ঘুরছে সে বিশ্বাসই করতে পারে না। সেদিন অ্যালিস বলেছিল, ডনাল্ডের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই, ওর সঙ্গে আমি কথা বলার বিষয় খুঁজে পাই না।
খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটে গেল, তাই না?
না, ডনাল্ড তো অনেকদিন থেকেই এ-রকম ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল, আমিই শুধু–কিন্তু আমি দেখলাম, আমি বড়ো দুর্বল, আমার পক্ষে একা বাঁচা সম্ভব নয়–আমার একটা কিছু অবলম্বন চাই– জীবনে আমি তো কখনো স্নেহ-ভালোবাসা পাইনি কারুর, কিন্তু এখন একটু পাবার জন্য
অ্যালিস, আমি আশা করি ডনাল্ডের সঙ্গে তোমার জীবন খুব সুখী হবে।
ধন্যবাদ, টপন—
অ্যালিস, তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব?
বলো।
-তুমি একটু আগে বলেছিলে, তুমি আমাদের দুজনের একটা সঠিক সত্য খুঁজে পেয়েছ, সেটা কী? আমি যদিও নিশ্চিত জানতাম, তুমি আবার ফিরে আসবে। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি, তোমার আমার ভালোবাসা অসার্থক হতে বাধ্য। তুমি তো শুধু আমার বাবাকে ঘৃণা করনি, তুমি ঘৃণা করেছ আমার জাতিকে–যে জাতই আসলে তোমার পিতার হত্যাকারী, যে জাতের অধীনে তোমরা ছিলে।
না, অ্যালিস, শোনো।
আমাকে আগে বলতে দাও। তুমি আর আমি পরস্পর ঘৃণা ভুলতে পারি–কিন্তু যতদিন দুটো দেশ অনেক কাছাকাছি আসে, সমান ভিত্তিতে আসে, ততদিন দু-দেশের মানুষের মিল হতে পারে না। সেসময় এখনও আসেনি–এখন আমরা দু-জন কাছাকাছি এলেও অনেক কমপ্লেক্স তোমাকে-আমাকে ঘিরে থাকবে।
না অ্যালিস, ভুল! আমি দেশ মানি না, জাত মানি না, তুমি তো জানো।
তুমিই তো বলেছিলে, আর সব ভোলা গেলেও, শিরায় শিরায় যে রক্ত, সে কিছু ভোলে না।
আমি রক্ত মানি না।
হ্যাঁ মান, তুমি এখন উত্তেজনায় বলছ।
না, না, আমার কোনো দেশ নেই, জাতি নেই, ধর্ম নেই, আমি একজন মানুষ শুধু।
টপন, পৃথিবীতে গাছপালার মতন মানুষও শিকড় ছাড়া বাঁচতে পারে না।
তপন কী করবে, সে কি হাঁটু মুড়ে বসে অ্যালিসের জানু ধরে বলবে, হ্যাঁ, অ্যালিস, মানুষ তাও পারে। তুমি ওই আংটি ছুঁড়ে ফেলে দাও! চলো, আমরা এমন একটা দেশে যাই, যেখানে তোমার-আমার দু-জনের জাতই অবান্তর। অ্যালিস, তুমিই বলেছিলে, তুমি আমাকে যেমন ভালোবেসেছ, সেরকম আর কারুকে কখনো ভালোবাসনি! সেই ভালোবাসা কেন মিথ্যে করবে! আমিও অনেক মেয়ের সঙ্গে মিশেছি, কিন্তু আর কারুর জন্য আমার বুক এমন কাঁপেনি, আর কেউ আমার স্বপ্নে এমন বারবার এসে দাঁড়ায়নি। অ্যালিস, আমিও ভালোবাসার জন্য কাতর।
কিন্তু তপন সেসব কিছুই করল না। তার অহংকার তাকে কখনো কারুর কাছে হাঁটু মুড়ে বসায়নি। কাতরভাবে ভালোবাসার কথা বলতেও সে জানে না। তপন অদ্ভুত ধরনের একটু হাসল শুধু। তারপর বলল, যাক এখন আর এসব কথা আলোচনা করে কোনো লাভ নেই। ইটস অল ওভার, ইজনট ইট? অ্যালিস, আমি তোমাকে শুভেচ্ছা জানাই।
অ্যালিসকে টেলিফোন করেছে কে যেন। অ্যালিস বারান্দায় টেলিফোন ধরতে গেল। তপন চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখল। ছবিটা নেই, তবু দেয়ালের সেই জায়গাটাতে একটা চৌকো সাদা দাগ রয়েছে। তপন যদি কখনো এ ঘরে না আসত–।
অ্যালিস ফিরে এসে বলল, ডনাল্ড ফোন করেছিল। আমি অফিসে এখনও পৌঁছোয়নি তো, তাই চিন্তা করছে।
তপন ব্যস্ত হয়ে বলল, তুমি এখনও যেতে পার অফিসে। একটু দেরি হবে, যদিও বিয়ের পর তো তোমাকে ছুটি নিতেই হবে, শুধু শুধু একটা দিন নষ্ট করবে কেন?
অ্যালিস মৃদু হাস্যে বলল, আমি ডনাল্ডকে বলেছি, আমি আজ অফিসে যাব না।
না, না, একটা দিন শুধু শুধু নষ্ট করবে কেন? আমি যাই অ্যালিস! আমার দু-দিন মাত্র থাকার মেয়াদ, তাই তোমার বিয়েতে থাকতে পারব না। এখনই আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
তপন সত্যিই বিদায় নিচ্ছে দেখে অ্যালিস তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। অ্যালিসের হাত ধরে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল তপন। এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে এখনও সে অ্যালিসকে বুকে টেনে নিয়ে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরতে পারে। কিন্তু অ্যালিসের আঙুলের আংটিতে খোঁচা লাগলো তার। সঙ্গে সঙ্গে হাত ছেড়ে দিয়ে তপন বলল, অ্যালিস, তুমি ওই ছবিটা একেবারে নষ্ট না করলেই পারতে। আসলে, আমি আজ তোমার কাছে এসেছিলাম ওই ছবিটার একটা কপি করিয়ে নিতে। আমার বাবার কোনো ছবি তো আমার কাছে নেই।
অ্যালিস যেন তপনের ওকথাটা শুনতেই পেল না। মুখ নীচু করে আপন মনে বলল, আমি জানতাম, তুমি আমাকে দুঃখ দেবার জন্য আবার ফিরে আসবে।
তপনও যেন অ্যালিসের কথাটা শুনতে পেল না, আপন মনেই বলল, আর কোনোদিন দেখা হবে না, আর কোনোদিন দেখা হবে না, গুড বাই অ্যালিস!
.
ছেলের জ্বর, তাই ললিতা আসতে পারেনি, দিবাকর এয়ারপোর্টে এসেছে তপনকে বিদায় দিতে। মালপত্র জমা দেওয়া হয়ে গেছে, কাস্টমস বেরিয়ারের সামনে দু-বন্ধুতে গল্প করছে। সিগারেট টানতে টানতে। একটু বাদেই প্লেন ছাড়বে। সারাদিন ধরে আজ ঝড়-বৃষ্টি, আবহাওয়া ক্রমেই খারাপ হচ্ছে, দিবাকর শেষ মুহূর্তেও তপনকে অনুরোধ করেছিল আর একটা দিন থেকে যেতে। তপন রাজি হয়নি।
দিবাকর জিজ্ঞেস করল, তা হলে কলকাতায় গিয়েও তোর মায়া পড়ল না? একবারও ইচ্ছে হল না দেশেই থেকে যেতে?
তপন হাসতে হাসতে উত্তর দিল, রে মায়া পড়া তো দূরের কথা, কলকাতা আমায় লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে বলতে পারিস!
ক্যানাডায় বিচ্ছিরি ঠাণ্ডাতেই কাটাবি দু-বছর?
বলা যায় না, চেষ্টা করব অস্ট্রেলিয়ায় যাবার।
অষ্ট্রেলিয়ায় সেখান থেকে আবার অতদূরে আমেরিকায় ফিরবি?
আমেরিকায় আর না ফিরতেও পারি। মনে হচ্ছে, আমরিকাও আর আমার ভালো লাগবে না!
অস্ট্রেলিয়াও তো ভালো লাগবে না। আমি ঠিক জানি! সেখান থেকে তা হলে আবার কোথায় যাবি?
এত বড়ো পৃথিবী, পৃথিবীতে এত মানুষ, এই মানুষের ভিড়েই কোথাও মিশে থাকব।
দিবাকর হো-হো করে হেসে বলল, কী রে, একথাটা কি একটু কবিত্ব কবিত্ব হয়ে যাচ্ছে না?
তপন লজ্জা পেয়ে বলল, যাঃ, মোটেই না। তাহলে, এইভাবে বলছি, যতদিন বেঁচে থাকব, কোথাও-না-কোথাও থাকব!
দিবাকর তপনের কাঁধ ছুঁয়ে বলল, না, তা নয়, আমি তোকে আসল কথা বলছি শুনে রাখ! তুই কোথাও টিকতে পারবি না! তুই কোনো জিনিসই সহজভাবে মেনে নিতে পারিস না! তোকে আবার দেশেই ফিরতে হবে।
তপন বলল, না।
দিবাকর বলল, আমি যা বললুম। দেখিস মেলে কি না।